সেদিন চলে গেছিলে কেন?মন ভেঙে ছিলে ঠিক আছে, কিন্তু দোষটা বলোনি কেন চলে যাবার আগে?
ঠিক ১১ বছর পর দেখা হয় আন্নি আর আনিক এর। উপরের কথা গুলো আন্নি আনিককে জিজ্ঞেস করে। আন্নির প্রশ্নে আনিক চুপ হয়ে আছে, নিচের দিকে তাকিয়ে কয়েক ফোটা পানি মাটিতে ফেললো।
আন্নি সেই আগের মতো আছে, আন্নির সেই মাটির ঘরটি এখনো রয়েছে। মা বাবা ছাড়া সেই আন্নি এখনো বেঁচে আছে, রেখেছে নিজেকে পবিত্র। মাটির ঘরটায় এখনো খোদাই করা আনিকের নামটা আছে। আনিক একটু সময় চুপ থেকে আন্নির হাতটি ধরতে চাইলো।
আন্নি নিজের হাতটি সরিয়ে নেয়, আর পাশে থাকা দা টা হাতে নেয়। আর বলে,
১১বছর ধরেই নিজেকে এভাবেই বাঁচিয়ে রাখছি, কোনো পুরুষ আমার শরীর স্পর্শ করেনি। আমার জন্মদাতা বাবা ছাড়া আর কোনো
পুরুষের স্পর্শ আমার শরীরে নাই, বাবার স্পর্শ এখনো চাই, কিন্তু বাবা তো আর পৃথিবীতে নাই।
আন্নির কথায় একটু অবাক হয়ে আনিক দুই পা পিছায়। আর আন্নিকে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। ভাঙা গলায় বললো, “তোমার স্বামী কোথায়? “
আনিকের প্রশ্নে আন্নি মুচকি হেসে বললো, যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে তো আমার হয়নি, তাই আর পুরুষ জাতিকে নিজের জীবনের সাথে এক করি নি।
আন্নির কথায় আনিক অবাক হয় নি, আনিক তো সত্যিই অপরাধী।
আমায় ছেড়ে গেলে কেন, বললে না যে?
আন্নির প্রশ্নে আবারো আনিক চুপ। আন্নি এবার মুচকি হেসে বললো, তোমার স্ত্রী সন্তান কোথায়?
আনিক মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝালো। আন্নিও আনিকের মাথা নাড়ানো বুঝতে পারে। এই মানুষটাই তো তার ভালোবাসা ছিলো, চোখ বন্ধ করে বলতে পারবে, আনিক এই পর্যন্ত তার শরীর স্পর্শ করেনি।
আন্নি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, শরীরের এই হাল কেন?তোমার রূপে আগের মতো উজ্জ্বলতা নাই।
আনিক একটু আস্তেই বললো,বয়স আমার ৩৫ হয়েছে, কীভাবে উজ্জ্বলতা থাকবে বলো?
আন্নি বসা থেকে উঠে ঘরের ভিতরে যায়,টিনের গ্লাসে করে আনিকের জন্য পানি এনে মাটিতে রাখে, আর আনিককে উদ্দেশ্য করে বলে।
এমন দিন আসলে, যে দিন আমার ঘরে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই তোমাকে এই পানিই দিলাম।
আনিক পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে সব পানি পান করে নেয়।
আন্নির দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে ছোট্ট করে প্রশ্ন করে আনিক।
এতো বছর ধরে একা চলছো কীভাবে?
আল্লাহ যেভাবে রেখেছেন। আল্লাহ চাইলে সব পারেন,বাবার অল্প জায়গাজমি বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়েই এই ১১বছর কাটিয়ে ফেলছি।
আনিকের কথার প্রতি উত্তরে আন্নি এই কথাগুলো বলে।
আনিক আবার চুপ, পেটের মধ্যে অনেক কথা, কিন্তু কণ্ঠে আসছে না সেই কথা গুলো।
বয়স তো এখনো ত্রিশ হয় নি! জায়গাজমিও তো নেই, এই বাড়িটা ছাড়া।
আনিকের কথা শুনে আন্নি ছোট্ট করে ঠোঁট নাড়ালো, “তো? “
বাকিটা জীবন কী এই জায়গা দিয়ে চলে যাবে?
আনিকের প্রশ্নে আন্নি মুচকি হেসে বললো।
এই জায়গা আমি বিক্রি করবো না, বাবা মার শেষ স্মৃতি। আমার কাছে যা টাকা আছে, তা দিয়ে দুইদিনের বেশি খরচ আমার ভাগ্যে জুটবে না। দুইদিন পর না খেয়ে থাকতে হবে, খাবার না খেয়েও মানুষ ৩ বা ৪ দিন বাঁচতে পারে। তার পর না হয় মৃত্যুর সাগড়ে ডোব দিবো।
আন্নির কথা গুলো শুনে আনিকের চোখ থেকে ঝর্ণার পানির মতোপানি মাটিতে পরতে থাকে।
আন্নি একটু জোরেই বললো,
আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পাইনি এখনো?
আনিক নিজের চোখের পানি মুছে বললো,
বিয়ে করবে আমায়?আমার উপরে থাকা অভিমান গুলো ভেঙে দিয়ে আপন করবে আমায়?
আন্নি একটু রেগেই বললো, আমিও তোমায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি?
আনিক একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,
শুনে কষ্ট পাবে না তো?
আন্নি এবার অট্টহাসি দিয়ে বললো, ১১বছরের কষ্ট তো তোমার কাছে কষ্ট মনে হয় নি?এই ১১ বছরে যে কষ্ট পেয়েছি, তা নিশ্চয় তোমার কথা শোনার পরে যে কষ্ট হবে তা মোচন হয়ে যাবে।
অপেক্ষায় ছিলাম এতোদিন নিজের ভুলটা শোনার জন্য! নিরদ্বিধায় বলতে পারো, একটুও কষ্ট হবে না আমার।
আন্নির অভিমানে বলা কথায় আনিক ভয় পেয়ে যায়।
আমার দোষ ছিলো না আন্নি! মা বাবা বাধ্য করেছেন আমায়, শুধু মা বাবা না, আমার সব আপনজন আমায় বাধ্য করেছেন।
কী?
তোমার সাথে সম্পর্ক রাখা।
কেন, সেটা তো বলবে?
তোমার মা বাবা বা কোনো ভাই ছিলো না বলে৷ সবাই বলেছিলো, বিয়ের পর বাচ্চা হলে মামা কাকে ডাকবে?লোকে বলবে, তোদের মামা নাই।
আনিকের কথা শুনে আন্নি খুব অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে।একটু সময় পর আন্নি নিজের চোখ মুছে বললো,
এই দোষের জন্য আমায় ছেড়ে গিয়েছিলে?
আনিক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।
আন্নি মুচকি হেসে বললো।
কথাটা শুনে আমার একটুও কষ্ট হয়নি, ভাগ্যিস মা বাবা বেঁচে নেই! নয়তো তোমার মুখের এই কথা শুনে নিজেদেরকে খুব অপরাধী ভাবতেন, আমার হাত জোর করে বলতেন, মা রে তোকে একটা ভাই দিতে পারিনি বলে আজ তোর বিয়ে হচ্ছে না!
আন্নির কথা শুনে আনিক কিছুই বলতে পারলো না। আন্নি আবার বললো,
তুমি আমায় বিয়ে করতে, আমার ভাইকে না। আমার ভাই নাই মানলাম, কিন্তু বাবার বাড়ি তো ছিলো। ভাই থাকলেও ভাইয়ের বউ কিন্তু ভালো হয় না সবার, কই তখন কীসেই ভাইয়ের কোনো মূল্য থাকে?
আন্নির প্রশ্নে আবারো চুপ আনিক।
আন্নি আবার বললো,
শেয়াল দেখেছো?শেয়ালের কণ্ঠ খুব সুন্দর। কিন্তু কেউ শেয়ালের কাছে ভুলেও যায় না, কারণ শেয়াল খুব ভয়ংকর।তেমনি, ভাই ভাল হলেও, ভাইয়ের বউ যে ভালো হয়, সেটা কখনো সত্য নয়।
আন্নির কথায় এবার আনিক বললো,
দেখো আন্নি! আমি জানি আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু দেখো?বাবা মা আমায় কখনো বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারেনি।
আমি তোমাকে বিয়ে করবো বলে আজো কোনো নারীকে গ্রহণ করিনি। বাবা মরেছেন অনেক আগেই, মা মরলেন কিছুদিন হল।
দেখো আমি ঠিক তোমার খুঁজে এসেছি। ভাগ্য দেখো তুমি সেই আগের মতো রয়েছো। ফিরিয়ে দিয়ো না আমায় আন্নি!
আনিকের কথা শুনে আন্নি গভীর ভাবে তাকায়,আনিক মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আন্নি কিছুক্ষণ ভেবে তারপর বলে।
হয়তো তোমার কাছের মানুষের জন্য আমায় এতোটা কষ্ট দিয়েছো।
আমি চাইলে আজ তোমারো দোষ না থাকা সত্যেও তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারি। যেভাবে তুমি আমার থেকে নিজের চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে। কিন্তু আমি তা কিছুই করবো না। আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম, বিশ্বাস ছিলো মরার পূর্বেও না হয় একবার দেখবো।
আনিক আন্নির কাছে হেরে যায়, আন্নির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আনিক বললো,
আন্নি সত্যিই তুমি ঠিক আগের মতোই রয়েছো। তোমার কাছে আমি কখনো জিততে পারবো না আর জিততে চাইও না।
তুমি চাইলেই আমায় ফিরিয়ে দিতে পারতে, পারতে পাশে থাকা দা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে।
আনিক কান্না করছে, আন্নি আনিকের সেই কান্নায় খুব সুখ পাচ্ছে। আনিককে দেখে বুঝতেই পারছে আন্নি, আনিকও ভাল ছিলোনা এতো বছর। শুধু সমাজের জন্য দুজন এতোটা কষ্টিত।
সমাজ সৃষ্টি হয়েছিলো মানুষের ভালোর জন্য, কিন্তো কিছু জিনিসে সমাজটা ঘাতকের মতোই কাজ করে।আন্নি আনিকের চেহারা থেকে চোখ,। সরিয়ে নিয়ে বললো, আমার একটা কথা রাখবে?
আনিক জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে আন্নির দিকে তাকালো। আন্নিও সেই তাকানোর মানে বুঝে বললো,
আমার বিয়ের পর এই মাটির ঘরেতেই দুজন থাকবো। দেখবে খুব সুখ পাবে, দুজন সামান্য কষ্টকে ভাগাভাগি করে নিবো।
আনিক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।
আনিকও নিজের বাবা মার সম্পদ বিক্রি করে টাকা গুলো নিজের সাথে করে নিয়েই ঘুরছে। আন্নির দেখা না পেলে, টাকা গুলো মসজিদ মাদ্রাসায় দিয়ে চলে যেতো কোনো আশ্রমে।
আনিক কাপড়ের ব্যাগ থেকে টাকা গুলো বের করে মাটিতে রেখে বললো,
এখানের সব টাকা তোমার বিয়ের মোহর, এই টাকাতে আমার কোনো দাবী নেই। তোমাকে আজ না পেলে সব টাকা দান করে আশ্রমে চলে যেতাম। ভাগ্য তোমায় আবার মিলিয়ে দিছে আমার কাছে।
আন্নি আনিকের কথা শুনে মুচকি হেসে টাকা গুলো নিজের হাতে নেয়, এবং আনিকের ব্যাগে ভরে দেয়। আর বলে, আগে বিয়ে হোক।
আন্নি আনিক দুজন মিলে পাশের বাজারে কাজী অফিসে যায়।
দুজন বিয়ে করে, সাক্ষী কাজী অফিসের মানুষেরাই ছিলো৷ বিয়ের মোহর হিসেবে কাগজে সেই ব্যাগটাই লিখে দেয় আনিক। সবাই অবাক হলেও আন্নি আর আনিক স্বাভাবিক ছিলো।
মাটির ঘরে এসে আন্নি ব্যাগ খুলে টাকা গুলো গুনে গুনে দেখলো, ২হাজার কম ২১ লক্ষ টাকা।
আন্নি অবাক হয়ে আনিকের দিকে তাকায়। আনিক চোখের দুই ফোটা নোনাজল নিজ হাতে মুছে মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলে।
এই টাকাতে আমার কোনো দাবী নেই। তুমি আমার এটাই আল্লাহ এর কাছে হাজারো শুকরিয়া।
আন্নি আনিকের কথা শুনে মুচকি হেসে বললো,
তোমার টাকা তোমারই। আমি মোহর হিসেবে তোমাকেই নিলাম। আর এটাই চাই তোমার কাছে, কালো সমাজের কালো রঙে আর কখনো নিজেকে হারাবে না। জিততে হবে তোমায়। মানুষ সমাজ সৃষ্টি করেছে, সমাজ মানুষকে নয়। আর মানুষের সৃষ্টি সমাজ কখনো ভালো হয় না।
আনিক মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। আন্নি মনে মনে এটাই বললো, সমাজ এর কিছু ভিন্ন মস্তিষ্কের মানুষের জন্য এতোটা বছর দুজন কষ্টে ছিলো। এমন কষ্ট যেন আর কেউ না পায়।
সমাপ্ত
কালো সমাজের কালো রঙ
লেখক: হানিফ আহমেদ
ভুল গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
গল্পটা সবার কাছে ভালো না লাগলেও তাদের কাছেই গল্পটা ভালো লাগবে, যাদের আপন ভাই নাই। তারাই জানে সমাজ আর মানুষ কী?
সমাস কী বলবে? এই শব্দটা যে বর্জন করতে পারবে সেই মানুষ গুলো কখনো অসুখী হবে না ইনশাআল্লাহ।)
লেখক: হানিফ আহমেদ
সমাপ্ত