জীবন থেকে নেওয়া – সত্য ঘটনা অবলম্বনে

জীবন থেকে নেওয়া – সত্য ঘটনা অবলম্বনে: রাতে দেবর বাসায় এসে রাতের খাবার শেষ করতো রাত প্রায় ১১.৩০ বাজেই। সব গুছিয়ে আমার সব ধুয়ে ঘুমাতে যেতে যেতে ১২ টা বাজে। তারপর ও যদি……


প্রথম অংশ

এশার এর আজান হচ্ছে চারদিকে। আজ কেন জানি নামায টা পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।
বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম, জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে মুখে পরছে। মাঝে মাঝে কেমন ছায়াও খেলে যাচ্ছে মুখের উপর। হাতের নিচে বালিস টা দিয়ে উপর হয়ে জানালার দিকে ফিরে তাকালাম।

আকাশে জ্বলজ্বল করছিল পূর্নিমার চাঁদ, আর জানলার পাশেই কলা গাছ টা মুখের উপর চাঁদ কে আড়াল করে ছায়ার সৃষ্টি করে চলছিলো।
আহ কতো সুন্দর এই রাত, নিজের চোখে অবলোকন করা ছাড়া বুঝা সম্ভব নয় এই স্নিগ্ধতা।
কিন্তু ক্ষানিক বাদেই এই সুন্দর রাত টাই বিষাদ মাখা সেই রাতের স্মৃতি চারণ ঘটালো মন জুড়ে স্মৃতিতে আমার দুই বছর আগের সেই অভিশপ্ত রাত।
জানিনা আর সবার কাছে তা কেমন রাত, আমার জীবনে এটা সত্যি অভিশাপ।

২৬ আগস্ট ২০১৮

দিবাগত রাত…..

কুরবানির ঈদের আমেজ এখনো কাটেনি। পাঁচ বোনে আর মা বাবা কে নিয়ে আমাদের টিনের চালের ঘর আমাদের। মধ্যবিত্ত পরিবারের আমি ছোট মেয়ে, আর চার বোনের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। বিয়ের বাকি শুধু আমি। সবে এসএসসি পাস করে কলেজ ভর্তি হয়েছি কয়েক মাস।

ঈদেরছুটি তে সব বোন এক হয়েছে বাড়িতে, ভালোই কাটছিলো দিন গুলো। হঠাৎ রাতে আমার এক দূরসম্পর্কের জেঠাতো ভাই তার মামা শশুড় বাড়ি থেকে কিছু মানুষ নিয়ে আমদের বাড়ির পাশে আসে। উদ্দেশ্য আমার জন্য তার মামাতো শালার সমন্ধ নিয়ে।

কিন্তু আমার পরিবারের কেউ আমার বিয়ে দিতে রাজি নেই, তাও জেঠাতো ভাইয়ের সম্মান রক্ষার্থে তাদের আমাদের বাড়ি আসার অনুমতি দেওয়া হয়।
যেহেতু আমাদের পরিবার থেকে এক তরফা বাধাঁ দেওয়া হয় তাই তারা নিজেদের সাথে নিয়ে আসা গাড়িতেই তাদের ছেলে কে রেখে আমাদের বাড়িতে আসে।
তাদের আপ্যায়ন শেষে জেঠাতো ভাই আমাকে একবার দেখানোর জন্য অনুরোধ করে।

যে কাপড় গায়ে ছিল সাধারণ গ্রামের মেয়েরা যেমন থ্রিপিস পরে তেমনি একটা থ্রিপিস পড়া মাথায় ঘোমটা টেনে বড় বোন আমাকে তাদের সামনে নিয়ে যায়।
তখন আমার ভিতরে কোনো ফিলিংস ছিলো না। কারণ আমার ভিতরে সম্পুর্ণ বিশ্বাস ছিলো যে বিয়ে টা হবে না।
সেখানে উপস্থিত মুরুব্বী টাইপের দুজন পুরুষ ছিলো আর প্রায় নয় দশ জন ভার্সিটি লেভেল আর এর নিচের লেভেলের ছেলে ছিলো। তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম আমাকে তাদের পছন্দ হবে।

কারণ দেখতে আমি ভালো না হলেও খারাপ না, আর আমাকে করা তাদের প্রশ্নের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলো শিক্ষা বিষয়ে। যেহেতু আমার শিক্ষা ব্যাকগ্রাউন্ড এখন পর্যন্ত ভালো তাই না করার প্রশ্নই আসেনা।
তারা আমার ছবি তুলতে চাইলে আমার বড় বোন ছবি তুলতে দেয়নি। সম্মানের সাথেই তাদের বিদায় দেওয়া হয়।
সেদিন রাতে এসব নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি। আর আমার সেই রাত টাও অন্য সব রাতের মতোই কেটে গেলো।

পরদিন সকাল বেলা হঠাৎ আমাদের বাড়িতে জেঠাতো ভাইয়ের আগমন ঘটে। তাদের মাঝে কি কথা হয়েছিলো জানিনা তবে ঘন্টা কয়েক বাদে আমার বাবা আর বড় বোনের স্বামী কে দেখলাম কোথায় যেন যাচ্ছে।

তারা গেলো সকালে ফিরতে বিকেল হলো। জানি না কিছু সময়ের মাঝে এমন কি হলো ঘরে ছোট খাটো উৎসবের মতো একটা আমেজ শুরু হলো, কিন্তু সবি আমার অগোচরে।
আমি উৎসুক হয়ে তাদের কাজ কর্মে দেখতে দেখতে বুঝতে পারলাম রাতে আমার বিয়ে। বিয়ে শেষে আমায় সাথে করেই নিয়ে যাবে। ছেলে ব্যাংকে জব করে, ভালো পজিশন ঢাকায় ফ্যামিলি সহ সেটেল।
সব চেয়ে বড় কথা তারা আমাকে বিয়ের পর পড়ালেখা করাবে।

আপনারা হয়তো ভাবছেন তখন আমার মনে অনেক রঙিন সপ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন তখন আমার মাথায় শুধু এটা ঘুরছিলো এখন বিয়ে টা হলে বুঝি মা বাবার কষ্ট টা কমে যাবে, পড়ালেখার খরচ টা কষ্ট করে আর বাবা কে জোগাড় করতে হবে না।

এখন ভাবলে হাসি পায়, কি এক মেয়ে ছিলাম আমি। নিজের জীবন নিয়ে ভাবি নি, ভাবিনি নিজের সপ্ন নিয়ে।
কোনো অনুভূতি তখন আমার ভিতর ছিলো না।

রাত তখন দুইটা পেরেয়েছে। বিয়ে টা হয়ে গেছে আর আমি আমার নতুন ঠিকানায় পাড়ি দিচ্ছি।
বিয়ের আমেজ নিয়ে দুই দিন কেটে গেলো কিন্তু এখন অব্দি আমি আমার জীবন সঙ্গির চোখের দেখা টুকুও পাইনি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এটাই বিয়ের তৃতীয় রাতেই আমি তাকে প্রথম দেখি।

যেখানে আমার বয়েস ১৬ সেখানে তার বয়েস ৩২ ছুইছুই, লম্বায় ৫.৪”, আর ওজন ৮০ হবে হয়তোবা ।
তাতে কি হয়েছে আমার আর বোন গুলোর স্বামীও এমনি।

মেনে নিলাম সব কিছুই, পরিস্থিতি আমাদের মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে দাড় করায় তখন সত্যি কে মেনে নিতে কষ্ট হয় কিনা জানি না। তবে এক মুঠো সুখ পাওয়ার আশায় মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটাতে হয়।

বিয়ের ৫ দিনের মাথায় আয়োজন চলে আমাদের বাড়িতে যাবার। আর এই বার গেলে আমার প্রথম বর্ষের পরিক্ষার কারণে বাড়িতে গেলে মাস খানেক থাকার কথা হয়েছে তার এখান থেকেই সবাই ঢাকা চলে যাবে।

সকাল হতেই নাস্তা না দিয়ে আমার শাশুড়ী হাতে ভাতের থালা নিয়ে আসে, তরকারি হিসেবে কলমি পাতা রান্না করা ছিলো। তিনি আমায় নিজ হাতেই খাইয়ে দিলেন আর বললেন,

  • শশুড় বাড়ির কথা বাপের বাড়ি বলতে নেই, আর শাকের ভাত খেয়ে বিরিয়ানির ঢেকুর দিতে হয়।

এই কয়দিনে উনি আমার সাথে তেমন কথা বলেনি। যত টুকু এখানে এসে শুনেছি আমার ভাই না থাকায় আমার ননদ আর শাশুড়ী রাজি ছিলো না এই বিয়েতে।
যাওয়ার জন্য প্রায় সময় ঘনিয়ে এলো, তখন আমার তিন শাশুড়ী অর্থাৎ শাশুড়ী, চাচি এবং জেঠি শাশুড়ী মিলে আমার হাত ধরে টেনে তাদের বড় পুকুর পাড়ে নিরিবিলি এক জায়গায় নিয়ে আসেন।

আমার জানা ছিলো না তারা কেন আমাকে এখানে এনেছেন, তাই উৎসুক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়েই থাকলাম।
হঠাৎ আমার চাচি শাশুড়ী আমার হাত ধরে বলতে শুরু করলেন,

  • “বউ মেয়েদের জীবনে প্রথম বিয়েই বিয়ে। প্রথম ডুবে যার কপাল ভিজে না হাজার ডুবেও তার কপাল শুকনোই থাকে।
    তারপর জেঠি শাশুড়ী বললেন,
  • এখন কার চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক উন্নত, তাই এসব সমস্যা কোনো সমস্যাই নয়।
    তোমার শশুড় দের বংশে এই সমস্যা টা আছে, কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যায়। তোমাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে কিছুই হয়নি তা আমারা জানি। মা তুমি এসব বাপের বাড়ি গিয়ে বইলো না। তোমার জীবন টাও শেষ আমাদের ছেলের ও একি অবস্থা। বুঝোই তো মা।
    শুধু এইটুকুই হয় কথা, তাদের কথা গুলোও আমার মাথায় নীতি বাক্যের মতো আটকে যায়।
    বাড়িতে আর এসব নিয়ে কথা হয়নি।

১ মাস পর আমার শশুড় আর দেবর আসে আমায় নিয়ে যেতে। যাই ওখানে, দিন কেটে যায়। মানুষ রুপি পশুর আসল চেহার আস্তে আস্তে আমার সাম্নে আসতে থাকে। বাঁধা আসে আমার পড়ালেখায়, নানা ধরনের মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে থাকি আমি।
আর আমার সামনে সেদিন রাতে তারাহুরো করে বিয়ের কারণ টাও পরিষ্কার হয়ে যায়।

আমার স্বামী যিনি ব্যাংকে কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নয়, সামান্য পিয়ন বটে। কিন্তু বিয়ের আগে জানা হয় তিনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। শিক্ষা নেই বললেই চলে, তাতে সমস্যা না। সমস্যা হলো আমার স্বামী আর অন্য দুজন স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়। তার ব্যবহার আর একটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের এক নয়, সামান্য কথা বলতেও তার মুখে আসে না। সাধারণ কথাও তার মাথায় ঢুকে না। একদম মায়ের কোলে ছোট্ট গজানন।

তাদের মুখে আমার একটাই দোষ, তাদের নানান কটু কথা আমি আমার বাপের বাড়ি ফোন করে সব জানিয়ে দেই। বাবা শশুড় কে জিজ্ঞাসা বাদ করে, এটাই আমার বড় দোষ।
এভাবে সাত মাস কেটে যায়, ইন্টার ইমিডিয়েট এ বিজ্ঞানের ছাত্রী কিভাবে কোনো ক্লাস ছাড়া পরিক্ষা দিয়ে পাশ করবে তা আমার জানা ছিলো না কিন্তু তাদের এটাই মতামত।
এভাবে প্রায় একবছর যায়, আমার বাড়ি যাওয়ার জন্য আমার বাবার ফোন আসে। তখন আমার শাশুড়ী আমাকে রান্না ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যায়, বলে তুমি শিক্ষিত মেয়ে তোমাকে সব ঢেলে সাজিয়ে বুঝাতে হবে না। স্বামীর উন্নতি চাইলে পড়ালেখা ছেড়ে দাও, তোমাকে তো আর চাকরি করবে না তাইনা।
আমি ওনাকে কিছুই বলিনি, শুধু বাবা কে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম।

কারণ তাদের কাছে আমি কিছুই চাইনি, শুধু এই পড়ালেখা ছাড়া।
শুরু হয় আমার জীবন যুদ্ধ, হঠাৎ একদিন বিকেলে আম্মুর ফোন আসে, ফোনে আমার মা আমাকে যা তা ব্যবহার করে।
যার কারণ হচ্ছে আমার শাশুড়ী আমার মাকে নালিশ করেছে আমি নাকি সারাক্ষণ বসে বসে মোবাইল চালাই, কোনো কাজ করিনা। আমার নাকি ১০ – ১২ টা ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে, আর আমি নাকি আমার স্বামীকে সম্মান করি না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি নাকি আমার স্বামীকে আমার শরীরে হাত দিতে দেইনা।

সকালে ফজরের আযানের সাথে ঘুম থেকে উঠে সবার জন্যে নাস্তা বানিয়ে, বাসন কোসন ধুয়ে রান্না ঘর পরিষ্কার করে এসে নাস্তা করতে হয়। কখনো খাওয়া হয় কখনো হয়না, পরিবারের ছোট মেয়েতো তাই মুখে স্বাদ মতো না হলে খাবার মুখে রোচে না। শুরু হয় রান্নার জোগাড়। ননদরা ভার্সিটি আর স্কুল মুখি হয়, স্বামী শশুড় অফিসে যায়। দেবর পরে পরে ঘুমায়, আর শাশুড়ীর ডায়াবেটিস।
রান্নার জোগার করে সবার বিছানা গোছাতে হয়, ঘর ঝাড় দিতে হয়।

তারপর আবার রান্না ঘরে ঢুকতে হয়, ৮ জন মানুষের রান্না করতে করতে দুপুর প্রায় দুইটা বেজে যায়। রান্না ঘর থেকে বের হয়ে ৪ রুমের বড় বারান্দা ওয়ালা ঘর টা মুছতে হয়।
তারপর ঘরের সব কাপড় ধুতে হয়। ভাত খেতে যেতে প্রায় ৩ টা পার হয়।
বিকেলে আর ঘুমানো হয়ে উঠে না কারণ আছরের নামায শেষে শাশুড়ী হাটতে বের হন, তিনি বাইরে যাবেন আমি ঘুমাবো এটা হয় নাকি। আমি কি এই বাসার মেয়ে নাকি, আমি তো বউ তাইনা।

এই সময় টা পার করার জন্য মোবাইল চালাতাম। আর সেটাই হয়তো আমার সারাদিনের পরিশ্রম গুলো কে মিথ্যে করে দিতো। সন্ধ্যা হলে ছোট ননদ পড়তে বসবে চা নাস্তা রেডি করতে হয়। তারপর আবার রাতের জন্য রান্না করতে হয়। এতো কিছু করার পর কারো পড়ালেখা করার শক্তি থাকে কিনা জানি না তবে আমার ছিলো না। তাই বাবার বাড়িতে নালিশ দেয় আপনার মেয়েতো এখানেই পড়ে না বাড়ি গিয়ে কি এমন করে উল্টাই ফেলবে।

রাতে দেবর বাসায় এসে রাতের খাবার শেষ করতো রাত প্রায় ১১.৩০ বাজেই। সব গুছিয়ে আমার সব ধুয়ে ঘুমাতে যেতে যেতে ১২ টা বাজে। তারপর ও যদি তিনি বলেন আমি কাজ করিনি তাহলে তো সত্যি আমি কোনো কাজি করতাম না, মোবাইলে নিয়ে পড়ে থাকতাম।


দ্বিতীয় অংশ

সেদিন আম্মুর মুখে এসব শুনার পর আমি অবাক এর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আমার শাশুড়ী এটা কিভাবে পারলেন, দোষ টা তার নিজের ছেলের হওয়ার সত্ত্বেও আমি আমার পরিবার কে না জানিয়ে তাদের ভালো করেছি। কিন্তু আজ সব আমার কাধেই এসে পড়ল। কিছুই বলিনি আমি সেদিন, শুধু স্বামী নামের পশুটির উপর থেকে সামান্য মানুষ হিসেবে যে সম্মান থাকে সেটাও উঠে গিয়েছিলো।

শুধু মাত্র পড়ালেখা ছাড়ানোর জন্য এতো বড় মিথ্যাচার কিভাবে করলেন, যিনি কিনা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তার মুখ দিয়ে কিভাবে এমন নোংরা কথা গুলো আসলো তা আমি বুঝতে পারলাম না।

আর আমার স্বামী যে কিনা কোনো কথাই বলেন না সে তার মা কে ফোনে এসব জানায় যার একটু সত্যতা ও আমি পাইনি।
এর আগে আমি আমার স্বামী কে সোজা সিদা জানলেও বুঝতে পারলাম ইনি একজন মুখোশ ধারী ভালো মানুষ।
যতো যাই হোক আমি আমার পড়ালেখা ছাড়বোনা জানিয়ে দিলাম।

অনেক ঝড় ঝাপটা সামলে বাড়ি আসলাম আমি, আমার শশুর আমাকে বাড়ি এনে দিয়ে গেছেন।
বাড়িতে গিয়ে মা বাবা কে সব বলি।
আমি যে বিয়ের এই এক বছরেও ভার্জিন সেটা বুঝতে তাদের বাকি রইলো না।

কিন্তু আম্মুর কথা দোষ টা নাকি আমার, কারণ বিয়ের পর বাড়ি আসার পর আম্মুরা আমায় জিজ্ঞাস করেছিল। আমি কিছুই বলিনি, তাদের মনেও সন্দেহ জেগেছিল।
কারণ বিয়ের মিষ্টি বিলি করতে যখন আমার চাচাতো ভাই আমার স্কুল এর প্রধান শিক্ষক এর বাড়ি গিয়েছিলেন তখন স্যার বলেছিলেন,
এই মেয়েকে অল্প বয়েসে এমন একটা অ্যাবনরমাল ছেলের সাথে বিয়ে না দিলেও পারতো।
এই কথা টা যদি প্রধান শিক্ষক না বলে অন্য কেউ বলতেন তবে হয়তো অবহেলা করা যেতো।
তাই চাচাতো ভাই এসেই বাড়িতে বলায় বাড়িতে একটা শোকের রোল পড়ে যায়।

কিন্তু আমি নিজেই বলে ছিলাম তখন সব ঠিক আছে। কারণ আমি তো তাদের বিশ্বাস করেছিলাম।
তাই বাবা মা চাইছিল বিচ্ছেদ না করে সমাধান করতে, মধ্যবিত্ত দের সব চেয়ে বড় সম্বল সম্মান। যা খোয়াতে অন্য সবার মতো আমার মা বাবাও চায়নি।
প্রথম বর্ষের পরিক্ষা শেষ, দ্বিতীয় বর্ষে পড়ালেখা শুরু।

এভাবেই সময় চলতে থাকে, রোযার কিছুদিন আগে আমার বাবা আমাকে তাদের বাসায় দিয়ে আসে।
আবার শুরু হয় অশান্তি, একটা রাত ও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি সেখানে। কিছুই বলিনি, শুধু চেয়ে দেখেছি।
বাপের বাড়ি থাকা কালিন মা রোযা রাখতে দিতেন না, একদিন থাকলে আর একদিন থাক্তে দিতেন না। শশুড় বাড়িতে এবার প্রথম রোযা, যেহেতু আগে রোযা থাকতাম না তাই এবার কষ্ট হবে এই ভেবে বাবা আমার শশুর কে বললেন আমার খেয়াল রাখতে।
আমার শশুড় বড্ড ভালো মানুষ, মেরুদণ্ড হীন পুরুষ।

ভোর রাতে উঠে সবার খাবার দিতে হতো, তারপর নিজে খেয়ে সব গুছিয়ে নামায পড়ে ঘুমাতাম।
সকালে উঠে ছোট ননদের জন্য নাস্তা বানাতে হতো। মাত্র ১৫ বছর তার, এই বয়েসে কি রোযা রাখা যায় নাকি?
ওদের কথা বাদ, ওরা তো আমার বোনের মতোই কিন্তু আমি বোন নয় আমি হচ্ছে ভাবি। ভাবি মানেই মহিলা তাই না?
বাড়িতে দেখতাম বিকেলের দিকে মা ইফতারি বানাতেন। কিন্তু এখানে নিয়ম দুপুরে সব রেডি করে রেখে গোসল করে রান্না চাপাতে হবে।
প্রথম বারের মতো টানা রোযা রাখতাম তাই খুব কষ্ট হতো।

ডাল বেটে পিঁয়াজু বানাতে হতো, তারপর একা হাতে ইফতারির সব বানাতে সন্ধ্যা হয়ে যেতো। তখন শশুর স্বামী দুজনেই বাসায় চলে আসতেন।
শাশুড়ী আমাকে সাহায্য করলে কোরান পরবে কে?
ইফতারের সময় আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে শশুড় বলতেন,
কেমন শুকিয়ে গেছো কাল থেকে রোযা থাকতে হবে না।

ব্যাস শুরু হয়ে যায় শশুড় কে কথা শুনানো। কি সুন্দর ছিলো আমার শাশুড়ির করা সেসব ব্যবহার। তারপর ও আমার দেবর বলতো, তারা আপনাকে কি করেছে। ভাত কষ্ট দিচ্ছে নাকি কাপড়ে কষ্ট দিচ্ছে আর আপনার গায়ে হাত ও তো তুলছে না তাই না?
সত্যি তো তারা আমায় কি এমন করতো?

তারা আমার গায়ে হাত তুলে নি, খাবার খেতে ও মানা করেনি। সবি তো ঠিকি আছে, আসলে আমি অনেক মিথ্যাবাদি, তাই না?
শাশুড়ী কে বলেছিলাম, আম্মু ইফতারির সাথে রাতের রান্না টাও করে ফেলি? ইফতারের পর আর চুলায় যেতে ইচ্চেহ করেনা।
ব্যাস শুরু হয়ে গেলো, আমি নাকি দু- দিন ইফতারি বানিয়েই তাকে খোটা দিচ্ছি। আর ইঙ্গিতে তাকে রান্না ঘরে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি।
যাক গেলো সেসব, ইফতারের পর আবার রান্না করে তাদের খাবার দিতে হতো, তখন আর নিজের খাওয়ার ইচ্চেহ থাকতো না। তারাবির নামাজ পরার সময় শরীরের কম্পন টের পেতাম।

এভাবেই চলতে থাকে, রোজ রাতে অশান্তি শুরু হতো, শশুড় বাসায় এলে শাশুড়ী বলতেন সারা দিন শাশুড়ী খেটে মরেন, আমি নাকি তারপর ও জোর গলায় কথা বলতে ছাড়ি না।
আসলেই ইদানীং আমার গলার আওয়াজ বেরে গেছে, খেয়াল করিনি।

এর মাঝে একদিন আমার জেঠি শাশুড়ী আমার শশুর কে ফোন দিয়ে আমার উপর এসব অত্যাচারের কথা জিজ্ঞাস করেন, কারণ আমার বাবা তাদের জানিয়েছেন।
শুরু হয় নতুন করে অশান্তি, যেদিন রাতে আমার জেঠি শাশুড়ী ফোন করেছেন সেদিন ঝগড়া টা প্রচুর বেড়ে যায়।
কারণ জেঠী শাশুড়ী বলেছিলেন,

আমার ননদের কারণেই নাকি সব অশান্তি হচ্ছে। ব্যাস, তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে আমার ননদ আর শাশুড়ী।
রাতের ১১ টা পেরিয়ে যায় চিল্লাচিল্লি থামে না।

আমার মাথায় কি আসে জানি না আমি আমার ফোনে রেকর্ড চালু করে ফ্রিজের উপর রেখে দেই।
কারণ আমার শাশুড়ী ননদ এসব অস্বীকার করতে সময় নিবে না। আর তাদের ভালো মানুষি চেহারা দেখে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, তাই আমার চাই প্রমাণ।
যেখানে আমার শাশুড়ী আর ননদের সব কথা রেকর্ড হয়ে যায়।
সেখানে আমার বলা কথাও ছিলো,

আমি ননদ কে বলেছিলাম আপু আপনার চাইছেন আমি চলে যাই এইতো। আচ্ছা আমি চলে যাবো, আপনারা আপনার ভাই কে নিয়ে থাকিয়েন।
কথা টা আমি বলেছিলাম ঠিকি কিন্তু ননদ আমার শশুড় কে বলে আমি নাকি তার ভাইয়ের সাথে তাকে খারাপ ভাবে ইঙ্গিত করেছি, নাউজুবিল্লাহ।
আমার ননদ আমার থেকে প্রায় ৬- ৭ বছরের বড় হবে, তিনি আমায় তখন অভিশাপ দেন।
আমি নাকি কোনো দিন মা হতে পারবো না, আর দশ দুয়ারে ঘুরে ঘুরে আমার মরণ হবে।

তারা আমায় খুব বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে, আমি নাকি তাদের ছেলে কে নিয়ে আলাদা বাসায় যাওয়ার জন্য নিজে থেকে এসব করছি।
যেখানে তাদের ছেলের সাথে নামকা অবস্থায় স্বামী এই সম্পর্ক ছাড়া প্রেম ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই সেখানে তাদের ছেলেকে নিয়ে আমি আলাদা কেন থাকবো বলেন।
এভাবেই দিন অতিবাহিত হয়, এর মাঝে আমার বাবার বাড়ি থেকে তাদের জন্য ইফতারি আর ঈদের কাপড় আসে। সবি তাদের মন মতো হয়েছিলো, কারণ মধ্যবিত্ত দের সম্মান টা এভারেস্ট কে পিছে ফেলবে।

রোযার শেষের দিকে একদিন বিকেলে আমি আমার বড় ননদ কে বলি,
আপু রোযা রেখে বিকেলে ডাল বেটে মশলা বাটার শক্তি পাইনা। আপনি একটু কষ্ট করে ব্লেন্ডার করে দিবেন।
তার কড়া জবাব, রোযা রেখে তিনি ক্লান্ত, ব্লেন্ডার করতে পারবেন না।
আসলেই তো আমি বোকা, রোযা রেখে কিভাবে ব্লেন্ডার করবেন তিনি।

যাক এভাবেই দিন গুলো কেটে গেলো। ঈদের দুদিন আগে তারা তাদের গ্রামের বাড়ি ঈদ করতে যাবেন।
আমার বাবা আমাকে ফোন করে বলেন তাদের না জানিয়ে আমি যেনো কাপড় বেশি করে আনি। কারণ এবার বাড়ি গেলে আমায় ২ য় বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া আসতে দিবেন না।

আমিও কাপড় বেশি করেই নিয়েছিলাম, কাপড় বলতে কি বিয়ের পর গজ কাপড় দিয়ে ৪ টা কামিজ বানিয়ে দিয়েছিল, যার সাথে না ছিলো ওড়না না ছিলো সেলোয়ার।
এবার আমার এই বাড়িতে প্রথম ঈদ, তাই আমার ননদ কে দিয়ে আমার জন্য একটা শাড়ি আনিয়ে দিয়েছেন আমার স্বামী।
প্রতিটি মেয়ের ইচ্ছে থাকে বিয়ের পর স্বামীর হাত থেকে কিছু পেতে কিন্তু আমার ভাগ্যে তা হলো কই, কারণ আমার স্বামীর নিজের কাপড় গুলোও বোন কিনে আনে। সে নিজে নিজের কিছুই করতে পারেনা, এমনকি সে কোন দিন কোন জামা পরবে তাও বোন বলে দিতে হয়।

ঈদে বাড়ি গিয়ে থেকে গেলাম, এটা নিয়ে আমার শাশুড়ি এক তরফা ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছেন।

বাপের বাড়িতে দিন গুলো বিয়ের আগের দিন গুলোর মতোই কাটতে লাগলো, কারণ যিনি আমার স্বামী তিনি সপ্তাহে একবার আমাকে ফোন দেয় কিনা সন্দেহ আছে।
সবাই বলে আমার কপাল ভালো, অনেক বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। আমিও মুখ ভরা হাসি দিতাম, এই ছাড়া আর কি বা করার ছিলো আমার।
পরীক্ষা কাছে এসে যায়, হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় আমার মায়ের রুম থেকে চিল্লাচিল্লি শুনা যায়।

আমাকে নিয়ে যা তা, আমার শাশুড়ী আমার মা কে কি বলেছে জানিনা তবে বলেছে এমন মেয়ে জন্ম দেওয়া আম্মুর জন্য লজ্জাজনক।
তাই আম্মু নানান কথা শুনাচ্ছে আমায়। আমি কিছুই বলিনি কারণ আমার আম্মু জানি আমি চুপ করে থাকি না, প্রতিবাদ করি। কিন্তু আমার মা জানতো না যে প্রতিটি মেয়ের চঞ্চলতা গুলো তার বাবা মায়ের কাছেই সীমাবদ্ধ।

অবশ্য আমার মায়ের কোনো দোষ ছিলো না, আমার মা খুব সহজ সরল প্রকৃতির মহিলা। অপরিচিত কেউ এসে যদি কিছু বলেন তিনি তা বিশ্বাস করে নেন, আর নিজের সব কষ্ট বলে হাল্কা হয়ে যেতে চান।
তাই তো এতো নরম হৃদয় নিয়ে বারবার তাকে আঘাত পেতে হয়।

আর আমার শাশুড়ী ননদরা এতোই ভালো মানুষ যে খুব সহজে আপনাকে আপন করে নিবে, তাদের কথা শুনে আপনিও যে কিনা আমায় এই মুহুর্তে ভালো বলছেন তার ও মত পাল্টাতে বেশি সময় লাগবে না।

সেখানে আমার মা বিশ্বাস করবেই না কেন?
আম্মুর কথা গুলো এমন পর্যায়ে যায় আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
কারণ যে মায়ের কাছে আমি চোখের মণি সে মা আজ আমার জন্যে চোখের পানি ঝরাচ্ছে।
হঠাৎ আমার সে রাতের রেকর্ড এর কথা মনে পরে যায়, আমি কিছু না বলে রেকর্ড টা আমার মায়ের কাছে নিয়ে দেই। আমার মা ঘন্টা ৩ ঘন্টার সেই রেকর্ড শুনে আর স্থির থাকতে পারলেন না।

সাথে সাথে শাশুড়ীর ফোনে কল করে আম্মুকে করা অপমানের প্রতি উত্তর করে। কারণ আম্মু জেনে গেছে আমার কোনো দোষ ছিলো না।


তৃতীয় অংশ (শেষ অংশ)

আম্মু কথার এক পর্যায়ে আমার শাশুড়ী বললেন,

  • আপনি বুঝি নিজের মেয়ের কথাই বিশ্বাস করলেন?
    আম্মু তখন প্রতি উত্তর এ রেকর্ড এর কথা বলে দেন।
    ব্যাস শুরু হয় নতুন অশান্তি।

তবে আমার মা কে কেন আমি আদর্শ মা বলি জানেন?
কারণ আমার মা কখনো আমার ননদ দের দোষ নিয়ে কিছুই বলেননি। তিনি বলেন আমার কাছেও মেয়ে আছে, কেন আমি অন্যের মেয়ের ব্যাপারে কিছু বলবো। মেয়েরা দোষ করলে শুধরানোর দায়িত্ব আমাদেরি।
হয়তো সেদিন আমার মায়ের উপর আমার ক্ষোভ প্রকাশ পেতে পারতো, কিন্তু সেদিনের পর থেকে মায়ের প্রতি সম্মান টা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
এর পরের দিন গুলোতে আমার স্বামী যতবার আমাকে কল করেছিলেন ততবারই তার কল রেকর্ডার চালু ছিল।

সে এটা জানেনা যে তিনি কল রেকর্ডার চালু রাখলে তার বিপরিতে যে আছে সে সহজেই বুঝতে পারে।
দেখতে দেখতে কুরবানির ঈদ চলে আসে।
বিয়ের পর আমার প্রথম কুরবানির ঈদ। নিয়ম অনুযায়ী গরু- ছাগল পাঠাতে হবে মেয়ের শশুর বাড়িতে, কি বলেন?

আমার বাবা মায়ের কাছে তো আর বিদেশি বা সরকারি চাকরি করে এমন ছেলে নেই, তাই ১৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলেন আমার শশুর বাড়িতে।
প্রতিবার ঈদে আমার স্বামীর পরিবার বাড়িতে ঈদ করলেও এবার তারা আসবেন না। কারণ তারা সেখানে গেলে আমিও যাবো, আর আমি যদি সেখানে কাওকে রেকর্ড গুলো শুনাই তাহলে তো মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে।

কারণ গ্রামে আমার শশুর দের বিরাট নাম ডাক।
সে হিসেবে আমার শাশুড়ী কেও মানুষ ভালোই জানে। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, ঢাকায় থাকেন।

আর ঈদে আমার চাচি শাশুড়ী জেঠি শাশুড়ী ওনারাও সপরিবারে আসবেন। তাই আমার শাশুড়ীর মনে ভয় জাগেন, তিনি তাই বাড়ি আসেন নাই।
কুরবানির অনেক আগেই আমার পরিক্ষা শেষ, আমার স্বামী কে আমাদের বাড়ি এসে আমাকে নিয়ে যেতে বলায় তিনি না করে দেন। তিনি বলেন আমি নাকি একা চলে যেতাম।
কারণ তারা জানে বিয়ের পর কোনো ঈদে মেয়েরা বাপের বাড়ি থাকলে সমাজে নানান ভাবে অপদস্ত হতে হয়।
তার পর ও আমার মা বাবা আমাকে একা পাঠাতে রাজি হন নাই।

ঈদের আগের দিন বিকেল বেলায় হঠাৎ আমার শশুর ফোন করে জানায় তিনি বাড়ি আসছেন, আর ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় আমাকে নিয়েই বাড়ি যাবেন।
এতোক্ষণ কেমন অস্থির লাগলেও খবর টা শুনার পর ভালোই লাগছিল।
এর পর পরি আমার স্বামী কল দেয়, আমি তাকে বাড়ি যাওয়ার কথা জানাই। কিন্তু সে মানা করে আমি যেন তাদের বাড়ি না যাই।
আমার শশুর ও মত পাল্টান তিনি একাই যাবেন আমাকে নিবেন না।

ব্যাস এবার ঈদ টা বাড়িতেই করতে হবে। সকালে কুরবানির ঈদ, ঘুমাতে প্রায় ১১ টা বেজে গেলো। হঠাৎ মাঝ রাতে গাড়ির আওয়াজ শুনতে পাই, আমার শশুর আর জেঠাতো দেবর এসেছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

গেলাম, ঈদ করলাম, আবার বাড়ি ফিরে আসলাম। আমার স্বামী আর শাশুড়ী জেনে গেছেন, তার অনেক চিল্লাচিল্লি করেছেন। আমার শশুর ঢাকায় চলে গেলেন। হঠাৎ এর মাঝে একদিন শুনি আমার জেঠী শাশুড়ী নাকি রেকর্ড শুনেছেন, কিন্তু আমি শুনাই নি।

পরে জানতে পারি জেঠাতো দেবর আমার অগোচরে আমার ফোন থেকে রেকর্ড গুলো নিয়েছিলেন।
আমার পরিক্ষার আর ৩ মাস আছে। আমার শশুর এসে আমায় ঢাকা নিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বই নিয়ে যাইনি, কারণ সেখানে আমার পড়ালেখা হবে না। সাথে ৮ টা প্রেক্টিক্যাল নিয়ে গেলাম।
বাসায় গিয়ে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যায়, সন্ধ্যার পর থেকে আবার শুরু হয় চিল্লাচিল্লি।
আমাকে চুপচাপ দেখে শাশুড়ী রুমে এসে উঁকি দিয়ে যান, যা দেখে এমন পরিস্থিতিতেও আমি হেসেছিলাম।
ভাবছেন পুরো গল্পেই নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে চাইছি?

মোটেও আমি ভালো নই, আমাকে আপনি যা বলবেন আমি মেনে নিব। কিন্তু আমার পরিবারের ব্যাপারে কিছু বলবেন তো দুকথা শুনাতে আপনাকেও আমি ছাড়বো না।
আপনি যেই হোন না কেন, আমার বাপ কেও আমি উচিৎ কথা বলতে ছাড়ি না।
সেখানে আপনি কোথাকার কে?
এভাবে প্রতি রাতে ঝগড়া চলতেই থাকে, যেই মেয়ে আমি রাতে খাওয়া ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না সে এখন রাতে খাই কিনা সন্দেহ আছে।
এক রাতে আমি আমার শাশুড়ী কে বলেছিলাম,

আপনারা কি রোজ রাতে আমি না খাওয়ার জন্যি এসব শুরু করেন নাকি। সোজা সাপটা বলে দিলেই পারেন।
ব্যাস আগুনে ঘি ঢেলে দিলাম।

আমি আবার বেশিক্ষন কথা না বলে থাকতে পারিনা। এতো বড় বাসায় তারা সবাই একে অপরের সাথে কথা বলবেন, কিন্তু আমি কিভাবে চুপচাপ থাকবো।
তার উপর আমি গ্রামের মেয়ে বাসা বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসে, যখন দেখি ছোট ননদ স্কুলে যাচ্ছে তখন বুক ফেটে কান্না আসতো। তাই প্রতিবার ঝগড়ার পরে আমি নিজে গিয়েই ননদ আর শাশুড়ীর সাথে কথা বলতাম। তাই আমার নাম দিয়েছিল গিরগিটির চেয়েও অধম। ছোট ননদের চুলে নানা রকম বিনুনি করে দিতাম, চুলে তেল লাগিয়ে দিতাম, ইউটিউব ভিডিও দেখে নানা ধরনের নাস্তা বানিয়ে দিতাম।

ছোট বোনের মতো আদর করতে চাইতাম, বিনিময়ে পেয়েছি খুব সুন্দর উপাধি।

আর আমার দেবর বলেছিলেন,
আমি নাকি সমস্ত মেয়ে জাতির কলংক।
সেদিন শুধু হেসেছিলাম, আর তারা বলেছিল আমার মুখের হাসি নাকি বেশিদিন থাকবে না।
কিন্তু তারা জানেনা শত কষ্টের মাঝেও আমি হাসতে ভুলি না।
এই বাসায় শশুর আর দেবর এই দুজনকেই আমার আদর্শ মানুষ মনে হতো। কিন্তু আমার ধারণা পাল্টাতে দেরি হয়নি।
ঈদে আমি শশুর বাড়িতে গিয়ে জেঠি শাশুড়ীদের ফোনে শুনতে পাই আমার দেবর আমাকে গালি দিচ্ছেন আর তুইতুকারি করছেন।
তারপর ও তারা যদি আমায় গিরগিটির চেয়ে অধম বলেন, তাহলে সত্যি আমি গিরগিটির চেয়ে অধম আর নারী জাতির কলংক।
শাশুড়ী কে আমি আম্মু ডাকতাম, তাই তিনি আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন।

তাদের হাসাহাসির জবাবে আমি বলেছিলাম,
নিজের মা আর শাশুড়ীর মাঝে তফাৎ কি?
আসলে তফাৎ টা আমি সেদিন বুঝিনি, বুঝেছিলাম আরও দেরিতে।
পিরিয়ড এর সময় টা মেয়েদের কেমন কাটে তা পুরুষ দের বোঝা সম্ভব না হলেও একজন নারী সেটা খুব সহজে বুঝতে পারেন।
তার উপর সব নারীর একই রকম অনুভূতি হয়না। কারো আছে অনেক ব্যাথা অনুভব হয়, যা সহ্য শক্তি সবার থাকেনা।
ঠিক এমনি ব্যাথা আমার অনুভব হতো।

পিরিয়ড এর একদিন আমি ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলাম। এর গে বাড়িতে এমন হলে মা গরম সেক দেওয়া, গরম পানি খাওয়ানো, ওষুধ খাওয়ানো সবি করতেন। কিন্তু সেদিন আমার শাশুড়ী আমাকে কাদতে দেখেও ফিরে তাকাননি। খাটের উপর গিয়ে সটান শুয়ে পরেছিলেন।
এমন ব্যাথা নিয়েও আমায় তাদের জন্য, রান্না করা, ঘর মোছা, কাপড় ধোঁয়া সবই করতে হয়েছিল।
সেদিন বুঝেছিলাম শাশুড়ী মা হলেও এক চোখ তার অন্ধই থাকবে।

ভালো ভালো শাশুড়ী গুলো তো সব গল্পেই বন্ধি, বাস্তবে তাদের দেখা মেলে কোথায়।
একদিন ঘর পরিষ্কার করার সময় পানির ফিল্টারের সাথে একটা বোতল দেখতে পাই। পানির বোতল হলে হয়তো সন্দেহ জাগতো না। বোতল টা ছিলো 7up এর, আর তার ভিতরে ছিল গোলাপি রঙের পানি। 7up তো আর গোলাপি রঙের হয়না, তাই ছোট ননদ কে জিজ্ঞাসা করলাম যে বোতল টা কিসের। সে আমাকে কিছুই না বলে ছোঁ মেরে হাত থেকে বোতল টা নিয়ে যায়।
তখন সন্দেহ টার সত্যতা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি আমার শাশুড়ীর কাছে গিয়ে বলি,

জানেন আম্মু ছোট বেলা থেকেই মা যদি কোন তাবিজ আমাকে লাগাতেন তা আমি লুকিয়ে ফেলে দিতাম। কারণ আমি তাবিজ, পানি পড়া এসবে বিশ্বাস করিনা তাই এসব আমায় কাজও করেনা।
তিনি সেদিন আমায় কিছু বলার মুখ পাননি, হিংস্র দৃষ্টিতে শুধু চেয়েছিলেন।
অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলে দিন দিন। আমার স্বামী আমার গায়ে হাত ও তুলে, তুই তুকারিও করে। তবে আমি নিজের অভ্যাস বদলে ফেলি, এখন আর হুটহাট বাবাকে কল দিয়ে বলিনা। নিজের কষ্ট নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখি।

এর মাঝে আমার বড় বোনের বাসায় গিয়ে আমার স্বামী নালিশ করে আসে আমার নামে, আমার বোন ও আমাকে যা তা বলে। যার দরুন আজও আমি আমার বোনের সাথে কথা বলিনা, থাক না ভালো আপন মানুষ গুলো।
ভুল গুলো না ভাঙাই থেকে গেলো।
আবার যুদ্ধ করে বাড়ি ফিরে আসি।
আমার শশুর এনে দিয়ে গেছেন, কারণ আমার স্বামী আর কোনো দিন এদিকে আসবেন না।

তার যথার্থ কারণ আছে, আসলে তাদের তো কোনো ধরা বাধা নেই। কারণ আমার কাবিন হয়নি। ১৮ বছর পুর্ণ না হওয়ায় কাবিন টা অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো, যার কারণে তাদের মনে এতো ফুর্তি। এখন আমি ভালোই আছি, ডিভোর্স টা এখনো হয়নি। কারণ মা বাবা সমাধান চায়, তারা তাদের সম্মান বাচাতে ব্যাস্ত। আমার মন দেখার সময় তাদের কই?
আমি তাদের বলেছি, তারা যা চায় আমি তাই করবো। কারণ আমি জানি আমার মা বাবা কতো কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে, তাদের সুখি আমার সুখ। কেউ কেউ আমার মা বাবা কে লোভী বলতে পারেন, হুম তারা লোভী।

তার মেয়েদের সুখের লোভ করেন। যার ঘরে ৫ মেয়ে আছে সে জানে তার প্রতি টি রাত কিভাবে কাটে। চারপাশের শকুনদের হাত থেকে কতটা যুদ্ধ করে মেয়েদের রক্ষা করতে হয়, তাদের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। ছেলে জন্ম না দেওয়া যে কতবড় পাপ তা এই সমাজের মানুষ গুলো পদেপদে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আমাদের সমাজ টা পঁচে গন্ধ ছড়াচ্ছে, যা সবার নাকে লাগে কিনা আমার জানা নেই। তবে নিত্যদিন সেই বিশ্রী গন্ধে আমি ঘুমাতে পারি না।
সেদিন আমার চাচা আমায় বলেছিলেন, তুই যদি ভালোই হতি তাহলে কি স্বামীর বাড়ি রেখে বাপের বাড়ি এসে পড়ে থাকতি নাকি।
আসলেই তো, ছোট বেলা থেকে জেনে এসেছি বাবা আর চাচা নাকি একি কথা।

তো আমার চাচা মিথ্যা কেন বলবে, আসলে তো আমি ভালো না।
ভালো মানুষের সাথে ভালোই হয়, আমি ভালো নই তাই আমার ভাগ্যে এসব ছিলো।
আমি এই কুৎসিত সমাজের কাছে খারাপ হয়ে থাকতে চাই। যে সমাজ নারী কে সম্মান দিতে জানেনা, যে সমাজের আনাচে- কানাচে আছে নারীর জন্য নির্মমতা। সেই সমাজ আমায় ভালো না বললে আমার গায়ের পশম ঝরে পরবে না সেটা আমি নিশ্চিত
এইটুকু জীবনে কতো কিছুই না দেখেছি, তাও ক্লান্ততা আমাকে ছুঁতে পারেনি।
আমি বাঁচার চেষ্টায় আকুল হয়ে আছি, না আর এসব নির্মমতা সইবো না।

খারাপ যখন হয়েছি, খারাপ হয়েই থাকব।
জীবনে অনেক প্রতারক এসেছে, দুদিন হাত ধরতে চেয়েছে, কিন্তু তারা জানেনা আমার ভিতর টা না পাওয়ায় খা খা করছে। দুদিনের ভালো থাকা আমায় তৃপ্ত করতে পারবে না, সারাজীবনের জন্য ভালো থাকা চাই।

যদি এটা কোনো গল্প হতো তবে হয়তো গল্পের সেই সুপুরুষ এসে আমার দুই হাত ধরে বলতো তুমি যেমনি হোক দুনিয়ার সবার থেকে আড়াল করে আমি তোমায় সুখের রাজ্যে নিয়ে যাবো।
আর গল্প পাঠকের মুখে তার জয়ধ্বনি শুনতে পেতাম।
কিন্তু আপসোস, এটা গল্প নয় সত্যি এক ঝরে যাওয়া ফুলের অকথিত ব্যাথার কথা।

সেসব অতীত, যা আর বর্তমান হতে পারবে না। আমি নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা দাবি করি, কারণ অতিত আমার মনে দাগ কাটতে পারেনা। আমি আমার না পাওয়া গুলো কল্পনায় খুঁজে নেই, তাই আমার ভিতরে না পাওয়ার আপসোস নেই।

শুধু আপসোস, যে বিশ্বস্ততার দুটো হাতের আশায় জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করবো তা আমার না পাওয়াই থেকে যাবে। কারণ এই সমাজে আমার স্থান হবে ডিভোর্সি হিসেবে।
তাই নিজের ভুবন টা একার হাতেই সাজাবো, যেখানে না হয় আমি গিরগিটি হয়েই থাকলাম।

না, আজ আর নয়। অন্য কোনো দিন এসে জীবনের সাফল্যের কথা শুনিয়ে যাবো, আজ না হয় ব্যার্থতায় সীমাবদ্ধ থাক।
নামাজ টা পড়ে নেওয়া উচিৎ এইবার, নতুন করে সব শুরু হোক পরিপূর্ণতা দিয়ে।

নাইবা হউক আমার শুরু টা মঙ্গল জনক, শেষ টা না হয় নিজের হাতে সাজিয়ে নিবো।

আমি ভালো আছি, ভালো থাকবো। মা বাবার ছায়ায় বেশ কেটে যাচ্ছে দিন গুলো। আমি চাই প্রতি টা মেয়ে ভালো থাক, কারো সাহায্য নিয়ে নয়। কারণ এই সমাজ নারী কে সাহায্য করার যোগ্য নয়, নিজেকে নিজে সাহায্য করার যোগ্যতা হাসিল করতে হবে তাকে।

এক টুকরো ভালোবাসা আঁকড়ে ধরতে তাকে হতে হবে হিংস্র। হোক না তারা নারী জাতির কলংক, তুবুও ভালো থাক তারা নিজের প্রত্যয়ে।

লেখিকা – মেহেরিকা সুলতানা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “জীবন থেকে নেওয়া – সত্য ঘটনা অবলম্বনে”গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – বৃষ্টি – ভালোবাসার ছোট গল্প fb

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *