পাহাড়ে মেঘের ছায়া – Premer Golpo 2021: নাফিসা শব্দ করে কেদে উঠলো! কিন্তু তার কান্নার শব্দ শুধু তার ঘর পর্যন্তই! বেশ কিছুক্ষণ কান্না করেছে কিন্তু শান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই পাশে! কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো নাফিসা। পরক্ষণেই মেঘের কথা মনে হলো। এই মানুষটা তার সাদাকালো জীবনকে রঙিন করে তুলেছে! তারপর…..
পর্ব – ২৯
নাফিসা গোসল করে আজ নীল শাড়িটা পড়েছে। যোহরের নামাজ আদায় করে আয়নার সামনে এসে দাড়ালো। মুখে হালকা ক্রিম দিলো, চিকন করে কাজল টানা দিলো, ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক লাগালো, কানের ছোট দুল খুলে স্টোনের দুল পড়লো, মেলা থেকে কিনে দেওয়া সেই লাল চুড়িগুলো পড়লো। ঘন কালো লম্বা চুল বাকা সিতি করে উন্মুক্ত করে রাখলো। হাতের ঝাকায় লাল চুড়ি গুলো একটু নড়তেই ঝুমঝুম শব্দ হলো।
নাফিসা মুচকি হেসে আলমারি খুলে মেঘের জামাকাপড় নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
মেঘ রুমে এসে পা রাখতেই ঝুমঝুম শব্দ পেলো। আলমারির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল নীল পরি আলমারিতে কিছু খুজছে। ঝুমঝুম শব্দ কিসের! মেঘ দরজা চাপিয়ে আস্তে আস্তে হেটে নাফিসার কাছে এলো। পেছন দাড়িয়ে দুহাত নাফিসার পেটে রেখে চুলের ঘ্রাণ নিতে লাগলো! নাফিসা সাথে সাথে কেপে উঠলো! প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও এখন বুঝতে পেরেছে এটা মেঘ! হঠাৎ এমন করে আক্রমণ করার কোনো মানে হয়! কাপা কাপা কন্ঠে বললো,
- গোসল করবেন না?
মেঘ তাকে আরও চেপে ধরে চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে বললো,
- সকালে একবার বলেছো, সেটার পানিশমেন্ট তো দিতে পারিনি এখন একসাথে দিবো দুইটা!
নাফিসা ভুলেই গিয়েছিলো! সে চোখমুখ কুচকে দ্রুত বললো, - গোসল করবে না? বাথরুমে যাও আমি জামাকাপড় নিয়ে আসি।
- উহুম আগে পানিশমেন্ট, বাকি সব পরে।
কথাটা বলে মাত্রই নাফিসাকে তার দিকে ঘুরিয়ে সে হতবাক হয়ে আছে! নাফিসা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে! মেঘ কি করবে বুঝতে পারছে না! এ কাকে দেখছে সে! এমনিতেই তো তার প্রতি সে দুর্বল! এখন তো তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে মেঘা! আচমকাই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো অন্যরকম কিছু শব্দ!
- “মুগ্ধ করেছে রূপ, সে তো বহুদিন আগেই!
হারিয়েছি তোমাতে, দেখেছি যখন শাড়িতে!
এখন আবার হারিয়েছি, কোন অজানা পৃথিবীতে!
মৃগ ন্যায় চোখের কাজল টানা,
দিয়েছে মোর হৃদয় গহীনে হানা!
গালে পড়া টোল আর ওষ্ঠের রক্তজবা,
বারবার বাধ্য করবে আমায় ফেলতে থাবা!
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, সবটাই কি শুধু রমনীর জন্য?”
মেঘের মুখের খই ফুটতে শুনে নাফিসা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো সামনে দাড়ানো মানবের দিকে! সৃষ্টিকর্তা সকল মধু কি তার সুরেই দিয়েছে! সকল অজানা শব্দ গুলো কি তার মুখেই দিয়েছে! মেঘ উৎফুল্ল হয়ে বললো,
- মেঘা পাগল করে দিবে তুমি আমায়!
মেঘ দু’হাতে নাফিসার মাথা কাছে টেনে কপালে ভালোবাসার পরশ দিতে ভুলেনি! মেঘের স্পর্শে নাফিসার মনের কথা, - পাগল তো আমি হয়ে যাচ্ছি মেঘ! তোমার প্রতিটি উক্তিতে, প্রতিটি স্পর্শে পাগল হয়ে যাচ্ছি!
মেঘের মুখে মুচকি হাসি আর নাফিসার মুখে লজ্জা! দৃষ্টি সরিয়ে আলমারি থেকে মেঘের লাল শার্ট আর কালো জিন্স বের করে হাতে নিতেই মেঘ সেগুলো নিয়ে খাটে রাখলো। নাফিসাকে কাছে টেনে ইশারা করলো শার্ট খুলে দেয়ার! মেঘের শরীরের ঘ্রাণ নাফিসাকে আরও বেশি আনমনা করে দেয়! এই ঘ্রাণে কখনো তৃপ্তি আসে না তার! দুইটা বোতাম খুলতেই চোখ বন্ধ করে বাকিগুলো খুললো সে। মেঘ পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করেই মেঘের গা থেকে শার্ট সরালো। মেঘ এখনো তাকে বেধে রেখেছে তাই সে বললো,
- এভাবে তাকালে আমার অসস্তি বোধ হয়!
- আম্মি কি বাসায় নেই?
- উহুম।
- কোথায়?
- খালামনির কাছে গেছে। বিশেষ প্রয়োজনে নাকি ডেকেছে খালামনি।
- গোসলটা আরেকটু পরে করলে কি হতো তোমার!
- সকালে রান্না করেছি, খাবার নষ্ট হয়ে যাবে।
মেঘ নাফিসাকে ছেড়ে দিয়ে খালি গায়ে বের হতে হতে বললো, - এতো বাহানা কেন খুজো। সবকিছুর অভ্যাস বানিয়ে দিবো তোমার এবং অতি শীঘ্রই।
নাফিসা পিছুপিছু এসে বাথরুমে জামাকাপড় দিয়ে গেলো। দুজন একসাথে খাবার খেয়ে ঘরে তালা ঝুলিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে।
চা বাগান থেকেই শুরু করেছে যাত্রা । সবুজের মাঝে নীল পরিকে দাড় করিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দী করেছে মেঘ। মেঘার সাথে প্রেমালাপ করতে করতে পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে গমন করেছে পান বনের দিকে। সাদা আর গোলাপি রঙের চারটা বনফুল একটা বড় পান পাতায় নিয়ে নাফিসার হাতে ধরিয়েছে মেঘ। নিজের হাতে কিছু লতা নিয়ে পেচিয়ে পেচিয়ে সেটার পুরত্ব বাড়িয়েছে।
সাথে বেধে দিয়েছে কিছু পান পাতা আর সরু সরু পাহাড়ি ঘাস। নাফিসার হাত থেকে বনফুল গুলো নিয়ে সেগুলোও লতার সাথে বেধে দিলো। কদম ফেলছে আর এসব উপকরণ কুড়াতে কুড়াতে মেঘ খুব সুন্দর একটা ব্যান বানিয়ে ফেললো। নাফিসা মেঘের সাথে গল্প করতে করতে খুব মনযোগ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলো মেঘ কি করছে! ব্যানটা দেখে সে উৎফুল্ল হয়ে মেঘের দিকে তাকাতেই মেঘ মুচকি হেসে ব্যানটা নাফিসার মাথায় পড়িয়ে দিলো।
পকেট থেকে ছোট সাদা ঘাসফুল বের করে নাফিসার ফুটানো নাকের ছিদ্রে পড়িয়ে দিলো। নাফিসার কদম ফেলা থেমে দৃষ্টি শুধু মেঘকেই দেখছে! মেঘ তার দৃষ্টিতে মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- কি দেখো এমন করে?
- কোন রূপক এসে থেমেছে আমার কাছে,
দৃষ্টির অগোচরে, প্রতিনিয়ত রঙিন করছে আমার ক্ষুদ্র ভুবন।
তাই দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয় শুধু তার পানে!
মেঘ মুচকি হেসে বললো,
- আরও কিছু গড়েছি আমি, সেটা কি মেঘা জানে?
- কি?
- আর একটু অপেক্ষা, মিসেস।
মেঘ পকেট থেকে রুমাল বের করে নাফিসার চোখে বেধে দিলো। হাত ধরে আস্তে আস্তে হেটে একটা জায়গায় এসে থামলো মেঘ। চোখের বাধন খুলে দিয়ে দুকদম পিছিয়ে দাড়ালো মেঘ। নাফিসার দৃষ্টি সামনে! তার চোখের সামনে ঝুলছে মোটা লতে তৈরি দোলনা। দোলনাটা বনফুল আর পাতায় সজ্জিত! চোখের অশ্রু বাধ মানছে না তার! আর কতো সুখ এনে দাড় করবে তার সামনে! সে কি এতো সুখের উপযুক্ত? সে কি আগলে রাখতে পারবে মেঘকে! পেছনে ফিরে ঝাপসা চোখে খুজতে লাগলো মেঘকে। তিন কদম পেছনে মেঘ দাড়িয়ে! মেঘা এক কদম ফেলার সময়ে তিন কদম পাড় হয়ে ঝাপটে পড়লো মেঘের বুকে! বাহুডোরে বাধতে সময় নেয়নি মেঘ! চোখের পানি বৃষ্টি হয়ে ঝরছে মেঘের বুকে! মেঘ দু’হাতে মাথা তুলে চোখের পানি মুছে বললো,
- ঝর্না তো পাথর টিলায় আছড়ে পড়বে, সেটা আমার বুকে কেন?
বৃষ্টি তো ভুবন ভিজিয়ে নতুন রূপ দান করবে, সে মানবকে ভেজাচ্ছে কেন?
স্রোতধারা তো সমুদ্রে গড়াবে, সেটা মেঘের বুকে কেন?
এই পাগলী, দোল খাবে না দোলনায়?
নাফিসা মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। মেঘ তাকে নিয়ে দোলনায় উঠালো। মেঘা বসতেই মেঘ ধাক্কা দিয়ে দোলাতে লাগলো। ফটোশুট করতে মিস হয়না মেঘের। মাথায় লতাপাতা ও ফুলের ব্যান, পড়নে নীল শাড়ি, হাতে লাল চুড়ি, নাকে স্বর্নের জায়গায় পাহাড়ি ঘাসফুল, ওষ্ঠে অপূর্ব হাসি নিয়ে দোলছে লতায়! এ যে এক অপ্সরী নেমে এসেছে পান বনে!
মেঘ মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার মেঘাকে! মেঘা দোলনায় বসে থেকে বললো,
- এটাতে কি দুজন বসা যাবে না?
- বসা যাবে, তবে দোল খাওয়া যাবে না। দোলনা ছিড়ে এই পাতালতার ঝোপে ছিটকে পড়লে খবর হয়ে যাবে!
নাফিসা একপাশে চেপে শুকনো মোটা ডালটায় জায়গা করে মেঘকে ডাকলো। - বসুন এখানে।
মেঘ ব্রু কুচকে তাকালো আপনি ডাক শুনে! নাফিসা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
- বসো এখানে।
মেঘ তবুও যাচ্ছে না! নাফিসা এদিকে তাকিয়ে বললো, - আমি কি এখন নেমে যাবো?
- জ্বি? আমাকে কিছু বলছেন?
নাফিসা মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। মেঘ ঠোঁটের এক কোনায় হাসি ফুটিয়ে নাফিসার কাছে এলো। নাফিসা খালি জায়গায় হাত দিয়ে রেখেছে যাতে মেঘ না বসতে পারে। মেঘ তার হাত ছুটিয়ে সেখানে বসে পড়লো। একহাত নাফিসার পেছনে রেখে জড়িয়ে ধরলো। নাফিসা সরাতে গিয়েও ব্যর্থ! আরও শক্ত করে চেপে ধরেছে। নাফিসার কাধে থুতনি রেখে তাকিয়ে আছে মেঘ। নাফিসা তবুও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ একপায়ে মাটিতে ভর দিয়ে ঠেলে ঠেলে দোলনা হালকা করে দোলাচ্ছে। নাফিসা এখনো রাগ করে আছে তাই মেঘ বললো,
- রাগলে লাগে ভিষণ ভালো,
হাসলে তুই, ছড়ায় আলো।
কাদলে হিংসে করে ঝর্ণা,
শশী মুগ্ধ হয় তা দেখে, ওহে পাহাড়ি কন্যা!
নাফিসা সেদিকে ফিরেই নিশব্দে হেসে উঠলো। মেঘ অন্যহাতেও পেটের উপর দিয়ে নাফিসাকে জড়িয়ে ধরলো। দু’হাতের মধ্যে এখন নাফিসা বন্দী আর মেঘের থুতনি নাফিসার কাধে। মেঘ গান ধরলো,
হয়তো শুরু নয়তো ইতি
শত রঙের প্রজাপতি
উড়ছে দেখো আকাশ পানে
আমি সঙ্গী হবো তাদের
তোমায় নিয়ে
গাইবো না গান তুমি হীনা
কাটাবো না প্রহর তোমায় বিনা
পায়ে পায়ে হাটবো দুজন,
সোনালী রোদ্দুরে
তোমায় নিয়ে
আমার একটাই অভিমানী তুমি
জানিতো ভুল ছিলাম আমি
শুধরে নিবো তা ক্ষণে ক্ষণে
আমি ভিজবো শ্রাবণ মেঘের দিনে
তোমায় নিয়ে
হয়তো শুরু নয়তো ইতি
শত রঙের প্রজাপতি
উড়ছে দেখো আকাশ পানে
আমি সঙ্গী হবো তাদের
তোমায় নিয়ে
নাফিসা মুগ্ধ হয়ে মেঘের কণ্ঠে গান শুনছিলো। হঠাৎ করেই দুজনে লতাপাতার উপর থেতলে পড়লো! কি থেকে কি হয়ে গেছে কেউই বুঝতে পারছে না! কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে একপর্যায়ে দুজনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! লতার সৃষ্ট দোলনা ছিড়ে পড়ে গেছে তারা! বেশ কিছুক্ষণ তারা হাসলো একপর্যায়ে মেঘ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে নাফিসার হাসি দেখতে লাগলো। মেঘকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাফিসার হাসি আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেলো। মেঘ জিজ্ঞেস করলো,
- ব্যাথা পেয়েছ তুমি?
- উহুম।
মেঘ দাড়িয়ে নাফিসাকে উঠতে সাহায্য করলো। পোশাকের ময়লা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিলো। ঝর্ণার ধারে কিছুক্ষণ হেটে দুজন সেই সমতল পাহাড়ের দিকে এলো সূর্যাস্ত দেখার জন্য। সূর্যাস্তের পরপর তারা পাহাড় থেকে নেমে গেলো। মেঘ কিছু একটা ভেবে আম্মিকে কল করলো। আম্মি বাসায় এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই আম্মি বললো তিনি আজ আসবে না। কাল বিকেলে আসবেন। মেঘ কল কেটে ফোন পকেটে রাখলো। নাফিসার হাত ধরে হেটে কিছুটা পথ অতিক্রম করে বিধু চাকমাদের দোকানে এসে দুকাপ চা অর্ডার করলো। নাফিসা বললো,
- এখন চা অর্ডার করার প্রয়োজন ছিলো! বাসায় ফিরতে হবে না? আম্মি বাসায় নেই।
- বাসায় ফিরে কি করবে?
- রান্না বসাতে হবে না!
- একবেলা চা খেয়ে কাটাতে পারবে না?
- আমি পারবো, তুমি খাবে না?
মেঘ মুচকি হেসে বললো, - উহুম। বসো।
মেঘের কথায় নাফিসা বেঞ্চিতে বসলো। চা এলে দুজন একসাথে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। শীতকাল খুব নিকটে। সন্ধ্যা হতেই ঠান্ডা পড়ে। এই হালকা ঠান্ডা পরিবেশে প্রিয় মানুষের সাথে রাস্তার ধারে বেঞ্চিতে বসে মাটির কাপে গরম চায়ে চুমুক দেওয়ার মাঝে আছে অন্যরকম প্রেমানুভূতি! ভাবতেই শিহরণ বয়ে যায় সর্বাঙ্গে! কবু তৃপ্তি মিটবে না এই অনুভূতির! মেঘের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে নাফিসার মনে কতো রকমের অনুভূতির জন্ম হয়েছে সেটা তার নিজেরও জানা নেই! কোনটা তার স্বীকৃতিতে কোনটা জোরপূর্বক।
- মেঘা
- হুম?
- সেদিন তোমার সাথে একটা মেয়ে ছিলো জলাশয়ের পাশে। মেয়েটি কে?
- খালামনির ছোট মেয়ে দিয়া।
- অহ। খালামনির ছেলেমেয়ে কতজন?
- দুইটা মেয়েই শুধু। বড় মেয়ে পৃথা চাকমা আর ছোট মেয়ে দিয়া চাকমা । পৃথা আপুর বিয়ে হয়ে গেছে আর ও ছোট।
- অহ, আচ্ছা।
আর একটু গল্প করতে করতে চা শেষ করলো।
পর্ব – ৩০
আবার হাত ধরে হাটতে হাটতে দুজন পাহাড়ি রাস্তায় সন্ধ্যার অন্ধকারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। মেঘ হাটতে হাটতে নাফিসাকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে এলো। একটা ফাঁকা টেবিলের কাছে এসে নাফিসাকে বসতে ইশারা করলো। নাফিসা বললো,
- এখানে কেন?
- এখানে সবাই কেন আসে?
- খাওয়ার জন্য।
- তাহলে আমরাও খাওয়ার জন্য এসেছি।
- শুধু শুধু টাকা নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। বাসায় রান্না করে খাওয়াবো, চলুন।
- শুধু শুধু কোথায়! খাবারের বিনিময়েই তো টাকা দিবো।
নাফিসাকে বসিয়ে চেয়ার কাছে টেনে মেঘও বসলো। এমনিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো বৃষ্টি কল করেছে তাও আবার ভিডিও কল! বাবা মা কেউ পাশে থাকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে তাই মেঘ রিসিভ করলো না। ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করলো। আবার ফোন বেজে চলেছে। মেঘ নাফিসার বিপরীতের চেয়ারে বসে ফোন রিসিভ করলো। - কি হয়েছে তোর?
- কেমন আছি, জিজ্ঞেস না করেই আগে বলে কি হয়েছে তোর!
- জানিই তো তুই কেমন থাকলে আমাকে মনে করিস। আচ্ছা বল কেমন আছিস?
- জানো যেহেতু আর বলবো না। তোমরা কেমন আছো?
- আমরা মানে?
- মানে বুঝো না! ভাবি কেমন আছে?
- ওই তোর পাশে কে আছে?
বৃষ্টি ফোন চারিদিকে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বললো, - এই দেখো কেউ নেই। আমি একা আমার রুমে। এবার বলো।
- আলহামদুলিল্লাহ, আমরা ভালো আছি। বাবা-মা কেমন আছে?
- হুহ্! তুমি জানো নাকি! এমন ভাব করছো যেন বাবামায়ের সাথে তোমার কথাই হয়না! আমি সব জানি, প্রতিদিন দুইতিন বার করে কথা বলো। শুধু আমাকেই মনে করো না।
- এই যে মনে করেই তো ফোন রিসিভ করেছি।
- হ্যাঁ, একেবারে শাব্বাস! তুমি এখন কোথায় আছো?
- সিলেট।
- ধ্যাত! আমি জিজ্ঞেস করেছি এখন কোথায় মানে রেস্টুরেন্টে বসে আছো নাকি!
- রেস্তোরাঁয়।
- ওই একই, বাংলা আর ইংরেজি। তুমি এখানে কি করো?
- রেস্তোরাঁয় আবার কি করে? ডিনারে এসেছি।
- কেন, ভাবি কি খাবার দেয় না!
কথাটা বলে বৃষ্টি হাসতে লাগলো ইচ্ছেমতো। মেঘ মুচকি হেসে এই চেয়ার থেকে উঠে আবার নাফিসার পাশের চেয়ারে বসলো। নাফিসাকে দেখে বৃষ্টি হাসি থামিয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বললো, - ওয়াও! ভাইয়া, তুমি ভাবিকে নিয়ে ডিনারে এসেছো! হাউ সুইট! ওফ্ফ! আমি যদি এখানে থাকতাম!
- তুই কেন আসবি আমাদের মাঝে!
- অহ! তাইতো! তোমরা তো জোড়া পাখি। বাদ দাও, তুমি অফ যাও ভাবির সাথে কথা বলবো। কেমন আছো ভাবি?
নাফিসা মুচকি হেসে জবাব দিলো, - আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?
- আমিও আলহামদুলিল্লাহ। আফসোস একটাই, সরাসরি তেমন কথা বলতে পারলাম না তোমার সাথে! এখন তো আমি সেই দিন গুনছি যেদিন তুমি বাসায় আসবে। আলাদীনের প্রদীপ থাকলে আমি তোমাকে ছো মেরে নিয়ে আসতাম। তোমাকে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে, কোথাও গিয়েছিলে আজ? আই মিন, কোনো প্রোগ্রামে?
হুট করে মেঘ বললো, - অনেক বলেছিস, এইবার তুই অফ যা। খাবার এসেছে, শান্তিতে খেতে দে। আল্লাহ হাফেজ।
মেঘ সাথে সাথে কল কেটে দিলো। বৃষ্টি মেসেজ পাঠালো, ” বউ নিয়ে বাহাদুরি করছ! বাসায় আয় একবার ভাবিকে আমার পক্ষে নিয়ে আসবো। “
মেঘ কোনো প্রতুত্তর দিলো না। দুজনেই খেয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
৩০
বাসায় ফিরে দুজনেই খরগোশের সাথে খেলা করলো আর তাদের একটু যত্ন নিলো। খরগোশ ছানাদের আম্মির রুমে রেখে এসে দেখলো মেঘ খাটে বসে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু করছে। নাফিসা মেঘের উপর দিয়েই মশারী টানালো। খাটে উঠে বালিশ ঠিকঠাক করে বললো,
- ঘুমাবে না?
- প্রতি রাত তো ঘুমিয়েই কাটাই। আজ গল্প করে কাটাতে পারবে না?
- শুনতে পারবো, বলতে পারবো না।
মেঘ হেসে উঠলো নাফিসার কথায়! - আচ্ছা, তাহলে শুনাই। এদিকে এসো।
নাফিসাকে কাছে টেনে বসিয়ে ল্যাপটপে বাবা মা ও বৃষ্টির ছবি দেখালো। তাদের সম্পর্কে কিছু ধারণা দিলো। তারপর অনলাইনে কিছু মনোমুগ্ধকর জায়গা দেখালো। এভাবে প্রায় এক ঘন্টার মতো জেগে থেকে গল্পের সমাপ্তি ঘটিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাফিসা রান্না বসিয়েছে। মেঘ নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। রান্না শেষ হতেই নাফিসা ডেকে তুললো মেঘকে। মেঘ হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসেছে। আর এদিকে নাফিসা খাবার আনতে গিয়েছে। মেঘের ফোন বেজে উঠলে দেখলো মা কল করেছে। সে রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রেখে কথা বলতে লাগলো আর আলমারিতে জামাকাপড় ঘাটতে লাগলো।
- আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো মোর জননী?
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ আমি তো ভালোই আছি। আমার পুত্র কেমন আছে?
- আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। নাস্তা করেছো?
- হ্যাঁ। তুই?
- না করবো।
- সময় মতো কিছু হয় না! কি অবস্থা করেছিস দেহের কে জানে! কবে বেরিয়েছে আর ফেরার খবর নেই!
- ওহহো! আমাকে নিয়ে শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করো না তো! তোমাদের খেয়াল রাখো। জানোই তো একটা কাজ হাতে নিয়েছি ওটা শেষ না করে কিভাবে আসি!
- কাজ অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে আয়। এবার তো তোকে আসতেই হবে। তোর বাবা মারিশার বাবার সাথে তোর আর মারিশার বিয়ের কথা পাকা করছে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, ছেলের সংসার দেখে যাবো না! ইচ্ছে তো আগেরই ছিলো এবার সেটা পূরণ করার সময় এসেছে।
- হোয়াট! মারিশার সাথে আমার বিয়ে!
- হ্যাঁ, সমস্যা কোথায়। আমার ও তোর বাবার খুব পছন্দ। তাছাড়া তোদের সম্পর্কও তো ভালো। তুই বাসায় ফিরে আয় আগে, তারপর কথা বলি।
মায়ের কথা শেষ না হতেই এদিকে কোন এক শব্দ হলো! মেঘ পেছনে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা দরজার সামনে দাড়িয়ে! চোখে তার অশ্রু, দৃষ্টি মেঘের দিকেই। তার হাতে যে খাবারের বাটি ছিলো সেটা মাটিতে পড়েই এমন শব্দ হয়েছে। মেঘ তাকানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নাফিসা দৌড়ে চলে গেলো বাইরের দিকে। মেঘ বললো, - মা, আমি তোমার সাথে পরে কথা বলছি। আল্লাহ হাফেজ।
- ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
মেঘ কল কেটে সাথে সাথে দ্রুত গতিতে বাইরে বেরিয়ে গেলো। নাফিসাকে খুজছে সে! উঠুনে নেমে লক্ষ্য করলো নাফিসা চালতা গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসে আছে। কাছে এসে দেখলো বাড়ির বাইরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিরবে কাদছে! মেঘ দ্রুত পাশে এসে বসলো। নাফিসাকে ধরে বললো,
- মেঘা! কাদছো কেন তুমি! এই, কি হয়েছে!
নাফিসা কোনো জবাব না দিয়ে মেঘের হাত সরিয়ে উঠে দাড়ালো। চোখ মুছতে মুছতে সে ঘরের দিকে দ্রুত পায়ে অগ্রসর হলো! মেঘও পিছু পিছু ছুটছে। নাফিসা বিয়ের কথা শুনে মনে আঘাত পেয়েছে এটা মেঘের অজানা নয়! নাফিসা ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলো কিন্তু তার আগেই মেঘ দরজা ঠেলে খুলে ফেললো। নাফিসা আম্মির রুমে চলে যাওয়ার জন্য বের হতে গেলে মেঘ তাকে টেনে রুমের ভেতরে এনে দরজা লাগিয়ে দিলো। তাকে খাটে বসিয়ে বললো,
- এমন করছো কেন তুমি? ব্যাপারটা তো বুঝো আগে। আমি
- বিয়ে করে নিন আপনি।
মেঘকে থামিয়ে নাফিসা হঠাৎ এমন কথা বলায় মেঘের রাগ উঠে গেছে! তবুও রাগ প্রকাশ করেনি! ঠান্ডা স্বরে বললো, - কান্না করো না শুধু শুধু। আমাকে বলার সুযোগ দাও। বুঝতে চেষ্টা করো।
নাফিসা মেঘের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাড়িয়ে বললো, - কিছু বুঝাতে হবে না আমাকে। আপনি বিয়ে করে নিন। বাবামাকে কষ্ট দেওয়ার প্রয়োজন নেই! মুক্ত করে দিলাম আমি আপনাকে। ভুলে যান নাফিসা বলে কেউ ছিলো!
এবার মেঘ উঠে দাড়ালো। রেগে গেছে খুব! নাফিসার বাহু চেপে ধরে ঝাকিয়ে বললো, - কিসের মুক্তি দিবি আমাকে বল? কিসের মুক্তি? সবাইকেই তোর বাবার মতো মনে হয়! এতোদিন ধরে পড়ে আছি শুধু তোর জন্য, আর আজ বলছিস মুক্ত করে দিয়েছিস! এতোটাই সহজ জীবন? পুতুল খেলা মনে হয়? এতো দেমাক কিসের তোর? কম চেষ্টা করেছি তোকে পাওয়ার জন্য? কম চেষ্টা করেছি তোর দুঃখ মুছে তোকে রঙিন জীবনের সন্ধান দিতে! আর আমাকে ভাবছিস আমি বিয়ে করে নিবো! মা বলেছে শুধু আর আমি বিয়ে করে ফেলেছি! বিরক্ত হয়ে যাস আমাকে দেখলে তাই না! খুব বোঝা মনে হয় আমাকে! চলেই তো যাচ্ছিলাম সেদিন! বাধা দিলি কেন! আবার এখনই দূরে সরিয়ে দিচ্ছিস কেন! কথায় আছে বানরকে আশ্রয় দিলে মাথায় উঠে বসে! হুম ঠিকই! অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছি, তার উপযুক্ত ফল এখন পাচ্ছি! যাহ, আসবো না তোর কাছে।
মেঘ প্রচুর রেগে গেছে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দেয়ায় ! দরজা খুলে হনহন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো! নাফিসা কান্না করতে করতে মাটিতে বসে পড়লো! কি করবে! এজন্যই তো পুরুষ মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ হতে চায়নি সে! পুরুষের মায়ায় জড়াতে চায়নি নিজেকে! কিন্তু মেঘের ভালোবাসা বাধ্য করেছে তাকে আপন করে নিতে! সে ও তো মেঘকে চায়! এটাও জানে মেঘ তাকে অনেক ভালোবাসে! কিন্তু না চাইতেও মেঘকে আঘাত করেছে!
সহ্য হয় না তার কিছু! প্রিয়জনকে হারানোর ভয়ে থাকে সবসময়! যে ভয়টা সবসময় তাকে দুশ্চিন্তায় রাখে সে ভয়টাই এখন বাস্তবের দিকে যাচ্ছে! মেঘের বাবা-মা যদি নাফিসাকে মেনে না নেয়! মেঘের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি মেঘকে জোর করেই বিয়ে করতে বাধ্য করে! তাহলে তার কি হবে! মেঘকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছে সেটা কি শেষ হয়ে যাবে! মেঘকে সে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে তাহলে!
নাফিসা শব্দ করে কেদে উঠলো! কিন্তু তার কান্নার শব্দ শুধু তার ঘর পর্যন্তই! বেশ কিছুক্ষণ কান্না করেছে কিন্তু শান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই পাশে! কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো নাফিসা। পরক্ষণেই মেঘের কথা মনে হলো। এই মানুষটা তার সাদাকালো জীবনকে রঙিন করে তুলেছে! তাকে খুব ভালোবেসেছে! সে নিশ্চয়ই তাকে ধোকা দিবে না! এটা কি করলো সে! শুধু শুধু এভাবে কেন কষ্ট দিলো তাকে! সে তো কোন অপরাধ করেনি, তাহলে সে কেন শাস্তি পাবে! সকালের নাস্তাও করা হয়নি! ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই, কিন্তু
কোথায় গেছে!
নানান কথা ভাবতে ভাবতে এবার বললো,
- না, এভাবে বসে থাকলে হবে না। খুঁজে দেখতে হবে।
নাফিসা চোখমুখ মুছে ঘরে তালা লাগিয়ে বের হলো বাসা থেকে। ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে মেঘ বেরিয়েছে। কোথায় যেতে পারে সে! আবার ঢাকা ফিরে যায়নি তো অভিমান করে! মনের ভেতর নানান চিন্তা নিয়ে পথে খুজতে লাগলো মেঘকে! পথে খুজতে খুজতে সে চা বাগান পেরিয়ে সেই পাহাড়ে এসেছে। পাহাড়ে উঠে এখানেই মেঘকে বসে থাকতে দেখে খুব বড় একটা নিশ্বাস ছাড়লো! এতো চিন্তা নিয়ে হাটতে হাটতে হাপিয়ে গেছে সে! কয়েকটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মেঘের কাছে এসে বসলো। মেঘ দু’হাতে হাটু বেধে বসে আছে। নাফিসার উপস্থিতি টের পেয়েও তাকায়নি একবারও! নাফিসা দু’হাতে মেঘের একহাত জড়িয়ে ধরে কাধ বরাবর হেলান দিলো মেঘের হাতের উপর! মেঘের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে বললো,
- সরি। আর কখনও এসব বলবো না। তোমার কথা আগে শুনবো। ক্ষুধা লাগেনি? নাস্তা করবে না?
মেঘ কিছু বলছে না। শুধু পলকহীন তাকিয়ে আছে সেই দূর পাহাড় পর্বতের দিকে। নাফিসার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিভাবে এখন মানাবে কিছুই বুঝতে পারছে না! সে উঠে মেঘের সামনে বসলো। নিজ হাতে হাত ছাড়িয়ে হাটু দুটোর বাধন খুলে পা টেনে তার দু’দিকে ছড়িয়ে দিলো। সে এখন মেঘের দু পায়ের মাঝে বসা! মেঘ এখন দৃষ্টি নাফিসার দিকে দিয়ে তার কান্ড দেখছে। নাফিসা আরেকটু পেছনে এসে মেঘের শরীরে হেলান দিলো। মেঘের দুহাত তার পেটের উপর দিয়ে নিয়ে নিজেকে বন্দী করার চেষ্টা করলো কিন্তু মেঘের কোন প্রতিক্রিয়া দেখছে না! ঘাড় ঘুরিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে মেঘের মুখে তাকিয়ে বললো,
- সরি তো। আর কখনো বলবো না! রাগ করো না প্লিজ! ক্ষমা করে দাও!
বাচ্চাদের মতো দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মেঘ মন খারাপ থাকা সত্ত্বেও ফিক করে হেসে নাফিসাকে দু’হাতে বেধে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। মাথার একপাশে মাথা ঠেকিয়ে বললো,
- রাগ করিনি তোমার উপর! খুব বড় চিন্তায় আছি আমি, মেঘা! বাবামায়ের কাছে কিভাবে তোমার কথা তুলে ধরবো বুঝতে পারছি না! এখন মনে হচ্ছে যখন বিয়েটা হয়েছিলো তখনই সবটা জানানো প্রয়োজন ছিলো! এখন যদি জানে বিয়ে করেছি সেই কবে অথচ জানিয়েছি এতোদিন পর তাহলে তো আরও বেশি কষ্ট পাবে! আর কি সিদ্ধান্ত নিবে সেটা আমি ধারণা করতে পারছি না! এতো চিন্তার মাঝেও তুমি আবার উল্টাপাল্টা বলা শুরু করেছো তাই রেগে গেছি!
- সরি।
- আর কখনো এসব বলবে না। আমি তোমাকেই ভালোবাসি। একাধিক বিয়ে করার কোনো ইচ্ছাও আমার নেই! পারলে ভালো কোন আইডিয়া দাও কিভাবে আমি বাবামায়ের কাছে বলবো বিয়ের কথাটা! মারিশার সাথে বিয়ে পাকা করার আগেই আমাকে ঢাকা ফিরে সবটা জানাতে হবে!
- না, কোথাও যাবে না!
মেঘ নাফিসার মাঝে ভয়টা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে! তাই পেছন থেকে কপালের একপাশে ভালোবাসার স্পর্শ একে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হতেই নাফিসা বললো,
- নাস্তা করবে না?
- হুম। চলো বাসায়।
খরগোশের জন্য কিছু নরম ঘাস হাতে নিয়ে নাফিসা মেঘের সাথে বাসায় ফিরে এলো। দুজনেই একসাথে নাস্তা করে নিলো। খাবারের বাটি পড়ে যাওয়ায় দুপুরের জন্য নাফিসা আবার রান্না বসালো। মেঘ কাজে বেরিয়েছে। দুপুরের পরে ফিরেছে বাসায়। গোসল করে দুজনেই খেয়ে ঘুম দিয়েছে।
পর্ব – ৩১
বিকেলে আম্মিও এসে পড়েছে। রাতের জন্য আম্মিই রান্না বসালো। আজ বিকেলে মেঘ বাজার করে এনেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাফিসা মেঘকে দেখতে পেল না! প্রতিদিন তো মেঘের বুকেই ঘুম ভাঙে আজ মেঘ তাকে না ডেকেই উঠে পড়লো কেন! নামাজ পড়তেও ডাকেনি, বেলা হয়ে গেছে! বিছানো ঠিকঠাক করে বাইরে এলো নাফিসা। ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে এসে দেখলো আম্মিকে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে!
- কি হয়েছে আম্মি?
- কই?
- এভাবে আছো কেন? চুলায় আগুন নেই ভাত বসিয়েছো!
আম্মি নিজের কান্ডে মৃদু হেসে চুলায় আগুন ধরাতে ধরাতে বললো, - বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো। এই তার প্রমাণ!
- হ্যাঁ, চুল পাকেনি অথচ বুড়ো হয়ে যাচ্ছো! এদিকে উঠে আসো, আমি রান্না করি।
আম্মি উঠে এলো নাফিসা রান্না করার জন্য বসলো। নাস্তা করার জন্য আম্মি ডাকলো। - হ্যাঁ বলো।
- খাবি না?
- তুমি খাও, আমি পরে খাবো।
- মেঘের জন্য অপেক্ষা করছো? মেঘ আজ আমাদের সাথে নাস্তা করবে না।
মেঘের কথা শুনে চমকে উঠলো নাফিসা! সে তো মেঘের অপেক্ষাই করছিলো। কিন্তু আম্মির কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, - আমাদের সাথে নাস্তা করবে না কেন?
- আমার কাছে বলেছে, কি একটা কাজে বেরিয়েছে ফিরতে দেড়ি হবে। এসো আজ আমি খায়িয়ে দেই। কবে থেকে খায়িয়ে দেই না আমার আম্মিটাকে!
নাফিসার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো! মেঘ তাকে বলেও যেতে পারতো! যাক আম্মি বলছে সেজন্য আর না করলো না। আম্মির হাতে নাস্তা করলো। বাসায় একা একা ভালো লাগছে না তার উপর সকাল থেকে মেঘের দেখা নেই! তার মনে আবার ভয়ও হচ্ছে তাই ভয় দূর করতে আলমারি খুলে মেঘের জামাকাপড় চেক করলো। সব এখানেই আছে দেখে চিন্তামুক্ত হলো। দুপুরেও আসেনি মেঘ! আম্মির সাথে খেয়ে আম্মির ফোনটা হাতে নিলো। নিজের রুমে এসে মেঘের নম্বরে ডায়াল করলো। একবার কল হয়ে কেটে গেছে দ্বিতীয় বার ডায়াল করতেই রিসিভ হলো। - আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় আছো?
- ইম্পর্ট্যান্ট কাজে বেরিয়েছি।
- কখন আসবে?
- কাজটা শেষ করেই চলে আসবো।
- খুব বেশি ব্যস্ত এখন?
- না, বলো।
- আমাকে ঘুম থেকে ডেকে গেলে কি হতো?
- ইচ্ছে করেনি ঘুমটা ভেঙে দিতে!
- এতো সকালে যাওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো! নাস্তা করে বের হলে কি হতো?
- প্রয়োজন ছিলো বিধায় বেরিয়েছি। বাইরে নাস্তা করেছি তো আমি। লাঞ্চ করেছো?
- হুম।
- তাহলে এখন একটা ঘুম দাও, বিকেলে আবার পড়াতে যাবে।
- সাবধানে থেকো, কাজ শেষ করে দ্রুত বাসায় ফিরবে।
- ওকে, বেগম সাহেবা। আল্লাহ হাফেজ।
- আল্লাহ হাফেজ।
নাফিসা ফোন রেখে কিছুক্ষণ ছোট জানালার পাশে বসে রইলো। টেবিলে মেঘের ল্যাপটপটা খুজলো কিন্তু পেল না! নিয়ে গেছে হয়তো সাথে!
মেঘের কথামতো দুপুরে ঘুমিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে বাচ্চাদের পড়াতে গেছে। মেঘ এখনো বাসায় ফিরেনি! খুব মিস করছে মেঘকে! রাতে আবার কল করলো। প্রথম বার কল কেটে দিয়েছে। দুমিনিট পর মেসেজ এসেছে, ” মেঘা, আমি আজ ফিরবো না। কাজের চাপ একটু বেশি। আজ আম্মির সাথে ঘুমাতে যাও।”
নাফিসা কল করেই যাচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না! একটু পর মেঘের নম্বর বন্ধ দেখছে!
ভয় তো বেড়েই যাচ্ছে! কান্না আসছে খুব! আম্মি একবারও জিজ্ঞেস করেনি মেঘের কথা। তার মানে আম্মি জানে! দৌড়ে আম্মির কাছে এসে বললো,
- আম্মি, মেঘ কোথায় গেছে?
- কাজে বেরিয়েছে। রাত অনেক হয়ে যাচ্ছে। চলো খাবার খেয়ে নেই।
- কি কাজে বেরিয়েছে?
- জরুরি কাজ আছে নাকি!
আম্মি কথা এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে তাই নাফিসা রেগে বললো, - সেটাই তো জানতে চাচ্ছি কি কাজে গেছে, কোথায় গেছে? তুমি সবটা জানো আমার কাছে লুকানোর চেষ্টা করছো কেন? বলো না মেঘের কি হয়েছে?
রোকসানা মেয়ের চিন্তা ও কান্না দেখে আর লুকিয়ে রাখতে পারলো না! বলেই দিলেন, - মেঘের কিছু হয়নি। মেঘ ঢাকা ফিরে গেছে বাবামায়ের সাথে কথা বলতে। অতি শীঘ্রই ফিরে আসবে।
নাফিসা স্তব্ধ হয়ে গেছে! তাহলে কি মেঘ তাকে ধোকা দিয়ে চলেই গেলো! ঢাকা গেলেই তো মেঘকে বিয়ে করতে হবে! ওর তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে! এজন্য সে তার মেঘাকে না জানিয়ে পালিয়ে গেছে! যেই ভয়টা মনে গেথে ছিলো আজ সেটাই ঘটতে চলেছে! খুব ঠান্ডা স্বরে আম্মিকে জিজ্ঞেস করলো, - কখন বলেছে তোমাকে?
- কাল রাতেই বলেছিলো। ভোরে যাওয়ার সময় আবার বলে গেছে। সকালের ট্রেনেই উঠেছে। তুমি চিন্তা করবে তাই তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছে। কালকেই ফিরে আসবে দেখো।
নাফিসা আর কিছু শোনার জন্য এখানে অপেক্ষা করলো না। দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে কান্না করেই যাচ্ছে! আম্মি এসে দরজা খুলতে বললো কিন্তু নাফিসা খুলছে না! দুই রুমে মা মেয়ের কেটে যাচ্ছে নির্ঘুম রাত! নাফিসার চোখে ঘুম নেই মেঘের জন্য আর রোকসানার চোখে ঘুম নেই মেয়ের অবস্থা দেখে!
দুপুরের দিকে কলিং বেলেরে শব্দ শুনে দরজা খুললো বৃষ্টি। দরজার ওপাশে মেঘকে দেখে অবাক হয়ে আছে!
- ভাইয়া তুমি!
মেঘকে সরিয়ে এপাশে ওপাশে বাইরে উঁকি দিয়ে কাউকে খুজতে লাগলো বৃষ্টি। কিন্তু আর কেউ তো নেই! মেঘ বুঝতে পেরে বললো, - এদিকে কাকে খুজছ? আমি তোর সামনেই দাড়িয়ে!
- তোমাকে তো দেখছি ই। তুমি একা এসেছো? ভাবি কোথায়?
মেঘ ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
- আমি আমার বাড়ি ভাবি ভাবির বাড়ি। আমার মা জননী কোথায়?
- হিহিহি, ওই যে তোমার মা আর জননী।
মোহিনী ছেলেকে দেখে অবাক হয়ে বললো, - মেঘ!
মেঘ মা কে সালাম করে বললো, - কেমন আছো তুমি?
- আলহামদুলিল্লাহ। বলা নেই কিছু না হুট করেই চলে যাওয়া আবার হুট করেই চলে আসা! চেহারার কি অবস্থা করেছে! এখন একটা লাগাতে মন চায়!
মেঘ মুচকি হেসে মায়ের সামনে গাল পেতে দিয়ে বললো, - লাগাও।
মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
- লাগিয়েছি! ফাজিল ছেলে একটা! এই ক’দিনেই শুকিয়ে গেছে।
মায়ের কথা শুনে বৃষ্টি বললো, - মা, তুমি ডাক্তার দেখাও। তোমার চোখে প্রব্লেম হয়েছে। ভাইয়া কোনদিন মোটা ছিলো বলো তো আমাকে একটু ?
- চুপ থাক তুই! নিজে আরেক শুটকি, আবার কথা বলতে আসে! কি যে অবস্থা, মনে হয় অভাবের সংসার আর তোদের না খায়িয়ে রাখি!
- যদি ফুলে বেলুন হয়ে আকাশে উড়েও যাই না তবু্ও বলবা শুটকি আছি। এটা তোমাদের মতো মায়েদের স্বভাব! বাবা কি বলে শুনো না? সুস্থ আছি এটাই আলহামদুলিল্লাহ।
- হইছে তোর জ্ঞান তোর মাথায়ই রাখ। মেঘ হাতমুখ ধুয়ে আয়, চোখ কেমন গর্তে চলে গেছে। রাতে ঘুম ও হয়না বুঝি!
মেঘ মনে মনে বললো, “ঠিকই ধরেছো মা। কাল রাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি।
এদিকে বৃষ্টি বিড়বিড় করে বললো, - শুকিয়ে গেছে হুহ্! আমি তো দেখছি জামাই আদর পেয়ে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে!
মেঘ বুঝতে পেরে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই বৃষ্টি হাসতে হাসতে ছো মেরে দৌড় দিলো তার রুমে। মেঘ তার রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো। নাফিসা কল করেছিলো তার সাথে কথা বলে নিলো। দুপুরের খাবার খেতে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
- মা, বাবা কোথায়?
- কোথায় আর থাকবে! রাত কাটে বাড়িতে আর ভোর হতেই ছুটে ব্যবসায়ের কাজে।
মেঘ খেয়ে কিছুক্ষণ ছাদে হাটলো। অনেক দিন হলো বাগানের যত্ন ছেড়ে দূরে আছে, তবে বাগান ভালোই আছে। বৃষ্টি যত্নে রেখেছে হয়তো। নানান ফুলের বাহার দেখে মনটা ভালো হয়ে গেলো কিন্তু চিন্তা টা মাথা থেকে যাচ্ছে না। আবার রুমে চলে এলো। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু চোখে ঘুম আসে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না বলছে ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্তি নেই! বিকেলে বাইরে একটু ঘুরেছিলো। সন্ধ্যায় বাবা বাসায় ফিরেছে। খেতে যাবে এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আম্মির নম্বর থেকে কল এসেছে। নাফিসা কল করেছে মেঘ নিশ্চিত। তাই একটা মেসেজ পাঠিয়ে ফোন বন্ধ করে দিলো। রাতে একসাথে খাওয়ার সময় বাবা বললো,
- মেঘ, মারিশার আর তোমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছি আমরা অভিভাবকরা। তোমার মায়ের খুব শখ হয়েছে বাসায় ছেলের বউ আনার। মারিশাকে তো আগে থেকেই পছন্দ। তোমাদের মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও ভালো। মারিশার মতামত আছে, তোমার নিশ্চয়ই অমত নেই?
বৃষ্টি খাওয়া রেখে বাবামায়ের মুখে একবার তাকালো আবার মেঘের মুখে তাকালো। মেঘ মাথা নিচু করে খাচ্ছে। বাবার কথায় প্লেটের দিকে তাকিয়েই বললো,
- বাবা, খাওয়া শেষে তোমাকে কিছু বলবো।
ছেলের এমন ভঙ্গি দেখে বাবা মা দুজনেই তাকালো তার দিকে। মেঘকে নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে দেখে তারা একে অপরের দিকে তাকালো। সিরিয়াস কিছু হবে তারা সেটা বুঝতে পেরেছে। অত:পর খাওয়া শেষ করে নিলো।
ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। মেঘ একটা কাগজ এগিয়ে দিলো বাবার দিকে। বহুবছর পর ছেলের এই অভ্যাস টা আবার দেখলো তারা। ছোট বেলায় কোনো অপরাধ করলে সরাসরি মুখে বলতে পারতো না মেঘ। চিরকুটে লিখে বাবামায়ের কাছে প্রেরণ করতো। এতো বছর পর আজ সে আবার এমন করছে! কি অপরাধ করেছে সে!
বাবা মা সামনের সোফায় বসা আর মেঘ তাদের বিপরীতে বসে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান চৌধুরী কাগজটা হাতে নিয়ে না খুলেই জোর গলায় বৃষ্টিকে ডাকলো। বাবার ডাক শুনে বৃষ্টি দ্রুত ড্রয়িং রুমে এলো। পরিবেশটা খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে! কি হবে বৃষ্টি আন্দাজ করতে পারছে না! রায়হান চৌধুরী বৃষ্টির দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
- অনেক দিন হলো তোমার রিডিং ধরি না। পড়ে শুনাও দেখি আগের মতো স্ট্রংভাবে পড়তে পারো কি-না!
বৃষ্টি বাবার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে পড়তে লাগলো,
পর্ব – ৩২
“প্রিয় জনক ও জননী,
প্রথমেই বলে নেই তোমাদের ছেলে বয়সে এতো বড় হয়েও অপরাধ করেছে। তোমাদের না জানিয়ে খুব বড় ভুল করে ফেলেছে। তোমরা আমাকে যা শাস্তি দিবে তা আমি মাথা পেতে নিবো। কিন্তু দয়া করে নিজেরা কষ্ট নিও না।
বেড়াতে যাওয়ার পর সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ছোট এক পাহাড়ে একটা মেয়ের সাথে দেখা হয় আমার। মেয়েটা পাহাড়ে ছোট বাচ্চাদের পড়াচ্ছিলো। অত:পর পাহাড় ছেড়ে চা বাগানে ঘুরতে যাই। সেখানেও আবার সেই মেয়েকে দেখেছি চা পাতা তুলছে। সেখানে আমি দুতিনদিন থেকেছি আর প্রতিদিনই পাহাড়ে, রাস্তায়, চা বাগানে ওই মেয়েটার সাথে দেখা হতো। তাকে ভালো লেগে যায় খুব। শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ শেষ করে ভালোলাগাটা মনের ভেতরে লুকিয়ে রেখেই বিকেলের দিকে শ্রীমঙ্গল ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম অন্যত্র।
পথে এক পাহাড় পড়লো যেটাতে আমার ভ্রমণ বাকি ছিলো। ভেবেছি চলে যাওয়ার আগে এই পাহাড়টাও দেখে যাই। সেখানে উঠেও পড়লাম। ঘুরেফিরে দেখছিলাম। পাহাড় থেকে নিচের দিকে তাকাতেই মাথা চক্কর দেয় আর আমি পড়ে যাই। জ্ঞান ফিরেছে আমার প্রায় একদিন পর। চোখ খুলেই দেখেছি আমি এক কাঠের ঘরে শুয়ে আছি। আর সেটা ছিলো সেই ভালোলাগা মেয়েরই। তার নাম নূর নাফিসা। মুসলমান সম্প্রদায়েরই। তার পরিবারে শুধু তার মা ও সে ই আছে। সুস্থ হতে আমার অনেকদিন লেগেছে। মা মেয়ে দুজনেই যত্ন নিয়েছে। আস্তে আস্তে আমি মেয়েটির মায়ায় পড়ে যাই। আশেপাশের লোকজন দেখতে আসতো আমাকে আবার অগোচরে তাদের উল্টাপাল্টা কথাও শুনিয়ে যেত। দুজন মহিলা, ঘরে একজন পর পুরুষ! সেজন্য তখন অনেকটা সুস্থ থাকায় আমি তাদের বাসা ছেড়ে আবার রিসোর্টে উঠি।
কিন্তু সেদিন ঠিক করেই ফেলি আমি এই মেয়ের মায়ায়ই সারাজীবন পড়ে থাকবো। অত:পর তাকে মানানোর জন্য চেষ্টা করতে থাকি। বাচ্চাদের পড়ানোর সময় পাহাড়ে চলে যেতাম, আবার পিছু পিছু চা বাগানে চলে গিয়ে বিরক্ত করতাম। কিন্তু মানাতে পারিনি, তার মন পাথরের মতো কঠিন। একদিন বিকেলে সুযোগ পেয়ে এবং সময় চেয়ে নাফিসার সাথে পাহাড়ে গল্প করি। সন্ধ্যায় পাহাড় থেকে নামার সময় স্থানীয় কিছু লোকের সামনে পড়ে যাই। তাদের উপেক্ষা করে নাফিসাকে চা খাওয়ার জন্য রিকোয়েস্ট করি আর টংয়ের দোকানে একসাথে চা খাই। সেখান থেকে নাফিসাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে যাই আর সেই পথেই ওই লোকগুলোর কুনজরে পড়ে যাই। তারা আমাদের ধরে নাফিসাদের বাসায় নিয়ে যায় এবং এলাকার মেম্বারসহ আশেপাশের লোকজন জমা করে। আর সেদিনই আমাদের বিয়ে দিয়ে দেয়!
আমি চেয়েছিলাম, নাফিসাকে মানিয়ে তোমাদের জানাবো তার কথা আর তোমরা রাজি থাকলে ওকে বিয়ে করবো। কিন্তু দুর্ঘটনাবশত সেদিন বাধ্য হয়েছি বিয়েটা করতে। না হলে এলাকা থেকে তাদের চুনকালি মাখিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হতো। হঠাৎ শুনলে তোমরা কষ্ট পাবে তাই জানাই নি। সেদিন থেকে একটাই চিন্তা করে যাচ্ছিলাম কিভাবে তোমাদের জানাবো। বাবা সিলেট যাওয়ার পরও চেষ্টা করেছি কিন্তু বলার সাহস পাইনি, সুযোগও হয়ে উঠেনি । দিন যত যাচ্ছে আমার চিন্তা তত বাড়ছে তাই হুট করেই আজ চলে এসেছি জানানোর জন্য। আমাকে যা শাস্তি দিবে তা গ্রহণ করার জন্য আমি প্রস্তুত। ‘
আরেকটা কথা, বৃষ্টি কুমিল্লা! “
এইটুকু পড়ে থেমে গেছে, বৃষ্টি আর পড়তে পারলো না! মেঘ তার কথা এখানে তুলেছে কেন! বৃষ্টি মেঘের দিকে তাকালো কিন্তু মেঘ মেঝের দিকেই তাকিয়ে আছে। মেঘের চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা পানি সরাসরি ফ্লোরে পড়ছে! রায়হান চৌধুরী বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,
- কি, পড়া শেষ?
বৃষ্টি মাথা নেড়ে “না” জবাব দিলো। এবার নিচু স্বরে আবার পড়তে লাগলো।
” আরেকটা কথা, বৃষ্টি কুমিল্লা যায়নি। তোমাদেরকে মিথ্যে বলে সে ফ্রেন্ডদের সাথে সিলেট গিয়েছে। আর আমার সাথে দেখা হয়েছে বাবা সিলেট যাওয়ার দুদিন আগে। আমি সিলেট গিয়েছি তাই সেও সেখানেই গেছে। এতোদূর তোমরা যেতে দিবে না তাই সে তোমাদের কুমিল্লার কথা বলেছে। আর কেউ না বুঝলেও বাবামা সন্তানদের বুঝে। এতো ভালোবাসো আমাদের, এতোসব করেছো আমাদের জন্য তবুও আমরা তোমাদের কষ্টই দিয়ে যাই। আল্লাহও হয়তো ক্ষমা করবে না!”
চিঠি পড়া শেষ হতেই টেবিলে কাগজ রেখে মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দাড়িয়ে আছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা! ভাইবোন কেউই তারা বাবামায়ের মুখে তাকানোর সাহস পাচ্ছে। রায়হান চৌধুরী ও মোহিনী ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে আবার একে অপরের দিকে তাকালো। রায়হান চৌধুরী দেখলেন মোহিনীর চোখে হাজার প্রশ্ন! অর্থাৎ রায়হান চৌধুরীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে মোহিনী। রায়হান চৌধুরী স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
- মোহিনী তাদের শৈশবকালে যে তুমি বেত বানিয়েছিলে সেগুলো কি আছে? থাকলে নিয়ে এসো, তারা যে হাতে পায়ে বেড়ে গেছে সেটা কি বুঝতে পারছে না! না মারতেই আমার বাড়িকে সুইমিংপুল বানানোর সাহস কি করে হয়! আজ আমি বেত্রাঘাত করবো তাদের, যাও নিয়ে এসো।
মোহিনী বুঝতে পেরেছে রায়হান চৌধুরী স্বাভাবিক আছে। ছেলে মেয়ে দুজনেই বাবামায়ের মুখে তাকালো! মায়ের মুখে হাসি আছে, আর বাবাও স্বাভাবিক! রায়হান চৌধুরী আবার বললো,
- মেয়ে তো আমাদের বিশ্বাস করে না! যাইহোক ওর শাস্তি কম হবে কিন্তু তোমার ছেলে এতো বড় অপরাধ করে কিভাবে! ভাবতে পারছো তুমি! বিয়ে করেছে অথচ বউ বাড়ির বাইরে। সাহস কি করে হয় বউ ছাড়া বাড়িতে ঢুকার!
অশ্রুসিক্ত নয়নে দুজনেই বাবার মুখে তাকিয়ে নিজেদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। আর এদিকে মোহিনী বললো,
- অপরাধ করলেই ছেলেমেয়ে আমার হয়ে যায়! আর সুনামের ক্ষেত্রে তোমার হয়ে যায়! না?
- এই দেখো, সবকিছুতে আমি বড় অথচ বেশি রেগে যাচ্ছো তুমি। কোথায় বিয়ে বাড়িতে খুশি থাকবে! তা না করে উল্টো প্রতিক্রিয়া!
মেঘ হেসে বাবার কাছে এগিয়ে এসে বাবাকে বসা থেকে উঠার জন্য টানতে লাগলো! কিন্তু রায়হান চৌধুরী উঠছে না। তিনি মোহিনীকে উদ্দেশ্য করে বললো, - মোহিনী, পরিষ্কার জানিয়ে দাও। বউয়ের মুখ না দেখিয়ে যেন আমার সামনে না আসে!
এদিকে চোখ মুছে মেঘ পকেট থেকে ফোন বের করে নাফিসার ছবি দেখিয়ে বললো ,
- বাবা, আপাতত ছবি দেখো। আর আমাকে শাস্তি থেকে মুক্তি দিয়ে উঠে দাড়াও।
ফোন নিয়ে বাবা মা দুজনেই নাফিসার ছবি দেখলো। রায়হান চৌধুরী বললো, - এই মেয়েকে তো আমি দেখেছি কোথাও!
- হ্যাঁ, আমার সাথে জলাশয়ের পাশে জমি দেখতে গিয়ে দেখেছো।
- মোহিনী, তোমার ছেলের কান্ড দেখেছো! আমার সামনে ছিলো অথচ পরিচয় করায়নি! একে এখন কি করা যায় বলো তুমি!
মোহিনী জবাব না দিয়ে নাফিসার ছবি দেখতে লাগলো আর মেঘ বললো, - উঠো আগে, আমিই বলে দিচ্ছে কি করবে!
মেঘ বাবাকে টেনে তুলে জড়িয়ে ধরে বললো, - থ্যাংক ইউ সো মাচ বাবা! আমার বিশ্বাস ছিলো তোমরা মেনে নিবে! সত্যি বলো, কষ্ট চাপা রাখোনি তো আবার?
রায়হান চৌধুরী মুচকি হেসে ছেলের পিঠ চাপড়ে বললেন, - না রে বাবা, সন্তানের সুখেই পিতামাতার সুখ। বৌভাতের আয়োজন করা হোক তাহলে আগামী শুক্রবার।
মেঘ বাবাকে ছেড়ে দিয়ে বললো, - আগামী শুক্রবার মানে! এই চারদিন পর?
- হ্যাঁ। কাল সকালেই বেরিয়ে পড়বি আর বউমা ও বেয়াইনকে এখানে নিয়ে আসবি। এদিকে যা করার সবটা আমি করবো। একমাত্র ছেলের বিয়ে, বিয়ের আয়োজন তো করতে পারলাম না। অন্তত বৌভাতের আয়োজন করে সবাইকে নিমন্ত্রণ করা হোক।
- আংকেলের সাথে না বিয়ে নিয়ে কথা বলেছো। এখন কি করবে!
- হ্যাঁ তাইতো! তাহলে তুই মারিশাকেও বিয়ে করে নে! কত ভাগ্যবান ছেলে আমার! একসাথে দুইটা বউ পাবে!
- কিহ!
বৃষ্টি ও তার মা হেসে উঠলো! আর মেঘ বোকার মতো বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো! বাবা আবার বললো,
- ছাগলের বাচ্চা! কোন বাবা কি তার একমাত্র মেয়েকে বিবাহিত ছেলের কাছে বিয়ে দিতে চাইবে! আমি তাকে বুঝিয়ে বললেই সে বুঝবে। তোর মতো অবুঝ লোক না!
ছাগলের বাচ্চা বলাতে মেঘ আর বৃষ্টি মুখ চেপে হাসতে লাগলো! আর মোহিনী বলেই ফেললো, - বুড়ো হচ্ছে আর জ্ঞান বুদ্ধি কমছে! লজ্জা করে না ছেলেমেয়ের সামনে নিজেকে ছাগল বলে পরিচয় দিতে!
- এএই তুমি উল্টো বুঝো সবসময়! আমি সেটা বলেছি নাকি!
- হ্যাঁ আমি সারাজীবন উল্টোই বুঝি, আর তুমি পাল্টাও!
মেঘ বৃষ্টি মিটিমিটি হাসতে হাসতে বাবা মায়ের মিষ্টি ঝগড়া থেকে কেটে পড়ে নিজেদের রুমে চলে গেলো। আর এদিকে রায়হান চৌধুরী স্ত্রীকে শান্ত করতে ব্যস্ত!
রুমে এসে মেঘ খুশি মনে আম্মির নম্বরে ডায়াল করলো। সাথে সাথেই আম্মি রিসিভ করেছে!
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। মেঘ?
- হ্যাঁ, আম্মি। নাফিসা কোথায়?
- ওর রুমে দরজা লাগিয়ে একা একা বসে কাদছে। ডাকছি একটুও শুনছে না! জেনে গেছে ও, তুমি ঢাকা চলে গেছো।
- আম্মি ওকে ডেকে আমার কথা বলুন। আমি কালকেই ফিরবো। বাবা-মাকে আমি সব জানিয়েছি আর বাবা মা আমাদের মেনেছে।
- আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কি কালই ফিরবে?
- ইনশাআল্লাহ, কাল সকালেই রওনা দিবো। নাফিসাকে ডেকে দিন।
আম্মি লাইনে থেকেই নাফিসাকে ডাকলো, মেঘের কথা বললো। নাফিসা আম্মির কথা শুনছে না! কোনো জবাবও দিচ্ছে না! মেঘের মন মানছে না! ইচ্ছে করছে এখনই চলে যেতে। রাতের খাবারটাও খায়নি নাফিসা! মেয়েটা এতো জিদ্দি কেনো!
এতোদিন জেদ করে ছিলো মেঘকে মেনে নিবে না আর এখন চোখের আড়ালই হতে দেয় না! কি করবে মেঘ বুঝতে পারছে না! তাকে বলে আসেনি নিশ্চয়ই সেই জেদ নিয়ে বসে আছে! আর বলবেই কিভাবে, বললে তো আসতেই দিতো না! ইচ্ছে থাকলেও এখন যেতে পারছে না মেঘ! এদিকে বাবা-মা কিছু জানতে পারলে টেনশন করবে আবার সেদিকে আম্মিও টেনশন করতে নিষেধ করে দিয়েছে। বলেছে তো আম্মি মানিয়ে নিবে কিন্তু নাফিসার কাছেই হয়তো যেতে পারছে না আম্মি, মানাবে কিভাবে! এতো রাতে জার্নি করে যাওয়াটাও মুশকিল!
নানান কথা ভেবে মেঘ আর রাতে বের হলো না। ঘুম নেই তার চোখে! মেঘা কি করছে সেটাই ভাবছে সে। আর উল্টাপাল্টা যেন কিছু না করে বসে, সেই দোয়াই করছে মেঘ! সেদিন বিয়ের কথা শুনেই যেই রিয়েক্ট করেছে! মন বলছে উল্টাপাল্টা কিছু করবে না। কারণ সবার আগে সে আম্মির কথা ভাববে। তবুও মেঘ শান্ত হতে পারছে না! ওদিকে মা মেয়ে, আর এদিকে মেঘ! তিনজনেরই কেটে গেছে নির্ঘুম রাত! সকাল হতেই মেঘ বাসে করে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
দুপুরের শুরুতেই শ্রীমঙ্গল পৌছেছে মেঘ। নাফিসা বাইরে কাপড় নেড়ে দিচ্ছিলো। মাত্রই গোসল করেছে। মেঘকে দেখেই “থ” হয়ে দাড়িয়ে রইলো! মেঘের ভেতরটা কেপে উঠলো নাফিসার চেহারা দেখে! চোখের চারিপাশ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! সারারাত কেদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে! মেঘের প্রচুর রাগ হচ্ছে! নাফিসা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে মেঘ পানে! মেঘ তাকে উপেক্ষা করে দ্রুত গতিতে ঘরের পাশে চলে এলো। আম্মিকে দেখেই সালাম দিয়ে কথা বললো। আম্মির কাছে জানতে পারলো সকালে ঘুম থেকে উঠেও নাফিসা কিছু মুখে দেয়নি!
মেঘ ঘরে এসে সোজা আলমারির কাছে গেলো। নিজের কাপড়চোপড় সব বের করে খাটে ফেলছে! আম্মি নাফিসার দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। নাফিসা দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকলো! মেঘের আচরণ দেখে কিছুই বুঝতে পারছে না! মেঘ এসব এভাবে ফেলছে কেন! নাফিসা ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
- এভাবে কাপড়চোপড় নামাচ্ছেন কেন?
মেঘ কোনো জবাব দিলো না। নাফিসা আবার বললো,
- কোথায় যাবেন আপনি?
- এক্সিউজমি? আমাকে কিছু বলছেন?
- এমন করছেন কেন? এসব উলোটপালোট করে কি করতে চাচ্ছেন! আর ফিরেই বা এসেছেন কেন?
- আসতে চাইনি তো! তবুও আসতে হয়েছে! আমার জামাকাপড় এখানে ছিলো, এগুলো নিয়ে যেতে এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোছগাছ করে আবার ফিরে যাবো।
নাফিসা খাট থেকে জামাকাপড় অগোছালো ভাবেই আলমারিতে তুলে রাখলো। মেঘ তাকে সরিয়ে বললো, - কে আপনি? আমার জামাকাপড়ে হাত দিচ্ছেন কেন? সরে দাড়ান, আমার কাজে বাধা দিবেন না!
নাফিসা পলকহীন মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
- বিয়ে করেছেন?
মেঘের রাগ আরও বেড়ে গেছে! সে কাপড়ের ব্যাগ নিতে নিতে বললো, - হ্যাঁ করেছি তো। একটা বউ আছে, দুইটা খরগোশের বাচ্চা আছে! যত্তসব!
নাফিসা মৃদু হেসে উঠলো অথচ চোখে তার নোনা জল! মেঘ ব্যাগ নিয়ে এদিকে আসতেই নাফিসা তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো! মেঘ টাল সামলাতে না পেরে একটু পিছিয়ে গেছে। আর নাফিসা তার বুকে জোকের মতো লেগেই আছে! মেঘের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে নাফিসা ছলছল চোখে তার মুখের দিকে তাকালো! এই মায়াবী মুখটা আর উপেক্ষা করতে পারেনি মেঘ! মেঘাকে মিশিয়ে নিলো তার সাথে!
- এতো পাগলামি কেউ করে! খাওনি কেন হুম? না ঘুমিয়ে চোখ মুখের কি হাল করেছো দেখেছো একবার আয়নায়!
- তুমিও তো ঘুমাওনি!
- তোমার জন্যই পারিনি!
- না বলে গিয়েছো কেন তাহলে!
- বললে তো যেতেই পারতাম না।
- ঘেমে শার্ট ভিজে গেছে, গোসল করবে?
- হুম।
নাফিসা জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে গেলো। মেঘ গোসল করে এলে খাবার খেয়ে নিলো দুজনেই। নাফিসাকে সাথে নিয়ে মেঘ এখন ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত। নাফিসা জিজ্ঞেস করলো, - বাবা-মা কি মেনে নিয়েছে বিয়ে?
- বউ রেখে একা বাসায় ফিরেছি বিধায় বকেছে আমাকে। কালকেই ঢাকা ফিরবো তোমাকে ও আম্মিকে নিয়ে।
- আমি ঢাকা যাবো না।
মেঘ ব্রু কুচকে তাকিয়ে বললো, - কেন?
নাফিসা দৃষ্টি নামিয়ে বললো,
- এমনি। আর কখনো ঢাকা যাবো না।
- তুমি কি আমাকে বাড়ি ছাড়া করবে!
নাফিসা ছলছল দৃষ্টিতে তাকালো মেঘের দিকে। মেঘ বললো,
- যেতেই হবে। আর কোন কথা হবে না এখন। ঘুমাও চুপচাপ।
পর্ব – ৩৩
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে মেঘ ঢাকায় ফেরা নিয়ে আম্মির সাথে কথা বললো। আম্মি নাফিসাকে নিয়ে যেতে বললো কিন্তু নিজে যাওয়ার জন্য রাজি হলো না! মেঘ অনেক চেষ্টা করলো, বাবা মায়ের সাথে কথাও বলিয়েছে কিন্তু যেতে রাজি হননি। নাফিসা বাচ্চাদের পড়িয়ে বাসায় ফিরলে নাফিসাকে আম্মি রাজি করালো। আম্মিকে ছেড়ে যেতে সে রাজি না। কিন্তু মেঘ ও আম্মির জোড়াজুড়িতে যেতে সে বাধ্য! মেঘ তাকে বললো, কিছুদিন কাটিয়ে আবার তাকে নিয়ে সিলেট ফিরবে। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাতেই গোছগাছ করে রেখেছে।
সকালে নাস্তা করে আম্মির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়েছে। কিন্তু তাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়নি মেঘ। সিলেটের কিছু জায়গা ঘুরেছে যেগুলো তার ঘুরা হয়নি। বারোটার দিকে লাঞ্চ শেষ করে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করেছিলো ট্রেনে যাবে নাকি বাসে যাবে। নাফিসা সিদ্ধান্ত মেঘের উপর ছেড়ে দেওয়ায় ট্রেনে যাওয়ার জন্যই প্রস্তুত হয়েছে। একটা কেবিন বুক করেছে মেঘ।
সেই ছোটকালে এই ট্রেন যাত্রায়ই ঢাকা থেকে সিলেট এসেছিলো নাফিসা। আজ বহুবছর পর আবার ঢাকার উদ্দেশ্যেই পাড়ি জমিয়েছে সেই ট্রেন যাত্রায়। মেঘ স্টেশন থেকে ফাস্টফুড জাতীয় কিছু খাবার কিনে নাফিসাকে নিয়ে ট্রেনে উঠলো। দুজনেই মুখোমুখি দুই সিটে জানালার পাশে বসেছে। এদিকে কোনো মানুষ দেখছে না নাফিসা তাই জিজ্ঞেস করলো,
- ট্রেনে তো ভীড় জমার কথা, কিন্তু এদিকে কেউ আসছে না কেন?
মেঘ মৃদু হেসে বললো,
- কেন, ভীড় ঠেলে যাওয়ার ইচ্ছা? পুরো কেবিন বুক করেছি আমি। আর এমনিতেও তেমন ভীড় হবে না। তবে ঈদুল আজহার জন্য কিছুদিন পর ভীড় হবে।
- ওহ্! কেবিন না নিলেও পারতে। দুই সিট হলেই হতো। শুধু শুধু টাকা নষ্ট।
- তোমার জন্যই তো নিয়েছি। আমি সিট ছাড়াও ভ্রমণ করতে পারবো কিন্তু তোমার ব্যাপার আলাদা।
নাফিসা আর কিছু বললো না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। ট্রেনের বেল বেজে গেছে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আস্তে আস্তে স্টেশন ছেড়ে গেছে সাথে ট্রেনের গতিও বেড়ে গেছে অনেক। মেঘ বললো, - মেঘা, শাড়ি পড়ে থাকতে কি অসুবিধা হচ্ছে?
- উহুম।
- অসুবিধা হলে চেঞ্জ করে নিতো পারো।
- চেঞ্জ করবো এখানে!
- সমস্যা কি, কেউ আসবে না এদিকে। আমি থাকায় প্রব্লেম হলে বলো, বাইরে যাই।
- না, আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।
মেঘ উঠে কেবিনের দরজা আটকে দিয়ে আবার আগের জায়গায় বসলো। নাফিসা তার দিকে তাকিয়ে আবার বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। দূরের দৃশ্য গুলো দেখা গেলেও কাছের দৃশ্য গুলো প্রচন্ড গতিবেগের কারণে তেমন দেখা যাচ্ছে না। নাফিসা তাকিয়ে আছে বাইরে আর মেঘ তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে।
মেঘ লক্ষ্য করলো নাফিসার মুখটা কেমন মলিন দেখাচ্ছে। চুল খোপা করে রেখেছে তবুও ছোট ছোট চুলগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে! শাড়ির আঁচল বেধে রেখেছে তবুও বাতাসে ঢেউ খেলছে আঁচলে! আজ প্রথম শশুর বাড়ি যাচ্ছে বিধায় মেঘের এনে দেওয়া লাল শাড়িটাই পড়েছে নাফিসা। চোখে হালকা কাজল টানা দিয়েছে, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়েছে কানে ছোট ছোট দুল আর হাতে লাল চুড়ি। এতোটুকু সাজই মেঘকে মুগ্ধ করতে যথেষ্ট! না সাজলেও তাকে ভালো লাগে। মেঘ মনের অজান্তেই প্রকাশ করলো,
” উড়ছে কালো চুল আর হেলছে কানের দুল,
মন্দ হতোনা, যদি থাকতো খোপায় ফুল!
করেছো ওষ্ঠ রাঙা, দিয়েছো কাজল টানা,
তবুও কেন হয়ে আছো তুমি আনমনা?
বেধে রেখেছো লালাচল,
তবুও ঢেউ খেলছে দেখো না হয়ে অচল।
এ কোন রূপে সেজেছো তুমি পাহাড়ি কন্যা?
যার ফলে প্রবাহিত হচ্ছে আজ, মেঘের হৃদয়ে বন্যা!”
নাফিসা বাইরের দৃষ্টি সরিয়ে মেঘের দিকে নিক্ষেপ করলো। এতো সুন্দর করে লোকটা কথা বলে কিভাবে বুঝে উঠতে পারে না সে! বারবার প্রেমে পড়তে বাধ্য করে তাকে! হবেই না কেন, যে কেউ প্রেমে পড়তে বাধ্য! মেঘ কথা শেষ করে মুচকি হাসলে নাফিসাও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। মেঘ তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। নাফিসা বুঝতে পেরেছে মেঘ তার পাশে আনার জন্য হাত বাড়িয়েছে। তাই বললো,
- আমি জানালার পাশে বসবো।
- এসো।
নাফিসা মেঘের হাত ধরে উঠতেই মেঘ জানালার পাশ থেকে না সরে নাফিসাকে টেনে তার কোলে বসিয়ে দিলো।
- হচ্ছে কি!
- এখনো তো কিছুই হলো না, মিসেস!
- ছি, ট্রেনে আছি!
- তো! কে দেখছে আমাদের!
- আমি উঠবো।
- উঠো, নিষেধ করেছে কে!
- না ছাড়লে কিভাবে!
- আমি কি জানি!
- বসতে অসুবিধা হচ্ছে আমার।
মেঘ জানালার দিকে মুখ করে নাফিসাকে ঠিক করে তার পায়ের উপর বসালো।
- এবার সুবিধা হচ্ছে?
নাফিসা আর কিছু বললো না। সুবিধা তো হয়েছে ঠিকই কিন্তু কোলে বসায় অসস্তি লাগছে তবুও কিছু করার নেই, মেঘ উঠতে দিবে না। তাই সে চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ নাফিসার কাধে থুতনি রেখে বললো, - মন খারাপ?
- উহুম।
- আম্মির জন্য খারাপ লাগছে না?
নাফিসা ছলছল চোখে মেঘ পানে তাকালো! এতো সহজে বুঝে যায় কেন সবকিছু! - আমরা সিলেট ফিরবো তো আবার। শুধু শুধু মন খারাপ করছো কেন!
মেঘ নাফিসার খোপা খুলে দিলো। নাফিসাকে নিজের সাথে আরও চেপে ধরে চুলের ঘ্রাণ নিতে লাগলো।
- মেঘা, কি আছে এখানে? সর্বদা এ সুবাস মাতাল করে কেন আমায়? তৃপ্তি মেটে না কেন কবু? ইচ্ছে তো করে প্রতিমুহূর্তে এমন মাতাল সুবাসে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে!
নাফিসা একহাতে মেঘের শার্ট খামচে ধরে বললো, - মেঘ চুপ! সহ্য হয়না আমার এতো সুখ! হারানোর ভয় লেগে থাকে সর্বদা! প্লিজ, এতো সুখের সন্ধান আমায় দিও না! মরে যাবো আমি অতি সুখে!
- অভ্যাসে পরিণত করবো তোমায়। লুপে দিবো সুখের রাজ্য। শুধু সঙ্গী থেকো মোর, করো নাকো ত্যাজ্য!
নাফিসা তার দেহের সমস্ত ভাড় মেঘের উপর ছেড়ে দিয়ে মেঘের বুকে হেলে পড়লো। মেঘ একটু থমকে গিয়ে বললো, - মেঘা!
নাফিসার মুখে হাসি দেখে মেঘও হেসে তার মাথাটা বুকে রেখে তাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সিটে হেলান দিলো। নাফিসা চোখ বুজে মেঘের হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলো। প্রতিটি স্পন্দন যেন চিৎকার করে বলছে, “ভালোবাসি মেঘা!” আর তার সাথে তাল মিলিয়ে নাফিসার স্পন্দন সাড়া দিচ্ছে “ভালোবাসি মেঘ!”
প্রথমে অস্বস্তি বোধ করলেও এখন খুব ভালো লাগছে নাফিসার! মেঘ তাকে প্রতিটি মুহুর্তে লোভ দেখিয়ে যায়! যার ফলে মন সবসময় সেই মুহূর্ত গুলো ফিরে পেতে চায়। কতোক্ষন তাদের এভাবে কাটলো জানা নেই! একটু পর মেঘ বললো, - ঘুমিয়ে পড়েছো মেঘা?
- উহুম।
- উঠো একটু।
- পা ব্যাথা করছে না?
- উহুম।
নাফিসা উঠে দাড়ালো কিন্তু সিটে বসলো না। মেঘ খাবারের ব্যাগটা নিয়ে আবার আগের জায়গায় বসলো। নাফিসা তার দিকে তাকিয়েই দাড়িয়ে আছে। মেঘ মুচকি হেসে নাফিসাকে টেনে আবার কোলে বসালো। চিপসের প্যাকেট ছিড়ে নাফিসার হাতে দিলে নাফিসা বললো, - আমি খাবো না।
- চিপস আবার কেউ না খায়! আমার বাবা মা ও চিপস খায়!
- এখন খেতে ভালো লাগছে না।
- চানাচুর খাবে?
- কিছু না।
- ওকে খেতে হবে না। আমাকে খায়িয়ে দাও।
- ঢং!
- হুম।
নাফিসা মেঘের উপর হেলান দিয়ে মেঘের মুখে চিপস তুলে দিচ্ছে। দু তিনটা দিতেই নিজেও খাওয়া শুরু করলো। দুজনেই টুকটাক গল্প করছে আর চিপস খাচ্ছে। এক পর্যায়ে প্যাকেট খালি হয়ে গেলে নাফিসা ইচ্ছাকৃত খালি প্যাকেট মেঘের মুখে দিলো আর মেঘ সেটাই কামড়ে ধরলো। মেঘকে বোকা বানাতে পেরে নাফিসা হিহি করে হেসে উঠলো! মেঘ প্যাকেট ফেলে তার কানে কামড় দিয়ে বললো, - তুমিই যদি এতো দুষ্ট হও, ভবিষ্যতে আমাদের বাচ্চারা কতো দুষ্টু হবে, মেঘা! ভাবতে পারছো!
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না! তার লজ্জা লাগছে। মেঘ একবার যে প্রসঙ্গে প্রবেশ করে সহজে বের হয়না! তার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো!
মেঘের সাথে ট্রেনে সময় কাটাতে ভালো লাগলেও ঢাকার মাটিতে পা রাখতেই নাফিসা ভীতি অনুভব করছে! খুবই অসস্তিকর লাগছে! এই শহরের সাথে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে, কিছুই ভুলতে পারেনি আজও! এতোবছর পর আজ আবার এখানে পা ফেলেছে শুধুমাত্র মেঘের জন্য !
পর্ব – ৩৪
মেঘ নাফিসাকে নিয়ে রিকশায় উঠালো। রাস্তা যত অতিক্রম করছে মনের ধুকপুকানি ততই বাড়ছে! নতুন পরিবেশে যাচ্ছে সে! শশুর বাড়ির লোকজন কেমন হয় সেটা ভাবতেও পারছে না! কিভাবে তাকে গ্রহণ করবে সেটাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে! মেঘের উপর ভরসা থাকলেও সে মনকে শান্ত করতে পারছে না। মাঝপথে আসতেই মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। মেঘ বুঝতে পারছে নাফিসা নার্ভাস ফিল করছে, সাধ্যমতো চেষ্টা করছে নাফিসাকে স্বাভাবিক করার! মেঘ তাকে নিয়ে একটা বাড়ির সামনে নামলো। দোতলা বাড়িটা লাইটিং করা! সন্ধ্যা হতেই লাইট জ্বালিয়ে ফেলেছে! মেঘ ভাড়া দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বললো,
- বাহ! তাড়া কতো, এর মাঝে লাইটিংও শেষ করে ফেলেছে! চলো।
- এটা কাদের বাড়ি?
- তোমার শশুরের বাড়ি।
- লাইটিং কেন?
- তোমার শশুরের আফসোস, ছেলের বিয়ের আয়োজন করতে পারলো না। তাই, বৌভাতের আয়োজন করেছে পরশু দিন। আর এজন্যই তোমাকে নিয়ে আসা।
- কিহ! এমন বিয়েতে বৌভাত! আমি তো আগে জানলে আসতামই না!
- এজন্যই তো তোমাকে আগে জানাইনি! কি হলো, দাড়িয়ে রইলে কেন?
- যাবো না আমি।
- হাতে ব্যাগ তো, কোলে নেই কিভাবে!
- আশ্চর্য! আমি বলেছি নাকি কোলে নিতে! বৌভাত প্রোগ্রাম হলে আমি বাসায় যাবো না।
- যেতে হবেই! বাবা মা মেনে নিয়েছে এটাই বেশি। বাবার একটা শখ হয়েছে এতে অন্তত আপত্তি করো না। বৃষ্টি!
মেঘ এখানে থেকেই জোরে বৃষ্টিকে ডাকলো। সাথে সাথে বৃষ্টি দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে এলো।
- ভাবিইইইই! এতো দেড়ি হলো কেন তোমাদের! আমি সেই কখন থেকে বসে আছি! কেমন আছো তুমি?
- আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কেমন আছো?
- আমিও আলহামদুলিল্লাহ। চলো চলো।
মেঘ বলে উঠলো,
- এই দাড়া! ব্যাগ নিয়ে যা, তোর ভাবি যেতে পারবে না, পায়ে ব্যাথা!
- এই মিথ্যে কথা, আমার পায়ে ব্যাথা নেই!
বৃষ্টি হিহি করে হেসে বললো, - ভাইয়া, পায়ে ব্যাথা হলেও হেটে যেতে হবে। বাবা বাসায়!
- ওফ্ফ! বাবা আজ এসময় বাসায়!
- বাড়িতে বউ আসবে দেখবে না! ভাবি চলো।
- এই দাড়া!
মেঘ নাফিসার মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললো,
- এবার নিয়ে যা।
বৃষ্টি হেসে নাফিসাকে সাথে নিয়ে যাচ্ছে আর মেঘ তাদের পিছু পিছু যাচ্ছে ব্যাগ নিয়ে।
দরজার সামনে এসে বৃষ্টি চেচিয়ে বললো, - আম্মাজান, বরন ঢালা নিয়ে আসবে নাকি নতুন বউ এমনিতেই প্রবেশ করবে?
নাফিসার ভেতরে ধুকপুকানি বেরেই যাচ্ছে! বারবার ঘুরে ঘুরে মেঘের দিকে তাকাচ্ছে! মেঘের মা গম্ভীর মুখ নিয়ে ছেলের বউকে বরন করে ঘরে তুললো। মেঘ ও নাফিসা দুজনেই বাবা মাকে সালাম করলো। বাবা কিছু সম্মানী দিলো নাফিসার হাতে। বাবার মুখে তো হাসি লেগে আছে কিন্তু মায়ের মুখ এমন গম্ভীর কেন! মেঘ বুঝতে পারছে না সেটা! বৃষ্টিও লক্ষ্য করেছে বিষয়টা! মেঘ বৃষ্টিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, বৃষ্টিও ইশারায় উত্তর দিয়ে দিলো সে জানে না। বাবা রুমে যাওয়ার সম্মতি দিলে বৃষ্টি নাফিসাকে নিয়ে মেঘের রুমে গেলো। মেঘও ব্যাগ নিয়ে রুমে গেলো। বৃষ্টি কথার খই ফুটিয়ে যাচ্ছে। মেঘ তাকে থামিয়ে বললো,
- বাসায় আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেছে তোর বকবকানি! ফ্রেশ হওয়ার সময় তো দিবি!
- সেটা তো দিবোই! তুমি এমন করছো কেন! বিয়ে করে বউ পেয়েছো বলে দাপট দেখাও! তুমি বউ পেলে আমিও কিন্তু ভাবি পেয়েছি! সুতরাং বৃষ্টি হতে সাবধানে থেকো বলে দিলাম! ভাবি তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
বৃষ্টি বেরিয়ে যেতেই মেঘ দরজা চাপিয়ে দিলো। শার্ট খুলে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, - মেঘা তোয়াল নিয়ে আসো, গোসল করবো।
মেঘ বাথরুমে ঢুকে পড়লো। নাফিসা বিড়বিড় করে বললো, - হুহ্! নিজের বাসায় ফিরে একেবারে শায়েন শাহ হয়ে গেছে!
ব্যাগ থেকে শার্ট প্যান্ট আর তোয়ালে নিয়ে বাথরুমের দরজার সামনে গিয়ে বললো, - ধরুন আপনার জামাকাপড়।
- ভেতরে এসো।
- না, আপনি নিন।
মেঘ দরজা খুলে জামাকাপড় না ধরে হাতে টান দিয়ে নাফিসাকে ভেতরে এনে দরজা লাগিয়ে দিলো। - এসব কি হচ্ছে!
- কিছুই হয়নি তবে এখন হবে!
মেঘ জামাকাপড় রেখে নাফিসাকে টেনে ঝর্ণার নিচে নিয়ে গেলো। নাফিসা বাধা দিতে বললো, - মেঘ না!
- ওকে, আমাদের মেয়ের নাম রাখবো মেঘনা!
নাফিসার কথাকে প্যাচাতে পেরে মেঘ হাহা করে হেসে উঠলো! নাফিসার বাধা আর মানলো না, সে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে নিজের সাথে নাফিসাকেও ভিজিয়ে দিলো!
- এটা কি হলো! আমি এখন গোসল করতাম না!
- কিন্তু আমি করাতাম!
- সকালে গোসল করে এসেছি!
- আমিও তো করেছি! সারাদিন জার্নি করে শরীরে ধুলাবালি লেগে আছে না! গোসল করলে ফ্রেশ লাগবে!
- জামাকাপড়ও নিয়ে আসিনি!
- সমস্যা কি! আমার টা পড়ে বের হবে। তুমি দেখছি গোসল করতে এসেও শান্তি দিবে না! আসতে না আসতেই বৃষ্টির বাতাস পেয়ে গেছো! আর একটা কথাও না, এখন আমাদের মাঝে প্রেমালাপ হবে আর গোসল হবে। এর বাইরে কিছুই না!
গোসল শেষে নাফিসা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। এমনিতেই ঠান্ডার দিন, এর মাঝে আবার রাতে ঠান্ডা পানিতে এতোক্ষণ গোসল! শরীর কাপছে তার! মেঘ চেঞ্জ করে বেরিয়ে নাফিসার জামাকাপড় ব্যাগ থেকে বের করে দিয়ে এলো।
রাতে খাওয়ার সময় রায়হান চৌধুরী একটু আধটু কথা বলে নাফিসা সম্পর্কে জানলো। বাবার কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো নেই। নেই বলতে বুঝে গেছেন দুনিয়াতে নেই। কিন্তু মোহিনী কিছুই বললো না। মেঘ বৃষ্টি কিছুই বুঝতে পারছে না! খাওয়া শেষ হতেই মোহিনী বললো,
- নাফিসা, কিচেনে ঘুরে এসো।
কেন এ কথা বললো, কেউই বুঝলো না! নাফিসা কথামতো কিচেনে ঘুরেফিরে সবটা দেখে নিলো। তারপর বেরিয়ে আসতেই মোহিনী আবার বললো,
- দেখেছো ঠিকমতো?
- জ্বি মা।
- এবার টেবিল থেকে সবকিছু নিয়ে যাও। ঠিকঠাক ভাবে রেখে এসো।
বৃষ্টি বললো, - মা, ঘরে আসতে না আসতেই ভাবিকে কাজ করতে বলছো! ভাবি তোমার করতে হবে না, আমি করে দিচ্ছি।
মোহিনী চোখ রাঙিয়ে বৃষ্টিকে বললো, - তোকে বলেছি আমি! বাড়ির বউ কাজে হাত লাগাবে। বাড়িতে আজ এসেছে তো কি হয়েছে! বিয়ে তো আর আজ হয়নি! যাও, রেখে এসো।
- মা
মেঘ অবাক হয়ে কিছু বলতে নিলে মোহিনী থামিয়ে দিলো। - একটা কথাও বলবি না কেউ! খুব কথা বলতে শিখে গেছিস মা বাবার উপর!
মেঘ আর কিছু বললো না। মুখটা মলিন করে বসে রইলো। বৃষ্টিও হতম্বর হয়ে তাকিয়ে আছে। আর এদিকে মোহিনী বলার সাথে সাথেই নাফিসা চুপচাপ প্লেট উঠাতে লাগলো। খাবার যা ছিলো সব ঠিকঠাক মতো রেখে বাকি থালাবাটি সব ধুয়ে গুছিয়ে রাখলো। মোহিনী দরজার সামনে দাড়িয়ে সবই দেখছে। নাফিসা কাজ শেষ হলে দরজার কাছে মোহিনীকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
- মা এখন কি করবো?
- মেঘের বাবা একটু পর চা খাবে, পানি বসাও।
“মেঘের বাবা” বলাতে নাফিসার একটু খারাপ লাগলো। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। পাতিলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো কোনটা চায়ের পাত্র! সঠিক পাত্রটা নিয়েই পানি বসালো চুলায়। মোহিনীকে জিজ্ঞেস করে চিনির পরিমাণ জেনে নিলো। বাকিটা নিজের ইচ্ছেমতোই করলো। সাথে এলাচি দিয়েছে। মোহিনীকে ও রায়হান চৌধুরীকে চা দিলো। মোহিনী কিছু বললো না কিন্তু রায়হান চৌধুরী অনেক প্রশংসা করলেন। নাফিসা কিচেনে এসে চায়ের পাতিলও ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখলো। আবার ড্রয়িং রুমে আসতেই বৃষ্টি বললো,
- মা, তোমার কাজ শেষ হলে বলো ভাবিকে নিয়ে যাই।
- কোথায় নিয়ে যাবি?
- গল্প করবো।
- কোনো গল্প হবে না। ঘুমা গিয়ে।
নাফিসাকে উদ্দেশ্য করে বললো, - বাড়ির বউদের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হয়। এটা কি জানা আছে তোমার?
মেঘ সোফায় বসে ছিলো। মায়ের এমন সব কথাবার্তা শুনে সেখান থেকে উঠে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেলো। বৃষ্টিও তার রুমের দিকে ছুটলো। নাফিসা এখানে দাড়িয়েই মেঘের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। মোহিনী তাকে যেতে বললে সে ধীর পায়ে রুমে চলে গেলো। মেঘ জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে।
রাতের বেলা জানালার গ্লাস খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেঘ। নাফিসা দরজা চাপিয়ে পাশে এসে দাড়িয়ে বললো, - কি দেখছো আকাশে?
মেঘ নাফিসাকে টেনে তার সামনে দাড় করিয়ে বললো, - তাকাও বাইরে। এবার বলো কি দেখছো?
নাফিসা বাইরে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে বললো,
” দেখেছি নিশী, আর করেছি অনুভব তোমায় সেই নিশীথে!
ছড়িয়েছে কিরন, আর ভূবণ হয়েছে উজ্জ্বল সেই চন্দ্রপ্রদীপে!”
নাফিসার কথা শেষ হতেই মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নাফিসার সাথে আরও আবেশে মিশে বললো,
- মায়ের আচরণে রাগ করেছো?
- উহুম।
- মেঘা, মা মোটেও এমন না। কিন্তু হঠাৎ এমন আচরণ করছে কেন কিছুই বুঝতে পারছি না!
- মায়ের কাজে বাধা দেওয়া তোমার উচিত হয়নি! মা বলতেই পারে। ঘরের কাজ তো মেয়েরাই করে!
- আমি কাজ করতে নিষেধ করিনি। মায়ের কথা একটু অন্যরকম লাগছে তাই কিছু বলতে চেয়েছিলাম।
- মা কিন্তু ভুল বলেনি। মা বাবার উপর কথা না বলাই শ্রেয়। আমরা অনেক কিছু জানলেও মা বাবার চেয়ে বেশি জানি না। আমার মাথায় বিলি কেটে দিবে একটু?
- মাথা ব্যাথা করছে?
- একটু।
- কারণ কি?
- সারাদিন জার্নি করেছি আবার রাতে গোসল!
- খাটে যাও, আমি আসছি।
- কোথায় যাচ্ছো?
- বাসায়ই আছি।
মেঘ বেরিয়ে গেলো, কিন্তু নাফিসা সেই চন্দ্রপ্রদীপের দিকেই তাকিয়ে আছে! যার নিজের কোনো আলো নেই, সেও পৃথিবীকে আলোকিত করে রেখেছে! অন্ধকারেও সে পথিককে পথের সন্ধান দেয়! জ্যোছনা মাখিয়ে শীতল করে রাখে ত্রিভুবন! কার না ভালো লাগে জ্যোছনা? কে না ভালোবাসে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো! কে না চায় শশীর রুপালী আলোতে নিজের রূপের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে! সবই মহান আল্লাহ তায়ালার চমকপ্রদ! সবকিছুতেই সম্পূর্ণ ভিন্ন মাধুর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এই জগৎ।
পর্ব – ৩৫
মেঘ রুমে এসে নাফিসাকে জানালার পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,
- এখনো এখানে দাড়িয়ে আছো। ঠান্ডা লাগছে না?
- ভালো লাগছে।
মেঘ দরজা লাগিয়ে এসে জানালার গ্লাস লাগিয়ে পর্দা টেনে দিলো। নাফিসার হাত ধরে খাটের দিকে যেতে যেতে বললো, - সারাদিন জার্নি করেছো, এখন বিশ্রামের প্রয়োজন।
মেঘ কম্বল নামিয়ে আনলো আলমারি থেকে। এতো ঠান্ডা না হলেও পাশে রাখবে। রাত গভীর হলে ঠান্ডা কতটা বাড়বে বলা যায় না। শীতকাল আসেনি তবুও মাঝে মাঝে বৃষ্টি নেমে আবহাওয়া একেবারে শীতল করে যায়। কখনো ঠান্ডা কখনো গরম! আবার গরমও না ঠান্ডাও না! যাকে বলা হয় নাতিশীতোষ্ণ!
মেঘ বৃষ্টির কাছে থেকে মাথা ব্যাথার মলম নিয়ে এসেছে। নাফিসার মাথায় মালিশ করে যাচ্ছে। নাফিসা মেঘের মুখেই তাকিয়ে আছে।
স্বামী বলেই কি এতো যত্ন নিচ্ছে তার? সব নারী কি এমন স্বামী পায়? এমন একজন মানুষকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিলো ভাবতেই নাফিসার ভেতরটা কেপে উঠে! সবসময় কি সে এই মানুষটাকে কাছে পাবে এভাবে!
পলকহীন তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ বললো,
- কি দেখো গো এমন করে?
- আমার জনাবকে দেখি।
অজান্তেই নাফিসার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে কথাটা! সাথে সাথেই মেঘের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠেছে দুষ্টুমি হাসি! নাফিসা লজ্জা পেয়ে চোখ বন্ধ করে মেঘের মাঝেই লুকিয়ে গেলো। মেঘ শরীর কাপিয়ে নিশব্দে হেসে কম্বলটা টেনে দুজনের দেহ সম্পূর্ণ ঢেকে শুয়ে পড়লো।
খুব সকালেই ঘুম ভেঙে গেছে আযানের শব্দে। নাফিসা বুঝতে পেরেছে মসজিদ কাছেই হবে। তাইতো এতো বেশি ধ্বনি ভেসে আসছে। রাতে লাইট অফ করেনি মেঘ। মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখলো খুব গভীর ঘুমে আছে মেঘ। মনে হচ্ছে আজ কতোদিন পর ঘুমাচ্ছে সে। হবেই না কেন! এতোদিন যে বিয়ের কথা জানানোর জন্য মেঘের মাথায় খুব বড় টেনশন চেপে ছিলো সেটা নাফিসার অজানা নয়! অবশেষে আজ নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে, সেটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
নাফিসার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মেঘকে কি নামাজ পড়ার জন্য ডাকবে? থাক, আরেকটু ঘুমাক। নামাজ পড়ে না হয় ডেকে দিবে। আস্তে আস্তে মেঘের হাত সরিয়ে সে উঠে পড়লো। ওযু করে এসে ব্যাগ থেকে ওড়না বের করে মেঝেতে বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নিলো। মোনাজাত শেষ করে উঠতে যাবে তখনই দেখলো মেঘ তার দিকে তাকিয়ে আছে। নাফিসা ওড়না ভাজ করতে করতে বললো,
- এই মাত্র দেখলাম গভীর ঘুমে, এতো তারাতাড়ি ঘুম ভেঙে গেলো!
- তুমি পাশে থাকলে আরও ঘুমাতে পারতাম। উঠে গেছো বলেই ঘুম ভেঙে গেছে আমার। ওয়ারড্রোবে জায়নামাজ ছিলো। একা একা নামাজ পড়লে, আমাকে ডাকলে না কেন?
- ঘুমটা খুব প্রিয় মনে হয়েছিলো। তাই ভাঙতে ইচ্ছে করেনি। এখন ডেকে দিতাম। নামাজ পড়বে না?
- হুম।
মেঘ উঠে পড়লো বিছানা ছেড়ে। নাফিসা ওড়না ভাজ করে ব্যাগে রাখতে গেলে মেঘ তার কাছে এসে কপালে ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে সকালটা মিষ্টি করে বললো,
- কাপড়চোপড় আলমারিতে তুলে ব্যাগ খালি করো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে দেখো চাবি রাখা আছে। নিজ দায়িত্বে সবকিছু খুটিয়ে দেখো। রুম এখন আমার একার নয়, এটা তোমারও। এটা কিভাবে সজ্জিত করবে সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছে। সজ্জিত হলেও তোমার, বিশৃঙ্খল অবস্থা হলেও তোমারই।
নাফিসাকে ছেড়ে দিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, - মেঘা, আমার একটা বদ অভ্যাস আছে। আমি মাঝে মাঝে তাড়াহুড়ো করে কিছু খুজলে সব এলোমেলো করে ফেলি। এতোদিন তো মা, না হয় বৃষ্টি গুছাতো। এখন সেটা তোমার দায়, মিষ্টি করে বকা দিতে ভুলো না!
নাফিসা মুচকি হেসে ব্যাগ থেকে কাপড়চোপড় নামিয়ে মেঘের কথামতো আলমারিতে তুলে রাখলো। মেঘ নামাজ পড়ছে আর নাফিসা বিছানাপত্র গুছিয়ে রুম থেকে বের হলো। নামাজ পড়ার জন্য ওড়না মাথায় পেচিয়েছে এখনো সেভাবেই আছে। রুম থেকে বেরিয়ে এখন বাড়িতে চোখ বুলালো। চার কোনে চারটা রুম, দুই রুমের মাঝামাঝিতে একদিকে একটা কিচেন অন্যদিকে একটা বাথরুম। মাঝখানটা ফাকা, এখানে ডাইনিং টেবিল বসানো। নিজেদের রুম আর ড্রয়িং রুম চিনেছে কিন্তু বাকি দুটোর মধ্যে কোনটা বৃষ্টির আর কোনটা মা বাবার জানা নেই। নাফিসা কিচেনের এক কোন থেকে ঝাড়ু নিয়ে এলো। তাদের রুম ঝাড়ু দিয়ে ড্রয়িং রুমও ঝাড়ু দিলো। মোহিনী রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো নাফিসা ডাইনিং টেবিলের সামনের ফাকা জায়গা ঝাড়ু দিচ্ছে। মোহিনীকে বের হতে দেখে নাফিসাই বললো,
- মা, রুম ঝাড়ু দিবো?
- দাও।
- বাবা কি রুমে আছে?
- না, মসজিদে গেছে। বৃষ্টি উঠেছে?
- দেখিনি আমি।
- মেঘ নামাজ পড়তে গেছে?
- ঘরে পড়েছে।
- এই মেয়েটা একটা দিনও ঠিকমতো নামাজ পড়ে না!
মোহিনী বিড়বিড় করে বৃষ্টিকে বকা দিতে দিতে বৃষ্টির রুমে গেলো ডেকে তোলার জন্য। নাফিসা একে একে সব রুম ঝাড়ু দিলো।
তারপর কিচেনে এলো মোহিনীর কাছে। মোহিনী তাকে তরকারি কেটে দিতে বললো। নাফিসা কেটে দিচ্ছে। মেঘ এসে একবার ঘুরে গিয়েছিলো কিন্তু কিছু বলেনি। পরক্ষণেই বৃষ্টি এসেছে। কিছু না বলে ডাইনিং টেবিলে এসে বিস্কুট খাচ্ছে। তার কাছে মায়ের কর্মকাণ্ড একদমই ভালো লাগছে না। নতুন বউ বাড়িতে এসেছে, দু তিনদিন পর থেকে কাজ দিলে কি হতো!
মোহিনী নাফিসাকে সবজি রান্না করতে বললে নাফিসা সেটা পরিপূর্ণ করলো। এখন আবার রুটি বেলতে দিলো। নাফিসা এতো সুন্দরভাবে রুটি বেলেছে যেটা মোহিনীর মতো পাক্কা গৃহিণীকেও হার মানাতে বাধ্য! মোহিনী জোর গলায় বৃষ্টিকে ডাকলো। বৃষ্টি কিচেনে আসতেই মোহিনী নাফিসাকে এক ধমক দিলো! নাফিসা কেপে উঠেনি, কিন্তু বৃষ্টি কেপে উঠেছে!
- এই মেয়ে! সব কাজে এতো দক্ষতা নিয়ে কেউ শ্বশুর বাড়ি আসে! আমাকে কিছু শিখাতে দিবি না নাকি! কোথায় ভেবেছি ছেলের বউকে নিজ হাতে সব শিখিয়ে দিবো, সেখানে কিছুই শিখাতে পারলাম না!
নাফিসা রুটি বেলতে বেলতে মুচকি হেসে জবাব দিলো,
- শিখেছি তো, কিভাবে ছেলের বউকে পরীক্ষা করা যায়!
- মেঘ এ কোন পাগলীকে বউ করে নিয়ে এসেছে! তাইতো বলি, এমনি এমনি কি আমার ছেলে পাগল হয়েছে!
মোহিনী মুচকি হেসে নিজের হাতের স্বর্নের বালা দুটো খুলে নাফিসার হাতে পড়িয়ে দিলো। নাফিসার মাথাটা কাছে টেনে কপালে একটা চুমু দিলো। নাফিসা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে মোহিনীর দিকে! মোহিনী মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, - এই দেখ মেয়ের কান্ড! এতোক্ষণ বকা দিয়েছি আর সে হেসেছে, আর এখন আদর করেছি এখন কাদছে! চোখে পানি কেন, হুম? বালা জোড়া খুলবি না কখনো, আমার আদেশ! এবার বল, ছেলের বউ হয়ে থাকবি নাকি মেয়ে হয়ে থাকবি আমার কাছে?
নাফিসা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়েও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। মোহিনী পেয়ে গেছে তার উত্তর। হাত বাড়িয়ে দিতেই নাফিসা মোহিনীকে জড়িয়ে ধরে নিরবে কান্না করতে লাগলো! মোহিনীকে পুরোই তার আম্মির মতো মনে হয়। বয়সে আম্মি একটু ছোট হলেও বেশে অনেকটা একইরকম। কারণ মোহিনীও প্রকৃত বাঙালি মেয়েদের মতো শাড়ি পড়ে।
এদিকে বৃষ্টি তো নির্বাক হয়ে গেছে শ্বাশুড়ি আর বউয়ের কান্ড দেখে! মোহিনী সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললো,
- ভয় পাসনি কেন, আমি যে ধমকে উঠলাম!
- সতর্ক বার্তা আগে থেকে জানা থাকলে দুর্যোগকে কেউ তেমন ভয় পায়না!
- কিভাবে জানলি?
নাফিসা আবার রুটি বেলতে বেলতে বললো, - আমাকে আগেই জানানো হয়েছে এ পরিবারের সদস্য সম্পর্কে। সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে আমি সবটা মিলিয়ে নিয়ে ৯০ ভাগ নিশ্চিত হয়েছি আমার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।
- বাহ! এতো কাজ কে শিখিয়েছে শুনি?
- সবই আম্মির কাছে শেখা।
- বৃষ্টি, শুধু খেতে জানো! শ্বশুর বাড়ি পাঠালে দিনে একশো একটা খোটা আসবে আমি মেয়েকে শুধু খেতে শিখিয়েছি! আর কিছুই শিখাতে পারিনি!
বৃষ্টি জবাব দিলো, - এমন করে বলছো মনে হচ্ছে আমি কিছুই পারি না!
- কি পারো শুনি! ঘর ঝাড়ু দিলে অর্ধেক ময়লা থেকেই যায়! রুটি বানাতে দিলে এক মাথা পশ্চিমবঙ্গে আরেক মাথা উত্তরবঙ্গে চলে যায়! রুটি তায়ে দিলে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়!
- এভাবে ইনসাল্ট করছো ভাবির সামনে! আর জীবনে কোনো কাজের কথা বলে দেখো! হুহ!
বৃষ্টি হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছে। মোহিনী বললো, - এমন জেদ করে করেই তো কোনো কাজ শিখতে পারলি না আজ পর্যন্ত!
- শিখতে হবে না, তোমাদের মেয়ের জামাই ই সব রান্না করে খাওয়াবে দেখো!
- হ্যাঁ, তোর জন্য রেস্টুরেন্টের কুকারই ঠিক করবো।
মা মেয়ের কথা শুনে নাফিসার মুখে হাসি লেগে আছে। মোহিনী রুটি ছেকার জন্য তা বসাতেই বললো, - মা, আমার রুটি বানানো শেষ। দিন, আমি ছেকে দিচ্ছি।
- আমি মেয়ে বানাতে চাইলাম আর মেয়ে আমাকে পর করে দিচ্ছে!
- সময় লাগবে অভ্যাসে পরিবর্তন করতে।
- আচ্ছা দিলাম সময়। কাল থেকে এসেই অনেক কাজ করেছিস, এবার হাতমুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নে। বিস্কুট, কেক আছে বক্সে। এইটুকু কাজ আমি একাই করতে পারি, শুধু মাত্র ধৈর্যের পরিক্ষা নিলাম। এইটুকুতেই আমি খুশি। আর সেদিকে মহারাজ গাল ফুলিয়ে বসে আছে!
- মা, ঘরের কাজ করে আমি অভ্যস্ত। না করলেও ভালো লাগে না। আর মেয়েদের কাজ তো এতোটুকুই।
- হয়েছে, আমি যতদিন আছি তোর এতো চাপ নিতে হবে না। সংসার পরে সামলে নিবি, এখন নিজের ক্যারিয়ার গঠন কর। এইটুকু বয়সে সংসারে মনযোগী হলে বাকি সব তুচ্ছ মনে হবে। কাল প্রোগ্রাম। আজ মেহমান আসবে। একটু হাসিখুশি থাকবি সবসময়। আম্মির সাথে কথা হয়েছে?
নাফিসা মাথা নেড়ে “না” জবাব দিলো। - আমি কিন্তু বলেছি কাল রাতে। যা কথা বলে আয়, কান্নাকাটি করবি না একদম!
নাফিসা মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে রুমের দিকে গেলো। মেঘকে পায়নি কিন্তু মেঘের ফোন পেয়েছে। আম্মির নম্বরে ডায়াল করে কিছুক্ষণ কথা বলে নিলো। কান্নাকাটিও করেছে মা মেয়ে উভয়ই।
সকালে নাস্তা করার সময় মোহিনী সবাইকে বললো একসাথে বসতে। নাফিসা নিজেই চাইলো খাবার বেড়ে দিতে। মেঘের প্লেটে খাবার তুলে দেওয়ার সময় নাফিসার হাতে মায়ের বালা দেখে অবাক হলো! তাছাড়া মায়ের মুখটাও হাসিমাখা! বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে মেঘের! সে একবার নাফিসার মুখের দিকে তাকাচ্ছে, একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আবার নাফিসার হাতের দিকে তাকাচ্ছে। নাফিসা হয়তো বুঝতে পেরেছে তার দৃষ্টি ভঙ্গি তাই মৃদু হেসে নিজে চেয়ার টেনে বসলো। মোহিনী বললো,
- শপিং করতে যাবি কখন?
মেঘ প্লেটের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো, - তুমি যখন বলো।
- বাহ! একেবারে বাধ্য হয়ে গেছে! এতোদিন কোথায় ছিলো সেই বাধ্যতা!
- এতোদিন তো এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি তাই বুঝিনি বাধ্যবাধকতা কি জিনিস! চিন্তা করো না, এখন থেকে ফলো করবো।
- এই যে শোনো, তোমার ছেলেকে বলে দাও আগের জায়গায় ফিরে যেতে! না হলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম! এটাও জানিয়ে দাও, নাফিসাকে পরীক্ষা করার জন্যই কালকের আচরণটা ছিলো। বাড়ির একমাত্র বউ, না চিনেই সাদরে গ্রহণ করবো!
মেঘ প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললো, - বাবা, আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া মানে কি! বিয়ে করে ফেলেছি এখন সেটা কি কভু সম্ভব!
মোহিনী রেগে তরকারির চামচ হাতে তুলে নিলো মেঘকে মারার জন্য! মেঘ তার আগেই প্লেট নিয়ে পালিয়েছে! রায়হান চৌধুরী ও বৃষ্টি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে আর নাফিসা অবাক হয়ে এ পরিবারের সদস্যদের কান্ড দেখছে! মেঘকে তাড়া করতে পেরে মোহিনী নিজেই মৃদু হেসে আবার খেতে বসে পড়লো।
মেঘ ড্রয়িং রুমে বসে খাওয়া শেষ করে এসেছে। কিচেনে গিয়ে নিজের প্লেট নিজেই ধুয়ে রেখে এলো। রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
- মেঘ বৃষ্টির পিতামাতাকে সকাল দশটায় বসুন্ধরা কমপ্লেক্সে শপিংয়ের জন্য নিমন্ত্রণ করা হলো!
বৃষ্টি হেসে উঠলো, আর মোহিনী উঁচু গলায় জবাব দিলো, - আমি যাবোনা কোথাও! মেহমান আসবে তাদের আপ্যায়ন করবে কে? তোর বাপের এতো তাড়া এবার তোর বাপকে নিয়ে যা!
রায়হান চৌধুরী বললো, - বুঝলি! সবই তোর বাপের ঠেলা! ছেলেমেয়ে একা একা দেশ ঘুরে বেড়াতে পারে তাহলে শপিং নিয়ে এতো টেনশন কিসের!
বাবার প্রতুত্তরে বৃষ্টি বললো, - বাবা তোমাকে টেনশন করতে কে বললো! নিমন্ত্রণ করেছে, ইচ্ছে হলে যাবে আর না হয় ইগনোর করবে! কাজ দেখবে ঠিকই হয়ে গেছে!
পর্ব – ৩৬
কিছুক্ষণ পরেই মেঘ বৃষ্টি ও নাফিসাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো শপিংয়ের উদ্দেশ্যে। সারাদিন ঘুরেফিরে বিকেলে বাসায় ফিরে এসেছে।
মেঘের কাজিনরা এসেছে। সবাই মেতে আছে বিয়ে বাড়িতে! নাফিসা তো এমনিতেই কম কথা বলে এর উপর এখানে কাউকেই চিনে না! বৃষ্টির সাথে প্রয়োজনে দু একটা কথা বলে শুধু। মোহিনী নাফিসাকে নিজের রুমেই বসে থাকতে বললো। মেঘ ফ্রেশ হয়ে ছাদে গেছে ফুলগাছ গুলো দেখতে। তার অনুপস্থিতিতে বৃষ্টি ভালোই যত্ন নিয়েছে। একটা সাদা গোলাপ হাতে নিয়ে আবার নিচে এলো। রুমে এসে দেখলো তার কাজিনরা সব নাফিসার পাশে বসে গল্প করছে আর নাফিসা চুপচাপ বসে আছে। মেঘের হাতে ফুল দেখে কাজিনরা বললো,
- ওয়াও! তোমার গাছের ফুল!
এদিকে একজন বলে, “ভাইয়া আমাকে দাও!” তো ওদিকে আরেকজন বলে “ভাইয়া আমাকে দাও!”
- সর, বউ থাকতে তোদের দিবো কেন! তোদের হাতে ফুল মানায় না। ফুল তো মানায় রমনীর খোপায়!
মেঘ তাদের টপকিয়ে নাফিসার কাছে এসে মাথা থেকে ওড়না ফেলে খোপায় পড়িয়ে দিলো। সবাই অদ্ভুত শব্দ করে তাদের প্রেমে অভ্যর্থনা জানালো! অন্য একজন বললো, - হাউ রোমান্টিক! আই উইশ মেঘ ভাইয়ার মতো প্রিন্স আসবে আমার লাইফে!
বৃষ্টি ধমক দিয়ে বললো, - চুপ থাক! আমার ভাই ভাবির উপর নজর দেওয়া শুরু করেছিস! মেট্রিক পাশ করেনি, এখনি লাইফের প্রিন্স খোজা শুরু করেছে! দাড়া চাচির কাছে বলে নেই!
- ছি আপু! তুমি এতো বেশি রিয়েক্ট করছো কেন!
মেঘ বেরিয়ে গেছে, তারা এদিকে হাসি ঠাট্টা করছে! মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে মেঘ নাফিসাকে একা পেয়েছে রুমে। মাথায় ওড়না পেচিয়ে রেখেছে নাফিসা। হয়তো নামাজ পড়েছে তাই রুমে একা। দরজা লক করে মেঘ পড়নের টিশার্ট চেঞ্জ করে অন্য একটা পড়লো। নাফিসা জানালার পাশে দাড়িয়ে ছিলো। মেঘ এসে তাকে স্পর্শ করে বললো, - মেঘা, কাল যদি আমাদের বৌভাত হয় তাহলে আজ কি?
- আজ আবার কি?
- এটাও জানো না দেখছি!
মেঘ কানে কানে ফিসফিস করে বললো, - কাল যদি হয় বৌভাত, আজ আমাদের বাসর রাত! এটাও মাথায় নেই তোমার!
নাফিসা বড় বড় চোখ করে তাকালো মেঘের দিকে! মেঘ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, - এভাবে দেখলেও লাভ নেই, ভিন্নভাবে দেখতে হবে! প্রস্তুত থেকো!
এদিকে দরজায় খটাখট শব্দ করে যাচ্ছে মেঘের ভাইবোনরা! মেঘ বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে বললো, - কি হয়েছে তোদের?
- তুমি এখানে কি করো! তোমার বন্ধুরা ডাকছে যাও! আমাদের কাজের লেট হয়ে যাচ্ছে! আর শুনো, আজকের জন্য ভাবিকে ছেড়ে দাও। ভাবি আমাদের সাথে থাকবে। ভাবির সাথে অনেক গল্প জমা আছে! সারারাত গল্প করবো।
- এক ঘন্টা সময় দিলাম।
- রাখো তোমার ঘন্টা সময়! একে তো না জানিয়ে বিয়ে করেছো সেটার উশুলই তুলিনি এখনো! আবার আসছে ঘন্টা নির্ধারণ কিরতে! আমরা চলে গেলে তারপর পাবে ভাবিকে!
- হুম ভাইয়া! আজ আমাদের সাথে থাকবে ভাবি!
বৃষ্টিও তাদের সাথে জোট বেধেছে! নাফিসা যে মনে মনে খুশি হয়েছে মেঘ সেটা বুঝতে পেরেছে! তাই নাফিসার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে বেরিয়ে গেলো সে।
ড্রয়িং রুমে নাফিসাকে সাথে নিয়ে তাদের মেহেদী অনুষ্ঠান শেষ করলো। মেয়েগুলো একেকজন সীমাহীন আনন্দ করেছে। আর বাকিরা কাজে ব্যস্ত! সন্ধ্যা শেষে রাত ঘনিয়ে এসেছে। অবশেষে মেঘ তার বোনদের ঘুষ দিয়ে নাফিসাকে রুমে এনেছে! নাফিসার মনের ভেতর ঢিপঢিপ করছে! সে যথাসম্ভব তারাতাড়ি এসে শুয়ে পড়লো খাটে! মেঘ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো নাফিসা চোখ বন্ধ করে আছে! মুচকি হাসি দিয়ে সে পাশে গেলো। নাফিসার হাতদুটো ধরে মেহেদী দেখলো, গাঢ় রঙে রাঙানো হাতে চুম্বন করলো। নাফিসার চোখের পাতায় কম্পন ধরে গেছে! মেঘ মাতাল সুরে বললো,
” অপূর্ব এই রাঙানো হাত,
আরও রাঙিয়ে দিবো!
মধুময় এই বাসর রাত,
আরও মাধুর্য করে তুলবো!
মেঘা, যাবে কি আমার সাথে
ছোট্ট প্রেমের তরীতে?
বাধবো ঘর তোমায় নিয়ে,
ভালোবাসা নামক দীপে!”
- একি, চোখে কেন অশ্রু?
নাফিসা আর চোখ বন্ধ রাখতে পারলো না। লুকিয়ে রাখতে চাইলেও বারবার মেঘের মুখোমুখি হতে সে বাধ্য! মেঘকে অবহেলা করার সাধ্য যেন তার মাঝে নেই! লোকটা বারবার তাকে শিহরিত করে তোলে! তাই সে চোখ খুলে তাকালো, মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। অত:পর শুধালো,
“যেথা নিয়ে যাবে তুমি,
সঙ্গী হবো আমি,
আর থাকবো তোমারই মতো!
হয়নাকো মন্দ,
ভালোবাসা নামক দীপে,
যদি রাজ্য ছেড়ে ওঠো!”
- জনাব, এ তো সুখের অশ্রু!
বৌভাতের প্রোগ্রাম হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে। সারাদিন সকলের আনন্দেই কাটলো কিন্তু পুতুলের মতো বসে থাকতে থাকতে নাফিসা বোরিং! দুপুরের পর থেকেই নাফিসাকে কেমন ভয়ার্ত দেখাচ্ছে! মেঘের চোখ এড়ায়নি সেটা! সে নাফিসার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
- কি হয়েছে, মেঘা? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?
- আমরা বাসায় যাবো কখন?
- প্রোগ্রাম শেষ হলেই বিকেলের দিকে।
- আমি এখন যাবো।
- এভাবে কথা বলছো কেন? খারাপ লাগছে তোমার? বলো আমাকে!
- কিছু হয়নি! মেহমানরা কি আমাদের বাসায় যাবে?
- মেহমানরা আমাদের বাসায় গিয়ে আর কি করবে! আম্মির কথা মনে পড়ছে?
নাফিসা মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। মেঘ বুঝতে পারছে হয়তো একা একা বসে থাকায় বোরিং লাগছে। সে বৃষ্টিকে ডেকে এখানে স্থিরভাবে বসিয়ে রাখলো। বৃষ্টি বসে বসে বকবক শুরু করলো সাথে তার বন্ধুবান্ধবও আছে। আকাশকে কল করে দাওয়াত করেছিলো, কিন্তু আকাশ আসেনি। আর আসবে না যে, সেটা আগেই বলে দিয়েছে। সিলেট থেকে ফেরার পর আকাশের সাথে ফোনে মাত্র তিনবার কথা হয়েছে তাও অল্প সময়ের জন্য! নিজে তো কল করেই না! বৃষ্টি কল করলেও রিসিভ করে না!
প্রোগ্রাম শেষ হতেই সন্ধ্যায় তারা বাসায় ফিরে এসেছে। নাফিসাকে রুমে রেখে বৃষ্টি নিজের রুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর মেঘ রুমে এসে দেখলো দরজা ভেতর থেকে লক করা! সে নাফিসাকে ডাকলো, নাফিসা এসে দরজা খুলে নিচের দিকে চোখ রেখেই সরে এলো। জানালার পাশে দাড়িয়েছে সে! মেঘ দরজা লাগিয়ে এসে নাফিসাকে তার দিকে ঘুরিয়ে দাড় করালো। মুখখানা ধরে বললো,
- তুমি কেদেছো?
- কোথায়?
- এখন তুমি রুমে বসে কেদেছো! সেন্টারে থাকতেও মনে মনে কেদেছো! কি হয়েছে তোমার? বলো আমাকে। লুকাবে না কিছু, বলো?
নাফিসা সাথে সাথেই মেঘকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেদে উঠলো! মেঘ ভেবে পাচ্ছে না তার কারণ! নাফিসা তো কখনো এভাবে কাদে না! - এই মেঘা, কি হয়েছে? কাদছো কেন?
- আমি আম্মির কাছে যাবো। থাকবো না এখানে। আম্মির কাছে যাবো আমি! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে আম্মিকে!
- এই পাগলী, চুপ করো! এভাবে কেউ কাদে! বাবা মা শুনলে কি ভাববে! চুপ, আর কিছুদিন এখানে থেকে আমরা সিলেট যাবো। দুদিন হলো এসেছি, এখনই যদি চলে যাই তাহলে বাবা মা নারাজ হবেন! একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও। দেখবে আর দুতিনদিন যেতেই ভালো লাগছে। আম্মির সাথে কথা বলবে?
- হুম।
- ওকে, আমি কল করছি। কাদবে না বলে দিচ্ছি। কাদলে কথা বলতে পারবে না! দেখি তাকাও আমার দিকে। বউ সেজে বসে আছে আবার কান্না করে! লোকে দেখলে কি বলবে! এতো বড় মেয়ে, দুদিন পর বাচ্চার মা হবে অথচ এখনো বাচ্চাদের মতো কাদে!
নাফিসা মেঘের কথা শুনে তার হাত থেকে রুমাল নিয়ে নিজেই চোখ মুছতে লাগলো! মনে মনে ফুসছে সে! এমন ভাবে বুঝ দিচ্ছে যেন সে এক বাচ্চা! আর কিছু হলেই বাচ্চার কথা তুলে বসে!
মেঘ তার মুখের ভঙ্গি দেখে হেসে উঠলো এবং বললো, - কি? মনে মনে আমাকে বকছো?
- এতো খারাপ কেন আপনি?
- কতো কেজি খারাপ যেনো?
নাফিসা ফিক করে হেসে উঠলো! মেঘ পকেট থেকে ফোন বের করে নাফিসার হাতে দিয়ে বললো, - এভাবে হেসেই আম্মির সাথে কথা বলবে এখন। না হলে দ্বিতীয়বার ফোন হাতে পাবে না বলে দিচ্ছি!
নাফিসা ফোন নিয়ে আম্মির সাথে কথা বললো। এই সময়টুকু মেঘ রুমেই ছিলো। বৃষ্টি এসে ডাকলে মেঘ বলে দিলো সে আম্মির সাথে কথা বলছে। নাফিসা কথা বলা শেষ করে মেঘের সাথে রুম থেকে বের হলো। নাফিসা চেঞ্জ করতে চেয়েছিলো মেঘ নিষেধ করলো। মোহিনী দেখে এগিয়ে এসে বললো, - কি হয়েছে আমার মেয়েটার? মুখটা এমন মলিন কেন? আম্মির সাথে কথা হয়েছে?
নাফিসা মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। মোহিনী আবার বললো,
- খুব ঝগড়া করবো আমি তোর আম্মির সাথে! মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, শ্বশুর বাড়ি কি একটু ঘুরে দেখে যাবে না! দেখা হোক একবার, কঠিন ঝগড়া করবো!
এদিকে বৃষ্টি এসে বললো, - মা, তোমার ঝগড়া আন্টির সাথে। সেটা সময় হলে করো। আমি এখন ভাবিকে নিয়ে যাই! ভাবি চলো!
নাফিসা বৃষ্টি ও তার কাজিনদের সঙ্গে একটু গল্প করলো। কাজিনরা যারা ছিলো একটু পরই চলে গেলো সবাই। রাতে খাবার খাওয়ার সময় মোহিনী নাফিসার পাশে বসে মাছের কাটা বেছে দিতে দিতে বললো, - যাক, একটা দোষ পেলাম খোটা দেওয়ার মতো! মাছের কাটা বেছে দিয়ে আদর করবো তোকে!
মেঘ মিটিমিটি হেসে প্লেটের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে। নাফিসা মেঘের দিকে তাকালো করুন দৃষ্টিতে! মেঘই মা কে জানিয়েছে সে নিশ্চিত! কোনো কিছু গোপন রাখবে না! জঘন্য লোক একটা! বৃষ্টি বললো, - মা, দেখোতো। আমার মাছেও কাটা বেশি মনে হচ্ছে আজ!
- দিবো একটা মাইর এখন! হিংসুটে মেয়ে কোথাকার!
বৃষ্টি হিহিহি করে হেসে উঠলো! খাওয়া শেষে মোহিনী নাফিসাকে কিছু করতে দিলো না। রুমে পাঠিয়ে দিলেন। মেঘ আগেই চলে গেছে, এখন নাফিসাও রুমে চলে এলো। রুমে পা রাখতেই মেঘ তাকে দাড় করিয়ে দরজা লক করলো। অত:পর নাফিসাকে কোলে তুলে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে আজ! মেঘ মুচকি হেসে বললো,
- মেঘা, জানো? আজ যে আমাদের ফুলসজ্জা!
নাফিসা মেঘের চোখেই তাকিয়ে আছে! প্রতিদিন প্রতিটি মুহুর্তে এতো রোমাঞ্চ কোথা থেকে আসে এই লোকটার মাঝে, ভেবে পায় না সে! মৃদু স্বরে বললো,
- চেঞ্জ করবো না আমি?
- এখনই কিসের চেঞ্জ! আমি তোমাকে দেখেছি নাকি!
- দেখো নি?
- উহুম, এখন দেখবো!
নাফিসা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে! সারাদিন তার আশেপাশে ছিলো আর এখন বলছে সে দেখেনি! মেঘ তাকে বিছানায় নামিয়ে নিজেও পাশে শুয়ে হাতে মাথা ভর করে পলকহীন তাকিয়ে আছে! নাফিসা একটু তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিলো। তার ভেতরে তোলপাড় চলছে! এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকে! দৃষ্টিতে খুন হয়ে যায়না মানুষ! প্রতিদিন প্রতিরাত এই অদ্ভুত প্রকৃতির লোকটা তাকে ভিন্ন জগৎ থেকে ঘুরিয়ে আনে এবং ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়! এতো শিল্প থাকে একটা মানুষের মাঝে সেটা মেঘকে না পেলে কখনো বুঝতেই পারতো না সে!
পর্ব – ৩৭
সকালে বৃষ্টি কোচিং-এর জন্য বেরিয়ে গেলো। মেঘ অনেক দিন হলো ব্যবসা থেকে দূরে আছে, তাই বাবার সাথে আজ সেখানে গেলো। বাসায় মোহিনী আর নাফিসা আছে। টুকটাক গল্প করলো মোহিনী নাফিসার সাথে। মেঘ অফিসে থেকে মায়ের ফোনে কল করে নাফিসার সাথে একটু কথা বললো। কোচিং শেষে বৃষ্টি আকাশকে কল করলো। আজ প্রথমবারেই রিসিভ করে ফেলেছে আকাশ।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি বলবে, বলো?
বৃষ্টি প্রথমে ক্ষেপে গিয়ে বললো, - ফোন রিসিভ করেই “কি বলবে বলো!” কেমন আছি সেটাও তো জিজ্ঞেস করতে পারতে!
প্রতুত্তরে আকাশ কিছু বললো না। বৃষ্টি ফোনে তাকিয়ে দেখলো কল কাটেনি সে, এখনো লাইনে আছে! সেও কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিজেকে ঠান্ডা করে কিছু বলতে যাবে এমন সময় আকাশ বললো, - কেমন আছো?
- এভাবে কথা বলো কেন তুমি? একটা কলও করো না! আমি প্রতিদিন কল দেই একবার রিসিভও করো না! এতোটাই ব্যস্ত থাকো তুমি, একটু আধটু কথা বলার সময় হয়না তোমার?
- এটা কি “কেমন আছো” এর উত্তর?
বৃষ্টি হেসে বললো, - না। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি আমি। তুমি কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ।
- দেখা করবে একবার?
- কি প্রয়োজন?
- দেখবো তোমাকে।
- দেখে কি করবে?
- দেখে ডান্স করবো!
- ডান্স বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনযোগী হও। বেশিদিন নেই এডমিশন টেস্টের!
বৃষ্টির রাগ আরও বেড়ে গেলো! বিরক্ত হয়ে সে কল কেটে দিলো! রিকশা ডেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মনে মনে আকাশকে হাজারটা বকা দিয়ে যাচ্ছে! ভালোবাসে খুব, তাই প্রকাশ্যে বকা দিতে পারে না! এজন্য মনে মনেই বকে যায়! পথেই দেখা হলো মারিশার সাথে! রিকশা থামিয়ে বললো,
- আরে, মারিশা আপু! কেমন আছো?
- এইতো, আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ। কোথায় যাচ্ছো?
- তোমাদের বাসায়ই যাচ্ছিলাম!
- তাহলে উঠে এসো। আমি তো বাসাতেই যাচ্ছি।
মারিশা উঠে পড়লো রিকশায়! দুজনেই গল্প করতে করতে বাসায় ফিরলো। মোহিনী মারিশাকে দেখে খুশি হয়ে বললো, - আরে মারিশা যে! কেমন আছো?
- এইতো আলহামদুলিল্লাহ। কেমন আছো আন্টি?
- আলহামদুলিল্লাহ। কাল তোমার বাবার সাথে এলে না কেন প্রোগ্রামে?
- এমনি আন্টি। এক জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।
মোহিনীও জানে, মেঘকে ভালোবাসে তাই তদের প্রোগ্রামে আসেনি মারিশা! নিজেই কথা ঘুরিয়ে বললো, - ওহ আচ্ছা। বসো।
- নতুন বউ কোথায়? দেখতে এলাম বউকে।
- রুমে আছে। বৃষ্টি, নাফিসাকে আসতে বল।
- ওকে।
মারিশা বললো, - আন্টি আমিই যাই, দেখা করে আসি।
- ওকে, যাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। একসাথে লাঞ্চ করবো আজ।
- ওকে।
মারিশা আর বৃষ্টি মেঘের রুমে এলো। নাফিসা জানালার পাশে দাড়িয়ে ছিলো। রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি আর সাথে একটি মেয়ে। বৃষ্টি বললো, - ভাবি, এ হচ্ছে মারিশা আপু। বাবার বন্ধুর মেয়ে।
নাফিসার সাথে সাথেই মনে পড়লো সেদিনের কথা! মা কল করে মেঘকে বলেছিলো মারিশার সাথে বিয়ে ঠিক করছে! তাহলে এ ই সেই মেয়ে! দেখতে সুন্দরী, বেশেও অনেক স্মার্ট দেখা যাচ্ছে! নাফিসা সালাম দিলো মারিশাও সালামের জবাব দিলো। নাফিসার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে! পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। যা নাফিসার মোটেও ভালো লাগছে না! বৃষ্টি হেসে বললো,
- আপু, কি দেখছো এমন করে?
- দেখছি, মেঘ কি জন্য পাগল হলো তোমার ভাবির প্রতি!
- সেটা তো মেঘ ভাইয়াই ভালো জানে।
- হুম, তাও ঠিক! কি ব্যাপার, মেহমান এসেছি বসতেও বলবে না?
নাফিসা বললো, - জ্বি বসুন।
মারিশা খাটে বসে পড়লো। বৃষ্টি আর তার রুমে যায়নি। এ রুমের বাথরুমে গিয়েই হাতমুখ ধুয়ে নিচ্ছে। মারিশা নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো, - মেঘ কি অফিসে গেছে?
- হ্যাঁ।
- নাম কি তোমার?
- নূর নাফিসা।
- বাসা কোথায়?
- সিলেটের শ্রীমঙ্গলে।
- পাহাড়ি মেয়ে! আসতে তো হলো ঢাকাতেই! কে জানে, মেঘ কি পেলো সেই পাহাড়ি অঞ্চলে! নাকি আবার কেউ বশ করে তাকে পাহাড়ি অঞ্চলেই বেধে রেখেছে সেটাই বা কে জানে!
মারিশার কথাবার্তা নাফিসার একটুও ভালো লাগছে না! না চাইতেও বাধ্য হয়ে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে! মারিশা আবার জিজ্ঞেস করলো,
- পড়ালেখা জানো তো?
- এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।
- বয়স কত?
- উনিশ চলছে।
- এখনই সংসারে নেমে গেছো! বিয়ের এতো তাড়া! নাকি মেঘকে দেখে আর মন মানাতে পারোনি?
নাফিসার ইচ্ছে করছে অনেক কিছুই কিন্তু আত্মসম্মানবোধের কারণে কিছুই বলছে না! বৃষ্টি বাথরুম থেকে বেরিয়ে লাস্ট কথাটা শুনেছে। তাই সে জবাব দিলো,
- এসব কি বলছো আপু! জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে তো আল্লাহর হাতে। যার যখন যেখানে হুকুম পড়বে সেখানেই সে স্থির হবে।
- তোমার যেমন জ্ঞান আছে, সেটাই যাচাই করছিলাম তোমার ভাবির আছে কিনা! জ্ঞানের স্বল্পতা আছে তোমার ভাবির মাঝে! জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান। তবে, বৃষ্টি এটা জানো তো? অন্যের খাবার ছিনিয়ে নেওয়ার মজাই আলাদা! কিছু কিছু মানুষের স্বভাব এমনই! না চাইতেও অন্যের জিনিসে লোভ ধরে যায়! আন্টি বোধহয় খাবার রেডি করে রেখেছে, চলো।
বৃষ্টি কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই মারিশা উঠে বেরিয়ে যেতে লাগলো। তাই বৃষ্টি থেমে গেলো। নাফিসা চুপচাপ দাড়িয়েই আছে। বৃষ্টি তার কাছে এসে বললো,
- ভাবি, মন খারাপ করেছো? আসলে মারিশা আপু ভাইয়াকে পছন্দ করতো। এজন্যই তোমার সাথে একটু এরকম ব্যাবহার করেছে। ভাইয়া কিন্তু মোটেও ওকে তেমন পছন্দ করে না। শুধুমাত্র বন্ধুসুলভ আচরণ করে। ভাইয়ার চেয়ে তিন বছরের ছোট, তবুও বাবার বন্ধুত্বের খাতিরে দু পরিবারের আসা যাওয়া বিধায় ছোট থেকেই তারা বন্ধু! চলো, লাঞ্চ করবে।
- হুম, যাও আমি আসছি।
- না, এখন আসো আমার সাথে।
নাফিসা বাথরুমে গিয়ে মুখে পানি ছিটিয়ে অত:পর বৃষ্টির সাথে ডাইনিং টেবিলে এলো।
মোহিনী ডেকে নিজের পাশে বসালো নাফিসাকে। কাটা বেছে দিতে নিলে নাফিসা বললো,
- মা, আমি এখন মাছ খাবো না।
- কেন?
- এমনি, ইচ্ছে করছে না খেতে।
- উহুম, খেতে হবে। আমি কাটা বেছে দিচ্ছি।
মারিশা বললো, - বাহ! আন্টি, এতো বড় মেয়ে সামান্য মাছের কাটা বেছে খেতে পারে না! এ তো দেখছি শাশুড়িকে সেবা করার বদলে উল্টো শাশুড়িকে দিয়ে নিজের সেবা করাচ্ছে!
নাফিসা চোখ বন্ধ করে কঠিন নিশ্বাস ছাড়লো! সে জানতোই মারিশা কাটা বেছে দিতে দেখলে কিছু না কিছু বলবেই! এজন্যই বলেছিলো মাছ খাবে না! শ্বশুর বাড়ির সম্মানের কথা ভেবে শুধু চুপচাপ সহ্য করে যাচ্ছে মারিশাকে! মোহিনী হেসে বললো, - এটা মা মেয়ের আদর মারিশা! যখন তুমি আমার অবস্থানে আসবে, তখন বুঝবে!
নাফিসা যথাসম্ভব দ্রুতই খাবার শেষ করলো। কিছুক্ষণ পূর্বের ব্যাবহারে মারিশার সামনে থাকতে তার মোটেও সস্তি বোধ হচ্ছে না! সবার খাওয়া শেষ হলে মাকে নিষেধ করে সে নিজেই থালাবাটি গুছাতে লাগলো। তবে মোহিনী বসে থাকেনি। সেও এগিয়ে দিচ্ছে।
মারিশা আরও কিছুক্ষণ থেকে মোহিনী ও বৃষ্টির সাথে গল্প করে চলে গেলো। নাফিসা একা তার রুমে বসেছিলো। কষ্ট তার ভেতর চাপা পড়ে আছে।
সন্ধ্যায় নাফিসা মায়ের সাথে কিচেনে ছিলো। সে কেটেকুটে দিয়েছিলো এখন মোহিনীই রান্না করছে আর নাফিসা পাশে বসে আছে। মেঘের গলার আওয়াজ শুনে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। মেঘ আর বৃষ্টি ফোন সম্পর্কে কিছু বলছে। রায়হান চৌধুরী বিকেলে ফিরলেও মেঘ সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো। আজ রোদ উঠেছিলো কড়াভাবে!
মেঘকে দেখেও ক্লান্ত মনে হচ্ছে, তাছাড়া ঘেমে একাকার। মেঘের হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে বৃষ্টি তার রুমে চলে গেলো।
মেঘ নিজের রুমে গেলে নাফিসাও পিছু পিছু গেলো। মেঘ তাকে রুমে ঢুকতে দেখে দরজাটা চাপিয়ে ক্লান্ত মুখে হাসি ফুটিয়ে নাফিসাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁটের গভীর ছোয়া দিলো। নাফিসা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। আজ এই স্পর্শ মনে কোনো সাড়া জাগাতে পারলো না! মেঘ ছেড়ে দিলে সে ওয়ারড্রব থেকে মেঘের জামাকাপড় বের করে বাথরুমে রেখে এলো। মেঘ শার্ট খুলে গোসল করতে চলে গেলো। বৃষ্টি এসে নাফিসার কাছে একটা ফোন দিয়ে গেলো।
- ভাবি নাও। সিম মেমোরি সব লাগিয়ে দিয়েছি। ফেসবুক একাউন্ট খুললে আমাকে এড দিও।
- আমি কি করবো এটা দিয়ে?
- ফোন দিয়ে তো কতো কিছুই করে! ফোন ছাড়া এখন কারো সময় কাটে নাকি! তাছাড়া ভাইয়া আজ এনেছে এটা তোমার জন্য।
- কে বলেছে ফোন ছাড়া সময় কাটে না! আমি তো ইউজ করি না, তাহলে আমার সময় কাটছে না?
- আচ্ছা, তাহলে ভাইয়ার কাছে জেনে নিও কেন আনলো এটা! আমি যাই! পড়তে বসবো।
বৃষ্টি ফোন রেখে চলে গেলো। মেঘ গোসল করে বেরিয়ে এসে দেখলো নাফিসা জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে আর খাটে ফোন রাখা। মাথা মুছতে মুছতে বললো, - মেঘা, ফোনটা পছন্দ হয়েছে?
নাফিসা কোনো উত্তর দিলো না! মেঘ বাসায় ফেরার পর থেকেই লক্ষ্য করছে নাফিসা কেমন মনমরা হয়ে আছে! দরজা লাগিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
- বেগমের মনটা কি আজ খুব বেশি খারাপ?
- বিয়ে কেন করেছেন আমাকে?
- এটা কেমন প্রশ্ন!
মেঘ তাকে ছেড়ে দিয়ে দাড়ালে নাফিসা ঘুরে দাড়ালো তার দিকে! চোখ তার ছলছল করছে! পরক্ষণেই আবার বলতে লাগলো, - প্রশ্ন যেমনই হোক, উত্তর দিন। বিয়ে কেন করেছেন আমাকে! পৃথিবীতে এতো মেয়ে থাকতে আমাকেই আপনার পছন্দ হলো কেন? আমি কি আপনাকে বশ করে পাহাড়ি অঞ্চলে বেধে রেখেছিলাম? আমি কি আপনাকে বিয়ের জন্য তাড়া দিয়েছিলাম? আমার জ্ঞান নেই, আমি মুর্খ, পশুর সমতুল্য! না আছি রূপে আর না আছি কোনো গুনে! মাছের কাটাটা পর্যন্ত বেছে খেতে পারি না! আপনি এতো মেধাবী, স্মার্ট হয়ে আমাকে কেন বিয়ে করতে গেলেন! অন্যের জিনিস ছিনিয়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই! কোনো লোভ নেই আমার অন্যের জিনিসের প্রতি! আমি তো আপনার কাছে আসিনি, তাহলে আপনি কেন গেলেন আমার কাছে! বলেছিলাম তো আমার কাছ থেকে দুরে সরে যেতে, তবুও কেন সরে এলেন না!
কথাগুলো বলতে বলতে নাফিসার চাপা কষ্ট অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে! মেঘ সিরিয়াস মুডে জবাব দিলো, - তোমার সব কেন এর উত্তর একটাই, ভালোবাসি তোমায়!
- কে বলেছে এতো ভালোবাসতে? আজ আপনার জন্য, শুধুমাত্র আপনার জন্য আমাকে এসব শুনতে হচ্ছে!
- কে কি বলেছে? বলো?
- কেউ কিছু বলেনি!
মেঘ নাফিসার বাহু চেপে ধরে বললো, - কি হয়েছে তোমার বলো আমাকে? কে কি বলেছে, বলো?
- বললাম না কেউ কিছু বলেনি!
- মেঘা, আমি সত্যিটা জানাতে চাইছি!
নাফিসা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো! ইগনোর করাতে মেঘের প্রচুর রাগ হচ্ছে! সে নাফিসার বাহু ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে বৃষ্টির কাছে চলে গেলো।
পর্ব – ৩৮
নাফিসা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো! ইগনোর করাতে মেঘের প্রচুর রাগ হচ্ছে! সে নাফিসার বাহু ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে বৃষ্টির কাছে চলে গেলো।
- বৃষ্টি, মেঘার কি হয়েছে?
- কেন, ভাবির আবার কি হবে?
- সেটাই তো জানতে চাইছি! সে তো পরিষ্কার ভাবে কিছু বলছেই না, শুধু আমার সাথে জেদ দেখাচ্ছে আমি কেন তাকে বিয়ে করলাম! কে কি বলেছে তাকে?
বৃষ্টি এবার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে বললো, - মারিশা আপু এসেছিলো আজ! ভাবির সাথে খোচা মেরে কথা বলেছে।
এবার মেঘের কাছে সবটা পরিষ্কার! মারিশা নিশ্চয়ই নাফিসার বলা পয়েন্টগুলো বলে গেছে! সে বৃষ্টিকে বললো, - নাফিসা কিছু বলেনি?
- না, ভাবিকে যা প্রশ্ন করেছিলো সেগুলোর উত্তর দিয়েছে শুধু।
- তুই কোথায় ছিলি?
- প্রথমে আমি পাশেই ছিলাম, পরে বাথরুমে হাতমুখ ধোয়ার সময় কি বলেছে জানি না। তবে আমি থাকাকালে দু একটা কথার জবাব দিয়েছিলাম।
- খেতে দেখেছে নাফিসাকে?
- হ্যাঁ, একসাথেই সবাই লাঞ্চ করেছি।
- ওকে। এরপর থেকে মারিশা আসুক আর যে ই আসুক, নাফিসাকে একা রাখবি না কারো পাশে।
- ওকে।
অতপর মেঘ রুমে ফিরে এলো। নাফিসা খাটের একপাশে বসে কান্না করছে! মেঘ দরজা লাগিয়ে পাশে এসে বসলো। নাফিসাকে ধরতেই হাত সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়লো।
- আমাকে সিলেট রেখে আসুন। আমি থাকবো না এখানে।
- এই বোকা মেয়ে! বাইরের কেউ এসে তোমাকে এসব কথা শুনিয়ে গেলো আর তুমি কিছু বলতে পারলে না! তোমার তো উচিত ছিলো উপযুক্ত জবাব দেওয়া!
- প্রয়োজন নেই তো কারো সাথে লাগতে যাওয়ার! কিছু না বলতেই এতো দোষ খুজে বের করে ফেলেছে! আর তখন তো এটাও বলতে পারতো দুদিন হয়নি শ্বশুর বাড়ি এসেছি আর এখনই কেমন চাপা ছাড়ছি! হয়তো আমার পরিবারকেও অপমান করতো!
মেঘ তাকে কাছে টানতে গেলে নাফিসা আরও দূরে সরে গেলো! মেঘ জোর করেই তাকে কাছে টেনে নিজের সাথে বাহুডোরে বেধে রেখে বললো,
- তাহলে এখন আমি বলি! শুনেছি স্বামী ভালো থাকলে নারীদের কাছে আর কোন শক্তির প্রয়োজন পড়ে না! এখন বলো তুমি আমার সাথে এমন জেদ দেখাচ্ছো কেন! আমি কি সঠিক জায়গায় নেই? তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছো কেন! আমি তো তোমার সঙ্গী।
- এজন্যই তো আপনার কাছে সব শেয়ার করলাম! এজন্যই তো কেবল আপনার কাছে আমার সব অভিমান অভিযোগ! সারাদিনে আমি আর কারও সাথে এ নিয়ে কোনো কথা বলিনি! নালিশ জানাচ্ছি না, শুধু এইটুকু চাচ্ছি আমি কারো কটু কথা শুনতে পারবো না মেঘ! অযথা কথা শুনতে সহ্য হয় না আমার! আমাকে সিলেট রেখে আসুন!
নাফিসা মেঘকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কাদতে লাগলো! মেঘ বাধা দিচ্ছে না। কাদলে মন হালকা হয়! তাই বুকে চেপে রেখেছে। সে জানে নাফিসা এখনো তার পরিবারের সদস্যদের সাথেও তেমন ফ্রী না। একমাত্র মেঘের উপরই ভরসা করে এখানে আছে সে! নাফিসার কান্নার গতি আস্তে আস্তে কমে এলো। চোখের পানি মুছে দিয়ে মেঘ বললো,
- সবসময় আত্মসম্মান নিয়ে বসে থাকলে চলে না, মেঘা। প্রয়োজনে উপযুক্ত জবাব দিতে হয়। মুখ বুজে বসে থাকলে তুমি বোকা হয়ে যাবে! হ্যাঁ, এটাও ঠিক অতিরিক্ত কিছুই ভালো না! তাই পরিস্থিতি বুঝে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জগৎ বড়ই কঠিন, জানো তো! তাই সময় ও সুযোগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে যেতে হবে, তবেই না সফলতা আসবে! জেদ নিয়ে হার মেনে বসে থাকলে চলবে না! অল্পতে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না, বরং নিজেকে কঠিন করতে হবে। যাও, মুখ ধুয়ে এসো।
নাফিসা মুখ ধুয়ে এসে আবার খাটে বসে পড়লো। মেঘ তাকে খাওয়ার জন্য সাথে যেতে বললো কিন্তু সে গেলো না! জোর করলো তবুও মানাতে পারলো না। তার কথা একটাই, ভালো লাগছে না তাই সে খাবে না! মেঘ খাবার নিয়ে আজ রুমে চলে এলো। নাফিসা বুঝতেই পারছে মেঘ তাকে খায়িয়েই ছাড়বে! মাছের কাটা মেঘ বেছে দিতে নিলে সে প্লেট নিয়ে নিলো। নিজেই মাছ বাছতে লাগলো। মেঘ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে! নাফিসা প্রথম লোকমা গিলে দ্বিতীয় লোকমা আর গিলতে পারলো না! গলায় কাটা আটকে গেছে! তার সাথে মাছের কিসের শত্রু ভেবে পায়না সে! কখনোই শান্তি দিলো না তাকে! এতো দেখে নেওয়ার পরেও কাটা ফুটবেই! মুখ নাড়াচাড়া বন্ধ দেখে মেঘ বুঝে গেছে!
নাফিসা দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে বমিই করে দিলো! এদিকে মেঘ রেগে গেছে! এতো জেদ নিয়ে থাকে কিভাবে! ইচ্ছে করছে অনেক কিছু কিন্তু কিছুই করতে পারছে না! নাফিসা মুখ ধুয়ে রুমে এলো। এখন আর কাটা লাগছে না, বেরিয়ে গেছে হয়তো! মেঘের চেহারা ভয়াবহ দেখাচ্ছে! চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট! মেঘ খুব শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
- কাটা সরেছে?
- হুম।
- চুপচাপ বসো এখানে।
নাফিসা মেঘের কথা মতো বসে পড়লো। মেঘ নিজ হাতে তার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। মেঘের রাগান্বিত মুখ এখনো স্বাভাবিক হয়নি! তাকে স্বাভাবিক করতে খাবার তুলে দেওয়ার সময় নাফিসা মেঘের হাতের আঙুল কামড়ে ধরে রাখলো! মেঘ টানলেও ছাড়ছে না! মেঘ আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকালো তবুও নাফিসা কামড়ে ধরেই রেখেছে! মেঘ আর রাগ নিয়ে থাকতে পারলো না! মুখ চেপেই হেসে উঠলো! নাফিসা এবার ছেড়ে দিলো। তার মুখও লাজুক হয়ে উঠেছে! মেঘ তার দিকে তাকিয়ে বললো,
- খাবে না আর? সব খাবার শেষ করতে হবে এখন!
- তুমি খাচ্ছো না কেন?
- খাবো কি করে, রাগিয়ে দিয়েছো আমাকে!
এবার মেঘও খাচ্ছে নাফিসাকেও খায়িয়ে দিচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে নাফিসাই প্লেট নিয়ে গেলো রেখে আসার জন্য। মোহিনী তাকে দেখে বললো,
- মন ভালো হয়েছে নাফিসার?
উত্তরে নাফিসা মুচকি হাসি দিলো। প্লেট ধুয়ে রেখে টেবিলের খাবারও গুছিয়ে রাখলো মোহিনীর সাথে। রুমে আসতেই মেঘ বললো, - মেঘা, আম্মিও শাড়ি পড়ে মা ও শাড়ি পড়ে। তুমি কি পড়বে না?
- আমিও তো পড়ি মাঝে মাঝে!
- সবসময় দেখতে ইচ্ছে করে।
নাফিসা আর কোনো জবাব দিলো না। মেঘ ল্যাপটপে কাজ করছে, সে তার কাছেই গিয়ে বসে রইলো।
আজ বৃষ্টি কোচিং সেন্টার থেকে বের হতেই দেখলো গেইটের একটু দূরে আকাশ দাড়িয়ে আছে! আকাশ এখানে কেন ভেবে পাচ্ছে না সে! আকাশ দেয়ালের লেখাগুলোর উপর হাত নাড়ছে আর ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। বৃষ্টি বন্ধুদের কাছে বিদায় নিলো। বন্দুরা চলে গেলো আর বৃষ্টি গেইটের সামনেই দাড়িয়ে আছে, আকাশ কেন এসেছে সেটা দেখার জন্য। আকাশ গেইটের দিকে তাকাতেই বৃষ্টিকে দেখে ফোনে কথা বলা শেষ করলো। বৃষ্টির কাছে এগিয়ে এসে বললো,
- চলো।
বৃষ্টি এক জায়গায়ই দাড়িয়ে আছে। কেননা আকাশ তার কাছে এসে থামেনি, ফোন দেখতে দেখতে দৃঢ় পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিকে কাছে না পেয়ে পেছনে ঘুরে তাকালো। এবার বৃষ্টি তাকে দেখেও না দেখার ভান করে রাস্তার এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো! মনে হচ্ছে সে গাড়ি খুজছে! আকাশ সেখানে থেকেই আবার বললো,
- দাড়িয়ে আছো কেন? যাবে না?
- এক্সিউজমি? আপনি আমাকে কিছু বলছেন?
আকাশ আর কিছু না বলে চুপচাপ সামনে হাটা শুরু করলো। বৃষ্টি এমনিতেই রেগে আছে কালকের আচরণে আর এখন তো আরও রেগে গেছে! কোথায় এসে একটু ভালোভাবে কথা বলে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করবে! তা না করে ফোনের দিকে তাকিয়ে হাটতে হাটতে বলে গেলো “চলো” ! এভাবে বললে কে বুঝবে কাকে বলছে! এখন আবার নিজে বিরক্ত হয়ে একা একা চলে যাচ্ছে! যাক সে চলে! বৃষ্টি মুখ ফুলিয়ে এখানেই দাড়িয়ে আছে। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো থামছে না, এবার সে ই দৌড়ে গেলো। আকাশের পিছু পিছু হাটতে হাটতে বিড়বিড় করতে লাগলো, - গোমড়ামুখো! একটা দিনও ঠিকমতো কথা বলে না! আসছে আবার দেমাক দেখিয়ে চলে যাচ্ছে! তাহলে এসেছেই কেন শুধু শুধু! কে বলেছে তাকে আসতে! মনে তো চায় ইট দিয়ে একটা মেরে মাথা ফাটিয়ে দেই!
আকাশ পিছু না দেখে সামনে তাকিয়ে হাটতে হাটতেই বললো, - ইট তো পেছনে ফেলে রেখে এসেছো। নিয়ে এলে না!
বৃষ্টির রাগ কমার বদলে আরও বেড়ে যাচ্ছে! বিড়বিড় করেও শান্তি নেই, শুনে ফেলে! বৃষ্টি আর পিছু পিছু না হেটে তার সমানে হাটতে লাগলো, একটু পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু আকাশ ফোনেই কিছু করছে! আর কতো অবহেলা সহ্য করা যায়! সে তো তার জন্য আসেনি মনে হচ্ছে! তার সমস্ত ব্যস্ততা পড়ে আছে ফোনে! শুধু শুধু তার সাথে হেটে যাচ্ছে কেন! সে তো তাকে একটুও পাত্তা দেয় না! কাকে এতো ভালোবাসে!
সমস্ত রাগ এবার অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসছে! আস্তে আস্তে পায়ের গতি থেমে গেলো। আকাশ তার দিকে তাকিয়ে মুখটা একটু মলিন করে ফেললো। পকেট থেকে রুমাল এগিয়ে দিলো। বৃষ্টি তার কান্ড দেখে নিজের হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে উল্টো পথে দ্রুত পায়ে হাটা ধরলো। অনেক হয়েছে, এবার সে বাসায়ই চলে যাবে! খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু রাস্তায় আছে বিধায় কান্নাও করতে পারছে না! রাস্তার পাশে রিকশা দেখে জিজ্ঞেস করলো যাবে কি-না? রিকশাওয়ালা যেতে রাজি হলেই সে রিকশায় উঠে পড়লো। রিকশা ঘুরিয়ে নিলে কোথা থেকে লাফ দিয়ে আকাশ এসে উঠে পড়লো! বৃষ্টি অবাক হয়ে বললো,
- আপনি রিকশায় উঠেছেন কেন?
- তোমার সাথে যাবো বলে। মামা, সামনে রেস্টুরেন্টের কাছে যান।
- মামা, রিকশা থামান। আমি নেমে যাবো!
- মামা, রেস্টুরেন্টের আগে রিকশা থামলে আপনার রিকশার চাকা পাঞ্চার হয়ে যাবে। আপনি সোজা চলুন।
রিকশা আর থামলো না। আকাশ বৃষ্টির পেছনে রিকশায় হাত রাখলে বৃষ্টি সরিয়ে দিতে চাইছে। তাই আকাশ বললো, - আরে! এমন করছো কেন! আমি তো রিকশায় হাত রেখেছি তাতে তোমার সমস্যা কি!
- আমার পেছনে হাত রেখেছেন এটাই আমার সমস্যা!
বৃষ্টি আরও চেপে বসলো আকাশের বিপরীত দিকে। আকাশ তাকে টেনে নিয়ে নিজের সাথে চেপে বসালো।
- পড়ে যাবে তো! এরপর আমাকে ঝামেলায় ফেলে বলবে, যে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি!
মানুষের কান্ড দেখে গা জ্বলে যায়! কেমন মানুষ এটা! রাগ ভাঙানোর জায়গায় একের পর এক রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে! এমন আচরণে কোনো মানুষের ভেতর আঘাত হানতে পারে সেই নূন্যতম অনুভূতিটুকু কি এই লোকটার মধ্যে নেই!
রিকশা এসে রেস্টুরেন্টের সামনে থামলো। বৃষ্টি বসে আছে রিকশায়। চোখ গড়িয়ে এক ফোটা দু ফোটা পানি পড়েই যাচ্ছে আর সে সাথে সাথে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আকাশ নামতে বললো কিন্তু সে নামছে না!
- কি হলো, নামবে না? মামা, আপনার ছেলে আছে? এই মেয়েকে নিয়ে যান তাহলে। বিয়ে দিয়ে দিবেন আপনার ছেলের সাথে। সাংসারিক কাজ সব পারে, তাছাড়া ভবিষ্যৎ ডাক্তার! আপনাদের খুব সেবা করবে।
রিকশাওয়ালা হাসছে আর আকাশ ভাড়া দিচ্ছে। এদিকে বৃষ্টির কান্না আরও বেড়ে যাচ্ছে! সে তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়লো রিকশা থেকে। না থেমে সোজা হাটা ধরলো তার বাসার পথে! আকাশ রিকশা থেকে দ্রুত নেমে বৃষ্টির হাত ধরে ফেললো। বৃষ্টি ছোটানোর চেষ্টা করছে, আকাশ আরও চেপে ধরেছে হাত! সে বৃষ্টিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে যাচ্ছে। বৃষ্টি আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো আকাশের মুখে হাসি! এ তো তার প্রাণ জুড়িয়ে দিতে বাধ্য!
কে জানে, হয়তো এই হাসি দেখেই বৃষ্টি তার প্রেমে পড়ে গেছে! তার জীবনে সে তিনজন পুরুষের মুচকি হাসি দেখে মুগ্ধ হয়েছে! এক তার বাবা, দুই তার ভাই মেঘ যার হাসি পুরোপুরি বাবার ফটোকপি! আর তিন এই আকাশ! সর্বদা শুনে এসেছে মেয়েদের হাসি দেখে ছেলেরা পাগল হয়ে যায়, কিন্তু বৃষ্টি ছেলের হাসি দেখে পাগল হয়েছে! এমন ঘটনা খুব কমই শোনা যায় আশেপাশে!
পর্ব – ৩৯
সে আকাশকে দেখতে দেখতে কখন যে রেস্টুরেন্টের ভেতরে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি! আকাশ বললো,
- বৃষ্টি, তাকিয়ে দেখো তোমার পরিচিত কেউ আবার এসে বসে আছে কি-না?
বৃষ্টির ধ্যান ভাঙলো। সে রেস্টুরেন্টে চোখ বুলিয়ে দেখলো অত:পর মাথা নেড়ে না জবাব দিলো। আকাশ তাকে একপাশে এনে বসতে বললো আর বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো, - বসে কি করবো?
- কি আর করবে! টেবিলে মার্ডার প্যাটার্ন আঁকো!
বৃষ্টির মনে পড়ে গেছে সেই জঙ্গলে কাটানো দিনের কথা! ইশ! ভাবতেই শিহরণ বয়ে যায় অঙ্গে! যদি আবার যেতে পারতো! প্রত্যেকটা দিন সেভাবেই কাটাতে পারতো! বৃষ্টি চেয়ারে বসে পড়লো। আকাশ খাবার অর্ডার করেছে। বৃষ্টির মুখ এখনো হুতোম প্যাঁচার মতো হয়ে আছে! আকাশ প্রথমে বিপরীত দিকে বসলেও এখন উঠে বৃষ্টির কাছে বসলো। খাবারের প্লেট সামনে টেনে বললো, - আহ! ক্ষুধায় একেবারে মুখটা শুকিয়ে গেছে! সকালেও খাওনি নাকি!
- হুহ! ঢং দেখাতে আসছে এখন!
আকাশের ফোনে কল এলে আকাশ দেখলো রিজভীর কল। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আকাশ ফোন রিসিভ না করে টেক্সট করলো এখন ব্যস্ত আছে। ফোন টেবিলের উপর রেখেই খাবারের প্লেট বৃষ্টির সামনে দিয়ে বললো,
- এখন আবার খায়িয়ে দিতে বলো না। রেস্টুরেন্টে অনেক লোক আছে তাছাড়া আমি খায়িয়ে দিতে পারিনা!
বৃষ্টির হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসছে না! গম্ভীর মুখেই বললো, - আপনি খেলে আমি খাবো না।
- হোয়াট! উল্টো বললে না কথাটা?
- না, ঠিকই বলেছি। আপনি খেলে আমি খাবো না।
- আমি কিন্তু লাঞ্চ করিনি। তোমাকে নিয়ে এসেছি লাঞ্চ করার জন্য।
- এতো কথা আমি জানতে চাইনি! আমার কথা আমি বলেছি। আপনি খেলে আমি খাবো না!
- ওকে আমি খাবো না। খাও তুমি।
বৃষ্টি নিজে খেতে খেতে বললো, - আপনি কি সত্যিই আমার জন্য এসেছেন?
- তোমার কোচিং শেষ হয় বারোটায়, আমি এসেছি এগারোটা পঞ্চাশে। তুমি বেরিয়েছো বারোটা চৌদ্দ মিনিটে। পুরো চব্বিশ মিনিট দাড়িয়ে ছিলাম আমি তোমার জন্য। এতো লেট করে বেরিয়েছো কেন?
- এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন আমাকে আগে জানিয়ে দিয়েছেন আপনি আসবেন! কালকে দেখা করার কথা বলতেই কেমন আচরণ করেছেন! আজ এসেও আমাকে কাদিয়েছেন! এমন বিহেভ করার হলে এসেছেনই বা কেন!
- এসেও ভুল করে ফেলেছি!
- আপনি জানেন কিভাবে আমার কোচিং এর সময়?
- সেন্টারের নাম জানিয়েছো এটা জানা ব্যাপার নাকি!
বৃষ্টি আর কিছু না বলে খেয়ে যাচ্ছে আর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে! দুতিন মিনিট পাড় হতেই আকাশ বললো,
- আমি বিল দিয়ে চলে যাই তাহলে? তুমি খাবে আর আমি বসে বসে দেখবো তা তো আর হয় না!
বৃষ্টি খাওয়ার মাঝেই হিহি করে হেসে উঠলো! কোনো জবাব না দিয়ে আরেকটু খেয়ে পানি খেয়ে মুখ মুছে নিলো। তারপর আকাশের প্লেট তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, - এবার খাও তুমি।
- একবার আপনি একবার তুমি! আমার মতে আপনি টা-ই ঠিক আছে!
- আমার যা ইচ্ছে বলবো, না শুনতে পারলে কান বন্ধ করে রাখো। ক্ষুধা না লেগেছে? এবার চুপচাপ খাও।
- এতোক্ষণ আমাকে বসিয়ে রাখলে কেন? নিজের পেট শান্তি তো সব শান্তি! তাই না?
- উহুম! আমার ক্ষুধা লাগেনি। তুমি আমার সাথে খেলে এখন খাওয়া শেষ হয়ে যেত আর তুমি চলে যেতে! তাই বসিয়ে রেখেছি, এখন তুমি খাও, আমি দেখবো তোমাকে!
- আবার ডান্স করবে না তো?
বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলো শুধু। আকাশ খাচ্ছে, আর বৃষ্টি তাকে দেখছে! সেই যে কবে দেখেছে আজ কতোদিন পর আবার দেখা! অনেকটা ফ্রেশ লাগছে আকাশকে! মেয়েদের মতো ক্রীম ট্রীম মাখে নাকি! আগে তো এতোটা ফ্রেশ লাগেনি! বৃষ্টি মনে মনে হাসছে। তার মনের হাজার রঙ তুলিতে আকাশকে রঙিন করছে! ভাসছে আকাশের মাঝে, বুনছে রংধনুর ন্যায় হাজার স্বপ্ন! চোখের ইশারায় আকাশের মাঝে আঁকিবুঁকি করছে অজানা স্বপ্নের জগৎ! পলকহীন তাকিয়ে আছে তার সামনে বসা মানব, আকাশের পানে!
এদিকে আকাশ খাওয়ায় ব্যস্ত! নিজের খাবার শেষ করে বৃষ্টির অবশিষ্ট খাবারও খেয়ে নিলো। তা দেখে বৃষ্টি বললো,
- এতো ক্ষুধা লেগেছে! আমার প্লেটও সাফ!
আকাশ সম্পূর্ণ খাওয়া শেষ করে জবাব দিলো, - ক্ষুধা বেশি লাগেনি তবে খাবার নষ্ট করা ঠিক না! এতো নষ্ট করো কেন তুমি! চলো
- আরেকটু বসো। দেখা শেষ হয়নি আমার!
- অনেক দেখেছো, উঠো! না হলে তুমি থাকো আমি চলে যাই!
- আকাশ আর দশ মিনিট।
আকাশ তার হাত ধরে টেনেই বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। রিকশা ডেকে বৃষ্টিকে উঠতে বললো। এদিকে রিজভী কল করেই যাচ্ছে! অন্য এক রিকশা নিয়ে সে নিজেও চলে গেলো। দুজন দুদিকে! এতোকিছুর পর বৃষ্টির মনটা আবার খারাপ করে দিলো আকাশ ! আর বিষন্ন মনে বৃষ্টি বাসায় ফিরে এলো।
সন্ধ্যায় মেঘ, তার বাবা ও মারিশার বাবা একসাথে বাসায় ফিরেছে। নাফিসা মোহিনীর সাথে কিচেনে ছিলো। মেঘ কিচেনে এসে বললো,
- মা, আংকেল এসেছেন।
- কোন আংকেল? মারিশার বাবা?
- হ্যাঁ।
মোহিনী কিচেন থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে চলে গেলো। এই সুযোগে মেঘ নাফিসাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, - কি রান্না করছো, বেগম সাহেবা?
- ছি, ছাড়ো! কিচেনে আছি।
- আমিও তো দেখতেই পাচ্ছি কিচেনে আছো! প্রব্লেম হলে বেডরুমে চলো!
- ছাড়ো তো! মা এসে পড়বে!
মেঘ মাথায় মাথা ঠুসে ছেড়ে দিয়ে দাড়ালো। কাটা টমেটো থেকে এক টুকরো টমেটো নিয়ে মুখে দিলো। নাফিসা জিজ্ঞেস করলো, - গোসল করবে এখন?
- তুমি করলে করবো।
মেঘের দুষ্টুময় কথা শুনে নাফিসা চোখ রাঙিয়ে একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিলো। মেঘ বললো, - আংকেলের জন্য কিছু নাস্তা রেডি করো। বক্সে দেখো কি আছে।
- এটা নাড়া দাও।
- বাবাহ! আমিও আজ মেয়েলি কাজে!
- কেন, ছেলেরা রান্না করে খায় না?
- খায়, বাধ্য হয়ে।
- শখেও খায়।
- দেখেছো কাউকে?
নাফিসা আর কোনো জবাব দিলো না। মেঘ বললো, - বৃষ্টি কোথায়?
- রুমে, পড়ছে হয়তো।
মেঘ এখানে থেকেই বৃষ্টিকে ডাকলো। মোহিনী এসে বললো নাফিসাকে দেখতে এসেছে মারিশার বাবা। তাই নাফিসাকে যেতে বললো। কেক, বিস্কুট আর ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে ট্রে তে নিলো মোহিনী। আর নাফিসাকে বললো পানির জগ নিয়ে যেতে। মেঘ রুমে চলে গেলো, আর নাফিসা চুলা বন্ধ করে ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে জগ নিয়ে মোহিনীর পিছু পিছু যাচ্ছে। মোহিনী ট্রে এনে টেবিলে রাখলো। নাফিসা এসে সালাম দিলো।
মারিশার বাবাও সালামের জবাব দিলো। নাফিসা লোকটিকে দেখে জগটা ঠিকমতো রাখতে পারলেও গ্লাসটা রাখতে পারেনি! মেঝেতে পড়ে ঠাস করে ভেঙে গুড়ো হয়ে গেছে! এ কাকে দেখছে সে! এই লোকটা মারিশার বাবা! গ্লাস পড়ে যাওয়ায় সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে! নাফিসার চোখ অশ্রুতে ভীড় জমে গেছে! সে বসে “সরি” শব্দটা উচ্চারণ করে তাড়াতাড়ি ভাঙা কাচ তুলতে লাগলো। মোহিনী বললো,
- কিছু হয়নি, আমি গ্লাস এনে দিচ্ছি। ধরো না নাফিসা, হাত কেটে যাবে। উঠো।
- সরি মা, আমি বুঝতে পারিনি পড়ে যাবে!
- আরে বোকা মেয়ে, একটা গ্লাস ভেঙেছে এতে কি হয়েছে! উঠো।
এদিকে রায়হান চৌধুরী ও সৈকত মির্জাও নিষেধ করছে কাচ ধরতে। নাফিসা উঠে দাড়ালো আর মোহিনী একটা গ্লাস এনে দিলো। নাফিসা ওড়না দিয়ে চোখ মুছে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। রায়হান চৌধুরী বললো, - মির্জা সাহেব, বউ মা কিন্তু পাহাড়ি মেয়ে।
- হ্যাঁ, চেহারায় কিছুটা ভাসে। কোথায় তোমাদের বাসা?
নাফিসা নিচু স্বরে বললো, - সিলেটের শ্রীমঙ্গলে।
- ওহ, পড়াশোনা সেখানেই?
- হ্যাঁ।
- কিসে পড়ো?
- এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।
- ভালো, এবার এদিকে ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাও। কি চৌধুরী, পড়াশোনার সুযোগ নেই?
- থাকবে না কেন! মেয়েকে পড়াচ্ছি, নাফিসাও তো আমার মেয়েই।
নাফিসা একটু চুপচাপ স্বভাবের এটা জানে বিধায় মোহিনী বুঝতে পারছে নাফিসা হয়তো অপরিচিত লোকের সামনে দাড়িয়ে থাকতে অসস্তি বোধ করছে। তাছাড়া এখন গ্লাস ভেঙে বোধহয় আরও অসস্তি বোধ করছে, তাই নাফিসাকে নিয়ে চলে আসতে চাইলো। সৈকত মির্জা উঠে সালামি স্বরূপ নাফিসাকে কিছু টাকা দিতে চাইলো কিন্তু নাফিসা নিচ্ছে না। মোহিনীও প্রথম না করছিলো, কিন্তু স্বেচ্ছায় সালামি স্বরূপ দিতে চাইছে না নিলে বেয়াদবি হবে। তাই মোহিনী নাফিসাকে ইশারা করলো নেওয়ার জন্য। মির্জা সাহেবকে ডিনার করে যাওয়ার জন্য বলে নাফিসাকে সাথে নিয়ে কিচেনে চলে এলো। নাফিসার আর সহ্য হচ্ছে না! পারছে না ভেতরের কষ্ট চাপা রাখতে! সে মোহিনীকে বললো,
- মা, আমি একটু রুমে যাচ্ছি।
- যাও।
নাফিসা চলে গেলো আর মোহিনীও ঝাড়ু নিয়ে ড্রয়িং রুমে গেলো ভাঙা কাচ পরিষ্কার করতে।
রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দৌড়ে এসে খাটের কোনে বসলো। হাতের টাকা ফেলে ওড়না দিয়ে মুখ চেপে রাখলো তবুও কান্না দমাতে পারছে না! মেঘ ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকে দেখে দ্রুত এসে পাশে বসলো। - মেঘা? কি হয়েছে তোমার?
নাফিসা কোন জবাব দিচ্ছে না! মেঘ দেখলো খাটে এক হাজার টাকার নোট! মুখ থেকে নাফিসার হাত টেনে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললো, - এই, কাদছো কেন তুমি? কি হয়েছে, বলো আমাকে! মেঘা!
নাফিসা ওড়না ছেড়ে দিয়ে মেঘের টিশার্ট খামচে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে আরও জোরে কাদতে লাগলো! কিন্তু মুখ লুকিয়ে রাখায় কান্নার শব্দ বেশি পাওয়া যাচ্ছে না!
নাফিসা কাদতে কাদতে বললো, “মেঘ ওই লোকটা আবার এসেছে কেন এ বাড়িতে! বারবার আসে কেন এখানে!”
কথা অস্পষ্ট হওয়ায় মেঘ কিছুই বুঝতে পারছে না! তাই বললো,
- কি বলেছো, বুঝিনি। আবার বলো।
- ওই লোকটা বারবার আসে কেন! দেখতে পারিনা আমি! একদম দেখতে পারি না!
- কার কথা বলছো তুমি?
- জানি না! আমি থাকবো না এখানে! আর থাকবো না এক মুহুর্তও! সিলেট রেখে আসুন আমাকে!
এমন অস্পষ্ট কথা আর কান্না মেঘের মোটেও ভালো লাগছে না। তবে মাথা খাটিয়ে কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে মেঘ!
দীপা চাকমা যখন বলেছিলো নাফিসার বাবার নাম সৈকত মির্জা তখনই মারিশার বাবার কথা মনে পড়েছিলো। কিন্তু মোটেও এমন কিছু সন্দেহ করেনি তাকে নিয়ে, শুধু মাত্র নামের মিলটা পেয়েই মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন তো অনেকটা সন্দেহ করছে, নাফিসা এখন সৈকত মির্জাকে দেখেই কাদছে! তাহলে কি তিনিই নাফিসার বাবা!
পর্ব – ৪০
নাফিসা জোকের মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে মেঘকে। মেঘ নাফিসাকে ছাড়িয়ে সোজা করে বললো,
- মেঘা চুপ করো। তাকাও আমার দিকে। আংকেল কি তোমার বাবা?
নাফিসা কেদেই যাচ্ছে, মেঘ নিচু স্বরেই ছোটখাটো একটা ধমক দিয়ে বললো, - কি বলছি, তোমার কানে যাচ্ছে না! অযথা এভাবে কাদার কোনো মানে হয়? বলো, তিনিই কি তোমার বাবা?
নাফিসা নিজের মুখ চেপে ধরে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। চাইলেও যে কান্না থামাতে পারছে না!
মেঘ ছোট একটা নিশ্বাস ছাড়লো। এবার নিজেই নাফিসার আরও কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
- এই বোকা মেয়ে, কাদছো কেন তুমি! বাবাকে পেলে মানুষ খুশি হয় আর তুমি কাদছো!
- তিনি আমার বাবা না! এমন লোক কারো বাবা হতে পারে না।
- হয়েছেন তো। তিনি মারিশার বাবা। কান্না থামাও তুমি।
মেঘ চুপ করে বসে রইলো। নাফিসা আস্তে আস্তে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে ! এখনো নাক টেনে কাদছে! কাদো কাদো গলায় বললো, - মেঘ, কেউ যেনো কখনো না জানতে পারে এসব! আমি আর আম্মি অনেক ভালো আছি! তুমি কাউকে না জানালে কেউ কিছু জানবে না! প্লিজ মেঘ, বলো না কাউকে! এতো বছর পর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না আমি! আম্মি এসব জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে! জানো, এজন্য সেদিনের পর আমরা আর কখনো ঢাকায় আসিনি। শুধুমাত্র এই ভয়ে! আজ সেটাই সামনে দাড়িয়ে আছে!
- আমি তো বলবো না কিন্তু তোমার রিয়েকশনেই তো সবাই জেনে যাবে! সেটা কি বুঝতে পারছো! এখন তুমি যে কাদছো সেটা যদি মা, বাবা কেউ বুঝতে পারে তাহলে তারা জিজ্ঞেস করবে না কেন কাদছো তুমি? তখন কি বলবো বলো! কালকেও কেদেছো আজও কাদছো এসব কি কিছুই বুঝতে পারবে না তারা? এভাবে আর কখনো কাদবে না।
- তারা এবাড়িতে কেন আসে! সহ্য করতে পারি না আমি! কাল সেই মেয়েটাও আমাকে কটু কথা শুনিয়ে গেছে!
- মেহমান, আসতেই পারে। তাদের কি আর তাড়িয়ে দেওয়া যাবে! এতো ভেঙে পড়ো কেন তুমি! কাল কথা শুনিয়ে গেলো উপযুক্ত জবাব দিলে না কেন! কথা সে জানে আর তুমি কি জানো না! নিজেকে তো নিজেই ছোট বানিয়ে রাখো! বৌভাতের সেই প্রোগ্রামে কি আংকেলকে দেখে কেদেছো তুমি?
- হুম!
- মেঘা, শক্ত করো নিজেকে। এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না! কঠোর করো মনটাকে! আর অযথা চোখে বন্যার সৃষ্টি করবে না। নিজেকে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে সক্ষম হও। আংকেল বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মারিশাও খুব আদরের তাছাড়া আমরা ছোট থেকেই একে অপরের সাথে বন্ধুসুলভ। তারা যেকোনো সময়ই আসতে পারে বাসায়। আর কখনো তাদের দেখে এমন রিয়েক্ট করবে না। নিজেকে স্ট্রং করবে, হুম?
- হুম।
- যাও, ওযু করে নামাজ পড়ো।আমিও পড়বো তোমার সাথে।
নাফিসা ওযু করতে চলে গেলো। দুজনেই একসাথে নামাজ আদায় করলো। নাফিসা আর বের হয়নি রুম থেকে। মেঘ বের বয়েছে, তার কাছে জানলো সৈকত মির্জা এখনো যায়নি। ডিনার করবে তাদের সাথে। বৃষ্টি এলো তার সাথে গল্প করতে। মির্জা সাহেব চলে গেলে নাফিসা, বৃষ্টি, মোহিনী ও মেঘ একসাথে ডিনার করলো। মেঘ রুমে চলে গেছে নাফিসা মোহিনীর সাথে প্লেট গুছিয়ে রাখছে। কাজ শেষ হয়ে এলে রায়হান চৌধুরী মেঘকে ডাকলেন। মেঘ বেরিয়ে এসে বাবার কাছে বসলো।
- হ্যাঁ বাবা, বলো।
- নাফিসা কি পড়াশোনা করবে না?
মেঘ এতো টেনশন আর কাজের চাপে এতোদিন ভুলেই গিয়েছিলো নাফিসার পড়াশোনার কথা! সে নাফিসার দিকে একবার তাকালো। নাফিসাও একবার মেঘের দিকে তাকাচ্ছে আবার রায়হান চৌধুরীর দিকে তাকাচ্ছে! মেঘ বললো, - বাবা, আমি তো পড়াশোনা করাতেই চাইছিলাম! তুমি কি বলো!
- আমি আবার কি বলবো! পড়াশোনা শেষ করবে না সে! সব সুযোগ আছে, তাহলে পড়বে না কেন! নাফিসা, পড়বে না?
নাফিসা কিছুই বলছে না! কি বলবে সে নিজেই বুঝতে পারছে না! মোহিনীও বললো, - পড়বে না কেন! বিয়ে হয়েছে বলে কি পড়াশোনা থেমে যাবে নাকি! সংসারে কোনো কাজ নেই, এটাই সুবর্ণ সুযোগ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত তাহলে সে বাদ পড়বে কেন! ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য এপ্লাই করো। বৃষ্টি, এপ্লাইয়ের শেষ সময় কবে?
- ন্যাশনালে এপ্লাই করার ডেট তো শেষ! আমি তো মেডিক্যালে এপ্লাইয়ের জন্য কোচিং করছি, ভাবি তো কমার্সের স্টুডেন্ট!
বাবা মেঘকে বললো,
- ডেট শেষ হয়ে গেছে, আগে খোঁজ রাখবি না! এখন একটা বছর পিছনে পড়ে গেলো!
- বাবা, আমার মনে ছিলো না একটুও!
- হ্যাঁ, পড়াশোনার কথা তোর মনে থাকবে নাকি! নিজেই তো পড়াশোনায় ফাকি দিয়ে এসেছিস সবসময়!
বৃষ্টি হিহি করে হেসে উঠলো। মোহিনীর মুখেও মৃদু হাসি!
মেঘ কিছুটা লজ্জা পেয়ে বললো, - এখন আরও কত কিছুই না বলবে! বৃষ্টি, পাবলিক ভার্সিটির এপ্লাই কি শেষ?
- না।
মোহিনী বললো, - নাফিসা তো কোচিং করেনি, পাবলিকে পারবে?
মেঘ নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো, - পারবে?
নাফিসা মাথা নাড়িয়ে ইশারা করলো পারবে না! রায়হান চৌধুরী বললো, - থাকুক তাহলে, আগামী বছর সময়মতো এপ্লাই করো। পড়াশোনা শুধু শুধু বন্ধ করো না। অন্তত অনার্স কমপ্লিট করো।
রায়হান চৌধুরী ড্রয়িং রুমে চলে গেলে নাফিসা সবকিছু গুছিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছে বৃষ্টিও যাচ্ছে পিছু পিছু। মেঘ আগেই রুমে এসে গেছে। রুমে ঢুকতে ঢুকতে বৃষ্টি বললো, - ভাবি, তুমি বাসায় পড়েও কিন্তু পাবলিকে ট্রাই করতে পারো। টিকো আর না টিকো, এক্সপারিয়েন্স আসবে।
- না, থাক। আগামী বছর ন্যাশনালে দেখবো।
- হু, তোমার ইচ্ছা। গুড নাইট।
- গুড নাইট।
নাফিসা এসে ঘুমানোর জন্য বিছানা ঠিক করতে লাগলো। মেঘ বললো, - মেঘা, কেমন তুমি! আমাকে একবার মনে করিয়ে দিবে না! নানান টেনশনে সত্যিই আমি ভুলে গিয়েছিলাম!
- এতো টেনশন করতে হবে না। আমি পড়বো না।
- পড়বে না কেন?
- যতটুকু পড়েছি ততটুকুই অনেক। পড়াশোনা করে কি করবো।
- কি করবে মানে! পড়াশোনা কেন করে মানুষ! নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও না?
- না করাই উত্তম মনে করি। কেননা, বিবাহিত নারীরা পড়াশোনা করে নিজে যদি স্বামীর চেয়েও বেশি যোগ্যতার ক্ষমতা রাখে তাহলে অহংকার বেড়ে যায় তাদের! আশেপাশের কাউকে গন্য করবে না, নিজেকেই সবকিছুতে মুখ্য ব্যক্তি ভাববে! এভাবে সংসারে অশান্তির ছায়া পড়ে।
মেঘ নাফিসার কাছে এসে বসলো এবং বললো, - যুক্তি আছে তোমার কথায় কিন্তু শিক্ষা লাভ করতে তো কোনো সমস্যা নেই! তুমি অন্যান্য কাজে না জড়িত হও, কিন্তু নিজে উচ্চ শিক্ষিত হও। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তো সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করতে পারবে। তুমি নিজে এমন গুটিয়ে চললে, বাচ্চারাও এমন ভাবেই চলতে শিখবে! আল্লাহ না করুক, যে কোন সময় দুর্ঘটনার সম্মুখীনও হতে পারো! যেখানে তোমার শিক্ষা তোমাকে বাচতে সহযোগীতা করতে পারবে। মা বাবা কি বললো শুনোনি! তাছাড়া বৃষ্টিও কিন্তু ভুল বলেনি! বাসায় পড়ে ট্রাই করতে পারো।
নাফিসা মুখটা মলিন করে বললো, - অনেকদিন গেভ দিয়ে ফেলেছি পড়াশোনায়! তাছাড়া ন্যাশনাল হলে মানা যেতো কিন্তু পাবলিকের জন্য কি সম্ভব! পারবো না আমি!
মেঘ তার সাথে ঘেঁষে বসে বললো, - বোকা মেয়ে, চেষ্টা তো করতে পারো। না টিকলে নেই! পরের বছর আবার দিবে। এখন বৃষ্টির হেল্প নিতে পারো। কোচিং-এ ভর্তি করিয়ে দেই, যতদিন বাকি আছে ততদিন ক্লাস করো।
নাফিসা কিছু বলছে না, শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। মেঘ তার মাথায় মাথা ঠুসে আহ্লাদী সুরে বললো,
- এই, সুযোগ থাকতে অবহেলা করবে কেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাত কলেজে এপ্লাই করে দেই? হুম? বলো?
নাফিসা এ পরিবারের সদস্যদের যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে! আর মেঘের কথা তো না বললেই নয়! যার নিজেকে নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই সেখানে তাকে নিয়ে এতো আগ্রহ তাদের! নাফিসা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, মেঘের চোখেই যেন ভাসছে তার স্বপ্ন! মেঘের স্বপ্নসমৃদ্ধ দৃষ্টি তাকে সাড়া দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে! সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নাফিসা বললো, - কোচিং করবো না। বাসায় পড়েই এক্সাম দিবো। না পারলে কিছু বলতে পারবে না কিন্তু!
মেঘ মুচকি হেসে নাফিসাকে ছেড়ে দিয়ে দ্রুত বৃষ্টির কাছে চলে গেলো। বৃষ্টির কাছে সকল তথ্য জেনে আবার রুমে চলে এলো। আম্মির কাছে কল করে নাফিসার এডমিট কার্ডের কিছু তথ্য নিয়ে নোট করলো। নাফিসা আম্মির সাথে কথা বলছে আর এদিকে মেঘ এপ্লাই করে দেওয়ার জন্য বৃষ্টির কাছে নোট দিয়ে এলো। বৃষ্টি জানিয়েছে, কিছু বিষয়ে নিজে হেল্প করবে নাফিসাকে আর তার কমার্স গ্রুপের ফ্রেন্ড আছে, বাকি বিষয়গুলো তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিবে।
৩৮
পাবলিক ইউনিভার্সিটির জন্য বৃষ্টি এপ্লাই করে দিয়েছে আর শুরু হয়ে গেছে নাফিসার ব্যস্ত জীবন! মোহিনীর কাজেও মাঝে মাঝে হেল্প করে আবার পড়াশোনায়ও মনযোগী। বৃষ্টি কোচিং-এ থাকাকালীন সে বাসায় পড়ে আর বৃষ্টি এলে তার সাথে সময় কাটায়।
আজ সন্ধ্যায় রায়হান চৌধুরী একা বাসায় ফিরেছে। মোহিনী মেঘের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন কাজ আছে তাই মেঘ আসেনি! রাতের বেলাও কি কাজ সেটা নাফিসা বুঝতে পারছে না আবার মেঘ সম্পর্কে বাবা মা কে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না! খাওয়ার একটু আগে নাফিসার ফোনে মেঘ কল করলো,
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। খেয়েছো, মেঘা?
- উহুম। বাসায় আসবে কখন?
- একটু কাজ আছে তাই আজ ফিরবো না। তুমি খেয়ে বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে ঘুমাও আজ।
- কোথায় আছো?
- বললাম তো, কাজে এসেছি। আমার চিন্তা করো না। আর শুনো, নিজে নিজে আবার কাটা বেছে খেতে যেও না! আমি বৃষ্টিকে বলে দিচ্ছি তোমার সাথে ঘুমাতে। দুজন একসাথে হয়ে আবার গল্প করে সারারাত পাড় করে দিও না। তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে।
- ওকে। তুমি খেয়েছো?
- খাবো এখন।
কল কেটে রাখতেই মেঘের নম্বর থেকে একটা মেসেজ এলো, ” সরি, মিসেস! আজ রাতটা অন্যদিনের মতো স্পেশালভাবে কাটাতে পারলাম না! কষ্ট হলেও ঘুমানোর চেষ্টা করো।”
পরপরই আরেকটা মেসেজ এলো, ” টেক্সট ডিলিট করে দিও, বৃষ্টি দেখলে আবার প্রব্লেম হবে! ” নাফিসা মৃদু হেসে মেসেজ ডিলিট করে দিলো।
রাতের খাওয়া শেষে বৃষ্টি তার রুমে এলো। ফোনটা নিয়ে আকাশের ফোনে ডায়াল করলো। আকাশ একটু লেট করেই ফোন রিসিভ করলো।
- বলো?
- কি বলবো?
- কল করেছো কেন?
- কেন, কল করতে পারিনা?
- কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই না।
- আচ্ছা, বলো তো আমাকে এতো ইগনোর করো কেন তুমি?
- সবাই তো আর তোমার মতো ফ্রী থাকে না!
- এতো ব্যস্ত কি নিয়ে?
- তোমার কাজে আমি কখনো জানতে চেয়েছি তুমি কি করছো!
- জানতে চাও না কেন! আমি তো সেটাই চাই, যেন তুমি আমার সম্পর্কে সবটা জানতে চাও!
- প্রয়োজন মনে করি না জানার।কথা বলে অযথা সময় নষ্ট করছো! এ সময়টা পড়াশোনায় ব্যয় করলে ভালো ফল পাবে।
- সারাক্ষণ পড়া পড়া আর পড়া! তুমি কতটুকু পড়েছো সেই খেয়াল আছে! আসছে আবার অন্যকে সাজেস্ট করতে! এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকতো! তাহলে ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট হতে পারলে না কেন!
আকাশ কিছু বলছে না, বৃষ্টিও চুপ করে আছে! কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে আকাশ বললো, - কল কেটে দিবো?
বৃষ্টি মৃদু স্বরে বললো, - আকাশ এমন করো কেন তুমি! আমি কি খুব বেশি সময় নষ্ট করে ফেলি তোমার! চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পাচ মিনিটও কি আমাকে দিতে পারো না! সেদিনও তুমি নিজে থেকে এসে আমাকে কষ্ট দিয়ে গেছো! এসবের মানে কি? শুধু শুধু এতো কষ্ট দাও কেন! এতো রাগিয়ে দাও কেন আমাকে?
- সব প্রশ্নের উত্তর সবসময় দেওয়া যায় না।
- তুমি কখনোই দাও না!
- এখন কি চাও সেটা বলো।
- কাল একবার আসবে দেখা করতে? সেই রেস্টুরেন্টেই। প্লিজ না করো না! একবার এসো। দশ মিনিটের জন্য অন্তত।
- ওকে।
- সত্যি!
- এখন “না” বলবো?
বৃষ্টি হিহি করে হেসে উঠে বললো, - উহুম! যাও, তোমার সময় আর নষ্ট করলাম না। গুড নাইট।
- গুড নাইট।
বৃষ্টি খুশি মনে বেরিয়ে নাফিসার কাছে চলে গেলো। দু একটা কথা বলে দুজনেই চোখ বন্ধ করে ঘুমের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু কেউই ঘুমাতে পারছে না! নাফিসার মেঘকে ছাড়া ঘুম আসছে না আর এদিকে অতি খুশিতে বৃষ্টির চোখে ঘুম নেই! সে নানান পরিকল্পনা করতে লাগলো কালকের জন্য!
পর্ব – ৪১
সকালে ঘুম থেকে উঠেই নামাজ পড়ে বৃষ্টি কিচেনে চলে এলো। মোহিনী রান্না বসানোর ব্যবস্থা করছিলো। নাফিসাও রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। বৃষ্টি বললো,
- আম্মা, সরো। আজ আমি রান্না করি!
- নাফিসা, সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়েছে তো!
মোহিনীর কথা বলার ভঙ্গি দেখে নাফিসা মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো আর বৃষ্টি নাক ফুলিয়ে বললো, - এমন ভাব করছো যেন আমি কখনো রান্না করিনি! এদিকে আসো তুমি, আমি আজ বিরিয়ানি রান্না করবো।
- মেঘ বাসায় নেই, তাছাড়া তোর বাবা একটু পর অফিস যাবে। আজ রান্না করতে হবে না।
- রান্না করতে বেশিক্ষণ লাগবে না! বাবা খেয়েই অফিস যেতে পারবে।
- যাক, তাহলে আমি ছুটিতে যাই!
- হুম যাও!
মোহিনী বেরিয়ে গেলো আর নাফিসা বৃষ্টিকে হেল্প করছে। রান্না প্রায় শেষ পর্যায়। মোহিনী এসে ফোন দিয়ে গেলো। লাউড স্পিকারে রেখে বৃষ্টি কথা বলছে, - ভাইয়া, বিরিয়ানি রান্না করছি আজ!
- যাক, বেচে গেলাম!
- বাচতে দিবো না! আমার জিনিস আমি আদায় করে ছাড়বো।
- কেন, আমি কি তোর রান্না খাবো নাকি!
- আমি তো নিষেধ করিনি! কবে ফিরবে তুমি?
- আজ বা কাল!
- কোথায় আছো?
- পৃথিবীতে।
- স্টুপিড! কখনো ঠিকমতো সত্যি কথা বলে না!
মেঘ হেসে উঠে বললো, - সত্যিই তো বললাম। মেঘা কোথায়?
- মেঘের পাশে।
- তোর কাছে নেই?
- বলবো কেন!
- দূর! ফোন রাখ!
মেঘ কল কেটে দিলো। নাফিসা তাদের ভাইবোনের কথা বুঝতে না পেরে বললো, - বৃষ্টি, তোমার ভাইয়া বেচে গেলো কেন? বুঝলাম না!
- আমার হাতের রান্না খেলে গিফট দিতে হবে তাই বেচে গেছে!
- ওহ!
- হুম, যাও গিয়ে দেখো তোমার ফোনে হয়তো অসংখ্য কল দিয়ে যাচ্ছে।
নাফিসা কাজ শেষ করে চলে গেলো। বৃষ্টি তার রান্না শেষ করলো। সবাই একসাথে নাস্তা করছে। রায়হান চৌধুরী খাওয়া শেষ করে বৃষ্টির হাত এক টাকার একটা লাল পয়সা দিলো। - বাবা, আমি কতবার রান্না করেছি সেই হিসেব কিন্তু তোমার দেওয়া লাল পয়সা ঠিকই রেখেছে!
- কত হলো?
- ছয় টাকা!
- আমি কিন্তু আরও অনেক জমা করে রেখেছি!
মোহিনী বললো, - জমা করে কি লাভটা হয়েছে! এই পয়সার চালান আছে! এখন এটা মূল্যহীন!
বৃষ্টি প্রতুত্তরে বললো, - মা, তুমি বুঝবা কি এর মূল্য! এটা আমাদের ভালোবাসার মূল্য!
মোহিনী চুপ হয়ে গেলো! এর উপর আর কোন কথা বলা যায় না! রায়হান চৌধুরী বললেন,
- কি হার মানতে হলো তো! তোমার কাছে লাল পয়সার মূল্য নেই, আমার মেয়ের কাছে আছে!
সবার মুখেই প্রশান্তির হাসি লেগে আছে! নাফিসা এদের যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে! এতো বেশি মেধাবী আর পারস্পরিক সহানুভূতিশীল পরিবার তার এই প্রথম দেখা! বাবা মেয়ের মধ্যে এতো খুশগল্প থাকে সেটা তাদের না দেখলে জানতোই না কখনো!
খাওয়া শেষে বৃষ্টি বন্ধুদের কথা বলে বক্সে বিরিয়ানি তুলে নিলো। কোচিং শেষে বান্ধবীদের সাথে একটু ঘুরেবেড়াবে বলে মায়ের কাছ থেকে গাঢ় সবুজ রঙের একটা জামদানী শাড়ি নিলো। নাফিসার সাহায্যে শাড়িটা খুব সুন্দর ভাবে পড়ে নিলো। বেশি সাজুগুজু করেনি, শুধু চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়েছে! প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে বৃষ্টির চেহারায়। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। কোচিং-এ বন্ধুবান্ধব দেখে নানা প্রশংসা আর জিজ্ঞাসা! বৃষ্টি বলে দিলো, কোচিং শেষে বেড়াতে যাবে তাই বাসা থেকে একবারে রেডি হয়ে এসেছে।
আজও বাড়িতে মারিশা এসেছিলো। মেঘকেও পেল না বৃষ্টিকে ও পেল না! পেয়েছে মোহিনী আর নাফিসাকে! নাফিসা মোহিনীর সাথে বসেই ড্রয়িং রুমে টিভি দেখছিলো। মারিশা মোহিনীর পাশে বসে বললো,
- আন্টি, বৃষ্টি কখন ফিরবে?
- আজ নাকি একটু দেড়ি হবে। ফ্রেন্ডের সাথে বেড়াতে যাবে।
- ওহ, ভালো। ঘুরাফেরা করলে মন ভালো থাকে! আমারও একা ভালো লাগছিলো না তাই তোমার কাছে চলে এলাম। আর প্রায়ই এসে বিরক্ত করে ফেলি!
- একটা মাইর দিবো! কিসের বিরক্ত হুম? যখন ইচ্ছে তখন চলে আসবে। আমি আছি, নাফিসা আছে আমাদের সাথে এসে গল্প করবে। একা একা থাকো কেন বাসায়!
- হুম, গল্প করতেই তো চলে এলাম। নাফিসা, সিলেট যাচ্ছো কবে?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে নাফিসা হতবাক! সে কিছু না বলে একবার মোহিনীর দিকে তাকালো আবার মারিশার দিকে তাকালো। মোহিনী বললো,
- সিলেট কেন যাবে! মেয়েদের আসল ঠিকানা শ্বশুর বাড়ি! আর এখন এটাই নাফিসার নিজের বাড়ি।
মারিশা হেসে জবাব দিলো,
- কি বলো আন্টি! বেড়াতে যাবে না! বিয়ের পর মেয়েরা বাবার বাড়ির জন্য আরও বেশি পাগল হয়!
- তা ঠিক বলেছো।
- হুম, কবে যাচ্ছো নাফিসা? বলতে ভয় পাচ্ছো না-কি! চিন্তা করো না, আমি তোমার সাথে যেতে চাচ্ছি না! আমি আমার জায়গায়ই থাকবো।
মারিশা আর মোহিনী একজোটে হেসে উঠলো। নাফিসা বললো, - ও যেদিন নিয়ে যাবে, সেদিনই যাবো।
মোহিনী বললো, - মারিশা তুমি যেতে চাইলে নাফিসা না করবে না!
- থাক যেতে চাচ্ছি না! আমার এ জায়গাই পছন্দ।
- চলো, খাওয়াদাওয়া করা যাক।
- না, আন্টি। আমি আজ খেয়ে এসেছি।
- তো কি হয়েছে, আমাদের সাথে আবার খাও।
- উহুম, একটুও ক্ষুধা নেই।
- বৃষ্টি বিরিয়ানি রান্না করেছে। অল্প হলেও খেতে হবে। চলো।
মারিশা গেলো টেবিলে। নাফিসা প্লেট ধুয়ে এনে টেবিলে রাখলো। প্লেটে খাবার বাড়তে যাবে এমন সময় মারিশা উঠে এসে চামচ নিয়ে নিলো। মুখে হাসি ফুটিয়েই বললো,
- তুমি তো সবসময়ই খাবার বেড়ে দাও, আজ না হয় আমি দেই। এ বাড়িতে তোমার অধিকার থাকলে আমারও তো অধিকার আছে! আন্টির প্রতি তো আমারও দায়িত্ব আছে। কি বলো আন্টি?
মোহিনী মুচকি হেসে জবাব দিলো,
- হুম।
মারিশা নাফিসাকে বললো, - তুমি আজ মেহমানের মতো চেয়ারে বসো, আমি প্লেটে খাবার দিচ্ছি।
নাফিসা কিছু বললো না। চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লো। মেহমান শব্দটা শুনে তার ভেতরে মোচড় দিয়েছে! সত্যিই কি সে এ বাড়ির মেহমান হয়ে এসেছে! মেঘ তাকে মেহমান বানিয়ে এনেছে! ভেতরের কষ্টগুলো চাপা পড়ে আছে! মেঘ তো বলেছিলো তাকে শক্ত হতে! মেঘের কথা অনুযায়ী সে নিজেকে সেভাবেই গড়ে তুলছে। কিন্তু মুখে মুখে জবাব দিতে গেলে সেটা তর্ক হয়ে যাবে! আম্মি ছোট থেকেই নিষেধ করেছে কারো সাথে তর্ক করতে! বড়দের সাথে কথা সাজে না! মারিশা তার চেয়ে অনেক বড়। কথার উপর কথা বললে কথা বাড়ে আর বেয়াদবির পরিচয় পাওয়া যায়! তার আম্মির দেওয়া শিক্ষার সম্মানহানি হতে দিবে না সে! তাই সহ্য করে যাচ্ছে সব! খাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে মা এর কাছে বলে রুমে চলে গেলো নাফিসা। মারিশা মোহিনীর সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে তারপর বেরিয়েছে।
কোচিং শেষ করে বৃষ্টি সেই রেস্টুরেন্টে গিয়ে আকাশের অপেক্ষা করতে লাগলো। কিন্তু আকাশের খবর নেই! কয়েকবার কল করলো আকাশ ফোন রিসিভ করছে না! এক পর্যায়ে তার ফোন বন্ধ পেলো! আধঘন্টার মতো বসে অপেক্ষা করেছে আকাশের জন্য, কিন্তু আকাশ এলো না! যদি না ই আসতে পারবে তাহলে বলেছিলো কেন আসবে! বৃষ্টির কান্না পাচ্ছে খুব! বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে রেগেমেগে বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে!
মুখ ফুলিয়ে বাসায় ফিরেছে কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি। নিজের রুমে এসে বালিশে মুখ চেপে ইচ্ছেমতো কান্না করতে লাগলো! কার জন্য শুধু শুধু এতো পাগল হয়ে আছে সে! অযথা কেন এই লোকটাকেই পেতে চায়, সবসময় যে তাকে অবহেলাই করে গেছে! সবসময় যে তাকে কাদিয়েই গেছে তাকেই কেনো ভালোবাসে সে! আকাশ তো বলেছিলো তাকে ভালোবাসে, তাহলে তার সাথে এমন করে কেন সে! কই সে তো একটুও ভালোবাসে না! তাহলে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়েছিলো সেদিন! অনেক হয়েছে! আর না! আকাশকে ভুলে যাবে, আর কাদবে না তার জন্য! মানুষকে বেশি গুরুত্ব দিলে সে আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলে দেয়! প্রয়োজন নেই তাকে, আর ভাববে না আকাশকে নিয়ে! আর কখনো কল করবে না, দেখাও করতে চাইবে না!
বেশ কিছুক্ষণ কান্না করে বৃষ্টি চোখের পানি মুছে ফোনটা নিয়ে আকাশের নম্বর ব্লক করে দিলো। তাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো। একবারে তো আর পারবে না তবে ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলবে আকাশ নামটাকে!
সারাদিন বিষন্নভাবেই কাটালো সে। পরক্ষণে নিজেকে অন্যান্য কাজে নিয়োজিত করে আকাশকে ভুলতে চেষ্টা করলো।
মেঘ সেদিন রাতেই বাসায় ফিরেছিলো। নাফিসা ঢাকায় আছে একমাসেরও বেশি হবে। আম্মিকে দেখে না কতোদিন হয়ে গেছে! তাছাড়া মেঘকে আর আগের মতো মনে হয় না তার কাছে। অনেক পরিবর্তন খুজে পেয়েছে যেটা মানতেই পারছে না নাফিসা!
মারিশা প্রায়ই বাসায় আসতো। মেঘের সাথে গল্প করতো, মেঘকে জোরজবরদস্তি করে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছে দুইদিন! নাফিসাকে যেতে বলেছিলো মেঘ কিন্তু মারিশার সাথে নাফিসা কখনোই ঘুরতে যাবে না! মেঘ প্রায়ই বাসায় ফিরে না! বাড়ির বাইরে কাটায় দু তিনদিন!
দিনে না হয় কাজ থাকে কিন্তু রাতে কিসের কাজ তার! আর মেঘ সবসময় তাকে পড়াশোনার জন্য তাড়া করে রাখে। বৃষ্টির সহযোগিতায় সে এক্সামও দিয়েছে। মারিশা এ পরিবারের সবার কাছেই খুব গ্রহণযোগ্য পাত্রী! নাফিসাকে ইশারা ইঙ্গিতে কতটা আঘাত করে যায় সেটা দেখতে পায়না কেউ! সবকিছু, মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছে নাফিসা। কোনো জবাবদিহিতা চায়না মেঘের কাছে! মেঘকে এতোটা আপন করে নিয়েছে এখন তার কাছেই অবহেলিত! দিন যত পাড় হয়েছে মেঘের দুরত্ব সে ততই অনুভব করেছে!
নাফিসা জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে। শীতকাল ছুইছুই, দুপুরের মিষ্টি রোদ দেহকে কোমল স্পর্শ দিতে পারলেও মনটাকে স্পর্শ করতে পারছে না! সবথেকেও তার যেন কিছুই নেই! আগের জীবনটা নিরানন্দ থাকলেও সেটাই ভালো ছিলো। মেঘ নামক মানুষটা এসে তার সাদাকালো জীবন রঙিন করে পালিয়ে গেছে! এখন যে এই রঙ তার ভালো লাগছে না! তুচ্ছ মনে হচ্ছে সব কিছু! পালিয়েই যখন যাবে, অযথা রঙের পরিচয় দেওয়ার কি প্রয়োজন ছিলো!
এখন আর দিনগুলো আগের মতো উজ্জ্বল রশ্মি ছড়ায় না! রাতগুলো আর আগের মতো মধুর হয় না! মেঘের পরিবর্তন মনে বিষন্নতা ডেকে আনছে।
রুমে এসে নাফিসার বিষন্ন হয়ে থাকা বাইরে দৃষ্টি দেখে বৃষ্টি বললো,
- কি ভাবছো এমন করে?
নাফিসা পেছনে ফিরে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো, - কিছু না।
- উহুম, তোমার মন খারাপ! ভাইয়াটাও আজকাল কাজের প্রতি বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে! তোমাকে বেড়াতেও নিয়ে যায় না কোথাও! বাসায় ফিরুক, জবাব নিবো আজ।
- আমি কোথাও ঘুরতে যাবো না। তোমার ভাইয়া এমনিতেই কাজে ব্যস্ত। শুধু শুধু এসব বলো না।
- বাব্বাহ! দরদ কতো! চলো আজ তুমি আর আমিই ঘুরে আসি বাইরে থেকে।
- না, ভালো লাগছে না। যাও তুমি।
- ভালো লাগছে না বলেই তো যেতে চাচ্ছি। চলো তো। শপিং মলে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো একটু। চলো শপিং করতেই যাই।
- ইচ্ছে করছে না যেতে।
- ইচ্ছে না করলেও যাবো। তাড়াতাড়ি রেডি হও। আমি এখনই আসছি মা কে বলে।
নাফিসাকে তাড়া দিয়ে বৃষ্টি চলে গেলো রেডি হতে। মোহিনী এসেও বললো, বাইরে থেকে ঘুরে আসতে। তাই নাফিসাকে যেতেই হলো। প্রথমেই বৃষ্টির সাথে শপিংমলে এলো। প্রয়োজনীয় কিছু কিনলো দুজনেই। শপিং শেষে নাফিসাকে সাথে নিয়ে বাইরে ফুচকা খেতে এলো বৃষ্টি।
দুজনেই প্রতিযোগিতা নিয়ে ফুচকা খেলো! খুব মজা পেয়েছে দুজন! বৃষ্টি এতোটা স্মার্ট, পাশে থাকা সকলকেই স্মার্ট বানাতে সক্ষম এই মেয়েটা! নাফিসার মনটা ভালো হয়ে গেছে বৃষ্টির সাথে বাইরে এসে! সারাক্ষণ মজার গল্প করে হাসিয়ে যায়!
ফুচকা খাওয়া শেষে দুজনেই কথা বলতে বলতে হাটতে লাগলো রাস্তার পাশ দিয়ে। কিছুটা পথ যেতেই আকাশ সামনে পড়লো সাথে দুজন লোকও আছে। বন্ধুবান্ধব হবে হয়তো! বৃষ্টি আর আকাশ দুজনেই একে অপরকে দেখে থমকে গেলো! আকাশ হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছিলো, নাফিসাকে পাশে দেখে থেমে গেলো। বৃষ্টি না দেখার ভান করে নাফিসার সাথে কথা বলতে বলতে হাটতে লাগলো। আকাশের একদম কাছাকাছি আসতেই আকাশ মৃদু স্বরে বললো,
- তোমার ফোন বন্ধ কেন?
বৃষ্টি না শুনার ভান করে নাফিসার সাথে কথা বলতে বলতে হাটছে। নাফিসা বললো,
- তোমাকে মনে হয় লোকটা কিছু জিজ্ঞেস করেছে!
- আমাকে! আমাকে কেন জিজ্ঞেস করবে! আমি চিনি না তো উনাকে! অন্য কাউকে বলেছে হয়তো!
- তোমাকেই বললো মনে হচ্ছে! সিলেট যে একটা ছেলের সাথে দেখেছিলাম উনার মতো মনে হচ্ছে!
- আরে নাহ! সেটা তো আমার ফ্রেন্ড ছিলো! অনেক হেটেছি, চলো এবার রিকশায় উঠে বাসায় যাই।
কথাগুলো শুনে আকাশ রাগে ফুসছে! তাকে ইগনোর করা তো কিছুতেই মানতে পারছে না! নাফিসা না থাকলে এখন অনেক কিছুই জানিয়ে দিতো বৃষ্টিকে! তাকে চেনে না! কথা শুনেও শুনেনি! কি করে এমন আচরণ করতে পারলো তার সাথে!
পর্ব – ৪২
এদিকে বৃষ্টি রিকশায় উঠে গেছে নাফিসার সাথে। বাইরে থেকে ঘুরে এসে দুজনেই একটু সতেজ হয়েছে! মনটা ফ্রেশ হয়ে গেছে! বৃষ্টির তো আকাশের মনোভাব দেখে আরও বেশি আনন্দ লাগছে! আকাশ তাহলে তাকে কল করেছিলো নিজ থেকে! তা না হলে তো জানতো না ফোন বন্ধ কি-না!
এর আগেও নাকি তার বান্ধবী নিতুর কাছে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো আকাশ! আজ আবার তার সাথেই দেখা! ইগনোর করতে পেরে মুখে হাসি ফুটিয়ে বৃষ্টি মনে মনে বললো, “ভালোবাসো তবুও অবহেলা করো! খুব তো জ্বালিয়েছো আমাকে, এবার নিজে ফল ভোগ করো মিস্টার আকাশ! আমিও ধরা দিচ্ছি না তোমার কাছে! ফলাফল যা হবার হবে। আমার প্রতি তোমার ফিলিংস থাকলে অবশ্যই তোমাকে পাবো আর না থাকলেও আফসোস করবো না! বরং ভাগ্যকে মেনে নিবো।”
গত দুদিন যাবত বাসায় ছিলো না, আজ সন্ধ্যায় ফিরেছে মেঘ। বৃষ্টির সাথে সারাদিন ঘুরে নাফিসার এখন মাথা ব্যথা করছে। মায়ের সাথে রান্নার কাজে হেল্প করেনি আজ সে। গিয়েছিলো কিন্তু মোহিনীই বলেছে বিশ্রাম নিতে। মেঘ রুমে এসে দেখলো নাফিসা চোখের পাতা বন্ধ করে খাটে বসে আছে। মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে মেঘ নাফিসার কাছে গেলো। কপালে উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে নাফিসা চোখ খুলে তাকালো আর মেঘের হাসিমাখা মুখটা দেখতে পেল। মেঘ পাশে বসে বললো,
- কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
- তুমি থেকে আবার আপনি হয়ে গেলাম! এভাবে বসে আছো কেন! শরীর খারাপ?
- না।
- ঠান্ডা লাগছে না, শীতের জামা কোথায়!
নাফিসা কিছু বললো না। মেঘকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তাই সে উঠে মেঘের জামাকাপড় আর তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে রেখে এলো। নাফিসা আবার খাটে এসে বসছিলো। মেঘ শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
- বেগম কি আমার উপর রেগে আছে?
নাফিসার কোনো উত্তর পেলো না। তাই আবার বললো, - আর কয়েকটা দিন আমার উপর রাগ জমা করো। পড়ে সব রাগ ভেঙে দিবো।
মেঘ বাথরুমে চলে গেলো। নাফিসার খুব কান্না পাচ্ছে তবুও নিজেকে শক্ত করে রেখেছে! সবার কথাই রহস্যজনক! কেউ তার সাথে সহজভাবে কথা বলছে না! সব কিছুতে একটাই মানে পাচ্ছে, সে মেঘকে আর পাবে না! অন্যকেউ মেঘের ভাগীদার হয়ে গেছে! সে কি মেঘের অযোগ্য!
হ্যাঁ, হয়তো! মেঘ তো সব দিক থেকেই তার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন একটা ছেলে! তার পাশে নাফিসাকে মানায় না, তার পাশে সেই মারিশাকেই মানায়! মারিশার সচ্ছল পরিবার আছে, মারিশার সামাজিক মর্যাদা আছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে! কিন্তু তার কাছে তো এসব কিছুই নেই! সবকিছুতেই মারিশা থেকে পিছিয়ে সে! তাহলে কিভাবে মেঘের যোগ্য মনে করবে নিজেকে! এটাই নাফিসার ভাবনা!
আরও একটা কঠিন মুহুর্ত যে আজ তার সামনে দাড়িয়েছে! সেটার কি হবে, আর তার জীবনই বা কোন দিকে ধাবিত হবে মাথায় ধরছে না নাফিসার!
মেঘ গোসল করে বেরিয়ে এলে নাফিসা ওযু করার জন্য চলে গেলো। ইশার নামাজ পড়ে নিলো দুজনেই। খাওয়া শেষে নাফিসা নিজের রুমে না গিয়ে বৃষ্টির রুমে চলে এলো। বৃষ্টি ফেসবুকে ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। নাফিসাকে দেখে বললো,
- ভাবি, এসো।
- কি করছো?
- এইতো, ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা! বসো এখানে।
নাফিসা কম্বলের নিচে পা রেখে বসে পড়লো। বৃষ্টি বললো, - ভাবি, আজকের ফুচকার কমপিটিশনটা কিন্তু খুব মজার ছিলো। আশা করি, খুব শীঘ্রই তোমার সাথে আবার এমন একটা কমপিটিশন হয়ে যাবে।
- আল্লাহ বাচিয়ে রাখুক।
- হুম, ইনশাআল্লাহ। তবে ভাইয়া থাকলে আরও বেশি মজা হতো! আগে ভাইয়ার সাথেও মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হতাম আর এমন কমপিটিশন চলতো। এখন তো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে!
- সবাই কি আর একরকম থাকে! সময়ের সাথে সাথে মানুষের মাঝে অনেক পরিবর্তন আসে বৃষ্টি। কখনো কারো কাছে আমরা খুব প্রিয় থাকি আবার হঠাৎ করেই অপ্রিয় হয়ে যাই! ছোট থাকতে এক অভ্যাস থাকে আমাদের বড় হলে সেটা ভিন্ন রূপ নেয়! সবাই পরিবর্তনশীল, তেমনি তোমার ভাইয়াও পরিবর্তন হয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে!
- হুম, ঠিক বলেছো! তবে আমার পরিবর্তন হতে ইচ্ছে করে না! সবসময় হাসিখুশি জীবনযাপন করতে ইচ্ছে করে তবুও কিভাবে যেনো বিষন্নতা চলে আসে!
- এটা নিয়তির খেলা!
নাফিসা রুমে যাচ্ছে না বিধায় মেঘ বেরিয়ে এলো তাকে খুজতে। প্রথমেই বৃষ্টির রুমে উঁকি দিয়েছে আর সেখানেই পেয়ে গেছে নাফিসাকে! রুমে এসে সে ও কম্বলের নিচে পা রেখে বসে পড়লো। কম্বলের নিচে কয়েকটা পা পেয়েছে তার ঠান্ডা পা সেই পা গুলোর সাথে লাগিয়ে রাখলো। বৃষ্টি ঝটপট নিজের পা সরিয়ে নিয়ে বললো,
- ওফ্ফ! ভাইয়া, আমার গরম পা ঠান্ডা করে দিচ্ছো কেন! এতো ঠান্ডা কেন তোমার পা!
- কোথায়, ঠান্ডা! মেঘা, ঠান্ডা লাগছে?
মেঘের দুষ্টুমিতে নাফিসা কিছু বললো না! বৃষ্টি পা সরিয়ে নিলেও তার পা দুটো সরায়নি নাফিসা। মেঘ কম্বলের নিচে নাফিসার পায়ে দুষ্টুমি চালাচ্ছে। কখনো পায়ে পা নাড়াচ্ছে আবার কখনো চেপে রেখে নিজের পায়ের ঠান্ডা নাফিসার গরম পায়ে দিয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টি বললো,
- ঠান্ডা হলেই বলবে নাকি! নিজের আগে তোমার চিন্তা করে ভাবি।
- আমার বউ। আমার চিন্তা করবে না তো, তোর চিন্তা করবে!
- হুহ্! বউ! কয়দিন বেড়াতে নিয়ে গেছো বউকে? আমার ভাবি, বলেই আজ বেড়াতে নিয়ে গেছি আমি!
বৃষ্টি ব্যঙ্গ করে বললো কথাটা। মেঘ পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললো, - নিয়ে যাবো রে! সময় পাচ্ছি না এখন। কেমন মজা করলি বেড়াতে গিয়ে?
- হুম, মোটামুটি। ইনশাল্লাহ, শীঘ্রই আবার যাবো অন্যকোথাও।
- বেশি দূর যাবি না। যাওয়ার হলে আশেপাশেই যাবি। সাড়ে দশটা বেজে গেছে! মেঘা ঘুমাবে না?
নাফিসা নেমে গেলো বৃষ্টির বিছানা থেকে। খোপা খুলে গিয়েছিলো, আবার খোপা করতে করতে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। মেঘও তার পিছু পিছু চলে গেলো। “বউ আগে তো বর পিছে” এই ভেবে বৃষ্টি মৃদু হাসলো!
নাফিসা রুমে এসে বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়লো। মেঘও কম্বল টেনে নাফিসার উপরসহ ছড়িয়ে দিয়ে নাফিসাকে ঝাপটে ধরে শুয়ে পড়লো। নাফিসাকে তার দিকে ঘুরিয়ে বললো,
- কি গো? এতো রাগ করেছো! একটুও কথা বলবে না আমার সাথে?
- কি বলবো?
- যা ইচ্ছে বলো।
- মাথা একটু একটু ব্যথা করছে আমার। ঘুমানো দরকার।
- ভ্রমণ করতে পারো না তাহলে যাও কেন, অযথা অসুস্থ হওয়ার জন্য!
মেঘ খালি হাতে মাথায় বিলি কেটে মেসাজ করতে লাগলো। নাফিসা হাত সরিয়ে দিয়ে বললো, - লাগবে না। এমনিতেই সেড়ে যাবে।
- আচ্ছা তাহলে ঘুমাও। আমারও ঘুম পাচ্ছে!
মেঘ নাফিসাকে আরও কাছে টেনে নাফিসার পায়ে পা লাগালো এবং পেটে হাত রেখে বললো, - আগের মতো আরাম নেই!
কথাটা শুনে নাফিসার ভেতরে হৃদয় নামক কাচে ফাটল ধরলো! মনে মনে বললো, ” কি করে আরাম লাগবে মেঘ! আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি! তুমি তো নতুন কারো স্বাদ পেয়ে গেছো! আর আরাম পাবে না আমার কাছে! সেই মাধুর্য আমি হারিয়ে ফেলেছি! চিন্তা করো না, আর চেপে থাকবো না তোমার ঘাড়ে!” চোখের দুপাশ দিয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো নাফিসার! মেঘের চোখ তো বন্ধ, দেখবে কিভাবে এই অশ্রু! আরাম যখন পাচ্ছে না এখনো বেধে রেখেছে কেন তাকে! এখনো আদর দিয়ে সুখের সমুদ্রে ভাসাতে চাইছে কেন তাকে! বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে নাফিসা চোখ বন্ধ করে রইলো।
হঠাৎ ভেজা অনুভব করতে পেরে মেঘ চোখ খুলে তাকালো নাফিসার দিকে। চোখে পানি দেখে বললো,
- মেঘা? কাদছো কেন তুমি? এই, কথা বলো! কাদছো কেন?
- সিলেট যাবো কবে?
- আম্মির কথা মনে পড়ছে?
নাফিসা ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। মেঘ চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে বললো,
- আর চারদিন পর আমরা সিলেট যাবো। কোনোমতে আর চারটা দিন এখানে কাটাও। আম্মির সাথে কথা হয়েছে আজ?
- হুম।
- কাদবে না একদম! তোমার চোখে পানি দেখলে আমার ভেতরটায় কষ্ট হয় জানো না তুমি! আর এক ফোটা অশ্রুও যেন না ঝড়ে! ঘুমাও এখানে!
মেঘ তার মাথাটা বুকে জড়িয়ে নিলো।
সকালে নাস্তা শেষে প্রতিদিনের মতো মেঘ ও রায়হান চৌধুরী চলে গেলো অফিসে। বাসায় তারা মা মেয়েরা তিনজন। বৃষ্টি নাফিসাকে নিয়ে ছাদে গেলো। কয়েক প্রকার ফুল গাছ আছে এখানে। নাফিসার কাছে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে শিউলি ফুল!
তার খুব প্রিয়! বৃষ্টি গাছগুলোতে পানি দিলো আর নাফিসা ঘুরে ঘুরে গাছগুলো দেখলো, ফুলগুলো স্পর্শ করলো। অবশেষে দুজন ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে গল্প করলো। বেশ কিছুক্ষণ ছাদে কাটিয়ে তারা নিচে চলে এলো। আজ বিকেলে মেঘ বাসায় ফিরেছে। ছাদ থেকে আনা কাপড়চোপড় ভাজ করে গুছিয়ে রাখছিলো নাফিসা। এমন সময় তার রুমে প্রবেশ করলো মেঘ সাথে মারিশা! মেঘ ও মারিশা দুজনের মুখেই মুচকি হাসি! মারিশা নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
- কেমন আছো?
নাফিসা কোন জবাব দিলো না শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো! মেঘ বললো,
- মেঘা, তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে মারিশা!
মেঘের কথা শুনে নাফিসা বললো, - ভালো।
মারিশা কেমন যেন আহ্লাদী দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকালো আর মেঘ ইশারায় মাথা নাড়িয়ে কিছু নিষেধ করলো। মেঘের ইশারা নাফিসা ধরতে পেরেছে। কিন্তু এর মানে কিছুই বুঝতে পারেনি! তার কাছে এর মানে অনেক কিছুই হতে পারে! মারিশা আবার নাফিসার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে এলো। নাফিসাকে খুব মমতায় জড়িয়ে ধরে বললো,
- সবসময়ই এভাবে ভালো থেকো।
ছেড়ে দিয়ে বললো, - আসি আমি। আসি মেঘ।
মেঘ জবাব দিলো,
- সে কি! আরও কিছুক্ষণ থাকো।
- না মেঘ! আজ আমি এমনিতেই অনেক খুশি, বেশিক্ষণ থাকলে আবার মনকে মানাতে পারবো না! আল্লাহ হাফেজ।
- আল্লাহ হাফেজ।
মারিশা চলে গেলো। মেঘও ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে চলে গেলো। নাফিসা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে এক জায়গাতেই। মারিশার এমন আচরণ কিছুতেই বুঝতে পারছে না সে! আজ এতো ভালো আচরণ করলো কেন তার সাথে! মেঘই বা তাকে ইশারা করে কি বললো! আজ হঠাৎ মারিশা এতো খুশি কেন! মেঘ কি তার ইচ্ছে পূরণ করে দিয়েছে! শেষ পর্যন্ত তাহলে মেঘকে হারিয়ে ফেললো! মারিশা তার ইচ্ছে পূরণ করেই ছাড়লো! ছিনিয়ে নিলো মেঘকে! না, একটা মেয়ের নিশ্চয়ই পুরুষের চেয়ে বেশি শক্তি নেই! মেঘেরও ইচ্ছে ছিলো! মেঘ চেয়েছিলো বিধায় মারিশা তার ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছে!
নাফিসার বুক ফেটে কান্না আসছে তবুও কাদছে না! নিজেকে নিয়ে নিজেই আশ্চর্য! সে কাদতে ভুলে গেছে! না আছে চোখে অশ্রু আর না আছে মুখে কান্নার আওয়াজ! অতি কষ্টে মানুষ কাদতে ভুলে যায়, আজ তারও সেটাই হয়েছে! কঠিন পাথরের মতো হয়ে গেছে সে!
বিকেল থেকে মেঘের সাথে কথা বলেনি নাফিসা। নিজেকে নানান কাজে ব্যস্ত রেখেছে মেঘ থেকে দূরে থাকার জন্য। মেঘও তেমন নাফিসাকে খুজেনি, কেননা সে নিজেও তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। বাসা থেকে বেরও হয়নি। বাকি সময়টুকু ল্যাপটপ নিয়ে ঘরেই বসে ছিলো। রায়হান চৌধুরী ফিরলে বাবা ছেলে বসে ব্যবসায়ের কাজে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করলো।
রাতে ঘুমানোর সময় হলে নাফিসা আগেই শুয়ে পড়েছে। মেঘ তার ঠান্ডা দেহ নাফিসার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে আর বেশি নড়াচড়া করে বিরক্ত করেনি মেঘ। চুপচাপ সে ও ঘুমিয়ে পড়লো।
দু নয়নের পাতা লেগে আছে ঠিকই,
কিন্তু ঘুম যে নেই চোখে!
অবশেষে প্রিয়জন হারানোর বেদনাটা,
অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়লো যে, পাথর ফেটে!
এতো কাছে আছে প্রিয় মানব,
তবুও আজ বহু দূরে দূরে!
আজ আবারও কেটে গেলো পাহাড়ি কন্যার এক নির্ঘুম রাত! পারেনি, পারেনি সে ঘুম ডেকে আনতে নয়ন জোড়ায়! শুধু নিশি কেটে যাওয়ার অপেক্ষায়!
ঘুম থেকে উঠে নাফিসাকে রুমে পেলো না মেঘ। রাতে কাজ করে দেড়িতে ঘুমিয়েছে বিধায় দেড়িতে ঘুম ভাঙলো তার। জানালার পর্দা ভেদ করে আলো ছড়িয়ে পড়েছে রুমে। নাফিসা তাকে নামাজ পড়ার জন্যও ডাকলো না কেন! জানালার পর্দাও সরায় নি! আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মেঘ। বাথরুম হতে ফ্রেশ হয়ে এলো। টিশার্ট পড়ে রুম থেকে বের হতেই বৃষ্টির সাথে দেখা। বৃষ্টি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে “ভাবি” বলে ডাকছে। মেঘ বললো,
- রুমে নেই, কিচেনে দেখ।
- আমি তো কিচেন থেকেই এলাম! কিচেনে নেই।
- তাহলে তোর রুমে হতে পারে।
বৃষ্টি তার রুমের দিকে গেলো আর মেঘ কিচেনে এলো মায়ের কাছে। - মা, বাবা কি বাইরে গেছে?
- হ্যাঁ। নাফিসা ঘুম থেকে উঠেছে?
- হ্যাঁ উঠেছে তো সেই কখনই।
- আজ ঘুম থেকে উঠে দেখলাম না যে, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
- দেখোনি মানে! সে তো বাইরেই ছিলো।
বৃষ্টি এসে বললো, - কোথায় ভাবি? আমার রুমেও তো নেই!
মেঘ চিন্তিত হয়ে বললো, - নেই মানে! ভালো করে দেখ।
- ভালো করেই দেখেছি আমি।
মেঘ বেরিয়ে আবার সব রুম গুলো ভালো ভাবে দেখলো। পেল না নাফিসাকে! আবার কিচেনে এসে বললো, - মা, তুমি কি একবারও দেখোনি ঘুম থেকে উঠে?
- না। আমি তো ভেবেছি ঘুমাচ্ছে।
- কোথায় যাবে তাহলে!
- ছাদে দেখে আয় একবার। হাটতে গিয়েছে কি-না!
মেঘ দৌড়ে ছাদে চলে এলো। না, এখানেও নেই! চিন্তিত হয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ খেয়াল হলো, হাতমুখ ধুয়ে চুল ঠিক করার সময় ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা ভাজ করা কাগজ দেখেছিলো! সে দ্রুত তার রুমে এলো। নাফিসার ফোনের নিচে রাখা আছে কাগজটা। হাতে নিয়ে দেখলো একটা চিঠি!
” মেঘ,
বলতে পারো অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমায়। জানো? ছোট থেকে অনেক কিছুতেই বুঝতে আমি প্রথমবার ভুল করে ফেলেছি দ্বিতীয়বার সেটা শুধরে নিয়েছি। ওই যে, ভুল থেকে শিক্ষা হয়! ভালোবাসাটাও প্রথম ছিলো, আজ এটাও বুঝতে ভুল করে ফেলেছি! বরাবরের মতো এটাও শুধরে নিবো। আমাদের অঞ্চলের অনেকেই বলতো, আমার চেহারা নাকি আম্মির মতো অনেকটা। আজ আমি নিজেই মিলিয়ে নিলাম, শুধু চেহারা নয় ভাগ্যও পুরোটাই আমার আম্মির মতো!
তুমি তো জানো সবটা, আম্মির জীবনটাও তো এমনই ছিলো! ভালোবেসেছে একজনকে তাকেই অন্যের জন্য বিসর্জন দিতে হয়েছে! আমাদের মা মেয়ের জীবনে ধোকা জিনিসটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে! বহুবছর আগে আম্মি ধোকার সম্মুখীন হয়েছে আর আজ আমি!
মারিশাকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে কিভাবে! মারিশা তো তোমার পূর্ব পরিচিত ছিলো, তাহলে তুমি আমাকে কেন টানলে তোমার জীবনে? কেন আমার সাদাকালো জীবন রাঙিয়ে দিয়ে আজ আবার পালিয়ে গেলে! কেন ভালোবাসার সাথে পরিচয় করালে আমায়? মারিশার বাবা আছে, সুসজ্জিত পরিবার আছে, সামাজিক মর্যাদা আছে, ধন সম্পদ আছে। সবদিক থেকেই তোমার জন্য উপযুক্ত সে। আমি তো তোমার যোগ্য নই, তাহলে আমাকে শুধু শুধু নিজের জীবনে জড়িয়ে রাখলে কেন! জানিনা, কি পাপ করেছি আমি যার ফলে এতো বড় শাস্তি পেয়ে যাচ্ছি! আমি এজন্যই কোনো পুরুষলোককে বিশ্বাস করতাম না! চাইনি কাউকে নিজের জীবনের সাথে জড়াতে! হারানোর ভয় হতো সবসময়! কিন্তু তোমাকে পেয়ে আমি সেই ভয়ের কথা ভুলে গিয়েছিলাম! মারিশাকে দেখার পর থেকে সেই ভয়টা আবার হানা দিয়েছে! আর আজ সেটাই ঘটলো! ভালোবাসতে বাধ্য করেছো তুমি। আজ অবহেলাও করলে তুমিই! আমরা পৃথিবীতে বেচে আছি কেন বলতে পারো? সব তো তোমাদের মতো শক্তিশালী মানুষের ইচ্ছাতেই হয়! তাহলে সৃষ্টিকর্তা আমাদের মনে ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন কেন, ভেবে পাই না আমি!
আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে হবে না মারিশার সাথে। আর গোপনে রাত কাটাতে হবে না মারিশার কাছে। অসংখ্য ধন্যবাদ যে, তুমি নিজেই বলে দিয়েছো আমার কাছে আর আগের মতো আরাম পাও না তুমি! কি করে পাবে, এক জিনিস কি আর সবসময় ভালো লাগে! আমি তো আমার মাধুর্য হারিয়ে ফেলেছি! আর পাবে না আগের মতো আরাম, আগের মতো সুখ আমার কাছে আর পাবে না। বাবা মায়েরও তো মারিশাকে খুব পছন্দ। বাসায় নিয়ে এলে সমস্যা কি! আমি থাকায় কি সমস্যা ছিলো? এবার তো আমিও সরে এলাম। তোমাদের পরিপূর্ণ জীবনের কাটা হয়ে থাকতে চাই না। স্বেচ্ছায় সরে এলাম তোমার জীবন থেকে। সুখে থাকো মারিশাকে নিয়ে।
কোনো কষ্ট নেই আমার, ভালো থেকো তুমি। অযথা আমার খোঁজ নিও না। অসহায় ভেবো না আমাকে। আল্লাহ আছে আমার সাথে। গুছিয়ে নিতে পারবো নিজেকে! শক্ত করে ফেলেছি নিজেকে, ধৈর্যশীল হয়ে গেছি, আর সেটা তোমার গুনেই! তোমার এই মোহনীয় গুনের জন্যই হয়তো না চাইতেও প্রেমে পড়ে গেছি! চিন্তা করো না, কাউকে কিছু জানাবো না আমি। কখনো কোনো অধিকার দাবি করবো না তোমার কাছে! সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকো। আল্লাহ হাফেজ।
ইতি,
রোকসানার মেয়ে নূর নাফিসা।
পর্ব – ৪৩
চিঠি পড়া শেষ করে কাগজটা মুড়িয়ে ফ্লোরে ফেলে দিলো মেঘ! রাগে তার সর্বাঙ্গে কম্পন ধরেছে! নাফিসাকে কাছে পেলে হয়তো এখন গলা টিপে হত্যা করে ফেলতো! কি করে এসব ভাবতে পারলো তাকে নিয়ে! সে বুঝতে পেরেছে নাফিসাকে সময় দিতে পারছে না বলে নাফিসা রেগে আছে কিন্তু তার প্রতি যে এরূপ সন্দেহ রেখেছে সেটা তো কল্পনার বাইরে! এতো গভীরভাবে যাকে ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে নিয়েছে আজ সে তার চরিত্রে আঙুল তুলেছে!
সমস্ত রাগ একদিকে ফেলে তার মাথায় এলো, নাফিসা এখন কোথায় আছে! আলমারি খুলে জামাকাপড় দেখলো। অনেক কিছুই আছে আবার কিছু কিছু নেই! বাসা থেকে যেসব কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছিলো সেসব নেই! মেঘ মনে মনে বললো,
” সে কি তাহলে সিলেট চলে গেছে একা একা! ঢাকার পথঘাট কি তার চেনা আছে! যেতে পারবে ঠিকমতো! যতই বলুক ধৈর্যশীল, সে তো টিকতে পারবে না আমাকে ছাড়া! আর পাচজন মানুষের মতো স্বাভাবিক না সে, ধোকা দিয়েছি এই ভেবে সহ্য করতে পারবে না সে! কেউ সামলাতে পারে না তাকে আমি ছাড়া! কোথায় আছে কিভাবে আছে কে জানে!”
মেঘ নিজের ফোন আর ওয়ালেট নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলো এমন সময় মোহিনী আর বৃষ্টি রুমে প্রবেশ করছিলো। মোহিনী বললো,
- পেয়েছিস নাফিসাকে?
- না, মা। নাফিসা রাগ করে চলে গেছে। আমি যাচ্ছি!
মোহিনী আর বৃষ্টি দুজনেই অবাক! মেঘ বেরিয়ে যেতে নিয়েও আবার রুমে এলো। মোহিনী পিছু পিছু এসে বললো, - রাগ করে চলে গেছে মানে!
- হ্যাঁ, আমার সাথে রাগ করে চলে গেছে।
- কেন রাগ করেছে?
- মা, এতো কিছু বলার সময় না এখন। পরে বলবো তোমাকে।টেনশন করো না, আমি যাচ্ছি।
- আরে কোথায় যাচ্ছিস?
- সিলেট।
মেঘ তাড়াহুড়ো করে ল্যাপটপ আর সামনে থাকা কিছু জামাকাপড় ব্যাগে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। কেউ জানলে নেতিবাচক ভাবনা ভাবতে পারে তাদের নিয়ে। তাই ফ্লোর থেকে মোড়ানো কাগজটাও তুলে নিতে ভুলেনি মেঘ! রাস্তায় হাটতে হাটতে কাগজটা কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলে দিলো। রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে এলো। টিকেট কেটে বাসে উঠে বসে রইলো। দশ পনেরো মিনিট পর বাস ছাড়লো। জ্যামবিহীন রাস্তায় দ্রুত গতিতে বাস চলছে তবুও পথ যেন তার শেষ হচ্ছে না আজ! সারাক্ষণ নাফিসার কথা ভাবছে! কোথায় আছে, কি করছে! সে কি নিজের দিকে খেয়াল রাখছে! ফোনটাও তো সাথে নেয়নি! কি করে জানবে কোথায় আছে! সিলেট গিয়ে তার দেখা পাবে তো! আম্মিকে কি একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করবে! না, আম্মি কিছু জানতে পারলে টেনশন করবে! সেখানে গেলে আম্মি নিজেই জানাতো কল করে। হয়তো সে এখনো রাস্তায়ই আছে, বাড়িতে পৌছাতে পারেনি!
মেঘ বাড়িতে ফিরে দেখলো নাফিসা দরজার সামনে আম্মিকে জড়িয়ে ধরে কাদছে! মাটিতে ব্যাগ পড়ে আছে। মাত্রই এসেছে তাহলে! ঠিকঠাক মতো এখানে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো মেঘ। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো। কান্না জড়িত কন্ঠে নাফিসার একটাই আওয়াজ ভেসে আসছে, “আম্মি মেঘ একটুও ভালো না! চিনতে তাকে ভুল করেছি আমরা। সেও ধোকা দিয়েছে আমাকে।” আম্মির চোখেও পানি। আম্মি শুধু বলে যাচ্ছিলো নাফিসাকে চুপ করতে। হঠাৎ আম্মির চোখ আটকে গেলো মেঘের দিকে! সাথে সাথেই আশ্চর্য কন্ঠে বললো,
- মেঘ!
আম্মির মুখে মেঘের কথা শুনে নাফিসা আম্মিকে ছেড়ে পেছনে তাকালো। মেঘকে দেখে সে চরম অবাক! মেঘ আম্মিকে সালাম দিলো। আম্মি সালামের জবাব দিয়ে বললো, - দেখো কেমন পাগলামি শুরু করেছে! সামলাও তাকে! বুঝাতে বুঝাতে অস্থির আমি!
নাফিসা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে! মেঘ কিছু না বলে চুপচাপ দ্রুত পায়ে ঘরে চলে গেলো। নাফিসা চোখ মুছতে মুছতে মেঘের পিছু পিছু এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বললো, - কেন এসেছেন আপনি? মুক্ত করে চলে এসেছি তো। আর কোনো বাধা পাবেন না আমার জন্য! তাহলে কেন এসেছেন আবার?
মেঘ চেয়ারে ব্যাগ রাখলো। ল্যাপটপটা বের করে চার্জে লাগালো। কোনো উত্তর না পাওয়ায় নাফিসার খুব রাগ হচ্ছে! জেদ নিয়ে মেঘকে তার দিকে ঘুরিয়ে জোর গলায় বললো, - কিছু জিজ্ঞেস করছি, জবাব দিচ্ছেন না কেন! এখানে কেন এসেছেন আপনি?
সাথে সাথে মেঘ নাফিসার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো! নাফিসা নিস্তব্ধ হয়ে গালে হাত রেখে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো মেঘ পানে! এবার মেঘের মুখ ফুটলো!
- সাহস কি করে হলো একা একা সিলেট চলে আসার? বলেছিলাম না, আমি নিজেই সিলেট নিয়ে আসবো! আর দুইটা দিন সহ্য হলো না তোর! এতো সাহস কোথায় পাস? কি করে ভাবতে পারলি আমি মারিশার সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়িয়েছি! এতো নিচু তোর ভাবনা! ছি! ভাবতেও পারিনি আমি এমন একজনকে ভালোবেসেছি! এখনো ভাবতে পারছি না, আমার মেঘা আমার সামনে দাড়িয়ে আছে! হারিয়ে ফেলেছি আমার মেঘাকে! হারিয়ে ফেলেছি আমি! অবহেলা করেছিলাম তোকে? বলেছিলাম না আমি এখন একটু কাজে ব্যস্ত! লুকিয়ে লুকিয়ে মারিশার সাথে দেখা করতে যাই? মারিশা যে আমার ফ্রেন্ড, বলেছিলাম না তোকে? মারিশার সাথে রাত বাইরে কাটাই? আম্মির কাছে জিজ্ঞেস করে আয়, এই ক’দিন আমি কতবার সিলেট এসেছি! যা জিজ্ঞেস করে আয়, তাহলেই বুঝতে পারবি আমি মারিশার সাথে ছিলাম নাকি সিলেট এসে থেকেছিলাম! আম্মিকে বাজার করে দিয়েছে কে? আরও দু-তিনজন ভাইবোন আছে তোর, আম্মির দেখাশোনা করার জন্য, বাজার করে দিয়ে যাওয়ার জন্য? এখানে যে নতুন বাসার একটা কাজ ধরেছি সেটা কি তোর অজানা ছিলো! তাহলে কি করে ভাবতে পারলি আমার সম্পর্কে এমনটা! হ্যাঁ, মারিশা আমাকে চেয়েছিলো, আমি পরপর অনেক বুঝিয়েছি তাকে! ঘুরতে আমি এমনিতেই যাইনি তার সাথে, তোকে যাতে বিরক্ত না করে, কষ্ট না দেয় আর আমকে ভুলে যায় সেটা বুঝাতেই দুদিন ঘুরতে বেরিয়েছি তার সাথে! অবশেষে গতকাল নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে সে এবং নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবে বলেছে ! সিলেট আসি এ কথা আম্মিকে জানাতে নিষেধ করি, কারণ জানতে পারলে তুইও চলে আসতে চাইবি আমার সাথে! নতুন বউ একমাসও যদি শ্বশুর বাড়ি না কাটাতে পারে তাহলে বাবা মা কি ভাববে সেটা তোর মাথায় আছে! এর বাইরেও কি আমি তোকে সময় দেইনি একটুআধটু! সবদিকের চাপ সহ্য করে সবটা সামলে নিয়ে আমি দিন রাত পাড় করছি তবুও তো মর্যাদা পেলাম না আমার জীবনসঙ্গীর কাছেই! এতো সন্দেহ ছিলো যখন একবার জিজ্ঞেস করে নিতে পারতি সত্যটা! নিজের কাছে নিজেকেই পিশাচ মনে হচ্ছে এখন! ভেবেছিলাম আর দুদিন পর এখানে নিয়ে এসে একেবারে নতুন বাড়িতে উঠে সারপ্রাইজ দিবো তোকে। সেটা আর হলো কোথায়! আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছি আজ! বাহ! দারুণ সারপ্রাইজ দিয়েছিস আমাকে!
নাফিসা গালে হাত রেখেই এতোক্ষণ হা হয়ে মেঘের কথা শুনে যাচ্ছিলো! মেঘ সিলেট এসে থেকেছে! এদিকে যে একটা কাজ ধরেছে সেটা তো সে ভুলেই গিয়েছিলো! মায়ের বাজার করার কথা তো তার কখনো মাথায়ই আসেনি! আবার সেদিকেও মেঘ ব্যবসা সামলিয়েছে বাবার সাথে! দিন শেষে যেটুকু সময় বাসায় ছিলো সেটুকু তো সত্যিই তাকে সময় দিয়েছে! মেঘ যে সত্য বলছে সেটা বিশ্বাস করতে একটুও বাধা পাচ্ছে না নাফিসার! মিথ্যে হলে মেঘ কখনো পিছু পিছু ছুটে আসতো না সিলেট! এতো কিছু না জেনে, না বুঝে উল্টাপাল্টা ভেবেছে এই নিখুঁত, মার্জিত মানুষটার সম্পর্কে! এতোটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মনের অজান্তে! এতোকিছু একসাথে সামলায় কিভাবে এই মানুষটা! তাকে কি মাফ করবে কখনো মেঘ!
নাফিসার অশ্রু কোনোভাবেই থামছে না! চোখের পাতা কাপছে, ঠোঁট জোড়া কাপছে, বুকের ভেতরটা থরো থরো কাপছে! তবুও মনে সাহস নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে মেঘের একটা হাত ধরতেই মেঘ ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলো!
- সর, একদম স্পর্শ করবি না আমাকে!
মেঘের কথায় অভিমান স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে নাফিসা। তাই আবার দু’হাত বাড়িয়ে মেঘের একটা হাত ধরলো এবং টেনে এনে তার পেটে চেপে রাখলো!
মেঘ এমন কান্ডে হতবাক! কি বুঝাতে চাইছে তার মেঘা! একবার নাফিসার পেটের দিকে তাকাচ্ছে তো আবার নাফিসার মুখের দিকে তাকাচ্ছে! গলা ধাধিয়ে আসছে মেঘের! কাপা কাপা কন্ঠে নাফিসার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,
- বেবেবি?
সাথে সাথে নাফিসার অশ্রুতে মাখামাখি এই মুখে মুচকি হাসির ঝলক ফুটে উঠলো! নাফিসা চোখের পাতা এক করে পানি ফেললো এবং মাথা নেড়ে মেঘের প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব দিলো! এদিকে মেঘের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে! মুহূর্তেই অভিমানগুলো বিলীন হয়ে রাগান্বিত মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আবার জিজ্ঞেস করলো,
- কখন জেনেছো?
- গত পরশু দিন।
- কি! পরশু দিন জেনে তুমি আজকে আমাকে জানাচ্ছো! এখন তো আরেকটা লাগাতে ইচ্ছে করছে!
নাফিসা অন্য গাল পেতে বললো, - লাগাও!
- এখন লাগালে তো আমি অপরাধী হয়ে যাবো!
কথাটা বলে মেঘ নাফিসাকে কাছে টেনে অন্য গালে কামড় বসিয়ে দিলো! নাফিসা গালে মেসাজ করতে করতে বললো,
- এর চেয়ে তো থাপ্পড়ই ভালো ছিলো! দুই গাল সেইম টু সেইম হয়ে যেতো!
মেঘ হেসে তার উভয় গালে ছোট ছোট কামড় দিয়ে লাল করে দিলো! এটা কামড় না, ভালোবাসার উপহার! অসংখ্য অজানা অনুভূতি মিশে আছে এই স্পর্শে! মেঘ বললো, - এবার হয়ে গেছে সেইম টু সেইম! মেঘা, কিভাবে পারলে ঢাকা থেকে একা চলে আসতে! তাও আবার এ অবস্থায়!
- সরি, আর কখনো এমন কিছু হবে না! কখনো তোমাকে কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ করবো না! একবার মাফ করে দাও!
মেঘ তার চোখের পানি মুছে দিয়ে দু’হাতের বন্ধনে শক্ত করে বেধে নিলো। অত:পর নাফিসার কপালে গভীর চুমু একে কপালে ঠোঁট ছুয়িয়ে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। নাফিসা চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে মেঘকে! তার কর্মকান্ডের জন্য সে অনুতপ্ত! নিজেকে নিজেই ক্ষমা করতে পারছে না অথচ মেঘ তাকে ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে নিয়েছে!
হঠাৎ তার মুখে অতিরিক্ত পানির স্পর্শ পেলো! নাফিসা চমকে উঠে চোখ খুলে তাকালো! মাথা উঁচু করে মেঘের দিকে তাকাতেই দেখলো মেঘের চোখে পানি! ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে নাফিসার! মেঘের চোখে পানির কারণ একটাই! সে মেঘের চরিত্র নিয়ে কথা বলেছে!
মেঘ তার চোখে তাকিয়ে আছে আর মুখে লেগে আছে হাসি! মেঘের চোখের পানি দেখে নাফিসা মেঘকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কান্না করে দিলো! কান্না করতে করতে বললো,
- মেঘ, মাফ করে দাও আমাকে। বিশ্বাস করো, আমি বাধ্য হয়েছি এমনটা ভাবতে! মারিশা এসে আমাকে নানান কটু কথা শুনিয়ে যেত তাছাড়া আমি তোমাকে কাছে পাচ্ছিলাম না তাই বাধ্য হয়েছি এমনটা ভাবতে!
- মেঘা, স্টপ ক্রায়িং!
- আমি জানি তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছো। প্লিজ একটা সুযোগ দাও আমাকে! প্লিজ!
- মেঘা, কান্না বন্ধ করতে বলেছি। আমি কোনো কষ্ট পাইনি! আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা ভেবেছো এজন্য থাপ্পড় দেই নি। থাপ্পড় দিয়েছি একা একা চলে এসেছো বলে! আজ তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি মরে যেতাম! নিশ্বাস বন্ধ না হলেও আমি জীবন্ত লাশ হয়ে যেতাম, মেঘা!
- কষ্ট না পেলে তুমি কাদছো কেন!
- কোথায় কাদছি!
নাফিসা মেঘের চোখের পানি হাতে নিয়ে বললো, - এই যে!
মেঘ নাফিসার নাক টেনে বললো,
- এটা কান্না নাকি, বোকা মেয়ে! এটা তো সুখ! আমি বাবা হবো সেই সুখ! কিছু বুঝো না তুমি! ভাবতেই অবাক লাগে তুমি মা হতে যাচ্ছো! নিজেই বুঝো না, বাচ্চাদের বুঝাবে কি!
- আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছো না? আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার কথায় কষ্ট পেয়ে কাদছো!
- তোমাকে বুঝানো দায়! আমি কষ্ট পাইনি, তোমার অবস্থান বুঝতে পেরেছি আমি। কষ্ট পেলে চিঠি পড়েই ছুটে আসতাম না এখানে! আচ্ছা বলো, কি করলে বিশ্বাস করবে যে আমি কষ্ট পাইনি এবং বাচ্চাদের জন্য সুখের অশ্রু এটা!
- তাহলে বাচ্চাদের মা কে আদর করছো না কেন?
মেঘ হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে! মেঘের চাহনি এমন দেখে, কথাটা বলে এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে নাফিসার! হঠাৎ করেই মেঘ তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে যেতে যেতে বললো, - স্বেচ্ছায় আদর চেয়ে নিয়েছো! বেগম, আজ তো তুমি শেষ!
নাফিসা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে! মেঘ তাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিতেই সে ঝটপট উঠতে গেলো কিন্তু পারলো না!
- মেঘ, বেশি ভালো হচ্ছে না কিন্তু!
- আচ্ছা, অল্প ভালো হলেই হবে!
- সকাল থেকে আমি কিছু খাইনি!
- আমিও তো খাইনি!
- মেঘ, ছাড়ো! নাহলে!
- নাহলে কি?
- নাহলে, বাচ্চাদের কাছে বিচার দিবো!
মেঘ অবাক হয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে পাশে শুয়ে পড়লো! নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে আবার হাতে মাথা ভর দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় থেকে বললো, - মেঘা, ভালো এক বাহানা পেয়ে গেছো দেখছি! বাচ্চারা না আসতেই বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে দিচ্ছো!
নাফিসা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো।
মেঘ তার হাতের একটা আঙুল নাফিসার চুলে নাড়াতে নাড়াতে বললো,
- মেঘা, আমি তোমাকে কখন বলেছি তোমার মধ্যে আরাম নেই সুখ নেই!
নাফিসার মুখ মলিন হয়ে এলো। মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো, - পরশু রাতে ঘুমানোর সময় তুমি বলোনি, আগের মতো আর আরাম নেই!
মেঘ অবাক হয়ে বললো, - আমি তোমাকে নিয়ে এমন কিছু মিন করেছি! বৃষ্টির রুমে যখন বসেছিলাম তখন তোমার পা গরম ছিলো আর আমার পা ঠান্ডা ছিলো। পায়ে পা লাগাতে আরাম লাগছিলো তখন। পরে তো আমার পা গরম হয়ে গিয়েছিলো, গরম পা কি আর গরম পায়ে লাগাতে ভালো লাগে! আর তুমি!
নাফিসা আরও বেশি লজ্জিত ! চোখ দুটো ছলছল করছে! কাপা কাপা কন্ঠে বললো, - সরি, মেঘ!
পর্ব – ৪৪
মেঘ তার ঠোঁটে ছুয়ে দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
- আর কখনো যদি কিছু নিয়ে সন্দেহ হয়, তাহলে আগে জিজ্ঞেস করে শিওর হয়ে নিবে। আর এমন বোকামি ভুলেও করবে না! মারিশা তোমার সঙ্গী কেড়ে নিতে চেয়েছে আর তুমি চুপচাপ বসে ছিলে কেন! যদি আমাকে ভালোবেসেই থাকো তাহলে আঁকড়ে ধরতে পারলে না কেন! বরং উল্টো হার মেনে চলে এসেছো! এখন আমি যদি রাগ করে বসে থাকতাম! না পারতে এদিকে তুমি বাচতে আর না পারতাম আমি! মেঘা, নিজের জিনিসকে আঁকড়ে ধরে বাচতে শেখো! নিজের অধিকার আদায় করতে শেখো! অন্যের ভালোর কথা চিন্তা করে নিজেকে শাস্তি দেওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই না! প্রতিবাদী হও! না হলে সুখ জিনিসটা জীবনে ধরা দিবে না কভু! পৃথিবীতে সবাই স্বার্থপর, কেউ কাউকে নিয়ে ভাবে না! সবাই নিজকে চিনে! নিজের স্বার্থ বুঝে, তাহলে তুমি কেন হাল ছেড়ে দাও! নিজ দাবি আদায় করতে শেখো, অন্যের জন্য ফেলে রেখো না কিছু! আমি যদি অন্যমনস্কও হয়ে যাই কখনো, তোমার উচিত আমাকে ঘিরে রাখা! না হলে সব হারিয়ে নিস্ব হয়ে যাবে একদিন! চেষ্টা না করলে তো কোনোকিছুই লাভ করা যায় না এটা জানো না?
- আল্লাহ যদি সবার জীবনেই এমন একটা মেঘ রাখতো তাহলে কেউ দুখ জিনিসটা উপলব্ধি করতে পারতো না কখনো!
মেঘ মুচকি হেসে বললো, - আর তুমি পেয়েও হারাতে বসেছো!
নাফিসা মেঘ থেকে চোখ সরিয়ে নিলো! নিজেকে নির্বোধ মনে হচ্ছে তার! হঠাৎই মেঘ মধুময় সুরে বলে উঠলো,
“জীবন ফুরিয়ে যাবে,
তবুও ফুরাবে না, এ তৃপ্তি আমার!
দিন কাটবে, রাত কাটবে,
কবু কাটবে না নেশা, প্রতি তোমার!”
মেঘের স্পর্শে মাতাল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে নাফিসার মনে! যতবারই স্পর্শ করে, পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়! মেঘকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য বললো,
- এই, গোসল করবে না!
মেঘ নাফিসাকে ছেড়ে উঠে বসলো। শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
- ছি! মেঘা, কেমন খাটাশ তুমি! শীতকাল ঠিকমতো না আসতেই তোমার গোসল বন্ধ! ভাবতে অবাক লাগে, তুমি নাকি বাচ্চার মা হবে! নিজেই খাটাশ, বাচ্চারা কি হবে!
নাফিসা তো হতবাক! এসব কি কথাবার্তা! সে কখন বললো গোসল করবে না! মনে মনে ভাবা বন্ধ করে মেঘকেই জিজ্ঞেস করলো, - আমি কখন বললাম গোসল করবো না!
- গোসল করার ইচ্ছে থাকলে কি আর বিছানায় এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছো!
- আমি এসেছি নাকি তুমি নিয়ে এসেছো বিছানায়!
- প্রমাণ কি?
- আমি নিজে প্রমাণ!
- তাহলে বসে থাকো তুমি তোমার প্রমাণ নিয়ে! নিজ প্রমাণে আদালতে রায় দেয়া হয় না!
নাফিসা আর কথা বাড়ালো না। মেঘ যে কতটা দুষ্টু সেটা তার অজানা নেই! তার সাথে কথায় পারবে না তাই চুপচাপ জামাকাপড় নিতে লাগলো। মেঘ দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো নাফিসাও জামাকাপড় নিয়ে পিছু পিছু বের হচ্ছে। আম্মিকে দেখতে পেয়ে মেঘ বললো, - আম্মি, বরাবর শীতেই কি নাফিসা গোসল বন্ধ করে দেয়?
রোকসানা অবাক হয়ে একবার মেঘের দিকে এবং একবার নাফিসার দিকে তাকালো! আম্মির দৃষ্টি বুঝতে পেরে নাফিসা বললো, - আম্মি, ও বললো আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে! আমি কি গোসল মিস করেছি কখনো!
মেঘ মিটিমিটি হাসতে হাসতে বাথরুমের দিকে চলে গেলো। আম্মি তাদের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে হেসে উঠলো! নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
- তোর গাল লাল কেন! কি হয়েছে, এলার্জি নাকি! দেখি?
নাফিসার মনে হতেই বড় বড় চোখ করে তাকালো এবং দ্রুত পায়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, - আম্মি কিছু না! তুমি চোখে বেশি দেখো!
রোকসানা মেয়ের আচরণ না বুঝতে পেরেও আর মাথা ঘামালো না, নিজের কাজে চলে গেলো। নাফিসা বাথরুমে এসে কাপড়চোপড় রাখলো এবং ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো। মেঘ নাফিসার জামাকাপড় দেখে বুঝতে পেরেছে নাফিসা তার সাথে গোসল করতে এসেছে! তাই একটু ভাব নিয়ে বললো,
- আরে, তুমি এখানে কেন!
- বাথরুমে আবার কেন আসে! গোসল করবো।
- আমি এসেছি দেখছো না!
- তো, কি হয়েছে!
- কি হয়েছে মানে! আমার সাথে গোসল করবে!
- হুম!
- ইশ! কি বলো এসব! আমার লজ্জা লাগে না বুঝি!
- হুহ্! লজ্জা কাকে বলে জানা আছে নাকি আপনার!
- হ্যাঁ, খুব ভালো জানা আছে! বউয়ের কাছে শিখে গেছি। যাও বের হও।
- না।
- না, আমি তোমার সাথে গোসল করবো না! বের হও!
মেঘ টেনে নাফিসাকে দরজার কাছে নিয়ে এলো। নাফিসার ভালো লাগছে না মেঘের আচরণ! ইচ্ছে করছে তার সাথে গোসল করতে তবুও মেঘ ঠাই দিচ্ছে না! আহ্লাদী কন্ঠে বললো, - মেঘ!
- কি, মেঘা? যাও, বের হও!
মেঘের এমন আচরণে আর কিছু না বলে নাফিসা মুখ ফুলিয়ে রাগ করে বের হতে যাচ্ছিলো, এমন সময় মেঘ তার উপর এক মগ পানি ঢেলে ভিজিয়ে দিলো! নাফিসা অবাক হয়ে পেছনে তাকাতেই মেঘ হেসে বললো, - কোথায় যাচ্ছো, মিসেস মেঘা চৌধুরী? গোসল করবে না?
এমন কাণ্ডে নাফিসা চোখ ছোট করে বিরক্তি নিয়ে তাকালো। মেঘ হেসে তার কাছে এসে বললো, - ভাবলে কিভাবে, গোসল না করিয়ে বের হতে দেবো! তুমি চাইলেও বের হতে পারবে না! আজ তো গোসল খুব ভালো জমবে বেগম! পারিবারিক গোসল হবে, বাবা-মা ও বাচ্চারা!
- বারবার বাচ্চারা বলছেন কেন! কয়জন বাচ্চা?
- হবে হয়তো, তোমার আমার বয়সের সমষ্টি যতো!
মেঘ হাহা করে হেসে উঠলো আর নাফিসা তার হাসি দেখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললো মুখে!
মেঘ আসার পরপরই রোকসানা রান্না বসিয়েছিলো। মেঘ নাফিসা উভয়ই গোসল সেড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো। সকাল থেকে এ পর্যন্ত তারা কেউই কিছু মুখে দেয়নি। এখন শান্তি। নাফিসা প্লেট নিয়ে রাখছে রান্নাঘরে। এর মাঝেই বমি এসে পড়েছে! উঠুনের এক কোনে এসে বমি করলো নাফিসা। রোকসানা দৌড়ে এসে মেয়েকে ধরলো। মেঘ শব্দ পেয়ে বাইরে এসে দেখলো নাফিসা বমি করছে! যা খেয়েছে সব উপচে দিয়েছে! মেঘ মগে পানি নিয়ে এগিয়ে গেলো। নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,
- মাত্র খেয়েছো, এখনই নড়াচড়া করার কি খুব প্রয়োজন ছিলো!
নাফিসা রুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাড়ালো। রোকসানা বললো,
- জার্নি করে এসেছিস, এমনিতেই তো দুর্বল দেখাচ্ছে। একটু যত্ন নিবি না নিজের প্রতি! প্লেট তো আমিও আনতে পারতাম! স্বভাব খারাপ! পেটে যা ছিলো সব ফেলে দিয়েছে! চল, আবার খেয়ে নে।
- মাথা খারাপ তোমার!
- হ্যাঁ, আমার মাথা খারাপই! চল!
মেঘ মগ নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললো, - আম্মি, ঠিক বলেছে মেঘা! খেয়ে নাও আবার। এমনিতেই এখন তোমার ডবল খাওয়া প্রয়োজন! আগে এক প্লেট খেয়েছো, এখন নতুন অতিথির জন্য দু প্লেট করে খাবে!
আম্মি নতুন অতিথির কথা শুনে অবাক হয়ে নাফিসার দিকে তাকালো! আর নাফিসার মেঘের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে! তাকে ফাসিয়ে দিয়ে সে চলে গেলো! আম্মি বললো, - নতুন অতিথি মানে?
নাফিসা আমতাআমতা করে জবাব দিলো,
- নতুন অতিথি মানে নতুন অতিথি!
- কিসের নতুন অতিথি?
- এই মনে করো শীতকালে নতুন অতিথি পাখি আসে!
- নাফিসা! স্পষ্ট বুঝতে পারছি কথা ঘুরাচ্ছো! তার সাথে তোমার খাওয়ার কি সম্পর্ক! নতুন অতিথি কি তোমার পেটে?
নাফিসা অপরাধী দৃষ্টিতে রোকসানার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ইতিবাচক জবাব দিলো। রোকসানা অবাক হয়ে গেছে তার উত্তরে! গলার আওয়াজ নিচু করে রোকসানা বললো, - এতো তাড়াতাড়ি কেন! আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারতে!
নাফিসা চিন্তিত হয়ে বললো,
- মেঘ খুশি আমি খুশি! আম্মি, তুমি খুশি হওনি?
রোকসানা হেসে মেয়ের কপালে চুমু দিলো। চোখ তার ছলছল করছে! নাফিসার দু গাল ধরে বললো, - খুশি হইনি মানে! আমার খেলার সাথী আসছে, আমি খুশি হবো না তো কে খুশি হবে! আমি তো ভাবতেই পারছি না আমার মেয়েটা এতো বড় হয়ে গেছে! আজ সে-ও নাকি মা হতে চলেছে!
নাফিসা হেসে আম্মিকে জড়িয়ে ধরলো। মেঘ দূর থেকেই মা মেয়ের মমতা দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে ঘরের দিকে এগোতে লাগলো। রোকসানা নাফিসাকে ছাড়িয়ে মেঘকে দেখে বললো, - মেঘ! তোমার স্বভাব তো আরও বেশি খারাপ দেখছি! নতুন অতিথির খবর শুনিয়েছো তাও আবার মিষ্টি ছাড়া!
- আম্মি, আমার কোনো দোষ নেই! মেঘা কিন্তু আমাকে এখানে আসার পর জানিয়েছে অতিথির কথা!
অভিমান নিয়ে নাফিসার উক্তি, - হ্যাঁ, সব দোষ আমার। এখন সবাই মিলে আমাকে মাইর দাও ইচ্ছেমতো!
- হ্যাঁ, এখন না খেলে দিবো তোকে ইচ্ছে মতো মাইর! চল!
রোকসানা নাফিসাকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। মেঘ নিশব্দে হেসে ঘরে চলে গেলো।
পর্ব – ৪৫
আম্মির হাতে জোরপূর্বক অল্প খাবার খেয়ে নাফিসা রুমে চলে এলো। মেঘ জানালার পাশে দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে মোহিনীর সাথে! সম্পূর্ণ ঘটনা বলেনি, শুধু এটা বলেছে নাফিসার সাথে তার ছোটখাটো ঝগড়া হয়েছে এবং মেঘ বকেছে নাফিসাকে । তাই, তার সাথে রাগ করে চলে এসেছে নাফিসা! মেঘ এখন নাফিসাকে রুমে আসতে দেখে ফোন লাউড স্পিকারে দিয়ে বললো,
- মা, কথা বলো নাফিসার সাথে।
- না, আমি কারো সাথে কথা বলবো না! শুধু শুধু কথা বলতে যাবো কেন! কেউ কি আমাকে গণ্যমান্য করে নাকি! মরে গিয়েছিলাম আমি! ঝগড়া হয়েছে সে আমার কাছে বিচার দিতে পারলো না! শাসন করতাম কিনা দেখে নিতো! সাহস কি করে হলো একা একা সিলেট চলে যাওয়ার!
নাফিসা অপরাধী কণ্ঠে বললো,
- সরি মা!
ওপাশ থেকে মোহিনী বললো, - আমি কারো মা না! আমাকে যেন কেউ মা না ডাকে! আমার সাথে কেউ যেন কথাও না বলে। যার যখন যেখানে ইচ্ছে চলে যাক! কিছু বলবো না আমি! আমি কে বলার!
- মা, সরি। আর কখনো হবে না এমন, প্রমিজ! আজকেই কি বাসায় ফিরে আসবো?
মোহিনীও যে রেগে আছে তার উপর খুব ভালো বুঝতে পেরেছে নাফিসা! তার চোখ দুটো ছলছল করছে! মেঘ নাফিসার দিকে তাকিয়ে আছে এবং বউ শাশুড়ির কথা শুনছে! ওদিক থেকে মোহিনী নাফিসার কথার জবাব দিলো, - না, কাউকে আর বাসায় ফিরতে হবে না! যেখানে গেছে সেখানেই থাকুক! যে আমাকে গণ্য করে না, তার এ বাড়িতে জায়গা হবে না!
- আপনার নাতি-নাতনী যে আসছে, তাদেরও জায়গা হবে না?
- হোয়াট! নাতিনাতনি আসছে মানে!
নাফিসা জ্বিভ কামড়ে ধরলো! কি বলতে কি বলে ফেলেছে! মেঘ প্রথমে বড় বড় চোখ করে তাকালেও এখন ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে! মোহিনী এদিকে বলছে,
- নাতিনাতনি আসছে মানে কি! মেঘ?
- তোমার মেডাম ফুলি মেয়েকে জিজ্ঞেস করো!
- নাফিসা? মানে কি?
নাফিসা দাতে দাত চেপে রেখেছে! সে রুম থেকে বের হওয়ার জন্য তারাতাড়ি বসা থেকে উঠতে গেলে মেঘ টেনে কোলে বসিয়ে দিলো! ফিসফিস করে বললো, - পালাচ্ছো কোথায়? মায়ের প্রশ্নের জবাব দাও।
- আমি পারবো না বলতে, ছাড়ো!
- উহুম, শুরু করেছো এখন বলতে হবেই!
নাফিসা মেঘের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, - তুমি বলে দাও না!
- আমি! আমি পারবো না!
নাফিসা মেঘের কানে আলতো কামড় দিয়ে বললো, - প্লিজ! প্লিজ!
মেঘ শরীর কাপিয়ে নিশব্দে হেসে উঠলো! এদিকে তারা দুজন ফিসফিস করে কথা বলছে আর ওদিকে মোহিনী জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে! কিন্তু কারো জবাব পাচ্ছে না! - নাফিসা? মেঘ? আরে কেউ তো কিছু বলো!
নাফিসা শক্ত করে মেঘের গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। এবার মেঘই জবাব দিলো,
- মা, ছোট্ট কদম ফেলে তোমার সাড়া বাড়িতে দৌড়ানোর মানুষ আসছে খুব শীঘ্রই!
- এসব কি শুনছি আমি! গাধা, নির্বোধ কোথাকার! তোর ধৈর্যশক্তি, জ্ঞানবুদ্ধি কি কিছু নেই! নাফিসার কি প্রাপ্ত বয়স হয়েছে! লাইফের খুটি না দাড়াতেই ভেঙে দিলি! অন্তত অনার্স কমপ্লিট পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতে পারতি! এই বয়সে কি সে এতোটা ধকল সহ্য করতে পারবে! অল্প বয়সে তার যে ক্ষতি হতে পারে সেই জ্ঞানটুকু কি তোর নেই! একটা মেয়ের বিশ বছরের আগে বাচ্চা নেয়া রিস্কের ব্যাপার! সে না হয় ছোট বিধায় বুঝেনি, তোর তো বুঝা উচিত ছিলো মেঘ! তোদের বয়স বাড়ছে আর দিন দিন জ্ঞান বুদ্ধি কমছে! আশেপাশের অবস্থাও কি তোদের চোখে পড়ে না!
মোহিনীর কথা শুনে দুজনের খুশিই উড়ে গেলো! নাফিসা মেঘের গলা ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে মেঘের দিকে তাকালো! মেঘ চিন্তিত হয়ে বিছানার দিকে তাকিয়ে আছে! মেঘের এই মলিন চেহারা তার একদম ভালো লাগছে না! সে কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারছে, মেঘের ভেতরে কষ্ট হচ্ছে মায়ের কথায়! মোহিনীর বলা শেষ না হতেই, নাফিসা ফোন হাতে নিয়ে কল কেটে দিলো! মেঘ বিছানা থেকে চোখ সরিয়ে নাফিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
- মেঘা, সেদিন তুমি নিজে থেকে কাছে না টানলে হয়তো এতো তারাতাড়ি এমনটা হতো না!
নাফিসা দু’হাতে মেঘের মুখখানা ধরে বললো, - এই তুমি মন খারাপ করছো কেন! আমার বয়স তো উনিশ! ছোট না আমি! আমাদের বেবি আসছে, আমি খুশি, তুমি খুশি! আর কিছু লাগে না আমাদের! হুম!
মেঘ নাফিসাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো! গলায় মুখ লুকিয়ে বললো, - মেঘা, তুমি কি ভয় পাচ্ছো? একদম ভয় পাবে না! আমি আছি তো তোমার সাথে! আমি আছি, আমাদের বাচ্চারা আছে! ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ ঠিক রাখবেন সবটা।
- মেঘ! ছাড়ো, সোজা হও! মেঘ!
মেঘের এ কন্ঠ স্বাভাবিক লাগছে না নাফিসার কাছে! খুব ভালো বুঝতে পারছে মায়ের কথায় মেঘ ভীষণ কষ্ট পেয়েছে এবং ভয়ও পেয়েছে ভীষণ! এদিকে মেঘকে ছাড়াতেও পারছে না! কল কেটে যাওয়ায় মোহিনী কল ব্যাক করছে! নাফিসা কোনোমতে হাতটা বাড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করে বললো,
- মা, মেঘ কাদছে! ওর কোনো দোষ নেই!
- মেঘ! এই বোকা ছেলে! এমন খুশির খবর শুনে কেউ কাদে! আমিও অনেক খুশি হয়েছি, আমাকে দাদু বলে ডাকার মানুষ শীঘ্রই আসছে বলে! আমি তো শুধু বুঝানোর চেষ্টা করছিলাম! কোনো ভয় পাবি না! সব ভালো হবে ইনশাল্লাহ! এই ছেলে, মায়ের সাথে কথা বল! বলবি না! আমি কিন্তু বেম্বো দিয়ে পেটাবো তোকে! আসবো এখন! এখন এলে কিন্তু জুতা রেখে মোজা দিয়ে পেটাবো!
মেঘ হেসে উঠলো নাফিসাকে জড়িয়ে ধরেই! মোহিনী জিজ্ঞেস করলো, - নাফিসা, মেঘ হেসেছে?
- হ্যাঁ, মা।
- তোমার চোখে পানি কেন!
নাফিসা হেসে তার চোখের পানি মুছে বললো, - কিভাবে বুঝলেন?
- মেঘ কাদবে আর মেঘা কি বসে থাকবে নাকি! ঝগড়া হবে, খুব বড় ঝগড়া হবে তোমার আম্মির সাথে আমার! আমিও আসছি সিলেট এবং খুব শীঘ্রই! ঝগড়া করার সব প্রস্তুতি নিয়ে আসবো, প্রস্তুত থাকতে বলো তোমার আম্মিকে! অনেক অভিমান জমা আছে, অনেক হিসাব নিকাশ বাকি আছে তোমার আম্মির সাথে!
- ফোন দিয়ে আসবো?
- না, ফোনে কি ঝগড়া করা যায় নাকি! শুধু শুধু আমার ব্যালেন্স নষ্ট! প্রত্যক্ষ যুদ্ধ হবে! আবারও বলছি, আমি কিন্তু একটুও রাগ করিনি! বরং অনেকের চেয়েও অনেক বেশি খুশি হয়েছি! এরপর যদি কেউ মন খারাপ করে তাহলে মোহিনী চৌধুরীর চেয়ে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম!
মেঘ বললো, - মোহিনী চৌধুরী খারাপ হোক তাতে আমার কিছু আসে যায়না! কিন্তু আমার মা কি সত্যি বলছে? আমার জননীকে কি সবসময় বাচ্চাদের নিয়ে খুশি দেখবো?
- পাক্কা!
- ওকে।
- হুম, আমার পরিবারের সব সদস্য যেন সবসময় সুখী থাকে আর যেখানেই থাকুক, নিজের খেয়াল রাখে! হুম!
- ইনশাআল্লাহ।
- রাখি এখন। তোর বাবাকে জানাই আগে!
মা ছেলের কথাবার্তা শুনে নাফিসার মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো! মেঘ কল কেটে নাফিসার মুখে হাসি দেখে ঠোঁটের ছোয়া দিলো ঠোঁটে! দুজনের মুখের সুখের ছায়া লেগে আছে এখন! নাফিসা পরম আবেশে মেঘের বুকে মাথা রেখে মিশে রইলো! মেঘ নাফিসার চোখে ঘুম দেখতে পাচ্ছে স্পষ্ট। তাই জিজ্ঞেস করলো,
- মেঘা, ঘুম পেয়েছে খুব?
- হুম।
- কারণ কি?
নাফিসা আর কিছু বললো না। চুপচাপ মিশে আছে মেঘের সাথে! মেঘ আবার বললো, - বলো, এতো ঘুমের কারণ কি?
- জানিনা!
- আমি জানি।
- কি?
- কাল সারারাত তুমি ঘুমাওনি!
- কিভাবে বুঝলে?
- তোমার চেহারায় সব ভেসে উঠে আর সেই ভাষা আমার মুখস্ত! পরবর্তীতে যদি কখনো এমন কিছু দেখেছি তাহলে তোমাকে তো আর কিছু করতে পারবো না, তবে নিজের সাথে কি করবো ভেবে পাবে না তুমি!
নাফিসা চুপচাপ মিশে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন সে গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে গেছে! মেঘ বললো,
- হয়েছে, এখন আর ঘুমের নাটক করতে হবে না। বালিশে যাও, ঠিকভাবে শুয়ে ঘুমাও।
- তুমি ঘুমাবে?
- উহুম, কাজ আছে আমার। তোমার জন্য মিটিং ফেলে চলে এসেছি। এখন কনফারেন্সে এটেন্ড করতে হবে।
- কখন মিটিং?
- চারটার দিকে।
- অনেক দেড়ি! একটু ঘুমালে ফ্রেশ লাগবে।
মেঘ কিছু একটা ভেবে বললো, - চলো, বালিশে যাও।
নাফিসা মেঘকে ছেড়ে বালিশে শুয়ে পড়লো পাশে মেঘও। মেঘের শরীরের মাতাল সুবাস না পেলে সহজে ঘুম আসে না তার! তাই আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সে। মেঘ বললো, - মেঘা?
- হুম?
- বেবির ব্যাপারে তুমি কি নিশ্চিত?
- হুম।
- কিভাবে নিশ্চিত হলে? হসপিটাল গিয়েছিলে?
- উহুম। সন্দেহ হয়েছিলো বিধায় প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট স্টিক কিনেছিলাম সেদিন বৃষ্টির সাথে শপিংমলে গিয়ে।
- বৃষ্টি দেখেনি?
- উহুম।
- সে কোথায় ছিলো?
- সে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ব্যস্ত ছিলো! সুযোগ বুঝে আমি কিনে নিয়েছি।
- একটু একটু চালাক হয়ে গেছো মনে হচ্ছে!
নাফিসা হিহি করে হেসে উঠলো! মেঘ আবার বললো, - মা কিন্তু ঠিক বলেছে। এতো তারাতাড়ি বেবি নেওয়াটা ঠিক হয়নি আমাদের! তোমার পড়াশোনা আগে শেষ করার প্রয়োজন ছিলো। তাছাড়া তোমার বয়সও কম।
- মেঘ! তুমি আবার মন খারাপ করছো!
- উহুম, সত্যটা শুধু বললাম।
- চুপ একদম! এ নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না। আর কোন দুশ্চিন্তাও করবে না।
মেঘ নাফিসার মাথার একপাশে আলতো চুমু একে বললো, - ওকে। ঘুমাও।
বিকেলে মেঘ চালতা গাছের নিচে বেঞ্চে বসে কনফারেন্সে মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করলো। পরিবেশটা মন্দ না, পেছনে একের পর এক সবুজ গাছপালায় আচ্ছন্ন। বিকেলের পড়ন্ত রোদের সোনালী আলো উঁকি দিচ্ছে পাতার ফাকে ফাকে! মেঘ আলোচনায় বসলে হঠাৎ দেখলো অফিসে থাকা লোকগুলো অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে! অত:পর সবাই চিৎকার চেচামেচি করতে লাগলো, “মেঘ! সাপ! মেঘ, সাপ সাপ!”
মেঘ তাদের কথা বুঝতে পারছে না! অফিসের ভেতর কি সাপ চলে গেলো! অফিসে সাপ আসবে কোথা থেকে! সে বুঝার চেষ্টা করছে আর অফিসের সবাই “সাপ! সাপ!” বলে চেচাচ্ছে আর তাকে সরে যেতে বলছে। এমন হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ শুনে নাফিসা একটু এগিয়ে এলো, সাথে সাথেই খুব জোরে চিৎকার দিলো! মেঘ কারো আচরণই বুঝতে পারলো না! তবে নাফিসাকে চিৎকার করতে দেখে সে বেঞ্চে ল্যাপটপ রেখে দৌড়ে নাফিসার কাছে চলে এলো! নাফিসাকে ধরে বললো,
- মেঘা! এই, কি হয়েছে তোমার!
নাফিসা ছলছল চোখে তাকিয়ে মেঘকে দেখছে!
- আরে, কি হয়েছে? চিৎকার করলে কেন?
নাফিসা আঙুল দিয়ে দেখালে মেঘ দেখলো, সে যেখানে বসেছে মাথা বরাবর গাছে একটা সবুজ রঙের মোটামুটি বড়সড় সাপ ঝুলছে! সাপ দেখে তো তার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে! এই সাপের নিচে বসে ছিলো সে! এই মুহুর্তে উঠে না এলে তো আজ তার ইন্তেকাল হয়ে যেতো! নাফিসাকে ধরে এখানে দাড়িয়েই ঢোক গিলছে মেঘ! সাপ এখনো ঝুলে আছে। মাথা একবার এদিকে নাড়াচ্ছে তো আবার অন্যদিকে!
রোকসানা নাফিসার চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। সাপ দেখে তিনিই লাঠি নিয়ে তাড়া করলেন। সাপটি লাফ দিয়ে পেছনে ঢালু জায়গায় নেমে ঝোপের আড়ালে চলে গেলো। মেঘ হাফ ছেড়ে বাচলো! নাফিসা একটু ধমকের সাথে বললো,
- এখানে এসে মিটিং করতে হবে! খোলা জায়গায় করা যায় না!
- আমি জানতাম নাকি, গাছে আবার সাপ ঝুলে!
রোকসানা বললো, - শীতকালে সব প্রানীই কোমল জায়গা খুজে। সাপও গাছ পর্যন্ত উঠে গেছে। সাবধানে থেকো একটু। পাহাড়ি অঞ্চলে ঝোপঝাড় বেশি, সাপের উপদ্রবও বেশি।
এবার মেঘ ঘর থেকে চেয়ার এনে খোলা আকাশের নিচে উঠুনের মাঝামাঝিতে বসলো ল্যাপটপ নিয়ে। আকাশ থেকে তো আর সাপ নামবে না! রায়হান চৌধুরীসহ অফিসের লোকজন মিটিংয়ের আলোচনা না করে মেঘ ঠিক আছে কিনা আর সাপ নিয়ে নানান কথা বলছে। প্রয়োজনের থেকে অধিক সময় নিয়ে তারা মিটিং শেষ করলো।
রাতে বৃষ্টি কল করে নাফিসা ও মেঘের সাথে ঘন্টাব্যাপী গল্প করলো। মেঘ তার মা কে নিষেধ করলো এখন সিলেট আসতে। কিছুদিন পর তারা নতুন বাড়িতে উঠবে, তাই বলে দিলো তখন যেন আসে। আম্মির সাথেও দেখা হবে এবং বাড়িটাও দেখা হবে।
পর্ব – ৪৬
মেঘের আরও দুদিন কাটলো শুধু ব্যস্ততার মাঝে। সিলেটই থেকেছে, নতুন বাড়ির জন্য কাজে ব্যস্ত ছিলো। এখন সে অনেকটা চাপমুক্ত! সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছে। উত্তরাঞ্চল হওয়ায় ঢাকার তুলনায় এখানে শীত অনেক বেশি। রোকসানা গরম পানি করে রেখেছে। মেঘ হাতমুখ ধুয়ে এসে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নাফিসা খাবার নিয়ে এসে এই সময় এভাবে মেঘকে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা চমকে উঠলো! শরীর খারাপ নাকি, তা ভাবতে ভাবতে টেবিলে প্লেট রেখে মেঘের কাছে এসে গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো।
মেঘ কোনো সাড়া দিচ্ছে না! নাফিসা ভয় পেয়ে আরও জোরে ডাকতে লাগলো! মেঘ চোখ খুলে নাফিসার ভয়ার্ত চেহারা দেখে জোরে হেসে উঠলো। নাফিসার খুব রাগ হচ্ছে, এভাবে ভয় দেখানোর কোনো মানে হয়! মেঘকে ধাক্কা দিয়ে সে উঠে যেতে চাইলে মেঘ একটানে তারউপর ফেলে দিলো। নাফিসা উঠার চেষ্টা করেও পারছে না! মেঘ বললো,
- খাওয়াদাওয়া যে একদম করো না এই তার প্রমাণ! আমি এক হাতে আটকে রেখেছি তাও ছোটার শক্তি নেই তোমার!
নাফিসা কোনো জবাব দিচ্ছে না! নাকমুখ ফুলিয়ে রেখে মেঘকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তার অযথা সেই চেষ্টা! মেঘকে ছাড়াতে পারছে না! মেঘ হেসে তাকে আরও চেপে ধরে বললো, - মেডাম ফুলি তো দেখছি অনেক রেগে গেছে! আমি তো শুধু একটু মজা করছিলাম!
নাফিসা এবারও তার কথায় কোনো রিয়েক্ট করছে না! নিজের ব্যর্থ চেষ্টা করেই যাচ্ছে। মেঘ তাকে খাটে নামিয়ে সে আধশোয়া অবস্থায় থেকে বললো,
- মেঘা! এই, তুমি এতো সিরিয়াস কেন! আমি সত্যিই মজা করছিলাম একটু! এখানে এতো রাগ করার কি আছে!
- আপনি এমন মজা কি করে করতে পারেন আমার সাথে! আমি কতোটা ভয় পেয়ে গেছি জানেন আপনি!
কথা বলে নাফিসা কান্না করে দিলো। মেঘ তার গালে গাল ঘষে বললো, - ওকে সরি, আর কখনো এমন মজা করবো না! হয়েছে তো! এই পাগলি, চুপ করো এবার! এই দেখি, বাচ্চার মা হয়ে গেছে এখনো কাদে! ছি ছি! বাবুরা, দেখো তোমাদের মা কিভাবে কাদছে! লজ্জা নেই একটুও!
নাফিসার কান্না থেমে গেলো। সে উঠতে চেষ্টা করলো কিন্তু মেঘ উঠতে দিলো না! কপালে আলতো স্পর্শ দিয়ে মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো নাফিসার দিকে। নাফিসা বললো,
- সরো।
- কেন?
- উঠবো।
- উঠতে দেবো না।
- আরে, খাবার নিয়ে আসবো আমি।
- তুমি পাশে থাকলে খাবার লাগবে না!
- আশ্চর্য! দরজা কিন্তু খোলা। যেকোনো সময় আম্মি এসে যেতে পারে।
- আসবে না আম্মি।
- কাজের চাপে থেকে মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি!
- তুমি কাছে থাকলে আবার মাথা ঠিক থাকার কথা নাকি!
মেঘের মাথা যে পুরো তালে হিল্লে হয়ে গেছে সেটা বুঝতে বাকি নেই নাফিসার! সে তার সর্বশক্তি দিয়ে মেঘকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে পড়লো। মেঘ চিত হয়ে পড়ে হাসতে লাগলো। নাফিসা খাবার নিয়ে এলে উঠে বসে খেতে লাগলো। মাছের কাটা বেছে দিতে গেলে নাফিসা নিষেধ করলো। মাছের গন্ধ একদমই সহ্য হয় না তার! অল্প খেয়েই উঠে যেতে চাইলো কিন্তু মেঘ উঠতে দিলো না। যতক্ষণ পর্যন্ত তার খাওয়া শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নাফিসাকে এখানেই বসে থাকতে হবে এটা মেঘের আদেশ। এবার খাওয়া শেষ হলেও উঠতে দিচ্ছে না মেঘ! বদহজম যাতে না হয় তাই এতোক্ষণ বিরতি দিয়ে নাফিসাকে জোর করে আরও কয়েক লোকমা খায়িয়ে পরে ছাড়লো মেঘ! তাকে নড়াচড়া করতে দিলো না, মেঘ নিজেই প্লেট রেখে এসেছে। পিঠের নিচে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে দুজন গল্প করছে। এর মাঝে নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
- তখন এভাবে শুয়ে পড়লে কেন? শরীর খারাপ লাগছিলো?
- উহুম, কাজের চাপমুক্ত হয়ে হাফ ছাড়লাম!
- এতো চাপ নেওয়ার কি আছে! আর এতো তাড়াই বা কেন ছিলো! আস্তে আস্তে কাজ হতো, এতে সমস্যা কোথায় ছিলো!
- সমস্যা ছিলো না আবার! ঢাকা ক’দিনও থাকতে পারোনি, ছুটে এসেছো সিলেট। একবার ঢাকা আবার সিলেট, এভাবে আর কত দৌড়ান যায়! তাই তারাহুরো করেই কাজ সারতে হচ্ছে। যদিও এখানো সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়নি তবে, হয়ে যাবে শীগ্রই। ঘুমিয়ে পড়েছো নাকি?
- উহুম।
- ঝিমাচ্ছো?
- উহুম।
- আমার ঘুম পেয়েছে ভীষণ। চলো ঘুমাবো।
- আমার এখন ঘুম আসবে না। দিনে ঘুমিয়েছি অনেক্ষন।
- তাই নাকি! তাহলে এখন কি করবে?
- কিছুনা।
- দাড়াও আমি তোমাকে কাজ দেই।
- কি?
মেঘ নাফিসাকে ছাড়িয়ে বালিশে মাথা রেখে পা ছড়িয়ে শুয়ে বললো, - আমাকে একটু আদর করে দাও তো বউ!
- ইশ! ঘুমাও চুপচাপ!
- আজকে আদর না দিলে সারারাতেও ঘুম আসবে না!
- আদর আবার কি!
- জানোনা আদর কি?
- না তো! কি সেটা? খায় না পড়ে?
- দাড়াও তাহলে জানাচ্ছি সেটা খায় না পড়ে!
মেঘ দুষ্টুমি হাসি দিয়ে চালাতে লাগলো তার দুষ্টুমি! তাকে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি নেই নাফিসার তাছাড়া ইচ্ছেও নেই কোনো!
সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে মেঘ আবার শুয়ে পড়েছে। নাফিসা কাছে এসে মেঘের বুকের উপর ডান হাত রেখে বললো,
“এই চলো না, আজ গায়ে কুয়াশা ও সোনালী কিরন মেখে প্রভাতী চাদর পড়ি দুজন!
চলো না, ঝলমলে সূর্যোদয় দেখে মুহুর্তটা উপভোগ করি আবার!
চলো না আবার সেই গিরিপথে, যেখানে তুমি আমি হেটেছিলাম আর ঝর্ণার পানির শব্দ ও পাখির কলোরব ঘিরে ধরেছিলো আমাদের!
কি গো? চলো না যাই, বেলা যে হয়ে আসছে! সোনালী রোদ যে পানিতে ভাসতে চলেছে, আর কতো রবে তুমি এমন আলসেমি করে!”
মেঘ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো তার মেঘার কথা! এ ঘরে প্রথম এসে রকমারি বই দেখেই বুঝতে পেরেছিলো নাফিসার মাঝে সাহিত্যের রস আছে! সে যে সাহিত্যে প্রেমী সেটা আগেই আন্দাজ করেছিলো আর এখন তার প্রত্যক্ষ প্রমান পেয়ে যাচ্ছে। আলসেমি ছেড়ে এক ঠেলায় মেঘ উঠে পড়লো। নিজের শরীরে জ্যাকেট চাপিয়ে নিলো এবং আলমারি থেকে একটা চাদর নিয়ে নাফিসার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললো,
” চলো, প্রভাতী চাদর পড়বো আজ তোমায় নিয়ে,
যা দেখে কুয়াশা ও সোনালী কিরন হিংসে করবে!
চলো, ঝলমলে সূর্যোদয় দেখবো একসাথে,
যা দেখে প্রকৃতিও মুগ্ধ হবে!
চলো, শুনবো ঝর্নার তান আর পাখির কন্ঠে গান!
আর মুহুর্ত উপভোগ করে স্বার্থক করে তুলবো প্রকৃতির দান!”
দুজনেই বেরিয়ে গেলো প্রভাতী চাদরে তাদের পবিত্র ভালোবাসাকে জড়িয়ে নিতে। নাফিসার বলা একে একে সব মুহুর্ত উপভোগ করে তারা বাড়িতে ফিরে এলো। শুধু শীতের সকাল হওয়ায় ঝর্ণার পানিতে গোসলটা করা হয়নি! নাফিসাকে বাসায় রেখে আবার মেঘ বাজারে চলে গেলো।
বাসায় ফিরলো শাকসবজি ও গরুর মাংস নিয়ে। নাফিসা হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিতে এলে মেঘ বললো,
- আজ মেঘার হাতের বিরিয়ানি ছাড়া মেঘ মুখে অন্ন তুলবে না!
নাফিসা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো আর মেঘ মুচকি হেসে ঘরে চলে গেলো! নাফিসা বিড়বিড় করতে করতে রান্না ঘরে এলো। “জঘন্য লোক একটা! সবকিছু জেনেও এখন উনার এমন আবদার করতে হবে! খেতে ইচ্ছে করছে যখন আম্মির হাতের বিরিয়ানি বললে কি হতো!”
নাফিসাকে বিড়বিড় করতে শুনে রোকসানা বললো,
- কি বলছিস একা একা?
- কিছু না। উঠো আমি রান্না করবো।
- না, তোকে করতে হবে না। আমিই করছি।
- তুমি করলে কাজ হবে না। আমাকেই করতে হবে। সরে এসো। বিরিয়ানি রান্না করবো।
- মেঘ বলেছে?
- হুম।
রোকসানা সরে এলো এবং নাফিসাকে হেল্প করলো। নাফিসা বেশি করে রান্নার আয়োজন করলো। আজ সারাদিন মেঘকে বিরিয়ানি খাওয়িয়ে তৃপ্তি মিটিয়ে ছাড়বে! দুদিন পর পর তার বিরিয়ানির আবদার রাখা এখন তার পক্ষে মোটেও সম্ভব না! কেননা, মাছ মাংসসহ তৈলাক্ত খাবারের গন্ধ তার একদম সহ্য হয় না! দেখলেই পেটে নাড়াচাড়া শুরু হয়ে যায় আর গড়গড় করে সব উপচে ফেলে!
নাফিসা নাকে ওড়না বেধে রান্না করতে লাগলো। মেঘের ইচ্ছেমতো তাদের সকালের নাস্তা বিরিয়ানি। নাফিসা মেঘকে খাবার দিয়ে বললো,
- নিন বিরিয়ানি! আজ সারাদিন বিরিয়ানি খায়িয়ে রাখবো আপনাকে!
মেঘ হেসে বললো, - তবুও তৃপ্তি মিটবে না গো, বেগম সাহেবা !
- তৃপ্তি না মিটলে কিছু করার নেই। আগামী এক বছরে বিরিয়ানি রান্নায় আমি আর নেই!
- আচ্ছা, দেখা যাবে! কিন্তু এ কেমন মিশ্রভাষা তোমার! একবার আপনি একবার তুমি!
- ভালো লাগে এক এক সময় এক এক ভাবে সম্মোধন করতে। খেয়ে নিন।
- তুমি কোথায় যাচ্ছো?
- আছি বাড়িতেই। কেন, কিছু লাগবে?
- হ্যাঁ, তোমাকে লাগবে।
- খাওয়া শেষ হলে ডাকবেন!
- কেন, তুমি খাবে না?
- জ্বি না!
- বসো এখানে।
- অনেক কষ্টে রান্না শেষ করেছি, প্লিজ এখন খেতে বলবে না!
মেঘ হেসে বললো,
- তাহলে খায়িয়ে দাও!
মেঘের এমন দুষ্টুমি দেখে নাফিসা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। মেঘ হাত বাড়িয়ে নাফিসাকে কাছে এনে বসালো। হাত ধুয়ে প্লেট নিয়ে একপাশে ইচ্ছে মতো লেবু চিপে নিলো বিরিয়ানিতে। নাফিসার মুখের সামনে এক লোকমা তুলে ধরলো। নাফিসা মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করলো সে খাবে না। মেঘ তার কথা না শুনে বললো, - হা করো।
নাফিসা বাধ্য হয়ে খাবার মুখে নিলো। মেঘ আবার বললো,
- খাবার বেশিক্ষণ মুখে রাখবে না, তারাতাড়ি গিলে ফেলার চেষ্টা করো। বমি হয় বলে কি, না খেয়ে থাকবে! এভাবে নিজেরসহ বাচ্চার ক্ষতি হবে। একটু পরপর খাওয়ার চেষ্টা করবে। বমির ভয়ে বসে থেকো না!
নাফিসাকে কিছু খাবার খায়িয়ে দিয়ে মেঘ পেট পুড়ে খেলো। দুপুরেও তাকে বিরিয়ানিই খেতে দিলো নাফিসা। তবে মেঘ একা খায়নি, নাফিসাকেও খায়িয়েছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করেই মেঘ নিজ হাতে নাফিসার কাপড়চোপড়সহ নিজের কাপড়চোপড় ব্যাগে নিতে শুরু করলো! নাফিসা দেখে বললো,
- কাপড়চোপড় ব্যাগে রাখছো কেন?
- চলে যাবো, রেডি হও।
- চলে যাবো মানে! কোথায় যাবো?
- কোথায় আর যাবে! যেখানে নিয়ে যাবো সেখানেই যাবে।
- মেঘ, বাবা-মা ক’দিন পর সিলেট আসবে তাহলে আমরা এখন কেন যাবো!
- এতো কথা বলো কেন! রেডি হতে বলেছি, চুপচাপ রেডি হও!
মেঘ ধমক দেওয়ায় নাফিসা মুখ মলিন করে ফেললো! মেঘের হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারছে না! সে বেরিয়ে আম্মির কাছে চলে গেলো। আম্মিকে গিয়ে মেঘের আচরণের কথা বলতেই আম্মি বললো মেঘের কথামতো চলতে! এ কেমন উল্টো বিচার! মেঘ কেন এমন করলো অন্তত সেটা তো জিজ্ঞেস করতে পারতো আম্মি! মেঘ আবার ডাকতেই নাফিসা রুমে এসে তৈরি হতে লাগলো। সকল কর্মেই তার জেদ স্পষ্ট! দুদিন হলো এসেছে, এখনই যাওয়ার জন্য এমন করছে কেন মেঘ! আর ক’টাদিন থাকলে কি হতো এখানে! মন খারাপ করে তৈরি হয়ে গেলো নাফিসা। মেঘ নিজে তৈরি হয়ে আম্মির কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো নাফিসাকে নিয়ে। নাফিসা আম্মিকে ধরে কান্না করছিলো। আম্মি সাবধানে থাকার জন্য বলে দিলেন। বের হওয়ার আগে মেঘ খরগোশ ছানাদের সাথে সাক্ষাৎ করে নিলো। ছানারা এখন আর সেই ছোট্ট ছানা নেই! তারা অনেকটা বড় হয়ে গেছে। তাদের খরগোশই বলা চলে!
পর্ব – ৪৭
মেঘ নাফিসাকে নিয়ে রেলস্টেশনে এলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাকে নিয়ে মেঘ চিটাগংয়ের ট্রেনে উঠলো! স্টেশনে কেউ জিজ্ঞেস করলে মেঘ বললো, “রাঙামাটি যাচ্ছি”। নাফিসা একটু দূর থেকেই শুনে ফেলে অবাক হয়ে গেছে! মেঘ কি এখন রাঙামাটি যাবে! রাঙামাটি কেন যাবে! নাফিসার জানতে ইচ্ছে করছে খুব কিন্তু কিছু বলতে পারছে না! কেননা মেঘ তাকে ধমক দেয়ায় রেগে আছে মেঘের উপর! আজও একটা কেবিন বুক করে নিয়েছে মেঘ।
নাফিসাকে বসতে বলে মেঘ দরজার সামনে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ফোনে কারো সাথে কথা বললো, সম্ভবত অফিসের কাজে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, মেঘ এখনো দরজার সামনে দাড়িয়েই কথা বলছে। নাফিসা অপলক তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। ব্লাক জিন্স ও অফহোয়াইট শার্টে খুব সুন্দর লাগছে তাকে! গলার নিচে শার্টে আটকে রেখেছে সানগ্লাস! সিল্কি চুলগুলো বাতাসে হেলছে! সবদিক থেকে এতো স্মার্ট কেন সে! এতো ভালো লাগে কেন তাকে ভেবে পায় না নাফিসা! সারাজীবন দেখলেও যেন তৃপ্তি মিটবে না!
মেঘ কথা বলা শেষ করে কেবিনের দরজা আটকে দিয়ে নাফিসার পাশে এসে বসলো। হঠাৎ করেই মেঘের উপর রাগের কথা মনে হলো নাফিসার। তাই সে উঠে বিপরীত সিটে চলে গেলো। আড়চোখে মেঘের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘ অবুঝের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে! সে দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। মেঘ মুচকি হেসে ফোন হাত থেকে পকেটে রেখে নাফিসার পাশে এসে বসলো। নাফিসা আবার উঠে অন্যদিকে যেতে নিলে মেঘ এক টানে কোলে বসিয়ে দিলো। নাফিসা উঠার জন্য ছটফট করছে কিন্তু মেঘ তাকে চেপে ধরে রেখেছে। মেঘ বললো,
- আরে কি করছো তুমি! বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে তো! চুপচাপ বসো, এতো নড়াচড়া করলে জেগে যাবে।
নাফিসা ব্রু কুচকে তাকাতেই মেঘ ফিক করে হেসে উঠলো! নাফিসা অভিমান নিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। মেঘ কানে আলতো করে কামড় দিয়ে বললো, - বাচ্চাদের মায়ের এতো রাগ এতো অভিমান কেন, হুম! আমি তো সেই ভয় পাচ্ছি, বাচ্চারা না জানি কতটা অভিমানী হয়! তখন আমার কি হবে! বাচ্চাদের মাকেই সামলাবো নাকি বাচ্চাদের!
মেঘের কথার সাথে তাল মিলিয়ে নাফিসার অভিমান যেন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভিমানগুলো অশ্রু হয়ে দেখা দিচ্ছে! মেঘ বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে নাফিসার কাধে থুতনি রেখে বললো, - ওগো, অভিমানী বউ আমার! এতো অভিমান কি কেউ করে! সব যদি আগেই বলে দেই, তাহলে সারপ্রাইজ দিবো কিভাবে! মেঘা, কথা বলো আমার সাথে।
- কোনো কথা বলবো না আপনার সাথে!
- বলেই তো ফেলেছো, এবার সমাপ্তি করো অভিমানের। চলো একটু একটু প্রেমালাপ করি!
- ধমক দিয়েছেন কেন আমাকে! আর কখনো কোনো কথা বলবেন না আমার সাথে।
- হায়! হায়! এক সপ্তাহের খাবার বন্ধ করে দিও, তবুও এতো বড় শাস্তি দিও না মোর বেগম সাহেবা ! এটা সম্ভব না! পানিশমেন্ট চেঞ্জ করো।
নাফিসা চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে। মেঘ আবার বললো, - কি হলো, কিছু বলো! ও, আমি তো ভুলেই গিয়েছি, এ তো বাচ্চাদের মায়ের আদর পাওয়ার বাহানা! এখনই পুষিয়ে দিবো সব!
নাফিসা বড় বড় চোখ করে তাকালো মেঘের দিকে! মেঘের মাথায় যে এখন দুষ্টুমির জাহাজ চলছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে নাফিসা! মেঘকে থামানোর জন্য বললো, - ছি! ছাড়ো! মেঘ, প্লিজ স্টপ!
মেঘ হাহা করে হেসে উঠলো এবং নাফিসার কথায় থেমে গেলো। নাফিসাকে পায়ের উপর বসিয়েই জানালার দিকে আরেকটু চেপে বসলো। নাফিসা মেঘের বুকে হেলান দিতে গেলে সানগ্লাসটা বাধা দিলো। নাফিসা সানগ্লাস হাতে নিয়ে আরাম করে বসলো এবং সানগ্লাস নিয়ে খেলতে খেলতে বললো, - রাঙামাটি কেন যাচ্ছি আমরা?
- কে বলেছে রাঙামাটি যাচ্ছি?
- তুমি বলেছো।
- ওহ! শুনে ফেলেছো! আমার সারপ্রাইজটা আর রইলো না!
- চিটাগংয়ের ট্রেনে উঠেই সারপ্রাইজড হয়ে গিয়েছি! এবার বলো?
- মেঘা, বিয়ে হয়েছে আমাদের দুমাসেরও বেশি হয়ে গেছে! বাচ্চারাও আসতে চলেছে অথচ কাজের চাপে আমাদের মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া হলো না! কাজের চাপমুক্ত হয়ে আজ সাজেক যাচ্ছি মধুচন্দ্রিমায়!
নাফিসা অবাক হয়ে মেঘের দিকে তাকালো! সে তো ভেবে নিয়েছিলো হয়তো কারো বাসায় দাওয়াত পড়েছে তাই বেড়াতে যাচ্ছে! এ তো দেখছে প্রেমরাজ! উনার এতো কাজ ফেলে মধুচন্দ্রিমা নিয়ে পড়েছে! মেঘ ব্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, - কি হয়েছে?
নাফিসা আবার আগের ন্যায় হেলান দিয়ে বললো, - তুমি খুব খারাপ এবং জঘন্য একটা লোক! এতো কাজ ফেলে মধুচন্দ্রিমা নিয়ে পড়ে আছো! এখন এটা মাথায় আসছে না, বাবা মা মধুচন্দ্রিমার কথা শুনলে কি ভাববে!
- ঘোড়ার ডিম!
- কি!
- ঘোড়ার ডিম বুঝো না! মানে কিছুই ভাববে না বাবা মা। উনারাই তো এখনো বছর দুএক পর পর হানিমুনে যায়!
- কিইই!
- জ্বিইই! বিয়ের পর যেদিন বাসায় গিয়েছি সেদিন বাবা জিজ্ঞেস করেছে হানিমুন টানিমুন সেড়ে ফেলেছি কি-না!
- ছি! এসব নিয়েও বাবা ছেলের মাঝে কথা হয়, আজ প্রথম শুনলাম! যেমন বাবা তেমন ছেলে!
- যেমনটা কেমন?
- রোমাঞ্চ গুরু!
মেঘ হাহা করে হেসে বললো, - মেঘা, তুমি এখনো বুঝেই উঠতে পারোনি! রোমাঞ্চ নামক ভাইরাসটা আমাদের পরিবারের রক্তেই মিশে আছে! চিন্তা করো না, অতি শীঘ্রই তোমার মাঝেও ছড়িয়ে পড়বে ভাইরাসটা!
নাফিসা কিছু বললো না। মেঘের কাছে রোমাঞ্চকর কিছু শুনলে কখনো শিহরিত হয় আবার কখনো খুব বেশি লজ্জা পায়! এখন লজ্জা পাচ্ছে তাই চুপ হয়ে আছে! মেঘ লজ্জা পেতে দেখলে আরও বেশি লজ্জা দিবে! একমাত্র তার আশ্রয় ছাড়া লজ্জায় এখানে কোথাও লুকানোরও জায়গা নেই!
তীব্র গতিতে ট্রেন চলেছে। জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে তীব্র বাতাস! ঠান্ডা লাগলেও বেশ ভালো লাগছে উভয়ের কাছে! মেঘ আগেই পাতলা কম্বল নিয়েছিলো সাথে। নাফিসাকেসহ সে কম্বল মুড়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। নাফিসা হঠাৎ বাইরে কিছু দেখে অবাক হয়ে বললো,
- দেখো! দেখো! দৃশ্যটা চমৎকার না!
মেঘ বাইরে তাকিয়ে দেখলো মাঠের ওপারে কিছু লোক পুকুরে মাছ ধরছে। অল্প পানিতে জাল ঘেরাও করেছে বিধায় মাছগুলো খুব বেশি লাফালাফি করছে যা এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে! মেঘ নাফিসাকে পরম আবেশে জড়িয়ে বললো,
- মেঘা, এর চেয়েও বেশি চমৎকার দৃশ্য দেখাবো তোমাকে।
- কোথায়? সাজেক?
- হুম। সাজেকের ভাঁজে ভাঁজে খুঁজে পাবে প্রকৃতির সাজ! প্রায় আঠারো’শ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া, যেন প্রকৃতির এক মিনার। সেই চূড়ার চারপাশে ঘন সবুজ অরণ্যের ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। সেই সারি সারি পাহাড়ের ওপর কুয়াশার মতো উড়ে বেড়ায় ধূসর এবং সাদা রঙের মেঘ। আর সেই মেঘের গা ছুঁয়ে আসা বাতাস শীতল পরশ বুলিয়ে যায় দেহে। মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ সাজেক!
মেঘের মুখে এটুকু বর্ননা শুনেই যেন নাফিসা হারিয়ে গেছে সেই বৈচিত্রময় জগতে! মেঘের মুখে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ যেন বাস্তব হয়ে তার চোখের সামনে ভাসছে! অতি উৎফুল্ল হয়ে নাফিসা জিজ্ঞেস করলো,
- সেই মেঘই কি ছোয়া যায়?
- হুম। তুমি মেঘ ছুতে পারবে না কিন্তু মেঘ তোমাকে ঠিকই ছুয়ে যাবে। এবং তোমার অনুভুতিতে সাড়া দিয়ে যাবে!
নাফিসা মেঘের শার্ট খামচে ধরে বললো,
- মেঘ, জানি না এসব কতটা সত্য! তবে কেন জানি অতি উৎফুল্ল করে তুলছে আমায়! প্লিজ থেমে যাও তুমি! না হয় সবটা ঘুমন্ত স্বপ্নের মতো হারিয়ে যাবে!
- ওকে, থেমে গেলাম! স্বপ্ন নয়, তোমাকে বাস্তবিক উপলব্ধির সম্মুখীন করতে চাই আমি। সরি।
এমন সময় মেঘের মুখ থেকে “সরি” শব্দটা শুনে নাফিসা চরম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, - সরি কেন?
- বিনা কারণে ধমক দিয়ে তোমার মুড নষ্ট করার জন্য।
- বিনা কারণ না। সারপ্রাইজটা ই সেটার কারণ ছিলো। বাদ দাও। আম্মি কি জানতো বেড়াতে যাওয়া সম্পর্কে কিছু?
- হুম।
- এজন্যই আমি বলার পরও কিছু বলেনি!
- হুম, ঘুমাবে একটু?
- উহুম।
- তাহলে কি করবে?
- তুমি গল্প শোনাবে আর আমি শুনবো। তবে সাজেক নিয়ে কিছু বলবে না। সবটা নিজ চোখে দেখতে চাই!
মেঘ নাফিসা উভয়ই গল্প করে ট্রেনে সময়টা পাড় করলো।
একসময় তারা পৌছে গেলো রাঙামাটি। তারা সাজেকের দার্জিলিং রিসোর্টে উঠেছে। ফ্রেশ হয়ে তারা এখন বিশ্রামের জন্য প্রস্তুত! পুরো একটা দিন কাটলো তাদের ভ্রমণ ও বিশ্রামে।
খুব সকালেই ঘুম ভাঙলো মেঘের। পাশে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে নাফিসা। মেঘ দুহাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে বালিশে কনুই ভর করে হাতে মাথা রাখলো। আধশোয়া অবস্থায় থেকে তাকিয়ে আছে তার মেঘার মুখপানে। কেমন যেন সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে আছে কপালে। মেঘ দু আঙুলে নাফিসার ঠোঁটের দু কোনে টেনে প্রশস্ত করে দিলো। এবার ঠিক আছে! হাসিমাখা মুখখানাই তো দেখতে ভালো লাগে, সবসময় এমন সিরিয়াস মুডে থাকে কেন!
মেঘ নাফিসার কপালে আলতো কোমল স্পর্শ একে দিলো। অত:পর নাফিসার মাথা ঘেঁষে আবার শুয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগলো তাকে।
- মেঘা, এই মেঘা?
- হুম?
- উঠো, ভোর হয়ে এসেছে তো!
নাফিসা চোখ না খুলেই মেঘের সাথে আরও জড়ো হয়ে ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,
- একটু পর!
নাফিসার ঘুম কাটেনি বুঝতে পেরে মেঘ মুচকি হেসে নাফিসাকে ছাড়িয়ে উঠে পড়লো। রুমের পর্দা টেনে সরিয়ে দিয়ে উঁচু গলায় বললো, - মেঘা! দেখো কি চমৎকার সাজেকের সাজ!
ঘুমের মধ্যে উচ্চ কন্ঠ শুনে নাফিসা ধরফরিয়ে উঠে বসলো! তাকিয়ে দেখলো মেঘ রুমের একপাশে দাড়িয়ে আছে। এপাশের সম্পূর্ণ দেয়াল কাচের আবরণ! সে যে রাঙামাটি এসেছে আর হোটেলে ঘুমাচ্ছে তার মনেই ছিলো না! এখন মনে পড়লো সেটা! কাচের বিপরীতে ঘোলাটে পরিবেশ দেখে কম্বল সরিয়ে ধীর গতিতে কদম ফেলে এগিয়ে গেলো নাফিসা। হাত বাড়িয়ে কাচের উপর নাড়ালো। সাথে সাথে কুয়াশার আস্তরণ মুছে গ্লাস স্বচ্ছ হয়ে গেছে। বাইরে যতদুর চোখ যাচ্ছে হালকা কুয়াশায় আচ্ছন্ন আর উঁচুনিচু পাহাড় দেখতে পাচ্ছে! আকাশপানে তাকাতেই খুব নিকটে ঘন কুয়াশা দেখতে পাচ্ছে! প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে আকাশ পানে তাকিয়েই বললো,
- মেঘ, বায়ুমন্ডলের নিম্নভাগে হালকা কুয়াশা আর উপরিভাগে ঘন কেন?
মেঘ গ্লাসে কুয়াশার আস্তরণে আঙুল দিয়ে লিখলো “হেভ এ সুইট মর্নিং, বেবি’স মম!” অত:পর কাছে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, - কেননা নিম্নভাগে কুয়াশা দেখতে পাচ্ছো আর উপরিভাগে মেঘ!
নাফিসা চমকে উঠে বললো, - ওগুলো মেঘ!
- হুম।
- এতো নিকটে!
- হুম।
- এগুলোই কি স্পর্শ করা যায়?
- হুম।
সাথে সাথে নাফিসার মুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠলো! মেঘের হাত ছাড়িয়ে পেছনে ফিরে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললো, - ও হে জনাব, আমি মেঘ স্পর্শ করিতে চাই!
মেঘ মাথা চুলকে বললো, - তো করো, নিষেধ করেছে কে! আমি তো তোমার সামনেই দাড়িয়ে আছি! যত পারো স্পর্শ করো!
অসময়ে মেঘের এমন দুষ্টুমি দেখে নাফিসা কড়া কণ্ঠে বললো, - আমি তোমার কথা বলেছি! আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের কথা বলেছি!
- যাক বাবাহ! আকাশের মেঘের জন্য এখন আমি পর হয়ে গেলাম! প্রকৃত মেঘের রূপে মুগ্ধ হয়ে এখন আমার কোন মূল্য নেই!
মেঘের হিংসে মাখা কথা শুনে নাফিসা মুচকি হেসে মেঘের খুব কাছে এগিয়ে গেলো। এতোক্ষণে খেয়াল করলো এই ঠান্ডার মধ্যে মেঘ খালি গায়ে দাড়িয়ে আছে! ঘুম থেকে উঠে কোনো শার্ট বা টিশার্ট কিছুই পড়েনি শুধু জিন্সের প্যান্ট পড়নে। তার নিজের গায়েও ওড়না নেই! সে বিছানায় ওড়না রেখেই নেমে এসেছে! এখন লজ্জা লাগছে খুব! কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভালো লাগছে তার সামনে দাড়িয়ে থাকা মেঘের রূপ! এ রূপ মুগ্ধ করেছে নাফিসাকে। তাই সেই মুগ্ধতায় লজ্জা আড়াল করে সে মেঘের উন্মুক্ত বুকের লোমে নাক ডুবালো! মাতাল সুরে বললো,
” হুম, নেই তোমার কোনো মূল্য!
তুমি আমার অমূল্য সম্পদ,
অমূল্যের মূল্য উঠালে তো যে কেউ করিবে ক্রয়!
হারিয়ে ফেলবো না তো কভু, সর্বদা থাকে মনে সংশয়!
ও হে জনাব,
প্রতি মুহূর্তে আমি তোমার উপর মুগ্ধ,
রঙিন আলো ছড়িয়ে করেছো তুমি, আমার জীবন স্নিগ্ধ!
ওগো, তুমি শুধুই যে আমার!
আমি সর্বদা কাতর, স্পর্শে তোমার!
জীবন ফুরিয়ে যাবে,
তবুও ফুরাবে নাকো তোমার প্রতি মোহ আমার!”
মেঘ খুব অনুভব করছিলো কথাগুলো! মেঘার কোমল স্পর্শ পেয়ে মেঘের মুখে উচ্চারিত হলো,
” ও হে বেগম সাহেবা ,
এ কেমন বুলি তোমার!
অসময়ে করো নাকো মাতাল,
হয়ে যাবো মাতোয়ারা!
আজ তোমার তরে দেখেছি আমি,
জাগ্রত হয়ে উঠেছে প্রেম, যা কেবল সর্বনাশা !”
নাফিসা লজ্জা পেয়ে মেঘকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,
- এতো দুষ্টু কেন আপনি!
- তোমার সর্বনাশা প্রেমের জন্য!
নাফিসা খাট থেকে ওড়না তুলে দ্রুত বাথরুমে চলে গেলো। মেঘ শব্দ করে হাসতে লাগলো! নাফিসা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলে মেঘ বাথরুমে যেতে যেতে বললো,
- শীতের জামা পড়ে দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। ভোর কেটে গেলে মেঘের সাক্ষাৎ পাওয়া দুষ্কর!
নাফিসা উৎফুল্ল হয়ে তারাতাড়ি তৈরি হয়ে গেলো। দুজনেই শীতের জামা পড়ে বেরিয়ে গেলো সাজেকের মেঘের সাক্ষাতের সন্ধানে।
পর্ব – ৪৮
তারা রিসোর্টের বাইরে এসে দেখলো খুব সুন্দর পাকা রাস্তা। পরিচ্ছন্ন জায়গা, আশেপাশে শুধু সবুজের সমারোহ! দার্জিলিং রিসোর্টের চারিপাশ দেখে মনে হচ্ছে এটা বাংলাদেশের দার্জিলিং শহর! যখন রিসোর্টের ভেতরে প্রবেশ করেছিলো তখন এতোকিছু খেয়াল করেনি। এখন সতেজ মনে দেখে নিলো চারিপাশ।
মেঘের হাত ধরে রাস্তা বরাবর হাটতে লাগলো নাফিসা। ঠান্ডা ঠান্ডা মৃদু বাতাস! দেহের উপরিভাগ স্পর্শ করতে না পারলেও মনের গহীন স্পর্শ করে ফেলেছে! কাছ থেকে কুয়াশা বুঝাই যাচ্ছে না কিন্তু দূরদৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যাচ্ছে প্রকৃতি কুয়াশার চাদরে ঢাকা!
মেঘের দেশে মেঘ তার মেঘার হাত ধরে হাটছে। এটা শুনতে সাধারণ মনে হলেও এই মুহূর্তে তার মনের অনুভূতিটা খুব গভীর! নাফিসাকে সাজেক ভ্যালি সম্পর্কে জানাতে জানাতে আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করছে মেঘ।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭২০ ফুট উঁচু রুইলুই পাড়া এবং ১৮০০ ফুট উঁচু কংলাক পাড়া নিয়ে গড়ে উঠেছে সাজেক।
তারা আঁকাবাঁকা গিরিপথ বেয়ে উঠে এসেছে পাহাড় চূড়ায়! মেঘের কথামতো মিলিয়ে নিচ্ছে নাফিসা। সত্যিই সাজেকের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে উঠেছে প্রকৃতির অপরূপ সাজ।
এই চূড়ার চারপাশে ঘন সবুজ অরণ্যের ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। সেই সারি সারি পাহাড়ের ওপর ঘন কুয়াশার মতো উড়ছে ধূসর এবং সাদা রঙের মেঘ। আর সেই মেঘের গা ছুঁয়ে আসা বাতাস শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে গায়ে।
আকাশ ছোঁয়া আর গিরিখাদে নামার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সর্পিল পাহাড়ি সড়ক বেয়ে সাজেকে পৌঁছাতে যে রুদ্ধশ্বাস দশা হয়েছে তাদের, তা নিমিষে উবে দিয়েছে এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
যতদূর দুচোখ যায় শুধু সারি সারি পাহাড় আর পাহাড়। কবির কল্পনা ও শিল্পীর ক্যানভাসকে হারমানিয়ে উচু নিচু পাহাড়ী টিলাগুলো চলে গেছে আকাশের দিগন্তে। আর সকালের সোনারোদ আসার আগে সবুজ পাহাড়ের উপর কে যেন ছিটিয়ে গেছে এক চিলতে মেঘের ফালি।
বাংলাদেশে এতো মনোরম জায়গা আছে সেটা আজ স্বচক্ষে প্রথম দেখলো নাফিসা! সিলেটের জায়গাগুলো যে অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর সেটা জানা ছিলো কিন্তু সাজেক ভ্যালিতে তার চেয়েও বেশি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ আজ প্রত্যক্ষ দেখা!
হঠাৎই মেঘ তার পেছনে দাড়িয়ে তাকে ডানদিকে ঘুরিয়ে দাড় করালো। নাফিসা সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো! বাতাসের তালে থোকা থোকা মেঘের এক অংশ ভেসে আসছে তাদের দিকে ভাবতে আনন্দ হচ্ছে আবার ভয়ও লাগছে খুব! মেঘ তার দুহাত নাফিসার পেটের উপর রেখে জড়িয়ে ধরে আছে। যার ফলে নাফিসা তার মানব মেঘের কাছে লুকিয়েও ভয়টা জয় করার সুযোগ পাচ্ছে না! মেঘ কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
- মেঘা, বি ইজি! কিছু হবে না! শুধু উপভোগ করো মুহূর্তটা! আমি আছি তো!
মেঘের দেওয়া সাহসেও কাজ হচ্ছে না! মনের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক করছে শুধু! সাদা তুলোর মতো মেঘগুলো একেবারে নিকটে আসতেই নাফিসা মেঘের হাত খামচে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। সাথে সাথেই অনুভব করতে পারলো অতি শীতল স্পর্শ! নাফিসা চোখ খুলে তাকালো। সাদা রঙের মেঘের ফালি শীতল স্পর্শ দিয়ে তাদের ভেদ করে যাচ্ছে। পেছনে তার মানব মেঘ সামনে আছে গগনতলে ভেসে বেড়ানো প্রকৃতির দান করা মেঘ! এতো সুখ, এতো গভীর অনুভূতি এ স্পর্শে যা একেবারে মন গহীন শীতল করে গেছে! নাফিসা পেছনে ফিরে দেখলো তুলোর মতো মেঘগুলো তাদের অতিক্রম করে চলে যাচ্ছে নিজস্ব ধারাবাহিকতার নিয়ম মেনে। এবার তো ইচ্ছে করছে আরেকবার ডেকে আনতে! কখন তার চোখে অশ্রু এসেছে টেরই পায়নি! দৃষ্টি সরিয়ে ছলছল চোখে মানব মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে নাফিসা! মুখে লেগে আছে স্বর্গীয় সুখ! এতো সুখ যে তার ভাগ্যে ছিলো কভু কল্পনা করেনি সে! এ মানুষটা তার জীবনে এসে পুরো পাল্টে দিয়েছে জীবন!
মেঘ সুখ লেগে থাকা উজ্জ্বল মুখখানা ধরে কপালে কোমল স্পর্শ দিতেই নাফিসা পরম আবেশে জড়িয়ে ধরলো মেঘকে! আর স্পষ্ট সুরে উচ্চারন করলো,
“ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি মেঘ! ভীষণ ভালোবাসি তোমায়! এতো সুখে রাখছো কেন আমাকে? আমি কি এতো সুখের যোগ্য?”
মেঘ জবাব দিলো,
- ভাগ্য তো আমরা তৈরি করি না মেঘা! সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমাদের ভাগ্যে লিখে রেখেছেন সুখ! এখন শুধু সেটা আঁকড়ে ধরে রাখার প্রচেষ্টা করতে হবে আমাদের।
- সবসময় তোমার পাশে একটু ঠাই দিও মেঘ। আমি কখনো তোমার অবাধ্য হবো না।
মেঘ গানের সুরে বললো,
“এ জীবন তোমাকে দিলাম বন্ধু, তুমি শুধু ভালোবাসা দিও। বন্ধু, তুমি শুধু ভালোবাসা দিও!”
নাফিসা একহাতে মেঘের জ্যাকেটের চেইন খুলে বুকের বামপাশে মাথা রাখলো। চোখ বন্ধ করে কান পেতে মেঘের হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলো! মাতাল সুরের তান তুলে যাচ্ছে স্পন্দনগুলো। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হতেই মেঘ বললো,
- আরে! তুমি কি ঘুমিয়ে যাচ্ছো এখানে!
মেঘের কথা শুনে নাফিসা কিছুটা রেগে গেলো! সবসময়ই দুষ্টুমি করতে হবে তার! এমন উপভোগ্য মুহুর্তে কি এসব হুটহাট ফাজলামো না করলে তার চলে না! চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ এনে তাকে ছেড়ে দিয়ে জ্যাকেটের চেইন লাগাতে লাগলো। মেঘ বুঝতে পেরে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
- রাগ করছো কেন গো! জায়গাটা তো আর আমার বাপের না! ওই দেখো, এখানে আরও লোক উঠে আসছে। তাদের সামনে আমাকে এভাবে লজ্জা দিবে! আমারও তো একটু একটু লজ্জা আছে!
নাফিসা তাকিয়ে দেখলো সত্যিই কয়েকজন উঠে আসছে গিরিপথ বেয়ে! এবার তার নিজেরই খুব লজ্জা লাগছে! তাদের মাথার উপর দিয়ে আরও মেঘ ভেসে যাচ্ছে কিন্তু সেটা তাদের নাগালের বাইরে! আরও কিছুক্ষণ পাহাড় চূড়ায় কাটিয়ে তারা নেমে এলো। কাশবন রেস্তোরায় গিয়ে সকালের নাস্তা সেড়ে নিলো। সারাদিন সাজেকের আশপাশ ঘুরে বেড়ালো। দুপুরে রিসোর্টে এসে বিশ্রাম নিয়েছে। বিকেলে আবার বেরিয়েছে। কংলাক পাড়ায় কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে সন্ধ্যায় রিসোর্টে ফিরে এলো। আবহাওয়া প্রচুর ঠান্ডা বিধায় সন্ধ্যার পর আর বাইরে হাটাহাটি করলো না। রিসোর্টেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলো। সন্ধ্যার পরপরই বৃষ্টি কল করলো।
মেঘ বাথরুমে ছিলো তাই রিসিভ করেছে নাফিসা। কথায় কথায় জানিয়ে দিলো তারা সাজেকে এসেছে! বৃষ্টি আরও উৎফুল্ল হয়ে তাদের হানিমুন নিয়ে মেতে গেছে! কখন কি করেছে, কোথায় কোথায় ঘুরেছে সব তথ্য খুটিয়ে খুটিয়ে নিচ্ছে বৃষ্টি! মেঘ এসে থামালো বৃষ্টিকে। বৃষ্টি এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বললো জগন্নাথে তার চান্স হয়েছে। আর নাফিসার বদরুন্নেসা কলেজে চান্স হয়েছে।
বৃষ্টির সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই মেঘ জিজ্ঞেস করলো,
- এখান থেকে কি সোজা ঢাকায় ফিরবে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য?
নাফিসা চোখমুখ সংকোচিত করে বললো,
- শুধু শুধু ভর্তি হয়ে কি হবে? বাবুর জন্য কি এখন পড়া সম্ভব! না পারবো ক্লাস করতে আর না পারবো ভালো রেজাল্ট করতে! তার চেয়ে বরং বাদ দাও।
- মেঘা, তোমার সমস্যা কি আমি বুঝতে পারছি না! পড়াশোনার প্রতি এতো অবহেলা কেন তোমার! সবসময়ই কি এমনটা করতে! আর যদি এমনটা করেই থাকো তাহলে ইন্টারমিডিয়েট এ ভালো রেজাল্ট এলো কি করে! সবাই পড়াশোনা করার জন্য কত রকমের সুযোগ খুঁজে আর তুমি সুযোগ পেয়েও বলছো পড়বে না! তোমাকে না সেদিনও বুঝালাম, আজ যদি আমার কিছু হয়ে যায় প্রতিষ্ঠিত না হলে তুমি নিজের দায়িত্ব নিবে কিভাবে আর আমাদের বাচ্চার দায়িত্বই বা কিভাবে নিবে!
- মেঘ!
- মেঘা, আমি শুধুমাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। বুঝতে চেষ্টা করো। কার জীবনে কখন বিপদ এসে হানা দেয় আর কার সময় কখন ফুরিয়ে আসে কেউ বলতে পারবে না সেটা! তুমি নিজে প্রতিষ্ঠিত হলে ঝড়ের অনুকূলে ভেঙে না পড়ে নিজেই নিজের খুটি হয়ে দাড়াতে পারবে। অন্যের আশ্রয়ের প্রয়োজন পড়বে না। কারো কাছে হাত পাততে হবে না আর না সহ্য করতে হবে কোনো অবহেলা! আর আমি তো এখন তোমাকে চাকরি করতে বলছি না! শুধু নিজেকে উপযুক্ত ভাবে গড়ে তোলার উপায়গুলো আয়ত্তে রাখো। ভুলে গেছো, গনতন্ত্র কি বলেছেন! “তুমি আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেবো!” তাছাড়া দেখো, পরিবারের সব সদস্য উচ্চশিক্ষিত আর তুমি একা অল্প শিক্ষিত থাকলে সেখানে তোমার মূল্য কতটুকু থাকবে সেটা ভেবে দেখেছো!
- এ বছর তো সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে আগামী বছর চেষ্টা করবো।
- ভুল করবে তুমি। এ বছর নিজেকে পড়াশোনায় যতটা ব্যস্ত রাখতে পারবে আগামী বছর ততটাও পারবে না! কেননা, বেবি এলে আরও বেশি ব্যস্ততা থাকবে তোমার। তখন আরও বেশি অবহেলা করবে পড়াশোনা!
- মেঘ, আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আমরা তো সিলেটের নতুন বাড়িতে উঠবো আর সেখানেই থাকবো। আর কলেজ তো ঢাকাতে! তাহলে ক্লাস করবো কিভাবে আর পরীক্ষাই দিবো কিভাবে!
মেঘ পড়ে গেলো টেনশনে! ঠিকই তো, তারা থাকবে সিলেট আর কলেজ ঢাকায়! অনার্স কমপ্লিট করতে লাগবে চার থেকে পাচ বছর! সমস্যাভেদে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। একবার ঢাকা আবার সিলেট এভাবে কি দৌড়াদৌড়ি করে পড়াশোনা সম্ভব! মেঘ বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো এবং দরজা খুলে বারান্দায় এলো। টেনশন করছে বুঝতে পেরে নাফিসাও নেমে এসে তার কাছে দাড়ালো। মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ তার চোখে তাকাতেই নাফিসা বললো,
- আমি বলি, আগামী বছর সুযোগ বুঝে স্থানীয় কলেজে ভর্তি হবো। কোনো অসুবিধাই হবে না তখন! কথা দিচ্ছি, ইনশাআল্লাহ আমি পড়াশুনা চলমান রাখার চেষ্টা করবো।
মেঘের একটা হাত জড়িয়ে ধরে বললো, - আর তুমি তো আছোই আমাকে গাইড দেওয়ার জন্য। হুম? কি গো, কিছু বলো!
- ওকে। চলো ডিনার করে আসি।
- তুমি আগে মাথা থেকে টেনশন ঝেড়ে ফেলো, পরে ডিনার।
- আচ্ছা, তাহলে রুমে চলো। বাবু ও বাবুর আম্মিকে একটু আদর করে মাথা থেকে টেনশন ঝেড়ে ফেলি!
- ওফ্ফ! কখন থেকে ক্ষুধা লেগেছে আমার, ডিনার করবে না!
মেঘ হেসে উঠলো এবং বললো, - রুমে চলো, ক্ষুধা মিটিয়ে দিবো।
- ছি! অসভ্য প্রেমিক! আমি যাই, তুমি থাকো!
নাফিসা নিচে যাওয়ার জন্য হাটতে লাগলো আর মেঘ পেছন থেকে বললো,
” আরে দাড়াও, দরজাটা লক করার সময়তো দাও!”
নাফিসা মুচকি হেসে দাড়িয়ে রইলো। মেঘ দরজা লক করে একসাথে ডিনার করতে গেলো।
পর্ব – ৪৯
মেঘ ও নাফিসার সাথে কথা বলে বৃষ্টি অনলাইনে এলো। বন্ধুদের খবর নিলো তারা কোথায় চান্স পেয়েছে জানার জন্য। ভার্সিটিতে তো একটা স্থান পেলো এখন মেডিকেলের রেজাল্টের প্রত্যাশায় বৃষ্টি। ফেসবুকে একটু ঘুরাফেরা করতেই মনে হলো আকাশের কথা। বেশ কয়েকদিন হলো তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখছে না! যোগাযোগের সকল রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। সেদিন রাস্তায় দেখা হওয়ার পর তো চেয়েছিলো কথা বলতে সেখানেও বৃষ্টি সুযোগ দেয়নি!
আজ আবার সেই বন্ধ সিমটা চালু করলো। আকাশের নম্বর আনব্লক করলো, ফেসবুকেও আনব্লক করলো। আরও কিছুক্ষণ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য এলো। মা বাবার সাথে গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ করে আবার রুমে এলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো আকাশ তাকে “হ্যালো” জানিয়েছে মেসেঞ্জারে! দুইটা মিসড কলও উঠে আছে ফোনে! নিশ্চয়ই অনলাইনে এক্টিভ দেখে মেসেজ এবং কল দিয়েছে!
“ভুলে যাও নি তাহলে, মিস্টার আকাশ! খুব জ্বালিয়েছো আমাকে! আমিও দেখতে চাই, তোমার কাছে আমার মূল্য কতটুকু! দাড়াও, মজা নেওয়ার ডোজটা আরেকটু বাড়িয়ে দেই!”
বৃষ্টি নিজেই আকাশের ফোনে কল করলো। সাথে সাথেই রিসিভ হলো! আজ বৃষ্টি কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে আকাশ বললো,
- হ্যালো, কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ভালো। আপনি কেমন আছেন?
- আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।
- হুম, ভালো হলেই ভালো।
- ফোন বন্ধ কেন তোমার?
- অপ্রয়োজনে কোন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছি। তাই ফোন বন্ধ।
- তাহলে এখন চালু কেন?
- এখন! এখন প্রয়োজন পড়েছে তাই চালু করেছি! আর বৃষ্টি বিনা কারণে কাউকে কল করা বন্ধ করে দিয়েছে! শুনুন, যে জন্য কল করেছি! আগামী ষোলো তারিখ আমার বিয়ে।
- হোয়াট!
- একবার বললে শুনেন না দেখছি! আগামী ষোলো তারিখ আমার বিয়ে। এবার বুঝতে পারছেন! জঙ্গলে করেকবার আমার প্রাণ বাচিয়েছেন, সে প্রেক্ষিতে তো আপনি আমার পরিচিত! সুতরাং, আপনিও আমার বিয়েতে আমন্ত্রিত। আশা করি আসবেন, মিস্টার আকাশ।
- বৃষ্টি, ফাজলামো বন্ধ করো!
- এক্সিউজমি! বিয়ে শব্দটাকে আপনার কাছে ফাজলামো মনে হচ্ছে! আপনি হয়তো ভিন্ন জগতে বসবাস করেন, কিন্তু আমি সামাজিক জীবনযাপন করি। আপনাকে আমন্ত্রণ জানানোর ইচ্ছে ছিলো তাই জানিয়ে দিলাম। এবার বাকিটা আপনার ইচ্ছে! আল্লাহ হাফেজ।
বৃষ্টি কল কেটে দিলো। আকাশ সাথে সাথে কল ব্যাক করলো! বৃষ্টি দাত চেপে হাসি দিয়ে আবার নিজেকে আগের অবস্থানে এনে ফোন রিসিভ করলো। - কি ব্যাপার? আবার কল করেছেন যে!
- বৃষ্টি, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! কি বলছো এসব! তোমার তো পড়াশোনাও শেষ হয়নি! এখনই বিয়ে! তোমার বাবা মা জানে!
- আশ্চর্য! বিয়ে কি একা একা করা যায় নাকি! বাবা মা জানবে না! বাবা মা ই তো ঠিক করলো আমার বিয়ে! ছেলে অনেক স্মার্ট, ফর্সা, লম্বা, শিক্ষিত, ভালো জব করে, মোটকথা সবদিক থেকেই আমার জন্য পারফেক্ট! বাবা মার পছন্দ আছে বটে! আমারও ভালো লেগেছে তাই রাজি হয়ে গেলাম! বিয়ে তো একদিন করতেই হবে, তাই আর শুধু শুধু দেড়ি করে কি লাভ! প্রিয়জনের সাথে জীবনের সুন্দর মুহুর্তগুলো উপভোগ করার সময় অযথা নষ্ট করার কোনো মানেই হয়না! এটাই উপযুক্ত সময়!
- মিথ্যে বলছো তুমি!
- বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার! ইনবক্স চেক করুন, ছবি পাঠাচ্ছি।
বৃষ্টি টেবিলের ড্রয়ার থেকে মেঘ ও নাফিসার বৌভাত প্রোগ্রামের কার্ড নিয়ে ছবি তুলে পাঠালো। কার্ডের উপর থেকে বুঝা যাবে না এটা বৌভাত নাকি বিয়ের কার্ড! আবার আকাশকে কল করে বললো,
- দেখেছেন ছবি? এটা আমার বিয়ের কার্ড। ব্যস্ততার কারণে কার্ড পৌছাতে পারছি না! আশাকরি কল করে বলা আমন্ত্রণই গ্রহণ করবেন।
- বৃষ্টি, আমি জানি তোমার বাবা মা পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে দিবে না তোমাকে! এসব নাটক বন্ধ করো, আর আমার কথা শুনো।
- আরে, পড়াশোনা তো শেষ করবোই বিয়ের পর। সব সুযোগ বুঝেই বিয়ে দিচ্ছেন বাবা-মা। তাছাড়া আপনি এতো মাথা ঘামাচ্ছেন কেন আমার ব্যাপারে!
- কেন মাথা ঘামাচ্ছি জানো না তুমি!
- না জানি না। আর জানতেও চাই না! দয়া করে আর আমার কোনো ব্যাপারে নাক গলাবেন না! পারলে একটু দোয়া করবেন যেন আমি সুখে থাকি! আমার মিস্টার হবু কল করছে। রাখি, আল্লাহ হাফেজ!
- বৃষ্টি!
বৃষ্টি আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না আকাশকে! বৃষ্টির তো এদিকে নাচতে ইচ্ছে করছে! আকাশ আবার কল করেছে, বৃষ্টি কল কেটে দিয়ে তার বান্ধবী রূপার সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া শুরু করলো যাতে আকাশ তাকে কল করে বিজি পায়! রূপা বললো অনেকদিন হলো দেখা হয়না তাই কাল বের হতে দেখা করার জন্য। বৃষ্টিও রাজি হয়ে গেছে। কথা বলা শেষ করে দেখলো আকাশ মেসেঞ্জারে একের পর এক মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে। বৃষ্টিকে তার কথা শুনতে বলছে, কল ব্যাক করতে বলছে। আর এদিকে বৃষ্টি তাকে আবার ব্লক করে দিলো। প্রশান্তির নিশ্বাস ছেড়ে শান্তির ঘুম দিলো!
সকালে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলো রূপার সাথে দেখা করতে। বাইরে গিয়ে তো খাবেই তাই হালকা নাস্তা সেড়ে নিলো বাসায়। মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে নিলো। মোহিনী আরও কিছু টাকা বাড়িয়ে দিলেন তার জন্য একজোড়া ইমিটেশনের চুড়ি কেনার জন্য।
বৃষ্টি রূপার সাথে দেখা করলো রেস্টুরেন্টের সামনে। সাথে আরও দুজন ফ্রেন্ডকে আসতে বলেছে। সবাই মেয়ে, চারজন একত্রিত হয়ে আজ সারাদিন ঘুরাফেরা করবে ভেবে নিয়েছে। তারা চারজনই রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো সকালের নাস্তা করার জন্য। ফাকা টেবিলের দিকে যেতেই চোখ পড়লো কর্ণারের টেবিলে! সিমি, রওনক, রিজভী, আকাশ সাথে আরও একটা মেয়ে! সিমি বৃষ্টিকে দেখার সাথে সাথেই বললো,
- আরে, বৃষ্টি না!
এখানে এসে এদের দেখবে ভাবতেও পারেনি বৃষ্টি! এখন কথা না বলেও উপায় নেই! কারণ তারা তো দেখেই ফেলেছে! বৃষ্টি তার বান্ধবীদের বসিয়ে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে সিমির কাছে এলো। - কেমন আছো আপু?
- এইতো ভালো। তুমি কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ।
- ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকফাস্ট করতে এসেছো?
- হ্যাঁ। তোমরাদেরও তো দেখছি!
- আমরা তো বিপদে পড়ে এসেছি। গাজীপুর গিয়েছিলাম, আজ সকালেই এলাম, একবারে ব্রেকফাস্ট সেড়েই বাসায় ফিরবো।
- ওহ!
- সবসময় তো আকাশের সাথে ও ফ্রেন্ডের সাথেই বসো, আজ না হয় আমাদের সাথে বসো ব্রেকফাস্ট করতে?
- না আপু, তোমরা করো ব্রেকফাস্ট! আমি বাসা থেকেই খেয়ে এসেছি। অনেক দিন হলো তাদের সাথে দেখা হয় না তাই একটু বেরিয়েছি।
রিজভী চেয়ার ছেড়ে উঠে বললো, - আরে ঝড়বৃষ্টি, বসে পড়ো। নাও, আকাশের পাশের সিট ছেড়ে দিলাম।
- লাগবে না ভাইয়া। সিট ছেড়ে দিয়েছেন ভালো কথা, এবার অন্য কাউকে এনে বসিয়ে দিন এখানে। আমি আর নেই!
- কেন! তুমি আবার কোথায় হারিয়ে গেলে!
এতোক্ষণ আকাশ চেয়ারে হেলান দিয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলো বৃষ্টির দিকে। এবার উঠে দাড়ালো এবং বৃষ্টির কাছে এসে হাত ধরে টানতে টানতে বের হতে লাগলো। পেছন থেকে সিমি ডাকলো আর আকাশ তাদের বলে দিলো ব্রেকফাস্ট করে নিতে! বৃষ্টি কিছুই বুঝতে পারছে না! এতো জোরে হাত চেপে ধরেছে ছাড়াতেও পারছে না, আকাশকে বারবার থামার জন্য বলছে কিন্তু আকাশ চলছেই। বৃষ্টির ফ্রেন্ডসহ আকাশের ফ্রেন্ডরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো! রূপা বাদে বৃষ্টির ফ্রেন্ডরা চিৎকার করতে লাগলো। সিমি আর রূপা তাদের থামতে বলছে। রূপা জানে আকাশের ব্যাপারে আর সিমি আশ্বাস দিলো, আকাশ বৃষ্টির সাথে কোনো খারাপ হতে দিবে না!
আকাশ বৃষ্টিকে টানতে টানতে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে তার গাড়ির কাছে এলো। দরজা খুলে বৃষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে উঠালো। বৃষ্টি পায়ে ব্যাথা পেয়েছে সেটাও আকাশ লক্ষ্য করছে না! দরজা লক করে সে অপর পাশে উঠে বসলো। অত:পর গাড়ি স্টার্ট দিলো। হাই স্পিডে গাড়ী চালাচ্ছে আকাশ!
- আকাশ! এমন করছো কেন তুমি! গাড়ি থামাও। গাড়ি থামাতে বলেছি! দেখো, আমি ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে এসেছি অযথা প্ল্যান নষ্ট করো না! আকাশ গাড়ি থামাও! আমি কিন্তু এখন চিৎকার করে লোক জানাবো!
আকাশ হঠাৎ করেই গাড়ি ব্রেক করলো! বৃষ্টি ঝুকে পড়ছিলো, আকাশ সিট বেল্ট লাগিয়ে দিয়েছিলো বিধায় রক্ষা! বৃষ্টি সিট বেল্ট খুলতে গেলে আকাশ তার হাত ধরে ফেললো। গাড়ির ড্রয়ারে কিসের যেন চিকন ফিতা রাখা ছিলো সেগুলো একসাথে নিয়ে পুরত্ব বাড়িয়ে বৃষ্টির হাত বেধে ফেলেছে এবং পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ বেধে দিলো। এবার গাড়ি চালাতো লাগলো, স্পিড আগের চেয়ে একটু কম হলেও স্বাভাবিক না! মনে হচ্ছে তাকে কিডন্যাপ করছে আকাশ!
বৃষ্টি কিছু বলার চেষ্টা করছিলো কিন্তু তার মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে বোবার মতো! ব্যর্থ হয়ে চুপ হয়ে গেলো! আকাশের চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট! গাড়ি এনে একটা বাড়ির সামনে থামালো। চার পাচ তলা হবে বাড়িটা! তলা গণনারও যেন সুযোগ নেই! আকাশ নিজে গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টিকে টেনে নামালো। টানতে টানতে তাকে নিয়ে দোতলায় উঠলো। একটা ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে একটা রুমের ভেতর এনে দরজা লাগিয়ে দিলো ভেতর থেকে! বৃষ্টির হাতের বাধন ও মুখের বাধন খুলে দিতে দিতে বললো,
- বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে না তোর? ষোলো তারিখ বিয়ে, তাই না?
বৃষ্টিও জেদ নিয়ে বললো,
- হ্যাঁ, হয়েছে বিয়ে ঠিক। দাড়াও, কার্ড আছে। দিচ্ছি।
বৃষ্টি পার্স থেকে কার্ড বের করে দিতেই আকাশ কার্ড ছিড়ে দু টুকরো করে ছুড়ে ফেলে দিলো। বৃষ্টির হাত থেকে ফোন নিয়ে বললো, - তোর মিস্টার হবুর নম্বর কোনটা, বল আমাকে। দেখি তোকে বিয়ে করে কিভাবে!
বৃষ্টি ফোন হাতে নিয়ে বললো, - দেখতে হলে বিয়ের দিন গিয়ে দেখো।
আকাশ আবার ফোন নিয়ে চেচিয়ে বললো, - নম্বর বল, কোনটা? কল করবো। শুধু কল না, ভিডিও কল করে লাইভে দেখাবো আজ! কল কর তোর মিস্টার হবুকে!
- আকাশ পাগল হয়ে গেছো তুমি! এভাবে কথা বলছো কেন! ফোন দাও আমার।
বৃষ্টি ফোন নিতে গেলে আকাশ তাকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিলো। ফোনও ঢিল মেরে বিছানায় ফেলে দিলো। অত:পর শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
- ভিডিও কল কর তোর মিস্টার হবুকে! আজ তোর এমন অবস্থা করবো যাতে আকাশ ছাড়া কেউ না পায় তোকে! কারো সাহস হবে না তোকে বিয়ে করার! দেখি তোর কাছে কাকে মানায়, আর কে ই বা তোর জন্য পারফেক্ট!
বৃষ্টির ভয় লাগছে খুব! সে সোজা হয়ে উঠতে লাগলো এবং ভয়ে ভয়ে বললো, - কি বলছো তুমি এসব! কি করতে চাইছো!
- দেখবেই তো সুইটহার্ট!
কথাটা বলে আকাশ একটানে বৃষ্টির গা থেকে ওড়না নিয়ে নিলো এবং ফ্লোরে ছুড়ে মারলো! বৃষ্টি চমকে উঠে বললো, “আকাশ!”
বৃষ্টি বুঝতে পারছে আকাশের মাথা ঠিক নেই! সে অনেক রেগে গেছে! চোখ মুখ লাল হয়ে আছে! ও এখন যেকোনো কিছুই ঘটাতে পারে! ফ্লোর থেকে দ্রুত ওড়না নিতে গেলেই আকাশ তাকে ধরে আবার বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেললো। বৃষ্টি উঠতে গেলে আকাশ বিছানায় চেপে ধরলো।
- আকাশ ছাড়ো, আকাশ ছাড়ো প্লিজ! এমনটা করো না, তোমার মাথা ঠিক নেই! আকাশ! ছাড়ো বলছি!
আকাশ জোড়াজুড়ি করে বৃষ্টির উপর শুয়ে পড়তে লাগলো। আর বৃষ্টি চিৎকার করেই যাচ্ছে আর তাকে থামানোর চেষ্টা করছে!
হাত ছাড়া পেয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে দরজার কাছে এলো বৃষ্টি। আকাশ উঠে এসে দরজা খুলার আগেই তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিলো! বৃষ্টি কোনোমত উঠে বাথরুমে এসে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আর এদিকে রুমের দরজার সামনেই আকাশ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়লো! মাথাটা দরজায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো এবং ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো। বৃষ্টি বাথরুমের দরজা আটকিয়ে জোরে শব্দ করে কাদতে লাগলো! আকাশের কান পর্যন্ত যাচ্ছে কান্নার আওয়াজ! কেমন মানুষকে ভালোবেসেছে সে ভাবতে পারছে না! এতোটা জঘন্য কাজে এগিয়ে আসবে আকাশ সেটা কল্পনার বাইরে ছিলো!
এটা কি করে করতে পারলো! কেন এমন করতে যাচ্ছিলো! বৃষ্টির বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে! আগে কতো বাহানা খুজতো বৃষ্টি তার সাথে দেখা করার কথা বলার! তখন তো পাত্তা দেয়নি! এখন এতো ভালোবাসা দেখাচ্ছে কেন! এমন পাগলামিই বা কেন করছে! একটা মেয়ের কোনো সম্মান নেই তার কাছে! মেয়েদের দিকে তো তাকায়ও না তেমন, তাহলে আজ কিভাবে পারলো কারো ইজ্জত ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে! এই আকাশকে তো চেনেনি সে! তাকে তো ভালোবাসেনি! মানুষ এতোটা বদলায় কিভাবে!
পর্ব – ৫০
ভেবে ভেবে খুব কান্না করছে বৃষ্টি! এখান থেকে বের হবে কিভাবে! কেউই যে নেই তাকে সাহায্য করার! কোথায় নিয়ে এসেছে তাকে! কার বাসা এটা!
বেশ কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির কান্নার শব্দ কমে এলে আকাশ উঠে দাড়ালো। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো বাথরুমের দরজার দিকে। দরজায় হালকা শব্দ করে বললো,
- বৃষ্টি বেরিয়ে এসো। বৃষ্টি, আমি স্বাভাবিক আছি। কাম আউট।
বৃষ্টির কোনো সাড়া পাচ্ছে না আরও দুইবার দরজায় টোকা দিয়ে বেরিয়ে আসতে বললো তবুও বৃষ্টি শুনছে না! এবার রেগে দরজার লাথি দিয়ে বললো,
- আমাকে না রাগালে তোমার ভালো লাগে না! বেরিয়ে এসো! না হয়, দরজা ভেঙে ফেলবো!
বৃষ্টি ভয় পেয়ে এবার দরজা খুললো। দৃষ্টি তার মেঝের দিকে, গায়ে ওড়না নেই বিধায় দু’হাতে নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। আকাশ তার হাত ধরে টেনে বাথরুম থেকে রুমে নিয়ে এলো। তখন ফ্লোরে ফেলে দেওয়ায় ব্যাথা পেয়ে এখন ঠিকমতো হাটতেও পারছে না! মেঝে থেকে ওড়না তুলে বৃষ্টির গায়ে জড়িয়ে দিলো আকাশ। বৃষ্টি এখনো কান্না করে যাচ্ছে কিন্তু কান্নার কোনো শব্দ হচ্ছে না। শুধু নাক টানার শব্দ হচ্ছে আর চোখ থেকে টুপটাপ পানি ঝরছে। আকাশ কাছে দাড়িয়ে দু’হাতে মুখখানা ধরে বৃদ্ধা আঙুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে আলতো ঠোঁটের ছোয়া দিলো। অত:পর বললো,
- সরি। আমি তোমার সাথে কিছুই করতাম না। শুধু ভয় দেখানোর জন্য এমন করেছি।
বৃষ্টি নিচের দিকে দৃষ্টি রেখেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমতা আমতা করে বললো,
- আমি বাসায় যাবো। আমাদের বাসায় যাবো! বাবা মায়ের কাছে যাবো!
আকাশের ভেতরটা চিনচিন ব্যাথা করছে! বৃষ্টি এতোটা ভয় পাবে ভাবতেও পারেনি! অবশ্য তখন রেগে ছিলো অনেক, তাই হয়তো ডোজটা বেশি হয়ে গেছে! কিন্তু এখন কিভাবে বৃষ্টিকে স্বাভাবিক করবে! - বৃষ্টি, সরি। আমি সত্যি বলছি, তুমি আমাকে ইগনোর করছিলে তাই শুধুমাত্র ভয় দেখানোর জন্য এমনটা করেছি! আর কাল বিয়ে নিয়ে মজা করছিলে তাই একটু রেগে গিয়েছি! প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো! সবসময় সবকিছু নিয়ে মজা সহ্য হয় না, বৃষ্টি! আমি তোমার সাথে বেশি মিশতে চাই না কারণ, তুমি বেশি আবেগী হয়ে যাবে! আর আবেগ জিনিসটা খুব খারাপ! তোমার ক্যারিয়ারে ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে সেটা! সবকিছু ভুলে তুমি আমার প্রতি ঝুকে পড়বে। বলেছিলে না, তোমার বাবার স্বপ্ন তুমি ডক্টর হবে! আবেগ জিনিসটা তোমাকে ঘেরাও করে ফেললে সেটা কখনো সম্ভব হবে না! তাই ভালোবাসি তবুও নিজেকে তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখি। আমার কাজের তেমন কোনোই চাপ নেই আর না আছে কোনো ব্যস্ততা! তবুও তোমাকে ইগনোর করার একটাই কারণ সেটা তোমার ভবিষ্যৎ, তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা মায়ের স্বপ্ন! আমি তো অন্য কারো সাথে নিজেকে জড়াচ্ছি না, তোমার ক্যারিয়ার গঠন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি বারবার কোনো না কোনোভাবে আমাকে তোমার দিকে ঝুকতে বাধ্য করো! সময় হলে তো আমিই যেতাম! তোমাকে সবসময় চোখে চোখে রাখি সেটা কি জানো তুমি! যখন কোচিং করেছো, প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভাবে খবর রেখেছি তোমার। কোচিংএ এসেছো কি-না, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছো কোথায়, কোচিং শেষে বাসায় গিয়েছো কি-না সব খবর রেখেছি! তবুও নিজেকে দমিয়ে তোমার কাছ থেকে দূরে থেকেছি! এতো প্রপোজাল এসেছে আমার লাইফে সেখান থেকে শ্রেষ্ঠ ছিলে তুমি! হয়তো এটাই নিয়তি ছিলো! পাই আর না পাই, তোমাকে ভেবেই জীবন পাড় করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত সিলেট থেকে ফেরার পরই নিয়ে ফেলেছি!
বৃষ্টি অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে! চোখদুটো ছলছল করছে তার! ভয় দূর হয়ে সমস্ত রাগ অভিমান এবার কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো! সাথে সাথে আকাশের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো! আকাশ দু’হাতে তাকে বেধে রেখেছে নিজের সাথে! এখন কাদতে বাধা দিচ্ছে না বৃষ্টিকে! কারণ সে জানে এটা দুখের নয়! এটা শুধুমাত্র অভিমান মুছে নেওয়ার কান্না! যত ইচ্ছে কাদতে থাকুক, সুখ এবং ভালোবাসা বর্ষনে কোনো বাধা দিবে না আকাশ! বৃষ্টির অশ্রুপাতে বুক ভেসে যাচ্ছে তাই তার মুখেও লেগে আছে সুখের ছায়া! ফুটে আছে প্রশান্তির হাসি!
৪৭
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি নিজেই নিজেকে শান্ত করে বললো,
- আমার বিয়ে ঠিক হয়নি। তোমার অবহেলা সহ্য করতে না পেরে মিথ্যে বলেছিলাম তোমাকে!
- জানি আমি সেটা। কেননা তোমার বাবা মা এখন তোমাকে বিয়ে দিবে না।
বৃষ্টি সোজা হয়ে বললো, - কিভাবে জানো?
- ভালোবাসি তাই!
- ফাজলামো রাখো, সত্যিটা বলো!
- বললামই তো! ভালোবাসি তাই, তোমার সব খবর রেখে যাই!
- বুঝলাম আমার খবর রাখো, কিন্তু আমার বাবা মায়ের সিদ্ধান্ত জানো কিভাবে! আনুমানিক বলছো না?
- না। কিভাবে জানি সেটা বলবো না। তবে এটা জেনে রাখো তোমার সম্পর্কে সব জানা আমার! বিশ্বাস না হলে মিলিয়ে না। আমার হবু মিসেস রুবাইয়া চৌধুরী বৃষ্টি – স্টুডেন্ট অফ ইন্টারমিডিয়েট , বাবা রায়হান চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী, মা মোহিনী চৌধুরী একজন গৃহিণী, ভাই মেঘ চৌধুরী বাবার সহকর্মী। বিয়ে করেছে সিলেটি মেয়ে। বাসায় এখন ননদ ভাবি সমবয়সী!
আকাশ থামতেই বৃষ্টি হিহি করে হেসে উঠলো। এবং বললো,
- আরেকজন বাকি আছে। জানো তুমি!
- আবার কে!
- পিচ্চি মেঘ কিংবা নাফিসা!
- মিষ্টি কোথায়!
- দোকানে!
বৃষ্টি আবার হিহি করে হেসে উঠলো! আকাশ বৃষ্টির হাসিমাখা মুখখানা ধরে উপরে তুললো আর একহাতের বৃদ্ধা আঙুলে ঠোঁটে স্লাইড করলো। সাথে সাথে বৃষ্টির মুখ মলিন হয়ে গেলো! মনে হচ্ছে আকাশ তার কাছে চলে আসছে! বৃষ্টি এক হাতে আকাশের মুখ ধরে ফেললো, ভয়ার্ত কন্ঠে বললো, - আকাশ, এটা ঠিক না!
আকাশ বৃষ্টির হাত সরিয়ে দিয়ে মুচকি একটা হাসি দিলো। অত:পর কপালে আরেকবার ঠোঁটের ছোয়া দিয়ে বললো, - এখনই এতো কাছে যাবো নাকি! আস্তে আস্তে হবে সবটা!
- আকাশ, বিয়ে ছাড়া একটা ছেলে একটা মেয়ে কাছে আসতে পারে না! এসব পাপ!
- বাহ! একটা ছেলেকে দেখেই ভালো লেগে যায় আর ভালোবেসে ফেলো সেটা পাপ হয় না আর কাছে এলে পাপ!
বৃষ্টি দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে বললো, - সেটাও পাপ তবে হয়তোবা তার চেয়ে সীমিত! জানো, আমি কোনো ছেলের প্রতি ইন্টারেস্টেড হইনি কখনো। কেন জানি, না চাইতেও তোমার প্রতি সেটা হয়ে গেছে!
- ভয় পেয়ো না, বিয়ের পর না হয় সম্পূর্ণ অধিকার নিয়েই যাবো।
এক আঙুল দিয়ে কপাল স্পর্শ করে বললো “এখন এ পর্যন্তই” আঙুল আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামিয়ে নাকে এনে বললো “তারপর এখানে” আঙুল আরও নিচে নামিয়ে ঠোঁটে এনে বললো “তারপর এখানে”! বৃষ্টি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। আকাশ হুট করেই তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় এনে নামিয়ে দিলো। বৃষ্টি তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেলে আকাশ বাধা দিলো। নিজেও শুয়ে পড়লো বৃষ্টির সাথে। বৃষ্টি ভয় পেয়ে বললো,
- আকাশ কি করছো তুমি! যেতে দাও আমাকে! আমার এখন যাওয়া প্রয়োজন!
আকাশ তার মাথাটা টেনে বুকে চেপে ধরে বললো, - হুশ! এতো ভয় পাচ্ছো কেন তুমি! ভালোবাসায় তো ভয় থাকে না! থাকবে শুধুই জয়! একটু চুপচাপ থাকো না এখানে! কেন জানি এই দিকটা খুব অশান্ত হয়ে আছে! একটু শান্ত করে দাও তো। সিলেট থেকে তো কতোবার বলেছিলে একটা রাত আমার বুকে কাটাবে! এখন আমি বলছি, তোমার যত রাত আর যত দিন ইচ্ছে হয় কাটাতে পারো এখানে। একটুও নিষেধ করবো না। সারাজীবন কাটাও!
- এখন এক মুহুর্তও সম্ভব না! প্লিজ আকাশ, আমার অসস্তি লাগছে!
- তোমার ভয় কাটেনি এখনো?
বৃষ্টি কোন জবাব দিলো না! আকাশ আবার বললো, - বৃষ্টি বিশ্বাস করো, ভালোবাসি! আর আজ যেটা হয়েছে তোমাকে একটু ভয় দেখানোর জন্য, যাতে যখন তখন আমাকে কাছে না চাও!
- ভালোবাসো! আমি কি খুব বেশি সময় চাই তোমার কাছে? প্রতিদিন দেখা করতে বলি! প্রতি মুহূর্তে কল করে বিরক্ত করি! এতো অবহেলা কেন! একটু আধটু কথাবার্তা, দেখা সাক্ষাৎ করলে কি আমার ক্যারিয়ারের মহামারি ক্ষতি হয়ে যাবে! তুমিই বলো, এ দুমাসে আমার সাথে কতবার দেখা করেছো আর কতটা সময় দিয়েছো আমাকে! বলো!
- বৃষ্টি, বুঝতে পারছো না কেন! একবার কোনোকিছুতে ভালো লেগে গেলে মানুষ লোভী হয়ে যায় এবং বারবার তা পেতে চায়! আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো না ভেবে তোমার ডাকে সাড়া কম দিয়েছি!
- জানো আকাশ! সেদিন খুব কষ্ট লেগেছে আমার। তোমার জন্য নিজের হাতে রান্না করে নিয়ে এসেছিলাম। এতো করে বললাম তবুও তুমি এলে না রেস্টুরেন্ট! কেন? দশ পনেরো মিনিটের জন্যও কি আসা যেতো না! ইম্পর্ট্যান্ট কাজও তো হতে পারতো! একটু দেখা করে চলে আসতে পারতে! আমি একা একা গিয়ে বসেছিলাম! অপেক্ষা করেছি তোমার, কল করেছি বারবার। রিসিভও করলে না একবার!
- গিয়েছিলাম আমি সেদিন।
- মিথ্যে বলছো কেন! আমি অনেক্ক্ষণ অপেক্ষা করেছি সেখানে!
- মিথ্যে বলছি না। যথাসময়ে আমি গিয়েছি এবং তোমাকে দেখেছিও কিন্তু সামনে যাইনি! কেননা তুমি সেদিন শাড়ি পড়েছিলে!
বৃষ্টি চমকে উঠে মাথা তুলে আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, - হোয়াট! এজন্য তুমি সামনে যাওনি! আমি তো তোমার জন্যই শাড়ি পড়েছি!
- আমার জন্য পড়েছো বলেই তো যাইনি! কিছু কিছু মুহুর্তে নিজেকে সামলে রাখা দায়! তাছাড়া সেদিন আমি তোমার কাছে গেলে অন্যদিন আবার দেখা করতে চাইতে, আবার আমার জন্য খাবার রান্না করতে, আবার শাড়ি পড়ে আসতে!
বৃষ্টির নাক টেনে আবার বললো, - কিন্তু ভেঙে ফেলেছো আমার ধৈর্য শক্তির বাধ! এবার রক্ষা নেই তোমার! বলেছো না ষোলো তারিখ তোমার বিয়ে! বাসায় যাও, ষোলো তারিখই তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে!
বৃষ্টি উঠে বসে বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো, - কিসের সারপ্রাইজ দিবে! বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে এইতো!
আকাশ শোয়া থেকে উঠে বসে বললো, - এই, তুমি আগেই বুঝে ফেলেছো! সারপ্রাইজড হওনি!
- না। অযথা প্রস্তাব পাঠিয়ে কোনো লাভ নেই! কেননা কোনমতেই বাবা মা এখন বিয়ে দিবে না! আগে মেডিক্যালে চান্স পেয়ে পড়াশোনা শেষ করবো তারপর বিয়ের চিন্তাভাবনা!
আকাশ হেসে বললো, - তা না হয় না দিক! কিন্তু সারপ্রাইজ তোমাকে দেবোই!
- আচ্ছা, দেখা যাবে! আমি এখন কোথায় আছি?
- শ্বশুর বাড়ি।
- মানে!
- মানে আবার কি! বরের বাপের বাড়ি!
- হোয়াট! এটা তোমাদের বাসা!
- হ্যাঁ, আর এটা আমাদের বেডরুম। বিয়ের পর এখানেই তোমার আমার বাসর হবে।
- আকাশ তুমি এতোটা পাগল কিভাবে হতে পারো!
বিয়ের আগে শ্বশুর বাড়িতে তাও আবার বেডরুম পর্যন্ত নিয়ে এসেছো! বাসার বাকি লোকজন কোথায়! তুমি আমাকে ধরে বেধে নিয়ে এসেছো কেউই দেখলো না কেন!
- দেখার মতো কেউ নেই বেগম সাহেবা! এ রাজ্যের রাজা আমি আর রানী তুমি! প্রজাহীন রাজ্য ও রাজত্ব এখন আমাদের!
বৃষ্টি মেঝে থেকে আকাশের শার্ট উঠিয়ে তার দিকে আসতে আসতে বললো, - তোমার আচরণগুলো সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে আজ! মেন্টাল হসপিটালে যাও। তোমার চিকিৎসা দরকার। ধরো শার্ট পড়ো।
আকাশ বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বললো, - ঠিক বলেছো, চিকিৎসা করাতে হবে! রোগীর সেবা করার জন্য তোমাকেও প্রয়োজন। চলো হসপিটালে যাই!
কথা বলেই আকাশ হেসে উঠলো। বৃষ্টি শার্ট নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আকাশ তার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বললো, - পড়িয়ে দাও।
বৃষ্টি পড়িয়ে দিতে লাগলো আর আকাশ বললো, - ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর। কোথায় যাবে ব্রেকফাস্টের জন্য?
- আমার কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই! বাসা থেকে খেয়ে বেরিয়েছি। তুমি খাও গিয়ে!
- এক কাজ করো তাহলে, কিচেনে গিয়ে তুমি রান্না করো তারপর দুজন মিলে খাই!
- আকাশ তুমি আসলেই পাগল হয়ে গেছো! আমি চিন্তা করছি কখন এ বাড়ি থেকে বের হবো আর তুমি বলছো রান্না করতে! বিয়ের পরবর্তী কাজ আগেই করিয়ে ফেলতে চাইছো! পরে কিন্তু এসবে আর মজা পাবে না!
- ওকে, করতে হবে না রান্না। পরেই করো কিন্তু আমার মায়ের মতো জীবনযাপন করার চেষ্টা করো না! তাহলে আমার কাছে কোনো মর্যাদা পাবে না।
- যথা আজ্ঞে মহারাজ! চুল ঠিক করো।
- তুমি করে দাও।
বৃষ্টি ড্রেসিং টেবিলের কাছে এসে চিরুনি নিয়ে আবার আকাশের কাছে এলো। আকাশ খাটে বসলো বৃষ্টি তার কাজ শুরু করতেই আকাশ থামিয়ে দিয়ে বললো,
- এই তুমি সত্যিই বাসা থেকে খেয়ে এসেছো?
- হুম।
- তাহলে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো আমি গোসল সেড়ে আসি।
- কিহ! এখন আবার গোসল!
- গাজীপুর থেকে এসেছি সকালে! গোসল না করা পর্যন্ত ফ্রেশ লাগবে না!
বৃষ্টি ধপাস করে খাটে বসে পড়লো! অত:পর বললো, - ওকে যাও!
আকাশ শার্ট খুলে জামাকাপড় নিচ্ছে আলমারি থেকে। বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো, - কতোক্ষন লাগবে?
- এই ধরো ত্রিশ মিনিট!
- আকাশ তুমি মেয়ে না! একজন ছেলের গোসলের জন্য পাচ থেকে সাত মিনিটই যথেষ্ট!
- দুদিন গাজীপুর থেকেছি! গোসলটা ভালোভাবে করা হয়নি! আজ তিনদিনের গোসল একসাথে করবো। চাইলে আসতে পারো আমার সাথে! কাপল বাথ উইল বি মোর ইন্টারেস্টিং!
বৃষ্টি করুণ দৃষ্টিতে তাকালো আর আকাশ হাসতে হাসতে বাথরুমে চলে গেলো। আর যাই হোক, মুগ্ধ হয়ে আকাশের হাসিটা দেখা মিস করে না বৃষ্টি! আকাশ বাথরুম থেকেই বললো, “বৃষ্টি, রুমের বাইরে বের হবে না। আর বাথরুমের দরজা খোলা আছে ইচ্ছে হলে চলে এসো!”
বৃষ্টি মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে মৃদু স্বরে বললো “ইডিয়ট!”
পর্ব – ৫১
আকাশের রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে রুমটা দেখলো। সজ্জিতই আছে সব! ছেলে মানুষ এতো গুছিয়ে রাখতে জানে! তার ভাই মেঘ হলে রুমের বারোটা বাজিয়ে রাখতো, এটা সে নিশ্চিত! যদিও মেঘ অগুছালো না কিন্তু বৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে রাখার জন্য নিজে গুছায় না! দেয়ালে তিনটা ফ্রেম ঝুলানো আছে। একটাতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলা ও একজন পুরুষ সাথে আকাশ। হতে পারে আকাশের বাবা মা। আরেকটায় আকাশের সাথে একজন বৃদ্ধ মহিলা, ইনি আকাশের দাদু! আরেকটাতে কিছুই নেই! মনে হচ্ছে উপরে টিস্যুর আবরণ, ভেতরে কিছু আছে কিনা বুঝা দায়!
পাচ মিনিটের মতো অতিক্রম হতেই আকাশ বেরিয়ে এলো। কাপড়ের ছোট বালতিটা রুমের দরজার বাইরে রেখে আবার দরজা লাগিয়ে দিলো। মাথা মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়াতেই বৃষ্টি বললো,
- আকাশ, উনারা কি তোমার বাবা মা?
- হুম।
- আর উনি দাদু?
- হুম।
- সাদা ফ্রেম ঝুলিয়ে রেখেছো কেন?
- কোনটা?
- ওই যে!
- এটা সাদা! এর মতো রঙিন কোনো ফ্রেম নেই!
- ফ্রেম না, মানে আমি ছবির স্ক্রিনের কথা বলছি।
- আমিও সেটার কথাই বলছি!
বৃষ্টি বিরক্তবোধ করলো। আকাশ সব কথাতেই আজ মজা মিশিয়ে ফেলছে যেটা একদমই ভালো লাগছে না! সাদা ছবিকে বলছে রঙিন!
কেউ আর কোনো কথা বললো না। আকাশ সাজুগুজু করছে আর বৃষ্টি দেখছে আয়নায়। ভেজা চুলে, খালি গায়ে অসম্ভব সুন্দর লাগছে! আকাশ নিজের কাজ করতে করতেই বললো, - পলক তো ফেলো একবার! এভাবে তাকালে লজ্জা লাগে আমার!
- স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, রিজভী ভাইয়ার বাতাস লেগেছে তোমার দেহে! প্রথম প্রথম একদম ভোলাভালা মনে হতো আর এখন পুচকে!
- ভোলাভালা মনে করেই প্রেমে পড়েছো তাই না!
বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে বাথরুমের দিকে যেতে লাগলো আর আকাশ বললো,
- আমি ছোট থেকেই অন্যরকম! কিন্তু ভোলাভালা না! একএকজনের কাছে এক এক ভাবে ধরা দেই। সহজে কারো কাছে নিজের আসল রূপ তুলে ধরি না!
বৃষ্টি কোনো প্রতুত্তর না করে বাথরুমে এসে চোখেমুখে পানি দিলো। আকাশ একটা টিশার্ট পড়লো অত:পর দুজনেই বের হলো রুম থেকে। আকাশ রুম লক করে বললো, - বৃষ্টি, পায়ে কি খুব ব্যাথা লাগছে?
- উহুম।
- ব্যাথা নিয়ে বসে থেকো না। সত্যটা বলো, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
- একটু একটু লাগছে, এমনিতেই সেড়ে যাবে। প্রয়োজন হলে যাবো ডাক্তারের কাছে।
- ওকে। শ্বশুর বাড়ি দেখে যাও ঘুরেফিরে।
- না, তাহলে পরে আর ইন্টারেস্ট থাকবে না! এমনিতেই তুমি আমার শখের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছো! চলো।
- দাদুর সাথে দেখা করবে না?
- দাদু বাড়িতে?
- হুম।
- আকাশ তুমি এতোক্ষণ আমাকে সেখানে বসিয়ে না রাখলেও পারতে!
- চুপ! বলো না আবার, এতোক্ষণ যে আমার বেডরুমে ছিলে!
- আর কে আছে বাসায়?
- দাদু আর দাদুর দেখাশোনা করার জন্য একজন মেয়ে। আর কেউ নেই। আব্বু আম্মু অফিসে। চলো।
আকাশ বৃষ্টিকে দাদুর কাছে নিয়ে এলো। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আবার বেরিয়ে এলো। গাড়িতে বসতেই রূপা কল করলো। বৃষ্টি জানিয়ে দিলো সে ঠিক আছে আর আজ তাদের সাথে জয়েন করছে না সে! কথা শেষ হলে গাড়ি চালাতে চালাতে আকাশ বললো, - মাই ডিয়ার উডবি, কোন রেস্তোরাঁয় যাবো? বলো?
- আকাশ, এতো স্বপ্ন দেখাচ্ছো কেন! যদি আমি তোমার না ই হলাম! যদি বাবা মা তোমার সাথে আমার বিয়ে না ই দিলো!
- না দেওয়ার কারণ কি হতে পারে?
- যেমন ধরো, তুমি বেকার বলে তোমার কাছে বিয়ে দিবে না! তখন?
আকাশ হঠাৎ করেই গাড়ি ব্রেক করলো এবং কাশির ভাব ধরে বললো,
- তুমি চোখে কম দেখো! আমি এখনো গাড়ি চালাচ্ছি আর তুমি বলছো আমি বেকার! এটা কি কাজ না!
- গাড়ি চালাচ্ছো ঠিকই কিন্তু টো টো কোম্পানির ম্যানেজার! এতে কি তোমার উপার্জন হচ্ছে!
- উপার্জনের চিন্তা কেন করছো! বাবা বিজনেস ম্যান, মা বিজনেসম্যান! দুজনের উপার্জনে আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদেরও জীবন ফুরিয়ে যাবে! তার উপরও টান পড়লে তোমার বাবা আছে!
- ছি! কিসব কথাবার্তা! কেউ কখনো জিজ্ঞেস করলে কি বলবো! বোকার মতো চুপ করে থাকতে হবে!
আকাশ হেসে বললো, - তখন বলে দিও, আসাদ আহমেদ কোম্পানির অংশীদার। আমিও তোমার ভাইয়ের মতো আব্বুর সহকর্মী! বেকার না আমি, মাঝে মাঝে যাই আরকি অফিসে। কাজ থাকে না তেমন, আব্বু আম্মুও কাজ করতে দেয় না। সেখানে আমার কি করার! আমি সময় বাচিয়ে নিয়ে আমার মতো করে বাচি!
আকাশ বৃষ্টিকে সাথে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে এলো। দুজনেই খেয়ে নিলো। আকাশ সারাদিন আজ বৃষ্টিকেই সময় দিলো। ঢাকার কয়েকটি জায়গা ঘুরে বিকেলে শপিংমলে এলো চুড়ি কেনার জন্য। বৃষ্টি চুড়ি পছন্দ করলো আর আকাশ সেগুলো রেখে অন্য ডিজাইনের চুড়ি তার হাতে পড়িয়ে দিলো। বৃষ্টি আশ্চর্য হয়ে বললো,
- মাথা খারাপ তোমার! আমি মায়ের জন্য চুড়ি কিনতে এসেছি!
আকাশ কাশির এক্টিং করে বললো, - আগে বলবে তো! আর সমস্যা কি! এগুলো তোমার আর সেগুলো আন্টির জন্য নিয়ে নাও।
- আমি কোনো প্রোগ্রাম ছাড়া চুড়ি পড়ি না। থেকে থেকে শুধু শুধু নষ্ট হবে।
আকাশ কানের কাছে এসে বললো, - আগে থেকেই অভ্যেস করো। বিয়ের পর পড়তে হবে। না হলে শাশুড়ির কটু কথা শুনবে!
বৃষ্টি চোখ কুচকে তাকালো তার দিকে কিন্তু কিছু বললো না। আকাশ মিটিমিটি হাসছে! শপিংমল থেকে বের হতেই আকাশের কাছে বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠেছে বৃষ্টি। তবুও আকাশ গাড়ি নিয়ে পিছু পিছু বাড়ি পর্যন্ত এসেছে। বৃষ্টি বাড়িতে প্রবেশ করলে আকাশ ফিরে গেলো।
মধুচন্দ্রিমা উপভোগ করতে মেঘ ও মেঘা আরও দুদিন কাটালো সাজেক ভ্যালিতে। সেখান থেকে ফিরে গেলো সিলেট।
আজ দুপুরে গোসল করে শাড়ি পড়েছে নাফিসা! সেজেছেও একটু! আম্মি খাবার খাওয়ার জন্য বললো কিন্তু সে খেলো না! দরজার সামনে বসে খরগোশ নিয়ে খেলা করছে। আর মেঘের জন্য অপেক্ষা।
একটু পরেই মেঘ বাসায় ফিরেছে। নাফিসাকে দেখতে পেল সেজেগুজে দরজার সামনে বসে আছে খরগোশ নিয়ে। মেঘকে দেখতে পেয়ে নাফিসা মুচকি হাসলো এবং সরে দাড়ালো। মেঘ মুচকি হেসে ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
- মেঘা, বেড়াতে যাবে নাকি আজ!
- হুম।
- কোথায়?
- আমি যেদিকে নিয়ে যাবো।
- তাই নাকি! তুমি বেড়াতে নিয়ে যাবে আজ!
- হুম।
- খেয়েছো?
- না।
- দিলে তো মুডটা খারাপ করে! দিনে ছয়বার খেতে বলেছি তোমাকে আর অর্ধেক দিন ফুরিয়ে গেছে তুমি একবার যে খেয়েছো সেটুকুতেই আছো!
- তোমার সাথে খাবো, তাই তো বসে আছি!
- বাচ্চাদের চেয়েও বেশি খারাপ তোমার আচরণ! আরও অনেক আগেই খাওয়া দরকার ছিলো তোমার, এখন আবার খেয়ে নিতে!
নাফিসা আর কিছু না বলে আলমারি থেকে মেঘের জামাকাপড় বের করে দিলো।
মেঘ হাতমুখ ধুয়ে একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে আম্মিকে বলে বের হলো দুজন। সাথে শীতের জামা নিয়েছে। প্রথমে চা বাগান তারপর তাদের প্রথম দেখা হওয়া সেই পাহাড়ে এলো। আজ অনেক দিন পর এখানে এসেছে। মেঘ এসেই শুয়ে পড়লো। নাফিসা পাশে বসে আছে। মেঘ হাত বাড়িয়ে নাফিসাকে টেনে ঘাসের উপর শুয়িয়ে দিলো। আর নাফিসার আঁচল ছড়িয়ে তার উপর মাথা রেখে শুয়ে ঘাসফড়িং নিয়ে খেলা করতে করতে বললো,
” তোমার আমার প্রেম নামক মেলায়,
আজ ঘাসফড়িংয়ের সাথে করবো খেলা!
গহীন বনের নির্জন পথে হেটে দুজন,
আজ কাটিয়ে দেবো সারাবেলা!
মেঘা, সূর্যকে নিয়ে করেছো কভু খেলা?
চাদকে ভালোবেসেছো আর সূর্যকে করেছো অবহেলা!
তাহার রূপেও যে পরম মাধুর্য আছে,
বুঝবে কিভাবে, যদি না ই করো খেলা!”
নাফিসা মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে আর মেঘ নাফিসার এক হাত নিয়ে আকাশের দিকে তুলে খেলা করে যাচ্ছে। একটু পরই নাফিসা উঠে বসতে চাইলো এবং বললো,
- মেঘ, চলো না যাই
উঁচু নিচু গিরিপথ বেয়ে!
বেড়াবো তোমায় নিয়ে
সবুজ পাহাড় ছেয়ে!
আঁচল ছেড়ে উঠো এবার!
মেঘ উঠে বললো,
- এই অবস্থায় তোমার বেশিক্ষণ হাটাহাটি ঠিক হবে না।
- আজকেই তো ঘুরতে বেরিয়েছি, প্রতিদিন তো আর আসছি না! চলো।
নাফিসার কথায় মেঘ আবার পাহাড় থেকে নেমে এলো। কথা বলতে বলতে হাটতে লাগলো দুজন। বন জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেটেছে, ঝর্ণার ধারে হেটেছে, অত:পর যাচ্ছে এক পাহাড়ের দিকে। পাহাড় কেটে সুন্দর সিড়ি করা উপরে উঠার জন্য। হাত ধরে দুজন একসাথে উঠছে উপড়ে। মেঘ চেয়েছিলো নাফিসাকে কোলে করে উঠাতে কিন্তু নাফিসা উঠেনি। নিজ পায়ে হেটে যাচ্ছে, মেঘের সাথে তাল মিলিয়ে। মেঘ এভাবে তাল মিলিয়ে হাটতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মুচকি হেসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ থেমে যাওয়ায় সেও থেমে গেলো। কিছু বুঝতে না পেরে মেঘ বললো,
- দাড়িয়ে গেলে কেন!
নাফিসা স্থির হয়ে জবাব দিলো,
” ছিলো সাদামাটা জীবন ধারীনী এক পাহাড়ি কন্যা!
হঠাৎ এসেছে এক রাজকুমার, দেখেছে তাকে,
আর রঙিন আলো ছড়িয়ে, সৃষ্টি করেছে সুখের বন্যা!
ছিলো না জানা ভালোবাসা তাহার,
না ছিলো কোন পরিচয়!
তবুও জেনে গেছে আজ সে ভালোবাসা কি,
আর তাহার সাথে জড়িয়ে আছে অদ্ভুত মায়া!
হবেই না কেন! পড়েছে যে,
পাহাড়ে মেঘের ছায়া!
না সাদা না ধুসর!
তাহার মাঝে আছে শত রঙের বাহার!
এ নহে ভেসে বেড়ানো অম্বরের মেঘ!
এ তো মানব মেঘের ছায়া!”
মেঘ এতোক্ষণে লক্ষ্য করলো পশ্চিমাকাশে হেলে পড়া সূর্যের কিরন তার ছায়া ফেলেছে পাহাড়ের গায়ে আর ছায়ায় কদম ফেলে তাল মিলিয়ে হেটে যাচ্ছে নাফিসা! মেঘের মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি! নাফিসা আবার বললো,
- ভালোবাসি মেঘ,
আরও ভালোবাসি পড়েছে বলে পাহাড়ে মেঘের ছায়া!
মেঘ হুট করেই নাফিসাকে কোলে নিয়ে সিড়ির ধাপ অতিক্রম করতে করতে তার কথায় সুর ধরে বললো,
- আর মেঘকে জড়িয়েছে পাহাড়ি কন্যার মায়া! ভালোবাসি বেগম সাহেবা!
পর্ব – ৫২
মেঘ হুট করেই নাফিসাকে কোলে নিয়ে সিড়ির ধাপ অতিক্রম করতে করতে তার কথায় সুর ধরে বললো,
- আর মেঘকে জড়িয়েছে পাহাড়ি কন্যার মায়া! ভালোবাসি বেগম সাহেবা!
- মেঘ, নামাও আমাকে। কারো বাড়ি যাচ্ছি আমরা, লজ্জা দিও না এভাবে!
- কাদের বাড়ি।
- আরে নামাও আগে, এসে পড়েছি তো!
মেঘ সবগুলো সিড়ি অতিক্রম করে নামিয়ে দিলো। মেঘ দেখলো পাহাড়ের উপর কয়েকটি বাড়ি আছে। প্রথম যে বাড়িটা আছে সেখান থেকে চার-পাঁচ বছরের একটা পিচ্চি মেয়ে দৌড়ে এলো নাফিসার কাছে। নাফিসা খুশি হয়ে মেয়েটা গালে স্পর্শ করে বললো, - আরে তৌশিমনিটা কেমন আছে?
- ভালো আছি তৌশিমনি! নাফিসা মনি কেমন আছো?
- আমিও ভালো আছি! আম্মু কোথায়?
- ঘরে আছে।
পিচ্চিটা এখান থেকেই চেচিয়ে বললো,
- আম্মু, নাফিসামনি এসেছে!
পিচ্চি মেয়েটা নাফিসাকে আরেকটু নিচু হতে ইশারা করলো এবং কানে কানে বললো, “মনি, উনি কে?” নাফিসা হেসে জবাব দিলো, - উনি তোমার আংকেল। হ্যালো জানাও,
- হ্যালো আংকেল।
মেঘ হেসে তাকে কোলে নিয়ে বললো, - হ্যালো। নাম কি তোমার?
- তৌশি চাকমা।
- হুম, খুব সুন্দর নাম।
- তোমার নাম কি আংকেল?
- আমি, মেঘ চৌধুরী।
- মেঘ! মেঘ তো আকাশে থাকে! ওই যে, ওগুলোকে মেঘ বলে।
- হুম, ওগুলো আকাশের মেঘ আর আমি মাটির মেঘ।
- ওহ্! আচ্ছা!
বাসা থেকে একটা মেয়ে বেরিয়ে আসতেই “আপ্পি” বলে নাফিসা তুলনামূলক দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। দুজনেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে খুব খুশি হয়ে আছে! নাফিসা ছেড়ে দাড়াতেই মেয়েটি মেঘকে ইশারা করে নাফিসাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মেঘ?”
নাফিসা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো আর মেঘকে উদ্দেশ্য করে বললো,
- দিপা খালামনির বড় মেয়ে পৃথা আপ্পি।
মেঘ জিজ্ঞেস করলো, - কেমন আছেন, আপ্পি?
- ভালো। আপনি কেমন আছেন?
- আলহামদুলিল্লাহ।
- নাফিসা, তোমার গাছের উপর কাঠের বাড়ি বানানোর লোক এসে গেছে তাহলে!
মেঘ কিছু বুঝলো না কিন্তু নাফিসা মৃদু হাসলো। পৃথা তাদের ঘরে যেতে বললো আর এদিকে পিচ্চিটা মেঘকে টেনে তার খেলনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে একটু দেখে আসার জন্য! মেঘও চলে গেলো। পৃথা নাফিসাকে পেটের দিকে কিছু ইশারা করলো আর নাফিসা হেসে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। পৃথা খুশি হয়ে নাফিসাকে আবার জড়িয়ে ধরে বললো,
- কতো খারাপ তুই! আমাকে জানাসনি! কত দিন চলে?
- দু মাসের বেশি। ভাইয়া এসেছে?
- এসেছিলো, আবার চলে গেছে।
- খালামনি আর দিয়া কোথায়?
- দিয়াকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গেছে। সর্দি লেগেছে আর সারানোর খবর নেই!
- ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে তো তাই এমন।
- হুম। আমি আর দিয়া গিয়েছিলাম তোদের বাসায়। তুই তখন ঢাকায়। আন্টির সাথে একদিন কাটিয়ে এসেছি।
- হ্যাঁ, আম্মি বলেছিলো।
- ভেতরে চল। ভাইয়া আসুন। তৌশি তোমার রান্না খাওয়ানো হলে এবার আংকেলকে ছেড়ে দাও। আবার পরে দাওয়াত করো।
নাফিসা হাসলো পৃথার কথা শুনে। মেঘের দিকেও তাকিয়ে ভাবছে, বাচ্চাদের সাথে খুব মিশতে পারে মেঘ! চেনা নেই জানা নেই খেলায় নেমে গেছে।
পৃথা তাদের জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করলো। তারা দীপা চাকমাদের বাসায় আরও কিছুক্ষণ কাটালো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে তাই তারা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। ঠান্ডা পরিবেশে গায়ে শীতের জামা চাপিয়ে হেটে হেটে পথ অতিক্রম করছে দুজন।
- মেঘা, পৃথা আপু কি বললো তখন? কাঠের বাড়ির কথা!
- কিছুনা!
- উহুম, লুকাচ্ছো আমার কাছে। বলো, আমি পরিষ্কার জানতে চাই।
- বললাম তো কিছু না!
- এখনো কি আমাকে তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নাও নি?
মেঘের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল শুনে আর চেপে রাখতে পারলো না। সে বলেই ফেললো,
- খুব ইচ্ছে ছিলো আমার গাছের উপর বাড়ি করার। অনেক ভালো লাগে ওসব বাড়ি। সেটাই আপ্পির কাছে বলেছিলাম আরও তিন-চার বছর আগে। তখন আপ্পি বলেছিলো, “চিন্তা করিস না! তোর রাজা মশাই বানিয়ে দিবে!” সেটাই বললো আজ। কিন্তু এখন আর আমার ইচ্ছে নেই গাছের উপর বাড়ি করার।
- ওহ, আচ্ছা।
পথের এক দোকানের কাছে এসে নাফিসা বললো,
- মেঘ, এ দোকানের চায়ের স্বাদ উপভোগ করেছো কখনো?
- উহুম! বিধু চাকমাদের চা বেশি উপভোগ করেছি!
- তাহলে আজ এখানে এক কাপ চা এ শীতের সন্ধ্যা বরণ করে নেয়া হয়ে যাক?
- তুমি চাইলে অবশ্যই!
দুজনেই এগিয়ে গেলো দোকানের দিকে। দোকানী আর তার মেয়ে আছে দোকানে। নাফিসা দোকানীকে জিজ্ঞেস করলো, - কেমন আছো মাসি?
দোকানী অবাক হয়ে বললো, - নাইসা! বহুত ভালা! কিরম আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ।
মেয়েটা বললো,
- মা, নাইসা না! নাফিসা কও!
দোকানী ধমক দিয়ে বললো, - তুই চুপ যা! নাইসা, বয়। অনেক কাল পরে আইলে! মেডামগো বাড়িতে গেছিলা?
- হ্যাঁ মাসি! ভাবলাম তোমার সাথেও দেখা করে যাই! দুকাপ চা দাও, ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি!
মেঘের ফোন আসতেই নাফিসাকে বললো,
- তুমি বসো, আমি আসছি।
মেঘ দোকানের এক পাশে গিয়ে কথা বলছে। আর নাফিসা বেঞ্চিতে বসেছে। দোকানী দোকান থেকে বেরিয়ে নাফিসার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো, - নাইসা! নাকফুল ক্যান! সাদী হইয়া গেছে!
নাফিসা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। দোকানী অবাক হয়ে নজর উঠানোর ভঙ্গিতে নাফিসার মাথার উপর দিয়ে দুহাত নাড়িয়ে নিজের গাল ধরে বললো,
- হায় রব্বা!
মেঘকে দেখিয়ে আবার বললো, - উনি কত্তা?
- হুম।
- নাইসা! হেব্বি! হেব্বি! মানাইছে তোমার ধারে!
নাফিসা হেসে বললো, - এবার চা দিবে নাকি উঠে যাবো!
- এই না! বয় বয়!
- তাড়াতাড়ি দাও। দোকানে মানুষজন এলে কিন্তু থাকবো না! ফাকা ছিলো তাই এসেছি।
দোকানী তাড়াতাড়ি দোকানে ঢুকে চা বানাতে লাগলো। নাফিসা লক্ষ্য করছে দোকানীর মেয়েটা মেঘের দিকেই তাকিয়ে আছে! নিশব্দে হাসছে আবার যেন লজ্জা পাচ্ছে! লজ্জা আরেকটু বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নাফিসা বললো, - চুমকি, ওদিকে কি?
- কই আপ্পি! কিচ্ছু নাই!
- আমি কিন্তু দেখছি সব!
মেয়েটা জ্বিভে কামড় দিলো! মেঘ কথা বলা শেষ করে নাফিসার পাশে এসে বেঞ্চিতে বসলো। - মেঘা, চায়ের সাথে আরও কিছু নিবে?
- কসমস বিস্কুট।
- ওকে, বলো।
- চুমকি, দুইটা কসমস দে।
চুমকি তারাতাড়ি করেই দোকান থেকে দুইটা বিস্কিটের প্যাকেট এনে একটা নাফিসার হাতে দিলো আরেকটা মেঘের হাতে! নাফিসা তো অবাক! চেয়েছে সে আর নিজের ইচ্ছাতেই চুমকি ভাগ করে দুইটা দুজনের হাতে দিলো! মেঘ তার দিকে প্যাকেট ধরতে দেখে হাতে নিলো এবং ছিড়ে নাফিসার হাতে দিয়ে দিলো। নাফিসা হাসছে চুমকির কান্ড দেখে! মেঘ বললো,
- হাসছো কেন?
- ইচ্ছে করছে হাসতে তাই।
- অযথা হাসলে আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখলে পাগল ভাববে!
নাফিসা আরও বেশি হেসে উঠলো! দোকানী চায়ের কাপ নিয়ে বের হয়ে এলে চুমকি দ্রুত এগিয়ে এলো দেওয়ার জন্য। দোকানী তাকে উপেক্ষা করে নিজেই হাতে দিতে চাচ্ছিলো। নাফিসার হাতে দিতে দিতে এদিকে চুমকি ট্রে থেকে আরেক কাপ নিয়ে মেঘের দিকে এগিয়ে ধরলো। দোকানী ব্রু কুচকে তাকালো তার মেয়ের দিকে! মেঘ তো এমন কান্ড দেখে হতবাক! আর এদিকে নাফিসা মিটিমিটি হাসছে! মেঘ কাপ হাতে নিয়ে নিলো। দোকানী দোকানে বসলো আর চুমকি মেঘের পাশে দাড়িয়ে আছে! শুধু দাড়িয়ে না, এদিক সেদিক নড়ছে, বারবার কানের পাশে চুল গুজে দিচ্ছে, চুল একবার সামনে আনছে, আবার পেছনে নিচ্ছে! মেঘের কাছে চুমকির হাবভাব ভালো লাগছে না! নাফিসা আর চেপে থাকতে না পেরে হিহি করে হেসে বলেই ফেললো,
- চুমকি? সাহেবকে পছন্দ হয়েছে? অনেক পয়সাওয়ালা, দুইটা বাড়ি আছে! একটা ঢাকায়, একটা শ্রীমঙ্গল! হেব্বি রোমান্টিক! সাদী করবি?
নাফিসার কথা শুনে মেঘ চায়ে চুমুক দিয়েও বিষম খেলো! নাফিসা হেসে কুটিকুটি! মেঘ চুমকির দিকে তাকিয়ে দেখলো বেচারি লজ্জায় যেনো মাটিতে মিশে যাচ্ছে! নাফিসা আবার বললো, - করবি সাদী?
লজ্জিত কণ্ঠে চুমকি তার মাকে বললো,
- মা, দেহো আপ্পি কি কয়!
দোকানী মেয়ের কীর্তি দেখে রেগে এক ধমক দিয়ে বললো, - এদিক আয়! লুইচ্চা ফুড়ি!
চুমকি দোকানীকে ভেঙচি কেটে এখানেই দাড়িয়ে রইলো। না পারছে মেঘের গা ঘেঁষে দাড়াচ্ছে! নাফিসার এই অদ্ভুত হাসি দেখে মেঘের একটুও ভালো লাগছে না! কাধের পাশে দাড়িয়ে আছে আরেক বেহায়া মেয়ে! সে বেঞ্চিতে কাপ রেখে উঠে বললো,
- মেঘা, তুমি দ্রুত চা শেষ করো। আমি এদিকেই আছি!
মেঘ আর নাফিসার প্রতুত্তরের অপেক্ষা করলো না। দ্রুত দোকানের অন্যপাশে চলে গেলো। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে মেঘ। নাফিসা হাসতে হাসতে নিজের কাপসহ মেঘের কাপ নিয়ে উঠে মেঘের কাছে এলো। মেঘ বললো, - এখানে এলে কেন?
নাফিসা মেঘের দিকে কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো, - একা একা চা খেতে ভালো লাগে নাকি! ধরো।
- উহুম, তৃপ্তি মিটে গেছে আমার!
- রাগ করেছো! চুমকির হাবভাব দেখে মজা করছিলাম একটু! চা টা অনেক মজা শেষ করো। ভালো লাগবে।
মেঘ কাপ নিলো নাফিসার হাত থেকে। কাপটা একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললো,
- মেঘা এটা আমার কাপ না!
- এটাই তোমার।
- উহুম! এটা আমার না!
- আরে এটাই তো তোমার ছিলো।
- দেখি তোমার হাতেরটা!
নাফিসা তার কাপও মেঘের হাতে দিলো। মেঘ নাফিসার কাপে চুমুক দিয়ে বললো - এটার স্বাদ বেশি, এটাই আমার ছিলো!
- মেঘ! এটা আমার কাপ!
মেঘ মুচকি হেসে দুকাপের চা একটা অন্যটাতে ঢেলে উলটপালট করে বললো, - কোনটা তোমার, বলো?
নাফিসা মেঘের দুষ্টুমি এবার বুঝতে পেরেছে! তাই হেসে বললো, - তুমি যেটা দাও, সেটাই।
মেঘ এক কাপ তার হাতে দিলো, আরেকটা নিজে রাখলো। বেঞ্চিতে বসে নয়, এবার তারা দোকানের একপাশে রাস্তায় দাড়িয়েই চায়ে চুমুক দিচ্ছে! মেঘের কাছে এখন মনে হচ্ছে মাটির কাপে চা খাচ্ছে! এতোক্ষণ মাটির ছিলো না পাথরের ছিলো কোনো খেয়াল ছিলো না ওই চুমকির জন্য! কিন্তু এখন খুব অনুভব করতে পারছে চায়ের স্বাদ! অসম্ভব ভালো লাগার মুহূর্ত! ল্যাম্পপোস্টের আলোতে দুজন দুজনকে দেখেছে, চোখে চোখে, মনে মনে শত রঙের আলাপন বিনিময় করছে! গভীর অনুভূতি নিয়ে একে অপরকে অনুভব করছে!
মেঘের চা শেষ হতেই নাফিসার কাপ নিয়ে যেটুকু ছিলো সেটুকুও শেষ করে দিলো সে। নাফিসা মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেঘ দুই কাপ নাফিসার হাতে দিলো। নাফিসা কাপ নিয়ে দোকানের ভেতরে যেতে নিলে মেঘ বললো,
- দাড়াও। টাকা নিয়ে যাও। দিয়ে এসো।
- চুমকিকে ভয় পাও?
মেঘ তাকাতেই নাফিসা হেসে উঠলো। মেঘ ওয়ালেট বের করে পঞ্চাশ টাকার নোট নিতে গেলে নাফিসা বললো, - একশো টাকার নোটটা দিবে?
- প্রয়োজন হলে ওয়ালেটই নিয়ে নাও। পুরোটাই তোমার।
- পুরোটা লাগবে না।
মেঘ পঞ্চাশ টাকার নোট রেখে একশো টাকার নোট নিয়ে নাফিসার হাতে দিয়ে বললো,
- মেঘা, আরেকটা কাজ করতে পারবে?
- কি?
- চায়ের কাপটা ধুয়ে রেখে এসো! এই চুমকি ছুমকি যেই ডেঞ্জারাস! বলা তো যায় না, যদি আবার কাপ চেটেপুটে রাখে!
নাফিসা ফিক করে হেসে উঠলো! কাপসহ টাকা নিয়ে সে দোকানে এসে বললো, - মাসি পানি দাও, আর টাকাটা রাখো।
দোকানী পানি দিয়ে ফেরত দেওয়ার জন্য টাকা নিতে নিতে নাফিসা কাপদুটো নিজ হাতে ধুয়ে দিলো। দোকানী টাকা দিতে যাবে, তখন নাফিসা বেঞ্চ থেকে বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে বললো,
- ফেরত দিতে হবে না মাসি। পুরোটাই রেখে দাও।
- ক্যানে! ধরো!
- আরে রেখে দাও তো! আর আমাদের জন্য দোয়া করো একটু। ভালো থেকো। চুমকি, যাইরে! ভালো থাকিস। আর শুন, তোর বিয়ের বয়স হয়নি এখনো! ছোকরাদের দিকে নজর দিবি না এখন! পরে দেখবি রাজকুমার পেয়ে যাবি!
নাফিসা বেরিয়ে যেতে লাগলো আর দোকানী বললো,
- নাইসা, আবার দেহা অইবো!
- ইনশাআল্লাহ, মাসি।
পর্ব – ৫৩
নাফিসা মেঘের কাছে আসতেই দেখলো মেঘ অটোরিকশা থামিয়ে দাড়িয়ে আছে। দুজনেই রিকশায় উঠে বসলো। হিমেল হাওয়া বইছে, শরীরে কম্পন তোলার মতো শীত। কিন্তু মুহুর্তটা খুব উপভোগ্য! মেঘ নাফিসাকে টেনে আরও জড়ো করে নিয়েছে তার সাথে। নাফিসাও পরম আবেশে মিশে আছে মেঘের উপর হেলান দিয়ে।
পথে থাকতেই আম্মি কল করেছে তারা এখনো বাড়ি ফিরছে না কেন সেটা জানার জন্য। মেঘ বললো তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌছে যাবে। রিকশায় থেকে নাফিসা কসমস বিস্কুট খেতে লাগলো, নিজ হাতে মেঘের মুখেও দিচ্ছে। এক প্যাকেট শেষ করলো দুজন আর অন্যটা রেখে দিলো।
কিছুক্ষণ পর তারা বাসায় ফিরে এলো। মেঘ শার্ট পাল্টানোর জন্য জ্যাকেট খুলছিলো, নাফিসা জুতা খুলে একপাশে রাখছিলো এমন সময় হইচই শুনতে পেল তারা!
মেঘ শার্টের বোতাম যা খুলেছিলো তা আবার লাগাতে লাগাতে বেরিয়ে এলো। নাফিসাও পিছু পিছু বেরিয়ে গেলো। রোকসানাও বেরিয়ে এসেছে উঠুনে। দুতিন বাড়ি পরে পাশের বাড়িতে হইচই সাথে কান্নার রোল পড়ে গেছে।
- কি হয়েছে আম্মি!
- জানিনাতো!
- মেঘা, আমি দেখে আসছি।
মেঘ চলে গেলো, নাফিসা আম্মিকে বলে সেও ছুটলো মেঘের পিছু পিছু। খালি বাড়ি রেখে রোকসানা যেতে পারছে না!
মেঘ নাফিসা উভয়ই এ বাড়িতে এসে দেখলো, গাছের উপর একটা ঘর ছিলো সেটাতে অসাবধানতা বশত আগুন লেগে গেছে! দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে সিড়ির দিকে।
উপরের দিকে এখনো তেমন জ্বলছে না। লোকজনের কাছে জানতে পারলো, একটা বাচ্চা আছে ঘরে, তার মা বাচ্চাকে রেখে নিচে এসেছিলো কোনো প্রয়োজনে। চুলা থেকে আগুন লেগেছে তাদের ধারণা। পাগলের মতো চিৎকার করছে মহিলাটি। পানি নিয়ে ছুটাছুটি করছে সবাই। আগুন নেভার বদলে যেন আরও জ্বলে উঠছে! মেঘ লক্ষ্য করলো ঘরে পুরোপুরি আগুন লাগেনি। সে পেছন দিকে দৌড়ে গেলো। গাছ বেয়ে অনেক চেষ্টা করে সে ঘরে উঠে পড়লো পেছন দিক দিয়ে। আগুন এক দিক থেকে অন্যদিকে প্রায় পুরো ঘরেই ছড়িয়ে পড়ছে। মেঘ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দুতিন বছরের বাচ্চাটাকে দেখতে পেল, বিছানার উপর বসে কাদছে! বিছানার এক কোনে আগুন লেগেও গেছে!
মেঘ দ্রুত তাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সামনে অল্প পরিধির যেই রোয়াক ছিলো সেখানে এসে চেচিয়ে বললো বাচ্চাটাকে ধরতে। সে উপর থেকে ঢিল দিবে আর কেউ ধরবে। সবাই অবাক! আর নাফিসা হতবাক! কাঠ পুড়ে পুড়ে ভেঙে পড়ছে নিচে! নাফিসার মনে ভয় আরও বেড়ে গেছে! মেঘ সেখানে গেলো কিভাবে! মাত্রই না তার পাশে দাড়িয়ে ছিলো! দুতিনজন লোক মেঘ বরাবর নিচে দাড়ালো বাচ্চাকে ধরার জন্য। মেঘ উপর থেকে ছেড়ে দিলো আর নিচ থেকে ধরে ফেললো বাচ্চাকে! মেঘ দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলো!
নাফিসা সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলো মেঘের নাম ধরে! কোথায় গেলো সে! লোকজন নাফিসার দিকেই তাকিয়ে আছে আর অপেক্ষায় আছে যে মানুষটা বাচ্চাকে বাচালো তার দেখা পাওয়ার জন্য! বাচ্চার মা বাচ্চাকে কোলে পেয়ে শান্ত কিন্তু মেঘের ভয়ে এদিকে নাফিসা অশান্ত! মেঘ সেখানে গেলো কিভাবে! আর এখন আসবেই কিভাবে! বাচ্চা তো এসে পড়েছে মেঘ এখনো আসছে না কেন! মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো নাফিসা! আগুন জ্বলতে জ্বলতে প্রায় পুরো ঘরেই ছড়িয়ে পড়েছে। আর এদিকে সবাই মেঘের প্রত্যাশায়! মেঘ কি ঘর থেকে বের হতে পেরেছে! বের হলে এখনো আসছে না কেন সবার সামনে! তার কিছু হয়নি তো!
হঠাৎ করেই পুরো ঘর উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়লো! ভেঙে একেবারে চুরমার! আগুন আরও তেজে জ্বলছে! নাফিসা “মেঘ” বলে চিৎকার করে আগুনের দিকে দৌড় দিলো! লোকজন যারা আগুনে পানি দিচ্ছিলো তারা নাফিসাকে আটকে ধরলো। নাফিসা মেঘের নাম ধরে চিতকার করছে আর হাউমাউ করে কান্না করছে! মেঘ এখানে আছে!
বাচ্চাকে বাচাতে গিয়ে সে নিজের জীবন শেষ করে দিয়েছে! এতো রিস্ক নিয়ে গেলো কেন সেখানে! লোকজন তো আরও ছিলো, তারা কি কম বুঝে! তারা তো কেউ যাওয়ার সাহস পায়নি! সে কেন গেলো, আগুনের সাথে কি যুদ্ধ করা যায়!
রোকসানা ঘর তালা দিয়ে ছুটে এসেছে এ বাড়িতে। নাফিসাকে কাদতে দেখেছে কিন্তু তার কারণ জানতে পারছে না! মেঘকেও দেখছে না! কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না! দৌড়ে এসে নাফিসাকে থামানোর চেষ্টা করছে আর কথা বলার চেষ্টা করছে।
এদিকে নাফিসা সবাইকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, সে মেঘের কাছে যাবে! তার মেঘ এই ঘরের ভেতর আছে! মেঘ জ্বলে যাচ্ছে আগুনে! তাকে রক্ষা করতে হবে, এটাই নাফিসার
প্রচেষ্টা! কিন্তু কাউকে ছাড়াতে পারছে না! এতোজন মিলে তাকে ধরে রেখেছে কেন!
হঠাৎ কেউ এসে সবাইকে ছাড়িয়ে নাফিসাকে টেনে পেছনে ঘুরানোর চেষ্টা করছে। সবাই নাফিসাকে ছেড়ে দিয়ে শান্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে আর কেউ কেউ পানি নিয়ে ছুটাছুটি করছে আগুন নেভানোর জন্য। কিন্তু নাফিসার শান্তি নেই! সে আগুনের দিকে ছুটে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেই যাচ্ছে! অন্যকোনো খেয়াল নেই তার!
মেঘ নাফিসাকে হেচকা টান দিয়ে ঘুরিয়ে “মেঘা!” বলে খুব জোরে ধমক দিলো! নাফিসা এবার সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেঘকে খেয়াল করলো! মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার তাকিয়ে ঝাপটে পড়লো মেঘের উপর। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে মেঘকে চেপে ধরে হুহু করে কাদতে লাগলো! খুব ভয় পেয়েছে বুঝতে পেরে মেঘও জড়িয়ে ধরলো। বড়সড় এক নিশ্বাস ফেলে নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে বললো,
- এই, কাদছো কেন তুমি! এই যে আমি তোমার সামনে দাড়িয়ে আছি! কিছু হয়নি আমার। আমি ঠিক আছি। মেঘা শান্ত হও! কান্না থামাও বলছি!
- মেঘ, তুমি কেন গেলে সেখানে! একবার আমার কথা ভাবলে না! একবার আমাদের বেবির কথা ভাবলে না! আরেকটু দেড়ি হলে তো আমি মরে যেতাম! এক মুহূর্তও চলে না আমার, তোমাকে ছাড়া! তোমার কিছু হলে বাচবো না আমি! সত্যিই, মরে যাবো!
- মেঘা চুপ করো। আমি ঠিক আছি তো! কিছু হয়নি আমার, দেখো! তাকাও আমার দিকে। সোজা হও।
- উহুম!
মেঘ কানের কাছে মুখ এনে বললো, - এই সোজা হও, সবাই দেখছে তো!
- দেখুক!
- মেঘা! পাগলামি বন্ধ করো! সোজা হও!
নাফিসা চুপচাপ এভাবেই আছে! মেঘ আবার বললো, - মেঘা, সবাই দেখছে তোমার লজ্জা লাগছে না! আমার কিন্তু লজ্জা লাগছে! ছাড়ো, সোজা হও!
নাফিসা চুপচাপ এভাবেই আছে। কোনো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে না! মেঘ ব্যর্থ হয়ে নিজেই হাল ছেড়ে দিলো! খুব ভয় পেয়েছে, এখন তাকে একটুও কথা শুনানো যাবে না!
আগুন নিভিয়ে দেয়া হয়েছে পানি ঢেলে! পরিবেশ অনেকটা নিরব। বাচ্চাটার বাবা বাচ্চাটার মায়ের গায়ে হাত তুললো সবার সামনেই। এমন অসাবধানে চলাফেরার জন্য! তিনি আগুন লাগার পরেই বাড়ি ফিরেছেন। মহিলা নিজের দোষ স্বীকার করছে তাই নিরবে কান্না করতে করতে বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে আছে। বাচ্চাটাও মায়ের কোলে মিশে আছে! লোকজন নানান আলোচনা আর সমালোচনা করছে। মেঘের প্রশংসাও করছে। বাচ্চার বাবা-মা এসে মেঘের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। নাফিসা এখনো মেঘকে ছাড়েনি, সেই
আগের মতোই আছে! অনেকে জানতে চাইলো মেঘ কিভাবে উদ্ধার করেছে বাচ্চাকে, মেঘ সংক্ষেপে বলে সেখান থেকে চলে এলো নাফিসাকে নিয়ে! রোকসানাও এসে পড়েছে বাড়িতে। রুমে এসে মেঘ নাফিসাকে খাটে বসালো। নাফিসা আবার মেঘকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো আর মেঘ ধমক দিয়ে চুপচাপ বসতে বললো! জোরে ধমক দেওয়ায় নাফিসা চুপ হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু কান্না থামেনি! চোখ থেকে অনবরত পানি পড়েই যাচ্ছে! মেঘ জগ থেকে পানি এনে নাফিসার মুখের সামনে ধরলো। না চাইতেও নাফিসা অল্প একটু পান করলো। মেঘ তার পাশে বসে মুখখানা দু’হাতে ধরে বললো,
- এতো পাগলামি করছিলে কেন! তোমার মাঝে যে অন্য কেউ সেটা কি তোমার অজানা! কোথায় নিজের খেয়াল রাখবে, তা না করে পাগলের মতো আচরণ করছিলে!
নাফিসার চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে মেঘ আবার বললো, - কিছু হয়নি আমার। একদম ঠিক আছি। এবার স্বাভাবিক হও।
নাফিসা উঠে দাড়িয়ে মেঘকে টেনে দাড় করালো। অত:পর মেঘের শার্ট খুলতে লাগলো। মেঘ বললো, - কি করছো তুমি! বললাম তো আমার কিছু হয়নি!
নাফিসা পেটে, পিঠে দেখলো কোনো ক্ষত নেই , হাতে দেখলো অল্প একটু আঁচড় পড়েছে। তারপর বললো, - প্যান্ট উপরে তোলো।
- হোয়াট! এখন কি প্যান্ট খুলেও দেখাতে হবে তোমাকে! তাছাড়া প্যান্ট আবার উপরে তোলে কিভাবে! আগুনের কোনো স্পর্শ লাগলে তো সেটা বাইরে থেকেই বুঝা যায়!
নাফিসা কোনো জবাব না দিয়ে নিচে বসে পড়লো। নিজ হাতে মেঘের হাটু পর্যন্ত প্যান্ট উঠিয়ে দেখলো কোনো ক্ষত নেই। - মেঘা, কি করছো তুমি এসব! বারবার বলছি আমার কিছু হয়নি তাও বিশ্বাস করছো না কেন!
নাফিসা উঠে দাড়ালো এবং হাত বাড়িয়ে মেঘের দু গালে ধরে বললো,
- ভয় হয় আমার! খুব ভয় হয় মেঘ! এজন্য বিশ্বাস করতে পারিনা সহজে! খুব ভালোবাসি যে!
মেঘ তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, - পাগল বানিয়ে দিবি আমাকে নাকি মেরে ফেলবি! তোর এতোসব পাগলামি দেখে তো আমি নিজে ঠিক থাকতে পারি না! আর একবার কাদলে মাইর শুরু করবো!
নাফিসা তার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে। মেঘ বললো, - মেঘা, ঠান্ডা লাগছে আমার।
- গোসল করবে?
- করা প্রয়োজন।
- কম্বল নিয়ে একটু বসো, আমি পানি গরম করে দিচ্ছি।
মেঘ গোসল সেড়ে এলে নাফিসা খাবার নিয়ে এলো। মেঘ বললো, - শাড়ি চেঞ্জ করবে না?
- না।
- মেঘা, পৃথা আপ্পিদের বাসায় যে খেয়েছি সেটা কি খাবার ছিলো?
- কোরল। চেনো?
- হ্যাঁ, কচি বাশ।
- হুম।
- মজা লেগেছে খুব। নাম জানি কিন্তু খাইনি কখনো।
- আবার খেতে চাও?
- খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে মিস নেই।
- চা টা কেমন ছিলো?
- চুমকিটা অনেক ডেঞ্জারাস ছিলো!
জিজ্ঞেস করলো একটা আর উত্তর দিলো আরেকটা! তাই নাফিসা হেসে উঠলো। মেঘেরও ভালো লাগছে তাঁর হাসি দেখতে। একটু হাসানোর জন্য ইচ্ছে করেই বলেছে। দুজনেই খাওয়াদাওয়া শেষ করলো। ঘুমানোর সময় নাফিসা কম্বলের নিচে মেঘের উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে বললো,
- মেঘ তুমি সেই ঘরে গেলে কিভাবে?
- বলেছি তো একবার শুনোনি?
- কখন?
- ও বাড়িতে থাকতেই বলেছিলাম।
- জানিনা, আবার বলো।
- যদি পড়ে যাই তাই আমাকে হেল্প করার জন্য একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে ঘরের পেছন দিকে গিয়েছি। তাকে নিচে দাড় করিয়ে গাছ বেয়ে ঘরে উঠেছি। সেদিকে তখন আগুন পৌছায়নি। ওইযে, বারান্দার বাঁ দিকটায়। বাচ্চাটাকে দ্রুত বের করে নিচে ফেলে আবার সেই গাছেই উঠেছি।
- উঠতে তো দেড়ি হয়নি, নামতে এতো দেড়ি হয়েছে কেন?
- গাছে উঠে ভালো করে লক্ষ্য করলাম কোথায় কোথায় ঘরটা আটকানো হয়েছে। পরক্ষণে দুইটা বাধ দেখতে পেয়েছি। ছেলেটাকে দা আনতে বলে আমি গাছেই বসেছিলাম। পরে দা দিয়ে কুপিয়ে ওগুলো ছুটিয়ে দিয়েছি যাতে উপরে বৈদ্যুতিক সংযোগে স্পর্শ না করতে পারে। দুইটা বাধ ছেড়ে দিতেই অপরদিকে ঢাল হয়ে ঘর পড়ে গেছে।
- আর কখনো এসবে যাবে না! আগুন পানির সাথে যুদ্ধ করা যায় না! ভয় হয় খুব!
- ভয় হলেও তো পাগলের মতো আগুনের উপর চলে যাচ্ছিলে! আমি এসেও কতবার ডাকলাম তুমি শুনছোই না!
নাফিসা চুপ হয়ে আছে তাই মেঘ বললো, - মেঘা?
- হুম?
- বাবুদের নাম কি রাখবে?
- মেঘনা, মেঘু, মেঘী, মেঘাই।
মেঘ হাহা করে হেসে উঠে বললো, - মাত্র তো এক হালি হলো, বাকিগুলো কি?
- আপাতত এক হালিই থাক, বাকিগুলো আগামী বছর।
- অনেক দুষ্টু হয়ে গেছো তুমি, মেঘা! এসো, এবার একটু কমিয়ে দেই দুষ্টুমিটা!
নাফিসা হিহি করে হেসে উঠলো!
কিছুদিন পরই নাফিসা ও আম্মিকে নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠলো মেঘ। আম্মি আসতে চায়নি কিন্তু মেঘ রাগারাগি, জোরাজোরি করে মানিয়ে নিয়ে এসেছে। থাকার জন্য দোতলায় ফ্ল্যাট দুটি শুধু পরিপূর্ণ হয়েছে আর বাকিটার কাজ চলছে। বাড়ির স্থান ও ডিজাইন খুবই পছন্দ হয়েছে নাফিসার। তাদের রুমের দুই দেয়ালে কাচ লাগানো। সাথে বারান্দা আছে। চমৎকার দৃশ্য দেখা যায় এখান থেকে। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ দৃশ্য! বৃষ্টির ফ্ল্যাটও একই ডিজাইনের।
নাফিসা বারান্দায় দাড়িয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিলো। মেঘ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
- পছন্দ হয়েছে?
- ভীষণ!
মেঘ তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্যপাশের দেয়ালের দিকে এলো এবং সম্পূর্ণ দেয়ালের পর্দা টেনে দিয়ে বললো, - মেঘা, আজকের পর থেকে আমি না বলা পর্যন্ত এই পর্দা সরাবে না।
- কেন?
- ইনশাআল্লাহ, উত্তর পরে জানবে। আর এখন শুধু মানবে।
- আচ্ছা।
এখন আবার দুজন একসাথে প্রকৃতির সাথে প্রেমালাপ করতে লাগলো বারান্দায় দাড়িয়ে। তারা নতুন বাড়িতে উঠার পর রায়হান চৌধুরী, মোহিনী ও বৃষ্টি এসেছে সিলেট। তিন চারদিনের মতো কাটিয়ে আবার ঢাকা ফিরে এসেছে। বৃষ্টির আরও থাকার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু মেডিক্যালের এডমিশন রেজাল্ট পাবলিশিংয়ের কারণে চলে এসেছে।
পর্ব – ৫৪
বৃষ্টি ডিএমসি-তে চান্স পেয়েছে। এ নিয়ে বাড়িতে খুশিতে মেতে উঠেছে সব। মেঘ আর নাফিসাকে জানাতে ভুলেনি সে! বাবামাকে জানানোর পরেই তাদের কল করে জানিয়েছে। অত:পর আকাশকে জানিয়েছে। আকাশ ভিডিও কলে কথা বলতে চাইলে বৃষ্টি ছাদে চলে এলো। বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো দুজন। প্রতিদিনই আকাশের সাথে কথা বলে বৃষ্টি।
ষোলো তারিখ আকাশ ও তার বাবা-মা বৃষ্টিদের বাসায় এসে হাজির সাথে হুজুর! বৃষ্টি মানুষের সমাগম শুনে ড্রয়িং রুমে একটু উঁকি দিয়েছিলো। আকাশকে দেখে সে হতবাক! মোহিনী বৃষ্টিকে দেখে গম্ভীরমুখে বললো রেডি হয়ে আসতে। বৃষ্টি তো কিছুই বুঝতে পারছে না! কি হতে যাচ্ছে!
বৃষ্টি নতুন জামা পড়ে অতিরিক্ত কোন সাজসজ্জা ছাড়া সেজেছে। মোহিনী নিজেই তাদের সামনে নিয়ে গেছে। রায়হান চৌধুরী আকাশের বাবামায়ের সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেন তারা পূর্বপরিচিত! পরিবেশটা অগুছালো মনে হচ্ছে বৃষ্টির কাছে, তার মনের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে! আকাশ এখানে আসবে তা নিয়ে তাকে কিছু বললো না কেন! তারা কি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে! তার মাথায় নানান চিন্তা আর এদিকে আকাশের মুখে হাসি। আকাশের মা উঠে এসে বৃষ্টিকে কাছে নিয়ে বসালো। উনারা জানালো উনাদের পছন্দ হয়েছে। রায়হান চৌধুরী বৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করলো,
- বৃষ্টি, আকাশকে চেনো?
বৃষ্টি একবার তার বাবার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার আকাশের দিকে।
রায়হান চৌধুরী আবার বললো,
- তোমার ভাই তো বিয়ে শেষে চিঠি লিখেছিলো তুমিও কি চিঠি লেখার চিন্তা করছো নাকি তার আগেই দরখাস্ত লিখবে?
বাবার মুখে এমন কথা শুনে বৃষ্টি হতবাক! তার মানে কি! বাবা কি তার আর আকাশ সম্পর্কে সবটা জানে!
তিনি আবার বললেন, - আমি কখনো জংলী দেখিনি, আর তুমি তাদের সাথে সাক্ষাৎও করে এসেছো! ভাবতে তো আমারই গলা শুকিয়ে আসছে!
বৃষ্টি চরম পর্যায়ে অবাক হয়ে আকশের দিকে তাকালো! এসব তার বাবা জানবে কিভাবে! সে নিশ্চিত আকাশ সব বলে দিয়েছে! সেটা আকাশের মুখে লেগে থাকা মৃদু হাসিই বলে দিচ্ছে! এ কোন মহা ঝামেলায় ফেললো আকাশ তাকে! এটাই কি ছিলো তার সারপ্রাইজ!
রায়হান চৌধুরী মোহিনীকে বললো, - মোহিনী, তোমার মেয়েকে পানি দাও এক গ্লাস! তোমার স্ট্রং মেয়ে আজ বিড়াল হয়ে গেছে!
বৃষ্টি এতোক্ষণে মুখ খুললো, - লাগবে না পানি।
- আচ্ছা, তাহলে বলো আকাশকে তুমি চেনো?
বৃষ্টি মাথা নিচু করে বললো, - বাবা, সিলেটে জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেখানেই তাদের সাথে দেখা।
- জঙ্গলে হারিয়েছিলে নাকি পানিতে?
- ওই একই কথা হলো না! পানির স্রোতে ডুবে গেছি সেখান থেকে জঙ্গলের ধারে উদ্ধার।
- বেয়াই সাহেব, ছোট বেলা কবিতা বানিয়েছিলাম,
নদীতে ধরিতে গিয়েছি মাছ।
নাহি পেয়েছি তাহা,
কিন্তু পেয়েছি মৎস কন্যা।
তুলে নিয়েছি মোর কুড়ে ঘরে
বেধেছি স্বপ্ন, বেধেছি আশা
আর ডেকেছি নিজের সর্বনাশ!
হুট করেই মোহিনী বলে ফেললো,
- কি গো! এটা কি কবিতা ছিলো নাকি বাস্তব? এই কবিতা তো আমায় কখনো শুনাও নি তুমি!
আকাশের বাবা মা হেসে উঠলো। আর বৃষ্টি মনে মনে বললো, “এই হচ্ছে আমার স্পেশাল বাবামায়ের কীর্তি! মেহমান বসিয়ে রেখেও তাদের রসিকতা ফুরায় না!”
রায়হান চৌধুরী বললো, - এই হয়েছে! এই বয়সে আমার উপর সন্দেহ করবে তুমি!
আকাশের বাবা বললো, - বেয়াই সাহেব এবার কাজের কথায় আসি। বৃষ্টি তোমার বাবা-মা সহ আমরা অনেক আগে থেকেই জানি তোমাদের পরিচয়ের ঘটনা। আকাশ তো এক পায়ে দাড়িয়ে কিন্তু তোমার কি আকাশকে ভালোলাগে? আকাশের সাথে বিয়েতে কি তুমি রাজি আছো?
বৃষ্টির মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না! কোনো পূর্বাভাস ছিলো না, হঠাৎ করেই এ কোন পরিস্থিতিতে পড়লো সে! সে একবার মায়ের দিকে তাকালো পরক্ষণেই আবার বাবার দিকে তাকালো। রায়হান চৌধুরী বললো, - এতো নার্ভাস কেন আম্মা? তোমাদের ছোট থেকেই চেয়েছি যাতে তোমরা স্বাধীনভাবে চলতে পারো। তোমার মা শাসনে রাখতে চেয়েছে আমি তা হতে দেইনি। শাসনে রাখলে তো আমি আমার সন্তানদের মন জানতে পারবো না, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তোমরা আমাকে কিছু জানাতে পারবে না, আমার কাছে কোনো আবদার করবে না। অন্যথায় তোমাদের ইচ্ছে পূরণে ব্যর্থ হবো! পৃথিবীর সকল পিতামাতাই চায় তাদের সন্তান ভালো থাকুক, সুখে থাকুক। তোমাদের সুখে আমরা বাবামায়েরা সুখী। আমার সকল প্রচেষ্টা তোমাদের ঘিরেই। পরবর্তী প্রজন্মে তোমাদের প্রচেষ্টাও হবে তোমাদের সন্তানের জন্য।
এটাই প্রকৃতির নিয়ম। চাইলেও অবহেলা করা যাবে না। জীবন তোমার, সিদ্ধান্তও তোমার। এবার বলো তো, আকাশকে তোমার পছন্দ হয় কি-না? তোমার মতামত ছাড়া কোনো মতামত আমরা দিতে পারছি না।
বাবার কথাগুলো শুনে বৃষ্টির মনে বইছে সুখের বাতাস আর চোখে বইছে অশ্রুধারা। শুধু আজ নয়, সবসময়ই তার কাছে মনে হয় সে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবতী। কেননা তার কাছে এমন বাবামা আছে। নিচু স্বরে বৃষ্টি জবাব দিলো,
- বাবা, তোমাদের সিদ্ধান্তে আমি একমত। তোমরা সর্বদা আমাদের সাপোর্ট করে এসেছো। আদর স্নেহ মমতাসহ উপযুক্ত শিক্ষা দান করেছো। বাবা মা সবার কাছেই আছে কিন্তু তোমাদের মতো এমন বাবা মা কারো কাছে নেই! তোমাদের মেয়ে সর্বদা তোমাদের বাধ্য। সিদ্ধান্ত সবটাই তোমাদের হাতে।
- এখন আমি যদি আকাশকে পছন্দ না করে তোমার জন্য অন্যকাউকে পছন্দ করি!
বৃষ্টি বাবার মুখে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, - তবুও আমি তোমাদের সিদ্ধান্তেই রাজি। কখনো এর কারণও জিজ্ঞেস করবো না। তখনও বলবো আমার বাবা মায়ের সিদ্ধান্তই শ্রেষ্ঠ।
রায়হান চৌধুরী এবার মৃদু হেসে বললো, - মোহিনী, এবার তোমার সুযোগ। বলো কি বলবে?
- আমার কিছুই বলার নেই। শুধু আমি আমার মেয়েকে সুখে দেখতে চাই। সিদ্ধান্ত তুমিই নিবে, হেরফের হলে তোমার খবর নিয়ে ছাড়বো।
- চাইলাম মতামত, আর দিলে ধমকি! আচ্ছা মেনে নিলাম তোমার কথা। বেয়াই সাহেব, তাহলে পাকাপাকি হয়ে থাকুক। ইনশাআল্লাহ, মেয়ের মেডিক্যাল কোর্স কমপ্লিট হলে আপনাদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যাবেন।
আকাশের বাবা বললো,
- আমরা আজই আমাদের বাড়ির বউ নিয়ে যাবো বেয়াই।
বৃষ্টির পরিবার সবাই অবাক! রায়হান চৌধুরী বললো, - তা হয় না বেয়াই। আমি কিন্তু আগেই বলেছি আপনাকে। আমার মেয়ের পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত শ্বশুর বাড়ি পাঠাবো না।
- হ্যাঁ, সেটা বুঝলাম কিন্তু আমার ছেলের জ্ঞান হওয়ার পর আজ প্রথম একটা পাকাপোক্ত আবদার করেছে সেটা তো আর আমি ফেলতে পারি না! আজকের এই দিন, এই তারিখেই সে বিয়ে করবে এবং সেটা বৃষ্টিকেই। এজন্যই তো সাথে হুজুর নিয়ে আসা।
- বেয়াই সাহেব, বৃষ্টির বয়স এখনো পরিপূর্ণ হয়নি। ওদের ইচ্ছাতে আপনারা আংটি পড়িয়ে রাখতে পারেন কিন্তু আজ বিয়ে সম্ভব না! এভাবে বললেই কি হয়! সবকিছুরই একটা প্রস্তুতি দরকার। কোর্স শেষ হলে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে ওদের বিয়ে দিবো।
আকাশের মা বললেন, - আকাশ, উনারা কিন্তু ঠিক বলছে। বৃষ্টির পরিপূর্ণ বয়স হয়নি এখনো। তাছাড়া ওর ক্যারিয়ার গঠন বাকি। আমরা এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখি।
- না আম্মু। আমি আজ বিয়ে করবো। বিয়ে না করে বাসায় যাবো না। এটাই আমার শেষ কথা!
রায়হান চৌধুরী হেসে বললো, - তাহলে তুমি আজ থাকো আমাদের বাড়িতে।
- সরি, আংকেল। আমি আজ বিয়ে করেই বাসায় যাবো। আপনারা আমাদের বিয়ে না দিতে চাইলে প্রয়োজনে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করবো। তবুও বিয়ে আজই হবে!
বৃষ্টি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে! এমন চাহনি দেখে আকাশ বললো, - বৃষ্টি, তুমি কি এখন আমাকে পাগল মনে করছো? যা-ই মনে করো, বিয়ে কিন্তু আজই করবো। আর বউও বাসায় নিয়ে যাবো।
আকাশের মা একটু ধমকের সুরেই বললো, - আকাশ তুমি তো সত্যিই পাগল হয়ে গেছো! উনারা বলছে আজ বিয়ে দিবে না আর তুমি বলছো তাদের উপেক্ষা করে কাজী অফিসে বিয়ে করবে!
- আম্মু আমি কিন্তু বাসা থেকে আগেই বলে এসেছি তোমাদের! আমি আজই বিয়ে করবো। আংকেল আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, বৃষ্টির সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করার দায়িত্ব আমার। আমার কাছে থাকলে ওর পড়াশোনা বেশি ভালো হবে সেটা আপনি গ্যারান্টিসরূপ ভেবে নিতে পারেন।
বরং বিয়ে না হলে বৃষ্টির পড়াশোনায় আরও ক্ষতি হবে। কেননা ও প্রায়ই চাইবে এখানে সেখানে বেড়াতে যাওয়া, পড়াশোনায় একটু ফাকি দিয়ে আমার সাথে দেখা করা। এর আগেও যে এভাবে কতবার দেখা করেছে সেটা কিন্তু আপনার অজানা নয়। আমার সাথে রাগারাগি করেও নিজেকে কষ্ট দিয়েছে। ভবিষ্যতেও যে এমন কিছু করবে না সেটার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই! আর আপনি দমিয়েও রাখতে পারবেন না, এবং হয়তো সেটা চাইবেনও না। আংকেল, বয়সটা খুব আবেগের। সময়টা আপনিও পাড় করে এসেছেন, সুতরাং এর সম্পর্কে আপনি অজ্ঞাত নন।
রায়হান চৌধুরী বললো,
- ঠিক আছে, তোমার কথায় ভরসা নিয়ে আমি বৃষ্টির বিয়ে দিতে রাজি। দু এক সপ্তাহ বাদে আনুষ্ঠানিকভাবেই বিয়ে হবে। কি বলেন বেয়াই?
- ঠিক আছে।
- এবার ঠিক আছে তো আকাশ?
- না আংকেল, আপনি আনুষ্ঠানিক ভাবে না হয় আগামী দু এক সপ্তাহ বাদে আয়োজন করুন। কিন্তু ঘরোয়াভাবে হলেও আজই বিয়ে করবো।
আকাশের কথা শুনে সবাই হতবাক! বৃষ্টির মুখে তো বুলি নেই ই! যে যা-ই বলছে, আকাশ বলছে আজকেই বিয়ে করবে! হুজুর সে ই নিয়ে এসেছে! অবশেষে ধার্মিকভাবে তাদের আজই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বউ বাসায় নিবে আনুষ্ঠানিক ভাবে। এখন উপস্থিত শুধু দুই পরিবার। আর ওদিকে মেঘকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কল করে। গম্ভীর হয়েও সবাই হাসিখুশি ভাবভঙ্গি প্রকাশ করলো। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ হলো রায়হান চৌধুরীর বাড়িতে।
বৃষ্টি তার রুমে জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে। আকাশ কাশি দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। বৃষ্টি ঘুরে দেখলো আকাশ এসেছে তার রুমে। স্যুট-কোট পড়ে একেবারে পরিপাটি সাজ, যেন বিয়ের পর বেড়াতে এসেছে শ্বশুর বাড়ি! অথচ আজ কিছুক্ষণ আগে তাদের বিয়ে হয়েছে যেটা কল্পনার বাইরে ছিলো! ভাবতেও পারেনি আকাশ তাকে এমন সারপ্রাইজ দিবে! আকাশ এগিয়ে এসেছে তার কাছে। বৃষ্টি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এমনিতে অতি চঞ্চল ভাব দেখালেও আজ আকাশের সামনে দাড়াতে তার লজ্জা লাগছে খুব! আকাশ তার থেকে এক ফুট দূরে প্যান্টের পকেটে দুহাত রেখে দাড়িয়ে বললো,
- বলেছিলাম না ষোল তারিখ সারপ্রাইজ দিবো। এখন বলো কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, মাই ডিয়ার ওয়াইফি ?
বৃষ্টি তার দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে কিছুক্ষণ আগে পড়িয়ে দেওয়া আংটিটা আঙুলে ঘুরাচ্ছে। আকাশের কথায় লজ্জাময়ী হাসি দিয়ে বললো, - আপনি একটা পাগল।
- প্রথম হানিমুন কি তাহলে পাবনা মানসিক হসপিটালে হবে?
- ছি!
আকাশ হেসে উঠলো আর বৃষ্টি লজ্জায় কাতর! আকাশ এক ফুট দূরত্ব বজায় রেখেই বৃষ্টির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
- আজ তো বউ সাজলে না। বাট আফটার নেক্সট টু উইক উডবি বি মেক রিয়েল ব্রাইড, মিসেস আকাশ।
বৃষ্টির মুখের হাসি আরও প্রশস্ত হয়ে উঠলো। কথাটা বলা শেষ হতে হঠাৎই আকাশ বৃষ্টির গালে আলতো চুমু একে দিলো এবং সোজা হয়ে দাড়ালো। বৃষ্টি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে আর আকাশের মুখে হাসির ঝিলিক। সে বললো, - আগামী দু সপ্তাহ আমাকে কোনোভাবেই খুজবে না। না সরাসরি আর না কোন যোগাযোগ ব্যাবস্থায়। আমি বিয়ের দিন তোমার সামনে উপস্থিত হবো। বিয়ের শপিং নিয়ে কোনো চিন্তা করো না। আমি নিজে সবটা ম্যানেজ করবো। সময় মতো তোমার কাছে পৌছে যাবে। আল্লাহ হাফেজ।
বৃষ্টি মুচকি হেসে বললো, - আল্লাহ হাফেজ।
পরক্ষণেই মিস্টার ও মিসেস চৌধুরীর কাছে বিদায় নিয়ে আকাশ তার বাবামায়ের সাথে বেরিয়ে গেলো।
পর্ব – ৫৫
দেখতে দেখতে দিনগুলো পেরিয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ। মেঘ ও নাফিসা দুদিন আগে এসেছে ঢাকা। রায়হান চৌধুরী ও মোহিনী রোকসানাকে বলেছে অনেক কিন্তু রোকসানা আসেনি। মেঘ সবটা জানে বিধায় তার বাবা-মাকে ম্যানেজ করেছে সে।
সকালে নাস্তা করার পর নাফিসা বৃষ্টির সাথে কথা বলছিলো বৃষ্টির রুমে। এমন সময় মেঘ তাকে ডাকলো “মেঘা” নাম ধরে। বৃষ্টি বললো,
- যাও, মেঘা! তোমার মেঘের ডাক পড়েছে যে। দেড়ি হলে আবার গর্জন তুলবে!
- পাজি মেয়ে।
বৃষ্টি হিহি করে হেসে উঠলো আর নাফিসা চলে গেলো। হাসি থামিয়ে কোল বালিশটা কোলে নিয়ে বললো, “মেঘ থেকে যদি মেঘা হয় তাহলে তুই কি হবি বৃষ্টি! আকাশী না বাতাসী!” নিজের সাথে কথা বলে একা একাই হাসতে লাগলো বৃষ্টি। পরক্ষণে মায়ের কথা মনে করে মায়ের কাছেই চলে গেলো।
নাফিসা রুমে এসে দেখলো মেঘ খাটে বসে ফুল নিয়ে কিছু করছে। নাফিসাকে দেখে বললো,
- বাচ্চাদের আম্মি, দরজা লাগিয়ে আমার কাছে এসো।
নাফিসা দরজা লাগিয়ে এগিয়ে এসে বললো, - ফুল দিয়ে কি করবে?
- তোমার শীতের জামা কোথায়? বাচ্চাদের যদি ঠান্ডা লাগে, তোমার খবর আছে!
- এখন তেমন ঠান্ডা লাগছে না, তাই খুলে ফেলেছি। বললে না তো, ফুল দিয়ে কি করবে?
মেঘ কোনো উত্তর না দিয়ে তার কাজের সমাপ্তি ঘটিয়ে উঠে দাড়ালো। নাফিসার কাছে এসে তার গলায় শিউলী ফুলের মালা ও হাতে বালা পড়িয়ে দিয়ে বললো,
“কুড়িয়ে এনেছি শিউলি ফুল,
অনায়াসে মুগ্ধ করেছে আমায়!
গেথে মালা, হাতের বালা,
পড়িয়ে দিবো তোমায়!
চাইলে তুমি আরও দেবো,
নাকে ফুল,
আর কানের দুল,
সাথে বেধেও দিবো খোপায়!”
ছাদে গিয়ে দেখলাম অনেকগুলো ফুল পড়ে আছে তাই কুড়িয়ে নিয়ে এলাম।
- এখন কি এগুলো পড়ে আমি সারাদিন রুমে বসে থাকতে পারবো!
- সারাদিন না, যতক্ষণ আমি বাসায় আছি ততক্ষণ পড়ে আমার কোলে বসে থাকো।
- অসময়ে তোমার দুষ্টুমি! বিয়ে বাড়ি, কাজ তোমার আমার সবারই আছে!
মেঘ খাটে বসে নাফিসাকে টেনে তার কোলে বসিয়ে দিলো। দু’হাতের বন্ধনে বেধে বললো,
- মা কিন্তু তোমাকে কাজ করতে একদম নিষেধ করেছে। আর আমার কাজ তো আমি করবোই। সব কাজে একটু একটু ফাকি দিয়ে বাচ্চাদের ও তাদের আম্মিকে আদর দিয়ে যাবো। বলা তো যায় না কখন আবার রাগ করে বসে!
- বাচ্চারা ও তাদের আম্মি জানে তুমি কাজে ব্যস্ত। দুষ্টুমি ছাড়ো আর যাও।
- এই, চুপচাপ বসো।
ঠান্ডা থেকে একটু উষ্ণতায় আনতে মেঘ তার জ্যাকেটের চেইন খুলে নাফিসাকেও অর্ধেক ঘেরাও করলো জ্যাকেটের মধ্যে। অত:পর কাধে থুতনি রেখে বললো, - বাচ্চারা কি খুব জ্বালাতন করে?
- উহুম। শুধু খাওয়ার সময় উপচে দেয়!
মেঘ হেসে উঠলো এবং বললো, - আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আগের চেয়ে কমেছে না অনেকটা?
- হুম।
এভাবেই চললো কিছুক্ষণ তাদের প্রেমালাপ। মেহমান আসতে শুরু করেছে বাড়িতে। সময় যাচ্ছে আর জাকজমাক হয়ে উঠছে বাড়ি। গায়ে হলুদ গেলো ধুমধামে, তারপর বিয়ে। মারিশা গায়ে হলুদে আসেনি কিন্তু বিয়েতে এসেছে। নাফিসার সাথে দেখা করেছে। বাচ্চার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। মেঘ পাশেই ছিলো সেটুকু সময়। মারিশা এবং বৃষ্টির বান্ধবীরা সঙ্গ দিয়েছে বৃষ্টির। নাফিসা অল্প সময় সেন্টারে অবস্থান করেছে।
পরবর্তীতে মেঘ নাফিসা ও মোহিনীকে বাসায় দিয়ে গেছে। অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় যখন বিদায় হবে তখন মোহিনী সেন্টারে গিয়েছে। সেখান থেকেই বৃষ্টির বিদায় হয়েছে। ছেলে বিয়ে করে অন্যের ঘর শূন্য করে ঘরে এক মেয়ে এনেছে অন্যদিকে নিজের মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছেন অন্যের ছেলের ঘরে। প্রকৃতির কি অপূর্ব নিয়ম! ছেলে আর ছেলের বউ থাকতেও আজ বাড়ি ফাকা লাগছে!
বৃষ্টি ফুল সজ্জিত বিছানায় একা বসে আছে। মাত্রই আকাশ রুমে এসেছে। বৃষ্টি একপলক দেখে আবার দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেছে। আকাশ দরজা লক করে মাথার টোপর খুলে টেবিলে রাখলো এবং বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,
- বৃষ্টি, আমার সাথে এক রাত কাটাতে চাও নাকি জীবনের সব রাত?
এমন প্রশ্নে বৃষ্টি হতবাক হয়ে তাকালো তার দিকে! এর দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছে সে! বৃষ্টি কি জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না! আকাশ ব্রু নাচিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
- এতো কনফিউশনে আছো কেন তুমি? বলো, এক রাত কাটাতে চাও নাকি বহুরাত?
- বহুরাত।
- তাহলে এসব চেঞ্জ করে এসো।
বৃষ্টি তার কথামতো নেমে গেলো। লাগেজের কাছে এলে আকাশ এসে লাগেজ খুলে দিলো। বৃষ্টি সুতি জামা নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। হাতমুখ ধুয়ে চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসে দেখে আকাশও চেঞ্জ করে প্যান্ট আর টিশার্ট পড়েছে। আকাশও বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। বৃষ্টিকে বসে থাকতে দেখে বললো,
- বসে আছো কেন? এনি প্রব্লেম?
- না।
- তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো।
বৃষ্টি বালিশ ঠিক করতে গেলে আকাশ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে মাথা আঁচড়ে বললো,
- মশা আছে কিন্তু প্রচুর। আমার এলার্জি আছে তাই স্প্রে করা যাবে না। মশারী টানিয়ে নিতে পারো।
বৃষ্টি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখলো খাটের কোনে মশারী আছে। সেটা নিয়ে ফুলের ঝারের ভেতরে চারকোনা টানিয়ে নিলো। বৃষ্টি ভেতর থেকে মশারী ঠিক করতে লাগলো, এদিকে আকাশ এসে দুই কোনা ছুটিয়ে দিয়ে বললো, - তোমার দিকে রাখো। আমার আবার মশারী টানালে ঘুম আসে না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হয়!
আশ্চর্য! মশারী না টানাতে পারলে রেখেছে কেন রুমে! এভাবে দুই কোনা টানিয়ে কি ঘুমানো যায়! বৃষ্টি ব্যর্থতার নিশ্বাস ছেড়ে বাকি দুইকোনাও ছুটিয়ে ফেললো। আকাশ শুয়ে পড়েছে। মশারী খুলে ফেলতে দেখে বললো, - খুলে ফেলছো! কয়েল কিন্তু জ্বালাতে পারবে না। আমি কয়েলের গন্ধ সহ্য করতে পারি না। তাছাড়া তোমাকে মশা কামড়ালে কিন্তু আমার দোষ না!
বৃষ্টি কোন জবাব দিলো না। মশারী রেখে বললো, - খাটে শুতে পারবো কি?
- অবশ্যই। খাট শুয়ার জায়গা তাহলে কোথায় শুবে! কিন্তু বালিশটা একটু দূরে রাখো। কেউ আমার সাথে ঠেকলে নির্ঘুম রাত কাটবে আমার। এজন্য আমার বন্ধুরাও আমার সাথে কখনো রুম শেয়ার করতে চায় না।
আকাশ বালিশটা একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে অপরদিকে ঘুরে শুয়ে আছে। বৃষ্টির ভেতরটা খুব কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ হচ্ছে না। চুপচাপ খাটে উঠে একপাশে চুপটি মেরে শুয়ে পড়লো। আকাশ আবার এদিকে ঘুরে বললো, - কি ব্যাপার! ঠান্ডা লাগছে না? কম্বল নিচ্ছো না যে!
বৃষ্টি কম্বলের এক কোনা টেনে নিয়ে কোনোমতে এঁটেছে তার উপর। দুজন দু কোনায় থাকলে কি এক কম্বলে থাকা সম্ভব! বৃষ্টি অন্যপাশে ঘুরে চোখ বন্ধ করে রইলো। আকাশ এমন ব্যবহার করছে কেন ভেবে পাচ্ছে না! তার কথামতো পনেরো দিন ধরে কোনো যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেনি বৃষ্টি। এর মাঝে তো কোনো ঝামেলার রস গন্ধ পাচ্ছে না সে! তাহলে আকাশ এমন আচরণ করছে কেন! আজ প্রথম রাত এমন কাটবে সেটা ভাবতেও পারেনি বৃষ্টি! আকাশকে বুঝে উঠতে পারে না সে! কখনো ভালোবাসা দেখায় আবার কখনো অবহেলা! মানুষ তো সবার কাছে একটু ভালো ব্যবহারই প্রত্যাশা করে! সেদিন তো বিয়ে না করেই একেবারে নিজ বাসায় তুলে এনেছে আর কি প্রেম দেখিয়েছে! আবার ও বাড়িতে গিয়ে বাবা মায়ের কথা উপেক্ষা করে বিয়ে করে তারপরই এসেছে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে এসেছে। তাহলে এতো ভালোবাসা দেখিয়ে এখন অবহেলা করার মানে কি!
এতোসব ভেবে বৃষ্টি মনে মনে বললো, “কোনো প্রতিবাদ করবো না কখনো তোমার বিরুদ্ধে, আকাশ। যেভাবে রাখতে চাও সেভাবেই থাকবো আমি তোমার কাছে। চুপচাপ না হয় তোমার পাগলামোর ভালোবাসার অপেক্ষায় জীবন পাড় করে দিবো।” বন্ধ চোখের ফাক দিয়ে গড়িয়ে পড়লো বৃষ্টির দু চোখের অশ্রু!
হটাৎ কারো স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকালো বৃষ্টি! অবাক হয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলো আকাশের কোলে! আকাশ তাকে বিছানা থেকে তুলে নিয়েছে এবং মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির দিকে। বারান্দার দিকে যেতে যেতে গানের সুরে বললো,
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি তোমায় ভালোবাসি
তুমি আমার প্রানপাখি, মৃগনয়না তোমার আঁখি
তাই পলকে পলকে শুধু তোমাকেই আগলে রাখি।
তোমায় ভেবে ভেবে কেটে যায় সাজের বেলা
নীলাম্বরে জমেছে দেখো লাখো তারার মেলা!
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি তোমাকেই ভালোবাসি
ঝিকিমিকি জ্বলছে দেখো, কত শত জোনাকির আলো!
অনুরাগে অভিমানে, অশ্রুপাতে লাগে কি আর ভালো।
ভালোবাসা কি, তা যদি তুমি জানো,
অভিমান ভেঙে বলছি তো এবার শুনো!
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি
লাখো স্বপ্ন, লাখো ইচ্ছে
বুনেছি যত, সবই তোমায় ঘিরে।
ছোটবড় সব ভ্রান্তি নিয়ে
কভু হারিয়ে যাবো, আবারও আসবো ফিরে।
কারণ শুধু একটাই ওগো প্রেয়সী!
নিশিতে জাগ্রত তুমি আমার এক টুকরো শশী
প্রাণের প্রণয়ী তুমি,
আমি যে এই তোমাকেই ভালোবাসি
এটা তো সেই গান যেটা মৌলভীবাজার থাকতে একবার আকাশ গেয়েছিলো! গান গাইতে গাইতে আকাশ বারান্দায় এসে বৃষ্টিকে কোলে নিয়েই চেয়ারে বসলো। বৃষ্টি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বারান্দায় কোনো লাইট নেই কিন্তু চাদের আলো পড়ে আলোকিত হয়ে আছে। দুজন দুজনকে দেখতে পাচ্ছে। আকাশ বৃষ্টির মুখখানা ধরে কাছে এনে গাল গড়িয়ে পড়া অশ্রু ঠোঁটে শুষে নিলো।
বৃষ্টির অশ্রুধারা যেন আরও বেড়ে গেছে! অশ্রু বিন্দু আকাশ ঠোঁটে মুছে নিতে নিতে বললো,
- বলছি আজ শুনো, চোখের বৃষ্টি ঝরতে দেবো না কখনো। আর ঝরে পড়লে তা শুষে নিবো ওষ্ঠে! প্রেমের তরীতে ভেসে যাবো, যেখানে থাকবে তুমি সুখে।
মাতাল স্পর্শে কাতর হয়ে বৃষ্টি আকাশের টিশার্ট খামচে ধরে বললো, - আকাশ, আমি এক রাত কাটাতে চাই না তোমার সাথে। আমার জীবনের সব রাত প্রয়োজন তোমাকে।
আকাশ বৃষ্টির কপালে চুমু দিয়ে বললো,
” তোমার প্রতিটি রাতকে রাঙ্গিয়ে দিবো শত রঙের মিশ্রণে।
মধুমাখা রাতগুলো উপভোগ করবো দুজন একসাথে।
যা দেখে নিশি আর শশীও লজ্জায় মুখ লুকাবে।”
অত:পর বৃষ্টির নাকে ও নাকফুলে চুম্বন করে বললো,
“তোমার প্রতিটি দিন শুরু ও শেষ হবে আমার কোমল স্পর্শে।
প্রেমময় প্রহর কাটাবো দুজন একসাথে।
যা দেখে রবিসহ, প্রকৃতির হিংসে হবে!”
এবার ঠোঁটে আঙুল স্পর্শ করে বললো,
- বৃষ্টি, সেদিন বলেছিলাম তুমি আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলেছো। তোমার আর রক্ষা নেই। দীর্ঘ সময় পরের কাজ তুমি আগে করতে বাধ্য করেছো আমাকে। বিশ্বাস করবে, সেদিনের পর এক মুহুর্তও চলছিলো না আমার তোমাকে ছাড়া। অবশেষে আজ সম্ভব হলো আমার কাছে নিয়ে আসার। আজ আমার পূর্ণ অধিকার আছে তোমার উপর। তবে অধিকার দিয়ে নয়, ভালোবাসার চাদরে জড়াবো তোমার সাথে। দিবে কি আমার ভালোবাসায় একটু সাড়া?
আকাশের কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তা বৃষ্টিকে শিহরিত করে তুলেছে! এতোক্ষণ কি ভাবছিলো আর এখন কি হচ্ছে তার সাথে! সব ভুলে সে আকাশের ভালোবাসার চাদরে জড়ানোর সাড়া দিয়ে দিলো চোখ বন্ধ করে। কিন্তু আকাশের কোনো প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে না! বৃষ্টি আরেকটু এগিয়ে এলো তবুও আকাশের কোনো প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে না। এবার চোখ খুলে তাকাতেই আকাশ ডুবে গেলো তার ওষ্ঠে!
পরক্ষণে লজ্জায় তলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। আকাশের কোলে বসেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আকাশ তাকে একটু ঘুরিয়ে পেছন থেকে কাধে থুতনি রাখলো। হাত বাড়িয়ে সামনে থাকা টেবিল থেকে দিয়াশলাই নিয়ে মোমবাতি জ্বালালো। বৃষ্টি অবাক হয়ে আছে টেবিলে তাকিয়ে! টেবিলে একটা কেক রাখা আছে। তার চারপাশে চারটা মোমবাতি। সবগুলোতেই আকাশ আগুন ধরালো। কেকের ওপর লাভ শেভের মধ্যে লেখা আছে, ” Welcome in my life, Mrs Akash” আকাশ বৃষ্টিকে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে বললো,
- আমাদের বিয়ের প্রথম রাত উদযাপন করেছি আমি একা। বিয়ের প্রথম সপ্তাহও উদযাপন করেছি আমি একা। আজ বিয়ের প্রথম পক্ষ ও বাসর রাত উদযাপন করবো তোমার সাথে। পরপর মাস ও বছরগুলোও ইনশাআল্লাহ তোমার সাথেই উদযাপন করবো।
বৃষ্টির চোখে বইছে সুখের বিন্দু। ধাধালো কন্ঠে বললো, - আকাশ! বলবে একটু! আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
- স্বপ্ন নয় অপ্সরী, স্বপ্ন তো এতোদিন দেখছিলে। আজ থেকে সব বাস্তব মুহূর্ত উপভোগ করবে। রুমে এসে আমি তোমার ধৈর্যশক্তির পরিক্ষা নিচ্ছিলাম। একটা গুণ গভীরভাবে ছুয়েছে আমায়, তুমি সহজে ভেঙে পড়ার মেয়ে নও। এতোদিন গোপনে ভালোবেসেছি ওয়াইফি, আজ থেকে প্রকাশে ভালোবেসে যাবো যখন তখন! কেক কাটো।
বৃষ্টি মৃদু হেসে বললো, - এখন কেক খাবে কে?
- তুমি, আমি এবং আমরা।
- মোমবাতি নেভাতে হবে?
- না।
বৃষ্টি কেক কেটে এক টুকরো তুলে নিয়ে আকাশের মুখের কাছে ধরলো। আকাশ সেটা কামড়ে ধরে বৃষ্টির দিকে এগিয়ে এলো। বৃষ্টি বুঝতে পেরেছে এবং লজ্জাও পাচ্ছে খুব। কিন্তু লজ্জা দূরে ঠেলে মুহুর্তটা অবহেলা না করে বরং উপভোগ করলো। আকাশের কেকের অংশ থেকে কামড় দিয়ে একটু নিয়ে নিলো। বাকি কেক ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখলো। কিছুক্ষণ নিরবে দুজন পূর্ণিমা উপভোগ করলো সাথে শীতল হাওয়া। শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে দুজনেরই। পরক্ষণেই আকাশ বৃষ্টিকে কোলে নিয়ে আবার বিছানায় ফিরে এলো।
বৃষ্টিকে বসিয়ে রেখে সে ড্রয়ার থেকে একটা ওষুধের প্যাকেট নিয়ে বৃষ্টির দিকে এগিয়ে দিতে গিয়েও দিলো না। নিজেই টেবলেট বের করতে করতে বললো,
- না, তোমার কাছে দেওয়া যাবে না। সাইন্সের স্টুডেন্টরা বেশি বুঝে!
- এটা কিসের ওষুধ! আমি তো অসুস্থ না।
আকাশ কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
- এটা পূর্ব রোগ নিরাময়কারী ওষুধ। অসুস্থ হওয়ার আগেই খেতে হয়!
বৃষ্টি ব্রু কুচকে তাকাতেই আকাশ ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে পানি নিতে নিতে বললো, - রুমে প্রবেশ করার আগে আম্মু বারবার আমাকে তোমার ক্যারিয়ারের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো। কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না! তাই আগে থেকেই সাবধান।
বৃষ্টি এবার কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। আকাশ তার হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে টুল নিয়ে এলো। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলো টেবলেট হাতে রেখেই নাড়াচাড়া করছে। তাই বললো, - বৃষ্টি, এনি প্রব্লেম?
বৃষ্টি তার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না জবাব দিলো এবং ওষুধ খেয়ে নিলো। আকাশ টুলে দাড়িয়ে দেয়ালে আটকানো সেই সাদা ফ্রেমটা ধরলো। বৃষ্টি তাকিয়ে দেখছে আকাশ কি করছে। পরক্ষণেই দেখলো আকাশ সেই ফ্রেমের উপর থেকে আস্তে আস্তে টিস্যুর আবরণ তুলছে। সম্পূর্ণ আবরণ তুলে ফেলতেই বৃষ্টি চরম অবাক! এটা তো তার ছবি! ছবিটা এক সাইড থেকে তোলা, যখন সবাই রংধনুর সাথে সেলফি তুলছিলো আর ফোন না থাকায় সে পাহাড়ের উপর বসে রংধনু দেখেছিলো! আকাশ এ ছবি তুলেছে আর সে টেরই পায়নি! এবার তার কাছে পরিষ্কার, কেন সে সাদাকালো ছবি বলা সত্ত্বেও আকাশ বলেছে এখানে শত রঙের মিশ্রণ আছে! হ্যাঁ, এখানে শত রঙ ই আছে। বৃষ্টিসহ রংধনুর রং গুলো একই ফ্রেমে আবদ্ধ হয়ে আছে।
বৃষ্টিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আকাশ মুচকি হেসে এগিয়ে এলো তার পাশে। কম্বল নিতে নিতে বললো,
- দেখেছো আমার শত রঙের ফ্রেম? এর চেয়ে রঙিন কোনো দৃশ্যই হয় না।
- এটা কেন তুলেছো তুমি?
- আজকে তোমাকে দেখাবো বলে। একদা পাহাড়ে গিয়েছিলো এক কন্যা। সেদিন পেয়েছিলো দেখা রংধনুর। মুগ্ধ হয়েছে প্রবল ও ইচ্ছে ছিলো বহুগুণ! ইশ! যদি থাকতো সাথে ফোন, কতো না ছবি বাধাই করতো আজ! কিন্তু অবহেলা করেনি সে মুহুর্ত। পাহাড়ের গায়ে বসে প্রত্যক্ষ করেছে রংধনু দর্শন!
বৃষ্টি চোখ বন্ধ করে বললো, - স্বপ্নেও ভাবিনি আকাশ, আজকের দিনে আমি এতোটা সারপ্রাইজড হবো! এতো ভালোবাসা জমা আছে তোমার মাঝে, একটু পূর্বাভাস দিলে কি হতো!
- মহা প্রলয় ঘটতো। তাছাড়া আগে এমন কিছুই ছিলো না। তুমি এসে জীবন পুরোই উলটপালট করে নতুন রূপে সজ্জিত করেছো।
- ফ্রেমে সবার সাথেই তুমি আছো, তাহলে আমার সাথে এক ফ্রেমে কেন নেই?
- নিচের দিকটায় আমারদের বিয়ের ছবি টানিয়ে দিবো, কি বলো?
বৃষ্টি মুচকি হাসলো। আকাশ বৃষ্টির উপর কম্বল দিতেই বৃষ্টি বললো, - ওহ, আপনি তো আবার কারো গা ঘেঁষে ঘুমাতে পারেন না!
বৃষ্টি তার বালিশে শুতে গেলে আকাশ তার বালিশ মাঝামাঝি রেখে বৃষ্টিকে শুয়িয়ে দিয়ে বললো,
- একটাই যথেষ্ট। মিথ্যে বলেছিলাম তোমাকে। আমার কোনো এলার্জি টেলার্জি নেই। রুমে মশাও নেই। স্প্রে আগেই করা আছে। সত্যি করে বলো তো, কিছুক্ষণ আগে শুয়ে শুয়ে কি ভাবছিলে?
বৃষ্টি চুপ করে আছে। আকাশ আবার বললো, - কি হলো, বলো?
- ভাবছিলাম, তোমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তুলবো না কখনো। যেভাবে রাখতে চাও আমি সেভাবেই থাকবো তোমার কাছে।
- আমার আচরণে খুব কষ্ট পেয়েছো না?
- এখন যে তার চেয়েও শতগুণ বেশি সুখ অনুভব করছি! সইবে তো আমার কপালে?
- সবসময় এমনই থেকো, সব সয়ে যাবে।
নিমিষেই ঠান্ডায় জমে যাওয়া দেহ পাশাপাশি জড়ো হয়ে কম্বলের নিচে চলে গেলো উষ্ণ ছোয়া পেতে। অবশেষে পেয়ে গেছে আজ তাদের ভালোবাসার পূর্নতা।
পর্ব – ৫৬
বৃষ্টির বিয়ের পর বেশ কিছুদিন কাটিয়ে মেঘ নাফিসা সিলেট চলে এসেছে। মোহিনীও একবার এসেছে বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে আবার চলে গেছে। তারা এখন থেকে সিলেটই থাকবে। রায়হান চৌধুরীকেও বলেছিলো ঢাকার ব্যবসা ছেড়ে সিলেট চলে যেতে। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঢাকার ব্যবসায়ে ব্যবস্থাপক রেখে সিলেট যাবেন। মাঝে মাঝে এসে এখানে ঘুরে যাবেন। আর সেদিকে রিসোর্টের দিকটা সামলে নিবে মেঘ।
নাফিসার প্রেগ্ন্যাসির ছয় মাস চলাকালে একদিন সকালে মেঘ ভেজা গায়ে কাপতে কাপতে বাড়িতে ফিরেছে। শীতকাল ফুরিয়ে গেলেও আবহাওয়া ঠান্ডা। নাফিসা তাকে দেখে বললো,
- এ কি অবস্থা তোমার! এতো সকালে ভেজা গায়ে!
- ঝর্ণার ধারে হাটতে গিয়েছিলাম। রূপে মুগ্ধ হয়ে আর থাকতে পারলাম না! একেবারে গোসল সেড়ে এলাম।
- যখন তখন এতো শখ জাগে কেন! তারাতাড়ি বাথরুমে যাও আমি জামাকাপড় নিয়ে আসছি।
- গোসল করবে নাকি এখন?
- পাগল হইনি আমি, যে এতো সকালে গোসল করবো!
মেঘ হেসে বললো, - পাগল কেন হতে যাবে! পাগলের বউ তুমি। জামাকাপড় আমিই নিয়ে যাবো। চুপচাপ বসে থাকো এবং নড়াচড়া কম করো তুমি।
আজ বিকেলে নাফিসা খাটে বসে বই পড়ছিলো। মেঘ রুমে এসে হাত থেকে বই রেখে নাফিসাকে নামালো। নাফিসা জিজ্ঞেস করলো, - কি হয়েছে?
মেঘ তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে সেই দেয়ালের কাছে নিয়ে গেলো যেটার পর্দা সরাতে নিষেধ করেছিলো মেঘ। নাফিসা কিছু বুঝতে না পেরে মেঘের দিকে তাকাতেই মেঘ বললো,
- চোখ বন্ধ করো মেঘা।
- কেন?
- আমি বলেছি তাই।
নাফিসা চোখ বন্ধ করলো এবং মেঘ পর্দা সরিয়ে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
- হ্যাপি বার্থডে সুইটহার্ট। নাউ ওপেন ইউর আইস।
নাফিসা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো গ্লাসের বিপরীতে সবুজ অরণ্যের মধ্যে লাল চালা সমৃদ্ধ এক ঘর! যেটা গাছের উপর অবস্থিত! অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে! চমকে উঠে নাফিসা বললো, - মেঘ এটা কারা তৈরি করেছে?
- এটা কেমন কথা বললে! অন্যের জিনিস তোমাকে দেখিয়ে সারপ্রাইজ দিবো! এটা তোমার বার্থডে গিফট, এটা তোমার বাড়ি। এর কারণেই তোমাকে পর্দা সরাতে নিষেধ করেছি।
- আমি যেতে চাই সেখানে!
- অবশ্যই। চলো।
মেঘ নাফিসাকে সাথে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলো। ঘরের সামনে এসে নাফিসা চরম অবাক! তিনটা মোটা গাছ আর আলাদা খুটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মোটামুটি বড়সড় এক ঘর! সুন্দর করে কাঠের সিড়ি বাধানো। ঘরের সামনের দিকে আছে সরু রোয়াক। সিড়িতে বাশের রেলিংয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে লাল ফিতা বাধানো আর সেখানে ঝুলছে বার্থডে কার্ড। মেঘ কাচি এগিয়ে দিয়ে বললো,
- ফিতা কাটো আর তোমার ঘরে পদচিহ্ন ফেলে আমার প্রচেষ্টা সার্থক করো বেগম সাহেবা। ধরো।
নাফিসা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। মেঘ কাচি ধরতে ইশারা করলে নাফিসা কাচি নিয়ে ফিতা কাটলো। মেঘের হাত ধরে একে একে সিড়ির ধাপ অতিক্রম করে পৌছে গেলো তার স্বপ্নের ঘরে। মেঝেতে স্টিলের পাটাতন বিছানো তার উপর কাঠের আস্তরণ। টিনের লাল চালা। কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো কাচের চারি দেয়াল। চারিদিকে রোয়াক সমৃদ্ধে ঘেরা মাঝখানে একটা রুম। রুমের চারি দেয়ালে সজ্জিতভাবে বিভিন্ন ফ্রেমে বন্দী করে রাখা হয়েছে তাদের কিছু স্মৃতিচারন মুহূর্ত। সুর্যাস্ত, সূর্যোদয়, সাজেকের মেঘ ছোয়া, ঝর্ণার ধারে হাটা, চা বাগানে কাটানো সময়, গায়ে জ্যোৎস্না মাখানো ও সবুজ পাহাড়ের বুকে আঁচল ছড়িয়ে বসে থাকা। ছোট ছোট তারা আটকে রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ দেয়াল জুড়ে আর ঘরের মাঝামাঝিতে ছোট একটা বিছানা। সবশেষে দৃষ্টি সরিয়ে মেঘের দিকে তাকাতেই দেখলো মেঘ মুচকি হেসে দাড়িয়ে আছে। প্রতুত্তরে সে ও মুচকি হেসে মেঘের কাছে এসে বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। মেঘ তাকে আঁকড়ে ধরে বললো, - কেমন লাগলো সারপ্রাইজটা?
- এটা তো সারপ্রাইজ ছিলো না! এটা স্বপ্ন ছিলো। আমার স্বপ্নের রাজা তুমি। এটা আমাদের রাজ্য। আর আল্লাহর রহমতে সেখানে অতি শীঘ্রই আসতে চলেছে রাজকন্যা বা রাজপুত্র।
- ওগো মোর রাজরানী, বলো তো এখন। এক কাপ চা হলে কেমন হয় এই রোমাঞ্চকর বিকেলে?
- মন্দ হয় না রাজামশাই।
- আজ কিন্তু আমরা এখানে রাত কাটাবো। থাকো তুমি এখানে, আসছি আমি।
- কোথায় যাচ্ছো?
- চা নিয়ে আসি।
মেঘ চা নিয়ে এলে দুজন রোয়াকে বসে গল্প করতে করতে চায়ের মাধুর্য উপভোগ করলো। সন্ধ্যায় আম্মির কাছে বলে মেঘ খাবার ও কম্বল নিয়ে এলো তাদের স্বপ্নের বাড়িতে রাত কাটানোর জন্য। ঘুমানোর সময় বিছানায় এলে মেঘ নাফিসার হাতে একটা প্যাকেট দিলো। - এটা কি?
- খুলে দেখো।
নাফিসা প্যাকেট খুলে দেখলো একটা কাচের বোয়াম এবং এর মধ্যে মিটিমিটি জ্বলছে জোনাকি পোকা! নাফিসা অবাক হয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
- এগুলো কোথায় পেলে!
- চা বাগানের পাশ থেকে দুজন ছেলেকে পারিশ্রমিক দিয়ে ধরিয়েছি।
- ছেড়ে দেই?
- এক মিনিট অপেক্ষা করো।
মেঘ সবগুলো পর্দা টেনে দিয়ে লাইট অফ করে দিলো। সাথে সাথে দেয়ালে আটকানো তারাগুলো জ্বলে উঠেছে! এগুলো তাহলে সেই জিনিস যেগুলো অন্ধকারে জ্বলে থাকে! মেঘ পাশে এসে বললো, - এবার ছেড়ে দাও।
নাফিসা বোয়াম খুলে জোনাকি পোকাদের উন্মুক্ত করে দিলো। সাথে সাথে জোনাকি পোকা ঘরের এদিকসেদিক ছড়িয়ে পড়েছে! সারাঘরে আলোতে ঝিকিমিকি করছে! মেঘের বুকে মাথা রেখে নাফিসা কৃত্রিম তারকা ও জোনাকি পোকার খেলা দেখতে লাগলো। এ যে স্বর্গীয় সুখ এনে দিয়েছে মেঘ তার জীবনে! সে কি এতো সুখের প্রাপ্য ছিল! একফোঁটা দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে মেঘের বুকে! - মেঘা?
- হুম?
- কাদছো কেন তুমি?
- বিনা স্বার্থে এতো সুখ দিয়ে যাচ্ছো কেন তুমি? বিনিময়ে আমার কাছ থেকে কি পেয়েছো?
- তোমার ভালোবাসা।
- ভালোবাসতেও তো পারিনা ঠিকমতো।
- পারো তো। এই যে এখনো ভালোবাসছো আমাকে।
নাফিসা বুকের উপর থেকে মাথা উঠিয়ে মেঘের মুখোমুখি বালিশে এলো। ঘরে ছড়িয়ে পড়া অল্প আলোতেই নিষ্পলক তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। মেঘ বললো, - কি দেখো?
- বাচ্চাদের বাবাকে দেখি।
- কেন?
- যাতে বাচ্চাগুলো পুরোই তাদের বাবার মতো হয়।
- এটা কি সত্যি? যাকে বেশি দেখবে তার মতো হবে?
- শুনেছি হয় অনেকটা।
মেঘ তড়িঘড়ি করে ফোন বের করে নাফিসার ছবি এনে তার সামনে ধরে বললো, - তাহলে এটা দেখো, যাতে বাচ্চারা তোমার মতো হয়।
- মেঘ!
- মেঘা আমি কিন্তু সিরিয়াস।
- আমিও সিরিয়াস! ফোন সরাও!
নাফিসা ফোন নিয়ে অন্যপাশে রেখে দিলো আর মেঘকে দেখতে লাগলো কৃত্রিম তারকা ও জোনাকির আলোতে। মেঘও দেখছে তার মেঘাকে।
মোটামুটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আজ নাফিসার প্রসব ব্যাথা উঠেছে। মোহিনী ও রোকসানা বাসায়ই ছিলো। মেঘ একটু কাজে বেরিয়েছে আর রায়হান চৌধুরী ঢাকা। মোহিনী মেঘকে কল করে বললে মেঘ কাজ রেখেই গাড়ি নিয়ে চলে এলো এবং নাফিসাকে হসপিটালে নিয়ে গেলো। নাফিসা এখন অপারেশন থিয়েটারে। সবাই খুব চিন্তিত! মেঘের খুব ভয় করছে। সব ভয়ার্ত মুহুর্তগুলো এখন তার চোখের সামনে ভাসছে। মোহিনী রায়হান চৌধুরী ও বৃষ্টিকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে নাফিসাকে হসপিটালে আনা হয়েছে। সবাই থিয়েটারের বাইরে বসে আল্লাহকে স্মরণ করছে। সুস্থসবল দেহ ফিরে আসার জন্য প্রার্থনা করছে।
কিছুক্ষণ পর অপারেশন শেষ করে হাসিমুখে ডাক্তার বেরিয়ে এলো। সুসংবাদ জানালো তাদের কন্যা সন্তান হয়েছে এবং মা মেয়ে দুজনেই সুস্থ আছে। উপস্থিত সবার মুখেই ভুবনজয়ী হাসি। সবাই মহান আল্লাহ তায়ালার সুক্রিয়া জানালো মনে মনে। নাফিসাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হলে তারা মা ও বাচ্চাকে দেখতে পেল। দাদু নানু মহাখুশি তাদের নাতনীকে নিয়ে। নাফিসার জ্ঞান ফিরেনি এখনো। মেঘ তার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আলতো স্পর্শ দিলো।
পরক্ষণে নাফিসার পাশে বসে তার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো।
মোহিনী বাচ্চাকে এনে মেঘের কোলে দিলো। মেঘ ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো তার কন্যার দিকে। যেন আকাশের চাঁদ নেমে এসে পুর্নিমা ছড়িয়েছে তার কোলে! আল্লাহর রহমতে মা-বাবার মিশ্রিত রুপে জন্ম নিয়েছে তাদের কন্যা! ভেসে আসছে মেঘের কানে সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার মধুমাখা ধ্বনি! আর এদিকে তার মা শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর নাফিসার জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলেই মেঘকে তার পাশে বসা দেখতে পেল। চোখ খুলে তাকাতে দেখে মেঘের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে জিজ্ঞেস করলো এখন কেমন লাগছে। নাফিসা চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো ভালো। বাচ্চা রোকসানার কাছে ছিলো। নাফিসার জ্ঞান ফিরতে দেখে তিনি বাচ্চাকে মেঘের কোলে দিয়ে নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে এককোণে চুমু দিয়ে গেলেন। মোহিনী রায়হান চৌধুরী ও বৃষ্টির কল রিসিভ করতে করতে ক্লান্ত! মেঘ বললো,
- মেঘা দেখো, আমাদের কোলে প্রথম রাজকন্যা এসেছে। আমি কত ভাগ্যবান ভাবতে পারছো তুমি! বাবুর দৈহিক গঠন তোমার আমার সংমিশ্রণ!
নাফিসার চোখের কোনা গড়িয়ে পানি পড়ছে। একবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে আবার মেঘের দিকে তাকিয়ে সন্তানকে কোলে নিয়ে একজন বাবার অনুভূতি উপলব্ধি করছে ও ভুবন জয়ী আনন্দ দেখছে। আজ প্রথম মেঘকে একটা উপহার দিতে পেরেছে নাফিসা। সেই ভেবে মনে খুব শান্তি লাগছে।
নাফিসার জ্ঞান ফেরার খবর শুনে মোহিনী দ্রুত পায়ে কেবিনে এলো। নাফিসার কপালে চুমু দিয়ে বললো, - অবশেষে আমার সময় কাটানোর উপায় এনে দিলি আজ! কেমন লাগছে এখন, মা?
- ভালো, মা।
রোকসানা কেবিনে এলে মোহিনী বললো,
- আপা, এখন কিন্তু আরও বেশি ঝগড়া হবে বলে দিলাম! নাতনি কিন্তু আগে দাদু ডাকই শিখবে।
- আচ্ছা! আমিও প্রস্তুত। দেখা যাবে দাদু ডাক শেখে নাকি নানু!
সবার মুখেই মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। ডাক্তার এসে নাফিসাকে দেখে গেলো তাছাড়া নার্স একটু পর পর আসছে আর খেয়াল রাখছে মা ও বাচ্চার।
সন্ধ্যায় রায়হান চৌধুরী, বৃষ্টি ও আকাশ এসে হাজির। এক এক জন বাচ্চাকে নিয়ে মহাখুশি। বৃষ্টি, মেঘ আর তাদের বাবার তো সারাজীবনই কিছু না কিছু নিয়ে ঝগড়া বেধে যায়। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। বাচ্চাকে নিয়ে সে কি হৈ-হুল্লোড়! তারা যে হসপিটাল আছে সেই খেয়ালই নেই তাদের! মোহিনী রেগে ধমকে তাদের থামিয়েছে। রাতে মেঘ ও রোকসানা থাকলো হসপিটালে। বাকিদের বাসায় পাঠায় দিয়েছে মেঘ।
সকালে ডাক্তার নাফিসার চেকাপ করছে আর মেঘ ও রোকসানা কেবিনের বাইরে বসে ছিলো। কারো ফোন আসতেই মেঘ হসপিটালের বাইরে গেলো। একটু পর আবার ফিরে এলো। মেঘ একা আসেনি। মেঘের সাথে এসেছে সৈকত মির্জা ও মারিশা সাথে আরেকটি ছেলে। রোকসানা সৈকত মির্জাকে দেখে চমকে উঠে দাড়ালো! এতো বছর পর তার সাথে দেখা যাকে জীবনে আর কখনো দেখতে চায়নি! যার কারনে সে সিলেটের এই গন্ডি থেকে কখনো বের হয়নি! আজ একদম তার সামনে দাড়িয়ে সে! রোকসানা আঁচলে মুখ ঢেকে অন্যদিকে ঘুরে দাড়িয়ে রইলো। এ কোন পরিস্থিতিতে পড়লো সে! চাইলেও এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারছে না। তার মেয়ে যে এখানে! সৈকত মির্জা এগিয়ে এসে তার কাছে দাড়ালো।
- রোকসানা! একবার ঘুরে দাড়াও। আমি জানি, অনেক বড় অপরাধ করেছি আমি। তোমাদের না জানিয়ে অনেক বড় অপরাধ করেছি। একবার শোনো আমার কথা!
রোকসানা বিপরীতমুখী হয়ে মুখ চেপে রেখেছে। এ যে তার জীবনের অপ্রত্যাশিত দিন! সৈকত মির্জা কোনো সুযোগ পেলো না রোকসানার কাছে, তবুও তিনি স্বচ্ছায় সুযোগ করে নিলেন। কেননা তাকে জানাতে হবে! তাই রোকসানা শুনতে রাজি না হলেও তিনি বলতে লাগলেন, - বিশ্বাস করো, বাধ্য হয়েছি তোমাকে বিয়ে করতে। অনন্যার সাথে আমার সংসার থাকতেও আমি তোমাকে নিয়ে সংসার বেধেছিলাম। কারণ ছিলো তার পেছনে। অনন্যা প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম ছিলো। একাধিক সন্তানের আশায় বিয়ে করেছিলাম তোমাকে, মিথ্যে বলেছিলাম দিনের পর দিন। বিশেষ করে বংশের প্রদীপ হিসেবে ছেলে সন্তান প্রত্যাশিত ছিলাম। তোমার জীবন নষ্ট করতে চাইনি। ছেলে সন্তান জন্মের পর তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতাম। যাতে বাবা মা সাদরে গ্রহণ করে তোমাকে। কিন্তু আমাদের ঘরে আবার আসে মেয়ে। আমার মেয়েও পছন্দ কিন্তু আমার মায়ের প্রত্যাশা ছিলো ছেলের। মা যদি তখন তোমাকে গ্রহণ না করে সেই ভয়ে নিয়ে যাইনি বাড়িতে।
এক্সিডেন্টের কারণে তোমাদের কাছে যেতে পারিনি। সেদিন তুমি আমার বাসায় যাওয়ার পর অনন্যা আমাকে তোমার বর্ননা দিতেই বুঝতে পেরেছি তুমি গিয়েছিলে। অসুস্থ শরীর নিয়েই তোমাদের কাছে যাই কিন্তু তোমাদের পাই না! অনেক খুজেছি তোমাকে। বুঝতে পেরেছি তুমি জেনে অনেক কষ্ট পেয়েছো। পরবর্তীতে অনন্যাকে জানিয়ে দেই তোমাদের কথা। সে নিজে কষ্ট না পেয়ে তোমার কষ্টে সমবেদনা জানায় এবং নিজেও খুজতে শুরু করে। অনেক খুজ নিয়েছি কিন্তু পেলাম না আর।
তার দু বছর পরই অনন্যা মারা যায়। আমার বড় মেয়েটাকে একাই লালন করি। প্রত্যেকটা মুহুর্ত তোমাদের মনে করতাম। কোথায় আছো কিভাবে আছো সেসব ভাবতাম। জীবন ফুরিয়ে আসার আগে যেন একবারের জন্য হলেও তোমাদের দেখা পাই আল্লাহর কাছে সেই প্রার্থনাই করেছি। পাপী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে। ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দিয়েছে আমাকে। ফিরিয়ে যে নিতে পারবো না সেটা জেনেও এসেছি ক্ষমা চাইতে। রোকসানা একবার ফিরে তাকাও।
রোকসানা ওদিকে ঘুরেই দাড়িয়ে আছে। মুখে আঁচল চেপে রেখে কান্না করছে। সৈকত মির্জা নিজেই ওদিকে এসে তার সামনে দাড়ালো। হাত জোড়া এক করে বললো,
- একবার ক্ষমা করে দাও আমাকে। একবার ক্ষমা করো। না হলে যে মরেও শান্তি পাবো না! সবটা জেনে আমার বড় মেয়েও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এই পৃথিবীতে আমি আজ সবচেয়ে বড় অসহায়। অনেক বড় অন্যায় করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, আমার দুই মেয়েকে কষ্ট দিয়েছি। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্যই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে এখনো বাচিয়ে রেখেছেন। তোমরা ক্ষমা না করলে যে আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করবে না কখনো! এই অসহায়কে ভিক্ষা স্বরূপ ক্ষমা দান করো রোকসানা।
সৈকত মির্জা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে! রোকসানা আর উপেক্ষা করতে পারলো না। কেন জানি অভিমানটার চেয়ে লোকটার আকুতিটাই হৃদয় গহীনে হানা দিয়েছে! অভিমান ভুলে যায়নি তবে উপেক্ষাটা হার মেনেছে! এতো বছর মানুষটাকে ছাড়া কাটাতে পারলেও আজ সামনে দাড়াতে দেখে আর পালিয়ে যেতে পারলো না! এটাই হয়তো প্রকৃত ভালোবাসার ক্ষমতা! সেও চাপা কান্নার সাথে সৈকত মির্জার দু’হাত ধরে বললো, - এ কি করছেন আপনি! আল্লাহর দোহাই, এসব করবেন না কখনো!
- ক্ষমা করো আগে, তা না হলে আরও বেশি কিছু হবে।
- ক্ষমা চাইছেন নাকি ধমকি দিচ্ছেন?
- না, ক্ষমা চাই।
- হাত নামিয়ে রাখুন।
- আগে বলো।
- বাচ্চাদের মতো জেদ করছেন কেন! ছেলেমেয়ে দাড়িয়ে আছে সামনে। লজ্জা নেই নাকি!
সৈকত মির্জা মাথা নাড়িয়ে না জবাব দিলো। কান্নার মাঝেও রোকসানার মুখের এক কোনে হাসি ফুটে উঠেছে। সে বললো,
- মেয়ের অভিমান ভাঙ্গাতে পারলেই ক্ষমা পাবেন। তার আগে না।
রোকসানার ইতিবাচক মনোভাব বুঝতে পেরে সৈকত মির্জা বললো, - কোথায় আমার মেয়ে?
- হসপিটালে কেন এসেছেন?
- অহ, আমার মেয়ে আর নাতনিকেই তো দেখতে এসেছি! এই কেবিনে নাকি?
- হ্যাঁ।
মির্জা সাহেব চোখ মুছে বললো, - এখন কি যাওয়া যাবে না ভেতরে?
- না। অপেক্ষা করুন।
রোকসানা নিজের চোখ মুছে দেখলো তারা দুজন বাদে বাকি তিনজনের মুখেও লেগে আছে মৃদু হাসি। মারিশার মুখে হাসির সাথে চোখে পানিও। রোকসানাকে তাকাতে দেখেই মারিশা বললো, - প্রায় দশ বছর আগে নিজের মাকে হারিয়েছি। এখন কি নতুন করে আপনাকে মা ডাকার সুযোগ পাবো?
মারিশার মুখে অনেক মায়া কাজ করছে। রোকসানা ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো, - স্কুল পড়ুয়া ড্রেসে দেখেছিলাম যে সেই ছোট্ট মেয়েটা না?
মারিশা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জবাব দিলো। রোকসানা মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, - আম্মি ডাক।
- আম্মি!
মারিশা এগিয়ে এসে রোকসানাকে জড়িয়ে ধরে নিশব্দে কান্না করতে লাগলো। রোকসানার চোখেও বইছে অশ্রুধারা। এটা যে সুখের অশ্রু তা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। এমন সময় আকাশ, বৃষ্টি ও তার মা বাবা এসে গেছে হসপিটাল। তারা নাস্তা করে মেঘ ও রোকসানার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। কিন্তু মারিশা আর রোকসানার এমন ভাব দেখে সবাই হতবাক! সবারই প্রশ্ন তারা কি পূর্বপরিচিত নাকি!
মোহিনী মেঘকে ইশারা করতেই মেঘ বললো,
- মা, আংকেল নাফিসার জন্মদাতা পিতা।
- মানে! নাফিসা যে বললো তার বাবা নেই!
- নেই মানে তাদের কাছে নেই। অভিমান নিয়ে তারা দূরে সরে গেছে।
রায়হান চৌধুরী বললো, - বন্ধু, অবশেষে পেয়ে গেছো তাহলে! অনেক তো খুজেছিলে কিন্তু আজ কিভাবে সম্ভব হলো!
- সবই মেঘের জন্য। মারিশা জেনেছে মেঘের কাছে আর আমি জেনেছি মারিশার কাছে।
বৃষ্টি আকাশ ও মোহিনী কেউই বুঝতে পারছে না তাদের কথাবার্তা। এদিকে ডাক্তার বেরিয়ে এসেছে কেবিন থেকে। মোহিনী পরিষ্কার জানতে চাইলে মেঘ বললো, - বিস্তারিত পরে জেনো। আংকেল, চলুন নাফিসার সাথে দেখা করতে পারবেন।
পর্ব – ৫৭
সবাই কেবিনের ভেতরে এলো। নাফিসাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে সিটে। প্রথমেই মেঘ প্রবেশ করলো তার পিছু সৈকত মির্জাকে প্রবেশ করতে দেখে নাফিসা চমকে উঠলো! পরক্ষণে দেখলো তার আম্মি ও মারিশাসহ সবাই প্রবেশ করেছে। সৈকত মির্জা জিজ্ঞেস করলো,
- কেমন আছো আব্বু?
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না শুধু মেঘ, মারিশা, মির্জা সাহেব ও তার আম্মির দিকে তাকাচ্ছে বারবার! আম্মিকে কেমন যেন চিন্তিত লাগছে! এই লোকটা এখানে এসেছে কেন! মেঘ! মেঘ কি জানিয়ে দিয়েছে সবটা! সৈকত মির্জা আবারও বললো,
- রাগ করে আছো আব্বুর সাথে! তোমার আম্মির কাছে ক্ষমা চেয়েছি তো। তোমার আম্মি বলেছে তোমার অভিমান কাটাতে পারলেই ক্ষমা করবে আমাকে। তুমি কি ক্ষমা করবে না আমাকে? জানিতো আমি, বাবা হিসেবে একদমই ভালো না। সেদিন চোখের সামনে দেখেও চিনতে পারিনি মেয়েকে!
নাফিসা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। এই লোকটাকে অসহ্য লাগছে তার কাছে! নাফিসার এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মেঘের একটুও পছন্দ হয়নি। এভাবে বড়দের অসম্মান করা হয়! অবশ্য তার কষ্টটা বুঝেই মেঘ চুপ করে আছে। মির্জা সাহেব বুঝতে পারছে মেয়ে তার কথা শুনতে চাচ্ছে না। তার প্রতি টান থাকলে প্রথম দেখার পরই পরিচয় দিয়ে দিতো। অবশ্য সে এটারই প্রাপ্য ছিলো। মোহিনী নার্সের কাছ থেকে বাচ্চাকে নিয়েছে। সৈকত মির্জার কাছে এসে বললো,
- ভাই সাহেব, এই যে আপনার নাতনী।
“মাশাল্লাহ” বলে মির্জা সাহেব হাত বাড়াতেই নাফিসা দাতে দাত চেপে বললো, - মেঘ, ওই লোকটা কোলে নিলে আমি আমার মেয়েকে ছুয়েও দেখবো না!
- মেঘা! এসব কি বলছো তুমি! আংকেল অনুতপ্ত উনার কর্মের জন্য।
- মেঘ প্লিজ!
সবাই হতম্বর নাফিসার কথায়। রোকসানা যা নিয়ে চিন্তিত ছিলো সেটাই ঘটলো। নাফিসা মানবে না তার বাবাকে। মির্জা সাহেব আর বাচ্চাকে কোলে নিলো না। মোহিনীকে উদ্দেশ্য করে বললো, - থাকুক ভাবি। দূর থেকেই দোয়া করি।
মির্জা সাহেব নাফিসার পায়ের কাছে এসে বসে নাফিসার পা স্পর্শ করতেই নাফিসা পা সরিয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু পা ব্যাথার কারণে পারলো না। মির্জা সাহেব মেয়ের পায়ে হাত বুলিয়ে বললো, - পাপ তো করেছিই। আল্লাহও নারাজ আমার উপর। পারলে এই হতভাগা বাপকে মাফ করে দিস মা। যদি মৃত্যুর পরে একটু শান্তি পাই তাতে। অবশেষে ক্ষমা তো চেয়ে যেতে পারলাম, এটাই আমার পরম সৌভাগ্য। না হয় আফসোস থেকে যেতো।
নাফিসার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। চোখ মুখ খিচে রেখে বেডশিট আঁকড়ে ধরেছে সে! পা টাকেও সরিয়ে আনার জন্য ছটফট করছে! মেঘ তার অবস্থা দেখে কাছে এসে দাড়াতেই নাফিসা মেঘকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। কাদতে কাদতে বললো,
- মেঘ আর পারছি না আমি! চলে যেতে বলো। সহ্য করতে পারছি না! চলে যেতে বলো ওদের! মরে যাবো আমি!
নার্স বলছে, “হচ্ছে কি এসব! সিজারিয়ান রোগীর সমস্যা হবে এভাবে!”
মেঘ বললো, - আংকেল, নাফিসা অসুস্থ!
সৈকত মির্জা চোখ মুছে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
- ভালো থেকো। আমার মেয়েটাকে ভালো রেখো মেঘ! অনেক কষ্ট করেছে, আর কষ্ট পেতে দিও না! রোকসানা, ক্ষমা করো না আমাকে। একটু দোয়া করো যেন তারাতাড়ি পরকালে গমন করি। মারিশা, তোমার বোন ছোট থেকেই অনেক অভিমানী। ভুল বুঝো না তাকে। কখনো বাবার কথা মনে হলে চলে এসো দেখা করতে। কাউকেই জোর করবো না কোনোকিছুতে। আমার জন্যই আজ তোমরা সবাই এলোমেলো!
অন্য কেউ আর সুযোগই পেলো না কিছু বলার। রায়হান চৌধুরী বেরিয়ে গেলো মির্জা সাহেবকে থামানোর জন্য। রোকসানা বেরিয়ে গেলো নিরবে কান্না করতে করতে। মারিশা সহ একে একে সবাই বেরিয়ে গেলো। কেবিনে আছে শুধু মেঘ, বৃষ্টি আর মোহিনী। মেঘের যাওয়াটা জরুরি ছিলো কিন্তু নাফিসার জন্য পারছে না! কে জানে রায়হান চৌধুরী থামাতে পেরেছে কিনা! পরিবেশটা খুব নিরব, শুধু নাফিসার হুহু কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। মেঘ নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে থামানোর চেষ্টা করছে,
- মেঘা, প্লিজ চুপ করো। প্রব্লেম হবে তোমার। এভাবে কান্না করছো কেন! আংকেল চলে গেছেন, সোজা হও তুমি। কান্না থামাও। মেঘা, সবাই চলে গেছে। শান্ত হও। মেঘা!
মেঘ থামতে বলছে, বৃষ্টি ও মোহিনীও থামানোর চেষ্টা করছে। নাফিসা থামছে না। অবশেষে মেঘ রেগে গিয়ে এক ধমক দিলো এবং এক ঝটকায় ছুটিয়ে নিলো। - এতো জেদ কেন তোমার! যা চাইছো তাই হচ্ছে! কোনো বাবা এসে মেয়ের পা পর্যন্ত স্পর্শ করে ক্ষমা চেয়েছে! সম্মান তো পেলোই না তোমার কাছে! এখন কাদছো কেন? নিজের সাথে কি বাচ্চার ও আমার সর্বনাশও করতে চাইছো!
মেঘ ছেড়ে দেওয়াতে নাফিসা দু’হাতে মুখ লুকিয়ে কাদছে। বৃষ্টি এসে অন্যপাশে বসলো এবং নাফিসাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো। নাফিসা হাত সরিয়ে এবার পেটে ধরেছে। কান্না থামানোর চেষ্টা করছে নিজেই কিন্তু পারছে না। সে যে পেটে চেপে ধরেছে মেঘের চোখে এড়ায়নি সেটা। মেঘ দ্রুত নাফিসার পাশে বসে পড়লো। নফিসার হাতের উপর হাত রেখেই বললো,
- কি হয়েছে? পেটে ব্যাথা লাগছে না এখন! নার্স, প্লিজ কল ডক্টর!
নার্স দ্রুত বেরিয়ে গেলো। মেঘের মেজাজ প্রচুর খারাপ হচ্ছে তবুও রাগ দেখাতে পারছে না। ডাক্তার এসে চেকাপ করলো, তাকে কোনো রকম চাপ নিতে নিষেধ করলো। বিশ্রাম নিতে বললো। চিন্তিত হয়ে মেঘ কিছুক্ষণ পাশে বসে রইলো। পরক্ষণে মোহিনী তাকে বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে বললো। বৃষ্টি আর মোহিনী আছে পাশে। মেঘ রোকসানাকে সাথে নিয়ে বাসায় ফিরলো। খেয়েদেয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার এসেছে। নাফিসা বসে আছে, পাশে বসে আছে বৃষ্টি। মেঘকে দেখে বৃষ্টি বেরিয়ে গেলো। মেঘ এসে নাফিসার পাশে বসলে নাফিসা ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো, - নিষেধ করেছিলাম না কাউকে কিছু জানাতে!
- জানানোটা প্রয়োজন ছিলো বিধায় জানিয়েছি।
- আমাকে আর আম্মিকে অশান্তির মাঝে ফেলার জন্য কি খুব প্রয়োজন ছিলো তোমার!
- কথা আস্তে বলো এবং শান্ত হয়ে বলো। প্রব্লেম হবে তোমার। আমি অশান্তি আনার জন্য বলিনি, বরং শান্তি আনার জন্য বলেছি।
- কোনো প্রয়োজন ছিলো না অতিরিক্ত শান্তির। ভালো কাটছিলো দিন, খুব সুখে ছিলাম এতোদিন।
- না জানালে এই সুখটুকুও পেতে না তুমি।
- মানে!
- এটা নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে, মারিশা উঠেপড়ে লেগেছিলো আমাকে পাওয়ার জন্য! সে যেকোনো মুল্যে তোমার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিতো। বুঝিয়েছিলাম তাকে, কিন্তু কাজ হয়নি! শেষ মুহুর্তে জানিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি তুমি ওর বোন।
আর তখনই থেমেছে সে। না হলে সর্বনাশ করে দিতো তোমার জীবন আর তার জন্য তুমি দোষারোপ করতে আমাকে। তুমি ওর বোন সেটা জানার পর থেকেই সে তোমার সাথে ভালো আচরণ করতে শুরু করেছে। কেননা, পরিবারকে খুব ভালোবাসে সে। এক সে আর তার বাবা ছাড়া কেউই নেই তার পরিবারে। মাঝে মাঝে আসতে চাইতো তোমার সাথে একটু দেখা করার জন্য, কিন্তু নিজেই আটকে রাখতো নিজেকে। কারণ সে জানতো তুমি তাকে তোমার কাছে আসতে দেখলে সন্দেহ করবে আর আমাকে হারানোর ভয় পাবে। তাই আসেনি। বাদ দাও। যা করার তা তো করেছোই তুমি! এবার নিশ্চয়ই খুব ভালো আছো। বিশ্রাম নাও। আর প্রেশার দূর করো।
- কাল থেকে এখানে পড়ে আছো। তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। অসুস্থ হয়ে পড়বে এভাবে!
- আমার কিছু হবে না। তোমরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি।
- আম্মি কোথায়?
- বাসায় রেখে এসেছি, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য।
- তুমিও যাও। এখন ঘুমাবে একেবারে সন্ধ্যায় উঠবে। যাও।
- উহুম। ঘুম আসবে না। দেহ গেলেই কি, মন এখানেই পড়ে থাকবে।
- এদিকে চেপে হেলান দাও।
- না, কাজ আছে।
- এটাও কাজই, বাকি কাজ পরে করো। এসো এদিকে।
মেঘ নাফিসার কথামতো নাফিসার দিকে একটু চেপে বসেছে। নাফিসা চোখ বন্ধ করে থাকতে বললো। দু মিনিট পরেই বাচ্চার ঘুম ভেঙে গেলো। সাথে সাথেই মেঘ কোলে নিয়ে বসলো। নাফিসা বললো, - চোখ বন্ধ করোনি তুমি!
মেঘ প্রতুত্তরে মুচকি হাসি দিয়ে বাচ্চার সাথে কথা বলতে লাগলো। নাফিসা বললো,
- আরেকটু পরে জাগলে কি হতো! বাবাকে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় দেওয়া যেতো না, পচা মেয়ে!
- এতেই যে তার বাবার সুখ সেটা জানে সে।
পাচদিনের মাথায় বিকেলের দিকে নাফিসাকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। বৃষ্টি ও আকাশ এখানেই আছে। রোকসানা ও মোহিনী নাতনীর যত্ন ভালো ভাবেই নিচ্ছে।
আজ মেঘ ধীর্ঘ সময় নিয়ে ঘুমিয়েছে। সকালে নাস্তার পর যে ঘুমিয়েছে, জেগেছে দুপুরের শেষ দিকে। খাওয়ার পর মেঘ রুমে এলে বৃষ্টি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। নাফিসা খেয়াল করলো এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে, তার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে। এই ক’দিন একটুও শান্তি দেয়নি তারা মা মেয়ে। নাফিসা ভেবেই মৃদু হাসলো। মেঘ নাফিসার মুখে হাসি দেখে কাছে এসে বললো,
- এতো হাসির কারণ কি?
- তুমি।
- কেন, পোশাক আশাকে ত্রুটি আছে নাকি কোনো দিক থেকে!
- ক্লান্তিতে ত্রুটি আছে।
- সেটা কেমন?
- গত কয়েকদিনের মধ্যে আজ ফ্রেশ লাগছে তোমাকে।
- তুমি কি ফ্রেশ আছো?
- হুম।
- তাহলে কিছু কথা বলি। মনযোগ দিয়ে ধৈর্যসহকারে শুনবে একটু?
- কি কথা?
- আগেই বলে নেই, মানো আর না মানো। শুনতে তো আর ক্ষতি নেই। ঠান্ডা মাথায় একটু শোনো।
- বলো।
- জীবনে প্রথম দেখা কোনো স্বামী তার স্ত্রীর কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চায়! জীবনে প্রথম দেখা কোনো বাবা তার মেয়ের পা ধরে ক্ষমা চায়! মানুষ তো সবাই ভুল করে। হয়তো কারো ভুলের পরিধি বড় আর কারোটা ছোট। কিন্তু বিনিময়ে শাস্তি পায় উল্টো।
- মেঘ প্লিজ, প্রসঙ্গ পাল্টাও। এসব নিয়ে আমি কিছু শুনতে চাই না।
- মেঘা, আগেই বলেছি ধৈর্য ধারণ করে শুনো একটু। আংকেল ভুল করেছে আর সেজন্য তিনি অনুতপ্ত। কিন্তু আমার মতে তিনি কোনো ভুল করেননি। আমাকে ভুল বুঝো না, আমি কিন্তু কারো পক্ষ নিচ্ছিনা। শুধু তোমাকে জানাতে চাইছি যেটা তোমার অজানা। আংকেল প্রথম স্ত্রী রেখে আম্মিকে বিয়ে করেছে সন্তানের আশায়। কেননা উনার প্রথম স্ত্রী দ্বিতীয়বার সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম ছিলো। প্রথম সন্তান তাও আবার কন্যা সন্তান। এতে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন না কিন্তু বংশের প্রদীপ হিসেবে ছেলে সন্তান প্রত্যাশিত ছিলো উনার এবং উনার পরিবারের। সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম সেটা কাউকে জানতে দেয়নি তারা দুজন। তাহলে হয়তো প্রথম স্ত্রীকে তাড়িয়েও দিতে পারতো উনার বাবা মা। সেদিকে আশ্বাস দিয়েছে মারিশার মাকে কিন্তু বাকিরা কষ্ট পাবে বলে কাউকে না জানিয়েই দ্বিতীয়বার বিয়ে করে। ভেবেছিলেন পুত্র সন্তানের জন্ম হলে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে বাড়িতে উঠবেন। কিন্তু এ সংসারেও জন্ম হয় কন্যা সন্তান। তিনি বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আর সাহস পায়নি তোমাদের। কেননা তার পরিবার যদি তোমাদের গ্রহণ না করে! পড়ে যান দোটানায় এবং পুত্র সন্তান জন্মের অপেক্ষায় থাকেন। এখানে উনার কি দোষ থাকতে পারে বলো। সবাই তো একাধিক সন্তানের প্রত্যাশা করে। আমাদের এক মেয়ে আছে, তুমি কি চাইবে না আরেক ছেলে আসুক? তাহলে উনার ইচ্ছায় দোষ কি ছিলো!
- উনি আম্মিকে ধোকা দিয়েছে, মিথ্যে বলেছে দিনের পর দিন।
- বললামই তো, দোটানায় পড়ে ঘটেছে সবটা। সব ঘটনা শুনে আম্মিও তো উনাকে ক্ষমা করে দিয়েছে তাহলে তুমি কেন পারছো না!
- আম্মি কখনোই ক্ষমা করবে না।
- করেছে মেঘা। আম্মি সেদিন বলেছে তোমার অভিমান ভাঙ্গাতে পারলেই ক্ষমা হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি তো সেই সুযোগই দিলে না!
- মেঘ, কি করে দেই আমি সেই সুযোগ! আমি নিজ চোখে দেখেছি আম্মি দিনের পর দিন কেদেছে ওই লোকটার জন্য। কতটা কষ্ট করে আজও বেচে আছে সেটা আমি দেখেছি মেঘ! যেই বয়সটা বাচ্চারা বাবার সাথে দুষ্টুমি করে হেসে খেলে কাটায় সেই বয়সটা আমি নিজের ও আম্মির চোখের জল মুছে কাটিয়েছি। চোখের সামনে দেখেছি কঠিন বাস্তব। সারাদিন পরিশ্রম করে দু পয়সা রোজগার করে সংসার চালিয়েছে, আমার পড়াশোনা চালিয়েছে, শখের খেয়াল রেখেছে আমার আম্মি। তোমার কাছে সহজ মনে হলেও আমার কাছে সহজ না সেটা। ভুলিনি আজও, কত দৌড়াদৌড়ি করে স্কুলের জরিমানা মওকুফ করিয়েছি। আম্মির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজেই লুকিয়ে কাজ করতাম। ধরা পড়ে যাই আম্মির কাছে আর আম্মি রাগ করে আমি কাজ করেছি বলে। তবুও নিজের দিকটা দেখেনি তিনি। এই সময়টাতে তো খুব প্রয়োজন ছিলো উনাকে! কোথায় ছিলেন তিনি সেদিন! বেচে থাকতেও আমাদের এতো কষ্ট সহ্য করতে হলো কেন!
- যদি বলি এর জন্য আম্মি দায়ী!
- মেঘ!
- মেঘা তুমি অবুঝ না। বুঝো সবটাই। দেখো সেদিন যদি আম্মি তোমাকে নিয়ে পালিয়ে না আসতো তাহলে কি এমন জীবনের সম্মুখীন হতে তোমরা! কোনো কিছুরই তো অভাব ছিলো না আংকেলের । তোমরা নিজেদের অধিকার নিয়ে উনার দুয়ারে দাড়াতে পারলে না কেন! ঠাই হবে না সে ভয় ছিলো? তাহলে দেশে আইন ছিলো, আইনের আশ্রয় নিতে পারতে। তাছাড়া সমাজে কি একাধিক বিয়ে করে না কেউ, তাই বলে কি সবার জীবন এভাবে চলে! তোমাদের প্রাপ্যটুকু তো পেলেই হতো। আংকেল তো আর তাড়িয়ে দেয় নি। নিজের দিকটা তো খুব ভালো দেখলে, একবার নিজেকে ওই লোকটার জায়গায় দাড় করিয়ে দেখো তো, বিবেক কি বলে! আংকেল খুজেছে তোমাদের। এমনকি মারিশার মা যখন শুনেছে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে তখন রাগ না করে তিনি নিজেও খুজেছে তোমাদের। অথচ রাগ করার অধিকার ছিলো তার। কারণ প্রথম স্ত্রী থাকতেও দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এটা সবাই মেনে নিতে পারে না। তুমি পুরোই আম্মির স্বভাবের। নিজের অধিকারটুকু আদায় করে নিতে জানো না। স্বার্থপর এই পৃথিবীতে বেচে থাকা খুব কঠিন মেঘা। নিজ স্বত্তাকে চিনতে শেখো। অন্যের আশায় ফেলে রেখো না কিছু। এটা বোকামি ছাড়া কিছুই না! আংকেল খুব কষ্ট পেয়েছে মেঘা, এতো বছর পর নিজের স্ত্রী আর সন্তানকে কাছে পেয়েছে তবুও তাদের মনে ঠাই পেলো না। আম্মি বুঝতে পেরেই আংকেলের সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনকি মারিশাকে আম্মি বলে ডাকার অধিকারও দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তোমার জন্য আর এগোতে পারলো না৷ শুধু মাত্র তোমার মুখ চেয়ে। লক্ষ্য করেছো তুমি? আম্মি কিন্তু একটা কথাও বলেনি সে সম্পর্কে। এমনকি প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া কোন অতিরিক্ত কথাও বলেনি তোমার সাথে। তুমি তো মূল্যহীন স্বার্থপর হলে। একবার কি আম্মির কথাটা চিন্তা করেছো! আম্মি যে নিজের মেয়ের বাড়িতে থেকে কতটা লজ্জিত ও ইতস্তত বোধ করে সেটা একবারও পড়েছে তোমার নজরে! মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকদের সম্মুখীন হতে হবে বলেই আম্মি আসতে চায়নি এ বাড়িতে। আত্মসম্মানবোধ আছে উনার। কিন্তু আমি মায়ের সম্মান দেই সর্বদা আম্মিকে আর আমার পরিবারও যথেষ্ট সম্মান করে সেটা তোমার নিজ চোখে দেখা। তবুও দেখো আম্মি তোমাকে ও আমাকে জিজ্ঞেস করে সব কাজ করে৷ উনার স্বামীর বাড়ি হলে কিন্তু সেটা কখনোই করতেন না। নিজের ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিতেন। আম্মি তোমার কথা ভেবে আজও চুপ। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আংকেলের সম্মুখীন হতে চাচ্ছেন না। আমার বাবা মাও তোমার সাথে এ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি তাদের থামিয়ে দিয়েছি। কেননা আমার বিশ্বাস তুমি অতি শীঘ্রই বুঝতে পারবে সবটা। সবার জীবনেই সঙ্গী প্রয়োজন, কেউই একা থাকতে পারে না। আম্মিও নিজের সুখদুখ কারো সাথে শেয়ার করতে চায়। তবে সবটা সবার সাথে শেয়ার করা যায় না। যেমন ধরো তুমি আমার সাথে যতোটা গল্প করো, আম্মির সাথে কিন্তু ততটা সময় দাও না। ওদিকে আংকেলও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন। তোমাদের কথা মারিশা জানার পর সেও তার বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। তাহলে আর উনার কাছে থাকেই বা কি বলতে পারো? বাবার সাথে রাগ করে নিহনকে বিয়ে করেছে স্বেচ্ছায়। তারপর থেকে পড়ে আছে শ্বশুর বাড়ি। সেদিন শুধু আংকেলের সাথে সিলেট এসেছিলো তোমাকে দেখতে। আজ তোমার বাবা সামনে থাকতেও অবহেলা করছো। কোনো দিন হয়তো এই বাবার জন্য কাদবে দেখে নিও। কিন্তু সেদিন হয়তো আর পাশে পাবে না! আফসোস করবে খুব! খুজবে তবু মিলবে না কভু!
নাফিসার দুচোখে অনবরত ঝরছে অশ্রু। মেঘ কাছে এসে দু’হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, - তুমি সব বুঝো মেঘা। বুঝার বয়স হয়েছে তোমার। বাচ্চার মা ও হয়ে গেছো, দুদিন পর নিজের মেয়েকে বুঝাতে শুরু করবে। তখন কি শিক্ষা দিবে মেয়েকে, বলোতো? এটাই কি শিক্ষা দিবে? বাবা ভুল করলে বাবাকে আশ্রয় দিবে না! বাবা মন না রাখলে বা সময় না দিলে এমন অবহেলা ও অভিমান করবে যাতে সারাজীবনেও না ভাঙে সে অভিমান! কি এসবই শিখাবে? তারপর যদি বাবা এসে পায়ে ধরে ক্ষমাও চায় তবুও মুখ ফিরিয়ে নিবে!
নাফিসা দু’হাতে কান চেপে ধরে বললো, - মেঘ, চুপ করো প্লিজ! আর শুনতে পারছি না আমি এসব! ঠিক সেই মুহুর্তটা আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো! এমন কিছু ঘটার আগে আমার মরণ হলো না কেন!
নাফিসা হুহু করে কেদে উঠলো! চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছে না! মেঘ তাকে কাদতে বাধা দিচ্ছে না বরং নিজের বুকে ঠাই দিয়েছে।
পর্ব – ৫৮
পরক্ষণেই পাশে থাকা রাজকন্যার ঘুম ভেঙে গেলো। মেঘ বললো,
- এবার হয়েছে মহাজ্বালা! মেয়েকেই সামলাবো নাকি মেয়ের মা কে! আল্লাহ, শক্তি দাও যাতে দু’হাতে দুজনকে সামলে নিতে পারি!
আড়চোখে নাফিসার দিকে তাকিয়ে দেখলো নাফিসা নিজের চোখের পানি মুছে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। এবং হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে বললো, - মেঘ, আমাকে ঢাকা নিয়ে যেতে পারবে?
- ঢাকা! তাও আবার এই অবস্থায়!
- হ্যাঁ।
- মেঘা, তুমি কি আমার জান বের করে পরেই শান্তি হবে! আমি দিনরাত এক করে ফেলছি তোমাদের সুস্থতার জন্য আর তুমি!
- মেঘ প্লিজ, একবার নিয়ে যাও।
- ঢাকা কি প্রয়োজন?
- আব্বুর সাথে দেখা করবো একবার। ক্ষমা চেয়ে আসবো। প্লিজ একবার নিয়ে যাও!
মেঘের চোখ জ্বলজ্বল করছে। সে মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে নাফিসার কপালে চুমু একে দিয়ে বললো,
- সত্যি বলছো?
- হুম।
- তাহলে আব্বুকে এখানে এনে দেই?
- না, একবার এসেছে এখন আবার আসবে! তার চেয়ে বরং আমরাই যাই। ঢাকা ও বাড়িতে ঘুরে আসবো।
- তা না হয় পরে যাবো। আজ না হয় আব্বুকে এনে দেই।
কথাটা বলে মেঘ বেরিয়ে গেলো রুম থেকে নাফিসা পেছন থেকে ডাকলো কিন্তু শুনলো না! এখন আবার সে কোথায় যাচ্ছে!
একটু পরই মেঘ রুমে এলো সাথে সৈকত মির্জাকে নিয়ে। নাফিসা বাচ্চার পাশে বসে ছিলো। তাদের দেখে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। তাহলে তারা এখনো সিলেট আছে! জন্মদাতা পিতাকে আজ অন্যচোখে দেখছে নাফিসা। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে তার! ঘটে যাওয়া মুহুর্তগুলো সব তার চোখে ভাসছে। সৈকত মির্জা শত আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে। সেই দৃষ্টির ডাকে সাড়া দিয়ে নাফিসা মুখ দিয়ে একটা একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পেরেছে “আব্বু”। আরও কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু গলায় আটকে যাচ্ছে তার। একবার মনে হচ্ছে স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন আরেকবার অতীত এসে বাধা দিচ্ছে! দুইয়ে মিলে খুবই অস্বস্তি বোধ করছে নাফিসা! সৈকত মির্জা কাছে এসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই বাবাকে ঝাপটে ধরে কান্না করতে লাগলো নাফিসা! ভেতরটা বেশ নাড়া দিয়েছে। অতীতকে পেছনে ফেলে সে স্বাভাবিকতাকেই বেছে নিয়েছে।
- আব্বু মাফ করে দাও, আমি এতো কিছু বুঝিনি! জেদ একটাই ছিলো, আম্মি ধোকার সম্মুখীন হয়েছে! সহ্য হয়নি আম্মির কষ্ট! জীবনের প্রত্যেকটা দিন আনেক মিস করেছি তোমাকে। এতো বছর পর দেখা হয়েও অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে, সরি! আমি চাইনি এমন আচরণ করতে, কিভাবে যেন হয়ে গেছে! ভুলতে পারিনি ফেলে আসা দিনগুলো!
- ভুল তো আমারই ছিলো আব্বু। কাদছো কেন তুমি! চুপ করো। কাদলে একদম পঁচা দেখায়!
সৈকত মির্জার কথায় নাফিসা শৈশবে ফিরে গেছে। পরম সুখ অনুভব হচ্ছে আজ। কান্নার মাঝেও মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। নাফিসা বললো,
- তোমার এই শান্তনায় কাজ হবে না! আমি ছোট নেই এখন! আমারই মেয়ে আছে।
- হ্যাঁ, সেটাই তো ভাবছি! চকলেট আমার মেয়েদের আর দিতে পারবো না। এখন থেকে নাতনীকে দিতে হবে!
মারিশা ও রোকসানা কখন এসেছে সেটা মেঘ লক্ষ্য করলেও তারা বাবা-মেয়ে লক্ষ্য করেনি। সবার মুখেই লেগে আছে প্রশান্তির হাসি। সৈকত মির্জা এক হাত নাফিসার মাথায় রেখে অন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন মারিশার দিকে। চোখের পানি মুছে মারিশা এগিয়ে এসে বাবার বুকের অন্যপাশে মাথা রাখলো। দুই মেয়েকে কাছে পেয়ে আজ পরম সুখ অনুভব করছেন মির্জা সাহেব। মির্জা নূর মারিশা ও মির্জা নূর নাফিসা, দুই রত্নই আজ তার কাছে আছে। দুই মেয়ের মাথায়ই চুমু দিলেন আর মহান আল্লাহর সুক্রিয়া জানালেন মনে মনে। তা দেখে রোকসানা মির্জা আঁচলে চোখ মুছে প্রশান্তির নিশ্বাস ছাড়লো। মারিশা বাবার বুকে মাথা রেখেই মৃদু হেসে নাফিসার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
- আপু ডাকবে আমাকে?
নাফিসা মৃদু হেসে বললো,
- আপ্পি ডাকবো।
- আর আবদার রাখবে সবসময় আপ্পির কাছে।
প্রতুত্তরে নাফিসা মুচকি হাসলো। মেঘ তার মেয়ের কাছে এসে কোলে নিতে বললো, - ওরা তো খুশগল্প করছে, তাহলে আমরা বসে থাকবো কেন আব্বু! চলো আমরাও একটু খুশগল্প করি!
মেঘের হিংসেমাখা কথা শুনে মারিশা ও নাফিসা দুজনেই বাবাকে ছেড়ে দাড়ালো। নাফিসা চোখ মুছতে মুছতে মেঘকে ইশারা করতেই মেঘ সৈকত মির্জার কাছে এসে এগিয়ে দিলো। সৈকত মির্জা কোলে নিলেন পিচ্চিটাকে। - মাশাল্লাহ। নানু ভাইয়ের নাম কি রেখেছো নাফিসা?
বাবুর নাম তো রাখাই হয়নি! নাফিসা মেঘের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে মেঘ বললো,
- মুশফিকা চৌধুরী নিশি।
মির্জা সাহেব বললো, - অনেক সুন্দর নাম। মির্জা নূর মারিশা ও মির্জা নূর নাফিসার মতো তোমার সন্তানদের নামও মুশফিকা চৌধুরী নিশির সাথে মিলিয়ে রেখো, মেঘ।
- ইনশাআল্লাহ।
নাফিসা তার আম্মির দিকে তাকাতেই তিনি হাসির রেখা আরও প্রশস্ত করলেন এবং ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।
পরক্ষণেই রোকসানার কাছে শুনে মোহিনী রুমে হাজির।
- দেখি, দেখি, মির্জা সাহেব নাতনীর মুখ দেখে কি দিয়েছে!
- নানু ভাই, বলে দাও তোমার দাদুকে। প্রাণ ভরে দোয়া দিয়েছি যা দেখা যায় না।
মোহিনী হেসে বাবুর নাকে স্পর্শ করে বললো, - কি বুড়ি! নানু ভাইয়ের কোলে উঠে টগবগিয়ে তাকিয়ে আছো কেন শুনি! হুম? রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি কিন্তু!
সবাই হাসলো মোহিনীর কথা শুনে।
মোহিনী মেঘকে বললো,
- মেঘ, টুনটুনির নাম কি ঠিক করেছিস? মৌলভী সাহেব কিন্তু সন্ধ্যায় আসবে, তোর বাবা বললো।
- জ্বি মা। মুশফিকা চৌধুরী নিশি।
- বাহ! বুঝতে হবে তো, আমার ছেলের রুচি!
মারিশা বাবুকে কোলে নিয়ে বের হলো সাথে বাকিরাও। শুধু মেঘ আর নাফিসা রুমে। মেঘ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে শার্টের হাতা ঠিক করে চুল ঠিক করছে। নাফিসা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে মুখ লুকিয়ে বললো,
- এতো কিছু কিভাবে পারো জনাব! আর কত সুখের সন্ধান দিবে আমাকে! বিনিময়ে তো কিছুই পেলে না!
মেঘ তাকে ছাড়িয়ে ঘুরে দাড়ালো। নাফিসার মুখখানা ধরে বললো, - বিনিময়ে আমি কি পেয়েছি সেটা আমিই জানি, মেঘা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়েছো আমার কোলে কন্যা সন্তান তুলে দিয়ে! সারাজীবন উৎসর্গ করে দিলেও ঋণ পরিশোধ হবে না।
এমন সময় বাইরে থেকে মারিশার আওয়াজ ভেসে এলো, - নাফিসা, নিশি কান্না করছে। ক্ষুধা লেগেছে মনে হয়।
মেঘ এগিয়ে গিয়ে বাবুকে কোলে নিলো। মারিশা চলে গেলো। মেঘ নাফিসার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
- মেঘা, বাবা হওয়ায় যে কি আনন্দ আছে তা তুমি বুঝবে না। আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সর্ব সুখ আমার কাছে আছে।
মেঘ বাবুর কপালে চুমু দিলো। নাফিসা লক্ষ্য করলো মেঘের চোখে পানি! প্রথমবার মেঘের চোখে পানি দেখেছে বাবুর আগমনের খবর শুনে। আজ দ্বিতীয়বারও চোখে পানি দেখলো বাবুর জন্যই! কতটা খুশি হলে চোখে পানি আসতে পারে, ভাবা দায়!
মেঘ নিশিকে নাফিসার কাছে দিয়ে চোখ মুছে নিলো। নাফিসা বললো,
- একটু কাছে আসো।
- কেন?
- আসো না!
মেঘ নিচু হতেই নাফিসা তার কপালে আলতো চুমু দিলো। মেঘ মুচকি হেসে নাফিসার ঠোঁটে ঠোঁট ছুয়ে বললো,
- হাটাহাটি কম করো। চুপচাপ বসে থাকো। বেশি নড়াচড়া করলে সুস্থ হওয়ার বদলে আরও বেশি প্রব্লেম হবে।
নাফিসা খাটে চলে গেলো। মেঘ দরজা লাগিয়ে তার পাশে এসে হাতে মাথা ভর করে শুয়ে পড়লো। নাফিসার পেটে হাত রেখে বললো, - মেঘা, সত্যি করে বলোতো বাকি বাবুগুলোকে কোথায় লুকিয়ে রেখে দিয়েছো?
এমন প্রশ্নে নাফিসা চমকে উঠে বললো, - মানে! কিসব আবোলতাবোল বলছো তুমি!
- এতো বড় পেট থেকে এইটুকু একটা বাচ্চা বের হয়েছে! আমি তো ভেবেছি পাচ ছয়টা ছিলো!
- ছি! কি অসভ্য কথাবার্তা! এতোগুলো বাচ্চা তো গরু ছাগলেরও হয় না!
মেঘ হাহা করে হেসে উঠে বললো, - আগামী বছর কি বাকি চার-পাঁচজনকে নিয়ে আসবে?
- মেঘ! চুপ থাকো! না হয় সুপার গ্লোব লাগাবো তোমার মুখে!
- তোমার ওষ্ঠ জোড়াই যথেষ্ট! জানো, ভেবেছিলাম এ বছর বোধহয় খরগোশগুলোও বাচ্চা দিবে। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস দেখো, উভয়েই পুরুষ খরগোশ!
- ছি! তোমার কি আর কোনো কাজ নেই! কার বাচ্চা হবে না হবে সেসব নিয়ে ঘুরো!
- ওহ! বলতে ভুলেই গিয়েছি, বৃষ্টির কাছে শুনলাম মারিশার নাকি বেবি হবে!
- তুমি আব্বুকে কোথা থেকে নিয়ে এলে?
- যেতে দেইনি তো তাদের। বৃষ্টির ফ্ল্যাটে থেকেছে তারা।
- মারিশা আপ্পির সাথে হসপিটাল দেখেছিলাম উনিই কি তার হাসব্যান্ড?
- হুম, নিহন।
- আপ্পির তুলনায় বয়স মনে হয় অল্প!
- আমার ক্লাস মেট নিহন। মারিশাকে খুব পছন্দ করতো। বাসা পাশাপাশিই। প্রপোজ করেছে কতবার কিন্তু মারিশা এক্সেপ্ট করেনি। মারিশার বিয়ের ঘটনা শুনবে?
- হুম!
- তোমার কথা জানার দুদিন পর সে নিহনকে কল করে দেখা করতে বলে। নিহন তার কথামতো দেখা করতে আসে। পরক্ষণেই মারিশা প্রত্যক্ষভাবে বিয়ের প্রস্তাব করে।
- নিহন, ভালোবাসো আমাকে?
- তা তো অনেক আগেই বলেছি। কিন্তু তুমি তো মেঘ বলতে পাগল।
- এই মুহুর্তে ভালোবাসো আমাকে?
নিহন একটু হতবাক হয়ে বলেছিলো,
- হ্যাঁ। এই মুহুর্তেও ভালোবাসি।
- তাহলে চলো বিয়ে করবো আজ কাজী অফিসে।
- হোয়াট!
- কি? ভালোবাসতে পারবে আর বিয়ে করতে পারবে না?
- মারিশা, তোমাকে নিয়ে জীবন কাটানোর জন্যই ভালোবাসি। কিন্তু আজ বিয়ে! তাও আবার কাজী অফিসে!
- বাসায় নিয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছো? দুজন না হয় পথে ঘুরেই জীবন পাড় করে দেবো!
- মারিশা, তুমি ঠিক আছো! আংকেল এসব জানলে কি ভাববে!
- কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না আমি! আজ এই মুহুর্তে বিয়ে করবে কিনা বলো। না হলে আত্মহত্যা করবো আমি!
- মারিশা! কি ধরনের কথা বলছো এসব! কি হয়েছে তোমার!
- ভয় পেয়ো না। আমি ধর্ষিত টর্ষিত হইনি। তোমাকে ফাসাতেও চাচ্ছি না। মেঘ বিয়ে করেছে সেটা তো জানো। এখন আমিও বিয়ে করবো। তুমি রাজি আছো কিনা বলো! তা না হলে চিরতরে হারাবে আমাকে।
নিহন চিন্তিত হয়ে বসে ছিলো। মারিশা কি বলছে আর তারই বা কি করা উচিত কিছুই মাথায় ধরছিলো না। আর এদিকে মারিশার তাড়া,
- কি হলো? এখানে বসে বসে ধ্যানমগ্ন হতে বলেছি নাকি একটা প্রস্তাব করেছি। পছন্দ হলে এক্সেপ্ট করবে নয়তো রিজেক্ট করবে।
- চলো।
দুজন চলে যায় কাজী অফিস। সেখানে গিয়ে আমাকে কল করে জরুরী তলব করে। কাজী অফিসের ঠিকানা শুনে আমি কিছুটা ভয় পাই! মনে হচ্ছিলো মারিশা কোনো হট্টগোল বাধানোর চেষ্টা করছে তাই সাথে আমার ফ্রেন্ড ইয়াছিরকে নিয়ে যাই। গিয়ে শুনি নিহনের সাথে সে বিয়ে করবে। সাক্ষ্যস্বরূপ আমাকে ডেকেছিলো। শেষ পর্যন্ত ইয়াছিরকে বানিয়ে দেয় উকিল বাপ! হয়ে যায় বিয়ে। নিয়নকে সাথে নিয়ে বাসায় যায় এবং আংকেলকে জানায় সে নিজেই। আংকেল কষ্ট তো পেয়েছেনই কিন্তু প্রকাশ করেননি। মেয়ের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে দোয়া করেছেন। নিহন বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বোন আছে কয়েকজন। ছেলে ফোর্স করে বাবামাকে, যেন মারিশাকে মেনে নেয়। ছেলেকে তো আর ত্যাগ করে পারবে না, তারাও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে এমন বিয়ে।
- নিহন ভাইয়াও কি সিলেট আছে নাকি চলে গেছে?
- সবাই সিলেট আছে।
- মুশফিকার আব্বু?
- হু?
- আমি যদি একাধিক সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম থাকি তবে কি তুমি আরেকটা বিয়ে করবে?
- কি আজেবাজে বলছো এসব। নিশির ক্ষেত্রে কিন্তু তোমার এমন কোনো প্রব্লেম হয়নি। নরমাল আছে সবটা।
- আমি “যদি” বলেছি। প্রব্লেম হয়েছে কি হয়নি সেটা জিজ্ঞেস করিনি। বলো? তুমিও কি আরেকটা বিয়ে করবে?
মেঘ নাফিসার হাত তার হাতের মাঝে নিয়ে বললো, - মেঘা, তাকিয়ে দেখো। এক হাতেরই পাঁচটা আঙুল অথচ একে অপরের থেকে আলাদা। সবাইকে একরকম ভাবলে কিভাবে হবে, বলো?
- আমার আর আম্মির ভাগ্য একই রকম। তাইতো ভয় হয় আমার।
- এসব দুশ্চিন্তা কেন করো বলো তো! তোমার আম্মির সাথে ঘটেছে বলে তোমার সাথে ঘটবে এমন কোনো কথা নেই। সবাই একইরকম ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না মেঘা। আম্মি তো পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছে। তুমি কি পালিয়ে বিয়ে করেছো? আর আমার এবং আমার পরিবার সম্পর্কে কি তোমার জানা নেই সবটা?
- জানি সবটা, খুব করে মানি-ও৷ কিন্তু আবার ভয়ও পাই। কোনো অবস্থাতেই আমাকে ছেড়ো না মেঘ। আমি মরে গেলে বিয়ে করে নিও। এতে আমার আপত্তি নেই।
- মেঘা, ভালো লাগছে না এসব শুনতে!
নাফিসা চুপ করে আছে। দুচোখের ধারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মেঘ মাথায় চুমু দিয়ে বললো,
- এসব দুশ্চিন্তা কখনো মাথায় আনবে না। এই মেঘ শুধুই মেঘার, হুম?
নাফিসা ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে মেঘের হাতটা মুঠোয় ধরে এনে হাতে চুম্বন করলো।
রায়হান চৌধুরী বাদে যারা ঢাকা থেকে এসেছিলো দুদিন পর সবাই চলে যাচ্ছে। মির্জা সাহেব রোকসানাকে বললো,
- রোকসানা, তুমি তোমার বাড়িতে উঠবে না কখনো?
অতি সাদরে থাকা সত্ত্বেও নিজের বিবেকেই বাধা পায় মেয়ের বাড়িতে এভাবে থাকতে! রোকসানা নাফিসার দিকে তাকাতেই নাফিসা বললো,
- আম্মিকে কোথাও যেতে দেবো না আমি। আমার কাছেই থাকবে।
- দু মেয়ে তাদের শ্বশুর বাড়ি থাকবে। অত বড় বাড়িতে আমি একা থাকবো কিভাবে! মেঘ তুমি বরং তোমার থার্ড ফ্লোর বেচে দাও আমার কাছে। আমি ঢাকা ছেড়ে এখানেই চলে আসি। ফোর্থ ফ্লোর থেকে না হয় রিসোর্টের কাজ কর?
মারিশা বললো,
- ভালোই তো! সবাই সিলেট। আমি ঢাকা থাকবো একা!
- নিহন আছে তো মা। তুমি না হয় কিছুদিন পর পর বেড়াতে আসবে আমাদের কাছে। তোমার আম্মি তো ঢাকা যাবে না। তাহলে সে বাড়িতে আমি একা। তুমিও নেই!
নাফিসা মেঘকে খোচা দিয়ে ফিসফিস করে বললো, - এই, বেচে দাও না থার্ড ফ্লোর।
মেঘ মুচকি হাসলো নাফিসার ভঙ্গি দেখে। মির্জা সাহেব আবার জিজ্ঞেস করতেই মেঘ বললো বাবার সাথে কথা বলে বেচে দিবে। এদিকে বৃষ্টির ইচ্ছে করছে না সিলেট ছেড়ে যেতে। আকাশ ও সে রেডি হচ্ছে তাদের রুমে। মুখ মলিন করে বললো, - আকাশ, আর কয়েকটা দিন থাকলে কি হতো!
- পরীক্ষা যে আগামী সপ্তাহে মনে আছে?
এবার পরীক্ষাকে মনে মনে বকতে বকতে রেডি হয়ে গেলো। নাফিসার রুমে গিয়ে নিশিকে নিয়ে এলো তার রুমে। আকাশের সামনে এসে বললো, - বাচ্চা তো সামলাতে পারো না, তাই বলে কি কোলে নিতেও জানো না!
আকাশ মুচকি হেসে নিশিকে কোলে নিয়ে বললো,
- নিতে তো জানি। কিন্তু সু্যোগ আছে না-কি! সারাদিন তো তুমিই কোলে নিয়ে ঘুরো, কাউকে সুযোগ দাও একটুও! তবুও তোমার তৃপ্তি মিটে না।
- ঠিকই বলেছো। তৃপ্তি মিটেই না! বুঝো সব, তবুও তো এনে দাও না একটা বাবু!
আকাশ চোখ পাকিয়ে বললো, - এজন্যই তো আরও তারাতাড়ি যেতে চাচ্ছি এখান থেকে! ভয়ংকর মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছো আস্তে আস্তে আর আমাকে বিরক্ত করা শুরু করবে!
- এমন করো কেন! বাবু আনবে না কখনো? ভাবির বাবু এসেছে, মারিশা আপুও প্রেগন্যান্ট! আমি হলে সমস্যা কি!
- এ তো দেখছি এখনই ভয়ংকর মায়ায় জড়িয়েই গেছে! ডাক্তার হয়েছো তুমি? এজন্যই আংকেল বিয়ে দিতে চায়নি তোমাকে। আমার কাছে সংসার করার জন্য কিন্তু আনিনি! এনেছি, স্বপ্ন পূরণ করার জন্য। আগে ডাক্তার হও, পরে সব।
- আযব ব্যাপার! ডাক্তার হয়ে কি আমি নিজের অপারেশন নিজে করবো? ছাড়ো বাবুকে। একদম ধরবে না! হুহ্! ডাক্তার হও আগে, পরে সব!
বৃষ্টি নিশিকে কোলে নিয়ে আকাশকে ভেঙচি কেটে হনহন করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কিছুক্ষণ পরেই তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
নিশির জন্মের পর দিপা চাকমা আর দিয়া তাদের বাড়িতে এসে দেখে গেছে একবার। মাসখানেক পর বৃষ্টি, আকাশ, মারিশা ও নিহন আবার সিলেট এসেছে বেড়াতে। সৈকত মির্জা আগেই এসেছিলো। মেঘ বেচে দিয়েছে তাদের তৃতীয় তলা। তিনি সেটার কাজ কমপ্লিট করে এখানেই থাকবেন।
বিকেলে নাফিসা রুমেই হাটছিলো নিশিকে কোলে নিয়ে। নিশি এখন খিলখিল করে হাসতে শিখে গেছে। মেঘ ও নাফিসাকে দেখলে অটোমেটিক হাসি চলে আসে তার মুখে। মেঘ তুলে ধরেছে হাসিটা পুরো নাফিসার মতো।
মেঘ রুমে প্রবেশ করলো পিছু পিছু মারিশা ও বৃষ্টিও বকবক করতে করতে রুমে এলো। সকালে যখন নাফিসার সাথে তারা আড্ডা দিয়েছিলো তখন তাদের সেই স্বপ্নের বাড়িটা দেখেছিলো এখান থেকে। সেখানে যাওয়ার জন্যই মেঘের পিছু পিছু ঘুরছে কিন্তু মেঘ পাত্তা দিচ্ছে না তাদের কথায়! বৃষ্টি নাফিসাকে বললো,
- ভাবি, বলো না ভাইয়াকে। একবার নিয়ে যেতে।
- নিয়ে যাও।
মেঘ জবাব দিলো, - না।
নাফিসা তাদের বললো, - তোমরাই তো যেতে পারো। দূরে না তো।
- গিয়েছিলাম তো। লাভ হয়নি কোনো! সিড়ির মাঝে কাটা দিয়ে রেখেছে ভাইয়া।
- এই, একবার যেতে চাইছে। নিয়ে যাচ্ছো না কেন?
- মেঘা, আমার ইচ্ছে সেই ঘরে প্রথম যাবে তুমি। তা পূরণ হয়েছে, এখন ইচ্ছে সেই ঘরে দ্বিতীয় ব্যক্তি যাবে আমাদের রাজকন্যা। তাই নিয়ে যাচ্ছি না। আগে নিশি যাবে তারপর তারা।
মেঘের শখের উপর নাফিসা কোনো কথা বলে না। অসহায় দৃষ্টিতে বৃষ্টি ও মারিশার দিকে তাকালো। মেঘের ইচ্ছের কথা শুনে তারাও আজ জোর করলো না। বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। নাফিসা বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ফ্ল্যাটের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো বারান্দায় রোকসানার হাতের উপর হাত রেখে দাড়িয়ে আছে মির্জা সাহেব। দুজনেই গল্প করছে। মেঘ বারান্দায় এসে নাফিসার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখলো সে তার বাবামায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
- বাহ! কি রোমান্টিক মুহুর্ত না?
- ছাড়ো, রোমান্স ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না তোমার!
- বাব্বাহ! কি তেজ! চোখ কি আমার পড়েছে নাকি তোমার পড়েছে আগে!
নাফিসা আর কিছু বললো না। এদিকে মায়ের কোলে থেকে বাবাকে দেখতে পেয়ে নিশির মুখে ভুবন জয়ী হাসি! মেঘও মুখে হাসি ফুটিয়ে কোলে নিয়ে মেয়ের সাথে কথা বলতে বলতে রুমে চলে গেলো। পিছু পিছু নাফিসাও এসে বললো, - ওহে জনাব, চলো তাহলে স্বপ্নের বাড়িতে এখনই যাই রাজকন্যাকে সাথে নিয়ে। সাথে আপ্পিদের ইচ্ছেটাও পূরন হোক।
- যাবে?
- হুম।
- ওকে।
অত:পর তারা বেরিয়ে এলো। সাথে আকাশ ও নিহনও। বাড়ির কাছে এসে মেঘ নিশিকে নাফিসার কোলে দিয়ে কাটা সরিয়ে পরিষ্কার করলো। তারপর নাফিসাকে প্রথম যেতে বললো কিন্তু সে যাচ্ছে না! মেঘ বললো, - কি হলো, যাও।
- উহুম, নিশি তার আব্বুর কোলে উঠে যাবে।
মেঘ দুষ্টুমি হাসি দিয়ে বললো,
- ফ্রেন্ডস, এক মিনিটের জন্য তোমরা একটু চোখ বন্ধ করো তো।
তারা বুঝতে পেরে সবাই চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে ঘুরে দাড়ালো। মেঘ নাফিসাকে বললো, “তুমি শুধু রাজকন্যাকে ধরে রাখো, মেঘা।” নাফিসা চোখ পাকালো কিন্তু কোনো লাভ হলো না। মেঘ সাথে সাথে নাফিসাকে কোলে তুলে নিলো আর নাফিসার কোলে নিশি! সিড়ির ধাপ সব অতিক্রম করে নামালো এবং বাকিদের বললো উপরে যেতে। সবাই ঘুরে ঘুরে দেখলো এবং মুগ্ধ হলো। বৃষ্টি আকাশকে বললো,
- ভাইয়া তো ভাবিকে গাছের উপর ঘর বানিয়ে দিলো, তুমি আমাকে কি দিবে?
আকাশ মৃদু হেসে বললো, - কি চাও তুমি, বলো?
- বেশি কিছু না, মাঝে মাঝে জঙ্গলে রাত কাটানো, ঝর্ণার পানিতে গোসল আর পাহাড়ের গোড়ায় মাছ ধরলেই হবে।
- ওকে।
মারিশা নিহনকে বললো,
- এই, মেঘ তো নাফিসাকে গাছের উপর ঘর বানিয়ে দিলো। আকাশ ভাইয়া বৃষ্টিকে নিয়ে জঙ্গলে রাত কাটাবে, ঝর্ণার পানিতে গোসল করবে আর পাহাড়ের গোড়ায় মাছ ধরবে। তুমি আমাকে কি দিবে?
- আমিও তোমাকে এমন একটা ঘর বানিয়ে দিবো, পাহাড়ের গোড়ায় মাছ ধরবো, জঙ্গলে রাত কাটাতে পারবো না। ভয় লাগে আমার। কিন্তু ঝর্ণায় গোসল করবো। ওকে?
- এগুলো তো তাদের কপি করা হয়ে গেলো না? ভিন্ন কিছু চাই আমার! ইউনিক কিছু বলো!
- উম্মম, ইউনিক কিছু! তাহলে বাবাকে বলে তোমাকে নিয়ে চাদের দেশে ঘুরে আসবো। হুম?
- গাধা কোথাকার! এটাই তোর প্রেম! যা তুই, তোর চান্দের দেশে! আমি আর নেই তোর সাথে!
- আরে! আরে! কোথায় যাচ্ছো!
মারিশা হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে যেতে লাগলো। নিহন পিছু পিছু রোয়াক পর্যন্ত এসে রেলিং ধরে চেচিয়ে বললো,
- মেঘবৃষ্টি রিসোর্টের অপজিটে যে একটা পাহাড় আছে সেখানে একটা তাবু টানাবো। তোমাকে নিয়ে আমাবস্যার রাত তাবুতে কাটাবো আর পূর্নিমার রাতে খোলা আকাশের নিচে ঘাসের উপর শুয়ে দুজন জ্যোৎস্না উপভোগ করবো। মাঝে মাঝে ঝর্নার ধারে পাথরের উপর বসে গল্প করবো ও নিজের লেখা গান গেয়ে শুনাবো। চলবে?
মারিশা নিচের সিড়ি পর্যন্ত এসে থেমে গেলো নিহনের কথা শুনে। সেখান থেকেই বললো, - সত্যি তো?
- মিথ্যা না।
মারিশা দ্রুত পায়ে আবার উপরে উঠতে লাগলে নিহন বললো, - এই, আস্তে। দাড়াও আমি নেমে আসছি।
- চুপচাপ দাড়াও।
মারিশা নিহনের কাছে এসে বললো, - এতেই চলবে, ফাকি দিলে ঠ্যাং ভেঙে দিবো!
- কোথায় একটু মধু মিশ্রিত কন্ঠে কথা বলবে, তা না করে উল্টো থ্রেড দিচ্ছো!
মারিশা মুচকি হেসে চট করেই নিহনের গালে চুমু দিয়ে বললো, - যাও ভালোবাসা দিলাম।
- এটা কি করলে! পাবলিক প্লেসে এভাবে খুন করে কেউ! ইশশ! আশেপাশে কতো মানুষ দেখছে, আমারই তো লজ্জা লাগছে! আমাদের বাবুটাও লজ্জা পেয়েছে। তোমার লজ্জা লাগছে না গো বাবুর আম্মু?
মারিশা নিহনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
- না, লাগছে না লজ্জা। তারা দেখে কেন, তাদের লজ্জা নেই!
নিহনও পরম আবেশে জড়িয়ে রাখলো।
ফিসফিসিয়ে করছে দুজন খুশগল্প। বৃষ্টি তাদের দেখে আকাশের শরীরে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে বললো,
- আকাশ, খুব সুখী দম্পতি দেখাচ্ছে না তাদের?
আকাশ এক হাতে বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বললো, - আমরা কি দম্পতি হিসেবে সুখী না?
- হুম, অনেক! এবার বলো মিস্টার আকাশ, কোথায় গেলো তোমার ইউনিক লাইফ?
- কেউ এসে যদি হুট করেই ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে নেয়, কেউ যদি আমার হাত টেনে নিয়ে ঝর্নার পানি স্পর্শ করায়, কেউ যদি আমার খোজে জংলীর কাছে চলে যায়, আবার আমার কোলে উঠে ঘুরাফেরা করে, একটা রাত আমার বুকে কাটানোর আবদার করে তাহলে কিভাবে সম্ভব ইউনিক লাইফ এনজয় করা!
বৃষ্টি হিহি করে হেসে বললো, - অবশেষে হার মানলে তো ভালোবাসার কাছে!
- সবটাই তোমার জন্য।
তারাও মেতে উঠেছে খোশগল্পে। নাফিসা ঘরের ভেতরে থেকে দুই রোয়াকের সুখী দম্পতিদের দেখছে। মেঘ তার সামনে দাড়িয়ে বললো, - ওইদিকে কি দেখো, হুম? দেখার হলে আমাকে দেখো। আমি সামনেই আছি।
নাফিসা হেসে দুষ্টুমি করে বললো, - ঘরে অন্ধকার, বারান্দায় চলো তোমাকে দেখি।
- আজকে দেখতে আবার লাইটের প্রয়োজন পড়ে গেলো! ঠিক আছে, চলো তাহলে।
মেঘ নিশিকে কোলে নিয়ে অন্যপাশের রোয়াকে এলো। নাফিসা পাশে এসে মেঘের এক হাত ঝাপটে ধরে হাতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। - মেঘ।
- হুম?
- ভালোবাসি।
- মেঘা।
- হুম?
- ভালোবাসি তার চেয়েও বেশি।
দুজনেই খুশগল্প করছে আর তাদের মেয়ে মুশফিকা চৌধুরী নিশির সাথে খেলা করছে।
মেঘবৃষ্টি রিসোর্টের ছাদে দাড়িয়ে আছে রায়হান চৌধুরী, মোহিনী চৌধুরী, সৈকত মির্জা ও রোকসানা মির্জা। ছেলেমেয়েরা বের হওয়ার পরপরই তারা আড্ডা দেওয়ার জন্য ছাদে এসেছে। চারজনই ছাদের একপাশে দাড়িয়ে উপর থেকে এতোক্ষণ ধরে তাদের ছেলেমেয়েদের কান্ড দেখছিলেন। কথা শুনতে পায়নি কিন্তু দূর থেকে দেখেই বুঝতে পেরেছে তারা আজ সবাই সুখী। ছেলেমেয়েদের সুখ দেখে এখন পিতামাতার মনেও প্রবাহিত হচ্ছে সুখের মেলা। শত দুখের পাহাড় ভেঙে আজ সব পরিবার একসাথে আছে এবং পুরনো অতীত ভুলে সুখে আছে সবাই। আর এই সুখের মূলে আছে মেঘ। ভাঙ্গা পরিবার জোড়া লেগেছে তারই প্রচেষ্টায়। গড়ে উঠছে সুখ নামক বিশাল পর্বত। মহান আল্লাহর রহমতে সবই সম্ভব হয়েছে কেবল, পড়েছে বলে “পাহাড়ে মেঘের ছায়া”!
লেখা – নূর নাফিসা
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “পাহাড়ে মেঘের ছায়া – Premer Golpo 2021″গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ুন – পাহাড়ে মেঘের ছায়া (১ম খণ্ড) -Valobasar Golpo 2021