সত্যমিথ্যা – সাংসারিক জীবনের গল্প

সত্যমিথ্যা – সাংসারিক জীবনের গল্প: সাফওয়ানের ডায়েরি পড়ে সব জানতে পেরেছি। জানার পর আমি অনেক অনুতপ্ত অনেক কষ্ট পাচ্ছি। লিখে এমন জায়গায় রাখলাম যেনো সাফওয়ান তা পড়ে।


পর্ব ১

আমার স্বামীর ডাইরির ভাজে আমার বড় বোনের ছবি দেখে আমার পুরো পৃথিবী থমকে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আজ আমাদের ৫ম বিবাহ বার্ষিকী। কত সারপ্রাইজ ই না প্ল্যান করেছিলাম। কিন্তু নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম।

ডাইরিতে খুব সুন্দর করে লেখাছিলো ভালোবাসি প্রিয়তমা। বুকের ভিতরটা কেমন যেনো ধক করে উঠলো।

পুরো ডাইরি তে হাজারো প্রেমের বর্ণনা লেখা আমার স্বামী আর আমার বড় বোনের। প্রতিটা ডাইরির পাতা যেনো তাদের এই ভালোবাসার সাক্ষী। চোখ টা কেমন যেনো ঝাপসা হয়ে আসছিলো আমার। মনে হচ্ছিলো আমার পুরো পৃথিবীটাই যেনো মিথ্যে। খুব রাগ হচ্ছিলো তাদের উপর। এভাবে আমাকে ঠকানো হলো। হঠাৎ চোখ পড়লো ডাইরির শেষ পাতায়।

“আমাদের ভালোবাসা এইভাবে ভুলে গেলে। আমার প্রথম ভালোবাসা তুমি আমার প্রথম অনুভূতি তুমি। আমাকে এভাবে ঠকালে। কেনো এমন করলে আমার সাথে? তোমরা ২ বোন মিলে আমাকে জ্যান্ত লাশ বানিয়ে দিলে। যেদিন তোমাকে বিয়ের জন্য প্রপোস করবো বলে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তার আগেই তুমি আমাকে এত বড় সারপ্রাইজ দিলে যে আমার পুরো পৃথিবীটাই থমকে গেলো। তুমি আমাকে বললে তিন্নি নাকি আমাকে ভালোবাসে আমি যাতে ওকে বিয়ে করি।

তোমার আদরের ছোটবোনের কোনো আবদার তুমি অপূর্ণ রাখোনি আজ ও রাখবেনা। তখন খুব বলতে ইচ্ছা করেছিলো আমাকে কি তোমার খেলনা মনে হয়। তোমার ছোট বোন চেয়েছে আর তুমি দিয়ে দিবে। যাকে ছোট থেকে নিজের বোন ভেবেছি তাকে কিভাবে বিয়ে করবো।

আর আমাদের এতো দিনের ভালোবাসার কোনো দাম নেই। বাট কিছু বলতে পারিনি ঐদিন। কোনো কথা যেনো বের হচ্ছিল না। তুমি কান্নারত অবস্থায় যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে আমি যাতে তোমার ছোট বোনকে বিয়ে করে নেই বিশ্বাস করো মনে হচ্ছিলো তোমাকে খুন করে ফেলি।

এর থেকে ভালো হতো আমকে খুন করে ফেলতে নিজের হাতে। যখন তুমি বললে আমি তিন্নিকে বিয়ে না করলে তুমি সুইসাইড করবে তখন আমার তোমাকে দুনিয়ার সবথেকে স্বার্থপর মানুষ মনে হচ্ছিলো। তিন্নি কে বিয়ে না করার কোনো রাস্তা তুমি খালি রাখোনাই আমার জন্য। যাওয়ার সময় তুমি যখন বলেছিলে ভালো থাকবে তুমি তখন তাচ্ছিল্যের হাশি দিয়ে বলতে ইচ্ছা করছিলো হ্যা অনেক ভালো থাকবো। ভালো থাকার জিনিসটাই তো আমার থেকে কেড়ে নিলে তুমি।”
আর কিছু লিখা নাই।

দীর্ঘ এতো গুলো বছর পর এমন অপ্রিয় সত্য সামনে আসবে কোনোদিনও ভাবতে পারিনি। আমি যেনো পাথর হয়ে গিয়েছি। এত বড় পাপ আমার দ্বারা হয়ে গেলো। সাফওয়ান আমার স্বামী সম্পর্কে আমার খালাতো ভাই। ছোট থেকে আমি তাকে ভালোবাসতাম। সাফওয়ান আর আমার আপু ছিলো বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো। সারাক্ষণ ঝগরা করতো। কখোনো বুঝতে পারিনি তাদের ভালোবাসার গভীরতা। হয়তোবা নিজের ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে তাদের টা চোখেই পরেনি। আপু আমার থেকে ৩ বছরের বড়।

একদিন সাহস করে আপুকে বলেই ফেলেছিলাম আমি সাফওয়ান ভাইকে অনেক ভালোবাসি। ওকে না পেলে মরেই যাবো। আপু ঐদিন শুধু একটা মলিন হাসি দিয়েছিলো। বুঝতে পারিনি ওই হাসির পিছনে লুকোনো তীব্র কষ্ট। আপু আমার কোনো চাওয়া পূরণ করে নি এমন কোনোদিন হয়নি।

তাই আমি সিওর ছিলাম সাফওয়ান ভাইকে আমি পাবো। আহা কত খুশি ই না ছিলাম। ২ টা মানুষকে জ্যান্ত মেরে ফেলেছি কখন তা খেয়াল ই করিনি। তার ২ সপ্তাহ পর সাফোয়ান ভাই এর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হলো। আপুই সব ম্যানেজ করেছিলো।

এতো খুশি ছিলাম তখন। আবার আপু স্কলারশিপ ও পেয়ে গেলো কানাডা যাওয়ার। তখন বুঝিনি যে আপু কেনো এত জলদি যেতে চাচ্ছে। আমার বিয়ের পরের দিন আপু কানাডায় চলে গেলো খুব কান্না পাচ্ছিলো ঐদিন। আপু আর কোনোদিন দেশে আসেনাই। বাবামাকেও ওখানে নিয়ে গিয়েছে।
আপু আজ ও বিয়ে করে নি। তার কারণ এতোদিন না জানলেও আজ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ত্যাগ করে খুব মহান হয়ে গেলিরে তুই।

সাফওয়ান আপুর নাম অব্দি শুনতে পারতো না। এটা নিয়ে আমি তেমন মাথা ঘামাইনি। সাফওয়ান আমাকে সব দিয়েছে কোনো দিন কছুতে কমতি রাখেনি। কিন্তু তবুও কোথাও যেনো একটুকমতি ছিলো। সেটা হলো ভালোবাসার। ও এখনো আপুকেই ভালোবাসে। আমার প্রতি আছে মায়া দায়িত্ববোধ।

আজ নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে। আপু আর সাফওয়ান অনেক মহান। তাদের মহান হওয়ার চক্করে আমাকে বড্ড ছোট করে দিয়েছে নিজের কাছে।
পিছন থেকে আমার ২ বছরের মেয়ে আমার শাড়ির আচল ধরে টানছে। ওকে কোলে নিয়ে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিলাম। ডাইরিটা যেখানে ছিলো সেখানে রেখে দিলাম।

নামাজ পরতে বসে নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইলাম আল্লাহর কাছে। মনে হচ্ছে আপু আর সাফওয়ানের পায়ে ধরে মাফ চাই। এই পাপের কোনো ক্ষমা হয় না। যা আমি অজান্তেই করে ফেলেছি।
তিন্নি নিজের ডাইরিটা রেখেদিলো।

১৫ বছর পর। তিন্নি আর সাফওয়ান খুব সুখে আছে। সাফওয়ান তিন্নিকে এখন অনেক ভালোবাসে। তাদের আর একটা ছেলেও হয়েছে।
তিন্নি বড় আপুর ছবির দিকে তাকিয়ে একটা বাকা হাসি হাসলো।
এই হাসির পিছে লুকিয়ে আছে না বলা অনেক রহস্য….


পর্ব ২ (অন্তিম)

তিন্নি বড় আপুর ছবির দিকে তাকিয়ে একটা বাঁকা হাসি হাসলো।
আমি জানতাম তুই আর সাফওয়ান ভাই একজন আর এক জনকে ভালোবাসতি। কিন্তু আমিও যে সাফওয়ানকে বড্ড ভালোবাসতাম রে। কিন্তু সাফওয়ানের মনে তো শুধু তুই ছিলি রে। আমি তোর থেকে হাজার গুনে সুন্দর কিন্তু তাও সাফওয়ান শুধু তোকে ভালোবাসতো। নিজের ভালোবাসা নিজের করে কে ই না পেতে চায়।

আর তুইতো ছিলি ইমোশনাল ফুল। তোর সামনে একটু কান্নাকাটি করে সাফওয়ান কে চেয়েছি বলে তুই ও সাফওয়ানকে আমাকে দিয়ে দিলি। তুই বড্ড বোকারে। আর তোর স্কলারশিপ ঐটা আমি আমার ফ্রেন্ড এর বাবাকে দিয়ে করিয়েছিলাম। কারণ আমি চাইনি তুই আমাদের কাছে থাকিস। তুই যাতে দূরে চলে যাস। তুই এতই বোকা যে সব ছেড়েছুড়ে চলে গেলি।

কিন্তু বিয়ে করেও যেনো আমি সাফওয়ানকে পেলামনা পুরোপুরি। ওর মনে শুধু তুই ছিলি। তাইতো আমি আর ও একটা প্ল্যান করলাম। আমার যে পারসোনাল ডায়েরিটা আছে যেটাতে আমি সাফোয়ান কে নিয়ে হাজারো কথা লিখি ওটাতে আমি এমন ভাবে সব লিখলাম যেনো আমি কিছু জানিনা তোদের সম্পর্কে।

সাফওয়ানের ডায়েরি পড়ে সব জানতে পেরেছি। জানার পর আমি অনেক অনুতপ্ত অনেক কষ্ট পাচ্ছি। লিখে এমন জায়গায় রাখলাম যেনো সাফওয়ান তা পড়ে। আর তাই হলো সাফওয়ান তা পড়ে নিলো। ঐদিন প্রথম সাফওয়ান আমাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো। আমি প্রথম তার ভালোবাসা অনুভব করতে পারি। তুই হেরে গেছিস আমি জিতে গেছি। তিন্নি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো।

আড়াল থেকে নিয়ামা সব শুনে ফেললো। নিয়ামা তিন্নি আর সাফওয়ানের মেয়ে। ও কোনো ভাবেই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। নিয়ামার চোখ বেয়ে পানি পরছে। এতো নিচু মনের মানুষ ওর মা। এইভাবে ঠকালো সবাইকে। নিয়ামা সিদ্ধান্ত নিলো ও কানাডা চলে যাবে ওর খাম্মির(তিন্নির বড় বোন তারিকা) কাছে।

নিয়ামা তার বাবাকে বলে পারি জমালো কানাডায় তার খাম্মির কাছে। তিন্নি অনেক কান্না করেছিলো সেদিন কিন্তু নিয়ামার মন গলেনি। ঐদিনের পর থেকে নিয়ামা তিন্নির সাথে আর কথা বলেনি। তিন্নি হাযার চেষ্টা করেও পারেনি কথা বলতে।

৪ বছর পর….

আজ নিয়ামার বিয়ে। তারিকার বন্ধুর ছেলের সাথে। সাফওয়ান কানাডায় গিয়েছে মেয়ের বিয়ের জন্য। নিয়ামা সাফ জানিয়ে দিয়েছে তার মা আসলে সে এই বিয়ে করবে না। নিয়ামার জিদ অনেক বেশি মায়ের ই তো মেয়ে বলে কথা।

দীর্ঘ ২৪ বছর পর সাফওয়ান আর তারিকার দেখা হয়। ২ জনের চেহারাতেই বয়সের ছাপ পরেছে। চুলে পাক ধরেছে। আজ ও তাদের মনে পরে প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি। এত বছরেও তাদের ভালোবাসা কমে নি। প্রথম ভালোবাসা কি আর ভুলা যায়। সাফওয়ান তারিকা এটাকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বলেই মেনে নিয়েছে।

নিয়ামার বিয়ে হয়ে গেলো…
সাফোয়ান আবার বাংলাদেশে ফিলে এলো। সময় এর মতো সময় অতিবাহিত হলো। তিন্নি আজ ও জানে না তার অপরাধ টা কি! তার মেয়ে তাকে এইভাবে ছেড়ে চলে গেলো কেনো?

তবে সে এটা বুঝে গিয়েছে প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে পছন্দ করে। প্রকৃতি ফাঁকা স্থান পূর্ণ করতে পছন্দ করে। অনেক বছর আগে তিন্নি যেভাবে তারিকার কাছ থেকে তার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিলো আজ কোনো এক অজানা কারণে তার মেয়ে তার থেকে দূরে। যার কারণ আজ ও খুঁজে বেড়ায় তিন্নি।
তাইতো আজ তার কাছে সব থাকতেও তার অমূল্য ধন তার মেয়ে তার কাছে নেই। আর তিন্নির ছেলে তার বউ কে নিয়ে কানাডাতেই থাকে চাকরির জন্য তারিকার সাথেই।

আজ তিন্নির ইচ্ছা করে তার ভুল শুধরাতে। কিন্তু তা কি আর কোনোদিন সম্ভব….

(পাপ বাপকেও ছাড়ে না। তিন্নির পাপের শাস্তি সে পেয়ে গেলো। আজ তার থেকে তার ছেলে মেয়েরা দূরে। সাফওয়ান ও মারা গিয়েছে ১ বছর হলো। তারিকা অনেকবার বলেছিলো সে যাতে কানাডা চলে আসে। কিন্তু তিন্নি যায় নি। তার বিবেক তাকে যেতে দেয় নি। এত বড় পাপ সে করেছে যার কোনো ক্ষমা হয় না।)

লেখা – নিয়ামা খন্দকার

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “সত্যমিথ্যা – সাংসারিক জীবনের গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – ইশারায় ভালোবাসার প্রকাশ – রোমান্টিক প্রেমের কথা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *