হৃদয়স্পর্শী ভালোবাসার গল্প ২৫

হৃদয়স্পর্শী ভালোবাসার গল্প – বেলা শেষে – শেষ পর্ব | Love Story

হৃদয়স্পর্শী ভালোবাসার গল্প – বেলা শেষে – শেষ পর্ব: আজ আমরা গল্পের শেষ পৃষ্ঠায় চলে এসেছি, যে পৃষ্ঠায় প্রিয়ন্তীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মাখা স্মৃতি ধারণ করে আছে। অনেকটা ছোট বাচ্চার মত ঘুরঘুর করে নীলের পিছে পড়ে থাকা মেয়েটি কত বড় হয়েছে? কতটা ম্যাচুরিটি লাভ করেছে তা শেষ লাইনটি আপনাকে বলে দেবে। তো আমি আর কথা না বাড়াই, চলুন এই বেলা শেষের নীলের নীল কষ্টে মাখা শেষ পৃষ্ঠাটি পড়তে শুরু করি।

তিন বছর পর

আজ দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল। নিহার একটা মেয়ে হয়েছে। রাকা আর সাব্বিরের বিয়েরও একবছর হয়ে গেল। অর্নের বিয়ে হয়েছে ছ’মাস আগে। সবাই সবার জীবনে সেটেল্ড। তো গল্পের নাইকার কি অবস্থা?
সেটাই নিশ্চয়ই জানতে চায় পাঠকরা।

প্রিয়ন্তীর জীবনের তিনটি বছর কেটে গেছে ঠিকই। কিন্তু কিভাবে কেটেছে সে নিজেও হয়তো জানেনা! মাঝে মাঝে তুরিন আপু দেখা করতে আসে কিংবা ফোন করে। কখনো নীলের একটা ফোন বা ম্যাসেজ আসেনা। আর সেটা প্রিয়ন্তী আশাও করেনা। কারণ সে জানে এটা আশা করা নিতান্তই বোকামি।
বাবা মা প্রতি মুহুর্তে বিয়ের জন্য বোঝায়।কিন্তু প্রিয়ন্তী কিছুতেই রাজী হয়নি। কিন্তু গত মাসে বাবার হঠাৎ স্ট্রোক আসায় বাধ্য হয়েই রাজী হলো সে।

হ্যা আগামী সপ্তাহেই আমাদের প্রিয়ন্তীর বিয়ে। বাবার বন্ধুর ছেলে তাহসিব আহমেদের সাথে। ছেলে হিসেবে তাহসিব যথেষ্ট ভালো কিন্তু প্রিয়ন্তীর মন কিছুতেই এসব মানেনা।
তাকে বিয়ে করে কি করে ঠকায়? সে তো আর কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারবেনা! তাহলে কি করে অন্য কাউকে বিয়ে করবে প্রিয়ন্তী অথচ মনের ভেতর থাকবে শুধুই নীল আর তার সাথে কাটানো সব মুহুর্ত…

প্রিয়ন্তীর বিয়ের আয়োজন বেশ ধুমধাম ভাবে করা হচ্ছে। সবাইকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। এতো আনন্দেও প্রিয়ন্তীর মনে শান্তি নেই। তার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে,
নীল যদি আজ থাকতো তাহলে কি এ বিয়েটা মেনে নিতো? হতে দিতো তাকে অন্য কারোর?
আবার ভাবে এসব ভেবেই বা কি! নীলের কিছু আসে যায়না। আজ এতো বছরে একবার খবর অবধি নেয়নি। তবু প্রিয়ন্তী নীলের উপর রাগ করতে পারেনা। মাঝেমাঝেই তুরিন আপুর থেকে খবর নেয় কেমন আছে তার নীল!

গায়ে হলুদ হচ্ছে। প্রিয়ন্তীর এসব প্রোগ্রামের কোন ইচ্ছেই ছিলনা। তবু বাবার ইচ্ছে বলেই বাধ্য হয়ে এসব করা। সে কেবল ভাবছে বিয়ের পর কি জবাব দেবে তাহসিব কে?
কিভাবে বলবে যে সে তাহসিবকে ভালোবাসতে পারবেনা?
এসব কি কেউ আশা করে নিজের বউ এর কাছে?
কিন্তু বাবার অসুস্থতার জন্যেই একটা নিরপরাধ মানুষকে ধোকা দিচ্ছে সে।
প্রোগ্রাম শেষে প্রিয়ন্তী ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসে রইল। আজ ঘুম আসছেনা। সে ভেবেছে সারারাত আকাশ দেখেই পাড় করবে। এই একটা রাত সে নিজের মত কাটাতে চায়। ভাবলেই তার চোখ ভিজে যায় আজকের পর তার কল্পনায় সে নীলকে ভাবতে গেলেও দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে কারণ তখন সে অন্য কারোর জীবনের অংশ।

আজ প্রিয়ন্তির বিয়ে

হঠাৎ ফোন বেজে উঠায় প্রিয়ন্তী চমকে গেল। একটা আননোন নাম্বার। কে হবে এতো রাতে?
প্রথমবার পিক করল না সে…
পরে আবারো কল আসায় পিক করল।
ফোন ধরতেই বুঝলো তাহসিবের নাম্বার এটা।
কল ধরতেই সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিল তাহসিব।
প্রিয়ন্তী কেবল সালামের উত্তর নিয়ে চুপ করে আছে।
: ডিস্টার্ব করলাম না তো?
: জ্বী না।আমি জেগেই ছিলাম। বলুন?
: না আমারো ঘুম আসছিল না। আর আপনার নাম্বারটাও ভাবী জোড় করে দিয়ে গেছে যেন আপনায় কল দেই। কিছু মনে করবেন না এতো রাতে ফোন করায়।
: জ্বী না সমস্যা নাই।
: খাওয়াদাওয়া করেছেন?
: জ্বী।
: ঘুমাবেন কখন?
: জ্বী একটুপরেই।
প্রিয়ন্তীর উত্তর গুলো ছোট ছোট হওয়ায় আর বাড়তি কোন কিছুই না বলায় তাহসিব ভাবল সে বোধ হয় লজ্জা পাচ্ছে।
তাই বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিল।

ফযরের আযান দিচ্ছে। প্রিয়ন্তী সেই একভাবেই বারান্দার গ্রীল ধরে বসে আছে। আকাশের ধীরে ধীরে ফর্সা হওয়া দেখছে সে। হঠাৎ তার মনে হলো আজকের পর আর মন খুলে কান্নাও করা যাবেনা। ভাবতে ভাবতেই চোখ গড়িয়ে ঝরঝরে পানি পড়রে লাগল।
প্রিয়ন্তীর মা বারান্দায় এসে মেয়েকে দেখেই বুঝে নিলো সে নীলের কথাই ভাবছে। কেন এই ছেলেটা তার মেয়ের মন থেকে চলে যায়না! মেয়েকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে তারও খুব কষ্ট হয়।
পাশে আসতেই প্রিয়ন্তী চোখ মুছে মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে সালাম দিল।
এরপর ওজু করে নামাজ পড়ে নিলো।
রান্নাঘরে গিয়ে বাবার জন্য চা করলো।
প্রিয়ন্তীর মা আজ কিছুই বলছেনা। মেয়ের যা ইচ্ছে হয় করুক।

প্রিয়ন্তী আগেই জানিয়েছে সে পার্লারে সাজবেনা। তাই রাকা আর নিহাই তাকে সাজাতে শুরু করল। রাকা, নিহা আর অর্ন কেবল প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কারো সাথে কথা বলছেনা। কেন যেন ওরাও মেনে নিতে পারছেনা বিয়েটা! কিন্তু নীল ভাইয়া তো ফিরে আসলো না, আর আসবে বলেও মনে হয়না।

প্রিয়ন্তী সেজেগুজে বারান্দায় গিয়ে দাড়াল। আর কিছুক্ষন!
নীলের সাথে একটা বার যদি কথা হতো!
শুধু জানাতো সে আজ অন্যের বউ সেজেছে…
পিছনে অর্ন এসে দাড়ালো। প্রিয়ন্তী ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরল। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল প্রিয়ন্তী। তার ডাক্তারবাবু কেন তাকে বুঝলোনা কেন? এই আক্ষেপ নিয়ে সে কিভাবে সারাজীবন অন্য কারো সাথে কাটাবে?

নীলের প্রর্তাবর্তন ও আকুল আবেদন

সন্ধ্যা নেমে এলো। বিয়ের স্টেজে বসল প্রিয়ন্তী। সবাই আশেপাশে কত আনন্দিত। কেবল প্রিয়ন্তীর মা আর তার বান্ধুবীরাই জানে এ বিয়েটা কত আনন্দের।
তুরিন আপু এসেই প্রিয়ন্তী কে জড়িয়ে ধরল।
কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
নীল এসেছে। একটাবার কথা বলতে চায় তোমার সাথে।
প্রিয়ন্তী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কিইইইইই!
নীল? তার ডাক্তারবাবু এসেছে?
প্রিয়ন্তী কিছু না বলে শুধু মায়ের কাছে গিয়ে বলল সে ওয়াশরুমে যাবে।
রাকাকে নিয়ে প্রিয়ন্তী স্টেজের পিছনে গিয়ে রাকাকে দাড়াতে বলল।
দ্রুত পায়ে পিছনের গেট দিয়ে বের হয়ে দেখলো নীল দাড়িয়ে আছে।

প্রিয়ন্তী সামনে গিয়ে শুধু নীলের চোখ দেখছে। আহহ সেই মায়াভরা দুচোখ!
কতোই না অপেক্ষা করেছে এই চোখজোড়া দেখার।
নীলের কথায় ধ্যান ভাঙ্গলো প্রিয়ন্তীর,
: কেমন আছো মিস প্রিয়ন্তী?
: হুম আলহামদুলিল্লাহ।
: অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে তোমায়।
: হু।
: বড্ড দেরী করে ফেলেছি না?
: হু।
: আমি জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমাযোগ্য নয়। তবু বলতে চাই প্রিয়ন্তী এই তিন বছরের তিনটা ঘন্টাও তোমাকে না ভেবে কাটেনি আমার। কিন্তু তাও আটকে রেখেছিলাম। কিন্তু আপুর কাছে তোমার বিয়ের কথা শুনে আর পারছিলাম না থাকতে। আমায় মাফ করো বা না করো তোমার ভালোবাসাটুকু কি আমাকে দেয়া যায়?
নীল হাটুর উপরে বসে কান্না করতে লাগলো।
প্রিয়ন্তী আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা বড় নি:শ্বাস নিল। আজ এই সময়টার জন্য সে গত তিন বছর কতো অপেক্ষাই না করেছে!
সেই দিন আজকে সে পেয়ে গেল। কিন্তু সময় কি কারো জন্য থমকে থাকে?
সময় তার নিয়মেই চলে। দেরী করে হলেও নীল ফিরে এসেছে।

বেলা শেষে

প্রিয়ন্তী এবার বলা শুরু করলো,
: জানেন ডাক্তার বাবু আপনি যাওয়ার পরের এই ১০৯৫ দিনের এমন একটা মুহুর্ত নেই আমি মন খুলে হেসেছি, খেয়েছি কিংবা এমন একটা রাত নেই নিশ্চিন্তে বা না কান্না করে ঘুমিয়েছি।
তবু আপনার উপর আক্ষেপ নেই।
আমি নিজেই নিজের জীবনকে এলোমেলো করে রেখেছি।
শুধু একটা খারাপ লাগা ছিল কি জানেন?
আপনি কেবল আপনার অতীতের একটা ভুল মানুষের জন্য আমায় এভাবে শাস্তি দিলেন?
আমার ভালোবাসায় কোন খাত ছিল না।
: জানি আমি জানি প্রিয়ন্তী। তাইতো ফিরে এসেছি তোমার কাছেই। প্লিজ ফিরিয়ে দিওনা। তুমি চাইলেই বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়া যায় এখনই। আমি নিজে আঙ্কেল, আন্টির সাথে কথা বলব।
: তার আর কোন প্রয়োজন নেই ডাক্তার বাবু।

বড্ড দেরী হয়ে গেল। এসব আর সম্ভব না। বিয়েটা ভেঙ্গে গেলেও আপনার জীবনে যাওয়া সম্ভব না। যে মানুষ এতোকিছুর পরেও এতোটা পাষাণ ছিল তার জীবনে আমি যেতে চাইনা। ফিরে যান আপনি,
নীল থমকে তাকিয়ে আছে প্রিয়ন্তীর দিকে। ও হয়তো ভাবতেই পারেনি প্রিয়ন্তী এমন কিছু বলতে পারবে!
প্রিয়ন্তী গুনগুন করে গেয়ে উঠলো,
তুমি যাকে ভালোবাসো,
স্ন্যানের ঘরে বাষ্পে ভাসো,
তার জীবনে ঝড়।
আমার দরজায় খিল দিয়েছি আমার দারুন জ্বর,
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেধো ঘর,

জীবনটা আসলেই প্রতিধ্বনির মতো। আপনি যা করবেন সেটা আপনার কাছেই ফিরে আসবে। হয়তো একদিন আগে কিংবা পরে। তাই জীবনের সব ডিসিশন ভেবে নেয়া উচিৎ।

ধন্যবাদ বেলা শেষের সকল পাঠকদের। প্রিয়ন্তীর জায়গায় আপনি হলে কি করতেন? সবাই কমেন্টে জানাবেন আপনাদের মতামত গুলো।

আরো পড়ুন- বিয়ের গল্প – আদর্শ বর ও বাবার গল্প যা আপনাকে কাঁদাবে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *