বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

অবশেষে তুমি আমার – বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

অবশেষে তুমি আমার – বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প: জীবন একটা আশ্চর্য গল্পের নাম। কখনো সুখ আবার কখনো পাহাড় ভরা কষ্ট। এমনি একটি কষ্ট মিষ্টি ভালোবাসার গল্প পড়ি চলুন।

পর্ব-১

মাহিম তার সামনে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠলো। কেনোনা এই মেয়েটিকেই সে ৩ বছর আগে সবার সামনে ঘটা করে অপমান করেছিলো। এমনকি শাড়ি তে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো যাতে সে সবার সামনে শাড়ি খুলতে বাধ্য হয়।

মাহিমের হাত পা কাঁপছে। এই শীতের দিনেও সে ঘামছে। গত ৩ বছর ধরে যাকে পাগলের মতো খুঁজেছে আজ তাকে সামনে পেয়েও কেমন যেনো ভয় লাগছে। কিভাবে মুখোমুখি হবে ভেবে পাচ্ছেনা সে।

মেয়েটি এখনো বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে বিধায় মাহিমকে দেখতে পাচ্ছেনা।

মাহিম ভয়ে ভয়ে শ্রাবণী বলে ডাক দিলো। নাহ মেয়েটা সাড়া দিচ্ছে না। সে এবার একটু জোরেই শ্রাবণী বলে ডেকে উঠলো। একটু বেশিই জোরে হয়ে গেলো। কেনোনা শ্রাবণী তো তাকালই সাথে সাথে ট্রেনে বসা তার আশেপাশের মানুষ ও অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“শ্রাবণী তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো?”
মেয়েটি কোনো জবাব দিলোনা। শুধু এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে মাহিমের দিকে।

“আমি তোমাকে গত ৩ টি বছর ধরে কত খুঁজেছি। তুমি কোথায় চলে ছিলে?”
মেয়েটির চোখে মুখে ক্ষোভ ফুটে উঠেছে। কি যেনো একটা ভেবে মেয়েটি উত্তর দিলো,

“বাহ শ্রাবণী নামটা তো বেশ মনে আছে আপনার। তা আমাকে খুঁজার কারণ কি?একবার অপমান করে কি শখ মিটে নি?” খুব রাগি গলায় বললো শ্রাবণী।
মাহিম নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। খুব লজ্জা লাগছে তার। অবশ্য লাগাটাই স্বাভাবিক। ৩ বছর আগে যে জঘন্য কাজটাই না সে করেছিলো।

“শ্রাবণী আমাকে একটা বার সুযোগ দাও। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।”

শ্রাবণী কিছু বললো না। কেননা আশেপাশের মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে যা তার একদম পছন্দ হচ্ছে না। সে আবার বই পড়ায় মন দিলো।

মাহিম বুঝতে পারলো কিছু বলে লাভ হবেনা। শ্রাবণী তার উপর খুব রেগে আছে। রাগাটাই স্বাভাবিক।

৩ বছর আগে,

তখন মাহিম অনার্স ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। বাবা মায়ের অঢেল ধনসম্পদ। ভাব ই আলাদা ছিলো। এক নামে সবাই চিনতো। কত মেয়ে যে তার জন্য পাগল ছিলো। মাহিমের বাঁকা দাঁতের হাসিতে সব মেয়ে পাগল হয়ে যেতো। আর তার মিষ্টি মিষ্টি কথায় যে কেউ ফেসে যেতো।

তার এই হাসিতেই পাগল হয় শ্রাবণী। শ্রাবণী তখন কেবল ভার্সিটি ভর্তি হয়। প্রথম দেখায়ই তার ভালো লেগে যায় মাহিম কে। শ্রাবণী বেশ চুপচাপ স্বভাবের ছিলো। আর একটু বোকাও ছিলো। যে কারো কথায় গলে যেতো। মাহিম ও তার সুযোগ নেয়। মিষ্টি মিষ্টি কথায় পটিয়ে ফেলে শ্রাবণীকে। ধীরে ধীরে শ্রাবণীর ফিলিংস মাহিমের জন্য বাড়তে থাকে। একটা টাইমে এমন হয়ে যায় সে মাহিম ছাড়া কিছুই বুঝেনা।
মাহিম এবং মাহিমের বন্ধুরা আড়ালে এটা নিয়ে বেশ মজা নিতো। কিন্তু বোকা শ্রাবণী কিছুই বুঝতোনা।

মাহিমের জন্মদিনের দিন শ্রাবণী নীল শাড়ি পরে মাহিমকে প্রপোজ করে সবার সামনে।
“তুমি কি আমার হবে?”

মাহিম তাকিয়ে বাঁকা একটা হাসি দিলো।

“আমাকে পেতে হলে তোমাকে এখন সবার সামনে এই সুন্দর শাড়িটা খুলতে হবে।” বলেই শ্রাবণীর দিকে এগোতে লাগলো।

শ্রাবণী নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এগুলো কি শুনছে সে। মাহিম তার সাথে এমন কেনো করবে।

“তুমি আমার সাথে মজা করছো তাইনা মাহিম?” ভয়ে ভয়ে বললো শ্রাবণী।
“মজা মাই ফুট। হারি আপ বেবি।” বলেই মাহিম শ্রাবণীর শাড়ির আঁচলে লাইটার দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিলো।

শ্রাবণী তো চিৎকার করছে। কিন্তু কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসছেনা। না চাইতেও তার শাড়ি খুলতে হলো। সে সবার সামনে বসে অঝোরে কাঁদছে।
উপস্থিত কেউ কেউ মজা নিচ্ছে। আবার কারো কারো শ্রাবণীর কান্নার আওয়াজে বুক কেঁপে উঠছে।

মাহিম এতক্ষন খেয়াল না করলেও কেন যেনো শ্রাবণীর কান্না টলারেট করতে পারছেনা সে। তার বুকে চিন চিন ব্যাথা হচ্ছে। সে তার জ্যাকেট টা খুলে শ্রাবণীকে পড়িয়ে দেয়। শ্রাবণী সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে শ্রাবণী আর আসেনি। মাহিম হাজার খুঁজেও আর শ্রাবণীর খোঁজ পায়নি।

আজ এতো বছর পর ট্রেনে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি মাহিম। মাহিম এক ধ্যানে শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে আছে।

শ্রাবণী যে স্টেশনে নেমে গেলো মাহিম ও তার পিছে পিছে ঐ একই স্টেশনে নেমে গেলো। যদিও মাহিমের পরের স্টেশনে নামার কথা ছিলো। মাহিম শ্রাবণীর পিছু পিছু যাচ্ছে।
মাহিমের ফোনে কল এলো,
ওপাশ থেকে..

“আরে গুল্লি মার তোর ক্লাইন্টকে। আমি এখন খুব ই গুরুত্বপূর্ণ কাজে আছি। জানিস আমি ওকে পেয়ে গেছি।” বলেই মাহিম ফোনটা রেখে দিলো।
সে দ্রুত শ্রাবণীর সামনে যেয়ে দাড়ালো।

“প্লিজ আমি একটা বার তোমার সাথে কথা বলতে চাই।”
শ্রাবণী কিছু বলছে না সে তার মতো হেটে চলছে।

হঠাৎ মাহিম শ্রাবণীর হাত ধরে ফেললো। সাথে সাথে শ্রাবণী এক ঝটকায় হাত টা ছাড়িয়ে ফেললো।
“আমি আপনার কেনা সম্পত্তি নই যে যা ইচ্ছা তাই করবেন?”

মাহিম এবার শ্রাবণীর সামনে হাটু গেড়ে বসে পরলো।

“প্লিজ একটা বার।”

শ্রাবণী কি ভেবে যেনো থেমে গেলো।

“আচ্ছা ঠিক আছে আমি আপনার কথা শুনবো এখন উঠুন তো।”

তারা দুজন একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো।

“কি বলবেন বলেন?”
“আমাকে মাফ করে দাও। ঐদিনের জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আমি তোমাকে পাগলের মতো খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। তুমি রিলেটেড কাউকেই আমার চেনা ছিলোনা যে তো ব্যাপারে জানতে পারবো।” মাহিম বললো।

“ভাগ্যিস জানতেন না।”

মাহিম এই কথা আগামাথা কিছুই বুঝলোনা।

“তুমি তো আমাকে তুমি করে বলো। তাহলে আজ কেনো আপনি বলছো?”

শ্রাবণী এই কথার কোনো জবাব দিলোনা।

“তোমার কথা শেষ?”
“তুমি যাওয়ার দুদিন পর আমার মা কার এক্সিডেন্টে মারা যায়। আমার পাপের ফল হয়তোবা আমার মাকে ভোগ করতে হয়েছে।” বলেই কেঁদে ফেললো মাহিম। কেননা তার মা ই তার দুনিয়া ছিলো।

শ্রাবণী তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। কিন্তু মাহিম তা দেখতে পেলো না।

“আমি এখন উঠি।”

“তোমার নাম্বারটা পাওয়া যাবে।”

“০১৯১… আমার নাম্বার।” বলেই শ্রাবণী ওখান থেকে চলে গেলো।
মাহিমের বেশ অদ্ভুত লাগলো ব্যাপারটা। এত সহজেই সে নাম্বারটা পেয়ে যাবে বুঝতে পারেনি।

শ্রাবণী বাসায় এসে সরাসরি রুমে ঢুকে পরলো। আলমারি থেকে সবুজ ডায়েরিটা বের করলো।
ডায়েরিটার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিলো। এই হাসির পিছে অজানা কত রহস্য আছে তা কারো জানা নেই। ডায়েরিটা আবার লকারে রেখে দিলো।

আজ তার এক অদ্ভুত শান্তি লাগছে। বেশ আয়েশ করে সাওয়ার নিলো।

ফ্রিজ থেকে আইস্ক্রিম বের করে খেতে খেতস গুন গুন করে গান গেতে লাগলো। এতো খুশি হতে এর আগে কেউ ওকে দেখেনি।

“মা তোর কি হয়েছে?আজ এতো খুশি?”

“কিছুনা বাবা। এমনি।”

রুমে এসে দেখেলো তার ফোন বাজছে। আননোন নাম্বার। তার বুঝতে বাকি রইলো না কে কল দিয়েছে। সে ফোনটা কেটে দিয়স অফ করে দিলো। তারপর শান্তির এক ঘুম দিলো।
রাতে সে গাড়ো নীল রঙের একটা শাড়ী পরলো। পরে মাহিম কে কল দিলো।
“আমি বাসার ঠিকানা দিচ্ছি তুমি এখনি আধা ঘন্টার মধ্যে আমার বাসার সামনে আসবে।” বলেই ফোন কেটে দিলো শ্রাবণী।

মাহিম তো আকাশ থেকে পড়লো। সে খুশি হবে নাকি কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। তার ফোনে একটি ম্যাসেজ আসলো।

শ্রাবণী ঠিকানা লিখে পাঠিয়েছে। সে সাথে সাথে রওনা হলো শ্রাবণীর বাড়ির উদ্দেশ্যে।
শ্রাবণী ছাদে দাড়িয়ে আছে। আনমনে গুনগুন করে গান গাচ্ছে। মাহিম কে দেখতে পেয়ে তাকে ইশারা করলো ছাদে আসার জন্য।

মাহিম ছাদে আসার পর শ্রাবণীকে ডাক দিলো। শ্রাবণী মাহিমকে দেখে সাথে সাথে জড়িয়ে ধরলো।
মাহিম এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। এতো সুন্দর শাড়ি পড়ার পর ও কেন যেনো মাহিমের ঐ আকর্ষণ টা কাজ করছে না। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগলো মাহিমের।

“আসো আমরা একসাথে আজ আকাশ দেখবো?”

এত পরিবর্তন দেখে মাহিম শক খেলো। কই তার সাথে ঝগড়া করবে তা না উল্টো তাকেই কিনা বলছে..

শ্রাবণীর ডাকে ঘোর কাটলো মাহিমের।

“কিন্তু তুমি যে একবার আমাকে বলেছিলে তোমার আকাশ পছন্দ না?”

এই ৩ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে মাহিম।

শ্রাবণী ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে। মাহিমও তার পাশে এসে দাড়ালো। দুয়ে দুয়ে চার মিলাতে পারছেনা সে। শ্রাবণীর কি আসলেই কোনো রাগ নেই তার উপর। মনে মনে খুশিও হলো সে।

আচমকাই শ্রাবণী মাহিমকে…


পর্ব- ২

আচমকাই শ্রাবণী মাহিম কে তার দিকে ঘুরিয়ে নাক বরাবর একটা ঘুষি দিলো। ঘুষিটা এতো জোরেই ছিলো যে মাহিমের নাক দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে গেলো।

এমন কিছুর জন্য মাহিম মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। সে শ্রাবণীর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। যেই মেয়ে নাকি ওর দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতোনা সে আজ তাকে মারলো।
“তুমি আমাকে মারলে?” মাহিম বললো।

“কেন রে বাবা?তোমার জন্য তো আমি সবার সামনে শাড়ী খুলেছিলাম। আমি তো তোমাকে একটা ঘুষিই দিয়েছি তাও সবার চোখের আড়ালে।” বলেই মুচকি একটা হাসি দিলো।
মাহিম ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে। সে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। তার খুব লজ্জা লাগছে। সে কত জঘন্য কাজ করেছিলো শ্রাবণীর সাথে। সেই তুলনায় এই এটা তো কিছুই না।
“তুমি আমাকে যত ইচ্ছে মারো কিন্তু আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।” শ্রাবণীর হাত ধরে বললো মাহিম।

“আমি তোমাকে মাফ করার কে বলো?” বলেই আকাশের দিকে তাকালো শ্রাবণী। তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু মাহিম তা দেখতে পেলো না।

“তুমি আমাকে মাফ না করলে কে করবে বলো?আমি অনেক অনুতপ্ত আমার কাজের জন্য। আই এম সরি শ্রাবণী।”

শ্রাবণী কিছু বললো না। মাহিমের হাত ধরে দাড়িয়ে রইলো।
এভাবেই কেটে গেলো কিছুক্ষণ। কেউ কোনো কথা বলছে না।

“তুমি এখন বাসায় যাও। অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে।” শ্রাবণী শান্তভাবে বললো।

“তোমাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে নীল শাড়িতে। পুরোই নীল পরী।”

“ঐদিনো কিন্তু আমাকে সুন্দরই লেগেছিলো নীল শাড়িতে কিন্তু আফসোস তোমার চোখে পরেনি।”

শ্রাবণীর কথা শুনে মাহিমের মন টা খারাপ হয়ে গেলো। সে শ্রাবণীর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে,

“আজকের পর থেকে আর কোনোদিন তোমাকে কষ্ট পেতে দিবোনা।” বলেই শ্রাবণীর কপালে চুমু খেলো। আর দেড়ি না করে সেখান থেকে চলে গেলো।

শ্রাবণী এখনো ঠাই দাড়িয়ে আছে। তার হাত পা কাঁপছে। মাহিমের স্পর্শে পুরো শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। এই যন্ত্রনা বয়ে বেড়ানো যে সম্ভব না।

আজ মাহিমের চোখে শ্রাবণীর জন্য শুধু ভালোবাসার প্রকাশ পেয়েছে। চোখ কখনো মিথ্যা বলে না।

শ্রাবণী পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো। গোছালো চুলগুলো সব অগোছালো হয়ে গেলো। পরনে শাড়িটাও আর গোছালো নেই। তার মধ্যে এক চাপা কষ্ট আছে যা কারো জানা নেই।
কিছুক্ষণ পর শ্রাবণী উঠে নিজের রুমে যেয়ে ১ ঘন্টার মতো শাওয়ার নিলো। তারপর বেরিয়ে সেই ডায়েরিটা বের করে বুকে জড়িয়ে বসে রইলো।

এইদিকে মাহিম তো খুশিতে শেষ। হাসতে ভুলে যাওয়া ছেলেটা আজ পুরো বাড়ি মাতিয়ে ফেলেছে। আফজাল সাহেব মাহিমের বাবা এসব দেখে খুশি হবে না অবাক হবে বুঝে উঠতে পারছেনা।

“বাবা আমি ওকে পেয়ে গিয়েছি। তোমার বউমাকে পেয়ে গিয়েছি।”বলেই খুশিতে বাচ্চাদের মতো লাফাতে লাগলো।

ছেলেকে এতো খুশি দেখে আফজাল সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।

” কালই আমরা ঐ মেয়ের বাসায় বিয়ের প্রপোজাল পাঠাবো। মেয়েটাকে আমাকে একটু দেখাতো।”

“না বাবা এখন না পরে। আরে একটু সবুর করো একবারে যেয়েই না হয় তোমার বউমাকে দেখো। আমি আগে ওকে নিজে প্রপোজ করবো তারপর তুমি না হয় ওর বাসায় যেও।” বলেই মাহিম নাচতে নাচতে নিজের রুমে চলে এলো।

আফজাল সাহেব আজ বেশ খুশি। তার একমাত্র ছেলে আজ এতো খুশি। এতগুলো বছর পর তার ছেলেকে সে হাসতে দেখেছে। কেননা মাহিমের মা মারা যাওয়ার পর সে কেমন যেনো হাসতে ভুলে গিয়েছিলো। যেই ছেলেকে এতোদিন বিয়ের কথা বললেই রেগে যেতো সে নাকি আজ নিজ থেকেই বিয়ে করতে চাচ্ছে। আফজাল সাহেব হাসতে হাসতে নিজের রুমে চলে গেলেন।

মাহিম ড্রয়ের খুলে শ্রাবণীর একটা ছবি বের করে হাসতে লাগলো। একদিনেই সে এতো কিছু পেয়ে যাবে নিজেও বুঝেনি। আজ সে শান্তির ঘুম দিবে একটা।

আর এইদিকে শ্রাবণীর ঘুম যেনো কোথায় উধাও হয়ে গেলো। সে চাইলেও ঘুমোতে পারছেনা। ঘুমও যেনো তার সাথে বেইমানি করছে।

এভাবেই বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। মাহিম যেনো শ্রাবণীকে চোখে হারায়। ছোট ছোট সব ব্যাপারেই শ্রাবণীর এতো খেয়াল রাখে। মানে গত ৩ বছরের কষ্ট পুষিয়ে দেয়ার ট্রাই করছে ভালোবাসা দিয়ে। শ্রাবণী দিনকে দিন অবাক হচ্ছে মাহিমের এই বিহেবে। মাহিম কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা তো দূরে থাক তাকায় অব্দি না। সারাদিন শ্রাবণী শ্রাবণী করে। ওর পুরোটা জুড়েই তো শুধু শ্রাবণীর বসবাস।

এভাবে কেটে গেলো ৬ মাস। আর দুদিন পর মাহিমের বার্থডে। শ্রাবণী অনেক কিছু প্ল্যান করেছে মাহিমকে সারপ্রাইজ দেওয়ার। এই সারপ্রাইজ হয়তো মাহিম কোনোদিন ভুলতে পারবেনা।

এইদিকে মাহিম মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে সে ঐদিনই শ্রাবণীকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করবে। তার থেকে বিডে গিফট হিসেবে তাকেই চাবে। সব থেকে স্পেশিয়াল গিফট তো তার জন্য শ্রাবণীই। গত তিন বছর ধরে যাকে পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছে ফাইনালি তাকে বিয়ের জন্য বলবে ভাবতেই খুশি খুশি লাগছে তার।

মাহিমের বিডের আগেরদিন শ্রাবণীর বাসায় পার্সেল আসলো একটা। পার্সেলটা খুলে দেখলো খুব সুন্দর একটা লাল শাড়ি। সাথে একটা চিরকুট।

“আমার দিলবার আমি চাই কাল তুমি এই শাড়িটা পরে আমার বার্থডেতে আসো। আমার লালপরী হয়ে। আই লাভ ইউ শ্রাবণী।”

রিপা চিরকুট টা হাতে নিয়ে মুচকি একটা হাসি দিলো। আনমনেই তার মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো,

“আই লাভ এই টু মাহিম”

সে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলো। শাড়িটা নিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। মাহিমের চয়েজ অনেক ভালো শাড়িটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
পরেরদিন শ্রাবণী খুব সুন্দর করে সাজলো। যে কে দেখেই ফিদা হয়ে যাবে। মাহিম নিজে নিতে আসলো শ্রাবণীকে। একটা রেস্টুরেন্টে খুব সুন্দর আয়োজন করা হয়েছে। মাহিমের ভাব দেখে শ্রাবণীর মনে হচ্চে আজ মাহিমের না তার নিজের বার্থডে। আনমনেই হেসে উঠলো সে।

রেস্টুরেন্টে ঢুকার সাথে সাথে সবাই একসাথে হ্যাপি বার্থডে বলে উইশ করলো মাহিমকে। কেক কাট করা হলো।

“আজ আমি তোমার থেকে কিছু চাবো?তুমি আমাকে দিবে না বলো?”

শ্রাবণী কোনো জবাব দিলো না।

মাহিম হাটু গেড়ে বসে সবার সামনে,

“আমি জানি শ্রাবণী আমি তোমার সাথে অনেক খারাপ করেছি। তুমি আমাকে মাফ করে সারাজীবন আমার সাথে থাকবে?তুমি কি আমার হবে?চলোনা শেষটায় তুমি আমি এক হয়ে যাই।” বলেই মাহিম শ্রাবণীর দিকে চেয়ে রইলো।

শ্রাবণী মুচকি একটা হাসি দিয়ে ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করলো।

মাহিম কিছু বুঝতে পারছেনা।

“দেখোতো ডায়েরিটা চিনো নাকি।” বলেই মাহিমের দিকে ছুড়ে মারলো। ডায়েরিটা মোটা হওয়ায় মাহিমের মাথায় লেগে মাথাটা কেটে গেলো।”

উপস্থিত সবাই হতবম্ভ হয়ে গেলো। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।

মাহিম ডায়েরিটা হাতে নিলো।

খুলতেই সে চমকে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। কিভাবে সম্ভব এটা তার মানে….


পর্ব- ৩

ডায়েরিটা খুলেই প্রথমে ২ টা মেয়ের হাস্যজ্বল ছবি দেখা যাচ্ছে। দেখতে তারা হুবহু একরকম। যমজ হলেও এমন কার্বনকপি খুব কমই দেখা যায়।
মাহিম এটা দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। তার হাত পা কাঁপছে। কেমন যেনো এক অজানা ভয় কাজ করছে।
“তার মানে?” মাহিম কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।

“জি আপনি একদম ঠিক অনুমান করেছেন। আমি শ্রাবণী নই। শ্রাবণীর বোন রিপা। শ্রাবণী কে তো আপনি ৩ বছর আগেই মেরে ফেলেছিলেন।”

মাহিম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

“কি বলছো এইসব?”

“কি বলছি মানে। যেই মেয়ে আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো তাকে কিনা আপনি ভরা মজলিসে ঘটা করে অপমান করেছেন। আপনি এতো নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারলেন?আরে পছন্দ ছিলোনা বলে দিলেই পারতেন?এতোটা অপমান করার কি দরকার ছিলো বলতে পারবেন?”

মাহিম কাঁদছে। কোনো কথা বলছে না।

“জানেন প্রথম ও যেদিন আপনার কথা আমাকে বলে কত খুশি ছিলো। শ্রাবণী আমার সাথে সব শেয়ার করতো। তাই আপনাকে আমি খুব ভালো করেই চিনতাম।

আমার বাবা মা সেপারেশনের পর আমি বাবার সাথে দেশের বাইরে চলে যাই। আর শ্রাবণী মায়ের সাথে এখানে থাকতো। ও খুব চাপা স্বভাবের ছিলো। আপনাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলো। আর আপনি কিনা ওর সাথে ছি।”

মাহিম এবার ডায়েরির পেইজ উল্টালো। যেখানে শ্রাবণী তাকে নিয়ে হাজারো কথা লিখেরেখেছে।

“আপনি যেদিন ওকে অপমান করেছিলেন সেদিনই ও ফ্যানের সাথে ঝুলে সুইসাইড করে। ও যে আপনার জন্য সুইসাইড করে তা আমাকেও বলেনি। মা আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে শ্রাবণী সুইসাইড করেছে। আপনি বুঝতে পারছেন এটা আমাদের জন্য কতটা কষ্টের ছিলো?”

রিপা এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা। মাহিমকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো আর কাঁদতে লাগলো।

“আপনার জন্য আমি আমার বোনকে হারিয়েছি। আপনার জন্য আমার মা আজ মেন্টাল হসপিটালে। সে শ্রাবণীর সুইসাইড মেনে নিতে পারেনি। এখনো তার ট্রিটমেন্ট চলছে। আপনি আমাদের জীবিত মেরে ফেলেছেন এমন কেনো করলেন বলেন কেনো করলেন?”

“শ্রাবণী মারা যাওয়ার ১ বছরের মাথায় আমি আর বাবা দেশে আসি। বোনের রুম থেকে ডায়েরিটা পেয়ে আমি সব বুঝতে পারি। আমার প্রথমেই আপনাকে সন্দেহ হয়েছিলো। কিন্তু শ্রাবণী ডায়েরিতে লিখে গিয়েছলো যাতে আপনাকে কোনোরকম ঝামেলায় না ফেলা হয় ওর মৃত্যুর জন্য। কিন্তু ও তো আমার বোন ছিলো, আমি কিভাবে আপনাকে ছেড়ে দেই। তাইতো নিজে নিজে প্রতিজ্ঞা করি যেদিন আপনি নিজ থেকে আমাকে ধরা দিবেন আমি আপনাকে ছাড়বোনা। আর আজকে ঐদিন এসে গিয়েছে। আজ আপনি কাঁদছেন আর আমি দেখছি। এখানের উপস্থিত সবাই দেখছে। আপনার এই ফেইসের পিছে যে কতটা কুৎসিত ফেইস লুকিয়ে আছে তা আজকে সবার সামনে এসেছে।”
মাহিম রিপার পা ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।

“আমি বুঝতে পারিনি ও নিজেকে শেষ করে দিবে। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ওকে অনেক খুঁজেছিলাম বিশ্বাস করো। আমাকে এতো বড় শাস্তি দিও না।”

রিপা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,

“শাস্তি ঐটা আমি দেওয়ার কে আপনাকে। আপনি তো শ্রাবণীকে ভালোবেসেছেন আমাকে না। সে তো অনেক আগেই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে। নাহ সরি আপনি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনার চোখে আমি ওর জন্য ভালোবাসা দেখেছি। আর এই ভালোবাসার আগুনেই আপনি জ্বলে পুড়ে মরবেন।”

বলেই রিপা সেখান থেকে উঠতে নিলে মাহিম ওর হাত ধরে ফেলে।

“আমার ভালোবাসা না হয় শ্রাবণীর জন্য কিন্তু তোমার ভালোবাসা কার জন্য?আমি তোমার চোখে যে আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি ঐটা মিথ্যে হতে পারেনা। এই ভালোবাসা তো আর ১দিনে তৈরি হয়নি। যেদিন তুমি আমাকে প্রথম ছাদে ডেকেছিলে ঐদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাস। তাহলে এটার মানে কি?”

রিপার বুকটা ধক করে উঠলো। সে হাত ছাড়িয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলো।

১ বছর পর। আজ রিপার বিয়ে। পুরো বাড়িতে হৈচৈ বেজে গিয়েছে।

রিপার বাবা তার মেয়ের রুমে এসে,

“মা তুই খুশিতো এই বিয়েতে?তো কোনো আপত্তি নেই তো। তোকে দেখে খুশি কেন মনে হচ্ছে না। তোর মা পুরোপুরি সুস্থ থাকলে আজ হয়তো সব আরো সুন্দর হতো। আমার এক মেয়েকে হাড়িয়েছি আমি। আরেক মেয়ে কষ্ট পেলে তা আমি মেনে নিতে পারবো না।” আফজাল সাহেব চশমা খুলে নিজের চোখ মুছলেন।”

“না বাবা আমি অনেক খুশি। তোমাকে ছেড়ে যাবো তো তাই একটু মন খারাপ।”

এর মধ্যে বর এসে গিয়েছে শুনে রিপার বাবা বাইরে চলে গেলেন বর কে বরণ করতে।

রিপার মনে যে এক চাপা কষ্ট আছে তার হয়তোবা কেউ কোনোদিন জানবে না। ১ বছর আগে সে তার বোনের হয়ে প্রতিশোধ নিলেও নিজের কাছে হেরে গিয়েছে সে।
ঐদিনের পর থেকে রিপা মাহিমের কোনো প্রকার খোঁজ নেয়নি। খোঁজ নিয়ে আর কি ই বা হবে। এসব ভাবতে ভাবতে রিপার ডাক পরলো।

৩ বার কবুল পড়ে রিপার বিয়ে হয়ে গেলো। কিন্তু তার মনের সেই চিন চিন ব্যাথা কোনোভাবেই কমছে না।

বাসর ঘরে বসে আছে রিপা। তুরাগের সাথে তার পরিচয় অদ্ভুত ভাবে। ছেলেটা বেশ ভালো। তাকে অনেক ভালোবাসে। এইসব ভাবতে ভাবতে রুমে দরজা লাগানোর আওয়াজ এলো। রিপা তাকিয়ে দেখলো তুরাগ এসেছে। কিন্তু আজব ব্যাপার তুরাগ রুমে ঢুকেই সোজা বারান্দায় চলে গেলো। রিপার দিকে একবার তাকালো ও না।

তুরাগ সিগারেট ধরালো। কি যেনো ভাবছে সে, দেখে বুঝা যাচ্ছে না।

রিপার রাগ এবার আসমানে উঠে গেলো। কেননা তার সিগারেট পছন্দ না তা খুব ভালো করেই জানে তুরাগ। রিপা উঠে যেয়ে তুরাগের পিছে যেয়ে দাড়ালো।

“আই তুমি জানোনা আমি সিগারেট পছন্দ করিনা।”

তুরাগ রিপার দিকে ঘুরে ঠাস করে থাপ্পর লাগিয়ে দিলো।

“আমার ডিভোর্স চাই।”

পর্ব-৪

“আমার ডিভোর্স চাই”।

এই কথাটা রিপার কোনোভাবেই হজম হচ্ছেনা। সে বুঝতেও পারছেনা তুরাগ তার সাথে এমনটা কেন করছে।

” তুমি এসব কি বলছো তুরাগ?আমি জানি তোমার মজা করার স্বভাব আছে তাই বলে এতো জঘন্য মজা করবে?” রিপা খুব রেগে কথাটা বললো।
তুরাগের চোখ লাল হয়ে আছে রাগে।

“তোমার কি মনে হয় আমি তোমার সাথে মজা করছি?তোমার কি আমাকে জোকার লাগে?আর এতো ইনোসেন্ট সাজার কোনো মানে নেই। তুমি যে কতটা নাটক করতে পারো তা আমার খুব ভালো করে জানা আছে। তোমাদের মতো মেয়েরা পারে শুধু ছেলেদের ফাঁসিয়ে প্রেমের অভিনয় করতে।”

রিপা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এসব কি বলছে সে।

“তুমি কি বলতে চাইছো?”

“তুমি বুঝতে পারছোনা?১ বছর আগে কি করেছিলে তোমার মনে নেই?”

“তারমানে তুমি!!”
“জি ১ বছর আগে যার সাথে তুমি প্রেমের নাটক করে তাকে মৃত্যুর মুখে ঢেলে দিয়েছিলে সে আমার খালাতো ভাই মাহিম।”

এটা শুনার পর রিপা হা করে তাকিয়ে আছে। এবার সে দুয়ে দুয়ে চার মিলাতে পারছে।
তুরাগ রিপাকে টানতে টানতে একটি রুমে গিয়ে ফেলে দিলো।

রিপা চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো তার আর মাহিমের অনেক ছবি দেয়াল জুড়ে। বেশিরভাগই রিপার সিঙ্গেল ছবি। মাহিম এগুলা কখন তুলেছে জানা নেই তার।
ঘরের এক কোণায় চোখ পড়তেই দেখলো একটি লোক বসে আছে চোখ বন্ধ করে। চুল বড় বড়। উষ্কখুষ্ক দাড়ি। মনে হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে তার যত্ন নেওয়া হয়না। রিপা ভালো করে খেয়াল করে দেখলো এটা মাহিম।

রিপার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহিমের এই অবস্থা দেখে। সে তাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু এতো কঠিন শাস্তি পাবে এটা কোনোদিনো ভাবেনি রিপা।

মাহিম রিপাকে দেখেই দৌড়ে আসলো।

“আমাকে শ্রাবণীকে এনে দাও। তুমি তো জানো আমি শ্রাবণীকে কত ভালোবাসি। ও আমার সাথে এমন কেন করলো বলো না?আমাকে শ্রাবণীর কাছে নিয়ে যাও না।”

এগুলো বলেই মাহিম কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষন পর আবার আচমকা হাসতে লাগলো পুরো বাচ্চাদের মতো।
রিপার খুব মায়া হচ্ছে মাহিমকে দেখে। সে কি ভুল কিছু করে ফেলেছিলো। তখনি তুরাগ রিপাকে টানতে টানতে নিজের রুমে নিয়ে গেলো।

“তুমি কতটা জঘন্য মেয়ে হলে আমার ভাইয়ের মতো ভালো মানুষের সাথে এমনটা করতে পারো। আমার যখন ১২ বছর বয়স তখন আমার বাবা মা মারা যায়। খালা আমাকে এখানে নিয়ে আসে। আপন ছেলের মতো আদর দিয়ে বড় করে। আর মাহিম ভাইয়া তো আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো আদর করতো। আমার আইডল ছিলো মাহিম ভাইয়া। আমি তার জন্য আমার জানটা দিয়ে দিতে পারি। তুমি যখন আমার ভাইয়াকে রিজেক্ট করেছিলে ভালোবাসার অভিনয় করে, তখন কি তোমার একটুও কষ্ট লাগেনি। জানো ভাইয়ার ঐদিন এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। সে পাগলের মতো রাস্তা দিয়ে হাটছিলো।

ভাইয়ার জন্মদিন উপলক্ষে আমি রাজশাহী থেকে এসেছিলাম ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিতে। আর দেখো এসে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম।

ভাইয়ার এক্সিডেন্টের সময় শুধু শ্রাবণী শ্রাবণী করছিলো।

এতটুকু বলেই থেমে গেলো তুরাগ। তার খুব রাগ হচ্ছে।

“আজ চুপ করে আছো কেনো। ঐদিন আমার ভাইকে কষ্ট দেয়ার সময় মনে ছিলো না?”

“যেদিন ভাইয়ার এক্সিডেন্ট হয় ঐদিন ভাইয়ার রুমে যেয়ে তোমার আর ভাইয়ার ছবি দেখতে পাই। তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করি এর মাশুল তোমাকে দিতেই হবে। তারপর প্ল্যান মোতাবেক তোমার সাথে দেখা। এরপর বিয়ে।”

রিপা তুরাগের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুই বলছে না। আসলে কি বলবে তাই বুঝতে পারছে না। এভাবে তার সামনে তার অতীত চলে আসবে বুঝতে পারেনি সে।

“মাহিম ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে খালু স্ট্রোক করে আর তখন থেকেই প্যারালাইসিস হয়ে যায় খালু। তুমি একটা ফ্যামিলিকে ধ্বংস করে দিয়েছো রিপা।”

রিপা কিছু বলছে না দেখে তুরাগের রাগ এবার সপ্তম আসমানে উঠে গেলো।

রিপা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,

“কবে ডিভোর্স লাগবে?”

তুরাগের এমন প্রশ্নে তুরাগ হতভম্ব। মানে এই মেয়ের মধ্যে কি ন্যুনতম গিল্টনেস নেই।

“চিন্তা করোনা। তুমি ডিভোর্স পেয়ে যাবে। যেদিন নিজের ভুল বুঝতে পারবে খুব দেরি যাতে না হয়ে যায়।”

তুরাগ কিছু বললো না। বারান্দায় যেয়ে দাড়িয়ে। আবার সিগারেট ধরালো। কেমন উলোটপালোট হয়ে গেলো তার জীবনটা। রিপাকে সে আগেই দেখেছিলো। দেখেই তার পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো। লাভ এট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে। কিন্তু এই রিপাই যে তার ভাইয়ের জিএফ ছিলো এমনকি তার ভাইয়ের সাথে এতো বড় গেইম খেলেছে ভাবতেই পারেনি সে। তার ভিতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। জীবনে প্রথম কোনোমেয়েকে ভালোবেসেছিলো। আসলেই তার কপাল খারাপ। ছোটবেলা থেকে হারাতে হারাতে বড্ড ক্লান্ত সে।

কিছু একটা ভেবে সে রিপার কাছে যায়।

“তোমার এখানেই থাকতে হবে। তুমি ভাইয়ার সেবা করে ভাইয়াকে সুস্থ করবে। আমার থেকে ভুলেও স্বামীর অধিকার আশা করবে না।”

রিপা কিছু বললো না। আচমকাই তুরাগকে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু তুরাগ রিপাকে ধরছেনা। সে চোখ বন্ধ করে তার মনে বয়ে যাওয়া ঝরকে শান্ত করতে চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পর রিপা নিজ থেকেই তুরাগকে ছেড়ে দিলো। তারপর সে পা বাড়ালো মাহিমের রুমের দিকে।

এটা দেখে তুরাগের ভিতরটা কেমন যেনো দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে কেমন যেনো এক জেলাছি কাজ করছে। সে থাকতে না পেরে সব কিছু ভাংচুর শুরু করলো।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো তুরাগের। তার মনে পরে গেলো কাল রাতের কাহিনি। সে উঠেই রিপাকে খুঁজতে লাগলো। পুরো বাড়ি খুঁজেও রিপাকে পেলো না। হতাশ হয়ে নিজের রুমে ফিরে এলো। টেবিলের উপর একটা কাগজ রাখা। তার ভিতরটা কেমন যেনো হাহাকার করছে। কাগজটা হাতে নিয়ে,

প্রিয় তুরাগ,

তোমার জন্য আমি অপ্রিয় হলেও আমার জন্য কিন্তু তুমি খুব প্রিয়। তুমি নিতান্তই একজন ভালোমানুষ। জানো কাউকে বিশ্বাস করা ভালো কিন্তু অন্ধবিশ্বাস ভালোনা। আমার উচিৎ ছিলো তোমাকে আমার অতীত সম্পর্কে সবটা বলে দেয়া। কিন্তু ঐটা যে বলার মতো কোনো অতীত ছিলোনা। আমি চাইনি আমার বর্তামান আমার অতীত নষ্ট করুক। আর ভাগ্যের কি পরিহাস দেখো তাই হয়েছে। একদিন তুমি তোমার ভুল বুঝতে পারবে। আমি আমার হয়ে কোনো সাফাই গাইবোনা। এভাবে তোমার সাথে থাকাও আমার সম্ভব না। ভালো থেকো। আমাকে খুঁজতে চেষ্টা করবেনা কোনোদিন। সবকিছুর উপরে একটা সত্য আছে সেটা হলো তুমি আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসো। তোমার এই ভালোবাসা নিয়েই আমি কাটিয়ে দিতে। পারবো সারাটা জীবন। কিন্তু তোমার সামনে থাকলে তুমি আমাকে ভালোবাসবে না আমি জানি। তাইতো চলে যাচ্ছি। ভালোবাসাটা না হয় দূর থেকেই থাকুক।

তোমার রিপা।

তুরাগ চিঠিটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলো।

৬বছর পর,

রিপার খুবই মেজাজ খারাপ। সে ট্রেনে আলাদা কেবিন পায়নি। খুবই বিরক্ত লাগছে তার। জানালার কাছে বসে আছে সে। তার অপসিট সিটে একটা পিচ্চি মেয়ে একা বসে আছে। বয়স আর কতই বা হবে ৪-৫। খুব মিষ্টি দেখতে মেয়েটি।

রিপা পিচ্চিটাকে কাছে ডাক দিলো।

“মামনি তোমার নাম কি?

” আমাল নাম প্লিয়।”

রিপা নামটা শুনে চমকে গেলো। তখনি একটা লোকের কন্ঠস্বর শুনা গেলো। শ্রাবণী শ্রাবণী করে ডাকছে।

লোকটা কেবিনে আসতেই শ্রাবণী পাপা পাপা বলে দৌড়ে গেলো।

রিপা খুব ভালোকরে লোকটাকে খেয়াল করলো। সেই পরিচিত মুখ। রিপা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

তখনি তার বয়সি এক মেয়ে এলো শ্রাবণীর কাছে। এসেই শ্রাবণীকে কোলে নিলো।

পর্ব-৫ (শেষ)

রিপা আস্তে করে বলে উঠলো মাহিম।

কিন্তু মাহিমের কান অব্দি পৌঁছালো না। মাহিম রিপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শ্রাবণীর পাশে গিয়ে বসলো।

রিপা খুশি হবে নাকি কষ্ট পাবে বুঝতে পারছে না।

“বাহ বিয়ে করে ভালোই সংসার করছে। অথচ আমার সংসার করা হলোনা।”
রিপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

“পাপা পাপা এই আন্তিতাকে আমি যেনো কোথায় দেখেছি?”

মাহিম মুচকি হাসি দিয়ে,
“না মা কোথাও দেখনি।”

“আত্তা পাপা।”

“ঈষা তুমি একটু শ্রাবণীর সাথে বোসো। আমি আসছি।” বলেই সেখান থেকে চলে গেলো মাহিম।

ঈষা রিপার দিকে তাকিয়ে রইলো। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে রিপাকে।
রিপা ডায়েরি বের করে লিখায় মনোযোগ দিলো।

“আবার আমার অতীত আমার সামনে এসে দাড়ালো। কিন্তু আজ কষ্ট হচ্ছে না। বরং ভালোই লাগছে। মাহিম ওর জীবনের এগিয়ে গিয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই আমার আর শ্রাবণীর পছন্দ একই ছিলো। দেখা যেতো দুজন একই জিনিস পছন্দ করতাম। সবাই মজা করে বলতো আমাদের নাকি যমজ ছেলের কাছে বিয়ে দিবে। তা না হলে একজকে নিয়ে টানাটানি লেগে যাবে। খুব ভালোই চলছিলো সব কিছু। কিন্তু বাবামার বনিবনা হচ্ছিলোনা। একটা সময় তারা কঠিন সিদ্ধান্ত নেন সেপারেশনের। আমাদের দু বোনকে আলাদা হতে হয়। আমি দেশের বাইরে চলে যাই বাবার সাথে আর শ্রাবণী মায়ের সাথে দেশেই থেকে যায়। কি কান্নাটাই না করেছিলাম সেদিন।”
রিপার চোখ থেকে পানির ফোঁটা পরলো ডায়েরির পেইজে। চোখ মুছে আবার লিখা শুরু করলো।

“এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। একদিন শ্রাবণী আমাকে মাহিমের ছবি দেখালো। প্রথম দেখাতেই ক্রাশ খেয়ে যাই আমি। এমন সুন্দর ছেলে দেখে যে কেউই ক্রাশ খাবে। শ্রাবণী আমাকে সব বলতো। দিনে দিনে মাহিমের প্রতি আমার মুগ্ধতা বাড়তে লাগলো। একটা সময় মনে হলো আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু আমার যে কিছুই করার ছিলোনা কারণ শ্রাবণীর জান ছিলো মাহিম। মেয়েটা মাহিম বলতে অজ্ঞান ছিলো। তাই নিজের ভালোলাগাকে মাটিচাপা দিলাম। কিন্তু মনের কষ্ট দিন দিন বাড়তে লাগলো। এরপর মাহিম আমার বোনের সাথে যা করলো এটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা আমি। মাহিমের উপর খুব রাগ হলো। সব থেকে রাগ হলো নিজের উপর। এমন ছেলেকে নাকি আমি পছন্দ করেছিলাম।

৮ বছর আগে যদি মাহিমের সাথে দেখা না হতো তাহলে হয়তোবা আমার জীবনটা এমন ছন্নছাড়া হতো না।”

হঠাৎ মাহিমের আওয়াজ পেয়ে রিপার হাত থেকে কলমটা পড়ে গেলো। হকচকিয়ে গেলো সে।
মাহিম ঠিক তার অপসিটে বসে আছে। পাশেই শ্রাবণী আর তার পাশে ঈষা। বাহ বেশ মানিয়েছে তাদের।
মাহিম কলমটা তুলে রিপার হাতে দিলো। রিপা কলমটা নিয়ে আবার লিখায় মনোযোগ দিলো।

“মাহিমকে দেখে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলাম। আমার বোনের সাথে ও যা করেছে এর দাম তো ওকে দিতেই হবে। কিন্তু আমি নিজেই ফেসে গেলাম। মাহিমের এতো কেয়ারিং এতো লাভ সব কিছুতে আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ছেলেটার মধ্যে অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে আকর্শন করার। তাইতো আমার বোনের আজ এই পরিণতি। দিন যত যেতে লাগলো আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পরলাম। কিন্তু আমাকে তো ভুলে গেলে চলবেন যে ও আমার বোনের খুনি। তাইতো রিভেঞ্জ টা নিয়েই নিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার আমি খুশি হতে পারিনি। কেমন যেনো সব খালি খালি লাগতো। খুব ইচ্ছে করতো ওর সাথে কথা বলতে কিন্তু আমি যে নিরুপায় ছিলাম।

এই ঘটনার একমাস পর ইনভাইটেশন পাইতমার বিয়ের। তমার আমার আর শ্রাবণীর ছোটবেলার বান্ধুবি ছিলো। না চাইতেও বিয়েতে এটেন্ড করা লেগেছে। ওখানে তুরাগ আর ওর ফ্রেন্ডরা আসে ফ্রিতে খাবার খেতে। আমরা বান্ধুবিরা মিলে ধরে ফেলি ওদেরকে। সেদিন কি কান্ডটাইনা ঘটেছিলো। ভেবেই রিপা নিজের অজান্তে হেসে উঠলো।”
মাহিম আড় চোখে দেখছে রিপাকে। হাসির কারণ বুঝতে চেষ্টা করলেও ব্যার্থ হলো।

“তারপর কাকতালিওভাবে আমার শুধু তুরাগর সাথে দেখা হতে থাকে। ছেলেটা আমার জন্য কি পাগ্লামিটাই না করতো। ওর চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম এবার বুঝি সবটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস আবার ঐ একই জায়গায় এনে দাড় করালো আমাকে। তুরাগকে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কেননা মাহিমের স্মৃতি আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াতো। লাভ টা কি হলো আবার সেই মাহিমের সামনে গিয়েই পরলাম।

তুরাগ রিভেঞ্জ নেয়ার জন্য বিয়ে করলেও আমি জানি সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসা কাতর ছিলাম। মাকে সেভাবে কাছে পাইনি যে।

কথায় আছে না তুমি কাকে ভালোবাসো তার থেকেও বেশি জরুরি কে তোমাকে ভালবাসে।

মাহিমের ভালোবাসা ছিলো শ্রাবণী। আমিতো শুধু কিছু দিনের জন্য ওর জায়গাটা নিয়েছিলাম। কিন্তু তুরাগ আমাকে ভালোবাসে। শুধুই আমাকে। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। এটা নিয়েই আমি খুব ভালো আছি। ও আমার সামনে আসলে ওকে প্রত্যাখ্যান করার মতো শক্তি আমার নেই। ভালোবাসা কে ই না চায়। এখন আর মাহিমের জন্য কোনো কষ্ট হয়না এমনকিন কোনো রাগ ও হয়না। সময়ের ব্যাবধানে ভালোবাসাটা কেমন যেনো ফিকে হয়ে গিয়েছে। তাইতো মনে হয় আমি কোনোদিন ওকে ভালোই বাসিনি।”
রিপা ডায়েরিটা অফ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।

শ্রাবণী ঘুমিয়ে গিয়েছে ঈষার কোলে। মাহিম নেই। হয়তো কোথাও গিয়েছে।

“আমার আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।”ঈষা বললো।
” জি আপনি আমাকে বলছেন?”রিপা অবাক হয়ে বললো।

” হ্যা আপনাকেই বলছি। আপনি আর শ্রাবণী আপু হুবহু একই দেখতে?”

এবারতো রিপা বেশ অবাক হলো।

“জি” কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন?

ঈষা মুচকি হাসি দিলো।
“আপনি খুব সুন্দর মাশাল্লাহ। ছবির থেকে সামনাসামনি আপনি বেশি সুন্দর। দেখেই কেমন যেনো এক আকর্শন কাজ করে। যে একবার আপনাদের দুই বোনের প্রেমে পড়বে কোনোদিন ভুলতে পারবে বলে মনে হয়না। আপনি নিজেকে অভাগী ভাবলেও আমি আপনাকে এমনকি শ্রাবণী আপুকে খুব লাকি মনে করি।”

রিপা ঈষার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। রিপা কিছু বলতে যাবে তখনি ঈষার কল এলো। তাই সে কিছু বলতে পারলো না।
রিপা উঠে কেবিন থেকে বাহিরে বেড়িয়ে দেখলো মাহিম ট্রেইনের দরজার কাছে দাড়িয়ে সিগারেট টানছে।

এটা দেখেই রিপার রাগ উঠে গেলো।

“তুমি সিগারেট খাওয়া শুরু করলে কবে থেকে?তোমার বউ কিছু বলেনা?”

মাহিম রিপার দিকে তাকিয়ে রইলো। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,

“আমার কোনো ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ আমি পছন্দ করিনা।”
রিপা মাহিমের কথা শুনে চমকে উঠলো। এতটা রুডভাবে কথা মাহিম কোনোদিনো বলতোনা। মানুষটা অনেক বদলে গিয়েছে। এই ৭ বছরে কত পরিবর্তন তার।

রিপা আর কিছু বললো না। মাহিমের সাথেই দাড়িয়ে রইলো।

“তোমার জন্য যে একজন এতোগুলো বছর ধরে অপেক্ষা করছে তোমার কি ইচ্ছে হয়নি একটাবার তার সাথে যোগাযোগ করতে।”

“ভাগ্যে থাকলে হয়তোবা কোনোদিন তার সাথে যোগাযোগ হবে।”

“খুব ভালোবাসো তুরাগকে?”

“ভালোবাসি নাকি জানিনা। তবে হ্যা এই ৬ বছরে এক সেকেন্ডের জন্যও তার কথা মাথা থেকে ফেলতে পারিনি। হয়তো তার ভালোবাসার শক্তি এতটাই প্রখর ছিলো যে আমি ধরা দিতে বাধ্য হয়েছি।”
মাহিম শুধু হাসলো। আচমকাই রিপাকে জড়িয়ে ধরলো। এতো তাড়াতাড়ি ঘটানাটা ঘটলো যে রিপা কিছুই বুঝতে পারলোনা। কিছুক্ষণ পর ওকে ছেড়ে দিলো।

“তুমি প্লিজ আমার সামনে থেকে যাও।”চিৎকার করে বললো মাহিম।

রিপা এবার ভয় পেয়ে গেলো। তার কেমন যেনো লাগছে সব। তাকে ঈষার থেকেই জানতে হবে সব।

রিপা আবার কেবিনে যেয়ে বসলো। ততক্ষণে শ্রাবণী উঠে পড়েছে। রিপা শ্রাবণীকে ডাক দিয়ে কোলে নিয়ে বসলো।

কিছুক্ষণ পর মাহিম এসে শ্রাবণীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

রিপার খুব রাগ হলো। একটু কোলেই তো নিয়েছিলাম এমন কেন করলো লোকটা।

” আপনাদের বিয়ে হয়েছে কতদিন হলো?” আমতা আমতা করে বললো রিপা।
ঈষা মলিন একটা হাসি দিয়ে,

আই উইশ আমি তার বউ হতে পারতাম। কিন্তু সেই ভাগ্য কি আমার আছে নাকি। জানো আপু গত ৫ টা বছর ধরে আমি তাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি। আমার আব্বু ওনার ট্রিটমেন্ট করছিলো। ওনার যখন মানসিক অবস্থা ঠিক ছিলোনা তখন থেকেই আমার তার প্রতি মায়া জন্মায়। এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করতো তার জন্য। আর ধীরে ধীরে তা ভালোবাসায় রূপ নেয়। এই অব্দি কতবার যে তাকে প্রপোজ করেছি কিন্তু সে প্রতিবার আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাকে ভালোবাসা নাকি তার পক্ষে সম্ভব না। সে কোনোদিন আমাকে ভালোবাসতে পারবেনা।”

এতটুকু বলেই থেমে গেলো ঈষা। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে হুহু করে কেঁদে ফেললো সে।

রিপার অনেক মায়া হচ্ছে তার জন্য। তাহলে মাহিমের বউই বা কে আর শ্রাবণীই বা ওকে পাপা বলে ডাকছে কেনো। ঈষা এমনিতেই কাঁদছে। আর কি জিজ্ঞেস করবে তাকে।
তখনি মাহিম এসে বসলো। কেউ আর কোনো কথা বললোনা। শ্রাবণী একাই বক বক করে গেলো সারা রাস্তা। বাতাসে রিপার চুলগুলো উড়ছে। মাহিম এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে রিপার দিকে। ঈষার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার কি ই বা করার আছে।

ওরা ৪ জন ই কক্সবাজার নামলো।

ঈষা রিপাকে হাগ করলো।

“আপু ভালো থেকো। আর সামনের মাসে আমার বিয়ে তোমাকে কিন্তু অবশ্যই আসতে হবে।”বলেই সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো ঈষা।
রিপা শ্রাবণীকে কোলে নিয়ে আদর করে দিলো। মাহিম শ্রাবণীকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।

রিপার তার বাবার কাছে এসেছে। তার মা ২ বছর হলো মারা গিয়েছে। তারপর থেকে তার বাবা তার চাচাদের সাথেই থাকে। রিপার বাবা দেশের বাহিরে যেতে চাইলেও রিপা রাজি হয়নি।

দুদিন পর,
রিপা সমুদ্রে খালি পায়ে হাটছে। তার বেশ লাগে জায়গাটা। সে এখনো শ্রাবণীকে নিয়ে ভাবছে। হিঠাৎ সে হাতে টান অনুভব করে। নিজেকে সামলাতে না পেরে কারো বুকে যেয়ে পরে। তাকাতেই দেখে তুরাগ। এত বছর পর তুরাগকে দেখে সে কিভাবে রিয়াক্ট করবে বুঝতে পারছে না। তুরাগ রিপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। ছেড়ে দিলে বুঝি চলে যাবে।

” প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও রিপা। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি তোমাকে ভুল বুঝে। আমাকে মাফ করে দাও। আমার থেকে দূরে যেও না।”
রিপাও তুরাগকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই কান্না যে সুখের কান্না।
কিছুক্ষন পর রিপা তুরাগকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে,

“তুমি সত্যিটা জানলে কি করে?”
“তোমার চিঠিটা পড়ার পর থেকে আমার কেমন যেনো খটকা লাগে। কিন্তু অনেক খুঁজেও আমি কিছু পাইনি।”

তুমি যাওয়ার পর থেকে আমার সব কিছু কেমন যেনো উলোটপালোট হয়ে গিয়েছিলো। একা হাতে সব কিছু করা লাগতো। তুমি যাওয়ার ১ বছর পর আমি আমাদের জীবনে আসে শ্রাবণী। ওকে আমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। ওকে দেখে এতো মায়া লেগেছিলো। ওকে যখন বাসায় নিয়ে আসি তখন ওকে দেখার সাথে সাথে ভাইয়া অনেক খুশি হয়ে যায়। তার পর থেকে শুধু শ্রাবণীকে নিয়েই থাকতো। নিজেই ওর নাম শ্রাবণী রাখে। শ্রাবণী আসার পর থেকে ভাইয়া মাঝে অদ্ভুত পরিবর্ত আসে। ধীরে ধীরে সে সুস্থ হতে থাকে। ঈষা এবং আংকেল মানে ভাইয়ার ডক্তর অনেক হেল্প করে। আর ভাইয়াও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যায়। এরপর থেকেই ভাইয়া শ্রাবণীকে নিয়েই আছে। শ্রাবণী ছাড়া সে কিছু বুঝেনা। ভাইয়া সুস্থ হওয়ার পর ভাইয়ার থেকেই আমি সব জানতে পারি। ভাইয়া খুব অনুতপ্ত তুমি প্লিজ ওকে মাফ করে দাও।”

রিপা হা করে তাকিয়ে আছে তুরাগের দিকে। তার মানে শ্রাবণী মাহিমের মেয়ে না।

“তোমাকে আমার খোঁজ নিশ্চই মাহিম দিয়েছে।”
তুরাগ কিছু বললোনা। হাসি দিয়ে রিপাকে আবার জড়িয়ে ধরলো।

“অনেক তো হলো এইসব মান অভিমানে পালা। শেষটায় তুমি আমি এক হয়ে নতুন এক জীবনের রচনা করি।
রিপা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তুরাগকে।

আশেপাশের মানুষ হা করে তাকিয়ে তাদের কান্ড দেখছে। তাদের মধ্যে মাহিমও শামিল হয়েছে। সে এই ভালোবাসার সাক্ষী থাকতে চেয়েছিলো।

“আমি আজো জানিনা আমি শ্রাবণীকে ভালোবাসি নাকি রিপাকে। দুজন আলাদা আলাদা হলেও সত্তা যে একই। আমি যাকেই ভালোবাসি বড্ড বেশি ভালোবাসি। আমার কাছে আমার শ্রাবণী তো আছেই। তাকে নিয়েই না হয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিবো।”

তুরাগ শ্রাবণীকে কোলে নিয়ে কোনো এক অজানা গন্তব্যের দিকে যেতে লাগলো।

সমাপ্তি।

অবশেষে তুমি আমার
লেখিকাঃ তানি তাসরিত

আরো পড়ুন – অন্ধকার বাসর রাত গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *