অজানা আলোর খোঁজে (শেষ খণ্ড) – Valobasar Misty Golpo

অজানা আলোর খোঁজে – Valobasar Misty Golpo: পর্সা রিলেশনের সপ্তাহ খানেক পরেই ব্রেকআপ করে দিয়েছে। কিন্তু পটকা মন থেকে পর্সার ভালোবাসা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এজন্যই পর্সার বিয়ের বার্তা পেয়ে পটকা বেশ কষ্ট পেয়েছে।


পর্ব ৯

কারণ খেয়াল করলো লঞ্চের করিডোরটা লাল নীল আলোয় আলোকিত। চারদিকে শুধু অবাক চোখে তাকাচ্ছিল রুকু। লঞ্চের মনোরম পরিবেশটা যেন তার ব্যাকুল মনটা শীতল করতেছিল। তানভীর শুধু রুকুর দিকে তাকিয়ে তাকে অবলোকন করছিল। রুকু চারপাশ তাকিয়ে তানভীরের দিকে তাকাতেই তানভীর হতচকিয়ে গেল। অজানা এক ভালোবাসার বান যেন তানভীরের বুকে বিদ্ধ করলো।

চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরানোর ব্যার্থ চেষ্টা করছে তানভীর। কোনোভাবেই চোখ সরাতে পারছে না। ভালোবাসার রঙ্গিন সূতার টানে যেন চোখের বাঁধনে আটকা পড়েছে সে। অসম্ভব মায়াময় এ চোখের তাকানো। রুকু তানভীরের দিকে একটু জোরে এগিয়ে আবার গতি মন্থর করে দিল।

যতই তানভীরের দিকে এগুচ্ছিল ততই তানভীরের বুকের পালপিটিশন যেন বেড়েই চলছে। বুকে হাত দিতেই খেয়াল করলো বুকের ভেতরে হার্টবিটটা বেশ জোরালো ভাবে আঘাত হানছে। মনে মনে ভাবতে লাগল একি টর্নেডো নাকি ঘূর্ণিঝড়। রুকুর সামনে আগানোর গতি আরও মন্থর হতে লাগল আর তানভীরের বুকের ধুকপুকানি আরও বাড়তে লাগল।

অনেকটা ব্যস্তানুপাতিক হারে বাড়ছিল। রুকু ঠিক তানভীরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। চোখ দুটো তানভীরের চোখে তাক করা। হালকা নয়ন জোড়ায় ইশারা দিতেই তানভীরের বুকের বানটা যেন ছেদ করে এপিঠ দিয়ে বের হয়ে ওপিঠে চলে গেল।
~ আচ্ছা লঞ্চটার একটু বর্ণণা দিবেন? একটু ঘুরে দেখাবেন।

বলেই রুকু চোখটা নামিয়ে ফেলল। রুকুর চোখটা নামানোর সাথে সাথে তানভীরের বুকের পালপিটিশানটাও কমে গেল। স্বস্থির একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। খয়াল করল আকাশে চাঁদ নেই তবে হাজারও তারা ফুটে মেলা বসে আছে। তানভীরের মনে হচ্ছে সেখান থেকে একটা তারা খসে পড়েছে। খসে পড়া তারাটার অবস্থান এখন লঞ্চের করিডোরে। সে আর কেউ না সে হলো রুকু। তানভীরের নীরবতা দেখে রুকু হালকা করে ডেকে বলল,
~ বলবেন না।

তানভীর আকাশ থেকে চোখটা সরিয়ে রুকুকে বলল,
~ আমরা এখন যে লঞ্চে আছি সেটার নাম হলো এ ভি মনামী। এটা ঢাকা টু বরিশাল আবার বরিশাল টু ঢাকা আসে। আমরা এখন বরিশাল যাব। লঞ্চের টিকেট কাটতে হয় চার পাঁচদিন আগে। বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত এ লঞ্চ। এটা মূলত তিন স্তরে বিভক্ত। মোট ভি আই পি কেবিন আছে চারটি। লঞ্চের প্রথমে ঢুকে দোতলায় উঠার সময় একটা বড় টিভি স্ক্রিন চোখে পড়বে সেখানে লঞ্চের সব বিষয়গুলো দেখানো হয়। আমরা যে কেবিনে আছি সেটা হলো সিনগেল কেবিন। ভি আই পি কেবিন গুলো আরও সুন্দর।

রুকু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
~ ভি আই পি কেবিনে কখনো ঢুকে দেখেছেন?
তানভীর মাথা নেড়ে বলল,
~ হ্যাঁ দেখেছি।

~ আমাকে একটু দেখাবেন?
~ এখন কতৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দেখানো সম্ভব না। বরিশাল থেকে যখন ঢাকায় আসব তখন দেখানোর চেষ্টা করব।
~ আচ্ছা ঠিক আছে এখন দেখাতে হবে না। পরে দেখালেও হবে। তবে দেখতে কেমন সেটা বলুন আগে।

~ ভি আই পি কেবিনের প্রথমে ঢুকতেই সোফা পড়বে। সেখানে দায়িত্বরত আছেন কয়েকজন কেবিনটা দেখাশোনার জন্য। তারপর একটু সামনে ডাইনিং টেবিল রাখা আছে খাওয়া দাওয়া করার জন্য। তারপর যেখানে থাকা হয় সেখানে মোট দুটো বেড আছে। মোট চারজন মানুষ অনায়েসে আরাম করে থাকতে পারবে। ভি আইপি কেবিন ছাড়াও এ লঞ্চে ডাবল কেবিনও আছে। এসি কেবিন আবার নন এসি কেবিন ও আছে আমরা যে কেবিনে আছি সেটা এসি কেবিন। মাঝখানের এ অংশে অনেকে তুশক নিয়ে শুয়ে আছে খেয়াল করেছেন হয়তো এটাকে অনেকে বলে তুশক ব্যবস্থা। চলুন আমার সাথে।
~ কোথায় যাব?

~ একটু ছাদের দিকে যাওয়া যাক। যদিও ছাদটা এখন তালা দেওয়া। বেশি মানুষের ভিড় হলে ছাদ খুলে দেওয়া হয়। ঈদের সময়টাতে ছাদ খুলা থাকে। বলেই রুকুকে নিয়ে ছাদের কাছে গেল। রুকু অবাক হয়ে লঞ্চের সব খুতিয়ে খুতিয়ে দেখল। এ যেন এক প্রাসাদ। বাড়ির ছাদে যেমন পানির ট্যাংক থাকে তেমনি লঞ্চের ছাদেও পানির ট্যাংক বসিয়ে দেওয়া আছে। রুকু একটু পুলকিত নয়নে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আমাদের বাড়ির ছাদে ও এমন পানির ট্যাংক দেওয়া আছে। এটা দেখে বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। লঞ্চটা একদম প্রাসাদের মতো। লঞ্চের ভেতরটা যে এত সুন্দর হবে কখনো বুঝতে পারিনি।

তানভীর হাসতে হাসতে জবাব দিল
~ হুম একটা তিন তলা সুন্দর বাড়ি বলা যায় আরকি। মনামী লঞ্চের এ পানির ট্যাংক গুলো ভি আই এস টি অনুমোদিত পানি দ্বারা পূর্ণ। এটা আবার পিউরিফিকেশনের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে। চলেন আপনাকে নিয়ে একটু খাবার যে জায়গায় বিক্রি করে সেখানে যাই৷ আপনি তো জানতে চেয়েছিলেন লঞ্চে কোথায় থেকে খাবার পাব। সেটা দেখিয়ে নিয়ে আসি চলুন।

বলেই তনাভীর খাবারের কাছে নিয়ে গেল। রুকু শুধু অবাক নয়নে সব দেখতে লাগল। একটা লঞ্চের পরতে পরতে যে এত সুন্দরতা লুকিয়ে আছে সেটা রুকুর একদম অজানা ছিল। রুকু অবাক নয়নে পুরো লঞ্চটা ঘুরে দেখল। তারপর করিডোরের কার্নিশে এসে দাঁড়ালো। হালকা মৃদুমগ্ন বাতাস লঞ্চে ধেয়ে আসছে। পানির উপর হেলে দুলে যাওয়ার মতো রোমাঞ্চকর ব্যাপার হয়তো দ্বিতীয়টি আর হতে পারে না। চোখ বন্ধ করে বাতাস অনুভব করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যেই তানভীর ডেকে উঠল।
~ কেবিনে চলুন অনেক তো হলো।

~ আরেকটু থাকি না একটু সমুদ্রবিলাস করি।
তানভীর কথাটা শোনে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। তানভীরের হাসি দেখে রুকু অবাক চোখে তাকাল।
~ হাসছেন কেন এভাবে?
~ তো হাসব না তো কাঁদব।
~ অকারণে হাসার তো কারণ দেখছি না।
~ আপনি নদীর উপর দিয়ে গিয়ে সমুদ্রবিলাস করছেন?
~ মানে?

~ মানে এটা সমুদ্র না। আমরা ছোট বড় মোট ১০~১৩ টার মতো নদী পার হয়ে বরিশাল লঞ্চ ঘাটে পৌঁছাব। নদীর সংখ্যাটা মনে নেই তবে এরকমেই হবে হয়তো। সেখান থেকে অটো দিয়ে নথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ডে যাব৷ ১৫~২০ টাকার মতো ভাড়া লাগবে। নথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে ২০০ টাকা করে সিট ভাড়া করে বি আর টি সি দিয়ে কুয়াকাটা যাব। তখন নাহয় সমুদ্র বিলাস করবেন। এখন আপাতত নদী বিলাস করুন। নদী বিলাস শেষ হলে চলুন৷ অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, প্রায় দুটো বেজে গেছে।

আর তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার মতো লাগবে বরিশাল পৌঁছাতে। এর মধ্যে না ঘুমাতে পারলে শরীরটা বেশ খারাপ লাগবে। মাইগ্রেনের ব্যাথাটাও চেপে বসবে। রুকু কথা না বাড়িয়ে বলল,
~ চলুন তাহলে।

রুকু আর তানভীর কেবিনে আসলো। রুকু বোরকাটা খোলে নিল। তানভীর কেবিনের নীচে একটা বিছানা পেতে শুয়ে রুকুকে বলল,
~ আপনি উপরে শুয়ে পড়ুন। বলেই তানভীর চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।
রুকুও কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমে চোখটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। নীচে খেয়াল করে তাকিয়ে দেখল তানভীর ঘুমিয়ে গেছে। রুকুও পরক্ষণে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেল।
খানিকক্ষণ পর দরজায় একটা আওয়াজ পেল। রুকু ভয়ে ভয়ে জেগে উঠল। খেয়াল করল রাত চারটা বাজে। তানভীর তখন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বেড থেকে নেমে তানভীরকে হালকা ডেকে বলল,
~ এই যে একটু উঠবেন দেখুন না দরজায় কে নক করছে।

তানভীর এ কাঁত থেকে ও কাঁত হয়ে বলল,
~ বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এভাবে নক করতে দিন৷ কে আর করবে। এত রাতে সাড়া না পেয়ে নক করে চলে যাবে। মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে। মাইগ্রেনের ব্যাথাটাও চড়েছে খুব। আমাকে একটু ঘুমাতে দিন।
রুকু কথা না বাড়িয়ে বেডে পুনরায় শুয়ে পড়ল। এদিকে দরজায় নকের শব্দ প্রখর থেকে প্রখর হতে লাগল। যতই দরজা নক করছিল রুকুর ভেতরটা ততই ছেদ করে উঠছিল। কি করবে বুঝতে পারছিল না। ভাবল লিয়াকত চাচা আসলো না তো। বেশ সাহস করে দরজার সামনে গিয়ে আওয়াজ করে বলল,
~ কে নক করছেন? কিজন্য?

খেয়াল করলো ওপাশ থেকে মধুমতি বলে উঠল,
~ আমি মা, খোলো একটু।
রুকু হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে দরজাটা খুলতেই কেঁপে উঠল। খেয়াল করলো তেজনস্বিনী দাঁড়িয়ে। রুকুকে দেখে তেজস্বিনী বিকট একটা হাসি দিয়ে মুখে কি যেন ছিটাল। সাথে সাথে রুকুর মুখ দিয়ে লালা পড়তে লাগল রুকুর শরীরের শক্তি বিলীন হয়ে যেতে লাগল। তবুও রুকু সাহস হারাল না। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে তানভীরের উপর আঁচড়ে পড়ল। রুকু খেয়াল করলো তানভীরের ঘুমের তীব্রতা এতই প্রখর যে তানভীরের কোনো সাড়া শব্দ নাই। রুকু তানভীরের শার্টে হালকা টেনে বলতে চাচ্ছিল যে আমাকে বাঁচান। তবে সে মুখ দিয়ে কিছুই বলতে পারছে না। যতই বলার জন্য আওয়াজ তুলতে যাচ্ছে ততই আওয়াজটা গলায় আটকে যাচ্ছে। এদিকে তেজস্বিনী রুকুর পা ধরে টান দিতেই।

রুকু হিচড়ে যাচ্ছে। তানভীরের শার্টের কলার থেকে রুকুর হাতটা ছুটে যাচ্ছে। রুকুর কলিজাটা যেন কেঁপে যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে। বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এর মধ্যেই তানভীর আওয়াজটা পেয়ে ধুম করে উঠে বসে পড়ল। খেয়াল করল রুকু বিছানায় শুয়ে হাপাচ্ছে। হাত পা কাঁপাচ্ছে। তানভীর দৌঁড়ে গিয়ে রুকুকে ধরে ধাক্কা দিল।

কিন্তু রুকু সে ধাক্কায় সাড়া না দিয়ে আআআআআ …. করতে লাগল। তানভীর বোতল থেকে হালকা পানি নিয়ে রুকুর মুখে ছিটা দিতেই রুকুর চোখ গুলো কাঁপতে লাগল। হালকা কাঁপুনি দিয়ে রুকু উঠল। ভয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাসের আওয়াজ তুলছিল। তানভীর রুকুকে ধরে বলল,
~ হুট করে এরকম করছিলেন কেন?
~ দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। তাই এমনটা হয়েছে।

~ অহ মাই গুডনেস। আমি তো ভেবেছিলাম আপনাকে বুবা জ্বিনে ধরেছে। যেভাবে আআআআ…. করছিলেন। বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম। আচ্ছা যাইহোক আপনি বোতল থেকে পানি খেয়ে শুয়ে পড়ুন। সাড়ে চারটা বাজে আর এক ঘন্টার মধ্যেই হয়তো পৌঁছে যাব। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নেন। চা খেলে বলুন চা করে দিই। যদিও ঠান্ডা চা খেতে হবে কারণ পানি গরম করতে পারব না এখন। ঠান্ডা পানিতে টি ব্যাগ ডুবিয়ে খেতে হবে।
রুকু কপালটা টেনে উপরে তুলে বলল,
~ কিছু লাগবে না। আপনি ঘুমান। আপনাকে বেশ কষ্ট দিয়ে ফেলছি।
~ তা তো একটু দিচ্ছেনেই। তবে কপালে ছিল কি আর করা। ভেবেছি কুয়াকাটা ঘুরার পর আমার এক বন্ধু আছে তার সাহায্য নিয়ে পুলিশকে সবটা বলে এর ব্যাবস্থা করব।
~ আচ্ছা আপনি কুয়াকাটা কোথায় যাবেন?

~ আমার দলবল সব ঐখানে একদিন আগেই পৌঁছেছে। আমি ঢাকায় একটা কাজে আটকে গেছিলাম। তাই একদিন পর যাচ্ছি। কুয়াকাটা ঘুরতে যাব৷ তারপর সেখান থেকে আরেকটা জায়গা বের করে ঘুরব। ঘুরাফেরার একটা ঝোঁক আছে তো তাই।
~ ওহ আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি ঘুমান।

বলতেই বলতেই ঘড়ির কাঁটার টুংটাং আওয়াজ জানান দিল যে পাঁচটা বেজেছে। তানভীর হাত পা মুড়াতে মুড়াতে বলল,
~ এখন আর ঘুমিয়ে লাভ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই লঞ্চ ঘাটে পৌঁছাব সব গুছিয়ে নিই আগে।

বলেই সবকিছু গুছিয়ে নিল। খানিকক্ষণ পর লঞ্চ গন্তব্যে পৌঁছাল। তানভীর রুকুকে তাড়া দিয়ে বলল,
~ আপনি উড়না দিয়ে মুখ মুড়ে দিয়ে নেন। আমি লিয়ালত সাহেবকে বোরকাটা দিয়ে আসি।
রুকু তার উড়না দিয়ে ভালো করে মুখটা ঢেকে নিল। তানভীর বোরকাটা নিয়ে লিয়াকত সাহেবের কাছে যাওয়ার জন্য দরজাটা খুলতেই খেয়াল করল লিয়ালত সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। তানভীরকে দেখে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
~ বাবা বিদায় নিতে আসলাম। আবার কখন দেখা হয় বলা যায় না। তবে তোমরা চাইলে আমাদের বাড়ি যেতে পার।

তানভীর হালকা হেসে বলল,
~ চাচা যা করেছেন যথেষ্ট করেছেন। আমি আর রুকু এতেই অনেক কৃতজ্ঞ। কোনোদিন সুযোগ হলে যাব আপনার বাড়িতে।
এর মধ্যেই মধুমতি হেসে বলল,
~ তোমরা ভালো থাকো দোআ করি।

মধুমতিকে দেখে তানভীর বোরকাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
~ চাচী আপনার বোরকাটা।
মধুমতি বোরকাটা হাত দিয়ে তানভীরের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
~ এটা রেখে দাও কখনো দরকার পড়লে পড়ো। অনেক কাজে লাগতে পারে। তোমরা ভালো থাকো।

রুকু উড়না মুড়িয়ে লিয়াকত সাহেব আর মধুমতির কাছ থেকে বিদায় নিল। এরপর তানভীর রুকুকে নিয়ে লঞ্চ ঘাটে নামল। তারপর একটা অটো ভাড়া করলো নথুল্লাবাদ যাওয়ার জন্য। দুজনেই অটোতে উঠে পড়ল। কিছুক্ষণ পর নথুল্লাবাদ এসে পৌঁছাল। তানভীর পকেট থেকে ২০ টাকার দুটো নোট বাড়িয়ে দিল। দিনের বেলা লঞ্চ ঘাট থেকে নথুল্লাবাদ যাওয়ার ভাড়া লাগে ১০ টাকা কম করে নেয় এখন শেষ রাত তাই ভাড়া ১০ টাকা করে বেশি। তানভীর ভাড়াটা এগিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে খেয়াল করলো কেউ একজন তার ঘাড়ে হাত দিয়েছে। তানভীরের হাতের স্পর্শ পেতেই পেছনে তাকিয়ে চমকে গেল।


পর্ব ১০

তানভীর কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই চমকে গেল। কি বলবে বুঝতে পারছিল না। শুধু অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। রুকু খেয়াল করল একটা সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো ভীষণ লম্বা। চোখ গুলো টানা টানা। বেশ ধবধবা ফর্সা। রুপকথার রাজকন্যা বলল, ভুল হবে।

রুপকথার রাজকন্যার থেকে আরও সুন্দর বলতে হবে। রুকু মেয়েটার রুপের সৌন্দর্য দেখে এতটাই বিমোহিত যে সে চোখ সরাতে পারছে না। যতই চোখ সরানোর চেষ্টা করছে ততই যেন চোখটা আরও বেশি করে মেয়েটার দিকে তাক হয়ে আছে। মনে মনে ভাবতে লাগল এ মেয়েটা কে? এর সাথে তানভীরের সম্পর্কই বা কী। চুপ করে এসব ভাবতে লাগল। এর মধ্যে মেয়েটি বলে উঠল,

~ কি রে কেমন আছিস? আগের থেকে তো বেশ বদলে গেছিস।
তানভীরের চোখটা তখন মেয়েটার দিকে তাক করা। মেয়েটার কথায় তানভীর মেয়েটার মুখ থেকে চোখটা সরিয়ে নিল তারপর বলে উঠল,
~ আরে নিশা তুই এখানে? আমি তো বেশ ভালোই আছি। তুই কেমন আছিস?তুই ও তো বেশ বদলে গেছিস।
মেয়েটা হালকা হেসে জবাব দিল
~ এক মেয়ের মা হয়ে গেছি বদলাব না এখনো।

কথাটা শোনে রুকু হা করে তাকিয়ে ছিল মেয়েটার দিকে। কে বলবে এ মেয়েটার একটা বাচ্চা আছে। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য ১৯~২০ বছরে পা দিয়েছে। অপরদিকে মেয়েটার কথা শোনে তানভীর একদম চুপ হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার ভেতরে কোনো ঝড় আঘাত হেনেছে। মুখ ফুটে অনেক কথায় বলতে ইচ্ছে করছে তার তবুও অজানা বাঁধা যেন মুখটাকে আটকে দিচ্ছে। বেশ তালগোল পাকিয়ে ফেলছে সবকিছু৷ নিজেকে সামলাতে চেয়েও সামলাতে পারছে না। আনমনা হয়ে যাচ্ছে বারবার। মনের বিরুদ্ধে তোলপাড় চলছে তার। সে তোলপাড়কে দমিয়ে দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

~ বাহ! তোর মেয়েও হয়ে গেছে। মেয়ের বয়স কত হলো?
~ এই তো দু বছর চলে।
~ বাহ! বেশ ভালো তো। তা তোর স্বামী কেমন আছে? কেমন চলছে তোর দিনকাল।
নিশাকে স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করতেই নিশা একদম চুপ হয়ে গেল। নিশার নীরবতা দেখে তানভীর বলে উঠল,
~ কি রে চুপ হয়ে গেলি যে?
~ নাহ এমনি কিছু না। এসব কথা বাদ দে তো।
~ আরে বল না কি হয়েছে?

বলেই নিশার চোখের দিকে তাকাল। খেয়াল করল নিশার চোখের কোণে এক বিন্দু অশ্রুজল চিকচিক করছে। এই বুঝি জলটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে। চোখের জলটাকে আড়াল করার ব্যার্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে বারবার। তবুও শেষ পর্যন্ত আড়াল করতে পারেনি। টুপ করে জলটা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। নিশাকে কাঁদতে দেখে তানভীরের বুকের ভেতরটাও যেন হুহু করে উঠল। নিশার দিকে একটু এগিয়ে বলল,

~ কি রে কি হয়েছে বলল,ি না তো। এভাবেই বা কাঁদছিস কেন? বাপ্পি ভাই ঠিক আছে তো?
নিশা উড়নার কোণা দিয়ে চোখের জলটা মুছতে মুছতে বলল,
~ তেমন কিছুই হয়নি। বাপ্পি ভালোই আছে।
~ তাহলে কাঁদছিস কেন?
~ বাপ্পির সাথে ডিভোর্স হয়েছে সবে আট মাস হলো। তুই ঠিকেই বলেছিলে বাপ্পি ছেলেটা ভালো না। সেদিন তোর কথা না শোনে বেশ বড় ভুল করেছি। সেদিন তোকে অনেক অপমান করেছিরে। তুই পারলে ক্ষমা করে দিস।

ডিভোর্স এর কথাটা শোনতেই তানভীরের মনটা ব্যাকুল হয়ে গেল।
~ আমি ঐদিকের কথা এখনো মনে রাখব সেটা ভাবলি কি করে? কবে কি হয়েছে এগুলো নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোর ভালো সবসময় চেয়েছিলাম আজকেও চাই। আল্লাহ তোকে উত্তম প্রতিদান দিক। তা কোথায় যাচ্ছিলি তুই?
~ এখানে ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম পাঁচদিন হলো। একটা কাজে এসেছিলাম। ঐ কাজেই যাচ্ছি।
~ ওহ আচ্ছা। তা তোর মেয়ে কোথায় মেয়েকে তো দেখছি না।
কথাটা শোনে নিশা হাত দিয়ে ইশারা করে একটা ছেলের কোলে ছোট বাচ্চা দেখাল। তানভীর বাচ্চাটাকে দেখে বলল,
~ বাহ তোর মেয়ে তো তোর মতোই সুন্দর।
নিশা হালকা হেসে বলল,

~ তুই ও না। তা তোর পাশে কে? বিয়ে করেছিস নাকি? নাম কি ওর।
তানভীর কি বলবে বুঝতে পারছিল না। সত্যি বলল,ে ভালো হবে নাকি মিথ্যা বলল,ে ভালো হবে সেটা তানভীরের অজানা। রুকু শুধু তানভীর আর নিশাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। তানভীরের নীরবতা দেখে নিশা পুনরায় বলে উঠল,
~ কি রে বলল,ি না তো কে হয় মেয়েটা।
তানভীর আমতা আমতা করে বলল,
~ হ্যাঁ ঠিক ধরেছিস। বিয়ে করে নিয়েছি ওকে। কিছুদিন হলো বিয়ের। কুয়াকাটা হানিমুন করতে এসেছি।
নিশা এক গাল মিথ্যা হেসে বলল,
~ তা তোর বউয়ের নাম কি?

~ সম্পূর্ণ নাম রুকাইয়া। তবে সবাই রুকু বলে ডাকে।
~ বাহ বেশ সুন্দর নাম। কিন্তু এভাবে মুখ মুড়িয়ে আছে কেন?মুখটা একটু খুলতে বল দেখি দেখতে কেমন।
তানভীর আমতা আমতা করে বলল,
~ আসলে ও সবার সামনে মুখ খুলতে লজ্জা পায়। মনে কিছু নিস না। অন্য একদিন দেখাব। এখন গেলাম রে পরে কথা হবে।
বলেই যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করতে লাগল। নিশাকে তানভীর এড়িয়ে যাচ্ছে এটা যেন নিশা মেনে নিতেই পারছে না। এক রাশ কষ্ট যেন তাকে গ্রাস করছে। তবুও কিছুক্ষণ নীরব থেকে মুক্ত মাখা দাঁতগুলো বের হালকা হেসে বলল,
~ আচ্ছা ঠিক আছে ভালো থাকিস।

কথাটা বলার পরপরই রুকুকে নিয়ে তানভীর বি আর টিসির কাউন্টারে গিয়ে টিকেট কেটে বাসে বসল। বাসে বসতেই রুকু তানভীরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলল,
~ মেয়েটা কে ছিল?

কথাটা শোনেই তানভীরের রাগটা পাহাড়সম হয়ে গেল। দাঁতটা কিড়মিড় করে বলল,
~ কে সেটা আপনার জানার দরকার নেই আপনি যেমন আছেন তেমনিই থাকেন। বেশ অদ্ভূত মেয়ে আপনি। এত প্রশ্ন করার কি হলো?
তানভীরের এমন আচমকা রাগে রুকু ভয় পেয়ে গেল। ভয়ে মুখটাকে ফ্যাকাশে করে বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। তানভীর কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুকুকে বলল,

~ মেয়েটার নাম নিশা। মেয়েটা আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়তাম। আমার ব্যাচমেট। খুব ভালো লাগত ওকে। প্রথম দেখায় হালকা ভালোবাসায় মুড়ে নিয়েছিলাম ওকে। অসম্ভব মায়াময় মুখের আদলে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলাম। আমি অনেক ভালো ছাত্র হওয়ার সুবাধে নিশার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় বেশ ভালো করেই। নিশার প্রতি মনের অজান্তেই বোকার মতো অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। বেশ শান্ত আর গম্ভীর স্বভাবের ছিলাম। তাই বেশ কয়েকবার মনের কথা বলতে চেয়েও বলতে পারি নি। তবে বন্ধু মহলের সবাই জানতো আমি নিশাকে অনেক পছন্দ করি। কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে নিশার কানে এ কথাটা গেলেও নিশা তেমন পাত্তা দেয়নি। আমার সাথে তার কথা স্বাভাবিক ভাবেই হত। একদিন বেশ সাহস করে বললাম

~ নিশা তোকে অনেক ভালোবাসি। চাইলে বিষয়টা বিয়ের দিকে এগিয়ে নিতে পারি। তুই কি বলিস?
নিশা তখন আমার স্বপ্নটাকে ভেঙ্গে দিয়ে বলল,
~ তানভীর আমি তোকে সবসময় নিজের বন্ধুর মতো দেখে এসেছি৷ আর আমি ভালোবাসি বাপ্পিকে। সুতরাং এ বিষয়টা দ্বিতীয় বার আর তুলবি না। বন্ধু আছিস বন্ধুর মতোই থাক।
রুকু অবাক হয়ে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে তানভীরের কথা শোনছিল। তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
~ এ বাপ্পিটা কে?
~ আমাদের সিনয়র ভাই ছিল। যাইহোক যখন বুঝতে পারলাম নিশা বাপ্পি ভাইকে ভালেবাসে তখন আর নিশাকে পাবার আশা ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনায় পুনরায় মনোযোগ দিলাম। একটা সময় জানতে পারলাম বাপ্পি ভাইয়া ড্রাগস নেয় নেশা করে। একাধিক ময়ের সাথে রিলেশন করে। মেয়েদের পটিয়ে রুম ডেট করে। আরও অনেক বাজে অভ্যাস আছে তার। বড়লোক বাপের ছেলে তো টাকা উড়াতে কষ্ট লাগে না আরকি। এটা জানার পর আমি নিশাকে সবটা বললাম। নিশা আমার কথা শোনে বাপ্পি ভাইকে সব বলল,। বাপ্পি নিশাকে কি বুঝিয়েছিল জানি না৷ নিশা বাপ্পি ভাইয়ের কথা শোনে আমাকে ক্যাম্পাসে সবার সামনে চড় দিয়ে বলল,

~ আমাকে পাবার জন্য বাপ্পির নামে এত গুলো মিথ্যা বলতে তোর বিবেকে বাঁধল না।
আমি শুধু হা করে নিশার কথা শেনছিলাম। আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম ঠিক। তবে ভালেবাসা যে পেতেই হবে সেভাবে ভালোবাসি নি। ভালোবেসেছিলাম উদার মনে।
সেদিনের পর থেকে নিশার সাথে আর কথা হয়নি। তিন বছরের বন্ধুত্বটাও নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। আমি গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে অন্য কেথাও ভর্তি হয়ে নিই। আর নিশা বাপ্পিকে বিয়ে করে নিল। নিশার সাথে বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ নেই। সাড়ে তিন বছর তো হবে। এর মধ্যে আমি মাস্টার্স শেষ করলাম। আর দুবছর যাবৎ বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছি। টুকিটাকি ব্যবস্যা করছি হাত খরচটা চালানোর জন্য আর ভবঘুরে হয়ে বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করছি। এ ছিল আমাদের কাহিনি। অনেক দিন পর ওকে দেখে চমকে গেছিলাম। কথা বলতে চেয়েও কথা বলতে পারছিলাম না।
রুকু কাহিনিটা শোনার পর তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল,

~ নিশাকে বড্ড ভালেবাসেন তাই না?
রুকুর প্রশ্নটা শোনে তানভীর কোনো জবাব দিল না৷ কারণ তার উত্তর হয়তো তানভীর নিজেও জানে না। চুপ করে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে রইল। এর মধ্যেই বাসটা ছেড়ে দিল কুয়াকাটার উদ্দেশ্য। রুকু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাসের সিটে হেলান দিয়ে রইল। মিনিট বিশেক পর তানভীরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল৷ কারণ….


পর্ব ১১

কারণ খেয়াল করে দেখল তানভীরের চোখ থেকে অনর্গল জল পড়ছে। রুকুর আর বুঝতে বাকি রইল না তানভীর নিশাকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসে। তা না হলে একটা ছেলে একটা মেয়েকে হুট করে দেখে এত বছর পার করার পরও চোখের জল ফেলতে পারত না। রুকু শুধু তানভীরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর তানভীর চোখটা বন্ধ করে চোখের জল ফেলছে। কিন্তু কেন জানি না রুকুর বড্ড কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে রুকুর ভেতরটায় যেন কোনো অসহনীয় ব্যাথায় তাড়না করছে।

তানভীর কাঁদছে সেটার থেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছে তানভীর যে কারণটা নিয়ে কাঁদছে সেটা ভেবে। তাহলে কী সে তানভীরকে ভালোবেসে ফেলেছে। না না একি ভাবছে সে। এটা ভাবা নেহাৎ অন্যায়। কথাগুলো মনে মনে আওরাতে লাগল রুকু। চোখটা তানভীরের দিক থেকে সরিয়ে বাসের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে পড়ল। মৃদু মগ্ন বাতাস জানালা দিয়ে ধেয়ে আসছিল। রুকু উড়নাটা মুখ থেকে সরিয়ে মুখটা বাতাসের দিকে ধরে রাখল।

হালকা হালকা বাতাসে রুকুর মুখের সামনে থাকা চুল গুলো পেছন দিকে গিয়ে তানভীরের মুখের উপর পড়ছিল। আচমকা চুলের স্পর্শ পেয়ে তানভীর চোখের জলটা মুছে তাকিয়ে দেখল রুকুর চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে। কিছুটা ঝড়ের বাতাস বইলে গুল্ম জাতীয় গাছগুলো যেমন নড়ে চড়ে ঠিক ওমন ভাবে।

এর মধ্যেই রুকু জানালার দিক হতে মুখ ঘুরাতে খয়াল করল তানভীর তাকিয়ে আছে। তানভীরকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার বুকের ভেতরটা চমকে গেল। নিজেকে সামলে নিতেও পারছে না। যতই তানভীরের দিকে তাকিয়ে আছে ততই যেন তার চোখে ডুবে যাচ্ছে। তাহলে কি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে তানভীরকে। নাকি এটা নিছকেই মায়া। মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো বারবার বিদ্ধ করছিল।
এর মধ্যেই তানভীর তার ভাবনায় ব্যাগরা দিয়ে চোখের সামনে হাত দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
~ কি ব্যাপার কি দেখছেন? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
রুকু তানভীরের প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে বলল,
~ আমাদের আর কতক্ষণ লাগবে যেতে?

তানভীর রুরুকে এড়িয়ে যেতে দেখে বুঝতে পারল সে এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছে না৷ তাই বাড়াবাড়ি না করে সোজাসোজি বলল,
~ আর বেশিক্ষণ লাগবে না। দুই ঘন্টার মতো। আর নয়টার মধ্যেই পৌঁছে যাব। ঐখানে গিয়ে কিছু খেয়ে নিব তারপর সরাসরি পটকার কাছে চলে যাব।
~ ওরা কোথায় আছে?
~ ওরা একটা রিসোর্টে উঠেছে। ঐখানে আমার জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছে। তবে আপনার থাকা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। আমার সাথে তো আর থাকতে পারবেন না। আর পটকাকে যদি বউ পরিচয় দিই তাহলে আমার বাসায় খবরটা পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না।
~ তাহলে আমি কোথায় থাকব?

~ আমার মেয়ে ফ্রেন্ড কতজন গেছে। ওদের সাথে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। আর আমি যা বলি সেটা শুধু মাথা নেড়ে যেতে হবে। কারণ উনিশ বিশ হলেই পটকা মায়ের কাছে কথা লাগাবে আর মা কান্নাকাটি আর আহাজাড়ি জুড়িয়ে দিবে। মায়ের একমাত্র সন্তান তো তাই।
~ কেন আপনার কোনো ভাই বোন নেই?
~ না ভাইবোন নেই।
~ আপনার বাবা কি করে?

~ বাবা নেই। আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন বাবা মারা যায়। এরপর মা আর বিয়ে করেনি। আমাকে নিয়েই বাকিটা জীবনটা পার করে দেয়।
~ দুঃখিত আপনাকে ঐভাবে প্রশ্ন করা উচিত হয়নি।
~ আপনি তো ইচ্ছা করে এমন করেন নি আমি মনে কিছু নিইনি। সত্যটা তো আর মিথ্যা হয়ে যাবে না।
~ হুম তা তো অবশ্যই। আন্টি কি করেন?
~ মা প্রাইমারি স্কুলের টিচার। মা গ্রামে থাকে আর আমি ঢাকায় পড়াশোনা করেছি।
~ চাকুরির জন্য চেষ্টা করেননি?

~ নাহ এখনো করিনি। নিজের হাত খরচটা হয়ে যায় ঐরকম কিছু একটা করছি। আপাতত ঘুরাঘুরিটাকে উপভোগ করতে চাই।
~ আপনার তো ভালোই বয়স হলো বিয়ে করবেন না?
প্রশ্নটা শোনে তানভীর একদম চুপ হয়ে গেল। কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। মনের গহীনে একটা চাপা কষ্ট শুধু অনুভব করছে। কষ্ট টা কি সেটাও বুঝার অন্তরায়। চুপ হয়ে নীরব হয়ে গেল। নীরবতা দেখে রুকুও আর প্রশ্ন করার সাহস পেল না। তবে এটা বুঝতে পেরেছে নিশার প্রতি তানভীরের একটা টান এখনো কাজ করছে। রুকু চুপ হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসলো। অপরদিকে তানভীর ইয়ারফোন কানে গুজে মাথা বাসের সিটে হেলান দিয়ে রইল।
“ভালোবাসি ভালোবাসি

সেই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়…
বাজায় বাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি”
গানটা মৃদু স্বরে বাজতে লাগল। আর তানভীর সেটা চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করতে লাগল। বেশ মনোযোগ দিয়েই গানটা শোনছিল। আর আস্তে আস্তে গুণগুণ করছিল। রুকু আড়ঁচোখে তানভীরকে দেখছিল। কেন জানি না এভাবে দেখতে বেশ ভালো লাগছে তার। অদ্ভূত একটা মায়া তার মনে তৈরী হয়েছে। যতই তানভীরের দিকে তাকাচ্ছে ততই যেন ভালোবাসার অতল সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করেও যেন সেখান থেকে বের হতে পারছে না। কেন? কি কারণে? এমন হচ্ছে সব প্রশ্নই তার অজানা। মনে হচ্ছে এটা উচিত না তবুও যেন মন সে বাধাঁ মানতে নারাজ।
” মন বড়ই অদ্ভূত জিনিস। সে কখন কোন পথে চলে সেটা মনের মালিকেরও অজানা।”
তানভীরকে দেখতে দেখতে রুকু কখন ঘুমিয়ে গেল টের পেল না। ঘুমটা ভাঙ্গল তানভীরের হালকা ডাকে।
~ এই যে আমরা চলে এসেছি উঠেন। বাস থেকে নামতে হবে।
রুকু চোখ টেনে টেনে চোখ খুলে বলল,
~ হ্যাঁ উঠছি।

বলেই সব গুছিয়ে সিট থেকে উঠে দাঁড়াল। মাথাটা বেশ চক্কর দিচ্ছিল। হুট করে ঘুম থকে উঠায় শরীরটাও বেশ দুর্বল লাগছিল। তবুও শক্তি জুগিয়ে বাস থেকে নীচে নামল। তানভীর বুঝতে পারছিল রুকুর হয়তো খারাপ লাগছে। তাই রুকুর হাত থেকে রুকুর ব্যাগটা নিতে চাইলে। রুকু চটপট তানভীরের হাত থেকে ব্যাগটা ছাড়িয়ে নিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
~ আপনাকে আমার ব্যাগ ধরার সাহস কে দিল? এত সাহস দেখাতে আসবেন না আমার সাথে।

তানভীর যেন বোকাবনে গেল। কী বলবে উত্তর দিতে বেশ হিমশিম খাচ্ছিল। খানিকটা বিরক্তি কাজ করছিল। তাই একটু গলাটা গম্ভীর করে জবাব দিল
~ আজিব মেয়ে তো আপনি। আমি তো ব্যাগটা নিতে চেয়েছিলাম আপনার ভালোর জন্য। ব্যাগ হাতে নিয়ে হেল দুল খাচ্ছিলেন। তাই ব্যাগটা নিয়ে আপনার কষ্ট কমাতে চাচ্ছিলাম। এ ব্যাগে কি এমন আছে যে এমন করে উঠলেন। আমি ছিনতাইকারী না। আর ছিনতাইকারী হলে এতক্ষণে আপনার সব নিয়ে পালাতাম।

এতটুকু পথ আপনাকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছি। আর আপনি এখন আমাকে সাহস দেখানোর কথা বলছেন? সাহস দেখানোর হলে আগেই দেখাতে পারতাম। বেশ স্বার্থপর মেয়ে আপনি। একজন মানুষ এতটা করেছে আপনার জন্য আর আপনি এমন করে বললেন। আপনার মতো আজিব পাবলিক দুনিয়াতে দ্বিতীয়টি দেখি নি।
বলার সাথে সাথে রুকু বলে উঠল,

~ আপনি একটু সাহায্য করেছেন বলে আমার মাথা কিনে নেন নি। আমার পারসোনাল কত কিছুই ব্যাগে থাকতে পারে। আমার অনুমতি ব্যাতীত ব্যাগটা কেন নিতে চাইবেন? আমার অনুমতি না নিয়ে সরাসরি ব্যাগ ধরে টান দিচ্ছিলেন এটা কি ঠিক? এটুকু সাহায্য করে কী নিজেকে হিরো ভাবা শুরু করেছেন?
তানভীর রুকুর কথা যতই শোনছিল ততই তার রাগে গা ফেটে যাচ্ছিল। রাগে গিজগিজ করে কর্কশ গলায় বলল,

~ আমি তো আর আপনার ব্যাগ খুলে দেখতে চাই নি। অহেতুক রাগ কেন দেখাচ্ছেন? আমাকে মনে হয় আপনার প্রয়োজন নেই। তাই এমন করছেন৷ থাকেন আপনি আপনার মতো করে। আপনাকে গায়ে পড়ে সাহায্য করতে যায়নি যে হিরো সাজতে যাব। আজিব পাবলিক। আপনাদের মতো মেয়েদের সাহায্য করাই ভুল। থাকেন আপনি গেলাম আমি।
বলেই হনহন করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল তানভীর। রুকু তানভীরকে পিছু ডাকলেও কোনো কথা শোনল না। পাঁচ মিনিটে বেশ সামনে এগিয়ে গেছে তানভীর। খেয়াল করল রুকুর কন্ঠ শোনা যাচ্ছে না। রুকু আর পিছু ডাকছে না। তানভীর পিছনে ফিরে খেয়াল করলো রুকু পেছনে নেই।

পর্ব ১২

রুকুকে না পেয়ে একটু সামনে এগিয়ে গেল। খেয়াল করল রুকুর অস্তিত্বও নেই। বেশ চিন্তায় পড়ে গেল তানভীর। এতক্ষণ সাহায্য করল আর শেষমেষ রুকুর কোনো বিপদ হলো না তো। এটা ভেবেই তানভীরের মন ভয়ে কেঁপে উঠল। নিজের ভেতরেই অপরাধবোধ কাজ করছে কেন এতগুলো কথা বলতে গেল এজন্য। রুকু বয়সে ছোট কিন্তু সে তো বয়সে বড় ছিল তাহলে এমন ছেলে মানুষী কেন করতে গেল এটা ভেবেই কপাল চাপড়াতে লাগল।

আশে পাশে ভালো করে খেয়াল করল কোথাও রুকু নেই। মনের ভেতরটায় একটা শূন্যতা কাজ করছে তানভীরের। মনে হচ্ছে কি নেই কি নেই। এমন কেন লাগছে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে রুকুকে ছাড়া সে অসম্পূর্ণ। মনের গহীনে চাপা কষ্টটা যেন আবার চিনচিন করে উঠছে। নিশার থেকে পাওয়া কষ্টটা যেন রুকুর মাধ্যমে দ্বিতীয় বার পেল এমন মনে হচ্ছে। তাহলে কি তানভীর রুকুকে ভালোবেসে ফেলেছে।

এসব প্রশ্নই মনে মনে আওরাতে আওরাতে হতাশ হতে লাগল। ভেতরটা পুড়ে ছাড় খাড় হয়ে যাচ্ছিল। সামলাতে চেয়েও পারছে না। একটু এগিয়ে গিয়ে রুচিতা হোটেল পেল। কি আর করবে কিছু খাওয়াও দরকার। তাই বুক ভরা কষ্ট নিয়ে রুচিতা হোটেলে ঢুকল। সেখানে গিয়ে একটা সাদা দই অর্ডার করে বসে চোখ বন্ধ করলো।

চোখটা বন্ধ করতেই রুকুর মুখটা চোখে ভেসে উঠল। তানভীর পরক্ষণে চোখ খুলে খেয়াল করল রুকু সামনের চেয়ারটায় বসা। তানভীরের বুকটা যেন ধক করে উঠল। বুকে হাত দিতেই যেন মনে হলো বেশ জোরে জোরে হার্টবিট কম্পন তুলছে। স্তব্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। মনে মনে ভাবতে লাগল এটা স্বপ্ন নাকি কল্পনা নাকি বাস্তব। বেশ অবাক চোখে রুকুর দিকে তাকিয়ে রইল। আর রুকু মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। এর মধ্যেই সাদা দইটা টেবিলের উপর আসতেই রুকু সেটা টান দিয়ে নিয়ে খেতে আরম্ভ করলো। তানভীরের বুঝতে বাকি রইল না এটা রুকুই সামনে বসে আছে এটা তার কোনো কল্পনা না এটা বাস্তব। তাই চুপ করে অবাক নয়নে রুকুর খাদ্য আহরণটা দেখছিল।

এদিকে রুকু খাচ্ছিল আর মুচকি মুচকি হাসির ফিরিক তুলছিল মুখে। রুকুর হাসি যেন তানভীরের মনকে শীতল করতে লাগল। তানভীর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার একটু অস্থির হয়ে বলল,
~ কোথায় ছিলে তুমি? কত খোঁজেছি। আশে পাশে কোথাও তো পায়নি তোমায়?
রুকু হালকা হেসে বলল,
~ একটু লুকিয়ে ছিলাম। দেখছিলাম আপনি কি করেন। এতগুলো বকা দিয়েছেন। তার উপর এত পিছু ডাকলাম সাড়া দেননি তাই এমন করেছি।
~ কাজটা ঠিক করো নি তুমি। আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম জানো। এরকম করা একদম ঠিক না।
রুকু কথার জবাব না দিয়ে হালকা হেসে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল। তানভীর যে কখন রুকুকে তুমি করে বলে ফেলল সেটা তার বুঝার অন্তরালে রয়ে গেল। রুকুর গা ছাড়া ভাব দেখে তানভীর কিছুটা রাগ করলেও রুকুকে তেমন কিছু বলল, না। আরেকটা দই অর্ডার করে খেতে লাগল। তারপর আরও কিছু নিয়ে খাওয়া শেষ করে দুজন উঠল।
তারপর তানভীর রুকুকে নিয়ে সিকদার রিসোর্টের সামনে উপস্থিত হলো। সেখানে গিয়ে রুকু খেয়াল করল একটা মোটা পেটটা বের করা এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। দুই হাতে একটা করে পাউরুটি আর কলা নিয়ে। তানভীর ছেলেটার কাছে গিয়ে সিগারেট দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

~ তোর জন্য সেই সদরঘাট থেকে এগুলো বয়ে এনেছি।
রুকুর বুঝতে বাকি রইল না এই ছেলেটায় হলো পটকা। পটকা একটা হাসি দিয়ে কলা আর পাউরুটি একহাতে নিয়ে সিগারেট দুটো অন্য হাত দিয়ে তানভীরের হাত থেকে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
~ তোকে খুব মিস করতেছিলাম।

বলেই রুকুর দিকে তাকাল। রুকুর দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগল। এরকম ভাবে দেখছিল যে রুকু বেশ অস্বস্তি অনুভব করছিল। কিছুক্ষণ রুকুকে দেখে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,।
~ এই মেয়ে কে? কোথায় থেকে ধরে নিয়ে এসেছিস? তোর সাথে কেন আসলো? একে তো আগে কখনো দেখি নি। আগে তো তুই এমন কোনো মেয়ের কথা বলিস নি। নিশাকে ছাড়া তো তোর জীবনে কেউ আছে শোনি নি।

গধোগধো করে আরও এক গাদা প্রশ্ন করতে লাগল। তানভীর পটকার এত প্রশ্ন শোনে উত্তর দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। বেশ বিরক্ত হয়ে শুধু প্রশ্নই করে যাচ্ছে। তানভীর কিছুক্ষণ প্রশ্নগুলো শোনে একটা দমক দিয়ে বলল,
~ তুই থামবি নাকি? আমাকে আগে বলতে দে।
পটকা তানভীরের দমক খেয়ে একদম চুপ হয়ে বলল,
~ হ্যাঁ বল কি বলতে চাস?
~ এ হলো আমার জুনিয়র। কুয়াকাটা বেড়াতে যায়নি কখনো তাই আমাকে আসতে দেখে আমার সাথে আসতে চাইল। ভাবলাম আমাদের গ্রূপে মেয়ে আছে ও থাকলে তো সমস্যা নেই তাই সাথে নিয়ে এসেছি। ওর নাম রুকু। পুরো নাম রুকাইয়া। আর ওকে তিরা, সাথী, আর শষীর সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিবি।
পটকা একটু চুপ থেকে বলল,
~ ওহ এ কাহিনি আমি ভাবলাম অন্য কিছু। সে নাহয় থাকার ব্যবস্থা করা যাবে।
~ চল এবার।

বলেই তানভীর রুকুকে নিয়ে রিসোর্টের ভেতরে গেল। ভেতরে যেতেই সাথীর সম্মুখীন হলো তানভীর। সাথী তানভীর আর রুকুকে এভাবে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
~ দোস্ত এটা কে? চিনলাম না তো?
~ আমার পরিচিত এক জুনিয়র আমার সাথে ঘুরতে এসেছে। কখনো কুয়াকাটা দেখেনি। আমাকে আসতে দেখে বলল, আসতে চায় তোরা আছিস তাই নিয়ে আসলাম।
সাথী তানভীরের দিকে একটু আঁড় চোখে তাকিয়ে বলল,

~ নিশার কাহিনির পর থেকে কোনো মেয়ের সাথে তো কথা বলতে দেখিনি। আর এখন একটা মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছিস। তাও তেমন পরিচিত না। ব্যাপারটায় তো কেমন গোলমেল মনে হচ্ছে। তিরা শোনলে কষ্ট পাবে।
তানভীর কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বলল,

~ তিরাকে কে কষ্ট পেতে বলেছে। কবে কি ঘটেছে সেটা নিয়ে এখনো পড়ে থাকলে চলবে? বাদ দে এসব কথা। ওকে নিয়ে তোদের রুমে যা। আমি পটকার সাথে যাচ্ছি।
সাথী রুকুর দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল,
~ এই যে চলো আমার সাথে। তোমাকে রেস্ট নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিই।
বলেই রুকুকে নিয়ে রুমে গেল। রুমের দরজা নক করতেই তিরা দরজা খুলল। তিরা দরজা খুলার সাথে সাথে রুকুকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
~ এ মেয়েকে কোথায় থেকে ধরে নিয়ে এসেছিস। এ মেয়ে কে?
সাথী গা ছাড়া ভাবে জবাব দিল
~ আমি না তোর প্রাণের নাগর তানভীর ধরে নিয়ে এসেছে। তোকে তো পাত্তা দেয় না। কথা বলতে গেলেও কথা বলতে চায় না। আর এখন অল্প পরিচয়ে এ মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে চলে এসেছে।
কথা শোনেই তিরা রাগে গিজগিজ করতে লাগল। কিছুটা রাগ নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। গিয়েই তানভীরের সামনে গিয়ে একটা কান্ড বাঁধিয়ে বসল। তানভীর তিরার কান্ড দেখে ভয় পেয়ে গেল। কারণ….

পর্ব ১৩

কারণ খেয়াল করলো তিরা তার হাতে পরিহিত কাঁচের চুড়ি ভেঙ্গে হাতটা আঁচড় দিয়ে কেটে ফেলেছে। বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল তানভীর। তিরার হাত কেটে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। তিরার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিরা শুধু তানভীরের দিকে রাগী চেহারায় তাকিয়ে আছে। পটকা তিরাকে এভাবে বাচ্চা মানুষী করতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। তানভীর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিরার কাছে গিয়ে তিরার হাতটা ধরল।

হাতটা ধরার সাথে সাথে তিরা একদম স্থির হয়ে গেল। রাগের ছাপটা মুখ থেকে চলে গেল। তিরা কিছুটা সাইকোর মতো তানভীরকে ভালোবাসে। প্রায় পাঁচ বছর যাবত তানভীরকে ভালোবেসে এসেছে। কখনো মুখ ফুটে বলেনি তবে কাজে কর্মে বহুবার প্রকাশ পেয়েছে তার ভালোবাসা। মা বাবার আদরের সন্তান তিরা। টাকা পয়সার অভাব নেই বলল,েই চলে। পরিবারও তিরার সব আবদার পূরণ করতে মরিয়া হয়ে উঠে। তানভীরের প্রতি তার ভালোবাসাটা কিছুটা সাইকো টাইপের মতো বলা যায়।
যাইহোক তিরাকে ধরে তানভীর খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল,

~ কি হয়েছে তোর? এভাবে হাত কাটলি কেন? কেউ কি কিছু বলেছে?
তিরা স্বাভাবিক স্বরে জবাব দিল
~ নাহ কেউ কিছু বলেনি। ইচ্ছা হয়েছে তাই কেটেছি। কিছুই হয়নি আমার।
তানভীর একটু হেসে বলল,
~ মানুষের হাত কাটতেও ইচ্ছা হয় জানা ছিল না তো।
কথাটা শোনে তিরা কপট রাগ করে বলল,
~ তোর মতো তো সবাই না।

~ যাইহোক ক্ষেপিস না। আমি হাতটা পরিষ্কার করে গজ দিয়ে বেঁধে দিচ্ছি। গিয়ে রেস্ট নে।
এই বলে তানভীর তার ব্যাগ থেকে ঔষধের বক্সটা বের করে তিরার হাতটা পরিষ্কার করে সব রক্ত মুছে গজ দিয়ে বেঁধে দিল। তিরা একদম চুপ হয়ে তানভীরের দিকে তাকিয়ে ছিল। গজ বাঁধা শেষে তানভীর বলল,
~ যা এবার ঘরে গিয়ে রেস্ট নে। খাওয়া দাওয়া কর।
তিরা খাট থেকে উঠতে উঠতে বলল,
~ হ্যাঁ যাচ্ছি। তবে একটা কথা ছিল।
~ কি কথা বলবি বল।

~ তোর সাথে যে মেয়েটা এসেছে সেটা কে?
~ এত কিছু জেনে তুই কি করবি?
~ দরকার আছে বল।
~ সাথী তোকে কিছু বলেনি?
~ নাহ বলেনি। তুই বল।
~ তাহলে আর জানার দরকার নেই। সাথীর কাছ থেকে জেনে নিস। নাহয় ঐ মেয়ের কাছ জেনে নিস।
~ মেয়েটার নাম কি সেটা বলবি তো?

~ নাহ বলব না। তুই জিজ্ঞেস করে জেনে নিস। এখন একটু রেস্ট নিতে দে। ঘ্যানঘ্যান করিস না একদম।
~ আমি ঘ্যান ঘ্যান করি?
~ তাই তো করতেছিস। অবশ্য তোর কাজেই এটা। হুদাই ঘ্যানঘ্যান করা।
~ বেশি বলে ফেলতেছিস কিন্তু।
~ হুম তা তো বলতেছিই। আমার কাজও বেশি বলা।
~ রাগ তুলিস না একদম।
~ আমার বয়েই গেছে রাগ তুলতে। যা গিয়ে রেস্ট নে।

বলেই তানভীর খাটে শুয়ে গা টা এলিয়ে দিল। তিরা কোনো কথা না বলে সরাসরি নিজের রুমে আসলো। এসে দেখল রুকু খাটের উপর বসে একা একা চোখ বন্ধ করে আছে। রুকুকে এভাবে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখে তিরা একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,
~ এটা আমার জায়গা তুমি বসে আছ কেন?
রুকু ধাক্কা খেয়ে হতচকিয়ে উঠে তিরার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জবাব দিল
~ ভালো করে বললেই হত। আমি সরে যেতাম।

~ কারও জায়গায় বসার আগে পারমিশন নিতে হয় সেটা কি তুমি জানো না? আবার বলো ভালো করে বলল,েই হত। ফাজিল মেয়ে একটা।
~ আমি তো সাথী আপুর পারমিশন নিয়েছিলাম। উনি তো বলেনি এটা আপনার জায়গা। তাহলে আমি বুঝব কি করে এটা আপনার জায়গা।
~ এত তর্ক কষতে কে বলেছে তোমাকে? ঐদিকে যাও।
বলেই বসতে নিতে এল তিরা। তিরা বসতে নিতে গেলেই সাথী বলে উঠল,
~ কি রে তিরা তোর হাতে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ করা কেন?
তিরা চোখগুলো বড় বড় করে বলল,

~ তোকে এত কিছু বলতে যাব কেন? তুই তোর মতো থাক।
সাথী আর কোনো কথা বলল, না। কারন জানে তিরা বেশ রগচটা প্রকৃতির। বেশি বলতে গেলেই রাগের পরিমাণটা বাড়িয়ে হুলুস্থুল পাঁকিয়ে ফেলবে। তিরা বিছানায় শুইয়ে রুকুর দিকে বাঁকা চোখে কিছুক্ষণ তাকাল। তারপর বলে উঠল,
~ তোমার নাম কি?
রুকু কোনো উত্তর না দিয়ে বিছনার এক কোণে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তিরা পুনরায় জিজ্ঞেস করল
~ আমি তোমাকে তোমার নাম জিজ্ঞেস করেছি সেটা কী তোমার কানে গেছে? বেয়াদবের মতো উত্তর না দিয়ে ওদিকে ফিরলে কেন? এমন বেয়াদব মেয়ে তো জীবনে দেখি নি।
রুকু কথা শোনেও না শোনার মতো করে শুয়েই রইল। পাশ থেকে সাথী বলে উঠল,
~ ওর নাম রুকু।
তিরা রাগী গলার উত্তর দিল

~ আমি তোকে নাম বলতে বলেনি। ওকে জিজ্ঞেস করেছি। উত্তর টা ওর দেওয়া দরকার।
~ তিরা থাক ও হয়তো কমফর্ট ফিল করছে না।
~ কমফোর্ট ফিল করবে না তো এসেছে কেন?
~ তিরা চুপ করবি তুই।
এর মধ্যেই শষী কোথায় থেকে যেন এসে তিরার কথায় জোর টেনে বলল,
~ এখানে কি হয়েছে? এত চিল্লা পাল্লা কেন?
সাথী গলার স্বরটা মৃদু করে বলল,
~ তেমন কিছু না। তিরার মাথায় ভূত চেপেছে।

~ কেন কি হয়েছে তিরার।
বলেই বিছানায় রুকুকে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
~ এ মেয়ে কে? এখানে কি করছে?
সাথী উত্তর দিতে গেলে সাথীকে ব্যাগরা দিয়ে তিরা বলে উঠল,
~ এ হচ্ছে পারস্যের শাহজাদী।
শষী চোখ গুলো বড় বড় করে বলল,
~ পারস্যের শাহজাদী এখানে কি করছে। তার তো পারস্যে থাকার কথা।
বলেই হাসতে লাগল। সাথী একটা দমক দিয়ে বলল,
~ তোরা কি থামবি নাকি বল?
তিরা কপট রাগ করে উত্তর দিল

~ তোর জ্বলে কেন এত?
শষী বুঝতে পারছিল না কাহিনিটা কি। তাই তিরাকে শান্ত গলায় বলল,
~ কাহিনি কী? সেটা আগে বলতো।
তিরা উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইল। সাথী শষীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
~ তানভীরের সাথে ঐ মেয়েটা এসেছে। তানভীর বলল, তানভীরের জুনিয়র মেয়েটা। তবে জানি না মেয়েটা কে। নাম রুকাইয়া। রুকু বলে ডাকে সবাই।
শষী কৌতুহলী গলায় জবাব দিল
~ সিরিয়াসলি তানভীর নিয়ে এসেছে এ মেয়েকে?
সাথী মাথা নেড়ে বলল,
~ হ্যাঁ।

~ তানভীর একটা মেয়ে নিয়ে এসেছে ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে লাগছে।
~ আমার কাছেও গোলমেলে লাগছে। কিন্তু এটা সত্যি মেয়েটাকে তানভীরেই নিয়ে এসেছে। আর সে মেয়েকে নিয়েই তিরার এত রাগ। জানিসেই ওর পাগলামির একটা বদ অভ্যাস আছে।
সাথীর কথা শোনে তিরার রাগ মুখটা পুনরায় চক্ষু গোচর হলো। রাগে চোখটা অগ্নিশর্মা করে বলল,
~ এখানে পাগলামির কি দেখলি? আমরা এসেছি একটা গ্রূপ করে ঘুরতে। হুট করে এ মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে। এটা কি তানভীর ঠিক করেছে?,
শষী শান্ত স্বরে বলল,
~ তা ঠিক করেনি। তবে নিয়ে এসেছে এখন তো আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। থাকতে দে। আমারা আমাদের মতো চললেই হবে। নিজেদের মজা নিজেরাই করব। ওর জন্য আমাদের আনন্দ মাটি হবে না।
সাথী শষীর কথায় জোর দিয়ে বলল,

~ একদম ঠিক।
বলেই শষী রুকুর দিকে তাকিয়ে বালল
~ কিন্তু মেয়েটা কোনো কথা বলছে না কেন?
তিরা রুকুর দিকে উঁকি মেরে দেখে মুখটা বাঁকিয়ে বলল,
~ পারস্যের শাহজাদী তো ঘুমাচ্ছে।
দাঁড়া তাকে ঘুমানো বের করছি ভালো করে। এই বলে তিরা বিছানা থেকে উঠল। তিরাকে হুট করে উঠতে দেখে সাথী বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
~ আরে আরে কি করতে যাচ্চিস আবার।
সাথীর অস্থিরতা দেখে শষী বলে উঠল,

~ আরে এত অস্থির হস না। ওরে ওর মতো করতে দে এতে যদি ওর শান্তুি হয়। কি আর করবে।
সাথী কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে তিরার কান্ড দেখতে লাগল। তিরা হুট করে..

পর্ব ১৪

তিরা হুট করে এক মগ পানি এনে রুকুর উপর ঢেলে দিল। রুকু সাথে সাথে উঠে খিঁচুনি দিতে লাগল। সাথী রুকুকে এভাবে খিঁচুনি দিতে দেখে তাড়াতাড়ি ওর কাছে গেল। ওকে ধরতেই লক্ষ্য করল ওর শরীরে প্রচন্ড ভাবে খিঁচুনি দিচ্ছি। সাথী ভয়ে ভয়ে বলল,
~ তিরা কি দিয়েছিস তুই। এখন মেয়েটার কিছু হলে কি করবি? পানির সাথে কি কিছু মিশিয়েছিস?
রুকুর অবস্থা দেখে তিরাও ভয়ে ঢুক গিলতে লাগল। ঢুক গিলতে গিলতে বলল,
~ আমি শুধু পানিই দিয়েছি আর কিছু দেয়নি। কেন যে এমন হলো বুঝতে পারছি না।
শষী তিরাকে দমক দিয়ে বলল,
~ সব কিছুতে তোর বাড়াবাড়ি না করলে হয় না।

শষীর কথা শোনে সাথী চেঁচিয়ে উঠে বলল,
~ তুই কথা বলিস না। তিরাকে তুই এই আস্কারা দিয়েছিস। এখন মেয়েটার কিছু হলে সমস্ত দায়ভার আমাদের নিতে হবে।
হাত পা মালিশ কর দেখি কি হয়। তিরা কিছু না বলে সাথীর সাথে রুকুর হাত পা মালিশ করা শুরু করল। এদিকে রুকুর অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। এমতাবস্থায় সাথী বলে উঠল,
~ শষী তুই তানভীরকে ডাক দে আগে।
শষী দৌঁড়ে তানভীরের কাছে গিয়ে হাঁপাতে লাগল। শষীর হাঁপানো দেখে পটকা বলে উঠল,
~ কি রে হাঁপাচ্ছিস কেন?
~ রুকু ….

বলেই শষী হাঁপাতে লাগল। রুকুর নামটা মুখে নিতেই তানভীর ভয় পেয়ে গেল। ভাবতে লাগল মোনালি এসে রুকুকে ধরে নিয়ে গেল না তো? বলেই ভয়ে কুঁকড়ে গেল। তাড়াহুড়া করে বিছানা থেকে উঠে বলল,
~ রুকু এখন কোথায়? মোনালি কি রুকুকে ধরে নিয়ে গেছে।
তানভীরের কথা শোনে শষী বোকার মতো তাকিয়ে রইল। বোকার মতো তাকিয়ে অবাক চোখে বলল,
~ মোনালি কে? আর কাকে ধরে নিবে? মানে বুঝলাম না।
শষীর কথা শোনে তানভীর বুঝতে পারল। রুকুকে কেউ ধরে নেয়নি তবে রুকুর অন্যকিছু হয়েছে। তাই তানভীর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। তারপর পরক্ষণেই উৎকন্ঠা হয়ে বলল,
~ তাহলে রুকুর কি হয়েছে?
শষী ঢুক গিলতে গিলতে বলল,

~ তিরা চোখে মুখে পানি ঢেলে দিয়েছিল। তারপর থেকে খিঁচুনি দিতেছে। হাত পা মালিশ করেও ঠিক করতে পারছি না।
কথাটা শোনেই তানভীর রাগী গলায় জবাব দিল
~ তিরার সাহস কি করে হয় এমন কাজ করার। এমনিই রুকুর অনেক সমস্যা চলছে। তার উপর ওকে এভাবে টর্চার করছে। আর তোরাও সেটা সায় দিয়ে গেলি? সাথী আর তুই কোথায় ছিলি।
তানভীরের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শষী একদম চুপ হয়ে রইল। পাশ থেকে পটকা বলে উঠল,

~ তানভীর এখন রাগারাগির সময় না। আগে চল গিয়ে দেখে আসি মেয়েটার কী অবস্থা। তারপর নাহয় বাকি রাগারাগি করিস।
তানভীর পটকার কথা শোনে কোনো কথা না বলে সরাসরি রুম থেকে বের হয়ে গেল। দৌঁড়ে রুকুর রুমে গেল। গিয়ে দেখল রুকু স্বাভাবিক হয়ে বসে আছে। পাশে তিরাও মাথা নীচু করে বসে আছে। পটকা, শষী আর তানভীর রুকুকে স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকতে দেখে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তানভীর রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আপনি ঠিক আছেন তো?
রুকু মাথা নেড়ে বলল,
~হ্যাঁ ঠিক আছি।

তারপর তানভীর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
~ সবার মনে হয় রুকুকে নিয়ে বেশ সমস্যা হচ্ছে। তাহলে শোন রুকু আমার কোনো জুনিয়র না। না ওর সাথে আমার প্রেম না কিছু। রাস্তায় দেখা ওর সাথে।
তানভীরের কথা শোনে সবাই হা করে তাকিয়ে রইল। সামন্য রাস্তায় দেখা একটা মেয়েকে তানভীর নিয়ে এসেছে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভূত মনে হলো সবার কাছে। সবাই এক গলায় বলে উঠল,
~ কিন্তু হুট করে এ মেয়েকে নিয়ে এখানে কেন আসলি? ওকে কি আগে সত্যিই চিনতিস না।

~ না চিনতাম না।
~ তাহলে? কি হয়েছে কাহিনি বল।
~ হ্যাঁ বলছি। তবে শষী তোকে একটা সাহায্য করতে হবে।
~ কি সাহায্য?
~ তোর মামা পুলিশ অফিসার তো তাই না?
~ হ্যাঁ।
~ তোর মামার সাহায্য লাগবে।
~ কারণটা কী আগে বল।

তারপর তানভীর রুকুর জীবনে ঘটে যাওয়া কালো অধ্যায়ের কথা বর্ণণা করলো। সবাই যখন কথা গুলো শোনছিল সবার কাছে বেশ অবাস্তব লাগছিল বিষয়টা। তানভীর যতই বলছিল ততই সবার মাথায় ইষৎ ঘাম চক্ষুগোচর হলো, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। বিষয়টা সবার কোমল মনে বেশ নাড়া দিল।

তিরার ভিতরটাও খা খা করতে লাগল এটা ভেবে যে কেন সে রুকুকে না জেনে এত কষ্ট দিল। তানভীর পুরো কাহিনি বলে চুপ হয়ে গেল। রুমটায় তখন পিনপনা নীরবতা বিরাজ করছে। সবার ভেতরটায় অজানা একটা ভয় তাড়া করছে। কেউ কিছু বলছে না শুধু নীচের দিকে তাকিয়ে দম নিচ্ছে। মিনেট পনেরো রুমটায় নীরবতা বিরাজ করল। নীরবতার বাঁধ ভাঙ্গে শষীর তীক্ষ্ণ কন্ঠে। শষী বলে উঠল,
~ আচ্ছা ঠিক আছে আমার দিক থেকে মামাকে বলে যতটা সাহায্য করার দরকার করব। আপাতত আমরা ঘুরতে এসেছি। দুদিন ঘুরে তারপর রুকুর দিকটা ভাববো। কি বলিস সবাই।
সবাই তাল মিলিয়ে এক গলায় বলে উঠল,

~ হ্যাঁ এটাই ভালো হবে। এতে করে রুকুর ও মনটা রিফ্রেশ হবে। সমুদ্র পাড়ে ঘুরতে যাব। মনটা রিফ্রেশ করে তারপর সবাই এক জোট হয়ে এ অন্যায়ের সমাধান করব।
তিরা কোমল কন্ঠে রুকুর হাতটা ধরে বলল,
~ তোমার সাথে এমন করা মোটেও উচিত হয়নি। এতটা কষ্ট সহ্য করেছ বুঝতে পারিনি। পারলে ক্ষমা করে দিও।
তিরা খুব রগচটা হলেও ওর রাগটা বেশিক্ষণ স্থায়ী না। ভেতরে ভেতরে সে খুব নরম মনের মানুষ বলা যায়। তিরার কথা শোনে রুকু হালকা স্বরে উত্তর দিল

~ আমি কিছু মনে করেনি। আপনারা তো না বুঝে করেছেন। তবে আমার জন্য এতকিছু করছেন এটাই অনেক। আপনাদের মতো হেল্পফুল কাউকে পাব কখনো চিন্তা করেনি। অজনা আলো খোঁজতে গিয়ে অজানা কতগুলো উদার মনের মানুষের সাথে দেখা হলো। আপনাদের ঋণ কখনো ভুলব না।
সবাই দৃঢ় গলায় বলল,

~ কাউকে সাহয্য করাতেই আমরা শান্তি পাই। তোমাকে সাহায্য করতে পারলে বেশ ভালো লাগবে।
সাথী পটকার দিকে তাকিয়ে দেখল। পটকা এখনো হাতে বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে একটা একটা করে বিস্কুট বের করছে আর মুখে পুড়ে খাচ্ছে। পটকাকে এভাবে খেতে দেখে সাথী কপালটা কু্ঁচকে বলল,
~ তুই কি একাই খাবি নাকি ওদের খেতে দিবি। কত দূর থেকে এসেছে সে হুঁশ কি তোর আছে। সারাদিন কি তোর খাওয়া ছাড়া কাজ নেই। এটা না ওটা খেতেই আছিস।
তানভীর সাথীর কথা শোনে হাসতে হাসতে বলল,
~ খেতে দে ওরে। ওর তো এই একটাই পেট। না খেলে সেটার কি মান থাকবে নাকি।

তানভীরের কথাটা শোনে সবাই হুহু করে হেসে উঠল। পটকা সবার হাসি দেখে মুখটা গম্ভীর করে বলল,
~ তোদের সবার শুধু আমার খাওয়ার দিকে নজর। যাইহোক তানভীর চল রুমে খাবার আছে খেতে চল। আর সাথী তুই আমার রুমে আস তো। খাবার এনে রুকুকে দে খেতে।
বলেই পটকা তানভীরকে নিয়ে চলে গেল। আর সাথীর পটকার সাথে গেল। তিরা এর মধ্যে রুকুর সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলল। সাথী এসে তিরা আর রুকুর এত ভাব দেখে মনে মনে ভাবতে লাগল। তিরা মেয়েটা সত্যিই পাগল। হুট করে রাগ করলেও সবচেয়ে বেশি মায়া তার মনেই আছে। সাথী তাদের আড্ডায় ব্যাগরা দিয়ে বলল,

~ হয়েছে হয়েছে এখন আর এত কথা বলতে হবে না। রুকু খবারটা খেয়ে নাও৷ তারপর সবাই সমু্দ্র পাড়ে ঘুরতে যাব।
বলেই সাথী খাবারটা এগিয়ে দিল রুকুর দিকে। রুকু খাবারটা সাথীর হাত থেকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে খুশিতে নাচতে লাগল। জীবনে কখনো সমুদ্র দেখেনি। আজকে সে সমুদ্রবিলাস করবে। এটা ভেবেই তার মন আনচান করতে লাগল। ঝটপট খাবারটা খেয়ে নিয়ে একটু গা ছড়িয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ল। খানিকক্ষণ পর একটা তীক্ষ্ণ আওয়াজে রুকুর ঘুম ভাঙ্গল। ঘুম থেকে উঠে অবাক চোখে।

পর্ব ১৫

ঘুম থেকে উঠে অবাক চোখে লক্ষ্য করল সবাই বেশ পরিপাটি হয়ে আছে সমুদ্র পাড়ে যাওয়ার জন্য। রুকু উঠতেই তিরা বলে উঠল,
~ রুকু তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও আমরা সবাই এখন সী বিচে যাব। সমুদ্রবিলাস করব। অনেক মজা করব।
তিরার সাথে সাথী আর শষী ও গলা মিলিয়ে বলে উঠল,
~ ইয়া… হো… খুব মজা হবে। রুকু তাড়াতাড়ি করো।

রুকু তাড়াহুড়ো করে উঠে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে কাপড়টা পাল্টে নিল। ওয়াশ রুম থকে বের হতেই তানভীরের চোখে চোখ পড়ল। তানভীর এসেছিল সবাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তানভীর রুকুর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। লাল জামায় লাল মায়া পরী লাগছিল রুকুকে। রুকুকে যে খুব ফর্সা বা আহামরি সুন্দর তা না। তবে রুকুকে কেন জানিনা তানভীরের বেশ ভালো লাগে। বলা যায় সৌন্দর্য নিরুপণ করে মানুষের চোখ।

মানুষের চোখের দৃষ্টিতে সৌন্দর্যের বর্ণনা গুলো বরাবরেই ভিন্ন হয়। কারও চোখে ফর্সা বেশ সুন্দর মনে হয়, কারো চোখে কালো, কারো চোখে শ্যামলা। বলা যায় বিচিত্র আকৃতির মানুষকে পছন্দ করার জন্য সৃষ্টিকর্তা বিচিত্র সব চোখ দিয়ে দিছেন। তানভীরকে রুকুর দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিরা বেশ ছটফট করছিল। তবে এখন রাগ দেখাতে একদম ইচ্ছা করছে না তার। রুকুর প্রতিও কেন জানি না অসম্ভব মায়া তিরার জমে উঠেছে। যা চাইলেও সে নিবারণ করতে পারছে না। তিরা একটু চুপ থেকে রুকুর সামনে গিয়ে রুকু আর তানভীরের মধ্যে একটা দেয়াল তৈরী করে তানভীরকে বলল,

~ কি রে যাবি না সমুদ্র পাড়।
তানভীর আর রুকু দুজনেই লজ্জায় মাথা অবনত করে ফেলল। রুকু চুপ হয়ে মাথার চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকাতে লাগল। আর তানভীর স্থিত গলায় জবাব দিল,
~ হ্যাঁ যাব তো। তোরা সবাই তৈরী তো?
সবাই এক গলায় বলে উঠল,
~ একদম তৈরী।
সাথী এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
~ পটকা কোথায়?

বলতে বলতেই সাথীর চক্ষুগোচর হলো যে বিশালদেহী পটকা এসে দাঁড়িয়ে আছে সাথীর সামনে। এক হাতে কলা আরেক হাতে কেক নিয়ে। বড় বড় কামড় দিয়ে কলাটা পুরো মুখে নিয়ে আমলাতে আমলাতে বলল,
~ আমাকে খুঁজছিস কেন?
সাথী পটকার দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে পটকার পেটে একটা থাপা বসিয়ে বলল,
~ পেটটা তো কম বড় হয়নি৷ এখন খাওয়া তো বন্ধ করতে পারিস। এত খাস কেন? তুই তো খেতে খেতেই অক্কা পাবি।
সাথীর কথা শোনে সবাই হুহু করে হেসে দিল সেই সাথে রুকুও। রুকুর অট্ট হাসিটা তানভীরের চক্ষুগোচর হলো। যতই রুকুকে দেখছিল ততই যেন রুকুর মায়ায় পড়ে যাচ্ছিল। ভালোবাসাটা দ্বিতীয়বারের মতো তার মনে নাড়া দিচ্ছিল। কিন্তু প্রথমবার যে ভুল করেছে দ্বতীয়বার তা করতে তানভীর বেশ নারাজ। নিজেকে সামলে নিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে সবাইকে ক্ষীণ গলায় চুপ করতে বলল,। তারপর বলল,

~ তোরা কি এখানেই সময় নষ্ট করবি নাকি বাহিরে যাবি।
তানভীরের কথায় সবাই একদম নিস্তব হয়ে গেল। নিস্তব হয়ে আস্তে গলায় বলল,
~ আমরা তৈরী চল যাওয়া যাক তাহলে। সাগরকন্যাকে দেখার জন্য। ঢাকা থেকে ৩২০ কি.মি দক্ষিণে এসেছি শুধু সাগরকন্যা দেখার জন্য। যাব না মানে অবশ্যই যাব।
তানভীর মুচকি হেসে সবাইকে বলল,

~ চল তাহলে বের হওয়া যাক। যার যা প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ঠিক করে নে।
সবাই সবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো ঠিক করে নিয়ে বের হলো সাগরকন্যা দেখার জন্য। সেখানে সমুদ্রে গোসল করে মাঝখানে রিসোর্টে ফিরে কাপড় পাল্টে আবার বের হবে। তারপর হালকা ঘুরে সন্ধ্যা হলে সূর্য অস্ত দেখে পুনরায় রিসোর্টে ফিরবে সবাই।

সবাই আনন্দে নাচতে নাচতে বের হলো। রুকু তানভীরের পাশ ঘেষে হাঁটতে লাগল। তিরা তা দেখে দুজনের মাঝখানে ঢুকে তানভীরকে বলতে লাগল
~ চল তাড়াতাড়ি পা চালা।
বলেই রুকুর হাতটা ধরে একটু সামনের দিকে এগুলো।
সাথী আর শষী বিষয়টা খেয়াল করে হাসতে লাগল। সাথী পটকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
~ কুয়াকাটা সম্পর্কে কিছু বল। তোর চেয়ে ভালো তো কেউ বলতে পারবে না। বেশ কয়েকবার এসেছিস।
পটকা খেতে খেতে বলল,

~ এখন খাওয়ার মধ্যে বিরক্ত করিস না। তানভীর এর আগে আমার সাথে এসেছে ওকে জিজ্ঞেস কর।
তিরা উদ্দীপনা নিয়ে তানভীরের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ কি রে বল তাড়াতাড়ি।
তানভীর হালকা পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

~ কুয়াকাটা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একটা সমুদ্র সৈকত যা সাগরকন্যা নামে পরিচিত। এটি ১৮ কি.মি দৈর্ঘ্যের একটি সমুদ্র সৈকত যেখানে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। পটুয়াখালী জেলার মাহিপুর থানার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলি ইউনিয়নে কুয়াকাটা অবস্থিত। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব সড়ক পথে ৩৮০ কি.মি এবং বরিশাল থেকে এর দূরত্ব ১০৮ কি.মি।

কুয়া শব্দটি কূপ শব্দ থেকে এসেছে। আরকানদের আগমণকে কেন্দ্র করে মূলত এ নামটা রাখা হয়। ধারণা করা যায় যে আঠার শতকে মোঘল শাসক দ্বারা বার্মা থেকে বিতারিত হয়ে আরকানরা এ অঞ্চলে এসে বসবাস করে। এখানে সুপেয় জলের অভাব পুরণের জন্য তারা অনেক কুয়া খনন করে সেখান থেকে এর নাম হয় কুয়াকাটা।
কুয়াকাটা সমুদ্রের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ম্যানগ্রোভ বনের নাম হলো ফাতরা বন। যা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সুন্দরবন হিসেবে পরিচিত।

কুয়াকাটার শুরুর দিকে রাখাইন পল্লী ও কেরানী পাড়ার শুরুতে শ্রি মঙ্গল বৌদ্ধ মন্দিরের নিকট রয়েছে প্রাচীন কূপ। যাকে কুয়াকাটার কুয়া বলা হয়।
কুয়াকাটা থেকে প্রায় ৪ কি.মি উত্তরের রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বড় মৎস ব্যবস্যা কেন্দ্র আলীপুর।
কুয়াকাটা থেকে প্রায় ৮ কি.মি পূর্বে রাখাইন আদিবাসীদের আবাসস্থল মিশ্রীয় পাড়া রয়েছে। সেখানের বৌদ্ধ মন্দিরে রয়েছে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূর্তি।

এছাড়াও রেয়েছে লাল কাকরা চর, শুটকি পল্লী, তিন নদীর মোহনা ইত্যাদি।
রুকু এসব শোনে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
~ এত কিছু দেখার আছে। আমার তো এখনেই খুশিতে মন নাচছে। এখন কোথায় যাব আমরা।
তানভীর উত্তর দিতে গেলে পটকা কথাটা আটকে দিয়ে বলল,
~ আমরা এখন সী বীচে যাব। তারপর সবকিছু ঘুরব। তারপর সূর্যাস্ত দেখে একদম ফিরব।

সাথী আর শষী উৎফুল্ল গলায় বলল,
~ কি যে আনন্দ লাগছে। উফ…..
সবাই আনন্দে উচ্ছাসে গেল কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। সমুদ্রের ঢেউ তখন আঁচড়ে পড়ছিল। রুকু দৌঁড়ে গিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছে যেতে নিলে তানভীর রুকুর হাত টা ধরে ফেলল। রুকুর হাতটা ধরার সাথে সাথে রুকু যেন একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করল। চোখটা বন্ধ করে পুনরায় চোখটা খোলে ফেলল। তানভীরের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল,
~ কি হয়েছে?

~ এখনেই দৌঁড়ে যাচ্ছ কেন একা একা। সবার সাথে যাও। জেয়ার ভাটা বিষয়টা ভালো করে জেনে যাও। ভাটার সময় সমুদ্রে না নামায় উচিত। এখন যদিও জোয়ারের সময়। তবে একা একা যাবে না। সাথী শষী ওদের সাথে থাকবে। সমুদ্রে নেমে খুশির জোয়ারে ভেসে একদম সমুদ্রের মাঝে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। তাহলে ওপারে যেতে বেশি সময় লাগবে না। বয়স অল্প তাই এতগুলো কথা বললাম। এর মধ্যেই তিরা এসে…

পর্ব ১৬

এর মধ্যেই তিরা এসে তানভীরের হাত থেকে রুকুর হাতটা ছাড়িয়ে বলল,
~ তুই চিন্তা করিস না আমি সামলে নিব ওকে।
তানভীর তিরার কথা শোনে হাসতে লাগল। তানভীরের হাসি দেখে তিরা রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
~ আমি হাসার মতো কী বললাম? হাসছিস কেন?
তানভীর হাসতে হাসতে তিরাকে বলল,

~ তুই সামলাবি রুকুকে। আগে নিজেকে সামলা। নিজেকে সামলাতে শিখিসনি আবার এসেছিস আরেকজনকে সামলাতে।
~ তুই কিন্তু বেশি অপমান করিস কথায় কথায়।
~ আজিব অপমানের কি দেখলি শোনি?
~ এই যে এখন যা করছিস এটা অপমান না?
~ অপমান হতে যাবে কেন? এটা তো তোকে বুঝানো যে তুই কেয়ারলেস।
~ এটাই অপমান।

রুকু তানভীর আর তিরার তর্ক শোনে তাদের থামিয়ে দিয়ে বলল,
~ আচ্ছা ঠিক আমিই আমাকে সামলে নিব। আপনারা থামেন। এভাবে এখানে এসে ঝগড়া করবেন না।
বাকি সবাই হাসতে হাসতে বলল,
~ আচ্ছা চল এবার সাবাই সমুদ্রের বিশালতায় নিজেদের ডুবিয়ে দেই।
সবাই হাসতে হাসতে সমুদ্রের কাছে যেতে লাগল। রুকু একটু এগুতেই একটা ঘোড়া দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। রুকুকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে তানভীর বলে উঠল,
~ কি ব্যাপার ওদিকে তাকিয়ে কি দেখছ?

~ ঘোড়াটা দেখছিলাম। অনেকে উঠতেছে। আমি একটু উঠতে চাই।
তানভীর রুকুকে সামনে নিয়ে ঘোড়ায় বসিয়ে দিল। রুকু ঘোড়ার পিঠে উঠে একটু ভয় পেতে লাগল। তবে পাশের ঘোড়ায় তানভীরকে দেখে যেন তার ভয়টা একটু কাটল। তারপর সাথী, শষী, তিরাও ঘোড়ায় চড়ল। পটকার পালা এবার। পটকাকে ঘোড়ায় উঠতে যেতে দেখে সবাই হুহু করে হেসে দিল। সবার হাসি দেখে পটকা ভ্রুটা কুঁচকে বলল,
~ এখানে হাসির কী দেখলি?
শষী হাসতে হাসতে বলল,

~ উঠিস না রে বাপ। বেচারা ঘোড়ার অনেক কষ্ট হয়ে যাবে। তার উপর যদি কিছু হয় জরিমানাও লাগতে পারে।
পটকা শষীর কথা শোনে হাতে থাকা পটেটো চিপসের প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে ঘোড়ায় না চড়ে সামনের দিকে হনহন করে যেতে লাগল। সাথী অবাক হয়ে বলল,
~ পটকা খাবার ফেলে দিল। ব্যাপারাটা বেশ রহস্যজনক তো।
তিরা চিপসের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল,

~ আরে শুধু শুধু প্যারা নিস না দেখ খালি প্যাকেট। সব সাবাড় করে আমাদের বুঝিয়েছে সে চিপস না খেয়ে ফেলে দিছে।
তিরার কথা শোনে সবাই হুহু করে হেসে দিল। এর মধ্যে রুকু বাইকের দিকে ইশারা করে বলল,
~ ঐটাই উঠব উঠাবেন।
রুকুর এত সব আবদার দেখে তিরা কপট রেগে বলল,

~ আসার পর থেকে একটার পর একটা আবদার করছো। তানভীর কি তোমার চাকর নাকি যে সব আবদার পূরণ করবে। ওকে ওর মতো একটু ছাড়ো।
রুকু তিরার কথা শোনে মাথাটা নুইয়ে জবাব দিল
~ সরি আমি বুঝতে পারিনি।

রুকুর অসহায় মুখটা দেখে তানভীর তিরাকে দমক দিয়ে বলল,
~ আরে শুধু শুধু ওকে দমকাচ্ছিস কেন? ও এসেছে ঘুরতে ঘুরবে না।
বলেই রুকুর হাতটা ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল বাইকে চড়ার জন্য। এদিকে তিরার ভেতরটা যেন পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছিল। অপরদিকে তানভীর রুকুকে বাইকের সামনে নিয়ে বলল,
~ বাইকে উঠো। তবে তুমি চালাবে নাকি আমি?
রুকু স্থিত গলায় বলল,

~ আমি চালাতে পারব না আপনি চালান।
তানভীর রুকুকে পছনে বসিয়ে নিজে সামনে বসে বাইকটা চালাতে লাগল। তিরা শুধু অবাক নয়নে দেখছিল আর চোখের পানি ফেলছিল। তিরার কাছে এসে সাথী তিরার এ অবস্থা দেখে বলল,

~ তিরা মন খারাপ করিস না। ভালোবাসা খুব অদ্ভূত জিনিস। সব ভালোবাসার পূর্ণতা পায় না। তানভীর নিশাকে কত ভালোবাসত তবুও কিন্তু সে ভালোবাসার পূর্ণতা পায়নি। এখন যদি সে রুকুর মধ্যে নিশাকে খুঁজে পায় মন্দ কী। তুই তোর মতো করে ভালোবেসে যা। ভালোবাসা যে পেতে হবে এর কোনো মানে হয় না। বরং অপূর্ণতায় ভালেবাসা আরও বেশি দৃঢ় হয়। মন খারাপ করিস না। একটু আনন্দ কর, সবকিছু উপভোগ কর ঠিক হয়ে যাবে। তানভীর তোর কপালে থাকলে অবশ্যই পাবি।

সাথীর কথা শোনে রুকুর চোখের পানি যেন আরও গড়িয়ে পড়তে লাগল। কান্নাটাকে একটু প্রবল করে ভাঙ্গা গলায় বলল,
~ পাঁচ বছরের ভালোবাসা তানভীরের চোখে পড়ল না? একদিনের পরিচয়ে মেয়েটার কাছে সব হেরে গেল।
~ জানি তিরা তোর কষ্টটা কেমন হচ্ছে। তবে ঐ যে বললাম ভালোবাসা বেশ বিচিত্র জিনিস। কখন কীভাবে আসে যায় সেটা শুধু মনেই বলতে পারে। মনের বিরুদ্ধে কেউ যেতে পারে না রে। একটু শান্ত হ। নিজেকে সামলে নে।
তিরা আর কোনো কথা না বলে চোখটা মুছে সামনের দিকে গেল। এর মধ্যেই তানভীর আর রুকু চলে আসলো। তানভীর সবাইকে বলল,

~ সবাই মিলে এবার সমুদ্রে নামার পালা। রুকু সমুদ্রে পাড়ে যেতেই বেশ ভয় পেয়ে গেল। তানভীরের হাতটা এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরল। তারপর সমুদ্রের পানি অন্য হাত দিয়ে নিজের মুখে ঝাঁপটে দিতে লাগল। তানভীর রুকুকে অভয় দিয়ে বলল,

~ তুমি একা একা একটু পানিতে ধরার চেষ্টা করো। আমি আছি তোমার পাশে।
বলেই তানভীর রুকুকে ছেড়ে দিল। রুকু একটু সাহস করে সমুদ্রে নেমে গোসল করতে লাগল। হাত দিয়ে পানি উপরে তুলে ঝাঁপটা দিতে লাগল। তানভীর রুকুর সমুদ্র বিলাস অবাক চোখে দেখতে লাগল। মুখের মধ্যে বিন্দু বিন্দু সমুদ্রের পানি গাল বেয়ে পড়তে লাগল রুকুর।

রুকু গোসল শেষে সমুদ্রের পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে চুলগুলো হাত দিয়ে উপরে তুলে পৃষ্ঠদেশে ঝাঁপটে দিল। তারপর তানভীরের দিকে তাকিয়ে রইল। তানভীরের ইচ্ছা করছে রুকুকে আষ্টে~পৃষ্ঠে ধরে বলতে বড্ড ভালোবাসি তোমাকে। তবে অজানা এক বাঁধা তাকে বারবার গ্রাস করছে। এর মধ্যেই সবাই গোসল শেষ করে আসলো। পটকা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

~ এবার রিসোর্টে গিয়ে কাপড় পাল্টে খেয়ে নিব৷ তারপর বাইকে কিছু জায়গা আছে সগুলো ঘুরব। এরপর ঘোরা শেষে লেবুর চরে সূর্যাস্ত দেখব। সবাই চলো এবার।
পটকার কথায় তানভীর নিজেকে সামলে রুকুর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর সবাই রিসোর্টে গিয়ে খাওয়ার পর্ব শেষ করল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়ল। তানভীর সবাইকে গুণে নিল। তারপর সবাইকে নিয়ে সামনের দিকে গেল। চারটা বাইক ভাড়া করল। একটাতে পটকা বসলো একটাতে তানভীর বসলো। এর মধ্যেই তিরা তানভীরের সাথে বসতে নিলে তানভীর বলে উঠল,
~ তুই শষীর সাথে বস।
তারপর রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল,

~ তুমি সাথীর সাথে বসো।
তিরা মুখটা একটু বাঁকিয়ে শষীর সাথে বসলো। এরপর তারা আশপাশ ঘুরতে গেল। একে একে বৌদ্ধ মন্দির, কুয়াকাটার কুয়া, মৎস কেন্দ্র ঝাউবন, লাল কাকড়া চর সব ঘুরল।
এবার লেবুর চরে এসে সবাই নামল। সূর্য অস্ত যাওয়ার পালা। সবাই খেয়াল করল সমুদ্রের ঢেউ হালকা ভাবে আঁচড়ে পড়ছে। তার মধ্যে আকাশটা লাল হয়ে সূর্যটা পশ্চিম গগণে নেমে পড়ছে। মনে হচ্ছে সূর্যটা সমুদ্রের বিশালতায় নিজেকে আস্তে আস্তে বিলিয়ে দিচ্ছে। কি এক মনোরম দৃশ্য সেটা হয়তো কাছ থেকে না দেখে বর্ণণা করা খুব দুষ্কর। কারণ সে বর্ণনার ভাষা নেই। কোন ভাষায় বর্ণণা করলে সেটা উপযুক্ত হবে সেটা সবার অজানা।

সূর্য অস্ত শেষে এবার তানভীর বেশ উচ্ছাসের সাথে বলে উঠল,
~ আমরা ক্যাম্প ফায়ার করব। বেশ মজা হবে।

তানভীরের কথা শোনে সবাই আনন্দ ভাসতে লাগল। ক্যাম্প ফায়ারের সকল ব্যাবস্থা পটকা করলো। অবশেষে দাউ দাউ করে সী বিচের পাশে আগুন জ্বলছে আর তার চার পাশে সবাই বসে আছে। শষী তার বি এফ এর সাথে ঝগড়ায় বেশ ব্যাস্ত। একের পর এক তর্ক করতে লাগল। সাথী ব্যাস্ত গুণ গুণ করে গান করায়। তিরা ব্যাস্ত তানভীরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকায়।

তানভীর এখানেও ইয়ারফোন কানে গুজে চোখ বন্ধ করে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনায় ব্যস্ত। রুকু আগুনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। পটকা এ মুহুর্তে এখানে নেই। সব মেনেজ করে পটকা হয়তো কোথাও গিয়েছে। তবে পটকা এখানে থাকলে ব্যাপারটা বেশ জমে উঠত। এদিকে রুকুর আগুনের দিকে তাকাতেই তার জীবনে ঘটে যাওয়া কালো অধ্যায়ের কথাটা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল তার মায়ের মাথা বিহীন লাশটা তার বাবা কীভাবে পুড়িয়েছিল। সেই সাথে মনে পড়ে গেল তার বাবার একের পর এক মৃত্যু খেলা। চোখ দিয়ে যেন এগুলোই ভাসতে লাগল। একটা সময় হালকা চেঁচিয়ে বলল,
~ আগুন নিভাও ভয় লাগছে খুব।

রুকুর চেঁচানোতে তানভীর ইয়ার ফোন খুলে রুকুর কাছে গিয়ে ঝাঁপটে ধরে বলল,
~ আরে বোকা মেয়ে ভয় পেও না আমরা সবাই তোমার পাশে আছি। কিছুই হবে না।
রুকু তানভীরকে শক্ত করে ধরে বলল,
~জানি না এ আগুনটা দেখে কেন মায়ের কথা মনে হচ্ছে। মায়ের সাথে বাবা যা করেছিল সেটা ভেসে উঠছে। কোনোভাবেই চোখ থেকে এগুলো সরাতে পারছি না। আমি এখানে থাকতে পারব না আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।
তিরা রুকুর কথায় হালকা রেগে কর্কশ গলায় বলল,

~ এসেছি মজা করতে আর তুমি কতক্ষণ পর পর নাটক করতেছ। সব মাটি করে দিচ্ছ।
শষী এর মধ্যে রুকুর চেঁচানো শোনে ঝগড়া থামিয়ে দিল। সাথী তিরাকে হালকা দমক দিয়ে বলল,
~ কারও দুর্বলতা নিয়ে এভাবে আঘাত করে কথা বলা ঠিক না। তানভীর চল রিসোর্টে যাই৷ কালকে আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। তারপর রুকুর পরিবারের বিষয়েও ভাবতে হবে। পটকাটা আবার কোথায় গেল।
শষী সাথীর কথা শোনে বলে উঠল,

~ হ্যাঁ তাই তো পটকা কোথায়?
এর মধ্যে পটকা এসে হাজির৷ তবে সে হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে আঁচড়ে পড়ল। পটকাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে সবাই ভয়ে পটকার কাছে গিয়ে পটকাকে তুলে বলল,
~ আরে কি হয়েছে? এভাবে পড়ে গেলি কেন?
পটকা হাঁপাতে হাঁপাতে কষ্টের সুরে জবাব দিল…

পর্ব ১৭

পটকা হাঁপাতে হাঁপাতে কষ্টের সুরে জবাব দিল
~ আমার জীবনের সব শেষ হয়ে গেল আজকে। আমাকে কেউ খাবার দে। খুব কষ্ট হচ্ছে।
তিরা পটকার কথা শোনে কপট হেসে বলল,
~ মানুষ কষ্টে খাওয়া ছেড়ে দেয় আর তুই কষ্টে খাবি। কাঁদব নাকি হাসব বুঝতে পারছি না।
পটকা তিরার কথা শোনে সোজা হয়ে বসে বলল,
~ দেখ তিরা সবসময় হেয়ালি ভালো লাগে না।

~ তো কী ভলো লাগে। এমন ভাবে দৌঁড়ে এসেছিস ভাবলাম কোনো কাটা লাশ দেখেছিস হয়তো সমুদ্র পাড়ে। তা’না এসে খাবার চাচ্ছিস।
~ তুই কি বুঝবি মনের কষ্ট। তুই শুধু আছিস আমাকে হেয় করার মধ্যে।
বলেই পটকা কাঁদতে লাগল। আর টাউজারের পকেট থেকে একটা কেক বের করে খেতে লাগল। পটকার কান্ড দেখে বসে থাকা সবাই হুহু করে হেসে দিল। সবার হাসির শব্দে পটকা পুরো কেকটা মুখে দিয়ে একবারে পুরে গিলে বলতে লাগল।
~ আর কেক খাবই না।
শষী হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে বলল,
~ আরে তুই আর খাবি কীভাবে তোর পেটেই তো সব চলে গেছে।

তানভীর সবাই কে হাতে ইশারা করে বলল,
~ তোরা সবাই চুপ হ। বেচারাকে আর ক্ষেপাস না।
বলেই পটকার দিকে তাকিয়ে দেখল। পটকার মুখটা বিষন্ন হয়ে আছে। পটকার পিঠে একটা হালকা চাপর দিয়ে বলল,
~ এবার বল কী হয়েছে? হুট করে এভাবে এসেছিস কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে কী?
পটকা শার্টের পকেটে থাকা চকলেটের প্যাকেটটা ছিড়ে মুখে নিয়ে আমলানি দিয়ে বলল,
~ পর্সা বিয়ে করে নিছে রে।

পর্সা হলো পটকার ভালোবাসা। ভালোবাসা বিষয়টা পটকার দিক থেকেই ছিল। তবে পর্সার দিক থেকে প্রথমে থাকলেও পরে ছিল না। এর কারন অবশ্য পটকা নিজে। পটকায় একমাত্র বিরল প্রজাতি যে তার জি এফ কে বার্গার দিয়ে অফার করেছে। যে জি এফকে ভালোবাসার প্রমাণ স্বরূপ মস্ত বড় মাঠের মতো পিজ্জা গিফট করবে বলেছে। এসব শোনে পর্সা রিলেশনের সপ্তাহ খানেক পরেই ব্রেকআপ করে দিয়েছে। কিন্তু পটকা মন থেকে পর্সার ভালোবাসা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এজন্যই পর্সার বিয়ের বার্তা পেয়ে পটকা বেশ কষ্ট পেয়েছে। তার নমুনা তো দেখায় যাচ্ছে।
তানভীর পটকার কথা শোনে হালকা হাসি দিয়ে বলল,
~ যাক বেচারি কাজের কাজ করেছে।
পটকা তানভীরের কথা শোনে কপট রেগে বলল,

~ কেন কি কাজের কাজ করেছে শোনি?
~ এই যে তোর মতো খাদককে রেখে বিয়ে করেছে। পেট টা যা বানিয়েছিস পর্সা কেন আর কেউ তোকে বিয়ে করবে না।
~ সবসময় আমাকে হেয় করিস তোরা। ক্ষুধা লাগলে খাব না?
~ হুম তা ঠিক। ওকে যা হয়েছে তে হয়েছেই এবার আরও কিছু পকেটে থাকলে খেয়ে চল। তোদের সবার সাথে কথা আছে। একসাথে বসে রুকুর বিষয়টা নিয়ে কথা বলব।
পটকা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
~ মনের কষ্ট কেউ বুঝল না রে।

পটকার কথা শোনে সবাই হাসতে লাগল। হাসাহাসি করে সবাই উঠে দাঁড়াল। রুকু ভয়ে তানভীরের হাতটা বেশ শক্ত করে ধরল। তিরা তা দেখেও নিজেকে সামলে নিল। তানভীরের হাত যখন রুকু ধরল। মনের অজান্তেই আস্তে গলায় তানভীর বলে উঠল,
~ এভাবেই হাতটা ধরে রেখো সবসময়।

তানভীরের কথা শোনে রুকু একদম চুপ হয়ে গেল। মনের গহীনে এক ভালোবাসা যেন উত্তাল সাগরের মতো তার বুকে ঢেউ তুলছে। চুপ হয়ে শুধু তানভীরের হাতে হাত রেখে চলতে লাগল আস্তে পায়ে। রাতের আকাশটায় তখন তারায় খেলা করছিল। চাঁদের হালকা আলোয় সবকিছু যেন জ্বল জ্বল করছিল। ভালোবাসার হাওয়া যেন তানভীর আর রুকুর গায়ে লেগে শীতলতার অনুভূতি দিচ্ছিল। ভিতরে অনেককিছুই হচ্ছে এখন কিন্তু দুজনের বাহিরে তা প্রকাশ পাচ্ছে না।

এক পর্যায়ে সবাই রিসোর্টে পৌঁছাল। রুকু রুমে এসে কাপড়টা পাল্টাতে ওয়াশরুমে গেল আর তিরা চুপ হয়ে বসে চোখের পানি ঝড়াতে লাগল। সাথী তিরার পাশে গিয়ে তিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ কষ্ট পাস না। একটু স্থির কর নিজেকে। জীবনে সব পেয়ে ফেললে পূর্ণতার মূল্য থাকে না। একটু অপূর্ণ থাকতে হয়।
তিরার কান্নাটা যেন আরও জোরে আসতে লাগল। সাথীকে জড়িয়ে সজোরে কান্না করে বলল,
~ হুম পাঁচ বছরের ভালোবাসা হেরে গেল। হয়তো ভালোইবাসতে পারিনি ওকে।

এই বলে দুহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চুখ দুটো মুছতে মুছতে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। শষীও তিরাকে দেখে মন খারাপ করেও নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল। এর মধ্যে তানভীর রুমে প্রবেশ করল। তানভীর রুমে প্রবেশ করে খেয়াল করলো তিরার চোখগুলো ফোলা। তিরার চোখ ফোলা দেখে তানভীর তিরার পাশে গিয়ে বসে বলল,
~ কি রে কাঁদতেছিস কেন?
~ নাহ কাঁদছি না তো।
~ চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে কাঁদতেছিস।
~ এমনি কেঁদেছি তোকে এত জবাব দিতে যাব কেন?

বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিল তিরা। তানভীর তিরার পাশে বসে দুহাতের চারটা আঙ্গুল কানের পিছনে দিয়ে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চোখটা চেপে মুছে দিয়ে বলল,
~ তোকে কাঁদলে মোটেও ভালো লাগে না। হাসলেই তোকে সুন্দর লাগে। তোর খামখেয়ালি গুলোই বেশি ভালো লাগে। এত সিরিয়াসনেস তোকে মানায় না।
বলেই হাতটা সরিয়ে পাশে বসলো। তিরা তানভীরের এতটুকো ভালোবাসায় একদম গলে গেল। নিজেকে স্বাভাবিক করে হেসে দিল। এর মধ্যেই রুকু ওয়াশরুম থেকে বের হলো। রুকু বের হওয়ার সাথে তানভীর বলে উঠল,

~ তোমার বাসার ঠিকানা দাও। কালকে সকালে এখান থেকে গিয়ে একদম তোমার বাসায় উপস্থিত হব।
এরপর শষীর দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তুই তোর মামাকে সবটা জানিয়ে রাখ। যদি কোনো দরকার পরে ফোন দেওয়ার সাথে সাথে যেন সাহায্য পাই।
শষী তানভীরকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
~ তুই চিন্তা করিস না আমি বলে রাখব।

রুকু এর মধ্যে বাসার ঠিকানাটা তানভীরকে বলল,। সবাই প্ল্যান করলো যে কালকে সকালে উঠেই তারা রুকুর বাড়িতে যাবে। সবকিছু প্রস্তুতি নিয়ে রাখল।
রাতের খাবার সেড়ে রুকু চুপটি করে রিসোর্টের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। রাতের মৃদুমগ্ন বাতাসে রুকুর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে তখন দুলছিল। তানভীর শুধু দূর থেকে রুকুকে চেয়ে দেখছিল। এক অপরূপ মায়া মুখটা যেন তানভীরকে শুধু তার দিকেই আকৃষ্ট করছে।

এত অল্প পরিচয়ে এত মায়া কীভাবে আসলো সেটাও তানভীরের কাছে বেশ আশ্চর্য লাগছে। রুকুর দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থেকে আরও মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে তানভীর। তার ভেতরের শ্বাস যেন জোরে জোরে বের হতে লাগল। মন চাচ্ছে দৌঁড়ে গিয়ে রুকুর পাশে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশটা উপভোগ করতে। তবে সে সাহস তার হচ্ছে না। তিরা এসে তানভীরকে এভাবে দেখে তানভীরের কাছে গিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,

~ দূর থেকে না দেখে কাছে গিয়ে দেখ। মনের কথাটা বলে ফেল। ভেতরে চেপে রাখলে হবে বল।
তিরার কথা শোনে তানভীর হালকা লাজুক কন্ঠে বলল,
~ ধুর কি যে বলিস না। কাছে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না।
~ ভালোবাসিস রুকুকে?
তানভীর তিরার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চুপ হয়ে রইল। তিরার আর বুঝতে বাকি রইল না তানভীর রুকুকে কতটা ভালোবাসে। তিরার ভেতরে ভাঙ্গনের ঝড় বইছে। তবে বাইরে সে ঝড়ের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে না। তানভীরের পিঠে হালকা হাতে ধরে বলল,
~ আচ্ছা দূর থেকেই দেখ তাহলে আমি গেলাম।

বলেই তিরা চলে গেল। তানভীর রুকুর দিকে তাকিয়ে রুকুকে পুনরায় দেখতে লাগল। রুকু তার সামনে আসা চুলগুলো পেছনে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর গায়ের উড়না ঠিক করছে৷ আবার দুহাত মেলে চোখ বন্ধ করে বাতাস উপভোগ করছে। এর মধ্যেই সাথী এসে তানভীরকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
~ আর এভাবে দেখতে হবে না এবার রুমে যা। অনেক রাত হয়েছে।
বলেই রুকুর কাছে গেল। রুকুকে নিয়ে রুমে গেল। তানভীর রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই রুকুর চোখটা ভেসে উঠল। পরক্ষণেই তানভীর চোখটা খোলে ফেলল। রুকুকে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেল। সকালে বেশ ভোরেই ঘুম ভাঙ্গল তানভীরের। রুম থেকে বের হয়ে খেয়াল করল রুকু ঠিক আগের জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে। এবার কাছে যেতেই রুকুকে দেখে বেশ বিস্মিত হলো তানভীর

পর্ব ১৮

এবার কাছে যেতেই রুকুকে দেখে বেশ বিস্মিত হলো তানভীর। রুকু হাতে ফোনটা নিয়ে প্রচন্ডরকম কান্না করছে। কারও সাথে কথা বলে ফোনটা রেখেছে সেটা বুঝায় যাচ্ছে। কারণ কিছুক্ষণ আগে ফোনটা তার কানেই ছিল। রুকুকে কান্না করতে দেখে তানভীর রুকুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
~ কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছো কেন?

রুকু হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখগুলো মুছতে মুছতে বলল,
~ মন ভালো লাগছে না আবিরকে অনেক মিস করছি। শুনেছি ও নাকি বিয়ে করেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। ওকেই ছবিতে দেখছিলাম আর কাঁদছিলাম
আবিরের কথা শোনে তানভীরের নিঃশ্বাসটা ভারী হয়ে গেল। বুকের ভেতরে একটা কষ্ট আঘাত হানল। তবুও সেটা বুঝতে না দিয়ে রুকুর দিকে তাকিয়ে বলল,
~ আবিরের ছবিটা কি দেখতে পারি?

রুকু কোনোরুপ কথা না বলে চুপ হয়ে রইল। মিনেট পাঁচেক দুজনের কেউ কোনো কথা বলল, না। বেশ নীরব নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর রুকু তার হাতে থাকা মোবাইলটা এগিয়ে দিল তানভীরের দিকে।
~ এই নিন এখানে ছবি আছে দেখে নিন।

তানভীর রুকুর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে আবিরের ছবিটা দেখল। বেশ পরিপাটি সুন্দর একটা ছেলে। এর মধ্যে হুট করে চাপ লেগে যায় মোবাইলে। তারপর যা দেখল তা দেখে রিতীমতো তানভীর ঘামতে লাগল। বেশ অদ্ভুত লাগছিল সবকিছু। বুঝতে পারছিল না এসব কি।

তানভীর কোনোরূপ কথা না বলে আস্তে করে রুকুকে মোবাইলটা দিয়ে দিল। রুকু মোবাইলটা নিয়ে আবার উদাস মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। এদিকে তানভীরের অস্থিরতা যেন বেড়েই চলেছে। নিজেকে সামলে নিল। তারপর দৌঁড়ে গেল রুকু যে রুমে থাকে সে রুমে। দরজায় খটখট আওয়াজ করতে লাগল। সাথী ঘুমঘুম চোখে দরজাটা খুলে বলল,
~ কি রে কি হয়েছে? এভাবে ঘামছিস কেন? আর এত সকালে এখানে কেন?
তানভীর গলার স্বরটা ভারী করে বলল,

~ আগে একটু রুমে ঢুকতে দে তারপর বলছি। আর দরজাটা লক করে দে যাতে রুকু এর মধ্যে রুমে প্রবেশ করতে না পেরে।
তানভীরের এমন বিমর্ষ কন্ঠ শোনে রুমে থাকা সবাই বিচলিত হয়ে গেল। সাথী দেরি না করেই রুমের দরজাটা লক করে দিল। তানভীর রুকুর ব্যাগটা নিয়ে সব ঘাটতে লাগল। অবাক হয়ে সব দেখতে লাগল। বার্থ সার্টিফিকেট দেখে অবাক হলো সে। রুকু বলেছিল রুকু ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। সে অনুযায়ী তার বয়স বিশের উর্ধ্বে হওয়ার কথা না। কিন্তু বার্থ সার্টিফিকেট অনুযায়ী রুকুর বয়স তেইশ এর উপরে।

মিথ্যা কেন বলল, সেটা তানভীরের কাছে একদম অজানা। বিষয়টা আরও খতিয়ে দেখতে লাগল তানভীর। একে একে ব্যাগের সব বের করল। যতই ব্যাগ ঘাটতে লাগল ততই তানভীর চমকাতে লাগল। কারণ রুকুর ডায়রিতে একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন তারিখ দিয়ে কয়েকবার লেখা। ভেতরটা কেমন জানি খাঁ খাঁ করছিল। তবে বুঝতে পারছে না এসবের মানে কি। গভীর রহস্য আছে এটা শুধু টের পাচ্ছে। কোনো কথা না বলে সবকিছু আবার গুছিয়ে রেখে দিল ব্যাগে। তানভীরের সাথে বাকিরাও বেশ চমকালো বিষয়টা নিয়ে। শষী বলে উঠল,

~ এর কারণ আমাদের অজানা। অবশ্যই কোনো রহস্য আছে। রুকুর বাড়ির ঠিকানা অনুযায়ী একা গেলে হয়তো বিপদে পড়ার আশঙ্কা আছে। যেহেতু ওকে আমরা চিনি না আর ও একের পর এক মিথ্যা বলে গেছে সেহেতু ওকে ভরসা করা ঠিক হবে না। আমি মামাকে বলে রাখব। প্রথমেই আমরা ওর এলাকার পুলিশের কাছে যাব তারপর ওদের বাসায় যাব। যদি রুকু সত্যি হয় তাহলে তো আমরা এর স্টেপ নিব। আর যদি রুকু সব বানিয়ে বলে তাহলে রুকুর বিরুদ্ধে স্টেপ নিব। ভেবে চিন্তায় পা ফেলতে হবে। রুকুকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না। সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে করতে হবে। তবে মেয়েটার চেহারায় যথেষ্ট মায়া আছে বলা যায়।

পাশ থেকে সাথী বলে উঠল,
~ চেহারায় মায়া মানে?
~ মায়া না থাকলে কি আর তেইশ বছরের মেয়েকে উনিশ বছরের মতো লাগে। ওর বার্থ সাটিফিকেট না দেখে কেউ বুঝবে না ওর বয়স তেইশ এর উপরে। কেন এসব লুকিয়েছে মেয়েটা কিছুই বুঝতে পারছি না।
সাথীও কিছুটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

~ সত্যিই এর কারণ বুঝছি না। কিছু তো একটা আছেই। অবশ্যই কোনো রহস্য আছে। নাহয় এরকম করার কথা না। কিন্তু তানভীর তোর সন্দেহ হলো কি করে?
তানভীর কি বলবে বুঝতে পারছে না। সবকিছুই তার এলোমেলো লাগছে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তিরা তানভীরের নীরবতা দেখে বলল,
~ তোরা ওকে প্রেসার দিস না। আগে সবকিছু জানতে দে। রুকু মেয়েটা বেশ রহস্যময়ী আর রহস্য উদঘাটন করতে দে। কিছুক্ষণ পর আমরা তো রওনা দিব ঢাকার উদ্দেশ্যে তারপর তার গ্রামে যাব।

সেখানে গিয়েই বাকিটা জানতে পারব। খুব সাবধানতার সাথে সব করতে হবে। কারণ বিষয়টা সেনসিটিভ। রুকুকে দেখে বুঝতে পারিনি মেয়েটা এমন। বেশ মায়াময় সহজ সরল মনে হয়েছে।
তিরার এমন কথা শোনে সবাই অবাক। যে মেয়েটা সবসময় পাগলামির ছলে কথা বলতো সে মেয়েটা এত গুছিয়ে কথা বলছে। সাথী তিরার হাতটা ধরে বলল,
~ বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শিখে গেছিস।

তিরা শান্ত গলায় জবাব দিল
~ জীবনের বিভিন্ন অধ্যায় মানুষকে অনেক কিছুই শেখায়।
“দূরন্ত মেয়েটাও শান্ত হয়ে যায় জীবনের বৈচিত্র্য সব অধ্যায়ের বিচরণে”
তানভীর এবার হালকা গলায় সবাইকে বলল,

~ তোরা এখানেই থাক। এ বিষয় নিয়ে আর কথা বলতে হবে না। আমরা কিছুক্ষণ পর নাস্তা করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিব। এর মধ্যে রুকুর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করবি। পটকার পেটে কথা থাকে না ওকে বলার কোনো দরকার নেই।
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তানভীর বের হয়ে গেল। রুকু ঠিক আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ফোনে কারও সাথে কথা বলছে। তানভীর কাছে যেতেই বুঝতে পারল আবিরের সাথে বিয়ে নিয়ে ঝগড়া করছে। বেশ চমকালো নিজেকে সামলে নিয়ে রুকুর কাছে যেতেই রুকু ফোনটা রেখে তানভীরের দিকে তাকাল। রুকুর চোখ বেয়ে তখন শ্রাবণের মেঘ ঝড়ছে। রুকুর দিকে তাকিয়ে বেশ অদ্ভুত অনুভব হচ্ছে তার। কি বলবে বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইতস্তত গলায় বলল,
~ তোমার এইচ এস সি কত সাল?

প্রশ্নটা শোনে রুকু কিছুটা অবাক হয়ে সালটা মনে মনে আওরাতে লাগল। কিন্তু উত্তরটা বলতে পারছে না। একটা সময় মাথায় চেপে ধরল। তানভীর রুকুকে হালকা করার জন্য বলল,
~ তোমাকে বলতে হবে না থাক। যাও রুমে গিয়ে তৈরী হয়ে নাও। আমরা নাস্তা খেয়ে রওনা দিব। সব বলে রেখেছি পুলিশকে। তোমার ব্যাপারে সব ভেবে রেখেছি। আমরা থাকতে তোমাকে কেউ কিছু করতে পারবে না।
কথাটা শোনে রুকু তানভীরকে হালকা জড়িয়ে ধরে বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। বলেই রুমের দিকে রওনা দিল। রুকুর এমন স্পর্শে তানভীর স্তব্ধ হয়ে গেল।

আকাশটায় সূর্য বিস্তৃত হয়ে তখন রোদের জ্বলকানি দেখা যাচ্ছিল। এর মধ্যে পটকা উঠে কিছু শুকনো খাবার খেয়ে নিল। তারপর সবাই নাস্তা করে নতুন গন্তব্যের দিকে রওনা দিল। একটা ফেমিলি কেবিন ভাড়া করে লঞ্চে উঠল। কখনো তারা বসে বসে গান তুলছে কখনো একে অপরকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। পটকা মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। শষী সবার সাথে যোগ দিচ্ছে আবার ক্ষণে ক্ষণে মোবাইল নিয়ে বি এফ এর সাথে তুমুল ঝগড়া করছে। রুকু তখন আনমনে বসে কি যেন ভাবছে আর চোখের জল ফেলছে। রুকুর কান্না সবার চক্ষুগোচর হলে সবাই বলে উঠল,
~ কি হয়েছে রুকু কাঁদছো কেন?

রুকু চোখের জলটা মুছে হালকা হেসে বলল,
~ বাড়ি যাব। জানি না কি চলছে সেখানে। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। কি হয় সে চিন্তায় মন আকুল হয়ে যাচ্ছে।
সবাই বুঝতে পারছে না এটা রুকুর অভিনয় নাকি সত্যি। রুকুর মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে তার মধ্যে কোনো মিথ্যা নেই তবে বাকি সবকিছু প্রমাণ দেয় রুকু অনেক কিছু লুকিয়েছে। সবাই তবুও রুকুকে স্বাত্ত্বনা দিয়ে বলল,
~ কিছু হবে না আমরা আছি তো।

সময়ের সাথে সাথে লঞ্চে হেলদুল খেতে খেতে সবাই পৌঁছাল ঢাকার সদরঘাটে। এবার রুকুর বাড়ি যাওয়ার পালা। বাসে না গিয়ে সরাসরি একটা গাড়ি ভাড়া করে নিল সবাই। রুকুর চোখে মুখে তখন ভয়ের ছাপ। রুকুর কথা অনুযায়ী রুকুর গ্রামে পৌঁছাল সবাই। থানার কাছে যেতেই তানভীর বলে উঠল,
~তোরা এখানে বস একদম বের হবি না। আমি রুকুর বিষয়ে কথা বলে আসছি।
কথাটা বলেই তানভীর নেমে গেল। গাড়ি থেকে নেমে থানার ভেতরে ঢুকল। ওসি সাহেব তখন থানায় বসে পান খাচ্ছিল। তানভীরকে দেখে বলল,
~ কি হয়েছে বলুন।

তানভীর নিজের পরিচয় দিয়ে রুকুর সমস্ত কাহিনি বলল,। ওসি সাহেব তখন একটা ছবি বের করে বলল,
~ আপনি কি এ মেয়ের কথা বলছেন?
তানভীর অবাক হয়ে বলল,
~ হ্যাঁ। কিন্তু রহস্য কি বলুন তো।
ওসি সাহেব চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
~ মেয়েটি কোথায়?
~ গাড়িতে আছে।

~ তাহলে চলুন আমার সাথে মেয়েটির বাড়ি যাওয়া যাক।
তানভীর ওসি সাহেবকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। রুকুর বাড়ির দিকে রওনা দিল। গাড়িটা আস্তে আস্তে রুকুর বাড়ির দিকে এগুতে লাগল। মিনেট দশেক পর রুকুর বাড়িতে এসে গাড়িটা পৌঁছাল। রুকুকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই একজন মধ্য বয়স্ক লোক রুকুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

~ কোথায় গিয়েছিলি মা। মোনালি তোকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল সেখান থেকে কোথায় গিয়েছিলি।
তানভীর অবাক হতে লাগল এসব কথা শোনে। কিসের ডাক্তার কিসের কি। বেশ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো বিষয়টা কি খুলে বলবেন?
ওসি সাহেব ঘরে রাখা চেয়ারটায় বসে বলল,
~ ওর নাম রুকু। মানসিক ভারসাম্যহীন এক মেয়ে। ওকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল মোনালি। আর ঐ ভদ্রলোক উনার চাচা হয়। ভদ্রলোকের স্ত্রী সন্তান খুন হওয়ার পর রুকুর দায়িত্ব উনিই নিয়েছে।
বলেই একজন মেয়েকে ইশারা দিল। তানভীর মেয়েটা দেখেই চিনে ফেলল। এই তো সেই মোনালি যার সাথে লঞ্চে দেখা হয়েছিল। তানভীর অবাক সুরে বলল,
~ উনি কি তেজস্বিনী?
ওসি সাহেব জবাবে বললেন
~ ও মোনালি রুকুর দেখাশোনা করে। তেজস্বিনী রুকুর তৃতীয় মা সে চার বছর যাবত জেলে আছে।
অবাক হয়ে তানভীর বলল,
~ মানে?

~ হ্যাঁ। রুকুর বয়স যখন পাঁচ বছর ছিল তখন রুকুর বাবা রুকুর মাকে নির্মম ভাবে খুন করে যেভাবে রুকুর ডায়রিতে খুনের বর্ণণা উল্লেখ করা ঠিক সেভাবে খুন করে। বিষয়টা একদম আড়ালে ছিল। তখন রুকুই এর সাক্ষী ছিল৷ তবে বিষয়টা পুলিশের কান পর্যন্ত যায়নি৷ তারপর রুকুর ভাইকে হত্যা করা হয়। সেদিন রুকুর চাচী রুকুর চাচাত বোনকেও তার বাবা আর সৎ মা মিলে হত্যা করে।

এরপর বিষয়টা চার বছর পর আমাদের কানে আসেনি। চার বছর পর রুকুকে যখন হত্যার করতে চায় তখন রুকু ভয়ে পালিয়ে আমাদের কাছে এসে সব বলে। রুকুর চাচা তখন বিদেশ ছিল বিদায় সবকিছু উনার আড়ালে ছিল। আমরা বিষয়টা নিয়ে তদন্ত করি। আর রুকুর বাবা আর তেজস্বিনির শাস্তির ব্যবস্থা করি। রুকুর বাবা মূলত কালুজাদু করতে এমনটা করেছিল। শক্তি হাসিল করতে চেয়েছিল কালো জাদু করে৷ তাই একের পর এক হত্যা করে গেছে নির্মম ভাবে। রুকুর বাবার প্রথম স্ত্রী অর্থাৎ শাদাফের মা মূলত এসব দেখেই পাগল হয়ে গেছিল। উনি পাগলা গারদে আছে।

এসব ঘটনার পর রুকু স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। এর মধ্যে একটা সম্পর্কে জড়ায় ছেলেটার নাম আবির। সেখানেও সে ঠকে। মূলত এতকিছুর জন্য তার জীবনটা আরও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। ছেলেটা অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে। ছেলেটার বিয়ে এদিকে এত নির্মম পরিস্থিতি মিলিয়ে সে মানসিক ভাবে আঘাত পায়। জীবনের ঘটে যাওয়া নির্মম পরিস্থিতি গুলো তাকে তাড়া করতে থাকে। মূলত মানসিক ভাবে উল্টা পাল্টা চিন্তা করে এমনটা করে।

সে যা চিন্তা করে সেটা সে বাস্তব মনে করে। সে ঘটনা গুলো থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারছে না। অতীতের ঘটনাগুলোকে সে বর্তমান মনে করে এমনটা করে। এ নিয়ে দুইবার পালালো। মোনালি বিষয়টা জানাতে পারে নি পুলিশকে কারন সে ঢাকায় ছিল রুকুকে চিকিৎসা করতে নিয়ে গেছিল। রুকুর যে ব্যাগটা সে যেখানেই যাক সাথে নিয়ে যাবে। আর কোথাও বের হলে সাদা শাড়ি পড়ে বের হবে। ঐ আগের ঘটনার ট্রমা।

আর আপনি বললেন না রুকুর মোবাইলে সীম কার্ড ইনসার্ট তবুও কার সাথে কথা বলে। আর আজকে সকালে এটা দেখেই আপনার ওকে সন্দেহ হয়।
তানভীর শান্ত গলায় বলল,
~হ্যাঁ এটা বুঝতে পেরেই অদ্ভূত লেগেছিল আর সন্দেহ হয়েছিল।

এটাও তার কল্পনা। মোবাইলে এলার্ম সেটিং করা সেটাই বেজে উঠে। আর ভাবে আবির কল দিয়েছে। তখন সে মোবাইলে কথা বলতে শুরু করে। কাহিনি এটাই। তবে এর আগের বার এরকম করে পালিয়ে মেয়েটা বেশ বিপদে পড়েছিল। ঠিক সময় উদ্ধার না করতে পারলে রেপ এর শিকার হতো। সেক্ষেত্রে আপনারা ওকে এত সাহায্য করেছেন এটার জন্য ধন্যবাদ। রুকুর বয়স তেইশ হলেও সে চার বছরের আগের সময়েই এখনো আটকে আছে।

কথাগুলো শোনার পর সবাই বেশ অবাক হলো। কত কিছু মানুষের জীবনে ঘটে তা সত্যিই কল্পনা করা যায় না। তানভীর রুকুর পাশে গিয়ে রুকুকে বলল,
~ ভালো থেকো। এই যে ওসি সাহেব দেখছো উনি তোমার বাবা আর তোমার সৎ মাকে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। আর মোনালি তেজস্বিনি না ভালো করে দেখো ও তোমার দেখাশোনা করবে। তুমি এখানে ভালো থাকবে।

রুকু স্বস্তির একটা নিঃশব্দ নিয়ে বলল,
~ আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।
তানভীরের মনটা রুকুর কাছে পড়ে থাকলেও বাস্তবতা এটাই যে তাকে এখন এ বাড়ি থেকে বিদায় নিতে হবে। সবাইকে বিদায় জানিয়ে তানভীর, শষী, তিরা, সাথী, পটকা বের হলো। খানিকটা পথ হাঁটতেই তিরা বলল,
~ তোর পাশে থাকার সুযোগ দেওয়া কি যায় না।

তানভীর তিরার হাতটা ধরে বলল,
~ জীবনে চলার পথে কত বৈচিত্র মানুষের সাথে দেখা হয়। বৈচিত্র্য তাদের জীবন। ঘটনার আড়ালে কত ঘটনা থাকে সেটা বুঝা বড় দায়। রুকু মেয়েটা কতটা কষ্ট পেয়ে এ জীবনে এসে পৌঁছেছে চিন্তা কর। নির্মম কত হত্যার সাক্ষী সে। আর তার বাবা সামান্য কালো জাদুর জন্য কতগুলো প্রাণ নির্মম ভাবে নিল। ভাবলেই গা টা শিউরে উঠে। জানি তোকে কষ্ট দিয়েছি তবে জীবন সাথী বানিয়ে সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে পারব না। ভালো থাকিস তুই।

তিরা আর কিছু বলল, না। সবাই রুকুর সাথে ঘটে যাওয়া নির্মমতার কথা ভেবে আঁৎকে যাচ্ছিল।
তারপর সবাই সবার গন্তব্য চলে গেল। তানভীরও বাসায় গেল। বছর দুয়েক রুকুর খোঁজ খবর নেয় নি তানভীর। তিরারও অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। এর মধ্যে একটা কলেজে তানভীরের চাকুরি হলো৷ প্রথম দিন যেতেই স্টুডেন্ট পরিচিতর জন্য একের পর এক নাম জিজ্ঞেস করতে লাগল।

একটা মেয়ে বলে উঠল, আমার নাম রুকাইয়া। নামটা শোনতেই তানভীরের বুকটা ধুক করে উঠল। এর মধ্যে রুকুর খোঁজ না নিলেও সেদিন কলেজ ফেরত এসে রুকুর খুঁজ নিয়ে জানতে পারল রুকুর পরিবার রুকুকে নিয়ে সব বিক্রি করে ঢাকায় চলে এসেছে কোথায় এসেছে কেউ জানে না। তানভীর সেদিন রাতে একটা ডায়রি নিয়ে ছোট্ট করে লিখল
“হয়তো কোনো এক পথে দেখা হবে দুজনের। যে পথে আমি আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব৷ আর তুমি আসবে অজানা আলোর খোঁজে।”

বিঃদ্রঃ

১) মেনালি একটা পর্বে কেবিনে ঢুকে বলেছিল যে হাতে একমাস সময় আছে আর রুকুকে একমাসের মধ্যে বের করবে। এর কারণটা ছিল যে রুকুর পরের চেক আপ একমাস পর ছিল এবং রুকুর চাচাকে মোনালি এজন্য স্বাত্ত্বণা স্বরূপ এ কথা বলেছিল।
২) তানভীর কেন দুবছর খবর নেয় নি। বাস্তবতা এটাই শত ভালোবাসা থাকলেও সব ভালোবাসার খোঁজ খবর প্রতিনিয়ত নেওয়া সম্ভব হয়না। এতে পারিবারিক ঝামেলা হওয়ার সম্ভবনা থাকে। আর তানভীর অত্যন্ত বাস্তবাদী তাই আর খোঁজ খবর নেয়নি।

লেখিকা: শারমিন আঁচল নিপা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “অজানা আলোর খোঁজে – Valobasar Misty Golpo” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – অজানা আলোর খোঁজে (১ম খণ্ড) – Valobasar Misty Golpo

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *