টুকটুকি – তোমাকে নিয়ে কিছু কথা যা ভোলার মত নয়

টুকটুকি – তোমাকে নিয়ে কিছু কথা যা ভোলার মত নয়: দু’জন মানুষের আত্তা দু’ই পাড়ে থেকেও যেন এক। নুহাস তার পরকালে থাকা প্রেমিকাকে নিয়ে যেন নতুন এক জগত গড়ে তুলেছে। দিব্যি সংসার করে চলছে। টুকটুকিতেই বেঁচে আছে নুহাস।


পর্ব ১

বিছানায় নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকা পিচ্চি মেয়েটার হাত ধরে বসে আছে নুহাস। নুহাসের ভেতরের ছটফটানি বাড়ছে ধীরে ধীরে। শ্বাসগুলো আছড়ে পড়ছে টুকটুকির হাতের উপর। টুকটুকির হাতটা ধরে বুকে বাম দিকে ঠেকিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে নুহাস,
~শুনতে পাচ্ছিস টুকটুকি! শুনতে পাচ্ছিস আমার ভেতরের উথাল-পাতাল হওয়ার শব্দ? তোর নুহাসের যন্ত্রণা,ছটফটানি? প্রেম মিশ্রিত চিৎকার। পাচ্ছিস শুনতে?

তোর প্রতি টান। পরছিস অনুভব করতে? সহস্র বর্ষ যে তোকে ভালোবাসা বাকি আছে এখনো।
বাচ্চাদের মতো কাঁদছে নুহাস। নাক টানছে অনবরত। ফোঁপাচ্ছে। হাতের ওল্টো পিঠ দিয়ে ঘষে চোখের জল মুছে নুহাস আবার বললো,
~এই ওঠ না। টুকটুকি? দেখ আমি তোকে আর বকব না। তোর নিত্যদিনের সব আবদার পূরণ করব। রোজ শিউলী ফুল দেব আমার গাছ থেকে। যত খুশি নিস ফুল। গিটার বাজাব তোর জন্য। বৃষ্টিতে ভিজলেও বকবো না আর। ওঠবি তুই? ফাজলামো হচ্ছে? আমার কষ্ট দেখিস না?
নুহাস আবার ভেসে গেল চোখের জলে। টুকটুকি কে ডাকতে ডাকতে যে তার প্রত্যেক রাত পার হয়। পার হয় দিন। পার হয় বছর।

কিন্তু এই পিচ্চি মেয়েটার যে এত তেজ,এত ঝাল আছে এই মেয়ের প্রেমে কে জানতো।
আকাশচুম্বী অভিমাণ পিচ্চিটার মনে। নুহাসের প্রতি। ওর ডাক্তার বাবুর প্রতি। আচ্ছা রাগ আছে,অভিমাণ আছে ঠিক। তবে ভালোবাসাও তো আছে। আছে সহস্র বর্ষের জমানো প্রেম। অল্প নয়! আছে এক সমুদ্র সমান প্রেম। আঠারো বছরের পিচ্চি মেয়েটা যে তার বয়সের চেয়ে অধিক ভালোবাসে নুহাসকে। তাহলে ভালোবাসার চেয়ে অভিমাণের ভার বেশি হবে কেনো?
কেন প্রতিটা দিন চোখ বুজে থাকবে? নুহাসের চোখে চোখ রেগে অবোধ আবদার করবে না। নুহাসের যে ব্যাথা হয়। দলা পাঁকানো ব্যাথারা গলায় আটকে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সর্বাঙ্গে ছড়ায়।

অন্যসব দিনের মতো আজ রাতেও টুকটুকির হাত বুকে ঠেঁকিয়ে ঘুমের অতলে ডুব দিল নুহাস।

অতীত…

হাতের মুঠো ভর্তি করে স্বচ্ছ সাদা আর কমলা রঙ্গের গভীর মিশ্রনের শিউলী ফুল নিয়ে এলো নুহাস। টেবিলে খুলে রাখা সাদা খাতার উপর রেখে দিল।
নুহাসেথ ঘর্মাক্ত মুখটা চকচক করছে। কপালে ল্যাপ্টে আছে সোজা সোজা চুলগুলো। ফুলগুলো রেখে মুচকি হাসলো। বিরবির করে বললো,
~এত শিউলী ফুল একসঙ্গে পেলে তো পাগলই হয়ে যাবে আমার টুকটুকিটা। ধুপ করে মাথা রাখবে আমার বুকে। তারপর নিজেই লজ্জা পাবে। হাহা।

কালো শার্টটা সাদা শরীরের সাথে আষ্টেপিষ্টে লেগে আছে। টুকটুকি এখন কাছে থাকলেই জড়িয়ে ধরে মুখ ডুবিয়ে দিত বুকে। নুহাস মুচকি হাসলো। টি-শার্ট আর টাওজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

মাবিয়াত জামান নুহাস। ইবনে নজরুল জামান আর জোবেদা মাহমুদের বড় ছেলে। ঢাকা মেডিক্যাল থেকে ইন্টার্নশীপ করছে। দেখতেই সেই রকম সুন্দর। বয়স পঁচিশ। ৫’৮ লম্বা,সুঠাম দেহ,সোজা সিল্কি চুল,মায়াবী চেহারা,যে কোনো মেয়ের নজর কাড়ার অধিকার রাখে। নুহাসের ছোট ভাই নিবির জামান। নুহাসের থেকে একবছর ছোট হলেও পড়ালেখা একসাথেই। সেও নুহাসের সাথেই ঢাকা মেডিক্যালে পড়ে।

মেজো চাচার দুই মেয়ে মাহিলা আর মিশ্মি,ছেলে নাভিন আর চাচি সেলিনা খাতুনকে নিয়ে যৌথ পরিবার নুহাসদের। টুকিটুকির মা অর্থাৎ রেহানা মনোরমার ছোট মেয়ে।

নুহাস বাড়ি এসছে টের পেয়েই ছাদ থেকে দু’বার হুমড়ি খেয়ে পড়ে দৌড়ে এলো টুকটুকি। মনোরমার সবচেয়ে ছোট নাতিনী। পুরো নাম ইপ্সাতুন মৌরিন। মা সৈয়দা রেহানা ইসলাম। বাবা আব্দুল ফাজর জামান আমেরিকা থাকেন। মা আর টুকটুকি তাই নানু বাড়িতেই থাকে। জামান বংশের সবচেয়ে ছোট মেয়ে মৌরিন। আদর করেই বড় করেছে ওকে।
নুহাস ভালোবেসে তাকে টুকটুকি ডাকে। নুহাসের চোখে টুকটুকি নিতান্তই পিচ্চি। ছয় বছরের ছো মেয়েটা ওর থেকে। তাও টুকটুকি ছোট থেকে খেলার সাথী নুহাস। শুধু খেলার নয় মনের সাথীও বটে। টুকটুকি মেয়েটা তার সবকিছুর আড়ালে ঘিরে রেখেছে নুহাসকে। নুহাসের চিন্তা ভাবনা অনুভূতি,সবকিছুই টুকটুকিকে ঘিরে।

নুহাসের ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল নুহাস নেই। টেবিলে চোখ পড়তেই চওড়া হলো ঠোঁটের ভাঁজ। স্পষ্ট হলো ঠোঁটের পাশের গর্ত। নুহাসের খাতার উপর অনেক অনেক শিউলী ফুল রাখা। খুশিতে আত্নহারা হয়ে গেল টুকটুকি। অস্ফূটস্বরে মুখ থেকে বের হয়ে এলো,
~আআ,আর,আআআ।

হয়ত খুশিতে নুহাসকে বলতে চায় এত ভালোবাসো? এত এত ফুল এনেছো আমার জন্য?
কিন্তু গলায় এসে আটকে যায় কথাগুলো। আর বের করতে পারে না। প্রচুর কষ্ট হয়।
মনের চার দেয়ালে তৈরি সব বাক্য,সব শব্দ,সব ধ্বনি মিলে মিশে একই উচ্চারণ বের হয়ে আসে,
আআআ,আআআ,আআআ।
কথা বলতে পারে না টুকটুকি। তবে শুনতে পায় সব। বুঝতে পারে সব। সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ পারে। নুহাস নিজে টুকটুকি সহ বাড়ির সকলকে শিখিয়েছে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ।

নুহাস গোসল সেরে খালি গায়ে বের হয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। তোয়াল দিয়ে চুল মুছে নিচ্ছিল। বের হতেই চোখ পড়লো বিছানায়। নুহাসের গিটার জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়েছে টুকটুকি। গিটারের চারিদিকে অসংখ্য শিউলী ফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাদা চাদরটা রঙ্গিন হয়ে ওঠেছে।
নুহাস গভীর চোখে দেখলো টুকটুকিকে। মেয়েটা কথা বলতে না পারলেও তার চোখ,ঠোঁট দিয়ে খুব সহজেই ব্যাক্ত করে মনের স্বাদ। কিন্তু কানে শোনে ঠিকি। নুহাস তোয়ালটা সোফার উপর রেখে এগিয়ে গের খাটের দিকে। এক হাতে ভর রেখে টুকটুকির উপর ঝুকে বসলো নুহাস।

সাদা-মাটা একটা শাড়ি পড়ে আছে মেয়েটা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে দাদু পড়িয়ে দিয়েছে। মনোরমার শাড়ি। পুরো পুরোন বাংলা নায়িকাদের মতো লাগছে মেয়েটাকে। টুকটুকির চুলগুলো কোঁকড়া। হালকা খয়েড়ি বর্ণ। ছাড়া অগোছালো চুলের একগুচ্ছ অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে চোখের সামনে। নুহাস ডান হাত দিতের দুই আঙ্গুল দিয়ে চুলগুলো আলত করে কানের পেছনে গুজে চুম খেল কপালে। টুকটুকি হালকা নেড়েচেড়ে ওঠে পিটপিট করে চোখ মেললো। ঠোঁটের পাশে ভাঁজ সূক্ষ।

টুকটুকির হাসি-মাখা মুখ দেখলে নুহাসের বুকে শীতল হাওয়া বয়ে যায়। শান্ত হয় চাহনী। উথাল-পাতাল শুরু হয় মনে।
নুহাস দ্রুত সোজা হয়ে বসে। টুকটুকি শুয়েই চেয়ে থাকে নুহাসের দিকে। নুহাস দ্রুত ওঠে টেবিল থেকে সিগেরেট হাতে নিয়ে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে তাকায় টুকটুকির দিকে। টুকটুকি ততক্ষণে ওঠে বসে। পিট পিট করে অবুঝের মতো তাকায় নুহাসের দিকে। নুহাস বারান্দায় যেতে যেতে গম্ভীর ভাবে বলে,
~আমার সামনে আর শাড়ি পড়ে আসবি না। মাথা ঠিক থাকেনা আমার।
টুকটুকি দ্রুত বালিশ চেঁপে ধরে তাকাল নুহাসের দিকে। আবার চোখ নামাল। লজ্জা নাক,কান লাল হয়ে গেছে। নুহাস অবাক হয়ে দেখছে। টুকটুকির মতো এত লজ্জাবতী মনে হয় ওর জীবনে দেখেনি। সামান্য সামান্য কথাতেও লজ্জা পায় মেয়েটা। লজ্জা যেন তার রক্তের সাথে বহমান। প্রসন্ন হাসে নুহাস। কন্ঠে মোহ ঢেলে বলে,

~তুই এত প্রেমময় কেনো টুকটুকি? কি আছে তোর মাঝে?
উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বারান্দায় চলে আসে নুহাস। পিছু পিছু টুকটুকিও আসে। নুহাসের সামনে এসে ওল্টে দাড়ায়। নুহাসের হাত দিকে সিগেরেটটা কেড়ে নিয় এক ঢিলে ফেলে দেয় বাহিরে। তারপর রাগ মিশ্রিত চোখে চেয়ে থাকে কতক্ষণ।
ধুপ করেই মাথা রাখে নুহাসের বুকে। দুই হাত দিয়ে পিঠ পেঁচিয়ে ধরে। নুহাস হাসে। বাহুবন্ধনে চেপে ধরে টুকটুকিকে।

~টুকটুকি!
বুক থেকে মাথা তুলে তাকায় নুহাসের দিকে। টুকটুকি ইশারায় বলে,
~কি?
~ফুচকা খেতে যাবি আমার সাথে? আজ নৌকায় ওঠাব।
টুকটুকির চোখ খুশিতে চকচক করে ওঠে। হাতের ইশারায় দ্রুত বলে,
~হ্যা। যাব যাব। তবে আমাকে চুড়ি কিনে দিতেই হবে।

নুহাস খোঁচা মারে,
~এহ! শখ দেখ মেয়ের। পাড়ব না কিনে দিতে। আর ফুচকা তো আমি খাব। তুই শুধু দেখবি।
শোনা মাত্রই মুখ ফুলিয়ে ফেলল টুকটুকি। এ মুখ ফুলিয়ে নিলে নুহাসের যা ভালোলাগে না! ! ! একদম পুতুলের মত লাগে মেয়েটাকে। নুহাস আবেগী কন্ঠে বললো,
~এই পুতুল। এত কিউট কেন তুই?
টুকটুকি ইশারায় বলে,
~তোমার মতো শয়তান না যে তাই।
নুহাস স্বজোরে হো হো শব্দ করে হেসে ওঠে। টুকটুকি চুপচাপ দাড়িয়ে নুহাসকে দেখতে লাগল। হাসলে নুহাসকে খুব সুন্দল লাগে। কপালে ভাঁজ পড়ে কিছু। চোখের পাঁপড়ি গুলো ঘন হওয়ার কারণে হাসিটা আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেছে। টুকটুকির মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে নুহাসের সৌন্দর্যের বিবরণ নিজ মুখে দিতে। কিন্তু বলতে পারে না। তখন খুব কষ্ট হয়। চোখে পানি চলে আসে কষ্টে। মনে নামে আষাঢ়ের গাঢ় কালো মেঘের তুলারাশির মতো একগুচ্ছ বিষাদ।

নুহাস টুকটুকির সামনে তুড়ি মেরে বলে,
~কিরে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? প্রেমে পড়ে যাবি তো!

টুকটুকি মুখ বাকায়। ভেঙচি কেটে মাথা নাড়ায়। ইশারায় বুঝায়,
~মোটেই না। তোমার মতো একটা ছাগলের প্রেমে পড়বো। তাও আবার আমি!
হাসিতে লুতপুত খায় টুকটুকি। নুহাসও হেসে বলে,
~ফুপিকে বলবি তোকে যেন গাঢ় নীল শাড়ি পড়িয়ে দেয়। আর হে চুল ছাড়বি।

টুকটুকি খুশি মনে চলে যায়। বিকেলে দু’জন এক সাথে অনেক ঘুরাঘুরি করে। নেমে আসে সন্ধ্যে। টুকটুকিকে দাড়াতে বলে কোথাও একটা যেন যায় নুহাস।
টুকটুকি নুহাসের বাইক থেকে কিছুটা দূরে এসে দাড়ায়। বাতাসে চুলগুলো উড়তে থাকে। কিছুক্ষণ বাদেই নুহাস এসে টুকটুকির দু’হাত ভর্তি কালো চুড়ি পড়িয়ে দেয়। টুকটুকি খুশিতে ডগমগ হয়ে যায়।

নুহাস আহ্লাদী কন্ঠে বললো,
~এখন একদম ঠিকঠাক আছে। নীল শাড়ি,কালো চুড়ি,হালকা লিপস্টিক,কাজলহীন চোখ,কোমর অবদি ছাড়া চুল। ওফ টুকটুকি! আমাকে কি পাগল করে ছাড়বি তুই?
টুকটুকি লজ্জায় মুখ লুকায় নুহাসের বুকে। কি লজ্জার মুখেই না ছেলেটা ফেলে দেয় ওকে বারবার। নুহাস বললো,
~আচ্ছা কাল তো তোর আবার কলেজ আছে। তাড়াতাড়ি বাসায় চল। নাহলে ফুপি আবার বকবে।

টুকটুকি এই কথা শুনেই জড়িয়ে ধরে নুহাসকে। তারপর নাছোড়বান্দার মতো হাত-পা ছুঁড়াছুড়ি করে ইশারা করে,যাবে না বাড়ি।
~না না,মা বকবে না। আমি এখনি যাব না প্লিজ।
~ভালোলাগে খুব। আমার ডাক্তারবাবুর সাথে থাকতে।
~ডাক্তার এখনো হইনি!
টুকটুকি হাতের ইশারায় বলে,
~তো?
~কিছুনা।

টুকটুকি হেসে মাথা নাড়ায়। নুহাস দুই হাত দিয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরে টুকটুকির। তারপর বলে,
~আর আমার সামনে শাড়ি পড়ে থাকলে আমার যে তোকে আদর করতে ইচ্ছা করে। তখন?
টুকটুকি লজ্জা পায়। দু’হাত মুখে চেপে ধরে। নুহাস টুকটুকির মুখ থেকে হাত সরিয়ে আরো কাছে টেনে নেয় ওকে। টুকটুকি ইশারায় বলে,
~তাহলে বিয়ে করে নাও।
নুহাস টুকটুকির মাথায় টোকা দিয়ে হাসে। মুগ্ধভাবে বলে,
~ওরে বাবাহ! এইটুকুন পিচ্চি মেয়েটার কি শখ!

মাত্র বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলো আর্দ্র। আমেরিকার প্রভাবশালী বিজনেসম্যান আর্দ্র। বাংলাদেশে জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা আমেরিকাতেই। খুব ছোট বয়সে বাবা-মাকে হারাতে হয়েছে শুধুমাত্র ধনী বলে। নিজের চাচা তার বাবা-মাকে খুন করে আর্দ্রকে বের করে দিয়েছিল বাড়ি থেকে। আর্দ্রর বয়স তখন নয় ছুঁই ছুঁই।

সেদিন মাসি আনা আর্দ্রকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকা। তার ছয় বছর বাদে সেও ছেড়ে গেছে আর্দ্রকে। বাস্তব আর মানুষের হিংস্রতার সাথে লড়াই করে গড়ে ওঠেছে এই বিশাল শিল্পপতি আর্দ্র।
বাংলাদেশে আশা শুধুমাত্র ওর পুতুলের জন্য। ওর ছোট্ট পুতুলটাকে যে ও ফেলে গেছিল একা। স্বার্থপরের মতো ছেড়ে গেছিল তাকে। ওর খালাতো বোন। আনার দু’ই মেয়ে ছিল। ছোট মেয়ে আফরা বান্ধবিদের সাথে খেলায় মগ্ন ছিল। মা হয়েও আনা সেদিন আর্দ্রর জীবন বাঁচাতে আফরা ফেলে বড় মেয়ে আকিকাকে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

ফার্ম হাউজের সামনে এসে থেমেছে আর্দ্রর গাড়ি। গাড়ির দরজা খুলে এক পা বের করে ভাবছে আর্দ্র। আর্দ্রর বয়স পঁচিশ। প্রায় ষোল বছর আগে ওর পুতুলকে বাংলাদেশে একা ফেলে চলে গেছিল আর্দ্র। সেই ভয়ানক দিনটা ষোলটা বছর আর্দ্রর হৃৎপিন্ডটা খুঁড়ে খুঁড়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে তার ঔষুন শুধু ওই বাচ্চা মেয়েটা। আচ্ছা ওর সেই ছোট্ট পুতুল আজ অনেক বড় হয়েছে না! উম আঠারো বছর বয়সী যুবতী। ভাবতেই ম্লান হাসির রেখা ফুটে ওঠে আর্দ্রর ঠোঁটে।

আকিকার ইচ্ছে করছে সব ভেঙ্গে চুড়ে ফেলতে। এতটা কেয়ারলেস কেন আর্দ্র নিজের প্রতি?
ও তো জানে বাংলাদেশে ওর কত শত্রু আছে। তাও আকিকার কথা না শুনে ওকে না বলেই চলে গেল বাংলাদেশ! ও মানছে ওদের কলিজার টুকরা পুতুল আছে সেখানে। তবে এরকম পাগলামীর মানে হয়? পুতুলকে কোথায় খুঁজে পাবে আর্দ্র? পুতুল বেঁচে আছে নাকি তাও তো জানা নেই ওদের। আকিকা ঘরের কিছু জিনিস ভেঙ্গে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,
~ক্রুশেভ! ক্রুশেভ! হোয়ের আর ইউ? কাম হেয়ার রাইট নাও।

ক্রুশেভ আকিকার চিৎকার শুনে দৌড়ে এলো। ক্রশেভ আকিকার বডিগার্ড। আঠাশ বছরের তরুণ ক্রশেভ। তবে যে কেউ দেখলে হয়ত বলবে সতের বছরের বালক। ক্রশেভ এসে ভয়ংকর চোখে দেখল রুমটাকে। সব কিছু ভাঙ্গচুর করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তার মাঝে বসে আছে আকিকা। ক্রশেভ ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
~ম্যাম। ম্যাম হোয়াট হ্যাপেনিং। হোয়াট আর ইউ ডুয়িং?
~অ্যাঅ্যা,জাস্ট শাট আপ।
চিৎকার করে ওঠলো আকিকা। রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
~আমি বাংলাদেশ যাব। এক্ষুণি সব এরেঞ্জ করো। না হলে প্রাইভেট এয়ারক্রাফ্ট হায়ার কর। বাট কুয়িক।

~বাট ম্যাম,ইটস ইম্পসিবল। স্যার মানা করে গেছেন
আপনাকে নিয়ে যেতে।
~আই থিংক তুমি ফায়ার হতে চাও না। যদি না চাও আমি তোমাকে জাস্ট থার্টি মিনিসট টাইম দিলাম।
ক্রুশেভ উপায়ান্ত না দেখে কঠিন সুরে বললে,
~ওকে একিকা (আকিকা)।


পর্ব ২

ছোট থেকেই নাচতে খুবি ভালোবাসে টুকটুকি। সবার মতে টুকটুকির রক্তে রক্তে নৃত্য মিশে আছে। গান ছাড়াও অসম্ভব সুন্দর নাচে টুকটুকি। রেহানাও ছোট থেকে নাম শিখিয়েছেন ওকে। আগামী সপ্তাহে টুকটুকির কলেজে একটি ইন্টার্নাল ডান্স কম্পিটিশনের জন্য নাচের প্র্যাক্টিস করছে ছাদে। পাশেই মনোরমা নিজের জলপাই,আম,চালতা আর তেঁতুলের ঝাল ঝাল আচার রোদে দিতে ব্যাস্ত। নিবির আর টুকটুকির মধ্যে সবসময়ই ঝগড়া হয় তেঁতুলের আচার নিয়ে। টুকটুকি ছোট বলে সবসময় এটা ওটা বলে নিবিরকে ফাঁসিয়ে আচার নিয়ে পালিয়ে যায়।

টুকটুকি ছাদের দক্ষিণ পাশে মোবাইলে গান ছেড়ে নাচছে। আর তার ঠিক দশ হাত দূরে নিবির দাড়িয়ে। ছাদের রেলিংএ পিঠ আর হাতের পেঁছন ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে রুহির সাথে দিব্যি চ্যাটিং করছে।

দিন পড়ে এসছে। আকাশ আস্তে আস্তে রক্তিম আভা ধারণ করছে। এক মুঠো রোদ সাদা মেঘের আড়াল থেকে সব বিচ্ছেদ্য পথ পাড়ি দিয়ে এসে পড়ছে টুকটুকির গায়ে,মুখে,চোখে। নিবির টুকটুকির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দুটো ছবি তুলে নিলো ঝটপট। তুলেই পাঠিয়ে দিল নুহাসের মেসেঞ্জারে।

দু’মিনিট পরই নুহাস রিপ্লাই দিল,
~ভাই রোগী দেখতাছিলাম।
নিবির একগাল হেসে বললো,
~দেখ ভালো কইরা দেখ। মানা করল কে?
~দিলি তো কাম সাইরা। এখন পিক দিতে কইছিল কে?
~ভালো না লাগলে ডিলিট কইরা দে।

~মাইর খাইতে চাস? ভিডিও কল দে।
~হা হা হা। দিমু না। টুকটুকি নাচতাছে।
~আমি কিন্তু রুহি ফোন কইরা কমু তুই ছোট থাকতে মারিয়ার লগে প্রেম করতি।
~ওহ হারামি। জীবনটা ত্যানা ত্যানা বানায় দিছস এই এক কথা লইয়্যা। দিতাছি কল। রিসিভ কর। বজ্জাত কোনখানকার।

নিবির ভিডিও কল দিতেই নুহাস দেখতে লাগলো ওর টুকটুকিকে। নাচার সময় টুকটুকির কোমর অবদি বেনুনী থেকে যখন চুল গুলো অর্ধেক বের হয়ে বারবার মুখে,চোখ আছড়ে পড়ে অপূর্ব লাগে টুকটুকিকে। মনে হয় কোনো এক নির্লিপ্ত মায়ায় আচ্ছন্ন তুলেছে নিজেকে।
ছুটে আশা এক পশলা রক্তিম রোদে টুকটুকির কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু পানিগুলো মুক্তার মতো লাগছে।

হঠাৎ মনোরমা আচারের বোয়াম গুলো তুলতে তুলতে বলেন,
~এইবার যদি আমার আচারের বোয়াম তোরা কেউ চুরি করছ,দেখিস পিডাইয়্যা মাইরা ফালামু।
মনোরমার কথায় টুকটুকি ভেঙচি কাটলো। নিবির বললো,
~কালকের মধ্যেই চুরি করে খেয়ে ফেলব সব। দেখো খালি।
~হতোচ্ছারা। তুই যদি আচার ধরোছ ও না অনেক পিটুনি খাবি।
~এহ দিনে দিনে তো বুড়ি হইছো। আচাড় দিয়া করবটা কি?
~কি? আমি বুড়ি হইছি? দাড়া তুই।
নুহাস দেখছে আর হাসছে। মনোরমা নিজের লাঠি দিয়ে তাড়া করছে নিবিড়কে। টুকটুকি খিলখিলিয়ে হাসছে। যেন এর চেয়ে মজাদার কান্ড সে দেখেনি আর কখনো।

হাসতে হাসতে হঠাৎই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে টুকটুকি। নুহাস আৎকে ওঠে। কলিজার পানি শুকিয়ে যায়। নিবির দৌড়ে আসে টুকটুকির কাছে। মনোরমাও আসেন। ভরকে গেছেন তিনি ঘটনার আকস্মিকতায়। নুহাস অসহায়ের মতো দেখে ওর টুকটুকিকে।
নাইট ডিউটি থাকা স্বত্তেও বাইক নিয়ে বের হয়ে যায় হসপিটাল থেকে। বুকের ভেতরটা ধুক ধুক করছে। মনে হচ্ছে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসছে। আধঘন্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যায় নুহাস। ততক্ষণে টুকটুকির জ্ঞান ফিরেছে।

বাড়িতে এসে কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় জোবেদা। নুহাস কিছু না বলে দৌড়ে চলে আসে টুকটুকির ঘরে। হঠাৎ পড়ে যাওয়া মাথার বাম পালে একটু চোঁট পেয়েছে। ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে নিবির। টুকটুকি আধাশোয়া ভাবে বসে ছিল। পাশে মনোরমা আর রেহানা। নজরুল চিন্তিত ভাবে ঘরের মাঝে পাইচালি করছিলেন। ছেলেকে আসতে দেখে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললেন। নুহাসের আশেপাশের কিছুই খেয়াল নেই। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো টুকটুকিকে। চোখের কার্ণিশে জমা পানি ফিটকে বের হয়ে এলো।
নুহাস টুকটুকির মাথা শক্ত করে চেঁপে আছে নিজের বুকে। মেয়েটার সামান্য কিছু হলেই মাথা ঠিক থাকে না ওর।

কিছুক্ষণ বাদে নুহাসের মন শান্ত হলে বন্ধন হালকা হয়। টুকটুকি লজ্জায় খোঁচা দেয় নুহাসের পেটে। অদ্ভুত রকম চমকে ভ্রঁ কুঁচকে তাকায় নুহাস। ভ্রঁ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করেকি?
টুকটুকি মাথা নাড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলায়। নুহাসের খেয়াল আসে বাসার সব বড়রা এখানে। লজ্জা পেয়ে কিছুটা সরে আসে নুহাস। নিবির আগেই বের হয়ে যায় ঘর থেকে।

নজরুল হাসে নিজের ছেলের কান্ডে। দিনে দিনে বড় নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে তার ছেলে প্রেমে পড়ে। নজরুল হেসে বলেন,
~বাবা তুই না ডাক্তার! দেখ,ভালো কইরা দেখ টুকটুকির মা’র কি হইছে। আমরা বরং যাই।
একে একে সবাই বের হয়ে যায় ঘর থেকে। নুহাস আবার হাত টেনে টুকটুকিকে নিজের বুকে এনে ফেলে। নরম গলায় বলে,
~এই বুকে তো আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলি একটু আগে। দেখছিস কেমন কাঁপছে এখনো?
টুকটুকি মাথা ওঠায়। ঠোঁটের ইশারায় বলে,
~বারে! আমি কি করলাম?

~খুব দুষ্টু হয়েছিস না? আচ্ছা এভাবে মাথা ঘোরালো কেনো তোর? দুপুরে তো আমি এসে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম। ক্ষুধা পেয়েছিল?
টুকটুকি আ,আ,আ,শব্দ করে মাথা দুই পাশে নাড়ায়। নুহাসের বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকে। নুহাস আবার চিন্তিত কন্ঠে বলে,
~এখন খারাপ লাগছে?
টুকটুকি দ্রুত ডানে-বামে মাথা নেড়ে নুহাসের বুকে মুখ লুকিয়ে নাক ঘঁষে।

মোবাইলের স্কিনে পুতুলের কিছু ছবি দেখে কথা বলছিল আর্দ্র। অভিমাণ,রাগ,ভালোবাসা অনুভূতির মিশ্রণে কন্ঠটা অদ্ভুত শোনাচ্ছিল। আর্দ্র পুতুলের ছবি দেখে ফিসফিসিয়ে বললো,
~এত দিন অনেক রাগ করে থেকে ছিস। আমি কিচ্ছুটি বলিনি। চুপচাপ তোর রাগ,অভিমাণ মেনে নিয়ে আমার প্রতি। আর না। এবার তোকে ধরা দিতেই হবে আমার কাছে। আমার পুতুলকে আমি খুঁজে নেবই এবার।

গভীর রাতেও উভ্রান্তের মতো গাড়ির দড়জা খুলে পা ছড়িয়ে বসে আছে আর্দ্র। শার্টের উপরের চারটে বোতাম খোলা থাকায় উন্মুক হয়ে আছে আর্দ্র সাদা বুক। মাথার গাঢ় খয়েরি কেশগুচ্ছ অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে কপালের উপর। গাঢ় লাল ঠোঁট। নীল চোখ দুটিতে উপছে পড়ছে জল।
চোখের জলের ওজন হয়না। নাহলে আর্দ্র ওর পুতুলকে বলতে পারত দেখ সবার চেনা-পরিচিত স্ট্রং ডেশিং আর্দ্র আহমেদ লুকিয়ে লুকিয়ে কত চোখের জল ফেলেছে তোর জন্য!

গাড়ি থেকে ডুলতে ডুলতে নামে আর্দ্র। পুতুলের নাম জপে পড়ে যেতে নিলেই দুটো শক্ত হাত আটকায় ওকে। মাথা ঘুরে পেছন দিকে তাকাতেই বলে,
~এই এই এই তুমি কে বলতো? কোথায় যেন দেখেছি!
~কোথাও দেখনি ড্যাম ম্যান। তুমি আমার সাথেই বড় হয়েছ।

কপট রাগ দেখিয়ে বলে ক্রশেভ। আর্দ্র মাতাল ছির। পুতুলের কথা ভাবলেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না ও। ক্রুশেভ রেগে বললো,
~আজ কি কি খেয়েছ শুনি?
~মদ,আফিং,সিগেরেট!
~নিজেকে অন্তত এতটুকু ঠিক রাখো যাতে নিজের ডলের সামনে গিয়ে দাড়াতে পারো। ভেতরটা তো পঁচিয়ে ফেলছ সব।

কন্ঠ দৃঢ় হয় ক্রুশেভের। আকিকার বডিগার্ড হলেও সম্পর্কটা অনেক গভীর থেকে ওদের সাথে ক্রুশেভের। ক্রুশেভ ছোট থেকেই বড় হয়েছে ওদের সাথে। কঠিন আর্দ্রও যখন রাতের আঁধারে ভেঙ্গে পড়ে ক্রুশেভ সামলেছে তাকে। বন্ধুর মতো!
না নিজের ভাইয়ের মতো। দুই ভাই বোনের সামনে ঢাল হয়ে থেকেছে ক্রুশেভ।

নুহাশের বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে কখন ঘুমের অতলে হারিয়েছে জানেনা টুকটুকি। সকালের এক গুচ্ছ রোদ জানালার কাঁচে এসে পড়ে। মৃদু হয়ে স্নান করায় টুকটুকিকে রৌদ্যজলে। টুকটুকির ডান হাত আপনা আপনি চলে আসে চোখের উপর। মাথা উচুঁ করে নিজের অবস্থান দেখে নেয় সে।
নুহাস ঘুমছে। ওর মাথায় চিবুক ঠেঁসে ঘুমচ্ছে। ওঠার জন্য নরতেই একটানে টুকটুকিকে খাটে ফেলে তার উপর ঝুঁকে শোয় নুহাস।
টুকটুকি চোখ বুঝে আছে দেখে নুহাস মুচকি হাসে। একচোখ ফাঁক করে একটু দেখে নুহাসকে। দেখেই রেগে বলে,
~আআ,আআআআ।

নুহাস বুঝে ওঠে টুকটুকি ভয় পেয়েছে। হেসে ওর নাকে নাক ঘঁষে দেয়। আহ্লাদি কন্ঠে বলে,
~আচ্ছা ভালোবাসার বৃষ্টি আছে?
টুকটুকি না বোঝার ভান করে ঠোঁট উল্টায়। নুহাস হেঁসে বলে,
~আমি ভালোবাসার অঝর ধারায় বৃষ্টি হয়ে নামতে চাই তোর উপর। ভিজিয়ে দিতে চাই তোর হৃদমাঝার। আমার প্রেমের বৃষ্টিতে খরায় উত্তপ্ত মাঠের মতো ভিজবি তুই। শুষে নিবি সব প্রেম,সব নেশা,সব মোহ।
আমি আমারো মাঝে বাঁধিব তোরে,আর তুই! অক্লান্ত প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াবি আমার মাঝে।

টুকটুকি ভীষণ লজ্জায় দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। নুহাস হেসে হাত সরিয়ে দেয়। দুই হাত দিয়ে টুকটুকির গাল চেপে ধলে কপালে চুমু দেয়।
নুহাস সোজা হয়ে ওঠে বসে। বালিশ নিয়ে হেডবোর্ডের সাথে রেখে আধাশোয়া হয়। হঠাৎই মুখে ঘন আষাঢ়ের কালো মেঘের ছায়া ছাপিয়ে বলে,
~একটা কথা ছিল।

টুকটুকি শোয়া থেকে ওঠে আসন করে বসে। জিজ্ঞেসা বোধক ভাবে তাকিয়ে বলে,
~আ আ আআ।
নুহাস হাটু ভেঙ্গে বসে। টুকটুকির দিকে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে চোখ সরিয়ে নেয়। উদাসী সুরে বলে,
~আমি কাল ঢাকা যাচ্ছি। সাত মাসের জন্য।

টুকটুকির মুখটা চুপসে গেল নিমিষে। হাত ঝাকিয়ে দেখালো,
~কেন? আমি যাব না?
~তোর কলেজ আছে। তাছাড়া আমি যাচ্ছি হসপিটালের জন্য। কোথায় থাকব এখনো জানি না।
টুকটুকি নিশ্চুপ। নুহাস টুকটুকির দুই হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
~যদিও থাকতে পারিনা তোকে ছাড়া। তাও থাকতে হবে।

টুকটুকি হাত দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে ইশারা করলো,
~আমি পারব না থাকতে। আমাকে নিয়ে যাও তোমার সাথে। আমিও যাব।
নুহাস মুচকি হেসে মাথার চুল এলোমেলো করে দিল টুকটুকির। আরো কাছে টেনে কোমর পেঁচিয়ে ধরলো দুই হাতে। টুকটুকি এক হাতে নুহাসের শার্ট খাঁমচে অন্য হাতে গলা পেঁচিয়ে ধরলো। নুহাস দুষ্টমি কন্ঠে মিশিয়ে বললো,
~তোর বয়স এবার আঠারোতে পড়লো না? সাতমাস অপেক্ষা কর। এসেই বিয়ে করে নিজের করে নিব।
টুকটুকির ঠোঁট প্রসস্থ হয়। ঠোঁটের নিজের ভাঁজ আরো সুগভীর হয়। ফাজলামো করে নুহাসের চুল টেনে দেয়। নুহাস বলে,
~তুই লজ্জা পাস কেন? তাও আবার আমার সামনে?

~তো আর কার সামনে পাব?
~তুই জানিস যখন তোর চোখ,মুখ লজ্জায় নুইয়ে পড়ে বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে ওঠে। মাথা নিচু করে যখন ঠোঁট কামড়ে থাকিস মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র নারী তুই। প্রেমময়ী। সারাজীবন এমনটা থাকিস।

মাহিলার বিয়ের কথাবার্তা চলছে রিয়াদের সাথে। ছেলেটা বেশ ভালো। নম্র-ভদ্র আর টাকা পয়সা ওয়ালা। ছেলে পক্ষের সমস্যা শুধু একটাই। তা হলো মিশ্মি। মিশ্মি মাহিলার থেকে বড়। দেখতে শুনতেও মাহিলা থেকে বেশি সুন্দরী,স্মার্ট। তাও কেন বিয়ে করলো না।
মিশ্মি বয়ফ্রেন্ডকে খুব ভালোবাসত সে। মাত্র চার মাস আগেই মিশ্মিকে ছেড়ে অন্য এক মেয়েকে সরাসরি বিয়েই করে নিলো।
মিশ্মি নিয়ামূল জামানকে বলে দিয়েছে বিয়ে সে করবে না। একটা কলেজে চাকরি করে। তা দিয়ে নিজের জীবন চালাতে আর বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে দেখতে কোন সমস্যা হবে না। নিয়ামূলেরও কোন ভাবান্তর নেই। মেয়েকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা তিনি দিয়েছেন।

কলেছে ক্লাস শেষ দাড়িয়ে আছে মিশ্মি আর টুকটুকি। আকাশ ঠেঁলে বৃষ্টি নামার উপক্রম। তবুও একটা রিকশাও পাচ্ছেনা।

হঠাৎ একটা গাড়ি আসতে বাধ্য হয়ে সামনে হাত মেলে লিফ্ট চাইলো মিশ্মি। কিন্তু গাড়িটা থামলো না।
দু’মিনিট বাদে আবার পাল্টা এলো গাড়িটা। টুকটুকি আর মিশ্মির সামনে এসে গাড়ির গ্লাস নামলো আর্দ্র। ততক্ষণে বড়বড় ফোঁটায় শুরু হয়েছে বৃষ্টি।

চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে টুকটুকির আপাতমস্তক দেখে নিল আর্দ্র। মেয়েটাকে সেদিন রাতে সে দেখেছে। নীল শাড়িতে।
হ্যা একেই দেখেছে। অপূর্ব লাগছিল।
আর্দ্রর চোখ সরানো দায় হয়ে পড়েছে। তাও দ্রুত সামলে নিলো আর্দ্র। বাম হাত চোখ সানগ্লাস পড়ে নিয়ে বললো,
ওঠে বসুন আপনারা।


পর্ব

বৃষ্টির পানি টিনের চাল বেয়ে পানির বালতিতে পড়ে টুপ টুপ আওয়াজে মাতিয়ে তুলছে পরিবেশ। চিলেকোটার ঘরের ছাউনি টিনের চালের। বৃষ্টির সময় টিন আর পানির সংঘর্ষে যে ধপাধপ আওয়াজ হয়,শুনতে বেশ লাগ টুকটুকির। মনে গেঁথে যায়,হৃদয়ে বসে যায়।
বৃষ্টি হলেই ছুটে আসে এখানে। বৃষ্টি হলো মাত্র। ঝুম বৃষ্টি। ছাদের ঘরটার সামনের বালতি দুটো প্রায় ভরে এসছে। পানি পড়ছে তো পড়ছে। টুপ টুপ টুপ।

টুকটুকি দুই হাত কাঠের টেবিলটাতে রেখে গালে ঠেস দিয়ে বসে বসে দেখছে। সামনে মুঠোফোন রাখা। নুহাসের কল দেয়ার কথা ছিল। সেই একঘন্টা হলো বসে আছে টুকটুকি।
বেগুনি পাড়ের সাদা শাড়ি পড়েছে সে আজ। নুহাস শাড়ি ভালোবাসে। পড়েছে বললে ভুল হবে। মনোরমা পড়িয়ে দিয়েছে। চুল আঁচড়ে দিয়েছে। মাথার মাঝে সিঁথি। ঠোঁট দু’টো আইসক্রিম খেয়ে লাল লাল হয়ে আছে। কিন্তু নুহাসই তো ফোন দিতে লেট করছে।

ভাবতে ভাবতেই টুং করে বেজে ওঠো মোবাইল। খুশির চোটে হুমড়ি খেয়ে পড়লো টুকটুকি ফোনে। কল রিসিভ করতে নিয়ে চোখে পড়লো অপ্রত্যাশিত কারো নাম্বার।
ভ্রুঁ কুঁচকে নাকের পাটা ফুলালো টুকটুকি। বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে চলে এলো নিচে। খালি পা’য়ে পানির উপর নিসংকোচে তৈরী করলো এক অনুভূতির অভিব্যাক্তি।

রাস্তার পাশে দাড়িয়ে একটা লোকের সাথে কথা বলছে আর্দ্র। পেছন থেকে আর্দ্রর কাধে কেউ একজন টোকা দিতেই পেছন ফিরে তাকায়।
অদ্ভুত চোখে তাকিয় আর্দ্র। তারপর মুচকি হেসে ডান হাত নাড়িয়ে বলে,
~আরে তুমি তো টুকটুকি। তাই না?
টুকটুকি উপর নিচে মাথা নাড়া। আর্দ্র আশ্চর্য হওয়ার ভান করে বলে,
~কেমন আছো তুমি? আর এখানেই বা কি করছ?

টুকটুকি প্রথমে বাচ্চাদের মতো হাসে। তারপর আর্দ্রর দিকে হাত মুঠো করে এগিয়ে দেয় অনেকগুলো তাজা শিউলী। আর্দ্র মুখ গুমোট করে ফেলে নিমিষেই। শিউলী আর্দ্রর অপছন্দ। ওর পুতুলের খুব পছন্দ ছিল শীউলি। পুতুলকে হারাবার পড় চোখের সামনে আসতে দেয়নি এই ফুল। আমেরিকাতে অবশ্য পাওয়াও যায়না।
আর্দ্র ঠোঁট টান টান করে জোরপূর্বক হেসে বলে,
~শিউলী নিতে এসেছিলে বুঝি?

টুকটুকি আবার মাথা নাড়ায়। আর্দ্রর এক হাত টেনে ফুলগুলো আর সাথে একটা কাগজ দিয়ে আবার উল্টা হাটা ধরলো টুকটুকি। আর্দ্র সচকিত।
কলেজের ড্রেস পড়া মেয়েটা। মাথায় উঁচু করে ঝুটি,দু’কাধে ব্যাগ। বেশ হেলিয়ে ধুলিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।

আর্দ্র ভ্রঁ কুঁচকে চিরকুটটা দেখে। খুব সুন্দর করে লিখা,
সেদিনের সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ।

আর্দ্রর ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে টুকটুকির পাশাপাশি দাড়ায়। টুকটুকি স্তব্ধ হয়ে দাড়ায়। আর্দ্রকে হাঁপাতে দেখে ফিক করে হেসে দেয়। হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে।
আর্দ্র অবাক চোখে দেখছে টুকটুকিকে। আর্দ্র ছোট থেকেই মেয়েদের থেকে অনেক দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কোনো মেয়েকেই পাত্তা দেয়নি তেমন। কিন্তু এই মেয়েটার হাসিতে হৃৎপিন্ড লাফিয়ে ওঠে আর্দ্রর। কেমন যেন লাগে। সে দিন রাতে টুকটুকিকে দেখার পর থেকে মনের ভেতর কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি রেশ টেনেছে মনে। কিছুতেই ভুলতে পারছিল না টুকটুকির চেহারাটা। কিন্তু ঐ বাড়িতে যাওয়ার সাহসও পায়নি। মন চাইলেও মস্তিষ্ক বাধা দিয়েছে বরাবর।

টুকটুকি হাসি থামিয়ে আবার হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করে,
~কি?
~বাড়ি যাবে তো এখন?
উপর নিচ মাথা নাড়ায় টুকটুকি।
~চল। আমি দিয়ে আসি।

টুকটুকি হাতের ইশারায় দ্রুত না করে,দেখায় হেটেই বাড়ি যাবে ও। আর্দ্র এবার একটু বিরক্ত হয়। খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বলে,
~তুমি কথা কেন বলো না? ইশারাই করে যাচ্ছ তখন থেকে।
নতজানু হয় টুকটুকির। হঠাৎই মনটা খারাপ হয়ে গেছে আর্দ্রর কথায়। ড্রেসের পকেটে থাকা ছোট ডায়েরিটার একটা পাতা কুট করে ছিড়ে কি যেন লিখে এগিয়ে দেয় আর্দ্রর দিকে।

আর্দ্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো কিছু সময়। তারপর চিরকুটের লিখাটা পড়ে নিল।

~বাবা ভালো না। পঁচা। রাগী। বাবা আদর করে না। পছন্দ করে না। ভালোবাসে না। বাবা ভালো না।

দীর্ঘ নয়বছর পর বাড়ি ফিরছেন ফাজর জামান। সে আসার পর থেকেই কেঁদে চলেছে রেহানা। ফাজর জামান বাড়ি ছেড়ে ছিল টুকটুকির জন্য। বোবা মেয়ের বাবা হয়ে তিনি থাকবেন না। রেহানা তো মা তাই টুকটুকিকে আগলে রেখেছেন এতগুলো বছর। স্বামী ছাড়া থেকেছেন। টুকটুকিকে মোটেই পছন্দ নয় তার।

টুকটুকির হাতের চিরকুটের লেখাগুলো যেন বজ্রপাতের মতো হানা আনে আর্দ্রর শরীর। এত সুন্দর বাচ্চা মেয়েটা কথা বলতে পারেনা! কিছুক্ষণ অষাঢ় হয়ে আর্দ্র তাকিয়ে রইলো টুকটুকির দিকে। মেয়েটার চোখ মুখ দিয়ে মায়া যেন উপছে পড়ছে। একটা পবিত্রতা আর বাচ্চামোর ছাপ আছে। যেটা আর্দ্রকে খুব গভীরভাবে স্পর্শ করে।
টুকটুকির কাছে থাকলে দুনিয়ার সব কিছু ভুলে যায় আর্দ্র।

আর্দ্র ওর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে হাতের তুড়ি বাজালো টুকটুকি। আর্দ্র হুঁশ ফিরতে দেখলো টুকটুকি আরো কয়েক হাত এগিয়ে গেছে। দৌড়ে গিয়ে আবার ওর পাশ ধরে হাটতে লাগলো।

আর্দ্র অনুরোধের কন্ঠে বললো,
~বাড়ি তো হেঁটে যেতে চাচ্ছো। আমি গল্প করতে করতে সংঙ্গ দিতে পারি কি ম্যাডাম?
টুকটুকি আবার হাসলো। মাথা নাড়িয়ে জানালো,
~হুম।
~ধন্যবাদ আমাকে এতবড় সুযোগ দেয়ার জন্য।

টুকটুকি হাটছে। আর্দ্রও চুপ। নিরবতার মাঝে দমকা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে দু’জনকে। আর্দ্র মনে মনে একবার ভাবলো,কাজটা সে ঠিক করছে না। মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে মন জয়ী হচ্চে বারবার। আর্দ্রর ভালো লাগছে মুহূর্তটা। আর্দ্র থমথমে গলায় টুকটুকিকে বললো,
~শাড়ি পড়তে ভালোবাসো?

টুকটুকি মাথা নাড়িয়ে হাত দুলিয়ে অনেক কিছু বুঝাতে চাইলো। কিন্তু আর্দ্র কিছুই বুঝছে না। কিচ্ছুটি না,,। ওর খুব রাগ হয় মাঝে মাঝে। একমাত্র নুহাস ছাড়া ওর কথা কেউ বোঝেই না।
ব্যাগ থেকে খাতা আর কলম বের করে লিখে দিলো।
~হুম খুব করে বাসি। কিন্তু পড়ে থাকতেই পারি না। দাদু পড়ায় দেয়।
আর্দ্র হাসলো। অর্থবোধক হাসি। টুকটুকি কিছুটা লজ্জা পেল। তারপর আবার লিখলো,
~আচ্ছা আপনার বাসা কোথায়?

~তোমার বাড়ি থেকে দশ মিনিট। একই এলাকা।
~বাহ! নুহাস ভাইয়া আসলে পরিচয় করিয়ে দেব। হিহিহি।
আর্দ্র এবার না হেসে পারল না। মেয়েটা খুবই বাচ্চামি করে। আর্দ্র খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বললো,
~তোমার বাসায় কে কে আছে?
~উমম। মা,নিবির ভাইয়া,নুহাস ভাইয়া,দাদু,চাচা,চাচিমনি,মিশ্মি,মালিহাপু।
~বাবা নেই?

টুকটুকির মুখটা এবার চুপসে এলো। বাসার সামন অবদি পৌঁছে গেছে দু’জন। আর্দ্র কিছু ভেবে বললো,
~আমি আসলে বুঝতে পারিনি। সরি।
টুকটুকি কাগজে কিছু লিখে আর্দ্রর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর কাগজটা হাতে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।

আর্দ্র কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে রইলো কিছু সময়। তারপর চিরকুটের লিখাটা পড়ে নিল।

~বাবা ভালো না। পঁচা। রাগী। বাবা আদর করে না। পছন্দ করে না। ভালোবাসে না। বাবা ভালো না।

টুকটুকি বাড়ি ফেরার পরই মুখমুখি হলো ফাজর জামানের। টুকটুকিকে দেখে এত বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিলেন যেন তার চোখ গুলো রসগোল্লায় পরিনত হয়েছে। মন্ত্র-তন্ত্র জানা থাকলে তো টুকটুকি তার চাহনীতে জ্বলে পুড়ে যেত। ফাজর রহমানের এভাবে তাকানোতে টুকটুকির ভেতর হাসিতে বিস্ফরিত হলেও বাহিরে ঠোঁট চেঁপে হাসি আটকে রাখলো।

ফাজর জামান টুকটুকির আপাতমস্তক দেখে নিলেন। মেয়েটাকে দেখলেই কেন যেন তার ঘাড়ের রগ খাড়া হয়ে যায়। তার উপর টুকটুকি এমনভাবে দাড়িয়ে আছে যেন তাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। এত অপমান তিনি সহ্য করবেন না। কিছুতেই না। ব্যাপক রাগ হচ্ছে তার।
রকচটা হয়ে আরো রাগ দেখিয়ে বললেন,

~ওই মেয়ে এখানে এমনে দাড়ায় আছোস কেন? যা আমার চোখের সামন থেকে। এক্ষুণি যা বলছি।

টুকটুকি তার কথায় পাত্তা না দিয়ে তার দিকে এগোতে লাগলো। ফাজর জামান একটু অবাক হলেন। কি সাংঘাতিক মেয়েরে এটা। যেতে বললে চলে আসে!
হন্তদন্ত হয়ে বললেন,

~আর এক পাও আসবি না। পিটুনি দিব কিন্তু।

টুকটুকি তারপর ও ফাজরের কাছে গিয়ে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল ওনার হাতে। ফাজর জামান খুলে দেখেন তাতে লিখা,

~এমা আব্বু তুমি তো দেখি টাকলা হয়ে গেছ! মাথাটা একদম কদবেলের মতোন! হা হা হা।

লিখাটা পড়ে ফাজর জামানের শরীরের রক্ত ফুটন্ত পানির মতো বলকাতে লাগলো। কিহ! এতবড় অপমান? টাক তো কি! এটা এমনে বলতে হবে? এটা সহ্য করা যায়?
বিস্ফরিত চোখে ফাজর জামান তাকালো টুকটুকির দিকে। সাথে সাথেই দু’হাত কানের কাছে নিয়ে,চোখ ট্যারা করে,জিহ্বা বের করে ভেংচি কেটে টুকটুকি দৌড়ে পালালো মনোরমার ঘরের দিকে।

ঘটনার আস্মিকতায় ফাজর জামান বোকা বনে গেলেন। প্রচন্ড রাগ হওয়ার বদলে দাঁত কেলিয়ে হেসে ফেললেন। মিনিট দু’য়েক হাসার পর তার খেয়াল হলো তার সম্মান যাও বাঁচা-পুচা ছিলো সব ওই বোবা মেয়েটা পাঞ্চার করে দিয়ে পালিয়ে গেছে।
বাড়ির ড্রইং রুমে সবার সামনে তাকে টাক বলে ভেংচি কেটে চলে গেল? হবে না। এ হবে না। এর প্রতিশোধ ওনি নেবেনই!

সদ্য গোসল সেরে ছাদে এলো আকিকা। ইদানিং নিজেকে একদমি সময় দেয়া হয়না। খেয়াল রাখার মানুষ নেই একটা।

আর্দ্র তো পাগলের মতো খেঁপে উঠেছে পুতুলকে খুঁজতে। পুলিশ,গোয়ান্দা,উচ্চ পর্যায়ের নেতা সবাইকে হেনস্ত করে ছাড়ছে। তার সবসময় শুধু পুতুলের জন্য। এদিকে যে তার জন্য একটা মেয়ে সারাক্ষণ অধির হয়ে বসে থাকে সে খেয়াল আছে কি তার?

পুতুল আকিকার নিজের বোন। পৃথিবীতে আর্দ্র আর সেই শুধু আছে। তবে ভয় হয়। প্রচন্ড ভয় হয়।
মাঝে মাঝে মনে হয় আর্দ্র পুতুলকে ভালোবাসে। আবার নিজেকে বকেই সে ধারণা পাল্টে নেয় আকিকা। যদি তেমনটাই হয় তবে ওর কি হবে?
এতগুলো বছরের ভালোবাসার চেয়ে ভ্রান্ত ধারণার প্রেমের অপেক্ষা কোন অংশেই বড় নয়। বড় হতে পারেনা। আকিকার কাছে পুতুলের থেকেও বড় সত্য আর্দ্রর প্রতি ওর ভালোবাসা।

ছাদে এসে দাড়াতেই ক্রুশেভ এসে দাড়ালো আকিকার পাশে। আকিকা এবার একটু বিরক্ত হলো। কটকটে গলায় বললো,

এই ছাদ থেকে পালিয়ে যাব না। সো ডোন্ট ফলো মি ড্যাম ম্যান।

ক্রুশেভ হাসকা হাসলো। আকিকার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার হাসিতে ফেটে পড়লো। আকিকা নাকের পাটা ফুলিয়ে বললো,

হোয়াট? আমি হাসার মত কিচ্ছুটি বলি নি।

তোমার পিছু সেই অনেক বছর আগে থেকে ধরেছি। বোধ হয় খেয়াল করোনি।
করতে চাই ও না।
কেন? এতটা খারাপও নই আমি। তোমার জন্য তো পার্ফেক্ট।

আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ ম্যান। কেন পড়ে আছ আমার পেছনে? তুমি ইঞ্জিনিয়ার। দেখতে ভালো। আমেরিকার অধিবাসী। ওখানে তোমার জন্য মেয়ের অভাব হবে না।


পর্ব ৪

ক্রুশেভ আকিকার মাথার পেছনে চুল ধরে টান দিয়ে নিজের সামনে নিয়ে এল। আকিকা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্রুশেভের ঠোঁট আবদ্ধ করলো আকিকার ঠোঁট দুটো। আকিকার চোখ বড়বড় হয়ে গেল। দু’হাত দিয়ে ক্রুশেভের বুকে ধাক্কা দিতে লাগলো। ক্রুশেভ আকিকার কোমর টান দিয়ে উঁচু করে মিলিয়ে নিল নিজের সাথে। রুদ্ধশ্বাসে আকিকার ঠোঁটের স্বাদ নিতে ব্যস্ত সে। যেন হাজার বছর ক্ষুধার্থ ক্রুশেভ।

আকিকা অনেকক্ষণ ধাক্কানোর পর ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল। চোখ বুজে নিল। ক্রুশেভ বেশ কিছুক্ষণ পর আকিকার ঠোঁট ছেড়ে কিছুটা সরলো। আকিকা বাচ্চাদের মত চোখ বুজে আছে। হালকা করে আরেকটা চুম খেল ওর ঠোঁটে। বৃদ্ধাঙ্গুলিয়ে বুলিয়ে দিল আকিকার লাল হয়ে যাওয়া ঠোঁটে।
তারপর ধাক্কা দিয়ে অনেকটা দূরে সরিয়ে ডান হাতের পেছন দিয়ে মুছে নিল নিজের ঠোঁট।
ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে আকিকা সজোরে বারি খেল রেলিং এর সাথে। চোখ খুলে অবাক হয়ে দেখলো ক্রুশেভকে। ক্রুশেভ এগিয়ে এসে আকিকার দিকে ঝুঁকে রেলিং ধরে দাড়ালো।
হিংস্র চোখে আকিকাকে দেখে বললো,

নির্বোধ মেয়ে। মরিচিকার পেছন ছুটছো তুমি। আর্দ্র ডোন্ট লাভ ইউ। এন্ড হি ক্যান্ট লাভ ইউ। আমার সারটা লাইফ তোমার পেছন দিয়েছি। তোমার বডিগার্ড হয়ে আছি তোমার জন্যই। খ্রিষ্টান থেকে মুসলিম হয়েছি। আর কি চাই তোমার? ইডিয়ট।

সঙ্গ এর মত দাড়িয়ে আছেন ফাজর জামান। চোখ দু’টো চড়াক গাছ হয়ে গেছে তার। বাংলাদেশে আর্দ্রর ফার্ম হাউজে এই প্রথম এসছেন ফাজর। কিন্তু আসার পর যে এমন অনাকাঙ্খিত কিছু দেখতে পাবেন বুঝতে পারেন নি।

আর্দ্র ওয়াশরুমে শাওয়ার নিচ্ছে দেখে নিজেই ফাইল নিতে এসছিলেন আর্দ্রর রুমে। এর আগে আমেরিকা থাকতেও কখনো আর্দ্রর ঘরে তিনি আসেননি। প্রয়োজন বোধেও না। রুমে ডুকেই উত্তর কর্ণারের দেয়ালে টাঙ্গানো দেখলো টুকটুকির ছবি। লাল একটা ফ্রগ পড়ে আছে টুকটুকি। একটা সুন্দর মতন শাড়ি পড়া মেয়ে কোলে নিয়ে রেখেছে ওকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না ফাজর।
আর্দ্র ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ফাজর জামান দাড়িয়ে। হালকা হেসে বললো,

তো,মিষ্টার জামান,রিমঝিম প্রজেক্টের মিটিংটা আজ নাকি কাল ফিক্সড করলেন?

জামান হা হয়েই দাড়িয়ে রইলেন। ফ্যাশফ্যাশে গলায় বললেন,
স্যার ছবিটা কার?

আর্দ্র ফাজরের কথা শুনে তার চোখ অনুসরণ করে তাকালো টুকটুকির দিকে। গলা ভিজে এলো আর্দ্র। চোখ হঠাৎই চকচকে হয়ে এলো। ঢোক গিলে বললো,
পুতুল। আমার পুতুলের। পাশে যে আছেন আমার খালামনি। আনা। আর তার কোলে আমার পুতুল। আফরা।

মানে? এ কিভাবে সম্ভব। ও টুকটুকি। আমার মেয়ে।

নুহাস রাগ করে কথাই বলছেনা টুকটুকির সাথে। সকাল থেকে রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে করে পাগল টুকটুকি। তবুও ক্লান্তি নেই মেয়েটার। একটু পরপর ভিডিও কল দিচ্ছে। নুহাস রিসিভ করে ব্যাপক মুড নিয়ে বসে আছে। টুকটুকি কান ধরছে,নাক ধরছে,হাত জোর করছে,শেষে অজ্ঞান হওয়ার ভানও ধরছে। লাভ’ই হচ্ছে। নুহাস রাগ করে আছে তো আছেই।
শেষ মেশে রাগে ফুঁপাতে ফুঁপাতে টুকটুকি ইশারায় বললো,
~আমি কিন্তু রাগের চরম সীমানায় আছি এবার। কামড়ে দিতে পারলে ভাল হতো।
~ইশঃ। এমন একটা দেখাচ্ছো যেন দোষ সব আমার। এত অবাধ্য কেন তুমি হে?
টুকটুকি ইনসেন্ট একটা লুক নিয়ে বসে রইলো। চোখ মুখ খিঁচে প্রস্তুতি নিচ্ছে নুহাসের বকা শোনার। নুহাস ওর চেহারার ছলনায় না ভুলে বলে উঠলো,
~আমার কথা কি ভাল্লাগে না? এতবার করে বলছি গায়ে জ্বর নিয়ে বৃষ্টি ভিজবে না। জ্বর সারুক তারপর। শোনো কথা?
টুকটুকির মাথা আরো নুইয়ে গেল। অপরাধী চোখে তাকালো সে। ইশারায় দেখালো,
~সরি। আর হবে না।

~কালও তো এ’কথাই বলছো।
টুকটুকির মাথা আরো নিচু হয়। হাত নাড়িয়ে বলে,
~কাল তো আইসক্রিম খেতে না করলেন।
~ওফ! তুমি বহুত পাগল আছো
টুকটুকি এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে। নুহাস ও হাসে। মেয়েটার হাসি দেখলে প্রশান্তির ঝড় বয়ে যায় বুকে।

নুহাস দুষ্ট হেসে বলে,
~এখন তো দূরে আছো সোনা। বিয়ের পর এমন করলে কিন্তু আর আদরই করব না।
টুকটুকির মুখ লাল হয়ে গেল লজ্জায়। কান গরম হয়ে ওঠলো। নুহাসের দিকে তাকাতেই পারছেনা চোখ তুলে। নুহাস খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বললো,
~ভালোবাসি টুকটুকি। তুই আমার রক্তের সাথে মিশে গেছিস। নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে ভালোবাসতে হয় তোকে। নাহলে বড় কষ্ট দিস আমায়।

হি হি করে হেসে উঠলো টুকটুকি। মোবাইল টেবিলে রেখে ভিডিও কলে কথা বলছিল নুহাসের সাথে। নুহাসের কথার লজ্জায় আটকা পড়ে ওরণা দিয়ে মুখ ডাকলো টুকটুকি। ওঠে দৌড়ে চলে যেতে চাইলো ঘর থেকে। তার আগেই লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।

রেহানার চোখের জলে গাঁ ভাসছে। কিভাবে থাকবেন তিনি টুকটুকিকে ছাড়া? যে মেয়ে বুকে জড়িয়ে এক অন্ধকার আচ্ছন্ন রাতে মাতৃত্বের স্বাদ ভোগ করে ছিলেন,সে মেয়েকে হারাতে হবে! না পারবেন না রেহানা। শাড়ির আঁচল থেকে মুখ সরিয়ে রেহানা বললেন,
~এত এত হিংসা তোমার মেয়েটার প্রতি? শেষ পর্যন্ত এ বাড়ি থেকে তাড়ানো ব্যবস্থা কইরাই ছাড়লা? এজন্যে এজন্যেই আল্লাহ্ তোমারে বাপ হওয়ার ক্ষমতা দেয় নাই। কি ক্ষতি করছিল তোমার ঐটুকুনি মেয়েটা।

কলিজাটা ছ্যাত করে ওঠলো ফাজরের রেহানার কথা শুনে। কপট রাগ কন্ঠে মিশিয়ে দ্রুত বললেন,
~দেখ রেহানা। ভদ্রভাবে কথা বলো। ওটা টুকটুকির ফ্যামিলি। ওর অধিকার ওটা।
~রাখো তোমার অধিকার। আমি আমার মেয়েটাকে ছাড়া থাকতে পারব না।
~মেয়ে হারা হতে হবে না তোমায় রেহানা। আমার স্যার আর্দ্র মেয়েটাকে সেই ছোট্টকাল থেকে ভালোবাসে। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হয়ছিল। স্যারের খালা তাদের নিয়ে পালাইছিল। টুকটুকিরে নিয়ে যেতে পারে নাই। এখন খুঁজতে আসছে। টুকটুকি ভালো থাকবো ওখানে।
রেহানা সচকিত। মাথা বাকিয়ে শ্যাতশ্যাতে গলায় ফাজরকে বললো,
~কি বলতে চাও?

~আমার স্যার মানে আর্দ্র তো ভালোবাসে টুকটুকিরে। মে বি নিয়ে গেয়ে বিয়ে করে নেবে। তেমনটাই তো বলছিল।
রেহানা মাথায় হাত চেঁপে বসে পড়লেন খাটে। লোকটা এতদূর অবদি ভেবে ফেলেছে? অবশ্য টুকটুকির পরিবার এসে জোর করলে আটকাবার ক্ষমতা তাদের নেই। তবে নুহাস যে খুব ভালোবাসে মেয়েটাকে!

পরদিন সকালে আর্দ্রকে নিয়ে আসে ফাজর। টুকটুকিকে দেখে রীতিমত হচকিত আর্দ্র। টুকটুকিই ওর পুতুল? সে জন্যই কি টুকটুকিকে দেখলে অস্থিরতায় ছেয়ে যেত মন? এতটা ভালোলাগা কাজ করতো?
কই কখনো তো শাড়ি পড়া কোন মেয়েকে এত ভালোলাগেনি। কাজলের অভাবে চোখের স্নিগ্ধতা খুঁজেনি! তবে টুকটুকিকে ভালোলেগেছে। মায়ার লতা দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে মেয়েটা আর্দ্রকে।
আকিকা আর ক্রুশেভ ও এসেছে আর্দ্রর সাথে। আকিকার কলিজাটা মোচর দিয়ে ওঠছে বারবার।
এই মেয়েটা! এই মেয়েটা তার আপন। অতি কাছের। ওর নিজের রক্ত। বসার ঘরের সকলের সামনে টুকটুকিকে জড়িয়ে ধরলো আকিকা।

অদ্ভুতরকম ভাবে টুকটুকির শরীর থেকে ওর মায়ে গন্ধ পাচ্ছে আকিকা। সুখে চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা জল। অস্ফূটস্বরে বললো,
~বোন। আমার বোন। আমার কলিজাটা।


পর্ব ৫

নুহাসের কল আসতে দেখে পা কাঁপছে রেহানার। কি বলবে সে? চোখ বেয়ে পানি পড়ছে রেহানার। টুকটুকি যাওয়ার পর থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করতেই নুহাস বলল,
চাচি এটা কি করে সম্ভব? ওরা নিয়ে গেলেই আপনি যেতে কেন দিলেন? ওই যে টুকটুকির রিয়েল ফ্যামিলি তার কি প্রমাণ?

তোর চাচা আমার কোনো কথাই শুনলো না নুহাস। আমি কি করে থাকব আমার মেয়েটাকে ছাড়া বল?
টুকটুকি আর কল করেছিল তোমায়?
হুম একবার। ও ফোন দিয়ে আআ করছিল। তারপর আকিকা নামের মেয়েটা ফোন নিয়ে বলল ও ভালো আছে। যখন ইচ্ছে ওকে ফোন দিয়ে কথা বলতে।
তুমি নম্বরটা দাও আমাকে।
আচ্ছা দু’মিনিট ধর। আমি দিচ্ছি।

আচ্ছা।
একটু পর রেহানা নুহাসকে বলল,
মেসেজ করে দিয়েছি। দেখে নে। বাবা তুই কবে আসবি? দ্রুত এসে বিয়ে করে আমার মেয়েকে আমার কাছে এনে দে।
কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো রেহানা। নুহাস তাকে বলল,
চিন্তা করো না চাচি। আমি খুব দ্রুত আসব। আর ওরা নিশ্চয়ই খেয়াল রাখবে টুকটুকির। তুমি রোজ ওকে দেখে এসো।
আচ্ছা বাবা।

আমি রাখি তাহলে। অপারেশন আছে এর পর একটা। ভালো থেকো।
তুই ও খেয়ার রাখবি নিজের। আর টুকটুকিকে নিয়ে একদম চিন্তা করবি না।
কল কেটেই মোবাইল সোফায় ছুড়ে মারল নুহাস।
দেখতে দেখতে একমাস কেটে গেল। রেহানার খারাপ লাগাটাও এবারে কমে এসেছে। টুকটুকি প্রত্যেকদিনই আসে এবাড়িতে। কখনো রাতে দেখেতে মন চাইলেও আর্দ্র নিজে নিয়ে আসে ওকে। আর্দ্র ছেলেটা বেশ ভালো তাও বুঝতে পেরেছে রেহানা।

রাত ১২টা বেজে ৩৮মিনিট। ছাদের বড় দোলনাটায় বসে আছে আকিকা। দৃষ্টি দূরের আধো আধো দেখা যাওয়া নদীটাতে। ভাবছে মানুষের জীবনটা কেমন অস্থিতিশীল। কোথায় এর শুরু আর কোথায় এর শেষ তা ঠাওর করা মুশকিল। আর ভালোবাসার এত ছড়াছড়ি চারিদিকে যে কোনটা আসল আর কোনটা নকল বোঝা মঙ্গল অভিজানের থেকে কোন অংশে কম নয়।

ক্রুশেভ আকিকার ঘরে তাকে না পেয়ে ছাদে এলো। চুপচাপ গিয়ে বসলো আকিকার পাশে। আকিকা নড়ল-চড়ল না। অন্য সময় হলে এতক্ষণে ক্রুশেভের এককান নষ্ট করে ছাড়তো। ক্রুশেভ হঠাৎই বলল,
এই নদীটা খুবই সুন্দর তাই না?
হুম। দেখলে চোখের রেশ কাটে। নদীর ঠান্ডা বাতাসে শরীর শিহরিত হয়।
ভালো লাগে খুব।
কই আমার তো কাটে না!

ক্রুশেভের কথায় চমকে তাকায় আকিকা। দেখে ছেলেটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আজ ক্রুশেভের কথায় একটা গাঢ় ক্লান্তির ছাপ আছে। চোখ মুখে অভিমান। আকিকার খুব ইচ্ছে করছিল একবার ছুঁয়ে দিতে ক্রুশেভকে। কিন্তু কোথায় যেন একটা বাধা পাচ্ছে।
দোলনা থেকে ওঠে গিয়ে দাঁড়াল ছাদের কর্ণারের দিকে। ছাদের সাইডে রেলিং নেই বলে রাতের আঁধারে আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠেছে জায়গাটা।

উত্তর দিক থেকে ছাদের উপর ঝাপটে পড়া জারুল গাছটায় পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা ফুলগুলো থেকে আসা মিষ্টি ঘ্রাণে নেশাতুর হয়ে আছে পরিবেশ।
ক্রুশেভ ও পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে আকিকার। আকিকা আড়ঁ চোখে বার দুইয়েক দেখলো ক্রুশেভকে। সাদা আর কমলার মিশ্রনে একটা সুতি পাঞ্জাবি পরা ক্রুশেভ‌। আকিকা এই প্রথম তাকে পাঞ্জাবি পরা দেখছে। তারপর চোখ সরিয়ে নিল আবার‌।

ক্রুশেভ খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বললো,
খুব বেশি বিরক্ত করি আমি? দেখলেই দূরে সরে থাকতে হয়!
শুধু বিরক্ত না অনেক অনেক বেশি বিরক্ত করো।
না থাকলে খুশি হবে?
আকিকার বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে ওঠে। কি বলছে এসব ক্রুশেভ! না থাকলে মানে?
ভেতরের চিন্তা ভাবনা সব দূরে সরিয়ে বাজখাঁই গলায় ভ্রঁ কুঁচকে বলল,
কোথায় যাচ্ছ?
ফিরে যাচ্ছি। আম্মুর শরীরটাও বেশি ভালো নেই।
বাবাহ বাঁচা গেল!

আকিকার সহজ কন্ঠ। ক্রুশেভ ভ্রু কুঁচকে তাকাল একবার। হঠাৎ আকিকাকে টান দিয়ে সামনে এনে বলল,
তুমি কি একটা মেয়ে? আমার ভালোবাসা চোখে পড়ে তোমার? কেন এত কেয়ারলেস তুমি আমার বিষয়ে? আমার ভেতরের কষ্টটা কি দেখতে পাও না তুমি?
আকিকা জোরে বলে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে নিজেকে। কিন্তু ক্রুশেভের শক্তির কাছে নিতান্তই ছোট ও।
আশ্চর্য হওয়ার ভান করে আকিকা বলে,
ক্রুশেভ খারাপ হচ্ছে এটা। ছাড় আমাকে। হাউ ডেয়ার ইউ টাচ মি। ইউ আর মাই গার্ড নট বয়ফ্রেন্ড। লিভ মি।

ক্রুশেভের চোখ দুটো এবার লাল হয়ে এলো। রাগে ক্ষোভে ঠোঁট টিপে টিপে বলল,
হুম চলেই যাচ্ছি‌। সারা জীবনের মত মুক্তি দিয়ে যাচ্ছি তোমায়। পরশু আমার ফ্লাইট। এর পর আর কোনদিন আমার চেহারা তোমায় দেখতে হবে না কথা দিচ্ছি। বাট আই লাভ ইউ পর এভার। সারা জীবন অপেক্ষা করে যাব। বাট তুমি খুঁজে পাবে না আমাকে।

আকিকা যেন ঘোরের মাঝে লুকিয়ে গেল। বিষিয়ে আসছে মন। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। ঘন শ্বাসকে ঠান্ডা করতে চোখ বুজে লম্বা শ্বাস নিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিল ক্রুশেভকে। ক্রুশেভ শক্ত হয়ে একই স্থানে দাঁড়িয়ে রইলো কিন্তু আকিকাকে ছেড়ে দিল।
হঠাৎ নিচ থেকে আর্দ্রর চিৎকারে আকিকা আর ক্রুশেভ চমকে ওঠে। দু’জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে কি হয়েছে বিষয়টা ঠাওর করার চেষ্টা করে। তারপর দৌড়ে নিচে চলে আসে‌।
টুকটুকি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর আর্দ্র তার পাশে বসে হাতের তালুতে তেল মালিশ করছে। মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে।

পর্ব ৬

বিছানায় পাতা কালোর মাঝে লাল ছোঁপ ছোঁপ চাদরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে নুহাস। মন তার ভিতরে আবদ্ধ নেই। ডুবে আছে টুকটুকিতে। বাড়ি ফিরেছে একমাস হল। সে তার কথা রেখেছে। বাড়ির ফেরার আগেই টুকটুকির পছন্দ মতো কুচকুচে কালোর মাঝে সোনালী পাথরের কাজের ভারী লেহেঙ্গা কিনে এনেছে। টুকুটুকি তার বিয়েতে কালো পড়বে বলে। সাথে অন্যান্যসব সরঞ্জাম। বিয়ের গয়নাও গড়ে রেখেছেন রেহানা।
কিন্তু টুকটুকি মোটেই রাখেনি। দৌড়ে এসে ঝাপটে জড়িয়ে ধরেনি নুহাসকে। নুহাসের বুকে মাথাও রাখেনি।

বরং স্বার্থপরের মত সব কথা চুকিয়ে দিয়ে,সব আশা মিটিয়ে চলে গেছে।
নুহাস বাড়ি ফেরার পর রেহানার কাছেই জানতে পারে টুকটুকিকে নিয়ে ঢাকা চলে গেছে আর্দ্ররা। খুব কাঁদছিল মেয়েটা। যে নম্বরে টুকটুকির সাথে এতদিন কথা বলছিল নুহাস সেটাও নন-রিচেবল বলছে।

নুহাসের পুরো পৃথিবীটা যেন হঠাৎই কাল বৈশাখী ঝড়ের বিধ্বস্ত জমির মতো এলোমেলো হয়ে গেছে। সত্যিই নারীরা ঘরের সৌন্দর্য মনের মাধুর্য্য। একজন নারী যেমন এক পুরুষের জীবনচক্র সাজিয়ে তুলতে পারে তেমন নিমিষে বিধ্বংসী পিস্তলের আঘাতে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। নারী মানেই মহনীয়,নারী মানেই কোমলতা,নারী মানেই সূর্যমুখীর মতো প্রস্ফূটিত স্বত্তা,নারী মানেই ভালোবাসা,নারী মানেই ধ্বংসাত্নক।

টুকটুকি তবে মরিচিকা ছিল নুহাসের জীবনে। যারে ও পেয়ে তবে ধরা দেয়নি! কষ্ট হচ্ছে নুহাসের। হৃৎপিন্ডটা বিনা দ্বিধায় খুঁড়ে খুঁড়ে ভেতরটা ক্ষত করছে। টুকটুকিকে ছাড়া যে সে অভ্যস্ত নয়। নুহাসের ভালোবাসা তো কোন মোহ নয়। সে ভালবাসা তার অন্তর্লীন মাধুর্য্য নিয়ে চলতে থাকে আপন গতিতে। নুহাস ওঠে বারান্দায় গিয়ে সিগেরেট জ্বালায়। এ’একমাস সে বিভিন্নভাবে খুঁজেছে টুকটুকিকে।

ফাজর জামান কিছু কাজের জন্য আমেরিকা গিয়েছেন। আর ওনাকে নুহাস যতটুকু চিনে লোকটা পুরোই পাগল প্রকৃতির। সে কখনোই চাইবেনা যে নুহাস জানুক টুকটুকি কোথায়।
তবে টুকটুকিকে নিয়ে তার নতুন ফ্যামিলি হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার কারণটা মোটেই ঠাওর করতে পারছেনা নুহাস। টুকটুকির জন্মের যথাযথ প্রমাণ তারা দিয়েছে। অর্থাৎতার আপন লোক তারা। খারাপ কিছু তো করবে না টুকটুকির সাথে। তবে এরকম গাঁ ঢাকা দেয়ার মানে কি?

নুহাস পরদিন ভোরে ঢাকা চলে এলো। এসেই গুলশান রিজভির ফ্ল্যাটে ওঠলো। রিজভি নুহাসের স্কুলের বন্ধু। কাকতালিয়ভাবে স্কুল থেকে তাদের বন্ধুত্বের একসঙ্গে যাত্রা শুরু হয়,তারপর কলেজ মেডিক্যাল সব একসাথেই পড়া হয়। রিজভির মা নেই। বাবাআর দু’বোন নিয়ে ছোট্ট ফ্যামিলি। নুহাস ঢাকা আসলেই রিজভির কাছে থাকতে হবে তা রিজভি নিজেই নিয়ম করে দিয়েছে। ঢাকা পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর সাড়ে তিনটা বেজে গেল। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে একটু বিশ্রাম পর্বের পর রিজভি নুহাসের ঘরে এলো। নুহাস তখন বের হবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলছে। রিজভি অবাক কন্ঠে বলল,
এখনি কোথায় বের হচ্ছিস? একটু বিশ্রাম তো নিবি। কত পথ জার্নি করছোস।
নারে,ছাড় সেসব। টুকটুকিকে ছাড়া একসেকেন্ড স্থির থাকতে পারতেছিনা বিশ্রাম কেমনে? শরীরের শান্তি দিয়ে কি হবে? ভেতরটা যে পুড়ে যাইতেছে।
হুম বুঝতেছি আমি। কিন্তু এমন কেমনে করতে পারে ঐ মানুষগুলো? একবার ইনফর্ম তো করা উচিত ছিল।

জানি না। তবে মনে হয় ইচ্ছা করেই করছে। আমাদের থেকে সরানোর জন্য। কতদূর আর যাবে! আমার টুকটুকিকে তো আমি খুঁজে বের করবও। পাতালে নিয়ে লুকালেও।
কিন্তু এতবড় শহরে খুঁজবি কই দোস্ত? ঠিকানা জানার পরও মানুস খোঁজা ভয়ংকর কাজ। আর এখানে তো পুরা ঢাকা শহর!
আর্দ্র নামের যে ছেলেটা টুকটুকির ভাই তার ঢাকা বনানী আর মিরপুর নিজস্ব বাড়ি আছে। ওর বাড়ির কেয়ার-টেকারের কাছ থেকে জানলাম।

দুই এলাকায় খুঁজতে হবে তাই তো। এখন কই যাস?
অত্যাধিক বড়লোক মানুষ। বনানীর বাড়িটা বিশাল। সেখানে আগে খোঁজ নিই।
আচ্ছা চল। আমিও যাব।
যাবি বলছিস। চল তবে। সত্যি প্রত্যেকটা বিপদে তুই পাশে থাকিস ভাই। তোর কাছে দিনদিন আমার ঋণ বাড়তেছে।

রিজভি নুহাসের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
তোর জন্য এত ভালো লাইফ পেয়েছি আমি। সেখানে এসব কিচ্ছু না। আর অতসব ফালতু কথা তুলবি না মুখে।
নুহাস হাসলো। প্রসন্ন হাসি। রিজভি আর নুহাস মিলে দু’দিনে বানানীর সবটা খুঁজেছে। পায়নি টুকটুকিকে। এর পরদিন মিরপুর যাবে বলে স্থির করে নিয়েছে। ওখানে তাকে পেতেই হবে। শুধু ভয় এক জায়গায়। আর্দ্র দেশে সেটেল না। যদি টুকটুকিকে নিয়ে আমেরিকা চলে গিয়ে থাকে!

এতবার কল করার পরও ক্রুশেভের ফোন বন্ধ পাচ্ছে আকিকা। ফেসবুক আইডি ডিলিটেড। ইমো,হোয়াটস এপ,ইন্সট্রাগ্রাম সকল জায়গা থেকে ক্রুশেম উধাও। ইমেল একাউন্ট অকার্যকর।

আকিকার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। একটা মানুষ মাত্র কয়েকদিনে কিভাবে হুট করে নিজেকে সোশাল সাইট থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে? মাথায় ঢুকছে না আকিকার।
কিন্তু ক্রুশেভকে সে হারিয়ে ফেলেছে এতটুকুন ধারণা ঠিক হচ্ছে। খুব কষ্টও হচ্ছে।
আকিকার মতে ক্রুশেভকে সে পছন্দ করে কিন্তু ভালোবাসেনা। আর যে মানুষটাকে সে ভালোবাসে না,ভালোবাসতে পারবেনা তাকে নিজের লাইফের সাথে এভাবে জড়ানো বোকামো বৈকি কিছু না।

কিন্তু মেনে নিতে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে যে মানুষটা ক’দিন আগে অব্দি ছিল ওর পাশে আজ এভাবে হারিয়ে যাওয়াটা কি জরুরী ছিল? স্বামী-স্ত্রী,প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া কি পৃথিবীর বাকি সম্পর্ক গুলোর কোন দাম নেই?
এই তো আর্দ্র ওকে ভালবাসেনা। তাই বলে কি ও ছেড়ে গেছে আর্দ্রকে? না তো। বরং বন্ধুর মতো পাশে থাকবে সারা জীবন।

টুকটুকির অবস্থা বেশ নাজেহাল। আকিকাকে তার কাছে শাকচুন্নী আর আর্দ্রকে তার কাছে পিশাচের মতো মনে হচ্ছে। ওকে যেতেই দিচ্ছে না নুহাসের কাছে,রেহানার কাছে। আচ্ছা ও কথা বলতে পারে না,অন্যদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। তাই বলে কি ওর কষ্ট নেই নাকি? ব্যাথা হয়না? ওর আপনজন নেই? তাদের আদরের গহীনে থাকতে ইচ্ছে করে না!
টুপ করে ধরে নিয়ে এসেছে নতুন একটা জায়গায়। ও বুঝতেই পারেনি।

নুহাসের নম্বরে অনেক ট্রাই করার পরও লাগছে না। কি করবে ও এখন?
আচ্ছা ও আর্দ্রকে শিউলি ফুল যখন দিয়েছিল তখন আর্দ্র অনেক খুশি হয়ে ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। আজও নিশ্চয়ই দিবে। বাহ! কি সুন্দর আইডিয়া!
এত বুদ্ধিমতি ও! আগে তো জানতোই না! বাড়ির সামনের ছোটখাটো একটা বাগান মতো আছে। সেখান থেকে শিউলি ফুলে মুঠো ভর্তি করে টুকটুকি চলল আর্দর ঘরে।

পর্ব ৭

সিগেরেটে ধোঁয়া উড়িয়ে দিয়ে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে নুহাস। ইদানিং সিগেরেটের অভ্যাসটা বেড়ে বের সর্বচ্চ পর্যায়ে। নিঃসন্দেহে এর কারণটা টুকটুকি। এই পিচ্চি মেয়েটাকে ও পাগলের মতো এতটাই ভালোবেসেছে যে আকাশ পাতাল এক করে দিতে পারে ওর জন্য। তাও ওর চাই টুকটুকিকে।
একটা পয়ত্রিশ বেজেছে হাত ঘড়িতে। ডানে বামে তাকিয়ে দেখলো রাস্তাটা ভূতুরে হয়ে আছে। আলোবিহীন রাস্তায় খানিক দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় একটা দুটা কুকুর শোয়ে আছে। খিদে পেয়েছে খুব নুহাসের।

সেই সকালে খেয়ে বের হয়েছিল এরপর পেটে আর কিছু পড়েনি। মিরপুর-১,২,৩ খুঁজেছে,পেলনা। বাসা যেতে আরো ঘন্টাখানিক লেগে যাবে। তাছাড়া ও দিককার রাস্তায় জ্যামও পড়বে অনেক। একটা ছোটখাটো রেস্তোরাতে ঢুকে পড়লো নুহাস। চারদিকে কাঠের পুরাতন বেঞ্চি পাতা। দু’একজন লোক কয়েকটা টেবিলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। নুহাসের হাতে এখন টাকাও বেশি নেই। যা ছিল সব বাস ভাড়া,রিকশা ভাড়া আর পুলিশের পকেটে গেছে। এটিএম বুথটাও নেই আশেপাশে।

একটা বাচ্চা ছেলে সবাই খাবার দাবার দেয়ার কাজ করছে। নুহাস ওকে ডাকা দিতেই দৌড়ে এলো।
এই পিচ্চি। এদিকে আয়।
স্যার কন কি খাইবেন? কি কি দিমু?

টুকটুকির খিচুড়ি পছন্দ। নুহাসের সাথে থাকলে হয়ত তাই থেতে বায়না ধরতো। নুহাস একটু গম্বীর কন্ঠে বললো,
ভুনা খিচুরি আছে?
হো আছে। এইডা দিমু? সাথে কি দিমু?
উমম,সাথে গরু মাংস ভুনা থাকলে দে আর নাহলে ডিম ভাজি।
আইচ্ছা। গরুই আছে।

রেস্তোরা থেকে বের হয়ে একটা টং দোকানে চা খেয়ে রওনা হলো হসপিটালের দিকে। রিজভির আজ নাইট ডিওটি। হাসপাতালে যেতে রিজভি অবাক হলো নুহাসকে দেখে। ওদের পুরো ফ্রেন্ডসার্কেলের মধ্যে সবচেয়ে আর্কষণীয় দেখতে ছিল নুহাস। হাসিখুশি,শক্তি-সামথ্য। কিন্তু ওর সামনে এখন যে ছেলেটা দাড়িয়ে আছে সে মোটেই তেমন নয়। রিজভি ব্যাপক বিরক্তি নিয়ে ভ্রঁ কুঁচকে বলল,
খেয়েছিস রাতে?

হুম। খাইছি।
সত্যি নাকি মিথ্যা?
নুহাস হো হো করে হেসে ওঠে বলে,
আরে দোস্ত একটু আগেই খাইলাম। খিচুড়ি গরুর মাংস দিয়ে।

তো তোর চেহারার এই বিধ্বস্ত অবস্থা কেন? দেইখা তো মনে হইতাছে ভিক্ষা কইরা বাড়ি ফিরছস। ডাক্তারী তো মনে হয় সব ভুইল্লা গেছস।
নুহাস প্রসন্ন হাসলো। রিজভির মেজায এবার আরো গরম হল। বলল,
এমনে কয়দিন চলবি? নিজের একটু খেয়াল তো রাখতে হবে নাকি? নাহলে টুকটুকিকে খুঁজবি কেমনে?
নুহাস আবারো হাসলো। রিজভি রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
তুই শুনতাছস আমি কি বলি? পাগল হইয়া গেছস?

আরে ব্যাটা চেতস কেন? পাগল হইনাই। আমার কিছু ভাল্লাগে না। কোন কাজেই মন টেকে না। সব অসহ্য লাগে। টুকটুকির হাসির আওয়াজ কানে বারি খায়। ওর ইশারাগুলো মনে পড়ে। ওর পছন্দ অপছন্দগুলো আমার পছন্দ হয়ে গেছে। বুকটা ফাঁকা লাগে রে। অনেক ব্যাথা হয় এনে।
নুহাস শাহদাত আঙ্গুল দিয়ে বুকের বামপাশ দেখায়। রিজভির খুব অসহায় লাগে নুহাসের কন্ঠ শুনে। রিজভি অনুনয় করে বলে,
এইভাবে বলিস না প্লিজ। আর তো মাত্র ক’দিন তারপরই তো খুঁজে পেয়ে বিয়ে করে নিবি টুকটুকিকে। এভাবে ভেঙ্গে পরিস না।

হুম মিরপুর-৮ নম্বরে আছে ঐ আর্দ্রর বাড়ি।
তুই খুঁজে পেলি! গিয়েছিলি বাড়িতে?
রিজভি উৎকন্ঠা। বড়বড় চোখ করে চেয়ে আছে নুহাসের দিকে। নুহাস সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল।
না।
তাহলে?
কাল যাব।
আমিও যাব। এখন চল বাড়ি চল।
তোর না ডিউটি এখন?

রোকসানা আর বাবর আছে। সামলে নিবে। তোর বিশ্রামের দরকার। চল আমার সাথে।
না। ডাক্তারের নিজের ব্যাক্তিগত জীবনের আগে নিজের প্রফেশন। আমি একাই যাই।
তোকে একা ছাড়ছি না আমি।
তাহলে সকালেই যাব বাড়ি। এখানেই আছি রাতে। তোর চেম্বারে।
তুই বড্ড জেদি নুহাস।
হুম। সে আমি ছোট থেকেই।
রিজভির চেম্বারে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বড় সোফাটায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো নুহাস। ঘুমিয়েও গেল খানি বাদে।

টুকটুকির ঠোঁটের হাসি দেখে সমুদ্রের ঢেউ এর মতো খুশির জোয়ার খেলে গেল আর্দ্রর মনের কিণারায়। একটা মেয়ে এতটা বাচ্চা কি করে করে? এতটা প্রশান্তি ওই হাসিতে! আসলে নারী শব্দটার সাথে পবিত্রতা শব্দাই শুধু খাপ খায়।

আর্দ্রর চোখ মুখ কুঁচকে এসেছিল যখন টুকটুকি ওকে শিউলি ফুল দিয়ে নুহাসের কাছে যাওয়ার বায়না ধরেছিল। এখানে আসার পর থেকে টুকটুকির মুখে আনন্দের ছিটেফোটাও দেখেনি আর্দ্র। ভেবে নিয়েছিল এই ছোট্ট হৃদয়টাতে হয়ত অনেকটা আঘাত করেছে আর্দ্র।
আকিকা টুকটুকিকে কি একটা রান্না শিখাচ্ছে। আআ ধ্বনি তুলে টুকটুকি তা গভীর মনোযোগে শিখছে। একটু ভুল হলেই আকিকা বকছে,আর দুষ্টমি করে হাসছে টুকটুকি। আর্দ্র ওদিকটাতে এগিয়ে যেতেই নজরে পরলো ওর। নাকের পাটা ফুলিয়ে মুখ লাল করে নিজের ঘরে চলে গেল টুকটুকি। আকিকা হতবম্ব হয়ে চেয়ে রইল।

গালে হাত দিয়ে বসে আছে রেহানা। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোকা মনে হচ্ছে। মনোরমা তার লাঠি ঠেকিয়ে নেমে এলো উঠানের দিকে। নুহাসকে দেখে আশেপাশে তাকাল। চশমা খুলে মুখের গরম হাওয়া দিয়ে কাপড় ঘষে আবার চোখে দিয়ে বলল,
টুকটুকিআমার নাতনি সোনাটা কই? কই লুকাইয়্যা আছোস ‘রে ছ্যামরি? বুড়ি বয়সে কি এত খুঁজতে পারিরে? বাইরাইয়্যা আয়।

রেহানার কান্নার বেগ আরো বাড়লো। মনোরমার কপাল কুঁচকাল। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,
এহন অমনে কাইন্দো না তো। মাইয়্যাডার কষ্ট হইব। কত্তদিন পর আইছে।
নুহাস মনোরমাকে একবার দেখে বাড়ির সিড়িতে বসল। রিজভি বলল,
টুকটুকি নাই দেশে। আমেরিকা নিয়ে গেছে ওরে। চৌদ্দ দিন আগেই।
মনোরমার ভেতরটা ছ্যাত করে ওঠল। নাতনিকে দেখবে বলে অনেক কাঁচা আমের আর তেতুঁলের আচার বানিয়ে রেখেছে মনোরমা। রিজভির কথা শুনেও ঠান্ডা আছে ও। বিপদেও প্রচন্ড ভেবে চিন্তে কাজ করতে পারে মনোরমা। কোমল গলায় মনোরমা বলল,
এত তাড়াতাড়ি?

নুহাস ভাঙ্গা গলায় বলল,
টুকটুকিকে দার্জিলিং পছন্দ ছিল। হানিমুনে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আগে থেকেই পাসপোর্ট বানিয়ে রেখেছিলাম। চাচি সেটাও দিয়ে দিছে। তাই দ্রুত নিয়ে যেতে পারছে।
তুই যাবি না ওরে আনতে?
নুহাস একপলক দেখেল মনোরমাকে। পায়ের আঙ্গুলে আঙ্গুল ঘষছিল নুহাস। নিচুস্বরে বলল,
পৃথিবীর যে প্রান্তেই নেক আমার টুকটুকিকে আমি নিয়ে আসবই আমার কাছে।
আমিও যামু। আমারে লইয়্যা চল।
আর্তনাদ করে ওঠলো মনোরমা। উপস্থিত সকলেই হতচকিত। নুহাস বলল,
পাসপোর্ট?

হজ্জ কইরা আইলামনা!
এত জার্নি শরীরে সইবে না।
পারমু আমি। আমি যামুই। আমরা লইয়া চল।
ভেজা কন্ঠ মনোরমা। নুহাস তাকে এতবার দেখল। কি একটা ভেবে বলল
আচ্ছা।

পর্ব ৮

চিন্তিত চাহনী মিলরেঞ্জ ড্রিকারের। টুকটুকির রিপোর্টটা আর্দ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে সংকিত কন্ঠে বলল,
ক’দিন যাবৎ হচ্ছে এমনটা?
আমার কাছে আছে দেড় মাস। সাত আটবারের মতো মাথা ঘুড়ে পড়েছে। এবার প্রচন্ড লেগেও ছিল।

আর কোন সিনড্রম?
নো ডক্টর।
লাস্ট কবে মাথা ঘুরেছিল?
আজ মনিং এ। খাচ্ছিল তখন।
ওকে। বাট রিপোর্টটা মে বি পুরোপুরি সঠিক হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। আরেকবার চেকআপ করিয়ে নাও।
ওকে ডালরেঞ্জ।
আর্দ্রর পাশে বসে মুখ বোতা করে কথাগুলো শুনছিল টুকটুকি। তবে মোটেই ইচ্ছা করছিল না শুনতে। ডাক্তার লোকটা কেমন যেন দেখতে। আসলে এই দেশেই সবাইকেই টুকটুকির কাছে ধবল রোগীর মতো লাগে। কারো চোখে মুখে মায়া মমতার ছিটে ফোঁটা পায়না। অথচ দেশি মানুষগুলো কতো আপন!
অচেনা কেও মনে হয় নিজের লোক।

নুহাস আর মনোরমা দশ মিনিট ধরে বসে আছে নুহাস আর মনোরমা। আর মাত্র ছ’মিনিট পরেই উঠতে হবে প্লেনে। অবশেষে রিজভী এলে সবাই প্লেনে করে রওনা করে আমেরিকার উদ্দেশ্যে।
চেকআপ করিয়ে বাড়ি ফিরেও শান্ত হয়ে বসতে পারছে না আর্দ্র। মনের মাঝে অশান্তির ঘন্টা বেজেই চলেছে। বড়সড় কোন রোগ যদি টুকটুকির থেকেই থাকে তাহলে এতদিন যেখানে ছিল তাদের চোখে কিভাবে পড়লো না?
এজন্য বোধ হয় বলে আপনি লোক আপনই হয়। পর কখনো আপন হয় না। রিপোর্ট আজ বিকেলে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডাক্তার আর নার্সদের অবরোধ আজ আর কাল তাই পরশু আনতে হবে রিপোর্ট।

টুকটুকিকে এভাবে হুট করে নিয়ে আসার কোন ইচ্ছাই আর্দর ছিল না। কিন্তু নুহাসের প্রতি ওর টানটা যেন কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করতে পারছিল না আর্দ। এতগুলো বছর পর ওর পুতুলকে ফিরে পাওয়ার পর হারানোর কোনো মানেই হয় না। এতদিন তার স্মৃতি ধরে বেঁচে এসেছে খুব দ্রুতই তাকে একদম নিজের করে নিবে আর্দ্র।
আমেরিকা পৌঁছে Seattle’s largest Premier হোটেলে ওঠলো নুহাসরা।
সামান্য কিছু রেস্ট নিয়েই নুহাস একা বের হয়ে গেল। মনোরমা তখন গভীর ঘুমে। ক্লান্ত হয়ে গেছেন তিনি।

আর্দ্র আমেরিকার মোটামোটি অনেক মানুষের সাথেই পরিচিত। তাই ওর বাসা খুঁজে পেতে খুব বেশি অসুবিধা হলনা নুহাসের। বরং বাংলাদেশের চেয়ে দ্রুত খুঁজে পেল। বাড়িটা একটা বাংলোর মতো দেখতে। নুহাস বাহির থেকে দেখেই হোটেল ফিরে এলো।
রিজভি তখন বেলকনিতে বসে ছিল। নুহাসকে আসতে দেখে বাঁজখাই গলায় বলে,
কই গেছিলি তুই?
নুহাস মাথা তুলে একবার দেখে রিজভিকে। তারপর শার্ট খুলতে খুলতে বলে,
আর্দ্রর বাড়ি খুঁজতে।

একটু রেস্টও নিলিনা। হুট করে চলে গেলি। পেয়েছিস?
হুম।
নুহাস খালি গায়ে তোয়াল নিয়ে ঢুকে পরে বার্থরুমে। গোছল করে বের হতেই দেখে রিজভি বড়বড় চোখ করে দেখছে ওকে। নুহাস পাত্তা না দিয়ে বলল,
অনেকদিন ঘুমাই না। আজ ঠিক মত ঘুমাবো। নিজে থেকে উঠার আগে যদি দুনিয়া কেয়ামত হৎএ যায় তাও আমায় ডাকবি না।
হুম।
রিজভি বোকা বনে গেল।

পর্ব ৯

ডা ড্রিকার সকাল সকাল ডেকে পাঠায় আর্দ্রকে। টুকটুকির রিপোর্ট তৈরী হওয়ার পর সরাসরি তার কাছে গেছে। আর্দ্রকে দেখে ড্রিকার বললেন,
‘বসো তুমি। ‘

আর্দ্র তখন বেজায় চিন্তিত। ড্রিকার কি বলবে তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তার। আর্দ্র খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বলল,

‘ডাক্টর প্লিজ টুকটুকির বিষয়টা একটু দ্রুত ক্লিয়ার করুন। বড় ধরনের কিছু হয়নি তো? ‘

ড্রিকার তার চেয়ারে বসে কিছু একটা ভাবলেন। তারপর আর্দ্রর দিকে একটা রিপোর্ট এগিয়ে দিলেন। আর্দ্র কাঁপা হাতে নিলো রিপোর্টটি। ডাড্রিকার বলা শুরু করলেন,

‘বড় ধরনের কিছু না মাই সন। বেশি টেনশন নিও না। তবে টুকটুকির মধ্যে ভেসোভেগাল অ্যাটাকের সিনড্রম আছে। ‘

আর্দ্র চুপ রইল। এই রোগটা সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা নেই তার তবে শুনেছে অনেক। ড্রিকার দু’দন্ড থেমে আবার বলেন,

‘ভেসোভেগাল অ্যাটাকে মানুষ হটাত অচেতন হয়ে যায়। এর পেছনে কারণ থাকতেও পারে আবার না। যেমন ধরো রাতে ওয়াশরুমে যেতে বা পানি খেতে ওঠলে। মাটিতে পা রাখতেই যদি অজ্ঞান হয়ে যাও! ব্যাপারটা ঠিক সে রকম। ‘

‘ডেঞ্জারাস। ‘অস্ফূটস্বরে বের হয়ে এলো আর্দ্রর মুখ থেকে।

‘উমম। ততটা নয়। নরমালি এই এ ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তবে যদি পানি বা আগুনের কাছে অজ্ঞান হয় তাহলে ভয়ংকর। সম্ভবত খুব কম সংখ্যক লোকের থাকে এটা। বিখ্যাত অভিনেতা অভিতাপ বাচ্চানেরো ভেসোভেগাল অ্যাটাক সিনড্রম আছে। ‘

‘এর কোন মেডিসিন? ‘
‘নেই। তবে দু’একটা থেরাপি মে বি টুকটুকিকে আগেই দেয়া হয়ছিল। আই থিংক ওর এর আগে ফ্যামিলি এই ডিজিজ সম্পর্কে অবগত ছিল। ‘
‘ওকে ডক্টর। থ্যাংকস ফর হ্যাল্পিং মি। ‘
‘ইটস মাই ডিউটি ডেয়ার। টেক কেয়ার অব হার। গড ব্লেস বোথ অব ইউ। ‘

{আমার পেইজে নতুন উপন্যাস দেয়া শুরু করা হয়েছে। যা শুধুমাত্র আমার পেইজ ব্যাথিত অন্য কোথাও দেয়া হবে না। সকলে পেইজ থেকে টুকটুকির পাশাপাশি উপন্যাসটি পড়বেন। }

বাগানের প্রান্তধারে বসে আছে টুকটুকি। সারা দেহময় বিশাল বিরক্তির ছাপ। এখান থেকে পালানোর কোন উপায়ই খুঁজে পাচ্ছেনা। নুহাস এসেছিল সকালে। নুহাসকে দেখে হাত পা থরথর করে কাঁপছিল টুকটুকির। তারপর হঠাৎই জ্ঞান হারায়। মানুষটা কতটাই খারাপ। সে জানে টুকটুকি তাকে ছাড়া থাকতে পারেনা তাও এত দেরি করল আসতে। আকিকা তখন বাড়িতেই ছিল। নুহাসকে দেখে সেও খুব খুশি হয়েছে। কিন্তু টুকটুকিকে নিয়ে আসতে দেয়নি।

তাই শতভাবনায় মগ্ন টুকটুকি। এখানে,আর্দ্রর কাছে সে থাকবেই না। লোকটাকে তার ভালো লাগে না। আর আজ যখন নুহাসের সাথে যেতে পারলো না তখন অসহ্যকর লাগছিল।

আর্দ্র বাড়ি ফিরে পেছনের দিককার বাগানে চলে এলো। ছোট্ট একটা পানির ফোঁয়ারা আছে এখানে। টুকটুকি প্রায়ই এখানে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
আর্দ্র সেদিকটায় পা বাড়াতে নিয়েও আটকে যায়। টুকটুকি তাকে দেখলেই মুখ বিবর্ণ করবে সে তার জানা। খুব খারাপ লাগা কাজ করে ভেতরটাতে তখন। একটা মানুষকে সে ছোট থেকে অন্ধের মত ভালোবাসেছে,
অথচ শুধুমাত্র পাশে থাকতে পারেনি বলে সেই মানুষটা এখন তার উপস্থিতি কেও অপছন্দ করে!

আকিকা ছাদ থেকে আর্দ্রকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নেমে আসে। দৃঢ় পায়ে আর্দ্রর পাশে এসে দাড়ায়। আর্দ্র মুখ শক্ত করে সে ভাবেই দাড়িয়ে থাকে মূর্তির মতো। আকিকা বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে,
‘এভাবে দূরে কেন দাড়িয়ে আছো? ‘

আকিকাকে চমকে দিয়ে আর্দ্র বললো,
‘ভালোবাসতে হলে প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে কি শরীরটাই আসল তাই না আকিকা। ‘

আর্দ্রর হঠাৎ এমন প্রশ্নে ভরকে যায় আকিকা। মিনমিনে স্বরে বলে,
‘মানে? শরীর কেন আসল হতে যাবে? মনটাই আসল। ‘
‘না। তা হলে টুকটুকি ভালোবাসতো আমায়। ‘
‘সময় দাও। বাসবে। ‘
‘বাসবে না। কারণ আমি ওর কাছে ছিলাম না এর আগে। ওকে আমার ভালোবাসার যথাযথ প্রমাণ আমি দিতে পারিনি। আমার আগেই অন্য কেউ জায়গা করে নিয়েছে ওর মনে। ‘

আকিকা ভ্রঁ কুঁচকায়। মৃদু কন্ঠে বলে,
‘হোয়াট আর ইউ সেয়িং? টুকটুকি অন্য কাওকে ভালোবাসে? ‘
‘নুহাসকে। আমার ধারণা। সত্যতা জানা নেই। ‘

আকিকা সচকিত। ভয়ার্থ কন্ঠে আর্দ্রকে বলে,
‘নুহাস আজ এসেছিল। টুকটুকির সাথে দেখা করে গেল। ‘
‘হোয়াট? আর তুমি আমাকে জানালে পর্যন্ত না? কখন এসেছিল সে

পর্ব ১০

মনোরমা বেশ রাগে ফায়ার হয়ে বসে আছেন। টুকটুকিকে তারা আসতে দেয়নি কথাটা যেন ঠিক তার গায়ে সয়নি। বিলাপ করেই চলছেন সন্ধ্যা থেকে। রিজভিও কিছুটা ক্ষেপেছে। বিকাল গড়িয়ে এলে নুহাস আবার আসে আর্দ্রর বাসায়। সঙ্গে এবার মনোরমা থাকে।

আসার পর জানতে পারে আর্দ্র নেই এখানে। কোথায় গেছে তা জানেনা। টুকটুকি আকিকাও যখন নেই তখন হালকা একটু খচকা লাগে নুহাসের মনে। মনোরমাকে হোটেলে রেখে রিজভিকে নিয়ে এয়ারপোর্ট চলে যায় ফিরে যাওয়ার টিকেট কাটতে। টুকটুকি সমেত চারটি টিকেটে। কিন্তু সেখান থেকেই জানতে পারে আর্দ্র বাংলাদেশে ফিরছে।

নুহাসের তখন প্রচন্ড পরিমাণ অসহায় লাগছে নিজেকে। কান্না কান্না পাচ্ছে। নুহাস সাধারণত কাঁদে না।
ছেলে জাতটা আল্লাহ্’র অন্যতম সৃষ্টি। শক্ত হাতে দুনিয়া সামলাবে। পরিবারের সুরক্ষার লৌহ’ঢাল তুলে নেবে। ভিতরটা ছাড়খাড় হয়ে রক্তক্ষরণ হলেও চোখ থাকবে দৃঢ়। ঠোঁটে ফুটবে এক চিলতে চাঁদের মতো চমৎকার হাসি। সূক্ষ রাগ তাদের বৈশিষ্ট্যে। চাহনী মায়ময়,হাজারো চোখ সে চোখে ভেতরকার যন্ত্রণা দেখতে পাবে না। মুখ ফুটে তারা বলবে না,আমি ভালো নেই।

নুহাস মুহূর্তেই সামলে নিল নিজেকে। কঠিন সময়ে হোচঁট খেলে তো চলবে না। টুকটুকি খেলছে তো ওর সাথে ছোটকালের সেই ‘হাইড এন্ড সিক’! খেলুক।
নুহাস ও দেখবে কতদূর সে খেলে। হাপিয়ে তো দিন শেষে নুহাসের কাছেই ফিরতে হবে। এত সহজে ছাড় নেই এই মেয়ের। দহন যখন দিয়েছে,এই প্রেমের দহনে দু’জন একসাথেই পুড়বে।

একটুকু নুহাসের কাছে পরিষ্কার আর্দ্র ইচ্ছে করে টুকটুকিকে দূরে রাখছে ওর কাছ থেকে। কিন্তু কারণটা কি?
গত ছ’দিন পর ছিল ওদের টিকেট। কিন্তু এ’দিন অপেক্ষা করা মানে যম ডেকে আনা। নুহাস দম আটকে মারা যাবে তাহলে। কিন্তু অত টাকাও নেই হাতে যে আবার টিকেট কাটবে। আর দ্রুত যেতে টাকাও বেশি প্রয়োজন হবে। না চাইতেও ছ’দিন পরই ফিরতে হলো।

বাংলাদেশ ফিরে রিজভি মনোরমাকে নিয়ে বাড়ি আসে। নুহাস থেকে যায় ঢাকা। মাথা এতটাই গরম রয়েছে রাত না চলে যেত মিরপুর। অসহ্য অস্থিরতায় কাটে নুহাসের সারাটা রাত।
এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হবে নুহাস তা কল্পনাতেও ভাবেনি। একটা মানুষ কিভাবে এসে কিছু কাগজের ভিত্তিতে এত বছরের সম্পর্কের ভীত কি করে নরবরে করে দিতে পারে? টুকটুকির বার্থ সার্টিফিকেটে ও আর্দ্রর ফ্যামিলি হতে পারে। কিন্তু ছোট থেকে রেহানা যে শরীরের রক্ত পানি করে টুকটুকিকে বড় করেছেন তার সার্টিফিকেট কেন নেই?
মনোরমার শেষ কালের অসুস্থ শরীর নিয়ে নাতনির জন্য এতদূর ছুটে আসা। তারও তো নেই। বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যর নেই।

এই যে নুহাস যে ভালোবেসেছে,তার মনটাই দিয়ে দিল সেটাও তো সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়নি। তাহলে হয়তবা এই মূল্যবান জিনিসটা ফেরত পেলেও পেতে পারতো।
কাগজের কয়েকটা কলমের কালির খোঁচায় সম্পর্কের গভীরতা প্রমাণ হয়?

মিরপুর ঘুরে যখন পায়নি রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় একটা বেজে যায়। তখনি নিবির কল দিয়ে বলে দ্রুত বাড়ি ফিরতে। অঘটন ঘটেছে।
ফিরে এসেই এতবড় ধাক্কা খাবে তাও ভাবতে পারেনি। যে টুকটুকিকে খুঁজে সে ঢাকার প্রত্যেকটা গলি চিনে ফেলেছে সে টুকটুকি এখন তারই বাড়িতে?

পর্ব ১১

নজরুল বাজার খুঁজে সবচেয়ে বড় মাছগুলো নিয়ে আসে নুহাসের জন্য। ছেলেটা যে আগে রুই,পাবদা,চিংড়ি খুব পছন্দ করতো। এখন তো ঠিক মতো খায়ই না। ছেলেটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা সবার। বাজার থেকে ফিরে সেলিনা আর রেহানাকে বাজারগুলো দিয়ে বলেন,

ভালো কইরা কসাইয়া মটর দিয়া ভুনা করবা রুই মাছটা। পাবদা রানবা টমেটো দিয়া। আর লতি আনছি দেখো। চিকন চিকন লতি দিয়ে ঝাল ঝাল কইরা রাঁধবা চিংড়ি।

রেহানা কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকায়। সেলিনা বসা কন্ঠে খ্যাকরি দিয়ে বলে,
খাইব কে এতো?
ক্যান বাড়ির ছেলেমেয়েরা কি খায়না নাকি।
ওই খায়। বেঁচে থাকার জন্য। কারো মনে আনন্দ নাই।

নজরুল ছোটছোট পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে সোফায়। কি একটা ভাবে। তার চোখ ভরে ওঠে সূক্ষ নোনতা জলে। আবেগ বিহীন চোখে বসে রইলো নজরুল।
মাহিলা নজরুলের জন্য চা নিয়ে এলো। মুখ বোঁতা করেই চা হাতে নিল নজরুল। চায়ের স্বাদ মুখে লাগতেই চমকে উপরে দেখলেন। এবাড়িতে ভালো চা বানায় টুকটুকি আর মাহিলা। মাহিলাকে দেখেই নজরুল দাড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

কখন এলি মা? আছস কেমন?
ভালো বড় আব্বু। কিন্তু তুমি তো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ দিনদিন।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে আসে নজরুলের ভেতর থেকে।
আমার সংসারটা কেমন জানি হইয়া গেলরে মা।

গলা ভেঙ্গে আসে নজরুলের। মাহিলা এবার কাঁদে। বলে,
সব ঠিক হয়ে যাবে বড় আব্বু।
মা। মারে তুই কাঁদিস না। রিয়াদ আসে নি?নজরুল দ্রুত মাহিলার চোখের জল মুছেন।
উহুম। ও রাতে আসবে। টায়রাকে আর আমাকে পৌঁছে অফিস গেল। অফিস থেকে এখানেই আসবে।
আচ্ছা। আমার টায়রা মনিটা কই? টুকটুক পায়ে সারা বাড়ি হাটে না কেন?

মাহিলা এবার আওয়াজ করে হেসে ওঠে। নাকি কন্ঠে বলে,
ঘুমোচ্ছে। ঘুম ছাড়লে দেখও তোমাদের সবার ঘুম হারাম করবে। হিহিহি।
নজরুল চশমা খুলে হা করে গরম ভাপ দিয়ে মুছে আবার পড়েন। কন্ঠে তার গাঢ় রূক্ষতা,
মনে আছে টুকটুকিকে যখন আমি এ বাড়ি আনি তোরা প্রায় সবাই বড়। সন্ধ্যার পর বাড়িতে পড়ার ধুম লেগে যেত। ও টুকটুক করে সারা বাড়ি ঘুরতো। তারপর নুহাসে খাটে গিয়ে টুপ করে ঘুমিয়ে পড়তো।
মাহিলা হেসে ওঠলো নজরুলের কথায়।

নুহাস গোসল,হালকা কিছু খাওয়া-দাওয়া সেরে টুকটুকির ঘরে এলো। টুকটুকি খাটে শুয়ে তাকিয়ে আছে নুহাসের দিকে। গত ছয়’মাস আগের এক্সিডেন্টে কোমায় যায়,একমাস পর চোখ মেললেও পুরোপুরি প্যারালাইজড হয়ে যায় টুকটুকি। পাঁচমাস যাবৎ নুহাসের সাথের চোখে চোখেই কথা হয় টুকটুকির।

ভালোবাসার মানুষটাকে দিনরাত সেবা করে যাচ্ছে নুহাস।
টুকটুকির উন্নতিও হচ্ছে দিনেদিনে। আর্দ্র নিজের ভুলটুকু বুঝতে পেরেছে। চৌদ্দ বছরের ভালোবাসার অপেক্ষার চেয়ে চৌদ্দ বছরের ভালোবাসার দাম অনেক। নুহাস চোখ দেখলেই টুকটুকির প্রতি তার ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। আর্দ্র ঠিক করেছে বাকি সময়টুকু বাংলাদেশেই কাটাবে। নিজের দেশে,দেশের গন্ধ যে পরিতৃপ্তি আছে তা কখনোই সেই ইট পাথরের আধুনিক শান্তিময় দেশে নেই। ফজর জামান অবশ্য আমেরিকাতে বিজনেস সামলাচ্ছেন। লোকটার টুকটুকির প্রতি চিন্তা ধারার বিন্দু মাত্র পরিবর্তন ঘটেনি। এ মেয়ে যেখানে আছে সে সেখানে থাকবে না।

আকিকার প্লেন দশ মিনিট আগে ল্যান্ড করলো। আর্দ্র গেছে ওকে ড্রপ করতে। কিন্তু আকিকার সাথে ক্রুশেভকে দেখে সচকিত আর্দ্র। আলিঙ্গন করে বুকের মাঝখানটাতে আটকে নিলো ছোটবেলার বন্ধুকে। পরে আবার আর্দ্রর মাথায় চিকন সরু রাগ নড়াচড়া দিয়ে ওঠলো। ক্রুশেভের মাথায় চাপড় মেরে বললো,

কই ছিল এতগুলা মাস? একটাবার যোগাযোগ করস নাই।
সরি ডেয়ার। সে অবস্থায় ছিলাম না যে যোগাযোগ করব। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার দু’মাসের মাথায় মোম মারা যায়। আমি মানসিক ক্ষতিগ্রস্থ হই। আকিকার প্রতি রাগে তোদের সাথে যোগাযোগ করিনি। করতামই কিভাবে? ফোনটা ভেঙ্গে ফেলছি সিম নষ্ট করে ফেলছি। আমি পুরো একা হয়ে যাই।
ক্রুশেভ এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে যেন কিছুই হয়নি। অথচ কত বড় ঝড় নেমেছে ওর জীবনে। আর্দ্রও ক্রুশেভের মা মিসেস এলাসের কথা শুনে ব্যাথিত হয়। বলে,

খুবই দুঃখজনক। তার আত্তার শান্তি কামনা করি। কিন্তু কি এমন রাগ আকিকার সাথে যে যোগাযোগ অফ করতে হবে?
ক্রুশেভ মাথা নিচু করে। তারপর হঠাৎ’ই কিছু বলতে নিলে তার আগেই আকিকা বলে,
আমরা ভালোবাসি একে অপরকে। কিন্তু প্রথমে আমি তা মানতে পারিনি। বুঝিও নি। বারবার আঘাত করে গেছি ওকে। অপমান করেছি। কষ্ট দিয়েছি। ইগনোর করেছি। অবশেষে চলে যায় ক্রুশেভ।

হঠাৎ’ই আকিকার মুখে ভালোবাসার কথা শুনে চমকে যায় ক্রুশেভ। মনের ভেতরটা এক অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরে ওঠে ওর।
আর্দ্র হতবিহ্বল। কিছু বলার ভাষা নেই ওর। ক্রুশেভ ইন্ট্রোভার্ট আর্দ্র তা জানে। বাট ফ্রেন্ড হিসেবেও কথাটা বলেনি তাকে। আর আকিকাও না। আর্দ্র অবাক হয়ে বোকার মতো বললো,

আর আমি বিষয়টা ধরতেই পারিনি!
ক্রুশেভ ঝটপট বলে,
মেয়েটার দিকে তো একবার তাকিয়েও দেখিস নি। আর যাই হোক বোন তো তোর। একবেলা খাওয়ার খোঁজ ও নিসনি। বাকিটা টের পাবি কি করে?
আচ্ছা বাবা সরি। তা আকিকা তোকে পেল কই?
সে অনেক কথা। আগে বাড়ি চল। আর আমেরিকা থেকেই বিয়ে করে নিয়েছি আমরা।

পর্ব ১২ (অন্তিম)

বাড়ি ফিরতে ফিরতে আকিকার ক্রুশেভকে খুঁজে বের করার পুরো কথাটা শুনে নিলো আর্দ্র। ক্রুশেভ আকিকাকে পেয়ে আর হারানোর অপেক্ষায় থাকতে পারবেনা বলেই দ্রুত করে নিলো বিয়েটা। আকিকা অবশ্য চায়নি আর্দ্রর অবর্তমানে বিয়ে করতে।

আর্দ্র খুবই খুশি আকিকা আর ক্রুশেভের বিয়েতে। আকিকা সবসময় আর্দ্রর ঐ ঠোঁটে হাসির রেশ চেয়েছে। তবে আজ আর্দ্রর এই হাসি ঠিক হজম হচ্ছে না। আচ্ছা মৌরিনের(টুকটুকি) সাথে আর্দ্রর বিয়ে হলে কি খুশি হতে পারত আকিকা?
জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। সে যাই হোক না কেন ক্রুশেভকে পেয়ে আকিকা খুশি। হয়ত নতুন করে ভালোবাসব ওকে। শুরু করবে নতুন প্রেমের অধ্যায়।

বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতেই নতুন দারোয়ান মদন মিয়া ছুটে এলো। মদনকে দেখলেই হাসি পায় আকিকার। কেমন মোটাসোটা গুলুমুলু বুদ্ধিহীন একটা লোক। এ যে দারোয়ান হয়ে এতো বড় বাড়ির নিরাপত্তা কিভাবে সামলাবে কে জানে!

মদন দু’মিনিটের রাস্তা দৌড়ে এসেই হাঁপাতে লাগলো। দুই হাত দিয়ে হাটুতে ভর দিয়ে একটু জিড়িয়ে নিল। আর্দ্র ওর কান্ড দেখে হেসে বলল,

কি মদন ভাই? কিছু বলবা?
মদন জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বললো,
একজন আইছিল আপনাগো খুঁজবার। পায় নাই পরে গেছেগা।
কে আসছিল?
একটা ছ্যামড়া।
আর্দ্র এবার বিরক্ত বোধ করলো। বললো,
আচ্ছা বুঝলাম। নাম তো বলো কে?
ভুইল্লা ফালাইছি তো।
আর্দ্র কপাল কুঁচকালো।
আমাকে খুজঁছিল?
হো।
আচ্ছা কেমনে দেখতে ছিল তা তো মনে আছে!
ইয়া লম্বা,শ্যামলা।
আকিকা অবাক কন্ঠে বললো,
এভাবে কি মানুষ চেনা যায়? আচ্ছা যে এসছে দরকার হলে আবার আসবে,নয়ত ফোনে জানিয়ে দিবে।

আর্দ্ররা ভেতরে আসতেই মদন আবার এলো ভেতরে। এসেই বত্রিশটা দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো। ক্রুশেভ বিরক্ত হয়ে বললো,
ভাই। আবার কি? এমন বত্রিশ দাঁত দেখাও কেন?

ক্রুশেভের কথা শুনে টেনশনে পরে গেল মদন। তার তো ত্রিশটা দাঁত। বত্রিশটা কিভাবে দেখলো? দুইটা দাঁত কি ওর অজান্তে ওঠে গেল নাকি? মদন ভয়াতুর চোখে ক্রুশেভকে দেখে বলল,
আমার তো তিরিশটা দাঁত আছিল। দুইডা বাড়লো কেমতে? আম্মায় ছুট্টুবেলা থাবড় দিয়ে দুইডা হালায় দিছিল। তয় এহন কি ওঠা গেলনি?
আর্দ্র এবার জোর গলায় রাগ দেখিয়ে বললো,
কি তামাশা করতেছো? যা বলার বলো।
ওহে,ওই ছ্যাড়াটায় আফনে নাই শুইনা কিছু লেইখ্যা দিয়া গেছে। কইলো আফনেরে দিতে।

আর্দ্র ঘরে এসে কাগজটা রেখে চলে গেল ওয়াশরুমে।
লম্বা শাওয়ারের পর শরীরটা ঝিমঝিম করছিল। বিছানায় শুয়ে নুহাসকে ফোন দিতে নিয়েও দিল না। শরীরে একফোঁটা শক্তি নেই কথা বলার মতো। ফোনটা অফ ছিল এতক্ষন। নুহাস অনেক গুলো কল করেছিল সারা দিনে আর্দ্রকে। কিন্তু আর্দ্র এতটাই ক্লান্ত যে এখন কথা বলা প্রায় অসম্ভব। মোবাইল আবার অফ করে রেখে দিয়ে ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল আর্দ্র।

ঘুম ভাঙ্গলো আকিকার ডাকে। ক্রুশেভ খুব ভালো রাঁধে। যদিও বাংলা খাবার সে পছন্দ করে তবে আমেরিকার প্রায় সকল রান্নাই পরে। আর্দ্র প্রায় রাত আটটা পর্যন্ত ঘুমোয়। আকিকা না ডাকলে হয়ত জাগতোই না। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং’এ আসার পর খেয়াল হয় নুহাসের কথা উপরে গিয়ে মোবাইল আর চিরকুটটা নিয়ে আসে নিচে।
ক্রুশেভ খুশি খুশি খাবার বারে সবার জন্য। আর্দ্র বার ছয়েক কল করে নুহাসকে। কিন্তু কেউ তুলছেই না। আর্দ্র অপ্রস্তুত ভাবেই খোলে কাগজটা।

চিরকুটের লেখাটা দেখে হচকিয়ে যায় আর্দ্র। স্পষ্ট অক্ষরে লিখা।
আর্দ্র ভাইয়া প্লিজ দ্রুত আমাদের বাড়ি আসো। ইসট আরজেন্ট। টুকটুকি নেই আমাদের মাঝে। যদি ওকে শেষবারের মতো দেখতে চাও তো আসো। নিবির

উপস্থিত সকলে সচকিত। আকিকা কিছু ভাববার আগেই কান্না শুরু করে দিয়েছে। মানে কি এসবের? এভাবে হুট করেই কিভাবে মারা যায় একটা মানুষ?
আর্দ্রর আশেপাশের দুনিয়ে অন্ধকার আর শূণ্য শূণ্য লাগছে। টুকটুকি! ওর পুতুল!
যে মানুষটাকে ও না চিনে,না জেনে অন্ধের মতো ভালোবেসেছে,সেই মানুষটা নেই?
যে মেয়েটার মুখে হাসি ফোঁটার জন্য নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছে সেই মেয়েটা নেই?
আর্দ্রর বুকে আবার আগের মতো সেই চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়েছে। এব্যাথা আরো গাঢ়,আরো দৃঢ়। শরীরের সমস্ত পেশি,কোষ যেন তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।

মনোরমা উদাসিন ভঙ্গিতে পড়ে আছেন ছাদের সিড়িকোঠায়। টুকটুকির সাথে সাথে নিস্তেজ হয়ে গেছে সম্পূর্ণ বাড়ি। এখন আর মনোরমার আচার নিয়ে ঝগড়া হয়না,আচারের ঘ্রাণে মৌ মৌ করেনা বাড়ি। নিবির আচার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সারাবাড়ি হুরহুর করে ঘুরে বেরায় না কেউ।
আর্দ্র সেদিন রাতেই এসেছিল এ’বাড়িতে। ততক্ষণে টুকটুকির দাফন কার্য শেষ। শেষবারের মতোও দেখতে পায়নি মেয়েটার মুখ।
আকিকা বোনকে ফিরে পেয়ে আবার হারিয়ে কাঁদে অনেক।
জানতে পারে একদম ঠিক ছিল টুকটুকি। হঠাৎ কেমন শ্বাস টান ওঠে। চিৎকার করে বলছিল,
আআ আ আআ আ আ!

আজ প্রায় তিনমাস কাটলো। বাড়ির পেছন দিকের শিউলি গাছের নিচেই আছে টুকটুকি। ওর মৃত্যুতে কিন্তু থেমে যায়নি কিছুই। পৃথিবী চলছে তার নিজ গতিতে। বাড়ির সকলের মনে গেঁথে আছে ওর নাম। নিবির বিয়ে করছে রুহিকে। মিশ্মিও বিয়ে করেছে। থেমে গেছে শুধু নুহাসের পথ চলা। ঘরের চারকোণ থেকে তেমন একটা বের হয়না। কথা বলে না।

ভোরে ওঠে বাড়ির পেছন দিকটাতে যায়। দেখে শিউলিতে কানায় কানায় ভরে গেছে টুকটুকির কবর। এ যেন এক শিউলির চাদর। সব ফুল পরিষ্কার করে,সকালে যায় হসপিটালে। বিকেলের আগে ফিরে। টুকটুকি খুব ঘুরতে চাইতো ওর সাথে বিকেল দিকে। বিকেল থেকে সন্ধ্যে টুকটুকিকে ঘিরেই কাটে নুহাসের। কত কি গল্প,কত কি কথা!
সারাদিনের সকল গল্প বলবে তাকে।

দু’জন মানুষের আত্তা দু’ই পাড়ে থেকেও যেন এক। নুহাস তার পরকালে থাকা প্রেমিকাকে নিয়ে যেন নতুন এক জগত গড়ে তুলেছে। দিব্যি সংসার করে চলছে। টুকটুকিতেই বেঁচে আছে নুহাস।
মাঝে মাঝে মধ্যরাতে নজরুল জেগে ওঠলে নুহাসের ঘরে দিয়ে দেখেন নুহাস নেই। বসে আছে বাড়ির পেছনে। ছুটে যান তিনিও। কবরের সামনে দাড়িয়ে দোয়া পড়েন টুকটুকির জন্য। তারপর দেখেন কবরের পাশে চাদর পেতে অত্যন্ত প্রশান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে আছে নুহাস। নজরুলের বুকটা কষ্টে ছিড়ে যায় ছেলেটার কষ্টে।

প্রথম প্রথম নুহাসকে ঘরে নিয়ে যেতে চাইতেন। নুহাস নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলতো,
এই অন্ধকারে আমার টুকটুকি একা থাকতে বড্ড ভয় পায় জানো না তোমরা? আমি যাব না। এখানেই থাকব। আমার টুকটুকির কাছে।
নজরুল চোখ মুছে নুহাসকে বৃথা বুঝাতেন। তারপর ঠিক ব্যার্থ হয়ে ঘরে যেতেন। নুহাস মুগ্ধ স্বরে বললো,

ভালোবাসি টুকটুকি।

লেখক – সাইমা ইসলাম প্রীতি

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “টুকটুকি – তোমাকে নিয়ে কিছু কথা যা ভোলার মত নয়” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – অনুভূতি – বেদনার কিছু গল্প কিছু কথা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *