তুমিময় অসুখ – পিচ্চি মেয়ের ভালোবাসা: এই প্রথম আমি আমার ক্রাশের নাম জানলাম। ইফতির কথা শুনে একলাফে আমি খাট থেকে নামলাম। এতটা এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার গলা দিয়ে আওয়াজ আসা বন্ধ করে দিল। আমি ইফতিকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করলাম। এমন রোমান্টিক গল্প দ্বিতীয়টি আর হতে পারে না।
পর্ব ১
ক্লাস টেনে পড়াকালীন এলাকার একটা ছেলেকে দেখে ফার্স্ট ক্রাশ খেয়েছিলাম।
এক্কেবারে কঠিন ক্রাশ যাকে বলে। ছেলেটাকে দেখলে আমার দিনদুনিয়ার কথা মাথায় থাকতো না। তাকে দেখলেই আমার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে শুরু করতো। স্কুল থেকে আসার পথে তাকে যখন দেখাতে পেতাম। তখন আমার পা দুটো আপনা-আপনি থমকে যেতো। কিন্তু ছেলেটা আমার দিকে তাকাতোই না। তখন মনে মনে ব্যাটাকে ইচ্ছেমতো গালি দিতাম।
ব্যাটা খবিশ চোখে কি কাঠের চশমা পড়ে ঘুরিস নাকি? আমার যে তোকে কত ভালোলাগে সেটা তুই বুঝিস না?
কিন্তু আমার মনের কথাগুলো মনের মধ্যেই আটকে থাকতো সেগুলো আর মুখ দিয়ে বের হতো না।
একদিন সকালে আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি ছেলেটা বাইক দিয়ে শাঁই করে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কোথায় জানি চলে গেল। আমি ভাবলাম সাতসকালে ব্যাটা কই যায়?
তারপর বিকেলে কোচিং শেষে মহাশয়কে আসতে দেখলাম।
ব্যাস আমাকে আর কে পায় ছেলেটাকে দেখার জন্য বেলকনিতে সকালে একবার আর সন্ধ্যার পূর্বে একবার গিয়ে দাঁড়াতাম। প্রতিদিন সকালে দেখা না পেলেও বিকালে ঠিকই দেখতে পেতাম তাকে। তারপর একদিন কাপড় আনতে ছাদে গিয়ে মহাশয়কে দেখতে পেলাম।
তিনি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে।
সেদিন থেকে আমি একটা রুটিন তৈরি করলাম। দিনে দুবার বেলকনিতে আর একবার ছাদে যাবই যাব। ঝড়-তুফান যাই হোক না কেনো।
আমার এই ক্রাশ খাওয়ার ব্যাপারটা কিভাবে জানি আমার বেষ্টু ইফতি ধরে ফেলল। ধরা খেয়ে আর কি করার সবটা স্বীকার করলাম। এরপর থেকে ও আমাকে ক্ষেপাতে লাগল। রাস্তায় দেখলে বলতো
ওই দেখ লতা তোর ক্রাশ।
ওর মুখে কথাটা শুনে কি পরিমাণ লজ্জা লাগতো বলে বুঝতে পারবো না।
একদিন ইফতি আমাকে এসে বলে,
_ বনু ফিজিক্স পড়ার জন্য আমরা কয়েকজন মিলে একটা টিউটর ঠিক করেছি। তুই পড়বি?
ছাত্রী হিসেবে আমি ফার্স্ট গার্ল না হলেও ভালো ছাত্রী ছিলাম। তাছাড়া আমাকে পড়ানোর জন্য একজন টিউটর আছে। আর এতগুলো প্রাইভেট পড়ার টাইম কোথায়? তাই ইফতিকে না করে দিলাম। ঠিক তখন ইফতি যা বললো তাতে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
_ তোর ক্রাশ মানে সিফাত ভাইয়া আমাদের ফিজিক্স টিউটর। এখন বল যে পড়বি না?
এই প্রথম আমি আমার ক্রাশের নাম জানলাম। ইফতির কথা শুনে একলাফে আমি খাট থেকে নামলাম। এতটা এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম যে আমার গলা দিয়ে আওয়াজ আসা বন্ধ করে দিল। আমি ইফতিকে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করলাম।
_ পড়বো না মানে? আমিতো একপায়ে রাজী।
মনের মধ্যে আমার খুশি ডামাডোল পেটাচ্ছে। আমার ক্রাশকে সামনে থেকে দেখতে পাবো আহা কত খুশির খবর।
সেদিন রাতে আম্মুকে ইনিয়েবিনিয়ে তালকে তিল করে সিফাত স্যারের কাছে পড়তে যাওয়ার জন্য রাজি করালাম। এমন একটা ভাব করলাম যে ফিজিক্স না পড়লে আমি ডাব্বা মারব। আম্মু আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে রাজি হয়ে গেল। ইফতির কাছে ফোন করে স্যার কখন পড়াবে সেটা জেনে রাখলাম।
রাতে যেন আমার ঘুম হারাম হয়ে গেল। কখন বিকেল হয়ে। ৪ টা বাজে পড়াবে আর আমি ২ টা বাজে রেডি হয়ে বসে আছি। বারবার বারান্দায় গিয়ে উঁকি দিচ্ছি যদি একবার ক্রাশকে দেখতে পাই। আমার মা আমাকে এমন করতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
_ কিরে লতা তোর কি হয়েছে?
আম্মুর কথায় কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম,
_ কি হবে আম্মু?
_ সেই কখন থেকে দেখছি বারান্দায় যাচ্ছিস আর আসছিস।
_ ইফতি আসছে কিনা দেখছি।
আম্মু আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। স্যারকে দেখার জন্য এতটাই এক্সাইটেড হয়ে গিয়েছিলাম যে লাফাতে লাফাতে বিকেল ৩ টা বাজে গিয়ে আমি তার ফ্ল্যাটের সামনে হাজির। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে আজ তাকে সামনাসামনি দেখতে পাবো। মনে হাজার সাহস সঞ্চয় করে কলিংবেলের সুইচ টিপ দিলাম। ওপাশ থেকে দরজা খোলার লোকটাকে দেখে আমার বেহুশ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমাকে দেখে তিনি একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন,
_ ভেতরে এসো।
আমি কাঁচুমাচু করতে করতে ভিতরে গেলাম। ফ্ল্যাটে ঢুকে বুঝলাম উনি এখানে একা থাকেন। আমাকে বসতে বলে উনি জিজ্ঞেস করলেন।
_ তোমাদের তো ৪ টায় আসার কথা ছিল, তাইনা?
স্যারের কথা শুনে আমি একটা ঢোক গিললাম। তাকে বলবো কিভাবে স্যার আমি আপনাকে দেখার এক্সাইটমেন্ট লুকিয়ে রাখতে না পেরে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। কিন্তু মুখে বললাম,
_ স্যার আমি শুনেছিলাম ৩ টায় পড়ানো হবে।
উনি টি-টেবিলের উপর থাকা ল্যাপটপটা বন্ধ করে বললেন,
_ আমি কাউকে পড়াই না। তোমরাই আমার ফার্স্ট স্টুডেন্ট।
আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলাম। মনে আমার হাজার জল্পনা কল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে। যদি স্যারের সাথে আমার বিয়ে হয় তাহলে আমরা দুজন এই ফ্ল্যাটে থাকবো। এভাবেই ঘরটা বেশ গুছানো তারপরও আমি যখন আসবো তখন নিজের মতো গোছাবো। আর যখন ইচ্ছে হবে দৌড়ে বাসায় চলে যেতে পারবো। আহা কি ভাবনা আমার।
আমার ভাবনার মাঝে স্যার বললেন,
_ কি খাবে লতা চা না কফি?
ইশ্ স্যার কি সুন্দর করে কথা বলে। আমি মুগ্ধ নয়নে স্যারের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে জানালাম যে আমার কিছু চাইনা। স্যার সামনের একটা সোফায় বসে আমার সাথে টুকটাক কথা বলতে লাগল। আমি শুধু স্যারের কথার জবাব দিচ্ছি। এভাবে আমি খুব বাচাল স্বভাবের কিন্তু স্যারের সামনে বসে থাকায় আমার মুখ দিয়ে যেন কথাই বের হচ্ছেনা।
স্যার ভীষণ মিশুক টাইপের। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমার সাথে ফ্রেন্ডলি হয়ে গেলেন। কথা পৃষ্ঠায় জানতে পারলাম যে স্যার মাস্টার্স করছে।
সমাপ্ত
কিছুক্ষণ পর ইফতি সহ আমাদের ক্লাসের দুজন ছেলে তারিক আর রেহান এসে হাজির হয়। আমাকে ওদের আগে আসতে দেখে দুজন অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। আর ইফতি সে তো আমাকে দেখে তখন থেকেই মুচকি মুচকি হাসছে। আমি ইফতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পড়ার টেবিলে পা বাড়ালাম।
পড়ানোর সময় আমি স্যারকে আমার খাতাটা দিলাম নোট লিখার জন্য। পড়া আমার গোল্লায় যাক আমি স্যারকে দেখতে ব্যাস্ত। আমি এমন ভাবে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি যেন আমি তার পড়া খুব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু আদৌ স্যারের কথাগুলো আমার কানে আসছে বলে মনে হচ্ছেনা। ঠিক তখন ইফতি আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
_ লতা সোনা তুমি যে কত ভালো পড়া বুঝছো সেটা আমি খুব ভালো করে জানি। তোমার রেজাল্ট এ+ আসবে আমি শিওর।
আমি ইফতির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
_ এ+ না বল গোল্ডেন এ+
পড়া শেষে আমি এক সিঁড়ি নামি আর একবার পিছনে ঘুরে তাকাই। স্যার দরজাটা খোলা রেখেছে কিন্তু বাইরে আসেনি। ভেবেছিলাম স্যার দরজা লাগাতে আসলে তাকে দেখতে পাবো। কিন্তু সেটা আর হলো কই? ধেৎ!
আমার কর্মকাণ্ডে ইফতি বেশ ক্রুদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি ইফতির তাকানো দেখে এমন একটা ভাব নিলাম যেন কিছুই হয়নি। ইফতি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
_ এই তুই কি মরে যাবি নাকি? এমন করছিস ক্যান?
আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম,
_ বালাইষাট এখন বিয়ে-শাদি করিনি আর তুই এসব বলছিস ছিঃ
_ তুই যেমনটা শুরু করেছিস তাতে আমার মনে হয়না তুই বেশিদিন বাঁচবি। ক্রাশ তো আমিও দিনে হাজারটা খাই। আমি কি তোর মতো করি নাকি? একটা ক্রাশ খেয়েই তোর মাথার স্ক্রুপ ঢিলা হয়ে গেছে তোর। শীগ্রই আঙ্কেল আন্টিকে বলে তোকে পাবনা পাঠানোর ব্যাবস্থা করতে হবে।
_ যদি যাই সাথে করে তোকেও নিয়ে যাবো জান্টুস। পাবনা পাঠানোর ব্যাবস্থা না করে আমার ক্রাশের কাছে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে দে প্লিজ।
ইফতি মাথায় হাত দিয়ে মনে মনে ভাবে, হায়রে এই মেয়ের মাথা পুরো গেছে।
রাতে পড়তে বসে আমি শুধু স্যারের লেখাগুলি দেখছিলাম। লেখাগুলো কমপক্ষে আমি একশো বার পড়েছি। আমার মন আর মস্তিষ্ক দুটো স্যারকে নিয়ে প্রখরভাবে ভাবতে শুধু করেছে। খাতাটা বুকে জড়িয়ে ধরে নাচতে লাগলাম। স্যার আমাকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করতে শুরু করে দিয়েছে। মস্তিষ্ক যেন আমাকে আগাম জানিয়ে দিচ্ছে,
তুই সিফাতের অসুখে পড়েছিস লতা। এটা তোর জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়ংকর অসুখ।
পর্ব ২
দিন যেতে থাকে সেই সাথে আমি অসুখটা বাড়তে থাকে। স্যার খুব ভালো পড়া বুঝাতে পারতো সেইদিক থেকে আমাদের ব্যাচের সবাই সিফাত ভাইয়া বলতে পাগল। স্যারের যখন পড়াতো আমি তাকে দেখতে ব্যাস্ত থাকতাম। একদিন মুখ ফসকে স্যারকে বলেই ফেলি।
_ স্যার আপনি জানেন আপনি যখন হাসেন তখন আপনাকে আমার ফেভারিট হিরো কার্তিক আরিয়ানের মতো দেখতে লাগে। ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি।
আমার কথা শুনে ইফতির কাশি উঠে যায়। তারিক আর রেহানের চোখ দুটো হয়ে গেছে রসগোল্লার সাইজ। আমি কথাটা বলেই একটা জিভে কামড় দেই। সবার সামনে এটা কি বললাম। স্যার আমার কথায় তার ঘায়েল করা হাসিটা দিয়ে বলল,
_ জানতাম না এখন জেনে নিলাম। এখন থেকে দুটো বডিগার্ড রাখতে হবে। তুমি কখন হামলা করবে বলা যায়না।
স্যারের কথা শুনে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। কেনো জানিনা স্যার যাই বলে আমার তাই ভালো লাগে।
টানটান দুদিন প্রচুর বৃষ্টি পড়ায় স্যারের বাসায় যাওয়া হলোনা। বৃষ্টির জন্য রাস্তায় বের হওয়ার মুশকিল। তবুও আমি বেলকনিতে গিয়ে উঁকি মারতাম স্যার যদি বের হয়। কিন্তু স্যারকে দেখতাম না। আবার মায়ের চোখ লুকিয়ে ছাদে গিয়ে দেখতাম স্যার ছাদে আছে কিনা। কিন্তু স্যার সেখানেও নেই। আমার অবস্থা প্রায় পাগলের মতো। মনে হচ্ছিল স্যারকে বহুবছর ধরে দেখিনা।
পরেরদিন দুপুরে বৃষ্টি হয়নি কিন্তু আকাশ ভীষণ মেঘলা। বৃষ্টি নেই এই সুযোগে আমি খাতা নিয়ে স্যারের বাসায় চলে যাই। স্যার দরজা খুলে আমাকে দেখে কিছুটা চমকে বললেন,
_ লতা তুমি?
আমি স্যারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। স্যারের চুলগুলো ভেজা বোধহয় কিছুক্ষণ আগে গোসল করেছেন। একহাতে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুচছে আরেক হাত দিয়ে দরজাটা ধরে রেখেছেন। স্যারের নামের মতোই স্যার দেখতে। আমি স্যারের দিকে থেকে চোখ নামিয়ে বললাম,
_ স্যার আমার একটা চ্যাপ্টারে অঙ্কে খুব প্রব্লেম হয়েছে। এটা সলভ করতে এসেছি।
স্যার আর কিছু না বলে ভেতরে আসতে বললো। হয়তো তার চোখে আমি আদুভাই এর মতো সেরা স্টুডেন্ট ছিলাম যে কিনা ঝড়বৃষ্টি দিয়েও পড়তে চলে আসে। প্রায় দু’ঘন্টা আমাকে পড়ানোর পর স্যার আমাকে বললেন,
_ লতা আকাশের অবস্থা ভালোনা। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাও। নাহলে একবার বৃষ্টি শুরু হলে আর যেতে পারবেনা।
আমি তো সেটাই চাই। বৃষ্টি হোক আর আমি এখানে থাকি। মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যে খুব জোরে বৃষ্টি হয়। ঠিক কিছুক্ষণ পর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। আমার খুশি দেখে কে? আনন্দটা চেপে রেখে স্যারের দিকে তাকিয়ে অসহায় মুখ করে বললাম,
_ স্যার বৃষ্টি হচ্ছে এবার কি হবে?
স্যার আমার সব আশায় পানি ঢেলে দিয়ে হাতে একটা ছাতা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
_ তাড়াতাড়ি বাসায় যাও।
আমি ছাতাটা নিয়ে গুটিসুটি মেরে চলে আসলাম। রাস্তায় স্যারের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছি আমি। এরকম আনরোমান্টিক মানুষ আমি জীবনে দুটো দেখিনি। সিনেমার দেখি নায়ক নায়িকার জন্য বৃষ্টির মধ্যে ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাতবিরেত দেয়াল টপকে নায়িকাকে দেখতে যায়। আর আমার কপালে এটা কি জুটেছে? আমি ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাকে দেখার জন্য তার বাড়িতে চলে গেলাম আর উনি আমার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে বলল বাসায় যাও।
হুহ্ আল্লাহ তুমি হেদায়েত কর মানুষটার উপর।
এরমধ্যে আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে আমাদের সাথে পড়তে আসা শুরু করলো। ওর নাম তুলি। মেয়েটা পড়তে এলো না জানি আমার উপর শনিরদশা পড়লো। তুলিকে দেখলে আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। যখন ও স্যারের সাথে ঢং করে কথা বলে ইচ্ছে করে ওর চুলগুলো ছিঁড়ে ন্যাড়া বানিয়ে দিতে।
স্যার আমাদের সেইখানে পড়ায় সেইখানে আমি সবসময় স্যারের মুখোমুখি বসি। তারিক আর রেহান স্যারের পাশে আর ইফতি আমার সাথে। আমার জন্য ওই চেয়ারটা বরাদ্দ করা ছিল। কারণ তারিক আর রেহান আমার স্যারের প্রতি অসুখের কথা খুব ভালো করে টের পেয়েছিল। তাই আমি না আসলে চেয়ারটা খালি পড়ে থাকবে তবুও কেউ বসবে না। বসলে যে ওদের মাথায় একটাও চুল থাকবে না সেটা ওদের ভালো করেই জানা আছে। কিন্তু তুলি আসার পর থেকে ওই চেয়ারে বসতে শুরু করে। আমি শুধু তুলির কাণ্ডগুলো দেখি আর মনে মনে ফুসতে থাকি। আবার স্যার সবসময় আমার খাতায় নোট লিখে দিতো। তুলি আসার পর ওর খাতায় স্যারকে নোট লিখার জন্য বায়না করতো।
স্যার প্রথমে আমার থেকে লিখে নিতে বলতো। কিন্তু তুলি এমন ঠ্যাটামি করতো যে একদিন স্যার ওর খাতায় নোট করে দেয়। সেদিন থেকে আমি স্যারকে আমার খাতা দেওয়া বন্ধ করে দেই। কারণ আমার জন্য তারিক, রেহান আর ইফতি কেউ খাতা বের করতো না। কিন্তু আমি খাতা দেওয়া বন্ধ করতে তুলি যেন মাথায় চড়ে বসলো। মনে মনে ওকে ঝাড়ার একটা পরিকল্পনা করলাম।
পাঠক আপনাদের জন্যই আমরা প্রতিনিয়ত লিখে থাকি। আপনাদের আনন্দ দেয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ। তাই এই পর্বের “পিচ্চি মেয়ের ভালোবাসা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো পড়া শেষে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।
একদিন প্রাইভেট পড়ে সবাই রাস্তায় দিয়ে হাঁটছি। সেইসময় তুলি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
_ আচ্ছা লতা একটা কথা বলবি?
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
_ কি?
_ আমরা সবাই সিফাত স্যারকে ভাইয়া বলে ডাকি শুরু তুই স্যার বলে ডাকিস কেনো?
তুলির কথায় আমার রাগ ঝাড়ার একটা সুযোগ পেলাম। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে বলতে শুরু করলাম,
_ আমি সিফাত স্যারকে ভাইয়া বলবো কেনো? ভাইয়া ডাকবি তোরা।
তুলি আমার কথায় বোকা বনে বলল,
_ মানে?
_ শোন সিফাত স্যার, আমার ভাই না আমার জামাই হয়। আমার জামাই তোদের দুলাভাই তো হবে ,তাইনা। নিজের বড়ভাইয়ের চোখে দেখবি সবসময় স্যারকে বুঝলি।
আমার কথা শুনে তারিক আরো সিটি বাজাতে শুরু করলো। রেহান তুলিকে খোঁচা মেরে বলল,
_ লতা তোকে না স্যারের সাথে বেশ লাগবে। দেখিস আবার কেউ যেন নজর না দেয়।
তুলি মুখ কালো করে রেখেছে। আমি তুলির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রেহানের কথার উত্তর দিলাম,
_ বললেই হলো নাকি? নজর দিলে চোখ উপরে হাতে ধরিয়ে দিব।
_ ক্যায়া বাত হে দোস্ত।
ইফতির কথায় আমি মুচকি হেসে বাড়িতে চলে আসলাম। মনের ভেতর একটা শান্তি অনুভব করছি। আমার স্যারের দিকে নজর এবার দেখ কেমন লাগে। নিজেকে এখন আমার বলিউডের হিরোইন মনে হচ্ছে। আহা কথাগুলো বলার সময় তুলির মুখের অবস্থাটা দেখার মতো ছিল।
সেদিনের পর থেকে তুলি আর আমার জায়গায় বসতো না। আবার নোট করার জন্য স্যারকে খাতাও দিতো না। একদিন স্যার নোট লিখার জন্য খাতা চাইছে। কিন্তু কেউ খাতা বের করছে না। আমি ইচ্ছে করেই বের করিনি কারণ আমি দেখতে চাই স্যার কার কাছে খাতা চায়। অনেকক্ষণ হয়ে গেল কিন্তু কেউ খাতা দিচ্ছেনা তখন স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
_ লতা খাতা দিচ্ছো না কেনো?
স্যারের কথা শুনে যেন আমার মনটা প্রজাপতির মতো উড়তে শুরু করলো। আমি মুখে বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে খাতা বের করে দিলাম। স্যার নোট করছে আর আমার দিকে তাকিয়ে তারিক, রেহান, ইফতি হাসছে। ওদের হাসি দেখে ভীষণ লজ্জা লাগছিল। চোখ সরিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখি স্যারের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠেছে।
পর্ব ৩
একদিন স্কুল না গিয়ে আমি আর ইফতি মেলায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। ভয়ে ভয়ে চারপাশ দেখছি আর হাঁটছি। যদি বাসার কেউ দেখতে পায় মার একটাও মাটিতে পড়বে না। মেলার মধ্যে হঠাৎ তারিক আর রেহানের সাথে দেখা। ওরা আমাদের দেখে বলে,
_ কিরে তোরা এখানে স্কুলে যাসনি?
আমি কাটাকাটা গলায় উত্তর দিলাম।
_ স্কুলে গেলে তো এখানে দেখতে পেতিস না ছাগল কোথাকার।
_ তোদের মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টরা যদি স্কুল ফাঁকি দিয়ে মেলায় ঘুরতে আসে তাহলে দেশের কি হবে?
রেহানের খোঁচা মারা কথার পালটা জবাব দিল ইফতি।
_ কি করবো বল তোদের মতো কয়টা গরু ছাগলকে দেখে রাখার জন্য আমরা এসেছি। যতই হোক তোরা আমাদের সহপাঠী। তোদের প্রতি একটা দ্বায়িত্ব আছে আমাদের।
তারিক মুখ গোমড়া করে কিছুটা ন্যাকামি করে বলল,
_ এভাবে ভরসমাজে আমাদের অপমান করিস নে। আজ ব্রিলিয়ান্ট না বলে এভাবে অপমান। এ পাপ তোদের ধর্মে সইবে নারে ধর্মে সইবে না।
তারিকর দেবদাসী গলা শুনে আমরা হাসতে হাসতে শেষ। তারিক কেশে গলা ঠিক করে বলল,
_ চল তাহলে চোরেরা যখন একসাথে হয়েছি তখন আর সাধু সেজে থেকে কি লাভ?
মেলায় গিয়ে ক্লাসের অনেক ছেলেমেয়েদের দেখলাম। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে আমার দম যাওয়ার অবস্থা প্রায়। তারমধ্যে আবার রেহান আর তারিক লাপাত্তা হয়ে গেছে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ওদের খুঁজলাম। দেখতে না পেয়ে ইফতিকে নিয়ে একটা ফুচকার দোকানে যেতে দেখি খবিশ দুটো বসে বসে ফুচকা খাচ্ছে। আমাদের দেখে একটা ভোকলা হাসি দিয়ে বলল,
_ তোরা কোথায় ছিলি? জানিস তোদের কত খুঁজেছি।
আমি দাঁত কটমট করতে করতে বলি।
_ সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। কি স্বার্থপর তোরা আমাদের ফেলে চলে আসলি। থাক তোরা এখানে আমরা চললাম।
ইফতিকে নিয়ে চলে আসতে নিবো। তখন দুজন এসে পথ আটকে ধরল।
_ বিশ্বাস কর দোস্ত আল্লাহর কসম। তোদের ওইখানে অনেক খুঁজছি। দেখতে না পেয়ে মাত্র এখানে এসে বসছি। দেখ এখনো প্লেটের একটা ফুচকাও খাই নাই।
ইফতি রেহানের হাত থেকে প্লেট কেড়ে নিয়ে বলে,
_ যা আমাদের জন্য ফুচকা নিয়ে আয়।
তারিক ওর প্লেটটা আমার হাতে দিয়ে ওর আর রেহানের জন্য ফুচকা আনতে চলে গেল।
চারজন বসে ফুচকা খাচ্ছি। অসম্ভব ঝাল দেওয়া। সবার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এত্ত ঝাল ফুচকা আমি আমার জীবনে কখনো খেয়েছিলাম কিনা সন্দেহ আছে। তারিক কিছুক্ষণ পর চিৎকার করে উঠে,
_ আল্লাহ আমারে পানি দে কেউ মা..আ..আ..আ
তারিকর চিৎকার শুনে আমাদের সবার ঝাল যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কোনোরকম ফুচকার টাকা দিয়ে দৌড়। তারিক একদম ঝাল সহ্য করতে পারেনা। ঝালে আমাদের সবার অবস্থা বেহাল। রেহান দৌড়ে গিয়ে পাশের একটা দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে নিয়ে আসে। তারিক আইসক্রিম খাচ্ছে আর আমাদের উপর ফুঁসছে।
_ তোরা মেয়েরা এই ফুচকা কি দেখে এত পছন্দ করিস ভাই। আমার তো অবস্থা আজকে টাইট।
_ চুপ কর হাঁদারাম। আমরা কি তোকে খেতে বলেছি নাকি? তুই নিজের ইচ্ছায় খেয়ে এখন আমাদের উপর রাগ দেখাস।
আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটতে লাগলাম। লোকজনের গিজগিজ আর ভাল্লাগেনা। বাড়ি চলে যাবো ঠিক সেইসময় রেহান চিৎকার করে বলে,
_ আল্লারে আমার কাকা দেখি মেলায় আসছে।
রেহানের কথায় সবাই চমকে উঠলাম। কারণ রেহানের কাকা একটা ভেজালে লোক। এভাবেই রাস্তায় দেখা হলে এটা ওটা বলতে বলতে কান ঝালাপালা করে দেয়। তার উপর যদি আমাদের এখানে দেখে নিঃসন্দেহে বাসায় মেলায় আসার খবরটা দিবে। রেহান আর তারিক তাকে দেখে ভোঁ দৌড়। ওদের দৌড়াতে দেখে আমি আর ইফতিও দৌড়াতে লাগলাম।
আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে। কোথাও ঘুরতে গিয়েও শান্তি নেই। দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা মেলা থেকে বেরিয়ে মেইনরোডে চলে এসেছি।
হঠাৎ পায়ে কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম। আমার সাধের আইসক্রিম ছিটকে গিয়ে পরল রাস্তার মাঝে। ইফতি আমাকে পড়ে যেতে দেখে দৌড়ে আসলো। ডানহাতে প্রচুর ব্যাথা পেয়েছি। আমি হাত ধরে বসে বসে কাঁদছি। ঠিক তখন একটা গলার আওয়াজ কানে ভেসে এলো।
_ লতা, ইফতি তোমরা এখানে?
মুখ তুলে দেখি স্যার বাইক বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যারকে দেখে আমার ব্যাথা যেন গায়েব হয়ে গেছে। আমি স্যারের দিকে হা করে তাকিয়ে আছি। স্যারকে এই প্রথম আমি পাঞ্জাবিতে দেখলাম। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। আমার তো তাকে সবসময় ভালোলাগে। কিন্তু আজ একটু বেশিই ভালো লাগছে। আমাদের চুপ থাকতে দেখে স্যার কিছুটা ধমক দিয়ে বলল,
_ কি হলো কথা বলছো না কেনো তোমরা?
স্যারের ধমক খেয়ে আমার কান্না চলে আসার মতো অবস্থা। আমি যে ব্যাথা পেয়েছি সেটা দেখছে না এখানে কেনো এসেছি সেটা নিয়ে ধমকাচ্ছে। স্যার বাইক থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাত টেনে বলল,
_ ব্যাথা কিভাবে পেলে?
_ পড়ে গেছি।
_ কিভাবে পড়লে?
আমি চুপ করে ইফতির দিকে তাকালাম। ইশারায় বুঝালাম কিছু একটা বল দোস্ত। স্যার একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার ইফতির দিকে। ইফতি কিছুটা কাঁচুমাচু করে বলল,
_ স্যার আসলে আমরা মেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে রেহানের কাকাকে দেখে পালিয়ে এসেছি। রাস্তায় দৌড়াতে গিয়ে লতা পড়ে ব্যাথা পেয়েছে।
ইফতির কথা শুনে স্যার আমার দিকে তাকালো। আমি ভয়ে মাথা নিচু করে রেখেছি। এই বুঝি স্যার একটা ধমক দিবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার গা কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো। আমি অবাক হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। স্যার আমাকে টেনে তুলে বলল,
_ বাসায় না বলে কোথাও ঘুরতে গেলে এমনি হবে।
স্যারের কথায় ভীষণ রাগ হচ্ছিল। আমি ব্যাথা পেলাম তা নিয়ে একটু দুঃখ প্রকাশ করলো না উল্টে হেসে মজা নিচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজের রাগটা চেপে রাখলাম। স্যার বাইকে উঠে বলল,
_ চলো তোমাদের দিয়ে আসি।
আমার তো খুশিতে উড়তে ইচ্ছে করছে। স্যারের বাইকে করে দুজন একসঙ্গে যাবো। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল স্যারের বাইকে ওঠার। আজ ইচ্ছেটা পূর্ণ হলো। আমি বাইকে উঠে দেখি ইফতি মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছে। বেচারী উঠবে কি উঠবে না তা নিয়ে দ্বিধায় আছে। কিন্তু আমি আমার জাস্টুসকে ফেলে কিভাবে যাই। ইশারায় ইফতিকে উঠতে বললাম। ইফতি উঠতে স্যার বাইক স্টার্ট দিল।
স্যার বাইক চালাচ্ছে। স্যারের পিছনে আমি আর আমার পিছনে ইফতি। আহা কি সুন্দর মুহূর্ত। স্যারের পাশে বসে আমার ভেতর শুধু একটাই গান বাজছে।
এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলতো?
পর্ব ৪
প্রেম প্রতিটি মানুষের বুকে একটি মন্দির নির্মাণ করে। যেখানে প্রিয় মানুষটাকে দেবতার স্থানে বসিয়ে তাকে পূজা করা হয়। আমার মনের সেই ছোট মন্দিরটা একজন ধীরে ধীরে দখল করতে শুরু করলো। আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা তাকে ঘিরে চলতে থাকে। মানুষকে নিয়ে আমার নোটবুকে লিখতাম অজস্র বাক্য।
বইয়ের পাতায় কোথাও সিফাত নাম দেখতে পেলে তারপাশে নিজের নামটা লিখতে পারলে আমার বিশ্বজয় করার মতো আনন্দ হতো। আমার ছেলেমানুষী গুলো দেখে বন্ধুরা খুব ক্ষেপাতো তবুও আমি পাগলামি করতাম। শুরু মনে একটা জিনিস নিয়ে আফসোস হতো সবাই বুঝে আমার এই অসুখের কথা শুধু স্যারই বোঝেনা।
বেশ চলছিল আমার দিনকাল। কিন্তু হঠাৎ এক ধাক্কায় আমার জীবন পুরো পাল্টে গেল। সেদিন আমি আর ইফতি স্কুল থেকে ঝালমুড়ি খেতে খেতে বাড়ি ফিরছিলাম। রাস্তায় ইফতি দাঁড়িয়ে পরলো। আমি ইফতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম।
_ কিরে এভাবে দাঁড়িয়ে পরলি কেনো?
_ লতা ওইদিকে দেখ।
ইফতি আঙ্গুল দিয়ে দেখাল। দৃশ্যটা দেখে আমার ঝালমুড়ির প্যাকেট হাত থেকে পড়ে গেল। গলা ধরে আসলো আমার। চোখদুটো দিয়ে নামতে লাগল জলের ধারা। স্যার একটা মেয়েকে নিয়ে বাইকে বসে আছে। মেয়েটা স্যারকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন স্যার তার বিশেষ কেউ। দুজনে কি সুন্দর হাসাহাসি করছে। কিছুক্ষণ পর স্যার মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেল। আমি একদৃষ্টিতে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।
কিছুসময় নিরবে কাটানোর পর ইফতি আমার হাত ধরে বলল,
_ চল বাসায় যাই।
আমি কোনো কথা না বলে ইফতির সাথে হাঁটতে লাগলাম। ইফতি আমার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,
_ তুই এভাবে চুপ করে আছিস কেনো? কথা বল প্লিজ। আমার তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছেনা।
আমি ইফতির দিকে তাকিয়ে বললাম।
_ একটা সত্যিই কথা বলবি।
ইফতি অবাক হয়ে বলল,
_ কি?
_ স্যারের সাথে মেয়েটাকে দেখে তোর কি মনে হয়েছে?
_ কি আবার মনে হবে? কিছুই মনে হয়নি। তুই এটা নিয়ে এত ভাবিস না। হয়তো স্যারের কোনো পরিচিত কেউ হবে। সেদিন আমাদের যেমন মেলা থেকে নিয়ে এসেছে। মেয়েটাকেও হয়তো কোথাও নিয়ে যাচ্ছে।
_ যেদিন আমাদের মেলা থেকে নিয়ে এসেছিল আমি কি স্যারকে এভাবে জড়িয়ে ধরে এসেছিলাম? একদম আমাকে তুই সান্ত্বনা দিবি না। কাছের মানুষ না হলে কেউ এভাবে কাউকে জড়িয়ে বসতে পারে? আমাকে তুই বাচ্চা ভেবেছিস নাকি? সত্যিই করে বলতো ইফতি মেয়েটাকে তোর স্যারের কাছের কেউ মনে হয়নি?
ইফতি মুখ মলিন করে বলল,
_ হয়েছে। কিন্তু লতা তাতে কি তুই তো স্যারকে,
ইফতির কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি গটগট করে হেঁটে বাসায় চলে আসলাম। ইফতি পেছন থেকে অনেকবার ডাকলো কিন্তু শুনলাম না।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। মেয়েটাকে স্যারের সাথে দেখে অনেক খারাপ লেগেছে। স্যারকে কেনো মেয়েটা এভাবে জড়িয়ে ধরবে? কেনো জানিনা স্যারের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল।
এসব ভেবে কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পরলাম।
সেদিনের পর আমি দুদিন স্যারের বাসায় পড়তে যাইনি। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে স্যার যে বিল্ডিং এ থাকে সেটা দেখলে আমার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। ভাবতাম আর তাকে দেখবো না। যত দেখবো তত কষ্ট হবে। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে কি লাভ? তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আর স্যারের কাছে পড়তে যাবনা। কিন্তু সেদিন বিকেলে ইফতি বাসায় এসে বললো,
_ কিরে লতা তুই পড়তে যাসনা কেনো? ভাইয়া তোর কথা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল।
_ এভাবেই রে। স্যারকে বলিস আমি আর পড়তে যাবনা। তুই একটু স্যারের ফ্রি টা আমার হয়ে দিয়ে আসবি?
_ লতা এমন কোনো করছিস তুই?
_ কি রকম করলাম? মানুষটার সামনে যেতে এখন আর ইচ্ছে করছেনা। তুই আমার জন্য এইটুকু করে দে দোস্ত।
ইফতি কিছুক্ষণ বিরস মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। আমার তখন বুক ফেটে কান্না আসছিল। ইচ্ছে করছিল স্যারকে একবার দেখে আসতে। কিন্তু নিজেকে শক্ত রেখেছিলাম। এখন যদি নিজেকে সামলাতে না পারি তাহলে পরে আরো বেশি খারাপ লাগবে।
এরপর স্যারের সাথে দেখা হওয়া আমার এক্কেবারে বন্ধ হয়ে গেল। যদিও রাস্তায় দূর থেকে দেখতাম তাহলে না দেখার ভান করে চলে আসতাম। কিন্তু যখন স্যারকে দেখতে অনেক ইচ্ছা করতো তখন বারান্দায় কিংবা ছাদে গিয়ে উঁকি মারার লোভটা সামলে রাখতে পারতাম না। কখনো দেখতে পেতাম আবার কখনো পেতাম না। এভাবে যেতে লাগল আমার দিনকাল।
সেদিন শুক্রবার ছিল। আমি বসে বসে টিভি দেখছি। হঠাৎ ইফতি দৌড়ে এসে বললো,
_ লতা স্যার চলে যাচ্ছে।
ইফতির কথা শুনে আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। আমি দৌড়ে আমার বেলকনিতে চলে আসলাম। দেখলাম তারিক, রেহানের সাথে স্যার রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কথা বলার মাঝে স্যার একবার আমাদের বাড়ির দিকে তাকালো। আমি তখন ধপ করে ফ্লোরে বসে পরলাম। মাথা ঘুরছে আমার। স্যার এভাবে চলে যাবে সেটা আমি কল্পনা করতে পারিনি।
স্যার আশেপাশের মানুষের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি সেখানে বসে বসে তার যাওয়া দেখলাম। ইচ্ছে করছিল স্যারকে দৌড়ে গিয়ে আটকাই কিন্তু আমার শরীর যেন অসাড় হয়ে আসছিল। নড়াচড়ার মতো শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিছুক্ষণ পর ইফতি এসে আমার পাশে বসলো। ইফতিকে দেখে জাপ্টে ধরে আমি কাঁদতে লাগলাম। ইফতি আমাকে ধরে বলল,
_ কাঁদিস না লতা। কেঁদে আর কি হবে? নিজেকে শক্ত কর।
আমি কান্না থামাতে পারছিলাম না। আমার কষ্টটা ইফতিকে বোঝাতে পারবো না।
আমার মনোমন্দিরের যাকে আমি দিনরাত পুজো করি সে চলে গেছে। এখন খুব আফসোস হচ্ছে কেনো নিজের মনের কথাগুলো স্যারকে বলতে পারিনি। কেনো তখন রাগ করে বসে ছিলাম।
স্যার যদি আপনি জানতেন যে এই ১৬ বছরের কিশোরী মেয়েটি তার জীবনের জমিয়ে রাখা সমস্ত প্রেম আপনাকে উৎসর্গ করেছে। তার জীবনের সকল আবেগ দিয়ে আপনাকে অনুভব করেছে।
একবার যদি আপনি তার নোটবুকটা দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন কতটা ভালোবেসে আপনার কথা লিখেছে।
যদি আপনি এই কিশোরী মেয়েটার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করতেন তাহলে বুঝতেন কতটা ভালোবাসা ছিল তার চাহুনিতে।
কিন্তু আপনি কিছুই জানলেন না স্যার কিছুই বুঝলেন না। আমাকে ফেলে আপনি চলে গেলেন।
পর্ব ৫ (শেষপর্ব)
স্যার চলে যাওয়ার কিছুদিন পর আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। খেতে পারতাম না ঘুমাতে পারতাম না সব মিলিয়ে একপ্রকার ডিপ্রেশনে পড়ে গিয়েছিলাম। আব্বু আম্মু ভীষণ চিন্তিত হয়ে পরলেন আমাকে নিয়ে। সামনে আমার টেস্ট এরমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। তাদের চিন্তার শেষ নেই। কোনোরকম টেস্ট পরীক্ষা দিলাম।
এতোদিন ক্রাশের কথা ভাবার ফলে টেস্টের রেজাল্ট এলো আমার টেনেটুনে পাস।
অসুস্থ ছিলাম বলে আব্বু আর আম্মু কিছু বলেনি। কিন্তু স্কুলের স্যাররা অনেক বকাঝকা করলেন।
বাসায় আম্মু অনেক বোঝালো পরীক্ষার এই কয়মাস মন দিয়ে পড়াশোনা করতে।
এরপর আটপাঁচ না ভেবে ধুমিয়ে পড়তে শুরু করলাম। পড়তে বসলে কিভাবে যে সময় চলে যেতো বুঝতেই পারতাম না।
দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করা একেবারে বন্ধ। সবাই নিজেদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পেলাম একটা লম্বা ছুটি। ইফতি চলে গেল কক্সবাজার। তারিক ওর নানাবাড়ি চট্রগ্রাম আর রেহান চলে গেল ইন্ডিয়া ভ্রমণ করতে। সবাই চলে যাওয়া দেখে আমি আমার দাদাবাড়ী শ্রীমঙ্গল চলে গেলাম।
এতকিছুর মধ্যেও আমি স্যারকে নিয়ে আমার নোটবুকে গল্প লিখতে ভুলিনি। নোটবুকটা সবসময় নিজের সাথে রাখতাম যদি রাস্তায় স্যারকে কখনো দেখতে পাই নোটবুকটা তার হাতে দিয়ে পালাবো।
দিন আসে দিন যায় রেজাল্ট পাবলিশ হলো। ভালো রেজাল্ট করায় সবার আদরের বাদর হয়ে গেলাম।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ যেতে শুরু করলাম। সব বন্ধুরা এক কলেজে ভর্তি হলাম। দিনগুলো বেশ কাটছিল আমার।
কিন্তু এসবের মধ্যেও স্যারের অনুপস্থিতি অনুভব করতাম। প্রতিদিন বিকেলে ছাদে গিয়ে তার বেলকনির দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
একদিন কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একজন আমার পিছন থেকে ডেকে উঠে,
_ লতা!
ডাকটা শুনে আমি বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে শুরু করে। মনে হচ্ছে আমি ঢুলছি। গলার আওয়াজটা খুব চেনা আমার। পিছনে ঘুরে দেখলাম সিফাত স্যার দাঁড়িয়ে আছে। স্যারের সাথে তারিক, রেহান আর ইফতি। স্যারকে দেখে আমার চোখে পানি চলে আসলো। আমার গলা ধরে আসছে। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
_ আসসালামু আলাইকুম স্যার। কেমন আছেন?
স্যার সালামের জবাব দিয়ে বলল,
_ ভালো তুমি কেমন আছো?
_ জ্বি স্যার ভালো।
_ পড়াশোনার কি খবর তোমার?
_ এইতো চলছে,
আমি মাথা নিচু করে স্যারের কথার উত্তর দিচ্ছি। আমি বুঝতে পারছি স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমি কেনো জানিনা স্যারের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছিলাম না। অনেকক্ষণ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সোজাসুজি না তাকালেও স্যারের দিকে আড়চোখে অনেকবার তাকিয়েছি। স্যার ব্ল্যাক জিন্স আর স্কাই ব্লু কালার একটা শার্ট পড়া আর চোখে দেওয়া সানগ্লাস। ফর্মাল গেটআপে দুর্দান্ত লাগছে তাকে। স্যারকে এখন আগের থেকে আরো বেশি হ্যান্ডসাম লাগে। আর কিছুক্ষণ স্যারের সামনে থাকলে আমার মাথার তাড় ছিঁড়ে যাবে। তাই বললাম,
_ আমার একটু কাজ আছে। আমি বরং যাই। স্যার সময় করে আমাদের বাসায় একদিন আসবেন।
স্যার মুচকি হেসে বলল,
_ আমার একটা ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাবো মোহাম্মদপুর। তোমরা যখন যাবে চলো তাহলে একসাথে যাওয়া যাক।
আমার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পরলো। স্যারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা বলে মিথ্যে বললাম আর এখন নাকি স্যারের সাথেই যেতে হবে। তারিক আর রেহান স্যারের সাথে যাওয়ার জন্য প্রায় মরে যাচ্ছে। সবাই স্যারের কথায় সহমত প্রকাশ করছে সেখানে আমি বিমত করি কিভাবে তাই উপায় না পেয়ে স্যারের সাথে যেতে রাজী হয়ে গেলাম।
আমাদের নিয়ে স্যারের একটা এ্যাশ কালার গাড়ি উঠে বসে। স্যার এখন আর আগের মতো বাইকে করে ঘুরে বেড়ায় না। তার লাইফস্টাইল কতটা চেঞ্জ হয়ে গেছে ভাবলেই হাসি পাচ্ছে।
পাঠক আপনাদের জন্যই আমরা প্রতিনিয়ত লিখে থাকি। আপনাদের আনন্দ দেয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ। তাই এই পর্বের “পিচ্চি মেয়ের ভালোবাসা” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো পড়া শেষে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।
রাতে ফেসবুকে নিউজফিড ঘুরছিলাম। রেহানের একটা পোস্ট দেখে মাথা ঘুরে গেল। স্যারকে ট্যাগ করে তাদের একটা ছবি আপলোড করেছে। ছবিটা দেখে আমি স্যারের প্রোফাইল ঘুরে দেখতে লাগলাম। স্যারের কত সুন্দর সুন্দর ছবি। সেদিন সারারাত স্যারের ছবি দেখে দেখে আমার রাত পাড় হয়ে গেল।
স্যারকে দেখার পর থেকে আমার অসুখটা আরো বেড়ে গেল। প্রতিদিন সকাল বিকাল তার প্রোফাইল ঘুরে বেড়াই। স্যারকে মেসেজ লিখেও পাঠাতে পারতাম না। একটা জড়তা কাজ করতো। ইদানীং আমার সবকিছু ফুরফুরে হয়ে গেছে। নিজের মধ্যে যেন আগের সেই লতাকে আমি অনুভব করছি।
একদিন সকালবেলা হুট করে আমার দাদুভাই বাসায় আসে। তাকে দেখে কিছুটা অবাক হলাম। কারণ দাদুভাই খুব কম ঢাকা আসে। দাদুভাই আর দাদিকে দেখে আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে সেদিন আর কলেজেই গেলাম না। সারাদিন তাদের সাথে বসে বসে গল্প করলাম। সন্ধ্যাবেলা আম্মুকে দেখে বাড়িঘর সুন্দর করে সাজাচ্ছে। কিছুটা খটকা লাগলো। হঠাৎ দাদা আর দাদির বাড়ি আসা আবার এখন আম্মুর ঘর সাজানো কিছু একটা হতে চলেছে। আমি আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম,
_ আম্মু কোনো মেহমান আসবে?
আম্মু আমার কথায় মিষ্টি হেসে বললো,
_ তুই ভালো একটা জামা পড়ে আয়তো দেখি।
আমার মাথার উপর দিয়ে সব যাচ্ছে। এইদিকে আব্বু আর দাদুভাই কোথায় জানি গিয়েছে তার উপর দাদি আর আম্মুর এমন করে কাজ করা মাথায় কিছু আসছে না। আমি রুমে এসে জামাকাপড় পাল্টে বসে আছি। হঠাৎ কোন মেহমান আসবে বাসায়? মনের মধ্যে একটা অজানা ভয় হানা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আম্মু এসে বললো,
_ মেহমান চলে এসেছে আয় আমার সাথে।
আমি আম্মুর হাত ধরে বলি,
_ আম্মু সত্যিই করে বলতো কারা এসেছে?
_ তোর দাদুভাই তোর জন্য খুব ভালো সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। ছেলে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে। আর ফ্যামিলিও নাকি খুব ভালো।
আমি চিৎকার করে বললাম,
_ এইজন্য দাদুভাই ঢাকা এসেছে? আমি তোমাদের কাজে বোঝা হয়ে গেছি তাইনা। আমাকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে পারলে তোমাদের শান্তি।
_ মেয়েমানুষ আজ নয়তো কাল বিয়ে তো হবে। আর ছেলেটাকে তোর বাবাও খুব পছন্দ করে। আমাদের পরিচিত। তোকে এখনি বিয়ে দেবোনা বোকা। এখন কথা বলে রাখবে পরে তোর পড়ালেখা শেষ হলে বিয়ে হবে।
_ বাহ্ আমাকে না জানিয়ে এতকিছু ভেবে ফেলেছো তোমরা?
_ দেখ লতা ছেলেটা খুব ভালো। আর তোর দাদুভাই চায় এখানে তোর সম্বন্ধ হোক। আর দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায়না। তোর যদি কোনো পছন্দ থাকে সেটা তোর দাদুভাইকে জানা। আমরা জেনেশুনে তোর খারাপ নিশ্চয়ই চাইবো না। উনারা বসে আছে তাড়াতাড়ি আয়।
আম্মুর কথা শুনে আমার হার্ট অ্যাটাক করার মতো অবস্থা। আমার সাথে কেনো এরকম হয় সবসময়। কি করবো আমি? ইচ্ছে করছে বাড়ি থেকে পালিয়ে স্যারের কাছে চলে যাই। এখন যদি তারা আমাকে পছন্দ করে ফেলে তাহলে বিয়ে পাক্কা। স্যারকে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম চিরদিনের মতো। কথাগুলো ভেবে আমি ধপ করে খাটে বসে পড়ি। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে আমার। এরকমটা যদি হওয়ার ছিল তাহলে কেনো সেই মানুষটার সাথে আবার দেখা হলো। কেনো তার জন্য মনের মধ্যে আল্লাহ এতো ভালোবাসা দিল। আমার ভাবনার ছেদ করে কেউ একজন বললো,
_ আসবো।
আমি চোখ মুছে দরজার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি নাকি? আমি অবাক হয়ে বললাম,
_ আপনি?
স্যার তার ঘায়েল করা হাসি দিয়ে বলল,
_ বিয়ে হয়ে যাবে বলে কান্না করছো লতা?
_ স্যার আপনি এখানে কি করে? আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা। দয়া করে বলবেন না আপনার বড় কোনো ভাইয়ের জন্য আমাকে দেখতে এসেছেন।
_ আমার তো কোনো বড়ভাই নেই লতা তবে ছোট ছোট কাজিন আছে। আমার আগে তাদের কেউ তোমাকে বিয়ে করবে বলে মনে হয়না। কারণ আমাদের বাড়ির সবাই জানে আমি লতা নামের এক অসুখে আক্রান্ত।
স্যারের কথা শুনে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম,
_ আপনি খুব খারাপ স্যার। আমাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলেন কিভাবে হ্যাঁ? একবারো আমার কথা মনে পড়েনি?
স্যার আমার গালে হাত রেখে বলল,
_ তোমার ভালোর জন্য তোমার থেকে দূরে যেতে হয়েছে লতা। আমি চাইনি আমার জন্য তোমার পড়াশোনায় কোনো ক্ষতি হোক। তার উপর আমি মাস্টার্সে পড়ুয়া ছেলে হয়ে স্কুলে পড়ুয়া একটা বাচ্চার সঙ্গে প্রেম করবো ভাবতেই পারতাম না। আমার তোমাকে খুব ভালো লাগতো। তোমার বাচ্চামি গুলো দেখতে দেখতে কখন যে তোমার প্রেমে পড়ে গেছি সেটা বুঝতেই পারিনি। কিন্তু যখন দেখলাম আমার জন্য তোমার পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে। তখন আমার ফ্যামিলি তোমার বাবা আর দাদুর সাথে তোমার ব্যাপারে কথা ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু তুমি তখন এতটা ম্যাচিউড ছিলেনা লতা। আর তার উপর তোমার বয়স ছিল কম। আবার আমার পড়াশোনাও কমপ্লিট হয়নি। সবদিক থেকে ভেবেচিন্তে চলে যেতে হয়েছে বুঝেছো পাগলী।
_ আমি পাগল?
_ নয়তো কি? বৃষ্টির মধ্যে আমাকে দেখার জন্য আমার বাসায় চলে গিয়েছিলে সেটা আমি বুঝিনি ভেবেছো? আবার আমার দিকে তাকানো নিয়ে তুলিকে থ্রেট দিয়েছিলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে আমাকে দেখার জন্য আবার মাঝেমাঝে ছাদেও চলে যেতে। আমি তোমার থেকে অনেকটা বড় লতা। তোমার সব বাচ্চামি আমি বুঝতে পারতাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি ছোট তাই এরকম বাচ্চামি করছো। কিন্তু তোমার বাচ্চামি দেখে দেখে আমিও কবে বাচ্চা হয়ে গেলাম সেটাই আজও বুঝলাম না।
_ তাহলে সেদিন ওই মেয়েটি কে ছিল আপনার সাথে।
_ কোন মেয়েটা?
_ একদিন দেখেছিলাম আপনার সাথে বাইকে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
_ ওহ ওটা মিশু। আমার একটা ফ্রেন্ড ছিল।
_ ফ্রেন্ড হয়েছে বলে কি আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুরে বেড়াবে?
সিফাত লতাের কড়া কথা শুনে হাসতে লাগল। লতা সিফাতর হাসি দেখে রাগে কটমট করে বলল,
_ হাসছেন কেনো এভাবে?
_ তুমি এখনো বাচ্চা রয়ে গেলে লতা। রেহান আর তারিকর সাথে তোমার যেমন রিলেশন আমারো মিশুর সাথে সেরকম রিলেশন। কলেজ ফ্রেন্ডরা স্কুল ফ্রেন্ডদের থেকে একটু বেশি ফ্রী থাকে। সেটা তোমার জানার কথা। আর মিশু একটু বেশি ফ্রী আমার সাথে।
_ যতই ফ্রী হোক তাইবলে এভাবে আপনাকে জড়িয়ে বসবে? আমার কত খারাপ লেগেছিল আপনি জানেন?
_ ওলে বাবা এইজন্য রাগ করে আর পড়তে যাওনি তাইতো? আর তুমি না আসায় আমার যে খারাপ লেগেছে সেটার কি হবে?
লতা সিফাতর বুকে মাথা রেখে বলল,
_ আমাকে একা ফেলে আর কখনো যাবেন না তো?
সিফাত লতাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
_ উহু কখনো যাবো না। দূরে থাকতে পারবো না বলেই তো কাছে রাখার ব্যবস্থা করছি। ভালোবেসে ফেলেছি এই পিচ্চি মেয়েটাকে। হবে আমার পিচ্চি বউ?
সিফাতর কথা শুনে লতা লজ্জায় চুপ করে থাকে। সিফাত লতাের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে আরো শক্ত করে লতাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে।
সমাপ্ত
তুমিময় অসুখ
লেখিকাঃ আনাবিয়া আনাহা
আরো পড়ুনঃ আজও ভালোবাসি – সিজন ১ । খুনশুটি ভালোবাসার গল্প