রোমাঞ্চকর গল্প

রোমাঞ্চকর গল্প – প্রতিশোধের আগুন | Thrilling Love Story

রোমাঞ্চকর গল্প – প্রতিশোধের আগুন: বাসার কাজের মেয়েটা মধ্যরাতে হঠাৎ আমার রুমে এসে দরজা আটকে দিল। রক্তমাখা ধারালো ছুরি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! মাথার চুলগুলো এলোমেলো, সমস্ত গায়ে রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে আছে। আমি হকচকিয়ে হাত থেকে মোবাইলটা ফেলে দিয়ে এক লাফে উঠে বসলাম। মেয়েটি আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কী হয়েছেরে ঈশিতা? তোর এই অবস্থা কেন? “সাথে সাথে আঙুল মুখে নিয়ে ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বললো। কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা আমার গামছাটা টেনে নিয়ে হাতে মুখে লেগে থাকা রক্তের দাগ মুছে ফেললো।”
 
ঈশিতার পরনে রক্তমাখা সেলোয়ার কামিজ, জামা সম্পূর্ণ কুঁচকে আছে, হাতার কিছু অংশ ছেঁড়া। রক্ত মোছার পর বুঝতে পারলাম ঈশিতার কিছু হয় নি, তবে এত রক্ত কিসের ছিল! ভয়টা ক্রমশ বেড়ে চলছে। ঈশিতা খুব সাবলীল শুদ্ধ ভাষায় আমাকে বলছে, “বাড়িতে এইমাত্র একটি খুন হয়েছে। সংখ্যাটা একটি পর্যন্ত রেখে যাব নাকি আরও একটা বাড়াবো সিদ্ধান্ত এখন আপনার!” আমি পুরো কথা শুনেও পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না, আবার প্রশ্ন করে বসলাম। মেয়েটি চাকুর এপিঠ ওপিঠ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনযোগ দিয়ে দেখছে আর উত্তর দিচ্ছে। “এই বাড়ির স্যার তালুকদার সাহেব এই মাত্র আমার হাতে খুন হয়েছেন!” কথা শুনে বুকে আমার প্রচন্ড চাপ বেড়ে গেল। মেয়েটা এসব কি বলছে!
 
চিৎকার আহাজারি করার মতো অবস্থানে ছিলাম না আমি। কারণ বাসাটা নিজের নয়, এই ফ্ল্যাটটি একজন কলেজ প্রফেসরের। আমি সাবলেট ভাড়াটিয়া হিসেবে তার ফ্ল্যাটে এক রুম নিয়ে থাকছি, আমার মতন আরও একটি রুম তারা ভাড়া দিয়েছেন, বাকি তিন রুমে স্যার তার স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। তাই বাড়িতে কার কি হয়েছে তার থেকে নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবাটাই এখন মূখ্য বিষয়। ঈশিতা কেন খুনি হতে যাবে!

আজব ব্যাপার, নিজেকে শান্ত রেখে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছি, আশেপাশে তাকিয়ে দেখছি আর ভাবছি আমি কি স্বপ্নের ঘোরে আছি নাকি বাস্তবে। মেয়েটা আমাকে বলছে, “কী ভাবছেন? বিশ্বাস হচ্ছে না?” একথা বলেই দরজা খুলে আমাকে উঁকি দিয়ে পাশের রুমে তাকাতে বলল। আমি মাথা উঁচিয়ে তাকালাম, দেখতে পেলাম পাশের রুমের মেঝে রক্তে ভেসে আছে, লোকটা বিবস্ত্র অবস্থায় নিচে পড়ে আছে! ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! পাশের রুমে খুন হয়ে গেল অথচ কিছুই টের পেলাম না! মা ঠিক কথাই বলতেন, বাড়িতে বোম ফুটলেও তুই কিছুই টের পাবি না, মোবাইলের ভিতরেই ঢুকে থাকবি!
 
মাথাটা ঠিকঠাক কাজ করছে না। একজন খুনির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, এখন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে তাহলে করনীয় কী? নিজেকে প্রস্তুত করে চাকুর দিকে লক্ষ্য রেখে কথা চালিয়ে গেলাম, “ঈশিতা শান্ত হ, কী হয়েছে খুলে বল? আমি তোর শত্রু নই, চাকুটা নামা” কথা বলতে বলতে দুই এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি তার দিকে। অল্পবয়সী যুবতী মেয়ে, লতাপাতার মতন বেড়ে উঠা হাতের মুঠে চাকুটা বড্ড বেমানান। মনে মনে ভাবছি, চাকুটা কোনোমতে ধরে ফেলতে পারলেই ব্যাস, এরপর বাকিটা নিজেই পেরে নিব, এই বাহুবল থেকে ছোটার মতো শক্তি প্রকৃতি তাকে দেয়নি।

এগিয়ে আসছি বুঝতে পেরে চাকু শক্ত করে উঁচিয়ে কর্কশ কন্ঠে সাবধান করে দেয়। “ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভারস্মার্ট! আর এক কদম এগিয়ে আসবি তো তোর দেহটাও ঠিক ওভাবে ফেলে রাখব!” আমি সাথে সাথে পিছিয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম আমি যে কাজের মেয়ে ঈশিতাকে এই কয়দিন দেখে এসেছি এই ঈশিতা সেই ঈশিতা নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রূপ। মুখের ভাষা থেকে শুরু করে চলনভঙ্গি সব কিছুই অচেনা লাগছে। মেয়েটি নিজ থেকেই বলা শুরু করলো, “চেয়েছিলাম শুধু স্যারকে মেরে যাবো, কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনে আপনাকেও উপরে পাঠিয়ে দেব, তাই বিন্দুমাত্র চালাকি করার চেষ্টা করবেন না, আপনাকে যেহেতু ভালো হিসেবেই চিনি অতএব ভালো হিসেবেই থাকুন, বাঁচতে চাইলে ওখান থেকে এক কদম নড়বেন না, যা যা বলবো মনোযোগ দিয়ে করে যান। আমি উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে বাধ্য শ্রোতা হয়ে খাটে উঠে বসে রইলাম।
 
মেয়েটা পাশে থাকা চেয়ার টেনে গা এলিয়ে বসে পড়লো। ফোনে কোথায় যেন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে, খুব শর্টকাট শব্দ ব্যবহার করছে। বাংলা হিন্দি নাকি চাইনিজ কিছুই বুঝতে পারলাম না। ধীরে ধীরে চাকুটাও নামিয়ে ফেললো। পুরো কক্ষ জুরে পিন পতন নীরবতা। কিছুক্ষণ পরপর সে বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে, কিছু একটা গভীর ভাবে ভাবছে। মেয়েটার কি মাথায় কোনো সমস্যা হয়েছে, নাকি সত্যিই ঠান্ডা মাথায় এমনটা করছে কিছুই বুঝতে পারছি না। মেয়েটা মাত্র দুই সপ্তাহ আগে এই বাসায় কাজে যোগ দিয়েছিল। এই মেয়ে যে এমন ভয়ংকরী খুনি ভাবতেও অবাক লাগছে। মনে হচ্ছে প্ল্যান করেই এই বাসায় তার আগমন। কিন্তু কেন? আদৌ কী এই একলা মেয়ের পক্ষে খুন করা সম্ভব?

বাড়ির বাকি মানুষেরা কই, তারা ঠিক আছে তো? মনে একেরপর এক প্রশ্নের ঝড় তুফান বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ছুরির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করার সাহস পাচ্ছিলাম না। এই কয়দিনে দুইএকবার কথাও হয়েছিল মেয়েটার সাথে, মুখটা দেখে একবার মনে মনে বলেছিলাম, আহারে! অভাবে পরে সুন্দরী মেয়েদেরকেও এভাবে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করতে হয়, আজ বড়লোক ঘরে জন্মালে তার পিছেও দু চারজন কাজের লোক ঘুরে বেড়াতো।

মেয়েটা কি আসলেই এত গরীব? নাকি বিপদে পড়ে কাজে নেমেছে? এরপর মুখের কথা শুনে সব সন্দেহ দূর হয়ে যায়, মুখে গ্রাম্য ভাষা, তোতলানো কথাবার্তা আর বোকার মতন ফ্যালফ্যালিয়ে হাসি এসব দেখে মনে আর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন জাগেনি। এখন আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, সে একজন নিখুঁত অভিনেত্রী! সন্দেহ করার মতন তেমন কিছুই আর খুঁজে পাইনি। এখন কথা শুনে বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা যথেষ্ট শিক্ষিত একটি মেয়ে। তার খুনের উদ্দেশ্যটা আসলে কী? সাহস নিয়ে আরও একবার প্রশ্ন করলাম। কে আপনি? কেন এসেছেন এখানে?
 
মেয়েটা নীরবতা ভেঙে উত্তর দিল,

– আমি মায়া, আমার একটাই পরিচয় আমি ভবঘুরে মায়া। বাকি সব পরিচয় মুছে ফেলেছি, এখানে সেখানে ঘুরে বেরিয়ে খাই, বাড়ি বাড়ি অমানুষ খুঁজে বেড়াই। খুব সহজ হিসেব, এখানেও এসেছিলাম খুন করতে।

– কেন খুন করেছেন?

– কারণ অমানুষদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।

– এই লোকটি আপনার কী ক্ষতি করেছে যে তাকে খুন করে ফেললেন?

– আমার আর কিসের ক্ষতি, আমার যা ক্ষতি হবার বহু আগেই হয়ে গিয়েছে, এখন মানুষের ক্ষতি রোধ করে বেড়াই, যাকে খুন করেছি তিনি একজন রেপিস্ট, এই বাসায় পূর্বে যেসব কাজের মেয়ে তার হাতে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে তাদের অভিযোগ পেয়ে প্রতিশোধ নিতে এসেছিলাম।

– তাই বলে মুখের কথায় সরাসরি খুন!

মেয়েটা মুচকি হেসে বলছে,

– মায়া প্রমাণ ছাড়া কারো কোনো ক্ষতি করে না, আমরা খবর পেয়ে সেই সব লম্পটদের বাসা বাড়িতে যাই, এরপর যতক্ষণ না নিজে তাদের লোভের শিকার হই ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাই, আজ যখন আমি নিজে শিকার হয়েছি, শোনা কথার প্রমান হয়ে গেছে, ব্যাস, সাথে সাথে আমাদের আদালতে তার মৃত্যুর রায় হয়ে গেল। সব তো প্রস্তুতি নেওয়াই থাকে, খুনটাও ঝটপট করে ফেললাম।

– আপনি পুলিশের কাছে যেতে পারতেন। আইনের আশ্রয় নিতে পারতেন, এভাবে কেউ নিজে নিজে।

এটুক বলতেই মেয়েটা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ছুড়ি নিয়ে আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে! গলায় ছুরি ঠেকিয়ে বলে,

– ও-ই সুশীল সমাজের বাচ্চা! আমাকে তুই আইন দেখাস? তোদের আইনরে আমি এইভাবে টুকরা টুকরা করে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবো!

– দেখুন প্লিজ, প্লিজ শান্ত হোন। আমি আপনার ভালোর জন্যেই বলছিলাম, আপনার বিপক্ষের কেউ নই, মাথা ঠান্ডা করুন।

মেয়েটা আস্তে আস্তে ছুরি সরিয়ে নেয়, নিজেকে শান্ত করে খোলা চুল মুড়িয়ে খোঁপা বেঁধে নেয়। মেয়েটার ভেতরে যে কী পরিমাণ ক্ষোভ জমে আছে একটু আগে তার চোখে মুখে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। তার রক্তিম চোখের চাহনি, নাকের ডগায় ভেসে উঠা লালচে রঙের আভা ক্ষনিকের জন্য আমার হার্টবিট বন্ধ করে দিয়েছিল।
 
মেয়ে শান্ত গলায় আমাকে বলছে,

দুঃখিত, আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই, যে কয়দিন থেকেছি জেনেছি, আপনি মানুষটা অনেক সহজ সরল, আমার ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না। বাসার নিচে গোলির মোরে আমাদের লোকেরা অপেক্ষা করছে আমাকে নিয়ে যেতে, কিন্তু ছোট্ট একটা বিপদে পড়ে বাধ্য হয়ে আপনার রুমে আসতে হলো। একটু আপনার সাহায্যের প্রয়োজন।

– কেমন বিপদ?

– আমাদের পালানোর পথ প্রতিবারের মতো প্রস্তুত করাই থাকে, কিন্তু সবসময় তো আর প্ল্যান মোতাবেক কাজ হয় না, ছাদে কে যেন আজ অন্য তালা লাগিয়ে রেখেছে। তালাটা আপনার ভেঙে দিতে হবে।

– না না আপনার কাজ আপনি করুন গিয়ে, আমাকে এসব ঝামেলায় ফেলতে আসবেন না।

– এই যে মিস্টার এই যে, আপনি কি জানেন এমুহূর্তে সবথেকে বিপদে এখন আপনিই রয়েছেন?

এখন যদি সবাই আমাকে ধরেও ফেলে একমাত্র আপনিই ফেঁসে যাবেন। আমি শুধু বসে বসে কাঁদবো, কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাব। কোনো থানা পুলিশে আমাকে কিছুই করতে পারবে না। মেডিক্যাল রিপোর্টে দেখবে আমি ধর্ষিত! আমি চাইলে ধর্ষিত হবার পূর্বেই লোকটিকে মেরে ফেলতে পারতাম,, অতটা কাঁচা প্লেয়ার যে আমি নই, প্রত্যেকের খায়েশ মেটানোর পরেই তাদের মেরে থাকি। যেন কখনো ধরা খেলে পুলিশ আদালত আমাকে ধর্ষিতা হিসেবেই দেখবে। এতে করে খুনটাকেও আত্মরক্ষা হিসেবে চালিয়ে বাঁচা যাবে। এখন আমার পালিয়ে যাওয়া মানে আপনার বেঁচে যাওয়া। আপনার ভালোর জন্যেই বলছি, বাকিটা আপনার ইচ্ছে।
 
– আমিতো এমনেতেও ফেসে যাবো, নিরপরাধ আমাকে যে ফাঁসিয়ে যাচ্ছেন, এদিকে একটিবার ভাবলেন না!

– কোথায় আপনি ফাঁসলেন?

– আপনি তো পালাচ্ছেন, কিন্তু ধরা তো খাব আমরা ভাড়াটিয়ারা, এরপর পুলিশ রিমান্ড পুরো লাইফটাই শেষ হয়ে যাবে আমার।

– দুশ্চিন্তার কিছু নেই, এই পর্যন্ত আমরা সবাই মিলে চুয়ান্নটা কেস সলভ করেছি! আজ পর্যন্ত নিরপরাধ কাউকে বিপদে ফেলিনি।

– কী বললেন, চুয়ান্নটা খুন! এরমানে মাঝেমধ্যে ধর্ষকের মৃত্যু নামে যেসব সংবাদ ভাইরাল হতে দেখি সেগুলো আপনাদের কারো কাজ?
 
মেয়েটা হ্যাঁ না কিছু না বলে মুচকি হেসে চাকুর দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে। অন্যমনস্ক হয়ে বলে, “জানেন, এই পথটা আমি বেছে নিয়েছি কতটা কষ্ট পাবার পর তা একমাত্র আমিই জানি, সেই কবেই মরে যেতাম, হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে তার সৃষ্টিতে জন্মে যাওয়া কিছু আবর্জনা সাফাই করতে। এই ছোট্ট জীবনে বহুবার অপবিত্র হয়েছি পবিত্র লেবাসধারী কিছু অমানুষ দ্বারা” কাহিনী বলতে বলতে আপনা আপনি নিজ আত্মকাহিনীর গভীরে ঢুকে যায় সে। একটানে গড়গড়িয়ে সব বলে দেয়, “জানেন, তখন আমি এতটাই ছোট ছিলাম যে (কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে) ধর্ষণ শব্দটার মানে কি সেটাও বুঝতে শিখিনি।

যাদের বুকে মাথা রেখে মেয়েরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যায়, সেখানেও আমাকে জামা টেনে দৌড়ে পালাতে হয়েছে। কেউ আমাকে সাহায্য করেনি, কাউকে বুঝাতে পারিনি। আমার কষ্টগুলো ছিল তাদের আনন্দের একটি অংশ মাত্র।” মেয়েটার কণ্ঠস্বর অনবরত কাঁপছে, ঠোঁট দুটো চাপিয়ে চোখের পানি ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্ষণিক বাদে মেয়েটা জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শক্ত করে নেয়। দুবার কেশে নিয়ে গলা স্বাভাবিক বানিয়ে বলে, “এভাবেই ধীরে ধীরে নিজেকে এই মানব সেবায় বিলিয়ে দিয়েছি, যদিও আমি তাদের নতুন সদস্য, আমার মত অনেকেই আছে এই দলে, সবাই একত্রে প্ল্যান করে কাজ করি, এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। আপনাদের কারো ভয় নেই, সবার রুম বাহির থেকে আটকে দিয়েছি, আপনার রুমটাও আটকে যাবো। পুলিশ এসে দেখবে সবার রুম বাহির থেকে তালা দেওয়া। কাউকে খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হবে না, আপনিও বাকিদের মতো কিছুটা বিচলিত ভাব নিয়ে চলবেন, তাতেই হবে। এবার বলুন আমি কি সাহায্য পেতে পারি?
 
আমি এতক্ষণ কথার ভেলায় ভেসে তার শৈশবে চলে গিয়েছিলাম। ক্ষণিকের জন্য তার জায়গাতে নিজেকে বসিয়ে ফেলেছিলাম। মেয়েটার জীবনের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছিল আমার। হাত দিয়ে নিজের মুখটা মুছে বললাম, “বিল্ডিংয়ের ছাদ বেয়ে নামবেন কিভাবে?” উত্তরে বলল, “সেই ব্যবস্থা আগেই করা আছে, যেদিন এসেছি সেদিনই পর্যাপ্ত দড়ি পানির ট্যাংকির পেছনে রেখে এসেছি, প্রতিদিন কাপড় শুকোতে গিয়ে দেখে আসতাম পালানোর রাস্তা সব ঠিকঠাক আছে কি না, ওসব নিয়ে চিন্তা নেই, শুধু তালাটা কে যেন আজ অন্যটা লাগিয়ে রেখেছে, এটার কিছু একটা ব্যবস্থা করলেই পালিয়ে যেতে পারব।”

আমি ড্রয়ার থেকে ছাদের চাবি বের করে হাত এগিয়ে বললাম, “জায়গা মতোই এসেছেন, ছাদের তালা কাল পরিবর্তন করেছে, চাবিটা দারোয়ান আমাকে দিয়েছিল স্যারকে দিতে, আর দিতে মনে নেই, মনে হচ্ছে আপনাকে দেয়ার জন্যেই আমার কাছে রয়ে ছিল।”

মেয়েটি ছোট্ট হাসি দিয়ে চাবি দ্রুত হাতে নিয়ে নেয়।
 
এরপর সে বাকিদের মতো আমার রুমের দরজাটাও আটকে দিতে নিচ্ছে, আমি দরজাটা টেনে ধরে শেষ বারের মতো তাকে জিজ্ঞেস করি,

– আপনার সাথে যোগাযোগ করার কি কোনো মাধ্যম আছে? কোনো নাম্বার কিংবা ঠিকানা?

মেয়েটা অবাক সুরে বলছে,

– ওমা, একজন খুনির সাথে যোগাযোগ রেখে কী করবেন শুনি?

– জানি না, তবে যদি কখনো কোনো সাহায্য করার সুযোগ হতো, এগিয়ে আসতাম।

মেয়েটা হাসিমুখে না সূচক মাথা নেড়ে বলে,

– ধন্যবাদ, এতটুকু বলেছেন তাতেই অনেক খুশি হয়েছি। আপনি সত্যিই অনেক আলাভোলা একটা ছেলে। এসবের ভেজালে আর জড়ানোর প্রয়োজন নেই, এনজয় ইউর লাইফ।
আমি আর কিছু না বলে বিদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটা দরজা আটকানোর আগমুহূর্তে উঁকি দিয়ে আমার কানে ফিসফিসিয়ে বলছে, “এর পরেও যদি আমার দেখা পেতে চান, তবে আপনিও এদের মতো দুই একটা রেপ করে ফেলুন! দেখবেন সময়মতো আমার দেখা পেয়ে যাবেন! হা হা হা” মেয়েটা নিচু স্বরে হাসতে হাসতে দরজাটা বাহির থেকে আটকে দেয়।
 
কী অদ্ভুত ভয়ংকরী মেয়ে! সিরিয়াস মুহূর্তেও মজা নিতে নিতে যাচ্ছে। মাথা থেকে সব চিন্তা ঝেড়ে বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে রইলাম। নিজেকে বুঝালাম, আমি কিছু জানি না, আমি কিছুই দেখিনি, বাকিদের মতো আমিও দরজা খুললে আকাশ থেকে পড়বো। জুড়ে চিৎকার দিয়ে পাশে যাকে পাবো তাকে জড়িয়ে ধরবো। কোনোমতে এই বিপদ থেকে বাঁচতে পারলেই হল, এরপর আমি আর এই এলাকার সীমানাতে নাই।
 
এভাবে ধীরে ধীরে ভোর হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন উঠেছে। পাশের রুমে দরজা ধাক্কানোর শব্দ, সম্ভবত ম্যাডাম রুম থেকে আওয়াজ করছেন। এরপর দরজা ধাক্কাধাক্কির শব্দে আরেক রুমের ভাড়াটিয়া ছাত্র দু’জন জেগে উঠেছে, তারাও দরজা ধাক্কাছে। সবার দরজা তালা দেওয়া। আমিও তাদের সাথে যোগ দিলাম। নিজেও জোরে জোরে দরজা ধাক্কাছি আর বলছি, দরজা আটকালো কে!

এভাবে শব্দ হতে হতে দারোয়ান উপরে উঠে এলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো বাড়ি হৈ চৈ বেধে গেল। আধাঘন্টার মধ্যে বাড়িতে পুলিশের গাড়ি এসে হাজির।

তারা একে একে রুমের তালা ভাঙছে। প্রত্যেকের রিয়াকশন ফলো করলাম, অন্য রুমের দরজা খুলতেই কে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম। সব শেষে আমার দরজায় হাত দিয়েছে তারা। আমার হাত পা বার বার ঘামছে। ঘাম মুছে নিতে গামছার দিকে তাকাতেই কলিজার পানি শুকিয়ে যায়! পুরো গামছা জুড়ে রক্ত লেগে আছে! মেয়েটা যে রক্তমাখা হাত মুখ মুছে দরজার পাশে ফেলে রেখেছিল আমার আর সেদিকে খেয়ালই নেই! সর্বনাশ হয়ে যাবে! দ্রুত লুকিয়ে ফেলার জন্য গামছাটা হাতে নিতে যাব ঠিক সেই মুহূর্তে দরজাটা খুলে যায়! দরজা খোলাতে গামছাটা দরজার আড়ালে পড়ে যায়। আমার আর নড়াচড়া করার কোনো উপায় নেই, সামনে পুলিশ, বাকিদের মতো রুম থেকে অবাক হয়ে বেরিয়ে এলাম, আমিও বাকিদের মতো বিচলিত হয়ে গেলাম। খুব বেশি অভিনয় করতে হয়নি, গামছাটা আমার রুমে রয়ে গেল সেই চিন্তায় আমার হাত পা এমনেতেই অনবরত কাঁপছে। পেছন ফিরে তাকানোর আর সুযোগ নেই। পুলিশের নির্দেশে সোজা নিচে নেমে যেতে হয়েছে।
 
বাড়ির গ্যারেজ ভর্তি পুলিশ। সবাই সেখানে জড়ো হয়ে আছে। ঠিকমতো দাঁড়ানোর জায়গা নেই। বাড়ির মেইন গেইট বন্ধ রাখা হয়েছে। ভাড়াটিয়ারা এক পাশে দাঁড়িয়ে আছি, অপরপাশে স্যারের স্ত্রী বাকশূন্য হয়ে বসে আছেন। কিছুক্ষণ বাদে ডেডবডি নামিয়ে এম্বুল্যান্সে তোলা হলো। উপরে থাকা পুলিশরাও ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। তারা ম্যাডামের সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছেন। কথাবার্তায় মনে হচ্ছে তারা এখন চলে যাবেন। মনে মনে বলছি এই যাত্রায় তাহলে বেঁচে গেলাম। তারা বোধহয় আমার রুমের গামছাটা আর খেয়াল করেননি। এমন সময় পেছন থেকে কারো হাত আমার কাঁধে এসে পড়লো। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম আমার থেকেও এক হাত লম্বা জলহস্তির ন্যায় একজন পুলিশ অফিসার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন! ইশারায় তিনি ম্যাডামকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলেন, ম্যাডাম শুধু দূর থেকে মাথাটা নাড়লেন। এরপর অফিসার আমার শার্টের কলারটা মোচড়ে ধরে হেঁচকা টেনে বললেন, “গাড়িতে উঠুন!”
 
চলবে…


পর্ব – ২

দানবীয় আকৃতির পুলিশ অফিসার যখন আমার কাঁধে হাত রাখলেন। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই জগতে আমার থেকে অসহায় আর কেউ নেই। শার্টের কলারে হেঁচকা টান খেয়ে বুঝতে পারলাম আমি এবার পুরোপুরি ফেঁসে যাচ্ছি। জেলের ভাত নসিবে বোধহয় লেখা হয়ে গেছে। কথা না বাড়িয়ে তারা আমাকে ঝটপট গাড়িতে তুলে নিল। ভেতরে ঢুকেই মুখোমুখি হলাম বাড়ির দারোয়ানের সাথে। তাকেও তারা আগেভাগে গাড়িতে তুলে রেখেছিল। আমাকে দেখা মাত্রই দারোয়ান উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলো, “স্যার এইতো এইতো তারেই কালকে চাবি দিছিলাম, ছাদের তালা খুললে সেই খুলছে, আমার কোনো দোষ নাই স্যার, আমারে ছাইড়া দেন স্যার” পুলিশ অফিসার এক ধমক দিয়ে বললেন, চোপ! যা কথা বলার থানায় কথা হবে, আর একটা সাউন্ড যেন না হয়।

আমি এমনেতেই পড়ে আছি মহাবিপদে তার উপর চাবির দোষ লাগিয়ে বিপদ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দুজন দুজনের দিকে খিটমিটে চোখে তাকিয়ে আছি। দারোয়ানের ব্যবহার দেখে মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হচ্ছে। বিপদ যখন আসে সব দিক থেকে ধেয়ে আসে।
 
আমাদের দুজনকে নিয়ে তারা রওনা দিয়েছে থানার উদ্দেশ্যে। আমাদের পাহারা দিতে পাশে ছয় জন পুলিশকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমার বংশের আমিই প্রথম কোনো সুসন্তান যে আজ হাতকড়া পরে থানায় যাচ্ছে, তাও আবার মার্ডার কেসের সন্দিহান আসামি হয়ে। এই মুসিবত থেকে বাঁচার এখন উপায়টা কী? বসে বসে গভীর ভাবে ভাবতে লাগলাম। চিন্তা করতে করতে দোটানায় পড়ে গেলাম, মনের একপাশ জানান দিচ্ছে, ধরা তো পড়েই গেছিস লুকিয়ে আর কী লাভ? যা শাস্তি হবার হবে, যা যা দেখছিস, সবকিছু খুলে পুলিশকে বলে দে, আবার সাথে সাথে মনের অন্যপাশ বলে উঠছে, স্বীকার করে নিলে আরও জটিল অবস্থায় ফেঁসে যাবি, খুনিকে পালানোর সাহায্যের অপরাধে তখন জেল হয়ে যাবে তোর, প্যাঁচে ফেলিয়ে তোকেও খুনি বানিয়ে দিতে পারে।

নীল পোশাকের উপর বিশ্বাসটা আজকাল উঠে গিয়েছে। কখন কে কার স্বার্থে তিলকে তাল বানিয়ে বিপদে ফেলে দেয় তার নেই ঠিক। নীল ছায়া তলে কত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায় আবার কত নিরপরাধীরা জেলের ভাত খায় তার হিসেব নেই। অনেক ভেবে দেখলাম, পুরোপুরি সত্যবাদী হতে চাইলে উল্টো আরো বিপদের আশংকা রয়েছে। এছাড়া অস্বীকার করলে কোর্টে লড়তেও সুবিধা হবে। এটা বাংলাদেশ, এই দেশে স্পষ্টভাষী আশরাফুল হতে গেলেই বিপদ, এর চেয়ে বরং রুবেল হয়ে থাকি ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে!
 
পৌঁছানোর সাথে সাথে দুজনকে কড়া নিরাপত্তায় নিয়ে যাওয়া হলো বিশেষ একটি কক্ষে। এক কর্মী এসে ফরমালিটি পালন করলেন, আমার নাম ঠিকানা বিস্তারিত লিখে নিয়ে গেলেন। এরপর রুমে অনেকক্ষণ যাবৎ একা একা বসে রইলাম। তারা প্রথমে দারোয়ানকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ যাবৎ তার সাথে কথা চলছে। এদিকে আমি বসে বসে নিজের মনটাকে শক্ত করে নিলাম। সব দিক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আমি অস্বীকার করেই যাব। যেহেতু এদিকেও বিপদ ওদিকেও বিপদ, চেষ্টা করতে দোষ কোথায়? রিস্ক না হয় একটা নিনেই নিলাম, যত ধকল সইতে হয় সইতে থাকি কিন্তু কিছুতেই খুন সম্পর্কিত কোন কিছু স্বীকার করা যাবে না। আমি কিছুই দেখিনি, আমি কিছুই জানিনা, খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

জটিল প্রশ্ন গুলোর উত্তর যা যা দেব ঝটপট মাথার ভেতর খসড়া বানিয়ে নিলাম। গামছা এবং চাবি এদুটোর সন্দেহ দূর করতে পারলেই হলো। এছাড়া পুলিশের কাছে আর কোনো সন্দেহের আলামত নেই। গামছাটা নিয়ে আমার প্রথম দুশ্চিন্তা, তবে স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে গামছা আমি স্পর্শই করিনি, গোসলের পর ধুয়ে হ্যাঙ্গারে মেলে দিয়েছিলাম, সেই গামছায় রক্তের দাগ, স্পর্শ, গায়ের ঘাম যা কিছু লেগে আছে সব কিছুই সেই মেয়ের স্পর্শ, পরীক্ষা নীরিক্ষা করলে আমার কোনো চিহ্নই পাওয়া যাবে না। এদিকে রুমের দরজাটা যেহেতু ভেতর থেকে আটকানো ছিল না, বাহির থেকে তালা দেওয়া ছিল সুতরাং আমার রুমে খুনি চাইলেই আসতে পারে, আমিও বাকিদের মতো গভীর ঘুমে ছিলাম, কিছুই জানি না। এই ব্যাপারটাই আত্মবিশ্বাসের সাথে তাদের বুঝাতে হবে।
 
কিছুক্ষণ বাদে আসলো আমার ডাক। রুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম সেই জলহস্তির ন্যায় অফিসার চেয়ার বাঁকিয়ে হেলে বসে আছেন। আমাকে দেখে তিনি এক ইঞ্চিও নড়লেন না, চোখ নাড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন ‘বসুন’। আমি চুপচাপ দারোয়ানের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লাম। লোকটা আমার নাম ঠিকানার ফরমটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করছেন,

– মিস্টার হৃদয়, শুরুতেই আপনাকে ছোট্ট একটা সুযোগ দিচ্ছি, এই খুন সম্পর্কিত আপনার কি কিছু বলার আছে?

– না স্যার, এমন কিছু জানা নেই।

– ঠিক আছে, এখন আমি যা যা প্রশ্ন করবো খুব সহজ ভাবে নির্ভয়ে উত্তর দিয়ে যাবেন।

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।

– আপনি খুনি কে চেনেন?

– না স্যার, কে খুন করেছে, কখন করেছে আমিই কিছুই জানি না, আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা কি হচ্ছে এসব!

অফিসার তার ভারী দেহ নাড়িয়ে উচ্চস্বরে রুম কাঁপিয়ে বললেন, “আমি জিজ্ঞাসা করেছি আপনি কি খুনিকে চিনেন, আপনার উত্তর হবে হ্যাঁ অথবা না। ইস দ্যাট ক্লিয়ার? বুঝতে সমস্যা হলে আপনার পাশের লোকের মুখটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, কি? কিছু দেখতে পেয়েছেন?

আমি দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালাম, দেখতে পেলাম তার গাল ফুলে পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে আছে!

অফিসার এবার কণ্ঠ স্বাভাবিকে নামিয়ে বললেন, “আপনাকে সম্ভবত বুঝাতে পেরেছি, আমি বাড়তি কথা একদম পছন্দ করি না, আপনাকে দেখে শিক্ষিত মনে হচ্ছে, তাই গায়ে হাত না তুলে বুঝিয়ে বললাম, যা জিজ্ঞেস করবো ঠিকঠাক উত্তর দিয়ে যান, নির্দোষ হলে এমনেতেই ছাড়া পাবেন।”

আমি বাধ্য ছেলের ন্যায় চুপ করে বসে রইলাম। পুলিশের হুংকারে গলাটা শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে, বুকের ধুকধুকানির শব্দ কানে এসে ধুপ ধুপ বাড়ি খাচ্ছে। ভয়ে ভয়ে পরবর্তী প্রশ্নের অপেক্ষায় বসে আছি।
 
– এবার বলুন, আপনি কি গতরাতে দারোয়ানের কাছ থেকে ছাদের চাবি নিয়েছিলেন?

– জ্বী স্যার।

– কেন নিয়েছেন?

– দারোয়ান আমাকে দিয়েছিল স্যারকে দিতে।

– চাবিটা এখন এনে দেখাতে পারবেন?

– চাবি এখন স্যার কোথায় রেখেছেন আমি কিভাবে পাবো? চাবি তো উনি বাড়ির স্যারকে দিতে বলেছিল, আমি নিয়ে সরাসরি স্যারের হাতে দিয়েছিলাম।

 অফিসার দারোয়ানের দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করলেন “আপনি কি চাবিটা স্যারকে দিতে বলেছিলেন?”

দারোয়ান ছোট করে উত্তর দিল, “জ্বী বলেছিলাম।”
 
অফিসার গভীর চিন্তায় মাথা ঝাঁকিয়ে পরের প্রশ্নে গেলেন,

– মিস্টার হৃদয়, আপনার গামছার রঙ মনে আছে?

– স্যার আমার দুটো গামছা, একটার প্রিন্ট লাল চেক আরেকটা হলুদ।

– হুম, হলুদ গামছাটা কোথায় রেখেছেন?

– গামছা তো আমার রুমেই থাকে, সম্ভবত চেয়ারে অথবা হ্যাঙ্গারে ঝোলানো, সঠিক মনে পড়ছে না।

– একটু মনে করে দেখুন,

– যেহেতু গোসলের পর ধুয়ে হ্যাঙ্গারে শুকাতে দিয়েছিলাম এরপর আর ব্যবহার করা হয়নি, সম্ভবত সেখানেই আছে। স্যার আপনি চাইলে দুটো গামছাই এনে দেখাতে পারবো, আমার রুমেই আছে।

পুলিশ চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন,

– গামছা দুটো দেখাতে পারবেন?

– জ্বী স্যার, অবশ্যই।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরের প্রশ্নে গেলেন,

– আপনি আমাকে স্পষ্ট ভাবে খুলে বলুন, আপনি বাসায় রাতে কোনো শব্দই পাননি?

– না স্যার।

– কোনো কথাবার্তা, ঝগড়া বিবাদ?

– না স্যার।

– একটি মানুষ খুন হয়ে গেল কিছুই শুনতে পাননি? কী করছিলেন সেই সময়?

– স্যার আমি কিছুই জানি না, মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, দরজা চাপানো ছিল, কে কখন আটকে দিয়েছে বুঝতেও পারিনি। এরপর কীভাবে যেন মোবাইল ব্যবহার করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, ভোর বেলায় দেখি কে যেন পাশের রুমে দরজা ধাক্কাছে, শব্দ পেয়ে উঠে দেখতে পেলাম আমার দরজাও লক।

– আপনি সর্বশেষ আপনার রুমে প্রবেশ করেছিলেন কখন?

– আনুমানিক রাত নয়টার পর।

– এরপর আর রুম থেকে বের হননি?

– না স্যার।

– আপনি মোবাইলে কী করছিলেন?

– সচারাচর যা করে থাকি, ফেসবুকিং চ্যাটিং এসবই আর কি।
 
অফিসার নড়েচড়ে বলে উঠলেন “গ্রেট আইডিয়া!” তিনি দ্রুত তার সহকারীকে আমার জব্দ করা মোবাইলটা দিতে বললেন। মোবাইল আমার হাতে দিয়ে বললেন লকটা ছাড়িয়ে দিন, আপনার ফেসবুক চেক করবো। আমি লকটা ছাড়িয়ে দিলাম আর মনে মনে ভাবলাম আসলেই তো গ্রেট আইডিয়া! পুলিশ নিজেই আমার বাঁচার পথ আরেক ধাপ এগিয়ে দিলেন। এটাতো আমার মাথাতেই আসেনি। তিনি যখন আমার ইনবক্স ঘাটবেন দেখতে পাবেন আমি পুরো সময় জুড়ে একনাগাড়ে বহুমুখী চ্যাটিং এ ব্যস্থ ছিলাম! টাইম গুলো চেক করলেই বুঝে যাবেন আমি রাতে মোবাইল নিয়েই পড়ে ছিলাম। যদিও প্রাইভেট ম্যাসেজ দেখানো নিজের জন্য লজ্জাজনক তবুও লজ্জা থেকে সন্দেহ মুক্ত হওয়াটাই এখন বেশি জরুরী।
 
অফিসার কপাল কুঁচকে গম্ভীর মুখে আমার মেসেঞ্জার ইনবক্স ঘাটছেন। একটা করে ম্যাসেজ পড়ছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন। এভাবে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে আমার ইনবক্স ঘাটলেন। মান সম্মান বলতে আর কিছু রইলো না! মোবাইল রেখে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বললেন, আপনাকে তো ভদ্র ছেলেই মনে করেছিলাম, দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছ উল্টোতে জানেন না! কিন্তু তলে তলে এই চলে! হুমম, মানুষ একটা নিয়েই পারে না আর আপনি একই সাথে ননস্টপ চার পাঁচটা চালিয়ে যাচ্ছেন, বাহ!

আমি লজ্জার হাসি হেসে বললাম,

– স্যার আসলে, ইয়ে মানে, অইরকম কিছু না! এমনি আর কি।

– হা হা হা, বুঝি বুঝি, আমরাও এই বয়স পার করে এসেছি!
 
অফিসারের কথার সুর শুনে বোঝা যাচ্ছে তার আর আমার উপর বিশেষ কোনো সন্দেহ নেই। তিনি এখন ভিন্ন সুরে আমার সাথে কথা বলছেন,

“মিস্টার হৃদয়, আসলে যতদূর বুঝতে পারছি খুনটা সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পিত। খুনের ধরন, আঘাতের ক্ষত স্থান, লাশের গায়ে ধর্ষক লিখে যাওয়া এগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে সংঘবদ্ধ কোনো চক্রের কাজ। এমন কেস এই কয়েক মাসে বেশ কয়েকটা পেয়েছি। এখানে বাড়ির কাজের মেয়ে পরিচয়ে ঢুকে খুনটা করা হয়েছে, একেক সময় একেক লেবাসে এরা খুন করে বেড়াচ্ছে, আলামত দেখে ধারণা করা হচ্ছে এটাও সেই একই চক্রের কাজ। বাকিটা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এলেই বুঝা যাবে। খুনি সব প্রস্তুতি নিয়েই ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল। আপনাদের ফ্ল্যাটে চেতনানাশক মেডিসিনও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। আপনারা একেকজন যেভাবে গভীর ঘুমে ছিলেন, তাতে বুঝা যাচ্ছে মেডিসিনের কোনো প্রয়োগ ঘটানো হয়েছিল। আর আপনার ইনবক্স ম্যাসেজ দেখেও বুঝলাম এতো রোমাঞ্চকর চ্যাটিং চলছিল এর মাঝপথে হুট করে যেভাবে চ্যাট বন্ধ করে দিলেন, মনে তো হচ্ছে আপনিও বাকিদের মতো অজান্তেই ঘুমের কোলে ঢোলে পড়েছিলেন।”

আমিও উনার সাথে তাল মিলিয়ে বললাম, “জ্বী স্যার, কিভাবে যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝতেও পারলাম না!”
 
যাই হোক, এবার মূল কথায় ফিরে আসি, যেকারণে আপনাকে ধরে আনা হয়েছে। আপনার রুমে খুনি এসেছিল সেই আলামত আমরা স্পষ্ট পেয়েছি, আপনার গামছাটা তারা ব্যবহারও করেছে। আপনার ভাষ্যমতে আপনি কিছুই জানেন না, আপাতত আপনার কথাই মেনে নিলাম, বাকিটা রিপোর্ট এলেই বুঝা যাবে। যেহেতু গামছাটা আপনার এবং কেসটা মার্ডারকেস তাই আপনাকে এই মুহূর্তে ছাড়তে পারছি না। গামছাটা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে, পোস্টমর্টেম রিপোর্টটাও হাতে পেয়ে যাবো, যদি আপনাদের কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে না পাওয়া যায় তবে দুশ্চিন্তার কারণ নেই, দুই একদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাবেন। তদন্ত আরও চলছে, রিপোর্ট গুলো হাতে পাবার আগ পর্যন্ত আপনাকে হাজতেই থাকতে হবে।
 
কি আর করার দুইদিন জেলের ভাত খেয়েই কাটিয়ে দিতে হবে। এখন অবশ্য আপত্তি নেই, মনের যত ভয়গুলো জমে ছিল, অধিকাংশই কেটে গিয়েছে, ছাড়া পাওয়া এখন কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
 
এভাবে দুইদিন পার হয়ে যায়, তারা কোনো দোষ না পেয়ে দারোয়ানকে ঠিকই ছেড়ে দেয় কিন্তু আমাকে আর ছাড়া হয় না। ইনিয়েবিনিয়ে তাদের মুখে একটাই কথা আপনার অভিভাবককে আসতে বলুন, জরুরী কথা আছে। মাঝে আমার এক প্রতিবেশী ভাই এসে ঘুরে যায়, তাতেও লাভ হয়নি। অনেক বুঝালাম, বাবা হার্টের রোগী তাই বাড়িতে এসব জানাতে চাচ্ছি না, আপনাদের সেই অফিসারের সাথে আমাকে আরেকবার একটু কথা বলিয়ে দিন, তারা কোনো কথা না শুনে পাশ কেটে এরিয়ে যায়। এসব দেখে পাশে থাকা অন্য এক আসামি আমাকে বলে,

– প্রথম আইছেন এইখানে?

– হুম।

– এজন্যই বুঝেন না কিছুই!

– মানে?

– আপনার লগে থাকা দারোয়ান ছাড়া পাইয়া গেল আর আপনে পাইলেন না, বুঝেন নাই? দারোয়ানরে রাইখা তাগো তেমন কুনো লাভ নাই, কিন্তু আপনেরে রাইখা দিলে লাভ আছে (ইশারায় দুই আঙুল ঘষে বলে) সব ধান্দার খেলা, কিছুমিছু না দিলে কাজ হইব না।
 
চাপা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাড়িতে বোধহয় এখন জানাতেই হবে। নিশ্চয়ই মোটা অংকের টাকা দাবি করে বসবে, এত টাকা আমি পাব কই! কাকে প্রথম জানাবো, কিভাবে শুরু করবো, আত্মীয়স্বজনদের কিভাবে এড়িয়ে যাব ভাবতে লাগলাম। আমি নিশ্চিত বাড়িতে বলা মাত্রই বাবা হই হুল্লোর শুরু করে দেবেন, যাকে তাকে ফোন দিয়ে অস্থির হয়ে যাবেন। এভাবে এলাকা আত্মীয়-স্বজন জানাজানি হলেই বিপদ। মানুষ তো আর এতকিছু শুনতে যাবে না, হৃদয়কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, একেকজন বাড়ি বাড়ি ঢোল পিটিয়ে বেরাবে। এসব ভাবতে ভাবতে সেই দিনটা পার হয়ে যায়।
 
রাত নয়টা বাজে, রাতের খাবার অর্ধেক পেটে ঢুকিয়েছি, এমন সময় এক পুলিশ কর্মী এসে বললো বেরিয়ে আসুন, আপনার জামিন হয়ে গেছে। শুনে বেশ অবাক হলাম, এই রাতে হুট করে জামিন! অফিসারের রুমে এগিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেলাম কোট টাই পরিহিত এক ভদ্রলোক সেখানে বসে আছেন। অফিসার হাসিমুখে তার সাথে গল্পগুজব করছেন। আমি রুমে প্রবেশের সাথে সাথে লোকটা চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, “আরে ভাগ্নে, তুই আমাকে একটা ফোন দিলেই পারতি, এভাবে থানায় পড়ে আছিস কেন!” আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, আমার তো কোনো মামা খালু কেউই নেই, এই মামা আবার কোত্থেকে আসলো!

লোকটা চোখ টিপে ইশারায় আমাকে চুপ থাকতে বললো। আমি মাথা নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। জলহস্তির ন্যায় অফিসারটি আমাকে আদুরে ধমক দিয়ে বললেন, “আপনি স্যারের আত্মীয় একটিবার আমাকে বলবেন না? আজব তো” সেই লোক এগিয়ে বললেন, “যা হওয়ার হয়েছে, আপনাদের কী আর কোনো জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে? “না না স্যার, উনি নির্দোষ, কাল সকালে এমনেতেই ছেড়ে দিতাম!” “ঠিক আছে তাহলে জামিনের প্রসেসিং করে ফেলুন, রাত অনেক হয়ে গেছে, উঠতে হবে।”
 
কিছু কাগজে সাইন করে চুপচাপ সেই লোকটির সাথে বেড়িয়ে পড়লাম। সে যেই হোক তা জেনে আমার কাজ কি, আগে মুক্তি পেয়ে নেই পরে অন্যকথা। বাহিরে এসে লোকটি তার সাথে কথা বলার আর কোনো সুযোগই দিলেন না, হন হন করে হেঁটে চলছেন। আমিও পিছু পিছু হেঁটে চললাম। কিছুদূর এগিয়ে তিনি একটি কালো রঙের প্রাইভেট কারে ঢুকে গেলেন। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। জানালার গ্লাস নামিয়ে তিনি আমাকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মাইক্রোবাস দেখিয়ে বললেম, ঐ গাড়িতে চুপচাপ উঠে পড়ুন।
 
রাতের রাস্তায় আশেপাশে তেমন লোকজন নেই। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ বাতির নিচে মাইক্রোবাসটি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার কথামতো কৌতুহল নিয়ে মাইক্রোর দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজার সামনে দাঁড়াতেই তারা আমাকে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল! ধপাস শব্দে মাইক্রোর দরজা সাথে সাথে বন্ধ হয়ে গেল। বেশ কয়েকজন মাইক্রোতে বসা ছিল। তাকিয়ে ঠিকঠাক দেখতেও পারিনি। উঠার সাথে সাথে তারা আমার চোখ আর হাত ঝটপট বেঁধে ফেললো! একটানা এতোগুলা প্রশ্ন করে গেলাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? কে আপনারা? কী চান? তারা আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, কেউ মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের করেনি।

নতুন করে এ কোন মুসিবতে পড়ে গেলাম! কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। চোখ বাধা অবস্থায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় আমার পেছনের সিট থেকে মেয়েলী কণ্ঠে কেউ একজন বলে উঠলো, “ভয়ের কিছু নেই, চুপচাপ আমাদের সাথে চলুন” পরিচিত কণ্ঠ চিনে নিতে আমি একবিন্দুও ভুল করিনি, তৎক্ষণাৎ বলে উঠলাম, আপনি মায়া?? পেছন থেকে কোনো উত্তর আসছে না। কী ব্যাপার কোনো উত্তর দিচ্ছে না যে? কী আশ্চর্য! দয়াকরে কিছু তো বলুন,? সাথে সাথে আমার মুখের উপর স্কচটেপ লেপ্টে দিয়ে ঠোঁট জোড়া কানের কাছে ঘেঁষিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠে, “উফ! আপনি খুব বেশিই কথা বলেন, একদম চুপ!”
 
চলবে…


পর্ব -৩

চোখ হাত বেঁধে গাড়িতে করে আমাকে কোথায় নেয়া হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। রাতের শুনশান রাস্তা পেয়ে গাড়ি গুলির বেগে ছুটে চলেছে। মায়া আমার পেছনেই বসে আছে অথচ তার আচরণ আজ বেশ অচেনা লাগছে। আমি তাকে সাহায্য করেছিলাম, ভালোমন্দ কিছু হলেও কথা হয়েছিল তার সাথে, কোনো সমস্যা থাকলে আমাকে সে বুঝিয়ে বলতে পারতো, তা না করে সরাসরি মুখে টেপ মেরে দিল! কী অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা। তবে এতদিনে এটুকু বিশ্বাস জন্মে গিয়েছে আর যাই হোক মায়া অন্তত আমার কোনো ক্ষতি করতে যাবে না।
অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, দুইদিন জেলের খাবার ঠিকঠাক মুখেই দিতে পারিনি, আসার সময় যা ও একটু আগ্রহ নিয়ে খেতে বসেছিলাম সেটাও পাতে রেখে আসতে হয়েছে, এই রাতে আমাকে যদি খাবার না দেওয়া হয় আমি নিশ্চিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবো।
 
আনুমানিক দুই ঘন্টা পর গাড়ি কোথাও এসে থামলো। দুজন ব্যক্তি আমাকে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিল। এরপর তারা স্থান ত্যাগ করে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। শব্দ শুনে বুঝতে পারছিলাম আমাকে কোনও এক বিল্ডিংয়ের গ্যারেজে নামানো হয়েছে। চোখ হাত বাঁধা অবস্থায় সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কেউ একজন হাত স্পর্শ করে বললো আমার সাথে আসুন। সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর! অর্থাৎ আমার সাথে মেয়েটিও গাড়ি থেকে নেমেছে। মুখ বন্ধ থাকায় কোনো কিছু বলতে পারছিলাম না। বাহু ধরে টেনে আমাকে লিফটে উঠালো। এরপর চোখে থাকা বাঁধনটি খুলে দিল। দুই ঘন্টা আলো বিহীন থাকায় চোখ পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে।

ধীরে ধীরে আলো ভেদ করে দেখতে পেলাম আমার সামনে মায়া দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে কোনও এক দেবদূত দাঁড়িয়ে আছে। দুজন লিফটে করে উপরে উঠছি। মায়া বলছে, “প্লিজ আরেকটু শান্ত থাকুন, ভেতরে ঢুকে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি” আমিও চুপচাপ শেষ দেখার অপেক্ষায় শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
 
মায়াকে এই প্রথম তার নিজস্ব রূপে দেখতে পাচ্ছি। মুখে বিশেষ কোনো সাজগোজ নেই। চোখে চিকন কাজল, খুব হালকা করে ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে। পরিপাটি দেহাবরণে দেখে বুঝার উপায় নেই এই মেয়েটা কখনো কাউকে খুন করতে পারে। তার ভেতরটা যতটা আক্রমণাত্মক তার বাহিরের রূপটা ততোটাই নমনীয়।

সপ্তম ফ্লোরে গিয়ে লিফট থেমে গেল। সে আমায় নিয়ে ঝটপট একটি ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লো। ফ্ল্যাটের দরজাটা আটকে দিয়ে সে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এরপর আমার হাতের বাঁধনটা সে খুলে দেয়, এক টান দিয়ে মুখের স্কচটেপ ছুটিয়ে ফেলে। আমি তৎক্ষণাৎ এক চিৎকার দিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিলাম! মায়া রীতিমতো ভয়ে চুপসে যায়, মুখের টেপ খুলার সাথে সাথে একজন ছেলে মানুষ এভাবে চিৎকার দিয়ে উঠবে মায়া মোটেও প্রস্তুত ছিল না। আমারই বা দোষ কোথায়? মেয়েটা অন্ধকারে না দেখে এমন ভাবে স্কচটেপ মেরে দিয়েছিল সেই টেপের আঠা আমার দুদিনের গজিয়ে উঠা দাড়িগোঁফে অক্টোপাসের ন্যায় আকড়ে ধরেছিল! এভাবে কেউ হেঁচকা টান দেয় নাকি? আশ্চর্য মেয়ে!
মায়া থ মেরে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে চিৎকারের কারণটা বুঝতে পারে। এরপর হাসতে হাসতে বলে,

– থ্যাংক্স গড! আমিতো ভেবেছিলাম আপনি এখন বাংলা সিনেমার নাইকাদের মতো বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করবেন! হা হা

– দেখুন আমার মোটেও হাসি পাচ্ছে না, হাসি থামিয়ে বলুন এবার, আমাকে এভাবে কেন নিয়ে এসেছেন?

– আচ্ছা বলছি তো, এতো অস্থির হবার কি আছে? জেলেই তো পড়ে থাকতেন, এরথেকে তো ভালো জায়গায় এসেছেন, ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি একলা একটি মেয়ে সারাদিন দৌঁড়ের উপর ছিলাম আমাকেও একটু ফ্রেশ হতে দিন। আমি একটু নিচে যাচ্ছি, আপনি থাকুন এখানে। আপনি অনেক বড় বিপদের মধ্যে ছিলেন। বিচলিত হওয়ার কারণ নেই, এটা আমার বাসা, ইউ আর সেইফ নাউ।

যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলো, “খুব বেশি ব্যথা পেয়েছেন?”

ঠোঁট গালে আগুন পোড়া জ্বালাতন করছে, এরপরেও বললাম, “না ঠিক আছি আমি”
 
মেয়েটা দরজা আটকে চলে গেল। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে পুরো বাসা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। খুব ছিমছাম করে সাজানো গোছানো একটি বাসা। আসবাবপত্র তেমন বেশি কিছু নেই, যা কিছুই আছে খুব হিসেব করে গুছিয়ে রাখা আছে। টেবিলের ক্লথ থেকে শুরু করে সোফার কুশন এক ইঞ্চিও আঁকাবাঁকা নেই। এমন ডেয়ারিং একটি মেয়ের বাসা এমন পরিপাটি গোছানো হবে সম্পূর্ণ ভাবনাতীত ছিল। এমন মেয়েদের বাসা হওয়া উচিৎ অলিগলির ভেতর বস্তির কোনো পরিবেশে, যেখানে ঘরের ভেতর সবকিছু থাকবে এলোমেলো, সেখানে মেঝেতে ড্রিংকসের খালি বোতল গড়াগড়ি করবে। দেয়ালে আজেবাজে পোস্টার লাগানো থাকবে। ভ্যাপসা পরিবেশে দম বন্ধ হয়ে আসবে। কিন্তু এমন কিছুই এখানে পাইনি। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক একটি বাসস্থান।
 
হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাই দরজা চাপানো একটি রুমের দিকে। ভেতরে ঢুকতেই দপ করে নাকে এসে লাগে কসমেটিক্স এর সুগন্ধি। বুঝতে পারলাম এটাই মায়ার রুম। লাইট জ্বালিয়ে দেখি পরনের জামাকাপড় এলোমেলো ভাবে বিছানায় ফেলে রেখেছে। টেবিলে অনেক গুলো উপন্যাসের বই সাজিয়ে রাখা আছে, এই মেয়ে বইও পড়ে! পাশে নিজস্ব একটি ডায়েরি পড়ে আছে। কারো ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়া আমার পুরনো বদঅভ্যাস! এমন কিছু পেলে কেন যেন আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে যায় কিন্তু এই মেয়ের কোনো ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেয়ার সেই সাহসটুক আমার নেই। হাজার হোক রাগ চটা মেয়ে বলে কথা, কখন কোন অপরাধে কোন শাস্তির নির্দেশ এসে যায় তার নেই ঠিক। এইটুক মনে মনে বলতেই কোত্থেকে যেন মায়া এসে হাজির! পেছন থেকে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠে,

– আশ্চর্য! আপনি কোন সাহসে আমার রুমে ঢুকেছেন?

– না মানে,, আসলে বুঝতে পারিনি,

– কিসের মানে মানে? এখনো ভদ্রতা শেখেননি? একটি মেয়ের রুমে বিনা অনুমতিতে ঢুকে ঘুরঘুর করছেন। বেহায়া কোথাকার। কাজের স্বার্থে নিজের সম্মান দিয়ে দেই বলে এটা ভাবার কারণ নেই আমার কোনো আত্মসম্মান নেই। বের হন এক্ষুনি।

এসব বলতে বলতে বিছানায় থাকা কাপড় গুলো কৌশলে আড়াল করে ফেলে।

আমি ধমক খেয়ে রুম থেকে যেইমাত্র বেরিয়ে যাচ্ছি মেয়েটা আবার আমাকে ডেকে বলে,

– আচ্ছা শুনুন, ঠিক আছে, এসেই যেহেতু পরেছেন এখানেই চেয়ার টেনে বসুন, এই রুমে এসি আছে, এখানে বসে বসে আমরা ঠান্ডা মাথায় কথা বলি।
অদ্ভুত! মেয়েটা মাত্রই এই নিয়ে চিল্লাপাল্লা করলো এখন আবার নিজেই! আমি শিওর হওয়ার জন্য আবারো জিজ্ঞেস করলাম।

– এই রুমেই বসবো?

– হ্যাঁ বসুন। স্যরি, আমার রাগ উঠে গেলে যা-তা বলা শুরু করে দেই। কিছু মনে করবেন না।

– ওকে সমস্যা নেই, এখন আমায় কি দয়া করে বলবেন আমার সাথে কী হচ্ছে এসব?
 
– হুম বলছি, আমার গ্রুপ কমান্ডারের সাহায্যে আপনাকে আমিই জেল থেকে ছাড়িয়েছি নয়তো আপনি অনেক বড় কোনো বিপদে ফেঁসে যেতেন। জেলের বাহিরেও আপনি এই মুহূর্তে নিরাপদ না। তারা আপনাকে টার্গেট করেছে, তাদের সন্দেহ দূর না হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার নিরাপদে থাকাটা অনেক বেশি প্রয়োজন।

– কারা টার্গেট করেছে? আমার কী দোষ?

– দোষ আপনার নেই বলেই এভাবে বাঁচানোর জন্য ছুটে এসেছি। সেইরাতে আমার জন্য আপনি সমস্যায় পড়ে গেছেন। গামছাটা আপনার রুমে ফেলে আসা, আপনার সাথে কথা বলা, সব কিছুই ছিলো আমার ভুল। সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে আজ আমাকে আপনাকে। উপরের হেড লিডারের চোখে সন্দেহের তালিকায় পড়ে যাই আমি। তাদের ছুরিতে মাইক্রোচিপ লাগানো আছে সেটা আমার খেয়াল ছিলো না, তারা চাইলে যেকোনো সময় ডিভাইস কানেক্ট করে নিয়ে আমার আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারতো, শব্দ শুনতে পেত। আবেগে আপনাকে সেদিন কেন যেন অনেককিছু বলে দিয়েছিলাম, আপনার সাথে কথপোকথন কালীন তারা কেউ আমাদের কথাবার্তা শুনে ফেলেছিল। গ্রুপ সম্পর্কে বহিরাগতদের কিছু জানানো গ্রুপের সীমালঙ্ঘন করা অন্যতম একটি অপরাধ।

আমাকে তারা সেই রাতেই ধরে নিয়ে যায় হেড অফিসে। আমি বিস্তারিত খুলে বলি তাদেরকে। আমি আপনার সম্পর্কে যতদূর চিনেছি জেনেছি বুঝিয়ে বলি তাদের। এরপরেও তাদের ভেতর সন্দেহ রয়ে যায়, তারা এতটাই প্রাইভেসি মেইনটেইন করে চলে যা সাধারণ মানুষের কল্পনার বাহিরে। তারা এক দিনের ভেতর আপনার সম্পর্কে সকল ডাটা কালেক্ট করে ফেলে, আপনাকে নিয়ে এনালাইসিস শুরু করে দেয়। আমার কোনো ফল্ট না পেয়ে আমাকে তারা ছেড়ে দেয়। কিন্তু আপনাকে নিয়ে উপর মহলে কোনও এক সমস্যা তৈরি হয়ে যায়, কী সমস্যা যা এখনো আমি বিস্তারিত জানতে পারিনি। যতদূর মনে হচ্ছে আপনাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়াতে তারা আপনাকে নিয়ে নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছে।

– কিন্তু আমিতো নির্দোষ, কাউকে কিছুই বলিনি।

– সেটা আমাকে বুঝিয়ে কী লাভ! আমি যথেষ্ট বুঝিয়েছি তাদের। আমার গ্রুপ কমান্ডার বিশ্বাস করলেও উপরের গ্রুপ লিডাররা এত সহজে বিশ্বাস করছে না।

– কমান্ডার লিডার এসব কিছুই বুঝতে পারছি না, একটু বুঝিয়ে বলবেন?
 
– যেই লোকটা আপনাকে ছাড়াতে গিয়েছিল তার আন্ডারে কাজ করি আমরা বারো জন। উনার মতন আরও অনেক কমান্ডার রয়েছে তাদের আন্ডারেও আমার মতো অনেক অনেক কর্মী রয়েছে। সেই সব কমান্ডারদের আবার বাপ আছে তাকে আমরা লিডার বলি, সেই বাপের উপরেও আবার বাপ আছে। এভাবে কোথা থেকে মূল নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে আমার নিজেরও জানা নেই। আমি শুধু আমার এরিয়া গ্রুপের কমান্ডার স্যারের দায়িত্ব পালন করে যাই, ব্যাস। কমান্ডার স্যারের মাধ্যমেই জানতে পারলাম আপনাকে নিয়ে উপর মহলে বেশ বড় সর সমস্যা তৈরী হয়েছে। আপনাকে যেকোনো সময় তারা মেরেও ফেলতে পারে।

এদের হাত এতটাই লম্বা যে এরা চাইলে জেলের ভেতরেও মানুষ খুন করতে পারে। এরপর কমান্ডার স্যারকে বুঝালাম আমার জন্য এভাবে নির্দোষ মানুষের কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না, স্যার প্লিজ কিছু একটা করেন। তিনিই পরামর্শ দিলেন ভেজাল না মেটার আগ পর্যন্ত আপনাকে আমার এখানে রাখতে। তিনি আপনাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে তার লোক দিয়ে আমার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। বাকিটা তিনি ভেজাল মেটানোর চেষ্টা করবেন, দেখা যাক কি হয়।
 
এসব শুনে আমার চোখমুখ শুকিয়ে যায়। একেরপর এক ভেজালে ফেঁসে যাচ্ছি আমি। এরা নাকি চুয়ান্নটা কেস সলভ করেছে কারো কিছুই হয় নাই, শেষ পর্যন্ত পঞ্চান্নর বেলাতেই ভেজাল হতে হইলো! আমার কপালটাই আসলে কুফা।

আমার মলিন মুখ দেখে মায়া বললো,

– এতো চিন্তার কিছু নেই, এখানে আপনি নিরাপদ আছেন। আশাকরি কয়েকদিনের মধ্যেই ভেজাল মিটে যাবে। আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি, চলুন খেয়ে নেই।
 
মনে মনে বললাম, খাবারের কথা আরেকটু আগে বললেও হতো, পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা ছিল, আগে খেয়ে নিতাম তারপর না হয় এসব শুনতাম। এখন তো পেটে পানিও ঠিকমতো ঢুকবে না।
 
মায়া প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়। সে নিজেও টেবিলের আরেক কোনায় গিয়ে প্লেট নিয়ে বসে পড়ে । খেতে খেতে তাকে বলি,

– জানেন, আপনি যখন প্রথম প্রথম সেই বাড়িতে কাজের মেয়ে হয়ে এসেছিলেন আমিতো আপনার রান্নার ফিদা হয়ে গেছিলাম। ভাবছিলাম আহ! এত দিনে মনের মতো একটা বুয়া পাওয়া গেছে! এই ব্যাচেলর লাইফে এমন রাধুনী বুয়া আমি জীবনেও চোখে দেখিনি।

– ওমা তাই নাকি, ভালোই তো প্রশংসা করতে জানেন। মজার একটা কাহিনী বলি, আমি যেদিন প্রথম সেই বাড়িতে ঢুকলাম তখন আমি বাড়ি ঢুকে প্রথমে আপনাকেই স্যার ভেবে বসেছিলাম! তখন ভাবছিলাম এই ছেলেটাকে আমার মারতে হবে! এমন ইনোসেন্ট মানুষও ক্রিমিনাল হতে পারে! এরপর যখন বুঝতে পারি আপনি ভাড়াটিয়া তখন একা একা অনেক হেসেছিলাম।

– কী সাংঘাতিক! যদি সত্যিই ভুল বুঝে খুন করে ফেলতেন?

মেয়েটা হেসে উত্তর দেয়,

– তাহলে অনেক ভালো হতো আজ আপনাকে নিয়ে এভাবে লুকোচুরি খেলতে হতো না।

– খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা? আমাকে নিয়ে আপনাকে সবাই সন্দেহ করছে, আপনার গ্রুপে নানান ভেজাল জন্মাচ্ছে। এক কাজ করলে কেমন হয়? আপনি নিজেই আমাকে মেরে ফেলুন! সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে, লিডাররা খুশি হয়ে আপনাকে প্রমোশন দিয়ে দেবে।

– ধ্যাৎ, ঝামেলায় তো উল্টো আমিই আপনাকে ফেলেছি, এখন নিজেকে তো সেটা ঠিক করতেই হবে, ইট’স মাই ফল্ট।

আবারও মজা করে বললাম,

– কী দরকার এত ঠিকঠাকের আরেকটা খুন না হয় করেই ফেললেন! সব ঝামেলা শেষ।

– ইশ মরার বুঝি খুব সখ?

– খুনি আপনি হলে মরতে কিন্তু অসুবিধে নেই!

– এই যে মিস্টার! সিনেমার ডায়লগ বাদ দিয়ে ঝটপট খাওয়া শেষ করে ঘুমোতে যান। আপনাকে বাঁচাচ্ছি বলে এটা ভাবার কারণ নেই আমি আপনাকে খুন করতে পারবো না। গ্রুপের মোট পঞ্চান্নটা কেসের মধ্যে আমি নিজ হাতে চারটা খুন করেছি, খুন করা আমার কাছে এখন ডালভাত। এমনি এমনি এই আলিসান ফ্ল্যাট পাইনি, এমনি এমনি মাসে মাসে আমাকে বেতন দেওয়া হয় না, নিজ যোগ্যতায় এসব অর্জন করে নিয়েছি। মায়া শুধু নিরপরাধ ব্যক্তিদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না, এটাই মায়ার একমাত্র দুর্বলতা।
 
এভাবে এই বাসায় আমি সাতদিন যাবৎ বন্দী হয়ে আছি। মায়া নিজেই বাজার করে আনে নিজেই রান্নাবান্না করে খাওয়ায়। আমার বাহিরে যাবার কোনো সুযোগ নেই। কথা বলার কোনো মানুষ নেই৷ সারাদিন একা একা বসে দিন পার করি। মায়া বাসায় থাকলে বসে বসে গল্প করি, আড্ডা দেই, আর মায়া বাসায় না থাকলে অপেক্ষা করি সে বাসায় ফিরবে কখন! লজ্জার কথা আর কিই বা বলবো, ইদানিং নিজেকে এখন বউ বউ মনে হয়! আর কয়দিন যে এভাবে ঘরকুনো হয়ে থাকতে হবে উপর ওয়ালাই জানে।
 
মায়ার সম্পর্কে এই কয়দিনে অনেক কিছুই জেনেছি, শুনেছি তাদের সাথে কাজ করা একেক মেয়ের জীবনের করুণ কাহিনী। প্রত্যেকটা মেয়ে যারা এখানে এসেছে কারোরই জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই। বেশিরভাগ মেয়েই একবার হলেও আত্মহত্যার জন্য উদ্যত হয়েছে। গ্রুপের একটা অংশ আছে যারা এমন মেয়েদেরকে খুঁজে বেড়ায়, তারা সেইসব মেয়েকে মোটিভেট করে তাদের দলে টেনে নেয়। তাদেরকে একটা জিনিস খুব ভালভাবে বুঝানো হয়, “মরে গেলে তো চলেই যাবে, হেরে যাওয়ার পূর্বে লড়াই করতে করতে মরে যাও এতে নিজেও শান্তি পাবে বাকি অসহায় মেয়েদেরও উপকার হবে”
 
মায়া মুখে মুখে যতই বলুক সে শুধুমাত্র আমাকে মানবতার খাতিরে বাঁচাতে চাচ্ছে এরবেশি কিছুই না। সে যতই প্রতিদিন কথায় কথায় আমাকে বুঝাক প্লিজ অন্য কিছু ভাববেন না, কিন্তু তার চোখের ভাষাতে বার বার সে আমার কাছে ধরা খাচ্ছে। সে দিন দিন আমাকে আপন করে নিচ্ছে হয়তো সে নিজেও টের পাচ্ছে না। তার ব্যক্তি জীবনের ঘটে যাওয়া সব কিছু সরল বিশ্বাসে আমার সাথে শেয়ার করে দিয়েছে, আমিও তার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করে গিয়েছি, কখনোই ভিন্ন নজরে তার দেহাবয়বে তাকিয়ে দেখিনি। সেদিনের পর একবারও তার রুমের আশেপাশে পা ফেলিনি। মেয়েদের অন্তর দৃষ্টি অত্যন্ত প্রখর, কে কার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তারা মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়েও বলে দিতে পারে। হতে পারে মায়া আমার মাঝে এসব কুদৃষ্টি খুঁজে পায়নি তাই হয়ত আমার প্রতি তার বিশ্বাসটা দিন দিন হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

মায়া নিজ থেকে কোনো স্বপ্ন দেখে না, কাউকে স্বপ্ন দেখাতেও চায় না, মায়া জানে এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, সে বার বার ইমোশন এরিয়ে চলার চেষ্টা করে। আমিও জানি, এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই তাইতো এতো কিছু বুঝেও মুখটা ভিন্নদিকে ঘুরিয়ে রেখে দেই। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে দিন দিন স্বপ্নের জালে জড়াতে বাধ্য করছে। আমিও কি জড়িয়ে যাচ্ছি? নাহ অসম্ভব! জড়িয়ে গেলেও ছিড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি আর সেই হৃদয় নই, একটা সময় আমার দ্বারা সবকিছুই ছিল সম্ভব। অতীতের ধাক্কা খেয়ে খেয়ে নিজেকে এখন শুধরে নিয়েছি।
 
বন্দী জীবনের আমার নবম দিন। মায়া বাসায় ফিরছে না। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত শুরু হয়ে গেল মেয়েটা তখনও বাসায় ফেরেনি! মোবাইলটাও দুপুর থেকে বলছে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না। তাদের আর কারোর নাম্বার আমার জানা নেই। সারা বাসা পায়তারা করে বেরালাম। চাপা দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই, মেয়েটার কোনও ক্ষতি হয়ে গেল না তো?
রাত দশটার দিকে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। মায়ার কণ্ঠস্বর! মায়া উৎকণ্ঠা নিয়ে বলছে,

– আপনি দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যান, এক্ষুনি!

– মানে, বুঝলাম না কিছুই?

– অনেক চেষ্টা করেছি, তারা আপনাকে কিছুতেই ছাড়বেনা, আজ রাতেই কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবে। কমান্ডার স্যারও তার মন ঘুরিয়ে ফেলেছে। তিনি সব কিছু বলে দিয়েছে। কেন আপনার পিছু নিয়েছে এরা আমার কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়নি।

– ঠিক আছে শান্ত হোন, কিন্তু দরজা লকের চাবি পাবো কই? চাবিতো আপনার কাছে।

– আমার রুমে গিয়ে আলমারির দ্বিতীয় ড্রয়ার খুঁজুন, আরেক কপি চাবি পেয়ে যাবেন। প্লিজ দ্রুত পালিয়ে যান, হাতে সময় নেই, তারা সম্ভবত রওনা দিয়েছে। যত দূরে সম্ভব চলে যান।

মেয়েটা এবার কেঁদে দিয়ে বলছে,

– আপনার সাথে হয়তোবা আর কোনওদিন আমার দেখা হবে না।

কথাটা শুনে বুকটা কেঁপে উঠলো, ভেতরে চাপা যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে।

– প্লিজ আপনি কান্না বন্ধ করুন, আমার কিছুই হবে না, আমি যাচ্ছি এখনি, আপনিও নিরাপদে থাকুন।

– আরেকটা কথা শুনুন।

– কী?
( মেয়েটা চুপ করে আছে )

– কী বলুন?

– যদি আপনার কোনো ক্ষতি হয়ে যায় প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দেবেন, প্লিজ।

কাঁদতে কাঁদতে এইটুক বলেই মায়া কল কেঁটে দেয়।
 
আমি দেরি না করে দ্রুত চাবি খুঁজে বের করলাম। নেয়ার মতো তেমন কিছু সাথে নেই, তবুও মায়ার কিনে দেওয়া আমার জামাকাপড় গুলো ফেলে আসতে পারলাম না। সত্যিই মায়ার সাথে আর দেখা হবে না! ভাবতেই কেমন যেন লাগছিল। ওঁরা কি সত্যিই আমাকে মেরে ফেলবে? অসম্ভব কিছু না। নিশ্চয়ই এমন কিছু জেনেছে বলেই মেয়েটা আমাকে দ্রুত পালাতে বলছে।

আমি দরজার লক খুলতে দরজায় চাবি ঢুকালাম, চাবি যেই মাত্র ঘুরাতে যাবো, সাথে সাথে কেউ দরজার ওপাশ থেকে কলিং বেল চেপে দিল! আমি পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যাই! আস্তে করে চাবিটা বের করে নেই। দরজার ফুটো দিয়ে বাহিরে দেখার চেষ্টা করি, তারা সিঁড়িকোঠার লাইট বন্ধ করে দিয়েছে, অন্ধকারে কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। এই কয়দিনে মায়া ছাড়া আর কাউকে এই ফ্ল্যাটের দরজা নক করতে দেখিনি। তবে কি মায়া একটু আগে যাদের কথা বলছিলো তারা চলে এসেছে! আমি চুপ মেরে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারা কলিং বেল বাজিয়েই যাচ্ছে। একাধিক মানুষের পায়ের আওয়াজ পেলাম।

কেউ একজন দরজায় সজোরে লাথি মেরে বসলো! দরাজ কণ্ঠে বলে উঠলো, “ওওই, শু***বাচ্চা দরজা খোল!”
 
চলবে…


পর্ব- ৪ (শেষ পর্ব)

অচেনা মানুষের পায়ের লাথিতে দরজা বার বার কেঁপে উঠছে। অশ্রাব্য গালিগালাজে বুক ধড়ফড় করছে। হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাহির থেকে কেউ একজন বলছে, “দরজাটা নিজ থেকে খুলবি নাকি ভেঙে ঢুকতে হবে? ভাঙার পর যদি ভেতরে তোরে পাই সোজা আগে হাত পা ভাইঙ্গা দিম, ভদ্র ব্যবহার পেতে চাইলে ভদ্রভাবে দরজাটা খুল”
আমিও বুঝলাম ধানাইপানাই করে লাভ নেই। পালানোর দ্বিতীয় কোনো পথ বাকি নেই, মুখোমুখি আমাকে হতেই হবে। যা হবার হবে, দরজার লকটা খুলে দিলাম। আট দশ জন লোক হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। মুখ ঢাকা একেকজন লোকের উচ্চতা পাহাড় সম। দুজন আমাকে ধরে ঝটপট হাত দুটো বেঁধে ফেললো। কথা বলার কোনও সুযোগ নেই। চুপচাপ থাকার নির্দেশ দিয়ে বললো “মুভ অন” তারা আমাকে ধরে লিফটে করে সোজা গ্যারেজে নেমে এলো।

কালো রঙের মাইক্রো দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে নিতে। আমাকে ভেতরে ঢুকাতেই সেই কমান্ডার স্যারের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। যে স্যার আমাকে জেল থেকে বাঁচিয়ে আনলো সেই স্যারেই আজ আমাকে ধরতে এসেছে! আমাকে দেখে তিনি বললেন, “ওয়েলকাম ওয়েলকাম মিস্টার হৃদয়! বসে পড়ুন” “স্যার, কোথায় নেওয়া হচ্ছে আমাকে?স্যার আমি কিছুই করিনি” “কাম ডাউন, এত ভয় কিসের ভাগ্নে? মামার গাড়িতে উঠেছো, বি রিলাক্স”

এটুক বলেই পেছনে কাকে যেন নির্দেশ দিলেন, “এই নাইন্টিসিক্স” “জ্বী স্যার?” “বসে আছিস কেন? আমার ভাগ্নেটা এভাবে কষ্ট করে যাবে নাকি? তাকে একটু ঘুম পারিয়ে দে”
পেছন থেকে নাইন্টি সিক্স সংখ্যা নামক লোকটি হাত এগিয়ে আমার মুখটা ভেজা রুমাল দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে। সেই অবস্থায় চার পাঁচ বার শ্বাস নিতে আমাকে বাধ্য করে, এরপর আর কিছু মনে নেই।
 
জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করলাম খুব নমনীয় একটি বিছানায়। আমাকে জেগে উঠতে দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি পাশের রুমের পর্দার ভেতর মুখ ডুবিয়ে কাকে যেন বলছে “স্যার, জ্ঞান ফিরে আসছে, উপরে নিয়ে যাব?”

তারা নির্দেশনা পেয়ে আমাকে তুলে সিঁড়ি বেয়ে উপর তলায় নিয়ে যায়। উপরে উঠতেই দরজার সামনে দু’জন মেয়ের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। ওড়না দিয়ে মুখ প্যাচানো। লোকটি আমাকে তাদের হাতে তুলে দিয়ে বললো, ম্যাডাম উনাকে ডেকেছেন। মেয়ে দুটি আমাকে ধরে হাঁটিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলো।
 
ভেতরে ঢুকে মনে হচ্ছিলো কোনো এক গোলকধাঁধার মাঝে ঢুকে পড়েছি। একের পর এক রুম। কিছু রুমে মনে হচ্ছে মানুষ আছে, কিছু রুমে আবার তালা ঝুলানো। কিছু রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলাম। তারা কি আমাকে কোনো টর্চার সেলে নিয়ে যাচ্ছে? হতেও পারে, মায়া বলেছিল তাদের নাকি নিজস্ব টর্চার শেল রয়েছে। কত মানুষ টর্চার শেলে মৃত্যুবরণ করেছে তার নাকি হিসেব নেই। মায়ার কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি জেনেছি সেই অনুযায়ী পরিবেশ দেখে বুঝা যাচ্ছে আমাকে তাদের কোনও ক্যাম্পে আনা হয়েছে।

তাদের ক্যাম্পে সচারাচর কমান্ডার লিডার ও আড়ালে থাকা উচ্চপদস্থ কর্মীরা ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারে না। মায়াদের মতো মাঠ কর্মীরাও চাইলে এখানে আসতে পারে না, তারা কোনো দরকারে আসলে কিংবা ডেকে আনলে তাদেরকেও চোখ বেঁধে ঠিকানা আড়াল রেখে নিয়ে আসা হয়। আমাকে যারা টানা হেঁচড়া করছে এরা একেকজন রোবটের ন্যায় কর্মী, এদের প্রত্যেকের একেকটা করে নাম্বার প্লেট রয়েছে। মুখে বাড়তি কোনো কথা নেই, যখন যাকে যা অর্ডার দেয়া হচ্ছে তখন তারা সেটাই পালন করে যাচ্ছে। তাদেরকে অহেতুক প্রশ্ন করে লাভ নেই, কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না। চুপচাপ তাল মিলিয়ে হেঁটে চললাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
 
এভাবে তারা আমাকে হাঁটিয়ে ভেতরে একটি অন্ধকার রুমে নিয়ে এলো। আমার হাতদুটো আগে থেকেই বাঁধা ছিল, চেয়ারে বসিয়ে দেহ শক্ত করে বেঁধে নিলো, চোখে কাপড় বেঁধে দিল। এরপর মেয়ে দুটি আমাকে একা রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অন্ধকার রুমে বসে আছি আর ভাবছি আজকেই আমার তাহলে শেষ দিন? কী হতে যাচ্ছে আমার সাথে? কেনইবা আমাকে ধরে আনা হয়েছে? আমাকে মেরে এদের লাভটা কী? এই ছোট মাথায় কোনো হিসেব মিলাতে পারছিলাম না। মায়া এখন কোথায় আছে? ও ঠিক আছে তো? আমাকে বাঁচানোর অপরাধে এরা কি তার কোনো ক্ষতি করেছে? এসব কথা ভাবতে ভাবতে ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠে৷ এমন সময় দূর থেকে শব্দ শুনতে পেলাম কেউ একজন রুমের দিকে এগিয়ে আসছে। টাইলসের সাথে এক জোড়া জুতার খটখট শব্দে বুঝতে পারলাম কোনও এক মেয়ে আমার দিকে আসছে। এখানে যে ম্যামের নাম কর্মীদের মুখে মুখে শুনতে পাচ্ছিলাম মনে হচ্ছে ইনিই সেই ম্যাম। রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন সম্মান দিয়ে উনাকে সালাম জানালো। ম্যাম মুখে জবাব না দিয়ে তাদেরকে বললো, “তোমরা এখন যেতে পারো, আমি একা সামলে নিচ্ছি”
 
ম্যাম রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন৷ তিনি আমার চারপাশে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরছেন। মুখে কোনো কথা বলছেন না। চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি বসে পড়লেন। নীরবতা ভেঙে ভাঙা কন্ঠে বললেন,

– স্বাগতম, সাইদুল ইসলাম হৃদয়।

আমিও এবার মুখ খুলে বললাম,

– দেখুন, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে, আমার কোনও দোষ নেই, কেন আপনারা আমার পিছু নিয়েছেন?

– দোষ গুণ বিচারের কাজ তো তোদের জন্য নয়, তোদের কাজ শুধু দোষ করে যাওয়া।

– কিন্তু আমিতো কোনো দোষ করিনি, কেন আমাকে হয়রানি করছেন?

মেকি হাসি দিয়ে বলছে,
– ওহ! রিয়ালি? কোনও দোষ করিস নি? (কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো) মায়ার সাথে দেখছি ভালোই চলছে দিনকাল!

– মায়ার সাথে আমার কিছুই চলছে না। ও আমাকে শুধুমাত্র বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিল। আপনারা আমার পিছু না নিলে তার সাথে এভাবে এক বাসায় কখনোই থাকা হতো না
– এটাকে শুধুই বাঁচানোর চেষ্টা বলে? নাকি অন্যকিছু! এসব শেখাতে আসবিনা আমাকে।

– মায়া কোথায় আছে এখন?

– মায়া এখন অনেক দূরে আছে,, মায়া এখন আর আমাদের কেউ না, তাকে অনেক অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে, হা হা।

– বিশ্বাস করুন মেয়েটার কোনো দোষ নেই, কেন আপনারা বার বার ভুল বুঝছেন। প্লিজ মেয়েটার কোনো ক্ষতি করবেন না।

– কী আজব প্রেম খেলা বাহ! এ বলে ওর কোনো দোষ নেই, সে বলে তার কোনো দোষ নেই, খুব ভালই তো জমে উঠেছে। আচ্ছা ওয়েট তোকে একটি জিনিস শোনাচ্ছি।

মেয়েটা একটা ভয়েস রেকর্ড ছেড়ে দিলো, সেখানে শোনা যাচ্ছে মায়া কেঁদে কেঁদে আমাকে না মারার জন্য বার বার আকুতি করে যাচ্ছে, “প্লিজ, ছেলেটা নির্দোষ, ছেলেটাকে মুক্তি দিয়ে দিন, একজন নির্দোষ ছেলেকে কেন মারতে চান? কী দোষ তার? আপনারা কিছু বলছেনও না, তাকে ছাড়ছেনও না, এভাবে কেন একজনকে বিপদে ফেলছেন?”
অপর আরেকটি রেকর্ড ছেড়ে দিয়ে বললো এটা আজকের রেকর্ড, এটা মনোযোগ দিয়ে শুনে দেখ, দেখ তোর মায়া কি বলছে, “আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছি, প্লিজ, সামান্য সন্দেহের বসে এভাবে তার ক্ষতি করবেন না, বিনিময়ে যা করতে বলবেন করবো আমি, তবুও প্লিজ, (কাঁন্নার আওয়াজ) “

রেকর্ড কেটে দিয়ে ম্যাম আমাকে বলছে, “কী বুঝলি এবার?”

– মায়া আমাকে ভালোবাসে সে কখনো আমাকে বলেনি, কেউ যদি ভালবেসেও থাকে এতে তারই বা কী অপরাধ? সে আপনাদের কর্মী, আপনাদের কাজ করে যাচ্ছে, আমিতো কোনো গুপ্তচর নই যে মায়াকে প্রেমের জালে ফেলে আপনাদের কোনও ক্ষতি করতে যাবো। কেন এমন করছেন আপনারা? আমিতো নিজেও আপনাদের কাজের কথা শুনে মনে মনে সবাইকে সম্মান দিয়েছি। কিন্তু এখনতো দেখছি আপনাদের নূন্যতম মানবতা বোধটুকুও নেই।
 
– কী বললি! মা-ন-ব-তা? বাহ! তোর ভেতর এতো মানবতার উদয় হল কবে রে?
 
ম্যাম তার হাতের পাঁচটি আঙুল আমার চুলে ডুবিয়ে দেয়, খুব আলতো করে মাথা বুলাতে বুলাতে খুউব কাছাকাছি চলে আসে। এমন ব্যবহারে আমি রীতিমতো ঘাবড়ে যাই, কি হচ্ছে এসব!

ম্যাম কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, “এত মানবতা কোথায় ছিল সেদিন?”
 
মুহূর্তেই আমার শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে যায়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠে। তথাকথিত সেই ম্যামকে এবার খুব চেনা চেনা লাগছে। তিনি তার ওড়না দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলেন, “এতো ঘাবড়ে গেলি যে? কিছু মনে পড়ে গেল নাকি?”
 
মানুষ খুব বেশি শক খেলে যেমন পাথর হয়ে যায় আমিও ঠিক তেমন পাথর হয়ে গেলাম। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছিলাম না৷ মনে হচ্ছে ভেতর থেকে কোনও অদৃশ্য হাত আমার জিহবা আঁকড়ে ধরেছে। পুরনো কিছু স্মৃতি আমার হাত পা অবস করে দিয়েছে।

মেয়েটা ছুরি দিয়ে গলায় আলতো স্পর্শ করে বলছে, এবার মনে হচ্ছে নির্দোষ ছেলেটা একটু একটু করে তার দোষ খুঁজে পাচ্ছে?

এই দিনটা দেখার জন্যেই হয়তো আমি এখনো বেঁচে আছি! কেঁচো খুড়তে গিয়ে পেয়ে গেয়েছি সাপ। যে সাপের দংশনে আমি আজ এইখানে সেই সাপ আমায় এখন শেখাচ্ছে মানবতা! বাহ! সাত বছর আগে কোথায় ছিল তোর এই মানবতা? হ্যাঁ?? কোথায় ছিল যখন আমাকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলি? কোথায় ছিল সেদিন এই মানবতা? কানের কাছে ভালোবাসি নামক মিথ্যে বুলি ছেড়ে আমার মুখটা বন্ধ করে দিয়েছিলি। কাঁদতে কাঁদতে যেদিন ফোনে বলেছিলাম আমি প্রেগন্যান্ট, তখন অ্যাবোরশন করাতে বলে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে কাপুরুষের মতো কোথায় পালিয়ে গিয়েছিলি? কই ছিল তখন তোর মানবতা? উত্তর আছে কোনো?
 
সেই অতীতের ছায়া যে এইখানে এসে লেগেছে আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। খুব কষ্টে গলা থেকে শব্দ বের করে এনে বললাম,

– বিশ্বাস করো মিনু, আমি সেই হৃদয় আর নই, সেই হৃদয় সাত বছর আগে মরে গিয়েছে, অনেক ছোট ছিলাম, বখাটে বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিশে চিন্তাধারা বিগড়ে গিয়েছিল, ভুল করে ফেলেছিলাম আমি।

– কি বললি? ভুল? এটাকে তুই বলছিস শুধুই ভুল? জানিস এরপর কি হয়েছিল? কয়দিন পর লুকিয়ে অ্যাবোরশন করাই আমি, কিন্তু সেটা আর লুকিয়ে রাখতে পারিনি, আমার বাবা জেনে যায়। সেই রাতেই উনি হার্ট এট্যাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আর আমি, আমি কি করেছিলাম জানিস? দেখবি? চিৎকার দিয়ে বলে এই দেখ,

এই কথা বলেই আমার চোখের বাঁধনটা এক টানে খুলে ফেলে।

আমি তাকে দেখে চমকে উঠলাম, চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিলাম। তার মুখের অর্ধেকটা পুরোপুরি ঝলসে গিয়েছে। কি বীভৎস! ভয়ংকর!

মিনুকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার জন্য একটি মেয়ের জীবন এভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কল্পনাও করিনি। ভেবে নিয়েছিলাম মেয়েটা হয়তো অতীত ভুলে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কিছু গুঁড়িয়ে যাওয়া অতীত চাইলেও গুছিয়ে নেয়া যায় না, মিনুকে দেখে সেটা এখন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি।
 
– কি রে ভয় পেয়ে গেলি? সেদিন আমি নিজেকে জ্বালিয়ে দিছিলাম। ৬৫% আগুনে পুড়ে যাই আমি। সাতদিন হাসপাতালে থাকার পর জ্ঞান ফিরে আমার। শ্বাসনালী পুড়ে গেছিলো, বহুদিন কথা বলতে পারিনি। সেখানে এক ডাক্তারের হাত ধরে আমি এই লাইনের সন্ধান পাই। আমাকে তারা তাদের সেল্টারে নিয়ে অনেক কিছু বুঝায়, মাথা থেকে আত্মহত্যার ঝোকটা আস্তে আস্তে নামিয়ে ফেলে। নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলি। আর আজ কোথায় কোন পজিশানে দাঁড়িয়ে আছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস? তোকে আমি একটানা অনেক খুঁজছিলাম, তোর বাবা সরকারী চাকুরীজীবি ছিল শুধু এইটুক জানতাম, কোথায় চাকুরী করে নাম ঠিকানা কিছুই জানা ছিল না তাই আর খুঁজে পাইনি তোকে।
বন্ধুদের কাছেও খোঁজ নিয়ে দেখি তুই সেই এলাকাতে আর নেই, বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছিস। আমাদের ব্যাচের কারো সাথে আর যোগাযোগ রাখিসনি। কিন্তু এত বছর পর এভাবে কেঁচো খুড়তে খুড়তে সাপ পেয়ে যাবো কল্পনাও করি নাই। আমাদের লিডারদের মিটিং এ হঠাৎ শুনলাম আমার পাশের এরিয়া গ্রুপের মায়াকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সে কাকে যেন গ্রুপের তথ্য শেয়ার করেছে। তোর সম্পর্কে সব ডাটা কালেক্ট করার পর আমি যখন তোকে খুঁজে পেলাম, সাথে সাথে সবার সাথে কথা বলে কেসটা নিজ দায়িত্ব নিয়ে নিলাম। কারণ এই মানুষের বিচার অন্যকেউ করলে আমি শান্তি পাব না।

নিজ হাতে এর প্রতিশোধ নিব। আর আমি কিভাবে প্রতিশোধ নেই জানিস? একটু আগে আশেপাশে কারও আর্তনাদ শুনতে পাইছিস? সেই মানুষটা কিন্তু এখন আর দুনিয়াতে নাই! মাত্রই কেস সলভ করে এলাম। এবার এই ভি আই পি কেসটা সলভ করবার পালা। হা হা, জানিস কী যে শান্তি লাগছে আমার এখন? মনে হইতেছে এই দিনটা দেখার জন্যেই আমি সেদিন বেঁচে গেছিলাম।
 
– মিনু আমি জানি, আমি ক্ষমার যোগ্য নই। প্রেগন্যান্ট শুনে সেদিন অনেক ভয় পাইছিলাম। সেই বয়সে ভুল করে ফেলছিলাম, এরপর অনেক অনুতপ্ত হইছি। নিজেকে একদম পরিবর্তন করে ফেলছি। বন্ধুবান্ধব ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে যাই। এই সাত বছরে অনেক বন্ধুবান্ধব বানিয়েছি কিন্তু কারো সাথে খারাপ কিছু তো দূরের কথা কোনো মেয়ের দিকে এক মুহূর্তের জন্যেও কুনজরে তাকিয়ে দেখিনি। এরপরেও জানি আমি একজন দোষী, আমি একজন প্রতারক। ক্ষমা চাওয়ার সাহসটাও আমার আর নেই। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছি আমি, তবুও ক্ষমা চাচ্ছি, প্লিজ যদি পারো।
 
– তুই যে কেমন অনুতপ্ত তা তো বুঝতেই পারছি, তুই মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও কী দোষ করছিস সেটাই খুঁজে পাসনি! এতেই বুঝা যায় তুই কতটুক অনুতপ্ত। আসলে তোর একার আর কি দোষ দিব। আমাদের শিক্ষিত সমাজের অনেক লোকেরাই এটাকে অপরাধ হিসেবে দেখতে চায় না। তাদের ধারণা হাত পা বেঁধে কোনো মেয়ের ইজ্জত নিলেই সেটাকে বলা হয় ধর্ষণ। অথচ সামান্য এক লাইনের মিথ্যে বুলি শুনিয়ে কতশত মেয়েদের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করা হয় সেই হিসেব কেউ রাখেনা। প্রতিবাদ করতে গেলেই সম্পর্কের দোহাই দিয়ে মুখ বন্ধ রাখা হয়, কেউ এসব পাত্তা দেয় না।
 
– সাত বছরের কালো অধ্যায়টা আমাকে সবসময় তাড়া করে বেরায়। কিন্তু আমি বুঝতেও পারিনি বর্তমান ঝামেলাটা যে সেই অতীতকে ঘিরে। বিশ্বাস করো আমি সেই হৃদয় আর নই। আমি সত্যিই লজ্জিত, এর পরেও যদি আমাকে শাস্তি দিতেই হয়, দেও, তবুও প্লিজ তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।
 
মিনু হেসে বলে,
ক্ষমা! ক্ষমা কত সহজ একটা শব্দ তাইনা? একটা জীবন উলোটপালোট করে দেওয়ার অপরাধ এক বাক্যের ক্ষমা দিয়ে পুষিয়ে দেয়া এতই সহজ! আমি জানি, তুই অনেক পরিবর্তন হয়েছিস। এই দশটাদিন আমি বসে বসে ঘোড়ার ঘাস কাটিনি। যখন শুনেছি মায়ার মতো এত বিচক্ষণ একটি মেয়ে তোর মত লম্পটের প্রেমে পড়েছে, তখন অবাক হয়ে তোর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত খোঁজ নিয়েছি, আরও তোকে জেনেছি। ভেবেছিলাম এক ছাদের নিচে রেখে দিলে মায়া হারে হারে টের পেয়ে যাবে তোর নজর আসলে কতটা খারাপ, কিন্তু তেমন কিছু না হয়ে উল্টো সে তোর প্রেমে পড়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, মেনে নিয়েছি তুই আর আগের মতো নেই। তাতে আমার কি রে? কি ভাবছিস এমনি এমনি ছেড়ে দেব? হা হা, এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়ার জন্যে তো এই লাইনে আসি নাই রে।

হাসতে হাসতে ছুরিটা আমার বুকে স্পর্শ করে দাঁত খিটমিট করে বলে, “আমার না খুউব রক্ত দেখতে ইচ্ছে করতেছে, ফিনকি দিয়ে তোর রক্তছোটার দৃশ্য দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে।”

এই বলেই ছুরিটা বুকের চামড়ায় হালকা দাবিয়ে লম্বা এক টান মেরে দেয়!

চোখটা বুঁজে ব্যথায় আঁতকে উঠি। রক্তে পড়নের কাপড় ভিজে উঠে, বুঝতে পারি আমাকে আর বাঁচিয়ে রাখা হবে না। মিনু এক লাথি মেরে আমাকে ফেলে দেয়। চেয়ার সহ মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে থাকি।

মিনুর চোখে মুখে তীব্র হিংস্রতা! এক বিন্দুও মায়া খুঁজে পাইনি তার মাঝে। কিছুক্ষণ পর মিনু হাতথেকে ছুরিটা ঢিল দিয়ে ফেলে দেয়। নিজ চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে আসে। সে মেঝেতে আমার পাশে মুখ এগিয়ে বলে, “কী ভেবেছিস? তোকে মারতে আমার কষ্ট হচ্ছে? ওয়াক থু,! তুই যতই ভালো হয়ে যাস, তুই আমার চোখে সেই হৃদয় হয়েই থাকবি। তোর সাথে সেই দুই মাসের মিথ্যে প্রেমে মায়া জন্মানোর প্রশ্নই আসে না৷ আমার এক বিন্দুও কষ্ট হচ্ছে না, তোকে আমি টুকরো টুকরো করে ফেলতাম কিন্তু, করলাম না। তোকে শুধুমাত্র মায়ার কথা ভেবে ছেড়ে দিলাম। মায়ার মতো মৃত মেয়েটাকে তুই নতুন রুপে স্বপ্ন দেখাইছিস, নতুন করে জীবনের স্বাদ নিতে শিখাইছিস। শুধু মাত্র মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ছেড়ে দিলাম তোকে। চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে, এই শহর থেকে। আমার চোখে যেন আর কোনোওদিন না পড়িস। ভিতরের হিংস্র পশু জেগে উঠলে আমি যেকোনো কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারি।
 
মিনু বোতল খুলে একটানে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেয়, নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলে,

মায়াকে দল থেকে ইচ্ছে করে বের করে দিতে বলেছি। যাতে সে নতুন করে জীবন গড়তে পারে। মেয়েটাকে কোনোদিন কষ্ট দিস না। মেয়েটা ভালোবেসে ফেলেছে তোকে। আমি যতটুকু বুঝি তুইও মায়াকে পছন্দ করিস। মায়া যদি জেনে যেত তোর এই অতীত তাও আবার আমাকে ঘিরে মেয়েটা তোকে টুকরো টুকরো করে ফেলতো। আমরা তাকে কিছুই জানাইনি জানাবো ও না। নতুনভাবে সে তার জীবনটা সাজিয়ে তুলুক এটাই চাই। সত্যিই যদি তোর ভেতর পাপের অনুশোচনা থেকে থাকে তবে এই মেয়েকে মেনে নিতে তোর কোনো আপত্তি থাকার কথা না।

আমিও তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে বললাম, আমার কোনও আপত্তি নেই। নিজ পছন্দ থেকেই হোক, পাপের অনুশোচনা থেকেই হোক কিংবা তোমার নির্দেশ হিসেবেই হোক, কথা দিলাম, আমি মায়াকে কোনদিন ছেড়ে যাব না।
 
মিনু কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কর্মীকে বলে টুয়েন্টিফাইভকে রুমে পাঠিয়ে দাও। এখানে প্রতিটি কর্মীকে নির্দিষ্ট একটি সংখ্যা ধরে ডাকা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে এক লোক রুমে ছুটে এলেন। ম্যাম ডেকেছেন?

হুম আসুন। আমাকে ইংগিত করে বললো, উনাকে উঠিয়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে মায়া যেখানে আছে সেই এলাকায় ছেড়ে দিয়ে আসুন। লোকটি তৎক্ষণাৎ আমাকে তুলে বাঁধন খুলে দিলেন। মিনু উল্টো হয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কী বলে বিদায় নিব বুঝতে পারছিলাম না, কীভাবে ক্ষমা চাবো আমি তার কাছে? সাহস নিয়ে ডাকলাম, মিনু, মেয়েটা ঘুরে তাকায়নি, সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে৷ নিজ থেকে বলা শুরু করলাম “ক্ষমা ভিক্ষা চাই তোমার কাছে, পারলে ক্ষমা করে দিও আমাকে” মিনু সেভাবেই উল্টো দাঁড়ানো অবস্থায় চিৎকার দিয়ে বললো “টুয়েন্টি ফাইভ! আমি ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছি”

লোকটি “ইয়েস ম্যাম” বলে আমাকে দ্রুত টেনে রুম থেকে বের করে নিলেন।
 
তাদের গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে একটি ফ্লাইওভারের উপর নামিয়ে দেওয়া হলো। ফ্লাইওভারের ঢাল বেয়ে নামতে নামতে আমার বন্ধ মোবাইলটা চালু করলাম। এক মিনিটের মধ্যেই মায়ার কল! আমার কণ্ঠ শুনে মায়া কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে৷ বার বার তার কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে, “ঠিক আছেন আপনি? কোথায় এখন আপনি?”
জায়গার নাম বললাম। এরপর দেখি মায়া কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে এসে হাজির।

মায়াকে বললাম,
– আমার কিছু হয়নি, তারা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছে।

মায়া আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলছে,
– আপনাকে তারা ছেড়ে দেয়নি, আপনাকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে! কমান্ডার স্যার আমাকে কল দিয়েছিলেন। তিনি সুপারিশ করে তাদের অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আপনাকে ছাড়িয়ে এনেছে, নয়তো এতক্ষণে তারা আপনাকে,,! চলুক এখন। দ্রুত পালিয়ে যেতে হবে এই শহর ছেড়ে।
 
কথা শুনে বুঝতে পারলাম মিনু হয়তো কমান্ডার স্যারকে দিয়ে মায়াকে উল্টাপাল্টা কিছু একটা বুঝিয়ে দিয়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? আপনিতো তাদেরই লোক।

– নাহ, আমি আর তাদের আন্ডারে নেই। কাজ ছেড়ে দিয়েছি, তারা আমাকে শর্ত দিয়েছিল আপনাকে বাঁচাতে হলে এই দল ছাড়তে হবে। আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে যাই। যারা নিরপরাধ মানুষকে অযথা বিপদে ফেলে দেয় তাদের সাথে থাকার কোনোই ইচ্ছে নেই।

দেরি না করে চলুন তো এখন,
– কিন্তু যাব কোথায়?

– যেকোনো জায়গায় চলে যান, যতদূর সম্ভব চলে যান, তারা যেন আপনাকে এই শহরে খুঁজে না পায়।

– আর আপনি কোথায় যাবেন?

– আমিও দূরে কোথাও চলে যাবো, আপাতত এক খালার বাসায় যাচ্ছি, দেখি এরপর কোথায় যাওয়া যায়।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম।

– আচ্ছা দুজন একত্রে এই শহর ছেড়ে পালিয়ে গেলে কেমন হয়?

– কোথায় যাবেন?

– আমার বড় বোন দেশের বাইরে থাকে, আমাকে প্রায়ই চলে আসতে বলেন, তাকে বললেই ভিসা পাঠিয়ে দেবে।

– সেটা আপনাকে পাঠাবে আপনি যান, আমি কোন পরিচয়ে সেখানে যাব? আশ্চর্য!

– যদি বলি আমার বউ পরিচয়ে! তবে কি মানা করবেন?

মায়া চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

– এই যে মিস্টার, আপনি জানেন আমি কে?

মায়ার ঠোঁটে আঙুল স্পর্শ করে কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম,

– আমি জানি তুমি মায়া, নিজ হাতে চারটা খুন করেছো, নিজ সম্মান বিলিয়ে দিয়েছো, এগুলা বাদে আরকিছু বলার আছে?

মায়া চুপ করে আছে, এরপর বলে,
– যদি রাগের মাথায় আপনাকেও খুন করে ফেলি?

– আমিতো আগেই বলেছি, খুনটা যদি তুমি করো আমার কোনো আপত্তি নেই। এটা সিনেমার ডায়লগ না, এটা আমার ডায়ালগ। এবার বলো, এরপরেও মানা করবে?
মেয়েটা আমার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে।
 
সেই হাত ধরে সেদিন দুজন নতুন এক দিগন্তের পথে পা বাড়িয়ে দেই। সেদিন বিকেলেই দুজন বিয়ে করে ফেলি। এরপর মায়া তার খালার বাসায় চলে যায়। আমি আস্তেধীরে বাড়িতে বুঝিয়ে সবাইকে মানিয়ে দেশের বাহিরে যাওয়ার কার্যক্রম শুরু করে দেই। বোনের পাঠানো ভিসাতে বিদেশে আসতে খুব বেশি একটা সময় লাগেনি। চার মাসের মাথায় দুজন দেশত্যাগ করে পাড়ি জমাই নতুন এই সংসারে।
 
আজ প্রবাস জীবনে আমাদের প্রথম রাত। বলতে গেলে বাসর রাত। এক বিছানায় মায়ার পাশে শুয়ে আছি আমি। মায়ার প্রচণ্ড মন খারাপ। জিজ্ঞেস করলাম দেশের কথা মনে পড়ছে? না সূচক মাথা নেড়ে চুপ করে রইলো। আবার জিজ্ঞেস করলাম তাহলে বোন দুলাভাই কেউ কিছু বলেছে? ছোট করে উত্তর দিল “নাহ” তবে কি হইছে?

মায়া আমার বুকে মাথা রেখে বললো, “সব মায়াদের ভাগ্যেতো আর তোমার মতো মানুষ জোটে না। অনেক মায়া আছে যারা যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে হারিয়ে যায়। একটু আগে কমান্ডার স্যার কল দিয়েছিলেন, শুনলাম আমাদের পাশের এরিয়া গ্রুপের এক লিডার ম্যাম অফিস রুমে আত্মহত্যা করেছেন!”

কথাটা শুনে চোখ গড়িয়ে টপটপ পানি পড়তে লাগলো। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো আমার। মায়ার মাথাটা বুকে শক্ত করে চেপে ধরে রইলাম। আড়ালে নিঃশব্দে কেঁদে গেলাম।
 
মায়া সবসময় আমাকে খুব মহান চোখে দেখে, সে ভাবে আমি তার জন্য কত বড় স্যাক্রিফাইস করেছি। তার ভাষ্যমতে আমি অযোগ্য কাউকে বিয়ে করে এনেছি। অথচ মায়া জানে না অযোগ্য মায়া নয় বরং অযোগ্য আমি নিজেই। আমার মতো মানুষরাই সমাজে মায়াদের মতো মেয়েদের জন্মাতে বাধ্য করে। আমার মতো মানুষরাই সামান্য সুখ লোভে মিনুদের মতো মেয়েদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়। এক জনের এক মুহূর্তের আনন্দ অপর জনের সারা জীবনের কান্না হয়ে দাঁড়ায়। তারা যদি একটিবার মায়া মিনুদের ভিতরের কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখতে পেত, আমার বিশ্বাস, কোনো ছেলেই সাময়িক আনন্দ পেতে এত বড় ভুল করতে যেত না।
 
আমি অনুতপ্ত, আমি লজ্জিত। মাঝেমধ্যে এখনও অনেক কষ্ট হয় আমি মিনুর জন্য কিছুই কর‍তে পারিনি। তবে মিনুর শেষ কথাটুকু রাখতে পেরেছি। তার মতো অন্য একটি মেয়েকে আপন করে নিয়েছি। তার জীবনটা বিনা সংকোচে ভালোবাসার রঙে সাজিয়ে দিতে পেরেছি। এখন মায়াকে বুকের মাঝে আগলে রেখে নিজ বিবেককে একটু হলেও স্বস্তি দিতে পারি, আমি কাপুরুষ নই। মিনু আমাকে ক্ষমা করবে তো?
 
( সমাপ্ত )

প্রতিশোধের আগুন
লেখা – Md Shahadat Hossain

আরো পড়ুন – ভয়ানক ভৌতিক গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *