ঊর্ণাজাল – Notun romantic love story in Bengali

ঊর্ণাজাল – Notun romantic love story in Bengali: আউচ! করে উঠল মায়ূমী। চমকে ওর দিকে তাকাল যিয়াদ। মায়ূমী ডান হাত দিয়ে বাম হাতের একটা অংশ ঘষছে। “হি হি! চিমটি কেটে শিওর হয়ে নিলাম স্বপ্ন দেখছি কিনা” বলল ও।


পর্ব ১

সময় তখন মধ্যরাত।

আটলান্টিকের বুক চিরে নীরব নিস্তব্ধ রাতের শান্তি বিনষ্ট করে এগিয়ে চলেছে একটি মাঝারি আকৃতির পার্টি ক্রুজ। গন্তব্য বাহামা দ্বীপপুঞ্জের নাসাউ।

তবে যাত্রীদের কারো সে ব্যাপারে আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছেনা। ক্রুজের ছাদ ও দ্বিতীয় তলায় ওয়াইন আর বিয়ারের ফোয়ারা ছুটিয়ে শ’খানেক যুবক-যুবতী মেতে উঠেছে পার্টির উন্মাদনায়।

ডান্স ফ্লোর দাপিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে এক দল তো আরেক দল তাদের উৎসাহ প্রদানে মত্ত। এর মাঝেই হালকা অন্ধকারাচ্ছন্ন কোণাগুলোতে জুটিবদ্ধদের দেখা মিলছে।

ক্রুজের ডেকেও চলছে আলো আঁধারির খেলা, তবে এখানে কদাচিৎ দুএকজনকে ওয়াইন গ্লাস, বিয়ারের ক্যান কিংবা সিগারেট হাতে দেখা যাচ্ছে। প্রত্যেকেই নিজের মত করে উপভোগ করছে জীবনকে, যৌবনকে।

তবে এক যুবককে এসব কিছুর বাইরে ডেকের অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তার নিস্পলক দৃষ্টি আকাশপানে, সেখানে এক বিশাল থালার সমান দ্বাদশী চাঁদ সমস্ত রূপের ডালি মেলে দিয়েছে। পেছনের এত শব্দ, এত কোলাহল, তার কর্ণকুহরে কোনভাবেই প্রবেশ করতে পারছেনা।

সে কেবলই আল্লাহ তায়ালার অপরূপ সৃষ্টির রূপ অবগাহন আর মনে মনে তাঁর স্মরণে মগ্ন। কিন্তু হঠাৎ কিছু একটা তার মগ্নতায় বাধা সৃষ্টি করল, চকিতে পেছনে তাকাল সে। ডান্স ফ্লোরে কিছু একটা হয়েছে, থেমে গেছে গান আর বাদ্যের ঝনঝনানি।

কান ঝালাপালা করা শব্দ হঠাৎ থেমে গেলে মনযোগে ব্যঘাত ঘটায় বৈকি। কী হয়েছে বোঝার জন্য একটু এগিয়ে গেল সে। কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই পুনরায় পেছাতে বাধ্য হল।

দুটো ছেলে, একজন আরেকজনের জ্যাকেটের কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল ডেকে। দুজনের কাউকেই চেনেনা ও।

পেছন পেছন বাকিরাও হৈ হৈ করতে করতে ডেকে চলে এল। দুজনের মধ্যে আরম্ভ হল প্রচন্ড মারামারি। বাকিরাও দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেল ওদের ছোটাতে গিয়ে। বেশ একটা হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল ডেকের মধ্যে।

এই হুটোপুটির মধ্যে সে যে কখন পেছাতে পেছাতে একেবারে ডেকের প্রান্তে চলে এসেছে, নিজেও বুঝতে পারেনি। যখন বুঝতে পারল ততক্ষণে সে নিচতলার রেলিঙে বাঁধা একটা লাইফবুয়ে (কমলা রঙের লাইফ সেভার টায়ার) ধরে ঝুলছে।

পড়ার সময় চিৎকার সে ঠিকই দিয়েছিল, কিন্তু এমনিতে যে চিৎকার চেচামেচি চলছিল, সেগুলো ছাপিয়ে ওর চিৎকার কারো কানেই পৌঁছেনি। ঝুলে থাকা অবস্থাতেই ও সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি আরম্ভ করল।

কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে লাইফবুয়েটা খুলে গেল রেলিঙ থেকে, ঝপ করে ওকে সহ পড়ে গেল আটলান্টিকের নিকষ কালো জলে।

ঠিক একই সময়ে ডেকের অন্যপাশ থেকে একটা মেয়ে এই শোরগোলের সুযোগ নিয়ে স্বেচ্ছায় ঝাঁপ দিল আটলান্টিকের বুকে, সেটাও কারো নজরে পড়লনা।

বেলা চারটে।

বিকেলের সূর্যালোক ঢাকা পড়ে গেছে সামনের দালানগুলোর আড়ালে। নইলে হয়ত পশ্চিমের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে নিরুপদ্রবে হানা দিত এই অফিসকক্ষে। যেখানে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে যিয়াদ। যিয়াদ আব্দুল্লাহ।

জিকে গ্রুপের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আর বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গুলশানের প্রধান সড়ক নিচে স্বমহিমায় ব্যস্ত। কাঁচ দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল যিয়াদ। মাঝে মাঝে কাজটা করতে ভালো লাগে ওর।

মানুষের কোলাহল, গাড়ির হর্ন, ইঞ্জিনের গুঞ্জন, কত রকমের শব্দই না বিরাজ করছে সেখানে। অথচ বারোতলার উপরে সাউন্ডপ্রুফ ঘরে বসে তার কিছুই টের পাওয়ার উপায় নেই। ব্যাপারটা অনেকটা সাউন্ড মিউট করে মুভি দেখার মত।

কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে যিয়াদ। পাঁচটা বাজতেই ইন্টারকমের রিসিভার তুলল ও।

“মি. সালেহীনকে একটু আমার রুমে আসতে বলুন আর আমাদের জন্য দুই কাপ কফি আর কিছু স্ন্যাকস পাঠিয়ে দিন”

“ওকে স্যার”

দুই মিনিটের মাথাতেই দরজায় নক শোনা গেল।

“কাম ইন” যান্ত্রিক গলায় বলল যিয়াদ।

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল স্যুট পরিহিত একজন ভদ্রলোক। বয়স যিয়াদের আশেপাশে হলেও লম্বা দাড়ি আর ঈষৎ ভারী স্বাস্থ্যের জন্য আরেকটু বয়স্ক দেখায়।

যিয়াদ ততক্ষণে বসে গেছে বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের পেছনে নিজের চেয়ারটাতে, অসহায়ের মত দুহাতের তালুতে মুখ রেখে। সালেহীনের নজর পড়ল যিয়াদের উপর।

দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।

“এনি প্রব্লেম, স্যার?”

“পাঁচটা বেজে গেছে, দোস্ত”
চকিতে ঘড়ির দিকে চোখ চলে গেল সালেহীনের।

“খেয়াল করিনি। কী হইসে তোর?” মুহূর্তে ফর্মালিটি ত্যাগ করে এগিয়ে গেল সালেহীন বন্ধুর দিকে। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল অনুমতির তোয়াক্কা না করেই। সালেহীন যিয়াদের কোম্পানির সিএফও, চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার।

প্রায় ষোল কী সতেরো বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ওদের।

তারপরেও অফিস টাইমে সম্পূর্ণ পেশাদারী আচরণ বজায় রাখে দুজনে। কেউ বলতে পারবেনা যে নিজের কোন যোগ্যতা নেই, বন্ধুর কোম্পানি বলে চাকরি পেয়েছে। নিজের কাজে এতটাই দক্ষ সালেহীন।

“মিস মারিয়াম তার পুত্রসমেত বাংলাদেশে আসছেন ছয় মাসের জন্য”
“মিস মারিয়াম মানে ওই ‘ডিসেন্সি বাই মারিয়াম” এর ওনার?”
“হুঁ”
“ছয় মাসের জন্য? দ্যাটস এ লট! এতদিনের জন্য কেন?”
“কী জানি”
“তাতে তোর এত ভেচকানোর কী হইল বুঝলাম না”
“ইউএসএ কোনদিন আমার পিছু ছাড়বেনা, তাই না দোস্ত”
এবার বুঝতে পারল সালেহীন।

“তুই এভাবে ভাবিস তাই। ইউএসএ তোর জীবনের একটা পার্ট। এটলিস্ট বিজনেস এর দিক থেকে ধরলেও। আমাদের মেইন কাস্টমার যে ইউএসএ, সেটা তো আর তুই অস্বীকার করতে পারবিনা। জাস্ট একটা মেয়ের জন্য তুই পুরো একটা দেশকে বয়কট করতে পারিসনা।

তার উপর তুই যখন টেক্সটাইল ইন্ড্রাস্ট্রিতে আছিস, তখন তো নইই”
“হুঁ। সারাজীবন তো এ যুক্তিই দিয়ে আসলি।

কিন্তু মন যে মানেনা দোস্ত। যদি নিহাদের বিজনেসে একটু ইন্টারেস্ট থাকত, আমি সব ছেড়ে বনবাসে যাইতামগা। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগেনা”
“এসব কী বাচ্চাদের মত কথাবার্তা!

এই বয়সে এসব মানায়? তার উপর তুই আমাকে কোনদিন পুরাটা বললিনা। এতগুলো বছর হয়ে গেল, এবার তো অন্তত আমারে সবটা খুইলা বল। প্লিজ দোস্ত, তোর পায়ে পড়ি” মিনতির সুরে বলল সালেহীন।

“কেন যে বলতে চাইনা তুই তো ভালো করেই জানিস, ক্ষত খুঁচিয়ে রক্ত বের করতে চাইনা। ভুলতে চাই আমি”
“কিন্তু ভুলতে তো পারিসনি তাইনা।

যে ক্ষত দশ বছরেও শুকায়নি, সেটা আর কোনদিন শুকাবে বলে মনে হয়না। সো কাম অন ম্যান, এবার বলে ফেল। হয়তো বললেই তোর মন হালকা হবে, ভুলতে পারবি”
দুহাতে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ ভাবল যিয়াদ।

“ঠিক আছে, লেটস ট্রাই ইয়োর মেথড” ফাইনালি ডিশিসন নিয়ে সোজা হয়ে বসল যিয়াদ।
“ও মাই গড! রিয়েলি! জাস্ট টু মিনিট দোস্ত!

আমি দুই মগ কফি নিয়ে আসি। খালি মুখে মোটেও এনজয় করতে পারবনা” উত্তেজনার সাথে উঠে দাঁড়ালো সালেহীন।

“তোরে যাইতে হবেনা। আমি পাঠাইতে বলসি”
“গ্রেট!” বলতে না বলতেই দরজায় নক হলো।

আই কান্ট বিলিভ দিস! দশ দশটা বছর ধরে বলতে বলতে আমার মুখে ফেনা উঠে গেছে, ফাইনালি! ও মাই গড! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কফিতে চিনি মেশাতে লাগল সালেহীন। ওরা দুজনে টেবিল ছেড়ে এসে বসেছে যিয়াদের রুমের সিটিং এরিয়ায়।

সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজেছে যিয়াদ। ঠিকই বলেছে সালেহীন, আজও প্রতিটা দিন, প্রতিটা ঘটনা স্মৃতির পাতায় বড় বেশি উজ্জ্বল। স্মৃতি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই জাহাজের ডেকে, যেখানে হয়েছিল ঘটনার সূত্রপাত।

ভোরের সোনালী আলো মুখে পড়তেই নড়ে উঠল নির্জন সমুদ্রতটে পড়ে থাকা দেহখানা।

পূবাকাশে মেঘের কোল ঘেঁষে সূর্যটা উঁকি দিয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি।

তবে পাহাড়ের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসতে তেজ বেড়ে গেছে অনেকটাই। তাই চোখের পাতা মেলতেই দু’চোখ ধাঁধিয়ে গেল যিয়াদের।

পরমুহূর্তেই ডান হাত দিয়ে চোখটা আড়াল করে উঠে বসল ও। চোখ কচলে স্বাভাবিক করতে গিয়ে হাতে বালির অস্তিত্ব অনুভব করল। কিছুটা আশ্চর্য হয়ে সামনে তাকাতেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে স্তব্ধ হয়ে গেল যেন।

সূর্য ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে স্বমহিমায়, আলোয় ভাসিয়ে দিয়েছে জগৎসংসার। বামদিকে একটু দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ গাছগাছালি, তারও পেছনে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের অস্তিত্ব। আর ডান দিকে সমুদ্রের বিস্তৃত সুনীল জলরাশি। প্রভাত কিরণে ঝলমল করছে সবকিছু। স্বগোতিক্তের মত মুখ দিয়ে উচ্চারিত হল যিয়াদের, “সুবহানাল্লাহ!”

চোখ খোলার আগমুহূর্তে স্বপ্ন কিংবা ঘোরে এক অতীব সুন্দর পাহাড়ঘেরা পুস্পদ্যানে বিচরণ করছিল যিয়াদ। চোখ খুলে উঠে বসলেও সেই ঘোর থেকে বের হতে পারেনি। তাই হঠাৎ সেই পুস্পদ্যান থেকে এই সমুদ্রতীরে কীভাবে চলে এল, মাথায় ঢুকল না ওর।

পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়তে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল যিয়াদের মুখ, চোখদুটো হয়ে গেল আরও একটু স্বপ্নালু। “আমি কি মরে গিয়ে সোজা জান্নাতে চলে এসেছি?!

এত সুন্দর সুন্দর জায়গা দুনিয়াতে কীভাবে থাকতে পারে? আল্লাহ গো, তুমি আমাকে বিনা হিসাবে জান্নাতে পাঠিয়ে দিয়েছো!”

“হেই, তুমি কী করছো এখানে?” যিয়াদের কল্পনার জাল ছিন্ন করে ইংরেজিতে একটা মেয়েলি কণ্ঠ বলে উঠল একটু দূর থেকে।

ঘোরলাগা দৃষ্টি সেদিকে ফেরাতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল যিয়াদের। অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে একহাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে আছে, অন্যহাতে একটা লাঠি মাটিতে ঠেস দেয়া।

ঝোপঝাড়ের জঙ্গল থেকে হঠাৎ যেন বেরিয়ে এসেছে এক বনকন্যা। অভ্যাসবশত চোখটা নামিয়ে নিতেই নিজের বোকামীতে হেসে ফেলল যিয়াদ।

“আরেহ! এ মেয়ে নিশ্চয়ই জান্নাতী হুর। জান্নাতী হুরের দিকে তাকাতে তো আর নিষেধ নেই”
“হেই, কী বিড়বিড় করছো তুমি?” আবারো ইংরেজিতে বলল মেয়েটা, ইতোমধ্যে খানিকটা এগিয়ে এসেছে ওর দিকে।

এবার ভালোভাবে তাকাল যিয়াদ। “হুরটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে! আর ও ইংরেজিতে কথা বলছে কেন? জান্নাতের ভাষা না আরবী হবে?”

মেয়েটা ততক্ষণে একদম কাছে এসে গেছে। পরণে টাইটফিটিং জিন্স আর উপরে থ্রি-কোয়ার্টার হাতার একটা টপ। কোমরে কিছু একটা বাঁধা আছে, সোয়েটার কিংবা জ্যাকেট টাইপ, গরমের জন্য খুলে ফেলেছে বোধহয়। জান্নাতী হুর কেন ওয়েস্টার্ন পোশাক পরে আছে, সেটাও বোধগম্য হলনা যিয়াদের।

“এনি প্রব্লেম?” যিয়াদের সামনে বসে আঙ্গুল দিয়ে চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল মেয়েটা।
“প্রব্লেম তো বটেই, জান্নাতী হুর ইংরেজিতে কথা বলছে, আশ্চর্য ব্যাপার!” এবার মেয়েটার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে ইংরেজিতেই বলল যিয়াদ।

কিন্তু ক্ষণকাল পরেই চোখ নামিয়ে ফেলতে বাধ্য হল। কুচকুচে কালো ঢেউ খেলানো চুল আর গভীর সমুদ্রের ন্যায় নীল চোখের অধিকারিণী কেন যেন ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলছে ওকে। মেয়েটার রূপ যেন সূর্যের প্রথম রশ্মির ন্যায় তেজী, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না।

“হুর? কে হুর? আমার নাম তো মায়ূমী” বলল মেয়েটা, একটু যেন আশ্চর্য হয়েছে।

“হুরদের নামও থাকে! থাকতেই পারে” আবারও বাংলায় বলল যিয়াদ।

“ফর গড’স সেক, তুমি নিজের ভাষায় বিড়বিড় করা বন্ধ করবে? আমি কিছু বুঝতে পারছিনা” এবার খানিকটা বিরক্তি মিশেছে মেয়েটার কণ্ঠে।
“তুমি বাংলা বুঝোনা? কিভাবে সম্ভব!? স্বর্গে তো এমন কোন প্রব্লেম হওয়ার কথা না” ইংরেজিতে বলল যিয়াদ।

“স্বর্গ!” গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল মায়ূমী, “মনে হচ্ছে ঢেউয়ের বাড়ি খেয়ে….. এক্কেবারে গেছে” মাথার দিকে আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করল সেই সাথে, “তোমার সাথে কথা বলে লাভ নেই।

প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে আমার। আমি আশপাশটা এক্সপ্লোর করতে বেরিয়েছি, তুমি চাইলে আমার সাথে যোগ দিতে পারো” যিয়াদের উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়াল সে। হাতের লাঠিটা ঘুরাতে ঘুরাতে এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে।

ক্ষুধার কথা শুনে যিয়াদের পেটও গুড়গুড় করে উঠল। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ের ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠল ও। যিয়াদের আর্তনাদ কানে যেতেই পেছন ফিরল মায়ূমী, প্রায় দৌড়ে এল ওর কাছে।

“কোথাও লেগেছে

যিয়াদের হাত ধরল মায়ূমী। এক ঝটকায় হাতটা ছাড়াল যিয়াদ। অবশেষে ক্ষুধা আর ব্যথা হুঁশ য়েছে ওর। বুঝতে পেরেছে, জান্নাতে না, মাটির দুনিয়াতেই আছে। আর এ মেয়েটাও কোন হুর নয়, রক্তমাংসের মানুষ। নিজের বোকামীতে এখন প্রচন্ড রাগ হচ্ছে যিয়াদের।

এত ফালতু চিন্তাও মানুষ করতে পারে! মেয়েটার সামনে তো বটেই, নিজের সামনেই পুরো স্টুপিড বনে গেছে ও।

তবে হাত সরিয়ে দেয়াটা ভালোভাবে নিলনা মায়ূমী।

“হেই, তোমার সমস্যাটা কি বলোতো? আমি তোমাকে সাহায্য করতে এলাম আর তুমি এমন করছো?”
নিজেকে সামলাল যিয়াদ। ওরা এমন জীবনযাত্রায়ই অভ্যস্ত, ও কেন হাত সরিয়ে নিয়েছে সেটা এই মেয়ে বুঝবেনা।
আপাতত এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।

“স্যরি, আমি নিজের মধ্যে ছিলামনা। পরিস্থিতি বুঝতে একটু সময় লাগল আর কি”
“ও আচ্ছা, তাই বলো। ওভাবে চিৎকার করলে, কোথাও লেগেছে তোমার?”

“হ্যাঁ, মনে হয় বাম পা টা কোথাও বাড়ি খেয়েছে। হঠাৎ উঠতে গিয়ে খুব লেগেছিল। এখন দাঁড়ানোর পর অত বেশি লাগছেনা” একটু হেঁটে দেখল যিয়াদ, হাঁটতে পারছে, তবে একটু
“আমি হেল্প করব?” এগিয়ে আসল মায়ূমী।

“না না, আমি পারব। থ্যাংকস” তাড়াতাড়ি বলল যিয়াদ।

ওর বলার ভঙ্গিতে একটু আহত হল মায়ূমী, তবে সেটা প্রকাশ করলনা। মুখে বলল, “ঠিক আছে, তোমার যা ইচ্ছা” কাঁধ নাচিয়ে আগের মতই লাঠিটা ঘুরাতে ঘুরাতে এগিয়ে গেল ও।

পেছন পেছন যিয়াদও এগোল, তবে মায়ূমীর দিকে না তাকিয়েই। দৃষ্টি নত রাখার চেষ্টা দেশে থাকতে শুরু করলেও সেটা কঠোরভাবে রপ্ত করতে হয়েছে এখানে এসে। যদিও এই দেশে কাজটা ছেলেদের জন্য এক প্রকার অসম্ভব।

ফ্লোরিডার আবহাওয়া কখনই মাইনাসের নিচে নামেনা আর অধিকাংশ সময়েই উষ্ণ আর মনোরম। মেয়েরাও তাই পোষাক আশাকের ব্যাপারে বেশ খোলামেলা। বেশিরভাগ মেয়েই জিন্স বাদে অন্য পোশাক হাঁটু পর্যন্ত বা তার উপরে পরে। আর সি-বিচের কথা তো না বলাই ভালো।

হাঁটার ফাঁকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ডানে বামে তাকাচ্ছিল যিয়াদ। বারে বারে মনে পড়ছে, কীভাবে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে।

নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে যেন কষ্ট হচ্ছে। যেখানে ভেবেছিল আটলান্টিকের বুকেই ওর সলীল সমাধি হবে, সেখানে এই অপরূপ সুন্দর সমুদ্রতীরে নিজেকে আবিষ্কার করে মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা অনুভব করছিল যিয়াদ। ইতোমধ্যে কতবার যে আলহামদুলিল্লাহ পড়ে ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই।

“তুমি বেশ পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছো, জায়গাটা চেনো নাকি? কোথায় আমরা?”

কিছুক্ষণ হাঁটার পর বলল যিয়াদ। ওরা ততক্ষণে সৈকত ছেড়ে এসে ঢুকেছে গাছপালার জঙ্গলে। জঙ্গল বললে আসলে ভুল হবে কারন গাছপালার ঘনত্ব খুব বেশি না। গাছগুলোও খুব বড় বড় না, মাঝারী আকৃতির।

এখানে সেখানে প্রচুর ঝোপঝাড়ও দেখা যাচ্ছে। তবে এক নারিকেল গাছ বাদে আর কোনটাই চিনতে পারলনা যিয়াদ।

“ওই, তোমার থেকে এক ঘন্টা বেশি চিনি। সূর্য ওঠার খানিক আগে জ্ঞান ফিরেছে আমার। আরেকটু ওইদিকে ছিলাম আমি। আশেপাশে কাউকে না পেয়ে লাঠি নিয়ে বেশ একটা এডভেঞ্চারে বেরিয়েছিলাম, দ্বীপ ঘুরে দেখার এডভেঞ্চার!এইখানে এসে দেখি তুমি”
“দ্বীপ! এটা কোন কোস্ট না?”

চোখ কপালে উঠল যিয়াদের।

“নাহ! যতদূর মনে হচ্ছে এটা একটা দ্বীপ। যদিও আমরা ঢেউয়ে চেপে ঠিক কতদূর ভেসে এসেছি বলা যায়না। তবে দুজনে এক জায়গায় এসে পড়েছি যখন, তার মানে খুব বেশিদূর হওয়ার কথা না।

আর আমরা যেই পথ ধরে যাচ্ছিলাম, তার আশেপাশে আমার জানামতে কোন কোস্ট নেই। আছে এমন ছোটবড় অনেকগুলো দ্বীপ”
“হায় হায়! কী বলছো তুমি! এখন কী হবে?”

চিন্তিত কন্ঠ যিয়াদের।

“কী আর হবে… আমার সাথে এই দ্বীপে এখন সংসার করতে হবে তোমাকে” নির্বিকার কণ্ঠে বলল মায়ূমী।
‘নাউজুবিল্লাহ!” আঁতকে উঠল যিয়াদ। সবেগে পিছিয়ে গেল কয়েক পা।

হেসে ফেলল মায়ূমী। পেছন ফিরে যিয়াদের চেহারা দেখে দুলে দুলে হাসতে থাকল।
“ইয়াহুউউউউউ! পেয়ে গেছি” হঠাৎ হাসি থামিয়ে চিৎকার দিল মায়ূমী।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে যিয়াদ তাকিয়ে দেখল এত খুশির কারণ। একটা ঝোপে লাল লাল বেরিজাতীয় ফল ধরে আছে।


পর্ব ২

“ডোন্ট ওরি! আমি তোমার প্রতি ইন্টারেস্টেড নই, তুমি আমার টাইপ নও” প্রথম ফলটা খাওয়ার পরেই বলল মায়ূমী।
কাঁধ নাচাল যিয়াদ, যেন ব্যাপারটা থোড়াই কেয়ার করে ও। আর মনে মনে বলল, তুমিও আমার টাইপ নও মায়ূমী। যে মেয়ে পোশাক চেঞ্জ করার মত বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ করে, সে আর যাই হোক, আমার টাইপ কখনোই হতে পারেনা।

যিয়াদের প্রতিক্রিয়া দেখে ভ্রু কোঁচকাল মায়ূমী, কিন্তু কিছু না বলে খাওয়ার দিকে মনযোগ দিল।

দুটো ফল খাওয়ার পর হঠাৎ যিয়াদের মনে পড়ল মেয়েটার প্রথম প্রশ্নটা। সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল ও, “হেই, তুমি কি আমাকে চিনো?”

ঘাড় ঘুরাল মায়ূমী, “চিনি বলতে লাইব্রেরিতে দেখেছি তোমাকে, রুডম্যান”
ও আচ্ছা ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল যিয়াদ। বোধবুদ্ধি ফেরার সাথে সাথেই ও মায়ূমীকে চিনতে পেরেছে ।

এই মেয়ে অলমোস্ট পুরো উইনিভার্সিটির হার্টথ্রব, সেই সাথে ওর মরক্কান ফ্ল্যাটমেট রুম্মানের বর্তমান অবসেশন। যতক্ষণ সামনে থাকে একে নিয়েই বকবক করতে থাকে। তাই মেয়েটার সম্পর্কে না চাইতেই অনেক কিছু জানে ও।

সেসব তথ্যের ভিত্তিতে এই মেয়ের মাথার উপর ‘একশো হাত দূরে থাকুন’ লেখা সাইন জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু এই মেয়ে ওর মত একটা লাইব্রেরি এসিস্ট্যান্টকে নোটিস করেছে, এ তো বিশাল আশ্চর্যের ব্যাপার। কিন্তু কী বলে ডাকল ওকে?

“রুডম্যান! কে রুডম্যান? বাই এনি চান্স তুমি কি আমাকে রুম্মানের সাথে গুলিয়ে ফেলছো?” আরে বাহ! এই মেয়ে ওর নাম জানে, রুম্মান শুনলে তো আকাশে উড়বে, ভাবল যিয়াদ।

হাসল মায়ূমী, “কারো সাথে গুলাইনি। তুমি তো এই নামেই পরিচিত, তুমি জানোনা?”

“কিহ! আমি কী নামে পরিচিত?” তিন নাম্বার ফলটা মুখে পুরতে গিয়েও থমকে গেল যিয়াদ।

“টল-ডার্ক-হ্যান্ডসাম ম্যান, বাট ঠু রুড! মেয়েরা তাই তোমার নাম দিয়েছে রুডম্যান, শুনেছি আমি” বিরতিহীনভাবে একটার পর একটা ফল খেয়ে যাচ্ছে মায়ূমী। ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফলের টকমিষ্টি স্বাদটা বেশ পছন্দ হয়েছে ওর।

“রিয়েলি!? আমার একটা এক্সট্রা উপাধিও আছে! আনবিলিভেবল!” অবিশ্বাস ঠিকরে বেরোচ্ছে যিয়াদের দুচোখ থেকে।

“তো, তোমার আসল নামটা কী?”

“যিয়াদ, জেড-আই-ডাবল এ-ডি”
“ওকে, যিয়াদ। গট ইট” স্পষ্টভাবেই উচ্চারণ করল মায়ূমী।

খানিকবাদে আবার মুখ খুলল যিয়াদ,
“আচ্ছা, আমি যতদূর জানি তোমাদের এখানের ম্যাক্সিমাম দ্বীপেই তো হোটেল বা রিসোর্ট বানানো হয়েছে। আমার মনে হয় বসে বসে ফল খেয়ে সময় নষ্ট না করে আমাদের সেগুলো খোঁজা উচিত” কথাটা বলতে গিয়ে না দেখেই একটা আধপাকা ফল মুখে পুরে চোখমুখ কুঁচকে ফেলল যিয়াদ।

থু থু করে ফেলে দিল মুখ থেকে। লটকন আকৃতির ফলগুলো এমনিতেই পুরো মিষ্টি না, টক আর কষযুক্ত। আর এটাতে তো মিষ্টির বালাই নেই, যিয়াদ টক খেতে মোটেই পছন্দ করেনা।

“তুমি চাইলে খুঁজতে যেতে পারো, আমি যাবনা” কাঁধ নাচাল মায়ূমী।

“কেন?” অবাক হলো যিয়াদ।

“আমি এখানেই থাকতে চাই, এই দ্বীপের রাণী হয়ে” নির্বিকার কণ্ঠ মায়ূমীর।

“মানেটা কী? আমাকে বলছিলে একটু আগে, এখন তো দেখছি তোমার মাথা গেছে। এখানে কেন থাকতে যাবে?”
“আমার ইচ্ছে” ভাবটা এমন যেন বেড়াতে এসে হোটেলেই একটু ঘুমাতে চাচ্ছে, বাইরে ঘুরতে তার ইচ্ছে করছেনা।

“তুমি কি ব্যপারটা বুঝতে পারছোনা? আমাদের তো খবর দিতে হবে কাউকে।

হোটেল বা রিসোর্ট থেকে যোগাযোগ করা যাবে, তবেই না ওরা আমাদের উদ্ধার করতে আসবে”
“আমি উদ্ধার হতে চাইছিনা। আমি যেখানে আছি, সেখানেই থাকব। তোমার মাথা যখন ঠিক আছে তখন তুমি যাও, আমি নিষেধ করেছি?”
মেয়েটা কি এমনই? একটু মাথা খারাপ? মনে মনে ভাবল যিয়াদ। কয়েক মুহুর্তের জন্য কী বলবে ভেবে পেলনা ও।

“কিন্তু আমি তোমাকে এখানে এই জঙ্গলে একা ফেলে রেখে চলে যাব? এটা হয়?” প্রশ্ন করল জিয়াদ।

“হাউ সুইট অফ ইউ! এতো প্রোটেক্টিভ হওয়ার দরকার নেই, হ্যাঁ। আমি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারব”
“ওকে, এজ ইউ উইশ!” আর কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ল যিয়াদ। তোমাকে প্রটেকশন দেয়ার জন্য যেন মরে যাচ্ছি আমি, বিড়বিড় করে হাঁটা ধরল সমুদ্রের দিকে। হোটেল বা রিসোর্ট থাকলে তার ছোটবড় কোন জেটি নিশ্চয়ই থাকবে। সৈকত ধরে এগোনই তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।


ফ্লোরিডায় ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য বছরের এই সময়টা দারুণ মনোরম। না শীত না গরম, আবার বৃষ্টির দেখাও ঘনঘন পাওয়া যায়না। তবে সাগরের মাঝে বলেই হয়ত আবহাওয়াটা একটু গরমের দিকে, তবে অসহনীয় নয়। সকালের মিষ্টি রোদ গাছের ফাঁকফোঁকর গলে ওদের গায়ে পড়ছে আর খানিক পর পর সাগরের নোনা অথচ ঠান্ডা হাওয়া শীতল পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ ওদের, যিয়াদ আর মায়ূমীর।

একা একাই হাঁটছিল যিয়াদ। হঠাৎ শুনতে পায় পেছন থেকে ওর নাম ধরে কেউ ডাকছে। সাড়া দেয় যিয়াদ।

খানিক বাদেই মায়ূমীর দেখা পাওয়া যায়, দুহাতে কিছু একটা ধরে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে আসছে। যিয়াদকে দেখে মুখে সলজ্জ হাসির রেখা ফুটে ওঠে মায়ূমীর, যদিও সেটা কাটিয়ে ফেলে মুহূর্তেই “ভাবলাম যে তুমি আবার কোন বিপদ আপদে না পড়ে যাও, তাই চলে এলাম”
কাছে আসতে দেখা গেল কোমরে যে সোয়েটারটা বাঁধা ছিল সেটা ভরে ফল নিয়েছে ও। যিয়াদকে ওগুলোর দিকে তাকাতে দেখে বলল, “ব্যাকআপ।

পরে যদি আর কোন ফলের গাছ না পাই”
“বেশ ভাল বুদ্ধি। কিন্তু এভাবে ধরে কতক্ষণ হাঁটতে পারবে?”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, একটু অসুবিধাই হবে। কিন্তু কী করব, আমাদের কাছে তো কোন ব্যাগ নেই”
“উম্ম, দাঁড়াও দেখি কী করা যায়” বলে নিজের জ্যাকেটটা নিচে পাতল যিয়াদ আর মায়ূমীর হাত থেকে সোয়েটারটা নিয়ে ফলগুলো সেখানে ঢেলে দিল।

সোয়েটারটা চেইন ছাড়া, মাথা গলিয়ে পরতে হয়। গলার কাটাটা বেশ প্রশস্ত আর হাতা দুটো প্রয়োজনের থেকে বড়। সোয়েটারটা দুহাত দিয়ে মেলে ধরে কিছু একটা ভাবল যিয়াদ। ভাবা শেষ হলে প্রথমে সোয়েটাররের নিচের দুই দিক ধরে একটা মোটা গিঁট দিয়ে নিচের দিকটা সুরক্ষিত করল আর উপরে দুই হাতার মধ্যে আরেকটা গিঁট দিয়ে হাতল বানালো। তারপর গলার ভেতর দিয়ে ফলগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে হাতল উঁচিয়ে ধরল, ঠিক যেন একটা হোবো ব্যাগ।

এতক্ষণ হা করে যিয়াদের কাজ দেখছিল মায়ূমী, কথা বলে উঠল এবারে, “ওয়াও! কী বুদ্ধি তোমার!”
যিয়াদের হাত থেকে সদ্য প্রস্তুতকৃত ব্যাগটা নিয়ে কাঁধে ঝোলাল মায়ূমী। “এবার এক্কেবারে পার্ফেক্ট, লেট’স গো”
জ্যাকেটটা উঠিয়ে ঝেড়ে নিয়ে হাতে ঝোলাল যিয়াদ। রোদে ঘেমে যাবে বলে সরাসরি বীচ দিয়ে হাঁটছেনা ওরা, একটু ভেতর দিয়ে গাছের ছায়া ধরে এগোচ্ছে।
তবে ফলগুলো নিয়ে ওদের এত টেনশন করার দরকার ছিলনা। এই দ্বীপে ওই ফলের ঝোপ বেশ ভাল পরিমাণেই আছে, খানিক পর পরই দেখা মিলছে সেগুলোর। হাঁটতে হাঁটতে ওরা কিছু কলা গাছেরও দেখা পেল।

“তুমি তো কালকের ওই ক্রুজে ছিলে, তাইনা? এখানে এলে কী করে?” নীরবতা অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে দেখে একসময় জিজ্ঞেস করল মায়ূমী।

“হুমম! কপালে ছিল তাই এলাম আর কী” বলল যিয়াদ।

“আরে ধুর, পরিষ্কার করে বলো”
কী হয়েছিল খুলে বলল যিয়াদ। শুনে থমকে গেল মায়ূমী। চোখদুটো বড়বড় করে বলল, “ও মাই গড! তার মানে ওই লাইফবুয়েটা না থাকলে তুমি এতক্ষণ হয় পানির তলায় নইলে কোন একটা মাছের পেটে।”

মায়ূমীর বলার ভঙ্গিতে হাসি পেল যিয়াদের, “হ্যাঁ, অনেকটা সেরকমই। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা কী? তুমি কীভাবে এখানে?”
মুখ ঘুরাল মায়ূমী, “স্যরি, আমি বলতে চাচ্ছিনা”
“ওকে, এজ ইউ উইশ। কিন্তু তুমিও কি ক্রুজে ছিলে? তুমি তো আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর নও”
“আমি ইনভাইটেড ছিলাম, গান গাওয়ার জন্য”
“ও আচ্ছা”
এর পিঠে আর কোন কথা খুঁজে পাওয়া গেলনা, নীরবেই তাই পা চালাল ওরা আপাত গন্তব্যের সন্ধানে।

জোয়ার এসে গেছে। বিশাল বিশাল ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ছে পায়ের কাছে। সূর্য মাথার উপরে উঠে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে দুজনেই যারপরনাই ক্লান্ত, আর পারছেনা। কিন্তু এতক্ষণ ধরে হাঁটার পরেও না পেয়েছে ওরা কোন মানুষের দেখা, আর না পেয়েছে তাদের বসবাসের কোন চিহ্ন। সময় যত গড়িয়েছে, যিয়াদের ভেতর দেখা দিয়েছে হতাশা আর মায়ূমীর চোখেমুখে খুশির আমেজ। মেয়েটার মাথায় কোন সমস্যা আছে, ধারণাটা ধীরে ধীরে পোক্ত হচ্ছে যিয়াদের মনে।

এদিকের সৈকতে বালু নেই, কিংবা থাকলেও এখন জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে। বড় বড় পাথর অর্ধেকটা করে পানিতে ডুবে আছে।

গাছের ছায়ায় তেমনি দুইটা পাথরের উপর বসেছে ওরা। ওই টক ফল আর কলা খেয়ে দুজনেই আপাতত পেট ভরিয়ে নিয়েছে। মায়ূমীর কথা জানেনা, তবে যিয়াদের পেট রাত থেকেই খালি ছিল। ক্লাসমেটদের কর্মকান্ড দেখে ওর খাওয়ার ইচ্ছা চলে গিয়েছিল। যদিও এখন রীতিমত আফসোস হচ্ছে সেজন্য।

কারণ ফল খাওয়ার পর পিপাসা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। হোটেল বা রিসোর্ট কিছু একটা পাবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যিয়াদের। তাই পানি খোঁজার কথা মনে হয়নি ওর। নারিকেলের পানি খেয়ে হয়ত পিপাসা মিটত, কিন্তু কোন ছুরি বটি ছাড়া নারিকেল ছাড়ানো সময় আর কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই তখন হোটেল বা রিসোর্ট খোঁজাকেই গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয়নি। পানির খোঁজ করাটাই এখন সর্বপ্রথম করণীয়। তবে তারও আগে আরেকটা কাজ করতে হবে।

উঠে দাঁড়াল যিয়াদ, লাফ দিয়ে নামল আরেকটা পাথরের উপর।

“কী হলো?” জিজ্ঞেস করল মায়ূমী।

“কিছুনা, তুমি বসো। আমি একটু আল্লাহর কাছে হাজিরা দিয়ে আসি”
নিচু একটা পাথরে বসল যিয়াদ। সুন্দর করে অজু করল। তারপর মনে পড়ল বিষয়টা, সালাত আদায় করতে হলে তো আগে দিক নির্ণয় করতে হবে।

আর তার জন্য সূর্য আরেকটু হেলে পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল ও। তাহলে বরং এর ফাঁকে অন্য কিছু করে নেয়া যাক।
“দিনের আলো থাকতে থাকতে আমাদের পানি আর আগুনের ব্যবস্থা করা উচিত” মায়ূমীর দিকে না ফিরেই বলল যিয়াদ।

“হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তুমিই তো নারকেলের পানি খেতে দিলেনা তখন” অনুযোগের স্বরে বলল মায়ূমী।

“স্যরি, আমি আসলে হোটেল বা রিসোর্ট এর ব্যাপারে একটু বেশিই আশাবাদী ছিলাম। আচ্ছা, আমরা তো পাহাড়ের অনেকটা কাছে এসে পড়েছি, চলো ওইদিকে যাই। কপাল ভাল হলে কোন ঝর্ণার দেখা পেয়ে যেতে পারি”
“ঠিক আছে, চলো” উঠে দাঁড়াল মায়ূমী।

দুজনেই এবার ঢুকে পড়ল গাছপালার ভেতরে, গন্তব্য পাহাড়ের দেয়াল। খানিক পর পর যিয়াদ একটু ডানে বায়ে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করছিল, খেয়াল করল মায়ূমী।
“কী করছো তুমি?”
“কাজে লাগতে পারে এমন কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখছি”
“কেমন জিনিস বলো, আমিও খুঁজি” উৎসুক কণ্ঠ মায়ূমীর।

“যেকোন কিছু। তবে বোতল কিংবা কোন কিছুর খালি প্যাকেট পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সমুদ্র দূষণ সম্পর্কে তো জানো নিশ্চয়ই। আমরা যেভাবে এসেছি, সমুদ্রে ফেলা ওইসব জিনিসও ভেসে আসে দ্বীপগুলোতে”
“রিয়েলি! বোতল পেলে আসলেই খুব ভাল হবে” এবার দুজনেই খোঁজাখুঁজি করতে করতে পথ চলছিল।

তবে ওদের দুর্ভাগ্য, তীর থেকে বেশি ভেতরে ঢুকে পড়েছে বলেই হয়ত কিছুই পেলনা।

“এত ভেতরে জোয়ারের পানি ঢুকার সম্ভাবনা কম। চলো, আর না খুঁজে আমরা একটু পা চালাই”
এবারে নারিকেল গাছ দেখতে পেয়ে আর আগের ভুল করলনা ওরা। তবে মাত্র দুটো নারিকেল ছাড়াতে গিয়েই যিয়াদ পুরো গলদঘর্ম হয়ে গেল। পাথর দিয়ে বাড়ি মেরে মেরে নারিকেলের উপরের খোসা আলগা করা, তারপর হাত দিয়ে টেনে টেনে ছুটানো।

ডিসকভারি চ্যানেলে দেখে তো এত কঠিন মনে হয়নি কাজটা, দ্বিতীয় নারিকেলের পানি পান করতে করতে মনে মনে ভাবল যিয়াদ।

এই একটুখানি পিপাসা মেটার পর দুজনেই নবউদ্যমে এগিয়ে চলল পাহাড়পানে। তবে সেখানে পৌঁছে আশাহত হতে হল ওদের। কোন ঝর্ণা বা জলস্রোতের নাম নিশানাও দেখা যাচ্ছেনা। পাহাড়ের দেয়ালও বেশ খাড়া, আপাতদৃষ্টিতে মানুষের পক্ষে উঠা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। তবু পাহাড়ের গা ঘেঁষে হেঁটে চলল ওরা, যদি কোন ছোটখাটো ফাটল বেয়েও জলের ধারা বইতে দেখা যায়। নারিকেলের পানি তো আর আসল পানির পিপাসা মেটাতে পারবেনা।

তবে একটা জিনিস খেয়াল করল যিয়াদ। জঙ্গল ঘন না হয়ে যেন আরো পাতলা হয়ে এসেছে এদিকটাতে। এটার কারণ কী হতে পারে এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে আনমনে ভাবছিল যিয়াদ। আর তাতেই একটুখানি পিছিয়ে পড়েছিল মায়ূমীর থেকে। হঠাৎ মায়ূমীর গলার আওয়াজে সম্বিত ফিরল ওর, যিয়াদের নাম ধরেই ডাকছে। যিয়াদ প্রায় দৌড় দিল চিৎকার লক্ষ্য করে।


পর্ব ৩

চিৎকার না বলে বলা উচিত ছিল হর্ষধ্বনি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে যিয়াদ দেখল মায়ূমীর চোখমুখ থেকে খুশি উপচে পড়ছে।

অবশ্য সে দৃষ্টির জবাব মায়ূমীকে আর দিতে হল না, কলকল আওয়াজটা অত্যন্ত মধুরভাবে কানে এসে প্রবেশ করছে। কাছে এসে দেখল পাথুরে একটা নালা বেয়ে পানির ধারা বইছে। স্বস্তিতে ধপ করে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল যিয়াদ। আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসল ওর।

আঁজলা ভরে তৃপ্তি সহকারে পানি পান করল ওরা। আর এর ফাঁকে যেন হাজারবার আলহামদুলিল্লাহ পড়ে ফেলল যিয়াদ। এই স্বচ্ছ পানিতে হাত মুখ ধোয়ার লোভ সামলাতে পারলনা মায়ূমী। ওর দেখাদেখি যিয়াদও আরেকবার অজু করে নিল।

নালার উৎসমুখ দেখার জন্য খানিকটা এগোল ওরা। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল, পাহাড়ের গায়ে একটা বিশাল পাথরের নিচ দিয়ে নালাটা বেরিয়ে এসেছে। পাথরটা একটু অদ্ভুত, দেখে মনে হচ্ছে যেন আলগা ভাবে পাহাড়ের গায়ে বসানো। তবে গায়ে জমে থাকা শ্যাওলা বলে দিচ্ছে যুগ যুগ ধরে ওখান থেকে নড়ানো হয়নি পাথরটা। আর নড়াবেই বা কীভাবে, এত বড় পাথর নড়ানো চাট্টিখানি কথা তো নয়।

পানি পান করার পর দুজনেই চিন্তায় পড়ে গেল কোনদিকে যাবে সেটা নিয়ে। পানি বহন করবার মত যখন কিছু নেই, তখন তো পানির কাছাকাছিই থাকতে হবে। আবার কোন সাহায্যের সন্ধান পাওয়ার জন্য সৈকতের কাছেও থাকা উচিত। কিন্তু ওরা এসেছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, কোনদিক দিয়ে গেলে যে কাছাকাছি সৈকতে পৌঁছা যাবে সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা।

তবে মায়ূমী একটা বুদ্ধি দিল। যে নারিকেল দুটোর পানি ওরা খেয়েছে, সেটার শাঁস তখন ওরা পেট ভরা থাকায় খায়নি। সেগুলো মায়ূমী ওর ব্যগে করে বয়ে এনেছে। এখন শাঁস খেয়ে নিয়ে ওই মালাদুটোতে করে পানি নেয়া যায়।

সায় দিল যিয়াদ। তবে বন জঙ্গলের রাস্তা, এভাবে পানি নিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে সেটা হচ্ছে কথা। কিন্তু এখন রিস্ক নেয়া ছাড়া কিছু করার নেই। কয়েকটা চিকন ডালকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ছুঁচালো মাথা বের করার চেষ্টা করল যিয়াদ। চার নম্বর ডালটা তুলনামূলক ছূঁচালো হয়ে ভাঙ্গল। ওইটা আর দাঁতের সাহায্যে বহু কসরত করে নারিকেলের শাঁস যতটা পারা যায় বের করে খেল ওরা। তারপর দুটো মালা ভরে পানি নিয়ে মায়ূমীর দুই হাতে দিল যিয়াদ।
“তুমিও বাকি দুটোতে নাও” বলল মায়ূমী।

“না, আমি নিলে হবেনা। আমাকে অন্য কাজ করতে হবে”
“কী কাজ?”
উত্তর না দিয়ে যিয়াদ একটা লম্বা আর মজবুত দেখে গাছের ডাল তুলে নিল। তারপর মায়ূমীর দিকে তাকিয়ে বলল, “চলো”
ওরা যেদিকে যাবে বলে ঠিক করেছে সেদিকে চলা শুরু করল যিয়াদ। একটু পর পর হাতের ডালটা দিয়ে আঘাত করে দুইপাশের ঝোপগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছিল ও।

“হেই, কী করছো তুমি এগুলো? পাগল হলে নাকি? শুধুশুধু ঝোপগুলোর ওপর অত্যাচার করছো কেন?” পেছন থেকে মায়ূমী বলল।

“আল্লাহ মাফ করুন। কিন্তু কী করব বলো, এরপরে যেন পথ চিনে আসতে পারি, তার তো চিহ্ন কিছু রাখতে হবে”
এরপর আর কী বলার থাকতে পারে, সাবধানে পানিভর্তি নারিকেলের মালাগুলো ব্যালেন্স করে যিয়াদকে অনুসরণ করল মায়ূমী।

গাছের ছায়ায় দুই পা সামনে মেলে দিয়ে বসে আছে মায়ূমী।

এই সৈকতটা ফেলে আসা সবগুলো সৈকতের চেয়ে সুন্দর। বালির এক নির্নিমেষ সমুদ্র যেন হঠাৎ পাহাড়ের গায়ে বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে।

পাহাড়ের একটা অংশ অবশ্য পানির মাঝেও ডুবে আছে। সেখানে ঢেউগুলো প্রবল বেগে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ছে দুপাশে, যদিও এখান থেকে কেবল একটা পাশই দেখা যাচ্ছে। লোলুপ দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে আছে মায়ূমী। এদিকের পাহাড়ের গা জঙ্গলের মত খাড়া নয়, বেশ ঢালু।

গাছ-লতাপাতাও আছে বিস্তর, মনে হচ্ছে ওঠা যাবে একটু চেষ্টা করলেই। আর পাহাড়ের ওই মাথাতে উঠে দ্বীপের যে অপরূপ রূপ দেখা যাবে সেটা ভেবেই পুলক অনুভব করছে ও। তবে যিয়াদের মনযোগ এসবে নেই, সে ডুবে আছে প্রভুর সান্নিধ্যে।

সৈকতের কাছে পৌঁছে গেছে বুঝতে পারা মাত্রই যিয়াদ প্রায় ছুটে এসেছে সৈকতে। মায়ূমী এসে দেখে, যে লম্বা ডালটা যিয়াদ ঝোপঝাড়ে বাড়ি দিতে দিতে নিয়ে এসেছে, বালিতে গর্ত খুঁড়ে সেটাকে একটা সমান জায়গায় পুঁতছে সে।

পুঁতার পর একটা ছোট নুড়ি নিয়ে ডালটার ছায়ার মাথা যেখানে পড়ছে, সেখানে রাখল। তারপর এসে বসে পড়ল একটা গাছের নিচে। মায়ূমীও এসে যিয়াদের হাতে নারিকেলের মালাদুটো ধরিয়ে ওর পাশে বসল। একটু সরে গেল যিয়াদ, খেয়াল করলনা মায়ূমী। ও তখন দুপাশে হাত ছড়িয়ে হাতের টান ছুটাতে ব্যস্ত, একভাবে ধরে থাকায় বেশ টনটন করছে।

ডান হাতের মালাটা থেকে চুমুক দিয়ে এক ঢোক পানি খেল যিয়াদ, তারপর অন্য মালাটা মায়ূমীর দিকে এগিয়ে দিল।
“থ্যাংকস” মালাটা হাতে নিয়ে চুমুক দিল মায়ূমী।

“থ্যাংকস তো তোমার প্রাপ্য। এই বুদ্ধিটা না দিলে তো এখনি আবার দৌড়াতে হত”
হাসিমুখে ধন্যবাদ গ্রহণ করল মায়ূমী, মুখে কিছু বললনা।

কথা বলতে বলতেই বালির ভেতরে হাত দিয়ে একটা ছোট গর্ত খুঁড়ল যিয়াদ, তারপর মালাটা সাবধানে সেখানে নামিয়ে রাখল। যিয়াদের দেখাদেখি মায়ূমীও একই কাজ করল। কিন্তু তারপরই উঠে দাঁড়াল ও, ঢুকল গিয়ে বনের মধ্যে। একটু পর ফিরে এল বড় বড় দুইটা পাতা হাতে করে। তারপর মালা দুটো পাতা দিয়ে ঢেকে দিয়ে আশপাশে কয়েকটা করে নুড়ি বিছিয়ে দিল। যিয়াদ তাকিয়ে তাকিয়ে সবটা দেখল, ওর চোখমুখ মায়ূমীর বুদ্ধির নিঃশব্দ তারিফ করছিল।

খানিকক্ষণ পর উঠে দাঁড়াল যিয়াদ, পুঁতে রাখা ডালটার দিকে এগিয়ে গেল। যিয়াদের পেছন পেছন মায়ূমীও এল যিয়াদ কী করে সেটা দেখার জন্য। যিয়াদ এবার আগে রাখা নুড়িটা দিয়ে ওই জায়গা থেকে ছায়ার নতুন মাথা পর্যন্ত একটা সোজা দাগ টানল। তারপর দাগটা দুইপাশ থেকে আরো লম্বা করে দিল।

প্রথম মাথার দিকে লিখল একটা ডব্লিউ আর পরের মাথার দিকে লিখল একটা ই। এবার মাঝ বরাবর দাগটাকে লম্বভাবে বিভক্ত করল আর যায়গামত এন আর এস লিখল।
“এভাবে কি দিক নির্ণয় করলে?” মুগ্ধতা আর বিস্ময়ের সমন্বয় মায়ূমীর দৃষ্টিতে।
“হুম!” ছোট করে উত্তর দিল যিয়াদ।

“ওয়াও! দারুণ তো! কীভাবে জানলে এই বুদ্ধি?” মায়ূমীর কণ্ঠে বিস্ময়।
“টিভিতে দেখেছিলাম” স্মিত হেসে বলল যিয়াদ।

“কিন্তু এখন দিক নির্ণয় করতে গেলে কেন হঠাৎ?”

“আমি প্রার্থনা করব। আর আমাদের প্রার্থনার জন্য সঠিক দিক নির্ণয় করতে হয়”
“ও আচ্ছা…… কিন্তু এই দিক ঠিক করাটা এত ইম্পর্ট্যান্ট কেন?”

“ওয়েল, এটা আমাদের প্রার্থনা অর্থাৎ সালাত আদায়ের অন্যতম শর্ত যে আমাদের কিবলামুখী হতে হবে। তুমি কা’বা শরীফের নাম শুনেছো?”
দুই দিকে মাথা নাড়ল মায়ূমী, শুনেনি।

“মক্কা, সৌদি আরব?”

“ও আচ্ছা, ওই যে চারকোণা কালো ঘর, ওইটা?”

হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাল যিয়াদ।

“আমি সম্ভবত কোন একটা ডকুমেন্টা
রিতে দেখেছি” বলল মায়ূমী।

“হ্যাঁ, ওইটাই হচ্ছে কা’বা শরীফ, আমাদের কিবলা। সারাবিশ্বের যেখানে যত মুসলমান আছে সবাই কা’বার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করে। এটা আমাদের একমুখীতা, শুধুমাত্র এক আল্লাহর সামনেই আমরা মাথা নত করি, তাই সবাই এক দিকেই সিজদাহ করি”
“ও, আচ্ছা। কিন্তু আমরা কোন দিকে চলে এসেছি সেটাতো জানিনা।

তুমি এখান থেকে কীভাবে বুঝবে কা’বা কোন দিকে?”

“উম্ম, এখন আমি ফ্লোরিডায় যেদিক করে সালাত আদায় করতাম, মানে উত্তর আর পূর্বের মাঝামাঝি, সেদিক ফিরেই করব”
“ও আচ্ছা। ঠিক আছে তুমি প্রার্থনা করো, আমি বরং একটু রেস্ট নিই। ভীষণ টায়ার্ড লাগছে”***

অবিরত ঘর্ষণের একটা শব্দে ঘুম ভাঙ্গল মায়ূমীর। চোখ না খুলেই নিজের প্রিয় ডলফিন পিলোটা টানতে গেল অভ্যাসবশত। তার বদলে পেল শুধুই ঝরঝরে বালুর ছোঁয়া। সাথে সাথে চোখ খুলল মায়ূমী। হেলান দিয়ে থাকতে থাকতে কখন দুচোখ বুজে এসেছে আর কখন যে শুয়ে পড়েছে, বুঝতেও পারেনি। আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসল ও। এদিক ওদিক তাকাতেই বুঝতে পারল, খুব কম সময় ধরে ঘুমায়নি ও।

কারণ সৈকতে তখন সূর্যাস্তের পরের মরা আলো বিরাজমান। সে আলোতেই ও অবাক হয়ে দেখল ওর থেকে একটু দূরে যিয়াদ উবু হয়ে বসে সামনে পেছনে করে দ্রুতগতিতে কী যেন একটা ঘষে চলেছে।

“কী করছো তুমি?” ওর কাছে এসে বলল মায়ূমী।

থামল যিয়াদ, রীতিমত হাঁপাচ্ছে। কথা বলার আগে কিছুক্ষণ দম নিল।

“আগুন ধরানোর চেষ্টা করছি। বাপরে বাপ! এই ফায়ার প্লাউ মেথড যে বাস্তবে এত কঠিন আমি কল্পনাও করিনি” পুরো কথা ইংলিশে বললেও ‘বাপরে বাপ’ বাংলায় বলল যিয়াদ।

“তুমি আমাকে একবার ডাকবানা? খালি খালি এতক্ষণ ধরে কষ্ট করছো!”

“মানে?” বাম হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল যিয়াদ।

“মানে এইটা! টা-ডা!” জিন্সের পকেট থেকে একটা লাইটার বের করে যিয়াদের সামনে ধরে বলল মায়ূমী।

হা করে লাইটারটার দিকে তাকিয়ে রইল যিয়াদ। মায়ূমী বসে পড়ল কাঠের টুকরোগুলোর পাশে, যেগুলো যিয়াদ একটা আরেকটার সাথে কোণাকুণি করে সাজিয়ে রেখেছে। আঁশ টাইপ শুকনো লতাপাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যে গোলাটা বানিয়েছিল যিয়াদ প্রথম আগুন ধরানোর জন্য, সেটা তুলে নিয়ে লাইটার জ্বালাল, তারপর আস্তে করে ধরিয়ে দিল কাঠগুলোয়।

আগুনের পাশে বসে যিয়াদের দিকে তাকাল ও, “এসো, বসো এখানে”
উঠে এল যিয়াদ, বসল একটু দুরত্ব রেখে।

হঠাৎ নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগছে ওর, কারণটা ঠিক ধরতে পারলনা।
“তুমি স্মোক করোনা, না?” জিজ্ঞেস করল মায়ূমী।

“করলে বুঝি আমার কাছে লাইটার থাকতো?” উল্টো প্রশ্ন যিয়াদের।

হ্যাঁ বোধক ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল মায়ূমী। কিন্তু মাথা নাড়ল যিয়াদ।

“করলেও থাকতোনা।

এই ঢোলা ট্রাউজারের পকেটের সব মালসামান এখন আটলান্টিকের তলায়। তবে হ্যাঁ, তোমার কাছে লাইটার থাকতে পারে এটা কিন্তু আমার ধারণাতেও আসেনি” মায়ূমী স্মোক করে এমন তথ্য রুম্মানের কাছে শুনেছি বলে মনে পড়ছেনা তো, ভাবল যিয়াদ।
মৃদু হেসে হাতেধরা লাইটারটার দিকে তাকিয়ে মায়ূমী বলল, “স্মোক আমিও করিনা। এটা একটা ট্রিক। আমার মাকে ধোঁকা দেয়ার” পকেট থেকে চিমশে যাওয়া একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল ও, পানিতে ভিজে এই দশা হয়েছে জিনিসটার।

“এই দুইটা জিনিস আমার মাকে বোঝায় যে আমি স্মোক করি”
“মানে? ঠিক বুঝলাম না” স্পষ্ট বিভ্রান্তি যিয়াদের কণ্ঠে।

“তুমি এত কিছু বুঝে কী করবে, রুডম্যান?” কেমন একটা দুঃখভরা কণ্ঠে বলল মায়ূমী, পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে,“ছাড়ো এসব। স্যরি, আমি ঘুমিয়ে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি। আরেকবার তো পানি আনতে হতো” লাইটারটা আবার পকেটে পুরে ফেলল মায়ূমী।
“ইট’স ওকে, আমি এনেছি। স্যরি, তোমার ব্যাগটা তোমাকে না বলে ব্যবহার করার জন্য।
আর প্লিজ, ওই ফালতু নামে ডাকা বন্ধ করো”
“ও….কে, রুড….উপস! স্যরি” যদিও কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছিল যে ও মোটেও দুঃখিত নয়।

ব্যাগটা থেকে এক এক করে একটা এক লিটার পানির বোতল, এক ছড়া কলা আর অনেকগুলো সেই টক ফল বের করল যিয়াদ। মনে মনে ফলগুলোর একটা নাম দিয়ে ফেলেছে যিয়াদ। লটকনের ছোটভাই ছটকন। কাঁপা কাঁপা হাতে বোতলটা তুলে নিল মায়ূমী।
“ও-মাই-গড! কোথায় পেলে এটা?” মায়ূমীর দুচোখভরা অবিশ্বাস।

“ওই যে বলেছিলাম, ওশেন পলিউশন। আলহামদুলিল্লাহ, অল্প খুঁজতেই পেয়ে গেছি এটা। আরও কয়টা বোতল আর কিছু জিনিস পেয়েছি, তবে পানি ভরে আনার পর। দুটো নারিকেলও এনে রেখেছি, জাস্ট ইন কেস”

“ও ডিয়ার! আই এম সো….. স্যরি। আমি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলাম আর তুমি কত কিছু করেছ” মায়ূমীর কণ্ঠে অপরাধবোধ বিরাজ করছে।
হাসল যিয়াদ “স্যরি বলতে হবেনা। কে জানে, হয়ত এরপরে আমি ঘুমাব আর তোমাকে এসব করতে হবে” বলতে বলতেই একটা কলা ছড়া থেকে খুলে এগিয়ে দিল মায়ূমীর দিকে।

“থ্যাংকস! কিন্তু এটাতে আমার অপরাধবোধ একটুও কমলনা। আমি সকালবেলা তোমাকে কত দাপটের সাথে বললাম, আমারটা আমি বুঝে নিব। আর এখন দেখো, তোমার ঘাড়ে বসে বসে খাচ্ছি” কলাটা নিয়ে বেজার মুখে বলল মায়ূমী।
“এরকম একটা পরিস্থিতিতে এতকিছু হিসাব করলে চলে না। যখন যে যা পারবে, করে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ”
“সেটা অবশ্য ঠিক” সায় দিল মায়ূমী।
হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় কেঁপে উঠল দুজনেই, কেঁপে উঠল প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখাও। আরও কিছু কাঠ আগুনে গুঁজে দিল যিয়াদ, উজ্জ্বল হয়ে উঠল আলো। মায়ূমীর সোয়েটার এর গিঁটগুলো খুলে ওর দিকে এগিয়ে দিল যিয়াদ। “পরে নাও, রাতে ঠান্ডা লাগতে পারে।”


পর্ব ৪

ঘুম থেকে উঠে বিরস বদনে বসে আছে মায়ূমী।

“কোন সমস্যা?” প্রশ্ন না করে পারল না যিয়াদ।

“রবিনসন ক্রুসো হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না” রাজ্যের হতাশা কণ্ঠে ঢেলে জবাব দিল ও। চকিতে একটা প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল যিয়াদ।
“আমি ভাবতে পারছিনা রবিনসন ক্রুসো দিনের পর দিন টুথপেষ্ট ছাড়া কীভাবে ছিল! ইয়াক!”

“ও এই কথা!” হেসে ফেলল যিয়াদ। অগ্নিকুণ্ডের পাশ থেকে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে এক টুকরো কাঠ কয়লা আলাদা করল। ঠান্ডা হলে সেটা এগিয়ে দিল মায়ূমীর দিকে।

“এই নাও, সর্বোৎকৃষ্ট টুথ পাউডার। টুথপেষ্ট আবিষ্কার হওয়ার আগে যুগ যুগ ধরে মানুষ এটা দিয়ে দাঁত মেজেছে, নিজের আঙুলকে ব্রাশ বানিয়ে”
“রিয়েলি!” ইতস্তত হাতে কয়লার টুকরোটা নিল মায়ূমী “এটা দিয়ে আবার দাঁত কালো হয়ে যাবেনা তো” ভ্রু কুঁচকে বলল ও।
“জি না, উল্টে ঝকঝকে সাদা হয়ে যাবে”
“আচ্ছা!” অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে উঠল মায়ূমী, “কিন্তু কীভাবে কী করব আমি না ঠিক বুঝতে পারছি না, তুমি একটু দেখিয়ে দেবে প্লিজ?”
“ঠিক আছে, চলো” অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল যিয়াদ। আগে জানলে নিজে মুখ না ধুয়ে বসে থাকতাম, ভাবল ও।

বোতল নিয়ে রওনা দিল ওরা পানির নালার দিকে।

যিয়াদ আব্দুল্লাহ একদিন পরিচিত একটা মেয়েকে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা শেখাচ্ছে, ভাবা যায়! আঙ্গুল দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে মনে মনে বলল যিয়াদ।
“উফ! এতক্ষণে নিজেকে একটু পরিস্কার মনে হচ্ছে” কুলকুচি করার পর মায়ূমী অত্যন্ত প্রফুল্ল চিত্তে বলল। “থ্যাংকস ম্যান, থ্যাংকস এ লট” আলতো হাতে যিয়াদের পিঠ চাপড়ে দিল ও।

কলা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে হোটেল-রিসোর্ট খোঁজার মিশনে আবার নেমে পড়ল ওরা। উদ্দেশ্য, দ্বীপের যে পাশগুলো দেখা বাকি রয়ে গেছে, সেগুলো খুঁজে দেখা। আজকে ওরা গতদিনের থেকে বেশি প্রস্তুত, কারণ খাবার আর পানির চিন্তা আপাতত করতে হচ্ছেনা।

কালকের হাঁটাতেই ফোস্কা পড়েছে দুজনের পায়ে, তাই হাঁটার গতি আজকে অনেক কম। কথাও দুজনের কেউই তেমন বলছেনা। একটু পর পরই দুজনের কোন একজন বিশ্রাম নেবার কথা বলছে, অন্যজন তাতে কেবল সায় দিচ্ছে।

একের পর এক মনমুগ্ধকর সৈকত পার করল ওরা। দ্বীপটার সৌন্দর্য বড় বিস্ময়কর। অল্প অল্প দুরত্বের একেকটা সৈকতের বৈশিষ্ট্য ভিন্নতর। কোনটা পাথুরে, কোনটা বালুময়, কোনটায় আবার বেলাভূমি নেই বললেই চলে। সেগুলোতে জোয়ারের সময় গাছগুলো সরাসরি সাগরের বুক থেকে উঠে এসেছে বলে ভ্রম হয়।

কোনটাতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থেকে সৌন্দর্য উপভোগ করল ওরা, কোনটা বা শুধুই পার হয়ে চলে এল। কিন্তু যে আশায় পথচলা, তার কোন আলো দেখা গেলনা। মাঝখানে এক জায়গায় সমুদ্রে নামতে চাচ্ছিল মায়ূমী, অনেক রিকোয়েস্ট করে ওকে থামিয়েছে যিয়াদ।
যখন যেখানে ক্ষুধা লেগেছে, কলা-নারকেল যা পেয়েছে, খেয়ে নিয়েছে বলেই আলাদা করে লাঞ্চ ব্রেক নেবার প্রয়োজন ছিলনা ওদের। তবুও মাঝদুপুর পার হলে ওরা একটু বেশি সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি করল।

যিয়াদের নামাজ পড়ার ফাঁকে ব্যাগ ভরে ছটকন তুলে আনল মায়ূমী। নামাজ শেষে প্রস্তাবটা দিল যিয়াদ, “আমরা তো পাহাড়ের অনেকটা উল্টোদিকে চলে এসেছি, ফিরতেও আবার ঠিক একই পরিমাণ সময় লাগবে। তার থেকে বরং এভাবেই এগিয়ে যাই? যেখানে রাত হবে সেখানেই আজকের রাতটা কাটিয়ে দিব”
“সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মূল প্রব্লেম পানি, কিন্তু সেটাও তো আমরা এমনিতেই বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে খাচ্ছি, কালকে পর্যন্ত এ দুই বোতলে চলে যাবে, কী বলো?” বলল মায়ূমী।

“নারিকেলের পানি একটু বেশি খেতে হবে আর কী” বলল যিয়াদ।

“হ্যাঁ” সায় দিল মায়ূমী।

বিকেলের আগ দিয়ে একটা সৈকতে বড় বড় লাল কাঁকড়ার দেখা পাওয়া গেল। ওরা আগের মতই গাছপালার ভেতর দিয়ে হাঁটছিল, কাঁকড়াগুলো তাই বেশ দূরেই ছিল। তবু ওই অংশটা মায়ূমী পার করল একদম যিয়াদের গা ঘেঁষে, চোখদুটো যেন আঠা দিয়ে আটকে রাখল সামনের দিকে। সেই সাথে জোর তাগাদা দিয়ে যাচ্ছিল যিয়াদকে, জোরে হাঁটার জন্য।

একটু পর যিয়াদ খেয়াল করে দেখে, বাচ্চাদের মত আলতো করে ওর জ্যাকেটের কোণাটা ধরে রেখেছে মায়ূমী। কিছু বলেনি যিয়াদ, ভান করেছে যেন দেখেইনি। জায়গাটা পার হয়ে ও বলল,

“পেরিয়ে গেছি কাঁকড়াপুর, এবার মনে হচ্ছে নারিকেল জিঞ্জিরা শুরু হলো”
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জ্যাকেটের কোণা ছেড়ে দেয় মায়ূমী। পরের অংশটা সত্যি সত্যিই কেবল নারিকেল গাছে ভরা ছিল, আর কিছুই ছিলনা। সেখানে ওরা পেট ভরে নারিকেলের পানি আর শাঁস খেয়ে নিল। আজকে যেহেতু নারিকেল মালার প্রয়োজন নেই, তাই ঝামেলা ছাড়াই টুকরো টুকরো করে ভেঙে আরামসে নারিকেল খাচ্ছিল ওরা।

সন্ধ্যা নামার আগেই সেদিনের মত যাত্রা স্থগিত করতে হলো। ততক্ষণে যিয়াদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে অনেকটাই। মনে মনে আল্লাহর কাছে কোন সাহায্য মিলিয়ে দেয়ার জন্য অনবরত দোয়া করে গেলেও মায়ূমীর মতো একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে দ্বীপটা নির্জন।

তৃতীয় দিন সূর্যাস্তের ঘন্টাখানেক আগে যাত্রা সমাপ্ত হলো। কিন্তু ফলাফল তথৈবচ। এদিকের পাহাড়ের সীমানাও শেষ হয়েছে গিয়ে সমুদ্রের বুকে। তাই পাহাড়ের ওইপাশে কী আছে বা আদৌ কিছু আছে কিনা, সেটা ওদের পক্ষে জানা সম্ভব হলনা।

একটু আশা হয়ত বেঁচে ছিল যিয়াদের মধ্যে, সেটাই ওকে মানসিকভাবে এতক্ষণ শক্তি দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পাহাড়ের গোড়া চোখে পড়তেই দপ করে সব আশার আলো নিভে গেল ওর। মানসিক অবসাদ কেড়ে নিল শক্তির শেষ বিন্দুটুকুও, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও বালুর মধ্যে।
অন্যদিকে মায়ূমীর উচ্ছাস ছিল দেখার মতো। দুহাত উপরে তুলে প্রায় লাফাচ্ছিল ও।

“ইয়াহুউউউউউ! ফাইনালি আমি রবিনসন ক্রুসোর মত একটা দ্বীপে বাস করতে যাচ্ছি। আই এম সো হ্যাপি! ইয়ে…..”
হঠাৎ ওর মনে হল যিয়াদের কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছেনা। পেছনে ফিরতেই যিয়াদের ওভাবে বসে থাকার দৃশ্য চোখে পড়ল ওর। সাথে সাথে লাফালাফি থামিয়ে এগিয়ে এল ওর দিকে। কাছে এসে বলল, “তুমি ঠিক আছো?”
“না, একদম ঠিক নেই” দু’হাতে মুখ ঢাকল যিয়াদ।

অপ্রস্তুতের মতো পাশে দাঁড়িয়ে থাকল মায়ূমী। কী করবে বুঝতে পারছেনা। খানিক বাদে উবু হয়ে পাশে বসল, সান্ত্বনার ভঙ্গিতে হাত রাখল যিয়াদের কাঁধে।
“দ্বীপে মানুষ না থাকলেও এত চিন্তা করোনা। এই রুটে প্রচুর প্লেন চলাচল করে। বীচে বড় করে এসওএস লিখে রাখব, দেখতে পাবে ওরা। আর তোমার কী মনে হয়, আমাদের খুঁজতে কেউ আসবেনা?” সান্ত্বনা দেয়ার জন্যই কেবল সান্ত্বনা দিল মায়ূমী। ও খুব ভালো করেই জানে, অন্তত ওকে খুঁজতে কেউ আসবেনা, সে রাস্তা ও নিজেই বন্ধ করে এসেছে।

আগের মতো ঝটকা দিয়ে না হলেও বেশ দ্রুততার সাথে মায়ূমীর হাতটা সরাল যিয়াদ। সান্ত্বনাবাণী খুব একটা আশাব্যঞ্জক না হলেও আপাতত এছাড়া আর কিছু করার নেই। নিজেকে সামলাল ও। নিশ্চয়ই এর মাঝে আল্লাহর কোন পরিকল্পনা আছে। এভাবে হাল ছেড়ে দিয়ে হতাশাগ্রস্থ হওয়া কোন মুমিনের সাজেনা। কাপড়ের বালু ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল ও।

“তাহলে এখন কী করণীয়?” মায়ূমীকে জিজ্ঞেস করল যিয়াদ। এমনভাবে, যেন ও কিছুই জানেনা।

“পানি নিতে হবে, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে হবে, রাতে থাকার মত জায়গা বাছতে হবে, আগুন জ্বালাতে হবে” কাজের ফিরিস্তি দিল মায়ূমী।
“ঠিক আছে, আমি কাঠ খুঁজি, তুমি পানি নিয়ে এসো” প্রস্তাব দিল যিয়াদ।

“আমরা কি এখানে থাকব?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“ভালো করে তাকিয়ে দেখো” চোখ ঘুরাল মায়ূমী। এবার যেন খেয়াল করল যিয়াদ।

অন্যপাশের পাহাড়ের পাদদেশের ন্যায় এ পাশটা বিস্তৃত বালুময় সৈকত নয়। গাছগাছালি আর বড় বড় পাথরে ভরা। সমুদ্রও নিকটে। জোয়ারের পানি যে অনেকখানি ভেতরে ঢুকে আসে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

আর কোন কথা না বলে উল্টো পথ ধরল যিয়াদ। নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করল মায়ূমী।


রাত কাটানোর জন্য স্থান নির্বাচনের পর মায়ূমীর লিস্ট অনুযায়ী সব কাজ শেষে আগুন ধরাল ওরা। মায়ূমীকে পানি ভরতে বেশিদূর যেতে হয়নি। মোহনার খুব কাছেই ওরা ক্যাম্প করেছে আজকে। মোহনা মানে যেখানে ওই পাহাড়ি ধারাটা সরু হয়ে সমুদ্রে নেমে গেছে।

আগুন জ্বালানোর পর সেখানে না বসে উঠে গেল যিয়াদ। ইতোমধ্যে ভাটার টানে পানি নেমে গিয়ে সৈকত পরিণত হয়েছে ফুটবল খেলার মাঠে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সমুদ্রের কাছে চলে গেল যিয়াদ। হাঁটু উঁচু করে বসে গেল বিস্তৃত জলরাশির দিকে মুখ করে।

পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। ঝকঝকে জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে চারপাশ। চিকচিক করছে সমুদ্রের তুলনামূলক শান্ত জল। অন্যসময় হলে হয়ত আল্লাহ পাকের এ অপরূপ সৃষ্টির রহস্য সন্ধানে বিভোর হতো যিয়াদ। কিন্তু আজকের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। খানিক বাদে ওর পাশে এসে দাঁড়াল মায়ূমী।

“তোমার সাথে জয়েন করতে পারি?”

“হুঁ” মুখ না খুলেই সম্মতি দিল যিয়াদ।

“তোমার মন কি খুব বেশি খারাপ?”

“হুঁ” যেন কথা না বলার পণ করেছে ও।

“তোমার যদি কোন অসুবিধা না থাকে, তাহলে কি কারণটা আমি জানতে পারি?” কিছুটা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল মায়ূমী।

এর বিপরীতে কিছুই বললনা যিয়াদ। শেষে যখন মায়ূমীর মনে হতে লাগল যে বোধহয় জিজ্ঞেস করে ভুল করে ফেলেছে, তখন মুখ খুলল ও।

“আজকে আমার একটা এসাইনমেন্ট জমা দেবার লাস্ট ডেট ছিল। কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজ করছিলাম এটার উপরে। অলমোস্ট সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলেছিলাম। জাস্ট ফাইনাল সাম আপ করা বাকি ছিল। মনটা একটু ফ্রেশ করার জন্য এই ঝটিকা ট্রিপে আসতে রাজি হয়েছিলাম আর সেটাই কাল হয়েছে।

গতকালকে ব্যাক করে বাকি কাজ টুকু শেষ করে আজকে জমা দিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন তো এসাইনমেন্ট কি, জীবনে আর এখান থেকে ফিরতে পারব কিনা জানিনা”একটু থামল যিয়াদ।

“তার থেকেও বড় কথা হচ্ছে এসাইনমেন্ট এর জন্য এত ব্যস্ত ছিলাম যে বাসায় ঠিকমতো কথা পর্যন্ত বলিনি। বলেছিলাম এসাইনমেন্ট জমা দেয়ার পর সবার সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলব। আমি নিশ্চিত, সবাই অপেক্ষা করে বসে আছে আমার ফোনকলের জন্য। কল না পেয়ে এতক্ষণে আমার মা টেনশন করতে শুরু করে দিয়েছে। আমি ভাবতে পারছিনা এরপর কী হবে। আমার মা জাস্ট পাগল হয়ে যাবে আমার নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে”
নিশ্চুপ হয়ে কথাগুলো শুনছিল মায়ূমী। যিয়াদ থেমে গেলেও কিছু বলল না ও। অনেকক্ষণ পর বলে উঠল,

“তুমি অনেক ভাগ্যবান। তোমার জন্য অপেক্ষা করার, তোমার কথা চিন্তা করে পাগল হবার মতো মানুষ আছে এই দুনিয়ায়। আমার তোমার প্রতি ঈর্ষা হচ্ছে যিয়াদ, প্রচণ্ড রকমের ঈর্ষা”।

বলেই উঠে দাঁড়াল মায়ূমী। চলে গেল হাঁটতে হাঁটতে ওদের জ্বালানো অগ্নিকুণ্ডের দিকে। সেটা তখনও জ্বলছিল কিছুটা স্তিমিত হয়ে। পেছনে রেখে গেল হতভম্ব যিয়াদকে আর ওর চারপাশে ছড়িয়ে গেল এক বুক হাহাকার। যে হাহাকার যিয়াদের বিষণ্ণতাকে ছাপিয়ে গেল বহুগুণে।


পর্ব ৫

আওয়াজটা যখন ওদের কানে ঢুকল, তখন ওরা জঙ্গলের মাঝামাঝি। পাহাড়ের ধার ঘেঁষে হেঁটে হেঁটে ওরা ফিরে আসছিল সেই জায়গায়, যেখানে ওরা প্রথম রাত কাটিয়েছিল। সার্বিক দিক বিবেচনায় এই জায়গাটাই ওদের কাছে ক্যাম্প করার জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত মনে হয়েছে। অনেকটা হাঁটা হয়েছে, বিশ্রাম নেবার কথা ভাবছে, এমন সময় আওয়াজটা শুনতে পেল হেলিকপ্টারের আওয়াজ।

যে মধুর আওয়াজের প্রতীক্ষায় যিয়াদ গুনছিল প্রতিটা মুহূর্ত।

দুজন দুজনের দিকে তাকাল কয়েক পলকের জন্য। একে অপরের চকচকে চোখ দেখে নিশ্চিত হলো যে কেউই ভুল শোনেনি। পরমুহূর্তে ছুট দিল বিদ্যুৎগতিতে।

“হেল্প হেল্প” “দাঁড়ান দাঁড়ান” “ফিরে আসুন” “প্লিজ ফিরে আসুন”
দুহাত উপরে তুলে চিৎকার করেই যাচ্ছিল ওরা। কিন্তু ততক্ষণে হেলিকপ্টার চলে গেছে দূরে, ওদের সৈকতে পৌঁছার অনেক আগেই চক্কর শেষ করে ফেলেছিল ওটা।নিদারুণ হতাশায় বালুর মধ্যে বারকয়েক ঘুষি মারল যিয়াদ।

প্রথমে এটা জানা যে দ্বীপটা নির্জন আর এখন মুক্তি পাবার সুযোগ এভাবে ফসকে যাওয়া। আর যেন কোন আশাই অবশিষ্ট রইল না।
এসওএস! বড় করে যেটা এঁকেছিলাম সকালে। সেটাও কি ওরা দেখতে পায়নি? সহসা মনে পড়ল যিয়াদের। কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর আগেই জবাব পেয়ে গেল। জোয়ারের পানি আজ উঠে এসেছে অনেকটা উপরে।

এসওএস এর সাথে ধুয়ে নিয়ে গেছে ওদের উদ্ধার পাওয়ার আশাটুকুও, এতে আর কোন সন্দেহ নেই।
বাকি দিনটা কাটল নিশ্চুপ নিস্তব্ধতায়। খাওয়ার কথাও যেন মনে পড়লনা কারও। যিয়াদ নামাজের সময় সময় উঠে নামাজ পড়ল, বাকি সময়টা বসে রইল চুপচাপ। আর মায়ূমী কোথায় যে গেল, যিয়াদের খুঁজতেও মন চাইলনা।

বেলা পড়ে এলে আর থাকা গেলনা। মন খারাপ তো আর পেট ভরায়না। আলো থাকতে থাকতেই জঙ্গলের সামনের দিকে এগিয়ে গেল যিয়াদ। একটা কলা ছিঁড়ে কামড় দিবে, তখনি মায়ূমীর কথা মনে পড়ল ওর। কে জানে, ওও হয়ত মন খারাপ করে না খেয়ে বসে আছে। তাতে কী, আমি কি ওকে খেতে নিষেধ করেছি? ওর ক্ষুধা লাগলে ও ঠিক খেয়ে নিবে। বিড়বিড় করে দুটো বড় বড় কলা সেখানেই সাবাড় করে আরও এক কাঁদি নিয়ে ফিরে এল যিয়াদ।
সেদিনের জ্বালানো অগ্নিকুণ্ডের ছাই সরিয়ে সেখানেই নতুন কাঠ সাজাল।

কয়েকবার এসে যেয়ে রাত পার করার মতো শুকনো পাতা আর কাঠ নিয়ে এসে রাখল। এসব করতে করতেই সূর্য অস্ত গেল। আগুন জ্বালাতে গিয়ে মনে পড়ল যে লাইটার মায়ূমীর কাছে। ওকে খুঁজতে যাওয়া উচিত, ভাবল যিয়াদ।

এখান থেকে একটু সামনে সমুদ্রের দিকে মুখ করে ভূমি সমান্তরালে হেলে পড়া একটা নারিকেল গাছ আছে। ওইদিন যাওয়ার সময় মায়ূমী ওই গাছটার উপর বসে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। এমনকি যিয়াদকে এটাও বলেছিল, “জোয়ারের সময় যদি এপর্যন্ত পানি চলে আসে, তাহলে দারুণ হবে। জায়গাটা মন খারাপের সময় একা একা বসে থাকার জন্য এক্কেবারে পার্ফেক্ট” তাই যিয়াদের ধারণা ও সেখানেই গেছে। তবে ওকে যেতে হলনা। যাওয়ার জন্য ওদিকে ফিরতেই দেখল মায়ূমী চোখ ডলতে ডলতে এগিয়ে আসছে এদিকপানেই।

“হেই! কী তুমি! রাত হয়ে গেছে আর আমাকে ডাকতে পর্যন্ত যাওনি। ও গড! এতক্ষণ কীভাবে ঘুমালাম আমি!”
“আর আমিও পাগল! ভাবছিলাম হেলিকপ্টারটা ধরতে না পারায় ওরও আমার মতো মন খারাপ” বিড়বিড় করল যিয়াদ, বসে পড়ল আবার নিজের জায়গায়।

“আগুন নিভে গেছে? জ্বালাওনি কেন?” ওর কাছে এসে বসতে বসতে বলল মায়ূমী। “ও স্যরি, লাইটার তো আমার কাছে” পরমুহূর্তে মনে পড়তেই যোগ করল কথাটা।

পকেট থেকে লাইটার বের করে এদিক ওদিক তাকাল প্রাথমিকভাবে আগুন ধরানোর মত কিছুর সন্ধানে। নিঃশব্দে একটা শুকনো কলাপাতা এগিয়ে দিল যিয়াদ। সেটা গোল করে পেঁচিয়ে আগুন ধরাল মায়ূমী। অগ্নিকুন্ডটা সুন্দরভাবে জ্বলে উঠলে সুন্দর একটা হাসি ফুটে উঠল ওর চেহারায়। অজান্তেই সেদিকে দৃষ্টি পড়ে গেল যিয়াদের। সেই মুহূর্তে আগুনের লালচে আভায় মায়ূমীকে দেখতে এত সুন্দর লাগছিল যে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ সরাতে ভুলে গেল যিয়াদ। লম্বা চুলগুলো একটা কাঠি দিয়ে পেঁচিয়ে উঁচু করে আটকে রেখেছিল মায়ূমী। গালের একপাশে কিছু নাছোড় বালিকণা চিকচিক করছিল। এরকম পরিবেশে আজন্ম বসবাস করা কোন এক আদিবাসী নারীর মতো দেখাচ্ছিল ওকে।

ওর মুখে ফুটে ওঠা সেই হাসিতে কোন বিষন্নতা, কোন হতাশার ছিটেফোঁটাও ছিলনা। সেই মুহূর্তে যিয়াদের মনে হলো, এই আদিবাসী নারীকে সে চেনেনা। যে মায়ূমীর কথা সে জানে, তার সাথে এই নারীর কোন মিল নেই।

তবে শুধু কয়েকটা মুহূর্তই। মায়ূমীর কথাতে সম্বিত ফিরে এল ওর। “প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। কিছু আছে নাকি এখন আবার জঙ্গলে ঢুকতে হবে?” মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে কোথায়, অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে জঙ্গলের দিকে তাকাল মায়ূমী।

আবারও কোন কথা না বলে কলার কাঁদিটা এগিয়ে দিল যিয়াদ। সেখান থেকে একটা কলা ছিঁড়ে নিল মায়ূমী।
“কী হয়েছে তোমার? মৌনব্রত অবলম্বন করছ নাকি?” একটা ভ্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল ও। পরক্ষণেই জিভে কামড় দিল। “উপস! স্যরি! সকালে যা হলো, তারপর তো…..” মায়ূমী কথা শেষ না করেই থেমে গেল।

“সকালবেলা যে দৌড়টা দিলে, উসাইন বোল্ট ফেইল” অবশেষে মুখ খুলল যিয়াদ।

“কে? আমি?” দুচোখ কপালে তুলে বলল মায়ূমী।

“নাতো কে? তুমি আমার থেকে আগে ছুট দিয়েছ, আর কী স্পিড! বাবারে বাবা! আর উনি নাকি ফিরতে চান না। এসব গালগল্প আমাকে আর শোনাতে এসোনা, হুঁহ!”
“মো-মোটেই না, তুমি আগে দৌড় দিয়েছো, আমি না” মুখ ঝামটা দিল মায়ূমী।

“তাই নাকি! আচ্ছা, সেটাও যদি হয়, তাহলে এটা বলো, তুমি দৌড় দিলে কেন?”

“সে…সে তো তোমার জন্য। হেলিকপ্টার নামলেই বা, আমি তো যেতাম না। তোমাকে তুলে দিয়ে গুডবাই বলতাম”
“ও রিয়েলি!” বাঁকা স্বরে বলল যিয়াদ, “হয়েছে হয়েছে, আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবেনা” প্রবাদ বাক্যটা বাংলাতেই বলল যিয়াদ।
“কী বললে ওটা?”

“একটা বাংলা প্রবাদ। এর অর্থ এখন কেমনে বোঝাই!” মাথা চুলকাল যিয়াদ, “কোন কিছু লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা, এরকম কিছু একটা”
“ওহ! কিন্তু আমি মোটেও সেরকম কিছু করিনি” জোরালো স্বরে বলল মায়ূমী।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি আমি” মুচকি হেসে বলল যিয়াদ।

“ঘোড়ার ডিম বুঝেছো” চোখ ঘোরাল মায়ূমী।

“আচ্ছা, তুমি খাও, আমার নামাজ পড়া হয়নি” অহেতুক তর্ক বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল যিয়াদ।

নারিকেলের শেষ পাতাটা সদ্য নির্মিত চালাঘরটার উপর তুলে হাত ঝাড়ল যিয়াদ। একটু পেছনে সরে দুহাত কোমরে রেখে বোঝার চেষ্টা করল ঠিক কতটা কী করতে পেরেছে। অবশ্য মায়ূমীর উল্লাস দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে খুব খারাপ হয়নি। ওরও তাই মনে হলো।

আজ সারাদিন খেটেখুটে দুটো গাছের মাঝখানে কোনরকম একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করেছে ওরা। শুরুটা যদিও মায়ূমীই করেছিল। মনে হচ্ছে এখানে বসবাসের জন্য কেউ ওকে লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। বাকি জীবন ও এই দ্বীপেই কাটাবে, এতে ওর আর কোন সন্দেহ নেই। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবকিছু গুছিয়ে নিতে চায়।

কোথায় থাকবে, কীভাবে ঘর বানাবে, কী করবে না করবে, ওর উৎসাহের যেন কোন শেষ নেই। প্রথমটা পাগলের কারবার মনে হলেও বসে থাকার থেকে কিছু করা ভালো, এই ভেবে মায়ূমীর সাথে সাথ দিয়েছে যিয়াদ।

মজবুত দেখে ডাল সংগ্রহ করা, সেগুলো মাটিতে পোঁতা, পাতা দিয়ে ছাদ বানানোর জন্য আড়াআড়ি চারটা ডালকে বাঁধা আর সবশেষে উপরে নারিকেল পাতার ছাউনি দেয়া। শুনতে সহজ মনে হলেও কোন সরঞ্জাম ছাড়া এতকিছু করা চাট্টিখানি কথা নয়।

কাজ করার কারণে প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছিল দুজনেরই। মাগরিবের নামাজের পরপরই নিঃশব্দে প্রতি বেলার মত কলা আর নারিকেল দিয়ে ডিনার সারল ওরা। একে ক্লান্তি, তার ওপর আগুনের ওম, এই আরাম ছেড়ে চালার নিচে যেতে মন চাইছেনা কারোই। তাই আরও কিছুক্ষণ বসে রইল। একটু পর মায়ূমীকে ঢুলতে দেখে ওকে ঘুমাতে যেতে বলল যিয়াদ।

“তুমি যাবেনা?” হাই তুলে বলল মায়ূমী।

“না, এশার মানে রাতের নামাজ পড়ে তারপর ঘুমাব আমি। তুমি যাও”
“ঠিক আছে”
ঢুলতে ঢুলতে চালার নিচে গিয়ে ঢুকল মায়ূমী, শুয়ে পড়ল শুকনো পাতার বিছানায়। সৌন্দর্যের জন্য উপরে কাঁচা কলাপাতা বিছাতে চেয়েছিল মায়ূমী। না না করে উঠেছিল যিয়াদ, কলার কষ নাকি মারাত্মক, জামাকাপড় নষ্ট হয়ে যাবে। যাকগে, শুকনো পাতাই সই। তিন রাত খোলা আকাশের নিচে বালুর উপর ঘুমানোর পর আজকের আয়োজন রীতিমতো থ্রি স্টার হোটেলের ফিল দিচ্ছে।

ছেলেটা তো জোস! এতকিছু জানে কীভাবে কে জানে? ও না থাকলে আমার রবিনসন ক্রুসোগিরী বের হয়ে যেত একেবারে। এত কেয়ারিং একটা ছেলেকে খামাখা রুডম্যান নাম দিয়েছে কেন গড নোজ। আমি তো এখন পর্যন্ত কোন রুডনেস দেখতে পাইনি। হ্যাঁ, একটু উইয়ার্ড। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনা, অন্য ছেলেদের মত গায়ে পড়া তো একেবারেই নয়। এটাকে সর্বোচ্চ লাজুক বলা যেতে পারে, কিংবা…… জেন্টলম্যান? হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল ঠোঁটের কোণে। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাল মায়ূমী।

কলা আর নারকেল; পাঁচ দিনেই ওদের বিরক্তি ধরে গেছে জিনিস দুটোর উপর। এক জিনিস কাঁহাতক আর খাওয়া যায়। আজ ঘুম থেকে উঠেই মায়ূমী ঘোষণা দিয়েছে, “আমি আর কলা খেতে চাই না না না।

আর একটা দিন সারাদিন কলা খেলে আজীবনের মতো কলা খাওয়া ঘুঁচে যাবে আমার”
যিয়াদ ভেবে দেখল, মায়ূমীর দাবী অন্যায্য নয়। এই দ্বীপের প্রধান খাদ্য যদি কলা আর নারকেল হয়, তাহলে এই দুটোতে অরুচি ধরিয়ে ফেলা কোন কাজের কথা না। যেখানে কতদিন এখানে থাকতে হবে তার কোন ঠিকঠিকানা নেই। কিন্তু সেদিন জঙ্গলের ভেতরে ছিল বলেই হেলিকপ্টারটা মিস করেছিল। তাই দুজনেই একসাথে সৈকত ছেড়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল না যিয়াদ।

আবার অচেনা জঙ্গলের ভেতরে একা একা ঘুরে বেড়ানোও নিরাপদ না। যদিও এ পর্যন্ত কোন বিপজ্জনক প্রাণীর আভাস ওরা পায়নি। কিন্তু ওরা তো বাইরে বাইরেই ছিল বলতে গেলে।

তখন মায়ূমীর বুদ্ধি অনুযায়ী উপরে নিচে বড় করে তিনটা এসওএস এঁকে এসেছে। যাতে জোয়ারের পানিতে সবগুলোই ধুয়ে না যায়।
এরপর ‘নতুন খাদ্য সন্ধান’ মিশনে ওরা বেরিয়ে পড়েছে দু’জন দুটো লাঠি নিয়ে।

পানির খালি বোতল নিয়েছে সাথে, ভরার প্রয়োজন হয়নি। কারণ পথ হারিয়ে ফেলার ঝামেলা এড়াতে ওরা জলধারাটার পাশ ধরেই এগোচ্ছে। প্রথমে অবশ্য মাছ ধরতে গিয়েছিল ওরা। কিন্তু প্রায় ঘন্টাখানেক চেষ্টা করেও খালি হাতে কিংবা লাঠির সাহয্যে মাছ ধরা সম্ভব হয়নি। জীবন রক্ষায় ওদের থেকে অনেকগুণ বেশি পারদর্শী মাছগুলো। লাঠির আগায় বাঁধার মতো ছুঁচালো পাথরের সন্ধান করছে এখন যিয়াদের উৎসুক দৃষ্টি। অবশ্য মায়ূমী খুঁজছে অন্যকিছু।

ওইদিন যখন ওরা পাহাড়ের পাশ দিয়ে আসছিল, তখন বেশ কিছু খরগোশের দেখা পেয়েছিল। বেশিরভাগই ওদের আঁচ পাওয়া মাত্রই পালিয়েছিল। কিন্তু দু’একটা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল ঝোপের ফাঁক দিয়ে। মায়ূমী আদুরে আওয়াজ করে ডেকে আদর করার চেষ্টা করেছিল। একটা এসেছিলও কাছে। মায়ূমী গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল ওটার আর যিয়াদের দিকে তাকিয়েছিল কড়া দৃষ্টিতে।

“খবরদার! চিন্তাও করবেনা। এটা আমার পীপ” বলেছিল ও।

“কী এটা! আর কীসের চিন্তা করব না?” অবাক হয়ে বলেছিল যিয়াদ।

“শিকার করার, আবার কী? আর আমি এটার নাম দিয়েছি ‘পীপ’”মাথা নিচু করে অদ্ভুত একটা শব্দ করে খরগোশটাকে আদর করছিল ও। সম্ভবত খরগোশটার উঁকি দেয়া দেখে ওর মাথায় এসেছে নামটা।

খাওয়ার চিন্তা যে একেবারেই যিয়াদের মাথায় আসেনি, সেটা বললে ভূল হবে। কারণ ওর জানামতে খরগোশের গোশত হালাল। কিন্তু ওদের কাছে জবাই করার মতো ধারালো কোন অস্ত্র নেই। তাই মনে আসার সাথে সাথেই বাতিল করেছিল চিন্তাটা।

“বয়েই গেছে আমার তোমার ‘পীপ’কে খেতে” চোখ ঘুরিয়ে বলেছিল যিয়াদ।

“হলেই ভালো” বলেছিল মায়ূমী, “তবে অন্যগুলোকে খাওয়া যেতে পারে”
“কীহ!” হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যিয়াদ।

“হ্যাঁ, পীপ সোনাকে আমি পেট বানিয়েছি, অন্যগুলোকে তো আর বানাইনি”
“আচ্ছা! আর অন্যগুলো যে তোমার পীপ সোনার মা বাবা ভাইবোন হতে পারে, তার বেলা? তখন বুঝি তোমার পীপের কষ্ট হবেনা?”
“আরে হ্যাঁ, ঠিক বলেছো তো! থাক, দরকার নেই কাউকে খাওয়ার” মুখে আদুরে শব্দ করে পীপের গায়ে হাত বুলিয়েছিল মায়ূমী। ও ভেবেছিল পীপ ওদের সাথে সাথে আসবে। কিন্তু ওরা পুনরায় হাঁটা শুরু করতেই ওকে নিরাশ করে পালিয়েছিল ওটা।

ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে। অল্প দূর যেতেই একটা জায়গায় জুক্কিনির ঝাড় দেখা গেল। অনেকগুলো পাখি বসেছিল ঝাড়টার উপর। ওদের দেখে একযোগে উড়ে গেল সবগুলো। অদ্ভুত সুন্দর লাগলো দৃশ্যটা।

কচি দেখে দুটো জুক্কিনি ছিঁড়ে ওরা কাঁচাই খেয়ে নিল। সবজি হিসেবে এদেশে এটা অত্যন্ত সমাদৃত হলেও কাঁচা খাওয়ার জন্য শসার মতো সুস্বাদু নয়। কচকচে দেশী শসার স্বাদ মনে পড়তেই জিভে পানি চলে এল যিয়াদের। অবাক হলো অনেক। কোনদিন ভেবেছিল, দুনিয়ায় এত খাবার থাকতে সামান্য শসার জন্য জিভে পানি আসবে? জীবন সত্যিই বড় অদ্ভুত।

এখানে তো আর রান্না করার কোন উপায় নেই। খুব বেশি হলে আগুনে রোস্ট করা যেতে পারে। তারপরও আজকের মিশন সফল বলা চলে। কচি দেখে বেশ কিছু জুক্কিনি সংগ্রহ করে নিজেদের আস্তানায় ফিরে এল ওরা।

যাওয়ার পূর্বে যিয়াদ কয়েকটা নারিকেলের মালায় করে সমুদ্রের পানি রেখে গিয়েছিল খোলা আকাশের নিচে। উদ্দেশ্য শুকিয়ে লবণ সংগ্রহ করা যায় কেনা দেখা। সেগুলোর পানি এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। তবে আজকে সূর্যের তেজ যেন একটু বেশিই।

মনে হচ্ছে সন্ধ্যার পূর্বে শুকিয়ে যাবে। কথা দিয়েছিল ও মায়ূমীকে, আজকে নতুন কিছু খাবে ওরা, ইন শা আল্লাহ। যদিও ওর প্রথম চিন্তা রোস্টেড কাঁচাকলা খাওয়া ছিল। নামটা গালভরা হলেও আদতে তো কলাপোড়া। খেতে যে ঠিক কেমন লাগবে, সে বিষয়ে যিয়াদ নিজেই সন্দিহান। তবে এখন জুক্কিনিগুলো পাওয়াতে একটু ভালো লাগছে। মনে হয় এগুলো লবণ দিয়ে খেতে ভালোই লাগবে। দরকার পড়ে তো শসা মনে করে খাবে।


পর্ব ৬

যিয়াদের লবণ সংগ্রহের পরিকল্পনা ফেইল করেছে। পানি পুরোপুরি তো শুকায়ইনি, উলটে উড়ে পড়া বালি মিশে ঘন কিচকিচে একটা জিনিসে পরিণত হয়েছে। এখনো এই জিনিসে চুবিয়ে কাঁচকলা কিংবা জুকিনি খাওয়ার মত দুরবস্থা ওদের হয়নি। তবে লবণ ছাড়াও কাঁচকলা আর জুকিনি আগুনে ঝলসে খেতে ভালোই লাগছিল।

“আমার মনে হয়না আমি এর আগে কোনদিন কাঁচা কলা খেয়েছি। অথবা খেলেও আমি জানিনা। লাঞ্চ আর ডিনার আমি বাসায় খুব কম করি। আর করলেও মিসেস রোজ যা দেয় খেয়ে নিই। উনার রান্না ভীষণ ভালো। তাই ফালতু জিজ্ঞেস করিনা, জাস্ট খেয়ে ফেলি” ডিনারের এক পর্যায়ে মায়ূমী বলল। এর বিপরীতে বলার মত কিছু ছিল না যিয়াদের, নিঃশব্দে খাচ্ছিল ও।

খানিক বাদে মুখ খুলল যিয়াদ, “ফেরার সময় তোমাকে হতাশ মনে হচ্ছিল। পীপ কে দেখতে না পেয়ে?”
“উঁহু! কোন ছাগল কিংবা মুরগী দেখতে না পেয়ে”

মুখভর্তি কলা নিয়ে বাজেভাবে বিষম খেল যিয়াদ। হতভম্ব মায়ূমী তাড়াতাড়ি ওর পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে পানির বোতল এগিয়ে দিল। ওকে নিষেধ করার মতো অবস্থা যিয়াদের ছিল না। কোনমতে পানি খেয়ে ঠিক হয়ে নিজেই সরে গেল।

“ঠিক আছি আমি, থ্যাংকস” যদিও হালকা কাশছিল তখনও।

“থ্যাংকস দিতে হবেনা। কিন্তু হঠাৎ কী হলো তোমার?”

মায়ূমীর আগের কথাটা মনে পড়তেই ফ্যাক করে হেসে ফেলল যিয়াদ।

“জনমানবহীন দ্বীপে কাউকে গরু-ছাগল খুঁজতে দেখলে মনে হয় স্বয়ং গরু-ছাগলও বিষম খাবে, আমি তো কোন ছার!” হাসি চাপার চেষ্টা করল যিয়াদ।
“আমি মোটেও গরু খুঁজিনি। ছাগল আর মুরগী খুঁজেছি”

“ওহো, মুরগী! স্যরি স্যরি। ভুল করে গরু বলে ফেলেছি” আর পারল না যিয়াদ, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। বিস্মিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল মায়ূমী। সেই দৃষ্টিতে যে মুগ্ধতার মিশেল একেবারেই ছিলনা, সেটা বললে ভুল হবে। যিয়াদকে এভাবে হাসতে এই প্রথম দেখল ও।

তবে যিয়াদ ভাবল, ওর কথা নিয়ে হাসায় মায়ূমীর খারাপ লেগেছে। তাই এভাবে তাকিয়ে আছে। সাথে সাথে হাসি থেমে গেল ওর।

“স্যরি! এভাবে হাসা ঠিক হয়নি আমার”
“ইট’স ওকে। তোমার দিক থেকে ভাবতে গেলে ব্যাপারটা হাস্যকরই” নিজেও মুখে হাসির রেখা টেনে বলল মায়ূমী। “কিন্তু আমার কী দোষ? রবিনসন ক্রুসো তো দ্বীপে বুনো ছাগল আর মুরগী পেয়েছিলেন। সেগুলোকে একটা গর্তে রেখে পোষও মানিয়েছিলেন।

বছর পেরিয়ে একটা খামারেই পরিণত হয়েছিল সেটা। উনি ছাগলের দুধ দিয়ে মাখন পর্যন্ত তুলতেন। নিয়মিত ডিম, মাংস খেতেন”
মুখটা ঈষৎ হা করে মায়ূমীর কথা শুনছিল যিয়াদ। “আচ্ছা! তো দ্বীপে আর কী কী করেছিলেন তোমার রবিনসন ক্রুসো?”
“শুনবে তুমি?” চকচকে চোখে জিজ্ঞেস করল মায়ূমী।

উপর নিচে মাথা দোলাল যিয়াদ। হাতে যেন আকাশের চাঁদ পেল মায়ূমী। যিয়াদের দিকে ফিরে আসন করে বসে রীতিমতো গল্প ফেঁদে বসল।
রবিনসন ক্রুসোর ভাগ্য দোষে দ্বীপে এসে পড়া, ভাঙা জাহাজ থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে গুহায় বসবাস করা, পাখির খাবার হিসেবে জাহাজে বহন করা কিছু শস্যদানা থেকে ফসল ফলানো, মাটির তৈজসপত্র বানানো, আঙ্গুরের ক্ষেত খুঁজে পাওয়া, সেটা থেকে কিশমিশ আর মদ বানানো; আর ওর সবথেকে পছন্দের অংশ, ছাগল মুরগীর খামার, সবকিছু একেবারে সবিস্তারে হাত নাড়িয়ে চোখ নাচিয়ে বর্ণনা করে যাচ্ছিল মায়ূমী।

সাধারণত গল্প শুনতে পছন্দ করেনা যিয়াদ। টানা পাঁচ মিনিট একটানা কারও কথা শুনলেই ঘুম পেয়ে যায় ওর। এজন্য লেক
চার এটেন্ড করার সময় সবসময় নোটস নেয়। ক্লাসরুমে ঘুমিয়ে পড়ার ইতিহাসও আছে বিস্তর। সেই যিয়াদ আজকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মায়ূমীর গল্প শুনছিল। ঘুমের ছিটেফোঁটাও আসেনি চোখে। গল্পটা ইন্টারেস্টিং শুধু সেজন্য না, ওর বলার ধরণটাই আসলে বিশেষ। যেন এক জাদুকরী নিজের কথার জ মায়া বিস্তার করে চলেছে।

এদিকে সময় বয়ে গেছে নিজস্ব গতিতে। চাঁদ উঠেছে, মায়াবী জোছনা ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশে, বাতাসে বেড়েছে হিমের প্রভাব, কিন্তু ওদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। মায়ূমীর গল্প বলা যখন শেষ হলো, ততক্ষণে রাত গড়িয়েছে ভালোই। এখানে আসার পর ঘুমাতে এতটা রাত ওরা কোনদিন করেনি।

এদিকে গল্প শুনতে শুনতে সমস্ত কাঁচাকলা আর জুকিনি খেয়ে ফেলেছে যিয়াদ। আর গল্প বলার নেশায় খাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেছে মায়ূমী।

“স্যরি! আমি কোন ফাঁকে সব শেষ করে ফেলেছি খেয়াল করিনি” কাঁচুমাচু মুখে বলল যিয়াদ।

“নো প্রব্লেম! গল্প বলতে পেয়েই পেট ভরে গেছে আমার। নিজের সবচেয়ে প্রিয় বইয়ের কাহিনী বলে এত আনন্দ পেয়েছি, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না।

থ্যাঙ্কিউ যিয়াদ, থ্যাংকস এ লট। আমি কোনদিন কাউকে এভাবে গল্প শোনাইনি”
“কি! আমি তো ভাবলাম রেগুলার গল্প শোনাও বলে এত সুন্দর করে বলতে পারলে। মা শা আল্লাহ! মানতে হবে, গল্প বলার এক অসাধারণ প্রতিভা আছে তোমার। নাহলে আমার মত মানুষকে তুমি এতক্ষণ ধরে গল্প শোনাতে পারতেনা”

সারাজীবন রূপের প্রশংসা, গানের গলার প্রশংসা শুনে আসা মায়ূমি এ অদ্ভুত প্রশংসায় লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। কিন্তু আগুনের রাঙা আলোয় সেই অপূর্ব লাজরাঙা রূপ না যিয়াদ দেখতে পেল আর না মায়ূমী নিজে অনুধাবন করতে পারল। সৃষ্টিজগতের হাজারো অজানা রহস্যের মতো মায়ূমীর ভেতরে জেগে ওঠা এ প্রথম অনুভূতিও আড়ালেই থেকে গেল।

পরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল যিয়াদের। ফজরের পর সৈকতের হিম হিম হাওয়ায় হাঁটতে অসম্ভব ভালো লাগছিল। এরপর ভেবেছিল নিজের জন্য যে চালাটা বানাবে সেটার জন্য জিনিসপত্র যোগাড় শুরু করবে। কিন্তু আগুনের পাশে বসে সেটা একটু উস্কে দিতেই একটা আলসেমিতে ধরে ফেলল, আর তারপরেই ঘুম। আড়মোড়া ভেঙে মায়ূমীর চালার দিকে তাকাতে দেখল, ও তখনো ঘুমে। একটা কাঠকয়লা আর খালি পানির বোতলগুলো নিয়ে যিয়াদ রওনা দিল পানির নালাটার দিকে।

মুখ হাত ধুয়ে বোতলগুলো ভরল ও। একটা কলার কাঁদিও নিতে হবে। এতকিছু একসাথে নেয়া তো সম্ভব না, কী করা যায়? হঠাৎ ওর মনে পড়ল, গ্রামের বাড়িতে ছোটবেলায় মামাদের দেখেছে, দড়ি দিয়ে বোতলের মুখ বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসতে। একটু খুঁজতেই কলাগাছের ভেতর দিকের শুকনো ছাল পেয়ে গেল। দড়ির থেকেও কয়েকগুণ বেশি মজবুত এগুলো। সেগুলো দিয়ে বোতলের গলায় ফাঁস আটকে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। আরেক কাঁধে কলার কাঁদিটা নিয়ে ফিরতে ফিরতে নিজেকে কেমন গ্রামের কিষাণ ছেলে মনে হচ্ছিল যিয়াদের। পরণে একটা লুঙ্গি আর মাথায় একটা মাথাল। ব্যস, তাহলেই ষোলকলা পূর্ণ হতো। এসব ভেবে হাসতে হাসতে নিজেদের আস্তানায় ফিরল যিয়াদ। অবশ্য সেখানে ফিরেই হাসি উবে গেল ওর।

“শিট! আবার! এই মেয়ের সাথে দেখছি কথা না বললে হচ্ছেনা” স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুখ দিয়ে খেদোক্তি বেরিয়ে এলো যিয়াদের।

তাড়াহুড়ো করে জিনিসপত্রগুলো রেখে দিয়ে আবার ঢুকে গেল জঙ্গলের মধ্যে।

প্রায় ঘন্টাখানেক পর মায়ূমীর গলা শোনা গেল, “যিয়াদ, যিয়াদ! কোথায় তুমি? যিয়াদ?” মায়ূমী ওর নামটা ডাকে একটু অন্যরকম করে। ‘য়া’ এর উপর একটু এক্সট্রা টান দিয়ে। মাঝে মাঝে তো যিয়াদের মনে হয়, ‘যি’ বাদ দিয়ে শুধু ‘য়াদ’ বলে ডাকছে।

যিয়াদ তখন এদিক ওদিক ঘুরে শুকনো নারিকেল পাতার যোগাড় করছে নিজের চালার ছাদ বানানোর জন্য।

প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাল সংগ্রহ করা অলরেডি হয়ে গেছে।

“আমি এখানে” অনিচ্ছাসত্ত্বেও সাড়া দিল যিয়াদ, যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে আছে ও মায়ূমীর উপরে। ইচ্ছে করছে এই মেয়ের থেকে কয়েকশো মাইল দূরে অবস্থান করে।
“আল্লাহ! দয়া করো। পোশাক আশাক গায়ে চাপিয়ে আসার সুবুদ্ধিটুকু অন্তত যেন এই মেয়ের হয়” বিড়বিড় করে প্রার্থনা করল ও। একটু বাদেই পাতার ফাঁক দিয়ে মিষ্টি কালার টপটার এক ঝলক দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ও।

“ব্যাপার কী তোমার? সকাল থেকে দেখছিনা তোমাকে” যিয়াদকে দেখতে পেয়ে বলল মায়ূমী।

“এই যে, কাজ করছি”
“এগুলো আবার যোগাড় করছ কেন? ঘর তো বানানো হয়ে গেছে”
“সাইডে দিতে হবে আর আমার জন্যেও একটা বানাব”
“বাবারে বাবা!

এই পুরো দ্বীপে তুমি আর আমি ছাড়া কোন মানুষ নেই আর তুমি সেপারেট ঘর তুলছ?”
“হ্যাঁ তুলছি। আর শোনো, তোমার সাথে জরুরি কথা আছে আমার”
“কী কথা, বলো” যিয়াদের গম্ভীর কণ্ঠ শুনে একটু অবাক হয়েছে মায়ূমী।

“আমার মনে হয় একসাথে থাকতে হলে আমাদের কিছু নিয়মনীতি ঠিক করে নেয়া উচিত”
“যেমন?” একটা ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচু হলো মায়ূমীর।

“আমি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং শালীনতা মেনে চলতে পছন্দ করি”
“তো আমি তোমার কোন গোপনীয়তায় আঘাত হেনেছি? আর কী এমন অশালীন কাজ করেছি শুনি?”
“শালীনতার ডেফিনিশন তোমার আর আমার কাছে ভিন্ন।

যেমন আমাদের সংস্কৃতিতে মেয়েরা ছেলেদের সামনে হুটহাট সাঁতার কাটতে নেমে যায়না”
“ফর গডস সেক, আমি ন্যুড তো ছিলাম না…..”
“সেজন্যেই তো বললাম তোমার আর আমার কাছে ভিন্ন” হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল যিয়াদ।

“তো আমাকে কী করতে হবে?” উদ্ধত কণ্ঠ মায়ূমীর।

“যখন তখন সাঁতার কাটতে সমুদ্রে নামতে পারবেনা। আর একান্তই নামতে ইচ্ছে করলে আমাকে আগে বলতে হবে। আমি এদিকে চলে আসব। তারপর তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো। অথবা আমার থেকে দূরে কোথাও গিয়ে সাঁতার কাঁটতে নামবে”
“আচ্ছা! আর?” কণ্ঠের সুর একটুও বদলায়নি ওর।

“এই যে তুমি যখন তখন আমাকে ছুঁয়ে ফেলো, সেটা করতে পারবেনা। আমি মেয়েদের ছোঁয়া পছন্দ করিনা” ধর্মের কথাটা ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেল যিয়াদ। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মের বিধিনিষেধের থেকে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ মানুষ বেশি স্বাভাবিকভাবে নেয়।

“আর যদি আমি এগুলো না মানি, তো?”
“আমার মনে হয় আমাদের আলাদা আলাদা থাকা উচিত”
“ফাইন, লেটস ডু দ্যাট দেন। মায়ূমী ইশিকাওয়া উইলিয়ামসন কোন নিয়মের ধার ধারেনা। আর এখানে? প্রশ্নই উঠেনা” মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা না করে হাঁটা দিল মায়ূমী।

“এই, শোনো। কোথায় যাচ্ছো তুমি? তুমি এখানে থাকবে, যেতে হলে আমি যাব। মায়ূমী, দাঁড়াও” ও এভাবে রিয়্যাক্ট করবে ভাবেনি যিয়াদ।
“তোমার বানানো ঘরবাড়ি নিয়ে তুমি থাকো। নিজেরটা নিজেই বুঝে নিব আমি”
“প্লিজ মায়ূমী, একটা কথা তো শুনো, প্লিজ” মরিয়া হয়ে বলল যিয়াদ।

“কী কথা?” ঘুরে দাঁড়াল মায়ূমী।

“প্লিজ, তুমি কোথাও যেওনা। এই যায়গাটা তুমি চুজ করেছিলে, ঘরও তুমি তোলা শুরু করেছিলে। আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করেছি। তাই এই ঘর তোমারই। প্লিজ তুমি এখানে থাকো। আমি অন্য ব্যবস্থা করে নিচ্ছি”
“স্যরি ম্যান, আমার মাথা তোমার বুদ্ধিতে চলেনা, ওকে? বাই। আমার পিছু নিওনা, প্লিজ। আমি তোমার ইচ্ছাকে রেসপেক্ট করেছি, তোমারও আমারটা করা উচিত”
হতবিহ্বল যিয়াদকে পেছনে রেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল মায়ূমী।


পর্ব ৭

যিয়াদের ধারণা সত্যি প্রমাণিত করে ওই হেলে পড়া নারিকেল গাছটার কাছেই আস্তানা গেড়েছে মায়ূমী। ওর বারণ থাকা সত্ত্বেও সন্তর্পণে পিছু নিয়ে দেখে এসেছে যিয়াদ। তবে বেশিক্ষণ লুকিয়ে লুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করার দুঃসাহস করেনি। ওর মনে হয়েছে ধরা পড়লে ফল খুব একটা সুখকর হবেনা। ব্যাপারটা একটু খারাপই লাগছে যিয়াদের। কথাগুলো মনে হয় একটু কঠোরই হয়ে গেছে। কিন্তু এছাড়া আর কীভাবে বলত ও?

দিনের বাকিটা সময় কাজ করে কাটাল যিয়াদ। নতুন চালা বানানোর চিন্তা আপাতত স্থগিত রেখে আগের চালাটাতেই হাত লাগাল। তিনদিকে নারিকেল পাতা দিয়ে বেড়া মতন করে মোটামুটি ঘরের আকৃতিতে আনা গেল জিনিসটাকে। কিন্তু কাজের ফাঁকেও ওর মনের উসখুসানি চাপা রইলনা। দ্বীপটা যেন এবার সত্যিকারের নির্জন মনে হচ্ছে। ছটফটে মেয়েটার উপস্থিতি ছাড়া সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ব্যাপারটা খেয়াল করে অদ্ভুত লাগল ওর। এমন তো হওয়ার কথা ছিলনা!

রাতে একা একা ডিনার করতে বসে আরও বেশি খারাপ লাগল। যতদূর বুঝেছে মেয়েটার সার্ভাইভাল স্কিল একেবারে শূন্যের কোঠায়। একা একা কী করছে না করছে আল্লাহ পাক জানেন। বারবার মনে হচ্ছে মেজাজ খারাপ করে ওভাবে না বললেই হতো। সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বুঝিয়ে বলা যেত নিশ্চয়ই। কাজটা ঠিক হয়নি।

ওর মন চাচ্ছিল একবার মায়ূমীকে গিয়ে দেখে আসে। দোনমনা করতে করতে শেষে আর গেলনা। দ্বীপে একাকী রাজত্ব করার এতই যখন শখ, সেটা একটু বরং মিটিয়েই নেক। আর এখন তো তাও কাছেই আছে। দেখা করতে গেলে বেশি রেগে গিয়ে যদি অন্য কোথাও চলে যায়, বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। কিন্তু চালাঘরটায় ঘুমাতে যেতে পারল না যিয়াদ।

মেয়েটা নিশ্চয় এর মধ্যেই ওদিকে একটা ঘর তুলে ফেলতে পারেনি। একদিক দিয়ে ওকে ঘরছাড়া করেছে যিয়াদই। সেখানে ও কীভাবে নিজে আরাম করে ঘুমাবে? কয়েকশো মিটার দূরে দুজন নরনারী নিজ নিজ আগুনের পাশে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ল। মন অন্যদিকে থাকায় এটাও মনে পড়লনা কারও যে ওরা দ্বীপবাসের এক সপ্তাহ পূর্ণ করে ফেলেছে।

পরদিন সকালে মুখ হাত ধুতে গিয়ে ইচ্ছে করেই অনেকক্ষণ নালার পাশে বসে রইল যিয়াদ। সেখানেই সময় নিয়ে কলা দিয়ে নাস্তা করল। কিন্তু মায়ূমীর টিকিটারও দেখা নেই। এদিকে শুধু শুধু তো আর বসে থাকা যায়না। তাই আরও একবার মাছ ধরার মিশনে নামল ও।

অনেকক্ষণ চেষ্টার পর গলদঘর্ম হয়ে যখন ভাবছে এ দফায়ও হলোনা, গোসল করে উঠে যাই, ঠিক তখনি আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন। একটা মাছকে ডালের ছুঁচালো মাথায় গেঁথে ফেলল যিয়াদ।

মাছটা খুবই ছোট, ওর হাতের তালুর সাইজের। তবুও খুশির চোটে চিৎকার করে উঠল ও,“মায়ূমী! এদিকে আসো, জলদি!”

পরক্ষণেই মনে পড়ল, বৃথাই ডাকছে, মায়ূমী তো নেই। কিন্তু এ মাছ ও কিছুতেই মায়ূমীকে ছাড়া একা খেতে পারবে না। আবার ভাবল মাত্র একটা মাছে কার কী হবে। তাই অন্তত আরও একটা মাছ ধরার জন্য দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে চেষ্টায় নামল যিয়াদ। কিন্তু এবার আর ভাগ্য প্রসন্ন হলোনা।

শেষমেশ ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল যিয়াদ। গোসল করে উঠে দেখে সূয্যিমামা কখন যে মাঝ গগনে এসে পড়েছে, খেয়ালই করেনি ও। চট করে তাই নামাজটাও পড়ে নিল। তারপর বসল মাছটা নিয়ে।
সামুদ্রিক মাছ, গায়ে আঁশ বলতে গেলে নেইই। তবু পাথরে একটু ঘষে নিল ও। ওই ডালটা দিয়েই পেটের দিকটা ফুটো করে ভালো করে পরিস্কার করে নিল মাছটা। তারপর বড় একটা পাতায় মুড়িয়ে নিয়ে রওনা দিল মায়ূমীর আস্তানার দিকে।

খানিকটা দূরে থাকতেই নাম ধরে ডাকতে শুরু করল ও। কিন্তু কেউ সাড়া দিলনা সে ডাকের। নারিকেল গাছটার কাছে

পৌঁছে দেখল মায়ূমী সেখানেও নেই। তবে বেশ মজার কিছু জিনিসের দেখা পেল ও। অগুনতি স্যান্ডক্যাসেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আশেপাশের বেলাভূমিতে। সোজা বাংলায় যাকে বলে বালুঘর। কোনোটা বড়, কোনোটা ছোট, কোনোটা আবার রীতিমতো প্রাসাদোপম। ঘুরে ঘুরে বেশ মনযোগ দিয়ে ঘরগুলো দেখল যিয়াদ। অদ্ভুত সুন্দর স্যান্ডক্যাসেলগুলোর প্রতিটাই বানানো হয়েছে অপরিসীম ধৈর্য আর যত্ন নিয়ে।

এর ভেতরে আবার জোয়ারের পানি এসে ভেঙে দিয়েছে অনেকগুলো, একটু আধটু অবশিষ্টাংশ রয়ে গেছে কিছু কিছুর। সেদিন নিজে বাস করার জন্য ঘর তোলার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিল। আর আজ দেখো, বসে বসে এগুলো বানাচ্ছে। মাথায় সমস্যা আছে কী আর আর সাধে বলি! ভাবল ও।

যিয়াদ এগিয়ে এসে বসে পড়ল ওই হেলে পড়া গাছটার উপর। পায়ের পাতা দিয়ে ছুঁয়ে দিল সমুদ্রের ঠান্ডা জল, ঠিক যেমনভাবে মায়ূমী বলেছিল। অনেক বছর আগের মধুর কিছু স্মৃতি ভেসে এল চোখের সামনে। তখন প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার পর অনেকদিনের জন্য ছুটি থাকত।

যিয়াদরা দাদুবাড়ি বেড়াতে যেত। একটা বিশাল দীঘি ছিল গ্রামের ঠিক মাঝখানে। আর তার একপাশে এরকম একটা হেলে পড়া তাল গাছ ছিল। গ্রামের সব ছেলেপেলেদের সাথে যিয়াদও ওই গাছটার উপর থেকে পুকুরে ঝাঁপ দিত। জলে ডুবে পার করত ঘন্টার পর ঘন্টা। ইশ! কী দিন ছিল!
“তুমি এখানে কী করছ?”
মায়ূমীর গম্ভীর কণ্ঠস্বর বর্তমানে ফিরিয়ে আনল যিয়াদকে। মায়ূমীর হাতে সেই বোতলটা, যেটা গতকালকে ইচ্ছে করে মাটি মাখিয়ে নালার পাশে ফেলে রেখেছিল যিয়াদ। দেখে খুশি হলো ও।

“তোমার বাসায় বেড়াতে এলাম” মাছধরা হাতটা পেছনে লুকিয়ে ফেলল যিয়াদ।
“আমি তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না?” অপরিবর্তিত স্বরে বলল মায়ূমী।

“হ্যাঁ, পিছু নিতে নিষেধ করেছিলে, বেড়াতে আসতে তো আর নিষেধ করোনি”
কাঁধ নাচাল মায়ূমী। মুখে কিছু বললনা। এ কয়দিন সবসময় ওর উচ্ছ্বসিত চেহারা দেখেছে যিয়াদ। এই নতুন গম্ভীর চেহারা বড্ড অদ্ভুত ঠেকছিল ওর কাছে। নেমে এল ও গাছ থেকে। সবথেকে সুন্দর স্যান্ডক্যাসেলটার কাছে এসে দাঁড়াল।

“তুমি আর্কিটেকচার নিয়ে পড়ছো নাকি?” উত্তরটা জানা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল যিয়াদ।
“না তো” প্রশ্নটায় বিস্মিত হয়েছে মায়ূমী, কণ্ঠস্বরে বোঝা গেল সেটা।

“কিন্তু এই সুন্দর সুন্দর প্রাসাদগুলো তো অন্য কথা বলছে”
“ছোটবেলা থেকেই এই কাজটা আমার অনেক ফেভারিট। সুযোগ পেয়ে তাই ইচ্ছেমতো বানিয়েছি” মুখটা যেন একটু নরম হলো মায়ূমীর।
“তাই তো বলি, যে এত বড় বড় ক্যাসেল নির্মাণ করতে পারে, তার কী আর সামান্য চালাঘরে মন টিকে!” কণ্ঠে মেকি হতাশার সুর টেনে বলল যিয়াদ।
যিয়াদের চেহারা আর কথার ভঙ্গিতে কিছু একটা ছিল। খিলখিল করে হেসে উঠল মায়ূমী। ঘন কালো মেঘ সরে যেন হেসে উঠল ঝকঝকে রোদ্দুর। মুচকি হাসল যিয়াদও। সন্তর্পণে ছেড়ে দিল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস।

“বাসায় যখন এসেছো, তোমাকে কী দিয়ে আপ্যায়ন করা যায় বলো তো” হাসি থামিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল মায়ূমী।

“তার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করো, ‘কী নিয়ে বেড়াতে এসেছো’?” বেশ একটা ভাব নিয়ে বলল যিয়াদ।

“রাইট! ওয়েট, ভালো কিছু পেয়েছো তুমি, তাই না?” জ্বলজ্বলে চোখে জিজ্ঞেস করল মায়ূমী।

হাতটা সামনে এনে পাতাটা খুলল যিয়াদ। দুই হাত কাঁধের কাছে তুলে ‘ইইইইইইইই’ টাইপ একটা আওয়াজ তুলে রীতিমতো লাফাতে শুরু করল মায়ূমী। এতটা রিএকশনের জন্য প্রস্তুত ছিল না যিয়াদ। আওয়াজটা সত্যিই উল্লাস বোধক কিনা কনফিউজড হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ও। বোতলটা নিচে রেখে ওর হাত থেকে মাছটা পাতাসমেত নিয়ে নিল মায়ূমী।

“ও মাই গড, ও মাই গড! ফাইনালি আমিষ কিছু খেতে পারব আমরা। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না” ওর খুশি যেন আর ধরছেনা। এবার নিশ্চিত হলো যিয়াদ।

“অনেকক্ষণ হয়ে গেছে কিন্তু মাছটা ধরা। আরও দেরি করলে পরে পচা মাছ খেতে হবে” হাসিমুখে বলল যিয়াদ।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। নাও, তুমি মাছটা রান্না করো। আমার কাছে দুটো জুকিনি আছে। কিন্তু ওতে আর এটুকু মাছে দুজনের পেট ভরবেনা। আমি আরও কিছু নিয়ে আসি”
“দাঁড়াও! তুমি রান্না করো। আমি নিয়ে আসি”
“না না, তুমি মাছ নিয়ে বেড়াতে এসেছো, এবার তোমার আপ্যায়নের জিনিস আমাকে আনতে দাও। ইট’স ফান। আমি এই যাব আর এই আসব” মাছটা যিয়াদের হাতে ধরিয়ে ঝড়ের গতিতে জঙ্গলে ঢুকে গেল মায়ূমী।

মায়ূমীর জিইয়ে রাখা অগ্নিকুন্ডে একটা নতুন কাঠ গুঁজে দিল যিয়াদ। তারপর আশপাশ থেকে একটা সরু ডাল খুঁজে বের করল। সেটায় মাছ গেঁথে আগুনে ধরল ও। একটু বাদেই ঝলসানো মাছের স্বাদু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। খানিক বাদেই লাফাতে লাফাতে হাজির হলো মায়ূমী। চোখমুখ দিয়ে খুশি উপচে পড়া চেহারা নিয়ে। কিন্তু সাথে কলার কাঁদি বা নারকেল কিছুই দেখতে পেলনা যিয়াদ।

“টা-ডা” যিয়াদের কাছে এসে দুই হাত সামনে মেলল মায়ূমী। দুটো ঈষৎ নীলচে বর্ণের ডিম সেখানে।

বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠল যিয়াদের। “কোথায় পেলে এগুলো?”

“হে হে! বুঝতে হবে। গড যখন অতিথি পাঠান, তখন তার আপ্যায়নের ব্যবস্থাও তিনিই করে দেন” মাথা দুলিয়ে ভাব নিয়ে বলল মায়ূমী।

“আরে বলোনা পরিষ্কার করে” উৎসুক কণ্ঠ যিয়াদের।

“আমি তো ভেবেছিলাম এক কাঁদি কলা নিয়ে এসে বলব, ‘এই নাও মায়ূমীর রাজ্যের উৎকৃষ্ট মানের কলা। সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা। ফুল্লি অর্গানিক, যেকোন প্রকার সার এবং কীটনাশক মুক্ত’ কিন্তু হঠাৎ দেখি গাছের নিচে একটা পাখির বাসা পড়ে আছে। সেখানে ছয়টা ডিম।

একটাও ভাঙেনি। মা পাখিটার জন্য মায়া হচ্ছিল, তাই শুধু দুটো নিয়ে এসেছি”
“আলহামদুলিল্লাহ! প্রথমে মাছ আর তারপর ডিম। দেনেওয়ালা যাব দেতাহে, ছাপ্পাড় ফাড়কে দেতাহে” চকচকে চোখে বলল যিয়াদ।

“এটা আবার কী প্রবাদ ছিল?”
“এটা বাংলা না, একটা হিন্দি কথা, প্রবাদ কিনা জানিনা। এটার অর্থ হচ্ছে, ‘দেওয়ার মালিক যখন দেন, অফুরন্ত দেন’”
“বাব্বাহ! তুমি হিন্দিও জানো?”

প্রত্যুত্তরে একটা মুচকি হাসি দিল ঠিকই, কিন্তু এই হিন্দি ভাষা জানার পেছনের কাজগুলোর কথা ভেবে সব সময়ের মতো মন খারাপ হয়ে গেল যিয়াদের। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, হিন্দি সিনেমা আর গানে বুঁদ হয়ে থেকেছে। জীবনের এতগুলো ঘন্টা নষ্ট করে শুধু এই একটা উপকারই হয়েছে, যেটা না হলেও কোন ক্ষতি ছিল না। অন্যদিকে হিসাবের খাতায় জমা হয়েছে কোটি কোটি গুনাহ। সমুদ্রে ডুবে যদি সত্যিই মারা যেত, কী নিয়ে দাঁড়াত মহান প্রভুর সামনে? এই হিন্দি ভাষা কি তখন রক্ষা করতে পারত তাকে?
এক ছুটে গিয়ে সমুদ্রের জলে ডিম দুটো ধুয়ে আনল মায়ূমী। ততক্ষণে মাছ ঝলসানো হয়ে গেছে। সেটাকে একটা পাতার উপর রেখে মায়ূমীর কাছে জুকিনিগুলো চাইল যিয়াদ। মোটাসোটা একটা গাছের দিকে এগিয়ে গেল মায়ূমী। গাছটার নিচে পুরু শিকড় অনেকটা অংশ নিয়ে ছড়িয়ে আছে। ওরা মূলত এখন এই গাছটার ছায়ার নিচেই আছে। জায়গাটা খুব খারাপ বাছেনি মায়ূমী। একটা শিকড়ের পাশ দিয়ে ওর সোয়েটারটা দেখা যাচ্ছিল।

সেটা নিয়ে ফিরে এল মায়ূমী। সোয়েটারটা আবারও হোবো ব্যাগে রূপ নিয়েছে দেখা গেল। ব্যাগের ভেতর থেকে জুকিনিগুলো বের করে মাছের মত করে ডালে গেঁথে আগুনের ভেতর ঢুকিয়ে দিল ওরা।

“তাহলে আগে কী খাচ্ছি আমরা? মাছ নাকি ডিম?” জানতে চাইল মায়ূমী।

“ডিম খাব মানে? কাঁচা খাব নাকি?” দুচোখ কপালে তুলল যিয়াদ।

“হ্যাঁ…. ডিম তো কাঁচাই খাওয়া যায়, জানোনা?”

“ছি! আমি কাঁচা খেতে পারবনা” নাকমুখ কুঁচকে বলল যিয়াদ।

“তো কী খাবে শুনি? ফ্রাই না কারি?” বিদ্রুপ করল মায়ূমী।

“আহ! ভাবতেই জিভে জল আসছে। কিন্তু চাইলেই তো আর পাওয়া যাবেনা। ডিমের লোভ করে আমার কাজ নেই।

ওই জুকিনিই ঠিক আছে”
চুক চুক করে অসন্তোষজনক শব্দ করল মায়ূমী।

“ভেবেছিলাম তোমাকে কাঁচা ডিম খাইয়ে শাস্তি দেব, কিন্তু সেটা আর হতে দিলেনা। ওয়েট! ফ্রাই বা কারি না হলেও বয়েলড এগ খেতে পারবে” ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকাল মায়ূমী।

উৎসুক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল যিয়াদ। কিন্তু যে জিনিসটা ও ব্যাগ থেকে বের করল, সেটা দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল যিয়াদের। একটা কোকের ক্যান।

“মা শা আল্লাহ! তোমার কপাল তো দেখছি বহুত চওড়া। ডিম পেয়ে যাচ্ছো, ক্যান পেয়ে যাচ্ছো” বিস্ময় কাটিয়ে বলল যিয়াদ। আর ওদিকে আমি শুধু শুধুই টেনশন করছিলাম ওকে নিয়ে, ভাবল ও।

“কেন মনে হচ্ছে বলো তো, তোমার সাথ ছাড়ার পর থেকেই আমার কপাল খুলেছে” ভ্রু নাচাল মায়ূমী।
“কিন্তু ডিম তো আমি আসাতে পেয়েছো। সো, তুমি মোটেই আমাকে একিউজ করতে পারোনা।

আর সেদিক দিয়ে ধরলে আমিও তো মাছ পেয়েছি তুমি চলে আসার পরেই”
“বাব্বাহ, রুডম্যান! তুমি ঝগড়াও করতে পারো?” দুষ্টুমি মার্কা হাসি দিয়ে বলল মায়ূমী।

“এটাকে মোটেই ঝগড়া বলেনা। আচ্ছা, আমরা কি মাছটা ঠান্ডা করব?”

“ইম্পসিবল! চলো আগে খাই”
ওইটুকু মাছ দুভাগ করে দুজনে প্রয়োজনের থেকে বেশী সময় নিয়ে খেল। স্বাদ আস্বাদন দীর্ঘায়িত করার বহুল পুরনো প্রচেষ্টা। যিয়াদে চোখের সামনে সার দিয়ে ভেসে উঠল মায়ের হাতের হাজারো মাছের পদ। সেগুলোর অতুলনীয় স্বাদ যেন চোখ বন্ধ করেই মনে করা যায়। তবু মনে হলো এত স্বাদের মাছ ও কোনদিন খায়নি।

খেতে খেতে যিয়াদ একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সমুদ্র আর ওই গাছটার দিকে।

“কি, রুডম্যান? আমার গাছটা কি তোমারও মনে ধরেছে নাকি?” খেয়াল করে বলল মায়ূমী।

“এ্যাঁ? কিছু বললে?” আচমকা বর্তমানে ফিরে এল যিয়াদ।

“বলছি কোথায় হারিয়ে গেছ?”

মাছের পদের কথা বলে শুধু শুধু ওর জিভে জল আনতে চাইলনা যিয়াদ। দাদুবাড়ি, দীঘি আর তার পাশের তালগাছের গল্পটা শোনাল ও।

“ওয়াও! জোস! আমারই শুনে লোভ হচ্ছে। জাস্ট ভাবো, আমি এটার উপরে দাঁড়িয়ে জলে ঝাঁপ দিচ্ছি, কী হবে?” চকচকে চোখে বলল মায়ূমী।

“এত জোরে একটা চিৎকার শোনা যাবে যে জঙ্গলের সব পাখি ভয়ে উড়ে যাবে আর তোমার কপালে বিশাল একটা আলু গজিয়ে যাবে” নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল যিয়াদ।
চোখ বড়বড় হয়ে গেল মায়ূমীর, পরক্ষণেই বুঝতে পেরে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ল ও। হো হো করে না হলেও হাসিতে যোগ দিল যিয়াদ। ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে চমকে উঠল দুজনেই।


পর্ব ৮

অদ্ভুত শব্দটা যে একটা পাখির ডাক, সেটা বুঝতে সময় লাগল ওদের। মাত্রাতিরিক্ত তীক্ষ্ণ ডাকটার সাথে যেন হাহাকার মিশে আছে। পাখিটা ডেকেই যাচ্ছিল, ডেকেই যাচ্ছিল।

দুইজন দুইজনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই দুখী দুখী হয়ে উঠল মায়ূমীর চোখ।

“নিশ্চয়ই ওই মা পাখিটা। ফিরে এসে বাসার অবস্থা দেখে এভাবে চিৎকার করছে”
“তাই হবে হয়তো। চলো দেখি, বাসাটা কোনভাবে তুলে দেয়া যায় কী না” উঠে দাঁড়াল যিয়াদ।

দেখা গেল ওদের ধারণা ঠিক। গাছটার উপর দিয়ে বেশ বড়সড় একটা পাখি চক্কর দিচ্ছে আর এমন শব্দ করছে। ওদের দেখে চিৎকার থামাল পাখিটা, কিন্তু চক্কর দেয়া বন্ধ করলনা, শুধু একটু নিচে নেমে এল। যেন বোঝার চেষ্টা করছিল ওদের মতলব টা কী।

যিয়াদ দেখল ওর হাতের নাগালে একটা ডাল আছে, সেখানে পাখির বাসাটা উঠিয়ে দেয়া সম্ভব। যদিও মনে হয়না পাখিটা এত নিচু ডালে বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু বাসাটা তোলার জন্য নিচু হতেই বাঁধল বিপত্তি। তীরের বেগে ছুটে এসে পাখিটা ঠোকর দিতে চাইল যিয়াদকে। একেবারে শেষ মুহূর্তে “যিয়া…..দ” বলে ধাক্কা দিয়ে মায়ূমী ওকে সরিয়ে দিল বলে বেঁচে গেল পাখিটার ধারাল চঞ্চুর হাত থেকে।

“ও ভাবছে আমরা ডিমগুলো নিতে এসেছি” বলল যিয়াদ।

ঘাড় নেড়ে সায় দিল মায়ূমী। ওর চোখেমুখে ভয়ের চিহ্ন। পাখিটা এখন একেবারে ওদের মাথার উপরেই ডানা ঝাপটাচ্ছে, যেকোনো সময় আঘাত হানতে প্রস্তুত। ভিন্ন এক সুরে ডাক শুরু করেছে এবার।
“দেখো, আমরা তোমার বন্ধু। আমাদের কোন খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমরা তোমার ডিম নিতে আসিনি, বাসাটা উঠাতে তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি” কাঁপা কণ্ঠে কথাগুলো বলল মায়ূমী পাখিটার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে অভিনয় করে।

কিন্তু পাখি কী আর মানুষের কথা বোঝে! যিয়াদ আবার নিচু হতে গেলে একইভাবে ধেয়ে এল পাখিটা। এবার সতর্ক ছিল যিয়াদ, সরে গেল দ্রুত।
“যিয়াদ, ডিমগুলো ফিরিয়ে দিব নাকি? ও তো দেখছে ওর দুইটা ডিম মিসিং” ফিসফিস করল মায়ূমী।

“না না, তাহলে ওর সন্দেহই ঠিক হয়ে যাবে। আমি দেখছি কী করা যায়”

এবার যিয়াদও মায়ূমীর মতো অভিনয় করে পাখিটাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, ওদের আসল উদ্দেশ্যটা কী। তারপর বিড়বিড় করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইল। বিসমিল্লাহ বলে নিচু হয়ে বাসাটা তুলে নিল। আল্লাহর অশেষ রহমত, পাখিটা এবার আর ধেয়ে এলনা। আর দেরি না করে সন্তর্পণে বাসাটা ডালের কোণে বসিয়ে দিল যিয়াদ। অদ্ভুত এক কিচকিচ শব্দ করে ওর মাথার উপর চক্কর দিতে থাকল পাখিটা। মুখে হাসি ফুটে উঠল ওদের। কে বলেছে পাখিদের ভাষা মানুষ বুঝতে পারেনা? ওরা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল, পাখিটা ওদের ধন্যবাদ দিচ্ছে।

ফিরে আসার সময় বারবার পেছনে তাকাচ্ছিল যিয়াদ। পাখি হোক বা মানুষ, মা তো মা-ই হয়। নিজের মায়ের কথা ভেবে বুকটা মোচড় দিচ্ছিল ওর। এই পাখিটার মতোই হয়তো বিলাপ করছে ওর মা। একটা গোটা সপ্তাহ ধরে ও নিখোঁজ। “আল্লাহ গো, আমার মাকে তুমি ধৈর্য ধারণ করার শক্তি দিও” বিড়বিড় করে চোখের কোণে চলে আসা তরল কষ্টটুকু সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল যিয়াদ।

অন্যমনস্ক ছিল মায়ূমীও। সৈকতে আসার আগ পর্যন্ত কেউই কোন কথা বলল না। সেখানে পৌঁছেই উপলব্ধি করল যিয়াদ, ওর কাজ শেষ হয়েছে। অপরাধবোধ দূর হয়েছে। মায়ূমী ভালো আছে। যিয়াদকে ছাড়া ওর কোন সমস্যাই হচ্ছেনা আর হবেওনা। মাছ খাওয়াও হয়ে গেছে, এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ওর চলে যাওয়া উচিত।

তবু কেন যেন মন চাইছে মায়ূমী ওর কথা মেনে নিক, ফিরে চলুক ওর সাথে। নাহ! অপরাধবোধ পর্যন্তই ঠিক আছে, আর আগে বেড়োনা, যিয়াদ আব্দুল্লাহ। এই মেয়ের থেকে আলাদা থাকাই সব দিক থেকে মঙ্গলজনক। বিদায় নেবার জন্য মায়ূমীর দিকে ফিরল যিয়াদ।

“আই এম স্যরি, তখন তোমাকে টাচ করে ফেলেছিলাম” যিয়াদ মুখ খোলার আগেই বলল মায়ূমী।
“স্যরি কেন বলছ? তুমি তো বাঁচিয়েছ আমাকে। জাযাকিল্লাহ। মানে থ্যাংক ইউ”

“তাহলে স্বীকার করছ তো, টাচ করার প্রয়োজন আছে”
“আমি আবার কখন বললাম যে টাচ করার প্রয়োজন নেই”
“যখন তখন আমাকে টাচ করতে পারবেনা, আমি মেয়েদের ছোঁয়া পছন্দ করিনা” যিয়াদের বলার ভঙ্গি নকল করে ভেংচি কেটে বলল মায়ূমী, “এটা কি ভুতে বলেছিল?”
“পছন্দ করিনা বলতে বোঝাতে চেয়েছি অপ্রয়োজনে। তার মানে এই না যে তোমার কোন বিপদ হলে আমি তোমাকে বাঁচাব না। ‘প্রয়োজন’ শব্দটার গুরুত্ব বোঝাতে চেয়েছিলাম”
“ওকে। ধরো, আমি বসে আছি। ওঠার জন্য তো
মার সাহায্য প্রয়োজন। আমি হাত বাড়ালাম। তুমি ধরে ওঠাবে, রাইট?” যিয়াদের দিকে তর্জনী তাক করে বলল মায়ূমী।

“জি না। ওঠাব না। কারণ তুমি আমার সাহায্য ছাড়াই উঠতে পারবে। ওটা তোমার প্রয়োজন না, কাজটা সহজ করার ইচ্ছা”
“মাই গড! তোমার চিন্তাভাবনা এত কমপ্লেক্স কেন বলোতো”
হাসল যিয়াদ, কাঁধ নাচাল একইসাথে।
“ইয়া, ইয়া, রুডম্যান নাম তো আর এমনি এমনি হয়নি, না!” হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মায়ূমী।

“আই এম অলসো স্যরি, মায়ূমী। গতকালকের জন্য। তবে যে কথাগুলো বলেছি, সেগুলোর জন্য না। যেভাবে বলেছি, সেভাবে বলাটা ঠিক হয়নি”
চোখ সরু করে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মায়ূমী। যেন বোঝার চেষ্টা করল, ও সত্যিই দুঃখিত কিনা। মায়ূমীকে কোন উত্তর দিতে না দেখে আবারও মুখ খুলল যিয়াদ, “ঠিক আছে তাহলে, আমি যাই। বাই মায়ূমী, নিজের খেয়াল রেখো” বলে হাঁটা দিল যিয়াদ।

“বাই” পেছন থেকে বলল মায়ূমী।
অর্ধেক পথ এসে যিয়াদের মনে পড়ল, ওর আগুনটা এতক্ষণে নিভে যাওয়ার কথা। যাওয়ার সময় মায়ূমীর থেকে একটু আগুন নিয়ে যেতে চেয়েছিল ও। আবার উলটো পথে রওনা দিল ও। একটু দূরে থাকতেই ডাকতে যাবে ঠিক তখনি থমকে যেতে হলো। কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আর ক্রন্দনরতা কোনরকম রাখঢাক না করে হাউমাউ করে কাঁদছে। কোন বিপদ হলো না কি? দৌড় দিতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল যিয়াদ। নাহ!

বিপদে পড়লে কেউ এভাবে কাঁদে না। বুকের ভেতর কষ্টগুলো দিনের পর দিন বন্দী থাকতে থাকতে যখন সহ্যসীমা অতিক্রম করে, কেবল তখনই এভাবে বেরিয়ে আসে। এটা শুধু কান্না না, বহুদিনের জমানো কষ্টের লাভা।

এখন যাওয়া মানে ওকে অপ্রস্তুত করা। আমি নিজে এভাবে কান্না করলে কখনোই চাইতাম না যে কেউ সেটা দেখুক।

এত ভেবেও মন মানলনা যিয়াদের। মেয়েটার সত্যি কোন বিপদ হয়নি নিশ্চিত হওয়ার জন্য হলেও যাওয়া উচিত। তাই কৌশল অবলম্বন করল ও, ঢুকে গেল জঙ্গলের ভেতর।
হেলে পড়া নারিকেল গাছটার উপরে না, গোড়ায় বসে আছে মায়ূমী। দুহাটু গুছিয়ে, সমুদ্রের দিকে মুখ করে। কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। একটু পর পর ডান হাত উঠিয়ে চোখ মুছছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাউকে এভাবে কাঁদতে দেখা যায়না। যদি কান্না থামানোর সামর্থ্য না থাকে, তাহলে সেখান থেকে চলে যাওয়াই উত্তম। সরে এল যিয়াদ।
কিন্তু ও এভাবে কাঁদছে কেন? ওর লাইফস্টাইল সম্পর্কে যেটুকু জানা আছে, তাতে ওর ভেতর এত কষ্ট জমা থাকার কোন কারণ যিয়াদ দেখছেনা। আর থাকলেও বা, হঠাৎ কী এমন হলো যে সেই বাঁধ ভেঙে গেল?
সন্ধ্যা হওয়ার পর যখন মনে হলো যথেষ্ট অন্ধকার নেমে এসেছে, মায়ূমী কান্নামাখা মুখ নিয়ে অপ্রস্তুত হবেনা, তখন যিয়াদ আবার ফিরে এল।

ঠিকই ভেবেছে ও। কান্না থেমেছে মায়ূমীর, কিন্তু নিজের যায়গা থেকে নড়েনি। অগ্নিকুন্ডে আগুনও জ্বলছেনা। সদ্য শিখা নির্বাপিত হওয়া লাল লাল কয়লাগুলো বিশালদেহী কোন প্রাণীর জ্বলজ্বলে চোখের মতো লাগছে। চাঁদও ওঠেনি এখনো। কেমন একটা গা ছমছম করা অনুভূতি।

“মায়ূমী, কোথায় তুমি?” না জানার ভান করল যিয়াদ।
চমকে উঠে দাঁড়াল মায়ূমী। দ্রুত লুকিয়ে চোখ মুখ মুছে ফেলল। সেটাও না দেখার ভান করে আবার ডাক দিল যিয়াদ।
“এই যে, এখানে” সাড়া দিয়ে এগিয়ে এল মায়ূমী।

“আমার আগুন নিভে গেছে। তাই আগুন নিতে এলাম। কিন্তু তোমার আগুনও তো মনে হচ্ছে নিভে যাবে একটু বাদে। নতুন কাঠ দাওনি কেন?”
“এমনি” ছোট করে উত্তর দিল মায়ূমী।

কয়েকটা শুকনো পাতা কয়লাগুলোর উপর ফেলে ফু দিল যিয়াদ।

দপ করে জ্বলে উঠল অগ্নিশিখা। কয়েকটা কাঠ নিয়ে এসে গুঁজতে যাচ্ছিল, নিষেধ করল মায়ূমী।

“শুধু একটা কাঠে আগুন নিয়ে নাও। এখানে আর কাঠ জ্বালিয়ে কাজ নেই” বলল ও।

“কেন?”

“শুধু শুধু দুই জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে কাঠ নষ্ট করে লাভ কি?”

একটা ভ্রু উঁচু করে ওর দিকে তাকাল যিয়াদ, বুঝতে চাইছে মায়ূমীর কথার পেছনের অর্থ।

“আচ্ছা বাবা, ওভাবে তাকাতে হবে না। আমি তোমার প্রস্তাবগুলোতে রাজি। মায়ূমী ইশিকাওয়া উইলিয়ামসন অন্যের ব্যাপারে এতটাও ইনকন্সিডারেট না, হুঁহ!” মায়ূমী নিজের প্রকৃত সত্ত্বায় ফিরে আসতে চাইছে যেন।

হেসে ফেলল যিয়াদ, স্বস্তির হাসি। মায়ূমী না বললে ও এবার নিজেই রিকোয়েস্ট করত ফিরে যাওয়ার জন্য। এভাবে কাঁদতে দেখার পর ওকে একা ফেলে রেখে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছিলনা যিয়াদের।

“নেক্সট টাইম বুঝেশুনে ওয়ার্ড চুজ করবে। কেউ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করুক, হুকুম করুক, এটা আমি পছন্দ করিনা। ওইভাবে না বলে যদি শুধু রিকোয়েস্ট করতে, আমি কিছুই মনে করতাম না। স্যরি বললে বলে দ্বীপের অনেকগুলো কাঠ বেঁচে গেল” ফেরার পথে বলল মায়ূমী। হাতে জ্বলন্ত কাঠ মশালের মতো ধরে থাকা যিয়াদ নিঃশব্দে হাসল।


পর্ব ৯

মায়ূমীর কান্না থামা কিংবা সন্ধ্যা নামার অপেক্ষায় অহেতুক বসে ছিল না যিয়াদ। রাত নেমে গেলে জঙ্গলে ঢুকতে আর ইচ্ছে করবে না। তাই সেই ফাঁকে জুকিনির ঝোপের জায়গাটা থেকে এক চক্কর মেরে এসেছিল। জ্যাকেটের দুই পকেটে দুটো জুকিনি পুরে এনেছিল রাতের সংস্থান হিসেবে। সেগুলো দিয়েই এখন ডিনার করছে ওরা।

মায়ূমী সাধ্যের অতীত চেষ্টা করছে নিজের স্বভাবচিত খোশ মেজাজে থাকার। যার শুরু হয়েছে আগুন জ্বালানো নিয়ে।

“একদিন একা একা আগুন জ্বালিয়েই আমি এক্সপার্ট হয়ে গেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না? দেখাচ্ছি দাঁড়াও” প্রয়োজনের থেকে বেশি ছুটোছুটি করে আগেরদিন যিয়াদের যোগাড় করে রাখা গাছের ডাল আনল, সাজাল, আগুন জ্বালাল। পুরোটা সময় জ্বলন্ত ডালটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো যিয়াদকে। কয়েকটা বড় ডালে আগুন ধরে আলো বাড়লে আলোকিত হয়ে উঠলো চালাঘরটা। সেদিকে তাকিয়ে লাফিয়ে উঠল মায়ূমী।

“হোয়া!” ঘরটার চারদিকে এক পাক ঘুরে, ভেতরে একটা ঢুঁ মেরে, নাচতে নাচতে আবার ছুটে এল ও যিয়াদের কাছে। “ওয়াও! কী বানিয়েছো রুডম্যান! জাস্ট অসাম!”

“থ্যাংকস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। যদিও এভাবে বলার মতো কিছু হয়নি” মায়ূমীর অতি উচ্ছ্বাস যিয়াদের ভালো লাগছিল না।

“এভাবে বলার মতো কিছু হয়নি” নাকি কণ্ঠে ওকে নকল করল মায়ূমী, “বলেছে তোমাকে” একটু থেমে আবার মুখ খুলল ও, “শোনো, আজকে তুমি ভেতরে ঘুমাও। আমি এখানে ঘুমাব”

“তোমার ঘর, তোমার পছন্দ হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। সেখানে আমাকে কেন পাঠাতে চাইছো?”

“না না। আমি রোজ রোজ ঘরে ঘুমাব আর তুমি বাইরে। এটা তো হতে পারেনা, তাইনা?”

“রোজ রোজ কই? কাল রাতে তো তুমিও খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়েছ” মুচকি হেসে বলল যিয়াদ।

“আরে হ্যাঁ, তুমি তো কালকে ঘরে ঘুমাতে পেয়েছিলে। ঠিক আছে, আমিই ঘুমাব আমার ঘরে। কিন্তু, আমি, মায়ূমী ইশিকাওয়া উইলিয়ামসন, কালকে তোমার ঘর বানিয়ে দিব, প্রমিস” বুকে হাত দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে শপথ গ্রহণের মতো সুর করে বলল মায়ূমী।

আনন্দ, উচ্ছাস সংক্রামক জিনিস। একজনের উচ্ছ্বাস খুব সহজেই আরেকজনকে স্পর্শ করে, আনন্দিত করে। কিন্তু, যখন কেউ জানে যে তার সামনের মানুষটা বুকভরা কষ্ট নিয়ে উচ্ছ্বসিত থাকার মিথ্যে অভিনয় করছে, তখন সেই উচ্ছ্বাস বড় কষ্টদায়ক, অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।

খেতে খেতেও কীসব বলতে বলতে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল মায়ূমী, যার অধিকাংশ যিয়াদের কানে ঢুকছিল না।

ওর ইচ্ছে করছিল ওকে বলে, “দ্যাটস এনাফ, মায়ূমী! কষ্ট পাওয়াটা দোষের কিছু নয়। কান্না করাও কোন গুনাহ না। সেগুলো লুকাতে এসব করতে হবেনা তোমাকে”

ভাবা পর্যন্তই, আদোতে কিছুই বলতে পারলনা ও। অনধিকার চর্চা করার ধাত ওর কোনকালেই ছিলনা। কিন্তু আর নিতেও পারছিল না যিয়াদ।

“মায়ূমী, আমাকে আরেকটা গল্প শোনাবে?” আচমকা বলল যিয়াদ।
“কী?” অবাক হলো মায়ূমী। এ জীবনে গান গাওয়ার রিকোয়েস্ট ও শুনেছে অজস্র বার, কিন্তু গল্প! যিয়াদ ছেলেটা এত অদ্ভুত কেন?

হঠাৎ চুপ হয়ে গেল মায়ূমী। তারপরেই পানির খালি বোতলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। “ঠিক আছে, চলো”

“কোথায়?”
“ওইখানে” বাম হাতের তর্জনী সমুদ্রতীরের দিকে তাক করে বলল মায়ূমী।

“শীত করবে, মায়ূমী। এখানেই থাকিনা”
“না। গল্প শুনলে ওখানে চলো, নাহলে বলবনা” বাচ্চাদের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মায়ূমী।

“ঠিক আছে, চলো” অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল যিয়াদ। এখন ওর মনটা ডাইভার্ট করা বেশি জরুরি। কিন্তু ওর ধারণাতেও ছিল না যে ও ভুল রাস্তায় হাঁটছে।
“মা পাখিটাকে দেখছিলে? কেমন করছিল নিজের সন্তানের জন্য?” একটু দুরত্ব রেখে দুজনে গুছিয়ে বসার পর ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল মায়ূমী।

“হ্যাঁ। পাখি হোক বা মানুষ, মায়েরা এমনই হয়” ধীরকণ্ঠে উত্তর দিল যিয়াদ।

“উঁহু! সব মায়েরা হয়না” বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলল মায়ূমী। একটু চমকে গেল যিয়াদ, কথার মোড় কোনদিকে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।

“হ্যাঁ, ব্যতিক্রম তো সবক্ষেত্রেই আছে, তবে পার্সেন্টেজটা খুবই কম। সত্যি এটাই যে সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার কোন তুলনা হয়না”

“তুলনা হয়না!…. হে হে…” হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মতো হেসে উঠল মায়ূমী। “তোমার জন্য বলা খুব সহজ, কারণ তুমি মায়ের ভালোবাসা পেয়েছো। সেই মাকে কী বলবে তুমি, যে নিজের সন্তানকে জন্মের পর ত্যাগ করে? হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে যায়? তারও তো কোন তুলনা হয়না, তাইনা?”

মায়ূমী যে নিজের মায়ের কথাই বলছে, এটা জানার জন্য মনোবিশারদ হওয়ার প্রয়োজন পড়েনা। তাহলে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণ এটাই ছিল, মনে মনে বলল যিয়াদ।

“কিছু বলছোনা যে? মাদের নিয়ে ভালো কথা সব বন্ধ হয়ে গেল?

“উঁহু! আমি তো আগেই বললাম, সবকিছুরই ব্যতিক্রম আছে”
“হ্যাঁ! পৃথিবীর সমস্ত ব্যতিক্রম তো শুধু আমার জন্যেই। আচ্ছা ছাড়ো, তুমি গল্প শুনতে চেয়েছিলে”
কী কী ব্যতিক্রম, কেন, কীভাবে, হাজারটা প্রশ্ন একযোগে জেগে উঠল যিয়াদের মনে। কিন্তু অন্যের ব্যাপারে অহেতুক কৌতুহল দেখানো শোভনীয় নয়। তাই মুখের আগায় চলে আসা প্রশ্নগুলো গিলে ফেলল যিয়াদ। একটা অবাস্তব আশাও করে ফেলল হুট করে।

আমি না জানতে চাইলেও তো ও বলতে পারে, যদি ওর ইচ্ছে হয়, তাইনা? আশা পূরণ হলো।

“চলো, একজন মায়ের গল্প শোনাই তোমাকে” বলে যাচ্ছিল মায়ূমী, “এমন একজন মা, যে কিনা গোটা মা জাতিকে কলংকিত করতে পারে”
স্তব্ধ হয়ে গেল যিয়াদ। শুরু করল মায়ূমী।

“আমি যার কথা বলছি, তার নাম ইসাবেলা উইলিয়ামসন। অত্যন্ত ধনী আর অভিজাত এই উইলিয়ামসন পরিবার। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিল ইসাবেলা। কোন প্রকার অভাব অভিযোগ ছাড়া একেবারে প্রিন্সেসের মতো বেড়ে উঠেছিল সে। স্বপ্ন দেখেছিল ডাক্তার হওয়ার। অত্যন্ত আনন্দের সাথে সেই স্বপ্ন পূরণের পথে তাকে এগিয়ে দিচ্ছিল তার পরিবার। হাই স্কুল গ্রাজুয়েশনের পর পারিবারিকভাবে তার বিয়ে ঠিক করা হয় আরেক অভিজাত পরিবারের এক ছেলের সাথে। এনগেজমেন্টও হয় তাদের। কথা ছিল ইসাবেলা ডাক্তার হয়ে বেরোবার পর তাদের বিয়ে হবে।

কিন্তু হঠাৎ তার জীবনে আসে এক সুদর্শন জাপানি যুবক সেইচি। স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়তে এসেছিল সে। ইসাবেলা তাকে এতটাই ভালবেসে ফেলে যে পরিবারকে লুকিয়ে তার সাথে দেখা করতে থাকে। শুধু ইসাবেলা না, সেইচিও ইসাবেলাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু বেশিদিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয়না। সন্তানসম্ভবা হয়ে যায় ইসাবেলা। নিজেদের ভালবাসার পরিণতি দিতে মরিয়া এই জুটি নিজ নিজ পরিবারকে জানাতে বাধ্য হয়।

কিন্তু যে আশঙ্কায় এতদিন লুকিয়ে রাখা, সেটাই সত্যি হয়। মেনে নেয়না উইলিয়ামসন পরিবার তাদের এই সম্পর্ক। ইসাবেলা তখন মেডিক্যালের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পিতামাতার সাহায্য ছাড়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল ডাক্তারি পড়া তার পক্ষে সম্ভব না। সেটা জানা সত্ত্বেও ভালোবাসার মানুষের জন্য মা, বাবা, স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, সবকিছু ত্যাগ করে ইসাবেলা। বিয়ে করে সেইচিকে। ভালোবাসার কী অনন্য নিদর্শন! তাইনা?”

আগের দিনের মতো হাত পা নাড়িয়ে, অনুভূতির পসরা সাজিয়ে গল্প বলছিল না মায়ূমী। মাঝে মাঝে শুধু দু’হাতে বালু নিয়ে মুঠো করছিল, আর হাত উপরে নিয়ে সেগুলো ঝরঝর করে ছেড়ে দিচ্ছিল। ওর বলা প্রতিটা শব্দ থেকে তাচ্ছিল্য আর বিদ্রুপ যেন ঝরঝরে বালুর মতোই ঝরে পড়ছিল। তারপরেও অনেক গুণ বেশী মনযোগ দিয়ে শুনছিল যিয়াদ। এতটাই ডুবে ছিল যে, মায়ূমী যে ওর উত্তর পাবার উদ্দেশ্যেই প্রশ্নটা করেছে, সেটা বুঝতে সময় লাগল ওর।

“কিছু বলছ না যে?” আবার জিজ্ঞেস করল মায়ূমী।
“পুরোটা না শুনে মন্তব্য করতে চাইনা। বলতে থাকো”

“বেশ!” আবার শুরু করল মায়ূমী। “এদিকে সেইচির পরিবারও ইতিবাচক ভাবে নেয়নি তাদের এ সম্পর্ককে। তারা কোন জাপানি মেয়েকেই ছেলের বউ করতে চেয়েছিল। হয়ত ইসাবেলার পরিবারের মতো কাউকে ঠিক করেও রেখেছিল। স্কলারশিপ স্টুডেন্ট হওয়ায় কাজের সুযোগ এবং উপার্জন সীমিত ছিল সেইচির। অথচ সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়েছিল তার কাঁধে। পরিবার থেকে কোন রকম আর্থিক সাহায্য না পাওয়ায় শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। দিন রাত এক করে, যেখানে সেখানে গোপনে বিভিন্ন প্রকার কাজ করে অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করে সেইচি। পড়াশোনার দিক অক্ষত রেখে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে ইসাবেলাকে ভালো রাখার চেষ্টা করে যায়।

কিন্তু এত কিছু করেও সন্তুষ্ট করতে পারেনা ইসাবেলাকে। ত্যাগের পরাকাষ্ঠা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনা ইসাবেলা। সন্তানকে জন্ম দেয়া পর্যন্ত শুধু অপেক্ষা করে সে। সেইচির ভালোবাসা আর এতদিনের সকল পরিশ্রমকে অপমান করে সে সেইচিকে ত্যাগ করে। সদ্যজাত মেয়েটাকে জন্মের দিনই হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে যায়। একটা নবজাতকের সকল দায়িত্ব তার বাবার ঘাড়ে ফেলে রেখে সে ফিরে যায় নিজের পুরনো জীবনে। সন্তান নাকি নাড়িছেঁড়া ধন। সেই নাড়িছেঁড়া ধনকে যে মা এভাবে ফেলে চলে যেতে পারে, তাকে কুমাতা ছাড়া আর কী বলা যায় যিয়াদ?”

অবরুদ্ধ কান্নার তোড়ে কাঁপছিল মায়ূমীর গলার স্বর। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলে কপোল ভেসে গিয়ে থাকবে। সেটা দেখতে পাচ্ছিলনা যিয়াদ, কারণ আজ চাঁদ ওদের পেছনে। এখন বুঝল যিয়াদ, কেন মায়ূমী এখানে এসেছে। আগুনের উষ্ণতা না, আলো এড়াতে চেয়েছে ও।

যিয়াদকে অবাক করে দিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে গেল মায়ূমী।
“দ্যাটস ইট! আমার গল্প ফুরলো, নটে গাছটি মুড়লো” বলল ও।

“উঁহু! গল্প তো আরও আছে। পরবর্তীতে মেয়েকে নিজের কাছে ফিরিয়ে এনেছিল ইসাবেলা। বর্তমানে মেয়ে তার মায়ের কাছেই থাকে। আমি সেগুলোও শুনতে চাই” মায়ূমী যে ওর মায়ের সাথে থাকে, আর ওর মা একজন নামী ডাক্তার; এই তথ্যও যিয়াদ রুম্মানের কাছে পেয়েছিল।

চমকে ওর দিকে তাকাল মায়ূমী। যিয়াদ ওর সম্পর্কে এতটা জানে, ও ধারণা করেনি।
“আমি আর বলতে চাচ্ছি না” শক্ত মুখে বলল মায়ূমী।

“এটা তুমি করতে পারোনা। তুমি শুধু তার খারাপ অংশটুকু বলবে, ভালোটুকু বলবে না, এটা তো হয়না, মায়ূমী” যথাসম্ভব নরম সুরে বলল যিয়াদ, মায়ূমীর অনুভূতিতে আঘাত করার কোন ইচ্ছে ওর ছিল না।

“ভালো, মাই ফুট!” দাঁতে দাঁত পিষে বলল মায়ূমী, “উদ্ধার করে দিয়েছে একেবারে উনি মেয়েকে ফিরিয়ে এনে! মোটেই সেটা নয়। বরং সেদিন সে একজন স্বামীকে অপমান করেছিল, এবার সে একজন বাবাকে অপমান করেছে। যে বাবা ছয় ছয়টা বছর ধরে বুকে আগলে খেয়ে না খেয়ে মেয়েকে মানুষ করল, তার কাছ থেকে অনায়াসে সে মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিল! এটাকে তোমার ভালোমানুষি মনে হচ্ছে বুঝি!”

“ছিনিয়ে নিলেই হলো? মেয়েটার বাবাই বা দিয়ে দিলেন কেন?” এ অবস্থায় মায়ূমীকে বেশি ঘাঁটাতে চাচ্ছিল না, কিন্তু মুখ ফস্কে প্রশ্নটা বেরিয়েই গেল।
“আজীবনের ভালোমানুষ তো! বড়লোক মায়ের কাছে মেয়ে সুখে থাকবে। আনন্দে আহ্লাদে ভেসে যাবে একেবারে। সেজন্য পাঠিয়ে দিলেন উনি মেয়েকে মায়ের কাছে। কিন্তু ওই ছোট্ট মেয়েটা কী চায়, একবারের জন্যও কেউ ভাবেনি। একবার মা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, তো আরেকবার বাবা। মেয়েটাকে নিয়ে এতই যখন সমস্যা, ওকে এই পৃথিবীতে আনতে কে বলেছিল?” কোনরকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া না করে কান্নামাখা কণ্ঠে উত্তর দিল মায়ূমী।

“আচ্ছা, তারপর কী হলো? ফিরিয়ে আনার পর ইসাবেলা কী করল তার মেয়ের সাথে?”

“দুনিয়ার সমস্ত ঐশ্বর্য এনে ফেলে দিল মেয়েটার পায়ের কাছে। নিজের মস্ত একটা ঘর, তাতে প্রিন্সেসদের মতো সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র, জামাকাপড়, খেলনা; এক কথায় যা কিছুর শখ আহ্লাদ মেয়েটার ছিল, অথচ ওর বাবা সেগুলো দিতে পারেনি, সে সবকিছু ওর মা ওকে এনে দিল। কিন্তু, যার জন্য আজন্ম লালায়িত ছিল ওই ছোট্ট মেয়েটা, মায়ের আদর আর ভালোবাসা, সেটা কিন্তু ইসাবেলা মেয়েকে দিতে পারল না। নিজের পেশেন্ট আর বয়ফ্রেন্ডদের দেয়ার পর তার কাছে মেয়েকে দেয়ার মতো সময়ই থাকত না। ছোট্ট মেয়েটা জন্মের পর শুধু মাকে হারিয়েছিল, এবার সে বাবাকেও হারিয়ে ফেলল। যার জন্য জীবনের সবথেকে আপন দুটো মানুষকে হারিয়ে এ গোটা বিশ্বচরাচরে ও একা হয়ে গেল, তাকে ঘৃণা করাটা কি খুব অন্যায় যিয়াদ?”

এবার সত্যিই ভাষা হারিয়ে ফেলল যিয়াদ। মায়ূমীকে দেবার মতো কোন যুক্তি আর অবশিষ্ট ছিলনা। আসলেই তো! এরকমটা আমার সাথে হলে, আমি কি পারতাম আমার মাকে ক্ষমা করতে? ভাবল যিয়াদ। আরে আমি ওকে কী জাজ করছি, আমি তো আমার বাবার একটা নগন্য অপরাধই ক্ষমা করতে পারিনি। এতগুলো মাস ধরে বাবার সাথে কথা বলিনা শুধু এজন্য যে, উনি আমাকে আমার মতের বিরুদ্ধে বিদেশে পড়তে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমার জীবনযাত্রার পরিবর্তনকে ভুল মানে করেছেন। আমি বিপথে যাচ্ছি ভেবে আমাকে শোধরাত চেয়েছেন। কিন্তু উনার এই বোঝার ভুলের দন্ডই কি আমি উনাকে দিচ্ছিনা? মায়ূমীর আয়নায় নিজেকে দেখে ভেতরে ভেতরে ছোট হয়ে গেল যিয়াদ।

“সো, রুডম্যান! এবার তোমার কী বলার আছে বলো” ভাবনার দুয়ারে করাঘাত করে যিয়াদকে ফিরিয়ে আনল মায়ূমী। কিন্তু কোন জবাব যিয়াদের কাছে ছিলনা।

“আই গেস, ইউ আর আউট অফ ওয়ার্ড। তাহলে আজকের গল্প এখানেই শেষ করি?” কীভাবে যেন আবারও নিজেকে সামলে নিয়েছে মায়ূমী। আগের মতই হালকা স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বলছিল ও।
মাথা নেড়ে সায় দিল যিয়াদ। উঠে দাঁড়াল সাথে সাথেই। মায়ূমীকে একটু একা থাকতে দেয়া উচিত।


পর্ব ১০

“আচ্ছা শোনো, একটা রিকোয়েস্ট করব, কিছু মনে করবেনা তো?” যিয়াদ উঠে দাঁড়ালে ওকে থামাল মায়ূমী।
“কী রিকোয়েস্ট?” একটু অবাক হলো যিয়াদ।
“তুমি এখন রাতের প্রার্থনা করবে, তাই না?”
“হ্যাঁ”

“তার আগে আজান দিবে, প্লিজ? তুমি যদিও সব বেলায় দাওনা। কিন্তু আমি কালকে থেকে একবারও শুনিনি তো, আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে”
বিস্ময়ের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গেল যিয়াদ। মায়ূমীর আজান শুনতে ইচ্ছা করছে, এটা কীভাবে সম্ভব?

“আচ্ছা, তোমার অসুবিধা হলে ঠিক আছে। তুমি এমনিই করে ফেলো প্রার্থনা” যিয়াদকে চুপ থাকতে দেখে বলল মায়ূমী।
“আরে না না, এটা অসুবিধার কিছু হলো নাকি। আমি আসলে… আচ্ছা ছাড়ো”

অজু করে একেবারে নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিল যিয়াদ। তারপর দুহাত কানের কাছে নিয়ে বুলন্দ আওয়াজ দিল, “আল্ল..হু আকবারুল্ল…হু আকবার”

আজান দিতে ভালো লাগে যিয়াদের। যদিও এখানে আসার পূর্বে কখনো আজান দেয়নি ও, দেয়ার প্রয়োজনও হয়নি। ঘটনাটা ঘটেছিল দ্বীপে আসার পরদিন। নারিকেল গাছে ভরা একটা অংশে থাকা অবস্থায় সন্ধ্যা হয়েছিল। নীড়ে ফেরা পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর এক অপূর্ব সূর্যাস্ত ওকে নিয়ে গিয়েছিল ছোটবেলায়। দাদু বাড়িতে গেলে এরকমই গাছপালায় ঘেরা কোন একটা মাঠে কিংবা বাগানে খেলায় ব্যস্ত থাকত সবাই মিলে। সন্ধ্যা নেমে আসছে দেখলেই মন খারাপ হয়ে যেত। সবাই মনে মনে চাইত, সূর্যটা একটু ধীরে ডুবুক, মাগরিবের আজানটা একটু দেরিতে হোক। আরেকটু বেশি যেন খেলা যায়। কারণ আজান শেষ হওয়ার আগেই সবাইকে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে হতো। এটাই ছিল হুকুম।

মুয়াজ্জিনের সুমধুর ধ্বনি খুব মিস করছিল স্মৃতিকাতর যিয়াদ। তখনই হঠাৎ ওর মনে হয়েছিল, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার সুবিশাল জমীনের এই ছোট্ট অংশে কেউ হয়ত কোনদিন আজান দেয়নি। ঘোষণা দেয়নি যে, ‘আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। মুহাম্মদ সল্লল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল’। সাথে সাথে এটাও মনে হয়েছিল, আমিই যদি এ ক্ষুদ্র জমীনের প্রথম সেজদাকারী হই, তাহলে প্রথম আজানদাতা কেন নয়? সেদিন জীবনে প্রথমবারের মতো আজান দিয়েছিল যিয়াদ। অদ্ভুত আবেগে ভরে উঠেছিল ওর মন।

কিন্তু আজকে তার থেকেও বেশি আবেগ কাজ করছিল ওর ভেতরে। একজন অমুসলিমের মনে যে আল্লাহর ডাকের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে!
মায়ূমী সেদিন ভীষণ কৌতুহলী হয়েছিল।

“এটাকে আজান বলে” ওর প্রশ্নের জবাবে বলেছিল যিয়াদ, “আমাদের প্রার্থনা অর্থাৎ সালাত আদায়ের সময় হলে এর মাধ্যমে মানুষকে জানানো হয় যে, সালাতের সময় হয়ে গেছে, তোমরা সবাই মসজিদে এসো।”

“কিন্তু এখানে তো আর কেউ নেই। তুমি আজান দিলে কেন?”
“কেন যেন ইচ্ছে করল। কিন্তু, তোমার কি অসুবিধা হলো? অসুবিধা হলে না হয় এর পর থেকে দূরে গিয়ে দিব।”

“না না” সাথে সাথেই বলে উঠেছিল মায়ূমী, “আমার তো শুনতে বেশ লেগেছে। সুর আর রিদম দুটোই দারুণ। তুমি নামাজ করো, আজান করো, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
এরপর থেকে মাঝেমধ্যে আজান দেয় যিয়াদ। বেশিরভাগ সময় ওয়াক্ত শুরু হওয়ার সাথে সাথে সালাত আদায় করতে পারলে আর ওর ইচ্ছে করলে। ও জানেনা, একা একা সালাত আদায় করার আগে এভাবে আজান দেয়ার কোন বিধিনিষেধ আছে কী না। কিন্তু আল্লাহ অন্তর্যামী। ওর নিয়্যাত আর আবেগ তো আর তাঁর নিকট অজানা নয়।

আজান দেয়ার পর যিয়াদ ভাবল আজকে সালাতে তেলাওয়াতও জোরে জোরে করবে। যার আজান শুনতে ভালো লাগে, কুরআন তেলাওয়াত তো তার কাছে অবশ্যই ভালো লাগবে। কুরআন তেলাওয়াতের হিলিং পাওয়ার মায়ূমীর মনকে শান্ত করবে, ইন শা আল্লাহ।

কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল যিয়াদ। আওয়াজ দিয়ে “আল্ল…হু আকবার” বলে হাত বেঁধে নিল। মনে মনে সানা পাঠ শেষে মাঝারি উঁচু কণ্ঠে শুরু করল তেলাওয়াত। না যিয়াদ অত্যন্ত সুললিত কণ্ঠের অধিকারী, আর না ও কোন অভিজ্ঞ ক্বারী। তারপরেও ওর করা তেলাওয়াত নীরব নিস্তব্ধ রাতে অদ্ভুত এক সুরের ঝংকার তুলছিল। বাতাসের গায়ে চেপে সেটা ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে। কুরআন যে স্বয়ং আল্লাহ পাকের বাণী, সে তার নিজস্ব মু’জেযার দ্বারা সুন্দর। তেলাওয়াতকারীর আবেগ আর ভালোবাসা সেটার মাধুর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।

মায়ূমীর কাছে এ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ নতুন। এমন কিছু ও কোনদিন শোনেনি। এটা তো আজানের থেকেও বেশি সুন্দর। এর আগে কখনো এভাবে জোরে জোরে পড়েনি কেন ও? মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বসে থেকে মায়ূমী ওর সালাত আদায় করা দেখল। এত নিষ্ঠা, এত বিনয়ের সাথে ছেলেটা প্রতিটা উঠাবসা করে, যেন ওর প্রভু সত্যিই ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যতবার দেখে, ততবারই অবাক হয় ও। কিন্তু আজকে মুগ্ধতার পারদ পৌঁছে গিয়েছিল অনন্য উচ্চতায়।

মনযোগ ধরে রাখার জন্য আগুনটা পেছনে রেখে দাঁড়িয়েছিল যিয়াদ। সব নামাজ শেষ করে পেছনে ফিরে চমকে গেল যিয়াদ। ও ভেবেছিল মায়ূমী ঘরে চলে গেছে কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে সেই একই জায়গায় বসে ছিল মায়ূমী। এক অদ্ভুত ঘোরলাগা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিল ওরই দিকে।

“তোমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছি, না? আই এম সো স্যরি। আমি ভেবেছিলাম আজান শুনতে যখন ভালো লেগেছে, হয়তো তেলাওয়াত শুনতেও ভালো লাগবে। এজন্যই জোরে পড়তে গেলাম” কাঁচুমাচু করে বলল যিয়াদ।

“আসলেই ভালো লেগেছে। অবশ্য শুধু ভালো বললে ভুল হবে, অ-সা-ধা-রণ লেগেছে” প্রতিটা অক্ষরে জোর দিয়ে বলল মায়ূমী। “থ্যাংক ইউ সো মাচ! এত এত ধরণের গান শুনেছি আমি জীবনে, কিন্তু বিশ্বাস করো, এরকম সুন্দর কিছু আমি কোনোদিন শুনিনি।”

মুচকি হাসল যিয়াদ। “স্রষ্টার বাণীর সাথে কি আর মানুষের কথার তুলনা হয়! সম্ভবই না!”
“স্রষ্টার বাণী মানে? এটা কি বাইবেলের মতো কিছু?”

“হ্যাঁ। একদম ঠিক বলেছো। আমাদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনের অংশ এগুলো।”
“এগুলোও কি আরবী ভাষায়?” আজানের শব্দগুলো যে আরবী ভাষার, সেটা প্রথমদিনই জেনে নিয়েছিল মায়ূমী।
“হুঁ”

“এগুলোর মিনিং কী, জানো তুমি?” ওইদিনের মতো আজকেও একই প্রশ্ন করল মায়ূমী। সেদিন আজানের প্রতিটা বাক্যের অর্থ বলেছিল যিয়াদ।
“সবগুলোর জানিনা। শুধু সূরা ফাতিহা, মানে যেটা প্রতি রাকাতেই পড়লাম, সেটার অর্থ জানি” উত্তর দিল যিয়াদ।
“আচ্ছা! বলোনা প্লিজ”

বলল যিয়াদ, ভেঙে ভেঙে, সুন্দর করে। মনে মনে ধন্যবাদ দিল ওর প্রিয় বন্ধুকে, যে একদিন এভাবেই ওকে সূরা ফাতিহার অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছিল।
“এভাবেই একটা সূরাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং তাঁর নিকট সরল পথে থাকার প্রার্থনা করা হয়ে যায়” শেষে উপসংহার টানল যিয়াদ।
“আচ্ছা, এই সরল পথটা কি?”

“ওই যে, পরের বাক্যে বলে দেয়া আছে, যারা আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্ত হয়েছেন তাদের পথ। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, এটা আল্লাহ এবং তার বান্দার সরল সম্পর্ক। একদম সোজা, কোন বাঁকজোঁক নেই। বান্দাহ আল্লাহ কে জাস্ট একটা ডাক দিলেই তিনি বলেন, ‘লাব্বাইক, ইয়া ‘আব্দি’; হে বান্দা, আমি হাজির”

“হুম! ইম্প্রেসিভ! আমি না, ধর্ম টর্ম নিয়ে খুব একটা বদারড নই। বাবা মায়ের ধর্ম আলাদা আলাদা, কোনটাই আমাকে খুব একটা টানেনা। ছোটবেলায় মায়ের সাথে চার্চে গেছি। বড় হওয়ার পর আর নিয়ে যেতে পারেনি। সত্যি বলতে, আমি ধার্মিক মানুষদের পছন্দ করিনা। কারণ তারা ধর্মকে নিজেদের খারাপ কাজগুলো আড়াল করার জন্য ব্যবহার করে। তবে আমি এটা বিশ্বাস করি যে, সর্বশক্তিমান কেউ একজন আছেন। আই মিন, আমি নাস্তিক নই”

“আমি নিজে খুব অল্প জানি। তোমার ধারণা হয়তো বদলাতে পারব না আমার স্বল্প জ্ঞান দিয়ে। কিন্তু একটা কথা বলতে পারি, গুটিকতক মানুষকে দিয়ে সকলকে বিচার করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তুমি যদি বলো যে ধার্মিক মানুষ মাত্রই ধর্মকে নিজের খারাপ কাজ আড়াল করতে ব্যবহার করে, তাহলে ধরতে হবে পৃথিবীর সমস্ত ধার্মিক মানুষদের তুমি চেনো। চেনো কি?”
“না, কিন্তু যাদের দেখেছি, তাদের কথা বললাম”

“তাহলে যাদের দেখোনি, তাদের মধ্যে যদি কেউ এরকমটা না করে, তার উপরে তুমি মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ফেলছো না কি?”

“হুমম! যুক্তি আছে তোমার কথায়। আর এমনিতেও তোমাকে দেখে আমার ধারণা বদলে গেছে। আমি এটা আর কখনোই বলব না যে ধার্মিক মাত্রই খারাপ হয়” মুচকি হেসে বলল মায়ূমী।
থমকে গেল যিয়াদ। চিন্তায় পড়ে গেল যেন। কিছুক্ষণ পর বলল, “ধার্মিক শব্দটা অনেক ভারী, মায়ূমী। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা প্রতিটা মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য। শুধু এটার দ্বারা কাউকে ধার্মিক বলা যায়না। তাই দুদিনের পরিচয়ে এত বড় সার্টিফিকেট দিওনা, প্লিজ”। আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল যিয়াদ, মায়ূমীকে বড় করে হাই তুলতে দেখে থেমে গেল। “আই থিংক আমাদের শুয়ে পড়া উচিত” বলল ও।

“হুমম, ইট’স রিয়েলি বিন এ লং ডে। গুড নাইট, যিয়াদ”
“গুড নাইট”

কিছুতেই ঘুম আসছে না যিয়াদের। মায়ূমীর মায়ের আচরণের যুক্তি খুঁজে ফিরছে ওর মন। মেয়েকে ভালো না বাসলে তাকে ফিরিয়ে আনল কেন? অপরাধবোধ থেকে? তাই যদি হয়, তাহলে আনার পরে আবার অবহেলাই বা কেন করল? কিছু একটা মিলছে না যেন।তবে ভাবতে ভাবতেই একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় এল যিয়াদের। এরপর অপেক্ষায় রইল সকাল হওয়ার। মায়ূমীকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাবেনা।

সকালে ঘুম ভেঙে যা দেখল, তাতে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার অবস্থা যিয়াদের। মাথার চুল চুড়ো করে বেঁধে ওর থেকে এক হাত দূরে বসে বালুতে গর্ত করছে মায়ূমী। পাশে গাছের ডাল আর নারিকেল পাতার স্তুপ। খেয়াল করে দেখল, ওইদিন যে ডালপালা আর পাতাগুলো জঙ্গলের ভেতরে গুছিয়ে রেখেছিল, সেগুলো সব বয়ে নিয়ে এসেছে।
“কী করছ তুমি?” চমক কাটলে বলল যিয়াদ।

ওর দিকে ফিরে মিষ্টি একটা হাসি দিল মায়ূমী। বলল, “গুড মর্নিং”
যিয়াদের ভাগ্য ভালো ওর দৃষ্টি নত ছিল। নাহলে ওই হাসির শরে ঘায়েল হবেনা, এমন হৃদয় পৃথিবীতে বিরল।
“গুড মর্নিং” উঠে দাঁড়িয়ে শরীর থেকে বালু ঝাড়ছিল যিয়াদ। “বলছি, এসব কী করছো তুমি?”
“ভায়োলিন বাজাচ্ছি” নির্বিকার কণ্ঠে বলল মায়ূমী।
“কীহ!”

“দেখছো তোমার ঘর বাঁধছি, আবার জিজ্ঞেস করছে” মাথা নাড়িয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল মায়ূমী।
“সেটাই তো! আমার ঘর তুমি বাঁধছো কেন?”
“তো আর কে বাঁধবে?”

প্রশ্ন আর তার উত্তর নিজেদের অজান্তে এমন উদ্ভট হয়ে যাওয়ায় অপ্রস্তুত হয়ে গেল দুজনেই। যিয়াদের কান আর মায়ূমীর গাল, রাঙা হয়ে উঠল সহসা। তবে প্রথমে সামলে নিল মায়ূমীই।
“মানে, ওই অর্থে না…. ইয়ে আমি কালকে তোমাকে বললাম না যে আমি তোমার ঘর বানিয়ে দিব, সেটাই বোঝাতে চেয়েছি… আর কি” হড়বড় করে বলল ও।
“আ…হ্যাঁ, তাইতো। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাকে হেল্প করছি” অস্বস্তির হাসি হেসে নিচু হয়ে একটা কয়লা তুলে নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল যিয়াদ।


পর্ব ১১

“আমি এদিকে আরও দুটো ডাল পুঁততে চাই” খুঁটি হিসেবে চারটা ডাল পোঁতা হলে বলল যিয়াদ।
“কেন?” অবাক হলো মায়ূমী।

“ভেতরের দিকে কিছু শুকনো কাঠ রাখার জন্য। কালকে বিকেলের দিকে আকাশ একবার কালো হয়ে গিয়েছিল খেয়াল করেছিলে? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যে বৃষ্টি হবে। আলহামদুলিল্লাহ, একটু বাদেই সরে গিয়েছিল মেঘটা। কিন্তু ভেবে দেখো, সব কাঠ ভিজে গেলে আমরা আগুন জ্বালাব কীভাবে?”
“ভালো কথা বলেছো তো! আমি তো ভাবিইনি”

এদিকে আজকের আকাশেও যে সূর্যের তেজ কম, একটু পর পরই তিনি নতুন বউয়ের মত মেঘের ঘোমটায় মুখ লোকাচ্ছেন, সেটা ওরা খেয়ালই করলনা।
“কিন্তু আমার মাথায় অন্য বুদ্ধি এসেছে” কথাটা যোগ করল মায়ূমী।
“কী বুদ্ধি?”

“ঘর বড় না করে ওইখানে রাখলে কেমন হয়?” পাহাড়ের গোড়ায় একটা ঈষৎ ঢুকে যাওয়া অংশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল মায়ূমী। এখানে যেদিন ওরা প্রথম ঘরটা বানিয়েছিল, সেদিনই যায়গাটা চোখে পড়েছিল ওদের। মায়ূমী তো একটু আফসোসই করেছিল যে, যায়গাটা আরেকটু গভীর আর উঁচু কেন নয়? তাহলেই রবিনসন ক্রুসোর মতো গুহায় বাস করতে পারত।

সেদিক তাকিয়ে যিয়াদ দেখল মায়ূমী আসলেই বুদ্ধিটা দারুণ দিয়েছে। জায়গাটা মানুষের থাকার মতো না হলেও কাঠ রাখার জন্য একেবারে পার্ফেক্ট। একে তো বৃষ্টির ফোঁটা থেকে বেঁচে যাবে, তার উপর নিচ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে ভেজারও কোন সুযোগ নেই। পাহাড়ের গোড়া থেকে সৈকত ঢালু হয়ে নেমে গেছে সমুদ্রের বুকে।

“গ্রেট আইডিয়া, মায়ূমী” প্রশংসা না করে পারল না যিয়াদ।
ওদের কথা চালাচালির ফাঁকে কখন মন খারাপ করা কালো মেঘের দল এসে মাথার উপর জড়ো হয়ে গেছে, বুঝতেই পারেনি ওরা। দিনের আলো হারিয়ে সাঁঝ নেমে এল মুহূর্তেই।
“যাব্বাবা! বলতে না বলতেই!” হতভম্ব গলায় বলল যিয়াদ।

প্রায় সাথে সাথেই বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল। দু’জনে চট করে ঢুকে গেল মায়ূমীর চালাঘরের তলায়।
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো বালু এত দ্রুত শুঁষে নিচ্ছিল যেন কতকাল ধরে তৃষ্ণার্ত। চালার নিচে বসে সে দৃশ্য দেখতে বেশ মজা লাগছিল। আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ বালু ভিজে গেলে ওই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য আর দেখা গেলনা।

“বিউটিফুল” চুপচাপ বৃষ্টি দেখতে দেখতে একটা সময় বলল মায়ূমী।
মাথা নেড়ে সায় দিল যিয়াদ। তারপর ওর মনে হলো, গতরাত থেকে যে কথাটা বলার জন্য মনটা উসখুস করছে, সেটা বলার এখনই উপযুক্ত সময়।
“মায়ূমী, আমি একটা কথা বলতে চাই” গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল যিয়াদ।

“হ্যাঁ, বলো” মুখ না ঘুরিয়েই বলল মায়ূমী। একটা হাত সামনে বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁতে চাইছে ও। যদিও ওর ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে না। কারণ ওদের চালাঘরটার স্থান নির্বাচন খুবই ভালো হয়েছিল। দুটো বড় গাছের ফাঁকে, সেগুলোর আশ্রয়ে। বৃষ্টি যেহেতু অনেক জোরে হচ্ছেনা, সেহেতু গাছের পাতা গলিয়ে খুব অল্প পানিই নিচে আসছে।
“ইসাবেলার ব্যাপারে আমার একটা থিওরি আছে” বলল যিয়াদ।

“নট ইন্টারেস্টেড” নিরস গলায় বলল মায়ূমী।
“আমার মনে হয় তোমার শোনা উচিত”

“প্লিজ যিয়াদ!” এবার ওর দিকে তাকাল মায়ূমী, “এত সুন্দর পরিবেশটা ওই ফালতু মহিলার কথা বলে স্পয়েল করে দিওনা”

যিয়াদের মনে হলো ওর মুখের উপর কেউ দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এত ভেবে ভেবে কথাটা মাথায় আনল, মায়ূমী একবার শুনবেওনা! ওর অভিব্যক্তি মুখে প্রকাশ পেয়ে গিয়ে থাকবে। কারণ হঠাৎই সুর পাল্টাল মায়ূমী, “আচ্ছা, রাতে শুনব, ওকে?”
কিছু বললনা যিয়াদ, শুধু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সামনের দিকে।

বৃষ্টি যত দ্রুত এসেছিল, তত দ্রুতই ছুটে গেল। এমনকি ওদের চালার ছাদটাও ভালো করে ভেজেনি। আবার কাজে ফিরে গেল ওরা। বাকি দিনটা সে কাজেই পার হয়ে গেল। দুপুরের দিকে বিশ্রাম নেয়ার ফাঁকে যিয়াদ কোকের ক্যানটা কাটার চেষ্টা করল। সেরকম ধারাল কোন পাথর ওরা এখনো পায়নি, তাই ক্যানটা সাধারণ পাথরের কোণায় ঘষে ঘষে কাটতে গিয়ে যিয়াদের কালঘাম ছুটে গেল। ক্যানের এবড়োথেবড়ো অংশে লাগিয়ে বাম হাতের একটা আঙ্গুলও কেটে ফেলল। তবে ঘাম ছুটাল বলেই লাঞ্চে সেদ্ধ ডিম খেতে পেল ওরা। আজকে ডিমের স্বাদও মাছের মতো অমৃতসম লাগল। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিল, মাছ আর ডিম সংগ্রহের জন্য আরেকটু বেশি চেষ্টা করতে হবে।

রাতে খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যখন যিয়াদ কিছু বলল না, তখন মায়ূমী নিজে থেকেই জানতে চাইল, “তুমি সকালে কী যেন একটা বলতে চেয়েছিলে”
“এত ইম্পর্ট্যান্ট কিছু না। বাদ দাও” মায়ূমীর মতই নিরস কণ্ঠে বলল যিয়াদ।
“উঁহু! অবশ্যই ইম্পর্ট্যান্ট। আমি শুনতে না চাওয়ায় তোমার মুখটা দেখার মতো হয়েছিল”
“মোটেই না”
“বলোনা প্লিজ”

“ইচ্ছে করছেনা”
“আচ্ছা বাবা, স্যরি। এবার তো বলো” মিনতির সুরে বলল মায়ূমী।
তবু চুপ করে রইল যিয়াদ। “প্লি..জ” বলল মায়ূমী।

“আচ্ছা, বলছি। তার আগে তোমাকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে”
“উম্ম, ঠিক আছে”
“ইসাবেলা মেয়েকে রেখে পুরনো জীবনে ফিরে গিয়েছিল মানে কি? সে কি ফ্যামিলির দেখে রাখা পাত্রকে বিয়ে করেছিল?”
“নাহ! নিজের মেডিক্যাল ক্যারিয়ারে ফিরে গিয়েছিল। ওই ছেলের ফ্যামিলি আবার ওকে নিত নাকি! ওরাও তো অভিজাত পরিবার ছিল”
“পরবর্তীতে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে সে?”

“না। এত এত বয়ফ্রেন্ড থাকলে বিয়ে করার কী দরকার” বিদ্রুপ করল মায়ূমী।
“অন্তত তোমার মুখে এই কথা মানায় না” না বলে পারলনা যিয়াদ।
“হোয়াট!”
“তুমি নিজেই কি ‘সিংগেল ডেইট কুইন’ হিসেবে পরিচিত নও?”

যিয়াদকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল মায়ূমী। মুহূর্ত খানেক পর চট করে আবার থামিয়েও ফেলল হাসিটা।
“মজার ব্যাপার কি জানো, তুমি যাকে ডিফেন্ড করছো, আমার এই টাইটেলটার জন্য সেই দায়ী। শি ইজ রেসপন্সিবল ফর মাই ড্যাম লাইফ! নো-ওয়ান-এলস” শেষের দুটো বাক্য চিৎকার করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল মায়ূমী। আর সেটা শুনে যিয়াদের মনে হলো, ও যেন নিজের কথা নিজেকেই বিশ্বাস করাতে চাইছে।

“আচ্ছা। তুমি বললে, মেয়েটার বাবা ওকে যেসব কিছু দিতে পারেনি, সেগুলো ওর মা দিয়েছিল” দ্রুত পরের প্রশ্নে চলে গেল যিয়াদ। “এর মানে কি, সেইচি কি তখনও নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব, ইসাবেলা ডাক্তার হয়ে গেল আর…” মাঝপথেই ওকে থামিয়ে দিল মায়ূমী।

“না না, সে ততদিনে নিজের ইউনিভার্সিটিতেই জব পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে আবার বিয়ে করেছিল, একটা সন্তানও চলে এসেছিল নতুন সংসারে। জাস্ট এক সন্তানের বাবা সে আর ছিলনা”
“দ্যাট সামস ইট আপ” তুড়ি বাজিয়ে বলল যিয়াদ।
“কী?” বিস্ময়ের সুর মায়ূমীর কণ্ঠে।

“দেখো, প্রতিটা ঘটনার কয়েকটা করে দিক থাকে। আমরা শুধু সেই দিকটাই বিশ্বাস করি, যেটা আমরা নিজেরা বিশ্বাস করতে চাই, নিজেদের দেখা অনুযায়ী। তুমি যেটা বলেছো, সেটা তোমার এবং সম্ভবত সেইচির দিক থেকে। কিন্তু ইসাবেলার পার্সপেক্টিভ এখানে পুরোপুরি মিসিং, অথচ গল্পটা তার। এ কাজগুলো করার পেছনে তার অবশ্যই কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকবে। কেননা একমাত্র পাগলই উদ্দেশ্য ছাড়া কাজ করে। তাই আমি ইসাবেলার দিক থেকে একটু ভাবার চেষ্টা করেছি। মন দিয়ে শুনবে আর শেষ করার আগে কিচ্ছু বলবেনা, ওকে?”

“আচ্ছা! ফাইন” বিদ্রুপাত্মক স্বরে বলল মায়ূমী।

“তুমি বলেছো, ইসাবেলা সেইচির সংসারে যখন আসে, সেইচি অনেক কষ্টে উপার্জন করছিল। তার অনেকগুলো সোর্স সম্ভবত লিগ্যালও ছিলনা। আমি নিজে স্কলারশিপ স্টুডেন্ট তো, পার্সোনাল নলেজ থেকে বলছি। আর এ ঘটনা তো আরও কতগুলো বছর আগের। তখন স্টুডেন্টদের জন্য সুযোগ সুবিধা কেমন ছিল, আমি বলতে পারছি না। কিন্তু সেইচি যদি একবার ধরা পড়ত, ওর তো বটেই, ইসাবেলা আর ওর মেয়ের ভবিষ্যতও নষ্ট হয়ে যেত। সেজন্য অনেক ভেবেচিন্তে ইসাবেলা এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।

আর ওই অবস্থায় ভাবার জন্য সে পর্যাপ্ত সময়ও পেয়েছিল। ও সেইচির ভালোবাসাকে অপমান করার উদ্দেশ্যে ওকে ছাড়েনি, বরং ওকে ভালোবাসত বলেই ছেড়েছে। ওভাবে তাকিওনা প্লিজ, আমাকে আগে শেষ করতে দাও। হ্যাঁ, নিজের স্বপ্ন আর ক্যারিয়ারের দিকটাও হয়ত ছিল। তাকে খুব বেশি দোষ কিন্তু দেয়া যায়না। আজন্ম লালিত একটা স্বপ্ন এভাবে চুরচুর করে ভেঙে যাওয়ার কষ্ট সহ্য করাটা কঠিন। নিজেকে দিয়ে বিচার করো। ভালোবাসার মানুষের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে হলে তুমিই কি পারতে?”

“ওইসব বুলশিট ভালোবাসা আমার কোনদিন হবেওনা” ভেংচি কাটল মায়ূমী।

“এত নিশ্চিতভাবে বলোনা। কেউ যখন এভাবে কোন কথা বলে, আল্লাহ তখন সেই পরিস্থিতিতে ফেলে তাকে পরীক্ষা করেন। আর ভবিষ্যৎ সর্বদাই অনিশ্চিত”
“আচ্ছা! তোমার থিওরি যদি মেনেও নিই, তাহলে সেইচিকে ত্যাগ করল, কিন্তু মেয়েকেও কেন? একটুও কি কষ্ট হয়নি?”

“কষ্ট যে হয়নি, তাই বা তুমি কীভাবে জানো? এমনও তো হতে পারে, ইসাবেলার পরিবার ওকে মেয়েসমেত ফিরিয়ে নিতে চায়নি”
এ কথায় যেন একটু দমে গেল মায়ূমী। কিন্তু মুখ খুলল পরক্ষণেই।
“থিওরি শেষ তোমার?”

“না, আরেকটু আছে। যেহেতু সে স্বেচ্ছায় মেয়েকে ত্যাগ করেনি, স্বনির্ভর হওয়ার পর সে মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। দেখো, মেয়ের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে এতগুলো বছর পর নিজের ঝুটঝামেলা বিহীন স্বাধীন জীবনে সে যেচে কেন মেয়েকে নিয়ে আসবে? তার উপর মেয়ে তো অন্য কোথাও না, তার বাবার কাছেই ছিল। হ্যাঁ, এরপরের অংশটা আমার কাছে একটু অপরিস্কার। মেয়ের প্রতি ইসাবেলার ব্যবহার। তবে এটা হতেই পারে যে, এতগুলো বছরের দুরত্ব আর মেয়ের প্রতি করা অন্যায়ের অপরাধবোধ একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছিল।

সেই দেয়াল সে চাইলেও ডিঙাতে পারছিল না। মেয়ের মতো মাও হয়ত মনের কথা সহজে মুখে আনতে পারত না। নিজের কষ্টগুলো নিজের ভেতরে খুব সুন্দর করে লুকিয়ে রাখতে পারত!”
এবার আর সাথে সাথে পালটা জবাব দিল না মায়ূমী। খানিকটা সময় পেরিয়ে গেল নীরবে। ও যেন চুপচাপ যিয়াদের কথাগুলো মেপে নিচ্ছিল।

“থ্যাংকস রুডম্যান! থিওরি খুব ভালো ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে তোমার থিওরি যাচাই করার আর কোন উপায় নেই” অনুভূতিহীন স্বরে বলল মায়ূমী।
“কেন? আমি বিশ্বাস করি, মেয়েটা যদি একটা ধাপ এগোয়, মাকে একবার সাহস করে জিজ্ঞেস করে, তাহলেই সবটা পরিস্কার হয়ে যাবে”
“আচ্ছা! তা কীভাবে জিজ্ঞেস করবে সে? টেলিপ্যাথি দিয়ে?”

বাস্তবতা যেন সপাটে আঘাত করল যিয়াদকে। মাঝসমূদ্রের একটা ছোট্ট দ্বীপে বসে এই দুখী মেয়েটাকে ও এমন একটা সমাধান দিচ্ছে, যেটা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কষ্ট কমানোর বদলে যা শুধু বাড়াবেই। এতগুলো দিন হয়ে গেল। না কোন হেলিকপ্টার, আর না অন্য কিছু। দিনে দিনে কি ও নিজেও মুক্তির আশা হারিয়ে ফেলছে না?

যিয়াদের নীরবতা স্পর্শ করল মায়ূমীকে। “দেখেছো, এজন্যই বলেছিলাম কোন থিওরিতে আমার ইন্টারেস্ট নেই। বাট… আমি কৃতজ্ঞ। সত্যি!”
ওর দিকে চকিতে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি করল যিয়াদ।

“একজন খুব ভালো বন্ধুর মতো এতকিছু ভেবেছো, সেজন্য। সো…. ফ্রেন্ডস?” ডান হাত বাড়িয়ে দিল মায়ূমী।
“উম্ম, স্যরি” নিজের ডান হাত বুকে ঠেকাল যিয়াদ, “আমার ধর্ম বলে, ছেলে আর মেয়ে হ্যান্ডশেক করতে পারেনা, আর বন্ধুও হতে পারেনা”
“দ্যাটস অড” হাত সরিয়ে নিল মায়ূমী।

“কিন্তু….. আমার ছোট বোন তোমার সমবয়সী হবে। আমি অনায়াসে তোমার ভাই হতে পারি” হাসিমুখে বলল যিয়াদ।
“নো, থ্যাংকস! ওসব ভাই টাই লাগবেনা আমার। আই হ্যাভ এনাফ ব্রাদারস এন্ড আই হেইট দেম” কঠিন স্বরে বলল মায়ূমী।
“সৎ ভাই, রাইট? ওদের ঘৃণা করো কেন?”

“ওরাও তো একটা কারণ, আমার বাবার সাথে আলাদা হওয়ার” বিনা নোটিশে উঠে দাঁড়াল মায়ূমী। কোন একটা গানের সুর গুনগুন করে ভাঁজতে ভাঁজতে এগিয়ে গেল সমুদ্রের দিকে। দুহাত পেছনে রেখে হাঁটতে লাগল জল ছুঁইছুঁই বেলাভুমিতে।

কখনো কখনো পৃথিবীর সমস্ত ডিকশনারির হাজারো শব্দ নিরর্থক হয়ে যায়। কথারা একটা যায়গায় এসে ফুরিয়ে যায়, আর কিছুই বলার থাকেনা। মানুষ এরকম অবস্থায় খুব কমই পড়ে। আজ সেরকম কিছুই মনে হচ্ছিল যিয়াদের। কী বলবে ও এই মেয়েকে? বলবে, ওর ভাইদের কোন দোষ নেই। কী লাভ বলে?

আর তার থেকেও বড় কথা, ও এত ভাবছে কেন? মায়ূমীর কষ্ট লেগেছিল, ও প্রাণ খুলে কেঁদে নিয়েছে। ওকে কে দিব্যি দিয়েছে মায়ূমীর মন ভালো করার? রাতদিন ভেবে ভেবে ওর মায়ের সপক্ষে কথা বলার? হোয়াট আর ইউ ডুয়িং, যিয়াদ? কাম টু ইয়োর সেন্সেস! নিজেকে শাঁসাল যিয়াদ।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীতে হাজার হাজার প্রাণী, প্রত্যেকের মন আর মাথা একত্রে কাজ করে। কেবল মানুষই এর ব্যতিক্রম। যার মন এক কথা বললে, মাথা বলে আরেক। এই যেমন এখন যিয়াদের কান শুনছে মায়ূমীর বিষাদের সুর, মন বলছে, ‘ইউ শুড ডু সামথিং’ আর মাথা বলছে, ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ একশো মাইল দূরে থাকো’।

তবে বুদ্ধিমান সে, যে মনের নয়, মাথার কথা শুনে। কারণ শয়তান মন তথা নফসকে খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করল যিয়াদ। মায়ূমীর চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে এশার সালাতের প্রস্তুতি নিল।


পর্ব ১২

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীতে হাজার হাজার প্রাণী, প্রত্যেকের মন আর মাথা একত্রে কাজ করে। কেবল মানুষই এর ব্যতিক্রম। যার মন এক কথা বললে, মাথা বলে আরেক। এই যেমন এখন যিয়াদের কান শুনছে মায়ূমীর বিষাদের সুর, মন বলছে, ‘ইউ শুড ডু সামথিং’ আর মাথা বলছে, ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ একশো মাইল দূরে থাকো’।
তবে বুদ্ধিমান সে, যে মনের নয়, মাথার কথা শুনে। কারণ শয়তান মন তথা নফসকে খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারে। বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করল যিয়াদ। মায়ূমীর চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে এশার সালাতের প্রস্তুতি নিল।

পরদিন।
ফজরের সালাত আদায় করার পর অলসতাকে প্রশ্রয় না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল যিয়াদ। ভাটার শেষ সময় চলছে। বুকের একটু নিচে দুহাত বেঁধে পীপিলিকার গতিতে হেঁটে সুপ্রশস্ত সৈকত পেরিয়ে চলে এলো পানির কাছে। ছোট ছোট ঢেউগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। জোয়ার শুরু হতে কিছুটা সময় বাকি আছে। পায়ের নিচে সদ্য পানি নেমে যাওয়া ঠান্ডা বালু সারা শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রকে হাতের বামে রেখে একই গতিতে আবার হাঁটতে শুরু করল যিয়াদ। ভোরের আধো আলো-আঁধারিতে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন পৌঁছে গেল মায়ূমীর প্রিয় জায়গাটাতে। নারিকেল গাছটার উপরে পা ঝুলিয়ে বসে গেল ও। ততক্ষণে আকাশ সাদাটে হয়ে এসেছে, সূর্য উঠি উঠি করছে।

পরবর্তী মুহূর্তগুলোতে বিমুগ্ধ নয়নে বিশুদ্ধ প্রকৃতির আশ্চর্য রূপবদল দেখল যিয়াদ। সাদাটে নীল আকাশকে ঝকঝকে নীলচে সোনালি বর্ণ ধারণ করতে দেখল। অন্ধকার পাহাড়ের পেছন থেকে সূয্যিমামার আলো নিয়ে আসা দেখল। সেই আলো কুচি কুচি হয়ে হয়ে সাগরের বুকে ছড়িয়ে পড়তে দেখল। জোয়ার শুরু হলে অবতারণা হলো আরেক দৃশ্যের। এ সমুদ্রতট, বালুকাবেলা, যেন সমুদ্রের সম্পত্তি। কয়েক ঘন্টার জন্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে প্রবল বিক্রমে সে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তীরে। একেকটা আগ্রাসী ঢেউয়ের আক্রমণে ফিরিয়ে নিচ্ছে ইঞ্চি ইঞ্চি জমি।

তারপর সূর্যের তেজ বাড়তে বাড়তে যখন আর গায়ে জ্যাকেট রাখা সম্ভব হলোনা, তখন পেটে ছুঁচোর অস্তিত্ব অনুভব করল যিয়াদ। একইসাথে ফেরার কথাও মনে হলো। এক ছড়া কলা দিয়ে পেটের ছুঁচোগুলোকে শান্ত করে দ্রুত পায়ে ফিরতি পথ ধরল ও।

ক্যাম্পে ওর জন্য একটা বড়সড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। অগ্নিকুন্ডের পাশে বালুর উপর বড় বড় অক্ষরে একটা লেখা, ‘একা থাকতে চাই। প্লিজ আমাকে খুঁজবে না’। হতভম্ব হয়ে লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইল যিয়াদ। মেসেজ রেখে যাওয়ার এই অভিনব পন্থা দেখে চমৎকৃত হলো। মাথায় একটা দুশ্চিন্তা আসি আসি করছিল, সেটাকে আপাতত ঝেঁটিয়ে বিদায় করল। এই দিনের বেলা নিরীহ জঙ্গলে আর কীসের ভয়? কোন হিংস্র জন্তু থাকলে এতদিনে ওরা ঠিক দেখা পেয়ে যেত।

কিন্তু আগেরবার তো নারিকেল গাছটার কাছে গিয়েছিল, এখন কোথায় গেল? আমি তো ওখান থেকেই আসলাম! হতবুদ্ধি হয়ে মাথার চুলে হাত চালাল যিয়াদ। কী করা উচিত, বুঝতে পারছে না। আচ্ছা, আজকের দিনটা দেখি অন্তত, সিদ্ধান্ত নিল ও।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, আগেরবার ওর ভেতরে যে অপরাধবোধটা কাজ করছিল, এবার আর সেটা করছে না। বরং একটা স্বাধীন স্বাধীন অনুভূতি হচ্ছে। তাই স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করতে এতদিন যে কাজটা ইচ্ছে থাকা সত্বেও করতে পারেনি, সেটাই করে ফেলল। উপরের জামাকাপড় খুলে বালুতে ফেলতে ফেলতে দৌড় দিল সাগরপানে। বেশি গভীরে গেলনা। মৃত্যুর একেবারে দোরগোড়া থেকে ফিরে আসায় ভেতরে একটা হালকা ভীতি কাজ করছে। ওইদিন জ্ঞান হারানোর আগের স্মৃতি বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। তারপরেও সময়-জ্ঞান ভুলে প্রায় দুপুর পর্যন্ত বুক সমান পানিতে আঁশ মিটিয়ে লাফালাফি, দাপাদাপি করল।

প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছিল। কোন ঝামেলায় না গিয়ে কলা আর ছটকন দিয়ে লাঞ্চ সেরে ফেলল। অবশেষে ফলগুলো মনে ধরেছে যিয়াদের। কারণ পাকতে শুরু করেছে ফলগুলো। আর পাকার পর রসালো, মিষ্টি আর সুস্বাদু একটা ফলে পরিণত হয়েছে। এই ফল খেলে এখন পানিও কম খেতে হচ্ছে। পানি! পানি আনা হয়নি কালকে রাত থেকে, হঠাৎ মনে পড়ল যিয়াদের। একটা বোতল মায়ূমী নিয়ে গেছে, খেয়াল করল ও।

খাওয়া আর সালাত আদায় করার পর পানি আর কাঠ নিয়ে আসতে জঙ্গলে ঢুকল যিয়াদ। এক গাদা শুকনো ডালপালা আর পানিভর্তি বোতলগুলো নিয়ে যখন ফিরে এলো, শরীরে আর কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। একটু পানি গলায় ঢেলে কোনমতে নিজের চালাঘরে ঢুকে ধপাস করে শুয়ে পড়ল আর বুঝে ওঠার আগেই পাড়ি জমাল ঘুমের দেশে।
ঘুম ভাঙতেই মনটা ভালো হয়ে গেল যিয়াদের। মায়ূমীর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে।

“ওই যে দেখছিস ছেলেটা, ওর আশেপাশে যাবিনা। এমনিতে ভালোই, খালি একটু ছোঁয়াবাতিক আছে। তুইও ওকে ছুঁতে টুঁতে যাসনা। আসলে যতই ভালো হোক, মানুষ তো! বহুতদিন মাংস-টাংস খেতে পায়নি, তোকে ধরে খপ করে খেয়ে ফেলতেই পারে! সবাই তো আর আমার মতো নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনা, তাইনা?” দুশ্চিন্তার পাহাড় মাথায় যে আসলে ছিল, সেটা সরে যাওয়ার পর বোঝা গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যিয়াদ। সাথে সাথেই আবার ভ্রু কোঁচকাল, এসব কী বলছে মেয়েটা?

আবার শোনা গেল, “আরে এমন করছিস কেন, কথা শোন সোনা। বুঝতে পারছি, তোকে এই বিপদের মধ্যে আনা উচিত হয়নি। কিন্তু তুই একদম চিন্তা করিস না, আমি থাকতে ওই ছোঁয়াবাতিক তোর কিচ্ছু করতে পারবে না” আধো আধো নিচু স্বরে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল মায়ূমী। শোয়া থেকে নিজে না উঠে সন্তর্পণে শুধু মাথাটা ঈষৎ উঁচু করল যিয়াদ। তেরছা করে চাইল শব্দের উৎসপানে। শেষ বিকেলের কমলা আলোয় দেখা গেল মায়ূমীকে। আগুনের উল্টোপাশে নিজের চালার সামনে বসে ছিল ও। আগুনের শিখার ফাঁকফোঁকর দিয়ে যেটুকু বোঝা গেল, তাতে ওর কোলে একটা খরগোশ। ওইটার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতেই এই বয়ান চলছে।

প্রচন্ড হাসি পাচ্ছিল ওর। তাও নিজেকে সংযত করে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে বসল যিয়াদ। চমকে ওর দিকে তাকাল মায়ূমী। হাই হ্যালো বিনিময় শেষ হলে প্রশ্ন করল যিয়াদ,“তারপর, সলো অভিযান কেমন হলো?”

“জোস!” রাজ্যের হাসিতে চোখমুখ ভাসিয়ে উত্তর দিল মায়ূমী, “এই দেখো, কাকে পেয়েছি” খরগোশটা দুহাত দিয়ে উপরে তুলে দেখাল মায়ূমী। সাদা আর বাদামী পশমের খরগোশটাকে দেখেই চিনে ফেলল যিয়াদ। লাল টুকটুকে চোখ দুটোর দিকে তাকাল ও। ডান হাত উঁচু করে নেড়ে হাসিমুখে বলল,“আরে, পীপসোনা দেখি। আসসালামু আলাইকুম”

লাফ দিয়ে মায়ূমীর কোল থেকে নামল পীপ। অগ্নিকুণ্ড ঘুরে চলে এলো যিয়াদের দিকে। একটু দূরে অবশ্য থেমেও গেল। যেন ভেবে দেখছে, এক ডাকেই এভাবে চলে আসা ঠিক হলো কিনা। দুহাত বাড়িয়ে ইশারায় কাছে ডাকল যিয়াদ। চোখে চোখ রেখে কয়েকটা মুহূর্ত পার করে দুই লাফে চলে এল যিয়াদের কোলে।

“শালা বিশ্বাসঘাতক!” বিড়বিড় করে মায়ূমী যে গালিটা দিল, তার ভদ্র অনুবাদ করলে এটাই হয়।
সেটা শুনে ফ্যাক করে হেসে ফেলল যিয়াদ। পীপের গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“পীপসোনা, তুমি এখন একটু অপেক্ষা করো। আমি আসরের নামাজ পড়ে আসি। আর ওই যে মেয়েটা, ওর সব কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই” মায়ূমীর দিকে চকিত নজর দিয়ে বাংলায় বলল যিয়াদ।
“হেই! হেই! তুমি আমার নামে বাংলায় কী বলছ ওকে?” চোখ সরু করে বলল মায়ূমী।

“যা খুশি। অন্তত কারও নামে ওর কানে বিষ ঢালছি না” কাঁধ নাচাল যিয়াদ।
“মিথ্যুক!” মুখ বাঁকাল মায়ূমী।

“ওহো, তোমাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি” ডিনারের সময় হঠাৎ বলে উঠল মায়ূমী।
“কী কথা?”

“ওইদিকে না, জুকিনির ঝোপগুলো পেরিয়ে আরও সামনে, একটা দারুণ জায়গা আছে। এত সুন্দর তোমাকে কী বলব! স্বর্গ মনে হচ্ছিল রুডম্যান, স্বর্গ! যদি আমার সাপখোপের ভয় না থাকত না, সিরিয়াসলি আমি ওইখানেই থেকে যেতাম। আর গোসল করার জন্যেও জায়গাটা জাস্ট ফাটাফাটি। আমি আজকে ইচ্ছামত গোসল করেছি। তুমি কালকে যেও, জাস্ট পাগল হয়ে যাবে”
“আচ্ছা!” মায়ূমীর বর্ণনা শুনে অবশ্য যিয়াদের ইচ্ছে করছিল, এখনি দৌড় দেয়।

“হ্যাঁ, গোসল সেরে যখন জামা কাপড় শুকোচ্ছিলাম, তখনই তো পীপকে পেয়ে গেলাম।”

পীপের বর্তমান আশ্রয় হয়েছে মায়ূমীর সোয়েটারের ভেতর। আগুনের পাশে শুধু মুখটা বের করে আদুরে ভঙ্গিতে ঘুমোচ্ছেন তিনি। সেদিকে তাকিয়ে ভালো লাগল যিয়াদের। এই অদ্ভুত অস্বস্তিকর জীবনে অবশেষে একটা স্বস্তিকর কিছুর দেখা পাওয়া গেছে, ভাবল ও।

তবে স্বস্তি বড্ড ক্ষণস্থায়ী ছিল। সকালে দেখা গেল, পীপসোনা নিজ আলয়ে ফিরে গেছেন। আশপাশে চিরুনি তল্লাশী করেও ওকে খুঁজে পেলনা মায়ূমী। ডাকতে ডাকতে গলা ভেঙে ফেলার উপক্রম। চোখমুখ অন্ধকার করে আগুনের পাশে বসে পড়ল ও। বসে বসে আগুনের ভেতর একটা একটা করে পাতা ফেলতে লাগল। প্রতিটা পাতায় ভস করে আগুন ধরে যাচ্ছিল। একটা পাতা পুড়ে পুরোপুরি ছাই হয়ে গেলে আরেকটা পাতা ফেলছিল একইভাবে। ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না, যাকে ও এত কষ্ট করে, এতদূর থেকে, এত ভালোবেসে নিয়ে এল, সে এভাবে ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারে! গত এক ঘন্টায় কথাটা অন্তত দশবার বলে ফেলেছে মায়ূমী।

“এত মন খারাপ হলে, আবার যাও গিয়ে নিয়ে এসো” শেষমেশ বলতে বাধ্য হলো যিয়াদ, “কথায় আছে, একবার না পারিলে দেখো শতবার”
“নাহ! থাক” একই রকম বিষন্ন মুখে বলল মায়ূমী।

“এমনও তো হতে পারে, ব্যাটা নিজের কর্মস্থলে গেছে। সন্ধ্যা হলে ঠিক ফিরে আসবে”
“কীহ! কর্মস্থলে গেছে! ইয়ার্কি মারছো আমার সাথে?” সরু চোখে বলল মায়ূমী।

“ইয়ার্কি মারতে যাব কেন? খরগোশ বলে কি সে মানুষ না? ওর কাজকর্ম থাকতে পারেনা?” সিরিয়াস কণ্ঠে বলল যিয়াদ, পরমুহূর্তেই “আউচ!” করে উঠল।

একটা বড়সড় ছটকন তুলে ওর দিকে ছুঁড়ে মেরেছে মায়ূমী। কনুইয়ের নিচে এসে লেগেছে সেটা। জ্যাকেট খুলে রেখে নারিকেলের ছাল ছাড়াচ্ছিল যিয়াদ। পাকা ফলটা ফেটে গিয়ে রস চুইয়ে পড়ল ওর অনাবৃত হাত বেয়ে।

“খরগোশ মানুষ, তাইনা?” হাসতে হাসতে বলল মায়ূমী। ত্রস্ত হাতে রসটা মুছতে মুছতে চকিতে ওর দিকে তাকিয়ে দেখল যিয়াদ, চোখমুখের অন্ধকার দূর হয়েছে।
“কিন্তু যদি না আসে?” মুহূর্তেই আবার মুখের হাসি নিভে গেল মায়ূমীর।

কীরে ভাই, এর নার্ভাস সিস্টেমে স্যুইচ টাইপ কিছু আছে নাকি। এই জ্বলে উঠে তো এই নিভে! হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে মনে মনে বলল যিয়াদ। ওর ভাবনার সত্যতা প্রমাণ করতেই যেন খানিকবাদে দুচোখে নতুন উৎসাহ ঝিলিক দিয়ে উঠল মায়ূমীর।

বলে উঠল ও, “সেই আসার দিন থেকে পাহাড়টা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পীপ যেমন আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে চলে গেছে, আমি তেমনটা করতে চাইনা। আমি আজকেই পাহাড়ে চড়ব” ঘোষণা দেয়ার সুরে শেষ বাক্যটা বলে উঠে দাঁড়াল মায়ূমী।
“ব্যস! হয়ে গেল!” বিড়বিড় করল যিয়াদ।


পর্ব ১৩

মায়ূমীর কথামতো জুকিনির ঝোপ পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেল যিয়াদ। পাহাড়ে ওঠার পাগলামি থেকে আজকের মতো নিরস্ত করা গেছে মায়ূমীকে। গতকাল জঙ্গলের ভেতর কোথায় যেন পায়ে বড়সড় কাঁটা ফুটেছিল, এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। আর এই পা নিয়ে নাকি তিনি পাহাড়ে চড়বেন! এটা বলাতে দমেছে সে। নিজেও হয়ত বুঝেছে যে এই পা-কে একটু রেস্ট দেয়াই উত্তম।

যিয়াদ বেরিয়েছে মায়ূমীর স্বর্গ দর্শন করতে। ফেরার সময় খাবার নিয়ে ফিরবে। কাঁধে মায়ূমীর হোবো ব্যাগ আর হাতে ওর নিজের তৈরি মাছ ধরার বর্শা। আজ সকালেই বানিয়েছে জিনিসটা। একটা সরু অথচ মজবুত ডালের মাথা ফাটিয়ে বহু কসরত করে একটা ছোট চোখা পাথর আটকিয়েছে। দেখতে অনেকটা বর্শার মতো হওয়ায় মনে মনে এটাকে বর্শাই বলছে।

ডালে ডালে পাখির কূজন আর পায়ের নিচে শুকনো পাতা ভাঙার মচমচ শব্দ। সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে যিয়াদের। গহীন জঙ্গলে অভিযানে বেরোনো কোন এক অভিযাত্রীর মতো লাগছে নিজেকে। মায়ূমীর পায়ে কাঁটা ফোটায় নিজেও একটু দেখেশুনে হাঁটছে। এখানে ও যদি কোন জিনিসের অভাব সবথেকে বেশি অনুভব করে থাকে তো সেটা জুতো। পায়ের নিচে ধুলোবালির ব্যাপারে ও ছোট থেকেই একটু বেশি খুঁতখুঁতে।

জুতো-স্যান্ডেল ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারে না। সেই ওকে এখন কীসের কীসের উপরেই না খালি পায়ে চলতে হচ্ছে। মানুষের জীবনে পারিনা, পারব না বলে কিছু হয়না। কখন কোন পরিস্থিতিতে কাকে কী করতে হতে পারে, কেও কল্পনাও করতে পারেনা। আল্লাহ যেন ওকে সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।

মায়ূমী রবিনসন ক্রুসোর কথা মনে করে যখন বিভিন্ন জিনিস বানানোর কথা বলে, যিয়াদও তখন ভাবে, কোনোভাবে কি পায়ে দেয়ার কিছু বানানো যায়না? এটা অবশ্য কখনো মায়ূমীর সামনে প্রকাশ করেনি। বলা যায়না, যে পাগল মেয়ে, হয়ত জুতো তৈরির মিশনে নেমে যেতে পারে!

হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে নারিকেল আর কলা গাছের পরিমাণ যেন কমে আসছে বলে মনে হলো। খানিক বাদে যেন একেবারেই অন্য কোথাও চলে এলো যিয়াদ, দৃষ্টিসীমায় আর একটাও কলা কিংবা নারিকেল গাছ নেই। এরকমটা এই দ্বীপে আর কোথাও দেখেনি ওরা। হঠাৎই একটা বড় বাঁক নিল নালাটা। বাঁকটা ঘুরতেই থমকে দাঁড়াল ও।

সত্যিই, কিছুমাত্র বাড়িয়ে বলেনি মায়ূমী। হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী জান্নাত এমন যে, কোন চোখ কখনো দেখেনি, কোন কান কখনো শোনেনি এবং কোন মানব হৃদয় কখনো কল্পনাও করতে পারবেনা। কিন্তু অবুঝ মানুষ নিজের কল্পনার সীমা দ্বারা জান্নাতের বাগান হিসেবে যেরকম অপার্থিব সুন্দর সুন্দর জায়গার কল্পনা করে থাকে, সেরকমই একটা জায়গা ছিল এটা।

ও দাঁড়িয়ে আছে একটা বড়সড় গোলাকার জলাশয়ের সামনে। জলধারাটা এসে মিলেছে এপাশে। আর ঠিক বিপরীত পাশ দিয়ে আবার সরু হয়ে বেরিয়ে গেছে। যিয়াদের ধারণা, সেটাই গিয়ে মিলিত হয়েছে মোহনায়। জলাশয় ঘিরে আছে শত শত রঙবেরঙের ফুল। ছোট-বড়, চেনা-অচেনা, এত রঙের এত ফুল যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।

কৃত্রিম সকলপ্রকার কোলাহল থেকে দূরে এই দ্বীপে নীরবতা কিংবা শান্তির কোন অভাব নেই। কিন্তু সৈকতে তবু সাগরের গর্জন ছিল। এখানে তাও নেই। অদ্ভুত প্রশান্তিদায়ক একটা নীরবতা বিরাজ করছে। মাঝে মাঝে কোন পাখির ডাক বা ভ্রমরের গুঞ্জন, এই নীরবতার মাধুর্য নষ্ট না করে উল্টো বাড়িয়ে দিচ্ছে। বড় বড় গাছের ছায়া আর পাতার ফাঁক দিয়ে আসা দুপুরের রোদটাও যেন এখানে বড্ড নরম। পীপের তুলতুলে শরীরের মতো আদুরে। সেই নরম রোদ আবার ছায়ার সাথে মিতালি করে জলের উপরে কারুকার্যময় আল্পনা এঁকেছে।

আর ‘মাতাল করা ফুলের ঘ্রাণ’ কথাটা এতদিন শুধু শুনেছে যিয়াদ, কিন্তু আজ অনুভব করতে পারছে এর মর্মার্থ। এই এত এত ফুলের সুগন্ধে যেন সত্যিই ও মাতাল হয়ে যাবে। মোহাবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েই রইলো যিয়াদ। সামান্য নড়াচড়া করেও এই নীরবতা, এই শান্তি, নষ্ট করতে ইচ্ছে করছেনা।

কিন্তু মায়ূমীর কথা ঠিক। ওই টলটলে জল যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে ওকে। নালার পানি দিয়ে এতদিন যেভাবে গোসল করেছে, সেটাতে অন্তত ডুব দেয়ার মজা তো ছিলনা। তাও নিজেকে সামলাল যিয়াদ। গতকাল সাগরে দাপাদাপি করার কারণেই সামলাতে পারল, নাহলে পারত না। গোসল ছেড়ে ওর মাথায় এল অন্য ভাবনা। যদি এখানে অন্য ধরণের গাছপালা থাকে, তাহলে খাবার মতো অন্য কিছু খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। আশপাশটা ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিল ও।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ওর ধারণা একেবারে মিলে গেল। আরও একবার মনে হলো, এ জায়গাটা স্বর্গ বলে সত্যিই ভূল বলেনি মায়ূমী। কারণ খাবারের প্রাচুর্য ছাড়া স্বর্গ আবার স্বর্গ কীসের? প্রথমে পেল একটা চেরী টমেটোর ঝোপ। সেটা দেখেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল যিয়াদ। সবুজের মাঝে সারি সারি লাল টুকটুকে গোলাপজাম আকৃতির বলগুলো জিভে জল আনল। একটা ছিঁড়ে গোটাটাই মুখে পুরে ফেলল ও।

দাঁতের নিচে চাপা পড়তেই রসালো পাকা টমেটোর স্বাদের আবেশে দুচোখ বুজে এল। এখানে খাওয়া অন্য সব কিছুর মতো এবারেও মনে হলো, এর থেকে সুস্বাদু টমেটো ও কোনওদিন খায়নি। পটাপট ছিঁড়ে একটার পর একটা খেয়েই যাচ্ছিল যিয়াদ। খেতে খেতে পেট ভরিয়ে ফেলল, তবু যেন সাধ মিটছিল না, এতটাই মজা ছিল টমেটোগুলো।
এবার আরেকটু এগোতে রীতিমতো হা হয়ে গেল। আফসোস হলো, কেন টমেটো খেয়ে পেট ভরিয়েছে।

সামনে একটা বড় জায়গা জুড়ে নানা আকৃতির তরমুজ গায়ে রোদ মেখে গড়াগড়ি দিচ্ছে। এরপরে পেল গাজরের ক্ষেত। পীপসোনাকে এখানে খুঁজে পাওয়ার কারণ এবার ভালোভাবে বোঝা গেল। ওর আওয়াজ পেতেই অনেকগুলো খরগোশ চোখের পলকে যে যেদিকে পারল লুকিয়ে গেল। গ্রিন বিনের ঝোপও দেখা গেল কয়েকটা। কোমরে হাত দিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে একবার এদিকে তো আরেকবার ওদিকে তাকাচ্ছিল যিয়াদ। এই এত এত জিনিস থাকতে আমরা তিনবেলা শুধু কলা আর জুকিনি খাচ্ছি, ভাবা যায়?
খানিক বাদে দেখা গেল মনের সুখে গলা ছেড়ে বাংলা গান গাইতে গাইতে গাজর তুলছে যিয়াদ। বাথরুম সিঙ্গার বলে মায়ূমীর সামনে এতদিন গলা খুলেনি একবারও। তার উপরে এতদিন ধরে মাতৃভাষায় কথা বলতে না পারায় মনটা হাঁসফাঁস করছিল।

এখন সুযোগ পেয়ে সব অনুভূতি গান হয়ে একসাথে বেরিয়ে আসছে। সেই হেঁড়ে গলার বেসুরো গান শুনে আশপাশের গাছগুলো থেকে পাখিরা যে নিজেদের গান থামিয়ে আকাশে উড়ে গেল, সেটা অবশ্য ও খেয়াল করল না। তরমুজ বাদে বাকি সব জিনিস এক এক করে মায়ূমীর ব্যাগে ধরার মতো সংগ্রহ করল ও। সবশেষে মাথায় একটা তরমুজ উঠিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে গুনগুন করতে করতে ফিরতি পথ ধরল যিয়াদ।

সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলতে শুরু করে দিয়েছে। যিয়াদ প্রায় পৌঁছে গেছে। ওদের নিয়মিত পানি নেয়ার স্থান থেকে একটু দূরে আছে, এমন সময়ে ও গুনগুন থামাল মায়ূমীর কণ্ঠস্বর শুনে। কোন একটা কারণে মায়ূমী খুশিতে ইয়েস ইয়েস করছে।

“মায়ূমী!” জোরে ডাক দিল যিয়াদ। উদ্দেশ্য কোনরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকলে যেন ও নিজেকে সামলে নিতে পারে।

“যিয়াদ, তুমি চলে এসেছো?” মায়ূমীর পালটা চিৎকার শোনা গেল।

“হ্যাঁ” বলতে বলতেই অবশ্য দৃষ্টিসীমার ভেতরে চলে এল দুজনেই।

“আই হ্যাভ এ সারপ্রা…….” চকচকে চোখে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মায়ূমী, মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। ইয়া বড় এক হা করে যিয়াদের দিকে তাকিয়ে রইল ও।

“বাবারে বাবা! হাত খসে গেল” করুণ স্বরে বলল যিয়াদ। মাথা থেকে নামিয়ে রাখল তরমুজটা। হোবো ব্যাগটার মুখ হালকা প্রসারিত করে মায়ূমীকে ভেতরের জিনিসের ঝলক দেখাল ও।

“ও-মাই-গড! এসব কীভাবে, রুডম্যান?” মায়ূমীর কণ্ঠে পুরোপুরি অবিশ্বাস। এগিয়ে এসে একটা একটা জিনিস বের করছে আর যিয়াদের দিকে তাকাচ্ছে।
“দাঁড়াও, বলছি” এগিয়ে গিয়ে কয়েক আঁজলা পানি পান করল যিয়াদ। তারপর দম নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কালকে ওখানে জাস্ট গোসল করেই চলে এসেছো? একটুও এদিক ওদিক যাওনি?”

“না। ওই কাপড় শুকাতে দিয়ে একটু গাছের ডালে হেলান দিয়েছিলাম। ঘুম ঘুম পাচ্ছিল, তখনই পীপ এসে ঘষাঘষি শুরু করে। পরে ওর সাথে খেলা করে ওকে নিয়ে চলে এসেছি। কেন?” বলতে বলতেই একটা গাজর ধুয়ে নিল মায়ূমী, কথা শেষ হতেই কামড় দিল সেটায়।
“এ-স-ব কিছুর গাছ ছিল ওইখানে” মায়ূমীর ঢঙেই বলল যিয়াদ।

“কী! সত্যি?” চিবোনো থামিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল ও। “ও গড! কী টেস্টি এটা” হাতে ধরা গাজরটার দিকে তাকাল মায়ূমী।
“না, মিথ্যা। স্বপ্ন দেখছো। এখনি ঘুম ভেঙে দেখবে এগুলো কিছুই ঘটেনি” হাসতে হাসতে বলল যিয়াদ।

আউচ! করে উঠল মায়ূমী। চমকে ওর দিকে তাকাল যিয়াদ। মায়ূমী ডান হাত দিয়ে বাম হাতের একটা অংশ ঘষছে। “হি হি! চিমটি কেটে শিওর হয়ে নিলাম স্বপ্ন দেখছি কিনা” বলল ও।

লেখা – ফারহিনা জান্নাত

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “ঊর্ণাজাল – Notun romantic love story in bengali” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূনভোলা – নতুন বাংলা রম্য গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *