বেনামি চিঠি (শেষ খণ্ড) – রোমান্টিক প্রেম পত্র

বেনামি চিঠি (২য় খণ্ড) – রোমান্টিক প্রেম পত্র: শোন, তুই নিজেই ভেবে দেখ। ভাইয়ার লাইফে বউ হওয়ার মতোন উপযুক্ত কয়টা মেয়ের সাথে উনার আন্তরিকতা আছে? আমার মনে হয় না পাবি তেমন করে কাউকে। কারণ যে কয়েকজন আছে, তাদের সাথে ভাইয়া টুকটাক কথা বলেন এই যা।

পর্ব-২৩

হাসপাতালের কোনো এককোণার একটা বেঞ্জে পাশাপাশি বসে আছি আমি আর নীল ভাইয়া। রোগীদের বেশ লম্বা সিরিয়াল। তাই অপেক্ষা করছি সেই কখন থেকে। অপেক্ষা জিনিসটা বড্ড বিরক্তিকর। আর হাসপাতালে প্রায় সবসময়ই অপেক্ষা করতে হয়।

আমার হাসপাতালে এলে কেন জানি বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। নিজে রোগী হয়ে এলেও আবার অন্য কোনো রোগীর সাথে এলেও এমনটা মনে হয়। সাথে কত-শত ভয়ও এসে জুটে মনের ঘরে। আপনজনকে হারানোর চিন্তা কেন জেন খুব করে চেপে বসে। তাই তো খুব বেশি দরকার না হলে আমি হাসপাতালে যেতে চাই না।

আমি চুপচাপ বসে আছি আর ভাইয়া ফোন স্ক্রোল করছেন। সারাদিন ফোন নিতে দেখি না কিন্তু আমার সাথে থাকলেই ফোনে ঢুবে থাকেন। ফোনে এতো কী করেন কে জানে? তবে এই দুইদিনে আমার প্রতি উনার এতো কেয়ার আমার মনে উনার জন্য অজানা মায়ার জাল বুনছে একটু একটু করে। মায়া জিনিসটা ব্যাধির মতোন। একবার এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কোনো পথ্যই এটা সারাতে পারে না।

হঠাৎ-ই ফোন বেজে উঠলো উনার। ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফোনের স্ক্রিনে কিছু সময় তাকিয়ে কল রিসিভ করে বলতে লাগলেন,
-“হ্যাঁ বল।”
ওপাশের মানুষটার কথা কিছুই শুনতে পেলাম না। ভাইয়া একের পর এক উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন,
-“হাসপাতালে আছি। আরে না, আমার কিছু হয়নি। তোকে কালকে বললাম না? কালকে রাত থেকে ভীষণ জ্বর। তাই তো হাসপাতালে নিয়ে এলাম।”

আমার নাম না নিলেও আমার বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে, আমার ব্যাপারেই কথা বলছেন। আমার কথা বলছেন বলে বেশ মনোযোগ দিয়ে উনার কথা শুনতে লাগলাম। একটু বিরতিতে উনি একগাল হেসে বললেন,
-“এখনই যেই প্যারাময় জীবন। জানি না পরে কী হবে?”

আবার জবাব দিলেন,
-“এসব প্রেম টেম আমাকে দিয়ে হবে না। যেভাবে আছি সেভাবেই থাকতে চাই। নিশ্চিত ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখে, সেটা নিয়ে অহেতুক আগ্রহ দেখিয়ে কী লাভ? উপরওয়ালা ভাগ্যে রাখলে আমার না হয়ে যাবে কোথায়?”
কিছুক্ষণ নিরব থেকে ভাইয়া আবার বলতে লাগলেন,

-“আমাকে না বলে নিজে একটা প্রেম কর। তাহলেই বুঝতে পারবি জীবনটা প্যারাময় না রোমান্সময়। তবে আমার অভিজ্ঞতা না থাকলেও আমি বলবো—করিস না ভাই। এমনিতেই বড্ড ভালো আছিস। কারন এক তো তোকে বুঝতে চাইবে না আবার ভাইয়া ডেকে আহত করবে। অতিরিক্ত ভাইয়া ডাকার কারনে পরে দেখা যাবে বিয়ের পর ছেলেপুলে, তোকে বাবা না ডেকে মামা বলে ডাকছে। ভাবতে পারিস, কী সাংঘাতিক ব্যাপার?”
ভাইয়ার এমন সব কথা শুনে তো আমি হতবাক হয়ে গেলাম,

-“কী বলছেন উনি এসব? আর ইদানীং কী হয়েছে উনার? এমন তো উনাকে আগে কখনোই দেখি নি।”
মনে মনে এসব ভাবছি তখন ভাইয়া আবার বলে উঠলেন,

-“মৃন্ময়, তুই কি আমার সাথে রসিকতা শুরু করেছিস? সব তো জানিসই। আমার জীবনের বারোটা বাজিয়ে চলেছে আর তুই? ফোন রাখ না হলে আমিই রাখছি।”
ফোন রাখার কথা বলেও ভাইয়া ফোন না রেখে বলতে লাগলেন,

-“কী শুনবো বল? এতো করে বুঝাই তবুও বুঝে না। বাচ্চা নয় কিন্তু বাচ্চাদের চেয়েও অবুঝ। জানিস, আমার উপর নজরদারি করা ঠিকই শিখে গেছে কিন্তু আমাকে বুঝতে শেখে নি এখনও। আচ্ছা বাদ দেয় এসব কথা। তুই ফিরবি কবে? ওহ, সাবধানে থাকিস। আর বাসায় গিয়ে আমি তোকে কল করবো। বাই।”

এই বলে উনি কল কেটে দিয়ে ফোন স্ক্রোল করতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আর আমি এদিকে মনে মনে হিসেব কষতে শুরু করলাম,
-“আজকে তো আমি একদমই নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, এটা কুহি আপু। কারণ আপু উনাকে ভাইয়া ভাইয়া ডেকে বাড়ি মাথায় তুলে। সুমাইয়াকে তো খবরটা দিতে হবে। আর মৃন্ময় ভাইয়াও দেখছি সব জানেন। কিন্তু আরেকটা বিষয়, ভাইয়া তো আপুর সাথে খুব একটা কথাই বলেন না।

তাহলে উনি এটা কেন বললেন যে, উনার উপর নজরদারি করা শিখে গেছে কিন্তু উনাকে বুঝতে শেখে নি এখনও? আর ‘ভাইয়া’ ডাকলে যদি উনি আহতই হোন তাহলে তো ‘ভাইয়া’ ডাকতে বারণ করতে পারেন। আজব!”
প্রায় দশ কী পনের মিনিট পর একজন নার্স এসে আমাদের বললেন,
-“আপনারা ভিতরে আসুন প্লিজ।”

নার্স কথাটা বলে চলে যেতেই ভাইয়া উঠে দাঁড়িয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“চল। হেঁটে যেতে পারবি তো?”
এটা হয়ত ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করতেন না। আসলে হাসপাতালে এসে যখন রিকশা থেকে নামতে নিয়েছিলাম, তখন মাথাটা আবার খুব করে ঘুরতে শুরু করেছিল। ভাইয়া যদি আমায় সামলে না নিতেন তাহলে হয়ত পড়েই যেতাম। সেটা মনে করেই হয়ত এখন আবার জানতে চেয়েছেন। প্রতুত্তরে আমি শুধু বললাম,

-“হুম।”
দরজার ঠেলে ভিতরে এসে দাঁড়াতেই একজন মহিলা ডাক্তারকে দেখতে পেলাম। উনি হালকা হেসে আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“বসুন। আর বলুন কী সমস্যা?”
ভাইয়া বসতে বসতে জবাব দিলেন,
-“বৃষ্টিতে ভিজেছিল তাই কাল রাত থেকে ওর ভীষণ জ্বর। সাথে খুসখুসে কাশিও আছে।”
-“ও আচ্ছা।”

প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তা আপনি কি উনার হাসব্যান্ড?”
আচমকা উনার এই প্রশ্নে আমি তো ভড়কে গেলাম। কিন্তু ভাইয়ার মাঝে ভিন্ন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। শুধু একটু মুচকি হাসতে দেখলাম। দুইহাত উনার টেবিলের উপর। মাথাটা কিঞ্চিৎ নুইয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে কী যেন ভাবলেন? তারপর চোখ তুলে ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলেন,

-“উম, আপাতত আমার চাচার মেয়ে।”
ভাইয়ার জবাবে ডাক্তারকে মুচকি মুচকি হাসতে দেখলাম। কিন্তু উনাদের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনে মনে বলতে লাগলাম,
-“ডাক্তার হয়েও সরাসরি এমন প্রশ্ন করলেন কী করে? আর ভাইয়া তো বললেন আমি উনার চাচার মেয়ে। তাহলে উনি এতে হাসলেন কেন?”

“গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল, বন্ধু তেমনি একটি বিশেষ জাতের মানুষ।”_রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বন্ধু মানে একটা আস্থা আর বিশ্বাসের কাঁধ। যেই কাঁধে নিশ্চিন্তে হাত রাখা যায় সারাজীবনের জন্য। সামান্য ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলেও যে সম্পর্কের জোড়া লাগে সেটাই হয়ত বন্ধুত্ব। বাবা মার পর বন্ধুর গুরুত্ব অপরিসীম তবে সেই বন্ধুটা অবশ্য প্রকৃত বন্ধু হতে হয়। কারণ সব বন্ধু প্রকৃত বন্ধু নয়, কিছু মানুষ বন্ধুরূপী শত্রুও হয়।

হাসপাতাল থেকে আসার পর সুমাইয়া কল করেছিল। যেই আমি বলেছি আমি অসুস্থ, সেই থেকে বাসায় আসার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। একদণ্ডও দেরি না করে ছুটে এসেছে আমাকে দেখতে।
বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছি আমি আর সুমাইয়া আমার পাশে বসে কথার ঝুলি খুলেছে। কয়েকদিন দেখা হয় নি বলে ওর পেটে নাকি অনেক কথা জমে গেছে৷ এখন সেগুলোই পেট থেকে বের করে আমার কানের বারোটা বাজিয়ে চলেছে।

সুমাইয়ার কথার মাঝে হঠাৎ-ই আমার ভাইয়ার কথা মনে পড়লো। তাই আমি বলে উঠলাম,
-” জানিস, আজকে যখন হাসপাতালে গেলাম, তখন মৃন্ময় ভাইয়া কল করেছিলেন নীল ভাইয়াকে। আর নীল ভাইয়া বললেন, ভাইয়া ডেকে নাকি আহত করে উনার পছন্দের মানুষ আর কুহি আপু-ই তো শুধু ভাইয়া ভাইয়া করে। আমি “

আমার কথাগুলো হয়ত সুমাইয়া ঠিক বুঝতে পারে নি। তাই তো আমার কথার আমায় থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“ওয়েট ওয়েট। তুই হাসপাতালে কার সাথে গিয়েছিলি?”
-“কেন? নীল ভাইয়ার সাথে।”
বিস্মিত হয়ে,
-“আর কেউ যায় নি?”

-“না তো। আর কে যাবে?”
-“লাইক সিরিয়াসলি? তুই আর ভাইয়া শুধু হাসপাতালে গেছিস? হাউ রোমান্টিক!”
ওর মাথায় চাটি মেরে কপট রাগ নিয়ে আমি বললাম,
-“ফাজিল মেয়ে, কী বলছিস এসব? রোমান্টিক মানে?”

-“রোমান্টিক নয়ত কী? শোন, নামটার সাথে কুহি আপুর মিল পেলেও অন্য কোনো দিক দিয়ে কিন্তু আপুর সাথে ভাইয়াকে জরানো যাচ্ছে না। আর কী যেন বললি? ওহ হ্যাঁ, ভাইয়া ডেকে আহত করেন। এটা তো তুইও করছি তাও প্রতি মুহূর্তে।”
সুমাইয়ার কথায় আমি হতবাক হয়ে গিয়েছি। কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ শুনছি। সুমাইয়া আবার বলতে লাগলো,

-“শোন, তুই নিজেই ভেবে দেখ। ভাইয়ার লাইফে বউ হওয়ার মতোন উপযুক্ত কয়টা মেয়ের সাথে উনার আন্তরিকতা আছে? আমার মনে হয় না পাবি তেমন করে কাউকে। কারণ যে কয়েকজন আছে, তাদের সাথে ভাইয়া টুকটাক কথা বলেন এই যা। বাট তুই তাদের সাথে ভাইয়ার কোনো আন্তরিকতা পাবি না। তবে যত্ন করা, খেয়াল রাখা, ছোট ছোট আবদার পূরণ করা আর ভালবাসা– এগুলো যদি উনি কারোর প্রতি করে থাকেন, তাহলে সেটা হলো একমাত্র তোকে।”

আমার কথা বলতেই আমি সাথে সাথে অবাক দৃষ্টি দিলাম সুমাইয়ার দিকে। আমার দৃষ্টি দেখে সুমাইয়া মাথা নাড়িয়ে বললো,
-“হ্যাঁ, তুই। লেখাটা থেকে কুহি আপুর নাম এলেও প্রকৃত মানুষটা তুই রে টিয়াপাখি।”
-“উফ, বাদ দেয় তো। রাত্রির আর তূর্যের প্রেমের কতদূর হলো রে।”

সুমাইয়ার মুখে ভাইয়ার সাথে আমাকে জরানো কথাগুলো কেমন যেন অহেতুক লজ্জা আর অস্বস্তির সৃষ্টি করছে। তাই আমি অতি কৌশলে সুমাইয়ার কথাটার মোড় ঘুরাতে রাত্রি আর তূর্যের কথা জিজ্ঞেস করলাম। আমার কৌশল হয়ত ওর বোধগম্য হয় নি তাই তো বলতে লাগলো,
-“ওদের কথা আর বলিস৷ ওদের প্রেম জমে তো পুরো দই হয়ে গেছে। কয়েকদিন ওয়েট কর বিয়ের কার্ড পাবি।”
হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
-“তাই নাকি?”

সুমাইয়াও হালকা হেসে জবাব দিলো,
-“হ্যাঁ রে। আচ্ছা শোন, তুই নিজের খেয়াল রাখিস। আমাকে এখন যেতে হবে।”
একটু অবাক হয়ে,
-“সেকি! এখনই চলে যাবি?”

-“হ্যাঁ রে টিয়াপাখি। প্লিজ রাগ করিস না। আমি আবার কালকে আসার চেষ্টা করবো।”
-“ঠিক তো?”
-“শতভাগ ঠিক।”
-“আচ্ছা, সাবধানে যাস। বাই।”
-“হুম বাই।”


পর্ব-২৪

-“তোর শরীরের কী অবস্থা?”
সদ্য ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে এলাম জেঠীমাকে খুঁজতে। ঘুমটা এখনও পুরোপুরি ভাঙেনি। আধোঘুমে বিভোর হয়ে হাঁটছি বিধায় খেয়াল করিনি যে, নীল ভাইয়া সোফায় বসে আছেন। আমিও ভাইয়ার সামনের সোফায় বসে পড়লাম।ঘুমঘুম চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি ঠোঁট উল্টে। কেন যেন এখন মুখ নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছে করছে না। তাই কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে আছি।

ঘুম ভাঙলে আমার মাথা রিস্টার্ট হতে আধঘন্টার উপরে সময় নেয়। আর ততক্ষণ কারো সাথে কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আর ইচ্ছে করলেও বলি না কারন ঘুমের ঘোরে আবোল তাবোল বলতে থাকি।
কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে আছি বিধায় ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু বলছিস না যে?”
মাথা চুলকে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,

-“হুম।”
উত্তরে ভাইয়া সন্তুষ্ট হলেন না তাই কপট রেগে বললেন,
-“হুম কি? জিজ্ঞেস করেছি শরীরের কী অবস্থা? দুই তিনদিন ধরে তো আমাকে গাধার মতো খাটালি। এতো বড় মেয়েকেও মুখে তুলে ওষুধ খাওয়াতে হয়। রাতে ঘুমাতেও পারি নি তোর যন্ত্রণায়।”

একনাগাড়ে বলেই গেলেন। আমি ঘুমের জন্য ঠিক মতো তাকাতেও পারছি না। তাই ভ্রু কুঁচকে চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করছি আর ভাবছি,
-“দুই তিন দিন একটু বলে বলে ওষুধ খাইয়েছেন বলে আমি গাধার মতো খাটিয়েছি? আমি তো উনাকে বলি নি আমার এতো কেয়ার করতে। আর রাতে ঘুমাতে কে বারণ করেছে উনাকে? আমি কখন যন্ত্রণা করলাম রাতে? আজব!”

গম্ভীর গলায় ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
-“ফ্রেশ হয়েছিস?”
-“উহুম।”
-“ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নেয়।”
-“আপনি খেয়েছেন?”

ঘুমের ঘোরে উনাকে প্রশ্ন করে বসলাম। ঘুমের রেশ কিছুটা কেটে গেছে। তাই বুঝতে পারছি প্রশ্ন করাটা ঠিক হয় নি। আমার প্রশ্নে ভাইয়াও কিছুটা চমকে গেলেন। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুটা সময়। তারপর বেশ শান্তভাবে জবাব দিলেন,
-“নাহ, ইচ্ছে করছে না।”

সোফা থেকে হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম,
-“ঠিক আছে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর দু’জনে এক সাথে খাবো। আমার বেশি সময় লাগবে না। আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি এক্ষুনি আসছি।”

এতোটুকু বলে ওয়াশরুমে চলে এলাম ভাইয়ার কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করে। ওয়াশরুমে ঢুকে পানির কল ছাড়তেই হঠাৎ সবকিছু মনে পড়তে লাগলো যে, অনর্গল আমি ভাইয়াকে কত কিছু বলেছি। নিজের বোকামির কথা মনে আসতেই বলে উঠলাম,

-“হায় আল্লাহ! আমার কী হয়েছে ইদানীং? আমি ভাইয়াকে অর্ডার করে এসেছি। যেই উনি প্রশ্ন করাই পছন্দ করেন না, সেই উনাকেই আমি অর্ডার করে এসেছি। আল্লাহ আপনি আমায় বাঁচান প্লিজ। ঐ হনুমানের নাতি তো আমায় খুন করে ফেলবে।”
ঘুমের ঘোরে উনাকে বলা কথাগুলো মনে পড়তেই খুব করে ভয় লাগছে। তাই ফ্রেশ হয়ে মুখ গোমড়া করে বিছানায় বসে আছি। এতো কথা উনাকে আগে কখনোই বলি নি। আর সেখানে গড়গড় করে কত কী বলে ফেললাম।

প্রায় পাঁচ দশ মিনিট হবে আমি ঠাঁই জায়গায় বসে আছি। ভয়ে আর অজানা লজ্জায় রুম থেকেই বের হতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ জেঠীমা এসে আমায় বললো,
-“কিরে? ফ্রেশ হয়ে এখানে বসে আছিস কেন? নীল তো তোর জন্য বসে আছে। তাড়াতাড়ি আয়।”
জেঠীমার কথা শুনে আমি চমকে গেলাম,
-” উনি আমার কথা শুনে আবার আমার জন্য অপেক্ষাও করছেন? স্ট্রেঞ্জ!”

ডাইনিং রুমে এসে দেখি ভাইয়া কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন। আমি চুপ করে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম উনার পাশে। উনি ফোনে বলছেন,
-“তোর কী আর কাজ নেই? সবসময় এমন ভুল টাইমে কেন কল করিস?”
ওপাশ থেকে কী বলছে আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। ভাইয়া আবার বললেন,

-“ফোন রাখ এখন। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। আর ভ্রমণে শেষ করে এসেছিস এবার বিশ্রাম নেয় আমাকে আবোল তাবোল না বকে। নিজের খেয়াল রাখিস। বাই।”
‘ভ্রমণ’ কথাটা উল্লেখ করেছেন বিধায় বুঝে গেলাম যে, এতক্ষণ ধরে উনি মৃন্ময় ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলেন। উনার কথা শেষ হতেই ফোনটা পকেটে রেখে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“আমাকে অপেক্ষা করতে বলে কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিস?”

-“না মানে_
আগে থেকেই একটা প্লেটে সাজিয়ে রাখা পরোটা আর সবজির প্লেটটা আমার সামনে রাখলেন। তারপর প্লেটে ডিম রেখে একটু রাগী ভাব নিয়ে বললেন,
-“আমতা আমতা না করে খাবার শেষ কর। আর সবগুলো খাবার শেষ করে প্লেটটা ফাঁকা করবি। এমন বাঁশপাতার মতোন শরীরে খাবার নিয়ে একদম আপত্তি করবি না। কারণ তুই হাতি হলেও তোর জামাইয়ের কোনো আপত্তি নেই। সো সব শেষ কর।”
ভাইয়ার কথা শুনে আমি হা করে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম,

-“উনি আমার জামাইয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন নাকি আমার জামাই এসে উনাকে বলে গেছেন? জোর করে একগাদা খাবার খাওয়াবে সবসময় আবার কথাও শুনতে হবে তাও এমন আজগুবি কথা। আর আমি হাতি না আপনি? হুহ।”
আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“কি?”

আমি ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালাম তারপর চুপচাপ খাওয়া শুরু করলাম। অনেকটা সময় নিরবতা ছেড়ে রইলো আমাদের মাঝে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
-“পেত্নী, জ্বর পুরোপুরি কমেছে তোর?”
মনে মনে একটু কনফিউজড হয়ে আমি প্রতুত্তরে বললাম,
-“মনে হয়।”

-“মনে হয় মানে?”
-“নিজের জ্বর তো নিজে বুঝতে পারি না আমি।”
-“চমৎকার! জ্বর কেন তোর গোবর মার্কা মাথায় অন্যকিছুও ঢুকে না।”
এই বলেই বাম হাতটা আমার কপালে রেখে জ্বর আছে কী না চেক করতে লাগলেন। কয়েক সেকেন্ড কপালে হাত রেখে আবার খাবারে মনযোগ দিয়ে বললেন,

-“খুব একটা নেই তবুও ওষুধগুলো ঠিক মতো খেয়ে নিস।”
-“হুম।”
জেঠীমা ভাইয়ার জন্য এককাপ চা নিয়ে এলো। চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
-“নীল, আজকে দুপুরে কী খাবি?”
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ভাইয়া জবাব দিলেন,

-“তোমার যেটা ভালো লাগে মা সেটাই রান্না করে রেখো।”
-“তারপরও কিছু একটা বল।”
চায়ের কাপে এক দফা চুমুক দিয়ে বললেন,

-“আমার কিছু বলার নেই মা।”
ইশারায় আমাকে দেখিয়ে জেঠীমাকে বললেন,
-“যেটা খাবে সেটাই রান্না করো বরং।”
এই বলে চায়ের কাপটা নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে চলে গেলেন। ভাইয়া চলে যেতেই জেঠীমা আমায় জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
-“কী খাবি বল? এখন তুই আবার বলিস না ভাইয়া যেটা খাবে সেটাই।”

বলেই জেঠীমা হাসতে লাগলো আর আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম আর ভাবলাম,
-“ইদানীং সবার কী হয়েছে? সবাই শুধু আমাকে নিয়ে হাসাহাসি আর রহস্য করে কেন?”


পর্ব-২৫

“Kehta hai pal pal tumse
Ho ke dil yeh deewana
Ek pal bhi jaan-e-jaana
Mujhe door nahi jaana”

জীবনের প্রথম কাউকে চিঠি লিখছি। তাই বুঝতে পারছি না কী দিয়ে শুরু করবো? এটা আমার পছন্দের গান। পছন্দের মানুষকে না হয় পছন্দের গান দিয়েই চিঠি লিখতে শুরু করি।
ম্যানি ম্যানি হ্যাপি রিটার্নস অফ দিজ ডে। আই কান্ট বিলিভ দ্যাট আই এম ইন লাভ উইথ ইউ। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছো লেখাটা। এই আমি, তোমাকে বড্ড ভালবাসি। কতটা ভালবাসি সেটা নিজেও জানি না হয়ত। কিন্তু হ্যাঁ, তোমাকে ছাড়া নিজের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারি না। তাই উপরওয়ালার কাছে খুব করে চাই, যেন তোমার আগে আমার হৃদয়টা স্তব্ধ হয়।

জানো, কাল অবধি ভাবি নি যে তোমায় চিঠি লিখবো। কিন্তু এখন হুট করে মনে হলো জানিয়ে দেই না মনের কথা আমার কথাপরীকে। আর তার জন্মদিনটা করে দেই একটু ভিন্ন। তোমার নামধাম আমার সবই জানা। কিন্তু আমি তোমায় কথাপরী নামেই ডাকতে চাই। তোমার পছন্দ না হলেও আই ডোন্ট কেয়ার।
প্রথমবার চিঠি লিখছি আর নিজেরও চর্চা নেই। তাই এখানেই শেষ করছি লেখা। তবে আরও একবার, শুভ জন্মদিন কথাপরী।
ইতি
তোমার ভবিষ্যৎ

চিঠিটা পড়ে অহেতুক তাকিয়ে রইলাম অনেকটা সময় আর মনে মনে বলে উঠলাম,
-“তোমার ভবিষ্যৎ? সত্যি কি আমার ভবিষ্যৎ আপনি?”

এটাই আমার কাছে আসা প্রথম বেনামি চিঠি। যেটা আমি পেয়েছিলাম আমার ১৭ তম জন্মদিনে। আজ থেকে প্রায় ছয় সাত বছর আগে,
সকাল থেকে হইচইপূর্ণ হয়ে উঠেছে সারা বাড়ি। পরশু দিন নাকি ফুপ্পিকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। কিন্তু আত্মীয়স্বজন দেখে মনে হচ্ছে দেখতে নয় বিয়ে করতে আসবে। জেঠুর আর বাবার কোনো বোন নেই বিধায় আফরোজা ফুপ্পিকে নিজের বোনের মতোন ভালবাসে। আমার দাদুভাইও ফুপ্পিকে বেশ আদর করতেন। তাই দাদুভাই মারা যাবার আগে ফুপ্পির বিয়ের দায়িত্ব জেঠু আর বাবার উপরই দিয়ে গেছেন।

ফুপ্পির কোনো ভাইবোন নেই। একমাত্র মেয়ে বলে উনার বাবা মাও উনাকে বড্ড ভালবাসেন। শুনেছি, ফুপ্পির বিয়ের সব অনুষ্ঠান নাকি আমাদের বাড়িতেই হবে। এটা শুনে তখন খুশি হলেও এখন এতো লোকজন দেখে নিজেকে নিজের বাড়ির অতিথি মনে হচ্ছে।

ছুটির দিন আজকে তাই সকালের নাস্তা সেরে চলে এলাম টিভি দেখবো বলে। এসে অন্য দেখি ফুপ্পির চাচাতো ভাই বোন মনির, সাইফুল, ফারিহা, সুষ্মিতা, তুর সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে আড্ডায় মত্ত। আর শাহেদ ভাইয়া টিভির রিমুট হাতে গভীর মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছেন।

উনার সাথে আমার আলাপ নেই। আগে কখনও কথাও হয় নি তেমন করে আর অন্য সবার সাথেও তেমন নয়। তাই টিভি দেখার আশা ছেড়ে দিয়ে, এক পাহাড় অভিমান নিয়ে রুমে চলে এলাম।

মুখ গোমড়া করে বিছানায় বসে আছি। হঠাৎ-ই টেবিলে থাকা একটা গিফটের বক্সে চোখ পড়লো আমার। অবাক-খুশি হয়ে বক্সটা হাতে নিয়ে দেখি এতে লেখা আছে,
-“হ্যাপি বার্থডে।”
লেখাটা দেখে আমার মনে পড়লো যে, আজকে আমার জন্মদিন। ফুপ্পিকে দেখতে আসা আর আত্নীয়স্বজনের ভীড়ে ভুলে গিয়েছিলাম যে, আজকে আমার জন্মদিন।

-“বাড়ির কেউ জন্মদিন টন্মদিন পালন করবে তো দূর মনেই রাখে না। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো কারো মনে না থাকলে এটা দিলো কে?”
মনের প্রশ্ন মনেই চেপে রেখেই বক্সটা খুলতে শুরু করলাম। খুলে যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। নীল রঙের ছয় ডজন রেশমি চুড়ি। চুড়িগুলো দেখে জাস্ট নাচতে ইচ্ছে করছে আমার৷

চুড়িগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ বক্সের এককোণে একটা কাগজ দেখতে পেলাম। কৌতূহল নিয়ে কাগজটা পড়তে শুরু করলাম। পড়ে তো আরেকবার চমকে গেলাম। কিন্তু এবারের চমকের মাত্রা এতোটাই বেশি যে, আমি যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

নাম পরিচয়হীনা কেউ একজন চিঠিতে জানিয়েছেন, উনি নাকি আমাকে ভালবাসেন। চুড়ি আর চিঠির বিষয়টা আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। তাই হাতে চিমটি কেটে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। চিমটি কাটতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,
-“আউচ।”
এটা স্বপ্ন নয় সত্যি বুঝতে পেরে একা ঘরে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম,

-“এটা তাহলে স্বপ্ন নয় সত্যি। কিন্তু আমাকে কেউ কেন ভালবাসবে? আমাকে ভালবাসার তো কোনো কারণ আমার চোখে পড়ছে না। আবার আমার পছন্দের জিনিস চুড়ি দিয়ে রোমান্টিক স্টাইলে প্রপোজ করেছেন। এমন রোমান্টিক মানুষটা কে হতে পারে? নামটাও লেখে নি। আমার মনে হয় কেউ আমার সাথে মজা নিচ্ছে। সে যা-ই হোক, চুড়ি পেয়েছি এতেই খুশি। এটা যদি ফাজলামো হয় তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ চুড়িগুলো আমি আর ফেরত দিচ্ছি না।”

ছয় সাত বছর আগে এই চিঠিকে ফাজলামো মনে করেছিলাম। কিন্তু এখন এই চিঠিকে সত্যি ভেবেই চিঠির মালিককে ভালোবেসে বসে আছি। ঐ দিন বাড়িতে অনেকে ছিল। তাই চিঠিটা কে দিয়েছিল সেটা আন্দাজ করতে পারি নি।

অবশ্য আজও বুঝে উঠতে পারছি না প্রতি জন্মদিনে চিঠিগুলো কে দিতে পারেন? হাতের লেখা চিঠি হলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু যিনি চিঠিটা দিয়েছেন, তিনি খুব চতুর। তাই তো হাতে না লিখে টাইপ করা লেখা প্রিন্ট করে দিয়েছেন। উনার এমন চালাকির জন্য আমার ইচ্ছে করে উনাকে পুরষ্কার হিসেবে বেত উপহার দিয়ে সেটা দিয়ে পিটিয়ে ভর্তা বানিয়ে ফেলি।

ইদানীং নতুন নতুন অনেক কিছুই যোগ হচ্ছে আমার ভাবনার ঘরে। আশে পাশের মানুষগুলোর মাঝেও পাচ্ছি রহস্যের গন্ধ। আগে যখন চিঠি পড়তাম, তখন কল্পনায় নিজের কন্ঠই অনুভব করতাম। কিন্তু কয়েকদিন ধরে চিঠি পড়লে কেন যেন নীল ভাইয়ার কন্ঠ অনুভব করি৷ এমনটা কেন হচ্ছে? কেন যেন মনটা বারবার ভুল করে বেনামি চিঠিকে মিলিয়ে ফেলছে নীল ভাইয়ার সাথে।

ভাইয়ার কেয়ার আর শাসন ইদানীং বড্ড ভালো লাগে। যদিও উনার শাসনটা কেন যেন একটু একটু করে কমে আসছে৷ আগের তুলনায় ভাইয়া এখন অনেকটাই বদলে গেছেন। এখন তো আমার উপর রাগ করতেও ভুলে যান।
হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ কানে আসতেই চট করে চিঠিটা লুকিয়ে ফেললাম বালিশের তলায়।

চিঠি লুকাতেই আমার দরজায় টোকা পড়লো। তাকিয়ে দেখি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন দরজা আঁকড়ে। সামান্য একটা চিঠি লুকালেও আমার মাঝে সৃষ্ট ভয়ে মনে হচ্ছে আমি যেন কোনো গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছি। ভয়ের দরুন কপালে সৃষ্টি হয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আলতো হাতে সেটা মুছে চটজলদি বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়িয়ে ভাইয়াকে বললাম,
-“ভেতরে আসুন ভাইয়া।”


পর্ব-২৬

আমি ভাইয়ার রুমে দৈনিক একবার হলেও যাই কোনো না কোনো প্রয়োজনে। কিন্তু ভাইয়া আমার রুমে খুব একটা আসেন না। এমন রাতদুপুরে উনার আসার কারণটা ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না। হাতে একটা গিটারের ব্যাগ নিয়ে আমার রুমের ভেতর ঢুকলেন উনি। বিছানায় বসে পাশেই গিটারের ব্যাগটা রেখে দিলেন। স্লিকি চুলে হাত বুলিয়ে ঠিক করে বলতে শুরু করলেন,

-“কালকে থেকে ভার্সিটি যাস। অনেক দিন তো ছুটি কাটালি আর শরীর তো আল্লাহ তায়ালার রহমতে ঠিক হয়েছে।”
প্রতুত্তরে আমি শুধু ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারা করে বললেন,
-“দাঁড়িয়ে না থেকে বস এখানে।”

ভাইয়ার কথা মতো আমি বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসলাম। বসতেই ভাইয়া গিটারের ব্যাগটা থেকে একটা সুন্দর কালো রঙের গিটার বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। উনার এসব কান্ড দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমার বিস্মিত চোখে চোখ পড়তেই একগাল হেসে উনি বললেন,

-“এটা তোর জন্য।”
আমার কানে কথাটা পৌঁছোতেই বিস্ময়ের মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেল। আর তাই উনাকে প্রশ্ন করলাম,
-“আমার জন্য?”

-“হ্যাঁ, তোর জন্য। এখন এটা ধর নয়ত নিয়ে চলে যাবো।”
আমি সাথে সাথে গিটারটা হাতে নিয়ে তাড়া দিয়ে বললাম,
-“না না আমি নিচ্ছি। আসলে আমার জন্য গিটার বললেন তো তাই খুব অবাক লাগছে।”

গিটারটা দেখতে দেখতে আমি কথাগুলো বললাম। ভাইয়া কোনো জবাব দিচ্ছেন না বলে আমি উনার দিকে তাকালাম। উনি স্থির দৃষ্টিতে আমায় দেখছিলেন। আমি তাকাতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললেন,
-“বাবার পারমিশন নিয়েই কিনে দিয়েছি। আর আমার টাকায় কিনে দেই নি।”

-“আপনার টাকায় কেন দেবেন? আমি তো বলি নি কিনে দিতে। সপ্তাহে চকলেট দেন সেটাই অনেক। আপনার মতো কিপ্টের হাত থেকে যে এই ক’টা টাকা খরচ হচ্ছে সেটা শুনলেই তো মানুষ হার্ট অ্যাটাক করবে। যে পরিমাণ কিপ্টে আপনি। হায় আল্লাহ!”
মনে মনে উনার বদনাম করে রচনা লিখে ফেললাম আর মুখে বললাম,

-“ওহ আচ্ছা।”
আমার রুমে চোখ বুলিয়ে উনি বলতে শুরু করলেন,
-“গিটার শেখার প্রাথমিক স্তরটা আমি শিখিয়ে দিবো৷ তারপর আমি যেখান থেকে শিখেছি তোকে সেখানে ভর্তি করিয়ে দিবো। নিয়মিত ক্লাস আর অনুশীলন করলে গিটার বাজাতে তোর কোনো প্রবলেম হবে বলে আমার মনে হয় না। তা খুশি হয়েছিস এবার?”

আমি গিটার বাজানো শিখতে পারবো আর আমার নিজের একটা গিটার হবে সেটা তো আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। সেদিন যখন ভাইয়া বলে ছিলেন,
-“কেন? আমাকে কি তোর চোখে পড়ে না? নাকি আমি শেখাতে পারবো না তোকে?”
সেদিন ভয়ে যদিও বলেছিলাম,
-“আপনার কাছেই শিখবো।”

কিন্তু একবারও ভাবি নি যে, সত্যিই উনার কাছে গিটার বাজানো শিখবো আর আমারও একটা সুন্দর গিটার থাকবে। অতিরিক্ত খুশিতে মানুষ যেমন শব্দ হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়ে, তেমন আমিও নির্বাক হয়ে গিয়েছি। ভাইয়াকে জবাব দিতে দ্বিগুণ বেগে মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
-“হুম।”

আমার এমন ছোট্ট জবাবেও ভাইয়ার মাঝে কোনো বিরক্তির সৃষ্টি হলো না বরং কোনো কিছু পাবার তৃপ্তি দেখছি উনার মাঝে। অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে মানুষের মাঝে যে তৃপ্তির সৃষ্টি হয় সেই তৃপ্তিই যেন ফুটে উঠছে উনার চোখে মুখে।
হঠাৎ রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করলেন ভাইয়া,
-“মিতালি, মিতালি, মিতালি?”

ভাইয়ার ডাকের এক-দুই মিনিট বাদেই মিতালি এসে হাজির হলো। অহেতুক ভয় জড়ানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমারে ডাকছেন ভাই?”
-“যা তো মা আর চাচীমাকে গিয়ে বল এই রুমে আসতে।”
-“আইচ্ছা ভাই।”

মিতালি চলে যাওয়ার কয়েকমিনিট বাদে মার আর জেঠীমার প্রবেশ করল আমার রুমে। উনারা আসার আগ মুহূর্তের সময়টুকুতে রুমে ছিল শুধুই স্তব্ধতা। জেঠীমা এসেই ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ডাকলি কেন হঠাৎ?”

আমার হাতে থাকা গিটারটা দেখিয়ে জবাব দিলেন,
-“গিটার এনেছি। ভাবলাম, সবাইকে দেখানো দরকার।”
আমার দিকে এগিয়ে এসে জেঠীমা বলতে লাগলো,

-“তাই না-কি? বেশ তো দেখতে গিটারটা।”
জেঠীমা না চাইতেও আমি গিটারটা এগিয়ে দিলাম জেঠীমার দিকে। জেঠীমা সেটা নিয়ে দেখতে লাগলো তখন পাশ থেকে মা বলে উঠলো,
-“হঠাৎ গিটার কেন বাবা?”
ভাইয়া প্রতুত্তরে বললেন,

-“গিটার শিখতে চেয়েছিল। বাবাও এই বিষয়ে আপত্তি করে নি। সেজন্য কিনে নিয়ে এলাম। আমার কাছে কিছুটা শিখে বাকিটা না-হয় ভর্তি হয়ে শিখে নেবে।”
-“কী বলছো বাবা তুমি এসব? এই বাঁদর মেয়ে এমনিতেই পড়তে চায় না। পড়াশোনা তো পারলে কবেই ছেড়ে দিতো। বিসিএস পরীক্ষা যে দিবে সেটারও কোনো চিন্তা নেই। সারাদিন চুড়ি দাড়ি নিয়ে থাকে। এখন আবার গিটার বাজানো শিখলে তো রাতদুপুরে আমার মাথার উপর দাঁড়িয়ে টং টং করবে।”

একনাগাড়ে আমাকে ধুয়ে দিয়ে ক্ষান্ত হলো মা। গিটার পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিলাম, এখন সবটাই যেন তেঁতো মনে হচ্ছে। মুখখানা মলিন করে মায়ের দিকে তাকিয়ে সবটা শুনে এখন মেঝেতে তাকিয়ে আছি অভিমানে। পাশ থেকে ভাইয়া মাকে বললেন,
-“চাচীমা, বাঁদর নয় পেত্নী। কিন্তু পেত্নী হলেও পড়াশোনা করছে ইদানীং। তাই তুমি ভেবো না। আর বিসিএস পরীক্ষা না দিয়ে যাবে কোথায়? আমি দেখবো তোমার কোনো চিন্তা নেই।”

ভাইয়ার কথাগুলো হয়ত মার খুব মনে ধরেছে। তাই ভাইয়ার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
-“আমার সোনার ছেলে৷ কত ভাবে আমার কথা।”

মার একটা দূর্বলতা আছে। কেউ যদি মার প্রশংসা করে তাহলে সে মার কাছে অনেক ভালো হয়ে যায় সাথে তার খাতির-যত্নও বেড়ে যায়। কিন্তু আমি হতভাগা যতবার প্রশংসা করতে গিয়েছি, ততবার উল্টো নিজে আরও বকা খেয়েছি। অনেকদিন আগে মা মুগ ডাল রান্না করেছিলেন কিন্তু আমি মিথ্যে তারিফ করতে গিয়ে বলেছিলাম,

-“মা, তোমার রান্না করা মাসকলাই ডাল খেতে দারুন হয়েছে। “
আমার কথা শুনে মা ক্ষেপে গিয়ে আমায় বলেছিল,

-“হতচ্ছারী মেয়ে, রান্নাবান্না তো কিছু জানিসই না খাবারের নামটা ঠিকমত বলতে পারিস না। এটা মাসকলাই ডাল নয়, মুগ ডাল।”
সেদিন যখন শুনেছিলাম, এটা মাষকলাই ডাল নয় মুগ ডাল, তখন হা করে কতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। খাবারের প্লেটে থাকা ডাল-ভাতের দিকে তাকিয়ে তখনও আমার মনে হয়েছিল এটা কোনোভাবেই মুগডাল নয় মাসকলাই ডাল। ঐ ঘটনার পর থেকে আমি আর কখনো মার অন্তত মিথ্যা প্রশংসা করিনা।

“সোনা বউ শুনছো নি গো
সোনা বউ শুনছো নি
নিতে আইলে নাইয়র যাইবা নি
সোনা বউ শুনছো নি গো
সোনা বউ শুনছো নি
নিতে আইলে নাইয়র যাইবা নি

ও বউ গো বউ……
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে
বাসরটা দিবে সাজিয়ে
যে ঘরে থাকবা দিন রজনী
ও বউ গো বউ……
সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরে

বাসরটা দিবে সাজিয়ে
যে ঘরে থাকবা দিন রজনী
নাই বিছানা,নাই মশারী
সঙ্গে নাই তোর সোয়ামী
নিতে আইলে নাইয়র যাইবা নি”


পর্ব-২৭

ভার্সিটির সুদীর্ঘ মাঠের একপাশ দিয়ে আনমনে হেঁটে চলেছি। মৃদুমন্দ বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে গানের সুর। গানের গলাটা আমার কাছে পরিচিত। তাই অনুমান করতে একবিন্দুও কষ্ট হয় নি যে, এটা তূর্যের গানের গলা।

স্তব্ধ দুপুরে মাথার উপরের সূর্যটাও যেন স্তব্ধ হয়ে আছে। রোদের তেজ খুব একটা নেই বললেই চলে। তাই তো রোদের সাথে প্রতিযোগিতায় বাতাস জিতে গিয়ে হালকা হিম ভাবের সৃষ্টি করছে। এমন একটা পরিবেশের সাথে গানটা যেন আমার খুব করে মনে ধরেছে। তাই চলার গতি কমিয়ে পরিবেশে মননিবেশ করলাম।

গুটিগুটি পায়ে একসময় পৌঁছে গেলাম আমাদের সংগীত শিল্পী তূর্যের কাছে। উনার শখের গিটারে আঙুল নাচিয়ে শেষ সুরে গানে ইতি টেনে ফেললেন।
তূর্যের পাশেই দেখতে পেলাম রাত্রিকে। সে তার ধ্যান, মন, প্রাণ উজার করে তাকিয়ে আছে তার প্রিয় মানুষের দিকে। আর খানিক তফাতে সবকিছু উপেক্ষা করে ফোনে নিমগ্ন হয়ে বসে আছে সুমাইয়া। ওর একটু একটু লজ্জা মাখা হাসি আর কথার ধরনে বুঝতে পারলাম যে, ও ইয়াসির ভাইয়ার সাথে প্রেমআলাপে মত্ত।

সাত-পাঁচ না ভেবে, বেশ উদাসীন মুখ করে সুমাইয়ার পাশে বসতেই রাত্রি বলে উঠলো,
-“কথামনি, তুমি এখানে? জানলে কী করে আমরা সবাই এখানেই আছি?”
নিরস গলায় জবাব দিলাম,
-“সুমাইয়া বলেছিল, ক্লাস শেষ করে এখানেই চলে আসতে। আর গ্যালারির কাছাকাছি হতেই গান শুনতে পেলাম।”
-“ও আচ্ছা।”

গিটারের ব্যাগে সযত্নে গিটার রাখতে রাখতে তূর্য আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“শুনলাম, তুমি নাকি গিটার বাজানো শিখবে। তা গিটারের ক্লাসে জয়েন করেছো?”
আমি তূর্যকে জবাব দেওয়ার আগেই রাত্রি প্রশ্ন ছুড়লো আমার দিকে,

-“ও মা! সত্যি কথামনি? তা কবে গিটার কিনলে?”
রাত্রির জানার আগ্রহ অনেক বেশি হলেও আমার বলার আগ্রহ নেই বললেই চলে। তবুও বলতে শুরু করলাম,
-“পরশুদিন রাতে হঠাৎ-ই ভাইয়া গিটার কিনে নিয়ে এসেছেন।”

-“সে কী! তুমি তো কালকে আমায় কিছু বলো নি।”
-“আসলে মনে ছিল না আর সুমাইয়াকেও জানিয়েছি কালকে রাতে।”
ফোনে কথা বলা শেষ সুমাইয়ার। এখন ফোন স্ক্রোল করতে ব্যস্ত। ব্যস্ত দুই হাতের সাথে এই মুহূর্তে চোখ জোড়াও ফোনে ব্যস্ত রেখে আমায় জিজ্ঞেস করলো,

-“সবই তো বুঝলাম। কিন্তু শিখবি কার কাছে?”
-“ভাইয়া বলেছেন আপাতত উনার কাছে প্রাথমিক ধাপটা শিখে নিতে। তারপর উনি যেখান থেকে শিখেছেন, সেখানে ভর্তি করিয়ে দিবেন।”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই তূর্য দাঁড়িয়ে গিটারের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললো,

-“বাহ! বেশ ভালো। শুভকামনা রইলো তোমার জন্য। শেখা হলে একদিন শোনা যাবে, কেমন?”
প্রতুত্তরে আমি শুধু হালকা হাসি দিলাম। এতেই সন্তুষ্ট হয়ে তূর্য সুমাইয়াকে বললো,

-“তুই কি পরে যাবি বাসায়?”
-“হ্যাঁ।”
-“ঠিক আছে। আমি তাহলে চলে যাই। কোনো কাজ নেই অহেতুক থেকে কী করবো?”
-“ওকে।”
রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে তূর্য বললো,

-“চলো যাওয়া যাক।”
রাত্রি হয়ত তূর্যের কথার অপেক্ষায় ছিল। তাই তো বলার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। ওর এমন কান্ডে আমি খানিকটা অবাক হলেও সুমাইয়ে শুধু মুচকি মুচকি হাসছে। সুমাইয়ার হাসির কারণটা যে রাত্রি সেটা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হয় নি।

রাত্রি আর তূর্য জোড়া কবুতর হয়ে হেঁটে হেঁটে চোখের পলকে মিলিয়ে গেল। ওরা যেতেই ফোন স্ক্রোল অফ করে সুমাইয়া আমায় জিজ্ঞেস করলো,
-“তারপর বল?”
কী বলবো– বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম,

-“কী বলবো?”
-“কী আবার বলবি? ভাইয়ার কাছে গিটার শিখছিস কবে, কখন, কীভাবে?”
একটু চমকে,
-“কীভাবে মানে?”
হঠাৎ-ই উপরের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলতে শুরু করলো,

-“উফ, আল্লাহ! আমি বলেছিলাম টিয়াপাখিকে রোমান্টিক জামাই দিতে। বাট আপনি তো রোমান্টিক Pro Max জামাই দিলেন৷”
ওর কথায় অবাক হয়ে,
-“ঐ, কী যা তা বলছিস তুই?”
-“যা তা কেন বলবো? আমি তো ঠিকই বলছি।”
-“ঠিক বলছিস মানে?”

-“উফ, তোর মাথায় বোধহয় একটুও বুদ্ধি নেই, মাথা ভর্তি শুধু গোবর। শোনো পিচ্চি মোনা তোমাকে বুঝিয়ে বলছি।”
কপট রাগ নিয়ে বললাম,
-“ধ্যাত! বলতে হবে না তোকে। আমি গেলাম৷ হুহ।”

ব্যাগ নিয়ে উঠে যেতেই আমাকে টেনে ধরে আবার বসিয়ে দিয়ে বললো,
-“পালাচ্ছো কোথায় চাঁদু? চুপচাপ বস এখানে।”
নিরবতা আঁকড়ে মুখ গোমড়া করে বসে রইলাম। সুমাইয়া বলতে শুরু করলো,

-“যাই বল। জামাই কিন্তু তোর হেব্বি রোমান্টিক আই মিন নীল ভাইয়া। উনি তোকে গিটার শেখাবেন। ইশ! কী একটা রোমান্টিক সিচুয়েশন ক্রিয়েট হবে তুই ভাবতে পারিস?”
আঁড়চোখে তাকাতে বলে উঠলো,

-“ত্যাড়া চোখে আমাকে দেখে লাভ নেই। যার দিকে তাকালে লাভ মানে ভালোবাসা হবে তার দিকে তাকিয়ে থাকিস।”
রাগ নিয়ে আঙুল দেখিয়ে বললাম,
-“দেখ_
কথা বেশি বাড়ানোর আগেই হতাশ গলায় আমায় বলতে লাগলো,

-“দেখবো কী করে? আমি কী আর তোর সাথে থাকবো? উফ, আমি তো কল্পনায় সাজিয়ে ফেলেছি তোদের। খোলা আকাশের নিচে, পড়ন্ত বিকেলে, ছাদের এককোণে একটা টুল পেতে বসবি তুই। পড়নে থাকবে কালো রঙের “
হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই বলে উঠলো,

-“না না, নীল রঙের থ্রি পিস। হাত ভর্তি নীল কাঁচের চুড়ি। চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে লাজুক হাসি। মাথার চুলগুলো থাকবে বিনুনি করা কিন্তু কিছু অবাধ্য চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকবে মুখের ডান-বামে। মৃদুমন্দ বাতাসে যখন অবাধ্য চুলগুলো আরও অবাধ্য হয়ে উঠবে, তখন সেগুলো কানে গুঁজে দিতেই নীল চুড়ি শব্দ করে ডেকে উঠবে নীল নামক মানুষকে।”
ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলাম,
-“সুমাইয়া, জাস্ট সাট আপ।”

-“উফ, বলতে দেয় আমায় না হলে ভুলে যাবো।”
কাব্যিক ভাব নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
-“নীল চুড়ির হাতটা যখন কানে চুল গুঁজে দিয়ে নিচে নামতে শুরু করবে, তার আগেই তোর কাজল কালো চোখ লজ্জার পর্দা সরিয়ে দৃষ্টি দিবে নীলের দিকে। কয়েক সেকেন্ড চোখাচোখি হবে দু’জনার।

কিন্তু লজ্জা খুব করে চেপে ধরবে তোকে, তখন চোখ সরিয়ে দৃষ্টি দিবি ছাদের মেঝেতে। লজ্জা ঢাকতে অহেতুক কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে তুলতে, পাশে থাকা গিটারটা তুলে নিবি হাতে৷ কিন্তু তোর তরুর মতো কোমল হাত, গিটার সামলাতে হিমশিম খাবে। সেটা দেখে চট করে নীল ছুটে আসবে তার কথামনির কাছে।”

এতটুকু শুনতেই রাগটা খুব করে চেপে ধরলো আমায় আর সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বলে উঠলাম,
-“জাস্ট অসহ্য। আর ইউ ম্যাড সুমাইয়া? কী সব যা তা সেই কখন থেকে বলে চলেছিস তুই?”

-“একটা থাপ্পড় দিবো। সমস্যা কী তোর? আমি তো জাস্ট কল্পনাই করছিলাম। এতে এতো ঢং করার কী আছে?”
-“ঢং হোক আর ভং হোক। আমার এসব শোনার একবিন্দুও ইচ্ছে নেই। সো আমি চললাম।”

-“আমার কথা শেষ হওয়ার আগে যদি তুই এক চুলও নড়েছিস। তাহলে ভাইয়াকে গিয়ে বলে দিবো তুই উনাকে ভালবাসি।”
দ্বিগুণ অবাক হয়ে,
-“হোয়াট? আর ইউ ম্যাড?”
-“জানি না। এখন শুনবি কি না বল?”

আমি জানি সুমাইয়া যা বলে তা-ই করে। সেজন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর অহেতুক বকবক শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করে বললাম,
-“ঠিক আছে।”
-“এই তো আমার সোনা মেয়ে। তা কোথায় যেন ছিলাম?”

ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম,
-“ছুটে আসছেন কথামনির দিকে।”
-“বাব্বা! খুব তো মনযোগ দিয়ে শুনেছিস দেখছি।

এনি ওয়ে, ছুটে এসে পিছন দিকে দাঁড়াবে। তারপর ঝুঁকে আসবে কথামনির ডান কাঁধের খুব কাছে। ডান হাতে কথামনির ডান ধরে আর বাম হাতে বাম হাত ধরে শিখে দিবে কী করে গিটার আঁকড়ে ধরতে হয়। তারপর দশের সাথে দশ মিলিত হয়ে বিশে হবে একত্রিত। আর দু’জনার বিশ আঙুল গিটারে নেচে নেচে সৃষ্টি করবে ভিন্ন সুর। যে সুর সবার কাছে অচেনা অজানা কিন্ত তোদের কাছে খুব করে চেনা জানা।”
এই বলে থেমে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“ভালো হবে না বল?”

কয়েক সেকেন্ড সুমাইয়ার হাসি মাখা মুখটা দিকে তাকিয়ে হঠাৎ-ই সুমাইয়াকে মারতে শুরু করলাম। মারতে মারতে বলতে লাগলাম,
-“বাঁদর মেয়ে, হনুমানের নাতির সাথে আমাকে মিলিয়ে উল্টো পাল্টা বলে এখন জিজ্ঞেস করছিস ভালো হবে কি না? তোর ভালোর আমি গোষ্ঠী কিলাই।”
-“আমার মতো নিরীহ মেয়েকে এভাবে কেন মারছিস?”

মারা বন্ধ করে বললাম,
-“নিরীহ মেয়ে তুই? ডাকিনী, আবার যদি দেখি আমাকে আর হনুমানের নাতিকে এক করে কিছু বলেছিস তাহলে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করবো হিরো আলমের সাথে।”
বিস্মিত নয়নে,

-“মানে কী? আমার ইয়াসির ক্রাশকে রেখে আমি হিরো আলমকে কেন বিয়ে করবো?”
-“তোমার ক্রাশকে বাঁশ বানিয়ে উগান্ডা বেঁচে দিয়ে আসবো। তারপর হিরো আলমের সাথে তোর বিয়ে দিবো। আর আমি হাই হীল পড়ে নাচবো।”
দুষ্ট হাসি দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে,

-“কার সাথে রে? তোর বর নীল ভাইয়ার সাথে?”
-“ধ্যাত! আর ভালো লাগছে না তোর এইসব উদ্ভট কথাবার্তা। আমি চললাম। হুহ।”

টিভিতে টকশো দেখতে ভালো না লাগলেও আমার মা আর জেঠীমার টকশো আমার ঠিকই ভালো লাগে। মা আর জেঠীমাকে একসাথে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেখলেই আমার মনে হয়, উনারা দু’জন চৌধুরী চ্যানেলে টকশো অনুষ্ঠান করছেন। আমাদের পরিবার যেহেতু চৌধুরী পরিবার সেই প্রেক্ষিতে আমি আমার কাল্পনিক চ্যানেলের নাম দিয়েছি ‘চৌধুরী চ্যানেল’। যেখানে কেবল মা আর জেঠীমার টকশো প্রচারিত হয় তাও আবার বিজ্ঞাপন ছাড়া।


পর্ব-২৮

রাতের খাবার শেষ করে টিভি দেখতে বসেছিলাম। তখন মা আর জেঠীমা ড্রয়িং রুমে চলে এলো গল্পগুজব করতে। আফরোজা ফুপ্পির মেয়ের আকিকা নিয়ে কথাবার্তা চলছে। আমি কিছুক্ষণ সেসব কথায় মন দিয়ে বসে রইলাম।

হঠাৎ ঘড়িতে চোখ পড়তেই দেখি, ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। টিভি দেখা অফ করে রুমে চলে এলাম বইপত্র নিতে। অনেকদিন হলো ভাইয়ার কাছে পড়া বন্ধ রয়েছে। বিয়ে, অসুস্থতা এসবের জন্যই পড়াশোনা বন্ধ ছিল আর ভাইয়াও পড়তে বলেন নি।

বইপত্র নিতে নিতে হঠাৎ সেই রাতের কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো ঘুমের ঘোরে বলা আবোলতাবোল কথাগুলো আর খুব করে মনে পড়লো ভাইয়ার হৃৎস্পন্দন। এখনও মাঝে মাঝে ভাইয়ার হৃৎস্পন্দন বেজে উঠে আমার কানে। অনুভব করি উনার হৃদয় কারোর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু জানি না, কে সেই ভাগ্যবতী মেয়ে যার জন্য এতোটা ব্যাকুল উনার হৃদয়?

বইপত্র নাড়াচাড়া করে খুঁজে নিতে হচ্ছে। কয়েকদিনের ব্যস্ততায় রুমটা একদম বস্তির মতোন হয়ে আছে। ইংরেজি গ্রামার বইটা হাতে নিতেই চোখ পড়লো ডায়েরিতে। এটা আমার শখের ডায়েরি যেটা চুরি হয়েছে বলে ঘুম থেকে কেঁদে কেঁদে জেগে উঠে ছিলাম। তখন অবশ্য ডায়েরিতে কিছু লেখা হতো না তবে ইদানীং বেশ নিয়ম করেই ডায়েরি লিখছি। হাতে সময় নেই তবুও ডায়েরিটা দেখার জন্য হাতে নিলাম।

আন্দাজে একটা পৃষ্ঠা খুলতেই চোখে পড়লো নিজের লেখা একটা কবিতা,
“নামটাই যে অজানা আমার কাছে
তাহলে সম্বোধন করবো কী দিয়ে?

অপরিচিতের সম্বোধন নাকি ‘আপনি’ হয়
কিন্তু গচ্ছিত চিঠিগুলো তো
বারবার আমাকে জানান দেয়
খুব করে সে আমার পরিচিত।

আপনজনের সম্বোধন নাকি ‘তুমি’ হয়
কিন্তু সম্পর্কহীনা মানুষটাকে
কী করে ডাকবো আমি ‘তুমি’ করে?

অতিরিক্ত আপনজন যার প্রতি খুব করে
ভালবাসা, রাগ, অভিমান করে থাকা যায়,
তার সম্বোধন নাকি ‘তুই’ হয়
কিন্তু আমি তো কিছুই অনুভব করি না,

তাহলে কি ‘তুই’ করে ডাকতে পারবো?
মাঝে মাঝে মনে হয় খুব পরিচিত

মাঝে মাঝে অপরিচিত কেউ।
কখনও হৃদয়ে ভালবাসা অনুভব করি
কখনও আবার হৃদয়টাই,
হয়ে পড়ে টান শূন্য।

একসাথে এতোকিছুর সৃষ্টি,
হয় কেন আমার মাঝে?
এতো শত কারণেই কি
আজও সম্বোধন বাকি রয়ে গেছে?”

এটা যে কোনো দিক দিয়েই কবিতা নয় সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। কিন্তু কাজকর্ম থাকে না আবার চিঠির উনার কথা খুব করে মনে পড়ে। তাই তো উনাকে নিয়ে হাবিজাবি লিখে ফেলি যখন-তখন। কবিতার আবার নামও দিয়েছি– সম্বোধন। উনার সম্পর্কে তো কিছুই জানি না, উনার নামটাও অজানা। তাই তো দোটানায় পড়ে যাই এই ভেবে যে, কী সম্বোধন হবে বেনামি চিঠির মালিকের?

সোয়া দশটা বাজতে চললো। তাই ডায়েরি দেখা বন্ধ করে বইপত্র হাতে দৌড় দিলাম নীল ভাইয়ার রুমে। ভাইয়ার রুমের কাছাকাছি এসে চলার গতি কমিয়ে পা টিপে টিপে উঁকি দিলাম রুমে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ভাইয়াকে কোথাও দেখতে পেলাম না। মনে মনে গোটা কয়েকটা প্রশ্নের সৃষ্টি হলো আর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যর্থ হয়ে, রুমে ঢুকে চুপটি করে বসে রইলাম চেয়ারে।

পাঁচ সাত মিনিট পর কারোর পায়ের শব্দ কানে আসতেই ঘুরে তাকালাম রুমের দরজার দিকে। দেখলাম তিক্ত মেজাজে হনহন করে রুমে ঢুকলেন ভাইয়া। ফুল স্পিডে ফ্যানে ছেড়ে তোয়ালে, টাউজার আর টিশার্ট নিতে শুরু করলেন। পুরো শরীর ঘেমে একাকার হয়ে আছে। উনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে হয়ত শাওয়ার নিবেন। ওয়াশরুমে দিকে পা বাড়ানোর আগে আমায় বললেন,

-“এক কাপ চা করে দিতে পারবি আমি গোসলটা শেষ করে আসার আগে?”
সবসময় ভাইয়া অর্ডার করেন আজকে জিজ্ঞেস করছেন বিধায় হকচকিয়ে গেলাম। দ্বিগুন বেগে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়াতেই যেন উনি কিঞ্চিৎ স্বস্তি ফিরে পেলেন। হালকা গলায় বলে উঠলেন,
-“ঠিক আছে করে নিয়ে আয়। আমি গোসল করে আসি।”

এই বলে ওয়াশরুমে চলে গেলেন উত্তরের প্রত্যাশায় একমুহূর্তও দেরি না করে। আমি ধীর পায়ে কিচেনে চলে এলাম। চুলা জ্বালিয়ে পরিমাণমতো পানি দিয়ে বসিয়ে দিলাম সসপ্যান। তেজপাতা, এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম পানি ফুটানোর জন্য।

কয়েকমিনিট পর ফুটন্ত পানিতে চা পাতার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিতেই সাদা পানি মুহুর্তেই লালচে হয়ে গেল। এক দুই মিনিট পর সেটা নামিয়ে, ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে ভাইয়ার চায়ের কাপে ঢেলে দিলাম। উনার খাবারের জিনিসপত্র সবই আলাদা করা। অন্য কারোর সাহস নেই উনার জিনিস ব্যবহার করার। চায়ের কাপে চা ঢেলে দেবার পর কিছু আদার কুচি ছড়িয়ে দিয়েছি চায়ে। ভাইয়া এভাবেই চা খেতে পছন্দ করেন, দুধ চিনি ছাড়া।

চায়ের কাপটা টেবিলে সাজিয়ে রেখে চুপটি করে বসে আছি। মিনিট পাঁচেক পর গোসল শেষ করে বের হলেন ভাইয়া। ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,

-“এনেছিস?”
-“হুম।”

উনি আর কথা না বাড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুলে কী যেন লাগিয়ে তোয়ালেটা ছড়িয়ে দিতে গেলেন বারান্দায়। রুমে এসে চেয়ার টেনে বসে ভেজা চুল হাতের সাহায্যে পিছনে ঠেলে দিলেন। কিন্তু খানিকটা নুইয়ে যখন চায়ের কাপ নিতে ব্যস্ত হলেন, তখন অবাধ্য আধোভেজা চুল উনার কপাল দখল করে পড়ে রইলো। এই মুহূর্তে উনার চেহারায় যেই সৌন্দর্যের সৃষ্টি হচ্ছে তাতে আমার চোখই যেন ধোঁকা খাচ্ছে আর মন বলে উঠছে,

-“উনি হুট করেই এতো সুন্দর কেন হয়ে গেলেন? কী এমন আছে উনার মাঝে যা এখন আমায় খুব করে উনার দিকে টানে? কেন এতো ভালো লাগে উনার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে?”

ভাইয়া চায়ের কাপে এক দফা চুমুক দিয়ে চায়ের কাপ মুখের সামনে ধরে রেখে সামনে তাকালেন। শূন্যে দৃষ্টি রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“অন্তত চা-টা খেতে দেয়। আর কত তাকিয়ে দেখবি আমায়?”

আচমকা উনার মুখে এমন কথা শুনে তো আমি ৪২০ ভোল্টের শক খেলাম। আমাকে না দেখেই কথাগুলো বললেন। হুট করে উনার এসব কথা যেন আমি ঠিক নিতে পারছি না। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পেরে লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগলো আমার। মনে মনে বলতে লাগলাম,
-“ছিহ! এমন নির্লজ্জ কেন আমি? এভাবে কেউ তাকিয়ে থাকে? আমি হয়ত দিন দিন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছি। তাই তো ভাইয়া আমাকে এভাবে বললেন।”

লজ্জায় গুটিশুটি মেরে মাথা নুইয়ে বসে আছি। ভাইয়া চা খাওয়া শেষ করে অন্য প্রসঙ্গ টেনে বললেন,
-“কয়েকদিন তো বেশ ছুটি কাটালি। এবার তাহলে পড়া শুরু কর নতুন করে, কেমন?”
ইদানীং উনার কথাগুলো বেশ মায়া জড়ানো মনে হয়। আর এখন ঐ মায়া জড়ানো কন্ঠ যেন আমার লজ্জাটা খুব করে বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই তো কেবল ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম।

ইংরেজি গ্রামার বইটার পাতা উল্টাতে উল্টাতে নরম সুরে বললেন,
-“অন্য কারোর পছন্দ জানা নেই তবে আমার লজ্জা রাঙা মুখটাই বেশ পছন্দ। কারণ লজ্জাই যে নারীর ভূষণ।”
হঠাৎ-ই আবার বলতে লাগলেন,

-“অনেক দিন পর ক্রিকেট খেলে বেশ ক্লান্ত লাগছে। কালকে বেশি করে পড়িয়ে দিবো। আজকে কেবল হোমওয়ার্ক দিয়ে দিচ্ছি।”
আমি চুপ করেই আছি। তবে মনে মনে ভাবছি,
-“হঠাৎ লজ্জা রাঙা মুখের কথা কেন বললেন উনি? আমি লজ্জা পেয়েছি বলে? যদি আমাকেই বলে থাকেন, তাহলে কি উনি আমায় পছন্দ করেন?”


পর্ব-২৯

বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি। কিন্তু ঘুম নামক পাখিটার দেখা মিলছে না কিছুতেই। রাতে ভাবনায় বিভোর থাকার মাঝে একটা অন্যরকম ভালো লাগা আছে। চারদিকের নিস্তব্ধতার মাঝে, একলা আমি কারোর চিন্তায় খুব করে বিভোর হয়ে আছি।
আজকাল কেন যেন খুব করেই মনে হচ্ছে আমার,

-“বেনামি চিঠির মালিক হয়ত আমার পরিচিত কেউ। মনটা বারবার বলছে, ‘কথামনি, আশেপাশে খোঁজে দেখ। পেয়ে যাবি হয়ত।’ সাথে সাথে আবার নীল ভাইয়ার দিকেও যেন ইশারা করছে।”
শোয়া থেকে উঠে বসতেই খানিকটা জোরে বলতে লাগলাম,

-“বেনামি চিঠির মালিক নীল ভাইয়া কিনা জানা নেই। তবে আজকে উনার কাছে পড়তে যাওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে ভাইয়া হয়ত আমাকে পছন্দ করেন।”
কথাগুলো বলতেই লজ্জা রাঙা হয়ে গেল আমার মুখখানা কিন্তু পরক্ষণেই আবার বলে উঠলাম,

-“হায় আল্লাহ! না না, একদমই না। উনার বউ হবো আমি! ইম্পসিবল। কারণ উনার জন্য আমি দোয়া করেছিলাম আপনার কাছে, উনার গার্লফ্রেন্ড যেন উনাকে বিয়ের পর মরিচগুঁড়ো দিয়ে তিনবেলা খেতে দেয়। আর প্রতিদিন দুটো চড়ের সাথে পাঁচটা ঘুষি উপহার দেয়। কিন্তু আমি তো ভয়ে এসব কিছুই করতে পারবো না। তাই আমার দোয়া কবুল করতে আমার সাথে উনার বিয়ে টিয়ে একদমই হওয়া যাবে না।”

পাগলের মতোন একা একা এসব বকবক করে নিজেই আবার হেসে উঠলাম। এই মূহুর্তে হুট করেই কেন যেন আমার ভালোও লাগছে না আবার খারাপও লাগছে না। তাই ভাবলাম একটু গান শুনে ঘুমানোর চেষ্টা করবো। ফোনে একটা গান প্লে করে, কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিলাম। বালিশে মাথা রাখতেই পুরো মনোযোগটা দিয়ে দিলাম গানে,
“সারা রাত ভোর
চোখের ভেতর

স্বপ্নে তোমার আনাগোনা।
নেমে আসে ভোর,
থাকে তবু ঘোর

হাওয়ায় হাওয়ায় জানা শোনা।
তুমি দেখা দিলে তাই,
মনে জাগে প্রেম প্রেম কল্পনা
আমি তোমার হতে চাই,
এটা মিথ্যে কোন গল্প না।

ও ছুয়েছো হৃদয় আমার,
প্রেমের আবির মেখে।
ডুবেছি তোমার মাঝে,

নিজেকে আড়াল রেখে।
তুমি আছো ভাবনাতে,
পুরোটা একটু অল্প না।
আমি তোমার হতে চাই,

এটা মিথ্যে কোন গল্প না।”
গান শুনতে শুনতে হঠাৎ নীল ভাইয়ার কথাগুলো মনে পড়তে লাগলো,
-“অন্য কারোর পছন্দ জানা নেই তবে আমার লজ্জা রাঙা মুখটাই বেশ পছন্দ। কারণ লজ্জাই যে নারীর ভূষণ।”
গানের সুর অস্পষ্ট করে কানে ভেজে উঠছে ভাইয়ার কথাগুলো। লাজুক হাসি দিয়ে আমিও হঠাৎ বলে উঠলাম,

-“অন্য কারোর পছন্দ জানা নেই তবে আপনার স্লিকি চুলে অন্তত একটিবার হাত বুলিয়ে বলতে চাই, ‘হনুমানের নাতি হোমওয়ার্ক একটু কম দেওয়া যায় না?’ বাঁদরমুখো একটা। আজকেও একগাদা হোমওয়ার্ক দিয়ে দিয়েছে। হুহ।”

হোমওয়ার্কের কথা মনে পড়তেই উনার প্রতি জন্মানো সকল ভালো লাগা, মন্দ লাগায় পরিনত হলো। সত্যি বলতে, উনার মতো মানুষের প্রতি ভালো লাগার বিষয়টা একদমই কাজ করে না। উনাকে নিয়ে ভাবতে গেলে, উনার উদ্ভট কথাবার্তা আর আচরণের কথা মনে পড়তেই, উনার প্রতি থাকা সকল ভাবনা জানালা দিয়ে পালাতে শুরু করে।
ইয়ারফোন খুলে গান অফ করে দিয়ে বলতে শুরু করলাম,

-“হে আল্লাহ! জীবনে অনেক প্যারা দিয়েছেন উনার মতো একটা মানুষকে আমার জীবনে দিয়ে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি একটুও নারাজ নই আপনার উপর। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তাই আপনার মর্জি অনুযায়ীই সব হবে। তবুও নীল ভাইয়া আমাকে পছন্দ করলেও আমি উনার জীবনের অংশ হতে চাই না, একদমই না। এইটুকুন রহমত আপনার কাছে কামনা করছি আল্লাহ। আমিন।”


-“তুই কি আমার জীবনে প্যারা দেওয়ার জন্য জন্মেছিস? সমস্যা কী তোর? এক কথা কতবার বলবি? আরে, তুই কি পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী যার বাগদান হবে? নাকি তুই-ই শেষ যার পর আর কোনো বাগদান অনুষ্ঠান হবে না?”

একনাগাড়ে সবটা বলেই ক্ষান্ত হলাম আমি। ইয়াসির ভাইয়ার সাথে সুমাইয়ার বাগদান অনুষ্ঠানের বিষয়টা এই পযন্ত না হলেও দু’শ বার বলেছে সুমাইয়া। বলে বলে আমাদের কান ঝালাপালা করে ফেলছে। ওর কথা হচ্ছে ও বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে যেন আমরা ভুলে না যাই। কিন্তু এটা ভুলবো কেন? এই কারণটাই আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

আজকে ক্লাস নেই বলে দুপুরে একটু ঘুম দিয়েছিলাম। কিন্তু পনেরো মিনিটও হয় নি সুমাইয়ার কলে উঠে পড়তে হয়েছে। একে তো সাধের ঘুমের বারোটা বাজিয়েছে তারউপর ফোনে সেই পুরাতন ক্যাসেট প্লেয়ার চালাচ্ছে বলে রাগে এসব শুনিয়েছি। আমার রাগ দেখে সুমাইয়া নেকামি করে বলতে লাগলো,
-“এমন কেন করছিস টিয়াপাখি?”
-“তো কী করবো তোকে?”
-“ভালোবাসবি আর কী?”

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
-“দেখ, আমাকে ঘুমাতে দেয় প্লিজ।”
আমার কথার তোয়াক্কা না করেই বলতে লাগলো,

-“আরে রাখ তো তোর ঘুম। পহেলা বৈশাখের প্ল্যান কী সেটা আগে বল।”
মেজাজ আমার জলন্ত উনুনে পরিনত হলেও বেশ মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলাম,
-“বলবো কি?”
বেশ আগ্রহ নিয়ে সুমাইয়া বললো,
-“হুম হুম বল।”

-“সকালে নয়টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হবো। তারপর সকালের নাস্তা শেষ করে, ছাদে গিয়ে লুঙ্গি ডান্স দিবো ফোন রাখ।”
প্রথম কথাগুলো বেশ নরম সুরে বললেও শেষের কথাগুলো বেশ রাগ নিয়ে বললাম। আমার কথা শুনে সুমাইয়া বলতে লাগলো,
-“আমি জানতাম তুই এমনই কিছু একটা বলবি। ওকে ফাইন। কিন্তু তোর এই পানসে স্বভাব খুব শীগ্রই নষ্ট হবে।”

একটু চুপসে গেলাম ভেতরে কিন্তু সেটা বুঝতে না দিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
-“কিসের পানসে স্বভাব আর কে নষ্ট করবে? হুম?”
-“ও গো আমার নেকা মনি, তোমার নীল ভাইয়ার কথা বলছি। যে তোমাকে বউ বানিয়ে, তোমাকে সুঁইয়ের ডগায় সত্যিই লুঙ্গি ডান্স দেওয়াবে। হুম।”
রাগে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলাম,
-“তোর সমস্যা কী? হ্যাঁ? অন্যকিছু দিয়ে তো পারিস না। তাই হনুমানের নাতির সাথে জরিয়ে আমাকে ক্ষেপানো চেষ্টা করিস, তাই তো?”
হঠাৎ-ই সুমাইয়া জোরে জোরে হাসতে লাগলো। ওর হাসি শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-“কী আশ্চর্য! এমন ডাকিনীর মতোন হাসছিস কেন?”
হাসি থামিয়ে বেশ রাজকীয় একটা ভাব নিয়ে বলতে লাগলো,
-“হা হা। এটা তো কেবল শুরু। পিকচার আবি বাকি হে মেরে দোস্ত।”

-“ঠাটায় একটা চড় লাগবো। হিন্দি বলে কি নিজেকে হিন্দি সিনেমার নায়িকা মনে করছিস?”
-“আজব তো! ভাবলে দোষ কোথায়?”
-“নাহ, কোনো সমস্যা নেই। আপনি হিন্দি বলে বলে জনি লিভারের নায়িকা হোন। আমি ঘুমাবো আর খবরদার আমাকে কল করবি না বায়।”


পর্ব-৩০

এই বলে কল কেটে, ফোন অফ করে দিলাম যেন আবার কল করতে না পারে। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে কাঁথা টেনে যেই বালিশে মাথা রাখতে যাবো ওমনি হনহন করে রুমে ঢুকলো মিতালি। ওর এমন ভাবসাব দেখে আমি চমকিত নয়নে জিজ্ঞেস করলো,
-“কী হয়েছে তোর?”

বেশ তাড়া দিয়ে বলতে লাগলো,
-“আপামনি, চুলাত দুধ আর চা বসায় আইছি পইড়া যাইবো গা।”
-“আহা! এতোকিছু না বলে কী জন্যে এসেছিস সেটা আগে বল।”
জিহ্বা কামড়ে বলতে লাগলো,

-“আরে হয়। যেই কামে আইছি হেডাই তো কই নাই। মৃন্ময় ভাই আইছে আফনারে ডাকে। আফনে তাড়াতাড়ি আইয়েন আমি গেলাম।”
বলেই দিলো দৌড় আমি কিছু বলার আগেই। ওর এমন দৌড়াদৌড়ি দেখে আমি হালকা হেসে উঠে বললাম,
-“আধা পাগল, মিতা+আলি।”

বান্দরবান যাবার আগে মৃন্ময় ভাইয়া আমাদের বাসায় এসে সবার সাথে দেখা করে গিয়েছিলেন। তখন যে উনার সাথে দেখা হয়েছিল, এরপর আর দেখা হয় নি। বান্দরবান থেকে ফিরে আসার পর আমাদের বাসায়ও আসেন নি, হয়ত ব্যস্ত ছিলেন।
আমি ড্রয়িং রুমে এসে দেখি মৃন্ময় ভাইয়া, নীল ভাইয়া, মা আর জেঠীমা মিলে গল্প করছে। আমায় দেখতেই মৃন্ময় ভাইয়া মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো,
-“কী খবর কথকপাখি?”

দুই কদম এগিয়ে এসে মা’র পাশে দাঁড়ালাম। ঘুমটা পুরোপুরি হয় নি বলে ঘুম ঘুম ভাব ছেয়ে আছে চোখে মুখে। মেজাজও খানিকটা বিগড়ে আছে। কিন্তু ‘কথকপাখি’ নামটার জাদুকরী শক্তি আমার মনটাকে ফুরফুরে করে দিলো। সতেজ মন আর সাথে হালকা হাসিতে ভাইয়াকে জবাব দিলাম,
-“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া। আপনি?”
-“হুম, ফাস্ট ক্লাস। তা তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?”

আমি বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম, এরমাঝেই মা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো,
-“আর পড়াশোনা। সারাদিন ধেই ধেই করে নেচে বেড়াবে, চুড়ি নিয়ে পড়ে থাকবে আর আড্ডা দিয়ে বেড়াবে। পড়াশোনার নাম গন্ধও নেই। তাও নীল বাবার কাছে পড়ছে বলে একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি।”
মার কথার জবাবে মৃন্ময় ভাইয়া বললো,

-“ফুপ্পি, তুমি ভেবো না। নীল তো আছেই তাছাড়া আমাদের কথামনি তো পড়াশোনায় বেশ ভালো।”
নীল ভাইয়া ফোন স্ক্রোল করছিলেন। মৃন্ময় ভাইয়ার কথা শুনে উনিও তাচ্ছিল্যের সুরে মিনমিন করে বললেন,
-“গোবরে ভর্তি মাথায় আবার পড়াশোনা।”

মা’র পাশে বসেছিল জেঠীমা। আমার প্রতি সবার অবহেলা দেখে জেঠীমা আমার পক্ষাবলম্বন করে বললো,
-“সবাই মিলে মেয়েটার পিছনে কেন পড়িস? বুঝি না। বাদ এইসব। তা মৃন্ময় এতো দিনে একবারও কি তোর ফুপ্পির কথা মনে পড়ে নি?”

-“কী যে বলো না তুমি ফুপ্পি। মনে পড়বে না কেন? আসলে কিছু কাজ ছিল সেগুলো সামলাতে গিয়ে আর সময় করতে পারি নি।”
-“ঠিক আছে। এখন থেকে আবার মাঝে মাঝে সে ফুপ্পিকে দেখে যাবি।”
-“ঠিক আছে আসবো।”
হঠাৎ-ই একটা শপিং ব্যাগ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে মৃন্ময় ভাইয়া বললো,
-“কথকপাখি, এটা তোমার জন্য।”

আচমকা শপিং ব্যাগ দেখে একটু অবাক হলাম। এক ব্যাগ শপিং বেগ দেখছি তো একবার উনাকে দেখছি। হঠাৎ আমার জন্য কিছু এনেছেন, সেটা ঠিক হজম করতে পারছি না। তাই কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“কী ভাইয়া?”
পাশ থেকে মা বলে উঠলো,
-“দিচ্ছি যখন নিয়ে দেখ।”

মা’র কথা শুনে আমি নীল ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়াও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন বলে চোখাচোখি হলো দু’জনার। আমার মনে কথাগুলো বোধহয় উনাকে বলার প্রয়োজন হয় না। তাই সুন্দর চোখ জোড়া বুঁজে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন ব্যাগটা নিতে। আমি উনার সম্মতি পেয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখতে শুরু করলাম। এতে পুঁথির মালা, চুড়ি, চাদর, আচার আর সাথে কিছু সৌখিন জিনিসপত্র রয়েছে। এসব দেখে অনুমান করলাম, বান্দরবান থেকে ভাইয়া এসব আমার জন্য এনেছেন।

-“কথকপাখি, পছন্দ হয়েছে?”
হালকা হেসে জবাব দিলাম,
-“হ্যাঁ ভাইয়া। খুব সুন্দর সবগুলো। থ্যাংকস ভাইয়া।”
-“ইউ’র মোস্ট ওয়েলকাম কথকপাখি।”


পর্ব-৩২

সকাল থেকেই আকাশটা মুখ ভার করে আছে। সূর্যের দেখা নেই বলে ক্ষণে ক্ষণে আবার কেঁদেও উঠছে। রাস্তাঘাট এই হালকা বৃষ্টিতেও হয়ে আছে কাদামাটিতে ভরপুর। গাছের পাতা থেকে, টপটপানি শব্দে পড়ছে জমে থাকা জল। মাঝে মাঝে হালকা বাতাস মনে করিয়ে দিচ্ছে– কাল পহেলা বৈশাখ। এমন চৈত্র মাসে মুখ ভার করা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করে,

-“এই আকাশ, তোমার কি মন খারাপ, পুরাতন সন চলে যাবে বলে?”
আকাশটা কোনো জবাব দিলো না শুধু গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে নিজের আর্তনাদ প্রকাশ করলো। কিন্তু আকাশ চুপটি করে থাকলেও সুমাইয়া চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
-“ঐ, তোর মাথা কি পুরাটাই গেছে? এমন বৃষ্টিতে আমায় ছাদে কেন নিয়ে এলি? অসুখ বিসুখ করলে আমার ইয়াসিরের কত টেনশন হবে তুই জানিস?”

এমনিতেই টেনশনে আছি তারউপর সুমাইয়ার কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। তাই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলাম,
-“আরে চুপ ইয়াসির, ইয়াসির, ইয়াসির। আর একবার ঐ মেয়েছেলেটার নাম নিলে জাস্ট ফুটবলের মতো একটা লাত্থি দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিবো তোকে।”

আমার তিক্ত মেজাজ আর ঝাঁঝালো কণ্ঠে চুপসে গেল সুমাইয়া। কাঁদো কাঁদো গলায় আমায় জিজ্ঞেস করলো,
-“মেয়েছেলে কাকে বললি টিয়াপাখি?”

আঁড়চোখে তাকিয়ে একমিনিট পর্যবেক্ষণ করে কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
-“নেকামো করছেন আমার সাথে? বুঝেন না কাকে বলেছি?”
ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো,
-“না তো।”
রাগে চোখমুখ খিঁচতে লাগলাম আমি। কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

-“দেখ, আমি একটা বিষয় নিয়ে খুব টেনশনে আছি। কালকে সারারাত ঘুমাতে পারি নি। তুই এসেছিস অনেক ভালো হয়েছে।”
আমার মেজাজ ঠান্ডা হতে দেখে এবার সুমাইয়া ভাব নিয়ে বললো,
-“আমি কিন্তু তোকে কোনো হেল্প করতে পারবো না আগেই বলে দিলাম।”
-“ভাব দেখাচ্ছিস?”

-“মোটেও না ঠিক আছে বল কী জন্যে ঘুমাতে পারিস নি সারারাত। কিন্তু প্লিজ আগে নিজে চল। ভিজে যাচ্ছি তো।”
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও অনেকটাই ভিজে যাচ্ছে সুমাইয়া সাথে আমি নিজেও। কিন্তু এতে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। হয়ত টেনশনে আছি বলে বৃষ্টিকে তোয়াক্কা করছি না। আমি ওর মাথায় হালকা চাটি মেরে বললাম,

-“ডাকিনী, তোর বুদ্ধিতে নিচে গিয়ে কথা বলি আর মা গিয়ে নীল ভাইয়াকে বলার সুযোগ পেয়ে যাক।”
বিষয়টা এবার বুঝতে পেরে সুমাইয়া বলতে লাগলো,

-“ও আচ্ছা আচ্ছা। আপনি নীল ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তিত। তা শুনি ভাইয়া আবার তোকে পানিশমেন্ট দিলো।”
-“আরে ধ্যাঁত! ভাইয়া কেন পানিশমেন্ট দিতে যাবেন? উনি তো ?”
হঠাৎ সুমাইয়া আমাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
-“ওয়েট ওয়েট। তুই ভাইয়াকে ভাইয়া ডাকছিস?”
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে,

-“হ্যাঁ, কেন আগে কখন ডাকতে শুনিস নি?”
-“তা কেন শুনবো না। কিন্তু এই প্রথম তোর ভাইয়া ডাকে রাগ নয় অন্য কিছু দেখছি।”
মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম,
-“তুই কি আমার কথা শুনবি?”
হালকা হেসে,

-“হুম বল বল।”
কয়েক সেকেন্ড নিরবতাকে আঁকড়ে ধরে দৃষ্টি দিলাম বৃষ্টি ভেজা ছাদে। তারপর মেঘলা আকাশ পানে তাকিয়ে বলতে শুরু করলাম,
-“নীল ভাইয়া সত্যি অন্যরকম। আর দিন দিন কেমন যেন বদলে যাচ্ছেন। অনেকটা বদলে গেছেন উনি। আগের নীল ভাইয়া আর এখনকার নীল ভাইয়ার মাঝে যেন আকাশ পাতাল ব্যবধান।

জানিস, আগের নীল ভাইয়াকে বড্ড ভয় পেতাম, বড্ড বেশি। কিন্তু এখন যাকে দেখছি তাকে কেন জানি বড্ড আপন মনে হয়।”
একটু দুষ্ট হাসি দিয়ে সুমাইয়া আমাকে পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“টিয়াপাখি, ব্যাপারটা কী বল তো? আজকে তোর মুখে ভাইয়ার প্রশংসা শুনছি। ইংরেজিতে কী যেন বলে এটাকে? হুম মনে পড়েছে, The devil listening to the Scriptures. এটা কি সত্যি নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি? সত্যিই কী তুই ভাইয়ার প্রশংসা করছিস!”
-“যে প্রশংসা পাবার মতোন কাজ করেন তার প্রশংসায় কীভাবে কার্পণ্য করি বল?”
আমাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে বিস্মিত নয়নে জিজ্ঞেস করলো,
-“মানে? ভাইয়া আবার কী কাজ করলো?”

ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে,
-“করেছে নয় করছেও আর ভবিষ্যতেও করবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।”
-“তোর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।”

হাত দেখিয়ে থামতে বলে আমি আবার বলতে শুরু করলাম,
-“ঠিক আছে বলছি আমি কিন্তু তুই কথার মাঝে কোনো কথা বলি না।”
ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে, দুই হাতের বৃদ্ধা আঙুল দেখিয়ে আমাকে বললো,
-“ওকে ডান।”

আধোভেজা চুলের খোঁপা থেকে খুলে দিলাম কাঠের কাঠিটা আর সাথে সাথেই কালো কেশ গড়িয়ে পড়লো। আঙ্গুলের সাহায্যে ভেজা চুলগুলো ঠিক করতে ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলাম,
-“কালকে ভাইয়ার কাছে পড়া শেষ করার পর উনি আমাকে অনেক কিছু বলেছেন। ভাইয়া চান, আমি বিসিএস পরীক্ষা দেই। আমার নিজের একটা পরিচয় হোক। আর এ-ও বলেছেন, অন্য কেউ না চাইলেও ভাইয়া নিজে আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নেবেন।”

-“এটা তো খুব ভালো কথা বলেছেন ভাইয়া কিন্তু এটা নিয়ে টেনশনের কী আছে যার জন্য রাতে ঘুমাস নি তুই?”
ছাদের রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম হাত ভাঁজ করে। ডান হাতে থাকা কাঠিটা নাড়াতে নাড়তে বেশ স্বাভাবিক চেহারায় কিন্তু থমথমে গলায় বললাম,
-“নীল ভাইয়া আমাকে পছন্দ করেন, অন্যরকম আর অনেক বেশি।”
দায়সারা ভাব নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে,
-“এটা আর নতুন কী?”

হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“ওয়েট ওয়েট। এটা তুই বলছিস?”
চোখ বুঁজে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
-“হ্যাঁ, আমি বলছি। কেন জানিস?”
-“কেন, কেন?”

-“কালকে কথার প্রসঙ্গে ভাইয়া আমাকে বলেছিলেন, চৌধুরী বাড়ির মেয়ে বা চৌধুরী বাড়ির বউ কি শুধু পরিচয় হতে পারে? চৌধুরী বাড়ির মেয়ে হলাম আমি আর চৌধুরী বাড়িতে ছেলে আছেন শুধু উনি। তাহলে উনার বউ হলেই তো আমাকে সবাই চৌধুরী বাড়ির বউ বলে ডাকবে। তাই না?”
মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয়ে বললো,

-“হায় আল্লাহ! কী বলছিস তুই এসব? লাইক সিরিয়াসলি ভাইয়া এটা বলেছেন?”
-“জ্বী, আপনার নীল ভাইয়া এটাই বলেছেন।”

খুশিতে গদোগদো হয়ে,
-“বল না বল আর কী বলেছে রে।”
-“সর তো সামনে থেকে। আর কী বলবেন? এতটুকুই বলেছেন আর শোন, উনার মতোন মানুষের বউ হওয়ার কোনো শখ নেই আমার। সো জাস্ট চেপে যা বিষয়টা।”

-“মোটেও না। আমি তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবো রে আমার ভবিষ্যৎ বানী যে এবার সত্যি হতে চলেছে।”
-“তোর ভবিষ্যৎ বাণীর আমি বারোটা বাজাবো। তুই কি পাগল? উনাকে বিয়ে করা জাস্ট ইম্পসিবল আর আমার অনুমান তো ভুলও হতে পারে। কারণ অনেক সময় চোখের দেখাতেও ভুল হয় সেখানে অনুমান করে কোনো কিছু ভাবাটা হয়ত ঠিক হচ্ছে না।”

-“রাখ তো তোর এইসব বোরিং ফিলোসোফি। আমার ধারণা কখনও ভুল হতে পারে না।”
আচমকা আমার চিবুকে হাত দিয়ে মুখটা খানিকটা উঁচু করে ধরলো সুমাইয়া। তারপর সুরে সুরে বলতে লাগলো,
-“ওগো সুন্দরী ললনা

ভালোবাসি বলো না।”
সুমাইয়ার এমন কান্ডে আমি রাগী ভাব নিয়ে হালকা হেসে তাকিয়ে বললাম,
-“ডাকিনী, দাঁড়া তোর ভালোবাসা বের করছি আমি।”

ওকে কিছু করার আগেই দৌড় দিলো সিঁড়ির দিকে। আমিও দুইহাতে স্কার্টটা ধরে খানিকটা উঁচু করে ওর পিছু নিতে দিলাম দৌড়। সিঁড়ির প্রতি ধাপে আমার পায়ের নুপুরে সুর উঠছে। চারপাশ না দেখেই ওর পিছন পিছন দৌড় দেওয়ার ফলস্বরূপ কারোর সাথে আমার সজোরে লাগলো ধাক্কা। নিজেকে সামলে নিয়ে তাকিয়ে দেখি মৃন্ময় ভাইয়া। আমি জাস্ট থ মেরে দাঁড়িয়ে আছি আর মনে মনে ভাবছি,
-“যা বাব্বা! ঐ দিনের কাহিনিটা আজকে সম্পূর্ণ হলো।”

দূর থেকে সুমাইয়া দুষ্ট হাসি দিয়ে বললো,
-“ইশ, কেসটা উল্টো হয়ে গেল।”

আমি বুঝতে পেরেছি, সুমাইয়া কেস উল্টো বলতে কী বুঝাতে চেয়েছে? শয়তানটা মৃন্ময় ভাইয়ার জায়গায় নীল ভাইয়া হলে বেশি খুশি হতো। ওর এমন মতলব বুঝতে পেরে আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম ওর দিকে। আমার কপট রাগ দেখে সুমাইয়া খানিকটা হেসে বললো,
-“টিয়াপাখি, আমি যাই রে। বাকিটা পরে শুনবো।”

-“এই শোন “
কে শোনে কার কথা? আমি কিছু বলার আগেই সুমাইয়া চলে গেল। এত কান্ড ঘটলো কিন্তু ভাইয়ার মুখ দিয়ে এখনও কোনো কথা বের হচ্ছে না। আমার ঘর্মাক্ত মুখখানা ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,

-“কেমন আছেন ভাইয়া?”
-“আলহামদুলিল্লাহ। তা এতো দৌড়াদৌড়ি কীসের জন্য কথকপাখি?”
জোরপূর্বক হেসে বললাম,

-“তেমন কিছু না ভাইয়া।”
-“ওহ আচ্ছা তা নীলকে একটু ডেকে দেবে?”
-“ভাইয়া তো বাসায় নেই।”

-“আমাকে তো বললো বাসায়ই আছে।”
-“ও আচ্ছা। আসলে আমি ছাদে ছিলাম তো তাই জানি না ঠিক আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি।”
-“হুম।”


পর্ব-৩২

সকাল থেকেই আকাশটা মুখ ভার করে আছে। সূর্যের দেখা নেই বলে ক্ষণে ক্ষণে আবার কেঁদেও উঠছে। রাস্তাঘাট এই হালকা বৃষ্টিতেও হয়ে আছে কাদামাটিতে ভরপুর। গাছের পাতা থেকে, টপটপানি শব্দে পড়ছে জমে থাকা জল। মাঝে মাঝে হালকা বাতাস মনে করিয়ে দিচ্ছে– কাল পহেলা বৈশাখ। এমন চৈত্র মাসে মুখ ভার করা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে করে,
-“এই আকাশ, তোমার কি মন খারাপ, পুরাতন সন চলে যাবে বলে?”

আকাশটা কোনো জবাব দিলো না শুধু গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে নিজের আর্তনাদ প্রকাশ করলো। কিন্তু আকাশ চুপটি করে থাকলেও সুমাইয়া চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
-“ঐ, তোর মাথা কি পুরাটাই গেছে? এমন বৃষ্টিতে আমায় ছাদে কেন নিয়ে এলি? অসুখ বিসুখ করলে আমার ইয়াসিরের কত টেনশন হবে তুই জানিস?”

এমনিতেই টেনশনে আছি তারউপর সুমাইয়ার কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। তাই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলাম,
-“আরে চুপ ইয়াসির, ইয়াসির, ইয়াসির। আর একবার ঐ মেয়েছেলেটার নাম নিলে জাস্ট ফুটবলের মতো একটা লাত্থি দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিবো তোকে।”
আমার তিক্ত মেজাজ আর ঝাঁঝালো কণ্ঠে চুপসে গেল সুমাইয়া। কাঁদো কাঁদো গলায় আমায় জিজ্ঞেস করলো,
-“মেয়েছেলে কাকে বললি টিয়াপাখি?”

আঁড়চোখে তাকিয়ে একমিনিট পর্যবেক্ষণ করে কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
-“নেকামো করছেন আমার সাথে? বুঝেন না কাকে বলেছি?”
ঠোঁট উল্টে জবাব দিলো,
-“না তো।”
রাগে চোখমুখ খিঁচতে লাগলাম আমি। কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

-“দেখ, আমি একটা বিষয় নিয়ে খুব টেনশনে আছি। কালকে সারারাত ঘুমাতে পারি নি। তুই এসেছিস অনেক ভালো হয়েছে।”
আমার মেজাজ ঠান্ডা হতে দেখে এবার সুমাইয়া ভাব নিয়ে বললো,
-“আমি কিন্তু তোকে কোনো হেল্প করতে পারবো না আগেই বলে দিলাম।”
-“ভাব দেখাচ্ছিস?”

-“মোটেও না ঠিক আছে বল কী জন্যে ঘুমাতে পারিস নি সারারাত। কিন্তু প্লিজ আগে নিজে চল। ভিজে যাচ্ছি তো।”
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও অনেকটাই ভিজে যাচ্ছে সুমাইয়া সাথে আমি নিজেও। কিন্তু এতে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। হয়ত টেনশনে আছি বলে বৃষ্টিকে তোয়াক্কা করছি না। আমি ওর মাথায় হালকা চাটি মেরে বললাম,

-“ডাকিনী, তোর বুদ্ধিতে নিচে গিয়ে কথা বলি আর মা গিয়ে নীল ভাইয়াকে বলার সুযোগ পেয়ে যাক।”
বিষয়টা এবার বুঝতে পেরে সুমাইয়া বলতে লাগলো,

-“ও আচ্ছা আচ্ছা। আপনি নীল ভাইয়াকে নিয়ে চিন্তিত। তা শুনি ভাইয়া আবার তোকে পানিশমেন্ট দিলো।”
-“আরে ধ্যাঁত! ভাইয়া কেন পানিশমেন্ট দিতে যাবেন? উনি তো ?”
হঠাৎ সুমাইয়া আমাকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
-“ওয়েট ওয়েট। তুই ভাইয়াকে ভাইয়া ডাকছিস?”
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে,

-“হ্যাঁ, কেন আগে কখন ডাকতে শুনিস নি?”
-“তা কেন শুনবো না। কিন্তু এই প্রথম তোর ভাইয়া ডাকে রাগ নয় অন্য কিছু দেখছি।”
মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম,
-“তুই কি আমার কথা শুনবি?”

হালকা হেসে,
-“হুম বল বল।”
কয়েক সেকেন্ড নিরবতাকে আঁকড়ে ধরে দৃষ্টি দিলাম বৃষ্টি ভেজা ছাদে। তারপর মেঘলা আকাশ পানে তাকিয়ে বলতে শুরু করলাম,

-“নীল ভাইয়া সত্যি অন্যরকম। আর দিন দিন কেমন যেন বদলে যাচ্ছেন। অনেকটা বদলে গেছেন উনি। আগের নীল ভাইয়া আর এখনকার নীল ভাইয়ার মাঝে যেন আকাশ পাতাল ব্যবধান। জানিস, আগের নীল ভাইয়াকে বড্ড ভয় পেতাম, বড্ড বেশি। কিন্তু এখন যাকে দেখছি তাকে কেন জানি বড্ড আপন মনে হয়।”
একটু দুষ্ট হাসি দিয়ে সুমাইয়া আমাকে পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“টিয়াপাখি, ব্যাপারটা কী বল তো? আজকে তোর মুখে ভাইয়ার প্রশংসা শুনছি। ইংরেজিতে কী যেন বলে এটাকে? হুম মনে পড়েছে, The devil listening to the Scriptures. এটা কি সত্যি নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি? সত্যিই কী তুই ভাইয়ার প্রশংসা করছিস!”
-“যে প্রশংসা পাবার মতোন কাজ করেন তার প্রশংসায় কীভাবে কার্পণ্য করি বল?”
আমাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে বিস্মিত নয়নে জিজ্ঞেস করলো,

-“মানে? ভাইয়া আবার কী কাজ করলো?”
ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে,
-“করেছে নয় করছেও আর ভবিষ্যতেও করবেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।”
-“তোর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।”

হাত দেখিয়ে থামতে বলে আমি আবার বলতে শুরু করলাম,
-“ঠিক আছে বলছি আমি কিন্তু তুই কথার মাঝে কোনো কথা বলি না।”
ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে, দুই হাতের বৃদ্ধা আঙুল দেখিয়ে আমাকে বললো,

-“ওকে ডান।”
আধোভেজা চুলের খোঁপা থেকে খুলে দিলাম কাঠের কাঠিটা আর সাথে সাথেই কালো কেশ গড়িয়ে পড়লো। আঙ্গুলের সাহায্যে ভেজা চুলগুলো ঠিক করতে ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলাম,

-“কালকে ভাইয়ার কাছে পড়া শেষ করার পর উনি আমাকে অনেক কিছু বলেছেন। ভাইয়া চান, আমি বিসিএস পরীক্ষা দেই। আমার নিজের একটা পরিচয় হোক। আর এ-ও বলেছেন, অন্য কেউ না চাইলেও ভাইয়া নিজে আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নেবেন।”

-“এটা তো খুব ভালো কথা বলেছেন ভাইয়া কিন্তু এটা নিয়ে টেনশনের কী আছে যার জন্য রাতে ঘুমাস নি তুই?”
ছাদের রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম হাত ভাঁজ করে। ডান হাতে থাকা কাঠিটা নাড়াতে নাড়তে বেশ স্বাভাবিক চেহারায় কিন্তু থমথমে গলায় বললাম,

-“নীল ভাইয়া আমাকে পছন্দ করেন, অন্যরকম আর অনেক বেশি।”
দায়সারা ভাব নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে,
-“এটা আর নতুন কী?”

হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“ওয়েট ওয়েট। এটা তুই বলছিস?”
চোখ বুঁজে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
-“হ্যাঁ, আমি বলছি। কেন জানিস?”

-“কেন, কেন?”
-“কালকে কথার প্রসঙ্গে ভাইয়া আমাকে বলেছিলেন, চৌধুরী বাড়ির মেয়ে বা চৌধুরী বাড়ির বউ কি শুধু পরিচয় হতে পারে? চৌধুরী বাড়ির মেয়ে হলাম আমি আর চৌধুরী বাড়িতে ছেলে আছেন শুধু উনি। তাহলে উনার বউ হলেই তো আমাকে সবাই চৌধুরী বাড়ির বউ বলে ডাকবে। তাই না?”
মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয়ে বললো,

-“হায় আল্লাহ! কী বলছিস তুই এসব? লাইক সিরিয়াসলি ভাইয়া এটা বলেছেন?”
-“জ্বী, আপনার নীল ভাইয়া এটাই বলেছেন।”

খুশিতে গদোগদো হয়ে,
-“বল না বল আর কী বলেছে রে।”
-“সর তো সামনে থেকে। আর কী বলবেন? এতটুকুই বলেছেন আর শোন, উনার মতোন মানুষের বউ হওয়ার কোনো শখ নেই আমার। সো জাস্ট চেপে যা বিষয়টা।”

-“মোটেও না। আমি তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবো রে আমার ভবিষ্যৎ বানী যে এবার সত্যি হতে চলেছে।”
-“তোর ভবিষ্যৎ বাণীর আমি বারোটা বাজাবো। তুই কি পাগল? উনাকে বিয়ে করা জাস্ট ইম্পসিবল আর আমার অনুমান তো ভুলও হতে পারে। কারণ অনেক সময় চোখের দেখাতেও ভুল হয় সেখানে অনুমান করে কোনো কিছু ভাবাটা হয়ত ঠিক হচ্ছে না।”

-“রাখ তো তোর এইসব বোরিং ফিলোসোফি। আমার ধারণা কখনও ভুল হতে পারে না।”
আচমকা আমার চিবুকে হাত দিয়ে মুখটা খানিকটা উঁচু করে ধরলো সুমাইয়া। তারপর সুরে সুরে বলতে লাগলো,
-“ওগো সুন্দরী ললনা

ভালোবাসি বলো না।”
সুমাইয়ার এমন কান্ডে আমি রাগী ভাব নিয়ে হালকা হেসে তাকিয়ে বললাম,
-“ডাকিনী, দাঁড়া তোর ভালোবাসা বের করছি আমি।”

ওকে কিছু করার আগেই দৌড় দিলো সিঁড়ির দিকে। আমিও দুইহাতে স্কার্টটা ধরে খানিকটা উঁচু করে ওর পিছু নিতে দিলাম দৌড়। সিঁড়ির প্রতি ধাপে আমার পায়ের নুপুরে সুর উঠছে। চারপাশ না দেখেই ওর পিছন পিছন দৌড় দেওয়ার ফলস্বরূপ কারোর সাথে আমার সজোরে লাগলো ধাক্কা।

নিজেকে সামলে নিয়ে তাকিয়ে দেখি মৃন্ময় ভাইয়া। আমি জাস্ট থ মেরে দাঁড়িয়ে আছি আর মনে মনে ভাবছি,
-“যা বাব্বা! ঐ দিনের কাহিনিটা আজকে সম্পূর্ণ হলো।”
দূর থেকে সুমাইয়া দুষ্ট হাসি দিয়ে বললো,
-“ইশ, কেসটা উল্টো হয়ে গেল।”

আমি বুঝতে পেরেছি, সুমাইয়া কেস উল্টো বলতে কী বুঝাতে চেয়েছে? শয়তানটা মৃন্ময় ভাইয়ার জায়গায় নীল ভাইয়া হলে বেশি খুশি হতো। ওর এমন মতলব বুঝতে পেরে আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম ওর দিকে। আমার কপট রাগ দেখে সুমাইয়া খানিকটা হেসে বললো,
-“টিয়াপাখি, আমি যাই রে। বাকিটা পরে শুনবো।”
-“এই শোন “

কে শোনে কার কথা? আমি কিছু বলার আগেই সুমাইয়া চলে গেল। এত কান্ড ঘটলো কিন্তু ভাইয়ার মুখ দিয়ে এখনও কোনো কথা বের হচ্ছে না। আমার ঘর্মাক্ত মুখখানা ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“কেমন আছেন ভাইয়া?”
-“আলহামদুলিল্লাহ। তা এতো দৌড়াদৌড়ি কীসের জন্য কথকপাখি?”
জোরপূর্বক হেসে বললাম,

-“তেমন কিছু না ভাইয়া।”
-“ওহ আচ্ছা তা নীলকে একটু ডেকে দেবে?”
-“ভাইয়া তো বাসায় নেই।”

-“আমাকে তো বললো বাসায়ই আছে।”
-“ও আচ্ছা। আসলে আমি ছাদে ছিলাম তো তাই জানি না ঠিক আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি।”
-“হুম।”


পর্ব-৩৩

গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলেছি ভাইয়ার খোঁজে। হাঁটতে হাটঁতে খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে কাঠি গুঁজে দিলাম আবার। রুমের কাছাকাছি আসতেই ডাকতে শুরু করলাম ভাইয়াকে,
-“ভাইয়া, ভাইয়া?”

ডাকতে ডাকতে একেবারে রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। ভাইয়া উনার আলমারিতে কী যেন করছিলেন তাই বোধহয় আমার ডাক খুব একটা শোনেন নি। আমি আবার ডাকতে লাগলাম,
-“ভাইয়া?”

আলমারি দরজার জন্য উনাকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না আর ভাইয়াও সেই অবস্থায় থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু বলবি?”
-“হ্যাঁ।”

-“বল।”
-“মৃন্ময় ভাইয়া এসেছেন। আপনাকে যেতে বলেছেন।”
আলমারির দরজাটা লাগিয়ে তালাবদ্ধ করলেন। কপাল দখল করে থাকা স্লিকি চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিতে দিতে বললেন,
-“ঠিক আছে আমি “

হঠাৎ উনার কথা অফ হয়ে গেল আমার দিকে দৃষ্টি দিতেই। কয়েকমিনিট পা থেকে মাথা অব্দি আমাকে স্ক্যান করলেন। উনার এমন সন্দেহী চাহনিতে আমি অহেতুক ঘাবড়ে গেলাম। উনি মুখখানা গম্ভীর করে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“এই অবস্থা কেন তোর? কোথায় ছিলিস?”
ইতস্তত করে বলতে লাগলাম,

-“আসলে ভাইয়া, সুমাইয়া এসেছিল তো তাই ছাদে গিয়েছিলাম “
আমার কথার মাঝেই বলতে লাগলেন,
-“ছাদে কেন? বাড়িতে কি বসার জন্য চেয়ার টেবিল নেই?”
-“না মানে “
ডান হাত উঁচিয়ে আমায় বলতে লাগলেন,

-“বেয়াদব মেয়ে, থাপ্পড় দিয়ে কান লাল করে দিবো তোর। সাহস কী করে হয় তোর এমন বৃষ্টির মধ্যে ছাদে দিয়ে নাচন কুঁদন করতে? কয়েকদিন কিছু বলছি না বলে তোর পাখা গজিয়ে গেছে? ফের যদি এমন বৃষ্টিতে অহেতুক তোকে ভিজতে দেখি তাহলে আমার অন্যরূপ দেখতে পাবি তুই।”
হঠাৎ এমন ক্ষেপে যাবেন উনি আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। উনার এমন রূপ সে রাতের পর আজকে আবার দেখছি। বরাবরের মতোই কিছু বলার সাহস নেই আমার। শুধু মাথায় নুইয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি আর মনে মনে ভাবছি,

-“কী এমন অন্যায় করেছি বৃষ্টিতে একটুখানি ভিজে? একটু আগেও উনার প্রশংসা করে বলেছিলাম, আগের নীল ভাইয়া আর এখনকার নীল ভাইয়ার মাঝে যেন আকাশ পাতাল ব্যবধান। আগের নীল ভাইয়াকে বড্ড ভয় পেতাম, বড্ড বেশি।

কিন্তু এখন যাকে দেখছি তাকে কেন জানি বড্ড আপন মনে হয়– এসব এখন মিথ্যে মনে হচ্ছে, বড্ড মিথ্যে মনে হচ্ছে। এই মানুষটা কোনোদিন বদলাবে না। আর উনি আমাকে পছন্দ করলেও আমি উনাকে কখনোই পছন্দ করি নি আর করবোও না জীবনে। আই জাস্ট হেইট ইউ মিস্টার নীল চৌধুরী, হেইট ইউ।”

আমার এইসব ভাবনার মাঝে ভাইয়া আমার অনেকটা কাছাকাছি এসে কাঠ গলায় বলতে লাগলেন,
-“ভাবিস না তোর সব ছেলেমানুষী আমি মেনে নিবো। তোর এইসব ছেলেমানুষী যে কাউকে কতটা যন রুমে গিয়ে ড্রেস বদলে নেয় নয়ত আবার শরীর খারাপ করলে আমাকে রাত জাগতে হবে।”

এই বলে ভাইয়া চলে গেলেন। এতক্ষণ ধরে অনবরত যুদ্ধ করতে থাকা জলটুকু অনেক কষ্টে আটকে ছিল চোখের কোলে। কিন্তু ভাইয়া চলে যেতেই সেটা এবার বিনা বাঁধায় গাল বেয়ে পড়তে লাগলো। আলতো হাতে মুছে সোজা হয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে কান্নাটা চাপা দিতে খুব তোড়জোড় চালাচ্ছি আর মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করছি,

-“আমার এসব কেবলই ছেলেমানুষী? হলেও কার কী সমস্যা? উনি বলে কেন গেলেন না, আমার ছেলেমানুষী কাকে কী করছে? আমি অসুস্থ হলে কি উনাকে বলি আমার জন্য রাত জাগতে? এতোটা পঁচা একটা মানুষ কী করে হয়? সামান্য বিষয়ের জন্য উনি সবসময় আমার সাথে কেন ?”
আর পারলাম না কান্নাটা চেপে রাখতে। কান্নার বেগ ক্রমশ বাড়ছে বলে সেটা মুছতে মুছতে নিজের রুমের দিকে ছুটতে লাগলাম সবার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে।


“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক।
এসো এসো

এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
যাক পুরাতন স্মৃতি
যাক ভুলে যাওয়া গীতি
যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
যাক যাক
এসো এসো

এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।

রসের আবেশ রাশি, শুষ্ক করি দাও আসি।
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুঁজঝটি জাল যাক দূরে, যাক যাক যাক।
এসো এসো “

বাংলা সনে আজকে পহেলা বৈশাখ, বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি সকল বাঙালী জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সার্বজনীন লোকউৎসব হিসেবে বিবেচিত।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। এই উৎসবটি শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল “শুভ নববর্ষ”।

নববর্ষের গানের সুরে ঘুম ভাঙলো আমার। ধারেকাছে কোথাও হয়ত গান বাজানো হচ্ছে। জেগে উঠতেই দৃষ্টি দিলাম ঘড়িতে, নয়টার ঘর পেরিয়ে গেছে ঘড়ির কাঁটা। যেহেতু আজকে ছুটির দিন, সেহেতু দুপুর বারোটা পর্যন্ত ঘুমালেও যে কেউ আপত্তি করবে না সেটা আমার জানা আছে।
বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালাম ফ্রেশ হবো বলে। গানের সুরটা আমার খুব মনে ধরছে। তাই আধোঘুমে আচ্ছন্ন হয়েও সুর মেলাচ্ছি,
“মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,

অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।”

আমার তেমন কোনো কাজ নেই তবুও চটপট ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। তোয়ালে দিয়ে ভেজা মুখ মুছতে যাবো তার আগে আমার চোখজোড়া আটকে গেল টেবিলে থাকা একটা গিফটের বক্স দেখে। মুখ মুছতে মুছতে ভাবতে লাগলাম,
-“আজকে আবার কীসের গিফট? আজকে না আমার জন্মদিন আর না আমার বিয়ে। তাহলে গিফট কেন? আর কে-ই বা দিলো? বেনামি চিঠি কি?”

হাতে থাকা তোয়ালেটা ছড়িয়ে দিয়ে গিফটের বক্স নিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। বাইরে থেকে বক্সটা কয়েক সেকেন্ড দেখে বলতে লাগলাম,
-“না এটা তো কোনো ভাবেই বেনামি চিঠি মনে হচ্ছে না। আর বক্সটাও যথেষ্ট ভারী মনে হচ্ছে। কী আছে এতে?”
আরও কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলতে লাগলাম,

-“ইশ, আমি কী বোকা! এটা তো খুললেই দেখা যাবে এতে কী আছে? এরজন্য এতো ভাবার কী আছে?”
নিজের মাথায় নিজেই হালকা চাটি মেরে বক্স খুলতে শুরু করে দিলাম। বক্সটা খুলে আমি তো ৪২০ ভোল্টের শক খেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাসই করাতে পারছি না। অবাক-খুশি হয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলাম,

-“হায় আল্লাহ! এ-তো দেখছি সেই জুতো জোড়া যেগুলো টাকার জন্য কিনতে পারি নি। আর উনার কাছে টাকা থাকা স্বত্বেও উনি কিনে দেন নি। হুহ তাহলে আজকে কে দিলো?”
খুশিতে এবার চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম,
-“ইয়েস, জেঠীমা দিয়েছে।”

জুতোজোড়া হাতে দিলাম দৌড় জেঠীমাকে খুঁজতে। আমার ভাগ্য ভালো বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে হলো না। রান্নাঘরেই পেয়ে গেলাম জেঠীমাকে। খানিকটা দৌড়েছি বলে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,

-“জেঠীমা, তোমাকে এত্তগুলা ভালোবাসা।”
জেঠীমা, ডালের হাড়িতে লবণ দিচ্ছিলো সেটা সম্পূর্ণ করে আমার দিকে ফিরে তাকালো। হাসিমাখা মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেন রে মা? আজকে হঠাৎ এত এত ভালোবাসা আমায় দিয়ে দিচ্ছিস যে বরং।”


পর্ব-৩৪

হাতে থাকা জুতোজোড়া দেখিয়ে বললাম,

-“এই যে, আমার পছন্দের জুতোজোড়া কিনে দিয়েছো বলে। আমি খুব খুব খুব খুশি হয়েছি জেঠীমা, খুব খুশি।”
আমার খুশি দেখে জেঠীমা হাসতে হাসতে বললো,
-“আমিও তোর খুশি দেখে অনেক খুশি হয়েছি রে মা। কিন্তু জুতো তো আমি কিনে দেই নি।”
বিস্মিত হয়ে,

-“তাহলে?”
-“নীল কিনে দিয়েছে?”
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“নীল ভাইয়া!”

-“হ্যাঁ রে পাগলী, তোর নীল ভাইয়া তোকে কিনে দিয়েছে। যা এবার নীলের কাছে ধন্যবাদ দিতে তারপর নাস্তা করতে আয়।”
সকাল সকাল আমার সাথে কী হচ্ছে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। একে তো জুতো পেয়ে শক খেলাম এখন তো নীল ভাইয়ার নাম শুনে মনে হচ্ছে এবার কোমায় চলে যাবো।

-“যেই উনি জুতোর জন্য সেদিন রাজি হয় নি, সেই উনি কিনা নিজের টাকায় জিতো কিনে দিয়েছেন। ভাবা যায়?”
এসব ভাবতে ভাবতেই জেঠীমার জবাবে কেবল ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। ভাইয়ার রুমে যাবার জন্য হাঁটছি কিন্তু উনি কিনে দিয়েছেন বিষয়টা বিশ্বাস করতে এতোটাই কষ্ট হচ্ছে যে, পা দু’খানাও চলছে না একবিন্দু।

পা টিপে টিপে ভাইয়ার রুমে এসে দেখি ভাইয়া সাজগোছ করছেন আই মিন কোথাও যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। ভাইয়ার ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে হয়ত সেখানে যাবেন বলেই তৈরি হচ্ছেন।

আমি মাত্রাতিরিক্ত অবাকে স্তব্ধ হয়ে আছি ভিতরে ভিতরে। কিন্তু আমার স্তব্ধতা কেটে গেল নীল নামক মানুষটাকে দেখে। নীল রঙের টিশার্টের উপর ব্ল্যাক জ্যাকেটটা পড়েছেন, যেটা আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন রাতে বাসায় ফিরবার পথে। পারফিউমে সারা রুম ভরিয়ে তুলে এখন আয়নাতে স্লিকি চুল ঠিক করতে ব্যস্ত উনি।

আমার গলা কে যেন চেপে ধরেছে। কিছু বলতে চাচ্ছি কিন্তু কেন যেন মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না। আমি এসেও ভাইয়ার দিকেই তাকিয়ে আছি। ভাইয়া হয়ত বুঝতে পেরেছেন রুমে কেউ এসেছে। তাই আয়না থেকে চোখ সরিয়ে দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে। চোখাচোখি হতেই আমি আরও চমকে গেলাম উনাকে দেখে।

কালো ঘন পাপড়ির চোখজোড়া হঠাৎ আমার চোখে ডুবিয়ে দিতেই মনটা আমার এলোমেলো হয়ে গেল। কপাল দখল করে থাকা চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর ড্রেসআপ উনাকে এতোটা ড্যাশিং লাগছে, যেকোনো মেয়ে একশো বার করে মরতে রাজি হয়ে যাবে। আমার চোখজোড়া উনি এমন ভাবে আঁটকে রেখেছেন যে, আমার হাশপাশ লাগলেও আমি চোখ সরাতে পারছি না। কয়েক সেকেন্ড নিরবতাকে আঁকড়ে চললো আমাদের দৃষ্টি বিনিময়। নিরবতা ভাঙতে নরম সুরে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,

-“কিছু বলবি কি?”
প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
-“হুম।”
বা’হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী বলবি বল? যদি দেখা শেষ হয়।”
অকপটে জিজ্ঞেস করলাম,

-“কী দেখা শেষ হলে ভাইয়া?”
বিছানায় বসে জুতো পড়তে শুরু করলেন। জুতো পড়তে পড়তে বললেন,

-“ইদানীং যে শকুনি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকিস সেটার কথা বলছি সে যা-ই হোক, তা কী বলতে এসেছিস সেটা আগে বল।”
-“আশ্চর্য! আপনাকে ড্যাশিং লাগলে আমি কী করবো? নিজে একটু কম সাজগোজ করলেই তো পারেন। আর আমার চোখ আপনার মতোই অসহ্য। এতো বারণ করি তবুও আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে বেহায়ার মতোন।”

এই কথাগুলো উনাকে শুনাতে পারলে মনটা বেশ শান্তি পেত। কিন্তু মনকে শান্ত করতে গেলে উনি আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠে আমার বারোটা বাজাবেন। তাই যথেষ্ট ভদ্র মেয়ের মতোন জবাব দিলাম,

-“জুতোগুলো আমার অনেক পছন্দ হয়েছে আর আপনি কিনে দিয়েছেন। তাই শুকরিয়া জানাতে এলাম।”
-“ও আচ্ছা ঠিক আছে। যা এবার।”
ভাইয়ার জুতো পড়া শেষ তাই উনি দাঁড়িয়ে গেলেন। আমাকে যেতে বলায় আমি পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করবো বলে পা বাড়ালাম। কিন্তু পিছন থেকে ভাইয়া ডেকে উঠলেন,

-“পেত্নী, শোন।”
উনার দিকে ঘুরে খানিকটা এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“জুতো কি পড়ে দেখেছিস?”

ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম,
-“উহুম।”
-“ঠিক আছে। এখানটায় বস তারপর পড়ে দেখ ঠিক আছে কী না? গোলমেলে লাগলে বদল করে নিয়ে আসতে হবে।”

‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নেড়ে বিছানায় বসে পড়লাম। একটা জুতো হাতে নিয়ে পড়বো বলে ফিতা খুলতে লাগলাম কিন্তু খানিকটা শক্ত আর অজানা ভয়ে আমার হাত কাঁপছে বলে ফিতা খুলতে পারছি না। আমার এমন অবস্থা দেখে ভাইয়া বললেন,
-“তুই কি সত্যিই ভার্সিটিতে পড়িস? আমার তো মনে হয় না। জুতোর ফিতাটা পর্যন্ত খুলতে পারছি না। দেয় আমায় আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”
-“না না, আ আমি প পড়তে পারবো।”

খুব বেশিই ভয় লাগছে বলে কথাও আঁটকে আসছে আমার। আমার বারণ ভাইয়া শুনলেন না। হাত থেকে জুতোটা নিয়ে হাঁটু গেঁড়ে মাটিতে বসে বলতে লাগলাম,
-“সবসময় এতো বেশি কথা কেন বলিস? যেই কম কথাটা শুনতে চাই সেটা তো জীবনেও বলিস না আর বলবি না দেখি পা বাড়া সামনে।”
মনের মাঝে একরাশ ভয় আর অস্বস্তি নিয়ে, পা বাড়িয়ে দিয়ে চুপটি করে বসে আছি, অন্য দিকে মুখ করে। ভাইয়া আর কোনো কথা না বলে একে একে দুই পায়ে জুতো পড়িয়ে দিয়ে বললেন,

-“পায়ে তো ঠিক মতোই ফিট হয়েছে জুতো তবুও তুই একটু হেঁটে দেখ ঠিকঠাক আছে কি না?”
এই বলে ভাইয়া দাঁড়িয়ে গেলেন। আমিও দাঁড়ালাম হেঁটে দেখবো বলে কিন্তু হঠাৎ-ই ভাবনায় বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপটি করে। আমার মাঝে নড়নচড়ন না দেখতে পেয়ে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু কি হয়েছে তোর?”

কোনো কিছু না ভেবেই ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
-“আপনি আমার জন্য এতোগুলো টাকা কেন খরচ করলেন ভাইয়া? জুতোগুলো আমার পছন্দ হলেও এতো দামী জুতো পড়ার জন্য শখ বা কষ্ট কোনোটাই নেই আমার।”

অকপটে বলা আমার কথাগুলো শুনে ভাইয়া হেসে উঠলেন। ডান হাত কপালে আর বাম হাত নিজের কোমড়ে রেখে হাসছেন আর এদিক সেদিক নজর দিচ্ছেন। উনার এমন প্রাণবন্ত হাসি এই প্রথম দেখছি আমি। আজকে আবার নতুন এক রূপ দেখছি মানুষটার। আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনি হাসি মাখা মুখেই বললেন,

-“বছরের প্রথমদিন তাই উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি। এটা আমি মোটেও তোর জন্যে কিনে আনি নি।”
চমকিত নয়নে,
-“তাহলে?”
-“এই বাড়িতে একটা ২২ বছরের পেত্নী আছে। বয়সে বড় হলেও মগজে আস্ত একটা নবজাতক। সেই পেত্নী নামক শাঁকচুন্নিটা কয়েকদিন পর কক্সবাজারে যাবে তার জন্যই কিনে এনেছি।”

একটু বিরতিতে,
-“জুতো কিনে দেই নি বলে তো সেদিন গাড়ির সাথে ধাক্কা খেতে নিয়েছিল। এতোকিছু দেখলে তো একটু মায়া হবেই। তাই কিনে এনেছি।”
উনার মুখে নিজের নানারূপ প্রশংসা শুনে আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে, উনি আমাকেই এসব বলছেন। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলতে লাগলাম,

-“জুতো কিনে দিয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? আর কী বললো? আমি নবজাতক? হনুমানের নাতি, আপনি নবজাতক আপনার ঐ হবু বউ নবজাতক। হুহ।”
উনার এসব কথায় বড্ড অভিমানের সৃষ্টি হচ্ছে আমার মনে। তাই মেঝেতে দৃষ্টি দিয়ে অভিমানী সুরে বললাম,
-“ওহ।”

হঠাৎ নরম কন্ঠে বলতে লাগলেন,
-“তোর মুখ ভার কারোর হৃদয় ভার করে দেয় অথচ সেটা বুঝার সাধ্যও তোর নেই।”
কথাগুলো শুনে বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই উনি বললেন,
-“নাস্তা শেষ করে নিস।”

নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করলাম,
-“আপনি খেয়েছেন?”
একগাল হেসে,

-“হুম আর দুপুরে আমার আসতে দেরি হবে তুই “
উনাকে বলতে না দিয়েই আমি বললাম,

-“আমি অপেক্ষা করতে পারবো। সমস্যা নেই।”
মায়া জড়ানো কন্ঠে,
-“সবসময় পারবি তো?”
-“হুম।”

হঠাৎ-ই অন্য প্রসঙ্গ টেনে বললেন,
-“তুই কি কখনও বড় হবি না?”
-“মানে?”

খানিকটা তাড়া দিয়ে বললেন,
-“আমি গেলাম মৃন্ময় আবার অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তুই নাস্তা করে নিস।”
বলেই বিছানা থেকে ফোন আর টেবিলের উপর থেকে বাইকের চাবিটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন ভাইয়া। আমি উনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম,

-“একটা মানুষ সর্বদা আমার মাঝে রহস্যের সৃষ্টি করতে কেন প্রস্তুত থাকে? এতো রূপই বা কেন দেখি উনার মাঝে? উনি কি পারেন না যেকোনো একটা রূপে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে? উনার এতো রূপ দেখলে সত্যিই মনে হয়, মানুষটা একজন কিন্তু সে যে বহুরূপে ভিন্নজন।”


পর্ব-৩৫

“খেয়ালি স্বপ্নে বিভোর মনে,

এসে দাঁড়াবে কি হৃদয়ের কোণে?
বলো রাখবে অনুভবে,
ভালোবেসে কি আমার হবে?”

শখের ডায়েরিতে, কালো কালিতে লিখে ফেললাম গোটা চারেক লাইন। নিচে আবার নিজের নামটাও লিখে দিলাম,
“কথা চৌধুরী”

দুই হাতে ডায়েরিটা চোখের সামনে সোজা করে ধরে হালকা হেসে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করে আপনমনে বিড়বিড় করে বললাম,
-“বাহ! আমি তো দেখছি কবি সাহিত্যিক হয়ে গিয়েছি। হুটহাট কবিতাও লিখে ফেলতে পারছি যে। মনে হয় ভবিষ্যতে আমার নামের আগেও লেখিকা পদবী বসবে। তখন সবাই হয়ত আমাকে ডাকবে ‘লেখিকা কথা চৌধুরী’।”

বেশ রাজকীয় ভাব নিয়ে কথাগুলো বলতে বলতেই ফোনের টোন কানে এলো। আর মুহূর্তেই আমার ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ডায়েরিটা রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি, সুমাইয়ার কল। স্ক্রিনে ভেসে উঠা ওর নামের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলাম,
-“এই ডাকিনীর জন্য আমার কপালে মনে হয় না লেখিকা পদবী জুটবে। দেখা যাবে, কেউ পদবীটা দিতে নিলেই কল করে বসবে।”
ফোন রিসিভ করে তিক্ত মেজাজে বললাম,
-“হ্যালো।”

-“মেজাজ চওড়া হয়ে আছে কেন তোর?”
রাগ লাগলেও সবসময় রাগ দেখানো উচিত নয়। তাই বেশ নরম সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
-“অসময়ে কল দিয়েছিস কেন সেটা আগে বল।”
-“কেন? আপনি বুঝেন না?”
-“নাহ বুঝি না।”

-“তা কেন বুঝবেন? সে যা-ই হোক, আজকে ভার্সিটিতে এত্ত সুন্দর অনুষ্ঠান গেল, সবাই শাড়ি টাড়ি পড়ে কত সুন্দর করে সাজগোজ করে এসেছে আর তুই?”
-“আমি কী?”

-“আজকে ভার্সিটিতে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে তোর বাসায়ও গিয়েছিলাম কালকে। কিন্তু তুই টানতে টানতে আমায় ছাদে নিয়ে গেলি তোর প্রেম আলাপন শোনাতে আহা! সুন্দরী ললনা, ভালোবাসি বলো না।”
সুমাইয়ার এমন আজগুবি কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললাম,
-“চুপ একদম চুপ। কীসের প্রেম আলাপন আর কীসের ললনা? হ্যাঁ? তোকে আমি “
কথার মাঝে হঠাৎ নীল ভাইয়ার ডাক শুনতে পেলাম,

-“পেত্নী, পেত্নী?”
ফোন কান থেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে চেঁচিয়ে ভাইয়াকে বললাম,
-“জ্বী ভাইয়া।”
-“বইপত্র নিয়ে আমার রুমে আয়।”
-“ঠিক আছে। আসছি।”

ভাইয়াকে জবাব দিয়ে আবার সুমাইয়ার সাথে কথা বলতে লাগলাম,
-“শোন, আমি রাখছি এবার।”
তাচ্ছিল্যের সুরে,
-“হুম গো ললনা, যান আপনার উনার কাছে যে পেত্নী বলে হয়রান হয়ে ডাকছে আহা! সুন্দরী ললনা, ভালোবাসি বলো না।”
দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

-“ডাকিনী, দাঁড়া তুই। আমি কালকে ভার্সিটিতে যাই তারপর তোর ললনাকে ছলনা বানিয়ে ছাড়বো। ফোন রাখ।”
সুমাইয়ার কল কাটার অপেক্ষা না করে আমিই কল কেটে দিলাম। মনে মনে ওর উপর হাজারও গালি বর্ষণ করতে করতে বইপত্র নিতে লাগলাম।
পা টিপে টিপে ভাইয়ার রুমে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম উনাকে। চেয়ারে বসে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন। আমাকে দেখেই হাতে ইশারা করে চেয়ারে বসতে বললেন। আমিও চেয়ার টেনে বসে পড়লাম চুপটি করে। ভাইয়া ফোনে বলছেন,

-“প্রবলেম তো হবেই। প্রবলেম হবে সেটা ভেবে কি চুপ করে থাকবো? দেখ মৃন্ময়, তুই দিহানকে বুঝা। আমাকে দিয়ে আর সম্ভব হচ্ছে না। আল্লাহ তায়ালা হয়ত আমাকে, কাউকে বুঝানোর ক্ষমতা কম দিয়েছেন। তাই তো এতগুলো বছরেও তাকে বুঝাতে পারলাম না আমি তাকে কতটা “
হঠাৎ ভাইয়া চুপ করে গেলেন তারপর আবার বলতে লাগলেন,

-“দেখি চেষ্টা করে হয়ত একদিন বুঝতে পারবে আমাকে। কিন্তু ভয় হয় যদি সে বুঝতে বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে যায়।”
ও পাশের মানুষের কথাগুলো শুনতে পেলাম না। ভাইয়া হতাশ গলায় বললেন,

-“কষ্ট তো তখন হয়, যখন অনুভূতিগুলো চেপে নিজেকে নাটকের জন্য তৈরি করে, মনের মানুষের কাছে নাটক করতে হয়। কারণ নাটক না করলে তো সে জেনে যাবে আর জেনে গেলে যদি আবদার নাকচ করে দেয়? এর চেয়ে নাটকই ভালো।”

হঠাৎ কথা বলতে বলতে আমার দিকে তাকালেন। আমিও উনার দিকেই তাকিয়ে রইলাম। চোখাচোখি হতেই উনি মৃন্ময় ভাইয়াকে বললেন,
-“আমি না হয় নাটকের ছলেই বলবো, আমি তোমায় ভালোবাসি।”

‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই তিনটা শব্দ বলে আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন যেন আমাকেই বলেছেন। উনার চোখে আমার চোখ দু’টো আঁটকে গেল। মনে হচ্ছে উনার চোখ দিয়ে উনি আমার চোখ দুটো আঁটকে রেখেছেন।

তাই তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনার চোখে চোখ ডুবিয়ে দিয়েছি। হঠাৎ ভাইয়া নিজে থেকেই চোখ সরিয়ে নিলেন। কিছু সময় উনাকে দেখে আমিও চোখ সরিয়ে নিলাম। আচমকা আমার হৃৎস্পন্দন তড়িৎ গতিতে বাড়তে লাগলো। লজ্জায় রাঙা হতে লাগলো মুখ খানা। বেশ অস্বস্তি লাগছে এখানে বসে থাকতে।
-“এখন রাখছি রে। তুই দিহানের সাথে কথা বলে আমাকে জানাস বাই।”

কথা শেষ করে কল কেটে দিয়ে ফোন পাশেই রেখে দিলেন। দুই হাতে চুলগুলো ঠিক করতে করতে চেয়ারে হেলান দিলেন। তারপর স্থির দৃষ্টিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী করছিলি এতক্ষণ?”

শুকনো একটা ঢোক গিলে জবাব দিলাম,
-“সুমাইয়া কল করেছিল। ওর সাথেই কথা বলছিলাম।”
-“পড়া সব শেষ করেছিস?”

-“হুম।”
-“আজকে তো পড়ানোর কথা না তাও পড়তে বলেছি যে কারণ জানতে চাইলি না কেন?”
উনার প্রশ্নের জবাব দিবো বলে উত্তর তৈরি করছি কিন্তু তার আগেই ভাইয়া বললেন,

-“এত মান্য করিস কেন আমার কথা? কখনও কখনও অমান্য করতে পারিস না?”
আমি বিস্ফারিত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম,
-“উনার মাথার তার কি ছিঁড়ে গেছে? কী সব বলছেন উনি?”

ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন,

-“কিছু বলছিস না যে?”
-“কী বলবো ভাইয়া?”
সোজা হয়ে বসে আমার বই খাতা টেনে দেখতে শুরু করলেন। মিনিট দশেক পর বললেন,
-“আজকে পড়াবো না শুধু হোমওয়ার্ক দিয়ে দিলাম।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে কিছু গোলাপফুল আর চকলেট নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি চমকিত নয়নে উনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,
-“নেয়, এগুলো তোর জন্য।”
আজকে যেহেতু পহেলা বৈশাখ তাই আমি ভাবলাম, এসব হয়ত উনাকে কেউ দিয়েছেন। মনে ভাবনার সত্যতা যাচাই করতে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“আপনি রাখবেন না?”

একগাল হেসে উনি বললেন,
-“তোর জন্য আনা জিনিস আমি কেন রাখবো?”
ফুল আর চকলেট হাতে নিতে নিতে জানতে চাইলাম,
-“আমার জন্য?”

ভাইয়া পুনরায় চেয়ারে বসে বললেন,
-“হ্যাঁ, তোর জন্য।”
-“শুকরিয়া ভাইয়া।”
বলেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে দেখতে লাগলাম লাল টকটকে গোলাপ। নরম সুরে ভাইয়া বললেন,
-“সরি।”

আমি ভাবলাম, ভাইয়া হয়ত আমার কথা বুঝতে পারেন নি। তাই আমি আবার বললাম,
-“বলেছি, শুকরিয়া ভাইয়া। আমি অনেক খুশি হয়েছি।”
-“কিন্তু আমি তো তোকে, সরি বলছি পেত্নী।”
-“আমাকে? কিন্তু কেন ভাইয়া?”

-“কালকে যে তোর চোখ থেকে পানি ঝরিয়েছি সেজন্য।”
আমি চঞ্চল চোখে আমতা আমতা করে বলতে লাগলাম,
-“কীসের পানি? আর আপনি তো কালকে কিছুই করেন নি ভাইয়া। শুধু শুধু এসব “
আমার কথার মাঝে ভাইয়া বলে উঠলেন,

-“এত মিষ্টি করে কেন মিথ্যা কথা বলছিস? তুই না বললেও আমি জানি, তোকে বকা দিলে তুই কতটা কান্না করিস? পিচ্চি তো তাই কিন্তু পিচ্চিটাকে কাঁদিয়ে আমি লজ্জিত, সত্যিই লজ্জিত। সেজন্যই সরি বলছি।”
ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,

-“এসব কিছু নয় ভাইয়া। যে স্নেহ করতে জানে সে শাসন করতেও জানে। আপনি আমার জন্য যা করছেন তার ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করতে পারব না। তাই এসব বলে আমাকে লজ্জা দিবেন না ভাইয়া। আপনার শাসন আমার কাছে আপনার দোয়া মনে হয়।”
অকপটে বলে ফেললাম অনেক কথা ভাইয়াকে আর উনিও মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কয়েক সেকেন্ড পর মাথা নুইয়ে ভাইয়া বলতে লাগলেন,
-“অনেক কথা বলতে পারিস দেখছি। ভালো লাগলো শুনে।”

আমার দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে,
-“তোকে কখনও সরি বলা হয় নি। আজকে বলে দিলাম। পারলে ক্ষমা করে দিস। আর ফুলগুলো তোর জন্যই এনেছি।”
একটু বিরতিতে,
-“উম, পেত্নী নামক শাঁকচুন্নিরা গোলাপফুল পছন্দ করে। বিষয়টা অদ্ভুত না?”

তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বলেই খানিকটা হেসে উঠলেন আর আমার রাগে শরীর রিহ রিহ করে উঠলো। মনে মনে বলতে লাগলাম,
-“এই হনুমানের নাতি কি জীবনেও ঠিক হবে না? সরি বলে এখন আবার আমাকে উল্টো পাল্টা বলছে। আল্লাহ, তুমি এটাকে কী দিয়ে বানিয়েছো? উনি কি জীবনেও আমাকে আমার নামে ডাকবেন না?”


পর্ব-৩৬

দুপুরের শেষ ভাগে এসে আকাশটাও যেন বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ক্লান্ত আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে আমার ক্লান্ত মনে কত-শত ভাবনা উঁকি দিচ্ছে নীল ভাইয়াকে নিয়ে।
ভার্সিটির শুনশান গ্যালারির এক কোণে অহেতুক বসে আছি হাতে ফোন ধরে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, আমি ভাইয়ার ফেইসবুক আইডিতে সংযুক্ত নেই। উনার প্রয়োজনে উনি কল করেন অথবা টেক্সট করেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় দু’জন দু’জনের থেকে আলাদাই আছি। তবে আমি মাঝে মাঝে উনার আইডিতে উঁকি মারি। আগে অভ্যাসটা একদমই ছিল না আমার। ইদানীং অভ্যাসটা খুব করে পেয়ে বসেছে আমাকে।
কালো রঙের শার্ট আর প্যান্ট পড়ে, চেয়ারে বসে আছেন নবাবি ভঙ্গিতে পা তুলে। কপাল দখল করে থাকা স্লিকি চুল আর চোখে থাকা কালো সানগ্লাসে উনাকে মনে হচ্ছে কোনো এক অজানা রাজ্যের রাজপুত্র।

এমন একটা ছবি ফেইসবুকে প্রোফাইল পিকচার হিসেবে দিয়েছেন উনি হয়ত মেয়েদের পাগল করতে। হুহ। না হলে কি কেউ এমন পিকচার প্রোফাইলে দেয়? সাথে আবার ক্যাপশনও দিয়েছেন,
“কালো রঙের মায়ায় নয়, জাদুতে পড়ে গিয়েছি। তাই তো অপছন্দের রঙকেও এতোটা ভালোবেসে ফেলেছি।”
উনার প্রোফাইল পিকচারে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আনমনে বলতে লাগলাম,

-“একবিংশ শতাব্দীর মেয়ে আমি। আপনি কী করে আমাকে এতোটা বোকা ভাবলেন? কী করে ভাবলেন, আপনার মনের কথাগুলো আমি বুঝতে পারব না? কী করে ভাবলেন, আপনার হৃদয়ের স্পন্দন আমি শুনতে পারব না? হ্যাঁ, আগে বুঝতাম না, আগে শুনতামও না।

সত্যি বলতে আগে ভাবতামও না। কিন্তু যেই দিন সুমাইয়া বললো, হয়ত আপনি আমাকে পছন্দ করেন, ঠিক সেই দিন থেকেই আমি আপনার উপর নজর রাখছি। দেখছি, সত্যিই আপনি আমাকে পছন্দ করেন কি না? জানেন, উত্তর পেয়ে গিয়েছি আমি। আপনি শুধু আমাকে পছন্দই করেন না বরং ভালোও বাসেন। কালকে হয়ত নাটকের ছলে বলেছেন ভালোবাসার কথা। কিন্তু আপনার চোখের তারায় কোনো নাটক ছিল না।

ছিল শুধু আমার প্রতি
ভালোবাসা। কিন্তু মিস্টার নীল, আপনি বড্ড দেরি করে ফেলেছেন। আপনার আগে আমি অন্য কাউকে আমার মনে ঠাঁই দিয়ে দিয়েছি। আমি ভালোবাসি সযত্নে রাখা বেনামি চিঠিগুলোকে। আমি ভালোবাসি কেবল বেনামি চিঠির নামহীনা মানুষটাকে। তাই আপনাকে আমি “
এই বলে হঠাৎ থেমে গেলাম। চোখ জোড়া বুঁজে কপালে হাত দিয়ে, আচমকা অগোছালো হওয়া মন আমার কাছে প্রশ্ন রাখলো,

-“কী হলো কথামনি? কথাটা কেন শেষ করতে পারলি না? খুব তো অকপটে বলে দিলি, তুই বেনামি চিঠির মালিককে ভালোবাসিস। তাহলে এটা কেন বলতে পারলি না, তুই নীলকে ভালোবাসতে পারবি না? সামান্য চিঠির উপর ভিত্তি করে নিজের মনটা তাকে দিয়ে দিলি। তাহলে যে তোকে বারবার ইশারায় ‘ভালোবাসি’ বলে বেড়ায় তাকে কেন ভালোবাসতে পারবি না?”
চোখ খুলে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে এবার মনকে জবাব দিতে বললাম,

-“এটা আমার মন, কোনো কক্ষ নয় যে যাকে তাকে ঢুকতে দিবো। আর আমার জীবনে ভালোবাসার কথা আগে এসেছে বেনামি চিঠির মালিক থেকে। তাই হনুমানের নাতির আবেগ মাখা কথায় আমি আমার ভালোবাসাকে অসম্মান করতে পারবো। আমার ভালোবাসা একদিনের নয়, ছয় ছয়টা বছরের অপেক্ষায়, তিল তিল করে এই হৃদয়ে ভালোবাসা জমেছে আর সেটা কেবলই বেনামি চিঠির মালিকের জন্য।”
-“তোর সিদ্ধান্ত তো ভুলও হতে পারে।”

-“অচেনা অজানা হলেও উনার প্রতি আমার ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়। আমার সত্যিকারের ভালোবাসাটা যদি আমার ভুল সিদ্ধান্ত হয় তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ ভালোবাসা কোনো সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে হয় না, হয় মনের উপর ভিত্তি করে।”
-“তাহলে নীল?”
-“আমি জানি না।”
-“তুই জানিস আর জেনেও না জানার ভান করছিস।”

মনের সাথে দ্বন্দ্ব করে আর পেরে উঠছি না আমি। হাতের ফোনটা ব্যাগে পুড়ে, ব্যাগ কাঁধে উঠে দাঁড়ালাম। শেষ বিকেলের বাতাস খানিকটা টেনে নিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে গেয়ে উঠলাম,
“বলো না কেন

ঐ আকাশ নেমে আসে সাগরের বুকে?
বলো না কেন
ঐ ঝরনা নদী খোঁজে কীসেরই সুখে?
সব কথা বলে না হৃদয়

কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।
পৃথিবীর পরে আর কোন পৃথিবী নেই তো
যত বাঁচি রব কাছাকাছি
তুমি আমি দুজনে এই তো
বল না কেন
ঐ শিশির ঝরে পড়ে সবুজ ঘাসে?
বল না কেন
ঐ জলের পাশে শুধু তারা হাসে?
সব কথা বলে না হৃদয়

কিছু কথা বুঝে নিতে হয়
জীবনের পরে যদি কোন জীবন থাকত
সেখানেও প্রিয় মন জেনে নিও
পাশে পাশে তোমাকেই রাখত
বল না কেন
ঐ চোখের পাতা জুড়ে স্বপ্ন হাসে

বল না কেন অন্তর চুপিচুপি ভালবাসে
সব কথা বলে না হৃদয়
কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।”
হঠাৎ পিছন থেকে কারোর কন্ঠে নিজের নামটা শুনতে পেলাম। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি, রাত্রি ছুটে আসছে। আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-“তুমি সবসময় এমন ছুটাছুটির মধ্যে থাকো কেন?”
হাঁপাতে হাঁপাতে আমায় জবাব দিলো,
-“আমি কী আর সাধে ছুটাছুটি করি? বাব্বা! তুমি এতো দ্রুত হাঁটতে পারো কী আর বলবো।”
হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলাম,

-“তা আমার কাছে কী জন্যে? কিছু বলবে কি?”
-“মৃন্ময় ভাইয়ার কাছে শুনলাম, তোমরা নাকি কক্সবাজার যাচ্ছো?”

-“হ্যাঁ।”
-“কবে নাগাদ যাবে?”
-“এই তো, সামনের সপ্তাহে যাবো।”
-“ওহ আচ্ছা। তা কে কে যাচ্ছে?”

-“আমাদের পরিবারের সবাই আর কুহি আপু, উনার আব্বু আম্মু।”
খুশিতে গদোগদো হয়ে বললো,
-“বাহ! খুব মজা হবে তোমাদের। তা সুমাইয়ার বাগদান অনুষ্ঠানে যাবে না?”

-“অনুষ্ঠান তো পরশুদিন আর আমি না গেলে আমাকে তো বাসা থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে।”
এই বলে দু’জনে একসাথে হেসে উঠলাম। হাসির ফাঁকে, হাত ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম,
-“বড্ড দেরি হয়ে গেছে। বাসায় যেতে হবে। আমি এখন আসি।”
-“ঠিক আছে।”

গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ভার্সিটির মাঠ পেরিয়ে চলে এলাম ভার্সিটির গেটে। গেট দিয়ে বের হয়ে, কাঁধের ব্যাগটা টেনে, সামনে তাকাতেই থমকে গেলাম। একজোড়া চোখের স্থির দৃষ্টিতে মুহূর্তে আমার মনের রাজ্য তুমুল ঝড়ের সৃষ্টি হলো। অনেক কষ্টে নিজের মনকে সামলে মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

-“ভাইয়া, আপনি এখানে?”
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শীতল কন্ঠে জবাব দিলেন,

-“এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম আর মা কল করে বললো, তুই ভার্সিটিতেই আছিস। তাই ভাবলাম, তোকে নিয়েই বাসায় যাই।”
ইতস্তত করে বললাম,
-“কখন এসেছেন? আমাকে কল করলেই তো চলে আসতাম। ক্লাস তো সেই কখন শেষ।”
-“মাঝে মাঝে অপেক্ষাতেও মিষ্টতা আছে।”

উনার কথায় আমি পলকহীন দৃষ্টি দিলাম উনার দিকে। কিন্তু উনি সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বাইকে বসে, বাইক স্টার্ট দিলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“যাবি না?”

কিঞ্চিৎ ভাবনায় বিভোর ছিলাম কিন্তু ভাইয়ার প্রশ্নে আমার ভাবনার ঘোর কেটে গেল। ভাবনা বাদ দিয়ে বিনা উত্তরেই বাইকে চড়ে বসলাম আমি।
বাইক চলছে সাথে আমার মনে উনাকে নিয়ে ভাবনাও চলছে,

-“প্রায় আধঘন্টা ধরে যার নাম মনে মনে জপেছি, সে-ই আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। উনি কি এমনিতেই এসেছেন নাকি টের পেয়েছে, উনাকে নিয়ে আমার মনে চলা হাজারো ভাবনা?”


পর্ব-৩৭

“অশ্রুতে লেপ্টে ছিল
আমার চোখেরও কাজল।
কারণ যত্ন করে যে,

আমায় আপনি কাঁদিয়ে ছিলেন।
তাহলে সেই অশ্রু মোছার অজুহাতে,
কেন আবার লাল গোলাপ
হাতে ধরিয়ে দিলেন?”

শুকিয়ে গেলে হয়ত সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়, মূল্য কমে যায়। কিন্তু স্মৃতি কখনও শুকায় না, মূল্যহীন হয় না। স্মৃতি তো মন গহীনে জমা থাকে সযত্নে। হয়ত সময়ের স্রোতে পুরনো হয়ে যায় কিন্তু মূল্যহীন হয় না।

তবে কখনও কখনও স্মৃতি পুরনো হতে হতে সেটা অমূল্য হয়ে উঠে।
দু’দিন আগের কিঞ্চিৎ নেতিয়ে পড়া, শুকনো গোলাপের দিকে তাকাতেই মনে পড়ে গেল পরশু রাতের কথা, মনে পড়ে গেল নাটকের ছলে আমায় বলা উনার ভালোবাসার কথা। মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই চোখজোড়া, যেই চোখের তারা শুধু ঝলমলে উঠে একজনের জন্য। সেই একজনটা হয়ত আমি নিজেই।

ইদানীং নিজের মাঝে দু’জনকে অনুভব করছি। মনে হচ্ছে আমি একজন নই আমার মাঝে আরও একজন বিদ্যমান আছে। সেই আরেকজন আমার সাথে প্রায়শই কথা বলে, নীল ভাইয়ার কথা বলে। কিন্তু আমি শুনতে চাই না উনাী কথা তবুও বাধ্য করে আমায় শুনতে। আমি ভাবতে চাই না উনাকে নিয়ে কিন্তু আমাকে বাধ্য করা হয় উনাকে নিয়ে ভাবতে। আমি উনাকে ভালোবাসতে চাই না কিন্তু আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে উনাকে
-“হে আল্লাহ! আপনি আমার সাথে কী করতে চাইছেন?

আমার জীবনে বেনামি চিঠির আগমন ঘটিয়ে কেন আবার নীল ভাইয়ার দিকে মনটাকে টানছেন? সবাই বলে আমি না-কি সহজে কিছু বুঝতে পারি না। তাহলে কী করে আমি নীল ভাইয়ার ভালোবাসা বুঝতে পারলাম? না-কি উনি আমায় ভালোবাসেন না? আমি অহেতুকই মনে করছি এসব। কিন্তু ইদানীং বলা উনার কথাগুলোতে তো আমি স্পষ্ট আমার প্রতি উনার ভালোবাসার ইঙ্গিত পাচ্ছি আর আমার মনও বলছে উনি আমায় “

হঠাৎ ফোনের টোন কানে আসতেই ভাবনায় ছেদ পড়লো আমার। টেবিলে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি সুমাইয়ার কল। খানিকটা রাগ অনুভব করলাম নামটা দেখে। তাই রাগী ভাব নিয়েই কল রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলাম,
-“এতোবার করে কল করতে হয়? হ্যাঁ? আর একবার যদি কল করতে দেখি না, পরে যাওয়াই ক্যানসেল করে দিবো।”
কাঁদো কাঁদো গলায়,

-“রাগ করছিস কেন টিয়াপাখি?”
-“নিকুচি করেছে তোর টিয়াপাখি।”
-“তোর দেরি হতে পারে বলেই না আমি এতোবার কল করে তাড়া দিচ্ছি। তাই বলে তুই আমায় “

এমনিতেই বেনামি চিঠি আর নীল ভাইয়ার ভাবনায় আমার রাতের ঘুম উড়ে গেছে তারউপর সকাল থেকে সুমাইয়ার এসব কান্ড আমি আর টলারেট করতে পারছি না। তাই ওকে বলতে না দিয়ে আমি বললাম,
-“এতো তাড়া কীসের তোর? অনুষ্ঠান কি শেষ হয়ে যাচ্ছে? সবে তো সকাল দশটা বাজে। আর আমি তো বলেছি এগারোটা মধ্যেই চলে আসবো। এখন শান্তি মতো আমাকে তৈরি হতে দেয় না হলে সত্যি সত্যি হিরো আলমের সাথে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করব।”
খানিকটা রাগ নিয়ে,

-“কিছু হলেই তোর ক্রাশ হিরো আলমকে কেন টানিস? হবু জামাই নীলকে টানতে পারিস না?”
সুমাইয়ার কথা শুনে আমি থ মেরে গেলাম। রাগটা যদি মাপা যেত তাহলে এই মুহূর্তে আমার রাগের ওজন বিশ কেজি হতো। চোখ মুখ খিঁচিয়ে কোনোরকমে বললাম,

-“তোর অনুষ্ঠানে আমি যাচ্ছি না আর এটাই আমার শেষ কথা। বায়।”
বলেই কল কেটে ফোন অফ করে দিলাম। অতিরিক্ত রাগের দরুন চোখে জল টলমল করছে। গলাটাও যেন কেমন ধরে আসছে। পানি পেলে হয়ত গলাটা স্বস্তি বোধ করবে। এই ভেবে কিচেনে আসতেই মা বলে উঠলো,

-“হয়েছে তোর?”
মুখের রাগী ভাবটা ধরে রেখেই বললাম,
-“না, হয় নি।”

-“তাড়াতাড়ি কর। নীল বসে আছে তোর জন্য।”
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-“নীল ভাইয়া মানে? আমার তো বাবার সাথে যাওয়ার কথা ছিল।”
-“তোর বাবাকে কোনো দিন কোথাও নিয়ে যেতে পেরেছিস?”
-“তাই বলে “
আমার কথার মাঝেই মা তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,

-“কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়। নীল কিন্তু বসে আছে।”
মুখখানা মলিন করে বিনা উত্তরেই একগ্লাস পানি হাতে রুমে চলে এলাম। এক দুই ঢোক পানি পান করে দাঁড়িয়ে পড়লাম আয়নার সামনে। রাগে এখনও আমি ফুঁস ফুৃঁস করছি আর নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত আছি।

অনুষ্ঠানে যাবো বলে আজকে আকাশী রঙের লেহেঙ্গা পড়েছি সাথে একই রঙের হিজাব। বেনামি চিঠির মালিকের দেওয়া সেই নীল রঙের চুড়িতে দুই হাত ভরিয়েছি। হিজাবটা ঠিক করার ছলে রিনিঝিনি করে উঠছে চুড়ি। এমন শব্দে মন ভরে উঠার কথা কিন্তু আমি মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে অনর্গল বলে চলেছি,
-“ধ্যাত! যার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি, সে আমার সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। যত বেশি দূরে ঠেলে দিতে চাইছি, তত বেশি আমাকে কাছে টানছে।”

হিজাব ঠিক করা শেষ। এবার আয়নার দিকে তাকিয়ে দুইহাত নাড়িয়ে জোরে বলে উঠলাম,
-“আমি পাগল হয়ে যাবো আল্লাহ, পাগল হয়ে যাবো।”

পায়ে ব্ল্যাক জুতো পড়ে আর ছোট একটা সোল্ডার ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম। ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াতেই দেখি নীল ভাইয়া জেঠুর সাথে কথা বলছেন। আমাকে দেখতেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জেঠুকে বললেন,

-“আচ্ছা বাবা, আমি না হয় বিষয়টা দেখবো। তুমি এ নিয়ে ভেবো না।”
-“হুম, দেখ কী করতে পারিস?”
আমি এসে জেঠুর পাশে দাঁড়াতে জেঠু হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলো,

-“এসে গেছিস মা?”
-“হুম জেঠু।”
-“ঠিক আছে। সাবধানে যাস।”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তে ভাইয়া আমায় বললো,
-“চল।”
ভাইয়ার সাথে একবার চোখাচোখি হতেই মাথা নুইয়ে নিলাম। উনাকে অনুসরণ করে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম।

বাইকে উঠে বাইক স্টাট দিতে দিতে আমার দিকে তাকালেন বাঁকা হাসি দিয়ে। বা’হাতে শার্টের পকেটে থাকা সানগ্লাসটা বের করে পড়ে নিয়ে বললেন,
-“এবার যাওয়া যাক?”
-“হুম।”

পরশু রাতের ঘটনার পর থেকে ভাইয়ার সাথে যতটা সম্ভব কম কথা বলার চেষ্টা করি, যতটা সম্ভব উনার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি। কারণ উনার কাছাকাছি থাকলে, উনার সাথে কথা বললে আমার মনটা নাছোড়বান্দা হয়ে উঠে। মনটা আমার কিন্তু যেন হয়ে আছে উনার গোলাম। তাই তো উনার হুকুম তামিল করতে, আমার মনটা বারবার হয়ে যায় নাছোড়বান্দা এক অচিন পাখি।
“ভালোবাসার ইঙ্গিত যে

দিচ্ছে বারংবার ঐ দু’টো আঁখি।
আঁখির পানে তাকিয়ে থেকে,
আমার মন যে হয়ে যায়
নাছোড়বান্দা এক অচিন পাখি।”


পর্ব-৩৮

সুমাইয়ার বাসার কাছে এসে বাইক থামাতেই আমি নেমে দাঁড়ালাম। ব্যাগটা কাঁধে নিতেই ভাইয়া আমায় বললেন,
-“বাসায় যাওয়ার আগে আমাকে কল করিস। আমি এসে তোকে নিয়ে যাবো।”

-“আমি তো যেতে পারবো ভাইয়া। আপনি শুধু শুধু কেন আবার কষ্ট করতে যাবেন?”
-“কিছু কিছু কষ্টে চোখে অশ্রু নয়, মনে সুখ আসে। আর আমি তো তোকে কোলে করে নিয়ে যাবো না যে, আমার কষ্ট হবে। বাসায় যাবার সময় হলে নিজে একটু কষ্ট করে কল করিস, তাতেই হবে।”

একটু থেমে,
-“এর চেয়ে কি কম সাজা যায়?”

কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে,
-“মানে?”
-“আকাশের রঙটা আজ বড্ড চোখে লাগছে।”
-“আমি কিছু বুঝতে পারছি না ভাইয়া।”
একগাল হেসে সোজা হয়ে সামনে তাকিয়ে বললেন,

-“বুঝবি কিন্তু তখন হয়ত বড্ড দেরি হয়ে যেতে পারে।”
বলেই চলে গেলেন একমূহুর্ত্বও দেরি না করে। উনার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলাম,

-“আকাশের রং নয়, আমার পরনের আকাশীরং আপনার চোখে লাগছে। আর মিস্টার নীল, দেরি হবে নয় বরং দেরি হয়ে গেছে। আমার জীবনে আপনার আগমন হতে দেরি হয়ে গেছে। তাই তো আমি আপনাকে “
আবারও বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে গেল কথাটা। যতবার বলতে যাই ততবারই বাঁধা সম্মুখীন হই আর মন গহীনে তুমুল ঝড় উঠে।

-“কেন সম্পূর্ণ করতে পারি না আমি কথাটা? কেন ভাইয়ার কাছাকাছি থাকলে মনের মাঝে সুখ পাখি ডানা মেলে উড়ে? কেন উনার সাথে কথা বলতে বড্ড ভালো লাগে? কিন্তু আমি তো উনার থেকে দূরে দূরে থাকতে চাই।”
ভাবনা বাদ দিয়ে রোদে ঝিলমিল করা আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্যের তেজে তাকাতে পারছি না তবুও কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সুমাইয়ার বাসার দিকে পা বাড়ালাম।

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে কিন্তু আমাদের বিউটি কুইন এখনও সাজগোজ নিয়েই আছে। পার্লার থেকে আপু আনা হয়েছে সুমাইয়াকে সাজানোর জন্য। আপুটা বেশ মনোযোগ দিয়ে সুমাইয়ার মুখে আটা ময়দা আর সুজি মাখাচ্ছে। সুমাইয়ার পাশেই আমি বসে আছি।

পার্লারের আপুর হাত চলছে, সুমাইয়ার চলছে মুখ আর আমার চলছে মন। কারণ সুমাইয়া পকপক আমি চুপটি করে শুনে মনে মনে ওকে গালি উপহার দিয়ে যাচ্ছি।

সুমাইয়ার মেকাপ করা শেষ এখন পার্লারের আপুটা চুল বেঁধে দিচ্ছে আর এই সুযোগে সুমাইয়া আমায় বলছে,
-“তোর মাঝে কি বিন্দু পরিমাণ শখ বলে কিছু নেই? মানে আমি বুঝি না কিছু। আমি তোর একমাত্র বান্ধবী আর আজকে আমার বাগদান অনুষ্ঠান।”
নীরস গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
-“তো?”

-“তো মানে? এমন বিধবা হয়ে এসেছিস কেন? তোর বাসায় কি মেকাপের কিছু নেই?”
হাতে থাকা ফোনটাতে দৃষ্টি দিয়ে বললাম,
-“এমন ছাইপাঁশ আমাদের বাড়িতে কেউ মাখে না। তাই থাকেও না।”

আমার কথা শুনে পার্লারের আপুটা হেসে উঠলো কিন্তু সুমাইয়া কপট রাগ নিয়ে বললো,
-“তোর মতো নিরামিষের বান্ধবী যে কেন হতে গেলাম?”
দায়সারা ভাব নিয়ে বললাম,
-“বেশি বললে কিন্তু বাসায় চলে যাবো।”

-“হ্যাঁ, সেই তখন থেকেই তো বলছেন বাসায় চলে যাবেন, বাসায় চলে যাবেন। তো যা না বাসায় চলে।”
-“সত্যি?”
ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু সুমাইয়া বিনা উত্তরে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। তাই আমিই আবার জিজ্ঞেস করলাম,
-“চুপ করে আছিস কেন? বল, চলে যাবো না-কি?”

এখনও চুপ করে আছে বলে আমি ওকে আরও রাগানোর জন্য দুষ্ট হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“কিরে? নীল ভাইয়াকে বলবো, আমাকে এসে বাসায় নিয়ে যেতে?”
আচমকা আমার দিকে তাকিয়ে একটা বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে বললো,

-“আহারে! ভাইয়াকে না দেখে বুঝি থাকতে পারছিস না। তা ভিডিও কলে কথা বলে নে ভালো লাগবে৷ হুহ।”
বলেই মুখটা এবার পেঁচার মতো করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার যথেষ্ট রাগ লাগলেও পার্লারের ঐ আপুটার জন্য কিছু বলতে পারলাম না। বিষয়টা ধামাচাপা দিতে অন্য প্রসঙ্গ টেনে এনে বললাম,
-“রাত্রি কি আসবে না?”

-“আমার জন্য হলে তো অবশ্যই আসতো না। এখানে তো উনার ডট ডট আছে। তাই না এসে যাবে কোথায়?”
দোটানায় পড়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“ডট ডট আবার কী?”
আঁড়চোখে তাকিয়ে,

-“চিরকাল এমন অবুঝ থাকিস কেন? ডট ডট বলতে তূর্যকে বুঝিয়েছি।”
এবার দোটানা দূর হতেই বললাম,
-“ওহ আচ্ছা আচ্ছা। তা তুই বসে আটা ময়দা গুলতে থাক আমি বাইরে গেলাম।”
অনুনয় করে,

-“বস না আমার কাছে।”
-“আরে আমি আসছি একটু বাইরে থেকে। দেখে আসি বাইরের কী অবস্থা?”
মুখখানা মলিন করে,
-“ঠিক আছে যা।”

খাওয়াদাওয়া এবং অনুষ্ঠান শেষ। এবার বাড়ি ফেরার পালা। অতিথিরা একে একে সবাই চলে গেছে। ইয়াসির ভাইয়াকে তো আজকে সবাই দেখে জাস্ট ফিদা হয়ে গেছে। উনি এমনিতেই হ্যান্ডসাম তারউপর ব্লেজার টেজার পড়ে একেবারে সাউথ ইন্ডিয়ান নায়কদের মতোন ভাবসাব নিয়ে এসেছিলেন।

সুমাইয়া এখন গহনাগাঁটি খুলতে ব্যস্ত। আজকে বেশ গর্জিয়াস লাল রঙের লেহেঙ্গা পড়েছিল ও। আটা ময়দা আর সুজি মাখার পর তো একদম পরীর মতো লাগছিল। এককথায়, আজকে সুমাইয়া এবং ইয়াসির ভাইয়া খুব বেশি সুন্দর লাগছিল।

আর আমাকে লাগছে একদম ফকিন্নির মতো। কারণ সাজগোজ বলতে শুধু একটু ভেসলিন দিয়ে ছিলাম। কারণ হনুমানের নাতির আমার সাজে ঘোরতর আপত্তি আছে। আজকে সাজি নি তাও পেনপেন করছিল, সাজলে না জানি কী করত?
সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। বাসায় যাবো সেজন্য মনস্থির করে ফোনটা হাতে নিলাম ভাইয়াকে কল করবো বলে। এক দুইবার কল হতে রিসিভ করে বললেন,
-“হ্যাঁ, বল।”

ঘরে শুধু আমি, রাত্রি আর সুমাইয়া। আমাকে কল করতে দেখে সবাই প্রায় চুপ মেরে বসে আছে। তাই স্তব্ধতা বিরাজ করছে ঘরময়। চারপাশের স্তব্ধতায় ‘হ্যাঁ, বল’ কথাটা কেমন যেন অন্য রকম শোনালো কানে। ফোনে কারোর কন্ঠস্বর হয়ত জাদুতে মাখানো থাকে। আর সেই জাদুই এখন আমাকে ভষ্ম করে ফেলছে। কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
-“অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। আমি বাড়ি যাবো।”

-“ঠিক আছে। তুই ওয়েট কর। আমি এসে কল করলে বাসা থেকে বেরিয়ে আসিস।”
-“হুম।”
কল কেটে দিলাম। লক্ষ্য করলাম হঠাৎ-ই আমার হাত কাঁপছে, গলা ধরে আসছে আর অহেতুক লজ্জায় মুখ রাঙা হচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই ভাইয়ার সামনে দাঁড়াতে, ভাইয়ার সাথে কথা বলতে মাত্রাতিরিক্ত লজ্জা লাগে।

এই মূহুর্তে, নিজের অহেতুক লজ্জাটা সুমাইয়া আর রাত্রির থেকে আড়াল করার জন্য বৃথা চেষ্টা করছি। কিন্তু ডাকিনী সুমাইয়া সেটা ঠিক ধরে ফেলেছে তাই তো দুষ্ট হাসি দিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলো,
-“কিরে? ভাইয়ার সাথে কথা বলে এমন হাশপাশ করছিস কেন?”

নিজের লজ্জাটা ডাকতে আর বিষয়টা আড়াল করতে এমনিতেই বানিয়ে একটা জবাব দিলাম,
-“সারাদিন লেহেঙ্গা পড়ে আছি তাই অস্থির লাগছে। এখানে তুই অন্য কারণ কেন খুঁজছিস?”
চুলের ঝট ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
-“বুঝি বুঝি সবই বুঝি। আমায় এতো বকা ভাবিস না।”

-“তাহলে এবার বুঝ নিয়ে বসে জুস বানিয়ে খা আমাকে লেকচার না দিয়ে।”
সুমাইয়া কিছু বলতে যাবে তার আগে রাত্রির কল এলো। মেয়েটা তড়িঘড়ি করে ফোন বের করে রিসিভ করে বললো,
-“হ্যাঁ ভাইয়া বল।”

‘ভাইয়া’ শুনে আন্দাজ করলাম হয়ত মৃন্ময় ভাইয়া কল করেছেন। রাত্রি আবার বললো,
-“ওহ, এসেছি? ঠিক আছে আমি আসছি।”
কল কেটে উঠে দাঁড়িয়ে বেশ তাড়া দিয়ে বললো,

-“ভাইয়া এসেছে। আমি তবে যাই। কালকে ভার্সিটিতে দেখা হবে। বায়।”
আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে রাত্রি চলে গেল। এরপর বেশ কিছুক্ষণ আমি আর সুমাইয়া দুষ্ট মিষ্টি খোশগল্পে মেতে রইলাম। প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর ভাইয়া কল করতেই আমি কল কেটে দিয়ে সুমাইয়াকে বললাম,

-“যাই রে। ভাইয়া এসে গেছেন।”
হঠাৎ কী ভেবে যেন সুমাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুই কি ভাইয়াকে ভালোবাসিস?”

ওর এমন কথা শুনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। জোরপূর্বক একটু হাসবার চেষ্টা করে বললাম,
-“উনি আমাকে পছন্দ করেন– এটা আমি অনুমান করে বলেছি। আমার অনুমান তো ভুলও হতে পারে। যেখানে পছন্দ করেন কি-না সেটা নিয়েই দোটানায় আছি, সেখানে আমি কেন উনাকে ভালোবাসতে যাবো?”
-“কিন্তু “
সুমাইয়াকে কিছু বলতে না দিয়ে বললাম,

-“দেরি করে গেলে বকা খেতে পারি। নিজের খেয়াল রাখিস। আল্লাহ হাফেজ।”
উত্তরের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। হাঁটতে হাঁটতে আনমনে বলতে লাগলাম,

-“আমাকে ক্ষমা করিস সুমুপাখি। উনি আমাকে শুধু পছন্দ নয় ভালোও বাসেন। কিন্তু বান্ধবী হলেও আমি তোকে সবটা বলতে পারবো না রে। যেমন পারি নি তোকে বলতে আমার ভালোবাসার বেনামি চিঠির কথা, তেমন পারবো না তোকে বলতে নীল ভাইয়াকে নিয়ে আমার বুকে চাপা কত-শত কষ্টের কথা। যেই কষ্টগুলো আমাকে তিল তিল করে শেষ করে দিয়ে বলছে, ‘নীল তোকে ভালোবাসে, মেনে নেয় তুই নীলকে।’

সুমু রে আমি না পারছি বেনামি চিঠির মালিকের অপেক্ষা করতে না পারছি নীল ভাইয়া ভালোবাসা উপেক্ষা করতে। ঐ মানুষটা দিন দিন আরও বেশি ভালোবাসছে আমায়। আমি এখন কী করব রে সুমাইয়া, কী করব আমি?”


পর্ব-৩৯

পায়ে পায়ে চলে এলাম সুমাইয়ার বাসার গেটের কাছে। গেট পেরিয়ে বাইরে পা রাখতেই দেখতে পেলাম বাইকে বসে কেউ একজন অপেক্ষা করছে। আমি এসেছি সেটা হয়ত মানুষটা বুঝতে পেরেছে। তাই তো ফোন স্ক্রোল অফ করে আমার দিকে তাকালেন মুগ্ধ নয়নে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গভীর হওয়ার তোরজোড় চলছে। তাই প্রাকৃতিক আলোয় প্রকৃতি দেখবার বিশেষ কোনো উপায় নেই। কারণ আকাশে চাঁদেরও দেখা নেই আজ। তাই কৃত্রিম আলোয় মানুষটার চেহারা দেখতে আমিও তাকিয়ে রইলাম। চোখাচোখি হতেই হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
-“পেত্নী, কল রিসিভ করিস নি কেন?”

কয়েক কদম এগিয়ে ভাইয়ার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে জবাব দিলাম,
-“বুঝতে পেরেছিলাম আপনি এসেছেন। তাই আর রিসিভ করি নি।”
ফোনটা পকেটে পুড়তে পুড়তে বললেন,

-“বাহ! দিন দিন অনেক কিছুই বুঝতে শিখে গেছিস কিন্তু মনটা বুঝতে শিখলি না আদোও।”
ইঙ্গিতটা যে উনাকে করেছেন সেটা আমার বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হয় নি কিন্তু বুঝলেও সেটা উনাকে বুঝানোর বা জবাব দেওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। তাই নিরবতা আঁকড়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাইয়া বাইক স্টার্ট দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

-“এখানেই কি থাকার প্ল্যান করছিস না-কি?”
আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন,

-“এখানে কি কোনো বট, তেঁতুল বা শেওড়া গাছের খোঁজ পেয়েছিস?”
অবাকের চরম সীমানায় দাঁড়িয়ে,
-“মানে?”
-“তুই তো পেত্নী নামক শাঁকচুন্নি আর তারা তো এসব গাছেই থাকে। আমার মনে হলো তুই তোর আসল বাসস্থান পেয়ে গিয়েছিস তাই তো বাসায় চাইছিস না।”

একটু আগেও আমাকে মিষ্টি মিষ্টি বুলি শোনাচ্ছিলেন আর এখন কি-না রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে যাচ্ছে তাই বলছেন। ইচ্ছে তো করছে উনার মাথায় কদবেল ভাঙতে। কিন্তু ইচ্ছে করলেও সেটা কখনও পূরণ হবে না। তাই নিজের রাগ নিজের কাছে চেপে রেখে একদৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে। রাগ চেপে রাখলেও হয়ত সেটা চেহারায় ভেসে উঠছে তাই তো কৃত্রিম আলোয় সেটা দেখে উনি তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

-“সারাক্ষণ নাকের ডগায় রাগ এসে থাকে কেন? এবার রাগ না দেখিয়ে বাসায় চল অন্য সময় গাছে উঠিয়ে দিয়ে যাবো।”
বলেই হাসতে লাগলেন আর উনার এমন হাসি দেখে রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু আবারও মনের রাগ মনে চেপে রেখে বাইকে চড়ে বসলাম।


-“আপামনি, আপমনি?”

ঘুমের মধ্যে ডাকাডাকির বিষয়টা আমার বড্ড অপছন্দের কিন্তু এখন এটাই হচ্ছে আমার। মিতালির ডাকে আমার সাধের ঘুমটা ভাঙতেই কপট রাগে চোখ মুখ খিঁচিয়ে কাঁথা টেনে মুখ ঢেকে দিলাম। কিন্তু মিতালি ক্ষান্ত না হয়ে আবার ডাকতে লাগলো,
-“আপামনি, উঠেন ছোট খালায় আফনেরে ডাকে।”

মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে চোখ বুঁজেই জিজ্ঞেস করলাম,
-“কেন? আমি তো কালকে রাতেই বলে রেখেছিলাম, আজকে আমার ক্লাস নেই। আমি অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠবো। তাহলে মা কেন আবার ডাকছে?”
-“ঐ কুহি আপারা আইছে।”

কুহি আপুর নাম শুনে ঘুমটা যেন হঠাৎ-ই উড়ে গেল। কী যেন ভেবে মিতালির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-“ঠিক আছে তুই যা। আমি এক্ষুনিই আসছি।”

মিতালি চলে যেতেই শোয়া থেকে উঠে বসে ভাবতে লাগলাম,
-“এতো সকাল সকাল উনাদের আগমনের হেতু কী?”

কেবল ডাইনিং রুমে পা রেখেছি কিন্তু যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। খাবার টেবিলে ভাইয়া আর কুহি আপু বসে আছে পাশাপাশি চেয়ারে। তাও আবার আমার চেয়ারেই বসেছেন আপু তারউপর ভাইয়ার সাথে কত ঢংঢাং করে কথা বলছেন আর হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ছেন। আর ভাইয়াও কত সানন্দে আপুর সাথে খোশগল্পে করে খাচ্ছেন।
আমাকে দেখেই কুহি আপু হাসি মাখা মুখ করে জিজ্ঞেস করলো,
-“পিচ্চিমনি, কেমন আছো?”

আপু ভাইয়ার চেয়ে দুই বছরের ছোট অর্থাৎ আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। আর কুহি আপু আমাকে ছোট বেলা থেকেই পিচ্চিমনি বলে ডাকে। আমারও নামটা ভালো লাগতো তাই কখনও আপত্তি করি নি। কিন্তু আজকে নামটা শুনে বড্ড রাগ লাগছে। বেশি রাগ লাগছে আমার চেয়ারে বসে ভাইয়ার সাথে ঢংঢাং করছে বলে।
মা, জেঠিমা, জেঠু, আঙ্কেল, আন্টি আর ভাইয়া সামনে আছেন বলে জোরপূর্বক একটু হেসে বললাম,
-“ভালো।”

আমার সামান্য উত্তরটা হয়ত আপুর পছন্দ হয় নি। অবশ্য না হওয়ারই কথা কারণ ডাইনিং রুমে এসেও আমি কেবল একজনের দিকেই তাকিয়ে আছি, সেটা হলো নীল ভাইয়া। কুহি আপুকে উত্তরটাও দিয়েছি উনার দিকেই তাকিয়ে কিন্তু মানুষটা একবারও আমার দিকে তাকালো না। অভিমানে মন আমার কেবলই বলে উঠছে,

-“আমি কি আপনার কাছে অপরাধী? আমার জন্য বরাদ্দ করে রাখা আসনটায় আপনি অন্য কাউকে কী করে বসতে দিলেন? এতোটা বছর আসনটায় শুধু আমি বসতাম। তাহলে আজ কেন এমন হলো? আপনি আমার জায়গায় অন্য কাউকে “
আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো মা’র ডাকে। মা সবাইকে খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত এর ফাঁকে আমায় বললো,
-“কিরে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বস তোকে খাবার দিচ্ছি।”

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে এসেছি কিন্তু তবুও উনার কোনো হেলদোল দেখছি না। উনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই আমি মাকে জবাব দিলাম,
-“ইচ্ছে করছে না।”

ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে ভাইয়ার দিকেই তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে, এই বুঝি উনি রাগ দেখিয়ে খেতে বলবেন কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি উনার মতোই রয়ে গেলেন। উনার এমন আচরণে আমার মাঝে রাগ আর অভিমানের সৃষ্টি হলো। তাই তো সেটার কিঞ্চিৎ বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মাকে বললাম,

-“ক্ষিধে নেই আমার। খাবো না আমি।”
বলেই ডাইনিং রুম ত্যাগ করতে পা বাড়ালাম। প্রতি কদমে আমার মনে হচ্ছে এই বুঝি ভাইয়া ডেকে উঠবেন ‘পেত্নী’ বলে। কিন্তু আফসোস সেই চিরচেনা কন্ঠে আমার নামটা ভেসে আসে নি আমার কানে।

“জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার
জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার
ভালোবাসার খামে
চিঠি লিখে তোমার নামে
পাঠিয়ে দিলাম আমি
পড়ে নাও এবার
জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার”


পর্ব-৪০

রুমের দরজার উল্টো দিকে মুখ করে বিছানায় বসে আছি। কানে ইয়ারফোন গুঁজে, পা দুলিয়ে গানটা শুনছি মনোযোগ দিয়ে। দু’হাতে বিছানার চাদর চেপে দাঁত কিড়মিড় করছি। অজানা রাগ আর অভিমান আমার মনকে উতলা করে চোখের কোল ভরিয়ে দিচ্ছে জলে। শত বাঁধা দিয়েও আটকাতে পারছি না, শেষমেশ শত বাঁধা উপেক্ষা করে জল গড়িয়ে পড়লো আমার গাল বেয়ে। আলতো হাতে সেটা মুছে দিয়ে অনেক চেষ্টা করছি কান্নাটা চাপা দিতে কিন্তু সেটা থামছে বৈ বাড়ছে শুধু।

কান্না পেলে কাঁদতে হয় নয়ত সেটা দ্বিগুণ কষ্টে নিজেকে পোড়াতে সক্ষম হয়। বিনা শব্দে চোখ দিয়ে বৃষ্টির ধারা বইছে আর আমার অভিমানী মন বলে উঠছে,

-“কেন এমন করলেন আমার সাথে? কী দোষ করেছি আমি? আপনার ভালোবাসা বুঝি না বলে মানি না বলে এভাবে আমাকে কষ্ট দিলেন? জানেন, আপনি আমায় যদি গালি দিতেন, মারধর করতেন তাহলেও আমার এতোটা কষ্ট হতো না। আপনার এমন অবহেলায় বুকটা যে চিঁড়ে যাচ্ছে আমার।”

আধঘন্টা হয়ে গেছে অথচ কেউ এসে একবার আমার খবরও নেয় নি। রুমের দরজা আধো লাগানো আছে আর আমি আগের মতোই দরজার উল্টো দিকে মুখ করে বসে আছি। কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছি বলে কেউ ডাকাডাকি করলেও হয়ত শুনবো না।

বিছানার চাদর খামচে ধরে বসে আছি মেঝেতে দৃষ্টি দিয়ে। চোখে বৃষ্টির ধারা এখনও ঝরছে কিন্তু সেটা মুছে দিতে বিন্দু পরিমাণ আগ্রহও নেই আমার মাঝে। হঠাৎ-ই একজোড়া পা চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ধরে রাখা চাদর হাত থেকে আগলা হয়ে গেল। কৌতূহল নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাতেই দেখি, হাতে খাবারের প্লেট আর পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নীল ভাইয়া। উনাকে দেখে চোখে শুধু বিস্ময় প্রকাশ পেল কিন্তু আমার মাঝে কোনো নড়নচড়ন ঘটলো না।

খাবারের প্লেট আর পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে হাঁটু গেঁড়ে মেঝেতে বসলেন আমার সামনে। হালকা হেসে নিজেই আমার কান থেকে ইয়ারফোন খুলে দিয়ে বললেন,

-“কক্সবাজারে যাবে তাই সে বিষয় নিয়ে আলাপ করার জন্য আমাদের বাসায় উনারা বেড়াতে এসেছেন। কেউ যদি নিজে থেকে এসে গল্প করতে চায়, কথা বলতে চায় তখন কি তাকে মানা করা যায়? ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারি নি। তাছাড়া বাবা, মা, চাচীমা, আন্টি, আঙ্কেল সবাই ছিলেন। সবার সামনে কি বাড়িতে আসা অতিথির সাথে বাজে ব্যবহার করা যায়?”

আমি চুপটি করে বসে আছি অন্য দিকে তাকিয়ে। আচমকা উনি আলতো আমার চোখের জল মুছে দিতে আমি আঁতকে উঠলাম। চমকিত নয়নে উনার দিকে তাকাতেই উনি মৃদু হেসে বললেন,

-“কথা বলি নি তাই এতো কেঁদেছিস। আমি যদি মরে যাই তখন কী করবি?”
উনার এমন কথা শুনে নিজের অজান্তেই এবার জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। আমার কান্না দেখে ভাইয়া পাশে এসে বসে চমকিত নয়নে বললেন,
-“আরে! আবার কেন কাঁদছিস? প্লিজ কান্না থামা। বাসার সবাই তোর কান্না দেখলে তো আমাকে বকাবকি করবে।”
আমি কান্না থামার চেষ্টা করছি কিন্তু কান্না থামছে না। ভাইয়া আমার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“পানিটা পান করে নেয় তারপর শান্ত হয়ে বস। আই প্রমিজ আমি আর কক্ষনও তোর সাথে এমন করব না।”

হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢোক ঢোক করে পান করে নিলাম পুরোটা। ফাঁকা গ্লাসটা উনার দিকে বাড়িয়ে দিতেই উনি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললেন,
-“এটা কী করলি! পুরো গ্লাস ফাঁকা করে দিলি? এখন খাবারগুলো খাবার কে খাবে রে পেত্নী?”

ভাইয়ার কথাগুলো মজা করে বলা বলে আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে হালকা হেসে দিলাম। আমার কান্না মাখা হাসি দেখে উনি বললেন,
-“তোকে তো বলেছিলাম, আমি সারাজীবন তোর পাশে থাকবো, তুই না চাইলেও। তাহলে এই সামান্য বিষয় নিয়ে কেন মন খারাপ করলি?”
মাথা নুইয়ে চুপটি করে রইলাম বলে ভাইয়া আবার বললেন,

-“পুরোটা বিষয় আমার অজানা আর নাগালের বাইরে ছিল তবে কথা বলি নি আমি ইচ্ছে করেই। কিন্তু সত্যি ভাবি নি যে, একটু কথা না বললে তুই এভাবে কান্না জুড়ে দিবি।”

টেবিল থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে বলতে লাগলেন,
-“আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোকে না খেয়ে থাকতো দিবো না। তাই এবার লক্ষী মেয়ের মতোন হা কর।”

মুখের সামনে একটুখানি রুটি সবজি ধরলেন। আমি খানিকটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে প্লেট ধরতে হাত বাড়ালাম। কারণ আজ অবধি উনার হাতে খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয় নি।
আমি ভাইয়ার হাতে খাবার খেতে চাই না সেটা উনি বুঝতে পেরে নরম সুরে জানতে চাইলেন,

-“খাবি না আমার হাতের খাবার? বললাম তো, এমন আর কক্ষনও করব না তোর সাথে। প্রমিজ।”
বলেই মুখ মলিন করে হাত সরিয়ে নিচ্ছিলেন কিন্তু আমি বিনা উত্তরে উনার হাত ধরে খাবারটা খেয়ে নিলাম। আর এতেই ভাইয়ার মলিন মুখখানা খুশিতে ঝলমল করতে লাগলো। বেশ সানন্দে পুরোটা খাবার আমাকে খাইয়ে দিলেন। খাওয়া শেষ হতেই হঠাৎ শান্ত গলায় বললেন,

-“তোর স্থান কেউ কোনোদিন নিতে পারবে না কারণ আমার লাইফে পেত্নী হাজারটা নয় শুধু একটাই আর সেটা কেবলই তুই। কখনও ডাক ঢোল পিটিয়ে বলা হয় নি কিন্তু আজকে বলে দিলাম। আর হ্যাঁ, ভুল করেও ভাবিস না তোর চোখের পানি আমি এমনি এমনি হজম করবো। তুই হয়ত জানিস না, তোর এক ফোঁটা জলের মূল্য কারোর কাছে কয়েকশত ফোঁটা রক্তের চেয়েও দামী। তাই তার রক্ত ঝরাতে না চাইলে নিজের চোখের জলকে দমিয়ে রাখিস।”

এই বলেই উঠে চলে গেলেন ভাইয়া। আমি উনার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলাম কিন্তু উনি যাবার আগে দরজা লাগিয়ে চলে গেলেন বলে আর দেখা হলো না আমার।

হঠাৎ মন গহীনে তৃপ্তি অনুভব করছি। হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পেলে মানুষ যেই তৃপ্তি অনুভব করে আমিও ঠিক সেই তৃপ্তিই অনুভব করছি। তাই তো একা ঘরে বসে বসে তৃপ্ত মনে সৃষ্টি হচ্ছে কত-শত প্রশ্নের। আপনমনে বিড়বিড় করে উঠলাম,

-“এতোটা ভালোবাসা কেন আমার জন্য রাখলেন ভাইয়া? সত্যিই কি আমি আপনার কাছ থেকে এতোটা ভালোবাসা পাবার যোগ্য? আমার চোখের জলকে কীভাবে নিজের রক্তের সাথে তুলনা করলেন? এতো এতো প্রশ্নের উত্তর আমার জানার ইচ্ছে হলেও আমি জানতে চাই না কেবল জানতে চাই, আমাকে কেন এতো ভালোবাসেন?”

বাড়িতে মেহমান এলে বাড়ির চেহারাই যেন পাল্টে যায়। নিজের বাড়িতেও নিজেকে যেন অতিথি মনে হয়। কক্সবাজার যাবে সেই নিয়ে সকাল থেকেই কত-শত আলাপচারিতা চলছে সবার মাঝে। সাথে সবার জন্য সুস্বাদু খাবারের আয়োজনও হচ্ছে সকাল থেকে। ফালুদা আর জুস তৈরি করছে মা আর জেঠীমা। আমি রান্নাঘরে বসে একটা আপেল খেয়ে চলেছি আর মা এবং জেঠীমার কথাবার্তা শুনছি।

ট্রেতে খাবার সাজিয়ে আমাকে আর মিতালিকে পরিবেশনের দায়িত্ব দেওয়া হলো। খাবার নিয়ে পায়ে পায়ে চলে এলাম আমি আর মিতালি। ড্রয়িং রুমে এসে দেখি বাবা, জেঠু, নীল ভাইয়া, আঙ্কেল, আন্টি আর কুহি আপু বসে আছেন।

মিতালি খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সবাইকে খাবার দিতে লাগলো। ভাইয়াকে দিতে গেলে উনি মিতালির থেকে নিলেন না। কিন্তু আমি যখন কুহি আপুকে দেওয়ার জন্য উনার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন আস্তে করে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“আমাকে কি দিবি না?”

সবাই সবার মতোন কথা বলতে ব্যস্ত তাই হয়ত ভাইয়ার ফিসফিস করে বলা কথাগুলো শুনতে পায় নি। আমি শেষ কালকে উনার সাথে কথা বলেছি। সকালের ঘটনার পর কেন যেন উনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তাই এখন প্রতুত্তরে নিরব থেকে উনার সামনে খাবারের ট্রে ধরে রাখলাম।

উনি উনার পছন্দ মতোন একটা ফালুদার বাটি আর জুসের গ্লাস রাখতেই আমি কুহি আপুর কাছে চলে এলাম। আপু আমাকে হাত ধরে টেনে উনার পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“পিচ্চিমনি, তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?”

-“না না আপু, তোমার উপর কেন রাগ করব?”
দু’হাতে আমার ডান হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তাহলে সকালের পর আমার সাথে কথা বলো নি কেন?”

আপুকে তো বলা যাবে না যে, উনার উপরই রেগে আছি। আর উনার জন্য সকালে কত কিছু হয়ে গেল। সত্যিটা চাপা রেখে জবাব দিলাম,
-“পরশু পরীক্ষা তো তাই একটু টেনশনে আছি, অন্যকিছু নয়।”
-“ওহ আচ্ছা।”

আমার জবাবটা কুহি আপুর কতটুকু বিশ্বাস হয়েছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু এটা সঠিক উত্তর না হলে বেঠিক নয়। তাই তো আমার জবাব শুনে নীল ভাইয়া আঁড়চোখে তাকালেও আমাকে কিছু বলেন নি।
কথার প্রসঙ্গে আঙ্কেল বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তা ফ্লাইট কয়টা থেকে যেন?”

‘ফ্লাইট’ কথাটা শুনে আমি চমকে গেলাম আর মনে মনে বলতে লাগলাম,
-“ফ্লাইট মানে? আমরা কি প্লেনে করে কক্সবাজার যাবো? হে আল্লাহ! এটা কী করলেন? আমি তো প্লেইন ভীষণ ভয় পাই। এই প্লেইনের নাম শুনে তো এখন যেতেই ইচ্ছে করছেন। ধ্যাত!”
আঙ্কেলের প্রশ্নের জবাবে জেঠু বললেন,

-“আর তো চারদিনই বাকি আছে আর ফ্লাইট সকাল এগারোটায়।”
-“ওহ আচ্ছা।”
সবার কথা শুনে ভয়ে আমার মন কেমন যেন ঠুকরে কেঁদে উঠছে। বিষয়টা আমার কাছে একটুও সত্যি মনে হচ্ছে না। তাই মা আর জেঠীমার কাছে চলে এলাম সত্যতা যাচাই করতে।

প্রায় কেঁদে দিবো এমন একটা ভঙ্গিতে জেঠীমাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“জেঠীমা, আমরা কীসে করে কক্সবাজার যাবো?”
জেঠীমার আগে মা জবাব দিলো,
-“প্লেইনে যাবো কারণ আমরা বুড়ো মানুষ আমাদের পক্ষে ১২/১৪ ঘন্টা বাসে বসে থাকা সম্ভব নয়।”
-“কিন্তু মা “

-“কোনো কিন্তু না। এখন গিয়ে পড়তে বস। রাত পোহালে পরীক্ষা।”
মায়ের কথায় বড্ড অভিমান লাগছে। তাই আঁড়চোখে মা’র দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকটা সময়। আমার উদাস মুখের পানে তাকিয়ে জেঠীমা বললো,
-“মন খারাপ করিস না মা। জানি তো, তোর প্লেনে ভয় লাগে।”


পর্ব-৪১

বলেই জেঠীমা আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আর আমি মুখখানা মলিন করে দাঁড়িয়ে আছি একরাশ অভিমান নিয়ে। অনবরত মাথায় হাত বুলিয়ে জেঠীমা বললো,

-“মন খারাপ করিস না মা। তোর এমন মুখখানা দেখলে যে আমার বড্ড কষ্ট হয়। পরিবারের সবাই তো সাথেই থাকবে। তাহলে ভয় কীসের শুনি? তাছাড়া আনন্দ ফুর্তির মাঝে ভয়টা তো আর থাকবে না।”
এখনও চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছি। কারণ আমি জানি, আমি যতই আনন্দ ফুর্তিতে থাকি না কেন? আমার প্লেনে ঠিকই ভয় করবে। এখন চিন্তার বিষয় হলো অতিরিক্ত ভয়ে জ্ঞান হারালে তখন কী হবে?

পরশু আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। তবে শেষ পরীক্ষা নিয়েও বেশ টেনশনে আছি। ইংরেজি বিষয়টা সব সময়ই আমাকে অতিরিক্ত টেনশন দেয়। কিন্তু এবারের পরীক্ষার সাথে নতুন টেনশনও যোগ হয়েছে আর টেনশনের রং এবং নাম হলো নীল।
জীবনের এতোগুলো বছরে একবারের জন্যও নীল রঙটা আমার ভালো লাগে নি। কিন্তু ইদানীং নীল রঙটা বড্ড ভালো লাগে। ভালো লাগার কারণটা অবশ্য অজানা হয়ত জানি কিন্তু মনকে সেটা জানান দিতে চাই না।

মুখের সামনে বই মেলে দুই গালে হাত দিয়ে বসে আছি। দৃষ্টি আমার বইয়ের পাতায় কিন্তু মনটা দুভাগ হয়ে আছে। একভাগ মন অস্থির পরীক্ষার চিন্তায় আরেকভাগ মন অস্থির নীল ভাইয়ার চিন্তায়।
হঠাৎ কোথ থেকে মিতালি এসে আমায় বললো,

-“আপামনি, নীল ভাই আফনারে পড়তে ডাকে।”
আজকে ভাইয়ার কাছে পড়ার কথা নয় আর উনি পড়াবেন না, সেটাও বলেছিলেন। তাই মিতালির কথা আমার একফোঁটাও বিশ্বাস হলো না। সন্দেহী গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

-“ফাজলামি করছিস আমার সাথে? আজকে ভাইয়ার কাছে আমার পড়া টোরা কিছু নেই।”
হা-হুতাশের মতো বলতে লাগলো,

-“আল্লাহ আপামনি! আফনে এডি কি কন? আমি ফাইজলামি করাম কেরে? ভাই এহন আমারে কইলো আপনারে কইতে। আমি কইলাম এহন আফনের ইচ্ছা। আমি তো গেলাম গা।”
বলেই চলে যেতে নিয়ে ছিল কিন্তু তার আগেই আমি বলে উঠলাম,
-“এই শোন শোন।”
আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,

-“জে কন আপামনি।”
বিষয়টা আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না বলে আবার জানতে চাইলাম,
-“এখন যেতে বলেছে?”
-“হয়।”
-“ঠিক আছে তুই যা।”

-“আইচ্ছা।”
মিতালি চলে যেতেই সোজা হয়ে বসলাম। বই উপর থাকা কলমটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবতে লাগলাম,
-“এখন আবার ডাকাডাকি কেন? উফ!”
গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলে এলাম ভাইয়ার রুমে। বইপত্র হাতে উনার রুমে উঁকি দিতেই চোখাচোখি হল উনার সাথে। আমাকে দেখেই মৃদু হেসে আমায় বললেন,

-“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভিতরে আয়।”
ভিতরে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম চুপটি করে। ভাইয়া কীসের বই যেন পড়ছিলেন, বই পড়া বন্ধ করে আমার দিকে মুখ করে বসে জিজ্ঞেস করলেন,

-“পড়ছিলি?”
আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। উত্তর পেয়ে ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“এমনিতে কিছু বুঝার আছে? মানে সমস্যা হচ্ছে কোথাও?”

এবারও নিঃশব্দে ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালাম। আমার জবাবে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
-“শেষ কালকে রাতে আমার সাথে কথা বলেছিস।”
মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস ফেলে বললেন,

-“একটু কথা বলি নি বলে আজকে সারাদিন কথা বলিস নি। আরও কি শাস্তি দেওয়ার বাকি আছে পেত্নী?”
উনার কথায় কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করলাম,
-“মানে?”
সাথে সাথেই হাসতে হাসতে বলতে,
-“পারিসও তুই। সত্যি, তোকে দিয়েই সম্ভব। বাব্বা! এতো রাগ তোর। রাগের জন্য প্রায় একদিন আমার সাথে কথা বলিস নি। তবুও ভালো, শেষমেষ ম্যাডাম মুখ খুলেছে।”

বিষয়টা সত্যি কি মিথ্যা সেটা মনে মনে ভাবছি আর লজ্জায় মাথা নুইয়ে বসে আছি। হঠাৎ ভাইয়া কিছু চকলেট সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“এই যে ম্যাডাম প্লাস পেত্নী নামক শাঁকচুন্নি, এই নে তোর চকলেট। আশা করি এবার আর রাগটা থাকবে না তোর মাঝে।”
ভাইয়ার হাত থেকে চকলেট নিয়ে ইতস্তত করে বললাম,

-“এমনিতেও রাগ ছিল না ভাইয়া।”
-“কিন্তু অভিমান তো ছিল, খুব বেশিই।”

‘অভিমান’ শব্দটা যেন সত্যিই মনে করিয়ে দিচ্ছে, আজকে ভাইয়ার সাথে কথা না বলার বিষয়টা। এই অভিমানই হয়ত আজকে সারাদিন আমাকে বিরত রেখেছে ভাইয়ার সাথে কথা বলার থেকে। আজকে অভিমানটা এতো শক্তিশালী হয়ে উঠলো কেন? কেন অভিমানের দেয়াল ভেঙে আমি কথা বলতে পারি নি উনার সাথে?

একজোড়া চোখের স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখজোড়াও স্থির হয়ে আছে। ঐ চোখে আমার চোখ কী যেন খুঁজে পেয়েছে। তাই তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডুবে আছে। কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি বিনিময় হলো আমাদের মাঝে। নিজের চোখজোড়া একই ভাবে আমার চোখে ডুবিয়ে রেখে ভাইয়া শান্ত গলায় বললেন,
-“যা এখন। নিজের রুমে গিয়ে পড়াটা শেষ করে নেয়। কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলিস।”

উনার থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। বইপত্র আর চকলেট হাতে নিয়ে, লজ্জায় ধরে আসা গলায় বললাম,
-“শুকরিয়া ভাইয়া।”

-“It’s make me happy.”

উনার কথায় চমকালেও সেটা বুঝতে না দিয়ে নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় কেন যেন মনে হলো পিছন থেকে কারোর হৃদয় থেকে ভেসে আসছে আমার নাম, মনে হলো কারোর চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে আমার উপর। কিন্তু এসব কি আমার নিছক ভাবনা না সত্যিই?


পরীক্ষা শেষ হতে আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকি আছে। তাই খুব দ্রুত হাত চলছে আছে। প্রশ্নপত্র পেয়ে বুঝতে পারি নি যে, প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে নাকি আমি নিজেই কিছু পারি না। তবুও সব প্রশ্নের যেমন তেমন উত্তর দিয়ে পরীক্ষা সম্পূর্ণ করলাম। আমি আবার প্রশ্ন বাদ দিতে পারি না। কেমন যেন মায়া মায়া লাগে প্রশ্নের প্রতি। মনে হয় এই বুঝি প্রশ্ন কেঁদে উঠে আমায় বলবে,
-“কথামনি, তুই ভীষণ পঁচা। আমাকে কেন বাদ দিলি?”

আমার আর সুমাইয়ার পরীক্ষা একই ক্লাসে। ওর পরীক্ষা আমার আগে শেষ হতেই ও খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমারও পরীক্ষা শেষ আবার সময়ও শেষ। তাই অতি দ্রুত খাতা জমা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সুমাইয়া ক্লাসের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন দিলি?”
হতাশ গলায় বললাম,

-“যেমনই হোক, পাস করলেই বাঁচি। ইংরেজিতে পাস মানে আমার কাছে ১০০ পাবার সমান।”
হালকা হেসে আমায় বললো,

-“ইংরেজির মতোন এমন সহজ বিষয়ে যে কেন এতো ভয় পাস সেটাই আমার বুঝে আসে না।”
তাচ্ছিল্যের সুরে আমি বললাম,

-“অংকের মতোন এমন সহজ বিষয়ে যে কেন এতো ভয় পাস সেটাই আমার বুঝে আসে না।”
সুমাইয়ার অনুকরণ করছি বলে ওর হাসি থেমে গেল। ওর হাসি থামতে দেখে আমি এবার দুষ্ট হাসি দিলাম আর এতেই রাগী ভাব নিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমার নকল করছিস কেন?”
-“ইচ্ছে হলো তাই।”

হঠাৎ কী ভেবে সুমাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“নীল ভাইয়ার ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?”
হঠাৎ সুমাইয়ার মুখে নীল ভাইয়ার নাম শুনে হকচকিয়ে গেল। ওর কথা বুঝিনি এমন একটা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“মানে?”

-“দেখ, ভাইয়া তোকে পছন্দ করে হয়ত ভালোও বাসে কিন্তু সেটা মানতে চাইছিস না কেন?”
জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললাম,

-“তোকে তো বললাম, এসব আমার অনুমান ছিল আর অনুমামটাও সম্পূর্ণ ভুল। তাছাড়া কালকে কুহি আপুরা আমাদের বাসায় এসেছিল। ভাইয়ার সাথে বেশ গল্পসল্প করে নাস্তা করলো। আর koi or tha nopil কুহি আপু-ই হবে। তাছাড়া আপুকে আমার ভালো লাগে তাই ভাবী বানাতেও আপত্তি নেই।”

অর্নগল কথাগুলো বলেছি বলে নিজেরই অবাক লাগছে। যে মানুষটা নিজের রক্তের চেয়ে আমার চোখের জলকে প্রাধান্য দিয়েছে তাকেই আমি দূরে ঠেলে দিচ্ছি, তার নিখাঁদ ভালোবাসা আমি উপেক্ষা করছি। এতোটা পাষাণ আমি কী করে হলাম?
-“কিন্তু আমার কেন যে “

সুমাইয়া আমাকে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু ভাইয়ার বিষয়টা নিয়ে কথা বাড়ানো আমার কোনো ইচ্ছে নেই। তাই ওর কথার মোড় ঘুরাতে বললাম,
-“আচ্ছা শোন না, আমাকে এখন যেতে হবে রে। কারণ পরশু তো কক্সবাজার যাচ্ছি। তাই ব্যাগ গোছাতে হবে।”
-“ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস। মিস ইউ।”
-“হুম, অনেক।”


পর্ব-৪২

বলেই জড়িয়ে ধরলাম সুমাইয়াকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বললাম,
-“আসি রে। আল্লাহ হাফেজ।”
-“হুম আল্লাহ হাফেজ।”

সুমাইয়ার সাথে আলাপচারিতা শেষ করে পা বাড়ালাম ভার্সিটির গেটের উদ্দেশ্য। ধীরে পায়ে হাঁটছি আর ভাবছি,
-“আমার জীবনে এতো কিছু কেন হচ্ছে? এই কয়েক মাসে জীবন যেন খুব বেশিই মোড় নিচ্ছে এদিক সেদিক। আশে পাশের মানুষের পরিবর্তন হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত। যেই নীল ভাইয়া সর্বদা চুপচাপ থাকতেন তিনিও এখন বাচালতা করেন। আগে হাসতে দেখতাম না অথচ এখন হাসি ছাড়া আমার সাথে কথা বলেন না। ভালোবাসলে কি মানুষ এভাবেই হুট করে বদলে যায়? আমিও তো ভালোবাসি বেনামি চিঠির মালিককে তাহলে আমিও কি নীল ভাইয়ার মতোন বদলে গিয়েছি?”

ভাবতে ভাবতে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে বাইরে চলে এলাম। আর বাইরে এসেই দেখি নীল ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশিও হলাম যদিও খুশি হবার কারণটা আমার জানা নেই। খানিকটা দ্রুত পায়ে উনার কাছে এসে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
-“এদিক দিয়ে বুঝি আপনার কাজ ছিল ভাইয়া?”

হালকা হাসিতে মত্ত হয়ে আলতো হাতে চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে জবাব দিলেন,
-“আজকে তোর জন্য এসেছি।”
আমার জন্য এসেছে সেটা শুনে কিঞ্চিৎ লজ্জা অনুভব করছি নিজের মাঝে। লজ্জায় চঞ্চল হওয়া দৃষ্টিতে বললাম,
-“আমার জন্য!”

-“কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না?”
আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করায় ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
-“না না, সেটা বলছি না।”

-“আর কিছু বলতে হবে না পরীক্ষা তো শেষ এখন চল কোথাও নিয়ে যায় তোকে।”
খানিকটা অবাক হয়ে,
-“কোথায় যাবো?”

নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেলেছি তবে সাথে সাথে সেটা বুঝতে পেরে এখন বড্ড ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি ভাইয়া রেগে যাবেন আর আমার সাথে তিক্ত মেজাজে কথা বলবেন। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করতে মায়া জরানো কণ্ঠে বললেন,
-“অন্যকিছু না হোক বিশ্বাস তো করতেই পারিস আমাকে, তাই না?”

মাথা নুইয়ে চুপ করে রইলাম। হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়লো আর সেটা হলো ভাইয়া বাইক ছাড়া এসেছেন। আমার জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু সাহস হলো না। হঠাৎ ভাইয়া দুই কদম এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশা দাঁড় করালেন তারপর আমাকে লক্ষ্য করে বললেন,
-“তাড়াতাড়ি আয়।”

কাঁধের ব্যাগটা শক্ত হাতে ধরে হেঁটে চলে এলাম ভাইয়ার কাছে। এসে দাঁড়াতেই আমায় বললেন,
-“উঠে বস।”

বিনা উত্তরে উঠে বসলাম। ভাইয়া বসে রিকশাওয়ালা মামাকে বললেন,
-“মামা চলেন।”

রিকসা চলছে আপন গতিতে। শান্ত হয়ে বসে আছি অশান্ত মন নিয়ে। আর অশান্ত মনে জেগে উঠছে কত শত প্রশ্ন,
-“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না উনি কি করতে চাইছেন? আর আমাকে কোথায়ই বা নিয়ে যাবেন? জানি তো জিজ্ঞেস করলেও হনুমানের নাতি কিচ্ছু বলবে না। হুহ।”

আজকের আকাশে সূর্যের প্রখরতা নেই। তাছাড়া এখন দিনের শেষ ভাগ। তাই বাতাসটা হিম হিম বলে বোধ হচ্ছে। তবে মনের গহীনে ভয় আর লজ্জা নামক পাখি দু’টো বড্ড ছটফট করছে। কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বসে আছি।
অনেকটা সময় হলো দু’জনে পাশাপাশি বসে আছি কিন্তু কেমন যেন একটা নিরবতা ছেয়ে আছে আমাদের মাঝে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে ভাইয়া বললেন,

-“পরীক্ষা কেমন হয়েছে তোর?”
-“জ্বী ভাইয়া, আলহামদুলিল্লাহ।”
-“সব দিয়েছিস?”

-“হুম।”
কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে আবার বললেন,
-“পাস করবি তো?”

হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে মনে মনে বললাম,
-“হায় আল্লাহ! ভাইয়া, আপনারও যেহেতু আমার পাস ফেল নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে তার মানে তো আমি এবার নির্ঘাত ফেল করব।”
শুকনো একটা ঢোক গিলে প্রতুত্তরে বললাম,
-“আসলে ভাইয়া আমি_
এতোটুকু বলতেই ভাইয়া বলে উঠলেন,

-“এসে গিয়েছি আমরা। এবার রিকশা থেকে নেমে দাঁড়া।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। ভাইয়া রিকশা ভাড়া মিটিয়ে, আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি মাত্রাতিরিক্ত অবাক হচ্ছি আর বোকার মতো উনার পিছু পিছু হাঁটছি।

-“আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। উনি আমাকে রেস্টুরেন্টে কেন নিয়ে এলেন?”
ভাবতে ভাবতে রেস্টুরেন্টের ভিতরে চলে এলাম। সবচেয়ে নিরিবিলি একটা জায়গা পছন্দ করলেন উনি। চেয়ার টেনে দিয়ে আমায় বললেন,
-“বস এখানটায়।”
-“হুম।”

বলে বসতেই মুখোমুখি একটা চেয়ারে ভাইয়া বসে পড়লেন তারপর ওয়েটারকে ডাকলেন। ওয়েটার আসার আগে ভাইয়া মেনুকার্ড হাতে নিয়ে একটু চোখ বুলালেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ডাকলেন,
-“পেত্নী?”

আমি রেস্টুরেন্টটা দেখতে ব্যস্ত ছিলাম কিন্তু ভাইয়ার ডাকে উনার দিকে ফিরে জবাব দিলাম,
-“জ্বী ভাইয়া।”
-“কী খাবি বল? অর্ডার দিবো।”
-“ভাইয়া, আপনার যেটা ভালো লাগে সেটাই অর্ডার দিন।”

ভাইয়া জানেন যে আমার রেস্টুরেন্টের খাবার সম্পর্কে তেমন কোনো ধারনা নেই। কারন বাইরের খাবার খাওয়া আমার খুব একটা পছন্দ না কিন্তু মাঝে মাঝে খাওয়া হয় যেমনঃ সমুচা, চিপস, চকলেট, কেক টেক এসব আর কি।
এক দুই মিনিট মেনুকার্ড পর্যবেক্ষণ করলেন। ওয়েটার এসে দাঁড়াতেই নিজের পছন্দ মতো কিছু খাবার অর্ডার করলেন। খাবার আসতে সময় লাগবে। তাই আমি বসে বসে আবার রেস্টুরেন্টটা দেখছি।

হঠাৎ ভাইয়ার দিকে চোখ পড়লো। উনি মুষ্টিবদ্ধ দুইহাতের উপর মুখ রেখে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় আঁতকে উঠলাম। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিয়ে মনে মনে বললাম,

-“আজকে এতো লজ্জা লাগছে কেন? জীবনের প্রথম তো রেস্টুরেন্টে আসি নি। তাহলে লজ্জায় আমার মর মর অবস্থা কেন হচ্ছে? আর হনুমানের নাতিও রোমান্টিক চাহনী দিয়ে আছে। ইশ, গার্লফ্রেন্ড নেই বউ আছে উনার। ঐ কবে বিয়ে হয়েছে আপনার সাথে আমার? ইচ্ছে তো করছে উনার মুখে বক্সিং করতে। হুহ।”

মিনিট দুয়েক পর আবার তাকিয়ে দেখি সেই এক ভাবেই তাকিয়ে আছেন। উনার মাঝে কোনো নড়ন চড়নই নেই। নিজের কাছে এখন আরও বেশি অস্বস্তি লাগছে। অতিরিক্ত লজ্জায় আমার হৃৎস্পন্দন বাড়ছে আর রাঙা হচ্ছে মুখখানা। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে লজ্জায় হয়ত হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে আমার। তাই কী ভেবে যেন কাঁপা কাঁপা গলায় উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“ভাইয়া, আমরা রেস্টুরেন্টে কেন এলাম হঠাৎ করে?”
প্রশ্ন করেই মনে মনে বললাম,

-“হায় আল্লাহ! আমি আবার প্রশ্ন করলাম। উফ, কী হয়েছে আমার? আমি এমন কেন করছি?”
আমার প্রশ্ন শুনে ভাইয়া এবার নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। মুখখানা গম্ভীর করে জানতে চাইলেন,
-“তোকে কি কৈফিয়ত দিতে হবে এখন?”

-“হনুমানের নাতি আমি কৈফিয়ত চাই নি শুধু জানতে চেয়েছি হঠাৎ এখানে আসার কারণ কী?”
এটা বললে আমার খরার মন বৃষ্টির জল পেত কিন্তু সেটা তো হবার নয়। তাই আমতা আমতা করে বললাম,
-“না, মানে_

আমাকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে উনি বললেন,
-“কৈফিয়ত হলেও আপত্তি নেই কারণ ইদানীং কৈফিয়ত দিতেও বড্ড ভালো লাগে আর ভাবতেও বেশ লাগে যে, কৈফিয়ত চাওয়ার মতোনও কেউ আছে জীবনে, মা বাবা বাদে।”


পর্ব-৪৩

উনার কথায় বিস্ফারিত নয়নে তাকালাম উনার দিকে আর উনিও আগের ভঙ্গিতে বসে তাকিয়ে আছেন পলকহীন দৃষ্টিতে। উনার ঐ চোখজোড়ায় কী যেন খুঁজে পেয়েছি আমি। বড্ড আপন লাগছে চোখ দুটো আর সাথে মানুষটাকেও। লজ্জায় মরে যাবার উপক্রম হলেও উনার চোখে তাকিয়ে এখন একটা গান আমার খুব করে মনে পড়ছে,

“Kehta hai pal pal tumse
Hoke dil ye deewana
Ek pal bhi jaan-e-jaana
Mujhse door nahi jaana
Pyaar kiya to nibhana
Pyaar kiya to nibhana
Aankhon mein meri
Tera hi chehra dhaRakta rahe
Haan tu jo naa mile
Seene mein dil ye taRapta rahe
Tu mujhe naa sataana
Mera dil naa dumhaana
Pyaar kiya to nibhana
Pyaar kiya to nibhana”

ওয়েটার খাবার নিয়ে হাজির হতেই আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। নিজেকে যত দ্রুত সম্ভব সামলে নিলাম। কিন্তু লজ্জায় চঞ্চল হওয়া চোখকে কোনো মতেই স্থির করতে পারছি না। হঠাৎ-ই ভুবন কাঁপিয়ে ফোন বেজে উঠলো আর আমি আরও অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।

তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলাম। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো সিম কোম্পানির কল দেখে। ইচ্ছে করছে ফোনটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলি। কিন্তু সাধের মোবাইলের বলী দেওয়া সম্ভব নয় তাই কল কেটে ফোনটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিলাম।

ভাইয়া নিজের আর আমার জন্য খাবার সাজিয়ে চোখে ইশারা করলেন আমাকে খেতে। আমি খাওয়া শুরু করতেই ভাইয়া আমায় জিজ্ঞেস করলেন,

-“কলটা রিসিভ না করে কেটে কেন দিলি? আমি সাথে আছি বলে?”
-“না ভাইয়া, আসলে সিম কোম্পানির কল ছিল তাই রিসিভ করি নি।”
-“ওহ।”

মনে মনে ভেবেছিলাম ভাইয়া হয়ত আরও কিছু বলবেন বা জিজ্ঞেস করবেন। কিন্তু উনি নিরবতা আঁকড়ে খাওয়ায় মন দিলেন। তাই আমিও নিঃশব্দে খেতে শুরু করলাম।


কত-শত অপেক্ষার পর চলে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। কত আশা ছিল, কত সাধ ছিল আমার মনে। আমি দুচোখ ভরে দেখবো সমুদ্রকে। আজকে আমার সকল চাওয়া পাওয়া পূরণ হবে সেটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না কিছুতেই।
সকাল থেকে বাড়িময় হইচই চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে রেখে না গেলে না-কি সমস্যা হবে। এই নিয়ে মা আর জেঠীমার কত-শত চিন্তা।

আজকে আমাকে জোরপূর্বক ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে জাগানো হয়েছিল। কিন্তু আমি সেই সাতটাই ঘুম থেকে উঠেছিলাম। কারণ আমার তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগে না। তাই এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া ব্যাগও গুছানো শেষ, কালকে বিকেলেই গুছিয়ে রেখেছিলাম।
সাতটা নাগাদ কুহি আপু, আন্টি আর আঙ্কেল চলে এসেছেন। এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করা হবে। সকালের নাস্তা শেষ করে সবাই এখন তৈরি হতে ব্যস্ত।

আটটা বাজতে চললো তাই জেঠু সবাইকে তাড়া দিচ্ছে বের হওয়ার জন্য। আমি প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছি শুধু জুতো পড়া বাকি। আজকে নীল ভাইয়ার দেওয়া জুতো পড়ে কক্সবাজারের মাটিতে পা রাখবো। ভাবতেই অবাক লাগছে যে, পছন্দের জুতো পড়ে পছন্দের জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছি। জুতো পড়তে পড়তে হঠাৎ মা’র ডাক কানে এলো,

-“কথামনি হয়েছে তোর?”
চেঁচিয়ে জবাব দিলাম,

-“হ্যাঁ মা।”
-“জলদি বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বস।”
-“যাচ্ছি।”
মা’র সাথে কথা বলতে বলতে জুতো পড়া শেষ। এবার দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে শেষবারের মতো দেখে বললাম,

-“এতো দেখার কিছু নেই কারণ ফকিন্নিকে কখনও বিউটি কুইন লাগবে না। তাই ভাব না নিয়ে এবার কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।”
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। রুমের দরজা লাগিয়ে দাঁড়াতেই জেঠীমা বললো,
-“সবাই গাড়িতে গিয়ে বসছে। তুইও যা। আমি আর তোর মা আসছি।”
-“ঠিক আছে জেঠীমা।”

বলেই হাঁটতে শুরু করলাম। বাসা থেকে বের হতেই পায়ে কেমন কেমন বোধ করছি। জুতোর ফিতা আর নুপুর একসাথে পেঁচিয়ে কেমন যেন ব্যথা ব্যথা লাগছে। সেটা ঠিক করার জন্য বাম পা খানিকটা উপরে তুলে বাম হাতে ঠিক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এক পা উপর তোলার দরুন আমি কিঞ্চিৎ বেসামাল হয়ে যাচ্ছি। তাই ডান হাত শূন্যে নাড়িয়ে কোনোকিছু ধরার জন্য খুঁজে চলেছি।

হঠাৎ হাতে কিছু লাগতেই সেটা ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে নুপুর আর ফিতা ঠিক করে নিলাম। সব ঠিকঠাক মতো হতে সোজা হয়ে তাকিয়ে দেখি এতক্ষণ আমি নীল ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাইয়াকে দেখার সাথে সাথে আমি আঁতকে উঠলাম আর উনার কাঁধে থাকা আমার হাতটা সরিয়ে নিলাম। হালকা হেসে ভাইয়া আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“শেষ?”

-“হুম।”
-“তাহলে গাড়িতে গিয়ে বস তাড়াতাড়ি।”

আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়াতেই ভাইয়া গাড়ির দিকে চলে গেলেন আর আমি ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম,
-“হায় আল্লাহ! উনার ড্রেসের কালার আর আমার ড্রেসের কালার এক কী করে হলো? ইশ, উনার ব্ল্যাক কালারের ড্রেস কেন পড়তে হবে? আর উনি কি জানেন না, উনার এমন ড্রেসআপে কারোর দুনিয়া থমকে যেতে পারে?”
-“কিরে কথামনি? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

আমাকে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জেঠীমা পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো। আমি এতোটাই শক খেয়েছি যে, এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। তাই জেঠীমার দিকে তাকালেও কিছু বললাম না। পাশ থেকে মা বলে উঠলো,
-“তাড়াতাড়ি কর মা। তোর বাবা আর জেঠু আবার রাগারাগি করতে পারে।”

আমি যাবার সম্মতি দিতে মা আর জেঠীমা সামনে দিকে হাঁটতে লাগলো। নীল ভাইয়ার কথা এখনও মাথা থেকে সরাতে পারছি না। তাই একগাল হেসে, মাটিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম,
-“I think, your black shirt is probably making me weak towards you.”
গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছি আমি আর মিতালি। বাইরের পরিবেশটা আমার বেশ নজর কাড়ছিল। তাই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে উপভোগ করছিলাম আর মনে মনে গুনগুন করছিলাম,

“আজ এই দিনটাকে
মনের খাতায় লিখে রাখো
আমায় পড়বে মনে
কাছে দূরে যেখানেই থাকো
আজ এই দিনটাকে
মনের খাতায় লিখে রাখো
আমায় পড়বে মনে
কাছে দূরে যেখানেই থাকো
ও হো হো
আ হা হা হা
উম হুম হুম হুম”

-“আপামনি, পেলেনে(প্লেন) কি বিছনা(বিছানা) আছে?”
হঠাৎ মিতালির প্রশ্নে ওর দিকে ফিরে তাকালাম বিস্ময় নিয়ে আর জিজ্ঞেস করলাম,
-“বিছানা দিয়ে কী করবি?”
-“কি আর করাম? ঘুম পাইলে ঘুমাইতাম।”

সামনের সিটে অবস্থানরত নীল ভাইয়া ফোঁড়ন কেটে বললেন,
-“তুই বিছানা দিয়ে কি করবি? ভোরে ঘুম থেকে উঠতে বললে যে রাতে উঠে তার জন্য বিছানা প্রয়োজন। যারা প্লেন বানায় তাদেরকে বলতে হবে, বিছানার ব্যবস্থা রেখে প্লেন বানাতে।”

এই কথাগুলো যে উনি আমায় বলেছেন, সেটা বুঝতে আমার একটুও কষ্ট হয় নি। যখন উনাকে এই গাড়িতে উঠতে দেখেছিলাম তখনই বুঝেছি, আমাকে কথা শোনানোর জন্য উঠছেন। কারণ জেঠু বলেছিল, জেঠুদের সাথে গিয়ে বসতে। কিন্তু হনুমানের নাতি বলেছিল,
-“না বাবা, আমি সামনেই বসতে পারব।”

এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে উনাকে পলি ব্যাগে মুড়িয়ে, গাড়ির জানালা দিয়ে নদীতে ফেলে দিতে।

এয়ারপোর্টে বসে সবাই অপেক্ষা করছি। কারণ প্লেন না-কি এখনও আসে নি। আমি, কুহি আপু আর মিতালি একসাথে বসে নিরবতা পালন করছি। কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। হঠাৎ কোথা থেকে নীল ভাইয়া এসে একটা প্যাকেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“এটা ধর।”
-“কী আছে এতে?”
-“খুলেই তো দেখতে পারিস সমুচা।”

সমুচার নাম শুনেই আমার মন নাচনকোঁদন করতে লাগলো। আমি খুশিতে গদোগদো হয়ে প্যাকেট খুলতে লাগলাম। ভাইয়া আবার বললেন,
-“অনেকগুলো আছে। আশা করি সবার হয়ে যাবে তবুও যদি আরও প্রয়োজন হয়, বললে কিনে দিবো।”
কুহি আপুকে ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“জার্নিতে অয়েলি ফুড মনে হয় না খাওয়াটা ঠিক।”

-“তৃপ্তি সহকারে কোনো খাবার খেলে সেটা সমস্যা হওয়ার কারণ দেখি না। যে-কোনো খাবারই আনন্দের সহিত খাওয়া উচিত তাহলেই সেটা শরীর আর মনের জন্য আরামদায়ক হয়– যদিও এটা আমার ধারণা।”

কুহি আপুকে বিনা পয়সায় জ্ঞান দিয়ে ভাইয়া চলে গেলেন। আপু হয়ত ভাইয়ার কথায় চুপসে গেছে তাই তো আর কথা বাড়ালো না। আমার কাছে অবশ্য বিষয়টা বেশ লেগেছে। তাই আপুকে আর একটু নাজেহাল করতে বললাম,

-“আপু, একটা সমুচা খাও প্লিজ।”
অনেক কষ্টে ঠোঁটে একটু হাসির রেখে টেনে আপু বললো,
-“না, তুমিই খাও।”
-“ঠিক আছে।”

একে তো প্রিয় সমুচার দেখা তার উপর ভাইয়া, আপুকে করলো নাজেহাল। খুশির ঠেলায় আমি আর মিতালি মিলে গপাগপ খেতে লাগলাম।
“কপালের লিখন না যায় খন্ডন” আর আমার কপাল তো এমন ভাবে পুড়েছে যে, একশ মাইল দূর থেকেও পোড়া গন্ধ পায় মানুষ।

প্লেনে যাওয়ার ইচ্ছে এমনিতেই আমার ছিল না। কত-শত ভাবে মনকে বুঝিয়ে রাজি করেছি। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, আমি আর মিতালি পাশাপাশি বসবো। কিন্তু আমার পোড়া কপালে লেখা আছে, হনুমানের নাতির সাথেই বসতে হবে। সেই সকাল থেকে উনি আঠার মতোন আমার পিছনে লেগে আছেন।

জানালার পাশেই আমার সিট পড়েছে বলে বড্ড খুশি হয়েছিলাম কিন্তু যখন ভাইয়া এসে আমার পাশে বসলেন আমি তো হতবাক হয়ে গেলাম। গাধার মতো উনাকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম,
-“ভাইয়া, মিতালি কোথায়?”
-“কেন?”

-“না মানে ওর সাথে বসার কথা বলেছিল জেঠীমা। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
কালো সানগ্লাসটা খুলে, শার্টের পকেটে রাখতে রাখতে বললেন,
-“মা’র সাথেই বসেছে। তোকে এতো ভাবতে হবে না। কিন্তু তোর সাথে যে কেন আমার সিট পড়লো? উফ, ডিজগাস্টিং।”
রাগে আমার তখন পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিলো। এখনও বড্ড রাগ লাগছে,

-“কত্তবড় সাহস! আমাকে বলে কি-না ডিজগাস্টিং। হনুমানের নাতি, আপনি ডিজগাস্টিং আপনার ঐ হবু বউ ডিজগাস্টিং।”
উনার বউকে ডিজগাস্টিং বলার পর আমার হুঁশ হলো যে, আমি নিজেই নিজেকে ডিজগাস্টিং বলছি। রাগের দরুন আমার মাথার তার হয়ত ছিঁড়ে গেছে। তাই তো কী সব আবোলতাবোল বলছি।


পর্ব-৪৪

-“এক মিনিট, আমি তো উনার বউ নই। কারণ উনি আমাকে পছন্দ করলেও আমি তো উনাকে বিয়ে করছি না। তাহলে আমি কেন নিজেকে ডিজগাস্টিং বলছি? আলবাত উনার বউ-ই ডিজগাস্টিং হবে সাথে শাঁকচুন্নি, শেওড়া গাছের পেত্নী আরও যা যা আছে সব। হুহ। আমি কেন এসব হবো? আমি তো নিরীহ একটা মেয়ে আর উনি আমায় বলেন কি-না “

-“ব্লেটটা লাগিয়ে নেয়। পারবি তো?”
ভাবনায় বিভোর ছিলাম আমি কিন্তু উনার ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো। জবাব দিতে উনার দিকে তাকালাম কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“পারবি না-কি আমি লাগিয়ে দিবো?”

-“না, আমি পারব।”
ব্লেট লাগিয়ে চুপ করে বসে আছি। প্লেন চলতে শুরু করবে ভাবতেই অস্থিরতা আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সৃষ্টি হচ্ছে। ধীরে ধীরে প্লেন চলছে পিচঢালা পথ ধরে আর প্লেনের সাথে তাল মিলিয়ে ধুকপুক করছে আমার হৃদয়।

আল্লাহকে খুব করে ডাকছি আর দোয়া পড়ে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করছি কিন্তু অস্থিরতা কমছে বৈ বাড়ছে শুধু। প্লেন যেই না উড্ডয়ন করলো অতিরিক্ত ভয়ের দরুন আমি হুট করে ভাইয়ার বুকে মুখ লুকালাম। আমার আচমকা এমন কান্ড দেখে ভাইয়া হকচকিয়ে গিয়ে বললেন,
-“পেত্নী, কী হয়েছে তোর? ভয় করছে?”
আমি প্রায় কেঁদে দেবো এমন অবস্থায় বললাম,

-“ভাইয়া, আমাকে নামিয়ে দিতে বলুন। আমি যাবো না, আমি যাবো না ভাইয়া।”
মৃদু হেসে ভাইয়া বললেন,
-“বোকা মেয়ে, আরে কিচ্ছু হবে না। তুই শান্ত হয়ে বস। বেশিক্ষণ লাগবে না যেতে।”

আমি ভয়ে চুপসে গিয়েছি ফলে মুখ দিয়েও কথা বের হচ্ছে না। এতোটাই ভয় লাগছে যে, নড়াচড়া করতেও ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে বসে আছি কেবল। ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“এভাবেই থাকবি?”
-“হুম।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

ঢাকা থেকে কক্সবাজার প্লেনে করে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেকের মতো সময় লাগে। ভয় নামক জালে জড়িয়ে এতোটা সময় আমি ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে পার করলাম। আমাদের মাঝে কোনো কথা হয় নি। শুধু এক কি দুইবার ভাইয়া জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-“কিছু খাবি?”
নড়াচড়া করলেই প্লেন মাটিতে পড়ে যাবে– এমন ভ্রান্ত ধারণায় আমি বরাবরই বলেছিলাম,
-“উহুম।”

প্লেন উড়ন্ত অবস্থায় যখন ছিল আমি কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম, এখন প্লেন অবতরণ করবে ভাবতেই ভয়ে মর মর অবস্থা হচ্ছে আমার। এক দুই মিনিটের মধ্যে প্লেন অবতরণ করতে শুরু করলো। ভয়ের দরুন এবার না পেরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। আমার এমন বাচ্চামো দেখে ভাইয়া ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“এ কি! কান্না করছিস কেন?”

কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,
-“ভাইয়া ভাইয়া আমার আমার ভীষণ ভয় করছে।”
-“ভয় কীসের? আমি তো আছি। তাছাড়া কক্সবাজার এসে গেছি। এক্ষুনি প্লেন থেমে যাবে।”

আমি কিছু না বলে হেঁচকি তুলে কাঁদছি আর ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে স্ট্যচু হয়ে বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ পর প্লেন থেমে গেল। সবাই একে একে প্লেন থেকে নামতে শুরু করছে। আমি আমার আগের অবস্থায় আছি। আমার মাঝে কোনো নড়নচড়ন নেই বলে ভাইয়া নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“প্লেন তো থেমে গেছে। নামবি না?”

উনার কথায় এবার সোজা হয়ে বসে চোখ মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। প্লেন থেকে নেমে দাঁড়াতেই কক্সবাজারের প্রবল বাতাসে মনের সকল ভয় দূর হয়ে গেল। মুক্ত বাতাস টেনে নিয়ে মনে আরও প্রশান্তি এনে দিলাম।
কক্সবাজার এয়ারপোর্টে বসতেই জেঠীমা জিজ্ঞেস করলো,

-“খুব ভয় পেয়েছিস?”
ভাইয়া পাশেই ছিলেন। ব্যাগ থেকে একটা পানির বোতল বের করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি তো ভয়ে বাকশক্তিই হারিয়ে ফেলেছি। তাই ভাইয়া জেঠীমাকে জবাব দিলেন,

-“ভয়ের কথা আর বলো না মা। পুরোটা সময় আমাকে ঝাপটে রেখেছে। তেজপাতা হলে কী হবে? এখন পিঠ ব্যথায় আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এমন বাচ্চা নিয়ে তোমাদের কক্সবাজার আসা উচিত হয় নি।”
উনার এমন তেঁতো কথা শুনে আমি সাথে সাথে উনার দিকে তাকালাম আর মনে মনে বললাম,

-“আপনাকে দিয়ে সিনেমা বানানো উচিত যেখানে আপনি একসাথে নায়ক এবং খলনায়কের চরিত্র অভিনয় করবেন। ট্রাস মি আপনার ভালো অভিনয় কেউ করতে পারবে না। কারণ প্লেনে যখন ভয় পেলাম আপনার জন্যই ভয়টা অনেক কম লেগেছিল। আমি তো ভেবেছিলাম ভয়ে আমি অজ্ঞানই হয়ে যাবো। আমি আমার মনকে বুঝালে কী হবে যে, আপনি ভালো। আপনি আস্ত একটা হনুমানের বংশধর না হলে কেউ এমন পাবলিক প্লেসে কাউকে অপমান করে?”

ভাইয়ার কথায় জেঠীমা চমকিত নয়নে জিজ্ঞেস করলো,
-“মানে? কী বলছিস এসব?”
-“ঠিকই বলছি মা। প্লেন উড্ডয়নের সময় বলছিল, কক্সবাজার আসবে না প্লেন থেকে নামিয়ে দিতে। আর প্লেন অবতরণের সময় তো কেঁদেই দিয়েছে।”

ভাইয়ার কথা শুনে জেঠীমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-“অনেক কষ্ট হয়েছে তোর মা?”

আমি জবাব দেওয়ার আগে ভাইয়া আবারও বলে উঠলেন,
-“ওর কীসের কষ্ট হয়েছে মা? কষ্ট তো হয়েছে আমার। এতোটা সময় রোবটের মতোন পেত্নী আঁকড়ে বসে থেকে এখন আমার পিঠ ব্যথা করছে।”

-“ইশ, নীল। সবসময় তোর এসব কথা ভালো লাগে না।”
আমি তো আগেই বলেছি, আমি নিরীহ মেয়ে। তাই তো এতো মানুষের সামনে আমার অপমানটাও মুখ বুঝে সহ্য করছি। আর আমাকে ইচ্ছে মতো অপমান করে এখন দুষ্ট হাসিতে মত্ত হয়ে আছে হনুমানের নাতি। হাতে থাকা পানির বোতলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-“পানিটা পান করে নেয় ভালো লাগবে। প্লেনেও তো কিছু খেলি না।”
নিঃশব্দে পানির বোতলটা নিয়ে পান করতে লাগলাম আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম,

-“কত-শত ব্যস্ততায়ও আমার খেয়াল রাখতে ভুলে না মানুষটা। এতো অপমানের পর সামান্য একটু যত্ন উনার প্রতি থাকা সমস্ত ঘৃণাকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয়।”


কালকে জার্নি করে এতোটাই কান্ত হয়েছি যে, বেলা দশটা বাজতে চললো অথচ আমার কোনো খবর নেই। বিছানায় পড়ে পড়ে নাক ডেকে ঘুম চলছে আমার। অবশ্য কেউ আমাকে ঘুম থেকে ডেকেও তোলে নি।

কালকে হোটেলে আসার পর সবাই-ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই সমুদ্রের দেখা এখনও মেলেনি কারোর। রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার মতো করে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। কুহি আপু, মিতালি আর আমার জন্য একটা রুম দেওয়া হয়েছে। অনেক রাত অবধি তিনজনে গল্প করে কাটিয়েছি।

আমি ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে, বের হতেই দেখি মা এসে হাজির। আমাকে দেখে মা তাড়া দিয়ে বললো,
-“তৈরি হয়ে নীলের রুমে যা। তোকে নিয়ে নাস্তা করতে যাবে।”
-“তোমরা সবাই খেয়ে নিয়েছো?”
-“হ্যাঁ।”

-“ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।”
মাত্র পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে চলে এলাম ভাইয়ার রুমে। দরজায় নক করতেই দরজা খুলে দিয়ে ভাইয়া বললেন,
-“ভিতরে আয়।”

আমি ভিতরে এসে বিছানায় বসে রুমটা দেখতে লাগলাম। কেবলই ভাইয়াকেই সিঙ্গেল রুম দেওয়া হয়েছে আর রুমটা দেখতেও অনেক সুন্দর। আমি চোখ বুলিয়ে রুমটা দেখছি আর ভাইয়া তৈরি হচ্ছেন। ফোন আর রুমের চাবি হাতে নিয়ে বললেন,
-“চল এবার।”
-“হুম।”


পর্ব-৩৩

গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলেছি ভাইয়ার খোঁজে। হাঁটতে হাটঁতে খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে কাঠি গুঁজে দিলাম আবার। রুমের কাছাকাছি আসতেই ডাকতে শুরু করলাম ভাইয়াকে,
-“ভাইয়া, ভাইয়া?”

ডাকতে ডাকতে একেবারে রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালাম। ভাইয়া উনার আলমারিতে কী যেন করছিলেন তাই বোধহয় আমার ডাক খুব একটা শোনেন নি। আমি আবার ডাকতে লাগলাম,
-“ভাইয়া?”
আলমারি দরজার জন্য উনাকে পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না আর ভাইয়াও সেই অবস্থায় থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু বলবি?”

-“হ্যাঁ।”
-“বল।”
-“মৃন্ময় ভাইয়া এসেছেন। আপনাকে যেতে বলেছেন।”
আলমারির দরজাটা লাগিয়ে তালাবদ্ধ করলেন। কপাল দখল করে থাকা স্লিকি চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিতে দিতে বললেন,
-“ঠিক আছে আমি “

হঠাৎ উনার কথা অফ হয়ে গেল আমার দিকে দৃষ্টি দিতেই। কয়েকমিনিট পা থেকে মাথা অব্দি আমাকে স্ক্যান করলেন। উনার এমন সন্দেহী চাহনিতে আমি অহেতুক ঘাবড়ে গেলাম। উনি মুখখানা গম্ভীর করে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“এই অবস্থা কেন তোর? কোথায় ছিলিস?”

ইতস্তত করে বলতে লাগলাম,
-“আসলে ভাইয়া, সুমাইয়া এসেছিল তো তাই ছাদে গিয়েছিলাম “
আমার কথার মাঝেই বলতে লাগলেন,
-“ছাদে কেন? বাড়িতে কি বসার জন্য চেয়ার টেবিল নেই?”
-“না মানে “

ডান হাত উঁচিয়ে আমায় বলতে লাগলেন,
-“বেয়াদব মেয়ে, থাপ্পড় দিয়ে কান লাল করে দিবো তোর। সাহস কী করে হয় তোর এমন বৃষ্টির মধ্যে ছাদে দিয়ে নাচন কুঁদন করতে? কয়েকদিন কিছু বলছি না বলে তোর পাখা গজিয়ে গেছে?

ফের যদি এমন বৃষ্টিতে অহেতুক তোকে ভিজতে দেখি তাহলে আমার অন্যরূপ দেখতে পাবি তুই।”
হঠাৎ এমন ক্ষেপে যাবেন উনি আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। উনার এমন রূপ সে রাতের পর আজকে আবার দেখছি। বরাবরের মতোই কিছু বলার সাহস নেই আমার। শুধু মাথায় নুইয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি আর মনে মনে ভাবছি,

-“কী এমন অন্যায় করেছি বৃষ্টিতে একটুখানি ভিজে? একটু আগেও উনার প্রশংসা করে বলেছিলাম, আগের নীল ভাইয়া আর এখনকার নীল ভাইয়ার মাঝে যেন আকাশ পাতাল ব্যবধান। আগের নীল ভাইয়াকে বড্ড ভয় পেতাম, বড্ড বেশি। কিন্তু এখন যাকে দেখছি তাকে কেন জানি বড্ড আপন মনে হয়– এসব এখন মিথ্যে মনে হচ্ছে, বড্ড মিথ্যে মনে হচ্ছে।

এই মানুষটা কোনোদিন বদলাবে না। আর উনি আমাকে পছন্দ করলেও আমি উনাকে কখনোই পছন্দ করি নি আর করবোও না জীবনে। আই জাস্ট হেইট ইউ মিস্টার নীল চৌধুরী, হেইট ইউ।”
আমার এইসব ভাবনার মাঝে ভাইয়া আমার অনেকটা কাছাকাছি এসে কাঠ গলায় বলতে লাগলেন,

-“ভাবিস না তোর সব ছেলেমানুষী আমি মেনে নিবো। তোর এইসব ছেলেমানুষী যে কাউকে কতটা যন রুমে গিয়ে ড্রেস বদলে নেয় নয়ত আবার শরীর খারাপ করলে আমাকে রাত জাগতে হবে।”
এই বলে ভাইয়া চলে গেলেন।

এতক্ষণ ধরে অনবরত যুদ্ধ করতে থাকা জলটুকু অনেক কষ্টে আটকে ছিল চোখের কোলে। কিন্তু ভাইয়া চলে যেতেই সেটা এবার বিনা বাঁধায় গাল বেয়ে পড়তে লাগলো। আলতো হাতে মুছে সোজা হয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে কান্নাটা চাপা দিতে খুব তোড়জোড় চালাচ্ছি আর মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করছি,

-“আমার এসব কেবলই ছেলেমানুষী? হলেও কার কী সমস্যা? উনি বলে কেন গেলেন না, আমার ছেলেমানুষী কাকে কী করছে? আমি অসুস্থ হলে কি উনাকে বলি আমার জন্য রাত জাগতে? এতোটা পঁচা একটা মানুষ কী করে হয়? সামান্য বিষয়ের জন্য উনি সবসময় আমার সাথে কেন?
আর পারলাম না কান্নাটা চেপে রাখতে। কান্নার বেগ ক্রমশ বাড়ছে বলে সেটা মুছতে মুছতে নিজের রুমের দিকে ছুটতে লাগলাম সবার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে।


“এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক।
এসো এসো
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো

যাক পুরাতন স্মৃতি
যাক ভুলে যাওয়া গীতি
যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক
যাক যাক
এসো এসো
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশ রাশি, শুষ্ক করি দাও আসি।
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
আনো আনো, আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুঁজঝটি জাল যাক দূরে, যাক যাক যাক।
এসো এসো “

বাংলা সনে আজকে পহেলা বৈশাখ, বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি সকল বাঙালী জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নিয়ে থাকে। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সার্বজনীন লোকউৎসব হিসেবে বিবেচিত।

গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়।

বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়। এই উৎসবটি শোভাযাত্রা, মেলা, পান্তাভাত খাওয়া, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হল “শুভ নববর্ষ”।

নববর্ষের গানের সুরে ঘুম ভাঙলো আমার। ধারেকাছে কোথাও হয়ত গান বাজানো হচ্ছে। জেগে উঠতেই দৃষ্টি দিলাম ঘড়িতে, নয়টার ঘর পেরিয়ে গেছে ঘড়ির কাঁটা। যেহেতু আজকে ছুটির দিন, সেহেতু দুপুর বারোটা পর্যন্ত ঘুমালেও যে কেউ আপত্তি করবে না সেটা আমার জানা আছে।
বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালাম ফ্রেশ হবো বলে। গানের সুরটা আমার খুব মনে ধরছে। তাই আধোঘুমে আচ্ছন্ন হয়েও সুর মেলাচ্ছি,
“মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,

অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।”

আমার তেমন কোনো কাজ নেই তবুও চটপট ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। তোয়ালে দিয়ে ভেজা মুখ মুছতে যাবো তার আগে আমার চোখজোড়া আটকে গেল টেবিলে থাকা একটা গিফটের বক্স দেখে। মুখ মুছতে মুছতে ভাবতে লাগলাম,
-“আজকে আবার কীসের গিফট? আজকে না আমার জন্মদিন আর না আমার বিয়ে। তাহলে গিফট কেন? আর কে-ই বা দিলো? বেনামি চিঠি কি?”
হাতে থাকা তোয়ালেটা ছড়িয়ে দিয়ে গিফটের বক্স নিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। বাইরে থেকে বক্সটা কয়েক সেকেন্ড দেখে বলতে লাগলাম,
-“না এটা তো কোনো ভাবেই বেনামি চিঠি মনে হচ্ছে না। আর বক্সটাও যথেষ্ট ভারী মনে হচ্ছে। কী আছে এতে?”
আরও কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলতে লাগলাম,

-“ইশ, আমি কী বোকা! এটা তো খুললেই দেখা যাবে এতে কী আছে? এরজন্য এতো ভাবার কী আছে?”
নিজের মাথায় নিজেই হালকা চাটি মেরে বক্স খুলতে শুরু করে দিলাম। বক্সটা খুলে আমি তো ৪২০ ভোল্টের শক খেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাসই করাতে পারছি না। অবাক-খুশি হয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলাম,

-“হায় আল্লাহ! এ-তো দেখছি সেই জুতো জোড়া যেগুলো টাকার জন্য কিনতে পারি নি। আর উনার কাছে টাকা থাকা স্বত্বেও উনি কিনে দেন নি। হুহ তাহলে আজকে কে দিলো?”
খুশিতে এবার চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম,

-“ইয়েস, জেঠীমা দিয়েছে।”
জুতোজোড়া হাতে দিলাম দৌড় জেঠীমাকে খুঁজতে। আমার ভাগ্য ভালো বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে হলো না। রান্নাঘরেই পেয়ে গেলাম জেঠীমাকে। খানিকটা দৌড়েছি বলে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,

-“জেঠীমা, তোমাকে এত্তগুলা ভালোবাসা।”
জেঠীমা, ডালের হাড়িতে লবণ দিচ্ছিলো সেটা সম্পূর্ণ করে আমার দিকে ফিরে তাকালো। হাসিমাখা মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেন রে মা? আজকে হঠাৎ এত এত ভালোবাসা আমায় দিয়ে দিচ্ছিস যে বরং।”


পর্ব-৩৪

হাতে থাকা জুতোজোড়া দেখিয়ে বললাম,
-“এই যে, আমার পছন্দের জুতোজোড়া কিনে দিয়েছো বলে। আমি খুব খুব খুব খুশি হয়েছি জেঠীমা, খুব খুশি।”
আমার খুশি দেখে জেঠীমা হাসতে হাসতে বললো,

-“আমিও তোর খুশি দেখে অনেক খুশি হয়েছি রে মা। কিন্তু জুতো তো আমি কিনে দেই নি।”
বিস্মিত হয়ে,
-“তাহলে?”
-“নীল কিনে দিয়েছে?”
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“নীল ভাইয়া!”

-“হ্যাঁ রে পাগলী, তোর নীল ভাইয়া তোকে কিনে দিয়েছে। যা এবার নীলের কাছে ধন্যবাদ দিতে তারপর নাস্তা করতে আয়।”
সকাল সকাল আমার সাথে কী হচ্ছে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। একে তো জুতো পেয়ে শক খেলাম এখন তো নীল ভাইয়ার নাম শুনে মনে হচ্ছে এবার কোমায় চলে যাবো।

-“যেই উনি জুতোর জন্য সেদিন রাজি হয় নি, সেই উনি কিনা নিজের টাকায় জিতো কিনে দিয়েছেন। ভাবা যায়?”
এসব ভাবতে ভাবতেই জেঠীমার জবাবে কেবল ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। ভাইয়ার রুমে যাবার জন্য হাঁটছি কিন্তু উনি কিনে দিয়েছেন বিষয়টা বিশ্বাস করতে এতোটাই কষ্ট হচ্ছে যে, পা দু’খানাও চলছে না একবিন্দু।

পা টিপে টিপে ভাইয়ার রুমে এসে দেখি ভাইয়া সাজগোছ করছেন আই মিন কোথাও যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন। ভাইয়ার ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে হয়ত সেখানে যাবেন বলেই তৈরি হচ্ছেন।
আমি মাত্রাতিরিক্ত অবাকে স্তব্ধ হয়ে আছি ভিতরে ভিতরে। কিন্তু আমার স্তব্ধতা কেটে গেল নীল নামক মানুষটাকে দেখে। নীল রঙের টিশার্টের উপর ব্ল্যাক জ্যাকেটটা পড়েছেন, যেটা আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন রাতে বাসায় ফিরবার পথে। পারফিউমে সারা রুম ভরিয়ে তুলে এখন আয়নাতে স্লিকি চুল ঠিক করতে ব্যস্ত উনি।

আমার গলা কে যেন চেপে ধরেছে। কিছু বলতে চাচ্ছি কিন্তু কেন যেন মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছি না। আমি এসেও ভাইয়ার দিকেই তাকিয়ে আছি। ভাইয়া হয়ত বুঝতে পেরেছেন রুমে কেউ এসেছে। তাই আয়না থেকে চোখ সরিয়ে দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে। চোখাচোখি হতেই আমি আরও চমকে গেলাম উনাকে দেখে। কালো ঘন পাপড়ির চোখজোড়া হঠাৎ আমার চোখে ডুবিয়ে দিতেই মনটা আমার এলোমেলো হয়ে গেল।

কপাল দখল করে থাকা চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর ড্রেসআপ উনাকে এতোটা ড্যাশিং লাগছে, যেকোনো মেয়ে একশো বার করে মরতে রাজি হয়ে যাবে। আমার চোখজোড়া উনি এমন ভাবে আঁটকে রেখেছেন যে, আমার হাশপাশ লাগলেও আমি চোখ সরাতে পারছি না। কয়েক সেকেন্ড নিরবতাকে আঁকড়ে চললো আমাদের দৃষ্টি বিনিময়। নিরবতা ভাঙতে নরম সুরে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু বলবি কি?”

প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
-“হুম।”
বা’হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী বলবি বল? যদি দেখা শেষ হয়।”
অকপটে জিজ্ঞেস করলাম,

-“কী দেখা শেষ হলে ভাইয়া?”
বিছানায় বসে জুতো পড়তে শুরু করলেন। জুতো পড়তে পড়তে বললেন,
-“ইদানীং যে শকুনি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকিস সেটার কথা বলছি সে যা-ই হোক, তা কী বলতে এসেছিস সেটা আগে বল।”
-“আশ্চর্য! আপনাকে ড্যাশিং লাগলে আমি কী করবো? নিজে একটু কম সাজগোজ করলেই তো পারেন। আর আমার চোখ আপনার মতোই অসহ্য। এতো বারণ করি তবুও আপনার দিকে তাকিয়ে থাকে বেহায়ার মতোন।”

এই কথাগুলো উনাকে শুনাতে পারলে মনটা বেশ শান্তি পেত। কিন্তু মনকে শান্ত করতে গেলে উনি আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠে আমার বারোটা বাজাবেন। তাই যথেষ্ট ভদ্র মেয়ের মতোন জবাব দিলাম,
-“জুতোগুলো আমার অনেক পছন্দ হয়েছে আর আপনি কিনে দিয়েছেন। তাই শুকরিয়া জানাতে এলাম।”
-“ও আচ্ছা ঠিক আছে। যা এবার।”

ভাইয়ার জুতো পড়া শেষ তাই উনি দাঁড়িয়ে গেলেন। আমাকে যেতে বলায় আমি পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করবো বলে পা বাড়ালাম। কিন্তু পিছন থেকে ভাইয়া ডেকে উঠলেন,
-“পেত্নী, শোন।”
উনার দিকে ঘুরে খানিকটা এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“জুতো কি পড়ে দেখেছিস?”
ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম,

-“উহুম।”
-“ঠিক আছে। এখানটায় বস তারপর পড়ে দেখ ঠিক আছে কী না? গোলমেলে লাগলে বদল করে নিয়ে আসতে হবে।”
‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নেড়ে বিছানায় বসে পড়লাম। একটা জুতো হাতে নিয়ে পড়বো বলে ফিতা খুলতে লাগলাম কিন্তু খানিকটা শক্ত আর অজানা ভয়ে আমার হাত কাঁপছে বলে ফিতা খুলতে পারছি না। আমার এমন অবস্থা দেখে ভাইয়া বললেন,

-“তুই কি সত্যিই ভার্সিটিতে পড়িস? আমার তো মনে হয় না। জুতোর ফিতাটা পর্যন্ত খুলতে পারছি না। দেয় আমায় আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”
-“না না, আ আমি প পড়তে পারবো।”
খুব বেশিই ভয় লাগছে বলে কথাও আঁটকে আসছে আমার। আমার বারণ ভাইয়া শুনলেন না। হাত থেকে জুতোটা নিয়ে হাঁটু গেঁড়ে মাটিতে বসে বলতে লাগলাম,

-“সবসময় এতো বেশি কথা কেন বলিস? যেই কম কথাটা শুনতে চাই সেটা তো জীবনেও বলিস না আর বলবি না দেখি পা বাড়া সামনে।”
মনের মাঝে একরাশ ভয় আর অস্বস্তি নিয়ে, পা বাড়িয়ে দিয়ে চুপটি করে বসে আছি, অন্য দিকে মুখ করে। ভাইয়া আর কোনো কথা না বলে একে একে দুই পায়ে জুতো পড়িয়ে দিয়ে বললেন,

-“পায়ে তো ঠিক মতোই ফিট হয়েছে জুতো তবুও তুই একটু হেঁটে দেখ ঠিকঠাক আছে কি না?”
এই বলে ভাইয়া দাঁড়িয়ে গেলেন। আমিও দাঁড়ালাম হেঁটে দেখবো বলে কিন্তু হঠাৎ-ই ভাবনায় বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপটি করে। আমার মাঝে নড়নচড়ন না দেখতে পেয়ে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু কি হয়েছে তোর?”

কোনো কিছু না ভেবেই ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে বসলাম,
-“আপনি আমার জন্য এতোগুলো টাকা কেন খরচ করলেন ভাইয়া? জুতোগুলো আমার পছন্দ হলেও এতো দামী জুতো পড়ার জন্য শখ বা কষ্ট কোনোটাই নেই আমার।”

অকপটে বলা আমার কথাগুলো শুনে ভাইয়া হেসে উঠলেন। ডান হাত কপালে আর বাম হাত নিজের কোমড়ে রেখে হাসছেন আর এদিক সেদিক নজর দিচ্ছেন। উনার এমন প্রাণবন্ত হাসি এই প্রথম দেখছি আমি। আজকে আবার নতুন এক রূপ দেখছি মানুষটার। আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনি হাসি মাখা মুখেই বললেন,
-“বছরের প্রথমদিন তাই উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি। এটা আমি মোটেও তোর জন্যে কিনে আনি নি।”
চমকিত নয়নে,

-“তাহলে?”
-“এই বাড়িতে একটা ২২ বছরের পেত্নী আছে। বয়সে বড় হলেও মগজে আস্ত একটা নবজাতক। সেই পেত্নী নামক শাঁকচুন্নিটা কয়েকদিন পর কক্সবাজারে যাবে তার জন্যই কিনে এনেছি।”
একটু বিরতিতে,

-“জুতো কিনে দেই নি বলে তো সেদিন গাড়ির সাথে ধাক্কা খেতে নিয়েছিল। এতোকিছু দেখলে তো একটু মায়া হবেই। তাই কিনে এনেছি।”
উনার মুখে নিজের নানারূপ প্রশংসা শুনে আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে, উনি আমাকেই এসব বলছেন। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলতে লাগলাম,

-“জুতো কিনে দিয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? আর কী বললো? আমি নবজাতক? হনুমানের নাতি, আপনি নবজাতক আপনার ঐ হবু বউ নবজাতক। হুহ।”

উনার এসব কথায় বড্ড অভিমানের সৃষ্টি হচ্ছে আমার মনে। তাই মেঝেতে দৃষ্টি দিয়ে অভিমানী সুরে বললাম,
-“ওহ।”
হঠাৎ নরম কন্ঠে বলতে লাগলেন,

-“তোর মুখ ভার কারোর হৃদয় ভার করে দেয় অথচ সেটা বুঝার সাধ্যও তোর নেই।”
কথাগুলো শুনে বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই উনি বললেন,
-“নাস্তা শেষ করে নিস।”

নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করলাম,
-“আপনি খেয়েছেন?”
একগাল হেসে,

-“হুম আর দুপুরে আমার আসতে দেরি হবে তুই “
উনাকে বলতে না দিয়েই আমি বললাম,
-“আমি অপেক্ষা করতে পারবো। সমস্যা নেই।”
মায়া জড়ানো কন্ঠে,

-“সবসময় পারবি তো?”
-“হুম।”
হঠাৎ-ই অন্য প্রসঙ্গ টেনে বললেন,
-“তুই কি কখনও বড় হবি না?”
-“মানে?”

খানিকটা তাড়া দিয়ে বললেন,
-“আমি গেলাম মৃন্ময় আবার অপেক্ষা করছে আমার জন্য। তুই নাস্তা করে নিস।”
বলেই বিছানা থেকে ফোন আর টেবিলের উপর থেকে বাইকের চাবিটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন ভাইয়া। আমি উনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম,

-“একটা মানুষ সর্বদা আমার মাঝে রহস্যের সৃষ্টি করতে কেন প্রস্তুত থাকে? এতো রূপই বা কেন দেখি উনার মাঝে? উনি কি পারেন না যেকোনো একটা রূপে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে? উনার এতো রূপ দেখলে সত্যিই মনে হয়, মানুষটা একজন কিন্তু সে যে বহুরূপে ভিন্নজন।”


পর্ব-৩৫

“খেয়ালি স্বপ্নে বিভোর মনে,
এসে দাঁড়াবে কি হৃদয়ের কোণে?
বলো রাখবে অনুভবে,
ভালোবেসে কি আমার হবে?”

শখের ডায়েরিতে, কালো কালিতে লিখে ফেললাম গোটা চারেক লাইন। নিচে আবার নিজের নামটাও লিখে দিলাম,
“কথা চৌধুরী”
দুই হাতে ডায়েরিটা চোখের সামনে সোজা করে ধরে হালকা হেসে উঠলাম। কয়েক সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করে আপনমনে বিড়বিড় করে বললাম,
-“বাহ! আমি তো দেখছি কবি সাহিত্যিক হয়ে গিয়েছি। হুটহাট কবিতাও লিখে ফেলতে পারছি যে। মনে হয় ভবিষ্যতে আমার নামের আগেও লেখিকা পদবী বসবে। তখন সবাই হয়ত আমাকে ডাকবে ‘লেখিকা কথা চৌধুরী’।”

বেশ রাজকীয় ভাব নিয়ে কথাগুলো বলতে বলতেই ফোনের টোন কানে এলো। আর মুহূর্তেই আমার ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ডায়েরিটা রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি, সুমাইয়ার কল। স্ক্রিনে ভেসে উঠা ওর নামের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলাম,
-“এই ডাকিনীর জন্য আমার কপালে মনে হয় না লেখিকা পদবী জুটবে। দেখা যাবে, কেউ পদবীটা দিতে নিলেই কল করে বসবে।”
ফোন রিসিভ করে তিক্ত মেজাজে বললাম,

-“হ্যালো।”
-“মেজাজ চওড়া হয়ে আছে কেন তোর?”
রাগ লাগলেও সবসময় রাগ দেখানো উচিত নয়। তাই বেশ নরম সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
-“অসময়ে কল দিয়েছিস কেন সেটা আগে বল।”

-“কেন? আপনি বুঝেন না?”
-“নাহ বুঝি না।”
-“তা কেন বুঝবেন? সে যা-ই হোক, আজকে ভার্সিটিতে এত্ত সুন্দর অনুষ্ঠান গেল, সবাই শাড়ি টাড়ি পড়ে কত সুন্দর করে সাজগোজ করে এসেছে আর তুই?”
-“আমি কী?”

-“আজকে ভার্সিটিতে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে তোর বাসায়ও গিয়েছিলাম কালকে। কিন্তু তুই টানতে টানতে আমায় ছাদে নিয়ে গেলি তোর প্রেম আলাপন শোনাতে আহা! সুন্দরী ললনা, ভালোবাসি বলো না।”
সুমাইয়ার এমন আজগুবি কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললাম,

-“চুপ একদম চুপ। কীসের প্রেম আলাপন আর কীসের ললনা? হ্যাঁ? তোকে আমি “
কথার মাঝে হঠাৎ নীল ভাইয়ার ডাক শুনতে পেলাম,
-“পেত্নী, পেত্নী?”

ফোন কান থেকে খানিকটা দূরে সরিয়ে চেঁচিয়ে ভাইয়াকে বললাম,
-“জ্বী ভাইয়া।”
-“বইপত্র নিয়ে আমার রুমে আয়।”
-“ঠিক আছে। আসছি।”

ভাইয়াকে জবাব দিয়ে আবার সুমাইয়ার সাথে কথা বলতে লাগলাম,
-“শোন, আমি রাখছি এবার।”
তাচ্ছিল্যের সুরে,

-“হুম গো ললনা, যান আপনার উনার কাছে যে পেত্নী বলে হয়রান হয়ে ডাকছে আহা! সুন্দরী ললনা, ভালোবাসি বলো না।”
দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
-“ডাকিনী, দাঁড়া তুই। আমি কালকে ভার্সিটিতে যাই তারপর তোর ললনাকে ছলনা বানিয়ে ছাড়বো। ফোন রাখ।”

সুমাইয়ার কল কাটার অপেক্ষা না করে আমিই কল কেটে দিলাম। মনে মনে ওর উপর হাজারও গালি বর্ষণ করতে করতে বইপত্র নিতে লাগলাম।
পা টিপে টিপে ভাইয়ার রুমে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম উনাকে। চেয়ারে বসে ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছেন। আমাকে দেখেই হাতে ইশারা করে চেয়ারে বসতে বললেন। আমিও চেয়ার টেনে বসে পড়লাম চুপটি করে। ভাইয়া ফোনে বলছেন,

-“প্রবলেম তো হবেই। প্রবলেম হবে সেটা ভেবে কি চুপ করে থাকবো? দেখ মৃন্ময়, তুই দিহানকে বুঝা। আমাকে দিয়ে আর সম্ভব হচ্ছে না। আল্লাহ তায়ালা হয়ত আমাকে, কাউকে বুঝানোর ক্ষমতা কম দিয়েছেন। তাই তো এতগুলো বছরেও তাকে বুঝাতে পারলাম না আমি তাকে কতটা “
হঠাৎ ভাইয়া চুপ করে গেলেন তারপর আবার বলতে লাগলেন,

-“দেখি চেষ্টা করে হয়ত একদিন বুঝতে পারবে আমাকে। কিন্তু ভয় হয় যদি সে বুঝতে বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে যায়।”
ও পাশের মানুষের কথাগুলো শুনতে পেলাম না। ভাইয়া হতাশ গলায় বললেন,

-“কষ্ট তো তখন হয়, যখন অনুভূতিগুলো চেপে নিজেকে নাটকের জন্য তৈরি করে, মনের মানুষের কাছে নাটক করতে হয়। কারণ নাটক না করলে তো সে জেনে যাবে আর জেনে গেলে যদি আবদার নাকচ করে দেয়? এর চেয়ে নাটকই ভালো।”

হঠাৎ কথা বলতে বলতে আমার দিকে তাকালেন। আমিও উনার দিকেই তাকিয়ে রইলাম। চোখাচোখি হতেই উনি মৃন্ময় ভাইয়াকে বললেন,
-“আমি না হয় নাটকের ছলেই বলবো, আমি তোমায় ভালোবাসি।”

‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই তিনটা শব্দ বলে আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন যেন আমাকেই বলেছেন। উনার চোখে আমার চোখ দু’টো আঁটকে গেল। মনে হচ্ছে উনার চোখ দিয়ে উনি আমার চোখ দুটো আঁটকে রেখেছেন।

তাই তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও উনার চোখে চোখ ডুবিয়ে দিয়েছি। হঠাৎ ভাইয়া নিজে থেকেই চোখ সরিয়ে নিলেন। কিছু সময় উনাকে দেখে আমিও চোখ সরিয়ে নিলাম। আচমকা আমার হৃৎস্পন্দন তড়িৎ গতিতে বাড়তে লাগলো। লজ্জায় রাঙা হতে লাগলো মুখ খানা। বেশ অস্বস্তি লাগছে এখানে বসে থাকতে।

-“এখন রাখছি রে। তুই দিহানের সাথে কথা বলে আমাকে জানাস বাই।”
কথা শেষ করে কল কেটে দিয়ে ফোন পাশেই রেখে দিলেন। দুই হাতে চুলগুলো ঠিক করতে করতে চেয়ারে হেলান দিলেন। তারপর স্থির দৃষ্টিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী করছিলি এতক্ষণ?”

শুকনো একটা ঢোক গিলে জবাব দিলাম,
-“সুমাইয়া কল করেছিল। ওর সাথেই কথা বলছিলাম।”
-“পড়া সব শেষ করেছিস?”
-“হুম।”

-“আজকে তো পড়ানোর কথা না তাও পড়তে বলেছি যে কারণ জানতে চাইলি না কেন?”
উনার প্রশ্নের জবাব দিবো বলে উত্তর তৈরি করছি কিন্তু তার আগেই ভাইয়া বললেন,
-“এত মান্য করিস কেন আমার কথা? কখনও কখনও অমান্য করতে পারিস না?”
আমি বিস্ফারিত চোখে উনার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম,

-“উনার মাথার তার কি ছিঁড়ে গেছে? কী সব বলছেন উনি?”
ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“কিছু বলছিস না যে?”
-“কী বলবো ভাইয়া?”

সোজা হয়ে বসে আমার বই খাতা টেনে দেখতে শুরু করলেন। মিনিট দশেক পর বললেন,
-“আজকে পড়াবো না শুধু হোমওয়ার্ক দিয়ে দিলাম।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে কিছু গোলাপফুল আর চকলেট নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি চমকিত নয়নে উনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,

-“নেয়, এগুলো তোর জন্য।”
আজকে যেহেতু পহেলা বৈশাখ তাই আমি ভাবলাম, এসব হয়ত উনাকে কেউ দিয়েছেন। মনে ভাবনার সত্যতা যাচাই করতে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“আপনি রাখবেন না?”

একগাল হেসে উনি বললেন,
-“তোর জন্য আনা জিনিস আমি কেন রাখবো?”
ফুল আর চকলেট হাতে নিতে নিতে জানতে চাইলাম,
-“আমার জন্য?”

ভাইয়া পুনরায় চেয়ারে বসে বললেন,
-“হ্যাঁ, তোর জন্য।”
-“শুকরিয়া ভাইয়া।”
বলেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে দেখতে লাগলাম লাল টকটকে গোলাপ। নরম সুরে ভাইয়া বললেন,
-“সরি।”

আমি ভাবলাম, ভাইয়া হয়ত আমার কথা বুঝতে পারেন নি। তাই আমি আবার বললাম,
-“বলেছি, শুকরিয়া ভাইয়া। আমি অনেক খুশি হয়েছি।”
-“কিন্তু আমি তো তোকে, সরি বলছি পেত্নী।”
-“আমাকে? কিন্তু কেন ভাইয়া?”

-“কালকে যে তোর চোখ থেকে পানি ঝরিয়েছি সেজন্য।”
আমি চঞ্চল চোখে আমতা আমতা করে বলতে লাগলাম,
-“কীসের পানি? আর আপনি তো কালকে কিছুই করেন নি ভাইয়া। শুধু শুধু এসব “
আমার কথার মাঝে ভাইয়া বলে উঠলেন,

-“এত মিষ্টি করে কেন মিথ্যা কথা বলছিস? তুই না বললেও আমি জানি, তোকে বকা দিলে তুই কতটা কান্না করিস? পিচ্চি তো তাই কিন্তু পিচ্চিটাকে কাঁদিয়ে আমি লজ্জিত, সত্যিই লজ্জিত। সেজন্যই সরি বলছি।”
ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,

-“এসব কিছু নয় ভাইয়া। যে স্নেহ করতে জানে সে শাসন করতেও জানে। আপনি আমার জন্য যা করছেন তার ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করতে পারব না। তাই এসব বলে আমাকে লজ্জা দিবেন না ভাইয়া। আপনার শাসন আমার কাছে আপনার দোয়া মনে হয়।”
অকপটে বলে ফেললাম অনেক কথা ভাইয়াকে আর উনিও মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কয়েক সেকেন্ড পর মাথা নুইয়ে ভাইয়া বলতে লাগলেন,
-“অনেক কথা বলতে পারিস দেখছি। ভালো লাগলো শুনে।”

আমার দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে,
-“তোকে কখনও সরি বলা হয় নি। আজকে বলে দিলাম। পারলে ক্ষমা করে দিস। আর ফুলগুলো তোর জন্যই এনেছি।”
একটু বিরতিতে,

-“উম, পেত্নী নামক শাঁকচুন্নিরা গোলাপফুল পছন্দ করে। বিষয়টা অদ্ভুত না?”
তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বলেই খানিকটা হেসে উঠলেন আর আমার রাগে শরীর রিহ রিহ করে উঠলো। মনে মনে বলতে লাগলাম,
-“এই হনুমানের নাতি কি জীবনেও ঠিক হবে না? সরি বলে এখন আবার আমাকে উল্টো পাল্টা বলছে। আল্লাহ, তুমি এটাকে কী দিয়ে বানিয়েছো? উনি কি জীবনেও আমাকে আমার নামে ডাকবেন না?”


পর্ব-৩৬

দুপুরের শেষ ভাগে এসে আকাশটাও যেন বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ক্লান্ত আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে আমার ক্লান্ত মনে কত-শত ভাবনা উঁকি দিচ্ছে নীল ভাইয়াকে নিয়ে।

ভার্সিটির শুনশান গ্যালারির এক কোণে অহেতুক বসে আছি হাতে ফোন ধরে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, আমি ভাইয়ার ফেইসবুক আইডিতে সংযুক্ত নেই। উনার প্রয়োজনে উনি কল করেন অথবা টেক্সট করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় দু’জন দু’জনের থেকে আলাদাই আছি। তবে আমি মাঝে মাঝে উনার আইডিতে উঁকি মারি। আগে অভ্যাসটা একদমই ছিল না আমার। ইদানীং অভ্যাসটা খুব করে পেয়ে বসেছে আমাকে।

কালো রঙের শার্ট আর প্যান্ট পড়ে, চেয়ারে বসে আছেন নবাবি ভঙ্গিতে পা তুলে। কপাল দখল করে থাকা স্লিকি চুল আর চোখে থাকা কালো সানগ্লাসে উনাকে মনে হচ্ছে কোনো এক অজানা রাজ্যের রাজপুত্র। এমন একটা ছবি ফেইসবুকে প্রোফাইল পিকচার হিসেবে দিয়েছেন উনি হয়ত মেয়েদের পাগল করতে। হুহ। না হলে কি কেউ এমন পিকচার প্রোফাইলে দেয়? সাথে আবার ক্যাপশনও দিয়েছেন,

“কালো রঙের মায়ায় নয়, জাদুতে পড়ে গিয়েছি। তাই তো অপছন্দের রঙকেও এতোটা ভালোবেসে ফেলেছি।”
উনার প্রোফাইল পিকচারে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আনমনে বলতে লাগলাম,
-“একবিংশ শতাব্দীর মেয়ে আমি। আপনি কী করে আমাকে এতোটা বোকা ভাবলেন? কী করে ভাবলেন, আপনার মনের কথাগুলো আমি বুঝতে পারব না? কী করে ভাবলেন, আপনার হৃদয়ের স্পন্দন আমি শুনতে পারব না? হ্যাঁ, আগে বুঝতাম না, আগে শুনতামও না।

সত্যি বলতে আগে ভাবতামও না। কিন্তু যেই দিন সুমাইয়া বললো, হয়ত আপনি আমাকে পছন্দ করেন, ঠিক সেই দিন থেকেই আমি আপনার উপর নজর রাখছি। দেখছি, সত্যিই আপনি আমাকে পছন্দ করেন কি না? জানেন, উত্তর পেয়ে গিয়েছি আমি। আপনি শুধু আমাকে পছন্দই করেন না বরং ভালোও বাসেন। কালকে হয়ত নাটকের ছলে বলেছেন ভালোবাসার কথা। কিন্তু আপনার চোখের তারায় কোনো নাটক ছিল না।

ছিল শুধু আমার প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু মিস্টার নীল, আপনি বড্ড দেরি করে ফেলেছেন। আপনার আগে আমি অন্য কাউকে আমার মনে ঠাঁই দিয়ে দিয়েছি। আমি ভালোবাসি সযত্নে রাখা বেনামি চিঠিগুলোকে। আমি ভালোবাসি কেবল বেনামি চিঠির নামহীনা মানুষটাকে। তাই আপনাকে আমি “

এই বলে হঠাৎ থেমে গেলাম। চোখ জোড়া বুঁজে কপালে হাত দিয়ে, আচমকা অগোছালো হওয়া মন আমার কাছে প্রশ্ন রাখলো,
-“কী হলো কথামনি? কথাটা কেন শেষ করতে পারলি না? খুব তো অকপটে বলে দিলি, তুই বেনামি চিঠির মালিককে ভালোবাসিস। তাহলে এটা কেন বলতে পারলি না, তুই নীলকে ভালোবাসতে পারবি না? সামান্য চিঠির উপর ভিত্তি করে নিজের মনটা তাকে দিয়ে দিলি। তাহলে যে তোকে বারবার ইশারায় ‘ভালোবাসি’ বলে বেড়ায় তাকে কেন ভালোবাসতে পারবি না?”

চোখ খুলে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে এবার মনকে জবাব দিতে বললাম,
-“এটা আমার মন, কোনো কক্ষ নয় যে যাকে তাকে ঢুকতে দিবো। আর আমার জীবনে ভালোবাসার কথা আগে এসেছে বেনামি চিঠির মালিক থেকে। তাই হনুমানের নাতির আবেগ মাখা কথায় আমি আমার ভালোবাসাকে অসম্মান করতে পারবো। আমার ভালোবাসা একদিনের নয়, ছয় ছয়টা বছরের অপেক্ষায়, তিল তিল করে এই হৃদয়ে ভালোবাসা জমেছে আর সেটা কেবলই বেনামি চিঠির মালিকের জন্য।”

-“তোর সিদ্ধান্ত তো ভুলও হতে পারে।”
-“অচেনা অজানা হলেও উনার প্রতি আমার ভালোবাসাটা মিথ্যে নয়। আমার সত্যিকারের ভালোবাসাটা যদি আমার ভুল সিদ্ধান্ত হয় তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ ভালোবাসা কোনো সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে হয় না, হয় মনের উপর ভিত্তি করে।”
-“তাহলে নীল?”
-“আমি জানি না।”

-“তুই জানিস আর জেনেও না জানার ভান করছিস।”
মনের সাথে দ্বন্দ্ব করে আর পেরে উঠছি না আমি। হাতের ফোনটা ব্যাগে পুড়ে, ব্যাগ কাঁধে উঠে দাঁড়ালাম। শেষ বিকেলের বাতাস খানিকটা টেনে নিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করে গেয়ে উঠলাম,
“বলো না কেন

ঐ আকাশ নেমে আসে সাগরের বুকে?
বলো না কেন
ঐ ঝরনা নদী খোঁজে কীসেরই সুখে?
সব কথা বলে না হৃদয়
কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।

পৃথিবীর পরে আর কোন পৃথিবী নেই তো
যত বাঁচি রব কাছাকাছি
তুমি আমি দুজনে এই তো
বল না কেন
ঐ শিশির ঝরে পড়ে সবুজ ঘাসে?

বল না কেন
ঐ জলের পাশে শুধু তারা হাসে?
সব কথা বলে না হৃদয়
কিছু কথা বুঝে নিতে হয়
জীবনের পরে যদি কোন জীবন থাকত
সেখানেও প্রিয় মন জেনে নিও

পাশে পাশে তোমাকেই রাখত
বল না কেন
ঐ চোখের পাতা জুড়ে স্বপ্ন হাসে
বল না কেন অন্তর চুপিচুপি ভালবাসে
সব কথা বলে না হৃদয়
কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।”

হঠাৎ পিছন থেকে কারোর কন্ঠে নিজের নামটা শুনতে পেলাম। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি, রাত্রি ছুটে আসছে। আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,
-“তুমি সবসময় এমন ছুটাছুটির মধ্যে থাকো কেন?”
হাঁপাতে হাঁপাতে আমায় জবাব দিলো,

-“আমি কী আর সাধে ছুটাছুটি করি? বাব্বা! তুমি এতো দ্রুত হাঁটতে পারো কী আর বলবো।”
হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
-“তা আমার কাছে কী জন্যে? কিছু বলবে কি?”

-“মৃন্ময় ভাইয়ার কাছে শুনলাম, তোমরা নাকি কক্সবাজার যাচ্ছো?”
-“হ্যাঁ।”
-“কবে নাগাদ যাবে?”
-“এই তো, সামনের সপ্তাহে যাবো।”
-“ওহ আচ্ছা। তা কে কে যাচ্ছে?”
-“আমাদের পরিবারের সবাই আর কুহি আপু, উনার আব্বু আম্মু।”
খুশিতে গদোগদো হয়ে বললো,

-“বাহ! খুব মজা হবে তোমাদের। তা সুমাইয়ার বাগদান অনুষ্ঠানে যাবে না?”
-“অনুষ্ঠান তো পরশুদিন আর আমি না গেলে আমাকে তো বাসা থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে।”
এই বলে দু’জনে একসাথে হেসে উঠলাম। হাসির ফাঁকে, হাত ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম,
-“বড্ড দেরি হয়ে গেছে। বাসায় যেতে হবে। আমি এখন আসি।”

-“ঠিক আছে।”
গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ভার্সিটির মাঠ পেরিয়ে চলে এলাম ভার্সিটির গেটে। গেট দিয়ে বের হয়ে, কাঁধের ব্যাগটা টেনে, সামনে তাকাতেই থমকে গেলাম। একজোড়া চোখের স্থির দৃষ্টিতে মুহূর্তে আমার মনের রাজ্য তুমুল ঝড়ের সৃষ্টি হলো। অনেক কষ্টে নিজের মনকে সামলে মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
-“ভাইয়া, আপনি এখানে?”

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শীতল কন্ঠে জবাব দিলেন,
-“এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম আর মা কল করে বললো, তুই ভার্সিটিতেই আছিস। তাই ভাবলাম, তোকে নিয়েই বাসায় যাই।”
ইতস্তত করে বললাম,

-“কখন এসেছেন? আমাকে কল করলেই তো চলে আসতাম। ক্লাস তো সেই কখন শেষ।”
-“মাঝে মাঝে অপেক্ষাতেও মিষ্টতা আছে।”
উনার কথায় আমি পলকহীন দৃষ্টি দিলাম উনার দিকে। কিন্তু উনি সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বাইকে বসে, বাইক স্টার্ট দিলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-“যাবি না?”
কিঞ্চিৎ ভাবনায় বিভোর ছিলাম কিন্তু ভাইয়ার প্রশ্নে আমার ভাবনার ঘোর কেটে গেল। ভাবনা বাদ দিয়ে বিনা উত্তরেই বাইকে চড়ে বসলাম আমি।
বাইক চলছে সাথে আমার মনে উনাকে নিয়ে ভাবনাও চলছে,
-“প্রায় আধঘন্টা ধরে যার নাম মনে মনে জপেছি, সে-ই আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। উনি কি এমনিতেই এসেছেন নাকি টের পেয়েছে, উনাকে নিয়ে আমার মনে চলা হাজারো ভাবনা?”


পর্ব-৩৭

“অশ্রুতে লেপ্টে ছিল
আমার চোখেরও কাজল।
কারণ যত্ন করে যে,
আমায় আপনি কাঁদিয়ে ছিলেন।

তাহলে সেই অশ্রু মোছার অজুহাতে,
কেন আবার লাল গোলাপ
হাতে ধরিয়ে দিলেন?”

শুকিয়ে গেলে হয়ত সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়, মূল্য কমে যায়। কিন্তু স্মৃতি কখনও শুকায় না, মূল্যহীন হয় না। স্মৃতি তো মন গহীনে জমা থাকে সযত্নে। হয়ত সময়ের স্রোতে পুরনো হয়ে যায় কিন্তু মূল্যহীন হয় না। তবে কখনও কখনও স্মৃতি পুরনো হতে হতে সেটা অমূল্য হয়ে উঠে।

দু’দিন আগের কিঞ্চিৎ নেতিয়ে পড়া, শুকনো গোলাপের দিকে তাকাতেই মনে পড়ে গেল পরশু রাতের কথা, মনে পড়ে গেল নাটকের ছলে আমায় বলা উনার ভালোবাসার কথা। মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই চোখজোড়া, যেই চোখের তারা শুধু ঝলমলে উঠে একজনের জন্য। সেই একজনটা হয়ত আমি নিজেই।

ইদানীং নিজের মাঝে দু’জনকে অনুভব করছি। মনে হচ্ছে আমি একজন নই আমার মাঝে আরও একজন বিদ্যমান আছে। সেই আরেকজন আমার সাথে প্রায়শই কথা বলে, নীল ভাইয়ার কথা বলে। কিন্তু আমি শুনতে চাই না উনাী কথা তবুও বাধ্য করে আমায় শুনতে। আমি ভাবতে চাই না উনাকে নিয়ে কিন্তু আমাকে বাধ্য করা হয় উনাকে নিয়ে ভাবতে।

আমি উনাকে ভালোবাসতে চাই না কিন্তু আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে উনাকে
-“হে আল্লাহ! আপনি আমার সাথে কী করতে চাইছেন? আমার জীবনে বেনামি চিঠির আগমন ঘটিয়ে কেন আবার নীল ভাইয়ার দিকে মনটাকে টানছেন? সবাই বলে আমি না-কি সহজে কিছু বুঝতে পারি না।

তাহলে কী করে আমি নীল ভাইয়ার ভালোবাসা বুঝতে পারলাম? না-কি উনি আমায় ভালোবাসেন না? আমি অহেতুকই মনে করছি এসব। কিন্তু ইদানীং বলা উনার কথাগুলোতে তো আমি স্পষ্ট আমার প্রতি উনার ভালোবাসার ইঙ্গিত পাচ্ছি আর আমার মনও বলছে উনি আমায় “
হঠাৎ ফোনের টোন কানে আসতেই ভাবনায় ছেদ পড়লো আমার। টেবিলে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি সুমাইয়ার কল। খানিকটা রাগ অনুভব করলাম নামটা দেখে। তাই রাগী ভাব নিয়েই কল রিসিভ করে জিজ্ঞেস করলাম,

-“এতোবার করে কল করতে হয়? হ্যাঁ? আর একবার যদি কল করতে দেখি না, পরে যাওয়াই ক্যানসেল করে দিবো।”
কাঁদো কাঁদো গলায়,
-“রাগ করছিস কেন টিয়াপাখি?”

-“নিকুচি করেছে তোর টিয়াপাখি।”
-“তোর দেরি হতে পারে বলেই না আমি এতোবার কল করে তাড়া দিচ্ছি। তাই বলে তুই আমায় “
এমনিতেই বেনামি চিঠি আর নীল ভাইয়ার ভাবনায় আমার রাতের ঘুম উড়ে গেছে তারউপর সকাল থেকে সুমাইয়ার এসব কান্ড আমি আর টলারেট করতে পারছি না। তাই ওকে বলতে না দিয়ে আমি বললাম,

-“এতো তাড়া কীসের তোর? অনুষ্ঠান কি শেষ হয়ে যাচ্ছে? সবে তো সকাল দশটা বাজে। আর আমি তো বলেছি এগারোটা মধ্যেই চলে আসবো। এখন শান্তি মতো আমাকে তৈরি হতে দেয় না হলে সত্যি সত্যি হিরো আলমের সাথে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করব।”
খানিকটা রাগ নিয়ে,

-“কিছু হলেই তোর ক্রাশ হিরো আলমকে কেন টানিস? হবু জামাই নীলকে টানতে পারিস না?”
সুমাইয়ার কথা শুনে আমি থ মেরে গেলাম। রাগটা যদি মাপা যেত তাহলে এই মুহূর্তে আমার রাগের ওজন বিশ কেজি হতো। চোখ মুখ খিঁচিয়ে কোনোরকমে বললাম,
-“তোর অনুষ্ঠানে আমি যাচ্ছি না আর এটাই আমার শেষ কথা। বায়।”

বলেই কল কেটে ফোন অফ করে দিলাম। অতিরিক্ত রাগের দরুন চোখে জল টলমল করছে। গলাটাও যেন কেমন ধরে আসছে। পানি পেলে হয়ত গলাটা স্বস্তি বোধ করবে। এই ভেবে কিচেনে আসতেই মা বলে উঠলো,
-“হয়েছে তোর?”

মুখের রাগী ভাবটা ধরে রেখেই বললাম,
-“না, হয় নি।”
-“তাড়াতাড়ি কর। নীল বসে আছে তোর জন্য।”
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

-“নীল ভাইয়া মানে? আমার তো বাবার সাথে যাওয়ার কথা ছিল।”
-“তোর বাবাকে কোনো দিন কোথাও নিয়ে যেতে পেরেছিস?”
-“তাই বলে “
আমার কথার মাঝেই মা তাড়া দিয়ে বলে উঠলো,
-“কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়। নীল কিন্তু বসে আছে।”
মুখখানা মলিন করে বিনা উত্তরেই একগ্লাস পানি হাতে রুমে চলে এলাম। এক দুই ঢোক পানি পান করে দাঁড়িয়ে পড়লাম আয়নার সামনে। রাগে এখনও আমি ফুঁস ফুৃঁস করছি আর নিজেকে সাজাতে ব্যস্ত আছি।

অনুষ্ঠানে যাবো বলে আজকে আকাশী রঙের লেহেঙ্গা পড়েছি সাথে একই রঙের হিজাব। বেনামি চিঠির মালিকের দেওয়া সেই নীল রঙের চুড়িতে দুই হাত ভরিয়েছি। হিজাবটা ঠিক করার ছলে রিনিঝিনি করে উঠছে চুড়ি। এমন শব্দে মন ভরে উঠার কথা কিন্তু আমি মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে অনর্গল বলে চলেছি,

-“ধ্যাত! যার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি, সে আমার সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। যত বেশি দূরে ঠেলে দিতে চাইছি, তত বেশি আমাকে কাছে টানছে।”
হিজাব ঠিক করা শেষ। এবার আয়নার দিকে তাকিয়ে দুইহাত নাড়িয়ে জোরে বলে উঠলাম,
-“আমি পাগল হয়ে যাবো আল্লাহ, পাগল হয়ে যাবো।”

পায়ে ব্ল্যাক জুতো পড়ে আর ছোট একটা সোল্ডার ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলাম। ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াতেই দেখি নীল ভাইয়া জেঠুর সাথে কথা বলছেন। আমাকে দেখতেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জেঠুকে বললেন,
-“আচ্ছা বাবা, আমি না হয় বিষয়টা দেখবো। তুমি এ নিয়ে ভেবো না।”
-“হুম, দেখ কী করতে পারিস?”

আমি এসে জেঠুর পাশে দাঁড়াতে জেঠু হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-“এসে গেছিস মা?”
-“হুম জেঠু।”

-“ঠিক আছে। সাবধানে যাস।”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তে ভাইয়া আমায় বললো,
-“চল।”

ভাইয়ার সাথে একবার চোখাচোখি হতেই মাথা নুইয়ে নিলাম। উনাকে অনুসরণ করে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম।
বাইকে উঠে বাইক স্টাট দিতে দিতে আমার দিকে তাকালেন বাঁকা হাসি দিয়ে। বা’হাতে শার্টের পকেটে থাকা সানগ্লাসটা বের করে পড়ে নিয়ে বললেন,
-“এবার যাওয়া যাক?”

-“হুম।”
পরশু রাতের ঘটনার পর থেকে ভাইয়ার সাথে যতটা সম্ভব কম কথা বলার চেষ্টা করি, যতটা সম্ভব উনার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি। কারণ উনার কাছাকাছি থাকলে, উনার সাথে কথা বললে আমার মনটা নাছোড়বান্দা হয়ে উঠে। মনটা আমার কিন্তু যেন হয়ে আছে উনার গোলাম। তাই তো উনার হুকুম তামিল করতে, আমার মনটা বারবার হয়ে যায় নাছোড়বান্দা এক অচিন পাখি।
“ভালোবাসার ইঙ্গিত যে
দিচ্ছে বারংবার ঐ দু’টো আঁখি।

আঁখির পানে তাকিয়ে থেকে,
আমার মন যে হয়ে যায়
নাছোড়বান্দা এক অচিন পাখি।”


পর্ব-৩৮

সুমাইয়ার বাসার কাছে এসে বাইক থামাতেই আমি নেমে দাঁড়ালাম। ব্যাগটা কাঁধে নিতেই ভাইয়া আমায় বললেন,
-“বাসায় যাওয়ার আগে আমাকে কল করিস। আমি এসে তোকে নিয়ে যাবো।”

-“আমি তো যেতে পারবো ভাইয়া। আপনি শুধু শুধু কেন আবার কষ্ট করতে যাবেন?”
-“কিছু কিছু কষ্টে চোখে অশ্রু নয়, মনে সুখ আসে। আর আমি তো তোকে কোলে করে নিয়ে যাবো না যে, আমার কষ্ট হবে। বাসায় যাবার সময় হলে নিজে একটু কষ্ট করে কল করিস, তাতেই হবে।”
একটু থেমে,

-“এর চেয়ে কি কম সাজা যায়?”
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে,
-“মানে?”
-“আকাশের রঙটা আজ বড্ড চোখে লাগছে।”

-“আমি কিছু বুঝতে পারছি না ভাইয়া।”
একগাল হেসে সোজা হয়ে সামনে তাকিয়ে বললেন,
-“বুঝবি কিন্তু তখন হয়ত বড্ড দেরি হয়ে যেতে পারে।”

বলেই চলে গেলেন একমূহুর্ত্বও দেরি না করে। উনার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে আমি তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলাম,
-“আকাশের রং নয়, আমার পরনের আকাশীরং আপনার চোখে লাগছে। আর মিস্টার নীল, দেরি হবে নয় বরং দেরি হয়ে গেছে। আমার জীবনে আপনার আগমন হতে দেরি হয়ে গেছে। তাই তো আমি আপনাকে “

আবারও বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে গেল কথাটা। যতবার বলতে যাই ততবারই বাঁধা সম্মুখীন হই আর মন গহীনে তুমুল ঝড় উঠে।
-“কেন সম্পূর্ণ করতে পারি না আমি কথাটা? কেন ভাইয়ার কাছাকাছি থাকলে মনের মাঝে সুখ পাখি ডানা মেলে উড়ে? কেন উনার সাথে কথা বলতে বড্ড ভালো লাগে? কিন্তু আমি তো উনার থেকে দূরে দূরে থাকতে চাই।”

ভাবনা বাদ দিয়ে রোদে ঝিলমিল করা আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্যের তেজে তাকাতে পারছি না তবুও কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সুমাইয়ার বাসার দিকে পা বাড়ালাম।
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে কিন্তু আমাদের বিউটি কুইন এখনও সাজগোজ নিয়েই আছে। পার্লার থেকে আপু আনা হয়েছে সুমাইয়াকে সাজানোর জন্য। আপুটা বেশ মনোযোগ দিয়ে সুমাইয়ার মুখে আটা ময়দা আর সুজি মাখাচ্ছে। সুমাইয়ার পাশেই আমি বসে আছি।

পার্লারের আপুর হাত চলছে, সুমাইয়ার চলছে মুখ আর আমার চলছে মন। কারণ সুমাইয়া পকপক আমি চুপটি করে শুনে মনে মনে ওকে গালি উপহার দিয়ে যাচ্ছি।
সুমাইয়ার মেকাপ করা শেষ এখন পার্লারের আপুটা চুল বেঁধে দিচ্ছে আর এই সুযোগে সুমাইয়া আমায় বলছে,
-“তোর মাঝে কি বিন্দু পরিমাণ শখ বলে কিছু নেই? মানে আমি বুঝি না কিছু। আমি তোর একমাত্র বান্ধবী আর আজকে আমার বাগদান অনুষ্ঠান।”

নীরস গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
-“তো?”
-“তো মানে? এমন বিধবা হয়ে এসেছিস কেন? তোর বাসায় কি মেকাপের কিছু নেই?”
হাতে থাকা ফোনটাতে দৃষ্টি দিয়ে বললাম,

-“এমন ছাইপাঁশ আমাদের বাড়িতে কেউ মাখে না। তাই থাকেও না।”
আমার কথা শুনে পার্লারের আপুটা হেসে উঠলো কিন্তু সুমাইয়া কপট রাগ নিয়ে বললো,
-“তোর মতো নিরামিষের বান্ধবী যে কেন হতে গেলাম?”

দায়সারা ভাব নিয়ে বললাম,
-“বেশি বললে কিন্তু বাসায় চলে যাবো।”
-“হ্যাঁ, সেই তখন থেকেই তো বলছেন বাসায় চলে যাবেন, বাসায় চলে যাবেন। তো যা না বাসায় চলে।”
-“সত্যি?”

ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু সুমাইয়া বিনা উত্তরে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। তাই আমিই আবার জিজ্ঞেস করলাম,
-“চুপ করে আছিস কেন? বল, চলে যাবো না-কি?”
এখনও চুপ করে আছে বলে আমি ওকে আরও রাগানোর জন্য দুষ্ট হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“কিরে? নীল ভাইয়াকে বলবো, আমাকে এসে বাসায় নিয়ে যেতে?”

আচমকা আমার দিকে তাকিয়ে একটা বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে বললো,
-“আহারে! ভাইয়াকে না দেখে বুঝি থাকতে পারছিস না। তা ভিডিও কলে কথা বলে নে ভালো লাগবে৷ হুহ।”

বলেই মুখটা এবার পেঁচার মতো করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার যথেষ্ট রাগ লাগলেও পার্লারের ঐ আপুটার জন্য কিছু বলতে পারলাম না। বিষয়টা ধামাচাপা দিতে অন্য প্রসঙ্গ টেনে এনে বললাম,
-“রাত্রি কি আসবে না?”

-“আমার জন্য হলে তো অবশ্যই আসতো না। এখানে তো উনার ডট ডট আছে। তাই না এসে যাবে কোথায়?”
দোটানায় পড়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“ডট ডট আবার কী?”
আঁড়চোখে তাকিয়ে,

-“চিরকাল এমন অবুঝ থাকিস কেন? ডট ডট বলতে তূর্যকে বুঝিয়েছি।”
এবার দোটানা দূর হতেই বললাম,
-“ওহ আচ্ছা আচ্ছা। তা তুই বসে আটা ময়দা গুলতে থাক আমি বাইরে গেলাম।”
অনুনয় করে,

-“বস না আমার কাছে।”
-“আরে আমি আসছি একটু বাইরে থেকে। দেখে আসি বাইরের কী অবস্থা?”
মুখখানা মলিন করে,
-“ঠিক আছে যা।”

খাওয়াদাওয়া এবং অনুষ্ঠান শেষ। এবার বাড়ি ফেরার পালা। অতিথিরা একে একে সবাই চলে গেছে। ইয়াসির ভাইয়াকে তো আজকে সবাই দেখে জাস্ট ফিদা হয়ে গেছে। উনি এমনিতেই হ্যান্ডসাম তারউপর ব্লেজার টেজার পড়ে একেবারে সাউথ ইন্ডিয়ান নায়কদের মতোন ভাবসাব নিয়ে এসেছিলেন।

সুমাইয়া এখন গহনাগাঁটি খুলতে ব্যস্ত। আজকে বেশ গর্জিয়াস লাল রঙের লেহেঙ্গা পড়েছিল ও। আটা ময়দা আর সুজি মাখার পর তো একদম পরীর মতো লাগছিল। এককথায়, আজকে সুমাইয়া এবং ইয়াসির ভাইয়া খুব বেশি সুন্দর লাগছিল। আর আমাকে লাগছে একদম ফকিন্নির মতো। কারণ সাজগোজ বলতে শুধু একটু ভেসলিন দিয়ে ছিলাম। কারণ হনুমানের নাতির আমার সাজে ঘোরতর আপত্তি আছে। আজকে সাজি নি তাও পেনপেন করছিল, সাজলে না জানি কী করত?

সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। বাসায় যাবো সেজন্য মনস্থির করে ফোনটা হাতে নিলাম ভাইয়াকে কল করবো বলে। এক দুইবার কল হতে রিসিভ করে বললেন,
-“হ্যাঁ, বল।”
ঘরে শুধু আমি, রাত্রি আর সুমাইয়া। আমাকে কল করতে দেখে সবাই প্রায় চুপ মেরে বসে আছে। তাই স্তব্ধতা বিরাজ করছে ঘরময়। চারপাশের স্তব্ধতায় ‘হ্যাঁ, বল’ কথাটা কেমন যেন অন্য রকম শোনালো কানে। ফোনে কারোর কন্ঠস্বর হয়ত জাদুতে মাখানো থাকে। আর সেই জাদুই এখন আমাকে ভষ্ম করে ফেলছে। কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

-“অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। আমি বাড়ি যাবো।”
-“ঠিক আছে। তুই ওয়েট কর। আমি এসে কল করলে বাসা থেকে বেরিয়ে আসিস।”
-“হুম।”

কল কেটে দিলাম। লক্ষ্য করলাম হঠাৎ-ই আমার হাত কাঁপছে, গলা ধরে আসছে আর অহেতুক লজ্জায় মুখ রাঙা হচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই ভাইয়ার সামনে দাঁড়াতে, ভাইয়ার সাথে কথা বলতে মাত্রাতিরিক্ত লজ্জা লাগে। এই মূহুর্তে, নিজের অহেতুক লজ্জাটা সুমাইয়া আর রাত্রির থেকে আড়াল করার জন্য বৃথা চেষ্টা করছি। কিন্তু ডাকিনী সুমাইয়া সেটা ঠিক ধরে ফেলেছে তাই তো দুষ্ট হাসি দিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলো,
-“কিরে? ভাইয়ার সাথে কথা বলে এমন হাশপাশ করছিস কেন?”

নিজের লজ্জাটা ডাকতে আর বিষয়টা আড়াল করতে এমনিতেই বানিয়ে একটা জবাব দিলাম,
-“সারাদিন লেহেঙ্গা পড়ে আছি তাই অস্থির লাগছে। এখানে তুই অন্য কারণ কেন খুঁজছিস?”
চুলের ঝট ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

-“বুঝি বুঝি সবই বুঝি। আমায় এতো বকা ভাবিস না।”
-“তাহলে এবার বুঝ নিয়ে বসে জুস বানিয়ে খা আমাকে লেকচার না দিয়ে।”
সুমাইয়া কিছু বলতে যাবে তার আগে রাত্রির কল এলো। মেয়েটা তড়িঘড়ি করে ফোন বের করে রিসিভ করে বললো,
-“হ্যাঁ ভাইয়া বল।”

‘ভাইয়া’ শুনে আন্দাজ করলাম হয়ত মৃন্ময় ভাইয়া কল করেছেন। রাত্রি আবার বললো,
-“ওহ, এসেছি? ঠিক আছে আমি আসছি।”
কল কেটে উঠে দাঁড়িয়ে বেশ তাড়া দিয়ে বললো,

-“ভাইয়া এসেছে। আমি তবে যাই। কালকে ভার্সিটিতে দেখা হবে। বায়।”
আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে রাত্রি চলে গেল। এরপর বেশ কিছুক্ষণ আমি আর সুমাইয়া দুষ্ট মিষ্টি খোশগল্পে মেতে রইলাম। প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর ভাইয়া কল করতেই আমি কল কেটে দিয়ে সুমাইয়াকে বললাম,

-“যাই রে। ভাইয়া এসে গেছেন।”
হঠাৎ কী ভেবে যেন সুমাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুই কি ভাইয়াকে ভালোবাসিস?”

ওর এমন কথা শুনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। জোরপূর্বক একটু হাসবার চেষ্টা করে বললাম,
-“উনি আমাকে পছন্দ করেন– এটা আমি অনুমান করে বলেছি। আমার অনুমান তো ভুলও হতে পারে। যেখানে পছন্দ করেন কি-না সেটা নিয়েই দোটানায় আছি, সেখানে আমি কেন উনাকে ভালোবাসতে যাবো?”

-“কিন্তু “
সুমাইয়াকে কিছু বলতে না দিয়ে বললাম,
-“দেরি করে গেলে বকা খেতে পারি। নিজের খেয়াল রাখিস। আল্লাহ হাফেজ।”
উত্তরের অপেক্ষা না করে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। হাঁটতে হাঁটতে আনমনে বলতে লাগলাম,

-“আমাকে ক্ষমা করিস সুমুপাখি। উনি আমাকে শুধু পছন্দ নয় ভালোও বাসেন। কিন্তু বান্ধবী হলেও আমি তোকে সবটা বলতে পারবো না রে। যেমন পারি নি তোকে বলতে আমার ভালোবাসার বেনামি চিঠির কথা, তেমন পারবো না তোকে বলতে নীল ভাইয়াকে নিয়ে আমার বুকে চাপা কত-শত কষ্টের কথা। যেই কষ্টগুলো আমাকে তিল তিল করে শেষ করে দিয়ে বলছে, ‘নীল তোকে ভালোবাসে, মেনে নেয় তুই নীলকে।

‘ সুমু রে আমি না পারছি বেনামি চিঠির মালিকের অপেক্ষা করতে না পারছি নীল ভাইয়া ভালোবাসা উপেক্ষা করতে। ঐ মানুষটা দিন দিন আরও বেশি ভালোবাসছে আমায়। আমি এখন কী করব রে সুমাইয়া, কী করব আমি?”


পর্ব-৩৯

পায়ে পায়ে চলে এলাম সুমাইয়ার বাসার গেটের কাছে। গেট পেরিয়ে বাইরে পা রাখতেই দেখতে পেলাম বাইকে বসে কেউ একজন অপেক্ষা করছে। আমি এসেছি সেটা হয়ত মানুষটা বুঝতে পেরেছে। তাই তো ফোন স্ক্রোল অফ করে আমার দিকে তাকালেন মুগ্ধ নয়নে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গভীর হওয়ার তোরজোড় চলছে। তাই প্রাকৃতিক আলোয় প্রকৃতি দেখবার বিশেষ কোনো উপায় নেই। কারণ আকাশে চাঁদেরও দেখা নেই আজ। তাই কৃত্রিম আলোয় মানুষটার চেহারা দেখতে আমিও তাকিয়ে রইলাম। চোখাচোখি হতেই হালকা হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
-“পেত্নী, কল রিসিভ করিস নি কেন?”

কয়েক কদম এগিয়ে ভাইয়ার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে জবাব দিলাম,
-“বুঝতে পেরেছিলাম আপনি এসেছেন। তাই আর রিসিভ করি নি।”
ফোনটা পকেটে পুড়তে পুড়তে বললেন,

-“বাহ! দিন দিন অনেক কিছুই বুঝতে শিখে গেছিস কিন্তু মনটা বুঝতে শিখলি না আদোও।”
ইঙ্গিতটা যে উনাকে করেছেন সেটা আমার বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হয় নি কিন্তু বুঝলেও সেটা উনাকে বুঝানোর বা জবাব দেওয়ার আমার কোনো ইচ্ছে নেই। তাই নিরবতা আঁকড়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাইয়া বাইক স্টার্ট দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“এখানেই কি থাকার প্ল্যান করছিস না-কি?”

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন,
-“এখানে কি কোনো বট, তেঁতুল বা শেওড়া গাছের খোঁজ পেয়েছিস?”
অবাকের চরম সীমানায় দাঁড়িয়ে,
-“মানে?”

-“তুই তো পেত্নী নামক শাঁকচুন্নি আর তারা তো এসব গাছেই থাকে। আমার মনে হলো তুই তোর আসল বাসস্থান পেয়ে গিয়েছিস তাই তো বাসায় চাইছিস না।”
একটু আগেও আমাকে মিষ্টি মিষ্টি বুলি শোনাচ্ছিলেন আর এখন কি-না রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে যাচ্ছে তাই বলছেন। ইচ্ছে তো করছে উনার মাথায় কদবেল ভাঙতে। কিন্তু ইচ্ছে করলেও সেটা কখনও পূরণ হবে না। তাই নিজের রাগ নিজের কাছে চেপে রেখে একদৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে। রাগ চেপে রাখলেও হয়ত সেটা চেহারায় ভেসে উঠছে তাই তো কৃত্রিম আলোয় সেটা দেখে উনি তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

-“সারাক্ষণ নাকের ডগায় রাগ এসে থাকে কেন? এবার রাগ না দেখিয়ে বাসায় চল অন্য সময় গাছে উঠিয়ে দিয়ে যাবো।”
বলেই হাসতে লাগলেন আর উনার এমন হাসি দেখে রাগে আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু আবারও মনের রাগ মনে চেপে রেখে বাইকে চড়ে বসলাম।


-“আপামনি, আপমনি?”
ঘুমের মধ্যে ডাকাডাকির বিষয়টা আমার বড্ড অপছন্দের কিন্তু এখন এটাই হচ্ছে আমার। মিতালির ডাকে আমার সাধের ঘুমটা ভাঙতেই কপট রাগে চোখ মুখ খিঁচিয়ে কাঁথা টেনে মুখ ঢেকে দিলাম। কিন্তু মিতালি ক্ষান্ত না হয়ে আবার ডাকতে লাগলো,
-“আপামনি, উঠেন ছোট খালায় আফনেরে ডাকে।”

মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে চোখ বুঁজেই জিজ্ঞেস করলাম,
-“কেন? আমি তো কালকে রাতেই বলে রেখেছিলাম, আজকে আমার ক্লাস নেই। আমি অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠবো। তাহলে মা কেন আবার ডাকছে?”

-“ঐ কুহি আপারা আইছে।”
কুহি আপুর নাম শুনে ঘুমটা যেন হঠাৎ-ই উড়ে গেল। কী যেন ভেবে মিতালির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-“ঠিক আছে তুই যা। আমি এক্ষুনিই আসছি।”
মিতালি চলে যেতেই শোয়া থেকে উঠে বসে ভাবতে লাগলাম,

-“এতো সকাল সকাল উনাদের আগমনের হেতু কী?”
কেবল ডাইনিং রুমে পা রেখেছি কিন্তু যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। খাবার টেবিলে ভাইয়া আর কুহি আপু বসে আছে পাশাপাশি চেয়ারে। তাও আবার আমার চেয়ারেই বসেছেন আপু তারউপর ভাইয়ার সাথে কত ঢংঢাং করে কথা বলছেন আর হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ছেন। আর ভাইয়াও কত সানন্দে আপুর সাথে খোশগল্পে করে খাচ্ছেন।

আমাকে দেখেই কুহি আপু হাসি মাখা মুখ করে জিজ্ঞেস করলো,
-“পিচ্চিমনি, কেমন আছো?”

আপু ভাইয়ার চেয়ে দুই বছরের ছোট অর্থাৎ আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। আর কুহি আপু আমাকে ছোট বেলা থেকেই পিচ্চিমনি বলে ডাকে। আমারও নামটা ভালো লাগতো তাই কখনও আপত্তি করি নি। কিন্তু আজকে নামটা শুনে বড্ড রাগ লাগছে। বেশি রাগ লাগছে আমার চেয়ারে বসে ভাইয়ার সাথে ঢংঢাং করছে বলে।

মা, জেঠিমা, জেঠু, আঙ্কেল, আন্টি আর ভাইয়া সামনে আছেন বলে জোরপূর্বক একটু হেসে বললাম,
-“ভালো।”
আমার সামান্য উত্তরটা হয়ত আপুর পছন্দ হয় নি। অবশ্য না হওয়ারই কথা কারণ ডাইনিং রুমে এসেও আমি কেবল একজনের দিকেই তাকিয়ে আছি, সেটা হলো নীল ভাইয়া। কুহি আপুকে উত্তরটাও দিয়েছি উনার দিকেই তাকিয়ে কিন্তু মানুষটা একবারও আমার দিকে তাকালো না। অভিমানে মন আমার কেবলই বলে উঠছে,

-“আমি কি আপনার কাছে অপরাধী? আমার জন্য বরাদ্দ করে রাখা আসনটায় আপনি অন্য কাউকে কী করে বসতে দিলেন? এতোটা বছর আসনটায় শুধু আমি বসতাম। তাহলে আজ কেন এমন হলো? আপনি আমার জায়গায় অন্য কাউকে “
আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো মা’র ডাকে। মা সবাইকে খাবার পরিবেশন করতে ব্যস্ত এর ফাঁকে আমায় বললো,
-“কিরে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বস তোকে খাবার দিচ্ছি।”

অনেকক্ষণ হয়ে গেছে এসেছি কিন্তু তবুও উনার কোনো হেলদোল দেখছি না। উনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই আমি মাকে জবাব দিলাম,
-“ইচ্ছে করছে না।”
ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে ভাইয়ার দিকেই তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে, এই বুঝি উনি রাগ দেখিয়ে খেতে বলবেন কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি উনার মতোই রয়ে গেলেন। উনার এমন আচরণে আমার মাঝে রাগ আর অভিমানের সৃষ্টি হলো। তাই তো সেটার কিঞ্চিৎ বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মাকে বললাম,

-“ক্ষিধে নেই আমার। খাবো না আমি।”
বলেই ডাইনিং রুম ত্যাগ করতে পা বাড়ালাম। প্রতি কদমে আমার মনে হচ্ছে এই বুঝি ভাইয়া ডেকে উঠবেন ‘পেত্নী’ বলে। কিন্তু আফসোস সেই চিরচেনা কন্ঠে আমার নামটা ভেসে আসে নি আমার কানে।
“জানে এই মন জানে

তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার
জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার
ভালোবাসার খামে
চিঠি লিখে তোমার নামে
পাঠিয়ে দিলাম আমি
পড়ে নাও এবার
জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার”


পর্ব-৪০

রুমের দরজার উল্টো দিকে মুখ করে বিছানায় বসে আছি। কানে ইয়ারফোন গুঁজে, পা দুলিয়ে গানটা শুনছি মনোযোগ দিয়ে। দু’হাতে বিছানার চাদর চেপে দাঁত কিড়মিড় করছি। অজানা রাগ আর অভিমান আমার মনকে উতলা করে চোখের কোল ভরিয়ে দিচ্ছে জলে। শত বাঁধা দিয়েও আটকাতে পারছি না, শেষমেশ শত বাঁধা উপেক্ষা করে জল গড়িয়ে পড়লো আমার গাল বেয়ে। আলতো হাতে সেটা মুছে দিয়ে অনেক চেষ্টা করছি কান্নাটা চাপা দিতে কিন্তু সেটা থামছে বৈ বাড়ছে শুধু।

কান্না পেলে কাঁদতে হয় নয়ত সেটা দ্বিগুণ কষ্টে নিজেকে পোড়াতে সক্ষম হয়। বিনা শব্দে চোখ দিয়ে বৃষ্টির ধারা বইছে আর আমার অভিমানী মন বলে উঠছে,
-“কেন এমন করলেন আমার সাথে? কী দোষ করেছি আমি? আপনার ভালোবাসা বুঝি না বলে মানি না বলে এভাবে আমাকে কষ্ট দিলেন? জানেন, আপনি আমায় যদি গালি দিতেন, মারধর করতেন তাহলেও আমার এতোটা কষ্ট হতো না। আপনার এমন অবহেলায় বুকটা যে চিঁড়ে যাচ্ছে আমার।”

আধঘন্টা হয়ে গেছে অথচ কেউ এসে একবার আমার খবরও নেয় নি। রুমের দরজা আধো লাগানো আছে আর আমি আগের মতোই দরজার উল্টো দিকে মুখ করে বসে আছি। কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছি বলে কেউ ডাকাডাকি করলেও হয়ত শুনবো না।

বিছানার চাদর খামচে ধরে বসে আছি মেঝেতে দৃষ্টি দিয়ে। চোখে বৃষ্টির ধারা এখনও ঝরছে কিন্তু সেটা মুছে দিতে বিন্দু পরিমাণ আগ্রহও নেই আমার মাঝে। হঠাৎ-ই একজোড়া পা চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ধরে রাখা চাদর হাত থেকে আগলা হয়ে গেল। কৌতূহল নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাতেই দেখি, হাতে খাবারের প্লেট আর পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নীল ভাইয়া। উনাকে দেখে চোখে শুধু বিস্ময় প্রকাশ পেল কিন্তু আমার মাঝে কোনো নড়নচড়ন ঘটলো না।

খাবারের প্লেট আর পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে হাঁটু গেঁড়ে মেঝেতে বসলেন আমার সামনে। হালকা হেসে নিজেই আমার কান থেকে ইয়ারফোন খুলে দিয়ে বললেন,
-“কক্সবাজারে যাবে তাই সে বিষয় নিয়ে আলাপ করার জন্য আমাদের বাসায় উনারা বেড়াতে এসেছেন। কেউ যদি নিজে থেকে এসে গল্প করতে চায়, কথা বলতে চায় তখন কি তাকে মানা করা যায়? ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারি নি। তাছাড়া বাবা, মা, চাচীমা, আন্টি, আঙ্কেল সবাই ছিলেন। সবার সামনে কি বাড়িতে আসা অতিথির সাথে বাজে ব্যবহার করা যায়?”

আমি চুপটি করে বসে আছি অন্য দিকে তাকিয়ে। আচমকা উনি আলতো আমার চোখের জল মুছে দিতে আমি আঁতকে উঠলাম। চমকিত নয়নে উনার দিকে তাকাতেই উনি মৃদু হেসে বললেন,
-“কথা বলি নি তাই এতো কেঁদেছিস। আমি যদি মরে যাই তখন কী করবি?”

উনার এমন কথা শুনে নিজের অজান্তেই এবার জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। আমার কান্না দেখে ভাইয়া পাশে এসে বসে চমকিত নয়নে বললেন,
-“আরে! আবার কেন কাঁদছিস? প্লিজ কান্না থামা। বাসার সবাই তোর কান্না দেখলে তো আমাকে বকাবকি করবে।”
আমি কান্না থামার চেষ্টা করছি কিন্তু কান্না থামছে না। ভাইয়া আমার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-“পানিটা পান করে নেয় তারপর শান্ত হয়ে বস। আই প্রমিজ আমি আর কক্ষনও তোর সাথে এমন করব না।”
হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢোক ঢোক করে পান করে নিলাম পুরোটা। ফাঁকা গ্লাসটা উনার দিকে বাড়িয়ে দিতেই উনি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললেন,

-“এটা কী করলি! পুরো গ্লাস ফাঁকা করে দিলি? এখন খাবারগুলো খাবার কে খাবে রে পেত্নী?”
ভাইয়ার কথাগুলো মজা করে বলা বলে আলতো হাতে চোখের পানি মুছে দিয়ে হালকা হেসে দিলাম। আমার কান্না মাখা হাসি দেখে উনি বললেন,
-“তোকে তো বলেছিলাম, আমি সারাজীবন তোর পাশে থাকবো, তুই না চাইলেও। তাহলে এই সামান্য বিষয় নিয়ে কেন মন খারাপ করলি?”
মাথা নুইয়ে চুপটি করে রইলাম বলে ভাইয়া আবার বললেন,

-“পুরোটা বিষয় আমার অজানা আর নাগালের বাইরে ছিল তবে কথা বলি নি আমি ইচ্ছে করেই। কিন্তু সত্যি ভাবি নি যে, একটু কথা না বললে তুই এভাবে কান্না জুড়ে দিবি।”
টেবিল থেকে খাবারের প্লেট নিয়ে বলতে লাগলেন,

-“আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোকে না খেয়ে থাকতো দিবো না। তাই এবার লক্ষী মেয়ের মতোন হা কর।”
মুখের সামনে একটুখানি রুটি সবজি ধরলেন। আমি খানিকটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে প্লেট ধরতে হাত বাড়ালাম। কারণ আজ অবধি উনার হাতে খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয় নি।

আমি ভাইয়ার হাতে খাবার খেতে চাই না সেটা উনি বুঝতে পেরে নরম সুরে জানতে চাইলেন,
-“খাবি না আমার হাতের খাবার? বললাম তো, এমন আর কক্ষনও করব না তোর সাথে। প্রমিজ।”

বলেই মুখ মলিন করে হাত সরিয়ে নিচ্ছিলেন কিন্তু আমি বিনা উত্তরে উনার হাত ধরে খাবারটা খেয়ে নিলাম। আর এতেই ভাইয়ার মলিন মুখখানা খুশিতে ঝলমল করতে লাগলো। বেশ সানন্দে পুরোটা খাবার আমাকে খাইয়ে দিলেন। খাওয়া শেষ হতেই হঠাৎ শান্ত গলায় বললেন,
-“তোর স্থান কেউ কোনোদিন নিতে পারবে না কারণ আমার লাইফে পেত্নী হাজারটা নয় শুধু একটাই আর সেটা কেবলই তুই।

কখনও ডাক ঢোল পিটিয়ে বলা হয় নি কিন্তু আজকে বলে দিলাম। আর হ্যাঁ, ভুল করেও ভাবিস না তোর চোখের পানি আমি এমনি এমনি হজম করবো। তুই হয়ত জানিস না, তোর এক ফোঁটা জলের মূল্য কারোর কাছে কয়েকশত ফোঁটা রক্তের চেয়েও দামী। তাই তার রক্ত ঝরাতে না চাইলে নিজের চোখের জলকে দমিয়ে রাখিস।”

এই বলেই উঠে চলে গেলেন ভাইয়া। আমি উনার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলাম কিন্তু উনি যাবার আগে দরজা লাগিয়ে চলে গেলেন বলে আর দেখা হলো না আমার।
হঠাৎ মন গহীনে তৃপ্তি অনুভব করছি। হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজে পেলে মানুষ যেই তৃপ্তি অনুভব করে আমিও ঠিক সেই তৃপ্তিই অনুভব করছি। তাই তো একা ঘরে বসে বসে তৃপ্ত মনে সৃষ্টি হচ্ছে কত-শত প্রশ্নের। আপনমনে বিড়বিড় করে উঠলাম,

-“এতোটা ভালোবাসা কেন আমার জন্য রাখলেন ভাইয়া? সত্যিই কি আমি আপনার কাছ থেকে এতোটা ভালোবাসা পাবার যোগ্য? আমার চোখের জলকে কীভাবে নিজের রক্তের সাথে তুলনা করলেন? এতো এতো প্রশ্নের উত্তর আমার জানার ইচ্ছে হলেও আমি জানতে চাই না কেবল জানতে চাই, আমাকে কেন এতো ভালোবাসেন?”

বাড়িতে মেহমান এলে বাড়ির চেহারাই যেন পাল্টে যায়। নিজের বাড়িতেও নিজেকে যেন অতিথি মনে হয়। কক্সবাজার যাবে সেই নিয়ে সকাল থেকেই কত-শত আলাপচারিতা চলছে সবার মাঝে। সাথে সবার জন্য সুস্বাদু খাবারের আয়োজনও হচ্ছে সকাল থেকে। ফালুদা আর জুস তৈরি করছে মা আর জেঠীমা। আমি রান্নাঘরে বসে একটা আপেল খেয়ে চলেছি আর মা এবং জেঠীমার কথাবার্তা শুনছি।

ট্রেতে খাবার সাজিয়ে আমাকে আর মিতালিকে পরিবেশনের দায়িত্ব দেওয়া হলো। খাবার নিয়ে পায়ে পায়ে চলে এলাম আমি আর মিতালি। ড্রয়িং রুমে এসে দেখি বাবা, জেঠু, নীল ভাইয়া, আঙ্কেল, আন্টি আর কুহি আপু বসে আছেন। মিতালি খানিকটা এগিয়ে গিয়ে সবাইকে খাবার দিতে লাগলো। ভাইয়াকে দিতে গেলে উনি মিতালির থেকে নিলেন না। কিন্তু আমি যখন কুহি আপুকে দেওয়ার জন্য উনার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন আস্তে করে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,

-“আমাকে কি দিবি না?”
সবাই সবার মতোন কথা বলতে ব্যস্ত তাই হয়ত ভাইয়ার ফিসফিস করে বলা কথাগুলো শুনতে পায় নি। আমি শেষ কালকে উনার সাথে কথা বলেছি। সকালের ঘটনার পর কেন যেন উনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তাই এখন প্রতুত্তরে নিরব থেকে উনার সামনে খাবারের ট্রে ধরে রাখলাম। উনি উনার পছন্দ মতোন একটা ফালুদার বাটি আর জুসের গ্লাস রাখতেই আমি কুহি আপুর কাছে চলে এলাম। আপু আমাকে হাত ধরে টেনে উনার পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-“পিচ্চিমনি, তুমি কি আমার উপর রেগে আছো?”
-“না না আপু, তোমার উপর কেন রাগ করব?”
দু’হাতে আমার ডান হাত চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,

-“তাহলে সকালের পর আমার সাথে কথা বলো নি কেন?”
আপুকে তো বলা যাবে না যে, উনার উপরই রেগে আছি। আর উনার জন্য সকালে কত কিছু হয়ে গেল। সত্যিটা চাপা রেখে জবাব দিলাম,
-“পরশু পরীক্ষা তো তাই একটু টেনশনে আছি, অন্যকিছু নয়।”
-“ওহ আচ্ছা।”

আমার জবাবটা কুহি আপুর কতটুকু বিশ্বাস হয়েছে তা আমার জানা নেই। কিন্তু এটা সঠিক উত্তর না হলে বেঠিক নয়। তাই তো আমার জবাব শুনে নীল ভাইয়া আঁড়চোখে তাকালেও আমাকে কিছু বলেন নি।
কথার প্রসঙ্গে আঙ্কেল বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তা ফ্লাইট কয়টা থেকে যেন?”

‘ফ্লাইট’ কথাটা শুনে আমি চমকে গেলাম আর মনে মনে বলতে লাগলাম,
-“ফ্লাইট মানে? আমরা কি প্লেনে করে কক্সবাজার যাবো? হে আল্লাহ! এটা কী করলেন? আমি তো প্লেইন ভীষণ ভয় পাই। এই প্লেইনের নাম শুনে তো এখন যেতেই ইচ্ছে করছেন। ধ্যাত!”

আঙ্কেলের প্রশ্নের জবাবে জেঠু বললেন,
-“আর তো চারদিনই বাকি আছে আর ফ্লাইট সকাল এগারোটায়।”
-“ওহ আচ্ছা।”
সবার কথা শুনে ভয়ে আমার মন কেমন যেন ঠুকরে কেঁদে উঠছে। বিষয়টা আমার কাছে একটুও সত্যি মনে হচ্ছে না। তাই মা আর জেঠীমার কাছে চলে এলাম সত্যতা যাচাই করতে।

প্রায় কেঁদে দিবো এমন একটা ভঙ্গিতে জেঠীমাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“জেঠীমা, আমরা কীসে করে কক্সবাজার যাবো?”
জেঠীমার আগে মা জবাব দিলো,

-“প্লেইনে যাবো কারণ আমরা বুড়ো মানুষ আমাদের পক্ষে ১২/১৪ ঘন্টা বাসে বসে থাকা সম্ভব নয়।”
-“কিন্তু মা “
-“কোনো কিন্তু না। এখন গিয়ে পড়তে বস। রাত পোহালে পরীক্ষা।”
মায়ের কথায় বড্ড অভিমান লাগছে। তাই আঁড়চোখে মা’র দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকটা সময়। আমার উদাস মুখের পানে তাকিয়ে জেঠীমা বললো,

-“মন খারাপ করিস না মা। জানি তো, তোর প্লেনে ভয় লাগে।”


পর্ব-৪১

বলেই জেঠীমা আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আর আমি মুখখানা মলিন করে দাঁড়িয়ে আছি একরাশ অভিমান নিয়ে। অনবরত মাথায় হাত বুলিয়ে জেঠীমা বললো,
-“মন খারাপ করিস না মা। তোর এমন মুখখানা দেখলে যে আমার বড্ড কষ্ট হয়। পরিবারের সবাই তো সাথেই থাকবে। তাহলে ভয় কীসের শুনি? তাছাড়া আনন্দ ফুর্তির মাঝে ভয়টা তো আর থাকবে না।”

এখনও চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছি। কারণ আমি জানি, আমি যতই আনন্দ ফুর্তিতে থাকি না কেন? আমার প্লেনে ঠিকই ভয় করবে। এখন চিন্তার বিষয় হলো অতিরিক্ত ভয়ে জ্ঞান হারালে তখন কী হবে?

পরশু আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। তবে শেষ পরীক্ষা নিয়েও বেশ টেনশনে আছি। ইংরেজি বিষয়টা সব সময়ই আমাকে অতিরিক্ত টেনশন দেয়। কিন্তু এবারের পরীক্ষার সাথে নতুন টেনশনও যোগ হয়েছে আর টেনশনের রং এবং নাম হলো নীল।
জীবনের এতোগুলো বছরে একবারের জন্যও নীল রঙটা আমার ভালো লাগে নি। কিন্তু ইদানীং নীল রঙটা বড্ড ভালো লাগে। ভালো লাগার কারণটা অবশ্য অজানা হয়ত জানি কিন্তু মনকে সেটা জানান দিতে চাই না।

মুখের সামনে বই মেলে দুই গালে হাত দিয়ে বসে আছি। দৃষ্টি আমার বইয়ের পাতায় কিন্তু মনটা দুভাগ হয়ে আছে। একভাগ মন অস্থির পরীক্ষার চিন্তায় আরেকভাগ মন অস্থির নীল ভাইয়ার চিন্তায়।
হঠাৎ কোথ থেকে মিতালি এসে আমায় বললো,

-“আপামনি, নীল ভাই আফনারে পড়তে ডাকে।”
আজকে ভাইয়ার কাছে পড়ার কথা নয় আর উনি পড়াবেন না, সেটাও বলেছিলেন। তাই মিতালির কথা আমার একফোঁটাও বিশ্বাস হলো না। সন্দেহী গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

-“ফাজলামি করছিস আমার সাথে? আজকে ভাইয়ার কাছে আমার পড়া টোরা কিছু নেই।”
হা-হুতাশের মতো বলতে লাগলো,
-“আল্লাহ আপামনি! আফনে এডি কি কন? আমি ফাইজলামি করাম কেরে? ভাই এহন আমারে কইলো আপনারে কইতে। আমি কইলাম এহন আফনের ইচ্ছা। আমি তো গেলাম গা।”

বলেই চলে যেতে নিয়ে ছিল কিন্তু তার আগেই আমি বলে উঠলাম,
-“এই শোন শোন।”
আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,

-“জে কন আপামনি।”
বিষয়টা আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না বলে আবার জানতে চাইলাম,
-“এখন যেতে বলেছে?”
-“হয়।”
-“ঠিক আছে তুই যা।”

-“আইচ্ছা।”
মিতালি চলে যেতেই সোজা হয়ে বসলাম। বই উপর থাকা কলমটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবতে লাগলাম,
-“এখন আবার ডাকাডাকি কেন? উফ!”

গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলে এলাম ভাইয়ার রুমে। বইপত্র হাতে উনার রুমে উঁকি দিতেই চোখাচোখি হল উনার সাথে। আমাকে দেখেই মৃদু হেসে আমায় বললেন,
-“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভিতরে আয়।”
ভিতরে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম চুপটি করে। ভাইয়া কীসের বই যেন পড়ছিলেন, বই পড়া বন্ধ করে আমার দিকে মুখ করে বসে জিজ্ঞেস করলেন,

-“পড়ছিলি?”
আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। উত্তর পেয়ে ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“এমনিতে কিছু বুঝার আছে? মানে সমস্যা হচ্ছে কোথাও?”

এবারও নিঃশব্দে ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালাম। আমার জবাবে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
-“শেষ কালকে রাতে আমার সাথে কথা বলেছিস।”
মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস ফেলে বললেন,

-“একটু কথা বলি নি বলে আজকে সারাদিন কথা বলিস নি। আরও কি শাস্তি দেওয়ার বাকি আছে পেত্নী?”
উনার কথায় কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে নিজের অজান্তেই জিজ্ঞেস করলাম,
-“মানে?”
সাথে সাথেই হাসতে হাসতে বলতে,

-“পারিসও তুই। সত্যি, তোকে দিয়েই সম্ভব। বাব্বা! এতো রাগ তোর। রাগের জন্য প্রায় একদিন আমার সাথে কথা বলিস নি। তবুও ভালো, শেষমেষ ম্যাডাম মুখ খুলেছে।”
বিষয়টা সত্যি কি মিথ্যা সেটা মনে মনে ভাবছি আর লজ্জায় মাথা নুইয়ে বসে আছি। হঠাৎ ভাইয়া কিছু চকলেট সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-“এই যে ম্যাডাম প্লাস পেত্নী নামক শাঁকচুন্নি, এই নে তোর চকলেট। আশা করি এবার আর রাগটা থাকবে না তোর মাঝে।”
ভাইয়ার হাত থেকে চকলেট নিয়ে ইতস্তত করে বললাম,

-“এমনিতেও রাগ ছিল না ভাইয়া।”
-“কিন্তু অভিমান তো ছিল, খুব বেশিই।”

‘অভিমান’ শব্দটা যেন সত্যিই মনে করিয়ে দিচ্ছে, আজকে ভাইয়ার সাথে কথা না বলার বিষয়টা। এই অভিমানই হয়ত আজকে সারাদিন আমাকে বিরত রেখেছে ভাইয়ার সাথে কথা বলার থেকে। আজকে অভিমানটা এতো শক্তিশালী হয়ে উঠলো কেন? কেন অভিমানের দেয়াল ভেঙে আমি কথা বলতে পারি নি উনার সাথে?

একজোড়া চোখের স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখজোড়াও স্থির হয়ে আছে। ঐ চোখে আমার চোখ কী যেন খুঁজে পেয়েছে। তাই তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডুবে আছে। কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি বিনিময় হলো আমাদের মাঝে। নিজের চোখজোড়া একই ভাবে আমার চোখে ডুবিয়ে রেখে ভাইয়া শান্ত গলায় বললেন,
-“যা এখন। নিজের রুমে গিয়ে পড়াটা শেষ করে নেয়। কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলিস।”

উনার থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। বইপত্র আর চকলেট হাতে নিয়ে, লজ্জায় ধরে আসা গলায় বললাম,
-“শুকরিয়া ভাইয়া।”

-“It’s make me happy.”

উনার কথায় চমকালেও সেটা বুঝতে না দিয়ে নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় কেন যেন মনে হলো পিছন থেকে কারোর হৃদয় থেকে ভেসে আসছে আমার নাম, মনে হলো কারোর চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে আমার উপর। কিন্তু এসব কি আমার নিছক ভাবনা না সত্যিই?

পরীক্ষা শেষ হতে আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকি আছে। তাই খুব দ্রুত হাত চলছে আছে। প্রশ্নপত্র পেয়ে বুঝতে পারি নি যে, প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে নাকি আমি নিজেই কিছু পারি না। তবুও সব প্রশ্নের যেমন তেমন উত্তর দিয়ে পরীক্ষা সম্পূর্ণ করলাম। আমি আবার প্রশ্ন বাদ দিতে পারি না। কেমন যেন মায়া মায়া লাগে প্রশ্নের প্রতি। মনে হয় এই বুঝি প্রশ্ন কেঁদে উঠে আমায় বলবে,

-“কথামনি, তুই ভীষণ পঁচা। আমাকে কেন বাদ দিলি?”
আমার আর সুমাইয়ার পরীক্ষা একই ক্লাসে। ওর পরীক্ষা আমার আগে শেষ হতেই ও খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমারও পরীক্ষা শেষ আবার সময়ও শেষ। তাই অতি দ্রুত খাতা জমা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সুমাইয়া ক্লাসের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

-“কেমন দিলি?”
হতাশ গলায় বললাম,

-“যেমনই হোক, পাস করলেই বাঁচি। ইংরেজিতে পাস মানে আমার কাছে ১০০ পাবার সমান।”
হালকা হেসে আমায় বললো,
-“ইংরেজির মতোন এমন সহজ বিষয়ে যে কেন এতো ভয় পাস সেটাই আমার বুঝে আসে না।”
তাচ্ছিল্যের সুরে আমি বললাম,

-“অংকের মতোন এমন সহজ বিষয়ে যে কেন এতো ভয় পাস সেটাই আমার বুঝে আসে না।”
সুমাইয়ার অনুকরণ করছি বলে ওর হাসি থেমে গেল। ওর হাসি থামতে দেখে আমি এবার দুষ্ট হাসি দিলাম আর এতেই রাগী ভাব নিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“আমার নকল করছিস কেন?”
-“ইচ্ছে হলো তাই।”
হঠাৎ কী ভেবে সুমাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“নীল ভাইয়ার ব্যাপারে কিছু ভেবেছিস?”

হঠাৎ সুমাইয়ার মুখে নীল ভাইয়ার নাম শুনে হকচকিয়ে গেল। ওর কথা বুঝিনি এমন একটা ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-“মানে?”
-“দেখ, ভাইয়া তোকে পছন্দ করে হয়ত ভালোও বাসে কিন্তু সেটা মানতে চাইছিস না কেন?”
জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললাম,

-“তোকে তো বললাম, এসব আমার অনুমান ছিল আর অনুমামটাও সম্পূর্ণ ভুল। তাছাড়া কালকে কুহি আপুরা আমাদের বাসায় এসেছিল। ভাইয়ার সাথে বেশ গল্পসল্প করে নাস্তা করলো। আর koi or tha nopil কুহি আপু-ই হবে। তাছাড়া আপুকে আমার ভালো লাগে তাই ভাবী বানাতেও আপত্তি নেই।”

অর্নগল কথাগুলো বলেছি বলে নিজেরই অবাক লাগছে। যে মানুষটা নিজের রক্তের চেয়ে আমার চোখের জলকে প্রাধান্য দিয়েছে তাকেই আমি দূরে ঠেলে দিচ্ছি, তার নিখাঁদ ভালোবাসা আমি উপেক্ষা করছি। এতোটা পাষাণ আমি কী করে হলাম?
-“কিন্তু আমার কেন যে “

সুমাইয়া আমাকে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু ভাইয়ার বিষয়টা নিয়ে কথা বাড়ানো আমার কোনো ইচ্ছে নেই। তাই ওর কথার মোড় ঘুরাতে বললাম,
-“আচ্ছা শোন না, আমাকে এখন যেতে হবে রে। কারণ পরশু তো কক্সবাজার যাচ্ছি। তাই ব্যাগ গোছাতে হবে।”
-“ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস। মিস ইউ।”
-“হুম, অনেক।”


পর্ব-৪২

বলেই জড়িয়ে ধরলাম সুমাইয়াকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বললাম,
-“আসি রে। আল্লাহ হাফেজ।”

-“হুম আল্লাহ হাফেজ।”
সুমাইয়ার সাথে আলাপচারিতা শেষ করে পা বাড়ালাম ভার্সিটির গেটের উদ্দেশ্য। ধীরে পায়ে হাঁটছি আর ভাবছি,

-“আমার জীবনে এতো কিছু কেন হচ্ছে? এই কয়েক মাসে জীবন যেন খুব বেশিই মোড় নিচ্ছে এদিক সেদিক। আশে পাশের মানুষের পরিবর্তন হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত। যেই নীল ভাইয়া সর্বদা চুপচাপ থাকতেন তিনিও এখন বাচালতা করেন। আগে হাসতে দেখতাম না অথচ এখন হাসি ছাড়া আমার সাথে কথা বলেন না। ভালোবাসলে কি মানুষ এভাবেই হুট করে বদলে যায়? আমিও তো ভালোবাসি বেনামি চিঠির মালিককে তাহলে আমিও কি নীল ভাইয়ার মতোন বদলে গিয়েছি?”

ভাবতে ভাবতে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে বাইরে চলে এলাম। আর বাইরে এসেই দেখি নীল ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন। উনাকে দেখে অবাক হওয়ার পাশাপাশি খুশিও হলাম যদিও খুশি হবার কারণটা আমার জানা নেই। খানিকটা দ্রুত পায়ে উনার কাছে এসে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
-“এদিক দিয়ে বুঝি আপনার কাজ ছিল ভাইয়া?”

হালকা হাসিতে মত্ত হয়ে আলতো হাতে চুলগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে জবাব দিলেন,
-“আজকে তোর জন্য এসেছি।”
আমার জন্য এসেছে সেটা শুনে কিঞ্চিৎ লজ্জা অনুভব করছি নিজের মাঝে। লজ্জায় চঞ্চল হওয়া দৃষ্টিতে বললাম,
-“আমার জন্য!”

-“কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না?”
আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করায় ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
-“না না, সেটা বলছি না।”

-“আর কিছু বলতে হবে না পরীক্ষা তো শেষ এখন চল কোথাও নিয়ে যায় তোকে।”
খানিকটা অবাক হয়ে,
-“কোথায় যাবো?”

নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেলেছি তবে সাথে সাথে সেটা বুঝতে পেরে এখন বড্ড ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি ভাইয়া রেগে যাবেন আর আমার সাথে তিক্ত মেজাজে কথা বলবেন। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করতে মায়া জরানো কণ্ঠে বললেন,
-“অন্যকিছু না হোক বিশ্বাস তো করতেই পারিস আমাকে, তাই না?”

মাথা নুইয়ে চুপ করে রইলাম। হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়লো আর সেটা হলো ভাইয়া বাইক ছাড়া এসেছেন। আমার জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু সাহস হলো না। হঠাৎ ভাইয়া দুই কদম এগিয়ে গিয়ে একটা রিকশা দাঁড় করালেন তারপর আমাকে লক্ষ্য করে বললেন,
-“তাড়াতাড়ি আয়।”

কাঁধের ব্যাগটা শক্ত হাতে ধরে হেঁটে চলে এলাম ভাইয়ার কাছে। এসে দাঁড়াতেই আমায় বললেন,
-“উঠে বস।”
বিনা উত্তরে উঠে বসলাম। ভাইয়া বসে রিকশাওয়ালা মামাকে বললেন,
-“মামা চলেন।”

রিকসা চলছে আপন গতিতে। শান্ত হয়ে বসে আছি অশান্ত মন নিয়ে। আর অশান্ত মনে জেগে উঠছে কত শত প্রশ্ন,
-“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না উনি কি করতে চাইছেন? আর আমাকে কোথায়ই বা নিয়ে যাবেন? জানি তো জিজ্ঞেস করলেও হনুমানের নাতি কিচ্ছু বলবে না। হুহ।”

আজকের আকাশে সূর্যের প্রখরতা নেই। তাছাড়া এখন দিনের শেষ ভাগ। তাই বাতাসটা হিম হিম বলে বোধ হচ্ছে। তবে মনের গহীনে ভয় আর লজ্জা নামক পাখি দু’টো বড্ড ছটফট করছে। কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বসে আছি।
অনেকটা সময় হলো দু’জনে পাশাপাশি বসে আছি কিন্তু কেমন যেন একটা নিরবতা ছেয়ে আছে আমাদের মাঝে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে ভাইয়া বললেন,

-“পরীক্ষা কেমন হয়েছে তোর?”
-“জ্বী ভাইয়া, আলহামদুলিল্লাহ।”
-“সব দিয়েছিস?”
-“হুম।”

কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে আবার বললেন,
-“পাস করবি তো?”
হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে মনে মনে বললাম,

-“হায় আল্লাহ! ভাইয়া, আপনারও যেহেতু আমার পাস ফেল নিয়ে সন্দেহ হচ্ছে তার মানে তো আমি এবার নির্ঘাত ফেল করব।”
শুকনো একটা ঢোক গিলে প্রতুত্তরে বললাম,
-“আসলে ভাইয়া আমি_
এতোটুকু বলতেই ভাইয়া বলে উঠলেন,

-“এসে গিয়েছি আমরা। এবার রিকশা থেকে নেমে দাঁড়া।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। ভাইয়া রিকশা ভাড়া মিটিয়ে, আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি মাত্রাতিরিক্ত অবাক হচ্ছি আর বোকার মতো উনার পিছু পিছু হাঁটছি।

-“আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। উনি আমাকে রেস্টুরেন্টে কেন নিয়ে এলেন?”
ভাবতে ভাবতে রেস্টুরেন্টের ভিতরে চলে এলাম। সবচেয়ে নিরিবিলি একটা জায়গা পছন্দ করলেন উনি। চেয়ার টেনে দিয়ে আমায় বললেন,
-“বস এখানটায়।”

-“হুম।”
বলে বসতেই মুখোমুখি একটা চেয়ারে ভাইয়া বসে পড়লেন তারপর ওয়েটারকে ডাকলেন। ওয়েটার আসার আগে ভাইয়া মেনুকার্ড হাতে নিয়ে একটু চোখ বুলালেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ডাকলেন,

-“পেত্নী?”
আমি রেস্টুরেন্টটা দেখতে ব্যস্ত ছিলাম কিন্তু ভাইয়ার ডাকে উনার দিকে ফিরে জবাব দিলাম,
-“জ্বী ভাইয়া।”
-“কী খাবি বল? অর্ডার দিবো।”
-“ভাইয়া, আপনার যেটা ভালো লাগে সেটাই অর্ডার দিন।”

ভাইয়া জানেন যে আমার রেস্টুরেন্টের খাবার সম্পর্কে তেমন কোনো ধারনা নেই। কারন বাইরের খাবার খাওয়া আমার খুব একটা পছন্দ না কিন্তু মাঝে মাঝে খাওয়া হয় যেমনঃ সমুচা, চিপস, চকলেট, কেক টেক এসব আর কি।
এক দুই মিনিট মেনুকার্ড পর্যবেক্ষণ করলেন। ওয়েটার এসে দাঁড়াতেই নিজের পছন্দ মতো কিছু খাবার অর্ডার করলেন। খাবার আসতে সময় লাগবে। তাই আমি বসে বসে আবার রেস্টুরেন্টটা দেখছি।

হঠাৎ ভাইয়ার দিকে চোখ পড়লো। উনি মুষ্টিবদ্ধ দুইহাতের উপর মুখ রেখে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় আঁতকে উঠলাম। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিয়ে মনে মনে বললাম,

-“আজকে এতো লজ্জা লাগছে কেন? জীবনের প্রথম তো রেস্টুরেন্টে আসি নি। তাহলে লজ্জায় আমার মর মর অবস্থা কেন হচ্ছে? আর হনুমানের নাতিও রোমান্টিক চাহনী দিয়ে আছে। ইশ, গার্লফ্রেন্ড নেই বউ আছে উনার। ঐ কবে বিয়ে হয়েছে আপনার সাথে আমার? ইচ্ছে তো করছে উনার মুখে বক্সিং করতে। হুহ।”

মিনিট দুয়েক পর আবার তাকিয়ে দেখি সেই এক ভাবেই তাকিয়ে আছেন। উনার মাঝে কোনো নড়ন চড়নই নেই। নিজের কাছে এখন আরও বেশি অস্বস্তি লাগছে। অতিরিক্ত লজ্জায় আমার হৃৎস্পন্দন বাড়ছে আর রাঙা হচ্ছে মুখখানা। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে লজ্জায় হয়ত হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে আমার। তাই কী ভেবে যেন কাঁপা কাঁপা গলায় উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-“ভাইয়া, আমরা রেস্টুরেন্টে কেন এলাম হঠাৎ করে?”

প্রশ্ন করেই মনে মনে বললাম,
-“হায় আল্লাহ! আমি আবার প্রশ্ন করলাম। উফ, কী হয়েছে আমার? আমি এমন কেন করছি?”
আমার প্রশ্ন শুনে ভাইয়া এবার নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। মুখখানা গম্ভীর করে জানতে চাইলেন,
-“তোকে কি কৈফিয়ত দিতে হবে এখন?”

-“হনুমানের নাতি আমি কৈফিয়ত চাই নি শুধু জানতে চেয়েছি হঠাৎ এখানে আসার কারণ কী?”
এটা বললে আমার খরার মন বৃষ্টির জল পেত কিন্তু সেটা তো হবার নয়। তাই আমতা আমতা করে বললাম,
-“না, মানে_

আমাকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে উনি বললেন,
-“কৈফিয়ত হলেও আপত্তি নেই কারণ ইদানীং কৈফিয়ত দিতেও বড্ড ভালো লাগে আর ভাবতেও বেশ লাগে যে, কৈফিয়ত চাওয়ার মতোনও কেউ আছে জীবনে, মা বাবা বাদে।”


পর্ব-৪৩

উনার কথায় বিস্ফারিত নয়নে তাকালাম উনার দিকে আর উনিও আগের ভঙ্গিতে বসে তাকিয়ে আছেন পলকহীন দৃষ্টিতে। উনার ঐ চোখজোড়ায় কী যেন খুঁজে পেয়েছি আমি। বড্ড আপন লাগছে চোখ দুটো আর সাথে মানুষটাকেও। লজ্জায় মরে যাবার উপক্রম হলেও উনার চোখে তাকিয়ে এখন একটা গান আমার খুব করে মনে পড়ছে,

“Kehta hai pal pal tumse
Hoke dil ye deewana
Ek pal bhi jaan-e-jaana
Mujhse door nahi jaana
Pyaar kiya to nibhana
Pyaar kiya to nibhana
Aankhon mein meri
Tera hi chehra dhaRakta rahe
Haan tu jo naa mile
Seene mein dil ye taRapta rahe
Tu mujhe naa sataana
Mera dil naa dumhaana
Pyaar kiya to nibhana
Pyaar kiya to nibhana”

ওয়েটার খাবার নিয়ে হাজির হতেই আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো। নিজেকে যত দ্রুত সম্ভব সামলে নিলাম। কিন্তু লজ্জায় চঞ্চল হওয়া চোখকে কোনো মতেই স্থির করতে পারছি না। হঠাৎ-ই ভুবন কাঁপিয়ে ফোন বেজে উঠলো আর আমি আরও অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।

তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলাম। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো সিম কোম্পানির কল দেখে। ইচ্ছে করছে ফোনটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলি। কিন্তু সাধের মোবাইলের বলী দেওয়া সম্ভব নয় তাই কল কেটে ফোনটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিলাম।

ভাইয়া নিজের আর আমার জন্য খাবার সাজিয়ে চোখে ইশারা করলেন আমাকে খেতে। আমি খাওয়া শুরু করতেই ভাইয়া আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“কলটা রিসিভ না করে কেটে কেন দিলি? আমি সাথে আছি বলে?”
-“না ভাইয়া, আসলে সিম কোম্পানির কল ছিল তাই রিসিভ করি নি।”
-“ওহ।”

মনে মনে ভেবেছিলাম ভাইয়া হয়ত আরও কিছু বলবেন বা জিজ্ঞেস করবেন। কিন্তু উনি নিরবতা আঁকড়ে খাওয়ায় মন দিলেন। তাই আমিও নিঃশব্দে খেতে শুরু করলাম।

কত-শত অপেক্ষার পর চলে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। কত আশা ছিল, কত সাধ ছিল আমার মনে। আমি দুচোখ ভরে দেখবো সমুদ্রকে। আজকে আমার সকল চাওয়া পাওয়া পূরণ হবে সেটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না কিছুতেই।
সকাল থেকে বাড়িময় হইচই চলছে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে রেখে না গেলে না-কি সমস্যা হবে। এই নিয়ে মা আর জেঠীমার কত-শত চিন্তা।

আজকে আমাকে জোরপূর্বক ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে জাগানো হয়েছিল। কিন্তু আমি সেই সাতটাই ঘুম থেকে উঠেছিলাম। কারণ আমার তৈরি হতে খুব বেশি সময় লাগে না। তাই এতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া ব্যাগও গুছানো শেষ, কালকে বিকেলেই গুছিয়ে রেখেছিলাম।

সাতটা নাগাদ কুহি আপু, আন্টি আর আঙ্কেল চলে এসেছেন। এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করা হবে। সকালের নাস্তা শেষ করে সবাই এখন তৈরি হতে ব্যস্ত।

আটটা বাজতে চললো তাই জেঠু সবাইকে তাড়া দিচ্ছে বের হওয়ার জন্য। আমি প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছি শুধু জুতো পড়া বাকি। আজকে নীল ভাইয়ার দেওয়া জুতো পড়ে কক্সবাজারের মাটিতে পা রাখবো। ভাবতেই অবাক লাগছে যে, পছন্দের জুতো পড়ে পছন্দের জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছি। জুতো পড়তে পড়তে হঠাৎ মা’র ডাক কানে এলো,
-“কথামনি হয়েছে তোর?”

চেঁচিয়ে জবাব দিলাম,
-“হ্যাঁ মা।”
-“জলদি বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে বস।”
-“যাচ্ছি।”

মা’র সাথে কথা বলতে বলতে জুতো পড়া শেষ। এবার দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে শেষবারের মতো দেখে বললাম,
-“এতো দেখার কিছু নেই কারণ ফকিন্নিকে কখনও বিউটি কুইন লাগবে না। তাই ভাব না নিয়ে এবার কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।”
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। রুমের দরজা লাগিয়ে দাঁড়াতেই জেঠীমা বললো,
-“সবাই গাড়িতে গিয়ে বসছে। তুইও যা। আমি আর তোর মা আসছি।”

-“ঠিক আছে জেঠীমা।”
বলেই হাঁটতে শুরু করলাম। বাসা থেকে বের হতেই পায়ে কেমন কেমন বোধ করছি। জুতোর ফিতা আর নুপুর একসাথে পেঁচিয়ে কেমন যেন ব্যথা ব্যথা লাগছে। সেটা ঠিক করার জন্য বাম পা খানিকটা উপরে তুলে বাম হাতে ঠিক করার চেষ্টা করছে। কিন্তু এক পা উপর তোলার দরুন আমি কিঞ্চিৎ বেসামাল হয়ে যাচ্ছি। তাই ডান হাত শূন্যে নাড়িয়ে কোনোকিছু ধরার জন্য খুঁজে চলেছি।

হঠাৎ হাতে কিছু লাগতেই সেটা ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে নুপুর আর ফিতা ঠিক করে নিলাম। সব ঠিকঠাক মতো হতে সোজা হয়ে তাকিয়ে দেখি এতক্ষণ আমি নীল ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাইয়াকে দেখার সাথে সাথে আমি আঁতকে উঠলাম আর উনার কাঁধে থাকা আমার হাতটা সরিয়ে নিলাম। হালকা হেসে ভাইয়া আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“শেষ?”

-“হুম।”
-“তাহলে গাড়িতে গিয়ে বস তাড়াতাড়ি।”
আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়াতেই ভাইয়া গাড়ির দিকে চলে গেলেন আর আমি ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম,
-“হায় আল্লাহ! উনার ড্রেসের কালার আর আমার ড্রেসের কালার এক কী করে হলো? ইশ, উনার ব্ল্যাক কালারের ড্রেস কেন পড়তে হবে? আর উনি কি জানেন না, উনার এমন ড্রেসআপে কারোর দুনিয়া থমকে যেতে পারে?”

-“কিরে কথামনি? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
আমাকে ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জেঠীমা পাশে এসে জিজ্ঞেস করলো। আমি এতোটাই শক খেয়েছি যে, এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। তাই জেঠীমার দিকে তাকালেও কিছু বললাম না। পাশ থেকে মা বলে উঠলো,

-“তাড়াতাড়ি কর মা। তোর বাবা আর জেঠু আবার রাগারাগি করতে পারে।”
আমি যাবার সম্মতি দিতে মা আর জেঠীমা সামনে দিকে হাঁটতে লাগলো। নীল ভাইয়ার কথা এখনও মাথা থেকে সরাতে পারছি না। তাই একগাল হেসে, মাটিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম,

-“I think, your black shirt is probably making me weak towards you.”

গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছি আমি আর মিতালি। বাইরের পরিবেশটা আমার বেশ নজর কাড়ছিল। তাই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে উপভোগ করছিলাম আর মনে মনে গুনগুন করছিলাম,

“আজ এই দিনটাকে
মনের খাতায় লিখে রাখো
আমায় পড়বে মনে
কাছে দূরে যেখানেই থাকো
আজ এই দিনটাকে
মনের খাতায় লিখে রাখো
আমায় পড়বে মনে
কাছে দূরে যেখানেই থাকো
ও হো হো
আ হা হা হা
উম হুম হুম হুম”

-“আপামনি, পেলেনে(প্লেন) কি বিছনা(বিছানা) আছে?”
হঠাৎ মিতালির প্রশ্নে ওর দিকে ফিরে তাকালাম বিস্ময় নিয়ে আর জিজ্ঞেস করলাম,
-“বিছানা দিয়ে কী করবি?”
-“কি আর করাম? ঘুম পাইলে ঘুমাইতাম।”

সামনের সিটে অবস্থানরত নীল ভাইয়া ফোঁড়ন কেটে বললেন,
-“তুই বিছানা দিয়ে কি করবি? ভোরে ঘুম থেকে উঠতে বললে যে রাতে উঠে তার জন্য বিছানা প্রয়োজন। যারা প্লেন বানায় তাদেরকে বলতে হবে, বিছানার ব্যবস্থা রেখে প্লেন বানাতে।”

এই কথাগুলো যে উনি আমায় বলেছেন, সেটা বুঝতে আমার একটুও কষ্ট হয় নি। যখন উনাকে এই গাড়িতে উঠতে দেখেছিলাম তখনই বুঝেছি, আমাকে কথা শোনানোর জন্য উঠছেন। কারণ জেঠু বলেছিল, জেঠুদের সাথে গিয়ে বসতে। কিন্তু হনুমানের নাতি বলেছিল,
-“না বাবা, আমি সামনেই বসতে পারব।”

এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে উনাকে পলি ব্যাগে মুড়িয়ে, গাড়ির জানালা দিয়ে নদীতে ফেলে দিতে।
এয়ারপোর্টে বসে সবাই অপেক্ষা করছি। কারণ প্লেন না-কি এখনও আসে নি। আমি, কুহি আপু আর মিতালি একসাথে বসে নিরবতা পালন করছি। কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। হঠাৎ কোথা থেকে নীল ভাইয়া এসে একটা প্যাকেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“এটা ধর।”

-“কী আছে এতে?”
-“খুলেই তো দেখতে পারিস সমুচা।”
সমুচার নাম শুনেই আমার মন নাচনকোঁদন করতে লাগলো। আমি খুশিতে গদোগদো হয়ে প্যাকেট খুলতে লাগলাম। ভাইয়া আবার বললেন,
-“অনেকগুলো আছে। আশা করি সবার হয়ে যাবে তবুও যদি আরও প্রয়োজন হয়, বললে কিনে দিবো।”
কুহি আপুকে ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“জার্নিতে অয়েলি ফুড মনে হয় না খাওয়াটা ঠিক।”
-“তৃপ্তি সহকারে কোনো খাবার খেলে সেটা সমস্যা হওয়ার কারণ দেখি না। যে-কোনো খাবারই আনন্দের সহিত খাওয়া উচিত তাহলেই সেটা শরীর আর মনের জন্য আরামদায়ক হয়– যদিও এটা আমার ধারণা।”

কুহি আপুকে বিনা পয়সায় জ্ঞান দিয়ে ভাইয়া চলে গেলেন। আপু হয়ত ভাইয়ার কথায় চুপসে গেছে তাই তো আর কথা বাড়ালো না। আমার কাছে অবশ্য বিষয়টা বেশ লেগেছে। তাই আপুকে আর একটু নাজেহাল করতে বললাম,
-“আপু, একটা সমুচা খাও প্লিজ।”

অনেক কষ্টে ঠোঁটে একটু হাসির রেখে টেনে আপু বললো,
-“না, তুমিই খাও।”
-“ঠিক আছে।”

একে তো প্রিয় সমুচার দেখা তার উপর ভাইয়া, আপুকে করলো নাজেহাল। খুশির ঠেলায় আমি আর মিতালি মিলে গপাগপ খেতে লাগলাম।
“কপালের লিখন না যায় খন্ডন” আর আমার কপাল তো এমন ভাবে পুড়েছে যে, একশ মাইল দূর থেকেও পোড়া গন্ধ পায় মানুষ।

প্লেনে যাওয়ার ইচ্ছে এমনিতেই আমার ছিল না। কত-শত ভাবে মনকে বুঝিয়ে রাজি করেছি। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, আমি আর মিতালি পাশাপাশি বসবো। কিন্তু আমার পোড়া কপালে লেখা আছে, হনুমানের নাতির সাথেই বসতে হবে। সেই সকাল থেকে উনি আঠার মতোন আমার পিছনে লেগে আছেন।

জানালার পাশেই আমার সিট পড়েছে বলে বড্ড খুশি হয়েছিলাম কিন্তু যখন ভাইয়া এসে আমার পাশে বসলেন আমি তো হতবাক হয়ে গেলাম। গাধার মতো উনাকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম,
-“ভাইয়া, মিতালি কোথায়?”

-“কেন?”
-“না মানে ওর সাথে বসার কথা বলেছিল জেঠীমা। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
কালো সানগ্লাসটা খুলে, শার্টের পকেটে রাখতে রাখতে বললেন,

-“মা’র সাথেই বসেছে। তোকে এতো ভাবতে হবে না। কিন্তু তোর সাথে যে কেন আমার সিট পড়লো? উফ, ডিজগাস্টিং।”
রাগে আমার তখন পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিলো। এখনও বড্ড রাগ লাগছে,

-“কত্তবড় সাহস! আমাকে বলে কি-না ডিজগাস্টিং। হনুমানের নাতি, আপনি ডিজগাস্টিং আপনার ঐ হবু বউ ডিজগাস্টিং।”
উনার বউকে ডিজগাস্টিং বলার পর আমার হুঁশ হলো যে, আমি নিজেই নিজেকে ডিজগাস্টিং বলছি। রাগের দরুন আমার মাথার তার হয়ত ছিঁড়ে গেছে। তাই তো কী সব আবোলতাবোল বলছি।


পর্ব-৪৪

-“এক মিনিট, আমি তো উনার বউ নই। কারণ উনি আমাকে পছন্দ করলেও আমি তো উনাকে বিয়ে করছি না। তাহলে আমি কেন নিজেকে ডিজগাস্টিং বলছি? আলবাত উনার বউ-ই ডিজগাস্টিং হবে সাথে শাঁকচুন্নি, শেওড়া গাছের পেত্নী আরও যা যা আছে সব। হুহ। আমি কেন এসব হবো? আমি তো নিরীহ একটা মেয়ে আর উনি আমায় বলেন কি-না “

-“ব্লেটটা লাগিয়ে নেয়। পারবি তো?”
ভাবনায় বিভোর ছিলাম আমি কিন্তু উনার ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো। জবাব দিতে উনার দিকে তাকালাম কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন,
-“পারবি না-কি আমি লাগিয়ে দিবো?”

-“না, আমি পারব।”
ব্লেট লাগিয়ে চুপ করে বসে আছি। প্লেন চলতে শুরু করবে ভাবতেই অস্থিরতা আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সৃষ্টি হচ্ছে। ধীরে ধীরে প্লেন চলছে পিচঢালা পথ ধরে আর প্লেনের সাথে তাল মিলিয়ে ধুকপুক করছে আমার হৃদয়। আল্লাহকে খুব করে ডাকছি আর দোয়া পড়ে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করছি কিন্তু অস্থিরতা কমছে বৈ বাড়ছে শুধু। প্লেন যেই না উড্ডয়ন করলো অতিরিক্ত ভয়ের দরুন আমি হুট করে ভাইয়ার বুকে মুখ লুকালাম। আমার আচমকা এমন কান্ড দেখে ভাইয়া হকচকিয়ে গিয়ে বললেন,

-“পেত্নী, কী হয়েছে তোর? ভয় করছে?”
আমি প্রায় কেঁদে দেবো এমন অবস্থায় বললাম,
-“ভাইয়া, আমাকে নামিয়ে দিতে বলুন। আমি যাবো না, আমি যাবো না ভাইয়া।”
মৃদু হেসে ভাইয়া বললেন,

-“বোকা মেয়ে, আরে কিচ্ছু হবে না। তুই শান্ত হয়ে বস। বেশিক্ষণ লাগবে না যেতে।”
আমি ভয়ে চুপসে গিয়েছি ফলে মুখ দিয়েও কথা বের হচ্ছে না। এতোটাই ভয় লাগছে যে, নড়াচড়া করতেও ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে বসে আছি কেবল। ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“এভাবেই থাকবি?”

-“হুম।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
ঢাকা থেকে কক্সবাজার প্লেনে করে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেকের মতো সময় লাগে। ভয় নামক জালে জড়িয়ে এতোটা সময় আমি ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে পার করলাম। আমাদের মাঝে কোনো কথা হয় নি। শুধু এক কি দুইবার ভাইয়া জিজ্ঞেস করেছিলেন,
-“কিছু খাবি?”

নড়াচড়া করলেই প্লেন মাটিতে পড়ে যাবে– এমন ভ্রান্ত ধারণায় আমি বরাবরই বলেছিলাম,
-“উহুম।”
প্লেন উড়ন্ত অবস্থায় যখন ছিল আমি কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম, এখন প্লেন অবতরণ করবে ভাবতেই ভয়ে মর মর অবস্থা হচ্ছে আমার। এক দুই মিনিটের মধ্যে প্লেন অবতরণ করতে শুরু করলো। ভয়ের দরুন এবার না পেরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। আমার এমন বাচ্চামো দেখে ভাইয়া ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-“এ কি! কান্না করছিস কেন?”
কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,
-“ভাইয়া ভাইয়া আমার আমার ভীষণ ভয় করছে।”

-“ভয় কীসের? আমি তো আছি। তাছাড়া কক্সবাজার এসে গেছি। এক্ষুনি প্লেন থেমে যাবে।”
আমি কিছু না বলে হেঁচকি তুলে কাঁদছি আর ভাইয়ার বুকে মাথা রেখে স্ট্যচু হয়ে বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ পর প্লেন থেমে গেল। সবাই একে একে প্লেন থেকে নামতে শুরু করছে। আমি আমার আগের অবস্থায় আছি। আমার মাঝে কোনো নড়নচড়ন নেই বলে ভাইয়া নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“প্লেন তো থেমে গেছে। নামবি না?”
উনার কথায় এবার সোজা হয়ে বসে চোখ মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। প্লেন থেকে নেমে দাঁড়াতেই কক্সবাজারের প্রবল বাতাসে মনের সকল ভয় দূর হয়ে গেল। মুক্ত বাতাস টেনে নিয়ে মনে আরও প্রশান্তি এনে দিলাম।
কক্সবাজার এয়ারপোর্টে বসতেই জেঠীমা জিজ্ঞেস করলো,

-“খুব ভয় পেয়েছিস?”
ভাইয়া পাশেই ছিলেন। ব্যাগ থেকে একটা পানির বোতল বের করে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি তো ভয়ে বাকশক্তিই হারিয়ে ফেলেছি। তাই ভাইয়া জেঠীমাকে জবাব দিলেন,

-“ভয়ের কথা আর বলো না মা। পুরোটা সময় আমাকে ঝাপটে রেখেছে। তেজপাতা হলে কী হবে? এখন পিঠ ব্যথায় আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এমন বাচ্চা নিয়ে তোমাদের কক্সবাজার আসা উচিত হয় নি।”
উনার এমন তেঁতো কথা শুনে আমি সাথে সাথে উনার দিকে তাকালাম আর মনে মনে বললাম,

-“আপনাকে দিয়ে সিনেমা বানানো উচিত যেখানে আপনি একসাথে নায়ক এবং খলনায়কের চরিত্র অভিনয় করবেন। ট্রাস মি আপনার ভালো অভিনয় কেউ করতে পারবে না। কারণ প্লেনে যখন ভয় পেলাম আপনার জন্যই ভয়টা অনেক কম লেগেছিল।

আমি তো ভেবেছিলাম ভয়ে আমি অজ্ঞানই হয়ে যাবো। আমি আমার মনকে বুঝালে কী হবে যে, আপনি ভালো। আপনি আস্ত একটা হনুমানের বংশধর না হলে কেউ এমন পাবলিক প্লেসে কাউকে অপমান করে?”
ভাইয়ার কথায় জেঠীমা চমকিত নয়নে জিজ্ঞেস করলো,

-“মানে? কী বলছিস এসব?”
-“ঠিকই বলছি মা। প্লেন উড্ডয়নের সময় বলছিল, কক্সবাজার আসবে না প্লেন থেকে নামিয়ে দিতে। আর প্লেন অবতরণের সময় তো কেঁদেই দিয়েছে।”

ভাইয়ার কথা শুনে জেঠীমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-“অনেক কষ্ট হয়েছে তোর মা?”

আমি জবাব দেওয়ার আগে ভাইয়া আবারও বলে উঠলেন,
-“ওর কীসের কষ্ট হয়েছে মা? কষ্ট তো হয়েছে আমার। এতোটা সময় রোবটের মতোন পেত্নী আঁকড়ে বসে থেকে এখন আমার পিঠ ব্যথা করছে।”
-“ইশ, নীল। সবসময় তোর এসব কথা ভালো লাগে না।”

আমি তো আগেই বলেছি, আমি নিরীহ মেয়ে। তাই তো এতো মানুষের সামনে আমার অপমানটাও মুখ বুঝে সহ্য করছি। আর আমাকে ইচ্ছে মতো অপমান করে এখন দুষ্ট হাসিতে মত্ত হয়ে আছে হনুমানের নাতি। হাতে থাকা পানির বোতলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-“পানিটা পান করে নেয় ভালো লাগবে। প্লেনেও তো কিছু খেলি না।”

নিঃশব্দে পানির বোতলটা নিয়ে পান করতে লাগলাম আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
-“কত-শত ব্যস্ততায়ও আমার খেয়াল রাখতে ভুলে না মানুষটা। এতো অপমানের পর সামান্য একটু যত্ন উনার প্রতি থাকা সমস্ত ঘৃণাকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয়।”


কালকে জার্নি করে এতোটাই কান্ত হয়েছি যে, বেলা দশটা বাজতে চললো অথচ আমার কোনো খবর নেই। বিছানায় পড়ে পড়ে নাক ডেকে ঘুম চলছে আমার। অবশ্য কেউ আমাকে ঘুম থেকে ডেকেও তোলে নি।

কালকে হোটেলে আসার পর সবাই-ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই সমুদ্রের দেখা এখনও মেলেনি কারোর। রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার মতো করে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। কুহি আপু, মিতালি আর আমার জন্য একটা রুম দেওয়া হয়েছে। অনেক রাত অবধি তিনজনে গল্প করে কাটিয়েছি।

আমি ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে, বের হতেই দেখি মা এসে হাজির। আমাকে দেখে মা তাড়া দিয়ে বললো,
-“তৈরি হয়ে নীলের রুমে যা। তোকে নিয়ে নাস্তা করতে যাবে।”
-“তোমরা সবাই খেয়ে নিয়েছো?”
-“হ্যাঁ।”

-“ঠিক আছে আমি যাচ্ছি।”
মাত্র পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে চলে এলাম ভাইয়ার রুমে। দরজায় নক করতেই দরজা খুলে দিয়ে ভাইয়া বললেন,
-“ভিতরে আয়।”

আমি ভিতরে এসে বিছানায় বসে রুমটা দেখতে লাগলাম। কেবলই ভাইয়াকেই সিঙ্গেল রুম দেওয়া হয়েছে আর রুমটা দেখতেও অনেক সুন্দর। আমি চোখ বুলিয়ে রুমটা দেখছি আর ভাইয়া তৈরি হচ্ছেন। ফোন আর রুমের চাবি হাতে নিয়ে বললেন,
-“চল এবার।”

-“হুম।”

লেখা- কথা চৌধুরী

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “বেনামি চিঠি (২য় খণ্ড) – রোমান্টিক প্রেম পত্র” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – বেনামি চিঠি (১ম খণ্ড) – রোমান্টিক প্রেমের চিঠি

6 thoughts on “বেনামি চিঠি (শেষ খণ্ড) – রোমান্টিক প্রেম পত্র”

    1. আমরা অন্তরের অন্তস্থল থেকে আপনার প্রতি গভীর ভালোবাসা ব্যক্ত করছি। বেনামি চিঠির এটাই শেষ খণ্ড। তবে থার্ড পার্ট আসলে আমরা নিশ্চয়ই আপনাকে মেনশন করব। ধন্যবাদ। আশা করি, আমাদের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করবেন।

      1. ভাই last এর পরব গুলি এলোমেলো। এক ই পরব বার বার আসছে।কেন??

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *