রঙ বেরঙে – আবেগী মায়ার গল্প

রঙ বেরঙে – আবেগী মায়ার গল্প: বাকি রাতটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়েটার উপর পাশবিক নির্যাতনকরে নিজের পুরুষত্ব ফলাও করেছে আরাফ। বিছানার একপাশে কালো কম্ফোর্টারে আবৃত প্রণয়ীর নগ্ন দেহ প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।


পর্ব ১

আমার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে সজোরে ধাক্কা মেরে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছে আমার প্রাক্তন। বিয়ের লাল টকটকে বেনারসি পরণে থাকা আমার স্ত্রী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে৷

মেয়েটা প্রতিবন্ধী। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিয়ের কনেকে পা দিয়ে ঠেলে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমার প্রাক্তন রুবা চিৎকার করে বলল,

“টাকার লোভে তুমি আমার নয় বছরের ভালোবাসা এভাবে জলে ভাসিয়ে দিলে? যে পুরুষ টাকার জন্য এত দিনের সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে পারে সে জানোয়ার ছাড়া কিছুই নয়। আমি কোনো দিন তোমাকে মাফ করবো না। তুমি পস্তাবে, আমার কাছেই ফিরবে। কয়েকটা ঘন্টার ব্যবধানেই তুমি আমার কাছে ফিরবে।”

রুবা এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। ওড়নার কোণায় চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত হেঁটে চলে যাচ্ছে সে।
আমার স্ত্রী প্রনয়ী আমার শার্টের এক কোণা ধরে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে৷

তাকে হাত ধরে টেনে তোলার পূর্বেই আমার বন্ধু এসে প্রায় তাকে জড়িয়ে ধরে তুলে চেয়ারে বসালো। আদুরে গলায় তাকে জিজ্ঞেস করল,
“বুনু ব্যথা পাইছিস?”

প্রনয়ী মাথা দুপাশে দুলিয়ে না করলে আমার জিগরি দোস্ত আমায় বলল,
“ওদিকে আয়। কথা আছে।”
“কী কথা বল।”

“তুই কী রাগ করে আছিস?”
“না রাগ করবো কেন? আজ আমার বিয়ে। দেখ আমি কত খুশী। বাংলা সিনেমার ওমর সানির মতো বেকারত্ব ঘুঁচাতে, বাবার স্বপ্ন পূর্ণ করতে আমি নয় বছরের ভালোবাসা ত্যাগ করে বন্ধুর অসহায়, প্রতিবন্ধী বোনকে বিয়ে করছি। যাকে নিয়ে না আমি দাঁড়াতে পারবো কারো সামনে, না তাকে দিয়ে হবে আমার সংসার।

এতদিন যে মেয়েটা আমাকে ভালোবেসে অপেক্ষা করে রইল? সেই মেয়েটা আজ বিয়ের আসর থেকে কেঁদে চলে গেল। আমি খুশী হবো না?”

“তবে তুই বিয়ের জন্য রাজী কেন হয়েছিলি? এই সম্পর্কের কোনো ভবিষ্যৎ তো তুই দেখছিস না!”
মারুফের কথা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করেনি আরাফ। দ্রুত পা ফেলে চলে এসেছে বাহিরে। পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নিলো সে। নাক মুখ দিয়ে অনবরত বেরিয়ে আসছে নিকোটিনের ধোঁয়া।

সে ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আরাফ বলল,
“সব কিছুর পোড়া গন্ধ হয় কিন্তু হৃদয় পোড়া গন্ধ হয় না কেন?

খেতে বসে নিজ পরণের কাপর নষ্ট করে ফেলেছে প্রনয়ী। তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রণব সাহেব। তার স্ত্রী রুমানা ছিল তার খালাতো বোন। রক্তের মাঝে বিয়ে হলে অধিকাংশ সময়ে না হলেও মাঝেমধ্যে এই সমস্যা হয়। সন্তানগুলো প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মায়।

তাদের প্রথম সন্তান ছিল ছেলে। রাজার ঘরে ঠিক রাজপুত্রের জন্ম। কিন্তু বয়স ছয় মাস হতে না হতেই সে ছেলের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেওয়া শুরু করলো। ডক্টর বলেছিল কম খাবার খাওয়াতে কারণ তার ওজন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছিল। যখন ক্ষুধা লাগতো বাচ্চাটা হাউমাউ করে কাঁদতো। মারুফ যখন পেটে এলো তখন রুমানা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ একদিন ভোর বেলা তাদের প্রথম সন্তানের খিঁচুনি শুরু হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যায় তাদের প্রথম সন্তান।

সন্তান হারিয়ে রুমানা দিন দিন আরো ভেঙ্গে পড়তে লাগে। বিভিন্ন সময় সে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টাও করে। নিজেকে দাবী করতে লাগে তার সন্তানের খুনী হিসেবে। কারণ সে তার সঠিক জন্ম নেয়নি।

এদিকে প্রণব সাহেব বেশ চিন্তিত ছিলেন কারণ জেনেটিক এবং ব্লাড ইকুয়েশন এর একটা কারণে তাদের সন্তান প্রতিবন্ধী জন্ম নিয়েছিল। যার সম্ভাবনা এবারো প্রবল ছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কৃপায় মারুফ সুস্থ এবং আর পাঁচটা বাচ্চার মতোন জন্ম নেয়। এক সময় মারুফের সাহায্যে তার মা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

ধীরে ধীরে মারুফ বড় হতে থাকে। মারুফের বয়স যখন দশ, রুমানা আবার সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়ে।
কিন্তু এবার জন্ম হয় প্রণয়ীর। প্রণয়ী আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়।

দেখতে সে সম্পূর্ণ মায়ের রূপ পেলেও তার বুদ্ধি স্বাভাবিক নয়। তাকে গভীরভাবে খেয়াল করলে বুঝতে পারা যায় সে হাতের কড় গুনে সবসময় হিসেবে ব্যস্ত থাকে। ঘাড় শক্ত করে রেখে শুধু মুখ অনবরত কাঁপতে থাকে তার। মাঝেমধ্যে সব ভুলে যায়। তার শারীরিক কোনো সমস্যা নেই তবে ভালো মন্দের বিচার সব সময় করতে পারে না। মাঝেমধ্যে হঠাৎ প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়, নার্ভাস হলে সে কাঁপতে থাকে। তাছাড়া সব’চে খারাপ যে দিকটা হলো প্রণয়ী রাগ উঠলে কামড়ে দেয়।

কাজের লোকগুলো তার আশেপাশে যায় না কিন্তু একজন খালা আছেন যিনি রুমানা বেগমের মৃত্যুর পর থেকে তার দেখাশোনা করে চলেছে।

আজ সন্ধ্যের ঘটনার পর প্রণয়ী কিছুটা ভয় পেয়ে আছে। রুবা নামের মেয়েটা তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল তাই।

মেয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলেন প্রনব সাহেব। পরম যত্নে খাবার খাইয়ে দিচ্ছেন মেয়েকে।
রুবার জন্য যে তার খারাপ লাগছে না তা নয়।

কিন্তু বাবা হিসেবে সে স্বার্থপর। বড়ই স্বার্থপর।
রুবা স্বাভাবিক মেয়ে, সে চাইলেই জীবনে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
কিন্তু প্রণয়ী? আজ বাদে কাল যখন বাবা থাকবে না তাকে কে দেখে রাখবে?

তাই আরাফকে প্রণয়ীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে দায়মুক্ত হয়েছেন প্রণব সাহেব। কিন্তু বার বার তার মনে হচ্ছে
আদৌও কী পৃথিবীর কোনো পিতা তার কলিজার দায়িত্ব কাউকে দিয়ে দায়মুক্ত হতে পারে?

বিদেশি হরেকরকম ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বাসরঘর। সেখানে বউ সেজে বসে থাকার কথা ছিল রুবার কিন্তু ঘুমিয়ে আছে প্রণয়ী। মেয়েটার প্রতি ঘৃণা না সহমর্মিতা দেখাবে আরাফ?

সে নিজে আজ সকালে তার বন্ধুর বাবাকে বলেছিল “প্রণয়ী ভালোবাসার স্পর্শ বুঝে আংকেল। যে কিছুই বুঝে না সে ভালোবাসার স্পর্শ বুঝে, ভালোবাসা বুঝে। ওর জন্য ভালোবাসার মানুষ খুঁজে আনুন।”
কে জানতো তাকেই বেছে নিবেন প্রনব সাহেব।

ফোনের শব্দে ধ্যান ফিরে আরাফের। স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে রুবার নাম।
কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে বলে উঠল,

“যে পুরুষ একজন নারীকে গভীর অন্ধকারে রেখে চলে যেতে পারে এর মানে দুটো হয়।
সে তাকে ভালোবাসে না এবং সে তাকে অবশ্যই ভালোবাসে না।

অভিনন্দন প্রাক্তন। তোমার আগামী জীবন এবং বাসর রাত সুখের হোক। আমি মেনে নিতে পারলাম না এটা আমার ব্যর্থতা। তুমি আমায় ভুলে গেলে এটা তোমার সফলতা। আজ যে টাকা, নামের জন্য আমায় ছাড়লে, একদিন তোমার সব হবে কিন্তু তুমি শূন্য থাকবে। না পাওয়া তোমায় ঘিরে রাখবে।

শুধু একটা অনুরোধ আমায় কাল একবার দেখতে এসো। একমুঠো মাটি আমার কবরে দিও।”
কল কেটে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি পাঠায় রুবা। যেখানে স্পষ্টত সে নিজেকে শেষ করবার জন্য পায়ের শিরা কেটে ফেলেছে।


পর্ব ২

বাকি রাতটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়েটার উপর পাশবিক নির্যাতনকরে নিজের পুরুষত্ব ফলাও করেছে আরাফ।
বিছানার একপাশে কালো কম্ফোর্টারে আবৃত প্রণয়ীর নগ্ন দেহ প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে।

সকালের আলো চোখেমুখে এসে লাগতেই চোখমুখে এসে পড়তেই উঠে বসলো আরাফ। সামনে কাউচের উপর পড়ে রয়েছে তার শার্ট। শার্ট টা দেখেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। রুবা উপহার দিয়েছিল তাকে।
তাদের নবম প্রণয় দিবস উপলক্ষে। বিনিময়ে সে রুবাকে কি দিয়েছিল?

হ্যাঁ মনে পড়েছে। এক জোড়া রুপার নুপুর।

মেয়েটার নুপুরের প্রতি খুব ভালোলাগা রয়েছে। আরাফ এর ইচ্ছে ছিল রুবাকে তার ২৫ তম জন্মদিনে ২৫ জোড়া নুপুর উপহার দিবে। চমকে দিবে মেয়েটাকে। কিন্তু তার বেকারত্ব তাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। টুকটাক ব্যবসার জন্য রুবা তার জমানো সব টাকা গুছিয়ে নিয়েছিল। দুজনে মিলে ছোট্ট একটা ব্যবসা শুরু করবে৷

রুবা নিজ হাতে বানানো পিঠে গুলো নিয়ে। তাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে, সেই সংসারের জন্য দুজনে অনেক পরিশ্রম করবে। দিন রাত পরিশ্রম করে যখন একে অপরে ক্লান্ত হয়ে যাবে তখন নাইয়ে নিবে ভালোবাসার জলে।

কাল দুপুর অবধি তাদের স্বপ্নগুলো কত রঙের ছিল। আজ তাদের জীবনটা শুধুই বেরঙের।

ফ্রেশ হতে এসে ওয়াশরুমের আয়নার দিকে নজর পড়লো। বুক জুড়ে কামড়ের দাগ। মেয়েটা যেমন পেরেছে তাকে আঁচড়ে কামড়ে তার থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি, তার পৈশাচিক অনুভূতি থেকে।
গায়ে পানি লাগতেই জ্বলতে শুরু করেছে আরাফের পুরো শরীর।

কাল রাতে রাগ দমাতে পারেনি সে।

যখন সে জানতে পারলো রুবা কোনো দিন হাটতে পারবে না। পারলেও অনেকটা ঝুঁকি থেকে যাবে।
তখন সব রাগ গিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত প্রণয়ীর উপর।

ভালোবাসার মানুষগুলো অমূল্য সম্পদ। তাদের কোনো দুঃসংবাদ মানব মস্তিষ্ককে ক্ষণিকের জন্য বিকল করে দেয়।

ফুলিখালা সকালের চা নিয়ে এসে দরজায় কড়া নাড়ছে তার পিছনে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন প্রণব সাহেব। চেহারায় খুশি খুশি ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। আজ থেকে তার দায়িত্ব ফুরিয়েছে। না হলে মেয়েটা এত বেলা অবধি ঘুমায় না। সকালবেলা উঠে বাবার ঘরের দিকটায় বসে থাকে সে।

রুমানা বেগম মারা যাওয়ার পর থেকে দিন শুরু হয় মেয়ের মুখ দেখেই।
আরাফ যখন দরজা খুলল, প্রনব সাহেব হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“হে জেন্টেলম্যান! গুড মর্নিং।”

“শুভ সকাল।”
“প্রণয়ী? উঠেনি?”
“এখনো না।”
“আমি একবার ডাকবো?”

ফুলি খালা ততক্ষণে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেছে। প্রণয়ীকে বেগতিক অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেলেন তিনি। ছোট্ট থেকে নিজ হাতে পালন করা মেয়েকে যদি স্বামী নামক মানুষটা এমন নির্যাতন করে যখন মেয়েটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে। দুচোখের পানি আটকে রেখে ফুলি খালা বললেন,

“ভাইজান আসার দরকার নাই। জননীরে আমি ডাইকা তুইলা আনতেছি। আপনি নিচে যান জামাই বাবাজীরে নিয়া। টেবিলে নাস্তা দিছি। ঠান্ডা হইয়া যাইবো।”

প্রনব সাহেব বিনাবাক্যে কথা মেনে নিয়ে আরাফকে নিয়ে নিচে চলে গেলেন।
খাবার টেবিলে বসে আরাফ সজলকে ম্যাসেজ করলো,

“রুবা কেমন আছে?”
“ভালো নেই। তুই ভালো থাকতে দিয়েছিস?”
“খেয়েছে কিছু?”
“স্যালাইন চলছে। রক্ত ক্ষরণ হয়েছে অনেক।”
“বাঁচবে তো?”

আরাফ খেয়াল করছিল তার দুহার অনবরত কাঁপছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। তবুও সে তাকিয়ে আছে ফোনের স্ক্রীনের দিকে। সেদিকে তাকিয়েই টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো ফোনের স্ক্রিনে।

“এ যাত্রায় বেঁচে যাবে। জানিস ওর গায়ে বেশ জ্বর। ওর মা খুব কাঁদছে রে।”

“আন্টির মাইগ্রেন এর সমস্যা আছে। তাকে মেডিসিন এনে দে। সাথে গ্লুকোজ পানি। উনার শরীর বেশি ভালো না।”

“এতই যখন ভাবিস তবে ছেড়ে দিলি কেন?”
“প্রতিটা ব্যর্থ প্রেমিকের একটা ব্যর্থ গল্প থাকে।”

মা! মা! পানি!
গোলাপি কম্ফোর্টারের অনেকটায় লাল রক্তের দাগ।
পুরো শরীর খুবলে খেয়েছে আরাফ। তাকে উঠিয়ে কোনো ভাবে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলেন ফুলি খালা। হাঁটতে পারছে না মেয়েটা। শরীরে পানি লাগতেই কাঁদতে লাগলো সে।

বাবাটা মারা গেলে এই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েটার কী হবে?
তার ভাই যে মেয়েকে পছন্দ করেছে সে মেয়ে মেনে নিবে না এই পাগলীটাকে। স্বামী অবশ্যই তাকে পুরো জীবন ভালো রাখবে না।

ফুলি সে নিজেই তো এই বাড়ির আশ্রিতা। তার বা সামর্থ্য কী?
প্রতিবন্ধী মানুষগুলো কেন এই সমাজের কাছে বোঝা?
বাবা মা ছাড়া কেন তাদের কেউ আপন হয় না?

সমাজ কেন তাদের নিয়ে সব সময় হাসিতামাশা করে?
একটু সহোযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই তো এই মানুষগুলোও স্বাভাবিক একটা জীবন পেতে পারে।
ডক্টর মাহিয়া রুহী বিগত বছর তিনেক যাবত প্রণয়ীকে কনসাল্ট করে।

মেয়েটাকে খুব পছন্দ করে প্রণয়ী। ছুটির দিনগুলো সে প্রণয়ীর সাথে কাটাতে পছন্দ করে। এই দিনটায় সে প্রণয়ীকে নিয়ে তার মতোন মানুষগুলোর সাথে দেখা করতে নিয়ে যায়। প্রণয়ী ছোটো বাচ্চাদের অংক শেখায়।

হ্যাঁ প্রণয়ী একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়েও গণিত বিষয়ে সে যে কোনো হিসেব খুব দ্রুত আয়ত্ত করে নিতে পারে। গণিত ছাড়া অন্য কোনো বিষয় সে খুব একটা মনে রাখতে পারে না। সে ছবি আঁকতে পারে না, ভালোভাবে কোনো ভাষাও বুঝে না। যদি কোনো কিছু সে ভালোবেসে থাকে তবে গণিত।

পুরো দিন সে হাতের কড় গুলে হিসেব করে৷ যেকোনো ধরনের গাণিতিক সূত্রাবলী বা জটিলতা প্রণয়ী খুব স্বাভাবিকভাবে বুঝে নিতে পারে যেখানে সে নিজের কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারে না।

এজন্য মাহিয়া রুহী তাকে নিয়ে সব সময় বলে,
“প্রতিবন্ধী নয়, তারা স্পেশাল হয়। আমাদের সৃষ্টিকর্তা সাধারণ মানুষ হিসেবে সব দিয়েছে কিন্তু স্পেশাল চাইল্ডদের সৃষ্টিকর্তা কোনো এক বিষয় খুব মেধা দান করে। যেমন প্রণয়ী গণিতে সে সেরা। আংকেল যেভাবে পারেন ওর লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।”

মাহিয়া রুহীকে কল দিয়ে ফুলীখালা সবটা বললে সে দ্রুত হাজির হয়।
এখনো প্রনব সাহেব কিছু জানেন না।

মাহিয়া আরাফকে মনে মনে পৃথিবীর সব’চে জঘন্য গালি দিয়ে বলল,
“শালা পার্ভাট একটা। ওকে তো আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।”


পর্ব ৩

মায়ের পরকীয়া সহ্য করতে না পেরে নিজ মা কে চাপাতি দিয়ে টুকরো টুকরো করে বাবাকে জন্ম দিনের উপহার দিয়েছে তার একমাত্র ছেলে। অন্ধ বাবার প্রতি মায়ের অবহেলা কিংবা মায়ের বাড়াবাড়ি রকমের সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তিত ছিল কিশোর নাজমুল। গতকাল রাতে দোকান থেকে ফিরে এসে মা কে অন্যের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেললে তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নেয় মাকে খুন করার।
অন্ধ বাবাকে মসজিদে রেখে এসে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে মাকে গরম দুধের সাথে মিশিয়ে নিজ হাতে মাকে খাওয়ায় ছেলে।

মা যখন গভীর ঘুমে বিভোর তখন গরু জবাই করার ছুড়ি এবং চাপাতি দিয়ে খুন করে মা কে।

খবরটা পড়েই চশমা খুলে পাশে রাখলেন আনোয়ার হোসেন। পেশায় স্কুল শিক্ষক ছিলেন তিনি। অবসরে এসেছেন বছর দশেক হবে। মেয়ে দুটো বিয়ে দিয়েছে। তবে ছোটো মেয়ের কপালটা খুব ভালো না।
মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার পর থেকেই কষ্ট করতে হচ্ছে। বড় মেয়ের স্বামী বিদেশে থাকে। ছোটো মেয়ের স্বামী বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা জমা দিলেও ধরা খেয়ে বসে আছে।
টুকটাক ব্যবসা করে চলছে। মেয়েটার ঘরেও আল্লাহ্ দুইটা মেয়ে দিয়েছেন। তাদের নিয়ে টেনেটুনে সংসার চলছে কোনো রকমে। বাড়িতে ভালো একটা খাবার রান্না হলে মনটা দুমড়ে মুচড়ে উঠে। কে জানে মেয়েটা আজ কী রান্না করছে? কী তুলে দিবে দুই নাতনীর প্লেটে৷ শেষ মেষ তার ভাগে কিছু পড়বে তো?

মেয়েকে খুব একটা দিতেও পারে না সে। কোথায় থেকেই বা দিবে? তার বা এত সামর্থ্য কই? নাতনী দুটোর জন্য ইদানীং মনটা কেমন কেমন করছে। ভেবেছে আজকালের মধ্যে যাবে দেখতে।
এদিকে আরো ছোটো একটা মেয়ে ঘরে বড় হচ্ছে। তাকেও বিয়ে দিতে হবে৷ লেখা পড়ায় ভালো মেয়েটা। অনেক পড়ানোর ইচ্ছে।

পাশ করে ছেলেটা শুনেছে টুকিটাকি চাকরি করছে। কিন্তু মেঝ মেয়ের জীবন দিয়ে সে বুঝতে পারছে টুকটাক চাকরি না ব্যবসায় জীবন চলে না চলার মতোন। যেখানে প্রতিদিন সকালে উঠে চিন্তা করতে হয় আজকের পুরো দিনে সন্তানের মুখে চারটে খাবার তুলে দিতে পারবো তো?

গত পরশু এক লোক এসেছিলেন তার সাথে দেখা করতে। তখন তিনি পাশের জমিতে আগাছা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।
ভদ্রলোক এসেছিলেন গাড়ি নিয়ে। সরাসরি নেমে গিয়েছিলেন চাষের জমিতেই। তপ্ত রোদে তার মুখশ্রী অল্প সময়েই লাল হয়ে উঠেছিল।
ভদ্রলোক এসেছিলেন তার একমাত্র মেয়ের সম্বন্ধ নিয়ে তার ছেলে আরাফের জন্য।

কিছু লুকোয়নি ভদ্রলোক। মেয়ের সকল কমতি এবং প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সরাসরি কথা বলেছেন তিনি।
অনেক কিছু ভেবে না করে দিতে চেয়েছিলেন আনোয়ার সাহেব কিন্তু আরাফের একটা ভালো ভবিষ্যৎ কিংবা অসহায় মেয়ের বাবার আবদার ফেলতে পারেননি তিনি। তাই ছেলেকে এক প্রকার বাধ্যই করেছে বিয়ে করতে৷

নিজ মাথায় তাকে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করিয়েছে মেয়েকে সে বিয়ে করবে।
সন্তান যতই অবাধ্য হোক না কেন বাবার মাথায় হাত রাখিয়ে যদি কোনো প্রতিজ্ঞা করানো হয় তবে সন্তান সে কথা নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে হলেও করে।
আরাফ এমনটাই করেছে।

ছেলেটার বিয়ের আসরে সে যায়নি। কারণ ছেলের মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই। সন্তানের ভালোর জন্য সে ছেলেকে বাধ্য করেছে বিয়েটা করতে। কারণ সে বিশ্বাস করে প্রেম ভালোবাসা বার বার হলেও ভালো ভবিষ্যৎ বারবার হাতছানি দেয় না।

রুবার সামনে রাখা ফুলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। তার মুখে ফুটে উঠেছে আধো বিরক্তির ছাপ।

আজ বিকেলে এসেছে ফুলগুলো। এই ফুলগুলোকে স্পর্শ করে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু এত দামী ফুল কোনো দিন কেনা হয়নি।
আরাফের কাছেও কখনো আবদার করেনি। তাদের ভালোবাসাটা এমন ছিল না। যেখানে আবদার থাকবে দামী বা উচ্চমূল্যের। তাদের সম্পর্ক ছিল পাশাপাশি বসে ঘরে বানানো পিঠা এক সাথে খাওয়া।
হোটেল বা রেস্টুরেন্টে তাদের প্রেম জমেনি। তাদের প্রেম জমেছিল ভীড়ে ভর্তি বাসের সিটে হাতে হাত রেখে।

রুবা আরাফকে ভুলতে পারছে না। তার কাছে সব কিছু কেমন অসহ্য লাগছে।

ইচ্ছে হচ্ছে সবাইকে সে যদি মেরে ফেলতে পারতো!

আরাফ নামের অর্থ তো যার সুবিচারক। কিন্তু সে তার ভালোবাসার সাথে এমন কেন করলো?
“আসবো?”

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মারুফের দিকে তাকিয়ে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো রুবা। মারুফ বিষয়টা বুঝে বলল,
“আমার বোনের কোনো দোষ নেই।”

“ওমন মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখেছো কেন? বিষ দিয়ে মেরে ফেলো।”

“মানছি যা হয়েছে খারাপ হয়েছে কিন্তু তাই বলে তুমি আমার বোনকে মরতে বলতে পারো না।”
“নয় বছরের সম্পর্ক মানে বুঝো? আমার সব সে আর তাকেই তোমার বোনের জন্য নিয়ে নিলে? শুধু টাকার জোরে?”
“আমরা জানতাম না বাবা কাকে পছন্দ করেছে।”

“হয়েছে। থামো ওকে নিয়ে আজ সাফাই গাইছো? মিলিয়ে নিও এই তোমার বোন এক দিন তোমার জীবনেও অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। আজ যেমন আমি হাসপাতালে কষ্ট পাচ্ছি তোমার আপনজন মৃত্যুর মুখে থাকবে তখন আমার কথাগুলো মনে পড়বে তোমার। খুব করে মনে পড়বে। আমার আজকের কথাগুলো।”

পুরো বিকেল অনেক কিছু চিন্তাভাবনা করে শেষ অবধি নিজের কাছে হেরে গিয়ে আরাফ কল দিলো রুবাকে।
অপর পাশ থেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো রুবা। হঠাৎ আরাফের মনে হলো পৃথিবীর সব’চে অসহায় পুরুষ সে নিজে। তার অসহায়ত্ব অশ্রু রূপে ঝাপসা করে দিলো দৃষ্টি। নিজেকে শক্ত করে সে বলল,
“এখন কেমন আছো?”

“আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমার তো কিছুই চাই না তুমি ফিরে এসো।”

“যে নিজেকে ভালোবাসে না সে আমাকে কী করে ভালোবাসবে?”
“তুমি না এলে সত্যি আমি মরে যাবো।”

“তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি মরে যাওয়া সাহসিকতা নয়। বেঁচে থেকে কাপুরুষদের দেখিয়ে দিতে হয় তাদের ছেড়ে যাওয়ার পরেও বেঁচে থাকতে জানি এটাই সাহসিকতা।”
“কী হয়েছে তোমার কেন এমন করলে? নিজেকে কাপুরষ বলছো?”

“যে যা স্বীকার করে নিতে কোনো আপত্তি নেই। আজ থেকে আমাদের যোগাযোগ হবে না।”

“মনে পড়ে একদিন বলেছিলাম তোমার ক্যারিয়ার হবে, টাকা হবে শুধু আমি থাকবো না। কথাটা সত্যি হলো।”
“নিজের খেয়াল রেখো।”

ফোন রেখে আরাফ রুমে ফিরে দেখলো প্রণয়ী তার সরু সরু আংগুল দিয়ে ধীরেধীরে কিছু মেলানোর চেষ্টা করছে। কাছে গিয়ে দেখলো সে ওয়ার্ড গেম খেলছে। শব্দের সাথে নতুন অক্ষর দিয়ে নতুন শব্দ বানাচ্ছে সে।

রুবার সাথে কথা বলে এমনিতেই তার কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে ছিল প্রণয়ীকে দেখে যেন বিস্ফোরকের কাজ করলো।

ইচ্ছেকৃত ভাবে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিলো বোর্ড। প্রণয়ীর চুলের গোড়ায় হাত চালিয়ে সজোরে টান দিয়ে বলল,
“বউ হয়েছো বরের সেবা করবে না? যাও চা নিয়ে এসো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে৷ না হলে গতকালের কথা মনে আছে?”

প্রণয়ী আরাফকে প্রচন্ড ভয় পেতে শুরু করেছে। সে দ্রুত ছুটতে চাইছে। ছটফট করতে থাকা প্রণয়ীকে হঠাৎ ছেড়ে দিলো আরাফ। প্রণয়ী ধপাস করে নিচে পড়ে হাতে ব্যথা পেলেও দ্রুত ছুটে চলেছে দরজার দিকে।

তার দিকে তাকিয়ে আরাফ বলল,

“তোমায় আমি এতটা কষ্ট দিবো যতটা কষ্ট দিলে যারা আমাকে বাধ্য করেছে তোমাকে বিয়ে করতে তারাই আমাকে অনুরোধ করবে ছেড়ে দিতে।”


পর্ব ৪

কিছুক্ষণ পূর্বে সম্পন্ন হয়েছে রুবা এবং আরাফের বিয়ে। রুবার বাসায় কাজি ডেকে পাঁচ লক্ষ টাকা দেন মোহরে বিয়ে হয়েছে তাদের।
বিয়ের পর রুবা কিছু খাবার মুখে তুলেছে। আরাফ নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে তাকে ঘুমানোর জন্য বলছিল। কারণ তাকে এখন ফিরতে হবে। প্রনব সাহেব আজ তাকে ব্যবসায়ী কিছু কাজ বুঝিয়ে দিবেন।
“প্রণয়ীকে ছেড়ে দিবে না?”

রুবার কথায় আরাফ বলল,
“ও থাকা না থাকা কী সমান নয়?”

“একজন নারী কখনোই তার স্বামীকে অন্যের সাথে মেনে নেয় না।”
“ওর সাথে আমাকে কখনো ভাগ করতে হবে না। কারণ আমি কোনো পণ্য নই রুবা।”
“বিয়েটা কী খুব জরুরি ছিল?”

“বাবাকে আমি বলেছিলাম তোমার কথা। কিন্তু সে আমাকে সুযোগ দেয়নি।
বলেছিল প্রণয়ীকে বিয়ে না করলে পরদিন পুরো পরিবারকে মৃত দেখবো।

তার মাথায় হাত রেখে কসম কাটানোর পর আমার কোনো পথ খোলা ছিল না।”
“আজ তবে কেন এলে?”

“নিজেকে জিজ্ঞেস করো। তুমি নিজের এতটা ক্ষতি করার চেষ্টা না করলেও পারতে।”
“এর মানে কী তোমার বাবা আমাকে মেনে নিবে না?”

“সময় আসুক দেখা যাবে।”

“না তুমি বুঝতে পারছো না। তুমি যদি প্রণয়ীকে না ছাড়ো তবে আমাকে সমাজ কী বলবে জানো?
তোমার ২য় পক্ষ। আমি মেনে নিতে পারবো না।”

“কেউ বলবে না। তাছাড়া প্রণয়ীর মতোন মেয়েরা খুব একটা বেশি দিন বাঁচে না।”
“তুমি সত্যি আজ চলে যাবে? আজ আমাদের বাসর।”

“যেদিন তোমার কাছে ফিরবো। একবারে ফিরবো। পিছন ফিরে তাকাবো না। কিন্তু আজ আমাকে ফিরতে হবে।”

রুবার কপালে গভীর চুমু দিয়ে বেরিয়ে গেলো আরাফ। বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল রুবা। গত কয়েক দিন নিজের উপর যা তা অত্যাচার করেছে সে। আরাফকে সে খুব ভালো ভাবে চিনে। তাই নিজেকে কষ্ট দিয়ে হলেও তাকে তার কাছে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করেছে সে।

রুবা চোখ বন্ধ করেই ধীর গতিতে বলল,

“নারী যখন তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে পায়, ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে যেতে থাকে অন্ধকারে তখন সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। ভালো মন্দ বিচার করে না। প্রয়োজনে নিজের সর্বোচ্চ ক্ষতি অবধি করতে দ্বিধা বোধ করে না।”

প্রণয়ীর জন্য পুরো বাসা প্রনব সাহেব পরীরাজ্যের মতোন সাজিয়েছেন। সে অবচেতন মনে আঘাত পাবে এমন কোনো কিছুই বাসায় নেই। ড্রয়িং রুমে কাউচে মাথা রেখে ফ্লোরে বসে আছে প্রণয়ী। তার সামনে বিভিন্ন রঙের পাজেল রাখা। প্রণয়ীর পরণে পোশাকের রঙ সাদা রঙের। পাজেল হাতে রেখেই সে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। টিভির স্ক্রীনে তখন চলছে একটি এনিমেশন ভিডিও। আরাফ মিনিট দুয়েক পূর্বে এসে বসেছে প্রণয়ীর পাশের কাউচে।

এনিমেশন ভিডিওটা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো প্রণয়ী।

একজন রাজার চার জন স্ত্রী। সবার ছোটো স্ত্রীকে সে সব থেকে বেশি ভালোবাসে। তাকে আদর করে সবার থেকে বেশি। দামী উপহার, গয়না না চাইতেই দেয় ছোটো রানীকে।
তৃতীয় রানী সে পাশের রাজ্যের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য রাজাকে পরামর্শ দেয়। যে সত্যিকারের সুন্দরী এবং দয়ালু। রাজা যখন কোনো পরামর্শের প্রয়োজন হয় তৃতীয় স্ত্রীর কাছে ছুটে যায়। কারণ তার ধৈর্য্য, বুদ্ধিমত্তার কারণে।

কিন্তু যখন সে নিজের প্রথম স্ত্রীর কথা চিন্তা করে সে হতাশায় ডুবে যায়। তার প্রথম স্ত্রী একজন ভালো নীতি নির্ধারক। যে রাজার স্বাস্থ্য এবং সম্পদের খেয়াল রাখতো।

কিন্তু রাজা কখনো তাকে ভালো ভাবে নিতে পারেনি। একদিন রাজা বুঝতে পারলেন তিনি মরন রোগে আক্রান্ত। তিনি হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলেন যখন তিনি মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে ভাবছিলেন। রাজা তার ছোটো স্ত্রীকে ডেকে বললেন,

মৃত্যুর পর সে কী তার সাথে যাবে না কি?

ছোটো স্ত্রী যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল সে নিষেধ করলো। রাজা ব্যথিত হলেন এরপর ৩য় স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন সেও মানা করলো এবং জানালো রাজার মৃত্যুর পর সে বিয়ে করে নিবে। যথারীতি ২য় স্ত্রীও একই জবাব দিলো। রাজা তখন ব্যথিত মনে অপেক্ষা করতে লাগলেন অন্তিম সময়ের জন্য।

সে সময় বাহিরের থেকে কারো কন্ঠ শোনা যাচ্ছিলো যে বলল,

“আমি আপনার সাথে যাবো। আপনি যেখানেই যান না কেন আমি আপনার সাথে যেতে রাজি।”

রাজা তাকিয়ে দেখলেন তার প্রথম স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। রাজা অনুশোচনায় ভুগলেন। এতদিন যাদের জন্য প্রথম স্ত্রীকে অবহেলা করেছেন আজ তারাই তাকে ছেড়ে যাচ্ছে শুধু প্রথম স্ত্রী বাদে।
সত্যি বলতে রাজা হচ্ছে আমরা সবাই। চতুর্থ স্ত্রী সে হচ্ছে আমাদের দেহ। যা মৃত্যুর সাথে সাথেই আমাদের ত্যাগ করে। কিন্তু আমরা সারা জীবন এই দেহকে সকল প্রিয় জিনিস দিয়ে থাকি। তৃতীয় স্ত্রী হচ্ছে আমাদের সমাজে আমাদের স্থান এবং ধন সম্পত্তি। যখন আমরা মারা যাবো অন্যের অধীনে চলে যাবে। দ্বিতীয় স্ত্রী হচ্ছে আমাদের পরিবার, আত্নীয়স্বজন এবং বন্ধু। তারা সারা জীবন আমাদের পাশে থাকলেও মৃত্যুর পর দ্রুত কবর স্থানে রেখে আসে। সাথে থাকে কবরের পাশ অবধি।

এবং প্রথম স্ত্রী হচ্ছে আমার আত্মা। কিংবা নিজস্ব সত্তা। দেহ, সম্পদ, ক্ষমতার দোহাই দিয়ে যাকে আমরা প্রায়শই অবহেলা করি। একমাত্র নিজস্ব সত্তাই আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকে। আমরা যেখানে যাই আমাদের সাথে সাথে চলে। পৃথিবীতে আমরা বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকি। কিন্তু নিজস্ব সুখের পিছনে কয়জন ছুটে যাচ্ছি?

ভিডিও ক্লিপ শেষ হতেই প্রণয়ী হাসি মুখে পাশে তাকাতেই আরাফকে দেখতে পায়। তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কারণ আরাফ যখন তার কাছে আসে তখন তাকে অত্যাচার ব্যতীত ভালোভাবে কথা অবধি বলেনি।

প্রণয়ী সেখান থেকে ছুটে চলে যেতে চাইলে চেয়ারের সাথে লেগে পড়ে গেল। আরাফ দ্রুত তুলতে গেলে তার হাতে কামড়ে দেয় প্রণয়ী। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকাতেই দ্রুত পালায় প্রণতী।
রাত গভীর হলেও ফোনে কথা চলছিল রুবার সাথে। হঠাৎ সে আবদার করলো ভিডিও কলের। কলে আসতেই সে দেখলো আরাফের বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে প্রণতি। যার লম্বা চুল বিছিয়ে আছে পুরো বিছানায়।

“তুমি কোথায় ঘুমাবে?”
“কেন বিছানায়?”
“ওর সাথে?”
“তাই তো থাকছি।”

“ভালো। তবে যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। মনে হয় বিরক্ত হচ্ছো।”
“আশ্চর্য, বিরক্ত কেন হবো?”

“কারণ হোক সে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কিন্তু তবুও সে একজন নারী। তাকে দেখে কামনা জেগে উঠা কোনো খারাপ কিছু নয় তাই না?”
আরাফ জবাব দিতে পারে না। তার পূর্বেই নিচ থেকে চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

দ্রুত নিচে নেমে সে দেখলো প্রনব সাহেবের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে খুব একটা সময় সে বাঁচবে না।

হয়তো হাসপাতাল অবধিই সময় তার হাতে নেই।


পর্ব-৫ (অন্তিম পর্ব)

ভোরের আলো ফুটে উঠেনি তখনো কিন্তু পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রনব সাহেব।

বাবার লাশ যখন বাড়িতে নিয়ে আসা হলো তখন প্রণতি নামের মেয়েটা জানেই না তার মাথার উপর থেকে শেষ অস্তিত্বটাও মুছে গেছে।
বাবার লাশের পাশে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল প্রণতি। ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলল তার বাবার মুখের কাপড়। ধীরে ধীরে
প্রণতির সরু সরু আংগুল আলতো স্পর্শ করলো তার বাবার মুখ।

লাশের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আরাফ। প্রণতির হাতের দিকে খেয়াল করতেই দেখতে পেলো।

আংগুলে রক্ত জমাট বেধেছে। প্রণতির গায়ে রয়েছে এমন অনেক রক্ত জমাটের অংশ যা প্রকাশ করছে আরাফের পুরুষত্ব।
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রণতি ভাবছিল তার বাবা ঘুমিয়ে আছেন। এই হয়তো কিছুক্ষণ পর সে জেগে উঠবে। উঠে তার সাথে কথা বলবে।

মারুফ তাকে ধমক দিলে মারুফকে বকা দিবে। কিন্তু এমন কিছুই হলো না। কালো চাদরে ঢেকে তার বাবাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো।
একজন লোক গোলাপজল ছিটিয়ে দিচ্ছে। প্রণতিকে ফুলি খালা দাঁড়ায় করাতেই সে বুঝতে পারলো তার বাবাকে নিয়ে যাচ্ছে।

পথ রোধ করে দাঁড়ালো সে। কিছুতেই নিয়ে যেতে দিবে না। এদিকে মারুফ তার বোনকে বলল,

“ঘরে যা প্রণতি। বাবাকে নিয়ে যেতে দে।”

প্রণতি দু পাশে ঘাড় নাড়িয়ে জবাব দিলো,
“বাবাকে নিয়ে যেতে দিবো না। আমিও যাবো।”

প্রণতির জেদে মারুফ কিছুটা বিরক্ত হয়ে তাকে ধমক দিলো। আশেপাশের মানুষে তখন চাপাস্বরে কথা শুরু হয়েছে।
বাবা মারা গেছে এক দিন হয়নি আর ভাই তার প্রতিবন্ধী বোনকে মারতে আসছে।

বাবার লাশ যখন বাড়িতেই। এই মেয়েরে এখন কে দেখবে?

আরাফ প্রণতির পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাকে মারুফের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। তাকে নিজের সাথে লেপ্টে নিয়ে জোড় করে জড়িয়ে ধরে রেখে মারুফকে ইশারা করলো এগিয়ে যেতে। মারুফরা গেট পার হতেই প্রণতি চিৎকার করতে লাগলো।

আরাফ প্রণতিকে ততক্ষণ অবধি ছাড়েনি যতক্ষণ না সে শান্ত হয়েছে।
সদ্য পিতা হারানো প্রণতিকে নিজের ছায়ায় নিয়ে নিলো আরাফ।

রুবা কল দিয়ে আরাফকে জিজ্ঞেস করলো কখন সে আসবে। আরাফ জবাবে তাকে বলল সে আসতে পারবে না কারণ প্রণতিকে মারুফ মারতে এসেছিল। মেয়েটা এখন এতিম এবং তার দায়িত্ব। একথা শুনে রুবা গুমরে কেঁদে উঠলো। তার চাপা কান্নার স্বর ফোনের অপর পাশ থেকে শুনতে পাচ্ছে আরাফ।

“আমি আসবো রুবা। তবে আজ নয়। কাল তোমার অপারেশন আছে। তুমি বিশ্রাম নাও। রাখছি।”

মারুফ ফিরলো গভীর রাতে৷ মদ্যপান করে। তার বাবা থাকাকালীন সময়ে এমন করতে পারেনি। আজ থেকে সে মুক্ত। ফিরে এসেই নিজ ঘরে দরজা লাগালো সে। বাড়িতে তার বোন আছে তাকে সামলানোর দায়িত্ব সে নেয়নি। নিজ ইচ্ছেমতো আছে সে। ফুলি খালা প্রণতিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।

এদিকে রুবার অনবরত কলে আরাফকে বেরিয়ে যেতে হলো মাঝরাতেই। কারণ রুবার শারিরীক সমস্যা হচ্ছে। রুবার মা একা একজন মানুষ। স্বামী সন্তান কিংবা অন্য কোনো আত্মীয় স্বজন তাদের নেই। এদিকে মেয়েকে নিয়ে সে কী করবে ভেবে না পেয়ে কল দিচ্ছিলো তাকে।

আরাফ রুবাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালে দ্রুত তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো কারণ আরাফ আসতে চায়নি বলে সে নিজের ক্ষতি পুনরায় করেছে।
ধীরে ধীরে কেটে গেল তিন দিন। এই তিন দিনে আরাফ ফিরতে পারেনি প্রণতির কাছে। যেদিন ফিরে এলো সেদিন ফিরে দেখতে পেল প্রণতিকে বেধে রাখা হয়েছে ড্রয়িং রুমের একটা চেয়ারের সাথে।
শুধু তাই নয়, তার মুখে মারের দাগ স্পষ্ট। ফুলি খালা দাঁড়িয়ে আছেন একটু দূরেই। মুখে আঁচল গুজে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন তিনি।

আরাফের চোখ এবার পড়লো অপর পাশে বসে থাকা মারুফের দিকে। তার ঘাড় দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। একজন ডক্টর এসেছে তাকে ট্রিটমেন্ট দিতে।
বুঝতে বাকী রইল না যে প্রণতি তাকে কামড়ে দিয়েছে। আর এজন্যই মারুফ তাকে বেধে রেখেছে।

মারুফের দিকে আরাফ এগিয়ে যেতেই তাকে সবটা বলল মারুফ।

প্রণতি তখন অনবরত কাঁপছে। আরাফ দ্রুত তার কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু কাছাকাছি যেতেই প্রণতি তাকে সজোরে লাথি মারে তার তলপেটের দিকটায়।
আকষ্মিকতায় তাল সামলাতে না পেরে আরাফ পড়ে গেল ফ্লোরে। বাম হাতের কনুইতে ব্যথা পেয়েছে সে।

মারুফ তাকে হাত ধরে তুলে বলল,

“তিন দিন কই ছিলি? তোর দায়িত্ব না? এখন নিয়ে বিদায় হো।”

“আমার দায়িত্ব একার মারুফ? তোর বোন না?”

“কোনো বোন তার ভাইকে এমন কামড়ে দেয়? গত তিন দিন ধরে সে বাসার জিনিসপত্র ভাংছে। বাবা বাবা করছে। যাকে পাচ্ছে তাকে আঘাত করছে।”
“ওর ডাক্তারকে ডাকছিস না কেন?”

“সময় বুঝে সেও পাল্লা ঝেড়েছে।”
“ওর মানসিক অবস্থাটা বুঝ। ওকে বেধে রাখলে…”

“গিয়েছিলি তো? লাথি দেয়নি? ওকে এভাবেই বেধে রাখতে হবে।”
এবার ফুলি খালা এগিয়ে এসে বললেন,

“ওরে বাইন্ধা রাইখো না। আমার কাছে দেও। আমি ওরে ঘরে নিয়া যাই। ও ডরাইতাছে। তোমাগো দেইখা। ওরে ঘরে নিয়া যাইতে দেও।”
ফুলি খালার কথায় দুজনে কোনো কান দিলো না। অনেক কথার পর সিদ্ধান্ত নিলো তাকে মেন্টাল আ্যসাইলামে পাঠানো হবে। যা অনেক আগেই করা উচিৎ ছিল কিন্তু তার বাবা করেনি। আজ যেহেতু বাবা নেই আর তাছাড়া প্রণতির এমন উগ্র আচরণের জন্য তাকে এভাবে রাখা যায় না।

ফুলি খালা এই কথা শুনে বলল,

“পাগলা গারদে পাঠাইবেন কেন? এইটা ওর বাড়ি। ভাইজান ওর নামে দিছে না?

ওরে নিয়া আমি দূরে চইলা যামু। তাও ওরে পাগলা গারদে দিও না। আমার গ্রামে যামুগা ওরে নিয়া। তোমরা ওরে পাগলা গারদে দিও না।”
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়েছে। আরাফের পকেটে থাকা ফোনে বার বার কল আসছে। কখন ফিরবে সে রুবার কাছে?
মারুফ তখন ব্যস্ত নিজের ব্যবসায়িক কলে।

গেটের বাইরে তখন লাল নীল আলোয় সাইরেন বাজিয়ে এসে থেমেছে সাদা রঙের গাড়ি। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো গোটা চারেক লোক। প্রণতি কী বুঝলো কে জানে।
উচ্চস্বরে শুধু বাবাকে ডাকতে লাগলো। তার বাবাকে না পেয়ে ফুলি খালাকে ডাকলো। কিন্তু ততক্ষণে তার চোখ বুজে আসছে ঘুমে। নিভু নিভু চোখে সে দেখলো তার হাতের বাধন খুলে দেওয়া হয়েছে। পায়ের বাধন খুলে তাকে তুলে নিচ্ছে স্ট্রেচারে।

গাড়িতে উঠানোর পূর্বে পায়েল একবার তার দিকে তাকিয়ে দেখলো। কোনো অনুভূতি হলো বলে মনে হলো না তার। আরাফ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। প্রণতি হাত বাড়িয়ে কখন তার শার্টের কোণা ধরেছিল সে জানে না। গাড়িতে উঠানোর সময় খেয়াল হলো। কিন্তু কর্তব্যরত সেবিকা হাত ছাড়িয়ে নিলো।

আরাফ খেয়াল করলো প্রণতিও ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।

সাদা গাড়িটা নীল সাদা রঙের আলো জ্বালিয়ে সাইরেন বাজিয়ে চলে গেল যে পথে এসেছিল। সে দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরাফ। পকেটে এখনো তার ফোন বেজেই চলেছে। সে ফিরবে রুবার কাছে।

শুরু হবে তার জীবনের নতুন অধ্যায়। আর সে পিছনে ফেলে যাচ্ছে রঙহীন এক মেয়ের বেরঙে গল্প।

লেখা – সাদিয়া খান (সুবাসিনী)

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “রঙ বেরঙে – আবেগী মায়ার গল্প” টি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ুন – আদর্শ বাসর রাত এর ৫টি গোপন সূত্র

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *