বৃষ্টি – ভালোবাসার ছোট গল্প fb: ওই মুহুর্তের অনুভূতিটা কেমন যখন তোমার প্রিয় মানুষটা চলে যায় না ফেরার দেশে? ওই মানুষটার সাথে আর কোনোদিন দেখা হবেনা, কথা হবেনা, ছুঁয়ে দেখা হবেনা একটাবার। ভাবলে ঠিক কেমন লাগে?
পর্ব ১
ঝুমঝুম শব্দ করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। দোতলা বিল্ডিংটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে বৃষ্টিভেজা কদমগাছের ফুলগুলো দেখছে রুমানা। তার দৃষ্টি শূণ্য। বৃষ্টি হলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। বুকের ভেতর শুরু হয় এক অন্যরকম ধুকপুকানি। তোলপাড় হয়ে যায় ভেতরটা। সেই ছোট থেকেই রুমানা এই জিনিসটা লক্ষ করে আসছে। বৃষ্টি হলেই অজানা এক মন খারাপের ঢেউ আছড়ে পড়ে বুকের আঙিনায়। সেই ঢেউগুলো বিন্দু বিন্দু কণা হয়ে বের হতে চায় চোখ বেয়ে। কিন্তু অজানা কোনো এক কারণে বের হতে পারেনা সেগুলো।
সিংহের মতো গর্জন করতে থাকে ভেতরে ভেতরে। রুমানা বারবার প্রশ্ন করে নিজেকে। কেন এই মন খারাপ? কেন এই তোলপাড়? কেন এই নাম না জানা কষ্ট দলা পাঁকায় বুকের ভেতর নামক বারান্দাটায়? উত্তর পায়নি সে। বরং সময়ের পালাবদলে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এর সাথে। এখন এই দলা পাঁকানো কষ্ট, মন খারাপগুলোকেই ভালো লাগে তার। মনেমনে অপেক্ষা করে বৃষ্টির। বৃষ্টি এলেই শূণ্য দৃষ্টিতে দেখে তাদের। মন খারাপ হলেই সেটাকে মনেমনে উপভোগ করে সে। এই মন খারাপের মাঝেই যে তার বড্ড বেশি ভালোলাগা!
রুমানার ধ্যানভঙ্গ হলো সাগরের ডাকে। সাগর রুমানার বন্ধু। বাচ্চাকাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সাগরই বলতে গেলে রুমানার একমাত্র বন্ধু। দুই বন্ধু একসাথে মিলে দৌড়াদৌড়ি, ঘোরাঘুরি সবকিছু করে এসেছে সেই ছোট থেকে। রুমানার ভালো লাগছেনা কথা বলতে।
তবুও বলল,
- “হু! কি বলবি বল? হঠাৎ বাসায়?”
সাগর রুমানার মাথায় গাট্টা মেরে বলল, - “কেন? আমি কি তোর বাসায় আসতে পারিনা? তোর বাসা কি আমেরিকার হোয়াইট হাউজ যে এখানে আসতে হলে আমাকে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে?”
সাগরের কথায় হেসে ফেলল রুমানা। বলল, - “আচ্ছা বল এবার। কি হয়েছে?”
- “আমার তো কিছু হয়নি। তোর কি হলো? আজ যে আমাদের রেজাল্ট দিয়েছে মনে নেই তোর?”
- “হু মনে আছে। রেজাল্ট যে খুব বেশি ভালো হবেনা এটা তো জানা কথা ই। তোর রেজাল্ট কি হলো সেটা বল।”
একগাল হেসে সাগর বলল,
- “আমার তো এজ ইউজুয়াল। খুব বেশি ভালো হয়নি আবার খারাপও হয়নি। ৪৬৯ পেয়েছি।”
ছোট্ট করে রুমানা জবাব দিলো, - “অহ।”
- “একি! তুই এরকম ভাব করছিস যেন আমি ফেইল করেছি!”
রুমানা কথার প্রতিউত্তরে কিছু বললো না। আবার চোখ ফেরালো কদম গাছটার দিকে। একটা পিচ্চি ছেলে গাছ থেকে কদমফুল ছিঁড়ছে। দেখতে ভালো লাগছে বেশ। বাচ্চাটাকে ডেকে তার কাছ থেকে একটা ফুল নিতে ইচ্ছে করছে রুমানার। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছেনা একদম। এখন বের হলেই আপাদমস্তক ভিজে যাবে সে। বৃষ্টিতে ভেজা মোটেই পছন্দ না রুমানার। এরচেয়ে মনের ইচ্ছা মনের ভেতরেই ডুবে থাক।
রুমানার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো সাগর। তারপর বলল,
- “কিরে! ওভাবে কি দেখছিস? ফুল নিবি?”
রুমানা মাথা নেড়ে না বলল। কিন্তু ওর উত্তরের অপেক্ষা করেনি সাগর। সে ততক্ষণে দৌড়ে চলে গেছে পিচ্চিটার কাছে। তারপর গুনে গুনে ৫ টা কদম নিয়ে এলো। সেগুলো রুমানার হাতে দিয়ে বলল,
- “একটুর জন্য জিপিএ ৫ মিস গেছে। এজন্য মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে রাখলে তো আর জিপিএ ৪৮৯ থেকে জিপিএ ৫ হয়ে যাবেনা। নেহ তোকে জিপিএ ৫ না পাওয়ার খুশিতে ৫ টা কদম দিলাম৷ হাস এবার।”
হাসলো রুমানা। সাগর বলল, - “জানিস রুমানা! তোর জায়গায় যদি আমি হতাম তাহলে কখনোই সায়েন্স নিয়ে পড়তাম না। আমার ইচ্ছা কমার্স নিয়ে পড়ার, তাহলে আমি কেন অন্যের কথা শুনে সায়েন্স নিয়ে পড়ে নিজের লাইফ, নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করবো? আমি তোর মতো মনেমনে জেদ না করে সেই জেদটাকে কাজে লাগাতাম। তুই একটা বোকা রুমানা। তুই পারিস আমার সাথে জেদ করতে, আমার সাথে রাগ করতে। কখনোই সেটা কাজে লাগাস না তুই। এখন তোর জন্য আর একটা সুযোগ এসেছে। এটাই তোর শেষ সুযোগ। আমি হলে এই সুযোগটাকে খুব ভালো করে কাজে লাগাতাম। আমি গেলাম, রাতে ফোন করিস।”
আঁতকে উঠে রুমানা বলল,
- “দাঁড়া সাগর।”
সাগর যেতে গিয়েও ফিরে আসলো। বলল, - “যদি হিতে বিপরীত হয়?”
সাগর রুমানার হাতদুটো নিজেত হাতের মাঝে নিয়ে বলল, - “হিতে বিপরীত হবার মতো কোনো ব্যাপার এটা না। নিজেকে এত নগণ্য কেন ভাবছিস তুই? তোর সব আছে। তোর ওপর অন্যকেউ কেন জোর খাটাবে? যাই আমি, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
এটুকু বলে সাগর চলে গেলো। আর আগের মতোই কদম হাতে শূণ্য চোখে বাইরে তাকিয়ে রইলো রুমানা। তার মনে কি চলছে তা কে জানে! রুমানা কি করবে তা রুমানা নিজেও জানেনা।
সাগর চলে যাচ্ছে। তার ঠোঁটে মুচকি হাসি। পৃথিবীর আর কেউ জানুক বা না জানুক সাগর জানে, রুমানা নামের বোকা মেয়েটাকে আজ সে অনেকটা সাহস যুগিয়ে এসেছে। সে এটাও জানে রুমানা নামের মেয়েটা আজ অনেক সাহসী হয়ে একটা কাজ করবে। আর এই কাজে সাফল্য পাবে রুমানা নিজেই।
পর্ব ২
সবচেয়ে বড় অঘটনটা ঘটলো রাতে। তখন সময় রাত ৮ টা। জনাব আহনাফ তখন মাত্র বাসায় এসেছেন।
এসে টাই ঢিলা করতে করতে স্ত্রী সাবানাকে জিজ্ঞেস করলেন,
- “মেয়ের রেজাল্ট হলো আর আমাকে একবারও ফোনে জানাওনি কেন? রুমানার রেজাল্ট কি হয়েছে?”
সাবানা মনেমনে যে ভয়টা পাচ্ছিলো তার মুখোমুখি যে এত দ্রুত হতে হবে এটা কে জানতো! হাত পা কাঁপছে সাবানার। সাবানা কিছু বলার আগেই আহনাফ আবার বলল,
- “রহমান সাহেবের মেয়ের কথা মনে আছে তোমার? শিমা, ওইযে সুন্দর করে লম্বা মেয়েটা। দেখতে কত লক্ষ্মী! ও নাকি গোল্ডেন এপ্লাস পেয়েছে। রহমান সাহেব রেজাল্ট জানার পর অফিসে এসে মিষ্টি খাওয়ালেন আমাদের সবাইকে। রুমানার রেজাল্টের কথা জিজ্ঞেস করছিলো। আমি কিছু বলিনি।”
ভয়েভয়ে সাবানা জবাব দিলো,
- “তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। পরে নাহয়”
সাবানার ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা দেখে কিছু একটা বুঝে ফেললেন আহনাফ। সাথেসাথেই তার মুখটা শক্ত হয়ে গেলো। তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন, - “ও! তার মানে মহারাণীর রেজাল্ট একটুও ভালো হয়নি। গোল্ডেনের কথা বাদ দাও। এপ্লাস পেলেও চলবে। ডাকো ওকে।”
সাবানা ভয়েভয়ে বলল,
- “রুমানাআসলে রুমানা এপ্লাস পায়নি”
এতক্ষণ ভেতরে দমিয়ে রাখা রাগটা এবার ফেটে বেরিয়ে এলো আহনাফের। চিৎকার করে বলল, - “কি পেয়েছো তোমরা মা মেয়েতে মিলে? আজকালকার যুগে সায়েন্সে কাড়ি কাড়ি এপ্লাস আর গোল্ডেন। তোমার মেয়ে সাধারণ এপ্লাসটুকু পেলোনা! কি লাভ হলো ওর পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলে?”
সাবানা চুপ করে রইলেন। এখন কিছু বললেই আরও রেগে যাবেন আহনাফ। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সিড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে রুমানার রুমের দিকে চলে গেলেন আহনাফ। যাবার সময় বলতে বলতে গেলেন,
- “কি পেয়েছে এই মেয়ে। আজ তাকে শায়েস্তা করবো আমি। এত এত টাকা দিয়ে হোম টিউটর রেখে পড়াচ্ছি, কোচিং করাচ্ছি। আর তার বিনিময়ে এই রেজাল্ট?”
রুমে বসে একটা ছোটগল্পের বই পড়ছিলো রুমানা। জনাব আহনাফ হুড়মুড় করে তার রুমে ঢুকে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন রুমানার গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় দুই মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলো রুমানা। তারপর শান্ত গলায় বলল,
- “আমার গায়ে হাত দেবার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে?”
- “কে দিয়েছে মানে? আমি তোমার বাবা।”
রাগে ফেটে পড়লেন আহনাফ। রুমানা তবুও শান্ত স্বরে বলল,
- “আপনি যে কেমন বাবা সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেনা। আমার গায়ে হাত দিবেন না আপনি। নয়তো আপনার বিরুদ্ধে আমি পুলিশের কাছে মামলা করতে বাধ্য হবো।”
রুমানার এমন কথায় হোঁচট খেলেন আহনাফ। এই মেয়ে এভাবে কেন কথা বলছে! তবুও গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললেন,
- “তোমার রেজাল্টের এই দশা কেন? এত এত টাকা খরচ করে তোমাকে পড়াচ্ছি। আর তুমি এই রেজাল্ট করছো কেন? তোমাকে কি আমি শাসন করতে পারিনা?”
- “এটাকে শাসন বলে না, এটাকে বলে অত্যাচার। আর রেজাল্টের কথা বলছেন তো? আমি আপনার পছন্দ অনুযায়ী সায়েন্সে পড়ছি তাই রেজাল্ট খারাপ হলে তার দায়ও আপনার। আর একদম টাকা নিয়ে খোঁটা দিবেন না আমাকে। আমি আপনার টাকায় খাইও না আর পড়িও না।”
- “কি বলতে চাচ্ছো তুমি! তোমার কি ভালো কিছু করার ইচ্ছা নেই?”
- “ইচ্ছা অবশ্যই আছে। কিন্তু আমার ইচ্ছা অনুযায়ী তো আপনি আমাকে পড়তে দেন নি। ইচ্ছার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন তখন?”
এই কথার উত্তরে আহনাফ কি বলবে তা ভেবে উঠতে পারছেন না তিনি। কিছু বলতে গিয়ে মুখ খুলতে নিয়েও বন্ধ করে ফেললেন। বলার মতো কোনো কথা নেই তার কাছে। এই মেয়েটার সাথে কথা বলতে আজ বড্ড ভয় করছে আহনাফের। মেয়েটা হঠাৎ করে এত সাহসী হয়ে উঠলো কবে? এত আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথাইবা বলছে কিভাবে! মাথা উঁচু করে সবগুলো কথার জবাব দিয়ে দিচ্ছে মুখের ওপর। জনাব আহনাফ ঘামছেন। আমতা আমতা করে ঠিক যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন তিনি।
সাবানা তার স্বামীর চলে যাওয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার রুমানার দিকে তাকালো। রুমানা তার দিকে অন্যরকম একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টিতে কি আছে কে জানে! হয়তোবা রুমানা মনেমনে তাচ্ছিল্য করে তাকে বলছে,
- “একজন মা হিসেবে ব্যর্থ তুমি। নিজের মেয়ের পাশে ভরসার খুঁটি দাঁড়াতে পারোনা।”
মেয়ের এই দৃষ্টি আর সহ্য করতে পারছেনা সাবানা। সেও চলে গেলো নিরবে।
এই প্রথম নিজেকে খুব সাহসী মনে হচ্ছে তার। এত সাহস তার কবে হলো ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছে সে। এই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে এতগুলো কথা কিভাবে বলে ফেললো সে! একটু আগেই সাগর বলেছিলো,
- “তোর বিপরীত পাশের মানুষটার সামনে তুই যেমন হবি, মানুষটা হবে ঠিক তার উলটো। কেউ যদি তোকে নিচু করে রাখতে চায়, আর তুইও তার সামনে নিচু হয়ে থাকিস তাহলে তোকে সে আরও নিচু করবে। একদম পিষিয়ে ফেলবে। কিন্তু তুই যদি তার সামনে সাহস নিয়ে উঁচু হয়ে থাকিস তাহলে দেখবি মানুষটা তোকে ভয় পাচ্ছে। একটু সাহসিকতা দেখা, তারপর দেখবি কত সহজ হয়ে যাবে তোর জন্য সবকিছু।”
সাগরকে একশটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে রুমানার। এত ভালো কেন ছেলেটা! ভাবতেই হেসে ফেলল। সাগরের মতো একজন বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। উঁহু ভাগ্য না, পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। অজানা এক ভালোলাগায় মনটা ভরে উঠলো রুমানার। এই ভালোলাগাটা রুমানা নামক বোকা মেয়েটার সাহসী হয়ে ওঠার অনুভূতি।
বেশ কিছুক্ষণ পর আহনাফ আবার এলো রুমানার রুমে। দরজার কাছে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। রুমানা বলল,
- “কিছু বলবেন?”
একটু কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে তিনি বললেন, - “তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো তুমি সায়েন্স নিয়ে পড়তে চাওনা?”
রুমানা ঠান্ডা স্বরে বলল, - “না, পড়তে চাইনা। আমি কমার্স নিয়ে পড়বো। কলেজে ভর্তির সময়ই আমি বিভাগ চেঞ্জ করে ফেলবো। আপনি অনুমতি দিন আর না দিন”
আহনাফের ইচ্ছে হলে এক চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেয় রুমানার। কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে বলল, - “বেশ! কিন্তু যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তাহলে মনে রেখো।”
এতক্ষণ আহনাফের দিকে তাকায়নি রুমানা। এবার মুখ তুলে তাকালো। আহনাফের দিকে কঠিন এক দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বলল,
- “আমার নিজের ইচ্ছামতো বিষয় নিয়ে পড়ে আমি ফেইল করলেও আমার আক্ষেপ থাকবেনা।”
রুমানার ওই দৃষ্টিতে কি ছিলো কে জানে! ওর ওই কঠিন দৃষ্টির সামনে আর টিকতে পারলেন না তিনি। চলে গেলেন রুম ছেড়ে।
এরপর দিনগুলো বড্ড ভালো কাটলো রুমানার। বই পড়ে এটা ওটা করে বেশ ভালো দিন চলে গেলো। রুমানার ভালো থাকার জন্য সাগর একাই যথেষ্ট। বাসায় থেকে বই পড়ে আর সাগর থাকলে ওর সাথে দিব্যি সময় কেটে যায়। বিপত্তি বাঁধলো কলেজে পড়ার সময়।
আহনাফের ইচ্ছা এক কলেজে রুমানাকে পড়াবে। আর রুমানার ইচ্ছা সে অন্য কলেজে পড়বে। এই দুই নিয়ে ওদের মাঝে আবার তর্ক বিতর্ক। সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাবানা কড়া গলায় আহনাফকে বলল,
- “রুমানা যেখানে পড়তে চায় ও সেখানেই পড়বে।”
আহনাফ খুব বেশি অবাক হয়ে বলল, - “কি বললে তুমি?”
- “তুমি যা শুনেছো তাই বলছি। রুমানার যেখানে ইচ্ছা ও সেখানেই পড়বে। তুমি নিজের ইচ্ছা ওর ওপর চাপিয়ে দিওনা।”
- “কিন্তু আমি তো ওর ভালোর জন্যই বলেছিলাম। রহমান সাহেবের মেয়েটা ওই কলেজে”
- “রহমান সাহেবের মেয়ে আর আমার মেয়ে এক নয়। আমার মেয়ে তার নিজ ইচ্ছামত পড়বে। রহমান সাহেবের মেয়ের সাথে আমার মেয়েকে তুলনা করবেনা তুমি।”
আহনাফ আর কিছু বলতে পারলেন না। রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন। রুমানা এতক্ষণ দেখছিলো তার মাকে। চোখ ভিজে উঠেছে তার। মন থেকে কেউ বলছে, - “হ্যাঁ রুমানা, ইনিই তোর মা। তোর নিজের মা। তোর ভরসার খুটি।”
ছোট্ট একটি এলাকার ছোট্ট এই দোতলা বাড়িতেও হাওয়া অন্যদিকে বইতে শুরু করেছে। পাখির ছানার মতো কেউ কেউ আপন বাসা ছেড়ে পাড়ি জমাতে শুরু করেছে একটু দূরে। তারপর আর একটু দূরে। এভাবেই সময়ের পালাবদলে মানুষ বদলায়, বদলায় সম্পর্ক। এই পালাবদলের মাঝেই তো জীবন!
পর্ব ৩
এরপর সবকিছু ভালো চলছিলো। রুমানা নতুন কলেজে ভর্তি হলো বিজনেস স্টাডিস নিয়ে। বেশ ভালোই চলছিলো জীবন। আহনাফ পারতপক্ষে রুমানার মুখোমুখি হয়না। একাদশ শ্রেনি থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করেই দ্বাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলো রুমানা।
বিপত্তি বাঁধলো কিছুদিন পরে। সেদিন বিকেলে রুমানা বাসায় ফিরেই অপরিচিত একজন লোককে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখলো। লোকটাকে দেখেই কেমন যেন শিউরে উঠলো রুমানা। লোকটা রুমানার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। চোখা দৃষ্টি দিয়ে রুমানার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। গা ঘিনঘিন করতে শুরু করলো তার। এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়েই রুমানা চলে গেলো তার রুমে। বেশ কিছুক্ষণ পর রুমানার মা এসে ডেকে নিয়ে গেলো তাকে। জনাব আহনাফ রুমানাকে বললেন,
- “শোনো রুমানা, উনি হচ্ছেন ফয়সাল। উনি এখন থেকে তোমাকে বাসায় এসে পড়াবেন। তুমি যেহেতু বিজনেস স্টাডিস বিভাগে নতুন সেহেতু উনি তোমাকে বেশ হেল্প করতে পারবে। সাথে আইসিটিও দেখে নিবে। কোনো ফাঁকিবাজি করবেনা। গুনে গুনে দশ হাজার টাকা বেতন দিবো ওনাকে। তোমার কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।”
রুমানা বলল,
- “আমার তো কোনো হোম টিউটরের প্রয়োজন নেই। আমি যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করছি তার পরেও এতো কাহিনি কেন করছেন আপনি?”
রুমানার মা সাবানা এবার মুখ খুললেন, - “কোনো ক্ষতি তো হচ্ছেনা। পড়েই দেখ। এমনিতেও সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার চাপ বেশি। তোর ভালোই হবে।”
সকলের চাপাচাপিতে রুমানা রাজি হয়ে গেল পড়তে। কিন্তু এই লোকটাকে মোটেও ভালো লাগেনি রুমানার। পরদিন থেকেই পড়াতে এলো ফয়সাল নামক লোকটা। যথেষ্ট ভদ্র আচরণ করলেও লোকটার চাহুনিটা কেমন যেন নোংরা মনে হয় রুমানার। একদমই পড়তে ইচ্ছা করে না।
সেদিন সাগর ফোন করলো। বলল, - “কিরে কেমন পড়লি?”
- “ভালো না আবার খারাপও না। লোকটার তাকানোটা যেন কেমন।”
- “আরে ধুর! এটা তোর মনের দুশ্চিন্তা। পড়তে থাক।”
একমাস ভালোয় ভালোয় কেটে গেলো। অঘটন ঘটলো তার কিছুদিন পর। সেদিন যথারীতি রুমানা পড়তে বসলো। সাদা রঙের একটা প্লাজো পরনে ছিলো রুমানার। প্লাজোটা একটু খাটো হওয়ায় রুমানার ফর্সা পা অনেকটাই দেখা যাচ্ছিলো। আর ফয়সালের নজর বারবার চলে যাচ্ছিলো রুমানার পায়ের দিকে। ঘেমে যাচ্ছে সে। রুমানা সেটা খেয়াল করলোনা।
সে আপনমনে আইসিটির লজিক গেইট করে যাচ্ছে। আর লোভাতুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে ফয়সাল। রুমানার দিকে এদিক ওদিক করে তাকাচ্ছে আর কিছু দেখা যাবে এই আশায়। রুমানা সমস্যাটা সমাধান করে খাতাটা ফয়সালের দিকে এগিয়ে দিলো। তাড়াহুড়ো করে খাতাটা নিতে গিয়ে রুমানার হাতের সাথে হাত লেগে গেলো তার। চোখ দিয়ে ঝাপসা দেখছে ফয়সাল। নিজের ভেতরের যেই দানবটাকে এতদিন ভদ্রতার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলো সে তা যেন ধীরে ধীরে জাগ্রত হচ্ছে
রুমানার রুম থেকে চিৎকার আর ধপাস করে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনে হুড়মুড় করে রুমে এলো সাবানা আর আহনাফ। এসে দেখে ফয়সাল চেয়ারসহ উলটে মাটিতে পড়ে আছে আর রুমানা তাকে পা দিয়ে লাথি দিচ্ছে। রুমানা বলছে,
- “কতবড় সাহস তোর। আমার গায়ে হাত দিস? তোর এই হাত আমি ভেঙে ফেলবো।”
বলেই ফয়সালের হাত ধরে মুচড়ে দিলো রুমানা। ঘটনার আকস্মিকতায় সাবানা- আহনাফ দুজনেই বিস্মিত। বেশ কিছুক্ষণ বাদে ঘটনা বুঝতে পারলেন দুজনে। জনাব আহনাফ রেগে গিয়ে দুটো চড় বসিয়ে দিলো ফয়সালের গালে। জঘন্য একটা গালি দিয়ে বলল, - “এজন্য কি তোকে রেখেছিলাম?”
মিসেস সাবানা বললেন,
- “ওকে পুলিশে দেওয়া উচিত।”
আঁতকে উঠলেন আহনাফ। বললেন, - “না না! পরে রুমানার অসম্মান হবে। এটাকে এখানেই চাপা দিয়ে দেই।”
তারপর ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বলল, - “রুমানার আশেপাশেও আর আসবিনা তুই। নয়তো এর পরিণাম ভালো হবেনা।”
এরপর ফয়সাল বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আহনাফের দিকে। এভাবে তাকিয়ে থেকে দুজনে চোখেচোখে কিছু কথা আদান- প্রদান করলো তা কেউ দেখেনি। রুমানা ও তার আশপাশটা বড্ড ঘোলাটে আর ঝাপসা। মানুষ চেনা যে বড্ড দায়!!
সেদিন রাতেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি এলো। মুষলধারে পড়তে থাকা বৃষ্টিগুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে রুমানা। সাগরের ফোন এলো তখন। সাগর বলল,
- “দেখ রুমানা। তোর জন্য বৃষ্টি হচ্ছে।”
অবাক হলো রুমানা। বলল,
- “বৃষ্টি আবার কারো জন্য আসে নাকি?”
- “হ্যাঁ আসে। বৃষ্টিরা তোকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। তুই একটু একটু করে খোলস ছেড়ে বের হচ্ছিস, প্রজাপতির মতন। জানিস! একটা শূককীট প্রজাপতি হওয়ার সময় কত বাঁধা কত যন্ত্রণা আসে? তোরও আসবে। এই সব বাঁধা, বিপত্তি পেরিয়ে তুই রঙিন একটা প্রজাপতি হবি দেখিস। তাই তোক অভিনন্দন জানাতে বৃষ্টিরা বরণডালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছে।”
মুহুর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেলো রুমানার। সাগরের কথাগুলো একদম হৃদয় ছুঁয়ে যাবার মতো। এত সুন্দর করে কথা কিভাবে বলে ছেলেটা? কেমন জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে মনটা ভালো করে দেয়। সাগর আবার বলল,
- “মন ভালো হয়েছে?”
- “হু।”
- “জানালার পাশেই তো আছিস। জানালাটা খুলে দে। বৃষ্টিতে ভিজতে বলবোনা। কিন্তু জানালা খুলে সেখানে দাঁড়িয়ে দেখ। বৃষ্টির এক একটা ছিটেফোঁটা যখন এসে তোর গায়ে লাগবে, মনে হবে ওগুলো তোর গায়ে না, হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছে গেছে। তখন মনটা আরও ভালো লাগবে। রাখছি আমি।”
রুমানা তাই করলো। সত্যিসত্যিই মনটা ভালো হয়ে গেলো তার। এর আগে বৃষ্টিকে কখনোই ভালো লাগেনি রুমানার কাছে। আজ কেন এত ভালো লাগছে? সত্যিই কি সে খোলস ছেড়ে বের হচ্ছে? সে কি সত্যিই একটা রঙিন প্রজাপতি হবে, ঠিক সাগরের কল্পনার মতো? বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েও আর ভিজলোনা রুমানা। কিন্তু দু’হাত আঁজলা ভরে বৃষ্টি নিলো। তারপর সেগুলোকে খুব কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,
- “ধন্যবাদ বৃষ্টি, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
পর্ব ৪
অঘটনটা ঘটলো তার ৪ মাস পর। সেদিনও বিকেলে রুমানা বাসায় ফিরে একইরকমভাবে ফয়সালকে সোফায় বসে থাকতে দেখলো। শুধু ফয়সাল না, তার সাথে আছে আরও ৩ জন মানুষ। দুজন মধ্যবয়সী নারী- পুরুষ আর একটা রুমানার বয়সী মেয়ে। রুমানাকে দেখে মহিলাটি এগিয়ে এলেন। বললেন,
- “বাহ! আপনাদের মেয়ে তো অনেক মিষ্টি। কিন্তু হাইট একটু কম। যাকগে ওটা কোনো ব্যাপার না। কি বলেন!”
মহিলাটির কথায় হইহই করে উঠলেন জনাব আহনাফ। একগাল হেসে বললেন, - “হাইট কিন্তু কমও না। ৫ ফুট ২ ইঞ্চি খুব একটা কম হাইট নয়।”
রুমানা দু’মিনিট হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর বলল,
- “এখানে হচ্ছেটা কি?”
তারপর আহনাফ বলে উঠলো, - “ফয়সাল তোমাকে কিছু বলবে।”
- “ওনার সাথে আমার কোনো কথা নেই। তুমি ওনাকে এই বাড়িতে ঢুকতে দিলে কিভাবে? আর উনিও কিভাবে নির্লজ্জের মতো এই বাড়িতে আসলো?”
এবার ওই মহিলাটি বলে উঠলেন, - “শোনো মেয়ে! ছেলেদের এরকম একটু আধটু দোষ থাকতেই পারে। এবারে আমরা একদম তোমাকেই নিয়ে যেতে এসেছি।”
রুমানার মাথার রগ যেন দপদপ করে উঠলো। বলল,
- “আপনি কার অনুমতি নিয়ে এসেছেন এখানে?”
এবার ওই মহিলার মুখটা কালো হয়ে গেল। জনাব আহনাফ বললেন, - “এটা কেমন কথা? ছেলেমেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে তাদেরকে বিয়ে দিতেই হয়। ফয়সাল তো পাত্র হিসেবে খারাপ না।”
- “আমার বিয়ের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার আগে আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে আমি বিয়ে করতে চাই কিনা? আমার মায়ের সাথে আলোচনা করেছেন? তবুও মানতে পারতাম যদি ছেলেটা ভালো হতো। কিন্তু এরকম একটা চরিত্রহীন ছেলের সাথে আপনি আমার বিয়ে কোন সাহসে ঠিক করলেন জনাব আহনাফ?”
রুমানার এমন জবাবে অবাক হয়ে গেলেন আহনাফ। ভেবেছিলেন কোনোরকমে বিয়েটা করিয়ে দিবেন। কিন্তু
রুমানা ফয়সালের পরিবারের দিকে তাকিয়ে বলল,
- “আপনারা কি জানেন যস এই জনাব আহনাফ আমার বাবা নন? উনি আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী। এমন একটা ফ্যামিলির মেয়েকে নিবেন আপনারা?”
বিন্দুমাত্র অবাকও হলোনা ওরা। বলল, - “আমাদের কোনো সমস্যা নেই। ফয়সালকে একটা ভালো চাকরি, একটা বড়সড় ব্যবসা, একটা বাড়ি, তোমার গা ভর্তি গহনা আর সংসারের কিছু আসবাব দিলেই চলবে।”
এবার মুখ খুললেন সাবানা। বললেন, - “আপনারা এক্ষুনি বের হয়ে যান আমার বাড়ি থেকে।”
এবার ফুসে উঠলেন ওই মহিলা।বললেন, - “এভাবে ডেকে এনে অপমান করার কোনো দরকার ছিলোনা ভাইসাহেব।”
ওরা চলে যেতেই আহনাফ বলল,
- “কি দরকার ছিলো ওদের সামনে এসব বলার? আমাদের কি টাকার অভাব যে কোনো অংশে রুমানাকে কিছু কম দিবো? বিয়েতে এসব কিছু দিতেই হয়। তার ওপর ফয়সাল যেই কাজটা করলো এটা জানাজানি হলে আর কোথাও বিয়ে দিতে পারবো মেয়েকে?”
সাবানা বলল,
- “আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে তুমি ভেবোনা। দরকার হলে আমার মেয়ে আজীবন অবিবাহিত থাকবে। তবুও ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনোই ওকে বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করবেনা।”
- “বড্ড বেশি কথা ফুটেছে তোমার মুখে?”
- “তুমি যদি এরপর আমার মেয়েকে নিয়ে অতিরিক্ত মাথা ঘামাও তাহলে ওকে আমি দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিবো। ওর বয়স আর কিছুদিন পরেই ১৮ হয়ে যাবে। তারপর আমি ওকে ওর সবকিছু বুঝিয়ে দিবো। তুমি এসবের মধ্যে এসোনা।যদি আসো তাহলে এর পরিণাম ভালো হবেনা। চলে আয় রুমানা।”
এটুকু বলে চলে গেলেন সাবানা।
আর ওখানে দাঁড়িয়ে চুল টানতে লাগলেন আহনাফ। এতদিনের এতসব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে গেল তার৷ দূরে গিয়ে ফোন করলো ফয়সালকে। ফয়সাল ফোন রিসিভ করতেই বাজে ভাষায় দুটো গালি দিয়ে বলল,
- “নিজের একটু আয়ত্তে রাখতে পারলিনা? তোর জন্য আমার এতদিনের সব পরিশ্রম শেষ। তুই না পেলি রাজকন্যা আর আমি না পেলাম রাজত্ব। এবার হাত কামড়াও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।”
রুমানার সাথে রুমানার রুমে এসে রুমানার হাত দুটো চেপে ধরলেন সাবানা। সাথেসাথে চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো রুমানার হাতে। সাবানা বললেন,
- “আমি তোকে ওই নোংরা মানুষগুলোর হাত থেকে বাঁচাতে পারিনা রে মা! মাফ করে দিস আমাকে। আমাকে মাফ করে দিস। আমি অনেক খারাপ একটা মা।”
- “না মা, তুমি মোটেও খারাপ না। তুমি আছো বলেই তো রুমানা এখনো আছে। নয়তো তো কবেই শেষ হয়ে যেতাম।”
দুষ্টুমির হাসি হেসে সাবানা বলল,
- “আচ্ছা এবার বল, সাগরের সাথে কেমন চলছে সবকিছু?”
- “সাগরের সাথে আমার কি চলবে?”
তারপর অবাক হয়ে বলল, - “তুমি কি ভাবছো ওর আর আমার মাঝে ইলুইলু আছে?”
রুমানার এমন জবাবে হাসিতে ফেটে পড়লেন সাবানা। সাবানার এমন হাসি দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো রুমানা নিজেও। বহুদিন পরে এমন প্রাণখোলা হাসি যেন বিশাল এই বাড়িটাতে একটা অন্য পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ওদের সাথেসাথে যেন হাসছে এই বাড়ির এক একটি ইট, পাথর সবকিছু।
সুখী হতে গেলে টাকা, পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্স কিছুই লাগেনা৷ শুধু প্রিয়জনের বিশ্বস্ত একটা হাত থাকলেই হয়। যে হাত ধরে একটা জীবন হেসে খেলে পার হয়ে যায়।
হাসতে হাসতে আপনমনেই রুমানা ভাবলো,
- “সাগরের সাথে কি সত্যিই রুমানার কিছু একটা আছে? কে জানে! উত্তরটা সময়ই দিয়ে দিক।”
- “হাই! আমি নিপুণ।”
রুমানা দেখলো হাসিখুশি একটা মেয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। মেয়েটা হাসলে ওর চোখও হাসে। অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটা। রুমানা বলল, - “আমি রুমানা।”
এবার মেয়েটা যেন অবাক হলো। এতোই অবাক হলো যে গালে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল,
- “আমাদের দুজনের নামের কত মিল দেখেছো? তুমি রুমানা, আমি নিপুণ। যেন বিপরীত দুটো শব্দ! ওয়াও। ভার্সিটিতে এসে তোমার মতো একজন পাবো কল্পনাও করিনি। চলো আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড হই।”
মেয়েটা বড্ড বেশি কথা বলে।
রুমানা বলল,
- “বেস্ট ফ্রেন্ড কি এত সহজে হওয়া যায়? দেখা যাক।”
একথায় যেন নিপুণ নামক মেয়েটার মন খারাপ হয়ে গেলো। সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বলল, - “যাইহোক! অনেকদিন একসাথে থাকবো। তোমাকে কিন্তু আমি অনেক জ্বালাবো হুম। আমি একটু বেশি কথআ বলি ঠিক, কিন্তু আমি একটুও খারাপ না। ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি।”
বলে রুমানার কাঁধে নাড়া দিলো। রুমানা একটু বিরক্ত হলো ঠিক।কিন্তু কিছু বললোনা।
রুমানা কি জানলো এই বাঁচাল মেয়েটার সাথে অদ্ভুত মায়াময় এক টানে বেঁধে গেছে সে? নাহ জানলোনা। প্রকৃতি রহস্য রাখতে বড্ড পছন্দ করে।
পর্ব ৫
নিপুণ নামের মেয়েটা সত্যিকার অর্থেই একটা ভালো মেয়ে। শুধু ভালো বললে ভুল হবে, অনেক ভালো একটা মেয়ে। অল্পতেই মিশে যায় সবার সাথে। মেয়েটা রুমানার সাথে একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। ডিপার্টমেন্টের সবগুলো মেয়ে যেন নিপুণের ভক্ত।
নিপুণ মেয়েটা পুরো আড্ডাটাকে মাতিয়ে রাখে। রুমানা নিপুণকে তেমন পাত্তা দেয়না, কিন্তু নিপুণ বারবার ওর কাছেই ঘেষে থাকে। সেদিন রাতে রুমানা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলো। এরইমাঝে নিপুণ সুন্দর দেখতে মুচমুচে ডালের বড়া বানিয়ে নিয়ে এলো। ঘ্রাণে ম ম করছে রুমটা। নিপুণ রুমানাকে একটা বডা দিয়ে বলল,
- “এই রুমানা, দেখো বড়াগুলো কি সুন্দর হয়েছে। একটা খেয়ে দেখো।”
রুমানা বিরক্তি মেশানো স্বরে বলল, - “আমি পড়ছি, পরে খাবো। তুমি খাও।”
কিন্তু নিপুণ যেন নাছোড়বান্দা। সে বলল, - “আরে খেয়েই দেখোনা কি মজা হয়েছে।”
রুমানা কিছু বললোনা। নিপুণ আবার ওকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
- “এই রুমানা!! খাওনা একটা! আচ্ছা একটা না খেলে দু’টো খাও। তুমি আরও বেশি নিতে চাও?”
এবার রুমানা চিৎকার করে উঠলো। বলল, - “কি সমস্যা কি তোমার? আমাকে এমন বিরক্ত করছো কেন তুমি? দেখছোনা পড়ছি। কালকে পরীক্ষা আছে আমার। পড়া নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা আছে তোমার মাথায়? লেখাপড়া করতে ইচ্ছে না হলে বাসায় বলো বিয়ে দিয়ে দিতে। প্লিজ আমাকে ডিস্টার্ব করোনা।”
হঠাৎ করে রুমানার এমন রিয়েক্টে হতভম্ব হয়ে গেলো নিপুণ। আর একটা কথাও না বলে সে চলে গেলো তার খাটে। বড়াগুলো রয়েই গেলো প্লেটের মধ্যে। কাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো নিপুণ। বড্ড কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু কান্নাটা রুমানাকে দেখানো যাবেনা। যদি আবার বিরক্ত হয়!
রুমানার পড়া শেষ হলো অনেক রাতে। ঘুমাতে যাবার আগে হঠাৎ চোখে পড়লো বড়ার প্লেটটা। যেমন ছিলো তেমনই রয়ে গেছে। রুমানা হালকা স্বরে বিড়বিড় করলো,
- “মেয়েটা পাগল নাকি! এত কষ্ট করে বড়া বানিয়ে এখন না খেয়ে রেখে দিলো কেন?”
পরদিন রুমানার পরীক্ষা খুব ভালো হলো। পরীক্ষা শেষ হবার আগেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি এসে ডুবিয়ে দিলো চারপাশ। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর একটা রিকশা করে চলে আসছিলো বাসায়। এরইমাঝে দেখলো একটা মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেখে বড্ড মায়া লাগলো রুমানার। মেয়েটা যেন শক্তিহীন! তার পা গুলো যেন চলছেই না। কত জোর করে হেঁটে যাচ্ছে। রুমানা তাকিয়ে থাকলো মেয়েটার দিকে। একটু বাদেই চিনতে পারলো। তারপরই বলে উঠলো,
- “নিপুণ!”
রুমানা জোরে ডাকলো,
- “এই নিপুণ! বৃষ্টিতে ভিজছো কেন?”
নিপুণ শুনতে পেলোনা রুমানার ডাক। সে আপনমনে হেঁটে যাচ্ছে। রুমানা আবার ডাকলো, - “নিপুণ! নিপুণ!”
এবার শুনলো সে। ফিরে তাকালো। বৃষ্টির মাঝে নিপুণের লাল শূন্য দৃষ্টির চোখ দেখে রুমানা কি বুঝলো কে জানে! সে বলল,
- “ভিজে ভিজে যাচ্ছো কেন? আসো রিকশায় উঠো।”
নিপুণ সুবোধ বালিকার মতো এসে রুমানার পাশে বসলো। রিকশা চলতে শুরু করলো আপনমনে। রুমানা জিজ্ঞেস করলো,
- “কি হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা হইসে?”
নিপুণ কিছু বললোনা। ফোঁটায় ফোঁটায় পড়া বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো সে। এই নিপুণকে রুমানা চেনেনা। এতদিন ধরে যেই মেয়েটা সবসময় হাসিখুশি ছিলো সেই মেয়েটা আজ এমন মনমরা হয়ে কাঁদছে কেন? ভাবতে ভাবতেই রুমানার মনে পড়লো কালকে রাতে তার ব্যবহার। নিপুণ কি ওর ব্যবহারে কষ্ট পেলো? তখন সাথেসাথেই রুমানা বলল,
- “সরি নিপুণ। কালকে তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। প্লিজ তুমি মন খারাপ করে থেকোনা।”
নিপুণ এবারও কিছু বললো না। রিকশা পৌঁছে গেলো তার গন্তব্যস্থলে। ভাড়া মিটিয়ে রুমানা নেমে নিপুণকে যখন নামতে বলল তখন নিপুণ নামতে গিয়ে যেন সারহীন হয়ে গেলো। নিপুণ পড়ে যেতে নিলেই রুমানা ধরে ফেললো। তারপর আঁতকে উঠে বলল,
- “মাই গড! তোমার তো মনে হয় জ্বর এসেছে।”
নিপুণ এবার বলল, - “আমি ঠিক আছি। এই জ্বরে আমার কিছু হয়না।”
নিপুণ রুমে এসে কাপড় বদলে সাথেসাথেই লুটিয়ে পড়লো বিছানায়। ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে রুমানাও আর বিরক্ত করলোনা। ঘুম থেকে উঠলে ঔষধ খাওয়াবে। আবার ভাবলো সারাদিন মেয়েটা কিছু খায়নি। কিছু রান্না করবে? যেই ভাবা সেই কাজ। চটপট গরম গরম ভাত আর আলুসেদ্ধ করে ভর্তা করে নিলো। মরিচের ভর্তা আর শুটকির ভর্তাও করলো সাথে।
জ্বর শরীরে ঝাল খেতে মজা। এরপর নিপুণকে ডাকতে গিয়ে দেখে নিপুণ নেই। দরজা খোলা। রুমানা বাইরে গিয়ে দেখে নিপুণ একমনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। একটুও নড়ছেনা। তারপর নিপুণকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
- “তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? আবার ভিজছো কেন? মরতে চাও?”
নিপুণ প্রতিউত্তরে রুমানাকে জড়িয়ে ধরে বলল, - “ইউ নো রুমানা! আই লাভ বৃষ্টি। যখনই বৃষ্টি আসে তখনই আমি ভিজি। বৃষ্টি তো পবিত্র। বৃষ্টির পবিত্র পানি আমার মতো কলঙ্কিনীর শরীর থেকে সব অপবিত্রতা ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে।”
রুমানা বুঝলো নিপুণ এখন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তার গলা কাঁপছে। কাঁপছে পুরো শরীর। অদ্ভুত একটা ভয়ে মনটা ভরে গেলো রুমানার। কান্না পেয়ে গেল কেন যেন।
তড়িঘড়ি করে নিপুণকে ঘরে এনে জামা বদলে দিলো। তারপর নিজেই ভাত মেখে খায়িয়ে দিলো তাকে। এরপর ঔষধ খাইয়ে বিছানায় তার পাশে বসে রইলো। নিপুণ ঘুমাচ্ছে। এরপর হঠাৎ রুমানার হাত ধরে বলল,
- “জানো রুমানা, আমার বাবা মা কেউ নেই।”
ধ্বক করে উঠলো রুমানার বুক। নিপুণের বলা কথাটায় কি যেন একটা ছিলো। বুক ভারি হয়ে গেলো রুমানার। নিপুণ নামের হাসিখুশি এই মেয়েটার বুকের ভেতর এমন কষ্টভরা একটা নদী আছে তা কি কেউ বুঝেছিলো? মানুষ খুব অদ্ভুত। সবসময় নিজেকে লুকায়। কখনো অন্যের কাছে লুকায়, কখনোবা নিজের কাছে। নিপুণ নামের মেয়েটাও ঠিক তাই করছিলো।
পর্ব ৬
নিপুণ সেদিন মাঝরাতে হঠাৎ করে উঠে রুমানাকে ডেকে তুললো। ঘুমঘুম চোখে রুমানা উঠে বসলো। তারপর নিপুণ বলতে শুরু করলো,
- “আমি যখন অনেক ছোট তখন আমার মা- বাবা চলে যান আমাকে ছেড়ে। তারপর আমি আমার খালার বাসায় বড় হই। ওরা আমাকে দয়া করে দু’বেলা খেতে দিতো, বছরে দু’সেট জামা দিতো, পড়ালেখা ও করতে দিতো। বিনিময়ে আমি ওদের বাড়ির ছুটা কাজ করে দিতাম।
মিথ্যা বলবোনা, মোটামুটি সুখেই ছিলাম। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি, এসএসসি পরীক্ষায় বৃত্তি এমনকি এইচএসসি পরীক্ষায়ও বৃত্তি পাওয়ার কারণেই আমাকে এখনও ওরা পড়াচ্ছে। নয়তো সেই কবেই বিয়ে দিয়ে দিতো। অবশ্য বিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টাই করেছে ওরা। পরে কোনো এক কারণে বিয়েটা হয়নি। এইটুকু শুনে মনে হবে আমি অনেক সুখী একটা মেয়ে। তাইনা?”
রুমানা মাথা নাড়লো। নিপুণ আবার বলল,
- “এই গল্পটুকু সবাই জানে। বাকিটুকু জানে অল্প কয়েকজন। ওই অংশটুকু রয়ে গেছে আড়ালে। আড়ালে থাকা গল্পগুলো কেউ জানেনা। আজকে তুমি জানবে। জানতে চাও?”
রুমানা আবার মাথা নড়লো।
- “আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। রাত জেগে পড়াশোনা করতাম। আমার খালার একটা ছেলে ছিলো। আমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। ও সবসময় কোনো অজুহাত খুঁজতো যেন আমি ওর ঘরে যাই। কখনো পানি দিয়ে আসতে বলত, কখনো বলতো ওর জামাকাপড় ধুয়ে দিতে। কখনো ওর বিছানা পরিষ্কার করে দিতে বা মশারি টানিয়ে দিতে বলতো।
যার কারণে ওর ঘরে যেতে হতো আমাকে। আর এমন সময়েই আমাকে ডাকতো যে সময় খালা- খালু বাসায় নেই বা দূরে কোথাও আসছেন। আমি ওর রুমে গেলেই আমার গা ঘেষে দাঁড়াতো, আমাকে ছুঁতে চাইতো। আর আমি যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করে চলে আসতাম। একদিন খালু অফিসে, আর খালা পাশের এক বাড়িতে গিয়েছিল কোনো এক কাজে।
এই সুযোগে ও আমাকে তার রুমে ডাকলো, বলল ঘর ঝাড়ু দিতে। আমি তাকিয়ে দেখি ঘরে কোনো ময়লা নেই, সকালেই আমি ঘর ঝাড়ু দিয়ে মুছে দিয়েছিলাম। ওর ধমকে আবারও ঝাড়ু দেওয়া শুরু করলাম। এরইমাঝে ও আমাকে পেছন থেকে চেপে ধরলো। কোনোরকমে নিজের সম্মান নিয়ে পালিয়েছিলাম আমি। ব্যাপারটা খালাকে জানাতেই খালার মুখ কালো হয়ে গেলো। বলল এই ঘটনা যেন কাউকে না জানাই। তার বেশ কিছুদিন পরেই খালা ওনার ছেলেকে দূরে পাঠিয়ে দিলো। খালা মানুষটা বড্ড ভালো ছিলো। উনি যদি সেদিন ওনার ছেলের পক্ষ নিতো তাহলে হয়তো আমার আর ভালোভাবে বেঁচে থাকা হতোনা।”
এটুকু বলে হালকা হাসলো নিপুণ। ওর চোখের কোণে চিকচিক করছে পানি। রুমানা বলল,
- “এজন্যই তুমি বৃষ্টি এলে এভাবে ভিজতে?”
- “হ্যাঁ। আচ্ছা তোমার ঘুমে ডিস্টার্ব করলাম। ঘুমাও তুমি।”
রুমানা ওর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম আসলোনা। মাথার ভেতর ঘুরছে নিপুণের বলা কথাগুলো। রুমানার জীবনের সাথে নিপুণের জীবনের অদ্ভুত কিছু মিল রয়েছে। আবার অমিলও রয়েছে। রুমানা গিয়ে নিপুণকে আবার ডাকলো। বলল,
- “নিপুণ তুমি কি আমার বন্ধু হবে? অনেক কাছের বন্ধু। সাগরের মতো বন্ধু।”
নিপুণ এক মুহুর্ত চুপ থেকে সাথেসাথে বলল, - “হ্যাঁ হবো, খুব করে হবো।”
এরপর যেন সবকিছু পালটে গেলো। সবসময় চুপচাপ থাকা রুমানাও এখন প্রজাপতির মতো হয়ে গেছে। নিপুণ আর রুমানা প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতে লাগলো মনের আকাশে। একদিন রাতে আবারও ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। এবার নিপুণ একা ভিজলোনা, ভিজলো রুমানাও। ভিজতে ভিজতেই সাগরের কথা মনে পড়লো। রুমানা নিপুণকে বলল,
- “জানো নিপুণ, আমার একটা বন্ধু আছে সাগর। ছোট থেকে আমার সাথে আছে। ওর এক একটা কথা আমাকে আন্দোলিত করে প্রতি মুহূর্তে। ওর বদৌলতে আজ আমি এখানে, সাগরের কারণেই আজ আমি রুমানা।”
সবকিছু শুনে নিপুণের জবাব ছিলো,
- “ডু ইউ লাভ হিম?”
নিপুণের হঠাৎ এই প্রশ্নে দুই মিনিট স্তব্ধ হয়ে ছিলো রুমানা। কি বলছে এই মেয়ে! বলল, - “পাগল তুমি? ওকে আমি শুধু বন্ধু হিসেবেই দেখি।”
- “কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে তুমি সাগরের প্রেমের গভীর সাগরে পড়ে ডুবে গেছো। তোমার চোখই তার প্রমাণ দিচ্ছে।”
নিপুণের কথায় লজ্জায় লাল হয়ে গেলো রুমানা। সত্যিই কি সে সাগরকে ভালোবাসে? নিপুণ বলল,
- “বৃষ্টি হচ্ছে। তোমার সাগর তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। একটা ফোন করো।”
- “না না আমি পারবোনা। কি আশ্চর্য! আমার লজ্জা করছে।”
- “আমার মনে হচ্ছে সাগরও তোমাকে ভালোবাসে। তুমি ওকে ফোন করো নয়তো আমিই ফোন করে বলবো,
‘ ভাইয়া, আপনার বান্ধবী আপনার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে ডুবে গেছে। ওকে টেনে তুলুন'”
বলতে বলতে হেসে দিলো নিপুণ।
এরইমাঝে সাগরের ফোন এলো। রিসিভ করতেই বলল,
- “বাইরে আয় তো একটু।”
রুমানা হতবাক। সাগর থাকে সেই মিরপুরে৷ সেখান থেকে এসেছে! এই রাতের বেলায়! দৌড়ে বাইরে যেতেই দেখতে পেলো সাগর দাঁড়িয়ে আছে। সাগরের কাছে যেতেই সাগর বলল, - “তোকে আমি সারাজীবন কদম ফুল দিয়ে যেতে চাই। নিবি তুই?”
- “সারাজীবন কিভাবে দিবি, বর্ষাকাল ছাড়া তো কদম ফুল পাওয়া যায়না।”
রুমানার এমন কথায় বোকা হয়ে গেল সাগর। মাথা চুলকে বলল, - “আসলেই তো! তুই এত বোরিং কেন রুমানা? আমার প্রোপোজ পাংচার করে দিলি।”
রুমানা হেসে বলল, - “আই হেইট ইউ সাগর। তুই অনেক পঁচা।”
সাগর হেসে বলল, - “আই অলসো হেইট ইউ।”
পর্ব ৭ (অন্তিম পর্ব)
ফোনটা বাজছে রুমানার। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মায়ের গলা ভেসে আসলো,
- “রুমানা! কেমন আছিস?”
- “ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?”
- “আমিও ভালো আছিরে। পড়ালেখা কেমন চলছে? বাসায় আসবিনা?”
একথা শুনেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো রুমানার। বলল, - “তোমার স্বামী যেই কাজটা করেছে তার পরেও তুমি বলছো আমি ওই বাসায় যাবো?”
- “তুই তো জানিসই মানুষটা এমন। তাই বলে তুই বাসায় আসবি না?”
- “না আমি যাবোনা। তোমার স্বামী শান্তিতে থাকুক।”
- “এমন করিস না মা।”
- “আমি যাবো না মানে যাবোই না।”
- “ঠিক আছে ভালো থাকিস। এই বাসায় আর আসিস না তুই। আমি মরে গেলেও না।”
বলেই ফোন কেটে দিলো রুমানার মা। এতক্ষণ নিপুণ শুনছিলো রুমানার কথাগুলো। সে বলল, - “রুমানা, তোমার পরিবারের ব্যাপারে কিছুই জানিনা আমি। আবার আজকে বারবার তোমার বাবাকে তোমার মায়ের স্বামী বলে সম্বোধন করেছো। কেন?”
রুমানা ম্লান হাসলো। বলল, - “আমি যখন অনেক ছোট তখন আমার বাবা লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যান। বাবা বড়সড় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আর ওনার বন্ধু ছিলেন মিঃ আহনাফ। আব্বুর ব্যবসায়ের ব্যাপারে আম্মু তেমন কিছু জানতোনা। তো আব্বু মারা যাবার পর কোত্থেকে যেন ঋণদাতারা এলো।
বলল যে আব্বু নাকি ওদের কাছ থেকে অনেক অনেক টাকা ঋণ নিয়েছে। এখন সেগুলো আমাদের শোধ করতে হবে। ওই খারাপ অবস্থায় আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন ওই আহনাফ। প্রস্তাব দিলেন আম্মুকে বিয়ে করার। ওই লোকের স্ত্রী কয়েক বছর আগে ওনাকে ছেড়ে চলে গেছিলেন। আমাদের সমাজে পুরুষবিহীন কোনো নারী চলতে পারেনা।
আম্মু সবকিছু বিবেচনা করে বিয়ে করে নিলেন আহনাফকে। তারপর উনি আমাদের ব্যবসায়টা নিজের নামে করে নিলেন ওই ঋণদাতাদের টাকা পরিশোধ করার অযুহাতে। তার বেশ কদিন বাদে জানতে পারলো বাবার আরও কিছু ব্যবসায়ে বিনিয়োগ আছে যেটা থেকে প্রতি বছর অনেক মুনাফা আসে বাবার একাউন্টে। ওই টাকাগুলো বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে আমিই পাবো। বাবার একাউন্টে নমিনি হিসেবে আমিই ছিলাম।
ওই টাকার পরিমাণ অনেক বেশি। এই টাকাগুলোর জন্যে আমার আম্মুর স্বামী অনেকরকম চাল চেলেছেন। কিন্তু কোনো এক কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। যাকগে বাদ দাও ওসব কথা। এই হলো আমার কাহিনি। উনি আমার বাবা নন তাই আমি ওনাকে বাবা বলে ডাকিওনা।”
এটুকু বলে আবারও হাসলো রুমানা। নিপুণ কি বলবে বুঝতে পারলোনা। চুপচাপ বসে রইলো। চারদিক নিশ্চুপ। এই নিরবতার মাঝেই দেওয়া- নেওয়া হয়ে গেলো অনেক অনেক কথা।
স্বপ্নের মতো দিনগুলো কেটে গেলো। রুমানা, নিপুণের বিবিএ শেষ হয়ে গেলো। নিপুণ স্কলারশিপের চেষ্টা করতেই পেয়ে গেলো। কাগজপত্র সব রেডি করে আর কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাবে অন্য এক দেশে। একদিন রাতে হঠাৎ করেই আকাশ গর্জন করে বৃষ্টি এলো। আকাশ ভাঙা বৃষ্টি যাকে বলে। নিপুণ বলল,
- “ইশ! কানাডায় গিয়ে এমন বৃষ্টি কি পাবো? তোমাকে ছাড়া আমার বৃষ্টি এখন আর ভালো লাগেনা রুমানা।”
নিপুণের এই কথায় রুমানা হাসলো। বলল, - “তাহলে চলো এখন ভিজে নেই। স্মৃতি হিসেবে রয়ে যাবে আগামী ৪ বছর।”
দুই বান্ধবী ইচ্ছামত ভিজলো বৃষ্টিতে। তারপরই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বুক ভারি হয়ে এলো দুজনেরই। আবার কবে দেখা হবে দুজনের! বোনের মতো হয়ে গেছে সম্পর্কটা। একজন আরেকজনকে ছেড়ে কখনো থাকেনি এতদিন। ভাবতেই কান্না এসে গেলো রুমানার। বৃষ্টির সাথে সাথে ধুয়ে গেলো চোখের নোনাজলটুকু।
আজ নিপুণ চলে যাবে। এয়ারপোর্টে ওকে ছাড়তে এসেছে সাগর আর রুমানা। সাগর, রুমানাকে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলতেই রুমানা রেগে গিয়ে কিল বসালো সাগরের পিঠে। সাগরও রুমানার চুল ধরে আলতো করে টেনে দিলো। ওদের এমন ঝগড়াঝাটি সবসময়ই চলতে থাকে। আজকে কেন যেন ওদের এই খুনসুটি দেখে নিপুণের খুব ভালো লাগছে। মুচকি হেসে পা বাড়ালো ওদের দিকে। একটু পরেই মাইগ্রেশনের জন্য যেতে হবে। তারপর এক উড়ালে কানাডা, মেপলের দেশ। রুমানাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
- “তোকে অনেক মিস করবো রে। অনেএএক।”
রুমানা অবাক হলো। চার বছরের বন্ধুত্বে নিপুণ কখনো ওকে তুই করে বলেনি। অনেক ব্ল্যাকমেইল করেও তুই বলাতে পারেনি রুমানা। আজ তুই করে বলছে। আনন্দে চোখে জল এসে গেলো রুমানার। নাক টেনে টেনে বলল, - “আমিও তোকে অনেক মিস করবো নিপুণ।”
নিপুণ রুমানাকে দেখে হেসে ফেলল,
- “এভাবে নাক টেনে কেউ কাঁদে? পাগল।”
তারপর সাগরকে বলল, - “আমার পাগলী বান্ধবীটাকে দেখে রেখো কিন্তু। আর জলদি ওকে নিয়ে যাও। তোমার বিরহে বান্ধবী আমার রাত বিরাতে মুড়ি ভেজে খায়।”
এটা বলতেই রুমানা নিপুণকে একটা চিমটি দিলো। নিপুণ হেসে হেসে বলল, - “যাই রে আবার দেখা হবে।”
- “যাই বলতে নেই। বল আসছি।”
- “হু আসছি।”
যাওয়ার পথে একবার পিছু ফিরে দেখলো রুমানা একইভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে এলো তার।
৪ বছর পর। ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। রুমানা দৌড়ে গেলো বারান্দায়। এই বাসার বারান্দাটা এভাবেই তৈরি। বৃষ্টিতে ভেজা যায়। টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়ে ভিজে যাচ্ছে রুমানা। বৃষ্টির ফোঁটাগুলা যেন ওর গায়ে লাগছেনা, লাগছে বুকের ভেতরটায়। ডুকরে কেঁদে উঠলো রুমানা। নিপুণের কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে তার। সেদিনও এমন বৃষ্টি হচ্ছিলো। বৃষ্টির সাথে মন খারাপের ঝুলিও এসেছিলো রুমানার মনে।কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে রেডিও শুনছিলো রুমানা। এরকম সময়েই খবরটা নিয়ে এলো সাগর। হন্তদন্ত হয়ে বলল,
- “নিপুণদের প্লেনটা ক্র্যাশ করেছে। একজন যাত্রীও বেঁচে নেই।”
সাগরের কথাটা সম্পূর্ণ শুনতে পায়নি রুমানা। তার কানে শুধু প্রথম লাইনটুকুই গিয়েছে। নিপুণদের প্লেনটা ক্র্যাশ করেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই রুমানা। কানে বাজছে রেডিও জকি নাইমা হাসানের আবেগ মেশানো কথাগুলো, - “আচ্ছা! ওই মুহুর্তের অনুভূতিটা কেমন যখন তোমার প্রিয় মানুষটা চলে যায় না ফেরার দেশে? ওই মানুষটার সাথে আর কোনোদিন দেখা হবেনা, কথা হবেনা, ছুঁয়ে দেখা হবেনা একটাবার। ভাবলে ঠিক কেমন লাগে?”
অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে রুমানা বিড়বিড় করে বলল,
- “বড্ড দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে।”
নিজের হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত করে দিয়ে রুমানা বলল,
- “নিপুণ দেখেছিস! তোর পছন্দের বৃষ্টিকে আমি বুকে জড়িয়ে রেখেছি। দেখছিস তুই? তোর ভালোবাসার বৃষ্টিকে আমিও এখন খুব ভালোবাসি। খুব বেশি ভালোবাসি।”
লেখা – জান্নাত
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “বৃষ্টি – ভালোবাসার ছোট গল্প fb”গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ুন – একজন সৎ পুলিশ অফিসার – দেশের জন্য ভালোবাসা