অপ্রত্যাশিত – আমি যা চাই তা অন্যে চায় না

অপ্রত্যাশিত: ছাত্রীর মা এ কী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে আমার মতো উচ্চশিক্ষিত ও সচেতন মানুষের সাথে তার এই অপ্রাপ্তবয়স্ক, মেধাহীন মেয়েকে নিয়ে। অথচ আমার স্বপ্ন আমি যাকে বিয়ে করবো সে হবে….


সেদিন ছাত্রীর মা অপ্রাসঙ্গিকভাবে আমাকে বলে বসলেন স্যার, বিয়ে করেছেন? আমি কিছুটা অনভিপ্রেত হয়ে সলজ্জ হাসি হেসে বললাম, না। ছাত্রী পড়ালে এ এক সমস্যা! অনেক অবিভাবক শিক্ষিত ছেলে দেখে বিয়ে দিতে চায়। আমি অবশ্য কখনো এমনটা ভাবি নি।

রিয়া’র ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই উঠেনি। মেয়েটি মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তা-ও আবার ছাত্রী হিসেবে তৃতীয় শ্রেণী! সব শিক্ষক জানেন অলস, পড়তে ভালো না লাগা টাইপ স্টুডেন্ট পড়ানো কী যে কষ্টের। তবু পড়াচ্ছি। না পড়িয়ে কী করবো, এই করোনা কালে? এমনিতেই আর্থিক সংকটে যাচ্ছি।

তবে গতকাল পড়াতে গিয়ে ছাত্রীর মা সহ পুরো পরিবারটির উপর রাগ হলো। ছাত্রীর মা ছাত্রীর সামনে আমাকে বললেন স্যার রিয়ার জন্য একটা পাত্র দেইখেন। আমি কিছুটা রাগের স্বরে বললাম সময় হোক। এটুকু বলেই চুপ করে গেলাম। কিন্তু ছাত্রীর মা নানান কথা দ্বারা নানা রকম ইন্ডিকেট করতেছে আর হাসতেছে।

এসবের মাঝে একবার বলেই বসলো রিয়া তোমার স্যার এতো সুন্দর কেন?

বাসায় এসে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম যে, এই অর্ধ-শিক্ষিত পরিবারে পড়াতে যাওয়ানোটাই ভুল ছিলো। অবচেতন মন বলছে টিউশনটা ছেড়ে দেয়া উচিত। পরোক্ষণেই চেতন মন বলছে টিউশন ছেড়ে এই শহরে চলবা কেমনে? যেই শহরের মানুষেরা প্রচন্ড রকমের স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক। কারণ এই শহরের মানুষেরা শিক্ষিত।

মানুষ যতো বেশি শিক্ষিত ততো বেশী সচেতন ও আত্মকেন্দ্রিক হয়। এখানে কেউ কাউকে স্বত্ব ত্যাগ করে এক টাকা দেয়া দূরে ১টাকা কর্যে হাসানা কেউ কাউকে দেয় না। এমনকি দোকানদারদের কাছে খুব পরিচিত না হলে ৫০০/১০০০টাকার খুচরাও পাওয়া যায় না। কারণ, বিশ্বাসের অভাব। এখানে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না।

সেই শহরে টিউশন ছেড়ে করবটা কী? নাহ টিউশন ছাড়বো না। কষ্ট হলেও আরো কয়েকমাস পড়াবো। তবে ছাত্রীর মা যে স্বপ্ন দেখে তা কখনো পূরণ হবার নয়। মাঝেমাঝে এই ভেবে হাসি পায় যে ছাত্রীর মা বোকার স্বর্গে বাস করছে। মানুষ স্বপ্ন দেখলে ও নিজের অবস্থা ও যোগ্যতার ওপর নজর রাখে। ছাত্রীর মা এ কী অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে আমার মতো উচ্চশিক্ষিত ও সচেতন মানুষের সাথে তার এই অপ্রাপ্তবয়স্ক, মেধাহীন মেয়েকে নিয়ে। অথচ আমার স্বপ্ন আমি যাকে বিয়ে করবো সে হবে উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত ও রুচিশীল।

আর হবে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী। যে বই পড়তে, গান শুনতে, নাটক-মুভি দেখতে ভালোবাসবে। যার সাথে গল্প হবে কোন উপন্যাস কিংবা কবিতার বই নিয়ে। কিংবা তার সাথে কথা হবে দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক হালচাল নিয়ে। আমি হয়তো একদিন কফি হাতে তাকে জিজ্ঞাসিব এই যে পেঁয়াজের দাম এতো বাড়লো বলতো এর পিছনে কী কী কারণ নিহিত? সে ব্যাখ্যা দিবে আমি তাকে স্ট্যান্ড বা কাউন্টার করবো আর এভাবেই আড্ডা জমে উঠবে।

সত্যি বলতে সুশ্রী, শিক্ষিত-রুচিশীল মেয়ের সাথে গল্প করতেও ভালো লাগে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাই নি।

আজ ২১তারিখ। আজ আমার বেতন পাওয়ার দিন। এই পরিবারের প্রতি আমি নানান কারণে রুষ্ট হলেও এদের ২টা গুণ আমার বেশ লাগে। এক.সময় মতো বেতন দিয়ে দেয়। দুই.প্রতিদিন নাস্তা দেয়। সন্ধায় পড়াই তাই বাইরে নাস্তার অতিরিক্ত খরচ বেঁচে যায়। আজ বেতন দিবে তাই ফুরফুরে মেজাজে আছি। ভাবতেছি টাকাগুলো দিয়ে কী কী কিনবো। কোথায় কোথায় খরচ করবো। এর মধ্যে আছে ৫০০টাকা এক্সটা রেখে দিবো বই কেনার জন্য। প্রতিমাসেই এমনটা ভাবি বাট ২০০/১০০ টাকার বেশী বই কিনতে পারি নি।

টিউশনির টাকা শব্দের গতিতে আসলে ও আলোর গতিতে চলে যায়। এ মাসের পরিকল্পনা ছাড়াও আগামী মাসে টিউশনির টাকা পেলে সম্ভাব্য কী কী করবো তার ও একটা ছক মনে মনে এঁকে নিলাম। তন্মধ্যে আছে আম্মাকে একটা শাড়ি আর আব্বাকে একটা ঘড়ি দিব। গত ২৬বছর শুধু তাদের থেকে নিলাম কিছুইতো তাদের দিতে পারলাম না।

তাই আগামী মাসের বেতনের অর্ধেক তাদের জন্য বরাদ্দ। আর ১০০০টাকা সঞ্চয় রাখবো সামনে চাকরি পরীক্ষার ফি বাবদ। এমন নানান পূর্ব পরিকল্পনার ফিরিস্তি যখন মস্তিষ্কের নিউরনে অনুরণিত হচ্ছিল ঠিক তখনি প্রতিদিনের মতো আজও ছাত্রীর মা ট্রে করে চা-নাস্তা নিয়ে এসেছেন। আজকের নাস্তায় আছে চা-বিস্কুট, ডিম অমলেট, আর এক ফ্রিচে কমলা।

প্রথম কমলা দিয়ে শুরু করলাম কমলা খাচ্ছি আর ডিম অমলেটের দিকে দৃষ্টি রেখে মনেমনে বললাম, যতই অমলেট খাওয়ান না কেন। যে স্বপ্ন দেখছেন সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
পড়ানো শেষে ছাত্রীর মা আমার হাতে একটি খাম এনে দিলেন। তারপর রিয়াকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি কি তোমার নানু বাড়ী যাবে?

রিয়া বললো, হ্যাঁ।

এবার ছাত্রীর মা তার দৃষ্টি আমার দিকে ফিরিয়ে বললেন,

স্যার, ওর মামার বিয়ে আছে। ওরা গ্রামের বাড়িতে যাবে। আগামীকাল থেকে আর পড়বে না। এ কথাটা শ্রবণে আমার বুকের বাম পাশটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এই পেন্ডেমিক টাইমে এমন অনাকাংক্ষিত বিদায়ের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।

সমাপ্ত

লেখায়ঃ আ.ম মমিনুল ইসলাম

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “অপ্রত্যাশিত” নামের গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ। )

আরো পড়ুন – স্বামী স্ত্রীর রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প – পর্ব ১

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *