অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার – Obsessive Compulsive Disorder: কলেজ জীবনে আমার এক রুমমেটকে কিছুটা পাগল ভাবতাম আবার মাঝেমাঝে মেয়েও ভাবতাম কারণ এত গোছাগোছি বা পরিপাটি তো মেয়েরা করে! তার বিছানা কখনো অগোছালো থাকতো না, যদি বসার পর একটু ভাজ হতো তাহলে সাথেসাথে সে ওটা ঠিক করত। আবার টেবিলে বই যদি একটু এঙ্গেলে বা উল্টো থাকতো তাহলে সাথেসাথেই ঠিক করত। আমার এলোমেলো আর অগোছালো তার ভীষণ খারাপ লাগত কিন্ত কখনও বলত না।
অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার কি?
ছোট থেকেই দেখে আসছি একদল মানুষ বিশেষ করে মেয়েরা সাজানো গোছানো আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ব্যাপক সচেতন। অনেকের সচেতনতা লেভেল এতটাই বেশি যে তাকে শুচিবাই বলার থেকে পাগল বলা বেশি মানানসই মনে হয়। আমাদের আশেপাশে এমন মানুষের অভাব নাই। আমরা হয়তো অনেকে ভাবি এ অহংকারী বা মিশতে পারে না। কিন্তু কথায় আছে যার জ্বালা সেই বোঝে।
সে এটা এসেপ্ট করতে পারছে না তার গা জ্বালা করে অরুচি আসে। এখন আমি যদি আপনাকে পাবলিক টয়লেটে বসিয়ে এক প্লেট ভাত দেই তাহলে আপনার যেমন অরুচি আসাটা স্বাভাবিক ঠিক তেমনি তার কাছে অগোছালো, অপরিচ্ছন্নতা অরুচিকর।
যেহেতু এই ব্যাপারটা বেশিরভাগ মানুষের মাঝে নেই, কিছু সংখ্যক মানুষের মাঝে আছে তাই এটাকে মানসিক রোগ হিসেবে ধরা হয় যাকে সাইকোলজির ভাষায় বলা হয়- অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি বা শুচিবাই বলে অনেকে।
এই ওসিডি ভোগা মানুষের জীবন বেশ দুর্বিসহ কারণ যখন তখন যেকোন জায়গায় যেকোন সময় সে মানুষের সাথে চলতে বা মিশতে পারে না, হ্যান্ডশেক করতে চায় না। এক ধরনের একাকীত্ব ও যন্ত্রণায় ভোগে প্রতি মুহুর্তে, রিলেশন ও সংসার জীবনে অনেক অশান্তি ও ভুল বোঝাবোঝি হয়।
ভাড়া বাসা, মেসের রুম নোংরা তো তার অসস্তি ভাব, টয়লেট নোংরা তো তার অরুচি ও অসস্তি। হোটেলে বসবে তো সবার আগে খাবারে মাছি আর পরিবেশ দেখে তার অসস্তি বোধ হবে। পরীক্ষার খাতায় ভুল হয়েছে এক টানে কেটে লেখাতেও তার মন খারাপ, ইসস কেন ভুল হলো? সৌন্দর্যতা নষ্ট হয়ে গেল। ওসিডিতে ভোগা মানুষেরা সময় মত কাজ শেষ করার চাইতে পারফেকশনকে গুরুত্ব দেয় বেশি। আর তাদের প্রধান শত্রু হল যারা অগোছালো, অপরিচ্ছন্ন বা আনস্মার্ট। আপনার ভাই যত টাকা পয়সা আর ডিগ্রি বা চাকুরী থাকুক যদি তার কাছে আপনাকে ক্ষেত লাাগে তাহলে টাইম নাই। কারণ সে সব সহ্য করতে পারবে কিন্তু আপনার অপরিপাটি সহ্য করবে না। আপনার অগোছালো চুল কিংবা কোকড়ানো পোশাক আর কথা বলেই সে বুঝে যাবে আপনি কেমন। কারণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি মানুষেরা ব্যক্তি জীবনেও এমন এটা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে।
অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা
প্রথম দেখাতেই অনুমান করতে পারবেন যে সে ওসিডি ভোগা কিনা। এজন্য তার পোশাক দেখবেন পরিচ্ছন্ন ও ঘামগন্ধ মুক্ত, বারবার হাত ধোবে, কোন কিছু হলেই টিস্যু ব্যবহার করবে, আশেপাশের পরিবেশের দিকে চোখ রাখবে আপনাকে দেখার চেয়ে, কথায় কথায় ‘কখনও না’, ‘সব সময়’, ‘এখনই’, ‘খুব খারাপ’, ‘খুব ভাল’ ইত্যাদির জ্বোরসূচক শব্দ প্রচুর ব্যবহার করবে৷ এরা ঘরে লাইট সুইচ বন্ধ করে তালা মেরে বাইরে এসে ভাববে হায় হায় আমিতো মনে হয় সুইচ অফ করি নাই, তালা মারি নাই। এনিয়ে সে ব্যাপক চিন্তায় থাকবে। আর মনের ভয়তো আছেই, কেউ মনে হয় আমার পিছু নিয়েছে, কেউ মনে হয় আমার ক্ষতি করবে, ভুত মনে হয় জানালার পাশে ইত্যাদি নানা অহেতুক ভয়ে ভীত থাকে।
বলা হয়, নিউরোটিক ও মেন্টালির সবচেয়ে মারাত্নক রোগ হলো এই ওসিডি, যা অনেক রোগের সমাহার যেমন- উচ্চতার ভয়, রক্তের ভয়, একাকীত্বের ভয়, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার ভয়, অন্ধকারের ভয় থেকে শুরু করে প্রায় সকল মানসিক চিন্তিত ভয়, এক কাজ বারবার করা, অহেতুক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কাজ করা, অহেতুক সন্দেহ ও অবিশ্বাস করা, অতিরিক্ত গোছানো ও যাচাই-বাছাই করা, এক কথায় বেশিরভাগ মানুষ যেগুলো নিয়ে মাথাব্যথা নেই কিংবা সময় ব্যয় করে না ঠিক সেগুলোই এরা করে সময় অপচয় করে দিনশেষে সময় নিয়ে একটা হতাশায় ভোগে। কারণ এরা গোসল, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সাজানো গোছানোর জন্য দিনের একটা লম্বা সময় ব্যয় করে।
এক প্লেটে বা গ্লাসে খেতে গেলেও এদের মনে শত সংশয়। বলতে গেলে এই রোগে বেশ সংখ্যক মানুষ ছোট থেকে আক্রান্ত, যারা কিনা জীবনের একটা সময় কর্মে, মেসে বা হোস্টেলে থাকার অভ্যাস করতে গিয়ে এই ওসিডির মাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে ফেলে। কারণ মানসিক রোগের সহজ সমাধান হলো সেটার বিপরীতে কাজ করা, যেটা প্রথমে ভীষণ খারাপ লাগলেও একটা সময় বাধ্য হয়ে অভ্যস্থ হতে হয়। আর এভাবেই একে জয় করা যায়।
ওসিডি থেকে বাচার উপায়
এই রোগের চিকিৎসায় কাউন্সিলিং, থেরাপি বা ওষুধ বেশ কার্যকর। এটা তেমন ভয়াবহ অসুখ না তবে প্রভাব বেশ ভয়াবহ চিন্তা ভাবনাগুলোকে একটু উপলব্ধি দিয়ে বদলাতে পারলেই সফলতা সম্ভব।
তামিল একটা মুভি (Mahanubhavudu) দেখেছিলাম যেখানে নায়ক ওসিডি আক্রান্ত যার কারণে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে তাল মেলাতে অনেক সমস্যা এবং নায়িকার বাবা তাদের বিয়েতে নারাজ। তো নায়ককে শেষমেষ নায়িকার গ্রামের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য ডাকা হয় এবং সে যেগুলো পছন্দ করে না সেগুলোই তার সামনে করানো হয় এভাবে তাকে নোংরা কাঁদায় নামিয়ে ভিলেনের সাথে ফাইট করে তার নায়িকাকে নিতে বলা হয়। ভালোবাসার টানে ওইসব মানসিক সমস্যার কোন টাইম নাই তা নায়ক প্রমাণ করে নোংরা কাঁদার মধ্যে ফাইট করে নায়িকাকে উদ্ধার করে, ব্যস সেদিন থেকে তার ভয় গায়েব সে সুস্থ্য মানুষ, ভাবছেন সিনেমায় সম্ভব কিন্তু পরে গুগল সার্চ করে দেখলাম এটা সত্যিকারের জীবন চরিত্রের উপর বেসড করে বানানো।
গত পর্বেই বলেছিলাম – সাইকোলজির ভাষায় ভালোবাসার মানুষ মানসিক রোগের প্রধান ওষুধ। আমাদের সবার উচিত যে মানুষগুলোকে এরকম ওসিডি টাইপের মনে হয় তাদের গ্রহণ করা, বুঝতে চেষ্টা করা। যদি কাছের মানুষ হিসেবে তাকে বদলাতে চান তাহলে ভালোবাসা ও সহমর্মিতা দিয়ে একটু করে অভ্যস্থতার দিকে নিয়ে যাওয়া। আপনিই পারেন আপনার কাছের মানুষকে স্বাভাবিক ও সুন্দর জীবন উপহার দিতে।।
লেখা- Nerjhor
আরো পড়ুন- একাকীত্বের ভয়