তুমি আমার প্রোপারটি – আই লাভ ইউ সোনা (সিজন ০২)

তুমি আমার প্রোপারটি – আই লাভ ইউ সোনা: সে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তার অন্য কোন দিকে আর কোন খেয়াল নেই। এমন কি আমি তার দিকে তাকানোর পরেও সে চোখ নিচে নামিয়ে নিলেন না। কেন জানি না ভেতর থেকে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। তাই আর সেখানে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে আমি আরিশার থেকে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে হাটা দিলাম। তখনি আমার হাত ধরে টান দিয়ে আরিশা বললো…


পর্ব ২০

রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রাজের গাড়ির দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছি আমি। রাজ কিভাবে পারলো আমাকে এভাবে চিনেও না চেনার ভান করে আমার থেকে সরে যেতে? ও বলেছিল ও আমাকে ভালোবাসে তাহলে এই কি ওর ভালোবাসার নমুনা? এভাবে কি কেউ কাউকে ভালবাসতে পারে? আমি ওকে মুখে হাজারবার ভালোবাসি না বলা সত্ত্বেও আজ বারবার ওর কাছে ফিরে আসতে চাইছি। তাহলে ও কেন আজ আমাকে এভাবে দূরে ঠেলে দিচ্ছে? কেন চিনেও না চেনার ভান করে পর হয়ে যাচ্ছে আমার থেকে?

কথাগুলো মনে মনে ভাবছি আর এক নজরে তাকিয়ে আছি ফাঁকা রাস্তার দিকে। কারন ততক্ষণে রাজের গাড়ি চেখের আড়াল হয়ে গেছে। হঠাৎ আমার হাতে টান অনুভব করায় রাস্তার মাঝখান থেকে সাইটে এসে দাঁড়ালাম আমি। তারপরে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলাম একটি মেয়ে আমার দিকে রাগি ভাবে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি রাগি গলায় বলে উঠলো,

~ এই মেয়ে তোমার কি কোন বুদ্ধি সুদ্ধি নেই? রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে আছো! আর একটু হলেই তো গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা যেতে। খেয়াল করেছো একবার তোমার পাশ থেকে যে গাড়ি আসছিল? এখন আমি ঠিক সময় না আসলে কি হতো বলতো?

মেয়েটির কথায় সামনের দিকে ফিরে তাকালাম আমি। তার পর খেয়াল করলাম সত্যিই আমি একদম রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর আমার পেছন থেকে একটি গাড়ি দ্রুতগতিতে ছুটে আসছিলো আমার দিকে, একটুর জন্য হয়তো বেঁচে গেছি আমি। এই মেয়েটি আমায় না বাঁচালে হয়তো এখনি আমাকে হাসপাতালে থাকতে হতো। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললাম,
~ সরি, আসলে আমি খেয়াল করিনি।

এবার মেয়েটা নিজেকে কিছুটা শান্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ নাম কি তোমার?
~ জ্বি, আমার নাম রাহি।

~ তোমার নামের মত তোমাকেও বেশ মিষ্টি দেখতে। আমি আরিশা, এই কলেজেই পড়ি। তুমিও কি এখানেই পড়ো?
~ হুমম আমি এবার ফাস্ট ইয়ারে।

~ আরে আমিও তো সেইম। বাট তোমাকে তো এখানে দেখিনি আগে? আর তুমি এভাবে রাস্তার মাঝখানেই বা দাঁড়িয়ে ছিলে কেনো? আমি যদি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে না আসতাম তাহলে তোমার কি হতো বলোতো?

আরিশার কথার উত্তরে আমি ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলাম,

~ মরে যেতাম, এটাই তো? মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না। আমার সাথে যে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর চাইতেও কষ্টদায়ক সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। যেটা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে আমার সজন্যে।
আমার কথা শুনে আরিশা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,

~ এমন কি ঘটছে তোমার সাথে? যে তুমি মরতে চাইলেও সেটাকে কষ্টদায়ক মনে করছো না?
আমি আরিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,

~ তেমন কিছু না, বাদ দাও সে সব। এখন বলো তোমার বয়ফ্রেন্ড কোথায়? যার সাথে তুমি এখানে দেখা করতে এসেছিলে?
আমার কথার উত্তরে আরিশা এদিক-ওদিক একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,

~ আরিয়ান হয়তো চলে গেছে। ও কি আর জানত যে আমি আবার ব্যাক করে ওকে এখানে খুঁজতে আসবো? জানলে ও এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতো।
~ আরিয়ান মানে, কোন আরিয়ান?

~ আরিয়ান চৌধুরী! চৌধুরী গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এর একমাত্র মালিক আরিয়ান চৌধুরি। ও’ই আমার বয়ফ্রেন্ড।

আরিশার কথা শুনে যেন বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল আমার। অসম্ভব শূন্যতা অনুভব করতে লাগলাম আমি। তবে কি আরিয়ান বলতে কার কথা বলছে আরিশা? রাজ ওর বয় ফ্রেন্ড হয়? তবে কি সত্যি ওগুলো আমার স্বপ্ন ছিল? রাজ আমায় ভালোবাসে না? তাহলে আরিশা কে ও ভালোবাসে? এসব হাজারো চিন্তা যেন মাথার মধ্যে এসে ভর করল আমার। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। ইচ্ছে করছে সারা দুনিয়ার সবকিছু ভেঙেচুরে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেই। এমনটা কেন হচ্ছে আমার সাথে? আমি দু পা পিছিয়ে গিয়ে কলেজের গেটের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কেন জানিনা হাত-পা থরথর করে কাঁপছে আমার। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা মুখ দিয়ে কোন কথা আসছে না আমার। আরিশা আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল,

~ আর ইউ ওকে রাহি? তোমার কি কোথাও কষ্ট হচ্ছে? তুমি এমন করছ কেন?

আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলাম। তারপর আরিশার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ আমাকে একটু ধরে ক্লাস রুমে নিয়ে যাবে আরিশা? আমার ভালো লাগছে না কিছু শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।

আরিশা আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে আমার হাত নিজের কাধের ওপর আলতো করে ধরে নিয়ে ক্লাসে একটি বেঞ্চে বসিয়ে দিল। আরিশার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ সময় এর পরিচয়ে যেনো সম্ভব আপন মনে হচ্ছে ওকে আমার। আরিসা আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,

~ চিন্তা করো না রাহি। আমাদের সাথে যেটা হয় সব সময় ভালোর জন্যই হয়। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করো।

আরিশার কথার অর্থ আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। ও কি বিষয়ে আমাকে চিন্তা করতে না করছে? আর কি এমন ভালো হবে আমার সাথে? তবে সেটা চিন্তা করার মত অবস্থাতেও এখন আমি নেই। আমার মনের মাঝে শুধু একটা কথাই বার বার দোল খাচ্ছে যে একটি স্বপ্ন কিভাবে বাস্তবের সাথে এতটা মিলে যেতে পারে। স্বপ্নের মানুষ গুলো কিভাবে বাস্তবে এভাবে ফিরে আসতে পারে। সবকিছু যেন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আমার। এসব কিছুর উত্তর যে করেই হোক আমাকেই খু্ঁজে বের করতে হবে।

কথাগুলো মনে মনে বলে যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে নিলাম আমি। তারপর আর আরিশার দিকে তাকিয়ে বললাম,

~ তুমি চিন্তা করো না আমি এখন অনেকটাই সুস্থ আছি। আসলে তখন কি হয়েছিল নিজেও জানিনা। এনিওয়ে তোমার সাথে পরিচয় হয়ে অনেক ভালো লাগলো।
আমার কথা শুনতেই আরিশা চট করে বলে উঠলো,

~তাহলে আর দেরি কিসের চলো এক্ষুনি আমরা ফ্রেন্ড হয়ে যাই। আইমিন বেস্ট ফ্রেন্ড! কি হবে তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড?
~ উয়াই নট, অবশ্যই।

এভাবে অনেকটা সময় নিয়ে বসে গল্প করলাম আমরা। তারপর ক্লাসে স্যার ঢুকতেই সবাই যার যার মতো ক্লাসে মনোযোগ দিলাম।

কলেজ টাইম শেষে আমি আর আরিশা একসাথে কলেজের গেট দিয়ে গল্প করতে করতে বের হয়েছি বাসায় ফিরব বলে। হঠাৎ সামনে থেকে কয়েকটি বাজে ছেলে এগিয়ে এসে ঘিরে ধরে আমাদের। তাদের মধ্যে থেকে একটি ছেলে বলে ওঠে,

~ হাই বেবিস কোথায় যাচ্ছ তোমরা? চলো আমরা তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি।

কথাটি বলেই আমার আর আরিশার হাত চেপে ধরে ছেলেটা। সাথে সাথে আরিশা নিজের হাতটা ওর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঠাস করে ছেলেটির গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। তারপর রাগী গলায় বলে ওঠে,

~ আপনার সাহস হলো কি করে আমাদের হাত ধরার? নেক্সট টাইম এমন কিছু করলে খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম।
আরিশার হাতে থাপ্পড় খেয়ে ছেলেটার রাগে চোখ মুখ নাক সব লাল হয়ে গেল। তার এমন রাগ দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। কিন্তু আরিশার মাঝে ভয়ের চিহ্নটুকুও নেই। আমি কেঁপে কেঁপে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে কোন কথা আসছে না আমার। ছেলেটি আরিশার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলো,

~ তোর সাহস হয় কিভাবে আমার গায়ে হাত তোলার? তুই জানিস আমি কে? এই এলাকার সবাই আমায় এক নামে চেনে। আমি এখানকার নাম্বার ওয়ান মাফিয়া। আমার কাকা এই এলাকার একজন প্রভাবশালী লোক। আর তোর এত বড় সাহস তুই আমার গায়ে হাত তুললি? তোকে তো আজকে আমি।

কথাগুলো বলেই আরিশার গালে থাপ্পড় মারার জন্য হাত তুলল ছেলেটি। সাথে সাথে কেউ একজন এসে ছেলেটির হাত ধরে ফেলে সজোরে একটি লাথি মেরে দিল তার পেটে। ছেলেটি ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে গেল। সাথে সাথে তার সাথে থাকা ছেলেগুলো এবার সেই আগুন্তক এর উপর ঝাপিয়ে পরল। আমি ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখতে পেলাম উনি আর কেউ নয়, উনি হলো রাজ, আমার রাজ। আমি হা করে তাকিয়ে থেকে সবকিছু দেখতে লাগলাম। আরিশাও আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। এবার আরিশার চোখে জল টলমল করছে স্পষ্ট। হয়তো আরিশাও এবার বেশ ভয় পেয়েছে।

রাজের সাথে বেশ ভালই লড়াই শুরু হলো ওই বখাটে ছেলে গুলোর সাথে। আমরা পাশে দাড়িয়ে শুধু চুপটি করে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম ঐ বখাটেদের মাঝে একটি ছেলে পকেট থেকে একটি ছোট ছুড়ি বের করে রাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে আর সহ্য করতে পারলাম না আমি। ছুটে গিয়ে ছেলেটির হাত ধরে ফেললাম। ফলস্বরূপ ছেলেটির ছুরির আঘাতে অনেকটা হাত কেটে গেল আমার।

আমার হাত কেটে যাওয়া দেখতেই আরিশা আমার নাম ধরে চিৎকার করে উঠল। সাথে সাথে রাজ আমার দিকে ফিরে তাকাল আর তাকিয়ে আমার হাতের ক্ষত স্থান দেখে আর ওই ছেলেটির হাতে ছুড়ি দেখতেই যেন চোখ মুখ লাল এবং হিংস্র হয়ে গেল রাজের। অদ্ভুত ভাবে ছুটে এসে সেই ছেলেটিকে ধরে এলোপাথাড়ি মারতে লাগল রাজ।

এমন ভাবে মারতে লাগল যেন আজ ওকে মেরে ফেলে তারপরেই শান্তি হবে ও। এদিকে ওকে থামানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগলো আরিশা। কিন্তু রাজের মাঝে যেন সে খেয়াল নেই। একদম পাগলের মত ছেলেটাকে মারতে শুরু করেছে রাজ। এটা দেখে বাকি ছেলেগুলো দৌড়ে পালিয়ে গেছে অনেক আগেই। আমিও অবাক চোখে তাকিয়ে আছি রাজের এই হিংশ্র রুপের দিকে। ঠিক এমন রুপটাই যেনো আমি সেদিন রাতে দেখেছিলাম।

এদিকে রাস্তার মাঝখানে এমন মারামারি করতে দেখে আশেপাশে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেল। বেশ কিছু লোক এসে রাজ কে থামিয়ে ফাঁকে সরিয়ে নিল। কিন্তু রাজ যেন থেমে যাওয়ার পাত্র নয়। সে চিৎকার করে বলতে লাগল,

~তোর এত বড় সাহস তুই আমার জানের গায়ে হাত দিয়েছিস? তোর সেই হাত আমি টুকরো টুকরো করে কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়াবো। তোর এত বড় সাহস তুই আমার প্রপার্টিতে হাত দিয়েছিস। তুই জানিস তোকে আমি কি করবো? ছাড়ুন আপনারা আমায়, আজ আমি ওকে শেষ করে তারপরে ছাড়বো। চেনে না ও, আমি কে?

রাজের এমন হিংস্র রূপ দেখে এবার ছেলেটি ভয়ে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে দ্রুত ভির এর মধ্য থেকে পালিয়ে গেল। তবুও যেন রাজকে কোন ভাবেই শান্ত করা যাচ্ছে না। তখনই আরিশা এগিয়ে গিয়ে রাজের সামনে দাঁড়িয়ে ওর দুই হাতের মধ্যে হাত গুজে বলল,

~ প্লিজ আরিয়ান শান্ত হও। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করো। নিজেকে কন্ট্রোল করো। ভুলে যেও না তুমি কি করছো এসব। আর তুমি এখন কোথায় আছো।

আরিশার কথাতে হালকা শান্ত হলেও যেনো চোখ দুটো লাল টকটকে আর হিংস্র হয়ে আছে রাজের। আশেপাশের মানুষ অনেকটা ভিতু চোখেই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও সেদিকে তোয়াক্কা না করে আরিশা কে বলল,

~ মেয়েটিকে গাড়িতে তোলো ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।

আরিশা এবার যেন একটু শান্তির নিশ্বাস ছাড়লো। তার পর আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার কাটা হাতের জায়গায় চেপে ধরে বলল,
~ তাড়াতাড়ি চলো তোমার এখানে ব্যান্ডেজ করতে হবে। নইলে রক্ত বেশি পড়ে গেলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে।

আমি কোন কথার উত্তর না দিয়ে আরিশার সাথে যেতে লাগলাম। তারপর গাড়িতে উঠে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে রাজ আমাদের একটি বড় ক্লিনিকের সামনে নিয়ে গাড়ি দাঁড় করালো। তারপর আরিসা আমার হাত ধরে নিয়ে ক্লিনিকের ভিতরে প্রবেশ করল। আমাকে নিয়ে ভিতরে যেতেই একজন মহিলা ডাক্তার ছুটে এলেন আমার পাশে। তারপর বললেন,
~ এ কি কি হয়েছে ওর হাতে? অনেক রক্ত বের হচ্ছে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার করতে হবে ওকে নিয়ে এসো।

ডাক্তারটি এমন আচরণ করতে লাগল যেন সে আমাকে আগে থেকেই চেনে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই একটি কেবিনে নিয়ে গিয়ে চেয়ারের ওপর বসানো হলো আমায়। তারপর ডাক্তার অনেক যত্নসহকারে আমার হাত পরিষ্কার করে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
~ এখন কেমন লাগছে তোমার মামনি?

ওনার এমন আচরণে বেশ কিছুটা অবাক হলাম আমি। তাই ওনার দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
~ জ্বি ঠিক আছি আমি। কিন্তু আপনি কি আমাকে আগে থেকে চেনেন?
উনি আমার কথায় মুচকি হেসে বললেন,

~ চিনতাম না, তবে এখন থেকে চিনি। তুমি আমার আরিশার বন্ধু তাই না? এই যে এই মেয়েটিকে দেখছো? এটা আমার’ই মেয়ে। ও ফোনে আগেই তোমার কথা বলেছিলো আমায়।


পর্ব ২১

~ চিনতাম না, তবে এখন থেকে চিনি। তুমি আমার আরিশার বন্ধু তাই না? এই যে এই মেয়েটিকে দেখছো? এটা আমার’ই মেয়ে। ও ফোনে আগেই তোমার কথা বলেছিলো আমায়।

আমি ওনার কথা শুনে বেশ কিছুটা অবাক হলাম। কেন না পুরোটা রাস্তা আমি একবার এর জন্যেও আরিশাকে ফোন হাতে দেখি নি। এমনকি কলেজে থাকাকালীনও। তাহলে ও ফোন কখন করলো ওর আম্মুর কাছে? তাই আমি কিছুটা ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ কিন্তু আরিশাকে তো আমি মোবাইল হাতে একবারের জন্যও দেখিনি আন্টি। তহলে ও আপনাকে কিভাবে মোবাইলে আমার কথা বলল?

আমার কথা শুনে যেন কিছুটা ইতস্ততায় পড়ে গেলেন ডাক্তার আন্টি। উনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনি এখন কি বলবে সেটা ভেবে পাচ্ছেনা। তখনই আরিশা পাশ থেকে বলে উঠলো,

~ আরে বাবা আমি আম্মুকে মেসেজ করে দিয়েছিলাম। ডাইরেক্ট ফোন করেছি নাকি? কিন্তু তুমি এত জিগ্যেসাবাদ করছো কেনো বলোতো?

ওর কথায় আমি মুচকি হাসলাম। কোন উত্তর দিলাম না। কারন ম্যাসেজ ও দিতেই পারে। তবে মেসেজ দেয়াতে যে এভাবে আন্টি আমাকে চিনবে আর মামনি বলে ডাকবে সেটা আমার ভাবনার বাহিরে ছিলো। তাই একটু অবাক হলাম আমি। কিন্তু ওদের বুঝতে দিলাম না।

হঠাৎ আমার চোখ পড়ল দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, মাথা নিচের দিকে দিয়ে, বুকের সাথে দুই হাত গুজে দাঁড়িয়ে থাকা রাজের দিকে। আর ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর মনটা ভীষণ খারাপ। চোখ বন্ধ করে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরিশা এবার ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে বলল,

~ কি হল আরিয়ান এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? অবশ্য শরীর খারাপ লাগতেই পারে যতটা মারামারি করেছো রাস্তার মাঝখানে। সত্যিই তুমি এত রাগী না কি বলবো?
আরিশার কথায় ওর দিকে ফিরে তাকাল রাজ। তারপর গম্ভির গলায় বলে উঠলো,

~ কি করবো বলো, তুমিতো ভালো করেই জানো আমার জান আমার প্রপার্টির ওপর অন্য কেউ হাত বা নজর দিলে সেটা আমি কখনোই সহ্য করতে পারি না। ইচ্ছে করে তাকে খুন করে ফেলি। সেটা তো তোমার চাইতে বেশি আর কারো জানার কথা নয়, তাই না আরিশা?

আরিশা শুধু মুচকি হাসল কোন উত্তর দিল না। তবে আমার মনের মাঝে কেন জানিনা রাজের কথাগুলো অন্য ভাবে আঘাত করল। কেন যেন মনে হচ্ছে রাজ জান ও নিজের প্রপার্টি বলতে আমাকেই বোঝাচ্ছে। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব হবে, রাজ তো একবারের জন্য আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এমনকি যখন আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসলো তখন ও আরিশাকে আমায় মেয়েটাকে বলে সম্মধন করে ছিল।

আমার নাম বলে একবারের জন্যও ডাকেনি। হয়তো সত্যিই আমি সব স্বপ্নেই দেখেছি। ওগুলো সব আমার কল্পনা ছিলো। বাস্তবে সাথে কল্পনার মিলে গেছে ঠিক। কিন্তু তার সাথে বাস্তবের কোন ভ্যালু নেই। আমি শুধু শুধুই তাকে নিয়ে এত ভাবছি।

কথাগুলো মনে মনে বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম আমি। আর মনে মনে শপথ করলাম এখন থেকে আর রাজ কে নিয়ে কোন কিছু ভাববো না। আই মিন আরিয়ান চৌধুরীকে নিয়ে আর কোন কিছু ভাববো না। সে আমার বান্ধবীর হবু স্বামী তাকে নিয়ে ভাবা নিতান্তই বোকামি আর পাপ ছাড়া কিছু নয়। স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না।

বেশ অনেকক্ষণ সময় ধরে চেয়ারের উপর মাথা নিচের দিকে দিয়ে বসে আছে রাজ। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। চোখ গুলো ভীষণ লাল রঙের হয়ে আছে। মুখটাও রূপ নিয়েছে অসম্ভব হিংস্রতার। চুলগুলো এলোমেলো একদম পাগলের মত লাগছে দেখতে তাকে। আরিশার আম্মু এসে রাজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠেন,

~ আরিয়ান নিজেকে শান্ত করো বাবা। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। তুমি মনে রেখো তুমি কোন মিশনে নেমেছো। আর যেটা তুমি করছো সেটার পিছনের কারন। তাই এতোটা ভেঙে পড়লে কখনোই তুমি সফল হতে পারবে না।

~ কিন্তু আমি কি করবো আন্টি। আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না। আমি কিভাবে নিজের চোখের সামনে অন্য মানুষ আমার জানের সাথে বাজে আচরণ করবে আর সেটা আমি সহ্য করবো? আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। ওই ছেলেগুলোকে যে পর্যন্ত মেরে না ফেলবো সে পর্যন্ত নিজেকে কন্ট্রোল করা অসম্ভব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে আন্টি। ওরা আমার প্রপার্টিতে হাত দিয়েছে। আর আমার জিনিসে যারা হাত দেওয়ার চেষ্টা করে তাদের হাত কেটে না নেওয়া পর্যন্ত আমি শান্ত হতে পারিনা। Because she is just my property.

কথাগুলো বলেই যেন আরো বেশি রাগে ফুসতে লাগলো রাজ। অসম্ভব ভয়ানক হয়ে উঠল ওর চেহারা। যেন এখনই ছুটে গিয়ে ওই ছেলেগুলো কে নিজে হাতে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে সে। ওকে এভাবে রেগে যেতে দেখে এবার আরিশা এসে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, ওর দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে নিলো। তারপর রাজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

~ আরিয়ান আমার দিকে তাকাও, একবার ভালো করে দেখো আমি একদম সুস্থ আছি। কিছু হয়নি আমার। এমন কি আমার বান্ধবী রাহিও ঠিক আছে। তাহলে তুমি কেনো এভাবে উত্তেজিত হচ্ছো। তোমাকে এখন যতটা সম্ভব নিজেকে কন্ট্রোল করে চলতে হবে। তুমি বেশ ভালো করেই জানো তুমি কি কাজে নেমেছো। আর সেটা পূরণ করতে হলে ধৈর্য্য ধরতে হবে তোমায়। এভাবে ধৈর্য্য হারিও না। তাহলে মাঝপথে সব শেষ হয়ে যাবে।

আরিশার কথা শুনে কোন উত্তর দিল না রাজ। বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থেকে আরিশার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাড়িয়ে শুধু একটা কথাই বলল,
~ আমি বাসায় যাচ্ছি আরিশা তোমার সাথে পরে কথা হবে।

কথাটা বলেই আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে বেরিয়ে গেল ক্লিনিক থেকে। তারপর গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে গেল বাসায়। রাহীকে অনেক আগেই আরিশা সাথে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছে। তবে রাজ ক্লিনিকেই ছিলো এতক্ষণ।

রাত ৯.০০ টা

খোলা চুলে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছি আমি। মাথার মধ্যে নানা রকম চিন্তা বারবার ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে আমার। হাতের ক্ষত স্থানে ও বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু সেই যন্ত্রণার চাইতেও এখন মনের যন্ত্রণা টা বেশি জ্বালাচ্ছে আমায়। কিছুতেই কোন কিছুই মিলাতে পারছি না।

সবকিছু যেন বারবার তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে। আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে হাতের ব্যান্ডেজ এর দিকে ফিরে তাকালাম আমি। ব্যান্ডেজ ভেদ করে রক্ত উপর পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে। স্পষ্ট রক্তের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে ব্যান্ডেজ এর ওপর।
আরিশা আমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর। নানা রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমায়। কিন্তু বাসায় এসে যখন আমি বলি সব ঘটনা তখন আরিয়ানের কথা শোনা মাত্রই সবাই চুপ হয়ে যায়।

কেউ আর একটা কথাও বলেনি। আর এটাই সবচাইতে বেশি চিন্তায় ফেলেছে আমায়। কেন তারা আরিয়ানের কথা শোনার পর আর কোন কিছু বললো না? তবে কি সবাই আমার সাথে মিথ্যে নাটক করছে? আরিয়ান’ই আসলে রাজ? আর সবাই মিথ্যে বলে আমার কাছে ওকে আরিয়ান হিসেবে প্রমান করতে চাইছে? কিন্তু এমনটা কেন করছে সবাই? কি এমন কারন লুকিয়ে আছে এর পেছনে?

এসব কথা ভাবতে ভাবতে যেন মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয়ে যাচ্ছে আমার। তবুও কোন কিছুই মেলাতে পারছি না আমি। বারবার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে। মন বলছে আমি যেসব ভাবছি সব সত্যি। কিন্তু ব্রেন বলছে সবই আমার মনের ভুল। ওগুলো শুধুই স্বপ্ন ছিল বাস্তবে তার কোন ভ্যালু নেই।

ভাইয়ার ডাকে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। তাকাতেই দেখলাম ভাইয়া গম্ভীরমুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়ার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে হয়তো কোন কারনে ভীষন বিষন্ন মনে রয়েছে। আমি ভাইয়াকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
~ কি হয়েছে? কিছু বলবে ভাইয়া?

ভাইয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
~ এখন তোর কেমন লাগছে রে পুচকি? তোর হাতের যন্ত্রণা কি একটু কমেছে? শরীর কেমন তোর?
হঠাৎ ভাইয়ার এভাবে কথা বলা শুনে কেন জানি না বুকটা কেঁপে উঠল আমার। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাইয়াকে হাত ধরে নিয়ে এসে খাটে বসিয়ে দিয়ে সামনে বসে বললাম,

~ আমি ঠিক আছি ভাইয়া একদম সুস্থ। কিন্তু তুমি হঠাৎ এভাবে মন খারাপ করে ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন? আর এমন প্রশ্নই বা করছো কেনো বলো তো ভাইয়া?

আমার কথার উত্তর না দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ভাইয়া বলল,

~ অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে খেতে আয়। তোকে ঔষধ খেতে হবে তো তাই না? খেয়েদেয়ে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়বি। তোর একটু ঘুমের প্রয়োজন।

কথাটা বলে আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল ভাইয়া। আমি অবাক হয়ে ভাইয়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কোন কিছুই আমার মাথায় ঢুকছেনা। সবার আচরণ যেন কেমন পাল্টে গেছে। সবাই অদ্ভুত আচরণ করে আমার সাথে। বুঝতে পারছি না এসব কিছুই আমার মনের ভুল নাকি সত্যি। কিছু ভালো লাগছেনা আর। তাই আর এত কিছু না ভেবে খাবার খাওয়ার জন্য রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।


পর্ব ২২

৭ দিন পর,

দুপুর ৩.০০ টা।

আমাদের বাসার ছাদের উপর বসে আছি আমি আর আরিশা। দুজনেই আলোচনা করছি কালকে কলেজে নবীনবরণ উৎসব এর বিষয়ে। আসলে নবীনবরণ উৎসবে যাওয়ার মতো কোন ইচ্ছাই নাই আমার। কেন জানি না একটুও যেতে ইচ্ছে করছে না আমার সেখানে। কিন্তু ভাইয়া আর আরিশার জোর করার কারনে অনিচ্ছা সত্যেও যেতে বাধ্য হয়েছি আমি। আর তার ওপর আলিশা জোর করে ধরেছে শাড়ি পরে যাওয়ার জন্য।

কিন্তু শাড়ি পড়াটা যে আমার কাছে অসম্ভব বিরক্তি লাগে সেটা ওকে কিভাবে বোঝাবো আমি। তবে আরিশা তো নাছোড়বান্দা। আমাকে শাড়ি না পরিয়ে ছাড়বেই না সে। আর এখন ওর আমাদের বাসায় আসার একটি কারণ আমাকে নিয়ে শপিং মলে গিয়ে পছন্দ করে শাড়ি কিনে আনা। যদিও আমার যাওয়ার একদমই ইচ্ছা নেই তাই সে এখন জোর করে আমাকে রাজি করানোর জন্য ছাদে নিয়ে এসেছে।

অনেক জোরাজুরির পর আর না করতে পারলাম না। তাই রাজি হয়ে গেলাম আমি। আমি রাজি হতেই আরিশা এমনভাবে লাফিয়ে উঠলো যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে ও।

~ ও রাহি তোমাকে অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ। তুমি জানো তুমি রাজি হওয়ায় আমি ঠিক কতটা খুশি হয়েছি! এখন দেরি না করে জলদি চলো তো রেডি হয়ে নাও। আমরা এখনই শপিংমলে যাব।

~ আরে এখনই শপিংমলে যাব মানে তুমি তো এই কিছুক্ষণ হলো আসলে। আর কিছুক্ষণ থাকি না তারপরে না হয় যাব! আর তাছাড়া তুমি আসার পরে কিন্তু এক কাপ কফি ছাড়া আর কিছু খাওনি। এখানে একটু বসো আমি নাস্তা নিয়ে আসছি। তারপরে না হয় যাব!

~ সে কথা বললে তো চলবে না রাহি। তাড়াতাড়ি চলো এমনিতেই অনেক লেট হয়ে গেছে। আর নাস্তা কেনো আমি তোমার এখানে ডিনার করে যাবো আজ কেমন?

আরিশার কথা শুনে খুশি হয়ে গেলাম আমি। আর হাসি মুখে বলে উঠলাম,
~ আচ্ছা ঠিক আছে তাই হবে। তাহলে চলো এখন রেডি হয়ে নেই।

দুজন মিলে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম শপিং মলের উদ্দেশ্যে। আরিশাকে দেখে অসম্ভব খুশি লাগছে। আমরা বাসা থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে বের হতেই দেখলাম একটি কালো রংয়ের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে। গাড়িটাকে দেখে আমার চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না। কারণ এটা আরিয়ানের গাড়ি।

আরিশার বয়ফ্রেন্ড আরিয়ানের গাড়ি এটা। গত 7 দিন হলো গাড়িটাকে এত বার দেখেছি যে মুখস্ত হয়ে গেছে গাড়িটার সব কিছু।

গাড়িটাকে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পা যেনো সেখানেই থেমে গেল আমার। আমি আর সামনের দিকে হাঁটলাম না। আমাকে থেমে যেতে দেখে আরিশা আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ কি হলো রাহি থেমে গেলে কেন? তাড়াতাড়ি চলো আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি আরিশার দিকে তাকিয়ে গম্ভির গলায় বলে উঠলাম,

~তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে কেন ডেকেছো আরিশা? আমরা দুজনেই চলে যেতাম!
~ আসলে কি বলো তো সারাদিন তো আরিয়ান কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই ঠিক করে আমার সাথে দেখা বা কথা বলতে পারেনা। যে কারণে সব সময় আমায় মিস করে ও।

আসলে অসম্ভব ভালোবাসে তো তাই। তাই যখনই চান্স পায় ছুটে আসে আমার সাথে সময় কাটাতে। আজকে নাকি ওর সময় ছিল আর যখন শুনেছে আমি তোমায় নিয়ে শপিং মলে যাব! তাখনই চলে এসেছে এত টুকু সময় আমার সাথে কাটাবে বলে। প্লিজ তুমি রাগ করোনা। চলনা তাড়াতাড়ি যাই ওর আবার সময় শেষ হয়ে যাবে।

আরিশার কথা শুনে আমি কোন উত্তর দিলাম না। মাথা নিচের দিকে করে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে হালকা করে নিশ্বাস ছাড়লাম। তারপর আরিশার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। কেন জানিনা আরিশাকে আরিয়ানের সাথে দেখলে আমার একটুও ভালো লাগে না। বুকের ভেতর কেমন যেনো হাহাকার করে। সব কিছু ফাঁকাফাঁকা লাগে। যেন অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি আমি। গত সাত দিনে আরিয়ানের সাথে অসংখ্য বার দেখা হয়েছে আমার কিন্তু কখনোই দুজনের মাঝে দুই একটা কথাও হয়নি।

যখন’ই দেখা হয়েছে সে আরিশাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল। দেখেই বোঝা যায় সে হয়তো আরিশাকে অনেক ভালবাসে। কিন্তু কেন জানি না ওদের ভালোবাসাটা দেখে ভালো লাগলেও বুকের মাঝে সব সময় এক হাহাকার এবং ফাঁকা ফাঁকা অনুভুতি হয়। বারবার মনে হয় আমার ওসব স্বপ্ন ছিল না সত্যি ছিল। আর এই আরিয়ান’ই আমার রাজ, আমার স্বামী ও। যে আমায় পাগলের মতো ভালবাসতো। যার নাম শুধু আমার হাতেই নয়। আমার হৃদয় গহিনেও লেখা ছিলো।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই গাড়ির কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা।

কিন্তু আরিয়ানকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিনা। আরিশা এদিক ওদিক তাকিয়ে আরিয়ান কে খুঁজতে লাগল। তখন’ই গাড়ি থেকে ড্রাইভার নেমে এসে বলল,

~ ম্যাডাম স্যার আসেন নি উনি শপিংমলে আছেন। আপনাদের নিয়ে যেতে বলেছেন। কোন একটা জরুরি কাজ এর জন্য একটু দেরি হয়ে গেছে তাই উনি আসতে পারেনি।

ড্রাইভার এর কথায় মন কিছুটা মন খারাপ করলো আরিশা। তারপরে আবার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

~ আচ্ছা ঠিক আছে সমস্যা নেই, চলো রাহি।

তারপর গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। আর রওনা হলাম শপিং মলের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা শপিং মলের কাছে পৌছে গেলাম। তারপর আরিশার সাথে একসাথে শপিংমলের মাঝে প্রবেশ করলাম। বিশাল বড় শপিং মল এটা, ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় শপিং মল।

ভেতরে গিয়ে একটি শাড়ির দোকানে নিয়ে গেল আরিশা আমায়। তবে ও বারবার আশেপাশে আরিয়ানকে খুঁজছে। আর সাথে আমিও না চাওয়া সত্ত্বেও আরিয়ানকে খুঁজে চলেছি। জানিন না কেনো ওনাকে না দেখে আমারও ভীষণ খারাপ লাগছে। তবুও নিজের খারাপ লাগা ভালোলাগাটাকে আড়াল করে রেখে শাড়ি দেখার দিকে মনযোগ দিলাম।

বেশ অনেকগুলো দামী দামী শাড়ী বিছিয়ে রাখা হয়েছে আমাদের সামনে। সবগুলোই একটা একটা করে বেছে বেছে দেখছি আমি আর আরিশা। সবগুলো তখন’ই পাশে কারো উপস্থিতি অনুভব করলাম আমি। পাশে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলাম আরিয়ান এসে শাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখতেই যেন বুকের মাঝে ধুকপুকানি হাজার গুণ বেড়ে গেল আমার। কেন যেন ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল সাথে এক অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভুতি দোলা দিয়ে যেতে লাগলো মনে।

হঠাৎ আরিয়ানের কথায় ধ্যান ভাঙলো আমার। ও আমার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ হাই রাহি, কেমন আছো তুমি? আমি কি তোমাদের শাড়ি চুজ করতে হেল্প করবো? আমার চয়েজ কিন্তু এতটাও খারাপ নয়। সো একটা চান্স দিতেই পারো!

আমি ওনার কথায় বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। কী উত্তর দেবো কিছুই যেনো আমার পেট থেকে আর মুখ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। কেন জানিনা হাত-পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো আমার। উনি হয়তো আমার অস্বস্থিটা বুঝতে পারলেন। তাই হালকা মন খারাপ করে শুধু বললেন,

~ ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আমি কি আরিশাকে একটু ওদিকে নিয়ে যেতে পারি? মানে ওর সাথে আমার কিছু দরকারী কথা ছিল। তুমি ততক্ষণ একা একা শাড়ি চয়েজ করতে পারো প্লিজ।

আমি ওনার কথার কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা ঝাকালাম। এদিকে আমার সারা শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। বোরকার জন্য হয়তো বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মুখটা বারবার টিস্যু দিয়ে মুছছি আমি। উনি আমার কথার উত্তরের অপেক্ষা না করে আরিশাকে সাথে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই যেন অনেকটা স্বস্তি ফিরে পেলাম আমি। ধীরে ধীরে নিজেকে স্বাভাবিক করতে লাগলাম। আমি বুঝতে পারি না কেন আমার সাথে এরকম হয়। কি সমস্যা আছে আমার মধ্যে?

প্রায় 15 মিনিট হয়ে গেল একা একাই শাড়ি দেখছি আমি। কেন জানিনা শাড়ি দেখায় মন বসছে না। যে কারণে সামনে একশটার বেশি শাড়ি থাকা সত্ত্বেও একটাও চুজ করতে পারছি না। তখনই আমার সামনে এসে দাঁড়াল আরিশা আর আরিয়ান। দুজনের মুখেই মুচকি হাসি। আরিশা এসে আমার পাশে বসতে বসতে বলল,
~ কি হল কয়টা শাড়ি পছন্দ করলে রাহি?

ওর কথায় ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলাম আমি,

~ এখনও একটাও পছন্দ করতে পারিনি। কেনো জানিনা একটাও পছন্দ হচ্ছে না আমার।
কথাগুলো বলে মন খারাপ করে বসে রইলাম আমি। আমাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে ফিক করে হেসে দিল আরিশা। তারপর বলে উঠল,

~ এমন ছোট বেবিদের মতো ঠোঁট উল্টাতে হবে না রাহি বেবি। তোমার শাড়ি আমি পছন্দ করে দিচ্ছি ওয়েট।
কথাটা বলেই দোকানদারকে বলে আরো অনেকগুলো শাড়ি নামালো আরিশা আমার সামনে। সব গুলোর মধ্য থেকে একটি হলুদ শাড়ি তুলে আমার হাতে দিয়ে বলল,
~ দেখো তো এই শাড়িটা কেমন লাগে?

আমি দেখে শুধু মাথা ঝাকালাম ভালো-মন্দ কিছুই বললাম না। আরিশা ওটা ফেলে রেখে এবার একটা কলা পাতা কালার অনেক সুন্দর একটি শুতি শাড়ি আমার কাছে দিয়ে বললো,

~ দেখো তো এইটা কেমন লাগে? এটাতে তোমায় অনেক সুন্দর মানাবে।
এবারকার শাড়িটা বেশ পছন্দ হলো আমার। শাড়িটা হাতে নিয়ে আমি বলে উঠলাম,
~ বাহ শাড়িটা তো ভিষন সুন্দর! আমি এটাই নিবো।

আমার কথা শুনে এবার বেশ খুশিই হলো আরিশা। ও দোকানদারকে বলে দুইটা ঐ একি শাড়ি নিলো। আর বললো দুজন এক সাথে এক সাজে কলেজে যাবো কাল। শাড়ি দুটো কিনে নিয়ে ফিরে আসার সময় গেটের কাছে আসতেই হঠাৎ আরিশা বলে উঠলো,

~ তুমি এখানে একটু দাঁড়াও রাহি। আমি একটু দোকান থেকে আসছি। ওই দোকানে ভুল করে আমার ফোনটা ফেলে এসেছি।

কথাটা বলে আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরিশা চলে গেল সেই দোকানে। আমি গুটি গুটি পায়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম। আরিয়ানও শপিং মলের ভিতরেই ছিলেন। একটু পরে হাতে একটি শপিং ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলো আরিশা। তার সাথে আরিয়ানও। ওর হাতে শপিং ব্যাগ দেখে আমি জিগ্যেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ আবার শপিং ব্যাগ কেন? আবার কি কিনলে আরিশা?
আমার কথায় ও মুচকি হেসে বলল,
~ পরে বলব এখন চলো যাওয়া যাক!


পর্ব ২৩

ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছে আরিয়ান। আর পিছনের সিটে আমি আর আরিশা বসে রয়েছি। শপিং মল থেকে বের হতেই আরিয়ান নিজের ড্রাইভারকে কি একটা কাজে পাঠিয়েছে। তাই এখন নিজেকেই ড্রাইভার হতে হয়েছে তার। আমার সাথে বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে আরিয়ানের গাড়ির ভেতর থাকা আয়নার মধ্যে।

আর প্রতি বারই চোখাচোখি হওয়ার সাথে সাথে আরিয়ান নিজের চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিয়েছে। সাথে আমিও। সারাটা রাস্তা জুড়ে আমি আর আরিশা মিলে গল্প করেছি কালকের নবীনবরন উৎসবের বিষয়ে। তবে আরিয়ান একটা কথাও বলেনি পুরো রাস্তা জুড়ে। একদম চুপচাপ গাড়ি চালিয়েছে সে।

আমরাও তাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করিনি। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো গাড়ি। গাড়ি থামতেই নেমে পড়লাম আমি। আমার পিছু পিছু আরিশাও গাড়ি থেকে নেমে আসলো। আমি আরিশার হাত ধরে নিয়ে বাসার মধ্যে ঢুকতে গেলে আরিশা বলে উঠলো,

~ আমি এখন তোমাদের বাসায় যেতে পারব না রাহি। আমার বাসায় একটু জরুরী কাজ আছে। তুমি বরং যাও কাল দেখা হবে তোমার সাথে নবীনবরন উৎসবে।

আরিশার কথায় ওর দিকে রাগি চোখে তাকালাম আমি। তারপর গাল ফুলিয়ে বলে উঠলাম,

~ আরিশা এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। তুমি আমাকে নিয়ে শপিংমলে যাওয়ার আগে বলেছিলে তুমি আজকে আমার সাথে আমাদের বাসায় ডিনার করবে। তাহলে এখন কেন বাহানা করছো? আমি কোন কথা শুনতে চাই না তোমাকে এখনই আমার বাসায় আসতে হবে। আর রাতের ডিনার সেরে তারপর যাবে, তার আগে নয়।
আমার কথায় আরিশা এবার মাথা নিচের দিকে দিয়ে অসহায় ভাবে বলল,

~ প্লিজ রাহি বোঝার চেষ্টা করো, আমারও অনেক ইচ্ছা আছে তোমার সাথে ডিনার করা। কিন্তু কি করবো বল, সবসময় একটি না একটি ব্যস্ততা থেকেই থাকে। অন্য একদিন আসবো না হয়। প্লিজ রাগ করো না। আর তাছাড়া আরিয়ানও আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে দেখো। এখন ওকে ছাড়া এভাবে গেলে ও কি ভাববে বলো তো?

আরিশার এমন অসহায় ভঙ্গিতে কথা বলা দেখে আর কিছু বলতে পারলাম না আমি। তবে একবার আমি গাড়িতে বসে থাকা আরিয়ান এর দিকে তাকালাম। আর তাকাতেই যেন বুকের মাঝে কেঁপে উঠল আমার। কেননা আরিয়ান কেমন অসহায় ভঙ্গিতে মায়া ভরা চোখে আমার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক অব্দি ফেলছেন না সে। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেন জানি না আমার পুরো শরীর জুড়ে একটি শিহরন বয়ে গেল। এ শিহরণটা ভয়ের নাকি ভালোলাগার কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না আমি।

সে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তার অন্য কোন দিকে আর কোন খেয়াল নেই। এমন কি আমি তার দিকে তাকানোর পরেও সে চোখ নিচে নামিয়ে নিলেন না। ওনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এবার বেশ অস্বস্তি লাগতে লাগলো আমার। কেন জানি না ভেতর থেকে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। তাই আর সেখানে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে আমি আরিশার থেকে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে হাটা দিলাম। তখনি আমার হাত ধরে টান দিয়ে আরিশা বললো,

~ কোথায় যাচ্ছো রাহি, তোমার সাথে আমার আরো কিছু কথা আছে।

আমি আবার থেমে গিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
~ কি কথা আরিশা?

আমার কথার উত্তরে আরিশা একটি মিষ্টি করে হাসি দিয়ে নিজের হাতে থাকা শপিং ব্যাগ টা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

~ এতে তোমার জন্য একটি গিফট আছে রাহি। আমি শুধু তোমার জন্যই পছন্দ করে এটা কিনেছি। আশাকরি তোমার এটা ভাল লাগবে। আর তুমি এটা গ্রহণ করবে।

আরিশার কথা শুনে আমি একবার শপিং ব্যাগের দিকে আর একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ কিন্তু এসবের কি দরকার ছিল আরিশা? আমি তো এমনিতে ও একটা শাড়ি কিনে এনেছি!
~ মনে করো আমার পক্ষ থেকে এটা তোমার জন্য বন্ধুত্বের গিফ্ট। তাই এটা স্বাদরে গ্রহন করো।
ওর কথা শুনে আমি মাথা নিচের দিকে দিয়ে আস্তে করে বললাম,
~ কিন্তু আমিতো তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না আরিশা!
ও আবারো একটি মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,

~ কখনো সময় এলে আমি সেটা তোমার কাছ থেকে চেয়ে নেব। তখন কিন্তু না করতে পারবে না কেমন? এখন এটা রেখে দাও আমি আসছি। কালকে দেখা হবে। সকাল সকাল রেডি হয়ে কলেজে চলে এসো কেমন।
কথাটা বলে আমার কোন কথার উত্তরের আশা না করে দ্রুত গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল আরিশা। আরিশা গাড়িতে বসলেই আরিয়ান দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্থান ত্যাগ করল। যতদূর পর্যন্ত ওদের গাড়ি দেখা যায় আমি তাকিয়ে রইলাম গাড়িটার দিকে। তারপর চোখের আড়াল হতেই একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শপিং ব্যাগ দুটি হাতে নিয়ে বাসার মধ্যে প্রবেশ করলাম।

কলিংবেল চাপতেই আম্মু দরজা খুলে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকে হাটা দিলাম। হাটতে হাটতে ভাইয়ার রুমের সামনে আসতেই রুমের মাঝে থেকে ভাইয়ার কিছু কথা কানে এসে বেজে উঠলো আমার। ভাইয়া কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। আর তাকে বারবার এই কথাটা বলছে যে,
~ প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো আমি যখন তখন এভাবে তোমার কাছে আসতে পারি না। আর তুমিও ভুল করেও বাসায় আসবে না। রাহি যদি একবার বুঝে যায় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুমি তো সব বুঝতে পারছ নাকি?

ভাইয়ার এতোটুকু কথা শুনলেই যেন পা সেখানেই থমকে গেল আমার। আমি আরও একটু দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাইয়া অ্যাকচুয়ালি কার সাথে কথা বলে সেটা বোঝার জন্য। কিন্তু তখনই ভাইয়া হঠাৎ করে পিছন ঘুরে তাকালো আর তাকিয়ে আমায় দেখতেই যেন থমকে গেল সে। কোনো কথাই আর বলবো না। শুধু বলল,
~ আচ্ছা আ আমি এখন ফোন রাখছি। তোমার সাথে পরে কথা হবে।

বলেই ফোনটা কেটে দিলো ভাইয়া আমি ভাইয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভাইয়া ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে আমার পাশে এগিয়ে এসে বলল,

~ কিরে তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন পুঁচকি? শপিংমলে শপিং করা শেষ? দেখি কি কি কিনলি?
ভাইয়ার কথা শুনে আমি বেশ ভালই বুঝতে পারছি ভাইয়া আমাকে ফোনের ব্যাপারটা ভুলাতে চাইছে আর কথা ঘুরানোর জন্য এভাবে জিজ্ঞেস করছে। আমি ভাইয়ার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে শপিং ব্যাগ গুলো ওর হাতে তুলে দিয়ে বলে উঠলাম,

~ এগুলো দেখো সব এতেই আছে যা যা শপিং করেছি। আর তোমার ফোনটা একটু দাও তো!
আমার কথায় যেন ভাইয়া এবার অনেকটা ঘাবড়ে গেলো। বেশ কিছুটা ঘামও ঝরতে লাগল ওর কপাল বেয়ে। আমি আবারও বলে উঠলাম,

~কি হলো ভাইয়া আমার কথা বুঝতে পারোনি? তোমার ফোনটা একটু দাও।
ভাইয়া পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের কপালের ঘামটা মুছে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ ঘাবড়ানো কন্ঠে বলে উঠল,

~ আমার ফোন দিয়ে কি করবি তুই রাহি? কেবল বাইরে থেকে এসেছিস যা ফ্রেশ হয়ে নে। ফোন না হয় পরে নিস।
আমি এবার বেশ কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলাম,

~ তুমি তো কখনো ফোন চাইলে আমাকে মানা করো না ভাইয়া! তাহলে আজ কেন মানা করছ? দাওনা একটু তোমার ফোনটা আমার একটু দরকার আছে।
ভাইয়া এবার না চাইতেও নিজের ফোনটা বের করে আমার হাতে দিলো। আমি ফোনটা নিয়েই দ্রুত কল লিস্ট চেক করার জন্য ঢুকে পড়লাম। কল লিষ্ট এর প্রথমেই একটি নাম্বার ভেসে উঠলো চোখের সামনে। যে নাম্বারটি সেভ করা আছে রাইয়ান দিয়ে। আমি নাম্বারটা ভাইয়ার সামনে তুলে ধরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
~ ভাইয়া এই নাম্বারটা কার? আর এই রাইয়ান’ই বা কে?
আমার কথার উত্তরে ভাইয়া থতমত খেয়ে বলে উঠলো,

~ রাইয়ান আমার কলিগ। আমরা একসাথে জব করি। তুই হঠাৎ এসব নিয়ে পড়লি কেন বলতো পুচকি?
আমি ভাইয়ার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে সেই নাম্বারটায় ডায়াল করলাম। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে এই নাম্বারটা আর কারো নয় এটা রাই এর নাম্বার। আর ভাইয়া এতক্ষণ রাই এর সাথেই কথা বলছিল।

পুউউ পুউউ শব্দে বেশ কয়েকবার রিং বাজতেই ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হলো। কিন্তু আমি কোনো কথা না বলে একদম চুপ করে রইলাম ও পাশে কে আছে সেটা জানতে। ওপাশ থেকে একটি ছেলে কন্ঠ বলে উঠল,

~ কি হয়েছে রাকিব, আবার ফোন করলে কেন? হ্যালো হ্যালো রাকিব কি হলো কথা বলছো না কেনো?

ছেলেটার কথা শুনতেই আমি ফোনটা কেটে দিলাম। তার মানে আমার ধারণা ভুল ছিলো। সত্যি এটা ভাইয়ার কলিগ এর নাম্বারই হবে। আর ভাইয়া এতক্ষণ তার কলিগ এর সাথেই কথা বলছিলো। আমাকে ফোন কেটে দিতে দেখে ভাইয়া এবার বেশ রাগী গলায় বলে উঠলো,

~ কি হলো নিজেই ফোন করলি, আবার কথা না বলে কেটে দিলি কেন বলতো? আসলে তোর কি হয়েছে কি পুচকি? এমন কেন করছিস তুই?

ভাইয়ার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ফোনটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম আমি। কেন জানিনা আমি ওই ঘটনাগুলোকে স্বপ্ন হিসাবে মেনে নিয়েও মেনে নিতে পারছি না। যেন বারবার আমার মন বলছে এগুলো কোন কিছু স্বপ্ন ছিল না। সবই ছিল সত্যি যে সব কিছু আমার সাথে ঘটেছে। তাহলে সবকিছু কেন এত বদলে গেল? এসব ভেবে মাথা ধরে যাচ্ছে আমার। আর কিছু ভাবতে পারছিনা আমি। তাই শপিং ব্যাগ গুলো বিছানার পাশে রেখে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় চুপটি করে শুয়ে পড়লাম। কারো সাথে আর কোন কথা বলার ইচ্ছা হচ্ছে না আমার।

রাত দশটা

আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার। আম্মু আমাকে ডাকতে ডাকতে বেশ রাগী গলায় বলে উঠলো,

~ কি হলো রাহি এত ঘুমালে চলে? সেই শপিং মল থেকে আসার পরে তো আর রুম থেকেই বের হলে না। কি হয়েছে কি তোমার বলতো? তাড়াতাড়ি উঠো, উঠে ডিনার সেরে নাও অনেক রাত হয়ে গেছে। তারপর না হয় আবার ঘুমাবে।

আমিও আর কথা না বাড়িয়ে উঠে ওয়াশরুমে গেলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে ডিনার করতে চলে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর ডিনার সেরে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বিছানার পাশে আসতেই চোখ পরলো বিছানায় থাকা শপিং ব্যাগগুলোর দিকে। আমি গুটি গুটি পায়ে শপিং ব্যাগের কাছে এগিয়ে গিয়ে সেগুলো হাতে তুলে নিলাম। তারপর আরিশার গিফ্ট করা ব্যাগটা খুলে তার ভিতর থেকে একটি প্যাকেট বের করলাম। প্যাকেটটা খুলতেন ভিতর থেকে অনেক সুন্দর একটি নীল রঙের শাড়ি বের হয়ে এল। অসম্ভব সুন্দর দেখতে শাড়িটা। একদম মিলমিলে পাতলা তবে অনেকটা ঘনসুতার। যার কারণে পড়লে হয়তো পেট দেখা যাবে না। শাড়িটা দেখে অসম্ভব ভালো লাগলো আমার। সত্যিই আরিশার পছন্দটা অনেক সুন্দর।

শাড়ি টা আমি বেশ কয়েকবার এপিঠ-ওপিঠ করে দেখতেই শাড়ির ভেতর থেকে ঝনঝন শব্দে কিছু একটা নিচে পড়ে গেল। আমি নিচে তাকাতেই আরো বেশি অবাক হয়ে গেলাম। কেননা শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে জুয়েলারি রাখা আছে ভিতরে। চুরি, ঝুমকো, মালা, টিকলি সবকিছুই রাখা আছে এতে। আর সবগুলো জিনিস’ই অসম্ভব সুন্দর। খুব ভালো লাগলো আমার শাড়ি ও জিনিসগুলো দেখে। আমি সুন্দর করে আলমারিতে সব গুছিয়ে তুলে রেখে দিলাম। কোন একসময় পড়বো ভেবে। তারপর বাকি সব শপিং ব্যাগগুলোও আলমারিতে গুছিয়ে রেখে চুপচাপ এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।


পর্ব ২৪

সকাল ১০.১৫ টা মিনিট

আয়নার সামনে বসে কলেজের নবীনবরন উৎসবে যাওয়ার জন্যে রেডি হচ্ছি আমি। শপিং মল থেকে কেনা সেই কলাপাতা রঙের শাড়িটা পড়েছি। সাথে ম্যাচিং করা চুরি, কানে ঝুমকা পরেছি, গলায় চিকন একটি স্বর্ণের চেন ছাড়া বাড়তি কোনো কিছুই পড়িনি। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চোখে গাড়ো করে কাজল। চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। ব্যাস আর কোন সাজ নেই মুখে। কোনো রকমের মেকআপও করিনি আমি।

অতিরিক্ত সাজ একদমই পছন্দ করি না তাই এতোটুকুই যথেষ্ট মনে করলাম। পরিপূর্ন সাজগোজ হয়ে গেলে নিজেকে আর একবার আয়নায় ভালো করে দেখে নিলাম আমি। বেশ ভালোই লাগছে দেখতে আমায়। তারপর তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাসায় আমি ছাড়া কেউ নেই। ভাইয়ার সাথে সবাই যেনো কই গেছে। যদিও যাওয়ার আগে ভাইয়া বলেছিলো ওরা নানি বাড়ি যাচ্ছে তবে আমি জানি সেটা মিথ্যে ছিলো। তবে সেই ব্যপারে প্রশ্ন করার কোনো ইচ্ছে হয়নি আমার। তাই আর কথা বারাইনি আমি।

আরিশা সেই আধ ঘন্টা আগে থেকে ফোন করে করে আমায় জ্বালিয়ে মারছে। এতক্ষণে হয়তো গাড়ি নিয়ে গেটের কাছে পৌঁছেও গেছে ও। ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে বাইরে বের হলাম আমি। আর বাইরে বের হতেই দেখতে পেলাম সত্যিই আরিশা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে।
আমাকে বাসা থেকে বের হতে দেখে আরিশা গাড়ি থেকে নেমে আসলো।

আরিশাও আমার মত একই রকম সাজে সেজেছে। তবে ওর মুখে মেকআপ এবং গলায় একটি বড় হাড় এই দুটো জিনিস একটু বেশি পড়েছে আমার থেকে। আমার চাইতে অনেক বেশি সাজগোছও করেছে ও। অনেক ভালো লাগছে দেখতে ওকে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলাম,
~ মাশাআল্লাহ তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে আরিশা!

আমার কথা শুনে ও মুচকি হেসে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল,
~ তোমাকেও কিন্তু কম লাগছেনা রাহি। এই অল্প সাজেও তোমায় একদম পরীর মত লাগছে।
ওর কথায় মুচকি হাসলাম আমি। তবে কোন উত্তর দিলাম না। ও আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসলো। তারপর ড্রাইভারকে বললো কলেজে যাওয়ার জন্য। আমি গাড়ির মধ্যে বসে এদিক ওদিক আরিয়ানকে খুঁজতে লাগলাম। কেন জানিনা ওনাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে আমার। আরিশা হয়তো আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলে উঠল,

~ কাকে খুঁজছো রাহি? আরিয়ানকে? ও তো আজকে আমার সাথে আসেনি। আসলে আমাদের নবীন বরণ উৎসব এর গেস্ট হিসেবে সিলেক্ট করা হয়েছে আরিয়ানকে। তাই ও ঐখানে যাবে আর সেখানেই আমাদের সাথে দেখা হবে।

আরিশার কথার কোন উত্তর দিলাম না শুধু মুচকি হাসলাম আমি। তারপর বাইরের দিকে চোখ রাখলাম। বেশ কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা পৌছে গেলাম কলেজে। কলেজের গেটে পৌঁছাতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম আমরা। তারপর দুজনে একসাথে হাত ধরে কলেজের মধ্যে প্রবেশ করলাম। এর মধ্যে পুরো কলেজের মাঝে মানুষের আনাগোনা অনেকটাই বেড়ে গেছে।

সবাই নানা রকম সাজে সেজে এসেছে নবীন বরণ উৎসব এর জন্য। স্ট্রেজের উপর অলরেডি অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। আমি আর আরিশা গিয়ে পাশাপাশি দুটি চেয়ারের উপর বসে পড়লাম। স্ট্রেজে জুনিয়ার একটি মেয়ে নৃত্য করছে। সাথে আশেপাশের সবাই হাত হালি দিয়ে তাকে উৎসাহ দিচ্ছে সাথে আমিও। মেয়েটির নৃত্য শেষ হতেই একজন স্যার স্ট্রেজের ওপর এসে ঘোষণা করলেন আরিয়ান এসে গেছে। আমাদের কলেজের গেস্ট হিসেবে। ওনাকে সবাই স্বাগত জানিয়ে স্ট্রেজের উপর নিয়ে এসে বসানো হলো। আমি আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ সরাতে পারছি না।

নীল রঙের পাঞ্জাবিতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। যেনো কোনো প্রিন্স এর চাইতে কম নয়। আমার মতো কলেজের সকল মেয়েরই একি অবস্থা। সবাই যেনো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে তাকে।
আরিয়ান চোখে সানগ্লাস পরে আছে। যে কারণে উনার দিকে তাকিয়ে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা ওনি কোনদিকে তাকিয়ে আছে। তাই আমিও বেহায়ার মত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি তাকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ আরিয়ান গলাখাকারি দিয়ে উঠলেন। ওনাকে এভাবে গলা খাকারি দিতে দেখে কেন জানিনা মনে হল যে উনি আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এমনটা করলেন। তাই আমি দ্রুত লজ্জা পেয়ে ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম।

তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে অনুষ্ঠান দেখতে লাগলাম। একেক জন একেক রকম পারফরম্যান্স করছে। একটি ছেলের গান শেষ হওয়ার পর এবার স্যার স্ট্রেজে এসে আরিয়ানের নাম ঘোষণা করে বললেন ওনাকে গান গাইতে। ওনার নাম ঘোষণা করার সাথে সাথে আশেপাশের সবাই খুব জোরে চিল্লিয়ে উঠলো। কেউ কেউ আবার সিটি বাজিয়ে উঠলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। আমার পাশে আরিশা আছে কি নেই সেদিকে কোন খেয়াল নেই আমার। এখানে আসার পর একবার ও আরিশার সাথে কথা হয়নি আমার। কিন্তু সেদিকে আমার যেনো কোনো খেয়ালই নেই। তারপর আরিয়ান হাতে একটি গিটার নিয়ে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। চারিদিকে সবাই নিরব নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। তখন’ই আরিয়ান গিটার বাজিয়ে গান গাওয়া ধরল,

শুধু তোমায় ঘিরে,
শুধু তোমায় ঘিরে,
সিঁদুর রাঙা মেঘ করেছে দূরে
শুধু তোমার ছায়া মেঘের উপর
ঢেউ খেলে রোদ্দুরে।
অভিমানের আড়ি কেটে,
কোথায় তুমি যাচ্ছ হেঁটে
হৃদয়ের চিরকুটে তুমি খুব ডানপিটে।
আমি তোমার মান ভাঙাবো,
ভালোবাসার চোখ রাঙাবো,
মিষ্টি কোনো গান শোনাবো
গলার নরম স্বরে।
(বাকিটা নিজ দ্বায়ীত্বে শুনে নিয়েন)

ওনাকে এই গানটা গাইতে দেখে কেন যেন মনে হলো উনি গানটা আমার জন্যেই গাইছিলেন এতক্ষণ। গানটা শেষ হতেই আশেপাশের সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। অনেকে সিটি বাজিয়ে উঠলো। আর মেয়েরা তো পারলে এখন আরিয়ানের সাথে ডান্স করবে। আমি সেদিকে লক্ষ্য না করে পাশে ফিরে তাকালাম আরিশার দিকে। তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। কেননা আরিশা আমার পাশে নেই। আমি ওকে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগলাম।

কিন্তু একি ও তো কোথাও নেই! ওকে খু্ঁজতে সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম আমি। চারিদিকের কোথাও আরিশাকে দেখতে পেলাম না আমি। তাই আরিশাকে খুঁজতে খুঁজতে এবার কলেজের ভেতর প্রতিটা রুমে রুমে চেক করতে লাগলাম আমি। এভাবে করতে করতে লাইব্রেরীর পাশে একটি অন্ধকার রুমের সামনে পৌঁছাতেই কেউ একজন হ্যাচকা টান দিয়ে আমার হাত ধরে সেই রুমটার মধ্যে নিয়ে গেল। রুমটা পরিপূর্ণ অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

হাতে এভাবে হ্যাচকা টান পড়ায় অনেক জোরে চিৎকার করতে নিলাম আমি। আর তখনই সে আমার মুখটা খুব শক্ত করে চেপে ধরল। যার ফলে আমার মুখ দিয়ে শুধু উম উম শব্দ ছাড়া আর কোন কিছুই বের হচ্ছেনা। সে আমাকে সেভাবেই ধরে রেখে এবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস সে বলে উঠলো,

~ I love you, I love you so much. & I miss you so much jaan. আর কত পোড়াবে আমায়। তুমি বিহনে যে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি আমি প্রতিটা মুহুর্তে। please jaan come back my life.

ওনার কথাগুলো শুনে আমি আর নড়াচড়া না করে একদম চুপ হয়ে গেলাম। আমাকে চুপ হতে দেখে উনি আমার মুখের সামনে থেকে হাতটা সরিয়ে নিলেন। তারপর আমার গালে ছোট্ট করে একটি চুমু এঁকে দিলেন। তার পর উনি আমায় ছেড়ে সামনে দু পা এগোতেই আমি ওনার হাত ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলাম,

~ র রা রাজ….!

আমার কথার উত্তরে উনি কিছু না বলে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। তারপর আমার হাতটা নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে আলতো করে হাতে চুমু এঁকে দিলেন। সাথে সাথেই কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল আমার হাতে। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না এটা ওনার চোখের পানি। আমি কিছুক্ষণ নিজের হাতের ওপর অন্য হাত বুলিয়ে পানিটা স্পর্শ করলাম। তারপর ওনাকে ধরার জন্যে সামনে এগোলাম। কিন্তু আমি যখনই ওনাকে ধরার জন্য সামনে পা বাড়ালাম উনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন আমার সামনে থেকে। আমি অন্ধকার হাতড়ে ওনাকে পাগলের মতো এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু না ওনার চিহ্ন টুকুও কোথাও নেই।

ওনাকে না পেয়ে আমি দৌড়ে এবার ছুটে আসলাম বাইরে। তারপর স্টেজের কাছে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে যেন আরো বেশি অবাক হয়ে গেলাম আমি। কেননা আরিয়ান সেই আগের জায়গায় একি ভাবে বসে থেকে সকলের পারফরম্যান্স দেখছে। তাহলে আরিয়ান যদি এখানে হয় তাহলে আমার পাশে ওটা কে ছিল? ভাবতেই যেন মাথা ঘুরতে শুরু করলো আমার। আমি চুপটি করে একটি চেয়ার টেনে বসে আরিয়ানের দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলাম। ওর ভাব ভঙ্গি বোঝার জন্য। কিন্তু না ও এখন সকলের পারফরম্যান্স দেখতে ব্যস্ত।

আমার দিকে এক বারের জন্যও ফিরে তাকাচ্ছে না। তবে কি আমি ভূল ভাবছি? এটাও কি আমার স্বপ্ন ছিল? এসব ভাবতে ভাবতে আমার চোখ গেলো আমার হাতের দিকে। আর সেখানে স্পষ্ট কয়েক ফোঁটা পানির চিহ্ন দেখতে পেলাম আমি। তার মানে এটা আমার স্বপ্ন ছিল না! সবকিছুই বাস্তব ছিল। তার মানে সত্যিই রাজ আমার কাছে এসেছিল! তবে কি আরিয়ান রাজ নয়? রাজ কি তাহলে অন্য কেউ? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? রাজ যদি সত্যিই থেকে থাকে তাহলে এই আরিয়ান’ই আমার রাজ। কেননা আমি ওকে দেখেছি সব সময়। এ সবকিছুর উত্তর আমাকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতেই হবে। মনে মনে শপথ করলাম আমি।


পর্ব ২৫

সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিট
গত আধ ঘন্টা হল ছাদের ওপর এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারি করছি আমি। আর সব কিছুকে মিলানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু বারবার’ই যেন মাথার মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তবে আমি এটা শিওর হয়ে গেছি যে রাজ এবং রাই কে নিয়ে ঘটনাগুলো কোন কিছুই মিথ্যে ছিল না। বা আমার স্বপ্নও নয়, ওগুলো সব ছিল বাস্তব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাহলে এখন সবাই কেন আমার সাথে এমন করছে? শুধু সেটাই খুঁজে বের করতে হবে আমায়। আর সেটা আমি বের করেই ছাড়বো যে ভাবেই হোক না কেনো!

আর তার জন্যে মনে মনে সব প্ল্যান করাও হয়ে গেছে আমার। মনে মনে এসব ভাবছি আর এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করে চলেছি। যেভাবেই হোক সব কিছু জানতেই হবে আমায়। হঠাৎ ছাদের গেটের পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে দিকে ফিরে তাকালাম আমি। আর তাকাতেই দেখলাম ভাইয়া গেটের সাথে হেলান দিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ভাইয়া কে দেখে যেন মনের মাঝে নেচে উঠল আমার। কেননা এখন আমার ভাইয়াকেই প্রয়োজন। কারণ আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করার জন্যে প্রথম গুটি হিসেবে আমি ভাইয়াকেই ব্যবহার করব। তাই দ্রুত ভাইয়ার কাছে ছুটে গিয়ে ওর হাত ধরে বললাম,

~ তুমি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো ভাইয়া? আসো এদিকে আসো, তোমার সাথে আমার একটু জরুরী কথা আছে।
আমাকে এভাবে খুশি হয়ে ওর হাত ধরে টেনে আনতে দেখে বেশ কিছুটা অবাক হল ভাইয়া। সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমি সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে ছাদের এক কোনায় দাঁড় করালাম। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,

~ ভাইয়া দেখো আজকের পরিবেশটা কত সুন্দর তাই না? কি সুন্দর মিলমিলে ঠান্ডা বাতাস বইছে, আর কত সুন্দর একটি অর্ধো চাঁদ উঠছে আকাশে।
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভাইয়া একবার আমার কপালে আর একবার আমার গলায় হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলল,

~ এই তোর শরীর ভালো আছে তো পুচকি? তুই এমন করছিস কেন বলতো? তুই তো কখনো এভাবে খুশি হয়ে এমন ভাবে কথা বলিস না? আজ হঠাৎ কি হল তোর আর এই সন্ধ্যা বেলা কেন ছাদে দাঁড়িয়ে আছিস একা একা? ভূতে ধরলো নাকি তোকে?

ভাইয়ার কথায় আমি খিল খিল করে হেসে দিয়ে বলে উঠলাম,
~ ভুতে তো ধরেইছে তবে আজ নয় প্রায় একমাস আগে আর অনেকগুলো ভুতে। আচ্ছা বাদ দাও ওসব কথা! তোমার সাথে জরুরী কথা আছে আমার। আশা করি তুমি আমার কথাটা রাখবে প্লিজ।
~ কি কথা বল শুনছি?

~ ভাইয়া প্লিজ তুমি একটু আব্বু আর আম্মুকে বলোনা আমার একটা মোবাইল চাই। খুব আর্জেন্ট।
আমার কথা শুনে ভাইয়া বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ এটা কি সত্যিই তুই বলছিস রাহি? নাকি এটা অন্য কাউকে দেখছি আমি?
ভাইয়ার কথা শুনে মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলাম আমি,
~ বাহ রে ভাইয়া! এখন নিজের বোনকে ও তুমি চিনতে পারছ না?

আমার কথায় ভাইয়া মুচকি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
~ আরে ধুর পাগলী আমি কি সেটা বলেছি নাকি? আসলে আব্বু তোকে অনেকবার ফোন কিনে দিতে চেয়েছে, আমিও চেয়েছি। কিন্তু তুই সবসময় বলতিস তোর ফোনের প্রয়োজন নেই। ফোন নিয়ে শুধু শুধু সময় ওয়েস্ট করতে চাস না। তাহলে আজকে তোর হঠাৎ কি হলো বলতো যে এখন ফোন চাইছিস?

~ আমার একটা জরুরি প্রয়োজন ভাইয়া প্লিজ তুমি আব্বুকে বলে আমাকে একটি ফোনের ব্যবস্থা করে দাও। প্রয়োজন না হলে কি আমি চাইতাম বলো?
ভাইয়া আমার কথায় মুচকি হেসে বলল,

~ চল নিচে যাওয়া যাক! আর চিন্তা করিস না আমি আজকে রাতের মাঝেই তোকে ফোন এনে দেবো প্রমিস।

ভাইয়ার কথায় আমি খুশি হয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম। ভাইয়া ও মহা আদরে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিল। তারপর দুই ভাইবোন মিলে নিচে নেমে আসলাম।

রাত 9:30, আমি নিজের রুমে বসে বসে কলম মুখের মধ্যে দিয়ে নানা রকম চিন্তা করছি। কিভাবে কি করব সে সব নিয়ে। হঠাৎ ভাইয়া পিছন থেকে এসে আমার চোখ ধরে বলল,
~ বলতো পুচকি তোর জন্য আমি কি এনেছি?

আমি মুচকি হেসে ভাইয়ার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
~ ভাইয়া তুমি আমার জন্য মোবাইল এনেছো?
ভাইয়া এবার আমার হাতে একটি প্যাকেট দিতে দিতে বলল,
~ দেখ তো তোর পছন্দ হয়েছে কিনা?

আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দ্রুত সেটা খুলে বের করলাম। অনেক দামী একটি সুন্দর ফোন কিনে এয়েছে ভাইয়া আমার জন্য। খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে আমার। আমি খুশি হয়ে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

~ পাগলী তোর এই হাসির জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। জানিস তোর এই হাসিটা আমি কত মিস করেছি? কত দিন হয়ে গেল তোর মুখের হাসি আনন্দ টা দেখতে পাইনি আমি। আমার কতটা কষ্ট হয়েছে তুই জানিস?

~ love you ভাইয়া, I love you so much.

~ love you too পুচকি আমার। আচ্ছা শোন এই ফোনের মাঝে তোর জন্য আমি নতুন সিম কিনে ভরে দিয়েছি। সাথে সবকিছু সেটিং করে দেওয়া হয়েছে। এখন তুই শুধু ইচ্ছে মতো চালাতে পারবি এটা। আর যেটা বুঝতে পারবি না সেটা আমায় জিজ্ঞেস করিস আমি শিখিয়ে দেবো কেমন! আমি এখন যাই রে অনেক ক্ষুদা লেগেছে। তুই ডিনার করেছিস?
~ হ্যাঁ ভাইয়া আমি একটু আগে ডিনার করেছি। তুমি যাও আমার কোন দরকার পড়লে আমি তোমায় বলবো!

আমার কথা শুনে ভাইয়া এবার আমার গালটা টেনে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি দ্রুত গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে খাটের উপর ফোনটা নিয়ে বসে পড়লাম। তারপর ফোনটা খুলে তার মধ্যে থেকে আমার সেই নতুন সিম টা বের করে নিলাম। সিমটা নিয়ে ধীরে ধীরে গুটি গুটি পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে বাইরের দিকে উঁকি দিলাম। আর উকি দিতেই দেখি ভাইয়া ডিনার করছে মনোযোগ দিয়ে। আমি চুপিচুপি ভাইয়ার রুমে চলে গিয়ে ভাইয়ার ফোন থেকে ওর সিমটা বের করে আমার সিমটা ওর ফোনে তুলে দিলাম। তারপর ওর সিমটাকে নিয়ে আবার চুপি চুপি নিজের রুমে চলে আসলাম। এসে আমার ফোনের মধ্যে ওর সিমটা লাগিয়ে ফোনটা ওপেন করলাম। এবার শুরু হবে সব প্রমাণ জোগার এর পালা।

ফোনটা ওপেন হতেই আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত সেই রাইয়ান নামে সেভ করা নাম্বার টা বের করে তাতে একটি মেসেজ সেন্ড করলাম। মেসেজে লিখে দিলাম,
“রাই আমি এই মুহূর্তে তোমার সাথে দেখা করতে চাই। খুব জরুরি একটি প্রয়োজন আছে রাহির ব্যাপারে। তুমি কি একটু আমাদের বাসার পাশের ওই পার্কটাতে আসতে পারবে? “
মেসেজটা সেন্ড করার কিছুক্ষণের মাঝেই ওপাশ থেকে মেসেজ আসলো,
“আমি এক্ষুনি আসছি রাকিব। তুমি চলে আসো”

মেসেজটা পেতেই আমার মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে উঠলো। বুকের মধ্যে ধুকধুক করে উঠলো। তারমানে আমার ধারণাই ঠিক। এটা অন্য কেউ নয় এটা আসলে রাই এর নাম্বার। যেটা আমার জন্যেই ভাইয়া রাইয়ান নামে সেভ করে রেখেছে। তারমানে ওসব কিছুই আমার স্বপ্ন ছিলো না সবকিছুই সত্যি!

আমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হলাম রাই এর সাথে দেখা করব বলে। যখনই রুম থেকে বের হয়েছি সামনে আম্মু আর ভাইয়া পরলো। আম্মু আমাকে রেডি হয়ে বাইরে যেতে দেখে বেশ কিছুটা রাগী গলায় আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

~ কি ব্যাপার রাহি তুমি এত রাতে একা একা কোথায় যাচ্ছ? এভাবে কাউকে কিছু না বলে?

আম্মুয় কথায় কী উত্তর দেবো বুঝতে পারছিনা আমি। তবুও যেভাবেই হোক আমাকে আজকে এখান থেকে একাই যেতে হবে নইলে সবকিছুই গুলিয়ে ফেলবো আমি। তাই কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলাম,
~ আমার একটা প্রয়োজন আছে আম্মু। প্রয়োজনটা পার্সোনাল তাই যাব আর আসব। প্লিজ তুমি আমায় বাধা দিও না। আমি বেশিক্ষণ দেরী করবোনা এই যাব আর এই আসব।

আমার কথা শুনে আম্মু রাগে গলায় কিছু বলতে যাবে তখনই ভাইয়া ধপ করে আম্মুর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে উঠল,

~ আম্মু তুমি ওকে যেতে দাও। বাধা দিও না হয়তো কোন প্রয়োজনে যাচ্ছে ও। আর তাছাড়া চিন্তা করো না আমি তো আছি আমি ওর সাথে যাচ্ছি।
ভাইয়া আমার সাথে যাবে শুনে এবার যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো আমার। আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে অসহায় ফেস করে বললাম,

~ ভাইয়া আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে তুমি যেতে পারবে না। আসলে আমি একটু পার্সোনাল কাজে যাচ্ছি। প্লিজ তুমি বোঝার চেষ্টা করো আর আম্মুকে বোঝোও আমাকে একটু যেতে দিতে।
আমার কথা শুনে ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবল তার পরে বললো,

~ আচ্ছা ঠিক আছে তুই যা সমস্যা নাই। তবে বেশি দেরি করিস না তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস। রাত কিন্তু অনেক হয়েছে দেশের অবস্থাও তেমন ভালো নয়।
আমি ভাইয়ার কথা শুনে খুব খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম। আর একটি রিক্সা নিয়ে দ্রুত রওনা দিলাম পার্কের উদ্দেশ্যে। ভাবতেই পারিনি বাসা থেকে বের হতেই সামনে একটি রিক্সা পেয়ে যাব। যেনো রিক্সাটা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

রিকশায় করে পার্কের দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছি তত যেন মনের মাঝে উত্তেজনা হাজার গুণ বেড়ে যাচ্ছে আমার। আজকে আমি সব প্রশ্নের উত্তর পাবো ভাবতেই একটা ভীষণ ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করছে মনে। রাজ কে আবার আগের মত আমার স্বামী হিসেবে ফিরে পাবো ভাবতেই যেন খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। ইচ্ছা করছে ডানা থাকলে এতক্ষন উড়ে চলে যেতাম পার্কে। আর রাই এর সাথে সব কথা বলে সবকিছু জেনে নিতাম। উত্তেজনার কারনে অল্প রাস্তাকেও যেনো হাজার মাইল দুরত্য মনে হচ্ছে আমার।

এভাবে চিন্তা করতে করতে একসময় পার্কের গেট এ পৌঁছে গেলাম আমি। পৌঁছাতেই তাড়াতাড়ি করে রিক্সাভাড়া মিটিয়ে পার্কের মধ্যে যাওয়ার জন্য রওনা হলাম। কিন্তু গেটের কাছে যেতেই দেখতে পেলাম পার্ক অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এটা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। ফিরে আসতে নিয়েও আবার চিন্তা করলাম পার্ক বন্ধ হলে কি হবে রাই তো এখানে আসতে পারে! তাই আর কিছু না ভেবে পার্কের সামনে থাকা একটি বেঞ্চের উপর গিয়ে বসে পড়লাম। আর রাই এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

বেশ অনেকক্ষণ সময় হল পার্কের গেটের সামনে বসে আছি আমি। কিন্তু আশেপাশে একটি জনমানবের চিহ্ন মাত্র নেই। বেশ কিছুক্ষণ পরপর রাস্তা ধরে শুধু কয়েকজন করে হেটে যাচ্ছে। এখন বেশ ভয় ভয় লাগছে আমার। রাত 10 টার উপরে বেজে গেছে কিন্তু রাই এর কোন দেখা নেই। হঠাৎ চোখে পড়ল একটি কালো গাড়ি এগিয়ে আসছে পার্কের এদিকে। গাড়িটা দেখে চিনতে আমার আর বেগ পেতে হল না। কারন এটা আরিয়ানের গাড়ি। এই গাড়িতে বহুবার চড়েছি আমি আরিশার সাথে।

গাড়িটাকে দেখেই আমি দ্রুত বেঞ্চের থেকে নেমে একটু আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। কারণ আমি জানি রাই হয়তো আমাকে এখানে দেখলেই এখান থেকে পালিয়ে যাবে। আমার কোন কথাই শুনতে চাইবে না। কারণ এ কয়দিনে যতোটুকু বুঝতে পেরেছি সবাই কোনো না কোনো কারণে আমার সাথে মিথ্যা অভিনয় করে চলেছে। আর এসবের উত্তর জানতে হবে আমায়। কিন্তু তাতে ধৈর্য হারালে চলবে না। তাই দ্রুত লুকিয়ে পড়লাম আমি। আর চুপটি করে দেখতে লাগলাম কি হয়। তখনই দেখলাম গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসছে রাই। আর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ভাইয়াকে খুঁজছে হয়তো।

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে যখন ভাইয়া কে কোথাও দেখতে পারলো না রাই। তখন ফোন বের করে ভাইয়াকে ফোন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। ওকে যখনই ফোন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে দেখলাম তখনই আমি দ্রুত আমার ফোনটা সাইলেন্ট করে ফেললাম। যার কারণে রাই আর ফোন দিলেও ফোনের শব্দ ওর কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। ফোন বাজতেই আমি ফোনটা রিসিভ করে নিজের কানে ধরে রাখলাম কিন্তু কোনো কথা বললাম না। তখনই রাই গাড়ির দিকে ঘুরে রাগি গলায় বলে উঠল,

~ কি ব্যাপার রাকিব আমি তো এসে গেছি কিন্তু তুমি এখনো আসনি কেন? আমাকে ফোন করে ডাকলে এখন তোমারি দেখা নেই?
আমি ধীরে ধীরে ফোন কানে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,
~ আমি তো অনেক আগেই চলে এসেছি রাই। শুধু তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।


পর্ব ২৬

আমি ধীরে ধীরে ফোন কানে ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,
~ আমি তো অনেক আগেই চলে এসেছি রাই। শুধু তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।

আমার কথা শুনে যেন ভয়ে কেঁপে উঠল রাই। আর এক ঝটকায় পেছনে ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখে দু পা পিছিয়ে গেলো। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
~ ত তু তুমি, নাহ মানে আপনি এখানে?

ওকে এভাবে কথা বলতে দেখে এবার আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। তারপর হাসি থামিয়ে বললাম,

~ আজকেও কি সেদিনের মত আমাকে না চেনার ভান করবে রাই? তবে মনে রেখো আজ কিন্তু তুমি আমার কাছে ধরা খেয়ে গেছো। তাই আমার কাছ থেকে কোন মতেই আর কিছু লুকাতে পারবেনা। তাই বলছি সব সত্যি করে বলো আমায়। তোমরা সবাই কেন এমন আচরণ করছো আমার সাথে? কেন সবাই অপরিচিতোর মতো আচরণ করছো?

~ দে দে দেখুন আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি রাই নয় আমার নাম আখি। আর আপনি এসব কি বলছেন আমি তো আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
রাই এর কথা শুনে এবার প্রচন্ড রাগ হল আমার। আমি ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলাম,

~ দেখো রাই আমি এখন তোমার সাথে বাজে আচরণ করতে চাচ্ছি না। তবে তুমি এমন কিছু করো না যার কারণে আমি তোমার সাথে রুড বিহেভ করে ফেলি। তাই প্লিজ আর অভিনয় না করে বল এসবের মানে কি? কেনো তোমরা আমার সাথে এমনটা করলে? আর এখনো করে চলেছো। এমনকি আমার নিজের ফ্যামিলির সবাইও আমার সাথে এমন করছে। এর কারণ কি আমি সবকিছু জানতে চাই! আমি জানি সবকিছু তুমি জানো তুমিই একমাত্র বলতে পারবে আমায় সব সত্যিটা।

আমার কথার উত্তর না দিয়ে রাই দ্রুত গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়ালো। আমি তখনই আবারো ওর হাতটা ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে বেশ রাগী গলায় বলে উঠলাম,

~ রাই তোমাকে আমার কসম রইল প্লিজ তুমি এভাবে চলে যেও না। তুমি জানো না আমি প্রতিটা মুহূর্তে এসব চিন্তা করতে করতে ধুকে ধুকে মরছি। আর কত শাস্তি দেবে তোমরা আমায়? কেন এভাবে সবাই মিলে অভিনয় করছ আমার সাথে। আমার আর সহ্য হচ্ছে না প্লিজ দয়া করো আমার উপর। দয়া করে বল এসব এর অর্থ কি? তোমরা সবাই মিলে কেন এমন করছ আমার সাথে?
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ওর দিকে তাকালাম আমি। স্পষ্ট দেখতে পেলাম কান্না করছে রাই। ওর দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অঝোর ধারায়। ওকে কান্না করতে দেখে এবার আমি ওর হাত ছেড়ে দিয়ে ওর দু গালে হাত রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

~ কাঁদছো কেন এভাবে? কেঁদো না প্লিজ রাই। আমি জাস্ট সত্যটা জানতে চাই। তুমি বলো আজ আমার সাথে যেসব হচ্ছে সেগুলো যদি তোমার সাথে হতো তাহলে তোমার কেমন লাগতো? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। তাই তোমার সাথে খারাপ আচরণ করে ফেলেছি। প্লিজ তুমি রাগ করোনা এভাবে কান্না করো না রাই। আই এম সো সরি। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও।
ওর সামনে হাত জোড় করে কথাগুলো বললাম আমি। সাথে সাথে আমার হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিলো রাই। তারপর আরও কান্নার গতি বাড়িয়ে দিল। তারপর আমার হাতে চুমু দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

~ তুমি আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে আর দোষী বানিও না ভাবি। আমি তোমার উপরে একটুও রাগ করিনি। তোমার অধিকার আছে আমাকে শাসন করার আমাকে বকার আমাকে মারার। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমার সাথে সবাই মিলে এসব কেন করছে এগুলোর কোন কিছুই আমি জানি না। শুধু জানি তোমার সাথে যা হচ্ছে সেসব শুধুমাত্র তোমার ভালোর জন্য হচ্ছে। আর এসব কিছুই হচ্ছে ভাইয়া আর রাকিবের প্লানে। তবে ওরা তোমার খারাপ চায় না বরং তোমার ভালোর জন্যই এমনটা করছে।
রাইয়ের কথা শুনে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লাম আমি। তারপর কান্না করতে করতে বললাম,

~তার মানে আমার নিজের ভাইও আমার সাথে এমন করার পেছনে জড়িত? আমি ভাবতে পারছি না ভাইয়া কিভাবে পারলো আমার সাথে এমন টা করতে? আর কি এমন ভালো হবে আমার এতে, আমি তো দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছি? এখানে আমার ভালোর কি দেখলো ওরা? আর তোমার ভাইয়া না আমায় ভালোবাসে রাই? আমি না তার বিবাহিত স্ত্রী? তাহলে সে কিভাবে পারছে আমার চোখের সামনে অন্য একটি মেয়ের সাথে ভালবাসার অভিনয় করতে? আমার থেকে দূরে থাকতে? আমার সাথে কথা না বলতে? এটাই কি তার ভালোবাসার নমুনা? আমাকে দিনে দিনে পাগল বানিয়ে নিজে অন্য জনের সাথে ফুর্তি করে বেড়ানো কি ভালোবাসা বলে?

রাই আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমার হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলে উঠল,

~ প্লিজ ভাবি তুমি এভাবে কান্না করো না। শান্ত হও প্লিজ। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি আর তোমার সাথে কোন রকম অভিনয় করব না। বা মিথ্যে বলব না। তুমি তবুও শান্ত হয়ে যাও ভাবী। তোমার সাথে এমন করার পেছনে অবশ্যই কোন না কোন কারণ আছে। নইলে আমি জানি ভাইয়া তোমাকে কতটা পাগলের মতো ভালোবাসে। তোমার ক্ষতি হোক তুমি পাগল হবে এমন কোন কিছু ভাইয়া কোনদিনও করবে না। অন্ততপক্ষে নিজে বেঁচে থাকা পর্যন্ত তোমার সাথে কখনই এত খারাপ আচরণ করতে পারে না। অবশ্যই এর পেছনে এমন কোনো কারণ আছে যার জন্য তোমার সাথে ভাইয়া বাধ্য হয়েই এমন করছে।

তুমি চিন্তা করো না ভাবী। আমি আজকেই বাসায় গিয়ে ভাইয়া কে বলবো এই অভিনয় থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে। সব কিছু তোমার কাছে খুলে বলতে। তারা কেন এমন করছে? আর তাছাড়া আমিও জানতে চাই। রাকিব এর কাছে অনেকবার জানতে চেয়েছি কিন্তু রাকিব আমায় সত্যিটা বলে নি। তাই আজ আমি ভাইয়ার কাছ থেকে জেনে তোমাকে জানাবো। তবুও তুমি প্লিজ এমন ভেঙে পরো না।
ওর কথা শুনে এবার উঠে দাঁড়ালাম আমি। আমার সাথে সাথে রাইও উঠে দাঁড়াল। আমি রাই এর হাত ধরে বললাম,
~ তুমি আমার কাছে একটি প্রমিস করতে পারবে রাই?

~ কি প্রমিজ করতে হবে একবার বলে দেখো ভাবি! আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। জানি সেদিন শপিংমলে তোমার সাথে আমি অনেক বাজে আচরণ করে ফেলেছি। তবে বিশ্বাস করো তোমার সাথে বাজে আচরণ করার পরে আমি অন্য একটি শপিং মলে গিয়ে পাগলের মত কান্না করেছি। আমি একটুও চাইনি তোমার সাথে ওমন আচরণ করতে। তুমি শুধু আমার ভাবি নও আমার নিজের বোন। আমি কখনোই চাইনা তোমার সাথে বাজে আচরণ করতে। বল আমাকে কি করতে হবে তোমার জন্য? তুমি যা বলবে আমি সেটাই করব প্রমিস।

রাই এর কথা শুনে এবার আমি একটি রহস্যময় হাসি দিলাম। তারপর রাইয়ের হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলতে শুরু করলাম,

~ তুমি এখন আমাকে কথা দেবে আমাদের মাঝে এখন যেসব কথা হলো এগুলো কোন কিছুই তুমি ভাইয়াকে অথবা তোমার ভাইয়াকে কাউকে বলবে না। কেউ জানবে না এখন আমাদের সাথে দেখা হওয়ার যাবতীয় কথাগুলো। আমি ওদের মুখ থেকে বের করে ছাড়বো ওরা কেন আমার সাথে এমন করেছ। আর এর মাঝে যত কিছু হয়ে যাক না কেন। তোমার ভাইয়া যদি আমার জন্য কষ্টও পায় তবুও তুমি কোন কিছু মুখ ফুটে বলবে না। এটা তুমি এখন আমার কাছে প্রমিস করবে। তুমি শুধু দেখে যাও তোমার ভাইয়াকে আমি কিভাবে শিকার করাই তারা কেন এমন করছে আমার সাথে। বলো রাই আমার কথা রাখবে তো? প্রমিস!

আমার কথাগুলো শুনে রাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর আমার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলে উঠল,

~ প্রমিস ভাবী, তুমি যেটা বলছো সেটাই হবে। আমি তোমার কাছে প্রমিস করলাম আমাদের এখন দেখা হওয়া সব কথা আমি কারো কাছে কোন কিছু বলবো না। এমনকি রাকিব এর কাছে ও না। আর আমি যতটা সম্ভব তোমার সাথে সেই আগের মতো অভিনয় করে যাবো সবার সামনে। তবে তুমি জেনে রাখো আমি কিন্তু তোমার ননদীনি, সাথে তোমার ভাবি ও।

আমি মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলাম রাইকে। সত্যিই খুব শান্তি লাগছে এখন। যেন মস্ত বড় এক বোঝা বুকের উপর থেকে নেমে গেল আমার। তারপর আরো কিছুক্ষণ ওর সাথে গল্প করে ওকে বিদায় করে দিয়ে আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত 11:00 বেজে গেছে। দরজা খুলে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই আম্মু এসে সামনে দাঁড়ালো। আম্মুকে দেখে আমি মাথা নীচু করে ফেললাম। আম্মু রাগি গলায় বলে উঠলো,

~ রাহি তোমার দিন দিন হয়েছে কি বলতো? তুমি এত রাত অব্দি কোথায় ছিলে? একটি মেয়ে মানুষের এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা ঠিক নয় এটা কি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে? আমি জানি তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে। তাহলে এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে তুমি?

আম্মুর প্রশ্নের উত্তরে আমি আম্মুর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলাম,

~ আম্মু তুমি চিন্তা করো না। তোমার মেয়ে যেটা করবে অবশ্যই সেটা ভালোই হবে। খারাপ কিছু করবে না। এত টুকু বিশ্বাস তুমি তোমার মেয়ের উপর রাখতে পারো।
কথাটা বলে আম্মুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাশ কাটিয়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম আমি। দরজা লাগিয়ে শুধু বোরকাটা খুলেছি তখনই দরোজায় টোকা পড়লো। আমি ভেতর থেকে বলে উঠলাম,

~ আম্মু প্লিজ এখন আমাকে ডেকোনা আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাবো।
~ রাহি আমি রাকিব দরজা খোল। তোর সাথে আমার কথা আছে।

ভাইয়ার কন্ঠ শুনে ছোট করে নিশ্বাস ছাড়লাম আমি। তারপর গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। কিন্তু ভাইয়ার চোখে আর চোখ রাখলাম না। অন্যদিকে তাকিয়ে সোজা এসে বিছানার উপর বসে পড়লাম। ভাইয়া আমার পিছু পিছু এসে আমার পাশে বসে বলে উঠলো,

~ রাহি তুই কি আমার ফোন থেকে আমার সিম খুলে নিয়েছিস? মানে আমার সিম টা কি তোর কাছে?
আমি নিচের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ হ্যা ভাইয়া আসলে আমার ফোনটা তো নতুন, তাই নতুন সিম দিয়ে আমার ফোনে কাজ করতে পারছিলাম না। তাই তোমার ফোনটা থেকে সিম খুলে নিয়ে এসে আমার ফোনে লাগিয়েছিলাম। এছাড়া কিছু না। প্লিজ তুমি রাগ করো না। আমি এখনই তোমার সিমটা খুলে দিয়ে দিচ্ছি।
ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

~ আরে পাগলি আমি রাগ করবো কেন? তুই আমার ফোনটা নিয়ে এলেও আমি রাগ করবো না। সমস্যা নাই তোর যখন খুশি তখন আমার সিমটা দিস।
আমি কথার উত্তর না দিয়ে ফোন থেকে সিমটা খুলে ভাইয়ার হাতে দিয়ে বললাম,

~ আমার সিমট তোমার সময়মতো দিয়ে দিও কেমন?
ভাইয়া পকেট থেকে সিম টা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল,
~তোর সিমটা আমার আগেই খুলে রেখেছি। এই নে!

তারপর ভাইয়া সিম টা আমার হাতে দিয়ে মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আমি গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। তারপর সেই সিমটা আমার ফোনে তুলে নিলাম। এখন শুরু হবে আমার খেলা। সকলের মুখ থেকে কিভাবে সত্যি টা বের করতে হয় এবার আমি দেখাবো সবাইকে। কেন এমন আচরণ করছে আমার সাথে সব কিছু বের করে ছাড়বো আমি। তাতে যদি সকলকে কষ্ট দিতে হয় তাহলে তাই দিব।


পর্ব ২৭

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কলেজের জন্য দ্রুত রেডি হয়ে নিচ্ছি আমি। আজ যে কলেজে আমার অনেক কাজ আছে। কাজটা তো আজকে থেকেই শুরু করতে হবে আমার। এবার’ই তো শুরু হবে রাহির খেল। মনে মনে এসব কথা ভাবছি আর আনমনে হেসে চলেছি আমি। তারপর তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলাম আমি। আমাকে একদম কলেজের জন্য রেডি হয়ে বের হতে দেখে আম্মু আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো,

~ কি ব্যাপার আজ এত সকাল সকাল কলেজের জন্য রেডি হয়েছো যে? কলেজে কোন জরুরী কাজ আছে নাকি?

আম্মুর দিকে তাকিয়ে আমি মুচকি হেসে বললাম,

~ আম্মু এখন তো শুধু আজ নয়, প্রতিদিনই আমার কিছু না কিছু জরুরি কাজ থাকবে। তুমি তাড়াতাড়ি আমাকে খেতে দাও আমার কলেজে যেতে হবে।

কথাটা বলেই ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে পড়লাম আমি। আম্মু একটা ছোট করে নিঃশ্বাস নিয়ে আমার জন্য খাবার রেডি করতে চলে গেল। সকালের খাওয়া শেষ করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কলেজের জন্য রওনা হলাম আমি। যদিও আম্মু অনেক বার মানা করেছে এত তাড়াতাড়ি কলেজে যেতে কিন্তু আমি শুনি নি। কারণ আমি আজকে কলেজে যাব হেটে হেটে। এটা ভেবেই বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা ধরে হাটতে লাগলাম আমি। ভীষণ ফুরফুরে লাগছে আজ মনটা।

আজ অনেক সুন্দর করে সেজেছি আমি, যদিও বোরকা পরা কিন্তু মুখটা তো বাইরে আছে। তাই ঠোটে লিপস্টিক চোখে গাঢ় কাজল দিয়েছি আমি। জানি আমাকে এখন দেখতে ভালোই লাগছে। একা একা এসব কথা চিন্তা করছি আর রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছি। হঠাৎ আমার পাশে এসে একটি কালো রঙের গাড়ি দাঁড়ালো। গাড়িটাকে পাশে দাঁড়াতে দেখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে। কারন আমি এইটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আমি সেদিকে এমন ভাব করে তাকালাম যেন আমি এটার জন্য একটুও অপেক্ষায় ছিলাম না। গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে আসলো আরিশা। তারপর আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

~ কি ব্যাপার রাহি আজকে হেঁটে হেঁটে কলেজ যাচ্ছো যে? গাড়িতে ওঠো আমি তোমাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।

আমি আরিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,

~ সমস্যা নেই আরিশা, তুমি যাও আমি আজকে হেটেই কলেজে যাব। আসলে কি বলো তো প্রতিদিনই তো রিক্সায় বা গাড়িতে করেই যাই। তাই আজ ভাবলাম একটু হেঁটে যাই দেখি কেমন লাগে। বেশ ভালই লাগছে। তুমি যাও আমার সমস্যা হবে না।

আমার কথার উত্তরে আরিশা কিছু বলার আগেই গাড়ি থেকে নেমে আসলো আরিয়ান। তারপর আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

~ তা বললে কি হয় নাকি রাহি। তোমাদের কলেজের তো এখনো অনেক দেরি। তুমি এত সকাল-সকাল কলেজে যাচ্ছ কেন? চলো আমরা সবাই মিলে আজ কফি খাবো।
আরিয়ানের কথা শুনে ওর দিকে আমি হাসিমুখে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ সমস্যা নাই দুলাভাই, আপনি আরিশাকে সাথে নিয়ে গিয়ে কফি খান। আমি শুধু শুধু আপনাদের মাঝে কাবাবের হাড্ডি হয়ে কী করব বলেন?

আমার মুখে দুলাভাই ডাকটা শুনতেই যেন চোখ বড় হয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল আরিয়ানের। উনি অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ দুলাভাই? কে তোমার দুলাভাই?

~ কে আবার হবে আপনি আমার দুলাভাই। আপনি তো আমার বান্ধবী আরিশার বয়ফ্রেন্ড তাই না? তাহলে একদিন যখন আরিশার সাথে আপনার বিয়ে হবে তখন তো আপনি আমার দুলাভাই’ই হবেন। তাহলে এখন তো আপনি আমার হবু দুলাভাই হন সম্পর্কে। সেজন্য দুলাভাই বলে ডাকছিস। কেন আপনার কোন সমস্যা হয়েছে দুলাভাই?

আমার মুখে কথাগুলো শুনে এবার কি বলবে বুঝতে পারছেনা আরিয়ান। শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর অসহায় ভঙ্গিতে আরিশার দিকে তাকাচ্ছে। আরিশা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তা সামাল দেওয়ার জন্যে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল,

~ আরে আমরা কি এখনই বিয়ে করেছি নাকি? যে তুমি ওকে দুলাভাই বলে ডাকছো? তুমি ওকে আরিয়ান বা স্যার বলে ডেকো কেমন?

~ আরে না না সেটা কি করে হয়। তোমরা বিয়ে করোনি তাতে কি হয়েছে? উনি তো তোমার হবু বর তাই না? তাহলে তোমার হবু বর হলে তো সম্পর্কে আমার দুলাভাই’ই হয়। আমি ওনাকে দুলাভাই বলেই ডাকবো। আর তাছাড়া উনি আমার কলেজের কোনো স্যার নয় যে আমি ওনাকে স্যার বলে ডাকবো। সো দুলাভাই এখন থেকে আপনার জন্য এই দুলাভাই নামটাই ফিক্সড।
আমার কথা শুনে এবার আরিয়ানের যেনো কাঁদো-কাঁদো অবস্থা হয়ে গেল। উনি আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে দ্রুত গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে পরলেন। তারপর আরিশার দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু একটা বললেন। আরিশা আমার হাত ধরে বলল,

~ আচ্ছা ঠিক আছে তুমি ওকে কি বলে ডাকবে সেটা না হয় পরে দেখা যাবে। এখন আমার সাথে আসো, চলো আমরা কফি খাবো।

আরিশার কথায় আমিও আর মানা না করে আরিশার সাথে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। কেননা আমিও তো ঠিক এটাই চেয়েছিলাম। গাড়িতে ওঠার পর আরিয়ান গাড়ি চালিয়ে নিয়ে একটি কফি শপের সামনে যেয়ে দাড়ালেন। তিনজন মিলে গাড়ি থেকে নেমে কফিশপের ভিতরে গেলাম আমরা। তারপর একটি টেবিলে গিয়ে তিনজন পাশাপাশি বসে পড়লাম। আরিয়ান একদম আমার মুখোমুখি বসেছে।

কফি খেতে খেতে তিনজন গল্প করতে লাগলাম। এমন সময় হঠাৎ করে আমি আরিশাকে উদ্যেশ্য করে বলে উঠলাম,

~ তা আরিশা তোমরা বিয়ে করছো কবে? মানে অনেকদিন হলো বিয়ের দাওয়াত খাওয়া হচ্ছে না তো তাই বলছি আর কি! কবে বিয়ে করছো তোমরা বল তো?
আমার কথা শুনে এবার চোখ বড় বড় করে আরিয়ান তাকালেন আমার দিকে। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আরিশার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। ও একবার আমার দিকে আর একবার আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটি ঢোক গিলে বলে উঠল,

~ আসলে কি বলো তো, আমার পড়াশোনা তো এখনো শেষ হয়নি রাহি। তাই বিয়ের চিন্তা ভাবনা এখন করছি না। তবে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো আর তোমাকে দাওয়াতও দিব।
আমি আর কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। কেন জানিনা ওর কথাটা শুনে বুকের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আমার। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আরিশা আমার হাতের উপর হাত রেখে বলে উঠলো,

~ তা তুমি কাউকে ভালো টালো বাসো না রাহি? মানে আজ পর্যন্ত কি কারো প্রেমে ট্রেমে পরেছ নাকি?
আমি যেন এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিলাম। আর প্রশ্নটা শুনতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। আর আরিশার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ হুমম বাসি তো। আমিও একজনকে ভালোবাসি। আর তার নাম হলো রাজ।

আমার মুখ থেকে রাজ নামটা শুনতেই আরিশা এবং আরিয়ান দুজনেই হাসিমুখে ফিরে তাকালো আমার দিকে। আরিয়ানের চোখে স্পষ্ট ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি আমি। অথৈ সমুদ্রের মতো গভীর ভালোবাসা রয়েছে আরিয়ানের চোখে আমার জন্যে। সেটা আমি বুঝতে পারছি কিন্তু সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে আবারো বলতে শুরু করলাম,

~ তবে কি বলতো আরিশা! আমি যাকে ভালবাসি তাকে দেখলে না তোমরা একদমই পছন্দ করবে না। তবে তোমাদের পছন্দ দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তাকে ভালোবাসি আর এটাই সত্যি। সবথেকে মজার কথা কি জানো, আমি না থাকে স্বপ্ন দেখেছিলাম। আর স্বপ্নটা যে এভাবে বাস্তবে রূপ নিবে কখনো ভাবতে পারেনি। সেই স্বপ্নের রাজ আমার জীবনে এসে গেছে তাকে আমি খুজে পেয়েছি। তবে স্বপ্ন যেরকম দেখেছিলাম সেই রকম হয়নি সে বাস্তবে এটাই শুধু আফসোস।

আমার কথা শুনে আরিয়ানের চোখ এবার বেড়িয়ে আসার উপক্রম হলো। তারপর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ও আমার দিকে। আমি কি বলি সেটা শোনার জন্য। আরিশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

~ এসব তুমি কি বলছো রাহি? যাকে স্বপ্ন দেখেছো তাকে খুঁজে পেয়েছ মানে? কে সে, কার কথা বলছো তুমি?

~ কার কথা আবার বলব আরিশা। আমি আমার রাজের কথা বলছি। তবে স্বপ্নে ওর নাম ছিল রাজ আর বাস্তবে ওর নাম রাজু। ও আসলে একজন অটো ড্রাইভার। অটো চালায়। ওর একটা চোখ না হালকা ট্যাড়া। যাকে বলে লক্ষীটেরা। তবে ওকে আমি অনেক ভালবাসি। বুঝলে আরিশা যতই হোক ও তো আমার স্বপ্নে দেখা রাজ কুমার। স্বপ্নে আমার স্বামীও ছিলো ও।

আমাকে সত্যিই অনেক ভালবাসে ও। আর আমিও ওকে অনেক ভালবেসে ফেলেছি। আর দুলা ভাই প্লিজ আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি প্রথমে আমার স্বপ্নে দেখা রাজ কুমার আপনাকে ভেবেছিলাম। তাই সেদিন রাস্তার মধ্যে আপনাকে ডেকে ঐ কথাগুলো বলে ছিলাম। সেজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তবে আমি আমার আসল রাজকে খুঁজে পেয়েছি। যাকে আমি সব সময় খুঁজতে চেয়েছি সে।

রাজ কেবল’ই এক চুমুক কফি মুখে দিয়েছিল আমার বলা কথাগুলো শোনার সাথে সাথে বেচারা কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। কফিটা মনে হয় মাথায় উঠে গেছে ওনার। আমি আর আরিশা দুজনে গিয়ে ওনার মাথায় ফু দিতে লাগলাম। আর একটি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলাম খাওয়ার জন্যে। উনি পানি খেয়ে হালকা শান্ত হতেই আমি আবারো বলে উঠলাম,

~ দুলাভাই আসলে কি বলুন তো, আমি রাজুকে এতটাই ভালবাসি যে এখন আপনাদের কাছে না বলে আর থাকতে পারলাম না। কারণ আপনারাই তো আমাদের বিয়ের সাক্ষী হবেন তাই।
কাশি যাও একটু থেমেছিল আমার বলা আবার এই কথাগুলো শুনে আবারও পুনরায় কাশতে শুরু করল উনি।

আর আমি ওনাকে এভাবে কাশতে দেখে মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছে। তবে সেটা প্রকাশ না করে উনাকে পানি খাওয়ার জন্য এগিয়ে দিচ্ছি। আর মাথায় ফু দিচ্ছি। উনি আবারো একটু শান্ত হয়ে আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি তখন ওনার চোখে চোখ রেখে বললাম,

~ কি করবো বলুন তো দুলাভাই! আপনারা ছাড়া তো আমার বাড়ির লোক কেউ একটা অটো ড্রাইভার কে আমার স্বামী হিসেবে মেনে নেবে না। তাই না? তাই আপনাদের দুজনকে একটু আমাদের বিয়ের শাক্ষি হয়ে আমাদের বিয়েটা দিতে হবে। আর সেটাও আগামি ৭ দিনের মধ্যে। আসলে ও খুব তারা দিচ্ছে বিয়ের জন্যে।

আমার বলা কথাগুলো শুনে এবার এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন অরিয়ান। তারপর রাগী গলায় চিৎকার করে বলে উঠলেন,

~ তুমি নিজেকে কি মনে করো রাহি? যখন যা খুশি তাই করে বেড়াবে? কাকে ভালোবাসার কথা বলছো তুমি তোমার বিয়ে হতে পারেনা কারো সাথে তোমার বিয়ে হতে পারে না।
চিৎকার করে কথাগুলো বলল আরিয়ান। আর উনার চিৎকার শুনে কফিশপে থাকা সব লোক গুলো অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালো। আমিও বেশ ভয় পেয়ে চেয়ারের উপর ধপ করে বসে পড়লাম। আরিশা ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করার জন্য আরিয়ানের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে কিছু বললো। সেটা আমার দৃষ্টি এরালোনা। আমি আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলাম,

~ দুলাভাই আপনি এমন রিয়েক্ট করছেন কেন? আমার রাজু একজন অটো ড্রাইভার বলে? আপনি এমন বিহেভ করছেন তাই না? তবে বিশ্বাস করেন দুলাভাই সে অটো ড্রাইভার হলেও আমাকে অনেক সুখে রাখবে। অনেক ভালোবাসবে। আর আমিও তাকে ভালবাসি। আমি বুঝতে পারছি আপনার শালিকা হিসেবে আপনার আমার প্রতি একটা দায়িত্ব আছে। তাই আপনি এমন করছেন। তবে আমি আশা করব শালিকা হিসাবে আমাকে আমার ভালোবাসার কাছে তুলে দেবেন আপনি।

কথাগুলো বলে ওনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে দৌড়ে কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসলাম। কারন আমি জানি এখন এখানে কি হতে চলেছে। আর এই মুহূর্ত টা আমি দেখতে চাই না। কফিশপ থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আর কোন দিকে তাকালাম না। সোজা কলেজের দিকে রওনা হলাম।

আর সামনে একটি রিক্সা পেতেই তাতে উঠে কলেজের রাস্তায় রওনা হলাম। আমি এদিকে একা একা আনমনে হেসে চলেছি খল খল করে। কেননা আমি জানি ওখানে আরিয়ানের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। আমার বিয়ের কথা শুনে ও আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারব না আমার সামনে। তবে আমি চাইনা ও এত তাড়াতাড়ি আমার কাছে নিজের আসল পরিচয় গুলো দিয়ে দিক। আমিও তো একটু নাচাতে চাই ওকে ঠিক যেভাবে ও আমায় এত দিন নাচিয়ে এসেছে। সে যদি আমাকে ভালোবেসে আমার সাথে এমন করতে পারে তাহলে আমি কেন করব না? এটাই তার শাস্তি।

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই কলেজের গেটে পৌঁছে গেলাম আমি। তারপরে রিকশাভাড়া মিটিয়ে কলেজের মধ্যে ঢুকে পরলাম।


পর্ব ২৮

ছাদে বসে বসে সেই কখন থেকে এক নাগাড়ে পাগলের মতো হেসে চলেছি আমি। কিছুতেই যেনো নিজের হাসি টাকে থামাতে পারছিনা। সারাদিনের সব ঘটনা গুলোর কথা মনে করছি আর হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। সত্যিই আজকে দুলাভাই ডাকাতে রাজের মুখটা দেখার মতো হয়েছিল।

ইচ্ছে তো করছিল ওর নাকটা ধরে একটু টেনে দেই। একে তো চোখ ট্যাড়া তার ওপর আবার অটো ড্রাইভার। ভাবতেই মনের ভিতর থেকে এক পৈশাচিক হাসি বেড়িয়ে আসছে আমার। হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার। আমি এবার হাসি কিছু টা কমিয়ে নিয়ে ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকালাম। আর তাকাতেই দেখতে পেলাম রাই ফোন করেছে। তবে আমার ফোনে নাম্বারটা রাই দিয়ে সেভ করার নেই।

বরং রাবিদা নামে সেভ করা। কেননা আমি চায়না ভাইয়া কখনো ধরে ফেলুক যে রাই আমার সাথে কথা বলে। আর আমি সবকিছু জানি। তাই আমি রাবিদা নামে নাম্বারটা সেভ করে রেখেছি। এবার ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে হাসতে লাগলাম। আমাকে এভাবে হাসতে দেখে কিছুটা রাগী গলায় বলে উঠলো রাই,

~ হ্যালো ভাবি কি হয়েছে কি তোমার তুমি এভাবে পাগলের মত হাসছো কেন? তুমি জানো এদিকে কি হয়েছে? ভাইয়া কি করেছে জানো তুমি?
রাই এর কথা শুনে আমি এবার হাসি থামিয়ে কিছুটা সিরিয়াস মুড নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

~ কি হয়েছে, কি করেছে তোমার ভাইয়া?
আমার কথার উত্তর রাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,

~ কি করে নাই সেটা বল! রুমের মাঝের সব কিছু ভেঙে চুরে চুরমার করে ফেলেছে। পাগলের মত করছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজের চোখ দেখছে আর আমাকে জিজ্ঞেস করছে ওর চোখদুটো কি ট্যারা নাকি? তুমি’ই বলো ভাবি! ভাইয়ার মতো হ্যান্ডসাম ছেলে সারা ঢাকা শহরের ভিতরে আর দুইটা আছে? আর সে নাকি ট্যাড়া হতে যাবে বলতো?

রাইয়ের কথা শুনে এবার যেন দম ফাটানো হাসি শুরু হলো আমার। আমি হাসতে হাসতে চেয়ারের উপর থেকে ছাদের উপর ধপ করে বসে পড়লাম। তবুও হাসি যেন কিছুতেই থামাতে পারছি না। তারমানে আমার ওষুধ টা ঠিক কাজে লেগেছে। তীরটা সঠিক জায়গাতেই ছুড়েছি আমি। ভাবতেই যেন অসম্ভব আনন্দ লাগছে আমার। আমি হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছি এমন অবস্থা। আমাকে এভাবে হাসতে দেখে রাই এবার ধমকের সুরে বলে উঠলো,

~ ভাবি কি হয়েছে বলোতো? তুমি এভাবে হাসছো কেন? আমি তোমাকে যেটা বলছি সেটার উত্তর দাও। আচ্ছা তুমি ভাইয়ার সাথে কিছু করোনি তো? ভাইয়া হঠাৎ এমন করছে কেন? ভাইয়া তো আগে কখনো এমন করেনি? নিশ্চয়ই তুমি কিছু করেছ, কি করেছ বলো তো?

আমি হাসতে হাসতে বলে উঠলাম,

~ তেমন কিছু করিনি রাই। শুধু একটা তীর ছুড়েছি আর আমার তীরটা গিয়ে সঠিক জায়গাতেই লেগেছে। এবার বোঝো মজা কাকে বলে। আমার সাথে অভিনয় করা তাই না? এখন বোঝো ঠেলা। তা তোমার ভাইয়া এখন কোথায় শুনি? মহাশয় কি এখনো নিজের চোখ দেখতে ব্যস্ত, নাকি ভাঙচুর করায়?

~ ভাইয়া বাসায় নাই একটু আগেই সব ভাঙচুর করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার আগে বলল কোন অটো ড্রাইভারকে নাকি খুঁজবে, কি দরকার আছে তাই।
অটো ড্রাইভারের কথা শুনতেই এবার হাসি থামিয়ে নড়েচড়ে বসলাম আমি। তারপরে বলে উঠলাম,

~ অটো ড্রাইভারকে খুঁজছে মানে? অটো ড্রাইভারকে দিয়ে কি হবে ওনার?

~ সেটা আমি জানি না ভাবি। তবে দেখে মনে হল অসম্ভব রেগে আছে ভাইয়া। ভাইয়া এতটা রাগ কখনোই করেনি। আর আমি জানিনা এখন কোন অটো ড্রাইভার কি করেছে, আর কেনো তাকে খুঁজতে গেল ভাইয়া।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলাম আমি,

~ আচ্ছা তুমি চিন্তা করো না। তেমন কিছুই হবে না। আর তোমার ভাইয়া যাকে খুঁজতে গেছে তাকে শুধু ঢাকা শহর কেন, সারা বাংলাদেশে খুঁজেও পাবে না। তাই ওইসব চিন্তাভাবনা বাদ দাও আর কুল থাক বেবি। নো প্রবলেম আমি আছি তো। শুধু আগে আগে দেখে যাও কি হয়। আর হ্যাঁ ভুলেও কিন্তু কারো কাছে বলবে না যে তুমি আমার কাছে সবকিছু খুলে বলেছো। তাহলে কিন্তু!

~ হয়েছে হয়েছে বলবোনা বলছি তো! আর ভয় দেখাতে হবে না ভাবি জান।
~ হুমম লাভ ইউ মাই কিউটি ননদিনী।

~ লাভ ইউ টু মাই সুইটি ভাবিজান।

রাই এর সাথে কথা বলে ফোন কেটে দিতেই ছাদের উপর এসে হাজির হলো ভাইয়া। ভাইয়ার দিকে এক নজর তাকাতেই অনেকটা কেঁপে উঠতাম আমি। কেননা ভাইয়াকে অসম্ভব রাগি মুডে দেখা যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে অনেক রেগে আছে। আমি সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে আবারও আমার ফোন টিপায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। ভাইয়া আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
~ রাহি, কি করছিস তুই এখানে?

আমি ভাইয়ার দিকে না তাকিয়েই ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলাম,
~ দেখতে পাচ্ছ না ভাইয়া কি করছি! বসে বসে ফোন টিপছি। কেনো কিছু বলবে?

আমার প্রশ্ন শুনে ভাইয়া বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিজেকে শান্ত করল। ভাইয়ের দিকে না তাকিয়ে আমি ভাইয়ার অনুভূতি ঠিক বুঝতে পারছি। কিন্তু কোন কথা বলছি না। মোবাইল টেপায় ব্যস্ত রাখছি নিজেকে। ভাইয়া কিছু টা রাগি সুরে বলে উঠলো,
~ এই অটো ড্রাইভার রাজুটা কে?

ভাইয়ার প্রশ্নে আমি ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,
~ মানে?

~ মানে এই অটোর ড্রাইভার রাজু টা কে? যার এক চোখ লক্ষীটেরা আর তুই তাকে ভালোবাসিস? এসব কি রাহি? আমাকে আগে কেন বলিসনি তুই। আর এই ছেলেটা আসলে কে?
আমি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সিরিয়াস মুড নিয়ে ভাইয়ার দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ তুমি এসব কথা কোথা থেকে জানলে ভাইয়া? আমি তো এসবের কোনকিছুই তোমায় বলিনি?

~ আমি কোথা থেকে জানলাম সেটা তোর জানতে হবে না। আগে তুই বল এই ছেলেটা কে? আর তোর সাথে এর সম্পর্ক কতদিন থেকে চলছে?
আমি এবার ভাইয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে শান্ত ভাবে চেয়ারে বসে শান্ত গলায় বলে উঠলাম,

~ আমি ওকে ভালোবাসি ভাইয়া। অ্যাকচুয়ালি আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্নে ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল। তবে স্বপ্ন ওর নাম ছিল রাজ চৌধুরী, আর বাস্তবে ওর নাম রাজু। স্বপ্নে ও অনেক হ্যান্ডসাম ছিল। তবে বাস্তবে ও একটু ট্যাড়া কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম। আমি ওকে খুব ভালোবাসি ভাইয়া। আর খুব তাড়াতাড়ি আমরা বিয়েও করছি। আমি তোমাদের জানাতাম কিন্তু কিছুদিন পর। জানিনা তুমি এখন কিভাবে যেনে গেলে সব?

ভাইয়া আমার সামনে ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে আমার দু গালে হাত রেখে নরম সুরে বলে উঠলো,

~ দেখ রাহি তুই এখনো অনেক ছোট। তোর এখনও ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয়নি। আর স্বপ্নে তুই যেরকম দেখেছিস সেরকম না হলে তাকে কিভাবে ভালবাসতে পারিস তুই? এ সব থেকে সরে আয়। আর তাছাড়া তোর সাথে একজন অটো ড্রাইভার যায় না। তুই আমাকে বল ছেলেটা কে? আমি ওকে দেখে ছাড়বো?
আমি এবার কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম,

~ এসব তুমি কি বলছো ভাইয়া? এটা তুমি কি বলতে পারো। রাজু একজন অটো ড্রাইভার বলে কি ওকে ভালোবাসার অধিকার নেই আমার? আমি শুধু ওকেই ভালবাসি আর ওকেই বিয়ে করব। তাতে তোমরা মানলে মানবে, নইলে আমি ওর সাথে চলে যাব। তোমরা আমাকে জোর করবে না। আমি যাকে স্বপ্নে আমার স্বামী হিসেবে পেয়েছি। বাস্তবেও তাকে আমার স্বামী হিসেবে পেতে চাই। অন্য কাউকে নয়।

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে ভাইয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে আসলাম আমি। কেননা আমি চাইনা ভাইয়া আমাকে আরো বেশি প্রশ্ন করে আমার মাথা ধরিয়ে দিক। আমি যে প্ল্যানটা করেছি আমি এই প্লানে সাকসেস হবই হব। শুধু রাই যদি আমার সাথে থাকে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের রুমে গিয়ে দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিলাম আমি।

রাত ৮.৪৫ মিনিট

গত তিন ঘন্টা হল পাগলের মত সব অটোতে চেক করে বেরিয়েছে আরিয়ান। এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে এখানে, এভাবে করে চলেছে সে। শুধু খোঁজ করছে রাজু নামে সেই অটো ড্রাইভারকে। যেভাবেই হোক তাকে খুঁজে বের করতে হবে আরিয়ানের। সে কিছুতেই মানতে পারবে না তার রাহি অন্য কাউকে ভালোবাসে। এটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না আরিয়ান।

কিন্তু গত তিন-চার ঘন্টা হল খুঁজেও কোনমতেই সেই রাজু অটো ড্রাইভার কে খুঁজে পাচ্ছে না। নাম মিললেও চেহারার সাথে কোন মিল নেই। আর চেহারার সাথে মিললেও নামের সাথে কোনো মিল নেই। এমন হয়েছে বহুবার। হঠাৎ একটি চায়ের দোকানে একটি লোকের দিকে চোখ আটকে গেল আরিয়ানের। আরিয়ান ভালো করে তাকাতেই দেখল একটি ট্যাড়া লোক বসে চা খাচ্ছে। বাইরে একটি অটো দাড় করে রাখা। আরিয়ান আর দেরি না করে দ্রুত এগিয়ে গেল লোকের সামনে। তারপর তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

~ আপনার নাম কি রাজু? আর আপনি কি একজন অটো ড্রাইভার?

লোকটি কিছুটা বিরক্ত নিয়ে তাকালো আরিয়ানের দিকে। তারপর বলল,
~ জ্বি আমি রাজু আর আমি একজন অটো ড্রাইভার। কেন আপনি কিছু বলবেন?


পর্ব ২৯

~ আপনার নাম কি রাজু? আর আপনি কি একজন অটো ড্রাইভার?
লোকটি কিছুটা বিরক্ত নিয়ে তাকালো আরিয়ানের দিকে। তারপর বলল,
~ জ্বি আমি রাজু আর আমি একজন অটো ড্রাইভার। কেন আপনি কিছু বলবেন?

লোকটির কথা শুনতেই নিজের হাতের মুঠো শক্ত করল আরিয়ান। কিন্তু এখন কারো সামনে লোকটাকে কিছু করতে চায়না সে। তাই মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলে উঠলো,
~ অ্যাকচুয়ালি আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আপনি কি আমাকে একটু সময় দিতে পারবেন?

~ ও তা কি কথা শুনি? আমি তো আপনাকে চিনিও না। তাইলে আমি আপনার লগে কেন যামু? আপনার যা কওনের এখানেই কন আমি কোথাও যাইতে পারমু না এহন।
লোকটার কথায় যেন মেজাজটা আরও দ্বিগুন বেশি বিগড়ে গেল আরিয়ানের। তবে যে করেই হোক এখন নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে হবে ওর। এত মানুষের মাঝে কোন গ্যাঞ্জাম করলে সেটা মোটেও ভালো দেখাবে না। তাই নিজেকে আরেকটু শক্ত করে নিয়ে মুখে হাসির রেখা টেনে পকেট থেকে একটি টাকার বান্ডিল বের করে বলল,

~ আসলে আমার বোনের কলেজে যাতায়াতের জন্য একটি অটো রিজার্ভ করতে চাই। প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের টাকা দেবো অটোওয়ালাকে। আর এডভান্স দেবো এক মাসের জন্য ২০ হাজার টাকা। আপনি কি আমার সাথে যাবেন? আমি আপনার অটো আমার বোনের জন্য রিজার্ভ করতে চাই।

আরিয়ানের হাতে টাকা দেখে এবার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো অটো ড্রাইভার রাজুর। সে হাতে থাকা চায়ের কাপটা সরিয়ে রেখে টাকার বান্ডিল এর দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল,
~ আমি রাজি, আমি রাজি আপনার বোনের অটো ড্রাইভার হতে। এত টাকা একসাথে কখনো কেউ দেয়নি আমায়। আমি রাজি আপনার প্রস্তাবে। চলুন কি বলবেন শুনবো আমি।

লোকটার মুখে সম্মতি পেতেই পৈচাশিক হাসি ফুটে উঠল আরিয়ানের মুখে। কিন্তু হাসিটা বেশিক্ষনের জন্য রইল না। বাহির কথা মনে পড়তেই হাসিটা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে আরো বেশি রাগে পরিনত হল। আরিয়ান কোন কথা না বলে নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে সামনের দিকে হাটতে লাগল। অটো ড্রাইভার টাকার লোভে আরিয়ানের পিছু আসতে লাগল। তখন’ই আরিয়ান ফোন বের করে মেসেজ করে দিলো রাকিবকে ওর দেওয়া ঠিকানায় চলে আসতে।

অটো ড্রাইভার কে সাথে নিয়ে একটি গোডাউনের ভেতর প্রবেশ করল আরিয়ান। কিছুক্ষণের মাঝেই সেখানে এসে হাজির হলো রাকিব। অটো ড্রাইভার এখানে আসার পর থেকেই আরিয়ানকে বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছে কি কথা বলবে। কিন্তু আরিয়ান কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিচ্ছে না। চুপ করে বসে হাতের মুঠো শক্ত করে রাগী ভাবে মাথা নিচের দিকে দিয়ে বসে আছে সে। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অটো ড্রাইভার এবার অনেকটা বিরক্ত নিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে নেয়। আর তখনই অটো ড্রাইভার এর সামনে এসে দাঁড়ায় রাকিব। রাকিব এর চোখেও রাগ স্পষ্ট। রাগে যেন শরীর জ্বলে যাচ্ছে রাকিব আর আরিয়ানের। কিন্তু কোনো কথা বলছে না ওরা। আরিয়ান চুপটি করে বসে আছে। রাকিব এবার গুটি গুটি পায়ে অটো ড্রাইভার এর সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো,

~ আপনার নাম রাজু?

~ হ আমি রাজু! কিন্তু কি হয়েছে বলেন তো? আর আপনেরা আসলে কেডা। আমার তো আপনেদের এহন সুবিধার মনে হইতাছে না। আমি কি আপনাদের লগে আইসা ভুল করে ফেলাইলাম নাকি?
লোকটির কথা শুনে পিছন থেকে রাগী গলায় বলে উঠলো আরিয়ান,

~ তুই রাহিকে ছেড়ে দে রাজু! ওর সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখিস না তুই।

আরিয়ানের কথা শুনে পিছন দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল লোকটি। তারপর কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ রাহি, এই রাহি ডা আবার কেডা?

আরিয়ান এবার নিচের দিক থেকে মুখ তুলে রাজুর দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,
~ যার সাথে তুই প্রেম করছিস যাকে তুই ভালবাসিস সে।

আরিয়ানের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা চিন্তা করে লোকটা বলে উঠলো,
~ আপনে কি আমার আফিয়ার কথা কইতাছেন?

ওর মুখে আফিয়া নামটা শুনতেই পেছন থেকে রাকিব রাগি ভাবে ওর সামনে এসে বললো,

~ আমরা আফিয়ার কথাই বলছি। আফিয়া আমার বোন। তুই ওকে ছেড়ে দে ও আরিয়ানের বিয়ে করা বউ। তুই ওর সাথে সম্পর্ক করিস কোন সাহসে?
রাকিবের কথা শুনে লোকটা যেন অবাক এর শীর্ষে পৌঁছে গেল। তারপর কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

~ আপনারা এগুলা কি কইতাছেন, আমার আফিয়া আপনার বউ হবো কেমনে? ওর লগে তো দুই মাস আগে আমার বিয়ে হইছে। ওর পেটে আমার বাচ্চা ও আছে। আর আপনারা কি কইতাছেন এগুলা? আমি ওরে জীবনেও ছাড়মু না। আমি ওরে অনেক ভালোবাসি।

এতোটুকু বলতে’ই আরিয়ান আর সহ্য করতে না পেরে পিছন থেকে সজরে একটি লাথি মারলো লোকটার পিঠে। লাথি মারার সাথে সাথে লোকটা মুখ থুবরে নিচে পড়ে গেল। আরিয়ান তার ওপরে গিয়ে এলোপাথাড়ি মারার জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু তার আগেই ওকে ধরে ফেলল রাকিব। তারপর বলল,

~ আরিয়ান তুমি শান্ত হও। ওর সাথে আমাকে কথা বলতে দাও। আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে এখানে কোন ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে আমাদের।

কিন্তু আরিয়ান যেন কোনো কিছুতেই মানতে চাইছে না। এখন সে পাগলের মত হয়ে আছে। কেউ কিভাবে তার প্রপার্টিতে হাত দিতে পারে? যে প্রপার্টি টা শুধুমাত্র তার, অন্য কারো নয়। অন্য কারো অধিকার নেই তার এই প্রোপার্টির উপর। আরিয়ান গিয়ে লোকটার পিঠে বেশ কয়েকটা কিল ঘুষি মেরে দিল। তখন’ই ওকে ধরে ফেলল রাকিব। তারপর আরিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে কিছুটা সরিয়ে দিয়ে বলল,
~ আরিয়ান রাগের বশে নিজের ওপর থেকে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলো না। একটু বোঝার চেষ্টা করো ও আমাদের রাহির নাম আফিয়া বলছে। হতে পারে আমাদের রাহির পুরো নাম “আফিয়া আক্তার রাহি”। কিন্তু তার পরেও তো ওর রাহি নামটা জানার কথা তাই না? তাই সব কিছু ঠিক ঠাক জানতে দাও আমায়।

কিন্তু আরিয়ান যেনো নাছর্বান্দা। ও একদম ক্ষেপে হিংস্র বাঘের মত হয়ে রয়েছে। রাকিবের কথা না শুনে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে রাজু নামের লোকটিকে এলোপাথাড়ি মারতে লাগল ও। মারতে মারতে লোকটার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করে দিল। তখন জোর করে সরিয়ে নিল আরিয়ানকে রাকিব। তারপর ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে রাগি গলায় বলল,

~ তুমি কি একটা মানুষ এভাবে কেন মারছো লোকটাকে? আগে তো সবকিছু জানতে দাও? আমার বিশ্বাস হয় না এমন একটি মানুষকে রাহি ভালবাসবে। প্লিজ একটু শান্ত হও আমাকে ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে দাও। তোমার মত রাগ কিন্তু আমারও হচ্ছে আরিয়ান। কিন্তু তবুও আমি সবকিছু না জেনে ওকে মারতে পারি না এভাবে।

রাকিবের কথা শুনে রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে পিছন দিকে ঘুরে দাঁড়ালো আরিয়ান। আরিয়ান কে শান্ত হয়ে দাড়াতে দেখে রাকিব আর দেরি না করে দ্রুত চলে গেল অটো ড্রাইভারের কাছে। তারপর ওর মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

~ আচ্ছা তুমি সত্যি করে বলতো তোমার স্ত্রীর নাম আসলে কি?


পর্ব ৩০

আরিয়ান কে শান্ত হয়ে দাড়াতে দেখে রাকিব আর দেরি না করে দ্রুত চলে গেল অটো ড্রাইভারের কাছে। তারপর ওর মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
~ আচ্ছা তুমি সত্যি করে বলতো তোমার স্ত্রীর নাম আসলে কি?

~ আর কইবার কমু স্যার, আমার বউ এর নাম আফিয়া। ওর লগে আমার দুই মাস আগে বিয়া হইছে। আপনে কইতাছেন আপনে আমার বউ এর ভাই। তয় আপনেরে আমি বিয়ার দিন শশুরবাড়িতে দেখলুম না ক্যান? তহন তো ওইহানে সকলেই আছিলো। তাইলে আপনে তখন কই আছিলেন? আর আমারে এমনে মারতাছেন’ই বা কি জন্যি? আমি আপনাগো কি করছি?

অটো ডাইভার রাজুর কথা শুনে এবার আরিয়ান ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকাল ওর দিকে। তারপর ওর পাশে এসে বসে বলে উঠলো,

~ তার মানে তোমার বউ রাহি নয়? তুমি সত্যি আফিয়া নামের কোন মেয়েকে বিয়ে করেছ? তোমার বউ এর কোনো ছবি আছে তোমার কাছে?

আরিয়ানের কথায় উঠে বসল লোকটি। তারপর পকেট থেকে একটি মানিব্যাগ বের করে তার ভিতর থেকে একটি ছোট পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করে আরিয়ানের হাতে দিয়ে বলল,
~ এই লন স্যার এইটা আমার বউ আফিয়া। দুই মাস আগে আমাগো বিয়া হইছে। আর আমার বউ এহন এক মাসের পুয়াতি।

অটো ড্রাইভার এর হাত থেকে ছবিটা দ্রুত হাতে নিল আরিয়ান। ছবিটা দেখে চমকে উঠল সে। কেননা এটা অন্য একটি মেয়ের ছবি রাহির নয়। আরিয়ান এর হাত থেকে রাকিবও ছবিটা নিয়ে দেখলো। তারপর আরিয়ান বলে উঠলো,

~ তুমি কি সত্যি বলছ এটাই তোমার বউ আফিয়া?

~ তো আমি মিথ্যা কেন বলমু স্যার? আপনের কোন সন্দেহ থাকলে আমার লগে আমার বাড়িতে চলেন। আমার বৌয়ের লগে আপনাগো পরিচয় করায় দিমু নি। আমি বুঝতে পারতাছি না আপনি আমারে এমনে ধইরা নিয়া আইসা মারধর করলেন ক্যান। এখন মুই গাড়ি চালায় খামু কেমনে?

কথাগুলো বলে হু হু করে কাঁদতে লাগল রাজু নামের অটো ড্রাইভারটি। ওনাকে কাঁদতে দেখে এবার নিজেকে অসম্ভব অপরাধী মনে হচ্ছে আরিয়ানের। আরিয়ান ধপ করে মাটির মধ্যে বসে পরলো। তারপর লোকটির হাত ধরে অপরাধীর মতো বলল,

~ আমাকে তুমি ক্ষমা করে দেও ভাই। আসলে আমি বুঝতে পারিনি, রাগের বসে তোমার সাথে খারাপ আচরণ করে ফেলেছি। সেজন্য তোমার কাছে আমি অনেক দুঃখিত। আসলে কাকতালীয় ভাবে তোমার সাথে সব কিছু মিলে গেছে। আর তাতেই এত ভুল!

~ মুই তো আপনের কথা কিছুই বুঝতে পারতাছি না স্যার। আপনি আসলে কি কইবার চাইতাছেন? আর আমারে মারার পিছনে আসলে কারণটা কি? আমারে সবকিছু খুইলা কন তো। আমি সব কিছু জানবার চাই।

অটো ড্রাইভার রাজুর কথা শুনে এবার রাকিব এক এক করে সকল ঘটনা খুলে বললো ওর কাছে। সবকিছু শুনে রক্তাক্ত অবস্থায় অটো ড্রাইভার হাসতে লাগল। ওকে হাসতে দেখে বেক্কলের মত তাকিয়ে রইলো রাকিব আর আরিয়ান। তারপর অটো ড্রাইভার হাসতে হাসতে বলে উঠলো,

~ মুই বুঝতে পারছি স্যার আপনার মনের কষ্টডা। আমি বুঝতে পারছি সব। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার বউ আপনার লগে দুষ্টামি করছে। তা ছাড়া আর কিছুই না। হেতি আপনারে পরীক্ষা করতে চাইছে হয়তো। আপনি হেতিরে কতটা ভালবাসেন এটা জানবার লাইগা এমন করছে। কিন্তু মাঝখান থাইকা আমি আপনেদের হাতের এত গুলা মাইর খাইলাম।

অটো ড্রাইভার এর সকল কথাগুলো শুনে পকেট থেকে একটি চেক বই বের করল আরিয়ান। তারপর তার মাঝে সাইন করে দিয়ে পাঁচ লাখ টাকার চেক হাতে তুলে দিলো অটো ড্রাইভার এর। তারপর অপরাধীর মত বলে উঠল,

~ তুমি কিছু মনে করো না ভাই। আসলে আমার ভুলবশত তোমার সাথে এমন করাটা একদম’ই উচিত হয়নি। প্রথমেই সবকিছু জেনে নেওয়া উচিত ছিল আমার। আসলে কি করবো বলো তো, আমি আমার বৌকে অসম্ভব ভালোবাসি তাই ওর মুখে এমন কথা শুনে সহ্য করতে পারিনি। নিজে হিতাহিত শূন্য হয়ে পরেছিলাম। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও আর এইটা আমার তরফ থেকে তোমার এবং তোমার বউ বাচ্চার জন্য উপহার। তুমি দয়া ভেবো না এটাকে, এটা ভালোবেসে আমি তোমায় দিলাম। আর কখনো কোনো প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই আমার সাথে যোগাযোগ করবে। এই নাও এটা আমার কার্ড কখনো কোনো প্রয়োজন হলে নির্দিধায় আমার কাছে চলে এসো। আর আমি সত্যিই ভিষন দুঃখিত।

আরিয়ানের কথা শুনে ওর হাত থেকে টাকার চেক টা নিয়ে, তারপর ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা রক্তটা হাত দিয়ে মুছে ফেলে বলল,

~ আপনে আমার কাছে এমনে ক্ষমা চাইয়েন না স্যার। আমি বুঝতে পারছি আপনের মনের দুক্কুডা। আসলে আপনের বউডা অনেক ভাইগ্যবান যে আপনের মত একখান জামাই পাইছে। এহুনকার যুগে তো এমন জামাই কোন হানে দেখাই যায় না। আর স্যার আপনের এই ট্যাহা মুই নিতে পারমু না। আপনি খালি আমারে ২০০ হান ট্যাহা দেন আমি ডাক্তাররে দেখাইয়া ওষুধ খাইবার চাই। আর এইডা নিজের কাছে রাখেন আমি যে টাকা কামাই করি আমার ওটা দিয়েই সংসার ভালোমতো চইলা যায়। তাই আমাদের ট্যাহা দেওয়া লাগবো না। মুই কিছু মনে করি নাই।

অটো ড্রাইভার এর কথা শুনে নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে আরিয়ানের। ও আর সহ্য করতে পারল না, অটো ড্রাইভার কে বুকে জড়িয়ে নিল। একটু পর আবার ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
~ ভাই আমি সত্যিই আজ একটা কথা মন থেকে মেনে নিয়েছি। সবাই যেমন বলে যে বড় লোকের চেয়ে গরিবের মন অনেক বড় হয়।

সেটা আজকে আমি তোমার থেকে প্রমাণ পেলাম। সত্যিই তোমার মনটা অনেক বড়। আমি ভাবতে পারছি না আমি এত ভালো একটা মানুষকে কিভাবে এভাবে মারতে পারলাম। নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে আমার। ভাই এই টাকা টা তুমি রাখো। এটা আমি তোমাকে মারার জন্য বা অন্য কোনো কারণে দিচ্ছি না। এটা আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য হাদিয়া মনে করো। তুমি দয়াকরে টাকাটা রাখো। নইলে আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবোনা। আর এটা কে কোন দান ভেবোনা, এটা আমার ভালোবাসা তোমার জন্য। তোমার ছোট ভাই হিসেবে।

আরিয়ানের কথা শুনে আর না করতে পারল না অটো ড্রাইভার। চেকটা এবার নিজের পকেটে রেখে বলল,

~ আপনের জন্যে অনেক দোয়া রইলো ভাই। আপনি যেন নিজের বউয়ের ভালোবাসা খুব তাড়াতাড়িই পাইয়া যান। আমি এখন যাই অনেক রাইত হইয়া গেল আমার বউডা মনে হয় আমার লেইগা চিন্তা করতেছে।

তারপর আরিয়ান আর রাকিব অটো ড্রাইভারকে ধরে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেখানে লোকটাকে ডাক্তার দেখিয়ে ভালো করে রক্ত পরিষ্কার করে, ঔষুধ কিনে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। ডাক্তার জানালো ওর তেমন কিছু হয়নি। দুদিন রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

অটো ড্রাইভার কে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যেতেই, অটোওয়ালা মনে মনে বলতে লাগল,

~ আরে শালা আর কিছু ট্যাকা বেশিও দিলো না! মাত্র পাঁচ লাখ ট্যাকা দিয়ে চলে গেল। যার জন্যে মাইর খাইয়াও এত ভালো হওনের নাটক কইরলেম, এত মিথ্যা কথা কইলাম। তারপরেও আমারে আর কিছু ট্যাকা বেশি দিলো না। যাকগে পাঁচ লাখ ট্যাকা তো পাইছি আপাতত এটা দিয়াই কাম চালাই। পরে ঠিকানা তো আছেই হেতির। হেই ঠিকানা মতো যাইয়া আরো ট্যাকা হাতানো যাইবো।
(অটো ড্রাইভার রাজু আসলে একজন পাকা জুয়ারু। সে সারাদিন রাস্তাঘাটে অটো চালিয়ে টাকা রোজগার করে।

তারপর সেই টাকায় জুয়া খেলে। আর রাতে বাসায় ফিরে বউয়ের সাথে খারাপ আচরণ করে যৌতুকের টাকা আনার জন্য। সাথে যাত্রাপালায় অভিনয়ও করেছে অনেকবার। আর সে খুব ভালভাবেই বুঝতে পারে কার মন কেমন। সে ভিষন ধুর্তবাজ লোক। সে জন্যই আরিয়ানের সাথে এত ভাল হওয়ার নাটক করেছে সে। কারন সে জানতো এই টাকাটা আরিয়ান তাকে দিবে। আর পারলে আরো কিছু টাকা বেশি দিবে। কিন্তু বেশি না পাওয়ায় রাগ করে এ ধরনের কথাগুলো বলল লোকটি। )

অটো ড্রাইভার কে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আরিয়ান রাকিবকে নিয়ে ওর বাসার দিকে রওনা হয়েছে। কিন্তু মাঝ রাস্তায় আসতেই রাকিব ওকে গাড়ি থামাতে বলে। ওর কথামত গাড়ি থামিয়ে ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় আরিয়ান। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে রাকিব মুচকি হেসে বললো,

~ জানো আরিয়ান, আজকে আমার মন থেকে সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব শেষ হয়ে গেছে। তোমার প্রতি অগাধ বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে আমার মনে। আমি বুঝতে পেরেছি সারা পৃথিবীতে আমার বোনের জন্য বেস্ট পাত্র হিসাবে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তুমি’ই একমাত্র আমার বোনকে সারা জীবন সুখে রাখার যোগ্য। আমার বোন পৃথিবীর সেরা স্বামীকেই পেয়েছে। সত্যিই আজ খুব খুশি হয়েছি আমি। তোমাকে এতটা কেয়ারিং হাসবেন্ড হিসেবে দেখে। সাথে তুমি অনেক ভালো একজন মানুষও। নইলে এত বড় একজন মানুষ হয়ে সামান্য অটো ড্রাইভারের কাছে যে কেউ এভাবে ক্ষমা চাইতে পারে না। সত্যিই তুমি বেস্ট।

~ না ভাইয়া আপনি ভুল বলছেন। আমার জন্য আপনার বোন আমার পৃথিবীতে সবচাইতে শ্রেষ্ঠ উপহার। আমি ওকে অসম্ভব ভালোবাসি। আর এতটা ভালবাসি বলেই এতটা কেয়ার করি। জানেন ভাইয়া ওর মুখে যখন শুনেছি ও কোন টেরা অটো ড্রাইভারকে ভালোবাসে, আমি পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। কারন আমি ওকে ছাড়া অন্য কিছু বুঝিনা। জানেন ভাইয়া আমি ওকে নিজের প্রপার্টি কেন বলি? কারণ ও আমার হার্ট। আর নিজের হার্ট তো শুধু নিজেরি থাকে তাই না? এটা তো অন্য কাউকে দেওয়া যায় না। কারন হার্ট ছাড়া তো মানুষ মারা যায়। তেমন আপনার বোনও আমার হার্ট। ওকে যদি অন্য কাউকে দিয়ে দেই, তাহলে আমি বেঁচে থাকতে পারবো না ভাইয়া। মরে যাবো আমি।

আরিয়ানের কথা শুনে চোখে পানি এসে যাওয়ার উপক্রম হল রাকিবের। সত্যিই ও মনে মনে অসম্ভব খুশি আজ। নিজের বোনের জন্য এতটা কেয়ারিং একজন হাসবেন্ড এবং ভালবাসার মানুষ পেয়েছে বলে। এতদিন নিজের চোখে দেখেছে কতটা ছটফট করেছে আরিয়ান রাহির জন্য। রাকিব মুচকি হেসে আরিয়ানকে একবার বুকে জড়িয়ে নিয়ে আলিঙ্গন করল। তারপর দুজনে আরো কিছুক্ষন গল্প করে বাসার দিকে রওনা হলো।


পর্ব ৩১

ফোন হাতে নিয়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম আমি। কারণ রাই এর সাথে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলার আছে আমার। আর তখন’ই জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম দূরে একটি কালো রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়িটাকে দেখে একটুও চিনতে অসুবিধা হলো না আমার। গাড়িটা আর কারো নয় এটা রাজের গাড়ি। আর তখনই গাড়ি থেকে নেমে এল ভাইয়া আর রাজ। দুজনে কাছাকাছি এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু গল্প করতে লাগলো। যদিও এখান থেকে ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি না। তবে বেশ ভালই বুঝতে পারছি ওরা আমাকে নিয়ে আলাপ করছে।

আমি রুমের লাইটটা অফ করে দিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। ওরা কি করে সেটা দেখার জন্য। গলার সাথে থাকা ইয়ার ফোনটা কানে লাগিয়ে নিলাম আমি। তারপর চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আমি রুমের মধ্যে ঢুকে গেলাম। যখন দেখতে পারলাম ভাইয়া রাজের থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে ফিরছে তখনই। রুমের মাঝে গিয়ে কানের ইয়ারফোন টা খুলে রেখে ফোনটা হাতে নিয়ে সাইলেন্ট করে দিলাম। তারপর কানের কাছে ধরে একা একাই বলতে লাগলাম,

~ হ্যালো রাজু বেবি, তোমাকে ভাইয়া দেখে ফেলেনিত? অনেক বাঁচা বেঁচে গেলাম। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার ভাইয়ার কাছে ধরা না পড়ে যাও। সে যাইহোক এখন কেমন আছো বলো বেবি?
এতোটুকু কথা বলতেই ভাইয়া এসে রুমের মাঝে প্রবেশ করল। আর অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। ভাইয়াকে দেখে ফোনটা কানের কাছে ধরে বলে উঠলাম,
~ আচ্ছা বাবু এখন ফোনটা রাখো। তোমার সাথে পরে কথা হবে।

কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে লক করে পাশে রেখে দিলাম। ভাইয়া আমার সামনে এগিয়ে এসে রাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
~ তুই এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলি রাহি?
আমি ভাবলেশহীনভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ আমি তোমাকে বলেছি ভাইয়া আমি রাজু নামের একটা ট্যাড়া অটো ড্রাইভারকে ভালোবাসি। আর আমি এতক্ষণ তার সাথেই কথা বলছিলাম। তুমি কেন আমাকে জিজ্ঞেস করছো এ কথা বলতো? আর তোমরা যেটা করেছ সেটা কিন্তু মোটেও ঠিক করোনি ভাইয়া? এভাবে না জেনে একটি অটো ড্রাইভার কে মারা তোমাদের কিন্তু একদমই উচিত হয়নি। আর সত্যি করে বলতো ওই আরিয়ানের সাথে তোমার কিসের সম্পর্ক? তুমি ওর সাথে কেন ছিলে এতক্ষণ?

আমার কথা শুনে ভাইয়া অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল। তারপর থতমত খেয়ে বলে উঠলো,
~ তুই কি করে জানলি আমরা অটো ড্রাইভার কে মেরেছি? আর আমি এতক্ষণ আরিয়ানের সাথে ছিলাম?
~ আমাকে আমার রাজু বলেছে।

~ রাজু বলেছে মানে? তার মানে কি ঐ অটো ড্রাইভারটাই তোর রাজু? কিন্তু ও তো বলেছিলো ওর বউ আছে তাও আবার প্রেগন্যান্ট?

~ আরে ভাইয়া তুমি কি পাগল হয়েছ? ওই অটো ড্রাইভার কে কেন ভালোবাসতে যাব আমি? উনি আমার রাজু নয়। বরং তোমরা যখন ওকে ধরে নিয়ে যাও তখন আমার ভালোবাসার অটো ড্রাইভার রাজু তোমাদের আশেপাশে ছিল। আর তোমরা যখন সবার কাছে ওর খোঁজ করছিলে তখন ও ফোন করে আমাকে সবকিছু বলে। যার কারণে আমি সব শুনেছি বুঝলে। আর তোমরা শত চেষ্টা করেও রাজুকে খুঁজে পাবে না। কারণ ওর ঠিকানা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আর আমি তোমাদের মরে গেলেও ওর ঠিকানা বলব না। এখন যাও তো ভাইয়া আমার রাজুর সাথে কথা বলতে হবে।
আমার কথা শুনে ভাইয়া রাগে হাতের মুঠো শক্ত করে ফেলল।

সেটা দেখতেই ভয়ে বুক কেঁপে উঠলাম আমার। আমি দু পা পিছিয়ে গিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে ফাঁকে সরে গেলাম। ভাইয়া কোন কিছু না বলে রাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল। আমি গিয়ে দ্রুত দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। তারপরে ইয়ারফোন ফোনটা আবারো কানের মধ্যে দিলাম। ওটা কানের মধ্যে দেওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে শুনতে পারলাম ফোনের শব্দ। তার মানে ভাইয়া আরিয়ানের কাছে ফোন করেছে। আমি হাসি মুখে ইয়ারফোনটা ভালোভাবে কানের মাঝে দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। কি কথা হয় ওদের মাঝে সেটা শুনতে।

( আপনারা সবাই হয়তো ভাবছেন যে ওদের কথা আমি কিভাবে শুনতে পাচ্ছি? তাহলে শোনেন আসল ঘটনা! আমি রাই এর সাথে অনেক আগেই প্ল্যান করে আরিয়ানের জামার সাথে ছোট একটি মাইক্রোফোন লাগিয়ে দিয়েছি। আর সেটার মাধ্যমে ওর সব কথা সব কিছু আমি এখানে বসে থেকেই শুনতে পাচ্ছি। জানতে পারছি ও কোথায় যাচ্ছে কি করছে সব কিছুই। কিন্তু বেচারা আরিয়ান কোন কিছুই জানোনা। আর সেই মাইক্রোফোনের সুবিধার্থেই আমি এতকিছু জানি। ওরা তখন কি করেছে না করেছে সবই আমার জানা। হিহিহি রাহি তোর কত বুদ্ধি রে। আই এম প্রাউড অফ মি😁)
ভাইয়ার ফোন রিসিভ করে ওই পাশ থেকে আরিয়ান বলে উঠলো,

~ কী হয়েছে ভাইয়া? এখন’ই তো আমাদের দেখা হয়েছিল তাহলে আবার ফোন করলেন কেন?
~ আরিয়ান তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে। আমরা ভুল করে ফেলেছি!
ভাইয়ার কথা শুনে আরিয়ান চিন্তিত গলায় বলে উঠলো,
~কী বলছেন ভাইয়া? কি এমন হয়েছে এত টুকু সময়ের মাঝে?

~ আরিয়ান রাজু নামের ঐ ট্যাড়া অটো ড্রাইভার এখনো আছে। আর আমরা ভুল একজনকে মেরেছি। আর আসল অটো ড্রাইভার আমাদের আশে পাশেই ছিল। আমি রাহির কাছে এখন সবকিছু শুনতে পারলাম। ও এতক্ষণ তার সাথে কথা বলছিল। ব্যাপারটা আমার একদমই সুবিধার মনে হচ্ছে না আরিয়ান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর একটি ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাবে। আমার মনে হয় রাহিকে সব সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত এখন।

ভাইয়ার কথার উত্তরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা পাগলের মত প্রশ্ন করে উঠল আরিয়ান। ওর প্রশ্ন শুনে ইয়ারফোন কানে আমি হাসতে হাসতে বিছানায় কুটিকুটি হয়ে পড়ে যাচ্ছি। প্রশ্নটা ছিল এমন,
~ আচ্ছা ভাইয়া আমার এক চোখকি ট্যারা? আমাকে কি অন্য রকম দেখতে? মানে দেখতে ভালো নই আমি? সত্যি করে বলেন তো ভাইয়া?

আরিয়ান এর এমন প্রশ্নে ভাইয়া অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে আরিয়ান হঠাৎ এটা কি প্রশ্ন করল? তারপর কিছুটা ধমকের সুরে বলে উঠল,
~ এসব তুমি কি বলছো আরিয়ান? তোমার কি মাথা ঠিক আছে? আমি তোমাকে কি বলছি আর তুমি এসব কি বলছ পাগলের মতো?
ভাইয়ার কথায় আরিয়ান এবার অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো,

~ তো কি করব ভাইয়া আমার কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছে রাহি আর কাউকে নিয়ে না আমাকে নিয়ে বলছে। হয়তো ওর কাছে আমার চোখ টাকে ট্যারা মনে হয়। আমাকে দেখতে ভালো লাগে না হয়তো। জানেন ভাইয়া সকাল থেকে আমি অনেকবার আয়না দেখেছি আর কেন জানিনা এখন আমার মনে হচ্ছে আমার এক চোখ সত্যিই ট্যারা। আর আমাকে দেখতে ভালো নয়। সত্যি করে বলেন তো ভাইয়া এটা কি ঠিক?

আরিয়ানের কথায় ভাইয়া বেশ কিছুটা ব্যাক্কল হয়েছে এটা বেশ ভালোভাবেই শুনে বুঝতে পারছি আমি। তাই ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবারো জোরে ধমকের সুরে বলে উঠল,
~ আরিয়ান তুমি সত্যি পাগল হয়ে গেছো। শুনেছি প্রেমে পড়লে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি সব লোপ পায়। কিন্তু তোমাকে তো দেখছি শুধু জ্ঞান বুদ্ধি নয় সাথে তোমার মাথার তারও ছিড়ে গেছে হয়তো দুই একটা। একদম পাগল হয়ে গেছো তুমি। এসব কি বলছ তুমি আবোল তাবোল? তোমার মতো হ্যান্ডসাম সুন্দর ছেলে পুরা বাংলাদেশে আর একটা নেই। আর তুমি কিনা হতে যাবে ট্যারা! এটা কি মানা যায় বল?

ভাইয়ার কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো আরিয়ান। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ভাইয়া আবারো বলে উঠল,
~ এখন ওসব কথা বাদ দাও আরিয়ানা। আর চিন্তা করো এখন কি করা যায়? সবকিছু কি বলে দেওয়া উচিত এখন রাহিকে? নাকি আরো সময় নিতে চাও তুমি? কিন্তু ভেবে দেখো আবার যেন সবকিছু উল্টা না হয়ে যায়। রাহি যেন সত্যি সত্যি আবার ভুল পথে পা না বাড়ায়?

~ ভাইয়া রাহিকে সবকিছু বলে দেওয়ার আগে ওকে একবার টেস্ট করতে হবে। আমাদের এই কষ্টগুলো বিফলে গিয়েছে নাকি সব কিছু সফল হয়েছে। সেটা টেস্ট না করে সবকিছু বলে দিলে তাহলে সব কষ্ট বৃথা যাবে আমাদের।

~ তা তুমি ঠিকই বলেছো আরিয়ান। কিন্তু এখন তাহলে কি করা যায় বলতো আমায়?

~ ভাইয়া সেটা আমি ফোনে নয় আপনাকে কাল সামনা সামনি বলব। এখন তাহলে ফোনটা রাখছি আমাকে একবার আয়নায় নিজের চোখটা দেখতে হবে!
~ মানে?
~ সরি ভাইয়া মানে বললাম আমাকে এখন ওয়াশরুমে যেতে হবে।

কথাটা বলেই আরিয়ান ফোনটা কেটে দিলো। আরিয়ানের কথাটা ভাইয়া না বুঝলেও আমি বুঝেছি। তাই আমি হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। জামাই একটা পেয়েছি কপালগুণে। এভাবে আর কিছুদিন চললে বেচারা সত্যিই ট্যাড়া হয়ে যাবে।


পর্ব ৩২

~ আচ্ছা রাই আমাকে একটা কথা বলতো! তোমার ওই খাটাশ ভাইয়া নিজের রাজ নামটা পাল্টে এই আরিয়ান নামটা কেন রেখেছে সে?
ফোন করে হঠাৎ এমন প্রশ্ন করায় অনেকটাই বিব্রতবোধ করল রাই। ও আমার কথার উপরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,

~ আচ্ছা ভাবি তুমি কি সত্যি ভুলে গেছো ভাইয়ার পুরো নামটা? মনে নেই তোমার বিয়ের দিন ভাইয়া যখন প্রথম তোমাদের বাসায় যায়, তখন কিন্তু সকলের সামনে ভাইয়া নিজের নাম আরিয়ান আহমেদ রাজ চৌধুরী বলেছিল। তোমার হয়তো খেয়াল নেই কিন্তু ভাইয়ার পুরো নাম কিন্তু আরিয়ান আহমেদ রাজ চৌধুরী। তুমি হয়তো সেটা ভুলে গেছো।

রাই এর কথায় আমার মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। সত্যিই তো আরিয়ান সেদিন নিজেকে আরিয়ান আহমেদ রাজ বলেইতো গিয়েছিল। একদম মাথা থেকে চলে গেছে। এই কথাটাকে মনে থাকলে তো এতদিন আর এত কষ্ট করে ছুটতে হতো না ওদের পিছনে। কথাগুলো ভাবতেই নিজের ওপর প্রচুর রাগ হচ্ছে আমার। তবে রাগটাকে এখন কন্ট্রোলে রেখে রাইকে আবারও জিজ্ঞেস করে উঠলাম,
~ তা তোমার মহারাজ ভাই এখন কোথায় শুনি?
আমার কথার উত্তরে রাই হেসে দিয়ে বললো,

~ ভাবী তুমিও না, এখন রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলল। এত রাতে মানুষ কি করে? নিশ্চয়ই ভাইয়া এখন ঘুমিয়ে পড়েছে তাই না? আর তুমিও নিজের ঘুমের সাথে আমার ঘুমেরও বারোটা বাজাচ্ছো। বলি তোমার কি এখনো ঘুম পায় নি নাকি? কাল কলেজ নেই তোমার?

~ হ্যাঁ হ্যাঁ জানি জানি, তুমি কেমন ঘুমাবে এখন। আমার কাছ থেকে ফোনটা কেটে দিয়েই তো আমার ভাইয়ের সাথে রোমান্টিক আলাপে মগ্ন হয়ে যাবে, জানি তো। বলি একদিন একটু ভাই এর বোনের সাথে কথা বললে কি সমস্যা আছে বল? আসলে কি বলতো আমার একদমই ঘুম আসছে না। তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু বকবক করে সময় কাটাই।
আমার কথার উত্তরে রাই কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর আস্তে আস্তে বলে উঠলো,

~ ভাবি ফোনটা তাড়াতাড়ি কেটে দাও। দরজায় ভাইয়া এসে নক করছে। বুঝতে পারছি না এত রাতে কেন নক করছে ভাইয়া।

কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলো রাই। আমাকে আর কিছু বলার সুযোগই দিলো না। আমি ওর কথা শুনে টেনশনে পড়ে গেলাম। এত রাতে উনি কেন আসবে রাইয়ের রুমে? নাকি রাই ভাইয়ার সাথে কথা বলার জন্য এভাবে ফাঁকি দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো আমার? কথাটা ভাবতেই আবারো ফোন দিলাম রাই এর নাম্বারে। আর ফোন দিতেই দেখতে পারলাম ফোনটা অফ করে রেখেছে ও। এবার আমি শিওর হলাম আর কিছু নয় নিশ্চয়ই আমার ভাইয়া ওর কাছে গেছে বা অন্য কোন ফোন দিয়ে ভাইয়ার সাথে প্রেম আলাপে মগ্ন হয়েছে সে। তাই সে চাইছে না আমি তাকে ডিস্টার্ব করি। আমিও আর বেহায়ার মত ওদেরকে ডিস্টার্ব না করে ফোনটা পাশে রেখে শুয়ে চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম ভাঙতেই তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম আমি। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে কলেজের জন্য রেডি হয়ে রুম থেকে বের হলাম। বের হতেই দেখলাম ভাইয়া ডাইনিং টেবিলে বসে হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর এই হাসির কোন অর্থই বুঝলাম না আমি। তাই আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আম্মুর কাছে কিচেনে এগিয়ে গেলাম। আম্মু সকালের নাস্তা তৈরি করছিল আমি পিছন থেকে গিয়ে আম্মুর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম,

~ আম্মু কি করো?

আম্মু নিজের হাত দিয়ে আমার হাত তার গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হেসে বললো,
~ কি ব্যাপার বলোতো? আমার মেয়েটাকে আজকে এত খুশি খুশি লাগছে? কি হয়েছে বলোতো?
আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,

~ তেমন কিছু না আম্মু আসলে ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে তাড়াতাড়ি খেতে দাও প্লিজ।
আম্মু আমার থুতনিতে হাত দিয়ে মুচকি হেসে বললো,
~ তুমি গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বস! আমি তোমাদের ভাই-বোন দুজনার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।

আম্মুর কথার উত্তরে একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে ভাইয়ার সামনাসামনি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম আমি। ভাইয়ার দিকে তাকাতেই লক্ষ করলাম ও এখনো আমাকে দেখে সেই আগের মতো দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ওর হাঁসির কোন কারণই খুঁজে পাচ্ছি না আমি। তাই কিছুটা রাগী গলায় বলে উঠলাম,

~ কি হয়েছে বলো তো ভাইয়া? তুমি সেই তখন থেকে আমাকে দেখে এভাবে হাসছো কেন? আমাকে কি দেখতে জোকারের মতো লাগছে?
ভাইয়া আমার কথার উত্তরে এবার ফিক করে হেসে দিল। বেশ কিছুক্ষন হাসার পরে ও হাসতে হাসতে বলে উঠল,
~ তোকে ঠিক জোকারের মতো লাগছে না! কিন্তু ইদানিং তুই সত্যিই একটা জোকার হয়ে গেছিস রে পুঁচকি!

কথাটা বলে আবারো আগের মত হাসতে লাগলো ভাইয়া। ওর কথার মানে আমি কিছুই বুঝলাম না। তবে ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার। আমি কিছুক্ষণ ভাইয়ার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে থেকে, সে দিকে আর পাত্তা না দিয়ে আম্মুকে জোরে ডাক দিয়ে বললাম নাস্তা দেওয়ার জন্য। আম্মুও তাড়াতাড়ি আমার জন্য নাস্তা নিয়ে এলো। আমি ভাইয়ার দিকে আর না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ করে কলেজে যাওয়ার জন্য সামনে হাটা দিলাম। তখনি ভাইয়া আমায় ডেকে বলল,

~ কিরে রাহী এত তাড়াতাড়ি কলেজে যাচ্ছিস কেন? কলেজের সময় হওয়ার তো এখনো বাকি। এত তাড়াতাড়ি কলেজে কি দরকার তোর?
আমি পিছনে ফিরে ভেঙচি কেটে বললাম,

~ আমার একটা প্রয়োজনীয় কাজ আছে ভাইয়া। আমি আসছি। তোমরা চিন্তা করো না।

কথাটা বলেই দ্রুত দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আসলাম আমি। আর মনে মনে বুদ্ধি আঁটতে লাগলাম আজকে কিভাবে আরিয়ানকে মজা বুঝানো যায়। ভাবতে ভাবতেই রাস্তায় নেমে পড়লাম আমি। এবার রাস্তা দিয়ে হেলেদুলে হাঁটছি আর সবকিছু চিন্তা করছি কি করা যায়।

বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছি আর এদিক ওদিক উকিঝুকি মারছি আজকে কেন জানিনা ওই ব্যাটা খাটাস মানে আমার জামাই মশাই এখনো আসছে না। এমনকি আরিশারও দেখা নেই। ব্যাপার কি বুঝতে পারছি না। ওদের জন্যই তো এতো তাড়াতাড়ি বের হলাম আমি তাহলে কেন আসছেনা ওরা? দূর ভাল্লাগেনা এবার মন খারাপ করে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করলাম আর হাটা সম্ভব না। অলরেডি অনেকখানি চামড়া উঠে গেছে পায়ের। তাই রিক্সা খোঁজার জন্য রাস্তার এক সাইডে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

তখনি চোখে পরলো আরিয়ানের সেই কাল গাড়িটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। গাড়িটা কে দেখতেই যেনো আমার চোখ মুখে উজ্জলতা ফুটে উঠল। এটারই অপেক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ আমি। আমি হাসিমুখে সে দিকে একবার তাকিয়ে আবার এমন ভাব করলাম যেন আমি গাড়িটাকে দেখি’ই নি। অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখনই গাড়িটা এসে একদম আমার সম্মুখে দাঁড়ালো। তারপর গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ভেতর থেকে আরিয়ান বাঁকা হেসে বলে উঠলো,
~ হাই শালী, এখানে দাঁড়িয়ে কার জন্য অপেক্ষা করছো?

আরিয়ানের মুখে শালী ডাক শুনতেই চোখদুটো যেনো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো আমার। এই ব্যাটা বলেকি, বউকে নাকি শালী বলে ডাকছে! এটা কেমন মানুষ, আমি না হয় ওনার সাথে অভিনয় করে ডেকেছি। কিন্তু উনি? উনি কেন আমায় শালি বলে ডাকছে? মনে মনে এসব চিন্তা করতে করতেই ওনার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম আমি। তখন উনি গাড়ি থেকে নেমে এসে আমার সামনে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়ালেন। তারপর বাঁকা হেসে বলে উঠলেন,

~ কি হলো শালী আমার আধাঘরওয়ালী দুলাভাইয়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে থেকে নজর দেওয়ার মানে কি বলতো? তোমার বান্ধবী মানে আমার হবু বউ আরিশা কিন্তু আমার সাথে রাগারাগি করবে। তোমায় এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখলে।

ওনার কথায় আমি নিচের দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম। ব্যাটা কি ফাজিলের ফাজিল, আমাকে এভাবে লজ্জা দেওয়ার মানে কি? আর উনি হঠাৎ আমাকে এমন শালী শালী বলে ডাকতে শুরু করলো কেন? উনি আবার সত্যি সত্যি আরিশা কে বিয়ে করবে নাতো? কথাটা ভাবতেই বুকের মাঝে ধুক করে কেঁপে উঠলো আমার। আচ্ছা আমি ওনাকে একটু বেশি জ্বালাতন করে ফেলিনিতো? যার কারনে উনি অতিষ্ঠ হয়ে আরিশাকে বিয়ে করতে চাইছেন? এমনটা মনে হতেই ওনার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে ফিরে তাকালাম আমি। তারপর আস্তে করে বলে উঠলাম,

~ আপনি হঠাৎ আমাকে শালী ডাকছেন কেন?

আমার কথার উত্তরে উনি নিজের চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বলে উঠলো,

~ কেন তুমি আমাকে দুলাভাই ডাকতে পারো! তাহলে আমি কেনো তোমাকে শালী ডাকতে পারবো না? শালী!
ওনার কথায় এবার আমি বেশ রেগে গিয়ে বললাম,

~ দেখুন এটা কিন্তু মোটেও ঠিক হচ্ছেনা। আমি আপনাকে দুলাভাই ডাকতেই পারি। কারণ আপনি আমার বান্ধবী আরিশাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু আপনি আমাকে শালী ডাকতে পারেন না কারণ শালী হলো একটা গালাগালি। আমার কাছে যা অসহ্য লাগে।

আমার কথা শুনে উনি অন্য দিকে তাকিয়ে অভিমানি গলায় বলে উঠলেন,

~ তোমার কাছে এটা গালাগালি মনে হচ্ছে! আর যখন আমাকে তুমি দুলাভাই বলে ডাকো, তখন সেটা গালাগালির চাইতেও বেশী তিতো লাগে আমার কাছে। সেটা কি তুমি বোঝনা?
উনার কথার উত্তরে আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,

~ মানে?
উনি কথা ঘুরিয়ে বলে উঠলেন,

~ মানে কিছুই না এখন তাড়াতাড়ি চলো আমরা যাই।
~ কোথায় যাবো আমি আপনার সাথে?

~ কোথায় যাবে আবার, তুমি কলেজের জন্য বের হয়েছো তাই না? চলো তোমাকে কলেজে পৌছে দেই।
~ সেটা বুঝলাম কিন্তু আরিশা কোথায়? ওকে দেখছি না যে আপনার সাথে?

~ আসলে আরিশা ওর আম্মুর কাছে গেছে। ওখান থেকেই কলেজে চলে যাবে ও। তুমি বরং আমার সাথে চলো আমি তোমাকে কলেজে পৌছে দিচ্ছি।

আমি আর ওনার কথায় কোন কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। কারণ পায়ের অবস্থা এমনিতেই দফারফা হয়ে গেছে আমার। উনি মুচকি হেসে আমার পাশে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে আমার দিকে একবার তাকিয়ে বাঁকা হেসে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভিং শুরু করলেন। আমি ওনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বাইরের দিকে নজর দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম উনি কলেজের দিকে না গিয়ে অন্য দিকে যাচ্ছেন। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে উঠলাম,

~ কি ব্যাপার আপনি কলেজের দিকে না গিয়ে এদিকে কোথায় যাচ্ছেন?
আমার কথার উত্তরে উনি আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,

~ তোমাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি বুঝলে? চুপ করে বসে থাকো।
ওনার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি,

~ আমাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন মানে? আমি কি কোন আসবাবপত্র নাকি যে আপনি আমাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন? দাঁড়ান, দাঁড়ান বলছি আমি এখানে নেমে যাব। আপনার হাবভাব আমার মোটেও ভালো লাগছেনা। নামিয়ে দিন বলছি আমায় নইলে আমি কিন্তু আমার রাজু কে ফোন করে ডাকবো।

রাজুর কথা বলতেই উনি জোরে করে ব্রেক কশে গাড়ি থামালেন। সাথে সাথে আমার কপাল গিয়ে সামনে বারি খেতে নিলো। কারন আমি সিট বেল্ট পড়িনি। সাথে সাথে উনি আমার কপালের কাছে নিজের হাতটা দিলেন। যার দরুন আমার কপালে আঘাত না লেগে বরং ওনার হাতে আঘাত লাগলো। আমি স্বাভাবিক হয়ে বসে উনার দিকে তাকাতেই ভয়ে চমকে উঠলাম। কেননা ওনার চোখ দুটো রক্ত লাল হয়ে আছে। উনি অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ওনার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

~ কি হয়েছে আপনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন আমার দিকে?

~ খুব শখ না তোমার রাজুর বউ হওয়ার? ঠিক আছে চলো এখনই তোমাকে রাজুর বউ হওয়াচ্ছি আমি। কে সেই রাজু এখনি বের করব আমি। চলো আমার সাথে।
কথাগুলো বলেই উনি সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। ভয়ে যেন আমার কলিজা শুকিয়ে গেল। লোকটা কি করতে চাইছে? সত্যিই কি আমাকে নিয়ে এখন সেই অটো ড্রাইভার রাজুর কাছে যাবে নাকি সে? যাকে সে কাল রাতে মেরেছিল? আমি ভয়ে ভয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ দেখুন আসলে রাজু বলে কেউ নেই। আমি আপনাদের সাথে এমনি দুষ্টামি করেছি। প্লিজ গাড়িটা থামান। আমার ভীষণ ভয় করছে।

আমার কথা শুনে উনি শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকালেন। তারপর গাড়ি চালাতে চালাতেই সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ ভয় পেওনা আমিও তোমার সাথে দুষ্টুমি করছিলাম। আমি জানি রাজু বলে কেউ নেই। আসলে তোমাকে নিয়ে আমি শপিংমলে যাচ্ছি। বিয়ের জন্য শপিং করব বলে।
~ বিয়ের জন্য শপিং মানে? কার বিয়ের জন্য শপিং করবেন আপনি?

~ কার আবার, যার বিয়ে খাবে বলে তুমি উঠে-পড়ে লেগেছো, আমার আর আরিশার বিয়ে আগামী শুক্রবার। আমরা এখন তার জন্যেই শপিংয়ে যাচ্ছি। আরিশাও সেখানেই আছে।


পর্ব ৩৩

~ কার আবার, যার বিয়ে খাবে বলে তুমি উঠে-পড়ে লেগেছো, আমার আর আরিশার বিয়ে আগামী শুক্রবার। আমরা এখন তার জন্যেই শপিংয়ে যাচ্ছি। আরিশাও সেখানেই আছে।
ওনার কথা শুনে মনে মনে ভীষণ রাগ হল আমার। কিন্তু এখন রাগ করলে চলবে না। ওনাকে ঠিক ওনার মত করে শাস্তি দিতে হবে আমার। কেন জানি না মনে হচ্ছে রাই ওনাকে সব কিছু বলে দিয়েছে। আর তাই এখন উনি আমার সাথে এমন আচরণ করছে। ঠিক আছে আমিও উনার সাথে তালে তাল মিলাবো।

আমিও দেখতে চাই উনি কতক্ষণ সহ্য করতে পারে। আমি তো সহ্য করে চলেছি বহুদিন, আমার এসবে কোনো কিছু যায় আসে না এখন। তাই মনে মনে পণ করলাম যাই হয়ে যাক না কেন আমি আর কষ্ট পাবো না। এবার ওনাকে কষ্ট দেওয়ার পালা। আমি যথেষ্ট সহ্য করেছি আর নয়। তাই আমি মুচকি হেসে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ ওয়াও দুলাভাই, আগে বলবেন তো আমরা শপিং মলে যাবো। তাহলে তো আমি আর একটু সেজেগুজেই আসতাম। আপনার সাথে শপিং মলে যাব বলে কথা, সেখানে কত হ্যানসাম ছেলে থাকবে একজনকে যদি পটিয়ে নিতে পারি তাহলে মন্দ কি বলেন?

আমার মুখ থেকে এমন উত্তর শুনে ওনার মুখটা নিমেষেই চুপসে গেল। হাতটা শক্ত করে মুঠো করলেন উনি। আমি সেদিকে একনজর তাকিয়ে না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
~ কি হলো দুলাভাই এখন আবার চুপ করে বসে রইলেন কেন? তাড়াতাড়ি চলুন আমার তো আর তর সইছে না শপিংমলে যাওয়ার জন্য।

আমার কথা শুনে উনি আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলেন। পুরো রাস্তায় আমার সাথে একটা কথাও বলেননি আর উনি। ওনাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে অসম্ভব রেগে আছেন উনি। তাতে অবশ্য আমার আর কিছু যায় আসে না।

শপিং মলের সামনে গিয়ে গাড়ি থামতেই আরিয়ান এর আগে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম আমি। তার পর ওনার অপেক্ষা না করে শপিং মলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। উনি তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির চাবিটা নিয়ে আমার পিছু পিছু আসতে লাগলেন। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে এদিক থেকে ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলাম। উনি এক সময়ে দ্রুত এসে আমার হাত ধরে রাগি গলায় বলে উঠলেন,
~ কোথায় যাচ্ছ তুমি? এভাবে পাগলের মত ছোটাছুটি করছো কেনো? আমিতো আসছি নাকি, এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ কেন তুমি?

উনার কথার উত্তরে আমি ওনার দিকে নীরব দৃষ্টি ফেলে শান্ত গলায় বলে উঠলাম,

~ আমি আপনাকে ছেড়ে কখন চলে গিয়েছি আরিয়ান? আমিতো আপনার পাশে ছিলাম কিন্তু আপনি তো আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন?
উনি আমার কথা শুনে হঠাৎ করেই আমার হাতটা ছেড়ে দিল। আমার হাত ছেড়ে দিতেই আমি খলখলিয়ে হেসে দিয়ে বলে উঠলাম,

~ আরে দুলাভাই আপনি তো দেখি মজাও বোঝেন না। আমি আপনার সাথে মজা করছিলাম। আর লাইক সিরিয়াসলি আপনি বিশ্বাস করেন যে আপনি আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন? বলি আপনার সাথে আমার সম্পর্কটা কিসের যে আপনি আমায় ছেড়ে চলে যাবেন? আর আমি বা আপনার কাছে যাব কেন? চলুন্ত তাড়াতাড়ি শপিং টা সেরে নেওয়া যাক। আর আরিশা কোথায়? ওকে কোথাও দেখছিনা কেনো?

আরিয়ান বেশ কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আমার হাতটি ধরে বলে উঠলেন আমার সাথে এসো। কথাটা বলেই আমার হাত ধরে টানতে টানতে একটি দোকানে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন। তারপর দোকানদারদের অর্ডার করলেন বিয়ের শাড়ি এবং লেহেঙ্গা দেখাতে। আমি ওনার মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছি না। ওনার দিকে তাকিয়ে কিছু বলব তার আগেই উনি হনহনিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর যাওয়ার আগে আমাকে শুধু বলে গেলেন ওখান থেকে না উঠতে।

আমিও আর কিছু না ভেবে সেখানে বসে থেকে শাড়ি এবং লেহেঙ্গা পছন্দ করতে লাগলাম। বেশ কয়েকটা শাড়ি এবং লেহেঙ্গা দেখার পরে একটি কালো রঙের লেহেঙ্গা অসম্বব পছন্দ হলো আমার। খুবই সুন্দর লেহেঙ্গা টি একদম পাতলা ও সফ্ট কাপড়ের তৈরী। যদিও নিচের কাপড়টা মোটা। তবে অনেক সুন্দর এবং চোখ ধাঁধানো কাজ করা লেহেঙ্গাটি। আমি লেহেঙ্গা টি হাতে নিয়ে দোকানদারের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলাম,

~ ভাইয়া এই লেহেঙ্গাটির প্রাইজ কত?

দোকানদার মুচকি হেসে বললেন,

~ আপনাকে জানতে হবে না আপনি শুধু চয়েজ করুন ম্যাম। স্যার আমাদের প্রাইজ টা দিয়ে দেবেন। আর উনি বলেছেন আপনার কাছে কোন কিছু না বলতে।
আমি অবাক হয়ে রাগি গলায় বললাম,

~ এটা কেমন কথা! পছন্দ করব আমি কিনবো আমি আর আমি প্রাইজ জানতে পারবো না? এটা আবার কেমন কথা? ঠিক আছে আমি এটা নেব না।
জানি না কেন হঠাৎ করেই ভীষণ রাগ উঠে গেল আমার। লেহেঙ্গা টা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই কেউ একজনের বুকের সাথে ধাক্কা লাগল আমার। সামনে তাকিয়ে দেখলাম আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে বাঁকা হেসে। ওনার হাসির মানে বুঝার আগেই উনি ছো মেরে লেহেঙ্গাটা তুলে নিয়ে আমার হাত ধরে সেই দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন।

আমার হাত ধরে নিয়ে উনি এত দ্রুত হেঁটে চলেছেন যে আমি যে ওনাকে কোন প্রশ্ন করব বা কিছু বলবো সেই সময়টুকুও পাচ্ছিনা। টানতে টানতে উনি আমাকে শপিং মলের কর্নারে লেডিস চেঞ্জিং রুম এর কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর আমার হাতে লেহেঙ্গাটি দিয়ে বললেন,

~ যাও লেহেঙ্গা টি পরে চেঞ্জ করে আসো।
আমি ওনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে উঠলাম,

~ মানে কি? এই লেহেঙ্গাএি আমি নিজের জন্য পছন্দ করিনি। আপনি বলেছিলেন আরিশার জন্য পছন্দ করতে। আমি ওর জন্যই এটা পছন্দ করেছি। আর তাছাড়া আপনার দেওয়া জিনিস আমি কেন পড়বো?

আমার কথার উত্তরে উনি কোন কথা না বলে আমার হাত ধরে নিয়ে সোজা সেই রুমের মাঝে ঢুকে গেলেন। আমি শুধু বেক্কলের মত তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আসলে কি করতে চাইছেন উনি?
আমার হাত ধরে নিয়ে রুমে ঢোকার পর লেহেঙ্গাটা একপাশে রেখে আমার হিজাবে হাত দিতেই আমি ওনার হাত ধরে ফেলে রাগী গলায় বলে উঠলাম,

~ এটা কি করছেন কি আপনি? আপনার সমস্যা কি বুঝতে পারছিনা আমি?

উনি আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে নরম সুরে বলে উঠলেন,

~ তেমন কিছুই না তুমি ড্রেস চেঞ্জ করতে চাইছো না তাই আমি নিজেই তোমাকে চেঞ্জ করে দিচ্ছি। আমি দেখতে চাই এটা পরলে তোমাকে কেমন লাগে?
এবার যেন রাগটা মাথায় চড়ে বসলো আমার। আমি ওনার হাত সজোরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে উঠলাম,

~ কি বলতে চান আপনি? আপনার কি মাথা ঠিক আছে? আপনি আমার ড্রেস চেঞ্জ করে দিবেন মানে? বের হন বের হন এখান থেকে? নইলে আমিই বেরিয়ে যাচ্ছি।
কথাটি বলেই আমি দ্রুত বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালাম। তখনই আমার হাত ধরে ফেলে উনি বলে উঠলেন,

~ কোথায় যাচ্ছ রাহি আজ আমি তোমাকে জামাটা পড়িয়েই ছাড়বো। তুমি এখান থেকে কোথাও যেতে পারবে না। তোমার প্রতি আমার অনেক দিনের লোভ-লালসা কাজ করে। আজকে সেটা আমি পুরন করেই ছাড়বো।

কথাটা বলেই উনি আমার হিজাবের একটি পিন টান মেরে খুলে নিলেন। যার দরুন আমার হিজাবটা অনেকটাই খুলে গেল। সাথে সাথে আমি রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে ওনার দিকে ঘুরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সজোরে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলাম ওনার গালে। আমার হাতের থাপ্পর খেয়ে উনি আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে সরে গেলেন। তখনি আমি ওনার কাছে এগিয়ে গিয়ে ওনার শার্টের কলার ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ওনার চোখে চোখ রেখে বলতে শুরু করলাম,

~ কি মনে করেন কি আপনি নিজেকে? যখন যা খুশি তাই করে বেড়াবেন আর কেউ কোনো কিছুর প্রতিবাদ করতে পারবে না? কি মনে করেছেন আপনি? আমার সাথে শুরু থেকে এতটা খারাপ আচরণ এর পরেও আপনাকে আমি মেনে নেব? কখনোই মেনে নেব না আমি আপনাকে। আই হেট ইউ মিস্টার আরিয়ান চৌধুরী। আমি আপনার ব্যাপারে সবকিছুই জানি। আমার সাথে নাটক করার কোন প্রয়োজন নেই আর আপনার। তবে আমি আপনাকে কখনো স্বামী হিসেবে মানি নি। আর আজও মানিনা, সারা জীবনেও মানবো না। আজ আপনি যেটা করলেন এটার জন্য সারাজীবন পস্তাতে হবে আপনাকে। আপনাকে আমি ঘৃণা করি মিস্টার আরিয়ান চৌধুরী। আই জাস্ট হেট ইউ।

কথাগুলো বলে ওনার কলার ছেড়ে দিয়ে ওনার বুকে দুহাত দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা দৌড়ে শপিং মল থেকে বেরিয়ে আসলাম আমি। দু চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে আমার। রাগে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। ইচ্ছে করছে নিজের হাতে খুন করে ফেলি ওই আরিয়ান চৌধুরি কে। উনি কেনো করলেন আমার সাথে এমন টা? আমি তো ওনাকে মনে মনে স্বামী হিসেবে মানতে শুরু করেছিলাম। তাহলে আজ হঠাৎ কেন এমনটা করলেন উনি? উনি কি তাহলে আমাকে কখনো ভালবাসেনি? সবকিছু উনার অভিনয় ছিলো?

এসব ভাবছি আর রাস্তা ধরে সোজা হেঁটে চলেছি আমি। মাথায় কোন কিছু কাজ করছে না। শুধু এতোটুকু জানি রাগে আমার সারা শরীর কাঁপছে। এভাবে বেশ কিছুদূর হেঁটে আসতেই কোথা থেকে যেনো ভাইয়া এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। তারপর সোজা আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠল,

~ আমার বোন সুস্থ হয়ে গেছে। আমার বোন ভালো হয়ে গেছে। আমি আর কোনো চিন্তা করিনা রাহি। তোকে নিয়ে অনেক চিন্তায় ছিলাম আমরা। আজ সেই চিন্তা থেকে মুক্ত হলাম। তুই চিরদিনের মত সুস্থ হয়ে গেছিস বোন। তোকে নিয়ে আর কোন চিন্তা নেই আমাদের। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া। যে উনি তোকে সুস্থ করে দিয়েছেন। আমাদের চেষ্টা বৃথা যায় নি।

ভাইয়ার কথাগুলোর অর্থ আমি কোন কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কি এমন হয়েছে যে আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছি? এসব কি বলছে ভাইয়া? আমি ভাইয়ার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভাইয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর হাসি মুখটা দেখছি। হাসির সাথে সাথে ওর চোখ থেকেও গড়িয়ে পরছে পানি। তবে আমি বুঝতে পারছি এই পানিটা কষ্টের নয়, এটা সুখের পানি গড়িয়ে পড়ছে ওর চোখ থেকে। আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ আমার কি হয়েছে ভাইয়া? যে আমি সুস্থ হয়ে গেছি? এসব কি বলছ তুমি?


পর্ব ৩৪

আমার রুমের মাঝে আমাকে সামনে বসিয়ে নিয়ে আমার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। আব্বু আম্মু ভাইয়া রাই আরিশা সকলেই আছে এখানে। আমি চুপ করে বসে থেকে নিচের দিকে মাথা দিয়ে রয়েছি। আর অপেক্ষা করছি সকল সত্যি জানার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যাওয়ার পর আমি এবার বিরক্তি নিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,

~ কি ব্যাপার তোমরা কি আমাকে কিছু বলবে, নাকি শুধু এভাবে বসিয়ে রাখবে? গত আধঘন্টা হলো বাসায় এসেছি আমরা কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাকে কোন সত্যিই তোমরা বললে না। কি হয়েছিল আমার আর কেন করলে তোমরা আমার সাথে এতো নাটক? আব্বু-আম্মু তোমরা তো আমার নিজের বাবা-মা তাহলে তোমরা কেন আমার সাথে এমন করলে?

আমার কথার উত্তরে আব্বু আম্মু কোনো কিছু না বলে চুপ করে দাড়িয়ে রইলেন। তখনই ভাইয়া বলে উঠলো,

~ আমি তোকে বলবো রাহি, সব সত্যি কথা আজ আমি তোকে বলবো। মনে আছে তোর সেদিনের কথা, যেদিন আমরা তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম অন্য একটি ছেলের সাথে। কিন্তু বিয়ের দিনে তাদের সাথে আমাদের ঝামেলা হয়েছিল। আর পরবর্তীতে আরিয়ান এসে তোকে বিয়ে করে নেয়। সে দিন কোনরকম কথা না বলে আমরা সবাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম আরিয়ানের কথা মত। কেন হয়ে ছিলাম সেটা কি তুই জানিস রাহি?

ভাইয়ার কথায় আমি কপাল কুঁচকে বলে উঠলাম,

~ কি এমন কারণ ছিল ভাইয়া যার কারণে তোমরা একবার আমাকে জিজ্ঞেস না করে সেদিন রাজি হয়েগিয়েছিলে আমার বিয়ের ব্যাপারে? আমি জানতে চাই সবকিছু জানতে চাই আজ আমি।
~ তাহলে শোন সেদিন যখন আরিয়ান আমাকে নিয়ে আলাদা ভাবে কথা বলতে চেয়েছিল তখন আমাদের মাঝে ঠিক কি কথা হয়েছিল! আরিয়ান আমাকে আলাদা রুমে নিয়ে গিয়ে সোজা আমার পায়ে পড়ে যায়। এবং বলতে শুরু করে,

~ ভাইয়া আপনার কাছে আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কেননা আমি আপনার বোনের সম্পর্কে এতক্ষণ যা যা বলেছি সব কিছুই মিথ্যে। রাহি একদম পবিত্র ওর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ও আমাকে আগে চিনতেও না। বরং সেদিনই আমাদের প্রথম দেখা যেদিন ও আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বাঁচিয়েছিলো। তবে আমি ওকে ভালোবাসি গত ছয় মাস আগে থেকে। আপনি হয়তো জানেন না আমি অনেক আগে থেকেই চিনি ওকে। আর সেটা ও নিজেও জানে না।

সেদিন আরিয়ানের এ কথাগুলো শুনে ওর ওপর মায়া হয়নি আমার। বরং আরো অনেক বেশি রেগে যাই আমি। কেননা ও তোর চরিত্র তুলে কথা বলেছে। আর তোকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। যেটা আমি ভাই হিসেবে কখনোই মেনে নিতে পারি না। তাই ওর কাছ থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে আমি ওর কলার ধরে ওকে দাড় করিয়ে তারপর রাগী গলায় বলে উঠি,

~ তোমার সাহস কি করে হলো আমার বাড়িতে এসে আমার বোনের নামে অপবাদ দিয়ে তার সাথে এমন আচরন করার? আর তুমি কি ভেবেছো আমার পা ধরে ক্ষমা চাইলেই আমি আমার বোনকে তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেবো? সেটা কখনোই না। আমি এখনই গিয়ে সকলের সামনে সত্যি কথা বলে দেব। আর রাহির সাথে তোমার বিয়ে কখনোই হতে দেবো না আমি। তুমি চলে যাও এখান থেকে।
কথাগুলো বলেই সেদিন ওই রুম থেকে বেরিয়ে চলে আসতে নেই আমি। তখনই আরিয়ান গিয়ে আবারও আমার হাত জড়িয়ে ধরে অশ্রু ভেজা চোখে বলে ওঠে,

~ ভাইয়া আপনি যদি এখন এখান থেকে চলে গিয়ে রাহির সাথে আমার বিয়ে না দেন! তাহলে আপনি সবচাইতে বেশি ক্ষতি করবেন আপনার বোনের অন্য কারো নয়। আপনারা হয়তো কেউ জানেন না রাহির একটি খুব খারাপ রোগ আছে। আর এই রোগের কারণে ও তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে। এমনকি একসময় হয়তো কোন প্রতিবন্ধী তে পরিণত হয়ে যাবে ও।
সেদিন আরিয়ানের কথায় চমকে যাই আমি। আমার পা আর সামনে আগায় না। আমি ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠি,

~ মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?

~ আমি যেটা বলছি সেটা সত্যি বলছি ভাইয়া। আপনারা হয়তো সেভাবে কখনো খেয়াল করে দেখেন নি, তবে আপনি কি একটা জিনিস আপনার বোনের মাঝে খেয়াল করেছেন কখোনো? আর সেটা হল আপনার বোন কখনো নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। কখনো নিজের ফিলিংসটা কারো কাছে সঠিকভাবে বলতে পারেনা। আরেকটু তেই সেন্সলেস হয়ে যায়? আমার জানামতে আপনার বোন হয়তো ছোটবেলা থেকেই এরকম ছিল না। তবে সে ধিরে ধিরে এমনটা হয়ে গেছে। এটা কি আপনারা অস্বীকার করতে পারবেন, যে আপনাদের সাথে এমন হয়নি যে আপনারা জোর করে রাহিকে কোন কিছু চাপিয়ে দিয়েছেন। আর রাহি তার কোনো প্রতিবাদ না করে মেনে নিয়েছে। পরবর্তীতে সে সেন্সলেস হয়ে গেছে?

সেদিন আরিয়ানের কথাটা শুনে আমার খেয়াল হলো সত্যি তোর অনেকবার এরকম হয়েছে। যখন আমরা তোকে জোর করে একটা কিছু করতে বলেছি তখন তুই তার প্রতিবাদ করতে পারিস নি। বরং সেন্সলেস হয়ে পড়ে যেতি। আর আমরা সেটাকে স্বাভাবিক ঘটনা ভেবে কখনো পাত্তা দিতাম না। এমন অনেকবার হয়েছে রাহি তুই হয়তো ভুলে গেছিস কিন্তু আমি ভুলিনি।

ভাইয়ার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম আমি। পুরো রুম জুড়ে নিরব নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। তারপরে আমি আবার প্রশ্ন করে উঠলাম,
~ তারপর কি হল ভাইয়া? তারপর তুমি কেন রাজি হলে আবার আমাকে বিয়ে দিতে? শুধু কি এটাই তার কারণ ছিল?

আমার কথা শুনে ভাইয়া আমার মাথায় হাত রেখে বলল,

~ না বোন শুধু এটা কারন ছিল না! এর চাইতে বড় একটি কারণ ছিল। যেটা খুবই ভয়ানক।
আমি এবার অবাক চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,

~ সেই কারণটা কি ভাইয়া? আমি জানতে চাই? বলো আমায়!
ভাইয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করে দিলো,

~ সেদিন আরিয়ানের কাছে তোর রোগের ব্যাপারে জানার পর বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। তাই আমি আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেই,” তোমার কথা কিভাবে বিশ্বাস করব আমি? আমি মানছি আমাদের রাহির একটু সমস্যা আছে ও কারো কোন অপমানের প্রতিবাদ করতে পারে না! বা কেউ বিনা কারনে অপবাদ দিলে তার প্রতিবাদও করতে পারে না। তাই বলে কি তোমার কথা শুনে কি আমরা ওকে তোমার সাথে বিয়ে দেবো? সেটা কখনোই না। তুমি বড়লোক হতে পারো কিন্তু আমার বোন কে আমি কোন বড় লোকের সাথে নয় বরং একজন ভালো লোকের সাথে বিয়ে দিতে চাই। যে আমার বোনকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখবে। ওকে অনেক ভালবাসবে। কিন্তু তুমি তো বিয়ের আগেই আমার বোনকে দুশ্চরিত্রা বানিয়ে দিয়েছো। তাহলে তোমার সাথে কিভাবে বিয়ে দেবো আমি আমার বোনকে?

কথাটা বলেই আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসতে নিলাম। কিন্তু তখনই আবার ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে আমার পা ধরে বলে উঠল আরিয়ান,

~ ভাইয়া প্লিজ আপনি এভাবে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবেন না। আপনি একবার আমার কথাটা শুনুন, আমি আপনার বোনকে অনেক বেশি ভালবাসি। ঠিক ততটা ভালবাসি যতটা আপনি এবং আপনার মা-বাবা রাহিকে বাসেন। আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না ভাইয়া। আমার জীবনে ভালোবাসা বলতে কোন কিছু নেই ছোটবেলা থেকে মা বাবার ভালোবাসা ছাড়া অবহেলায় বড় হয়েছি আমি। প্লিজ ভাইয়া আপনি এভাবে আমার শেষ ভালোবাসা টুকু আমার থেকে কেড়ে নেবেন না।

আপনি জানেন না আমি রাহির জন্য ঠিক কতটা পাগল। আমি চাইলেই রাহিকে আপনাদের চোখের সামনে থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে পারতাম। ওর সাথে যা কিছু করতে পারতাম আপনারা বাধা দিতে পারতেন না আমায়। সে ক্ষমতা আমি রাখি। কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি ভাইয়া। ওর সাথে কখনোই আমি এমনটা করবো না। ওর সম্মান মানে আমার সম্মান। হতে পারে আমি ওর বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি, তবে এর পিছনে একটা কারন ছিল। আপনারা হয়তো ভালোভাবে খোঁজখবর না নিয়েই ওই ছেলেটির সাথে বাহিকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আপনারা কি জানেন ঐ ছেলেটির চরিত্র মোটেও ভালো নয়?

~ মানে, কি বলতে চাও তুমি?

~ আমি বলতে চাই ভাইয়া আপনারা যে ছেলেটির সাথে রাহির বিয়ে ঠিক করেছিলেন! সেই ছেলেটির চরিত্র মোটেও ভালো নয়। সে একজন নেশাখোর ও খুবই বাজে লোক। সে সারারাত জুরে পরে থাকে সব খারাপ ক্লাবে এবং সারারাত বাজে মেয়েদের সাথে ফুর্তি করে ড্রাক্স এবং মদের নেশায় বিভোর থাকে। যে কারণে বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল সে। কিন্তু নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য তারা চিটাগাং থেকে ঢাকায় এসে থাকতে শুরু করেছে। আর এখানে আসার পর নিজেদের লুকিয়ে রাখছে তারা। যার কারণে আপনারা জানতেও পারেননি তারা আসলে কেমন লোক। তাদের ভেতর থেকে একবার খোঁজ নিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন তারা কেমন। তারা কিন্তু এখানকার লোক নয় তারা ছয় মাস হলো ঢাকায় এসেছে। এর আগে তারা চিটাগাং থাকতো।
~ কিন্তু তুমি এত কিছু কি করে জানো?

আমার কথার উত্তরে সেদিন আরিয়ান হেসে দিয়ে বলেছিল,

~ ভাইয়া আমি যাকে ভালোবাসি তার কোথায় বিয়ে হচ্ছে সে আমায় ছেড়ে কোথায় চলে যাচ্ছে এতোটুকু জানার দায়িত্ব আমার আছে। আপনারা যদি কোন ভালো ছেলের সাথে রাহির বিয়ে ঠিক করতেন তাহলে আমি কখনোই ওর বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়াতাম না। ওকে দূর থেকেই ভালবেসে যেতাম। কিন্তু আপনারা এমন একটি ছেলের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করেছেন যারা ওর জীবনটাকে নরক এ পরিনত করবে। শেষপর্যন্ত হয়তো ওর শেষ পরিণতি হবে কোনো এক হাসপাতাল বা পাগলা গারদে।

যেটা আমি কখনোই চাইনা। কারণ এমনিতেই রাহি অসুস্থ। তাই আমি ওর বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি। তবে বিশ্বাস করুন ভাইয়া আমি ওকে পাগলের মতো ভালোবাসি। আমার সাথে আপনার বোনকে বিয়ে দিলে ও কখনো কষ্টে থাকবেনা। আপনাকে আমি এতোটুকু কথা দিতে পারি।
সেদিন আরিয়ানের কথায় আমি বেশ কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম,

~ তুমি যে কথাগুলো বলছ তার গ্যারান্টি কি আছে যে তুমি ভবিষ্যতে বড়লোক বলে আমার বোনের সাথে খারাপ আচরণ করবে না? তুমি তো অনেক সম্পত্তির মালিক তুমি যদি আমার বোনের সাথে খারাপ কিছু করো তাহলে তো আমরা কোনভাবেই তোমার সাথে পেরে উঠব না।

আমার কথা শুনে তখন আরিয়ান যে কাজটা করে ছিল সেটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি। আরিয়ান তখন কোনো কথা না বলে সোজা আমার পায়ের কাছে গিয়ে নিজের প্রপার্টির সকল কাগজপত্র রেখেছিল। এবং বলেছিল ও শুধু রাহিকে চায়। আমি ওর এমন আচরন কল্পনাও করতে পারিনি। ভাবতেও পারিনি এত বড়লোক একটি ছেলে শুধুমাত্র তোর জন্য এভাবে আমার পায়ের কাছে নিজের প্রপার্টির সমস্ত কিছু রেখে দেবে। সব সম্পত্তি তোর নামে করে দিতে চাইবে।

সেদিন ওর চোখে আমি তোর জন্য সুস্পষ্ট সত্যিকারের ভালবাসা দেখেছিলাম রাহি। ওর চোখের প্রতিটি অশ্রুকণা বলে দিয়েছিল তোকে ও কতটা চায়। কতটা ভালোবাসে ও তোকে। ওর মত ভালবাসার মানুষ হয়তো সারা পৃথিবীতে তোর জন্য আর আমি পেতাম না। তাই তখন আমার ওকে তোর স্বামী হিসেবে বেস্ট মনে হয়েছিল। আর ও আমাকে সব সত্যি বলে দিয়েছিল কোন মিথ্যে বলেনি আমায়। যে কারণে আমি সেদিন রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। তোর সাথে ওকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। তারপরে আমরা রুম থেকে বেরিয়ে আসি এবং আমি রাজি হয়ে যাই তোর সাথে ওর বিয়ের ব্যাপারে।

এতোটুকু বলে থেমে গেল ভাইয়া। আমি ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছিনা। কারন আমিও তো দেখেছি আরিয়ানের চোখে আমার প্রতি ভালোবাসা। তবুও নিজের মনকে গুছিয়ে নিয়ে আবার কিছু বলতে যাব তখনি রাই আমার পাশে এগিয়ে এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাতদুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলতে শুরু করল,

~ প্লিজ ভাবি তুমি আর ভাইয়ার উপর রাগ করে থেকো না। তুমি জানো না ও জীবনে কতটা কষ্ট সহ্য করেছে। ওর জীবনে ভালোবাসা বলতে কোন কিছু নেই। তুমি জানো ও মেয়েদের কে কেন এত ঘৃণা করে? তোমাকে আর আমাকে ছাড়া কেন কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারে না? তার একমাত্র কারণ ওর নিজের মা। ওর মা, ও যখন একদম ছোট তখন ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো পরকীয়া করে অন্য একটি লোকের সাথে। সেই সময় থেকে ভাইয়া একদম একা। ভাইয়ার মা চলে যাওয়ায় বাবাও ধীরে ধীরে পর হতে থাকে ভাইয়ার।

কিন্তু তারপরেও যথেষ্ট ভালোবাসতেন তিনি ভাইয়াকে। কিন্তু মা এবং বাবার এই শূন্যতা তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে থাকে। ধীরে ধীরে বিষিয়ে ওঠে ভাইয়ার মন মেয়েদের প্রতি। আর এই বিশটা আরো বেশি করে ঢেলে দিতে আবারো ওর মা ফিরে আসে ওর জীবনে। এবং ফিরে এসে ভাইয়াকে ভালোবাসার বদলে ভাইয়াকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সে। কেননা সে জানতো ভাইয়ার আব্বু তার সমস্ত সম্পত্তি ভাইয়ার নামে করে দিয়েছেন। ভাইয়ার যখন 20 বছর পূর্ণ হবে তখন সেই সমস্ত সম্পত্তির মালিক ভাইয়া হবেন। তাই তার নিজের মা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সামান্য সম্পত্তির লোভে।

কিন্তু তখন সে হত্যা করতে পারেনি। তবে ভাইয়ার বাবাকে হত্য করতে সফল হয়েছিলো সে। তখন থেকে তারা এখন অব্দি জেল হাজতে বন্দি। সেই সময় থেকে মা’ই তার দু চোখের কাঁটা হয়ে যায়। নিজের মাকে সে ঘৃনা করতে থাকে। সকল মেয়েকে একইরকম ভাবতে থাকে সে। ভাইয়ার কাছে কোন মেয়ে ঘেষতে পারত না। তুমি যে আরিশা কে চেনো তার সাথেও ভাইয়া আগে কথা বলতো না। কিন্তু আরিশা ছোটবেলা থেকেই ভাইয়া কে পছন্দ করত। ভাইয়ার আব্বুর বন্ধুর মেয়ে হওয়ার সুবাদে।

একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলে থামল রাই। ওর কথা শুনে কেন জানি না দুচোখ ভরে পানি আসতে লাগলো আমার। কতটা কষ্ট সহ্য করেছেন উনি নিজের জীবনে। কিন্তু একটা খটকা মনের মাঝে এসে বাসা বাঁধলো আমার। রাই কেন বারবার বলছে ভাইয়ার মা ভাইয়ার বাবা। তারা তো রাই এর নিজের মা-বাবাও ছিলেন। তাহলে রাই এমন করে কেন বলছে। আমি রাই এর দিকে তাকিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

~ তুমি বারবার ভাইয়ার মা-বাবা এমন কেন বলছো? তুমিও তো তাদেরই মেয়ে তাই না রাই?

আমার কথা শুনে রাই একবার এদিক একবার ওদিক মাথা ঝাঁকিয়ে না বলল। আমি ওর কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
~ তুমি আরিয়ানের আপন বোন না রাই? তুমি না করছ কেন? আরিয়ান তোমার আপন ভাই নয়?

এবার কান্না করে দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে উঠলো রাই,

~ না ভাবী, ভাইয়া আমার আপন ভাই নয়। আর না আমি ভাইয়ার আপন বোন। কিন্তু সে আমাকে অনেক বেশি ভালোবেসে নিজের বোনের চাইতে বেশি ভালোবেসে মানুষ করেছে। আমি যখন অনেক ছোট তখন আমি রাস্তায় ভিক্ষা করতাম। আমি একজন অনাথ ছিলাম। আমার বাবা-মা কে, তারা কোথায় কিছুই জানতাম না আমি। আমাকে ভাইয়ার বাবা একদিন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসে নিজের বাড়িতে স্থান দেয়। তখন থেকেই ভাইয়া আমাকে নিজের আপন বোনের মতো মর্যাদা দিয়ে নিজের কাছে রেখেছে। কখনো আমার শরীরে ফুলের টোকাও লাগতে দেয়নি।

লেখা – এম সোনালী

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “তুমি আমার প্রোপারটি – আই লাভ ইউ সোনা”গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ুন – তুমি আমার প্রোপারটি – আই লাভ ইউ (সিজন ০১)

তুমি আমার প্রোপারটি – আই লাভ ইউ জান (শেষ সিজন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *