মা, এত তাড়াহুড়ো না করে আরেকটু ভালোভাবে খোঁজ নিলে হতো না?’
তুলির কথার জবাবে তার মা বললেন, ‘যা খোঁজ নেওয়ার নিয়েছি। ছেলের পরিবার শিক্ষিত ও বিত্তবান। এক নামে লোকে চেনে৷ এত ভালো সম্বন্ধ রোজ রোজ আসবে না।’
‘তাও ছেলের বিষয়ে আরো যদি একটু খোঁজ নিতে, ভালো হতো তবে।’
‘ছেলের বাবা-মা খুবই ভালো মানুষ। তাদের ছেলেটা নিশ্চয়ই খারাপ হবে না। খুব শীঘ্রই বাবার মতো সেও নামকরা উকিল হয়ে উঠবে দেখিস। তাছাড়া ছেলেটা দেখতেও সুদর্শন, যথেষ্ট শিক্ষিত। তোর বাবার সঙ্গে তো ইংরেজিতে ছাড়া কথাই বলে না।’
তুলি মলিন গলায় বললো, ‘কিন্তু পাশের বাড়ির কাকি যে বললো, ছেলেটা নাকি সুবিধার না।’
ধমকের স্বরে তুলির মা বলেন, ‘তারা কখনো ভালো চাইবে আমাদের! তোর ভালো জায়গায় বিয়ে হোক এটা অনেকেই চায় না, কথাটা মাথায় রাখবি। হিংসার বশে এসব কথা বলে বেড়ায়। কানে নিবি না ওদের কথা।’
তুলি চুপ করে রয়। মনের মধ্যের খচখচানিটাকে চাপা দিয়ে মায়ের কথা মেনে নেয়। পরিবারের পছন্দের উপর কথা বলার মেয়ে তুলি নয়। তাছাড়া নিজের পছন্দের কেউ নেইও তার। তবে যে মানুষটার সঙ্গে বিয়ে হবে সেই মানুষটার সঙ্গেই সারাজীবন পার করে দেওয়ার মনোবাসনা তার।
বেশ ধুমধামে বিয়েটা হয়ে যায়৷ তুলির বাবা মায়ের মুখের হাসি যেন ফুরায়’ই না৷ মেয়েকে ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে পেরে অহংকার বেড়ে দ্বিগুণ তাদের। লোকের কাছে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির গল্প করতেই এখন তারা খুব ভালোবাসেন।
শ্বশুরবাড়ির লোকের সঙ্গে বেশ মানিয়ে নিয়ে সংসার শুরু করে তুলি। স্বামি সাফিনকে সে ভীষণ ভালোবাসে। সাফিন শান্ত স্বভাবের একজন ঠিক তুলিরই মতো। স্বামীর এই স্বভাবে বেশ খুশি তুলি। সুযোগ পেলে বান্ধবীদের সঙ্গে তুলিও তার শ্বশুরবাড়ির গল্প জুড়ে দেয়।
মাস দুয়েক যেতেই তুলি টের পায় এতদিন চিনে আসা সাফিন আসলে অচেনা কেউ। প্রথম যেদিন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরে সাফিন, তুলি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা সেদিন তুলিকে এটা সেটা বুঝিয়ে সামলে নিলেও যখন একই ঘটনা প্রায়ই ঘটা শুরু করে তখন তুলি দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে। নানাভাবে বোঝাতে শুরু করে সাফিনকে, কিন্তু সাফিন কানেই তোলে না তুলির সেসব নীতিবাক্য।
রোজ রোজ নেশাগ্রস্ত হয়ে সাফিনের রাত করে বাড়ি ফেরার দৃশ্যে যেদিন চড়াও হয়ে তুলি প্রতিবাদ শুরু করে, সেদিন থেকে শুরু হয় তুলির উপর শারীরিক নির্যাতনের দৃশ্য। তুলির জানতে বাকি থাকে না যে সাফিনের এই স্বভাবটাই আসল, এতদিন সে কেবল অভিনয় করেছে।
তুলিকে সান্ত্বনা দিয়ে তার শাশুড়ি মা বলেন, ‘ধৈর্য ধরো বউমা৷ ছেলেটা খুব শীঘ্রই এসব থেকে বেরিয়ে আসবে। তোমার শ্বশুর যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। দেখবে খুব তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তুলি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। সব ঠিক হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদেরকে ভালো চোখে দেখা হয় না৷ সে চায় না সমাজের মানুষ তার দিকে আঁড়চোখে তাকাক, তাকে নিয়ে আড়ালে আবডালে লোকে ভুলভাল কথা বলে বেড়াক, তার জীবনে একটা দাগ লাগুক।
তুলির সাদা গালে লাল হয়ে যাওয়া থাপ্পরের দাগ দেখে কাজের মেয়ে জামিলা বলে উঠলো, ‘ভাবী, আপনে ক্যান যে তারে বিয়া করলেন! এট্টু খোঁজ খবর করোনের দরকার ছিলো আপনাগো।’
মশলার বয়ামটা হাতে নিয়ে জামিলার কথার জবাবে তুলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘বাবা শহরের নামকরা উকিল। ছেলেও তার বাবার পেশায়। শীঘ্রই সেও নাম করবে। এমন সম্বন্ধ পেয়ে আমার মধ্যবিত্ত পরিবার ছেলের স্বভাব নিয়ে আর অত নাড়াচাড়া করতে যায়নি। কে জানতো এমন হবে!’
জামিলা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আপনে এহোনো জানেন না?’
অবাক স্বরে প্রশ্ন করে তুলি, ‘কী জানি না?’
ফিসফিস করে বলে জামিলা, ‘সাফিন ভাইজানে তো উকিল না। বিয়ার আগে খালুজানের লগে কয়দিন গেছিলো কোর্টে তয় হে কোনো উকিল টুকিল না।’
তুলির হাত থেকে মশলার বয়ামটা ঠাস করে ফ্লোরে পড়ে গেলো। চেহারা জুড়ে বিষন্নতায় ছেয়ে যায় তার। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘মা, একটা সত্যি কথা বলবেন?’
তুলির মলিন গলার প্রশ্ন শুনে তার শাশুড়ি বললেন, ‘হ্যাঁ বউমা। বলো।’
‘আপনার ছেলে কী আসলেই উকিল?’
তুলির মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে শাশুড়ি মা চুপ হয়ে রইলেন।
শাশুড়ির নিরুত্তর চেহারা দেখে তুলির চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে।
‘তার মানে জামিলা যা বলছে তা সত্য মা?’
শাশুড়ি মা এখনো নিরুত্তর। মাথা নিচু করে চুপ করে আছেন তিনি।
তুলির চোখ থেকে টপ টপ করে জল গড়িয়ে গাল ভিজতে আরম্ভ হলো। দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে রুমের দরজা বন্ধ করে মুখ চেপে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে।
রাত করে বাড়ি ফেরা নেশাগ্রস্ত সাফিন যখন রুমের দরজা বন্ধ করে তুলিকে মারধর করে, দরজার ওপাশ থেকে তুলির শ্বশুর শাশুড়ি তখন চিৎকার করে সাফিনকে থামতে বলেন। কিন্তু মাতাল সাফিনের কানে সেসব কথা প্রবেশ করে না, তুলির চোখের পানিও তখন তাকে স্পর্শ করে না।
রাতের পাষণ্ড সাফিন সকাল হতেই যেন বদলে যায়। রাতের কর্মকাণ্ডের জন্য সকালে ক্ষমা চাইলেও রাত হলে আবার ভুলে যায়। তবুও তুলি সব সহ্য করে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। একদিন সে তার স্বামীকে বোঝাতে ঠিক সক্ষম হবে, সেদিন থেকে সাফিন আর নেশা করবে না, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে, সকালের মতোই সুন্দর হয়ে উঠবে সাফিনের জীবন। তারপর থেকে শুরু হবে দু’জন মিলে খুব ভালো থাকার দিন। এসব স্বপ্ন নিয়েই দিন গুনে তুলি।
বিকেলে ছাদে গেলে নিচ তলার ভদ্রমহিলা তুলিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তো লেখাপড়া জানা মেয়ে। তবুও কেন এই মাধ্যমিক ফেল, বেকার, মাতালের সংসার করছো?’
তুলি অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘মাধ্যমিক ফেল?’
‘হ্যাঁ। তুমি জানতে না? সাফিন তো মাধ্যমিকও পাশ করেনি। তার আগেই ছেলেটা বখে গেলো। তবে মেধাবী ছিলো খুব, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একেবারে গোল্লায় গেলো ছেলেটা।’
তুলির মাথায় চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হতে লাগলো। তাড়াতাড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে রুমে এসে আলামারিতে তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে সাফিনের সার্টিফিকেটগুলো। সাফিন তাকে বলেছিলো আলমারিতেই তার সমস্ত সার্টিফিকেটগুলো রাখা আছে।
দেড়ঘন্টা যাবৎ খুঁজেও কোনো সার্টিফিকেট পেলো না তুলি। ধপ করে বসে পড়ে ফ্লোরে। ভাবতে থাকে, আর কতকিছু লুকানো হয়েছে তার থেকে!
ইদানীং তুলির পরিবারের লোকেদের সঙ্গেও খারাপ আচারণ করে সাফিন। তুলিকে তার পরিবারের লোকেদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দেখলেই গালাগাল শুরু করে। বাবা বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেয় তুলির। শারীরিক নির্যাতনের সঙ্গে মানসিক নির্যাতন শুরু হয় তার উপরে।
বাবা বাড়ির লোকেদের থেকে এতদিন সব আড়াল করেছে তুলি। বাবা জানতে পারলে তাকে এবাড়ি থেকে নিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে এই ভয়ে সব গোপন করে সহ্য করেছে সে। কিন্তু এখন আর পারছে না৷ সবকিছুরই সীমা থাকে। সহ্য শক্তির সীমা ছাড়িয়ে এবার তুলির ভেতরে জমে উঠে ক্ষোভ৷
মা’কে কল করে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের শিক্ষিত জামাই তোমাদেরকে গালাগালটা কী ইংরেজিতে দেয় নাকি বাংলাতেই দেয়?’
চুপ করে রইলেন তুলির মা৷ তুলি আক্ষেপ করে বললো, ‘ইংরেজি জানলেই যেমন কেউ খুব শিক্ষিত হয়ে যায় না মা। তেমন বাবা মা ভালো হলেই সন্তানেরা ভালো হয় না। এবার কী টের পাচ্ছো মা?’
উত্তরে ওপাশ থেকে তুলির মা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
তুলিকে ব্যালকনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জামিলা বললো, ‘স্বামীর টাহাপয়সা, লেহাপড়া, চাকরি বাকরি না থাকলেও সংসার করোন যায়, যদি মানুষটা ভালো অয়। তাই না কন ভাবী?’
তুলি উত্তর না দিয়ে রুমে এসে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে৷ এমন সময় তুলির বাবার ফোনকল।
‘তোকে নিতে আসব মা?’
‘অনেক মার খেয়েছি বাবা, তাই বলে বাড়ির ঠিকানাটা এখনো ভুলে যাইনি৷ আসতে পারব। নিতে আসতে হবে না।’
মেয়ের আক্ষেপের কথা শুনে চুপ হয়ে রইলেন বাবা।
সাফিন বাসায় নেই৷ সারাদিন সে বাসাতে থাকেও না৷ তুলির শ্বশুর শাশুড়ি চুপ হয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছেন।
তুলিকে দেখে শাশুড়ি মা কান্না জড়ানো গলায় বললেন, ‘ভেবেছিলাম, ছেলেটা বিয়ের পরে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আমাদেরকে ক্ষমা করে দিও মা।’
তুলির ভেতরে ছটফটিয়ে উঠলো চেপে রাখা সমস্ত ক্ষোভ।
‘আপনারা আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন। স্বার্থপরের মতো নিজের ছেলের কথা ভেবে অন্যের মেয়ের জীবনটা এমন দুর্বিষহ করে তুলতে আপনাদের বাধলো না। আমি এমন স্বার্থপর মানুষদের কখনো ক্ষমা করতে পারব কী না জানি না!’
তুলির শ্বশুর অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তুলি তাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘অসুস্থ ছেলেকে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মেয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ছেলের সুস্থতা আশা করা বন্ধ করুন। বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, এমনটা ভাবাও বাদ দিন। আপনাদের উচিৎ ছিলো আগে ছেলেকে সুস্থ করা, তারপর সব বলে কয়ে সুস্থ একটা মেয়েকে বাড়িতে আনা।’
গাড়ি চলছে। তুলি বাসের জানালার ওপাশে তাকিয়ে আছে আর জীবনের সব হিসেব কষছে৷ তার কোনো ভুল ছিলো না এখানে। তবুও তাকে ভুগতে হবে বিনা কারণে৷ কেননা মানুষ বানিয়ে হলেও তার দোষ ঠিক খুঁজে বের করবে। বিয়ের আগের জীবনটা সে এখন চিৎকার করে হাজারবার কাঁদলেও ফেরত পাবে না। সময়ের সঙ্গে বদলে গিয়েছে তার সেই সুন্দর জীবন।
-জীবন
মাহফুজা রহমান অমি
আরো গল্প পড়ুন – হঠাৎ বৃষ্টি – একটা ভালোবাসার গল্প