রিয়ার এ বাজে অভ্যাসটা মোটেও ভালো লাগত না আমার। আমি যখন রাতে ঘুমিয়ে থাকতাম অকারণেই সে আমার ঠোঁটে চুমু খেতো!
ব্যাপারটা দু’একদিন না প্রায়ই সে এমন কাজটা করত। মাঝে মাঝে তার ঠোঁটের শীতল স্পর্শে আমার ঘুম ভেঙে যেত।
তখন সে লাজুক মেয়ের মতো অজুহাত দিয়ে বলত, ”সরি, তোমার কাঁথাটা ঠিক করে দিচ্ছিলাম,হঠাৎ করে এমনটা হয়ে গেল।”
আমি তখন ঘুম ঘুম চোখে রিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তার ঘন ঘন গরম নিশ্বাস আমার গালে এসে লাগত। ঘুম জড়ানো গলায় তাকে বলতাম, ”অনেক রাত হয়েছে রিয়া, প্লিজ একটু ঘুমোতে চেষ্টা কর।” সে তখন অসহায়ের মতো আমার দিকে তাকাত। তার নিশ্বাসের গতিও কিছুটা কমে আসত। তারপর কিছুটা বিরক্তিকর ভাব এনে উল্টো দিকে ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়তো।
আমাদের এ বিষয় টা স্বামী স্ত্রী দু’জনের মধ্যে খুনশুটি ও হতে পারত। কিন্তু ব্যাপার টা তেমন না, একটু ভিন্ন।
রিয়ার সাথে আমার সংসার দশ বছরের।আমাদের নিঃসন্তান দম্পতির, প্রথম সন্তান রিয়ার পেটেই মারা গিয়েছিল। এরপর থেকে রিয়া আর বাচ্চার মা হতে পারেনি,কখনো হতেও পারবে না। অবশ্য ডাক্তার সেসময় বলেছিল, পরবর্তীতে বাচ্চা নেওয়াটা রিয়ার জন্য অনেক ঝুঁকির।
তাই আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাইতাম না।কিন্তু পাগলাটে রিয়া এ কথাটা কিছুতেই বুঝতে চায় না। মা হওয়ার ইচ্ছেটা তার মাথা থেকে কখনই যায়নি।
হয়ত কারণে অকারণে রিয়ার এই চুমুর ভাষা আমি বুঝতে পারতাম। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকতে হতো আমায়।
.
অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায়ই সন্ধা হয় আমার। মাঝেমধ্যে রাত আট’টা নয়টাও বেজে যেত । যদিও সব সময় চেষ্টা করি অফিস শেষ করেই খুব দ্রুতই বাসায় আসতে। কারণ, রিয়া একা একা বাসায় থাকে। গল্পের বই পড়ে, টিভি দেখে।
মন খারাপ হলে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর খুব বেশি বোরিং হলে বন্ধুবান্ধব, রিলেটিভ একে তাকে ফোন দিয়ে কথা বলে সময় কাটায়। বলতে গেলে সারাদিন কাজ তার এগুলোই।
একদিন সন্ধায় অফিস থেকে ফিরে এসে লক্ষ্য করি দরজার খানিকটা খোলা। কিন্তু এমন টা তো হওয়ার কথা না! দরজা ঠেলে আস্তে করে ভেতরে ঢুকি। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সন্ধ্যা হয়েছে অনেক আগেই,অথচ সারা বাসায় কোন আলোই জ্বলছে না!
হঠাৎ মনের ভেতর অজানা এক ভয় ঢুকে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকলাম, রিয়া রিয়া।
কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। গলার ভেতরটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছিল। আস্তে করে ঢুক গিলে আবার ডাকলাম, রিয়া কোথায় তুমি? দেয়ালে আমার কথা গুলো প্রতিধ্বনি হয়ে পিনপতন নীরবতা।শুধু আমার হৃদপিন্ড তুমুল আওয়াজ করে চলছে।
ফোনের ফ্লাশ ধরে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি টিভির রিমোট টা পড়ে আছে মেঝেতে, ব্যাটারি গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। লক্ষ্য করি,সোফার এক কোণেতে রিয়ার ওড়না ঝুলে আছে। দ্রুত বেডরুমে আসলাম, দেখলাম ওর ফোনটা শুধু বিছানায় উপর; কিন্তু তাকে পেলাম না।
সারা বাসায় ও ছাদে তন্নতন্ন করে খুঁজে যখন নিশ্চিত হয়ে গেলাম রিয়া বাসায় নেই; তখন হঠাৎ খেয়াল হলো ব্যালকনির কথা। সেটা এখনো দেখা হয়নি।
নিশ্বাস বন্ধ করে দরজা খুলতেই দেখি ব্যালকনিতে ছায়া মূর্তির মতো কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
আচমকা পিছন থেকে জাপটে ধরলাম, চিৎকার করে বললাম, “রিয়া কী হয়েছে তোমার? কতক্ষণ ধরে তোমায় পাগলের মতো খুঁজছি, তুমি কী আমার ডাক শুনতে পাওনি?”
রিয়া আমার দিকে আনমনে হয়ে তাকাল। ভাঙা স্বরে বলল, “কই, কখন এলে তুমি?”
আমি চুপকরে রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। শুধু বুঝতে পারছিলাম কোন কারণে সে হয়ত এতক্ষণ কান্না করছিল। বললাম, “এসেছি তো অনেকক্ষণ হলো।”
“জানো, আজ বিকেলে পাশের ফ্ল্যাটের বড় ভাবী এসেছিল।”এই বলে ছোট নিশ্বাস নেয় রিয়া।
জিজ্ঞেস করলাম, “কে চুমকি ভাবি?”
“হ্যাঁ। চুমকি ভাবির বাচ্চাটা আমার কোল থেকে আজ যেতে যাচ্ছিল না। ভাবিকে তখন বললাম, আর একটু থাকুক না আমার কোলে ,” বলতে বলতে রিয়ার গলার স্বর কাঁপতে শুরু করল। ” কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে আসছে বলে কোল থেকে বাচ্চা কে জোর করে নিয়েই বের হয়ে গেল। তাকে পিছন থেকে কত করে বললাম, ভাবী বাচ্চাটা কান্না করছে দাঁড়ান, ওকে একটু আদর করে চুমু দিয়ে দিই; সে শুনলই না আমার কথা।”
আমি শক্ত করে রিয়াকে জড়িয়ে ধরি। সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।আমি ওর চোখ দুটো মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম।
.
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি রিয়া বিছানায় নেই। ঘড়িতে সবেমাত্র সকাল ছয়টা বাজে। রিয়া এত সকালে ঘুম থেকে কখনই উঠে না। আমার সকাল আট টায় অফিস যেতে হয়। যখন রেডি হয়ে বের হবো, তখন দরজা লক করার জন্য রিয়াকে ডাক দিয়ে ওর ঘুম ভাঙাই। সে দরজা বন্ধ করে আবার ঘুম দেয়।
হঠাৎ টিভির শব্দ কানে এলো, দ্রুত ড্রয়িংরুমে ছুটে গেলাম। এসে দেখি রিয়া সোফায় ঘুমিয়ে আছে। আমি সাবধানে ওর হাত থেকে রিমোট নিয়ে টিভি বন্ধ করে দিই।
রিয়া হাটু মুড়ি দিয়ে বাচ্চা মেয়ের মত ঘুমিয়ে আছে। সারারাত হয়তো টিভি দেখে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই। প্রায়ই সে মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। একা একা সারা বাসায় হাঁটাহাঁটি করে। আরও কত কী অদ্ভুত কান্ড যে ঘটায় সেই ভালো জানে।
বেডরুম থেকে কাঁথা এনে ওর শরীরে জড়িয়ে দিতেই আচমকা সে চমকে ওঠে।
“আরে ভয় পেয় না,” রিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। “কী ব্যাপার, এখানে ঘুমালে যে?”
রিয়া ঘুমঘুম চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। কথার জবাব দিচ্ছেনা। গালে আস্তে করে টোকা দিয়ে বললাম, “এবার বিছানায় ঘুমাতে যাও।”
“কেন,তুমি অফিস যাবে না?”
“না আজ হলিডে।”
রিয়ার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে ওঠে। সে বাধ্য শিশুর মতো বিছানায় ঘুমাতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আমি ওর পাশে এসে শুতেই, আচমকা চোখ মেলে তাকিয়ে বলল, ” গত রাতে বিছানায় শুধু ছটফট করছিলাম, একটুও ঘুম আসছিল না।”
মৃদু হেসে বললাম, “কেন?”
রিয়া আমার কথায় আবারও মুচকি হাসল। এক হাত আমার হাতের মুঠোও রেখে আরেক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
“এই যে এত বছর পর তুমি রাজী হয়েছ আমাদের বাচ্চা নেয়ার ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে কথা বলবে। সে খুশিতেই তো আমার ঘুম আসেনি।”
এই বলে রিয়া ঢুলুঢুলু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর কপালে মৃদু চুমু দিলাম। সে আবারও মিষ্টি করে হাসল।
.
অবশ্য রিয়ার এমন ডিপ্রেসড থাকা ও এমন অদ্ভুত আচরণের পিছনে আরও কিছু কারণ ছিল। সেই সমস্যা গুলো কিছুটা আগে থেকেই জানতাম আমি।
তার অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ আচরণ, বিষণ্ণতা, হঠাৎ অকারণেই মেজাজ হারিয়ে ফেলা। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় কিছু মেয়েদের আচরণই বোধোদয় এমন।
কিন্তু না, এর মধ্যে কিছু বিষয় লুকিয়ে আছে। অনেকেই জানে না যে এর পিছনে ‘হাইপার থাইরয়েড’ হরমোন সমস্যার হাত রয়েছে। এই সুপ্ত অসুখটা অনেক নারীর জীবনেই নানা ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রথম সন্তান ধারনের সময় এই থাইরয়েড সমস্যা রিয়াকে জটিল করে তুলেছিল, এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই বাচ্চা পেটেই মারা যায়।
যত কিছুই হোক বা ঘটুক না কেন তবু রিয়ার একটা বাচ্চার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু রিয়া কিছুতেই বুঝতে চায় না তাকে যে আমার সারা জীবনের জন্যই প্রয়োজন। প্রথম সন্তান ধারনের সময় মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া রিয়াকে অনেক কষ্টেই ফিরে পেয়েছিলাম। কিন্তু এবার রিয়ার একরোখা পাগলামোর অনুরোধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেই হলো।
ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানালেন, নারীর রিপ্রোডাকিভ বা প্রজননসত্তা এত ব্যপক প্রভাব ফেলে যে প্রত্যক নারীর উচিত সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা করলে একবার থাইরয়েড পরীক্ষা করে নেওয়া। আর সন্তান ধারণে সমস্যা বা গর্ভপাত হলে তা অবশ্যকরণীয়।
ডাক্তার রিয়াকে, বেবি কনসিভ করার তিন মাস আগে থেকে নিয়মিত ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যেতে বললেন। আশ্বস্ত করলেন সব কিছু ঠিকঠাক মতো হলে নাকি কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।
রিয়া খুব নিয়ম করেই ওষুধ খায়। তার হাসিখুশি মুখ, নতুন এক অতিথির জন্য আকুল অপেক্ষা, ওর এসব দেখে মনে আনন্দ হলেও, ক্ষণিকের জন্য একটু ভয় হতো।
দিন যত যায় আমার উৎকণ্ঠা তত বাড়ে। কিন্তু, রিয়ার ভয়টা শুধু তার পেটের বাচ্চাকে ঘিরেই ছিল। আমি তাকে প্রতিদিন সান্ত্বনা দিয়ে বলতাম, প্রতি সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে চেকআপ তো হচ্ছেই এত ভয় কীসের?
কিন্তু, তবু তার সে ভয় লেগেই ছিল। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে তার ডাকে ঘুম ভাঙে। দেখি, চোখেমুখে তার আতঙ্ক লেগে আছে। খুব দ্রুত নিশ্বাস নিচ্ছে। ভাবলাম হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখেছে।
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে আমার হাত তার পেটে ছুঁইয়ে বলল, “বাচ্চা কি নাড়াচাড়া করছে?”
লক্ষ্য করলাম রিয়ার মুখটা ফ্যাকাসে, বিন্দু বিন্দু ঘাম সারা নাকে মুখে। আমি হাতটা ওর পেট থেকে সরিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে দিলাম। রিয়ার এই কান্ডে আমি মোটেও বিচলিত না। প্রতিদিন বেশ কবার তার পেটে হাত ছুঁয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে হয় যে, বাচ্চা নাড়াচাড়া করছে।
আমি সবসময় তাকে হাসি মুখেই বুঝাতাম, তার এই অযতা দুশ্চিন্তা নিজের শরীর ও বাচ্চা দুটোর জন্যই খারাপ করে তুলবে।
.
প্রথম দিকে সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও প্রেগনেন্সির শেষ দিকে ওর শারীরিক অবস্থা একটু জটিল হতে শুরু করল। ডাক্তার জানাল সিজার ছাড়া উপায় নেই।
ঘটনার দিন আম্মা দুপুরে ফোন দিয়ে বললেন, দ্রুত হসপিটালে আসতে। রিয়ার অবস্থা নাকি খুব খারাপ। আমি পাগলের মত ছুটতে ছুটতে অফিস থেকে বের হলাম। সকালে রিয়াকে সুস্থই দেখে গিয়েছিলাম। কী ঘটছে আর কী হচ্ছে মাথায় কিছুই যেন ঢুকছিল না।
রাস্তায় জ্যামে আটকে আছি অনেক্ষণ; বাসের মধ্যে পাশের সিটের একজন বলল, ভাই পকেটে আপনার ফোন বাজছে।
ফোন স্কিনে তাকিয়ে দেখি আম্মা ফোন দিয়েছেন।
“বাবা কই তুই? রিয়া তোকে দেখতে চাইছে,” আম্মা’র কথার সাথে সাথে রিয়ার গোঙানির শব্দ শুনতে পেলাম। “তাড়াতাড়ি আয় বাবা, ওকে এখনি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে।” কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম রাস্তায় দৌউচ্ছি। লোকজন আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে ভাই?
আমি দৌড়তেই লাগলাম। ঘামে ভেজা শরীর, দুপুরের তপ্ত রোদ কিছুতেই আমার ক্লান্তি লাগছে না। আমাকে যে রিয়ার কাছে পৌঁছতেই হবে।
.
হসপিটালে এসে শুনি রিয়াকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইমার্জেন্সি সিজার করতে হবে। আমার শরীর কাঁপন শুরু হলো, আস্তে আস্তে হাত পা ঠান্ডা হতে লাগলো।
একজন ডাক্তার তাড়াহুড়ো হয়ে ঢুকছিল, তাকে বললাম, “প্লিজ আমায় ঢুকতে দিন।আমি রিয়ার হাসবেন্ড।”
ডাক্তার হতবিহ্বলের মত তাকিয়ে রইলেন। আমার কাঁধে আলতো করে হাত রেখে শুকনো মুখে শুধু বললেন, “আল্লাহ্র কাছে দোয়া করেন।’
আমি আম্মার দিকে তাকালাম, তিনি শাড়ির আঁচলে মুখে গুঁজে কান্না আটকাবার চেষ্টা করছেন। পিছন থেকে শ্বশুর বললেন, “বাবা আমার মেয়েটা বাঁচবে তো…,”এই বলে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। “মেয়েটা জ্ঞ্যান হারাবার আগ পর্যন্ত তোমার খুঁজ করছিল।”
কথা শেষ করে তিনি আবার শিশুর মত করে কাঁদতে লাগলেন।
আমি কী করব বুঝতে পারছি না। বার বার রিয়ার মুখটা ভেসে উঠছে। সে আমায় দেখতে চেয়েছিল। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। ভীষণ কান্না আসছে। তার হাতটা মুঠো করে তাকে বলতেও পারিনি, রিয়া এই তো আমি এসে গেছি, ভয় পেয়ো না। ইনশাল্লাহ, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সময় যেন থমকে গেছে। কত সেকেন্ড কত মিনিট পার হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। এক সময় ডাক্তার এসে বললেন, আপনার মেয়ে হয়েছে। একজন নার্স ফুটফুটে শিশু আমার কোলে তুলে দিলেন। আমি আমার মেয়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে বললাম, “রিয়া কেমন আছে। আমাকে ওর কাছে নিয়ে যান।”
ডাক্তার অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন, “বাচ্চা বেশ সুস্থই হয়েছে। কিন্তু, মায়ের অবস্থা খানিকটা আশংকা জনক। কিছু বলা যাচ্ছে না। বড় স্যার’রা সেখানে আছেন। এখনই কেউ ভেতরে যেতে পারবেন না।”
আমার পৃথিবী হঠাৎ দুলতে শুরু করল। এটা দুঃস্বপ্ন ভেবে চিৎকার করে জেগে উঠতে চাইছি বার বার। কিন্তু কিছুতেই কিছু পারছি না।
কেউ একজন মনে করিয়ে দিল, বাচ্চার কানে আযান দিতে হবে। আমি মেয়েকে কোলে নিয়েই ওর কানের কাছে আযান দিতে লাগলাম। কয়েক ফোঁটা চোখের পানি আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে মেয়ের সাদা তোয়ালে উপর পড়তে লাগল। মেয়েটা দেখতে হুবুহু তার মায়ের মতোই হয়েছে।
যার কারণে রিয়ার এত সেক্রিফাইস, নয় মাস ভালোবাসা দিয়ে তিলে তিলে যাকে গড়ে তুলেছে, সেই তাকে না দেখেই রিয়া এভাবে চলে যেতে পারেনা। হ্যাঁ, রিয়া অবশ্যই রিয়া জেগে উঠবে। তার মেয়ে কে দেখে কী কান্ডই না সে করবে। হয়ত, জড়িয়ে ধরে খুশিতে কান্নাই করতে থাকবে।
কিন্তু আমি জানি এটাই হবে তার শেষ কান্না।
নীরব সময় কাটতে লাগল। শ্বশুর-শাশুড়ি দু’জনেই নিশ্চুপে কেঁদে চলছেন। আম্মা বাচ্চাটা কে শান্ত করার চেষ্টা করছেন অনেকক্ষণ ধরেই,কিন্তু সে ও ক্রমাগত চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে জানান দিয়ে যাচ্ছে যে,তোমরা আমাকে মায়ের নিয়ে চলো। আমি শুধু চোখ বন্ধ করে পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইলাম।
.
পরিশিষ্ট :
আজ রিতুর জন্মদিন। মেয়েটা আজ দু’বছরে পা দিয়েছে। সে খুব ভালোভাবে হাটতে শিখে গেছে এখন; টুকটুক করে সারা বাসা ছুটে বেড়ায়। হোঁচট খেয়ে কোথাও পড়ে গেলে তার মা দৌড়ে ছুটে আসে। আমার দু’বছর বয়সী চঞ্চল মেয়েটা তখন তার মায়ের মুখটা ধরে অসংখ্য চুমু দিয়ে বলে, “মাম্মাম আমি ব্যথা পাইনি তো।”
সারা দিন মা মেয়ের এমন কাণ্ডকারখানা দেখে আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
নারীর সংসার জীবনের পরিপূর্ণতা আসে সন্তান লাভের মাধ্যমে। রিয়া এখন আস্তে আস্তে তার ডিপ্রেসড জীবন কাটিয়ে উঠে ওর বাচ্চার কাছে সে সমস্ত সুখ খুঁজে পায়।
অফিস যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলাম। দরজার কাছে আসতেই রিয়া বলল, “আজ মেয়ের জন্মদিন অফিস না গেলেই কি পারতে না।”
“একটা জরুরী মিটিং আছে সেটা শেষ করেই সকাল সকাল এসে পড়বো।” কথা শেষ হতে রিয়া হুট করেই আমার ঠৌঁটে চুমু বসিয়ে দিল।
রিতু কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। রিয়াকে ফিসফিস করে বললাম, “কী করছ মেয়ে বড় হচ্ছে তো!”
রিয়া আহ্লাদে গলায় বলল, ” হোক…!”
রিতু কী বুঝে হঠাৎ দু’হাতে তালি দিয়ে খলখলিয়ে হাসতে লাগল। আমি লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম।
রিয়া পেছন থেকে বলছে, তাড়াতাড়ি এসে পড়ো কিন্তু। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে রিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। সে ও মিটমিটিয়ে হাসছে।ভাবছি, স্বর্গের মতই পবিত্রময় অনুভূতি স্ত্রীর ঠোঁটের স্পর্শে ও তার আদর মাখানো চুম্বনে।
ভালোবাসার স্পর্শ (Romantic Wife Love Story)
-মিয়াদ রহমান
আরো পড়ুন – নিরব ভালবাসার গল্প