মেয়েটার হাত দুটো কেমন কালো কালো ছিল? দেখেছো মা? আর একেবারেই শুকনা রোগাটে টাইপের একটা, তেমন হাইট ও নেই! না মা, এই মেয়ে ভাইয়ার সাথে একেবারেই যায় না! আরেকটা কনে দেখা পর্ব শেষ করে গাড়িতে উঠতেই নায়লা মতামত বর্ণনায়!
নায়লা আমার একমাত্র ছোট বোন, অনেক আদরের। ও আর মা গত দুই বছর ধরে বিপুল আগ্রহ নিয়ে হন্যে হয়ে আমার জন্য পাত্রী খুঁজে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত আজ ওরা কত নম্বর পাত্রী দেখেছে, এই তথ্যটা দুজনের কেউই বলতে পারবে না। আমি কিন্তু ঠিকই গুনে রেখেছি! এই মাত্র আমরা সতের নম্বর কনে দেখলাম গুলশান আড়ংয়ের এই ক্যাফেটাতে!
নায়লার পাত্রী দেখার এ প্রজেক্টে ইদানিং আমার প্রচন্ড বিরক্তি! প্রায় ছুটির দিনই মা আর নায়লা এক প্রকার জোর করেই বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়, কনে দেখাবে বলে! পাত্রী দেখা হয়, তবে কেনো জানি কথাবার্তার চেয়ে খাওয়া দাওয়াতেই সবার মনোযোগ! এখনো পযর্ন্ত কোন প্রস্তাবই আর এগোয়নি!
নায়লার বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক হতে চললো। ওর হাসব্যান্ড সোহেল, পেশায় ব্যস্ত ব্যাংকার। অসম্ভব ভালো একটা ছেলে, থাকে উত্তরায়। কনে দেখা প্রজেক্টের অন্যতম সদস্য এই সোহেল, প্রতিটা ইভেন্টেই আসে সম্ভবত বউয়ের নির্দেশে!
আজকের এই কনে দেখার পর্বেও বরাবরের মতো নায়লার নেতৃত্বে মা, সোহেল আর আমি। কনে পেশায় ব্যাংকার, নামী একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস গ্র্যাজুয়েট। লালমাটিয়া থেকে বেশ কষ্ট করে বড় বোনকে নিয়ে এই গুলশানে এসেছে, আমাদের সাথে দেখা করতে।
সত্যি বলতে কি, এক রাশ মুগ্ধতা নিয়েই মেয়েটার সাথে পুরোটা সময় কাটালাম। নিঃসন্দেহে অসম্ভব স্মার্ট আর গুনী মেয়ে, অল্প আলাপেই তা বুঝে গেলাম। বতর্মানে বেসরকারী একটা ব্যাংকের ধানমন্ডি ব্রাঞ্চে আছে!
আমার জন্য পৃথিবীর সবচাইতে সেরা কনে খোঁজার চেষ্টায় নায়লা। তবে ওর এপ্রোচটায় ইদানিং আমি যারপরনাই বিরক্ত! গভীর পর্যবেক্ষণের পর বুঝলাম, ও পাত্রী দেখতেই যায় নেগেটিভ এটিচুড নিয়ে! কনে দেখার এক মিনিটের মধ্যেই ওর সিদ্ধান্ত বুঝে ফেলি, ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে! অল্প সময়েই পাত্রীর হাজারো খুঁত কিভাবে যে ও বের করে ফেলে, এটা আজো বড় এক রহস্য। আমি আর মা অবশ্য পাত্রী পছন্দের বিষয়ে ওর সিদ্ধান্তেই চলি! সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্ট বলে কথা!
আজকের এই কনের নাম শিলা। অসম্ভব রূপবতী, এতে কোন সন্দেহ নেই! গায়ের রং হয়তো ধবধবে সাদা নয়। কিন্তু তাতে কি? মেয়েটা পুরো সময় সৌন্দর্যের আলো ছড়িয়েই নিজের উপস্হিতি জানান দিয়ে গেছে। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ ফেরাতে পারিনি। তার উপর বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ও পেয়েছি ওর বলা প্রতিটা কথায়!
লন্ডন বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ করেছি, এটা শুনেই ঐ প্রোগ্রাম সম্পর্কে এক গাদা ইনফরমেশন বলে দিল। অবাক হলাম। এমনকি আমি রিজেন্টস পার্ক ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করেছি কিনা? সেটা জানতে চাইলে, বুঝলাম ও আর আট দশটা মেয়ের চেয়ে ভিন্নই! ওর জগতটা অনেক বিস্তৃত, ভীষণ ওপেন মাইন্ডেড!
শিলা ভালো রবীন্দ্র সংগীত গায়, বাফার ধানমন্ডি ব্রাঞ্চের এক সময়ের স্টুডেন্ট, এই তথ্যটা জেনেও বেশ ভালো লাগলো। সবমিলিয়ে ওর সাথে কাটানো এক ঘন্টাকে মিনিট খানেক বলেই মনে হল! অনেকদিন পর ভালো সময় কাটালাম। দূরে যেতে হবে বলে ওদের উঠে যাওয়ার তাড়া ছিল, বাধ্য হয়েই পর্বটাকে সংক্ষেপ করতে হলো। পুরো সময়টাতেই কনে ও তার বড় বোনের ভদ্রতা প্রশংসনীয় ছিল!
গাড়িতে উঠেই নায়লার কনে দেখার মতামত শুনে খানিকটা বিরক্ত হলাম। আরো আশ্চর্য হলাম পাত্রীর নাকি একটু “লাজ শরম কম” কথাটা শুনেই।
ওর দাবীর পক্ষে মাকে বলা “দেখেছো মা, মেয়েটা ভাইয়ার সাথে কিভাবে গায়ে পরে কথা বলছিল?”
কথাটা জোরদার করতে পরক্ষনেই ওর স্বামী সোহেলকে ওর জিজ্ঞেস “আচ্ছা সোহেল তুমিই বলো, যেদিন আমাকে দেখতে এসেছিলে, তোমার সাথে কি আমি একটা কথাও বলেছিলাম?”
সোহেলের উত্তরের তোয়াক্কা না করে ওর নিজের উত্তর ” না, বলিনি। তোমার চেহারাই সেদিন আমি ভালো করে দেখিনি। আর এই মেয়ে কিনা সারাক্ষণ ভাইয়ার সাথে বকবক করেই গেল।” আমি, মা আর গাড়ি চালনারত সোহেল নায়লার একতরফা কথার নির্বাক শ্রোতা!
বরাবরের মত এই প্রস্তাবটাও অঙ্কুরেই শেষ, আমার মতামতের তোয়াক্কা না করেই! নায়লাই ফোনে বিয়ের মধ্যস্হতাকারিকে জানিয়ে দেয়, কনে পছন্দ হয়নি। এরপর ওর নতুন পাত্রীর সন্ধানে নামা, ঠিক আগের মতো করেই।
শিলা নিঃসন্দেহে আমার মন ছুঁয়েছে, সারাক্ষণই মাথায় ঘুরছে বুদ্ধিদীপ্ত ও রূপবতী এই মেয়েটাকে। ওর চাহনী, কথা বলার স্টাইল আর ডিসকাশন টপিকস গুলো, ওর সম্পর্কে আমাকে ভিন্ন ধারনা দিয়ে গেছে। মেয়েটা অসম্ভব রূপবতীও। মেধা আর সৌন্দর্য সব কিছু মিলিয়ে শিলা বেশ স্পেশাল, অন্ততপক্ষে আমার কাছে।
পরপর দু রাত শিলার ভাবনায় ঘুমোতে না পেরে, লাঞ্চ ব্রেকের পর অফিস ছুটি নিয়ে শিলার ব্যাংকে চলে এলাম! ধানমন্ডিতে। গুলশান থেকে জ্যাম ঠেলে পৌঁছুলাম, অফিস ছুটির একটু আগে আগে।
দুরু দুরু বুকে ব্যাংকে ঢুকতেই দেখি শিলা। চোখে পড়ার মতো ব্যাক্তিত্ব নিয়ে ডেস্কে একমনে কাজে ব্যস্ত। আমার দিকে চোখ পড়তেই, খানিকটা অবিশ্বাস নিয়ে বলে উঠলো” আরে আপনি? এখানে?”
সাথে সাথে ওর আশেপাশের কলিগদের এটেনশন পেলাম, অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ আগ্রহ ভরে আমাকে দেখছে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই চিরচারিত সেই মিথ্যেটা “না, পাশ দিয়েই যাচ্ছিলিম। ভাবলাম আপনার সাথে একটু দেখা করে যাই!”
“খুব খুশী হলাম। একটু বসুন। আমি মিনিট দশেকের মধ্যেই ফ্রি হয়ে যাব।” বুদ্ধিদীপ্ত চাহনীতে আমার প্ল্যানটা বুঝে যাওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল! নিজেই আমার জন্য দ্রুত চায়ের ব্যবস্হা করে, শেষ মুহূর্তের কাজের ব্যস্ততায় ডুবে গেলো।
মুগ্ধতা নিয়ে চোরা চোখে শিলাকে দেখতে লাগলাম, ভীষণ ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে। ওর দু একজন কলিগ পুরো বিষয়টিতেই সজাগ ছিলো, হয়তো ধরাও খেয়ে গেলাম অভিজ্ঞদের কাছে। হু কেয়ার্স?
অফিস শেষে শিলা কাছের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল, ওখানকার চাইনিজ ফুড ভালো বলে। অনেকটা সময় কাটলো উদ্দেশ্যহীন কথাবার্তা বলে।
এরপর টানা দুমাস আমাদের ফোনে কথা হয়, মাঝে মধ্যে ধানমন্ডি বা তার আশেপাশে ঢু মারা। এরপর শিলাকে বিয়ে করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্তটা একদিন বাসায় জানিয়ে দিলাম। মা বাবা দুজনেই এতে বেশ খুশী, শেষ পযর্ন্ত নিজের পছন্দের মেয়ে খুঁজে পেয়েছি বলে।
বিপত্তি ঘটলো নায়লাকে নিয়েই। খবরটা শুনেই, আধ ঘন্টার মধ্যে সোহেলকে নিয়ে উত্তরা থেকে ও বনানীতে। এসেই আমার কাছ থেকে তথ্যটা কনফার্ম হল, এই শিলা কি সেই শিলা?
নিশ্চিত হতেই বেশ ব্যথিত হলো। তবে ওর কষ্ট কি পাত্রী দেখার প্রজেক্টটা শেষ হয়ে যাওয়াতে, না শিলাকে নেওয়ার বিয়ের চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে, তা বুঝতে পারিনি। সত্যি বলতে কি বোঝার চেষ্টাও করিনি! আমার সিদ্ধান্তটা যে অনেক ভেবেই নেওয়া, নিশ্চিত হয়েই।
আমার কাছে পাত্তা না পেয়ে নায়লা বেশ খানিকক্ষণ শিলার খুঁতগুলো মায়ের সাথে আলোচনা করতে চাইলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। শেষমেশ সোহেলকে নিয়ে রাতের খাবার না খেয়েই চলে গেল, সম্ভবত অভিমান করে!
আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী! বেশ জাকজমক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই শিলাকে বিয়ে করেছিলাম আজ থেকে দশ বছর আগে। দেখতে দেখতে কিভাবে যে এতটা সময় বয়ে গেল, অবিশ্বাস্য! মাঝখানের এ সময়টায় সংসারে বাড়তি আরো দুজন যোগ হয়েছে। আমাদের দুকন্যা জারা আর মাইশা। অবিকল মায়ের মতোই। অসম্ভব রূপবতী ও মেধাবী।
হাসি ঠাট্রা, মান অভিমান আর সুখ দুঃখে দশটি বছর পাড়ি দেওয়া এ পথটায় কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও শিলার সৌন্দর্যের কোন কমতি নেই। অফিস যেদিন স্ট্রেসফুল যায়, অপেক্ষায় থাকি ওর মন ভালো করা হাসিটার জন্যে!
আজ ঘুম থেকে উঠে শিলা বিশাল বড় একটা ফুলের তোড়া আর ওর প্রিয় ডায়মন্ডের দুল জোড়া উপহার পেয়ে ভুবনমোহনী হাসিটা দিল। আমিও খুশিতে আমাদের দুজনেরই ভীষণ পছন্দের সেই গান
“আমি তোমারো সঙ্গে বেধেঁছি আমারো প্রান, সুরেরও বাঁধনে……..”
বেসুরো গলায় গাইতে শুরু করলাম! বরাবরের মতোই বিরক্তির অভিব্যক্তি দেখিয়ে শিলা হাত দিয়ে কান ঢাকার চেষ্টায়! আমি কিন্তু গানেই আছি। খুব ভালো করেই জানা, যতো বেসুরোই হোক না কেনো, আমার গাওয়া এ গানটা যে ওর অনেক প্রিয়, ভীষণ রকমের!
কনে দেখা (New Love Life Story)
ইমাম হোসেন
আরো পড়ুন –