এরেঞ্জ ম্যারেজ – বাসর রাতের গল্প

বাসর রাতের গল্প: দোস্ত, বাসর রাতেও আমি এক মুহূর্তের জন্যও কারো স্পর্শ পাই নি, জানিস? বুঝলাম না তোর কথা। কালই না বিয়ে হলো তোর? বাসর রাতে সবার অভিজ্ঞতা এমন হয় যে একটু কোমল স্বরে দুজনের কথা বার্তা শুরু হয়, কিন্তু বিশ্বাস কর দোস্ত, আমার এমন কিচ্ছু হয় নি।

~ কেন হয় নি কেন?
~ ভাই, আমি তোদের ভাবিকে দেখে আর তোদের ভাবি আমাকে দেখে দুজনেই চিৎকার!
~ তুই কি ইদানীং মদ টদ খাস নাকি?কি আজে বাজে কথা বলছিস?
~ ভাই সত্যি! বিশ্বাস কর।
~ কী হয়েছে?তাহলে চিৎকার কেন করলি?
~ ভুল মেয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।
~ ভাই! প্লিজ….তুই কি আসলেই মদ খেয়ে এসেছিস?
~ ধুর, না। শোন আগে সবটা কথা।
~ হ্যাঁ আচ্ছা বল।
~ আমরা যেই কমিউনিটি সেন্টারে বিয়েটা এরেঞ্জ করেছিলাম সেখানে মেয়ের বাড়ির লোকেরা আগে থেকে বসেছিলো।

সব কমিউনিটি সেন্টারে সব বিয়েতেই মেয়ের বাড়ির লোক আগেই যায়। তাতে কী?
~ আরে শোন তো আগে! সেখানে সিস্টেম টা এমন যে মেয়ের বাড়ির লোক আসলে তাদের একটা ফ্লোরে জায়গা হয়, সেই ফ্লোরেই বিয়ে টা হয়। তারপর তাদের জিজ্ঞেস করে জামাই এর পরিচয় সংগ্রহ করে রাখা হয়। জামাই নিচে আসলে সেই ফ্লোরের টোকেন দেয়া হয়। আমার সাথে একই সময় আরেকটা বিয়ের বর এসে হাজির হয়। কমিউনিটি সেন্টারের লোকজন ভুল করে আমার টোকেন তাকে আর তার টোকেন আমাকে দিয়ে দেয়।

ছি! কি আজব কথা। আর তুই কি বলদ নাকি?বিয়েতে ঢুকেও বুঝলি না কোন কনে তোর?
~ ভাই, কনে তো দূরের কথা। বাংলাদেশের কোনো কমিউনিটি সেন্টারে কোনো বিয়ের কনের চৌদ্দগোষ্ঠির কাউকেও চেনা যায় মেকাপের কারণে। আমার নিজের কনে হোক অন্যের কনে হোক একই রকমই লাগে। কনের মায়েরাও এমনই মেকাপ সমুদ্রে ডুব দিয়ে এসেছিলেন তাদেরও চেনার উপায় নেই। মহিলা রা বাদই দিলাম, কনের বাপও ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে এসেছিলো কিনা আমার সন্দেহ আছে।

~ আমার তো মাথা ঘুরছে ভাই। কী শোনালি? আমার তো ঘুমই হবে না।
~ তাহলে ভাব, আমার কেমন ঘুম হয়েছে। রাতে মেকাপ টেকাপ ছেড়ে আসলে পরে সবাই সবকিছু জেনেছে। আমার জন্য পছন্দ করা মেয়েটার ফ্যামিলির লোকের সঙ্গে কথা হয়েছে, সে কি লজ্জা কি লজ্জা!
~ আবার করবি নাকি বিয়ে?
~ পাগল নাকি?সমাজে থাকা যাবে আবার বিয়ে করলে?
~ নতুন মেয়ের ফ্যামিলি কেমন?
~ জানি না। এই যে কি এখন বাড়িতে যাবো, সন্ধ্যায় এই মেয়ের বাড়ির লোককে দাওয়াত করা হয়েছে, দেখি কি সিদ্ধান্তে আসা যায়।
~ কিছু ভেবেছিস?
~ হালকা পাতলা ভেবেছি। মেয়ে তার বাবা মার সঙ্গে চলে যাবে, দু এক বছর চলে গেলে এলাকার মানুষ ভুলে যাবে হয়তো। পরর আবার বিয়ে করে ফেলবো। মেয়ের বাবা মাও ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারবে।

আর তোর সাথে যার আসলে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো।
~ মেয়েটার নাম ছিলো বর্ষা, আমার মতোই মধ্যবিত্ত ঘরের। দেখতে ভালোই, তার বাবা মা গিয়ে ওই ছেলের বাড়িতে অনেক অনুনয় বিনয় করেছে যেন বিয়েটা না ভাঙ্গে, লোকলজ্জার ভয়।
~ স্বাভাবিক।
~ হ্যাঁ, ওই ছেলে শুনলাম অনেক বড় শিল্পপতি। অনেক টাকা, বিয়ে না ভাঙ্গার জন্য অনুনয় বিনয় করা স্বাভাবিকই।
~ টাকা টাই দেখছিস তুই?ছেলেটা যদি খুব গরীবও হতো তাহলেও মেয়ের বাড়ির লোক একই কাজ করতো। এটা বাংলাদেশ, এখানে সমাজে মেয়েদের অবস্থান খুব ঠুনকো। সমাজ যেন ছি ছি না করে, সেই চিন্তা তার বাবা মা কে ভিখারী বানিয়ে দিয়েছে।
~ জানি না ভাই। আদর্শের কথা মাথায় কিচ্ছুই ঢুকছে না আমার। আমার মাথা কাজই করছে না, আমি গেলাম। তুই একটু সন্ধ্যা থাকি বাসায় আমার, মা অনেক জোর করে বলেছে তোকে থাকতে হবে।
~ কেন?
~ ভাই বুঝতেই পারছিস। এমন একটা পরিস্থিতে দুই ফ্যামিলির মিটিং একটা আদালত রুমের চেয়ে কম কিছু হবে না।
~ আচ্ছা আমি থাকবো,সন্ধ্যার আগেই চলে যাবো।
এরপর ফারহান কে নিজের বাসায় সন্ধ্যায় যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে সেখান থেকে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলো আকাশ। আকাশের কেমন যে লাগছে ব্যাপারটা নিয়ে তা কোনোভাবেই বোঝাতে পারছে না সে কাউকে। তার না ভালো লাগছে না খারাপ, এই অনুভূতির কোনো নামই জানা নেই তার, অথবা হয়তো সব অনুভূতির নাম হয় না সবসময়।

বিকালবেলা বাড়ির সবাই উদাস হয়ে যার যার ঘরে বসে আছে। ভুল করে বিয়ে করে ফেলা আকাশের বউটির তোভার ঘর নেই কোনো, সেও উদাস হয়ে আকাশের ঘরেই বসে আছে, কে ভেবেছিলো জীবনে এমন দিনও আসবে। আকাশ অনেক্ষণ ধরেই বসে আছে মেয়েটার সামনাসামনি। মেয়েটার চোখেত দিকে তাকিয়ে একদমই যে কোনো মায়া হয় না তা কিন্তু না, কিন্তু মায়াটা কারো আত্মসম্মান কে অতিক্রম করতে পারছে না বলে কেউ কথাও শুরু করতে পারছে না। আকাশ শেষমেষ না পেরে মুখ খুলেই ফেললো,

~ আপনার নাম কী?
মেয়েটা কোনো উত্তর দিলো না, আকাশ একটু কেশে আবার জিজ্ঞেস করলো,
~ এই যে, আপনাকেই বলছি। আপনার নাম কী?
তবু মেয়েটি কথা বললো না। মেয়েটির মনে বিস্তর অভিমান, তার তো দোষ ছিলো না। দুই পাত্রই ভুল ভাল ফ্লোরে চলে যায়, আর তার খেসারত পাত্রীরা কেন দেবে। তবে সাথে সাথে এও মনে হলো, এই লোকেরও দোষ নেই। পরে একটু জড়তার সঙ্গে উত্তর দিলো,
~ আমার নাম চৈতী।
আকাশ একটু অবাক হওয়ার ভাব ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, চৈতীও জিজ্ঞেস করলো,
~ নাম শুনে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
~ না কিছু না। আমি আরকি অবাক হলাম, আমি তো মাত্র ধরেই নিয়েছিলাম আপনি কথা বলতে পারেন না।
~ কেন কালকে রাত্রে চিৎকার শোনেন নি?
~ ভুলে গিয়েছিলাম। মানে এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আসলে আমি আপনি সবাই যে সবকিছু উলটপালট হয়ে যাচ্ছে।
~ বাবাকে আই ভীষণ ভয় পাই! বাবা আজকে এসে আমাকে কি করবেন কে জানে!
~ আপনার তো দোষ নেই।
~ আচ্ছা, আপনাদের ছেলেদের মাথায় কি মগজ নামে কিছু থাকে না?
~ আমি কিন্তু ভদ্রভাবে কথা বলছি।
~ আমিও যথেষ্ট ভদ্রভাবেই জিজ্ঞেস করছি। শুধু মেয়ে হলেই হলো, বিয়ে করে নিয়ে চলে আসবেন। কাকে আনছেন কার সঙ্গে কবুল বলছেন কিচ্ছু দেখবেন না?
আকাশের রাগ হচ্ছে অনেক কথাগুলো শুনে, উঠে সে বারান্দায় চলে গেলো। আকাশ কল করে ফারহান কে বললো,
~ হ্যালো, ফারহান?
~ হ্যাঁ আমি ফারহান, বল।
~ আসার সময় একজন উকিল আনতে পারবি সাথে?
~ কেন?
~ দেখি, যদি আজই ডিভোর্স টা করা সম্ভব হয় ভালো হবে। আমার সবার আগে বাসার সবার শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। মেয়েটা যতক্ষণ ধরে আছে বাবা মা কেউ ভালোমতো কথা বলছে না, খাচ্ছে না। কিছুই করছে না।
~ ডিভোর্স হয়ে গেলে তাদের খাবারের ক্ষুধাও ফিরে আসবে?
~ না আসার কোনো কারণ নেই। যা বলছি তা কর।
~ আচ্ছা তুই যা বলিস। আমি আর কি বলবো।
এরপর কল কেটে দিলো আকাশ। আকাশ একটু মায়ের ঘরে গেলো, গিয়ে মা কে ডেকে বললো,
~ তুমি দুপুরেও খাও নি কিছুই?
~ খাবো না কেন বাবা। আয় তো তুই, এইখানে বোস। আমার পাশে বোস, কথা বলি। অনেক্ষণ ধরে তোর সঙ্গে কথা বলি না।
~ কিভাবে যে কী হয়ে গেলো।
~ কেন?
~ এতকিছুর পরেও বলছো কেন?
~ কেন, মেয়েটা কি খারাপ?
~ জানি না।
~ ব্যাবহার কেমন?
~ আমি তো কথা বলি নি,জানি না।
~ যা গিয়ে কথা বল, সান্ত্বনা দে।
~ ধুর, তুমি এখন এইসব বাদ দাও।
~ বাবা, জানিস আমার আর তোর বাবার বিয়ে কিভাবে হয়েছিলো?
~ না দাওয়াত পাই নাই।
~ চড় দিবো ধইরা!এখনো আমার হাতে যে শক্তি আছে না! তোর দাঁত কয়েকটা তো ভাঙ্গবেই।

আকাশ কিছু না বলে হাসতে থাকলো, অনেকক্ষণ পরে হাসতে পারলো। তার মা ছাড়া কেউ তাকে এভাবে হাসাতে পারে না। তারপর তার মা তাকে বললো,
~ শোন, তোর বাবার সাথে আমার বড়বোনের বিয়ের আলাপ চলছিলো। কিন্তু তোর দাদা, মানে আমার শ্বশুরমশাই, উনি আমাকে দেখে বেশি পছন্দ করেন তার ছেলের জন্য।
~ বিয়ের আলাপ চলা, আর বিয়ের দিন গিয়ে ভুল করে অন্য কাউকে বিয়ে করে আনা তো আলাদা।

আমি সেটা বলি নি। আমি বললাম, বিয়ে করার পরেই তো সংসার গোছাতে হয়। এমন তো না ওই বর্ষাকে তোর পছন্দ ছিলো। সেও তোর কাছে আগন্তুক, এই মেয়েও তোর কাছে আগন্তুক। ক্ষতি কি যদি তোরা সংসারটা করিস?

আকাশের ভালো লাগছে না আর, সেও এখান থেকেও চলে গেলো। কিন্তু মায়ের কথাগুলো তার মনের মধ্যে গেঁথে গেলোমসে বুঝলো মা চাইছেন না যে বিয়েটা ভাঙ্গুক, কারণ এতে তাকেই সমাজের কাছে ছোট হতে হবে। কোনো মা ই চাইবেন না তার সন্তান সমাজের সামনে ছোট হোক।

আকাশ হঠাৎ ই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। ফারহান কে কল করে আবার না করে দিলো উকিলের কথা। ফারহান বেচারার শুধু শুধু দু হাজার টাকা জলে গেলো। এরপর আকাশ আবার মায়ের ঘরে গেলো, মাকে পেলো না। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে দেখে ভিতর থেকে দরজা লাগানো, সে ভয় পেয়ে গেলো মেয়েটা উলটাপালটা কিছু করে বসবে না তো আবার!একবার নক করলো, তখন ভেতর থেকে তার মা আওয়াজ দিলো,
~ এখান থেকে যা, আমি একটু ওর সঙ্গে আলাপ করছি।
মা আছে এই আশায় নিশ্চিন্ত হয়ে আকাশ চলে গেলো। ফারহানও এসে পড়লো। তারপর আরো একবার কলিং বেল বাজলো। আকাশ গিয়েই খুললো, দরজা খুলে দেখলো তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, দুকন লোক আর একজন মহিলা। তাদের মধ্যে থেকে একজন লোক বললো,

আমি চৈতীর বাবা। উনি আমার স্ত্রী। আর এই ভদ্রলোকটি হচ্ছেন আমাদের উকিল।
এরপর সুন্দরভাবে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদের ভেতরে আনা হলো। খাতির যত্নের কমতি হলো না। দুই পরিবারের মধ্যে কোনো কটু কথা কিচ্ছু হলো না, চৈতীর বাবা ভাবলেন, শুধু শুধু সম্পর্ক খারাপ করে লাভ নেই। হাসিমুখে ডিভোর্স টা সেরে ফেলতে পারলেই বাঁচা যায়। তাই উকিল নিয়েই এসেছেন। আকাশও তার বিকালে বিয়েটা না ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। ডিভোর্সে তারও আপত্তি নেই।

কিন্তু বাঁধ সাধলো চৈতী নিজেই। তার বাবা মা কে সে বললো ডিভোর্স সে দিতে পারবে না। সে সংসার করতে চায় এখানেই। কথাগুলো শুনে চৈতীর মা কেন যেন আকাশের মায়ের চোখের দিকে তাকিয়েছিলো কিছুক্ষণ। এই কয়েক মুহূর্তের চোখাচোখিতে দুই মায়ের মধ্যে হাজার হাজার বছরের আলাপ করা শেষ হয়ে গেছে।

ডিভোর্স টা আর হলো না। মেয়েকে ছাড়াই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন চৈতীর বাবা মা। গাড়িতে বসে চৈতীর বাবা বললো,
~ মেয়েটা যদি কেউ সংসার করতে চায় এখানে করুক, এদের দেখে খারাপ মানুষ মনে হলো না। কিন্তু…
~ কিন্তু কী?
~ একদিনে ছেলেটার সঙ্গে তার কি এমন প্রেম হয়ে গেলো যে সে সংসার করবে বলে স্থির করে ফেললো?
~ না ওই ছেলের সঙ্গে এখনো তার প্রেম হয় নি। আজকে দুটো সংসার বেঁচে গেছে তুমি জানো?মনে মনে কিন্তু আমরাও চেয়েছিলাম ডিভোর্স না হোক।
~ তা ঠিক।
~ স্বামী আর স্ত্রী বড়জোর একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে, তবে একটা আস্ত সংসার টিকিয়ে রাখতে তা যথেষ্ট না।
~ কী লাগে তাহলে সংসার টিকিয়ে রাখতে?
~ সংসার টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন হয় একজন মা।
এরপর ধীরে ধীরে হাসতে থাকলেন চৈতীর বাবা। হাসতে হাসতে বললেন,
~ তার মানে তুমি বলতে চাইছো চৈতী ওই ছেলেটার প্রেমে পড়েনি, ছেলেটার মায়ের প্রেমে পড়েছে!
~ হ্যাঁ আমি তাই বলতে চাইছি।
এটা বলে চৈতীর মা নিজেও হাসতে শুরু করে দিলো।

লেখা ~ রুবাইয়াত ফেরদৌস আলভী

আরো পড়ুন – আদর্শ বাসর রাত এর ৫টি গোপন সূত্র

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *