মারিয়ার বিয়ের এক সপ্তাহ পর থেকেই মনে হতে থাকে সে যখন ঘরের টুকিটাকি কাজ করে তখন রবিন বেশ বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকায়। আড়চোখে লোকটার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কিছু একটা সে পছন্দ করছে না। সে ঘুরে রবিনের দিকে সরাসরি তাকাতেই আবার সে চোখ সরিয়ে নেয় বা মুচকি একটা হাসি দেয় তার দিকে দৃষ্টিবদ্ধ রেখে। রবিন যে তাকে পছন্দ করে না, বিষয়টা এমন না।
লোকটা যে তাকে এর মধ্যেই কতটা ভালোবেসে ফেলেছে তা সে বুঝতে পারে। সে যখন রবিনের পাশে গিয়ে বসে কী মায়া নিয়ে লোকটা তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। অন্য মানুষের সঙ্গে যে কোনো কথা বলতে গেলে মুখটা কিছুটা শক্ত করে কথা বলে সে। কিন্তু সে হাজির হলেই মুখের কঠোরতা উধাও হয়ে যায়। কী এক মিষ্টি ভঙ্গিতে কথা বলে তার সঙ্গে। যেন এখনো লজ্জা কাটেনি তার। মারিয়ারও বেশ লজ্জা লাগে হঠাৎ।
বিয়ের পরই একটা সংসারের পুরো দায়িত্ব চলে এসেছে তার উপর। রবিনের বাবা-মা বেঁচে নেই। আত্মীয়-স্বজন সব বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই চলে গেছে। রবিনের আপন বড় বোন অনেক কষ্টে তিন দিন ছুটি নিয়ে ভাইয়ের বিয়েতে উপস্থিত ছিল স্বামী সন্তান সহ। অফিসের সঙ্গে রাগারাগি করেও অতিরিক্ত আর ছুটি না পেয়ে চলে যেতে হয়েছে তাকে শ্বশুরবাড়িতে।
অবশ্য প্রায় প্রতিদিনই কল করে মারিয়ার খোঁজ খবর রাখছেন তিনি। আর ক্ষমা চাচ্ছেন সংসারে এনে তাকে একা ফেলে দিয়ে কিছু বুঝিয়ে না দিয়েই চলে যাওয়ার কারণে। রবিনের বড় বোন লতা আপুকে বেশ ভালোই লাগে তার। নিজের পরিবারের মানুষের সঙ্গেও যোগাযোগ হয় নিয়মিত। আর রবিনতো চোখের আড়ালই হয় না। লোকটার বোধ হয় বাইরে বাইরে ঘুরার অভ্যাস নেই।
এক কথায় বিবাহিত জীবনের শুরুর দিন গুলো ভালোই উপভোগ করছে মারিয়া।
শুধু ওই একটাই সমস্যা। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় রবিন বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকায় যখন সে কাজ করে সংসারের। এটা কী তার মনের ভুল! রবিন নিশ্চই চায় না যে সব কাজ ফেলে সারাদিন তার পাশে এসে বসে থাকুক সে! চাইতেও পারে! নতুন নতুন এসবই ভালো লাগে! এসব ভাবতেই লজ্জা অনুভব করে মারিয়া। আনমনে হাসে। লোকটার সঙ্গে যখন কথা বলে কেমন ফ্যালফ্যাল করে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। একই সাথে লজ্জা আর লোকটার প্রতি মায়া অনুভব করে সে।
মুঠোফোনে কথা বলে এরমধ্যেই লতা আপুর সঙ্গে তার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। সব সময় আজগুবি কিছু না কিছু উপদেশ তাকে দিতেই থাকে রবিনের এই একমাত্র বড় বোন। মানুষটাকে বেশ মজার মনে হয় মারিয়ার কাছে। একদিন ফোনে কথা হচ্ছিল। লতা আপু হঠাৎ বললেন,
‘নতুন বিয়ে হয়েছে। তোমাদেরর মধ্যে নিশ্চই ঝগড়া, খুনসুটি লেগে থাকে সব সময়?’
‘আমারতো ইচ্ছা ছিল এমনটাই করার। কিন্তু আপনার ভাইতো ঝগড়ার ধার কাছ দিয়েই যায় না!’
‘হাহাহা! ও এইরকমই! বেশ চাপা স্বভাবের। শত অভিযোগেও মুখ খুলবে না। অবশ্য তোমাকে যতটুকু চিনেছি তুমি অভিযোগ করার সুযোগ রাখো না। তবে আস্তে আস্তে দেখবে ও কতটা ফ্রি হয়ে উঠবে তোমার সাথে! অবশ্য তুমি যদি ওর আপন হয়ে যাও অনেক এক গুঁয়েমিই ওর সহ্য করতে হবে।’
‘তাই নাকি!’ হালকা বিস্ময় ফোটায় মারিয়া কণ্ঠে।
‘তুমি জানো, আমি ওর আপন বড় বোন! অথচ আমার সঙ্গে এমন লজ্জা পেয়ে কথা বলে যেন আমি পাশের বাড়ির মহিলা! প্রয়োজনের বেশি একটাও কথা বলে না। আমি নিজেও সংসার , অফিসের কাজে ওকে সময় দিতে পারিনি ঠিকমতো! আগে অবশ্য এমনটা ছিল না। খুব ছটফট স্বভাবের ছেলে ছিল। কিন্তু মা মারা যাওয়ার পর…….!’
লতা আপুর কণ্ঠটা কেমন আর্দ্র হয়ে উঠলো। মারিয়া কিছুটা নার্ভাস হয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারছে না। এসব প্রসঙ্গ উঠলে সে বিব্রত হয়ে পড়ে। আগে থেকেই। লতা আপুই আবার নিজেকে সামলে নিয়ে বলে গেলেন,
‘ মা রোগে ভুগছিলেন আমরা ছোট থাকা থেকেই। বাবা মারা যাওয়ার পর অযত্নেই তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। হঠাৎই এক দিন স্ট্রোক করে মারা গেলেন বাড়িতেই। সবে কলেজ থেকে ফিরেছিল রবিন সেদিন। বাড়িতে ফিরে দেখে বাড়ি ভর্তি মানুষ। মায়ের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারলো না ছেলেটা। একদম শান্ত হয়ে এলো। আচ্ছা মারিয়া তুমি যখন সাংসারিক কাজ করো তখন তোমার দিকে রবিন বিরক্ত হয়ে তাকায় না?’
মারিয়া কিছুটা হকচকিয়ে গেল। এ কথা সে আপাকে বলেনি। সে কী করে জানলো! শান্ত কণ্ঠেই সে উত্তর দিল, ‘নাতো!’
‘তুমি খেয়াল করোনি তাহলে মারিয়া! আমি নিশ্চিত সে অমন করে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে ওই সংসারে মায়ের জায়গায় আর কাউকেই কল্পনা করতে পারে না। মা মারা যাওয়ার কয়দিন পর আমাদের এক মামী গিয়েছিল রান্নাঘরে। বাচ্চা ছেলের মতো কান্না করে , রেগে-মেগে সে তাকে ওখান থেকে বের করে দেয়। না কাউকে বাড়ির কাজ করতে দেবে, না সে খাবে কিছু। কত বুঝিয়ে রাজি করলাম আমরা। সদ্য কলেজে উঠলেও বাচ্চা একটা ছেলের মতোই ছিল সে। এরপর থেকে আমি বিয়ের আগে পর্যন্ত বাড়ির কাজ করা অবস্থায় হুট করে যখনই ওর দিকে তাকিয়েছি, তখনই ভয় পেয়ে গেছি। কী একটা আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে।
বাড়িতে যেই কাজ করুক তার দিকেই। কতগুলো বছর কেটে গেছে। মায়ের ছবি কত ঝাপসা হয়ে গেছে আমাদের চোখে। এখনো সেই স্বভাব তার যায়নি। যদিও বড় হয়েছে, মাস্টারি করে, কত বই পড়ে! এখন অনেক কিছুই বুঝে বলে বাধা দেয় না। কিন্তু তার চোখের বিরক্তিও চোখ এড়ায় না কারো। তুমি জানো না কত কসরৎ করে বিয়েতে ওকে রাজি করাতে হয়েছে! তোমার ছবি দেখে কী হয়ে গেল তার, কোনো আপত্তি করলো না আর।
তবুও বিয়ের সময়টায় আমরা সবাই মিলে যখন কাজ করছিলাম তখন ওর মুখভঙ্গি যদি দেখতে! এই বুঝি ক্ষেপে মারতে আসে। হাহাহা!’
কথাগুলো শুনে আর রবিনের সেই দৃষ্টির কথা মনে পড়ে কেন যেন কান্না পেয়ে গেল মারিয়ার। চোখ দুটোর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। হয়তো প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষ হিসেবে রবিনের এই আচরণকে উদ্ভট আর অদ্ভুত আচরণ বলে মনে হবে। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর সন্তানের মনে মানসিক ধাক্কা থেকে সৃষ্ট এই আচরণকে অতোটা হালকা ভাবে উপহাস করাও যায় না। এটা যে ওর মনের কোন কোণায় শক্ত করে গেঁথে রয়েছে তা কে কী করে খুঁজে বের করবে!
বিয়ের বয়স বাড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে অভস্থ হয়ে উঠতে লাগলো মারিয়া রবিনের সেই আড়াল করা বিরক্তি দৃষ্টির। স্থানীয় একটা স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক রবিন। দিনের অর্ধেকের বেশি সময় থাকে সে ওখানে। বাকিটা সময় বাড়িতে। সময় বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে রবিনও কী অভস্থ হয়ে উঠছে নতুনত্বে! ধীরে ধীরে পরিবর্তন করতে চাইছে নিজের মনে সৃষ্ট হয়ে বিদ্বেষী এই আচরণ!
মারিয়া খেয়াল করে আজকাল লোকটার সেই ভালবাসা পূর্ণ মায়াবী দৃষ্টি সেটে থাকে তার দিকে সব সময়েই। সে যখন তার পাশে থাকে তখন যেমন, আবার সাংসারিক কাজ করে যখন তখনও। সংসারের যে কোনো কাজই যখন সে করতে যায় রবিন এসে তার পাশে দাঁড়ায়। টুকটাক গল্প করে, আনাড়ি হাতে সেসব কাজ করতে সাহায্যও করে, আর বাকিটা সময় অদ্ভুত মায়ার আলো ফেলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এমনটা সে আগে করতো না।
এক টুকরো জীবন (Life Story)
লেখা: Masud Rana
আরো পড়ুন –