অবশেষে বৃষ্টি (শেষ খণ্ড) – প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা র গল্প: পৃথা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। এতক্ষণ মনের ভেতর যা চলছিল বলেই ফেললো, অবন্তি। বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক করা কি ঠিক? নির্ঝর ভালো ছেলে বুঝলাম।কিন্তু তোদে যে কখনো ব্রেক আপ হবেনা এমন নিশ্চয়তা আছে?
পর্ব ১৭
সকালবেলা আবির কানের কাছে এসে চায়ের কাপে পিরিচ বাজিয়ে টিং টিং শব্দ করছে। ঘুম ভেঙে চোখ মেলে পৃথা তারাহুরো করে উঠে বসে। আবির বলল, গুড মর্নিং। বেড টি এসে গেছে।
পৃথা দেখলো ট্রে তে করে অনেকগুলো চায়ের কাপ নিয়ে যাচ্ছে আবির। ও হেসে বলল, চা বিলি করা দায়িত্ব কি আপনাকে দেয়া হয়েছে?
~ আমি ই নিয়েছি। আমার আম্মুদের হেল্প করতে ভালো লাগে।
~ আম্মুদের বলতে? কতগুলো আম্মু আপনার?
~ হা হা হা। মায়ের বয়সী চাচী খালাদের মিন করছি আরকি। চা টাও কিন্তু আমি বানিয়েছি।
~ তাই নাকি? তাহলে তো খেয়ে দেখতেই হয়।
পৃথা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, উমম অসাধারণ। লোভ লাগিয়ে দিলেন ভাই। এখন থেকে তো আপনার কাছে চা খাওয়ার বায়না ধরবো।
~ তা ধরতে পারেন। আমি আজীবন বানিয়ে খাওয়াতে প্রস্তুত হা হা হা।
~ যে কয়দিন এখানে আছি আরকি।
~ আপনি চাইলেও পরেও খাওয়াতে পারি। মাঝেমাঝে চা খাওয়ার দাওয়াত দিবো বাসায়। আমি আবার কাউকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে বড্ড ভালোবাসি।
~ কাউ মানে তো গরু। আমি ফিমেল ওকে?
~ হা হা হা।
শব্দ করে হাসতে লাগল আবির। অবন্তি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ভালোই তো হাসির মেলা বসেছে দেখছি। এত হাসি কোথায় পেলে?
পৃথা বলল, চায়ের কাপে রে ভাই। তোর ভাই যা চা বানিয়েছে না! এনিওয়ে, থ্যাংকস ফর দ্যা ম্যাজিক্যাল টি।
~ ওয়াও, ম্যাজিক্যাল! তা ম্যাজিকে কি কাজ হয়েছে শুনি?
~ উমমম, আপনার জন্য পাত্রী দেখে দিতে পারি।
~ পাত্রী! ওটা আমি নিজেই জোগাড় করে নিবো ম্যাডাম।
পৃথা আর কিছু বললো না। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। আবির বলল, চুমুতেই শান্তি। আহ!
পৃথা চোখ বড়বড় করে তাকাল। আবির বলল, মানে চায়ের কাপে চুমুতে শান্তি। হা হা হা।
পৃথা প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও পরে হেসে ফেলল। আবির ট্রে হাতে বেরিয়ে গেলো এই ঘর থেকে অন্য ঘরে। অবন্তি বলল, আবির ভাইয়া খুব ভালো মানুষ জানিস? অসহায় মানুষ দেরকে ভীষণ হেল্প করে।
~ তাই”
~ হ্যাঁ। কেউ যদি এসে ওর কাছে সাহায্য চায়, প্রয়োজনে অফিসে না গিয়ে তার কাজ করে দেবে। পকেটে যা থাকবে বের করে দেবে।
~ বাহ! এরকম মানুষ আছে সত্যি!
~ হ্যাঁ। ভাইয়ার আরেকটা ভালো গুণ হচ্ছে ও সব কাজে মাকে হেল্প করে। এই যে চা বানিয়েছে না? দেখবি এখানে বেড়াতে এসেও রুম ঝাড়ু দেবে, মাকে জিজ্ঞেস করবে কোন কাজে হেল্প লাগবে কি না।
পৃথা কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। মনেমনে ভাবল, এরকম একটা মানুষকে ভালো না লেগে উপায় নেই। হুট করে প্রেমে পড়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার তো এখন প্রেমে পড়া বারণ। আগে নিজের স্বপ্ন পূরণ। অতদিন নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকবে নাকি দূরে সরে যাবে সেটা নিয়ে ভয় হয় পৃথার। তবুও নিজেকে শক্ত রাখার প্রচেষ্টা। পাগলামি করলে হবে না।
অবন্তির বড় বোনের সাথেও বেশ ভাব হয়ে গেলো পৃথার। আপু অনেক ভালো মনের আর মিশুক। অবন্তির মত অত বেশি কথা বলে না, তবে গল্প করতে জানে। পৃথার সময় খুব ভালোই যাচ্ছে এখন।
বিকেলে নাচের রিহার্সাল হচ্ছিল। পৃথাকেও নাচের পার্ট দেয়া হয়েছে। প্রথমে সে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। অবন্তি আর ওর বোনের জোরাজুরিতে রাজি হয়েছে। অবন্তি ও পৃথা একসাথে নাচবে। ওদের নাচের প্রাকটিসের মাঝখানে অবন্তি আবির ভাইয়াকে টেনে নিয়ে আসল। বলল ভাইয়াকেও পারফর্ম করতে হবে। ভাইয়া বলছে সে নিজের মত করে নাচবে। পৃথা বলছে, আমাদের কারো সাথে ডুয়েট ডান্স দিতে হবে। চাপে পরে আবির ভাইয়া রাজি হয়ে গেল। আবির ভাইয়া ও অবন্তি একসাথে প্রাকটিস করলো নাচের। নাচ শেষ করে এসে পৃথাকে জিজ্ঞেস করলো,কেমন নাচলাম?
~ নট ব্যাড। ভালোই লাগল।
~ ভালো নাচতে পারবো মনে হচ্ছে?
~ হুম। তবে চায়ের মত ভালো হবে না। হা হা।
~ চা খাওয়ার ধান্ধা নাকি?
~ যদি কষ্ট না হয়, তবে এখন না। সন্ধ্যায়।
~ ওকে। যদি চুলা ফাঁকা পাই আরকি। হা হা।
আবির ভাইয়া রসিক মানুষ। কথায় কথায় হাসিয়ে ছাড়েন আবার নিজেও হাসেন। ওনার মুখটাই হাসি হাসি। পৃথা বলল, আপনি কোথায় থাকেন?
~ চিটাগাং।
~ একা?
~ হুম। মা চেষ্টা করছে খুব শীঘ্রই আমাকে দোকলা বানানোর।
~ আমিও করতে পারি। আরেক কাপ চা খাওয়ালে। ওহ সরি, আপনি তো আবার নিজের পাত্রী নিজেই খুঁজে নেবেন।
~ সেটাই ইচ্ছে। এতদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তারপর প্রাকটিস নিয়ে, তারপর জব নিয়ে। এখন সবকিছু সেটেলড, এবার মন দিয়ে শুধু পাত্রী ই খুঁজবো।
~ বেস্ট অফ লাক। কেমন পাত্রী পছন্দ?
~ হলেই হল একটা।
~ হা হা। হলেই হল?
~ হুম। আবার শুধু বউ দরকার। তবে একটা কথা, আমার বউ যেন আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আর আমি তাকে সবচেয়ে বেশি ভালো রাখবো।
~ বাহ! দেখি খোঁজ করে। আমার পরিচিত ভালো পাত্রী আছে।
~ থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।
আবির হাসছে। #পৃথাও হাসছে। সন্ধ্যাবেলা আবির চা বানিয়ে আনল পৃথার জন্য। এবার বানিয়েছে মালাই চা। চায়ের রংটা দারুণ, আর খেতেও ভীষণ টেস্ট হয়েছে। পৃথা হেসে বলল, আপনি কি চিটাগং ও রান্না করে খান?
~ জ্বি।
~ তাহলে তো আপনার বউ সোনায় সোহাগা।
~ তা তো অবশ্যই। মেয়েরা একজন ভালো ছেলের সাথে একটা ভালো ক্যারিয়ার, ভালো বেতন, ভালো ফ্যামিলি সবই খোঁজে। অথচ মুখে বলে ছেলে ভালো হলেই হল।
~ আপনার তো সবই আছে। ভালো চেহারাও। হা হা।
~ চেহারা?
~ অবশ্যই। আপনি যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। একটা বোন থাকলে দিয়ে দিতাম।
~ ওহ মাই গড! মিস করলাম।
পৃথা চা খেতে খেতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত সুন্দর চা! এমন একটা মানুষ হলে রোজ চা বানিয়ে খাওয়াত, সব কাজে হেল্প করত। কতই না ভালো হত! কিন্তু…
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পৃথা। আবির চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেলো। অন্যান্য ছেলের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক্সট্রা কথা বলার স্বভাব ওর নেই। পৃথা বারবার মুগ্ধ হচ্ছে ওর প্রতি।
রাত্রিবেলা অবন্তি ফোনে কথা বলতে বলতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়ে বসে রইল। পৃথা জানতে চাইল কি সমস্যা? অবন্তি বলল নির্ঝর বাসায় আসতে চাইছে। ওর নাকি ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। এত লোকজনের মধ্যে ওকে কিভাবে নিয়ে আসবো?
~ লোকজনের মধ্যে আসলেই তো কেউ বুঝতে পারবে না। বাইরে দেখা করবি। আর আংকেল আন্টিও এখন ব্যস্ত।
~ ও আমার রুমে আসতে চায়।
~ কেন?
~ বুঝিস না? একটু হাগ করবে না? একটা ছোট্ট কিসি দেবে না?
~ তোদের যা প্রেম রে। আমাকে জ্বালাচ্ছিস না?
~ কি আর করবো বল। ও যখন আমাকে দেখতে চায় আমারও ওকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে।
পৃথা কিছুক্ষণ ভেবে বলল ওকে আসতে বল। আমি পাহারা দেবো। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না, বড়জোর দশ মিনিট।
~ ওকে ওকে। থ্যাংক ইউ রে। ওকে এক্ষুনি বলছি।
অবন্তি আনন্দে উচ্ছল। পৃথার দেখতে ভালো লাগছে। একটা মানুষ প্রিয়জনকে দেখার জন্য, একবার জড়িয়ে ধরার জন্য কত ব্যকুল হতে পারে। হায়রে প্রেম!
নির্ঝরের সাথে পরিচিত হল পৃথা। তারপর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল ওদেরকে রুমে রেখে। বন্ধু হয়ে এইটুকু দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। দশ মিনিটের জায়গায় বিশ মিনিট পেরিয়ে গেলো, এখনও দরজা খোলার নাম নেই। কেউ রুমের দিকে আসলে পৃথা বলে, অবন্তি চেঞ্জ করছে। ভেতরে যাওয়া যাবে না। এভাবেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছে ও।
নির্ঝর চলে গেলে পৃথা রুমে দেখে অবন্তি কে কেমন যেন দেখাচ্ছে। ও অবাক হয়ে বলল, ইউ লুক ডিফারেন্ট।
~ ও আমাকে অনেক আদর করেছে।
~ কিরকম?
~ অ… নে…ক।
অবন্তি বালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো। পৃথার কেমন যেন লাগছে। ও ছাদে চলে গেলো। কিছুক্ষণ মশার কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল। খানিক হাঁটাহাঁটি করল। মন খারাপ লাগছে। কেন যে লাগছে নিজেও বুঝতে পারছে না। কি হল হঠাৎ করে!
আবির ভাইয়া হঠাৎ এসে জিজ্ঞেস করলো, কিছু হয়েছে?
~ না তো।
~ একা দাঁড়িয়ে?
~ এমনি।
~ অবন্তি বলল আপনি ছাদে তাই এলাম। এই নিন চা।
~ আবারো বানিয়েছেন? আপনি তো মশাই নেশা ধরিয়ে দেবেন।
~ হা হা।
চা খাওয়ার পর আবির কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেলো। পৃথা অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। এতক্ষণ ভালো লাগলেও এখন আর ভালো লাগছে না। আবারও মন খারাপটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কেন এমন হচ্ছে কে জানে!
রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে পরল বিছানায়। অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, কি রে এতক্ষণ ছাদে ছিলি যে?
~ এমনি।
অবন্তি নানান কথা বলার চেষ্টা করল। শুনতে ভালো লাগছে না পৃথার। ও নিশ্চুপ হয়ে রইলো। অবন্তি অনেক্ষণ পর বুঝতে পেরে বলল, তোর কি মন খারাপ?
~ না রে।
~ এমন লাগছে কেন? এত চুপচাপ? কি হয়েছে বলতো?
~ কিছু না।
অবন্তি পৃথার হাত ধরলে পৃথা ওকে জড়িয়ে ধরলো। পৃথাকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। অবন্তি আবার জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোর?
~ তোকে একটা কথা বলবো মন খারাপ করবি না তো?
~ না। বল?
~ তোরা কি আজকে সেক্স করেছিস?
অবন্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, হ্যাঁ। অল্প কিছু সময়। নির্ঝর থাকতে পারছিল না তাই ছুটে এসেছে।
~ কিন্তু..
~ কি?
পৃথা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। এতক্ষণ মনের ভেতর যা চলছিল বলেই ফেললো, অবন্তি। বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক করা কি ঠিক? নির্ঝর ভালো ছেলে বুঝলাম।কিন্তু তোদে যে কখনো ব্রেক আপ হবেনা এমন নিশ্চয়তা আছে? কিংবা ও যে তোকেই বিয়ে করবে এমন গ্যারান্টি কে দেবে? এভাবে নিজেকে ধীরেধীরে শেষ করে দিচ্ছিস না? যদি কখনো তোরা আলাদা হয়ে যাস, পারবি অন্য কাউকে বিয়ে করতে? পারবি কাউকে তোর শরীরের সাথে মিশতে দিতে? পারবি না। সবসময় নির্ঝরের শরীরেও গন্ধ, স্বাদ তোকে তাড়া করে বেড়াবে। ধুকে ধুকে মরবি। এসব আর করিস না প্লিজ। আমার ভালো লাগছে না ব্যাপারটা।
অবন্তি কথা বলছে না। শান্ত হয়ে আছে। অন্ধকার রুমে পৃথা দেখতে পারছে না। দেখতে পারছে না সেই অদ্ভুত দৃশ্য, অবন্তির টলমলে চোখ।
পর্ব ১৮
পৃথা অবন্তিকে জড়িয়ে ধরে বললো, ভালোবাসা মানে পাশে থাকা, একজন আরেকজনের আত্মার সাথে মিশে যাওয়া। যে ছেলে থাকতে পারেনা বলে প্রেমিকার বাসায় এসে শারীরিক চাহিদা মেটায় সেটাকে কেমন ভালোবাসা বলে? আমি জানি তোর শুনতে খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাই কঠিন বাস্তবতা অবন্তি। প্লিজ একবার বিবেক দিয়ে ভেবে দ্যাখ। নির্ঝর তোকে আসলেই কতটা ফিল করে? কতটা চায় ও তোকে? বিয়ের প্রেশার আসলে কি পালিয়ে যাবে নাকি বিয়ে করবে?
অবন্তি বলল, ও বিয়ে করবে আমাকে। ও অনেক ভালো রে।
~ আমি জানিনা কেমন ভালো। যদি বিয়ে করতে অসম্মতি জানায়। বা মনটা কখনো চেঞ্জ হয়ে যায়। তখন তুই কি করবি? এভাবে লাইফ টাকে শেষ করে দিস না।
অবন্তি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, আমি চেষ্টা করবো। আর যেন এরকম না হয়।
~ থ্যাংক ইউ অবন্তি। আমি তোকে খুব ভালোবাসি তাই তোর ভালোর জন্যই বললাম। যেটা ভালো লাগেনা সেটাকে জোর করে ভালো লাগাতে পারিনা আমি। তোর কাছে এসব শুনে আমার খুব খারাপ লাগছিল।
~ বুঝতে পারছি। এজন্যই তোর মন খারাপ সেই তখন থেকে। আর এমন করবো না লক্ষিটি। আর মন খারাপ করিস না।
অবন্তিকে জাপটে ধরে পৃথা। তারপর সুখের গল্প করতে লাগল। রাত যত গভীর হতে লাগল, দুজনের গল্পও তত মধুর হয়ে জমতে লাগল৷ ঘড়ির কাটায় দুটো বাজলে ঘুমিয়ে পড়ল দুজনে।
পরেরদিন যথারীতি চায়ের কাপে টুংটাং আওয়াজ করে পৃথার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো আবির। পৃথা চোখ মেলতে মেলতে ধড়মড় করে উঠে বসল। আবির হেসে বলক, সুপ্রভাত।
~ আজকেও হাজির হয়েছেন?
~ হ্যাঁ। এই নিন আপনার বেড টি। গরম গরম পান করে নিন। আমি আসছি।
বাড়ির মেহমান বেড়ে গেছে। লোকে গিজগিজ করছে আজ। আজকে নাচের ফাইনাল প্রাকটিস করা হবে। নাচের সময় আবির পৃথাকে জিজ্ঞেস করলো, আমার সাথে নাচতে আপত্তি আছে আপনার?
পৃথা কোনো উত্তর দিলো না। আবির আর কিছু বলল না ওকে।
রাত্রিবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছে পৃথা। আবির এসে চায়ের কাপ হাতে দিয়ে বলল, নিন খান। পৃথা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আজকের রাতটা অনেক সুন্দর তাইনা?
~ হ্যাঁ। রাত আমার অনেক ভালোলাগে। উপভোগ করুন, রাতের একটা মোহময়ী সৌন্দর্য আছে।
~ আপনি বই পড়তে পছন্দ করেন?
~ আমার প্যাশন। স্টাডি লাইফ তো বই নিয়েই কেটেছে।
~ তাই নাকি?
~ হ্যাঁ।
~ আজকের চায়ে চিনি বেশি কেন?
~ হয়তো আজকে মায়াটা বেশি পরে গেছে।
~ মানে?
আবির মুচকি হাসলো। পৃথা চা শেষ করে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলো, আবির চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে কাছে এসে বলল, আপনার ঘুমন্ত চেহারাটা খুব বেশি মায়াবী। ঘুম ভাঙাতেই ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল এ ঘুম ভাঙালে পাপ হবে আমার। এই মায়াবী মুখের দিকে চেয়ে একটা জীবন পার করে দেয়া যায়।
পৃথা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। আবির কাপ হাতে চলে গেলো ছাদ থেকে। ছেলেটা প্রেমে পড়ে যাচ্ছে না তো? এই ভয়টাই তো পাচ্ছিল পৃথা। আবার যদি প্রপোজ করে বসে! এরকম একজন মানুষ কে এড়িয়ে যাওয়াটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। যে কেউ রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু না, পৃথাকে এত সহজে ভাংলে চলবে না। মজবুত হতে হবে, অনেক মজবুত।
আজ গায়ে হলুদ। মেয়েরা সবাই হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। শাড়ি আর গাদা ফুলের রঙে সকলেই রাঙা। নাচে,গানে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিয়ে বাড়ি। পৃথা আবিরের চোখের দিকে ভুল করেও তাকাচ্ছে না। কয়েকবার আবির সামনে এসে ঘুরঘুর করছিল। সেদিকে পাত্তা দিচ্ছিল না পৃথা।
গায়ে হলুদের রাতে সবাই যখন ক্লান্ত। যে যার মত বিশ্রাম নিচ্ছে। পৃথা বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে একটা ছেলের সাথে প্রচুর হাসছে আর হাত ধরে রেখেছে। আহা কি প্রেম! চারিদিকে শুধু প্রেম আর প্রেম।
বেলকুনি থেকে পিছন ফিরেছে এমন সময় মুখোমুখি আবির এসে দাঁড়াল। না চাইতেও চোখাচোখি হয়ে গেলো আবিরের সাথে। এত কাছ থেকে কারো চোখের দিকে তাকায়নি পৃথা। এমনকি সায়ানের দিকেও না। পৃথার বুক ঢিপঢিপ করতে শুরু করলো। আবির বলল, আপনাকে আজকে ভীষণ সুন্দর লাগছিল। মায়াপরির মত।
~ এটা বলার জন্য এখানে এসেছেন?
~ না। মানে খুঁজছিলাম, পাচ্ছিলাম না আরকি।
~ ওহ আচ্ছা। কেন খুঁজছিলেন?
~ এমনি।
পৃথা হেসে বলল, এবার তাহলে যান।
~ যেতেই হবে?
~ থাকার কোনো অপশন নেই।
~ অপশন তৈরি করতে চাইলে কি আমার পাপ হবে?
~ হতেও পারে।
~ পার্মানেন্ট অপশন যদি তৈরি করতে চাই?
~ চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আগেভাগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
পরেরদিন সকাল থেকে সকলে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। পৃথাও জামাকাপড় সবকিছু গুছিয়ে রাখছিল। এমন সময় এক মেয়ে এসে বলল তার মা ডাকছে। পৃথা বাইরে এসে দেখে একজন মায়ের বয়সী মহিলা। ও সালাম দিয়ে হাসিমুখে জানতে চাইলো, বলুন?
~ আমার পাশে বসো মা।
পৃথা মহিলার পাশে বসে পড়লো। উনি পৃথার হাত ধরে বললেন,তোমার নাম কি মা?
~ পৃথা।
~ আমি আবিরের মা। আবিরকে চেনো?
~ জ্বি আন্টি। আবির ভাইয়া।
~ হ্যাঁ। আমার ছেলেটা ভীষণ ভালো ছেলে রে মা। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। সব ক্লাসে বৃত্তি পেয়েছে। কখনো কোনো মেয়ে সংক্রান্ত ঝামেলা ওর নেই। আমাকে সবসময় হেল্প করে। সব কাজে।
~ শুনেছি আন্টি।
~ তাহলে তো হলোই। স্যালারি পাচ্ছে আশি হাজার টাকা। নতুন জয়েন করেছে তো। তো মা, আমার ছেলেটা তোমাকে পছন্দ করেছে মাশাল্লাহ। কখনো মুখ ফুটে বলেনি কাউকে এসব কথা। তোমাকে প্রথম ভালো লেগেছে। তোমার যদি ওকে ভালোলাগে তাহলে বিয়ের ব্যাপারে আমি কথা বলতে চাই। তুমি কি এটা নিয়ে ভাব্বে?
পৃথা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আন্টি বললেন, তোমার সমস্যা থাকলে বলতে পারো৷ তবে সবকিছুর আগে আমার ছেলেটার সাথে কথা বলো, মিশে দেখো।
~ আন্টি আমি এখন কোনোভাবেই বিয়ে করবো না। আমার স্বপ্ন আছে, লক্ষ্য আছে। আগে স্বপ্ন পূরণ করবো তারপর সবকিছু আন্টি।
~ ভেবে দেখো মা।
~ আচ্ছা ভাব্বো। আসি আন্টি।
পৃথা অবন্তির রুমে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে রইলো। মানব মন এত বিচিত্র কেন! অকারণে মন খারাপ লাগছে। এ মন খারাপের কি কোনো মানে হয়!
বিয়ের প্রোগ্রাম থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলো। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ামাত্র ঘুমে ঢলে পড়েছে পৃথা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখে অবন্তি গভীর ঘুমে মগ্ন। ও উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর অবন্তিকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। চোখ কচলে অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে?
~ সকালে যদি আবির ভাইয়া চা নিয়ে আসে রুমে ঢুকতে দিবি না৷ দরজা খুলে বলে দিবি পৃথা চা খাবে না।
~ এটা বলার জন্য ঘুম ভাঙালি?
~ মনে অশান্তি নিয়ে আমি ঘুমাতে পারি না।
~ আজব!
পৃথা উল্টা পাশ হয়ে শুয়ে গেলো। ঘুমিয়েও পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। পরদিন সকালের নাস্তা করেই পৃথা বাসায় ফিরে এলো। বৌভাতে যাওয়ার আর কোনো প্রশ্নই আসে না।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। পৃথা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। প্রস্তুতি নিচ্ছে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। দু একদিনের মধ্যেই হয়তো চলে যাবে। হঠাৎ অবন্তির নাম্বার থেকে কল। পৃথা রিসিভ করে বলল, ফুচকা না খেলে তোর চলে না সে আমার জানা আছে। নিশ্চয় বলবি বাইরে যেতে? আমি ব্যাগ গুছাচ্ছি। যেতে পারবো না বাবু।
~ পৃথা..
কেঁদে ফেলল অবন্তি। অবাক হয়ে পৃথা জানতে চাইলো, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন তুই?
~ নির্ঝর আমার সাথে ব্রেকাপ করে দিয়েছে।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অবন্তি। পৃথা ওর কান্নার শব্দ সহ্য করতে পারছে না। ফোন রেখে দ্রুত অবন্তিদের বাসায় চলে এলো ও। অবন্তি পৃথাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত কাঁদতে লাগল।
পৃথা জানতে চাইছে কিভাবে এটা হল? অবন্তি কান্নার জন্য কিছু বলতেও পারছে না। তবে এতটুকু বলল যে নির্ঝরের অন্য একটা মেয়ের সাথে রিলেশন ছিল। সেই মেয়েটাকেই বিয়ে করেছে ও। গত দুদিন আগে বিয়ে হয়েছে। অবন্তির সাথে দুদিন ধরে যোগাযোগ নেই। অনেক চেষ্টার পর এ জানতে পারে নির্ঝর বিয়ে করেছে। হাত পা ছুঁড়ে কাঁদছে অবন্তি। পৃথা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তোকে আগেই বলেছিলাম। এই ভয়টা অনেক আগে থেকে পাচ্ছিলাম আমি।
~ আমার এখন কি হবে? কি করে বাঁচবো আমি? আমি মরে যাবো। মরে যাবো।
~ একটা ঠকবাজের জন্য কেন মরে যাবি?
~ ও ঠকবাজ হতে পারে। কিন্তু আমি তো সবকিছু উজার করে ওকে ভালোবেসেছি। নিজের জন্য যা করিনি ওর জন্য তাও করেছি। কি না করেছি আমি? ও আমাকে এভাবে ঠকালো। এটা হতে পারে না। হতে পারে না।
~ হয়ে গেছে অবন্তি৷ হতে পারে না বলে আর লাভ নেই৷ কিছুই আর আগের মত স্বাভাবিক হবে না। ওর দোষে তুইও কিন্তু দোষী। তুই ওকে ভুলে যা।
~ ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ?
মেঝেতে শুয়ে ছটফট করতে লাগল অবন্তি। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। অবন্তির মা মেয়ের এই অবস্থা দেখে ভয় পাচ্ছেন। কিছু বলারও সাহস পাচ্ছেন না, সহ্য করতেও পারছেন না। এটুকু বুঝতে পারছেন মেয়েটা অনেক বড় কষ্ট পেয়েছে।
অবন্তির কান্না দেখে পৃথারও ভীষণ কান্না আসছে। অবন্তি বলল, আমি ওরে আমার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসছি রে। কখন আরেকটা মেয়ের সাথে জড়াইছে বুঝতেও পারিনাই।
~ প্লিজ শান্ত হ।
~ আমি মরে যাবো। শেষ হয়ে যাবো রে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নির্ঝর আর আমার লাইফে নাই এটা আমি মানতেই পারছি না।
অবন্তিকে বুকে চেপে ধরে রইলো পৃথা। অবন্তি বাচ্চাদের মত পৃথার বুকে গুটিশুটি মেরে কান্না করতে লাগলো।
পৃথার আর বাড়ি ফেরা হল না। অবন্তির সাথেই থাকতে হল ওকে। এইমুহুর্তে অবন্তিকে একা ছেড়ে দিলে অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে ও। খাওয়া, ঘুম সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে মেয়েটা। গোসল করেনা, সারাদিন মেঝেতে পরে থাকে। পৃথা এসে অবন্তিকে গোসল করিয়ে দেয়, চুল আঁচড়ে দেয়, খাইয়ে দেয়। এভাবে চলছে দেখে অবন্তি নিজে থেকেই বলল, আমার এখানে থেকে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কিছুদিন পাহাড়ে ঘুরতে যেতে চাই।
অবন্তির মা রাজি হলেন। পৃথা অবন্তি ও আরেকটা মেয়ে সহ সাজেকে চলে এলো ঘুরতে। অন্তত প্রকৃতির সাথে থাকলে ট্রাজেডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে অবন্তি। সাজেকে একটা কাঠের কটেজে উঠেছে ওরা। অবন্তি ভীষণ মনমরা। কটেজের ভিতরের দিকে পাহাড়ের উপর একটা দোলনা আছে। সেখানে গিয়ে পা দুলিয়ে দোলনায় বসে দোল খেতে লাগল ও। দূরে দাঁড়িয়ে মেঘের ভেসে যাওয়া দেখছে পৃথা। মাঝেমাঝে অবন্তির দিকে তাকাচ্ছে। পাগলপ্রায় হয়ে গেছে ও। কবে যে স্বাভাবিক হবে! কেন যে মানুষ প্রেমের মত পাগলামি করতে যায় কে জানে। আচমকা মুখ ঘোরাতেই পাশের কটেজের বারান্দায় একটা চেনা মুখ দেখে চমকে উঠল পৃথা। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠলো। ওপাশের মানুষ টাও একইভাবে চমকে তাকিয়ে আছে। পিছন থেকে একটা মেয়ে ডাকতে ডাকতে এলো, সায়ান এই সায়ান…
পর্ব ১৯
সায়ান মেয়েটার ডাকে সাড়া না দিয়ে পৃথার দিকে ই চেয়ে রইলো। সায়ানের চেহারায় অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। আগে ওকে দেখতে যেমন টিন এজ মনে হতো, এখন আর সেটা মনে হচ্ছে না। গড়নে একটা ভাড়িক্কি ভাব এসেছে। কাঁধ প্রশস্ত হয়েছে, চোয়াল শক্ত হয়েছে। পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত এক যুবক! পৃথা চোখ ফেরাতে পারলো না।
মেয়েটা সায়ানের পিছনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো, বাবা ফোন করেছিল। কথা বলতে চেয়েছে।
সায়ান পৃথার দিকে তাকিয়ে বিভ্রান্তিকর হাসি দিয়ে মেয়েটাকে বলল, বাহ এই ড্রেসে তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে তো!
~ থ্যাংকস ডিয়ার।
~ তুমি রুমে যাও, আমি একটু পরে আসছি।
মেয়েটা দুলতে দুলতে রুমের দিকে চলে গেলো। পৃথার কপালে ভাঁজ পড়ল। এতদিন পর দেখা হলো তাও এভাবে হবে এটা ভাবতে পারেনি ও। সায়ান বিয়ে করে ফেলেছে! সায়ানের জন্য কোনো স্মৃতি বুকে জমা নেই। কোনোদিনো সায়ানকে ভেবে রাতে কষ্টও হয়না। তবুও কেন জানি ওর স্ত্রীকে দেখে মেনে নিতে খারাপ লাগছে পৃথার। এটাকে জেলাস বলে কিনা পৃথার জানা নেই। ও দ্রুত রুমে চলে এলো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছে। অবন্তি বলল আমরা বাইরে হাঁটতে যাবো। সূর্যাস্ত দেখবো।
বলামাত্রই #পৃথা ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, এখনই যাবো। হঠাৎ পৃথার মেজাজ খারাপের কারণ বুঝতে পারলো না ওরা।
হ্যালিপ্যাডে সূর্যাস্ত দেখতে অনেকে জড়ো হয়েছে। সামনে বিশাল পাহাড়ের মেলা, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে উড়ছে মেঘ। মেঘেদের দল একদিক থেকে আরেকদিকে ছুটে চলেছে। কোথাও আবার মেঘেরা দলবেঁধে আটকে রয়েছে। সূর্যের আলো লেগে কিছু মেঘ লালচে রঙের দেখাচ্ছে। অবন্তির মন খারাপ কিছুক্ষণের জন্য দূর হয়ে গেল এখানে এসে।
পৃথা দূরে একলা এক জায়গায় বসে আছে। মেঘের ভেলা দেখছে। বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট ই কাপল। কেউ এসেছে প্রেমিকা নিয়ে আবার কেউ এসেছে স্ত্রী নিয়ে। সবার মনে কত আনন্দ। অথচ পৃথা এসেছে বান্ধবীর ডিপ্রেশন কাটাতে। অবন্তির সেই প্রেমিকও এখন নেই, আর নেই সেই প্রেমের দিনগুলোও। ও হয়তো এখানে এসে স্মৃতিচারণ করছে। সায়ানকে স্ত্রীর সাথে দেখার পর পৃথার মনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কোনো একটা জিনিস ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সে মেয়ে নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে অথচ পৃথা এখনো সিঙ্গেল, হতে পারে সেই যন্ত্রণা।
মাথা ঘুরাতেই সায়ানকে দেখতে পেল পৃথা। সায়ান একলা দাঁড়িয়ে আছে। ওর বউকে খুঁজছে পৃথা। পেলো না। কিছুক্ষণ পরেই দেখল মেয়েটা ছবি তোলার বায়না নিয়ে সায়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথা চোখ ফিরিয়ে নিলো।
রাতে হোটেলে খাবার খাওয়ার সময় পাশের টেবিলে সায়ান বসল। সাথে সেই মেয়েটা, টেবিলে আরো কয়েকজন ছেলে মেয়ে আছে। ওদেরকে পৃথা চেনেনা। হতে পারে সায়ানের বন্ধু। তার আবার বন্ধু বান্ধবীর অভাব নেই। পৃথা মাথা নিচু করে খাবার খেয়ে যেতে লাগল।
রাত্রিবেলা অবন্তির গলাফাটানো কান্নার শব্দে একটুও শান্তির উপায় ছিল না। এই রিসোর্টে এসে ও শান্তিপূর্ণ অনেক সময় কাটিয়েছে সে সবের কথা বলে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। পৃথা অনেক্ক্ষণ ওকে স্বান্তনা দেয়ার পরও ওর কোনো ভাবান্তর হল না। ঘর থেকে বেরিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পৃথা কটেজের ভেতরের দিকের দূরের বারান্দায় গিয়ে বসে রইল। ঝিঁঝিঁর ডাকে চারিদিক সরব হয়ে উঠেছে। মন খারাপের সময়টাকে উপভোগ করছে ও।
বারান্দা থেকে উঠে আসার সময় পাশের বারান্দায় সায়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হল। সায়ান এখান থেকে ওর দিকে চেয়ে ছিল না তো? পৃথা নিজের বসার জায়গাটার দিকে একবার তাকাল। তারপর সায়ানের পাশে এসে দাঁড়াল।
সায়ানের কোনো ভাবান্তর হল না। পৃথা জিজ্ঞেস করলো, হানিমুনে এসেছেন?
সায়ান প্রথমে ভ্রু কুঁচকে তাকালো পৃথার দিকে। তারপর শব্দ করে হেসে উঠলো। ওর হাসির শব্দ ধ্বনিত হতে লাগলো চারিদিকে।
হাসি থামিয়ে বললো, ফাজলামো করছো? হানিমুন? হা হা হা।
~ আপনার কি মনে হচ্ছে আমি ফাজলামো করছি?
~ তো?
~ আপনার স্ত্রীকে দেখলাম।
~ ও মাই গড! আমি এখনো আমার স্ত্রীকে দেখতে পারলাম না আর তুমি দেখে ফেললে? তাকে এনে দাও না প্লিজ। এত সুন্দর রাতটা একা কাটাতে ইচ্ছে করছে না।
~ আপনি বিয়ে করেননি?
~ না। বিয়ে করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে না?
~ তাহলে কি উনি গার্লফ্রেন্ড? নাকি…
~ বিকেলে যাকে দেখেছো? ও আমার বড়বোন। দুলাভাই ও বোনের সাথে বেড়াতে এসেছি ডিয়ার।
~ ওহ সরি সরি। ভুল ভেবেছিলাম। মাফ করবেন।
~ উহুম, মাফ তো করা যাবে না। এত দিন পর এমন একটা জায়গায় এসে দেখা হয়ে যাবে এটা ভাবতেও পারিনি।
~ আমিও ভাবতে পারিনি। কি করছেন আজকাল?
~ বাবার ব্যবসায়ে জয়েন করিনি। পাশ করে বেরোবার পর নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান খুলেছি। বাবার কাছে টাকাও নেইনি, জমানো টাকা আর লোন নিয়ে করছি। আমি একজন উদ্যোক্তা।
~ বাহ! শুনে ভালো লাগলো। শুভ কামনা রইলো।
~ তোমার জন্যও।
দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার পরও পৃথা গেলো না। দাঁড়িয়ে রইল পাশে। সায়ান জিজ্ঞেস করলো, কেমন লাগছে সাজেক?
~ অদ্ভুত সুন্দর। এত কাছে থেকে মেঘ আমি কখনোই দেখিনি। আমরা কত উপরে চলে এসেছি ভাবতেই পারছি না।
~ পড়াশোনা শেষ?
~ মাত্র ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা দিলাম। প্রত্যেকটা সেমিস্টারে আমি ফার্স্ট গার্ল ছিলাম। স্কলারশিপে পড়াশোনা চালিয়ে এসেছি।
~ খুব ভালো। এখন কি করার ইচ্ছে আছে?
~ প্রস্তুতি নিচ্ছি জবের জন্য। দেখা যাক কি হয়।
~ উদ্যোক্তা হতে চাও না?
~ কি ব্যবসা করবো বুঝে উঠতে পারি না।
~ ব্যবসা করা আর উদ্যোক্তা হওয়া কিন্তু এক কথা নয়।
পৃথা কিছু বলল না। সায়ান উদ্যোক্তা হওয়ার উপকারিতা বুঝিয়ে বলতে লাগলো পৃথাকে। উদ্যোক্তা হওয়া মানে নিজের স্বপ্ন নিজে পূরণ করা। আর চাকরি করা মানে অন্যের স্বপ্ন পূরণ করা। অন্য কেউ যেভাবে আদেশ করবে সেভাবেই কাজ করা। জীবনটা যখন তোমার, রিস্ক নিয়ে হলেও নিজের মত করে কাজ করা উচিৎ।নিজস্ব স্বপ্ন থাকা উচিৎ। চাকরির থেকে নিজে কিছু করাটা যেমন সম্মানের তেমনি আনন্দের। ছোট ছোট সফলতায় খুশি হওয়া যায়।
পৃথা বলল, আমি কখনো ব্যবসা নিয়ে ভাবিনি। যদিও নিজেই কিছু করতে চেয়েছি সবসময়। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবো এটাই ভাবতাম।
~ হয়ত বড় কোনো চাকরি পেয়ে যাবে। কিন্তু ওই যে বললাম চাকরি করলে অন্যের স্বপ্ন পূরণে কাজ করতে হয়। এখানে নিজের কোনো চাওয়া পাওয়ার মূল্য থাকে না। নিজের ইচ্ছে মত কাজও করা যায় না।
~ তা ঠিক বলেছেন।
সায়ান পৃথাকে দাঁড়াতে বলে রুমের দিকে চলে গেলো। ফিরে এলো কিছুক্ষণ পর। হাতে করে এনেছে দুটো বই। পৃথার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এ দুটো তুমি নিয়ে যাও। একটু পড়াশোনা করে দেখো উদ্যোক্তা ও চাকরির মধ্যে পার্থক্য। আশা করি তোমার সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে।
পৃথা কৌতুহলী হয়ে চেয়ে রইলো। নেবে কিনা ভাবছে। সায়ান বললো, দ্যাখো পৃথা। আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমরা প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে গিয়েও জড়াইনি। আমি বিয়ে করতে চাইলেও তুমি করোনি। তারমানে এই নয় যে আমাদের মাঝে কোনো খারাপ সম্পর্ক ছিল। শেষ দেখা হবার আগ পর্যন্তও আমরা বন্ধুর মতই ছিলাম। তুমি ভুল বুঝেছিলে, আমি তোমার ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো খারাপ কিছু হয়নি। ঝগড়া হয়নি, তর্ক হয়নি, মনোমালিন্য হয়নি। এমন নয় যে একজন আরেকজনের শত্রু। এমন নয় যে ব্রেকাপ হয়ে গেছে। প্রেমই হয়নি, যতদিন পাশে ছিলে লাইক এ ফ্রেন্ড। কাজেই আমার মনে হয় অযথা নিজেদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি না করাই ভালো। এইযে দীর্ঘ বছর পর দেখা হল, ভালো করে দুটো কথা বললাম। একজন আরেকজনের খোঁজ খবর নিলাম। এর জন্য তো আমাদের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়নি। তাইনা? অযথা মুখ ফিরিয়ে রেখে, চিনেও না চেনার ভান করে কি লাভ? দু একটা স্বাভাবিক কথাবার্তা বললে মনের ভেতর যন্ত্রণা থাকবে না। আমরা স্বাভাবিক থাকবো।
পৃথা মৃদু হেসে বলল, থ্যাংকস এত সুন্দর করে বলার জন্য। আমি আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম, কিন্তু সেটা মাত্র কয়েকদিনের জন্য। তাছাড়া সবসময় আপনাকে রেস্পেক্ট করেই এসেছি। আপনি মানুষটা কখনো খারাপ ছিলেন না।
~ তুমি আমাকে খারাপ ই ভাবতে।
~ না না। সত্যি আমি এমন কখনো ভাবতাম না। যেটুকু ভেবেছিলাম সেটা ভুল বুঝে। যাইহোক, কোনো কারণ ছাড়াই একটা অজানা দেয়াল আমাদের মাঝে শিকড় গেড়ে উঠেছিল। তাই মনের মাঝে ক্ষোভ ছিল। সেটা দূর করে দেয়ার জন্য আবারও থ্যাংকস।
~ ওয়েলকাম। বই দুটো নেবে? তোমার সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। বুঝতে পারবে আমাদের কেন নিজেদেরকেই কিছু করা উচিৎ।
~ হুম।
পৃথা হেসে সায়ানের কাছে বই দুটো চেয়ে নিলো। তারপর ধন্যবাদ দিয়ে রুমে চলে এলো। সায়ানের প্রতি রাগ ছিল না, তবুও মনটা কেমন যেন বিষিয়ে ছিল। কোনো কারণ নেই তবুও সায়ানকে সহ্য হত না। অথচ মানুষটা অনেক ভালো। পৃথাকে সবসময় ভালোবাসা ছাড়া খারাপ ব্যবহার কখনো করেনি৷ ওর কথাগুলো শোনার পর মন থেকে একটা পাহাড় সরে গেছে। উফফ!
পৃথা রুমে এসে দেখে অবন্তি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই ওকে আর ডাকল না। ফোনের আলো জ্বেলে একটা বই খুলে বসল। কিছুদূর পড়ার পর আনমনে বইটা বন্ধ করে রেখে দিলো। জানালা দিয়ে শিরশির করে বাতাস আসছে। এত স্নিগ্ধ এখানকার বাতাস! শরীর মন ফুরফুরে করে দিচ্ছে। হঠাৎ ই নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে পৃথার। সায়ান শুধু ভালো বাসতেই চেয়েছিল। কোনোদিনো পৃথাকে কষ্ট দেয়নি ও। অথচ সায়ানের সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছে পৃথা। সায়ানের বাবা মাকেও ফিরিয়ে দিয়েছে। সব খারাপ আচরণের জন্য কখনো ওকে সরি বলা হয়নি। আর কখনো দেখা নাও হতে পারে। কাল দেখা হলে একবার সরি বলতে হবে। মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল পৃথা।
খুব ভোরেই উঠতে হল সূর্যোদয় দেখার জন্য। তিন বান্ধবী সূর্যোদয় দেখার জন্য হ্যালিপ্যাডে এলো। সবাই যাচ্ছে কংলাকের দিকে। ওখানে সূর্যোদয় দেখবে। পাহাড়ের বুক চিড়ে সাদা মেঘের মাঝ থেকে সূর্য উঠবে। পৃথা আশেপাশে তাকালো। মানুষজন খুব একটা নেই।
তিনজনে হাঁটা শুরু করলো কংলাক পাড়ার দিকে। যাওয়ার পথে সায়ানের সাথে দেখা। পৃথা চেঁচিয়ে বলল, সায়ান!
সায়ান পৃথার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো। পৃথা বলল, আমরা কংলাক পাড়ায় যাচ্ছি।
~ আমরাও যাচ্ছি।
অনেক লোক হাঁটছে কংলাকের দিকে। সায়ান দৌড়ে পৃথার কাছাকাছি চলে এলো। হাফাতে হাফাতে বলল, এখানকার সকালটা অনেক স্নিগ্ধ তাইনা?
~ হ্যাঁ। আমি ভোর চারটা থেকে জানালায় বসে মেঘ দেখছিলাম।
~ আমি এবার দেখিনি। আগে একবার এসে সারা রাত বাইরেই শুয়ে ছিলাম। হা হা হা।
~ বাইরে শোয়া যায়?
~ অফ কোর্স যায়। কেউ কিচ্ছু বলবে না। কটেজের বারান্দায় শুয়ে থাকতে পারবা।
~ তাহলে আজকে শোবো।
~ বাইরে শুলে মনে হবে তারা গুলো অনেক কাছে চলে এসেছে।
~ তাই!
~ হ্যাঁ। অনেক বড় বড় নক্ষত্র। কালো কুচকুচে একটা আকাশ।
~ আকাশ বুঝি কালো হয়?
~ হা হা হা।
দুজনে হাসতে হাসতে দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগলো। সূর্য ওঠার আগেই কংলাকে যেতে হবে।
পর্ব ২০
কংলাক পাড়ার দিকে যেতে যেতে হাফিয়ে উঠেছিল সবাই। বেশ দ্রুত ছুটতে হচ্ছে। সূর্য ওঠার আগেই পৌঁছাতে হবে। তাহলে মেঘের ছোঁয়া পাওয়া যাবে। দেরি হয়ে গেলে আর মেঘ ছোঁয়া যাবে না। পৃথা বলল, রাতে একটা বইয়ের কিছু অংশ পড়েছি। ভীষণ ভালো লেগেছে আমার। ইন্সপায়ারড হয়েছি। এরকম একটা বইয়ের জন্য থ্যাংকস দিতেই হয়।
~ দুটোই ভালো করে পড়ে দেখো। যে অংশটুকু প্রয়োজনীয় মনে হবে নোট করে রেখো।
~ কিন্তু আমি কি বিজনেস করবো? কুটির শিল্প টাইপের কিছু?
~ হ্যাঁ করতে পারো। আরো ভালো কোনো আইডিয়া পাবা আশা করি।
~ ওকে।
কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সবাই যখন হাফাচ্ছিল, পৃথা এদিক থেকে ওদিকে সমানে ছুটোছুটি করছিল আনন্দে। চারিদিকে এত মেঘ, এত মেঘ ভেসে আসছে, উড়ে যাচ্ছে। খুশিতে কান্না আসতে চাইছে।
কিছু মেঘ উড়ে এসে শরীর ছুঁয়ে চলে গেলো। চোখ বন্ধ করে সে সুখটুকু অনুভব করলো পৃথা। সায়ান বললো, কাছাকাছি একটা ঝরণা আছে। জংগলের ভিতরে। খুব গভীর জংগলে। পথটা অনেক দূর্গম। আমি একবার গিয়েছিলাম ওখানে। সেই দূর্গম পথ শেষ করে যখন ঝরণার দেখা পেয়েছি, কি যে আনন্দ হয়েছে তোমাকে বোঝাতে পারবো না।
~ খুব কষ্ট হবে যেত?
~ হ্যাঁ।
~ আসার পথে রিসাং ঝরণায় গিয়েছিলাম। জানেন আমি এর আগে কখনো ঝরণা দেখিনি। কি যে ভালো লেগেছে ঝরণা টা।
~ আমারও ঝরনায় গোসল করতে ভালো লাগে।
~ তাহলে চলুন এখানকার ঝরণাটায় যাই।
~ ওটা বেশ ভিতরে। খুব কষ্ট হবে। ভয়ংকর দূর্গম পথ।
~ হোক না, এডভেঞ্চার হবে। আমি আজীবন বইতেই পড়েছি এসব এডভেঞ্চারের কথা। কখনো যাই নি।
~ আচ্ছা আমি দেখি আমার ফ্রেন্ড সার্কেল যেতে চায় কিনা।
পৃথা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো। সায়ানের দলের ছেলেরা প্রথমে যেতে চায়নি, পরে ওরা রাজি হলো। পৃথার বন্ধুরা কেউ যাবে না। ওরা কটেজে ফিরে যেতে চায়। অবশেষে পৃথা একাই সায়ান ও ওর বন্ধুদের সাথে ঝরণায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
পাহাড় থেকে নেমে এসে অন্য একটা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ঢুকতে হলো। ভিতরে ঢুকতেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। পৃথার অবশ্য ভালোই লাগছে।
ঝিরিপথ দিয়ে হেঁটে যেতে হয় ঝরণার দিকে। ঝিরিপথের ভিতর ঘন অন্ধকার। গা ছমছম করা একটা ভাব। ও সায়ানের পিছু পিছু এগোচ্ছিল। এতগুলো ছেলের সাথে পৃথা একা। এখনো সায়ানের প্রতি ওর অগাধ বিশ্বাস। সায়ান ওর কোনো ক্ষতি করবে না এই বিশ্বাসটুকু শিরায় উপশিরায় উপস্থিত। সেই বিশ্বাসের জোরেই এতদিন পরও সায়ানের সাথে জংগলে ঢুকতে ভয় করছে না পৃথার।
যত ভিতরে যাচ্ছে পথের দুর্গমতা ততই বাড়ছে। পায়ের নিচে আটকে যাচ্ছে কাঁটা ও শ্যাওলা। কোথাও কোথাও আবার পিচ্ছল। একবার পা পিছলে পড়েই যাচ্ছিল পৃথা। চেঁচিয়ে উঠেছিল বলে সায়ান খপ করে ওর হাত ধরে ফেলেছে। এরপর আর হাত ছাড়েনি। সায়ানের হাত ধরে পৃথা ঝিরিপথের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে। পৃথার হাতের নরম স্পর্শ পেয়েও সায়ানের ভাবান্তর নেই। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ই নেই ওর। ও কেবল এডভেঞ্চার উপভোগ করছে। আর পৃথা সায়ানের উষ্ণ হাতের স্পর্শে আরো বেশি শিহরিত হয়ে উঠেছে। গাছের গন্ধ, পাহাড়ের গন্ধ, শ্যাওলা, ঝিঁঝিঁর ডাক, পথের দূর্গমতা সবকিছুকে ছাড়িয়ে সায়ানের উষ্ণতাকেই বেশি ভালো লাগছে। ইচ্ছে করেই আরো শক্ত করে হাত ধরলো।
সায়ানের সেদিকে মনোযোগ নেই। পথ হাঁটছে খুব দেখেশুনে। কাঁটা সরিয়ে ভেতরের দিকে নিজেও হাঁটছে আর পৃথাকেও নিয়ে যাচ্ছে। কখনো সরু পথে দুজনকে খুব কাছাকাছি চলে আসতে হয়। আবার কখনো পৃথার হাত টেনে ধরে সাবধানে নিয়ে যাওয়া। সায়ান বারবার একটা শব্দই উচ্চারণ করছে, এই সাবধানে এসো। পৃথা একটু সাবধানে পা ফেলো, এখানে কাটা আছে, এখানে পাথর। একটু দেখেশুনে..
এই সাবধানী বাণীগুলো পৃথার মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সায়ানকে কতই না ভুল বুঝেছিল ও। অথচ কত সুন্দর একটা মানুষ!
অনেক এডভেঞ্চার পাড়ি দিয়ে অবশেষে ঝরণার দেখা মিললো। সায়ান ঝরণার নিচে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ভিজতে লাগলো। পৃথা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর দেখছে ওর পাগলামি। ঝরণা থেকে সরে এসে সায়ান বলল, তুমি ভিজছো না কেন? ভয় করছে?
~ না।
~ তাহলে? আসো আমার সাথে।
হাত বাড়িয়ে দিলো সায়ান। পৃথা সেই হাত ধরে সায়ানের সাথে ঝরণার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। শীতল জলে স্নান করতে করতে মনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাচ্ছিল। কি যে আনন্দ লাগছিল! পৃথা চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো। লাফাতে গিয়ে পরে যাচ্ছিল প্রায়। সায়ান এক টানে নিজের কাছে টেনে নিল। সায়ানের বুকের উপর এসে পড়ল পৃথা। ঝরণার জল মাথার উপর সজোরে আঘাত করছিল। জলের ভিতরেই একে অপরের দিকে তাকালো। কত দিন পর চোখাচোখি! ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। জলের ধারা অনেক প্রবল। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা গেলো না। সরে এলো পৃথা।
ফেরার সময় সায়ান ওর গলার তোয়ালে পৃথার গায়ের উপর জড়িয়ে দিলো। তারপর বলল, সাবধানে পা ফেলবে পৃথা। খুব সতর্ক ওকে?
~ ওকে বাবা।
এবার পৃথাকে ধরতে হল না। ও একা একাই হাঁটছে বেশ। সায়ান বারবার পিছনে ফিরে তাকায় আর পৃথাকে বলে এখানে গর্ত, একটু দেখে পা ফেলো। কখনো বলে এখানে পাথর, আবার পা কেটে যাবে। এত কেয়ার করা দেখে পৃথার সুখের মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কেউ কেয়ার করলে বুঝি এত আনন্দ লাগে, এটা ওর জানা ছিল না। মনেমনে প্রবল খুশির জোয়াল উঠেছে যেন।
ফেরার পথটা তারাতারিই শেষ হয়ে গেলো। কটেজে ঢোকার সময় পৃথা সায়ানের তোয়ালে এগিয়ে দিচ্ছিল, সায়ান বাঁধা দিয়ে বলল, নিয়ে যাও।
ঘরে ঢুকতেই অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, তুই চেনা নেই জানা নেই ওই ছেলের সাথে কিভাবে গেলি বলতো? তখন জিজ্ঞেস করলাম কাউকে চিনিস কিনা? বললি তোর পরিচিত। তুই কিভাবে চিনিস ওদেরকে?
~ সব’চে হ্যান্ডসাম ছেলেটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো।
~ ওহ আচ্ছা।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবন্তি আবার জিজ্ঞেস করলো, সবচেয়ে হ্যান্ডসাম বলার কারণ?
পৃথা উত্তরে হাসল। কেন ও এটা বলেছে নিজেও বুঝতে পারছে না। হয়তো সায়ানকে সবার চেয়ে আলাদা বোঝাতে। তাতে ওর কি লাভ তাও বুঝতে পারছে না৷ তবে কথাটা বলতে পেরে ভালো লাগছে।
পৃথা শাওয়ার নিতে নিতে আপনমনেই হাসছিল। এই কাঠের ঘরেও এত আধুনিক বাথরুম যিনি বানিয়েছেন তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিৎ।
পৃথা গোসল সেরে বেরিয়ে এলে অবন্তি বলল, আমরা কাল সকালেই চলে যাবো।
পৃথা চমকে উঠে বলল, না। আমরা আরো অনেকদিন থাকবো।
~ অনেকদিন?
~ হ্যাঁ। যতদিন আমার থেকে যেতে ইচ্ছে করবে ততদিন। হা হা হা।
অট্টহাসি হাসতে হাসতে পৃথা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অবন্তি কেবলই অবাক হচ্ছে। এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন পৃথা! কি হল মেয়েটার!
রাত্রিবেলা কটেজের খোলা বারান্দায় পা মেলে দিয়ে বসে রইলো পৃথা। আজ মনটা ভীষণ ফুরফুরে। বিগত অনেকগুলো দিন এতটা ফুরফুরে মন কখনো ছিলো না। গুণগুণ করে গান গাইছিল ও। বাকি দুই বান্ধবী ঘরেই আছে। ওরা বুঝতে চেষ্টা করছে পৃথার আচমকা পরিবর্তনের কারণ কি?
কটেজের খোলা বারান্দা। শিরশির করে হাওয়া আসছে। কি যে শান্তি লাগছে!
সায়ান চলে এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। পৃথা জানত সায়ান আসবে। না এসে থাকতে পারবে না। সায়ান এসে পাশে বসলে #পৃথা বলল, আজ আকাশে অনেক তারা।
~ গুণছিলে নাকি?
~ না। আপনি আসলে একসাথে গুণবো বলে অপেক্ষা করছিলাম।
সায়ান মুচকি হাসল। পাঁচ মিনিট সময় চেয়ে চলে গেলো কটেজের ভেতরে। ফিরে এলো দু কাপ কফি হাতে। একটা কাপ পৃথার দিকে এগিয়ে দিয়ে পাশে বসে পড়লো। রাতের নির্জনতা বেড়ে চলেছে। সায়ান খালি গলায় গান ধরলো। পৃথা হাত তালি দিচ্ছিল। গান গাইতে গাইতে অন্য এক জগতে বিচরণ করছিল দুজনে। বেশিরভাগ সময়েই দুজনে নিশ্চুপ থাকে৷ যখন কথা বলে তখন প্রকৃতি, পাহাড়, আকাশ এসব নিয়েই কথা হয়।
এক ফাঁকে সায়ান জিজ্ঞেস করলো, প্রেম করছো না?
~ আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে?
~ করছো। খুব রোমান্টিক লাগে তোমাকে আজকাল।
~ আমাকে রোমান্টিক লাগে?
~ তোমার মুডটাকে আরকি। রোমান্টিক মনে হয়।
~ হা হা। নাহ, এতগুলো বছর একাই আছি। আমার প্রেমের সময় হয়নি।
~ সময় কি আদৌ হবে? আমার মনেহয় কখনো হবে না। আজীবন কেউ কেউ সিঙ্গেল ই কাটিয়ে দেয়।
~ হয়তো বা নয়। আমার জীবনের একটা অংশে গিয়ে আমিও প্রেমে পড়বো। কারো কেয়ারের, কারো আদরের, শাসনের।
~ এসব দেখে কেউ প্রেমে পড়ে না। কারণ প্রেম করার আগে এসব পাওয়া যায় না। প্রেমে পড়ার পর এসব পায়।
~ আমি যদি আমার বরের থেকে এসব পেতে চাই? তবে তো সম্ভব।
~ হুম তা সম্ভব। কিন্তু বর হবার সুযোগ ও তো কাউকে দিতে চাও না। বললাম না কেউ কেউ আজীবন সিঙ্গেল থাকতে চায়।
পৃথা উত্তরে কিছু বলতে পারলো না। খানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, আপনি প্রেম করছেন নিশ্চয়?
~ সেটা করলে আর তোমার সাথে বসে গল্প করতাম না নিশ্চয়?
~ কেন? প্রেম করলে কি অন্য কারো সাথে গল্প করা যায় না?
~ আমি অন্তত করতাম না। আমার কাছে প্রেমিকাই সব হত। একমাত্র সে ছাড়া আর কাউকে পাত্তা দেয়ার মত সময় আমার নেই।
~ সব সময় তাকেই দিতেন?
~ অবশ্যই। তাকে নিয়েই এখানে আসতাম। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে মেঘ ছোঁয়াতাম। দুজনে মেঘ গায়ে মাখতাম একসাথে।
পৃথা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে কেউ একজন ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। আর ও কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মেঘ এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেলো দুজনকে। একটা শীতল অনুভূতি। হালকা তুলোর মত মেঘ। কি অদ্ভুত সুন্দর! পৃথা পিছন দিকে পড়ে যাবেই হয়তো, পিছনে থাকা মানুষ টার বুকের উপর হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবে, মেঘ দেখবে। আর মানুষটা পৃথার চুলের গন্ধ শুকবে। কত সুন্দর ই না হতো!
সায়ান বললো, আমার একটা স্বপ্ন আছে। কি জানো? আমি আমার লাইফ পার্টনারকে নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে চাই। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য দেখে ফেলতে চাই। যেভাবে আমার বাবা মা এখন দেখছেন, ঘুরছেন। পৃথিবীটা কতই না সুন্দর। একসাথে পাহাড়ে যাবো, সমুদ্রে যাবো, মেঘের দেশে যাবো, কখনো বা হারিয়ে যাবো নদীর মোহনায়। ভিজবো ঝরণা ধারায়। হাতে হাত রেখে চাঁদনী রাতে সমুদ্র তীর ধরে হাঁটবো। কেমন হবে বলো তো?
পৃথা অবাক হয়ে বললো, আপনার স্বপ্নটা সুন্দর।
~ এটা হয়তো খুব বড় পাওয়া নয়, আবার বড় পাওয়া। এছাড়া আমার আর জীবনে কিচ্ছু চাওয়ার নেই। বড় হওয়ার তীব্র ইচ্ছাও নেই, টাকা পয়সা দিয়ে পাহাড় বানাবার ইচ্ছাও নেই। আমি শুধু সময়কে উপভোগ করতে চাই। কারণ সময়কে আমরা ধরে রাখতে পারবো না।
পৃথা মুগ্ধ হয়ে সায়ানের কথা শুনছে। এত সুন্দর করে কাউকে কখনো বলতে শোনেনি ও। কারো স্বপ্ন এত সুন্দর ও হতে পারে!
সায়ান বলতেই থাকলো, জীবনটা অনেক ছোট। উপভোগ করার জন্য সময় খুব কম। তবে যতটুকু পেয়েছি ততটুকুই যদি উপভোগ করি তাতেও একটা সুন্দর লাইফ লিড করা সম্ভব। অবশ্য মানুষ টাকেও মনের মত হতে হবে। এমন একটা মানুষ সবসময় খুঁজে বেড়ালাম… হন্য হয়ে খুঁজলাম।
পৃথা মনেমনে বলল, এমন একটা মানুষ কে না চায়! আমিও তো মনেমনে এমন একটা মানুষ ই সবসময় চেয়েছি হয়তো। হয়তোবা স্বপ্ন দেখেছি, কখনো নিজের মনকেও বুঝতে দেইনি আমি কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি।
~ কি ভাবছো?
~ না কিছু না।
~ বলো?
~ ভাবছি, এরকম একটা মানুষ হয়তো সবাই চায়।
~ সবাই চায় না পৃথা। সবাই চায় না।
পৃথার বুকটা কেমন যেন করে উঠলো। মনে হলো সায়ান ওকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বললো। সবাই চায় না! সহস্র গাঁথা দুঃখ মিশে আছে এই কথায়।
পর্ব ২১
বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ বারান্দায় শুয়ে পড়ে সায়ান। আকাশে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র। এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে তারা গুলো অনেক কাছে চলে এসেছে। এই বুঝি ঝুপ করে গায়ের উপর পড়বে। মাথার উপর ঝুলে আছে এমন একটা ভাব। কি সুন্দর ঝিলমিল করছে তারা গুলো! পৃথা কিছু একটা বলে গল্প জমাতে চাইছে। কিন্তু কি বলে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। সায়ান ও নিশ্চুপ। এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে সংকোচ লাগে পৃথার। তার উপর নিশুতি রাত। রাতের নির্জনতা আর ঝিঁঝিঁর ডাকে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে মন চাইছে। অনেক্ষণ চুপ থাকার পর পৃথা বলল, আমার এক বান্ধবীর রিসেন্টলি ব্রেক আপ হয়েছে। ও ছেলেটাকে খুব ভালোবাসত।
~ ব্রেকাপ হয়েছে কেন?
~ ছেলেটা ওকে রেখে অন্য একটা মেয়ের সাথে জড়িয়েছিল। শুনেছি তাকে বিয়ে করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় আমার বান্ধবীর কিছু করার ছিল না।
~ ওহ আচ্ছা। বিয়ে করে ফেললে আর তার কাছে যাওয়ার উপায় নেই। সো স্যাড..
~ ছেলেরা এমন কেন করে?
~ মেয়েরাও এমন করে। ছেলে মেয়ে বিষয় না। বিষয় হচ্ছে সত্যিকার ভালোবাসা। এটা সবাই সবাইকে দিতে পারে না। আর কার মন কখন চেঞ্জ হয়ে যায় কেউই জানেনা।
~ হুম। মাঝেমাঝে দেখি অনেক বছর সংসার করার পরও আরেকজনকে বিয়ে করে ভেগে যায়।
~ আসলে একটা কঠিন সত্য কি জানো? কেউ যদি তোমাকে রেখে আবার কাউকে ভালোবাসে তাহলে বুঝতে হবে সে তোমাকে ভালোই বাসেনি। তোমার প্রতি তার একটা আলগা মোহ ছিল। যেটাকে সে ভালোবাসা বলে
সায়ানের কথাটা ভীষণ ভালো লাগলো পৃথার। এমন করে সত্যিটা কারো কাছে শোনা হয়নি। ও বলল, ভালোবাসা একটা অদ্ভুত বিষয়। মনের অজান্তেই এটা জন্মে আর বেড়েও চলে।
~ আমার দূর্ভাগ্য যে অনেক চেষ্টা করেও কারো মনে সে অনুভূতি টুকু জাগাতে পারিনি।
~ এমন করে বলছেন কেন? আপনার মত একজন মানুষকে অনেক মেয়েই চায় নিশ্চয়।
~ সে চাওয়াতে আসল চাওয়াটুকুই থাকে না, যা আমি চাই। প্রেম ভালোবাসা প্রাপ্তিটাও একটা সৌভাগ্যের মত। কারো থাকে, কারো থাকে না।
~ হুম। জানিনা সৌভাগ্য কিনা। তবে ভাগ্যে বেশ জোটে।
~ তাই?
~ হ্যাঁ। এই ক’বছরে অনেকেই প্রেমের জন্য এগিয়ে এসেছিল। কেউবা বিয়ের জন্য। আমার ইচ্ছে করে নি।
~ বলেছিলাম না.. হা হা হা।
সায়ান হাসছে। হাসতে হাসতে মাথাটা হাতের উপর নিয়ে পৃথার দিকে তাকাল। দূর থেকে আলো এসে পৃথার ঠোঁটের উপর পড়েছে। কি আকর্ষণীয় লাগছে দেখতে। শিউরে উঠল সায়ান।
পৃথা বলল, আজ কি সারারাত বাইরে শুয়েই কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছে?
~ একজন সঙ্গী পেলে আমার থাকার আগ্রহটা আরো তুমুল হতো হয়তো। হা হা..
~ আমাকে সঙ্গী হিসেবে কেমন লাগে?
~ তা কি তোমার অজানা?
~ এই কয়েক বছরে কি সবকিছু বদলায় নি?
~ কিছু কিছু জিনিস হয়তো কখনোই বদলায় না। যেমন কারো প্রতি প্রেম, আবেগ, মোহ, আকর্ষণ।
~ আর অনুভূতি?
সায়ান পৃথার হাতটা নিয়ে নিজের বুকের উপর ধরে বলল, টের পাচ্ছো?
পৃথা বেশ টের পাচ্ছে সায়ানের বুকটা ধকধক করছে। জোরে জোরে বিট হচ্ছে। শিউরে উঠলো পৃথার শরীর।
সায়ান বললো, কি ভাবছো?
~ একটা চুম্বন, আমাকে অনেক গুলো রাত ঘুমাতে দেয়নি। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম আর শেষ চুম্বনও। এর আগেও কেউ আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখার সাহস করেনি, আর পরেও না।
~ কারো দখল করা সম্পত্তিকে আগলে রেখেছো মনে হচ্ছে?
~ এটাকে সম্পত্তি বলা যায়?
~ না, সম্পদ।
~ তাহলে?
~ ভুল বলে ফেলেছি। আগলে রাখা হচ্ছে?
~ জানিনা। কিচ্ছু জানিনা।
সায়ান মুচকি হেসে পৃথার পাশে শুয়ে পড়ল। দুজনে পাশাপাশি খানিক দূরত্বে শুয়ে রইলো বারান্দায়। খোলা বারান্দা। উপরে বিশাল তারা ভরা আকাশ। শো শো করে বাতাস বইছে। শরীরে একটা হিমশীতল অনুভূতি। গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথা, সায়ানও তা টের পায়নি। কিন্তু সায়ানের চোখে ঘুম নেই। পৃথাকে জাগিয়ে দেবার সাধ্যও ওর হল না। এমন নিষ্পাপের মতন ঘুমাচ্ছে, তাকে কি করে জাগিয়ে দেয়া যায়? ওকে একা ফেলে রুমেও যাওয়া যাবে না। তারচেয়ে ভালো হয় এখানে বসে ওকে পাহারা দিলে।
সায়ান পাশেই দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে রইলো। যাতে পৃথার পায়ের সাথে পা টাও স্পর্শ না করে। এতটাই সাবধানে রইলো ও। বুঝতেই পারল না কখন ঘুমে ঢলে পড়েছে।
প্রায় শেষ রাতের দিকে একবার ঘুম ভেঙে গেলো সায়ানের। পাশে তাকিয়ে দেখে দুজনে ঘুমের মাঝে গড়াতে গড়াতে অনেক কাছাকাছি এসে শুয়ে আছে। সায়ান অন্ধকারেই পৃথার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। কিছুটা সময় বয়ে গেলো নিরবে। নিজেকে সংযত করে রেখেছে সায়ান। সেই কবেই নারীদেরকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। পৃথার যেন কোনো অবমাননা না হয়।
পৃথা আচমকা একটা হাত তুলে দিলো সায়ানের গায়ের উপর। সায়ান নিশ্চুপ হয়ে রইলো। একদিকে হার্টবিট বাড়ছে, অন্যদিকে একটা অজানা ফিলিংস হচ্ছে। #পৃথা গায়ের উপর হাত রেখেছে, উফফফ। একরকম জাপটে ধরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল পৃথা। শুধু ঘুম নেই সায়ানের চোখে। পৃথার হাত সরিয়ে দিতে গেলে যদি ও জেগে যায়, তখন ভুল বুঝতে পারে। তারচেয়ে না জাগিয়ে দেয়াটাই ভালো। ও হাত সরিয়ে নিলে সায়ান দূরে সরে যাবে।
সায়ান আবার ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। ভোরবেলা ঘুম ভাংল পৃথার। কারো শরীরের উষ্ণতা টের পাচ্ছিল খুব করে। ঘুমের ঘোরে আরো শক্ত করে জাপটে ধরছিল। একটা শান্তি শান্তি অনুভূতি। একবার মনে হয়েছিল স্বপ্ন। পরক্ষণেই মনে হলো অবন্তি। খানিক সময় বাদে ভ্রম দূর হল পৃথার। সায়ানের শরীর বুঝতে পেরে চোখ মেলে দেখে সত্যিই ও সায়ানকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। লজ্জায় দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তারপর উঠে এক দৌড়ে রুমে চলে এলো।
রুমের দরজা খোলা রেখে বান্ধবীরা ঘুমাচ্ছে। ওরা হয়তো পৃথার জন্যই দরজা খোলা রেখেছিল। পৃথা রুমে ঢুকে আস্তে আস্তে অবন্তির পাশে শুয়ে পড়ে। চোখে আর ঘুম আসে না। অস্থির লাগছে ভীষণ। সায়ান যদি টের পেয়ে থাকে পৃথা ঘুমের ভেতর ওকে জড়িয়ে ধরেছিল তাহলে কি ভাব্বে কে জানে। যদিও সায়ানকে দেখে ঘুমন্ত মনে হচ্ছিল। তবুও লজ্জা লাগছে পৃথার। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলো শুধু।
সকালের নাস্তা করার পর হ্যালিপ্যাডের পাশের দোলনায় দোল খেয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলো পৃথা। কটেজে ফিরে রুমে ঢোকার আগেই সায়ান এসে বলল, আজকে বিকেলে আমরা চলে যাবো। আমাদের চান্দের গাড়িতে তিনজন যেতে পারবে। তোমরা কি আমাদের সাথে যেতে চাও?
পৃথা বলল, আমরা সিএনজিতে এসেছিলাম। তাহলে সিএনজিকে আসতে বারণ করে দেই।
~ চান্দের গাড়িতে যেতে পারলে আর সিএনজি কেন?
~ থ্যাংকস।
পৃথা রুমে এসে অবন্তিকে বলল, আজকেই আমরা বিকেলে রওনা দিবো।
~ মানে কি? তুই না বললি অনেকদিন থাকবি?
~ হ্যাঁ। সাথে এটাও বলেছিলাম যে যতদিন আমার ইচ্ছে করবে। আমার আজকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে তাই চলে যাবো।
~ অদ্ভুত!
~ অদ্ভুতের কি দেখলি?
~ ঠিকাছে ভাই। সিএনজিকে বলে দিবো?
~ দরকার নেই।
~ কেন?
~ আমরা চান্দের গাড়িতে যাবো।
~ গাড়ি কই পাবি?
~ সেটা আমার উপর ছেড়ে দে।
অবন্তি আর কথা বাড়াল না। পৃথাকে এখানে এসে অন্যরকম লাগছে। আগে কখনো এরকম লাগেনি। নাকি প্রকৃতি দেখে মেয়েটা বদলে গেলো কি জানি বাবাহ। সবকিছু আজগুবি লাগছে। অবন্তিকে সময় না দিয়ে ও বেশিরভাগ সময়ই বাইরে ঘুরে বেড়ায়।
পৃথা ফ্রেশ হয়ে এসে অবন্তিকে নিয়ে বসল। বুঝিয়ে বলতে লাগ নানান কথা। অবন্তি বললো, আমি বাসায় গিয়ে বাবাকে বলবো বিয়ে করতে চাই। আমার একা থাকতে ভালো লাগছে না।
~ এখনই বিয়ে করবি?
~ হ্যাঁ। তাহলে ছেড়ে যাওয়ার ভয়ও থাকবে না। আমি একা থাকতে পারবো না রে। আমার কষ্ট হয়। কারো ভালোবাসা আর কেয়ার ভীষণ মিস করি।
~ বুঝতে পারছি।
~ কিচ্ছু বুঝিস নি। কারো কেয়ার পেলে বুঝতি।
~ যা পেয়েছি তাতেই বুঝতে পারছি।
~ তুই আবার কার কেয়ার পেলি?
পৃথা হাসল। সায়ানের শরীরের উষ্ণতা, ওর কথা, ঝরণায় যাওয়ার মুহুর্তে ওর করা কেয়ার সবকিছুই পৃথাকে উদাস করে দিচ্ছে। কেমন যেন লাগে। ভোরবেলা থেকেই অস্থির হয়ে আছে ওর মনটা। আর ভালো লাগছে না।
অবন্তি পৃথাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে বুঝে গেল ও প্রেমে পড়েছে। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। যার যা খুশি করুক।
পৃথা গুণগুণ করে গান গাইতে লাগল। অবন্তি হা হয়ে দেখতে লাগল ওর চেনা বান্ধবীকে।
চান্দের গাড়িতে ফেরার সময় সায়ান অবন্তির মুখোমুখি বসল। দুজনে বারবার চোখাচোখি হচ্ছিল আর হাসছিল। গাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে। থেকে থেকে হেসে উঠছে সবাই।
খাগড়াছড়িতে এসে বাসের টিকেট কাটা নিয়ে বাঁধল ঝামেলা। পৃথাদের ফিরতি বাসের টিকেট কাটা নেই। তিন বান্ধবী পড়ে গেলো দুশ্চিন্তায়। সায়ান কাউন্টারে ঘুরে এসে দেখল সৌদিয়া বাসের পিছনের দিকে কয়েকটা সিট বাকি আছে। সায়ান ওর এক বন্ধুকে রাজি করিয়ে পৃথাকে বলল, তোমার দুই বান্ধবী কে আমাদের সিটে যেতে বলো। আর তুমি আমি আর আমার ফ্রেন্ড আমরা সৌদিয়া বাসে টিকেটের ব্যবস্থা করি। যদি পিছনেই দিকে বসে যেতে তোমার আপত্তি না থাকে। তোমার বান্ধবীকে তো আর আমার সাথে যেতে বলতে পারবো না। আর এই ফ্রেন্ড ছাড়া আমার কোনো বন্ধুই অন্য বাসে যেতে রাজি হবেনা। কারণ সবার গার্ল ফ্রেন্ড আছে।
~ আচ্ছা ঠিকাছে। আপনি আর আমি সৌদিয়ায় যাই।
পৃথা অবন্তিকে এসে কথাটা বলতেই অবন্তি বুঝে গেলো পৃথা সায়ানের সাথে যেতে বেশি আগ্রহবোধ করছে। তবে তাই হোক। অবন্তি রাজি হয়ে গেল। এরপর সায়ান ও ওর বন্ধুর সিটে অবন্তি ও তার বান্ধবী উঠে চলে গেলো। আর সৌদিয়া বাসের পিছনের দিকে টিকেট কেটে বসে অপেক্ষা করতে লাগল সায়ান ও পৃথা। ওদের বাস ছাড়বে আরো কিছুক্ষণ পরে।
বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত কাউন্টারেই বসে থাকতে হলো। একসাথে বসে চা খেল সায়ান ও পৃথা। সায়ান এখানকার আদিবাসিদের সম্পর্কে গল্প শোনাচ্ছিল। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে আজকের সন্ধ্যাটাকে সবচেয়ে অপূর্ব বলে মনে হচ্ছিল পৃথার। বুকের ভিতর টানটান উত্তেজনা কাজ করছে। পৃথা আমতা আমতা করে সায়ানক জিজ্ঞেস করলো, শুনুন..
~ হ্যাঁ বলো..
~ মানে আমি আর আপনি কি পাশাপাশি সিটে বসবো?
~ হ্যাঁ। কেন কোনো সমস্যা?
~ না।
~ সমস্যা হলে বলো। চেষ্টা করে দেখি মহিলা সিট পাওয়া যায় কিনা।
~ না না থাক। লাগবে না।
সায়ান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুচকি হাসল। একসাথে পাশাপাশি সিটে বসে ঢাকায় যাবে ভেবে উত্তেজনা কাজ করছিল পৃথার। বাসেও অনেক গল্প হবে তাহলে!
পর্ব ২২
খাগড়াছড়ি থেকে বাস ছাড়ল রাত ন’টায়। বাস ছাড়ার আগে সায়ান অনেক গুলো চিপস, চকোলেট, পেপসি, কেক এসব নিয়ে আসলো। পুরো প্যাকেট টা পৃথার কোলের উপর দিয়ে বললো, এগুলো বসে বসে খাও আর বাস জার্নি এনজয় করো।
~ তাই বলে এতগুলো?
~ হুম। পুরো রাস্তা খাবা।
~ আপনি খাবেন না?
~ আমি তো ঘুমাবো। একবারে ঢাকায় পৌঁছে তারপর ঘুম থেকে উঠবো।
পৃথার মনটা খারাপ হয়ে গেলেও সায়ানকে বুঝতে দিলো না। জানালা খুলে দিয়ে অন্ধকারেই বাইরে তাকিয়ে রইলো। চাইলেই খুব সুন্দর একটা জার্নি হতে পারে, উপভোগ্যকর। আর সে কিনা ঘুমাবে! মনেমনে কিছুটা রাগও জন্মালো পৃথার।
সায়ান একটা চিপসের প্যাকেট খুলে দিয়ে বললো, নাও।
পৃথা চিপস না নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। সায়ান একটা চিপস বের করে পৃথার মুখের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলো, হা করো।
পৃথা সায়ানের দিকে তাকালো। এখন আবার ভাব জমানো হচ্ছে। চোখে রাগ স্পষ্ট। সায়ান জানতে চাইলো রেগে আছো কিনা? পৃথা বলল, না।
~ কিঞ্চিত রেগে আছো।
~ হ্যাঁ আছি।
~ রেগে থাকলে চিপস খাওয়া যাবে না এমন আইন কে বের করেছে?
~ আমি করেছি।
~ রাগের কারণ কি জানতে পারি?
~ না পারেন না।
~ ও আচ্ছা।
~ আমার সামনে ও আচ্ছা ও আচ্ছা করবেন না।
~ তাহলে কি করবো?
সায়ান ফ্যালফ্যাল করে পৃথার দিকে তাকিয়ে রসিকতা করতে লাগলো। পৃথা হাসি আটকাতে পারলো না। জানালা দিয়ে শিরশির করে হাওয়া আসছে। চুল উড়ছে দিগ্বিদিক হয়ে। পৃথা চিপসের প্যাকেটে হাত ঢুকানোর সময় কাকতালীয় ভাবে সায়ানও হাত ঢুকিয়ে দিলো। তারপর দুজনে একসাথে হাত বের করতে গিয়ে ফেটে গেলো চিপসের প্যাকেট। চিপস গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে সায়ানের গায়ের উপর পড়ল।
খিলখিল করে হেসে উঠলো পৃথা। সায়ান গায়ের উপর থেকে একটা একটা করে চিপস তুলে খাওয়া শুরু করল। হাসতে লাগলো পৃথা।
চিপস শেষ করে সায়ান বাসের সিটে হেলান দিয়ে বললো, এখন আমি ঘুমাবো।
ক্ষণিকের জন্য রাগটা ভুলে গেলেও আবার রেগে গেলো পৃথা। কিন্তু রাগ করার মত অধিকার তো ওর নেই। আর কেনই বা রাগবে। সায়ান ওর কে! এসব ভেবে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রইলো। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সায়ান বুঝতে পারছে না পৃথা রেগে আছে কিনা।
কিছুদূর আসার পর এক জায়গায় চেকিং হচ্ছে। এখান থেকে সবগুলো বাস একসাথে ছাড়বে। বাসের সব যাত্রীর ছবি তোলা হচ্ছে। সায়ান মনেমনে ভাবছে, আপু নিশ্চয় বাসায় গিয়ে বাবা মাকে বলবে আমি আবারও পৃথার সাথে মিশছি।
ভাবতে ভাবতে বোনকে কল দিয়ে বাবা মাকে না জানানোর জন্য অনুরোধ করলো সায়ান। পৃথার কথা শুনলেই মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে। এখনো ওনারা হয়তো পৃথাকে মনে রাখেননি, কিন্তু সেই ফিরিয়ে দেয়ার কারণে এখনো সায়ানকে কথা শোনাতে ভোলেন না।
অনেক্ষণ সারা শব্দ নেই। পৃথা ভাবল সায়ান বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। নিজেও বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। তবুও চেষ্টা করা যাক।
বাস একবার একদিকে হেলে যাচ্ছে, আরেকবার অন্যদিকে। পাহাড়ি রাস্তা। ভীষণ দূর্গম। ভয়ও হচ্ছে আবার কোনো দূর্ঘটনা না ঘটে। সময়মত ব্রেক করতে না পারলে সোজা খাদে পড়ে যাবে। এতটাই ভয়ংকর রাস্তা। হঠাৎ বাস ব্রেক কষতেই সায়ান হাত বাড়িয়ে পৃথালে ধরে ফেলল। চমকে উঠল পৃথা। সায়ান তাহলে জেগেই আছে? নাকি ঘুমের ঘোরেও ওর মনে আছে পৃথা পাশে। ওকে আগলে রাখতে হবে।
পৃথা বাসের সিটে হেলান দিয়ে সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুমাচ্ছেন?
সায়ান পৃথার দিকে তাকালো। আবছা আলো বাস জুরে। স্পষ্ট না হলেও একে অপরকে দেখতে পাচ্ছে। সায়ান ও পৃথা দুজনের খুব কাছাকাছি। মুখোমুখি হয়ে চেয়ে আছে একে অপরের দিকে। দুজনের মুখেই মিষ্টি হাসি। কেউ কিছু বলছে না ঠিকই কিন্তু মনে মনে এক ধরণের ফিলিংস অনুভব করছে।
সায়ান পৃথাকে ওর অতীতের একটা গল্প বলতে শুরু করলো। কয়েক বছর আগে সায়ান পৃথার জীবন থেকে সরে আসার পর অনেকদিন একরোখা হয়ে ছিল। কারো সাথেই তেমন মিশত না। বন্ধুদের সাথে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। অর্পা এরপরেও অনেক চেষ্টা করেছে সায়ানকে কাছে টানার। সায়ান অর্পাকেও পাত্তা দেয় নি। মেয়েটা ক্ষমা চেয়েছিল, তবুও অর্পার উপর সায়ানের রাগ কমেনি। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে দৌড়ে এসে সায়ানকে বলল, আমাকে একটু মেডিকেল মোড়ে পৌঁছে দেবেন?
সায়ান মেয়েটার মুখ দেখে বুঝতে পারেনি তার কোনো বিপদ হয়েছে। ও রসিকতা করে বলেছিল, বাসের ড্রাইভারদের বুঝি পছন্দ হয়নি? বাইকের ড্রাইভারকে পছন্দ হলো?
~ আপনার কি মনে হচ্ছে আপনার চেহারা দেখে আমি বাইকে উঠতে চাচ্ছি। ছিহ, এ কেমন মন মানসিকতা। আমার বড় বোনকে হসপিটালে নেয়া হয়েছে। ওর বাচ্চা হবে।
~ সরি সরি। প্লিজ উঠুন আমি আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি।
মেয়েটা মুখ কঠিন করে গিয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়লো। সায়ান ক্ষমা চাওয়ার জন্য রিকশার পিছু পিছু ছুটছিল। মেয়েটা ধরে নিলো সায়ান বখাটে ছেলে। এরপর একদিন রাস্তায় দেখা। মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় সায়ানকে দেখে। তারপর অনেক গুলো দিন কেটে যায়। সায়ান ভুলেই যায় মেয়েটার কথা। আচমকা একদিন ধানমন্ডি লেকের পাশে মেয়েটা এসে এক থোকা পদ্ম ফুল দিয়ে সায়ানকে বললো, আমি আপনাকে ভালোবাসি।
সায়ান বুঝে উঠতে পারছিল না কি বলবে। এই মেয়ে দুদিন আগেও সায়ানকে দেখে ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাতো। হুট করে এসে আবার প্রপোজ করে দিলো। আজব মেয়ে মাইরি। মেয়েটা লজ্জা লজ্জা মুখে বলেছিল, আমি কি আপনার সঙ্গী হতে পারি?
সায়ান কোনোকিছু না ভেবেই প্রেম করতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন কারো সাথে বন্ধুত্বও ছিল না। একটা পাগলাটে মেয়ে এসে প্রপোজ করছে আর সায়ান তাকে ফিরিয়ে দিবে এমন সাধ্য ছিলো না। প্রেম করেছে প্রায় মাস সাতেক। হঠাৎ মেয়েটা উধাও হয়ে যায়। ফোন বন্ধ, ফেসবুকে একটিভ নেই। সায়ান কিছুদিন পর জানতে পারে ওর বাবা জোর করে ওকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। দেখতে এসেই বিয়ে করে নিয়ে গেছে। সায়ানকে জানানোর সুযোগ পর্যন্ত পায় নি। অবশ্য জানালেও কিছু করার ছিল না। কারণ তখন সায়ান মাত্র বিজনেসে হাত দিয়েছে। এই অবস্থায় বিয়ে করাটা একেবারেই অসম্ভব ছিলো সায়ানের জন্য। এভাবেই একটা প্রেম বিলুপ্ত হয়ে যায়।
গল্পটা শুনে পৃথা হাসবে নাকি কাঁদবে, কি রিয়েকশন দেবে বুঝতে পারলো না। স্যাড রিয়েক্ট দেয়া যায়। কিন্তু হাসি পাচ্ছে কোনো এক কারণে। কৌতুহলী হয়ে পৃথা জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা মেয়েটা কি অনেক সুন্দর ছিলো?
~ মোটামুটি ছিলো। একটু অগোছালো টাইপের।
~ আমার চেয়েও সুন্দর?
পৃথা অবাক চোখে সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবছা অন্ধকারে সায়ানের বুঝতে অসুবিধা হলোনা পৃথার সেই অবাক চাহনি। ও গভীর ভাবে তাকিয়ে বললো, আমার চোখে তোমার চেয়ে সুন্দর জগতে আর একটি মেয়েও দেখিনি।
একটা আনন্দধারা বয়ে গেলো পৃথার শরীর জুরে। সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করলো ওর। এমন করে কেউ কখনো বলেনি কেন! কি ভালো লাগছে কথাটা শুনতে। একেই বোধহয় বলে প্রিয়জনের প্রিয়বচন।
পৃথা জিজ্ঞেস করলো, ঘুমাবেন না?
সায়ান হাসতে হাসতে বলল, আমি কখনো বাসে ঘুমাই না।
~ তাহলে তখন বললেন কেন?
ছেলে মানুষের মতন পৃথা সায়ানকে মারতে শুরু করলো। সায়ান পৃথার হাত দুটো ধরে দমিয়ে দিল পৃথাকে। পৃথা সায়ানের হাতের মুঠোয় হাত রেখে সমানে হাত কচলাতে লাগলো। তবুও সায়ানের হাত থেকে ছাড়া পেলো না। কি শক্তি মানুষ টার বাবাহ!
বাস হেলেদুলে চলছে বলে একবার পৃথা সায়ানের উপর ঝুঁকে পড়ছে আর একবার সায়ান পৃথার উপর। যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখার, আর গাড়ির পেছনে বসলে যা ঝাঁকুনি খেতে হয়। তবুও পারা যাচ্ছে না। সায়ান বলল, তোমার চুলে কি শ্যাম্পু দাও?
~ ডাভ। কেন?
~ ভয়ংকর সেন্ট।
~ এটা আমার চুলের, শ্যাম্পুর নয়।
~ একটু শুঁকে দেখার অনুমতি পাবো?
পৃথা কিছু বলতে পারলো না। মাথাটা এগিয়ে দিলো সায়ানের দিকে। সায়ান নিচু হয়ে পৃথার চুলের গন্ধ শুঁকতে লাগলো। খামচি দিয়ে ধরলো পৃথার খোপার পিছনে। সায়ানের বুকের কাছে মুখ নিয়ে চোখ বন্ধ করে সায়ানের শরীরের অদ্ভুত সৌরভ অনুভব করতে লাগল পৃথা। আহ! কি সুন্দর!
সায়ান পৃথার চুলের গন্ধে পাগল হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। ও পৃথার বাহু ধরে পৃথাকে তুলে ধরে বললো, পরের জন্মে তোমার চুলের গন্ধ যেন এমনই থাকে।
~ থাকতো। কিন্তু আমি পরজন্মে বিশ্বাসী নই।
সায়ান হাসল। পৃথার চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে মাথায় বিলি কাটতে লাগল। পৃথা চোখ বন্ধ করে শুধু ফিল করছে। এ কেমন ভালোলাগা!
সায়ান পৃথাকে আচমকা কাছে টেনে নিয়ে চোখের দিকে তাকালো। পৃথার ঠোঁট কাঁপছে। সায়ান বললো, তোমার সেই চুম্বনের কথা মনে আছে?
~ হুম। প্রথম ঠোঁটের স্পর্শ। ভুলার কথা নাকি?
~ পৃথা, তোমার ঠোঁটে মধু আছে। একবার স্পর্শ করেই আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে সংযত করাটা ভীষণ কষ্টকর হয়ে উঠেছিল।
~ তাই!
~ হ্যাঁ।
অন্ধকারে সায়ান এক হাতে পৃথার গাল স্পর্শ করল। তারপর ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে দিলো। শিউরে উঠলো পৃথা। সায়ানের শার্ট খামচি দিয়ে ধরলো ও। সায়ান পৃথার চিবুকে আলতো করে স্পর্শ করলো, তারপর কপালে, নাকে, থুতনিতে, কানে। কানে হাত বুলানোর সময় পৃথা বারবার কেঁপে উঠছিল। অস্থিরতা বাড়ছে ক্রমশ। পৃথা স্থির হয়ে থাকতে পারছে না। এই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। পাগল পাগল লাগছে। পৃথার কান্না এসে যাচ্ছে। উত্তেজনায় ব্যকুল হয়ে সায়ানকে জড়িয়ে ধরলো পৃথা।
সায়ান বুঝতে পারলো আবেগের বশে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বাড়াবাড়িটা যেন ভুল না হয়ে যায়। আর কিছু না করে পৃথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, সরি পৃথা। পৃথা সায়ানকে খামচি দিয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। সায়ান পৃথাকে আর স্পর্শ করলো না। স্তব্ধ হয়ে রইলো। ক্ষণিক পর হাতটা রাখল পৃথার মাথার উপর। পৃথা কাদতে কাঁদতে বললো, আমাকে আর ছেড়ে যাবে না তো?
বুকের ভিতর একটা শিহরণ বয়ে গেলো সায়ানের। চোখ বন্ধ করে পৃথার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো, না রে। আর কখনো তোকে ছেড়ে যাবো না। তুই থাকবি তো আমার হয়ে?
পর্ব ২৩
খাগড়াছড়ি থেকে বাস ছাড়ল রাত ন’টায়। বাস ছাড়ার আগে সায়ান অনেক গুলো চিপস, চকোলেট, পেপসি, কেক এসব নিয়ে আসলো। পুরো প্যাকেট টা পৃথার কোলের উপর দিয়ে বললো, এগুলো বসে বসে খাও আর বাস জার্নি এনজয় করো।
~ তাই বলে এতগুলো?
~ হুম। পুরো রাস্তা খাবা।
~ আপনি খাবেন না?
~ আমি তো ঘুমাবো। একবারে ঢাকায় পৌঁছে তারপর ঘুম থেকে উঠবো।
পৃথার মনটা খারাপ হয়ে গেলেও সায়ানকে বুঝতে দিলো না। জানালা খুলে দিয়ে অন্ধকারেই বাইরে তাকিয়ে রইলো। চাইলেই খুব সুন্দর একটা জার্নি হতে পারে, উপভোগ্যকর। আর সে কিনা ঘুমাবে! মনেমনে কিছুটা রাগও জন্মালো পৃথার।
সায়ান একটা চিপসের প্যাকেট খুলে দিয়ে বললো, নাও।
পৃথা চিপস না নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। সায়ান একটা চিপস বের করে পৃথার মুখের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলো, হা করো।
পৃথা সায়ানের দিকে তাকালো। এখন আবার ভাব জমানো হচ্ছে। চোখে রাগ স্পষ্ট। সায়ান জানতে চাইলো রেগে আছো কিনা? পৃথা বলল, না।
~ কিঞ্চিত রেগে আছো।
~ হ্যাঁ আছি।
~ রেগে থাকলে চিপস খাওয়া যাবে না এমন আইন কে বের করেছে?
~ আমি করেছি।
~ রাগের কারণ কি জানতে পারি?
~ না পারেন না।
~ ও আচ্ছা।
~ আমার সামনে ও আচ্ছা ও আচ্ছা করবেন না।
~ তাহলে কি করবো?
সায়ান ফ্যালফ্যাল করে পৃথার দিকে তাকিয়ে রসিকতা করতে লাগলো। পৃথা হাসি আটকাতে পারলো না। জানালা দিয়ে শিরশির করে হাওয়া আসছে। চুল উড়ছে দিগ্বিদিক হয়ে। পৃথা চিপসের প্যাকেটে হাত ঢুকানোর সময় কাকতালীয় ভাবে সায়ানও হাত ঢুকিয়ে দিলো। তারপর দুজনে একসাথে হাত বের করতে গিয়ে ফেটে গেলো চিপসের প্যাকেট। চিপস গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে সায়ানের গায়ের উপর পড়ল।
খিলখিল করে হেসে উঠলো পৃথা। সায়ান গায়ের উপর থেকে একটা একটা করে চিপস তুলে খাওয়া শুরু করল। হাসতে লাগলো পৃথা।
চিপস শেষ করে সায়ান বাসের সিটে হেলান দিয়ে বললো, এখন আমি ঘুমাবো।
ক্ষণিকের জন্য রাগটা ভুলে গেলেও আবার রেগে গেলো পৃথা। কিন্তু রাগ করার মত অধিকার তো ওর নেই। আর কেনই বা রাগবে। সায়ান ওর কে! এসব ভেবে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রইলো। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সায়ান বুঝতে পারছে না পৃথা রেগে আছে কিনা।
কিছুদূর আসার পর এক জায়গায় চেকিং হচ্ছে। এখান থেকে সবগুলো বাস একসাথে ছাড়বে। বাসের সব যাত্রীর ছবি তোলা হচ্ছে। সায়ান মনেমনে ভাবছে, আপু নিশ্চয় বাসায় গিয়ে বাবা মাকে বলবে আমি আবারও পৃথার সাথে মিশছি।
ভাবতে ভাবতে বোনকে কল দিয়ে বাবা মাকে না জানানোর জন্য অনুরোধ করলো সায়ান। পৃথার কথা শুনলেই মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে। এখনো ওনারা হয়তো পৃথাকে মনে রাখেননি, কিন্তু সেই ফিরিয়ে দেয়ার কারণে এখনো সায়ানকে কথা শোনাতে ভোলেন না।
অনেক্ষণ সারা শব্দ নেই। পৃথা ভাবল সায়ান বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। নিজেও বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। তবুও চেষ্টা করা যাক।
বাস একবার একদিকে হেলে যাচ্ছে, আরেকবার অন্যদিকে। পাহাড়ি রাস্তা। ভীষণ দূর্গম। ভয়ও হচ্ছে আবার কোনো দূর্ঘটনা না ঘটে। সময়মত ব্রেক করতে না পারলে সোজা খাদে পড়ে যাবে। এতটাই ভয়ংকর রাস্তা। হঠাৎ বাস ব্রেক কষতেই সায়ান হাত বাড়িয়ে পৃথালে ধরে ফেলল। চমকে উঠল পৃথা। সায়ান তাহলে জেগেই আছে? নাকি ঘুমের ঘোরেও ওর মনে আছে পৃথা পাশে। ওকে আগলে রাখতে হবে।
পৃথা বাসের সিটে হেলান দিয়ে সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুমাচ্ছেন?
সায়ান পৃথার দিকে তাকালো। আবছা আলো বাস জুরে। স্পষ্ট না হলেও একে অপরকে দেখতে পাচ্ছে। সায়ান ও পৃথা দুজনের খুব কাছাকাছি। মুখোমুখি হয়ে চেয়ে আছে একে অপরের দিকে। দুজনের মুখেই মিষ্টি হাসি। কেউ কিছু বলছে না ঠিকই কিন্তু মনে মনে এক ধরণের ফিলিংস অনুভব করছে।
সায়ান পৃথাকে ওর অতীতের একটা গল্প বলতে শুরু করলো। কয়েক বছর আগে সায়ান পৃথার জীবন থেকে সরে আসার পর অনেকদিন একরোখা হয়ে ছিল। কারো সাথেই তেমন মিশত না। বন্ধুদের সাথে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। অর্পা এরপরেও অনেক চেষ্টা করেছে সায়ানকে কাছে টানার। সায়ান অর্পাকেও পাত্তা দেয় নি। মেয়েটা ক্ষমা চেয়েছিল, তবুও অর্পার উপর সায়ানের রাগ কমেনি। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে দৌড়ে এসে সায়ানকে বলল, আমাকে একটু মেডিকেল মোড়ে পৌঁছে দেবেন?
সায়ান মেয়েটার মুখ দেখে বুঝতে পারেনি তার কোনো বিপদ হয়েছে। ও রসিকতা করে বলেছিল, বাসের ড্রাইভারদের বুঝি পছন্দ হয়নি? বাইকের ড্রাইভারকে পছন্দ হলো?
~ আপনার কি মনে হচ্ছে আপনার চেহারা দেখে আমি বাইকে উঠতে চাচ্ছি। ছিহ, এ কেমন মন মানসিকতা। আমার বড় বোনকে হসপিটালে নেয়া হয়েছে। ওর বাচ্চা হবে।
~ সরি সরি। প্লিজ উঠুন আমি আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি।
মেয়েটা মুখ কঠিন করে গিয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়লো। সায়ান ক্ষমা চাওয়ার জন্য রিকশার পিছু পিছু ছুটছিল। মেয়েটা ধরে নিলো সায়ান বখাটে ছেলে। এরপর একদিন রাস্তায় দেখা। মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় সায়ানকে দেখে। তারপর অনেক গুলো দিন কেটে যায়। সায়ান ভুলেই যায় মেয়েটার কথা। আচমকা একদিন ধানমন্ডি লেকের পাশে মেয়েটা এসে এক থোকা পদ্ম ফুল দিয়ে সায়ানকে বললো, আমি আপনাকে ভালোবাসি।
সায়ান বুঝে উঠতে পারছিল না কি বলবে। এই মেয়ে দুদিন আগেও সায়ানকে দেখে ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাতো। হুট করে এসে আবার প্রপোজ করে দিলো। আজব মেয়ে মাইরি। মেয়েটা লজ্জা লজ্জা মুখে বলেছিল, আমি কি আপনার সঙ্গী হতে পারি?
সায়ান কোনোকিছু না ভেবেই প্রেম করতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন কারো সাথে বন্ধুত্বও ছিল না। একটা পাগলাটে মেয়ে এসে প্রপোজ করছে আর সায়ান তাকে ফিরিয়ে দিবে এমন সাধ্য ছিলো না। প্রেম করেছে প্রায় মাস সাতেক। হঠাৎ মেয়েটা উধাও হয়ে যায়। ফোন বন্ধ, ফেসবুকে একটিভ নেই। সায়ান কিছুদিন পর জানতে পারে ওর বাবা জোর করে ওকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। দেখতে এসেই বিয়ে করে নিয়ে গেছে। সায়ানকে জানানোর সুযোগ পর্যন্ত পায় নি। অবশ্য জানালেও কিছু করার ছিল না। কারণ তখন সায়ান মাত্র বিজনেসে হাত দিয়েছে। এই অবস্থায় বিয়ে করাটা একেবারেই অসম্ভব ছিলো সায়ানের জন্য। এভাবেই একটা প্রেম বিলুপ্ত হয়ে যায়।
গল্পটা শুনে পৃথা হাসবে নাকি কাঁদবে, কি রিয়েকশন দেবে বুঝতে পারলো না। স্যাড রিয়েক্ট দেয়া যায়। কিন্তু হাসি পাচ্ছে কোনো এক কারণে। কৌতুহলী হয়ে পৃথা জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা মেয়েটা কি অনেক সুন্দর ছিলো?
~ মোটামুটি ছিলো। একটু অগোছালো টাইপের।
~ আমার চেয়েও সুন্দর?
পৃথা অবাক চোখে সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবছা অন্ধকারে সায়ানের বুঝতে অসুবিধা হলোনা পৃথার সেই অবাক চাহনি। ও গভীর ভাবে তাকিয়ে বললো, আমার চোখে তোমার চেয়ে সুন্দর জগতে আর একটি মেয়েও দেখিনি।
একটা আনন্দধারা বয়ে গেলো পৃথার শরীর জুরে। সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করলো ওর। এমন করে কেউ কখনো বলেনি কেন! কি ভালো লাগছে কথাটা শুনতে। একেই বোধহয় বলে প্রিয়জনের প্রিয়বচন।
পৃথা জিজ্ঞেস করলো, ঘুমাবেন না?
সায়ান হাসতে হাসতে বলল, আমি কখনো বাসে ঘুমাই না।
~ তাহলে তখন বললেন কেন?
ছেলে মানুষের মতন পৃথা সায়ানকে মারতে শুরু করলো। সায়ান পৃথার হাত দুটো ধরে দমিয়ে দিল পৃথাকে। পৃথা সায়ানের হাতের মুঠোয় হাত রেখে সমানে হাত কচলাতে লাগলো। তবুও সায়ানের হাত থেকে ছাড়া পেলো না। কি শক্তি মানুষ টার বাবাহ!
বাস হেলেদুলে চলছে বলে একবার পৃথা সায়ানের উপর ঝুঁকে পড়ছে আর একবার সায়ান পৃথার উপর। যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখার, আর গাড়ির পেছনে বসলে যা ঝাঁকুনি খেতে হয়। তবুও পারা যাচ্ছে না। সায়ান বলল, তোমার চুলে কি শ্যাম্পু দাও?
~ ডাভ। কেন?
~ ভয়ংকর সেন্ট।
~ এটা আমার চুলের, শ্যাম্পুর নয়।
~ একটু শুঁকে দেখার অনুমতি পাবো?
পৃথা কিছু বলতে পারলো না। মাথাটা এগিয়ে দিলো সায়ানের দিকে। সায়ান নিচু হয়ে পৃথার চুলের গন্ধ শুঁকতে লাগলো। খামচি দিয়ে ধরলো পৃথার খোপার পিছনে। সায়ানের বুকের কাছে মুখ নিয়ে চোখ বন্ধ করে সায়ানের শরীরের অদ্ভুত সৌরভ অনুভব করতে লাগল পৃথা। আহ! কি সুন্দর!
সায়ান পৃথার চুলের গন্ধে পাগল হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। ও পৃথার বাহু ধরে পৃথাকে তুলে ধরে বললো, পরের জন্মে তোমার চুলের গন্ধ যেন এমনই থাকে।
~ থাকতো। কিন্তু আমি পরজন্মে বিশ্বাসী নই।
সায়ান হাসল। পৃথার চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে মাথায় বিলি কাটতে লাগল। পৃথা চোখ বন্ধ করে শুধু ফিল করছে। এ কেমন ভালোলাগা!
সায়ান পৃথাকে আচমকা কাছে টেনে নিয়ে চোখের দিকে তাকালো। পৃথার ঠোঁট কাঁপছে। সায়ান বললো, তোমার সেই চুম্বনের কথা মনে আছে?
~ হুম। প্রথম ঠোঁটের স্পর্শ। ভুলার কথা নাকি?
~ পৃথা, তোমার ঠোঁটে মধু আছে। একবার স্পর্শ করেই আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে সংযত করাটা ভীষণ কষ্টকর হয়ে উঠেছিল।
~ তাই!
~ হ্যাঁ।
অন্ধকারে সায়ান এক হাতে পৃথার গাল স্পর্শ করল। তারপর ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে দিলো। শিউরে উঠলো পৃথা। সায়ানের শার্ট খামচি দিয়ে ধরলো ও। সায়ান পৃথার চিবুকে আলতো করে স্পর্শ করলো, তারপর কপালে, নাকে, থুতনিতে, কানে। কানে হাত বুলানোর সময় পৃথা বারবার কেঁপে উঠছিল। অস্থিরতা বাড়ছে ক্রমশ। পৃথা স্থির হয়ে থাকতে পারছে না। এই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। পাগল পাগল লাগছে। পৃথার কান্না এসে যাচ্ছে। উত্তেজনায় ব্যকুল হয়ে সায়ানকে জড়িয়ে ধরলো পৃথা।
সায়ান বুঝতে পারলো আবেগের বশে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বাড়াবাড়িটা যেন ভুল না হয়ে যায়। আর কিছু না করে পৃথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, সরি পৃথা। পৃথা সায়ানকে খামচি দিয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। সায়ান পৃথাকে আর স্পর্শ করলো না। স্তব্ধ হয়ে রইলো। ক্ষণিক পর হাতটা রাখল পৃথার মাথার উপর। পৃথা কাদতে কাঁদতে বললো, আমাকে আর ছেড়ে যাবে না তো?
বুকের ভিতর একটা শিহরণ বয়ে গেলো সায়ানের। চোখ বন্ধ করে পৃথার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো, না রে। আর কখনো তোকে ছেড়ে যাবো না। তুই থাকবি তো আমার হয়ে?
পর্ব ২৪
ব্লক করার ঠিক বিশ মিনিটের মাথায় আনব্লক করে দিয়েছে পৃথা। সায়ান প্রথমে লিখলো, রাগটা দ্রুত কমে যাবে জানতাম কিন্তু এত দ্রুত কমে যাবে জানতাম না। পরক্ষণেই আবার মেসেজটা মুছে ফেললো। কারণ মেয়েদের রাগ ভয়ংকর জিনিস। কখন ওঠে, কখন নেমে যায় ঠিক নেই। ব্লক বিষয়ে কোনো কথাই বললো না।
লিখলো, আমি কি ভিডিও কল দিতে পারি একবার?
~ কেন?
~ প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করা যায় জানতাম না তো।
~ না দিতে পারেন না।
~ পারি না?
অনেক্ষণ পর পৃথা লিখল, আচ্ছা দিন।
ভিডিও কলে পৃথাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। গালে ও গলায় ঘাম জমেছে। সায়ান জিজ্ঞেস করলো, ঘামছো কেন?
~ এক্সারসাইজ করছিলাম।
~ ঘামলে তোমাকে কেমন লাগে জানো?
~ না তো। কেমন?
~ সে.. নাহ, সুন্দর।
সায়ান হাসল। পৃথা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বললো, আপনার মোচ বেশি বড় হয়ে গেছে।
~ তাই? কেটে ফেলবো।
~ ক্লিন শেভ করেন না কেন আপনি?
~ ভালো লাগে না তাই।
~ আপনাকে একবার ক্লিন শেভে দেখেছিলাম। বেশ মনে আছে। অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছিল আপনাকে।
~ সত্যিই!
~ হ্যাঁ।
~ তাহলে এখন থেকে মাঝেমাঝে করতেই পারি।
~ আই ডোন্ট মাইন্ড। আমি কিন্তু স্পষ্ট কথা বলতেও পছন্দ করি আর শুনতেও। আপনি কেন নন?
~ কে বলল?
~ এইযে তখন কথা ঘুরিয়ে নিলেন। ঘামলে আমাকে কেমন লাগে বলতে গিয়েও বললেন না।
সায়ান হাসলো। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, সেটা শুনতে ইচ্ছে করছে?
~ কেন নয়? এখন পূর্ণ যৌবন আমার। কাছের মানুষ টা আমাকে বললে শুনতে খারাপ লাগবে কেন?
~ সিরিয়াসলি পৃথা! তুমি এটা বলছো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
~ হা হা হা। রাতে খেয়েছেন?
~ হ্যাঁ। তুমি?
~ হুম। আপনাকে আমার সামনাসামনি দেখতে ইচ্ছে করছে।
~ এত রাতে?
~ কেন? এত রাতে ইচ্ছে হতে পারেনা? আপনার ভিডিও কলে দেখার ইচ্ছে হতে পারে আর আমার বাস্তবে।
সায়ান একবার চোখ নিচে নামাচ্ছে আর একবার পৃথার দিকে তাকাচ্ছে। মনেমনে হাসছে পৃথা। এত রাতে সায়ানকে ডাকলে আসবে কিনা সেটাই পরীক্ষা করতে চাইছে ও। আগে তো আসত, এখনও আসবে কি?
সায়ান বলল, আচ্ছা আসছি। ফোন রাখো।
সায়ান ফোন রেখে দিলো। পৃথা মুহুর্তেই দৌড়ে বেলকুনিতে চলে এলো। সায়ান এখানে পৌঁছতে আরো পনেরো/ বিশ মিনিট লাগবে। কিন্তু পৃথার অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে। মাঝেমাঝে কিসব অদ্ভুত ইচ্ছে যে হয়!
পৃথার হঠাৎ কি মনে এলো কে জানে। ছুটে রুমে গিয়ে তারাহুরো করে জামাকাপড় বদলে হালকা সাজুগুজু করে নিলো। তারপর ধীরপায়ে দরজা খুলে বাসার বাইরে বেরিয়ে এলো। গেটে দাড়োয়ানকে ফিসফিস করে বলল, আমি হাঁটতে যাচ্ছি। ফিরে এলে দরজা খুলে দেবেন।
~ এত রাতে হাঁটতে যাবেন?
~ হ্যাঁ। হাঁটার ইচ্ছে যখন তখন হতে পারে। এর জন্য আবার রাত দিনের তফাৎ কি বলুন তো?
দাড়োয়ান কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। পৃথা বাসার বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলো। সায়ান বাইক চালিয়ে আসার সময় দূর থেকে দেখে চমকে উঠল। প্রথমে ভেবেছিল অন্য কেউ হবে হয়তো। কিন্তু ধীরেধীরে পৃথার মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এত রাতে ও বাইরে আসবে এটা অকল্পনীয় ছিল সায়ানের। ওর বিশ্বাস ছিল পৃথা বেলকুনিতেই থাকবে। কিন্তু আজ যেন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে।
পৃথার মুখটা হাসিহাসি। সায়ান বাইক থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাইরে এসেছো কেন?
~ আপনাকে দেখতে। আমার না একটু পাগলামি করতে ইচ্ছে করছে।
~ কি ধরণের পাগলামি?
~ ফাঁকা ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছে। নিয়ে যাবেন আমায়?
~ এ আবার কেমন ইচ্ছে? এত রাতে?
~ ইচ্ছের আবার রাত বিরাত আছে নাকি? বলুন না নিয়ে যাবেন আমায়?
~ হুম। চলো।
পৃথা বাইকের পিছনে উঠে পড়ল। একটা হাত রাখলো সায়ানের কাঁধের উপর। সায়ান চমকালো। এমন রোমান্টিক ভাবে কাঁধের উপর হাত রাখার মেয়ে পৃথা অন্তত ছিলো না। আজ শুধু চমকানোর পালা।
বাইক চালাচ্ছে ধীরগতিতে। পৃথা দুহাতে সায়ানকে পিছন দিক থেকে আঁকড়ে ধরলো। রাতের ঠান্ডা বাতাসে হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার মত ফিলিংস হচ্ছিল। ফাঁকা রাস্তা। বাইক ছুটছে দ্রুত গতিতে। পৃথা দুহাত দুদিকে মেলে দিয়ে বসে রইলো। এত আনন্দ হচ্ছে!
বাতাসের ঝাপটায় নিজেকে পাখির মত মনে হচ্ছে। ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় পৃথা খুশিতে চিৎকার করছিলো। সায়ান কিছুদূর গিয়ে বাইক থামিয়ে বলল, নামো। ফিল নাও।
ফ্লাইওভার প্রায় ফাঁকা। মাঝেমাঝে একটা দুটো গাড়ি চলে যাচ্ছে। দুজনে এক সাইডে গিয়ে দাঁড়াল। দেখতে লাগল রাতের শহরকে। পৃথার মজা লাগছে। এর আগে কখনো এভাবে ফ্লাইওভারে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়নি ও। তাও আবার রাত্রিবেলা। রাতের শহরকে ভীষণ ভালো লাগছে। টিমটিমে আলো জ্বলছে সব জায়গায়। রাস্তার মাথার উপরে জ্বলছে ল্যাম্পপোস্ট। হলুদ আলোয় ঢাকা রাতের শহর। বিমোহিত হয়ে যাচ্ছে পৃথা।
সায়ান বললো, ভালো লাগছে?
~ থ্যাংকস সায়ান। আমার ইচ্ছে পূর্ণ করার জন্য।
~ আমি কখনো কারো ইচ্ছেকে এতটা গুরুত্ব দেইনি। যতটা তোমার ইচ্ছেকে দেই।
পৃথা হাসলো। সায়ান পৃথাকে বাইকে উঠতে বলে আবার বাইক ছাড়ল। অনেক দূর আসার পর ফুটপাতে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ালো। টং দোকানে চা খাওয়ার অভ্যেস আছে সায়ানের। পৃথার এই প্রথম এমন অভিজ্ঞতা। ও বেশ উপভোগ করলো ব্যাপারটা। চায়ে চুমুক দিয়ে প্রশংসায় বিগলিত হয়ে পড়েছিল। বলল, আমরা মাঝেমাঝে এখানে রাত্রিবেলা চা খেতে আসতে পারি?
~ হ্যাঁ পারি। তুমি চাইলে অবশ্যই নিয়ে আসবো।
বাইকে উঠে সায়ানকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে রইলো পৃথা। সায়ানের পিঠের উপর মাথা রাখলো। অনুভব করছিল সায়ানের উষ্ণতা। ইচ্ছে করছে এখন থেকে প্রতিদিন রাতে এভাবে ঘুরতে বের হতে। কিন্তু প্রতিদিন করলে সেটার আনন্দ থাকবে না। মাঝেমাঝে বের হওয়া যেতেই পারে। তবে বিয়ের পর। বিয়ের চিন্তা মাথায় আসতেই লজ্জা লজ্জা লাগতে আরম্ভ করলো। মূলত সে জন্যই আজ সায়ানের সাথে বের হওয়া।
বাসায় পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো সায়ান। পৃথা দারোয়ানকে ডাকলে উনি দরজা খুলে দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। পৃথা বলল, ছেলেটাকে কেমন লাগছে মামা? ওর সাথে আমার বিয়ে হলে কেমন হবে?
~ ছেলেটাকে আমি চিনি আপা। অনেক বছর আগে সে আপনার জন্য অনেক কিছু করছে।
~ মানে?
দাড়োয়ান বললো, সে প্রতিদিন আইসা আপনের খবর নিতো, কেমন আছেন কই আছেন, সুস্থ আছেন কিনা, কবে আসবেন এইসব। কি যে পাগলামি করছিল আপনের খবর না পাইয়া। আপনারে দেখার জন্য রাস্তার পাশে খাড়ায়া থাকতো। প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা কইরা খাড়ায়া থাকতো।আমি এত কইতাম আপা বাইরে আসবো না। আপনে চইলা যান। সে যাইত না। জানালার দিকে চাইয়া রইতো, ব্যালকনির দিকে চাইয়া রইত। একদিন বাপ মা নিয়াও আসছিল। ভাবছিলাম বিয়াটা হইয়া যাইবো। কিন্তু হইলো না। ক্যান হইলো না তাও জানলাম না। খালি দেখলাম ছেলেটা মন খারাপ কইরা বাইর হইয়া গ্যালো। আইজ এত বছর পর আবার দেখলাম। বিশ্বাস ই হউতেছে না আপনেরা আবার একত্র হইছেন।
পৃথা কি বলবে বুঝতে পারবে না। সায়ানের বিষয়ে দারোয়ানের বলা কথাগুলো ওকে ভীষণ নাড়িয়ে দিয়েছে। সায়ান এত কষ্ট করেছে অথচ পৃথা ওকে পাত্তাই দেয় নি। অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে, ফোন ধরেনি, ফেসবুকে ব্লক করেছে। ছেলেটাকে এত আঘাত করার পরও ও কোনো রিভেঞ্জ নিতে চায় নি। কখনো কটু কথাও বলে নি। এমন একটা মানুষ কে অযথা কষ্ট দেয়াটা মোটেও উচিত হয়নি। নিজের কাজের জন্য অনুতাপ হচ্ছে পৃথার।
পৃথা ঘরে এসে চিন্তায় পড়ে গেল। যে মানুষটার সব পাগলামি পৃথার অগোচরেই রয়ে যেত। সায়ান কখনো বলেও নি সে বাসার সামনে এসে চাতকের মত তাকিয়ে থাকত। আর রোজ আসত এটাও তো কম কথা নয়। পৃথার দূর্বলতা বাড়ছে সায়ানের প্রতি। মনটা টানছে। সামনে বসিয়ে রেখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
এতবার সুযোগ পেয়েও সায়ান কোনো সুযোগ নিলো না। পৃথা বাসে বাঁধা না দেয়া সত্তেও সায়ান আগ বাড়িয়ে কিছু করে নি। এর মানে তো এটাই সায়ান পৃথাকে অনেক সম্মান করে। এখনো! এতকিছুর পরও এখনো এত সম্মান। পৃথার ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে সায়ানাকে ও আগে ফিরিয়ে দিয়েছে। বাবা মাও চেয়েছিলেন সায়ানের সাথে বিয়েটা হয়ে যাক। তখন নিজের ইগো নিয়ে সবার কথার অবাধ্য হয়েছে পৃথা। এখন সবার সামনে যাবে কি করে!
পরদিন সকালে ফেসবুকে ঢুকে পৃথা দেখে সায়ানের কোনো টেক্সট আসেনি। অথচ ও অপেক্ষা করে ছিল সায়ান অনেক গুলো মেসেজ পাঠাবে। হয়তো বা সায়ানও পৃথার অপেক্ষায় ছিলো। নিজে থেকে আর কতই বা ধরা দেবে। পৃথা সংকোচ ভুলে লিখলো, মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কি করে? রাত থেকে একটিবারও আমাকে স্মরণ করলো না।
অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও সায়ানকে অনলাইনে না পেয়ে অফলাইনে চলে গেলো পৃথা। কি বিরক্ত লাগছে। অপেক্ষা এত কষ্টের হয় কেন!
সামান্য মেসেজের অপেক্ষাই পৃথাকে বুঝিয়ে দিলো সায়ানের অপেক্ষা করতে কেমন লাগতো। সে দিনরাত পৃথার ফোন আর মেসেজের অপেক্ষায় থাকতো। বাসার সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো। কিভাবে করেছে ও এসব! পৃথা ক্রমশই দূর্বল হয়ে পড়ছে সায়ানের প্রতি।
আজ হঠাৎ শাড়ি পরতে ইচ্ছে করলো। শাড়ি পরে সেজেগুজে পৃথা বসে রইল। সায়ান অনলাইনে আসামাত্রই ভিডিও কল দিলো। পৃথাকে দেখে চমকালো সায়ান। শাড়িতে এই প্রথম! ও বিমোহিত হয়ে অনেক্ষণ কথা বলতে পারলো না।
পৃথা জিজ্ঞেস করলো, আমাকে দেখে কি ইচ্ছে করছে?
~ উমম, খোলা সবুজ প্রান্তরে হাঁটতে।
~ আর?
~ হাতে হাত রাখতে।
~ হাত যদি ধরতে না দিই?
~ জোর করে ধরবো।
~ যদি জোর খাটানোর কারণে মামলা করি?
~ হাত ধরার অপরাধে যদি মামলা হয়ে যায়, তবে আমি জেল খাটতে রাজি আছি। তবুও হাত ধরা ছাড়বো না।
~ তাই?
~ হুম। মহারানীর হঠাৎ শাড়ি যে?
~ এমনি। ইচ্ছে হলো। আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাবো কাল পরশুর মধ্যে।
~ এর আগে একবার দেখা করবে না?
~ করা যেতে পারে। কারণ আর ঢাকায় আসবো না হয়তো। একেবারে জবের প্রস্তুতি নিয়ে।
~ এখন ও জবের চিন্তা মাথায়?
~ হা হা হা। বিজনেস নিয়ে একটু লেকচার দিন তো।
~ শাড়ি পরা কন্যাকে বিজনেসের কথা বললে মানাবে না।
~ কি মানাবে?
~ অবশ্যই সংসারের কথা।
~ সংসার!
পৃথার একটা কেমন নরম অনুভূতি হলো। সংসার! কি মিষ্টি শব্দ। কখনো কারো মুখে এ শব্দ শুনে এত ভালো লাগেনি যতটা সায়ানের মুখে শুনে ভালো লাগছে। সব মেয়েদেরই স্বপ্ন থাকে সংসার নিয়ে, স্বামী নিয়ে। পৃথার কখনোই ছিলো না। এই প্রথম সায়ানের কথা শুনে সংসার নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে। এত ভালো লাগছে কেন?
সায়ান বিষয়টা বুঝতে পেরে আর কোনো প্রশ্নে না গিয়ে বললো, সংসার একটা পবিত্র বিষয়। বাবা মাকে দেখেছি বছরের পর বছর বিনা দ্বন্দে সংসার করছে। মাঝেমাঝে ঝগড়া হলে দুজনেই খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েন। দুজনেরই চেষ্টা থাকে কে আগে ঝগড়া মেটাতে পারে। অথচ বেশিরভাগ স্বামী স্ত্রীকে দেখি ইগো নিয়ে বসে থাকে। ঝগড়া হলে কেউই আগে কথা বলতে চায় না।
পৃথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলো সায়ানের কথা। তারপর বললো, আপনি খুব সুন্দর করে বললেন সংসার শব্দটা।
~ সংসার বিষয়টা অনেক সুন্দর পৃথা। আমরাই এটাকে জটিল করে তুলি।
~ হুম।
সায়ান বললো, রোজ সকালে চায়ের কাপ নিয়ে কেউ একজন ঘুম ভাঙাবে। মিষ্টি হাসিতে দুজনের সকাল শুরু হবে। খুনসুটি, দুষ্টুমি আর একসাথে খাওয়া, একসাথে গোসল, একসাথে ঘুমানো। মাঝেমাঝে বউ রান্না করবে আর বর পাশে দাঁড়িয়ে গল্প শোনাবে। জটিলতা মুক্ত একটা জীবন। এমন হলে কতই না সুন্দর হয় বলো?
পৃথা কল্পনায় ডুবে গেছে। দেখতে পাচ্ছে একটা ছোট্ট সাজানো গোছানো সংসার। খুব যত্ন করে ও খাবার রান্না করে, টেবিলে সাজায়। সায়ানকে ডাকলে ও এসে খেতে বসে। বিষয়টা সুন্দর। মাঝেমাঝে খাইয়ে দেবে। আগলে রাখা আর ভালো রাখা দুটো মিলে একটা সুন্দর সুখী জীবন হবে। ইস! সবকিছু যদি কল্পনার মত হতো।
সায়ান জিজ্ঞেস করলো, আমার বউকে একটা ছোট্ট রাজ্য উপহার দিবো। আমার সংসার টাই হবে আমার রাজ্য। আমার মিষ্টি বউটা সারাদিন ছুটোছুটি করবে সেখানে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবো। পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আকাশ দেখবো। তারা গুণবো। মাঝেমাঝে বাইরে চা খেতে যাবো। ফ্লাইওভারের উপরে দাঁড়িয়ে শহর দেখবো। আহা জীবন!
পৃথা স্বপ্নের ঘোরে ডুবে গেছে। এই ছেলেটা একটা নতুন স্বপ্নে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওকে। এমন করে স্বপ্ন দেখেনি আগে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি!
পর্ব ২৫
সংসারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে পৃথা। রাতে ঘুমের ঘোরেও দেখছে নানান স্বপ্ন। সায়ান আর ওর একটা ছোট্ট সংসার হয়েছে। সায়ান বাজার করে আনে, পৃথা রান্না করে। সকালে এক কাপ চা নিয়ে সায়ানের ঘুম ভাঙায়। সায়ান ঘুম ঘুম চোখে পৃথার দিকে তাকায়, পৃথাকে বুকে টেনে নেয়। পৃথার ভেজা চুল সায়ানের বুক আর মুখের উপর পড়লে শিউরে ওঠে সায়ান। বাসি ঠোঁটে একটা গভীর চুম্বন। কত মধুর সব স্বপ্ন পৃথার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে।
রাতে কয়েকবার ঘুম ভেঙে গেলো। প্রত্যেকবার চোখ মেলার পর ওর মনেহয় এবারও সায়ানকে নিয়ে নতুন একটা স্বপ্ন দেখেছে। অবচেতন মনের সমস্ত ভাবনা রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন হয়ে ধরা দিচ্ছে। পৃথা বুঝতে পারছে না কি করে এই ভূতটাকে তাড়াবে মাথা থেকে। মাঝেমাঝে উঠে বিছানার উপর চুপ মেরে বসে থাকে। বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নাহ, মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে। কাল পরশুর মধ্যেই গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। অনেকদিন মাকে দেখা হয় না।
সকালবেলা নাস্তা করে পৃথা চলে এলো অবন্তির বাসায়। অবন্তি তখনও ঘুমাচ্ছে। পৃথা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুম থেকে তুললো ওকে। অবন্তি চোখ কচলে জিজ্ঞেস করলো, কখন এসেছিস?
~ এইমাত্র। ওঠ তো। অনেক বেলা হয়েছে।
অবন্তির চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। চুলগুলো উশকো খুশকো। জট বেধে আছে। যেন এই কদিন চুল আচড়ায় নি ও। পৃথা চিরুনি এনে অবন্তির চুল আচড়ে দিয়ে বললো, ওঠ। আমি একটু আন্টির সাথে কথা বলতে চাই।
অবন্তি হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখলো পৃথা নাস্তা নিয়ে বসে আছে। পাশে ওর মা। এতক্ষণ দুজনের মধ্যে কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। অবন্তি আসতেই ওরা চুপ করে গেলো। ও বলল, কি আলাপ হচ্ছিল শুনি? আমায় নিয়ে?
মা বললেন, না তেমন কিছু না। তুই নাস্তা কর।
মা উঠে গেলেন। অবন্তি নাস্তা খেতে খেতে পৃথাকে জিজ্ঞেস করলো, তা প্রেম কেমন চলছে?
~ কিসের প্রেম? কার প্রেম?
~ আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কিসের প্রেম?
~ তো?
~ তোর প্রেম। বাসে নিশ্চয় ই হেভি রোমান্স হয়েছে।
~ না। কিছুই হয়নি। আমি ওসব পছন্দ করিনা তুই জানিস।
~ পছন্দ ঠিকই করিস এটাও জানি। আসলে এরকম সুযোগ কখনো পাস নি, আর আদর করবে এরকম কাউকে কখনো পাস নি।
পৃথা পরোটা মুখে পুরে বলল, সায়ানের সাথে একবার একটা বাড়িতে থাকার সুযোগ হয়েছিল। ওর বন্ধুর বাসা। রাতে সুযোগ ছিল। আমি সুযোগের আশ্রয় নেইনি।
অবন্তি অবাক হয়ে বললো, তারমানে প্রেমটা আগেও ছিল? মাঝখানে কি ব্রেক আপ?
~ ঠিক ব্রেক আপ নয় আবার ঠিক প্রেমও নয়।
~ তাহলে কি?
~ তোকে সব বলবো। আন্টিকে রাজি করিয়েছি। তুই আমার সাথে আমাদের গ্রামের বাসায় যাবি। কয়েকদিন থাকবি আমার সাথে। অনেক গল্প হবে।
অবন্তি কি যেন ভেবে বললো, যাবো। বাসায় থাকলে প্রচন্ড ডিপ্রেশন কাজ করে রে। তোর কাছে থাকলে একটু শান্তি পাবো।
~ ব্যাগ গুছিয়ে রাখিস। আমরা কালকেই যাবো।
পৃথা অবন্তিকে অনেক্ষণ সময় দিয়ে দুপুরের পরপর বের হলো ওর বাসা থেকে। এর মধ্যে একবারও অনলাইনে যায় নি। বাসায় ফিরে ওয়াইফাই অন করতেই মেসেঞ্জারের টুংটুং শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো চারিদিক। পৃথা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সায়ান। অনেক মেসেজ পাঠিয়েছে। পৃথাকে অনলাইনে দেখেই ভিডিও কল পাঠালো।
ফোনের স্ক্রিনে সায়ানের মুখ দেখে পৃথা বললো, খুব চিন্তিত নাকি?
~ মেয়ে মাইর চিনো? ফোন নাম্বার দাও তোমার। এক্ষুনি দাও।
~ হা হা হা। কি করবেন নাম্বার দিয়ে? বিকেলে বের হবো। ধানমন্ডি লেকে আসতে পারবেন?
ধানমন্ডি লেকে বসে দুজনে গল্প করে পুরোটা বিকেল কাটিয়ে দিয়েছিলো। মাঝেমাঝে খুব সাধারণ সময় গুলোও একজন সঙ্গীর গুণের কারণে অসাধারণ হয়ে ওঠে। বিকেলের রং তখন রঙিন মনেহয়। ঝালমুড়ি ওয়ালার ঝালমুড়ি বানানোর স্টাইলেও একটা আর্ট খুঁজে পাওয়া যায়। লেকের জলে রৌদ্রছায়া অপূর্ব মনেহয়। জীবনে একজন সঠিক সঙ্গীর কারণেই কেউ সুখী হয় আবার কেউ অসুখী। পৃথার আজকাল প্রায়ই মনেহয় সায়ানের চেয়ে ভালো কেউ ওর জীবনে আসবে না। এই মানুষটা এতকিছুর পরও ওর জন্য অপেক্ষা করে, ওর জন্য ছুটে আসে৷ তাকে আর অবহেলা করবে না পৃথা।
পৃথার গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে সায়ানের মনটা বিষন্ন হয়ে উঠেছিল। তবে নিয়মিত কথা হবে এই আশ্বাস দেয়ায় কিছুটা শান্ত হয়েছে মন। দুজনের কেউই হয়তো মুখে বলতে পারছে না। তবে সত্যি এটাই যে একজন আরেকজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
সায়ান পৃথাকে বাসায় নামিয়ে দেবার আগে ফুটপাত থেকে কাঁচের চুড়ি ও খোপার গাজরা কিনে দিয়েছে। পৃথা প্রথমে নিতে চায়নি। পরে সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে আর আপত্তি করতে পারে নি। শেষ বেলায় পৃথার হাতটা একবার ধরার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক সংকোচ আটকে রেখেছিলো সায়ানকে।
পরেরদিন পৃথা গ্রামে চলে আসে। সাথে আসে অবন্তি। দুই বান্ধবী মিলে পুকুরে ঝাঁপাঝাপি করে গোসল করে, মাছ ধরে, মায়ের সাথে রান্নাবান্না করে একটা দিন আনন্দেই কাটিয়ে দেয়। গ্রামের নতুন পরিবেশের প্রভাবে অবন্তির ডিপ্রেশন কেটে উঠছিলো। দুজনে মিলে বিকেল বেলা টংয়ের উপর বসে হাওয়া খায়, সন্ধ্যার আগে আগে ধানক্ষেতের পাশে হেঁটে বেড়ায়। ধীরেধীরে স্বাভাবিক ও উৎফুল্ল হয়ে উঠছিল অবন্তি।
পৃথার সাথে সায়ানের মেসেঞ্জারেই চ্যাটিং ও ভিডিও কল হচ্ছিল। পৃথা এখনো ওর নাম্বার দেয়নি সায়ানকে। আসলে দেবার কথা মনেও আসেনি। যখন নিয়মিত কথাই হয়।
হঠাৎ একদিন পৃথা বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে আসে৷ সায়ানকে জিজ্ঞেস করে, বিজনেস তো ভালোই জমেছে। বিয়ে করবেন কবে?
সায়ান বলে, সেটা তুমি জানো৷ তুমি যখন চাইবে।
পৃথা দুষ্টুমি করে বলেছিলো, আমি যদি বলি কালকেই?
অনেক্ষণ সায়ানের রিপ্লাই নেই। ও একটা ইমোজি দিয়ে অফলাইনে চলে যায়। আর সবুজ বাতিটি জ্বলে ওঠে না। সায়ানের সাথে কথা বন্ধ হয়ে যায় এভাবেই। বারবার সায়ান মেসেঞ্জারে নক দেয় না, কল দেয় না, পৃথার মেসেজও সিন হয় না। ধীরেধীরে সায়ানের নামের পাশে active two days ago লেখা ওঠে। পৃথা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সায়ান তো এমন করার মানুষ নয়। ওর হঠাৎ কি হলো? সবকিছু কি এখানেই শেষ করে দিতে চায়? নাকি কোনো বিপদ হলো!
পৃথার মাঝেমাঝে মনেহয় সায়ান ওকে এভোয়েড করছে। ওকে ভুলে যেতে চাইছে। বিয়ের কথা তোলামাত্রই এমন করে উধাও হয়ে গেলো। ফোন নাম্বার টাও নেয়া হয়নি। ফোন দিয়ে খোঁজ নেবে সে সুযোগ টাও নেই। সায়ানের কোনো বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগ করার উপায়ও নেই।
আবার মাঝেমাঝে মনেহয় সায়ান ইচ্ছে করেই এমন করছে। ওকে আর মেসেজ পাঠাবে না পৃথা।
কিন্তু পাঠাতে না চাইলেও মেসেজ দিয়ে বসে। অপেক্ষা করে ওর উত্তরের। অপেক্ষা করে থাকে সায়ানের নামের পাশে আবার সবুজ বাতি জ্বলে ওঠার৷ কিন্তু এই অপেক্ষার অবসান হয় না।
পৃথার মনটা ভেঙে যাচ্ছে। সায়ানের নিশ্চয় অন্য কোনো আইডি আছে। সে আইডি দিয়েই ও ফেসবুক চালায়। পৃথার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়াটা ওর ইচ্ছেকৃত কাজ।
মনকে চাইলেই ধরে রাখা যায় না। পাগল মন বারবার ছুটে যায় তার কাছে। কতবার সায়ানের আইডিতে ঢুকে আগের মেসেজ গুলো পড়তে থাকে, কতবার সায়ানের প্রোফাইল ঘুরে আসে, ছবিগুলো দেখে। কিন্তু মন শান্ত হয় না। সায়ানের ছবি সেভ করে গ্যালারিতে। রাত্রিবেলা রুমে এসে সায়ানের ছবিটাকে ওয়ালপেপার করে দেয় পৃথা। কিন্তু মনের ভেতর খচখচানি টা থামছে না।
অবশেষে সায়ানের আইডিতে গিয়ে সাজেক ট্যুরের ছবিতে ট্যাগ করা সায়ানের বোনের প্রোফাইলে গিয়ে তাকে নক দেয় পৃথা।
~ আপু। আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।
সেই মেসেজও সিন হয়না। সারা দিন কেটে যায়, রাত হয়। অপেক্ষা করতে থাকে পৃথা। যখন এখানেও কোনো উত্তর মেলে না তখন সায়ানের প্রোফাইলের ট্যাগ থেকে ওর এক বন্ধুকে নক দিয়ে রাখে।
সে দ্রুত রিপ্লাই দেয়, জ্বি বলুন।
~ আমাকে চিনতে পেরেছেন? সাজেক থেকে ফেরার সময় আপনি আমি আর সায়ান একই বাসে ছিলাম।
~ জ্বি চিনতে পেরেছি আপু। ভালো আছেন?
পৃথা তার উত্তর না দিয়ে বলে, সায়ানের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আপনি ওর কোনো খোঁজ জানেন?
~ না আপু। ওর সাথে অনেকদিন কথা হয়না।
~ একটু খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবেন ওর কি হয়েছে? ফেসবুকে আসেনা অনেকদিন।
~ ওর নাম্বার নেই আপনার কাছে?
~ না নেই।
~ সেকি? নাম্বার রাখবেন না। আমি দিচ্ছি।
পৃথা সায়ানের নাম্বারে কল দিয়ে দেখে বন্ধ। তাহলে কি এসব ইচ্ছে করেই করছে সায়ান? পৃথা মানতে পারছে না।
অভিমানে বুক ফেটে কান্না আসছে। নাম্বার টাও বন্ধ রেখেছে। চার বছর আগে #পৃথা যেরকম আচরণ করেছিল সায়ান এখন ঠিক সেটাই করছে। এসব ওর সাজানো প্লান ছিলো। পৃথার দূর্বলতা বুঝতে পেরে এতদিন ভালোবাসার নাটক করেছে। এসব ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়ল পৃথা। বালিশে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলো।
অবন্তি জানতে চাইলো, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন এভাবে?
~ আমার সাথে খেলা করেছে সায়ান। রিভেঞ্জ নিয়েছে।
~ মানে কি? কিসের রিভেঞ্জ?
~ আমি ওর সাথে যেরকম করেছিলাম। ও ঠিক সেভাবেই আমাকে এভোয়েড করছে।
~ তোকে কে বলেছে? সায়ানের সাথে তোর কথা হয়েছে?
~ না।
~ তাহলে?
পৃথা চোখ মুছে বললো, ওর নাম্বার বন্ধ। ফেসবুকে আসেনা অনেকদিন। নিশ্চয় আরেকটা আইডি চালাচ্ছে। আমিও চার বছর আগে এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিলাম। ফেসবুক আইডি চেঞ্জ করেছিলাম, নাম্বার চেঞ্জ করেছিলাম। সায়ান তখন এতটাই কষ্ট পেয়েছে যতটা এখন আমি পাচ্ছি। ও রিভেঞ্জ নেয়ার জন্য এসব করেছে।
~ তুই সায়ানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা কর। একবার কথা হলেই ওকে জিজ্ঞেস করবি কেন এমন করলো?
~ জিজ্ঞেস করে কি লাভ বল? আমি ওকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি।
~ এখন বোঝ ও কতটা কষ্ট পেয়েছিল।
~ বুঝতে পারছি রে। সায়ানের উপর রাগ করতে পারছি না। একবার কথা হলেই ওকে বুঝিয়ে বলবো আমি ওর কষ্টটা ফিল করছি। সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যায়। ওকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতেই পারছি না।
~ কি বলিস?
পৃথা বালিশ বুকে চেপে ধরে বললো, নিজের অজান্তেই ওকে এতটা ভালোবেসে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি।
সত্যিই ভালোবাসাটা অজান্তেই কারো প্রতি এসে যায়। আমরা যেটা বুঝতেও পারি না। আর যখন বুঝতে পারি তখন হয়তো সঠিক সময় নয়। নিজেদের ভালোবাসা আর ভুল দুটোই বুঝতে পারলে সরি বলার সুযোগ টা তারা আমাদেরকে দেয় না। পৃথা জানেনা আসলেই সায়ানের কি হয়েছে।
একেকবার একেক চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে ও। কখনো মনে হয় সায়ান ওকে এভোয়েড করছে। আবার কখনো মনে হয় সায়ান কোনো বিপদে পড়েছে!
পর্ব ২৬
ভালোবাসার রংটা জীবনে হঠাৎ আসে। রংধনুর মত মনের আকাশটা রাঙিয়ে দিয়ে যায়। আবার হঠাৎ বৃষ্টির মত ভিজিয়ে দিয়েও যায়। পৃথার এখন সেই দশা। ক্রমাগত চোখের পাপড়ি ভিজছে ওর। যাকে পাবার জন্য এত আকুলতা, তার ফোন নাম্বার টাও না নেয়ার অপরাধে নিজেকে শাস্তি দিতে মন চাইছে। মন এত ছেলেমানুষী কেন করে?
বিষন্ন মনে সারাদিন কাটলো পৃথার। দিনে অনেকবার ফোন করে দেখলো নাম্বার টা এখনো বন্ধ। আর পারছে না ও। এবার খুব অভিমান জমছে। মনে হচ্ছে সায়ান ইচ্ছেকৃত ভাবে এমন খেলছে ওর সাথে। আর যদি সত্যিই এটাই হয় তাহলে সায়ানকে কখনো ক্ষমা করবে না ও।
আহত পাখির মত ছটফট করতে করতে হঠাৎ কি মনে করে অনলাইনে এসে দেখলো সায়ানের বন্ধুর মেসেজ। বুকটা ধড়াক করে উঠলো ওর।
~ Apu Shayan accident koreche. Or phone venge geche tai number off ache. Ekhon hospital a admitted.
মেসেজ দেখে বুকের উপর ওঠা ঢেউ যেন আরো ফুলে ফেঁপে উঠলো। মানুষটা হাসপাতালে পড়ে আছে অথচ পৃথা কি না ওর উপর অভিমান করছে! এ কেমন নিষ্ঠুরতম হৃদয় আমার! অবশ্য বারবার মনে কু ডাক আসছিলো। মনে হচ্ছিলো সায়ানের কোনো বিপদ হয়েছে। পৃথার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। রাতে খেতেও পারলো না ঠিকমতো। ঘুমাতেও পারছিল না। কেবল প্রার্থনা করে সায়ানের সুস্থতা কামনা করছিল। মাঝরাতে কান্না চেপে রাখতে না পেরে অবন্তিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ওর কান্নার শব্দে পাশের রুম থেকে মা ছুটে আসলেন। পৃথা মাকে জানালো সায়ান এক্সিডেন্ট করেছে। ওর আর কোনো খবর পাচ্ছি না। আমাকে কালকেই ঢাকায় যেতে হবে। প্লিজ মা..
মা প্রথমে বেশ অবাক হলেন। এত বছর পর সায়ানের নামটা মেয়ের মুখে শুনেও যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মেয়েটা কখনো কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায় নি। বিয়ের কথা বলতে দেয় নি। দীর্ঘদিন পর প্রথম কারো জন্য কাঁদছে তাও আবার সায়ানের জন্য। ওদের কি তবে আবার প্রেম হয়েছে? মনে প্রশ্ন লুকিয়ে রেখে মা বললেন, আচ্ছা কালকে যাস। আমি তোর বাবাকে বুঝিয়ে বলবো। টাকা পয়সা বা কিছু লাগলে আমাকে বলিস।
পরেরদিন সকাল সকাল পৃথা অবন্তিকে নিয়ে রওনা হলো। জ্যামের কারণে সন্ধ্যা হয়ে গেলো পৌঁছাতে। সায়ানের বন্ধুর কাছে হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে সোজা সেখানে উপস্থিত হলো পৃথা। কিন্তু জানেনা কোথায়, কত নাম্বার কেবিনে সায়ান আছে। অনেক ছোটাছুটি করে অবশেষে খুঁজে বের করে রুমের দরজায় এসে বড় বড় শ্বাস ফেলতে লাগলো। এমন সময় সেখানে এসে দাঁড়ালেন সায়ানের বাবা। উনি পৃথার মুখের দিকে তাকিয়ে চেহারা কঠিন করে ফেললেন। পৃথা সালাম দিলে উনি উত্তর না দিয়ে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। পৃথাকে আসতেও বললেন না। পৃথা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। সায়ান বেডে শুয়ে আছে। বুকে, হাতে, পায়ে ব্যান্ডেজ। মুখটা ভীষণ কালো হয়ে আছে ওর। চোখ দুটো নিতান্তই ছোট ছোট করে চেয়ে আছে। পৃথাকে দেখে যেন চোখ দুটো চমকে উঠলো। পৃথার উপস্থিতি নাড়িয়ে দিলো সায়ানকে। তবে বাবা ও পৃথা দুজনকে একসাথে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে ও।
সেদিন রাতে পৃথা যখন বিয়ের প্রসঙ্গ তুলেছিলো, তখনই সরাসরি বাবাকে গিয়ে ও বিয়ের কথা জানায়। বাবা মা বিয়ের কথা শুনে খুশি হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যখন পৃথার নাম উচ্চারণ করলো, ঠিক তখনই বাঁধলো বিপত্তি। বাবার চেয়ে মা রেগে আগুন। যে মেয়ে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে এ বাড়ির বউ করে নিয়ে আসা অসম্ভব ব্যাপার। উনি কিছুতেই এ বিয়েতে রাজি হবেন না। সায়ানের বাবারও একই কথা। নিজের ব্যবসা বাণিজ্য ফেলে যে মেয়ের বাবার পিছনে সময় ব্যয় করে তিনি বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই মেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাও আবার সরাসরি। আত্মসম্মান থাকা অবস্থায় ওনারা কখনো আর ওই মেয়েকে মেনে নেবেন না।
সায়ান অনেক চেষ্টা করেও লাভ হয়নি উল্টো ক্ষতি হয়েছে। বাবা একসময় রেগে গিয়ে এমন সব কথা বলে ফেলেন যা সায়ান ওর জন্মের পর কখনো শোনেনি। ওর মাথায়ও রক্ত উঠে যায়। রাগে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় ও। কিন্তু বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক পা ফেলতেই একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারপর থেকেই হাসপাতালে। হুশ আছে, বারবার চেয়েছিলো পৃথার সাথে যোগাযোগ করতে কিন্তু কেউই ওকে ফোন হাতে দেয় নি। আজকে পৃথাকে দেখে তাই অবাক না হয়ে পারছে না।
পৃথা সংকোচে এগিয়ে আসতে পারছে না। সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সায়ানের মা ভেতরে ছিলেন। উনিও বেশ অবাক। কিন্তু স্বামীর ভয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলছেন না। নিরবে কেটে গেলো অনেক্ষণ।
বাবা বললেন, ডাক্তার এসেছিল কখন?
সায়ানের মা জবাব দিলেন, কিছুক্ষণ আগে। একটা মেডিসিন দিয়ে গেছে।
~ দাও আমাকে। রাতে কি খাবে ও? কি আনবো?
সায়ান পৃথার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি আমার এখানে এসে বসো। কিভাবে জানলে আমি হাসপাতালে?
সায়ানের বাবা মা দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এ অবস্থায় কিছু বলতেও পারছেন না। বাবা ওষুধের নামটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পৃথা কাছে গিয়ে বসল সায়ানের। কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, কি করে হয়েছে এমন?
~ বাদ দাও ওসব। তুমি আজকেই বাড়ি থেকে এসেছো মনে হচ্ছে?
~ হ্যাঁ। সোজা এখানে এসেছি। এখন কেমন লাগছে?
~ অনেক ভালো। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে সুস্থ হয়ে গেছি।
সায়ানের মা রাগী রাগী মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। সায়ান বললো, তুমি বোধহয় সকাল থেকে কিছু খাও নি। ওখানে হটপটে ভাত আছে, বাটিতে তরকারি আছে। নিয়ে খেতে বসো তো আমি দেখি।
পৃথা অবাক হলো। শুধু অবাক না, বেশ অবাক হলো। এই অবস্থায়ও সায়ান ওর দিকে খেয়াল রাখছে। একটা মানুষ কি করে এত ভালো হয়!
সায়ান বললো, চুপ করে আছো কেন? যাও খাবার নিয়ে আসো। নিয়ে আসো তো। লজ্জার কিছু নেই।
পৃথা চুপচাপ বসে রইলো। সায়ানের মা ছেলের কথাবার্তায় অবাক। মেয়েটার প্রতি তাহলে ভীষণ প্রেম আছে বলতে হবে। উনি চুপ না থেকে উঠে বাইরে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় শব্দ করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে গেলেন।
পৃথা অবাক হয়ে সায়ানের দিকে তাকালো। কি বলবে বুঝতে পারলো না। বাবা মা দুজনের আচরণ দেখেই মনে হলো ওনারা পৃথার উপর রেগে আছেন। কিংবা পৃথাকে পছন্দই করেন না। না করাটাই স্বাভাবিক। পৃথা ওনাদের সাথে যা করেছেন তার বদৌলতে ভালোবাসা প্রাপ্তির আশা কোনোভাবেই করা যায় না।
সায়ান বললো, যাও খাবার নিয়ে আসো।
~ খালার বাসায় গিয়ে খাবো। এখন কিছুতেই খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না।
~ আমার বাবা মায়ের আচরণে মন খারাপ কোরো না প্লিজ।
~ করিনি। ওনারা কি আমার উপর রেগে আছেন?
~ একটু।
সায়ান আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো কতটুকু। হেসে ফেললো পৃথা। সায়ান পৃথার হাত ধরে বললো, কেমন আছো তুমি? তোমার কথা ভেবে ভেবে শরীরটা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো আমার।
~ কে বলেছে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে?
~ তুমি করোনি?
~ আমাকে দেখে বুঝতে পারছেন না? পাগলের মত দুটো দিন কেটেছে আমার।
~ ইস রে। স্যরি প্রিয়া আমার। স্যরি।
পৃথা কিছুক্ষণ সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু হয়ে এসে সায়ানের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুম্বন করলো। অমৃতের মত বোধ হলো সেই চুমু। সায়ান বললো, আমি সুস্থ হয়ে গেছি৷ একদম সুস্থ।
পৃথা আরেকবার চুমু খেলো আলতো করে। সায়ান পৃথার হাত শক্ত করে ধরে বলল, আমার উপর ভরসা রেখো তুমি। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।
~ আপনিও আমার উপর ভরসা রাখবেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সায়ানের মা চলে এসেছেন কেবিনে। ওনাকে দাঁড়িয়ে থাকলে কেমন দেখায়। পৃথা চেয়ার ছেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। সায়ান বললো, তুমি এখন বাসায় চলে যাও।
পৃথা তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। বের হয়ে আসার সময় সায়ানের মা ডেকে বললেন, শোনো। তুমি আর কখনো এখানে আসবে না। আর কখনো যেন তোমাকে এখানে না দেখি। দেখলে মুখে যা আসবে তাই বলবো। আশাকরি যেচে অপমানিত হওয়ার ইচ্ছে তোমার নেই।
কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন। পৃথার মনটা কিছুক্ষণের জন্য ভালো হলেও আবার আধার নেমে এলো। উনি এমন আচরণ করবেন এটা পৃথা ভাবতেও পারে নি। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেছে। কান্না পাচ্ছে ওর। ভেবেছিল কাল সকালেই হাসপাতালে চলে আসবে। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হবে না। কি যে করবে!
চোখ মুছতে মুছতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলো পৃথা। মনের ভেতর প্রবল বেগে ঝড় বইছে। সায়ান বলেছে অন্তত চারদিনের আগে ও হাসপাতাল থেকে ছাড়বে না। তাহলে কি এই চারদিন যোগাযোগ হবে না? সারা রাত নির্ঘুম কাটলো ওর। শেষ রাতে আর থাকতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিলো আন্টি যাই বলুক না কেন, পৃথা অবশ্যই যাবে সায়ানের সাথে দেখা করতে। সায়ানকে না দেখে কিছুতেই থাকতে পারবে না ও।
হাসপাতালে আসার সময় নিজের হাতে খাবার রান্না করে নিয়ে এলো পৃথা। মায়ের সামনে বলতে লজ্জা পেলেও সায়ানের মন চাইছিল যদি পৃথা ওকে খাইয়ে দিতো। সেটা বলতে না পেরে মাকে বলল, মা তুমি আমাকে খাইয়ে দাও। আর পৃথার হাতের রান্না খেয়ে দ্যাখো তো ও কেমন রাঁধে। হাজার হলেও তোমার বাড়ির রাঁধুনী হবে। তোমার সাথে মিলবে কি না দ্যাখো।
সায়ানের মা ছেলের মুখের উপর কিছু বলতে পারলেন না। সহ্য করতেও পারলেন না। উনি অন্যদিকে রাগী রাগী মুখে তাকিয়ে রইলেন। আজকে অবন্তি ভেতরে এসেছে। গতকাল পৃথাকে রেখেই চলে গিয়েছিলো। ও সায়ানের সাথে বিভিন্ন কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগল। দুপুর পর্যন্ত বসে রইলো পৃথা। এর মধ্যে সায়ানের মায়ের সাথে ওর কোনো কথা হয় নি। উনি কিছুক্ষণের জন্য আজকে বাইরেও যান নি। পৃথা লাজ লজ্জা ভুলে সায়ানের শিয়রের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার সময় বললো, কালকে আবার আসবো। ততক্ষণ ভালো থাকবেন।
পৃথা বেরিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। একবারও পিছন ফিরে তাকালো না। দ্রুত আড়াল হয়ে গেলো ও। যেন আন্টি ওকে কিছু বলার সুযোগ না পান। গেটে আসার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো ও। সায়ান সুস্থ হলে আশাকরি সবকিছু ঠিক করে নেয়ার একটা উপায় পাওয়া যাবে। তবে এটুকু নিশ্চিত যে সায়ানের মা একেবারেই পৃথাকে পছন্দ করেন না।
পরেরদিন আবারও রান্নাবান্না করে পৃথা হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। গত রাতটা ওর একেবারেই ঘুম হয় নি। শুধু ভেবেছে কখন সায়ানের দেখা পাবে। সায়ানকে না দেখতে পেলে যেন ওর শান্তি হবে না। আসলেই তাই। কি এক অস্থিরতায় সময় পার হতে লাগল ওর।
কিন্তু করিডোরে আসামাত্র হঠাৎ সায়ানের মা এসে সামনে দাঁড়ালেন। মুখ কঠিন করে বললেন, তোমাকে নিষেধ করেছিলাম আসতে। তারপরও কেন এসেছো? খুব দুঃসাহস তাই না? নূন্যতম লজ্জাবোধটুকু তোমার নেই। নয়তো মায়ের সামনে বসে ছেলের সাথে প্রেম করতে পারতে না। শোনো, আমরা তোমাকে আমাদের বাড়ির বউ করতে চাই না। তুমি আর সায়ানের কাছে যাবে না।
~ আপনার ছেলে ও কি তাই চায়?
~ বড়দের মুখের উপর কথা বলবা না। চলে যাও। আর আসবে না। সায়ানকে কিভাবে বোঝাতে হয় আমি দেখে নেবো। আজকে কোনোভাবেই তোমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবো না আমি।
পৃথার কান্না এসে গেলো। ওনার সামনে দিয়ে সায়ানের কাছে যাওয়াটা নিতান্তই বেয়াদবি হয়ে যাবে। সায়ানকে না দেখে থাকতেও পারবে না ও। তবুও বুকে পাথর চেপে আজকে ওকে চলে আসতে হলো। কারণ আন্টির সামনে বেয়াদবি করলে উনি পৃথাকে আরো অপছন্দ করবেন।
বাসায় ফিরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশ ভিজিয়ে ফেললো পৃথা। এতদিন কোনো অশান্তি ছিলো না, যন্ত্রণা ছিলো না। ভালোবাসার পর এত জ্বালা কেন? সায়ানের সাথে পুনরায় দেখা না হলেই বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু সায়ানের কাছে থাকলে এত সুখ সুখ লাগে! ভালোবাসার যন্ত্রণাও যেমন ভারি, এর সুখটুকুও অসীম!
পর্ব ২৭
সায়ান পৃথার অপেক্ষায় না খেয়ে বসে আছে। শরীর মোটামুটি সুস্থ। আজকে মনটাও ভীষণ ফুরফুরে।সায়ান ঠিক করে রেখেছে আজ পৃথা আসলেই মায়ের সাথে বসিয়ে দুজনের মধ্যে যেভাবেই হোক একটা সন্ধি করিয়ে দেবে। একই রুমে দুজনেই অনেক্ষণ বসে থাকে তবুও কেউ কারো সাথে কথা বলে না। পৃথা মাঝেমাঝে দু একটা কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কোনো লাভ হয় নি। মা কোনো উত্তর ই দেন নি। উনি পৃথাকে বেশ অপছন্দ করেন সেটা ওনার আচরণেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারপরও সায়ান চেষ্টা করে দেখতে যায়। পৃথার সামনেই ও মাকে বলবে, ‘মা তুমি ওর সাথে কথা বলো না কেন? ও কে কি তোমার খুব বেশি খারাপ লাগে মা? এমন একটা মেয়েকে কি করে আদর না করে থাকতে পারো তুমি? তুমি না মা? মা কি কখনো মেয়েকে দূরে রাখতে পারে?’
কিন্তু ভাবনা সেটা ভাবনার জায়গাতেই রয়ে গেলো। বেলা বয়ে যাচ্ছে এখনো পৃথার আসার নামগন্ধ নেই। একবার ফোন করে ওর খোঁজ নেবে সেই সুযোগ ও নেই। প্রথমত মোবাইল ফোন নেই, দ্বিতীয়ত পৃথার নাম্বারও নেই। বসে বসে শুধুই অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো। সায়ান বেডে বসে আছে। মাটিতে পা ফেলতে পারবে না এখন। নয়তো জানালার পাশে গিয়ে একবার উঁকি দিতো। অনেক সময় পার হয়েছে, পৃথার তো এত দেরি করার কথা নয়। এবার তো মন খারাপ হতে শুরু করেছে। অপেক্ষা না করলে একটা কথা ছিলো। যখন কারো জন্য খুব করে অপেক্ষা করা হয় আর তাকে পাওয়া না যায়, তাহলে সত্যিই কষ্ট হয়। মনকে তো আর সবসময় নিয়ন্ত্রণ করে রাখা যায় না।
সায়ান অস্থির হতে শুরু করেছে। মা সায়ানকে দেখে বুঝতে পারলেন ছেলে কেন এমন করছে। ওনার মন এতে এতটুকুও গললো না। আর যাই হোক ওই মেয়ের বিষয়ে এক বিন্দু ভাবার ইচ্ছেও ওনার নেই। সায়ানকে কিভাবে বোঝাবেন সেটা নিয়েই চিন্তিত উনি।
সায়ান বলল, মা আমরা কবে বাড়ি যাবো? আমি তো সুস্থ হয়ে গেছি। তাহলে আর হসপিটালে পড়ে থাকা কেন?
~ তুই বেশি বুঝিস নাকি? ডাক্তার বলেছে আরো দুদিন থাকতে হবে।
~ মা, ওরা তো বলবেই। একটু জেদ করলেই বাসায় যেতে দেবে।
~ কেন জেদ করবো?
~ আমার এখানে একদমই ভালো লাগছে না। এর আগে কখনো হাসপাতালে আসিনি আমি। খুব বোর লাগছে।
~ লাগুক। ডাক্তার যা বলবে তাই করবো আমরা। তুই কেন বুঝছিস না তোর ভয়াবহ বিপদ হতে পারতো। সবসময় ছেলেমানুষি ভালো না সায়ান।
~ আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। তারপরও আমাকে তুমি বাচ্চা বলতে পারো না। এখানে কোনো ছেলেমানুষী আমি করছি না। আমি ভেবেচিন্তে পৃথার সাথে সারাজীবন থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরা এটাকে মানতে চাও না কেন?
~ ও একটা মেয়ে হলো? এর চেয়ে ভালো মেয়ে দিয়ে তোকে বিয়ে দেবো।
~ আমার পৃথাকেই চাই। আমার জন্য ওর চেয়ে ভালো কেউ হবে না। তুমি না জেনে ওকে নিয়ে কথা বোলো না তো মা।
~ একটা অচেনা মেয়ের সাথে দু দিনের পরিচয়ে মা পর হয়ে গেলো?
মায়ের কণ্ঠটা কাঁদোকাঁদো শোনালো। সায়ান পড়লো মহাবিপদে। এবার শুরু হলো মাকে সান্ত্বনা দেয়া। যা প্লান করে রেখেছিল সব ভেস্তে গেলো। পৃথাও এলো না। এদিকে মা কাঁদছেন। সায়ান বসে বসে মাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বোঝাতে লাগলো। পৃথার বিষয়টা আপাতত এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না।
বিকেল পেরিয়ে গেলো। এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে অর্পা দাঁড়িয়ে বলল, আসবো?
সায়ানের মা উঠে গিয়ে অর্পাকে ভেতরে নিয়ে এলেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস মা?
~ জ্বি আন্টি ভালো আছি। সায়ান এখন কেমন আছে? আমি আজকেই শুনলাম ও এক্সিডেন্ট করেছে। শোনার পর আর থাকতে পারিনি। ছুটে এলাম। যদিও সায়ান এখন আমাকে সহ্য করতে পারে না।
গত চার বছরে অর্পা অনেক ভাবেই সায়ানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সায়ান অর্পাকে পাত্তা দেয় নি। শেষমেষ বাধ্য হয়ে অর্পা বন্ধু হয়ে থাকার আবদার জানিয়েছিল। সায়ান বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখেছে ঠিকই কিন্তু কখনো নিজে থেকে খোঁজ খবরও নেয়নি। অর্পা ই মাঝেমাঝে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতো কেমন আছিস? সায়ান দায়সারা কথাবার্তা বলে রেখে দিতো। তবে মায়ের সাথে অর্পার সম্পর্কটা আম আর আমের আঁটির মতন। মাকে ওকে মেয়ের মত দেখেন। নিজেই অর্পার বাসায় বেড়াতে গিয়ে ওর মায়ের সাথে গল্প গুজব করে আসেন। আবার অর্পাকেও জোর করে বাসায় নিয়ে আসেন। তিনি জানেনও না সায়ানের সাথে দীর্ঘ এতগুলো দিন অর্পার সম্পর্ক ভালো নেই।
মা বললেন, এভাবে বলছিস কেন? বোস মা। সায়ান আগের চেয়ে ভালো আছে। কাল পরশুর মধ্যেই বাড়ি চলে যাবো আমরা।
অর্পা সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, শরীর কেমন লাগছে এখন?
সায়ান শুকনো মুখে উত্তর দিলো, ভালো।
~ কিভাবে হলো এমন?
সায়ান কোনো উত্তর দিলো না। অর্পা উত্তরের আশায় না থেকে হাতের প্যাকেট টা রেখে বলল, আমি কিছু ফ্রুটস এনেছি। ওকে খাইয়ে দিয়েন আন্টি। আপনার শরীর কেমন এখন?
~ আমার আর শরীর। দিন রাত হাসপাতালে। এক ফোঁটা ঘুম নেই চোখে। সাইমু (সায়ানের বোন) আজ আসার কথা। ও এলে আমি বাসায় যাবো।
সায়ান বললো, আমি তো বলছি এভাবে কষ্ট করে হাসপাতালে থাকার দরকার নেই। আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছি। বাসায় চলো। শুনছো না আমার কথা।
অর্পা বললো, আন্টি যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলি?
~ বল মা।
~ আপনি অনেক ক্লান্ত। আপনি বরং বাসায় চলে যান। আমি এখানে থাকি। সায়ানের দিকে খেয়াল রাখবো। আর ওষুধও ঠিকমতো খাওয়াবো।
সায়ান বললো, না না। তোকে কষ্ট করে থাকতে হবে না।
~ প্লিজ সায়ান। তোকে আমি যে কষ্ট দিয়েছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত। আমাকে তোর সেবা করার সুযোগটুকু দিয়ে অনুশোচনা করতে দে প্লিজ।
~ লাগবে না। তোর ওপর আমার কোনো রাগ নেই।
~ সায়ান, আমার উপর এখনো রেগে আছিস আমি জানি। আন্টির শরীরটা খারাপ। ওনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। উনি বাসায় চলে যাক। আমি থাকি এখানে। প্রমিস তোকে ডিস্টার্ব করবো না।
মা বললেন, এভাবে কেন বলছিস? বন্ধুদের মাঝে ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি হয়েই থাকে। তাই বলে এত ছোট হতে হবে না। আমি জানিনা কি হয়েছে কিন্তু এত কষ্ট পাস না। আমি তোকে এখানে রেখে যাচ্ছি। ওর দিকে খেয়াল রাখিস।
সায়ান বারবার আপত্তি জানিয়ে বলল, না মা। ওকে থাকতে হবে না।
~ আমি একটু বাসায় যাই তুই কি সেটা চাস না?
~ চাই। কিন্তু অর্পাকে থাকতে হবে না।
~ ও থাকুক। একজনকে তো থাকতেই হবে তোর পাশে।
~ লাগবে না মা।
মা কোনো কথা শুনলেন না। উনি প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অর্পা সায়ানের কাছে এসে দাঁড়াল। নরম গলায় বলল, অনেকদিন তো হয়ে গেছে। এখনো রাগ পুষে রেখেছিস?
~ নাহ। তোর বয়ফ্রেন্ড এর কি খবর?
~ কোন বয়ফ্রেন্ড?
~ বারে কতগুলো বয়ফ্রেন্ড পালিস?
~ সেটা বলিনি। আমার তো কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিলই না।
~ ছিলো না? চশমা ওয়ালা একটা ছেলের সাথে খুব ঘোরাফেরা, ছবি আপলোড দিতে দেখলাম।
~ ও.. ও তো আমার ফ্রেন্ড।
~ আমার মত ফ্রেন্ড? যাকে কাছে পেলে চুমু খেতে ইচ্ছে করে? বাসায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে?
~ সায়ান প্লিজ। এভাবে বলিস না।
~ তো কিভাবে বলবো? তোর কারণে আমার সম্পর্কটাই শেষ হয়ে গেছে। ও আমাকে এতটাই ভুল বুঝেছিল যে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে। আমার বাবা মাকেও ফিরিয়ে দিয়েছে। সব তোর জন্য।
~ সায়ান, আমি সরি। আমি যা করেছি কেবল তোকে পাওয়ার জন্যই করেছিলাম। শুধুমাত্র পাগলের মত তোকে চাইতাম বলে।
~ চাওয়ার একটা ওয়ে থাকতে হয়। কোনো নোংরা চাল চেলে কাউকে চাইতে হয় না।
অর্পা অপমানে মুখ কালো করে চুপ হয়ে গেলো। ইচ্ছে করছে এখান থেকে বেরিয়ে চলে যেতে। কিন্তু আন্টিকে বাসায় পাঠিয়ে এভাবে চলে গেলে উনি কি মনে করবেন? তাই আর কথা না বাড়িয়ে অর্পা চুপচাপ চেয়ারে বসে রইলো।
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলো। অর্পা কোনো কথা বলছে না। সায়ানের শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে। মনটাও অস্থির। বুক ব্যথা করছে ভীষণ। কিন্তু নিরবে সহ্য করছে। কিছু বললেই অর্পা কাছে এসে ধরার চেষ্টা করবে। সায়ান এটা চায় না। অর্পার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য ওকে মুখ বুজে ব্যথা হজম করতে হচ্ছে। কিন্তু মনটা বড় অস্থির। ক্রমশ অস্থিরতা বাড়ছে। পৃথা আজকে কেন এলো না? ও কি কোনো সমস্যায় পড়েছে? কি জানি কি হলো ওর আবার। দুশ্চিন্তাও হচ্ছে পৃথার জন্য।
কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিল সায়ান। ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দর্শন পেলো পৃথার। দেখলো পৃথার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। পৃথা সিল্কি চুল ওর মুখের উপর এসে পড়েছে। সায়ান একহাতে সেই চুল সরিয়ে দিতে যাবে এমন সময় ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে দেখে সাইমু আপু এসেছে।
সায়ান উঠে বসার চেষ্টা করলো। আপু বলল, সরি রে। আসতে দেরি হয়ে গেলো। মা বললো এখানে অর্পা আছে তাই আমিও ভাবলাম দেরি করে যাই।
~ আপু, তোর ফোনটা একটু দিবি?
~ কেন দেবো না?
আপুর ফোনটা এগিয়ে দিলো সায়ানের দিকে। সায়ান ফোন হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকলো। পৃথার আইডি নাম লিখে সার্চ করে মেসেজ পাঠাতে গিয়ে দেখলো ওর অনেক গুলো মেসেজ রিকুয়েষ্ট অপশনে জমা পড়ে আছে। আপু সিন করে নি। পৃথা জানতে চেয়েছিল সায়ানের কি হয়েছে। ও সুস্থ আছে কিনা। ওর মেসেজ দেখে সায়ানের কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে গেলো।
ও রিপ্লাইয়ে লিখলো, আমি সায়ান বলছি। আপুর কাছে ওর ফোন নিয়ে তোমার আইডিতে ঢুকলাম। তুমি আজ আসো নি কেন গো? জানো না তোমাকে না দেখলে আমার ভালো লাগে না? আমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছি। এর দায় কি তুমি নেবে? আমাকে কষ্ট দিয়ে কি পাও তুমি বলো? আমি রাতে ঘুমাতেও পারবো না। কেন আসো নি? কেন?
মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে সায়ান বেরিয়ে এলো ফেসবুক থেকে। আপুকে বলল, তুই তো আজ রাতে থাকবি তাই না? তোর ফোনটা আমার কাছে থাক। নাকি সমস্যা আছে?
~ না না সমস্যা হবে কেন? রাখ তোর কাছে।
সায়ান বারবার ফেসবুকে ঢুকে মেসেজ চেক করতে লাগল। হঠাৎ রিপ্লাই এলো পৃথার~ সরি সায়ান। আমার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। বলতেও পারছি না, যেতেও পারছি না আর থাকতেও পারছি না। আমি কি করবো বলে দিন আপনি।
~ কেন? কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো?
পৃথা প্রথমে বলতে চায় নি। পরে আর থাকতে না পেরে লিখল, আপনার মা আমাকে নিষেধ করেছেন। যেন আর কখনো না যাই আপনার কাছে।
~ ওহ শিট। শোনো এখন মা নেই। বাসায় গেছে। তুমি কাল খুব সকালে চলে এসো প্লিজ।
~ আমি এখনই আসছি।
~ না না। এখন রাত অনেক। পাগলামি কোরো না প্লিজ।
পৃথা অফলাইনে চলে গেছে। রাত সারে এগারো টা। এত রাতে ও ছুটে আসবে। কি পাগলামি ব্যাপার স্যাপার। কিন্তু এখন ওকে বারণ করলেও ও মেসেজ দেখবে না। এত রাতে একা বের হবে, দেশের যা অবস্থা! আবার কোনো বিপদ না হয়ে যায়। সায়ানের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যেতে লাগলো।
ভালোবাসা তো এমনই। আপনজনকে সবসময় বুকের ভেতর আগলে রাখতে ইচ্ছে করে। তার বিপদের কথা ভাবলেই শরীর শিউরে ওঠে। পৃথা অফলাইনে জেনেও সায়ান বারবার মেসেজ পাঠাতে লাগলো, তুমি কোথায়? প্লিজ আজকে আসার দরকার নাই। আমাকে টেনশন দিও না, এমন পাগলামি কোরো না। একা বের হয়ো না। এরকম অসংখ্য মেসেজ। কিন্তু কোনো মেসেজ ই সিন হলো না।
পর্ব ২৮
পৃথা দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। রীতিমতো হাঁফাচ্ছে ও। সায়ান চমকে তাকালো ওর দিকে। এক পলক দেখেই যেন বুকে বৃষ্টির পশলা নেমে এলো। উত্তপ্ত রোদের পর বৃষ্টি যেমন প্রকৃতিকে ঠান্ডা করে দেয়, তেমনি সায়ানের মনটাও শীতল হয়ে গেলো এক পলক পৃথাকে দেখে।
পৃথা একবার সায়ানের বোনের দিকে তাকালো, আরেকবার তাকালো অর্পার দিকে। এত রাতে অর্পাকে এখানে দেখতে পেয়ে ও ভীষণ অবাক হয়েছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ধীরেধীরে সায়ানের কাছে এগিয়ে গেলো। সায়ান শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করছিল। পৃথা ছুটে গিয়ে সায়ানকে ধরে ফেললো।
সায়ান পৃথার চোখের দিকে চেয়ে বলল, জানিস না তোকে না দেখলে আমার কি ভীষণ অস্থির লাগে? তবুও কেন আসিস নি?
~ আমার কিছু করার ছিলো না।
~ আমি কোনো বাধা মানি না। মানবো না। তোমাকে আমার কাছে আসতে হবে, আমার পাশে থাকতে হবে ব্যস।
সায়ান বাচ্চাদের মত করছে দেখে অবাক হয়ে সাইমু তাকিয়ে আছে। সেই সাথে অর্পারও চোখ ছানাবড়া। অর্পা জানে সেই ঘটনার পর থেকে ওদের আর যোগাযোগ ই হয় নি। এ আবার কোথ থেকে উড়ে চলে এলো? কি গভীর প্রেম! তাহলে কি ওদের প্রেমটা সবসময় ই ছিলো? মনে প্রশ্ন নিয়ে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো অর্পা।
সায়ান পৃথাকে পাশে বসিয়ে বললো, আজকে সারা রাত তুমি আমার পাশে বসে আমাকে গল্প শোনাবে। পারবে না?
পৃথা সংকোচ বোধ করছে। কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে বললো, হুম শোনাবো।
সায়ান বালিশে হেলান দিয়ে বেডের উপর বসে রইলো। পৃথাকে বসিয়েছে ওর পাশে। পৃথাকে দেখে অর্পার আর ভালো লাগছে না। ও যখন এসেই গেছে, তখন ওদের রঙ্গ দেখার জন্য আর এখানে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। অর্পা বাসার ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসতে বললো। সায়ান ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। জোর করে অর্পাকে এখানে আটকে রাখার ইচ্ছে ওর একেবারেই নেই। তাছাড়া সাইমু আপু যখন আছে তখন অর্পার দরকারও আর হবে না। সায়ান তো বিকেল থেকে এই সুযোগ টাই চাইছিলো।
অর্পা চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেলো, লাইফটাকে হেলায় নষ্ট করিস না। লাইফকে এমন কিছু উপহার দিস লাইফ তোকে যেমনটা দিয়েছে। আবেগের স্রোতে গা ভাসানোর মত সময় বা বয়স কোনোটাই এখন আমাদের নেই।
অর্পার কথাটা কানে বাজছিল পৃথার। কথাটা অর্থবহ। কিন্তু সায়ানকে বলা উচিত হয়নি বলে মনে হচ্ছে। পরোক্ষভাবে পৃথাকেই ইঙ্গিত করছিল কথাগুলো। পৃথা ছোট হবেই বা কেন? নিজেকে অগোছালো করে উপস্থাপন করাটাই তাহলে ভুল হয়ে গেছে। সায়ানের জন্য পাগলের মত ছুটে আসতে গিয়ে নিজের গেট আপ নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না ওর। তাতেই অর্পা এভাবে বলার সুযোগ পেয়ে গেছে। অদ্ভুত মেয়ে! নিজেকেই সবসময় সবার উপরে ভাবে। তবে ভেবে তো লাভ নেই। সায়ান তো কেবল আমারই~ মনেমনে এই কথা ভাবছিল পৃথা।
সায়ান ওর বোনকে বলল, আপু। পৃথা থাকলে কি তোর কোনো সমস্যা হবে?
~ না না। আমার সমস্যা হবে না। তবে বেড তো একটাই। তোর পাশে একজন শুতে পারবে। আরেকজনকে বসে বসে রাত কাটাতে হবে।
পৃথা বলল, সমস্যা নেই আপু। আমি সারা রাত ওকে গল্প শোনাবো।
~ ও কি ঘুমাবে না? সারা রাত তোমার গল্পই শুনবে?
পৃথা চুপ হয়ে গেলো। সায়ান বলল, আপু তুই চিন্তা করিস না। আমরা জেগে থাকবো। কতদিন মন খুলে কারো সাথে কথা বলা হয় না। আজকে মনটা হালকা হয়ে যাবে।
সায়ানের কথা শোনার পরও আপু স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলো না। কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়লো। পৃথা গল্প শুরু করে দিয়েছে। সায়ানের মাথার কাছে বসে একমনে গল্প বলছে ও। কত রকমের কথা! ওর ছোটবেলার গল্প, বড়বেলার গল্প, এই কয়েকটা বছর কিভাবে কেটেছে তার গল্প। সায়ানের বোন ঘুমিয়ে পড়েছে। সায়ান পৃথার আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে আরেকহাতে পৃথাকে ধরে রেখেছে। একসময় বলল, তুমি পা দুটো বিছানায় তুলে আমার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। যতটুকু ঘুম হয় ততটুকুই লাভ।
~ আমার ঘুম লাগবে না। আপনি ঘুমান। আমি বরং জেগে থাকি।
~ তোমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছি গত কয়েকটা দিন তুমি ঘুমাতে পারোনি। আজকে প্লিজ আমার বুকে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও।
~ কি করে বুঝলেন আমি ঘুমাইনি?
~ তোমার পরির মত চেহারাটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। শুষ্ক মুখ, চোখ দেবে গেছে।
~ এতকিছু মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন?
~ ভালোবাসি যে তাই।
~ সত্যি ভালোবাসেন?
~ হুম। বোঝোনা?
~ জানিনা। কিচ্ছু জানিনা।
~ আরে আসো তো।
সায়ান পৃথাকে জোর করে বিছানায় তুলে নিজের কাঁধের উপর ওর মাথাটা রাখালো। কোনোমত পা দুটো তুলে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল পৃথা। সায়ান ধরে রইলো যাতে ও পরে না যায়।
সায়ানের কাঁধে মাথা রাখলে ও মাথাটা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরল। পৃথার আচমকা মনে হল এর মত আশ্রয় আর কোথাও নেই। এতটা শান্তিপূর্ণ, এতটা কোমল। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই চোখ ভিজে আসতে শুরু করলো ওর। নিজের অজান্তেই সায়ানকে এতবেশি ভালোবেসে ফেলেছে, এটাও হয়ত কান্নার একটা কারণ।
সায়ান পৃথার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথা বুঝতেই পারেনি।
ঘুম ভাংল যখন তখন ভোর হয়ে এসেছে প্রায়। সায়ান বালিশে হেলান দিয়ে অর্ধশোয়া অবস্থায় ঘুমাচ্ছে। আর পৃথা ওর বুকে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছিল। কি লজ্জার বিষয়। অসুস্থ মানুষটার সেবা করার কথা ওর, অথচ সে কিনা বুকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। লজ্জায় কি করবে বুঝতে পারলো না পৃথা।
সায়ান ঘুমে মগ্ন। পৃথা আস্তে করে উঠে এসে সায়ানের গায়ে হাত বুলাতে লাগল। চমকে উঠে ঘুম ভেঙে গেলো সায়ানের। ও বলল, কি করছো পাগলী?
সায়ানের কথা শুনে ঘুম ভেঙে গেলো সাইমু আপুরও। সে উঠে দেখলো পৃথা সায়ানের পায়ে, হাতে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পৃথা লজ্জা লজ্জা মুখে মাথা নত করে রইল। আপু বুঝতে পারলো মেয়েটা আসলেই সায়ানকে ভালোবাসে। কিছু না বলে সে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। সায়ান বললো, তুমি ঘুমাচ্ছো না কেন?
~ আর লজ্জা দেবেন না তো। বেঘোরে ঘুমিয়েছি।
~ ঘুম কেমন হয়েছে?
পৃথার কাছে মনে হল জগতের সবচেয়ে সেরা প্রশ্নটা ও এখন শুনছে। কারণ আজকের মত এত ভালো ঘুম ওর কখনোই হয়নি। কখনো এত আরাম করে ঘুমায়নি, ঘুমিয়ে এতটা তৃপ্তিও পায় নি। ভালোবাসার উষ্ণতায় ওর হৃদয় ছেয়ে গেলো।
সায়ান হাত বাড়িয়ে দিলো। পৃথা ওর আপুর দিকে তাকিয়ে হাত এগিয়ে সায়ানের হাত ধরলো। সায়ান বললো, জানো আমি দিনের বেলা খুব অসুস্থ ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে সুস্থ হয়ে গেছি।
~ তাই?
~ হুম। তুমি এসেছো বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। থ্যাংক ইউ ডিয়ার। আচ্ছা তুমি রাতে খেয়েছিলে তো?
~ না মানে খাইনি।
~ সেকি! আমার একবার মনেও হল না। ছিই, কি বোকা আমি। আপু ভাত এনেছিল, আমি সব খেতে পারিনি। অর্ধেক ভাত আছে। প্লিজ খাবার নিয়ে আসো। আমার সামনে খেতে বসো।
~ এই রাত্রিবেলায়?
~ হ্যাঁ। সমস্যা কোথায়? আমারও ক্ষুধা লেগেছে। তুমিও খাও আর আমাকেও খাওয়াও।
পৃথা হাসিমুখে গিয়ে বাটি থেকে খাবার নিয়ে এলো। সায়ানকে তুলে খাওয়ানোর সময় আপু একবার মাথা তুলে তাকালো। কিছুক্ষণ চোখ মেলে এই দৃশ্য দেখার পর এত ভালো লাগা কাজ করলো যে অভিভূত হয়ে গেলো। নিজের ই অসুস্থ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এমন প্রেম দেখে। যদি বর এসে এভাবে সেবা করতো! তুলে খাইয়ে দিতো!
পৃথা বলল, আপু আপনাকে খাইয়ে দিই একটু?
সাইমু আপু চমকে উঠলো। বলল, না না। আমি খাবো না।
~ আরে খান একটু।
~ খিদে লেগেছে বটে। আচ্ছা দাও।
আপু হেসে ফেললো। পৃথা কাছে এসে আপুর মুখেও কয়েকবার খাবার তুলে দিলো। মনটা ভীষণ নরম হয়ে গেলো আপুর। পৃথাকেই মনে হতে লাগলো জগতের সবচেয়ে ভালো মেয়ে। কি মিশুক, কি আদুরে! সায়ান একটা সঠিক মেয়েকেই বেছে নিয়েছে।
সায়ান বললো, পৃথা আমি কিন্তু আর খাবো না। যা খেয়েছি সব বমি করে ফেলে দেবো।
~ সেকি? কেন?
~ তুমি একটুও মাংস খাচ্ছো না। সব আমাকে খাইয়ে দিচ্ছো।
পৃথা লাজুক হাসলো। সাইমু আপু বলল, তুই যে ওরে ছাড়া বাঁচবি না সে আমি বুঝে গেছি।
~ হ্যাঁ রে আপু। খালি আব্বু আম্মুই বুঝতেছে না।
~ দেখি তোর জন্য কিছু করতে পারি কি না।
সায়ানের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখা গেলো। আপুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো ওর।
.
সকালবেলা মা খাবার নিয়ে হাজির। উনি হয়তো দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতেই পারেননি এই ভেবে যে, আবার এই সুযোগে সকালে পৃথা চলে আসে। উনি তাই খুব সকালেই চলে এলেন। কিন্তু যখন দেখলেন পৃথা সায়ানের হাত ধরে বসে আছে তখনই মাথায় রক্ত উঠে গেলো ওনার। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। পৃথার কাছে এসে রেগে বললেন, তোমার বাপ মা তোমাকে ভদ্রতা শেখায়নি? পড়াশোনা করে কি অর্জন করেছো? বেহায়ার মত আবার এসেছো? লজ্জা নেই এতটুকুও?
সায়ান চেঁচিয়ে উঠল, মা। থামো।
কিন্তু পৃথা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। গাল বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো ওর। সায়ান ওঠার চেষ্টা করে পারলো না। ব্যথা পেয়ে বলল, আহ!
মায়ের আগে পৃথাই ছুটে গিয়ে সায়ানকে ধরে ফেললো। তাতেও মেজাজ গরম হলো ওনার। পৃথা সায়ানকে বলল, আপনি বলুন আমি কি করবো? চলে যেতে বললে চলে যাবো। আপনার মা চাইছেন আপনি আপনার জীবন থেকে সরে যাই। আপনিও কি তাই চান? চাইলে আমি আর কক্ষনো আপনার সাথে যোগাযোগ করবো না।
~ তুমি জানোনা আমি কি চাই? তুমি আসার পর আমি কতটা সুস্থ হয়ে গেছি খেয়াল করেছো তুমি? আমার জীবনে তোমাকে ভীষণ প্রয়োজন পৃথা।
~ আমি কি করবো এখন বলুন?
সায়ান মাকে বললো, মা। পৃথার সাথে দুদিন মিশে দেখো। ও অনেক ভালো মেয়ে, মা। তোমার খেয়াল রাখবে দেখে নিও।
মা কিছু বললেন না।
পৃথা বললো, আপনার জায়গায় থাকলে আমিও হয়তো রেগে থাকতাম। এটাই স্বাভাবিক। তবে সেদিন আপনাদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না। আসলে তার আগে আমি নিজেকে এমন করে প্রস্তুত করছিলাম যে সবকিছুর আগে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলবো। তাছাড়া সায়ানকে আমি ভুল বুঝেছিলাম। কাজগুলো করেছিলো অর্পা আপু। আমি তার কথাকেই বিশ্বাস করে সায়ানকে ঘৃনা করতে শুরু করি। আপনি ভেবে দেখুন, যাকে অপছন্দ করি তাকে কিভাবে স্বামী হিসেবে মেনে নেবো? আর নিজেকে গড়ে তোলার শপথ করার পর আমি কি করে মাঝপথে থেমে যাবো? আমার জায়গায় থাকলে আপনি কি করতেন? যদি জানতেন ছেলেটা অন্য মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত, তাকে কি বিয়ে করতে চাইতেন? আশাকরি কথাগুলো ভেবে দেখবেন। তারপর আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন, আমি তাই করবো। আজ আসি।
সবাই চুপচাপ। পৃথা ব্যাগ কাঁধে নিতেই সায়ান বলল, পৃথা..
~ আপনি প্লিজ আর কিছু বলবেন না। আপনার মাকে বিষয়টা বুঝতে দিন। উনিই বলবেন আমার দোষটা কোথায় ছিল? নিজের যত্ন নেবেন।
পৃথা বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে। চোখে জল। চোখ মুছতে মুছতে কেবলই মনে হতে লাগল, হয়তো এখানেই শেষ নয়ত এখানেই শুরু জানিনা কি হবে! তবে যাই ঘটুক, আমাকে নিজের লক্ষ্য থেকে সরে দাঁড়ালে হবে না। আবারও একটা শিক্ষা পেলাম। মাত্র পড়াশোনা শেষ করেছি। এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াইনি। আমি হাল ছেড়ে দেবো না। সায়ান আমার ভাগ্যে থাকুক বা না থাকুক, সেই সময়ে শুরু করা যুদ্ধটা আমি মাঝপথে থামিয়ে দেবো না। আমি পারবো, অবশ্যই পারবো।
পর্ব ২৯
পৃথা চলে যাওয়ার পর পুরো কেবিনে পিনপতন নীরবতা চলে এলো। সায়ান মাথায় হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। জীবনে সবসময় একটা না একটা ঝামেলা লেগে থাকতেই হবে নয়তো সেটা জীবনই নয়। ইচ্ছে করছে এই অসুস্থ শরীরেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যেতে।
সাইমু এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। সায়ানের দিকে দেখে ওর বড় মায়া লাগলো। বলল, কাজটা ঠিক করলে না মা। একটা মেয়েকে এভাবে কষ্ট দিলে কেন?
~ কষ্ট কি ও আমাদের দেয়নি?
~ ও তো বিষয়টা ব্যাখা করেই দিলো। ওর জায়গায় থাকলে আমিও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে বিয়ে করতাম না।
সায়ান বললো, মা। পৃথাই ঠিক ছিলো। আসলে ওই সময়ে আমি একাই ওকে ভালোবাসতাম। আমার প্রতি ওর বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা ছিলো না। যেটা ছিলো সেটা কেবলই সামান্য মায়া। ও সেই মায়া কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো। আমি পারিনি বলেই বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।
মা কিছু বললেন না। সাইমু বলল, ওকে আমার খুব ভালো লেগেছে আম্মু।
~ একদিন দেখেই ভালো লেগে গেলো?
~ মা, মাঝেমাঝে কারো সামান্য একটা আচরণের জন্যও তাকে অনেকদিন মনে রাখা সম্ভব। পৃথা আমার মন জয় করে নিয়েছে। তুমি ওর সাথে মিশে দেখো, তুমিও ওর প্রেমে পড়বেই।
মা এবারও কিছু বললেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। সায়ান ‘ধুর ভালো লাগে না’ বলে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
.
পৃথা খালার বাসায় ফিরে গোসল সেরে খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লো। মাথায় বড় ধরণের জেদ চেপেছে। কিছু একটা করতেই হবে ওকে। সারাদিন শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াল, চিন্তা ভাবনা করলো কি শুরু করা যায়। চাকরি করে অন্যের স্বপ্ন পূরণের চেয়ে নিজে কিছু করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করাটাই হবে শ্রেয়। বিভিন্ন দোকানে ঘুরেঘুরে আইডিয়া খোঁজার চেষ্টা করলো। পরিচিত কয়েকজনকে ফোন দিয়ে আলাপ আলোচনা করলো। পথ হাঁটতে হাঁটতে ভাবল অনেক বিষয় নিয়ে। গুগলে ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে লাগলো কি করা উপযুক্ত হবে।
রাত্রিবেলা বাড়িতে বাবাকে ফোন দিলো। ও সবসময় মাকেই কল দেয়। মায়ের ফোন থেকেই বাবার সাথে কথা হয়। এবার বাবাকে ফোন দেয়ায় বাবাও বেশ অবাক হলেন। উনি রিসিভ করে বললেন, হ্যাঁ পৃথা মা, বল।
~ তোমাকে একটা জরুরি কথা বলবো আব্বু।
~ বল।
বাবা ভাবলেন বিয়ের ব্যাপারে বলবেন। পৃথা সময় নিচ্ছিল। মনেমনে গুছিয়ে নিচ্ছিলো কি বলবে। বাবা ভাবলেন মেয়ে লজ্জার কারণে বলতে সংকোচ করছে। উনি নিজে থেকেই বললেন, তুই কি বিয়ের কথা বলতে চাচ্ছিস মা? লজ্জার কিছু নেই। যা মনে আছে বলে ফ্যাল। আমি ছাড়া তোর আর আপন কে আছে বল?
পৃথা বলল, না আব্বু। বিয়ের ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না। আমি তোমাকে যেটা বলতে চাই সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু।
~ বিয়ের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ?
~ আপাতত আমার কাছে তাই। কারণ আগে এই স্বপ্ন পূরণ করবো তারপর অন্যকিছু। বিয়ে নিয়ে আমি কিছু ভাবছি না।
~ তুই খুব দ্রুত নিজেকে মোটিভেট করতে পারিস। এটা ভীষণ ভালো লাগে আমার। তা বল কি গুরুত্বপূর্ণ কথা? আমি প্রস্তুত শোনার জন্য।
পৃথা বললো, আব্বু। আমার বেশ কয়েক লাখ টাকার দরকার।
~ বেশ কয়েক লাখ?
~ হ্যাঁ। তুমি ম্যানেজ করে দিতে পারবে? যেমন ধরো লোনের ব্যবস্থা করে বা অন্য কোনোভাবে। আমি একটা বিজনেস শুরু করতে চাই।
~ খুবই ভালো উদ্যোগ। কিসের বিজনেস মা?
~ একটা ক্যাফেটেরিয়া দিতে চাই আব্বু। পাশাপাশি স্পাইসি ফুডস থাকবে।
~ হুমম বুঝলাম। কোথায় দিতে চাও?
~ শহরেই। আমার বান্ধবীর বাবার দোকান থেকে দোকান ভাড়া নিতে পারবো। ডেকোরেশন আমি নিজে করবো। তুমি বলো সেটা কেমন হবে?
~ খুব ভালো হবে। প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
~ এখন টাকার ব্যবস্থা করতে হবে আব্বু। ইনশাআল্লাহ একদিন খুব বড় বিজনেস হবে আমার। বড় একটা রেস্টুরেন্ট হবে।
~ সবকিছু থাকতে হঠাৎ ক্যাফেটেরিয়ার চিন্তা আসলো কেন?
~ আমার খুব ইচ্ছে করে মাঝেমাঝে। একটা কফিশপ দেয়ার।
বাবা পৃথাকে ভরসা দিয়ে ফোন রাখলেন। আর পৃথা ল্যাপটপ নিয়ে বসল। কফিশপের ডেকোরেশন কেমন হবে সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। খাতা কলম নিয়ে ডিজাইন করতে গিয়ে হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়লো। উপুর হয়ে শুয়ে গুগলে ডিজাইন আইডিয়া দেখতে দেখতে খাতায় আনমনে কিসব লিখছিল। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলো সেখানে শুধুই সায়ানের নাম। পৃথার বুকটা ফাঁকা হয়ে গেলো। সায়ান সায়ান সায়ান। আমি তোমাকে ভালোবাসি সায়ান। তুমি কখন আসবে? আমার কাছে আসো। আসো আসো আসো।
এরকম অসংখ্য শব্দ লিখে ফেলেছে খাতায়। চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো ওর। বুকের ভেতর উথাল পাথাল ঝড় শুরু হয়ে গেলো। সায়ানকে ছাড়া থাকার কথা যেন ভাবতেই পারে না ও। কি ভীষণ কষ্ট হতে থাকে! মানুষটা অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছে। ওকে নিয়ে বারবার স্বপ্ন আসে চোখে। অজান্তেই ওর কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হয়, একি আমি ওকে নিয়ে কেন ভাবছি! মন বড় অদ্ভুত।
রাতটা আর ঘুমাতে পারলো না পৃথা। ক্যাফেটেরিয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের যন্ত্রণাকে নিয়ে সময় কাটাতে লাগল। রাতগুলো এমনই। দিনের বেলা যে মানুষটা সবচেয়ে কঠিন, রাত্রিবেলা সে মানুষ টাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে একাকী ও নরম। সমস্ত বেদনারা এসে বুকে জমাট বাঁধে। ভালোবাসার শূন্য খাঁচাটা ডানা ঝাপটাতে থাকে। কারো ভালোবাসা পাবার তীব্র ব্যকুলতা জাগে। ভালোবাসায় নিজেকে রাঙাতে বড্ড ইচ্ছে হয়। কখনো কখনো হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে কোনো অজানায়। কিন্তু বাস্তবতায় ফিরে এলে সবকিছু শূন্য, ফ্যাকাশে হয়ে ধরা দেয়। তখন বুকটা ফাটতে থাকে। কাউকে কাছে পাবার আকুলতাটা আরো নাড়া দিতে থাকে।
পরদিন ঘুম ভাংলো বেশ দেরিতে। দুপুর হয়ে গেছে। পৃথা আড়মোড়া ভেঙে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে অনেকগুলো কল এসেছে। নাম্বারটা অচেনা। রাতে মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই বুঝতে পারে নি। কিছুক্ষণ পর সেই নাম্বারে কল দিতেই একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো। ~ হ্যালো কে বলছেন?
পৃথা বলল~ এ নাম্বারে থেকে অনেকগুলো কল এসেছিল। আমি পৃথা।
~ ও পৃথা! আমি সাইমু। সায়ানের বোন।
~ জ্বি আপু। বলুন
~ সায়ান রাতে খুব পাগলামি করেছে বুঝলে? অনেক চেষ্টা করে তোমার নাম্বার যোগাড় করে ফোন দিয়েছি। সায়ান ওষুধ খাচ্ছে না। বাচ্চাদের মত অভিমান করে বসে আছে। তুমি কি একবার আসবে?
~ কিন্তু আপু..
~ কি?
~ আন্টি তো আমাকে..
~ মা কিছু বলবে না। তুমি আসো প্লিজ। আমার ভাইটা আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তুমি এসে ওকে খাওয়াতে পারো কি না দেখো।
~ আচ্ছা আপু আমি আসছি।
পৃথা রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো খালা মাছের কালিয়া আর সাদা ভাত রান্না করেছে। ভাজিও আছে। দ্রুত বাটিতে তুলে নিয়ে রুমে এসে জামাকাপড় বদলে নিলো। তারপর হঠাৎ মনে হল সায়ানের দেয়া চুড়ি ও গাজরার কথা। কি ভেবে যেন আজকে পৃথা শাড়ি পরলো। হালকা সাজগোছ করে খোপায় গাজরা ও হাতে সায়ানের দেয়া চুড়িগুলো পড়লো। চুল আচড়ে বেণী করে সামনে এনে ঝুলিয়ে রাখলো। এভাবে একবার পৃথাকে দেখলেই সায়ানের সব পাগলামি ছুটে যাবে পৃথার মনে এই বিশ্বাস।
হাসপাতালের দরজায় শব্দ করলে দরজা খুলে দিলো সাইমু আপু। পৃথাকে দেখে বলল, একেবারে বউ সেজে এসেছো!
সায়ান ঘুমাচ্ছিল। পৃথা কাছে এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। সাইমু আপু বলল, সায়ান দ্যাখ কে এসেছে? ওঠ।
সায়ান চোখ মেলে হা করে তাকিয়ে রইলো। বড়বড় হয়ে গেলো ওর চোখ দুটো। পৃথা এসেছে! নাকি এটা নিছক স্বপ্ন?
পৃথা হাসির চেষ্টা করে বলল, কি দেখছেন?
~ তুমি এসেছে?
~ হ্যাঁ। উঠুন, ভাত খাবেন।
~ তুমি শাড়ি পরেছো কেন?
~ কি অদ্ভুত প্রশ্ন! শাড়ি পরলে মন ভালো থাকে তাই পরলাম। আমার মন আজ খুব খারাপ ছিল।
~ কেন?
~ আপনি অসুস্থ তাই। এবার সুস্থ হয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।
সায়ানের মা এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পৃথাকে দেখতে সুন্দর লাগছে এটা স্বীকার করতেই হয়। উনি না চাইলেও তাকিয়ে আছেন। পৃথা কি ভেবে হঠাৎ ওনার দিকে তাকিয়ে বলল, আন্টি আপনি খেয়েছেন? আসুন খেয়ে নিন। আমি গরম ভাত আর মাছের কালিয়া এনেছি। সাথে ডিম ভুনা আর ভাজি।
আন্টি কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। তবে পৃথা এটা বুদ্ধি করেই বলেছে। কারণ ছেলে অসুস্থ, তার উপর কিছু খায়নি। এমতাবস্থায় কোনো মা ই খেতে পারবেন না। পৃথা আন্টির কাছে গিয়ে ওনার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো। বেডের উপর বসিয়ে বাটি থেকে ভাত নিয়ে প্লেটে তুলে এগিয়ে দিলো। পানির বোতল আর একটা প্লেট দিয়ে বলল নিন হাত ধুয়ে নিন।
আন্টি শুধু অবাক হয়ে দেখছেন। কিছু বলতে পারছেন না। পৃথা মনেমনে হাসছে। আর ওর মনটা কোনো অদ্ভুত কারণে ভালো হয়ে গেছে। মন ভালো না থাকলে ও শাড়ি পরতো না। হয়তো বা ফ্রেশ ঘুমের পর যখন কেউ শুনবে একটা ছেলে তার জন্য পাগলামি করে না খেয়ে আছে, স্বাভাবিক ভাবেই তার মন ভালো হয়ে যাওয়ারই কথা। পৃথা বলল, আজ অবশ্য আমি রান্না করিনি। খালা করেছে। তবে খালাও ভালো রান্না করেন। খেয়ে নিন। আমার উপর যত রাগ থাকুক আর যা ই থাকুক। খেতে তো অসুবিধা নেই।
সায়ান বলল, আমাকে খাইয়ে দাও আম্মু।
আন্টি সায়ানকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেলেন। পৃথা চেয়ারে গিয়ে বসল। সায়ান বলল, মা পৃথাকেও খাইয়ে দাও।
মা একবার পৃথার দিকে তাকালেন আর একবার সাইমুর দিকে। পৃথা উঠে এসে কাছে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ খাইয়ে দিন। আমিও কিছু খাইনি তাই বেশি করে ভাত এনেছি।
মা কি করবেন বুঝতে পারলেন না। একটা মেয়ে সামনে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার আনা ভাত তিনি নিজে খাচ্ছেন অথচ সেই মেয়েটার মুখে দেবেন না, তা কি করে হয়! ব্যাপারটা বাজে হয়ে যাবে। উনি পৃথার মুখে খাবার তুলে দিলেন। সায়ান মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। এত সুন্দর দৃশ্য বোধহয় আগে দেখেনি। ইস! মা যদি সবসময় পৃথাকে এভাবে তুলে খাওয়াতো! তাহলে কত ভালোই না হতো।
সাইমু বলল, আমারও তো খেতে ইচ্ছে করতেছে আম্মু।
~ আয় তুইও খা।
মায়ের মুখে হালকা হাসির আভাস। সায়ানের দৃঢ় বিশ্বাস মায়ের মনটা আস্তে আস্তে গলছে। নিশ্চয়ই তিনি পৃথাকে আপন করে নেবেন। পৃথার সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করতে হবে। মাকে কিভাবে পটানো যায়। অবশ্য পৃথা এমনিতেই সেটা আদায় করে নেবে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে পৃথা সায়ানকে বলল, আমি একটা ক্যাফে দিতে চাচ্ছি কোন এরিয়ায় হলে ভালো হয়?
~ ক্যাফে?
~ হ্যাঁ।
~ হঠাৎ এই ভাবনা? তুমি তো জব করবে বলেছিলে?
~ অনেক ভেবে এই ডিসিশনে এলাম। আমি ক্যাফে দিয়ে শুরু করতে চাই। পরে রেস্টুরেন্ট।
~ আমি কি তোমার সাথে থাকবো না?
~ কো অপারেশন করতেই পারেন। তবে আমি একার চেষ্টায় এগোতে চাই।
~ এটা খুব ভালো ডিসিশান। তোমার যেটা মনে হবে যে এটা ভালো করতে পারবে তুমি সেটাই শুরু করো।
পৃথা দোকানের লোকেশন জানালো সায়ানকে। সায়ান কিছুক্ষণ ভেবে বলল ওটা ক্যাফের জন্য ভালো জায়গা। আশেপাশে কোনো ক্যাফে নেই। ওরকম জায়গায় একটা শপ হলে ভালোই হবে। পৃথা কয়েকটা ডিজাইনও দেখালো মোবাইল থেকে ওকে। কিভাবে ডেকোরেশন করতে চায়, কিভাবে শুরু করতে চায় সবই বললো। সব শুনে সায়ান মুগ্ধ। একটা মেয়ের মাথাতেও এরকম ঝুঁকির আইডিয়া আসতে পারে এটা বিশাল কিছু। পৃথা সেটা বুদ্ধিমত্তার সাথে বেশ ভালোভাবেই পারবে। সায়ানও ওকে আইডিয়া দিতে লাগলো।
এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিলেন সায়ানের মা। ওনারও মনে ধরেছে পৃথার চমকপ্রদ আইডিয়া গুলি। মেয়েটা অনেক ট্যালেন্ট। কাজের প্রতি ভালোবাসা আছে মনে হচ্ছে। একাগ্রতা আছে। কিন্তু পুরনো ক্ষোভটা এখনো ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। সেটা সম্ভব হবে কি না উনি তাও জানেন না। আজকে পৃথাকে শাড়ি পরে আসতে দেখে ওনার সত্যিই রাগ হয়েছিল। কিন্তু দেখতে ভালোও লাগছিল। মনের ভেতর কি যে চলছে নিজেও বুঝতে পারছেন না। একদিকে অসহ্য লাগছে, আবার একদিকে ভালোও লাগতে শুরু করেছে। এই অনুভূতি মা ধরতে না পারলেও সায়ান ঠিকই ধরতে পারছে। এখন ভালো লাগাটা ক্ষোভটাকে বিদায় করে দিয়ে জায়গা দখল করে নিতে পারবে তো?
পর্ব ৩০
পৃথা চলে যাওয়ার পর পুরো কেবিনে পিনপতন নীরবতা চলে এলো। সায়ান মাথায় হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। জীবনে সবসময় একটা না একটা ঝামেলা লেগে থাকতেই হবে নয়তো সেটা জীবনই নয়। ইচ্ছে করছে এই অসুস্থ শরীরেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যেতে।
সাইমু এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। সায়ানের দিকে দেখে ওর বড় মায়া লাগলো। বলল, কাজটা ঠিক করলে না মা। একটা মেয়েকে এভাবে কষ্ট দিলে কেন?
~ কষ্ট কি ও আমাদের দেয়নি?
~ ও তো বিষয়টা ব্যাখা করেই দিলো। ওর জায়গায় থাকলে আমিও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে বিয়ে করতাম না।
সায়ান বললো, মা। পৃথাই ঠিক ছিলো। আসলে ওই সময়ে আমি একাই ওকে ভালোবাসতাম। আমার প্রতি ওর বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা ছিলো না। যেটা ছিলো সেটা কেবলই সামান্য মায়া। ও সেই মায়া কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো। আমি পারিনি বলেই বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম।
মা কিছু বললেন না। সাইমু বলল, ওকে আমার খুব ভালো লেগেছে আম্মু।
~ একদিন দেখেই ভালো লেগে গেলো?
~ মা, মাঝেমাঝে কারো সামান্য একটা আচরণের জন্যও তাকে অনেকদিন মনে রাখা সম্ভব। পৃথা আমার মন জয় করে নিয়েছে। তুমি ওর সাথে মিশে দেখো, তুমিও ওর প্রেমে পড়বেই।
মা এবারও কিছু বললেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। সায়ান ‘ধুর ভালো লাগে না’ বলে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
.
পৃথা খালার বাসায় ফিরে গোসল সেরে খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লো। মাথায় বড় ধরণের জেদ চেপেছে। কিছু একটা করতেই হবে ওকে। সারাদিন শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াল, চিন্তা ভাবনা করলো কি শুরু করা যায়। চাকরি করে অন্যের স্বপ্ন পূরণের চেয়ে নিজে কিছু করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করাটাই হবে শ্রেয়। বিভিন্ন দোকানে ঘুরেঘুরে আইডিয়া খোঁজার চেষ্টা করলো। পরিচিত কয়েকজনকে ফোন দিয়ে আলাপ আলোচনা করলো। পথ হাঁটতে হাঁটতে ভাবল অনেক বিষয় নিয়ে। গুগলে ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে লাগলো কি করা উপযুক্ত হবে।
রাত্রিবেলা বাড়িতে বাবাকে ফোন দিলো। ও সবসময় মাকেই কল দেয়। মায়ের ফোন থেকেই বাবার সাথে কথা হয়। এবার বাবাকে ফোন দেয়ায় বাবাও বেশ অবাক হলেন। উনি রিসিভ করে বললেন, হ্যাঁ পৃথা মা, বল।
~ তোমাকে একটা জরুরি কথা বলবো আব্বু।
~ বল।
বাবা ভাবলেন বিয়ের ব্যাপারে বলবেন। পৃথা সময় নিচ্ছিল। মনেমনে গুছিয়ে নিচ্ছিলো কি বলবে। বাবা ভাবলেন মেয়ে লজ্জার কারণে বলতে সংকোচ করছে। উনি নিজে থেকেই বললেন, তুই কি বিয়ের কথা বলতে চাচ্ছিস মা? লজ্জার কিছু নেই। যা মনে আছে বলে ফ্যাল। আমি ছাড়া তোর আর আপন কে আছে বল?
পৃথা বলল, না আব্বু। বিয়ের ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না। আমি তোমাকে যেটা বলতে চাই সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু।
~ বিয়ের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ?
~ আপাতত আমার কাছে তাই। কারণ আগে এই স্বপ্ন পূরণ করবো তারপর অন্যকিছু। বিয়ে নিয়ে আমি কিছু ভাবছি না।
~ তুই খুব দ্রুত নিজেকে মোটিভেট করতে পারিস। এটা ভীষণ ভালো লাগে আমার। তা বল কি গুরুত্বপূর্ণ কথা? আমি প্রস্তুত শোনার জন্য।
পৃথা বললো, আব্বু। আমার বেশ কয়েক লাখ টাকার দরকার।
~ বেশ কয়েক লাখ?
~ হ্যাঁ। তুমি ম্যানেজ করে দিতে পারবে? যেমন ধরো লোনের ব্যবস্থা করে বা অন্য কোনোভাবে। আমি একটা বিজনেস শুরু করতে চাই।
~ খুবই ভালো উদ্যোগ। কিসের বিজনেস মা?
~ একটা ক্যাফেটেরিয়া দিতে চাই আব্বু। পাশাপাশি স্পাইসি ফুডস থাকবে।
~ হুমম বুঝলাম। কোথায় দিতে চাও?
~ শহরেই। আমার বান্ধবীর বাবার দোকান থেকে দোকান ভাড়া নিতে পারবো। ডেকোরেশন আমি নিজে করবো। তুমি বলো সেটা কেমন হবে?
~ খুব ভালো হবে। প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
~ এখন টাকার ব্যবস্থা করতে হবে আব্বু। ইনশাআল্লাহ একদিন খুব বড় বিজনেস হবে আমার। বড় একটা রেস্টুরেন্ট হবে।
~ সবকিছু থাকতে হঠাৎ ক্যাফেটেরিয়ার চিন্তা আসলো কেন?
~ আমার খুব ইচ্ছে করে মাঝেমাঝে। একটা কফিশপ দেয়ার।
বাবা পৃথাকে ভরসা দিয়ে ফোন রাখলেন। আর পৃথা ল্যাপটপ নিয়ে বসল। কফিশপের ডেকোরেশন কেমন হবে সেটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। খাতা কলম নিয়ে ডিজাইন করতে গিয়ে হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়লো। উপুর হয়ে শুয়ে গুগলে ডিজাইন আইডিয়া দেখতে দেখতে খাতায় আনমনে কিসব লিখছিল। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলো সেখানে শুধুই সায়ানের নাম। পৃথার বুকটা ফাঁকা হয়ে গেলো। সায়ান সায়ান সায়ান। আমি তোমাকে ভালোবাসি সায়ান। তুমি কখন আসবে? আমার কাছে আসো। আসো আসো আসো।
এরকম অসংখ্য শব্দ লিখে ফেলেছে খাতায়। চোখ বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়লো ওর। বুকের ভেতর উথাল পাথাল ঝড় শুরু হয়ে গেলো। সায়ানকে ছাড়া থাকার কথা যেন ভাবতেই পারে না ও। কি ভীষণ কষ্ট হতে থাকে! মানুষটা অস্তিত্বের সাথে মিশে গিয়েছে। ওকে নিয়ে বারবার স্বপ্ন আসে চোখে। অজান্তেই ওর কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হয়, একি আমি ওকে নিয়ে কেন ভাবছি! মন বড় অদ্ভুত।
রাতটা আর ঘুমাতে পারলো না পৃথা। ক্যাফেটেরিয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের যন্ত্রণাকে নিয়ে সময় কাটাতে লাগল। রাতগুলো এমনই। দিনের বেলা যে মানুষটা সবচেয়ে কঠিন, রাত্রিবেলা সে মানুষ টাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে একাকী ও নরম। সমস্ত বেদনারা এসে বুকে জমাট বাঁধে। ভালোবাসার শূন্য খাঁচাটা ডানা ঝাপটাতে থাকে। কারো ভালোবাসা পাবার তীব্র ব্যকুলতা জাগে। ভালোবাসায় নিজেকে রাঙাতে বড্ড ইচ্ছে হয়। কখনো কখনো হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে কোনো অজানায়। কিন্তু বাস্তবতায় ফিরে এলে সবকিছু শূন্য, ফ্যাকাশে হয়ে ধরা দেয়। তখন বুকটা ফাটতে থাকে। কাউকে কাছে পাবার আকুলতাটা আরো নাড়া দিতে থাকে।
পরদিন ঘুম ভাংলো বেশ দেরিতে। দুপুর হয়ে গেছে। পৃথা আড়মোড়া ভেঙে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে অনেকগুলো কল এসেছে। নাম্বারটা অচেনা। রাতে মোবাইল সাইলেন্ট করে ঘুমিয়ে পড়েছিল তাই বুঝতে পারে নি। কিছুক্ষণ পর সেই নাম্বারে কল দিতেই একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো। ~ হ্যালো কে বলছেন?
পৃথা বলল~ এ নাম্বারে থেকে অনেকগুলো কল এসেছিল। আমি পৃথা।
~ ও পৃথা! আমি সাইমু। সায়ানের বোন।
~ জ্বি আপু। বলুন
~ সায়ান রাতে খুব পাগলামি করেছে বুঝলে? অনেক চেষ্টা করে তোমার নাম্বার যোগাড় করে ফোন দিয়েছি। সায়ান ওষুধ খাচ্ছে না। বাচ্চাদের মত অভিমান করে বসে আছে। তুমি কি একবার আসবে?
~ কিন্তু আপু..
~ কি?
~ আন্টি তো আমাকে..
~ মা কিছু বলবে না। তুমি আসো প্লিজ। আমার ভাইটা আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তুমি এসে ওকে খাওয়াতে পারো কি না দেখো।
~ আচ্ছা আপু আমি আসছি।
পৃথা রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো খালা মাছের কালিয়া আর সাদা ভাত রান্না করেছে। ভাজিও আছে। দ্রুত বাটিতে তুলে নিয়ে রুমে এসে জামাকাপড় বদলে নিলো। তারপর হঠাৎ মনে হল সায়ানের দেয়া চুড়ি ও গাজরার কথা। কি ভেবে যেন আজকে পৃথা শাড়ি পরলো। হালকা সাজগোছ করে খোপায় গাজরা ও হাতে সায়ানের দেয়া চুড়িগুলো পড়লো। চুল আচড়ে বেণী করে সামনে এনে ঝুলিয়ে রাখলো। এভাবে একবার পৃথাকে দেখলেই সায়ানের সব পাগলামি ছুটে যাবে পৃথার মনে এই বিশ্বাস।
হাসপাতালের দরজায় শব্দ করলে দরজা খুলে দিলো সাইমু আপু। পৃথাকে দেখে বলল, একেবারে বউ সেজে এসেছো!
সায়ান ঘুমাচ্ছিল। পৃথা কাছে এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। সাইমু আপু বলল, সায়ান দ্যাখ কে এসেছে? ওঠ।
সায়ান চোখ মেলে হা করে তাকিয়ে রইলো। বড়বড় হয়ে গেলো ওর চোখ দুটো। পৃথা এসেছে! নাকি এটা নিছক স্বপ্ন?
পৃথা হাসির চেষ্টা করে বলল, কি দেখছেন?
~ তুমি এসেছে?
~ হ্যাঁ। উঠুন, ভাত খাবেন।
~ তুমি শাড়ি পরেছো কেন?
~ কি অদ্ভুত প্রশ্ন! শাড়ি পরলে মন ভালো থাকে তাই পরলাম। আমার মন আজ খুব খারাপ ছিল।
~ কেন?
~ আপনি অসুস্থ তাই। এবার সুস্থ হয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।
সায়ানের মা এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পৃথাকে দেখতে সুন্দর লাগছে এটা স্বীকার করতেই হয়। উনি না চাইলেও তাকিয়ে আছেন। পৃথা কি ভেবে হঠাৎ ওনার দিকে তাকিয়ে বলল, আন্টি আপনি খেয়েছেন? আসুন খেয়ে নিন। আমি গরম ভাত আর মাছের কালিয়া এনেছি। সাথে ডিম ভুনা আর ভাজি।
আন্টি কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। তবে পৃথা এটা বুদ্ধি করেই বলেছে। কারণ ছেলে অসুস্থ, তার উপর কিছু খায়নি। এমতাবস্থায় কোনো মা ই খেতে পারবেন না। পৃথা আন্টির কাছে গিয়ে ওনার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো। বেডের উপর বসিয়ে বাটি থেকে ভাত নিয়ে প্লেটে তুলে এগিয়ে দিলো। পানির বোতল আর একটা প্লেট দিয়ে বলল নিন হাত ধুয়ে নিন।
আন্টি শুধু অবাক হয়ে দেখছেন। কিছু বলতে পারছেন না। পৃথা মনেমনে হাসছে। আর ওর মনটা কোনো অদ্ভুত কারণে ভালো হয়ে গেছে। মন ভালো না থাকলে ও শাড়ি পরতো না। হয়তো বা ফ্রেশ ঘুমের পর যখন কেউ শুনবে একটা ছেলে তার জন্য পাগলামি করে না খেয়ে আছে, স্বাভাবিক ভাবেই তার মন ভালো হয়ে যাওয়ারই কথা। পৃথা বলল, আজ অবশ্য আমি রান্না করিনি। খালা করেছে। তবে খালাও ভালো রান্না করেন। খেয়ে নিন। আমার উপর যত রাগ থাকুক আর যা ই থাকুক। খেতে তো অসুবিধা নেই।
সায়ান বলল, আমাকে খাইয়ে দাও আম্মু।
আন্টি সায়ানকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেলেন। পৃথা চেয়ারে গিয়ে বসল। সায়ান বলল, মা পৃথাকেও খাইয়ে দাও।
মা একবার পৃথার দিকে তাকালেন আর একবার সাইমুর দিকে। পৃথা উঠে এসে কাছে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ খাইয়ে দিন। আমিও কিছু খাইনি তাই বেশি করে ভাত এনেছি।
মা কি করবেন বুঝতে পারলেন না। একটা মেয়ে সামনে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার আনা ভাত তিনি নিজে খাচ্ছেন অথচ সেই মেয়েটার মুখে দেবেন না, তা কি করে হয়! ব্যাপারটা বাজে হয়ে যাবে। উনি পৃথার মুখে খাবার তুলে দিলেন। সায়ান মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। এত সুন্দর দৃশ্য বোধহয় আগে দেখেনি। ইস! মা যদি সবসময় পৃথাকে এভাবে তুলে খাওয়াতো! তাহলে কত ভালোই না হতো।
সাইমু বলল, আমারও তো খেতে ইচ্ছে করতেছে আম্মু।
~ আয় তুইও খা।
মায়ের মুখে হালকা হাসির আভাস। সায়ানের দৃঢ় বিশ্বাস মায়ের মনটা আস্তে আস্তে গলছে। নিশ্চয়ই তিনি পৃথাকে আপন করে নেবেন। পৃথার সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করতে হবে। মাকে কিভাবে পটানো যায়। অবশ্য পৃথা এমনিতেই সেটা আদায় করে নেবে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে পৃথা সায়ানকে বলল, আমি একটা ক্যাফে দিতে চাচ্ছি কোন এরিয়ায় হলে ভালো হয়?
~ ক্যাফে?
~ হ্যাঁ।
~ হঠাৎ এই ভাবনা? তুমি তো জব করবে বলেছিলে?
~ অনেক ভেবে এই ডিসিশনে এলাম। আমি ক্যাফে দিয়ে শুরু করতে চাই। পরে রেস্টুরেন্ট।
~ আমি কি তোমার সাথে থাকবো না?
~ কো অপারেশন করতেই পারেন। তবে আমি একার চেষ্টায় এগোতে চাই।
~ এটা খুব ভালো ডিসিশান। তোমার যেটা মনে হবে যে এটা ভালো করতে পারবে তুমি সেটাই শুরু করো।
পৃথা দোকানের লোকেশন জানালো সায়ানকে। সায়ান কিছুক্ষণ ভেবে বলল ওটা ক্যাফের জন্য ভালো জায়গা। আশেপাশে কোনো ক্যাফে নেই। ওরকম জায়গায় একটা শপ হলে ভালোই হবে। পৃথা কয়েকটা ডিজাইনও দেখালো মোবাইল থেকে ওকে। কিভাবে ডেকোরেশন করতে চায়, কিভাবে শুরু করতে চায় সবই বললো। সব শুনে সায়ান মুগ্ধ। একটা মেয়ের মাথাতেও এরকম ঝুঁকির আইডিয়া আসতে পারে এটা বিশাল কিছু। পৃথা সেটা বুদ্ধিমত্তার সাথে বেশ ভালোভাবেই পারবে। সায়ানও ওকে আইডিয়া দিতে লাগলো।
এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিলেন সায়ানের মা। ওনারও মনে ধরেছে পৃথার চমকপ্রদ আইডিয়া গুলি। মেয়েটা অনেক ট্যালেন্ট। কাজের প্রতি ভালোবাসা আছে মনে হচ্ছে। একাগ্রতা আছে। কিন্তু পুরনো ক্ষোভটা এখনো ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না। সেটা সম্ভব হবে কি না উনি তাও জানেন না। আজকে পৃথাকে শাড়ি পরে আসতে দেখে ওনার সত্যিই রাগ হয়েছিল। কিন্তু দেখতে ভালোও লাগছিল। মনের ভেতর কি যে চলছে নিজেও বুঝতে পারছেন না। একদিকে অসহ্য লাগছে, আবার একদিকে ভালোও লাগতে শুরু করেছে। এই অনুভূতি মা ধরতে না পারলেও সায়ান ঠিকই ধরতে পারছে। এখন ভালো লাগাটা ক্ষোভটাকে বিদায় করে দিয়ে জায়গা দখল করে নিতে পারবে তো?
অন্তিম পর্ব
পৃথা ক্যাফেতে বসে অন্যমনস্ক হয়ে আছে। একদিন হয়ে গেলো সায়ান ফোন রিসিভ করছে না। গত কয়েকটা দিন দুজনের প্রত্যেকটা সময় একসাথে কেটেছে। একসাথে অফিসে আসা, বসে প্লানিং করা, কেনাকাটা করা, অফিস সাজানো, আর্কিটেক্ট এর সাথে কাজ করা, সবকিছুতেই দুজনে একসাথে কাজ করেছে। রাতে শহরে হাঁটতে গিয়ে বলা হয়ে গেছে কত কাব্য! কখনো বা হাইওয়ের পাশে বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রেমের কথা বলা। ছেলেমানুষি বায়না করা। রাত জেগে ফোনে মৃদুস্বরে কথা বলা। কখনো রাস্তা পার হওয়ার সময় হাতটা ধরে ফেলা। সমস্ত স্মৃতি বুকের ভেতর মুচড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কি গভীর প্রণয় হয়েছে দুজনাতে। বাইরে থেকে কেউ হয়তো বুঝবে না ব্যাপারটা, কিন্তু পৃথা তো জানে সায়ান তার কত আপন। যে মানুষ টা ধীরেধীরে পৃথার একটা অংশ হয়ে উঠেছে। একটা অংশকে বাদ দিয়ে কি চলা সম্ভব?
পৃথা পেরে উঠছে না। সায়ানকে অজস্রবার ফোন দিয়েছে ও। কিছুতেই রিসিভ করছে না। মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে না, অনলাইনে আসছে না। এতটাও অভিমান কেউ করে! পৃথা বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। বাবাকে ওদের বাসায় পাঠালে যদি ওনারা খারাপ কিছু বলে ফেলেন বাবা খুব দুঃখ পাবেন। পৃথা বাবাকে দুঃখ দিতে পারবে না। এই দুঃসাধ্য ওর নেই। তবে কি সায়ানকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে হবে?
দুটো দিন কেটে গেলো ভীষণ বিরহে। সারা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটছে পৃথার। একটুও দু চোখের পাতা এক করতে পারছে না। সায়ানের কণ্ঠটা শোনার জন্য মনটা বড় ব্যকুল হয়ে আছে। একটা নেশা ধরিয়ে দিয়েছে ছেলেটা। ওর কণ্ঠ না শুনে কিছুতেই ভালো লাগে না। কণ্ঠও তবে নেশার কারণ হতে পারে!
রাতে পৃথার রুমে আলো জ্বলতে দেখে বাবা দরজায় নক করে বললেন, কি রে মা? ঘুমাস নাই?
~ না আব্বু। ঘুম আসছে না।
পৃথা লুকিয়ে চোখ মুছলো। বাবার কেন যেন মনে হল পৃথা কাঁদছিলো। লুকাতে গিয়েও বাবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলো না। উনি জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি কোনোকিছু নিয়ে টেনশনে আছিস?
~ না আব্বু। নতুন বিজনেসে নামলাম তো, সামান্য দুশ্চিন্তা তো হবেই।
~ হুম।
পৃথা বিষয়টা লুকালেও বাবার বারবার মনে হতে লাগলো মেয়েটা মানসিক ভাবে কষ্ট পাচ্ছে। উনি বললেন, আমি কি কালকে বাড়ি চলে যাবো?
পৃথার বুকটা ধক করে উঠলো। বাবা চলে গেলে আর কোনোভাবেই সায়ানের সাথে সবকিছু ঠিক হবে না। সায়ান যেভাবে অভিমান করে বসে আছে তাতে যেভাবেই হোক বাবাকে ওর বাসায় পাঠাতে হবে। কিন্তু ভয় করছে পৃথার। কথাটা বলার ইচ্ছে বা সাহস কোনোটাই নেই। ও বলল, আর দুটো দিন থেকে যাও না আব্বু।
~ আচ্ছা ঠিক আছে। তুই রাত জাগিস না। তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।
~ আব্বু, আমার পাশে এসে একটু বসবে? কতদিন আমাকে বাচ্চাদের মত আদর করো না। আমি কি খুব বড় হয়ে গেছি আব্বু?
বাবা কাছে আসতেই পৃথা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। নিজেকে কোনোভাবেই সংবরণ করতে পারলো না। কান্না থামাতেও পারলো না। সব চাপা যন্ত্রণারা চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো। বাবা এবার বেশ বুঝতে পারলেন মেয়েটার সত্যি কিছু হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে সেটা কিভাবে জিজ্ঞেস করবেন বুঝতে পারলেন না।
বললেন, আমার সাথে শেয়ার কর মা। তোর কি মন খারাপ কিছু নিয়ে?
~ না।
~ কেউ কিছু বলেছে?
~ আমি কি বাচ্চা যে কেউ কিছু বললে কাঁদবো?
~ হা হা। বাচ্চা না হলে কি এভাবে আদর করে দিতে বলতি? আমার ছোট্ট মা, তুই এখনো আমার কাছে বাচ্চা। বাবা মায়ের কাছে সন্তানরা সবসময়ই আদরের, সবসময়ই ছোট্ট সোনামণির মতন।
পৃথা বাবাকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। বাবা মেয়ের পাশে অনেক্ষণ বসে রইলেন। মেয়ের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কিছু সময়। বিধাতা বড় মায়া দিয়ে গড়েছেন মেয়েটাকে। কত দ্রুত বড় হয়ে গেলো যেন! অথচ সেদিন ই ছোটাছুটি করে এসে বায়না ধরে বলত, আব্বু আমার চকলেট আনোনি? না আনলে কান্না শুরু করে দিতো। কোনো বাবাই হয়তো মেয়ের কান্না সহ্য করতে পারেন না। সেটা তুচ্ছ কারণে হলেও। আজ নিশ্চয় মেয়েটার বড় কোনো কারণে কষ্ট হচ্ছে। বাবা কি করে সইবেন?
নিরবে উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন তিনি। কিন্তু ঘুমাতে পারলেন না। সায়ানের কথা মনে পড়ছে ওনার। উদ্বোধনের দিন সায়ান এসেছিলো। তার আগে পৃথার সাথে ওর কেমন ওঠাবসা ছিল বাবা তা জানেন না। কাজেই বলতে পারছেন না ওদের মাঝে কোনো ঝামেলা হয়েছে কি না। এটা বোঝার কি কোনো উপায় আছে? ভাবতে ভাবতে রাত প্রায় শেষ হতে চললো। তিনি চিন্তিত মুখে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। হঠাৎ একটা দৃশ্যে ওনার চোখ আটকে গেলো। উনি অবাক হয়ে দেখলেন রাস্তায় সায়ান দাঁড়িয়ে পৃথার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। একহাতে কপাল এমনভাবে ঘষছে যে ওকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে গেলো বাবার। এত রাতে সায়ান কেন এসেছে! প্রায় ভোর হতে চললো। পৃথা তো জানেও না বোধহয় সায়ান এসেছে। ও তো ঘুমাচ্ছে। নাকি পৃথা ইচ্ছে করেই সায়ানকে বাইরে দাড় করিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে? রহস্য যাই হোক না কেন,বাবা এটুকু নিশ্চিত হলেন যে ঝামেলাটা সায়ানের সাথেই হয়েছে।
উনি চাইলে নেমে গিয়ে সায়ানের সাথে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু গেলেন না। ছেলেটা ভীষণ লজ্জায় পড়ে যাবে। এই বয়সের একটা যুবকের মনে এখন ভীষণ তোলপাড় চলে, খুব পাগলামি থাকে। পাগলামিটা গুরুজনের কাছে ধরা পড়ে গেলে ওরা লজ্জা পায়। বাবা সায়ানকে সেই লজ্জায় ফেলে দিতে চাইলেন না। আগামীকাল একটা কিছু করা যাবে।
.
পরেরদিন নাস্তার টেবিলে বাবা পৃথাকে বললো, সায়ানকে শপে আসতে বল। ওর সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই।
চমকে উঠলো পৃথা। বাবা কি সব বুঝে ফেলেছে! ও বিস্মিত চোখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মাথা নিচু করে ফেললো। মাথা দুলিয়ে বলল, আচ্ছা।
বিকেল পর্যন্ত বাবা অপেক্ষা করলেন কিন্তু সায়ান এলো না। এখন বিষয়টা আরো জটিল মনে হচ্ছে। সায়ানের সাথে আদৌ কথা হয় তো? নাকি পৃথার সাথে ঝগড়ার কারণে কথাই বন্ধ হয়ে গেছে? এটা বোঝার জন্য অবশ্যই পৃথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। উনি পৃথাকেও লজ্জায় ফেলতে চান না।
পৃথার কাছে এসে বললেন, মা রে। রাত বিরাতে ছেলেটাকে রাস্তায় দাড় করিয়ে রাখিস না। তোর খালা খালু অনেক ফ্রি। প্রয়োজন হলে ওকে বাসায় ডেকে এনে দুটো কথা বলে বিদায় করে দিবি। অত রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে খারাপ বলবে না?
পৃথা চমকে উঠে তাকালো। বিস্ফোরিত হলো ওর চোখ। মানে কি! বাবা আসার পরেরদিন ই তো সায়ানের সাথে ঝগড়া হলো। তারমানে ও ঝগড়া হবার পরেও রাতে বাসার নিচে এসেছিলো! এত অভিমান করার পরও না এসে থাকতে পারে নি। হয়তো এক পলক দেখার জন্য ছুটে এসেছে। পারছে না মুখে বলতে, পারছে না অভিমান ভাংতে। আবার পারছে না, না দেখে থাকতে। সায়ানের প্রতি ভালোবাসায় ভরে গেলো পৃথার বুক। এত আনন্দ হতে লাগলো যে ইচ্ছে করলো ছুটে ওর কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, আমায় এত ভালোবাসো কেন? অভিমান করার পরও কেউ বাসার নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে নাকি পাগল? তুমি আসলেই একটা পাগল।
বাবা বললেন, সায়ান এলো না যে? ব্যস্ত বোধহয়?
পৃথা ইতস্তত করতে লাগলো। ওর মুখের ভঙ্গি দেখেই বাবা বুঝতে পারলেন সায়ানের সাথে হয়তো কথা হয়নি। উনি মেয়েকে বিব্রত না করে বললেন,ওর নাম্বারটা আমাকে দে। আমি ওর সময়মত ওর সাথে যোগাযোগ করে নেবো।
পৃথার চোখ দুটো এবার আরো বিস্ফোরিত হলো। বেশিক্ষণ বাবার দিকে চেয়ে থাকতে পারলো না। বাবার হাসিমুখের সামনে ওর তাকিয়ে থাকতে লজ্জা করছিল। তারপরও বলল, আব্বু। সায়ানের সাথে এখন কথা বলার দরকার নেই।
~ রাগ করে বলছিস?
~ না। আমি জানি দেখা হলে ও কি বলবে। কিন্তু আমি সেটা করতে দিতে পারি না আব্বু। প্লিজ এ ব্যাপারে কিছু জানতে চেও না।
~ তুই নাম্বার দিবি?
~ না আব্বু। প্লিজ। ও তোমাকে যেটা বলবে আমি সেটা করতে দিবো না। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব কষ্ট পাবো। প্লিজ আব্বু প্লিজ।
~ কষ্ট তো এখনও পাচ্ছিস।
পৃথা বাবাকে জাপটে ধরে চুপ করে রইলো। বাবা আর কোনো প্রশ্ন করলেন না।
.
রাতে পৃথা বারবার জানালার পাশে উঁকি দিতে লাগল। অকারণে বেলকুনিতে এসে দাঁড়াল। দেখতে চাইলো সায়ান আজও আসে কি না। এক পলকের দেখা তো হবে। কিন্তু না, অনেক রাত হয়ে গেলো তবুও সায়ান এলো না। আশাহত হয়ে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়লো পৃথা।
পরেরদিন দুপুরের পরপর সায়ান হঠাৎ ক্যাফেতে এসে হাজির। হাস্যোজ্জ্বল মুখ। ছুটে এসে সবার সামনেই পৃথার হাত ধরে ফেললো। বললো, আমি জানতাম তুমি এটা পারবে। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা আমার কলিজা।
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলল, বুঝলাম না।
~ তোমার বাবাকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে তুমি প্রমাণ করে দিয়েছো সত্যিই আমাকেই চাও।
~ মানে কি!
ছোটখাটো স্বরে আৎকে উঠলো পৃথা। কাছে এসে বলল, বাবা কখন গেছে?
~ আজকে এগারো টার দিকে।
~ কি হয়েছে খুলে বলো?
~ আমার আব্বু আম্মুকে রীতিমতো পটিয়ে ফেলেছে। আমি সামনে যাইনি। পাশের রুম থেকে ওদের হাসাহাসির শব্দ কানে আসছিলো। দুপুরে একসাথে খেয়েছি আমরা। উনি আমাকে বললেন, যেন সবসময় তোমাকে আগলে রাখি। যেন কখনো কষ্ট না দেই। আমি ওনাকে কথা দিয়েছি কক্ষনো কষ্ট দেবো না। কলিজায় আদরে রাখবো।
পৃথা কি বলবে বুঝতে পারলো না। সবকিছু তাহলে ঠিকঠাক হয়ে গেছে! কিন্তু.. কিন্তু…
সায়ান বলল, তুমি খুশি হও নি? আচ্ছা কবে তোমাকে আংটি পরাতে আসবো বলো? উফফ বিয়েটা আজকেই করে ফেলতে পারতাম যদি। আর তো তর সইছে না।
পৃথা ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলবে বুঝতেই পারছে না।
সায়ান বললো, আমরা কিন্তু বেশিদিন অপেক্ষা করবো না প্লিজ। অপেক্ষা অনেক কষ্টের।
~ তুমি বাবাকে বলেছিলে তোমাদের বাসায় যেতে?
~ কি আজব! আমি কেন বলবো? গত তিনদিন তো আমি বাসা থেকেই বের হইনি। ফোনটাও হাতে নেইনি।
~ তারমানে আব্বু নিজে থেকেই এভাবে…
পৃথা এত বেশি আশ্চর্য হয়ে গেছে যে বিশ্বাসই করতে পারলো না। ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। বাবা এত ভালো কেন! সায়ান পৃথার পায়ের কাছে বসে বললো, জানো কাল রাতে তোমাকে না দেখে একেবারে ই ঘুমাতে পারছিলাম না। ইচ্ছে করছিল মরে যাই। না দেখে থাকা দায় হয়ে যাচ্ছিল। তাই ছুটে এসে প্রায় দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে রইলাম বাসার সামনে। একবার বেলকুনিতে এলেও না। অথচ তোমার রুমে লাইট জ্বলছিলো।
পৃথা কিছুই বললো না। বাবা এখান থেকেই সবকিছু বুঝে নিয়েছেন। সত্যিই বাবা এত বেশি বুদ্ধিমান যে কিভাবে যেন সবকিছু বুঝে নিয়ে আবার সামলেও নিলেন। সায়ানকে পেয়ে যাওয়ার পুরো ক্রেডিট টাই ওনার।
সায়ান বলল হাসবে না একবার? সমস্ত অপেক্ষা অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বৃষ্টি নেমেছে।
তবুও পৃথার কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ দূর হলো না।
বাসায় ফিরে বাবার ঘরে এসে পৃথা দেখে উনি ঘুমাচ্ছেন। ও কাছে এসে আব্বুর পা ছুঁয়ে দিলো। এত কান্না আসছিল!
বাবা চমকে উঠে বললেন, কি রে মা তুই!
পৃথার চোখ ভিজে উঠলো, আব্বু। তুমি কিভাবে এতকিছু বুঝে গেলে! আমি খুব ভাগ্যবতী যে তোমার মত আব্বু পেয়েছি।
~ পাগলী। তবে তুই আসলেই ভাগ্যবতী। সায়ান খুব ভালো ছেলে রে মা। বাইরে থেকে দেখে কাউকে আসলে জাজ করা যায় না। ছেলেরা সবকিছু প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু ওদের ভেতরটা বড় নরম। কি যে ভালোবাসবে ও তোকে!
~ আব্বু। তুমি এত ভালো কেন বলোতো?
~ কারণ আমি তোর আব্বু। তুই যে আমার সবচেয়ে ভালো মেয়েটা। বাবাকে কষ্ট দিতে চাস না বলে কিছুই জানাস নি।
~ হুম। তুমি তবুও সব বুঝে গেছো।
~ তোর কান্না আমি সহ্য করতে পারি না মা। ছোটবেলায় চকলেটের জন্য কাঁদলেই ছুটে বাজারে নিয়ে যেতাম। আর এখন কাঁদলে কিভাবে সহ্য করবো বল?
পৃথার সত্যিই এখন কান্না আসছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ও নিরবে অশ্রুপাত করতে লাগলো। অশ্রু সবসময় কষ্টের হয় না। বাবা মেয়ের চোখে আজ যে অশ্রু, তা কেবল আনন্দের, পরম আনন্দ।
সমাপ্তি ঘটলো বৃষ্টির অপেক্ষার। সবাইকে অনেক অপেক্ষা করিয়েছি, অনেকেই ফেসবুকে এসে বারবার নিরবে খুঁজে গেছেন অবশেষে বৃষ্টি এলো কি?
আবার কেউ মন্তব্য করে জবাবের অপেক্ষায় ছিলেন।
সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
পরিশেষে অনুরোধ যতজন পাঠক/পাঠিকা গল্পটি পড়েছেন সবাই ছোট্ট একটি মন্তব্য করে যাবেন। তাহলে অন্তত বুঝতে পারবো আমার গল্পের কতজন পাঠক (শুভাকাঙ্ক্ষী) ছিলেন।
ধন্যবাদ গল্পটি ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য। পৃথিবী সহ আমরা সবাই সুস্থ থাকলে আবার নতুন কোনো গল্পে কথা হবে। গল্পের ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
লেখা – নীলাভ্র নেহাল
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “অবশেষে বৃষ্টি (শেষ খণ্ড) – প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা র গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – অবশেষে বৃষ্টি (১ম খণ্ড) – প্রেমিক প্রেমিকার ভালোবাসা ‘র গল্প
অনেক সুন্দর একটা গল্প। এরকম গল্প আরো চাই। আপনাদের গল্প গুলো অনেক ভালো লাগে। সব পর্ব একসাথে পাওয়া যায়।
ভাই আপনার গল্প টা খুব ভালো লেগেছে বললে চলে না, বরং অনেক অনেক বেশিই ভালো, আমি 2020 সালে পড়েছি এখনো পরি গল্প টা,
যদি আপনি অনুমতি দেন আপনার গল্প টা আমি fb তে শেয়ার করতে চাই,
আপনার নামই থাকবে গল্প তে