আমাদের জেলা শহরে নতুন যে গণগ্রন্থাগার হয়েছে মৌসেনাকে সেখানেই প্রথম দেখেছিলাম। দেখেছিলাম মানে প্রথম দেখায় ড্যাব ড্যাব করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম আর মনে মনে বললাম, এমন রূপবতী মেয়ে যে পরমেশ্বর আমার কপালে লিখে নাই সে কথা নিশ্চয়ই জ্যোতিষী রামচন্দ্রও স্বীকার করবে। তবুও কোথায় যেন পড়েছিলাম “চেষ্টায় সুসিদ্ধ করে জীবনের আশা” মূলত সেই ভরসাতেই মৌসেনা নতুন সদস্য অন্তর্ভূক্তির ফর্ম হাতে নিতেই কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, কখন টেলিফোন নাম্বারের ঘরটা পূরণ করে!
ওমা! টেলিফোন নাম্বারের ঘর আর পূরণ করবে কী! আমি কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছি দেখে এক রকম জেরার মত করে প্রশ্ন করলো,
- কী চাই?
ধর্মাবতার, আমি জীবনে কোনোদিন তোতলামো করিনি তবুও সেদিন যাই বলতে চাচ্ছিলাম তাই যেন জড়িয়ে যাচ্ছিলো। কোনো রকমে বলতে পারলাম, পে.…..ন হ….বে?
মৌসেনা যেন কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললো,
- আপনারাও না! লাইব্রেরিতে আসেন অথচ একটা পেন সাথে আনতে পারেন না!
মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো,
পেন এনে আর কী হবে? ও পাঠ বহু আগেই চুকিয়ে দিয়েছি।
মৌসেনা ওমনি জিজ্ঞেস করে বসলো, - তবে এসেছেন কেন এখানে?
- সেকথা আপনাকে বলা যায় না।
- এমন কী কথা যে আমাকে বলা যাবে না?
- বলা যাবে না মানে যাবে না।
কিন্তু মৌসেনা হঠাৎ ওমন জেদ ধরে বসবে সেটা আমার ভাবনারও বাইরে ছিলো। আমাকে এক রকম চেপে ধরেই বললো, - কিন্তু মশায় না শুনে তো আপনাকে ছাড়ছি না।
- ঠিক আছে। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে বলবো।
- তবে বাইরে চলুন।
.
বাইরে এসে মৌসেনা আমার কথা শুনে হাসছে আর হাসছে। আমি ঠিক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম, শেষমেশ না আবার লোক জড়ো হয়। মৌসেনা এক রকম হাসি থামিয়ে বললো - জানেন আজকে সকাল থেকে মনটা খুব খারাপ ছিলো আর এখন কি না এত হাসলাম যে পেটে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে।
- আর হাসবেন না তো প্লিজ।
- কেন?
- নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে।
- কিন্তু যাই বলেন না কেন? আপনার মা বুদ্ধিটা কিন্তু মন্দ দেয়নি।
-পাত্রী দেখার বিড়ম্বনা সে তো আর আপনি বুঝবেন না। যার ব্যথা সেই বুঝে। - আহারে বেচারা!
- বেচারার একটা নাম আছে কিন্তু।
- কী নাম শুনি?
- উপল।
- আমি মৌসেনা।
- দুর্ভাগ্য আমার।
- কেন?
- এটা পাশ্চাত্যের কোনো দেশ নয়।
- তাতে কী হলো ?
- ওই তো! এমন রূপবতীর সাথে একবার হ্যান্ডশেক করার উপায়ও নেই! অমানবিক কালচার।
- হাহাহ। আপনি কিন্তু ওতটাও বোকা নন উপল বাবু।
- বলছেন!
- আজ্ঞে!
পাশে সুন্দর মতন কোনো মেয়ে দাঁড়ালে ঘণ্টার কাঁটাটাও যেন মিনিটের কাঁটার বেগে ছুটে। আর এ তো মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার। মৌসেনা বললো,
-আজ আসি উপল বাবু।
- কাল আসবেন আবার?
- কোন দরকার আছে কী?
- রাতে ঘুম না হলে বোঝা যাবে সেটা।
- কী?
- না! কিছু না। আসুন।
.
বাড়ি ফেরার পথে মনে মনে একটা ব্যাপার খুব ভাবলাম। পুরুষ মানুষের জীবন ছোটো নাকি বড়ো সেটা আসলে নির্ভর করে ঘরের বউ-টা কেমন হবে তার ওপর। যেমন আমাদের নগেন কাকা দিনে অন্তত দশবার বলে, কবে যে আমার হাড় জুড়াবে! কবে একটু শান্তি পাব। জীবন এতো দীর্ঘ কেনে! কাকীমা সব সময় কাকাকে যন্ত্রণার ওপর রাখে। মনে মনে তাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি নগেন কাকার মতো পুরুষ মানুষের জীবন দীর্ঘায়িত না হোক!
বৈদ্যতলার দিকে আসতেই পেছন থেকে ভিম ডেকে বললো,
- উপলদা সেই সকাল থেকে তোমাকে খুঁজছি।
- কেন খুঁজিস? কার বাপের শ্রাদ্ধ?
- তুমিও না! গত কয়েকদিন ধরে কাকিমা আমার মাথা খাচ্ছে।
- কোন কাকিমা?
- তোমার মা?
- কী করছে?
- আমার মাথা খাচ্ছে।
- ঝাল নুন মিশিয়ে?
- ধ্যাত! একটু সিরিয়াস হও।
- ঠিক আছে বল।
-আমার এক পিসতুতো বোন আছে ঝিলিরপুরে বাসা। তোমাকে নিয়ে গিয়ে দেখে আসতে বলে একবার। - নাম কী?
- সুনয়না।
সুনয়নার সাথে দেখা করার জন্য কাজল কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওমা! দেখি চোখ দুটোই ট্যারা! আধ ঘণ্টা বসে থেকেও ভেবে একটা কিনারা করতে পারলাম না কাজলটা দেওয়া ঠিক হবে কি না! সে যাই হোক, সুনয়না তাকিয়ে ছিলো কোল্ড ড্রিংকসের দিকে। এদিকে ভিম বিড়বিড় করে বললো, উপলদা তোমাকে দেখছে কিন্তু এখন!
মনে মনে বললাম, সেরেছে!
তারপর দিন কয়েক গত হলো।
সুনয়নার চোখের মায়া ত্যাগ করে নিজের কাজে মন দিব ভাবছি কিন্তু মন কি আর কাজে বসে! লাইব্রেরির রবীন্দ্রনাথ- নজরুল ছাপিয়েও একটা মুখ কেবল ভেসে উঠে সময়- অসময়। সেদিন তাই লাইব্রেরির উদ্দেশে বেরিয়েছিলাম। পথের মধ্যে ভিমের সাথে দেখা।
- উপলদা তোমার দেখি ইদানীং বই পড়ার ঝোঁক।
- তার আগে একটা কথা সত্যি করে বল তো।
- কী কথা?
- তুই কখনও জ্যোতিষী রামচন্দ্রকে হাত দেখিয়েছিস?
- দেখিয়েছিলাম। শালা জোচ্চর একটা!
- কেন? কী হয়েছে?
- ব্যাটা হাত দেখে বলে আমার কপালে নাকি রাজকন্যা আছে।
- ভালোই তো। অসুবিধা কী হলো এতে?
- কী আর হবে? আমাদের পাড়ার নগেন কাকার মেয়ে ঊর্মিলাও সাথে ছিলো তো। ক্ষেপে গেল একদম।
- কেন? ক্ষেপলো কেন?
- ক্ষেপবে না? নগেন কাকা যদি ঘরের একপাশ থেকে অন্যপাশে হাতাহাতি করে, দুটো চার আনা পয়সা বের করতে পারবে? বলো পারবে? আর ও ব্যাটা বলে কি না রাজকন্যা!
-তারপর কী হলো? - কী আর হবে? ঊর্মিলা রেগেমেগে বললো, তলে তলে তুই কয় ঘাটের জল খাচ্ছিস রে ভিমচন্দ্র! প্রেমটাই গেলো আমার!
- আহা! বেদনাদায়ক!
সেদিন লাইব্রেরিতে মৌসেনা আমার পাশে এসে দাঁড়াতেই, আমি রিস্টওয়াচের কাঁটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মৌসেনা জিজ্ঞেস করলো,
- উপল বাবু কী দেখছেন ওমন করে?
-ঘড়ির কাঁটা। - কেন?
- দ্রুত চলে না-কি এখন। সেটাই।
মৌসেনা হেসে বললো, - উপল বাবু আপনি কি সব সময় এমন?
- কেমন?
- জানি না। যান তো!
আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মৌসেনা চুপিচুপি হাসছে। এই মুহূর্তে কী বলা যায় আমি ঠিক ভেবে পেলাম না। কিছু সময় পর মৌসেনাই বললো, - চা খাবেন?
- আজ্ঞে। আমি আবার ঘন ঘন চা খাই।
- কই! আপনার সাথে এর আগেও দেখা হলো আমার। একবারও তো চা খেতে দেখলাম না।
- কেউ বিনে পয়সায় খাওয়ালে খাই আর কী!
- হায় ঈশ্বর!
চা খেতে খেতে মৌসেনাকে জিজ্ঞেস করলাম, - এর আগে এভাবে কাউকে খাইয়েছেন চা?
- কীভাবে?
- মিষ্টি হেসে হেসে।
- যদি বলি হ্যাঁ, আপনার চা কি তেতো-বিস্বাদ হয়ে উঠবে?
- তেমনটি হলে না হয় চিনি আরও দু চামচ বাড়িয়ে দিবেন।
- হাহাহ! কথায় আর পারে কে!
- আগে বলবেন না?
- কী?
-এই যে কথায় হারাতে চান। - তবে কী হতো?
- আমি না হয় বোবা হয়েই থাকতাম!
- উপল বাবু!
আহা! উপল বাবু! ডাকের মধ্যেও যে ওত মধু!
মাঝেমাঝে নিজের কানকেই বিশ্বাস হতে চায় না। মাঝেমধ্যে তাই মৌসেনার দেখা না পেলে ভিমকেই বলি,
- উপল বাবু বলে দুটো ডাক দে তো ভিম।
- তুমি কিন্তু প্রেমে পড়েছো উপলদা, সত্যি বলছি।
- পড়েছি?
- হ্যাঁ।
- উঠাবে কে?
উঠাবে আর কে? দুনিয়ায় ডোবানোর মত লোকের অন্ত নাই। তা না হলে ভিম দুই দিন পর আমাকে এই খবর এনে দিবে কেন?
- উপলদা?
- বল
- আমি খবর নিয়েছি।
- কী খবর?
- হরিশ্চন্দ্র নামে এক প্রফেসরের সাথে মেয়েটার বিয়ের কথা চলছে।
কথাটা শুনেই মন খারাপ হয়ে গেলো আমার।
ভিম আমাকে কিছুটা আশ্বস্ত করার জন্যই বললো বোধহয়, - তুমি ওত মন খারাপ করছো কেন উপলদা?
- করব না? ওমন সুন্দর মেয়েটা সকাল বিকাল লেকচার শুনবে?
ভিম আপাতত বলার মত কিছু খুঁজে পেলো না।
এরপর ভাবলাম দিন কয়েক বিরহে ঘর থেকেই বেরুবো না। সকাল বেলা রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে মধু মিশিয়ে এক কাপ লেবু চা খাব, উদাস দুপুরে বিড় বিড় করে জীবনানন্দ দাশের আকাশলীনা কবিতাটা আওড়াবো, বিকেলে পোষা বিড়ালটার মাথায় হাত বোলাবো। একটা টিয়া পাখিও কিনে আনবো। মাঝেমধ্যে পাখির সাথে কথা বলবো। এক দুইদিন ট্রাইও করে দেখলাম। বিরহ-টিরহ আমার সাথে যায় না ঠিক।
ভিমও এসে বললো, ছেড়ে দেও তো উপলদা!
ছেড়ে দিলেও তো মনটা আবার কেমন খচখচ করে উঠে। মৌসেনাদের বাড়ির সামনের টংয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই চায়ের কাপ খালি করছিলাম একের পর এক। বিকেলের দিকে মৌসেনা বাড়ি থেকে বেরুতেই এগিয়ে গিয়ে বললাম,
- এখানেই আপনার বাড়ি? এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম দেখুন তো কেমন কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেলো।
টংয়ের দোকানি কানাই জোর গলায় ওমনি বললো, - মিথ্যে কথা দিদি। লোকটা সেই কখন থেকে চা খেয়েই যাচ্ছে একের পর এক। আমি চায়ের কাপ ধুয়ে কূল পাচ্ছি না।
আমি মৌসেনাকে বললাম, - দেখলেন তো? অমানবিক কালচারের সাথে সাথে এই দেশের মানুষগুলোও কেমন অসভ্য?
মৌসেনা কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বললো, উপল বাবু!
চৈত্রের পড়ন্তবেলায় আমি ও মৌসেনা পৌর উদ্যানের পাশ দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছিলাম।
হাঁটতে হাঁটতেই কিছুটা অভিমানী কণ্ঠে বললাম,
- মেয়েরা না অনেক মায়াবিনী!
- কেন?
- এই যে দেখা হলে মিষ্টি মিষ্টি হাসে আবার ভেতরে ভেতরে প্রফেসরও খুঁজে।
- খুঁজবে না? কেউ তো ঝেড়ে কাশে না?
- ওই তো! সব দোষ আমার মায়ের।
- কেন? উনি আবার কী করলেন এরমধ্যে?
- একটুখানি কাশি হতে না হতেই যষ্টি মধু খেতে বলে কি না!
- উপল বাবু! আপনি কিন্তু চালাকই নন শুধু, চালুও খুব।
- সেটা বুঝব কেমন করে?
- এই যে আমার মত একটা মেয়েকেও কথায় কথায় কেমন দূর্বল করে দিলেন।
- সত্যি দিয়েছি?
- কোনো সন্দেহ নেই।
- তবে ভিটামিন কিনে দেওয়ার দায়িত্বও আমাকে দিন না? আবার প্রফেসর কেন?
মৌসেনা হাসতে হাসতে গড়িয়েই পড়ে!
সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর নজরুলের সিন্ধু হিন্দোল নিয়ে বসেছিলাম। কবিতার পাতায় চোখ ছিলো ঠিকই মন যে কোথায় ছিলো সে কথা ঈশ্বর জানেন। কোথা থেকে মা এসে চমকে দিয়ে বললো, উপল! একা একা হাসছিস কেন?
প্রথমে ভড়কে গেলাম তার পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে এক রকম কপট রাগের ভান করে মা কে বললাম,
- তুমি কি সত্যিই আমাকে পেটে ধরেছো?
- কেন? কী হলো আবার?
- তবে বোঝো না কেন? এই বয়সে একটা ছেলে কখন চুপিচুপি হাসে?
- হায়! ঈশ্বর! আর আমি এদিকে মেয়ে খুঁজে খুঁজে মরি।
- তা খুঁজে তো আর পেলে না।
- পেলেই বা কী! বাবা উপল চন্দ্রের কী আর মনে ধরে!
- যাকে মনে ধরে তাকে তো খুঁজো না।
- কাকে ধরে?
- খুঁজে আনো গিয়ে। আমি কী জানি তার!
এই জগতে যা আমি জানি না সেটা ভিম জানে।
ভিম না জানলে কেউ জানে না। তাই তো ভিমের সাথে মায়ের ইদানীং ঘন ঘন দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে, কথাবার্তা হচ্ছে। এদিকে আমার যেন ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়! ভিমকে তাই বললাম,
- তোদের এই উরুগুয়ে রাউন্ড কত বছর ধরে চলবে শুনি?
- কী রাউন্ড?
- ও তুই বুঝবি না। কবে যাচ্ছিস তোরা?
মা কতদিন কত জায়গায় গিয়েছে, থেকেছে। আমার সে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিলো না।
আজকে বারবার এত গলা শুকাচ্ছে যে ঘরের ভেতর একটা টিকটিকি হাঁটলেও মনে হচ্ছে, ওই তো মা এলো বুঝি! তা মা কী আর আসে? এদিকে জলের গ্লাসও খালি হচ্ছে একের পর এক। বোধকরি পৃথিবীতে আজকে জলের টান পড়ে যাবে!
মা এলো রাত নয়টা বাজিয়ে। ওমনি বললাম, এই তোমার কান্ডজ্ঞান?
মা বললো,
- হয়েছি কী শুনবি তো আগে?
- বলো।
-মৌসেনার মা অরুনিমা আমার কলেজের বান্ধবী। সেই কতদিন পর দেখা! রাতে না খেয়ে কী আসতে দেয়? তারপর কত গল্পগুজব! কতদিনের পুরনো সব স্মৃতি! - তারপর?
- তারপর কী করে ওর বিয়ে হলো? স্বামী সংসার নিয়ে কেমন আছে? আমিই বা যোগাযোগ করিনি কেন এতদিন ? কেমন যাচ্ছে? আরও কত কী!
আমি প্রায় রেগে গিয়ে বললাম, নিজের আপন মা ওত নির্দয় তো দেখিনি তো কোনো কালে?
- আরে বলছি বলছি। একটুও যেন ধৈর্য নেই।
মেয়েটাকে দেখেই মনটা ভরে গেলো আমার। অরুনিমাকে বললাম, তোর মেয়েটা আমাকে দে। আমার নিজের কোনো মেয়ে নেই। - তারপর?
- অরুনিমা বললো, এখনকার ছেলেমেয়ে। ওকে জিজ্ঞেস না করে কী করে কথা দেই? দিন কয়েক পর ওর মত নিয়ে আমি জানাবো।
এরচেয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষাই ঢের ভালো ছিলো আমার ।পূর্ণেন্দু পত্রী যথার্থই লিখেছিলেন, অপেক্ষার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। ঘরের ভেতর মন টিকে না। ভিমকে নিয়ে এদিক যাই, ওদিক যাই সময় যেন কাটেই না। ভিমকে বলি,
- ঈশ্বর বুঝি এভাবেই সময়ের সামঞ্জস্য করে রে!
- তুমিও না উপলদা? একবার গিয়ে দেখা করে এলেই পারো।
- বলছিস?
- তবে আর কী!
- না থাক।
- কেন?
- বেড়ে যায় তো।
- কী বাড়ে ?
- হার্টবিট!
হার্টবিট বাড়লেও মৌসেনাদের বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়ার পথটুকু, লাইব্রেরি, পৌর উদ্যান বেশ কয়েকবার চক্কর দিলাম। চক্ষুলজ্জার একটা ব্যাপার না থাকলে বোধকরি কানাইয়ের দোকান অবধি ছুটে যেতাম। সে যাই হোক রাস্তায় এত লোকজন তবু শূন্য শূন্য লাগে। দিন কয়েক ওমন শূন্যতার মাঝে কাটিয়ে মনের মধ্যে অভিমান চেপে বসলো। মেয়েটাও তো পারতো একবার নিজে থেকেই যোগাযোগ করতে। তাছাড়া মতামত জানাতে এত দেরি হওয়ার কী আছে!
সেদিন লাইব্রেরির এক কোনায় তাই গোমড়া মুখে বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি মৌসেনা আসছে। পরনে তার ঢাকাই শাড়ি। মনে মনে ওমনি পণ করলাম মুখে কোনো কথাই বলবো না আজ। এসপার কি ওসপার! মৌসেনা কাছে এসেই জিজ্ঞেস করলো কেমন আছেন?
আমি মুখে কথা না বলে একটা কাগজে লিখে দিলাম,
সময় অসময় একা লাগছে খুব
ভীষণ রকমের একা।
বুকের ভেতর উথালি-পাতালি
কেউ তো দেখে না।।
মৌসেনার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি চুপিচুপি হাসছে। একটা চেয়ার টেনে বসে আমার লেখাটার নিচে লিখে দিলো,
কাছে এসেও আসছো না কাছে
দিচ্ছো না যেন ধরা
রাত কেটে যায় ভোর আসে না
এ কেমনতর খেলা?
কিছুটা ভেবে আমিও লিখলাম তার নিচে
বলছি আমি কবে থেকে
জ্বলছি একা অনলে
ওমন রূপেই ছাই হয় পুড়ে
গ্রিস ট্রয় রোমান জুড়ে।
মৌসেনা কিছুটা সময় নিলো এবার। তারপর লিখলো,
নারী জন্ম ধন্য ওগো
লাজে মরি আড়ালে
আমিও দিতে পারি সঁপে
দু-হাত তুমি বাড়ালে।
খুশি মনে কী ছেড়ে কী লিখব বুঝতে পারছিলাম না! এক রকম কলম চালালাম,
এসো তবে যুগলবন্দী হই
চৈত্র দিনের শেষে
তুমি আমি মিলব দুজনে
পলাশ ফুটবে বনে।
মৌসেনা লজ্জাবতীর মত হেসে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। হাতে হাত রাখতে গিয়ে মনে পড়লো আমার, এটা একটা গণগ্রন্থাগার!
গল্পঃ চৈতি হাওয়া।
মঈনুল সানু।
আরো গল্প পড়ুন – না পাওয়ার কিছু কথা