অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্প (১ম খণ্ড) – তোমাকে আজও খুজে বেড়াই

অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্প – তোমাকে আজও খুজে বেড়াই: সুদর্শন চেহারার অধিকারী রাকিব ক্লাসের মেয়েমহলে খুবই পরিচিত। ফ্লার্ট করার অভ্যাস তার শিরায় শিরায়। মেয়েদের অহেতুক প্রশংসা করা, তাদের সাথে হাসি ঠাট্টা, আড্ডা দেওয়া তার স্বভাব। রাকিবকে কলেজে মেয়েদের সাথেই বেশি দেখা যায়।


পর্ব ১

ছোট্ট একটা গ্রাম। যে গ্রামের কিছুদূর পর পর ঘরবাড়ি। টিনশেড ঘরবাড়ি, বেশ কয়েকটা চালাঘরও আছে। গ্রামটির প্রায় প্রতিটি ঘরবাড়িকে বেস্টন করে আছে গাছপালা।

ফলমূলের গাছ বিশেষ করে আম, কাঁঠালের গাছই বেশি দেখা যায়। পেয়ারা, বরই আরও অন্যান্য সব গাছের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। কোন কোন বাড়িতে ঘরের অর্ধেক চাল জুড়ে রয়েছে বিশাল সব গাছ ৷ শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কানায় কানায় পরিপূর্ণ গ্রামের পুকুর, ডোবা, নালা, নদী ; ক্ষেত, বাঁশবাগান, আম বাগান, লিচু বাগান, ধানের জমি সবকিছু মিলিয়ে অপরুপ সৌন্দর্যের অধিকারী গ্রামটি । সবুজ গাছপালায় ঘেরা প্রাণবন্ত গ্রামটি যেন ঠিক ছবির মতন। মনে হয় যেন দক্ষ শিল্পীর রং তুলির আঁচড়েই এর সৃষ্টি।

রাত্রিবেলায় অন্য রকম সৌন্দর্য ফুটে ওঠে গ্রামটিতে। যেখানে নেই বিষাক্ত বায়ু, অতিরিক্ত জনসমাগম, আর নেই কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া।

গ্রামের মানুষেরা অত্যন্ত সহজ সরল, অতিথি পরায়ণ এবং একতাই যাদের মূলমন্ত্র। একে অপরের বিপদে ছুটে আসতে কেউ কখনো দ্বিধাবোধ করে না।

গ্রামের মানুষদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না হলেও সকলের মাঝে বিশ্বাস আছে, ভরসা আছে, ভালোবাসা আছে। তবে নিয়মের মাঝে ব্যতিক্রম যেমন থাকে, তেমন ব্যতিক্রমধর্মী আত্মকেন্দ্রিক, সুবিধাবাদী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ক্ষমতাবান মানুষও আছে।

রাত প্রায় নয়টা। খোলা মাঠে ছোট ছোট সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে রাতের আকাশ টা কে দেখছে নিঝুম। অন্ধকারে সবুজ ঘাসগুলো কে সবুজ নয় বরং কালোই মনে হচ্ছে। ছোট ছোট ঘাসগুলো নিঝুমের শরীরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রাম হওয়ায় বিদ্যুৎ এসে পৌঁছায়নি এখনো। সন্ধ্যা হলেই সকলে ঘুমিয়ে পড়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এজন্যই রাত্রিবেলা খুব দ্রুত নিস্তব্ধতা নেমে আসে গ্রামটিতে।

রাতের নিস্তব্ধতায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে আকাশের তারাগুলোকে দেখতে দেখতে নানা রকম কল্পনার জাল বুনছে নিঝুম। চাঁদের আলো চাঁদ থেকে আকাশে ছড়িয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর সেই দৃশ্য! নিঝুমের চোখে মুখে অদ্ভুত মুগ্ধতা!

খোলা মাঠটি থেকে কিছুটা দূরত্বে আছে একটি বড় পুকুর৷ পুকুরপাড়ে মাথা উঁচু করে স্বগৌরবে দন্ডায়মান কয়েকটি নারিকেল গাছ। সেদিক থেকেই হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে বিনা অনুমতিতে ছুঁয়ে দিচ্ছে নিঝুমকে। হঠাৎ হঠাৎ ঠান্ডা বাতাসের ঠান্ডা স্পর্শে কেঁপে উঠছে সে। আনমনে পুকুরপাড়ের নারিকেল গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে শব্দ করে হাসে।

নিঝুমের মনে হয় গাছগুলো যেন তাকেই পাহাড়া দিচ্ছে। ফের আকাশের তারা গুণতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। আকাশ সম, বিশাল উঁচুতে স্বপ্নগুলো। পারবে কি পূরণ করতে? নাকি মাঝপথেই বিলীন হয়ে যাবে? যেমন করে চাঁদের আলো শরীর ছুঁয়ে দেওয়ার আগেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে শূণ্যে!

রাত বাড়ছে। আকাশের ঠিক মাঝখানে চাঁদকে ঘিরে ধরেছে কালো কালো মেঘ। হয়ত শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি হতে পারে! ধীরে সুস্থে ঘাসের ওপর থেকে উঠে জামাকাপড় ঝেড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে নিঝুম। কোন রকম শব্দ না করে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। জানালা দিয়ে হুহু করে বাতাস ঢুকছে। একসময় ধীরে ধীরে গভীর ঘুমের অতলে হারিয়ে যায় নিঝুম।

গভীর রাতে বৃষ্টির পানির ঝাপটায় ঘুম ভেঙ্গে যায় নিঝুমের। জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানি বিছানায় পড়ে বিছানা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে নিঝুমের বাবা মাও সজাগ হয়েছেন। কখন যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে কেউ টেরই পায় নি।

নিঝুম টিনের পাল্লা দেওয়া জানালা লাগাতে ব্যস্ত। বৃষ্টির পানির কারণে, বাতাসের কারণে জানালা টা লাগাতেই পারছে না ঠিকমতো। প্রতিবারই হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। শেষমেষ আর না পেরে বিছানার তোশকের নিচে রাখা দঁড়ি টেনে বের করলো। দঁড়ি দিয়ে জানালার দুই পাল্লা টেনে এনে লাগিয়ে দিলো।

জানালা টেনে লাগাতে গিয়ে টিনের সাথে লেগে ডান হাতের উল্টো পিঠে সামান্য কেটেও গেল নিঝুমের। হালকা রক্ত বেরোতে শুরু করেছে। নিঝুম বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কাঁটা স্থান টা চেঁপে রাখলো কিছুক্ষণ।

তাতেই রক্ত বের হওয়া বন্ধ হয়েছে। নিঝুমের বাবা মহসিন, মা শাহেদা ঘরের যে জায়গাগুলোতে বৃষ্টির পানি পড়ছে সেই জায়গাগুলোতে মগ, বালতি, পাতিল দিয়ে রাখছেন। টিনের চাল কয়েকটা জায়গায় ছিদ্র হওয়ায় পানি গড়িয়ে পড়ছে সেদিক দিয়ে।

বিষাদে ছেয়ে গেছে শাহেদার মুখ। তিনি স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ “কত করে কইছি বাড়িটা সাঁড়াও। ঝড় বাদলের সময় এখন। তাছাড়া দুর্যোগ কি বলে কয়ে আসে? কবে জানি দেখবেন ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে।”

শাহেদার ঝাঝালো কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে মহসিন গম্ভীর মুখে বললেন,
~ “এবারের ফলন ভাল হয় নাই। হাতে টাকা পয়সাও তেমন নাই। কিভাবে কি করবো? তাছাড়া মেয়েটারেও শহরে পাঠাতে হবে। কত টাকাপয়সা দরকার!”
শাহেদা আর কিছু বললেন না।

নিজেও গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। কিন্তু দৃষ্টি কিছুটা দূরে রাখা প্লাস্টিকের মগ এ আবদ্ধ। যেখানে টিনের চালের ফুঁটো দিয়ে বৃষ্টির পানি ফোঁটায় ফোঁটায় মগ এর ভিতরে পড়ছে।
কয়েক মুহূর্ত পর,
মহসিনের ডাকে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে শাহেদার।

প্লাস্টিকের মগ এর ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। মহসিন তার দৃষ্টি উপেক্ষা করেই গায়ে গামছা জড়িয়ে দরজা চাপিয়ে ঘরের বাইরে চলে যান। স্বামীকে যেতে দেখে শাহেদাও শাড়ির আঁচল দিয়ে ভালভাবে মাথা ঢেকে তার পিছু পিছু বাইরে যায়। মহসিন গোয়ালঘরে চলে যান। গোয়ালঘরে গরু নেই। কিন্তু একটি ছাগল আর তিনটা ছাগলছানা আছে।

মহসিন, শাহেদা দেখেন গোয়ালঘরের পানি পড়ছে টিনের চাল দিয়ে। মেঝে পানির কারণে কাঁদা কাঁদা হয়ে গেছে। মা ছাগলকে টেনে শুকনো জায়গায় বেঁধে দিলেন মহসিন। শাহেদা ছানাগুলোকে ধরে মা ছাগলটির কাছে রেখে দিলেন।

নিঝুমের ভাই বাবলু চঞ্চল একটা ছেলে৷ মাত্র বছর ছয়েক হয়েছে। জেগে গিয়ে বিছানার দু’পাশে হাতরিয়ে বাবা মা কাউকে না পেয়ে উঠে চলে আসে নিঝুমের ঘরে। বোনকে একমনে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বোনের ডান হাত ধরে টান দেয় বাবলু। ছঁড়ে যাওয়া জায়গায় ব্যাথা পেয়ে আর্তনাদ করে ওঠে নিঝুম।

বাবলু ভয় পেয়ে দূরে সরে যায়। সেখান থেকেই জিজ্ঞেস করে,
~ “বুবু, আম্মা রে দেখিনা ক্যান?”
~ “বাইরে গেছে।”

দায়সাড়া জবাব দিয়ে আবারো বাইরে তাঁকায়।
বৃষ্টির পানি টিনের চালে পড়লে যে শব্দ হয়, সেটা শুনতে সুরের মত লাগে। বৃষ্টি এবং শব্দটা উপভোগ করা যেত যদি কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে না হত।

শহরের উঁচু উঁচু ভবনে ইট, পাথর, সিমেন্টের তৈরি বিলাসবহুল বাড়ি~ঘর থেকে বৃষ্টি উপভোগ করতে সবারই ভাল লাগে। নিজেদের “বৃষ্টিবিলাসী” ভাবতেও ভাল লাগে। কিন্তু দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য বৃষ্টি সবসময় উপভোগ্যকর হয় না। এটা যন্ত্রণার, যদি তা প্রয়োজনের অধিক হয়। অনাবৃষ্টি যেমন কাম্য নয়, তেমন অতিবৃষ্টিও কাম্য নয়।

এমন বরষার দিনে, শহরের মানুষগুলো হয়তো কয়েক রকমের ভাজা দিয়ে গরম খিঁচুড়ি খেয়ে কম্বলের নিচে শুয়ে, গল্পগুজব আর ঘরোয়া খেলা খেলেই কাটায়। তবে হতদরিদ্র মানুষগুলো হয়তো তাদের শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতেই ব্যস্ত থাকে। রাস্তার ওপরে, ফুটপাতে থাকা মানুষগুলোরই বা কি অবস্থা হয় এমন দিনে? নিঝুম গভীর ভাবনায় ডুবে।

অন্যদিকে বাবলু এতই ছটফটে একটা ছেলে, যে এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকতে পারে না। বাইরে সে বারবার উঁকিঝুঁকি মারছে। বাবা মা কে খুঁজছে। একটু পর ফিরে আসে তাদের বাবা মা।

শাহেদা নিঝুমকে বললেন,
~ “ঐ ঘরে গিয়া ঘুমা। এখানে তোর বাপ থাকবে নে। বাবলুরে নিয়ে যা।”
বাবলুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
~ “যা বুবুর সাথে যা।”

নিঝুম চলে যায় ঘরে। পিছু পিছু যায় বাবলুও। দুজনে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। নিঝুমের খুব শীত শীত করছে! কাল ছিল গরম, আর আজই শীত। বাবলুর দিকে তাকিয়ে দেখলো কালো রঙের একটা হাফ শার্ট আর নীল রঙের একটা হাফ প্যান্ট পড়ে আছে বাবলু। পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা নিয়ে নিজেও গায়ে দিল, বাবলুর গায়েও দিয়ে দিল। বাবলুও টেনে নিল নিজের দিকে।

মহসিন নিঝুমের বিছানার এক কোণায় বসে পড়েন। কোন কথা বলছেন না তিনি। মুখখানি খুবই গম্ভীর, বিষন্ন। তার ফর্সা চেহারায় সব রকমের অভিব্যক্তি স্পষ্ট বোঝা যায়। মাঝেমধ্যে শান্ত ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করে বাইরে তাকাচ্ছেন তিনি। বাইরের পরিবেশ, বৃষ্টির বেগ, প্রহর ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করছেন। কিন্তু তার চেহারায় চিন্তার ছাপ বেড়েই চলেছে।

শাহেদা একেবারে অধৈর্য হয়ে উঠলেন৷ একে তো বাড়িঘর এর এই অবস্থা, বৃষ্টিতে ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, মেয়েটাকে বাইরে পাঠানো সব মিলিয়ে এক ভয়ানক অবস্থা। রাতের প্রথম দিকটায়ও বৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখেন নি। বর্ষাকালে এই এক সমস্যা। হুটহাট ঝড় বৃষ্টি নেমে পড়ে। বোঝাই যায় না।

শাহেদা আতঙ্কিতভাবে স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
~ “কি হবে? কি করবো আমরা এবার? সবদিক সামাল দিতে পারবো তো?”

মহসিন কিছু বললেন না। শাহেদা কিছুক্ষণ তার হাবভাব লক্ষ্য করে আবার বললেন,
~ “মেয়েটারে না হয় গ্রামেই পড়াই। শহরে না পাঠালে হয় না? রাবেয়া বুবু বলছিলো শহরের পরিবেশ ভাল না। তাছাড়া এত পড়াশোনা করে করবে কি? সেই তো বিয়ে~শাদি করে রান্নাঘরের ঘানিই টানতে হবে।

পড়াশোনা করতে শহরে পাঠালেই নাকি সবাই খারাপ হয়ে যায়। বাপ মারে ভুলে যায়, বাপ মা রে মান্য করে না,অবাধ্য হয়ে যায়। আজেবাজে ছেলেমেয়ের সাথে ওঠাবসা করে। তখন কি হবে?”

মহসিন চোখ গরম করে তাকায় শাহেদার দিকে। শাহেদা তার তাকানো দেখে আমতা আমতা করে বললেন,
~ ” রাবেয়া বু বলছিলো। তাই!”

মহসিন বললেন,
~ “আমার মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে তুমি একটা কথাও বলবা না। শুনে রাখো তাসনিয়ার মা, আমি আমার মেয়েকে অনেক দূর পর্যন্ত পড়াবো। আমি যা পারিনি আমার মেয়েটা সেটাই করে দেখাবে।

আমার মেয়ের মত একটা মেয়ে এই গ্রামে আছে নাকি? এত ভাল নম্বর আর কেউ পাইছে নাকি? শহরের বড় কলেজে পড়ার সুযোগ পাইছে নাকি? দেখাবার পারবা আমারে? আমার মেয়েটার ভাল তো কারোর সহ্য হয় না। তাই তোমারে এসব বুদ্ধি দেয়৷ আর যদি কোন কথা শুনছি, তবে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হইবো না। মনে রাইখো নিঝুমের মা।”
শাহেদা কাঁচুমাচু করে বললেন,

~ “আমি শুইতে গেলাম।”
মহসিন আর কোন কথা বললেন না। শাহেদা গিয়ে বাবলুর পাশে শুয়ে পড়েন। একসময় ঘুমিয়েও যান। তবে বাকি রাতটা গভীর চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে কোন এক রকম জেগেই কাটিয়ে দেন মহসিন।


পর্ব ২

ভোরের দিকে বৃষ্টির বেগ কমে আসে। সকাল হতে হতে বৃষ্টি থেমেও যায়। বৃষ্টি থামতেই বেরিয়ে যান মহসিন। ফসলের জমি, বাড়িঘর এবং গাছপালা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা দেখাই তার উদ্দেশ্য।

বৃষ্টি পড়া বন্ধ হলেও আকাশ টা মেঘলা। হালকা কালো মেঘে ঢাকা রয়েছে সুবিশাল আকাশ। সূর্যটা ঢেকে গেছে কালো মেঘে। সূর্যের রশ্মি পৌঁছাতে পারছে না এই পৃথিবীর মাটিতে।

মহসিন ঘর থেকে বের হওয়ার পরপরই বাবলু ঘুম থেকে উঠেই বাইরে ছুটে চলে যায়। প্রচন্ড দুষ্টু একটা ছেলে। বাবা মার কথা শুনতেই চায় না। পড়ালেখাতেও অমনোযোগী। এবারই ভর্তি করিয়ে দিয়েছে বাবলুকে। গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে পড়ছে। অন্যদিকে নিঝুম পুরোটাই বাবলুর বিপরীত। শান্ত, ভদ্র এবং কিছুটা কল্পনাবিলাসী।

কল্পনায় একটা আলাদা জগৎ তৈরি করতে সে খুব ভালবাসে। যে জগতে থাকে একাধিক কাল্পনিক চরিত্র। তবে পড়ালেখায় সে বেশ মনোযোগী। বাবা মার স্বপ্ন পূরণই তার একমাত্র লক্ষ্য। এসএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। স্কুল থেকে যে দুই জন জিপিএ ফাইভ পেয়েছে তার মধ্যে নিঝুম একজন।

সকাল সাড়ে ছয়টা নাগাদ শাহেদা সজাগ হলেন। পাশে বাবলুকে না পেয়ে তিনি ঠিকই বুঝলেন তার দস্যি ছেলে এখন পাড়া বেড়াচ্ছে। নিঝুম তখনও ঘুমে বিভোর। শাহেদা নিঝুমকে হালকা ধাক্কা দিলেন।

~ “এ্যাই মেয়ে, উঠ জলদি। আর কতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমাবি?”
~ “উম”
নিঝুম নড়াচড়া করলেও ঘুম ভাঙ্গেনি তখনো। শাহেদা বার কয়েক ডেকে, ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে যান। নিঝুম উঠোনে গিয়ে চারপাশটা খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। বৃষ্টির পানিতে চারপাশটা ধুয়ে একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। গাছের পাতাগুলো ভিজে রয়েছে। গাছের ডাল বেয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ছে।

ভিজে পাতার কোণায় পানি জমা হয়ে টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে নিচে। টিনের চালের ওপর সেই পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দটা খুব ভাল লাগছে নিঝুমের৷ কি অদ্ভুত সৌন্দর্য এই প্রকৃতির! তবে কিছু কিছু জায়গায় পানি জমে গেছে। পথঘাট বৃষ্টির পানিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়েছে।

গাছপালা, ঘাস, লতাপাতা সবকিছুই যেন সজীব, সতেজ হয়ে উঠেছে পানি পেয়ে। প্রাণহীন মরুভূমি যেন পানির স্পর্শে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। একদিনের বৃষ্টির পানিতেই যেন জীবনীশক্তি হাজার গুণে বেড়ে গেছে। নদী, পুকুর, ডোবা পানিতে ভরে উঠেছে, কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে। অনেকেই মাছ ধরার সরঞ্জাম হাতে ঘর থেকে বের হয়েছে।

উঠোনের একপাশে মাটির তৈরি উনুন ভিজে আছে। গতকাল রাতে উনুন ঢেকে না রাখায় বৃষ্টির পানি জমেছে। উঠোনের নিচু জায়গায় খানিকটা করে পানি জমে কাঁদার মতন হয়েছে। শ্যাওলা পড়া জায়গাগুলো দেখেই পিচ্ছিল মনে হচ্ছে। যে কেউ একবার পা রাখার সাথে সাথেই পিছলে যাবে।

নিঝুমের পর্যবেক্ষণের মাঝপথেই বাবলু কোথা থেকে যেন ছুটে এল। আর হেসে হেসে বলতে লাগলো,
~ “বুবু দ্যাখ। আমি এই পাখিটা পাইছি।”

বাবলু পড়ে গিয়ে সামনের তিনটি দাঁত ভেঙ্গে ফেলেছে৷ তাই হাসলে বা কথা বললে ওপরের চোয়ালের সামনের ভাঙ্গা দাঁতগুলোই আগে চোখে পড়ে।

নিঝুম বাবলুর হাতে মৃতপ্রায় একটা শালিক পাখি দেখতে পায়৷ হয়ত ঝড়বৃষ্টির কারণে এটার এই অবস্থা হয়েছে। বাবলু পাখিটাকে দু এক দানা ভাত ও পানি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হচ্ছে। পাখিটা কিছুই মুখে নিচ্ছে না। নিঝুম অনেকক্ষণ দেখে বললো,
~ “বাবলু, কোথায় পেয়েছিস এটা?”

~ “সজিব ভাই দের আম বাগানের মাটিতে পড়ে ছিল।”
বাবলু উত্তর দিলো।

~ “এমন করিস না, মরে যাবে তো। ওটাকে এত নাড়াচাড়া করিস না৷ রেখে দে কোন এক জায়গায়।”
বিরক্ত হয়ে বললো নিঝুম। কিন্তু বাবলু নাছোড়বান্দা। কারও কথাই সে শোনে না৷ নিজের যা ভাল মনে হয় তাই করে। আর নিঝুমের কথা তো সে কানেই তোলে না।

~ “নাহ্ রাখবো না”, বলেই শালিক পাখিটাকে নিয়ে আবারও চলে যায় বাড়ির ত্রিসীমানা পেরিয়ে। হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিঝুম।
বাবলু কে কোন কিছু মানা করলে সেই কাজটা আরও বেশি করে করবে।

এই বয়সেই বড্ড পাকা৷ গ্রামের ছোট বড় ছেলেপেলের সাথে মিশে খারাপ কয়টা কথাও শিখে ফেলেছে। কোন কিছুতে নিষেধ করলে তখন সেই কথাগুলোই প্রয়োগ করে বাবলু।
বাবলু চলে যাওয়ার পর নিঝুম মায়ের ডাক শুনতে পায়।
~ “নিঝুম আছিস নাকি উঠোনে?”

~ “হ্যা আম্মা যাই।”
মায়ের গলার আওয়াজ অনুসরন করে গোয়ালঘরে যায় নিঝুম। শাহেদা গোয়ালঘর পরিষ্কার করছিলেন। মেয়েকে দেখে বললেন,
~ “ছাগল সহ ছাগলের বাচ্চাগুলোকে শুকনো জায়গায় বেঁধে রেখে আয়। যেন কাঁদায় মাখামাখি না করে।”

মায়ের কথামত ছাগল ছানাগুলোকে বাড়ির বাইরে ঘাসের ওপর ছেঁড়ে দেয় নিঝুম। ছাগল ছানাগুলো সাদা ধবধবে। মাঝে মাঝে কালো ছোপ আছে। কালো সাদার মিশ্রণে অদ্ভুত সুন্দর লাগে দেখতে!

গফুর চাচার বাড়ির জাম্বুরা গাছটা ঝড়ের তোড়ে কিছুটা নুইয়ে পড়েছে। গাছটি জাম্বুরা ফলে ভর্তি। গ্রামের ছোটছোট বাচ্চারা জাম্বুরা ফল ছেঁড়ার জন্য দাঁপাদাঁপি, ঝাঁপাঝাঁপি করছে। দু একটা জাম্বুরা নিচে পড়েছে।

কয়েকটা বাচ্চা ফুটবল খেলছে জাম্বুরা দিয়ে। আর নিঝুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সবাইকে।
ঝড় বৃষ্টির কারণে আমের মুকুল মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ছোট্ট দানার মতো আমগুলো ঝরে পড়েছে ঝড়ের সাথে লড়তে না পেরে। প্রকৃতিতে তারাই টিকে থাকতে পারে যাদের পায়ের তলার জমিন শক্ত, যারা শক্তিশালী। দুর্বলরা কখনোই টিকে থাকতে পারে না প্রকৃতিতে। চাই সে মানুষ হোক কিংবা পশুপাখি অথবা গাছপালা।

মহসিন ফসলের ক্ষেত ঘুরে আসেন। খুব বেশি ক্ষতি হয়নি ফসলের। ফসলি জমিগুলোই এখন তার সম্বল। ফেরার পথে গ্রামের সবচেয়ে পয়সাওয়ালা ব্যক্তি জব্বার হোসেনের সাথে দেখা। মহসিনকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করেন,
~ “কি মহসিন মিয়া, খবর ভালো তো?”

~ “জ্বী ভাই। আল্লাহ যেভাবে রেখেছেন।”
মহসিন আলি জব্বার হোসেন সাথে জমিজমা, সংসার বিষয়ক কিছু আলোচনা করলেন।
~ “তা শুনলাম, মেয়েকে নাকি শহরে পড়তে পাঠাচ্ছো।”

~ ” জ্বী ভাই, আপনি ঠিকই শুনেছেন। মেয়েটা রেজাল্ট ভাল করেছে। শহরে পড়ার সুযোগ পাইছে। স্কুলের মাস্টাররা বলছে শহরে গিয়ে পড়ালেখা করলে আরও ভালো করবে। আমারও তাই ইচ্ছা। সুযোগ যখন পাইছে হাতছাড়া করার কি দরকার!”

মাটিতে পানের পিক ফেলে জব্বার হোসেন বললেন,
~ “ভাল কথা। তবে মেয়ে মানুষের এত পড়ে কাম কি? ভালো ছেলে পাইলে বিয়ে দিয়ে দেও। সংসার, বাচ্চা, ঘর সামলাবে। এই তো৷ বেশি লেখাপড়া করলে কেউ আর মানুষ থাকে না। গুরুজন মানে না, নিয়ম মানে না, ধর্ম মানে না, উচ্ছনে চলে যায়।”
মহসিন দমে গেলেন না।

~ “আমার নিঝুম এমন না। দেখবেন ভাই, ও একদিন অনেক শিক্ষিত হবে, এই গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে।”
~ ” হ, এমন থাকে না কেউই। শহরে গিয়েই এমন হয়। দ্যাখো কি করতে পারো । আমি যাই তবে।”

মহসিন আর কিছু বললেন না৷ তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড়। যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেয়েকে শহরে পড়াবেন, তখন পড়াবেনই৷ ওনার দূর সম্পর্কের এক ভাই শহরে থাকেন। তার মাধ্যমেই ভর্তি ও থাকার ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। সপ্তাহখানেক পড়েই মেয়েকে রেখে আসবেন। নিজে বেশিদূর লেখাপড়া করতে না পারায় কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে, সংসার সামলাতে হচ্ছে।

গ্রামের অনেকেই শহরে গিয়ে কাজ করছে। হয়ত তিনিও করতে পারতেন। তবে যেমন আছেন স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে, তাতেই সন্তুষ্ট। দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে কোন রকমে দিন পার হলেই হয়।

তবে মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তার। জীবনের অনেকগুলো বছর বাউণ্ডুলেপনা করে কাটিয়েছিলেন। গ্রাম থেকে শহরে পড়তেও গিয়েছিলেন। শহরে গিয়েই আঞ্চলিক ভাষা ছেড়ে শুদ্ধ চলিত ভাষায় কথা বলা শিখেছেন। নিঝুমকেও শিখিয়েছেন।

শহরে গেলেও পড়া আর ততটা হয়ে ওঠে নি। বাজে পাল্লায় পরে লেখাপড়ার ইতি টানতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। এরপর গান বাজনার শখ হয়েছিল। দু একজনের কাছে শিখেওছিলেন।

কিন্তু গানকে তিনি পেশা করতে পারেন নি। তবে নেশা হিসেবে রয়েই গিয়েছিল। তার বাবা কোন জমিদারের থেকে কম ছিলেন না। কিন্তু বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি তিনি ধরে রাখতে পারেন নি।

সময়ের পরিবর্তনে মহসিন এখন শক্ত চরিত্রের মানুষ। এমন একজন মানুষ যিনি তার নিজের চারপাশটা গুছিয়ে নিতে জানেন না ঠিকই কিন্তু কোন কিছু জমিয়ে রাখার চেয়ে বিলিয়ে দিতেই বেশি আনন্দ পান। কিছু কিছু মানুষ তো এমন হয়েই থাকে। জীবনে বেঁচে থাকতে আনন্দটা খুব জরুরি জিনিস। এখন যে যাতে আনন্দ পায় আর কি!

বাড়ি ফিরে শাহেদাকে ডাকেন মহসিন।
~ “কি গো কিছু খাইতে দেও। বেলা তো কম হল না।”

ঘর থেকে শাহেদা জবাব দেন,
~ “চুলায় বৃষ্টির পানি জমছে। ঢাকা হয়নি কাল। ভিতরের চুলায় তো রান্না করা হয় না। আগুন জ্বলে না৷ একটু সবুর করেন।”
~ “আচ্ছা। ছেলেমেয়েরা কই?”

~ “ওরা আছেই। কি খবর ওদিককার?”
মহসিন জমির ফসল, গাছের বাগানের অবস্থা সম্পর্কে সংক্ষেপে স্ত্রীকে জানালেন। তবে জব্বার হোসেনের ব্যাপারটা মাঝখান থেকে এড়িয়ে যান। সে ঘটনা স্ত্রীকে না জানানোই উত্তম।

বললেই সে আবার তার রাবেয়া’বু ও পাড়া প্রতিবেশীর উপদেশ সম্পর্কে বলা শুরু করবে। তাহলে আর রক্ষে নেই।
সকালের খাওয়া দাওয়া সেড়ে মহসিন কাজে যান৷ শাহেদা ঘরের কাজে লেগে পড়েন। আর বাবলু, নিঝুম নিজেদের মত ঘুরে বেড়ায়।

বাবলু যায় মাছ ধরা দেখতে। বর্শি দিয়ে অনেকেই পুকুর থেকে মাছ ধরছে। সেটাই মনোযোগ দিয়ে দেখছে বাবলু। এই মুহুর্তে তারও ইচ্ছে করছে বাকি সকলের মত বর্শিতে মাছ ধরতে। তবে মাকে এ কথা বললে পিঠে দু এক ঘা পড়তে পারে।

সেই ভয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে বাবলু। আর নিঝুম তার পাড়ার সাথীদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। কয়েকটা দিনই তো আছে গ্রামে। ওদের সাথে সময় কাটানো তো আর হবে না। ঘুরে ফিরে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামের মাঝখানের বড় পুকুরে কয়েকটা শাপলা ফুল দেখতে পায়।

খুব ইচ্ছে হয় ফুলগুলো নেওয়ার। কোন কিছু বিবেচনা না করেই পুকুরে নামে। গতকাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় পুকুরের পানি প্রচন্ড ঠান্ডা। তবুও সাঁতরে গিয়ে একটা শাপলা ফুল তুলে আনে।

দুপুর পর বাড়ি ফেরে ভাই বোন দুজনে। শাহেদা ছেলে মেয়েকে এক দফা গালাগালি করলেন। ছেলেমেয়ের দস্যিপনা তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। মায়ের বকুনি খেয়ে গোসল, খাওয়া সেড়ে নেয় দুজনেই।

বাবলু বিছানায় বসে সামনে বই খুলে রাখে, আর নিঝুম শুয়ে পড়ে। বাবলু সামনে বই খুলে রেখেছে ঠিকই কিন্তু পড়ায় তার মনোযোগ নেই। বাবলু নিঝুমকে ফিসফিসিয়ে বলে,
~ “বুবু তুই শহরে যাবি?”

~ “হুম”
বাবলু কিছুক্ষণ ভেবে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
~ “আচ্ছা বুবু, শহর কোথায়? খুব কাছেই?”

নিঝুম ভাই এর সাথে মস্করা করে বললো,
~ “হ্যা, জানালা খুললেই শহর দেখা যায়।”

~ “আসার সময় আমার জন্য সাইকেল নিয়ে আসিস। ছোটদের সাইকেল৷ মন্টুর সাইকেলটার মত।”
ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে ভাবতে শুরু করে নিঝুম।

~ “দিনগুলো কত দ্রুত চলে গেল। কয়দিন পর সবাইকে ছেড়ে অচেনা অজানা একটা শহরে গিয়ে অচেনা লোকদের সাথে থাকতে হবে। কিভাবে একা থাকবে ওখানে আব্বা আম্মাকে ছাড়া? বাবলুটাও থাকবে না।”

এসব ভাবতেই কেমন মন খারাপ হতে থাকে। হঠাৎ করে বাবলুর দিকে চোখ পড়তেই দেখে বাবলু তার খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে কাগজের নৌকা বানাচ্ছে। বাবলুর ওপর প্রচন্ড রাগ চেপে যায়। খাতাটা বাবলুর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে কান মলে দেয়। কান ধরে টেনে নিয়ে যায় মায়ের কাছে। মহসিনও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

নিঝুম বিচার দিল বাবলুর নামে। সব সময়ই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি ঘোরে বাবলুর। এই জন্য শাস্তিও কম পায় না। তবুও সোজা হয় না। যেমন সেমনই থাকে। গ্রাহ্য করে না কোন নিষেধ।

মায়ের হাতে মার ও খায় তার জন্য। শাহেদা বিচার শুনে স্বামীর দিকে তাকালেন। মহসিন স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে নিঃশব্দে ইশারায় বোঝালেন এখন বাবলু কে মারার দরকার নেই। নইলে তার কান্নার শব্দের যে তীব্রতা, পুরো গ্রামের মানুষ জড়ো করে ফেলবে।


পর্ব ৩

রাত নামে। এ ধরণী অন্ধকারের চাদরে আবৃত হয়। শুরু হয় অন্ধকারের রাজত্ব। ঝিঁঝি পোকার ডাক ক্রমশ তীব্র হয়। অন্ধকারে নির্জন রাতের কাঠিন্য ভেদ করে আসা ঝিঁঝি পোকার ডাক, বাঁশবাগানে পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ ভুতুড়ে শোনায়।

দীর্ঘ রজনী শেষে একসময় ভোরের আলো ফোঁটে, চারিদিক আলোকিত হয় সূর্যের আলোতে। রাতের অন্ধকার আছে বলেই দিনের আলো ফোঁটার অপেক্ষায় থাকে মানুষ। দিনের আলোর সাথে সাথে আবারো শুরু হয় কর্মব্যস্ততা।

বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে যায়। মহসিন নিঝুমকে আজই শহরে নিয়ে যাবেন। দুদিন পর নিঝুমের প্রথম ক্লাস। তাই সকাল থেকে নিঝুমের মা শাহেদা গোছগাছের কাজে লেগে পড়েছেন।

নিঝুমের পোশাক, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, প্রসাধন সামগ্রী সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরে দিলেন। সাথে কিছু শুকনো খাবার দিতেও ভুললেন না। বিস্কুট, চানাচুর, নাড়ু আরও কত কি! যাত্রাপথে যদি ক্ষুধা লাগে তার জন্য পরোটা, আলুর দম বানিয়ে দিলেন।

গোছাতে গোছাতে সকাল সাড়ে দশটা বেজে গেল। নিঝুম চলে যাবে শুনে বাবলুর সে কি কান্না! শাহেদা নিঝুমকে পরামর্শ, উপদেশ দিতেও ভুললেন না। মেয়ে শহরে গিয়ে একা থাকবে, এটা কোনভাবেই মন সায় দিচ্ছে না তার। নানা দুর্ঘটনা, বিপদ আপদের আশঙ্কা হচ্ছে তার। শাহেদা মেয়েকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলেন।

১০:৪৫ মিনিটে মহসিন মেয়েকে নিয়ে ভ্যানে করে বাস স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। ১১: ১৫ মিনিটে বাস স্টেশনে এসে পৌঁছে নিঝুম ও মহসিন। নিঝুমের বাবা মহসিন একে একে ব্যাগপত্র গুলো ভ্যান থেকে নামাতে লাগলেন। আর নিঝুম চারিদিকের জনসমাগম দেখতে থাকে। চোখ দিয়েই মেপে দেখতে থাকে বাস স্টেশনটি।

টিকিট কেটে ব্যাগপত্রগুলো বাসের বক্সে ঢুকিয়ে মেয়েকে নিয়ে নির্ধারিত সিটে গিয়ে বসলেন মহসিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটি যাত্রী দিয়ে ভরে যায়। নির্দিষ্ট সময়ে বাস চলতে শুরু করে। যাত্রাপথে আরও অনেক যাত্রী তোলা হয় বাসে। বাসে সিট না থাকায় মাঝের যাতায়াতের জন্য বরাদ্দ ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে তারা।

মহসিনের পাশেই একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। একহাতে সিট ধরে, অন্যহাতে বাচ্চা কোলে নিয়ে আছেন। বছর খানেক বয়স হবে বাচ্চাটির, বেশ মোটাসোটা। হয়ত মহিলাটির কষ্ট হচ্ছে।

একেতো বাচ্চা কোলে, তার ওপর আবার দাঁড়িয়ে যাওয়া। অন্যসময় হলে মহসিন হয়তো নিজের সিট ছেড়ে দিতেন।
কিন্তু এত লোকের ভীড়ে, অচেনা মানুষদের সঙ্গে গায়ে গা সেঁটে গাম বিনিময় করতে তাঁর ঘৃণা হয়। মনে হচ্ছে যেন পাশে মানুষের তৈরি দেয়াল। বিকিরিত হচ্ছে মানুষের শরীরের উত্তাপ। বাসের ভিতরে উত্তাপ বেড়েই যাচ্ছে। আর তাছাড়া এদের সবারই অভ্যাস আছে দাঁড়িয়ে যাওয়ার, নইলে তো এভাবে ভরা বাস দেখে উঠতোই না।

গরমের দিন, তার ওপর এই মানুষগুলোকে এভাবে চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মহসিন যেন আরও বেশি ঘামতে শুরু করলেন। হাত বাড়িয়ে বাসের জানালাটা অনেকটা খুলে দিলেন তিনি। আর নিঝুমকেও সাবধান করে দিলেন যাতে জানালা দিয়ে বাইরে হাত বা মাথা না দেয়।

নিঝুম জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত। রাস্তার ধারের গাছপালা, দোকানপাট যেন বাসের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাসের বিপরীত দিকে ছুটছে। যেন তারা স্থির নয়। চলমান কোন বস্তু। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাস থামানোর সময় সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে নিঝুম।

এতক্ষন বাইরেটা দেখতে এতই ব্যস্ত ছিল যে, সে কোথায় আছে, কি করছে সব ভুলে গিয়েছিল। আর একটু হলেই সামনের সিটের সাথে মাথা লেগে যেত। কিছুক্ষণ পর পর বাস থামায় বাস চালক। যাত্রী নামায় এবং তোলে।

বাসের মধ্যে পর্যাপ্ত সিট ফাঁকা না থাকলেও যাত্রী তোলে। ইংরেজি এবং বাংলা বিষয়ে প্যারাগ্রাফ বা অনুচ্ছেদ হিসেবে ‘রোড এক্সিডেন্ট’ বা ‘সড়ক দুর্ঘটনা’ সম্পর্কে পড়তে হয়েছে অনেকবার। এর কারণ হিসেবে যানবাহনে অতিরিক্ত যাত্রী তোলার যে কারণ সম্পর্কে জেনেছিল, আজ তা স্বচক্ষে দেখছে নিঝুম।

ঘন্টা দুয়েক পর কাঙ্ক্ষিত শহর বগুড়াতে এসে পৌঁছায় মহসিন ও নিঝুম। ঠনঠনিয়া বাসস্ট্যান্ডে বাস থামে। তাদের সাথে করে আনা জিনিসপত্র বাসের হেল্পারই নামিয়ে দেয়। বাস স্টেশনে আগে থেকেই এসে অপেক্ষা করছিলেন মহসিনের দূরসম্পর্কের ভাইটি। তিনি নিঝুম ও মহসিনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেও মহসিন গেলেন না।

তিনি তার দূরসম্পর্কের ভাই হোসেন আলি কে নিঝুমের থাকার জন্য ঠিক করা লেডিস হোস্টেলেই সরাসরি নিয়ে যেতে বললেন৷ অনেক জোরাজুরি করেও হোসেন আলি নিঝুম ও মহসিনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারলেন না। অগত্যা হোসেন আলিকে তাদের নিয়ে যেতে হল সেউজগাড়ীর একটি লেডিস হোস্টেলে।

নিঝুমের সাথে তার রুমে আরও একটি মেয়ে থাকবে। মেয়ের থাকার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করে মহসিন মেয়েকে বুঝ পরামর্শ দিয়ে, কিছু টাকা~পয়সা হাতে দিয়ে, একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়ে সেদিনই গ্রামে ফেরার জন্য রওনা হলেন। তবে তার পূর্বে লেডিস হোস্টেলের দায়িত্বে থাকা মহিলাটির সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলতে ভুললেন না।

বাবা চলে যাওয়ার পর নিঝুমের ভীষণ মন খারাপ হতে থাকে। বসে বসে গ্রামে কাটানো দিনগুলোর কথা ভাবতে থাকে। এই অচেনা শহরে বাবা মা ভাই ছাড়া একা, দম বন্ধ হয়ে আসছে নিঝুমের। বুক ভারি হয়ে আসে, কান্না আসতে চায়। এমন সময় নিঝুমের রুমমেট মেয়েটা পাশে এসে বসে। তাকে দেখে নিঝুমের থেকে তিন~ চার বছরের বড় মনে হয়।

এ কথা সে কথা বলতে বলতে খুব কম সময়েই দুজন দুজনের সম্পর্কে নানান কথা জুড়ে দেয়৷ নিঝুমও তার সম্পর্কে জেনে নেয়। মেয়েটির নাম আনিশা। আনিশা নিঝুমের চার বছরের সিনিয়র।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ২য় বর্ষে পড়ছে আনিশা। আর নিঝুম এ শহরের সবচেয়ে ভাল কলেজ, বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়তে এসেছে। নিঝুমও সরকারি আজিজুল হক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শাখাতেই পড়ছে।

আনিশা হোস্টেলে অন্য মেয়েদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় নিঝুমের। তবে শুধুমাত্র একজন ব্যতীত।
মহসিন রাতেই গ্রামে ফিরে গেলেন।

বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই শাহেদা সমাচার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। মহসিন রেগে গিয়ে বললেন,
~ “এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম। সবুর করো। বিশ্রাম নিতে দাও। সব বলব। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে আমার।”

শাহেদার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তিনি যে অসময়ে প্রশ্ন করে ফেলেছেন তা হয়তো বুঝতে পেরেছেন। মহসিন ততক্ষণে পোশাক পাল্টে নিয়েছেন। বিছানায় শরীরটা রেখেছেন মাত্র। শাহেদা হাত পাখা এনে বাতাস করতে লাগলেন।

অনেক্ষণ যাবৎ মহসিন ও শাহেদা দুজনই চুপ করে থাকেন। চোখ দুটো বন্ধ রেখে থেমে থেমে শহরে যাওয়া, হোসেন আলির সঙ্গে সাক্ষাৎ, নিঝুমকে রেখে আসা সকল ঘটনার বিবরণই দিলেন স্ত্রী শাহেদাকে।

শাহেদা এই নিয়ে কথা আর বাড়ালেন না। বললেন,
~ “খেয়ে নেন আগে। রাত তো অনেক হলো।”

মহসিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
~ “কি জানি মেয়েটা খেয়েছে কি না! কী যে করতেছে একা একা৷”
শাহেদার বলতে ইচ্ছে করছে,
~ “এজন্যই বলেছিলাম শহরে পাঠাইয়েন না। আমার কথা শুনলে তো!”

মনের কথা মনেই রেখে দিলেন শাহেদা। মুখে আর কিছু বললেন না।
ওদিকে নিঝুম আর আনিশা একসাথেই হোস্টেলের খালার রান্না করা খাবার খেয়ে দুজনে বেশ জমিয়ে গল্প করা শুরু করে দিয়েছে।

গল্পের আসর জমিয়ে ফেলেছে একদম। নিঝুম আনিশার সাথে সহজ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে যেন খই ফুটতে থাকে নিঝুমের। আনিশাও নিঝুমকে দেখে অবাক। হালকা পাতলা গড়নের চুপচাপ মেয়েটাও যে এত কথা বলতে পারে আনিশা ভাবতেই পারে নি প্রথমে।

হঠাৎ আনিশার ফোনে একটা কল আসলে আনিশার মুখের হাসিটা প্রশস্ত হয়ে যায়। কল রিসিভ করে রুমের বাহিরে চলে যায় আনিশা। আর সেদিক পানে চেয়ে থাকে নিঝুম। আনিশার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।


পর্ব ৪

মুয়াজ্জিনের সুমধুর কন্ঠে আযানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় নিঝুমের। আনিশা তখনো ঘুমে মগ্ন। হোস্টেলে আর কেউ উঠেছে কিনা সন্দেহ। কোথাও কোন আওয়াজ নেই। তবে দূর থেকে যানবাহনের হর্ণের মৃদু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শহরে বোধহয় এমনই হয়ে থাকে। সকালটা শুরুই হয় দশটার পর। আর রাত শুরু হয় ১২ টার পর।

গ্রাম অঞ্চলে ভোরবেলা আযানের পর থেকেই দিন শুরু হয়। গ্রামের সকলে এমনকি ছোট ছোট বাচ্চারাও খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। সালাত আদায় শেষে বাসি পান্তা ভাত খেয়েই কৃষকেরা লাঙ্গল, কোদাল, কাস্তে হাতে দলেবলে মাঠে কাজ করতে চলে যায়। ছোট বাচ্চারা ছুটে বেড়ায়, খেলে।

একটু বুঝ হওয়ার বয়স হলে সকাল সকাল কুরআন পড়তে পাঠানো হয়। ছেলেরা পাঞ্জাবি, মেয়েরা হিজাব পরে কায়দা, কুরআন হাতে মসজিদ প্রাঙ্গনে চলে যায়। সেখানে কুরআন শেখার পাঠ নেয়। তাদের সমস্বরে কুরআন তিলাওয়াতের ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়।

নিঝুম ওযু করে সালাত আদায় করে আনিশাকে কয়েকবার ডাক দিল। তবে আনিশা নিরুত্তর। নিঝুমের ডাক তার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছেই না। বার কয়েকের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় হাঁপিয়ে উঠলো নিঝুম।

বিছানায় গিয়ে ফের শুয়ে পরলো। আসার আগে শাহেদা বহুবার বলে দিয়েছেন সালাত যাতে কাযা না করে নিঝুম!
শুয়ে পরার পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিঝুম সেই যে ঘুমিয়ে পরলো, জাগলো একেবারে আটটার সময়। বিছানা থেকে উঠে বসে সামনে আনিশাকে তৈরি হতে দেখলো। ছোট্ট একটা আয়না মুখের সামনে নিয়ে আনিশা কাজল লাগাতে ব্যস্ত।

নিঝুমকে উঠে বসতে দেখে বললো,
~ “উঠে গিয়েছো! যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। খালা খাবার দিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। খিঁচুড়ী আর আলুর ভর্তা।

ঠান্ডা হয়ে গেছে মনে হয়। খেয়ে নাও জলদি। তারপর তৈরি হয়ে নাও। মনে তো হয় না এখানে কিছু চেনো বা জানো! আমি বাইরে যাচ্ছি। তোমাকেও কলেজ যাওয়ার রাস্তা চিনিয়ে দেব। দুপুরে খাবার দিতে মানা করেছি খালাকে। বাইরে খেয়ে নিব আমরা।”

খাবার খাওয়ার পর নিঝুম তৈরি হয়ে নিল। ঢোলঢালা সালোয়ার কামিজ, বুকের ওপর ওড়নাটা ভি~শেইপ হয়ে আছে, দু’টো বেণুনী সামনে এনে রাখা, তেল চুপ চুপ করছে মাথায়। মুখে হয়তো পাউডার লাগিয়েছে! সেটাও ভেসে উঠেছে মুখে। আনিশা নিঝুমকে গালে হাত দিয়ে দেখলো।
~ “তুমি এভাবে যাবে?”

নিজেকে উপর নিচ দেখে নিঝুম জবাব দিল,
~ “হ্যাঁ, কেনো?”

~ “নাহ কিছুনা চলো।”
নিঝুমকে সাথে নিয়ে বের হলো আনিশা। তার কথাবার্তায় প্রকাশ পায় সে কতটা চঞ্চল টাইপের মেয়ে। হোস্টেল থেকে বেরিয়ে মিনিট দুয়েক হাঁটলো দুজনে। তিন রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালো রিকশার জন্য।

রিনরিনে গলায় নিঝুম বললো,
~ “আপনি কলেজে যাবেন না আপু? ক্লাস হবে না আজকে?”

নিঝুমের দিকে তাকিয়েই জবাব দিল আনিশা,
~ “নাহ, আজ যাব না৷ প্রতিদিন ক্লাস করতে ভাল লাগে না।

তাছাড়া আজ আমি আমার একটা বন্ধুর সাথে ঘুরতে যাব। তুমিও দেখতে পাবে তাকে।”
নিঝুম আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। কেননা ইতোমধ্যে আনিশা রিকশাওয়ালাকে ডেকে ফেলেছে।
~ “মামা, যাবেন? আজিজুল হক কলেজ যাবেন?”

~ “কোনটায় যাবেন?”
~ “পুরাতন ভবনে যাব মামা।”
~ “আচ্ছা চলেন পঁয়ত্রিশ টাকা কিন্তু।”

~ “আচ্ছা দেব। নিঝুম উঠো।”
রেললাইনের কাছে এসে আটকে গেল ওরা। রিকশা, সাইকেল, স্কুল বাস আটকে দেওয়া হয়েছে। সাইরেনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রেলগাড়ি আসার সময় হয়েছে।

বাতাসে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে রেলগাড়িটা চোখের সামনে থেকে এক মুহুর্তেই হারিয়ে গেল দিগন্তে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কলেজ গেটের সামনে এসে রিকশা থামে। ভাড়া মিটিয়ে নিঝুমকে নিয়ে ভিতরে যায় আনিশা। ক্লাসরুম, টিচার্সরুম, কমনরুম দেখিয়ে দেয়।

কলেজের আশেপাশের জায়গাগুলো চিনিয়ে দেয়। কিভাবে প্রতিদিন কলেজে আসতে হবে, কিভাবে ফিরে যেতে হবে তাও বলে দেয়।
পুনরায় রিকশা নিয়ে সাতমাথার পৌর পার্কে আসে। মাঝের বিশাল পুকুরের কাছকাছি একটি সাদা বেঞ্চে বসে।

পুকুরের এক পাড়ে অনেকগুলো গোলাপ গাছ। তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় ফুলের গাছ লাগানো, বড় বড় কাঠগাছও অনেক আছে। পুকুরে অনেকেই সাঁতার শিখছে। আরও আছে একটা দোকান৷ যেটা সবেমাত্র খোলা হয়েছে। পার্কে সকাল বিকাল সবসময়ই লোকজনের যাতায়াত আছেই। সেজন্য এখানে সর্বক্ষণ জনসমাগম বজায় থাকে।

নিঝুম চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ যতদূর চোখ যায়, দেখে নিচ্ছে। আর আনিশা ফোন নিয়ে কী যেন করছে! আনিশা এত মোবাইল টিপতে পারে! কী করে এত নিঝুম ভেবে পায় না। মনের মধ্যে প্রশ্নটা চেপে না রেখে বলেই দেয় আনিশাকে,
~ “মোবাইলে এত কী করছেন আপু?”

আনিশা মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়েই মুচকি হেসে ছোট্ট করে বলে,
~ “কথা বলি।”

নিঝুমের এভাবে বসে থাকতে বিরক্ত লাগছে। তাই আশেপাশে ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিল। নিঝুম মুগ্ধ হয়েছে পার্কটা দেখে। কেননা এসব তার কাছে নতুন। শহরে সে প্রথমবার এসেছে। এত উঁচু উঁচু দালান, যানবাহন, টিউবওয়েলের পরিবর্তে ট্যাপ কল, গ্যাসের চুলা সবকিছুই তার কাছে একদম নতুন। মানুষের মুখে মুখে শুনেছে এতকাল, এখন দেখছে।

~ “আপু আমি একটু আশেপাশে দেখি?”
আনিশা তাকায় নিঝুমের দিকে। বলে,
~ “ঘুরবে? ঠিক আছে। তবে বেশিদূর যেও না। হারিয়ে যেতে পার। আমি এখানেই আছি।”

~ “আচ্ছা”
নিঝুম উঠে হাঁটতে হাঁটতে এদিক সেদিক দেখতে থাকে। আনিশার পাশে এসে বসে একটা লম্বা, ফর্সা মতন দেখতে একটা ছেলে। আনিশার চোখে মুখে প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে পরে। হাসিমুখে কথা বলে দুজনে। আনিশার বাম হাতটা ধরে ছেলেটি কথা বলছে আর শুনছে। মাঝে মধ্যে হাত দিয়ে কপালে আসা ছোট ছোট চুলগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ করে এ দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে যায় নিঝুম। বুকের ভিতরে কিছু একটা যেন ভয়ে অনবরত কাঁপতে থাকে, দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকে। দৃষ্টি সরিয়ে আশেপায়ে তাকায় নিঝুম।

আশেপাশে অনেকেই আছে, তবে কেউ আনিশাদের দিকে খেয়াল করছে না। বলা ভালো দেখেও না দেখার ভান করছে।
নিঝুম অবাক হয়ে যায় এমন দৃশ্য দেখে। তাদের গ্রামে ছেলেমেয়ে এভাবে পাশপাশি বসে থাকতেও পারে না, হাতে হাত রেখে গল্প করা তো দূর। ভাই বোন, আত্মীয় ছাড়া নিজেরা এভাবে বসে গল্প করতে পারবে না, নিষেধাজ্ঞা আছে। যদি কেউ তা না মানে, তবে চরম শাস্তি ভোগ করতে হয়। এছাড়াও কলঙ্ক লেগে যায় মেয়েদের চরিত্রে।

আনিশা নিঝুমের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় ডাকে। মাথা নিচু করে নিঝুম এগিয়ে যায় সেদিকে। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই আনিশা বলে ওঠে,
~ “নিঝুম ও তোমার ভাইয়া, রায়হান।”
~ “আপু উনি কি আপনার ভাইয়া?”

নিঝুমের বোকার মত প্রশ্ন শুনে দুজনেই হেসে ফেলে। রায়হান এই প্রথম নিঝুমের সামনে মুখ খোলে,
~ “এ তো বড় সহজ সরল মেয়ে আনিশা।”

~ “হুম বটে!”
নিঝুমের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসেই বলে উঠলো,
~”নিঝুম, রায়হান তোমার ভাইয়া, আমার নয়। আমার তো উডবি হাসবেন্ড। খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করবো।”

আবারো হেসে ফেললো আনিশা। নিঝুম লজ্জিত হল এমনতর প্রশ্ন করায়। মনে মনে অবাকও হল প্রচন্ড। শহরের কি এটাই নিয়ম? এখানে বিয়ের আগে এভাবে দেখা সাক্ষাৎ, গল্পগুজব করা যায়? কেউ কিছু বলে না? মারে না? একঘরে করে দেয় না? আপাতত মনের ভিতরে জাগ্রত হওয়া প্রশ্নগুলোকে মনেই চেপে রাখলো। পরে একসময় আনিশাকে জিজ্ঞেস করবে বলে ভাবলো নিঝুম।

রায়হান আনিশা ও নিঝুমকে রানার প্লাজায় নিয়ে যায়। দুপুর বারোটা বাজে। পাঁচ তলায় চলে যায়। রেস্টুরেন্টগুলোতে বেশি ভীড় নেই। এখানে ওখানে বসে আছে অনেকেই। বেশিরভাগ টেবিল চেয়ারই ফাঁকা পরে আছে। বিকেল এবং রাতের দিকেই ভীড় বেশি থাকে রেস্টুরেন্টে।

তিনজনে মিলে রেস্টুরেন্টের বাইরেই বসে পরে ফাঁকা জায়গা দেখে। ভিতরে দুজন বসে আছে। সম্ভবত তারা কাপল। সেট মেনু অর্ডার দিয়ে নিজেদের মত গল্প করতে তাকে আনিশা ও রায়হান।

বেচারা নিঝুম চুপচাপ বসে থেকে ওদের দুজনের কথা শুনছে। মাঝে মধ্যে তাদের কথা শুনে লজ্জায় লাল হচ্ছে।
খানিক পরে বিপরীত পাশের রেস্টুরেন্টের ভিতরে চোখ গেলে আঁতকে ওঠে নিঝুম। হঠাৎ করে এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না মোটেই। একটা ছেলে একটা মেয়েকে চুমু দিচ্ছে। নিঝুম চোখ মুখ, কপাল কুঁচকে একত্রিত করে ফেলার প্রচেষ্টা করছে যেন!

হাত পা কাঁপছে অনবরত। ঘামছেও খুব। কপাল কুঁচকে, চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে যাচ্ছে দুটো শব্দ,
~ “নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ।”

নিঝুমকে এমন অদ্ভুত আচরণ করতে দেখে হতভম্ব হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে আনিশা ও রায়হান।


পর্ব ৫

খাবার চলে আসায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হল। আনিশা, রায়হান ব্যস্ত হয়ে পরলো। নিঝুমও হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাই, সালাদ, চিকেন কারি, কোল্ড ড্রিংক্স আরও কয়েক পদের খাবার দেখে নিঝুমের ভিমড়ি খাওয়ার জোগাড়।

প্রতিবেলার খাবারে সর্বোচ্চ দুটো পদ থাকতো তাদের। এর বেশি কখনোই রাঁধতো না শাহেদা। খুব হিসেব করেই চলতে হত। প্রতি সপ্তাহে একবার মাছ কিংবা মাংস খাওয়ার সুযোগ হত। আর এখানে!

আনিশা, রায়হান খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। তাদের দিকে তাকিয়ে নিঝুম বড় চামচটা ডানহাতে তুলে নেয় আর বামহাতে নেয় কাঁটা চামচটা। চামচে করে ফ্রাইড রাইস মুখে তুলে নেয়। নতুন খাবারের স্বাদে চোখ বন্ধ করে নেয় নিঝুম। এই ভাতটা ভীষণ ভালো লাগছে নিঝুমের।

আনিশা, রায়হানের মত করে চিকেন ফ্রাই, চিকেন কারি, সালাদ ও সাথে নিয়ে খেতে লাগলো। খাওয়া শেষে লাচ্ছি, আইসক্রিম ও আনলো একজন লোক।
তৃপ্তি নিয়েই নিঝুম সবটা খাবার খেল। এই সময় নিঝুমের মনে হল তারা গ্রামে কতকিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে!

ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছুঁই ছুঁই। বিলের কাগজ দিয়ে গেলে রায়হান টাকা দিয়ে দেয়। টাকা নিয়ে ফের কাগজটা দিয়ে যায় খাবার দিয়ে যাওয়া লোকটিই। রায়হান আবারো পঞ্চাশ টাকা রাখলো বিলের কাগজের ভিতরেই। লোকটাও বাড়তি টাকাসহ কাগজটা নিয়ে চলে গেল।

নিঝুম অবাক চোখে দেখে গেল সবটা।
রায়হান নিজেই আনিশা ও নিঝুমকে তাদের হোস্টেলে রেখে গেল। রুমে ফিরে ড্রেস না পাল্টেই দুজনে শুয়ে পরলো বিছানায়। একরাশ ক্লান্তিতে শরীর ভার হয়ে আছে। খাবার খাওয়ার পরপরই এমন হয়।

নিঝুম হাতের ওপর ভর করে শুয়ে আনিশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
~ “আচ্ছা আপু, ভাইয়া হোটেলে টাকা দেওয়ার পর আবার পঞ্চাশ টাকা দিল কেনো? একবারেই তো দিতে পারতো!”
আনিশা চোখ খুললো। শব্দ করে হেসে উঠে পরলো।

আয়েশী ভঙ্গিতে বিছানায় হেলান দিয়ে বালিশটাকে বুকে চেপে ধরে বললো,
~ “আমরা যেখানে গিয়েছিলাম, সেটাকে হোটেল বলো না। লোকে হাসবে শুনলে।”
এ পর্যায়ে নিঝুমের মন খারাপ হয়ে যায়।

আনিশা তো বলতেই থাকে।
~ “আমরা রানার প্লাজায় গিয়েছিলাম। বহুতল বিশিষ্ট ভবন সেটা। প্রতিটা ফ্লোরে আলাদা আলাদা জিনিসের শো~রুম সেখানে। এই যেমন ধরো ষষ্ঠ তলায় মোবাইল ফোনের অনেকগুলো শো~রুম, পঞ্চম তলায় শুধু রেস্টুরেন্ট, চতুর্থ তলায় কাপড়ের শো~রুম, তৃতীয় তলায় প্রসাধনী, শো~পিচ আরও অনেক কিছু।

আর হোটেল শব্দাটা রাস্তার ধারের সেসব দোকানকে বলা সাজে, যেসব দোকানে সস্তার খাবার পাওয়া যায়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবারদাবার রান্না, বিক্রি হয় এবং খাবারগুলোও অস্বাস্থ্যকর হয়। আর আমরা যেখানে গিয়েছিলাম সেটাকে রেস্টুরেন্ট বলা চলে।

সেখানে দেশি, বিদেশি সব ধরনের দামী খাবার পাওয়া যায়। আর রায়হান পরে যে টাকাটা দিয়েছে সেটা হল ঐ লোকটার টিপস যে লোকটা আমাদের খাবার সার্ভ করেছিলেন এবং আমাদের কথামতো এটা ওটা আনছিলেন। রেস্টুরেন্টে গেলে এভাবে বিশ, ত্রিশ, পঞ্চাশ টাকা টিপস দেওয়া হয়।”

নিঝুম সব বুঝেছে এমন ভাব করে মাথা নাড়ায়। মনে মনে ভাবে ধনী গরীব ভেদাভেদের মতোই হোটেল রেস্টুরেন্টের পার্থক্য। দামী এবং সস্তা খাবার ভিন্নতার দরুনই বুঝি এই পার্থক্যের সৃষ্টি!

নিঝুম আবার প্রশ্ন করে বসে আনিশাকে।
~ “ঐ লোকগুলোতে বেতন দেওয়া হয় না আপু?”

~ “হ্যাঁ, অবশ্যই দেওয়া হয়। ওটা তো তাদের জন্য চাকরি। কেউ কেউ ফুল টাইম আবার কেউ কেউ হাফ টাইমের জন্য নিজেদের পড়ালেখা বা কাজের পাশাপাশি তারা রেস্টুরেন্টে কাজ করে থাকে।”

~ “তাহলে তাদেরকে টিপস দেওয়ার কি দরকার! টিপসের টাকাটা ভিখারিকে দেওয়া যেত! ৫০ টাকা ৫ টাকা করে দিলেও ১০ জন ভিখারিকে দেওয়া যেত! সেটাই তো ভাল হত, তাই না? তাদের তো আর চাকরি নেই, একটা কি দুটো!”

আনিশা থমকে যায়। অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকায় নিঝুমের দিকে। মেয়েটার মধ্যে নরম, তুলতুলে একটা মনের সন্ধান পায় আনিশা। সত্যিই তো! রোজ রোজ রেস্টুরেন্টে হাজার হাজার টাকা যারা ব্যয় করে আসতে পারে, কর্মচারীদের আলাদা করে টিপস দেওয়ার মত সক্ষমতা যাদের আছে, তাদের অনেকেরই ভিক্ষুককে এক টাকা দেওয়ার মানসিকতা পর্যন্ত নেই। ভিক্ষুক এসে দরজার কড়া নাড়লে ঠিকই মাফ চেয়ে বসেন। এই হল বর্তমানের অনেক মানুষের দুরবস্থা।

পরেরদিন শনিবারে,
আনিশা নিঝুমকে রেখে যায় কলেজে। কলেজের প্রত্যেকটা রুম অনেক রকম ফুল, বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। রোল অনুযায়ী ভাগ করে ছাত্রছাত্রীদের আলাদা রুমে বসতে বলা হয়েছে। নতুনদের সাদরে বরণ করে নিতেই এই আয়োজন ৷

যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। কলেজের প্রিন্সিপাল সহ অন্যান্য শিক্ষক শিক্ষিকাবৃন্দ সহ বিভিন্ন সংগঠন প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। প্রিন্সিপালসহ কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকা তাদের মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেন। তাদের বক্তব্যের মূল বিষয় নবীণদের জন্য কিছু উপদেশ, যেমন নবীণরা কিভাবে তাদের জীবনে এগিয়ে যাবে, কিভাবে পড়ালেখা করবে, কিভাবে চলাফেরা করবে সেসবই বলেছেন ওনারা।

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা এসে রজনীগন্ধা স্টিক দিয়ে বরণ করে নেয় নতুনদের। কলেজে নিঝুমের একজন বন্ধু হয়ে যায়। পিয়ালী নাম তার। শিক্ষকরা রুম থেকে চলে গেলে সকল ছাত্রছাত্রী কলেজ ঘুরতে শুরু করে। আবার অনেকেই যার যার মত বাসায় ফিরে যায়। নিঝুমও পিয়ালীর সাথে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। তারপর আনিশার নির্দেশ মতন রিকশা নিয়ে হোস্টেলে ফিরে যায়।

কোন এক কারণে আনিশার ক্লাস ছিল না। তাই আনিশা হোস্টেলেই ছিল। নিঝুম ফিরে এসে দেখলো আনিশা ফোনে গভীর প্রেমালাপে ব্যস্ত। নিঝুমের বুঝতে সমস্যা হয় না ওপাশে রায়হান আছে। নিঝুম যে রুমে প্রবেশ করেছে সেদিকে কোন খেয়ালই নেই আনিশার। হঠাৎ বেখেয়ালে নিঝুমের দিকে চোখ পড়তেই আনিশা নিঝুমকে মুখভার করে বসে থাকতে দেখে। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপও স্পষ্ট।

আনিশার ফোনে কথা বলা শেষ হলে নিঝুমকে বললো
~ “তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলাম, বুঝলে?”

নিঝুম নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেয়,
~ “বুঝেছি, আপু।”

আনিশা আগ্রহী হয়ে বললো,
~ ” জানো তোমার ভাইয়া রায়হান ………
আনিশা আগ্রহভরে তার বয়ফ্রেন্ডের গল্প শুনাতে লাগলো।

কেমন যত্ন করে আনিশার, কতটা খেয়াল রাখে, কতটা ভালোবাসে, কিভাবে আনিশার সকল ইচ্ছা অনিচ্ছার খেয়াল রাখে, তার সকল আবদার পূরণ করে, সব শুনাতে লাগলো নিঝুমকে।

নিঝুম ভয় পেতে শুরু করে। সংকোচ কাজ করে তার মধ্যে। তার গ্রামের কথা ভাবতে ভাবতেই কোন এক কাল্পনিক জগতে চলে যায়। আনিশার এক ধাক্কায় কাল্পনিক জগতে বিচরণ থেমে যায় তার। আনিশা করুণস্বরে নিঝুমকে বললো,
~ “কী ভাবছিলে এতক্ষণ?

কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? বিরক্ত লাগছিলো তোমার খুব? স্যরি! আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি ফিরেছো, এখনও ফ্রেশ হওনি, আর আমি বকবক করতে শুরু করে দিয়েছি। আমি খুব খুব স্যরি।”

আনিশার কথায় হেসে ফেলে নিঝুম। আর বলে,
~ ” আমি একটুও বিরক্ত হইনি আপু। আমার তো তোমাদের ভালোবাসার গল্প শুনতে খুব ভালোই লাগছিলো। ভাইয়ার কথা বলার সময় তোমার মুখে এক প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে, তোমার গালগুলো কেমন যেন লাল লাল হয়ে যায়।

তোমাকে খুব সুখী সুখী লাগে৷ তবে বেশি ভালো হত যদি ভাইয়া তোমার প্রেমিক না হয়ে তোমার স্বামী হত। আর তুমি তোমার স্বামীর গল্প বলতে, অন্য কোন পুরুষের গল্প নয়।”

আনিশা লজ্জাবনত হয়ে বললো,
~ “যাহ্! একটু বেশি বেশি বলা হয়ে গেলো না, হুমম? হবেই তো স্বামী কয়েকদিন বাদে।”

নিঝুম দুষ্টুমি করে বললো,
~ “আয়নায় দেখো মুখটা আপু। গালের দু পাশটা কেমন লাল লাল দেখাচ্ছে। আর ভাইয়া স্বামী হবে কিন্তু হয়নি তো! দুটো অবস্থা যদি একই হত তবে বিয়ে করার প্রয়োজন তো হত না!”

আনিশা কথা কাটাতে বলে উঠলো,
~ “কলেজে প্রথম দিন কেমন কাটলো তোমার? কলেজ পছন্দ হয়েছে? নতুন বন্ধু হয়েছে?”
নিঝুম অনেক আগ্রহ নিয়ে বলতে লাগলো,
~ “খুব খুব পছন্দ হয়েছে।”

নিঝুম কলেজ এর অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে নতুন বন্ধু পিয়ালীর সাথে কলেজে ঘোরাসহ সকল কিছুই তুলে ধরে আনিশার কাছে। আনিশাও মনোযোগী শ্রোতার মত সবকিছু শুনতে থাকে।

সবকিছু শুনে আনিশা বললো,
~ “হ্যা, সবই ঠিক আছে। তবে সাবধানে থাকবে। এখনই বন্ধুদের সাথে বেশি ঘোরাফেরা করার দরকার নেই। অচেনা জায়গায় এসেছো। বলা যায় না যদি হারিয়ে যাও। তোমার এখানে কোন সমস্যা হবে না। শুধু একটু সতর্ক থাকতে হবে।”

নিঝুমও আনিশার কথায় পূর্ণ সমর্থন জানায়।
~ “আর একটু আপডেট হও বুঝলে। শহরে এসেছো, এখানে গ্রামের চালচলন ধরে রাখলে কেউ পাত্তা দেবে না, মিশবে না।

টিফিনে কেউ অমলেট অফার করলে তুমি যদি তাকে মানা করে দিয়ে বলো আমি অমলেট খাইনা ডিম ভাজা খাই, তবে পরিস্থিতিটা অপমানজনক হয়ে যাবে তোমার জন্য। শহরে থাকতে এসেছো, পড়তে এসেছো, শহুরে মানুষদের সাথে মিশতে হবে তোমার। নিজের প্রয়োজনেই খোলস পাল্টাতে হবে, শহুরে চালচলনে অভ্যস্ত হতে হবে।”

আনিশার কথাগুলো ভালোমতোই মনে গেঁথে যায় নিঝুমের মনে। এখন সময়ই বলবে, কতটুকু পরিবর্তন সে হতে পারবে কিংবা এই পরিবর্তন তার জীবনটাকে সুখকর করবে নাকি ধ্বংস করে দেবে!


পর্ব ৬

মহসিন সকাল সকাল আজ বাজারে চলে এসেছেন। কিছু খরচাপাতি করা দরকার। জিনিসপত্রের যা চড়া দাম! আজকাল বাজার করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। বাবলুটাও হয়েছে এমন যে মাছ, মাংস, ডিম ছাড়া একবেলা খেতেও চায় না। গতকাল রাতেরবেলা খেতে বসে সে হুলস্থুল কান্ড ঘটিয়েছে। শাহেদা কোনমতে আলু চটকে রাতের খাবারের আয়োজন করেছিলেন ঘরে সবজি, মাছ কিছুই ছিল না বলে।

বাবলু শুধু আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাবেনা। তাই ভাতের থালাটাই পা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে ভাতের দানাগুলো থালা থেকে ছিটে এদিক সেদিক পরে গিয়েছিল। শাহেদা শান্ত থাকলেও মহসিন শান্ত থাকতে পারেন নি।

বাবলুর গালে চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। আলু ভর্তা ভাতই অনেকে খেতে পারে না। আর এই ছেলে কিনা সেটা ফেলে দিল! আল্লাহ রিযিকে যেটা রেখেছেন সেটাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। আর বাবলু ভাত ফেলে দেওয়ার সাহস দেখালো কী করে এতেই যেন মহসিনের সমস্ত রাগ ভর করেছে।

এখন তাকে কিছু না বললে ভবিষ্যতে এমন কাজ আবারো করবে ভেবেই মহসিন বাবলুর গায়ে হাত তুলেছিলেন। বাবলু কেঁদে কেটে জামপুর এক জায়গায় একত্রিত করে ফেলেছিল বলতে গেলে।

তাই আজ সকাল হতে না হতেই বাজারের ব্যাগ হাতে বাজারে এলেন মাছ, ডিম, সবজি কিনবেন বলে। তবে বাজারে এসে আগে হাশেম ভাইয়ের চায়ের দোকানে চলে গেলেন। এক কাপ চা পান করে আগে মেজাজটা ফুরফুরে করে নেওয়া দরকার।

হাশেম ভাইয়ের চায়ের স্বাদ ভুলবার নয়। এখানে তার চায়ের খুব জনপ্রিয়তা। অন্য দোকানগুলোর থেকে হাশেমের দোকানেই লোকজন আসে বেশি।

দোকানে ঢুকে আরাম করে বেঞ্চে বসলেন মহসিন। হাশেমের উদ্দেশ্যে হাক পাড়লেন,
~ “কি ভাই ভালো?”

চায়ে চিনি দিয়ে চামচ দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে হাশেম ভাই মৃদু হেসে মাথা নাড়ালেন। দোকানের অল্পবয়সী ছেলেটা হাতে চায়ের কাপ নিয়ে সকলকে এগিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর’ই জীর্ণশীর্ণ দেহের অধিকারী ছেলেটা এক কাপ দুধ চা নিয়ে হাজির হয় মহসিনের সামনে।

হাসিমুখে বল্টুর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে মহসিন বললেন,
~ ”কী বল্টু মিয়া! দিনকাল ভাল?”

ঠোঁটদুটোকে যথাসম্ভব ছড়িয়ে হলদেটে দাঁতগুলো বের করে বিস্তর হেসে বল্টু বলে উঠলো,
~ “হ চাচা মিয়া, বহুত ভালা যায়।”

মহসিন আর কিছু না বলে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। চায়ের স্বাদ গ্রহণের পর ‘আহহ’ শব্দ করে ভালোলাগার জানান দিলেন।
পাশে বসে একজন লোক শব্দ করে চা পান করছেন। মহসিন বিরক্তিতে অস্পষ্ট শব্দ করে ফেললো। তারপর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
~ ”ভাইয়ের বাড়ি কই? এই গ্রামের তো মনে হয় না।”

লোকটির চায়ের কাপ শূণ্য। বেঞ্চের মাথায় চায়ের কাপ রেখে তাকালেন মহসিনের দিকে। তারপর হেসে বললেন,
~ “ঠিক কইছেন মিয়া ভাই। পাশের গ্রামেত বাড়ি আমার। পাশের গ্রামের দুলা চেয়ারম্যানের দুঃসম্পর্কের ভাই হই আমি। জলিল নাম আমার”
~ “ওহ আচ্ছা আচ্ছা। দুলা মিয়ার দুসম্পর্কের ভাই আপনি!”

চিনতে পারার ভঙ্গিতে বললেন মহসিন। জলিল নামের লোকটি বললেন,
~ “আপনাগো গ্রামেত আইছি একখান কামে।”

কৌতুহলী হয়ে মহসিন জিজ্ঞেস করলেন,
~ “কি কাজ?”
~ “আপনাগো গ্রামের রাজা মিয়া বছর কয়েক আগে নাহি মরছে। হের ব্যাটা হেলালের বড় ব্যাটা সাকিবের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতি আইলাম। চিনেন আপনে?”

উত্তেজিত গলায় বললেন,
~ “সাকিবের খোঁজে কেনো আসলেন? আবার কি চুরি করছে?”
~ “চুরি? কিয়ের চুরি? চুরির সাতে হের কিয়ের সম্পর্ক?”

~ “আপনার এখানে আসার কারণ বলেন আগে। সাকিবের খোঁজ নিতে কেন আসছেন?”
~ “আমার বড় ভাইডার একমাত্র মাইয়ার লগে বিয়াশাদীর কতা উঠাইছে।

হের লাইগা খোঁজ নিতে আইছি। আপনে কন তো, বিয়াশাদীর আগে ভালা মতোন খোঁজ খবর নেয়া জরুরি কি না! মাইয়া দিমু যারে, তার সম্পর্কে ভালা মতোন জানতি হইবো না? যাচাই করি নিমু না তারে? কি কন মিয়া?”

~ “মিয়া ভাই, যার সাথে আপনার ভাতিজীর বিয়ের কথা উঠেছে সে তো জাত চোর। জন্মসূত্রে চুরির শিক্ষা পাইছে মনে হয়। দাদাও এককালে চুরি করছে, বাপেও করছে আর এখন ছেলেও করে। এই তিন~চার দিন আগেই তো কোথায় থেকে কার যেন একটা দামী মোবাইল চুরি করে আনছিলো।

তারপর তো কয়েকজন জোয়ান ছেলে সাকিবরে ধাওয়া করলো। সে আর জায়গা খুঁজে পায়নি, আমার বাড়িতে গিয়েই উঠেছিল। আমার বাড়িওয়ালী তো ঐ ছেলেগুলোরে মিথ্যা কথা বলে একপ্রকার বাঁচাতেই চাইছিলো কিন্তু আমার জন্য পারেনি।

একপ্রকার ধমকি ধামকি দিয়ে সাকিবকে বাড়ি থেকে বের করে দিলাম। বাড়িওয়ালী ভয়ে ছিল যে, সাকিবরে ধরিয়ে দিলে যদি পরে আমাদের ক্ষতি করে বসে! বলেন দেখি কেমন কথা সেটা! তার ভয়ে নাকি মিথ্যা বলে অন্যের ক্ষতি করতে হবে! তারপর ছেলেগুলো সাকিবরে খুব মারলো। মারধোর করে মোবাইলটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে সেটা ওর মুখ থেকে বের করে নিলো।

পুলিশে দিতে চেয়েছিলো, তবে আমরা গ্রামের লোকেরা অনুরোধ করে পুলিশে দেওয়া আটকিয়েছি। এর আগেও এর ওর বাড়ি থেকে মুরগি, কবুতর, মোবাইল, টাকা অনেক চুরি করেছে। ধরাও পরেছে বেশ কয়েকবার। তারপর থেকে গ্রামের লোকজনেরা খুব সচেতন থাকে। নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস, টাকা খুব সামলে রাখতে হয় এখন।

বলা তো যায় না কখন চুরি করে বসবে টের পাওয়া মুশকিল হবে।”
মহসিন কথা শেষ করে লোকটির দিকে তাকালেন। লোকটির মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তেতো কিছু মুখে নিয়ে বসে আছেন তিনি। জলিল হতাশ হয়ে বললেন,
~ “এ কী অবস্থা!”

জোরে শ্বাসত্যাগ করে মহসিন বললেন,
~ “ভালো হয়েছে আগেই খোঁজ নিতে এসেছিলেন। আর আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে অন্য কারোর থেকে জেনে নিবেন। দরকার হলে আমাদের বাড়ির আশেপাশের মানুষের থেকে শুনবেন।

সাকিবের বাড়ি তো আমার বাড়ির তিন বাড়ি পরেই। বুঝলেন মিয়া ভাই? তাছাড়া কারো বিয়েতে ভাঙ্গানি দেওয়ার মত মানুষ আমি না। যা বললাম সব খাঁটি কথা। দাঁড়ান আপনি। শুনাচ্ছি আরও।”

তারপর মহসিন বল্টুকে কাছে ডেকে বললেন সাকিবের সম্পর্কে যা জানে বলতে। সে কেমন, কী করে এসব বলতে বললেন। বল্টু তো আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বললো,
~ “চাচা, আপনে হেই চোরের কতা জিগান কিয়ের লাই? সবই তো আপনার জানা। নতুন করি কিয়া শুনবেন?”

মহসিন নীরব থাকলে বল্টু বলে,
~ “কতা কন না কে রে?”
জলিলের বুঝতে সমস্যা হল না। আর কিছু না শুনে হতাশ হয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চলে গেলেন।

মহসিন ভাবতে লাগলেন এই ছেলেকে কে মেয়ে দেবে? যে মেয়ের সাথে বিয়ে হবে তার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। চোরের বউয়ের পরিচয় পেতে হবে তাকে। তাছাড়া মনে হয় না এই গ্রামের আশেপাশের কারো সাথে তার বিয়ে হবে।

মোটকথা এই জায়গায় থাকলে সাকিবের বিয়ে হবেই না। যাক সে চিন্তা। তার বাজার করে বাড়িতে যেতে হবে। তবেই উনুন জ্বলবে আজ। চায়ের দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে সবজি বাজারের দিকে এগোলেন মহসিন।

গতকাল আনিশার কথায় নিজেকে বদলানোর তাগিদ অনুভব করেছে নিঝুম। প্রথমদিন গিয়েই টের পেয়েছে তাকে ক্লাসের বাকিরা সাদরে গ্রহণ করবে না। তাকে দেখে নাক সিটকানোর মত মেয়ে অনেক আছে ক্লাসে। আর কেনোই বা করবেনা এমন! কলেজের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর সামনে তাকে বড্ড বেমানান দেখায় যে!

তবে পিয়ালী তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম। অনেক সুন্দর তার চালচলন। কথাও বলে কি সুন্দর করে! শহুরে সুন্দরী মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও সে নিঝুমের সাথে মিশেছে। কিছু কিছু মানুষের অন্যকে হাসানোর অদ্ভুত সুন্দর ক্ষমতা থাকে।

পিয়ালী তেমনই একজন। একদিনের কিছুসময়ের ব্যক্যালাপে নিঝুমের এই ধারণা হয়েছে। মিনিট কয়েক পিয়ালীর সাথে কথা বললেই যেন অনেক হালকা লাগে, বিষাদ দূর হয়।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে সালাত আদায়ের পর আর ঘুমায়নি নিঝুম। মনের মধ্যে একটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে।

সাথে ভয় ভয়ও লাগছে কিছুটা। আজ প্রথম ক্লাস হবে! বইপত্র আগেই কেনা হয়েছে। নতুন বই অতি উৎসাহে উল্টে পাল্টে দেখাও হয়েছে। কয়েক পাতা করে না বুঝে পড়েও ফেলেছে নিঝুম। এসবই অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টের ফল!

উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে নিঝুমের। সময় নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে সে।


পর্ব ৭

আনিশা ঘুমে বিভোর ছিল বলে নিঝুম তাকে না জানিয়েই একা একা কলেজে চলে গেল। আনিশা আগে থেকে নিঝুমকে সব বুঝে দিয়েছিল বলে নিঝুমের কোনো সমস্যা হয় নি।

কলেজে পৌঁছলো এগারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে। গিয়ে দেখলো ১ম বর্ষের তেমন কেউ আসেইনি কলেজে। ক্লাসরুমগুলোতে ক্লাস হচ্ছে। সম্ভবত দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস।

১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হবে বারোটায়। সবাই হয়তো দেরি করে আসবে, একদম বারোটা বাজার আগ মুহুর্তে।
বারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই পিয়ালী আসে। নিঝুম তাকিয়েই ছিল দরজার দিকে। পিয়ালী দরজায় দাঁড়ানোর সাথে সাথেই নিঝুম আওয়াজ দেয়,
~ “পিয়ালী! এদিকে আসো।”

নিঝুম বসেছিল থার্ড বেঞ্চে। পিয়ালীও গিয়ে নিঝুমের পাশেই বসলো। বেঞ্চে ব্যাগ রেখে বসার পর নিঝুমের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। তারপর তাদের কথোপকথন শুরু হল।

নিঝুমের ধারণা অনুযায়ী ঠিক বারোটায় কলেজের তিনটি বাস পরপর এসে রাস্তায় দাঁড়ালো। ছাত্রছাত্রীদের ভীড় লেগে গেল কলেজের মাঠে। ছুটে ছুটে সবাই ক্লাসরুমে যাচ্ছে। ক্লাসে ক্লাসে শিক্ষক শিক্ষিকারা যেতে শুরু করেছেন। ছাত্র ছাত্রীদেরও ক্লাস ধরতে হবে।

প্রথম ক্লাস বলে রীতা ম্যাম তেমন কিছু পড়ালেন না। গল্পগুজব করলেন। চল্লিশ মিনিট পার হলে তিনি চলে গেলেন। পরবর্তী ক্লাস নিতে আসেন একজন স্যার। নাম তার রেজাউল করিম। ইংরেজি পড়াবেন। তিনি অল্প স্বল্প পড়িয়ে ক্লাস শেষে পরিচয় দিয়ে চলে গেলেন। বাকি দুটো ক্লাস আর হল না। তাই ক্লাসের বিরতি না দিয়ে একবারে ছুটি দিয়ে দিল।

দেড়টা বাজে। কলেজ মাঠে পাশাপাশি হাঁটছে পিয়ালী আর নিঝুম।
~ “প্রাইভেট শুরু করেছিস?”
পিয়ালী আগে কথা শুরু করে।

মাথা নাড়িয়ে না জানায় নিঝুম।
~ “আমি তো এখানে কিছুই চিনি না। ক্লাস করার পরও প্রাইভেট পড়তে হয়?”

~ “টিচার যদি ভালোমতো পড়াতেন তাহলে লাগতো না। কলেজে এটা আসলে সম্ভবও নয়। সরকারি কলেজ, অনেক ছুটি থাকে। কারণবশত কোনো শিক্ষক ক্লাস নিতে না পারলে পুনরায় সেটা নেওয়া হয় না। আর একটা সাবজেক্টই এখানে অনেক শিক্ষক পড়াবেন। সেক্ষেত্রে তো আরও সম্ভব না।”
~ “তুই কিভাবে এতকিছু জানিস?”

উৎসুক দৃষ্টিতে পিয়ালীর দিকে তাকিয়ে নিঝুম জিজ্ঞেস করলো কথাটা।
পিয়ালী ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বললো,
~ “আমার বোন পড়তো এই কলেজে।”

~ “ওহ তাহলে এখন কি করবো?”
~ “আমি তো বাসাতেই তিনটা প্রাইভেট পড়বো। আজ থেকেই স্যার আসবেন বাসায়। আমার বোনকে যারা পড়াতেন, তারাই।”

ইতস্তত করে নিঝুম জানতে চাইলো,
~ “কত টাকা দিতে হবে তাদের?”
~ “সে আমি ঠিক জানি না। একেক জনের একেক রকম। তবে পাঁচ হাজারের কমে তো নয়ই।”

~ “ওহ”
কলেজের গেটে এসে পৌঁছলে পিয়ালী বলে,
~ ” কাল আবার দেখা হবে। ওকে নাউ বাই।”

আবছা হেসে বিদায় জানায় নিঝুম।
হোস্টেলে ফিরে আনিশাকে পায় না। সারাদিন বাবাকে কিভাবে প্রাইভেট পড়ার কথা জানাবে সেটাই ভাবতে থাকলো।

এত এত খরচ কিভাবে দেবে! চাষাবাদের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে আর কতটুকুই বা সম্ভব! নিঝুম তো অবুঝ নয়। সে বুঝতে পারে তার বাবা মহসিন দারিদ্রতার লেশমাত্র তাদের গায়ে লাগতে দেয় না। তাই বলে তার ওপর কত চাপ দেওয়া যায়!

রাত ৮টা। সাহিত্যপাঠ বইটা উল্টে পাল্টে দেখছে নিঝুম। আনিশা কিছুক্ষণ পূর্বেই ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে আবারো মোবাইলের ভিতরেই ডুব দিয়েছে।

~ “আপু”
~ “হু”
আনিশা ফোনেই কিছু একটা করছে। মাথা তুলে নিঝুমের দিকে তাকালো না পর্যন্ত।
~ “আসলে আমার প্রাইভেট পড়া দরকার! আমি তো এখানে তেমন কিছু চিনি না। কিভাবে কি করবো! কাদের কাছে পড়বো বুঝছি না।”

~ “ওহ এই ব্যাপার..!”
ফোন রেখে নিঝুমকে বিস্তারিত জানালো আনিশা। প্রাইভেট পড়ানোর স্থানই হল জলেশ্বরীতলা। এখানেই অধিকাংশ শিক্ষক কোচিং, প্রাইভেটে ক্লাস নিয়ে থাকেন। ব্যাচে পড়ানো হয় বলে খুব বেশি টাকাও দিতে হয় না শিক্ষকদের। এসব কথা শুনে নিঝুম যেন একটু খুশিই হল। মহসিনকেও ফোন করে অল্পবিস্তর জানিয়ে দিল, মায়ের খোঁজখবর নিল, বাবলুর সাথে কথা বললো।

পরদিন কলেজে পিয়ালী ও নিঝুমের সাথে আরও একজন যোগ দিল। আর সে হল রাকিব। রাকিব পিয়ালীর স্কুল ফ্রেন্ড ছিল। সুদর্শন চেহারার অধিকারী রাকিব ক্লাসের মেয়েমহলে খুবই পরিচিত।

ফ্লার্ট করার অভ্যাস তার শিরায় শিরায়। মেয়েদের অহেতুক প্রশংসা করা, তাদের সাথে হাসি ঠাট্টা, আড্ডা দেওয়া তার স্বভাব। রাকিবকে কলেজে মেয়েদের সাথেই বেশি দেখা যায়। তাকে ছেলেদের সাথে খুব সামান্য সময়ের জন্যই দেখতে পাওয়া যায়। তবে আদৌ তার ছেলে বন্ধু আছে কিনা সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নয় অনেকেই।

নিঝুম ভেবে পায় না মাত্র তিনদিনের কলেজ জীবনে এত এত মেয়ে বন্ধু কিভাবে বানালো ছেলেটি। সংকোচ, ভয় থেকে রাকিবের সাথে কথা বলে না নিঝুম। শুধু রাকিব নয় কোন ছেলে ক্লাসমেটের সাথেই কথা বলে না।

তবে পিয়ালী আর রাকিব ক্লাসরুমে, ক্লাসের বাহিরেও অনেক গল্প করে, মাঠে বসে আড্ডা দেয়।
নিঝুম খেয়াল করে ক্লাসের কেউ তার সাথে কথা বলতে চায় না। কেমন করে যেন তাকায়! সেই দৃষ্টিতে নিজের জন্য তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের রেশ দেখতে পায় নিঝুম।

একদিন তো লিজা নামের মেয়েটি কটাক্ষ করে বলেছিলো,
~ “বাসায় কি তেল রেখেছো কিছু? নাকি সব মাথায় দিয়ে এসেছো?”

আশেপাশের সবাই যখন হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছিলো নিঝুমের মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছিলো। তারপর নিঝুম মনে মনে পরিকল্পনা করে ভালো ফলাফল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে। মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখাও শুরু করে।

দিনগুলো পার হতে লাগল ভারি ব্যস্ততায়। কলেজ যাওয়ার আগে ও পরে প্রাইভেট পড়তে হয়। সেখানকার পড়া, ক্লাসের পড়া সবমিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটে নিঝুমের।

প্রথম সাপ্তাহিক পরীক্ষাতেও সে ভালো নাম্বার পায়। ইনচার্জ স্যার যখন প্রথম বিশ জনকে দাঁড় করায়, তখন অনেকেই হতভম্ব দৃষ্টিতে দেখছিলো তাকে। তাদের সেই অবাক হওয়া দৃষ্টি নিঝুমকে আনন্দ দিয়েছিল। পিয়ালী তো খুশি হয়েছিলই। সাথে রাকিবও টুকটাক কথা বলতে শুরু করে। নিঝুম মনে মনে পুলকিত হয়।

কলেজে ব্রেক টাইমে যখন আড্ডা দেওয়া হয় নিঝুম আঁড়চোখে কখনো কখনো রাকিবকে দেখে। মাঝে মাঝে নিঝুমের খারাপ লাগে রাকিব তো তার সাথে বেশি কথা বলতেই পারে! তাহলে কেনো বলে না সে? বন্ধুত্ব করতে পারতো না! তাকায়ও না তো! কি সমস্যা? আর তাকালেও যেন কেমন করে তাকায়! খুব খুব খারাপ লাগে নিঝুমের।

আবার এমন খারাপ লাগার জন্য অবাকও কম হয় না নিঝুম। কি হচ্ছে এসব তার সাথে! ছেলে বন্ধু তার লাগবে না। পড়াশোনায় মনোযোগী সে আগে থেকেই। চিন্তা করলো এসব ফালতু কথা না ভেবে আরও মনোযোগী হতে হবে।

তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই যুগের সাথে তাল মেলাতে ফেসবুক জগতে নাম লিখিয়েই ফেলে নিঝুম। নিঝুমকে আনিশাই ফেসবুক আইডি খুলে দেয় এবং ফেসবুকের ব্যবহারও সীমিত আকারে শিখিয়ে দেয়। আনিশা নিঝুমের ফেসবুক আইডিটির নাম দেয় “নিঝুম রাত”।

এরপর থেকে কলেজ, প্রাইভেট, পড়ালেখার পরে অবসর যেটুকু সময় পায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম “ফেসবুক” এ পরিচিত অপরিচিতদের সাথে চ্যাটিং এ ব্যস্ত থাকে নিঝুম। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত চলতে থাকে ভার্চুয়াল আড্ডা। কাযা হতে থাকে ফজরের সালাত।

প্রথম দিকে ফেসবুকের তেমন কিছুই বুঝতো না বলে পরিচিত অপরিচিত সবাইকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতো এবং কেউ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালে সেও এক্সেপ্ট করে নিত। তথাকথিত আধুনিক মেয়েদের সংস্পর্শে ততোদিনে ছেলেদের নিয়ে নিঝুমের জড়তা ও ভয় কাটতে শুরু করেছে। তার বদলে স্থান পেয়েছে শহুরে জীবনযাপনের প্রতি একরাশ কৌতুহলের।

আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে বন্ধুর সংখ্যা, ভারী হতে থাকে ইনবক্স, বাড়তে থাকে নোটিফিকেশন। ছেলেদের ‘হাই’, ‘হ্যালো’ লেখা মেসেজ আসতেই থাকে প্রতিদিন, কি ফ্রেন্ড কি অপরিচিত! সবাইকেই রিপ্লাই দিতে শুরু করে নিঝুম।

দিনের অনেকটা সময় মেসেজিং এই যায়। নিউজফিড এর অধিকাংশ জায়গা জুড়ে বন্ধুদের শেয়ার করা মিউজিক ভিডিও আর না’হয় ছবি। সেলফি আর গানের জন্য ফোন স্টোরেজ ভরে যেতে থাকে। ইসলামিক এপগুলোতে আর ঢোকার সময় পায় না নিঝুম।

এভাবেই তার জীবনটা চলতে থাকে। কলেজ, প্রাইভেট, পড়ালেখা, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, মাঝে মাঝে গ্রামে ফোন করে বাবা, মা, ভাই এর সাথে কথা বলা, তাও খুব স্বল্প সময়ের পরিসীমায়।


পর্ব ৮

ফেসবুক আইডি খোলার প্রায় দেড় মাস পরে হঠাৎ একদিন “আদনান হাবিব” নামের একটা ছেলের আইডি থেকে নিঝুমের আইডিতে মেসেজ আসে,
~ “হাই! আমরা কি বন্ধু হতে পারি?”

নিঝুম ছেলেটির প্রোফাইলে গিয়ে দেখলো ছেলেটা ওর ফ্রেন্ড লিস্টেই আছে। দারুণ একটা ছবি প্রোফাইলে ঝুলছে। এবাউটে গিয়ে দেখলো ছেলেটা ওদের কলেজেরই বিশ্ববিদ্যালয় শাখাতে অনার্সে পড়ছে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে। কোন বর্ষে পড়ছে তা জানতে পারে না নিঝুম।

তারপর মেসেজের উত্তরে লিখলো,
~ “জ্বী, আমরা তো বন্ধুই রয়েছি।”

হাসির ইমোজির সাথে ছেলেটি আবারো মেসেজ পাঠায়,
~ “তোমার বুঝি সাফা কবিরকে ভালো লাগে? আমিও সাফা কবিরকে খুব পছন্দ করি।”
~ “কে সে?”

অবাক হওয়ার ইমোজির সাথে ফিরতি মেসেজ,
~ “প্রোফাইল পিকচার হিসেবে যার ছবি দিয়েছো!”

~ “ওহ, না জেনেই দিয়েছি। আমার রুমমেট আপু দিয়ে দিয়েছিলেন।”
~ “ওহ”
এরপর এক কথা দুই কথায় অনেক অনেক কথা হয়ে যায় দুজনের।

নিঝুমের কেন জানি আদনান নামের ছেলেটির সাথে কথা বলতে ভালোই লাগছিলো।
কথায় কথায় কখন যে গভীর রাত হয়ে যায় নিঝুমের খেয়ালই ছিল না।

আনিশা নেই হোস্টেলে। দিন দুয়েকের জন্য মায়ের কাছে থাকতে গিয়েছে সে। রাত ১ টা পর্যন্ত কথা বলে দুজন দুজনকে বিদায় জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে আবারও সেই রুটিনমাফিক কলেজ, প্রাইভেট, বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি, হইচই।

তবে সারাদিনে নিঝুম কয়েকবার অনলাইনে গিয়ে চেক করেছে আদনান মেসেজ দিয়েছে কিনা। কেন করেছে এমন জানে না সে। তবে না চাইতেও করেছে। যতবারই অনেক আশা নিয়ে অনলাইনে গিয়েছে ততবারই আদনানের মেসেজ না পেয়ে আশাহত হয়েছে। মন খারাপ করেছে।

ক্লাস বিরতির আড্ডার নিঝুমকে অন্যান্য দিনের মতো অতটা প্রাণোচ্ছল না দেখে তার বন্ধুবান্ধবরা তাকে জিজ্ঞেস করে,
~ “কি হয়েছে তোর?”

~ “কিছু না।” বলে নিঝুম এড়িয়ে গিয়েছে। তবে নিঝুমও ভেবে পায় না হঠাৎ করে অচেনা অজানা এক ছেলের মেসেজ না পাওয়ায় তার এত খারাপ লাগছে কেনো? তাও আবার একদিনেই! হয়তোবা দীর্ঘ সময় কথা বলার কারণে হতে পারে। হয়তো এটাকেই মায়া বলে!
~ ”আচ্ছা নিঝুম, একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?” আড্ডার ফাঁকে বিজ্ঞ ভাব নিয়ে কথাটি বললো রাইসা।

~ “হুম কী?” আনমনে উত্তর দিলো নিঝুম।
~ “আজকাল পিয়ালী একটু বেশি সেজে আসছে না?”
~ “এই কী বললি তুই?” পিয়ালী রেগে গেল।

রাইসা ঠাট্টার সুরে বললো,
~ “বলছি তুই কী বিয়ে বাড়িতে এসেছিস? চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, চুলের এই বাহারী সাজ…. কেনো ভাই কেনো! এত সাজ কেনো? জাতি জানতে চায়।”

পিয়ালীর মুখের সামনে মাইক্রোফোনের ভঙ্গিতে হাতটা ধরলে পিয়ালী ঢং করে বললো,
~ “সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখার মত কোনো বিষয় নয়। নিজের সৌন্দর্য দেখিয়ে হাজার পুরুষের রাতের ঘুম হারাম করা আর নারীদের ঈর্ষান্বিত করার মধ্যেই এক রকম আনন্দ আছে। বুঝলি তো!”

পিয়ালীর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকালো রাইসা। আর নিঝুম মনে মনে পিয়ালীর বলা কথাটা আওড়াতে থাকে।
আগেরদিনের মত রাত্রিবেলায় নিঝুমকে মেসেজ দেয় আদনান। দুজন দুজনের সাথে কথা বলে অনেকক্ষণ।

পাশের বেডে আনিশা রায়হানের সাথে রোমান্টিক কথোপকথনে ব্যস্ত। খুব কম সময়ই তাকে বই হাতে দেখা যায়, পড়তে দেখা যায়। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে লাজুক হাসছে সে।

নিঝুমের মনটাও চায় এমন কেউ তার জীবনে আসুক। অবুঝ কিশোরী নিঝুম হৃদয়ের ক্যানভাসে রঙ তুলিবিহীন ছবি আঁকতে শুরু করে তার স্বপ্নপুরুষের।

তার অবুঝ মনও এমন একজন মানুষকে জীবনে পাওয়ার কামনা করে যে তাকে খুব খুব ভালোবাসবে, তার যত্ন নেবে, তার সাথে সুখ দুঃখ বিনিময় করবে, তার ভালো~খারাপ সময়ে তাকে সঙ্গ দেবে, তার সকল বলা~না বলা কথা নিমিষেই বুঝে যাবে, তার সকল মান অভিমান বুঝতে পারবে, তার ছোট বড় সকল ইচ্ছার মূল্য দিবে, তার সকল কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনবে, জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তার জীবনে থাকবে।

প্রচন্ড পিপাসার্ত হয়ে পড়ে নিঝুম। কোন এক অচেনা অজানা ভালোবাসা পাওয়ার পিপাসা, তাকে নিজের করে নেওয়ার পিপাসা, তার চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা খোঁজার পিপাসা। নিঝুমের কোমল হৃদয় মরিয়া হয়ে উঠেছে যেন এমন একটা দিনের, সময়ের, মানুষের আকাঙ্ক্ষায়।

যত দিন যেতে থাকে নিঝুমের সাথে আদনানের বন্ধুত্ব ততই জমতে থাকে। একে অপরের সাথে একদিন কথা না বলেও থাকতে পারে না, এমন অবস্থা। এখন ফেসবুকের বাইরেও দুজনে মেসেজে কথা বলে, একে অপরের খোঁজ নেয়। দুজন দুজনের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে যেন।

কয়েকদিন আগে নিঝুমের কলেজে সাপ্তাহিক পরীক্ষা হয়। আজ তার ফলাফল দিয়েছে। নিঝুম অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী হলেও গত সাপ্তাহিক পরীক্ষাতে সন্তোষজনক নাম্বার পায় নি। এতে সে নিজেও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছে। বিকেলের দুইটা প্রাইভেট পড়ে এসে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে নিঝুম। মাথার উপরে ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যানের দিকেই নিঝুমের দৃষ্টি আবদ্ধ।

হঠাৎ ফোনে মেসেজের টুংটাং শব্দ শুনে উঠে বসে ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটি বের করে ফোনের মেসেজ অপশনে ঢুকে আদনানের মেসেজ দেখেই নিজের অজান্তেই ঠোঁটে হাসি চলে আসে নিঝুমের। এক মুহুর্তে সব খারাপ লাগা, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা যেন গায়েব হয়ে গিয়েছে। আদনান মেসেজ পাঠিয়েছে তাকে, ” মেসে ফিরে একটা মিসডকল দিও প্লিজ। চিন্তা হয় আমার।”

ছোট্ট এই মেসেজটা নিঝুমের কাছে অনেককিছু। সাথে সাথেই কল করে আদনানকে। পুরো পনের মিনিট ধরে কথা বলে দুজনে। ফোন রাখতে ইচ্ছে করছিলো না নিঝুমের। মনে হচ্ছিলো এভাবেই যদি সারাজীবন আদনানের সাথে কথা বলে যেতে পারতো! তবে কতোই না ভালো হতো।

অদ্ভুত এক ভালোলাগা ঘিরে ধরেছে নিঝুমের হৃদয়কে। আদনানের যত্ন, নিঝুমের ওপর তার মনোযোগ ধীরে ধীরে তাকে আদনানের এর প্রতি দুর্বল করে দিচ্ছে।

বয়সে বড় হয়েও আদনান কিভাবে নিঝুমের এত ভালো বন্ধু হয়ে গেল বুঝতেই পারলো না। তবে মাঝে মাঝে মস্তিষ্ক মনকে প্রশ্ন করে বসে,
~ “এটা কি শুধুই বন্ধুত্ব? নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু? নাকি নিছক এক মায়া এটা!”

আনিশার সাথে আজ নিউমার্কেটে এসেছে নিঝুম। পুরো নিউ মার্কেট ঘুরে জামাকাপড়, কসমেটিক্স কিনলো আনিশা। মার্কেটের সুন্দর চকচকে পোশাকের ভীড়ে নিঝুমের চোখ চকচক করতে লাগলো। অল্প দামের একটা পোশাক কিনলো নিঝুম। তবে মন তো পরে আছে দামী, আধুনিক পোশাকে। জিনস আর টপসে নিজেকে সাজানোর সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হচ্ছে।

মার্কেটে কেনাকাটা শেষে নিঝুমকে সাথে নিয়ে জলেশ্বরীতলার সুকন্যা পার্লারে গেল আনিশা। সামনে পেছনে চুল কাটে, কালার করায়। নতুন এক লুক চলে আসে আনিশার। পার্লারের আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই যেন চিনতে পারে না আনিশা। নিজের নতুন লুকে তৃপ্ত হয়ে হাসে সে।

নিঝুম দুষ্টুমি করে বলে,
~ “নায়িকা লাগছে একদম।”

নিঝুমের কথায় আনিশা শব্দ করেই হেসে ফেলে। আমতাআমতা করে নিঝুম বলে,
~ “আমারো চুল কাটতে ইচ্ছা করছে আপু।”

~ “কাটো, সমস্যা কী? ভালো লাগবে দেখতে। সামনে পিছনে লেয়ার দিবে?”
~ “আমি তো বুঝি না!”
~ “আসো বসো এখানে।”

নিজে উঠে জায়গা করে দেয় নিঝুমকে। পার্লারের মহিলাটা নিঝুমের চুলে হাত দিয়ে বললো,
~ “শ্যাম্পু করা আছে?”

~ “হ্যাঁ”
মহিলাটি টুম্পা নামের কাউকে ডেকে চুল প্রস্তুত করতে বললে, একটা ছোট মেয়ে এসে নিঝুমকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে দেয়। চুল আঁচড়ে পানি ছিটিয়ে দেয়। পার্লারের সামনে পিছনের আয়নাতে নিজেকে দেখতে থাকে নিঝুম। মহিলাটা এসে ব্যস্ত হাতে তার চুল কাটতে আরম্ভ করে দিয়েছে।

পার্লার থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠে নিঝুমের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে আনিশা বললো,
~ “সবসময় চুলে তেল দেবে না। কালো কালো দেখায়। খুব বাজে লাগে। সবসময় বেঁধে না রেখে চুলগুলোকে উড়তে দাও। ভালো লাগবে। নিজেকে নিয়ে ভাবো একটু। নিজেকে আয়নায় দেখে চোখ শান্ত না হলে কি ভালো লাগে?”

নিঝুম কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসে। মনটা আজ তার অনেক ভালো। ফেরার সময় দুজনে বেশ কয়েকটা সেলফিও তোলে।
মাত্র কয়েকটা মাসেই নিঝুমের এত পরিবর্তন ঘটে যায়।

যে মেয়েটা ছেলেদের সাথে কথা বলতে ভয় পেত লোকসমাজের ভয়ে, সেই মেয়েটার আজ ঘনিষ্ঠ ছেলে বন্ধু আছে। যে মেয়েটা নিয়ম করে সালাত আদায় করতো, আজ সে দু এক ওয়াক্ত সালাত খুব দ্রুত আদায় করে ফেলে।

যে মেয়েটা নিজেকে আড়াল করে রাখতো সবসময়, সেই মেয়েটিই আজ নিজেকে প্রদর্শনীর বস্তু মেনে শহুরে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতে চাইছে। এখন বাবা~মা এর তেমন খোঁজ নেওয়া হয় না নিঝুমের। শুধুমাত্র টাকা নেওয়ার সময়ই নিজ থেকে যোগাযোগ করে। মহসিন মনে করেন মেয়েটা পড়ালেখায় ব্যস্ত। তেমন একটা গুরুত্ব দেন না এ বিষয়ে।


পর্ব ৯

বদলেছে সময়, বদলেছে সঙ্গ, সাথে বদলেছে নিঝুম। নিঝুম আজকাল পিয়ালী, রাইসার মত করে চলছে। তাকে আর তেল দেওয়া চুলে দেখা যায় না। শ্যাম্পু করা সিল্কি চুলগুলোকে সবসময় উড়তেই দেখা যায়। হালকা সাজগোজ করতেও তাকে দেখা যায়। পড়ালেখায় ঘাটতিও কিছু কম হচ্ছে না।

ইদানীং আদনান নিঝুমকে দেখতে চায়। খুব জেদ করে নিঝুমের একটা ছবি দেখার জন্য, নিঝুমের সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু নিঝুম মোটেই এত সহজে ধরা দিতে চায় না। আদনান প্রতিদিন নিঝুমকে বন্ধুত্বের অজুহাতে অনুরোধ করতে থাকে।

মাঝে মাঝে নাকি কলেজে আসে, ক্লাসেও আসে, এই আশায় যদি খুঁজে পায় নিঝুমকে। নিঝুমের অদ্ভুত অনুভূতি হয়,
~ “ইশ! ছেলেটা তাকে দেখার জন্য এভাবে ছুটে আসে!”

কথাটা ভাবলেই যেন হৃদয়ে কাঁপন ধরে।
নিঝুম ভাবলো আদনানের সাথে দুষ্টুমি করা যাক।

এ চিন্তা থেকে নিঝুম একদিন বান্ধবী পিয়ালীর সাহায্য নিয়ে সেজেগুজে মোবাইলে কয়েকটা ছবি তোলে। কোনো ছবিতে মুখে হাত, কোনোটায় মুখের একপাশ দেখা যায়। এমনই একটা ছবি রাতের বেলা নিঝুম ফেসবুকের প্রোফাইলে দেয়। তারপর অফলাইনে চলে যায়। আর ভাবতে থাকে আদনান দেখলে কী বলবে!

নিঝুমের ছবিটা দেখার সাথে সাথেই আদনানের মেসেজ,
~ “নিঝুম, তোমার চোখগুলো খুব খুব সুন্দর। সবসময় কাজল দিয়ে রাখবে। তাহলে আরও সুন্দর লাগবে৷”

আদনানের মেসেজে নিঝুম লজ্জা পেয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। যেন আদনান ওর সামনে বসে থেকেই ওর প্রশংসা করছে আর ওকেই অপলক দেখছে। সাথে অল্প অল্প খুশিও হয় নিঝুম৷ নিঝুম আদনানের মেসেজের কোন উত্তর দিতে পারে না। কী দিবে, কী দিবে ভাবতে ভাবতে হাসির একটা ইমোজি পাঠিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পর আদনান আরো একটা মেসেজ পাঠায়, যা দেখে নিঝুমের হৃদয়ে ভালোবাসার সঞ্চার ঘটতে থাকে। মেসেজটি ছিল এমন,
~ “প্রোফাইলের ছবিটা ডিলেট করো প্লিজ। আমি চাই না তোমার এত সুন্দর চোখগুলো অন্য কেউ দেখুক আর প্রেমে পড়ুক। প্লিজ আমার কথা শোনো।”

নিঝুমের মনে ভালোবাসার ঢেউ খেলে গেলেও আদনানের এমন নীরব অধিকার দেখানোয় কিছুটা অবাকও হয়। অনুভব করে তার জন্য আদনানের একটুখানি ভালোবাসা। মনের মধ্যে কোথাও একটা সুপ্ত বাসনা জেগে ওঠে আদনানকে পাওয়ার। মনের ভেতরে আঁকা স্বপ্ন পুরুষের সাথে মেলাতে থাকে আদনানকে।

দুই প্রান্তের দুই জন মানুষ একই সময়ে দু’জন দু’জনকে নিজের করে পেতে চাইছে, অনুভব করছে একে অপরের জন্য নিজেদের দুর্বলতাকে। তবে একে অপরের প্রতি অনুভূতিটুকু তারা হয়তো জানে না, বুঝছে না।

নিঝুম নিশ্চিত হতে চায়। আদনান কি তাকে ভালোবাসে? নাকি সে নিজেই ভুল? আদনানের প্রতি দুর্বলতা ভালোই বুঝতে পারে নিঝুম। দুরু দুরু কাঁপছে বুক। জিজ্ঞেস করতেও ভয় হচ্ছে। সরাসরি তো জিজ্ঞেস করাও যায় না। তাই আদনানকে বললো “কেনো কি সমস্যা? পড়ুক প্রেমে৷”

রাগান্বিত হওয়ার ইমোজি পাঠিয়ে আদনান বললো,
~ “তুমি কি সত্যিই বোঝোনা কী সমস্যা? কেন বলছি আমি এই কথা বোঝোনা? আমি তোমাকে ভালোবাসি নিঝুম। কখন কিভাবে হলো এটা বুঝলামই না। হয়তো মায়া থেকেই শুরু হয়েছিল। তুমি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছো নিঝুম।

তোমার সাথে একদিন কথা না হলে আমার দমবন্ধ লাগে। কী করবো আমি? আমি তো ইচ্ছা করে এমন অনুভূতি তৈরি করিনি। হয়ে গেছে আপনা আপনি। এতে দোষ কী আমার?”

নিঝুমের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। ফোনটা বুকে চেপে জোরে জোরে শ্বাস নিলো কয়েকবার। হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখে। আড়চোখে আনিশার দিকে তাকালো নিঝুম। আনিশা লিখতে ব্যস্ত। নিঝুমকে সে খেয়াল করেনি। খেয়াল করলে হয়তো এমন হাসার কারণ জিজ্ঞেস করতো। আর সত্যিটা জানতে পারলে খুব ক্ষ্যাপাতো।

নিঝুমকে ফিরতি মেসেজ দিতে না দেখে আদনান বললো,
~ “কিছু বলো প্লিজ। কথা বলবে না আমার সাথে? আমি এই ভয়ই পাচ্ছিলাম। আমাকে ভুল বুঝোনা প্লিজ।”
~ “আচ্ছা” সময় নিয়ে লিখলো নিঝুম।

~ “কল দেই?”
~ “……….”
~ “দেবো?”
~ “………”
~ “কিছু বলছো না কেনো?”

~ “কি বলবো?”
~ “তোমার কণ্ঠটা একটু শুনতে চাই প্লিজ। কল দিলে ধরবে প্লিজ।”
~ “জানি না”
আদনান তবুও কল দেয়। একবার, দুবার কল কেটে যাওয়ার পর তৃতীয়বার নিঝুম কল রিসিভ করে কানে চেপে ধরে রাখে। আদনান ওপাশ থেকে ”হ্যালো, হ্যালো” করেই যাচ্ছে। তবে নিঝুম নিশ্চুপ থেকে আদনানের ব্যাকুল কণ্ঠ শুনছে।

একসময় কেটে দেয় কল। তারপর অফলাইনে চলে যায়। নিজের সাথে বোঝাপড়া করা জরুরি। মনের দোটানা ভাব নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো নিঝুম।
পরদিন কলেজে নিঝুমের জন্য একটা চমক অপেক্ষা করে ছিল। পিয়ালী একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে তারই ঘোষণা দেয় বন্ধুমহলে।

সাথে দুজনের রোমাঞ্চকর কাহিনী, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করা, কথা বলা, প্রেম করার কাহিনী সবিস্তারে তুলে ধরে। নিঝুম যেন কিছুটা স্বস্তি পায়। তার মনের দোটানা ভাব কেটে যায়। পিয়ালীও তো কাউকে ভালোবাসে, সেও যদি কাউকে ভালোবাসে তবে সমস্যা কী?

তিনদিন পর পিয়ালীর জন্মদিন। সব বন্ধুদের ট্রিট দিবে সে। জন্মদিনে একটা বিশেষ উপহার তো দিতেই হবে পিয়ালীকে। না দিলে কেমন যেন দেখায়। কিন্তু মাসের শেষদিক হওয়ায় হাতে তেমন টাকাও নেই। কয়দিন আগেই মিথ্যা বলে কিছু টাকা নিয়েছে নিঝুম। সাজগোজের জিনিসপত্র, পোশাক কেনার জন্য খরচ করেছে সেগুলো। পিয়ালীকে না করে দেওয়াটাও সম্ভব নয়।

চিন্তা ভাবনা করতে করতে নিঝুম মহসিনকে ফোন করে বসলো। মহসিন বেশ কয়েকদিন পর মেয়ের ফোন পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে কথা বলতে লাগলেন। শরীর~স্বাস্থ্য, পড়ালেখা, কলেজ, হোস্টেলের খবর নিতে লাগলেন।

অনেকদিন হল মেয়েকে না দেখতে পেয়ে কথা বলতে গিয়ে শাহেদা কেঁদে ফেললেন। শাহেদা বললেন,
~ “মাগো তুই কেমন আছিস? শরীর ভালো তো? খাওয়া দাওয়ার কোন সমস্যা হয় না তো? অন্য কোন সমস্যা?”

~ ” না আম্মা, আমি ঠিক আছি। আর কোন সমস্যাই হয় না। তুমি এত চিন্তা করো না তো। তোমরা সবাই ভালো আছো তো? আর বাবলু?”
~ “শোন মা, ভালোই আছি তবে তোর বাবার শরী……”
মহসিন স্ত্রীর হাত থেকে মোবাইল টা কেড়ে নিয়ে কড়া চোখে তাকায়। শাহেদা চুপসে যান।

ফোন রাখার আগে আমতা আমতা করে মহসিনকে টাকার ব্যাপারটা জানিয়ে দেয় নিঝুম৷ নিঝুম বলে,
~ “বাবা, আমার এখন কিছু টাকা লাগতো। কলেজে পরীক্ষার ফি দিতে হবে।”

মহসিন বললেন,
~ “কত টাকা রে মা?”
~ “উমমম… এক হাজার হলেই হবে।”

মহসিন বললেন,
~ “আচ্ছা বিকাশে পাঠিয়ে দেবো।”
~ “থ্যাংক ইউ আব্বা।”

মহসিন হেসে বললেন,
~ “ভাল থাকিস মা।”
ফোন রাখার পর শাহেদা স্বামী কে জিজ্ঞেস করেন,
~ “এই সময় এক হাজার টাকা কোথায় থেকে আনবেন? ফসল এখনো ওঠে নি৷ তাছাড়া আপনার শরীরটাও ভালো না। ডাক্তার দেখাতে হবে। বুকে ব্যাথা তো ভালো না। ভালো লক্ষণ না এইটা।”

মহসিন বললেন,
~ “টাকা না থাকলেই কি? কলেজের পরীক্ষার জন্য দিতে হবে৷ দিতে তো হবেই। দেখি কারো থেকে ধার করে নিয়ে পাঠিয়ে দেবো। আর আমার শরীরের চিন্তা এত করতে হবে না তোমাকে। নিজে চিন্তা করবা, তার সাথে মেয়েটাকেও চিন্তায় রাখবা।

এই জন্যই তো বলতে যাচ্ছিলা, তাই না? তোমার হুশ আক্কেল কই পালাইলো? মেয়েটা অত দূরে থাকে, পড়ালেখা করে, পড়ালেখার কত চাপ। ওকে আর মানসিক যন্ত্রণা দিও না। আমাদের এসব অভাব অশান্তির কথা ওর কাছে তুলে ধরে কোনো সমাধান মিলবে না।

উল্টো মেয়েটার পড়ালেখার ক্ষতি হবে।”
চিন্তিতমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মহসিন। একদিন পরই টাকা জোগাড় করে পাঠিয়ে দেন মহসিন। টাকা পেয়ে নিঝুমও আনিশাকে নিয়ে নিউমার্কেট চলে যায় পিয়ালীর জন্য উপহার কিনতে। ঘুরে ঘুরে দুজনে মিলে একটি হাত ঘড়ি, কানের দুল, আর কিছু চকোলেট কিনে নেয়। সেগুলো নীল র‍্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে নেয়। ফুচকা খেয়ে দুজনে ফিরে আসে হোস্টেলে।

দেখতে দেখতে পিয়ালীর জন্মদিনটা চলেই আসে। কলেজ ফাঁকি দিয়ে দুপুরবেলা নিঝুম, রাইসা, সাথী, রাকিব সকলে রানার প্লাজার একটা সুন্দর রেস্টুরেন্টে একত্রিত হয় পিয়ালীর জন্মদিন পালন করার জন্য।

কেক কাটা, একে অপরকে কেক মাখানো, খুনসুটি, লাঞ্চ, সেলফি তোলা সবকিছুর মাধ্যমে উপভোগ করে সময়টা। আনন্দের চাদরে জড়িয়ে থাকে কিছুটা সময়।


পর্ব ১০

মনের ভিতরে আদনানের জন্য অনুভুতিরা জমা হলেও অজানা আশঙ্কায় এগোতে গিয়েও পারছিলো না নিঝুম। শহরে স্বাভাবিক মনে হলেও গ্রামে স্বাভাবিক নয় ব্যাপারটা। মহসিন, শাহেদা জানলে কী হবে ভাবলেই শিউরে ওঠে নিঝুম।

আবার দু’দিন আদনানের রাগ করে থাকায়, যোগাযোগ না হওয়ায় সে নিজেই মৃতপ্রায় হয়েছিল যেন! তারপর নিজে থেকেই যোগাযোগ করে আদনানের সাথে। এটা ওটা বলে মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে।

~ “তুমি কি আমাকে ভালোবাসবে না?” আদনান জিজ্ঞেস করে নিঝুমকে।
~ “আব্বা আম্মা জানলে আমাকে মেরেই ফেলবে। আর তাছাড়া আমাদের গ্রামে প্রেম করা, বিয়ের আগে কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক করাকে পাপ বলে মনে করা হয়। যারা এমন করে, তাদের অনেক শাস্তি দেওয়া হয়৷ আমি পারবো না। আমার ভয় লাগে।”

আদনান প্রতিউত্তরে বলে,
~ “সমস্যা থাকলে সমস্যার সমাধানও আছে।”
~ “কি সমাধান?”

~ “আমাদের সম্পর্কের কথা আমরা আমাদের পরিবারকে জানাবো না। আমার পড়ালেখা শেষে ভালো কোনো চাকরি পেলে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব তোমার আব্বা আম্মার কাছে। তখন তারা আর আমাকে ফেরাতে পারবে না।

আর এখন যদি আমাদের সম্পর্কে না জানে, তবে শাস্তি দেওয়ারও সুযোগ পাবে না। আর তারা জানবেই বা কী করে? আমরা তো আর গ্রামে যাচ্ছি না প্রেম করতে। আমরা শহরেই থাকবো তাই না? তাহলে তোমার ভয় পাওয়ার কোনো কারণ থাকলো না। এইন্ট আই রাইট?”

~ “হুম”
আদনানের যুক্তি নিঝুমকে আশ্বস্ত করেছিলো এবং তাই ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কটা এগিয়ে যাচ্ছিলো। আদনান নিঝুমের সম্পর্ক যত গাঢ় হতে লাগলো নিঝুমের পড়ালেখার ওপর থেকে মনোযোগ ততো কমতে থাকলো। বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজিও কমতে থাকলো। কিন্তু আদনানের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকলো।

নিঝুম সারাদিন আদনানকে নিয়ে ভাবতে থাকে। ধ্যান জ্ঞান এখন শুধুই সে। মন চাইলেও পড়তে পারে না, শুধু তাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। আজকাল আর পিয়ালীর কাছে তার প্রেমের কাহিনী শুনতে ইচ্ছে করে না, শুধু আদনানের সাথে কথা বলে যেতে ইচ্ছে করে।

নিঝুম দিন দিন আদনানের প্রতি পজেসিভ হয়ে যাচ্ছে। তার অতিরিক্ত যত্ন, ভালোবাসা পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী ভেবে নিয়েছে। নিঝুম তো সবসময়ই তার জীবনে এমন কাউকে চাইতো। আর আদনান তার জীবনে এসে পূরণ করে দিয়েছে তার চাওয়াগুলো। ভরিয়ে দিয়েছে নিঝুমের ভালোবাসাহীন পিপাসার্ত হৃদয়কে।

তবে নিঝুম আদনানের ওপর কিছুটা অভিমান করে থাকে আজকাল। আদনানের মেয়ে বন্ধুদের সাথে চলাফেরাটা সে মেনে নিতে পারে না কিছুতেই। মনের কোনো এক কোণে আদনানকে হারানোর ভীষণ ভয় কাজ করে।

নিঝুম চায় আদনানের জীবনে মেয়ে বলতে শুরু সে নিজে থাকবে, আর কেউ না। অন্য কোন মেয়ের সাথে তার হাসি, ঠাট্টা, মজা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না নিঝুম। কেনোই বা মেনে নিবে?

আদনান তো তাকে অন্যকোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেয় না। এমনকি ফেসবুক আইডির পাসওয়ার্ড নিয়ে সবগুলো ছেলেকে ব্লক করে দিয়েছে। পরিচিত কয়জন ফ্রেন্ড ব্যতীত সবাইকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে। প্রতিদিন নিঝুম কার সাথে কী কথা বলে সেটাও চেক করে আদনান। তাহলে নিঝুম কেনো একই কাজ করতে পারবে না? নিঝুমকে আদনান তার নিজের ফেসবুক আইডি কেনো দিতে পারলো না? তবে কি বিশ্বাস, ভরসা করে না?

মাঝে মাঝে ফেসবুক সম্পর্কিত এসব কারণে ঝামেলা হয় দুজনের। এমনকি আদনানের ছবিতে অন্য মেয়েদের লাভ রিয়েক্ট, কমেন্টের কারণেও মন কষাকষি চলে দুজনের। আদনান আবার নিঝুমকে এটা সেটা বুঝিয়ে ঠিক করে সম্পর্কটা।
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল কিছুদিন। ছবি বিনিময়, দীর্ঘসময় ফোনালাপ হতে থাকলো। তবে নিঝুমের ও

পর আদনানের অধিকার খাটানো যেন দিন দিন বাড়তেই থাকলো। মাঝে মাঝে নিঝুমের খারাপ লাগে আদনানের এত জোর জবরদস্তি আর জেদ। যখন তখন ছবি তুলে পাঠিয়ে দিতে বলা, রাত বিরেতে ফোন করে লাভ ইউ বলার মত প্রেমের পরীক্ষায় অতিষ্ঠ নিঝুম। তবুও ভালোবাসে বলেই খারাপ লাগলেও মেনে নেয়, মানিয়ে নেয়।

প্রথমবার আদনানের অতিরিক্ত অনুরোধে নিঝুম সংকোচ, ভয়, লজ্জা, জড়তা নিয়ে তার কথা মত সেজে তার সাথে দেখা করলেও এরপর থেকে সপ্তাহে তিন~চার দিন করে দেখা করার জন্য বলতে লাগলো আদনান। ওদিকে নিঝুম মেসেজিং করতে লজ্জা পায় না, তবে ফোনে কথা আর সামনাসামনি দেখা করতে খুব লজ্জা পায়, গলা কাঁপে, চোখ তুলে তাকে দেখতেও পারে না।

আদনান বুঝতে পারে তবুও জোর করে। দেখা হলে হাত ধরা, হাতের উল্টোপিঠে চুমু খাওয়াটা আদনানের অভ্যাস। নিঝুম ভয় পায়, ভীষণ ভয়। লোকলজ্জার ভয়, সম্মানের ভয়। তাই যথাসম্ভব চেষ্টা করে আদনানকে বোঝানোর যাতে সে দেখা করার কথা না বলে। কেননা নিঝুমের পরিচিত কেউ যদি দেখে ফেলে!
আজকাল নিঝুমের খুব ভয় হয় এটা ভেবেও যে মহসিন, শাহেদা আদনানকে মেনে নিবে কি না!

ঈদুল আযহার ছুটিতে গ্রামে ফেরে নিঝুম। প্রথমবারের মত এতোটা পথ একা চলা। বাবা মাকে না জানিয়ে এসেছে। কেননা নিঝুম চেয়েছিলো তাকে দেখে মহসিন, শাহেদা চমকে যাক। এমনিতে নিঝুমের আসার কথা ছিল, তবে দিনটা যে আজই তা তো আর নিঝুমের আব্বা আম্মা জানতেন না।

দুপুর বারোটা পঁচিশে বাড়ির আঙিনায় উপস্থিত হয় নিঝুম। শাহেদা তখন উনুনে ভাত চড়িয়েছেন। ভাতের মাড় ঢাকনা উপচে পড়ছে, পাতিল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
~ “আম্মা…..!”
পরিচিত মিহি কণ্ঠের ডাক শুনে চমকে ওঠে শাহেদা। শব্দটা আবার হয়।

~ “আম্মা…..!”
শব্দ অনুসরণ করে পিছনে তাকিয়ে নিঝুমকে ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন।
খুশি হয়ে মেয়ের কাছে এসে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন মুখে, মাথায়।

অসীম মমতা নিয়ে বুকে টেনে নেন। অকারণেই বুকটা ভার হয়ে আসে নিঝুমের। না, না অকারণ নয়। অকারণে কিছু হয় না কি আবার! কারণ নিশ্চয়ই আছে। বুকের ভিতরে কষ্ট হচ্ছে। কেমন যেন অপরাধবোধ মাখা আছে কষ্টটায়।

শাহেদা কান্নামাখা গলায় বললেন,
~ “আহা রে! কতদিন পর আমার মাইয়াডা আসলো। কতদিন পরে আমার মায়ের মুখটা দেখলাম আবার। দে দে ব্যাগ দে। ভারী ব্যাগ, কতক্ষণ ধরে নিয়ে আছিস। আয় ঘরে আয়। তোর আব্বা বাড়িতেই আছে। তোকে দেখলে খুশি হবে খুব।

আগে ভাগে কইবি না আসার কথা! একা আসলি ভয় করে নাই? যদি কোনো বিপদ হতো? তখন কি হতো বল তো? তোর আব্বা শুনলে রাগ করবেন।”
ঘরে যেতে যেতে বললেন শাহেদা।

~ “তুমি আব্বাকে কিছু বলো না আম্মা”
অনুরোধ করে কথাটা বললো নিঝুম।

~ “তিনি বুঝবেন না! তিনি কি ছোট বাচ্চা? তাকে বলার পর তিনি বুঝবেন?”
নিঝুম আর কিছুই বললো না। মায়ের সাথে কথায় সে পেরে উঠবে না, সেটা কুব ভালো মতোই বুঝেছে।

নিঝুম আব্বা আম্মার ঘরে গিয়ে দেখলো মহসিন বিছানায় শুয়ে আছেন। তাকে দেখে নিঝুমের চোখের কোণে জল জমা হতে লাগলো। চোখের দেয়াল উপচে পড়তে লাগলো মুক্তোদানার ন্যায় জল। মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান মানুষটার এ কী অবস্থা! চোয়াল বসে গেছে, চোখের নিচে কালো দাগ হয়েছে, শরীর শুকিয়ে গেছে। বয়সটাও যেন অনেক বেশি লাগছে।

নিঝুম বাবার পায়ের কাছে কিছুক্ষণ বসে নিজের ঘরে চলে গেল। বাড়িঘর এখনো আগের মতোই আছে। ভাঙ্গাচোরা টিনের দরজা, জানালা। বাড়ির আশেপাশে জঙ্গল। মাটি, ইটের ফাঁকে ছোট ছোট গাছ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। পোশাক বদলানোর প্রয়োজন অনুভব করছে নিঝুম। দীর্ঘ জার্নি করে এসে ক্লান্তও লাগছে। গোসল করে খেয়ে ভাতঘুম দেওয়া প্রয়োজন।

শাহেদার মন আনচান করছে। মেয়েটাকে কী দিয়ে খেতে দেবে! আগে থেকে জানিয়ে আসলে না’হয় কোনো একটা ব্যবস্থা তিনি করে ফেলতেন। তবে এখন কী করা যায়! স্বামী মহসিনের অসুস্থতার সময় থেকে বাজার~সদাই তিনি নিজেই করতেন।

পানির মতো টাকা খরচ হচ্ছে মহসিনের পেছনে। তাই ইদানীং খুব হিসাব করে চলতে হয়। ডাল ভাত খেয়েই দিন পার করতে হচ্ছে, মাছ মাংস মেলা ভার! বাবলুটাও কিছু বলতে পারছে না বাবার অসুস্থতা দেখে। যেমনই হোক মহসিনকে বাবলু খুব ভালোবাসে। মহসিনের অসুস্থতা বাবলুকেও শান্ত করে দিয়েছে কিছুটা।

ঘরে গিয়ে বালিশের নিচে, বিছানার চাদরের নিচে, বয়ামের মধ্যে হন্যে হয়ে টাকা খুঁজলেন শাহেদা। যদি কিছু পাওয়া যায়! তবে তিনি ব্যর্থ হলেন। কোথাও কিছু পেলেন না। বালিশের নিচে বিশ টাকা রেখেছিলেন গতকাল সেটাও নেই। নিশ্চয়ই বাবলু নিয়েছে সেটা। গতকালই টাকা চেয়ে জেদ করেছে সে। মাঝে মাঝে শান্ত থাকে, মাঝে মাঝেই আবার জেদ করে।

শাহেদা বেগম বাড়ি থেকে বেরোলেন মুখে আঁচল গুঁজে। দু’বাড়ি পর ময়নাদের বাড়িতে চলে গেলেন। দুদিন পর ময়নার বিয়ে।। বাড়িতে আত্মীয় স্বজন আসতে শুরু করেছে। ভালো মন্দ রান্না হবে নিশ্চয়ই। যদি কিছু পাওয়া যায়! ভেবে শাহেদা চলে গেলেন ওদের বাড়িতে।

আঁচলের তলায় বাটিটা ঢেকে বাড়িতে আসার পথে বাবলুকে রাস্তায় দেখলেন শাহেদা। বাবলুকে দেখে মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। সাথে সাথে তরকারির বাটিটা ঢেকে নিলেন ভালোভাবে। বাবলুকে এক হাতে টেনে বাড়িতে ঢুকলেন। রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
~ “টাকা নিয়েছিস কেনো না বলে?”

বাবলু বুঝলো ধরা পড়েছে। মিথ্যা বলে লাভ নেই। উল্টো শাস্তি বাড়তে পারে। তাই সত্যিটাই বললো,
~ “হোটেলে মাছ ভাত খাইছি। তুমি খালি ডাল, আলু ভর্তা করো। এসব প্রতিদিন খাইতে মন চায় না আম্মা।”

চোখ ভিজে উঠলো শাহেদার। শাহেদা বললেন,
~ “এমন কাজ করবি না যা লুকিয়ে করতে হয়, মিথ্যা বলে করতে হয়।”
কাপড় শুকাতে দিতে এসে কথাটি শুনলো নিঝুম। মন ও মাথায় বারবার প্রতিধ্বনি হতে থাকলো কথাটি।

ছেলেকে আর কিছু না বলে রসুইঘরে চলে গেলেন শাহেদা। বাবলু বুবুকে কাছে পেয়ে খুব খুশি। কথা বলা শেষে চলে গেল খেলতে। দুপুর, সন্ধ্যা কোনো সময়ই খেলা বাদ যায় না বাবলুর।

কিছুক্ষণ পর শাহেদা খেতে দিলেন নিঝুমকে। নিঝুম একাই খেতে বসলো। মহসিন তখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। শরীরে নাকি খুব ক্লান্তি তার। তাই ঘুমের ঔষধ খেয়েছেন দীর্ঘ সময় ঘুমাবেন বলে। প্লেটে বড় এক টুকরো মাছ দেখে জিভে জল চলে আসলো নিঝুমের। খেতে শুরু করলো। মায়ের কাছে তুলে ধরলো কতশত অভিযোগ।

~ “জানো আম্মা, হোস্টেলের খাবার ভালো নয়। একদম খাওয়া যায় না। কখনো হলুদ বেশি, কখনো লবণ হয় না। মাছ সপ্তাহে দু~তিন দিন আর মাংস একদিন একবেলা করে দেয়। তবে খুব ছোট এক টুকরো করে। ডাল রান্না করবে একদম পানির মত পাতলা। মনে হয় যেন এক বালতি পানিতে এক মুঠো ডাল দিয়ে রান্না করেছে।”

শাহেদার খারাপ লাগলো মেয়েটার জন্য। মেয়েটাও কষ্টে আছে! খাওয়ার মাঝপথে নিঝুম বললো,
~ “বাবলু খাবে না?”

শাহেদা বললেন,
~ “তুই খা মা। বাবলু হোটেল নাকি খেয়েছে।”

~ “আচ্ছা”
খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো নিঝুম। মায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।

শাহেদা দু’চোখ ভরে মেয়ের খাওয়া দেখছিলেন। নিঝুম ঘরে ঢুকতেই মহসিনকে সজাগ দেখে তার কাছে গিয়ে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিল, শরীরের খবর নিলো। তবে মহসিন অসুস্থতার ব্যাপার সাবধানে এড়িয়ে গেলেন।

শাহেদা মহসিনকে খাবার খাওয়ার জন্য তাগাদা দিলেন। অসুস্থ মানুষ সঠিক সময়ে খাবার খেয়ে ঔষধ খাওয়া দরকার। নিঝুম জোর করে মহসিনকে খেতে পাঠিয়ে নিজের ঘরে গেল।

তবে কোন এক প্রয়োজনে আব্বা আম্মার কাছে রান্নাঘরে গেল। ভিতরে ঢোকার আগেই কিছু কথা কানে আসে তার,
~ “ওরে কী দিয়ে খাওয়ালা?”

~ “ময়নার মায়ের থেকে এক টুকরা মাছ সহ তরকারি আনছিলাম।”
আর কোনো কথা হয় না তাদের মাঝে। বিমর্ষ চেহারা নিয়ে খাবার গিলতে থাকেন দুজনে। চাবাতেও কষ্ট হচ্ছে যে!

দরজার বাহিরে থেকেই মাথা ভিতরে ঢুকিয়ে নিঝুম দেখলো মাটিতে মাদুর বিছিয়ে বসে হোস্টেলের মত পাতলা ডাল আর কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খাচ্ছেন নিঝুমের আব্বা আম্মা।

বাম চোখের কোণ ঘেষে অশ্রুধারা বয়ে গেল। নিঝুমের কেবলই মনে হতে থাকলো,
~ “ইশ! পাকস্থলী থেকে সব খাবার বের করা যেত যদি!”


পর্ব ১১

বিকেলের রোদ শেষে অন্ধকারের কালো ছায়া ধরণীকে গ্রাস করতে আরম্ভ করেছে।

গোধূলির রং ফিকে হয়ে আসছে। নিজের ঘরে বিছানায় শায়িত অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিঝুম বুঝতেই পারে নি৷ ঘুম থেকে উঠে বাহিরে এসে কাউকেই দেখতে পেল না নিঝুম। আব্বা, আম্মা, বাবলু কেউ নেই বাড়িতে।

গেল কোথায় তিনজনে? তাও আবার একসাথে! নিঝুমকে ডেকে বলেও গেল না। নিঝুম বাড়ির দরজার খুলে বাহিরে আসার সাথে সাথে আশেপাশের কোনো বাড়ি হতে চাপা গুঞ্জন শুনতে পায়।

এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে নিঝুম। তাদের বাড়ির আশেপাশে ছোট বড় অনেক গাছ থাকায় দেখা যায় না বিপরীত পাশের বাড়িগুলোতে কি হচ্ছে! একটু সামনে গিয়েই দেখতে পায় ময়নাদের বাড়ির দরজা থেকে ভিতর পর্যন্ত মহিলা মানুষের জটলা। পুরুষও কম নেই সেখানে। উদ্বিগ্নতার রেশ সকলের চোখে মুখে। ময়নার বাবা, চাচাকে দেখলেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন কোথাও।

নিঝুমেরও চিন্তা হতে লাগলো। কারো কোনো অসুখ বিসুখ হলো না তো! মারাত্মক কিছু যে ঘটেছে তা তো স্পষ্ট। জটলার কাছাকাছি যেতেই মাকে দেখতে পায় নিঝুম। ভীড় ঠেলে ভিতরের দিকে এগিয়ে যায়।

মহিলারা আঁচলে মুখ চেপে গুঞ্জন করে যাচ্ছেন। নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে বাক্য বিনিময় করছেন। দু একটা কথা নিঝুমের কানেও এল। তবে নিঝুম গ্রাহ্য করলো না।

ভিতরে গিয়ে দেখে ময়না আপার মা’কে শাহেদা ধরে রেখেছেন। আর ময়না আপার মা অঝোর ধারায় অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। আশেপাশের লোকজন মুখ দিয়ে নিক্ষেপ করতে বিষাক্ত তীর যা সরাসরি বুকে গেঁথে যাচ্ছে।

একেকজন চাপা গলায় একেক কথা বলে যাচ্ছে।
~ ”কি দিন আইলো রে!”
~ “বাপ মায়ের কাছ থিকে মাইয়া পলায়!”

~ “ছিঃ ছিঃ ছিঃ তোমাগো মান ইজ্জত নাই? সারা গেরামে যে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেল তার কি হবে? আমাগো মাইয়া ছাওয়াল আছে না? বিয়া দেওন লাগবো না? এই গেরামে আর আইবো কেউ বিয়া করাইতে?”

ময়নার মামা রাগত স্বরে বলে উঠলেন,
~ “চুপ করেন আপনারা। আমাগো ময়না পালায় নাই। সারা গেরামে কথা চালান করার জন্য আপনেরাই যথেষ্ট। দোষ কারে দ্যান? কথা চালাচালি করা তো আপনাগো মতন জঘন্য মহিলাদের কাম।

যাগো কামই হইলো গিয়া মানষের বাড়ির শান্তি নষ্ট করা। নিজেগো মাইয়ারে নিয়া এত চিন্তা থাকলি পারে এত দুর্নাম গাইতেছেন ক্যান? যান বিদেয় হন সকলে।”

~ “চোরের মায়ের বড় গলা! শাক দিয়ে মাছ ঢাকা গেলেও মিথ্যা দিয়া সত্যরে কেউ ঢাকতি পারে না। আজ হউক, কাল হউক তা সগলি জানবার পারবে।”
~ “এমন চরিত্রহীনা মাইয়ারে এই গ্রামেত থাইকা বাহির কইরা দেওয়াই উচিত। নইলে আমাগো ছাওয়ালরা খারাপ হইয়া যাইবো।”

কতজনে কত রকম কথা যে বললো।সত্য মিথ্যা মিশিয়ে বদনাম করতে থাকলো তারা। এতদিন যারা শুভাকাঙ্ক্ষীর অভিনয় করে গেছে, আজ তারাই ময়না, তার বাবা মায়ের চরিত্র সম্পর্কে জঘন্য সব কথা বলতেও বাকি রাখছে না। কেউ কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটাচ্ছেন।

কাঠের পুতুলের ন্যায় মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম। ময়নার মা মনোয়ারা গুণগুনিয়ে কাঁদছেন। এত জঘন্য সব কথা শোনার পর তার ইচ্ছে হচ্ছে না বেঁচে থাকতে। একদিকে তারা মেয়ের খোঁজ না পেয়ে চিন্তিত। অপরদিকে তাদের এমন পরিস্থিতি জেনেও সান্ত্বনা দিয়ে, সাহায্য না করে মৌমাছির মত হুল ফুটাতে ব্যস্ত প্রতিবেশী, স্বজনরা।

ময়না দুপুরে কোন এক বান্ধবীর সাথে দেখা করার কথা বলে সেই যে গেল সন্ধ্যা হয়ে আসছে এখনো ফিরলো না। একদিকে পরিবারের লোকেরা ময়নার বিপদের আশঙ্কা করছে, আর অন্যদিকে প্রতিবেশীরা কুকথা ছড়াচ্ছে।

নিঝুমের বুক ভারী হল। এসব দেখতেই কি বাড়ি এসেছিল সে! জানতে পারলো বরপক্ষের জোরাজুরির কারণেই বিয়ের তারিখ ঈদের আগে ঠিক করা হয়েছে। বেশি সম্ভব তাদের পরিবারের কোনো এক বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য মৃত্যুশয্যায়।

তার ইচ্ছাতেই বাড়ির বউ নিয়ে যাওয়ার এত তাড়া সকলের। ঈদের আগে জন বিশেক মানুষের সামনে বিয়ে পড়িয়ে ময়নাকে নিয়ে যেতেন তারা। পরে সময় বুঝে ঈদের পর ওয়ালিমার আয়োজন করতো।

বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা। আনন্দ করার বদলে শোকাছন্ন হয়ে পড়েছে বাড়ির মানুষ। শোকের কালো ছায়া গোটা বাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে। এক মুহুর্তও লাগে না পরিস্থিতি বদলে যেতে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রতিপালক ছাড়া আর কেউ জানে না। যদি জানতো তাহলেই বোধহয় খারাপ হত। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় জীবন আনন্দে কাটানো যেত না।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। ময়নাদের বাড়িটা এখন ফাঁকা হয়ে গেছে। মেয়ের খোঁজ না পাওয়ার সময় থেকেই কাঁদছেন মনোয়ারা। তাকে ঘিরে চিন্তিত মুখে বসে আছে তার ভাইয়ের বউ, শাহেদা, নিঝুম আরও কয়েকজন আত্মীয়া।

এ বাড়িতে আজ চুলো জ্বলবেনা। কোনো এক আত্মীয়া বাটি ভরে খাবার নিয়ে এলেন। বাড়িতে কত মানুষ! চিন্তা, কষ্ট, রাগ সব থাকবে। তবে পেট কি আর এসব মানে? তাছাড়া দুপুর থেকেই না খাওয়া অনেকে।

শাহেদা মেয়েকে নিয়ে ফিরে এলেন নিজ বাড়িতে। বাড়ি ফাঁকা, চোর এসে চুরি করে নিয়ে গেলেও ওখান থেকে টের পাওয়া যেত না। মহসিন অসুস্থ শরীর নিয়েই ময়নার বাবা জমিরের সাথে ময়নাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। বাবলুও পিছে পিছে চলে গেছে।

শাহেদা রাতের জন্য ভাত, আলু সিদ্ধ করলেন। দুপুরে তরকারি চেয়ে এনেছেন। এখন কী করবেন? কারো থেকে কিছু আনার মতো পরিস্থিতি নেই এখন।
গ্রামে কোনো বাড়িতে কিছু হলে তা পুরো গ্রামেই ছড়িয়ে যায়।

আর শহরে পাশের ঘরের মানুষের খোঁজই কেউ রাখে না। এমন হয় একই বিল্ডিং এর এক ফ্লোরে বিয়ের আনন্দ থাকে, অন্য এক ফ্লোরে মৃত্যুশোক থাকে। অথচ কেউ কারো খোঁজ নেয় না। মানুষ মারা গেলেও তার খবর পাওয়া যায় না মাইকিং ছাড়া।

নিঝুম নিজেও আতঙ্কে আছে। গ্রামে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না তেমন! কয়েকবার চেষ্টা করলো অনলাইনে গিয়ে আদনানের সাথে যোগাযোগ করার। তবে পারলো না। এমনিতেই আজকে মনটা বিষন্ন। ভয় করছে নিঝুমের।

ময়না আপা যদি সত্যিই কোনো ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে থাকে! ধরা পড়লে কী হবে! ময়নার এমন কাজের শাস্তি তো সে জানে।

নিঝুমের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। আদনানের সাথে কথা বলে মনটাকে একটু শান্ত করতে চেয়েছিলো। তবে নেটওয়ার্কের কারণে সম্ভব হল না। হতাশ হয়ে বাড়ির বাহিরে থেকে ভিতরে গেল নিঝুম। বিছানায় শুয়ে ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

যতোই আদনান বলুক কিছু হবে না, কেউ জানবে না। তবে মন মানছে না। আবার আদনানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন কথাও ভাবতে পারছে না নিঝুম। পাগল পাগল লাগে নিজেকে। কী হচ্ছে এসব!

ময়নাকে যারা খুঁজতে গিয়েছিল তারা সকলে ফিরে এল রাত করে। ময়নাকে পাওয়া যায় নি। তবে খোঁজ মিলিয়ে। তাকে কেউ কোনো এক ছেলের সাথে যেতে দেখেছে। এ খবর পাওয়ার পর থেকেই ময়নার বাবা চুপ হয়ে আছেন। মহসিন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাড়িতে রেখে এসেছেন। বাবলু তার কাঁধে ঘুমিয়ে পড়েছিল। নিঝুম খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

বাবলুকে ঘুম থেকে ডেকে না তুলে শাহেদা মহসিন কয়েক লোকমা করে খেয়ে শুয়ে পড়লেন। আসন্ন ভোরের অপেক্ষায় সবাই। নতুন ভোরটা কী সকলের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে? নাকি একটা ঝড় এসে ধ্বংস করে দেবে সবকিছু?


পর্ব ১২

পরদিন গ্রামের ক্ষমতাবান লোকেরা, চেয়ারম্যান সাহেব লোক লাগালেন ময়নাকে খোঁজার জন্য। এটা শুধুমাত্র ময়নার খোঁজ পাবার জন্য নয়। বরং ময়না যদি নিজেকে ভুল পথে চালিত করে থাকে, তাহলে তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি দেওয়ার জন্যও। নিজেদের ক্ষমতার প্রয়োগ করে গ্রামে নিজেদের শাসন চালু রাখার জন্যও।

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আশেপাশের গ্রাম, বাড়িঘর খোঁজাখুঁজি করা হল। পাশ্ববর্তী গ্রামের অদূরে বাসস্ট্যান্ডে ময়নাকে খুঁজে পাওয়া গেল, তাও একটা ছেলের সাথে। দুজনকে ধরে আনলো চেয়ারম্যানের লোকজন৷

গ্রামের লোকজন প্রতিপত্তিশালী মানুষদের সমীহ করে চলে। তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মানের নামে অন্ধভাবে সত্য হিসেবে মেনে নেয়। তাদের সিদ্ধান্তের ওপর মতামত প্রদানের সাহস কেউ করে না।

চেয়ারম্যানের বাড়িতে বিচারসভা বসানো হল। ময়নার বাবা মেয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন না। শুকনো মুখে চেয়ারম্যানের একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। মনোয়ারা মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদছেন। সন্তান অন্যায় করলেও বাবা মা সবসময় কঠোরতা দেখাতে পারেন না।

চেয়ারম্যানের দুজন লোক ছেলেটাকে ধরে রেখেছে। গ্রামের কিছু লোকজন এসেছে বিচার দেখতে। আত্মীয় স্বজন চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। শাহেদা, মহসিন, বাবলুও আছে।

চেয়ারম্যান ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে ময়না এবং সাথের ছেলেটির দিকে একবার তাকিয়ে কথা শুরু করলেন,
~ ”ময়নার বাপ মা তোমাগো দিয়েই বিচার করায়ে নেই। কি কও? তোমাগো মাইয়া এইডা ঠিক কাম করছে? তোমাগো মন কী কয়? শাস্তি পাওয়া উচিত কি না?”

ময়নার মা শুধু কেঁদে যাচ্ছেন। ময়নার বাবাও তাই। আজ সাত চড়েও কারো কোনো রা নেই। অন্যায়টা তাদের মেয়ে করেছে। তারা জানেন। এই গ্রামে এমন কাজ করে কেউ কখনো ছাড় পায় নি। তাদের মেয়েও পাবে না, এটা তারা ভালো জানেন। ময়নারও অজানা নয় বিষয়টা। তবুও এমন কাজ করে বসলো!
চেয়ারম্যানের পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ লোকটি বলে উঠলেন,

~ ”এই ছেড়ি গেরামের মান সম্মান ডুবাইলো। মুখ দেখাইতাছে কেমনে এত পাপ করার পর। পুরো গেরামটা অপবিত্র কইরা ফালাইছে।”
ময়না চিৎকার করে উঠলো,
~ “আমি কোনো পাপ করি নাই। আমি ভালোবাসছি। ভালোবাসা কোনো পাপ না।”

~ “বিয়ের আগে ভালোবাসা, পেরেম, আকাম কুকাম কইরে বড় গলায় কথা কইস ছেড়ি। সবই পাপ।”
একজন বয়স্কা মহিলা বলে উঠলেন পাশ থেকে।

ছেলেটা বলে উঠলো,
~ “আমরা বিয়া করছি। পাপ করি নাই কোনো। আমরা কিসের শাস্তি পামু?”

চেয়ারম্যানের পাশে বসা লোকটি বললেন,
~ “অভিভাবক ছাড়া কিয়ের বিয়া? আবার কইতেছে কিসের শাস্তি। আর একটা কথা কইলে মুখ ভাইঙ্গা দিব ছ্যাড়া।”

চেয়ারম্যান চুপচাপ শুনলেন, পরিস্থিতি বুঝলেন,
~ “এই তুমি কোন গেরামের পোলা?”

ছেলেটাকে ধরে রেখেছে দুজনে। প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়া চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হচ্ছে।
~ “আমি সমীর। রশ্মিপুর গেরামের গফুর আলীর পোলা আমি।”

~ “গেরামের লোকসকল যারা আছেন এহানে, সবাই জানেন এই গেরামের রীতি। এহানে অন্যায় করে ছাড় পাওন যায় না। এই কাজের শাস্তি আগেও অনেকে পাইছে, আজও পাইবে। কারো ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নাই। আমার পরিবারের কেউ এমন করলেও তারে এই শাস্তিই পাইতে হইতো। আপনারাই কন কী শাস্তি দেওয়া হইবো এদের?”

কয়েকজন চেঁচিয়ে বললেন,
~ “মাথার চুল কেটে মুখে কালি মাখিয়ে পুরো গ্রামে ঘোরানো হবে।”

চেয়ারম্যান নির্দেশ দিলেন,
~ “আজ হইতে এই ছেড়ির পরিবারের লোকজনের লগে কাউর কোনো সম্পর্ক থাকবে না।

এরা নিজেগো মতন একলা থাকবে, একঘরে হয়ে। ঐ ছেড়ির মাথার চুল কেটে কালি মাখিয়ে পুরা গ্রাম ঘোরানো হোক। আর ওইটারে (সমীর ছেলেটাকে) কয়েক ঘা বসাইয়া গেরামের বাহিরে ফালায়া আসা হোক।”
~ “না চেয়ারম্যান সাব না, এমন কইরেন না। দোহাই লাগে।”

মনোয়ারা আহাজারি করতে লাগলেন। কারো কোনো কথা, কারো কোনো আহাজারি কাজে লাগলো না।

নাপিত এনে ময়নার মাথার চুল কেটে দেওয়া হলো। ঐদিকে সমীরকে ধরে রাখা লোক দু’জন তাকে কাঠ দিয়ে পেটাচ্ছে অনবরত। শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে সমীরের। তবে ভালোবাসার মানুষকে এত মানুষের সামনে অপমানিত হতে দেখার কষ্টটাই বুঝি বেশি!

কেনো জড়িয়েছিলো এই সম্পর্কে? পাপ জেনেও কেনো গেল এমন কাজ করতে? এমন কাজ না করলে এই দিন কি দেখতে হতো তাদের!
শরীর আর মনের অসহনীয় যন্ত্রণায় চোখ বুঁজে আসে সমীরের। একসময় জ্ঞান হারায় সে।

ময়নার চোখে মুখে কালি লাগিয়ে দেয় চেয়ারম্যানের একজন লোক। কোন মহিলা নয়, বরং পুরুষ দিয়েই ময়নার চোখে মুখে কালি লাগালো হল। এমন পাপিষ্ঠা মেয়ের বাবা হওয়ার দরুণ ময়নার বাবার মুখেও কালি লাগানো হল। তবে তাকে পুরো গ্রাম ঘোরানোর নির্দেশ দেওয়া হল না।

দুজন দীর্ঘাকার পুরুষ ময়নাকে টেনে হিঁচড়ে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ালো। ময়না, ময়নার মায়ের আহাজারিতে আকাশ বাতাস কম্পিত। এ দৃশ্য দেখে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। তবে বাধা দেওয়ার ক্ষমতাও কারো নেই। এ গ্রামে এমনটাই হয়ে আসছে।

পুরো ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকলো আরও একজন মানুষ। সে হল নিঝুম। ছলছল চোখে পুরো ঘটনা দেখে গেল সে। মনের মধ্যে ঝড় বইছে। এ ঝড় থামবে কীভাবে?
গ্রাম ঘোরানো শেষে ময়নাকে এনে ফেলা হয় তাদের বাড়ির উঠোনে। বিচারসভায় উপস্থিত লোকজনেরাও তার পিছে পিছে সারা গ্রাম ঘুরেছে। বাড়ির উঠোনে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে ময়নার বাবা। মনোয়ারার কান্না থেমে গেছে।

অশ্রু শুকিয়ে দু’গালে চটচটে ভাব এসেছে। দু’চোখ পানিশূণ্য, দৃষ্টিতে অস্থিরতা। অগোছালো সেই দৃষ্টি কোথায় গিয়ে মিলেছে তা ঠাওর করা যাচ্ছে না। বারান্দার বাঁশের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি।

তার সুখের সংসার বালির বাঁধের ন্যায় ধসে পড়লো। এটা কি মেনে নেওয়া যায়? একমাত্র মেয়ে, স্বামী নিয়ে তাদের সংসার। কত সুখেই না কাটছিলো তার দিনগুলো। আজ যদি মেয়েটা এমন কাজ না করতো তাহলে গ্রামে সম্মান হারাতে হতো না।

ময়নার বাবাকে মুখ ভর্তি কালি নিয়ে গ্রামের মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে অসম্মানিত, অপমানিত হতে হতো না। স্বামীর প্রতি অবিচার তাকে ভীষণভাবে পোড়াচ্ছে।

মেয়ের প্রতি ক্রোধ জেগে উঠলো মনোয়ারার। উঠে দাঁড়িয়ে ময়নাকে টেনে তুললেন মাটি থেকে। দু’গালে অনবরত থাপ্পড় বসাতেই থাকলেন। আর মুখ দিয়ে অশ্রাব্য গালাগাল ছুড়ে দিচ্ছেন।

~ “হতভাগী, ঘর জ্বালানী তুই মরতে পারিস নাই। আজ তোর জন্যে এত অপমান সইতে হবে জানলে জন্মের সমেই নুন মুখে দিয়া মাইরা ফালাইলামনি।”
সন্তান ভুল করলেই কেনো বাবা মা কে দোষারোপ করা হবে?

কেনো বলা হবে বাবা মা তাকে শিক্ষা দিতে পারেনি? বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক তার সর্বোচ্চটা দিয়ে শিক্ষাদান করার পর কোনো ছাত্র সে শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলে শিক্ষককে তো দোষারোপ করা হয় না। দোষ দেওয়া হয় সেই ছাত্র বা ছাত্রীকে। তার হয়তো মেধা কম, নয়তো সে পরিশ্রম করে মা কিংবা সে মনোযোগী নয়। তাহলে বাবা মায়ের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব মানা হয় না কেনো?

বাবা মা সন্তানকে খারাপ শিক্ষা দেন? না দেয় না। সময়, সঙ্গ, পরিস্থিতির কারণেও সন্তান পথভ্রষ্ট হলে তার সকল দায় বাবা মায়ের ওপর পড়ে কেনো? নিজেকেই প্রশ্ন করে যাচ্ছে মনোয়ারা। এ কোন দিন দেখতে হচ্ছে তাকে! চারিদিকে অন্ধকার দেখছেন তিনি। অন্ধকারের অতলে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেখছেন।

বাবার পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে ময়না বলে,
~ “আব্বা ক্ষমা কইরা দেন আমারে। ও আব্বা কথা কন আমার লগে। আপনি আমারে মাইরা ফালান। তাও কথা কওয়া বন্ধ কইরেন না আব্বা।”
ময়নার বাবা যেন এ দুনিয়াতেই নেই। কোনো শব্দ, কান্না তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। তার মন, শরীরজুড়ে শুধুই অপমানিত হওয়ার যন্ত্রণা কাজ করছে।
~ “নাটক দেখা শ্যাষ। এবার বাড়িত যান সবাই।” খেকিয়ে উঠলো মনোয়ারা।

সবাই যার যার মতো চলে গেল। মনোয়ারা স্বামীকে টেনে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। ময়না পড়ে রইলো সেখানেই। আজকের নতুন ভোরটা তার জীবনে এসেছিলোই তাকে ধ্বংস করে দিতে।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে নিঝুম। আজ স্বচক্ষে এমন ঘটনা দেখার পর সে সাহস পাচ্ছে না আদনানের সাথে সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে। আবার আদনানকে ভুলে যেতে মনকে বুঝ দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।

একবার বাড়ির বাহিরে গিয়ে দেখে এসেছে ময়না সেখানে নেই যেখানে বিকালে পড়ে ছিল। ঘরে গিয়েছে নাকি অন্য কোথাও? বেশিদূর ভাবতে পারে না নিঝুম। রাতটা কেটে গেল দুশ্চিন্তায়, নির্ঘুমে।

পরদিন সকালে,
ঈদুল আযহার দিন। ঈদের সালাত শেষে মাঠে কুরবানি দেওয়া হয় এ দিনে। মুসলমানদের উৎসবের একটি দিন এটা। তবে দিনটা যদিও আনন্দের, তবে পরিস্থিতিটা কষ্টের, যন্ত্রণার, আক্ষপের হয়ে উঠলো।

সকালে উঠে মেয়েকে ডাকতে ডাকতে মেয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই চিৎকার করে উঠলেন তিনি। হায় আল্লাহ! এ কী হল! তার মেয়েটা, তার কলিজার টুকরো ঝুলছে। চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসবে, জিহ্বা মুখের বাহিরে চলে এসেছে। এমন একটা দৃশ্য দেখে ভয়ে, কষ্টে থরথর করে কাঁপতে থাকলেন মনোয়ারা।

স্বামীকে এ খবর দিতে গিয়ে দেখলেন তার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। নিঃশ্বাস ফেলছে কি না পরীক্ষা করার জন্য নাকের কাছে হাত নিয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু হায়! তাকেও মৃত অবস্থায় পেলেন মনোয়ারা। ঘুমের মধ্যেই সম্ভবত মারা গিয়েছেন তিনি।

হয়তো হার্ট অ্যাটাক বা স্টোক করে। আল্লাহই ভালো জানেন।
চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করলেন মনোয়ারা। ততক্ষণে বাড়ির অন্যরা, মেহমানরা চলে এসেছেন। ময়নাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে মনোয়ারার কাছে এসেছেন। মনোয়ারা সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে।

গ্রামে জানাজানি হয়ে গেল বাবা মেয়ের মৃত্যুর খবর। শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিল মেয়েটা! এমন মৃত্যু হলে লাশ বেশিক্ষণ না রাখার চল আছে গ্রামে। দূর দূরান্তের আত্মীয়স্বজনের অপেক্ষায় না থেকে সকাল নয়টার মধ্যেই লাশ দুটো দাফন করা হয়।

আজ ঈদের দিন। পরিস্থিতির উর্ধ্বে আল্লাহর হুকুম, নির্দেশ। গ্রামের বাকি ঘরবাড়িতে আনন্দ লেগে আছে ঠিকই, তবে ময়নাদের বাড়িতে শোকের ছায়া। ঈদের সালাত, কুরবানি সবকিছুই হল সময়মত। কুরবানির মাংস রান্নার পর জমজমাট খাওয়া দাওয়াও হয় প্রতি বাড়িতে। অনেকে মনোয়ারাদের বাড়িতে মাংস পাঠাতে চেয়েছিলেন, তবে সাহস করে উঠতে পারে নি।

মহসিনও নিজেদের ছাগলটা কুরবানি করেছেন। ক’দিন হল এত চাপ তিনি নিতে পারছেন না। আবারো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাবলুটা ময়নার ঝুলন্ত লাশ দেখে এত ভয় পেয়েছে যে, ঘর থেকেই আর বের হচ্ছে না। এই যেন ময়নার লাশ তার উপর চেপে বসবে!

নিঝুমের গলা দিয়ে কিছু নামলো না। সকালে দু মুঠো মুড়ি, পানি আর দুপুরটা না খেয়েই কাটলো তার। ভয় চেপে বসেছে মনে। ময়নার জায়গায় নিজেকে এবং ময়নার বাবার জায়গায় মহসিনকে বারবার কল্পনা করতে লাগলো সে। নাহ! এটা নিঝুম সইতে পারবে না।

তার কারণে তার বাবা মায়ের অসম্মান কিংবা মৃত্যু হবে এর চেয়ে নিজের মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়াও ভালো মনে হচ্ছে নিঝুমের। কষ্ট হলেও আদনানের থেকে তাকে দূরে থাকতে হবে।

তার ওপর বাবা মায়ের অটল বিশ্বাসের দাম দিতে হবে। বিছানায় শুয়ে হাজারো চিন্তা ভাবনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো নিঝুম।


পর্ব ১৩

নিঝুম গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে সপ্তাহখানেক হয়ে গেছে। আজও নিঝুম ময়নার কথা ভাবে। ভালোবেসেই মরলো মেয়েটা। আর ঐ ছেলেটা, ময়নার প্রেমিক সমীর, ওর কথাও ভাবে নিঝুম। সেদিন সমীরকে গ্রামের বাহিরে নিয়ে তার বাবা মা’কে ডেকে এনে তাদের হাতেই তুলে দিয়েছে। একেতো ক্ষমতাবান মানুষ সমীরের ওমন অবস্থা করেছিল, তার ওপর সমীর কী করেছে তা জানার পর নিজেরাও সাহস দেখায় নি কিছু বলার।

নিঝুমের জানতে ইচ্ছে করে সমীর কি ময়নার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিল? তার কেমন অনুভূতি হচ্ছিলো ময়নার আত্মহত্যার খবরে? ময়নাকে ভুলে সে কি নিজের জীবনকে এগিয়ে নিতে পেরেছে? নতুন কাউকে কি স্থান দিয়েছে জীবনে? না কি হৃদয়ের অন্তস্থলে লালন করছে ময়নার স্মৃতি, ময়নার জন্য তার ভালোবাসা!

ভাবনায় বিঘ্ন ঘটে ফাতেমার আপুর কথাতে। ইনিই সেই, যাকে হোস্টেলের অন্যান্য মেয়েরা এড়িয়ে চলে, পছন্দ করে না। অবশ্য তার কারণও আছে। একেতো সবসময় ধর্মের জ্ঞান দিতে আসেন। আদেশ উপদেশ দিতেই যেন তিনি অধিক পছন্দ করেন।

হোস্টেলের অন্য মেয়েরা বেসিন, বাথরুম নোংরা করলে, ঝুড়ির আশেপাশে নোংরা ফেললে তিনি নিঝেধ করেন। এটাই তার দোষ, সবচেয়ে বড় দোষ। আর এই দোষের কারণেই তাকে কেউ দেখতে পারে না। তবে হোস্টেলের মালিক আন্টির খুব পছন্দের মেয়ে ফাতেমা আপু। নিঝুম কখনো তার সাথে কথা বলেনি। বলা ভালো কোনো দরকার পড়েনি কথা বলার।

গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর আদনানের সাথে সম্পর্কটা আর রাখতে চায় নি নিঝুম। তবে মস্তিষ্ক সায় দিলেও মনটা বিরোধিতা করে বসে। মনটা নিজেই কাঁদতো আদনানের সাথে কথা বলার জন্য, এক পলক চোখে দেখার জন্য, কথা শোনার জন্য।

নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে না পেরে আদনানকে কল করে বসে নিঝুম। সেদিন শুধুই শুনে গেছে সে। আদনানের কন্ঠস্বর নিঝুমের অশান্ত মনটাকে শান্ত করতে পেরেছিল। এমনটাই মনে হয়েছে নিঝুমের।

সেদিনের পর থেকে নিঝুম চেষ্টা করে গেছে ততটুকু কথা বলার যতটুকু বললে তার মনটা অশান্ত হয় না, মনের মধ্যে চাপা কষ্ট অনুভব হয় না। এতে আবার আদনানের সমস্যা। আদনান নিঝুমের সাথে আরও বেশি বেশি সময় কাটাতে চায়। মনের দোলাচলে সম্পর্কটা ভাসমান অবস্থায় বিরাজমান। কথা কাটাকাটি, ঝগড়া, অভিমান নিত্যদিনের বিষয় হয়ে গেছে।

নভেম্বর মাসের শেষের দিকে,
নিঝুমের ষান্মাসিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষার প্রস্তুতি মোটেও ভালো নয়। আদনানের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে পড়ালেখায় তো মনোযোগই নেই। তাছাড়া আদনানের সাথে নিত্যদিনের ঝামেলায় পড়াশোনা আর করা হয় না।

আদনানের হঠাৎ কী হলো কে জানে! নিঝুমের সাথে দেখা করতে চাইছে। তার ধারণা দুজনের দেখা করে কথা বলা উচিত। তাহলেই মান অভিমান দূর হবে। তাছাড়া নিঝুম গ্রাম থেকে ফেরার পর, আর দেখা হয় নি দুজনের।

নিঝুমও ভাবলো আদনানকে তার সমস্যাটা বোঝানো দরকার। এই ভেবে চলে গেল তার সাথে দেখা করতে। জলেশ্বরীতলার রেস্টুরেন্ট “Adda” কে বলা হয়ে থাকে প্রেমিক প্রেমিকার জন্য পারফেক্ট একটা প্লেস।

নিঝুমকে সেখানেই ডেকেছে আদনান। আদনান রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়েই ছিল। নিঝুম পৌঁছাতেই তাকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।
ভিতরে ঢুকে নিঝুম দেখলো টিমটিমে রঙিন বাতি জ্বলছে। উজ্জ্বল বাতি অনুপস্থিত সেখানে।

একপাশে বসলো দুজনে। দুজনেই চুপ। আদনানই প্রথমে মুখ খুললো,
~ “তোমার কী সমস্যা এখন বলো আমাকে? কেন এমন ইগনোর করছো আমাকে?”

আমতা আমতা করে নিঝুম বললো,
~ “আমাদের আর এগোনো উচিত না। আপনি যদি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন, তাহলে একবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই আমার আব্বা আম্মার কাছে যাবেন। আমিও আপনাকে ভালোবাসি। আমি অপেক্ষা করবো। পবিত্র সম্পর্কে জড়ানোর অপেক্ষা করবো। তার আগে আমাদের এভাবে মেলামেশা ঠিক নয়। এটা অন্যায়।”

আদনান শান্ত দৃষ্টিতে নিঝুমকে দেখলো। তার মনে কী চলছে তা বোঝা যাচ্ছে না। নিঝুম বুঝছে না কী বলা উচিত আর। এদিকে সেদিক তাকাতেই আরও বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তাদের ডানপাশেই প্রেমিক প্রেমিকা চুম্বনরত অবস্থায়।

এই স্বল্প আলোর ব্যবস্থা তাদের ভালোই করেছে মনে হয়। নিঝুম দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। ততক্ষণে আদনানও দেখে ফেলেছে এ ঘটনা। নিঝুমের গালে হাত রেখে সে বললো,
~ “আমরাও পারি…!”

আদনানের কথা শেষ হওয়ার আগেই দাঁড়িয়ে পড়লো নিঝুম।
~ “আমাকে যেতে হবে।”

কথাটা শেষ করেই চলে গেল নিঝুম। পেছনে ফেলে রেখে গেল আদনানের রাগান্বিত মুখ।
নিঝুমের বুঝে আসে না আদনান হঠাৎ উল্টা পাল্টা আচরণ করতে শুরু করেছে কেনো?

কোন সে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল বগুড়ায়, আর কী করছে এখন! বাবা মাকে কি সুন্দরভাবেই না ঠকাচ্ছে সে। এর আগে মাঝে মাঝে অপরাধবোধ কাজ করলেও সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না। তবে আজ এই অনুভূতি অনেক অনেক বেশি গাঢ়। হোস্টেল পর্যন্ত সে কাঁদতে কাঁদতেই গেল।

পরদিন পরীক্ষা শেষে হোস্টেলে ফিরে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় রাখতেই নজর গেল টেবিলের কোণায় পড়ে থাকা ফোনটার দিকে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো, নো কল! নো মেসেজ! আদনান তাকে কল, মেসেজ কিছুই করেনি। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ কোথাও কোনো আনরিড মেসেজ নেই আদনানের। ফেসবুকের নিউজফিডে জ্বলজ্বল করছে একটা ছবি।

একটি সুন্দরী মেয়ের সাথে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে আদনানের কথা বলতে থাকার দৃশ্য! কাভার ফটো দেওয়া হয়েছে ছবিটা। ছবির কমেন্ট পড়ে সবটা স্পষ্ট হয়ে গেল। উফ! নিঝুমের শরীরের ক্লান্তি হাজার গুণ বেড়ে গেল।

প্রচন্ড কষ্ট হতে থাকলো৷
আকাশকুসুম চিন্তা না করে আদনানকে কল দিল নিঝুম। ফোন রিসিভ করলে নিঝুম কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
~ “ভালোই ইনজয় করছেন?”

আদনান ছোট্ট করে জবাব দেয়,
~ “হুম”
~ ” এখন আর আমাকে ভালো লাগে না তাইনা? এই আপনার ভালোবাসা?

এতোদিন কতোই না মধুর কথা শুনিয়েছেন! সব মিথ্যা! অপেক্ষা করতে বলেছি, চুমু দিতে দেইনি বলে ভালোবাসা শেষ। এখন অন্যজনকে নিয়ে….! এক মনে কয়জনকে জায়গা দিতে পারেন আপনি?

হাহাহা!”
হাসতে থাকলো নিঝুম। কষ্টেই আজ প্রচন্ড হাসি পাচ্ছে তার। হাসি থামিয়ে বললো,
~ “এতদিন কি তবে নিছক অভিনয় করে গেছেন আমার সাথে?”

আদনান বলে উঠলো,
~ “তুমি যা ভাবো তাই।”
আদনানের এমন উত্তরে নিঝুম প্রচন্ড রাগ নিয়ে কল কেটে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে সেভাবেই ঘুমিয়ে যায় একসময়।

ঘুম ভাঙ্গার পর দেখে আনিশা কাপড়চোপড়, সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। নিঝুমকে জাগতে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে নিঝুমকে আনিশা বললো,
~ “জানো তো নিঝুম।

তোমার রায়হান ভাইয়া ফার্মাসিউটিক্যাল একটা কোম্পানি চাকুরি পেয়েছে। আর তাই সে আর অপেক্ষা করতে নারাজ। নিজেই আমার বাবা মায়ের কাছে ওর বাবা মাকে পাঠিয়ে দিয়েছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। সবাই রাজি থাকায় আগামী মাসের প্রথম রবিবার আমাদের বিয়ের দিন ঠিক করা হয়েছে। তাই আমি আজ বাড়িতে ফিরছি। কত কেনাকাটা করতে হবে বলোতো! তবে যাই বলো, আমি খুব খুব খুশি।”

আনিশার খুশিতে আজ নিঝুম খুশি হতে পারছে না। একদিকে আনিশা যে কি না নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পেতে চলেছে। আর অন্যদিকে নিঝুম যে কি না নিজের ভালোবাসাকে হারাতে বসেছে। আনিশার কথা শুধু শুনেই গেল নিঝুম।

কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পেল না। আনিশা তো বলেই চলেছে,
~ “তোমাকে কিন্তু আমার বিয়েতে যেতেই হবে নিঝুম। বুঝেছো?”

নিঝুম শুকনো মুখে জবাব দিলো,
~ “জ্বী আপু।”
অধিক খুশিতে আনিশা নিঝুমের অবস্থাটা আঁচ করতে পারলো না। করবেই বা কিভাবে! সে তো জানতোই না নিঝুমের প্রেমের সম্পর্ক সম্পর্কে। কলেজ ড্রেসেই নিঝুমকে শায়িত অবস্থায় দেখেও তার মনে কোনো ভাবনা আসে নি।

সবাইকে বিদায় জানিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে গেল। হয়তো আর পড়াশোনা চালিয়ে যাবে না, সুখে শান্তিতে স্বামীর ঘর করবে।
এই দুনিয়া একদিকে ভাঙ্গতে থাকবে, আর অন্যদিকে গড়তে থাকবে। ভাঙ্গা গড়ার এই অদ্ভুত খেলা আজীবন চলতেই থাকবে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আদনান আর নিঝুমের জীবনের গতির পরিবর্তন হয়েছে। তাদের অতিরিক্ত ভালোবাসা এখন অতিরিক্ত বিরক্তিতে রুপান্তরিত হয়েছে।

আদনান ও নিঝুমের একসাথে পথচলা থেমে গেছে, দুজনের ভালোবাসার পথ আলাদা হয়ে গেছে। নিঝুমের গভীর ভালোবাসার মূল্য এখন আর আদনানের কাছে নেই। আদনান আর নিঝুমের ভালোবাসার গভীরতা মাপতে চায় না। নিঝুমের ভালোবাসা বোঝার চেষ্টাও করে না।

ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া না করেই আদনানকে কল দিল নিঝুম। মনটা মানছে না। নিঝুম বিরতি চেয়েছিল, বিচ্ছেদ চায় নি। পবিত্র সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছিল পরিবারের উপস্থিতিতে। তবে সেটা আদনানের সাথেই।

দশ বারো বার কল দেওয়ার পরও যখন আদনান কল রিসিভ করলো না তখন নিঝুম পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করতে পারলো। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে আদনান একবার তার ফেসবুক পাসওয়ার্ড দিয়েছিল নিঝুমকে। নিঝুম সেটা টুকে রেখেছিলো ডায়েরিতে।

সেই পাসওয়ার্ড দিয়ে আদনানের আইডিতে ঢুকলো নিঝুম। যদি মেয়েটার সাথে কোনো কনভারসেশন চোখে পড়ে যায়! কিন্তু পাসওয়ার্ড ইরোর দেখাচ্ছে। মানে আদনান ফেসবুক পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করেছে।

নিঝুম আর কল না করে মেসেজ দিলো আদনানকে,
~ “এখন আর আমার কলও রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না? এত ইগো আপনার? এতোই বিরক্তির কারণ হয়ে গেছি আমি? এত অবহেলা কেন করছেন আমায়? আমি সত্যি ভালোবাসি বিশ্বাস করুন। আগের মতো হয়ে যান না প্লিজ। কলটা রিসিভ করবেন একবার? বেশিক্ষণ কথা বলবো না কথা দিচ্ছি। বিরক্ত করবো না আপনাকে।”

নিঝুম বুঝছে না সে কি আবলতাবল বলে যাচ্ছে। যোগাযোগ না রেখে ভালোবাসা টিকিয়ে রাখা যেত। কষ্ট হলেও তা সহ্য করা যেত বোধহয়। কিন্তু বিচ্ছেদ মানে সে এখন অন্য কারো। এ দুঃখ সহ্য করা সহজ হচ্ছে না নিঝুমের পক্ষে।

প্রায় সতের মিনিট পর আদনানের উত্তর আসে,
~ “কি বলবে বলো? আমি তো ফোন সবসময় ধরে বসে থাকি না।”

নিঝুম ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিল। মেসেজ পেয়ে ভেবেছিল আদনান সরি বলে সবটা ঠিক করে নেবে। কিন্তু তার মেসেজের শব্দগুলো নিঝুমকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। আজকের এই আদনানকে কেন যেন মেলাতে পারছে না আগের আদনানের সাথে।

নিঝুম কল করে। আদনান কল রিসিভ করলে নিঝুম বললো,
~ “কী ভুল করেছি আমি বলেন আমাকে। আমি আমার সব ভুল শুধরে নেবো বিশ্বাস করেন। একটাবার শুধু বলেন আমাকে। একবার সুযোগ দেন আমাকে।

আমি যে আপনার ভলোবাসা ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না। আমাকে পরীক্ষা করার জন্য এসব করছেন? প্লীজ বলেন না! আমি খুব খুব ভালোবাসি আপনাকে। বিশ্বাস করেন আমাকে। প্লিজ…!”

নিঝুম কেঁদে ফেলে কথা বলতে বলতে। তার কান্না, আকুতি আদনানকে একটুও গলাতে পারে নি। উল্টো আরও বিরক্ত হয়ে যায়। কোনরকম ভনিতা ছাড়াই বলে দেয়,
~ “আমি আর সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো না।

ব্রেকআপ আজ থেকে আমাদের। আজ ছবিতে যে মেয়েটার সাথে আমাকে দেখলে ওর নাম সানিয়া। আমার নিউ গার্লফ্রেন্ড। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। তুমি আর আমাকে ফোন করে, মেসেজ করে বিরক্ত করবে না।”

কল কেটে দেয় আদনান। নিঝুমের কথাগুলো বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লাগে। নিঝুম দিশেহারা হয়ে যায়। পাগলপ্রায় হয়ে কল করতে থাকে। কয়েকবার কল হয়ে কেটে যায়। একসময় আদনানের ফোন বিজি দেখায়৷ নিঝুম বুঝতে পারে তার নাম্বার ব্লকলিস্টে রেখেছে আদনান। ফেসবুকে গিয়ে দেখে ফেসবুকেও ব্লক করে দিয়েছে।

আমার এত আবেগ ভালোবাসার এই মূল্য দিলেন আপনি। আমার রাগ, অভিমান, অধিকারবোধের মধ্যে ভালোবাসা দেখলেন না। আজ অন্য কেউ আপনার জীবনের সব হয়ে গেল। আজ আমি আপনার কেউ না! আপনাকে ভালোবাসার অধিকার অন্য কাউকে দিয়ে দিলেন?

আপনাকে নিজের বলে ভাবার অধিকার একবারে কেড়ে নিলেন আমার থেকে? আপনাকে নিয়ে দেখা সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে দিলেন? আপনাকে নিয়ে ভালোবাসার যে সংসার গড়তে চেয়েছিলাম, তা সূচনাতেই শেষ করে দিলেন!
শূণ্যে ছুঁড়ে দিল প্রশ্নগুলো।

অশ্রু মুছে নিজেকে বুঝ দিতে লাগলো! আর বিরক্ত করবো না আপনাকে। থাকুন আপনি আপনার ভালোবাসাকে নিয়ে। তবে যাকে ছেড়ে ভালো থাকতে চেয়ে অন্য কাউকে বেছে নিলেন তাকে নিয়ে ভালো থাকতে পারবেন তো?

কিন্তু তবুও প্রচন্ড আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে তার সাথে কথা বলার। ঠিক আগের মতো মধুময়, আদুরে কথাবার্তা বলার। প্রচন্ড রকম অবহেলার স্বীকার হয়েছে সে ভালোবাসার মানুষটির কাছে। এত অবহেলার স্বীকার হয়েও প্রচন্ডরকম ভাবে ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে তাকে।

‘ভালোবাসি, ভালোবাসি’ বলতে ইচ্ছে করছে খুব। ভালোবাসার গল্প শুনিয়ে বিরক্ত করতে ইচ্ছে করছে তাকে। অতিরিক্ত ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে মানুষটাকে।

প্রিয় মানুষবিহীন, ভালোবাসাবিহীন, মরুভূমিময় জীবনটা থেকে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। চিৎকার করে কাঁদার ইচ্ছা থাকলেও কাঁদতে পারছে না। আদনান আর তাকে একটুও মিস করবে না! তাকে আর ভালোবাসি বলা হবে না! দুষ্টুমি করা হবে না। ভালোবাসা শিখিয়ে আজ সে নিজেই সরে দাঁড়ালো! ভালোবাসাময় এক সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখিয়ে আজ সে নিজেই বেখবর!

শব্দহীন ভাঙ্গাচোরার এই খেলায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে নিঝুমের কোমল হৃদয়। যেই ক্ষত প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। গভীরতা যার ক্রমশ বাড়ছে। যে ক্ষততে মলম লাগানো সম্ভব নয়। এ ক্ষতের মলম যে হয় না৷ একমাত্র আদনানের ভালোবাসার পরশই এ ক্ষত সাড়াতে পারে।

কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। জীবনের গতিশীলতায়, সময়ের পরিবর্তনে ক্ষতটা হয়তো কখনো না কখনো শুকিয়ে যাবে, কিন্তু সেই ক্ষতের দাগ কি কখনো মুছে ফেলা সম্ভব? না কি রয়েই যাবে আজীবন?


পর্ব ১৪

ভালোবাসা অদ্ভুত একটা অনুভূতি। যার মন আছে সে ভালবাসবেই। সত্যিকারের ভালবাসতে ভালবাসি বলার প্রয়োজন হয় না, পাশাপাশি থাকার প্রয়োজন হয় না। একজন আর একজনকে না দেখে, না ছুঁয়ে, জীবনে তাকে না পেয়েও ভালোবাসতে পারে। ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া নয়।

তাকে নিজের না করে, তার ওপর অধিকার না থাকা সত্ত্বেও দূর থেকে তার ভালো চাওয়া, ভালোবেসে যাওয়াই হল ভালোবাসা। ভালোবাসার মানুষকে কখনো জোর করে বেঁধে রাখতে চাইতে নেই।

ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসার জন্য, তার ভালোর জন্য নিজের ভালোবাসা ত্যাগ করাটাও ভালোবাসা। ভালোবাসা টা সকল স্বার্থের উর্দ্ধে। ভালোবাসা নিঃস্বার্থ। ভালোবাসায় কখনো স্বার্থ থাকতে নেই।

কথাগুলো কেউ একজন নিঝুমকে বলেছিলো একসময়। তবে সে নিজের ক্ষেত্রে চেষ্টা করেও মানতে পারছে না। মানব মন বড়োই অবুঝ। মন নিজেও জানে না, সে কখন কী চায়!

এখন গভীর রাত। আদনান আর তার নেই, আদনান এখন অন্য কারো ভাবলেই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে নিঝুমের। অনেকক্ষণ কান্নাও করেছে। কান্নার কারণে মাথায় ভীষণ যন্ত্রনা হচ্ছে। আনিশা বিয়ে উপলক্ষে কয়েকদিনের জন্য বাবা মা এর কাছে গিয়েছে বলেই নিঝুম বদ্ধ ঘরের মধ্যে মন মতো কাঁদতে পারছে। তবুও যেন কষ্ট কমছে না।

নিঝুম একা একা নিজের সাথেই কথা বলছে,
~ “নাহ্। আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। চোখের সামনে আপনাকে অন্য কারোর হয়ে যেতে দেখতে পারবো না। পারবো না অন্য কারো সাথে আপনাকে হাসতে, ঘুরতে, খুশি থাকতে দেখতে।”

উঠে দাঁড়ায় নিঝুম। এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়। রুমের দরজা খুলে এগিয়ে যায় মূল দরজার দিকে। দরজায় হাত দিয়ে বুঝতে পারে বাহির থেকে লাগানো আছে দরজা। নাসিমা আন্টি রোজ বাহিরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে যান।

যাতে রাতে মেয়েরা বাহিরে বেরোতে না পারে।
নিঝুম ফিরে আসে নিজের রুমে। রুমটায় আজ আলো জ্বলছে না। গভীর অন্ধকার! দরজা খোলা রেখেই ভিতরে গিয়ে খাটে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। সেই অবস্থায় বিড়বিড় করে কথা বলছে আর গুনগুনিয়ে কাঁদছে।

ফাতেমার ঘুম খুব পাতলা। সামান্য আওয়াজেই ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। তাছাড়া রাত জেগে সালাত এবং একাডেমিক পড়ার অভ্যাস থাকায় রাতের বেলা অ্যালার্ম ছাড়াই জেগে ওঠে সে। এই রাতের বেলায় নিঝুমের গুনগুনিয়ে কান্নার আওয়াজ বেশ ভৌতিক লাগছে। একদম পাশের রুমে থাকে বলে ফাতেমাও সে শব্দ শুনতে পায়।

অন্য কেউ হলে হয়তো ভয়ই পেয়ে যেত। কিন্তু ফাতেমা ভয় পেল না। বরং কী হয়েছে, কিসের শব্দ তা জানার জন্য উৎসুক হয়ে উঠলো। নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এল রুম থেকে। পাশের রুম থেকে আসছে শব্দটা। পাশের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শব্দটা জোরালো হল। বাহির থেকে আসা আলোয় বোঝা যাচ্ছে দরজা খোলা রাখা আছে। রুম থেকে বেরোনোর সময় ফোনটা সাথে করেই নিয়ে এসেছিল ফাতেমা।

ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে দিল সে। হঠাৎ আলোয় পিলে চমকে ওঠে নিঝুমের। নিঝুম নিজ অবস্থান থেকে কিছুটা পেছনে সরে যায়। আলো জ্বালানো ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি আর কেউ নন তাদের হোস্টেলেরই ফাতেমা আপু, যার সাথে সচরাচর তারা কেউ কথা বলে না, সবসময় এড়িয়ে চলে।

নিঝুমের ভাবনার মাঝেই তার কাছে এসে বাসে ফাতেমা। তার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। ফাতেমা বুঝছে না এত রাতে এই মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেনো! নিঝুমের অবস্থা অগোছালো, সেই সাথে ঘরেরও।

নিঝুমকে জড়িয়ে ধরে, টেনে নেয় বুকের মাঝে । ফাতেমার হার্টবিট বেড়ে গেছে, হাত পা কাঁপছে। ফাতেমা নিজেকে সামলে নিয়ে নিঝুমকে বললো,
~ “কী হয়েছে? কাঁদছিলে কেনো?”

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে একটুখানি স্নেহের উষ্ণতা পেয়ে নিঝুমের ফাতেমাকে বড় আপন মনে হয়। এমন একজনের বুকে বা কাঁধে মাথা রেখে ইচ্ছামতো কাঁদতেই তো ইচ্ছে করছিলো নিঝুমের। নিঝুমও ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে আষ্টেপৃষ্ঠে। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি তুলে ফেলে।

তারপর কোন কিছু না ভেবেই বলে দেয় সব ঘটনা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা বললো সে। গ্রামের ঘটনা, সেই ঘটনা থেকে নিজের সিদ্ধান্ত কোনো কিছুই বাদ রাখলো না। আংশিক পরিচিত ব্যক্তিকে নিজের ব্যক্তিগত কথাগুলো কেনো বললো নিঝুম, তা সে নিজেই জানে না।

নিঝুমের শুধুই মনে হচ্ছিলো তার বুকটা ভার লাগছে। নিজের মধ্যে কথাগুলো আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। কাউকে নিজের কষ্টের কথা বলে হালকা হওয়া দরকার। আর ফাতেমাকে দেখে মনটা আরও বলছিলো “বলে দাও যা মন বলতে চাইছে!”

সব শুনে ফাতেমা নিশ্চুপ। অবুঝ মনের জটিলতা সে বুঝতে পারে। নিঝুমের বয়সটা সে একসময় অতিক্রম করে এসেছে। এ সময়টা ভুল হয় বেশি। এ সময়ে নানান অনুভূতিরা ভীড় করে। তাদের নিয়ন্ত্রণ আনা জরুরি হয়ে পড়লেও কঠিন হয়ে থাকে। সবকিছু মন দিয়ে বিবেচনা করা হয় এ সময়ে।

ফাতেমা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই নিঝুম ভাঙ্গা ভাঙ্গা হলায় বললো,
~ “আমি ওনাকে ভুলতে পারবো না আপু। আমার পক্ষে জাস্ট ইম্পসিবল।”

ফাতেমা উত্তরে হাসলো। কিছুটা সময় নিয়ে বললো,
~ “হ্যা ইম্পসিবল তো বটেই। তবে তা ভুলে থাকার চেষ্টা করার আগ মুহুর্ত পর্যন্তই। জানো নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে,
‘Impossible is a word which is only found in the dictionary of fools.’
ভুলে যাওয়াও আল্লাহর অন্যান্য নেয়ামতের মতোই একটা নেয়ামত।

মানুষ ভুলে যেতে পারে। হয়ত ভুলতে পারলেও কোন এক বৃষ্টির দিনে, কিংবা এক পড়ন্ত বিকেলে যখন একজোড়া প্রেমিক প্রেমিকাকে ভালোবাসা বিনিময় করতে দেখবে, তখন বুকের ভিতরে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করবে।

কিন্তু তবুও চেষ্টা করতে হবে। এভাবে তোমাকে মানানো যাবে না। তোমার ব্যথাতুর হৃদয়টাকে একমাত্র দ্বীনের আলো, আল্লাহর ভালোবাসাই উপশম করতে পারে।”

নিঝুম তাকিয়েই থাকে ফাতেমার দিকে। গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে ফাতেমার কথা। দ্বীন? আল্লাহর ভালোবাসা? সে তো কতদিন আগেই আল্লাহ বিমুখ হয়ে গেছে নিজের অজান্তেই।

ফাতেমাও নিঝুমের মত করে খাটে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে অন্ধকারের মাঝেই নিঝুমের চেহারার ভাবগতি বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর বললো,
~ “নিঝুম, বিবাহের আগে প্রেম~ভালোবাসাকে ইসলাম অনুমোদন দেয় না।

তোমরা দুজন দুজনকে দেখেছো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোমাঞ্চকর কথাবার্তা চালিয়েছো, দেখা করার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছো, ঘুরে বেড়িয়েছো। এতে করে যে যিনা হয়েছে তার পরিণতি যে খুব ভয়াবহ বোন। একটা ছেলে তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলে তুমি এত কষ্ট পাচ্ছো! কিন্তু তোমার এহেন কাজে আল্লাহ তা’আলা যদি তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার কি হবে ভেবেছো কখনো?

একটা ছেলে তোমার কাছে এত বড় হয়ে গেল? আর তোমার রব? তোমার বাবা মা? তোমার রব তোমাকে এতোই ভালোবাসেন যে, তুমি অন্যায় করলেও সাথে সাথে তোমাকে কোনো শাস্তি দেন না, তোমাকে সুযোগ দেন তওবা করার, নিজেকে শুধরে নেওয়ার।

বাবা মা এর মুখগুলো মনে পড়ে? ভুলে গেলে তাদের ভালোবাসা, আত্মত্যাগ? ওনারা এত কষ্ট করে তোমাকে পড়তে পাঠিয়েছেন, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন, আর তুমি কি করছো? তোমার বাবা মা এর ভালোবাসার এই মূল্য দিচ্ছো তুমি?”

নিঝুম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এ অনুতাপ আগেও হয়েছে। নিজের মস্তিষ্ক তাকে বারবার এ কথা মনে করিয়েছে। তবে আজ অন্যকারো মুখে এমন কথা শুনে নিঝুমের প্রচন্ড ঘৃণা আসে নিজের ওপর। ছিঃ বাবা মাকে মুখ দেখাবে কিভাবে!

ফাতেমা আবার বলতে শুরু করলো,
~ “নিঝুম, আমরা যাদের বাবা মা থাকে না, তাদেরকে এতিম বলি। কিন্তু সবচেয়ে বড় এতিম কারা জানো?”
নিঝুম অশ্রুভরা উৎসুক চোখে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে আছে।

~ “সবচেয়ে বড় এতিম তারাই, যারা আল্লাহর ভালোবাসা পায় না। দ্বীনের আলো যাদের অন্তরে পৌঁছায় না। বিয়ের আগে এত এত ছেলেমেয়েরা হারাম প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। এই সম্পর্কটা ঠিক কতদিন টিকে? সবাই কি সম্পর্কটাকে বিয়ে অবদি নিয়ে যেতে পারে?

আর যদি পারেই, তবে কেন এত বিচ্ছেদ? যে সম্পর্কের শুরুই হারাম দিয়ে সেটা যে টিকবে এমনটা ভাবাই তো ভুল। বিচ্ছেদের পর অনেকেই ভেঙ্গে পড়ে। বিছানার বালিশটা তখন সবচেয়ে আপন হয়ে যায়। সব ভুলে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যায়।

আল্লাহকে ভুলে, ইবাদত বন্দেগী বাদ দিয়ে, দুনিয়া থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রেখে বালিশে মুখ গুঁজে রাতের পর রাত কান্না করাটা হয়ে যায় নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের খুবই ভালবাসেন।

তিনি কখনওই চান না তাঁর বান্দারা কষ্টে নিমজ্জিত থাকুক। যা কিছু তাঁর বান্দাদের জন্য ক্ষতিকর, কষ্টকর সেসব কিছুই তিনি হারাম করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা দয়াশীল। আমরা মানি বা নাই মানি, কিন্তু অধিকাংশই জানি “আল্লাহ তায়ালা উত্তম ফয়সালাদানকারী।”

তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। একমাত্র তিনিই আমাদের ভাল~মন্দ সম্পর্কে অবগত। আদনান তোমাকে ছেড়ে গেছে বলে তুমি কষ্ট পাচ্ছো? কিন্তু একবারো ভেবে দেখেছো আল্লাহ তায়ালা তোমাকে এই হারাম কাজ থেকে বেরিয়ে আসার একটা সুযোগ দিচ্ছেন।

তুমিও তো তাই চেয়েছিলে তাই না? যাকে তুমি ভালোবাসো সে তোমার হবে না। যে তোমাকে ভালোবাসে সেও তোমার হবে না। তাহলে হবে কে? যাকে আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য সৃষ্টি করেছেন সে। সেজন্য এই প্রেম প্রেম খেলায় তাৎক্ষণিক কষ্ট আর আখিরাতের জন্য অনেক গুনাহ কামাই হবে শুধু। এছাড়া কী লাভ এতে?”

ফাতেমা নিঝুমের হাত দুটো মুঠোয় ধরে রেখে বললো,
~ “নিঝুম, বুকে এক সমুদ্র ভালোবাসা অন্য কোন পুরুষের জন্য রেখে, ভবিষ্যতে স্বামীর সামনে কী নিয়ে দাঁড়াবে বোন?

নাকি দায়িত্ব কর্তব্যের খাতিরে ভালোবাসাবিহীন সংসার করে যাবে? স্বামীর আমানত নষ্ট করে তার সামনে দাঁড়াতে বুক কাঁপবে না? মৃত্যুর কোনো সময় অসময় নেই। জীবিত প্রাণিকে মরতেই হবে। মারা গেলে স্রষ্টার সামনে কী নিয়ে দাঁড়াবে? তোমার ঝুলিতে কত পূণ্য, আমল, সওয়াব আছে, আর কত গুনাহ, পাপ, অন্যায় আছে হিসাব করেছো?”

নিঝুমের শরীর শিউরে ওঠে ফাতেমার প্রতিটি কথায়। ফাতেমার বলা কথাগুলো নিঝুমের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কথাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে নিঝুমের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে মলমের মতো কাজ করে। কতক্ষণ এই মলম কাজ করবে তা জানা নেই!

নিঝুম ধীর আওয়াজে বললো,
~ “আমি চেষ্টা করবো আপু।”
ফাতেমা মিষ্টি হেসে বললো,
~ “ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তোমার সহায় হোন। ভুল মানুষই করে। কিন্তু তাদের মধ্যে উত্তম হলো তারাই, যারা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদেরকে পরিবর্তন করে। আদনানকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব ভেবো না। কাছের মানুষ মারা গেলে আমরা কিন্তু তাদের ভুলে যাই।

সময়ের পরিবর্তনে ক্ষত সেরে যায়, শোক কেটে যায়। তবে কিছু কিছু স্মৃতি মনে থাকে আজীবন। তা থাকুক। তবে প্রিয়জন, কাছের মানুষের মৃত্যুশোক হোক কিংবা তোমার প্রেমিককে ভুলতে পারাটা কোনোটাই অসম্ভব নয়। এসব কারণে নিজের জীবনটা কখনো থেমে থাকতে পারে না।”

এরপর ফাতেমা নিঝুমকে তার রুমে নিয়ে যায়। তাকে অল্প কিছু খাইয়ে দেয়। ফাতেমা ভাবে মেয়েটার এখন কারো সঙ্গ দরকার, কাউন্সিলিং দরকার! বিছানায় শুয়ে দিয়ে নিঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। গল্প করে তার সাথে। ভুলিয়ে দিতে চায় অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো।
একসময় নিঝুম ঘুমিয়েও পড়ে। ফাতেমা সেদিকে খেয়াল করে। শুকরিয়া জানায় রবকে। নিঝুমের রুমের দরজা ভালো করে আটকে দিয়ে ফাতেমা চলে যায় নিজের রুমে।


পর্ব ১৫

ফাতেমার ভয় হয়, নিঝুমের যে মনের অবস্থা, কী থেকে কী করে ফেলবে ঠিক নেই। সেজন্য ওকে একটু সঙ্গ দেওয়া প্রয়োজন। নিঝুমের রুমের দরজাটা চাপানো ছিল। বাইরে থেকে দু’বার নক করে কোনো সাড়া না পেয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে আসে ফাতেমা।

মিডিয়াম ভলিউমে মনোযোগ দিয়ে গান শুনছে নিঝুম। ঢুকে গিয়েছে গানের গভীরে। গানের প্রতিটি লাইন ছুঁয়ে দিচ্ছে তার হৃদয়কে। তবে হৃদয়ের ক্ষত সারিয়ে দিচ্ছে না বরং ক্ষতটা কে আরও গভীর করে দিচ্ছে। রুমে যে ফাতেমা প্রবেশ করেছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই নিঝুমের। চোখ বন্ধ করে রেখেছে। দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

ফাতেমা গিয়ে নিঝুমের কাঁধে হাত রাখে। নিঝুম চমকে ওঠে, চোখ খুলে তাঁকায়। ফাতেমা গিয়ে পাশে বসে। দ্রুত হাতে ফোনটা টেনে নিয়ে গান বন্ধ করে দেয় নিঝুম।
ফাতেমা জিজ্ঞেস করলো,
~ “গান শুনে ভালো লাগছে কি? মনটা শান্ত হয়েছে?”

নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,
~ “নাহ্। আরও বেশি খারাপ লাগছে। মনটা আগেও চেয়েও অনেক বেশি অশান্ত হয়ে আছে।”

ফাতেমা মুচকি হেসে বললো,
~ “সেটাই স্বাভাবিক। গান শুনলে মন কখনো ভালো হয় না, আরও বিষন্ন হয়। গান শোনা হারাম। গান শুনলে কিয়ামতের দিনে কানে গরম সীসা ঢেলে দেওয়া হবে। কল্পনায় ফিল করে দেখো বিষয়টা!”

নিঝুমের চোখে মুখে ভয় ফুটে ওঠে। সে আগে থেকেই ধর্মভীরু ছিল। এখানে এসে অসৎ সঙ্গ পেয়ে তার অবনতি হয়েছে। এখন আবার ফাতেমার সঙ্গ তাকে তার পুরনো অনুভূতি, ভাবনা ফিরিয়ে দিচ্ছে।
~ “কিন্তু আমার যে অভ্যাস! কিভাবে পারবো?”

নিঝুমের চোখে মুখে দুশ্চিন্তা। ফাতেমা তাকে আশ্বস্ত করে বললো,
~ “একদিনে তো পারবে না। তবে চেষ্টা তো করতে হবে। মন খারাপ হলে গানের বদলে কুরআন তেলাওয়াত শুনবে। নামাজ পড়বে। দেখবে মন ভালো হয়ে গেছে।”
নিঝুম নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে ফাতেমাকে বললো,
~ “আপু আমার আজকাল নামাজ পড়তে ভালো লাগে না। খুব আলসেমি লাগে। চাইলেও পড়তে পারি না। ফজরের নামাজ তো সম্ভবই নয়।”

ফাতেমা অস্ফুটস্বরে বললো,
~ “ইন্নালিল্লাহ….!”
একটু থেমে বললো,
~ ” ‘গুনাহসমূহের জন্য এতটুকু শাস্তিই যথেষ্ট যে, সেগুলো তোমাকে আল্লাহর ইবাদত করা থেকে বিরত রাখে; যদিও বা তোমার ইচ্ছে ছিলো ইবাদত করার।’

ইবনুল কাইয়্যুম (রাহিমাহুল্লাহ)
নিঝুম, বুঝতে পারছো এই কথাটার গভীরতা?
যা কিছু নিষিদ্ধ তার প্রতি আমাদের প্রবল আকর্ষণ,
আর যা আমাদের করতে বলা হয়েছে, তার প্রতি আমাদের অবহেলা, অনীহা। মুনাফিকদের জন্য ফজর আর এশার নামায পড়া কষ্টকর।

তুমি কি নিজেকে মুনাফিকের পরিচয় দিতে চাও? যারা দু’মুখো সাপের মত। যাদের অন্তরে এক আর বাহিরে অন্য আর এক। যারা বাহিরে নিজেদের ঈমানদার হিসেবে উপস্থাপন করে কিন্তু অন্তরে ইসলাম ও এর বিধানসমূহকে অস্বীকার করে! মুনাফিকদের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।

আর ফজরের নামাজ দিয়ে দিনটা শুরু করলে, পুরো দিনের কার্যক্রমের একটা বরকতময় সূচনা হবে। ফজরের নামাজ আদায়ের অনেকগুলো ফযিলতও আছে।

আমরা মুসলিম। আমাদের দিনের শুরুটা অন্যরকম হবে। একজন মুসলিমের দিনের শুরুটা রবের ইবাদতে শুরু হবে এবং শেষটাও হবে রবের ইবাদতের মাধ্যমেই। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে না গিয়ে যিকির করা এবং কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত।

ভোরে ঘুম থেকে উঠলে একদিকে যেমন ফজরের নামাজ কাযা হওয়ার ভয় থাকে না, সময়মত ফজরের সালাত আদায় করা যায় তেমনি সকালের আবহাওয়া টা, প্রকৃতি, বাতাস উপভোগ করা যায়। যা শরীর ও মন উভয়ের জন্যই খুব উপকারী। আজকাল শহরের মানুষের সকাল শুরু হয় দেরিতে।

তারা সকালটা উপভোগ করবে কী করে? শহরের ইট, বালু, সিমেন্ট এর তৈরি কৃত্রিমতায় শহুরে জীবন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ আর ঘরে বসে করা যায় না। এজন্য দর্শনীয় স্থানগুলোতে যেতে হয়।”

নিঝুমের শরীর শিহরিত হয়। ফাতেমার কথাগুলো তার হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যাচ্ছে। হৃদয়কে নাড়িয়ে দিচ্ছে। সে ভাবছে তার গুণাহ এত বেশি হয়ে গেছে যে, চাইলেও ইবাদত করতে পারছে না!

~ “ইনশাআল্লাহ, আমি আগামী ওয়াক্ত থেকে নামাজ পরবো।”
ফাতেমা বললো,
~ “আল্লাহ তোমার নিয়ত কবুল করুন।”

~ “আমিন”
কিছুক্ষণ নীরবতার পর ফাতেমা বললো,
~ “আজ তোমার পরীক্ষা আছে না?”

~ “হ্যা আপু। আজকেই শেষ পরীক্ষা।”
নিঝুম জবাব দিলো। ফাতেমা নিজের ঘর থেকে এক প্লেট খিঁচুড়ি নিয়ে এসেছিলো। প্লেটটা নিঝুমকে দিয়ে বললো,
~ “খেয়ে দেয়ে তৈরি হয়ে পরীক্ষা দিতে যাও।

পরীক্ষা শেষে হোস্টেলে ফিরে আমার কাছে এসো। দরকার আছে।”
~ “খালা আমাকে খাবার দিয়ে যাবে আপু।”

~ “রেখে দিও, পরে খেও। আজ এগুলোই খাও।”
নিঝুম “হ্যা” বলে সম্মতি জানালে ফাতেমা চলে যায়। নিঝুম অনুভব করে যতক্ষণ সে ফাতেমার সাথে থাকে ততক্ষন অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে মনের মধ্যে।

ফাতেমা কথাগুলো ও শুনতে ভালো লাগে, আরও বেশি করে জানতে ইচ্ছে করে ইসলাম সম্পর্কে, ইসলামের আরও গভীরে প্রবেশ করতে ইচ্ছে করে।
নড়বড়ে কাঠের টেবিলে একটা বক্সের ভিতরে আদনানের দেওয়া কিছু উপহার ছিলো।

কানের দুল, ঘড়ি, নেইল পলিশ, লিপস্টিক আরও অনেক কিছু। বক্সটা নিয়ে বাইরে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল নিঝুম। এগুলো এখনো রাখার কোন মানে হয় না। যে মানুষটা জীবন থেকে চলে গেছে, সেই মানুষটার স্মৃতি গুছিয়ে রাখার মানে হয় না। বরং এগুলো তাকে কষ্ট দিতে পারে। তার মানসিকতা পাল্টে দিতে পারে।

নিঝুম বাইরে থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে, তৈরি হয়ে নিল। খেয়ে দেয়ে রুমের দরজায় তালা লাগিয়ে কলেজে চলে গেল। সাথে মনের মধ্যে এক আশঙ্কা নিয়ে। আদনানের সাথে দেখা হওয়ার আশঙ্কা।

তার সামনে পড়লে যে সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যাবে নিঝুমের। নিজেকে আর কঠিন করে ধরে রাখতে পারবে না। রাস্তায় কি দেখা হয়ে যেতে পারে দুজনের!

পরীক্ষা শেষ করে হোস্টেলে ফিরে আসে নিঝুম। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে পোশাক না পাল্টেই। ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। গতকাল থেকে কাঁদতে কাঁদতে চোখগুলো ফুলে গেছে, লাল হয়ে গেছে।

আজকের পরীক্ষাটা ভালো হয় নি। প্রস্তুতি ছিল না বলে। কোনোমতে পাশ মার্ক ওঠার মতো উত্তর করে এসেছে নিঝুম। ফাতেমা আপুর সাহায্যে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে নিঝুম।

চোখে থাকা রঙিন পর্দা যেটা দিয়ে নিঝুম দুনিয়াকে রঙিনভাবে দেখছিলো তা সরিয়ে দিয়েছে গতকালই। যেকোন পরিস্থিতিকে মন এবং আবেগ দিয়ে নয় বরং মস্তিষ্ক, বিবেক দিয়ে বিচার করতে হয়।

যোহরের আযান দিয়ে দিয়েছে। টেনে হিঁচড়ে শরীরটা বিছানা থেকে উঠিয়ে গোসল করে নিল। ওযু করে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। অনেকদিন পর জায়নামাজে দাঁড়িয়ে অপরাধবোধে নিঝুম কুঁকড়ে যেতে থাকলো ভেতরে ভেতরে।

নামাজ শেষে মোনাজাতে অনেকক্ষণ কাঁদলো। আদনানকে ভুলে যাওয়ার জন্য সাহায্য চাইলো আল্লাহর কাছে, হারামে জড়িয়ে পড়ায় মাফ চাইলো। কয়েক লোকমা ভাত মুখে গুঁজে ফাতেমার রুমের দিকে এগোলো নিঝুম।

ফাতেমার রুমের দরজায় কয়েক বার টোকা দেয়। ফাতেমা এসে দরজা খুলে দিলে ভেতরে ঢুকে বিছানায় বসে নিঝুম।
~ “জলদি তৈরি হয়ে নাও। আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে তুমি নিঝুম।”

নিঝুম হা করে তাকিয়েই থাকলো ফাতেমার দিকে। তা দেখে ফাতেমা আবারো তাগাদা দিতে আরম্ভ করলো,
~ “আরে হা করে দেখছো কী? তৈরি হতে বললাম যে?”
বাষ্পাচ্ছন্ন গলায় নিঝুম বললো,

~ “আমি কেনো যাব আপু?”
~ “তোমাকে কি আমি পাচার করে দেবো নাকি? ভয় পাচ্ছো আমাকে?”

অনবরত মাথা নাড়াতে নাড়াতে নিঝুম বললো,
~ “না না আপু তা নয়। আপনি প্লিজ রাগ করবেন না।”

~ “আমি তোমাকে আমার সাথে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু সত্যিই আমার ভাবা উচিত ছিল আমি তোমার কাছে তেমন পরিচিত কেউ নই। আমাকে বিশ্বাস করে তুমি কেনই বা এতোদূর যাবে?”

~ “আই এম সরি আপু।”
~ “তোমার কলেজ ছুটি না?”
~ “হ্যাঁ, দুই সপ্তাহ।”

~ “তাহলে আমার সাথে চলো। ভালো লাগবে। এই মুহুর্তে নিজেকে সামলানো জরুরি তোমার। যেটা বাবা মা কে সামনে রেখে হবে না।”
নিঝুম এক ছুটে রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিলো। আজকে জামার ওপর হিজাব পড়েছে নিঝুম। সাথে দুইটা জামা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে ফাতেমার কাছে চলে যায়।

দুপুর দুইটা সতের মিনিট,
বিআরটিসি বাস কাউন্টারে বসে আছে নিঝুম। ফাতেমা টিকেট নিতে গিয়েছে। নিঝুম ছাউনির নিচে একা একা বসে আছে চুপচাপ। কিন্তু দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ। কখনও কেউ জানবে না কতটা রক্তক্ষরণ হয় এই হৃদয়ে, নিঃশব্দে প্রতিনিয়ত ভেঙে চলেছে হৃদয়টা!

কে যেন বলেছিলো,
~ “বালিকার প্রথম প্রেম সর্বগ্রাসী।”
আসলেই তাই। জীবনের প্রথম প্রেম নিঝুমের জীবন, আবেগ, অনুভূতি সবকিছুকে গ্রাস করেছে।

সময়ে সময়ে মনে হয় আদনানকে বুঝি সে যতটা ভালোবাসে ঠিক ততটাই ঘৃণা করে। আর তাই তো ঘৃণাকে অতিক্রম করে বেশি বেশি ভালোবাসতে পারছে না, আবার ভালোবাসাকে অতিক্রম করে অধিক ঘৃণা করতে পারছে না।

দু’টা ত্রিশ মিনিটে বাস যাত্রা শুরু করে রংপুরের উদ্দেশ্যে। জানালার ধারের সিটে বসেছে নিঝুম। তার পাশেই ফাতেমা। এক একটা ঘর, গাছ, দোকানপাট সর্বোপরি শহরটাকেই পিছনে ফেলে সামনের দিকে নতুন এক উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলেছে বাসটি।

ঠিক তেমনি নিঝুমও এগিয়ে চলেছে নতুন এক জীবনের উদ্দেশ্যে।

আদনান বিহীন নতুন এক জীবন। এ কথাটা ভাবতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে তো তাকে ছাড়া নতুন জীবন শুরু করতে চায় নি। তাকে নিয়েই নতুন জীবন শুরু করতে চেয়েছিল।

তবে সেই পথটা ভুল ছিল। আসলেই হারামে সুখ নেই।
এই এলাকা, এই শহর তাকে বড্ড জ্বালায়। তার আবেগের শহরে যে ভাটা পড়েছে ।

ভালোবাসায় রাঙানো শহরেরই এখন ভালোবাসায় এলার্জি। “ভালোবাসা” শব্দটা এখন তার কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্যতম শব্দ।

বিরতি চাই তার জীবনে। নিজের সাথে নিজেরই চুক্তি করতে হবে তার। আদনানকে ভুলে থাকার চুক্তি। নিঝুমের কিশোরী মনে আদনান যে ভালোবাসার রং লাগিয়েছিলো সেই রং মুছে ফেলার চুক্তি।

নিঝুম বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
~ “অনুভূতি মিশ্রিত ভুল ছিলি তুই।
না পারি ভাবতে আর না পারি ভুলতে।

ভালোবাসাটা যদিও তুই শিখিয়েছিলি। ঘৃণাটা না হয় আমিই শেখাবো…!”
বাসের জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকেই ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করলো,
~ “আপু আমি পারবো তো একজন দ্বীনদার, ধার্মিক মুসলিমাহ হয়ে উঠতে?”

~ “লক্ষ্যপূরণের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান থাকলে আল্লাহর সাহায্যই তোমাকে ঘিরে রাখবে।”
নিঝুম উত্তর পেয়ে গেছে। মনের মধ্যে এক প্রশান্তি কাজ করছে।

মোবাইলে কুরআন তেলাওয়াত ডাউনলোড করে নিয়েছে আজ সকালেই। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে সূরা আর~রাহমান চালু করলো নিঝুম। চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলো কুরআন তেলাওয়াত ও অনুবাদ।

প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জার্নির পর সন্ধ্যা ছয়টায়, তারা দুজনে রংপুরে ফাতেমার বাবার বাড়িতে এসে পৌঁছায়। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেয় ফাতেমার বড় ভাই আদহাম।

বোনের পাশে অপরিচিতা মেয়েকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় সে। নিঝুমকে সাথে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে ফাতেমা।

ফাতেমা ‘মা’ বলে ডাকলে রান্নাঘর থেকে সালেহা খানম আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। অনেকদিন পর মেয়েকে দেখে বুকে টেনে নিলেন। নিঝুম সম্পর্কে জানলেন, আদর করে দিলেন।

ফাতেমা নিঝুমকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। ফাতেমার রুমে গিয়ে নিঝুম অবাক। রুমের একপাশ জুড়ে রয়েছে বইয়ের তাক। অসংখ্য ইসলামিক বই তাতে। নিঝুম খুশি হয়ে যায়। বইগুলো দেখে ভাবতে থাকে কোন বইটা আগে পড়বে সে! ফাতেমা তার মনোভাব বুঝতে পেরে নিঝুমের কাঁধে হাত রেখে বললো,
~ “আজ নয়।

আজ অনেক সময় জার্নি হয়েছে। কাল থেকে বই পড়বে। অনেক কিছু জানতে পারবে বইগুলো থেকে। খুব উপকারী বই এগুলো।”
বিনিময়ে নিঝুম মুচকি হাসে।

ইশার নামাজ আদায় করে রাতের খাবার খেয়ে ফাতেমা, নিঝুম, সালেহা খানম গল্পগুজব করলেন৷ রাত দশটা নাগাদ ফাতেমা ও নিঝুম ঘুমানোর উদ্দেশ্যে রুমে আসে।

লেখা – সাদিয়া আফরোজ মীম

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “অপ্রকাশিত ভালোবাসার গল্প – তোমাকে আজও খুজে বেড়াই” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূনঅপ্রকাশিত প্রেমের গল্প (শেষ খণ্ড) – তোমাকে আজও খুজে বেড়াই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *