বেনামি চিঠি (১ম খণ্ড) – রোমান্টিক প্রেমের চিঠি: ঠাসঠাস করে কানের গোঁড়ায় কয়েকটা দিয়ে কান একদম লাল করে ফেলবো। ফাজিল মেয়ে। বেশি পাকনা হয়ে গিয়েছিস? আমি বলেছি তোকে আমার বউকে কিছু বলে ডাকতে?
পর্ব ১
আজকের এই দিনটা আমার জন্য অনেক স্পেশাল। কেন জানো? কারন, এই দিনেই একটা মানুষরূপী পরীর জন্ম হয়েছিল। আর এই পরীটা আমার জীবনে উপরওয়ালার দেওয়া এক চমৎকার উপহার। যাকে আমি আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আজ সেই কথাপরীর জন্মদিন।
ম্যানি ম্যানি হ্যাপি রিটার্নস অফ দিস ডে কথাপরী। তোমার জীবন খুশি আর আনন্দে ভরে উঠুক। জানো, তোমার মুখের হাসিটা দেখার জন্য আমি প্রানও পার করতে পারি। কি? আমার কথা শুনে নিশ্চয়ই আমাকে পাগল মনে হচ্ছে, তাই না? তোমার ভালোবাসায় যে আমি পাগলই হয়ে গেছি। তাই তো আমার কথাবার্তায় পাগলামির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
জানো, কখনো ভাবতেও পারি নি যে, আমার জীবনেও ভালোবাসা আসবে আর তোমার ভালোবাসায় এতোটা পাগল হবো আমি। কেন এতো পাগল করলে আমায় তোমায় ভালোবাসতে? হুম!
ঐ কথাপরী, অভিমান করে আছো আমার উপর? হুম! প্লিজ কথাপরী, ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি এখন চাইলেও তোমার সামনে এসে দাঁড়াতে পারবো না। আই এম হেল্পলেস কথাপরী। আই এম হেল্পলেস। আমি জানি, তুমি আমার পরিচয় জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছো। শুধু আর একটা বছর কথাপরী। তোমার অপেক্ষার পালা শেষ করে, ঠিক একবছর পর, এমনই তোমার জন্মদিনে আমি নিজ হাতে তোমায় চুড়ি পড়িয়ে দিতে আসবো। তখন না হয় দেখে নিবে আমায় আর জেনে নিবে তোমার না জানা হাজারো প্রশ্নের উত্তর।
তোমার থেকে দূরে থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু কী আর করার? একপ্রকার বাধ্য হয়ে দূরে আছি তোমার থেকে। এবার সবুজ রঙের চুড়ি উপহার দিলাম যেটা তোমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। যখন আমি তোমার সামনে এসে দাঁড়াবো তখন লাল টকটকে গোলাপের সাথে লাল চুড়ি নিয়ে আসবো আর নিজ হাতে পড়িয়ে দিবো। তোমার এতো দিনের অপেক্ষার পালা শেষ করে ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিবো।
উম, সবইতো বলে ফেললাম। যাইহোক আজকে আর কিছু লিখছি না। নিজের খেয়াল রেখো। জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে দিলাম। গিফটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলতে লাগলাম। খুলে দেখি, ছয় ডজন সবুজ রঙের রেশমি চুড়ি আর অন্য আরেকটা প্যাকেটে আমার পছন্দের অনেকগুলো চকলেট।
এটা আমার জন্য নতুন কিছু না। গত ছয় বছর ধরে আমার প্রতি জন্মদিনে ছয়ডজন চুড়ি আর একটা বেনামি চিঠি পাই। চিঠিটা বেনামি বলার কারন চিঠিতে কোনো নাম ঠিকানা লেখা থাকে না। আর কে দিয়ে যায় কখন দিয়ে যায়? সেটাও আজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না। প্রতিবার ঘুম থেকে উঠে আমার পড়ার টেবিলের উপরে দেখতে পাই। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা বলে,
- হয়ত তোর জেঠীমা দিয়েছে।
আর জেঠীমাকে জিজ্ঞেস করলে বলে, - হয়ত তোর জেঠু বা বাবা দিয়েছে।
আমি জানি, ওরা কেউই দেয় নি। কিন্তু আমাকে সবাই এভাবে কনফিউজড কেন করে সেটাই আমার বুঝে আসে না। অবশ্য আমি শুধু চুড়ির কথাই জিজ্ঞেস করি চিঠির ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে করলেও লজ্জায় কাউকে কিছু বলি না। কিন্তু এবারই প্রথম চিঠি আর চুড়ির সাথে আলাদা একটা প্যাকেটে চকলেট পেলাম। এর আগে কখনও চকলেট পাই নি।
উম, হয়ত এবার ইচ্ছে হয়েছে তাই দিয়েছে।
জানি না, কেন বাড়ির সবাই এই ব্যাপারে জেনেও আমায় কিছু বলে না? অথচ আমার অভিভাবক হিসেবে আমাকে বকাঝকা করার কথা আমার কাছে জবাব চাওয়ার কথা। কিন্তু কেউ কিছুই বলে না। বিষয়টা আমাকে ভাবালেও আমি কিন্তু অনেক খুশি চুড়িগুলো পেয়ে।
ওহ, আমার পরিচয়টা তো দেওয়া হয় নি। আমি কথা চৌধুরী কিন্তু সবাই আমায় কথামনি বলে ডাকে। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে আমি। মা, বাবা, জেঠু, জেঠীমা আর উনাদের একমাত্র ছেলে নীল ভাইকে নিয়ে আমাদের পরিবার। নীল নামটা শুনলে ভয়ে এতোটাই কেঁপে উঠি যে, কোথাও নীল রঙ দেখলেও ভয় লাগে। কারন নীল ভাইয়াকে আমি অনেক অনেক ভয় পাই। এতোটা ভয় আমি আমার মা-বাবাকেও পাই না।
নীল ভাইয়া সারাক্ষণ একটা গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকেন। উনাকে জীবনে হাসতে দেখেছি বলেও মনে হয় না। মাস্টার্সে পড়েন খুবই মেধাবী ছাত্র উনি। আর এই কারনে বাবা মায়ের কাছে আমাকে এক্সট্রা বকা খেতে হয়। কারন আমি ছাত্রী হিসেবে তেমন খারাপ নাহলেও পড়াশোনায় আমার একদম মনোযোগ নেই। পড়াশোনা আমার মাথায় ঢুকতেই চায় না। আর কী করেই বা ঢুকবে? সারাদিন তো গান শুনে আর গল্প পড়েই দিন পাড় করে দেই। আর আমার একমাত্র ঢঙ্গী বান্ধবী সুমাইয়ার সাথে আড্ডা দেই।
চিঠিটা ভাঁজ করে আলমারিতে সযত্নে তুলে রাখলাম। কয়েকখানা চিঠি জমেছে এই পর্যন্ত। ঘুম থেকে উঠে আমি আগে নিজের ঘর পরিষ্কার করি এটা আমার নিত্যদিনের কাজ। আজকেও ঘর পরিষ্কার করে বিছানা গুছাতে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ মা আমার রুমে এসে আমায় বললো,
- কথামনি? উঠেছিস মা?
মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললাম, - হ্যাঁ মা, উঠেছি।
মা আমার কাছাকাছি এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
- হ্যাপি বার্থডে আমার সোনা মা।
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, - থ্যাংক ইউ মা।
মাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মা আমার কপালে পড়ে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিতে দিতে বললো,
- যা। এবার তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। খাবার টেবিলে সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
- আচ্ছা মা।
কিছুটা সময় ভেবে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, - মা? কালকে কি মৃন্ময় ভাইয়ারা এসেছিলো?
- হ্যাঁ, তুই তো কালকে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গিয়েছিলি, তখন সবাই এসেছিল। কী যেন কাজ করেছে সবাই মিলে নীলের সাথে। তারপর রাত একটার দিকে মনে হয় বাসায় চলে গেছে। তা হঠাৎ মৃন্ময়ের কথা কেন জিজ্ঞেস করছিস?
- না মা, এমনিতেই।
- আচ্ছা, এখন তাড়াতাড়ি খেতে আয়।
- ঠিক আছে।
মৃন্ময় ভাইয়া হলেন নীল ভাইয়ার মামাতো ভাই। জানি না, কেন? তবে মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, হয়ত এই বেনামি চিঠির পিছনে মৃন্ময় ভাইয়ার হাত আছে। কিন্তু সত্যিটা না জেনে তো কাউকে কিছু বলা যাবে না। কী আর করার আছে অপেক্ষা করা ছাড়া? তাই এখন এক বছর অপেক্ষা করতে এই বেনামি চিঠির মালিককে খুঁজে বের করতে।
ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং রুমে যেতেই সবাই একসাথে বলে উঠলো,
- হ্যাপি বার্থডে কথামনি।
হাসি হাসি মুখ নিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। নীল ভাইয়ার পাশের চেয়ারেই বসলাম। উনার পাশেই সবসময় খেতে বসতে হয় আমাকে। আমি নাকি একদম খাওয়াদাওয়া করি না। তাই উনি সবসময় আমার খাওয়ার ব্যাপারে আমাকে বকাঝকা করেন। আজকে আমার জন্মদিন অথচ উনি আমাকে একবার উইশও করলেন না। এসেও দেখছি রাক্ষসের মতো খেয়েই যাচ্ছেন। উইশ তো দূরের কথা আমার দিকে একবার তাকানোরও প্রয়োজন মনে করে নি এই হনুমানটা। আমি তো উনার বোন তাই হয়ত আমার দিকে তাকান না অথচ সুমাইয়ার দিকে ঠিকই হা করে তাকিয়ে থাকেন। হুহ!
শুনেছি, এই হনুমানের নাকি আবার গার্লফ্রেন্ডও আছে। হায় আল্লাহ! তুমি ঐ বেচারীকে দেখে রেখো। না জানি কী অবস্থা করে ঐ বেচারীর? তবে কাকে পছন্দ করেন বা কে সে? সেই সম্পর্কে কেউই কিছু জানে না। যেই রাগী উনি তাই সাহস করে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। তবে আমার জানতে অনেক ইচ্ছে করে যে, কোন মেয়ের জীবনটা উনি তেজপাতা বানাচ্ছেন? হঠাৎ জেঠীমা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
- কিরে কথামনি? আজকে কী বানাবো তোর জন্য?
আমি খুশিতে গদোগদো হয়ে বললাম,
- পুলিপিঠা খাবো জেঠীমা।
আমার কথা শুনে জেঠী মা হেসে হেসে বললো, - ধুর পাগলী! জন্মদিনে পিঠা? তার চেয়ে অন্য কিছু বল। পিঠা তোকে অন্য কোনো দিন বানিয়ে খাওয়াবো।
আমি একটু ভেবে বললাম, - তাহলে তোমার যেটা ভালো লাগে সেটাই বানিয়ে রেখো।
- ঠিক আছে। তা এবার তোকে চুড়ি দিতে হবে?
- হুম হুম, অবশ্যই দিতে হবে। দেখো না আমাকে চুড়ি পড়লে কত সুন্দর লাগে।
দুই হাত সামনে বাড়িয়ে জেঠী মাকে চুড়ি দেখাচ্ছি, তখন আমার ডান পাশ থেকে গম্ভীর গলায় নীল ভাইয়া বলে উঠলেন,
- তোর মতো পেত্নীকে আবার কেমন লাগবে? বড়জোর চুড়ি পড়ার পর পেত্নী থেকে প্রমোশন হয়ে শাঁকচুন্নির মতো লাগতে পারে।
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, এই হনুমানটা আমার পাশেই বসে আছে। আমাকে কথা গুলো বলে আবার রাক্ষসের মতো খেতে লাগলেন। হিংসুটে একটা। আমার খুশি উনার কখনোই সহ্য হয় না। যা মুখে আসে আমাকে তাই বলেন।
এতে আমি খুশি হলাম না কষ্ট পেলাম সেটা কখনোই ভেবে দেখেন না। আমি ঠোঁট উল্টে মুখ গোমড়া করে বসে আছি। উনি সব সময় আমাকে নিয়ে মজা করেন। উনার কথাগুলো শুনে আমার সব খুশি মাটি হয়ে গেলো। ইচ্ছে করছে খাবার রেখেই উঠে যেতে। কিন্তু উঠে গেলেও উনি আবার আমাকে কথা শুনাবেন। তাই চুপচাপ খেতে লাগলাম। আমার কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখে জেঠী মা উনাকে বললো,
- নীল, মেয়েটাকে এভাবে কেন বলিস? তুই তো জানিস ও চুড়ির জন্য কত পাগল।
একটু রাগ রাগ ভাব নিয়ে নীল ভাইয়া, জেঠী মাকে বললেন,
- মা, এসব পাগলামি জেনে আমার কোনো কাজ নেই। আমি_
উনি আর কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেন নি। কারন ডাইনিং রুমে হঠাৎ মৃন্ময় ভাইয়ার আগমন হলো। হাসি মাখা মুখে একটু চেচিয়ে মৃন্ময় ভাইয়া আমাকে বলে উঠলেন, - হ্যাপ বার্থডে কথকপাখি।
উনার মুখে ‘কথকপাখি’ নামটা শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে। আমার যখন মন খারাপ থাকে তখন মৃন্ময় ভাইয়া নামটা ধরে ডাকলে মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়। এখনও তাই হলো। হনুমানের কারনে যেই খুশিটা মাটি হয়েছিল সেটা মৃন্ময় ভাইয়া আবার ফিরিয়ে দিলেন। আমিও তাই হাসিমাখা মুখে বললাম,
- থ্যাংক ইউ ভাইয়া।
- কি কথকপাখি? মন খারাপ নাকি তোমার?
- না ভাইয়া, মন খারাপ না। আপনি বসুন ভাইয়া। আমাদের সাথে নাস্তা করে নিন।
- না না, আমি নাস্তা করেই এসেছি।
- ও আচ্ছা।
জেঠীমা, মৃন্ময় ভাইয়াকে বললো, - তোকে না বলেছি, আমাদের বাসায় এসে সকালে নাস্তা করবি।
- ফুপ্পি, কী করবো বলো? মা তো না খেয়ে বাসা থেকে বের হতে দেয় না।
- ভাই কেমন আছে রে আর ভাবী?
- হ্যাঁ, ভালো। তবে বাবার ব্লাডপ্রেশার কালকে একটু বেড়ে ছিল। আজকে আল্লাহ রহমতে ভালোই আছেন। আর মাও ভালোই আছেন।
হঠাৎ আমি মৃন্ময় ভাইয়াকে বলে উঠলাম,
- ভাইয়া, রাত্রি কেমন আছে? ওকে কেন নিয়ে আসেন না আপনার সাথে?
- হুম ভালো আছে। রাত্রি তো আসতেই চায় কিন্তু_।
ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে আমি বলে উঠলাম, - কোনো কিন্তু না ভাইয়া আজকে বিকেলে রাত্রিকে নিয়ে আসবেন।
ভাইয়া একটু হেসে আমায় বললো, - ঠিক আছে। নিয়ে আসবো।
নীল ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, - কিরে খাওয়া শেষ হয় নি তোর?
নীল ভাইয়া গম্ভীর গলায় বললেন, - হুম।
- তাহলে চল এবার। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
নীল ভাইয়া, জেঠীমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- মা, আমি ভার্সিটিতে গেলাম।
জেঠীমা ‘হ্যা’ সূচক মাথা নাড়ালেন। চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে নীল ভাইয়া বললেন, - খাওয়া শেষ করে, সব পড়া কমপ্লিট করে রাখবি। জন্মদিন বলে নাচানাচি যেন করতে না দেখি।
আমি মলিন মুখে জবাব দিলাম,
- আচ্ছা ভাইয়া।
মৃন্ময় ভাইয়াকে সাথে নিয়ে উনি ভার্সিটিতে চলে গেলেন। সব সময় আমাকে শুধু শাসনই করেন। আমার মা বাবাও আমাকে এমন শাসন করেন না উনি আমাকে যেভাবে শাসন করেন।
ইংরেজিতে কোনো রকম পাশ করি বলে মা আমাকে এই হনুমানের কাছে পড়তে দিয়েছে। এমনিতেই উনার জ্বালায় আমি বাঁচি না তারউপর উনার কাছে পড়তে গেলে তো আমাকে নাজেহাল করে ছাড়েন। আর কিছু না ভেবে খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে চলে এলাম।
বই খাতা নিয়ে পড়তে বসলাম। পড়ছি বললে ভুল হবে আসলে বসে বসে পা দুলাচ্ছি। পা আর টেবিলে ধাক্কা লাগছে বারবার। ফলে ঝুনঝুন শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে নুপুরে। দৃষ্টি আমার বইয়ের পাতা কিন্তু মনোযোগটা নুপুরের ঝুনঝুন শব্দে। চুড়িতে ভরতি দুই হাত ব্যস্ত বারবার কলমের ক্যাপ খুলতে আর লাগাতে।
পাঁচ মিনিটও হয় নি পড়তে বসেছি অথচ মনে হচ্ছে যেন পাঁচ ঘন্টা ধরে পড়ছি। ইংরেজি বিষয়টা বরাবরই আমার কাছে খুবই ভয়ানক লাগে।
খুবই বিরক্ত লাগছে পড়তে তাই ভাবলাম একটা গান শুনি তারপর না হয় পড়বো। হাতের কলমটা রেখে ফোন নিয়ে গান খুঁজতে লাগলাম। খুঁজে খুঁজে একটা তামিল ছবির গান পেলাম। গান প্লে করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিলাম,
Un Peyaril En Perai Serthu
Viralode Uyir Koobal koorthu
Oor Munne Ondraga Naamum
Nadandhaal Enna
En Nenjam Theeye
Ul Engum Neeye
Kan Moodum Bothum
Kan Mum Nindraaye
Sirikadhe Sirikadhe
Siripale Mayakadhe
Adikadhe Adikadhe
Adikadhe Adikadhe
আমি সবচেয়ে বেশি বাংলা গান পছন্দ করি। মায়ের ভাষা বাংলা আর কী মধুরই না লাগে বাংলা ভাষা। এমন একটা ভাষায় কথা বলতে পেরে নিজেকে অনেক ধন্য মনে হয়। তবে অন্যান্য ভাষা যেমনঃ হিন্দি, তামিল, তেলেগু, পাঞ্জাবি, কোরিয়ান, জাপানি এসব ভাষার গানও আমার অনেক ভালো লাগে। কিন্তু ইংরেজি গান শুনলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। তাই ইংরেজি গান থেকে একশ হাত দূরেই থাকি। নীল ভাইয়া অবশ্য ইংরেজি গান অনেক পছন্দ করেন।
আমাকে মাঝে মাঝে বলেনও ইংরেজি গান শুনতে। কিন্তু কে শুনে কার কথা? উনাকে দেখলে হয়ত একটু শুনি কিন্তু উনি না থাকলে ভুলেও ইংরেজি গান শুনতে ইচ্ছে করে না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই জোরে জোরে বলে উঠলাম,
- এই যা! একটা দুটো করে গান শুনতে শুনতে তো পুরো একঘন্টাই পার করে ফেললাম। এখন কী হবে?
তাড়াতাড়ি গান শোনা বন্ধ করে পড়ায় মন দিলাম। যে করেই হোক সব পড়া শেষ করতে হবে নাহলে আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে।
পর্ব-২
বাবা জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালন করা কখনোই পছন্দ করেন না। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা তাই আমার জন্য সামান্য হলেও ঘরোয়া আয়োজন করতে হয়। আজকেও তাই করা হয়েছে। ক্ষুদ্র পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষকে নিয়ে। অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে সুমাইয়া, রাত্রি আর মৃন্ময় ভাইয়াকে। আপ্যায়নের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে ঘরের তৈরি খাবার আর সেই সাথে কিনে আনা হয়েছে আমার পছন্দের চকলেট কেক।
বিকেলের শেষ রোদটুকু যেন এক নিমিষেই ফুরিয়ে যায়। আকাশ পানে তাকিয়ে থেকেও যেন শেষ রোদটুকু ধরে রাখা যায় না। সূর্যকে ডুবিয়ে চাঁদের আগমন ঘটবে বলেই হয়ত এতো তাড়া দিয়ে রোদটুকু মিলিয়ে যায়। জানালা ভেদ করে আসা রোদটা গায়ে মেখে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ঘুমঘুম চোখে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি চারটা বেজে গেছে। এখন দিনের চেয়ে রাত বড় তাই সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সূর্য ঘুমিয়ে পড়ে আর চাঁদ জেগে উঠে ঝলমল করে।
ফ্রেশ হয়ে নিলাম খুব দ্রুত। এখন আয়নার সামনে চুলগুলো বিনুনি করতে আমার হাত দুটো ব্যস্ত। মাঝেমাঝে তাকিয়ে দেখছি আয়নাতে বিনুনি ঠিক মতো হচ্ছে কি না। হঠাৎ মিতালির আগমন ঘটলো আমার রুমে। তড়িঘড়ি করে এসে আমায় বললো,
- আপামনি? কাকিমা আপনারে ডাকে।
মিতালি আমাদের বাসায় তিন চার বছর ধরে আছে। বয়স সতেরো আঠারো হবে। বাড়ির সব কাজে মা আর জেঠীমাকে সাহায্য করে। মিতালির মুখে ‘কাকীমা’ শুনে বুঝতে পারলাম যে মা ডাকছে। বিনুনি করতে করতে জবাব দিলাম,
- ঠিক আছে। তুই যা আমি আসছি।
সবগুলো দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে বললো, - আইচ্ছা।
হেলেদুলে মিতালি চলে গেলো। মেয়েটা বড্ড চঞ্চল। তবে কাজে যেমন পটু তেমনই বেশ মিশুক প্রকৃতির। আমার মতো মিতালিও নীল ভাইয়াকে বড্ড ভয় পায়। কিন্তু আমাকে যতটুকু শাসন করেন তার চার ভাগের একভাগও মিতালিকে করেন না। তাও কেন সে এতো ভয় পায় সেটাই আমার বুঝে আসে না?
আমি চুল বাঁধা শেষ করে রুমে থেকে বের হতেই দেখি সুমাইয়া চলে এসেছে। একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
- হ্যাপি বার্থডে কথামনি।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অভিমানী সুরে বললাম,
- না আসলেই হতো। কী দরকার ছিল আসার?
আমার গাল টিপে আহ্লাদী সুরে বললো, - রাগ করছিস কেন টিয়াপাখি? আসলে রেডি হতে একটু দেরি হয়ে গেলো।
আপাদমস্তক সুমাইয়াকে পর্যবেক্ষন করে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলাম, - আজকে কি আমার বিয়ে?
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে, - মানে?
- এতো সেজেগুজে এসেছিস কেন? নীল ভাইয়াকে দেখাতে বুঝি?
হাত দিয়ে মুখ চেপে একটু লাজুক হাসি হেসে বললো। - আরে না রে। কী যে বলিস না তুই? নীল ভাইয়ার জন্য কেন সাজবো? তাছাড়া উনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে।
- হুম, তা তো আছেই। কিন্তু তোর হাবভাব কেন জানি আমার ঠিক সুবিধার মনে হয় না?
- কী বলছিস?
আমি ভাবলেশহীন ভাবে বললাম,
- ঠিকই বলছি। হুহ!
- ঠিক বলছিস না ছাই! আচ্ছা বাদ দেয় এসব কথা। এই নেয় তোর গিফট।
প্যাকিং করা বক্সটা সুমাইয়ার হাত থেকে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম। কি থাকতে পারে সেটা বুঝতে না পেরে ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, - কি আছে এতে?
- খুলেই দেখ।
খুলতে চেয়েও না খুলে বললাম, - উম, না থাক পরেই দেখবো।
হঠাৎ ড্রয়িং রুম থেকে মা ডেকে বললো, - কথামনি, রাত্রি এসেছে।
- আসছি মা।
রাত্রির নাম শুনে খুশিতে গদোগদো হয়ে সুমাইয়াকে বললাম, - চল চল, রাত্রি এসেছে।
- তো?
একটু রেগে, - তো তোর মাথা। আচ্ছা, সবসময় রাত্রির সাথে এতো হিংসে করিস কেন?
- আজব তো! আমি আবার উনার সাথে কখন হিংসে করতে গেলাম?
আঁড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
- তাহলে সেদিন ওর দিকে রাগী ভাব নিয়ে তাকিয়ে ছিলিস কেন?
আমতা আমতা করে জবাব দিলো, - আআমি আবার কখন__
কথার মাঝে সুমাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগলাম, - থাম, তোকে আর ব্যাখা দিতে হবে না। এখন চল।
আমি সুমাইয়াকে টানতে টানতে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলাম। এসে দেখি নীল ভাইয়ার সাথে মৃন্ময় ভাইয়া হেসে হেসে কথা বলছেন। আর মৃন্ময় ভাইয়ার পাশে অস্বস্তি নিয়ে দাড়িয়ে আছে রাত্রি। ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই রাত্রির দিকে তাকিয়ে হাসি মাখা মুখে বললাম, - রাত্রি?
আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,
- হ্যাপি বার্থডে কথামনি।
- আমি তো ভেবেছিলাম আসবে না তুমি। ভাইয়া তোমায় নিয়ে আসলো তাহলে।
আমায় ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, - তোমার কথা কী ভাইয়া ফেলতে পারবে বলো? আফটার অল ভাইয়ার একমাত্র পাখি তুমি। আই মিন কথকপাখি।
বলেই হাসতে লাগলো। আর এদিকে লজ্জারাঙ্গা মুখে কিছু একটা বলবো বলে ভাবছি। কিন্তু আমার ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে সুমাইয়া রাগী ভাব নিয়ে রাত্রিকে বললো, - কথামনি কারোর একার পাখি না। সো কেউ যেন এসব আজগুবি কথা না বলে।
আচমকা সুমাইয়ার এমন কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম আর রাত্রি তো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। অবাক হলেও বেশ স্বাভাবিক ভাবে রাত্রি বললো, - মিস. সুমাইয়া, আমি আজগবি কথা বলি নি। আর আপনি সবসময় আমার পিছনে না লাগলে হয়ত আমি খুশি হবো।
আমার দিকে তাকিয়ে, - কথামনি, এটা তোমার জন্য আমার আর ভাইয়ার পক্ষ থেকে।
রাত্রির হাত থেকে দুটো প্যাকিং করা বক্স নিয়ে হাসি মাখা মুখে বললাম, - থ্যাংকস রাত্রি।
আর কিছু বলবো তার আগেই নীল ভাইয়া আমাকে ডাকতে লাগলো। আমি গিফটগুলো রেখে উনার কাছে ছুটে এসে দাঁড়াতেই মৃন্ময় ভাইয়ার বললো, - হ্যালো কথকপাখি, কী খবর? দুপুরে খাওয়াদাওয়া হয়েছে?
উনার একনাগাড়ে সব কথা শুনে উত্তর কি দিবো সেটা ভেবে কনফিউজড হয়ে গেলাম। বেশি কিছু না ভেবে জোরপূর্বক একটা হাসি দিয়ে ছোট্ট করে বললাম, - হুম।
পাশ থেকে নীল ভাইয়া বললো,
- শোন, মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর সব কি শেষ হয়েছে নাকি আরো সময় লাগবে? আর বলিস অনুষ্ঠান তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে।
- ঠিক আছে ভাইয়া।
ছয়টা বেজে দশমিনিট। মাগরিবের সময় পেড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। ভাইয়ার কথা মতো তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান শুরু করা হয়েছে। বাহারি খাবারে ভরপুর টেবিলের সামনে সবাই মিলে দাঁড়িয়ে আছি বেশ উদগ্রীব হয়ে। মৃন্ময় ভাইয়া বললেই কেক কাটতে শুরু করবো ২২ টি মোমবাতিতে ফুঁ দিয়ে। ভাইয়ার ক্যামেরায় কী যেন সমস্যায় হয়েছে তাই ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছি বিরক্ত আর উত্তেজনা নিয়ে।
উত্তেজনাটা হচ্ছে মোমবাতিতে ফুঁ দিতে পারছি না বলে। কারন এগুলোর দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছে আমায় ডেকে বলছে,
- কথামনি, আর কত জ্বলবো রে? এবার তো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয়।
প্রায় দশমিনিট অপেক্ষার পর মৃন্ময় ভাইয়ার হুকুমে নিভিয়ে দিলাম মোমবাতিগুলো। সাথে সাথে সবাই বলে উঠলো, - হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু কথামনি।
কেক কেটে একে একে সবাইকে খাইয়ে দিলাম কিন্তু নীল ভাইয়াকে খাওয়ানোর সাহস হয়নি। উনি এতো সব বাড়াবাড়ি কখনোই পছন্দ করেন না। দূরে একটা চেয়ারে বসে ফোন স্ক্রোল করছেন। সুমাইয়াকে কেক খাওয়ানোর সময় উনার দিকে একবার তাকিয়ে ছিলাম। পুরো নিরামিষ একটা মানুষ। কেন জানি মনে হয়? উনার মাঝে হয়ত অনুভূতি নামক সফটওয়্যারটা নেই।
মৃন্ময় ভাইয়া ছবি তোলা শেষ করে একটুকরো কেক তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। একটুখানি খেয়ে আমিও উনার দিকে কেক বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু উনি আমার হাতে কেক না খেয়ে নিজ হাতে নিয়ে খেলেন। এতে আমি একটু অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম,
- আমার হাতে খেলেন না কেন?
কেক খেয়ে ভাইয়া, নীল ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- নীল, তোর গিটারে সুর তুললে কিন্তু মন্দ হয় না।
গিটারের কথা শুনে আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে নীল ভাইয়ার দিকে তাকালাম। আমার হাসিখুশি মুখ দেখেও হনুমানের মায়া হলো না। আমার দিকে তাকিয়ে মৃন্ময় ভাইয়াকে বললো, - আবার এসব কেন বলছিস মৃন্ময়? মুড নেই এখন আমার এসবের।
উনার কথায় মুহূর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটু গিটার বাজালে কি উনার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? মৃন্ময় ভাইয়া আমার মলিন মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে উনাকে আবার বললেন, - আরে মামা, মুডের কী আছে? আমি গিটার নিয়ে আসছি তোর রুম থেকে। ওয়েট।
নীল ভাইয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করে ভাইয়া গিটার নিয়ে এসে উনার হাতে ধরিয়ে দিলেন। গিটার হাতে নিয়ে বেশ বিরক্তবোধ করলেন যা উনার মুখে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। উনার বিরক্তি মাখা মুখ দেখে ইচ্ছে করছে মানা করে দিয়ে বলি, - বোনকে তো উইশ করতেই ইচ্ছে করে না তাহলে গিটার বাজিয়ে আর কী উদ্ধার করবেন? তার চেয়ে এটা আপনার উনার জন্য রেখে দিন। হুহ।
চোখ বুঁজে উনি গিটারে মন দিলেন। এদিকে আমরা সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আনমনে হাতের সরু আঙুলগুলো নাঁচিয়ে উনি সুর তুলছেন গিটারে,
তোমাকে দিয়েছিলাম
চেনা চেনা কথা গুলো
এসো না জুড়ে নিতে
ছেঁড়া ছেঁড়া ব্যথা গুলো
তোমাকে দিয়েছিলাম
চেনা চেনা কথা গুলো
এসো না জুড়ে নিতে
ছেঁড়া ছেঁড়া ব্যথা গুলো
এ অগোছালো হাওয়া
ব্যস্ত আশা যাওয়া
আমাদের চেনালো কি?
আবছা হয়ে এসো
আমাকে ভালোবাসো
এরচেয়ে বেশি চেয়েছি কি?
তোমাকে দিয়েছিলাম
চেনা চেনা কথা গুলো
এসো না জুড়ে নিতে
ছেঁড়া ছেঁড়া ব্যথা গুলো
তোমাকে দিয়েছিলাম
চেনা চেনা কথা গুলো
এসো না জুড়ে নিতে
ছেঁড়া ছেঁড়া ব্যথা গুলো
গিটারের সুরে সুরে যেন হারিয়ে যাচ্ছি। উনার প্রতি জমে থাকা রাগটা যেন গিটারের সুর হাওয়ায় মিলিয়ে দিচ্ছে। আমি সুরের ভুবনে হারিয়ে যাচ্ছি।
আমরা সবাই জানি ভাইয়া খুব ভালো গিটার বাজাতে পারেন। কিন্তু এতোটা ভালো বাজাতে পারেন সেটা আগে জানা ছিল না। এতো সুন্দর গিটার বাজানোর জন্য ইচ্ছে করছে উনাকে এক প্যাকেট চকলেট গিফট করি। চকলেট গিফট করবো। কারন উনাকে আমি রোলেক্সের ঘড়ি গিফট করলেও নিবেন না। তাই চকলেট না নিলে আমি নিজেই খেয়ে ফেলবো।
ডিনার শেষ করার পর পর রাত্রি আর মৃন্ময় ভাইয়া চলে গেল। আর সুমাইয়া ডিনার না করেই চলে গেছে। আন্টি নাকি তাড়াতাড়ি চলে যেতে বলেছেন সেজন্য। আর আমি মাত্রই ডিনার শেষ করলাম। সবার সাথে খেতে ইচ্ছে করছিল না তখন। খিদে ছিলো না বলে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে যেই না রুমের দিকে পা বাড়িয়েছি ঠিক তখন-ই ভাইয়া গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
- কথামনি?
- জ্বী ভাইয়া।
- বইখাতা নিয়ে তাড়াতাড়ি আমার রুমে আয়। আমি রুমে গেলাম।
বইখাতার নাম শুনতেই কষ্টে চোখে পানি টলমল করতে শুরু করলো। মনে মনে বলতে লাগলাম, - আল্লাহ! উনাকে আপনি কী দিয়ে তৈরি করেছেন? মাটি দিয়েছেন নাকি শুধু ইট পাথর দিয়ে বানিয়েছেন? এমন একটা দিনেও কেউ পড়ার কথা বলবে? তারউপর দেখছে আমায় কত ক্লান্ত লাগছে তাও এমন করছে। যত্তসব।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, - কী হলো? বট গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
- ভাইয়া, আজকে না পড়লে হয় না?
হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
- কেন?
উনার ঐ রাগী মুখটা আমার ঠিক হজম হলো না। শুকনো একটা ঢোক গিলে কোনোরকম বললাম, - ঠিক আছে যাচ্ছি।
- হুম, কুইক।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রুমে এসে বই খাতা নিতে লাগলাম আর উনাকে খুব করে বকে গেলাম সাথে উনাকে দোয়াও করে দিলাম, - হনুমানের নাতি! আপনার গার্লফ্রেন্ড যেন আপনাকে বিয়ের পর মরিচগুড়ো দিয়ে তিনবেলা খেতে দেয়। আর প্রতিদিন দুটো চড় সাথে পাঁচটা ঘুষি উপহার দেয়। আমিন!
পর্ব-৩
নীল ভাইয়ার রুমে এসে দেখি পড়ার টেবিলে বইয়ে মুখ গুঁজে রেখেছেন। বইয়ের কভারে চোখ পড়তেই দেখলাম বড় করে লেখা ‘উত্তরাধিকার’। ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসটা সমরেশ মজুমদারের লেখা। আমি ভাইয়ার থেকে বইটা নিয়ে পড়েছিলাম অনেক আগে। তখন তিনি সবেমাত্র বইটা কিনে নিয়ে এসেছিলেন। সেদিন উনার হাতে বইটা দেখে বলেছিলাম,
- ভাইয়া, আমি আগে বইটা পড়ি?
উনি জবাবে কিছু না বলে আঁড়চোখে তাকিয়ে আমার দিকে বইটা বাড়িয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলেছিলাম, - বহুরূপী! আর এতো এতো রূপে আপনাকে দেখে আমি কনফিউজড হয়ে যাই। সেটা কি আপনি জানেন ভাইয়া?
ভাইয়া অনেক মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছেন বলে আমাকে লক্ষ্য করেন নি। তাই আমি শান্ত গলায় বললাম, - ভাইয়া?
বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন, - বস।
আমি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। অহেতুক বই খাতা নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। ভাইয়া বইয়ের দিকে ঝুঁকে ছিলেন বলে চুলগুলো কপালে এসে পড়ে আছে। বইটা বন্ধ করে আলতো হাতে চুলগুলো পিছনে ঠেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। হাতে কলম নিয়ে সেটা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
- হোমওয়ার্ক বের কর।
ভার্সিটিতে পড়া স্বত্ত্বেও শিশু শ্রেনীর বাচ্চাদের মতো হোমওয়ার্ক দিবেন আবার সেটা চেকও করবেন। আমি হোমওয়ার্ক বের করে উনাকে দিলাম। উনি চেক করে বললেন, - Benevolent মানে কি?
- দয়ালু।
বইয়ের পাতায় দৃষ্টি রেখে বললেন, - Synonyms বল।
- উম, Unselfish.
খানিকটা চমকে জিজ্ঞেস করলেন,
- Kind না বলে Unselfish কেন বললি? Kind তো তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল।
আমতা আমতা করে বললাম, - আসলে ভাইয়া, বিশেষ একটা দিকে মিল রেখে এটা মুখস্থ করেছি।
- কোন বিশেষ দিক?
- একজনকে Selfish মনে হয়। তো উনাকে মনে রেখেই Unselfish মুখস্থ করেছি।
বেশ স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, - কাকে? আমাকে?
উনার কথায় কাশি দিয়ে উঠলাম খানিকটা। মনে মনে বললাম, - এই হনুমান কী করে বুঝলো আমার মনে কথা?
উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
- কিছু বলছিস না কেন?
- না মানে_
- Antonyms বল এবার।
দাঁত কেলিয়ে বললাম, - Selfish.
উত্তর দিয়েও উনার দিকে দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছি। উনাকে Selfish বলতে পেরে মনে মনে আমি লুঙ্গি ডান্স দিচ্ছি। যখন এই শব্দটা মুখস্থ করেছিলাম তখন আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলেছিলাম,
- আল্লাহ! হনুমানকে তো মনে মনে গালি দিলেও ভয় লাগে। অন্তত পড়া দেওয়ার ছলে যেন উনাকে আমি এটা বলতে পারি তুমি সেই ব্যবস্থা করে দিও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ!
কিন্তু আমার কপালে লুঙ্গি ডান্স বেশি সময় রইলো না। আমার খুশিটা যেন উনার কাছে চিরতার মতো তেঁতো লাগছে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, - এটা সবাই পারে সো এটা বাদে বল।
আমি হতবাক হয়ে করুন গলায় বললাম, - ভাইয়া! আপনি তো একটাই মুখস্থ করতে বলেছিলেন। সেজন্য আমি একটা করেই মুখস্থ করেছি। এটা ছাড়া আমি আর কিছুই পড়ি নি।
- চেষ্টা কর। মনে আসবে।
উনার কথায় রেগে মনে মনে বললাম, - পড়েছিই একটা মনে কোথ থেকে আসবে? আকাশ থেকে? হুহ।
- পারবি না?
ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম, - উহুম।
- ওকে নো প্রবলেম। আমম, আর ইউ রেডি ফর পানিশমেন্ট?
উনি খুব নরম সুরে বললেন কিন্তু পানিশমেন্টের কথা শুনে মনে হচ্ছে এবার কেঁদেই দিবো। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে উনি রেগে বললেন, - পড়া পারিস না তো আবার কান্না কিসের শুনি? তুই কি ভেবেছিস তোর জন্মদিন বলে আমি তোকে ছেড়ে দিবো? আর তোর এইসব ন্যাকামো আই কান্ট টলারেট। সো আমাকে ডিসট্রাক্ট করার চেষ্টা ভুলেও করবি না। মাইন্ড ইট।
আমি কিছু বলছি না চুপচাপ মাথা নুইয়ে বসে আছি। চোখে পানি টলমল করছে বলে সামনে সব কিছু আবছা লাগছে। আমার মলিন মুখ উনাকে দমাতে পারলো না। উনি অনর্গল বলে গেলেন, - কালকে সকালে ব্রেকফাস্টে দুটো পরোটা, দুটো ডিম, দুটো কলা আর একগ্লাস দুধ খাবি। এটাই তোর শাস্তি। মনে থাকবে?
উনার কথার জবাবে ‘হ্যা’ সূচক মাথা নেড়ে আগের মতোই বসে আছি। এমন আজব শাস্তি মনে হয় না পুরো পৃথিবীতে কেউ দেয় আর না কখনও কেউ দিবে। উনি ভালো করেই জানেন যে, আমার খেতে ভালো লাগে না। আর খাওয়াদাওয়ায় অনিহারের কারনে শরীরের গঠন বেশ পাতলা আমার। তবে মানানসই আছে বলেই আমার মনে হয়। কারন ৪৯ কেজি অবশ্যই খুব কম ওজন নয়। তারপরও শুধুমাত্র আমাকে খাওয়ানোর জন্য শাস্তি হিসেবে এসব দিবেন। শাস্তি হিসেবে উনি সাধারণত এসবই দেন আর এতেই আমার বারোটা বেজে যায়। কারন একটা পরোটাই শেষ করতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে এতোকিছু অবশ্যই আমার জন্য পারফেক্ট পানিশমেন্ট। মা বাবাকে এসব বললে উনারা উল্টো আমায় বলে, - তোর রোগা শরীরে এর চেয়ে ভালো শাস্তি আর হতেই পারে না।
এমন উত্তর পাওয়ার পর আমার আর কিছু বলার থাকে না। আর এসবে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় আমার মা। কারন উনাকে আর কষ্ট করে আমাকে খাবার খাওয়ার জন্য তাড়া দেওয়া লাগে না। মা তো পারলে নীল ভাইয়াকে মাথায় করে রাখতো এসবের জন্য।
এমনিতেও আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন বলে আমার মনে হয়। এসবে আমার যে রাগে গা জ্বলে যায় সেটা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই।
উপন্যাসের বইটা খুলে আবার পড়তে শুরু করলেন। বইয়ে দৃষ্টি রেখে আমায় বললেন,
- যা গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আজকে আর পড়তে হবে না।
মলিন মুখে ছোট্ট করে জবাব দিলাম, - হুম।
তাড়াতাড়ি করলে যে, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয় না সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। যতই তাড়াতাড়ি করি না কেন ঠিক সেই দেরিই হবে। তারপরও অহেতুক দ্রুত গতিতে কাজ শেষ করার বৃথা চেষ্টা। ক্লাস আছে আজকে কিন্তু তাড়াহুড়ো করেও তৈরি হতে পারছি না। সকাল সকালই উঠেছি। তবুও এতো দেরিতে সব কিছু কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। সকালে নাস্তা করতে গিয়ে বমি করার জোগার হয়েছিল। ভাইয়ার দেওয়া শাস্তি অনুযায়ী জোরজবরদস্তি করে সব খেয়েছিলাম কিন্তু দুধটা আর সম্ভব হয়নি। বমি করার মতো খালি মুখে আওয়াজ হতেই জেঠীমা বলেছিল,
- অনেক খেয়েছিস আর খেতে হবে না। তাছাড়া জোর করে খেলে উল্টো শরীর খারাপ করতে পারে।
ভাইয়া কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখনই জেঠীমা আবার বলেছিলেন, - নীল, মেয়েটা এখন বমি করলে নিশ্চয়ই ভালো হবে না। তাই চুপ কর। কিচ্ছুটি বলবি না।
জেঠীমার মুখের উপর ভাইয়া আর কোনো কথা বলেনি। আমি দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। তখন আমার হাত থেকে দুধের গ্লাসটা কেড়ে নিয়ে জেঠীমা বলেছিল, - রুমে যা। চোখে মুখে পানি দিয়ে রেস্ট নেয়। তাহলে বমি বমি ভাবটা কেটে যাবে।
আমি ‘হ্যা’ সূচক মাথা নেড়ে রুমে চলে এসেছিলাম। জেঠীমার জন্য বড়জোড় বেঁচেছি সকালে। তাও কতগুলো খাবার খেতে হয়েছে আমাকে।
রেডি হওয়া প্রায় শেষ তাই আয়নাতে নিজেকে একটু দেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। মাকে আশেপাশে কোথাও দেখতে না পেয়ে খানিকটা চেঁচিয়ে বললাম,
- মা, আমি ভার্সিটিতে গেলাম।
মা বোধহয় কিচেনে ছিল। সেখান থেকে জবাব দিলো, - সাবধানে যাস।
মার উত্তরের জন্য কিঞ্চিৎ অপেক্ষায় ছিলাম। উত্তর পেয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটতে শুরু করলাম। দ্রুত পায়ে হাঁটার কারনে গেটের সম্মুখে এসে মৃন্ময় ভাইয়ার সাথে সংঘর্ষ হওয়ার উপক্রম হলো। কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়েছি বলে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। আমার এতো অস্থিরতা দেখে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো,
- কথকপাখি, এতো ছোটাছুটি করছো কেন?
আমি খানিকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, - না মানে।
আমাকে বলতে না দিয়ে, - রিলেক্স কথকপাখি, রিলেক্স। তা তোমার ক্লাস নেই? রাত্রি তো সেই কখন ভার্সিটিতে চলে গেছে। আমি তো ওকে পৌঁছে দিয়েই এলাম।
- হ্যাঁ ভাইয়া, ক্লাস আছে। আসলে আজকে দেরি হয়ে গেছে। তাই ফার্স্ট ক্লাসটা মিস হয়ে গেল।
- ওহ, তা একাই যাবে?
- জ্বী ভাইয়া।
- তুমি বললে আমি তোমাকে পৌঁছে দিতে পারি?
- না ভাইয়া। আপনি একবার তো গেলেন রাত্রিকে নিয়ে। আমি যেতে পারবো।
- তাতে কী? তুমি এসো আমার সাথে। আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
দেরি হয়ে গেছে কিন্তু ভাইয়ার বাইকে করে যেতে বেশ সংকোচ লাগছে। কারন এর আগে কখনও উনার বাইকে উঠিনি। কি করবো বুঝতে পারছি না? তাই অন্যদিকে তাকিয়ে ভাবছি, - কী বলা যায় উনাকে?
ভাইয়া হয়ত বুঝতে পেরেছেন আমি লজ্জা পাচ্ছি তাই নিজে থেকেই বললেন,
- ওকে। আমি বরং তোমায় একটা রিকশার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কেমন?
ভাইয়ার কথায় একটু স্বস্তি পেলাম। হালকা হেসে বললাম, - ঠিক আছে।
রিকশায় উঠে বসতেই ভাইয়া আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বললেন,
- সাবধানে যেও আর ভার্সিটিতে পৌঁছে ছোট ফুপ্পি টেক্সট করে দিও, কেমন?
উনার মায়া ভরা কথাগুলো শুনলাম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। নীল ভাইয়া আর মৃন্ময় ভাইয়া দুজনে আমার অনেক কেয়ার করেন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্র মনে হয় যেন মৃন্ময় ভাইয়াই বেশি কেয়ার করেন। আমি শান্ত গলায় জবাব দিলাম,
- ঠিক আছে। আমি মাকে টেক্সট করে দিবো।
উনি রিকশার হুট ধরে আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমার থেকে জবাব পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালা মামকে বললেন, - মামা, সাবধানে যাবেন।
- আইচ্ছা।
আকাশটা বরাবরই আমার কাছে খুব স্পেশাল হোক সেটা দিনের আকাশ বা রাতের। আকাশের কত-শত রূপে আমি যেন শতসহস্র বার তার প্রেমে পড়ে যাই। রাতের আকাশে স্নিগ্ধতা, বিকেলের আকাশে মুগ্ধতা, দুপুরের তপ্ত আকাশে উদাসীনতা, মেঘলা আকাশে শীতলতা, আরও কত কত রূপ আছে আমার এই আকাশের। এতো এতো রূপে পাগল হয়ে কখনো কখনো আপনমনে বিড়বিড় করে বলি,
- ও আকাশ! আমাকে তোমার করে নাও না। একদম তোমার করে। আমি যে, বড্ড ভালোবাসি তোমায়। তোমার প্রতিটা রূপ আমায় বারবার বাধ্য করে তোমাকে। হ্যাঁ, শুধু তোমাকেই ভালোবাসতে।
এসব বলে আবার নিজেই হেসে ফেলি নিজেকে পাগল ভেবে। আসলে মানুষের পাগলামির কোনো সীমা থাকে না। আর ভালোবাসায় কোনো সীমারেখা হয় না।
সুযোগ পেলেই ছাদে বা বেলকনিতে ছুটে আসি আমার ভালোবাসার আকাশকে দেখতে, তার সাথে মনে মনে কথা বলতে। এসব পাগলামো হলেও আমার কাছে এসব যে, আকাশের প্রতি আমার এক মুঠো ভালোবাসা।
আজকের আকাশটা বড্ড বেশি ভালো লাগছে। হালকা মৃদুমন্দ বাতাস আমায় স্পর্শ করছে। এমন একটা মুহুর্তে খুব করে গান গাইতে ইচ্ছে করছে। ছাদে আমি একাই দাড়িয়ে আছি আকাশের দিকে মুখ করে। তাই খানিকটা জোরে গান গাইতে শুরু করলাম,
বাতাসে কান পেতে থাকি
এই বুঝি ডাকছো তুমি
আকাশে চোখ মেলে থাকি
এই বুঝি পাঠালে চিঠি
একবার বলি
বারবার বলি
বলি যে লক্ষবার
তুমি আমার প্রিয়তম
তুমি যে_
এইটুকু বলে পিছন ঘুরে দাঁড়াতেই থমকে গেলাম। কেউ একজন আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা আমি একদমই টের পাইনি। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন নীল ভাইয়া। উনাকে দেখলেই কেন জানি আমার প্রাণপাখি উড়াউড়ি করতে থাকে। উনার গম্ভীর মুখ দেখে শুকনো একটা ঢোক গিলে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি দুই হাত ভাঁজ করে দাড়িয়ে আমায় বললেন,
- পেত্নীর গানের গলা কি আর রুনা লায়লা হবে? পেত্নীই থাকবে।
আমি জানি আমার গানের গলা খুব একটা ভালো না। তবে এতোটাও খারাপ না যে আমি গান গাইলে পেত্নীদের মতো লাগবে। কিন্তু উনাকে জবাব দেওয়ার মতো সাহস আমার নেই। তাই মনের কষ্ট মনেই চেপে রেখে দিলাম। আমার নিরবতাও হয়ত উনার কাছে ভালো লাগছে না তাই গম্ভীর গলায় বললেন,
- এখানে মূর্তির মতো দাড়িয়ে না থেকে আমার জন্য এককাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়।
বেশ রাগ লাগছে তবুও মুখ বুঁজে সব সহ্য করা। তাই শান্ত গলায় বললাম, - ঠিক আছে।
মুখে ‘ঠিক আছে’ বললেও মনে মনে বললাম,
- আমি না পেত্নী? তাহলে আমার হাতে কেন চা খাবেন? নিজে বানিয়ে খান নয়ত আপনার উনাকে বলেন। যত্তসব!
পর্ব-৪
আমি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ছাদ থেকে নামার জন্য সিঁড়ির কাছে আসতেই কানে এলো,
- কী খবর কথকপাখি?
কিঞ্চিৎ চমকে মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখি মৃন্ময় ভাইয়া। বেশ হাসি হাসি ভাব নিয়ে আমার থেকে উত্তরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন পলকহীন দৃষ্টিতে। উনার মুখে এই নামটা কেমন যেন জাদুর মতো লাগে আমার। ১৩০° রাগটা এখন ০° তে চলে এসেছে। যদিও রাগ মাপা যায় না তাও মনে মনে ডিগ্রি হিসেবে মেপে দেখলাম। আমার মাথায় যে এসব অদ্ভুত বিষয় কোথ থেকে আসে আল্লাহ মালুম।
মুখে মিষ্টি একটা হাসি ঝুলিয়ে ভাইয়াকে বললাম,
- জ্বী ভাইয়া ভালো। আপনার কী খবর?
বাইকের চাবিটা আঙ্গুলে অনবরত ঘুড়িয়ে জবাব দিলেন, - চলছে আর কী। তা নীল কি ছাদেই আছে?
- জ্বী ভাইয়া।
- ঠিক আছে।
বলেই ছাদের দিকে হাঁটতে লাগলেন। কিছু একটা মনে পড়তেই আমি উনাকে ঢেকে বললাম,
- ভাইয়া?
আমার দিকে ফিরে গজ দাঁতে হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, - কিছু বলবে কথকপাখি?
- জ্বী ভাইয়া। আসলে নীল ভাইয়া চা খাবেন তো আপনি খেলে আপনাকেও এক কাপ বানিয়ে দিতাম।
- তুমি বলেছো এতেই আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে। তোমাকে কষ্ট করে চা বানাতে হবে না কথকপাখি।
- না ভাইয়া কষ্ট কিসের? আমি তো চা বানাবো-ই। এক সাথে নাহয় দুজনের জন্য বানিয়ে দিবো।
- উম, তুমি যখন বলছো তাহলে তো চা খেতেই হয়।
- ঠিক আছে। তা চিনি কয় চামচ দিবো?
- নীল কয় চামচ খায়?
- আগে তো এক চামচ খেত কিন্তু এখন কোনো চিনিই খান না।
- ওহ, আমাকে দু’চামচ দিও। আমার আবার মিষ্টি একটু বেশিই পছন্দ।
- ঠিক আছে ভাইয়া।
পায়ের নুপুরে সুর তুলে আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নিচে। হনহন করে কিচেনে ঢুকে উনাদের জন্য চা বানাতে শুরু করে দিলাম। - এটা কি চা বানিয়েছিস নাকি চিরতা ভেজানো পানি নিয়ে এসেছিস?
আজকে অনেক মনযোগ দিয়ে চা বানিয়েছি। ভেবেছিলাম চা মুখে দিয়ে অন্তত আজকে আমার প্রশংসা করবেন নীল ভাইয়া। কিন্তু মৃন্ময় ভাইয়ার সামনে এভাবে আমার প্রশংসা করবেন সেটা আমার চিন্তারও বাইরে। চিরতার পানি কতটা তেঁতো জানি না তবে উনার কথাগুলো আমার কাছে চিরতার চেয়েও তেঁতো লাগছে। মুখ মলিন করে মাথা নুইয়ে দাড়িয়ে আছি উনার সামনে। আমাকে এভাবে অপদস্ত হতে দেখে মৃন্ময় ভাইয়া উনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- চিরতা কেন হবে? কথকপাখি তো খুব ভালো চা বানাতে পারে। এটা অবশ্য আমার জানা ছিল না।
- মৃন্ময়, তোর কাছে ভালো লাগলেও আমার কাছে মোটেও ভালো লাগছে না।
- তুই সবসময় এতো হাইপার হয়ে কেন থাকিস নীল? মাঝে মাঝে তো ওর প্রশংসা করলেও পারিস।
- প্রশংসা করার মতো আগে কিছু করুক তারপর নাহয় ভেবে দেখবো।
আমার দিকে তাকিয়ে নীল ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন, - পড়া শেষ করেছিস সব?
- উহুম।
- কেন?
পড়া তো সব শেষ করেছি সেই সকালেই। কিন্তু রাগে বললাম শেষ করিনি। উনার তিক্ত মেজাজ আমার একটুও ভালো লাগে না। পড়ার জন্য এখন আবার বকা দিবেন সেটা আমি জানি। এতো কষ্ট করে চা বানানোর পরও যার মুখে একটু ভালো কথা আসে না সে আমাকে পড়ার জন্য বকা দিলেও আমার কোনো আপত্তি নেই।
চুপচাপ দাড়িয়ে আছি বলে আবার জিজ্ঞেস করলেন, - চুপ করে আছিস কেন? আনসার মি।
ওপাশ থেকে মৃন্ময় ভাইয়া বলে উঠলো, - নীল, প্লিজ স্টপ। ভার্সিটি পড়ুয়া একটা মেয়েকে এভাবে কেন শাসন করিস?
- মৃন্ময়, ওকে আর আস্কারা দিস না তো। ভার্সিটিতে পড়লেই কেউ বড় হয়ে যায় না। আর এই পিচ্চি তো বিয়ের পরও পিচ্চি থাকবে। দেখবি ওর বর ওকে বলবে, ‘এমন বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করে ভুল হয়েছে’ তখন আমার কথা মিলিয়ে দেখিস।
উনার এসব কথা চুপচাপ হজম করছি আর মনে মনে ভাবছি, - আমি পিচ্চি না বুড়ি তাতে আপনার সমস্যা কোথায়? আর আমাকে যে বিয়ে করবে তার কি চোখ থাকবে না? সে তো দেখেই বিয়ে করবে। আর আমায় বিয়ে করলে যদি ভুল হয় তাহলে বিয়ে না করলেই তো পারে।
মৃন্ময় ভাইয়া উনার কথায় খানিকটা হেসে বললেন,
- বাদ দেয় তো। এখন চল কাজ আছে।
- কোথায় যাওয়ার কথা বলছিস?
- চল তো। গেলেই দেখতে পাবি।
- ঠিক আছে।
আমাকে উদ্দেশ্য করে,
- এখন ছাদে থাকিস না। সন্ধ্যাবেলায় ছাদে থাকা ঠিক হবে না। আর বিকেলের নাস্তা করে নিস।
আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়তেই উনারে চলে গেলেন। শাসন করে আবার কত কেয়ারও করে। উনার এসব ছোটখাটো যত্নে আমার কত-শত রাগ মাটির সাথে মিশে যায়।
চাপা ভয় নিয়ে ঠোঁট উল্টে চেয়ারে বসে আছি। আমার সামনেই গম্ভীর মুখে হোমওয়ার্ক চেক করতে ব্যস্ত নীল ভাইয়া। বেশ মনোযোগ দিয়েই দেখছেন আর মাঝে মাঝে হাতের কলমটা নাড়াচাড়া করছেন। ইংরেজি গ্রামার বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করলেন। পাতা উল্টাতে উল্টাতে জিজ্ঞেস করলেন,
- She is considering not to go— এটা কি ঠিক আছে?
শুকনো একটা ঢোক গিলে ছোট্ট করে জবাব দিলাম, - উহুম।
- তাহলে সঠিকটা কি বল।
- She is considering not going.
- গুড।
বই বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
- পড়া তো সব কমপ্লিটই করেছিস সাথে আজকে পড়াও ভালোই শিখেছিস দেখা যায়। তাহলে বিকেলে মিথ্যে কেন বললি?
কি বলবো বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করতে লাগলাম, - না মানে_
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন, - আমি কি খুব খারাপ?
হঠাৎ ভাইয়ার মুখে এমন কথা শুনে অনেক অবাক হয়ে গেলাম। উনার মাঝে অন্য কাউকে যেন দেখছি আমি। উনার করুণ সুরের কথাগুলো আমার মাঝে বিস্ময়ের সৃষ্টি করছে। আমি উনাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ভাবনায় বিভোর হয়ে গেলাম। আমাকে বিভোর হতে দেখে ভাইয়া বললেন,
- কিরে কিছু বলছিস না কেন? খুব কি খারাপ আমি?
স্বাভাবিক হয়ে ভাইয়াকে বলতে লাগলাম, - ভাইয়া, আপনি তো_
এতোটুকু বলতেই জেঠীমা এসে বললো, - কথামনি, তোর বাবা তোকে ডাকছে। এখুনি যেতে বলেছে।
জেঠীমার কথা শুনে আমি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। ভাইয়া চোখ বুঁজে ডান দিকে মাথা হেলালেন। আমি বুঝে গেলাম অনুমতি পেয়ে গেছি। হালকা হেসে উঠতে যাবো তখন জেঠীমা হেসে হেসে বললো,
- বাহ বাহ! এতো মানছিস নীলকে? সারাজীবন কিন্তু এভাবেই মানতে হবে।
জেঠীমার কথার জবাবে কিছু না বলে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বাবার কাছে চলে এলাম।
হাতের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ঠিক বারোটা বাজে। আধঘন্টা ধরে ক্যান্টিনে বসে আছি। বাংলা ক্লাস ছিল যেটা স্যার হঠাৎ-ই ক্যানসেল করে দিয়েছেন। উপায় না দেখে ক্যান্টিয়ে একা একা বোরিং সময় পার করছি। সুমাইয়ার লাইব্রেরিতে কি যেন কাজ আছে। আমাকে খুব করে বলেছিল,
- প্লিজ কথামনি, চল আমার সাথে লাইব্রেরিতে।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেছিলাম, - ভালো লাগছে না কোথাও যেতে তুই একাই যা। নয়ত তূর্যকে বল তোর সাথে যেতে।
- ওহ, তুই তাহলে যাবি না?
- নাহ।
- ওকে ফাইন। আমি তূর্যকে নিয়েই যাচ্ছি।
আমি সাথে যাই নি বলে সুমাইয়া যে অভিমান করেছে সেটা আমি ভালোই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু মন ভালো ছিল না বিধায় যেতে ইচ্ছে করেনি। - আরে কথামনি! এখানে একা একা কি করছো?
বই হাতে রাত্রিকে দেখলাম আমার দিকে এগিয়ে আসতে। একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, - এইতো বসে আছি। তা তোমার ক্লাস নেই?
আমার পাশে এসে বসে বললো, - মাত্র শেষ করে এলাম। খুব খিদে পেয়েছে তো তাই। তা তুমি এখানে?
- আমার ক্লাস নেই তাই বসে আছি।
- ওহ! আমি কিছু খাবো। তুমি কি খাবে বলো আমি দুজনে জন্য নিয়ে আসি।
- নাহ! আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমিই খাও।
- এসব বললে শুনছি না। তাড়াতাড়ি বলো কি খাবে? আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।
- ঠিক আছে তাহলে সমুচা নিয়ে আসো।
- আর?
- নাহ! আর কিছু খাবো না। আমি এমনিতেও বাইরের খাবার খুব একটা খাই না।
- উম, ঠিক আছে। তাহলে আর জোর করছি না।
পর্ব-৫
রাত্রি খাবার আনতে চলে গেল আর আমি ফোনে মনোযোগ দিলাম। প্রায় দশ বারো মিনিট পর খাবার নিয়ে ফিরলো। একরাশ বিরক্তি ভরা মুখে রাত্রি বলতে লাগলো,
- ধ্যাত! আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করলেই সেটা ক্যান্টিনে থাকবে না।
আমি কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম, - কী হয়েছে?
- আর বলো না।
- ঠিক আছে বলবো না। কিন্তু মুড অফ কেন সেটা বলো।
আমার কথায় রাত্রি হেসে হেসে বললো, - কথামনি, তুমিও না।
হাতের খাবার গুলো টেবিলে রেখে বলতে লাগলো, - আমার বার্গার খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বার্গার নাকি শেষ হয়ে গেছে। তাই এখন স্যান্ডউইচ খেতে হচ্ছে।
- আহারে! তাহলে তো খুব দুঃখের বিষয়।
- হুম, আমার তো রীতিমতো কান্না করতে ইচ্ছে করছে।
বিস্মিত হয়ে, - পাগল নাকি! ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে বার্গারের জন্য কান্নাকাটি করলে লোকে বলবে কী?
- লোকের কথা বাদ দাও তো। পরচর্চা করা ছাড়া তো তাদের আর কোনো কাজকর্ম নেই।
- এটা কিন্তু একদম ঠিক বলেছো।
হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই রাত্রি বললো, - দেখো দেখি কান্ড! এসে শুধু বকবকই করছি। এই নাও তোমার সমুচা।
আমার দিকে সমুচা এগিয়ে দিতেই আমি হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে নিলাম। খেতে খেতে আমি আর রাত্রি গল্পগুজব করতে লাগলাম।
মিনিট পাঁচেক পর, হঠাৎ সুমাইয়া আর তূর্য এসে হাজির। রাত্রিকে দেখেই সুমাইয়ার মুখখানা কালো মেঘে ঢেকে গেল। ওর সাথে রাত্রির ছোটখাটো একটা বিরোধ আছে। বিরোধ থাকার পিছনে আবার ছোট্ট একটা কাহিনি আছে। আমি বলবো, সিনেমার চিরচেনা একটা কাহিনি।
এক দেড় মাস আগে_
আমার, সুমাইয়ার আর রাত্রি ক্লাস একই সেকশনে। ক্লাস শেষ হতেই স্যার বেরিয়ে গেলেন। আমার ব্যাগ গুছাতে দেরি হয়ে গেল বিধায় রাত্রি আর সুমাইয়াও আগে আগে বেরিয়ে গেল ক্লাস থেকে। আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে খানিকটা দৌঁড়ে ক্লাস থেকে বের হতেই স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম।
মুহুর্তেই আমার চোখের সামনে বাংলা চলচ্চিত্রের সেই অতি পরিচিত কাহিনি, যেখানে নায়ক নায়িকার সাথে অজান্তে ধাক্কা খায় আর নায়িকার হাত থেকে বই পড়ে গেলে সেটা তুলে দিতে দিতে সরি বলে– এই অংশটুকুন মঞ্চায়িত হলো।
আমি মুখ হা করে একবার চোখ বুঁজে দিচ্ছি আবার খুলে দিচ্ছি। আসলে নিজেকে বিশ্বাসই করাতে পারছি না যে, চোখের সামনে বাংলা চলচ্চিত্র মঞ্চায়িত হলো। এখানে নায়ক আর নায়িকার চরিত্রে রয়েছে যথাক্রমে তূর্য আর রাত্রি।
রাত্রির হাতে আগে কখনও বই নিতে দেখি নি, সবসময় ব্যাগেই রাখে। আজকে কাকতালীয় ভাবে হাতে বই ছিল। আর ধাক্কা লাগতেই কী সুন্দর বইগুলো পড়ে গেল। আর আমাদের নায়ক তূর্য নায়িকার চোখে এতোটাই ডুবে গেছে যে, না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে বই খুঁজে চলেছে ফ্লোরে।
এদিকে সুমাইয়া রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করছে। আর আমি এতো কিছু আমার চোখের সামনে ঘটতে দেখে উইথ আউট এক্সপ্রেশনে দাঁড়িয়ে আছি।
কিছু সময় দুজন, মেঝেতে হাঁটু ভর দিয়ে চোখে চোখ রেখে শব্দহীন আলাপচারিতা করলো। তারপর তূর্য বইগুলো তুলে দিতে দিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
- আই এম সরি।
রাত্রি হাত বাড়িয়ে বইগুলো নিয়ে তূর্যকে একটা লাজুক হাসি উপহার দিলো। অবাধ্য চুলগুলো কানে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
- ইটস ওকে।
ওদের এমন চোখাচোখি আর হাবভাব দেখে আমার একটা গান গাইতে ইচ্ছে করছে,
পড়ে না চোখের পলক
কী তোমার রূপের ঝলক
এদিকে আরেকজনেরও চোখের পলক পড়ছে না। না পড়ার কারণ হলো পলকহীন মানুষটা এই দুজনের উপর খুব রেগে আছে। এতোটাই রেগে আছে যে, ওদেরকে খুন করতেও দ্বিতীয়বার ভাববে না। নিজেকে খুনীর জায়গায় দাঁড় করাতে প্রস্তুত মানুষটা হলো সুমাইয়া।
রাগে ওর মুখখানা লাল টমেটো মতোন দেখাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে ওদের সব কাহিনি দেখে আমার দিকেও এক ঝলক তাকালো। তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল। আমি সুমাইয়ার রাগ কমাতে ওর পিছু নিলাম। পিছন থেকে ডাকতেও শুরু করলাম,
- সুমুপাখি, সুমুপাখি?
কিন্তু কে শুনে কার কথা? পেত্নীটা একবার ফিরেও তাকালো না আমার দিকে। আমার ডাক সম্পূর্ণ রূপে উপেক্ষা করে চলে গেল।
বর্তমান সময়ে_
পর্ব-৬
ঐ ঘটনার পর থেকে সুমাইয়া তো রাত্রিকে একদমই সহ্য করতে পারে না। আর ভুলেও যদি তূর্য আর রাত্রিকে একসাথে দেখে, তাহলে সুমাইয়ার মাঝে আগ্নেয়গিরির রূপ দেখা যায়। আর আমার মাঝে চাপা খুশির। সত্যি বলতে, ওদের তিনজনের এসব কর্মকান্ড আমার কাছে ছোটখাটো একটা বিনোদন মনে হয়।
তূর্য হলো সুমাইয়ার আপন চাচাতো ভাই। ওদের দু’জনের সম্পর্ক আপন ভাইবোনের মতোই। তূর্য সুমাইয়ার চেয়ে এক বছরের বড়। গান টান করে তবে তূর্যের হাবভাব কেমন যেন কবি কবি লাগে আমার কাছে।
কালো ফ্রেমের একটা চশমা থাকে চোখে, মাথার চুলগুলো সর্বদাই অগোছালো। আর অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবতে থাকে সারাক্ষণ। তূর্যের এসব আচরণে আমার তূর্যকে কবিই মনে হয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে, তূর্য কবিতা লিখবে সেই কথা চিন্তা করা আর আমার চাঁদে যাওয়া এক কথা। কারণ সে গান পছন্দ করলেও কবিতা একদমই পছন্দ করে না। কবিতা পছন্দ না করার কারণটা অবশ্য আমার জানা নেই। সুযোগ পেলে একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে।
তূর্য এসেও রাত্রির সাথে শব্দহীন আলাপচারিতা করছে। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? তাই নিরবতা ভেঙে তূর্য রাত্রিকে জিজ্ঞেস করলো,
- কেমন আছেন? উম, কী যেন নাম আপনার?
রাত্রি হালকা হেসে জবাব দিল, - রাত্রি।
- রাত্রি। হুম, নাইস নেইম।
আরেক দফা হালকা হাসি দিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো, - থ্যাংকস।
- আমার আবার নাম মনে থাকে না। সো নেক্সট টাইম যেন আপনাকে কষ্ট করে না বলতে হয়। তাই একটা গান দিয়ে আপনার নামটা নিজের কাছে গচ্ছিত করে রাখতে চাই।
কথাগুলো বলেই তূর্য গানে সুর দিলো,
রাত্রি নিঝুম
চোখে নেই ঘুম
তোমাকে ভেবে ভেবে
কাটাই প্রহর
রাত্রি নিঝুম
চোখে নেই ঘুম
তোমাকে ভেবে ভেবে
কাটাই প্রহর
চাপা কান্নার সুর
বুকেরই ভিতর
আমার হলে না তুমি
হয়ে গেলে পর।
তূর্যের গানের গলা সত্যিই খুব সুন্দর। ছেলে হোক বা মেয়ে, তূর্যের কন্ঠে গান শুনলে একবার হলেও বলবে,
- অসাধারণ!
চুপচাপ সবাই গানটা শুনছি। রাত্রি গানের সুরে সুরে হয়ত হারিয়েই গেছে সুরের ভুবনে। এই কাঠফাটা রোদের তেজেও গানের সুরে বসন্ত এসে যেন উঁকি দিচ্ছে রাত্রির মনে। অন্যদিকে ক্রোধে নিজের মাঝে কালবৈশাখী ঝড় অনুভব করছে সুমাইয়া। তবুও আজ কেন যেন কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে চুপটি করে বসে আছে। গান থামিয়ে তূর্য, রাত্রিকে উদ্দেশ্য করে বললো, - গান আমার ভীষণ পছন্দ। যদিও গানের গলা খুব একটা ভালো নয় তবে প্রায় গান গেয়ে থাকি।
রাত্রি শান্ত গলায় জবাব দিলো, - খুব একটা নয় আপনার গানের গলা খুবই সুন্দর। গত অনুষ্ঠানেই আমি প্রথম আপনার গান শুনেছিলাম। খুব ভালো লেগেছিল আমার কাছে। আর যেই গানটা পরিবেশন করে ছিলেন সেটা আমার ভীষণ পছন্দের একটা গান ছিল।
তূর্য এতোটা সময় দাঁড়িয়ে ছিল। এখন রাত্রির মুখে নিজের প্রশংসা শুনে চেয়ার টেনে বসলো, ভালো করে শুনবে বলে। চেয়ারে হেলান দিয়ে, চোখের চশমাটা ঠিক করে রাত্রিকে জিজ্ঞেস করলো, - কোন গানটা?
রাত্রি কিছু বলার আগে সুমাইয়া বলে উঠলো,
- তূর্য, তুই কি থামবি?
- আরে চুপ কর তো। গানের মর্ম তো একবিন্দুও বুঝিস না। তাও কথামনি গান টান শুনে বলে ওর সাথে একটু আধটু গান নিয়ে কথা বলা যায়। তুই তো পুরাই নিরামিষ তরকারি, যা মাঝে মাঝে নেওয়া যায় সবসময় না।
- কী বললি তুই আমায়?
- উফ, চুপ করতো। এতোদিন পর কাউকে পেলাম যার কাছে কিনা আমার গান ভালো লেগেছে।
- তুই বসে বসে আজাইরা কথায় কান ভরা আমি গেলাম। হুহ!
সুমাইয়া ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে, ক্যান্টিন থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল। ওর রাগে আমাদের মাঝে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ে নি। শুধু তূর্য একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, - আরে আজব তো!
আমি তো এমন ভাব নিয়ে বসে আছি যেন সুমাইয়া এখানে ছিলই না। আসলে আমার নিজেরই মনের উপর শনি লেগে আছে তো ওকে আবার কী বলবো?
আমাকে উদ্দেশ্য করে তূর্য বললো,
- এটা কী পাগল নাকি?
আমি বেশ শান্ত গলায় বললাম, - আপনার বোন আপনিই জানেন না তো আমি এখানে কী বলবো?
- তাও ঠিক। যাজ্ঞে ওইসব কথা। তা কী যেন বলছিলাম? ওহ হ্যাঁ, তা কোন গান?
রাত্রি প্রতুত্তরে কবিতার মতো করে গানটা বলতে লাগলো, - রাত নির্ঘুম বসে আছো তুমি
দক্ষিণের জানালা খুলে
যত নির্বাক অভিমান মনে
আজ সবটুকু নিলাম তুলে - ওহ আচ্ছা। তা এখন কি আবার শুনতে চান?
- আপনার যদি গানে সুর দিতে আপত্তি না থাকে, তবে আমার শুনতে কেন আপত্তি হবে?
হঠাৎ করে আমি বলে উঠলাম, - আমার আপত্তি আছে।
আমার কথায় দু’জনেই গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- কিসে আপত্তি?
আমি হ্যাবলাকান্তের মতো একটা হাসি দিয়ে বললাম, - এমনিতেই বলেছি।
রাত্রি আমায় বললো,
- উফ, কথামনি ফাজলামো না করে গানটা শুনতে দাও।
ভাবলেশহীন ভাবে বললাম, - ওকে।
চোখ বুঁজে তূর্য গানে সুর তুললো,
রাত নির্ঘুম বসে আছো তুমি
দক্ষিণের জানালা খুলে
যত নির্বাক অভিমান মনে
আজ সবটুকু নিলাম তুলে
এসো তবে বৃষ্টি নামাই
সৃষ্টি ছাড়া ভালোবাসায়
এসো তবে জোছনা সাজাই
দু’চোখে তারায় তারায়
রাত নির্ঘুম বসে আছো তুমি
দক্ষিণের জানালা খুলে
যত নির্বাক অভিমান মনে
আজ সবটুকু নিলাম তুলে
চুপচাপ ঝরছে শিশির কণা
রাতের পাখিরা সব গান গেয়ে যায়
নিশ্চুপ বাতাসে তোমার স্মৃতি
আমার গানের সুরে দূরে ভেসে যায়।
তোমার হাতে রেখে হাত,
শুরু হোক না
আরেকটা নতুন প্রভাত।
ঘুম ভেঙেছে দশমিনিট আগেই কিন্তু এখনও বিছানায় পড়ে আছি। আজকে আমার ছুটির দিন। শুধু ভার্সিটি নয়, নীল ভাইয়ার কাছে টিউশনও অফ আমার আজকে।
শুক্রবার দিনটা আমার কাছে যেন ঈদের দিন। সপ্তাহে এই একটা মাত্র দিনই আমার জন্য প্যারামুক্ত দিন। অনেক বেলা করে ঘুমালেও কেউ কিছু বলে না এমনকি নীল ভাইয়াও না।
ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। ঘুম ভাঙার পর শুয়ে থাকতেও ইচ্ছে করে না। তাই এখন আর বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও খুব একটা ভাল বোধ হচ্ছে না। তাই বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
নাস্তা করবো বলে ডাইনিং রুমে চলে এলাম। চেয়ার টেনে বসে মিতালিকে ডাকতে শুরু করলাম,
- মিতালি, মিতা+আলি, মিতালি?
এই মেয়ে এক ডাকে কখনও সাড়া দেয় না। আমি ডেকে ডেকে যেন হয়রান না হই তাই ওর নামের সন্ধিবিচ্ছেদ করে সেটা দিয়েও ডাকতে থাকি। ওর সেটা মোটেও বোধগম্য নয় আমি তা ভালোই বুঝতে পারি। তবুও ডাকি একটু বিনোদনের লোভে।
মিতালি আমাদের পরিবারে অনেকদিন যাবত আছে। তাই ওর প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে। কিন্তু শুনেছি, ওর পরিবার নাকি ওর বিয়ে দিবে বলে সম্বন্ধ দেখছে। সপ্তাহখানেক আগে ওর মা এসেছিল।
পরিবারে মা ছাড়া মিতালির কেউ নেই। বাবা আছেন কিন্তু না থাকার মতোন। মিতালির বয়স যখন চারমাস, তখন ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে ওর মাকে ফেলে রেখে চলে যায়। মিতালির মার মুখে উনার জীবন কাহিনি শুনেছিলাম, যখন আমার মার আর জেঠিমার কাছে বলেছিলেন। আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল উনার কথাগুলো শুনে।
মিতালি এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে অহেতুক হাসতে শুরু করলো। ওর লজ্জা মাখা হাসি আমার সৃষ্টি করলো অহেতুক কৌতূহল। আর আমার কৌতূহল মেটাতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
- এতো খুশি কেন তুই? ব্যাপার কী রে?
- খুশি না আপামনি শরম করতাছে।
খেতে খেতে বললাম,
- ঐ হলো। তা শরম করার কারনটা কী?
- আম্মায় আইছিল হেদিন।
- হুম, জানি। তোকে নাকি বাসায় নিয়ে যেতে চায়। খুব সম্ভবত তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।
হঠাৎ-ই জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলতে লাগলো, - আর কইয়েন না আপামনি, শরম করে তো।
মিতালির মাত্রাতিরিক্ত লজ্জা দেখে আমি নিরস গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
- লজ্জার কী আছে? তোকে দেখতে আসছে বিয়ে করতে তো নয়।
- আমার করলে কী করমু কন?
অবাক হয়ে, - কী করলে?
- ইশ, আল্লাহ! আপামনি গো শরম, শরম।
- হায়রে! যা তো আর লজ্জা পেতে হবে না। আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। নাস্তা নিয়ে আয় আমার জন্য।
- আইচ্ছা।
ইংরেজি বিষয়টা হয়ত ততটাও জটিল নয় আমার কাছে যতটা জটিল মনে হয়। ইংরেজি বইয়ের পাতায় নজর দিতেই আমি চোখে যেন লাল নীল সাদা কালো দেখতে শুরু করি। সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট মনযোগ ধরে রাখতে পারি ইংরেজি বিষয়ে। এরপর আমার কী হয় আল্লাহ মালুম।
কালকে নীল ভাইয়া বেশ কিছু পড়া দিয়েছিলেন ইংরেজির উপর। আজকে যেহেতু ছুটি আছে তাই ভাবলাম, পড়াগুলো শেষ করে ফেলি। বইয়ের পাতায় আমার স্থির দৃষ্টি কিন্তু মনটা নড়বড়ে হয়ে আছে। চোখের সামনে ইংরেজি বই মেলে রেখেছি কিন্তু চোখে ভাসছে চুড়ির ছবি।
কালকে চুড়ির কিছু ছবি গুগুল থেকে ডাউনলোড করেছিলাম। আমার ফোনের গ্যালারি ভরে আছে অসংখ্য চুড়ির ছবিতে। প্রায়শই সেগুলো দেখে মন ভরাই।
আমার রুমের দরজার দিকে পেছন দিয়ে পড়ার টেবিলে, বইয়ে মুখ গুঁজে আছি আমি। হঠাৎ কেউ একজন পিছন থেকে বলে উঠলো,
- কিরে কথামনি? কী করছিস?
পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখি সুমাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাসি মাখা মুখে বললাম, - আরে তুই! আয়, আয়, ভিতরে আয়। তা হঠাৎ কী মনে করে এই সকাল সকাল আমার বাড়িতে তোর পায়ের ধুলো দিলি?
আমার পাশেই বিছানায় বসতে বসতে বললো, - কী যে বলিস না তুই? আর সকাল সকাল কোথায় পেলি? ঘড়ি দেখা কী ছেড়ে দিয়েছিস? তাকিয়ে দেখ, এগারোটা বাজতে চললো।
- লেকচার না দিয়ে আসল কথা বল।
- হুম।
এই বলেই সুমাইয়ার মুখখানা মলিন হয়ে গেল। মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, - তোকে বলেছিলাম না আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে?
- হ্যাঁ।
- এবার মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়েই যাবে।
- এই কথা বলতে এসেছিস?
আমার দায়সারা ভাব দেখে সুমাইয়া চমকিত নয়নে জিজ্ঞেস করলো, - এভাবে কেন বলছিস?
- তো কী ভাবে বলবো বল? এই পর্যন্ত পাঁচ পাঁচজন পাত্র এসে তোকে দেখে গেছে। আর প্রতিবারই তুই এসে আমায় বলতিস, ‘এবার বোধহয় বিয়ে হয়ে যাবে, এবার বোধহয় বিয়ে হয়ে যাবে’ এই এককথা শুনতে আমার কান হাঁপিয়ে উঠেছে। এখন ট্রাই সাম থিং নিউ।
আড়ঁচোখে তাকিয়ে রাগী ভাব নিয়ে বললো, - তুই আমার সাথে ফাজলামো করছিস?
পর্ব-৭
- না তো। ফাজলামো কেন করবো? আজব তো!
- প্লিজ কথামনি, ফাজলামো না করে কোনো সলিউশন দেয়।
- সুমুপাখি, আমি তোকে কী করে সলিউশন দিবো?
এইটুকুন কথা বেশ শান্ত গলায় বলে হঠাৎ-ই রাগী ভাব নিয়ে বললাম, - আমি কি সলিশনের বস্তা নিয়ে বসেছি? হ্যাঁ? এসব নিয়ে একদম আমার সাথে কথা বলবি না। কারন তোর বিয়ে এই জীবনেও হবে না। হুহ।
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে, - কেন? কেন?
- এটা কথামনির ভবিষ্যৎ বাণী তাই।
বলেই আমি হাসতে শুরু করলাম। আমার হাসিতে রেগে গিয়ে সুমাইয়া বললো, - ধ্যাত! তোকে আমি আর কখনও আমার বিয়ে কথা বলবো না এমনকি বিয়েতে ইনভাইটও করবো না।
ভাবলেশহীন ভাবে বললাম, - হলে তো করবি, তাই না? হবেই না। সো এসব নিয়ে ভাবিস না।
আবারও হাসতে শুরু করলাম। আমার হাসি দেখে সুমাইয়া আঁড়চোখে তাকিয়ে বললো, - খুব বেশি কিন্তু করছিস বলে দিলাম। উফ, হাসি থামা তো। কাজের কথা শোন এবার।
- হুম বল।
- নুহাশপল্লীতে যাওয়া নিয়ে কী ব্যবস্থা করলি?
- কী করবো?
- কী করবি মানে? পারমিশন নিবি না নাকি?
- ওহ। হ্যাঁ, মা বাবা তো রাজি তবে ডাইনোসরকে বলা হয় নি।
অবাক হয়ে, - ডাইনোসর মানে?
হঠাৎ-ই কী যেন মনে পড়তেই হাসতে হাসতে বললো, - এবার আমার ভবিষ্যৎ বাণী শোন। আর ভবিষ্যৎ বাণীটা হলো তোর ডাইনোসর তোকে পারমিশন দিবে না। ইশ, তোকে যদি মানা করে দেয় তাহলে তোকে দেখিয়ে দেখিয়ে নুহাশ পল্লীতে যাবো আর লুঙ্গী ডান্স দিবো।
মুখ মলিন করে জিজ্ঞেস করলাম, - আমার কষ্টে তুই লুঙ্গী ডান্স দিবি। কেন রে? আমি কী তোর গরম ভাতে পানি দিয়েছি?
- পানি দিয়েছিস না হানি, সেটা বরং তুই নিজেই ভেবে দেখ। আর পারমিশন নেওয়ার ব্যবস্থা কর। আমি এখন যাই।
- সেকি! এখনই চলে যাবি?
- হ্যাঁ, একটু পার্লারে যাবো।
- আহারে! ঠিক আছে। যান যান পার্লু গার্ল।
- পার্লু গার্ল মানে?
- সপ্তাহে সাতদিনের মধ্যে পাঁচদিনই আপনি পার্লারে থাকেন তাহলে পার্লু গার্ল বলবো না তো কী বলবো?
আমার কথায় হালকা হেসে সুমাইয়া বললো, - হায় আল্লাহ! এসব নাম তোর মাথা ছাড়া কারো মাথায় আসবে না।
- কজ, আই এম এক্সট্রা অর্ডিনারী।
- বাট, নীল ভাইয়ার কাছে অর্ডিনারীও নয়। সো ভাব কম দেখা।
- উফ, সবসময় ঐ ডাইনোসরের নাম কেন নিস?
- আর কত নাম দিবি তুই ভাইয়াকে?
- যেই পরিমাণ প্যাড়া দেয়, সেই তুলনায় এই নাম কিছুই নয়।
- ঠিক আছে। তুই বসে বসে নাম রাখ ভাইয়ার। আমি গেলাম।
- আচ্ছা, সাবধানে যাস।
ঘড়ির কাঁটা এখন তিনটার ঘরে। এদিকে আমার পেটের ঘড়িতে বারোটা বাজে। ক্ষুধায় পেটে মহাভারত শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু হনুমানের নাতির কোনো খবর নেই।
সকালে অবশ্য ভাইয়া বলে গিয়েছিলেন, - আমার ফিরতে দেরি হবে। তুই দুপুরে খেয়ে নিস।
বেশি পাকনামি করে জবাব দিয়ে ছিলাম, - সমস্যা নেই ভাইয়া। আপনি এলে তারপরই খাবো।
- এতক্ষণ ওয়েট করতে তোর কষ্ট হবে। মুরগির ছানার মতো খেলেও তো ক্ষুধা সহ্য করতে পারিস না। তাই ক্ষুধা না নেতিয়ে খেয়ে নিস।
আমি মুরগীর ছানা? অসহ্য! উনার এসব কথায় খানিকটা রাগ অনুভব করলেও শান্ত গলায় বললাম, - না, ভাইয়া। আমার সমস্যা হবে না।
- ঠিক আছে তাহলে।
সকালের ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে ক্ষুধার্ত পেটে। আর আমি এতোটাই বোকার বোকা যে, হালকা কোনো খাবারও খাই নি সকালে নাস্তা করার পর। হালকা কিছু খেয়ে নিলে কী হতো? উফ, না এখন খেতে পারবো আর না অপেক্ষা করতে পারবো। আল্লাহ!
দশ পনেরো মিনিট পর মিতালি রুমে এসে বললো,
- আপমনি, তাড়াতাড়ি আসেন। নীল ভাই খাইতে ডাকে আপনারে।
খাওয়ার কথা শুনে মনে অনেকটা শান্তি বোধ করছি। খুশি মনে জবাবে মিতালিকে বললাম,
- ঠিক আছে। তুই যা।
এই বলে চটপট বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে ডাইনিং রুমে দিকে পা বাড়ালাম। ডাইনিং রুমে এসে দেখি ভাইয়া আমার জন্য খাবার রেডি করছেন।
অনেক আগে থেকেই, দুজন একসাথে খেলে ভাইয়া আগে আমাকে খাবার দিবেন তারপর নিজের জন্য নিবেন। প্রকৃতপক্ষে, ভাইয়া খুব একটা রাগী নন। কিন্তু উনার গম্ভীরতা আমাকে সবসময় আতংকিত করে রাখে।
নীল ভাইয়ার শাসন আর স্নেহ দুটোই সমানুপাতিক। তবে শাসনগুলো আমার পছন্দ নয় বলে আমি উনাকে কত-শত আজগুবি নাম উপহার দিয়ে থাকি।
চেয়ার টেনে ভাইয়ার পাশে এসে বসে পড়লাম। চেয়ারে বসতেই একগ্লাস পানি এগিয়ে বললেন,
- আমি কী জোর করেছিলাম আমার জন্য বসে থাকতে?
- না মানে ভাইয়া, আপনার সাথে খাবার খাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। তাই ভেবেছিলাম আপনার সাথেই বরং খাবো।
- অভ্যাস করিস না। অভ্যাসে পরিণত হলে কিন্তু ভবিষ্যতে সেই অভ্যাস নষ্ট করতে তোকে বেগ পেতে হবে।
ভাইয়ার কথার জবাবে আমি নিরব হয়ে রইলাম। কারণ এখানে আর কী বলবো? তবে এটা ঠিক, উনি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছেন অনেক আগেই।
খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়লো, নুহাশ পল্লীতে যাবো সেটা ভাইয়াকে বলা হয় নি। ইতস্তত করে ভাইয়াকে ডাকলাম,
- ভাইয়া?
উনি খাবারের প্লেটে দৃষ্টি রেখেই জিজ্ঞেস করলেন,
- কী?
- ভার্সিটি থেকে আমাদের নুহাশ পল্লীতে নিয়ে যেতে চায়। এটাতে মার্কসও আছে।
- কত তারিখে?
- ১৪ই ফেব্রুয়ারি।
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে, - ১৪ই ফেব্রুয়ারি!
- জ্বী ভাইয়া।
- কখন যেতে হবে? আর কাকু কাকিমা পারমিশন দিয়েছেন?
- হ্যাঁ, ভাইয়া। বাবা মা পারমিশন দিয়েছেন আর সকাল নয়টার আগে ভার্সিটিতে উপস্থিত থাকতে হবে।
এক দুই মিনিট ভাইয়া কী যেন চিন্তা করলেন? তারপর আমাকে বললেন, - ভার্সিটিতে এসে আমাকে কল করবি আমি গিয়ে তোকে নিয়ে আসবো। হয়ত তোর ফিরতে রাত হতে পারে। আর রাত করে একা একা আসার কোনো প্রয়োজন নেই।
অবাক-খুশি হয়ে, - তার মানে আমি যাচ্ছি ভাইয়া?
- না করে তোর গোমড়া মুখ দেখার শখ নেই। এমনিতেই পেত্নীর মতো তোর চেহারা। গোমড়া করলে তো শাঁকচুন্নির মতো লাগে। এখন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।
এই বলে ভাইয়া খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এদিকে খুশিতে গপাগপ খেতে লাগলাম আমি। ভাইয়া রুমের দিকে পা বাড়িয়ে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে আমাকে বললেন,
- শোন, সুমাইয়াকে জিজ্ঞেস করিস তো, কোন রঙের লুঙ্গী পড়ে লুঙ্গী ডান্স দিবে?
- ঠিক আছে ভাইয়া।
আমি খেতে ভাইয়াকে উত্তর দিলাম। কিন্তু হঠাৎ আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, - ভাইয়া, সুমাইয়ার লুঙ্গি ডান্সের কথা কী করে জানলো? তার মানে কী উনি সকালে আমাদের সব কথা শুনেছিলেন? হায় আল্লাহ! তাহলে তো এটাও শুনেছেন হয়ত যে, আমি উনাকে ডাইনোসর বলেছি।
ভাইয়ার কথায় এতোটাই অবাক হলাম যে, আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মনের মাঝে কত-শত ভয় নিয়ে, শুকনো একটা ঢোক গিলে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। উনি চেয়ারে দুইহাতে ভর দিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই ভ্রু নাঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, - কী?
প্রতুত্তরে আমি ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালাম। আর ভাইয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
- পেত্নী।
তারপর চলে গেলেন একমুহূর্তও দেরি না করে। আমি উনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে মনে মনে বললাম, - ইশ, পেত্নী! নিজে কী? হনুমানের নাতি। হুহ।
খাওয়ায় মন দিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম, - যাক বাবা। আমাকে কিছু বলেন নি উনি। আমি তো ভেবেছিলাম, আজকে আমার কপালে শনি এসে ভর করবে। কিন্তু শনিটা আমার দিকে এসেও মোড় নিয়ে নিলো। উম, হনুমানের নাতি অতোটাও খারাপ নয়। তবে সম্পূর্ণ ভালোও নয়।
একা একা বিড়বিড় করতে শুনে মা এসে জিজ্ঞেস করলো, - কিরে? একা একা কার সাথে কথা বলছিস?
- আমার আমি’র সাথে মা।
- মানে?
হালকা হেসে বললাম, - কারো সাথে না মা। আমার সাথেই আমি কথা বলছিলাম।
- পাগল মেয়ে। এখন খাওয়া শেষ কর তাড়াতাড়ি। নীলের অপেক্ষায় তো কত বেলা করে ফেলেছিস।
- এই যে, শেষ তো।
- ঠিক আছে। তাহলে এবার রুমে যা।
আমি রুমে যাবো বলে উঠে দাঁড়াতেই মা ডাকতে শুরু করলো মিতালিকে, - মিতালি, মিতালি?
পর্ব-৮
মেয়েটা মনে হয় টিভি দেখছিল। কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলেই টিভি নিয়ে বসে পড়ে। সিরিয়ালের এতো পাগল যে, সারাদিন সিরিয়াল দেখবে আর সিরিয়ালের ডায়লগ বলতে থাকবে। ওর এসব ডায়লগ শুনলে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওকে দিয়েই সিরিয়ালে কাজ করাতে। সিরিয়াল দেখে কী মজা পায় কে জানে? সেদিন তো সিরিয়াল দেখতে গিয়ে একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল।
কয়েকদিন আগে,
রাত আটটা। মিতালি তার প্রিয় সিরিয়াল ‘জীবন সাথী’ দেখার জন্য মাত্র টিভির রিমোটটা হাতে নিলো। যেই না টিভি অন করবে ঠিক তখনই নীল ভাইয়ার ডাক কানে এলো মিতালির,
- মিতালি, মিতালি?
হাতে রিমোট নিয়ে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে মিতালি। টিভি অন করবে নাকি নীল ভাইয়ার ডাকে সারা দিতে ভাইয়ার রুমে যাবে? এসব ভাবতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ড দোটানায় ভুগে টিভির রিমোট রেখে ভাইয়ার রুমে এসে জিজ্ঞেস করলো,
- ভাই, ডাকছেন আমারে?
- কী করছিলি?
হ্যাবলাকান্তের মতো একটা হাসি দিয়ে জবাব দিলো, - না মানে, কিছু না ভাই।
গম্ভীর গলায়, - সিরিয়াল দেখছিলি?
সিরিয়াল পাগলী মিতালির খবর মোটামুটি সবারই জানা আছে। তবে ওর টিভি দেখা নিয়ে বাসার কেউই কিছু বলে না। কারণ নিজের কাজটুকু যথাযথভাবে শেষ করেই টিভি নিয়ে বসে থাকে।
ভাইয়ার প্রশ্নের জবাবে মিতালি বললো,
- হও ভাই।
- পরে দেখিস। এখন একগ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে আয় তারপর যত খুশি সিরিয়াল দেখ।
- আইচ্ছা ভাই।
বলেই কিচেনের দিকে দৌঁড় দিলো মিতালি। ওর দৌঁড় দেখে নীল ভাইয়া পেছন থেকে বলে উঠলো,
- আরে সাবধানে যা। তোর সিরিয়াল কেউ নিয়ে নিবে না।
কে শুনে কার কথা? মিতালি এক দৌঁড়ে চলে এলো কিচেনে। ওর চিন্তা হলো ঝটপট শরবত বানিয়ে ভাইয়াকে দিয়ে তারপর সিরিয়াল দেখতে বসবে। তড়িঘড়ি করে শরবত বানিয়ে ফেললো। তারপর ভাইয়ার রুমে এসে বললো, - ভাই, আপনার শরবত।
শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে দিতেই সেটা হাতে নিয়ে ভাইয়া বললো, - যা। এবার গিয়ে তোর সিরিয়াল দেখ, যত ইচ্ছে হয়।
মুখের সবকটা দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। তারপর ছোট্ট করে জবাব দিলো,
- আইচ্ছা ভাই।
খুশিতে আত্মহারা হয়ে মিতালি ড্রয়িং রুমে চলে এলো টিভি দেখতে। টিভি অনও করতে পারে নি তার আগেই ভাইয়া আবার ডাকতে শুরু করলেন, - মিতালি, মিতালি?
এবারের ডাকগুলোতে ভাইয়ার কন্ঠস্বর বেশ গম্ভীর শোনাচ্ছে। তাই মিতালি দেরি না করে ভাইয়ার রুমে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, - ভাই, ডাকছেন আমারে?
কিঞ্চিৎ রাগী ভাব নিয়ে শরবতের গ্লাসটা মিতালিকে দেখিয়ে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
- এটা কী বানিয়েছিস তুই?
থতমত খেয়ে বললো, - কেন ভাই? লেবুর শরবত।
- লেবুর শরবত?
- হও ভাই, লেবুর শরবতই তো।
ভাইয়ার রাগের মাত্রা বাড়তে লাগলো। কোনো রকমে রাগটা চেপে বলতে লাগলেন, - আমি শরবতে চিনিই দিতেই বারণ করি আর তুই কী না একগাদা লবণ দিয়ে শরবত বানিয়েছিস।
- হায় আল্লাহ! এডা কী কন ভাই? লবণ দিছি?
মিতালির পাল্টা প্রশ্নের জবাবে ভাইয়া মুখ খিঁচিয়ে চুপ করে রইলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন,
- মাকে গিয়ে বল আমি ডাকছি।
- ভাই, আমি নতুন করে__
মিতালিকে কিছু বলতে না দিয়ে বললেন,
- তোকে যা বলেছি সেটা কর।
মলিন মুখে জবাব দিলো, - আইচ্ছা ভাই।
এই বলে মিতালি চলে গেল জেঠী মাকে ডাকতে। আমাকে বকাবকি করলেও আজ পর্যন্ত ভাইয়া মিতালিকে বকাবকি করেন নি অনেক বড় অপরাধ করলেও। ভাইয়ার এই দিকটা আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু আমাকে বকা দেন সেটা মোটেও ভালো লাগে না আমার।
আমাদের চারপাশ অনেক মানুষ আছেন যারা সামান্য বিষয় নিয়ে গৃহকর্মীর সাথে খারাপ আচরণ করেন এমনকি মারধরও পর্যন্ত করেন। কিন্তু সামান্য বিষয় নিয়ে গৃহকর্মীর সাথে এসব আচরণ করা অবশ্যই কাম্য নয়।
- বাবা, আমার একজোড়া নতুন জুতো লাগবে।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে বাবা টিভিতে নিউজ দেখছেন আর বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে আছি আমি।
আমার বাবার বয়স আটচল্লিশ উর্ধ্ব কিন্তু দেখলে মনে হয় না এতো বয়স উনার। এখনও বেশ লাগে বাবাকে। শুনেছি যুবক বয়সে নাকি বাবা বেশ সুদর্শন ছিলেন। বাবার বন্ধু দুলাল রহমান নাকি বাবাকে অক্ষয়কুমার বলে ডাকতেন। নিজের বাবা বলে বলছি না, আমার বাবা যুবক বয়সে সত্যিই সুদর্শন ছিলেন।
বাবা টিভি দেখতেই নিমগ্ন। কেউ একজন যে উনার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এবং উনাকে কিছু বলেছে সেটা যেন উনি টেরই পান নি। আমি বাবাকে আবার বললাম,
- বাবা, তুমি কি শুনছো?
টিভি দেখতে দেখতেই বাবা বললো,
- হ্যাঁ, বল।
- বাবা, আমি তো সেই তখন থেকে বলেই যাচ্ছি। তুমিই তো শুনছো না।
আমাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে বাবা টিভি দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাবা সবসময়ই নিউজ দেখতে নিলে আশে পাশে কোনো মনযোগ রাখেন না। নিউজেই সব মনোযোগ দিয়ে রাখেন। বাবার নিউজ দেখাকালীন সময় যদি চোর এসে বাবার সামনে সব চুরি করে নিয়ে যায় তবুও বাবা নিউজ থেকে মনযোগ সরিয়ে চোরকেও আটকাবেন না আবার পুলিশেও খবর দিবেন না। শুধু নিউজ নিয়েই পড়ে থাকবেন।
কয়েক সেকেন্ড চুপটি করে দাঁড়িয়ে বাবাকে পর্যবেক্ষণ করলাম। এইমূহুর্ত্বে বাবার উপর খুব অভিমান হচ্ছে আমার। তাই একটু অভিমানী সুরে বাবাকে বললাম,
- বাবা, তুমি কি আমার কথা শুনবে নাকি আমি জেঠুকে কল করবো?
জেঠুর নাম বলতেই বাবা টিভির স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, - কী বলবি তাড়াতাড়ি বল?
- তোমাকে বলেছিলাম না, আমি নুহাশ পল্লীতে যাবো।
- হ্যাঁ, যা। কে মানা করছে তোকে যেতে?
- কেউ মানা করছে না বাবা। সবাই রাজি।
- তো এখন আবার কী দরকার?
- নুহাশ পল্লীতে নতুন জুতো পড়ে যেতে চাই। তাই আমাকে জুতো কিনে দিতে হবে।
- ঠিক আছে কিনিস। আমি তোর মাকে বলে দিবো যেন তোকে নতুন জুতো কিনে।
- মাকে বলেছি। মা বলেছে, তোমাকে নিয়ে যেতে।
- আমি আবার কেন বাবা?
- সেটা তুমি মাকে জিজ্ঞেস করে নি। এখন জুতো কিনে দিবো কবে সেটা বলো।
- যাবি যেন কবে?
- ১৪ ফেব্রুয়ারিতে।
- আজকে কয় তারিখ?
- আজকে ৬ তারিখ।
- তাহলে তো অনেক সময় আছে।
- কে বললো সময় আছে? একদম নেই। আমাকে তাড়াতাড়ি কিনে দিতে হবে।
- আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে পরশুদিন কিনে দিবো। এখন আমাকে খবর দেখতে দেয়।
- আজকে জেঠু বাসায় এলে বলে দিবো বাবা?
- দেখ মা, এমন করিস না তো। বাবার সাথে কেউ এমন করে?
- অন্য কেউ না করলেও আমি করবো বাবা।
বলে দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে রইলাম বাবার দিকে। বাবা, জেঠু্কে ছোটবেলা থেকেই ভয় পায়। কিন্তু জেঠু আমাকে বড্ড ভালোবাসে। আর সেই সুযোগটা নিয়ে বাবাকে জেঠুর ভয় দেখিয়ে নিজের আবদারগুলো পূরণ করি। আসলে বাবার সাথে আমার সম্পর্ক একদম বন্ধুর মতোন। তাই আমার এসব ছেলে মানুষীতে বাবা আমাকে বকাবকি করেন না।
ওগো সূর্য,
সকাল সকাল কেন তুমি
আমায় রাঙিয়ে তুলো?
ওগো পাখি,
প্রভাতে কেন আমায়
করো এতো ডাকাডাকি?
ভোর পাঁচটা বাজে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল আমার। স্বপ্নে কী সব আবোলতাবোল দেখেই ঘুমটা ভেঙে গেল। বিছানায় চোখ বুঁজে পড়ে আছি। আমি জানি, এখন হাজারো চেষ্টা করলেও ঘুম আসবে না আমার। তাই বিছানা থেকে নেমে, ঘর পরিষ্কার করে, বিছানাপত্র গুছিয়ে নিলাম। ওয়াশরুমে এসে খুব করে পানির ঝাঁপটা দিলাম মুখে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা কিচেনে চলে এলাম।
জেঠীমা সবার জন্য নাস্তা তৈরি করছেন। সকালের নাস্তা সাধারণত জেঠীমাই তৈরি করেন। তবে মাঝে মাঝে মাও তৈরি করে থাকেন। আমাকে দেখে জেঠী মা জিজ্ঞেস করলো,
- কিরে? আজকে এতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লি যে?
- জানি না, হঠাৎ-ই ঘুম ভেঙে গেল। আর পরে ঘুম আসছিল না। তাই ভাবলাম উঠেই পড়ি।
- মুখ মুছিস নি কেন?
আমার মুখে এখনও ঝাঁপটা দেওয়া পানি লেগে আছে। মুখ মুছতে ইচ্ছে করে নি। তাই আপনা থেকে শুকিয়ে যাবে ভেবে রেখে দিয়েছি। একগাল হেসে জেঠী মাকে বললাম, - শুকিয়ে যাবে। এ আর এমন কী?
জেঠীমা এককাপ চা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, - যা তো, নীলকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে, চা-টা দিয়ে দেয়।
অবাক হয়ে, - আমি এই সকাল সকাল চা দিতে যাবো?
- হ্যাঁ, কেন?
- না মানে_
আমাকে আমতা আমতা করতে দেখে জেঠী মা হেসে হেসে বললো, - ভয় পেলে হবে? হুম? সারাজীবন তো পড়েই আছে তখন কী করবি?
জেঠীমার জবাবে কিছু না বলে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে নিরব থাকতে দেখে জেঠীমা আবার বলতে লাগলো, - এখন দাঁড়িয়ে না থেকে যা। কিছু বললে আমার কথা বলে দিস।
ভিতরে ভিতরে খুব ভয় লাগছে। কারণ সকাল সকাল উনার রুমে যাওয়া নিয়ে উনি আবার বকাঝকা করেন কি না কে জানে? তারউপর উনাকে ডেকে তুলবো ভাবতেই বুকের ভিতর ধুকপুক করছে আমার। কত-শত ভাবনা বাদ দিয়ে আমি পা বাড়ালাম নীল ভাইয়ার রুমের দিকে।
উনার রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি। ভিতরে যাবো কী যাবো না ভেবে দোটানায় আছি।
আস্তে আস্তে উনার রুমে উঁকি দিয়ে গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলাম। চারদিকের নিস্তব্ধতার মাঝে পায়ের নুপুরে সুর উঠছে আমার। ঘরময় অন্ধকার করে উনি কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। আমি উনার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কয়েকমিনিট উনাকে পর্যবেক্ষন করে মনে মনে বলতে লাগলাম,
- ঘুমের মাঝে তো নিষ্পাপ বাচ্চার মতোন লাগছে। কত শান্ত, কত মায়াময় মুখখানা। আর এমনিতে? পুরো জলহস্তির মতোন লাগে। জীবনটা আমার ত্যানা ত্যানা করে ফেলে। হুহ!
মনে মনে খানিকটা রাগ বোধ করলেও শান্ত গলায় ডাকতে লাগলাম, - ভাইয়া, ভাইয়া, ভাইয়া?
আমার ডাকে উনার ঘুম তো ভাঙলোই না উল্টো আরও ভালো করে কাঁথা মুড়ি দিলেন। আমার হাতে থাকা চায়ের কাপটা রেখে দিলাম বিছানার পাশে থাকা টেবিলে। বেশ লজ্জা লাগছে তবুও আমি আলতো হাতে উনাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, - ভাইয়া, উঠুন সকাল হয়ে গেছে।
আমচকা উনি আমার হাত টেনে উনার হাতে চেপে ধরলেন। আমার হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমঘুম গলায় বললেন, - মা, প্লিজ আরেকটু ঘুমোতে দাও না।
আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। আচমকা এমন কিছু হবে আমার সাথে, সেটা আমি ভাবতেও পারি নি। আমাকে জেঠীমা ভেবে, আমার হাতটা একেবারে নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছেন। উনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো আমার হাতের তালুতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। লজ্জা আর ভয়ে রীতিমতো কাঁপা কাঁপি করছি। হাত টানছি কিন্তু এতোটাই শক্ত করে চেপে ধরেছেন যে, ছাড়াতে পারছি না। শুকনো একটা ঢোক গিলে খানিকটা জোরে বললাম,
- ভাইয়া, উঠুন আর হাত ছাড়ুন আমার।
পর্ব-৯
আমার ডাকে উনার ঘুম ভাঙতেই চোখ খুলে তাকিয়ে বললেন,
- তুই এখানে?
ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বললাম, - জেঠীমা পাঠিয়েছেন, আপনাকে চা দিতে। আর এখন আমার হাতটা ছাড়ুন, খুব ব্যথা লাগছে আমার।
আমার কথায় উনার মাঝে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। বরং উনি অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাতটাও ছাড়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না উনার মাঝে। আমার হাত ধরে রেখেছেন বিধায় আমি কিঞ্চিৎ ঝুঁকে আছি উনার উপর। এমন একটা অবস্থায় কতটা লজ্জাবোধ করছি আমি, সেটা কেবল আমিই জানি। লজ্জার পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে আর সাথে মুখখানাও লাল হচ্ছে আমার।
- আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে কী দেখছেন উনি? এভাবে তো কখনও তাকিয়ে থাকতে দেখি নি।
এসব ভাবছি ঠিক তখনই উনি বলে উঠলেন, - খাওয়াদাওয়া না করলে যা হয় আর কী।
এই বলেই আচমকাই আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন। আমি দাঁড়িয়ে হাতটা দেখতে লাগলাম। একদম লাল হয়ে গেছে হাতটা আর খুব ব্যথাও লাগছে।
- আমার হাতকে কি উনি বালিশ পেয়েছেন, যে মাথা রেখে ছিলেন? হনুমানের নাতি। হুহ!
মনে মনে একদফা গালি দিয়ে দিলাম উনাকে। শোয়া থেকে উঠে বসে নিজের চুলে খানিকটা হাত বুলিয়ে নিলেন উনি। টেবিলে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে আমায় বললেন, - যা এখন।
- হাতের বারোটা বাজিয়ে এখন বলেছে, যা এখন। আস্ত একটা টিকটিকি। হুহ।
কিঞ্চিৎ রেগে মনে মনে আরেক দফা গালি উপহার দিয়ে মুখে বললাম, - ঠিক আছে ভাইয়া।
জবাব দিয়ে আমি আমার মতো করে চলে আসার জন্য পা বাড়ালাম। কিন্তু পেছন থেকে হঠাৎ-ই উনি ডেকে বললেন, - শোন।
আমি ঘুরে উনার দিকে তাকাতেই উনি বলতে লাগলেন,
- ঘুম থেকে উঠে কখনও আমার রুমে আসবি না তাও আবার আধো ভেজা মুখে।
ভাইয়ার কথায় খানিকটা অবাক হয়ে মনে মনে বলতে লাগলাম, - আজব তো! আমি ঘুম থেকে উঠে উনার রুমে এলে প্রবলেমটা কোথায়? বস্তির মতোন একটা রুম সেটার জন্য আবার কত নিষেধাজ্ঞা। হুম!
মনে মনে উনাকে কথা শুনিয়ে পৃথিবী উল্টিয়ে মুখে শুধু বললাম,
- ঠিক আছে। আসবো না আর সকালে।
- হুম, যা এবার।
আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু হঠাৎ-ই ভাইয়ার কথাটা মনে পড়তেই বিড়বিড় করে বলে উঠলাম,
- আধোভেজা মুখ– এটা বললেন কেন উনি?
সূর্যটা আলো দিচ্ছে খুব করে। কিন্তু তেজটা কেমন যেন তপ্ত মনে হচ্ছে না। হয়ত শীতের আমেজের সাথে রোদটা পেরে উঠছে না বলে। আর তাই তো ঝলমল করা রোদেও বেশ শীত শীত লাগছে।
দুপুরের শেষ দিকের সময়টাতেও বেশ শীত অনুভব হচ্ছে আমার। রিকশায় করে ফিরছি বলে শীতল বাতাসের তীক্ষ্ণতায় খুব করে যেন কেঁপে উঠছি। অথচ শীতের আর বাকি নেই। কিন্তু শীতের এই শেষাশেষি সময়েও আমার কেন যেন শীত শীত লাগছে।
ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরছি একটা রিকশা নিয়ে। বাসার কাছাকাছি এসে রিকশা থেকে নেমে, ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। কাঁধের ব্যাগটা পড়ে যাচ্ছিল বলে টেনে শক্ত করে ধরে, বাড়ির ভেতর ঢুকবো বলে পা চালালাম।
কলিং বেল বাজাতেই মিতালি এসে দরজা খুলে দিলো। মিতালির হাসি মাখা মুখখানা দেখে আমিও একটু হেসে ভিতরে পা বাড়ালাম। ভিতরে ঢুকতেই দেখি সোফায় হেলান দিয়ে, ফোনে নিমগ্ন হয়ে বসে আছেন মৃন্ময় ভাইয়া। আমি এসেছি সেটা বোধহয় ভাইয়া টের পেয়েছেন। তাই তো চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। ভাইয়ার সাথে চোখাচোখি হতেই আমি মুচকি হেসে খানিকটা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলাম,
- কেমন আছেন ভাইয়া।
হাতের ফোনটা পকেটে রেখে হালকা হেসে প্রতুত্তরে বললেন,
- এই তো, আলহামদুলিল্লাহ। ক্লাস করে এলো?
- জ্বী ভাইয়া।
- শুনলাম, তোমাদের নাকি নুহাশ পল্লীতে নিয়ে যাওয়া হবে?
- জ্বী ভাইয়া।
- তুমি যাচ্ছো তো?
সোফায় বসতে বসতে জবাব দিলাম,
- হ্যাঁ, যেতে তো হবেই। কারণ এটা উপর নম্বর দেওয়া হবে। আর সবার কাছ থেকে পারমিশনও পেয়ে গিয়েছি।
- তাহলে তো আর কোনো প্রবলেমই নেই। আমাদের কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
- কক্সবাজারে!
- হ্যাঁ, সেখানে চারদিন ছিলাম আমরা সবাই। বাসে করে গিয়েছিলাম। বন্ধুরা মিলে বেশ মজার দিন কাটিয়ে ছিলাম। সমুদ্র, হিমছড়ির পাহাড় আরও কত কী!
- কবে গিয়েছিলেন ভাইয়া? আমি তো কখনও শুনি নি যে, নীল ভাইয়া কক্সবাজারে গিয়েছে।
আমার কথায় কিঞ্চিৎ হেসে ভাইয়া বললেন, - গেলে তো জানবে?
- মানে!
- মানে হলো নীল কখনও কক্সবাজারে যায় নি। আমরা সবাই গিয়েছিলাম বাট ও রাজিই হয় নি যেতে।
- কেন?
- জানি না। হয়ত স্পেশাল কোনো কারণ ছিল। অনেক করে রিকুয়েষ্ট করার পরও যখন যায় নি তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন যাবি না? কিন্তু সেটারও কোনো আনসার পাওয়া হয় নি।
ভাইয়ার কথায় খানিকটা চিন্তা উদয় হলো আমার মাঝে। ভাবনায় বিভোর হয়েই ভাইয়াকে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
- ওহ।
- এনিওয়ে, তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?
- এই তো, মোটামুটি।
- নীলের কাছে পড়েও মোটামুটি! অবাক হলাম তোমার কথা শুনে। কিন্তু মোটামুটি কেন সেটা বলো তো?
- আসলে নীল ভাইয়া তো শুধু ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞান পড়াচ্ছেন। বাকিগুলো তো আমাকেই পড়তে হয় তাই বললাম মোটামুটি।
- এই ব্যাপার? তারপরও ভালো করে পড়াশোনা করো। কারণ আমরা সবাই চাই তুমি বিসিএস পরীক্ষা দিবে আর ভালো একটা পজিশনে নিজেকে দাঁড় করাবে। এইজন্য তো মন দিয়ে পড়তে হবে কথকপাখি। তাই না?
আমি অহেতুক মাথা চুলকে আমতা আমতা করে বললাম, - পড়তেই তো ভালো লাগে না ভাইয়া। বিসিএস পরীক্ষায় কী দিবো?
ভাইয়া উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে বললো, - বলো কী!
ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম, - হ্যাঁ।
- এই কথা কিন্তু নীলের কানে পৌঁছোতে দিও না তাহলে তো_
ভাইয়ার কথার মাঝেই নীল ভাইয়া এসে হাজির। ভ্রু জোড়া কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন সন্দেহের দৃষ্টিতে। উনার চাহনি দেখে বুঝা যাচ্ছে, উনি আমাকে নয় কোনো ডাকাতকে দেখছেন। শান্ত গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, - কখন এসেছিস?
- একটু আগেই ভাইয়া।
- যা। ভিতরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় আর খাবার খেয়ে নিস।
- ঠিক আছে ভাইয়া।
- আমার ফিরতে দেরি হলেও আমার রুমে বসে পড়তে থাকবি, কেমন?
- হুম।
আমার থেকে উত্তর পেয়ে ভাইয়া, মৃন্ময় ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন,
- বাইক এনেছিস?
- না, তুই তো না করলি তাই আমি দিহানের বাইকে করে এসেছি। দিহান নাকি বাজারে যাবে তো আমি বললাম, আমাকে এখানে দিয়ে তারপর যেতে।
- ভালো করেছিস। এখন চল। যাওয়া যাক।
- হুম চল।
চুপি চুপি কোথা থেকে
এলো আজ শীত,
গুন গুম গায় পাখি
শীত শীত শীত।
কৃষকেরা ধান কেটে
পায় খুঁজে সুখ,
পিঠাপুলি খাবে তাই
উজ্জ্বল মুখ।
রাখালেরা বাঁশি নিয়ে
সুর তুলে গায়,
চারদিকে মাঠগুলো
ধানে ছেয়ে যায়।(গুগুল থেকে নেওয়া)
একে তো শীতের শেষ সময়টা চলছে তারউপর শহরে তো শীতের আমেজ একদমই পাওয়া যায় না। শহরের শীতে শুধু দেখা মেলে বস্ত্রহীন পথশিশু আর অসহায় দুঃস্থ মানুষদের। কনকনে শীতেও যাদের কপালে এক টুকরো উষ্ণ কাপড় মেলে না। পথের ধারে সারারাত কাটাতে হয় কতই না কষ্ট করে। আমরা বিত্তবান লোকেরা উষ্ণ কাপড়ে নিজেদের মুড়িয়ে, শীতে কাতর মানুষদের পাশ কাটিয়ে চলে যাই। আমাদের বিবেক একবারও নাড়া দিয়ে উঠে না, এই অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে।
আধুনিকতার ছোঁয়া আমাদের যেন নিষ্ঠুর করে তুলছে দিন দিন।
গ্যালারিতে অহেতুক আড্ডায় মত্ত হয়ে আছি আমি, সুমাইয়া আর তূর্য। এখন বেশিরভাগ ক্লাসই যেন অফ যাচ্ছে কোনো না কোনো কারণে। আজকের ক্লাসটাও অর্ধেক করে স্যার চলে গেলেন। আর তূর্যেরও নাকি ক্লাস নেই। তাই তিনজন মিলে আড্ডা দিতে লাগলাম গ্যালারিতে বসে।
আমি আড্ডায় থাকি আর শোকসভায় থাকি সব জায়গাতেই মৌনতা অবলম্বন করে থাকি।
আমার নামের সাথে মিল রেখেই আমি কথা বলতে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু সবার সাথে সব জায়গায় কথা বলতে বড্ড আনইজি লাগে আমার।
চুপচাপ বসে আছি বলে আমার পাশেই বসে থাকা সুমাইয়া হঠাৎ গুঁতো দিয়ে বললো,
- মুখে তালা মেরো রেখেছিস কেন?
কাঠ গলায় জবাব দিলাম,
- সবসময় কি এফএম রেডিও এর মতো পকপক করা যায়?
- তোকে পকপক করতে বলি নি, কথা বলতে বলছি।
- ভালো লাগছে না। তোরা বল আমি শুনছি।
- তোর মাঝে মাঝে কী হয় আমায় বলবি?
- আজব তো! আমার আবার কী হবে?
- কিছু হয় না তোর?
খানিকটা জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো সুমাইয়া। আমি উত্তর দিতে যাবো তার আগেই তূর্য বলে উঠলো,
- তোদের টম এন্ড জেরি বন্ধ করবি?
তূর্যের কথায় আমি আর সুমাইয়া দুজনেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে। আমাদের সন্দেহী দৃষ্টি দেখে হালকা হেসে তূর্য জিজ্ঞেস করলো, - এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তোদের তাকানো দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন তোদের বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।
কিঞ্চিৎ বিরক্ত নিয়ে সুমাইয়া বললো, - এতো বিয়া বিয়া করিস কেন? বিয়ের জন্য এতো উতলা কেন তুই? সব কিছুতে শুধু ঘুরেফিরে বিয়ের প্রসঙ্গই টেনে আনিস। অন্যকিছু কি বলতে পারিস না?
সুমাইয়ার এতো সব প্রশ্নে হয়ত তূর্য ভড়কে গেছে। খানিকটা অবাক হয়ে জানতে চাইলে,
- এতো ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন? আমি তো জাস্ট বিয়ের কথাই বলছি তোকে খুন করার কথা তো বলি নি।
তূর্যের কথায় ওর মাঝে যেন আরও বিরক্ত এসে ভর করলো। মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তে চোখমুখ খিঁচতে লাগলো সুমাইয়ার। ওর এমন অদ্ভুত আচরণ দেখে আমি তূর্যকে বললাম, - তূর্য, প্লিজ থামুন। বিয়ের টপিক বাদ দিয়ে অন্য কিছু বলুন। বেচারীর মুড অফ।
নিরস গলায় তূর্য জবাব দিলো, - ওর মুড তো দৈনিক ২৪ ঘন্টা, সপ্তাহে ৭ দিন আর বছরে ১২ মাসই খারাপ থাকে। আজ পর্যন্ত কোনো দিনও মুড ভালো আছে– বলতে শুনি নি।
একটু রেগে সুমাইয়া, তূর্যকে বললো, - তুই আমার ভাই? আমার তো মনে হয় না। সারাদিন আমার পিছনেই পড়ে থাকিস জ্বালানো জন্য। কোথাও তোর জন্য কপালে আমার একটু শান্তি মেলে না।
- এতো কেয়ারিং ভাই পেয়েও এমন কমেন্ট করলি আমাকে নিয়ে? আজকে তুই প্রমাণ করে দিলি।
কৌতূহল নিয়ে সুমাইয়া জিজ্ঞেস করলো, - কী প্রমাণ করলাম?
- পঁচা ডিম মার্কা তোর মন কোনো দিনও ভালো হবে না।
এই বলে তূর্য জোরে জোরে হাসতে লাগলো। আর সুমাইয়া রেগে আলতো হাতে ওর ভাইকে মারতে লাগলো। মুহুর্তেই আমার চোখের সামনে ফুটে উঠলো ভাই বোনের খুনসুটি আর ভালোবাসা।
পর্ব-১০
আমার ইচ্ছের দাম হয়ত কারোর কাছেই নেই। আবদার পূরণ হলেই কি মানুষ তৃপ্ত হয়? আমার তো মনে হয়, মানুষ চায় ইচ্ছে পূরণ হোক আনন্দের সহিত। আর আমার ইচ্ছেটা সর্বদা পূরণ হয় একরাশ হতাশা নিয়ে।
নুহাশ পল্লীতে যাবো বলে মাকে বলেছিলাম,
- মা, আমাকে জুতো কিনে দিতে হবে।
জবাবে শান্ত গলায় মা বলেছিল, - তোর বাবাকে বল, তোকে নিয়ে যেতে।
বাবাকে তো জেঠুর ভয় দেখিয়েও কাজ হলো না। আমার হাতে জুতো কেনার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
- তোর জেঠীমাকে বলেছি, তোর সাথে যেতে। বিকেলে চলে যাস তোর জেঠীমার সাথে।
বাবা মার উপর খুব করে অভিমান বোধ করেছিলাম আমি। কিন্তু চোখে জল টলমল করলেও সেটা বুঝতে না দিয়ে, এই বিকেলে জেঠীমাকে নিয়ে চলে এলাম জুতো কিনতে।
ব্যান্ডের পন্যের পিছনে প্রায় সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ব্যান্ডের পণ্য মানেই যেন নিজেকে আধুনিক আর স্মার্ট প্রমাণ করা কত-শত চেষ্টা। এসব ব্যান্ডের পণ্য অনেক ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে থাকে বিধায় অনেক মানুষই কিনতে অক্ষম।
মানুষের শখ থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শখ পূরণ করতে গিয়ে, পরিবার আর সমাজের প্রতি উদাসীন হওয়া আমার কাছে যথাযথ মনে হয় না। আমাদের সাধ্য আর চাহিদা সমান না থাকলে আমরা নিজেকে কখনোই সুখী মনে করতে পারবো না। একটা হতাশা বারবার আমাদের মনের দরজায় এসে উপস্থিত হবে যন্ত্রণা দিতে। তাই ব্যান্ডের পণ্যের প্রতি আগ্রহ থাকলে, নিজের সাধ্য আর পরিবারের সামর্থ্যের দিকে নজর রেখে নিজেদের শখ পূরণ করা উচিত।
আমি নিজে ব্যান্ডের পণ্যের প্রতি এতো বেশি আগ্রহী নই। তবে জুতোটা বাটা অথবা এপেক্স থেকেই কিনে থাকি। আগেরবার জুতো জোড়া এপেক্স থেকে কিনেছিলাম বলে এবার বাটা থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার কেনাকাটা করতে খুব একটা সময় লাগে। প্রথম যেটা পছন্দ হয় সেটাই কিনে ফেলি। কারণ একশ দোকানের দু’শ পণ্য দেখে কেনার অভ্যাস আমার নেই।
আমি আমার জন্য জুতো পছন্দ করছি আর জেঠীমা নিজের জন্য। কিছুক্ষণ পর আমার একজোড়া কালো জুতো পছন্দ হলো। একদম নরমাল জুতো। ভ্রমণের জন্য বেশ আরামদায়ক হবে বলে মনে হতেই জেঠীমা ডেকে বললাম,
- জেঠীমা, আমার জুতো পছন্দ হয়েছে। এটাই নিবো।
আমার কাছে এসে হাত থেকে জুতোটা নিয়ে এক-দুই মিনিট পর্যবেষণ করলো জেঠীমা। তারপর জিজ্ঞেস করলো, - এটাই নিবি?
- হুম।
- জুতোর সাইজ মিলিয়ে দেখেছি?
- হ্যাঁ, সব ঠিক আছে আর আমার পছন্দও হয়েছে।
- প্রাইজ কত?
- বেশি না। মাত্র ৯৯০ টাকা। ভালো না?
- ভাল না হলেও ভালো। আমার মেয়ের পছন্দ কি আমার অপছন্দ হতে পারে?
- হুম হুম। সেটাই।
- আমি পেমেন্ট করে আসি আর তুই এখানেই থাক। নীল নাকি আসছে আমাদের নিতে। আমাকে কল করেছিল একটু আগে।
অবাক হয়ে, - নীল ভাইয়া আসছে!
- হ্যাঁ, তুই থাক এখানে আমি চট করে পেমেন্টের কাজটা শেষ করে আসি।
- হুম।
জেঠীমা ক্যাশ কাউন্টারে চলে গেল পেমেন্ট করবে বলে। আর আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম,
- হঠাৎ নীল ভাইয়া কেন আসবেন? আসার সময় জেঠীমা কত করে উনাকে বলেছিল, আমাদের সাথে যেন আসেন। কিন্তু নবাবজাদা রাজী হোন নি। তখন বাধ্য হয়ে আমি আর জেঠীমাই চলে এসেছি।
এসব ভাবতে ভাবতে একজোড়া ব্ল্যাক হীল চোখে পড়লো আমার। কাছে গিয়ে হাতে নিয়ে সেটা দেখতে লাগলাম। বেশ নিখুঁতভাবে ফুলের কাজ করা রয়েছে এতে। হীল জুতোর প্রতি ভালো লাগা কাজ করলেও বাবার জন্য পড়তে পারি না। আমার জন্যই বাবার অপছন্দ আমার হীল জুতো পড়া। কারণ কয়েক বছর আগে, হীল জুতোর বদৌলতে হোঁচট খেয়ে চিৎপটাং মেরেছিলাম মাটিতে। নিটফল, সবার সামনে হাসির পাত্রী আর মা-বাবার কাছে এক পাত্র ভর্তি বকুনি। এরপর থেকেই হীল পড়া আমার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
জুতো জোড়া এতোটাই পছন্দ হয়েছে যে, খুব করে ইচ্ছে করছে কিনে পায়ে দিয়ে দি তাং দি তাং ডান্স দিতে। কিন্তু মন চাইলে কি সবকিছু করা যায়? তাই মলিন মুখে অনেকটা সময় জুতো জোড়া দেখে, রেখে দিলাম আগের জায়গায়। রেখে দিয়েও তাকিয়ে রইলাম অনাথের দৃষ্টিতে। আমাকে থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জেঠীমা এসে জিজ্ঞেস করলো,
- কিরে? এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
জুতো জোড়া দেখিয়ে জেঠীমাকে বললাম,
- জেঠীমা, আমার না, ঐ জুতো জোড়া খুব পছন্দ হয়েছে।
- কোনগুলো?
- ঐ যে কালো হীলের জুতো জোড়া।
- এই জুতো! তোর বাবা দেখলে রাগ করবে মা। তা ছাড়া দামটাও তো কম নয়, ৩৫০০ টাকা। টাকা থাকলে নাহয় তোকে লুকিয়ে কিনে দিতাম। এতো টাকা তো নিয়ে আসি নি মা।
মনে মনে খুব ইচ্ছে জাগলেও সেটা বুঝতে না দিয়ে বললাম, - উফ, জেঠিমা, তুমিও না। আরে আমি তো এমনিতেই বললাম যে, আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। কিনবো যে, সেটা তো বলি নি।
- কিন্তু_
- কোনো কিন্তু নয় এখন_
এইটুকুন বলতেই নীল ভাইয়া এসে হাজির। আর কিঞ্চিৎ তাড়া দিয়ে বললেন, - মা, তোমাদের শেষ হয় নি?
- হ্যাঁ, শেষ। কিন্তু কথামনি এক জোড়া হীল জুতো পছন্দ করেছে। তোর কাছে কি টাকা আছে?
- হীল কেন? নরমাল জুতো পড়ে যাবে। হীল পড়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে নেচে দাঁত ভাঙার কী দরকার?
- নরমাল জুতোই কিনেছে। মেয়েটা এতোটাও ইরেসপন্সিবল না রে।
- তাহলে আবার হীল কেন?
- এমনিতেই। ঐ কালো জুতো জোড়া নাকি পছন্দ হয়েছে। তোর কাছে টাকা থাকলে দেয় আমি বাসায় গিয়ে দিয়ে দিবো। তাও মেয়েটার সাথে রাগারাগি করিস না। বাচ্চা মানুষ, শখ করতেই পারে।
জেঠীমার কথায় উনি বেশ বিরক্ত বোধ করলেন। অন্য দিকে তাকিয়ে কাঠ গলায় জবাব দিলেন,
- আমার কাছে টাকা নেই।
- কোনো ব্যবস্থাও করতে পারবি না?
- না।
- আচ্ছা বাদ দেয়।
আমাকে উদ্দেশ্য করে জেঠীমা বললো, - চল মা। পরে সুযোগ হলে তোকে কিনে দিবো।
এতোটা সময় করুন মুখখানা নিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে উনার কথাগুলো শুনছিলাম। আমি জানি, উনার কাছে টাকা ছিল আর না থাকলেও উনি চাইলেই টাকা সংগ্রহ করতে পারতেন। কিন্তু কিছুই করলেন না। পাষাণের মতোন মুখের উপর না করে দিলেন। আমার করুন মুখখানা দেখেও কি উনার মায়া হয় নি?
জুতোর দোকান থেকে বের হতেই ভাইয়া জেঠীমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- মা, কিছু খাবে?
- আমার ইচ্ছে করছে না। কথামনিকে খাওয়া।
জুতো কিনতে পারি নি খেয়ে আর কী হবে? তাই মলিন মুখে বললাম,
- আমি কিছু খাবো না জেঠীমা। বাসায় যাবো। চলো তাড়াতাড়ি।
- সেকি! তুই না বললি তখন, সমুচা খাবি।
- ইচ্ছে করছে না। চলো বাড়ি চলে যাই।
জেঠীমা কিছু বলবে তার আগে ভাইয়া জেঠীমাকে বললো,
- মা, তুমি গাড়িতে গিয়ে বসো। আমি দেখছি ওকে।
বলেই রাগী রাগী ভাব নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমি খুব একটা রাগ করতে পারি না। যতটুকুই করি সেটাও ভাইয়ার সামনে স্থায়ী হয় না। ভাইয়ার কথায় জেঠীমা হালকা হেসে বললো, - ঠিক আছে। আমি তাহলে যাই।
জেঠীমা চলে গেল। আমারও খুব ইচ্ছে করছিল চলে যেতে। কারণ এই পাষাণ মানুষটাকে খুব বেশি অসহ্য লাগছে এই মুহুর্তে।
দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে দায়সারা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে ভাইয়া দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে। ভয় ভয় চোখে আমিও তাকালাম উনার দিকে। হোয়াইট শার্ট, ব্ল্যাক জ্যাকেট আর ব্ল্যাক প্যান্টে অন্যরকম লাগছে উনাকে। এই অন্যরকমটা কেমন? সেটা আমার জানা নেই। সাদা আর কালো রং উনার পছন্দ নয়। কিন্তু অপছন্দ হওয়া সত্ত্বেও বেশিভাগ পোশাক-আশাকই পড়ে থাকেন এই দুই রঙের। কেন পড়েন? সেই কারণটাও আমার অজানা।
প্রায় একদুই মিনিট পর ভ্রু নাঁচিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, - সমস্যা কী তোর?
আমি কোনো জবাব না দিয়ে চোখ নামিয়ে চুপটি করে রইলাম। আমার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ভাইয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন,
- আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি।
ইতস্তত করে জবাব দিলাম, - খাবো।
- কী খাবি?
- সমুচা।
আমার জবাব শুনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথার চুলগুলো হাতের আঙুল দিয়ে ঠিক করে জিজ্ঞেস করলেন,
- খাবিই যখন, তখন মানা করেছিস কেন? এতো রাগ আসে কোথ থেকে তোর? আর রাগটা শুধু আমার উপর আসতে দেখি। ব্যাপার কী?
কিছু একটা বলবো বলে ভাবছি, ঠিক তখনই ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে উনার পাশে নিয়ে দাঁড় করালেন। আচমকা উনার এমন ব্যবহারে আমি চমকে গিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন,
- আশেপাশে নজর রেখে দাঁড়াতে পারিস না? আরেকটু হলেই তো ধাক্কা লাগতো রিকশার সাথে। সবকিছু আমাকে কেন দেখতে হয়? নিজের চোখগুলোও কি আমাকে দিয়ে রেখেছিস?
এমনিতেই মন ভালো না তার উপর উনি আমাকে রাস্তা উপর দাঁড় করিয়ে কত কথা শুনাচ্ছেন। জাস্ট কান্না করতে ইচ্ছে করছে আমার। একটা মানুষ এতোটা হৃদয়হীন হয় কী করে?
শান্ত গলায় ভাইয়া বললেন,
- আয় আমার সাথে। আর দেখে শুনে পথ চলবি।
আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নেড়ে ভাইয়াকে অনুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলাম। উনি একটা দোকান থেকে আমার জন্য সমুচা আর চকলেট কিনে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, - আর কিছু খাবি?
আমি সংক্ষিপ্ত আকারে জবাব দিলাম,
- উহুম।
- খেতে ইচ্ছে করলে বল। কিনে দিবো।
- না ভাইয়া আর কিছু লাগবে না।
আমি মানা করা স্বত্বেও ভাইয়া আবার চিপসও কিনে দিলেন। সবসময়ই উনার থেকে কিছু খাওয়ার আবদার করলে সেটা রাখার চেষ্টা করেন। অন্তত আমি কিছু খেতে চাইলে মানা করেন নি আজ পর্যন্ত। বরং আমি খাওয়াদাওয়া করলে উনি খুব খুশি হয়ে থাকেন। উনার প্রতি আমি রাগ করি আর অভিমান। সেটা উনি হয়ত টের পান। তাই তো ঘুষ হিসেবে চকলেট বা চিপস দিয়ে আমার রাগটা মাটি করেন। আজকেও তাই করলেন।
পর্ব-১১
সময়টা এখন দুপুর তিনটা। রোদের আলোয় গাছের পাতাগুলো ঝিলিক দিচ্ছে যেন। দুপুরের এই মূহুর্তটা যেন বিরক্তি লাগবার জন্য একদম পারফেক্ট সময়। অহেতুক ঘুম এসে দেখা দিবে কিন্তু ঘুমোতেও আবার যেন ইচ্ছে করবে না। কী যে এক অস্বস্তিকর অবস্থা! বরাবরের মতোই এই সময়টাতে আমি বড্ড বোর ফিল করি। এটা শুধু আমারই হয় নাকি অন্য কারোর হয় তা জানা নেই।
আমাদের সবার দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর্ব এখনও শেষ হয়নি। আজকে রান্নাবান্না শেষ হতে একটু বেশি সময় লেগে গেছে। কারণ মার শরীরটা একটু দূর্বল তাই জেঠীমাকে একা সব সামলাতে হয়েছে আজকে।
- কথামনি, যা তো, নীলকে ডেকে নিয়ে আয়।
জেঠীমা কিচেন থেকে চেঁচিয়ে বললো আমায়। আমি ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলাম। জেঠীমার জবাবে আমিও খানিকটা চেঁচিয়ে বললাম, - যাই জেঠীমা।
এই বলে টিভিটা অফ করে দিলাম। একটা হিন্দি মুভি দেখছিলাম। ‘Dil ka kya kasoor’ মুভি। এই মুভিটা দেখলে, সবসময়ই আমার মন খারাপ হয়। কারণ মুভিতে নায়িকা মারা যায়। সেড ইন্ডিং কোনোকিছু আমি একদমই নিতে পারি না। সেটা গল্প, উপন্যাস, নাটক বা মুভি যা-ই হোক না কেন? এতোটাই কষ্ট লাগে যে, ইচ্ছে করে পরিচালকদের পিটিয়ে সেড ইন্ডিং না করে নিজেই হেপি ইন্ডিং করে দেই।
- সামান্য একটা মুভিতেও কেন ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না?
এই প্রশ্নের উত্তর হয়ত আমি কখনও পাবো না। আর পেলেও মানতে রাজি হবো না। আমার যদি কোনো অলৌকিক শক্তি থাকতো। তাহলে আমি শুধু মুভিতে নয়, বাস্তবেই সকল ভালোবাসায় পূর্ণতা পাবার বিষয়টা নিশ্চিত করে দিতাম।
Dil jigar nazar kya hai
Main toh tere liye jaan bhi de dooh
Dil jigar nazar kya hai
Main toh tere liye jaan bhi de dooh
Dil jigar nazar kya hai
Main toh tere liye jaan bhi de dooh
O meri jaaneja tu hai mera jahaah
Main toh tere liye jaan bhi de dooh
Dil jigar nazar kya hai
Main toh tere liye jaan bhi de dooh
O meri jaaneja tu hai mera jahaah
Main toh tere liye jaan bhi de dooh
Maine tujhko chaha is mein meri khata kya
Maine tujhko chaha is mein meri khata kya
এই গানটা ‘Dil ka kay kasoor’ মুভির যেটা আমার খুব ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে? উম, ভাবতে হবে।
নীল ভাইয়ার রুমের কাছাকাছি আসতেই গিটারের টুংটাং শব্দ কানে এলো। ভাইয়া বাসায় খুব একটা গিটার বাজান না। তাই তেমন করে কখনও শোনা হয় নি আমার।
গিটারে সুর তুলছেন বলে নিঃশব্দে উনার রুমে এসে উঁকি দিলাম। উনি চোখ বুঁজে আছেন। হোয়াইট টিশার্ট আর টাউজার পড়ে বিছানায় বসে আছে গিটার হাতে। কপালে পড়ে থাকা চুল, উনার হেলেদুলে উঠা শরীরের সাথে তাল মিলিয়ে নড়ছে।
আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। উনার বুঁজে থাকা চোখ হয়ত আমার মাঝে সাহসের সৃষ্টি করছে অপলক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে। উনার খোলা চোখে তাকিয়ে থাকার খুব একটা সাহস আমার হয় নি আজও।
সুর উঠলো গিটারে আর আমিও চুপটি করে দাঁড়িয়ে মন দিলাম সেই সুরে,
তোমাকে দিয়েছিলাম
চেনা চেনা কথা গুলো
এসো না জুড়ে নিতে
ছেঁড়া ছেঁড়া ব্যথা গুলো
তোমাকে দিয়েছিলাম
চেনা চেনা কথা গুলো
এসো না জুড়ে নিতে
ছেঁড়া ছেঁড়া ব্যথা গুলো
এ অগোছালো হাওয়া
ব্যস্ত আশা যাওয়া
আমাদের চেনালো কি?
আবছা হয়ে এসো
আমাকে ভালোবাসো
এরচেয়ে বেশি চেয়েছি কি?
তোমাকে দিয়েছিলাম
চেনা চেনা কথা গুলো
এসো না জুড়ে নিতে
ছেঁড়া ছেঁড়া ব্যথা গুলো
তোমাকে দিয়েছিলাম
চেনা চেনা কথা গুলো
এসো না জুড়ে নিতে
ছেঁড়া ছেঁড়া ব্যথা গুলো।
- এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
হঠাৎ ডাকে চমকে উঠলাম। সুরটা এতোটাই ভালো লাগছিল যে, আমিও চোখ বুঁজে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তাই তো গিটার বাজানো বন্ধ হওয়ার পরও আমি সেটা বুঝতে পারি নি।
ভাইয়ার কথার জবাব দিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, - জেঠীমা পাঠিয়েছিল আপনাকে এসে বলতে, দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য।
- তো না বলে দাঁড়িয়ে আছিস যে বরং।
- আপনি গিটার বাজাতে ব্যস্ত ছিলেন তাই ডাকি নি আপনাকে।
- ওহ। লুকিয়ে লুকিয়ে শুনছিলি? তা কেমন হয় আমার গিটার বাজানো?
ভাইয়া গিটারটা দেখতে দেখতে আমায় জিজ্ঞেস করলেন। আমি প্রতুত্তরে বললাম, - অনেক অনেক ভাল হয় ভাইয়া। সত্যি আপনি_
আমাকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
- থাক। অনেক প্রশংসা হয়েছে। তুই গিয়ে বস। আমি আসছি খেতে।
মানুষ প্রশংসা করলে খুশি আর নবাবজাদার প্রশংসা করলে আমাকে অপমানিত হতে হয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অহেতুক অপমানিত হওয়ার শখ নেই বলে ছোট্ট করে জবাব দিলাম, - হুম।
এই বলে চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই ভাইয়া ডেকে বললেন,
- ঐ পেত্নী শোন।
উনার ডাকে দাঁড়ালেও আমাকে পেত্নী বলাতে একবিন্দুও ভালো বোধ করছি না আমি। ভাইয়া উনার গিটারটা বিছানার পাশে রেখে আমাকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, - তোকে গিটার বাজানো শেখালে শিখবি?
ভাইয়ার কথায় অবাক-খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, - সত্যি ভাইয়া?
- হুম সত্যি। শিখবি কিনা সেটা আগে বল।
- কার কাছে শিখবো?
- কেন? আমাকে কি তোর চোখে পড়ে না? নাকি আমি শেখাতে পারবো না তোকে?
- না না। আমি তো সেটা বলি নি।
- তাহলো কোনটা বলেছিস শুনি?
- আপনার কাছেই শিখবো।
আমার জবাব পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাইয়া নরম সুরে বললেন,
- এতো ভয় পাস কেন আমায়? যা বলি তাই মেনে নিস। এতো মেনে নিস কেন আমার কথা? আমি কি অনেক বেশি রাগী? আর, খুব কি খারাপ আমি?
- সেসব কিছু নয় ভাইয়া। আমার জন্য আপনার মাঝে রাগের সৃষ্টি হোক, সেটা আমি চাই না। আর মেনে নেই কারণ, আপনার কথাগুলো মানতে ভালো লাগে। ভালো লাগার পিছনেও একটা কারণ আছে। সেটা হলো আপনি কখনও আমার ক্ষতি চাইবেন না।
- ভালোই তো কথা বলতে পারিস দেখছি।
আমি চুপ করে রইলাম। আমাকে চুপ থাকতে ভাইয়া নিজে থেকেই বললেন,
- অনেক বেলা হয়েছে। তুই যা আমি আসছি।
- ঠিক আছে ভাইয়া।
সকাল সকাল বাসায় বৈঠক বসবে– এই ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু ছোট খাটো একটা বৈঠক হবে সেটা জানা ছিল। তবে আজকেই হবে সে সম্পর্কে একটুও ধারণা ছিল না আমার।
সকালে নাস্তা শেষ হতেই মিতালির মা এসে হাজির। শুনেছিলাম মিতালিকে নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। কিন্তু মিতালির মা এসে বলছেন,
- আমার মাইয়ার বিয়া ঠিক হইয়া গেছে। আগামী শুক্রবার বিয়া।
এটা শুনে আমি খুব একটা অবাক হই নি। তবে যখন শুনলাম পাত্রের বয়স ৪৮ বছর, তখন আমি জাস্ট হতবাক। হাউ ইজ দিস পসিবল?
এখনও সবার সাথে আলাপ আলোচনা চলছে মিতালিকে নিয়ে। মা আর জেঠীমা মিতালির মার সাথে এই বিষয়ে কথা বলছে। কথার একপর্যায়ে মিতালির মা বললো,
- ছেলের তো মাশাল্লাহ টাহা পইসা (টাকা পয়সা) আছে। চাইলের (চালের) ব্যবসা করে। আমার মাইয়ায় আল্লায় দিলে ভালোই থাকবো।
মিতালির মার কথা শুনে জেঠীমা জিজ্ঞেস করলো, - পাত্রের সব কিছু ভালো মতো খোঁজ খবর নিয়েছো তো?
- আমাগো পাশের বাড়ির মর্জিনা খালার চাচাতো বোইনের পোলা। উনারাই তো বিয়ার প্রস্তাব দিছে। দিবো না আবার। আমার মাইয়াই তো যেই সুন্দর আর সুন্দর দেইখাই প্রস্তাব দিছে। আর চেনা শোনা মানুষ হেরলাইগাই তো বেশি কিছু না ভাইবা রাজি হইয়া গেছি।
- তাই বলে কোনো খবর নাও নি?
- আপনার (আপন) মানুষের মাইদ্ধে (মধ্যে) আবার কিয়ের খবর লমু?
- নিজের জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটার পরও কী ভাবে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলে? ভুলে গেছো? ভালোভাবে খবর নাও নি বলে কতটা কষ্ট সহ্য করেছো জীবনে?
মিতালির মা, জেঠীমার কথার জবাবে নিরব হয়ে রইলো। মিতালির মায়ের নাম রোকসানা। বিশ বছর বয়সে, গ্রামে পঙ্গু বাবা আর মাকে রেখে শহরে এসেছিল গার্মেন্টসে কাজ করবে বলে। অনেক সাধনার পর একটা কাজ জুটেছিল কপালে। আর সেখানে কাজ করতে গিয়েই মিতালির বাবা, তারেকের সাথে উনার পরিচয় হয়েছিল। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই দুজন দুজনকে পছন্দ করতে শুরু করে। আর পছন্দ করতো বিধায় দুজনের সম্মতিতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল মাত্র চারমাসের পরিচয়ে।
মিতালির মা রোকসানা নিজের স্বামীর সম্পর্কে তেমন কোনো খোঁজ খবর নেন নি। এমনকি উনার গ্রামের বাড়ি কোথায় সেটাও সঠিকভাবে জানা ছিল না উনার। নিটফল, মিতালিকে জন্ম দিয়ে মিতালির বাবা তারেক পলায়ন করেছিলেন। চারমাসের মিতালিকে কোলে করে তিনি স্বামীর অনেক খোঁজ করেছিলেন। পরে কেউ একজন তাকে জানিয়েছিলেন উনাকে তালাক দিয়ে উনার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।
স্বামীর জন্য অনেক কান্নাকাটি করে যখন ব্যর্থ হলেন। তখন বাস্তবতা মেনে নিয়ে কাজের খোঁজ করতে লাগলেন। কারণ বেঁচে থাকতে হলে অর্থের প্রয়োজন আর অর্থের জন্য কাজের প্রয়োজন। আগে যেখানে কাজ করতেন, সেখান থেকে কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন কিছু অসুবিধা থাকার দরুন।
মৃন্ময় ভাইয়ার নানার বাড়ি যে গ্রামে সেখানেই থাকতো মিতালিদের পরিবার। মিতালির নানি নাকি মৃন্ময় ভাইয়ার মামার সাথে কথা বলেছিলেন, তখন মিতালির মাকে কাজ দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই কাজ করতে থাকেন উনি।
আমাদের একজন গৃহকর্মীর প্রয়োজন হয়েছিল। তাই জেঠীমা আলাপ করেছিল উনার ভাই মানে মৃন্ময় ভাইয়ার বাবার সাথে। তখন মৃন্ময় ভাইয়ার মা, মিতালির কথা বলেছিল। সেই থেকেই মেয়েটা আমাদের পরিবারে যুক্ত হয়েছে। দিনে দিনে ওর প্রতি সবারই একটা মায়া জমে গেছে। তাই জেনে শুনে কেউ রাজি হচ্ছে না এমন অজানা মানুষের সাথে মিতালির বিয়ে হোক।
মিতালির মাকে এটা সেটা বলে বুঝানোর চেষ্টা চলছে। জানি না, মেয়েটার কী দশা হবে? আমার ক্লাস আছে। তাই থাকতে পারছি না আমি। এদিকে ভার্সিটিতে যেতেও মনে সায় দিচ্ছে না মেয়েটার জন্য। কিন্তু কী আর করার আছে? অন্য কোনো উপায় না পেয়ে রওনা দিলাম ভার্সিটিতে।
পর্ব-১২
পরশুদিন নুহাশ পল্লীতে যাচ্ছি আমরা সবাই। সে বিষয়েই ক্লাসে কথা বলছেন স্যার। আমি চুপচাপ শুনছি কিন্তু মনযোগ গিয়ে আছে মিতালির উপর। মনটাও বড্ড খারাপ হয়ে আছে আমার। কারণ বাসায় গিয়ে হয়ত মিতালিকে আর পাবো না। সকালে তো তেমনই কথা বলতে শুনেছিলাম মিতালির মাকে।
আমি নিরবই থাকি বেশিরভাগ কিন্তু আজকে খুব বেশিই নিরবতা পালন করছি। ভার্সিটিতে এসে হুম হ্যাঁ এর বেশি কিছুই বলি নি। আমার মাত্রাতিরিক্ত নিরবতা দেখে সুমাইয়া জিজ্ঞেস করলো,
- টিয়াপাখি, এতো নিরব হয়ে আছিস কেন? স্যার কতকিছু বলে হাসাচ্ছেন। একটু হাসলেও তো পারিস।
- ভাল লাগছে না রে।
- কেন?
- মিতালির জন্য আর চুপ কর এখন। স্যার টের পেলে দুটোকে ক্লাস থেকে বের করে দিবেন।
- ওহ। হ্যাঁ হ্যাঁ।
ক্লাস শেষ হতেই স্যার সবাইকে একটা করে টিশার্ট নিতে বললেন। সবার জন্য একটা করে টিশার্ট বরাদ্দ রাখা হয়েছে পরশুদিনের জন্য। আমার ভাল লাগছিল না বলে সবার শেষে গিয়েছিলাম টিশার্ট নিতে। নিটফল, আমার কপালে জুটলো হাতির সাইজের একটা টিশার্ট। এতো বড় সাইজের টিশার্ট পেয়েও আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু সুমাইয়া শুরু করেছে,
- তোকে কত ডাকলাম টিশার্ট নিতে। কিন্তু তুই ঠাঁই জায়গায় বসে রইলি পেঁচার মতো মুখ করে। তোর এই তেজপাতার শরীরে এখন এই টিশার্টে পুরো হাতির মতো লাগবে।
সুমাইয়ার এতো কথায়ও আমার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। আমি শুধু কাঠ গলায় জবাব দিলাম,
- আমাকে হাতি লাগুক বা জিরাফ। তাতে তোর এতো ভাবনা কিসের? নিজেকে শাবনুর লাগবে না মৌসুমী সেই চিন্তা কর।
- আজব একটা মেয়ে তুই। কোনো কিছুতেই তোর মাঝে খুশির সৃষ্টি হতে দেখি না।
- ১৭/১৮ বছর বয়সের একটা মেয়ের ৪৮ বছর বয়সের একটা বুড়ো কুমড়োর সাথে বিয়ে হতে চলেছে। এসব শুনে আমি খুশি হবো এমনটা তুই ভাবলি কী করে?
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে সুমাইয়া জিজ্ঞেস করলো, - ৪৮ বছরের বুড়ো কুমড়ো মানে?
- আরে, সকালে মিতালির মা এসেছেন। মিতালির নাকি বিয়ে ঠিক করেছেন আর পাত্রের বয়স ৪৮ বছর। ৪৮ বছর বয়স সমস্যা হতো না যদি মিতালির বয়স৪০/৪৫ বছর হতো। কিন্তু ১৭/১৮ বছর বয়সের একটা মেয়ের সাথে ৪৮ বছর বয়সের কুমড়োর বিয়ে– এটা কি মানা যায়? এসবের জন্যই মনটা খারাপ। তাছাড়া বিয়ে হলে তো মিতালি আর থাকবে না আমাদের বাসায়।
- আহারে! আমার টিয়াপাখিটার দেখছি সত্যিই মনটা খুব খারাপ। দেখ, মন খারাপ করিস না। তুই মন খারাপ করলে কিন্তু আমি কান্না করে দিবো।
হালকা হেসে বললাম, - তোর এসব বাচ্চামো টাইপের কথা শুনলে আমার না, বড্ড হাসি পায়।
- তোকে হাসতেই তো এসব বলা। যাক বাবা, একটু তো হেসেছিস এতেই শান্তি শান্তি লাগছে আমার। এখন বল, কালকে কখন আসবি?
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, - কালকে তো আমার ক্লাস নেই তাহলে অহেতুক ভার্সিটিতে কেন আসবো?
- আসবি না মানে? আরে কালকে তো পহেলা ফাল্গুন।
ভাবলেশহীন ভাবে, - তো।
আমার মাথায় হালকা চাটি মেরে সুমাইয়া বললো,
- তো তোর মাথা। কালকে ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান আর আমরা সবাই আসবো সাজুগুজু করে। তুইও আসবি।
সুমাইয়ার কথায় আমি হেসে উঠলাম। আমাকে হঠাৎ হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো, - কী আজব! ডাকিনীর মতো হাসছিস কেন?
- তোর আজগুবি কথা শুনে।
- তোকে আমি বলেছি, কালকে সাজগোজ করে ভার্সিটিতে আসতে। কারণ পহেলা ফাল্গুন বলে ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান আছে। এখানে তুই আজগুবি কথা কোথায় পেলি?
আঁড়চোখে তাকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- এসবে আমি কবে আসি?
- না এসে তাহলে কী করবো সারাদিন?
- ঢ্যাং ঢ্যাং করে নাচবো তোর কোনো সমস্যা আছে?
- তাহলে আসবি না?
- না।
আমার কথায় সুমাইয়া ফুঁস শব্দ করে নিশ্বাস ফেলে আমায় বললো, - তোর মতো পানসে মেয়ের কপালে রোমান্টিক জামাই থাকবে। এটা আমার বদদোয়া তোর জন্য। মিলিয়ে নিস।
আমি গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, - অনুষ্ঠানে আসবো না বলে তুই আমায় বদদোয়া দিচ্ছিস?
- বদদোয়া বল আর সদদোয়া বল। তোর জামাই তোকে জ্বালিয়ে মারবে। হুহ।
একটু ভেবে আমি শান্ত গলায় বললাম, - আমাকে এতো সুন্দর দোয়া দিলি তো তোকেও তো দেওয়া উচিত। উম, কী দেওয়া যায়? ইয়েস, পেয়েছি। তোর জামাই এতোই পানসে হবে যে, আই লাভ ইউ বউ বলতে গিয়ে বোন বলে দিবে?
এই বলেই ব্যাগ কাঁধে দৌঁড় দিলাম। কারণ এক মুহূর্ত দাঁড়া সুমাইয়া আমার পিঠে দুমদাম মার বসাবে। আমার দৌঁড় দেখে সুমাইয়া পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, - পাজি মেয়ে। পালাচ্ছিস কোথায়?
আমি ছুটতে ছুটতে জবাব দিলাম, - এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আমি বাসায় গেলাম। বাই রে।
কিঞ্চিৎ হেসে সুমাইয়া জবাব দিলো, - বাই।
নিজের বাসায় ঢুকবো অথচ কেমন যেন অস্বস্তি কাজ করছে নিজের মাঝে। দরজা খুলে প্রথমে মিতালির মুখের হাসিটা দেখা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘Habit is the second god/habit is the second nature.’ অর্থাৎ মানুষ অভ্যাসের দাস। আর সেই অভ্যাসগত কারণেই মিতালিকে দেখবো না ভাবতেই কেমন যেন লাগছে নিজের মাঝে।
কলিং বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দৃষ্টি রেখে মাটিতে। হঠাৎ দরজা খুলে গেল। কে খুললো? সেটা দেখতে মলিন মুখখানা নিয়ে চোখ তুলে তাকালাম মানুষটার দিকে। আর মুহুর্তেই আমার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। খুশির দরুন চেঁচিয়ে বললাম,
- মিতালি!
- হও আপামনি আমি।
- তুই তাহলে যাস নি?
- না আপামনি। জেঠায় আইসা মার লগে রাগারাগি করছে। কারণ মায় তো বুঝতো চায় না। পরে ভালা কইরা বুঝাইয়া বিয়াডা ডিস মিস (ভেঙে দিয়েছে) কইরা দিছে।
- যাক বাবা। আল্লাহ তাহলে বাঁচিয়েছেন। তুই জানিস, আমার কতটা মন খারাপ লাগছিল?
- কী যে কন না আপামনি? আমি জানমু না তো কেডায় জানবো? চিন্তা কইরেন না। আমি আছি আল্লায় দিলে। এহন গিয়ে ফেরেশ (ফ্রেশ) হইয়া লন।
- ঠিক আছে।
ইষ্টিশনের রেল গাড়িটা
মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা
ইষ্টিশনের রেল গাড়িটা
মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা
প্লাটফর্মে বইসা ভাবি
কখন বাজে ১২টা,
কখন বাজে ১২টা।
কখন বাজে ১২টা,
কখন বাজে ১২টা।
যখন ছাড়ে থামেনা রে
ভারী জংশন ধরেনা রে
যখন ছাড়ে থামেনা রে
ভারী জংশন ধরেনা রে
জরিমানা হইয়া যাইবো
যদি টানো চেইনটা যদি টানো চেইনটা
যদি টানো চেইনটা যদি টানো চেইনটা
ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে এগারোটার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করতে করতে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছি। তাই মনে মনে গেয়ে চলেছি,
ইষ্টিশনের রেল গাড়িটা
মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা
প্লাটফর্মে বইসা ভাবি
কখন বাজে ১২টা,
কখন বাজে ১৩টা,
কখন বাজে ১৪টা,
কখন বাজে ১৫টা।
ভাইয়ার কাছে পড়বো বলেই সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি বই খাতা নিয়ে। কিন্তু ভাইয়া এখনও বাসায় ফিরে আসেন নি।
আজকে পহেলা ফাল্গুন। সেই উপলক্ষে নাকি ভাইয়ার ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান আছে৷ আমাকে বিকেলে কল করে বলেছিলেন,
- আমার আসতে দেরি হবে। তুই বসে পড়তে থাকিস আমি না আসা পর্যন্ত।
ভাইয়া আমাকে পড়তে বলেছিলেন আর আমি পড়া বাদ দিয়ে ইস্টিশন, রেলগাড়ী আর ঘড়ির কাঁটা নিয়ে পড়ে আছি। বিড়বিড় করে গানটা গেয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই চোখ পড়লো ভাইয়ার গিটারে। কালো রঙের গিটারটা পড়ে আছে ভাইয়ার বিছানার একপাশে।
- যেই মানুষের কালো রং পছন্দ না সে তার শখের জিনিস কেন কালো রঙের কিনলো?
এই প্রশ্নটা আমার মনে হাজারবার এলেও উত্তর আসে নি একবারও। উনার পছন্দের জিনিসের মধ্যে গিটারটাও বেশ পছন্দ করেন উনি। তাই পছন্দের জিনিসে অন্য কেউ হাত দিবে সেটা উনি একদমই পছন্দ করেন না। তবে আমি একদিন সাহস করে হাতে নিয়েছিলাম গিটারটা।
কয়েকদিন আগে_
ভাইয়ার কাছ থেকে একটা উপন্যাসের বই এনেছিলাম, যেটা এই মাত্র পড়ে শেষ করলাম। বইটা হাতে নিয়ে বসে বসে ভাবছি,
- বইটা পড়া যখন শেষ, তখন ফেরত দিয়ে আসি।
বই হাতে চলে এলাম ভাইয়ার রুমে। কিন্তু এসে দেখি ভাইয়া রুমে নেই। উনার পড়ার টেবিলে বইটা রাখতেই হঠাৎ আমার চোখ পড়লো গিটারে। কালো গিটারটা দেখে খুব লোভ হলো এটা নিয়ে অন্তত একবার সুর তুলতে। এক দুই মিনিট ভেবে মনে মনে বললাম, - যা হওয়ার হবে। আজকে একবার গিটারে সুর তুলতে না পারলে আমার মন কিছুতেই শান্ত হবে না।
মনের কথা বাস্তবে পরিণত করতে, এগিয়ে এলাম গিটারের কাছে। কাঁপা কাঁপা হাতে গিটারটা নিয়ে বিছানায় বসে দেখতে শুরু করলাম। গিটারের বডির এক কোণে ছোট্ট করে সাদা রঙে উনি নিজেই লিখেছেন বোধহয়, - Koi or tha Nopil!
আমি আলতো হাতে লেখাটা স্পর্শ করে ভাবতে লাগলাম,
- এটার মানে আবার কী হতে পারে? উম, বুঝতে পারছি না হয়ত হবে কিছু একটা।
আমি ভাবনা বাদ দিয়ে, বাজানোর জন্য গিটারটা ভালো করে নিয়ে মুচকি হেসে দিলাম এই ভেবে যে, - আমি গিটার বাজাবো!
আমার হাতের আঙুল দিয়ে ছন্দহীন সুর উঠলো গিটারে। আরও কয়েকবার ছন্দহীন সুর তুলে মনে মনে হেসে উঠলাম আর খানিকটা জোরে বললাম,
- এটা তোকে দিয়ে হবে না রে কথামনি।
- কেন হবে না?
হঠাৎ কারো কন্ঠে চমকে উঠলাম আমি। কন্ঠের মালিককে খুঁজতে চোখ দিলাম রুমের দরজায় আর সাথে সাথেই চমকে দাঁড়িয়ে গেলাম নিজের অজান্তেই। শুকনো একটা ঢোক গিলে গিটার হাতেই তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে। দুইহাত বেঁধে দরজায় হেলান দিয়ে বেশ গম্ভীর একটা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নীল ভাইয়া। কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি বিনিময় হতেই ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
- কী ব্যাপার?
- কিছু না ভাইয়া। আসলে_
এতোটুকু বলতেই ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে এলেন। এটা দেখে ভয়ে আমার কথা অটোমেটিক অফ হয়ে গেল। আমার কাছে এসে উনি হাত বাড়িয়ে কিছু চাইলেন আমার কাছে। কিন্তু ভয়ে বুঝতে পারলাম না উনি কী চেয়েছেন? তাই জিজ্ঞেস করলাম,
- কী ভাইয়া?
- গিটার দেয়।
- ওহ।
বলেই সাথে সাথে গিটারটা দিয়ে দিলাম। গিটার হাতে নিয়ে ভাইয়া বললেন, - কোনো দরকার ছিল?
- হ্যাঁ, বইটা পড়া শেষ। তাই দিতে এসেছিলাম।
- ওহ। আচ্ছা তাহলে যা এবার।
- ঠিক আছে।
হঠাৎ কী ভেবে যেন ইতস্তত করে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, - ভাইয়া?
- বল।
- আপনার গিটারের লেখাটার মানে কী?
আমার প্রশ্নটা ভাইয়ার খুব একটা পছন্দ হয় নি। তাই রাগী একটা ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আঁড়চোখে। উনার চাহনিতে আমি চুপসে গিয়ে বললাম, - এমনিই জিজ্ঞেস করেছি ভাইয়া। বলতে হবে না।
- আমি এমনিতেও বলতে চাই না। পারলে নিজে মানেটা খুঁজে নিস।
- আমি!
- কেন?
- না না। কিছু না। আমি যাই ভাইয়া।
- হুম।
সেদিনের পর লেখাটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু আমার গোবর ভর্তি মাথায় এটার কোনো মানেই আসে নি আজ পর্যন্ত। এসব ভাবছি আনমনে বসে বসে, তখন ভাইয়া রুমে ঢুকলেন, হাতে কিছু চকলেট আর লাল টকটকে কয়েকটা গোলাপ নিয়ে। গোলাপ ফুল দেখেই খুশিতে পাগল হয়ে গেলাম। আমার অনেক পছন্দের একটা ফুল। কিন্তু হলেই বা কী হবে? এই হনুমানের নাতি কখনও আমাকে ফুল ধরতেও দিবেন না। তাই খুশিটা মাটি চাপা দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। উনি বিছানায় ফুল আর চকলেটগুলো রেখে আমায় জিজ্ঞেস করলেন,
- কখন এসেছি?
- ভাইয়া, রাত দশটা থেকেই এসে বসে আছি। আপনি এতো দেরি করলেন যে, অনুষ্ঠানের পর কোথাও গিয়ে ছিলেন?
- কোথাও গিয়েছি কিনা সেটা কি তোকে বলতে হবে এখন?
সামান্য একটা প্রশ্ন এতো রাগ করার কী আছে? উনার রাগী কন্ঠটা আমার ঠিক হজম হলো না। তাই উত্তরের প্রতীক্ষায় দ্বিতীয় বার প্রশ্ন না করে বললাম, - না, আসলে এই প্রথম আপনার এতো দেরি হলো। তাই জানতে চাইলাম।
ভাইয়া হাতে একটা তোয়ালে নিতে নিতে বললেন, - বেশি বকবক না করে পড়া শুরু কর আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
- হুম।
পর্ব-১৩
উনি ফ্রেশ হতে চলে গেলেন আর আমি বই নিয়ে বসে আছি। কিন্তু বই সামনে ধরে বসে থাকলে কী হবে? মন তো আটকে আছে ঐ লাল টকটকে গোলাপে। জানি, মন চাইলেও পাবো না। তাই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে পড়ায় মন দিলাম।
মিনিট দশেক পর ওয়াশরুম থেকে বের হলেন ভাইয়া। মুখে ঝাপটা দেওয়া পানি এখনও লেগে আছে আর কপালে পড়ে আছে আধো ভেজা চুল। এরূপ চেহারা একপলক দেখলে মন মানবে না কিছুতেই। মন চাইবে, মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে মিমিটের পর মিনিট আর ঘন্টার পর ঘন্টা। ইদানীং আমার কী হয়েছে আমি নিজেও জানি না। অহেতুক ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কেন যেন ইদানীং ভাইয়াকে অন্যরকম লাগে।
- উনি কি আগের চেয়ে ফর্সা হয়েছেন নাকি?
আমার এসব ভাবনার মাঝেই ভাইয়া চেয়ারে বসতে বসতে আমায় বললেন,
- আজকে তোকে বেশি পড়াতে পারবো না ক্লান্ত লাগছে।
এটা শুনে আমি মনে মনে বললাম, - আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনি আমায় বাঁচালেন।
ভাইয়া তাগাদা দিয়ে বললেন, - হোমওয়ার্ক গুলো দেয়।
আমি খাতাটা উনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ ভাইয়াকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। ভাইয়া খাতার পাতায় দৃষ্টি রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, - পেত্নী, আমি কি ইদানীং সুন্দর হয়ে গিয়েছি? এভাবে তাকিয়ে থাকিস যে।
হঠাৎ এমন কথা শুনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। আমতাআমতা করে বললাম, - ইয়ে মানে ভাইয়া_
খাতার পাতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে। শান্ত চাহনি আর নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
- ইতস্তত করছিস কেন? আমি কী মিথ্যা কিছু জানতে চেয়েছি?
- উহুম।
- তাহলে?
চুপচাপ শুধু তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে আর উনি একগাল হেসে বললেন, - পেত্নী।
এই বলে আবার নিজের কাজে মন দিলেন। আজব একটা মানুষ। একটু আগেও রাগে ফুঁস ফুঁস করছিলেন আর এখন, আমায় কনফিউজড করতে হাসছেন। ইদানীং উনার চেহারায় শুধু নয়, উনার মাঝেও পরিবর্তন দেখছি। যে মানুষটা হাসতে জানতো না খুব একটা, সেও এখন একগাল হেসে নিজেকে ব্যস্ত রাখে। অতিরিক্ত গম্ভীর এই মানুষটা কেন যেন নরম স্বভাবের হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। এসব অর্থহীন ভাবনা আমার মাঝে কেন আসে কে জানে?
হোমওয়ার্ক চেক করে আর নতুন করে হোমওয়ার্ক দিতে দিতে রাত বারোটা বেজে গেল। বই খাতা গুছিয়ে যখন চেয়ার থেকে উঠবো, তখন ভাইয়া বলে উঠলেন,
- পেত্নী শোন।
- পেত্নী কী? হ্যাঁ? হনুমানের নাতি।
মনে মনে এটা বললেও মুখে বললাম, - জ্বী ভাইয়া।
- লাল গোলাপ আমার পছন্দ না সেটা তো জানিসই।
- জ্বী ভাইয়া। আপনার তো জবাফুল পছন্দ।
আমার হিসেব মতে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের পছন্দের ফুল হওয়া উচিত গোলাপ। আর উনার কিনা জবাফুল পছন্দ। সত্যিই আজব একটা মানুষ।
আমার কথায় কিছুসময় আমার দিকে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন,
- ভালোই তো আমার পছন্দ আর অপছন্দের খবর রাখছিস। সে যা-ই হোক, আমাকে কেউ একজন এই ফুলগুলো দিয়েছে কিন্তু এগুলো আমার রাখার ইচ্ছে নেই। তাই তুই ফুলগুলো নিয়ে যা।
খুশিতে গদোগদো হয়ে, - সত্যি ভাইয়া?
- হুম সত্যি আর এই নেয় তোর চকলেট। সপ্তাহে তো দুইদিন দেই। তবে এই সপ্তাহে তিনদিন পাবি।
- শুকরিয়া ভাইয়া।
খানিকটা অবাক হয়ে, - শুকরিয়া! এটা কেন বলিস?
- ভাল লাগে আর আপনজনদের তো ধন্যবাদ দিতে নেই। কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হয় তাই শুকরিয়া বলে একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি মাত্র।
- ইদানীং খুব বড় হয়ে যাচ্ছিস দেখছি।
হঠাৎ কী যেন ভেবে আমায় বললেন, - কিন্তু তুই কথাটা শুধু আমায় কেন বলিস? আর কাউকে তো বলতে শুনি না এমনকি চাচা আর চাচীমাকেও নয়। তারা কি তোর আপন নয়? নাকি আমি তোর পর? তাই সবার থেকে আলাদা করে শুধু আমায়ই এটা বলিস।
কথাটা সত্যিই যে, আমি কেবল ভাইয়াকেই শুকরিয়া বলি কিন্তু এর কারণটা নিজের মাঝেও খুঁজে পেলাম না। তাই উনার সব প্রশ্নকে উপেক্ষা করে আমি বললাম,
- আমি এখন আসি ভাইয়া।
বলেই বইখাতা, চকলেট আর বিছানা থেকে ফুলগুলো নিয়ে চলে এলাম নিজের রুমে। ভাইয়াও কোনোরূপ বাঁধা দিলেন না বা জিজ্ঞেসও করলেন না যে, উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছিস কেন?
সকাল আটটা। ঘড়ির কাঁটার সাথে যেন পাল্লা দিতে ছুটছি আমি। অনেক সকালে উঠেছিলাম তৈরি হবো বলে। কিন্তু ছোটাছুটি করেও যেন সেই দেরিই হয়ে যাচ্ছে।
সকালে নাস্তা করার ইচ্ছে ছিল না একবিন্দুও। কিন্তু মা আমায় শুধু মুখে দরজাও পার হতে দিবেন না। তাই একটু রুটি মুখে দিয়েছিলাম।
আমি প্রায় তৈরি হয়ে গিয়েছি। এখন শুধু নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিবো এই যা। কয়েকদিন আগেও মনে হয়েছিল, নুহাশ পল্লীতে যেতে অনেকদিন বাকি। কিন্তু এক দিন এক দিন করে চলে এলো কাঙ্ক্ষিত দিন। আজকে যাচ্ছি সেটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার।
আমি ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই রুমে প্রবেশ করলো সুমাইয়া। রুমে ঢুকেই অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
- কিরে? তোকে আবার কে ভ্যালেন্টাইন ডে এর শুভেচ্ছা জানালো?
ওর কথায় আমি মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, - ভ্যালেন্টাইন ডে এর শুভেচ্ছা মানে?
- ন্যাকা! বুঝেন না? আপনাকে আজকে ভ্যালেন্টাইন ডে এর শুভেচ্ছা জানিয়েছে আর বলছেন কিসের ভ্যালেন্টাইন ডে?
দ্বিগুন অবাক হয়ে, - আজকে ভ্যালেন্টাইন ডে!
- হ্যাঁ, কেন? তুই জানিস না?
- কই? না তো।
- তাহলে তোকে এই ফুল আর চকলেট কে দিলো?
টেবিলে থাকা ফুল আর চকলেটগুলো দেখিয়ে সুমাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমিও সেখানে তাকিয়ে চমকিত নয়নে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, - তুই এসব দেখে এমন উল্টো পাল্টা বলছিস?
- হ্যাঁ।
- আরে এগুলো তো আমাকে নীল ভাইয়া দিয়েছেন। উনাকে কে যেন দিয়েছিল? কিন্তু উনার তো লাল গোলাপ নাকি তেমন পছন্দ না। তাই উনি আমাকে দিয়ে দিয়েছেন।
কৌতূহল নিয়ে, - কখন দিয়েছে রে?
- কাল রাতে। কেন?
- কয়টা বাজে সেটা বল তাড়াতাড়ি?
- বারোটার পর মনে হয়।
- হুম, আই এম শিওর নীল ভাইয়া তোকে একটু একটু পছন্দ করেন। তাই তো এতো কেয়ার করে তোকে। এমনকি নিজেই পড়ান কোথাও পড়তে যেতে দেন না। আবার_
- দেখ, আমি উনার ছোট বোন।
- সেটা কি ভাইয়া নিজে কখনও বলেছেন? তোকে তোর নামেও ডাকেন না। নিজে থেকেই আলাদা একটা নামে পেত্নী বলে ডাকেন। উনি তোর পছন্দের দিকেও কত নজর রাখেন। আর কী ভাবে বুঝাবেন তোকে উনি?
- উফ, সকাল সকাল কী শুরু করেছিস তুই? উল্টো পাল্টা ভাবা বন্ধ করবি? ভাইয়া অন্য কাউকে পছন্দ করেন আর এটা আমরা সবাই জানি।
- অন্য কেউটা কে শুনি? আজও তো মেয়েটার নামটাই জানা হয় নি। তাই তো বলছি_
- পাজি মেয়ে, খুব অসহ্য লাগছে আমার। তোর এসব মনগড়া কথা যদি জানতে পারে না ভাইয়া। তাহলে গাছে উল্টো ঝুলিয়ে বেদম প্রহার করবে তোকে। সো চুপ যা। একদম আজেবাজে কথা বলে আমার মাথা খাবি না।
- ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি চুপ করলাম। কিন্তু আমার কথা যদি ঠিক হয় না, তাহলে তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে এই আমি বলে দিলাম।
আঁড়চোখে তাকিয়ে বললাম, - খুব বেশি বেশি কিন্তু বলছিস।
- মোটেও বেশি না বরং খুব কম বলছি।
- উফ, চল তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সুমাইয়া জোরেশোরে হেসে বললো, - হুম, চল।
একরাশ বিরক্তি নিয়ে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আমার পাশেই খানিকটা দূরে মিনারেল ওয়াটার দিয়ে মুখ ঝাপটা দিচ্ছে সুমাইয়া। এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে ওকে ফুটবলের মতো একটা লাত্থি দিতে। কী কান্ডটাই না করেছে গাড়িতে!
আমাদের সেকশনে স্টুডেন্ট কম বলে স্যার শুধু আমাদের জন্য আলাদা একটা মিনিবাস নিয়েছিলেন। সবাই৷ যার যার পছন্দ মতো স্বাধীনভাবে বসেছিল। আর আমি, রাত্রি এবং সুমাইয়া একসাথে বসেছিলাম।
বাসে এয়ারকন্ডিশনও ছিল। কারণ এটা ভার্সিটির টিচারদের জন্য ব্যবহৃত হতো।
সকালে নাস্তাটা আমাদের দেওয়া হয়েছিল গাড়িতেই। আমি নাস্তা করেছিলাম বলে খাবারটা খুলেও দেখি নি। কিন্তু সুমাইয়া নাস্তা করে আসে নি বলে সেটা খেয়েছিল। এয়ারকন্ডিশনারে বসে অতিরিক্ত তেলযুক্ত পরোটা খেয়ে মিনিট পনেরো পর সুমাইয়া গাড়ির ভিতরই দিয়েছিল বমি করে। সেটা দেখে আমারও বমি আসার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। কোনোরকম নিজেকে সামলে কিড়মিড় করে বসে ছিলাম। মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সেটা অবশ্য পরিষ্কার করা হয়েছিল।
কিন্তু বাকিটা পথ সুমাইয়ার উপর আমার মেজাজটা জলন্ত ফ্রাইংপ্যানের মতো ছিল। তারউপর এই মেয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল। এতো কান্ড করার পরও আমি ওকে কিছু বলতে পারি নি। কারণ সুমাইয়া এক লতাপাতা ফ্রেন্ড হে মেরা।
নুহাশ পল্লী গাজীপুর জেলার পিরুজ আলী (পিরুজালী) গ্রামে অবস্থিত। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ব্যক্তি উদ্যোগে গাজীপুরে নিজ বড় ছেলে নুহাশ হুমায়ূনের নামানুসারে পল্লীটির নাম রেখেছিলেন ‘নুহাশ পল্লী’। পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র ও শুটিংস্পট হিসেবে এটি বেশ পরিচিত।
পর্ব-১৪
৪০ বিঘা জমির উপর স্থাপিত নুহাশপল্লীর মূল ফটক পেরোতেই চোখে পড়লো সবুজ ঘাসের গালিচা। নুহাশপল্লীর উদ্যানের পূর্বদিকের খেজুর বাগানের পাশে ‘বৃষ্টিবিলাস’ নামে একটি অত্যাধুনিক ঘর রয়েছে।
এর ছাদ টিনের তৈরি। মূলত বৃষ্টির শব্দ শুনতেই নাকি এতো আয়োজন। আমরা সবাই এসে এতে আশ্রয় নিলাম ক্লান্ত শরীরকে স্বস্তি দিতে। বিশ্রামের জন্য কিছু কক্ষ খোলা ছিল। এতে বিছানাও পাতা ছিল৷ আমি আর সুমাইয়া ভিতরে ঢুকে বিশ্রাম নিতে লাগলাম। হঠাৎ কোথ থেকে তূর্য এসে বললো,
- এতেই হাঁপিয়ে গিয়েছিস তোরা?
সুমাইয়া জবাব দিলো, - বমি করে আমি ক্লান্ত। একটু জিরিয়ে নেই তারপর পুরোটা ঘুরে দেখা যাবে।
- তুই তো একটা ঠেলাগাড়ি। তোকে না ঠেললে নড়বি না তুই।
আমাকে উদ্দেশ্য করে তূর্য বললো, - কথামনি, এটাকে ঠেলেঠুলে চলো তো ঘুরে আসি।
আমি হালকা হেসে সুমাইয়াকে টেনে তুললাম আর সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম।
‘বৃষ্টি বিলাশ’ বাংলো থেকে বেরিয়ে একটু ভেতরে রয়েছে আরেকটি বাংলো, যার নাম ‘ভূতবিলাস’। দুই কক্ষের আধুনিক বাংলোটির পেছনে রয়েছে ছোট্ট পুকুর। যার চারিদিক সুন্দর ঘাসে মোড়া ঢাল দিয়ে ঘেরা, এই ঢালের চারিদিকে রয়েছে গাছ-গাছালি।
ভূতবিলাসের পাশ দিয়ে একটি নড়বড়ে কাঠের সাঁকো রয়েছে। এর উপর দিয়ে হেঁটে পুকুরের মাঝখানের ছোট্ট এক টুকরো দ্বীপাকারের ভূখণ্ডে যাওয়া যায়। তূর্য আর সুমাইয়া সেখানে গিয়ে ছবি তুললো। আমার এসব শুধু দেখতেই ভালো লাগে নিজের কিছু করতে ইচ্ছে করে না।
নুহাশ পল্লীতে রয়েছে প্রায় ২৫০ প্রজাতির গাছ, ঔষধি গাছের বাগান, হুমায়ুন আহমেদের কটেজ, ট্রিহাউজ, দাবা খেলার এবং নামাজপড়ার কক্ষ, ডিম্বাকৃতির সুইমিংপুল, কাদামাটি ও টিন দিয়ে তৈরি করা শুটিং স্টুডিও। রয়েছে মৎস্যকন্যার মূর্তিসহ একটি পানির রিজার্ভার। এটির পাশে একটি রাক্ষসের মূর্তিও আছে। এছাড়া আছে কনক্রিট দিয়ে তৈরি ডাইনোসারের মূর্তি, শালবন, অর্কিড বাগানও রয়েছে।
সবকিছু দেখতে দেখতে দুপুরের খাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। স্যার সবাইকে ডেকে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিতে বললেন। খাবার নিয়ে সবাই বসে পড়লাম একসাথে। কাকতালীয় ভাবে তূর্য আর রাত্রি একসাথে বসলো খেতে। দুজনের মাঝেই চাপা লজ্জামাখা হাসি দেখতে পেলাম আমি। আর এদিকে সুমাইয়ার মাঝে চাপা রাগ। বলতে গেলে ছোটখাটো একটা বিনোদন চলছে আমার চোখের সামনে। আমি বিনোদন উপভোগ করছি আর খাচ্ছি।
দুপুর তিনটা। খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ করে সবাই একসাথে মাঠের এক প্রান্তে আড্ডা দিবো বলে ঠিক করলাম। বসারও ব্যবস্থা আছে। একে একে সবাই বসতে লাগলো যখন, তখন সুমাইয়া আমাকে পাশ কাটিয়ে ইয়াসির ভাইয়ার সাথে গিয়ে বসলো। আমি হ্যাবলাকান্তের মতো ওর দিকে কিছু সময় তাকিয়ে ওর পাশে এসে বসে রইলাম চুপটি করে। সবই মিলে তূর্যকে জোর করতে লাগলো গান গাওয়ার জন্য। প্রথম দিকে না না করলেও মিষ্টি সুরে যখন রাত্রি বললো,
- সবাই যখন এতো করে বলছে তখন গেয়ে শোনান না একটা গান।
এমন মিষ্টি সুরে মিষ্টি অনুরোধ তূর্য কেন অন্য কেউও হয়ত বারণ করতে পারবে না। তাই তূর্যও সম্মতি জানিয়ে গানে সুর দিলো,
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
ওগো তোমার আকাশ দুটি চোখে
আমি হয়ে গেছি তারা
এই জীবন ছিল
নদীর মতো গতিহারা
এই জীবন ছিল
নদীর মতো গতিহারা
দিশাহারা
সূর্যটা ঢলে গেছে পশ্চিম আকাশে আর ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। এখনও পুরোপুরি অন্ধকারে ছেয়ে যায় নি আকাশ। কিন্তু অন্ধকার নামতেও বেশি যেন দেরি নেই আর। আমরা রওনা দিয়েছি অনেক আগেই। কিন্তু পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত হয়ে যাবে হয়ত।
বাসের জানলার ধারের সীটটাতে বসে, আনমনে তাকিয়ে আছি আলতা রাঙা আকাশের দিকে। যেটা ধীরে ধীরে আরও গাঢ় হয়ে অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে। দূর আকাশে তাকিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো সুমাইয়ার কথাগুলো,
- তুই ভাইয়ার ছোট বোন সেটা কি ভাইয়া নিজে কখনও বলেছেন? তোকে তোর নামেও ডাকেন না। নিজে থেকেই আলাদা একটা নামে পেত্নী বলে ডাকেন। উনি তোর পছন্দের দিকেও কত নজর রাখেন। আর কী ভাবে বুঝাবেন তোকে উনি?
- এই কথাগুলো একদম ঠিক। আজ অবধি ভাইয়া বলেন নি যে, আমি উনার বোন। কখনও আমায় আমার নাম ধরেও ডাকেন নি। তাহলে কি সুমাইয়ার অনুমান ঠিক?
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কলের টোন শুনে ভাবনার ঘোর কেটে গেল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি,ক
ল যাকে নিয়ে ভাবনায় মত্ত ছিলাম তারই কল। এখন কলটা পেয়ে কেন যেন খুশি লাগছে মনের ভিতর। অজানা খুশি যেন আমায় খুব করে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মনে মনে হালকা হেসে কল রিসিভ করে বললাম,
- হ্যালো।
- রওনা দিয়েছিস?
- হ্যাঁ ভাইয়া। আর হয়ত আধঘন্টা লাগতে পারে।
- সমস্যা নেই। আমি তোর ভার্সিটিতেই আছি। ভাবিস না তুই।
- আপনি চলে এসেছেন?
- হুম। আরও আগেই। আমি ভার্সিটির গেটের সামনেই আছি তবুও এসে যদি না খুঁজে পাস তবে কল করিস।
- হুম।
ভাইয়া কল কেটে দিতেই আরেক দফা মনটা হেসে উঠলো আমার। খুশি মনেই দৃষ্টি দিলাম বাইরের ঐ আকাশে। আমি আমার মত ব্যস্ত আছি আকাশ আর ভাইয়াকে নিয়ে ভাবতে। আর অন্য সবাই ব্যস্ত আছে আড্ডা দিতে। অবশ্য বারকয়েক সুমাইয়া ডেকেছিল আমায় সবার সাথে আড্ডায় যোগ দিতে। কিন্তু আমি নাকচ করাতে মুখখানায় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে সবার সাথে একাই যোগ দিলো আড্ডায়।
প্রায় ত্রিশ কী চল্লিশ মিনিট পর বাস এসে পৌঁছালো ভার্সিটিতে।
আমি বেশ তাড়াহুড়ো করেই নেমে পড়লাম বাস থেকে। সুমাইয়া আর তূর্য একসাথে যাবে– এটা আমাকে আগেই বলেছে। তাই ওর জন্য অপেক্ষা না করে ভাইয়াকে খুঁজতে নেমে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক নজর দিতে লাগলাম। খানিকটা দূরেই চোখে পড়লো ভাইয়াকে। আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছেন উনার দিকে। উনাকে দেখে ভিতরে যেন স্বস্তি বোধ করছি। দ্রুত পায়ে হেঁটে ভাইয়ার কাছে এসে দাঁড়াতেই উনি ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
- সব শেষ কি ঠিক মতো?
- হুম।
- তাহলে চল বাসায় যাওয়া যাক।
- হুম।
- মন খারাপ?
তুমুল বেগে মাথা নাড়া দিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলাম, - উহুম।
আমার থেকে জবাব পেয়ে একগাল হেসে বাইক স্টাট দিলেন ভাইয়া। আমিও দেরি না করে উনার কাঁধে ভর দিয়ে বাইকে চড়ে বসলাম।
চলন্ত বাইকে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি জলমল করছে চাঁদ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, চাঁদটাও যেন আমার সাথেই চলেছে আমায় ছাড়তে চাইছে না বলে। একে সময়টা এখন রাত তারউপর বাইকে করে যেতে বাতাসটা যেন খামচে ধরছে আমায়। বেশ শীত শীত অনুভব করছি। তবুও চুপটি করে বসে আছি। হঠাৎ-ই রাস্তার পাশে বাইক থামিয়ে দিলেন ভাইয়া। এটা দেখে আমি যতটা না চমকে গিয়েছি তারচেয়ে বেশি চমকে গিয়েছি উনাকে জ্যাকেট খুলতে দেখে। বাইকে বসেই উনার জ্যাকেটটা খুলে আমাকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
- পেত্নী।
- হুম।
- এটা পড়ে নেয় নয়ত ঠান্ডা বাতাসে সর্দি লেগে যাবে তোর।
- কিন্তু ভাইয়া আপনি তাহলে_
আমার কথার মাঝেই ভাইয়া শান্ত গলায় বললে উঠলেন, - ডাইনোসরের শীত লাগে না। তুই-ই পড়ে নেয়।
‘ডাইনোসর’ নামটা শুনে চমকেও গেলাম আবার খানিকটা লজ্জাও পেলাম। লজ্জা রাঙা মুখে আলতো হাতে জ্যাকেট নিয়ে পড়ে নিলাম। আমি জ্যাকেট পড়তেই ভাইয়া আবার বাইক স্টার্ট দিলেন।
বাসায় এসে বাইক থামাতেই আমি নেমে দাঁড়িয়ে জ্যাকেটটা খুলে ভাইয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
- শুকরিয়া ভাইয়া।
- কিসের জন্য?
- সবকিছুর জন্যই।
জ্যাকেট পড়তে পড়তে ভাইয়া বললেন, - সবকিছুর জন্য হলে শুকরিয়া দিয়ে হবে?
অবাক হয়ে, - তাহলে?
- রাতে খাবার খেয়ে, ঘুমিয়ে পড়িস। আর মাকে বলিস আমি একটু মৃন্ময়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছি।
- হুম।
আমার প্রশ্নকে উনি এমনভাবে এড়িয়ে গেলেন যেন আমি উনার কাছে কিছু জানতেই চাই নি। এড়িয়ে গেছেন সেটা বুঝেও দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করার মতোন সাহস আমার নেই। কারণ অহেতুক প্রশ্ন উনার পছন্দ নয়। আর যে মানুষটা শুধু একটা টিশার্টে এতোটা পথ ঠান্ডা বাতাস সহ্য করে আমাকে আগলে রেখেছেন, তাকে অহেতুক প্রশ্ন করে রাগান্বিত করার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।
এক গ্লাস শরবত হাতে নিয়ে মুখ গোমড়া করে আমার বিছানার একপাশে বসে আছে সুমাইয়া। আমিও একগ্লাস শরবত হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ওর পেটে যেন কথাগুলো রান্না হচ্ছে। রান্না শেষ হলেই পরিবেশন করে আমার সামনে এগিয়ে দিবে। এদিকে কী বলার আমার বাড়িতে সুমাইয়ার হঠাৎ আগমন? সেটা জানার জন্য মনটা বড্ড আনচান করছে আমার। তাই অসহ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
- রান্না শেষ হয়েছে?
- কিসের রান্না!
- এই যে, পেটের ভিতর কথাগুলো রান্না করছিস। যদি শেষ হয় তাহলে আমার সামনে এবার পরিবেশন কর। কারণ আমাকে দিয়ে আর অপেক্ষা করাটা হচ্ছে না।
- বলবো?
আঁড়চোখে তাকিয়ে,
- আবার ন্যাকামো করছিস? এসব ন্যাকামো করলে শরবত না খেয়ে এবার তোর মাথায় ঢালবো।
কাঁদো কাঁদো গলায়, - এবার মনে হয় আমার বিয়েটা হয়েই যাবে রে।
- তুই আবার সেই পুরাতন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজিয়ে আমার কান ঝালাপালা করার ফন্দি এঁটেছিস?
- কিসের ফন্দি? আমি সত্যিই বলছি।
মেকি খুশি দেখিয়ে চেঁচিয়ে বললাম,
- ও মা! সত্যি?
- এতো চেঁচাচ্ছিস কেন?
ভাবলেশহীন ভাবে,
- প্রতিবার আজাইরা কথা বলে আমার কানের বারোটা বাজাতে পারেন আর আমি একটু চেঁচালেই দোষ?
- উফ, ইদানীং তুই বাড়তি কথা অনেক বেশি বলিস। আমার কথা আগে ভালো করে শোন তারপর তুই নিজেই বুঝতে পারবি বিয়ে হবে কি হবে না?
শরবতের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বললাম, - হুম বল।
- ঐ দিন পাত্র পক্ষ যে আমায় দেখতে এসেছিল সেটা তোর মনে আছে?
- হুম মনে আছে।
- পাত্রটা কে জানিস?
- কে?
- ইয়াসির।
অবাকের চরম সীমানায় দাঁড়িয়ে,
- হোয়াট? কোন ইয়াসির?
- আমার তো একটাই ইয়াসির। মাই ক্রাশ।
- তোর কঞ্চি বাঁশ আই মিন তোর ক্রাশ সেই ইয়াসির।
- হুম।
সুমাইয়ার থেকে উত্তর পেয়ে কোনোরকম গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে আলতো হাতে মারতে শুরু করলাম। আমার এমন আচরণে সুমাইয়া চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, - একি! মারছিস কেন আমায়?
- মারবো না তো কি আপনাকে পুজো দিবো? এতো কিছু হয়ে গেছে আর তুই আমাকে কিছুই জানাস নি। তথ্য গোপন করার অপরাধে তোকে তো জ্যান্ত বালি চাপা দেওয়া উচিত।
- আজব তো! কী সব বলছিস তুই? আরে আমি নিজেও তো কিছু জানতে আর বুঝতে পারি নি।
- মানে?
পর্ব-১৫
- শোন তাহলে। তোকে তো বলেছিলাম যে, পাত্রপক্ষ আমায় দেখতে এসেছিল। ঐদিন শুধু ইয়াসিরের বাবা মা এসেছিলেন। আর আমি জানতামও না যে, উনারা ইয়াসিরের বাবা মা। পরশুদিন যখন ছবি দিয়েছে মা, তখন ছবি দেখে তো আমি পুরাই হতবাক। সব জেনেশুনে বুঝতে পারলাম ইয়াসিরের সাথেই আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আর দুই পরিবারের সবাই মোটামুটি রাজি। আর তুই তো জানিসই আমি যে, উনাকে_
ইয়াসির হলেন আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্ট। উনি এমবিএ’র পরীক্ষার্থী। ভার্সিটিতে প্রথম যেদিন আমাদের ক্লাস ছিল, সেদিনই প্রথম সুমাইয়া উনাকে দেখেছিল। উনি হলেন সুমাইয়ার ক্রাশ নামক কঞ্চি বাঁশ। উনার প্রেমে সুমাইয়া অনেক আগে থেকেই মত্ত। আমি ভেবেছিলাম এটা হয়ত একতরফা ভালবাসা, এখন তো দেখছি দুতরফা হওয়ার পাশাপাশি বিয়ে হয়ে বাচ্চাকাচ্চারও প্ল্যান চলছে।
ইয়াসির ভাইয়ার নাম নিতেই সুমাইয়া লজ্জায় রাঙা হয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে আমি ওকে বললাম,
- ইয়ে ঢঙ্গি আই নো।
- উফ, চুপ করে সবটা শোন আগে। নুহাশ পল্লীতে ইয়াসিরকে দেখেছিলি না? উনাদের কিন্তু যাওয়ার কথা ছিল না। আমার জন্যই নাকি গিয়েছিলেন। আর কালকে উনার সাথে কথাও হয়েছে আমার। জানিস, উনিও আমায় পছন্দ করেন।
সুমাইয়া কথা শুনে আমার মুখখানা এমন হয়েছে যে, কেউ দেখলে ভাববে আমি এইমাত্র মুলার জুস খেয়েছি। তেমনই মুখখানা নিয়ে ওকে বললাম,
- আমি তো তোর জন্য দোয়া করেছিলাম যেন আল্লাহ তায়ালা তোকে পানসে জামাই দেয়। কিন্তু এই বেটা তো দেখছি রোমান্টিকেরও একহাত উপর।
- ঐ, বেটা বলছিস কাকে? তোর দুলাভাই হয়। সো দুলাভাইয়া ডাক।
সুমাইয়ার কথা শুনে আমি জোরেশোরে হেসে উঠলাম। হেসে হেসেই বললাম, - উনাকে ভাই বানিয়ে তোকে ভাবী ডাকতে রাজি আছি, কিন্তু ঐ বেটাকে দুলাভাই ডাকতে পারবো না।
- কেন?
- আমার দোয়ার সাথে উনার মিল নেই বলে।
- হিংসুটে। হুহ। তবে আমার দোয়ার সাথে কিন্তু মিল আছে।
অবাক হয়ে, - কিসে?
- এই যে, তুই আর নীল ভাইয়া। উফ, তোরা দু’জন হবি ২০২১ সালের বেস্ট রোমান্টিক কাপল। আর পুরষ্কারটা দিবো আমি নিজেই।
সুমাইয়ার কথায় বেশ রাগ লাগলেও শান্ত গলায় বললাম, - তুই কি চাস এখন তোর মাথার চুলগুলো আমি একটা একটা করে টেনে তুলে ফেলি?
- ভালো কথা বললে যে, এসব শুনতে হয় সেটা আমি জানি। ওকে মানলাম, ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড অন্য কেউ। এখন সেই অন্য কেউটা কে? সেটা খুঁজে বের করবি তুই।
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে, - আমি!
- হুম টিয়াপাখি আপনি।
- তুই আমাকে খুন করার প্ল্যান করছিস? তুই কি আমার বান্ধবী নাকি ডাকিনী?
- উফ, চুপ কর তো। শোন, তুই কৌশলে ভাইয়ার কাছে উনার গার্লফ্রেন্ডের নাম জানতে চাইবি।
- আমায় মাফ করেন আমার আম্মা। আমি এখনও পিচ্চি বাচ্চা। এতো তাড়াতাড়ি দুনিয়া ছাড়ার ইচ্ছে নেই আমার।
হঠাৎ-ই সুমাইয়া অন্যদিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো, - এক ঢালা চুড়ি দিবো ভেবেছিলাম তোকে। ঠিক আছে, যখন রাজি না তাহলে আর কী করার আছে আমার?
আমি গোল গোল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, - কি! চুড়ি দিবি?
- হুম, সেরকমই তো ভেবেছিলাম।
আমি তাগাদা দিয়ে বললাম, - আমি রাজি, আমি রাজি, আমি রাজি।
- না, থাক। তুই নাকি পিচ্চি বাচ্চা। আবার খুন হওয়ার রিস্কও নিতে পারবি না।
- আরে আমি তো ৮৪ বছরের বুড়ি আর এতো বছর বেঁচে কী করবো? তাই খুন হতেও সমস্যা নেই।
- ঠিক তো?
- চুড়ির জন্য সব বেঠিকও ঠিক।
- ওকে।
ক্লাস শেষ করে বের হতেই পিছন থেকে কারো কন্ঠে ভেসে আসতে লাগলো আমার নাম,
- কথামনি, কথামনি, কথামনি?
কন্ঠের মালিককে দেখার জন্য পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, রাত্রি ডাকতে ডাকতে ছুটে আসছে। আমার কাছাকাছি এসে হাঁপিয়ে বলতে লাগলো, - ক্লাস শেষ তোমার?
- হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এভাবে ছুটে এসে হাঁপাচ্ছো কেন? আমি তো দাঁড়িয়েই ছিলাম তোমার ডাক শুনে।
- সেসব কিছু নয়। এমনিতেও দৌঁড়ঝাঁপ করা উচিত। এতে স্বাস্থ্য ভালো হয়।
- এমন শরীরে বেশি দৌঁড়ঝাঁপ করো না। পরে দেখা যাবে একটু হাওয়া লাগলেই উড়ে যাচ্ছো।
আমার কথায় খানিকটা হেসে রাত্রি বললো, - উফ বাবা! তোমার সাথে কথা পারি না গো।
- আমার নামটাই যে, কথা। তাই হয়ত।
আরেক দফা হেসে বললো, - হুম, নামের স্বার্থকতা বজায় রাখছো। যা-ই হোক, চলো ক্যান্টিনে গিয়ে বসি।
- হুম।
চেহারা নাকি মনের আয়না। আর সেই আয়নাতে ভেসে উঠে একটা মানুষের মনের অবস্থা। তবে চেহারা দেখে সবাই বুঝতে পারে না কার মনের ভেতর কী চলছে? কারোর প্রতি টান থাকলেই হয়ত সেটা বুঝতে পারা যায় খুব সহজে।
ভার্সিটি থেকে এসেও গালে হাত দিয়ে ঠোঁট উল্টে বসে আছি। দৃষ্টি টিভির স্ক্রিনে হলেও মনযোগটা নেই সেখানে। দুপুরের খাবার খেয়ে জেঠীমা এসে আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
- কিরে? মুখখানা এমন ভার করে রেখেছিস কেন?
নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে জেঠীমাকে জবাব দিলাম,
- ভার কোথায়? আমি তো ঠিকই আছি।
- মাকে মিথ্যা বলা?
- ইশ, তোমরা মায়েরা এতো কেন বুঝো?
হালকা হেসে, - যাতে সন্তানের দুঃখ কষ্ট বুঝে সেটার সঠিক সমাধান দিতে পারি। এখন বল তো, মনটা ভালো নেই কেন তোর?
- আজকে রাত্রি বললো, রুনু আর তার পরিবারের সবাই নাকি বৈশাখ মাসে কক্সবাজার যাবে। আবার মৃন্ময় ভাইয়াও গিয়েছিলেন। এসব শুনে সমুদ্র দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। তাই মনটা একটু পঁচা হয়ে আছে।
- বোকা মেয়ে, এটা নিয়ে মন খারাপ করতে হয়? আমি তোর জেঠুর সাথে কথা বলে দেখি।
- না না জেঠীমা। আমি যাওয়ার কথা বলি নি, এমনিতেই বললাম। নীল ভাইয়া জানলে খুব বকবে গো। হুম।
আমার কথায় জোরে জোরে হেসে জেঠীমা বললো, - এতো ভয় পেলে হবে? ভয়কে জয় করে জীবন ধারণ করতে হবে। আর তোকেই তো বেশি দেখতে হবে নীলের রাগ।
অবাক হয়ে, - কেন?
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে,
- তুই কবে বড় হবি মা? আমার মেয়েটা আজও সেই ছোট্ট কথামনিই রয়ে গেছে। জানিস, তুই যেদিন পৃথিবীর আলো দেখেছিস, সেদিন কেউ তোর কান্না থামাতে পারে নি এমনকি তোর মাও না। আমার কোলে এসে ধীরে ধীরে তোর কান্না থেমে ছিল। জন্ম নিয়েই আমায় তোর মায়া বেঁধে ফেলেছিলি। মাঝে মাঝে মনে হয়, তুই যেন আমারই মেয়ে।
জেঠীমার প্রতুত্তরে আহ্লাদী সুরে আমি বললাম,
- মনে হওয়ার কী আছে? আমি তোমারই মেয়ে আর তুমি আমার মা। আমার কিউট কিউট আর সুইট সুইট জেঠীমা।
এইবলে জেঠীমাকে জড়িয়ে ধরলাম আর জেঠীমাও আলতো হাতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
সন্ধ্যার পর বসে বসে টিভি দেখছি। হঠাৎ কানে কলিং বেলের শব্দ এলো। কিন্তু টিভির ধ্যানে এতোটাই মত্ত যে, কানে কলিং বেলের শব্দ আসার পরও বুঝতে পারছি না যে, এখন দরজা খুলে দেওয়া উচিত। কলিং বেল বেজেই চলেছে। অসহ্য হয়ে কিচেন থেকে মা ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
- কথামনি? তুই কি টিভি গিলে খাবি? সেই কখন থেকে কলিং বেল বেজে চলেছে তোর কি কানে যাচ্ছে না?
সব সময় আমি টিভি দেখতে নিলেই কিছু না কিছুর জন্য আমার টিভি দেখার বারোটা বাজাবে। খুব রাগ লাগছে আমার। তাই একটু রাগী ভাব নিয়ে বললাম, - যাই মা।
টিভি অফ করে হাঁটা শুরু করলাম দরজার দিকে আর রাগে মনে মনে বললাম,
- মিতালি কি বাচ্চী যে কোথায় গেল? আমার সাধের অনুষ্ঠানটা গেল শেষ হয়ে। উফ, কোন বান্দর যে এলো এই অসময়ে?
দরজা খুলে দেখি নীল ভাইয়া এসেছেন। উনার মুখে গম্ভীর একটা ভাব হয়ত দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় রেগে আছেন। একটু আগে টিভি দেখতে না পেরে যেই রাগ উঠেছিল আমার, এখন উনার রাগ দেখে সেটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। উনার ঐ রাগী মুখটা দেখে আমি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠলাম, - কেমন আছেন ভাইয়া?
আমার প্রশ্ন উনার মাঝে দ্বিধার সৃষ্টি হলেও মুখের গম্ভীর ভাবটা ধরে রেখে কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, - মাথা কি গেছে নাকি উল্টো পাল্টা কিছু খেয়েছিস?
উনার কথায় আমার হুঁশ হলো যে, এক দুই ঘন্টার ব্যবধানে কাউকে কী এসব জিজ্ঞেস করা যায়? নিজের বোকামি টের পেয়ে একটু হাসবার চেষ্টা করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি বলে উনি তিক্ত মেজাজে জিজ্ঞেস করলেন,
- আমি কি ভেতরে ঢুকবো না বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো?
জবাব না দিয়ে মলিন মুখে একপাশে এসে দাঁড়ালাম। উনি আমায় পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন ভিতরে। আমি দরজা লাগিয়ে ভিতরে চলে যাবো ঠিক তখনই আমায় ঢেকে বললেন, - ঐ পেত্নী শোন।
আমি মলিন মুখে উনার কাছে এসে দাঁড়াতেই উনি বললেন,
- বড়দের সেবা করার আদব-লেহাজ তো দেখছি একবিন্দুও নেই। যা একগ্লাস পানি নিয়ে আয় আমার জন্য আর মা কোথায়?
- জেঠীমার রুমেই, কী যেন পরিষ্কার করার কাজ করাবেন মিতালিকে দিয়ে– বলেছিলেন।
- ঠিক আছে পানি নিয়ে আয়।
- হুম।
আমি কিচেনে চলে এলাম। আমাকে দেখে মা জিজ্ঞেস করলো, - কে এসেছে?
- কে আবার? এই বাড়িতে একজন নবাবজাদা আছেন না, যে নিজেকে নবাব মনে করেন মুকুট ছাড়াই? সেই হনুমান নবাবজাদা এসেছেন।
কিঞ্চিৎ রেগে মা আমায় বলতে লাগলো, - দিন দিন দেখছি বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস। নীল না তোর বড়? এসব যদি আবার বলতে শুনি তাহলে তোর বাবার কানে কথা পৌঁছোবে বলে দিলাম। বেয়াদব মেয়ে কোথাকার।
আমাকে ঝাড়ি দিয়ে মা কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল। আমি গ্লাসে পানি ঢালছি আর উনার জন্য মায়ের ঝাড়ি খেয়েছি বলে মনে মনে খুব করে উনাকে বকছি। ইচ্ছে করছে পানি না দিয়ে একগ্লাস কেরোসিন তেল দেই। হুহ।
পানির গ্লাসটা নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এলাম। ঠোঁটে একটা মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে উনার দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলাম। তারপর শান্ত গলায় বললাম,
- আপনার পানি।
- হ্যাঁ, দেয়।
ভাইয়া মার সাথে আলাপ করছিলেন। আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে আবার আলাপ করতে লাগলেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি আর মার এবং ভাইয়ার আলাপচারিতা শুনছি। মা ভাইয়াকে বললো,
- নীল বাবা, রান্না শেষ। খাবি চল।
- দশ মিনিট পরে খাবো চাচীমা। সবে তো এলাম।
- ঠিক আছে। আমি তাহলে যাই। আপা অনেক আগেই ডেকেছিল।
- আচ্ছা।
মা চলে গেল তাই আমিও চলে যাবো বলে ঠিক করলাম। যেই হাঁটার জন্য পা বাড়ালাম ঠিক তখন ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন, - কোথায় যাচ্ছিস?
- কেন ভাইয়া?
জানতে চাওয়ায় উনি রাগী ভাব নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। উনার এমন ভাব দেখে আমি শুকনো ঢোক গিলে বললাম, - এইতো, রুমে যাচ্ছিলাম।
পকেট থেকে ফোন বের করে, হাতে নিয়ে আমায় বললেন,
- বস এখানে।
আমাকে বসতে বলে উনি ফোন স্ক্রোল করতে শুরু করলেন। প্রায় দুই-তিন মিনিট পর জিজ্ঞেস করলেন, - কালকে ক্লাস আছে?
- হুম।
ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই আবার জিজ্ঞেস করলেন,
- রাতে খেয়েছিস?
- উহুম।
- ওকে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি তারপর খেয়ে নিবো।
- হুম।
ভাইয়া উঠে দাড়িয়ে কী যেন ভেবে আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, - ইদানীং জবাবগুলো অন্যরকম লাগে। ছোট কিন্তু ভিন্ন।
এই বলেই চলে গেলেন। কিন্তু কথাটা আমাকে বলেছেন না অন্য কাউকে সেটাই আমি বুঝি নি আর কথাটার মানে বুঝবো সেটা তো অনেক দূরের ব্যাপার।
ভাইয়া ফ্রেশ হয়ে এসে আমায় ডাকলেন খেতে। আমি ডাইনিং রুমে এসে দেখি উনি দুইহাত মুষ্টি বদ্ধ করে তার উপর থুঁতনি রেখে বসে আছেন। আমি আসতেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি নিরীহ মানুষের মতো উনার পাশে গিয়ে বসতেই মা খাবার দাবার দিয়ে চলে গেল। চুপচাপ দুজনেই খেয়ে চলেছি, কারো মুখে কোনো কথা নেই। কিছু সময় যাওয়ার পর ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
- কিছু বলবি?
আমি উনার প্রশ্ন শুনে সাথে সাথেই হুম বলে সম্মতি জানালেও পরক্ষণেই আবার উহুম বলে অসম্মতি জানালাম। আমি ভয়ে এমন করছি সেটা বুঝতে পেরে ভাইয়া একগাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
- এতো ভয় পাস কেন আমায়? আমি তো তোকে মারধর করি না। তাহলে এতো কেন ভয় জাগে তোর আমার প্রতি?
উনার প্রশ্নের জবাবে কিছুই বললাম না। আমাকে নিরব থাকতে দেখে উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, - কি হলো? কিছু বলছিস না যে? আমি কি খুব রাগী?
- না না, ভাইয়া। সেসব কিছু নয়। তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।
উনি খেতে খেতে বললেন, - আজকে যা খুশি জিজ্ঞেস করতে পারিস। নো প্রবলেম।
কথাটা শুনে মনে যেন একটু সাহস হলো তবুও ভয়টা কাটছে না। ভেতরে ভেতরে সাহস জুগিয়ে হুট করেই জিজ্ঞেস করে উঠলাম, - ভাইয়া, হবু ভাবীর নাম কী?
পর্ব-১৬
খুব দ্রুত জিজ্ঞেস করে চোখ মুখ খিঁচিয়ে, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলাম, যেন ভাইয়ার রাগী চেহারাটা দেখতে না হয়। মনে মনে ভাবছি, ভাইয়া হয়ত অনেক রাগারাগি করবেন কিন্তু আমার ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে দিতে ভাইয়া কাশতে শুরু করলেন। কাশির শব্দে চমকিত নয়নে উনার দিকে তাকাতেই দেখি, উনি বিষম খেয়ে কাশছেন আর পানি পান করছেন। বউয়ের নামই তো শুধু জিজ্ঞেস করলাম এতে এভাবে কাশাকাশি করার কী আছে? সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
তিন চার মিনিট হওয়ার পরও উনার কাশি থামছে না। বেশ বড়সড় বিষম খেয়েছেন। উনাকে এভাবে কাশতে দেখে আমার তো এবার ভয় লাগছে ভীষণ। একে তো প্রশ্ন করেছি তাও এমন প্রশ্ন যেটা উনার মোটেই পছন্দ নয়। আবার আমার প্রশ্ন দিয়ে উনার বারেটা বাজালাম। ভয়ে মনে মনে খুব করে আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম।
একটুপর কিছুটা স্বাভাবিক হতেই উনি আমায় বললেন,
- কোশ্চেন করার পারমিশন দিয়েছি বলে কি কোশ্চেন দিয়ে জানে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিস আমায়?
ভয়ে মিনমিন করে বললাম, - আমি বুঝতে পারি নি ভাইয়া যে, আপনাকে হবু ভাবীর কথার জিজ্ঞেস করলে আপনার অবস্থা এমন হয়ে যাবে।
- দেখ, অনেক হয়েছে। আমার সাথে আজকে যা করলি এরপর তো তোকে কোশ্চেন করার কোনো চান্সই দেওয়া যাবে না। আর সবার আগে ভাবী ডাকা অফ কর। টলারেট করতে পারছি না। জাস্ট অসহ্য লাগছে।
- ঠিক আছে তাহলে না হয় আপু বলেই ডাকবো।
হঠাৎ-ই ঝাঁঝালো কণ্ঠে ভাইয়া বলতে লাগলেন,
- ঠাসঠাস কানের গোঁড়ায় কয়েকটা দিয়ে কান একদম লাল করে ফেলবো। ফাজিল মেয়ে। বেশি পাকনা হয়ে গিয়েছিস? আমি বলেছি তোকে আমার বউকে কিছু বলে ডাকতে? আজ পর্যন্ত নিজে আই লাভ ইউ বলতে পারি নি আর উনি আসছে ভাবী ডাকতে। খবরদার আমার বউ নিয়ে কোনো কথা তুলেছিস তো। যেদিন বিয়ে করবো তখন চোখ দুটো বের করে হাতে নিয়ে দেখে নিস যে, যাকে বিয়ে করব তাকে ভাবী ডাকা যায় কিনা।
একটু বিরতিতে বললেন, - আস্ত ঢেঁড়স একটা।
এই বলে ভাইয়া খাবার ফেলে রেখে, চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন। কিন্তু সামনে পা বাড়িয়েও থেমে গেলেন আর কী যেন ভেবে আমায় বললেন,
- আজকে যেহেতু বলেছি সব জিজ্ঞেস করতে পারবি তাই জবাবটা দিয়ে দিচ্ছি। তবে এতো সহজে নাম বলবো সেটা ভুলে যা। পারলে নিজে মগজ খাঁটিয়ে বের করে নেয়। আমি কিছু হিন্টস দিয়ে দিচ্ছি। আমার গিটারের যে লেখাটা আছে ওটাতেই ওর নাম আছে আর বাংলায় চার অক্ষরের হয় নামটা।
আমি কিছুই বলছি না। উনার ধমক খেয়ে স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছি। আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
- তোর মতো মেয়ে, যার মাথা গোবরে ভর্তি, তার মাথায় যদি নামটা আসে তাহলে আমি নিজে একঢালা চুড়ি কিনে দিবো তোকে। সুমাইয়ার অযথা টাকা খরচ করতে হবে না।
‘সুমাইয়া’, ‘একঢালা চুড়ি’– এগুলো শুনে আমি চমকে গেলাম। আর মনে মনে বললাম, - উনি এগুলো জানলেন কী করে?
কাঠ গলায় ভাইয়া আবার বলতে লাগলেন, - আর হ্যাঁ, গোপন বৈঠক বাড়িতে না করে অন্য জায়গায় করিস। কারণ তোদের প্ল্যান বাস্তবায়ন হওয়ার আগে ফাঁসই হয়ে যায়। তোর বান্ধবীকে বলিস, আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই, যে আছে সে আমার বউ। বিয়ে না করেই বউ বলছি কারণ এইসব গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের ন্যাকামো আর মনমানসিকতা আমার নেই।
আচমকা চেয়ারে দুইহাতে ভর দিয়ে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন,
- কলা গাছের মতো লম্বা হলেই কেউ বুড়ি হয় না, মগজেও বড় হতে হয়। আর তুই তো পিচ্চিরও একহাত নিচে। সো বড় হবি জীবনে, সেই আশা ছেড়ে দেয়।
এই বলে উনি চলে গেলেন আর আমি খাবার প্লেট সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে আছি। মনে হচ্ছে, একটু আগে একটা ঝড় বয়ে গেছে আমার উপর দিয়ে। ঝড়ে আমার তেমন কিছুই হলো না। শুধু চোখের কোল জলে ভর্তি হয়ে উপছে পড়লো গাল বেয়ে।
- কোনো একটা কাজও ঠিক মতো করতে পারিস না। জাস্ট একটা নাম বের করতে পারলি না। তোকে দিয়ে এই কি জীবনে কিছু হবে? আর Koi or tha nopil– এমন ভুংভাং লাইনে কী নাম থাকতে পারে যেটা বাংলায় চার অক্ষরের হবে?
ক্যান্টিনের একপাশের একটা টেবিলে অসহায়ের মতো গালে হাত দিয়ে বসে আছি আমি। কালকের ঐ ঝড়ের কথা মনে পড়লেই বুকটা কেঁপে ওঠে আমার। কয়েক মুহূর্তে কতকিছু যেন হয়ে গিয়েছিল কালরাতে। আর কত-শত রহস্যও সৃষ্টি করেছিলেন উনি। রহস্যের উন্মোচন করতে গিয়ে ভেবেছিলাম কাল রাত থেকে কিন্তু ভাইয়ার কথা মতো আমার গোবর ভর্তি মাথায় কিছুই আসে নি।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা চেঁচিয়ে এতো সব কথা শোনাচ্ছে সুমাইয়া। ওর কাছে মনে হচ্ছে আমি যুদ্ধে পরাজিত সৈনিক। মনে হলেও কিছু করার নেই আমার। আর এই মুহূর্ত ওর কথায় মনযোগ নেই। মনে হচ্ছে, ওর কথা গুলো আমার কান দিয়ে নয় মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে বকবক করছে। কিন্তু আমি কোনো জবাবই দিচ্ছি না তাই অসহ্য হয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলো,
- চুপ করে আছিস কেন? কিছু তো বল।
গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
- কালকে বাঘের গর্জন শুনিয়ে এখন আবার কী বলতে বলছিস আমায়?
- বাঘের গর্জন মানে?
- কালকে ভাইয়া যেভাবে হুঙ্কার দিয়েছিলেন, আমার জায়গায় তুই হলে হয়ত হার্ট অ্যাটাক করতিস।
নিরস গলায়, - তো তুই করিস নি কেন?
হঠাৎ-ই রেগে জবাব দিলাম, - তোকে খুন করে বদলা নিবো বলে বেঁচে আছি। ডাকিনী, আমার প্রাণপাখি কালকে একটুর জন্য উড়াল দেয় নি। আমার সাথে যা হয়েছে তারজন্য তুই যদি আমায় চুড়ি কিনে না দিস তবে তোকে হালুয়া বানিয়ে পরোটা দিয়ে খাবো।
- ইশ, মামা বাড়ির আবদার।
আমি মুখ ভেংচি কেটে,
- হুহ।
- যেই ভুংভাং জেনেছিস, সেটা দিয়ে ঘোড়ার ডিম তো দূর ছাগলের ডিমও হবে না। বাই দা ওয়ে, নীল ভাইয়া আমাদের প্ল্যানের খবর জানলো কী করে?
ভাবলেশহীন ভাবে, - আমার রুমের সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে।
- কিহ! ঐ তুই কী রে? আমায় আগে কেন বলিস নি যে, তোর রুমে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে।
- দুগাল ঠাসঠাস দুটো দিবো। এমনিতেই মন ভালো না তারউপর আবোল তাবোল বলছিস। আরে, বেডরুমে কেউ সিসিটিভি ক্যামেরা লাগায়?
- তো তুই বললি কেন?
- আরে, কালকের শকে আমার মাথা ম্যা বি উলোট পালোট হয়ে গেছে।
- তোর মাথা এমনিতেও উলোট পালোটই থাকে। সে যা-ই হোক, সবার আগে খুঁজে বের কর যে, প্ল্যান ফাঁস করছে কে?
আঁড়চোখে তাকিয়ে, - তোর জন্য কি আমি এখন মিশন ইম্পসিবলে নামবো?
- ওয়েট ওয়েট। আমার মনে হয় তোর বাসার কেউ ভাইয়াকে এসব বলে দেয়। জাস্ট এ মিনিট, ঐ দিন মিতালি আমাদের শরবত দিয়ে গিয়েছিল। আই থিংক মিতালিই ভাইয়াকে সব বলে দেয়।
- কী যা তা বলছিস? যে মেয়ে ভাইয়ার নাম শুনলে থরথর করে কাঁপে, সে গিয়ে ভাইয়ার সাথে এতো কিছু বলে আড্ডা দিবে। ইম্পসিবল।
- পসিবল পসিবল। এটা মিতালিরই কাজ।
- আরে না।
- আরে হ্যাঁ, তুই জিজ্ঞেস করে দেখিস। আর নামটার কোনো হদিস পেলি ঐ ভুংভাং লেখা থেকে?
- না, পাই নি। কালকে রাতে এতো কিছু সহ্য হয় নি। তাই একটুখানি অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলাম আর এতোই চোখ, মাথা ব্যথায় রাতে ঘুম হয় নি। তাও ভেবেছিলাম, কিন্তু ফলাফল শূন্য।
- সমস্যা নেই। তুই গোপন তথ্য ফাঁসকারীর সন্ধান বের কর। আমি দেখছি ঐ ভুংভাং থেকে কী বের হয়?
- ঠিক আছে কিন্তু চুড়ি কবে দিবি আমার?
- কিসের চুড়ি?
- এখন কিন্তু সত্যি সত্যি হালুয়া বানাবো তোকে।
- উফ, বাবা! তোর জামাইকে বলবো অন্য কোনো ব্যবসা না করে চুড়ির ব্যবসা করতে হেপি?
খুশিতে দ্বিগুণ বেগে মাথা নাড়িয়ে, - হুম হুম। খুব খুশি।
- ছিহ! বেহায়ার মতোন আবার হাসা হচ্ছে। ঠিক আছে, ঠিক আছে কিনে দিবো। কিন্তু চুড়ি এতো পাগল কেন তুই?
- কারণ, চুড়ি মানেই একমুঠো ভালবাসা।
দুপুর গড়িয়ে সময়টা ছুটে চলছে বিকেলের দিকে। আমি সোফা পা ঝুলিয়ে বসে আছি এক হাতে আপেল আর অন্য হাতে ছুরি নিয়ে। অর্ধেকটা আপেল খেয়ে বাকিটার খোসা ছাড়াচ্ছি আর আনমনে ভাবছি,
- কেউ তো অবশ্যই ভাইয়াকে আমাদের ব্যাপারে বলছে। কারণ, ভাইয়া ঐ দিন বাসায় ছিলেন না আর উনি তো কোনো সুপার ম্যানও নয় যে, নিজে থেকেই জেনে যাবেন। তাহলে কি সুমাইয়া অনুমানই ঠিক? মিতালিই ভাইয়াকে সব বলেছে? কিন্তু এটা কী করে সম্ভব?
আমার এসব ভাবনার মাঝেই দেখতে পেলাম, হাতে কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে মিতালি আসছে। ওকে দেখে চট করে আপেল রেখে, বসা থেকে উঠে, ছুটে এসে ওর মুখের সামনে ছুরি ধরে জিজ্ঞেস করলাম, - তোকে কি ভাইয়া আমার পিছনে লাগিয়েছে গোয়েন্দাগিরি করতে?
ছুরি দেখেই ঘাবড়ে গেছে মিতালি তবুও আমায় পাল্টা প্রশ্ন করলো, - কিয়ের গোয়েন্দাগিরি আপামনি?
- সেদিন সুমাইয়ার সাথে যে আমি আমার রুমে বসে কথা বলেছিলাম এইসব কি তুই ভাইয়াকে বলেছিস? সত্যি করে বল, নয়ত ফল কাটার ছুরি দিয়ে তোর চুল কাটবো।
মিতালির মাথার চুল কোমর অবধি লম্বা। বেশ ঘন আর কালো। তাই চুল নিয়ে ওর যত ভাবসাব। চুলগুলো আগলে রাখতে কত কী করে? ওর দূর্বলতা বলতে গেলে ওর চুল। তাই আমিও ওর দূর্বল জায়গায় আঘাত করার হুমকি দিয়ে সত্যি কথা বের করার চেষ্টা করছি। চুল কাটার কথা শুনেই মিতালির সব ভাবসাব, ফুটো বেলুনের হাওয়ার মতো বেরিয়ে গেছে। কাঁদো কাঁদো গলায় আমায় বললো,
- খোদার কিরে(কসম) করে বলতাছি গো আপামনি, আমি ভাইরে কিছু কই নাই। হেই দিন তো শরবত দেওনের পর আমি আপনার রুমের তিসীমানায়ও যাই নাই। তাইলে কেমনে কী শুনমু আর কী কমু?
- সত্যি তো?
- খোদার নাম লইয়া কি মিছা কতা কওন যায় আপামনি? আমি হাছাই কইতাছি, আমি ভাইয়েরে কিছু কই নাই।
- ওহ। ঠিক আছে তুই যা।
মিতালি চলে যেতেই ভাবতে লাগলাম, - নাহ, এত করে যখন বলছে তাহলে এটা মিতালির কাজ নয়। আমি তো আগেই জানতাম এটা মিতালি নয়। তাহলে কে হতে পারে?
আমার ভাবনার মাঝে হঠাৎ ছেদ পড়লো কলিংবেলের শব্দে। হাতের ছুরিটা রেখে দিলাম খুব দ্রুত নয়ত কেউ দেখলে আমায় আবার হবু খুনী ভাবতে পারে। গায়ের ওড়নাটা ঠিকঠাক করে, দরজা খুলে দিতেই চমকে গেলাম। অবাক-খুশি হয়ে বলে উঠলাম, - ঐশী তুই?
- সারপ্রাইজ। তা কেমন আছিস?
- ভালো। ভিতরে আয়। আঙ্কেল ভিতরে আসুন।
ঐশী আমার বান্ধবী। তবে স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটির নয়। আমার নানা বাড়ির পাশের বাড়িটাই ওদের। ছোট থেকে একটু আধটু খেলাধুলা আর আড্ডা দেওয়া হতো দুইজনের। সেই থেকেই বন্ধুত্ব নামক দুষ্টু মিষ্টি একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছি দু’জনে। আজকে সকালে আমি যখন ভার্সিটিতে যাবো, তার আগে ওর সাথে আমার ফোনালাপ হয়েছিল। কিন্তু একবারের জন্যও আমায় বলে নি যে, আজকে ও আসবে আঙ্কেলকে নিয়ে।
ঐশী আর আঙ্কেল ভিতরে এসে বসতেই আমি মাকে ডেকে আনলাম। মা আর আঙ্কেল কথা বলছে এদিকে আমি ঐশীকে নিয়ে চলে এলাম আমার রুমে। রুমে এসেই ওকে চাটি মেরে জিজ্ঞেস করলাম,
- ঐ, আজকে আসবি আমায় বলিস নি কেন?
- জানু, সবসময় আমায় এতো মারিস কেন তুই?
- কী করবো বল? তোকে দেখলেই আমার হাতটা আমায় বলে, কথামনি পিট্টি দে পিট্টি দে।
- তোর হাত তোর মতোই পাঁজি।
ওর কথায় হেসে বললাম, - হবে হয়ত। তা কেমন আছিস বল?
- আরে জানু, বড় বোনের বিয়ে আমি ভালো না থাকলে কী চলে? আর দুলাভাইয়ের নাকি ভাইয়ের অভাব নেই।
চোখ টিপে কথাটা বলে হাসতে লাগলো। আমি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, - তারমানে তোর চরিত্র এখনও ঠিক হয় নি?
- নিজের জামাই নিজে খোঁজতে গেলে চরিত্র খারাপ হয়ে যায়?
- তুই তো একটা ছেঁছড়ি। তুই কখনও ঠিক হবি না। তাই তোর কথা বাদ দিয়ে আপুর কথা বল। বিয়ে কবে?
- কার্ড নিয়ে এসেছি দেখে নিস। শোন, হলুদসন্ধ্যা অনুষ্ঠানে মেহেদী কিন্তু তুই পড়িয়ে দিবি আমায়। মানে হলুদসন্ধ্যা অনুষ্ঠানেও তোকে আলবাত থাকতে হবে। তোর কোনো বাহনা আমি শুনবো না। যদি না যাস তবে তোর খবর আছে মনে রাখিস।
- এমন হুমকি দিলে তো যেতেই হবে। ভাবিস না, তোকে মারার জন্য হলেও আগে আগে চলে যাবো।
আমার কথায় দু’জনে একসাথে হেসে উঠলাম। হেসে হেসেই ঐশী বললো, - তোর অপেক্ষায় থাকবো জানু।
পর্ব-১৭
হুট করেই জানান দিলো কেউ আমায়,
‘নিজের চেয়েও ভালবাসি তোমায়। ‘
পরিচয়হীনা সে খুব করে চায়,
আমিও যেন বলি, ‘ভালবাসো আমায়। ‘
সাদা কাগজে কালো কালিতে লিখে,
ভালবাসায় মুড়িয়েছে কিছু স্মৃতি।
বছরের পর বছর আগলে রেখে,
স্মৃতিগুলোর নাম দিয়েছি বেনামি চিঠি।
ছয় বছরে ছয়খানা চিঠি জমেছে একটা একটা করে। এই পর্যন্ত সেগুলো কত-শত বার পড়েছি, সেটা আমার নিজেরও জানা নেই। চিঠিগুলোর প্রতি একটা মায়া জন্মে গিয়েছে আমার। চিঠিতে লেখা প্রতিটি শব্দ আর বাক্য দিয়ে আমি উনাকে কল্পনায় তৈরি করেছি অনেক আগেই। আমার কল্পনায় আঁকা উনার ছবির সাথে আমি প্রায়ই কথা বলি, কখনও বা হাসি, কখনও অভিমান করি। এসব নিতান্তই আমার ছেলেমানুষী হিসেবে গন্য হবে। কিন্তু এইসব ছেলেমানুষীই যে আমাকে উনার দিন দিন প্রতি দূর্বল করে তুলছে।
চিঠির প্রতিটা শব্দ যখন আমার মুখ থেকে নিসৃত হয়, তখন মনে হয় উনার সম্মুখে দাঁড়িয়েই আমি উনার প্রতি উনারই ভাষায় ভালোবাসার নিবেদন করছি। প্রতিটি বাক্যে যখন আমার স্থির দৃষ্টি থাকে, তখন মনে হয় আমি যেন উনাকেই দেখছি।
এতোগুলো বছর বেনামি চিঠিগুলো, আমার মন গহীনে লালন করে আমি যে চিঠির মালিককে ভালবেসে ফেলেছি। হ্যাঁ, সত্যিই ভালবেসে ফেলেছি। আর নিজের কাছে নিজে সেটা স্বীকার করতে একবিন্দুও সংকোচ নেই আমার মাঝে। দেখি নি কখনও, চিনিও না কে সে? কিন্তু আমার মন গহীনে তাকে নিয়ে ভালবাসার সৃষ্টি করে ফেলেছি।
রাত বারোটা। এই সময়টা আমার কাছে বরাবরই অন্যরকম। এই সময়টাতেই আমি চিঠিগুলো নিয়ে উনাতে বিভোর হয়ে থাকি। প্রতিদিন না হলেও আমার এই পাগলামিটা আমি মাঝে মাঝে করে থাকি। ধীরে ধীরে কেন যেন এটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
ইদানীং একটা বিষয় আমাকে খুব করে ভাবাচ্ছে। যেদিন সুমাইয়া আমাকে বলেছিল, নীল ভাইয়া আমাকে পছন্দ করেন। সেদিন থেকে কেন যেন ভাইয়াকে নিয়ে আমার মাঝে ভাবনা আসে। সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা ভাবনা। এমন ভাবনা আগে কখনও আসে নি উনাকে নিয়ে। জানি না, এমন অদ্ভুত ভাবনার হেতু কী?
ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছি আমি। কিন্তু সাধের ঘুমটা ভেঙে গেল ফোনের টোন শুনে। চোখের পাতা বুঁজে রেখেই বকে যাচ্ছি মনে মনে যিনি আমার ঘুমের বারোটা বাজাতে এমন সাতসকালে কল করেছেন।
আমি বিছানাতেই পড়ে আছি। কল রিসিভ করবো তো দূর ফোন নিয়ে দেখার ইচ্ছেও নেই যে, কে কল করেছে। ফোন বেজেই চলেছে। ফোনের শব্দে আর শুয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না বিধায় শোয়া থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিলাম। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে একটা নাম, ‘ঢঙ্গি মানে সুমাইয়া। ‘
ঘুম ভেঙেছে বলে খুব রাগ লাগছে সুমাইয়ার উপর। কিন্তু রাগটাকে কন্ট্রোল করে কল রিসিভ করে বললাম,
- ‘আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে, কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।
এই বলে কল কেটে দিবো ভাবছি কিন্তু তার আগেই তিক্ত কণ্ঠে সুমাইয়া বললো, - লাত্থি খাওয়ার শখ হয়েছে তোর? ফাজলামো কেন করছিস আমার সাথে?
কাঠ গলায় জবাব দিলাম, - সাতসকালে কল করেছিস কি আমার সাধের ঘুম ভেঙে এসব জিজ্ঞেস করতে? তুই জানিস না, আমি ছুটির দিনে বেলা করে ঘুম থেকে উঠি?
- না, জানি না। জরুরি কথা বলতেই কল করেছি সো চুপ যা।
- কী এমন জরুরি কথা? ঠিক আছে বল, শুনি।
খুশিতে গদোগদো হয়ে, - ঐ লেখা নিয়ে গবেষণা করে আমি তো সাইন্টিস্ট হয়ে গিয়েছি।
নিরস গলায়, - লেখা নিয়ে গবেষণা করে কেউ সাইন্টিস্ট হয়– এমনটা আমার জানা ছিল না। যা-ই হোক, তা কী নাম পেলি?
- নামটা শুনলে তোর মাথা ঘুরে যাবে।
খানিকটা বিরক্ত হয়ে। - উফ, ভণিতা না করে আগে বল তো। তারপর না হয় দেখবো, মাথা ঘুরবে না স্থির থাকবে।
থমথমে গলায় সুমাইয়া বললো। - কোহিনূর।
নামটা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
- হোয়াট? কুহি আপু আই মিন কোহিনূর আপু?
- ইয়ে বেবি, কোহিনূর আপু।
- আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
বেশ আগ্রহ নিয়ে সুমাইয়া ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো। - আমি তোকে বুঝিয়ে বলছি। শোন, Koi or tha Nopil এখান থেকে শব্দ নিয়ে সাজা K O H I N O O R. একসাথে, Kohinoor বাংলায় এটা চার অক্ষরের নাম। আর বাকি থাকছে T I L. আমার মনে হয় এটা হবে তিল। কারণ কুহি আপুর কিন্তু মুখে তিল আছে। আর এই তিলে আপুকে অনেক সুন্দর লাগে সেটাও সবাই বলে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে কুহি আপুই হবে।
- আমি তো হতবাক। তোর মাথায় এতো সব এলো কী করে? আর কুহি আপু না হওয়ার সম্ভাবনাও কিন্তু খুব কম। কারণ আপু দেখতে বেশ সুন্দরী আবার ভাইয়াকে একটু একটু পছন্দও করে হয়ত। আমাদের বাসায় এলে আহা! ভাইয়ার দিকে কী চাহনি।
- হ্যাঁ, এসব দেখে আর বুঝেই মনে হলো কুহি আপু হবে।
- কিন্তু তোর মাথায় এসব এলো কী করে?
- হা হা। ফিউচার সাইন্টিস্ট বলে কথা। সে যা-ই হোক, আসলে কালকে অক্ষয় কুমারের একটা মুভি দেখছিলাম। তুই তো বলেছিলি যে, কুহি আপুর বাবা নাকি আঙ্কেলকে মানে তোর বাবাকে অক্ষয়কুমার বলে ডাকতো।
- হ্যাঁ।
- এই থেকেই কুহি আপুর নামটা চট করে মাথায় এলো, সাথে অন্যান্য বিষয়ও। পরে সব মিলিয়ে এইরূপ ফল বের হলো।
- বাহ! তুনে তো কামাল হি কার দিয়া।
- তা তো অবশ্যই। আচ্ছা এখন রাখছি কালকে ভার্সিটিতে বাকি কথা হবে। বাই।
- হুম বাই।
কল কেটে দিয়ে থ মেরে বসে রইলাম। সুমাইয়ার কথাগুলো মনে মনে ভেবে হাসতে লাগলাম। মেয়েটা সত্যিই মানেটা খুঁজে বের করলো। ভাবা যায়! আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম এটা এমনিতেই একটা হিন্দি লেখা। হেসে হেসে আনমনে বলে উঠলাম।
- শেষমেশ কুহি আপু আমার ভাবী হবে? উপস, আবার ভাবী বললাম? একদম ভাবী ডাকা যাবে না। কিন্তু আপুও তো ডাকতে পারবো না। আচ্ছা, ভাইয়াকে পাগল? উনি আমার ভাইয়া হলে উনার বউ কি আমার দাদী হবে নাকি?
ভাইয়া বাসায় ছিলেন না দুপুরে। তাই সুযোগ পেয়ে দুপুরে খুব অল্প খাবার খেয়েছিলাম। আর সেই সুবাদে এখন আমার পেটের ভিতর ক্ষুধায় ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। এটা একবার মিতালিকে বলেছিলাম, তখন সে দাঁত কেলিয়ে আমায় বলেছিল।
- আপামনি, একটা বিলাই খাইয়ালান তাইলে পেটের ভিতর থাহা ইন্দুরগুলা বিলাই খাইয়ালাইলে আপনার আর কোনো সমেস্যা থাকতো না।
ক্ষুধায় আমার নাজেহাল অবস্থায় ওর এমন লেইম জোক্স শুনে ইচ্ছে করছিল ওর উপর গালি বর্যণ করতে। কিন্তু তখন নিরবতা আকড়ে আঁড়চোখে কেবল তাকিয়েছিলাম ওর দিকে।
খাবার অনুসন্ধানে চলে এলাম কিচেনে। এসে দেখি মা আর জেঠীমা মিলে কী যেন রান্না করছে। খাবারের গন্ধটা আমার কাছে বেশ পরিচিত মনে হলো। কেমন যেন পিঠা পিঠা সুভাস পাচ্ছি। কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই দেখি, ওমা! সত্যিই পিঠা বানানো হচ্ছে। তবে যেই সেই পিঠা নয়, আমার পছন্দের পুলি পিঠা। আমি কোনো কথা না বলে গপাগপ খেতে শুরু করলাম। আমার খাওয়া দেখে জেঠীমা কিঞ্চিৎ হেসে বললো।
- পিঠার গন্ধে গন্ধে চলে এসেছিস দেখছি। তোর খাওয়া হলে এগুলো নিয়ে মৃন্ময়কে দিয়ে আয়।
পিঠায় মুখ ভরে আছে। এমন অবস্থায় কথার জবাবও যেন দিতে পারছি না। মুখেরটা শেষ করে কোনো রকমে জিজ্ঞেস করলাম। - মৃন্ময় ভাইয়া এসেছেন?
- হ্যাঁ।
- ঠিক আছে দাও। আমি দিয়ে আসি।
- তুই খেয়ে নেয় তারপর দিস।
- আমার খাওয়া তো সবে শুরু হলো। কখন শেষ হবে আমারও জানা নেই। ভাইয়াকে দিয়ে আসি তারপর আবার শুরু করবো। এখন সাময়িক বিরতি এই যা।
আমার কথায় জেঠীমা হাসতে লাগলো আর পাশ থেকে মা বলে উঠলো,
- সেটা আর নতুন কী? ভাত খাওয়া চলে না কিন্তু পিঠা ঠিকই চলে।
পিঠা ভর্তি মুখে হালকা হেসে বললাম। - মা, ভাত যদি পিঠার মতো টেস্টি টেস্টি হতো তাহলে তো কথাই ছিল না।
হালকা হেসে মা বললো, - থাক। যা দিয়ে আয়।
- হুম।
ডান হাতে নিজের জন্য একটা পিঠা নিলাম আর বাম হাতে ভাইয়ার জন্য সাজিয়ে রাখা পিঠার বাটিটা নিলাম। খেতে খেতে ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়াতেই চিরচেনা ডাকে আমায় ডেকে উঠলেন মৃন্ময় ভাইয়া,
- কথকপাখি কেমন আছো?
- জ্বী ভাইয়া ভালো। আপনি?
- হুম ভালো।
ভাইয়ার সম্মুখে পিঠার বাটিটা রেখে দিয়ে বললাম,
- নিন ভাইয়া পিঠা খান।
- সে পরে খাবো। তুমি বসো।
আমি বসতেই ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন, - নীল কখন ফিরবে?
- এখন তো চলে আসার কথা ছিল।
হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, - রাত্রি বললো, আপনি নাকি ভ্রমণে যাচ্ছেন।
- হ্যাঁ, বান্দরবান যাচ্ছি। আসা যাওয়ায় দুইদিন আর মাঝে দুইদিন মোট চারদিন থাকবো।
- হুম। কিন্তু আপনাদের তো একটা বিয়ের নেমন্তন্ন আছে শুনলাম। জেঠীমা বললো।
- হ্যাঁ, আমাদের বন্ধুর মামার বিয়ে। আমি থাকতে পারছি না তবে নীল বিয়েতে যাবে।
- ওহ আচ্ছা। তা ভাইয়া, বান্দরবানে কী কী আছে দেখার মতোন?
সোফায় হেলান দিয়ে ভাইয়া বলতে শুরু করলেন। - অনেক কিছুই আছে। এই ধরো, শৈলপ্রপাত, নাফাখুম, জাদিপাই জলপ্রপাত, বগা লেক, বুদ্ধ ধাতু জাতি মন্দির, চিম্বুক, মেঘলা, নীলাচল আর সবচেয়ে বেশি আকর্ষনীয় নীলগিরি। এছাড়াও বান্দরবানের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলো হলো- শুভ্র নীলা, জীবন নগর পাহাড়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট ও জাদুঘর, বাকলাই জলপ্রপাত, রিজুক জলপ্রপাত, চিংড়ি ঝিরি জলপ্রপাত, জিংসিয়াম সাইতার জলপ্রপাত, পাতাং জারি জলপ্রপাত, ফাইপি জলপ্রপাত, প্রান্তিক লেক, মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স, কেওক্রাডাং পাহাড়, তাজিনডং পাহাড় প্রভৃতি।
ভাইয়ার মুখে এতো এতো নাম শুনে আমি হা হয়ে গেলাম। আমার চোখ মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে ভাইয়াকে বললাম,
- এ-তো দেখছি বাংলাদেশের অর্ধেক জিনিস বান্দরবানে গেলেই দেখা হয়ে যাবে।
আমার কথা হালকা হেসে সোজা হয়ে বসে ভাইয়া বললেন। - তা অবশ্য মন্দ বলো নি। সত্যিই বান্দরবানে দেখার মতোন অনেক কিছু আছে। সেজন্যই তো যাচ্ছি।
- হুম সেটা তো খুব ভালো। আচ্ছা ভাইয়া, আপনি খান আমি একটু ভিতরে গেলাম।
- ঠিক আছে কথকপাখি।
পর্ব-১৮
কিচেনে এসে গোটা কয়েক পিঠা একটা বাটিতে নিয়ে সোজা চলে এলাম নিজের রুমে। বিছানায় আয়েশ করে বসে, হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ফোনটা নিলাম। মুখে খানিকটা পিঠা পুড়ে গুগুলে সার্চ দিলাম বান্দরবান সম্পর্কে জানতে। মোটামুটি অনেক কিছুই পেয়ে গেলাম বান্দরবান সম্পর্কে। বান্দরবানের এতো এতো জায়গার মধ্যে আমার বিশেষ ভাবে নজরে এসেছে শৈলপ্রপাত, নাফাখুম, জাদিপাই জলপ্রপাত, বগা লেক, নীলাচল আর নীলগিরি।
শৈল প্রপাত মিলনছড়ি এলাকায় অবস্থিত এবং বান্দরবান থেকে থানচিগামী সড়কের চার কিলোমিটারের মধ্যেই। বান্দরবানের উল্লেখযোগ্য জলপ্রপাতের মধ্যে এটি একটি। বর্ষাকালে এখনকার পানির প্রবাহ নাকি খুব বেশি থাকে। এখানে ভ্রমণকালে ছোট ছোট বাজারগুলোতে আদিবাসীদের তৈরি হস্তশিল্প, তাঁতের দ্রব্যাদি ও খাদ্যসামগ্রীর সংস্পর্শ পাওয়া যায়।
বাংলদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জলপ্রপাতগুলোর মধ্যে নাফাখুম অন্যতম। থানচি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা রেমাক্রিতে পাহাড় ও বনের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা সাঙ্গু নদীতে অবস্থান নাফাখুমের। নাফাখুম আবার রেমাক্রি জলপ্রপাত নামেও পরিচিত। একবার এখানে গেলে বারবার নাকি যেতে মন চায়।
বাংলাদেশের প্রশস্ততম জলপ্রপাতগুলোর একটি হলো জাদিপাই। এটি রুমা উপজেলায় অবস্থিত। কেওক্রাডং চূড়া থেকে হেঁটে জাদিপাই জলপ্রপাতে পৌঁছতে হলে ঘণ্টাখানেকের পথ অতিক্রম করতে হবে।
বগা লেক বাংলাদেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক হ্রদ। রুমা উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে বগা লেকের অবস্থান। লেকের স্বচ্ছ নীল পানি নাকি নজর কাড়ে সবার।
বান্দরবান শহরের সবচেয়ে নিকটবর্তী পর্যটন স্পট হলো নীলাচল যা টাইগার হিল নামেও পরিচিত। এর অবস্থান টিগেরপাড়ায়। যা বান্দরবান শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। নীলাচল থেকে পাখির চোখে নাকি দেখতে পারা যায় পুরো বান্দরবান শহরকে। বর্ষা মৌসুমে মেঘের মধ্যদিয়ে হেঁটে যাওয়ার রোমাঞ্চ। সোনালী রংয়ের গোধুলিই নয় নীলাচল থেকে উপভোগ করা যায় জোছনা রাতের অনাবিল সৌন্দর্যও, সেই সাথে শীতকালে চোখ জুড়ানো কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল।
বাংলাদেশের উচ্চতম ও আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলোর একটি নীলগিরি। বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি রোডে অবস্থিত নীলগিরি। এর কাছাকাছিই রয়েছে ম্রো আদিবাসীদের গ্রাম। ক্যাম্পফায়ার করার জন্য জায়গাটি খুবই উপযোগী। জায়গাটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। নীলগিরির একেবারে চূড়ায় তাদের নির্মিত একটি আকর্ষণীয় রিসোর্ট রয়েছে।
খুব সহজেই গুগুল থেকে অনেক কিছুই জানতে পারলাম বান্দরবান সম্পর্কে। কিন্তু সচক্ষে একটিবার যদি নীলগিরি, নীলাচল আর নাফাখুম দেখতে পেতাম তাহলে হয়ত মনটা তৃপ্ত হতো খুব করে।
একটি বই একশটি বন্ধুর সমান কিন্তু একজন ভালো বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরির সমান_এ পি জে আব্দুল কালাম
লাইব্রেরির এক কোণের এক টেবিলে বসে আছি আমি আর সুমাইয়া। তূর্যও আমাদের সাথে এসেছিল কিন্তু জরুরি একটা কল আসছিল বিধায় তূর্য চলে গিয়েছে। আমি আর সুমাইয়া দুজনেই অহেতুক দু’টো বই মুখের সামনে মেলে রেখে বসে আছি।
বই পড়ার চেয়ে বেশি আলাপচারিতা করার জন্যই আমাদের লাইব্রেরিতে আসা। নিচু স্বরে দুজনে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি খুব ধীরে ধীরে সুমাইয়াকে বললাম,
- নামটা না হয় খুঁজে পেয়েছিস। কিন্তু আমাদের কথাগুলো ভাইয়ার কানে কে পৌঁছে দিয়ে আমাদের বারোটা বাজিয়ে চলেছে সেটা তো জানা হলো না।
সুমাইয়াও নিচু স্বরে বললো।
- আরে নামটাই তো খুব বেশি জটিল ছিল। এটা যখন পেয়ে গিয়েছি তবে ওটাও পেয়ে যাবো। সো ডোন্ট ওয়ারি।
- আমি তো মিতালিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু ওর কথায় বিশ্বাস হয়েছে যে, মিতালি এটা করে নি।
- মিথ্যাও তো বলতে পারে।
- আরে না। এমন করে কেউ মিথ্যা বলবে বলে আমার মনে হয় না। সে যা-ই হোক, ভাইয়াকে নিয়ে যদি কোনো কথা থাকে তবে সেটা বলতে ভুলেও আমার বাড়িতে পা রাখবি না। আমাদের পিছনে কে ভাইয়ার হয়ে নজর রাখছে সেটা আগে বের করে তারপর বাড়িতে এসব কথা তুলবো তার আগে নয়।
- সেই ভাল হবে। তা তুই কি ভাইয়াকে কুহি আপুর কথা বলবি?
- পাগল। এটা বলে কী আমি বিপদ ডেকে আনবো?
- বললে হয়ত চুড়ি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ভাইয়া তো বলেছিলেন, নামটা বের করতে পারলে তোকে চুড়ি কিনে দিবেন।
খানিকটা রেগে, - ডাকিনী, আমার সাথে এতো কিছু হবার পরও এসব বলছিস কেন তুই? ভাইয়ার রাগ তো জীবনে সচক্ষে দেখেন নাই। তাই কয়েকদিন পর পর আমাকে এসব বলেন। ফের যদি আমায় চুড়ির লোভ দেখিয়ে এসব করতে বলিস তবে তোকে আমি পঁচা গোবরে গোসল করাবো। হুহ।
- ভাল কিছু বললেই আমার দোষ হয়ে যায়।
- শোন, আমার ভালো আমি ভালোই বুঝি। এখন চল বাসায় যাবো।
হাত ঘড়িতে সময় দেখে অবাক হয়ে সুমাইয়া জিজ্ঞেস করলো, - এখনই?
- হুম, এখনই।
- ঠিক আছে তাহলে চল।
ইজি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন জেঠু। আমি জেঠুর রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
- জেঠু, আসবো?
খবরের কাগজ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, - আয় মা আয়।
জেঠুর কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই বসবার জন্য ইশারা দিয়ে বললেন,
- বস এখানটায়।
আমি বসে জিজ্ঞেস করলাম। - ডেকেছিলে আমায়?
খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে করতে জবাব দিলেন। - হ্যাঁ, তোর জেঠীমা বললো, তুই নাকি সমুদ্র দেখার কথা বলেছিস?
আমি ইতস্তত করে বললাম। - না মানে ঐ রুনুরা পহেলা বৈশাখে নাকি কক্সবাজার যাচ্ছে সেটা শুনেই একটু দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু আমি যাবার কথা বলি নি।
হালকা হেসে জেঠু জিজ্ঞেস করলো। - না গেলে দেখবি কী করে?
- আমি দেখেছি তো জেঠু। গুগুলে দেখে নিয়েছি।
আমার কথায় জেঠু এবার জোরেশোরে হাসতে লাগলেন। হাসি থামিয়ে বললেন। - গুগুলের দেখায় কি আর হবে? সচক্ষে যেন দেখতে পারিস সেই ব্যবস্থাই করছি। তোর সেমিস্টার ফাইনালের পর আমরা সবাই যাবো কক্সবাজারে, তখন মন ভরে দেখে নিবি।
খুশিতে গদোগদো হয়ে।
- সত্যি জেঠু?
- হ্যাঁ রে মা সত্যি। এখন তোর জেঠীমাকে একটু ডেকে দেয় তো।
- ঠিক আছে।
এই বলে আমি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম জেঠীমার খোঁজে। জেঠীমাকে খুঁজতে খুঁজতে হাজির হলাম কিচেনে। এসে দেখি জেঠীমা আর মা মিলে রাতের খাবার তৈরি করছে। আমি জেঠীমার কাছে এসে বললাম,
- জেঠীমা, জেঠু তোমায় ডাকছে।
- কেন রে?
- জানি না। আমায় তো কিছু বলে নি। তুমি গিয়ে দেখো।
- ঠিক আছে।
জেঠীমা চলে গেল। আমি এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপটি করে। তরকারি কাটার ফাঁকে মা একবার তাকালো আমার দিকে। তারপর নিজ কাজে মন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- কথা মা, মুখটা ভার কেন তোর?
ঠোঁট উল্টে বললাম, - কে যেন আমার আর সুমাইয়ার সব কথা নীল ভাইয়াকে বলে দেয়। সেজন্যই মনটা খারাপ।
- এটা হলে মন খারাপ করিস না। কারণ সেগুলো আমিই নীলকে বলেছিলাম।
আমি অবাকের চরম সীমানায় দাঁড়িয়ে, - কিহ! তুমি বলেছো?
- হ্যাঁ, তোরা দুই পাঁজি মিলে নিরীহ একটা ছেলেকে নিয়ে এতোসব কান্ড করবি আর আমি ওর মা হয়ে এসব সহ্য করবো?
কাঁদো কাঁদো গলায়,। - মা, তুমি তো আমার মা উনার না। তুমি নিজের মেয়ের গোপন কথা ঐ হনুমানের নাতিকে কেন বললে? একটু কি মায়া হয় নি তোমার এই আমার উপর?
- না হলে কী করবো? আর ছেলেটা তোর কী ক্ষতি করেছে রে যে দিনরাত ওর পিছনে পড়ে থাকিস।
মার কথায় হতাশ হয়ে, - মা, আমি পড়ে থাকি না গো উনি নিজেই আমাকে সায়েস্তা করার তালে থাকেন।
একটু থেমে গম্ভীর গলায়। - তাহলে এতো দিন ধরে তুমিই সব কিছু উনাকে বলতে?
- সবকিছু বলি নি। তোর রুমে আসা যাওয়ার পথে যতটুকু শুনেছি ততটুকুই বলেছি।
মেকি খুশিতে। - বাহ! চমৎকার।
আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে মা জিজ্ঞেস করলো, - কিছু খাবি?
এই মুহূর্তে খাওয়ার কথা জানতে চাওয়াটা যেন আমার কাছে জুতো মেরে গরু দান মনে হলো। তাই প্রতুত্তরে বললাম,
- না মা। তোমার কথা শুনেই পেট ভরে টইটম্বুর হয়ে গেছে।
মা আর কোনো কথা না বলে নিজের কাজে মন দিলো। আর আমি মলিন মুখে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলাম। এই মুহুর্তে কষ্টে আমার বুকে ফেটে যাচ্ছে। তাই মনে মনে গাইতে লাগলাম।
ফাইট্টা যায়
বুকটা ফাইট্টা যায়
ফাইট্টা যায়
বুকটা ফাইট্টা যায়
মায় যখন চুপ কইরা
নীল ভাইয়ার কাছে গিয়া
আমার কথা সব কইয়া
আমারই বারোটা বাজায়
ফাইট্টা যায়
বুকটা ফাইট্টা যায়
ফাইট্টা যায়
বুকটা ফাইট্টা যায়
মা আমাকে এমন একটা ছ্যাকা দিবে আমি ভাবতেও পারি নি। নিজের মেয়ে কথা গিয়ে উনি বলেন মেয়ের শত্রুকে। এটা কি ভাবা যায়?
পর্ব-১৯
- নান্নু নিনান্নু প্রীতিসুথিন– এই নানা নানির মানে কী?
ভার্সিটিতে আসতে না আসতেই সুমাইয়া আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললো, কাগজটা পড়তে। আমি ওর কথামতো কাগজটা পড়লাম। কিন্তু এই নানা নানির মানে কিছুই বুঝলাম না। হতাশ হয়ে যখন সুমাইয়ার কাছে মানে জানতে চাইলাম তখন ও বললো, - তুই কি মেয়ে গাদা? এটা নানা নানি কেন হবে? কানাডিয়ান ভাষায় আই লাভ ইউকে নান্নু নিনান্নু প্রীতিসুথিন বলে।
নিরস গলায় বললাম, - তা নিজের ক্রাশকে রেখে হঠাৎ আমাকে লাভ লেটার কেন দিলি? মাথা কি পুরাই গেছে নাকি একটু আধটু বাকি আছে?
- আমার মাথা ঠিকই আছে তবে তোকে এখন যেটা বলবো সেটা শুনলে তোর মাথা একবার ডান থেকে বামে আরেকবার বাম থেকে ডানে ঘুরে যাবে।
কৌতূহলী কন্ঠে,
- কী কথা?
- এটা তূর্যকে দিয়েছে। কে দিয়েছে জানিস?
- কে, কে?
থমথমে গলায়, - রাত্রি।
- হোয়াট? কী বলছিস এসব?
- হুম। তবে নাজুক কলি তো তাই বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দিতে না দিয়ে কানাডিয়ান ভাষায় দিয়েছে।
- কিন্তু জল এতদূর গড়ালো কী করে? ওকে দেখে অবশ্য আন্দাজ করেছিলাম তূর্যকে পছন্দ করে কিন্তু এমন হুট করে প্রেমপত্র দিয়ে বসবে সেটা তো আমার চিন্তারও বাইরে।
শান্ত গলায় সুমাইয়া বলতে লাগলো, - আমরা যেটা ভাবি সেটা কি কখনও হয়? যেটা চিন্তার বাইরে সেটাই হয়।
- সবই বুঝলাম কিন্তু তুই এমন শান্ত মেজাজে কেন কথা বলছিস? সবচেয়ে বেশি তো তোর চেঁচামেচি করার কথা আর তুই কিনা এমন ঠান্ডা?
- যেখানে তূর্য নিজে রাজি, সেখানে আমি কেন অহেতুক চেঁচামেচি করবো?
বিস্মিত হয়ে, - মানে কী? হ্যাঁ?
- মানেটা সোজা। তূর্য, রাত্রিকে পছন্দ করে তো সেখানে আমার আর কী বলার আছে?
দ্বিগুণ অবাক হয়ে খানিকটা জোরে, - কিহ! তূর্য রাজি?
- কি হয়েছে তোর? এতো অবাক কেন হচ্ছিস?
- অবাক হওয়ার মতো বিষয়ে কান্না করবো?
- এখানে এতো অবাক হওয়ার কী আছে? রাত্রি যে তূর্যকে পছন্দ করতো এটা আগেই বুঝা গেছে। আর ওকে আমি পছন্দ না করলেও ভাইয়ের বউ হিসেবে মানতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
- বাহ! ভাবী পাগল ননদী।
- ফোড়ন কাটবি না তো।
- আমার যে কষ্টে বুক ফাইট্টা যাচ্ছে তোর কি সেই খবর আছে?
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে, - বুক ফাইট্টা যায় মানে?
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগলাম,
- আমাদের গোপন তথ্য ফাঁস কারীর খবর পেয়েছি আর তার নাম শুনলে তোরও ফাইট্টা যাবে।
নাম জানতে পেরেছি বলে সুমাইয়া বেশ খুশি হয়েছে। আর খুশি মনেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, - তাই নাকি? বল, বল। কে সে?
- মাই ডিয়ার মাদার।
জবাবটা ওর পছন্দ হয় নি বিধায় বিরক্তি ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, - ফাজলামো করছিস আমার সাথে?
- জানতাম বিশ্বাস করবি না। কারণ আমারই বিশ্বাস হয় নি যে, আমার মা এটা করেছে।
ক্লাস শুরু হতে বেশি দেরি নেই। তাই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিজে প্রস্তুত করতে করতে বলে উঠলাম, - তোর বিশ্বাস করতে হবে না। শুধু হনুমানের বিষয়ে কথা বলতে আমার বাড়ি যাবি না। ব্যাস! আর কালকে আমার ক্লাস নেই। আবার পরশুদিন থেকে ছুটি নিয়েছি নানা বাড়ি যাবো বলে। ভালো থাকিস।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ক্লাসে যাবার জন্য হাঁটতে শুরু করলাম। সুমাইয়াকে কোনোকিছু বলার সুযোগ দিলাম না। আমার এতোকথা শুনে বেচারি হয়ত শক খেয়েছে। তাই চলে আসার কথা বলার পরও কিছু বলে নি।
রাত দশটা কি অনেক রাত? শহরে তো রাত দশটা খুব বেশি রাত নয়। তাহলে আজকে রাতটা এতো গভীর লাগছে কেন? কেমন যেন থমথম করছে চারপাশ। স্তব্ধতা ছেয়ে আছে আশেপাশে। কোনো সাড়া নেই, কোনো শব্দ নেই, নেই কোনো কোলাহল। শুধু বইয়ের পাতার শব্দে কান ভারী হচ্ছে আমার।
সন্ধ্যার পর থেকেই বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটরেও কী যেন সমস্যা হয়েছে। তাই দুইঘন্টা পার হওয়ার পর হুট করে অফ হয়ে গেছে। চার্জের একটা বাতির সাহায্যে নীল ভাইয়া রুমে খানিকটা আলোর ব্যবস্থা করেছেন আমাকে পড়াবেন বলে। বাতির আলোর কিছুটা অংশ এসে পড়েছে ভাইয়ার উপর। বইয়ের উপর ঝুঁকে আছেন উনি ফলে মাথার চুলগুলো পড়ে আছে কপালে। কপালে পড়ে থাকা স্লিকি চুল আর আধো আলোয় অন্য এক উনাকে দেখছি আমি।
নীল ভাইয়া উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের আর সুঠাম দেহের অধিকারী। আমার কাছে উনার মাঝে সুন্দরতম জিনিস হচ্ছে উনার স্লিকি চুল আর ঘন কালো পাঁপড়ির দুটো চোখ। বুঁজে থাকা চোখ জোড়া যখন হঠাৎ দৃষ্টি দেয়, তখন ধুকপুক করে উঠে বুকের ভিতরে। যে-কোনো মেয়ে একবার হলেও উনার চোখের প্রেমে পড়বে। উনার খুন করা চাহনিতে একবার হলেও বলবে,
- হায়! মে মার যাউঙ্গি।
উনাকে নিয়ে এতো জল্পনা কল্পনা আমার মাঝে আগে কখনও আসে নি। এমনকি উনাকে এতো মনযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণও করি নি। জানি না কেন? তবে ভালো লাগে উনাকে পর্যবেক্ষণ করতে আর ভালো লাগে উনাকে নিয়ে ভাবতে আবার কেন যেন খুব করে লজ্জাও লাগে।
বইয়ের পাতায় দৃষ্টি রেখেই ভাইয়া হঠাৎ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
- স্ক্যান করা হয়েছে?
আমি উনার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। মনযোগটাও উনার মাঝেই আঁটকে ছিল। তাই হঠাৎ করে করা প্রশ্নে একটু নড়েচড়ে উঠলাম। আমচকা এমন প্রশ্নের উত্তরটা ঠাওর করতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, - কিসের স্ক্যান?
আমার প্রশ্নে সাথে সাথে উনি আমার দিকে তাকালেন৷ উনার গম্ভীর চাহনিতে আমি শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলবো বলে ভাবছিলাম তার আগেই উনি বললেন,
- আমি ছাড়া তো রুমে কেউ নেই। আর যতদূর মনে হচ্ছে এতক্ষণ ধরে আমাকেই স্ক্যান করছিলি।
বইয়ের পাতায় দৃষ্টি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, - কি? ঠিক বলছি?
আমি কিছু না বলে মাথা নুইয়ে চুপ করে বসে আছি। কথাটা শতভাগ সত্যি বিধায় লজ্জায় আমার কান গরম হয়ে যাচ্ছে। আগে ভাইয়ার প্রতি আমার ভয় কাজ করতো সাথে চাপা রাগ কিন্তু ইদানীং কেন যেন লজ্জা কাজ করে, অহেতুক লজ্জা। - নানা বাড়ি কতদিনের জন্য যাচ্ছিস?
আমি লজ্জা পাচ্ছি সেটা হয়ত ভাইয়া বুঝতে পেরেছেন। তাই প্রসঙ্গ বদলে আমায় প্রশ্ন করলেন। আমি জবাবে ভাইয়াকে বললাম, - তিনচার দিনের জন্য।
- কালকে কখন যাবি?
- সকাল দশটায়। বিকেলে ঐশীদের বাসায় যেতে হবে হলুদ সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে।
- রাত দশটার বেশি থাকবি না, কেমন?
- হুম।
- কালকে সকালে তৈরি থাকিস আমি তোকে দিয়ে আসবো। কালকে আমার তেমন কোনো কাজ নেই।
- ঠিক আছে।
আবারও কিছুক্ষণ নিরবতা ছেয়ে রইলো পুরো রুম জুড়ে। আধো আলোময় রুমে এখন চুপচাপ হয়ে আছি দু’জনেই। আগের মতোন এখন আবার স্তব্ধ হয়ে গেল চারপাশ। নিরবতার চাদর সরিয়ে ভাইয়া হঠাৎ আমাকে ডেকে উঠলেন, - পেত্নী।
দিন দিন এই বিচ্ছিরি নামের মাঝে কেন যেন ভালো লাগা অনুভব করছি। মনে হয়, যেন এই নামটা শুনবার জন্যই চাতক পাখির মতোন অপেক্ষায় থাকে আমার মন। আমার মাঝে এতো পরিবর্তন কেন আসছে দিন দিন? কই? আগে তো নিজেকে এমন মনে হয় নি। সুমাইয়ার মুখে নীল ভাইয়া আর আমার নামটা একসাথে শোনার পর থেকেই আমি একটু একটু করে যেন বদলে যাচ্ছি।
ভাইয়ার ডাকে আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
- হুম।
- নামটা কি খুঁজে পেয়েছিস?
আমি ভাইয়ার কথার জবাবে সাতপাঁচ না ভেবে বলে দিলাম, - উহুম।
উত্তরটা জেনেও কেন বোকার মতোন মানা করলাম বুঝতে পারছি না। আমি তো বলতে পারতাম কুহি আপুর নাম কিন্তু কেন বললাম না?
ভাইয়া খাতায় কী যেন লিখছিলেন, লেখা বন্ধ করে আমাকে বললেন,
- তাড়া নেই। তুই ভাবতে থাক। তবে যেদিন নামটা জানবি, সেদিন তোর অনুভূতিটা কেমন হবে সেটা দেখার খুব ইচ্ছে আছে আমার।
একটু বিরতিতে, - তোকে আমি শুধু শাসন করি, সেটা আমি জানি। আর এ-ও জানি, আমি তোর কাছে খুব বাজে একজন মানুষ। তবে কি জানিস? তোর কাছে আমি বাজে মানুষই হয়ে থাকতে চাই, ভালো হয়ে নয়।
ভাইয়ার কথার জবাবে আমি নিরব হয়ে রইলাম। কারণ উনার কথাগুলো আমাকে এই মুহূর্তে খুব করে ভাবাচ্ছে আর মনের কোণে তৈরি করছে হাজারও প্রশ্ন, - কুহি আপুর নাম শুনে তো আমার অনুভূতি নিতান্তই সামান্য ছিল। এই সামান্য অনুভূতি দেখার জন্য উনার এতো ইচ্ছে কেন? আর উনি বাজে মানুষ! আমি তো উনাকে কখনও বাজে মনে করি নি। উনাকে অসহ্য লাগে তবে বাজে নয়। কিন্তু উনি আমার কাছে বাজে হয়ে থাকতে চান কেন?
মনের মাঝে জেগে উঠা হাজারো প্রশ্নকে নিজ হাতেই আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। কারণ আমার প্রশ্নের জবাব ভাইয়া কখনও দিবেন না। তাই সেই আশাকে বালি চাপা দিয়ে চুপটি করে বসে রইলাম।
এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলতো
যদি স্বপ্নের দেশ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলতো
(তুমিই বল)
এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলতো
কোন রাখালে,
ওই ঘর ছাড়া বাঁশিতে সবুজে
ওই দোল দোল হাঁসিতে রাখালে
কোন ঘর ছাড়া বাঁশিতে সবুজে
ওই দোল দোল হাঁসিতে
মন আমার মিশে গেলে বেশ হয়
যদি পৃথিবী তা স্বপ্নের দেশ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলতো
(বলব না)
এই পথ যদি না শেষ হয়।
তবে কেমন হতো তুমি বলতো
নীল ভাইয়ার সাথে উনার বাইকে করে নানা বাড়ি যাচ্ছি। সকাল থেকেই মনটা কেন যেন আমার বেশ ফুরফুরে লাগছে। সকাল বেলা তারউপর বাইকে করে যাচ্ছি তাই সাধারণ বাতাসটাও ক্ষিপ্র বলে মনে হচ্ছে। আর আশেপাশে নজর দিয়ে মনটা বেশ প্রফুল্ল লাগছে বলে আনমনে গানটা গেয়ে চলেছি।
আমার নানা বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। বাইকে করে যেতে ৩০ মিনিট সময় লাগে মাত্র। তবে আমার খুব ইচ্ছে একদিন রিকশা করে যেতে বা বাসায় ফিরতে। ইচ্ছেটা পূরণ হবে না আমি জানি। কারণ কেউই রাজি হবে না আমার এমন অযৌক্তিক আবদারে।
নানা বাড়ি পৌঁছাতে ভাইয়া বাইক থামালেন আর আমিও চট করে নেমে পড়লাম। আমার একটা ব্যাগ ভাইয়া বাইকের হ্যান্ডেলে নিয়ে পুরোটা পথ এসেছেন। সেটাই আমাকে দিতে দিতে বললেন,
- সাবধানে থাকিস আর খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করবি। ফোনটা কাছে রাখবি যেন কল করলে সাথে সাথে পাই তোকে।
- ঠিক আছে।
- আসি তাহলে।
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে। - সেকি! ভিতরে আসবেন না? নানা আর নানুমনি জানলে তো কষ্ট পাবেন।
একগাল হেসে বললেন। - বিয়ের পর বউকে নিয়ে এসে থাকবো। আত্মীয় বলে কথা। সে যা-ই হোক, নানুকে বলিস আমার একটু তাড়া আছে। আজকে মৃন্ময় বান্দরবান চলে যাবে তো। তাই ওর সাথে একটু যেতে হবে। তুই বুঝিয়ে বলিস নানা আর নানুকে।
- ঠিক আছে বলবো।
আমার থেকে উত্তর পেয়ে দ্রুত বাইক চালিয়ে ভাইয়া চোখের পলকে মিলিয়ে গেলেন। আমি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আর হাতে আরেকটা ব্যাগ নিয়ে উনার পথ পানে তাকিয়ে মনে মনে বললাম।
- বউকে নিয়ে এসে থাকবেন আর আমার সাথে ভিতরেও ঢুকলেন না। আজব একটা মানুষ!
পর্ব-২০
জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার
জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার
ভালোবাসার খামে
চিঠি লিখে তোমার নামে
পাঠিয়ে দিলাম আমি
পড়ে নাও এবার
জানে এই মন জানে
তুমি যে আমার
তোমারই স্বপ্নে আমার
রোজ পারাপার।
হলুদ সন্ধ্যা অনুষ্ঠানের জন্য বেশ জমজমাট আয়োজন করা হয়েছে। আত্মীয় স্বজনে ঐশীদের বাড়ি যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। চারপাশে অনেক হৈচৈ হচ্ছে কিন্তু এত এত হৈচৈ কীভাবে যেন উপেক্ষা করে আমি মনযোগ দিয়ে রেখেছি গানে।
সন্ধ্যায় নানুমনিকে সাথে নিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ভাইয়ার কথা মতো দশটা বাজে চলে যাবো। কিন্তু নানুমনি সেই কখন থেকে ঐশীর দাদীর সাথে খোশগল্প করছে। আমি কাছে গিয়ে আকারে ইঙ্গিতে চলে যাওয়ার কথা বলতেই নানুমনি বলেছিল।
- এতো কাছে বাসা তাহলে থাকতে সমস্যা কী?
সমস্যা যে কী সেটা তো আমি জানি কিন্তু নানুমনিকে বুঝাতে পারলাম না। নানুমনিকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে স্টেজের এককোণে একটা চেয়ারে বসে আছি।
ঐশী ভীষণ ব্যস্ত। আমি কোনো রকমে আপুকে হলুদ দিয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছি। হাতে ধরে রাখা ফোনটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো। কল এসেছে বুঝতে পেরেই ভয়ে আঁতকে উঠলাম মনে মনে। ভয় নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি, ‘হনুমানের নাতি’ লেখাটা ভাসছে। আলতো হাতে রিসিভ করে হ্যালো বলবো ভাবতেই ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন।
- তুই এখনও বিয়ে বাড়িতেই?
গানের শব্দে হয়ত বুঝে গেছেন আমি বিয়ে বাড়িতেই আছি। ভাইয়ার প্রশ্নের জবাবে করুন গলায় বলতে লাগলাম। - হুম। আসলে আমি তো নানুমনির সাথে এসেছিলাম। আমি কখন থেকে বলছি নানুমনিকে বাসায় চলে যাবো। কিন্তু নানুমনি বলছে এতো কাছাকাছি বাসা তাও যাবার জন্য আমি তাড়া দিচ্ছি কেন?
গম্ভীর গলায়, - বারোটার পর একমিনিটও যেন দেরি না হয়, বুঝেছিস?
- হুম বুঝেছি।
- বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়িস।
- ঠিক আছে।
- রাখছি তবে। নিজের খেয়াল রাখিস।
এই বলে ভাইয়া কল কেটে দিলেন। থাকার অনুমতি পেয়ে এখন স্বস্তি লাগছে এতক্ষণ মনটা আনচান করছিল ভয়ে। আমি চাইলে মিথ্যা বলে অনেক রাত পর্যন্ত থাকতে পারতাম। কিন্তু আমার প্রতি ভাইয়ার যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা আমি করতে চাই না।
দুপুর তিনটা। আমাদের কনে আপু মানে চৈতী আপুর রুমের একটা সোফায় বসে বসে পা দুলাচ্ছি আমি। আমার পাশে বকবকানির মা বসে বকবক করে আমার মাথা খাচ্ছে। আমি গালে হাতে দিয়ে ঐশীর সেই বকবক শুনছি আর বুঝে না বুঝে হুম হ্যাঁ করছি। এই মুহুর্তে আমার দৃষ্টি ঘরে অবস্থানরত ময়দা সুন্দরীদের উপর আর মনযোগ তাদের ভাবসাবের উপর। আমার কাছে মনে হচ্ছে সবকটা আজকে সকালে রুটি না খেয়ে সেটা মুখে মেখে এসেছে। মেকাপ জিনিসটা আমার একদমই সহ্য হয়। দেখলেই রাগে রিরি করে উঠে শরীর।
অনেকটা সময় হয়ে গেছে কিন্তু আমার কাছ থেকে ঐশী মন মতো জবাব পাচ্ছে না। তাই অসহায়ের মতো খানিকটা জোরে আমায় বললো,
- আচ্ছা, সেই কখন থেকে শুধু হুম হ্যাঁ করছিস কেন? অন্য কিছু তো বল?
আমি আড়ঁচোখে তাকিয়ে বললাম। - এতক্ষণ ধরে বকবক করে আমার মাথা খেয়েছিস। এখন আবার কী চাই তোর?
- জানু তুমি এমন করছো কেন?
এমনিতেই ওর বকবকানিতে মাথা ধরে গেছে তারউপর এখন এই নেকামোটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। তাই কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে কিছু বলতে যাবো কিন্তু তখনই কেউ এসে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো। - বরযাত্রী এসেছে, বরযাত্রী এসেছে।
ঐশী তো এটা শুনে লাফিয়ে উঠলো। খুশিতে অস্থির হয়ে বললো, - জানু চল চল।
আমি বিরক্ত ভরা কন্ঠে বললাম। - তুই যা আমার ভালো লাগছে না। আমি বরং আপুর কাছেই থাকবো।
আমার কথায় অবাক হয়ে ঐশী বললো। - কী বলছিস এসব? ঢং না করে চল তো তাড়াতাড়ি।
- সত্যি ভালো লাগছে না এসব তুই_
কথাটা পুরোপুরি শেষও করতে পারলাম না তার আগেই ঐশী আমার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলো। বুঝতে পারলাম যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়ে ওর সাথে চলে এলাম বিয়ের গেটে। মুখ গোমড়া করে ঐশীর পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছি,
- আমাকে এখানে আনার কী দরকার ছিল? আজব!
সবাই জামাইকে বরণ করতে ব্যস্ত আর ঐশী তো পারলে ডান্স শুরু করে দেয় খুশির ঠেলায়। চোখের সামনে এতো কিছু দেখেও আমার মাঝে বিন্দুমাত্র খুশি কাজ করছে না। আমি শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে এসব দেখছি আর ঐশীকে গালি দিচ্ছি মনে মনে। হঠাৎ-ই কেউ একজন খানিকটা জোরে বলে উঠলো।
- রিশাদ, কিরে? বাইক থেকে নেমে আমার জন্য না দাঁড়িয়ে এভাবে হনহন করে কেন চলে এলি?
কন্ঠটা আমার কাছে কেমন যেন পরিচিত পরিচিত লাগছে। নিজের কৌতুহল মেটাতে চোখ তুলে তাকালাম ঐ পরিচিত কণ্ঠের মানুষটার পানে। যা দেখলাম, এতে তো আমার পুরো পৃথিবী ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। আমি মুহুর্তেই ৪২০ ভোল্টের শখ খেয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। আমাকে শক খাওয়ানোর মানুষটা আর কেউ নয় স্বয়ং নীল ভাইয়া।
মিনিট কয়েক ধরেই চলছে আমাদের দৃষ্টি বিনিময়। আমিও তাকিয়ে আছি ভয় নিয়ে আর ভাইয়া তাকিয়ে আছেন বিস্ময় নিয়ে। উনি এমন ভাবেই তাকিয়ে আছেন যেন জীবনের প্রথম আমাকে দেখছেন। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না? এক রকম জোর করে একটা হাসি দিলাম। কিন্তু ভাইয়া হাসলেনও না কিছু বললেনও না শুধু তাকিয়েই আছেন। উনার কোনো নড়ন চড়নও নেই। হঠাৎ উনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ধাক্কা দিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলেন।
- কিরে কী দেখছিস?
উনি একটু ঘাবড়ে গিয়ে চোখ সরিয়ে নিলেন। আমিও চোখ নামিয়ে নিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই আবার তাকিয়ে দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়ে পাশের ছেলেটা জবাব দিচ্ছেন, - কই? কিছু না তো।
এমনিতেই দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না আমার, এখন তো নীল ভাইয়াকে দেখে আরও অস্বস্তি লাগছে। উনার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া প্রমান করছে উনি কিঞ্চিৎ রেগে আছেন। আর উনার চাহনিতে পাচ্ছি আমি বিস্ময়ের আভাস।
- একই সাথে রাগ আর বিস্ময় কেন উনার মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে?
নিজেকে করা প্রশ্নের জবাব পেলাম না আমি। এই মুহূর্তে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে না তাই ঐশীকে বললাম,
- শোন, আমার ভালো লাগছে না। আমি আপুর কাছে গেলাম।
কথাটা বলেই হনহন করে আপু কাছে চলে এলাম। ঐশী অনেক ডাকলো কিন্তু আমার ওর কথায় কান দেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। কারন বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বলি দিতে পারবো না। যেই ভাবে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে আল্লাহ ই জানে আজকে আমার কি হাল করবে?
সোফায় বসেছি বড়জোর দুই কী তিন মিনিট হবে। এরমাঝেই ভুবন কাঁপিয়ে ফোন বেজে উঠলো। ফোনে তাকিয়ে দেখি ভাইয়ার কল। আমি যথারীতি রিসিভ করে বললাম,
- হ্যালো।
- একটু দেখা কর আমার সাথে।
- হুম আসছি।
একহাতে ফোন আর অন্য হাতে লেহেঙ্গাটা ধরে হাঁটছি আর এদিক সেদিক তাকিয়ে উনাকে খুঁজে চলেছি। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ছেলের সাথে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। উনাকে হাসতে দেখে আমি ভাবতে লাগলাম। - বাহ বাহ! হনুমানের নাতি দেখি হাসতেও জানে।
উনার কাছাকাছি হতেই চোখাচোখি হলো দু’জনার। আর চোখাচোখি হতেই হাসি থামিয়ে দিয়ে মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেলেন উনি। উনাী গম্ভীর মুখাখানা কোনোমতে হজম করে বললাম। - ভাইয়া?
আমার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বললেন। - ঐ দিকে চল।
- হুম।
সম্মতি দিয়ে উনার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলাম। হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে পায়ের নুপুরে ঝনঝন শব্দ হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে উনি আমাকে একেবারে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলেন। ঐশীদের বাড়ির পাশে একটা পুকুর আছে। সেখানে এসে দাঁড়ালাম উনার সাথে। পুকুরটা ঐশীদেরই আর এখানে মাছ চাষও করা হয়। আমি মনযোগ দিয়ে পুকুরটা আর আশপাশটা তাকিয়ে দেখছি। হঠাৎ গম্ভীর গলায় বললেন,
- এতো সেজেগুজে আসার কি আছে?
- একটু কাজল আর একটুখানি লাল লিপস্টিক ছাড়া অন্য কিচ্ছুটি দেই নি। তাহলে এটা অনেক সাজ কী করে হলো? এটা যদি অনেক হয় তাহলে আটা ময়দা আর সুজির দোকান নিয়ে আসা মেয়েদের কী বলা হবে?
মনে মনে কত-শত প্রশ্ন এলো আমার মাঝে। কিন্তু প্রশ্নগুলো ধামাচাপা দিয়ে কিছু সময় তাকিয়ে রইলাম ভাইয়ার দিকে। আমার সামান্য সাজেও উনি এমন কথা বলেছেন বলে হয়ত আমার চমকে উঠার দরকার ছিল। কিন্তু আমি বিন্দুমাত্র বিস্মিত না হয়ে স্বাভাবিক হয়েই আছি। কারন আমার এই হালকা সাজেও উনি আপত্তি করেন সবসময়। একটু ভয় ভয় নিয়ে উনার কথার জবাবে বললাম,
- ভাইয়া আমি সাজতে চাই নি। বিয়ের অনুষ্ঠান বলে নানুমনি আমাকে জোর করেছেন সাজতে।
আমার জবাবে কিছুক্ষণ নিরবে কী যেন ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, - খেয়েছিস?
- উহুম।
- কার সাথে এসেছিস?
- নানুমনির সাথে।
- নানা আসেন নি?
- নানার কী যেন কাজ আছে তাই আসবেন না আর নানুমনি আমার সাথে এসে খেয়েদেয়ে আবার চলে গেছে।
- তুই খেলি না কেন?
- ঐশীর সাথে খাবো বলে খাই নি তখন।
- ওহ। তা যাবি কার সাথে?
- একাই যাবো। এতো কাছে বাসা। এইটুকুন পথ আমি নিজেই যেতে পারবো।
- যখন বাড়ি ফিরবি আমাকে কল দিবি। আমি পৌঁছে দিবো।
উনার কথায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। পাশাপাশি বাড়ি, এই বাড়ি থেকে ঐ বাড়ি যাবো। এখানে পৌঁছে দেওয়ার কী আছে? বারণ করার মতো সাহস আমার নেই। তাই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলাম,
- হুম।
কিছু সময় আমাকে দেখে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। আমিও উনার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম। ভাইয়া খুব দ্রুত হেঁটে বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। এদিকে আমি লেহেঙ্গা সামলাতে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। বাড়িতে ঢুকতেই ঐশী ছুটে এসে বললো,
- কিরে কোথায় গিয়েছিলি?
- কোথাও না।
- শোন, অনেক বেলা হয়েছে তাই মা বলেছে আমাদের খেয়ে নিতে।
- ঠিক আছে চল।
হায় রে! আমার কপাল এমনই ভালো কী আর বলবো? ঘুরে ফিরে হনুমানের নাতির সাথেই খেতে বসতে হলো। আল্লাহ আপনি কেন আমার সাথে এমন করেন? আর ঐশী ছেঁছড়ি একটা। বারবার আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে,
- জানু, নীল ভাইয়ারে আজকে জোশ লাগতেছে। হায় মে তো মার যাউঙ্গি।
ঐশীর ভুলভাল হিন্দি শুনে রাগে আমিও ফিসফিসিয়ে বললাম, - হিন্দি পারিস না তো ভুলভাল কেন বলিস? আর এখন চুপচাপ আমায় খেতে দেয়। তোর কারনে কপালে শনি আনতে পারবো না।
- মানে?
- আরে_
কিছু বলবো তখনই নীল ভাইয়া হালকা কাশি দিলেন। বুঝলাম, কপালে শনি এসেই গেছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে গেলাম।
পর্ব-২১
সন্ধ্যা হয়ে আসছে এখন তো বাসায় ফেরা উচিত। ঐশীর থেকে বিদায় নিয়ে ওদের বাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম। বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াতেই খানিক তফাতে চোখে পড়লেন নীল ভাইয়া। বাইকে হেলান দিয়ে ফোন স্কোল করছেন। গুটিগুটি পায়ে উনার কাছে এসে উনাকে ডেকে উঠলাম,
- ভাইয়া?
উনি সোজা হয়ে ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বললেন,
- ওহ, এসে গেছিস? হুম চল।
দুই তিন মিনিটের পথটুকু দু’জনে চলতে লাগলাম নিরব হয়ে। আমি সামনে হাঁটছি আর ভাইয়া আমার পিছন পিছন। নানা বাড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই উনি বললেন। - শোন, তোর সাজ শুধু একজনই দেখবে। তাই এইটুকুও সাজার দরকার নেই। বুঝতে পেরেছিস?
বিয়ে বলে একটু সেজেছি সেখানেও হনুমানের আপত্তি। বিষয়টা আমার একটুও ভালো লাগে নি। তাই ছোট্ট করে জবাব দিলাম, - হুম।
- পেত্নী, এদিকে আয়।
উনার কাছে যেতে ডাকলেন বলে কিঞ্চিৎ চমকে গেলাম তবুও বাধ্য মেয়ের মতো উনার কাছে এসে দাঁড়ালাম। কাছে এসে দাঁড়াতেই ফোন বের করে দুজনের কয়েকটা সেলফি তুললেন। উনার এসব কান্ড দেখে আমি তো হা হয়ে গেলাম।
- আজকে সূর্য কোন দিকে উঠেছে? উনি আমার সাথে সেলফি তুলছেন? হায় আল্লাহ!
মনে মনে এসব ভাবছিলাম হঠাৎ কাঠ গলায় ভাইয়া বললেন। - ভালো করে তাকা ক্যামেরার দিকে। ছবি তো জঘন্য উঠছে।
উনার কথায় এবার ভালো ভাবে ক্যামেরার দিকে তাকালাম। উনি চটপট বেশ কয়েকটা সেলফি তুলে সেগুলো দেখতে শুরু করলেন। আর আমি উনাকে দেখতে লাগলাম। সারাদিনে আমার নজরে আসে নি যে, উনি আজ লাল পাঞ্জাবি পড়েছেন। আজই প্রথম ভাইয়াকে দেখছি লাল পাঞ্জাবিতে। অতিরিক্ত ভয়ের কারনে সারাটা দিন খেয়াল করা হয় নি। এখন বিষয়টা আমার চোখে পড়লো যে, উনি লাল পাঞ্জাবি পড়ে জামাই সেজে এসেছেন। যদিও ছেলেদের পাঞ্জাবি পড়া আমার তেমন পছন্দ না। কিন্তু লাল রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামায় উনাকে সেই লেভেলের Handsome লাগছে। জানি কেন? তবে উনার থেকে চোখ সরাতেই ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ উনি আমার দিকে তাকাতেই লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলাম। না হলে উনি আবার নিজেকে হিরো ভাবতে শুরু করবেন। ফোনটা পকেটে রেখে উনি আমায় বললেন। - ইদানীং কারণে অকারণে চোখ দিয়ে গিলতে থাকিস কেন? খুব কি সুন্দর হয়ে গেছে ডাইনোসর নাকি আগে অসুন্দর ছিল বেশি?
ভাইয়ার কথায় এখন খুব বেশি লজ্জা লাগছে। আর ‘ডাইনোসর’ নামটা শুনলে নিজেকেই নিজের পেটাতে ইচ্ছে করে। আমায় চুপ থাকতে দেখে ভাইয়া নিজে থেকে জানতে চাইলেন, - বাসায় কবে যাবি?
চোখ তুলে তাকিয়ে জবাব দিলাম,
- কাল পরশু।
- ঠিক আছে। এবার ভিতরে যা আর রাতের খাবার খেয়ে নিস ঠিকমতো।
- হুম।
জবাব দিয়ে সামনে পা বাড়িয়েও থেমে গেলাম। আমাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
- পেত্নী, কিছু বলবি?
একটু ভয় নিয়ে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলাম। - না মানে, আপনার তো একটা বিয়ের নেমন্তন্ন ছিল কিন্তু আপনি এখানে সেটাই_
আমার আমতা আমতার মাঝেই ভাইয়া বলতে লাগলেন, - আমার বন্ধুর মামার বিয়ের দাওয়াত ছিল। যাকে বর বেশে দেখলি সে-ই আমার বন্ধু রিশাদের মামা।
একটু বিরতিতে। - কী ব্যাপার বল তো? খুব কৈফিয়ত চাস যেন ইদানীং। এতো নজরদারী কিসের জন্য?
হ্যাবলাকান্তের মতো একটা হাসি দিয়ে বললাম। - না, একটু কনফিউশান লাগছিল। তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনি না বললে আমি আর জানতে চাইতাম না।
- ওহ। তা জানিয়ে তো দিলাম। আর কিছু?
দ্বিগুন বেগে মাথা নাড়িয়ে বললাম। - উহুম। এতটুকুই জানার ছিল। শুকরিয়া ভাইয়া।
হঠাৎ কেন যেন স্থির দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে। আকাশের আলতা রাঙা আলোয় খুব একটা বুঝা না গেলেও আশেপাশের কৃত্রিম আলোয় উনার স্থির দৃষ্টি খুব স্পষ্ট আমার কাছে। ঘন কালো পাপড়ির দুটো চোখ আমার চোখে ডুবে আছে। চোখ দুটো অনেক কিছু বলছে আমায় কিন্তু আমি কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছি না। লজ্জায় নিজেই সরিয়ে নিলাম আমার কাজল কালো চোখ। মনে মনে ভাবছি কিছু একটা বলে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত কিন্তু তার আগে ভাইয়া বললেন। - আমাকে যেতে হবে। তুই ভিতরে চলে যা।
মাটিতে দৃষ্টি রেখে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। শেষ বারের মতোনও উনার দিকে তাকালাম না লজ্জায়। উনি উনার মতোন আর আমি আমার মতোন নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।
বাতাসে একটা ঠান্ডা আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছে হয়ত কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। আকাশটা বেশ অন্ধকারও লাগছে। এখন যদি বৃষ্টি হয় তাহলে ভিজে একাকার হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ নানার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ইচ্ছে করে ছাতা না নিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। নানুমনি এতো করে বললো।
- দেখ কথামনি, পাকামো না করে ছাতা নিয়ে যা।
নানুমনির কথার পাত্তা না দিয়ে বলেছিলাম, - নানুমনি, আকাশ তো ফকফকা পরিষ্কার। বৃষ্টি আসবে কোথ থেকে?
এখন তো বেশ টেনশন লাগছে। আর নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই বেত্রাঘাত করতে ইচ্ছে করছে। এমনিতেই শরীরের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক না। কালকে রাত থেকেই খুসখুস কাশিতে অস্থির হয়ে উঠেছি। জায়গা পরিবর্তন করলে আমার সামান্য সর্দি কাশি হয়। কারণ একেক জায়গার পানি নাকি একেক রকমের হয়– মা বলে।
এখন যেন ঋতুর কোনো তালই পাওয়া যায় না৷ এমন ফেব্রুয়ারি মাসে বৃষ্টি হওয়ার কেন ঘনঘটা পড়েছে কে জানে?
কালকে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বাসায় যখন ভাইয়া দিয়ে গেলেন, ভেবেছিলাম আরও দুই একদিন থাকবো। কিন্তু আজকে সকালে হঠাৎ করে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে। আর নানা বাসায় নেই সেই সুযোগে আমার এতো দিনের লুকানো ইচ্ছেটা পূরণের সুযোগ এলো। কাউকে না জানিয়ে আমি বাসায় ফিরছি রিকশায় করে। কিন্তু এরজন্য পকেট থেকে ১০০ টাকা গচ্ছা যাবে আমার, যেখানে বাসে কুড়ি কী ত্রিশ টাকা লাগতো।
মেঘলা আকাশ আমার মনে চিন্তার আবির্ভাব ঘটালেও রিকশায় করে যেতে বেশ ভালোই লাগছে। হিমেল হাওয়া এসে বারবার ছুঁয়ে দিতেই কাঁপুনি দিয়ে উঠছে গা। ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে মনে মনে গুনগুনিয়ে গেয়ে চলেছি,
বেখেয়ালী মনে
ভেবেছি গোপনে।
বেখেয়ালী মনে
ভিজেছি দুজনে।
আদরে চাদরে
নেবো তোকে মুড়ে।
বৃষ্টি চাস, বারো মাস
ভিজি আয়।
বেখেয়ালী মনে
ভেবেছি গোপনে।
বেখেয়ালী মনে
ভিজেছি দুজনে।
আলোর ওই দেশে
সাত রং মেশে।
সেই রঙে তোকে রাঙাবো।
রাত্রি গড়িয়ে
বুকে জড়িয়ে।
তোর ভোরের-ই ঘুম ভাঙ্গাবো।
আর মাত্র কিছুটা পথ বাকি ছিল কিন্তু মেঘটা আমার সাথে বেইমানি করলো। আকাশের বুক চিরে অঝোরে সে বৃষ্টি নামিয়ে দিলো। আমি দ্রুত রিকশার হুট লাগিয়ে রিকশাওয়ালা মামাকে জিজ্ঞেস করলাম,
- মামা আপনার কাছে প্লাস্টিকের কাগজ নেই?
- না মামা, নাই তো। গরিব মানুষ। একখান ছিলো হেইডা ছিঁড়া গেছে তো পরে আর কিনতাম পারি নাই।
- ঠিক আছে মামা।
বৃষ্টির পানিতে সব ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে। দুইহাতে ব্যাগ আঁকড়ে বসে আছি গুটিসুটি মেরে। ভীষণ শীত শীত অনুভব হচ্ছে। মার আর ভাইয়ার কথা মনে পড়তেই ভীষণ ভয় লাগছে। যদি জানতে পারে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছি তাহলে কথা শুনিয়ে আমার কান ঝালাপালা করে ফেলবে। বৃষ্টির তীব্রতা দেখে মামাকে বললাম, - মামা একটু তাড়াতাড়ি যান। আর বেশি পথ বাকি নেই।
- আইচ্ছা।
মামাও আমার কথা মতো দ্রুত গতিতে রিকশা চালাতে লাগলেন। পাঁচ দশ মিনিট পর এসে পৌঁছালাম। বাসার সামনে আসতেই,
- মামা এখানেই থামান।
রিকশা থামাতেই ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে একপ্রকার দৌঁড়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম। কলিং বেল টিপে, ভেজা শরীরে কাঁপাকাঁপি করতে লাগলাম। জেঠীমা এসে দরজা খুলে দিয়ে বললো, - একি অবস্থা তোর? ভিজে তো পুরা শেষ। বলিস নি কেন তুই আজকে আসবি? আয় আয় ভেতরে আয়।
হালকা হেসে ভিতরে ঢুকতেই জেঠীমা দরজা লাগিয়ে দিয়ে বললো, - যা। তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে নেয় নয়ত শরীর খারাপ করতে পারে। তুই কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে যা। আমি মিতালিকে তোয়ালে দিতে বলি।
এদিক সেদিক তাকিয়ে একটু ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, - ভাইয়া কোথায়?
- বাসায় নেই।
- আর মা?
- তোর ফুপ্পির কাছে গেছে হাসপাতালে। আজকে তো ডেলিভারি হবে।
আফরোজা ফুপ্পি আমার দাদার ছোট বোনের মেয়ে। ফুপ্পির বেবি হবে শুনেছিলাম কিন্তু আজকে দিনে, সেটা আমার জানা ছিল না।
জেঠীমা আবার বললো, - তোর বাবা মা দুজনেই গেছেন। এখন তুই তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টে নেয়।
- ঠিক আছে।
কাপড় পাল্টে একটা ফুল ইয়োলো কালারের থ্রিপিস পড়ে নিলাম। হিজাবে ঢাকা থাকা স্বত্বেও মাথার চুলগুলো ভিজে টপটপ করে পানি পড়ছে।
তাই ভালো করে মুছে চুলগুলো খুলে দিলাম শুকিয়ে যাবার জন্য। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আরো অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দে মনে হচ্ছে কানে তালা লেগে যাবে। এই বৃষ্টি সহজে কমার কোনো লক্ষণ দেখছি না।
ব্যাগের ভিতরে থাকা কাপড় চোপড়া সব ভিজে গেছে বিধায় সেগুলো বের করে শুকাতে দিলাম বিছানার উপর। ফোন খুঁজতে লাগলাম ঠিক তখনই হাতে একগ্লাস দুধ নিয়ে এসে জেঠীমা বললো,
- কথামনি।
- জ্বী জেঠীমা।
- বৃষ্টিতে ভিজেছিস তো তাই গরম গরম দুধটা খেয়ে নেয় ভালো লাগবে।
গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে বললাম, - ইয়ও।
- কি হলো? এমন মুখ ভেঙচি দিচ্ছিস কেন?
- আমি দুধ খাবো না জেঠীমা। তুমি তো জানো যে, সকালের নাস্তায় খেলেও অন্যসময় খাই না।
- আরে বোকা মেয়ে! এটা গরুর দুধ না বাদামের দুধ।
- ওহ।
- কালকে তোর জেঠু নিয়ে এসেছিল আমার জন্য। ডাক্তার বলেছিল বাদামের দুধ খেতে। সেখান থেকেই তোকে গরম করে দিলাম।
- বাদামের দুধ হলো ঠিক আছে। দাও খেয়ে নেই।
গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক চুমুক খেয়ে বললাম, - হুম, দারুণ টেস্টি তো খেতে।
- তো তাড়াতাড়ি পুরোটা শেষ কর।
- ঠিক আছে।
জেঠীমা চলে গেল। আমি বিছানায় আয়েশ করে বসে খাওয়া শেষ করলাম। যেই গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখলাম, সেই ফোনের টোন কানে এলো। আমি দ্রুত ফোন খুজতে লাগলাম। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল রিসিভ করে বললাম, - হ্যালো মা।
- বেয়াদব মেয়ে। তুই কী বুড়ি হয়ে গেছিস? রিকশা করে কেউ এতোটা পথ আসে? যদি কিছু একটা হয়ে যেত তখন? আর এসেছিস তাও বৃষ্টিতে ভিজে এবার যদি শরীর খারাপ হয় তাহলে ডাল ঘুঁটনি ভাঙবো তোমার পিঠে।
একনাগাড়ে সব বলে গেল মা। আমি কিছুই বললাম না শুধু চুপচাপ শুনে গেলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে মা জিজ্ঞেস করলো, - বোবা হয়ে গেছিস?
- কি বলবো?
- কিছু বলতে হবে না। ভালো মতো থাকিস আর একদম বেয়াদবি করবি না। মনে থাকবে?
- হুম।
- তোর ফুপ্পি জন্য টেনশন হয় তার মাঝে তোর আবার এসব বাচ্চাদের মতোন কান্ড দেখে রাগ উঠে গেল। রাতে খেয়ে নিস মা। আমরা হয়ত ফিরতে পারবো না।
আমার উপর মার রাগ উঠলেও শেষ কথাগুলো বেশ মায়া মাখানো ছিল। তাই মার প্রতি অভিমান এসেও আবার চলে গেল। আমি নরম সুরে মাকে জবাব দিলাম, - ঠিক আছে।
জেঠীমা রাতের জন্য রান্না করছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি আর এটা সেটা বলে হাসছি। হঠাৎ-ই কাশতে শুরু করলাম। কোনো ভাবেই কাশি থামছে না। আমার মাঝে মাঝেই কাশিটা বড় আকার ধারণ করে, তখন দেখা যায় একটানা কাশি চলতেই থাকে। আর অতিরিক্ত কাশিতে চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকে।
জেঠীমা আমাকে নিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে ভাইয়াকে ডাকতে শুরু করলেন,
- নীল, নীল, নীল?
ভাইয়া ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলেন, - কী হয়েছে মা?
- দেখ না, মেয়েটা হঠাৎ করে কাশতে শুরু করেছে। বৃষ্টিতে ভিজে এসেছিল হয়ত সর্দি লেগে এই অবস্থা হয়েছে।
- আমার কাছে কাশি বন্ধ হওয়ার ট্যাবলেট আছে আমি নিয়ে আসছি। তুমি বরং আদা চা করে দাও।
- ঠিক আছে।
খুব দ্রুত ভাইয়া ট্যাবলেট আর একগ্লাস পানি এলেন। আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
- একটু কষ্ট করে খেয়ে নেয়। দেখবি একটু পরেই সেরে যাবে।
আমি বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলাম। কয়েক মিনিট পর আস্তে আস্তে কিছুটা কমছে। জেঠীমা আদা চা বানিয়ে এনে আমায় বললো, - এটা খেয়ে নেয় মা। আর এখন থেকে গরম পানি খাবি দুইদিন।
আমি ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। জেঠীমা তো চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠেছে। আর ভাইয়াকেও অনেকটা চিন্তিত দেখলাম। আমার জন্য এতোটা চিন্তিত উনাকে আমি আগে কখনও দেখি নি। আমি একটু একটু চা পান করছি আর মাঝে মাঝে উনাকে দেখছি। ভাইয়া আমার সামনের সোফায় বসে আছেন আর জেঠীমা রান্না সামলাতে চলে গেল। হঠাৎ ভাইয়া গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
- আমাকে টেনশন না দিলে কি তোর হয় না? একে রিকশা করে এসেছিস তারউপর ছাতা না নিয়ে এসেছিস। এখন যে বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হয়েছিস সেটার কী করবো?
করুন গলায় বললাম, - আসলে ভাইয়া_
আমাকে বলতে না দিয়ে খানিকটা রেগে বললেন,
- তোকে কৈফিয়ত দিতে বলি নি আমি। চুপচাপ চা শেষ কর। এইটুকুন বয়সেই এই অবস্থা করছিস বাকি জীবন কীভাবে যাবে কে জানে?
চমকিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, - বাকি জীবন মানে?
আমি চুপচাপ উনার দিকে তাকিয়ে আছি বলে উনি আমায় বললেন, - হা করে কী দেখছিস? চুপচাপ চা শেষ কর।
আমি নিরবতাকে আঁকড়ে ধরে চায়ে মন দিলাম। উনার কথাগুলো আমার যে খুব ভালো লেগেছে তা কিন্তু নয়। বরং খুব বেশি কষ্ট লাগছে যে, আমার অসুস্থ শরীরেও উনি আমাকে এভাবে বলছেন। কষ্ট লাগলেও কিছু করার নেই। কারণ উনার তীক্ষ্ণ কথার জবাব দেওয়ার মতো ইচ্ছে বা সাহস কোনোটাই আমার নেই। ভাইয়া ফোন স্ক্রোল করতে ব্যস্ত। কয়েক মিনিট বাদে ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- সম্পূর্ণ ইয়োলো রঙের ড্রেস কেন পড়েছিস?
পর্ব-২২
চায়ে চুমুক দিয়েছিলাম সবেমাত্র কিন্তু উনার কথা শুনে কিঞ্চিৎ বিষম খেলাম। হালকা কাশিও উঠলো আমার। তবে পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে বললাম,
- না মানে, অনেক শখ করে ড্রেসটা বানিয়েছিলাম সুমাইয়ার ড্রেসটা দেখে। অনেক আগে বানালেও পড়ি নি। আজকেই পড়লাম প্রথম।
উনি সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। আমার কথার জবাব দিতে সোজা হয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, - আর আজকেই লাস্ট। ড্রেসটা আলমারিতে তুলে রাখবি পড়ার দরকার নেই।
উনার জবাব শুধু ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ালাম। বিষয়টা আমার মোটেও পছন্দ হয় নি বলে মুখ ফুটে একটা কথাও বললাম না। উনি আবার ফোনে মন দিয়ে আস্তে করে বলে উঠলেন,
- সরিষা ফুল।
উনি যথেষ্ট নিচু স্বরে বললেও আমি কথাটা ঠিকই শুনেছি আর মনে মনে একটুখানি অবাক হয়েছি,
- আমি সরিষা ফুল! হনুমানের নাতি আমি যদি সরিষা ফুল হই তবে আপনি একটা অক্টোপাস। হুহ।
- ভাবনায় ডুবে না থেকে চা শেষ কর। ঠান্ডা হয়ে যাবে।
উনার কথায় আমার ভাবনায় ছেদ পড়তেই নিজেকে চায়ে ব্যস্ত করে তুললাম। চা খাচ্ছি কিন্তু মনে মনে উনার উপর গালি বর্ষণ করে বলছি,
- হনুমানের নাতি জামাটা কি সাজিয়ে রাখার জন্য বানিয়েছি?
- হৃদয়ে জমা সবটুকু ভালবাসা শুধু আমার ছোট্ট কথাপরীর জন্য। ভালোবাসি কথাপরী। ভালোবাসি তোমায়।
কারো কন্ঠে নিজেরই অন্য একটা নাম শুনতে পেলাম। বহুকাঙ্ক্ষিত আর অপ্রত্যাশিত নাম। যেই নাম শুনবার জন্য আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে আছে। পাশাপাশি মাথায় কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করছি। হঠাৎ স্পর্শটা আর অনুভব হচ্ছে না সাথে কন্ঠটাও শুনতে পাচ্ছি না। তাই খুব দ্রুত চোখ মেলে শোয়া থেকে উঠে বসে ডাকতে শুরু করলাম, - যাবেন না প্লিজ। নীল ভাইয়া, প্লিজ যাবেন না।
আমার ডাকে নীল ভাইয়া ছুটে এলেন আমার রুমে। বাতি জ্বালিয়ে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
- পেত্নী ডাকছিস কেন? আর একি! তুই কাঁদছিস কেন?
আমি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলতে লাগলাম, - আপনি চলে কেন যাচ্ছিলেন কথাপরীকে রেখে?
- মানে?
- একটু আগে তো কথাপরী বলে ডেকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি চোখ মেলে তাকানোর আগেই চলে কেন গেলেন?
রাতে ডিনার করার পর আমি আর জেঠীমা টিভি দেখছিলাম। তখন হঠাৎ-ই খুব শীত শীত অনুভব হচ্ছিল।
জেঠীমাকে সেটা বলতে আমার কপালে হাত দিয়ে দেখেন আমার প্রচন্ড জ্বর এসেছে। এতো রাতে ডাক্তারের কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই অনেক রাত পর্যন্ত জলপট্টি দিয়ে জেঠীমা যখন ক্লান্ত, তখন নীল ভাইয়াকে বলতে শুনেছিলাম,
- মা, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি ওকে সামলে নিতে পারবো।
জেঠীমা চলে যাওয়ার পর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভাইয়া আমার দেখাশোনা করছিলেন বোধহয়। মাঝ রাতে ঘুমের ঘোরে আমি ‘কথাপরী’ নামটা শুনতে পেয়েছি। আর কন্ঠটা আমার কাছে নীল ভাইয়ার কন্ঠের মতো লেগেছে বলেই আমি উনাকে ডাকাডাকি করছিলাম।
ঘড়ির কাঁটা তিনটার ঘর পেরিয়ে গেছে। এমন মাঝরাতে আমার কথাগুলো হয়ত ভাইয়া হজম করতে পারছেন না। তাই কপট রাগ দেখিয়ে আমায় বললেন,
- দেখ, আমি কিচেনে ছিলাম। তুই জ্বরের কারণে আবোলতাবোল বলছিস।
- আমি আবোলতাবোল বলছি না আপনিই ছিলেন আর আমায় কথাপরী বলে ডাকছিলেন। কেন মিথ্যা বলছেন আমায়?
- রাত দুপুরে কী যা তা বলছিস এসব? তোকে আমি কখনও পেত্নী ছাড়া তোর নামে ডেকেছি?
- বলুন না ভাইয়া ঐটা আপনিই ছিলেন। আমি তো… … আমি তো স্পষ্ট আপনার গলাই শুনেছি। আপনি আমায়… …
হঠাৎ-ই মাথা ঘুরতে শুরু করলো। ভাইয়া আমাকে বেসমাল হতে দেখে ছুটে এসে ঝাপটে ধরে সামলে নিলেন। আর আমিও উনার বুকে মাথা রেখে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে বসে রইলাম। অসুস্থ শরীরে কান্নাকাটি করে এসব বলছি বলে ভাইয়া আমায় বললেন,
- প্লিজ থাম। তোর শরীর খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে রে পেত্নী। কেন এমন পাগলামো করছি?
উনার বুকে মাথা রেখেই ধীরে ধীরে বলতে লাগলাম। - ছয় বছর ধরে আমাকে অপেক্ষা করাচ্ছে। চোখে দেখবো তো দূর নামটাও জানি না। আমার কেমন লাগে সেটা কি বুঝতে পারে না? এতো কিছুর পরও আমার এসব কি পাগলামো ভাইয়া?
- প্লিজ চুপ কর। তোর কথা বলতেও তো কষ্ট হচ্ছে।
ভাইয়ার প্রতিটি কথায় আমি একবুক যন্ত্রণার প্রকাশ পাচ্ছি। হয়ত আমি অসুস্থ বলে ভাইয়ার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি না থেমে আবার বলতে লাগলাম, - সামান্য জ্বরে আর কিসের কষ্ট ভাইয়া? এর চেয়ে বেশি জ্বরে পুড়ছে আমার মন তাও ছয় বছর ধরে।
- আর একটা কথা বললে জাস্ট খুন করবো তোকে তাও এই মুহূর্তে।
জানি না কেন? তবে এখন ভাইয়ার রাগে আমার মাঝে কোনো ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে না। আমি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছি, - এটা আপনাকে দিয়ে কখনও সম্ভব হবে না ভাইয়া।
ভাইয়া চুপ করে আছেন। কিন্তু আমি শব্দ শুনতে পাচ্ছি। খুব করে শুনতে পাচ্ছি উনার হৃদয়ের স্পন্দন। চারপাশের নিরবতার মাঝে উনার হৃদয়ের স্পন্দন আমার সহ্য হচ্ছে না তবে অসহ্যও লাগছে না। আমার মনে হচ্ছে, প্রতিটি স্পন্দন কাউকে ডাকছে কিন্তু নামটা আমি শুনতে পারছি না। তাই নিজেকে প্রশ্ন করলাম।
- কাকে ডাকছে ভাইয়ার হৃদয়? কার জন্য স্পন্দিত হচ্ছে এমন করে?
মিনিট দুয়েক নিঃশব্দে গুনতে লাগলাম স্পন্দনগুলো। ভাইয়াও কিছু বলছেন না। কিন্তু নিরবতাটা আমার ঠিক ভালো লাগছে না বিধায় আমিই জিজ্ঞেস করলাম। - চুপ করে আছেন কেন? ইদানীং আমার উপর রাগ করতেও যেন ভুলে গেছেন।
এখনও উনি চুপটি করেই আছেন। তাই নিজেই ডেকে উঠলাম, - ভাইয়া?
- বল।
- ঘুমাবো আমি। আমাকে শুইয়ে দিয়ে সেই বেনামি চিঠির মালিকের মতোন হাত বুলিয়ে দিন মাথায়। সে আমাকে কথাপরী বলে ডেকেছে, আপনি না হয় পেত্নী বলেই হাত বুলিয়ে।
বিনা উত্তরে আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলেন। আমি বালিশে মাথা রাখতেই গায়ে কাঁথা টেনে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমার চোখে চোখ রেখে একগাল হেসে বলে উঠলেন। - পেত্নী।
সারা গায়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে চুপটি করে বিছানায় বসে আছি। আমার ঠিক সামনে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন নীল ভাইয়া। মুখটা বেশ ক্লান্ত আর মলিন লাগছে। উনার মাঝে এই মলিনতা এসেছে গতকাল রাতের অনিদ্রা থেকে।
কোনো স্বপ্ন যদি বাস্তব চরিত্রের সাথে মিল থাকে তাহলে জেগেও সেটা নিয়ে আমি একা একা বকবক করি। ছোটবেলা থেকেই আমার এমন হয়। একবার স্বপ্নে দেখেছিলাম কেউ আমার ডায়েরি চুরি করেছে। স্বপ্নে কান্না করতে করতে জেগে উঠেও কাঁদছিলাম, তখন মা এসে জিজ্ঞেস করেছিল,
- কিরে কাঁদছিস কেন?
- আমার ডায়েরি চুরি করেছে। আমার সাধের ডায়েরি।
মা তাকিয়ে দেখেছিল ডায়েরিটা টেবিলেই আছে আর সেটা দেখিয়ে আমাকে বলেছিল।
- কোথায় চুরি হয়েছে? ঐ তো টেবিলেই পড়ে আছে।
আমি কথাটা বিশ্বাস না করে শুধু কাঁদছিলাম আর বলছিলাম। - না না আমার ডায়েরি চুরি করেছে। আমার ডায়েরি চুরি করেছে।
এখনও এমনটা হয় আমার সাথে, কালকে রাতে যেটা করলাম। কিন্তু আজকে গতকাল রাতের বিষয়গুলো মনে পড়তে খুব লজ্জা লাগছে। অবশ্য কালকের ঐ ঘটনা নিয়ে ভাইয়া আমায় কিছু জিজ্ঞেসও করেন নি, বলেনও নি। আর আমি তো লজ্জায় এমন একটা ভাব নিয়ে রেখেছি যেন কালকের বিষয়টা আমার স্মৃতিতেই নেই।
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর অপলক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি ফোন স্ক্রোল করতে ব্যস্ত। তাই কেউ যে উনাকে দেখছেন সেটা হয়ত বুঝতে পারছেন না। কিন্তু আমার ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে ফোনের দিকে তাকিয়েই হঠাৎ বলে উঠলেন।
- আমাকে চোখ দিয়ে না গিলে চা শেষ কর। একটু পরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে তোকে।
উনার কথায় আমি ৪২০ ভোল্টের শখ খেলাম। মনে মনে বলতে লাগলাম। - না তাকিয়েও কী করে বুঝলেন যে আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি? আর তাকিয়ে আছি বলে কী হয়েছে? এরজন্য এভাবে বলতে হবে? হুহ!
আমি প্রতুত্তরে নিরব রইলাম। এক দুই মিনিট পর ভাইয়া নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, - শেষ হয়েছে?
- উহুম।
- তাহলে তাড়াতাড়ি শেষ করে তৈরি হয়ে নেয়। আমি একটা রিকশার ব্যবস্থা করছি। এই জ্বরের মাঝে বাইকে বসে থাকতে পারবি না। মাথা ঘোরাতে পারে।
- আচ্ছা।
কোনো রকমে জেঠীমার সাহায্যে হিজাব বেঁধে তৈরি হয়ে নিলাম। বৃষ্টিতে ভেজার পরিণতি এতোটা করুন হবে সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। মা যদি জানতে পারেন তাহলে আমায় আর আস্ত রাখবেন না। তাই তো সকালে অনেক অনুরোধ করে জেঠীমাকে বলেছিলাম,
- মাকে প্লিজ জানিও না। যদি জানে জ্বর এসেছে তাহলে আমায় আর আস্ত রাখবেন না।
তখন ভাইয়া আমার কথায় সায় দিয়ে বলেছিলেন, - হ্যাঁ মা, চাচীমাকে আপাতত জানিও না। অযথা টেনশন করবেন আর আমরা তো আছিই। আশা করি সুস্থ হয়ে যাবে।
ভাইয়া আমার কথায় সায় দিবেন আমি ভাবতেও পারিনি। জেঠীমার আমায় নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফুপ্পির মেয়ে হয়েছে। তাই জেঠুকে নিয়ে হাসপাতালে যাবেন, ফুপ্পি আর নতুন পুচকে সোনাকে দেখতে।
একটা রিকশা দাঁড় করিয়ে এসে ভাইয়া জেঠীমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- মা, হয়েছে?
- হ্যাঁ, হয়েছে।
- তাহলে তুমি ওকে নিয়ে এসো। আমি নিচে গেলাম।
- ঠিক আছে যা।
জেঠীমার সাথে নিচে এসে রিকশায় উঠে বসলাম। জেঠীমা, ভাইয়াকে এটা সেটা বুঝিয়ে বললেন যেন আমার কোনো প্রকার অসুবিধা না হয়। জেঠীমার সাথে কথা শেষ করে ভাইয়া আমার পাশে এসে বসলেন। অনেকদিন পর রিকশায় ভাইয়ার পাশাপাশি বসলাম। অন্যদিন হলে হয়ত খুব সংকোচ লাগতো। কিন্তু অসুস্থতার কারনে এসবে খুব একটা ধ্যান নেই আমার। ভাইয়া রিকশাওয়ালা মামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
- মামা চলেন।
আপন গতিতে রিকশা চলতে শুরু করলো। কালকের বৃষ্টির আবেশ এখনও আকাশে বিদ্যমান। তাই আকাশে রোদের তেজ নেই একদমই। হিমেল বাতাস আমার জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীরে আরো কাঁপুনির সৃষ্টি করছে। আচমকা রিকশায় ব্রেক কষতেই আমি বেসামাল হয়ে গেলাম। প্রায় পড়ে যাবার উপক্রম হতেই ভাইয়া আমাকে ধরে ফেললেন। করুন গলায় বললেন,
- কিরে? খুব কি খারাপ লাগছে? আরেকটু হলেই তো পড়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল।
জ্বরের জন্য মাথাটা বেশ ভারী ভারী লাগছে। চোখ খুলে রাখতেও যেন বড্ড কষ্ট হচ্ছে। খুব বেশি অসুস্থ বোধ করছি তাও ছোট করে জবাব দিলাম, - উহুম।
ভাইয়া রিকশার হুট তুলে দিয়ে আমার দিকের হুটটা ধরে বসলেন আমাকে একপ্রকার বাঁধ দিতে। উনার হাতটা আমার সামনে দিয়ে হুট আঁকড়ে রয়েছে যেন হঠাৎ ব্রেকে আমায় আর বেসামাল হতে না হয়। হুট লাগলোর কারনে অনেকটা কাছাকাছি এসে গিয়েছি ভাইয়ার।
এখন খুব অস্বস্তি লাগছে এতোটা কাছাকাছি বসতে। এটা উনি বুঝতে পারছেন কিনা জানি না। তবে অস্বস্তিটা বেশিক্ষণ রইলো না আমার মাঝে। জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীর নেতিয়ে যাচ্ছে তাই এসব ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী রইলো না মগজে। হঠাৎ হালকা গলায় ভাইয়া বললেন।
- তুই এবার আমার হাতটা ধরে বস। অসুস্থ শরীরে রিকশা থেকে পড়ে গেলে অন্য ঝামেলা হবে।
কোনো জবাব না দিয়ে আমার তপ্ত দুই হাতে উনার শীতল হাতটা আলতো করে ধরে চুপটি করে বসে রইলাম। মনে মনে খানিকটা লজ্জা বোধ করছি উনার হাত ধরে বসে থাকতে। আমার তপ্ত হাত যেন উনার হাতটা পুড়িয়ে দিচ্ছে। উনি শান্ত আর ক্লান্ত চোখে সামনে তাকিয়ে বাম হাতে আমায় বাঁধ দিয়ে রেখেছেন। কিছু সময়ের নিরবতার পর ভাইয়া গম্ভীর গলায় বললেন,
- আর কখনও একা আসবি না। আমাকে বলবি। তোকে যেমন নানার বাসায় দিয়ে এসেছিলাম, তেমন আমি গিয়ে তোকে নিয়ে আসবো।
ক্লান্ত কন্ঠে ছোট্ট করে জবাব দিলাম, - আচ্ছা।
লেখা – কথা চৌধুরী
চলবে
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “বেনামি চিঠি (১ম খণ্ড) – রোমান্টিক প্রেমের চিঠি” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – বেনামি চিঠি (২য় খণ্ড) – রোমান্টিক প্রেম পত্র