শুরুতেই শেষ – প্রেমিকার মৃত্যু: লাশ গুলো দেখার পূর্বে নিহাল একজন বয়স্ক লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে। এই বাসার চারজন সদস্যের মধ্যে তিনজনকেই কাল রাতে ডাকাত দল খুন করেছে। একজনকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মূলগল্প
নিহালের হাতে নীল রঙের খাম দিয়ে দৌড়ে পালায় আদিলা। দৌড়ে যাবার পূর্বে মিষ্টি কণ্ঠে নিহালকে বলছিলো আদিলা। পড়বেন কিন্তু?
নিহালকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পালিয়ে যায় আদিলা। নিহাল আদিলাকে ভালো ভাবে চিনেও না, এভাবে অচেনা মেয়ে হঠাৎ সামনে এসে খাম দেওয়াতে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। ‘ প্রেমটেম নিয়ে কিছু লেখা নাই তো?’ নিহাল মনে মনে কথাটা ভেবেই খামটা খুললো এবং পাশেই গাছতলায় বসলো।
নিহাল খাম খুলে একটি কাগজ পায়। কাগজের এপিঠ ওপিঠ উভয় দিকেই লেখা। নিহাল প্রথমেই মুচকি হাসে আর গুনগুন করে বলে উঠে, ‘লেখাটা ভারী সুন্দর’
নিহাল কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে এখন কারো মনের মধ্যে জমে থাকা কথা গুলো সে জানবে। নিহাল পড়তে শুরু করে চিঠিটা।
আমি আফিফা আদিলা। অবাক হচ্ছেন কে আমি? আমি আপনার অজান্তে গড়ে উঠা প্রেয়সী। আপনাকে দেখে প্রতিটা সকাল শুরু হয় আমার। ভাবছেন কীভাবে?
লাল দুতলা বাসাটা আমাদের। আর বেলকনিতে বসে আপনাকে দেখি প্রতিটা সকাল। প্রতিদিন দেখতে দেখতেই আপনার অজান্তে আপনাকে ভালোবেসে ফেলছি। ঠিক যেন ‘হঠাৎ বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেওয়ার মতো আপনি এসেছেন আমার জীবনে।’ দীর্ঘ ১৪ মাস ধরে দেখে আসছি আপনাকে।
প্রথম যেদিন আপনায় দেখি, সেদিন খুব হেসেছিলাম। জানেন কেন? আসলে সেদিন আপনার পরনে সাদা লুঙ্গি ছিলো। সেদিন রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম বেলকনিতে৷ এখানেই শেষ হয়ে যেতো সব। কিন্তু পরের দিন সকালেও আপনি এই রাস্তায়। এভাবে করে ১৪টা মাস কেটে গেলো।
আপনাকে অল্প কিছুক্ষণ দেখতে পেতাম। একটু অল্প অল্প করে দেখেই আপনার প্রেমে পড়ি। জানেনতো চাঁদটাকেও অল্প দেখলে মন ভরে না, দীর্ঘসময় নিয়ে দেখতে হয়। তাহলেই চাঁদের প্রতি ভালোবাসাটা দিগুণ হয়। কিন্তু আপনাকে অল্প অল্প করে দেখে ভীষণ ভাবে আপনাতে হারিয়েছি আমি।
আপনি ছিলেন আমার কাছে একটি ফুল ফোটার মতো, সকালে ফুটতেন আবার বিকেলে ঝরে যেতে।
সকাল ছাড়া আপনাকে দেখিনি, বিকেলে বসে থাকতাম বেলকনিতে। কিন্তু পেতাম না আপনার দেখা। ফুল ঝরলে মাটিতে পাওয়া যেতো, কিন্তু আপনি সকালে ফুটতেন, ঝরতেন না।
আপনার জন্য আজো আমি অপেক্ষায়। জানেন আপনি! আপনার চলে যাওয়া দীর্ঘরাস্তা পর্যন্ত ভিডিও করে রাখতাম। এভাবে প্রতিদিনই চলতো।
অনেক ভেবে দেখলাম, আপনার প্রতি আমার ভালোবাসাটা আপনাকে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাই ভয়কে জয় করে মনে জমে থাকা কথা গুলো এই কাগজে আবদ্ধ করলাম।
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেছে আমি আপনাতে কতোটা মগ্ন? যদিও না বুঝে থাকেন তাহলে পুরো চিঠিটা শেষ পর্যন্ত পড়বেন, তাহলেই বুঝবেন।
আপনি আমার বসন্ত। ১৪ মাসের প্রতিটা দিনই আপনাকে নতুন বসন্তের মতো দেখতাম। আপনি আমার নিজস্ব চাঁদ। আকাশের চাঁদে এতোটা মগ্ন না, আপনাতে যতোটা মগ্ন আমি। আপনি আমার ফুটন্ত গোলাপ।
আপনার নাম জানিনা এখনো আমি। কখনো কথাই তো হয় নি, নাম জানবো কীভাবে! তবুও আপনার একটা নাম দিয়েছি আমি ‘চাঁদ’।
আপনি ছিলেন আমার দিনের আকাশের চাঁদ। আপনাকে দেখার পর থেকে আর রাতের চাঁদ দেখিনি কখনো।
আপনাকে জানার অনেক আগ্রহ। প্রতিদিন এই রাস্তার বুকে হেটে কোথায় হারান? যেখান থেকে দিনে আর ফিরেন না? সব কালকে জানবো আপনার কাছ থেকে।
আজ না হয় আমার মনে জমে থাকা কথা গুলোই বলি।
আসলে লজ্জা বলতে কিছু নাই আমার মধ্যে, তাইতো আপনাকে ভালোবাসি কথাটা লিখে ফেললাম কাগজে।
কিন্তু আমি অনেক লজ্জাবতী। এইযে নিজের মনের কথা গুলো লিখে বলতে হচ্ছে আপনাকে। সামনা সামনি একটা শব্দও বলতে পারতাম না। তাই এই পন্থা অবলম্বন করলাম নিজ মনের কথা জানাতে।
আর জানেন! আপনি যদি চিঠি পড়ে আমায় ভালোবেসে ফেলেন, তাহলে নিশ্চয় আপনি চিঠিটা বুকে জড়িয়ে নিবেন। জড়িয়ে নিবেন আমার অনুভূতি গুলো। এই কথা গুলো মুখে বললে হয়তো কখনো জড়িয়ে নিতে পারতেন না!
আমার বিশ্বাস আপনার জীবনে এখনো কোনো মেয়ে আসেনি। এটাও বিশ্বাস আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না কখনো। আর যদিও ফিরিয়ে দেন তাহলে হারিয়ে যাবো ধানের শীষে জমে থাকা শিশিরের মতো। যদি ফিরিয়ে দেন তাহলে চুপ হয়ে যাবো মৃত নদীর মতো।
তবুও বিশ্বাস আপনিও আমায় ভালোবাসবেন। কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমায় ঠিক ভালোবাসবেন।
আর কিছু লেখার প্রয়োজন মনে করছিনা। কাল তো আবার দেখা হবে। কাল আপনার মুখ থেকে আপনার মনের কথা শুনবো।
ভালোবাসি আপনাকে, খুব ভালোবাসি। আমাতে শুধুই আপনি, শুধুই আপনি, আর কেউ নয়।
আপনার প্রেয়সী।
নিহাল চিঠিটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। নিহাল এর মনে খুশির জোয়ার বইছে। নিহাল কখনো ভাবেনি, তাকে কেউ ভালোবাসবে। নিহাল দেখতে খুব সুন্দর।
যে কোনো মেয়েই তার প্রেমে পড়বে। কিন্তু নিহাল এর মা বাবা কেউ নাই। নিজের আপুর সাথে বিরাট বাসায় থাকে। নিহালের পড়ালেখার খরচ চালাতে গিয়েই বাবা মায়ের সব টাকা শেষ করে দেয় নিহালের আপু।
আদিলার বাসার সামনে চলে যাওয়া রাস্তার বুকে দিয়েই হেটে যায় টিউশনি করতে। আর গভীর রাতে ফিরে। নিহাল আর তার আপুর বাসা ছাড়া আর কিছুই নাই। নিহালের আপুও এখনো বিয়ে করেনি নিজ ভাইয়ের কথা ভেবে।
নিহাল আজ খুব খুশি, এমন মেয়েকে আপন করে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের। তাকে ভেবেই ১৪মাস কাটিয়ে দিয়েছে এই মেয়ে। চোখ বন্ধ করে ভালোবাসা যায় এই মেয়েকে।
নিহাল আজ আর টিউশনিতে যায় নি। এমন খুশির খবর নিজ আপুকে তো জানাতেই হবে।
নিহাল আবার ফিরে বাসার দিকে। লাল বাসার সামনে এসে মুচকি হেসে তাকায়। এই প্রথম মন দিয়ে বাসাকে দেখছে। এর পূর্বেও দেখেছে, লাল রঙ দেখে ভাবতো নিহাল। বাসার রঙ কখনো লাল হয় নাকি?
বাসার ঠিক সামনে আসতেই নিহাল আদিলাকে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। নিহালকে দেখে আদিলা দৌড়ে রুমে ঢুকে যায়। নিহালও লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি হেটে রাস্তা অতিক্রম করে।
আদিলাকে অল্প সময় দেখেও চেহারাটা মনে রাখতে পারেনি। নিহাল ভাবলো, কাল মন ভরে দেখবে।
নিহাল সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। সাথে নিজের আপুকেও ঘুমাতে দেয় নি। সারাক্ষণ আদিলার কথা ভেবেছে। নিহালের আপুও খুব খুশি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বউ করে নিয়ে আসবেন।
নিহাল তার আপুকে একটু পরপরই আদিলার কথা বলছে, কাল কী কী বলবে আদিলাকে। সব নিজের আপুকে বলছে। নিহালের আপু নিহালের মুখে এতোটা হাসি দেখে খুব আনন্দিত।
সকাল ৮টায় নিহাল নিজের আপুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। আদিলাকে বলবে নিজের মনের কথা। আদিলা কেমন খুশি হবে, সেই কথা ভাবতেই নিহালের অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে।
নিহাল যতোটা পথ আগাচ্ছে, ততোটাই ভালোলাগা আবার ভয় কাজ করছে। কীভাবে কথা বলবে। যতোই হোক, অচেনা মেয়ে বলে কথা।
নিহাল লাল বাসার সামনে আসতেই ভিতরটা কেমন জানি নড়েচড়ে উঠলো। বাসায় অনেক মানুষের ভীড়। বাসার গেইটের সামনে গিয়ে অনেক মানুষের ভীড় দেখে ভিতরে যাওয়ার ইচ্ছা হয়। কিন্তু আদিলা যদি ওরে দেখে তাহলে কী ভাববে?
নিহাল অনেক্ষণ বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষ আসছে যাচ্ছে। ভিতরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। নিহাল আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। ভিতরে ঢুকে যায় সে। বাগানে অনেক মানুষ। নিহাল একজনকে জিজ্ঞেস করে, ভাই এখানে কী কোনো অনুষ্ঠান?
নিহালের প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষুণ তাকিয়ে থাকে তারপর লোকটি বলে। ভিতরে গেলেই দেখতে পাবেন।
নিহাল আস্তে আস্তে সামনের দিকে যেতে থাকে। নিহাল সব মানুষের মধ্যে মন খারাপের আভাস দেখতে পাচ্ছে।
নিহাল বাসার ভিতরে ঢুকতেই অবাক হয়ে যায়। সাদা কাপড় দিয়ে তিনটে লাশ ফ্লোরে রাখা। লাশের সামনে পুলিশ সহ অনেক মানুষ। নিহাল এমন দৃশ্য দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। এমন কিছু হবে সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
আস্তে আস্তে হেটে তিনটি লাশের সামনে যায় সে।
লাশ গুলো দেখার পূর্বে নিহাল একজন বয়স্ক লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে। এই বাসার চারজন সদস্যের মধ্যে তিনজনকেই কাল রাতে ডাকাত দল খুন করেছে। একজনকে হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নিহাল এমন কথা শুনে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। নিহাল অনুভব করলো তার শরীর কাঁপছে। আরেকটু সামনে যায় লাশ গুলোর। একজন এক এক করে লাশ গুলোর মুখ দেখাচ্ছে। শেষের লাশটা দেখে কালকের আদিলার মতো লাগে নিহালের কাছে।
বুঝতে সমস্যা হয়নি এটাই আদিলা। আদিলা বলে এক চিৎকার দেয় নিহাল। সাথে সাথেই মাটিতে ঢলে পড়ে নিহাল আদিলার মুখের উপর। নিহাল এর চোখজোড়া বেয়ে পানি পরছে।
পাথর হয়ে জড়িয়ে ধরে আছে আদিলাকে। একজন পুলিশ এসে নিহালকে তুলে ধরে দাঁড় করায়। পুলিশ অফিসার নিহালকে অনেক প্রশ্ন করছে৷ কিন্তু নিহাল কোনো কথাই বলতে পারছে না। শুধু হাত দিয়ে নিজের পকেটের দিকে ইশারা করে।
পুলিশ নিহালের পকেটে হাত দিয়ে আদিলার দেওয়া চিঠিটা পায়। পুলিশ অফিসার চিঠিটা পড়ে কেমন জানি মন খারাপ করে ফেলেন। চোখ বেয়ে পানি পড়লো কয়েক ফোটা।
নিহাল আবারো আদিলাকে জড়িয়ে ধরে। এবার আর নিহাল কান্না করেনি। অজ্ঞান হয়ে যায়।
আদিলা সহ ওর পরিবারের দুজন মরেছে আজ তিনদিন হলো।
নিহালের আপু নিহালের এই অবস্থা দেখতে পারছে না। আদিলার মা কে নিয়ে এসেছে নিহালের আপু নিজের কাছে।
নিহাল চুপ করে রুমের মধ্যে শুয়ে থাকে। খাবার-দাবার সব ছেড়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ আদিলার চিঠিটা জড়িয়ে রাখে বুকে।
নিহালের মুখ দিয়ে একটি কথাই বের হয় শুধু, তাকে একটিবার ভালোবাসি বলতে পারিনি আমি।
নিহালের আপু কোনোভাবেই নিহালকে স্বাভাবিক করতে পারছেন না। নিহাল আর আদিলার শুরুতেই শেষ। আজ হয়তো একটি সুন্দর সম্পর্ক শুরু হতো। কিন্তু সম্পর্কটা শুরুতেই শেষ হয়ে গেলো।
কালকেই নিহালের মুখে হাসি ছিলো। কিন্তু আজ কান্না ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না নিহালের আপু।
লেখক – হানিফ আহমেদ
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “শুরুতেই শেষ – প্রেমিকার মৃত্যু” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – ভুল সংশোধন – মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে