সরল প্রণয় – একাকী ভালোবাসা: ঘরে ফোনের রিংটন শুনে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকলাম। ফোনটা তুলে দেখি সিম কম্পানির ফোন। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম আমি।
মূলগল্প
~ চৈতি, আমার শার্টটা বের করে দিয়ে যাও। খুঁজে পাচ্ছিনা।
~ আলমারিতে সামনেই ঝুলিয়ে রেখেছি তো। ভালো করে দেখেন।
~ পাচ্ছিনা তো। তুমি বের করে দাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
~ আমি মাছ কাটছি। এখন আসতে পারবোনা।
~ তাড়াতাড়ি এসো।
আমি ধ্যাত্ বলে উঠে পড়লাম। মোটে মাছটা কাটতে বসেছি। এর মধ্যই আহসানের ডাকাডাকি। কোনরকম হাতটা ধুয়ে শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে রুমে ঢুকলাম। ডুকে দেখি উনি আয়নার সামনে দাড়িয়ে ঘড়ি পরছে।
আমিতো জানি আপনি খুঁজেনই নি, না দেখেই আমাকে ডাকছেন। কি মজা পান আমাকে বিরক্ত করে?বলতে বলতেই শার্টটা বের করে উনার হাতে দেই। উনি একটা হাসি দিয়ে শার্টটা পরে নেন।
উনার হাসি দেখেই আমার রাগ নেমে যায়। তবুও মুখের রাগী ভাবটা বজায় রেখে ড্রয়ার থেকে মানিব্যাগটা বের করে উনার দিকে এগিয়ে দেই। উনি এবারও হাসি দিয়ে সেটা নিয়ে পকেটে ঢুকান।
তারপর একহাতে কোমড় জড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে নেন। আমার মাথাটা যেয়ে উনার বুকে বাড়ি খায়। উনি মুখটা ঝুকিয়ে কানের সামনে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,
~ যখন বুঝোই যে আমার তোমাকে লাগবে তখন শুধু শুধু কাজের অজুহাত দেখাও কেনো?
আমি মাথা নিচু করেই বললাম,
~ ছাড়ুনতো। আপনার না দেরি হয়ে যাচ্ছে?
~ তোমার পালাই পালাই সভাব আর গেলনা। বিয়ের একবছর হয়ে গেলো অথচ তোমার লজ্জাই কাটাতে পারলাম না।
~ আমি লজ্জা পাই না।
~ ওহ্, তাই নাকি?বলেই উনি আমার কাঁধে নিবিড়ভাবে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলেন।
আমি কেঁপে উঠলাম। হাত দিয়ে মুচরে ধরলাম উনার কোমড়ের দিকের শার্ট। উনার স্পর্শে কখনোই স্বাভাবিক থাকতে পারিনা আমি। সর্বাঙ্গে উথাল পাতাল হয় আমার।
উনি মুচকি হেসে মুখ উঠিয়ে নিলেন। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললেন,
~ ভালোবাসো না?
আমি এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে বললাম,
~ খুব ভালোবাসি।
আমি জানি এটা না বলা পর্যন্ত আমাকে ছাড়বেন না। উনি কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলেন। আয়রন করা শার্টটা জোরে চেপে ধরাতে কুঁচকে গেছে। উনি সেখানটায় তাকিয়ে হতাশ ভাবে বললেন,
~ এই তোমার লজ্জা না পাওয়ার নমুনা?
আমি বোকা বোকা একটা হাসি দিয়ে বের হয়ে গেলাম।
উনি কাজে বেরিয়ে পরতেই দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আবারো মাছ কাটতে বসে পরলাম। একঘন্টার মধ্যে মাছ কেটে রান্না চড়িয়ে দিলাম।
বিকেলবেলা…
বাড়িতে শুধু আমি আর শাশুড়ি মা আছি। মা দুপুরের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পরেছেন। একা একাই সারাটা বিকাল কাটে আমার। আহসান ফেরেন রাতের বেলা। লোকটা দিন রাত খেটে যাচ্ছেন সংসারটা গুছিয়ে নেয়ার জন্য।
আমি অলস ভঙ্গিতে ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট বারান্দায় এসে দাড়ালাম। পাশে তাকিয়ে কিছু একটা মনে পরতেই ছুটে গিয়ে একমগ পানি নিয়ে আসলাম। পরম যত্নে বড় করা গোলাপ গাছটায় আজ পানি দিতে ভুলেই গেছিলাম। সেদিন এর কথা আজও মনে পরে যেদিন আহসান গাছটা নিয়ে আসলেন…..
একসাথে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম আমরা। বিয়ে হয়েছে তখন কেবল তিনমাস। সবকিছুতেই তখন প্রেম প্রেম ভাব।
ভালোবাসার ছড়াছড়ি আনাচে কানাচে। যদিও এখনো তার খুব বেশি ব্যাতিক্রম না।
সেদিন আমার পরণে ছিল লাল শাড়ি আর আহসান আমার সাথে মিলিয়ে লাল পানজাবি পরেছিলেন। নদীর পাড়ে হেঁটে বেরাচছিলাম। হঠাৎই একটা বাচ্চা ছেলে এসে দাড়ালো। হাতে একতোড়া লালগোলাপ।
আহসান মুচকি হেসে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করলেন। দুইটা দশটাকার নোট বের করে ছেলেটার দিকে এগিয়ে দিলেন।
বাচ্চা ছেলেটা হাসিমুখে দুটো গোলাপ আহসানের হাতে দিলো। ছেলেটা চলে যেতেই উনি আমার দিকে ঘুরে একটা ফুল আমার খোঁপায় গুঁজে দিলেন। আর একটা ফুল আমার হাতে দিয়ে বললেন,
~ একতোড়া ফুল কিনে দেয়ার সামর্থ্য আমার নেই। তুমি একটাই রাখো। সামর্থ্য হলে একদিন তোমাকে পুরো গোলাপের বাগান উপহার দিব।
আমি মুচকি হেসে জবাব দিয়েছিলাম,
~ আমার বাগান লাগবেনা। আমি এতেই খুব খুশি।
আহসান সেদিন আমাকে পাবলিক প্লেসেই সবার সামনেই কপালে চুমু খেয়েছিলেন। লজ্জায় তখন আমার মাথা কাঁটা যাওয়ার অবস্থা। যদিও দু একজন ছাড়া কেউই তাকায়নি।
কারণ নদীর পাড়ে সবাই ব্যস্ত ছিলো সবার প্রিয় মানুষ নিয়ে। আমাদের দিকে তাকানোর সময় কোথায়?
সেই ঘটনার ঠি ক তিন দিন পরে উনি রাতে বাড়ি ফেরার সময় এই গোলাপ গাছটা নিয়ে আসেন। আমি বিস্মিত নয়নে বলেছিলাম,
~ শুধু শুধু টাকা অপচয় করলেন কেনো?
উনি দুষ্টু হেসে জবাব দিয়েছিলেন,
~ কিসের টাকা নষ্ট?এই গাছের যত্ন নিয়ে ফুল ফুটিয়ে সেই ফুল বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে আমরা একটা গোলাপের বাগান করবো। আর তারপর শুধু গোলাপ বিক্রি করবো আর টাকা আর টাকা। সুতরাং এটা টাকার বৃদ্ধি, অপচয় না..বুঝলে?
আমি হো হো করে হেসে উঠেছিলাম। সেই থেকে আমি গাছটার যত্নে কোন ক্রুটি রাখিনি। নিয়ম করে পানি দেই।
নমাসে মোট আটটা ফুল হয়েছে গাছটায়। এখনো দুটো বড় বড় ফুল ফুটে আছে।
একবার ঝড়ের সময় তীব্র বাতাসে গাছটা পরে গিয়েছিলো। মাটির টব ভেঙে মাটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে ছিলো।
সকালবেলা এ দেখে আমার সে কি কান্না। উনি কোনোভাবেই কান্না থামাতে পারছিলেন না। গাছটার প্রতি আমার এতটা মায়া জন্মে গিয়েছিলো। অগত্যা উনি তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পরেন। মা ভাবেন আমার কান্নায় হয়তো উনি বিরক্ত হয়েছেন।
রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছেন। এ কথা শুনে আমি আরো জোরে কান্না করে দেই।
আহসান ফিরেছিলেন দুটো মাটির টব হাতে। একটাতে গাছটাকে আবারও সুন্দর করে লাগিয়ে দিয়ে অন্যটা আমার হাতে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেছিলেন,
~ এরপর ভেঙে গেলে এটায় লাগিয়ে দিবো। এই সামান্য বিষয়ে এতটা কাঁদার কি আছে?আর কখনো যেন তোমাকে কাঁদতে না দেখি। মনে থাকবে?
আমি মাথা নাড়িয়ে বলেছিলাম,
~ থাকবে।
ঘরে ফোনের রিংটন শুনে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকলাম। ফোনটা তুলে দেখি সিম কম্পানির ফোন। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম আমি।
ফোন ধরলেই এরা বলবে মাত্র দুইটাকা দিয়ে শুনুন আপনার পছন্দের প্রিয় গানটিআমি ভেবে পাইনা, মানুষ কেনো দুইটাকা খরচ করে গান শুনতে যাবে?টাকা কি বেশি হয়ে গেছে?
আহসান তো আমাকে একদম বিনামূল্য কত সুন্দর করে গান শোনান।
উনার ফেরার সময় হয়ে গেছে। এখনও আসছেন না কেন?দুবার ফোন দিয়েছি। উনি ধরেননি। চিন্তা হচ্ছে খুব।
এমন সময় বেল বাজলো। আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। সামনের মানুষটাকে দেখে কলিজায় পানি এলো আমার। আহসান দাড়িয়ে আছেন। ঘামে ভিজে গেছে উনার শার্ট। খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আমি উনার হাতের ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। উনি এসে শার্টটা খুলে বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে দিলেন।
আমি রান্নাঘর থেকে শরবতের গ্লাসটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। উনি চোখ বন্ধ করে আছেন। আমি সামনে যেয়ে মৃদু কন্ঠে বললাম,
~ আপনি কি খুব ক্লান্ত?
উনি চোখ মেললেন। আমার দিকে তাকিয়ে স্লান হেসে গ্লাসটা নিয়ে বললেন,
~ নাহ। একটু টায়ার্ড লাগছিলো আরকি।
~ ফ্রেশ হয়ে আসেন। খাবেন না?
~ হ্যাঁ, আসছি। তুমিওতো খাওনি?
আমি নাবোধক মাথা নাড়ালাম। উনি আর কিছু বললেন না। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলেন।
খাওয়া পর্ব শেষ করে, সব গুছিয়ে রুমে যেতে একটু দেরি হয়ে গেলো আমার। রুমে ঢুকে দেখলাম উনি নেই। সিগারেটের গন্ধে বুঝতে পারলাম উনি বারান্দায় আছেন।
আমি ধীরপায়ে উনার পাশে যেয়ে দাড়ালাম। উনি আমার উপস্থিতি টের পেয়ে সিগারেটটা ফেলে দিলেন।
~ না খেলে হয়না?
উনি পেছন থেকে জাপটে ধরে আমার গালে গাল ঘঁষতে ঘঁষতে বললেন,
~ বেশি খাইনা তো। এক দুইটা।
আমি মৃদু আর্তনাদ করে বললাম,
~ উফফ…গাল ঘঁষবেন না তো। আপনার দাড়ি বিঁধে। ব্যাথা পাই।
উনি মুখ স্হির করে বললেন,
~ দোষটা আমার দাড়ির না, দোষটা তোমার গালের। ওটা একটু বেশিই নরম।
~ হু, বলেছে আপনাকে?
উনি হাসলেন। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো এসে পরেছে বারানদায়। উনি আমার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে মোহনীয় কন্ঠে গান ধরলেন,
হঠাৎ এসেছিলে চোখের আলোতে,
হারিয়ে ফেলেছি এক ঝলকে…….
তবুও তুমি ছিলে চোখের কোনে,
আগলে রেখেছি বড় যতনে…
এরপর আমাকে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে গাইলেন,
ভালোবেসেছি তোমাকে প্রথম-
চোখের আলোতে এসেছো যখন,
ছিলে হৃদয় জুড়ে প্রতিক্ষণে…..
ভালোবাসা তো হয়না মনের বিপরীতে…..
লেখিকা – মালিহা খান
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “সরল প্রণয় – একাকী ভালোবাসা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – মনের গহীনে – Romantic Love story BD