জ্বীনবর (সিজন ৪) – ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প শোনাও

জ্বীনবর (সিজন ৪) – ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প শোনাও: ভেবেই কান্না পাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল ছাদবাগানের গাছ গুলো সশব্দে নড়ে উঠল। মনে হল খুব জোরে কেউ কিছু ছুড়ে মেরেছে। আতকে উঠে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, কে ওখানে?


পর্ব ১

লেখিকাঃ আস্থা রাহমান শান্ত্বনা
উঠোনে দাঁড়িয়ে নিজের যত্নে লাগানো গাছের ফুলগুলো দেখছিলাম। পড়ন্ত বিকালে র রোদে কত সুন্দর দেখাচ্ছে তাদের! আল্লাহর সৃষ্টি কতই না অপরুপ সুন্দর। সাত-পাঁচ ভেবে উদাসীন হতেই নিচের ঘর থেকে দাদীমার ডাক এল।

“মুসকান, ও মুসকান। কই গেলি আপু?”

কানে আসতেই দেরী না করে নিচের ঘরে চলে গেলাম। এসে দেখি দাদীমা অনবরত কাশছে। তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে পানি নিয়ে এসে তার হাতে দিলাম। দাদীমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম,
~ এখন একটু ভালোলাগছে দাদী?

দাদীমা একটু মুচকি হেসে কপালে একটা চুমু একে দিল। তারপর বলল,
~ লক্ষী আপু আমার। তোর টিউশনিতে যাওয়ার সময় হয়ে গেছেনা?
আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ। আচ্ছা আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।
দাদীমা আমার হাত চেপে বলল, কিছু খেয়ে যাবিনা? আসতে আসতে সেই সন্ধ্যে গড়াবে। চুপ থেকে বললাম,
~ ওখানে নাস্তা দেয় দাদী। সেটা খাই তো।

দাদীমা হয়ত কিছু আচ করতে পেরেছে। উঠে গিয়ে তার মাটির ব্যাংক খুচিয়ে খুচিয়ে ২০টাকা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, তাও কিছু খেয়ে নিস।
আমি মাথা নিচু করে টাকাটা নিলাম। এই অবধি আমার জন্য দাদীমার শখের ব্যাংক থেকে যে কত টাকা খুচিয়ে বের করতে হয়েছে তার হিসেব হয়ত তার নিজেরও জানা নেই। না ও করতে পারিনা, করলেই ওমনি পাজি বুড়ো কেদে দেয়।
বোরকাটা গায়ে জড়িয়ে ওড়না দিয়ে মুখ ডেকে নিতেই কাকি এসে হাজির।
~ কই যাওয়া হচ্ছে মহারাণীর?
~ টিউশনিতে।

~ কাজ ফাকি দেওয়ার জন্য তো প্রতিদিন ই যাওয়া হয় জানি। ঢেং ঢেং করে যে বের হচ্ছিস, দুপুরের এটো বাসনপত্র ধুয়েছিস? উঠোন কুড়িয়ে মুরগীগুলোকে খাইয়েছিস?
~ সব করেছি। ভুলে যাইনি কিছু। এখন আমি আসি?

কাকি আর কিছু বললনা, মুখ ভেঙ্গচিয়ে নিজের কাজে চলে গেল।
রোজকার অপমান, হাজারো খোটা-ভেঙ্গচি এখন গায়ে সয়ে গেছে। অন্যের সংসারে বোঝা হয়ে থাকলে যা হয়!
বাড়ি থেকে ২০মিনিটের দূরত্বে ৩টে টিউশনি করাই। তার টাকায় আমার হাতখরচ আর দাদীমার টুকটাক ওষুধপত্র হয়ে যায়। দাদাভাই যতদিন বেচে ছিলেন এত চিন্তা করতে হয়নি, হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করিয়েছেন।

তখন নিজেকে সংসারের বোঝা মনে হতনা, পরিবারের একজন ই ভাবতাম।
কিছুমাস আগে দাদাভাই গত হয়েছেন, তখন থেকেই কাকির কাছে আমি একপ্রকার বোঝা। মা-বাপ মরা মেয়ের একমাত্র সহায় এই দাদীমা ই।
সারাদিন গাধার মত খেটেও কাকির মন পাইনা, দাদীমাও আমার জন্য কম কথা শুনেননা।
আজও ফিরতে বেশ দেরী হয়ে গেছে। সন্ধ্যে গড়িয়ে যাচ্ছে, ছাত্রদের পরীক্ষা এলে তাদের থেকে বেশী প্যারায় আমি ই থাকি। ছোট ফোনটার ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে একা একা হাটছি। পুরো রাস্তাটা এখন নির্জন, লোকবল নেই বললেই চলে। হালকা ভয় ভয় করতে লাগল। ব্যাগ থেকে কেনা বিস্কুটগুলো বের করে খেতে আরম্ভ করলাম যাতে মনোযোগ অন্যদিকে থাকে আর ভয় না পাই।

এমন সময় কে যেন আমার পাশে এত জোরে দৌড় দিল, তার সাথে ধাক্কা খেয়ে আমার ফোন,ব্যাগ- শেষ সম্বল বিস্কুট ও মাটিতে চিৎপাত। মূহুর্তে চিন্তা করলাম এত জোরে দৌড়াচ্ছে যেহেতু এটা চোর ই হবে। এইবার চেচিয়ে চেচিয়ে বলতে লাগলাম, চোর! চোর!
একটুপর চোর ব্যক্তিটি ফিরে এসে বললাম, ষাড়ের মত চোর চোর করে চেচাচ্ছেন কেন? চোর কোথায় পেলেন আপনি?
~ এত জোরে দৌড়াচ্ছেন, চোর না বলে কি বলব? দেখুন আমার সব ফেলে দিয়েছেন। ব্যক্তিটি কিছুটা বিরক্ত হয়ে মাটি থেকে ফোন আর ব্যাগ উঠিয়ে আমার হাতে দিল। আমি বিস্কুটগুলোর দিকে তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী মুখ করে ফেললাম।

ফোনের ফ্ল্যাশ তার দিকে দিয়ে দেখে নিলাম তাকে। ২০-২১ বয়সী একটা সুন্দর ছেলে। মুখটা একদম লাল টমেটো হয়ে গেছে। চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। বললাম, দিলেন তো আমার বিস্কুটগুলো ফেলে। ব্যাটা চোর কোথাকার!
কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে ছেলেটি বলল, ভদ্রতা জানেন না নাকি! চোখে এভাবে আলো ফেলছেন কেন? আমি তো ইচ্ছে করে ফেলিনি। আমি দুঃখিত এর জন্য।
~ আপনার দুঃখিত দিয়ে আমি কি করব?
আমার বিস্কুটগুলা!

ছেলেটা আমার কাদো কাদো মুখ দেখে অট্টহাসি হাসতে লাগল।
~ আপনাকে কি এখন বিস্কুট কিনে দিতে হবে?
~ লাগবেনা। ব্যাটা চোর কোথাকার।
আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা দ্রুত হেটে চলে এলাম ওখান থেকে।
এটুকু বুঝতে পেরেছি যে ছেলেটা ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাকে আচ্ছামত বকাঝকা করেছে। করুকগে তাতে আমার কি!

ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে দাদীমা উঠোনে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। আসামাত্র জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, এত দেরী করলি কেন? জানিস না এই বুড়িটার টেনশান হয়?
আমি মুচকি হেসে বললাম, বুড়ো হয়েছো কিন্তু টেনশান করার রোগ টা গেলনা।
কাকী বাহিরে এসে বলল, এত দেরী দেখে আমি তো ভাবলাম কোন ছেলের সাথে পালিয়ে টালিয়ে গিয়েছিস? দাদীমা কিছু বলতে চাইলে বাধা দিলাম।
মুচকি হেসে বললাম, কোনো কাজ পড়ে আছে কাকী?
~ কাজের কি শেষ আছে নাকি? সারাদিন আমি খেটে মরি কি সাধে!
রান্নাঘরে তোর জন্য পান্তা রাখা আছে, খেয়ে আমায় উদ্ধার কর।

দাদীমা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আজ ভালমন্দ রান্না হলেও আমাকে পান্তা খেতে হবে এটা জানা কথা। নিশ্চয়ই দাদীমাকেও আজ দুধভাত দিয়েছি তাই আমার জন্য লুকিয়ে কিছুটা রাখার অবকাশ পাননি। নিজে খাবেনা, আমার জন্য লুকিয়ে রেখে দিবে।
ধরা পড়লে দাদীমার ভালমন্দ খাবার বন্ধ করতে দেরী করবেনা কাকী।
শরীর টলছিলনা এতটা খাটনীর পর। ক্ষুধা ও বেশি লেগেছে তাই অল্প পান্তায় পেট ভরেনি। এই জন্য ঘুম ও আসছেনা। উঠে একটু পায়চারী করার জন্য ছাদে গেলাম।
খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে আকাশে, হালকা বাতাস ও আছে। রেলিং এর পাশে বসে একদৃষ্টিতে চাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

খুব বোরিং হয়ে গেছে জীবনটা, মাঝে মাঝে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দাদীমার মুখের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছেটা কে মাটিচাপা দেই। কিন্তু যেদিন দাদীমা থাকবেনা সেদিন আমার কি হবে? কে পাশে থাকবে আমার?
ভেবেই কান্না পাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল ছাদবাগানের গাছ গুলো সশব্দে নড়ে উঠল। মনে হল খুব জোরে কেউ কিছু ছুড়ে মেরেছে। আতকে উঠে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, কে ওখানে?


পর্ব ২

ছাদবাগানের ক্যাকটাসের ঝোপের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। ভয় ও লাগছিল যেহেতু হাতে লাইট নেই, বারান্দায় জ্বালানো বাতির আবছা আলো এসে পড়েছে এদিকে। ঝোপের কাছে যেতেই দেখলাম একজোড়া জ্বলজ্বল করা সবুজ চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। তখনি বিড়ালটা মিও করে ডেকে উঠল। একটু আশস্ত হলেও ভাবনায় পড়লাম। এত রাতে কার বিড়াল এই উচু ছাদে লাফিয়ে পড়ল! পায়ে তরল কিছু স্পর্শ লাগতেই সরে দাড়ালাম।

ভালো করে দেখলাম কালো বিড়ালটার পা থেকে রক্ত ঝড়ছে। হয়ত ক্যাকটাসের কাটা পায়ে ফুটেছে। দেখে খারাপ লাগল অনেক। অবুঝ প্রাণীটার বেশ কষ্ট হচ্ছে। প্রাণীপ্রেমি হলেও কালো বিড়াল ধরতে আমার একটু অস্বস্তি হয়, তাও একে টেনে কোলে নিলাম। ভয় ছিল আচড় কাটবে নাকি, সে তেমন কিছু করলনা। ব্যথা কোকড়ে আমার কোলে শক্ত হয়ে বসে রইল।

ছাদ থেকে নেমে নিজের ঘরে চলে আসলাম। কোল থেকে নামিয়ে মেঝেতে রেখে ফার্স্ট এইড বক্স এনে কাটা তুলে ব্যান্ডেজ করে দিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার এর মধ্যে সে একবারো ডাক দেয়নি, অপলক আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কালো হলেও চোখ দুটো বেশ মায়াবী তার। আমি তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~ ব্যথা করছে? সে চুপচাপ চোখ বুজে আমার হাতের স্পর্শের আরাম নিচ্ছিল।

উদাসমনে তার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলাম,
~ এই অসুস্থ অবস্থায় তোকে রাখতে চাইলেও আমার রাখার সাধ্য নেই। কাকী কোনো প্রাণী পোষা পছন্দ করেনা। সকাল হলেই তোকে বাহিরে ছেড়ে আসব। ভুল করেও কখনো এই বাড়ীতে আসিস না। কাকা দেখলে পা ভেঙ্গে দিবে নতুবা মেরে ফেলে দিয়ে আসবে।
বিড়ালটা আমার দিকে তাকিয়ে একবার মিও ডাক দিল। আমি খাটের নিচ থেকে একটা ছোট্ট চৌকি বের করে ওকে শুইয়ে দিয়ে খাটের কোণায় রেখে শুয়ে পড়লাম।

সকালে কাকীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গল। ও ঘর থেকে চেচাতে চেচাতে আমার ঘরের দিকে আসছে, কিরে মহারাণী। এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি আপনার? সারারাত কি চুরি করলি না চোর পাহাড়া দিলি?
ধড়পড়িয়ে উঠে বসলাম। কাকী এদিকে আসছে তাহলে তো বিড়ালটা দেখে ফেলবে। বাসায় বিড়াল ঢুকানোর শাস্তিস্বরুপ আমার আজ সারাদিন ভাত না জুটলেও আফসোস নেই, কিন্তু নিরীহ জীবটা রেহাই পাবেনা। ভেবেই খাট থেকে নামতেই কাকী এসে ঘরে ঢুকল। আমার চুলের মুঠি ধরে বলল, এত করে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিসনা।

আমি ব্যথা পেয়ে বললাম, কাকী, ব্যথা পাচ্ছি। রাতে ঘুম আসতে দেরী হওয়ায় উঠতে দেরী হয়ে গেছে। আমি এক্ষুনি সব কাজ করে দিচ্ছি।
কাকী রাগান্বিতস্বরে বলল, দেরী হল কেন? নাগর জুটাইলি নাকি? ঘাড়ের উপর বসে হঠাৎ চুপ মেরে আমার চুলের মুঠি ছেড়ে খাটের কোণার দিকে গেল। আমার দুশ্চিন্তা এবার সীমা ছাড়িয়ে গেল, এবার নিশ্চয়ই কাকী বিড়ালটা দেখে ফেলবে।

আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, চৌকিটা এখানে কেন? এটা তো খাটের নিচে ছিল।
উকি মেরে দেখি চৌকিতে বিড়ালটা নেই। মস্তবড় হাফ ছেড়ে বাচলাম। আমতা আমতা করে বললাম, ময়লা হয়ে গেছে তাই ধোয়ার জন্য বের করলাম।

~ তাড়াতাড়ি এসে কাজগুলো শেষ কর। আমি যাচ্ছি। বলে কাকী বেরিয়ে গেল।
পুরো রুম ঘুরেও বিড়ালটাকে দেখলামনা। নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কাজে মন দিলাম।
দাদীমার ঘরে গিয়ে দেখলাম উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। কাল ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ছিলাম। তার রেশ এখনো কাটেনি। ওষুধ ও ফুরিয়ে গেছে, ওষুধ ঠিকমত না খেলে আবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় উনার। কাকাকে একবার বলে দেখি যদি কিছু টাকা দেয় ওষুধ নিয়ে আসব। বিকালে কাকাকে বলতেই উনার সোজা উত্তর দিলেন,
~ আধমরা বুড়ির জন্য আর এক টাকা ও খরচ করতে পারবনা। টাকা কি গাছে ধরে নাকি? আর তুই তো কিসব করে বেড়াস, টাকা যায় কই?

~ কাকা, মাস তো শেষ হয়নি। তাই টিউওশনির টাকা এখন পাবনা।
যা ছিল কিছুদিন আগে দাদীকে ডাক্তার দেখানোর পিছনে শেষ হয়ে গেছে। তুমি আমায় ৫০০টাকা ধার দাও। কথা দিচ্ছি, টাকা হাতে পেলে তোমায় দিয়ে দিব।
~ যা ভাগ তো, এখন আমার কাছে এক পয়সা ও নেই।
মন খারাপ করে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম এমনসময় কাকার ছেলে ১১বছর বয়সী মুজাম্মেল ঢুকে তার নতুন জামা কিনে দেওয়ার বায়না ধরল। কাকাও এখনি কিনে দিবে বলে বেরিয়ে গেল তার সাথে।

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিউশনির জন্য বেরিয়ে পড়লাম।
নির্জন রাস্তা দিয়ে যেতেই ভীষণ বাতাস শুরু হল। অদ্ভুত লাগল এতক্ষণ কড়কড়ে রোদ ছিল, হঠাৎ এত ঝড়ো বাতাস কোথা এল? ধুলো সব চোখে ঢুকছে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা।
টাল সামলাতে না পেরে চোখ হাত দিয়ে ঢেকে পিছু নামছি। ভুলেই গেছিলাম উচু রাস্তার কিনারায় বিরাট জঙ্গলে পানিভর্তি গভীর খাদ। পিছু নামতেই নুড়িপাথরের সাথে হোচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। ভয় পেয়ে গেলাম, আমি তো এখন সোজা গভীর খাদে পড়ে যাব। যে নির্জন রাস্তা কেউ আসতে আসতে আমার লাশ ভেসে উঠবে।

হঠাৎ একটা ঠান্ডা বলিষ্ঠ হাত আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল, পড়তে গিয়ে পড়লাম না। চোখে ধুলো যাওয়ায় পুরোপুরি চোখ খুলতে পারছিলামনা। হালকা মেলে দেখলাম কালকের ছেলেটা আমার হাত ধরে আছে। চোখ জ্বলছে তাই আবার হাত দিয়ে চেপে ধরে বললাম, আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন? ছাড়ুন বলছি।

এত সাহস কেন আপনার? অচেনা একটা মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন?
ছেলেটা শান্তকন্ঠে বলল, ছেড়ে দিব?
~ তো কি ধরে রাখবেন? ছাড়ুন বলছি।
উনি আলগা ভাবে ছাড়তেই পড়ে যাওয়ার অবস্থা হল। বুঝলাম যে উনি এখন হাত ছাড়লেই আমি সোজা গিয়ে খাদে পড়ব। উনি আবার শক্ত করে ধরে বলল, পুরোপুরি ছেড়ে দিব?
~ নাহ, নাহ। আমাকে উঠান প্লীজ।

উনি আরেকটু টেনে রাস্তার নিরাপদ কিনারায় নিয়ে আসল। আমি হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে চোখ ডলতে লাগলাম। এখনো জ্বলছে আর খচখচ করছে।
উনি বলল, আপনি ঠিক আছেন তো? চোখে কি হয়েছে আপনার?
~ ঝড়ো বাতাসে চোখে ধুলো ঢুকে গেছে তাকাতে পারছিনা। খচখচ করছে অনেক।
বিনয়ীকন্ঠে বলল, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
~ লাগবেনা। আপনি কি করবেন এতে?
উনি শুনে বলল, চোখের ধুলো ঝেড়ে দেই?
~ লাগবেনা, আপনি আর আমাকে স্পর্শ করবেননা।
~ আচ্ছা করবনা।

~ ঠিক আছে তাহলে।
উনি পকেট থেকে একখানা শুভ্র রুমাল বের করে পুটলির মত করে বেধে মুখের কাছে ঘন ঘন জোরে ফু দিতে লাগলেন। আমার চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল তাই আবার বন্ধ করে ফেললাম। উনি রুমাল টা চোখের উপর দিতে অনেকটা আরাম লাগল, কয়েকবার করতেই জ্বালাটা কমল। কিন্তু খচখচানি রয়ে গেল।

উনি আমাকে বলল, চোখ বড় বড় করে তাকান আমার দিকে।
~ কেন হ্যা? আপনাকে বড় বড় করে দেখার কি আছে?
~ উফফফ! এত বকেন কিভাবে? তাকাতে বলছি তাকান। ধমক শুনে বড় বড় করে তাকালাম। উনি কিসব বিড়বিড় করে চোখে কয়েকবার ফু দিয়ে দিলেন। রুমালটা হাতে দিয়ে বললেন, চোখের পানি মুছে নিন।
~ ধন্যবাদ আপনাকে।

~ জাযাকাল্লাহ।
চোর ব্যাটা এত হুজুর হল কেমনে সেটা ভাবছি! এখন নিশ্চয়ই ভাব জমাতে চাইবে, ছেলেদের তো স্বভাব ই এটা। উনি বলল, আপনি একা যেতে পারবেন?
মনে মনে এটাই সন্দেহ করছিলাম। কড়া করে বলে দিলাম,
~ শুনুন, আপনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন তার জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। এর চেয়ে বেশি মহৎ সাজতে আসবেননা। আর একটা কথা, আমার সাথে মোটেও ভাব জমাতে আসবেন না। দূরে থাকুন। ব্যাটা চোর!

~ আপনি সবসময় এত ঝগড়া করেন কেন? আমাকে দেখে মনে হয় আমি চোর!
~ জ্বি তেমনি লাগে।
আরো কিছু বলতে যাব দেখি রাস্তা দিয়ে কিছু মানুষ আসছে। এভাবে দাঁড়িয়ে কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলে খারাপ ভাববে। তাই চুপচাপ সামনে তাকিয়ে হাটা শুরু করলাম, একবারো পিছু ফিরলামনা।

পিছন থেকে শুনলাম উনি বলছেন, অদ্ভুত মেয়ে।
ছাত্রীকে পড়াতে গিয়ে খেয়াল করলাম তার রুমালটা নিয়ে চলে আসলাম। ফেলে দিব ভাবলাম কিন্তু অন্যের জিনিস ফেরত না দিয়ে ফেলে দেওয়াটা বিবেকে বাধলাম। আসার সময় খুজলাম কিন্তু তাকে পাইনি। কিন্তু সবসময় মনে হচ্ছে কেউ আমাকে অনুসরণ করছে, আমার উপর সারাক্ষণ নজর রাখছে। ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করতে লাগল।
সন্ধ্যেবেলা বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখে পড়ল আমার জানালার সামনে একটা কালো প্রতিবিম্ব। ধড়পড়িয়ে উঠে পড়ায় সেটা নিশ্চুপে সরে গেল। লাইট দিয়ে এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে কিছুই দেখতে পেলামনা।

জানালা বন্ধ করার মূহুর্তে বিড়ালের ডাক শুনলাম। জানালা খুলে আবার উকি মারতেই সে এক লাফে আমার রুমে ঢুকে পড়ল। আমি মুচকি হেসে বললাম,
~ কই গিয়েছিলি সকালে? এই পা নিয়ে এখনো লাফালাফি করছিস!
সে মিউ মিউ করতে করতে আমার পায়ে গা ঘেষতে লাগল।
আমি কোলে তুলে বললাম, এখানে আর আসিসনা বুঝলি। বেঘোরে মারা পড়বি।
সে চুপটি মেরে আমার কোলে বসে রইল। হঠাৎ কি বুঝে খাটের উপর লাফ দিল আর ওই রুমালটা নিয়ে ইচ্ছেমত পিষাপিষি শুরু করল।

তাড়াতাড়ি উঠে ওর থেকে রুমাল টা কেড়ে নিলাম। রুমালটা কেড়ে নেওয়ায় সে অনবরত মিউ মিউ ডেকে যাচ্ছে। আমি তাকে কোলে করে জানালার বাহিরে দিয়ে জানালা বন্ধ করে দিলাম। রুমালটার দিকে তাকিয়ে দেখি ময়লা লেগে আছে। কি থেকে কি হল বুঝলামনা। অন্যের আমানত এভাবে খেয়ানত হতে দেওয়া চরম অপরাধ হবে।

তাই তাড়াতাড়ি এটা ধুতে নিয়ে গেলাম। রুমালটায় খুব মিষ্টি একটা আতরের ঘ্রাণ, ভীষণ মাতাল করা। ভেবেছি ধুয়ে ফেললে হয়ত চলে যাবে, কিন্তু রয়েই গেল। ভালোই লাগছিল ঘ্রাণটা। শুকার সময় খেয়াল করলাম রুমালের এককোণায় আরবিতে ছোট করে কি যেন লেখা আছে। আমি তো পুরোপুরি আরবি পরতে জানিনা, তাই আর পাত্তা দিলামনা। গুছিয়ে ব্যাগে রেখে দিলাম যাতে দেখা হলে চোর টাকে ফেরত দিয়ে দিতে পারি।


পর্ব ৩

দাদীমার ওষুধ আনার জন্য বাজারে গেলাম। কিন্তু যে ফার্মেসী থেকে নিতাম, সেখানে ওষুধগুলো এবার আসেনি। দোকানী কাকা বলল, এই মাসে আর আমাদের দোকানে ওষুধগুলো আসবেনা। আমি একটু চিন্তিত হয়ে বললাম,
~ দাদীমার তো ওষুধ গুলো ছাড়া একদিন ও চলেনা। এখন কি হবে?
~ দেড় মাইল দূরে সেবারখোলায় যে বাজারটা বসে ওখানে নতুন বড় ফার্মেসিতে এইগুলো বেশি কালেকশানে থাকে আর কমদামেও পাবি।

~ অতদূর গেলে তো ফিরতে দেরী হয়ে যাবে। আপনি একটু আনিয়ে দিতে পারবেন কাকা?
~ আমার তো আজ সময় হবেনা মা। তুই টাকা দিয়ে যা আমি কাল-পরশু আনার ব্যবস্থা করে দিব।
দাদীমার শরীরটা ভীষণ খারাপ। এমনিতে টিউশনির টাকাটা পেতে দেরী হওয়ায় ওষুধ কিনতে পারছিলামনা। বের হওয়ার সময় দেখলাম খুব খারাপ অবস্থা। ওষুধ পেতে দেরী হলে তো যেকোনো সময় খারাপ কিছু হয়ে যাবে। দাদীমার জন্য এটুকু কষ্ট আমি করতেই পারি।

দেরী না করে তখনিই রওনা দিলাম বাজারটার উদ্দেশ্যে। ভেবেছিলাম সন্ধ্যের মধ্যে বাসায় ফিরে যাব, কিন্তু এখানে পৌছাতেই সন্ধ্যে নেমে এল। তাড়াতাড়ি ওষুধগুলো কিনে বাসার দিকে রওনা দিলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম গাড়ির জন্য, একটাও গাড়ি ফাকা পাচ্ছিনা। পেলেও কেউ আমার এলাকা অবধি যেতে চাচ্ছেনা, কেউ কেউ এক্সট্রা ভাড়া দাবী করছে। খুব বেশী পরিমাণ টাকাও সাথে আনিনি, যা এনেছিলাম ওষুধ আর দাদীমার জন্য কিছু ফলমূল কেনায় ফুরিয়ে গেছে। যা টাকা আছে তা দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাওয়া যাবে, কিন্তু কোনো বাস ই পাচ্ছিনা। অগত্যা হাটতে থাকলাম মেইন রোড ধরে, কিছুটা হেটে যদি কমে যাওয়ার গাড়ি পেয়ে যাই। একে তো আমি একা, অচেনা এলাকা, তার উপর রাত হয়ে গেছে। ভয়টা ক্রমশ আমায় জাপটে ধরেছে।

মনে সাহস নিয়ে রাস্তার ধারে হাটতে লাগলাম। ব্যস্ত হাইওয়ে কিন্তু রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই, রাস্তার বাকে বড়বড় গাছগাছালি। শুনেছি এই রাস্তাটা নাকি ভাল না। দোয়া পড়ে ফু দিলাম বুকে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি সাড়ে সাতটা বাজে, ফোনে চার্জ ও নেই তেমন। এতদূর আসব জানলে চার্জ দিয়ে রাখতাম। আসলেই সময় যখন খারাপ যায় সবকিছুই বেঈমানি করে। কিছুটা হাটার পর বুঝতে পারলাম কেউ আমার পিছন পিছন আসছে। থেমে থেমে কয়েকবার পিছনে ফিরলাম, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলামনা। এটা কি আমার মনের ভুল নাকি আসলেই কেউ আমাকে অনুসরণ করছে? এই ভেবে আরেকবার পিছু ফিরে তাকাতেই দেখলাম কুচকুচে কালো বর্ণের একজন লোক গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল, হাতে শান বাধানো ছুরিটা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝকঝক করছে।

হলুদ হাতগুলো বের করে নোংরা হাসি দিতে দিতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এক মূহুর্ত দেরী না করে আমি প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম, লোকটাও আমার পিছনে দৌড়াচ্ছে।
ভারী ব্যাগগুলো নিয়ে দৌড়ানো ও সম্ভব হচ্ছেনা, হাপিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। হঠাৎ কারো শক্ত বুকের সাথে ধাক্কা খেলাম। তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে বললাম, প্লীজ আমাকে সাহায্য করুন। বাজে লোকটা আমার পিছু নিয়েছে। সে এদিক সেদিক কয়েকবার তাকিয়ে বলল,
~ ভয় পাবেন না, এখানে কেউ নেই।

~ আপনি ভালো করে দেখুন, একটা কালো লোক ছুরি নিয়ে আমার পিছু আসছে।
–সত্যি বলছি কেউ নেই। আপনি শান্ত হন।
উনাকে মূহুর্তে ছেড়ে দিয়ে চারপাশে তাকালাম, আসলেই কেউ নেই। লজ্জায় মুখ নীচু করে বললাম, দুঃখিত, ভয় পেয়ে আপনাকে এতটা উদ্বিগ্ন করলাম।
~ ব্যাপার নাহ। কোথায় যাচ্ছেন আপনি? এত রাতে একা এখানে কি করছেন?
~ বাজারে গিয়েছিলাম। আসার সময় কোনো গাড়ি ই পাচ্ছিনা, পাচ্ছিনা তাও নয় কোনো ড্রাইভার ওইদিকে যেতে রাজি হচ্ছেনা।

~ একা একটা মেয়েকে বাজারে যেতে হল কেন? প্রতুত্তরে আমি চুপ করে রইলাম।
উনি আমার নিস্তব্ধতা দেখে বলল, আমিও এলাকায় ই যাচ্ছি। চলুন একসাথে যাওয়া যাক। আমি চুপ করে একটু ভেবে নিলাম।

উনি আবার প্রশ্ন করলেন, চোর ব্যাটার সাথে যেতে ভয় করছে?
~ স্যরি, আমি আসলে
~ যাওয়া যাক তাহলে?
–আচ্ছা চলুন। হাটতে হাটতে দুজন হালকা কথা বললাম। আমি আমার ব্যাপারে বললে উনি তার ব্যাপারে তেমন কিছুই বললেননা। আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম টা তো জানা হলনা।
~ চোর ব্যাটা। বলে হালকা হাসতে লাগল। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গেল উনার হাসিটা দেখতে বেশ ভালোলাগছে।

~ আমি কিন্তু সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করলাম। আপনি কিন্তু আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন। উনি মুচকি হাসলেন। মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকিয়ে হাটতে লাগলাম। কেমন মানুষরে বাবা! চুপচাপ থাকে মানলাম তাই বলে এতটা চুপচাপ থাকতে হয়। প্রতিটি কথার উত্তরে হয়ত মুচকি হাসছে নয়ত হুম হা করছে। ঝগড়া করার সময় এই ভাব কোন গাছের ডাব হয়ে যায় সেটাই ভাবছি।
অনেকটা পথ আসার পর একটা অটো রিকশা পেলাম। আমার পাশে জায়গা থাকা সত্ত্বেও উনি আমার মুখোমুখি বসলেন। ব্যাপারটা ভালো লাগল।
সারাপথ কেউ আর কোনো কথা বললামনা। কয়েকবার আড়চোখে তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেল। লজ্জায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম, তারপর বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন, এবার তাহলে আসি। আল্লাহ হাফেজ।

~ ধন্যবাদ। ভেবেছিলাম এর উত্তর মুচকি হাসি ই হবে। ভুল প্রমাণ করে বললেন,
~ ধন্যবাদের চেয়ে জাযাকাল্লাহ বললে বেশি মধুর শোনায়।
আমি জ্বী আচ্ছা বলে গেটের ভিতরে ঢুকে গেলাম। মনে হল একবার পিছন ফিরে তাকাই, তাকিয়ে দেখি ছেলেটা নেই। এইটুকু সময়ের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন বুঝলামনা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসার ভিতরে ঢুকে গেলাম।

দাদীমাকে ফল কেটে দিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলাম। এসব কিছু বলিনি আর, অযথা চিন্তা করবে। কাকীমা এসে বেশ কড়া কথা শুনিয়ে গেছেন, আজ আর সেসব কানে নিয়ে মন খারাপ করিনি। শোকর আল্লাহর কাছে, আজ বড় একটা বিপদ থেকে বেচে ফিরলাম। শুতে এসে দেখি কালো বিড়ালটা আমার বিছানার উপর বসে আছে। কিভাবে যে আমার রুমে ঢুকল মাথায় ধরলনা। আমাকে দেখে বসা থেকে এমনভাবে দাড়াল যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আজ ওর চোখগুলো ভীষণ জ্বলজ্বল করছিল, কেন কে জানে!

প্রতিদিনের মত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় দিলাম। ছেলেটার উপর আমার রাগ একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে। সারাটা রাস্তায় আমাকে এত ভাব দেখাল, যেন একজন মহান লোক উনি। ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করে ভাবলাম, ওহহো, তার রুমালটা তো ফেরত দেওয়া হয়নি। এর ঘ্রাণটা এত মিষ্টি যে এটা পাশে নিয়ে না ঘুমালে শান্তি পাইনা।

পরেরদিন সকালে কাকার মুখে শুনি, হাইওয়ের পাশে একটা লোকের বিভৎস লাশ পাওয়া গেছে। যার চোখ দুটো উপড়ে ফেলা হয়েছে, প্রতিটা আঙ্গুল ধারালো ছুরি দিয়ে ছিড়ে ফেলা হয়েছে। বুক থেকে টেনে কলিজাটা আধা বের করা। লোকটা নাকি সিরিয়াস কিলার। রাতে পথে অসহায় মেয়ে বা শিশু দেখলে ধর্ষণ করে, ডাকাতিও করে। শুনে রক্ত হিম হয়ে গেল, কাল রাতে এই হাইওয়ে দিয়ে আমরা ফিরেছিলাম। আরো বিবরণ জেনে অবাক হলাম, এই লোকটাই সে যে কিনা আমার পিছু নিয়েছিল। মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল। নিজেকে এটা বলে শান্ত্বনা দিলাম, আল্লাহ তাকে তার উপযুক্ত কর্মফল দিয়েছেন। এখানে আমার সাথে কোনো যোগসুত্র নেই।

দুইদিন ধরে নিজের কাছে কেমন জানি অস্বস্তি ফিল হচ্ছে। বিড়ালটা কেমন জানি অস্বাভাবিক আচরণ করে, যেন মনে হয় এটি কোনো সাধারণ বিড়াল নয়। যেমনঃ গভীর রাতে আমার রুমে ঢুকে পড়া, চোখ দুটি ভীষণ জ্বলজ্বল করা। তাও অত সিরিয়াস কিছু না দেখে অত পাত্তা দিলামনা।
কাকীর ভাই কিছুদিনের জন্য এখানে বেড়াতে এসেছেন। উনার আচরণ আমার খুব বাজে লাগে। যখন-তখন গায়ে হাত দেওয়া, আমার রুমে হুট করে ঢুকে পড়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি-কথাবার্তা। ব্যাপারটা আমি কাউকে বলিনি, জানি এসব বললে কেউ বিশ্বাস করবেনা, যতটা পারি নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করি।

এর মাঝে ছেলেটার সাথে আরেকদিন দেখা হল। আমি ভাব দেখিয়ে কথা বলিনি।
উনি নিজে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার রুমালটা আপনার কাছে তাইনা?
কিছুটা আমতা আমতা করে বললাম, হ্যা কেন?
~ ফেরত দিবেননা?

~ জ্বি নাহ। এটা এখন থেকে আমার।
~ চোরের জিনিস রাখতে ভাললাগবে? চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম। উনি হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করে বললেন, এখন অন্তত ঝগড়া করবেন না।
~ আপনি আমাকে ঝগড়ুটে প্রমাণ করতে চাইছেন?
~ উহু। আপনি তো লক্ষী মেয়ে। লক্ষীর মেয়ের মত ৫ওয়াক্ত নামায পড়বেন আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখবেন।

পর্ব ৪

কথাগুলো শুনে নিজেকে অনেকটা হালকা লাগল। তার কথামত নিয়মিত নামায পড়ার চেষ্টা করলাম। অনেকটা শান্তি লাগে এখন। কয়েকদিন ধরে বিড়ালটার দেখা পাচ্ছিনা, কোথায় যে উধাও হল।

মাঝরাতে হঠাৎ দেখি আমার ঘরটা কালো ধোয়ায় ভরে যাচ্ছে। কেমন জানি দমবন্ধ করা গরম বাতাসের অস্তিত্ব পাচ্ছি। বেডের পাশে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পটা বার বার অন-অফ হচ্ছে। উঠতে চাইলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ আমার হাত-পা দুটো শক্ত করে বেধে রেখে বুকের উপর মস্ত পাথর দিয়ে রেখেছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম উঠার কিন্তু নড়ার একটুও শক্তি পাচ্ছিনা।

এরমধ্যে আমার রুমের দরজাটা হুট করে খুলে গেল, আবছা অন্ধকারে কেউ একজন ঢুকল। হুডি পরা কেউ আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তার চেহারাটা স্পষ্ট নয়। চিৎকার করলাম, আমার গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ ই বের হচ্ছেনা। ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে। সেই প্রতিবিম্বটা আমার পাশে এসে বসতেই ল্যাম্পটা অফ হয়ে গেল। ভয়ে আমার হার্ট দ্রুত পাম্প করছে, মনে হচ্ছে এ আমার কোনো ক্ষতি করে বসবে। তার একটা বলিষ্ঠ হাত আমার মুখের দিকে এগিয়ে দিয়ে আমার গাল ছুয়ে দিল। হাতটা এতই ঠান্ডা ছিল যে আমার গাল অবশ হয়ে যাচ্ছিল।

হাত সরিয়ে নিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল। ফিসফিস করে কয়েকটা কথা বলল যার কিছুই আমি বুঝলামনা। আস্তে আস্তে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছি আমি।

চিৎকার দিয়ে উঠে বসলাম। খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছি আর হাপাচ্ছি। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। সবকিছু ঠিক আছে, রুমের দরজা বন্ধ আর ল্যাম্পটা ও জ্বলছে। তবে আমি কি এতক্ষণ বাজে স্বপ্ন দেখছিলাম?
হাত-পা ঝিমঝিম করছে উঠতে পারছিনা, বহুকষ্টে হাত দিয়ে গালটা স্পর্শ করলাম। বরফের মত ঠান্ডা হয়ে আছে, কিছুটা অবশ মনে হচ্ছে। স্বপ্ন ই যদি দেখে থাকি তবে এমন ফিল হচ্ছে কেন? আমার রুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। কোনোমতে উঠে দরজা খুললাম। দাদীমা এসে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোর? চিৎকার করছিস কেন?

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি চিৎকার শুনলে কি করে? অবাক হওয়ার কারণ হচ্ছে, দাদীমার রুম আমার রুম থেকে দূরে। এই বাসার অধিকাংশ রুম থেকে বাহিরে শব্দ যায়না। আমার রুমটাও তেমন, বাহিরে থেকে ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যায়। দাদীমা আমার মাথায়-গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম তাই শুনেছি। পানি খাবি?
আমার অন্যমনস্ক হয়ে বললাম, হুম। দাদীমা টেবিল থেকে পানির জগ নিতে গেলেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম দেয়ালে দাদীমার ছায়া পড়ছেনা, পড়ছে একটা ঘন কালো অদ্ভুত প্রতিবিম্বের ছায়া। ভয় পেলেও কিছু বললামনা, দাদীমা আমার কাছে আসলে আমি বললাম,
~ আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। আমি এখন ঘুমাই?

পানি পরে খাব বলে শুয়ে ঘুমানোর ভান করলাম। দাদীমারুপী জিনিসটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে আয়াতুল কুরসী পড়লাম, দাদীমা আমার মাথায় হাত ছোয়াতে এসে অস্বস্তিবোধ করলেন। চুপচাপ বাহিরে থেকে দরজা নক করে চলে গেলেন। শোয়া থেক্ব উঠে বসলাম। বুঝতে পারছিনা আমার সাথে এসব কি হচ্ছে? কেউ কি সত্যিই আমার উপর নজর রাখার চেষ্টা করছে? করলে সে কে? ভয়ের চোটে সারারাত আর ঘুম হলনা।
সকালে উঠেই দাদীমাকে জিজ্ঞেস করলাম,

~ তুমি কি কাল রাতে আমার ঘরে এসেছিলে? দাদীমা মাথা নাড়িয়ে বলল, নারে আপু। কাল ওষুধ খাওয়ার পর খুব ঘুম পেয়েছিল, সারারাতে আর জাগিনি।
সারাদিন আমার মাথায় এসব ঘুরপাক খেতে লাগল। দাদীমাকে বলতে গিয়েও বললামনা, অযথা চিন্তা করে শরীর খারাপ করবে। মনটা উদাসীন লাগছিল তাই আজ আর টিউশনি করাতে গেলামনা। সারাসন্ধ্যে ছাদে দাঁড়িয়ে রইলাম। দাদীমা এসে বলল,
~ কিরে মুসকান, তোর কি মন খারাপ?
~ না দাদীমা।

~ তুই চুল ছেড়ে এই সন্ধ্যেবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি চুল বেধে নে।
আমি চুলে খোপা করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, বাধতে হবে কেন? না বাধলে কি হয়?
দাদীমা ফিসফিস করে বললেন, তেনাদের নজর পড়ে। এটা ভালোনা বুঝলি।
–তেনারা কারা?
~ বোকা মেয়ে। তোকে এখন ভেঙ্গে বলতে হবে? জ্বীন-ভূত এর নজর পড়ে, আছর করলে আর ছাড়েনা।

আমি জোরে জোরে হেসে হেসে বললাম, নজর পড়লে তো ভাল। তোমার নাতনীর একটা গতি হত। এত পাত্র খোজাখুজি করতে হতনা।
~ বোকা মেয়ে বলে কি! ওরে জ্বীন আর মানুষের কখনো বিয়ে হয়! ওরা শুধু মানুষের ক্ষতিই করে।
~ কেন হয়না?
~ ওরা তো ভালো মানুষদের মত অত ভালনা। অন্যের ক্ষতি করাই এদের স্বভাব। আর দেখতেও নাকি ভয়ংকর। তাদের কিভাবে মানুষ বিয়ে করবে বল!
~ ভাবার বিষয়।

~ অত ভাবতে হবেনা। তোর বিয়ে আমার একটা লাল টুকটুকে রআজপুত্রের সাথেই দিব। যে আমার নাতনীটাকে ভালোবেসে আগলে রাখবে।
~ আদৌ পাও কিনা দেখো নাহলে আমি জ্বীন ই বিয়ে করব।
~ মেয়ের অলক্ষী কথাবার্তা সব। এসব বলবিনা আর।
চল নিচে চল। তেল দিয়ে তোর চুল বেধে দিব।
~ তুমি যাও, আমি আসছি।
~ আবার!

~ আসছি তো। সুন্দর বাতাস টা আরেকটু গায়ে লাগুক।
~ বাতাসের সাথে ও কিন্তু এরা আছর করে বলে দিলাম।
~ বুড়ি আর ভয় লাগাইওনা তো। যাও তুমি, আমি খানিকবাদে আসছি।
ছোটবেলা থেকে নানি-দাদীর থেকে ভয়ানক গল্প শুনে দাদীমার এসব ই ধারণা হয়েছে। আমারো হয়নি তা বলবনা কিন্তু কৌতুহল আছে তাদের প্রতি। আসলেই কি তারা দেখতে ভয়ংকর কিংবা তাদের বিয়ে করা যায়না?

কপালে একটা জ্বীনবর জুটলে মন্দ হতনা।
ভাবতে ভাবতে নিচে থেকে আবার দাদীমার ডাক। দেরী না করে নিচে চলে এলাম।
সন্ধ্যেবেলা খবর এল পাশের পাড়ার দাদীমার সই সালেহা দাদী মারা গেছেন। দাদীমা আর বাসার সবাই সেখানে চলে গেল। আমার শরীর খারাপ থাকায় দাদীমা ই আমাকে সাথে নিয়ে গেলনা। শোয়া থেকে উঠে ছাদে এসে বসলাম। বাহিরে খুব ঝড়ো বাতাস হচ্ছে, হয়ত খুব জোরে বৃষ্টি হবে। মাঝে মাঝে জোরে জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। মনে হচ্ছে আজ কাকীমা আর দাদী সেখান থেকে ফিরতে পারবেনা। এদিকে শরীরটা অনেক খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে, শরীর কাপুনি দিচ্ছে।

দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা আর। এমনসময় সিগারেট পোড়ানোর গন্ধ নাকে আসল। পিছনে তাকিয়ে দেখি কাকীমার ভাই ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। উনাকে দেখে আমি পাশ কাটিয়ে নিচে নামতে গেলে উনি শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরলেন। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। উনি আমাকে ছাদের কোণার দিকে ছুড়ে মারলেন। সিগারেট ফেলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। আমি হাত জোড় করে বললাম,
~ কাকা, আমি তো আপনার মেয়ের মত।

আমার সাথে এমন অন্যায় করবেন না। আল্লাহর দোহাই লাগে আমাকে যেতে দিন। উনি আমার থুতনি চেপে ধরে বললেন, এতদিন এই সুযোগটার ই অপেক্ষায় ছিলাম। আজ বলছিস ছেড়ে দিব। আচ্ছা ছেড়ে দিব আগে আমার কাজ হাসিল করি।

কান্নাভরা আকুতি মিনতি যখন মাঠে মারা গেল, তখন পাশ থেকে একটা ফুলের টব নিয়ে তার কপাল লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলাম। আমার কপালটা এতই খারাপ যে, সেটা উনার কপালে লাগার আগে উনি সরে গেলেন। তার ক্ষোভ আরো দ্বিগুণ হল। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরলেন। মনে হচ্ছিল, আমি আর নিজেকে বাচাতে পারবনা। পশুটার লালসার কাছে হেরে যাব। ভাবতে ভাবতে তার কবজি বরাবর জোরে কামড় বসালাম। ব্যথা পেয়ে আমাকে ছেড়ে দিল। উঠে পালাতে যাব এমনসময় মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল যে জায়গায় আবার বসে পড়লাম। লোকটা এসে আমার তলপেট বরাবর জোরে লাথি মারল। ব্যথায় সেখানেই লুটিয়ে পড়লাম। এবার আমার চুলের মুঠি জোরে চেপে ধরে বলল, তোকে আজ তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে ধর্ষণ করব। আমাকে কামড় দেয়া, চল আমার সাথে নিচে। তোর শরীর কেটে আজ লবণ-মরিচ লাগাব।

শরীরটা এতই খারাপ হয়ে গেছে যে উঠে দাড়াতে পারছিনা। উনি আমাকে চুল ধরে টেনে-হেচড়ে নিচে নিয়ে গেলেন। রুমে বন্ধ করে রান্নাঘর থেকে লবণ-মরিচ আর ছুরি আনতে গেলেন।
ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। আজ কি শেষ রক্ষা হবেনা আমার!

পর্ব ৫

বদ্ধরুমে বসে আল্লাহকে স্মরণ করা ছাড়া কোনো উপায় ই রইলনা। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখি রুমের জানালার কার্ণিশটা ভাঙ্গা। আল্লাহ সহায় থাকলে কোনোমতে এখান দিয়ে বের হওয়া যেতে পারে। উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেলাম। একটু চিপা থাকায় বের হতে কষ্ট হল, অনেক কষ্টে বের হলাম। হাতের বাহুতে খুব ব্যথা করছে। হাত দিয়ে দেখি ভাঙ্গা কার্ণিশের একটুকরো কাচ গেথে আছে এবং অনেক রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে। কাচ বের করতে গিয়ে দরজা খোলার শব্দ পেলাম। দেরী না করে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম। অনেকটা দৌড়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি শয়তানটা আমার পিছু নিয়েছে। আমি আর একটুও এগোতে পারছিলামনা, শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। উপায় না দেখে সামনের জঙ্গলের ভাঙ্গাচোরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

মুখ চেপে বাড়িটার দরজার পিছনে বসে রইলাম। শুকনা পাতার উপর কারো হাটার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শব্দটা আস্তে আস্তে আমার কাছাকাছি চলে আসছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম, আর বুঝি রক্ষা নেই। হুট করে দরজায় কারো ধাক্কা খাওয়ার শব্দ আসল। মেঝেতে আবছা ছায়া পড়ছে, আমার বেশিক্ষণ ছায়াটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিনা। চোখ প্রচুর জ্বলছে, মাথাটা ভার ভার লাগছে। আস্তে আস্তে আমার সবকিছু যেন অবশ হয়ে আসল। সব ঝাপসা হতে হতে চোখ বুজে গেল।

আস্তে আস্তে চোখ মেললাম। একটা পুরোনো ভাঙ্গাচোরা ঘরে শুয়ে আছি আমি, চারপাশে কয়েকটা হারিকেন জ্বলছে। অনুভব করলাম, আমি কারো কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি। তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই ছেলেটা বলল,
~ ভয় পাবেননা। আমার কোলে মাথা রেখে আছেন আপনি। উঠে বসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দুর্বলতার কারণে সেটা পারলামনা। ক্ষীণকন্ঠে বললাম,
~ আপনি এখানে কেন? আর আমি ই বা কোথায়?
~ সেসব বলব আপনাকে। আগে বলুন শরীর এখন কেমন?
একটু ভালো লাগছে?
আগের চেয়ে শরীরটা একটু ভালো লাগছে। জ্বর জ্বর ভাব অনেকটাই কমে গেছে। মাথায় জলপট্টি দিয়েছে বুঝতে পারলাম।
~ জ্বী অনেকটাই ভাল।

উনি আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আপনার হাতের বাহুতে কাচ ঢুকল কি করে?
উনার কথা শুনে হাতের দিকে তাকালাম। সেখানে ব্যান্ডেজ করা। উনি আমার চুপ থাকা দেখে বললেন,
~ কাচ বের করে আমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। অনেক রক্ত গেছে আপনার হাত থেকে, তাছাড়া খুব জ্বর ও ছিল। এখন অনেক দুর্বল লাগবে। চোখ বুজে একটু শুয়ে থাকুন।
~ আপনি এখানে কেন? আমি কোথায়?

~ আপনি ভাঙ্গাচোরা বাড়িটাতেই আছেন। আমি এখানে এসেছিলাম মন টা ভালো করতে, আসলে একাকী পরিবেশ,এক ঝাক জোনাক, ঝি ঝি পোকার ডাক খুব ভালো লাগে তাই বসে এসব উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ কাউকে ঢুকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে দেখি আপনি অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছেন।
আমি তো প্রায়ই এখানে আসি। তাই নিজের সুবিধার জন্য কয়েকটা হারিকেন, বিছানা আরো প্রয়োজনীয় জিনিস এনে রাখি। তার জন্যই আপনার সেবা করতে পারলাম। চোখ বড় বড় করে তার কথা শুনছিলাম। সিরিয়াসলি? এমন একটা গা ছমছম করা জায়গা কারো ভালো লাগতে পারে? ছেলেটার কি মাথায় সমস্যা আছে নাকি! দিনের বেলায় ও কেউ এই বাড়ির আশে পাশে ঘেষতে চায়না। ভয় লাগছিল একটু একটু, মিনতিমাখা কন্ঠে বললাম,
~ আমি বাড়ি যাব।

~ এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কিভাবে যাবেন? পারবেন তো?
হঠাৎ মনে পড়ে গেল, ওই নরপশুটার কুৎসিত হাসিমাখা মুখটা। আতকে উঠে উনার শার্ট খামচে ধরলাম। বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলাম, না আমি আর ওখানে যাবনা। আমাকে মেরে ফেলবে। বলে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে শুরু করলাম তার কোলে জড়োসড়ো হয়ে। উনি আমাকে থামানোর চেষ্টা করে বললেন,
~ কি হয়েছে আপনার? শুনুন ভয় পাবেননা। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবনা। আপনার ভালোর জন্যই বলছিলাম এই শরীর এখন না যাওয়াই ভাল। যদি আপনি চান তবে আমি বাহিরে গিয়ে বসছি আপনি একটু রেস্ট নিন। সকালেই আপনাকে আমি বাড়ি পৌছে দিব।
বলে উনি উঠে যেতে উদ্ধত হলেন। আমি উনাকে শক্ত করে চেপে ধরে আরো জোরে জোরে কেদে বললাম,
~ প্লীজ যাবেননা। আমার ভয় করছে।

~ ভয় পাবেননা। আপনি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় আমার খুব স্বস্তি ফিল হচ্ছিল। ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ভয়টা যেন কেটে গেছে, অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছিল। বাচ্চাদের মত উনার শার্টের নিচের অংশ চেপে ধরেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।

কিন্তু ঘুম আমার পুরোপুরি আসছিলনা। একটু পর পর ভেঙ্গে যাচ্ছিল আতঙ্কে। যতবার ভাঙ্গছিল ততবার উনার কোলে আরো জড়োসড়ো হয়ে হচ্ছিলাম। আবার জ্বর এসেছিল, জ্বরের ঘোরে উনার হাত আমার গালের কাছে চেপে ধরেছিলাম। উনি একটুও বিরক্ত হননি উলটো আমার এমন অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন। আমি জ্বরের ঘোরে বলে ফেললাম, আমি আর পারছিনা এভাবে থাকতে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আম্মু আব্বু আমাকে তোমাদের কাছে নিয়ে যাবে?

এত স্বার্থপর কেন তোমরা, এমন একটা নরকে ফেলে রেখে তোমরা জান্নাতে চলে গেলে?
হঠাৎ টের পেলাম আমার কপালে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে। ঝাপসাদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি উনার চোখদুটো ভেজা ভেজা। গাল বেয়ে মুক্তোদানার মত অশ্রু ঝড়ছে।

নিজের অজান্তে হাত দিয়ে চোখ মুছে দিলাম উনার। জানি না কি হল, উনি আমার হাত শক্ত করে জড়িয়ে বাচ্চাদের মত কাদতে শুরু করলেন। আমি বিব্রত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কাদছেন কেন?
উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন, আপনার ঠান্ডা লাগছে? কাপছেন মনে হচ্ছে।
উনার কথায় এখন নিজের কাপুনি টের পাচ্ছি। উনি এদিক ওদিক তাকিয়ে কি যেন খুজলেন। আশাহত হয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, চাদরটা কোথায় ফেলে রেখেছি এখন দেখছিনা।
~ আপনি এই গরমকালে চাদর নিয়ে চলাফেরা করেন?

উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, আমি পাতালতা জড়ো করে আগুন জ্বালাচ্ছি আপনি তার পাশে বসলে ঠান্ডা কম লাগবে। আলতো করে আমার মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে মেঝেতে রাখলেন। তারপর আগুন জ্বালালেন, ততক্ষণে আমি চেষ্টা করে একটু উঠে বসলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওড়নাটা পেচিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিন। উনার কথামত তাই করলাম। উনি পাশে বসে কপালে হাত দিয়ে আবার চেক করলেন। আমার মাথাটা ভার ভার লাগছিল, স্থির হয়ে বসতে পারছিলামনা। তাই উনার কাধে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। উনি বিশেষ কিছু বললেননা, শুধু একবার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন।

অনুনয়ের স্বরে বললাম, আপনার হাতটা আমার কপালে ধরে রাখবেন? উনি তাই করলেন এবং বললেন,
~ এভাবে জ্বর বাধালেন কি করে?
~ কিছু তো করিনি। শুধু সেদিন আইসক্রীম
শুনুন না, আমায় এখন আইসক্রীম খাওয়াবেন প্লীজ!
আইসক্রীমের কথা মাথায় আসতেই পাগলামীর ঝোক উঠল। উনি আমার দিকে ভুত দেখার মত তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, কি খাওয়াবেন না?

~ এত রাতে আইসক্রীম কোথায় পাব?
আর আপনার তো জ্বর অনেক।
~ আপনি জানেন না, জ্বরের সময় যেটা খেতে ইচ্ছে করে সেটা খেতে হয়। নাহলে জ্বর বেড়ে যায়।
উনি বিড়বিড় করে বললেন, এমন কথা কোন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করল?
~ সেটা জেনে কি হবে হুম?

এখন আমাকে আইসক্রীম খাওয়াতে হবে ব্যাস! আর চোর ব্যাটা সব পারে, যেভাবে যত রাত ই হোক ঠিকই চুরি করতে পারে। উনি মুখ গম্ভীর করে বললেন,
~ আপনার ভয় লাগবেনা একা থাকতে?
~ আইসক্রীমের জন্য এটুকু বিসর্জন করা ই যায়।
~ আচ্ছা, আসছি। বলে উনি চলে গেলেন।

কিছুটা সময় পর আমার হুশ আসল আমি পোড়াবাড়ীটা তে একা। ভয় লাগতে শুরু করল অল্প অল্প। উনাকে পাঠিয়ে যে কত বড় ভুল করলাম এখন বুঝতে পারছি। চারপাশের ভাঙ্গা দেয়াল গুলো যেন আমার দিকে ভয়ানক চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কি একটা জোরে আওয়াজ হল আমি উঠে দিলাম ভৌ-দৌড়। উনাকে এদিকেই আসছিলেন,উনাকে দেখে ঝাপিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আমতা আমতা করে বললাম, ভূ–ত।
~ কোথায় ভুত?

~ আপনি একটা ভয়ংকর আওয়াজ শুনেন নি?
~ ওইটা বাদুরের ডাক।
এবার আমি উনাকে ছেড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম, লজ্জা লাগছিল এমন ঘটনায়। উনি আইসক্রীমটা আমাকে দিয়ে বললেন, নিন।
~ এত রাতে কোথায় থেকে আনলেন?

~ জ্বরের রোগী খেতে চেয়েছে, না এনে উপায় আছে।
জ্বরের সময় যেটা খেতে ইচ্ছে করে সেটা খেতে হয়।
আমি লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে দিলাম।
খাওয়া শেষ করে দেখি উনি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি নিচুকন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
~ তাকিয়ে আছেন কেন?

উনি কিছু না বলে আমার কাছে আসলেন, আমার ওড়না এককোণা গুটিয়ে নিয়ে নাকের ডগাটা আলতো করে মুছে দিলেন। তারপর বললেন,

  • এভাবে বাচ্চাদের মত আইসক্রীম খায় কেউ?
    নাকের ডগায় লাগিয়ে ফেললেন।

~ আসলে আমি এতটাই অগোছালো যে এখনো নাকে মুখে আইসক্রীম লাগিয়ে ফেলি।
উনি মুচকি হেসে বললেন, শরীর কেমন এখন? জ্বর আছে কিনা দেখি! হুম অনেকটা কমে গেছে। ঘন্টা দুয়েক বাদে সকাল হয়ে যাবে। একটু ঘুমাবেন?
~ আপনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুমাব। উনি আমার দিকে তাকাতেই বললাম, আসলে তখন তাড়াতাড়ি ঘুম এসে যায়।

~ আচ্ছা আসুন। আবার উনার কোলে ঘুমিয়ে পড়লাম। চোখ মেলতেই দেখি উনি হাত দিয়ে আমার মুখের উপর ছায়া তৈরির চেষ্টা করছেন। আমাকে জাগতে দেখে হাত সরিয়ে নিলেন, সাথে সাথে একফালি রোদ এসে আমার চোখে পড়ল। এখন বুঝলাম রোদ যাতে আমার চোখে পড়ে ঘুম না ভাঙ্গে তাই এমন অভিনব খাটাচ্ছিলেন। আমি উঠে বসতেই বলল, চলুন আপনাকে বাসা অবধি দিয়ে আসি।
~ আচ্ছা। উনি বাড়ির গেইট পর্যন্ত পৌছে দিয়ে বললেন,
~ ফি-আমানিল্লাহ। নিজের খেয়াল রাখবেন।
~ আপনিও।

আমি গেইটের ভিতরে ঢুকে বারবার পিছু তাকাচ্ছিলাম। কেমন জানি খারাপ লাগছে বিদায় জানাতে। বাড়িতে ঢুকতেই কাকীমা এসে আমার চুলের মুঠি ধরে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলেন। কাকীর ভাই আর দাদীমা সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন। দাদীমা কাদতে কাদতে বললেন,
~ বউ আমার মুসকান রে মারিসনা। মাইয়াটার শরীর ভালনা।
কাকীর মারের চোটে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছি তাও ছাড়ছেনা। এলোপাথাড়ি লাথি মারছে শরীরে। একটা লাথক আমার বাহুর ক্ষতস্থানে পড়তেই ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। এদিকে আমার ঠোট ফেটে রক্ত পড়ছে।

কাকীমা ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে,
~ আমার খাস, আমার পরিস। আর আমার ক্ষতি করতে চাস। ডাইনী কোথাকার। কালোযাদু করে আমার ভাইকে মারার চেষ্টা। কাল সারারাত কোন নাগরের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে গেছোস?
মা-বাপ রে খাইছোস এখন আমার পরিবার খাওয়ার জন্য বসে আছিস। তোরে আমি অনেক সহ্য করছি আর না। হয় তুই তাড়াতাড়ি এই বাড়ি থেকে বিদায় হবি নাহলে তোরে আমি ঝেটিয়ে বিদায় করব। নষ্টা মাইয়া। বলে কাকীমা আমার গায়ে থুথু ফেলে ঘরে চলে যায়।
দাদীমা চোখ মুছে আমাকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে যায়

পর্ব ৬

দাদীমা বার বার চোখ মুছতে মুছতে ঠোটের ফাটা অংশের রক্ত পড়া বন্ধ করার চেষ্টা করছে। আমি একমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। শরীরের কষ্ট টা না মনের ভিতরে একরাশ যন্ত্রণা আমাকে বেশি জ্বালাচ্ছে। ভাবছি কাকীমা হঠাৎ আমাকে ডাইনী বলল কেন? আমি কালোজাদু করি এসব ই বা ভাবছে কেন? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দাদীমার দিকে তাকিয়ে বললাম, কাকীমা আমাকে এসব বলল কেন দাদী?

~ কাল রাতে যখন আর বৃষ্টি আইলনা আমরা বাড়ি ফিরে আসছিলাম। আইসা শুনি লোকটার ঘর থেকে চাপা গোঙ্গানীর আওয়াজ আসতাছে। তড়িঘড়ি করে বউ, তোর কাকা আর আমি ওর ঘরে গেছিলাম। দরজা ভাঙ্গতে হইসিল, ভাঙ্গার পর দেখি তারে দেয়াল ঘেসাইয়া কেউ উপরে উঠাইয়া রাখছে। শরীরের অনেক জায়গায় গভীরভাবে কাটা, অইখানে আবার লবণ-মরিচ লাগানো। আমি দোয়াদরুদ পড়া শুরু করলাম। একটু পরে ওই লোক ফ্লোরে পড়ে গেছে। জ্ঞান ফেরার পর বলে তুই নাকি ওরে মারার চেষ্টা করে তোর নাগরকে নিয়ে পালাইসোস।

অবাক হয়ে এসব শুনলাম। এগুলো কি করে সম্ভব? দাদীমা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, কই ছিলি সারারাত? আমি জানি তুই এসব করতে পারিসনা, তাই দাদীমার কাছে সত্যি কথা বল।
কাদতে কাদতে দাদীমাকে ওই লোকের সব ঘটনা খুলে বললাম। শুনে দাদীমা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
~ তুই এতকিছু সহ্য করে এখানে কেন পড়ে আছিস হতভাগী? পালাতে পারিসনা। যা পালিয়ে যা এখান থেকে। আর কোনোদিন ও এইমুখো হবিনা।
~ এটা সম্ভব না দাদীমা। তোমাকে ফেলে আমি কিভাবে যাবো বলো? তুমি ছাড়া আমার কে আছে? আর যদি যেতে হয় তোমাকে নিয়েই যাব, এই জাহান্নামে তোমাকে একা ফেলে আমি কখনোই যেতে পারবনা। খুব তাড়াতাড়ি আমি একটা মাথা গোজার ব্যবস্থা করব তারপর তোমাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।

~ প্রত্যেকদিন তোর সাথে বউয়ের খারাপ আচরণ আমার সহ্য হচ্ছেনা রে। ওরা তোকে তিলে তিলেই মেরে ফেলবে। তুই আমার জন্য ভাবিসনা। এখান থেকে পালা মুসকান।
আমি আর কয়দিন বাচব বল!
~ এসব একদম বলবানা বুড়ি। চিন্তা করোনা তুমি, আমাকে একটু সময় দাও। আমি তোমাকে নিয়েই এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাব।

রাতে কাকা এসে সাফ জানিয়ে দিল, উনি আমাকে তার কাকীর ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিবেন। এখানে আমার কোনো আপত্তি ই খাটবেনা। যদি আপত্তি থাকে, তবে যেন এক্ষুনি এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাই। জঘন্য মানসিকতাসম্পন্ন চল্লিশার্ধ বয়স্ক লোককে আমি কিছুতেই বিয়ে করবনা সাহস করে জানিয়ে দিলাম কাকাকে। কাকীমা আমাকে মারার জন্য মোটা চেলাকাঠ নিয়ে তেড়ে এলেন। দাদীমা বাধা দিতে গিয়ে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায়। সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, পুরো ফ্লোর দাদীমার রক্তে ভেসে যায়। কাকা, কাকীমা ঘটনার আকস্মিকতায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমি কাকার পায়ে ধরে বললাম,
~ দাদীমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো কাকা। এভাবে পড়ে থাকলে আমার দাদীমা যে আর বাচবেনা। আমি তোমার সব কথা শুনতে রাজি।

কাকা ভয়ে ভয়ে বলে, এখন হাসপাতালে নিলে পুলিশ কেসে আমি ফেসে যাব। কিছু হয়নি মার, মাথা একটু ফেটে গেছে। তুই ব্যান্ডেজ করে দে। অবস্থা বেশী খারাপ হলে আমি নাহয় ডাক্তার ডেকে দিব।
কাকা ডাক্তার নিয়ে এল। উনি সেলাই করে ব্যান্ডেজ বেধে দিলেন কিন্তু দাদীমার জ্ঞান ফেরলনা। নামাযে বসে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে দাদীমার সুস্থতা চাইলাম।
শেষরাতে দাদীমার জ্ঞান ফিরল। আমার হাত ধরে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু সে সুযোগ আর তার হলনা। অবশ হয়ে গেল চোখের মনি। আমার দাদীমা আমাকে ছেড়ে সত্যিই অন্য জগতে চলে গেছে। আমার চোখে তখন পানি এলনা, পাথরের মত অবশ হয়ে বসে রইলাম দাদীমার হাতটি ধরে। দাদীমাকে যখন দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল, চোখের পানি আর বাধ মানল না। বাচ্চাদের মত দাদীমার কবর আকড়ে ধরে কাদলাম।

সারাদিন ঘরের এককোণে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কাকীমা এসে চেচিয়ে চেচিয়ে বলল,
~ ডাইনী, নিজের দাদীমারেও খাইসোস। এখন এখানে বসে ন্যাকামী দেখাস, যা উঠে সব কাজ কর। আমি না শোনার ভান করে আগের মতই বসে রইলাম। কাকী ক্ষেপে গিয়ে আমার চুলের মুঠি ধরতে এলে উনার হাত খামচে ধরে বাধা দিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে বললাম,
~ এতদিন তোমাদের সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছিলাম। কেন জানো? আমার দাদীমার দিকে তাকিয়ে, অন্তত তাকে তোমরা ভাল রাখবে বলে। আর তোমরা তাকেই মেরে ফেললে। তোমাদের কাউকে আমি ছাড়বনা।

কাকীমা চুপসে গিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাত ১০টায় কাকা, কাকীমা আর তার ভাই মিলে আমার রুমে ঢুকল। আমাকে ইচ্ছেমত মেরে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করল। আমার পুরো গায়ে ঘুরে ঘুরে কেরাসিন ছিটাল। আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মূহুর্তে হঠাৎ ঘরে দমকা হাওয়া ঢুকতে লাগল। সেই সাথে ভয়ানক ভয়ানক শব্দ। দেয়াল ফুটো হয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগল। জানালা দিয়ে কে যেন কাটা মাথা, উপড়ে ফেলা চোখ ছুড়ে মারতে শুরু করল। এসব দেখে আমার খুব ভয় হচ্ছিল। দৌড়ে দরজার বাহিরে চলে এলাম। কাকা-কাকীমারাও ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। তারাও বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে ছুটে গেল। কিন্তু আমি বের হওয়ার সাথে সাথে দরজা আটকে গেল, কাকীমারা ভেতরেই আটকা পড়ে রইল।

দরজা খোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু খুলছেই না। হঠাৎ দেখি একটা বিভৎস কাটা মাথা লাফাতে লাফাতে আমার ঘাড়ের কাছে উঠে বসল। চিৎকার করে ওটা ছুড়ে ফেলে দিলাম। ওইটা আমার পায়ের কাছে পড়ে ভয়ানক হাসি দিল। দরজার ফাক দিয়ে নাড়িভুড়ি, রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়তে লাগল,আর ভেতর থেকে আত্মচিৎকার যেন কেউ কারো টুটি ছিড়ে ফেলছে। ভয়ে আর এক মূহুর্ত ও দাড়ালামনা। বাসা থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় চলে এলাম।

আকস্মিকভাবে মুহুর্তেই পুরো বাড়িতে ভয়ানক বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ধরে গেল। চোখের সামনে ছাই হয়ে গেল কাকা-কাকীমাসহ পুরো বাড়ীটা।
বিকট শব্দে কারো হাসির আওয়াজে আমার কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। আমি ভয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম। চারপাশে তাকাচ্ছিলাম, কিন্তু কাউকেই দেখছিনা। মনে হচ্ছে আমি কোনো নিস্তব্ধ গোরস্তানে আছি। সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

বুঝতে পারছিনা কি করব! পায়ের সাথে কি একটা বেধে হোচট খেয়ে পড়ে গেলাম। মাথা তুলে উঠে বসার চেষ্টা করতেই কেউ একজন আমার সামনে এসে দাড়াল। তাকিয়ে দেখি লম্বামতন কোনো পুরুষ, মুখের সামনে হুডির ক্যাপ তোলা, অন্ধকারাছন্ন চেহারা। ঠিক যেমনটা সেদিন আমি স্বপ্নে দেখেছি। আমতা আমতা করে বললেন,
~ কে আপনি? সে কিছু না বলে আমার দিকে এক পা করে এগোতে লাগল। আমার পিছু হটতে থাকলাম। সে আমার সামনে বসে আমার হাতটা চেপে ধরল শক্ত করে। আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
~ আহ! ছাড়ুন। আমার ভীষণ ব্যথা লাগছে।
কে আপনি? ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে উঠে উলটো দিকে দৌড়াতে লাগলাম।
দৌড়ে কিছুটা দূরে এসে সামনে সেই লোকটাকে আবার দেখতে পাই। যেইদিকেই যাচ্ছি সেখানে লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। কি হচ্ছে আমার সাথে এগুলো!
“আপনি এভাবে আমার পিছু নিচ্ছেন কেন? কে আপনি?
কি চাচ্ছেন বলুন?”

“আমাকে মেরে ফেলতে চান? তাহলে এক্ষুনি মেরে ফেলুন।”
লোকটা আমার মুখের সামনে মুখ আনল। তার প্রচন্ড ঠান্ডা নিঃশ্বাস টা আমার মুখ অবশ করে ফেলছে। সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে নিলাম। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখলাম কেউ নেই আমার সামনে। চারপাশটা ভালো করে দেখলাম লোকটা উধাও। রাস্তায় আমি একা দাঁড়িয়ে আছি।
এমনসময় কেউ আমার কাধের উপর হাত রাখল। ভয়ে আতকে উঠলাম। সে লোকটা আবার এসেছে! এবার কি সত্যি আমাকে মেরে ফেলবে।

পিছনে ফিরে দেখি সে চোরব্যাটা দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে-আতঙ্কে নাকি স্বস্তিতে জানিনা আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। উনি আমার এমন অবস্থা দেখে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
~ কি হয়েছে আপনার? আবার ভয় পেয়েছেন? আমি আছি তো ভয় পাবেননা।
উনার এমন শান্ত্বনাতে আমার দাদীমার কথা মনে পড়ে গেল। উনাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠলাম। সেই সাথে শুরু হয়ে গেল হেচকি উঠা।
উনি বারবার বলতে লাগলেন,
~ কান্না থামান। কি হয়েছে বলুন?

আমি হেচকির জন্য কথা ই বলতে পারছিনা। উনি জোরে একটা ধমক দিয়ে বললেন, কান্না থামাতে বলেছিনা আপনাকে। আমি একদম চুপ মেরে গেলাম।
উনি আবার নরমকন্ঠে বললেন,
~ দুঃখিত, আপনার হেচকি থামানোর জন্য ভয় লাগতে ধমক দিয়েছি। আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
উনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, কি হয়েছে বলুন?
~ আমার একমাত্র আপনজন দাদীমা মারা গেছেন। আমার আর কেউ রইলনা।
~ বোকা মেয়ে। যার কেউ নেই, তার আল্লাহ আছে। কাদবেননা, আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।

পর্ব ৭

উনার কথা শুনে ছলছল করা চোখের পানি ছেড়ে দিলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কোথায় যাবেন ঠিক করেছেন? আমি না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
~ আপাতত কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। জানিনা কি হবে? আল্লাহ আমার ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন?

~ আপনি এভাবে ভেঙ্গে পড়ছেন কেন? আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।
~ রেখেছি আর রাখব ইনশাআল্লাহ। একটু চুপ থেকে উনি বললেন, আমার সাথে যাবেন? আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার সাথে? কোথায়?
~ আমার বাসায়।
~ না।

~ কেন?
~ আমাকে আপনি চিনেননা, জানেননা তাও অনেক সাহায্য করেছেন। এখন আপনার গলগ্রহ হয়ে আপনার বোঝা বাড়াতে চাইনা। আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা রেখেছেন তাই হবে।
~ আল্লাহ চান বলেই তো আপনাকে এত সাহায্য করছি। উনি আমার মাধ্যমেই আপনার ভালো করতে চাচ্ছেন। আর আপনাকে আমার গলগ্রহ হয়ে থাকতে হবেনা। আপনি যখন নিজের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবেন, তখন আপনি চলে যেতে পারবেন। আমার মনে বিন্দুমাত্র অসৎ উদ্দেশ্য নেই, আমি কেবল আল্লাহর একজন অসহায় বান্দাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি এবং আল্লাহকে খুশি করতে চাচ্ছি।

এখন আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে বলুন?
আমি উনার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। এই নিষ্পাপ মুখের পিছনে অসৎ উদ্দেশ্য থাকবে সেটা আমি ভাবছিনা, ভাবার কারণ ও নেই। ক্ষতি করার মনোভাব থাকলে সেদিন আমাকে একা পেয়েই করতে পারতেন। কিন্তু আমার আর কারো উপর নির্ভরশীল হতে ইচ্ছে করছেনা। এখন আমার কাছে সেই উপায় ও নেই যা দ্বারা আমি নিজেই একা চলতে পারব। তাছাড়া কেউ একজন আমাকে তাড়া করে বেরাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমার একটা আশ্রয় প্রয়োজন।
~ আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি নিজের ব্যবস্থা করামাত্রই আপনার ওখান থেকে চলে আসব।
~ বেশ তাই হবে। তাহলে যাওয়া যাক।

এরপর উনি আমার সাথে তেমন কথা বলেননি। একসাথে বাসে উঠে বসলাম পাশাপাশি সিটে। বাহিরের দিকে তাকিয়ে নিজের এলাকাটা বিদায় দিচ্ছি। এতদিন ভেবেছি উনি আমার এলাকায় ই থাকেন। কিন্তু এখন যা দেখছি তাতে উনি বেশ দূরে থাকেন। ইচ্ছে থাকাসত্ত্বেও জিজ্ঞেস করলামনা উনি এই এলাকায় কেন এসেছিলেন!
আমার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার এলাকায় আমি একটা জরুরি কাজে এসেছিলাম। আমার বাসা এখানে নয়। বিষম খেলাম, উনি কিভাবে বুঝলেন যে আমি এটাই ভাবছিলাম।

বাস থামতেই ঘুম ভাঙ্গল। উঠে দেখি উনি আমার কাধে মাথা এলিয়ে ঘুমাচ্ছেন। ঘুমন্ত অবস্থায় উনাকে বেশ কিউট লাগছে দেখতে। জাগাতে মন চাইলনা, কাধ হালকা একটু ঝুকে দিলাম যাতে বাস থামলেও উনার ঘুম না ভাঙ্গে।
জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি সবে ভোর হচ্ছে। আমার অন্যজীবনের সূচনা ও নতুনভাবে হচ্ছে। পরবর্তীতে কি হবে? উনার সাথে যাওয়াটা আদৌ ঠিক হচ্ছে কিনা! এর জন্য আবার নতুন কোনো ঝামেলায় পড়ব কিনা! এমন অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এতকিছু সত্যই আমার জানা নেই শুধু একটাই কথা জানি, একজোড়া বিশ্বস্ত হাত ধরে আমি ভবিষ্যতের সন্ধানে যাচ্ছি। এই হাত যদি বেঈমানি করে, তবে আল্লাহর কাছেই দায় রয়ে যাবে। এমন সাতপাচ ভেবেও নিজের অস্থিরতাকে দমাতে পারছিনা। মন সায় দিলেও মস্তিষ্ক আমাকে ভীত করছে।

সকালে একটা বাসস্টেশনে এসে নামলাম। উনি এরমধ্যে একবার জিজ্ঞেস করলেন, কি খাবেন? আমি ক্ষিধে পায়নি বলে না করে দিলাম। যতক্ষণ অস্থিরতা থাকে ততক্ষণ শান্তিতে কিছুই গিলতে পারবনা।
তারপর রিকশা ঠিক করে রিকশায় উঠলাম। রিকশায় উনি আমার সামনে হাত দিয়ে অন্যপাশের হুড শক্ত করে ধরে বসলেন। কয়েকবার রিকশার প্রচন্ড ঝাঁকুনিতেও উনার হাতের জন্য আমি সেইফ ছিলাম। উনার এমন আচরণে আমার মস্তিষ্ক ও কিছুটা বুঝ মানতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ পর রিকশা একটা বিশাল বাড়ির সামনে এসে থামল।

চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম, বড়লোকদের বাড়ীর মতই। কিন্তু উনার আচরণে কখনো আচ করতে পারিনি উনি এত বড়লোক বাড়ির ছেলে। যাই হোক, ভয়ে ভয়ে উনার পিছু পিছু বাড়িতে ঢুকলাম। বাড়ির ভেতরটা বেশ মনোরম। উনি আমাকে বসতে বলে উপরে চলে গেলেন। ভয় আর অস্থিরতা আবারো ঝেকে বসেছে।
কিছুক্ষণ পর এক মাঝবয়সী সুন্দরী মহিলাকে সাথে নিয়ে নামলেন উনি। আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। উনি বেশ হাসিমুখে আমার সাথে কথা বললেন। কিন্তু তারপরও কেন জানি মনে হল আমার আসাটা উনার বিরক্তির কারণ। খুব রহস্যময় লাগছে সবকিছু। একটু পরে আরো একজন মহিলা, আমার সমবয়সী দুইটা মেয়ে আমার সাথে পরিচিত হতে এলেন।

মোটামুটি সবার ব্যবহার আমার একটু ভিন্ন ঠেকলেও ভালোই লাগল। কেউ জিজ্ঞেস করল না, কেন এসেছি? কোথায় থেকে এসেছি? কতদিন থাকব? উনার চোখের ইশারায় আমাকে রিলেক্স থাকতে বললেন। মেয়ে দুজনের মধ্যে একজন আমাকে একটা রুমে নিয়ে আসল। মেয়েটা ভীষণ মিশুক আর বাচাল টাইপ। পুরো বাড়ির মধ্যে ওকেই আমার বেশ মনে ধরল। একটু রিলেক্সে বসতেই উনি এসে বললেন, আপনার তো কিছু খাওয়া হয়নি। আসুন খাবেন সবার সাথে।
চুপচাপ উনাকে ফলো করে খেতে আসলাম। খাওয়ার মধ্যে মহিলাটি বলল, তোমার সাথে তো সবার পরিচয় ই করাইনি। আমি তাসবীনের মা।

ও হল আমার বোন মানে তাসবীনের খালামণি। এ সানজানা আর সানজিদা। এরা দুজন আমার বোনের মেয়ে। তাসবীনের আব্বু এখন বাড়ীতে নেই, আসলে উনার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিব। এই বাড়ীতে থাকতে কোনো অসুবিধা হলে সবার আগে আমি বলবে কেমন।
আমি মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বললাম, আচ্ছা আন্টি।
মনে মনে ভাবলাম, এই তাসবীনটা কে?

নাস্তা শেষ করে সানজানাকে রুমে এনে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তাসবীন কে?
সানজানা কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললাম, হাসছো কেন এভাবে?
সে বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, যার সাথে এই বাড়ীতে এসেছো তার নাম জানোনা। ভাইয়ার নাম ই তো আহনাফ তাসবীন। আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। উনি তো আমাকে কখনো উনার নাম ই বলেননি। জানব কি করে উনার নাম তাসবীন। সানজানা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
~ কি ভাবছো?
~ নাহ কিছু না তো।
~ আমার ভাইয়াটা কিন্তু অনেক ভালো একটা মানুষ। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারেনা, আর আমাদের সব্বাইকে খুব ভালোবাসে।

~ উনি আসলেই অনেক ভাল। কিন্তু উনি এখন কোথায়?
~ ভাইয়া? সে তো এখন মনে হয় স্টাডিরুমে। একটু ফাক-ফোকর পেলেই টেবিলভর্তি বই নিয়ে বসে। মাঝে মাঝে তো আমাকেও বলে তার সাথে পড়ার জন্য।
আমি তো বাবা তখন পালিয়ে বাচি।
মনে মনে উনাকে কেন জানি খুজছিলাম। শুনে একটু স্বস্তি লাগল। একটুপর উনি এসে এসে জিজ্ঞেস করে, কি লাগবে কিনা? ঠিক আছি কিনা। খুব ভালোই লাগছিল তার কেয়ারিংগুলো। কিন্তু এতগুলো ভালো থাকার মাঝে হঠাৎ আমার সাথে এমন কিছু একটা হবে আমি ভাবতে পারিনি। হয়তবা কল্পনা ও করিনি কখনো।

পর্ব ৮

রাতে একা শুয়েছিলাম। সারাদিন জার্নি করার কারণে তাড়াতাড়ি ঘুম আসার কথা, কিন্তু কি কারণে জানি আসছিলনা। এপাশ ওপাশ করেই যাচ্ছি। হঠাৎ জানালার দিকে চোখ পড়তেই দেখি একটা কালো প্রতিবিম্ব আমার দিকে তাকিয়ে আছি। ধড়পড়িয়ে উঠে বসতে দেখি সেটা নেই। মনের ভুল ভেবে আবার অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

হঠাৎ একটা অদ্ভুত আওয়াজ পেলাম, মমে হচ্ছে আওয়াজ টা খাটের নিচ থেকে আসছে। ভয়ে ভয়ে খাটের নিচে উকি দিলাম, সেখানেও কিছু দেখলামনা। সত্যিই কি আমার মনের ভুল এসব? ভাবতে ভাবতে রুমের জানালা আপনা আপনি জোরে জোরে খুলে বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। ঘাবড়ে গিয়ে দরজা খুলতে গেলাম, কিন্তু খোলা যাচ্ছেনা। বারবার লক ঘুরিয়েও কোনো কাজ হচ্ছেনা। পায়ের নিচে তরল কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করতেই তাকিয়ে দেখি ফ্লোর রক্তে ভেজা। ভয় পেয়ে লাফিয়ে সরে গেলাম।

রুমের মধ্যে ল্যাম্পের আলো একবার নিভছে আর জ্বলছে। তাকে সাজিয়ে রাখা বইগুলো সব নিচে পড়ে যাচ্ছে ঝাকুনিতে। অনুভব করলাম, ঘাড়ের উপর কারো গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। পিছনে তাকাতেই দেখি বিভৎস চেহারার একজন লোক আমার পাশে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ঠেলে বের হয়ে আসছে, কন্ঠনালী ছেড়া সেটা বের হওয়া আর তা থেকে রক্ত ঝড়ছে। পা দুটো উলটো, হাতে একটা কাটা মাথা ঝুলছে। বিড়বিড় করতে বলতে লাগল,
~ চলে যা এখান থেকে।

বাচতে চাইলে এক্ষুনি চলে যা। নাহলে তোর হাল আমার মতই হবে। ভয়ের চোটে আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা, পুরো শরীর প্রচন্ড কাপছে। কোনোমতে বললাম, কেন চলে যাব? না গেলে কি হবে?

লোকটা অট্টহাসি দিয়ে বলল, শয়তানের কাছে এলে কি হয় জানিসনা! তুই তো শয়তানের আস্তানায়। ভয়ংকর শয়তানের হাত ধরে এসেছিস, এবার তো তোর নিস্তার নেই। তোর কাউকে বাচতে দেয়নি, তোকেও দিবেনা।
বলে লোকটা আমার গলা চেপে ধরল শক্ত করে। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম আমার। নিঃশ্বাস ছেড়ে দেওয়ার মূহুর্তে সে আমাকে ছেড়ে দিল। আমি মৃতের মত ফ্লোরে পড়ে রইলাম। সে লোকটি জানালার দিকে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ থেমে শরীর না ঘুরিয়ে শুধু মাথা ঘুরিয়ে বলল, চলে যা এখান থেকে।

আমি আর সজাগ থাকতে পারলামনা, মূহুর্তেই জ্ঞান হারালাম।
চোখ খুলে দেখি তাসবীন আমার পাশে বসে আছে আমার হাত শক্ত করে ধরে। আমার কপালে হাত ছুয়ে বলল,
~ কি হয়েছে আপনার?
কাল রাতের ঘটনাগুলো এক এক করে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। ধড়পড়িয়ে উঠে বিছানা থেকে নেমে নিজের কাপড়চোপড় গোছাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। উনি আমার এমন আচরণ দেখে বলল,
~ আপনি কাপড়চোপড় গোছাচ্ছেন কেন?
~ আমি এখানে থাকবনা।

~ কেন? আপনি কি থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন?
আমি একবার তাসবীনের মুখের দিকে তাকালাম। লোকটি বলেছিল, আমি শয়তানের হাত ধরে এখানে এসেছি। তার মানে সে তাসবীনকে শয়তান বলেছে। তাসবীন কি আসলেই কোনো শয়তান? উনার অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে আমাকে এখানে আনার পিছনে!
উনি আমার হাত ছুয়ে বলল, কেউ কি আপনাকে কিছু বলেছে? আমি শান্তভাবে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
~ আপনি আসলে কে? উনি চোখ মুখ অন্যরকম হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, আমি কে মানে?

~ আপনার আসল পরিচয় কি?
~ আপনি কি ঠিক আছেন? শান্ত হয়ে বসুন তো। আমার সন্দেহ টা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। উনি এভাবে ভয় পাচ্ছেন কেন? কেন ই বা প্রশ্নটা বার বার এড়িয়ে যাচ্ছেন?
আমার হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বলল,
~ আপনি এখান থেকে কোথাও যাচ্ছেন না। এখানেই থাকবেন। বলে চলে গেলেন। আমি বেড়ের উপর বসে মাথা চেপে ধরে ভাবছি, তাসবীনের মধ্যে কোনো না কোনো রহস্য অবশ্যই আছে। উনি আমাকে না যেতে দেওয়ার পিছনে কারণ তো রয়েছে। কিসের এত ঠ্যাকা উনার যে আমাকে জোর করে হলেও রাখতেই হবে? তাসবীন কি আসলেই কোনো মানুষরুপী শয়তান?

আমি স্থির করে নিলাম, এই বাড়ীতে আমি থাকবনা। তাসবীনকে আমার সন্দেহ হচ্ছে। উনার আচরণ, আমার উপর জোর খাটানো সব ই আমাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করছে। নিজের সন্দেহটার যুক্তি খুজতে লুকিয়ে লুকিয়ে উনার বেডরুমে ঢুকলাম। ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো, ওয়ালে আল্লাহর কালামের প্রিন্টিং। একপাশে জায়নামায, তসবীন, কুরআন শরীফ। পুরো রুমটায় মিষ্টি আতরের গন্ধ।

তেমন খারাপ কিছু চোখে পড়লনা, তাই সন্দেহটা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করল। শয়তান নিশ্চয়ই আল্লাহর কালাম কিংবা এসব নিজের রুমে রাখবেনা।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের ঘরের দিকে যেতেই উনার স্টাডি রুম চোখে পড়ল। একটু উকি মেরে দেখতে গেলাম উনি আদৌ ওখানে আছেন কিনা! দরজা হালকা খুলে পুরো রুমটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম, উনি নেই এখানে। দরজা বন্ধ করে চলে যাব এমনসময় কৌতুহলবশত উনার স্টাডি রুমে ঢুকতে ইচ্ছে হল।

ধীরপায়ে ঢুকলাম, কয়েকটা সাজানো গোছানো বইয়ের তাক আর একটা টেবিল-চেয়ার আছে। আমার নিজেরও বই পড়তে খুব ভালোলাগে। দু-একটা বই ঘেটে ঘেটে দেখলাম। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে তাড়াহুড়ো করে বই রাখতে গিয়ে কয়েকটা বই ফেলে দিলাম। সেগুলো উঠাতে গিয়ে দেখি তাকের কর্ণারে একটা ছোট্ট সুইচ। এটা কিসের সুইচ? ভাবতে ভাবতে চাপ দিতেই তাক টা সরে গেলাম আর একটা খোলা গুপ্তদরজা দেখতে পেলাম। কেউ স্টাডি রুমের দরজা খুলছে টের পেয়ে তাড়াতাড়ি গুপ্তঘরটাতে ঢুকে গেলাম। সাথে সাথে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি চুপচাপ আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলাম।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর বের হতে চাইলাম। কিন্তু বের হব কি করে? এইদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে বের হওয়ার উপায় খুজছি। ঘরটায় বেশ ভারী কিছু জিনিসপত্র আছে, সবগুলোই সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। একটার সাদা কাপড় সরিয়ে দেখলাম এটা একটা বইয়ের তাক। অনেক পুরোনো, ছেড়া বই দিয়ে ভর্তি। বইগুলো থেকে ভ্যাপসা গন্ধ বের হচ্ছে। একটা হাতে নিয়ে নিলাম, কাভারের উপরের ধুলো ছেড়ে বইয়ের নাম টা পড়ার চেষ্টা করলাম।”শয়তানের উপাসনা” নামটি পড়েই ঘাবড়ে গেলাম।

একে একে আরো কয়েকটা বই নামিয়ে দেখলাম, সবগুলোই শয়তান ও তার সন্তুষ্টি লাভ সম্পর্কিত। উনার স্টাডির গুপ্ত ঘরে এসব বই কেন? ব্যাপারটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল।
ভাগ্যক্রমে এখানেও তাকটার সাথে একটা সুইচ পেয়ে গেলাম। সব গুছিয়ে রেখে সেটায় প্রেস করলাম। দরজা খোলার পর স্বাভাবিক ভাবেই বের হয়ে আসলাম। কেমন যেন ঘাপলা লাগছে। যাক, ওইসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাসবীন চলে এসেছে। আমাকে রুমে না দেখলে জেরা করবে। তাড়াতাড়ি নিচে চলে এলাম। ঠিক যে ভয়টা পাচ্ছিলাম তাই ই হল। তাসবীন আমার বেডের উপর বসে আছে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
~ কোথায় ছিলেন?

~ তেমন কোথাও না, আশে পাশেই।
আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার হাতে এত ধুলো কেন? ভিমড়ি খেয়ে গেলাম এমন প্রশ্নে।
হাত ঝেড়ে বললাম, জানিনা কিভাবে লেগেছে? কয়েকটা জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম।
উনি একপলকে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমি মনে মনে ভয় পাচ্ছি উনি বুঝে ফেললেন নাকি আবার

পর্ব ৯

উনি আমাকে আর কিছু বললেননা। আমি উনার চেহারার দিকে তাকিয়ে ভাবছি, এত ভালো একটা ছেলে কি করে আমাকে ধোকা দিতে পারে! এত সুন্দর করে আল্লাহর বাণী বলে বেড়ানো মানুষ কি করে শয়তান হয়!

এমনসময় সানজানা আর আন্টি আমার রুমে আসল। আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলে? তোমাকে খুজছিলাম। আমি উনার মুখের দিকে তাকালাম, উনিও আমার উত্তরের জন্য আগ্রহচিত্তে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। দুজনকে দুইরকম কথা বললে প্যাচে পড়ে যাব। এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম,
~ আন্টি আমাকে খুজছিলেন কেন?
~ সবাই মিলে সন্ধ্যে বেলা একটু বের হব। তোমাকেও আমাদের সাথে নিতে চাই। রেডি হয়ে থেকো কেমন?
~ কোথায় যাব আন্টি?

~ আমার বান্ধবীর মেয়ের আকদ, সবাইকে স্বপরিবারে দাওয়াত করেছে।
আমি একটু চুপ থেকে বললাম, আন্টি আমি যাবনা। আন্টি কিছু বলার আগে সানজানা আমাকে নিজের দিকে টেনে এনে বলল, যাবেনা কেন? তোমাকে আমাদের সাথে যেতেই হবে।
~ আসলে আমার শরীরটা একটু খারাপ। আমি এখন বের হলে আমার কাছেই বেশী খারাপ লাগবে। তারচেয়ে বরং আমি বাসায় রেস্ট করি। তাসবীন আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, আপনার শরীর খারাপ বলেননি তো!

~ তেমন কিছু না। মাইগ্রেনের পেইন হালকা। একটু ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।
আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোমাকে বাসায় একা ফেলে কিভাবে যাই?
~ চিন্তা করবেন না আন্টি। আমি ঘুমিয়ে থাকব। সমস্যা হবেনা, আপনারা বরং তৈরি হয়ে নিন।
তাসবীন তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আম্মু তাহলে তোমরা যাও। আমি বাসায় ই আছি।
~ তুইও যাবিনা? ফারজানা যে এত করে তোকে যাওয়ার জন্য বলে গেল।
~ উনাকে অসুস্থ অবস্থায় একা ফেলে কিভাবে যাই বলো তো? উনি যেহেতু এখন আমাদের বাসায় ই আছেন, উনার ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তো আমাদের।

আমি উনাকে সরাসরি বললাম, আমি সত্যিই ঠিক আছি। আপনি এভাবে জেদ করবেননা।
~ মুসকান আপনাকে এভাবে ফেলে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না। আন্টির ডাক এল বাহির থেকে, উনি আমাকে বললেন,
~ দেখোনা, এর মধ্যে যদি শরীর ভাল হয়ে যায় তবে আমাদের সাথে যাবে। একটু রেস্ট করো।
আর যদি না ভাল হয় তবে সানজানা তোমার সাথে থাকবে।

আর তাসবীন ফারজানা কিন্তু খুব করে বলে গেছেন, তুমি না গেলে ব্যাপারটা বাজে দেখাবে। দরকার হলে বেশীক্ষণ থেকোনা, দেখা সাক্ষাত করে চলে এসো।
এসব বলে আন্টি আর সানজানা চলে গেলেন। আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ আপনি কিন্তু এভাবে আমাকে ছোট করছেন। আপনি যদি এমনটা করতে থাকেন, তাহলে আমার এখানে থাকা সম্ভব হবেনা। অনুরোধ করছি, আপনি আন্টিদের সাথে যান। আমার কোনো অসুবিধা হবেনা।
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
~ আচ্ছা।

তবে আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরব, ততক্ষণ অবধি নিজের খেয়াল রাখবেন।
~ ধন্যবাদ অনুরোধ রাখার জন্য। আল্লাহ হাফেজ।
ওরা চলে যাওয়ার পর আমি দরজা লক করে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। পরপর সব ঘটনা মিলানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু একটা ঘাপলা রয়েই গেছে। এতসব করার পরও তাসবীন কেন ভালো মানুষ সেজে আছে? আর কালকে রাতের লোকটাই বা কে যে আমাকে সাবধান করতে এসেছিল? এই সবকিছুর উত্তর তাসবীন নাহলে ওই লোকটিই দিতে পারবে।

কিন্তু এখন আমার কি করা উচিত? এখান থেকে চলে যাওয়া নাকি ওনার মুখোশ সবার সামনে টেনে ছিড়ে ফেলা? এমনসময় লোডশেডিং হয়ে গেল। একটু ঘাবড়ে গেলাম। উঠে মোম বা টর্চ খোজার চেষ্টা করছি। রান্নাঘরে নিশ্চয়ই থাকবে, আবছা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে রান্নাঘরে গেলাম।

ভাগ্যক্রমে মোমবাতি পেয়ে গেছি। সেটা জ্বালিয়ে ফেরার সময় জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে চোখ পড়ল। সেখানে এখনো ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে, কিছুটা দূরের আশেপাশের বাসার আলো জ্বলছে। মোটকথা, শুধু এই বাড়ীতেই লোডশেডিং। ব্যাপারটা কেমন জানি রহস্যজনক।
মোমবাতি নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে রইলাম। নিজের রুমে একা যাওয়ার সাহস পাচ্ছিনা। হঠাৎ বিকট শব্দে সদর দরজা খুলে গেল। লম্বামতন কেউ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মোমবাতি উচিয়ে ধরে বোঝার চেষ্টা করলাম মানুষটা কে!

পরক্ষণেই চেচিয়ে বললাম, কে ওখানে? সামনে আসুন বলছি।
ছায়ামানুষটা আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। হঠাৎ আবার চোখের সামনে মিলিয়ে গেল। মোম হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম দেখতে আসলেই কেউ আছে কিনা। কেউ যেন আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আমায় খুজছো? চমকে গিয়ে মোম সেদিকে ঘুরিয়ে দেখি তাসবীন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
তার চোখ দুটো ভীষণ লাল, সাদা শার্ট পুরো রক্তে লাল হয়ে আছে। এক হাতে শান দেওয়া ছুরি চকচক করছে।

আমতা আমতা করে বললাম,
~ আপনি? কখন এলেন? এই অবস্থা কেন আপনার?
উনি ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা দিলেন। হাত দিয়ে ছুরিটা নাড়তে নাড়তে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। আমি বুঝতে পারছিনা উনি কি করতে চাচ্ছেন?
ভয়ে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। পিছুতে পিছুতে দেয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকলাম। উনি হিংস্রভাবে আমার কাছে এসে আমার চুল চেপে ধরে ছুরিটা আমার গলা বরাবর তাক করলেন। ফিসফিস করে বললেন,
~ আমার ব্যাপারে সব জেনে গেছিস তাইনা?
এখন তো তাহলে তোকে মরতে হবে। তোর রক্ত আমি শয়তানের উদ্দেশ্যে ভোগ দিব। বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

এত তাড়াতাড়ি তাসবীনের আসল রুপ আমার সামনে চলে আসবে সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। এর হাত থেকে যে করে হোক আমাকে বাচতে হবে। বিড়বিড় করে আয়াতুল কুরসি পড়তে শুরু করলাম। তাসবীন দুহাতে কান চেপে ধরে আমার থেকে দূরে সরে গেল। এই সুযোগ আমার পালানোর।
দৌড়ে দরজার বাহিরে এসে দোয়া পড়ে দরজা বাহিরে থেকে বন্ধ করে বেরিয়ে এলাম। জানিনা এটা আদৌ কাজ করবে কিনা? কতক্ষণ সে ভিতরে আটকে থাকবে? কিন্তু এটা জানি এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব আমার পালাতে হবে।

রাস্তায় এসে এদিক ওদিক তাকালাম। কোথায় পালাব বুঝতে পারছিনা! নিজের উপর ভরসা রেখে উলটো দিকে দৌড়াতে লাগলাম। খালি পায়ে দৌড়াতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, পায়ের কোথাও হয়ত ছড়ে গেছে। কিছুটা দৌড়ে আসার পর দেখি বিপরীত দিকে তাসবীন ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
ছুটে আসছে আমার দিকে। প্রাণপণে আবার দৌড়াতে লাগলাম।

ধরতে না পেরে সে আমার দিকে ছুরি ছুড়ে মারল। আল্লাহ সহায় ছিল বলে অল্পের জন্য গায়ে লাগেনি। তবে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা ছড়ে গেছে পিঠ। প্রচন্ড ক্ষোভে সে আমাকে আবার তাড়া করতে শুরু করল। রাস্তায় কত গাড়ি, থামানোর কত চেষ্টা করলাম কিন্তু একটা গাড়িও থামলনা। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এতক্ষণ দৌড়ে। কিন্তু নিজের উপর ভরসা করে যতটা পারি ছুটতে লাগলাম। ছুটতে ছুটতে বড় একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেলাম। চোখ বুজে আসার মূহুর্তে দেখলাম তাসবীন এগিয়ে আসছে ছুরি নিয়ে। মুখে ভয়ংকর হাসিটা।
আমার মৃৃত্যু আমার সামনে উপস্থিত, আর বাচার কোনো উপায় নেই। আল্লাহ আপনি আমাকে রক্ষা করুন। যেভাবেই মরি আফসোস নেই, কিন্তু কোনো শয়তানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে চাইনা।

পর্ব ১০

আস্তে আস্তে চোখ মেলে চারপাশে তাকালাম। বুঝার চেষ্টা করলাম আমি আসলে কোথায় আছি! মার্বেল পাথরের প্রশস্ত ঘর, সাজানো দেয়াল, নরম বিছানা কিছুই আমার চেনা নয়। উঠে বসে মনে করার চেষ্টা করলাম আমি এখানে এলাম কি করে? উহু কিছুতেই স্মরণ করতে পারছিনা। তবে এটুকু মনে পড়ল কাল তাসবীন আমাকে ধাওয়া করেছিল। শেষে আমার তার নাগালের মধ্যে পড়ে গেছিলাম। শান দেওয়া ছুরিটা নিয়ে সে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল, তারপর কি হল আমি জানিনা। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আমি এখনো বেচে আছি।

কিন্তু আমি এখানে কি করে এলাম? আর তাসবীন ই বা কোথায়? হাতের নাগালে পেয়েও সে আমাকে ছেড়ে দিল! অদ্ভুত লাগল। বিছানা থেকে মেঝেতে পা নামিয়ে রাখতে একজন আধবয়স্ক লোক ছুটে এল আমার কাছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা তুই ঠিক আছিস তো? কে কোথায় আছিস দেখে যা আমার ত্বোহা মায়ের জ্ঞান ফিরেছে।
আমার অস্বস্তি লাগল। কে ত্বোহা? আমি তো মুসকান! আর উনি ই বা কে? আমি নিচুকন্ঠে বললাম,
~ বুঝতে পারলাম না আপনি কার কথা বলছেন!

দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি আরো দুজন মহিলা, একটা মেয়ে আর একজন আধবয়স্ক লোক এসে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি এগিয়ে এসে উনাকে বলল,
~ ভাইয়া শান্ত হও। ত্বোহা এখন সুস্থ আছে। তুমি চিন্তা করোনা। আমি জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মহিলাদের মধ্যে একজন এসে আমার চুমু একে দিয়ে বলল, আপনাকে বলেছি না ভাইয়া আমাদের ত্বোহা ঠিক একদিন আমাদের কাছে ফিরে আসবে।
লোকটা খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
~ তুমি ঠিকি বলেছিলে সামিয়া। দেখো মেয়েটার মুখ কেমন জানি শুকিয়ে গেছো। কেউ টেবিল সাজাও, আজ আমি আর আমার মেয়ে একসাথে বসে খাব। কিরে মা বাবার সাথে বসে খাবিনা?
আমি মাথা নাড়িয়ে হুম বললাম। পাশের লোকটা বলে উঠল, চল ভাইয়া। ও বরং ফ্রেশ হয়ে আসুক। আমরা টেবিলে গিয়ে বসি।

~ ত্বোহা মা, তাড়াতাড়ি আয়। বাবা আজ তোকে খাইয়ে দিব। সবাই আস্তে আস্তে ঘর ফাকা করে দিয়ে বের হয়ে গেল। চিন্তিত হয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। কে এরা? আমাকে ত্বোহা বলেই বা সম্বোধন করছে কেন? কিছুই বুঝতে পারছিনা। সব জানতে হবে আমাকে। এখন এরা যা বলছে তাই করি। ফ্রেশ হয়ে নাস্তার টেবিলে এলাম। লোকটি আমাকে তার পাশে বসাল। স্যুপের বাটি থেকে স্যুপ নিয়ে আমাকে খাইয়ে দিতে লাগল। জানিনা কেন আমার চোখ বেয়ে বেয়ে পানি ঝড়তে লাগল। খুব কম ই আমি বাবার আদর পেয়েছি, স্পষ্ট করে মনেও নেই মা-বাবার কথা। তারপর থেকে কেউ আমাকে এভাবে আদর করে খাইয়ে দেয়নি। এত বছর পর বাবার বয়সী কারো থেকে এমন আদর পেয়ে আনন্দে-বিরহে চোখে পানি চলে আসল।
লোকটা আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, খাওয়ার সময় কাদতে আছে পাগলি! বাবা পাশে আছি তো তোর।

ত্বোহা মা, আমাকে একবার বাবা বলে ডাকবি?
কতদিন তোর মুখ থেকে বাবা ডাক শুনিনি বল তো।
আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলামনা। লোকটাকে জড়িয়ে ধরে কেদে কেদে বললাম, বাবা, খুব ভালোবাসি তোমায়। আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যেওনা।
লোকটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, কোথাও যাবনা আর তোকেও যেতে দিবনা। তোকেও আমি খুব ভালোবাসি।
খুব শান্তি লাগছিল ওই মূহুর্তে। মনে হচ্ছিল আমি সত্যিই আমার বাবাকে ফিরে পেয়েছি। অনেক হালকা লাগছিল ভেতরটা। নিজেকে আর অসহায়, এতিম মনে হলনা। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ইনি আমার বাবা।

কিন্তু মানুষ যা চায় তা তো সবসময় হয়না। উনার মেয়ের জায়গা আমি নিজেকে বসিয়েছি ঠিক ই কিন্তু আদৌ উনার মেয়ে হয়ে উঠতে পারব তো! এসব কি ভাবছি আমি? কারো দূর্বলতা কাজে লাগিয়ে আমি নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে পারিনা। এটা অন্যায়। ভেবেই উনাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে চলে এলাম।

ছাদে উঠে বসে আছি। হালকা বাতাসে কপালের সামনের চুলগুলো নড়ছে, বার বার সরাতে খুব একটা খারাপ লাগছেনা। উঠে রেলিং এর গা ঘেষে দাড়ালাম। যতদূর চোখ যায়, আবছা জ্যোৎস্নাভেজা অন্ধকার। এই বাড়ীটা অনেক বিশাল, মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার বলা চলে। প্রতিটা মানুষও অনেক ভালো। কপালের জোরে এখানে এসে পড়লাম। নিজেকে কেমন জানি হাওয়ায় ভাসা খড়কুটা মনে হচ্ছে, হাওয়ার টানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে পড়ছি।
এমনসময় কেউ আমার পিছনে এসে দাড়াল। চমকে উঠে বললাম, কে? লোকটি উত্তর দিল, আমি। তোমার তথাকথিত চাচ্চু। আমি আস্তে করে বললাম,
~ কিছু বলবেন?
~ হ্যা বলার জন্য ই এসেছি।
~ জ্বি বলুন।

~ তোমার মনে অনেক প্রশ্ন তাইনা? তুমি এখানে কি করে এলে? আমার ভাই তোমাকে নিয়ে এত উতলা কেন? তোমাকে অন্য নামে সম্বোধন করছে কেন?
~ হ্যা, আমি এসব জানতে চাই। দয়া করে আমাকে বলুন।
~ আমার ভাই একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিল। এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে বেশ সুখেই ছিল। কোনো এক দুর্ঘটনায় ভাবী আর আমার ভাগ্নি মারা যায়।

তারপর থেকে শুরু হয় ভাইয়ার পাগলামী। যখন এসব ঘটে, আমি বিদেশে ছিলাম। তাড়াহুড়ো করে আমার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে এখানে চলে আসি। ভাইয়া এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে তার ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।
কিছুটা ভালো হওয়ার পর তার আবার পাগলামী বেড়ে যায়। ও বিশ্বাস করে ওর মেয়ে বেচে আছে, উনার কাছে ফিরে আসবে। এইরকম পাগলামী দেখে আমরা তাকে আশ্বাস দেই তার মেয়েকে তার কাছে এনে দিব।

এভাবে শান্ত্বনা দেওয়ার মধ্যেই কয়েকটা বছর কেটে যায়। কিছুদিন ধরে ওর পাগলামীটা আবার চড়া হয়েছে। আর কিছুতেই ও বুঝ মানছেনা।
এসব টেনশান নিয়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে তোমাকে ধাক্কা মেরে দিই। অত রাতে দূরের হাসপাতালে না নিয়ে তোমাকে বাড়ীতে নিয়ে আসি। পার্সোনাল ডাক্তার দেখাই, উনি আশ্বাস দিলেন ভয়ের কিছু নেই। তোমার তেমন আঘাত লাগেনি। ভেবেছি তোমার জ্ঞান ফিরলে তোমাকে তোমার বাড়ীতে ছেড়ে দিয়ে আসব।

মাঝরাতে ভাইয়া হঠাৎ তোমার রুমে ছুটে এসে বলে, এটাই তার ত্বোহা। অনেক বুঝিয়েও লাভ হয়নি। সে মানতে নারাজ তুমি অন্য কেউ। সারারাত তোমার মাথার পাশে বসে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। ভাইয়ার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার কথা ভেবে তোমাকে ত্বোহা বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি।

এবার বলো তুমি কে? কোথায় থাকো?
চোখের পানি আড়াল করে বললাম,
~ আমি মুসকান। কাকা-কাকী আর দাদীমার সাথেই থাকতাম। বেশ কিছুদিন আগে উনারা সবাই মারা গেছেন। তাই নিজের ব্যবস্থা করতে এখানে চলে এসেছি।
উনি একটু চুপ থেকে বললেন,
~ তোমার কাছে একটা অনুরোধ করব।

~ কি অনুরোধ?
~ আপাতত আমার ভাই সুস্থ হওয়া অবধি তুমি এখানে ত্বোহা পরিচয়েই থাকো। দেখছোই তো তুমি আসার সময় ও কেমন হাসি-খুশি থাকছে, কোনোরকম পাগলামী করছেনা।
~ কিন্তু এটা তো উনাকে ঠকানো হবে।
~ এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তুমি আর না করোনা। ভাই ভালো হলে তোমার ইচ্ছে হলে চলে যেও।

এর জন্য আমি পেমেন্ট করতেও রাজি।
~ সবকিছু টাকা দিয়ে হয়না আঙ্কেল। আপনি যেহেতু আমাকে এত করে বলছেন ঠিক আছে আমি আপনার কথা রাখব। ভরসা রাখতে পারেন।
~ আল্লাহ তোমার ভালো করুন।
বলে উনি নিচে চলে গেলেন। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম একরাশ নিস্তব্ধতার মাঝে। একটু পর লোকটার মেয়ে আসল। এসে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছো আপু?
~ হ্যা ভাল, তুমি?

~ হ্যা ভাল। অনেকক্ষণ একা ছাদে আছো দেখলাম তাই গল্প করতে চলে আসলাম। মেয়েটির দিকে একনজর তাকিয়ে দেখলাম। শ্যামলা বর্ণের মেয়েদের মধ্যে আলাদা একটা মায়া থাকে। মেয়েটির মধ্যেও তাই, প্রায় সমবয়সী ই মনে হল। মেয়েটি একটু থেমে বলল,
~ কিছু ভাবছো?

~ না তেমন কিছু না। তোমার নাম কি?
~ লামিয়া। আচ্ছা আমরা তো সমবয়সী, তাছাড়া তুমি আমার বোনের মত। তোমায় তুই করেই বলি?
~ হ্যা অবশ্যই। তুই শব্দ টা আমারো খুব আপন লাগে।
অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর নীচে চলে এলাম। বাবার সাথে খেতে বসলাম, খাওয়া শেষে উনি উনার কোলে আমার মাথা রেখে হাত বুলাতে বুলাতে কতশত গল্প করল। নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হচ্ছিল। এমন একটা বাবার ছায়া যদি মাথার উপরে থাকে শত তাসবীন ও সামনে আসার সাহস করবেনা।

বাবার ঘুম চলে এলে আমি আস্তে করে নেমে নিজের রুমে চলে এলাম। দরজা লক করে শুয়ে পড়ব এমন সময় দেখি ব্যালকুনিতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে গেল, তাসবীন আমার পিছু নিয়ে এখানেও চলে এসেছে। আজ ওর নিস্তার নেই আমার হাত থেকে। বেডটেবিল থেকে ভারী ফুলদানিটা নিয়ে আস্তে আস্তে ব্যালকুনির দিকে যেতে লাগলাম। তার পিছনে দাঁড়িয়ে সবে মারার প্রস্তুতি নিচ্ছি। লোকটা আমার হাতটা খপ করে ধরে মুখ চেপে ধরে। তার এমন কাজে আমার হাত থেকে ফুলদানি পড়ে উচ্চশব্দে ভেঙ্গে গেল। আমি কিছু বলার চেষ্টা করছি কিন্তু শক্ত হাতটার জন্য কোনো কথা ই বের হচ্ছেনা। পুরুষকন্ঠটা ফিসফিসিয়ে বলল, মারতে আসছেন কেন?
এভাবে পিছনে আঘাত করাটা কি ঠিক? যদি ব্যথা পেতাম।

আমি বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছেনা, তার উপর মাথার উপর হুড তুলে আছে। সে আবার বলা শুরু করলেন,
~ এভাবে বড় বড় চোখ করে কি দেখছেন? আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছিনা।
দাত দিয়ে তার হাতে ছোট করে কামড় দিতেই তার হাত সরিয়ে নিলেন। তাড়াতাড়ি উবু হয়ে হাতড়ে ভাঙ্গা ফুলদানির এক টুকরো অংশ হাতে নিয়ে তার দিকে উচিয়ে বললাম, ব্যথা পাওয়ার জন্য ই তো মারতে চেয়েছি। কে আপনি হুম? এভাবে লুকিয়ে অন্যের রুমে ঢুকতে লজ্জা করেনা। দাড়ান লাইট জ্বালিয়ে এক্ষুনি সবাইকে ডাকছি।

সে আমার হাতটা উলটো করে মোচড়ে ধরে বলল,
~ আমি কি জানি এটা আপনার মত বদরাগী মেয়ের রুম?
ভুল করে চলে এসেছি। কাউকে ডাকতে হবেনা আমি চলে যাচ্ছি।
~ আমি বদরাগী। ছাড়ুন বলছি, আমি ব্যথা পাচ্ছি।
~ ব্যথার পাওয়ার জন্য ই তো ধরেছি।

এমনসময় বাহিরে থেকে দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। সে আমার হাত ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে আলো জ্বালালাম। লামিয়া ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম,
~ কিছু একটা ভাঙ্গার শব্দ পেলাম। কি ভেঙ্গেছে?
আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে ব্যালকুনির দিকে গেলাম। ওখানে কেউ নেই, ফুলদানিটা আগের মত ওখানে পড়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে তো এটা ভেঙ্গে গেছিল, জোড়া লাগল কি করে!
লামিয়া আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
~ কি হল? উত্তর দিচ্ছিস না যে! ব্যালকুনিতে কে আছে?

~ কেউ নেই। ফুলদানিটা হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল ভাগ্যিস ভাঙ্গেনি।
~ ওহ আচ্ছা। তুই ঘুমাসনি?
~ এইতো ঘুমাব।
~ আচ্ছা আসিরে। আমারো বড্ড ঘুম পেয়েছি।
~ ঠিক আছে আয়। আল্লাহ হাফেজ।
লাইট অফ করতেই আবার সে পুরুষকন্ঠ,
~ ঘাবড়ে গেছেন মনে হয়?

~ মোটেও নাহ। আপনি আসলে কে বলুন তো?
এভাবে রাত-বিরাতে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? অই সময় কোথায় ই বা পালালেন?
~ এত প্রশ্নের উত্তর একসাথে কিভাবে দেই বলুন তো!
আপনি এখন ঘুমান। আমি আসছি।
মাঝে মাঝে ভয় দেখানোর জন্য আসব।
বলে চুপ মেরে গেল। বুঝলাম, সে চলে গেছে। মনের মধ্যে আতঙ্ক ঢুকে গেছে। এটা তাসবীন নয় তো, আমাকে ফাদে ফেলার নতুন কোনো ষড়যন্ত্র না তো?

পর্ব ১১

এমন সাতপাচ চিন্তাভাবনা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম। এই বাড়ীতে আসার পর দিনগুলো কেমন স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছে। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা এত মধুর হয় জানা ছিলনা। বিকালবেলা বাবাকে নিয়ে হাটতে বের হলাম। বাবা হাটতে হাটতে বলল, জানিস মা, অনেকদিন পর বাসা থেকে বের হলাম। খোলা আকাশ, মুক্ত বাতাস সব যে কত ভালো লাগছে বলে বুঝাতে পারবনা।
~ এবার থেকে প্রতিদিন আমার সাথে তুমি বের হবে।
~ সত্যি বলছিস?

লোকটার চকচক করতে থাকা চোখের দিকে বললাম, হ্যা বাবা। সত্যি বলছি, তবে একটা শর্তে কোনো অনিয়ম করা যাবেনা। রোজ রুটিনমত খাবার-ওষুধ খেতে হবে।
লোকটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম, সব শুনব রে মা। শুধু তুই তোর বাবার কাছে থাকিস। ভাগ্যটা ভীষণ অদ্ভুত। এমন এক জায়গায় এনে দাড় করিয়েছে যেখানে দুটো মানুষের প্রাপ্তির হিসাব সমান। হঠাৎ করে লোকটা বুকে হাত দিয়ে নিচে বসে পড়ল। আমি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে বাবা তোমার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো!
বাবা বিছানায় শুয়ে আছে আর আমি আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ডাক্তার এসে একবার চেকআপ করে গেল। উনাকে অতিরিক্ত উত্তেজিত করতে বারণ করে গেল, শরীর এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি উনার।

চুপচাপ বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেমন জানি একটা মায়া কাজ করছে তার প্রতি। আংকেলটা ডাক্তার কে বিদায় দিয়ে ফিরে এসে বলল,
~ আমার মনে হয় ভাইয়ার একটু বিশ্রাম দরকার।
চল, আমরা তাকে একটু রিলেক্সে ঘুমাতে দেই।
আমি আরেকবার বাবার দিকে তাকালাম। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন, এখন তাকে একা রাখা উচিত। উঠে চলে এলাম, লামিয়াকে খোজার জন্য রান্নাঘরের দিকে গেলাম।
তখন কিছু টুকরো কথা কানে ভেসে আসে। আন্টিটা লামিয়াকে বলছে,
~ এত আদিক্ষেতার কি আছে বুঝিনা! এক্সিডেন্ট হয়েছে, সেবাযত্নে সুস্থ ও হয়েছে কোথায় চলে যাবে। তা না করে ঘাড়ের উপর চেপে বসেছে।

~ উফফ মা। ত্বোহা কি নিজের ইচ্ছেতে এই বাড়ীতে আছে নাকি জেঠুর শরীর খারাপ বলেই তো!
~ চুপ থাক। এইরকম মেয়েদেরকে আমার ভালোই চেনা আছে। সুযোগ পেলেই হল, বড়লোকের বাড়ী দেখেছে ওমনি লোভে চেপে বসেছে।
আর কি ত্বোহা ত্বোহা করছিস? এই মেয়ে মোটেও ত্বোহা নয়। আমার তো মনে হয় এই কোনো ডাকাতনী। তক্কে তক্কে আছে বড় দাঁও মারার আশায়।
~ চুপ করো তো মা।
~ উচিৎ কথা বললেই তোদের সহ্য হয়না। সেদিন ও আর বেশী দূরে নেই যেদিন বুঝবি আমার কথা কতটা সত্য।
যেমন মেয়ে তার তেমন বাপ।
আল্লাহ সব নির্বোধ আমার কপালেই জুটিয়েছে।
এক মূহুর্ত আর ওখানে দাড়ালামনা। ছুটে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বালিশ জড়িয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলাম। কথাগুলো কাটার মত আমার গায়ে বিধছে। আমার তো কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই, কখনো কারো ক্ষতিও চাইনি তাহলে আমাকে সবাই কেন এত খারাপ ভাবে!
আমি বাবাকে না ঠকাতে চেয়েছি আর না এই বাড়ীতে থাকতে চেয়েছি! তাও কেন এত বাজে মন্তব্য শুনতে হচ্ছে।

পুরুষকন্ঠটি বলে উঠল,
~ এত সহজে ভেঙ্গে পড়লে চলে? আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের এভাবেই ধের্য্যের পরীক্ষা নেন। সেটাকে ভয় পেয়ে পথ চলা বন্ধ করে দিলে আল্লাহ নারাজ হবেননা।
আমি তক্ষুনি উঠে বসে চোখ মুছে বললাম,
~ কে? ঘরের অন্ধকার কোণা থেকে আওয়াজ এল।
~ আমি।

~ আপনি আবার কেন এসেছেন? কে আপনি?
কেন আমাকে এভাবে জ্বালাতন করছেন বলুন তো!
~ শান্ত হন আপনি। এভাবে ভাঙ্গা রের্কডার মত চেচাবেন না তো।
~ আমি ভাঙ্গা রেকর্ডার? বাজে কথা বন্ধ করে বলুন কে আপনি? এখানে কি চান?
~ সত্যি বললে ভয় পাবেন না তো!
~ না পাবনা। বলুন আপনি।
~ আমি একজন জ্বীন। আমার নাম সাদাফ।

শুনে আমার কেমন জানি হাতপা কাপতে লাগল। আমার কাছে জ্বীন কেন এল? তাসবীন কি এবার আমাকে মারতে জ্বীন পাঠাল? কাপা কাপা কন্ঠে বললাম,
~ আপনি জ্বীন তাহলে আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন? কেন এসেছেন?
~ আমি কেবল আপনাকে সঙ্গ দিতে এসেছি। ভয় পাবেন না, আমার দ্বারা আপনার কোন ক্ষতির আশংকা নেই। নির্ভয়ে থাকুন।
~ আমার চাইনা কারো সঙ্গ। আপনি এখন আসতে পারেন। ভবিষ্যতে আমার আশেপাশে ঘেষার চেষ্টা করবেননা। আমি জ্বীন-টীন কাউকে বিশ্বাস করিনা।
~ কিন্তু

~ দয়া করে আমাকে একা ছেড়ে দিন। চলে যান এখান থেকে। এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামলাম। রুমটার বাতাস এখন অনেকটা হালকা লাগছে। বোধহয় জ্বীনটা চলে গেছে। তাসবীন শয়তানটার কথা মনে পড়তেই মাথার মধ্যে রাগটা ভীষণ চড়া দিয়ে উঠেছিল। কাউকে বিশ্বাস হচ্ছেনা আমার। হবে ই বা কেন? তাসবীন ও আমার সামনে এমন ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে এসেছিল আমাকে সঙ্গ দিতে। অনেক ভালোলাগা জন্মে গেছিল তার প্রতি, খানিকটা দূর্বলতা আর অগাধ বিশ্বাস জয় করে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। দুনিয়ায় এত মানুষ থাকতে এরা কেন আমাকে আঘাত করতে আসে? আল্লাহ কি আমার কপালে ভালো কিছু কখনোই লিখে রাখেননি!

লামিয়া দরজায় কড়া নেড়ে ডাকল, ত্বোহা। দরজা অফ করে রেখেছিস কেন? চোখমুখ মুছে দরজা খুললাম।
~ ডাকছিস যে?
~ জেঠু উঠে গেছে। তোকে ডাকছে।
বাবা আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলল, কিরে ত্বোহা মা! তোর মুখটা এত শুকনো কেন?
~ কই তেমন কিছুনা।
~ শুন মা, জীবনে কোনোকিছুর সাথে আপোস করবিনা।
আল্লাহর উপর ভরসা রাখবি। সবাইকে একরকম ভেবে ভুল করিসনা। বাবার কথাগুলো শুনে কেমন জানি খারাপ লাগতে শুরু করল। সাদাফ যদি তাসবীনের কেউ না হয়, তাহলে আমার এমন আচরণ করাটা খুব অন্যায় হয়েছে। কিন্তু আমার ই বা কি করার! বিশ্বাসটা যে হারিয়ে ফেলেছি।
নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় হয়।

লামিয়া পিছন থেকে আমার চোখ চেপে ধরল। মূহুর্তে ভাবলাম হয়ত সাদাফ এসেছে। অস্ফুটস্বরে বললাম,
~ আপনি এসেছেন? ও চোখ ছেড়ে আমার পাশে বসে বলল, কার কথা বললি?
~ উহু কারো না। এত রাতে তুই ছাদে কেন?
~ ঘুম আসছিলনা। তোর রুমে গিয়ে দেখি তুই নেই। তাই ছাদেই চলে আসলাম আড্ডা দিতে।
~ ভালোই হল। একা একা বসে ছিলাম।

~ আচ্ছা তুই সবসময় এত কি ভাবিস বল তো? বিএফ এর কথা নাকি?
~ আরেহ না, আমার ওইসব নেই।
~ বলিস কি! সত্যিই নেই?
তাহলে কাউকে পছন্দ করিস নিশ্চয়ই!

প্রতিউত্তরে চুপ করে রইলাম। পছন্দ তো একজন কে করেছিলাম, কিন্তু সে তার যোগ্য ছিলনা।
~ তাও নাহ।
~ এত বেরসিক তুই! না আছে বিএফ আর না আছে পছন্দের কেউ!
~ উমম, তবে একটা উইশ আছে।

~ কি উইশ?
~ একটা জ্বীনকে বিয়ে করব। লামিয়া আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। একটু চমকে উঠে বলল, মজা করিস?
~ মজা কেন করব? দাদীমা যখন আমাকে জ্বীনের ভয় দেখাত, তখন আমার কেন জানি উইশ হত আমার এক্লটা জ্বীনবর হবে।
~ দূর, এসব আবার হয় নাকি?

~ কেন হবেনা? দাদীমা আমাকে বলেছে জ্বীন আর মানুষের বিয়ে হয়।
~ আচ্ছা ম্যাম, আপনি জ্বীন পাবেন কোথায়?
উঠে দাঁড়িয়ে হাত ছোড়াছুড়ি করে বললাম, বনে-বাদাড়ে, পাহাড়-জঙ্গলে যেখানে তাহার হদিস পাই। বলে দুজন মিলে হাসতে লাগলাম। এমনসময় চোখ পড়ল মাধবীলতা গাছের পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝতে দেরী হল না এটা সাদাফ।
এখন যে করে হোক লামিয়াকে সরাতে হবে এখান থেকে। নতুবা, উনি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবে।
~ লামিয়া, অনেক রাত হয়েছে। চল, ঘুমাবি।
~ তুইও চল।
~ আমি একটু পরে যাব।

~ সমস্যা নেই, তোর সাথেই নামব। আমার তো এখন ঘুম পাচ্ছেনা। মাথা চুলকাতে চুলকাতে হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। এভাবে তো ওকে তাড়ানো সম্ভব না। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সন্দেহ করবে।
হঠাৎ চিলেকোঠার ছাদে জোরে ঢিল মারার শব্দ হল। এমন শব্দে লামিয়া ভয় পেয়ে গেল। আমার হাত টেনে বলল,
~ শুন এত রাতে আমার ছাদে থেকে কাজ নেই। চল নিচে চলে যাই। আমার ভয় করছে।
~ ভয় করছে কেন?
~ মা বলে, আমাদের ছাদের পাশের আমগাছে নাকি ভুত আছে। এই তাকাস না ওইদিকে। চল না, নিচে চলে যাই।
~ আচ্ছা চল।

আমি শুধু ওর পিছু পিছু দরজা অবধি গেলাম। এইটুকু গিয়ে ও আমাকে রেখে “ওরে বাবারে” বলে এমন ভৌ-দৌড় দিল যে আর পিছনে তাকালনা। আমি ওর অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে শেষ। তারপর মাধবী গাছের দিকে তাকিয়ে উনাকে খুজতে লাগলাম। ততক্ষণে উনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে খুজছেন?
~ মোটেও নাহ।
~ আচ্ছা তাহলে চলে যাচ্ছি।

~ শুনুন, কালকের ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। আসলে
একটু মন খারাপ ছিল।
~ আমি কিছু মনে করিনি।
কথা বলতে বলতে বেঞ্চিতে এসে বসলাম। উনি আমার থেকে অনেকটা দূরে বসলেন। খারাপ লাগল, কেন জানি মনে মনে চাচ্ছিলাম উনি আমার পাশে বসুক।
~ আচ্ছা জ্বীন আর মানুষের বিয়ে হয়?
উনি একটু চমকে উঠে বলল, হ্যা, কেন হয়না! ভালোবাসা আর বন্ধন পবিত্র হলে এসব কোনো বিষয় নয়। অবশ্য আমি কখনো হতে দেখিনি। শুনেছি এমনটা নাকি হয়!
আগেও হয়েছে বহুবার। শুনে মনে একটু আশা জাগল। কারণ, আমার যে ভীষণ ইচ্ছে একটা জ্বীনবর পাওয়ার।

~ আপনি আমাকে আপনার চেহারা দেখাননা কেন?
~ সময় হলে দেখবেন। আমরা জ্বীনেরা আবার বৈধতা ছাড়া চেহারা দেখাইনাহ।
~ কিসের বৈধতা?
~ সেটা নাহয় পরেই জানবেন।
হঠাৎ মাথাটা কেমন জানি ব্যথা শুরু করল, চোখ দুটো ও জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। আমার খুব অল্পতে জ্বর বাধে। এসব তোয়াক্কা না করে ভরসন্ধ্যেবেলা শাওয়ার নিয়েছিলাম, চুলের পানিও নেইনি ঠিকমত। তার ফল বোধহয় এই অকালজ্বর।
উনি আস্তে করে বলল, শরীর খারাপ লাগছে?

আমি কিছু বলতে পারলামনা। উনি আলতো করে আমার কপালে হাত ছুয়ে দিলেন। তারপর বললেন, আপনার তো জ্বর এসেছে। আমি আস্তে হুম করলাম। উনি তার কোল পেতে দিয়ে বলল, আমার কোলে মাথা রাখুন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
কি এক ঘোরের মধ্যে উনার কোলে মাথা রাখলাম। উনি আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে তার ঠান্ডা হাত আমার কপালে বার বার ছুয়ে দিলেন। ভীষণ ভালোলাগছিল। মনে হচ্ছিল, সারাজীবন এভাবেই উনি আমার চুলে বিলি কেটে দিক।
কিন্তু অজানা এক আতঙ্ক আমাকে জড়িয়ে ধরল। তাসবীনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি উনার মধ্যে। উনিও আমাকে ওর মত ঠকাবেন না তো? আস্তে করে বললাম,
~ সবাই আমার সাথে কেন এমন করে?

~ ভালো মানুষের সাথে দুনিয়ায় সবসময় খারাপের ই দেখা হয়। তাই বলে ভালো মানুষটা খারাপ হয়ে যায়না। আল্লাহ সবাইকে একই মানসিকতা দিতে সৃষ্টি করেননি। অতএব, উনার উপর ভরসা রাখুন। বিপদে-আপদে উনার শরণাপন্ন হন। আর হ্যা, নিয়মিত নামায পড়বেন। মনের সব কথা মোনাজাতে আল্লাহকে বলবেন, দেখবেন কষ্ট কমে গেছে। নিজেকে হালকা লাগছে।
উনার কথাগুলো খুব ভালোলাগছে শুনতে। এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি, নামাযের ব্যাপারেও আলসেমি করেছি।
রাত জেগে নানান গল্প করলাম। সবি আমার ভালোলাগা, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে।
এভাবে সারারাত গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টের ই পেলামনা।

পর্ব ১২

সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আমি নিজের বিছানায় ঘুমাচ্ছি। ভেবে চমকে উঠলাম, আমি তো ছাদে ছিলাম উনার সাথে। এখানে আসলাম কখন? এটা নিশ্চয়ই উনার কাজ। শরীর এখন অনেকটা চাঙ্গা লাগছে।
ফ্রেশ হয়ে বাবার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি বাবা বিছানা থেকে নিচে পড়ে আছে। আতকে উঠে ছুটে গেলাম বাবার কাছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আছে বাবার। পালস ও পাচ্ছিনা ঠিকমত। জোরে জোরে চাচ্চুকে ডাকতে শুরু করলাম।
ডাক্তার বাবাকে দেখছে, আমি এককোণায় দাঁড়িয়ে মুখ লুকিয়ে কাদছি। মানুষটা দুদিন আগেও কত চঞ্চল,হাসি-খুশি ছিল, এখন কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে।

ডাক্তার চাচ্চুর সাথে কিসব বলে চলে গেল। বাবা আমাকে কাছে ডেকে নিল। আমি কাছে গিয়ে বাবার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,
~ তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো? বাবা টেনে টেনে বলল,
~ নারে মা, তুই আমার কাছে আছিস। আমি এখন ঠিক ই আছি।
~ কথা বলোনা বাবা। চুপ করে শুয়ে রেস্ট নাও।

কয়েকদিন ধরে তোমার শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে।
~ সেটা তো বুঝতে পারিরে মা। এখন আমার একটাই চিন্তা, আমার ভালোমন্দ কিছু হয়ে যাওয়ার আগে তোর বিয়েটা যাতে ঠিক মত দিয়ে যেতে পারি।
~ এসব বিয়ে-টিয়ে কিছু দিতে হবেনা। আমার বাবা খুব তাড়াতাড়ি আবার সুস্থ হয়ে যাবে।
~ বাবা হিসেবে তো কখনো তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি। এখন যদি বিয়েটা না দিতে পারি, আমি তো মরেও শান্তি পাবনা। বাবাকে এইটুকু অন্তত করতে দে।

চাচ্চু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এখনি বিয়ে ধরার কি আছে ভাইয়া? আগে তুমি সুস্থ হও। তারপর সেসব দেখা যাবে। এতবছর পর ত্বোহামণিকে কাছে পেয়েছো এখনি তাড়াতে হবে বুঝি!
~ নারে ভাই, ও চলে গেলে বেশি কষ্ট আমার ই হবে। কিন্তু আমার ভীষণ ছটফট লাগে। শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে, ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে ত্বোহা মায়ের বিয়েটা দেখার সাধ আমার অপূর্ণ থেকে যাবে।
তাছাড়া, আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই যোগ্য কারো কাছে আমার ত্বোহা মায়ের দায়িত্ব দিয়ে। চাচ্চু একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
~ সে ঠিক আছে। তুমি যা চাও তাই হবে।

আমি ত্বোহার জন্য সম্বন্ধ দেখা শুরু করি তাহলে।
~ হ্যা, শুভ কাজে দেরী করতে চাইনা। কি বলিস ত্বোহা মা!
আমি কিছু বলতে পারলামনা। চোরের মত পালিয়ে চলে এলাম। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছিনা। নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। আমি আসলে কি চাই সেটা আমিও বুঝতে পারছিনা, কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছিনা। এখন যদি না করি, তাহলে বাবা কষ্ট পাবে। উনার মেয়ে নাহলেও এতদিন বাবার স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছেন। চাচ্চুর সাথে কথা বলে দেখি উনি যদি পারেন এই ব্যাপারটা বাদ দিতে। রাতে চাচ্চুর ঘরে ঢুকার সময় শুনতে পেলাম। চাচ্চু বলছে,
~ ভাইয়ের মাথায় এখন ভুত চেপেছে ওই রাস্তার মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। চাচীমা বলে উঠল,
~ তো তুমি আটকালেই পারো!

~ আটকানো কি এত সহজ? আমার তিল তিল করে সাজানো প্ল্যান টাই ভেস্তে দিল মেয়েটা। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। ভাইয়ের ব্রেইন টিউমার এর জন্য ভাই এমনিতেই কিছুদিন পর দুনিয়া ছাড়বে। ভেবেছি তারপর মেয়েটাকে বিদায় করে দিয়ে ভাইয়ের সব সম্পত্তি নিজের আয়ত্বে আনব।
এখন যদি মেয়েটাকে বিয়ে দিই, ভাই মরার আগে সম্পত্তি মেয়েটা কিংবা তার স্বামীর নামে উইল করে দিয়ে যাবে। সেটা নাও করলে মেয়েটার স্বামী যদি বেশি চতুর হয়, সে এই সম্পত্তি দাবী করে বসবে। বিয়ে দিলে এই ঝামেলা, বিয়ে না দিলে ভাইয়ের প্যানপ্যানানি। টেনশানে আছি অনেক।
~ আমি বলি কি! তুমি এমন একটা ছেলের সাথে মেয়েটার বিয়ে দাও যে বিয়ের পর মেয়েটাকে নিয়ে এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাবে। এইদিকে আর পা ও বাড়াবেনা।
~ এমন ছেলে পাওয়া কি মুখের কথা!
~ খুজে তো দেখতে পারো।

~ আচ্ছা দেখি তাহলে। ভাই বড়জোর আর ২-৩সপ্তাহ বাচবে। এর মধ্যে বিয়েটা দিয়ে বিদায় করে দিলে এখানে আসার পথ বন্ধ হয়ে যাবে মেয়েটার। ভাই ও উইল করার সময় পাবেনা।
~ তুমি ই বেশি বেশি করেছো! কি দরকার ছিল মেয়েটাকে থাকতে বলার? ঝামেলা বয়ে আনার?
~ তোমার মত মাথামোটার মাথায় এসব ঢুকবে না। ভাইয়ার উইলে বলা আছে ভাইয়ার সুস্থ মানসিকতায় স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হলেই কেবল তার পরিবার এই সম্পত্তি পাবে। নাহলে এসব এতিমখানায় দান হয়ে যাবে।

ভাইয়ার বন্ধু শালা নচ্ছার উকিলটা বুদ্ধি করে এমন শর্ত দিয়েছিল। নাহলে ভাইকে এতদিন বাচার সুযোগ আমি দিতামনা। ভাইয়ের পাগলামী কমাতেই তো মেয়েটাকে রাখা। যাতে মরে গেলে এটা প্রমাণ ভাইয়া মৃত্যুর আগে সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন ছিল।

কথাগুলো শুনে হঠাৎ নিজের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে, এক বাবাকে হারিয়ে আরেকটা বাবা পেয়েছি। আল্লাহ আমার থেকে তাকেও কেড়ে নিচ্ছে। আর এই মানুষগুলো তার কথা না ভেবে সম্পত্তি হাতানোর চিন্তা করছে। ছিঃ! এ নাকি আপন ভাই।
একজন মৃত্যুপথ যাত্রীর প্রতি এদের একটুও মায়া মমতা নেই। পশুর থেকেও জঘন্য এরা। কেউ একজন আমার পাশে বসে বলল, কাদছেন কেন?

চমকে উঠে পাশ ফিরলাম, সাদাফ বসে আছে আমার দিকে তাকিয়ে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললাম,
~ আপনি কখন এলেন?
~ ৫মিনিট ৩০ সেকেন্ড।
~ বাহ, সময়ের খুব ভালো হিসেব রাখেন।
~ সবকিছুর ই রাখি। অন্ধকারে আপনার চোখের প্রতি ফোটা পানির ও। শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম।

উনি আবার বললেন, আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে জানালার দিকে তাকিয়ে কি এত ভাবছেন?
~ তেমন কিছুই না।
~ খুব আপসেট?
প্রতিউত্তরে চুপ করে রইলাম। ইমোশোনাল মোমেন্টে আমি মিথ্যে বলতে পারিনা। বললেও হাবভাব আর চোখ দেখেই যে কেউ বুঝে যাবে আমি মিথ্যে বলছি।
উনি আরেকটু এগিয়ে এসে বলল,
~ আপনার মাথাটা একটু আমার কাধে রাখবেন?

উনার দিকে একবার তাকালাম। মনে মনে ভেবেছিলাম এই মূহুর্তে যদি কোনো কাধে মাথা এলিয়ে দিতে পারতাম নিজের অশান্ত মনটা একটু শান্ত হত। মাথার ভেতরে চিন্তা নামক পোকাগুলো গিজগিজ বন্ধ হত। চুপচাপ উনার প্রশস্ত কাধে মাথা রাখলাম। সাথে সাথে আমার রুমের জানালাটা খুলে গেল। মিষ্টি বাতাস ঢুকে আমার সবটা ছুয়ে গেল। স্বস্তি লাগছিল তখন। উনি আস্তে করে বললেন,
~ ওই যে রুপার থালার মত চাঁদ টা দেখছেন! ওই চাদের অনেক সৌন্দর্য আর জ্যোৎস্না থাকা সত্ত্বেও লোকে বলে তার কলঙ্ক আছে। তার গায়ের সামান্য কালো দাগ তার হাজার গুণ ছাড়িয়ে তাকে কলঙ্কিত আখ্যা দিয়েছে।

মানুষের চরিত্রটাও ঠিক এমন। অনেক ভালো গুণ থাকলেও একটা ছোট ভুল কিংবা খারাপ গুণ বড় ভাবে প্রকাশ হয়। তখন কেউ দেখেনা মানুষটা ভাল না সৎ।
আপনাকে নিয়ে হাজারজন হাজারটা কথা বলবে, কিন্তু আপনি নিজের উপর বিশ্বাস রাখবেন। কেননা, আপনাকে আপনার চেয়ে ভালো কেউ চিনেনা। আপনি নিজেই যদি নিজেকে দোষী ভাবেন তবে অন্য মানুষগুলো আপনাকে নির্দোষ কি করে ভাববে বলুন!

আমি উনার মুখের দিকে তাকালাম। হয়ত উনি ঠিক ই বলছে, বাস্তবিকতা বুঝিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু মনের সাথে যুদ্ধ করে কতক্ষণ টিকে থাকা যায়। যে মানুষদেরকে কখনো চিনতামনা, জানতামনা তারাই আমার নিজের হয়ে আছে। আমার জন্য যদি তাদের কষ্ট হয় আমি তো নিজেকে দোষী ভাবতে বাধ্য।
~ আচ্ছা আপনি এটা বলতে পারবেন মনের সাথে যুদ্ধ করে কি করে জিতে যাওয়া যায়?

উনি মুচকি হেসে বললেন, নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে জিততে পারবেন? ভিতরটাও আপনার আর বাহিরটাও আপনার। যুদ্ধে দুইপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি আপনার নিজের ই হবে। তাই মনের সাথে যুদ্ধ না করে বিবেকের আশ্রয় নিন। মনটা আবেগতাড়িত, তার নেওয়া সব সিদ্ধান্ত ই ঠিক হবেনা৷। এইজন্য মনের সাথে যুদ্ধে জিতে যাওয়া কেবল অনর্থ।

কয়েকটা জোনাক পোকা রুমে ঢুকে রুমটাকে আলোকিত করছে। মাঝে মাঝে আমার কপাল-গাল ছুয়ে যাচ্ছে। অজানা ভালোলাগায় আমি বার বার শিহরিত হচ্ছি। হঠাৎ বেফাসে বলে উঠলাম,
~ বিয়ে করবেন আমাকে?

উনি একটু চুপ থেকে আমার দিকে ফিরলেন। তার ঠান্ডা দুহাত দিয়ে আমার দুগাল জড়িয়ে ধরে বললেন,
~ বিবেক থেকে বলছেন নাকি আবেগ থেকে?
~ জানিনা।
~ হুম করব।
~ কিভাবে?
~ জানিনা। বড্ড অভিমান হল আমার। সরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। উনি মুচকি হেসে আমাকে উনার বুকের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। পরম শান্তিতে আমি চোখ বুজে অবশের মত তার বুকের সাথে লেগে রইলাম। হ্যা, হয়ত এটাই আমার পরম শান্তির আশ্রয়। এটাই আমাকে ভালো রাখবে।

আল্লাহ আমাকে বুঝার মত ঠিক সময় তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বাবা পাত্র আর বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলেছেন। মাত্র ২দিন পর ই আমার বিয়ে। তোড়জোড় আয়োজন চলছে, আমার অসুস্থ বাবাটা নিজে তদারকি করে বিয়ের সব আয়োজন করছেন। তার হাসিমুখটা দেখে শত কষ্টের মাঝেও স্বর্গীয় প্রশান্তি পাচ্ছি। এটাই হয়ত স্নেহের টান। যেখানে রক্তের মিল না থাকলেও ভালোবাসা একই থাকে।

কয়েকবার নিজের অমতের কথা বলতে গিয়েও বাবার স্বস্তিভরা মুখটা দেখে দরজা থেকেই ফিরে এসেছি। এই রৌদ্রজ্জ্বল মুখটাকে কালো মেঘে ঢেকে দিতে বুকের গভীর থেকে বাধা পাচ্ছি। চুপচাপ নিয়তির খেলা দেখে যাচ্ছি। চোখের সামনে কল্পনা করছি, আমার অমতের কথা শুনে বাবার বিষন্নতায় ছেড়ে যাওয়া অসুস্থ মুখটা।

বিবেক যেন বার বার বলে উঠছে, এই মানুষটাকে তুই কষ্ট দিতে পারিসনা। তোর মুখপানে চেয়েই মানুষটা বেচে আছে এখনো। শেষ সম্বল যদি বেঈমানি করে উনি যে আর ভালোভাবে শেষ কয়টা দিন বাচতে পারবেনা।
তুই নিজেও আমৃত্যু অবধি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবিনা। সাদাফের কথামত মনের সাথে যুদ্ধে নামিনি, বিবেকের কথা ই মেনে নিয়েছি।
সেদিনের পর ৩-৪দিন সাদাফ আর আমার কাছে আসেননি। আসতে পারেননি নাকি আসতে চাননি সেটা আমি জানিনা। শুধু এইটুকু বিশ্বাস করে আছি উনি ঠিক সময় আমার সামনে হাজির হবেন আর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাকে বিয়ে করবেন।

এদিকে সময় যেন তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে আসছে। সে আমাকে একটু ফুসরত দিচ্ছেনা বিশ্বাসের জোর রাখার। প্রতিনিয়ত একটু একটু আশার আলো ক্ষীণ হচ্ছে।

লামিয়ার কথায় আমার হুশ ফিরল। আমাকে আয়নার সামনে এনে বসিয়ে বলল, দেখ নিজেকে। কেমন লাগছে তোকে? একপলকে আয়নায় পড়া নিজের অপরিচিত প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বিয়ের সাজ মেয়ের বহু আকাঙখিত সাজ।

টকটকে লাল বেনারসী, ভারী গয়না, লালরঙ্গা মেহেদী আকা হাতে রাশি রাশি চুড়ি, চোখে-মুখে আলাদা সাজ, খুব যত্নে করা খোপায় অনেক লাল গোলাপের ঢল, টিকলি আর ঝাপড়ার উপর টেনে দেওয়া মসলিনের গর্জিয়াস ওড়না এসব মিলিয়ে সত্যি বউ বউ লাগছে। লামিয়া টিটকারী মেরে বলল,
~ বউ সাজে যে তোকে এত সুন্দর লাগবে ভাবিনি। দুলাভাই না আজ ট্যারা হয়ে যায়। বলে হাসতে লাগল।
আমি ঠোট প্রশস্ত করে উপহাসের হাসিটা হাসলাম। বিয়ের কোনো আয়োজন ই আমার ভিতরটা স্পর্শ করছেনা।

এমনসময় বাবা আমার ঘরে এলেন। অপলক আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,
~ আমার মেয়েটাকে সত্যি আজ রাজরাণীর মত দেখাচ্ছে। তোকে ছোটবেলায় বলেছিলামনা রাজরাণীর মত করে বিয়ে দিব। আমি আমার কথা রেখেছি।
ত্বোহা!
~ জ্বী বাবা।
~ আমাকে কখনো ভুলে যাবিনা তো মা?
~ বাবাকে কেউ ভুলতে পারে বলো! কখনোই ভুলবনা তোমায়।
~ আমি মরে গেলে?

আমি টলমল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
~ আমার থেকে আর কত লুকাবি বলো? আমি যে দুনিয়ায় কয়েকদিনের অতিথি এটা আমার অজানা নয়।
আমি শক্ত করে বাবাকে জাপটে ধরলাম,
~ এসব কথা বলতে বারণ করেছিনা? কেন বলো এসব! আমার বাবাকে আমি কোথাও যেতে দিবনা।
~ পাগলি মেয়ে আমার। বলে আমার কপালে একটা চুমু খেল। আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে বলল,
~ আমার সমস্ত সম্পত্তি আমি তোর নামে দিয়ে গেলাম।

আমার আর কোনো দায় নেই, এবার নিশ্চিন্তে মরতে পারব।
আর ছেলেটা খুব ভাল বুঝলি। তোকে ভীষণ সুখে রাখবে।
বলে পাঞ্জাবির হাতায় ঝাপসা চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।
লামিয়া আমার মুখটা ছুয়ে বলল, কি হয়েছে তোর? মনমরা দেখাচ্ছে কেন? চলে যাবি বলে কষ্ট হচ্ছে!

আমি চুপ করে রইলাম। আমার মধ্যে কি চলছে সেটা কারো বোঝার সাধ্য নেই। চাচ্চু আর বাবা কাজী নিয়ে রুমে আসলেন। আমি এখনো অবধি সাদাফের জন্য অপেক্ষা করে আছি। শেষ আশা ও এক্ষুনি আসবে। এদিকে কাজী তাড়া দিচ্ছে কবুল বলার জন্য। আমি বাবার মুখের দিকে তাকালাম, মুখটা শুকনো হয়ে গেছে। বাবা বললেন,
~ মা তোর কি এই বিয়েতে মত নেই?
কি বলব আমি বুঝে উঠতে পারছিনা। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি সে তো নেই। আর বিয়ে ভেঙ্গে কি হবে! মানুষটাও কত আশা করে আমার বিয়ে দিচ্ছে, তাকে কষ্ট দিলে আল্লাহ ও যে আমাকে ক্ষমা করবেননা।

চাচ্চু বলল, ও হয়ত বলতে লজ্জা পাচ্ছে। মা তোর এই বিয়েতে সম্মতি আছে? হ্যা বললেই চলবে।
নিজের ভেতরটাকে শক্ত করে বলেই ফেললাম, হুম।
মোনাজাত শেষ করে সবাই বেরিয়ে গেল। জানালার কার্ণিশ ধরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চোখ দিয়ে এখন পানি পড়েনা, হয়ত সব অশ্রু শুকিয়ে গেছে। সাদাফ তার কথা রাখেনি, সেও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

আর কাউকে বিশ্বাস করবনা কখনো।
লামিয়া এসে বলল, তোর বরটাকে হেব্বি দেখতে। আমি তো ফিদা হয়ে গেলাম। আমি মুচকি হেসে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। সে যেমন ই হোক, আমার কোনো আর্কষণ নেই। দায় সারাতে বিয়েটা করেছি, তাকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো পুরুষকেই আমি আমার পাশে মানতে পারছিনা।

বিদায়বেলা বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। আমি এই অবস্থায় বাবাকে রেখে যেতে চাইলামনা। চাচ্চুকে মিনতি করলাম উনাদের যেন বুঝিয়ে বলে আজকের রাতটা আমি বাবার কাছে থাকতে চাই। বাবার পাশে বসে বসে ঢুলছি। অনেকটা সময় চেষ্টা করে বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে লামিয়া এসে একবার ডেকে বলল, আমি জেঠুর পাশ্র আছি, তুই দুলাভাইয়ের কাছে যা। এখনো অবধি কেউ কারো মুখটা দেখিসনি। আমি এক কথায় বলে দিয়েছি,
~ এখন বাবাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবনা। অনেক বুঝিয়ে যখন কাজ হলনা, লামিয়া চলে গেল।
ডেকে বললাম, উনাকে বলিস ঘুমিয়ে পড়তে। আমি আজ বাবার কাছে থাকব।

দুই-তিন দিন ঘুম হয়নি তার উপর সারাদিন বিয়ের এত ধকল চোখ ঘুমে ফেটে যাচ্ছে। বাবা জেগে উঠলে যদি কিছু লাগে এইজন্য ঘুমাচ্ছি ও না। বসে বসে চোখ বুজে ঢুলছি।
এমনসময় টের পেলাম ঘরে কেউ ঢুকল। ঘুমের জন্য চোখ মেলতে পারছিলামনা, আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, কে?

মিষ্টি পুরুষকন্ঠে কেউ আমাকে সালাম দিল। চোখ মেলে দেখতে চাইলাম সে কে! কিন্তু মেলে রাখতে পারছিনা।
~ আপনার তো অনেক ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ুন।
বাবার কাছে আমি থাকি। কথা দিচ্ছি সর্বোচ্চ খেয়াল রাখব।
বুঝতে দেরী হলনা উনি আমার সদ্য বিয়ে করা স্বামী।
~ ধন্যবাদ, তার প্রয়োজন নেই।
আমি আছি এখানে। আপনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
আর যদি বসতে হয় বসুন।

~ আপনার অস্বস্তি হচ্ছে বুঝতে পারছি। আমি যাচ্ছি, বাবার দিকে খেয়াল রাখবেন। আর নিজের দিকেও।
মানুষটা কে এভাবে কতদিন এড়িয়ে যেতে পারব জানা নেই। কাল আমাকে এখানে রাখবেও না, আবার এক দমকা হাওয়ায় অন্য জায়গায় ছিটকে পড়ব।
সকালে উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম। বাবার শরীর একটু ভালো এখন। চাচ্চু তাড়া দিচ্ছে তৈরী হওয়ার জন্য, আমরা একটুবাদেই বের হব। ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। বাবার পা ছুয়ে সালাম করে জড়িয়ে ধরলাম,
~ নিজের খেয়াল রেখো। সময়ে সময়ে আমাকে আমাকে খবর জানিও। শরীর বেশি খারাপ লাগলে আমি চলে আসব।

~ পাগলি মেয়ে আমার।
এখন বাবাকে নিয়ে এত ভাবিসনা, নতুন একটা সংসারে যাচ্ছিস। সবাইকে ভালো রাখিস। বলে কপালে একটা চুমু একে দিলেন। উইলটা নিয়ে বাবার চোখ এড়িয়ে চাচ্চুর কাছে গেলাম। চাচীও ছিল সেখানে। চাচা-চাচীকে সালাম দিয়ে চাচ্চুর হাতে উইল টা দিয়ে বললাম,
~ এগুলো আমার লাগবেনা।

অধিকারের ভিত্তিতে এসব তোমার পাওনা। আমার বাবাটার খেয়াল রেখো শুধু। চাচ্চু আর চাচীমা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হয়ত ভাবেনি এমন কিছু আমি করতে পারি। সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়ীতে উঠে বসলাম।
বরপক্ষের লোকজন কম। শুধু বরের বোন এসেছে সাথে।
বোন পিছনে বসে আমাকে তার ভাইয়ের সাথে বসিয়ে দিল।
খুব অস্বস্তি লাগছিল আমার। জেদ করে তাকাচ্ছিও না উনার দিকে। কিন্তু বুঝতে পারছি উনি ঘন ঘন আমার দিকে তাকাচ্ছেন। রাগ করে বলে ফেললাম,
~ এতবার তাকানোর কি আছে?

ঠিকমত ড্রাইভিংটা করুন। দেখার জন্য অনেক সময় পড়ে আছে।
উনি বলে ফেললেন,
~ আগে জানতাম কাদলে মেয়েদেরকে শাকচুন্নির মত লাগে। আপনাকে কাদলে বেশ ভালোই লাগে, ইচ্ছে করে আরো কয়েকটা চিমটি দিয়ে কাদাই।
উনার কথা শুনে এত রাগের মধ্যে আরো কেরাসিন পড়ল। রাগীচোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, কাদলে বলেছি রাগলে সুন্দর লাগে বলিনি।
আমি চুপচাপ বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। লামিয়া একটুও মিথ্যে বলেনি আসলেই ছেলেটা সুদর্শন, লম্বা আর বাকপটু। একটা মেয়েকে আর্কষিত করার জন্য যা যা থাকা দরকার সব ই আছে। কিন্তু আমার মনটা সাদাফের কাছেই পড়ে আছে। ও আমাকে ঠকিয়েছে জেনেও ওর জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।

গাড়ি থামলে বরের বোন আমাকে সবিনয়ে গাড়ি থেকে নামায়। বাড়ীটার দিকে তাকালাম সত্যিই বাবা তার মেয়েকে রাজরাণী সাজিয়ে রাজপ্রাসাদেই পাঠিয়েছেন।
পিছন থেকে উনি ডাকলেন, এই যে আমার লাল টুকটুকে বউ এত বড় ব্যাগ নিয়ে এসেছেন, আমি তো এর লোড নিতে পারছিনা। আসুন হাতে হাত লাগান।
আমি ভেঙ্গচি কেটে বললাম, মাংসল শরীরটা কি শুধু মেয়ে পটানোর জন্য বানিয়েছেন? একটু কাজে লাগান এখন।

~ ও আমি তো ভুলেই গেছি এক আটার বস্তা আরেক আটার বস্তা কিভাবে নিবে! আচ্ছা সমস্যা নেই, আমি একাই পারব।
সাহারা তুই তোর ভাবীকে ভিতরে নিয়ে যা।
~ আমি আটার বস্তা? আমাকে কোন দিক দিয়ে আপনার আটার বস্তা মনে হয়? নিজে কি জানেন সেটা! লইট্টা শুটকি কোথাকার।
সাহারা হাসতে হাসতে বলে উঠল, ভাইয়া আসতে না আসতে ভাবীর পিছনে লাগা শুরু করলে? তুমি আর বড় হবানা।

সাহারা আমাকে নিয়ে বাড়ীর ভিতরে ঢুকল। বাড়ির পরিবেশটা কেমন থমথমে। বোঝা ই যাচ্ছে মানুষজন বেশী নেই। একটু পরে দুইজন মহিলা নেমে আসল। একজন আমার নানীশ্বাশুড়ী আর একজন আমার শ্বাশুড়ী। ভীষণ মিশুক তারা। নানীশ্বাশুড়ী আমাকে গলায় ছোট হার পড়িয়ে দিয়ে বললেন, বাহ, পরীর মত নাতবউ পেয়েছি আমি।
উনি পিছন থেকে টিপ্পনী কেটে বললেন,
~ দেখ আমার ক্রেডিট! তোমার নাতী জ্বীনের মত সুন্দর বলেই তার মত পরী হয়েছে। জ্বীন শব্দটা শুনে ভিতরটা কেমন ফুলে-ফেপে উঠল রাগে। এই শব্দটা কি হাসিঠাট্টার বিষয়! নিজেকে শান্ত রেখে উপরে চলে এলাম।

সাহারা একটা মনোরম সুন্দর রুমে ঢুকিয়ে বলল, এটা ভাইয়ার রুম। আজ থেকে এটা তোমাদের রুম। তুমি এখন শাড়ি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও। কিছু লাগলে ডেকো।
আমি মাথা নেড়ে দরজা ভেজিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। এতক্ষণের খারাপ লাগা টা ক্রমশ বাড়ছে। আমার স্বপ্নগুলো কেন সবসময় এভাবে ভেঙ্গে যায়! আল্লাহর কি ইচ্ছে সেটা আমি জানিনা, য়বে এই জীবনের সাথে আমাকে মানিয়ে চলতে হবে।

পর্ব ১৩

সে হাতে মাটির ভাড়ভর্তি চা ধরিয়ে দিলেন।
~ এখানকার বিখ্যাত চা। খেয়ে নিন।
~ এত সকালে চা পেলেন কোথায়?
~ মানিক কাকা খুব ভোরেই দোকান খুলে। জানে আমি চা খেতে আসব। আমার তো প্রায় প্রতিদিন ই এখানে চা খাওয়া পড়ে। চা খাওয়া শেষে রাস্তাঘাটে মানুষ বাড়ার আগেই আমরা ফিরে এলাম বাসায়। খুব ফুরফুরে লাগছে নিজেকে। অনেকদিন পর একটা অজানা শান্তিতে মনটা ভরে উঠেছে।
সবটা হয়ত উনার ই জন্য।

রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম চা-নাস্তা বানানো আছে। অবাক লাগল এত সকালে তো এখনো বাড়ির কেউ জাগেনি। তাহলে বানালো কে! উনি রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি বানিয়েছি। নতুন এসেছেন এই বাড়ীতে, সবকিছু বুঝে উঠতে একটু বুঝে নিতে সময় লাগবে। তাই এসব আমি বানিয়ে দিলাম।
~ ধন্যবাদ। যদিও আমি করতে পারতাম।

~ তাহলে তো ভাল। রোজ রোজ আমি কিন্তু এসব করতে পারবনা, আর একদিন করেছি বলে ভাববেন না প্রতিদিন করব। ঘরে বউ রেখে নিজে গাধার মত খাটার কোনো মানে আছে!
~ এত কথা শুনাচ্ছেন কেন? এসব আমি করতে পারি। আপনার সাহায্যের কোনো প্রয়োজন ছিলনা।
~ আটার বস্তা কাজকর্ম করতে পারে তাহলে! তা সেগুলো খাওয়া যাবে তো?
~ ভালো হচ্ছেনা কিন্তু।

উনি আমার এই কাদো কাদো মুখ দেখে হাসতে লাগলেন। রেগে গিয়ে বাটির সব মেয়োনিজ উনার মুখে ছুড়ে মারলাম। হাসতে হাসতে বললাম,
~ আমার ভুত দেখার শখ মিটে গেছে।
উনি ফুসতে ফুসতে বললেন, আমি ভুত হলে আপনি ভুতনী। সাহারাকে রান্নাঘরের দিকে আসতে দেখে উনি দৌড়ে পালালেন। মনে মনে স্বস্তি পেলাম উনাকে কথার জবাব দিতে পেরে।
গভীর রাতে খবর এলো, বাবা মারা গেছেন। সকাল হতেই পাগলের মত ছুটে যাই সে বাড়ীতে। শেষবারের মত বাবার মুখটা দেখে তাকে বিদায় জানালাম। সারাদিন কিছু মুখে তুলিনি, কাদতে কাদতে হেচকি তুলে ফেলেছি।

বাবাকে জানাযার জন্য নেওয়ার পর বাবার রুমে ঢুকলাম। সবকিছু একি রকম আছে, শুধু আমার বাবা ই নেই। এখন আর ডাক ভেসে আসেনা, ত্বোহামা, এদিকে আয় তোকে খাইয়ে দিই। বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আর মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিবেনা। মা মা বলে ডাকবেনা। লামিয়া এসে খাওয়ার জন্য ডাকল।
~ আমি খাবনা এখন। তুই যা।

চোখ মুছে নিয়ে বললাম,
আর শুন, বাবার একটা ছবি স্মৃতি হিসেবে আমার সাথে নিব। কোথায় আছে ছবির এ্যালবাম? লামিয়া অনেক খুজে ধুলোমাখা একটা ছবির এ্যালবাম বের করে দিয়ে বলল,
~ বর্তমানে জেঠু কোনো ছবি তুলেনি। আগের গুলো দেখতে পারিস। আমি যাচ্ছি।
ছবির এ্যালবাম ঘেটে দেখতে বাবা আর এক মহিলার ছবক পেলাম। তাদের সাথে একটা ফুটফুটে ছোট্ট বাচ্চা। অনুমান করে দেখলাম, এটাই ত্বোহা। মাঝের পৃষ্ঠা উল্টাতেই দেখলাম ত্বোহার ৩-৪ বছর বয়সের ছবি। যেটা দেখতে আমার ছোটবেলার ছবির মত। দাদীমার কাছে আমি আমার এমনই একটা ছবি দেখেছিলাম। লামিয়াকে ডাকলাম সাথে সাথে।
~ কিরে ডাকছিস কেন?
~ ত্বোহা কত বছর বয়সে হারিয়ে গিয়েছিল?
~ বাবা বলেছিল ৩-৪বছর বয়স হবে তখন ওর।

এটা তো ত্বোহার ই ছবি। জেঠু আমাকে দেখিয়েছিল। বাবা বলেছিল, যখন জেঠু পাগলামী শুরু করেছিল তখন নাকি আমাকে দেখিয়ে বলা হয়েছিল আমি তার মেয়ে ত্বোহা।
কিন্তু জেঠু বলেছে,
আমি তার মেয়ে নই। তার মেয়ের বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলে একটা তিল আছে। কনুইতে একটা কালো রঙ্গের গোলাকৃতির জন্মদাগ আছে। ওর কথা শুনে চমকে উঠলাম। সত্যিই আমারো এগুলো আছে। তার মানে উনিই আমার আসল বাবা ছিল। আমি উনি ঠিকই চিনতে পেরেছিল।
ভেবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কিন্তু কিছু প্রশ্ন মাথায় গেথে গিয়েছিল। আমি হারালাম কি করে? হারিয়ে যদি থাকি দাদীমা আমাকে কজ করে পেল? এত বছর ই বা কেন সত্যটা বললনা! কাকা-কাকীও কি জানতনা আমি যে তাদের কেউ নই?

যারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত তারা কেউই আজ বেচে নেই। সারাজীবন এই প্রশ্নগুলো প্রশ্ন ই থেকে যাবে।
উনি ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাতে গেলেন, আমি বারণ করে বললাম, আলো জ্বালাবেননা প্লীজ।
~ ত্বোহা এভাবে অন্ধকারে বসে থাকবেননা, সারাদিন কিছু খাননি। আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি, আসুন খেয়ে নিবেন।

~ আমি খাবনা। আমাকে একা থাকতে দিন।
~ আপনি এমন করলে বাবার রুহ তো কষ্ট পাবে। আর উনি আপনার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছেন, সেটা আমি কি করে অবহেলা করি বলুন।
নিজেকে শক্ত করুন, একদিন সবাইকেই এই দুনিয়া ছেড়ে যেতে হবে। এখন এভাবে কান্নাকাটি না করে বাবার আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করুন। বলে আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমি হাত ছুড়ে সরিয়ে দিলাম,
~ স্বামীত্ব ফলাতে এসেছেন তাইনা?

আমি কতবার বলছি আমাকে একা থাকতে দিন। আপনার সহমর্মিতার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি কাগজে-কলমে আমার স্বামী আছেন, থাকুন। এর বাহিরে বেশী কিছু করতে আসবেনা। এখন এই রুম থেকে বেরিয়ে যান প্লীজ।
উনি কিছু বলতে চাইলেন। আমি বলার সুযোগ না দিয়ে উনাকে ঘর থেকে বের করে দিলাম। ভালোলাগছেনা কিছু, সবকিছু অসহ্য লাগছে।

পর্ব ১৪

দরজা লক করে এসে শুয়ে রইলাম। অনেকগুলো প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে এতকিছুর মধ্যে আল্লাহর অসীম কুদরতে নিজের বাবাকে ফিরে পেয়েছি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। অতীত জেনে আর কি হবে! আপন বাবার স্নেহ-ভালোবাসা সব পেয়েছি, নতুন একটা জীবন পেয়েছি আর ভীষণ ভালো স্বামী।

প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পরও উনি সামান্যতম খারাপ ব্যবহার কিংবা যত্নের ত্রুটি করেননি। আর আমি সাদাফের জন্য তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। তার সাথেই অকারণে খারাপ ব্যবহার করেছি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল। সাদাফ যা করেছে, তার জন্য নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে দায় থাকবে। কিন্তু আমি জেনেবুঝে যা করছি, তার জন্য আমার ও কম দায় থাকবেনা। একজন নির্দোষ মানুষকে অকারণেই কষ্ট দিচ্ছি।
নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সাদাফকে ভুলে এখন উনার সাথে আমার নতুন জীবন শুরু করা উচিত। নিজেকে আর বিবেকের কাছে ছোট করতে চাইনা।

দরজা খুলে বের হয়ে আসলাম। পুরো বাড়ী তন্নতন্ন করে উনাকে খুজলাম। কিন্তু কোথাও পেলামনা। উনি কি তাহলে আমার উপর রাগ করে চলে গেছেন? হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। লামিয়া আমাকে এমন অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ নাকি?
~ উহু, তোর দুলাভাই কি চলে গেছে?

~ নাহ তো। উনাকে তো একটু আগে ছাদের দিকে যেতে দেখলাম। এত করে বললাম সারাদিন কিছু খাননি, কিছু একটা খেয়ে নিন। কিছুতেই খেতে রাজী হলনা। একটা কথা তুইও সারাদিন কিছু না খেয়ে আছিস। স্বামী হয়ে তোকে ফেলে কি করে খাবেন উনি!
আমি আর কিছু বলতে পারলামনা। যা তুই উনাকে ডেকে নিয়ে আয়। দুজন একসাথে খাবি। তুই সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী। ভাগ্য করে এমন স্বামী পেয়েছিস।

আমি দুহাত দিয়ে চোখ মুছে ছাদের দিকে ছুটে গেলাম। আজ আকাশটা চাদের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় ভরে আছে। অনেক সুন্দর বাতাস বয়ছে, ছাদবাগানে বোধহয় বেলীফুল ফুটেছে। চারিদিক বেলী ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে। ছাদের ঝাড়বাতিগুলো আজ জ্বালানো হয়নি, তাই আবছা অন্ধকার। ছাদে উঠে উনাকে খুজতে লাগলাম এদিক সেদিক। হঠাৎ চোখ পড়ল রেলিং ঘেষে দাঁড়ানো প্রতিবিম্বটা। ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~ আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন আর আমি আপনাকে সারাবাড়ী খুজে বেড়াচ্ছি। আসলে আমি ভীষণ দুঃখিত। বুঝতেই পারছেন, বাবার মৃত্যু যেকোনো মেয়ের কাছেই ভয়ংকর শোকাবহ। এভাবে বাবা হারিয়ে মানসিকভাবে একটু ভেঙ্গে পড়েছিলাম, তাই নিজের অজান্তেই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি।
এতকথা বলে একটু চুপ রইলাম। উনি ফিরেও তাকাচ্ছেননা, কিছু বলছেন না।
~ আপনি কি বেশী রাগ করেছেন?

~ ত্বোহা! কন্ঠটা শুনে গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। উনার কন্ঠটা অন্যরকম লাগছে কেন? আর উনি তো আমাকে কখনো নাম ধরে ডাকেননা। তবে এটা কি উনি নয়?
~ কে?
~ চিনতে পারছোনা? আমি সাদাফ। বিস্মিত হলাম কিন্তু বুঝতে না দিয়ে বললাম,
~ ওহ! কি মনে করে এখানে এসেছেন? দেখতে আমার বিয়ে হয়েছে কিনা? নাকি আমি আপনাকে না পাওয়ার শোকে মরেছি কিনা?

~ ত্বোহা, সবসময় কেন মন দিয়ে চিন্তা করো?
~ এখন মন দিয়ে কিছুই চিন্তা করিনা, সব বিবেক দিয়ে চিন্তা করি। আর আপনি এসবের কি বুঝবেন? বিশ্বাসঘাতকতা করে কোন মুখে আবার আমার সামনে এসে দাড়িয়েছেন বলুন তো! দেখতে চান, কতটা ভালো আছি?

আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। আপনার মতো বেঈমানের থেকে অনেকগুণ ভালো জীবনসঙ্গী পেয়েছি। আল্লাহ ঠিকসময় আমাকে সবার আসল রুপটা দেখিয়ে দিয়েছে।
~ তাহলে আমাকে আর চাওনা?
~ চাওয়ার সময় যখন পাইনি, এখন আর চাইনা। চলে যেতে পারেন এখান থেকে। আপনাকে আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি, আর কখনো সামনে না আসলে খুশি হব।
~ কিন্তু আমাকে তো তোমার সামনে বার বার আসতে হবে।
~ মানে!

হঠাৎ করে ছাদের সব ঝাড়বাতিগুলো জ্বলে উঠলে। সাদাফ আমার দিকে ফিরে জ্যাকেটের হুড সরিয়ে ফেলল। অবাক হয়ে আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছেনা। তাও আমতা আমতা করে বললাম,
~ আপনি!
~ হুম, তোমার বিয়ে করা স্বামী।
~ এসবের মানে কি!

~ মানে খুজছো বোকা মেয়ে। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম বিয়ে করব। আর আমি তোমাকে বিয়ে করে নিয়েছি সে যেভাবেই হোক।
কাদতে কাদতে সাদাফের গায়ে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল, আপনি আসলেই একটা খারাপ লোক। এতগুলো দিন আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। একটাবার বললে কি হত যে আপনি সাদাফ!
~ তাহলে তো জানতে পারতামনা ত্বোহা আমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে।
অভিমানের স্বরে বললাম, উহু ভালোবাসিনা। এমন মানুষগুলো ভালোবাসা যায়না।
~ ভেবে বলছো তো?

~ নাহ।
~ লাল টুকটুকে বউ আমার। বলে বুকের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে। নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। আমার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, আমি আমার জ্বীনবর পেয়ে গেছি। সাদাফ নিজের হাতে আমাকে খাইতে দিল। তারপর আমার কোলে তার মাথাটা এলিয়ে দিল, আমি তার চোখে-মুখে-চুলে হাত বুলাতে বুলাতে সারারাত গল্প করলাম। রাতটা স্বপ্নের মত কেটে গেল।

আল্লাহ এতদিনে আমার ডাক শুনেছেন, সব কষ্ট-দুঃখ দূর করে দিয়ে সুন্দর একটা জীবন দিয়েছেন।
বাড়ি ফিরে সাদাফ আমাদের ব্যাগ গোছাতে লাগল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কিগো, ব্যাগ গোছাচ্ছো যে? আমরা কোথায় যাব?
~ আমার লাল টুকটুকে বউটার আরেকটা শ্বশুড়বাড়ি আছে। সেখানে যাব, মাকে দেখাবনা তার ছেলের বউ দেখতে কেমন হয়েছে!
~ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
~ যেতে যেতে সব বলব। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও তো। ভেবে নিলাম, ও যেহেতু জ্বীন। ওর নিজস্ব কোনো পরিবার আছে। আর সে পরিবারের কাছেই আমাকে নিচ্ছে।
কিন্তু কথা হল, তাহলে এরা কে?

আস্তে আস্তে সব জিজ্ঞেস করে নিব ভেবে রেডি হয়ে গেলাম। মা, নানুমণি আর সাহারা থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। অবাক ব্যাপার, কেউ একবারো জিজ্ঞেস করলনা আমরা কোথায় যাচ্ছি! তাহলে তারাও কি জানে সাদাফ জ্বীন। গাড়িতে উঠে সাদাফের দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ আমাকে ব্যাপারটা খুলে বলো তো।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
~ রিলেক্স। সব বলব।

আসলে ওরা আমার রক্তের কেউ ই নয়। আমার পালিত মা বলতে পারো, আমার মা যখন ছোটবেলায় জ্বীনরাজ্যের কাজে ব্যস্ত ছিল তখন মায়ের বিশ্বস্ত মানুষ্য বোন ই আমাকে লালনপালন করেছেন। তবে উনি ছাড়া আর কেউ ই জানেনা আমি জ্বীন।
~ তাহলে তুমি তোমার আসল মায়ের কাছে কেন থাকোনা?
~ মা তো জ্বীনরাজ্যের কাজেই ব্যস্ত থাকেন প্রায়সময়। আর আমার উপর আদেশ আছে আমাকে জ্বীনরাজ্য পরিচালনা করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। তাই মায়ের আদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়।

এসব তুমি বুঝবেনা। তুমি এখন জ্বীন পরিবারের একজন সদস্য। পরিবারটাকে নিজের ভেবে আগলে রেখো, এইটুকুই তোমার কাছে চাওয়া।
আর মাকে কখনো কষ্ট দিওনা। মা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, দেখবে তোমাকেও অনেক ভালোবাসবে।

ভাবনায় পড়ে গেলাম। সাদাফের মা কি সত্যি আমাকে মেনে নিবে তার ছেলের বউ হিসাবে? মানুষ বলস অবজ্ঞা করবে না তো।
গাড়ি এসে বাড়ীর সামনে থামল। গাড়ী থেকে নেমে চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল এই বাড়ীতে আমি আগেও এসেছি। আবছা আবছা ভাবে মনে পড়ছে। সাদাফ আমাকে ডেকে বলল, কি দেখছো? এটাই আমার আসল বাড়ী।

চলো ভেতরে চল। সবার সাথে দেখা করবে।
চুপচাপ ওকে অনুসরণ করে বাড়ীতে ঢুকলাম। ঢুকেই সাদাফ তার মাকে জড়িয়ে ধরল। শ্বাশুড়িমাকে দেখে আমার চক্ষুচড়ক। কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
~ উনি তোমার মা?
~ হ্যা, সালাম করো। মা, এই হচ্ছে তোমার বউমা। না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। জানি তুমি রাগ করবেনা।

উনি আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম, তাসবীনের মা কি করে সাদাফের মা হয়? তবে কি ওরা ভাবতে ভাবতে তাসবীন চলে এল। আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
পরে আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সাদাফের সাথে কোলাকুলি করল।
সাদাফ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এ হচ্ছে আহনাফ তাসবীন। আমার বড় ভাই। আমার পুরো নাম সাদাফ তাশবীহ। নামের মত সব কিছুই মিল আমাদের।
আমি তো ভাইয়ার কলিজা টুকরা।

খালামণি আর মিষ্টি দুটো বোন ও আছে আমার। সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, এদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে এরা আমাকে চিনেই না। আজ ই প্রথম দেখছে।
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সব কেমন জানি গুলিয়ে যাচ্ছে। সাদাফ যদি তাসবীনের ভাই হয় তবে কি সাদাফ ও একজন শয়তান? তাসবীন শয়তান হলে ও জ্বীন পরিবারের সদস্য হয় কি করে! আর আমাকে মারতে চাওয়ার পিছনে ওর উদ্দেশ্য ই বা কি থাকতে পারে।
সবটা কেমন জানি এলোমেলো লাগছে। সব সূত্র মিলাতে হবে আমাকে।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে এলাম। সাদাফ মা-ভাইদের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

পর্ব ১৫

উপরে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি ঠিক জানিনা সাদাফের রুম কোনটা! এখন সাদাফের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি করার আছে? এর মধ্যে সানজানা আমার কাছে আসল। আমার ব্যাগটা নিয়ে বলল, এসো৷ ভাবী তোমাকে রুমে নিয়ে যাই।
আমি কিছু না বলে চুপচাপ সানজানাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। ও একটা রুমে ঢুকে ব্যাগটা রেখে বলল, এটা তোমাদের রুম। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, এটা তো তাসবীনের রুম। যেখানে আমি আগে এসেছিলাম।

~ সানজানা এটা তো তোমার তাসবীন ভাইয়ার রুম। এখানে কেন আমরা থাকব?
~ খালামণি এই রুমে তোমাদেরকে থাকতে বলেছে।
~ সানজানা, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছোনা?
~ পারবনা কেন! তুমি তো এর আগে তাসবীন ভাইয়ার সাথে এই বাড়ীতে এসেছিলে।
~ তাহলে কথা বললেনা কেন? ওমন না চেনার ভান করেছিলে যে?

~ সবাই একটু রাগ করেছিল তোমার উপর। তুমি একা একটা মেয়ে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে, তাসবীন ভাইয়া তোমাকে পাগলের মত খুজেছে জানো। এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরে নিয়েছিলাম, তুমি ইচ্ছে করেই পালিয়ে গিয়েছো। সেই থেকেই সবার রাগ তোমার উপর।
এইজন্য ই আমি সবার সামনে চুপ ছিলাম। খালামণির সামনে কিছু বললে রাগ করত হয়ত।
~ তাসবীন আমাকে খুজেছে?

~ হ্যা, অনেক খুজেছে। তোমাদের এত ভাল বন্ডিং দেখে তো আমরা মনে করেছিলাম তাসবীন ভাইয়া ই হয়ত তোমাকে বিয়ে করবে। তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো।
কিন্তু তুমি তাশবীহ ভাইয়াকে কোথায় পেলে?
এতদিন কোথায় ই বা ছিলে?

~ সময় করে সব বলব। তোমার থেকে আমার অনেককিছু জানার আছে। তুমি সময় করে আমার কাছে এসো।
আর এসব ব্যাপারে তোমার তাশবীহ ভাইয়া কিংবা কাউকে কিছু বলোনা। এমনসময় দেখি সাদাফ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পেয়ে গেলাম, ও কিছু শুনতে পায় নি তো। এগিয়ে এসে বলল, ত্বোহা।
~ হ্যা বলো।
~ ভাবী আর ননদের দেখি খুব ভাব হয়ে গেছে। একা একাই গল্প করলে, আমাকে একবারো ডাকলেনা।

আমি যেন হাফ ছেড়ে বাচলাম। সাদাফকে এই মূহুর্তে সবকিছু খুলে বলা উচিত হবেনা। ও ওর পরিবারকে খুব ভালোবাসে। অনেক কথা ই সে বিশ্বাস করবেনা, উলটো আমাকে ভুল বুঝবেনা।
~ ও কিছুনা। তুমি ফ্রেশ হবেনা?
~ হ্যা, ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। মা আজ আমার পছন্দের খাবার রান্না করছে। আমার তো তর সয়ছেনা। তুমি মায়ের কাছে যাও, টুকটাক সাহায্য করো। দেখবে মা খুব খুশি হবে।
আমি সাদাফের চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, কত সরল ছেলেটা। তার ভাই কি করে শয়তান হয় সেটাই ভাবার বিষয়।

~ আচ্ছা সাদাফ, তোমার পরিবারের সবাই ই কি জ্বীন?
~ হ্যা, তাসবীন আর মা জ্বীন। বাবা ও ছিলেন, কিন্তু তিনি তো অনেক আগেই মারা গেছেন।
তুমি তো জানো, জ্বীনদেরকে মানুষের সাথে মানুষরুপেই বাস করতে হয়। আমরাও সেরকম ই। খালামণিরা আমাদের কেউ হয়না, ওরা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। সানজানার বাবা আমার বাবার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। উনি মারা যাওয়ার পর মা ওদেরকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু উনারা জানেনা আমরা জ্বীনবংশ।

অবাক হয়ে চিন্তা করলাম, এত প্যাচ এখানে। এই বাড়ীর লোকগুলোর শিরায় শিরায় রহস্য। কিন্তু তাসবীনের মা আমাকে বলেছিলেন, তাদের বাবা ব্যবসায়ের কাজে বাহিরে আছেন। আমাকে মিথ্যে কেন বলেছিলেন? এর পিছনে কি কারণ থাকতে পারে!
~ আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।
আমি নিচে যাচ্ছি।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখি শ্বাশুড়িমা রান্না করছেন। আমি গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম, মা, আমি আপনার সাথে হাত লাগাই?

~ তুমি এসেছো? তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
ছেলেটা এতদিন পর বাসায় ফিরল তো, তাই ওর পছন্দের রান্না করছিলাম। এর মধ্যে সুযোগ ও পাইনি তোমার সাথে দেখা করে আসব।
~ মা, আপনারা সবাই কি সত্যিই জ্বীন?
উনি বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যা মা। আমি জ্বীনবংশের সর্দারনী ছিলাম। এক গন্ডগোলের জন্য জ্বীনরাজ্য ছাড়া হলাম। দুই ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে মানুষের দুনিয়ায় আশ্রয় নিলাম।
এখন এই দুই ছেলে ই আমার শেষ সম্বল। আমরা এখানেই ভালো আছি।
~ আগেরবার এসেছিলাম তখন আপনি কিংবা তাসবীন কেউ ই বলেননি আপনার আরেক ছেলে আছে।

~ বলার সুযোগ পাইনি বোধহয়। আমার এই ছেলেটা অনেক ভ্রমণপ্রিয়। বেশিরভাগ সময় ওর ভালো মার কাছেই থাকে। ওকে নিয়ে ওর বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। ওকে জ্বীনরাজ্যের সর্দার বানাবে। তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন খারাপ জ্বীনদের সাথে ওর লড়াই করতে হয়, বিভিন্ন ভালো জ্বীনের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। এইজন্য বেশিরভাগ সময় ও বাহিরে বাহিরে থাকে। তাসবীন ই আমার কাছে থাকে ওর অবর্তমানে। যখন ও ও কাজে থাকে, তখন আমার ভীষণ খারাপ লাগে একা একা।
~ ওহ আচ্ছা।

~ তোমাকে আমার ভীষণ ভালোলেগেছিল। ভেবে রেখেছিলাম আমার তাসবীনের বউ করব তোমায়। কিন্তু তুমি যে কোথায় চলে গিয়েছিলে! তাসবীন তোমাকে পাগলের মত খুজেছিল।
একপর্যায়ে ভেবেই নিয়েছিলাম, তুমি হয়ত জেনে গিয়েছো আমরা জ্বীন। তাই পালিয়ে গিয়েছো। একটা আফসোস রয়ে গিয়েছিল যে, হয়ত জ্বীনের সাথে মানুষের কখনোই মিল সম্ভব নয়।
কিন্তু আল্লাহ আমার মনের খায়েশ ঠিকি পূরণ করেছে। আমার আদরের তাশবীহর বউ করে আমার ঘরে পাঠিয়েছে। আল্লাহর কি অসীম কুদরত বলো! পারবে তো মা আমাদের পরিবারটাকে নিজের পরিবার মনে করে আগলে রাখতে? জ্বীন বলে মনে মনে দূরে সরিয়ে রাখবে না তো!
~ এসব কি বলছেন মা? আমি সব জেনেশুনেই আপনার ছোটছেলেকে গ্রহণ করেছি। ইনশা আল্লাহ এই পরিবারকে আমার সবটুকু দিয়ে আগলে রাখব।
~ আল্লাহ তোমার ভালো করুক মা।

আমার মনের দ্বিধা এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। তাসবীন যদি শয়তানের উপাসনা করে থাকে, তবে মা আর সাদাফ কেন টের পাচ্ছেনা? আর আমাকে মারতে গিয়ে মারলনা, তারপর আবার পাগলের মত খুজল। আসল রহস্যটা কি এখানে!
মাথা হ্যাং হয়ে গেছে এসব ভেবে। মাথা ঠান্ডা করার জন্য গোসল করে নিলাম। চুল মুছতে মুছতে ব্যালকুনিতে পায়চারী করছিলাম। এমনসময় কারো গলা ঝাড়ার আওয়াজ পেয়ে পিছু ফিরে তাকালাম। তাসবীন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভিতরে আসতে পারি?
আমি মাথায় ঘোমটা টেনে বললাম, আপনি এখানে?
~ আপনার সাথে কথা বলতে এলাম।

~ কিন্তু আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। পরে কথা বলি ভাইয়া?
~ হঠাৎ মাথা ধরল কেন? আমি কি মাথায় হাত বুলিয়ে দিব? মূহুর্তে বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি আমার ভাসুর। আপনাকে আমি আর আমার স্বামী বড় ভাই হিসেবেই সম্মান করি। অতএব, এমন কিছু বলবেন না কিংবা করবেননা যাতে আমাদের চোখে আপনি ছোট হয়ে যান।

তাসবীনের চোখ কেমন ছলছল করছিল। আমার কথায় হয়ত বড় আঘাত পেয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
~ দুঃখিত, অযাচিত কথা বলে ফেললাম।
আসলে আগে করেছিলাম তো। তাই আর কি
আর এক মূহুর্ত ও উনি দাড়ালনা। দ্রুত বেরিয়ে গেল। মনে হল উনি নিজের চোখের পানি আড়াল করতে চাইল।

সবকিছু কেমন জানি অদ্ভুত লাগছে। সেই আগের মত মোলায়েম স্বাভাবিক আচরণ যা দেখে তার প্রতি আম মুগ্ধ হয়েছিলাম, এখন নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই তাসবীন ই সেরাতে আমাকে মারতে এসেছিল!
রাতে শ্বাশুড়িমা আমার ঘরে এলেন। দরজায় কড়া নেড়ে বললেন, বউমা, আসব?
আমি চোখ বুজে শুয়ে ছিলাম। তাড়াতাড়ি উঠে মাথায় কাপড় টেনে বললাম, আসুন মা। অনুমতি নেওয়ার কি প্রয়োজন ছিল!
~ তোমারো তো সুবিধা-অসুবিধা থাকতে পারে তাইনা। যাই হোক, তোমার জন্য কিছু শাড়ি আর গয়না এনেছিলাম। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা!

~ আপনি ভালোবেসে দিয়েছেন, অপছন্দ হতে পারে! মায়ের সব ই পছন্দের হয়।
~ লক্ষী বউমা আমার।
তাশবীহ এখনো ফিরেনি?
~ বলল তো তাসবীন ভাইয়ার সাথে বের হচ্ছে। কিছু কেনাকাটা করবে নিজের জন্য।
~ তাহলে নিশ্চিন্ত থাকো। তাসবীন ওকে নিজের চেয়েও বেশী ভালোবাসে। দুইভাই যখন একসাথে থাকে, আমি খুব নিশ্চিন্ত থাকি। কারণ জানি তাসবীন নিজের সবটুকু দিয়ে হলেও ভাইকে আগলে রাখবে।
মনে মনে ভাবলাম, তাসবীন কি সত্যিই এমন নাকি এসব তার মুখোশ মাত্র!
~ বউমা।
~ হ্যা মা, বলুন।

~ তোমার কাছে একটা অনুরোধ ছিল।
~ কি অনুরোধ মা?
~ যতটা বুঝেছি তোমাদের মধ্যে এখনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেদের মত সময় কাটানোর সুযোগ পাওনি তুমি।
~ হুম।
~ অনুরোধ হল এটাই, তাশবীহ জ্বীনরাজ্যের সর্দার না হওয়া অব্ধি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক করোনা।
~ কেন মা?

~ তাহলে এতদিন ধরে ওর অর্জিত সমস্ত শক্তি সব বিনষ্ট হয়ে যাবে। ওর বাবার স্বপ্ন আর পুরণ হবেনা। আমি এত তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে দিতে চাইনি, কিন্তু আল্লাহর হুকুমে হয়ে গেছে। যখন তুমি বাড়ীতে এলে, ভাবলাম হয়ত আমাদের আশা-ভরসা সব শেষ। পরে তাশবীহ থেকে জানলাম তোমাদের সম্পর্কটা এতদিন স্বাভাবিক ছিলনা।
এখন তুমি আমার অনুরোধ টা রাখো।
একটু ভেবে নিয়ে বললাম, আচ্ছা মা। আপনি যা চান তা হবে।

পর্ব ১৬

গভীর রাত আমি একা রুমে শুয়ে আছি। ভীষণ অস্থির লাগছে, কিছুতেই ঘুম আসছেনা। সাদাফ মনে হয় তাসবীনের কাছে ঘুমিয়েছে। তাসবীন কান্নামাখা চেহারাটা বার বার চোখের সামনে ভাসছে। খুব মায়া লাগছে ওর জন্য। ও আমাকে কি বলতে এসেছিল? আমার কি ওর কথা শোনা উচিত? যে আমাকে মারতে চেয়েছিল, যে শয়তানের পূজারী তার সাথে আমার কিসের কথা থাকতে পারে?
ওর সাথে আমার কোনো কথা নেই। হ্যা, একসময় ওকে ভালোবাসতাম ঠিকিই কিন্তু এখন তো আমি বিবাহিত। ওর ছোট ভাইয়ের বউ তারপরো কেন আমার ওর জন্য গভীর একটা টান অনুভব হচ্ছে?
না এসব আর ভেবে কাজ নেই। আমি এখন সাদাফের স্ত্রী। আর ও এসব জানলে কষ্ট পাবে, আমি ওকে কোনোভাবেই কষ্ট দিতে চাইনা।

এপাশ ওপাশ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। চোখ বন্ধ করলেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে। আমার জ্বরের সময় ওর কান্না, আবদার মেটানো, বিপদের সময় আমাকে সাপোর্ট দেয়া। সব যেন একে একে চোখের সামনে ভাসছে। না আমার ঘুম হবেনা। শোয়া থেকে উঠে বসলাম। গলাটা শুকিয়ে আছে, একটু পানি খাওয়া দরকার। বেডটেবিলের গ্লাসে পানি নেই। এখন নিচে ফ্রিজ থেকে পানি আনতে হবে।
আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বাহিরে এলাম। পুরো বাড়ী নিস্তব্ধ, অল্প আলোর ঝাড়বাতিগুলো জ্বলছে। ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে পানি খেলাম। হঠাৎ ক্ষীণ আওয়াজে কারো কান্নার স্বর শুনতে পেলাম।
এতরাতে কে কাদছে? বাড়ীতে বিড়ালের বাচ্চা ঢুকল না তো! কিচেন থেকে বেরিয়ে চাপা কান্নার শব্দ অনুসরণ করে নিচের রুমে গেলাম। এই রুমগুলোর একটাতে আমি থেকে ছিলাম। কিন্তু এখন সেখানে কে আছে!

সাবধানে পা ফেলে রুমটার সামনে এলাম। দরজাটা ভিতর থেকে ভেজানো। দরজা খুলব কি খুলব না ভাবছিলাম। নিজের ভিতরে একটা আতঙ্ক জেগে উঠেছে। এই বাড়ী আর পরিবারটা আমার কাছে রহস্য। কখন কোন রহস্য আমাকে ঘিরে ধরবে কে জানে। না দেখে চলে যেতে উদ্ধত হলাম, কিন্তু কান্নাটার প্রতি কি একটা আর্কষণ আমাকে যেতে দিচ্ছেনা। বারবার মনে হচ্ছে খুলে দেখি ভিতরে কে আছে?
সাহস নিয়ে কাপা কাপা হাতে দরজাটা হালকা খুললাম। উকি দিয়ে দেখি মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে তাসবীন বসে আছে। সরে গিয়ে চিন্তা করলাম এত রাতে তাসবীন একা মোম জ্বালিয়ে কি করছে? এটা কি তার শয়তানের উপাসনার অংশবিশেষ? আজ ওকে হাতেনাতে ধরব, ওর ভালোমানুষির মুখোশ আজ সবার সামনে টেনে ছিড়ে ফেলব। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ও কি ভুল করেছে সেটা আজ ও বুঝবে।

এই ভেবে দরজাটা পুরো খুলে ফেললাম। অবাক হয়ে দেখি ও জায়নামাযের উপর বসে আছে, সামনে কুরআন শরীফ খোলা, আর মোনাজাত ধরে চাপাস্বরে কাদছে।
বিড়বিড় করে কি জানি বলছে, যা স্পষ্ট শুনতে পেলামনা। তবে এটুকু শুনলাম, আল্লাহ আপনি ওকে সুখে রাখুন।
আমি যে রুমে ঢুকলাম সেদিকে ওর বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।
আমি আর দাড়ালামনা, দৌড়ে রুমে ফিরে পেলাম।
আমার সাথে এসব কি হচ্ছে, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। সবকিছু মরিচীকা মনে হচ্ছে। বিছানায় বসে হাপাতে লাগলাম। একজন শয়তান উপাসক কি করে কুরআন পড়তে পারে? আর মোনাজাতে কাদতেও পারে?
সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম একটা ছায়া আস্তে করে সরে যাচ্ছে। ক্ষীণ কন্ঠে বললাম, কে ওখানে?
তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে এদিক সেদিক তাকালাম। স্পষ্ট দেখলাম কেউ ছিল এখানে, সে হয়ত আমাকে অনুসরণ করছে।
টের পেয়ে সরে গেছে। কিন্তু কে ছিল?
সকালে উঠে নামায পড়ে কিচেনে সবার জন্য চা বানাতে গেলাম। গিয়ে দেখি তাসবীন কিচেনে দাঁড়িয়ে কি জানি করছে? আমি সেটার দেখার জন্য ওর কাছে যেতেই ও মিষ্টিস্বরে আমাকে সালাম দিল এবং বলল, শুভ সকাল।

~ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আপনি এখন এখানে?
~ চা আর নাস্তা বানাচ্ছিলাম।
~ আমি থাকতে আপনি কেন বানাবেন?
~ হঠাৎ ইচ্ছে হল ছোট ভাইয়ের বউকে চা-নাস্তা বানিয়ে খাই। এই বাড়ীতে বউ হয়ে এসেছো, ভাসুর হিসেবে আমারো তো একটা দায়িত্ব আছে।
কথাগুলো বলার সময় তাসবীন কেমন জানি মন মরা হয়ে গেছে। চোখ দুটো থেকে যেন এক্ষুনি পানি নামবে।

আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। বললাম, আমাকে দিন। আমি করে নিচ্ছি। ওর হাত থেকে ছুরি আর আপেল নিতে গেলাম, ও দিতে চাচ্ছিলনা। জোরাজুরি করতে গিয়ে আমার আঙ্গুলে ছুরির খোচা লেগে গেল৷, সেখান থেকে রক্ত ঝড়তে শুরু করল। তাসবীন সেটা দেখে পাগলের মত করতে লাগল। অস্থির হয়ে যাচ্ছিল সে, ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে ক্ষতস্থান চেপে ধরল। তারপর নিজের রুম থেকে ব্যান্ডেজ নিয়ে আসল। ব্যান্ডেজ করার সময় আমি একটু ব্যথা পাচ্ছিলাম দেখে বলল, এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে। একটু ধের্য্য ধরো।
খুব বেশী ব্যথা করছে?

আমি অবাক হয়ে ওর অস্থিরতা দেখি। এই তাসবীন আমাকে আঘাত করতে পারে এটা আমার কল্পনার বাহিরে। এমনসময় সাদাফ এসে আমাদের সামনে দাড়াল। গম্ভীরকন্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে তোমার?
~ ছুরির সাথে একটু খোচা লেগেছে।
সাদাফ এক ধাক্কায় তাসবীনকে সরিয়ে দিল। ধাক্কা খেয়ে তাসবীন অবাকচোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে রইল। সাদাফ একনজর আমার হাতটা দেখে তাসবীনের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ ত্বোহাকে কেন আঘাত করলি তুই?

~ তাশবীহ আমি ইচ্ছে করে করিনি। অসাবধানতায় লেগে গেছে।
~ ভাইয়ের বউয়ের সাথে তোর এত ঘেষাঘেষি কিসের? কতটা কেটে গেছে দেখেছিস! আমার এখন কতটা কষ্ট হচ্ছে জানিস? তুই কিভাবে জানবি! ও তো তোর কেউ না যে, ওর আঘাতে তোর কষ্ট হবে। ও আমার বউ তাই ওর আঘাতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
তাসবীন আর কিছু বললনা। শার্টের হাতায় চোখ মুছে ফাস্ট এইড বক্সটা নিয়ে চলে গেল। আমি রাগ দেখিয়ে বললাম
~ তুমি ভাইয়ার সাথে এভাবে কথা বললে কেন?
এখানে উনার কি দোষ!

~ তুমি চুপ থাকো। এত সকালে দুজন একা একা এখানে কি করছো! লজ্জা করেনা তোমার?
~ সাদাফ! ওর হাত ধরতে গেলে ও আমার হাত ছুড়ে দেয়। আঘাত লেগে মূহুর্তে আমার সাদা ব্যান্ডেজ আবার লাল হয়ে যায়। সাদাফের এমন রুপ আমাকে বিস্মিত করছে।
এমন পাগলামী ও কেন করছে?
ও কি তাহলে আমার আর তাসবীনের ব্যাপারে কিছু জেনে গেছে? বুঝে গেছে তাসবীন আমাকে ভালোবাসে?

সারাদিন আর তাসবীন রুম থেকে বের হয়নি। খাবার সময় ডেকেছিলাম, কোনো সাড়া পাইনি। অকারণে আজ সাদাফ ওর সাথে বাজে ব্যবহার করেছে। মাকেও এ নিয়ে কিছু বলার সাহস পাইনি। এখন হয়ত আমার দিকে আঙ্গুল উঠবে আমি দুইভাইয়ের সম্পর্ক নষ্ট করেছি।
আমিও সাদাফকে রীতিমত এড়িয়ে গেছি। কথা বলিনি সারাদিন, আজ ওর কথাগুলো আমাকে যথেষ্ট আঘাত করেছে। শেষমেষ কিনা ও আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এমন একটা মানুষকে আমি বিয়ে করেছি!

রাতে সাদাফ আমার রুমে আসে। আমি দেখেও না দেখার ভান করে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম। ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, রাগ করেছো?
আমি চুপ করে রইলাম।

~ কথা বলবেনা? এইবারো আমি কিছু বললামনা। ও আমার হাতটা টেনে নিয়ে জড়িয়ে বলল,
~ আমি সত্যিই দুঃখিত ত্বোহা। তোমার হাতের রক্ত দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলনা। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কেউ তোমাকে আঘাত করলে সেটা আমি সহ্য করতে পারিনা।
~ আঘাতের উপর আঘাত দিতে পারো তাই তো?
~ ত্বোহা!
~ তুমি যখন দেখেই ছিলে আমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে, তখন কেন এগিয়ে এসে ব্যান্ডেজ টা করলেনা! সারাদিনে একবারো জিজ্ঞেস করলেনা আমার হাতের কি অবস্থা! উলটো হাত ছুড়ে দিয়ে আবার রক্ত ঝড়ালে।
এটা কে কি আমি ভালোবাসা বলব?

~ আসলে আমি তখন কেমন জানি হয়ে গেছিলাম। স্যরি ত্বোহা এমনটা আর হবেনা। আমি তাসবীন ভাইয়ার কাছে ক্ষমা চাইব। তোমাকে আর কখনো কষ্ট দিবনা সত্যি।
আমি আর কিছু বললামনা। কেন জানি অসহ্য লাগছে সাদাফের কথাগুলো! আগের মত কোনো ভালোবাসা খুজে পাচ্ছিনা। সাদাফ আমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে। আমি অবশের মত পড়ে থাকি। খেয়াল করি, কেউ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকানোর সাথে সাথে সরে যায়। সাদাফকে সরিয়ে আমি দরজার কাছে গেলাম। দেখি নিচে ব্যান্ডেজ আর ওষুধ পড়ে আছে।
মনে হল, এইগুলো তাসবীন এনেছিল। ছেলেটার হয়ত খেয়াল আছে আমার ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করতে হবে। কিন্তু ও এভাবে চলে গেল কেন?
তাসবীনের রুমে গিয়ে দেখি ও একমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার গলা ঝাড়ার শব্দে উঠে দাড়াল। আস্তে করে বলল, আপনি?

~ ব্যান্ডেজ নিয়ে গিয়েছিলেন, না করে চলে এলেন যে?
~ স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গ সময়ে বিরক্ত না করাই ভাল।
~ তাহলে আর গেলেন কেন?
~ তাশবীহ তো এসব করতে পারেনা, তাই আপনার ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করা হবেনা। এইজন্য করে দিতে গিয়েছিলাম।
~ তো করে দিন।

তাসবীন কয়েকমূহুর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যান্ডেজ করতে শুরু করল। আমি একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলাম,
~ আমাকে নিয়ে এত ভাবেন কেন?
তাসবীন কোনো উত্তর দিলনা। মুখে বলল,
~ ব্যান্ডেজ করা শেষ। পানি লাগাবেননা
আপনাকে নিয়ে আমি আর ভাবব না। তাশবীহ আছে ভাবার জন্য।

আমি আর কিছু না বলে চলে এলাম। আর কোনো পিছুটান না থাকাই ভাল। তাসবীন ঠিকটা বুঝতে পারছে এখন, শুধু আমার নিজে গুটিয়ে নেওয়ার পালা।
এরপর থেকে আমরা কেউ কারো সামনে পড়তে চাইতামনা। তাও দিনে ২-৩বার অনিচ্ছাকৃত সামনে পড়ে যেতাম। চোখ ফিরিয়ে নিতাম, কারণ তাসবীনের চোখের দিকে তাকালে অন্য একটা মায়ায় পড়ে যাই।

তাসবীন ও আমার সাথে খুব একটা কথা বলত না। তবে বুঝতাম মাঝে মাঝে ও আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করতাম।
যখন মায়া বাড়িয়ে লাভ হয়না, তখন মায়া কাটাতে শিখতে হয়।
মাঝরাতে চাপা গোঙ্গানির আওয়াজ শুনে ধড়পড়িয়ে উঠে পড়ি। আওয়াজ টা এমন যেন কেউ কাউকে মেরে ফেলছে। তাড়াতাড়ি উঠে নিচে নেমে গেলাম। বুঝতে পারছিনা আওয়াজটা কোথায় থেকে আসছে?

একটু এগিয়ে দেখি আওয়াজটা সাদাফের রুম থেকে আসছে। তাড়াতাড়ি দরজা খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি ওর রুমের দরজা লক করা, বাহিরে থেকে ধাক্কাতে শুরু করলাম।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পর দরজা খুলল। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, সাদাফ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে।

ওর সারা শরীরে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করার দাগ, চামড়া ফেটে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে।
সাদাফ মেঝেতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমি ছুটে গিয়ে কেদে কেদে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার এই অবস্থা হল কি করে!
সাদাফ কিছু একটা বলতে চাইল কিন্তু বলতে পারলনা।

পর্ব ১৭

কিছু বলার আগেই সাদাফ জ্ঞান হারায়। আমি কি করব বুঝে উঠতে পারছিলামনা। সাদাফের এই অবস্থা কে করল? মেঝেতে কারো রক্তমাখা পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। সাদাফের রক্ত মাড়িয়ে যাওয়ার কারণে পায়ের ছাপ গুলো স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে। ভীষণ জেদ চেপে গেল, যে সাদাফের এই অবস্থা করেছে তাকে আমি ছাড়বনা। আমি পায়ের ছাপটা অনুসরণ করলাম, পিছু নিয়ে দেখি ছাপগুলো তাসবীনের ওয়াশরুম পর্যন্ত আছে। ওয়াশরুমের ভিতর থেকে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে, ভেতরে কেউ আছে। বুঝতে বাকি রইলনা সাদাফের উপর কে আক্রমণ করেছে। আমি সাদাফের কাছে ফিরে এলাম, ওর এখনো জ্ঞান ফিরেনি।

নিজে কেমন জানি অসহায় লাগছে। চিৎকার করে মাকে ডাকলাম, মা এসে সাদাফের এই অবস্থা দেখে কান্না জুড়ে দিল। বিলাপ করে বলতে লাগল, কোন জ্বীন আমার সাদাফের এই অবস্থা করে,ছে? আমার ছেলে কার কি ক্ষতি করেছিল!
আমি সব বুঝেও চুপ করে রইলাম। তাসবীন এমনটা করতে পারে আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা। কিন্তু নিজের চোখকে এতবার ভুল বলতে পারছিনা। আচ্ছা তাসবীন এখন কোথায়? এত হট্টগোল শুনে তো ওর আসার কথা। ও কি ওয়াশরুম থেকে এখনো বের হয়নি!

সাদাফের শরীরের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। আল্লাহর রহমতে আঘাত অত গুরুতর হয়নি, আপাতত জ্ঞান ফেরার পর ব্যথায় ঘুমিয়ে পড়েছে। মা কেও বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলাম। নিজের কাছে ও ক্লান্ত লাগছে। চুপচাপ বেরিয়ে তাসবীনের রুমের সামনে এলাম। মেঝের দিকে খেয়াল করে দেখলাম, একটাও পায়ের ছাপ নেই। সব যেন কেউ সুন্দর করে মুছে নিয়েছে। তাসবীনের রুমের দরজাও পুরো খোলা, ভিতরে ঢুকলাম।

আজ তাসবীনকে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, কেন? কি কারণে? ও এসব করেছে। কি চায় ও?
পুরো রুম খুজে দেখলাম তাসবীন কোথাও নেই। এইটুকু সময়ের মধ্যে ও কোথায় উধাও হল? নাকি সাদাফকে মরার প্ল্যান করে পালিয়ে গেল?
সময় যত যাচ্ছে তত যেন সবকিছু রহস্যময় হয়ে উঠছে। যত সমাধান করতে যাচ্ছি, তত যেন গোলকধাধার অতলে তলিয়ে যাচ্ছি।

তাসবীনকে অনেক খোজার পর না পেয়ে নিজের রুমে ঘুমাতে চলে এলাম। সাদাফের জন্য খারাপ লাগছে, এমন এক অবস্থা ওর পাশে থাকতেও পারছিনা। কাল সকালে সাদাফকে জিজ্ঞেস করে নেব, ওর উপর আক্রমণ কে করেছিল? আর তাসবীন থেকে সব রহস্যের উত্তর আমি বের করেই ছাড়ব।
সকালে উঠে সাদাফের কাছে গেলাম। ও অনেকটা সুস্থ, তবে চোটের ব্যথা এখনো রয়ে গেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম,
~ তোমার শরীর কেমন এখন?
~ হ্যা, ভাল।
~ উঠে বসতে পারবে? তোমাকে ওষুধটা খাইয়ে দেই, ব্যথা কমে যাবে। আর একটু স্যুপ এনেছি খেয়ে নিলে ওষুধ দিব।

সাদাফকে সাবধানে উঠে বসালাম। হেলান দেওয়ার জন্য পিছনে একটা বালিশ দিয়ে দিলাম। সামনে স্যুপের বাটি এগিয়ে দিয়ে বললাম, খেয়ে নাও।
সাদাফ ডান হাত নাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ব্যথার জন্য হাত নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে, তার উপর ব্যান্ডেজ বাধা। তাই ঠিকমত চামচ ধরতে পারছেনা। এই অবস্থা দেখে বললাম,
~ আচ্ছা আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তুমি তো পারছোনা।
ও চুপ থেকে সম্মতি দিল। অতি যত্নে ওকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছিলাম। খেতে খেতে ওর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। আমার চোখে চোখ পড়তেই আড়াল করার চেষ্টা করল।

~ সাদাফ!
~ হুম।
~ তোমার কি বেশী কষ্ট হচ্ছে?
~ না তো।
~ তাহলে কাদছো কেন?
~ কই এমনিতে।
~ একটা সত্যি কথা বলবে?
~ কি কথা?

~ কাল রাতে তোমার উপর কে আক্রমণ করেছিল?
সাদাফ চুপ করে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,
~ আমি জানিনা ত্বোহা। আমি তাকে দেখিনি, অন্ধকারে আঘাত করেছিল আমাকে।
বুঝতে পারলাম, সাদাফ আমার কাছে স্বীকার করতে চাচ্ছেনা। এইজন্য মিথ্যে বলছে। কেননা, আমি ওর গোঙ্গানীর আওয়াজ শুনে সাথে সাথে এসে দেখি রুমের আলো জ্বালানো। ও কি তাসবীনকে বাচানো চেষ্টা করছে?

যদি করেও থাকে, তবে কেন? কাল সকালেও তো সাদাফ সামান্য ব্যাপার নিয়ে তাসবীনের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে।
আর আজ এতবড় কাহিনীতেও তার টনক নড়লনা। সাদাফকে আর কিছু জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, যতবার জিজ্ঞেস করব ও মিথ্যে বলেই এড়িয়ে যাবে। এর চেয়ে যা জানার সব তাসবীন থেকে জেনে নিব।

আমি তাসবীনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু অবাক ব্যাপার ও সারাদিন বাড়ী ই ফিরলনা। কোথায় আছে সেটাও জানিনা। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কিছু বললেননা।
এই ব্যাপারে উনাকে চিন্তিত মনে হলনা অত। তাই আবারো জিজ্ঞেস করলাম, মা, তাসবীন ভাইয়া কি কোনো কাজে গিয়েছেন?
~ কাজ না ঠিক। ওর জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। তাকেই আনতে পাঠিয়েছি। জানো, মেয়েটাকে আমার ভারী পছন্দ হয়েছে। ভাবছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের বিয়ে দিয়ে দিব। আমার ঘরটা পরিপূর্ণ হবে। কি বলো?

আমি একটু চুপ থেকে বললাম, আপনি যা ভাল বুঝেন মা।
তাসবীন বিয়ে করবে ভেবে কেমন জানি একটু খারাপ লাগল। জানিনা কেন আমার এমন ফিল হচ্ছে।
চোখের সামনে এত প্রমাণ পেয়েও আমার মনে হচ্ছে তাসবীন নির্দোষ।
সন্ধ্যার দিকে তাসবীন ফিরল সাথে একটা অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে। দেখে মনে হচ্ছে চেহারা থেকে নূর ঠিকরে পড়ছে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর একটু হেসে দিয়ে বলল,
~ আপনি তাশবীহ ভাইয়ার স্ত্রী তাই তো? আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম। তারপর তাসবীনের দিকে তাকালাম। ওকে বেশ খুশিই মনে হচ্ছে। হয়ত এই বিয়েতে ওর সায় আছে।
সাদাফের এমন অবস্থা শুনে তাসবীন পাগলের মত ছুটে এল। সাদাফের কপালে চুমু খেয়ে বার বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ডাক্তার ডেকে আনল।

আমি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কি নিখুত অভিনয় জানে তাসবীন! যে কেউ বিশ্বাস করতে বাধ্য ওর মত ছেলে কখনো খারাপ কাজ করতে পারেনা। তাসবীনকে যে প্রশ্নগুলো করব ভেবে রেখে ছিলাম করতে পারলামনা।

ওকে একটিবারের জন্য ও একা পেলামনা। মেয়েটি আঠার মত সর্বক্ষণ ওর সাথে লেগেই ছিল।
এই প্রথম কোনো মেয়ের প্রতি আমার হিংসে লাগল। কেন জানি তাসবীনের পাশে ওকে সহ্য করতে পারছিলামনা। আমি এমন করছি কেন? আমার তো স্বামী-সংসার সবি আছে তাও কেন আমি তাসবীনকে আকড়ে ধরে আছি। আর তার চেয়ে বড় কথা হল তাসবীন একজন শয়তান। যে নিজের স্বার্থে ঘা লাগলে ভাইকে মারতেও দ্বিধাবোধ করেনা।
রাতে মেয়েটি আমার দরজায় কড়া নাড়ল। আমি ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
~ মাইশা।

~ ওহ, তুমি! এসো ভেতরে এসো।
~ দুঃখিত ভাবী, তোমাকে বিরক্ত করতে চলে এলাম।
~ আরেহ না। বিরক্ত কেন হবে? তোমার সাথে তো ঠিকমত আলাপ ই হলনা। ভালোই হল, তুমি এলে।

~ ভাবী, তুমি আর তাশবীহ একসাথে থাকোনা?
~ না, মায়ের নিষেধ আছে।
~ উনার শরীর কেমন এখন? রাতে খেয়েছেন?
~ আগের থেকে কিছুটা ভালো। না এখনো খাবার নিয়ে যাইনি আমি। ও বোধহয় ঘুমাচ্ছে, একটুপরেই যাব।
~ আচ্ছা।
~ তুমিও কি কোনো জ্বীন?
মেয়েটা মুচকি হাসল। তারপর একটু থেমে বলল,
~ কেবল তুমি মানুষ হয়েও একটা জ্বীনবর পেয়ে গেলে। তুমি কত সৌভাগ্যবতী বলো।
~ হয়তোবা।
সাদাফের ওষুধ আর ডিনারের সময় হয়ে গেছে। আমি খাইয়ে দিয়ে আসি।
~ ভাবী আমি নিয়ে যাই।
~ আরেনা, তুমি কেন নিবে!

~ নিজের প্রিয়বন্ধুর একটু সেবা করতে সাধ জাগল। নিয়ে যাব?
আমি একটু ভেবে বললাম, আচ্ছা নাও।
ও সাদাফের রুমের দিকে যেতেই আমি লুকিয়ে তাসবীনের রুমে চলে এলাম। এই একটা সুযোগ তাসবীনের সাথে নিরিবিলি একটু কথা বলার।
তাসবীনের দরজায় কড়া নাড়লাম। ও দরজা খুলে আমাকে দেখে কোনো কথা না বলে ভিতরে চলে গেল। আমিও পিছু পিছু ঢুকে বললাম, তাসবীন।
~ জ্বি বলুন।

~ আপনি মনে হয় আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
~ এড়িয়ে যাব কেন? আপনি তো আমার শত্রু নন।
~ ওহ আচ্ছা। কাল কোথায় ছিলেন?
~ রাতে মাইশাকে জ্বীনরাজ্য থেকে আনতে গিয়েছিলাম।
~ আপনাদের দুজন কে কিন্তু বেশ মানায়।
~ ধন্যবাদ।

তাসবীনের কথাগুলো কেমন খাপছাড়া। ও বোধহয় আমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নয়। তাও জিজ্ঞেস করলাম,
~ সাদাফের এমন অবস্থা হল কি করে জানতে চাইলেননা যে?
~ সাদাফকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও কিছুই বলেনি।
হয়ত মনের দিক থেকে খুব চাপে আছে। সময় দিন, সাপোর্ট দিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি আর কোনো কথা খুজে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
~ আপনি কি এখন খেয়ে নিবেন?

~ মাইশা কোথায়? ও আসুক, একসাথে খাব।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। একদিন আগেও যে চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম, আজ তাতে তার ছিটেফোটা ও নেই। পরক্ষণে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, তাতে আমার কি! সে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে, উপযুক্ত কাউকে খুজে নিয়েছে এখানে আমার আপত্তি কিসের। ভালো থাকুক ও।
আমিও সাদাফকে নিয়ে ভালো থাকব।

রাতে খাওয়ার পর সব গুছিয়ে কিচেন থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম তাসবীন সিড়ি বেয়ে উপরে যাচ্ছে। এত রাতে ও উপরে যাচ্ছে কেন? উপরে তো মা আর আমার রুম।
মা তো সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। তাহলে ও যাচ্ছে কার কাছে? চুপি চুপি ওর পিছু নিলাম। মা আর আমার রুম পেরিয়ে যাওয়ার পর বুঝলাম ও অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এসেছে। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে স্টাডি রুমের সামনে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে স্টাডি রুমের দরজা খুলল। এতদিন আমি এই স্টাডি রুমের কথা ভুলে ছিলাম! এখানেই হয়ত সব রহস্যের সমাধান আছে।

কিন্তু তাসবীন এখানে কেন ঢুকল! ও কি গুপ্তঘরে যাওয়ার জন্য এসেছে? আস্তে আস্তে উকি মারলাম দরজার ফাক দিয়ে। যা সন্দেহ করেছিলাম তাই, তাসবীন গুপ্তঘরে ঢোকার সুইচে চাপ দিল। ভিতরে ঢুকে পড়ার পর দরজা বন্ধ করলনা। হয়ত নিশ্চিন্ত হয়ে ঢুকেছে এখন কেউ এদিকে আসবেনা। দেরী না করে আমিও স্টাডি রুমে ঢুকলাম। বইয়ের তাকের পিছনে বসলাম যেখান থেকে ওকে ভালোভাবে দেখা যায়। ঘাপটি মেরে রইলাম ও কি করে দেখার জন্য।
ও অনেকগুলো মোম জ্বালিয়ে এর মাঝখানে বসে পড়ল। একটা বাটি সামনে রেখে পকেট থেকে ছুরি বের করে হাতে জোরে চেপে ধরল। আমি আতঙ্কিত হয়ে একটু নড়ে বসতেই তাক থেকে দুই-তিনটা বই মেঝেতে পড়ে গেল। তাসবীন সেটা টের পেয়ে উকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল, ততক্ষণে আমি আরেকটু কোণায় গিয়ে মাথা নিচু করে রইলাম।

ও চোখের ইশারায় গুপ্তঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
আমি ভয় পাচ্ছিলাম ও হয়ত উঠে আসবে, আর আমি ধরা পড়ে যাব। এই অবস্থায় উঠে যাওয়া হয়ত বারণ তাই আসতে না পেরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
এই সুযোগে আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে রুমে এসে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে পড়লাম। একটু পরে টের পেলাম কেউ দরজা সরিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আমি জানি তাসবীন আমাকে সন্দেহ করছে, আর ও আসবে যাচাই করতে।
একটুপর দরজা টেনে দেওয়ার শব্দ পেয়ে উঠে বসলাম। দিনের আলোর মত সব পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে। এইবার শুধু প্রমাণ করার পালা।

পর্ব ১৮

সকালে নাস্তার টেবিলে তাসবীনের সাথে চোখাচোখি হল। ও একদম স্বাভাবিক আচরণ করছে, আড়চোখে কয়েকবার হাতের দিকে তাকালাম। ও ফুলহাতার শার্ট পড়ায় হাতে কোনো কাটা দাগ আছে কিনা বুঝতে পারলামনা। মা খেতে খেতে মাইশার সাথে বিয়ের তারিখ ঠিক করার ব্যাপারে কথা বলছিলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
~ বউমা, কবে ঠিক করলে ভালো হয়?

~ আপনি আর মাইশার মা-বাবা মিলে একটা দিন ঠিক করুন যাতে দুইপক্ষের ই সুবিধা হয়।
মাইশা তোমার মা-বাবাকে আসতে বলেছো তো?
মাইশার মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেল। খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল। আমি আবার ডাকলাম,
~ মাইশা!

~ জ্বি ভাবি।
~ কি হল? কি ভাবছো?
~ কিছু না তো। আমি আর খাবনা, হাতটা ধুয়ে আসি।
তাসবীন গম্ভীর হয়ে বলল, খাবার ফেলে উঠতে নেই জানোনা! বাকিটা খেয়ে সবার সাথে উঠো।
মাইশা চুপচাপ আবার বসে পড়ল। কেমন জানি রহস্য লাগছে, মা-বাবার কথা উঠতেই মাইশা এমন হয়ে গেল কেন। জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে সাদাফের দিকে তাকালাম। ও ও কেমন গম্ভীর হয়ে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

~ সাদাফ, তোমার কি কিছু লাগবে?
~ নাহ।
~ খাচ্ছোনা যে?
~ শরীরটা একটু খারাপ লাগছে। আর খেতে পারছিনা, আমি বরং গিয়ে একটু শুয়ে থাকি। বলে সাদাফ উঠে চলে গেল। হঠাৎ করেই যেন সাদাফ অনেকটাই বদলে গেল। কেমন জানি গম্ভীর হয়ে থাকে, আমার সাথেও ঠিক করে কথা বলেনা, কিছু জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়।

আমি বোধহয় এবার পাগল ই হয়ে যাবে। চারিদিকের এত রহস্য আমি আর নিতে পারছিনা। কে ঠিক আর কে বেঠিক মূহুর্তে মূহুর্তে গুলিয়ে যাচ্ছে। সবাই খেয়ে উঠার পর মা আমাকে বললেন, আসলে মাইশার মা-বাবা দুইজন ই মারা গেছেন। এসব মনে পড়লে বেচারী কষ্ট পায়, তাই আমরা কেউ এসব কথা উঠাইনা। তুমিও আর এসব কিছু বলোনা। মেয়েটা জীবনে অনেক কষ্ট করেছে, এখন ওকে সুখে রাখতে চাই। শুনে আমার ভীষণ খারাপ লাগল। এইজন্যি হয়ত মাইশা ওইরকম গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। ওকে একবার স্যরি বলা উচিত।
মাইশার রুমে গিয়ে ওর দরজায় কড়া নেড়ে বললাম,
~ আসব?

মাইশা বোধহয় কাদছিল। অতিব্যস্ত হয়ে চোখ মুছে বলল,
~ আরে ভাবী তুমি! আসার জন্য অনুমতি নিতে হয় নাকি? এসো ভিতরে এসো।
আমি ভিতরে ঢুকে ওর মুখোমুখি দাড়ালাম। মেয়েটার চোখ এখনো ভেজা ভেজা, মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ কষ্টে আছে মেয়েটা।
~ স্যরি মাইশা।
~ কেন ভাবী?

~ তোমাকে তোমার মৃত মা-বাবার কথা মনে করিয়ে দিয়ে কষ্ট দিলাম। ও চমকে উঠে বলল,
~ না তেমন কিছুনা। সাদাফের শরীর এখন কেমন?
~ আগের চেয়ে একটু ভালো। তুমি দেখা করে আসোনি?
ও ধরাগলায় বলল, নাহ, কালকের পর আর দেখা করিনি।
~ দুইজন যখন বন্ধু বসে একটু আড্ডা দিতে পারো। এতে দুজনের ই ভালোলাগবে।
~ সবসময় কি সে উপায় হয়?
~ মানে?
~ সাদাফ অসুস্থ তো তাই তাসবীন তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছে। এইজন্যই যাইনা। সাদাফ সুস্থ হোক, তখন আড্ডা দিব।

আমি চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম,
~ আচ্ছা, তুমি রেস্ট নাও তাহলে। আমি কাজ শেষ করে আসি। আল্লাহ হাফেজ।
~ আল্লাহ হাফেজ।
মাইশার রুম থেকে বের হতেই দেখি তাসবীন মাইশার রুমের দিকে আসছে। সরে গিয়ে বাহিরের পর্দার আড়ালে লুকালাম, কেন জানি তাদের কথোপকথন শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। এর থেকেও কোনো ক্লু পেয়ে যেতে পারি তাসবীন যে একজন শয়তান তা প্রমাণ করার। তাসবীন মাইশার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি আড়ি পাতলাম, ভিতর থেকে তাসবীনের উচ্চ স্বরে চেচানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিনা।

তাও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পর দরজা খোলার শব্দ পেতেই সরে গেলাম। তাসবীন কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা চলে গেল। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মাইশার রুমে উকি দিলাম। মেয়েটা বালিশ চেপে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে।
তাসবীন কি এমন বলল যে মেয়েটা এভাবে কাদছে। কি নিয়ে এত চেচামেচি করল? আমি তাসবীনকে এতদিন ধরে দেখছি, ওকে কখনো এভাবে কাউকে বকতে দেখিনি।
আস্তে আস্তে নিজের আসল রুপে আসছে শয়তানটা। মাইশার মত এত ভালো একটা মেয়ের জীবন আমি শয়তানটার সাথে যুক্ত করতে কিছুতেই দিবনা। এই বিয়েটা যে করে হোক, ভেঙে ফেলব। খুব ভালোই বুঝতে পারছি মাইশা তাসবীনকে বিয়ে করলে সুখী হবেনা। শুধু মাইশা কেন কোনো মেয়েই সুখী হবেনা, উলটো শয়তানের ভোগের স্বীকার হবে।

পা টিপে টিপে স্টাডি রুমের সামনে এসে দাড়ালাম। এদিক সেদিক ভালো করে দেখে নিলাম কেউ কোথাও নেই। সবাই ঘুমাচ্ছে, এই সুযোগ স্টাডি রুমে ঢুকে তাসবীনের ব্যাপারে কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করার। স্টাডি রুমে তালা ঝুলছে, চাবি তো তাসবীনের কাছে।

এখন ওর রুম থেকে চাবি চুরি করতে গিয়ে যদি ধরা খাই, তাহলে হয়ত আমাকে আর বাচিয়ে রাখবেনা। অন্য উপায় খুজতে হবে।
মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়। চিকন ক্লিপ দিয়ে তালা খোলা যায় ভেবেই চুলের বান থেকে চিকন ক্লিপ খুলে বহুকষ্টে তালাটা খুললাম। তালা ঝুলিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে ভেজিয়ে দিয়ে গুপ্তঘরের দিকে গেলাম। এটার দরজা খোলার সুইচটা কোনদিকে ছিল মনে পড়ছেনা।
এদিক সেদিক কিছুক্ষণ দেখার পর ও খুজে পেলামনা।
তাসবীন কি তাহলে সুইচটা সরিয়ে নিয়েছে?

সেটা না পেলে আমি গুপ্তঘরে ঢুকব কি করে? আর প্রমাণ ই বা খুজব কিভাবে!
হতাশ হয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। যা প্ল্যান করি, সব ভেস্তে যায়। আল্লাহ তুমি আমার সহায় হও। সব রহস্যের একটা কিনারা করে দাও। এভাবে আর পারছিনা।
উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার পুরো স্টাডি রুম খুজে বেড়ালাম। কোথাও পেলামনা। হতাশ হয়ে বেরিয়ে যাব এমনসময় শাড়ির আচলটা টেবিলের পায়ায় আটকে গেল। উবু হয়ে খুলতে গিয়ে দেখি সেখানে সুইচটা সেট করা। খুশিতে বড় একটা বিজয়ী মুচকি হাসি দিলাম।
সুইচে চাপ দিতেই গুপ্তঘরের দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সাথে টর্চ বা মোমবাতি আনলে ভালো হত। গুপ্তঘর থেকে বের হয়ে স্টাডি রুমে এমনকিছু খুজতে লাগলাম। ভাগ্য ভালো, মোমের একটা ছোট টুকরো খুজে পেলাম। টেবিলের উপর রাখা দীর্ঘদিনের পুরোনো দিয়াশলাইটা নিলাম। ভেতরে ৩-৪টা কাঠি অবশিষ্ট আছে, অচল হয়ে গেছে মনে হয়।

২-৩টা দিয়ে ট্রাই করার পর আগুন জ্বালাতে পারলাম। মোম নিয়ে ঢুকে দেখি ও রুমটা পুরো পরিষ্কার। শুধু সাদা পর্দা দিয়ে আসবাবপত্রগুলো ঢাকা দেওয়া আছে। তাসবীন দেখি সব প্রমাণ লোপাট করে দিয়েছে, কিন্তু সে কি জানেনা শয়তান যতই চালাক হোক কিছু তো ভুল সে করেই থাকে।
সাদা পর্দা গুলো সব উল্টিয়ে দেখলাম কোনো বইয়ের তাক ই নেই। মনে হচ্ছে আমি কোনো স্টোর রুমে আছি।

এত কষ্ট ই বৃথা আমার। হঠাৎ আমার মোমবাতিটা নিভু নিভু করা শুরু করল। এই বদ্ধ রুমে বাতাস আসল কোথা থেকে! মোমবাতিটা আগলে রাখার চেষ্টা করেও নিভে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমি একা পড়ে গেলাম। এখন এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া ই ভাল। কিন্তু দরজার সুইচ কিংবা দরজা কোনদিকে? অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খোজার চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ সামনে কারো কঠিন বুকের অস্তিত্ব পেলাম। হকচকিয়ে দুইপা সরে গেলাম। তাসবীন কি চলে এসেছে? এবার কি হবে? ভাবতেই গলা শুকিয়ে গেল। ২-১বার ঢক গিলে পিছু হটলাম। আমার ডানগালে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলাম, আগের মতই মনে হচ্ছিল গালটা অবশ হয়ে যাচ্ছে।
ভীষণ কনকনে ঠান্ডা নিশ্বাস গুলো আমার শরীরে লাগতেই কেপে কেপে উঠছি। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে পালিয়ে যাই, কিন্তু কি কারণে জানি পারছিনা। অবশ পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছি। সে আমার হাত চেপে ধরে বলল,
~ তুমি যা এখন ভাবো৷ তা আমি অনেক আগেই ভেবে রাখি।

তুমি চালাক কিন্তু আমার চেয়ে বেশি নয়।
~ একজন শয়তান আমার চেয়ে বেশি চালাক হবে এটাই স্বাভাবিক। শয়তানের শয়তানী ই তো তার শক্তি।
~ ওহ আচ্ছা তাই?
কেন শয়তানকে নিজের পাশে মেনে নিতে পারবানা!
~ মানে?

~ মানে কিছুনা। এত সাহস করে যে এখানে এলে এখন যদি আমি বাহিরে থেকে চিরতরে এই দরজা বন্ধ করে দিই। সারাজীবন তুমি এখানে পচে মরবে। তুমি এটা জানো?
এবার ভয়টা আমার মধ্যে চাড়া দিয়ে উঠল। শয়তানটা যদি সত্যিই এমন করে! এখানে বন্দি থাকলে কেউ আমাকে উদ্ধার করতে আসবেনা। কেউ জানবেও না।
~ আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? তাহলে শুনুন আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকেই ভয় পাইনা। আপনার যা খুশি আপনি তা করতে পারেন। আল্লাহ আমার সহায় হবেন।
~ বাহ, ভীষণ ভালো কথা বললেন তো।

তাহলে এখন আমার কি করা উচিত বলুন তো?
~ কি করতে চান আপনি?
~ আপনাকে এখানে পচিয়ে মারব নাকি ছেড়ে দিব?
ছেড়ে দিতে পারি তবে একটা শর্ত পেট থেকে কোনো কথা বের করা যাবেনা। যা যা তুমি দেখেছো আর যা তুমি শুনেছো।
~ শয়তানের গোমরাহী শত ঢাকতে চাইলেও ঢাকা যায়না। একদিন না একদিন তা ফাস হবে। আর আল্লাহ সবার কৃতকর্ম সম্পর্কে অবগত।

সে হাসতে লাগল। যেন কোনো মজার জোক্সস শুনেছে।
এরপর আমার দুগাল আবারো চেপে ধরল।
~ খুব ভালো কথা জানো।
গাল অবশ হয়ে যাওয়ার কারণে কথা বলতে পারছিলামনা। হঠাৎ সে আমার গলাটা শক্ত করে চেপে ধরল। আমার দম বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা। শত চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছিলামনা। মনে হল এক্ষুনি আমি নিঃশ্বাস ছেড়ে দিব।

এমনসময় সে আমাকে ছেড়ে দিল আর গুপ্তঘরের দরজাটা খুলে গেল। বুঝে উঠতেই কোনোমতে পালিয়ে বের হয়ে এলাম। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম।
রুমে এসে দরজা বন্ধ করে পানি খেলাম। গাল যেন এখনো অবশ হয়ে আছে। শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামার আগেই আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে হয়ত।
আল্লাহ আমার সহায় থাকলে শয়তানটার কোনো শয়তানিই আমাকে থামাতে পারবেনা। কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস ই করবেনা। কি করা যায় বুঝতে পারছিনা।
অনেকক্ষণ ভাবার পর মনে হল, সাদাফকে ব্যাপারটা বলি। অন্তত বিশ্বাস না করুক স্বামী হিসেবে আমার কথার গুরুত্ব ত দিবে। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম প্রথমে সাদাফকেই কথাগুলো জানাব। সে বিশ্বাস করলে তবে বাকিটা দেখা যাবে।

ও যদি একবার আমার কথা বিশ্বাস করে তবে আমার জন্য রহস্য সমাধান করাটা সহজ হয়ে যাবে। ও একজন জ্বীন, আমি যা জানিনা বা করতে পারিনা তার অনেকটাই ও পারবে। এই ব্যাপারে যদি ওর একবার সাহায্য পাই, আমাকে আর ফিরে তাকাতে হবেনা। স্থির করলাম সুযোগ পেলেই ওকে সব খুলে বলব। কিন্তু ইদানিং ওর যে কি হল! আমাকে এড়িয়ে চলে খুব, কথাবার্তা বলতে চায়না।
বুঝিনা এটা কেন করছে? তার উপর কি কোনো শয়তানি প্রভাব পড়েছে?
পরেরদিন সকালে আমি আর তাসবীন মুখোমুখি হলাম। ও আমাকে ডাকল, আমি শুনেও না শোনার ভান করে চলে এলাম। সব জেনে যাওয়ার পরও ও কেন আমার সামনে ভালো মানুষ সাজতে আসে বুঝিনা। ও কে যত এড়িয়ে চলতে চাচ্ছি, ও ততই আমার সামনে বেশি পড়ে।

আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
~ ত্বোহা, তুমি আমাকে কেন এড়িয়ে চলতে চাচ্ছো?
আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
আমি হাত সরিয়ে নিয়ে বললাম,
~ আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।
লজ্জা করেনা একজন বিবাহিত মেয়ের হাত ধরতে! আপনার হবুবউ এটা জানলে তার ফল কি হবে বুঝতে পারছেন?
চরিত্রহীন লোক একটা।

বলে চলে গেলাম। দিন দিন উনার এসব বেড়েই চলেছে। আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। আজ ই সাদাফকে এই ব্যাপারটা জানাব। এই ভেবে সাদাফের রুমের দিকে গেলাম। কড়া নাড়ব এমনসময় দেখি দরজা ভেজানো। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে যা দেখি তা দেখার জন্য আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলামনা।
সাদাফ আর মাইশা একে অপরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। সাদাফ আলতো করে মাইশার কপালে চুমু খেয়ে বলল, চিন্তা করোনা। আল্লাহ ভরসা।
~ তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবনা সাদাফ।

তুমি কিছু একটা করো। এটুকু শুনে আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি কি কোনো ঘোরের মধ্যে আছি?
চোখের সামনে এসব কি দেখছি! নিজের স্ত্রী বর্তমান থাকতেও সাদাফ! ছিঃ! এইজন্যই ও আমাকে এত এড়িয়ে চলে? আর মাইশার মত মেয়ে এটা কি করে করতে পারল! একবারো আমার কথা ভাবলনা।
সবাই আমাকে ঠকিয়ে কি পায়?
ভাবতে ভাবতে কেদে দিলাম।

পর্ব ১৯

রুমে শুয়ে বালিশে গুজে কাদতে লাগলাম। কি কপাল নিয়ে এই দুনিয়ায় এসেছি! জন্মের পর থেকে শুধু দুঃখ ই পেয়ে যাচ্ছি। আল্লাহ বোধহয় সব কষ্ট আমার ভাগ্যে লিখে দিয়েছেন। সবকিছু ভুলে যখন তাসবীনকে ভালোবেসে পানিতে ভাসা খড়কুটোর মত আকড়ে ধরে বাচতে চেয়েছি, সে আমাকে ধোকা দিল। বাবাকে তো পেয়েও হারালাম, আর সাদাফকে বিশ্বাস করে নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছি আজ সেও আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।

কাকে বিশ্বাস করব আমি! আর পারছিনা এভাবে বাচতে। এই জীবন থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো। আল্লাহ তুমি আমাকে এভাবে তিলে তিলে আর কষ্ট দিওনা, এরচেয়ে একেবারে মেরে ফেলো। অসহ্য লাগছে জীবনটা।
হঠাৎ কাধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে উঠে বসলাম। তাসবীন আমার দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
~ কাদছো কেন?

~ এমনিতে।
~ দেখো ত্বোহা, দুঃখ আল্লাহ তাকেই বেশি দেয় যাকে উনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আর তুমি যদি সেই ভালোবাসা উপেক্ষা করে নিজের জীবন শেষ করতে চাও, তাহলে তোমার চেয়ে বড় বোকা আর নেই।
আমি রেগে গেলাম। একজন শয়তান উপাসকের মুখে আল্লাহর গুনগান ভীষণ বেমানান লাগছে। যে নিজেকেই খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনা, আল্লাহর বিরুদ্ধে চলে তার মুখে আল্লাহর গুনগান বড্ড অহেতুক। রাগান্বিত কন্ঠে বললাম, আপনার বলা শেষ হয়েছে? এবার আসতে পারেন।
~ ত্বোহা, এমন করছো কেন?

~ আপনাকে চলে যেতে বললামনা, প্লীজ চলে যান।
আপনার মত শয়তানের কোনো সহানুভূতি আমার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ আমার সাথেই আছেন, আমি যথেষ্ট শক্ত একটা মেয়ে। তাই এত সহজে ভেঙ্গে পড়ে আপনার মিষ্টি কথায় ভুলে যাবনা। আসুন তাহলে।
তাসবীন মনমরা হয়ে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে উঠে চলে গেল। আমাকে সহানুভূতি দেখাচ্ছে? কারো সহানুভূতি কিংবা ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন নেই। কাউকে বিশ্বাস করিনা আমি। বলে বেডটেবিলের সবকিছু হাত ছুড়ে ফেলে দিলাম।

তারপর কাদতে কাদতে মেঝেতে বসে পড়লাম। বাবাকে খুব মিস করছি, অন্তত বাবা আমাকে কখনো ঠকাতনা। পাশে থেকে ঠিক কষ্ট ভুলিয়ে দিত। বিকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রুমেই শুয়ে রইলাম। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে মরার মত শুয়ে আছি। সাদাফ আমাকে ডাকতে ডাকতে রুমে এল।
এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,
~ শরীর খারাপ তোমার?
~ খারাপ হলে তাতে কি?
~ মানে? দুপুরেও খেলেনা, সারাদিন রুমের কোণায় পড়ে রইলে। কি হয়েছে? মন খারাপ? বাবার কথা মনে পড়ছে?
আমি চোখ তুলে সাদাফকে একনজর দেখে নিলাম। এখনো কি নিখুত অভিনয় করে যাচ্ছে আমার সাথে!

প্রমাণ করতে চাইছে সে আমার ব্যাপারে খুব সেনসিটিভ। কিন্তু আসল সত্যিটা জানার পর এসব দেখে হাসছি। কতই না বোকা ভাবে আমাকে সবাই?
~ কি হল ত্বোহা? চুপ করে আছো যে!
~ আমাকে একা থাকতে দাও। যাও এখান থেকে।
~ তোমার কি হয়েছে না বললে তো যাবনা। ত্বোহা বল না।
আমি আর ওর এসব ন্যাকামি নিতে পারছিনা। তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,
~ আমাকে ঠকালে কেন সাদাফ?

সাদাফ বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হয়ত বুঝতে পেরেছে আমি কি বলতে চাচ্ছি! কিছু না বলে মাথা নিচু করে চলে যেতে উদ্ধত হল। আমি ওর হাত টেনে বললাম, উত্তর না দিয়ে তুমি কোথাও পালাতে পারবেনা। আমাকে সঠিক উত্তরটা দাও।
সাদাফ এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি কাউকে ঠকাইনি। বরং নিজেকে ঠকিয়েছি আর বারবার ঠকেছি।

~ তুমি কি অস্বীকার করতে পারো মাইশার সাথে তোমার অবৈধ ভালোবাসার সম্পর্ক নেই?
ও মাথা নিচু করে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। খানিকক্ষণ পর শান্তশিষ্ট অনুতপ্ত মুখের খোলস ছিড়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
~ তুমিও কি অস্বীকার করতে পারো তাসবীন ভাইয়ার সাথে তোমার এমনি অবৈধ ভালোবাসা ছিলনা!
আমার টা যদি অবৈধ হয় তবে তোমারটাও অবৈধ ছিল।
এখনো তুমি ওর প্রতি দুর্বল, ওকে নিয়ে ভাবো। এটা কি অস্বীকার করতে পারবে! তোমার নিজের চরিত্র ই নোংরা, তুমি আমায় নিয়ে কোন সাহসে মন্তব্য করো?
আমি সাদাফের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এতগুলো কথা কঠিনভাবে জঘন্য ইঙ্গিতে বলতে ওর একটুও বাধলনা। এই ওর আসল রুপ!

এসব বলে সাদাফ রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বাসা থেকে বেরিয়ে লাগলাম। কানে সাদাফের কথাগুলো অনবরত বেজে যাচ্ছে। হাটতে হাটতে বাসার অদূরে বড় খাদের কিনারায় চলে এলাম। আর একপা এগোলেই বড় খাদের অতলে তলিয়ে যাব। বেচে থাকাটা বৃথা মনে হচ্ছে। তাই নিজের অস্তিত্বকে বিসর্জন দেওয়ার চিন্তা করছি।
এমনসময় কেউ আমাকে টেনে নিয়ে আসল। আমি অবাক হয়ে বললাম, মা আপনি!
~ কি করতে যাচ্ছিলি? আরেকটু হলে তো বেঘোরে মারা পড়তি। তোর কি হয়েছে মাকে বল।
~ মা আমি বার বার ঠকে যাচ্ছি। আর পারছিনা এভাবে বাচতে। মা চুপ করে শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তোমার কাছে হয়ত আর কিছু লুকানো উচিত হবেনা। তোমাকে সব সত্য বলার উপযুক্ত সময় এসে গেছে।

~ কিসের সত্য মা?
~ আমি নিজেও জানি, তাসবীন একজন শয়তান উপাসক জ্বীন। অনেকবার চেষ্টা করেও ওকে এই পথ থেকে ফেরাতে পারিনি। ও সবার ক্ষতি করতে ব্যস্ত। তুমক যে সাদাফকে ভুল বুঝছো তার পিছনেও তাসবীন দায়ী। ও সাদাফের রুপ ধরে এসব করছে, আর তুমি সাদাফকে ভুল বুঝে যাচ্ছো।
আমি শুনে অবাক হয়ে গেলাম। তার মানে, সাদাফের কোনো দোষ নেই। যা হচ্ছে সব তাসবীনের প্ল্যানেই হচ্ছে। ও এভাবে আমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে।

মা চোখ মুছে বলল, নিজের চোখের সামনে দুই সন্তানের এমন ভবিষ্যত দেখেও কিছু করতে পারছিনা। হতভাগী মা আমি। এভাবে চলতে থাকলে তাসবীনের হাতে পুরো জ্বীনসাম্রাজ্য চলে আসবে। ও সেই চেষ্টা করছে আর অনেকটা সফলের পথেও।
~ এসব বন্ধ করার কি কোনো উপায় নেই মা?
~ আছে। সেটা হল তাসবীনের মৃত্যু।
আমি আতকে উঠলাম। তারপর আবার বললাম,
~ এসব কি বলছেন মা?

~ হ্যা, এটাই সত্য। ও শয়তানের সন্তুষ্টি লাভ করে ফেলেছে, এখন যদি ওকে থামানো না হয় তবে ও পুরো পৃথিবীতে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করবে। এক্ষুনি ওকে না আটকালে না জানি ও কত লোকের সর্বনাশ করবে।
~ তাই বলে ওকে মেরে ফেলে!
~ মা হয়ে এটা আমার কাছেও ভীষণ কষ্টকর। কিন্তু বুকে পাথর বেধে এই কথাগুলো আমাকে বলতে হচ্ছে। নিজের কোল ঠিক রাখার জন্য, অন্য মায়েদের কোল আমি ফাকা করে দিতে পারিনা।
আমি চুপ করে রইলাম। মা একটু থেমে আবার বলতে লাগল, তাসবীনকে মারার কাজটা একমাত্র তুমিই করতে পারবে।

আমি আতকে উঠে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা আমার এমন এক্সপ্রেশন দেখে কাদো কাদো মুখ করে বলল,
~ তোমাকেই এই কাজটা করতে হবে।
তাসবীন যাকে বেশি পছন্দ করে, যার প্রতি প্রচন্ড রকমের দূর্বল একমাত্র সে ই তাসবীনকে হত্যা করতে পারবে।
~ এই কাজ আমি করতে পারবনা মা।

~ তুমি কি চাও না আমার ছেলেটা শয়তানের হাত থেকে মুক্তি পাক? নাকি চাও আরো অনেক নিরীহ মানুষের মৃত্যু হোক! আমি ওর মা হয়ে চরম কষ্টটা মাথা পেতে নিচ্ছি।
তুমি কেন পারবেনা?
ত্বোহা মা, এখন সব তোমার কাছে। যা করতে চাও, তাই করো। ভালো-মন্দ বুঝে নাও।
আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। তাসবীন এত খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আমি এটা মানতে পারছিনা। যাকে একবারের জন্য হলেও ভালোবেসেছি তাকে নিজের হাতে কি করে মারব!
কিন্তু ওকে না মারলে পুরো দুনিয়ায় ও ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে।
ভাবতে ভাবতে দেখি তাসবীন আমাদের খুজতে খুজতে এখানে চলে এসেছে। মা বলল,
~ ঘাবড়িয়োনা। এই সুযোগ ওকে শেষ করে শয়তানী থেকে মুক্তি দেওয়ার। বলে আমার হাতে একখানা ছোরা তুলে দিলেন। আমি ওইটা হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
তাসবীন আমাদের কাছে এসে বলল,
~ তোমরা এখানে কেন?

আমি তো খুজে খুজে হয়রান। মা-ত্বোহা চল একসাথে খাব। আজ আমি তোমার পছন্দের সব রান্না করেছি মা। আমার কান্না পাচ্ছে, এই তাসবীনকে মোটেও আমার শয়তান মনে হচ্ছেনা। মা ফিসফিস করে কাদো কাদো স্বরে বলল,
~ আর কোনো উপায় নেই আমাদের হাতে। এক্ষুনি ওকে মারতে হবে। আজ শয়তান ওকে বর দিবে বলে কথা দিয়েছে। একবার যদি ও বর পেয়ে যায় তবে আর কিচ্ছু করার থাকবেনা। আমার হাত কাপছে ভীষণভাবে। এটা কখনোই পারবনা আমি। তাসবীন আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কত কথা বলে ফেলছে। ভীষণ মায়া লাগছে।
~ তাসবীন।

~ হ্যাঁ।
~ আমি তোমাকে খুন করতে যাচ্ছি।
ও বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি কান্না করতে করতে বললাম, ক্ষমা করে দিও আমায়।
বলে ছুরিটা ওর পেট বরাবর ধরলাম। তাসবীন একবার আমার দিকে আরেকবার মায়ের দিকে তাকাতে লাগল।

~ কেন খুন করবে আমায়?
~ এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে।
তাসবীনের চোখ ছলছল করছে। আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে কাদছি। আমি পারছিনা ছুরি দিয়ে ওকে আঘাত করতে। ভীষণভাবে হাত কাপছে আমার।
এমনসময় মা আমার হাত ধরে জোরে ছুরিটা তাসবীনের পেটে ঢুকিয়ে দেয়। তাসবীন পেট চেপে ধরে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে, আমি পাথরের মত অবশ হয়ে এই দৃশ্য দেখছি। কেন জানি চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে হচ্ছে।

তাসবীন ছলছল চোখে মাকে বলে,
~ মা, দোয়া করো। আল্লাহ যেন আমাকে এর উত্তম প্রতিদান দেন। কথা শেষ না করতেই মা তাসবীনকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দেয়।
তারপর চিৎকার করে কাদতে কাদতে বলে, আল্লাহ তুমি আমাকে কি পরীক্ষা ফেললে! আমার ছেলেটাকে তুমি ক্ষমা করে দিও।
আমি চুপ করেই দাঁড়িয়ে আছি, তাসবীনের রক্ত এখনো আমার হাতে লেগে আছে। কাপতে কাপতে অবশ হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে, নিঃশ্বাসটা যেন বন্ধ হয়ে যাবে।
আমারো কি মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে?

পর্ব ২০

জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমার পাশে সাদাফ আর মাইশা বসে আছে। তাসবীনের কথা মনে পড়তেই ধড়পড়িয়ে উঠে বসলাম। সাদাফের দিকে তাকালাম, ওর চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। অনেকক্ষণ কান্না করেছে হয়ত।

আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে বলল, তুমি এটা কি করে করতে পারলে ত্বোহা? তোমার বিবেকে একবারো বাধলনা কাজ করতে। যে মানুষটা তোমাকে এত ভালোবাসে তাকেই তুমি
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি ওকে মারতে চাইনি। কিন্তু ও একজন শয়তান। আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্ট করতে চেয়েছে। ও বেচে থাকলে না জানি কত মানুষের সর্বনাশ করত। তাই মায়ের আদেশে আমি ওর দিকে ছুরি তুলেছি। কিন্তু আমি নিজেও চাইনি ওকে মারতে।

আমার কথা শুনে মাইশা আর সাদাফ একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। সাদাফ আমার পাশ থেকে সরে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কাদতে লাগল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা, তাসবীন সাদাফের এত ক্ষতি করার পর সাদাফ ওর জন্য কষ্ট পাচ্ছে। মাইশা আমার গালে হাত রেখে বলল, তুমি যে কত বড় ফাদে পড়েছো সেটা তুমি বুঝতে পারছোনা।
~ মানে?

~ মানে তাসবীন মোটেও শয়তান না। তোমাকে সব ভুল বুঝানো হইসে। শয়তানী চালে তোমাকে একটা গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছে মাত্র। আজ তোমার কাছে কিছুই লুকাবনা। এতদিন লুকিয়েছি সাদাফ আর আমার মা-বাবার ক্ষতি হওয়ার ভয়ে।
~ তোমার মা-বাবা তো মৃত।
~ না আমার মা-বাবা বেচে আছে। তোমার সন্দেহ না হওয়ার জন্য এসব বলেছে ওই শয়তানী।
আসলে সাদাফ আর আমি দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমাদের বিয়েও হয়ে গেছে অনেক আগে।
আমার অবাকতা সীমা ছাড়িয়ে গেল। বললাম,
~ তাহলে সাদাফ আমাকে বিয়ে করল কেন? তোমরা আমাকে ঠকালে কেন?

~ সাদাফ আর তোমার বিয়ে হয়নি। বিয়ের অভিনয় হয়েছে শুধু। আর সবকিছু করা হয়েছে প্ল্যান করে, যাতে তাসবীন ভাইয়া আর তোমাকে আলাদা করা যায় এবং তোমার মনে তাসবীন ভাইয়ার ব্যাপারে খারাপ ধারণা জন্মায়।
পিছন থেকে মহিলাকন্ঠ বলে উঠল,
~ বাকিটা আমি বলি মাইশা?
আমরা সবাই দরজার দিকে তাকালাম। আমি অস্ফুটস্বরে বললাম, মা, আপনি?
~ হাহাহা, আমি তোমার মা নই। আমি বদজ্বীনের সর্দারনী আর শয়তানের একনিষ্ঠ উপাসক। স্টাডি রুমে তুমি যা যা দেখেছো সব আমার।

মা আমার পাশে চেয়ারের উপর বসে পায়ের উপর পা তুলে বসে বলল, তাসবীন আর সাদাফ কেউ ই আমার ছেলে নয়। এরা এক একটা আমার স্বার্থ হাসিল করার অস্ত্র। তাসবীনকে আমি অল্প বয়সে ওর মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে এসেছিলাম। স্বার্থ একটাই ও হচ্ছে জ্বীনরাজ্যের ভবিষ্যত। ২১ বছরে পর্দাপন করলে ও জ্বীনি তলোয়ার আর জ্বীনরাজ্য পাবে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ ছিল, তখন ও জ্বীনরাজ্যের ভার নিতে রাজি হয়নি। এইজন্য আমি খুব সুক্ষ্ম একটা প্ল্যান করি যাতে জ্বীনরাজ্য ও আমার হাতে আসে আর তাসবীনকেও চিরতরে সরিয়ে দিতে পারি।

তাসবীনকে সরাতে হলে প্রয়োজন ছিল একটা মানুষ্যকন্যার যার সাথে প্রণয় হবে। একমাত্র সে ই পারবে তাসবীনকে মারতে। এর জন্য আমি ওকে আর জ্বীনরাজ্যে পাঠাইনি, বিভিন্ন জায়গায় জায়গায় পাঠিয়ে দিতাম। অপেক্ষায় থাকতাম কবে এমন কিছু একটা হবে।
পরে খবর পেলাম তোমাকে ও ভালোবেসে ফেলেছে। এবার আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এল। আমি তোমার পুরো পরিবারকে মেরে ফেললাম যাতে তাসবীনের কাছে তুমি আসো। আর আমি এমন কিছু করি যার জন্য তাসবীনকে তুমি মারতে বাধ্য হও।

ঠিক তাই হল। তাসবীনের সাথে তুমি এই বাড়ীতে এলে, আর আমি তাসবীনের রুপ ধরে একটা বদজ্বীনকে তোমার পিছনে লেলিয়ে দিলাম। তোমাকে বুঝালাম তাসবীন একজন শয়তান।
তারপর প্ল্যানটা ঘুরে গেল। তুমি অন্য কারো আশ্রয়ে চলে গেলে। এইবার ভাবলাম অন্যভাবে খেলাটা খেলি। জ্বীনরাজ্য থেকে সাদাফকে নিয়ে আসলাম তোমাকে আবার এই বাড়ীতে ঢুকানোর জন্য। বেচারা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলনা, শেষে মাইশাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রাজি করালাম। ও তোমাকে এই বাড়ীতে নিয়ে আসার সাথে সাথে তাসবীনকে মানসিকভাবে আমি বিপর্যস্ত করে দিলাম। তোমার চোখে বানিয়ে দিলাম শয়তান।

তাসবীনের রুপ ধরে কে এতকিছু করেছে জানো? দেখতে চাও তাকে? দেখো।
রুমের ভিতর একটা কালো বিড়াল ঢুকল। এই তো সে বিড়ালটা যে আগে আমার পাশে পাশে ঘুরত। তাসবীনের দেওয়া রুমালটা তো ও ই মাড়িয়েছিল।

বিড়ালটা তার রুপ পরিবর্তন করে হুডি পরা একজন ছেলে হয়ে গেল। সব স্পষ্ট মনে পড়ছে আমার। একে তো আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, যে আমাকে ছুয়ে দিলে আমার গাল অবশ হয়ে যেত।
সেদিন রাতে তাহলে ও ই আমার উপর আক্রমণ করেছিল।
~ কি ভাবছো ত্বোহা! ও ই আমার আসল ছেলে।
আমার ছেলেটা আবার তোমার প্রেমে পড়ে যায়। কেন জানি পড়েছিল? ও হ্যা, তুমি ওকে সুস্থ করেছিলে। তোমাকে এতটাই ভালোবাসত, যার ফলে যেই তোমার দিকে কুদৃষ্টি দিতে ও তাকেই মেরে ফেলত।
আমি আজ বুঝতে পারলাম, সেদিন কেন কাকীমা আমাকে কালোজাদুকারিণী বলে তার ভাইকে মারার অভিযোগ তুলেছিল।

আমি কিছু বলতে গেলে শয়তানী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। পুরো গল্পটা শুনো তারপর বলো আমার প্ল্যান কেমন হয়েছে?
আরেকটা কথা তো বলা হয়নি সাদাফকে সেদিন আমার ছেলে সারবান ই মেরেছিল। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম সাদাফ তোমাকে হয়ত সব বলে দিবে।
তাই মাইশাকে নিয়ে এলাম সাদাফকে হুমকির মুখে রাখার জন্য। এর মধ্যে তাসবীনকে জ্বীনরাজ্যে পাঠালাম এই বলে, জ্বীনি তলোয়ারটা পেলে তোমাদের মধ্যে সবকিছুর অবসান হয়ে যাবে। বেচারা আমাকে বিশ্বাস করে তার দায়িত্ব ফাকি দিয়ে অতি মূল্যবান সম্পদ আমার হাতে তুলে দেয়নি। ততদিন যা যা খারাপ ব্যবহার তাসবীন তোমার সাথে করেছে, তাসবীনের রুপ ধরে আমার ছেলে সব করেছে।

তলোয়ার হাতে পাওয়ার পর ভাবলাম খেলাটায় এবার ইতি টেনে দিই। আমার স্বার্থ উদ্ধার এখন তাসবীনকে মরতে হবে নাহলে আমি জ্বীনরাজ্য দখল নিতে পারবনা।
তাই তোমার হাত দিয়ে তাসবীনকে মেরে ফেলেছি।
এখন আমিই গোটা জ্বীনরাজ্যের মালিক।
আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মিথ্যের মায়াজালে পড়ে তাসবীনকে এতদিন ভুল বুঝেছি। এখন কি করব আমি?
হুডি পরা ছেলেটা ইশারায় সবাইকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। শয়তানী মহিলা কুৎসিত হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায়। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর হুডি পরা ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে এসে পাশে বসল।

আমি তখনো পাথরের মত বসে চোখের পানি ফেলছি। ছেলেটা হুডি নামিয়ে আমাকে কয়েকবার মিষ্টি করে ডাকল,
~ ত্বোহা।
আমি শুনেও না শুনার ভান করলাম। এইবার সে রুক্ষস্বরে জোরে ডাকল। আমি ভয়ে চমকে উঠলাম। ও আবার মিষ্টি করে বলল, এতবার ডাকছি শুনতে পাচ্ছোনা!
আমি জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলাম।

ও জোর করে আমার হাতটা টেনে শক্ত করে ধরে বলল,
~ এতদিন ধরে তোমাকে ভালোবেসে তোমাকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছি। আজ দেখ, আমার অপেক্ষা সার্থক হল।
তোমাকে কষ্ট দিয়েছে বলে কত জনকে মেরেছি।
~ আমাকেও মেরে ফেলুন।
~ তোমাকে মারলে বিয়ে করব কাকে? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে বিয়ে করব।
~ আপনার মত শয়তানকে আমি কখনোই বিয়ে করবনা।

সে আমার গাল চেপে ধরে বলল,
~ বিয়ে তো আমাকেই করতে হবে তোমার।
আজকেই করতাম কিন্তু আজ শয়তান আমাদেরকে বর দিবে।
একটু অপেক্ষা করো, তোমাকে জ্বীনরাজ্যের রাণী বানিয়ে দিব।
গাল ছেড়ে ও বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি বিছানা ছেড়ে দরজা খোলার চেষ্টা করলাম। বাহিরে থেকে লক করে দিয়েছে শয়তানটা। দরজা ধাক্কিয়ে চেচাতে লাগলাম,
~ কেউ দরজাটা খুলে দাও।
আমি তাসবীনের কাছে যাব। অনেকক্ষণ ধাক্কানোর পর মেঝেতে বসে কাদতে লাগলাম।
কত বড় ভুল করেছি ওদের কথা বিশ্বাস করে। যার জন্য আজ তাসবীনকে হারাতে হয়েছে। ও কতবার আমার সাথে কথা বলতে এসেছিল কিন্তু আমি তার কথা একবারের জন্য ও শুনতে চাইনি। কষ্ট লাগছে অনেক।

ওই শয়তান টাও আমাকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ওর এই স্বপ্ন আমি কিছুতেই পূরণ হতে দিবনা। তার আগে আমি নিজেকেই শেষ করে দিব।
উঠে রুমের মধ্যে এমনকিছু খুজতে লাগলাম, যেটা দিয়ে নিজেকে শেষ করতে পারব। সাদাফ পিছন থেকে ডাকল,
~ এভাবে হেরে যাবে?
~ আর কিছুই তো করার নেই। বেচে থাকলে সারাজীবন ওই শয়তান গুলোর সাথে থাকতে হবে। তাসবীনও আমার পাশে নেই, নিজের হাতে ওকে খুন করেছি আমি।
~ আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।
আমি আর মাইশা জ্বীনরাজ্যে ফিরে যাচ্ছি। ওখানে আমাদের জ্বীনদাদু আছেন। তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা বলতে পারবেন।

তুমি যাবে আমাদের সাথে?
মাইশা বলল, ওকে কি নিতে পারব আমরা! আমরা তো অদৃশ্য হয়ে যেতে পারব কিন্তু ত্বোহা আপুকে কি করে নিব!
~ সে একটা ব্যবস্থা করব। এখন আগে ওকে এখান থেকে বের করতে হবে।
চলো, ত্বোহা।

সাদাফ অদৃশ্য হয়ে বাহিরে থেকে দরজা খুলে দিল। আমি আর মাইশা বের হতে গিয়ে দেখি সারবান আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
~ আমার চোখ ফাকি দিয়ে ত্বোহাকে নিয়ে পালাবে তোমরা? এতই সহজ।
বাচতে চাইলে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও, নাহলে ২জনকেই মেরে মাটিতে পুতে দিব।
সাদাফ আর মাইশা আমাকে চোখের ইশারা করে অদৃশ্য হয়ে গেল। সারবান আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
~ এখান থেকে পালানোর চেষ্টা ভুলেও করোনা।

বলে দরজার বাহিরে একটা লাল দাগ টেনে দিল। এই দাগের বাহিরে ভুলেও এসোনা।
বলে মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল। কিছু করার নেই আর। এখানে পচেই মরতে হবে। সবকিছুর জন্য আমি দায়ী, না আমি তাসবীনের জীবনে আসতাম, না ওকে এভাবে মরতে হত। আল্লাহ তুমি আমাকে মরণ দাও, তবুও কোনো শয়তানের দাসী বানিওনা।

পর্ব ২১

নিজেকে বন্দি ঘরের অন্ধকারের কীট মনে হচ্ছে। সাদাফের কথায় একটু আশার আলো দেখতে পেলাম, ও বলেছে ওদের জ্বীনহুজুর নাকি দাদু এই ব্যাপারে ওদের কিছু বলতে পারবে।
একটুপর আবার মনখারাপ আমাকে ঘিরে ধরলাম। তাসবীন তো মারা গেছে, যাই হোক ওকে তো আমি কখনো ফিরে পাবনা। আশার আলো দেখে কি হবে!

ভাবতে ভাবতে বাহিরে থেকে খুব অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসল। প্রচন্ড ধোয়া ও রাশি রাশি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কি হচ্ছে বাহিরে? দেখার জন্য দরজার বাহিরে লাল দাগে পা রাখতেই কে যেন সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে ধাক্কা মারল। আরেকটুর জন্য খাটের কোণার সাথে চোখে আঘাত পাইনি। অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে সারবান আমাকে এখান থেকে বের হওয়া থেকে আটকাচ্ছে। এই মা-ছেলে আর কি চায়? সব ই তো পেয়েছে। এত লোভ এদের!

সারবান এসে আমার রুমে ঢুকল। শক্ত করে আমার হাত-পা বেধে পাজকোলা করে রুম থেকে বের করে স্টাডি রুমে নিয়ে আসল। আমি অবাক হয়ে বার বার জিজ্ঞেস করছি, আমাকে এখানে কেন এনেছেন? হাত-পা বেধেছেন কেন?
ছাড়ুন বলছি। সে আমাকে এক প্রশস্ত ধমক দিয়ে বলল,
~ চুপ থাকো। যা হচ্ছে শুধু দেখো।

বলে আমাকে গুপ্তঘরে নিয়ে গেল। সেখানে একটা বইয়ের তাক তার জায়গা থেকে সরানো ছিল, ওখানে একটা টানেল। সেখান থেকে আলোর সরু একটা রেখা বের হয়ে আসছে। সারবান আমাকে নিয়ে টানেলের ভেতর ঢুকে গেল। আমি হাত-পা ছুড়ছি, ও এটা দেখে কি একটা অদৃশ্য শক্তি দিয়ে আমাকে অবশ করে ফেলল।
আশ্চর্য আমি এখন সামান্য আঙ্গুল ও নাড়াতে পারছিনা। গলাটাও ধরে আছে, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা।
সারবান হাটতে হাটতে আমার দিকে তাকিয়ে ব্লল,
~ তোমাকে ভালো কথা বললে কাজ হয়না।
তাই তুমি যেমন তোমার সাথে করতে হবেও তেমন।

তারপর টানেল পার হয়ে আরেকটা বিশাল রুমে ঢুকলাম। এখানে অনেক বিভৎস চেহারা লোক দাঁড়িয়ে আছে গোল হয়ে। মাঝখানে স্টার চিহ্ন আকা, সেখানে একপাশে বসে আছে শয়তানীটা। বসে কিসব বিড়বিড় করছে, লাল-কালো পোশাক পড়ায় সবাইকে কেমন জানি অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
সারবান আমাকে কোল থেকে নামিয়ে এককোনায় বসিয়ে রাখল এবং বলল,
~ এখানে বসে থাকো। আমরা শয়তানের নামে আহুতি দেওয়া শেষ করি।
হেলান দিয়ে বসেই রইলাম। শরীরে একবিন্দুও নড়ার শক্তি নেই। চোখের পলক আর নিশ্বাস ছাড়া আমার সবই প্যারালাইজড। বসে বসে তাদের এসব দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

অদ্ভুতভাবে আবার শব্দ-কোলাহল শুরু করল এবং চারিদিক ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ভুমিকম্পের মত সব কাপতে লাগল। এরমধ্যে কিছু লোক সানজানা, সানজিদা আর খালামনিকে নিয়ে আসল। ওদের সবার হাতমুখ বাধা, সবাই কেমন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এতদিন ওরা কোথায় ছিল! আমাকে তো বলেছিল ওরা কি একটা কারণবশত তাড়াহুড়ো করে রাতের আধারে তাদের নানাবাড়ীতে চলে গিয়েছিল। খুব জরুরী ছিল তাই কাউকে বলে যেতে পারেনা। তার মানে এতদিন এদেরকে এই শয়তানী আটকে রেখেছিল। কিন্তু কেন!

আমি ঠোট নেড়ে ওদের ডাকতে চাইলাম, ওরা যেন আমাকে দেখতেই পারছেনা। একদৃষ্টিতে ধোয়ার কুন্ডলীর দিকে তাকিয়ে রইল। শয়তানী মহিলা ইশারা করতেই খালামনি সোজা হেটে সামনে রাখা বড় পাথরের উপর মাথাটা এলিয়ে দিল হাসিমুখে। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম, কি করতে যাচ্ছে উনারা!

একটা জল্লাদটাইপ লোক এল, যার ঠোট থেকে কান অবধি ছেড়া। মস্ত রামদা দিয়ে এককোপ বসাল খালামনির ঘাড়ে। সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। খালামনির কাটা মাথাটা তখনো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
রক্তে সারামেঝে ভেসে গেল। কিছুটা ছিটা আমার গায়ে এসেও পড়ল। বারবার বলতে চাচ্ছিলাম এই নিরীহ মানুষগুলোকে তোমরা ছেড়ে দাও, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ ই বের হচ্ছেনা।
এইবার সানজানা আর সানজিদা এগিয়ে এল। ওরা বুঝেশুনে মৃত্যুর দিকে কেন এগোচ্ছে! ওরা কি বুঝতে পারছেনা ওদের মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। শয়তানী কি এদেরকে যাদুশক্তি বলে ঘোরের মধ্যে রেখে দিল।

আমার ভিতরটা কেমন ছটপট করতে লাগলাম, পারছিনা চোখের সামনে এদের মৃত্যু দেখতে। ওরা এগিয়ে এসে আগুনের কুন্ডলীতে স্বেচ্ছায় মাথা ঢুকিয়ে দিল। সাথে সাথে পুড়ে যাচ্ছে ওদের মাথা দুটো। মগজ গলে গলে পড়ে যাচ্ছে, ভীষণ বাজেরকম পোড়া গন্ধে রুমটা ছেয়ে গেল। এসব দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে, বমি পাচ্ছে অনেক।

সহ্য করতে পারছিনা আর, কত নৃশংস এরা। ক্ষমতার লোভে এরা কত নিচে নামতে পারে। আল্লাহ আপনি এদের বিচার করুন, এই শয়তানদের পানাহ থেকে আমাকে মুক্ত করুন।
একটু পর অনুভব করলাম কেউ যেন আমার হাতে ছুরি চেপে ধরল। সাথে সাথে জোরে এক টান মারল। ব্যথায় ককিয়ে উঠে চোখ খুললাম। সারবান আমার হাতের কাটা অংশ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত একটা বাটিতে নিচ্ছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, ওই অংশে প্রচন্ড জ্বালা করছে।
সারবান আমাকে ফিসফিস করে বলল,
~ একটু শান্ত থাকো। সব ঠিক করে দেব আমি।

শয়তানের পূজোয় একজন কুমারী মেয়ের রক্ত প্রয়োজন তাই নিলাম।
বলে রক্ত নিয়ে চলে গেল। আমি ব্যথায় চোখ বুজে রইলাম, খুব খারাপ লাগছে। একবারের জন্যও ইচ্ছে করলনা চোখ খুলতে, রক্তহীম করা দৃশ্য এখনো চোখের সামনে ভাসছে।

এসব আর সহ্য করা যাচ্ছেনা। শয়তান জ্বীনগুলো যা শুরু করেছে এরা কাউকে শান্তিতে থাকতে দিবেনা। খুব দ্রুত এদের সমূলে উচ্ছেদ না করলে না জানি আরো কত মানুষের প্রাণ নেবে, ক্ষতি করবে। কিন্তু আমি তুচ্ছ মানুষ ওদের শক্তির সামনে মাথা তুলে পর্যন্ত দাড়াতে পারবনা।
এসব ভাবছি আর সারাঘরে পায়চারি করছি।

হাতের ব্যথাটা সেরে গেছে, সারবান কি জানি কি করল সবটা ঠিক হয়ে গেছে। ও যাওয়ার সময় এটাও বলে গেছে কাল-পরশুর মধ্যে ও আমাকে বিয়ে করবে। প্রস্তুত থাকার জন্য।
আমি যখন তাসবীনের হতে পারিনি আর কখনো কারো হবনা। সারবানের মত শয়তান যা ই করুক আমি ওর কাছে ধরা দিবনা। কিন্তু আমি ওদের সাথে টিকে থাকতে পারবনা।
এখান থেকে পালাতেও পারছিনা, হে রাহমানের রাহিম তুমি আমাকে পথ দেখাও। শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করো।

হঠাৎ আয়নায় কেমন ঠকঠক শব্দ করে উঠল। দেখার জন্য আয়নার সামনে দাড়াতেই সাদাফের প্রতিবিম্ব ভেসে উঠল। অবাক হয়ে বললাম, সাদাফ তুমি! আয়নার মধ্যে কিভাবে এলে?
~ আমরা জ্বীনরা আয়নার মধ্যে চলাচল করতে পারি। ওখানকার কি অবস্থা? সারবান কি তোমার উপর বেশি অত্যাচার করছে?
~ ওরা সানজানা, খালামনিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে সাদাফ। এত জঘন্য কি করে হতে পারে!
~ ওরা ক্বারিন বংশের জ্বীন। ওদের কাছে সব সম্ভব।
তুমি সাবধানে থেকো।

~ আমার নিজেকে নিয়ে আর চিন্তা নেই।
যা হবার তাই হবে। তোমরা সুখে থাকো এটাই দোয়া করি।
~ ত্বোহা, তোমাকে আমাদের জ্বীনরাজ্যে আসতে হবে একবার।
~ কেন?

~ জ্বীনহুজুর তোমার সাথে কথা বলতে চায়, হয়ত তাসবীনের ব্যাপারেই কিছু বলবেন।
~ আমি তো মানুষ, আমি জ্বীনরাজ্যে কি করে যাব? উনি কি আয়নায় আসতে পারবেননা!
~ উনি তোমাকে জ্বীনরাজ্যে আসতে বলেছেন। তোমাকে আসতে হবে এটাই।
~ কি করে যাব? আমার তো রুম থেকে বের হওয়াই দায়। তাছাড়া আমি কিছুই চিনিনা।
~ সব ব্যবস্থা আমি করে দিব।
তুমি শুধু কাল রাত ১২টায় তৈরী থেকো।
~ কাল তো সারবান আমার উপর কড়া নজর রাখবে। কাল-পরশুর মধ্যে আমাকে বিয়ে করার চিন্তা করছে।

~ এটুকু সামাল তোমাকে দিতেই হবে।
আজ আসি। আল্লাহ হাফেজ।
চিন্তায় পড়ে গেলাম। কিভাবে কি করব? আল্লাহ ভরসা, নিজেকে শক্ত রাখি। আল্লাহ ই আমাকে পথ দেখাবেন।

সকাল থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল। শয়তানী মহিলা এসে কিছু বিয়ের ব্যবহারিক জিনিসপত্র দিয়ে গেলেন। বললেন, এসব পড়ে তৈরী হয়ে থাকতে। রাতেই আমাদের বিয়ে হবে শয়তানকে সাক্ষী রেখে। এদেরকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবেনা আমি কি করতে চলেছি।
তাই গম্ভীর হয়ে বিয়ের জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করতে লাগলাম। খ্রিষ্টানদের মত সাজগোজ দিয়েছে, সাদা গাউন,প্যার্ল এর মুকুট। আজব লাগছে।
সারবান এসে একবার আমার রুমটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে গেল। হয়ত ও তেমন কিছু সন্দেহ করছে।
আমাকে চুপচাপ দেখে মনে মনে বেশ খুশি হয়েছে বোঝা ই যাচ্ছে। এই হাসি-খুশি আমি চিরস্থায়ী হতে দিবনা।

নিজের প্ল্যানটা গুছিয়ে নিয়েছি এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
শয়তানী মহিলা এসে তৈরী হওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে।
নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য এত উৎসাহ আর খুশি হতে দেখে অবাক হচ্ছি।
এর পিছনেও এই মহিলার কোনো স্বার্থ নিশ্চয়ই আছে। স্বার্থ ছাড়া উনি এক পা ও চলেনা সেটা বুঝতে বাকি নেই আমার।

টুকরো কথা কানে ভেসে আসতে সময় লাগলনা।
ওদের প্ল্যান আমরা বিয়ে করলে সারবান আর আমার সন্তানের উপর শয়তানের আলাদা একটা সুদৃষ্টি থাকবে। সে হবে অন্যতম শক্তিধর শয়তান। ওকে দিয়ে এরা পুরো দুনিয়ায় কতৃর্ত্ব চালাবে।
শয়তান বর হিসেবে এটাই দিয়েছে সারবান আর আমার সন্তান পৃথিবীতে আসলে শয়তান তাকে তার সমকক্ষ শক্তি আর ক্ষমিতা প্রদান করবেন।
এই জন্য ই বিয়েটা দেওয়ার এত তাড়া আর মহিলার এত উৎসাহ। ওদের প্ল্যানে যদি আমি কেরাসিন না ঢালি তবে দেখা যাবে।

পর্ব ২২

সাদা গাউন পরে তৈরী হয়ে নিলাম। ২-১ জন জ্বীনি মহিলা পাঠানো হয়েছে এসবের তদারকি করার জন্য। এরা আমাকে নজরে নজরে রাখছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারবি ডলের মত দেখাচ্ছে আমাকে।

তাসবীনের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। কান্না আটকে আছি, কিন্তু চোখের পানি তো বাধা মানেনা। দু-এক ফোটা অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে। চোখ মুছে ঘড়ির দিকে তাকালাম। ১২টা বাজার আর ২৫মিনিট বাকি। শয়তানী মহিলা এসে আমাকে সাথে করে সেই গুপ্তঘরে নিয়ে গেলেন।
আঙ্গুলের কর ধরে সময় গুনছি। যেভাবে হোক এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। নিয়ে সারবানের পাশে বসানো হল আমাকে। শুরু হল সেই একি আওয়াজ, ঘরভর্তি ধোয়া। এমন একটা ভাব করলাম আমার এসবে অস্বস্তি হচ্ছে।

সারবান বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। ফিসফিস করে বলল, কি হয়েছে তোমার?
~ আমার খুব খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে বমি আসবে।
~ সহ্য করে বসো কিছুক্ষণ। একটু পরে চার্চ এসে আমাদের বিয়ে পড়াবেন।
~ বসে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। বলে বমি করার ভান করলাম।
শয়তানী চোখ পাকিয়ে বলল, এটা পবিত্র জায়গা। শয়তানের আরাধনার জায়গা। এটাকে নোংরা করোনা।
সারবান তুই ওকে ওয়াশরুমে নিয়ে যা। ফ্রেশ করিয়ে তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে চার্চ চলে আসবেন। সারবান মাথা নেড়ে আমাকে উঠে চলে এল। আমি টলমল পায়ে হাটতে হাটতে হোচট খেয়ে বুঝাচ্ছি আমার শরীর অনেক খারাপ। ও আমাকে নিয়ে রুমে ঢুকল। আমি ওয়াশরুমে ঢুকার সাথে সাথে ও আসতে চাইল। আমি বললাম,
~ একটু ওয়েট করুন। আমি ফ্রেশ হয়ে বের হচ্ছি।
~ দেরী করোনা।

দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আস্তে আস্তে একটা গোলাকার চক্রে সাদাফের প্রতিবম্ব ভেসে উঠল। দেখে একটু স্বস্তি পেলাম।
~ এসেছো তুমি?
~ হ্যা। এখন আমি যা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনো। যা করার তাড়াতাড়ি ই করতে হবে। জ্বীনরাজ্যের দরজা একমিনিটের জন্যই খোলা হবে। এ সময়ের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারলে আর জ্বীনরাজ্যে ঢোকা সম্ভব না।

তুমি আয়না জগতে চলে আসার পর অনেকরকম পরীক্ষার মুখোমুখি হবে, সেগুলো যদি বুদ্ধি দিয়ে সঠিকভাবে অতিক্রম করতে পারো তবেই তুমি জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বারের কাছে পৌছাতে পারবে।
সময় নষ্ট করবেনা কোনোভাবেই। আমি তোমাকে সঠিক জায়গায় খুজে নিব। এখন তাড়াতাড়ি আয়নায় আমার হাতের উপর হাত রাখো। বিসমিল্লাহ বলে চোখ বন্ধ করো।
বাহিরে থেকে সারবানের গলা শুনতে পেলাম।
~ ত্বোহা তোমার হয়েছে?

চার্চ চলে এসেছেন। তাড়াতাড়ি বের হও নাহলে আমি দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকব।
আমি পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে বললাম, আসছি একটু অপেক্ষা করুন। সাদাফ হাতটা বাড়িয়ে দিল আমি কিছু না ভেবেই তা ধরার চেষ্টা করলাম। শরীরটা প্রচন্ড ঝাকুনি দিয়ে উঠল।
একটু পর নিজেকে অন্য এক জগতে আবিষ্কার করলাম। চারিদিকে নীল রঙ্গের ছোয়া, সরু টানেল, আবছা আবছা আলো, দেয়ালে দেয়ালে টুকরো টুকরো আয়না লাগানো।
আমি কি এই সরু টানেল ধরে হাটতে থাকব?
সাদাফ তো বিস্তারিত কিছুই বললনা। ও কোথায়!

নিরুপায় হয়ে টানেলের পথ ধরে সোজা হাটতে লাগলাম। পথে একটা মোটামুটি বড় গভীর গর্ত পড়ল। সেটা টপকে কিছুতেই ও পাড়ে যাওয়া যাবেনা। গর্তে যদি পা রাখি তাহলে নিশ্চিত গভীরে তলিয়ে যাব। লাফ দিয়েও এতবড় গর্ত পার হওয়া যাবেনা।

তাহলে কি করব এখন? এদিকে একমূহুর্ত সময় ও নষ্ট করা যাবেনা। তাহলে পৌছাতে দেরী হয়ে যাবে। গর্তে নামা ছাড়া কোনো উপায় দেখছিনা। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটুকরো ছোট্ট মাটির শক্ত টুকরো নিলাম। এটা ছুড়ে গর্তের গভীরতা নির্ণয় করা যাবে। ছুড়ার সাথে সাথে এটি অতলে তলিয়ে গেল। বেশ গভীর গর্ত বুঝতে বাকি রইলনা। এখন কি করে আমি গর্তটা পার হব! দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।

আল্লাহর নাম নিয়ে আরেকটি মাটির টুকরো ছুড়লাম এই ভেবে গর্তের ভিতরে নেমে আবার উঠা যাবে কিনা! কিন্তু অবাক ব্যাপার টুকরোটা গর্তের মুখে পড়ে রইল।
অবাকতার ঘোর কাটিয়ে তাড়াতাড়ি গর্তের মুখে পা রাখলাম। মনে হচ্ছে আমি বিছিয়ে রাখা কোনো স্বচ্ছ টাইলসের উপর হাটছি। দেখে বুঝার উপায় নেই এখানে সত্যি কোনো স্বচ্ছ কিছু বিছানো আছে।
নিরাপদে গর্তটা পেরিয়ে হাটতে লাগলাম। মস্তিষ্কে এখনো বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছে। হাটতে হাটতে টানেলের শেষ সীমানায় এসে পড়লাম।

জানিনা আর কতটা যেতে হবে। আমার হাতেও আর কত সময় আছে সেটাও পরিষ্কার না। টানেল থেকে বের হতেই অনেক বড় মাঠে চলে এলাম। চারিদিকে ফলের গাছ আর মাঠ ভর্তি কাচের টুকরো পড়ে আছে। শেষ মাথায় ঝরণা হতে সৃষ্ট বিরাট জলাশয়।
ঝুলন্ত পাকা পাকা আঙ্গুর আর আতাফল দেখে খেতে ইচ্ছে হল, স্বচ্ছ পানি দেখে পিপাসায় কাতর হয়ে গেলাম। কিন্তু নিজেকে সংযত রাখলাম। কে জানে কোথায় বিপদ ওত পেতে আছে। কিন্তু এই কাচের টুকরা গুলো পার হব কি করে? পা দিলেই তো পায়ে ঢুকে যাবে। এখানেও বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু একটা করতে হবে।

কিন্তু কি করা যায়? আশেপাশে তো এমন কিছু দেখছিনা যেটার সাহায্যে নির্বিঘ্নে পার হওয়া যাবে।
শেষমেষ ভাবলাম গাছের ফল দিয়ে কিছু হয় কিনা দেখি? মস্তিষ্ক কেন জানি বার বার বলছে এইগুলোর দ্বারা কিছু একটা হতে পারে। ভয়ে ভয়ে দু-একটা ফল ছিড়লাম। ছুড়ে দিয়ে সবগুলো দুটুকরো করলাম। এত শক্ত ছিল যে হাত দিয়ে ভাগ করতে পারছিলামনা। ভয়ে তো মুখেই নিলামনা।
ফলগুলোতে অদ্ভুত গন্ধ ছিল।
তারপর টুকরোগুলো কাচভর্তি মাটির উপর রাখলাম। প্রচন্ড শব্দে কাচগুলো ফেটে গলে গেল। দেখে মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। ফলগুলো যদি আমি খেতাম না জানি কি অঘটন ঘটে যেত।

গলে যাওয়া কাচগুলো গলে সুন্দর প্রলেপ হয়ে গেছে মাটির উপর। আরো কিছু ফল টুকরো করে নিয়ে নিলাম। আস্তে আস্তে ওইগুলো ব্যবহার করে ধাপে ধাপে জলাশয়ের নিকট পৌছে গেলাম।
দূর থেকে এতক্ষণ খেয়াল করিনি পানিতে বিশাল বিশাল ভয়ংকর কাটাদাত ওয়ালা মাছ ঘুরাঘুরি করছে। আমার কাছে এগুলো সাধারণ মাছ মনে হলনা। হতে পারে এইগুলো পাহারাদার জ্বীন, যারা এমন ভয়ংকর ছদ্মবেশ নিয়ে আছে।
যাতে কোনো আগন্তুক জলাশয় পার হয়ে জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বারে না যেতে পারে।
এত কঠিন নিরাপত্তা দিয়ে জ্বীনরাজ্যে ঘেরা তাও কি করে সারবানদের মত শয়তান রাজ্য দখলের চিন্তা করতে পারে।
এদেরকেই তো এই জলাশয়ে নামিয়ে দেওয়া উচিত।

কামড় খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে ক্ষমতার লোভ মন থেকে দূর করত।
সারবান চুপচাপ বসে রইল। মহিলাটা ওর সামনে কয়েকবার পায়চারী করল, চোখ-মুখ দিয়ে তার যেন আগুনের ফুলকা ছুটছে। কপালে রীতিমত বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চিন্তায় মুখ শুকিয়ে আছে। পায়চারি থামিয়ে শুণ্যে পা ছড়িয়ে বসে বলল, আমার ছেলে হয়ে তুই কি করে এত বোকামী করিস?
তুই জানিস মেয়েটার উপর আমাদের এতদিনের সাধনার ফল নির্ভর করছে। ওর গর্ভস্থ সন্তান আমাদের পুরো পৃথিবী পরিচালনার অস্ত্র হবে।
সব নষ্ট হয়ে গেল। ওকে ছাড়া কোনোকিছুই সম্ভব না।

~ মা তুমি চিন্তা করোনা। ও যেখানে থাকুক আমি ঠিক ওকে খুজে বের করে আনব।
~ ততদিনে যদি ও কুমারী না থাকে?
সবকিছু ভেস্তে যাবে। একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নে, শয়তান ওই মেয়েকেই এ বর দিয়েছে। ও ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে দ্বারা কিছু হবেনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে খুজে বের করার চেষ্টা কর।
যদি না পারিস তবে আমি সব ছারখার করে দিতে দুইবার ভাববনা।

~ মা তুমি শান্ত হও। আমাকে ভাবতে দাও ও কোথায় যেতে পারে? আর কেন ই বা যেতে পারে! তাসবীন তো বেচে নেই, ওর তাসবীনের আশায় তো কোথাও পালাতে পারেনা।
~ শোন, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে।
ভুলে যাসনা, তাসবীন একজন শক্তিশালী আর জ্বীনবংশের ক্ষমতাধর জ্বীন। আর এসব জ্বীন এত সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। এরা কি করতে পারে, কি হতে পারে তা আমাদের মত ক্বারিন জ্বীনদের চিন্তার বাহিরে।

কোনোকিছুকেই তুচ্ছ করে নেওয়ার সুযোগ নেই।
~ তাহলে তুমি বলছো তাসবীন ফিরে আসতে পারে?
~ সেটার কোনো সম্ভাবনা দেখছিনা। আমি শুধু ভাবছি ত্বোহা কি করতে চায়? এভাবে উধাও হওয়ার কারণ কি! কে তাকে এসবে সাহায্য করছে?

~ সাদাফ-মাইশা করতে পারে। সেদিন ও ওরা ত্বোহাকে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছে।
~ সব যখন বুঝে গেছিস তো বসে আছিস কেন?
তাড়াতাড়ি জ্বীনরাজ্যে রওনা দে, আর ঐ মেয়েকে টেনে হিচড়ে এখানে নিয়ে আয়। ওকে আমি জীবিত আর কুমারী অবস্থায় ই চাই।
~ ঠিক আছে মা৷ চিন্তা করোনাম
আমি ওকে তোমার সামনে ঠিক হাজির করব।

পর্ব ২৩

আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই স্বচ্ছ জলাশয় কি করে পার হব? সাতরে পার হওয়া অসম্ভব। মাছগুলো খুব হিংস্র, নামলেই ছিড়ে খেয়ে নিবে।
তবে কি আমি পারবনা পার হতে? আল্লাহ তুমি আমার সহায় হও। কয়েকবার আয়াতুল কুরসী পড়ে পানিতে নেমে গেলাম। যা হবার হোক, সাতরেই পার হব। সাতার কাটতে শুরু করলাম। মাছগুলো কাছে এসে আমাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করল, কিন্তু কিসের সংস্পর্শে দূরে ছিটকে পড়ল। এদিকে আমি সাতার কাটতে পারছিনা, পায়ে গাউন জড়িয়ে সাতার কাটতে অসুবিধা হচ্ছে। কয়েকদফা ডুবে ডুবে পানি খেয়ে ফেললাম। এভাবে তীরে পৌছানো সম্ভব না কোনো ভাবেই। সাতার কেটে আরেকটু এগোতেই দেখি একটা ভেলা ভাসছে মাঝখানে। কোনোরকম সাতার কেটে ভেলায় উঠে পড়লাম। উঠে অনেকক্ষণ হাফাতে লাগলাম। এটা পানির টানে ভেসে ভেসে তীরে চলে এল। নেমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।

এত সহজে লক্ষ্যে পৌছাতে পারব কল্পনা করিনি। যা হোক, সময় খুব কম হাতে। এপারটা জঙ্গলে ঘেরা। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা সরু রাস্তা। আল্লাহর নাম নিয়ে সরু পথ ধরে হাটতে লাগলাম। দুপাশের ঘন ঝোপের ভেতর থেকে বিভিন্ন ভয়ংকর আর্তনাদ ভেসে আসছে। থমকে দাড়াচ্ছি বার বার, বুকের ভেতরটা ভয়ে ঢিপ ঢিপ করছে। পিছন থেকে কেউ অনেকবার আমার নাম ধরে ডাকছে। মনে হল দাদীমার গলা। ভাবলাম একবার পিছন ফিরে দেখব কিন্তু মস্তিষ্ক বাধা দিচ্ছে। এটা কোনো ফাদ, পিছনে তাকালেই কোনো বিপদ হবে। পিছন তাকানোর সিদ্ধান্ত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে হাটতে লাগলাম। এইবার টের পাচ্ছি কেউ আমার পিছু পিছু আসছে।

এইবার হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। পথটা বাক নিল, সেই বাকেই কিছুটা হেটে দেখি বিশাল আকৃতির দরজা। উপরে আরবীতে লেখা, জ্বীনি। তার নিচে ছোট্ট করে লিখাঃ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ আগুন হতে জ্বীনদের সৃষ্টি করেছেন। তাদের ক্ষমতা দিয়েছেন অদৃশ্য হওয়ার।
এটাই তাহলে জ্বীনরাজ্যের প্রবেশদ্বার। দরজাটা কি এখনো খোলেনি নাকি খুলে এতক্ষণে বন্ধ করে ফেলেছে! পিছনে হিসহিস শব্দ শুনে পিছনে তাকালাম। বিশাল ভয়ংকর সাপ আমার দিকে তেড়ে আসছে। হাবভাবে বুঝা যাচ্ছে, সে আমাকে গিলে খেতে চায়। আল্লাহ এখন কি হবে? দরজাটা এখনো খুলছেনা কেন?
ভাবতে ভাবতেই প্রচন্ড শব্দে দরজাটা খুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ভিতর থেকে আলোর ঝলকানি বের হয়ে আসছে। চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছেনা। এদিকে সাপটাও আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বিসমিল্লাহ বলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। সাপটা আরো দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। কিন্তু দরজার কাছে এসে আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারছেনা। হিসহিস শব্দে নিজের ক্রোধ প্রকাশ করছে। দরজাটা আবারো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল।

এবার এদিক সেদিক তাকিয়ে জ্বীনরাজ্যটা দেখতে লাগলাম। অনেকটা মানুষের পৃথিবীর মতই। এদিক সেদিক লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চারিদিকে ফুল-ফলের গাছ, হালকা বাতাস কিছুটা দূরে দূরে ছোট ছোট ছাউনিওয়ালা ঘর-বাড়ি, প্রশস্ত রাস্তার মোড়ে মোড়ে আরবী সাইন।
আরেকটু এগোবো এমনসময় কে জানি আমার হাত টেনে গাছের আড়ালে নিয়ে এল। আমি আতঙ্কিত হয়ে বললাম,
~ কে? কে?

সাদাফ দৃশ্যমান হয়ে বলল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছিলে?
~ অকারণে হাটছি। তোমাকে যদি খুজে পাই এই আশায়।
~ আরেকটু হলে বিপদে পড়তে। তোমার কাপড়-চোপড়, সাজগোজ দেখে ওরা বুঝে যেত তুমি এই জ্বীনরাজ্যের কেউ নও। সাথে সাথে তোমাকে হত্যা করত।
~ তুমি তো বিস্তারিত কিছুই জানাওনি, তাই ভুলবশত করে ফেলছিলাম।
~ আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া। তুমি নিরাপদে সব ধাপ পেরিয়ে এখানে আসতে পেরেছো। আমি তো দুশ্চিন্তায় ছিলাম।

~ এমন সব ভয়ানক পরিস্থিতি ছিল যে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
~ এসব হচ্ছে বুদ্ধির খেলা। যে বুঝেশুনে পা ফেলবে কেবল সে ই নির্বিঘ্নে পৌছাতে পারবে। যাই হোক, এখন তোমাকে কৌশলে আমার ছাউনিতে নিয়ে যেতে হবে। তারপর ওখান থেকে জ্বীনহুজুরের কাছে যাব। এখন চোখ বুজে আমার হাত স্পর্শ করো। তোমাকে এখানে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অতএব, অদৃশ্য হয়েই যেতে হবে।
আমি চুপচাপ সাদাফের কথামত কাজ করলাম। চোখ খুলে দেখি একটি বিস্তীর্ণ সুন্দর বাড়ীর ভিতর আমি অবস্থান করছি। মাইশা আমাকে দেখে এসে জড়িয়ে ধরল,
~ কেমন আছো বুবু?

~ আলহামদুলিল্লাহ ভাল। তোমরা কেমন আছো?
কুশল বিনিময় করতেই চোখ পড়ল এক বৃদ্ধ দম্পতির উপর। উনারা হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি সালাম দিলাম, উনারা উত্তর নিতেই মাইশা বলল,
~ আম্মি, আব্বু এই ই ত্বোহা বুবু। যার কথা তোমাদের বলেছিলাম। ত্বোহা বুবু এরা আমার আম্মি-আব্বু।

এদেরকে বন্ধি করেই শয়তান গুলো আমাকে কাজে লাগিয়েছে। উনারা বললেন,
~ বড্ড আশা নিয়ে এই ঝুকিটা নিয়েছো। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোমার খায়েশ পূরণ করেন। মাইশা মা, তুই ওকে ঘরে নিয়ে যা কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করে দে আর বিশ্রাম এর ব্যবস্থা করে দে।
~ জ্বী আম্মি। সাদাফ তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো?
~ আমি জ্বীনহুজুরকে জানিয়ে আসি ত্বোহা এখানে এসেছে। তুমি ওর জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করে দাও। এভাবে ও জ্বীনরাজ্যে চলাফেরা করতে পারবেনা।
আমি মাইশার পিছু পিছু অন্য ঘরে গেলাম। ভেজা জামা ছেড়ে ঢিলেঢালা লম্বা গাউন পরে নিলাম, আর মাথায় হিজাব জড়িয়ে নিলাম। কিছু খেয়ে রেস্ট নেওয়ার জন্য একটু শুয়ে পড়লাম। মনটা কেমন জানি ভার হয়ে আছে। আমি কেন এসব করছি তার সঠিক জানিনা? এসব করে কি আমার তাসবীন ফিরে আসবে?

সাদাফ খোলসা করে আমাকে কিছু বলছেনা। সত্যি আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে করতে। জানিনা জ্বীনহুজুর আমাকে কি বলবেন? আদৌ তাতে আমার মন শান্ত হবে কিনা! ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো বুজে এল।
মাইশার ডাকে উঠে পড়লাম। জ্বীনহুজুর নাকি আমাকে তলব করেছেন। চোখে-মুখে পানির ছিটে দিয়ে মাইশা আর আমি বেরিয়ে পড়লাম।
সাদাফ নাকি জ্বীনহুজুরের কাছেই আছে। কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে, উনি আমাকে দেখে কি বলবেন না বলবেন এই নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। কিছুটা হেটে একটা বড় আস্তানার সামনে এসে দাড়ালাম। মাইশা আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে ঢুকে গেল।
আমি দুশ্চিন্তা নিয়ে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আস্তানার আশপাশটা নির্জন, জনলোকের চিহ্ন নেই। খানিকবাদে মাইশা বের হয়ে এসে বলল,
~ ত্বোহা বুবু চল, জ্বীনদাদু তোমাকে ডাকছে।

অস্বস্তি নিয়ে মাইশাকে অনুসরণ করে আস্তানায় ঢুকলাম। ভিতরে গিয়ে দেখি নূরানী চেহারার এক বৃদ্ধ মনোযোগ দিয়ে কুরআন পড়ছেন। তার শরীর থেকে যেন নূর ঠিকরে পড়ছে। একবার চারিপাশটা দেখে নিলাম। সাদামাটা ঘর, নিচে খেজুর পাতার পাটি বিছানো, এক কোণায় মশকভর্তি পানি-গ্লাস, একটা বড় অংশ জুড়ে ভীষণ সুন্দর বড় একখানা আয়না।
সাদাফ বৃদ্ধের পাশে বসে তসবীহ আওড়াচ্ছে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বৃদ্ধ মুখ তুলে আমাকে একনজর দেখে নিলেন। কুরআন পড়া বন্ধ করে চুমু খেয়ে সাদাফের হাতে দিয়ে আমাকে সালাম দিলেন।

আমি লজ্জা পেয়ে সালামের উত্তর দিলাম। ইশারায় কাছে এসে বসতে বললেন। চুপচাপ এসে বসলাম। জিজ্ঞেস করল,
~ তুমিই ত্বোহা? তাসবীনের মহব্বত!
আমি মাথা নাড়লাম। উনি গম্ভীর হয়ে বললেন,
~ তাসবীনের খুনীও বটে!

আমি চমকে মুখ তুলে চাইলাম। কথা শুনে খুব খারাপ লাগছে। উনি আমার অবস্থা বুঝে প্রসঙ্গ পাল্টালেন।
~ তোমাকে আমি একটা কারণেই এখানে নিয়ে এসেছি। আমি চাইলে তোমার সাথে আয়নায় ই কথা বলতে পারতাম, কিন্তু সেটা কারো জন্যই নিরাপদ ছিলনা।
তাই এত কাঠখড় পুড়িয়ে তোমাকে এখানে আনা।
~ কি কারণ?
~ তোমার নিশ্চয়ই জানতে বাকি নেই শয়তানীগুলোর কোনো কোনো চালে তুমি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছো।

~ জ্বী, জানতে পেরেছি।
তারা প্ল্যান করছে আমার আর সারবানের বিয়ে দিতে। আর আমাদের সন্তানকে অস্ত্র বানিয়ে পুরো দুনিয়ায় রাজত্ব করা।
~ এখন ওদের শেষ করতে তোমাকে প্রয়োজন।
আমরা চাই তাসবীনের সাথে যা হয়েছে তা আর কারো সাথে পুনরায় না হয়। এইজন্য তোমার সাহায্য প্রয়োজন।
~ আমি এই ব্যাপারে যে কোনো সাহায্য করতে প্রস্তুত।
~ মাশা আল্লাহ। খুব ভালো।

কিন্তু এই কাজ তুমি একা করতে পারবেনা। এর জন্য তোমার একজন উপযুক্ত সঙ্গী প্রয়োজন।
~ কে হবে এই কাজে আমার সহায়ক?
~ আছে। সে একজন জ্বীন, আমার হেফাজতে থেকে সকল কৌশল রপ্ত করেছে। আশা করছি সে তোমাকে পূর্ণ সহযোগীতা করবে।
আরাফ, আরাফ। এদিকে আয় তো।
কয়েকবার ডাকতেই অন্য ঘর থেকে কেউ একজন এই ঘরে প্রবেশ করল। আমাকে জ্বীনহুজুর বললেন,
~ এই হচ্ছে আমার নাতী আরাফ।

সে ই তোমাকে পূর্ণ সহযোগীতা করবে।
আমি ছেলেটির দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। আমি কি স্বপ্ন দেখছি! তাসবীন আমার সামনে দাড়িয়ে আছে।
অস্ফুটস্বরে বলে ফেললাম, তাসবীন।
মাইশা আমাকে বলল, উনি তাসবীন নন, উনি আরাফ।
~ চোখের সামনে তাসবীনকে দেখে তুমি বলছো উনি তাসবীন নন। আমি কি তাসবীনকে চিনিনা!
~ দেখতে একই হলে কি মানুষ একই হয়।

উনি তাসবীনের মত দেখতে তবে তাসবীন নন।
আমি হতাশ হয়ে একপলকে তাকিয়ে রইলাম। হুবহু তাসবীনের মত দেখতে ছেলেটি। তাসবীন ভেবে যতটা উৎফুল্ল হয়েছিলাম নিমিষে ততটাই চেহারা মলিন হয়ে গেল। উনি আমাকে সালাম দিলেন।
আমি সালামের উত্তর নিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। একরাশ হতাশা কাজ করছে। আর কোনো কথা ই বললামনা তার সাথে।

চুপচাপ ফিরে এলাম মাইশা আর সাদাফের সাথে। দরকার পড়লে আমাকে আবার তলব করা হবে। চোখের সামনে বার বার ছেলেটির চেহারা ভেসে উঠছে। এতটা মিল কারো থাকতে পারে! অবশ্য উনারা ভুল কিছু বললেননি, তাসবীন তো মারা ই গেছে। সে কি আর ফিরে আসতে পারে?
একই চেহারা দেখে আমি সব ভুলে তাসবীন ভেবে ভুল করেছি। চিরন্তন সত্য মেনে নিতে হবে, তাসবীন আর কখনো আমার কাছে ফিরবেনা।
এতভাবে বুঝ দেওয়ার পর ও মনকে মানাতে সক্ষম হলামনা ও অন্য কেউ। নিজের মনটাকেই শান্ত করতে পারছিনা। ছেলেটার মুখ থেকেই যদি কড়াভাবে শুনতাম তবে হয়ত মনটা কে দমাতে পারতাম।

ছেলেটির সাথে একবার হলেও এই ব্যাপারে কথা বলব। অন্তত নিজের মনটাকে তো বুঝ মানাতে পারব আমি যা ভাবছি তা ভুল।
এপাশ ওপাশ করার পর ও ঘুম এলনা। সাহস করে বাহিরে বেরিয়ে এলাম। একবারো ভাবছিনা এই সময় বের হলে বিপদ হতে পারে, মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ছেলেটার মুখ থেকে শুনতে চাই সে অন্যকেউ।

চুপিসারে আস্তানার সামনে এসে দাড়ালাম। মধ্যরাতে চারিদিক নিস্তব্ধ, আস্তানার দোর ও বন্ধ। একবার ভাবলাম করাঘাত করব কিন্তু জ্বীনহুজুর এতে রেগে যাবে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলাম। দেখি বিপরীত দিকে থেকে ছেলেটা আসছে।
তার চালচলন-ব্যবহার সব ই তাসবীনের মত।

আমি ছুটে গিয়ে তার সামনে দাড়ালাম।
উনি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি? এত রাতে এখানে!
আমি ছলছল করা চোখে উনার হাত জড়িয়ে বললাম,
~ আপনি কে?
আমার তাসবীন না!

উনি একঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
~ কি যা-তা বলছেন? কে তাসবীন?
আপনাকে এতবার করে বলা হল আমি আরাফ। জ্বীনহুজুরের নাতীম
তাও বার বার এক প্রশ্ন করে কেন আমাকে বিব্রত করছেন।

ভালো করে শুনুন, আমি আরাফ তাসবীন নই। আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। এইবার চলে যান, এতরাতে বাহিরে থাকা আপনার জন্য মোটেও নিরাপদ নয়।
বলে উনি পাশ কাটিয়ে আস্তানায় ঢুকে গেলেন।
আমি একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফিরে চলে এলাম।

পর্ব ২৪

মন থেকে তাসবীনের চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলাম। মেনে নিচ্ছিলাম ছেলেটি তাসবীন নয়, আরাফ। সবকিছু সহজ ভাবে নেওয়ার চেষ্টা করছি। যে চলে গেছে সে আর ফেরার নয়। তাসবীন ও আমার কাছে আর কখনো ফিরবেনা।

এখন আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য শয়তানগুলোকে শেষ করা। না পারলে হয়ত ওদের হাতেই আমার মৃত্যু হবে।
আমি জীবন থেকে আর কিছুই আশা করিনা, যা ছিল সব ই হারিয়েছি। নতুন করে আর কিছুই চাইনা।
বিকালে আসর নামায শেষ করার পর মাইসা এসে ডাকল,
~ ত্বোহা বুবু, তোমার নামায শেষ?
~ হ্যা, কিছু বলবে?

~ জ্বীনহুজুর তোমাকে তলব করেছেন। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে চল।
মাইশার কথা শুনে হিজাব জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাদাফ-মাইশা একে অপরের হাত ধরে সামনে সামনে হাটছে। সাদাফের আস্তে আস্তে বলা কথা শুনে মাঝে মাঝে হাসতে হাসতে গায়ের উপর ঢলে পড়ছে মাইশা, সাদাফের কাধে মুখ লুকাচ্ছে, শক্ত করে হাত জড়িয়ে ধরে সাদাফের কাধের উপর মাইশা তার মাথাটা এলিয়ে দিল। দুজনকে মাশা আল্লাহ খুব সুন্দর মানিয়েছে। দেখতেও খুব ভালোলাগছে ওদের এত মিষ্টি খুনসুটিগুলো।

নিজের ভেতরে কেমন খারাপ লাগা ফিল হচ্ছে। আজ যদি সবকিছু ঠিক থাকত আল্লাহর চাহে আমার আর তাসবীনের বিয়ে হত। সাদাফ-মাইশার মত একটা ছোট্ট সংসার হত, সেখানেও এমন দুষ্ট-মিষ্টি খুনসুটি হত। নিজের করা ভুলের জন্য সব হারিয়েছি, সারাজীবন এটার মাশুল দিতে হবে আমাকে। স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে গেল।

ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এসব ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে জমে থাকা পানি কখন যে নাকের ডগায় গড়িয়ে পড়ল টের পেলামনা। তাড়াতাড়ি মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হলাম।
পথে বেশ কয়েকজন জ্বীন দেখলাম। মাশা আল্লাহ সবারই কম-বেশি নূরানী চেহারা। কারো হাল্কা খোচা দাড়ি, কারোবা স্বল্প ছাড়া দাড়ি। সাদা জোম্বায় দেখতে অনেক পবিত্র লাগছে। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাইশা দুষ্টুমি করে বলল, ত্বোহা বুবু, কাউকে পছন্দ হয় নাকি?
~ উহু, কেউ ই তাসবীনের মত নয়।

জ্বীনহুজুরের আস্তানায় ঢুকে তাকে সালাম দিলাম। উনি সালামের উত্তর নিয়ে বসতে বলে মোনাজাত ধরলেন। আমি চারিপাশটা একবার দেখে নিলাম। আরাফকে কোথাও দেখলামনা, হয়ত ও এখানে অনুপস্থিত। ও যত আমার চোখের আড়ালে থাকবে, ততই ভাল।
জ্বীনহুজুর মোনাজাত শেষে আমাদের সামনে এসে বসলাম। গোটাকয়েক খোরমা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
~ নাও খাও।

খেজুরগুলো দেখতে অপেক্ষাকৃত সাধারণ খেজুর থেকে বড়, গাঢ় কালো রঙ্গের। মাইশা আমার হাতে দিয়ে বলল,
~ খাও বুবু। একটা মুখে দিতেই বুঝলাম এই খেজুরের স্বাদ তুলনাহীন। এমন খেজুর আমি জীবনেও খাইনি।
জ্বীনহুজুর গলা ঝেড়ে নিয়ে বললেন,
~ ত্বোহা, তোমার জ্বীনরাজ্য হতে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। তোমার খুব শীঘ্রই এই রাজ্য ত্যাগ করা উচিত।

খাওয়া বন্ধ করে বললাম,
~ কখন ফিরতে হবে?
আবার কি সেই প্রবেশদ্বার দিয়েই যেতে হবে?
~ সন্ধ্যের আগেই। শুনো, এই জ্বীনরাজ্যে প্রবেশ করা যতটা কঠিন, ফিরে যাওয়া ততটাই সোজা।
তুমি প্রস্তুতি নাও, এখান থেকে ফিরে তোমাকে শয়তানদের মুখোমুখি হতে হবে। লড়াই করতে হবে বুদ্ধি দিয়ে।
আশা করছি, এই জ্বীনরাজ্যের সম্পদ জ্বীনি তলোয়ার তুমি সহীহ হেফাজতে ফিরিয়ে দিতে পারবে ইনশা আল্লাহ।

~ আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ। আপনি শুধু দোয়া করবেন।
~ অবশ্যই। ফটকের বাহিরে আরাফ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ও তোমাকে এখান থেকে তোমার জগতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তোমার সহায়ক সঙ্গী হিসেবে থাকবে।
শয়তান দের শেষ করে তবে থেমো।
জ্বীনহুজুরের পায়ে ধরে সালাম করে বেরিয়ে আসলাম। সাদাফ-মাইশা আমাকে জ্বীনরাজ্যের প্রধান ফটক অবধি এগিয়ে দিল। যাওয়ার সময় মাইশা জড়িয়ে ধরে বলল,
~ নিজের খেয়াল রেখো এবং বিজয়ী হও দোয়া করি।

সাদাফ আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
~ জানিনা আর কখনো তোমার সাথে দেখা হবে কিনা। সবসময় দোয়া করি ভালো থাকো। আর আমি যা করেছি তার জন্য অবশ্যই আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
তবে তোমার সাথে জ্বীনদের যে সম্পর্ক হয়েছে, তা আজীবন অটুট থাকবে ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ।
ফি-আমানিল্লাহ।

আমি তাদেরকে বিদায় জানিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে উঠে আরাফের পাশে বসলাম। অকারণে বার বার চোখ থেকে পানি পড়ছে আর আমি বার বার মুছে নিচ্ছি। গাড়ি চলতে শুরু করার পর আরাফ আমার দিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
~ যে যুদ্ধে আপনি নেমেছেন, সেখানে জেতার জন্য এমন হাজারো মায়া আপনাকে ত্যাগ করতে হবে। হোক সেটা আপনজনের কিংবা নিজের জীবনের।

অতএব, এখান থেকে নিজেকে শক্ত করুন।
আয়নাজগত থেকে আরাফের হাত ধরে বাহিরে বেরিয়ে এলাম। ভাবনামত বাবার বাসায় এলাম। চাচ্চু-চাচীমা আমাদের দেখে রীতিমত অবাক। জিজ্ঞেস করল,
~ এতদিন পর এখানে?
~ চাচ্চু আমরা কিছুদিন এখানে থাকতে এসেছি। তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে আমরা থাকতে পারি?

চাচ্চু একটু চুপ থেকে বলল, হুম পারিস। তোর ই তো বাড়ি এটা। কিন্তু ও কে? জামাই কোথায়?
আমি চুপ করে আরাফের দিকে তাকালাম। আরাফ সালাম দিয়ে বলল, আমি ই আপনাদের জামাই।
চাচ্চু কপাল কুচকে বলল, তুমি তো সে নও, যার সাথে ত্বোহার বিয়ে হয়েছে।
আমি মনে মনে এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। এমনি কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হব। এখন চাচ্চুকে কি বলব? কিভাবে ম্যানেজ করব? আরাফ হেসে বলল,
~ জ্বী আমি সে নই।

আসলে আপনারা যার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, তার এই বিয়েতে মত ছিলনা। সে তার পছন্দের মানুষের সাথে চলে গেছে ত্বোহাকে ফেলে।

তখন আমি ত্বোহাকে বিয়ে করি। আমি তো এখানে থাকিনা, বাহিরে থাকি। ত্বোহাকেও ওখানে নিয়ে যেতে চাইছি।
বাসায় তো এসব নিয়ে ঝামেলা চলছে তাই বাহিরে যাওয়ার সংক্রান্ত বিষয়ে একটু সময় দরকার। আর আমি এই কয়েকটা দিনের জন্য ওকে ওখানে রাখতে চাচ্ছিলামনা।
~ তুমি সেই ছেলেটার কে হও?

~ ভাই। আত্মীয় সম্পর্কের।
~ আচ্ছা যা হওয়ার হয়ে গেছে।
তোমরা চাইলে থাকতে পারো, আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
আমি আরাফের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। অনায়াসে কতগুলো মিথ্যে উনি বলে ফেললেন। অবশ্য এ ছাড়া কি ই বা করার ছিল।
~ আল্লাহ ভরসা।

তারপর অনেকটা পথ চুপ করে রইলাম। একসময় নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, এই ঘোড়ার গাড়ী কি আমাদেরকে বাড়ী অবধি পৌছে দেবে?
~ নাহ, এটা কেবল আয়নাজগত পর্যন্ত ই যাবে।
বাকিটা ক্ষমতা ব্যবহার করেই যেতে হবে।
~ সরাসরি কি বাড়ীতেই যাব?

~ সরাসরি শয়তানদের মুখোমুখি হওয়া ঠিক হবেনা।
এর জন্য আমাদের কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।
তার জন্য প্রথমে একটা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
এখন আপনি বলুন, এমন কোন স্থানে যাওয়া যায়?
আমি চুপ করে ভাবতে লাগল। এখন যাব কোথায়? ওই বাড়ী ছাড়া তো এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। হঠাৎ স্মরণে আসল নিজের বাবার বাড়ীর কথা।

অবশ্য সেখানে ঠাই হবে কিনা জানিনা! এখন তো বাবা নেই যে নিজের মেয়ে রাখবেন। তাও একবার গিয়ে দেখি যদি ২-১দিনের জন্য আশ্রয় পাই।
~ আমার বাবার বাড়ীতে চলুন।
ভাগ্য ভালো থাকলে সেখানে আশ্রয় পেতে পারি।
আরাফের হাত ধরে আয়না জগত থেকে বেরিয়ে এলাম। ভাবনামত বাবার বাড়িতে চলে এলাম দুজনে। চাচ্চু আর চাচীমা আমাদের দেখে রীতিমত অবাক।
চাচ্চু জিজ্ঞেস করলেন,
~ এতদিন পর তুই এখানে?

~ আমরা এখানে কিছুদিনের জন্য থাকতে এসেছি। তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে আমরা কি এখানে থাকতে পারি?
চাচ্চু একটু চুপ থেকে বলল, এটা তো তোরই বাড়ি। কিন্তু ও কে? আর জামাই কোথায়?
আমি চুপ হয়ে আরাফের দিকে তাকালাম। জানতাম এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এখন কি বলব আমি?
আরাফ হাসিমুখে সালাম দিয়ে বলল,
~ আমি ই আপনাদের জামাই।

চাচচু গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি তো সেই নও যার সাথে আমরা ত্বোহার বিয়ে দিয়েছিলাম।
~ চাচ্চু, আপনারা যার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, সে এই বিয়ে মানতে নারাজ। তাই সে তার পছন্দের মানুষের সাথে চলে গেছে। তখন আমি ত্বোহাকে বিয়ে করি।
আমি তো এখানে থাকিনা, বাহিরে থাকি। ত্বোহাকেও আমার সাথে বাহিরে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। কিন্তু এ সংক্রান্ত কাজে একটু সময় লাগবে। বাসায় ও এসব নিয়ে ঝামেলা চলছে। তাই ওকে আমি ওখানে রাখতে চাচ্ছিনা।
এইজন্য আমরা এখান কিছুদিন থাকতে চাচ্ছিলাম।
~ সেই ছেলেটা তোমার কি হয়?
~ আত্মীয় সম্পর্কের ভাই।

~ তোমরা এখানে থাকতে পারোম আমাদের কোনো আপত্তি নেই। লামিয়া ত্বোহা আর জামাইকে রুমে নিয়ে যা তো। জামাই বাবা, অনেকটা জার্নি করে এসেছো মনে হচ্ছে। একটু রেস্ট নাও। ত্বোহা তুই ও যা, ফ্রেশ হয়ে নে।
আমি মাথা নাড়ালাম। আরাফ রুমে চলে গেল লামিয়ার সাথে। আমি পিছন পিছন ভাবতে ভাবতে আসছিলাম। কি অনায়াসে উনি এতগুলো মিথ্যে বলে ফেললেন। অবশ্য এখন এই ছাড়া কি ই বা করার আছে। মানিয়ে নেওয়া ই জীবনের ধর্ম।

রুমে ঢোকার পর অনেক বেশী ক্লান্ত লাগছিল। গোসল করে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। ঘুম আসতে বেশীক্ষণ সময় লাগলনা। একপর্যায়ে ঘুমের মধ্যে মনে হল কেউ আমাকে উপর উবু হয়ে খুব কাছ থেকে আমাকে দেখছে।
মূহুর্তে চোখ খুলে দেখি আরাফ ঝুকে বসে আছে।
অবাক হয়ে বললাম,
~ আপনি এভাবে আছেন কেন?
~ আপনার খোলা চুলের সাথে আমার ঘড়িটা আটকে গেছে তাই। খোলার চেষ্টা করছি। এইতো খুলে গেছে।

লম্বা চুলগুলো একটু সামলে রাখুন।
মনে মনে স্বস্তি পেলাম যাক খারাপ উদ্দেশ্য ছিলনা। লামিয়া গলা ঝেড়ে বলল, আপনাদের রোমান্স কি শেষ হয়েছে?
আমি তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। আরাফ কিছু না বলে বাহিরে চলে গেল। লামিয়া পাশে বসে বলল,
~ খুব তো সুখে আছিস দুলাভাইকে নিয়ে!
আমি কিছু বললামনা।

~ কিরে চুপ করে আছিস যে?
~ বলার মত কিছু নেই। জীবনের মোড় ঘুরে যাচ্ছে প্রতিক্ষণে।
~ তুই কি আগের জন্য মন খারাপ করছিস? যে চলে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয়না। এখন যে আছে তাকে নিয়ে ভাব।
~ সবটা জানলে হয়ত এটা বলতিনা।
যাই হোক বাদ দে। চাচ্চু কি রাগ করেছে আমরা আসায়?
~ মোটেওনা জানিস তুই চলে যাওয়ার পর মা-বাবা প্রায়ই তোর কথা বলত। তারাও চাইত তুই একবার হলেও আসিস। ওরা তোর সাথে না বুঝে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে।
তখনি আরাফ এসে বলল, তৈরী থেকো। কাল ই আমরা বের হব।
~ এত তাড়াতাড়ি?

~ পরে বলব। আমি বলা ছাড়া এই রুম থেকে বের হয়োনা। বলে বেরিয়ে গেল। কিছুই বুঝলামনা, উনার এমন সর্তকবাণী করার কারণ কি! তবে ওরা টের পেয়ে গেছে আমরা কোথায় আছি। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। শয়তানগুলো যদি এখানে আসে চাচ্চুদের কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে। সেটা আমি একদমই চাইনা।

পর্ব ২৫

সারারাত টেনশানে ঘুমাতে পারলামনা, ভিতরে ভিতরে ছটফট করতে লাগলাম। আরাফ বিছানায় ঘুমাচ্ছে, আমি জানালার ধারে বসে আছি। ছেলেটি তাসবীন নয়, কিন্তু তাসবীনের মতই দেখতে।
জানিনা ওকে দেখলে নিজের ভিতর একটা স্বস্তি অনুভব করি। মনে হয় তাসবীন আমার পাশেই আছে। বারবার ভাবতে চাইনা তাসবীনের কথা। কিন্তু ওকে দেখলেই মনে পড়ে যায়। ঘুমন্ত অবস্থায় ভীষণ নিষ্পাপ লাগছে আরাফকে।

দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম, নিজেকে শক্ত রাখতে হবে।
লক্ষ্য অর্জন করা হয়ে গেলে আমরা যে যার মত ফিরে যাব নিজেদের অবস্থানে। কয়েকদিনের জন্য তাসবীন মনে হয় মায়ায় পড়তে চাইনা। চোখ বুজতেই তাসবীনের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো ভেসে উঠে। কত ভালোই ছিল সময়টা!

সকাল সকাল উঠে চাচীমার সাথে রান্নাঘরে গেলাম সাহায্য করতে। নাস্তা বানাতে বানাতে আরাফ উঠে গেল, ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বলল, তুমি তৈরী ত্বোহা?
আমি বললাম, এক্ষুনি বের হবেন?
~ যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া যায় ততই ভাল।
চাচ্চু খবরের কাগজ পড়ছিল। আরাফের কথা শুনে জিজ্ঞেস করল, আজ ই চলে যাবে?
~ হ্যা চাচ্চু, কিছু কাজ আছে।

~ কাল ই তো এলে, কয়েকটা দিন থেকে যাও।
~ ইনশা আল্লাহ অন্য কোনোদিন।
~ যাই বলো, এত সকালে তোমাদেরকে ছাড়ছি। বিকালের দিকে যেও। আরাফ না করতে লাগল। অবশেষে চাচ্চুর জোরাজুরিতে বিকাল পর্যন্ত থাকতে রাজি হল।
আমি রুমে ঢুকতেই বলল, আমি আশংকা করছি সারবান আপনাকে খুজতে খুজতে না এখানে চলে আসে।
~ ও কি চাচ্চু-চাচীমার ও ক্ষতি করবে?
~ সেটার ই ভয় পাচ্ছি। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই স্থান ত্যাগ করতে চাচ্ছি।
~ কিন্তু যাব কোথায়? সেই বাড়ীতে ফিরে যাব?
তারা তো আমাদের দেখলেই আক্রমণ করবে আর সেটা প্রতিহত করার মত পর্যাপ্ত শক্তি কি আমাদের আছে?
~ আল্লাহ ভরসা।

বিকালবেলা আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। আকাশটা ঘন মেঘে ঢেকে আছে, চারিদিকটা ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঝড়ো বাতাস বয়ছে, চাচ্চুরা এই সময় বের হতে বারণ করল।
কিন্তু আরাফ ভীষণভাবে না করে বেরিয়ে এল। আমিও ভাবলাম একবার বলব, এই দুর্যোগপ্রবণ সময়ে বের হওয়ার দরকার না। কিন্তু এখন আমার কাছে আমার নিজের থেকেও এই নিরীহ মানুষগুলো জান বাচানোটা জরুরী।
চারিদিক কেমন থমথমে হয়ে আছে, আশেপাশে কেউ নেই। জনমানবহীন এলাকা মনে হচ্ছে।
একটু একটু ভয় পেতে লাগলাম। থেমে থেমে জোরেসোরে বজ্রপাত হচ্ছে। আরাফ আমার হাতটা শক্ত করে ধরে তাড়াতাড়ি হাটতে লাগল। ও কোথায় যাচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা। একবার আমার দিকে ফিরে বলল,
~ আল্লাহকে ডাকুন। উনি ই আমাদের সহায় হবেন।

হঠাৎ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে আরাফ দূরে ছিটকে পড়ল। আমি তার কাছে গিয়ে উঠানোর চেষ্টা করে বললাম, কি হয়েছে আপনার? এভাবে ছিটকে পড়লেন কেন?
এমনসময় কেউ যেন আমার হাতটা শক্তকরে চেপে ধরল। ব্যথা পেয়ে পাশ ফিরে দেখতেই দেখি সারবান ভয়ানক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
~ এভাবে পালিয়ে বাচতে পারবে ভেবেছো? আমার হাত থেকে তোমাকে কেউ বাচাতে পারবেনা। চল, আমার সাথে।
আরাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
~ উপরে আল্লাহ আছেন, তার কাছে তোদের মত শয়তানরা কিছুই নয়। সারবান চোখ বড়বড় করে আরাফের দিকে তাকিয়ে রইল। অবাক হয়ে বলল,
~ তাসবীন! তুই বেচে গেলি কি করে?

বেচে গিয়েছিস যখন নতুন করে আবার আমাদের হাতে মরবি।
সারবান চোখ বন্ধ করে কিসব বিড়বিড় করে চোখ খুলে আরাফের দিকে আগুনের গোলা ছুড়তে লাগল। আরাফ সরে গিয়ে এইগুলো থেকে বাচার চেষ্টা করছে। আমি এই সুযোগে সারবানের হাতে কামড় দিলাম। সারবান আমার হাত ছেড়ে দিতেই আমি আরাফের হাত ধরে দৌড়াতে লাগলাম।
আরাফ টাল সামলাতে না পেরে বলল,
~ দৌড়াচ্ছেন কেন?
~ আপনি ওদের সাথে পেরে উঠছেন না। তাই নিজেদের আত্মরক্ষা করতে হলে এখন দৌড়াতে হবে।
~ যুদ্ধ করতে এসে পিছু হটলে চলবেনা।
~ যুদ্ধ করার জন্য হলেও আগে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কথা শেষ না হতে সামনে তাকিয়ে দেখি শয়তানী মহিলা আর সারবান দাঁড়িয়ে আছে।

শয়তানী মহিলা এসে আমার চুল চেপে ধরে বলল,
~ তোকে বাচিয়ে রাখাটাই ভুল হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য না করে তুই আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিস? আজ দেখ তোকে দিয়ে কি করে আমরা লক্ষ্য অর্জন করি।
বলে আমাকে সারবানের দিকে ছুড়ে দিল। সারবান টানতে টানতে আমাকে ওইপাশে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল। আরাফ এগিয়ে আসতে চাইলে শয়তানী তাকে বাধা দিয়ে বলে,
~ আমি তো ভেবেছি তুই মরে গিয়ে জ্বীনভুত হয়ে গেছিস।

কিন্তু তুই তো আমার কাজ বাড়াতে আবার ফিরে এসেছিস। চিন্তা করিস এবার আমি তোকে খুব ভালোভাবে উপরে পাঠাব। যাতে কষ্ট করে আর দুনিয়ায় ফিরতে না হয় তোর।
আরাফ নাকমুখ খিচিয়ে বলল, আমিও একই ভুল বারবার করবনা। নিজের মা ভেবে তোকে বিশ্বাস করে তোর হাতে জ্বীনি তলোয়ার তুলে দিয়েছিলাম। আর তুই শয়তানী বেঈমানি করে আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছি। আজ তোদের কে না শেষ করে এই তাসবীন থামবেনা ইনশা আল্লাহ।
~ আয় তবে হয়ে যাক যুদ্ধ।

বলে শয়তানী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমি অবাক হয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে আছি, তাহলে এই আরাফ ই আমার তাসবীন। তাসবীন মরেনি, আমার কাছে ফিরে এসেছি। পরক্ষণেই ভাবলাম শয়তানগুলো যেহেতু ওকে তাসবীন ভেবেছে তাই সে নিজেকে তাসবীন হিসেবে জাহির করছে। যাতে শয়তানগুলো দমে যায়।

শয়তানী মহিলা সারবানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে। সারবান তা দেখে মূহুর্তে আমার উপর হিংস্রভাবে ঝাপিয়ে পড়ে। আমি নিজেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি। আমার কাছে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় সারবান জোরে আমার গালে থাপড় লাগিয়ে দিল।

সারাগায়ে আচড় দিতে লাগল। শরীর থেকে রক্ত বেয়ে বেয়ে পড়ছে, ব্যথায় আর জ্বলুনিতে কাতরাচ্ছি তাও দমে যাচ্ছিনা। শয়তানটার হাত থেকে বাচার চেষ্টা করছি।
অন্যদিকে আরাফকে শয়তানী আগুনের গোলা এবং ধারালো ছুরি ছুড়ছে। ওর কয়েক জায়গায় লেগেও গেছে, রক্তে ভিজে গেছে ওর পাঞ্জাবির কয়েক অংশ।
জ্বীন হিসেবে আরাফের শক্তি খুব কম হচ্ছে। ঠিকমত পেরে উঠতে পারছেনা, শয়তানীর কোনোরকম ক্ষতি হওয়ার আশংকা নেই।
সারবানেত সাথে আর পেরে উঠা সম্ভব হচ্ছেনা। আমার জামার কয়েক অংশ ছিড়ে ফেলেছে, ওড়নাটা কোথায় ছুড়ে ফেলেছে কে জানে। নিজেকে কেমন জানি বিবস্ত্র মনে হচ্ছে।
আল্লাহ আপনি আপনার বান্দীকে সাহায্য করুন।

শয়তানী লাফিয়ে এসে আরাফের বুকে কষে কয়েকটা লাথি মারল। আরাফ মূহুর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। শয়তানী ইচ্ছেমত আরাফকে আঘাত করতে লাগল। ওদের শেষ করার সব রাস্তা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেল। সারবানকে ধাক্কা দিয়ে উঠে আসতেই ও পিছন থেকে আমার চুল চেপে ধরল।
আরাফকে ডাকছিলাম বারবার তাও ও নড়ছেনা।
মনে মনে একটা ভাবনা চলে আসল আরাফ কি মারা গেছে?
শয়তানী জ্বীনি তলোয়ার হাতে নিল, আরাফকে মারার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমি চিৎকার করে বলল, দোহাই লাগে তোমরা উনাকে মেরোনা। এতটা নিষ্ঠুর হয়োনা।
ও তো তোমাদের জাতি। মারলে আমাকে মারো।

~ বাহ, তোর তো দেখছি জ্বীনদের জন্য খুব দরদ। চাপ নিসনা, তোকেও ওর সাথে উপরে পাঠাব।
তুই শুধু আমাদেরকে বাচ্চাটা এনে দে। যদি আমার কথা মত কাজ করিস তবে আমি ওকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবব।
আমি ছলছল চোখে আরাফের দিকে তাকালাম। আমার জন্য এই নিরীহ জ্বীনটা কেন মরবে?
এদেরকে শেষ করা অসম্ভব ই তাই ওদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু কে যেন আমার কানে কানে বলছে, হার মানিসনা ত্বোহা। তুই প্রমাণ করে দে তুইও জ্বীনকন্যার যোগ্য মেয়ে।

আমি অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলাম। কে বলল এই কথা নাকি আমার মনের ভুল?
এমনসময় শয়তানী হোচট খেল, তলোয়ারটা তার হাত থেকে ছুটে গিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি সেটা তুলে নিলাম। সারবানকে কনুই দিয়ে জোরে এক ঘুষি দিয়ে ওর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সারবান আমার দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে আমি তলোয়ার উচিয়ে বলি,
~ ভুলে যেওনা জ্বীনরাজ্যের সর্বশক্তিমান তলোয়ার আমার হাতে। কাছে আসলে কেউ বাচবেনা।
অনেক সহ্য করেছি তোদের শয়তানী। প্ল্যান প্ল্যান করে আমার জীবনটা নষ্ট করে দিলি, আমার তাসবীনকেও মেরে দিলি। আজ দেখব তোদের গড শয়তান আমার হাত থেকে তোদের কিভাবে বাচায়!

বলে এগিয়ে এসে সারবানকে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলাম। অদ্ভুত ভাবে ওর কিছুই হলনা। চিন্তায় পড়ে গেলাম এই তলোয়ার কি নকল? ওরা আসল তলোয়ার সরিয়ে রেখেছে?
শয়তানী উঠে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল
~ বোকা মেয়ে, এই তলোয়ারের ব্যবহার যদি এত সহজ ই হত আমাকে আর তোর আশায় থাকতে হতনা। এই মূহুর্তেই জ্বীনরাজ্য আর পৃথিবী আমার হাতের মুঠোয় থাকত। তোরা একবারো ভাবিসনি, তলোয়ার তো আমি পেয়ে গেছি তারপরও কেন জ্বীনরাজ্য কবজা করিনি! বেকার বেকার এত প্ল্যান করে এই তলোয়ার হাতালাম কিন্তু ব্যবহার ই করতে পারলামনা।

তলোয়ার কাজ না করলে আমি এদের শেষ করব কি করে? কানের কাছে সেই একই ফিসফিসানি, তলোয়ারে তাজা রক্ত মাখিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে আঘাত কর। ইনশাআল্লাহ শয়তান শেষ হবে।
আমার শরীরের রক্ত মাখিয়ে আল্লাহর কালাম পড়ে সারবানের দিকে ছুড়ে মারলাম। সাথে সাথে ঘড় থেকে ওর মাথা আলাদা হয়ে মাটিতে লাফাতে লাগল। শয়তানী ভয় পেয়ে উলটো দিকে ছুটে পালাতে লাগল। আমিও তলোয়ার হাতে নিয়ে পিছু নিলাম। দূর থেকে ছুড়ে মারতেই ওর মাথাটাও আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সাথে সাথে তলোয়ার আবার আমার হাতে চলে এল। আরাফের কাছে গিয়ে ওর জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু উঠতে পারছেনা। তলোয়ারটা আল্লাহর নাম নিয়ে ওর গায়ে ছুয়ে দিলাম। সব ক্ষত মুছে গিয়ে ও সুস্থ হয়ে উঠে দাড়াল।

পর্ব ২৬

আরাফের কি হল জানিনা! হঠাৎ করে আমাকে শক্ত করে
জড়িয়ে ধরল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ততক্ষণে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। রেগে গিয়ে বললাম,
কি করছেন কি? বেগানা নারীকে স্পর্শ করা হারাম জানেননা!
আরাফ মাথা নিচু করে রইল। এইসময় সাদাফ-মাইশা আর
জ্বীনহুজুর এসে হাজির। জ্বীনহুজুর বললেন,
~ অভিনন্দন তোমাদেরকে শয়তানের বিপক্ষে জয়ী হওয়ার জন্য। আমি মুচকি হেসে বললাম,
~ সবি আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছে।

~ এইবার তোমাকে আমি কিছু সত্য বলতে চাই ত্বোহা।
~ কি সত্য জ্বীনহুজুর?
~ তোমার আসল পরিচয়। জানো তুমি কার সন্তান?
~ আমি আমার বাবার পরিচয় জানতে পেরেছি অনেকপরে। একটু আগে কেউ আমার কানে ফিসফিস করে বলছিল, জ্বীনকন্যার মেয়ে। এটা বুঝলামনা।
~ এটা সত্য, তুমি জ্বীনকন্যা সিমরানের মেয়ে
এবং জ্বীন মেহরাবের নাতনী।
~ এসব কি বলছেন আপনি?

~ হুম, জ্বীন মেহরাবের ২টি যমজ ছেলেমেয়ে ছিল- মুহিব এবং সিমরান। তাদের দুজনেরই বিয়ে হয়েছে মানুষের সাথে। মুহিবের সন্তান তাসবীন এবং সিমরানের সন্তান
তুমি।
~ আপনি যা বলছেন তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমিও একজন জ্বীন হতাম। কিন্তু আমি একজন সাধারণ মানুষ। তাসবীন আর আমি যদি জ্বীনের বংশধর হয়ে থাকি ও জ্বীন হলে আমি কেন সাধারণ মেয়ে?

~ মুহিব এবং সিমরান শয়তান তান্ত্রিককে শেষ করার পর রাজ্যের ভার গ্রহণ না করে সব শক্তি ত্যাগ করে সাধারণ জ্বীনরুপে দুনিয়ায় ফিরে এসেছিল তাসবীনের মা ওয়াফাহ আর তোর বাবা তাওহীদের সাথে বাকিটা জীবন সুখে কাটানোর জন্য। সিমরান সব শক্তি ত্যাগ করার পর তুই হয়েছিস তাই তুই সাধারণ মানুষ্যমেয়ে রুপেই জন্ম নিয়েছিস।
মুহিব শয়তানের আস্তানায় বন্দি থাকাকালীন ওয়াফাহর গর্ভে তাসবীন এসেছিল। মুহিবের সব জ্বীনিশক্তি তাসবীন ধারণ করেছিল।
~ তাহলে আমি আমার মা-বাবা থেকে আলাদা হলাম কেন? এতবছর বাবাকে পেলেও মাকে পাইনি। তাসবীনের মা-বাবার কথাও শুনিনি কখনো। ওর মা তো ছিল এই শয়তানী।

~ তাহলে তোকে পুরো ঘটনাটাই বলি। তখন তাসবীনের বয়স ৪-৫ বছর ছিল আর তোর ৩-৪ হবে হয়ত। কথা ছিল তাসবীন হবে জ্বীনরাজ্যের উত্তরাধিকারী, ২১বছর বয়সে সে রাজ্য পরিচালনার ভার নিবে। এই খবর বদজ্বীনের সর্দারনী জানতে পারে তাসবীনকে তার আয়ত্বে নিয়ে আসার প্ল্যান করে। সেদিন ছিল ঘোর বৃষ্টির রাত, বাহিরে প্রচন্ড তুফান হচ্ছিল। তোদের মা-বাবা বসে আড্ডা দিচ্ছিল। কথা দেওয়া-নেওয়া চলছিল বড় হলে তোদের বিয়ে দিবে। আরেকটি কাহিনী রচিত হবে জ্বীন-মানুষের বিয়ে। সেই রাতে শয়তানী তার দলবল নিয়ে তোদের উপর আক্রমণ করে। মুহিব আর ওয়াফাহ বাধা দিতে গিয়ে নৃশংসভাবে খুন হয়, ওদের শরীরের সব রগ ছিড়ে দেওয়া হয়।

তাসবীনকে পাওয়ার পর ওরা তোকে আর তোর মা-বাবার প্রাণ নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। তোর মা-বাবা তোকে আড়কোলে করে বেরিয়ে পালাতে থাকে। ওদের হাত থেকে বাচার জন্য গাড়িতে উঠে। তোর বাবা একহাতে তোকে শক্ত করে আগলে রেখে অন্যহাত দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে। শয়তানী ওদের পিছু ধাওয়া করে মূহুর্তে বিভৎস রুপ নিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। তোর বাবা ভয় ব্রেক করতে গেলে গাড়ি উলটো গড়িয়ে পড়ে যায়। আল্লাহর কুদরতে তোর বাবা গাড়ির দরজা ভেঙ্গে পড়ে যায় রাস্তায়। মোটা গাছের সাথে প্রচন্ড আঘাত পায় মাথায়। ততক্ষণে গাড়ি বিস্ফোরণ হয়ে তোর মা সেখানেই মারা যায়। সেইদৃশ্য দেখতে দেখতে তোর বাবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তুই বাবার পাশে বসে কাদছিলি, ততক্ষণে খবর পেয়ে আমি সেখানে যাই আর তোকে শয়তানীর চোখ ফাকি দিয়ে নিয়ে আসি।

শুনে আমার চোখ বেয়ে বেয়ে পানি ঝড়তে লাগল। ভাবতে পারছিলামনা এভাবে আমার মাকে মরতে হয়েছে। ভেবেই গায়ে কাটা দিচ্ছিল। জ্বীনহুজুর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন,
~ তোকে জ্বীনরাজ্যে নিয়ে আসার পর আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল। জ্বীনজাতি জানতে পারলে তোকে মেরে পুতে ফেলবে, দুনিয়ায় রাখলে যেকোনোসময় শয়তানীর হাতে তুই শেষ হয়ে যাবি৷ তাই আমি এমন একটা পরিবার খুজছিলাম যেখানে তুই নিরাপদ থাকবি।
ভাগ্যক্রমে এক দম্পতি পেয়ে যাই, যারা হন্য হয়ে বাচ্চা দত্তক নেওয়ার জন্য ছুটছিল। সাধারণ মানুষ সেজে তোকে ওদের হাতে হস্তান্তর করি আর শর্ত রাখি তুই যে তাদের পালিতা মেয়ে। এটা যেন কেউ না জানে এবংকি তুই ও না।
তোর বাবা ঠিক তোকে চিনতে পেরেছিল।

আমি চোখ মুছে নিয়ে বললাম,
~ তাসবীনের সাথে যেহেতু আমার বিয়ে ঠিক ছিল তাহলে বাবা আমার অন্যত্র বিয়ে ঠিক করেছিল কেন?
~ শয়তানীর প্ররোচনায় বাধ্য হয়ে সাদাফ তোর বাবার কাছে নিজেকে তাসবীন হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। সেই বিশ্বাসে তোর বাবা এই বিয়ে ঠিক করে ফেলে।
ওনার শেষ ইচ্ছে ছিল সবার মনের আশা পূরণ করা, তোকে তাসবীনের বউ করা।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
~ হতে তো পারলাম না উলটো তাসবীনকে তো হারিয়ে ফেললাম। ওর সাথে কি হয়েছিল? সে কি এসবের বিন্দুমাত্র জানতনা!
~ তাসবীনকে সেই শয়তান নিজের ছেলে হিসেবে পালন করতে লাগল। তার উদ্দেশ্য ছিল তাসবীন যখন পরিণত হবে তখন তাকে দিয়ে জ্বীনি তলোয়ার নিয়ে আসবে এবং তাসবীনকে মেরে সারবান কে বানাবে জ্বীনিরাজ্যের রাজকুমার। কিন্তু তাসবীনের যখন ২১বছর তখন তাসবীন জ্বীনরাজ্যের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

কেননা, তাসবীন কখনো এর আগে জ্বীনরাজ্যে যায়নি। সে নিজেকেও জানত না সে একজন জ্বীন। অতএব, ২৫ বছর বয়স ছাড়া সে আর জ্বীনরাজ্যে ঢুকতে পারবেনা। এরপর শয়তানী তাকে ভালোভাবে তৈরী করে নেয়। মারার পরিকল্পনা ও করে ফেলে, সাদাফকে জ্বীনরাজ্য থেকে নিয়ে আসে পরিকল্পনা সফল করার জন্য।
তাসবীনকে বলে এটা তাসবীনের ছোটভাই। সবটা তো তুমি জানো। তোমার আর সাদাফের বিয়ের কথা শোনার পর তাসবীন ভেঙ্গে পড়েছিল। ও আজীবনের জন্য জ্বীনরাজ্যে ফিরে আসতে চেয়েছিল।
শয়তানী ওকে বুদ্ধি দেয় জ্বীনরাজ্যে ফিরে গিয়ে রাজ্যভার গ্রহণ করে তলোয়ার নিয়ে আসতে। এতে তাসবীনের তোমাকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

তাসবীনও সেই ফাদে পা দেয়। এদিকে শয়তানী আর সারবান সন্দেহ করতে থাকে সাদাফ তোমাকে সব বলে দিবে এইজন্য সারবান তাসবীনের রুপ ধরে মাইশাকে নিয়ে আসে। তোমার সামনে তাসবীন সেজে সব কিছু করতে থাকে যাতে তুমি তাসবীনের উপর ক্ষিপ্ত হও এবং ওকে খুন করো। এতে দুইটা কাজ হাসিল হয়- সাদাফকে ব্ল্যাকমেইল করা আর তোমার চোখে তাসবীনকে খারাপ বানানো।
শেষ অবধি ওরা সফল হয় আর তুমি তাসবীনকে খুন করো।
মনে পড়তেই আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকি।
বিড়বিড় করে বলতে থাকি,
~ ভুল করেছিলাম তাসবীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওকে অবিশ্বাস করে মেরে ফেলে। ওকে তো আর কখনো ফিরে পাবনা। এই ভুলটা মাশুল আমাকে সারাজীবন দিতে হবে। বলে কাদতে লাগলাম অনবরত।

জ্বীনহুজুর আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
~ শান্ত হ ত্বোহা। তাসবীন বেচে আছে, আল্লাহর রহমতে সেদিন ও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে। কিন্তু নিজের সব জ্বীনি শক্তি হারিয়ে সাধারণ জ্বীন হয়ে ছিল।
আমি চোখেমুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,
~ কোথায় আমার তাসবীন? বলুন না জ্বীনহুজুর।
জ্বীনহুজুর আরাফকে কাছে ডেকে বললেন,
~ ও তোর তাসবীনের দেখতে নয়, ও ই তোর তাসবীন।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

মাইশা বলতে লাগল, হ্যা বুবু। এই ই আমাদের তাসবীন ভাইয়া। তোমার উপর অভিমান করে নিজের পরিচয় গোপন রেখেছিল। আমাদেরকেও গোপন রাখতে বাধ্য করেছে।
আমি তাসবীনের দিকে এগিয়ে এলাম। ওর ছলছল করা চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
~ কেন এমন করলে? কত কষ্ট হয়েছে আমার জানো।

বোকা ছেলেটি ফ্যালফ্যাল করে কেদে দিল। আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। জ্বীনহুজুর বললেন,
~ ত্বোহা একটা কথা বলা বাকি রয়ে গেছে।
আমরা লজ্জা পেয়ে দুজন দুজনকে ছেড়ে দিলাম।
~ কি কথা হুজুর?

~ ফিসফিস করে কথাগুলা তোর মা বলেছিলেন।
~ মা? উনি কি বেচে আছেন?
~ তোদের একসাথে দেখার আক্ষেপে তার রুহ রয়ে গেছে দুনিয়ায়। দেখবি তোর মাকে?
~ হ্যা জ্বীনহুজুর। ডাকুননা আমার মাকে।
জ্বীনহুজুর চোখ বন্ধ করে বললেন,
~ সিমরান বুবু, আমি তোমার ছোটভাই জুহানী তোমাকে একটাবার দেখার জন্য ডাকছি। আজ অন্তত দেখা দাও।
দেখে যাও তোমার আক্ষেপ আমি দূর করতে পেরেছি।
একজন সুদৃশ্য মহিলা দৃশ্যমান হয়ে বললেন,
~ আল্লাহ তোমার ভালো করুক ভাই। আয় ত্বোহামা আমার বুকে আয়। মাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলাম।

~ পাগলি মা, কাদিসনা। আমার রুহ এখন শান্তি পেল। সুখে থাক মা। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে আমাকে যেতে হবে। ভালো থাকিস, তাসবীন আমার মেয়েটার দায়িত্ব তোকে দিয়ে গেলাম।
জ্বীনহুজুর তাসবীনের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তুই কি জ্বীনরাজ্যের ভার নিবি? জ্বীনি তলোয়ার হাতে নিলেই তুই তোর সব শক্তি ফিরে পাবি।
~ আমি আর সেটা চাইনা হুজুর। সাদাফকেই আমি জ্বীনরাজ্যের ভার দিয়ে দিলাম। ইনশাআল্লাহ ও সুনিপুনভাবেই পরিচালনা করবে। কিরে পারবিনা?
সাদাফ তাসবীনকে সালাম করে বলল,
~ ইনশাআল্লাহ। তোমার দেওয়া দায়িত্ব আমি মাথা পেতে নিলাম। কিন্তু তুমি কি করবে?
তাসবীন আমার হাত শক্ত করে ধরে বলল,
~ ওর সাথে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিব।
মাইশা হেসে বলল,
~ তাহলে হয়ে যাক বিয়ের আয়োজন।

বউ সেজে ফুলে সাজানো বিছানায় বসে আছি। রুমে কয়েকটা রঙ্গিন ঝাড়বাতি জ্বলছে, খোলা জানালা দিয়ে সুন্দর বাতাস ঢুকছে। বেশ ভালো লাগছে।
একবার আয়নার দিকে উকি মারলাম। ভীষণ সুন্দর লাগছে বউসাজে। টকটকে লালরঙ্গা শাড়ি, হালকা গয়না-সাজ, খোপায় বেলিফুলের মালা এবং হাতভর্তি লাল টুকটুকে মেহেদী। তাসবীন ঠিক যেভাবে বলেছিল সেভাবেই সেজেছি। তার এখনো আসার নাম নেই।

দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠে মাথাটা নীচু করে রইলাম। আড়চোখে তাসবীনের দিকে তাকালাম। লাল পাঞ্জাবিতে রাজপুত্রের মত দেখাচ্ছে তাকে। তাসবীন আমার সামনে বসে থুতনী ধরে মুখটা ধরে বলল, মাশা আল্লাহ, আমার বউটাকে কি মিষ্টি দেখাচ্ছে? আমি লজ্জা পেয়ে তার বুকে মুখ গুজলাম। ও আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,
~ সব অপূর্ণতা আজ পূর্ণতা পেল।
~ হুম পেয়েছে তো। আমি আমার জ্বীনবরকে পেয়ে গেছি।
তাসবীন মুক্তোঝরা হাসি হেসে কপালে ঠোটের স্পর্শ দিয়ে বলল, ভালোবাসি বউ আমার।
আমি আরো জড়োসড়ো হয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম,
~ ভালোবাসি জ্বীনবরটা।

অবশেষে আমরা এক হলাম। সব বাধা-বিভেদ পেরিয়ে শুরু করলাম জ্বীন-মানুষের ভালোবাসার ছোট্ট সংসার। এভাবেই যেন যুগে যুগে এমন ভালোবাসাগুলো পূর্ণতা পায়।
আপনারা কি শুধু গল্প পড়েই যাবেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন না হুম!

লেখা – আস্থা রহমান শান্ত্বনা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “জ্বীনবর (সিজন ৪) – ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প শোনাও” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – জ্বীনবর (সিজন ৫) – ভয়ংকর ভুতের গল্প বাংলা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *