নোনাজলের শহর (শেষ খণ্ড) – ভালোবাসার কষ্টের কথা

নোনাজলের শহর (শেষ খণ্ড) – ভালোবাসার কষ্টের কথা: আদিব আর প্রয়া একসাথে মুমুর দুই গালে চুমু দিতে শুরু করে। বাবা~ মেয়ের পাগলামি দেখে মুমু ফিক করে হেসে দেয়। তার আর কিচ্ছু চাই না, এই দুইটা ভালবাসাই তো তার স্বর্গ।


পর্ব ১৪

কষ্ট হচ্ছে? কেবলমাত্র শুরু, আট বছরের সকল কষ্ট পায় পায় শোধ করবো আমি। বি প্রিপেয়ার মিসেস মিশিকা মাহমুদ মুমু। টু সিটেড সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে রেগে কথাগুলো বলছে আদিব।

আদিবের কন্ঠ শুনেই হাত~ মুখ বাধা অবস্থায় ছটফট করে বিছানার উপর উঠে বসে মুমু। সোফায় পায়ের উপর পা তুলে, দুই হাত মেলে সিলিং এর দিকে মুখ করে গা এলিয়ে বসে আছে আদিব। কালো শার্টের বুকের দিকে দুটো বোতাম খুলে রাখাই ফর্সা লোমেশ বুকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুমুর চোখে পানির সাথেই অন্যরকম খুশির ঝিলিক উপস্থিত হয়েছে। কতদিন পরে তার আদিব ভাইয়াকে দেখছে, সে কি সত্যি দেখছে? চোখ দুটো বন্ধ করতেই নোনাজলেরা গাল বেয়ে নিচে নেমে যায়।

হঠাৎ আদিবের বলা কথা মনে পড়তেই ফট করে চোখ মেলে তাকায় মুমু, আদিব একদম তার সামনে বিছানার উপর বসে আছে। আদিবের চোখ গুলো ভয়ংকর রকমের লাল হয়ে আছে, মুমু অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় আদিবের দিকে। আদিব মুমুর তাকানো দেখে চট করে একহাতে মুমুর চুল গুলো শক্ত করে ধরে মুখটা একদম নিজের মুখের সামনে নিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে, আমাকে ডিভোর্স দিয়ে সিঙ্গেল মাদার হয়ে মহৎ হওয়ার চেষ্টা করছিস? তুই কি ভেবেছিলি ডিভোর্স পেপার সই করে উধাও হয়ে গেলেই আমি তোকে ডিভোর্স দিয়ে দিব? (অন্যহাতে মুমুর মুখ থেকে টেপ টেনে খুলে)

আদিবের রণমুর্তি দেখে মুমু কাঁপতে শুরু করে। মুমু কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আদিব ভীষণ জোরে তার ঠোঁট কামড়ে ধরে। ব্যাথায় মুমুর চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। হঠাৎই আদিব মুমুর ঠোঁট জোড়া খুব সফটলি আবদ্ধ করে নেয় নিজের ঠোঁটে, অনেক দিনের পিপাসা, কষ্ট, ক্ষোভ সব মিটাতে ব্যস্ত আদিব। অন্য দিকে আদিবের এমন ছোঁয়ায় মুমুর মনে হচ্ছে তার সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে, একটুও নড়া সম্ভব না। সুখ, ভালোবাসা, কষ্ট মিলে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। দুজনের চোখ থেকেই অঝোরে নোনাজলের স্রোত গড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই আদিব মুমুকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে উঠে দাড়ায়। তারপর গটগট করে হেটে দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ করে বের হয়ে যায় রুম থেকে। দরজার শব্দে শুনে মুমু ফুপিয়ে কেঁদে উঠে

মিমনের দমবন্ধ হয়ে আসছে, প্রচন্ড পরিমাণ হাত~ পা ঘামছে। আট বছর আগের ঘটনার সময়ও এতো ভয় লাগেনি তার। প্রয়া সন্ধ্যা থেকে মাম মাম যাবে বলে চুপ করে ছিল। কিন্তু এখন রীতিমতো ঠোঁট ফুলিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না শুরু করেছে। মা ও সৃজা অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারছেনা। মিমনের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। ভার্সিটি, বিল্ডিং এর দারোয়ান কেউই মুমুর কথা কিছু বলতে পারছে না। হ্যা রূপক, রূপককে বলতে হবে। রূপক ঢাকা ~ থানার এস আই, ওই পারবে মুমুকে খুঁজে দিতে।

রূপক রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে বসেছে মাত্র, ফোনের কম্পনে তাকিয়ে দেখে মিমন ফোন করেছে। সাড়ে নয়টা বাজে প্রায়, এসময় মিমনের কল দেখে খুশি হয়ে ফোন উঠায় রূপক। মিমন অস্থির হয়ে বলে উঠে, রূপক মুমুকে পাচ্ছিনা রূপক, তুমি আমার মুমুকে খুঁজে দাও প্লিজ। বলেই কেঁদে ফেলে মিমন। ফোন তুলেই এমন কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না রূপক। মিমনকে শান্ত করে বলল, ভাই ঠিক কি ঘটেছে এখন বলুনতো। তারপর মিমন সকাল থেকে মুমুর নিখোঁজ হওয়ার সবকিছু জানাই।
রাগে মাথা টনটন করছে রূপকের, লিফটের সিসি ক্যামেরা রাত থেকে নষ্ট দেখাচ্ছে। এদিকে দারোয়ান বলছে সে মুমুকে বের হতে দেখেনি। ভার্সিটি কতৃপক্ষ বলেছে মুমু আজ আসেনি। পুরো বিল্ডিং সার্চ করেছে সে। পাশের এপার্টমেন্টে নতুন এসেছে NSI অফিসার তরুণ আহমেদ তাকেও অনেক সময় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে রূপক। কিন্তু কোনো কিছুই জানতে পারেনি সে। রাগে নিজের চেম্বারের সবকিছু ভেঙে লন্ড ভন্ড করে চোখে অথৈ জল আর কেটে যাওয়া হাত নিয়ে ফ্লোরে বসে আছে রূপক।

রূপকের জীবনে প্রথম অনুভূতি জাগিয়ে তোলা মেয়েটি হচ্ছে মুমু। মুমকে প্রথম দেখেছিল রুপার জন্মদিনে। সন্ধ্যায় কেক নিয়ে এসে রুপার রুমে ঢুকতেই কয়েকটা হার্টবিট মিস করে রূপক। বাচ্চা একটা মেয়ে আসমানী রংয়ের ড্রেস পড়া, কোমড় পর্যন্ত একগাদা লম্বা চুল, চোখের উপরে মোটা করে আইলাইনারের রেখা, ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক, আর তার ঠিক নিচে কালো তিল, একদম মায়াবিনী। মেয়েটা তার দিকে ভীতু ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে। রূপক যখন রুপার কথা জিজ্ঞেস করেছিল, উত্তরে মুমুর ভীতু আর আদুরে গলার কথা শুনে আরেক দফা হার্টবিট মিস হয়ে যায় তার। বাইকে যাওয়ার কথা শুনেই আতকে উঠা দেখে হেসে ফেলেছিল রূপক। বাইকে উঠে কাঁধ ধরতে বললেই মুমুর ভীতু হয়ে ঢোক গিলাটাও চোখে পড়েছিল তার। সেইরাতে একটুও ঘুমতে পারেনি সে।

পরদিনই রুপাকে কলেজ পৌঁছে দিতে যায় রূপক, একপলক মুমুকে দেখার জন্য। কিন্তু সেদিন তার দেখা পায়নি। পরের দিনও যখন মুমু আসেনা, তখন তার বাসার সামনে যেয়ে দাড়িয়ে থাকে। সেদিনই প্রথম মুমুকে আদিবের সাথে রিকশাই বসে বের হতে দেখে। তবে তখনও মুমু আর আদিবের সম্পর্কে কিছু জানতো না সে। এরপর রোজই সে মুমুকে দেখতে যেত। কিন্তু যেদিন সে জানতে পারে আদিব মুমুর হাসবেন্ড, সারাদিন নিজেকে ঘর বন্দি করে রেখেছিল। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর কখনো মুমুর দিকে তাকাবে না। কিন্তু দুই দিনে নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছিল। তাই আবারও মুমুকে দেখতে যেত। কিন্তু আদিবের সাথে দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারতো না রূপক।

তাইতো মুমুকে উঠিয়ে নিয়ে আসে ভয় দেখানোর জন্য। কিন্তু নিজের পাগলামির জন্য সেদিন মুমুকে চুমুর জায়গা কামড়ে দিয়েছিল। মুমু যখন সেন্সলেস হয়ে যায় তখন রূপকের হুঁশ ফিরে। মুমুকে হাজার ডেকেও যখন জ্ঞান ফিরে না, সে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যায়। আর এরই মাঝে পুলিশ মুমুকে নিয়ে যায়। হসপিটালে আদিবকে মুমুর পাশে দেখে আবারও মাথা খারাপ হয়ে যায় তাই সেই রাতে আবার মুমুকে ভয় দেখিয়ে ছিল। রুপাকে দিয়ে মুমুর খবর নিতে আদিবকে ফোন দিলে যখন মুমু কথা বলেছিল তখন সব শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছিল। তাইতো আদিবের এক্সিডেন্ট করিয়ে দিয়েছিল।
মুমুর কলকাতা যাওয়ার ভিসা পাসপোর্ট বাবাকে দিয়ে নিজ দায়িত্বে করিয়েছিল। মুমু যাওয়ার পর নিজেই আদিবকে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিল। মিমনের কাছে আাট বছরে অনেক বার মুমুকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু মুমু কখনো রাজি হয়নি। আজ সকালেও প্রয়াকে মেনে নিয়েই বিয়ে করার কথা বলেছিল মিমনকে। তাইতো রাতে মিমনের ফোন পেয়ে খুশি হয়ে গেছিলো।
রক্ত লেগে থাকা হাতটা সামনে ধরে নিরবে কেঁদে উঠে রূপক।

রাত ১:৩৭ মিনিট

মিমন চিন্তিত হয়ে ড্রয়িং রুমে বসে আছে, মা পাশে বসে কাঁদছেন। প্রয়াকে অনেক কষ্টে সন্ধ্যারাতে ঘুম পাড়ালেও আবার উঠে কান্না শুরু করেছে। সৃজা কোনো ভাবেই শান্ত করতে পারছেনা। আর এসব কিছুই ল্যাপটপ এর সামনে বসে দেখছে আদিব। গতকাল রাতে সে লিফটের সিসি ক্যামেরা নষ্ট করে মুমুর এপার্টমেন্টে যেয়ে ক্যামেরা সেট করে এসেছিল।
মিমন নিজের মাথার চুল টেনে ধরে হাটুর উপর হাত দিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে প্রয়া ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছে। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজে ধুপ করে উঠে দাড়ায় মিমন। মুমু এসছে ভেবেই দরজা খুলে দেয়, কিছু বোঝার আগেই কেউ নাক বরাবর ধুম করে একটা ঘুষি দেয় মিমনকে। তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে যায় সে। নিজেকে সামলে সামনে তাকাতেই দেখে, আদিব গটগট করে হেটে সৃজার কোল থেকে প্রয়াকে নিয়ে আবার গটগট করে হেটে পাশের এপার্টমেন্টে ঢুকে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে।


পর্ব ১৫

‘কি হয়েছে পরীটার এতো কাঁদছে কেন? বলো আমাকে’ প্রয়ার চোখের পানি মুছে আদুরে গলায় বলল আদিব। প্রয়া চোখ টলটলে করে বলল, মাম মাম আদিব প্রয়াকে একটু উচু করে গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে বলল, ছোট্ট পরীটা কি তার মাম মামের কাছে যাবে? প্রয়া ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নেড়ে বলল, মাম মাম দাবো।
আদিব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্রয়ার দিকে, প্রয়াকে মুমুর বিছানায় বসিয়ে দিতেই সে একটাও শব্দ না করে মুমুর গালে একটা চুমু দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে মুমুর বুকের সাথে মিশে শুয়ে পড়েছে। এতো শান্ত বাচ্চা সে তার জীবনে মনে হয় প্রথম দেখলো।

আদিব রেগে বেরিয়ে যাওয়ার পর মুমু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছিল। সারাদিন না খেয়ে কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোনোর ফলে বেশ গভীর ঘুম দিচ্ছে মুমু। হঠাৎ ঘুমের মাঝে তার মনে হলো প্রয়া তার বুুকের কাছে। অনেকক্ষণ কাদার ফলে চোখ মেলতেই চোখটা কেমন ব্যাথা করে উঠে। সত্যিই প্রয়া তার গলা জড়িয়ে শুয়ে আছে। মুমু চোখ মেলতেই প্রয়া তার নাকে চুমু খায়। মুমুও তার নাকে চুমু খায়। হাত বাধা থাকায় প্রয়াকে জড়িয়ে ধরতে পারছেনা মুমু। এতক্ষণ মা মেয়ের প্রেম দেখছিল আদিব। মুমুর হাতে চোখ পরতেই ‘সিট’ বলেই দৌড়ে বাঁধন খুলে দেয়।

অনেকক্ষণ হাত বাধা থাকায় সোজা করতেই আহ করে চোখ বন্ধ করে ফেলে মুমু। ডোন্ট মুভ বলেই অস্থির ভাবে মুমুর পাশে বসে হাত দুটো ধরে ম্যাসেজ করতে থাকে আদিব। মুমু টলটলে চোখে আদিবের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর প্রয়া মুমুর পিছন থেকে গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে আদিবের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে লোকটা মাম মামের হাতে কি করছে।
আদিব হাত ম্যাসেজ করে সামনে তাকাতে দেখে মা~ মেয়ে দুজনেই তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। শান্ত কন্ঠে মুমুকে প্রশ্ন করে, প্রয়া কে? মুমু ফট করে উত্তর দেয়, আমার মেয়ে উত্তর শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় আদিবের। থাপ্পড় দিতে যেয়েও প্রয়ার দিকে তাকিয়ে ফটাফট পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে যায়।

মিমন, সৃজা আর মা অবাক হয়ে বললে ভুল হবে, স্তব্ধ হয়ে যে যার জায়গাতে দাড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে সকলে বাক~ প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে। হঠাৎই মিমন কি যেন ভেবে এগিয়ে গিয়ে পাশের এপার্টমেন্টের কলিংবেল চাপলো, দুই বার বাজার পরেও কোনো সাড়া না পেয়ে কয়েকবার আদিব বলে ডাকলো। কিন্তু ফলাফল শূন্য, হতাশ হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসে পড়ে মিমন। সৃজা দ্রুত মেডিসিন বক্স নিয়ে এসে মিমনের নাক থেকে রক্ত মুছতে লাগে। তখনই আদিব ঝড়ের বেগে এসে সৃজাকে সড়িয়ে মিমনকে ওরা ধুরা মারতে থাকে আর রেগে বলতে থাকে, আগের টা আমার পক্ষ থেকে ছিল, এগুলো তোর বোনের জন্য। তুইতো বলেছিলি তোর বোনের গায়ে যেন হাত না উঠায়। সৃজা থামাতে এলেই আদিব রেগে চিৎকার করে বলে উঠে, Sriza stay away টানা বিশ মিনিট মিমনকে ইচ্ছা মতো পিটিয়ে সেখানেই সোফাতে গা এলিয়ে বসে আছে আদিব। মরিয়ম বেগম আদিবের উদভ্রান্তের মতো আচরণ দেখে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেছেন। আদিব মারার সময় টু শব্দ না করলেও, সৃজা ঔষধ লাগাতেই উহ আহ করছে মিমন।

মিমন মাথা নিচু করে বসে আছে আদিবের সামনের সোফাতে। তুই বলবি নাকি তোর বোনের গলা টিপে কথা বের করবো? ভীষণ রেগে কথাটা বলল আদিব। মিমন শান্ত চাহনিতে তাকায় আদিবের দিকে। তারপর মুমুর নিখোঁজ হওয়া থেকে শুরু করে কলকাতা যাওয়ার ঘটনা বলে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে মিমন। আদিব গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভেবে ফট করে বলে উঠলো, প্রয়া কী তোর মেয়ে? মিমন ফত করে একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, না

কলকাতার মতো শহরে মুমুকে একলা যেতে দেওয়ার সাহস হয়নি আমার। কাকুর পরিচিত বন্ধুর বাসায় একমাস থাকার পর মুমকে কলেজে ভর্তি করে হোস্টেলে তুলে দিই। আর আমিও একটা বয়েস হোস্টেলে থাকতে শুরু করি। কলেজেই প্রনয়া নামের একটা হিন্দু মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয় মুমুর। তিন মাসেই মুমুকে কলিজার বান্ধবী বানিয়ে নিয়েছিল মেয়েটা। মুমুর সবকিছু জানার পরে মেয়েটা আমার সামনেই মুমকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেছিল। যদিও স্যাড মোমেন্ট ছিল কিন্তু ওর বাচ্চাদের মতো কান্না দেখে আমি আর মুমু অট্টহাসি দিয়েছিলাম। চারমাসে সেদিনই হয়তো প্রথম হেসেছিল মুমু।

তারপর থেকে মুমুকে নিজের আপন বোনের মতো ভালোবাসতো। মুমুকে সব ছুটি, অনুষ্ঠানে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেত। বাবার অসুস্থতার কারনে আমি পাঁচ মাস পরই ব্যাক করি। ততদিনে প্রণয়া মুমুকে স্বাভাবিক জীবনে নিয়ে এসেছে। দুজনেই একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। ভার্সিটিতে প্রণয়ার তার সিনিয়র রায়ান খান নামের একটা মুসলিম ছেলের সাথে রিলেশন হয়। প্রণয়ার ফাইনাল ইয়ারে রায়ান জব পেয়ে দুই পরিবারের অমতেই বিয়ে করে নেয়।

খুব ভালো কাটছিল ওদের সংসার। বিয়ের পর প্রণয়া মুমুকে জোর করে নিজের বাসায় নিয়ে যায়। বিয়ের তিন মাস পরেই প্রনয়া প্রেগন্যান্ট হয়, তার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়। দুজনে মিলে আগেই প্রয়া নাম ঠিক করে রেখেছিল। মুমু, প্রয়া, রায়ান আর প্রণয়ার জীবন চলছিল আপন গতিতে। প্রয়ার ছয়মাস বয়সে হঠাৎই এক ভয়ানক দুর্ঘটনায় রায়ান মারা যায় আর প্রণয়া হসপিটালে একদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর মারা যায়। হসপিটালে থাকাকালীন প্রয়াকে মুমুর হাতে তুলে দিয়েছিল প্রণয়া। মারা যাওয়ার পরেও ওদের পরিবারের কেউ কোনরকম খবর নেয়নি।

ছোট্ট দুধের বাচ্চাকে নিয়ে মুমু দিশেহারা হয়ে উঠেছিল। আমাদেরও যাওয়া সম্ভব হয়নি, তখন কাকুর সেই বন্ধুই আবার সাহায্য করেছিলেন। মুমু প্রয়াকে নিয়ে তার বাসায় থেকে অনেক কষ্টে মাস্টার্স শেষ করেই দেশে ফিরে আসে।
সবকিছু বলেই মিমন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিবের দিকে তাকায়। আদিব একধ্যানে তার সামনে থাকা টি~ টেবিলের দিকে চেয়ে আছে। হঠাৎই কোনো কথা ছাড়া আদিব উঠে হাটা শুরু করে, দরজার কাছে যেয়ে পিছনে ঘুরে গমগমে গলায় বলল, তোর মাথামোটা, অসভ্য বোনকে একদম শেষ করে ফেলবো আমি, ওর ওস্তাদগিরি ছুটাচ্চি। বলেই দরজা বন্ধ করে বের হয়ে যায় আদিব।

পর্ব ১৬

সারারাত না ঘুমোনোর ফলে মাথাটা কেমন ভারী ভারী লাগছে আদিবের। তাই এসেই ফটাফট সাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে চলে যায়। বের হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সাড়ে আটটা বাজে প্রায়। মৃদু পায়ে মুমুর রুমের দিকে এগিয়ে যায় আদিব। দরজা হালকা খুলতেই দেখতে পায়, মা~ মেয়ে দুজনেই এখনো ঘুমিয়ে আছে। আদিব দরজাটা চাপিয়ে ভিতরে এসে দাঁড়ায়।
প্রয়া মুখে আঙুল পুড়ে একহাতে মুমুর শাড়ী ধরে মুমুর বুকের সাথে মাথা ঠেসে ঘুমিয়ে আছে। এক পলক মুমুর দিকে তাকাতে মাথাটা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। সেই একইভাবে লম্বা চুল গুলো এলোমেলো করে বালিশের এক পাশে ছড়িয়ে আছে, সামনের জুলফি গুলো মুখে গলায় লেপ্টে আছে, ভরাট ঠোঁটের নিচে তিলটা মনে হচ্ছে আগের থেকে কালো দেখাচ্ছে, আগের থেকেও বেশি মোহনীয় লাগছে মুমুকে।

আদিব খেয়াল করলো মুমু আগের চেয়ে অনেক ফর্সা হয়ে গেছে। প্রয়া শাড়ী ধরে রাখায় মুমুর ফর্সা পেটটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। উফফ অসভ্য মেয়েটা এতো ভয়ংকর ভাবে ঘুমচ্ছে কেন? মুমুর কপালে একটা ডিপ কিস করে। হঠাৎই প্রয়ার দিকে চোখ পড়তেই দেখে প্রয়া তার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আদিব তার দিকে চেয়ে হাসি দিতেই সেও তার ফোলা ফোলা চোখে গালে টোল ফেলে হাসি দেয়। তারপর সাবধানে প্রয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে।

প্রয়াকে ফ্রেশ করে নিয়ে ছাদে চলে আসে আদিব। ছাদে এসে ভীষণ খুশি হয়ে যায় প্রয়া, আদিবের সাথে জমিয়ে ছুটাছুটি করে হাঁপিয়ে গিয়ে আদিবের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। আদিব তাকে একটা গোলাপ তুলে দিতেই ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে আদিবের গালে চুমু দেয়। আদিবও তার পাওনা টা পরিশোধ করে দেয়। এসময় টুকু তেই প্রয়াকে পাপা বলার ট্রেনিং দিয়ে ফেলেছে আদিব। প্রয়া যখন তাকে তার পাখির মতো ছোট্ট ঠোঁটে পাপা ডাকতে শুরু করে, তার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি নামে তাকে ডাকছে ছোট্ট পরীটা।

সাড়ে নয়টায় এসেছে টুনি কিন্তু কারো আতা পাতা পাচ্ছে না। মরিয়ম বেগম নিজের রুমে বসে চা খাচ্ছেন। কিন্তু প্রয়াকে একবারো দেখা যায়নি। অন্যদিন আসলেই পিছন পিছন ঘুরঘুর করে ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এসব ভাবতে ভাবতে সবজি কাটছিলো টুনি, কলিংবেলের শব্দে ভাবনাতে পানি ঢেলে উঠে যায়।
দরজা খুলে আদিবের কোলে প্রয়াকে দেখে চোখ বড়ো হয়ে যায় টুনির। পয়া আম্মা কি আইজকাও বাইর হইয়া গেচিলো, কিন্তু আমিতো দোরোজা আটকাইয়াই ঢুকচি। অপরাধী কন্ঠে বলল টুনি। আদিব শান্ত কন্ঠে বলল, না, ও আমার কাছেই ছিল। টুনি প্রয়াকে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই প্রয়া আদিবের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে যার অর্থ সে পাপার কাছেই থাকবে। ততক্ষণে মরিয়ম বেগম কলিংবেলের শব্দ শুনে ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়িয়েছেন।

ঘুম ভেঙে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাতেই লাফিয়ে উঠে বসে মুমু। দশটা বেজে গেছে অথচ কেউ তাকে ডাকেনি কেন? রাতের কথা মনে হতেই পাশে তাকিয়ে দেখে প্রয়া নেই। তাড়াহুড়া করে দরজা খুলতে গেলেই বুঝতে পারে দরজা বন্ধ রয়েছে। হতাশ হয়ে আবার বিছানায় এসে বসে। ভাবতে থাকে তার জীবনের সবচেয়ে বিশ্রী দিনটার কথা।

কলকাতা যাবার পরেও বিভিন্ন ব্ল্যাঙ্ক নম্বর থেকে মেসেজ পেতো মুমু। প্রণয়ার বিয়ের কিছুদিন পর তারা মুমুকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিল ডিনার করতে। কিন্তু সেদিনের মেসেজ টা পড়ে মুমুর পৃথিবী থমকে গিয়েছিল। খাবার টেবিলে বসার পরে অপরিচিত নাম্বার থেকে অনেক বার কল আসলেও রিসিভ করে না মুমু। কিছুক্ষণ পরে একটা মেসেজ আসে, সেটা ওপেন করে জান আদিব তো অনেক আগেই উপরে চলে গেছে তুমি এবার আমার কাছে ফিরে আসো জান। মেসেজ টা পড়েই মুমু সেন্সলেস হয়ে যায়। তারপর জ্ঞান ফিরেতে প্রণয়াকে সব বলতেই রায়ান ভাই অনেক চেষ্টা করেও আদিবের কোনো খবর নিতে পারেননি। মুমুর পাগলামি দেখে প্রণয়া তাকে নিজের কাছে নিয়ে রেখেছিল।

অতীতের কথা মনে করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে মুমু। তখনই দরজা খুলে খাবার ট্রে হাতে ভিতরে আসে আদিব। খাবার ট্রে বিছানায় রেখে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই মুমু তাকে জাপটে ধরে। হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় পড়ে যেতে নিয়েও কোনরকম সামলে নেয়। মুমু তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে যেয়ে হঠাৎই ডিভোর্স পেপারের কথা মনে পরতেই মুমুকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় আদিব। তাল সামলাতে না পেরে মুমু নিচে পড়ে যায়। আদিব মুমুর সামনে হাটু গেড়ে বসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবি না, ডিভোর্স দিয়ে এখন নেকামি করছিস? বলেই রুম থেকে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই ঝড়ের বেগে এসে রেগে বলে উঠে, খাবার গুলো না খেলে প্রয়াকেও কোনো খাবার খেতে দিবো না। বলেই শব্দ করে দরজা বন্ধ করে চলে আসে আদিব।

সকালে মিমনের ফোন পেয়েই ছুটে এসেছে রূপক। আজ সে মুমুকে রাজি করিয়েই ছাড়বে, আর পারবে না সে অপেক্ষা করতে। ড্রয়িংরুমে বসে অস্থির ভাবে পা ঝাঁকাচ্ছ আর কথাগুলো ভাবছে রূপক। মিমন আসতেই মিমনের সাথে হাত মিলিয়ে জড়িয়ে ধরে। রূপকের এই হাগ করার ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে মিমনের। পরিচয় হওয়ার পরে যতবারই দেখা হয়েছে রূপকের অমায়িক ব্যবহার বরাবরই মুগ্ধ করে। চার বছর আগে আদিবের কোনো খবর না পেয়ে মুমু যখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল রূপক তখনই প্রথম মুমুকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল। মুমুর সকল বিপদে সবসময় সাহায্য করেছে এই ছেলেটা।

মিমন ভাই আমি মুমুর সাথে একটু কথা বলতে চাই, ওকে আমি নিজে বোঝাবো বিয়ের ব্যাপারে প্লিজ ওকে একটু ডেকে দিন ভাই। মিমনের হাত ধরে অস্থির হয়ে কথাটা বলল রূপক। মিমন কিছু বলবে তার আগেই কলিংবেলের শব্দে উঠে দাড়ায়, দরজা খুলে দেখে আদিব দাঁড়িয়ে আছে। মিমনের পিছনে আদিবকে দেখে রূপক হতবাক হয়ে উঠে দাড়ায়। মিমন রূপকের পরিচয় দিতেই আদিব নিজের হাত বাড়িয়ে দিল রূপকের দিকে।
চলবে

পর্ব ১৭

আদিব হাত বাড়ালেও রূপককে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে গলা পরিষ্কার করার ভঙ্গি করে বলল, আদিব মাহমুদ
রূপক বুঝতে পেরে চোখ নামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে হাত মিলিয়ে বলল, রেদোয়ান হাসান রূপক

তারপর তিনজন বসে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পরে সৃজা তাদের কে নাস্তা দিয়ে যায়। কথার মাঝে রূপকের বার বার মুমুকে দেখার ইচ্ছা করলেও প্রকাশ করেনি। এমনিতেই রূপকের বেশ অস্বস্তি হচ্ছে সাথে রাগও হচ্ছে আদিবকে দেখে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, আমাকে উঠতে হবে, আসলে একটু কাজ আছে।

বলেই উঠে দাড়ায় রূপক, মিমন আর আদিবও দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে। ঠিক তখনই প্রয়া এসে আদিবকে পাপা বলে ডেকে উঠে। আদিব মিষ্টি হেসে প্রয়াকে কোলে তুলে বলল, কী হয়েছে আমার পরীটার? প্রয়া আদিবের দিকে চেয়ে বলল, তুমি তি সমিদদো ভাইয়ালও পাপা? আদিব কিছু বুঝতে না পেরে মিমনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।
মিমন হেসে প্রয়াকে কোলে নিয়ে বলল, না না মা এটা তো শুধু তোমার পাপা, আর সমৃদ্ধ ভাইয়ার পাপা তো আমি সোনা। বলেই প্রয়ার কপালে চুমু খায়। আদিব মিমনের উত্তর শুনে নিরবে হেসে উঠে।

ফ্লোরে দুই হাতে হাটু মুড়ে মুখ নিচু করে বসে নিরবে কাঁদছে মুমু। সাইড টেবিলের কোণায় লেগে হাতে বেশ ব্যাথা পেয়েছে। কিন্তু সে ব্যাথাতে কষ্ট হচ্ছে না মুমুর, কষ্ট হচ্ছে আদিবের আচরণের কথা ভেবে, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মুমু কিছুতেই বুঝতে পারছে না আদিব কেন বার বার ডিভোর্সের কথা বলছে। তার আদিব ভাইয়া তাকে এতো কেন কষ্ট দিচ্ছে?

সৃজা তোকে কি ভাবি বলে ডাকতে হবে? হেসে বলল আদিব। সৃজা মুমুর কাপড় গুলো আদিবের হাতে দিয়ে সিরিয়াস মুখ করে বলল, অবশ্যই বলতে হবে, তোর বউয়ের বড় ভাবি তোর তো আমাকে সালাম করা উচিত। আদিব সৃজার মাথায় টোকা দিয়ে বলল, আগে তোর ননদকে সাইজ করি, তারপর তোকে দেখবো। বলেই সৃজার চুলে টান দিয়ে বেরিয়ে যায় আদিব। সৃজা চিৎকার করে বলল, হারামি আমিও দেখে নেব তোকে। অন্যদিকে সমৃদ্ধ তার মা ও ফুপাজি নামক লোকটার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, কি হচ্ছে?

আদিবের মাথা রাগে দপদপ করছে, চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। কিন্তু ফলাফল শূন্য, খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে। ঝনঝন শব্দে সামনে তাকাতেই আদিবের ভয়ানক রাগী চেহারা দেখে কেঁপে উঠে মুমু। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বেড সাইড টেবিলের সাথে আরো ঠেসে বসে কাঁপতে শুরু করে মুমু। আদিব মুমুর দুই বাহু শক্ত করে ধরে দাঁড় করিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, খাসনি কেন? মুমু ভয়ে কিছু বলতে পারলো না। আদিব উত্তর না পেয়ে মুমুকে ঝাকিয়ে চিৎকার করে বলল, খাসনি কেন? মুমু ভয়ে ফুপিয়ে কেঁদে দেয়। তুমি আআমার সাথথে এএএমন…. আর কিছু বলার আগেই মুমু আদিবের বুকে ঢলে পড়ে।

মুমুকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠে আদিব। দ্রুত মুমুকে চেক করে, ডান হাতের কাটা দেখে আবার চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আদিবের। এই মেয়ে এতো কেন জ্বালায় তাকে? কেন? রাগে দুঃখে চোখ টলটল করছে আদিবের। হাতে ব্যান্ডেজ করে চোখে মুখে পানি দেয়। মুমু পিটপিট করে চোখ খুলে আদিবের দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে। তারপর হরহর করে বলতে শুরু করে, বিবিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে কিকিছুই করিনি, আমি তোমাকে ডিডিভোর্সও দিইনি সসত্যি বলছি। বলেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে মুমু।

আদিব কিছুক্ষণ মুমুর দিকে তাকিয়ে থেকে দুই হাতের তর্জনী দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর মুমুর কপালে অনেক সময় নিয়ে ভালোবাসার পরশ দেয়। মুমু আবেশে চোখ বন্ধ করতে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। আদিব মুমুকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে হাতে জামা কাপড় দিয়ে বলল, জাস্ট ফাইভ মিনিটস

মুমু নিজের কাপড় গুলো দেখে মনে মনে বিভিন্ন বিষয় ভেবেও কিছু বুঝতে পারলোনা। একগাদা প্রশ্ন নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই আদিব কিছু না বলে হাত ধরে রুম থেকে ডাইনিং এ নিয়ে আসে। এতক্ষণে মুমুর মনে হলো বাসাটা একদম তার বাসার মতো। এসব ভেবে সামনে তাকাতেই দেখে আদিব তার মুখের সামনে একনলা খাবার ধরে রেখেছে, দেখেই তার চোখ চিকচিক করে উঠে। এতো কেন ভালোবাসে রাগীটা? আদিব ইশারা করতেই মুমু খাবারটুকু মুখে পুড়ে নেয়।

সারা রুমের জিনিসপত্র চুরমার করে এক পা ভাজ করে ফ্লোরে বসে বিছানায় মাথা রেখে সিলিং এর দিকে একধ্যানে তাকিয়ে আছে রূপক। চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে মাথার চুলের ভিতর হারিয়ে যাচ্ছে। হাতের ব্যান্ডেজটা লাল হয়ে আছে, পা থেকেও রক্ত ঝরছে। বুকটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। আবারও মুমুকে হারিয়ে ফেলল সে, তার হৃদ স্পন্দ হারিয়ে ফেলেছে। কি করবে সে? কিসের জন্য বেচে থাকবে সে?

মিসেস ইত্তেফাক হাসান অনেকক্ষণ হলো ছেলের রুমের সামনে দাড়িয়ে ডাকছেন। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো শব্দ না পেয়ে ঘাবড়ে গেছেন। কিছুক্ষণ আগে রুমের ভেতর থেকে প্রচন্ড ভাঙচুরের শব্দ পেয়ে দৌড়ে আসেন। ছেলেটার রাগ উঠলে সকল রাগের অবসান ঘটে জিনিসপত্রের উপর দিয়ে। কিন্তু আজ একটুও কথা বলছে না কেন? কি করবে ভেবে দৌড়ে ঘর থেকে চাবির ছড়িটা নিয়ে ছেলের ঘরের দরজা খুলেন। ভাঙচুর ডিঙিয়ে ছেলের কাছেই বিছানায় বসে আস্তে ডাকলো, রূপক… রূপক মায়ের কন্ঠ শুনে অসহায় দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে হুট করে মায়ের কোমড় পেচিয়ে ধরে কোলে মুখ গুজে কাঁদতে শুরু করে।

মিসেস ইত্তেফাক হাসান কি করবেন বুঝতে পারছেন না, ছেলেটা এভাবে কাঁদছে কেন? কিসের জন্য কষ্ট পাচ্ছে? তিনি কি ছেলেটার খেয়াল রাখতে পারেননি? এসব ভেবে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
ডিভোর্স পেপারে তোর সাইন আসলো কোথা থেকে? অনেকটা রেগেই বলল আদিব। মুমু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বিশ্বাস করো আমি সত্যি কিছু জানিনা।

বলেই মাথা নিচু করে রাখে। আদিব বিরক্ত হয়ে বলে উঠে, কতবার বলেছি মাথা নিচু করে থাকবি না, তাকা আমার দিকে। মুমু মাথা উঁচু করলেও টলটলে চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর কথায় কথায় কাঁদিস কেন? তুই কি এখনো ছোট আছিস? এক বাচ্চার মা হয়েও তোর ফ্যাচফ্যাচানি বন্ধ হলো না! আদিবের কথায় মুমুর টলটলে চোখ এবার বন্যায় ফ্যালফ্যালে হয়ে গেল।

কলিংবেলের শব্দে আর কিছু না বলেই উঠে দাড়ায় আদিব, দরজা খুলে দেখে মিমনের কোলে প্রয়া ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে। প্রয়ার কান্না শুনে মুমু ছুটে আদিবের পিছনে এসে দাঁড়ায়। মুমুকে দেখে প্রয়া ঠোঁট ফুলিয়ে মাম মাম বলে হাত বাড়িয়ে দিল। মুমু ঝটপট প্রয়াকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বলল, কি হয়েছে আমার মাম মাম সোনাটা কাঁদছে কেন? মিমন হতাশ হয়ে বলল, সমৃদ্ধ আবার ঝুটি খুলে দিয়েছে।

পর্ব ১৮

প্রয়ার কান্না থামলেও সমৃদ্ধর কান্নার শব্দে মুমু মিমনকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া সমৃদ্ধ কাঁদছে কেন?
~ প্রয়া হাতে কামড়ে দিয়েছে।
মুমু দ্রুত নিজের এপার্টমেন্টে এসে সমৃদ্ধর কাছে বসে, পিচ পিচ মিমন আর আদিবও আসে। সৃজা সমৃদ্ধর হাতে বরফ দিচ্ছে। মুমুকে দেখতেই সমৃদ্ধ কেঁদে বলল, ফুপি প্রয়া গল্পের মতো রাক্ষস হয়ে গেছে, দেখো আমাকে কামড়ে দিছে। বলে হাত উঁচু করে দেখাই মুমুকে। বেশ জোরই কামড়ে দিয়েছে, অনেকটা দাগ হয়ে গেছে। মুমু দুঃখী মুখ করে বলল, ইশশ, আমার বাবাটার অনেক লেগেছে দাড়াও ফুপি প্রয়াকে এখনই বকে দিচ্ছি।
মুমু প্রয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, মাম মাম ভাইয়াকে কামড় দিয়েছ কেন? ভাইয়া কাদছে তো সরি বলো যাও। প্রয়াকে সমৃদ্ধর পাশে বসিয়ে দেয়। প্রয়া ভীষণ অপরাধী চেহারা করে বলল, থলি ভাইয়া আল কলবো না।

বাচ্চাদের শান্তিচুক্তির পরে তারা মরিয়ম বেগমের রুমে চলে যায়। আর আদিব উঠে মুমুর হাত ধরে সোজা নিজের এপার্টমেন্টের দিকে হাঁটা দেয়। মুমুকে বাচ্চাদের মতো হাত ধরে নিয়ে যাওয়া দেখে মিমন আর সৃজা নিরবে হাসতে শুরু করে। আদিব ওদের হাসি দেখে বলল, ক্যালাচ্চিস কেন? আমার বউ আমার কাছে থাকবে এতে হাসির কি হলো, যত্তসব। বলেই মুমুকে নিয়ে চলে আসে। অন্যদিকে মুমুতো লজ্জায় শেষ, ভাইয়ার সামনে থেকে এভাবে নিয়ে এসেছে। লজ্জায় তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
মুমুকে বিছানায় বসিয়ে চট করে মুমুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো আদিব। ঘুমবো, যতক্ষন আমার ঘুম না হয় একচুলও নড়বি না এখান থেকে।

বুঝলি? স্বামী সেবা কর। মুমু অবাক হয়ে বলল, হা? আদিব কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, হা না হ্যা, নিজ ইচ্ছায় আট বছরের বনবাস নিয়েছিলি এখন থেকে টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স আমার সেবা করবি। এটা তোর শাস্তি। বলেই মুমুর কোমড় পেচিয়ে পেটে মুখ গুজে হালকা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে আদিব।

আদিবের এমন ছোঁয়ায় শিহরণে কুঁকড়ে যায় মুমু। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আ আদিব ভাভাইয়া, আআমার সুসুড়সুড়ি…. বাকি কথা বলার আগেই আদিব ফট করে উঠে বসে রাগী চোখে তাকায় মুমুর দিকে। মুমু ফাকা ঢোক গিলে মনে মনে নিজেকে হাজার রকম গালি দিল আদিবকে ভাইয়া ডাকার জন্য। আদিব কটকটে গলায় বলল, কত শখ ছিল বউ নাম ধরে ডাকবে, ওগো শুনছো বলবে। তা না বউ আমার নামের সাথে আন্তর্জাতিক বিশেষণ যোগ করে ডাকে। বলেই ধুপ করে আবার শুয়ে পড়ে মুমুর কোলে। হঠাৎই মুমুর পেট থেকে শাড়ী সরিয়ে পট করে একটা কামড় দেয় আদিব। মুমু আহ করতেই বলল, আন্তর্জাতিক বিশেষণ যোগের শাস্তি। ‘ বলেই সোজা হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ে আদিব।

রাতে না ঘুমোনোর কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায় আদিব। আর মুমু পলকহীন ভাবে তার বরকে দেখতে থাকে। নেভি ব্লু কালারের টিশার্টে ভীষণ ফর্সা দেখাচ্ছে আদিবকে, গালভর্তি খোচাখোচা দাড়ি, লাল লাল ঠোঁট, কপালে এলোমেলো চুল। উফফ তার বরটা কি আগের থেকেও বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছে। মুখের খোচাখোচা দাড়ি গুলোতে হাত বুলিয়ে দেয় মুমু। ঠোঁটে চোখ পড়তেই তার ভয়ানক একটা ইচ্ছে জাগে। কিন্তু ইচ্ছেটা ধামাচাপা দিয়ে চুপিচুপি কপালে একটা চুমু খায় মুমু।
অনেকদিন পর সবাই একসাথে হওয়ায় সারা সন্ধ্যায় সবাই মিলে বেশ আড্ডা দিল। রাতে মুমু আর সৃজা মিলে আদিবের পছন্দের রান্না করে। ডিনার শেষে মিমন আর আদিব কিছু নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলছিল আর প্রয়া আদিবের গলা জড়িয়ে ধরে কোলের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। সৃজা সমৃদ্ধকে ঘুম পাড়াতে গেছে তাই মুমু একাই টেবিল পরিষ্কার করে ড্রয়িংরুমের দিকে যায়।

পাপা থাদে যাবো আদিবের গলা জড়িয়ে ধরে ভীষণ আদুরে ঢঙে বলছে প্রয়া। মুমুতো অবাক হয়ে গেছে, তার মেয়ে একদিনেই আদিবকে পাপা বলে ডাকছে। এমন ভাবে ডাকছে মনে হচ্ছে জন্ম থেকেই সে জানতো এটা তার পাপা। এখন তো রাত হয়ে গেছে পরী আমরা কাল যাবো, ওকে? বলে প্রয়ার নাকে একটা চুমু দেয় আদিব। হঠাৎ ফোন বাজতেই আদিব প্রয়াকে মুমুর কাছে দিয়ে বাইরে চলে যায়।
আদিব ফোন রিসিভ করেই গমগমে গলায় বলল, হ্যা তরুণ কিছু জানতে পারলি?
~ তেমন কিছুই জানতে পারিনি, অনেক আগের ঘটনা এতো সহজে কিছু পাওয়া যাবে না।

~ ভালো করে খবর নে অবশ্যই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।
~ আমি চেষ্টা করছি তবে তেমন কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তুই চিন্তা করিস না আমি দেখি কি করা যায়।
আরো অনেক সময় ধরে কথা বলে ফোন রেখে দেয়। কিছু একটা মনে পড়তেই নিজের রুমে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আদিব।
কাজ করতে করতে অনেকটা সময় পরে আদিব ঘড়ির দিকে তাকায়, বেশ রাত হয়ে গেছে। ল্যাপটপ টা বন্ধ করে প্রয়া আর মুমুর রুমের দিকে যায়।
~ বাহ মা মেয়ে দুজনেই ঘুম, আমার খবর নেওয়ারও দরকার হয়নি। ভেবেই ফত করে একটা নিশ্বাস নেয় আদিব। তারপর বাতি নিভিয়ে মুমুকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পড়ে।

সকালে আদিবের ঘুম ভাঙলো প্রয়ার টুপটুপ করে চুমু খাওয়ার তোড়ে। মুমু তার ডান বাহুতে আরামসে ঘুমচ্ছে আর প্রয়া মাঝখান থেকে আদিবের গলা জড়িয়ে ধরে টুপটাপ করে নাকে চুমু খাচ্ছে। আদিব তাকাতেই নিয়মমাফিক ভুবন ভোলানো হাসি দিল যার অর্থ সে ছাদে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।

মুমু ঘুম ভেঙে দেখে কেউ নেই, সব রুম খুঁজে কাউকে না পেয়ে ফ্রেশ হয়ে মেইন ডোরের সামনে দাড়িয়ে ভাবতে থাকে নিজের এপার্টমেন্টে যাবে কিনা। আদিব কি রাগ করবে ভেবে প্রায় দশ মিনিট পরে নিজের এপার্টমেন্টের দরজা নক করে। দরজা খুলে টুনি মুচকি মুচকি হেসে চলে যায়। মুমু হাসির কি হলো বুঝতে না পরে বোকা বোকা মনে সামনে আগাতেই দেখে আদিব, প্রয়া আর সমৃদ্ধ গভীর মনোযোগ দিয়ে হানি বানি কার্টুন দেখছে। আদিব একবার তার দিকে তাকিয়ে এমন একটা ভাব করলো মনে হচ্ছে সে মুমুকে চিনেই না। মুমু ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মায়ের কাছে যায়।
নাস্তা শেষে মুমু অনেকক্ষণ ধরে আদিবের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু আদিব তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। এবার তার কান্না পাচ্ছে, ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে কি করেছে যে তার সাথে কথায় বলছে না।

রূপক সকাল আটটা থেকে মুমুর ভার্সিটির সামনে এসে গাড়িতে বসে আছে। বিগত দেড় বছর যাবত সে প্রতিদিনই এখানে আসে শুধুমাত্র মুমুকে একপলক দেখার জন্য। শুধুমাত্র মুমুর জন্য অনেক চেষ্টা করে এখানে ট্রান্সফার নিয়েছে রূপক। দুইদিন যাবত মুমুকে দেখতে না পেয়ে নিজেকে ভীষণ এলোমেলো লাগছে। দু’ঘন্টা যাবত বসে থেকেও মুমুর দেখা না পেয়ে রূপকের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করতেই একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।

অনেকক্ষণ ধরে মুমুকে দেখতে না পেয়ে আদিব সৃজাকে বলল, তোর মাথামোটা ননদটা কই? সৃজা মিমনের মাথায় তেল ম্যাসেজ করতে করতে বিরক্তি ভাব নিয়ে বলল, তোর বউ কোথায় আমি কি করে জানবো! আদিব উঠে মুমুর রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, তা জানবি কি করে সারাদিন তো বরের সাথে চিপকিয়ে থাকিস, বেশরম! তা ননদটা কে তো কিছু শেখাতে পারিস। সৃজা রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিব মুমুর রুমে চলে যায়।

পর্ব ১৯

আদিবের অবহেলায় মুমু ভীষণ মনখারাপ নিয়ে রুমে বসে ঝুড়ি ঝুড়ি কষ্ট পাচ্ছে। সে ঠিক করেছে সে আর যাবেই না আদিবের সাথে কথা বলতে, একদম যাবে না। দেখুক সে কার্টুন, দেখে দেখে সে বিখ্যাত কার্টুন দার্শনিক হয়ে যাক। মুমুর সাথে কথা বলার দরকার নেই। টলটলে চোখে এসব ভাবছে আর ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখার কঠিন চেষ্টা করছে মুমু।

দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকাতেই দেখে আদিব এসেছে। আসুক, সে কথা বলবে না, একদমই বলবে না। তাই চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। আদিব বেশ বুঝতে পেরেছে মুমুর সাথে কথা না বলাতে সে ভীষণ অভিমান করেছে। তাইতো আর আশেপাশে যায়নি। বউটা এখনো আগের মতোই রাগ করে ভেবেই শয়তানি হাসি দিয়ে মুমুর কাছে যায়।

বিছানায় ধপাস করে শুয়ে বলল, হাত~ পা খুব ম্যাজ ম্যাজ করছে, একটু টিপে দে তো মুমু। বলেই মুমুর দিকে পা এগিয়ে দেয় আদিব। মুমুর এবার সত্যি সত্যিই কান্না পাচ্ছে, ভীষণ কান্না। একেতো সারা সকাল একটাও কথা বলেনি তার উপর মুমু যে রাগ করেছে তার কোনো খবরই নেই। এখন আবার পা টিপতে বলছে। মুমুর কোনো সাড়া না পেয়ে আদিব ঘাড় উঁচিয়ে দেখে মুমু কাঁদছে। ফোঁত করে একটা নিশ্বাস ফেলে, মুমুকে ঝট করে বিছানায় ফেলে ওর উপর আধশোয়া হয়ে ঝুকে বলল, একটু কথা বলিনি তাই কেঁদে সুনামি বানিয়ে ফেলছিস আর রাতে যে আমাকে ফেলে ভুস ভুস করে ঘুমিয়ে গেলি তার বেলায় কি? হুম?

মুমু প্রচন্ড অপরাধী ভাব নিয়ে বলল, প্রয়াকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম আমি ইচ্ছে করে ঘুমোইনি। মুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ হাসি পাচ্ছে আদিবের, কেমন বাচ্চাদের মতো মুখ করে কথা বলছে। আদিব মুমুর নাকে ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে বলল, তোর এতো শাস্তি পাওনা রয়েছে তার উপর আবার নতুন শাস্তি, কীভাবে শোধ করবি রে মুমু? মুমু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রয়ার ডাকে দুজনেই ফট করে উঠে বসে। মুমু দ্রুত দরজা খুলে দিতেই প্রয়া হেসে মুমুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

আদিব অনেকক্ষণ যাবত হতাশ ভাবে বসে গালে হাত দিয়ে উদাস হয়ে চিপস খাচ্ছে। সৃজা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বিরক্তি নিয়ে বলল, আদি, এরকম গরুর মতো জাবর কেটে চিপস খাচ্ছিস কেন? তোর কি খুধা পেয়েছে? খাবার কিছু এনে দিব? আদিব দেবদাসের থেকেও হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে সৃজার দিকে তাকালো তারপর ফট করে উঠে এসে সৃজার একহাত ধরে বলল, সৃজা আমার ভীষণ প্রেম পেয়েছে, তোর অসভ্য ননদটাকে এনে দিবি? আদিবের কথা শেষ হতেই সৃজা হুহা করে হেসে দেয়।

আদিব রেগে বলল, হাসবি না, তোর মাথামোটা, বেআক্কল, গবেট ননদকে আমি আস্ত রাখবো না। অসভ্য মেয়ে এতদিন পরে বর এসেছে কোথায় বরের সঙ্গে লটকিয়ে থাকবে তা না সে ঘুমচ্ছে। বলেই আবার ধুপ করে সোফায় বসে পড়ে। সৃজা কিছুক্ষণ হেসে গড়াগড়ি খেল তারপর উঠে সিরিয়াস মুখ করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কলিংবেলের আওয়াজে উঠে দরজা খুলে।
সৃজা আপু বলেই জড়িয়ে ধরে রুপা। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রূপক। সৃজাও হালকা জড়িয়ে ধরে বলল, আরে রুপা, কেমন আছো?

রুপা, সৃজা আর রূপককে আসতে দেখে হাসি মুখে উঠে দাড়ায় আদিব। সকলে মিলে অনেকক্ষণ কথা বলার পরেও মুমুর দেখা না পেয়ে রূপকের মন অস্থির হয়ে উঠে।
কিছুক্ষণ পরে মুমু প্রয়া আর সমৃদ্ধকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসে। প্রয়া যেয়ে আদিবের কোলে উঠে বসে আর মুমু রুপা ও রূপকের সাথে কথা বলে সমৃদ্ধকে পাশে নিয়ে আদিবের কাছে বসে। অন্যদিকে রূপক বার বার আড় চোখে মুমুর দিকে তাকায়, মুমু আর আদিবকে পাশাপাশি দেখে ভীষণ রাগ লাগছে তার। বুকটা ভীষণ জ্বলছে, মুমু কেন তাকে একটু ভালোবাসে না। হঠাৎ আদিবের ফোন আসায় সে প্রয়াকে মুমুর কোলে বসিয়ে এক্সকিউজ মি বলে বেরিয়ে যায়। রুপা তার ছেলেকে রেখে এসেছে বলে সন্ধ্যার পরই রূপকের সাথে চলে যায়।

মিমন প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে আদিবের সামনে বসে আছে। আট বছর আগের ঘটনা আবার তাকে পায়~ টু~ পায় শুনাতে হচ্ছে। আদিব সিরিয়াস ভাবে মুমুর কলকাতা যাওয়ার ঘটনা সবকিছু শুনছে। মিমন সবকিছু বলে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কলকাতা যাবার পরে আর কোনো ধরনের সমস্যা তো হয়নি। শুধু মাঝে মাঝে ব্ল্যাঙ্ক নম্বর থেকে মেসেজ পেতো মুমু, তাও চার বছর যাবত মেসেজও পায়নি। আমার মনে হয় না আর কোনো ধরনের সমস্যা হবে। আদিব দুই হাত মুঠো করে মুখের সামনে ধরে শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। মিমন উঠে দাড়িয়ে আদিবের কাঁধে হাত রেখে বলল, এসব নিয়ে আর ভাবিস না তো।

প্রয়াকে ঘুম পাড়িয়ে বিছানার উপর বাবু হয়ে বসে আছে মুমু। আজ সে কোনো ভাবেই ঘুমবে না তাই এই সিস্টেমে বসে আছে। আদিব অনেকক্ষণ হলো ভাইয়ার ঘরে গেছে কিন্তু আসার নাম নেই। উফফ কোমড়টা ব্যাথা হয়ে গেছে এভাবে বসে থেকে। তাই একটা বালিশ নিয়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো। প্রায় আধাঘণ্টা পরে আদিব এসে দেখে মুমু বসে বসে ঝিমাচ্ছে। শয়তানি একটা হাসি দিয়ে ফোন থেকে কাউকে মেসেজ করল। তারপর শব্দহীন ভাবে হেটে প্রয়ার কাছে গেল। গুড নাইট আমার পরীটা, হ্যাব আ সাউন্ড স্লিপ। বলেই প্রয়ার কপালে চুমু খেল।

আদিবের কথা শুনে মুমু পট করে সোজা হয়ে বসে, দেখে আদিব প্রয়ার কপালে চুমু দিচ্ছে। মুমু কিছু বুঝে ওঠার আগেই আদিব ফট করে তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাটা শুরু করে। আরে আরে বাইরে কেন যাচ্ছ? কেউ দেখলে কী ভাববে প্লিজ নামাও। বলে মুমু নামার জন্য ছটফট শুরু করে দেয়। আদিব মুমুর দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, শাট আপ এন্ড স্টপ ব্র্যাগিং ড্রয়িংরুম পেরিয়ে মেইন ডোরের সামনে আসতেই দেখে সৃজা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে আর তাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। লজ্জায় মুমুর কান্না পাচ্ছে তাই সে শক্ত করে চোখ বন্ধ করে নেয়। এতো কেন নির্লজ্জ তার বর!

প্রয়াকে দেখে রাখিস আর সকালের আগে একদম দরজা নক করবি না বলেই এক চোখ টিপ দিল আদিব। সৃজা আগেই আদিবের এপার্টমেন্টের দরজা খুলে রেখেছিল। সে দরজায় দাঁড়িয়ে সৃজার দিকে ঘুরে দাঁত কেলিয়ে বলল, লাভ ইউ দোস্ত সৃজা উত্তরে শব্দ করে হেসে দরজা বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে আদিবের কথা শুনে লজ্জায় মুমুর কান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে মনেমনে পণ করছে আর চোখ খুলবে না, কোনদিন খুলবে না।

পর্ব ২১

মুমুকে অস্বাভাবিকভাবে বসে পড়তে দেখে আদিব প্রথমে অবাক হলেও হঠাৎই মনে হলো মুমু অসুস্থ হয়ে যায়নি তো? ভেবেই তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে মুমুর কাছে আসে। মুমুকে ধরতেই বুঝতে পারে মুমু প্রচন্ড কাপছে। আদিব অস্থির হয়ে বলল,
~ মুমু, এই মুমু? কি হয়েছে, এতো কাঁপছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
~ আ আদি…, ওই লোলোকটা…।

মুমু আদিবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অস্পষ্ট ভাবে কেঁদে কেঁদে কোনরকম কথাটা বলে। ততক্ষণে আশেপাশের অনেকে এসে দাঁড়িয়েছে। আদিব মুমুর কথা কিছু বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি মুমুকে কোলে তুলে গাড়িতে নিয়ে আসে। একটা মেয়ে হয়তো মুমুর স্টুডেন্ট সে মুমুর ফোন আর ব্যাগপত্র পৌঁছে দেয়। গাড়িতে বসে মুমু আদিবকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে সাথে প্রচন্ড কাপছে।
আদিবের মাথায় কিছু ঢুকছে না হঠাৎ কি হলো যে মুমু এভাবে কাঁদছে আর কাঁপছেই বা কেন? আদিব মুমুকে শান্ত করার জন্য নিজেও জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর মুমুর হাতের বাধন আলগা হতেই আদিব বুঝতে পারে মুমু অবচেতন হয়ে গেছে।

ডাক্তার বলেছেন হঠাৎ কোন মানসিক চাপের কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছে মুমু। কিন্তু সকাল থেকে তো মুমুকে বেশ সতেজ দেখাচ্ছিল। কি এমন হলো যে এতোটা প্যানিক হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারছে না আদিব। তরুণ ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে আদিব এখনো মুমুর কাছে বসে গম্ভীর হয়ে কোন কিছু ভাবছে। তরুণ আদিবের কাঁধে হাত দিয়ে বলল,
~ টেনশন করিস না ডক্টর তো বলল কিছুক্ষণ ঘুমলে ঠিক হয়ে যাবে।

আদিব তরুণের কথা না শুনেই হঠাৎ করে কিছু খোঁজা শুরু করে। মুমুর ফোন নিয়ে ওপেন করতেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় আদিবের। রাগে মাথা দপদপ করছে, হাতের ফোন টা ছুড়ে ফেলে দেয়। পাশে থাকা টেবিল টাতে জোরে লাথি দেয়। আদিবের রণমুর্তি দেখে তরুণ দ্রুত ওকে থামিয়ে বলল,
~ পাগল হয়ে গেছিস, কি করছিস তুই?
তরুণের কথা শুনে আদিব কিছু না বলে দ্রুত আবার মুমুর ডিসপ্লে ভাঙা ফোন টা হাতে নিয়ে তরুণের সামনে ধরে বলল,
~ তরুণ ট্রেস দিস নাম্বার, আই নিড ইচ এন্ড এভ্রি ডিটেইলস এবাউট দিস নাম্বার এন্ড দ্যা ওনার।

সন্ধ্যার দিকে মুমু জেগে ওঠে, বিছানার পাশে তাকাতেই দেখতে পাই আদিব তার পাশে বসে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু করছে। সকালের কথা মনে হতেই মুমু অস্থির হয়ে উঠে আদিবকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। হঠাৎ করে জড়িয়ে ধরায় আদিব চমকে গেলেও নিজেকে সামলে ল্যাপটপ টা পাশের টেবিল রাখে। তারপর মুমুকে কোলে বসিয়ে নিজেও জড়িয়ে ধরে মাথার পাশে একটা চুমু খেয়ে বলল,
~ কিচ্ছু হয়নি মুমুসোনা, এই দেখ আমি তোর পাশেই আছি। কিচ্ছু হয়নি, কান্না করে না পাখিটা আমার। চোখ খোল তাকা আমার দিকে।
আদিবের কথা শুনে মুমু আরো শক্ত করে করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। কোনরকম বলল,
~ তু তুমি চলে যাও আদি, তুমি আবার চলে যাও। ওওই লোকটা তোমাকে আবার….। বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

আদিব অনেকক্ষণ যাবত মুমুকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও মুমু একভাবে কেদেই চলেছে আর আদিবকে চলে যেতে বলছে। এভাবে কাঁদতে থাকলে অারো অসুস্থ হয়ে যাবে। তাই আদিব জোর করে নিজের থেকে মুমুকে ছাড়িয়ে রেগে ধমক দিয়ে বলল,
~ চুপ, একদম চুপ। আর একটু কান্নার আওয়াজ হলে খুন করে ফেলবো।
আদিবের ধমকে ভয়ে কেঁপে উঠে মুমু। কান্না থামানোর চেষ্টা করেও কোনো কাজ হলো না তাই মাথা নিচু করে হেঁচকি তুলে নিরবে কাঁদছে মুমু। আদিব মুমুর মুখ মুছে দিতে দিতে বলল,
~ প্রয়া কান্নাকাটি করবে তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নে। আর বোকার মতো কাঁদছিস কেন? আমি কি মরে গেছি?

আদিবের কথা শুনে মুমু আবার ফুপিয়ে কেঁদে দেয়। আদিব মুমুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ আমি আছি তো মুমুপাখি, কিচ্ছু হবে না সব ঠিক করে দিব।
আদিবের রাগে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছে। সামনে থাকা ছেলে টাকে আরো দু’চার টা থাপ্পড় দিতেই তরুণ এসে থামিয়ে দেয়। আদিবকে টেনে সামনের চেয়ারে বসিয়ে বলল,
~ ওর মতো ছিচকে চোর এতো বড় ব্লান্ডার করতে পারবে না, আর ওতো বললোই সিম টা ছয় মাস আগেই ও হারিয়ে ফেলেছে।

~ আদিব কাজটা যে করছে খুবই তীক্ষ্ণ ও চতুর বুদ্ধির। আর সিমটা আজই ইউজ করে আজই ফেলে দিয়েছে যার কারণে আমরা লোকেশান ট্রেস করতে পারছি না।
আদিবের কিছুই শুনতে ইচ্ছে করছে না, ওর মাথায় একটা কথায় ঘুরছে কে এমন নোংরা খেলা খেলছে মুমুর সাথে? মুমুর কথা মনে হতেই ঘড়ি দেখে ফট করে উঠে দাড়ায় আদিব। তরুণের ফোন পেয়ে, আসার সময় আদিবকে কিছুতেই বের হতে দিচ্ছিল না মুমু। মুমুকে কোনরকম বুঝিয়ে শাশুড়ীকে বলে এসেছে, লেইট হলে অস্থির হয়ে যাবে। তরুণের দিকে তাকিয়ে বলল, ওকে ছেড়ে দে, আর যাকে যাকে সন্দেহ করছিস তাদের পিছনে টুয়েন্টি ফোর আয়ার্স লোক লাগিয়ে দে। বলেই বেরিয়ে যায় আদিব।

একসপ্তাহ হলো মুমু নিয়মিত ইউনিভার্সিটি আসছে। প্রতিদিন আদিব নিজে এসে পৌঁছে দেয় আর নিয়ে যায়। আদিব অনেক বুঝিয়ে আর আশ্বাস দিয়ে তাকে বলেছে কিছুই হবে না সব ঠিক হয়ে যাবে। একরকম জোর করেই বাইরে আসে আর প্রতি মিনিটে মিনিটে আদিবকে ফোন করে। আদিব তিন মাসের ছুটিতে আসলেও সে প্রায়ই এখানের অফিসে যায়। মুমু বাসায় থাকলে কোথাও বের হতে দেয় না তাই মুমুকে জোর করে ভার্সিটিতে দিয়ে যায়। আজও মুমুকে পৌঁছে দিতে এসেছে আদিব। মুমু গাড়ি থেকে নামতেই দেখে মুমুর ফোন রেখে গেছে। তাই দ্রুত ফোনটা নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে মুমুকে ফোন টা দিয়ে বলল,
~ এই যে আপনার হাসবেন্ড কে নিয়ে যান।

আদিবের কথা শুনে মুমু ফিক করে হেসে দেয়। বার বার ফোন দেওয়ার কারণে মুমুকে বিভিন্ন কথা বলে মজা করে আদিব। এটা তার মধ্যে অন্যতম।
অন্যদিকে রূপকও নিয়মিত মুমুর ভার্সিটির সামনে এসে বসে থাকে। আদিবকে দেখলেই রাগ ওঠে না তার। কারণ মুমুর ভীতু ভীতু মুখটা দেখলে তার সব রাগ উধাও হয়ে যায়। মেসেজ দেওয়ার পর থেকেই মুমুর এই ভীতু চাহনি আবার সে দেখতে পেয়েছে। তবে আজ আদিবকে দেখে তার রাগ হচ্ছে, ভীষণ রাগ হচ্ছে। আদিব মুমুর হাত ধরতেই হাত মুঠো করে ফেলে রূপক।

পর্ব ২২

ক্লাস থেকে বের হয়ে আদিবকে ফোন করে মুমু, কিন্তু ফোন আনরিচেবল বলেছে। মুমুর হাত~ পা কাপছে, কপাল বেয়ে ঘাম পরতে শুরু করেছে। কোনরকম নিজের চেম্বারে এসে বসে। মেসেজ টা পাওয়ার পর থেকে মুমু সব সময় ভয়ে থাকে বলে ফোন করার সাথে সাথেই তার কল রিসিভ করে আদিব। সেখানে ফোন অফ থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কাঁপা কাঁপা হাতে আরো কয়েকবার কল দেয়, কিন্তু বার বার একই উত্তর আসছে।

মুমুর চোখ থেকে অলরেডি পানি পরতে শুরু করেছে। সামনে থাকা গ্লাস টা নিয়ে পুরো পানিটুকু খেয়ে নেয় মুমু। চোখের পানি মুছে বাসায় ফোন করে। মায়ের কাছে আদিবের কথা শুনলে মা জানাই বাসায় নেই। কিছু না বলেই ফোন রেখে দেয় মুমু। এবার মুমুর ভীষণ ভয় লাগছে, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ায় মুমু আদিবের অফিসে যাওয়ার জন্য। হঠাৎই ফোনের রিংটোন শুনে হাতে নিয়ে দেখে আদিবের কল, তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করেই ঝড়ের গতিতে বলা শুরু করে,
~ আদি কোথায় তুমি? তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন? তুমি এখনই এইমুহূর্তে আমার ভার্সিটি আসো, রাইট নাউ।
~ কুল জান কুল, তোমার আদিব ঠিক আছে তবে কতক্ষণ ঠিক থাকবে সেটা তুমি বলবে জান।

কথাটা শুনেই ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে মুমু। ফোন টা কখন হাত থেকে পড়ে গেছে বুঝতে পারে নি। গলা থেকে একটা শব্দও বের করতে পারছে না মুমু, চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে, হাত প্রচন্ড কাপছে। কাঁপা হাতেই দ্রুত ফোন টা তুলে নেয় মুমু।
~ পি প্লিজ প্লিজ আদিকে কিছু করবেন না। আমি ওকে ছেড়ে চলে যাব, আই সোয়ার আমি আজই চলে যাব। আ আপনি ওকে কিছু করবেন না প্লিজ। মুমু হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে।

মুমুর কান্না শুনে রূপক অস্থির হয়ে বলল, কাঁদে না জান তুমি যা বলবে তাই হবে জান। তবুও কেঁদো না জান, উম্মাহ। বলেই ফোন রেখে মুচকি হাসি দেয় রূপক।
ভ্রু কুঁচকে তরুণের দিকে তাকিয়ে আছে আদিব। একে NSI অফিসার কে বানিয়ে ছিল ভেবে মেজাজ খিটে যাচ্ছে আদিবের, সামন্য হাতের ব্যান্ডজটাও করতে হাত কাপছে। এমনিতেই অফিসের সামনে নামতেই হুট করে কোথা থেকে একটা বাইক এসে কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাত থেকে ফোন নিয়ে চলে গেছে। আবার হাতটা যে কিসে কাটলো সেটাও বুঝতে পারছে না, তার উপর এই তরুণের নাদানি দেখে রাগে হাত ছাড়িয়ে নিজেই ব্যান্ডেজ করতে শুরু করে। তরুণ চিল্লিয়ে বলল,
~ আরে আমি করছিলাম তো, দে আমাকে…
আদিব রেগে তাকাতেই চুপ হয়ে যায় তরুণ। আদিব ব্যান্ডেজ করতে করতে তরুণকে বলল,
~ অফিসের সামনের সিসিটিভি ফুটেজ চেক কর, আর আমাকে তোর ফোন টা দে।
তরুণের ফোন নিয়ে মুমুকে দুবার কল দেয় আদিব। কিন্তু ফোন তুলছে না মুমু, আরো একবার দিলো কিন্তু একই অবস্থা। হয়তো ক্লাসে আছে ভেবে আর ফোন না দিয়ে তরুণের সাথে ফুটেজ দেখা শুরু করে।
রাগে আদিবের মাথা টগবগ করছে, মুমুকে পেলে সে খুন করবে। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ~

মুমুর ফোন হঠাৎ বন্ধ পেয়ে আদিব মুমুর ভার্সিটি গিয়ে জানতে পারে মুমু আরো ঘন্টা খানেক আগেই বেরিয়ে গেছে। কি করবে ভেবে দ্রুত বাসায় চলে আসে আদিব। দরজা খুলেই শাশুড়ী হরবর করে বলতে শুরু করেন,

~ আদিব বাবা তোমার ফোন বন্ধ কেন? আমি কখন থেকে ফোন করছি। দেখোনা বাবা মুমু টা হঠাৎ এসে প্রয়াকে নিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেল। আর আমাকে বলল আমি যেন বাড়িতে চলে যায়। বলেই কেঁদে দেন মরিয়ম বেগম। আদিব অবাক হয়ে বলল,
~ ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেল মানে? কোথায় গেছে?
মরিয়ম বেগম কেঁদে বললেন,
~ জানিনা বাবা তবে মেয়ে টা আমার আবার কোনো সমস্যায় পড়েছে নইলে এমন পাগলের মতো আচরণ করে না ও।

শাশুড়ীর কথা শুনে আদিব দৌড়ে মুমুর ঘরে যেয়ে সবকিছু ঘেটে দেখে মুমুর ভিসা পাসপোর্ট কিছুই নেই। মুমুর ফোনটাও বিছানায় পরে আছে।
এয়ারপোর্টে এসেই আগে রিসেপশনিস্টের কাছ থেকে ইন্ডিয়া ফ্লাইট কখন জেনে নেয় আদিব। আধাঘণ্টা পরে শুনে দৌড়ে পেসেঞ্জার সিটিং এরিয়া খুজতে শুরু করে। হঠাৎই পাপা ডাক শুনে ডান দিকে তাকিয়ে দেখে প্রয়া তার দিকে চেয়ে হেসে হাত বাড়িয়ে আছে। আদিব কালবিলম্ব না করে দ্রুত যেয়ে প্রয়াকে কোলে নিয়ে চুমু খায়। পাশে তাকিয়ে দেখে মুমু দু’হাতে মাথা রেখে ঝুঁকে চেয়ারে বসে আছে।

মুমুকে দেখেই আবার রাগেরা মাথা নেড়ে উঠে। প্রয়াকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে মুমুর দু’হাত শক্ত করে ধরে টেনে দাঁড় করায়। হঠাৎ করে এরকম করায় মুমু চমকে সামনে তাকাতেই কেউ তাকে সজোরে থাপ্পড় দেয়। গালে হাত দিয়ে আবার সামনে তাকাতেই আদিবকে দেখে ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে দেয় মুমু। অন্য দিকে মুমুকে থাপ্পড় দেওয়ায় প্রয়া ভয়ে কেঁদে দেয়।

প্রয়ার কান্না শুনে আদিবের হুঁশ ফিরে, দ্রুত প্রয়াকে কোলে তুলে থামানোর চেষ্টা করে। কান্না থামলেও মুমুর কাছে যাওয়ার জন্য হাত বাড়ায়। তাই মুমুর কোলে প্রয়াকে দিয়ে মুমুর হাত শক্ত করে ধরে হাটা শুরু করে। মুমু হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
~ আমি যাব না মুমুর কথা শুনে আদিব রক্তিম চোখে তার দিকে তাকায়। আদিবের তাকানো দেখে মুমু মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর মুমুকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয় আদিব।

গাড়িতে একটা কথাও বলেনি আদিব, রেগে সারাপথ রকেট গতিতে গাড়ি চালিয়েছে। প্রয়া মুমুর বুকের মাঝে ঘুমিয়ে গেছে আর মুমু মাথা নিচু করে ভয়ে, কষ্টে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। গাড়ি থেকে নেমে মুমুকে টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে বাসায় আসে। শাশুড়ী দরজা খুলতেই প্রয়াকে তার কোলে দিয়ে শান্ত ভাবে বলল,
~ মা, প্রয়াকে নিয়ে রুমে যান।
শাশুড়ী কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিব কিছুটা রেগে বলল,
~ মা, প্লিজ রুমে যান। বলেই শাশুড়ীকে কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে মুমুর হাত ধরে টানতে টানতে রুমে চলে যায় আদিব।

রুমে এসেই মুমুকে বিছানায় ছুড়ে ফেলে ভীষণ শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয় আদিব। শব্দে মুমু ভয়ে কেঁপে উঠে। দরজা বন্ধ করে মুমুকে বিছানা থেকে টেনে তুলে থাপ্পড় দিতে গিয়েও থেমে যায় আদিব। পাশে থাকা ফ্লাওয়ার ভাসটা হাতে নিয়ে সজোরে ক্লজেটের দিকে ছুড়ে মারে। কাচের ঝনঝন শব্দে নিজের শাড়ী দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে মুমু, মাথা তুলে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তাই মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাঁদছে। মুমুর দুই বাহু শক্ত করে ধরে রেগে মুমুকে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বললো,
~ কোথায় যাচ্ছিলি বল? কোথায় যাচ্ছিলি? তোর সাহস হয় কি করে আবার আমাকে ছেড়ে যাওয়ার…. মাথা নিচু করে থাকবি না…. কথা বল…. স্পিক আপ ড্যামেট।

কথাটা বলেই মুমুকে আবার ধাক্কা দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়। রাগে দুই হাতে নিজের মাথার চুল গুলো শক্ত করে চেপে ধরে, ড্রেসিং টেবিলের সামনে থাকা টুলে জোরে লাথি দিয়ে চেচিয়ে বলল,
~ কান্না বন্ধ কর মুমু, আমি কি বলছি শুনতে পাচ্ছিস না? আই সেইড স্টপ ক্রায়িং মুমু।

আদিবের কথা শুনে নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে মুমু। হঠাৎই মুমুকে দাঁড় করিয়ে মুমুর চুল ধরে মুখের সামনে মুখ নিয়ে দাতে দাঁত চেপে বলল,
~ আমাকে ছেড়ে কেন যাচ্ছিলি বল? কেন?
আদিবের রাগী ফেস দেখে মুমু গড়গড় করে তখনকার ফোন কলের কথা বলে দেয় আর আদিবকে জড়িয়ে ধরে আবার কান্না শুরু করে।

পর্ব ২৩

~ মুমু পাগলামি করিস না, ফর গড সেক হাত থেকে চাকুটা সরা।
আদিব অস্থির হয়ে মুমুকে বার বার কথাটা বলছে। আদিব মুমুকে থামাতে একটু কাছে আসতেই মুমু হাতের সাথে চাকুটা চেপে ধরে, সাথে সাথে বেশ খানিকটা কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে। আদিব থেমে যায় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে বলল,
~ ওকে, ওকে তুই যা বলবি তাই হবে। তুই যা চাস তাই হবে। আই প্রমিজ তুই যা বলবি আমি তাই শুনবো।
আদিবের কথা শুনে মুমু হাত থেকে চাকু ফেলে ওখানেই ধুপ করে বসে পড়ে। আদিব দৌড়ে যেয়ে মুমুকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। তার প্রাণটাই বের করে ফেলেছিল মেয়েটা। মরিয়ম বেগম পাশে দাড়িয়ে মুখে কাপড় দিয়ে কাঁদছেন। আট বছর আগে বাবা আর মিমনের সাথে এভাবেই জোর করে কলকাতা চলে গেছিল মেয়েটা। আজ আবার আদিবকে বাধ্য করলো তার কথা শুনতে।
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা _

মুমুর থেকে সব শুনে রাগে আদিবের গা রিরি করছিল। মুমুকে রেখে তখনই বের হতে গেলে বাধা দেয় মুমু, কোনভাবেই আদিবকে বাইরে যেতে দেবে না। তার একই কথা,
~ আদি তুমি কোথাও যাবে না। আমরা এখান থেকে চলে যাব। আমরা এখনই চলে যাব, আদি তুমি আমাকে আর প্রয়াকে নিয়ে অন্য কোথাও চলো যেখানে ওই লোকটা আমাদের খুঁজে পাবে না। ওই লোকটা তোমাকে মেরে ফেলবে আদি, তোমার কিছু হয়ে গেলে….। বলেই ঝরঝর করে কেঁদে দেয় মুমু।

মুমুর কথাতে আরো রেগে যায় আদিব, মুমুকে ধরে ঝাকিয়ে বলে উঠে,
~ গাধার মতো কথা বলবি না মুমু, সামান্য মেসেজ আর ফোন কলে আমি পালাতে যাব কেন? এর শেষ আজ আমি দেখেই ছাড়বো।
বলেই মুমুকে ছেড়ে দরজা খুলে বের হতে গেলেই মুমু দ্রুত ডাইনিং থেকে চাকু নিয়ে নিজেকে শেষ করে দেবার হুমকি দেয়। মুমুর কাজে আদিব হতবাক হয়ে যায়।
আজ একসপ্তাহ হলো রূপক কলকাতা এসে বসে আছে, বসে আছে বললে ভুল হবে মুমুকে পাগলের মতো খুজছে। সেদিন এয়ারপোর্টে মুমুকে ইন্ডিয়া ফ্লাইট টিকিট বুক করা দেখেই স্বস্তি নিয়ে অফিসে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু তার ইনফর্মার যখন জানাই মুমু কলকাতা আসেনি তার একদিন পরেই চলে আসে কলকাতা। কিন্তু যার জন্য আসা তার টিকিটারও খবর নাই।

দেড় মাস পর,
সকালের মিষ্টি একফালি রোদ মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় মুমুর। চোখ খুলতেই দেখতে পায় আদিবের উদোম বুকে উপর মুখে আঙুল পুড়ে শুয়ে আছে প্রয়া, আদিব ডান হাতে আগলে রেখেছে প্রয়াকে। আর বাম হাত দিয়ে মুমুকে জড়িয়ে ধরে আছে। আলতোভাবে আদিবের হাত সরিয়ে উঠে বসে, প্রয়ার মাথায় চুমু দিয়ে একটু উচু হয়ে আদিবের বা গালে খোচাখোচা দাড়ির উপর ঠোঁট ছুয়িয়ে দেয় মুমু। তারপর আস্তে করে নেমে যায় বিছানা থেকে, চুল গুলো হাত খোঁপা করতে করতে এগিয়ে যায় বেলকনিতে।

লোকালয় থেকে দূরে এই দোতলা বাড়িটার বেলকনি থেকে চা বাগান টা অপূর্ব দেখায়। রেলিঙের উপর হাত রেখে একটু ঝুকে সামনে তাকিয়ে বড় একটা নিশ্বাস নেয় মুমু। তারপর বেলকনির বা দিকে তার সব থেকে পছন্দের পুকুর ঘাট আর কৃষ্ণচূড়া গাছটি দেখে মিষ্টি হাসে মুমু। কিছুক্ষণ প্রকৃতি বিলাস করে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে যায় মুমু।

ফোনের ভাইব্রেশনে ঘুম ভেঙে যায় আদিবের, তাড়াতাড়ি ফোন নিয়ে সাইলেন্ট মুড করে। স্ক্রিনে তরুণের নাম দেখে প্রয়াকে আলতো করে বিছানায় শুয়ে দিয়ে উঠে বেলকনিতে এসে ফোন রিসিভ করে আদিব। তরুণের সাথে কথা বলে রুমে এসে মুমুকে কোথাও না পেয়ে নিচতলায় নেমে আসে আদিব। কিচেন থেকে আওয়াজ পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। মুমু কোমড়ে শাড়ী বেধে গুনগুন করে গান গাইছে আর রুটি বানাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবথেকে সুখী গৃহিণী। এই সুখী মুখটা দেখার জন্যই তো আদিব সব ছেড়ে দিয়ে এখানে বসে আছে।

সেদিন মুমুর পাগলামি সামলাতে আদিব মুমুকে নিয়ে কানাডা চলে যাওয়ার ডিসিশন নেয়। কিন্তু হুট করে কানাডা যাওয়া তো সম্ভব নয়। এদিকে মুমু কোনভাবেই আর ঢাকা থাকবে না। তাই মায়ের পছন্দের বাড়িতে আসার ডিসিশন নেয় আদিব। সিলেটে এসে এই বাড়ি টা খুব ভালো লেগেছিল মায়ের তাই বাবা মাকে জন্মদিনে উপহার দেন এই বাড়ি টা। সেদিনই বাবাকে ফোন করে এখানে আসার কথা জানাই আদিব। সেদিন রাতেই শাশুড়ীকে চট্টগ্রাম রেখে পরদিন রাতেই সিলেট চলে আসে তারা।
যেদিন কানে কানে সব বলবো তোমাকে,
বুকের মাঝে জাপটে জড়িয়ে ধরবো তোমাকে||

মুমুর গান শুনে আদিব শয়তানি হাসি দিয়ে চুপিচুপি যেয়ে মুমুকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আদিব জড়িয়ে ধরতেই মুমু লাফিয়ে পিছনে ঘুরে দেখে আদিব ভিলেনি হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মুমু ঘুরতেই আদিব চট করে মুমুর কোমড় থেকে শাড়ির বাঁধন খুলে কোমড় চেপে ধরে একটানে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। মুমুর গলায় মুখ ডুবিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
~ জড়িয়ে ধরেছি মুমুপাখি, এবার ফটাফট কানে কানে বলতো কি বলতে চাস। মুমু আদিবের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ছাড়া পাওয়া জন্য ছটফট করতে করতে বলল,
~ আদি প্লিজ ব্রাশ করে আসো, আই হেইট ইউর মর্নিং কিসেস, প্লিজ আ…।
মুমু কথা শেষ করার আগেই আদিব তার কথা বন্ধ করে দেয়। কিছুক্ষণ পরে ছাড়া পেতেই মুমু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
~ আই হেইট ইউ।

~ আই নোও দ্যাট মুমুপাখি। বলেই মুমুর ঠোঁটে শব্দ করে একটা চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে চলে যায় আদিব।
আদিব ফ্রেশ হয়ে প্রয়াকেও ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ করে নিচে নেমে আসে। ততক্ষণে মুমু টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আদিব হেসে প্রয়াকে মুমুর কোলে বসিয়ে দিতেই প্রয়া মুমুর এক গালে চুমু দিয়ে বলল,
~ দুদ মনিং মাম মাম। প্রয়াকে কপি করে আদিব মুমুর আরেক গালে চুমু দিয়ে বলল,
~ গুড মর্নিং মাম মাম। বলেই হুহা করে হেসে দেয় আদিব। প্রয়াও বাবার সাথে খিলখিল করে হাসতে শুরু করে। বাবা~ মেয়ের প্রাণবন্ত হাসি দেখে মুমুর সব রাগ ফুসস।

মুমু ধোঁয়া ওঠা লেবু চায়ে চুমুক দিচ্ছে আর চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে আদিব আর প্রয়ার দিকে। ইদানীং আদিবকে চোখে হারায় প্রয়া। সবসময় আদিবের সাথে লেপ্টে থাকে, খাওয়া, ঘুম সবকিছুতেই পাপাকে চায় তার। এই যে বাবা~ মেয়ে ঘেটো স্টাইলে নাস্তা করছে। তাদের এই ঘেটো স্টাইল লাস্ট পর্যন্ত মুমুকে সহ্য করতে হয়। এই যে প্রয়া ফট করে ডিম পোঁচ থেকে আঙুলে কুসুম নিয়ে তার পাপার নাকে লাগিয়ে দিল, তার পাপাও তার নাকে লাগালো। আর খাবার শেষে দুজনেই মুমুর গালে নাক ঘষে লাগাবে, ভেবেই ফত করে একটা নিশ্বাস নেয় মুমু। এসব উদ্ভট কাজগুলো সবই রাগী গাধাটার থেকে শিখেছে প্রয়া।
আদিব মুমুর দিকে তাকিয়ে বলল,
~ মুমু তরুণ ফোন দিয়েছিল, সব কমপ্লিট।

পর্ব ২৪

~ মুমু, তরুণ ফোন করেছিল, সবকিছু কমপ্লিট সামনের সপ্তাহে আমাদের ফ্লাইট। বলেই আদিব মুমুর দিকে তাকালো, মুমু মন খারাপ করে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিব মুমুর হাত ধরে আবার বলল,
~ মুমু আরেক বার ভেবে দেখবি, এখনো সময় আছে আমরা এখানেই সেটেল্ড হতে পারি আর বাড়িটাও তো তোর পছন্দ।

মুমু ফটাফট উত্তর দেয়,
~ ভাবাভাবির কিছু নেই আদি আমরা সামনে সপ্তাহেই যাচ্ছি। বলেই উঠে চলে যায় মুমু। মুমুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে আদিব।
সকালের নাস্তা শেষে প্রয়াকে নিয়ে গার্ডেনে ফুল গাছে পানি দিচ্ছে আদিব। মুমু একবার দুজনকে দেখে দুপুরের রান্না করতে চলে যায়। রান্না শেষে কিচেন থেকে বের হয়ে রুমে যাওয়ার সময় বাবা~ মেয়ের হাসির শব্দ শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলে মুমু। দ্রুত পায়ে গার্ডেনের দিকে যায়। যা ভেবেছিল তাই, দুজনে বসে কাদামাটি নিয়ে ভীষণ মনযোগ দিয়ে খেলছে। প্রয়া তার সারা হাতে কাদা করে আদিবের সাদা টিশার্টে হাতের ছাপ দিচ্ছে আর আদিব মনোযোগ দিয়ে মেয়েকে দেখাচ্ছে কোথায় কোথায় লাগাতে হবে। অসভ্য লোক একটা, অদ্ভুত সব বুদ্ধি বের করে। কতবার বলেছে এসব না করতে, উফফ প্রয়ার থেকেও বেশি জ্বালায় অসভ্যটা।

মুমু এসে দাড়াতেই প্রয়া ফট করে আদিবের পিছনে লুকিয়ে যায়। আদিব মুমুর দিকে তাকিয়ে ক্যাবলা একটা হাসি দেয় যার অর্থ উই আর ইনোসেন্ট। মুমু কিছু না বলে রাগী চোখে আদিবের দিকে তাকিয়ে প্রয়াকে কোলে তুলে নেয়। প্রয়া অসহায় দৃষ্টিতে পাপার দিকে তাকায় যার অর্থ আরো খেলবো। মুমু কয়েক পা আগাতেই আদিব ঝট করে প্রয়াকে সহ মুমুকে কোলে তুলে নেয়। হঠাৎ এমন করাই মুমু ভয় পেয়ে যায় প্রয়াকে সামলে রেগে বলে উঠে,
~ আদি ছাড়ো বলছি, পড়ে যাব আমরা।

কে শোনে কার কথা আদিব সোজা পুকুর ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। মুমু আরো রেগে বলল,
~ আদি ভালো হবে না কিন্তু, এদিকে যাচ্ছ কেন? পুকুরে একদম নামবে না। আদি প্রয়ার ঠান্ডা লেগে যাবে, আদি আমার ভয় করে আদি প্লিজ না। (শেষের কথাগুলো অনুরোধ করে বলল মুমু)
ততক্ষণে আদিব সিড়ি বেয়ে বুক পানিতে নেমে গেছে। পানিতে মুমুকে নামিয়ে দিতেই প্রয়াকে সহ মুমু একহাতে আদিবের গলা জাপটে ধরে। আদিব একহাতে প্রয়াকে নিজের কোলে নিয়ে অন্যহাতে মুমুর কোমড় ধরে কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
~ মুমুপাখি দুই মাসের হানিমুনে এসে সমুদ্র না পেলাম পুকুরে তো গোসল করতেই পারি তাইনা। বলেই হেসে দেয় আর অন্যদিকে প্রয়া তো পানিতে নেমে পানি নিয়ে খেলছে আর খিলখিল করে হাসছে। মুমুর হঠাৎই মনে হলো জীবন এতো সুন্দর কেন? সময়টাকে কি একটু থামিয়ে দেওয়া যাবে? মুমুর মনের কথা হয়তো প্রকৃতিও বুঝতে পারে তাই জীবন টাকে আর একটু রাঙাতে বাতাসে কৃষ্ণচূড়া ফুল ছড়িয়ে দেয়। আজ সুখের কৃষ্ণ~ বৃষ্টিতে ভিজেছে তারা।

অসময়ের বৃষ্টিতে আটকে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে মিমনের। ড্রয়িংরুমে ঢুকে বাবার সাথে রূপককে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়ে যায়। মিমনকে দেখে হেসে উঠে দাড়ায় রূপক। মিমন হেসে বলল,
~ আরে রূপক কেমন আছো, সুস্থ এখন?

~ ভালো আছি মিমন ভাই, আপনি কেমন আছেন? ( হাত মিলিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল রূপক)
~ এইতো বেশ ভালো আছি, তারপর বলো কি খবর তোমার? (হেসে বলল মিমন)
~ জ্বি ভালো, একটা জরুরি কাজে এসেছি বাট কাজটা শেষ করতে পারিনি তাই অযাচিতভাবেই আসতে হলো। কালই চলে যাব। ( সংকোচ নিয়ে বলল)
~ আরে এভাবে বলছো কেন? তোমার যখন খুশি আসতে পারো তুমি তো আমাদেরই একজন।

মিমনের কথায় মুচকি হাসলো রূপক। ইন্ডিয়া থেকে আসার পরে মুমুর খোঁজ না পেয়ে মাথা নষ্ট হয়ে গেছিল। বেপরোয়া হয়ে ড্রাইভ করে এক্সিডেন্ট হয়, একমাসের বেশি হসপিটালে ছিল সে। এখন আবার তার মুমুকে চায়।

মিমনের সাথে কথা বলে রুমে এসে মুমু আর প্রয়াকে কোথাও না পেয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ায় আদিব। দোলনায় মা~ মেয়ে দুজনেই বসে দুলছে। প্রয়া ঘুমে চোখ ছোট করে আছে আর মুমু গুনগুন করে গান গাইছে। আদিব সামনে দাড়াতেই প্রয়া ঘুমু ঘুমু চোখে পাপা বলে হাত বাড়িয়ে দিল। আদিব হেসে প্রয়াকে কোলে তুলে টুপ করে একটা চুমু খায়। তারপর প্রয়াকে বুকের উপর নিয়ে মুমুর কোলে মাথা রেখে দোলনাতে শুয়ে পড়ে। মুমু মিষ্টি হেসে আদিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ যেতেই প্রয়া আদিবের বুকের উপর ঘুমিয়ে যায়। মুমু আদিবের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ বন্ধ করে আছে। ঘুম কিনা ঠিক বুঝতে পারলোনা তাই আস্তে করে ডাকলো,
~ আদি মুমুর ডাকে পট করে চোখ খুলে আদিব। মুমু বলল,
~ রুমে চলো, প্রয়া ঘুমিয়ে গেছে।
আদিব মুমুর হাত নিয়ে একটা চুমু দিয়ে বলল,
~ পরশু তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে মুমু।
~ কি সারপ্রাইজ? মুমুর কথা শুনে মুচকি হাসে আদিব তারপর উঠে মুমুর হাত ধরে নিচে নামতে নামতে বলল,
~ পরশু জানতে পারবি।

~ জানো দাদু প্রয়া আজকে পুকুরে গোসল করেছে। ফুপাজি ওকে সাঁতার শিখিয়েছে। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দাদুকে গল্প শোনাচ্ছে সমৃদ্ধ।
খাবার টেবিলে বসতে বসতে সমৃদ্ধর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায় রূপক। মিমনের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ মুমুরা কি গ্রামে গেছে?
রূপকের প্রশ্নে মিমন অবাক হয়ে বলল,
~ কেন তুমি জানোনা, আঙ্কেল কিছু বলেনি তোমাকে? অবশ্য তুমি তো অসুস্থ ছিলে তাই হয়তো বলেননি।

মিমনের কথায় আগ্রহ নিয়ে তাকায় রূপক। দেড় মাস আগের সকল ঘটনা জানায় রূপককে। তারপর অনুরোধ করে বলল,
~ তুমি একটু দেখোনা কিছু করতে পারো কিনা। এভাবে আর কতকাল কাটাবে। আদিবকে তো ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে কিছুই করতে দিলো না মুমু। তুমি যদি কিছু করতে পারো।
সকাল থেকে মুমুর খুব খারাপ লাগছে, খুব অস্থির লাগছে। আজ কয়েকদিন শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে। কিন্তু আজ একটু বেশি খারাপ লাগছে। নাস্তার টেবিলে বসে দুইবার খাবার মুখে নিতেই ভীষণ বমিবমি লাগতেই দৌড়ে বেসিনে গিয়ে হরহর করে বমি করে দেয় মুমু। মুমুর বমি করা দেখে আদিব আর প্রয়া ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। আদিব দ্রুত মুমুর কাছে এসে কাঁধ ধরে। মুমুর চোখে মুখে পানি দিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেয় আদিব। পাশের চেয়ারে নিজে বসে মুমুর দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে বলল,
~ ওহ মাই গড মুমুপাখি, আমি বাবা হবো!

মুমু কেবলই মাথাটা টেবিলের উপর রেখে শুয়েছিল, আদিবের কথা শুনে রাগ উঠে গেল। এখানে আসার তিন দিন পরে শারীরিক দুর্বলতা ও টেনশনে মুমুর বমি হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। তখন জ্ঞান ফেরার পর আদিব ঠিক এই কথাটা বলেছিল। মুমুর খেতে ইচ্ছে না করলে সাথে সাথে তার মনে হয় মুমু প্রেগন্যান্ট, সেবার কীট এনে জোর করে টেস্টও করিয়েছিল সে। কথায় কথায় তাকে প্রেগন্যান্ট বানিয়ে দেয় গাধাটা। ভেবেই রেগে কটমট চোখে আদিবের দিকে তাকাতেই আদিব ইনোসেন্ট একটা হাসি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
~ মানে হতেও পারে আরকি।

পর্ব ২৫

আদিবের পাগলামি সামলাতে না পেরে বাধ্য হয়ে গতকাল ডক্টরের কাছে গিয়েছিল মুমু। ডক্টর সব জেনে প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট সহ আরো কিছু টেস্ট করেন। তবে আদিবের ধারণা সে এবার অবশ্যই বাবা হবে। কাল থেকে তাকে ভীষণ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। প্রয়াকে তো বার বার বলছে, ‘ পরী মাম মামের পেটের মধ্যে ঠিক তোমার মতো আরেকটা পরী আছে বুঝলে। ‘ প্রয়া কি বুঝছে সেই জানে তবে আদিব যতবার কথাটা বলছে সে ততবার মুমুর পেট থেকে শাড়ী সরিয়ে পেটের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলছে, মাম মাম সত্যি পলি আছে?
একেতো অসুস্থ তার উপর দুইজনের অত্যাচারে আরো ক্লান্ত লাগছে মুমুর। সকাল থেকে কোন কিছুই আদিব করতে দেয়নি। নিজেই নাস্তা বানিয়ে প্রয়াকে নাস্তা করিয়েছে। মুমু কোনরকম একটু রুটি মুখে দিয়েছে, আদিব জোর করে ডিম খাওয়ানোর একমিনিট পরই বমি করে দিয়েছে। এখন সে বিছানায় বসে বাবা~ মেয়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আদিব ভীষণ ফুরফুরে মেজাজে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে রেডি হচ্ছে উদ্দেশ্য মুমুর রিপোর্ট আনতে যাবে। আর প্রয়া পাপার সাথে যাবে বলে রেডি হয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে আছে।
রেডি হয়ে প্রয়াকে কোলে নিয়ে মুমুর সামনে এসে দাঁড়ায় আদিব, একটু ঝুকে মুমুর কপালে চুমু দিয়ে বলল,

~ একঘন্টার মধ্যেই চলে আসবো, গেটে রঞ্জিত কাকা আছেন কিছু লাগলে বলিস। আর বেশি খারাপ লাগলে আমাকে ফোন দিবি।
অনেকক্ষণ শুয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে নিচে নেমে আসে মুমু। ভীষণ খুধা পেয়েছে, কিছু খেতে হবে। সবকিছুই বাজে লাগছে তাই লেবু শরবত করে খাচ্ছে মুমু। ল্যান্ড লাইনে ফোন আসায় ভ্রু কুঁচকে ফেলে মুমু, এই নাম্বার তো কেউ জানেনা। দুইবার বাজতেই ফোন তুলে মুমু, হ্যালো বলতেই আদিব অস্থির হয়ে বলল,
~ মুমুপাখি তোর মোবাইল কই বলতো? কখন থেকে ফোন দিচ্ছি, এত খুশির খবর তোকে না জানিয়ে আমার তো পেট ফেটে যাচ্ছে। ইসস মুমুপাখি আমি সত্যিই আবার বাবা হবো রে!

আদিবের কথা শুনে মুমু নিজের পেটে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। তার ভেতরে সত্যি একটা প্রাণ আছে ভেবেই খুশিতে চোখ ভরে ওঠে মুমুর। চোখে টলমল পানি, ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুমু। জীবনে প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি, উফফ সুখে তার পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।
~ হ্যালো মুমু, হ্যালো। আদিবের কথায় ধ্যান ভাঙে মুমুর, উত্তর দেয়,
~ হুম

~ কথা বলছিস না কেন? তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?
~ না না ঠিক আছি আমি, তুমি কখন আসছো?
~ এইতো এখনই বের হবো, ইসস মুমু আমার না এখনই তোকে দমবন্ধ করা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।
আদিবের কথা শুনে ফট করে ফোন রেখে দেয় মুমু। গাধাটা এতো অসভ্য কেন?
মুমু শরবতের গ্লাসটা নিয়ে সিড়ির দিকে আগাতেই কলিংবেল বেজে উঠে। রঞ্জিত কাকা এসেছে ভেবে দরজা খুলে দেয় মুমু, সামনে দাড়ানো মানুষটাকে দেখে অবাক হয়ে বলল,
~ ভাইয়া আপনি!

মুমুকে দেখার সাথে সাথেই ঝট করে জড়িয়ে ধরে রূপক। হঠাৎ রূপকের অযাচিত জড়িয়ে ধরায় মুমু ভয় পেয়ে যায়, হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে খন্ড খন্ড হয়ে যায়। কাচের ঝনঝন শব্দে মুমুকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ায় রূপক। মুমু কিছু বলতে যাবে তার আগেই রূপক চট করে মুমুর দুই হাত ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পাগলের মতো বলতে শুরু করে,
~ আমাকে একটু ভালোবাসবে জান? শুধু একটু, আচ্ছা ভালবাসা লাগবে না শুধু আমার সাথে থাকবে তাহলেই হবে। বলেই পাগলের মতো মুমুর সারা হাতে চুমু খেতে শুরু করে।
রূপকের কাজে মুমু ঝট করে হাত সরিয়ে নেয়। অবিশ্বাস্য চোখে রূপকের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
~ আ আ আপনিই? বলতে বলতে একপা পিছাতেই ভাঙা কাচের টুকরোতে পা পড়ে মুমুর।

~ তোর মাথামোটা বোন তো মনে হয় ভুলেই গেছে আজ ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার কথা। বলেই হেসে উঠে আদিব। তারপর আবার ফিসফিস করে বলল,
~ অবশ্য ভুলবারই কথা, মা হবে বলে কথা।
আদিবের হাস্যজ্বল সুখী মুখ দেখে ভীষণ ভালো লাগছে মিমনের। বাবা হবার অনুভূতি আসলেই অন্যরকম, তার জীবনেও তো এই মুহূর্তটা এসেছিল। তাই সে আদিবের এক্সাইটমেন্ট বুঝতে পারছে। আদিব ব্যাক সিটে বসা সৃজাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ সবাইকে একসাথে দেখে ভীষণ খুশি হয়ে যাবে মুমু। আমিতো ভাবছি সবাইকে দেখে ওর প্রথম রিয়াকশনটা কেমন হবে? বলেই প্রাণখোলা হাসি দেয় আদিব।
গেটের সামনে এসে ভ্রু কুঁচকে ফেলে আদিব, দ্রুত গাড়ি থামিয়ে রঞ্জিত কাকার দিকে এগিয়ে যায়। মিমনও নেমে আসে। বেহুশ রঞ্জিত কাকাকে কয়েকবার ডেকে জাগানোর চেষ্টা করে, মিমন দৌড়ে গাড়ি থেকে পানি নিতে যায়। ততক্ষণে মা~ বাবা, সৃজা বাচ্চাদের নিয়ে নেমে দাড়িয়েছে। মিমন পানি নিয়ে কাছে আসতেই হঠাৎ আদিব রঞ্জিত কাকাকে রেখে দৌড়ে ভেতর চলে যায়। মেইন ডোরের সামনে এসে আদিব সামনে তাকিয়ে ফ্লোরের বেশ খানিকটা জায়গায় রক্ত দেখে আঁতকে ওঠে।

আদিব দৌড়ে ভেতরে ঢুকে মুমুকে ডাকতে থাকে। পুরো বাড়ি খুঁজেও মুমুকে না পেয়ে দিশাহীন হয়ে দৌড়ে আবার গেটে আসে। ততক্ষণে মিমন রঞ্জিত কাকার চোখে মুখে পানি দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে। আদিবকে দেখে রঞ্জিত কাকা অসহায় কন্ঠে বলে উঠে,
~ বাবা একটা লোকে বৌমারে হাত~ মুখ বাইন্ধা নিয়া গেছে। আমি থামাইতে গেলে আমারে মাইরা বের হইয়া গেছে। আদিব অস্থির হয়ে বলল,
~ কাকা লোকটাকে দেখলে চিনতে পারবেন আপনি?

রঞ্জিত কাকা মাথা নেড়ে হ্যা জানাতেই আদিব দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যাপটপ নিয়ে এসে রঞ্জিত কাকাকে কিছু ছবি দেখায়।
চোখ থেকে নোনাজলের স্রোত বয়ে পড়ছে মুমুর। রূপার ঘরে খাটের উপর মুখ হাত বাধা অবস্থায় বসে আছে মুমু। রূপক ফ্লোরে বসে মনোযোগ দিয়ে মুমুর পা ড্রেসিং করছে।

~ মুমু মনে আছে তোমার, এই ঘরটাতে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। বলে ড্রেসিং শেষে মুমুর পায়ে চুমু দিতেই মুমু চট করে পা সরিয়ে নেয়। আট বছর আগের সেই দিনের কথা ভাবতেই মুমু ভয়ে কুঁকড়ে পিছনে সরে যায়। আজকেও যদি রূপক কোনো খারাপ কিছু করে ভেবেই মুমু ফুপিয়ে কেঁদে দেয়। রূপক মুমুর কান্না দেখে চোখের পানি মুছে দিতে হাত আগাতেই মুমু ভয়ে আরো সরে যায়। রূপক মুমুর বাধা হাত ধরে নরম কন্ঠে বলল,
~ মুমু, জান আমি কিচ্ছু করবো না, আমার শুধু তোমাকে চায় জান। তুমি শুধু আমার কাছে থাকলেই হবে জান, আর কিচ্ছু চাই না আমার।
রূপকের কথা শুনে মুমু আরো জোরে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।

পর্ব ২৬

~ মুমু? এই মুমু? পাখিটা, তাকা আমার দিকে, দেখ আমি চলে এসেছি। প্লিজ চোখ খোল, মুমুসোনা আমি ভয় পাচ্ছি একটু চোখ খোল, দেখ আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্লিজ কথা বল।
~ উফফ এই বালের এম্বুলেন্সটা এতো আস্তে যাচ্ছে কেন? এই মিমন দেখনা ও কথা বলছে না, তুই প্লিজ ওদেরকে তাড়াতাড়ি যেতে বল। বলেই এম্বুলেন্সের পাটাতনে বসে রক্ত মাখা দুই হাত মুখে ঠেকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে আদিব।
কয়েকঘন্টা আগে_

রূপক একটা খাবার প্লেট হাতে মুমুর সামনে বসে মুমুর মুখের বাধন খুলে দেয়। বাধন খুলতেই মুমু কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে,
~ রু রূপক ভাইয়া প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। প্লিজ ভাইয়া আ আপনার পায়ে পরছি, প্লিজ আমাকে যেতে দিন।
রূপক মুমুর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
~ তুমি চাও বা না চাও তোমাকে আমার কাছেই থাকতে হবে মুমু। এখন চুপচাপ খেয়ে নাও।

বলেই জোর করে মুমুর মুখে খাবার পুড়ে দেয়। খাবার মুখে দিতেই মুমু হরহর করে রূপকের গায়ে বমি করে দেয়। মুমুর বমি করা দেখে রূপক হতবাক হয়ে যায়। কিছু না বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে। এই ফাঁকে মুমু দাঁত দিয়ে হাতের দড়ি খুলেই হুরপার করে বিছানা থেকে নেমে যায়। দরজা পর্যন্ত যেতেই রূপক হেঁচকা টানে মুমুকে নিজের দিকে ফেরায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে,
~ আমার সাথে চালাকি করছো, আমার সাথে? আদিবের কাছে যাবার এতো তাড়া? এমন অবস্থা করবো জীবনেও আদিবের কাছে যেতে পারবে না। বলেই মুমুকে বিছানায় ছুড়ে ফেলে দেয়। রূপককে রেগে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মুমু ভয়ে প্রাণপণে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। রূপক মুমুর কাছে আসতেই মুমু কেঁদে চিৎকার করে বলে,
~ ভাইয়া আপনার পায়ে পরি। প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।

রূপকের হিংস্রতা থেকে মুমু নিজেকে রক্ষা করতে কোনরকম সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে প্রচন্ড জোরে রূপকের মাথায় হিট করে।
একটানে দরজা খুলে কোনদিকে না তাকিয়ে ছুটতে শুরু করে মুমু। কোনদিক ছুটে কোথায় যাচ্ছে জানেনা, তার শুধু একটাই চিন্তা রূপকের থেকে পালাতে হবে। শরীর অবশ হয়ে আসছে আর দৌড়ানো সম্ভব না তারপরও প্রাণপণে ছুটছে, হঠাৎই তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ বন্ধ করে ফেলে মুমু।

সিলেটে আসার পরপরই মুমু আর প্রয়াকে সবসময় ব্যবহারের জন্য লোকেটসহ চেইন গিফট করেছিল আদিব। সুপ্ত একটা ভয় থেকেই সে লোকেটে ট্রেসার যুক্ত করে দিয়েছিল। সেই ট্রেসারের মাধ্যমেই মুমুর লোকেশান ট্র্যাক করেছে আদিব। তবে তার পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যাবে তাই তরুণকে দ্রুত ফোর্সসহ যেতে বলেছে আদিব।

রঞ্জিত কাকা রূপকের ফটো দেখানোর পর থেকে একটা কথাও বলেনি মিমন। আসলে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এতটা বোকা, বোধহীন কী করে হতে পারলো সে, ভেবেই নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে। ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে আদিব, তার পাশের সিটে চোখ বন্ধ করে দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে বসে আছে মিমন।

তরুণ রূপককে অচেতন অবস্থায় পেলেও মুমুকে পাইনি জানাতেই মাথা ভো ভো করছে আদিবের। দ্রুত গাড়ি সাইড করে ফোনটা নিয়ে আবার লোকেশান চেক করে আদিব। হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় চোখ খুলে আদিবের দিকে তাকায় মিমন, দেখে আদিব অস্থির হয়ে ফোনে কিছু একটা দেখছে। তারপর ফোনটা হাতে নিয়েই ড্রাইভ করতে শুরু করে। লোকেশনটা বেশ কাছেই দেখাচ্ছে, আদিব দিকবিদিকশুন্য হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।

কিছুদূর যেতেই রাস্তার মধ্যে লোকজনের ভিড় দেখে আদিবের বুক ধকধক শুরু করে দেয়। লোকেশনটা এখানেই দেখাচ্ছে, গাড়ি থেকে নামতে নামতে একটা এম্বুলেন্স এসে দাঁড়ায়। ভিড় ঠেলে সামনে আগাতেই স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ে আদিব। তার পাখিটা রক্তে মাখামাখি হয়ে নিথর হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। মিমন দৌড়ে মুমুকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

আশেপাশের লোকজন দ্রুত মুমুকে এম্বুলেন্সে তোলার কথা বলতেই মিমন তাড়াহুড়ো করে মুমুকে এম্বুলেন্সের বেডে শুইয়ে দেয়। আদিবের কথা মনে হতেই পিছনে তাকিয়ে দেখে আদিব একভাবে রাস্তায় লেগে থাকা রক্তের দিকে চেয়ে আছে। মিমন দৌড়ে আদিবকে নিয়ে এম্বুলেন্সে বসিয়ে নিজেও উঠে বসে।
বর্তমানে_
রিকোভার বেডে চোখ বন্ধ করে নিথর হয়ে পড়ে আছে মুমু। ডক্টর মুমুর বুকে হিট দিয়ে পুশ করছেন। দুই বার দিয়েও নো রেসপন্স, তৃতীয় বার পুশ করতেই জোরে শ্বাস নেয় মুমু। নার্স দ্রুত অক্সিজেন মাস্ক পড়িয়ে দেয় মুমুকে। বাইরে দাঁড়িয়ে কাচের ভেতর দিয়ে সবকিছু দেখছিল আদিব। মুমুকে শ্বাস নিতে দেখে দরজার সাথেই হেলান দিয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে। দুই হাত মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠে আদিব। তার কিছু দূরে দাঁড়িয়ে মিমন কাঁদছে।

কিছু সময় পর ডক্টর এসে জানাই প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে পেসেন্টের, মাথায় গভীর চোট পেয়েছে খুব ক্রিটিকাল অবস্থা। দ্রুত ব্লাড এর ব্যবস্থা করেন আর পেসেন্ট মেবি প্রেগন্যান্ট আই থিংক উই সুড এবোর্ট দ্যা বেবি। আদিব ব্যস্ত গলায় বলল,
~ করে দিন এবোর্ট, করে দিন আমার কোনো বাচ্চা চাই না আপনি শুধু ওকে ঠিক করে দিন। যত রক্ত লাগে আমি ব্যবস্থা করছি। আমার জাস্ট ওকে চাই, আপনি ওকে ঠিক করে দিন।

প্রায় দু’ঘন্টা পর মুমুকে ওটি থেকে আই সি ইউ তে শিফট করা হয়। ডাক্তার জানিয়েছেন চব্বিশ ঘন্টার ভিতর জ্ঞান না ফিরলে পেসেন্ট কমায় চলে যাবে। পরিবারের সকলে চলে এসেছে, সকলের মুখে চিন্তার ছাপ। প্রয়া আদিবের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমচ্ছে। প্রয়াকে শাশুড়ীর কাছে দিয়ে ডাক্তারের থেকে পারমিশন নিয়ে ভেতরে যায় আদিব। সাদা বেডে অক্সিজেন মাস্ক পড়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা বেন্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছে মুমু। ধীর পায়ে মুমুর বেডের কাছে যায় আদিব, বুকে খুব ব্যাথা করছে তার চোখটাও জ্বলছে। মাথার বেন্ডেজর উপরে একটা চুমু দেয় আদিব। মাস্কের সাইড দিয়ে আলতো করে মুমুর গালটা ছুয়ে দিল। অনেকক্ষণ মুমুর মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। হঠাৎই মুমুর গলায় কামড়ের দাগ দেখতেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, রাগে হাত মুঠো করে বের হয়ে যায় আদিব।

পর্ব ২৭

আদিব হাসপাতাল থেকে কাউকে কিছু না বলেই বের হয়ে যায়। মিমন আদিবকে রেগে বের হতে দেখে দৌড়ে পিছু গেলেও আদিবকে ধরার আগেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায়।

আদিবের কথায় রূপককে এন এস আই~ এর কাস্টাডি তে রাখা হয়েছে। কাচের গ্লাসে মাথায় বেশ চোট পেয়েছে রূপক। তরুণ একজন ডক্টর ডেকে ড্রেসিং করে বেন্ডেজ করে দিয়েছে। জ্ঞান ফিরে হাতে হাতকড়া দেখে অবাক হয়ে সামনে তাকায় রূপক। সম্পূর্ণ খালি একটা রুমের মধ্যে চেয়ারে বসে আছে সে, মাথাটা বেশ ভারি লাগছে। মুমুর কথা মনে হতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে রূপকের। মুমু তার হলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো। যদি নাই হবে তবে কেন আল্লাহ এতো অনুভূতি দিয়েছে মুমুর জন্য, কথাগুলো ভাবতেই চোখ থেকে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।
রূপক চোখ বন্ধ করে কথাগুলো ভাবছিল, হঠাৎই কেউ এসে তার কলার ধরে দাঁড় করিয়ে প্রচন্ড জোরে নাক বরাবর ঘুষি দেয়। ঘুষি খেয়ে নিচে পড়ে যায় রূপক চোখ তুলে সামনে তাকাতেই আদিবকে দেখতে পায়। আদিব রেগে রূপকের কলার ধরে আবার দাঁড় করিয়ে চিৎকার করে বলল,
~ কেন করলি এসব, কেন? বলেই আরো কয়েকটা এলোপাতাড়ি ঘুষি দেয় আদিব। রূপক আদিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ ভালোবাসি আমি মুমুকে ভালোবাসি, যেকোন মূল্যে ওকে চায় আমার।
রূপকের কথা শুনেই নিজের গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে রূপককে থাপ্পড় দেয় আদিব। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুজতে শুরু করে। দরজার পেছন থেকে একটা স্টিক বের করে রূপককে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করে।
~ ভালবাসিস? ভালোবেসে আট বছর যাবত মেন্টালি টর্চার করছিস আমার মুমুকে? বলছে আর পাগলের মতো মারছে রূপককে।

~ আট বছর আগে জানোয়ারের মতো মলেস্ট করেছিস আমার মুমুকে, আজ আবার… বলে রূপকের হাতের উপর বেধড়ক মার শুরু করে। এতক্ষণ সহ্য করলেও এবার রূপক ফ্লোরে শুয়ে আর্তনাদ করে উঠে। হঠাৎই মার থামিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে আদিব। কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এসে রূপকের চুল ধরে দাঁড় করে দাতে দাঁত চেপে বলল,

~ মুমুর গায়ে কামড়ে ছিস নাহ? এই আদিবের কলিজাতে কামড় দিয়েছিস তুই? বলেই আদিব রূপককে হাত~ পা চেয়ারের সাথে শক্ত হয়ে বেধে দেয়। তারপর একটা প্লাস নিয়ে রূপকের গাল চেপে ধরে দাঁতে সেট করে চাপ দিতেই রূপক জ্ঞান হারায়।
আদিবকে রেগে কাস্টাডিতে যেতে দেখে তরুণও পিছে পিছে এসেছে। আদিবের মারের চোটে আর ভয়ে অনেক আগেই রূপক জ্ঞান হারিয়েছে। কিন্তু আদিব থামছে না দেখে তরুণ দ্রুত আদিবকে জাপটে ধরে থামায়। আদিব রেগে প্লাসটা ছুড়ে ফেলে বের হয়ে আসে। অফিস রুমে এসে তরুণকে বলল,
~ জ্ঞান ফিরলে ট্রিটমেন্ট করে আমাকে ফোন দিবি। ওকে নিজ হাতে খুন করবো আমি। বলে হনহন করে বের হয়ে যায় আদিব।

আঠারো ঘন্টা পরে মুমুর জ্ঞান ফিরলেও অতিরিক্ত হাইপার হয়ে যাওয়ায় ডাক্তার তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছেন। আট বছর আগের মতোই মুমু ট্রমাটাইজ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ডক্টর। আরো একটা সমস্যার কথা ডক্টর জানিয়েছেন তবে সেটা শুধু আদিবকেই বলেছেন। মুমুকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। আদিব সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। মুমুর ডান হাত ধরে পাশের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে আদিব। হঠাৎই মুমু তার হাত শক্ত করে চেপে ধরায় দ্রুত সোজা হয়ে বসে। মুমু ঘুমের মাঝেই ঠোঁট নেড়ে কিছু বলছে আর বন্ধ চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে।
আদিব দ্রুত বেড সাইডে বসে মুমুর গালে হাত রেখে ডাকল,

~ মুমু, এই মুমু? মুমুসোনা? আদিবের ডাকে মুমু পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। আদিব তার মুখের সামনে ঝুকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আদিবকে দেখে যেন তার কান্না বাঁধ ভেঙে যায়, গলা জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে বলল,
~ আদি….. রু রুপক ভা…. এটুকু বলেই আবার কাঁদতে শুরু করে মুমু। আদিব মুমুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর মুমু একটু শান্ত হলে ছাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,
~ সব ঠিক হয়ে যাবে মুমুপাখি, আমি আছিতো। বলে মুমুর কপালে গভীর চুমু দেয়। হঠাৎ মুমু অস্থির হয়ে পেট হাত রেখে বলল,
~ আদি, আমার বাবু, আমার বাবু ঠিক আছে তো? বলে কেঁদে উঠে মুমু। আদিব অসহায় দৃষ্টিতে একবার মুমুর দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে নিচে চোখ রেখে বলল,
~ বাবু ঠিক আছে মুমু, তুই শান্ত হ প্লিজ। (কাঁপা গলায়)
~ আদি, তুমি আমার দিকে তাকাও। আদি সত্যি করে বলো আমাদের বাবু ঠিক আছে, বলো? (দু’হাতে আদিবের মুখ নিজের দিকে করে)

আদিব টলটলে চোখে মুমুর দিকে তাকিয়ে বলল,
~ বললাম তো বাবু ঠিক আছে। আদিবের দিকে তাকিয়ে মুমু জোরে কেঁদে বলল,
~ তুমি মিথ্যে বলছো না? আমার বাবু ঠিক নেই, আদি আমি তোমার বাবুকে ঠিক রাখতে পারিনি তাইনা? বলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে মুমু। আদিব মুমুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ আমাদের বাবু আছে তো মুমু, আমাদের প্রয়া আছে তো সোনা। তুই এতো বোকার মতো কাঁদছিস কেন? কান্না থামা প্লিজ। বলতে বলতেই আদিবের চোখ থেকে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।

প্রায় পনেরো দিন হসপিটালে থেকে তারপর বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় মুমুকে। আর এই পনেরো দিন আদিব রূপককে নিজের ইচ্ছে মতো পিটিয়েছে। রূপকের বাবা~ মা ছেলের সব কার্যকলাপ কথা জেনে কিছু বলতে পারেননি আদিবকে। তবে ছেলেকে বাচানোর জন্য মুমুর কাছে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাই। মুমু তাদেরকে খালি হাতে ফেরায় নি, কেঁদে কেটে আদিবকে জোর করে বুঝিয়ে ছিল। আদিব আগত্য রূপককে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করে দেয়। আইন রূপককে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। তারপর মুমু সুস্থ হবার একমাস পরেই আদিব জোর করে তাদের নিয়ে কানাডা চলে যায়। সে চাই না আবার কখনো রূপকের ছায়া তাদের জীবনে আসুক।

মুমুর ভীষণ মনখারাপ।
সন্ধ্যা থেকে কেঁদেকেটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। তবু্ও আদিব তার কোন কথা শুনছে না। আজ দুই বছর হলো কানাডা এসেছে তারা, মুমু এই দুই বছরে সাতশো পয়ত্রিশ বার বাবু নেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু আদিব কোনো ভাবেই রাজি হয় না। আজ খুব জেদ করায় আদিব তাকে থাপ্পড় দিয়েছে। তাই সে না খেয়ে কেঁদে কেঁদে বিছানার একপাশে শুয়ে বালিশ ভিজচ্ছে। বিছানার অন্যপাশে প্রয়া আদিবের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমচ্ছে আর আদিব মুমুর দিকে তাকিয়ে আছে। কান্নার জন্যে থেকে থেকে শরীর কেপে উঠছে মুমুর।

প্রয়ার কপালে চুমু দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় আদিব। তারপর উঠে বিছানার অন্য পাশে এসে মুমুকে কোলে তুলে নেয়। কোলে নিতেই মুমু নামার জন্য ছটফট শুরু করে দেয়, আদিব চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই শান্ত হয়ে যায় মুমু। ডাইনিং এর চেয়ারে বসিয়ে প্লেটে খাবার নিয়ে মেখে মুমুর মুখে পুড়ে দেয় আদিব। মুমুর খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকতে দেখে আবার চোখ রাঙিয়ে তাকায়, মুমু কাঁদতে কাঁদতে খাবার খেতে শুরু করে। মুমুর কান্না দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিব। তারপর খাবার প্লেট রেখে মুমুর সামনে হাটু গেড়ে বসে মুমুর হাত ধরে বলল,
~ প্রয়া আমাদের বাবু না? মুমু কাঁদতে কাঁদতে মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।

~ তাহল আর বাবুর তো দরকার নেই। আর আমরা যদি আরেকটা বাবু নিয়ে প্রয়াকে অযত্ন করে ফেলি, তাহলে তো ওর প্রতি আমাদের অন্যায় হয়ে যাবে তাইনা।
মুমু কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
~ অযত্ন কেন করবো, ওতো আমাদের প্রথম বাবু।
~ এখন তোর মনে হচ্ছে অযত্ন করবি না কিন্তু নিজের বাবু হলে মন পরিবর্তন হয়ে যায় মুমু। আর তোর কথা বাদ দে আমার তো এমনই হবে আমি নিশ্চিত। তাই আমি কখনো বাবু চায় না। কারণ আমি প্রয়াকে একটুও কষ্ট দিতে চায় না।

মুমু ভ্রু কুঁচকে কিছু ভেবে বোকা বোকা চাহনিতে বলল,
~ সত্যি এমন হবে? আদিব প্রবল জোরে মাথা নেড়ে হ্যা জানালো। ঠিক তখনই প্রয়া চোখ ডলতে ডলতে এসে আদিবকে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ মাম মাম তোমরা এখানে কি করেছো? আমার একা ভয় লাগে তো?
আদিব প্রয়ার গালে শব্দ করে চুমু দিয়ে বলল,
~ পরী তোমার মাম মাম রাগ করেছে, চলতো আমরা মাম মামের রাগ ভাঙায়।
বলে আদিব আর প্রয়া একসাথে মুমুর দুই গালে চুমু দিতে শুরু করে। বাবা~ মেয়ের পাগলামি দেখে মুমু ফিক করে হেসে দেয়। তার আর কিচ্ছু চাই না, এই দুইটা ভালবাসাই তো তার স্বর্গ।

লেখিকাঃ হৃদিতা আহমেদ

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “নোনাজলের শহর (শেষ খণ্ড) – ভালোবাসার কষ্টের কথা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরও পড়ুন – নোনাজলের শহর (১ম খণ্ড) – ভালোবাসার কষ্টের কথা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *