অনেক চেষ্টা চালিয়েও বিয়েটা ভাঙ্গতে সক্ষম হইনি। কালো বেটে লোকটার সঙ্গেই বিয়েটা হয়ে গেল। আমার পাশে এমন একটা লোক’কে কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে! তবুও আমি এখন তার বিবাহিত স্ত্রী।
আমার কুঁচকানো নাক চোখ দেখেই ভদ্রলোক বুঝে গিয়েছেন আমার তাকে পছন্দ হয়নি। কষ্ট করে আর মুখ ফুটে তাকে বলতে হয়নি যে এই বিয়েতে আমি কিঞ্চিৎ পরিমাণেও সন্তুষ্ট নয়।
এতে তার মন খারাপ হয়েছে কী না জানি না। জানার প্রয়োজনও মনে করি না। কষ্ট পেলে পাক! তাতে আমার কী! আমার তাকে অপছন্দ, এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মা’কে আকুতি করে, রেগে, বিরক্ত হয়ে অনেকভাবে অনেকবারই বলেছি যে এই ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু মা কানেই তুললো না।
বরং যতবার বলেছি অপছন্দের কথা ততবারই মা বলেছে, ‘শোন বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে কিছুই হয় না। ভালো থাকার জন্য চাই একটা ভালো মানুষ। আর ভালো মানুষ সে হয়, যার উপর নয় ভেতরটা ভালো। আমরা তোর জন্য একজন ভালো মানুষ খুঁজে পেয়েছি৷ মুবিন খুবই ভালো ছেলে। তুই খুব ভালো থাকবি।’
‘ভালো থাকবো না ছাই! যে মানুষটাকে দেখেই ভালো লাগে না, তার সঙ্গে ভালো থাকা অসম্ভব।’
‘দেখে শুনেই তো প্রেম করেছিলি নাহিদের সঙ্গে। সেই সুদর্শন ছেলের সঙ্গে ভালো থাকতে পেরেছিলি শেষ অব্দি?’
‘দেখ মা, তাই বলে সবাই যে একরকম হবে এমন তো নয়। আর মানুষের উপর দেখে তো ভেতর বোঝা সম্ভব নয়।’
‘একদমই ঠিক! তবে মানুষ যেমনই হোক তার উপরের থেকে ভেতরটাই দামি।’
এই বিষয়ে মায়ের সঙ্গে যুক্তিতর্কে হেরে গিয়েছি বরাবর। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই এই লোক’কে বিয়ে করতে হলো।
নাহিদকে ভীষণ ভালোবাসতাম। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়েছিলাম। আড়াই বছরের সম্পর্কে কখনো সন্দেহ করার প্রয়োজনই মনে করিনি। কিন্তু যেদিন জানতে পারলাম আমারই অগোচরে আমারই বান্ধবী নীরার সঙ্গে নাহিদ গোপনে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে, সেদিন আর সন্দেহ নয়, গোটা সম্পর্কটার’ই ইতি টেনে দিলাম। বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয়েছিল, এত বড় ধোঁকায় আমি এতগুলো দিন ডুবেছিলাম।
সম্পর্ক ভাঙ্গার পর কষ্ট পেয়েছিলাম খুব। বেশি কষ্ট লেগেছিল নীরার কারণে। আমার এতটা কাছের বান্ধবী হয়েও কিভাবে এত বড় ক্ষতিটা করলো, ভেবে এখনো অবাক হই! তারপর আর কোনো সম্পর্ক আমায় টানেনি।
পড়াশোনা শেষ হলে বাবা দুম করে বলে বসলেন, এখন বিয়ে করতে হবে। ছেলে তার পূর্বপরিচিত।
অনিচ্ছা সত্বেও রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু যখন ছেলের ছবি দেখাল মা, তখন উঠে পড়ে লাগলাম বিয়ে ভাঙ্গতে। বাবাকে কিছু বলার সাহস আমার কোনো কালেই ছিল না। মা’কে খুব করে অনুরোধ করলেও কোনো লাভ হলো না।
‘আপনার হয়তো আমায় পছন্দ হয়নি।’
মুবিনের কথা শুনে বিরক্তির পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম। অবশ্য, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।
মুবিন নিজ থেকেই আবার বললো, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, আপনার এ বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই।’
‘তবুও আপনার ভালো করে খোঁজ নেওয়া উচিৎ ছিল।’ কড়া স্বরে বললাম।
‘চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার বাবা চাচ্ছিলেন না বিয়ের আগে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করি।’
চুপ করে রইলাম। প্রসঙ্গ বদলাতে মুবিন বললো, ‘আমি বরং আপনার খাবারটা এনে দিই।’
খাওয়া শেষে আমি আমার মত শুয়ে পড়লাম। বাবার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে, নিজের মেয়েকে এত বড় ধোঁকা দিল সে। একবার মুবিনের সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ দিলো না। বাবার প্রতি ক্ষোভে চোখ ভিজে জল নেমে এলো।
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো পাখির কিচিরমিচির শব্দে। ব্যালকনিতে ঝুলানো খাঁচাগুলোতে বেশ কিছু পাখি রাখা আছে। পাখিগুলো ভীষণ সুন্দর। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
এমন সময় মুবিন এসে বললো, ‘মা নাস্তা নিয়ে অপেক্ষা করছে। আপনি যাবেন নাকি রুমেই নিয়ে আসবো?’
‘নাহ্! নিয়ে আসতে হবে না। আমিই আসছি।’
নাস্তার টেবিলে শাশুড়ির সঙ্গে বেশ আলাপ জমে উঠলো। খুব সুন্দর দেখতে তিনি আর ভীষণ হাসিখুশি। শ্বশুরকে ছবিতেই দেখেছি, তিনি বেঁচে নেই। দেখতে ঠিক মুবিনের মত। আফসোস, এই মুবিনটা দেখতে যদি তার মায়ের মত হত!
সন্ধ্যায় আমার এক কাপ চা না হলে চলেই না। চা না খেলে মাথা ধরে যায়। এবাড়িতে নতুন বলে বলতেও পারছি না৷ চুপচাপ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি৷
হঠাৎ শাশুড়ি মা এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মুবিন বললো তোমার নাকি সন্ধ্যায় চা খাওয়ার অভ্যাস।’
মুবিন কী করে জানেন এ কথা! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। শাশুড়ি মা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে একের পর এক গল্প করে যাচ্ছিলেন।
আমি মুখখানা হাসি হাসি করে সেই গল্পে মনোযোগ ঢাললাম।
‘সন্ধ্যায় আমার চা খাওয়ার বিষয়টা কী মা আপনাকে বলেছে?’
মুবিন মুচকি হাসি দিয়ে বললো, ‘নাহ্! মা বলেননি।’
‘তাহলে?’
‘আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে ঢু মারতে গিয়ে জানতে পারলাম, সন্ধ্যাটা আপনার চা ছাড়া চলে না।’
অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লাম, ‘আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পেলেন কী করে?’
‘আপনি তো আর আমাকে বন্ধু তালিকায় রাখবেন না। তাই ফলোয়ার হয়ে বেশ আগেই ঝুলে আছি। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি।’
কিছু না বলে চুপচাপ মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে তল্লাশি চালাতেই মুবিনের অ্যাকাউন্টটা পেয়ে গেলাম। বিয়ের আগের দিনই সে আমায় রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছিল, দেখিনি এতদিন। এখন থাকুক ঝুলে এমনি।
সারাদিন যেন সময় কাটে না। শাশুড়ির সঙ্গে গল্প করা ছাড়া কাজ নেই আর কোনো। বাসার কাজের জন্য রেবেকা খালা রয়েছেন৷ তিনিই সব করেন।
সেদিন সকালে খালাকে দেখলাম বাড়ির নিচ থেকে ঘাস সংগ্রহ করতে। বাসায় এলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খালা, ঘাস দিয়ে কী করবেন?’
হেসে জবাব দিলেন, ‘বউমা, আমার ছোট মেয়েটা খরগোশ পুষে দুইটা। ওগুলোর জন্যই ঘাস খুঁজছিলাম।’
‘তাই নাকি! আমারও খরগোশ ভীষণ পছন্দ। মা’কে কতবার যে বলেছি বাবাকে দিয়ে আমায় একজোড়া সাদা খরগোশ আনিয়ে দিতে। কিন্তু মা দিলোই না। বললো, ওসব পোষা নাকি খুব ঝামেলা।’
‘তা ঠিক। এগুলো পোষা আসলেই ঝামেলা। তবুও মেয়ে শখ করছে তো তাই।’ রেবেকা খালা কথা শেষ করে চলে গেলেন। আমি বসে টেলিভিশন চালু করলাম।
মুবিন অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল মাত্র। যাওয়ার সময় তার মুখে ভদ্রতা রক্ষার খাতিরে প্রতিদিনই আমাকে শুনতে হয়, ‘আসি। নিজের খেয়াল নিবেন।’
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করি। না হলে বাড়ির লোকে সন্দেহ করে বসবে, দাম্পত্যের শুরুতেই কলহ বাধিয়েছি। এই কারণেই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রায়ই অনেক কাজ করতে হয় আমায়৷
দুপুরে কলবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতে এগিয়ে গেলাম। রেবেকা খালা রান্নাঘরে আর মা গোসলে। দরজা খুলতেই দেখি এক অপরিচিত লোক একটা খাঁচায় দু’টো সাদা খরগোশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বললেন, ‘মুবিন স্যার পাঠিয়েছেন আপনার জন্য। আমি স্যারের অফিসে কাজ করি।’
‘ধন্যবাদ।’
খাঁচাটা হাতে নিলাম। লোকটা বিদায় নিয়ে চলে গেল। খরগোশ দু’টো ভীষণ সুন্দর। খুব সুন্দর তাদের চোখ। চোখে মুখে খুশি জেগে উঠলো আমার।
এটা নিশ্চিত যে সকালে রেবেকা খালার সঙ্গে বলা কথাগুলো মুবিন শুনতে পেয়েছিল। আর যা’ই হোক অন্তত এই কারণে মুবিনকে আমার একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলো মুবিন। আমার আজ সারাদিন খরগোশের পিছনেই চলে গেল। আমার এমন খুশি দেখে শাশুড়ি মাও বেশ খুশি হলেন। তিনি খরগোশ দু’টোর সুন্দর নামও দিলেন।
‘খরগোশ পছন্দ হয়েছে?’
মুবিনের কথায় পাশ ফিরে তাকাই।
‘খুব। আপনাকে ধন্যবাদ।’
আমার মুখের হাসি যেন মুবিনের ঠোঁটেও হাসি এনে দিলো।
রাস্তার ধারের দোকানের ফুসকা, চটপটি, ঝালমুড়ি আমায় বেজায় টানে। কী করে যেন এই টান’টা জেনে যায় মুবিন। তারপর প্রায় সন্ধ্যাতেই আমায় আর মাকে নিয়ে বের হয় রাস্তার ধারের দোকানের মজার সব খাবারের স্বাদ নেওয়ার জন্য। বেশ আনন্দে সময় কাটে তখন।
এই আনন্দ আর হাসির মাঝে আমি আর মুবিন অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছি। জটিল সম্পর্কটা এখন বন্ধুত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফেসবুকে একে অপরের বন্ধু তালিকায় জায়গা করে নিয়েছি।
আজ ভীষণ বৃষ্টি। বৃষ্টি আমার খুব ভালো লাগে। আমার মনের পরম বন্ধু, কিন্তু আবার এই বৃষ্টিই আমার শরীরের চরম শত্রু। বৃষ্টিতে ভিজলেই ঠান্ডা লেগে যাবে। তারপর জ্বর, সর্দি-কাশি, হাঁচি হবে। এটাই যেন নিয়ম। এর ব্যতিক্রম কখনো হয়’ই না৷
আজকের বৃষ্টি দেখে লোভ সামাল দেওয়া অসম্ভব। এখানে মা-বাবাও নেই যে কেউ বকবে। ভেজার উদ্দেশ্যে ছাদের দিকে রওনা হতেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াল মুবিন।
‘আপনার শরীর খারাপ করবে। বৃষ্টি উপভোগ করতে খুব মন চাইলে ছাতা নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকুন। তবে গায়ে যেন পানি না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।’
খুব রাগ চাপলো মুবিনের কথায়। তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছি, তাই বলে অধিকার খাটানোর অনুমতি তাকে দেওয়া হয়নি। আমার কোনটাতে ভালো আর কোনটাতে মন্দ সেটা আমার থেকে সে বেশি বুঝবে, এটা মানার মত মানসিকতা এখনো আমার তৈরি হয়নি।
রেগে বললাম, ‘আমাদের নিজেদের সীমার মধ্যে থাকা উচিৎ। আমাকে শাসন করার অধিকার আপনার নেই।’
মুবিন চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমার থেকে এমন আচারণ হয়তো সে প্রত্যাশা করেনি। তাই বলে আমি মোটেও অনুতপ্ত নই। সে কেনোইবা এমন অধিকার খাটাবে। আমাকে উপদেশ দেওয়ার মত সম্পর্ক তার সঙ্গে আমার এখনো হয়ে ওঠেনি।
আমি দ্রুত পায়ে ছাদে চলে এলাম। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। দৌড়ে ছাদের মধ্যখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। টানা এক ঘন্টা বৃষ্টিতে ভেজার পর নেমে এলাম। মনটা খুব সতেজ লাগছে। মুবিন আমার থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এতে বরং আমার ভালোই৷ বেশি আদিখ্যেতা আমার একদম অসহ্য লাগে।
সন্ধ্যা হতেই হাঁচি শুরু হলো। রাত যত গভীর হচ্ছে আমার জ্বরও যেন বেড়ে চলছে।
শাশুড়ি মুবিনের উপর খিটখিটে মেজাজ দেখিয়ে রেগে চলছেন।
‘তুই বউমাকে নিষেধ করবি না ভিজতে? তুই জানিস না বউমার বৃষ্টির পানিতে ঠান্ডা লাগে?’
মুবিন শান্ত গলায় জবাব দিলো, ‘মা, আমার আসলে খেয়াল ছিল না।’
আমি চুপচাপ শুয়ে আছি। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য শাশুড়ি আর মুবিনের জোর অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করলাম। এত রাতে ডাক্তারের কাছে যেতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছে না। সকাল হলেই যাব, এমনটা বলেই থামিয়ে রেখেছি তাদের।
সারা রাত মুবিন আমার পাশে বসে রইলো। খানিক পর পর কপালে ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছিল। চোখ ভর্তি তার দুশ্চিন্তা জমে আছে। আমি সে যত্নে একজন দায়িত্বশীল মানুষ আবিষ্কার করলাম।
সকাল হলেই মুবিন আমায় নিয়ে ছুটলো ডাক্তারের কাছে। মুবিনের এমন অস্থিরতা আমাকে ভাবিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত। মনে হয় যেন আমি তার পরম আপনজন। খুব প্রিয়জনের জন্যই মানুষের এমন ছটফটানি হয়। যেটা আমি মুবিনের ভেতর স্পষ্ট দেখতে পাই।
ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরছি আমরা। গাড়িতে পাশাপাশি দু’জন বসে আছি।
মুবিন প্রশ্ন করলো, ‘আপনার কি একটুও ভালো লাগছে নাকি এখনও খুব কষ্ট হচ্ছে?’
ঠোঁটে হাসির রেখা জেগে উঠলো আমার।
বললাম, ‘এই প্রশ্নটা গতকাল রাত থেকে কতবার করেছেন হিসেব রেখেছেন?’
মুবিন নত স্বরে বললো, ‘আমি দুঃখিত।’
‘এমনভাবে বলবেন না। আমিই আসলে লজ্জিত।’
অবাক হয়ে তাকায় মুবিন।
আমি হেসে চুপ হয়ে রইলাম।
তারপর থেকে বাড়িতে দ্বিগুন যত্ন চলতে লাগলো আমার উপর।
রেবেকা খালা দরদ মাখা কন্ঠে বললেন, ‘ভবিষ্যতে বৃষ্টির ধারে কাছেও ঘেঁষার সাহস করো না বউমা। আমরা কিন্তু খুব কষ্ট পাই।’
আমি হেসে বললাম, ‘আপনাদের এত আদর যত্ন দেখে আমার এখন ইচ্ছে করে রোজ রোজ বৃষ্টিতে ভিজি। আর আপনারা এভাবে আমাকে ভালোবাসুন।’
শাশুড়ি মা কাছে এসে বসলেন। কপালে হাত রেখে বললেন, ‘তোমাকে আমরা সবসময়ই ভালোবাসি।’
বিকেলের গল্পে শাশুড়ি মা তার নিজের গল্প জুড়ে দিলেন।
‘তোমার শ্বশুরের সঙ্গে যখন আমার বিয়ের কথা চলে, একদমই পছন্দ হয়নি তাকে। দেখতে ভালো না, এটাই অপছন্দের একমাত্র কারণ ছিল। বাবা মায়ের মুখের উপর কিছু বলার সাহসও পাইনি। মন খারাপ থাকতো খুব। কিন্তু বিয়ের পর বুঝতে পারি, আমি আসলে একজন ভালো মানুষের সঙ্গ পেয়েছি। এটাই একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া।’
শাশুড়ির সঙ্গে আমার চোখ জোড়াও টলমলিয়ে উঠলো।
চোখের জল লুকিয়ে তিনি বললেন, ‘মুবিন হয়েছে ঠিক ওর বাবার মত। দেখতে সুশ্রী নয়, কিন্তু ভেতরে একজন সুন্দর মানুষ।’
আমি চুপ হয়ে তার সব কথা শুনতে লাগলাম। ভেতরে কেমন যেন একটা হচ্ছিলো। অস্থির হয়ে উঠছিলাম। মুবিনের মুখটা খুব মনে পড়ছিলো। কেন এমন হচ্ছিলো, তখন বুঝে উঠতে না পারলেও পরে ঠিক টের পেলাম।
সন্ধ্যায় ব্যালকনি জুড়ে জোছনার আলো জমেছে। মুবিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই থতমত চেহারায় তাকায় সে।
‘আপনার শরীরের অবস্থা এখন কেমন? খারাপ লাগছে?’
‘আমার শরীর ঠিক আছে। কিন্তু..’
‘কিন্তু?’
‘মন ভালো নেই।’
আকুতলার সঙ্গে প্রশ্ন করলো মুবিন, ‘কেন?’
‘আমিও আপনার মত ভেতর থেকে একজন ভালো মানুষ হতে চাই। যতদিন ভালো মানুষ না হতে পারব, ততদিন মনও ভালো হবে না।’
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মুবিন।
আমি মাথা নিচু করে বললাম, ‘যে মানুষের ভেতরটা সুন্দর, সে’ই তো প্রকৃত সুন্দর মানুষ। সেই মানুষটাই ভালো রাখতে জানে আর ভালোবাসতেও।’
মুবিন অবাক চোখে চুপ হয়ে রইলো। আমি তার চোখের দিকে চোখ রাখলাম।
সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় আমি দুম করে বলে বসলাম, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাই।’
মুবিনের দু’ঠোঁটে খুশির বান নামলো। চোখ মুখ জুড়ে সে খুশির রেশ ছড়িয়ে গেল। আনন্দে তার সঙ্গে আমার চোখ জোড়াও চকচক করে উঠলো।
ভেজা চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘বিগত কর্মকাণ্ডের কারণে অনুতাপে পুড়তে থাকা এই মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারবেন তো?’
মুবিন হেসে বললো, ‘হাতটা ধরতে পারি একবার?’
উত্তরে বললাম, ‘আমি তো আপনারই।’
মুবিন হেসে উঠে হাতটা শক্ত করে ধরে বললো, ‘আপনাকে নিয়েই ভালো থাকতে চাই।’
মায়ের কথাটা আজ ভীষণ মনে পড়ছে, প্রকৃত সুন্দর থাকে মানুষের ভেতরে, বাহিরে নয়।
গল্প: সুন্দর (Hero Love Story)
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।
আরো গল্প পড়ুন – ভালোবাসার স্পর্শ – পিচ্চি বউ রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প