ভালোবাসি তাই – ভালোবাসার গল্প 2021: অবাক হতে হতে আর অবাক হতে পারছি না আমি। সবকিছু এতো তারাতাড়ি হয়ে যাচ্ছে যে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না আমার। অবাক হওয়া চেহারা নিয়েই মাকে বললাম…
পর্ব ২০
মাকে কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না আমি। সত্যিই একদিন না একদিন তো বিয়ে করতেই হবে। মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছি তখন সারাজীবন তো আর এ বাড়িতে পড়ে থাকতে পারবো না। এই সমাজে থেকে সেটা তো আরো সম্ভব নয়। আর আমিই বা না করবো কেনো? ফুয়াদ ভাইয়ার জন্য? উনি নিজেই তো সারাজীবনের জন্য অন্য কারো হাত ধরতে চলেছেন। শুরু করতে চলেছেন এক নতুন জীবন। যেখানেমেঘা নামক কারো স্থান নেই।
আমি একজন মেয়ে। জীবনের পথে তো আর একা একা চলতে পারবো না। বাস্তবতা তো এটাই। কাউকে ভালোবাসলে তাকে যদি না পাই তাহলে যে সারাজীবন তাকে ভালোবেসে একা একাই কাটিয়ে দেবো সেটা নিছকই স্বপ্ন। বাস্তবে তা কখনো সম্ভব নয়।বাস্তবতার কাছে ভালোবাসা সবসময়ই হেরে যায়। এটা মেনে নিতেই হবে আমায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলাম আমি। ঘুরে তাকালাম মায়ের দিকে। মা এখনো উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে দেখে চলেছে আমায়। আমি দমবন্ধ করে উত্তর দিলাম
- আমি রাজি মা। বাকিটা তোমাদের ইচ্ছা।
আমার উত্তরে মুহুর্তেই উজ্জ্বল হয়ে গেলো মায়ের মুখ। যেনো নিভে যাওয়া মোমবাতিটা জ্বলে উঠেছে। আমার একটা সেক্রিফাইজ কতগুলো মানুষের আনন্দের কারণ হতে পারে! তাই আমি এই বিয়েটা করবো। নিজের জন্য না হলেও ফেমিলির জন্য। মা হাঁসিমুখ করে বললো
- তুই বুঝতে পেরেছিস এটাই অনেক। দেখবি তানভীরের সাথে তুই অনেক সুখী হবি।
- হয়তো।
মা চট করে একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
- নে রেডি হয়ে নে।
-এটা কি?
- শাড়ি।
- কিন্তু আমি তো শাড়ি পরবো না। এই গাউনটা পরবো।
- আরে কনেকে আলাদা পোশাক পরতে হয়। সবাই তো গাউন পরছে। এখন যদি তুইও পরিস তাহলে কে কনে তাকে কি চেনা যাবে?
- তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না মা। কনে তো আপু। আর আপু তো শাড়ি পরছেই। আজ আপুর এনগেজমেন্ট মা। আমার না যে আমায় শাড়ি পরতে হবে।
- আজ তো শুধু মালিহার এনগেজমেন্ট নয়। আজ তোরও এনগেজমেন্ট হবে।
অবাক হতে হতে আর অবাক হতে পারছি না আমি। সবকিছু এতো তারাতাড়ি হয়ে যাচ্ছে যে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না আমার। অবাক হওয়া চেহারা নিয়েই মাকে বললাম,
- কিসব বলছো মা? আজ আমার এনগেজমেন্ট মানে কি?
- হ্যাঁ, তানভীরের মা চান আজই ফুয়াদ আর মালিহার সাথে তোদের এনগেজমেন্টটাও যেনো হয়ে যায়। শুধু এটাই না বিয়েটাও ওদের বিয়ের দিন দিতে চান। তাহলে সব ঝামেলা একসাথে শেষ হয়ে যাবে।
- এতো তারাহুরো করার কি আছে? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি?
- একহিসেবে ভালোই হবে। বিয়েটা আজ হোক বা কাল হোক হবে তো। তাই আগেভাগে হয়ে যাওয়াটাই ভালো হবে। জানিস না শুভ কাজে দেরি করতে নেই।
- আমি কিছু জানি না। তোমরা যা ভালো মনে করো তা-ই করো।
- হুম। এবার যাতো তারাতাড়ি রেডি হয়ে আয়।
- তুমি যাও আমি আসছি।
মাকে বিদায় দিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম আয়নার সামনে। সাজতে ভালো না লাগলেও আজ আমি সাজবো। পুরো আপুর মতো করে সাজবো। সবকিছু যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে থাকুক। তাতে ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা না করে মানিয়ে চলাটাই ভালো হবে সবার জন্য।
শাড়ির রঙটা কালো। কিন্তু তানভীর ভাইয়া তো কালো পরেননি। কালো তো পরেছেন ফুয়াদ ভাইয়া। হাহ……. যাকিছুই করতে যাই না কেনো ফুয়াদ ভাইয়ার কথা মাথায় আসবেই। উনি আমার খুব কঠিন একটা রোগ। যেটা থেকে আমি চাইলেও পরিত্রাণ পেতে পারছি না।
সাজা শেষে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়েই হাঁটা ধরলাম ড্রয়িংরুমের দিকে। এনগেজমেন্ট পার্টি ওখানেই হচ্ছে। সিড়ি দিয়ে নামার সময় খেয়াল করলাম আমার সব কাজিন আর পরিচিত আত্মীয়রা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হবেই তো, যেই আমাকে মেরে ফেললেও এভাবে সাজতে চাইতাম না। সেই আমি আজ এতো ভাড়ী মেকআপ করেছি। ওদের এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝতে পারছি ওরা কেউ এখনো আমার এনগেজমেন্ট সম্পর্কে কিছু জানে না।
আপুকেও নিয়ে আসা হয়ে গেছে এখানে। ভালোভাবে খেয়াল করে বুঝলাম আমার আর আপুর শাড়ির ডিজাইন সেইম। আমিও আপুর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। আশেপাশের মানুষের গুজুরগুজুর শুনে বুঝা যাচ্ছে তারা কনফিউজড হিয়ে আছে। কে আসল কনে সেটা বুঝতে পারছে না বোধহয়।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এনগেজমেন্টের রিচুয়াল শুরু হবে। সবাই নিজেরদের মাঝে ভীষণ আগ্রহ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আর আঙ্কেল মিলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে নানা কথা বললেন। এবার পালা আংটি বদলের। ফুয়াদ ভাইয়া আর আপুকে পাশাপাশি দাঁড় করানো হলো। পলকহীন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। পলক ফেলতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না আমার মাঝে।
- ফুয়াদ রিংটা পরিয়ে দাও মালিহাকে।
খালামনির কথামতো আংটিটা নিয়ে আপুর দিকে হাত বারালো ফুয়াদ ভাইয়া। এবার নিজেকে ঠিক রাখা কষ্টকর হয়ে আমার। ফুয়াদ ভাইয়ার হাতটাও কেমন কাঁপছে।
দুজনেই দুজনকে আংটি পরানোর মাধ্যমে এনগেজমেন্ট শেষ করলো। সবাই মিলে হাততালি দিয়ে চলেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে সবার তালিগুলো যেনো আমাকেই উপহাস করছে। সবাই যখন তালি দিতে ব্যাস্ত তখনই বাবা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো
- এখানেই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়নি। আরেকটা খুশির সংবাদ আছে। আমার ছোট মেয়ে মেঘা আর তানভীরেরও এনগেজমেন্ট হবে আজকে।
বাবার এই কথা শুনে উপস্থিত সকলেই যে অবাক হয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারছি আমি। তবে আমার মাঝে তেমন কোনো পতিক্রিয়া নেই। হঠাৎই চোখ গেলো ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে। উনি কেমন ভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনার চোখে অবাক আর ক্ষোভ দুটোই ভেসে উঠছে। আমি উনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকালাম তানভীর ভাইয়ার দিকে। উনার চোখমুখ চকচক করছে।
একইভাবে আমায় আর তানভীর ভাইয়াকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে আংটি পরানোর জন্য বলা হলো। তানভীর ভাইয়া ঝটপট আমার হাতে আংটি পরিয়ে দিতে লাগলেন। সবকিছুই অসহ্য লাগছে আমার। তানভীর ভাইয়ার হাতটা ছুরে মারতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার তো কোনো উপায় নেই। আমিও কোনো ভণিতা ছাড়া রিং পরিয়ে দিলাম উনাকে।
আবারও সবাই হাততালি দিলো। ওখান থেকে সারার পাশে এসে দাঁড়ালাম আমি। সারাও যে আমার এ সিদ্ধান্তে অনেক খুশি সেটা ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
- অবশেষে তোর মাথা থেকে একতরফা ভালোবাসার ভুত নামলো। এটা তোর লাইফে সেকেন্ড বেস্ট সিদ্ধান্ত।
- সেকেন্ড বেস্ট সিদ্ধান্ত মানে? প্রথমটা কি ছিলো?
- আমায় তোর ফ্রেন্ড হিসাবে চুজ করাটা ছিলো ফার্স্ট বেস্ট সিদ্ধান্ত।
- ওওওও তাই নাকি?
- হুম জানু। এই তুই আমার সাথে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো রে?
- তাহলে কি তোর ভুতের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবো?
- তা কেনো? তোর বরের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবি।
- আমার বর আবার কে?
- কেনো তানভীর ভাইয়া।
- সারা আমাদের বিয়েটা এখনো হয়নি।
- বাট হবে তো।
- হওয়ার পর বর বলিস। এখন না।
- ওক্কেহ।
সারার সাথে কথা বলার সময়ই পাশে এসে দাঁড়ালো ভাইয়া। একটা বড় শ্বাস নিয়ে বললো
- এতো তারাতাড়ি বিয়ে করে আমাদের ছেড়ে চলে যাবি সেমাই?
- তোকে কতবার বলবো যে আমার নাম মেঘা। সেমাই নয়। মুর্খের ডিম সামান্য নামটাও উচ্চারণ করতে পারিস না।
- বলনা সত্যিই বিয়ে করে নিবি?
- আজব! এনগেজমেন্ট করেছি যখন বিয়েটাও নিশ্চই করবো। নাকি তুই চাইছিস বিয়ের দিন যেনো হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো লাল লেহেঙ্গা পরে স্লো – মোশনে দৌড়ে পালিয়ে যাই। আমারো কিন্তু এমন ইচ্ছা আছে ভাইয়া। তুই হেল্প করলে সত্যি সত্যিই পালিয়ে যেতে রাজি আছি। যদিও আমার বয়ফ্রেন্ড নেই। পালানোর পরে কোথায় থাকবো সেটা কিন্তু তোকেই ঠিক করে দিতে হবে।
- এতো তারাতাড়ি তোর বিয়ে হয়ে যাবে ভাবতে পারছি না আমি। তুই রাজি কেনো হয়ে গেলি?
- তো কি করবো? সারাজীবন কি গায়েঅবিবাহিত নামক তকমা লাগিয়ে ঘুরবো নাকি?
আমার উত্তরে ভাইয়া মুচকি হেঁসে চলে গেলো।
- রাফাত ভাইয়া, এখনই তোকে মিস করা শুরু করেছেরে মেঘা।
সারার কথায় আমিও এক ফালি মুচকি হাঁসি দিলাম।
- জানি। সারাদিন যার সাথে ঝগড়া করতো তাকে ছেড়ে থাকতে তো কষ্ট তো হবেই।
- হুম।
রাত প্রায় ১০:০০ টা। বেশির ভাগ গেস্টরাই চলে গেছে। কাছের অতিথিরা থেকে গেছে শুধু। তবে ফুয়াদ ভাইয়ারা যায়নি। উনারাও কাল যাবেন।
নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। মেকআপ গুলোকে জাস্ট অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে এসবের ওজনই তিন চার কেজি হয়ে জাবে। এখনই যদি ফ্রেশ না হই তাহলে যেকোনো মুহুর্তে বিরক্তির চোটে স্ট্রোক করে বসবো আমি। তাই দ্রুত পা চালাচ্ছি ঘরের দিকে।
কিন্তু গেস্টরুমের সামনে আসতেই একজোড়া হাত টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো আমায়। আচমকা এমন কিছু হওয়ায় ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেম আমি। কিন্তু কেমন চেনা চেনা গন্ধ পাচ্ছি মনে হয়। ফট করে চোখ খুলে ফুট করে দেখে নিলাম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে।
আমায় টেনে আনা ব্যাক্তিটি হলো ফুয়াদ ভাইয়া।
-এমন ব্যবহারের মানে কি ভাইয়া?
- জানি না।
- তো আমায় এখানে আনলেন কেনো?
- তোকে উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।
- বাহ বাহ। আমায় নিয়ে টানাটানি করছেন আর জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে বাধ্য নন?
- আগে আমার প্রশ্নের জবাব দে?
- হুম বলুন কি প্রশ্ন?
- তানভীরকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছিস কেনো?
- সেটা একান্তই আমার ব্যাক্তিগত বিষয়।
আমার উত্তরে রেগে গিয়ে দেয়ালে একটা ঘুষি মারলেন ফুয়াদ ভাইয়া। সাথে সাথে কেঁপে উঠলাম আমি। ঘুষি উনি দিলেও মনে হয় ব্যাথাটা আমার লেগেছে। কিন্তু আমি কোনো কিছুই বললাম না উনাকে। উনার প্রতি কেয়ারিং হওয়ার জন্য তো আপু আছে। এবার কাছে এসে কাধ ঝাকিয়ে উনি বললেন
- তুই দেখতে পাসনি আমি দেয়ালে ঘুষি মেরেছি?
- হ্যাঁ দেখেছি।
- তবুও কিছু বললি না কেনো?
- কি বলবো? এটাও আপনার ব্যাক্তিগত বিষয়।
- হুম তাইতো।
দুজনেই আবার চুপ করে গেলাম। অনেকক্ষণ পর নিরবতা কাটিয়ে আমিই বললাম
- একটা কথা বলবো?
- কি?
- বিয়েটা তো এখনো হয়ে যায়নি ভাইয়া। আপনি কি পারেন না আমায় মেনে নিতে? আমি যে আজও ভালোবাসি আপনাকে।
আমার কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেললেন ফুয়াদ ভাইয়া। পরমুহূর্তেই মাথা তুলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন
- পসিবল না।
ব্যাস এটুকুই। আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। এখন তো আমার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। আমি তো জানি উনি আমায় কোনোদিন মেনে নেবেন না। তবুও নির্লজ্জের মতো আবার উনার কাছে ভালোবাসার কথা বলতে গেলাম? কিন্তু না। এই ভুল দ্বিতীয়বার আর করবো না আমি। তানভীর ভাইয়ার মাঝেই ভালোবাসা খুজে নিতে চেষ্টা করবো।
পর্ব ২১
পুরো বাড়িটায় কেমন শুণ্যতা বিরাজ করছে আজ। সব গেস্টরাই চলে গেছে। কালকেও বাড়িটা মেহমানে ভর্তি ছিলো আর আজকে কেউ নেই। কাল এতো এতো মানুষ ভালো লাগছিলো না কিন্তু আজ এই শুণ্যতাটাও ভালো লাগছে না। মন জিনিসটা খুব অদ্ভুত। কখন কি চায় সে নিজেই জানে না।
আজ ভারসিটিও নেই। নয়তো ভারসিটি গিয়ে সারার সাথে সময় কাটালেই মনের অবস্থার অনেক উন্নতি হতো। কিছুই করার নেই এখন। তাই ভাবলাম আপুর ঘরে যাই। যেই ভাবা সেই কাজ। বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা গলায় জরিয়ে হাঁটা ধরলাম আপুর ঘরের উদ্দেশ্যে।
আপুর ঘরে এসে দেখলাম মা -বাবা আর ভাইয়াও ওখানে আছে। আমায় দেখেই বাবা বললো
- এইযে মেঘাও এসে গেছে। এদিকে আয় মা। তোকেও এখনই ডেকে পাঠাতাম। তার আগেই তুই চলে এলি।
- কেনো বাবা? কোনো দরকার?
- হ্যাঁ, একটা খুশির খবর আছে?
- খুশির খবর?
- হ্যাঁ, এদিকে আয় তো এখন। আমার পাশে এসে বসতো।
আমি তারাতাড়ি করে বাবার পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। বাবার পাশে বসতেই বাবা আমাকে আর আপুকে উদ্দেশ্য করে বললো
- তোমাদের দুই বোনের বিয়ে একই দিনে ঠিক করেছি আমরা। এতে তোমাদের কোনো প্রবলেম নেইতো?
আমি আর আপু দুজনেই মাথা ডান – বামে ঝাকালাম। যার মানেনা, নেই। আমাদের উত্তরে আস্বস্ত হয়ে পরের কথাটা বলের জন্য প্রস্তুতি নিলো বাবা। ভাষণ দিতে গেলেও বোধহয় এভাবে প্রস্তুতি নেয় না কেউ। কিন্তু আমার বাবা নিচ্ছে। আমরাও মনোযোগী শ্রোতাদের মতো বসে রইলাম। যেনো বাবা কিছু বললেই সেটা ঢপ করে মাথায় ঢুকিয়ে নেবো। বাবা গলা খাকারি দিয়ে বললো
- আগামী সপ্তাহেই তোমাদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। আমরা কেউই দেরি করতে চাই না।
যতোটা মনোযোগ সহকারে বাবার কথা শুনছিলাম ততটাই জোরে কি বলে একটা চিৎকার দিলাম আমি। আমার চিৎকারের বর্ণণাটা এমন যেনো পরীক্ষার আগের দিন জানানো হচ্ছে কাল আমার পরিক্ষা। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ভাইয়া বলে উঠলো
- এসব কি বলছো বাবা? এতো তারাতাড়ি?
- হ্যাঁ, আগামী সপ্তাহের বৃহস্পতিবারে বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।
জানি না ভাইয়ার কি হলো। সে একদম রেগেমেগে বললো
- আমি কিছু জানি না বাবা। ফুয়াদ আর মালিহার বিয়ে আগামী সপ্তাহে হলেও মেঘার বিয়ে আগামী সপ্তাহে হবে না। তুমি ক্যান্সেল করে দাও।
- মানে কি? তানভীর কি খারাপ ছেলে?
- সেটা না। তানভীর অনেক ভালো ভদ্র একটা ছেলে। কিন্তু মেঘার বিয়ে এতো তারাতাড়ি হবে না।
- কেনো? কারণটাতো বল।
- আমি কিছু জানি না। আগামী সপ্তাহে মেঘার বিয়েও যদি হয়ে যায় তাহলে তানভীরকে বলবে ওকে ঘরজামাই থাকতে হবে। মেঘা এতো তারাতাড়ি এই বাড়ি থেকে যাবে না।
ভাইয়ার কথা শুনে আপু অভিমানী কন্ঠে বললো
- শুধু মেঘাকেই মিস করবি ভাইয়া? তাই ওকে এ বাড়িতে রেখে দিতে বলছিস? আর আমি কি কেউ না?
- তোর শুণ্যতা কাটাতেই তো মেঘার এ বাড়িতে থাকতে হবে। দুই বোনকেই একসাথে চলে যেতে দেবো না আমি। দরকার পড়লে ফুয়াদ আর তানভীর দুজনকেই ঘরজামাই রাখবো। এবার আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম
- এএএ, জীবনেও না। ফুয়াদ ভাইয়া কখনোই ঘরজামাই থাকবেনা। আমি আর ফুয়াদ ভাইয়া খালামনির বাসায়ই থাকবো। তোর খাটাশমার্কা মন যদি আমায় মিস করে তাহলে ওখানে চলে যাবি। বুঝলি?
আমার কথা শুনে সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম না কি এমন বলে ফেললাম আমি। ওদের দেখে মনে হচ্ছে আমি বলেছি জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ নয় কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছেন। আজব?
ভাইয়া এবার আরো ভাব নিয়ে বললো
- নিজের বরের নামটাও ঠিকমতো মনে রাখতে পারে না। বোনের হাজবেন্ডের নাম মনে আছে অথচ নিজের জনের নামই মনে নেই। ওটা ফুয়াদ না তানভীর হবে।
এতক্ষণে বুঝলাম আসল কাহিনী কি। আবারো ফুয়াদ নামের পিছনেই পরে আছে আমার মন। তাই তানভীর নামক কাউকে নিয়ে ভাবার সময় হচ্ছে না তার। পরিস্থিতি ঠিক করতে আমি বললাম
- মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। এতো ঢং করার কি আছে? হুহ…..
- আমার ঢং আমি করছি তাতে তোর কি?
- আমার কিছুই না। বুঝলি? আমার কিছই না। বাবা…..
- হ্যাঁ
- তোমরা যা ঠিক করেছো তা-ই করো। আমার কোনো প্রবলেম নেই।
- প্রবলেম থাকলেও বিয়েটা আগামী সপ্তাহেই হবে। একবার যখন কথা দিয়ে ফেলেছি তখন তো আর তা ফেলে দিতে পারি না। রাফাত, বাবা তুই রাগ করিস না। তানভীরদের বাসা তো কাছেই। মেঘা সবসময় আসা যাওয়া করবে।
- জানি না কিছু। তোমাদের যা ইচ্ছা তা-ই করো। এই পেত্নির বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের করতে পারলেই শান্তি।
এটুকু বলেই আপুর ঘর ত্যাগ করলো ভাইয়া। মা-বাবা আর আপু হাসছেঁ। মা প্রশান্তি ভরপুর একটা শ্বাস নিয়ে বললো
- সারাদিন সাপে -নেউলের মতো লেগে থাকবে আর এখন বিয়ে হতে দেবে না। পাগল ছেলে।
আমি রেগে থাকলেও মনে মনে একটা সুখ অনুভুত হচ্ছে আমার। পরিবারের সবাই কতো ভালোবাসে আমায়। কারো ভালোবাসার কমতি নেই। এতো এতো ভালোবাসার মাঝে কি আমার ফুয়াদ ভাইয়ার ভালোবাসার খুব প্রয়োজন? ওদের ভালোবাসা পাবার জন্য তো ওদের পিছু পিছু ঘুরতে হয়নি আমায়। কতটা নিঃস্বার্থভানে ভালোবাসে। সত্যিই আমি অনেক লাকি।
বাবা – মাও চলে গেলো নিজের ঘরে। এবার আপু ড্রেসিং টেবিলের উপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো। আমিও বিছানায় পা ছড়িয়ে বসলাম। আপু কেমন উদাসীন হয়ে বললো
- আর মাত্র এক সপ্তাহ একসাথে আছি আমরা। তাইনা?
- হুম
- মিস করবি না আমায়?
এতক্ষণ পর্যন্ত সবটা কেমন কল্পনা মনে হলেও আপুর কথা শুনে এবার মনে হচ্ছে সত্যিই আমাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।বিয়ে শব্দটা কেমন জানি। কোনো পরিবার থেকে খুব কাছের কাউকে আলাদা করে দেয় আবার কোনো পরিবারে নতুন সদস্য তৈরি করে দেয়। আমি টলটলে চোখে উত্তর দিলাম
- জানি না।
- ইশ! যদি বিয়ের পরেও একসাথে থাকার কোনো উপায় থাকতো!
আপু সাধারণত কম কথা বলে। এখন যে নিজে থেকে এই কথাগুলো বলছে এটাই তার জন্য অনেক বেশি কথা। প্রথমে অবাক হলেও পরে ভাবলাম থাক আজকে বলুক। মাঝে মাঝে নিজের ভেতরের কথাগুলো প্রকাশ করতে হয়। যারা কম কথা বলে তারা নিজের মাঝে অনেক কথাই জমিয়ে রাখে শুধু প্রকাশ করে না। হয়তো তাদের ভালো লাগে না।
আপুর কথার মাঝেই আমি প্রশ্ন করে বসলাম
- ফুয়াদ ভাইয়াকে ভালোবাসো আপু?
আমার প্রশ্নে থমকে গেলো আপু। বুঝতে পারছি এই প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি আমার। কিন্তু কেনো যে করে ফেলেছি তা নিজেই জানি না। কতক্ষণ থম মেরে বসে থেকেই একটা কঠিন কথা বলে ফেললো আপু
- ভালোবাসা নামক কোনো বস্তুর উপর আমার বিশ্বাস নেই। আমি দায়িত্ব, কর্তব্যে বিশ্বাসী। আমার পরিবার উনাকে বিয়ে করতে বলেছে তাই করছি। এখানে ভালোবাসা আছে নাকি জানি না তবেদায়িত্বনামক ভাড়ী শব্দটার অস্তিত্ব মিশে আছে।
আপুর এমন কঠিন কথা আগামাথা কিছুই বুঝলাম না আমি। বুঝার চেষ্টা করতে যাবো তার আগেই আপু বললো
- ভালো লাগছে না, মেঘা। তুই নিজের ঘরে যা এখন। আমি একা থাকতে চাই।
আমারও কেনো যেনো মনে হচ্ছে আপুর একা থাকা প্রয়োজন। কেমন যেনো বিষন্ন লাগছে তাকে। তাই চুপচাপ এখান থেকে চলে এলাম ছাদে। আমারো যে ভালো লাগছে না। আমারও একা থাকতে ইচ্ছে করছে আজ। আর আমার মন ভালো করার একটা কার্যকরী মেডিসিন হলো ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা।
রৌদ্রতীপ্ত বিকাল। সারাদিনই সূর্য মামা তার সমস্ত ঝাঁঝ ঢেলেছে আমাদের উপর। তাই বিকাল হয়ে যাওয়া সত্বেও রোদের স্থায়িত্ব রয়েই গেছে। যদিও দুপুরের মতো তেজ নেই।
এক বালতি রাগ আর বিরক্তি নিয়ে তৈরি হয়ে চলেছি আমি। এসময় বাসার বাইরে যাওয়ার একসুতো পরিমাণ ইচ্ছেও নেই আমার। কিন্তু যেতে তো হবেই। তানভীর ভাইয়ার মা আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন তাদের বাসায়। বিয়ের গয়না গাটি না কিসের জন্য আমায় প্রয়োজন উনার। বড়দের মুখের উপর তো আর না করা জায় না। তাই এখন ছুটতে হবে তানভীর ভাইয়াদের বাসার উদ্দেশ্যে।
আজকেই প্রথম যাচ্ছি উনাদের বাসায়। তাই একা যাওয়া সম্ভব নয়। আমার সাথে সারাও যাচ্ছে।
বাসার সবাইকে জানিয়ে আমরা চলে এলাম তানভীর ভাইয়াদের বাসায়। এখানে এসে কলিংবেল বাজানোর সময়ও হাত কাঁপাকাঁপি করছিলো আমার। অস্বস্তিরা যেনো জেকে বসছে আমার মাঝে। অথচ সারার মাঝে তেমন কোনো কিছুই লক্ষ্য করছি না আমি। সে পুরো রিফ্রেশ মাইন্ড কেরি করছে। আমি কুনোই দিয়ে একটা খুচা মারলাম সারাকে। সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। আমি ফিসফিসিয়ে বললাম
- এখানে প্রথমবার এসেছি আমরা। কিন্তু তোর ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে এটা তোর নিজেরই বাড়ি।
- প্রথমবার এসেছি কিন্তু শেষবার নয়। সো, চিল বেবী। কাঁপাকাঁপি করতে করতে সব মজা নষ্ট করে দিস না।
- হুম, বুঝলাম।
পর্ব ২২
তানভীর ভাইয়াদের ড্রয়িংরুমে বসে আছি আমি আর সারা। আমাদের সামনের সোফায় বসে আছেন আন্টি। উনি একটার পর একটা গয়না পরিয়েই যাচ্ছেন আমায়। আর আমি চুপচাপ বসে সেগুলো পরছি। এমুহূর্তে তো যে ব্যাক্তি গয়না আবিষ্কার করেছে তার উপর ব্যাপক রাগ লাগছে আমার। সামনে পেলে কানের নিচে ঠাস ঠাস করে লাগিয়ে দিতাম কয়েকটা।
আমার পাশে বসেই আন্টিকে গয়না পছন্দ করতে উৎসাহিত করছে সারা। আমি এসবে বিরক্ত হচ্ছি সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে সে। তাই আরও বেশি বেশি করে করছে। বেস্টফ্রেন্ড নামক জাতিটাই বোধহয় এমন হারামী। ওরা থাকলে আর কোনো শত্রুর প্রয়োজন পরবে বলে মনে হয় না আমার।
তানভীর ভাইয়া বাড়িতে নেই এখন। তাই একটু স্বস্তি পাচ্ছি আমি। আজকাল উনার সামনে পড়তেই কেমন লাগে আমার। আগে যেমন স্বাভাবিকভাবে কথা বলতাম এখন সেটা পারি না।
- বাহ এই ঝুমকোটা অনেক সুন্দর। তাই না সারা?
আন্টির কথার ধরনে মনে হচ্ছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ পছন্দটাই মনে হয় সারার। সে যেটা পছন্দ করবে সেটা কখনোই খারাপ হতে পারে না। না মানে না। আন্টির তালে তাল মিলিয়ে সারাও বললো
- অভিয়েসলি আন্টি। এটা অনেক সুন্দর।
- কিন্তু এর আগেও তো দুইজোড়া ঝুমকো পছন্দ করেছি আমি। সবগুলোই তো অনেক সুন্দর। কোনটা নেবো বুঝতে পারছি না।
- আরে আন্টি এটা নিয়ে এতো চিন্তার কি আছে? সবগুলোই নিয়ে নিন। একটা মাত্র ছেলের বউ বলে কথা।
সারার এমন উত্তরে মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। কি নিঃস্বকোচে বলে ফেললো তিনটাই নিয়ে নিন। আন্টি না থাকলে এতক্ষণে ওর বারোটা বাজিয়ে ফেলতাম আমি। আন্টি কতক্ষণ ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সারার মুখপানে। তারপরই চোখমুখ চকচক করে উঠলো উনার৷ সারাকে বাহবা দিয়ে বললেন
- একদম ঠিক বলেছো তুমি। তিন জোড়া ঝুমকোই নেবো আমি।
- থেঙ্ক ইউ আন্টি। আমি জানতাম আমি ঠিক বলেছি।
- হুম। তবে একটা কথা ভুল বলেছো।
- কোন কথা আন্টি?
- ঐ যে একমাত্র ছেলের বউ বললে সেটা ভুল।
- মানে? মেঘা আপনার বাড়ির একমাত্র বউ না মানে কি তানভীর ভাইয়া আরো বিয়ে করেছে আন্টি?
আন্টির কথায় আমিও অবাক হয়েছি। তাই বলে সারার মতো এমন আজগুবি চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসেনি যে তানভীর ভাইয়া আরেকটা বিয়ে করেছে। আন্টি হেঁসে হেঁসে বললেন
- আরে তানভীর বিয়ে করতে যাবে কেনো?
- তাহলে?
- মেঘা আমার একমাত্র বউমা না মানে হলো তানভীর আমার একমাত্র ছেলে না। আমার আরেকটা ছেলে আছে।
আন্টির কথায় আমি আর সারা একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। তানভীর ভাইয়ার ভাই আছে? আমরা তো জানতাম না।আমাদের দুজনের রিয়েকশন এমন যেনো তানভীর ভাইয়ার ভাই থাকা কোনো অপরাধ।
সারা সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আন্টিকে জিজ্ঞেস করলো
- তানভীর ভাইয়ার ভাই মানে আপনার আরও একটা ছেলে আছে আন্টি?
- হ্যাঁ, কেনো তোমরা জানো না?
- না আন্টি। মেঘাও তো জানে না।
- ওহ, আগে না জানলেও আজ তো জেনে গেলে।
- হুম।
- আচ্ছা বাকি কথা পরে হবে এখন বলো কোন গয়নাগুলো নেবো।
আবারও আমার উপর শুরু হয়ে গেলোগয়না নামক অত্যাচার। আমি আলাভোলা মানুষের মতো এই অত্যাচারটাই সহ্য করে নিচ্ছি মুখ বুজে। নিজের বেস্টুই যখন বেঈমানী করছে তখন তো সহ্য করতেই হবে।
আমাদের কাজকর্মের মাঝেই কলিংবেলের শব্দ এলো কানে। আমাদের বসতে বলে দরজা খুলতে গেলেন আন্টি। আন্টি চলে যেতেই সারা আমার দিকে আরেকটু চেপে এসে বলতে লাগলো
- আহা জানু তোর দেবর আছে। ভাবতে পারছিস বিষয়টা?
- কিসের বিষয়?
- আরে আমার কত সখ যে তোর বিয়েতে দিদি তেরা দেবার দিওয়ানা গানে নাচবো। সেজন্য তো তোর একটা দেবর থাকার প্রয়োজন।
- হুম বুঝলাম। কিন্তু তুই কিভাবে জানিস উনি আমার দেবর না ভাসুর। উনি তো তানভীর ভাইয়ার বড়ও হতে পারে।
- আমার মনে হয়না বড় হবে। তাহলে তানভীর ভাইয়ার বিয়ে কেনো আগে হবে?
- জানি না। এখন একদম চুপ থাকবি। উল্টাপাল্টা কথা বললে মেরে চ্যাপ্টা করে দেবো।
- জানি জানি।
আমাদের কথা মাঝেই ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন তানভীর ভাইয়া।অস্বস্তি নামক অনুভূতিটা আবার দানা বেধেছে আমার মাঝে। ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। উনি একপলক আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হেঁসে চলে গেলেন উপরে। একটা বড় শ্বাস নিলাম আমি। এতক্ষন একমতো শ্বাস আটকে বসে ছিলাম যেনো।
-এখনই হাওয়া ফুস বেইবী?
- সারা তোর কি মনে হচ্ছে না আজকাল তুই আমার সাথে একটু বেশিই সাহস দেখাচ্ছিস?
- মনে হবে কেনো। আমি তো জানিই আমি আজকাল তোর সাথে বেশি সাহস দেখাচ্ছি। তুমি কি বুঝবে জানু। বেস্টুর বিয়ে ভাবতেই সাহসের পরিমাণ কয়েক মিটার বেড়ে যায়। যখন তোমার বেস্টুর বিয়ে হবে তখন বুঝবে।
- ওওও এবার আসল কাহিনী বুঝলাম। বললেই তো হয় যে তোরও বিয়ের সখ হয়েছে। এতো ঢং করার কি আছে।
- আরে তুই ভুল বুঝছিস।
- আমি জানি আমি কি বুঝেছি। এতো বিয়ের সখ হলে তানভীর ভাইয়ার ভাইয়ের সাথেই তোর বিয়ে দিয়ে দেবো। ঠিক হবে না বাবু?
এবার একটু ক্ষান্ত হলো সারা। মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো চুপচাপ।
সবধনের গয়নাগাটি চুজ করা শেষ আন্টির। এতক্ষণে একটু শান্তিতে বসলাম আমি। কিন্তু আমার এই শান্তিটাকে অশান্তিতে বদলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আন্টি।বললেন
- তানভীরের ঘর থেকে ঘুরে এসো মা। ভালো লাগবে।
- আন্টি আমি?
- হ্যাঁ, তুমি। কদিন পর তো ওটা তোমার নিজেরই ঘর হবে। তাই একবার দেখে এসো তোমার ঘরটা কেমন।
- না না আন্টি। লাগবে না।
আমার তখনের কথার প্রতিশোধ স্বরূপ সারা জোর দিয়ে বললো
- কে বলেছে লাগবে না। অভিয়েসলি লাগবে। আন্টি আপনি ওকে ঘরটা দেখিয়ে দিন। আসলে ওতো লজ্জা পাচ্ছে তাই এমন করছে। কিন্তু ওরও যাওয়ার ইচ্ছা আছে আন্টি শুধু প্রকাশ করছে না।
- আরে এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তুমি আমার সাথে এসো তো। সারা এখানেই একটু বসুক। কি বলো সারা?
- শিউর আন্টি। আমি এখানে ওয়েট করছি। মেঘা তোর যত টাইম লাগে লাগুক। আমি অপেক্ষা করবো।
- তাহলে তো হলোই। এবার তুমি চলোতো মা।
অবশেষে আন্টির সাথে পা বারালাম তানভীর ভাইয়ার ঘরের উদ্দেশ্যে। সারা মুচকি হাঁসির মাধ্যমেই তার জয়ের জানান দিচ্ছে। পেছন ফিরে সারার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালাম আমি। যার অর্থ বিয়ে কি শুধু আমারই হবে? তোমার সময় শুধে আসলে শোধ নেবো আমি। সেও চোখের ইশারায় উত্তর দিলো সেটা আমার বিয়ের সময়ই বোঝা যাবে। আপাতত নিজেরটা সামলা।
তানভীর ভাইয়ার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আন্টি আমায় ঘরটা দেখিয়ে দিয়েই চলে গেছেন নিচে। আর আমি এখন অস্বস্তি নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎই ঘরের দরজা খুললেন তানভীর ভাইয়া। আমায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটুও অবাক হলেন না উনি। যেনো উনি জানতেনই যে উনার ঘরে আসবো আমি। উনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন
- এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?ভেতরে এসো।
- না মানে আসলে হয়েছে কি।
- না মানে আসলে এসব কি হ্যাঁ? তোমার ফিউচার ঘর দেখতে এসেছো এটা নিয়ে এমন করার কিছু নেই। ভেতরে এসো।
তানভীর ভাইয়ার সাথে উনার ঘরে ঢুকলাম। ঘর দেখার কথা থাকলেও আমি তাকিয়ে আছি ফ্লোরের দিকে যেনো ফ্লোর নিয়ে গবেষণা করে ইয়া মোটা বই ছাপবো আমি। দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। কি কথা বলবো বুঝতে পারছি না। কিন্তু এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকায় অস্বস্তি যেনো চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে। মথায় অন্য কিছু না আসায় হুট করেই তানভীর ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে বসলাম
- আপনার নাকি একটা ভাই আছে?
- হ্যাঁ, তুমি কি করে জানো?
- তখন আন্টি বললো।
- ওহ।
- উনি কি আপনার ছোট?
- হুম আমার ছোট।
- নাম কি উনার?
আমার প্রশ্নে শয়তান মার্কা একটা হাঁসি দিয়ে তানভীর ভাইয়া বললেন
- কি ব্যাপার বলোতো? হাজবেন্ডকে ছেড়ে হঠাৎ দেবরকে নিয়ে পড়লে যে?
তানভীর ভাইয়ার এমন কথা মোটেও আমার কাম্য নয়। এতোটা ফ্রীলি উনার সাথে কথা বলা আমার কাছে অসম্ভব না হলেও সম্ভবও নয়। এইমুহূর্তে চরম এক পরিস্থিতিতে পড়েছি আমি। কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না।
- আরে এতো সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই মেঘা। আই ওয়াজ কিডিং। ওর নাম রোহান।
- ওহ নাইস নেইম।
- তাহলে কি আমার নাম সুন্দর না?
- সেটা না। আপনার নামও ভালো।
- ভালো না লাগলে বলো নাম পাল্টে ফেলি।
- কিসব বলছেন আপনি। আঙ্কেল আন্টি কত ভালোবেসে এই নাম দেয়েছেন আর আপনি নাম পাল্টে ফেলতে চাইছেন?
- পাশ করে গেছো।
তানভীর ভাইয়া কি কথার মধ্যে কি বলছেন সব মাথার বিশ হাত উপর দিয়ে গেছে আমার। বিশ হাত উপর থেকে টেনে এনে সেটা আবার মাথায় ঢুকানো সম্ভব নয় আমার পক্ষে। তাই তানভীর ভাইয়াকেই জিজ্ঞেস করলাম
- মানে?
- আরে আমি তোমায় পরিক্ষা করছিলাম যে তুমি আমার কথায় কেমন রিয়েক্ট করো। আর তুমি আমার আশানুরূপ রিয়েক্ট করেছো। তাই পাশ করে গেছো।
- ওহ। আচ্ছা, আপনার ভাই কোথায়? উনাকে তো কোনোদিনও দেখিনি।
- ও একবছর আগে স্কলারশিপ পেয়ে দেশের বাহিরে গেছে পড়াশুনা করতে।
- বিয়েতে আসবেন না?
- না। ওর এক্সাম পরে গেছে। তাই বলেছে রিসিপশনের দিন আসবে।
-ওহ।
- তা দেবরের বিষয়ে জানা শেষ হলে হাজবেন্ডের বিষয়ে জানার আগ্রহ আছে কি মেডাম?
- আই থিঙ্ক সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমাদের তো ফিরতে হবে। পরে বেশি দেরি হয়ে যাবে।
- সব পালানোর ধান্দা। পালাও পালাও যত পারো পালাও সময় আমারও আসবে।
- কিসের সময় আসবে ভাইয়া?
সারার গলা পেয়ে দুজনেই তাকালাম দরজার দিকে। সে ঠোঁটের কোণে বিটকেল মার্কা হাঁসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারা গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো
- ডিসটার্ব করলাম নাতো ভাইয়া? আসলে খুব দরকার ছিলো মেঘার সাথে নয়তো আসতাম না।
- আরে না না শালিকা। কি দরকার আছে বলো।
- মেঘা শোন না আমি এখনি চলে যাচ্ছি। ভাইয়া পাশেই কোথাও আছে। এখন বাসায় যাবে তাই ভাবলাম আমিও চলে যাই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পরে প্রবলেম হতে পারে।
- তুই চলে গেলে আমি যাবো কার সাথে?
- কেনো তানভীর ভাইয়াকে কি তোর অকর্মার ঢেকি মনে হয়? উনি আছেন কি করতে?
- শালিকা তুমিই একমাত্র বুঝলে আমার কষ্টটা। সত্যিই তোমার বান্ধবী আমায় অকর্মার ঢেকি মনে করে।
- করলে করবে। আমি এখন গেলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসি জানু।
সারা আমায় অসহায়ের মতো ফেলে রেখেই চলে গেলো বাসায়। আমার অবস্থা এখন বর্ননাতীত। তবুও বাসায় তো যেতেই হবে। তাই এক ডিব্বা অস্বস্তি নিয়েই তানভীর ভাইয়ার সাথে রউনা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে। তানভীর ভাইয়া বাইকে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি গাড়ি নিয়ে আসতে বলায় বাইক আনেন নি উনি। এখন আমি গাড়িতে উনার পাশের সিটে বসে আছি।
হঠাৎ করেই চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দিলেন তানভীর ভাইয়া। আচমকা এমন হওয়ায় সামনের দিকে ঝুকে পড়লাম আমি। উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই গাড়ি থেকে নেমে গেলেন উনি।
কি হয়েছে বুঝার চেষ্টা করতেই কানে এলো চিরচেনা সে কন্ঠ। বাইরে কথা বলছেন ফুয়াদ ভাইয়া আর তানভীর ভাইয়া।
- আরে ফুয়াদ তুই এখানে কি করছিস?
- এইতো তেমন কিছুই না।তুই কি করছিস?
- আমি মেঘাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।
আর কোনো কথা শুনা গেলো না। তবে গাড়ির জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন ফুয়াদ ভাইয়া।
- নেমে আয়।
- মানে কি?
- বাংলা বুঝিস না?
- নামবো কেনো?
-আমি তোকে বাসায় দিয়ে আসবো?
- কিন্তু আমি তো তানভীর ভাইয়ার সাথে যাবো।
- বিয়ের আগেই শশুড় বাড়ি যাওয়াটা ভালো দেখাবে না। তুই আমার সাথে যাবি।
- আপনিও তো তাহলে বিয়ের আগে শশুড় বাড়ি চলে যাবেন। সেটাও তো ঠিক না।
আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কিছুই বললেন না ফুয়াদ ভাইয়া। আমিও আর কিছু না বলে চলে এলাম তানভীর ভাইয়ার সাথে।
পর্ব ২৩
আলসেমীনামক শব্দটা বোধহয় আমার জন্যই কোনো এককালে তৈরী করা হয়েছিলো। সবকিছুতেই চরমরকম আলাসেমী লাগে আমার। এমনকি চুপ করে বসে থাকতেও আলসেমী লাগে। এখনও রাজ্যের আলসেমী জেকে বসেছে আমার মাঝে।
বিয়ের শপিং করতে যেতে হবে। দুইবোনের বিয়ের শপিং করা একা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমাদের চাচা-চাচীদেরকে আগেই চলে আসতে বলা হয়েছে। যাতে সব কাজিনরা মিলে শপিং করা যায়। কথামতো তারাও চলে এসেছে আজ সকালে।
এখন সবাই মিলে শপিং করতে যাওয়ার তোরজোর চলছে। সবার সে কি আনন্দ! মনে হচ্ছে আনন্দের সাগরে ভাসছে তারা। কিন্তু এদিকে আমি আর আপু গা-ছেড়ে দিয়ে বসে আছি। যেনো তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলছে না এখানে। এজন্যই বোধ হয় বলে যার বিয়ে তার হুশ নেই, পাড়া পড়শীর ঘুম নেই। এই কথাটা যে একদম সত্য তা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি আমি আর আপু।
- কিরে তুই এখানে চুপচাপ বসে আছিস কেনো? তৈরী হবি না? মালিহা তো চলে গেছে তৈরী হতে।
দিশা আপুর কথা কানে আসছে ঠিকই কিন্তু তার উত্তর দিতেও কষ্ট হচ্ছে। মুখ খোলতেই ইচ্ছে করছে না আমার। তবুও কথা তো বলতেই হবে।
-আপু তোমরা সবাই যাও না। আমি যাবো না প্লিজ। ভালো লাগছে না আমার।
- মানে কি? তোর বিয়ের শপিং করবো আর তুই যাবি না?
- যেতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তোমরা চুজ করে কিনে আনবে আমার জন্য।
- তুই কি বোকা? কিসব পাগলের মতো কথা বলছিস৷ তুই যাবি মানে যাবি। এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। তোর ফ্রেন্ড সারাকেও তো বলা হয়েছে যাওয়ার জন্য। এখন যদি তুই-ই না যাস তাহলে তো বেচারীর খারাপ লাগবে।
- হয়েছে হয়েছে বুঝেছি। আমার যেতেই হবে। যাচ্ছি…..
অলস পায়ে হেঁটে চলে গেলাম তৈরী হতে। তৈরী হয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখলাম সকলেই প্রস্তুত। আপু নীল একটা শাড়ি পরেছে আজ। কোমড় পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো খুলে রেখেছে সে। চোখে কাজল বাদে অন্য কিছুই ইউস করে নি মুখে। এটুকুতেই যেনো তার রূপের বর্ণণা প্রকাশ করা যাচ্ছে না। লাস্ট দুই বছর ধরে একদিনও আপুকে নীল শাড়ি পড়তে দেখিনি আমি। শেষ তাদের ভারসিটির কোনো এক প্রোগ্রামের দিন পড়েছিলো। আজ এতোদিন পর এই শাড়িতে জাস্ট ওয়াও লাগছে।
আপুকে দেখে আমারও চুল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার চুলতো হাঁটু পর্যন্ত লম্বা। এতো লম্বা চুল ছেড়ে দিয়ে বাইরে গেলে লোকে পাগল ছাড়া আর কিছুই ভাববে না আমায়। তাছাড়া আমার ড্রেসের সাথে খোলা চুল মানাবেও না তেমন।তাই ইচ্ছেটাকে নিজের মাঝেই দমিয়ে রাখলাম আমি।
- ফুয়াদ ভাইয়ারাও বেরিয়ে পরেছে চাচী। তানভীর ভাইয়ারা কোন পর্যন্ত?
অহনা আপুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়ও যেনো নেই মায়ের। তিনি তো মহাব্যাস্ত। দুই মেয়ের বিয়ে একসাথে দিতে গেছে যখন তখন তো ব্যাস্ত থাকতেই হবে৷ ব্যাস্তভাবেই মায়ের উত্তর
- তানভীর, ফুয়াদ সবাই পৌঁছে গেছে শপিং মলে। আর আমরাই এখনো পারলাম না বাসা থেকে বেরোতে। কি যে হবে? কি ভাববেন সবাই।
- আরে চাচী এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই। একটু ওয়েট করুক না। এতো সহজে আমাদের বাড়ির মেয়ে নিয়ে যাবে নাকি? অপেক্ষা তো করতেই হবে।
- আজাইরা কথাবার্তা ছেড়ে তারাতাড়ি আয়। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সামনে।
- ও হ্যাঁ হ্যাঁ। চলো।
বাড়ির দুই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এলাম শপিং মলের উদ্দেশ্যে। সামনের গাড়িতে সব বড়রা আছে আর আমরা ছোটরা সবাই পেছনের গাড়িতে।
জানালার পাশে বসে আছে আপু। তার পাশেই আছি আমি। আপুকে আজ কেমন অন্যরকম লাগছে। কেমন লাগছে বুঝতে পারছি না কিন্তু একটু আলাদা লাগছে সেটা বুঝতে পারছি। বাকি সবাই নানান কথা বলে বলে কান ব্যাথা করে দিচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন হলো সারা। সে কোথাও আছে আর সেখানে নিরবতা বিরাজ করছে এটা ভাবা অনেকটা অমাবস্যায় চাঁদ দেখতে চাওয়ার মতো। তবে আজকে আমার সাথে নয় আমার কাজিনদের সাথে বকবক করে চলেছে সে। তাই একটু রেহাই পেয়েছি আমি।
- একটা কথা জিজ্ঞেস করবো আপু?
- হুম কর। এভাবে বলার কি আছে?
- আজ অনেকদিন পর নীল শাড়ি পড়লে তুমি। তাই না?
- হুম।
- হঠাৎ ইচ্ছে হলো যে?
- ইচ্ছে হওয়ার কারণটা আমার নিজেরই অজানা। শুধু জানি ইচ্ছে হয়েছে তাই পড়েছি।
- ওহ।
কেনো যেনো মনে হচ্ছে আপুর শাড়ি পড়ার কারণটা কোনোভাবে ফুয়াদ ভাইয়া নয়তো? এটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে আমার। আপুকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। আবার ভয়ও হচ্ছে। যদি আমার ভাবনাই সত্যি হয়? এটা ভেবেই বা কি হবে। পড়তেই পারে। আর মাত্র চার দিন। চারদিন পর থেকে তো আপুর অনেক কাজের একমাত্র কারণ হিসেবে ফুয়াদ ভাইয়াই থাকবে। এসব ভেবে একটা বড় শ্বাস নিয়ে আপুকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম
- ফুয়াদ ভাইয়ার জন্য শাড়ি পড়েছো আপু?
আমার কথা শুনে হালকা হাঁসলো আপু। তারপরেই বললো
- বললাম না ইচ্ছে হয়েছে। আমার ইচ্ছের প্রাধান্য দিতেই পড়েছি। কারণ স্বরূপ কারো নাম মাথায় আসে নি। কাউকে কারণ হিসেবে রেখে কোনো কাজ করা ঠিক না। তাহলে তার অনুপস্থিতিতে অন্য কাউকে কারণ হিসেবে গ্রহণ করতে কষ্ট হতে পারে৷
- ফুয়াদ ভাইয়া তো তোমার জীবনে পাকাপোক্তভাবে উপস্থিত করতে চলেছে আপু। উনার অনুপস্থিতি তোমাকে অনুভব করতে হবে বলে মনে হয় না।
আমার কথা শুনে কেমন টলটলে চোখে তাকালো আপু। যেনো পলক ফেললেই গরিয়ে পরবে এক ফোটা নোনাজল। কেমন ধরা গলায় সে বললো
- নিশ্চয়তা আছে? কখন কি হয় আমরা কি জানি? তাই আগে থেকে বলা ঠিক না। কার সাথে কখন কি হয় বলা যায় না।
- কদিন ধরে তুমি কেমন ম্যাথ টিচারের মতো কঠিন ভাষায় কথা বলো আপু। কিছুই মাথায় ঢুকেনা আমার।
এবার জোরে জোরে হেঁসে উঠলো আপু। হাঁসতে হাঁসতে যেনো পেটে খিল ধরে যাচ্ছে তার।
- তাই নাকি? আচ্ছা সরি। আর বলবো না। হ্যাপি?
- হুম হ্যাপি।
- কিরে জান আজ তো দেখি আমায় ভুলেই গেলি তুই।
সারার অভিমানী কন্ঠে বলা কথায় হেঁসে দিলো সবাই। সবার মধ্য থেকে রিয়াদ ভাইয়া বলে উঠলো
- এই যে মিস। মেঘাকে জান, জানু, বাবু এসব ডাকা বন্ধ করুন। এখন এসব ডাকার অধিকার আপনার নেই।
- কিসব বলছেন ভাইয়া? এটা শুধুমাত্র আমার অধিকার। আমি কাউকেই দিবো না। প্রয়োজন পড়লে মেঘার বিয়েই হবে না। তবুও জানু, বাবু বলে ডাকা আমি বন্ধ করবো না।
- আপনি বললেই তো আর হবে না।
- আমি বললেই হবে। আপনি আমায় না বলার কে ভাইয়া?
- আমি আপনার কোন কালের ভাই, মিস?
- কেনো? আপনি তো আমার সাম্প্রতিক কালের ভাইয়া। মেঘার ভাইয়া হিসেবে আপনি আমারও ভাইয়া। তাই না ভাইয়া?
- প্রত্যেক লাইনে লাইনে ভাইয়া বলে মনে করিয়ে দিতে হবে না যে আমি আপনার ভাইয়া।
- ওকেহ ভাইয়া।
- ওহ রাবিশ, ডোন্ট কল মী ভাইয়া।
রিয়াদ ভাইয়া যে সারাকে পটানোর ধান্দায় আছে সেটা এতক্ষনে সবারই বুঝা হয়ে গেছে প্রায়। সব জায়গায় মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করাটা তার অভ্যাস। তবে সারাও তো আর কম নয়। তবুও রিয়াদ ভাইয়ার সাথে পেরে উঠবে কিনা সন্দেহ।
গাড়ি এসে থেমেছে মলের সামনে। বড়রা আস্তে আস্তে নামছে তাদের গাড়ি থেকে। আমরাও নেমে গেলাম তারতাড়ি করে। সবাই মিলে একটা শাড়ির দোকানে আসতেই ফুয়াদ ভাইয়া আর তানভীর ভাইয়াদের দেখতে পেলাম। দুজন একসাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তানভীর ভাইয়া সব কথার শেষেই বড় বড় হাঁসি দিচ্ছেন। ফুয়াদ ভাইয়াও হাঁসছেন। তবে মুচকি মুচকি।
আমরা তাদের কাছে যেতেই এগিয়ে এলেন খালামনি। খালামনি প্রথমেই আপুর দিকে তাকিয়ে বললেন
- বাহ, নীল শাড়িতে তো বড্ড মানিয়ছে আমার বউমাকে। লোকে বলে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর মেয়েদের সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায়। আজ মনে হচ্ছে কথাটা একদম ঠিক।
- আপা, এসব কথা পরে হবে। এখন কেনাকাটা শুরু করি।
মায়ের কথায় কপাল কুচকে এলো খালামনির। যেনো প্রচন্ড বিরক্ত তিনি। কুচকানো কপালকে আরও কুচকে নিয়ে বললেন
- দোকান কি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? নাকি দোকানিরা পালিয়ে যাচ্ছে? কোনোটাই না। তাইতো? তাহলে এতো তাড়া কিসের তোর? শান্তিমতো দেখতেও দিবি না নাকি? এখনো তো আরেক কনেকেই দেখা হলো না। মেঘা কোথায়?
খালামনির প্রশ্ন করতে দেরি হলেও হতে পারে। কিন্তু সারা ঝড়ের গতিতে আমায় দেখিয়ে বললো
- তানভীর ভাইয়ার বউ এখানে আন্টি।
সারার এমন উত্তরে সবাই হেঁসে উঠলেও ফুয়াদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে রইলেন ভাবলেশহীন ভাবে। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই উনার মাঝে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে একটু হলেও যদি উনি রেগে যেতেন!
আমার ভাবনাত মাঝেই গালে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম আমি। তাকিয়ে দেখি তানভীর ভাইয়ার মা দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে।উনার সৌন্দর্য যেনো আরো বেড়ে গেছে আজ। উনি মিষ্টি করে হেঁসে বললেন
- আমার বউ মাও কিন্তু কম না আপা।
আন্টির কথায় খালামনি একটু ভাব নিয়ে বললেন
- এই যে বললেন নাআমার বউমা? এই কথাটা বলার কোনো সুযোগই আমি আপনাকে দিতাম না আপা। যদি আমার আরেকটা ছেলে থাকতো। দুই বোনকেই আমার ঘরে তুলতাম।
- এখন ভাব নিলেও ভাব নেই আপা৷ আমার ছেলের বউ হিসেবেই মানতে হবে।
- তানভীর কি শুধু আপনার ছেলে? না তো। তানভীর আমারও ছেলে। সে হিসেবে মেঘা আমারও বউমা।
উনাদের এসব কথায় বড়রা মজা পেলেও ছোটরা বোর হয়ে গেছে। তাই সারা ঠাস করে বলে উঠলো
- এই যে, মেঘার দুই শাশুড়ি। আমরা যেনো এখানে কি করতে এসেছি? আমি মনে হয় ভুলে গেছি। তোমাদের কারো মনে আছে?
সারার সাথে সবাই সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লাম। মানে আমরাও ভুলে গেছি। রিয়াদ ভাইয়া তো অভিনয় করে বলতে লাগলো
- আমি তো আমার নামই ভুলে গেছি গাইজ। আমার নাম কি?
সারা অবাক হওয়ার মুখভঙ্গি করে বললো
- এমা তাই নাকি?
- হুম
- আমি বলবো? আপনার নাম কি?
- বলুন না মিস। আমিও জানি আমার নামটা কি?
- আপনার নাম হলোআমার ভাইয়া।
- এই, এই মনে পরেছে। আই থিঙ্ক আমার নাম রিয়াদ।
এবার সবাই আবারও হেঁসে উঠলো একসাথে। কিন্তু আমি তাকিয়ে আছি ফুয়াদ ভাইয়ার মুখের দিকে। উনি সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। চেহারা পুরো স্বাভাবিক। যেখানে ভাসছে না কোনো হাঁসি বা কষ্টের ছোপ।
প্রায় সব কেনাকাটা শেষ করে আসা হলো শাড়ি কিনতে। বড় একটা দোকানে বসে আছি সবাই। উদ্দেশ্য বিয়ের বেনারসি চুজ করা। আন্টি, খালামনি আর মায়ের পছন্দ একরকম। আবার আমার কাজিন সিস্টারদের পছন্দ অন্যরকম। এই নিয়ে বেধেছে বিরাট থেকে বিরাটতম ঝামেলা। কোন শাড়ি কেনা হবে তা দেখে কনফিউজড সবাই। অবশেষে সবার সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিলো সারা। তার বক্তব্য হলো
- সবাই যখন পছন্দ নিয়ে কনফিউজড। তখন আমার মতামত হলো যার যার বউ সে সে শাড়ি পছন্দ করুক।
- ওহ তাহলে আপনার ড্রেস আমি পছন্দ করে দিই মিস?
রিয়াদ ভাইয়ার কথায় রাগ করার কথা থাকলেও রাগলো না সারা। হেঁসে উত্তর দিলো
- আপনি বোধ হয় আমার কথা বুঝতে পারেন নি ভাইয়া। আমি বলেছি বররা বউদের শাড়ি পছন্দ করবে। ভাইরা বোনদের নয়।
- হুম বুঝলাম।
- ভালো। তো কি বলেন আন্টিরা?
মা বললো
- ঠিক বলেছো সারা। এটাই ঠিক হবে।
সারার বুদ্ধি মতো তানভীর ভাইয়া আর ফুয়াদ ভাইয়ার উপর শাড়ি চুজ করার দ্বায়িত্ব পরলো।তানভীর ভাইয়া খুশিমনে এটা মেনে নিলেও ফুয়াদ ভাইয়া যেনো চরম বিরক্ত। তবুও মেনে নিলেন উনি। তানভীর ভাইয়া একে একে অনেক শাড়ি দেখলেও আমার পছন্দ হচ্ছে না একটাও। হঠাৎ চোখ পরলো একটা হালকা গোলাপি শাড়িতে। শাড়িটা হাতে নিয়ে সামনে থাকা আয়নায় তাকালাম আমি। বুঝতে পারছি না ভালো লাগছে কিনা।
আয়না থেকে চোখ সরাতে যাবো তখনই দেখলাম ফুয়াদ ভাইয়াও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। দুজনের চোখাচোখি হতেই উনি চোখ দিয়ে ইশারা করলেন। যার অর্থ এটাই ভালো। উনার ইশারায় এক চিলতে হাঁসি ফিটে উঠলো ঠোঁটের কোণে।
সবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আমি এই শাড়িটাই নেবো। আপুর অন্য কোনো শাড়ি পছন্দ না হওয়ায় সেও সেইম শাড়ি নিলো। আপাত্ত সব কেনাকাটা শেষ। পরে কোনোকিছু প্রয়োজন হলে কেনা হবে। সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাসায় চলে এলাম আমরা।
বাসায় এসেই সবাই ফ্রেশ হতে চলে গেলেও আমি চলে এলাম আয়নার সামনে। হাতে আছে সেই শাড়িটা। কেনো জানিনা শাড়িটাকে জরিয়ে ধরেই বসে থাকতে ইচ্ছে করছে আমার। ভাবতেই পারছি না এটা ফুয়াদ ভাইয়া পছন্দ করে দিয়েছে। আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনে আমারই সবচেয়ে প্রিয় মানুষের পছন্দ করা শাড়ি পরবো আমি। কি ভাগ্য আমার!
পর্ব ২৪
নিজের ঘরে নাকে সরষে তেল দেওয়া ছাড়াই গভীর ঘুমে নিমগ্ন ছিলাম আমি। কিন্তু আমার আরামের ঘুমটা হারাম করে দিতেই বোধহয় সেই কখন থেকে চিৎকার চেচামেচি ভেসে আসছে ড্রয়িংরুম থেকে। সারা বাড়ি গমগম করছে। এতো এতো লোকজন একসাথে হওয়ায় সাধারণভাবে কথা বললেও মনে হচ্ছে গলা ছেড়ে চিৎকার করে চলেছে তারা। আজ সন্ধ্যায় গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। আর কাল বিয়ে। এই সপ্তাহটা বোধহয় বুলেট ট্রেনের গতিতে ছুটে চলেছে। দিনগুলোও যেনো ছোট হয়ে গেছে। এই সকাল তো এই রাত।
বেলাও হয়ে গেছে অনেক তারউপর এমন চিৎকার চেচামেচি। অসহ্য হয়ে উঠে পরলাম বিছানা থেকে। এভাবে আর শুয়ে থাকা সম্ভব নয়। এমনিতেও আজকে অনেক দেরী করে উঠেছি ঘুম থেকে। তাই চোখমুখ হালকা ফোলা ফোলা হয়ে গেছে। যেটা আমি নিজেই বুঝতে পারছি।
ফ্রেশ আমিও হয়ে চলে এলাম ড্রয়িংরুমে। বাড়ির সবাই উপস্থিত এখানে৷ তার মানে আজ আমিই সবার পরে উঠেছি ঘুম থেকে। অন্য সবাই এ বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও গ্রাম থেকে আসা বয়স্ক চাচী – দাদিরা কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। যেনো ভুল করে মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীতে চলে এসেছি আমি। তবে উনাদের এমন চাহনির কারণটা অজানা নয় আমার। তাই বেশি মাথা ঘাটাঘাটি না করে সোফায় দিশা আপুর পাশে গিয়ে বসে পড়লাম আমি। দিশা আপু আমার দিকে একটু চেপে এসে ফিসফিস করে বললো
- আজ তোর গায়ে হলুদ আর তুই এতো রিল্যাক্সভাবে চলাফেরা করছিস কিভাবে?
- গায়ে হলুদ বলে রিল্যাক্স হয়ে চলা যাবে না এটা কোন দেশের আইন আপু?
- এটা আমার মনের দেশের আইন। সব মেয়েরাই নাকি তাদের বিয়ে নিয়ে এক অন্যরকম অস্থিরতায় ভোগে। আর তোর মধ্যে তো তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পারছি না।
- তাহলে আমি সেসব মেয়েদের কাতারে পড়ি না। এটা তো স্বাভাবিক একটা বিষয়। এতোদিন যেভাবে চলতাম সেভাবেই চলবো। কিছুটা পরিবর্তন আসবে শুধু।
- তোরা দুই বোনই বিয়ে নিয়ে কেমন উদাসীন। মালিহা আপুও তোর মতো আজব বিহেভ করছে। কি হয়েছে তোদের বলতো?
- কিছু হয়নি তো। তোমাদের কাছেই এমন মনে হচ্ছে। আমরা ঠিকই আছি।
- হুম বুঝতে পেরেছি। তোদের পেট থেকে কথা বেরুবে না। তাই এসব বাদ এখন তারাতাড়ি সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে।
সবার মাঝেই ব্যাস্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সকলে মিলে নানা কাজ করে চলেছে আজ। গায়ে হলুদ আর বিয়ে কোনোটাই বাড়িতে হবে না। তার জন্য কমিউনিটি সেন্টার ঠিক করা হয়েছে। তিন পরিবারের সবাই একসাথে আনন্দ করার উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বড়রা।
মেজো চাচী আমায় আর আপুকে তাড়া দিয়ে বললেন
- তারাতাড়ি করে খাওয়া দাওয়া সেরে নাও তোমরা। একটুপরেই আরো মেহমান এসে পড়বে। তখন তোমাদের খাওয়া দাওয়ার দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ হবে না।
চাচীর কথামতো খাওয়ার পর্ব শেষ করলাম আমি আর আপু। কেনো জানি না আজকে একটুও কষ্ট হচ্ছে না আমার। সারাজীবনের জন্য ফুয়াদ ভাইয়ার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি এটা ভাবতেও দম বন্ধ হয়ে আসতো আগে। কিন্তু আজ এমন কিছুই হচ্ছে না। ভাবছি স্টার জলসার সিরিয়ালে যেমন বিয়ে হওয়ার একটু আগেই লোডশেডিং হয় আর তখনই কনে পাল্টে যায়। আমার লাইফেও যদি এমন কিছু হতো! এসময় এমন চিন্তা মাথায় আসায় আমার নিজেরই হাঁসি পাচ্ছে। কোথায় আমি কষ্টে জর্জরিত হয়ে যাবো সেখানে মাথায় ঘুরছে এসব আজগুবি চিন্তা। তবে এই আজগুবি চিন্তাভাবনার চক্করেই কষ্টটা কাবু করতে পারছে না আমায়। সত্যি সত্যিই যদি এমন হতো! এসব কি শুধু সিরিয়ালেই সম্ভব? বাস্তবজীবনে কি হতে পারে না এমন?
হঠাৎ করেই হুশ এলো আমার। কিসব ভাবছি আমি। এমন হলে চারজনের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া স্বার্থপরের মতো এসব ভাবছিই বা কি করে? তানভীর ভাইয়াকে বিয়ে করতে রাজি হয়েও ফুয়াদ ভাইয়াকে নিয়ে ভেবে চলেছি ক্রমাগত। এটা তো তানভীর ভাইয়ার সাথে চিট করার মতো। আর আপু? আপুও তো ফুয়াদ ভাইয়াকে মেনে নিয়েছে। হয়তো অনেক স্বপ্নও সাজিয়ে ফেলা হয়ে গেছে তার। এমন কিছু হলে তো আপুও কষ্ট পাবে।
আজকাল ভাবনাগুলোও বুঝেশুনে ভাবতে হয় আমার। কি একটা পরিস্থিতিতে পড়েছি আমি।
- কিরে? তুই কি নিউটনের মতো বিজ্ঞানী হওয়ার পরিকল্পনা করছিস নাকি মেঘা?
আচমকা সারার গলা পেয়ে চোখ তুলে তাকালাম আমি। সে কোমড়ে কাত দিয়ে ব্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে।
- বিজ্ঞানী হওয়ার কথা আসছে কোথা থেকে?
- যেভাবে গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবাভাবি করছিস। তাই মনে হলো। তবে একটা কথা বলি বিজ্ঞানী হওয়ার চিন্তাভাবনা থাকলে সেটা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দে।
- কেনো?
- তাহলে স্টুডেন্টদের অভিশাপ পেতে পেতে শেষ হয়ে যাবি। এই যে নিউটনের কথাই ভাব। আমি তো ব্যাটাকে কথায় কথায় অভিশাপ দিই। সামান্য একটা আপেল মাথায় পড়ার জন্য কতকিছু আবিষ্কার করেছেন উনি। মাঝে মাঝে আমার ঐ লোকের উপর রাগ হয় যে আপেল গাছটা লাগিয়েছিলো।
- বকবক বন্ধ কর নইলে রিয়াদ ভাইয়ার কাছে যা।
- এখানে ঐ মিস্টারভাইয়ার কথা এলো কিভাবে?
- বিয়ের কথার মাঝখানে নিউটনের কথা এলো যেভাবে।
আমার কথায় দমে গেলো সারা। কিছু না বলে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কতক্ষণ। তারপরই বড় একটা শ্বাস নিলো সে। বলতে লাগলো
- আজ আবার একবার বলছি তুই অনেক স্ট্রং। এতোদিন ধরে নিজের ভেতরের আর্তনাতটা কাউকেই বুঝতে দিসনি। কি নিখুঁত অভিনয় করে যাচ্ছিস। সত্যিই কিছু বলার নেই আমার। শুধু বলবো এতোদিন ধরে যখন মনের কথা না শুনে মস্তিষ্কের কথা শুনেছিস আজকেও সেটাই করবি।। শেষমুহুর্তে এসে মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে মনটা যেনো জিতে না যায়। মনে রাখবি তোর মনের জিত মানে তোর হার।
সারার উপদেশগুলো কেমন কাঠিন্যতায় ভরপুর। প্রত্যেকটা কথাই খুব ভাড়ী। কিন্তু আমায় যে ওর কথাগুলো মানতেই হবে। তাই এতক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকলেও এখন নিজেকে ঠিক করলাম আমি। মুখে নিয়ে এলাম এক টুকরো হাঁসি। আমার এমন কাজে সারাও খুশি হলো যেনো৷
-মেঘা তারাতাড়ি তোর ঘরে আয় তো। কিছু জিনিস খুজে পাচ্ছি না৷
আপুর ডাক পেয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। সারাকে সাথে আসতে বলে হাঁটতে লাগলাম আমার ঘরের দিকে।
কমিউনিটি সেন্টারের একটা আলাদা রুমে বসে আছি আমরা। বাইরে সব অতিথিরা আছেন। পুরো হলুদে সাজিয়ে তোলা হয়েছে আমায়। শাড়ি থেকে শুরু করে গয়না সবকিছুই হলুদ। আপুর অবস্থাও সেইম। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হতে আরো দেরি। তাই এখন মেহেদী পরানোর ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলতে চাইছে বাকিরা।
পার্লার থেকে আসা মহিলারাই মেহেদী পরাবেন বলে ঠিক করা হয়েছে। সিদ্ধান্তমতো দুজন মহিলা বসেও পরেছে আমাদের সামনে। বাইরে সব ভাইয়ারা মিলে লাউড মিউজিক বাজিয়ে রেখেছে। কাছে বসে থেকেও একজন আরেকজনের কথা শুনতে কষ্ট হচ্ছে।
মেহেদী পরতে গেলেও বিশাল ধৈর্যের প্রয়োজন। চুপচাপ বসে থাকো, নো নড়াচড়া। অথচ মেহেদী পরতে গেলেই হাতে চুলকানি শুরু হয়ে যায় আমার। যার জন্য নড়েচড়ে উঠতেই হয় বারবার। এখনও তার ব্যাতিক্রম কিছু নয়। একটু পরপরই হাত চুলকে চলেছি আমি। যার ফলে বিউটিশিয়ানের সমস্যা হচ্ছে প্রচুর। তবুও তিনি কিছু বলছেন না আমায়। এমুহূর্তে উনাকেই বিশ্বের সবচেয়ে ধৈর্যশীল মহিলা বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। উনার জায়গায় আমি থাকলে কি করতাম কে জানে? হঠাৎ করেই মহিলাটি বলে উঠলেন
- ম্যাম, আপনার বরের নাম বলুন।
- কেনো?
- হাতে লিখার জন্য।
- ওহ। থাক হাতে কারো নাম লিখতে হবে না।
- ম্যাম, এখন তো সবাই লিখে। এটা একটা সিম্পল বিষয়।
- না থাক। আমি লিখবো না।
- ওকেহ, এজ ইউর উইশ।
কোনো নাম ছাড়াই মেহেদী পরানো শেষ করা হলো। হাত উপরে ধরে চুপচাপ বসে আছি আমি। আমার পাশে বসেই কিছু একটা বলার জন্য উশখুশ করছে সারা। তার অস্থিরতা বুঝতে পেরে আমিই বললাম
- কি বলবি বল।
- হ্যাঁ বলবো। কিন্তু তুই মাইন্ড করবি না তো?
- না।
- তুই হাতে নাম লিখতে মানা করলি কেনো তার কারণ তো জানি। কিন্তু মালিহা আপু কেনো লিখায় নি?
- আপুও লিখায় নি?
- না।
- হয়তো ভালো লাগেনি তাই।
- এটাই আসল কারণ?
- তুই এমন গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব কবে ছাড়বি? সব কিছু নিয়েই বাড়তি চিন্তা।
- আচ্ছা আচ্ছা আর বাড়তি চিন্তা করবো না।
পাক্কা বিশ মিনিট পর হাত পরিষ্কার করলাম আমি। এতোক্ষণ হাত উঁচু করে ধরে থাকায় কেমন ঝিম ধরে গেছে হাতে। এখন প্রায় সব সাজই কমপ্লিট। গায়ে হলুদের সময়ও হয়ে গেছে। তাই আমায় আর আপুকে নিয়ে আসা হলো স্টেজে। সামনাসামনি দুটো স্টেজ। একটা আমার আর আপুর জন্য। আরেকটা ফুয়াদ ভাইয়া আর তানভীর ভাইয়ার জন্য।
স্টেজে এসে বসার পর থেকেই নিচের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। সামনে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই আমার। আমার পাশ থেকেই সারা বলে উঠলো
- এভাবে নিচে না তাকিয়ে সামনে তাকিয়ে তানভীর ভাইয়াকে দেখ একবার। কি জোশ লাগছে উনাকে। সামনে তাঁকা প্লিজ। একবার তাঁকা শুধু।
সারার জোরাজোরিতে সামনে তাকাতেই হলো আমার। তবে এবারেও ভুল মানুষের দিকে চোখ গেলো। তানভীর ভাইয়াকে না দেখে ফুয়াদ ভাইয়ার দিকেই তাকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে। হলুদ পাঞ্জাবিতেও যে উনাকে এতো সুন্দর লাগে আগে জানতাম না। আমার ভুলটা ভেঙে দিতে সারা আবারও বলে উঠলো
- তানভীর ভাইয়াকে সেই লাগছেনা দোস্ত? ইশ ভাবতেই অবাক লাগছে আমি উনার শালীকা হচ্ছি। কেমন প্রাউড ফীল হচ্ছে রে জানু। কিরে কিছু তো বল। তোর কেমন লাগছে?
- হুম ভালো
- শুধু ভালো?
- না। খুব ভালো। আমার দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। যার সারা মুখটাই মায়ায় বাধানো। যার চোখের দিকে তাকালেই হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ঐ মায়ার সাগরে। যার চাহনীতে বুকে কম্পন সৃষ্টি হয়, শীড়ায় শীড়ায় বয়ে যায় একরাশ শুভ্রতা। যাকে দেখলে শুধু ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। হাজারবার তাকে উপেক্ষা করার পণ করলেও বারবার তার কাছেই ছুটে যাই আমি। যার কাছ থেকে বেহায়া, ছেচড়া, আত্মসম্মানহীন উপাধি পাওয়ার পরেও নির্লজ্জ মন শুধু তাকেই চায়। যাকে দেখলেই মনে শুধু একটা কথাই আসে ভালোবাসি তাইভালোবাসি তাই ভালোবাসি তাই।
আনমনা হয়ে এতকিছু বলার পরেই তাকালাম সারার দিকে। সেও কেমন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উদাসীন ভাবেই বললো
- আমি তানভীর ভাইয়ার ব্যাপারে বলতে বলেছি ফুয়াদ ভাইয়ার ব্যাপারে নয়।
- আরে না মানে হয়েছে কি।
- থাক আর কিছু বলতে হবে না। তবে আমার সাথে যে কথা গুলো বলে ফেললি অন্য কেউ যেনো সেসব শুনতে না পায়।
- হুম। পাবে না।
শুরু হয়ে গেলো হলুদ সন্ধ্যা। একে একে সবাই হলুদ লাগিয়ে যাচ্ছে আমাদের। সবার হলুদ লাগানো শেষে আমাদের চারজনকে পাঠানো হলো ফ্রেশ হতে। পাশাপাশি দুটো রুম। যেটা আমাদের দুই বোনের জন্য সেটায় চলে গেলাম আমি আর আপু। আপুর নাকি বেশি আনইজি লাগছে তাই সে-ই প্রথমে গেলো ফ্রেশ হতে। একা একা এই ঘরে বসে থাকার চেয়ে ঘরের সামনের জায়গায় গিয়ে একটু দাঁড়িয়ে থাকাটা শ্রেয় মনে হলো আমার কাছে। তাই চলে এলাম সেখানে। এদিকটায় কোনো মানুষ নেই। তাই জায়গাটা নিরব। একটু সামনে এগিয়ে যেতেই কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম উনি ফুয়াদ ভাইয়া। ফুয়াদ ভাইয়ার সামনে পড়া মানে দুর্বল হয়ে যাওয়া। তাই আবার উল্টোদিকে হাঁটতে লাগলাম আমি। কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে ফুয়াদ ভাইয়া বলে উঠলেন
- অনেক অনেক শুভকামনা তোর নতুন জীবনের জন্য।
উনার কথা শুনে গলা ধরে আসছে আমার। কান্নাটাকে কতক্ষণ আটকে রাখতে পারবো জানি না আমি। তবুও ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে উনার দিকে ঘুরলাম আমি।
- কিরে চুপ কেনো? আমাকেও উইশ কর।
- ভাভালো থাকব..বেন।
- শুধু এটুকুই?
-………..
- আচ্ছা এতেই চলবে আমার। তো, সবাই তোকে হলুদ লাগালো আমায় লাগাতে দিবি না?
ফুয়াদ ভাইয়ার কথা শুনে অবাক হচ্ছি শুধু। কিছু বলার পরিস্থিতিতে নেই আমি। উনি তো জানেন আমার মনের কথা। জেনে শুনে আমার ক্ষতগুলো বাড়িয়েই যাচ্ছেন। আমার অনুভূতিগুলোর দাম উনার কাছে না-ই থাকতে পারে তাই বলে কি কষ্টগুলোরও দাম নেই?
- তুই না করলেও আমি তোকে হলুদ লাগাবো। তাই তোর কিছু বলার দরকার নেই। এভাবেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।
ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলেন ফুয়াদ ভাইয়া। উনার হাতেই খানিকটা হলুদ ছিলো। উনি আলতো করে হলুদ ছুঁয়িয়ে দিলেন আমার গালে। উনার স্পর্শ পেয়েই অবাধ্য চোখের জল গরিয়ে পড়লো গাল বেয়ে। উনি সেটা দেখেও মুচকি হাঁসলেন। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছে দিলেন চোখের পাশটা। আবারও উনার মায়ায় জড়িয়ে পরলাম আমি। নিজের অজান্তেই করে ফেললাম এক অন্যায় আবদার।
- আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে দেবেন আমায়? প্লিজ। শুধু একবার। এটাই প্রথম আর এটাই শেষ। ধরে নিন এটাই আমার শেষ ইচ্ছে।
- মানে?
- মানে কিছুনা। কেনো জানি না মনটা কু গাইছে খুব। মনে হচ্ছে খুব তারাতাড়ি মরে যাবো আমি।
- পাগল হয়ে গেছিস? কিসব উল্টাপাল্টা বকছিস? খবরদার যদি মাথায় কোনো আজগুবি চিন্তা ঘুরে।
- আরে আপনি ভুল ভাবছেন। আমি কখনো এমন কিছু করবো না। তবুও খুব ভয় করছে। কেনো সেটা জানি না। প্লিজ একবার অনুমতি দিন।
কিছু বলছেন না ফুয়াদ ভাইয়া। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছেন শুধু। উনার নিরবতাটাকেই সম্মতি হিসেবে ধরে নিলাম। একবুক দ্বিধা নিয়েই জড়িয়ে ধরলাম ফুয়াদ ভাইয়াকে। এই প্রথম উনার এতোটা কাছাকাছি আমি। হয়তো ভুল সময়ে। তবুও শেষ স্মৃতি হিসেবে একটা ভুলকেই আকড়ে ধরতে চাইছে আমার মন।
পর্ব ২৫
অপেক্ষার প্রহর শেষে আজ চলে এলো সেই দিন। যেটা আমার কাছে পুরোপুরি অনাকাঙ্ক্ষিত।বিয়ে নামক ভাড়ী একটা কাজের মাধ্যমে নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে চলেছি আমি। আজকের পর হয়তো ফুয়াদ ভাইয়াকে ভালোবেসে যাওয়াটাও অন্যায় হিসেবে ধরা হবে। দুজনেই সম্পূর্ণ ভিন্ন দুজন মানুষের সাথে সারাজীবনের মতো একটা সম্পর্কে জরিয়ে যাবো। ফুয়াদ ভাইয়ার কথা জানি না। তবে আমার ক্ষেত্রে সেই সম্পর্কে ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটাও হয়তো থাকবে না৷ থাকবে দায়িত্ব কর্তব্যের এক অদ্ভুত বোঝা। আমি চাইলেও যেগুলো এড়িয়ে যেতে পারবো না।
সারা বাড়িতে খুব বেশি কোলাহল নেই আজ। থাকবে কি করে? বাড়ির সবাই যে চলে গেছে কমিউনিটি সেন্টারে। বাড়িতে শুধু আমি, আপু, সারা আর আমার কাজিনরা রয়েছি। একটুপরই পার্লার থেকে বউটিশিয়ান আসবে। দুবোনকে সাজানো শেষে নিয়ে যাওয়া হবে কমিউনিটি সেন্টারে। সন্ধ্যা নামবে বলে। অন্ধকারের রাজত্ব শুরু হবে একটুপর। সারা শহরটাই যেনো নিস্তব্ধপুরিতে পরিণত হয়েছে আজ। কেমন শুণ্য শুণ্য অনুভুতি। চারপাশের নিরবতাটা যেনো ভালোবাসায় আমার হেরে যাওয়াটাকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার।
দিশা আপু পার্লারে ফোন করে জেনেছে ওদের আসতে একটু দেরি হবে। তাই এখন চুপ করে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। হঠাৎ ইচ্ছা হলো ছাদে যাবো। আমার মন খারাপের সময়গুলোর সবথেকে বড় সাক্ষী হলো এই ছাদ। আজকেও যে আমার মন খারাপ। বড্ড মন খারাপ। তবে আজকেও কি ছাদে গেলে মন ভালো হয়ে যাবে নাকি সেটা জানি না আমি। তবুও আমি যাবো। হতেও তো পারে এটাই আমার শেষবারের মতো ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। তানভীর ভাইয়াদের বাড়িতেও যে এভাবে ছাদে যেতে পারবো তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাদের সেটা পছন্দ নাও হতে পারে।
আজকে নিজের মনের চাওয়াটার প্রাধান্য দিতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। তাই কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ হেঁটে চলে এলাম ছাদে। যদিও ছাদটা আমার খুব প্রিয়। তবে আজ কেনো জানি অন্যরকম টান অনুভব করছি পুরো বাড়িটার প্রতি। ছাদ থেকে বাড়ির পেছনের বাগানটা পুরোপুরি স্পষ্ট দেখা যায়। ছাদের রেলিং ধরে তাকালাম বাগানটায়। আমার নিজের হাতে লাগানো কত গাছ আছে সেখানে। ভাইয়া আর আপু গাছ নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলো না। আমিই খুব পছন্দ করতাম গাছ লাগাতে। স্কুল লাইফে টিফিনের টাকা জমিয়ে রাখতাম শুধুমাত্র গাছ কেনার জন্য। সেইবার বাগানে ডেইজি ফুল লাগানোর জন্য কি পাগলামোটাই না করেছিলাম আমি। সকলে মিলে আমায় বুঝাতে ব্যার্থ হয়েছিলো যে ডেইজি ফুল এতোটাও সহজলভ্য নয়। শেষে আমার জেদের কাছে হার মেনে নিয়ে বাবা তার এক প্রবাসী বন্ধুকে দিয়ে আনিয়ে ছিলেন আমার সেই পছন্দের ডেইজি। আজ এই ফুল গাছটার প্রতিও এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে। ছাদের কার্নিশ বেয়ে বেড়ে উঠা আগাছাগুলোও ভালো লাগছে খুব। যে জিনিসগুলোর দিকে ফিরেও তাকাতাম না সেসব জিনিগুলোও ভয়ানক মিস করছি আমি।
এমন অনুভূতির কারণটা জানি না। শুধু জানি কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। ছাদের আরেক পাশটায় চোখ যেতেই দেখতে পেলাম কাউকে। এটা তো ভাইয়া। কিন্তু ও এখানে কি করছে? ভাইয়ার তো এখন কমিউনিটি সেন্টারে থাকার কথা। প্রশ্নগুলো মাথায় আসতেই দৌড়ে গেলাম ভাইয়ার কাছে। উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে।
- তুই এখানে কেনো ভাইয়া? তোর তো বিয়ের কাজে হেল্প করার জন্য সেন্টারে থাকার কথা।
আমার কথায় চমকে উঠলো ভাইয়া। অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ যখন সামনে চলে আসে তখন এভাবে চমকে যাই আমরা। নিজেকে স্বাভাবিক করে আমার দিকে ঘুরলো সে। ভাইয়াকে দেখে চমকে গেলাম আমি। চোখদুটো অসম্ভব রকমের লাল হয়ে আছে। চোখের চারপাশটাও কেমন ফোলা।
- কি হলো কথা বলছিস না কেনো?
- ভালো লাগেনি তাই যাইনি।
- এটা আবার কেমন কথা?
- জানি না। তুই নিচে যা। তৈরী হবি কখন?
- সেটা তোর ভাবতে হবে না।
ভাইয়াকে একা থাকতে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিচে আসার জন্য পা বারালাম আমি। তখনই পেছন থেকে বলে উঠলো ভাইয়া
- তোরা দুই বোনই খুব খারাপ মেঘা। একসাথে মিলে চলে যাচ্ছিস এ বাড়ি থেকে। একবারো ভাবলিনা আমার কথা?
-…………………
- মালিহা, তুই দুজনই আমার কি সেটা জানিস তোরা? ভাবতেই পারছিনা এখন থেকে বাসায় ফিরে তোদের দেখতে পারবো না। বাসায় এসেই তোর সাথে ঝগড়া করা হবে না। তোর সাথে মারামারি করার জন্য মালিহার বকুনিগুলো আর খাওয়া হবে না।
- এভাবে বলছিস কেনো ভাইয়া?আপুতো খুব কাছেই থাকবে। ওর সাথে তো প্রায়ই দেখা করতে পারবি।
- আর তুই?
- আপুর মতো এতটা কাছে না থাকলেও খুব একটা দুরেও তো থাকবো না।
- এই কাছাকাছি তো আগের মতো না। চাইলেও আগের মতো থাকতে পারবো না আমরা। আজ থেকে তোরা অন্য বাড়ির সম্পত্তি হয়ে যাবি। আর এবাড়ির অতিথি।
ভাইয়ার কথাগুলোয় কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে মনে হয়। চোখ থেকে টপটপ করে গরিয়ে চলেছে নোনা জল। কিন্তু ভাইয়া কাঁদছে না। ওহ, ছেলেদের তো কাঁদতে নেই। তাই হয়তো কাঁদছে না। আচমকাই ভাইয়াকে বলে উঠলাম
- এখন তো তবুও দেখতে পারবি, কথা বলতে পারবি। কিন্তু আমি যদি আর বেঁচেই না থাকি তখন?
- এখানে এসব কথা বলার মানে কি? বেঁচে থাকবি না মানে?
- আরে আরে রেগে যাচ্ছিস কেনো? বুঝলাম না মারা যাওয়ার কথা শুনেই সবাই রেগে যাই। আরে আমি তো আর অমর নই। একদিন না একদিন তো মারা যেতেই হবে। সেটাই বলছি।
চুয়াল শক্ত হয়ে এসেছে ভাইয়ার। বুঝতে পারছি ভয়ানক রেগে গেছে সে। কোনোকিছু না বলেই ছাদ থেকে চলে গেলো ভাইয়া। আমি মুচকি মুচকি হাঁসতে লাগলাম। ইশ! আজকে সত্যি সত্যিই একবার মরতে ইচ্ছে করছে। মরে যাওয়ার পর যদি দেখতে পারতাম কে কেমন রিয়েক্ট করে তাহলে সত্যিই মরে যেতাম। কাধে কারো স্পর্শ পাওয়ায় পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলাম সারাকে। সে বাসের কন্ট্রাক্টরের মতো তাড়া দিয়ে বলতে লাগলো
- অসময়ে ছাদে এসে বসে আছিস কেনো? তারাতাড়ি নিচে চল। সাজানোর জন্য মহিলা এসে গেছে। সময়ও বেশি নেই। আঙ্কেল আন্টি তারাতাড়ি সেন্টারে পৌঁছুতে বলেছে।
আমি ভাবলেশহীন ভাবেই উত্তর দিলাম।
- যাচ্ছি যাচ্ছি। এতো তাড়ার কি আছে?
- তুই যে দিনদিন আজব এক প্রাণীতে রূপান্তরিত হচ্ছিস সেটা কি তুই জানিস? একটুপর তোর বিয়ে আর এখনও তুই গা-ছেড়ে দিয়ে বসে আছিস।
- ঠিকই বলেছিস। আজব এক প্রাণী। যে একজনকে ভালোবাসতে বাসতে এতটাই নিঃশ্বেস হয়ে গেছে যে অন্য কারো জন্য ভালোবাসা নামক অনুভূতিটাই কাজ করে না। তার বেঁচে থাকার কারণ হিসেবে রয়েছে দায়িত্ব দায়িত্ব আর দায়িত্ব।
সারার ফোঁপানোর শব্দ কানে আসছে ঠিকই কিন্তু ওর দিকে তাকাচ্ছি না আমি। সে তার চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো
- একটা কথা বলবি আমায়?
- কি কথা? বল।
- আমি কি ভুল করছি? বন্ধু হিসেবে তো আমার উচিৎ ছিলো তোর অনুভূতিগুলোর সাথে থাকা। তোকে তোর ভালোবাসার প্রতি সাপোর্ট করা। যেটা আগে করতাম। বিশ্বাস কর। আগে আমিও চাইতাম তোর ভালোবাসা জিতে যাক। পেয়ে যা তুই ফুয়াদ ভাইয়াকে। কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়া কন্টিনিউয়াসলি যেভাবে তোর ফিলিংসগুলোর অপমান করছিলো সেটা মেনে নিতে পারি নি আমি। তারপর যখন খেয়াল করলাম তানভীর ভাইয়ার তোর প্রতি একটা সফট কর্ণার আছে। তখন…………
- তুই শুধু শুধু নিজেকে ভুল ভাবছিস। তুই যেটা করেছিস একটা প্রকৃত বন্ধু হিসেবে সেটাই তোর করনীয় ছিলো। তুইও যদি আমার একতরফা ভালোবাসাটাকে সাপোর্ট করতি তাহলে হয়তো আমি কোনোদিনও নিজেকে ফুয়াদ ভাইয়ার থেকে দুরে সরিয়ে আনতে পারতাম না। সেটা আমার জন্য শান্তির হলেও আমার পরিবার? আমার পরিবারের জন্য ঠিক হতো না। তানভীর ভাইয়ার সাথে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সাপোর্ট করেছিস বলেই পরিবারের সবাই খুশি। আমি খুশি না থাকলেও খারাপ থাকবো বলে মনে হয় না। তুই আমায় আবেগ নিয়ে পড়ে থাকতে না না বলে বাস্তবতাটা বুঝিয়ে গেছিস ক্রমাগত। তাই বলছি তুই একদম ঠিক করছিস।
আমার কথা শেষ হতেই আমায় জরিয়ে ধরলো সারা। কাধের উপর গরম অনুভূত হওয়ায় বুঝলাম কাঁদছে সে। যে কান্নার শব্দ নেই। তবে রয়েছে বেস্টফ্রেন্ডের কষ্ট মেনে নিতে না পারার আহাজারি।
- আজকে আমার চিৎকার করে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছে শেখো, এই মেয়ের থেকে শেখো তোমরা। কাউকে নিঃস্বার্থভাবে কিকরে ভালোবাসা যায় সেটা শেখা উচিত তোর থেকে। আবার পরিবারকে কতটা ভালোবাসলে সেই ভালোবাসাটাও বিসর্জন দেওয়া যায় সেটাও তোকে দেখে শেখা উচিত।
- আরে ধুর কান্নাকাটি থামা তো। এভাবে কাঁদছিস যেনো মরে গেছি আমি। তারাতাড়ি চোখ মোছ। নিচে যেতে হবে না? কতটা লেইট হয়ে গেছে।
- হুম আর কাঁদবো না। কি পাগল আমি। যেখানে তোর কাঁদার কথা সেখানে তুই কাঁদছিস না। আর আমি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে চলেছি।
নিচ থেকে অহনা আপুর ডাক পেয়ে আর একমিনিটও দাঁড়ালাম না ছাদে। মুখে হাঁসি এনেই তারাতাড়ি চলে এলাম ঘরে। যেখানে আমার আর আপুর সাজের ব্যাবস্থা করা হয়েছে।
প্রায় দুইঘন্টার মতো সময় নিয়ে মানুষ থেকে পুতুলে পরিণত করা হলো আমায়। নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না আমি। সাজগোছ কোনোকালেই পছন্দ নয় আমার। সম্ভব হলে আজকেও সাজতাম না। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে যদি বউকেই সাজতে দেখা না যায় তাহলে হয়তো খবরের কাগজের হেডলাইন হিসেবে বেরিয়ে পরবে এই খবর।
আপুকেও সাজানো হয়ে গেছে। দুজনেই এক রকম শাড়ি পরেছি। তবে জুয়েলারিগুলো আলাদা আলাদা। আপুরগুলো খালামনির দেওয়া আর আমার গুলো তানভীর ভাইয়াদের দেওয়া। তাই ম্যাচ করেনি। আমাদের সাজানোর সময় বাকি আপুরাও সেজে নিয়েছে। এখন শুধু বাবার ফোনের অপেক্ষা। বাবা ফোন করলেই বেরিয়ে পরবো আমরা। আর ফেরা হবে না এবাড়িতে। ওখান থেকেই চলে যাবো এক নতুন ঠিকানায়।
সবার মাঝে ভালো না লাগায় সারার সাথে নিজের ঘরে এলাম একটু। এই ঘরটা ছেড়ে আজ থেকে থাকতে হবে আরেক ঘরে। ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস নিজের হাতে গুছিয়েছি আমি। সবকিছুর প্রতিই মায়া পরে গেছে। যে মায়া কাটাতে খুব কষ্ট করতে হবে আমায়।
হঠাৎ ফোনের মেসেজ টোনে ভাবনার সুতো ছিড়লো আমার। তাকিয়ে দেখি তানভীর ভাইয়ার মেসেজ। এসময় উনার মেসেজে ভীষণ অবাক হলাম আমি। কৌতুহল মেটাতে মেসেজটা অপেন করলাম। মেসেজে লিখা
তোমাদের বাড়ির পেছনের বাগানটায় এসো প্লিজ। আমিও ওখানেই আছি এখন। অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। জলদি এসো। খুব বড় সারপ্রইজিং আছে তোমার জন্য। আসবে কিন্তু
ইতি
তোমার আশায় বসে থাকা আমি
মেসেজ পড়ে কৌতুহল কমার বদলে আরো বেড়ে গেলো। কি এমন সারপ্রাইজ দেবেন উনি? যার জন্য এখন বাগানে যেতে হবে আমায়। একটুপরই তো বিয়ে। বুঝতে পারছি না যাবো কি যাবো না।
- কার মেসেজ?
সারার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোজা ফোনটাই ধরিয়ে দিলাম তার হাতে। মেসেজ পড়ে সেও যে অবাক হয়েছে সেটা তার মুখভঙ্গিই বলে দিচ্ছে।
- কি করবো এখন?
- সেটাই তো। কি করবি?
- বুঝতে পারছি না। কি এমন সারপ্রাইজ বলতো?
- আরে আজব আমি কিভাবে জানবো? কি সারপ্রাইজ সেটা জানতে চাস?
- হুম।
- আরে গাধা তাহলে বসে আছিস কেনো? চলে যা বাগানে।
- এখন এইভাবে?
- তো?
- আরে একটু পর বিয়ে এখন যাওয়া ঠিক হবে কি? তাছাড়া যে ভাড়ী সাজ। এসব নিয়ে হাঁটতে পারবো কিনা সন্দেহ।
- তাহলে আর কি। বসে থাক।
-বসে থাকতেও তো পারছি না। কিউরিসিটি বেড়েই চলেছে। আচ্ছা আমি কি যাবো?
- আমি কি জানি।
- আচ্ছা আমি যাবো। কিন্তু কেউ যেনো না জানে। নাহলে কি না কি ভাববে।
- আচ্ছা কেউ জানবে না। তুই যা। কিন্তু তারাতাড়ি ফিরবি।
- হুম। তুই নিচ পর্যন্ত আয় না আমার সাথে। প্লিজ
- ওকে চল।
আমি আর সারা পা টিপে টিপে নামতে লাগলাম সিড়ি বেয়ে। কেউ জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। অতিরিক্ত গয়নার ভাড়ে হাঁটতেও পারছিনা ঠিকমতো। অনেক কষ্টে ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই সারা বলে উঠলো
- বাকিটুকু তোর একার পথ। আমি যাবো না। কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার সখ নেই।
আমারও কেমন ভয় করছে। বুকে ফু দিয়ে আবারও হাঁটা ধরলাম আমি। বাগানে লাইট থাকায় অন্ধকাজনিত সমস্যায় পরতে হয়নি আমায়। বাগানের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াতেই পেছন থেকে ভেসে এলো তানভীর ভাইয়ার গলা।
-এসে গেছো তুমি।
তারাতাড়ি করে পেছনে ঘুরলাম আমি। কিন্তু তানভীর ভাইয়াকে দেখে অবাকের চরমসীমায় পৌঁছে গেলাম যেনো।
বিয়ের সাজের বদলে কি অদ্ভুতভাবে সেজে আছেন তানভীর ভাইয়া। মুখে মাস্ক, কালো রেইনকোট পড়ে হাতদুটো পেছনে রেখে দিয়েছেন। বাইরে তো বৃষ্টি নেই। তাহলে রেইনকোট পড়ার কারণটাই বুঝে উঠতে পারছি না আমি। উনার কন্ঠ না চিনলে বুঝতেই পারতাম না এটা তানভীর ভাইয়া। বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করলাম
- আপনি এভাবে কেনো?
- কারণ এখন আমি যেটা করবো তার জন্য এমন ভাবেই থাকতে হবে আমায়।
- মানে? কি করবেন আপনি?
- দেখতে চাও?
- হুম
- ওকে।
পেছন থেকে হাতটা সামনে নিয়ে এলেন তানভীর ভাইয়া। উনার হাতে কিসের একটা বোতল যেনো। আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন
- এটা দিয়ে কি করবো দেখতে চাও? দাঁড়াও দেখাচ্ছি।
উনি বোতলের মুখটা খুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমার একদম কাছে এসে মুখে হাত রেখে বললেন
- ইউ নো? তুমি অনেক সুন্দর। তোমার চেহারায় এক অন্যরকম লাবণ্যতা আছে।
- কিসব বলছেন আপনি? পাগল হয়ে গেছেন? আর আপনি আমার মুখে হাত দিয়েছেন কেনো?
আমার কথায় হাঁসলেন তানভীর ভাইয়া। উনার আজব ব্যাবহার মেনে নিতে পারছি না আমি। উনি হেঁসে হেঁসে বললেন
- আজকের পর আর কেউ তোমার এই মুখে হাত দেবে না।
- মানে?
আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর এলো না তানভীর ভাইয়ার তরফ থেকে। উনি অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন কতক্ষন। হঠাৎ করেই বোতলের ভেতর থাকা তরল কিছু ছুড়ে মারলেন আমার মুখে। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে সব। মুখে অনুভূত হচ্ছে অসহ্য যন্ত্রনা। সারা মুখটা জ্বলে যাচ্ছে মনে হয়। সহ্য করতে না পেরে মুখে ধরে এক গগনবিদারী চিৎকার দিলাম আমি। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পড়ে গেলাম বাগানের সবুজ ঘাসের উপর। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরায় হাতটাও জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মরে যাচ্ছি আমি। সহ্য করতে পারছি না এই যন্ত্রনা। আমি চিৎকার করেই চলেছি। কিন্তু কেউ এলহনো আসে নি আমার কাছে। ঝাপসা চোখে তানভীর ভাইয়াকে দৌড়ে যেতে দেখলাম শুধু।
গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করছি আমি। পাশে নেই কোনো আপনজন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ফুয়াদ ভাইয়ার মুখ। আমি কি মরে যাচ্ছি? শেষবারের মতো কি ফুয়াদ ভাইয়াকে দেখা হবে না আর। মৃত্যুর মাধ্যমেই কি আমার অসমাপ্ত ভালোবাসার ইতি ঘটবে আজ? চোখ বন্ধ হওয়ার আগে সারাসহ বাকিদের আমার দিকে ছুটে আসতে দেখলাম।
পর্ব ২৬
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালাম আমি। চোখের সামনে সবটাই ঝাপসা। বাপাশের চোখটা খুলতে পারছিনা। বুঝতে পারছি মুখের বা পাশটায় ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে। কতক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখের সামনে স্পষ্ট হতে লাগলো সব। ডান চোখ দিয়েই দেখতে পারছি শুধু। মুখের অসহ্য জ্বালা কমেনি এখনো। মৃত্যু যন্ত্রণাও বুঝি এমন কষ্টের হয়।
একচোখ দিয়েই পিটপিট করে দেখতে লাগলাম চারদিকে। খুব বেশি ভুল নাহলে এমুহূর্তে হসপিটালের কোনো কেবিনে আছি আমি। রুমের জিনিসগুলো তো তাই বলছে। আমায় চোখ খোলতে দেখেই অস্থির হয়ে উঠলেন কেবিনে উপস্থিত একজন নার্স। খুব তারাতাড়ি করে বেরিয়ে গেলেন কেবিন থেকে।
কিছুক্ষণ পরেই কেবিনে ঢুকলেন একজন ডাক্তার। সাথে আছে মা -বাবা, ভাইয়া, আপুসহ আরো অনেকে। আপু এখনো বিয়ের সাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদে চলেছে। আপুকে দেখে অন্য সবকিছু ভুলে গেলাম যেনো। মনে শুধু একটাই প্রশ্ন আসছে। তাহলে কি ওদের বিয়েটা হয়ে গেছে? এতক্ষণে তো বিয়ে হয়ে যাওয়ারই কথা। এসব ভাবতেই মুখের যন্ত্রণার থেকেও ভয়ানক যন্ত্রণা হচ্ছে মনে।
মায়ের ফুঁপানোর শব্দ কানে আসতেই ভাবনার সুতো ছিড়লো আমার। আমি নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছি এখনো। কথা বলতে পারছি না। ডাক্তার সবাইকে দূরে দূরে থাকতে বলে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। কতক্ষণ আমায় পর্যবেক্ষণ করেই বেরিয়ে গেলেন কেবিন থেকে। যাওয়ার আগে সবাইকে একসাথে আমার কাছে আসতে বারণ করলেন তিনি।
ডাক্তার চলে যেতেই মা ছুটে এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। এতোক্ষণ বোধহয় খুব কষ্টে কান্না আটকে দাঁড়িয়ে ছিলো। তাইতো আমার হাত ধরে নিয়েই জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন তিনি। মায়ের কান্নায় আমার কষ্ট যে আরও বেড়ে যাচ্ছে সেটা কি মা বুঝতে পারছে না? কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না মা। তবে কিছু বলতে চাইছে হয়তো। আমি ধীর কন্ঠে বলে উঠলাম
- তোমার কান্না সহ্য হচ্ছে না মা। প্লিজ কান্না বন্ধ করো।
আমার কথার উত্তরটাও দিতে পারছে না মা। এবার ভাইয়া এগিয়ে এলো। মাকে জোর করে পাশের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো সে। তারপরেই আমার কাছে এসে আস্তে করে বসে পড়লো আমার পাশে। ভাইয়াও যে কেঁদেছে সেটা তার চোখ দেখেই বুঝতে পারছি আমি। কষ্ট হলেও সবার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে আমার। আমি উঠে বসার চেষ্টা করতেই আমায় ধরে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো ভাইয়া। অস্পষ্টভাবেই কথা বলতে লাগলাম ভাইয়ার সাথে
- আমার মুখটা খুব জ্বলছে ভাইয়া। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আচ্ছা আমি কি মরে যাবো ভাইয়া?
টলমলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ভাইয়া। তবুও মুখে হালকা হাঁসি এনে বললো
- ধুর পাগলী, কিচ্ছু হবে না তোর। মুখটা সামান্য একটু জ্বলে গেছে শুধু। কয়েকদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে।
- মিথ্যে বলছিস কেনো ভাইয়া? আমি জানি আমি কখনো ঠিক হবো না। আমার আগের মুখটা আর কখনো ফিরে পাবো না আমি। আচ্ছা ভাইয়া একটা কথা বলতো?
- কি?
- আমি মরে গেলে আমায় মিস করবি না? রোজরোজ কার সাথে ঝগড়া করবি বলতো? আমি মরার পর যেই জিনিসগুলো নিয়ে আমরা রোজ মারামারি করতাম সেগুলো তুই নিয়ে নিস। সে গুলো নিয়ে আর কেউ কাড়াকাড়ি করবে না। আর শোন, আমার গাছগুলোর যত্ন নিবি কিন্তু। ডেইজি গাছটার যেনো কিছু না হয়। ওগুলো দেখলেও আমায় মনে পড়বে তোদের।
আমার আর কোনো কথা না শুনেই কেবিন থেকে চলে গেলো ভাইয়া। এভাবে বলা ঠিক হয়নি বোধহয়। হাতের ইশারায় আপুকে কাছে ডাকলাম আমি। সেও কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে একদম। সবাই যে হারে কান্না করছে তা দেখে মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই মরে গেছি আমি।
- বিয়ে হয়ে গেছে আপু?
- কার?
- তোমার আর ফুয়াদ ভাইয়ার।
- পাগল হয়ে গেছিস তুই? তোর এই অবস্থায় আমি বিয়ে করবো?
- আমি এখানে এলাম কি করে আপু?
- আমরা সবাই একসাথে ঘরে বসেছিলাম। তখনই হঠাৎ বাগান থেকে তোর চিৎকার শুনতে পাই। সবাই মিলে গিয়ে দেখি তোর এই অবস্থা। তখন বাড়ির সবাইকে ফোন করে জানানো হয়। আর তারা হসপিটালে নিয়ে আসে তোকে। এখানে আসার পর ডাক্তার জানায় তোর মুখে এসিড পড়ায় এমন হয়েছে। মুখের ফোরটি পার্সেন্ট অংশই জ্বলে গেছে তোর।
আর কিছু বলতে পারলো না আপু। কান্না করতে লাগলো আবারও। সবার মাঝে ফুয়াদ ভাইয়াকে খুঁজতে লাগলাম আমি। কিন্তু উনাকে চোখে পড়লো না কোথাও। তাহলে কি উনি আসেননি? এতোটা অপছন্দ করেন উনি আমায়? আমার এঅবস্থাতেও একবার আমার কাছে এলেন না উনি? আমার ভাবনার মাঝেই খুব জোরে কেবিনের দরজা খুললো কেউ। এতো জোরে শব্দ হওয়ায় সবাই তাকালো দরজার দিকে। আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। কেমন উসকোখুসকো হয়ে আছে উনার চেহারা। উনি ধীরে ধীরে হেঁটে চলে এলেন আমার কাছে। এখন পাশে অন্য কেউ নেই। তাই আমি মুচকি হেঁসে আস্তে আস্তে বললাম
- দেখলেন তো ভাইয়া? আমার ভালোবাসাটা যেনো আপনি ছাড়া অন্য কেউ না পায় সেটা বোধহয় প্রকৃতিও চায় না। তাই তো এমন কিছু ঘটলো আমার সাথে। আমি মরে গেলেই ভালো হবে। আপনিও আপুকে বিয়ে করতে পারবেন। কিন্তু আমার আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে জীবনসাথী হিসেবে মেনে নিতে হবে না। আজকে বলছি, বাঁচতে চাই না আমি। মরে যেতে চাই। সত্যিই মরে যেতে চাই।
আমি কথাগুলো আস্তে বলছিলাম যেনো কেউ শুনতে না পায়। কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়া কারো পরোয়া না করে সবার সামনে আধশোয়া অবস্থাতেই জরিয়ে ধরলেন আমায়। আমিসহ কেবিনে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলো উনার কাজে। ভাবতে পারছি না ফুয়াদ ভাইয়া নিজে আমায় জরিয়ে ধরেছেন। ফুয়াদ ভাইয়া বলতে লাগলেন
- আরেকবার মরে যাওয়ার কথা বললে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। কেনো মরবি তুই? কিছু হবে না তোর। তোকে তো বাঁচতে হবে। আমায় ভালোবাসার জন্য বাঁচতে হবে। আমায় জ্বালানোর জন্য বাঁচতে হবে। আমার হাজার অপমানগুলো সহ্য করার জন্য বাঁচতে হবে। তুই না থাকলে আমি বেহায়া, ছেচড়া বলে ডাকবো কাকে? আমার যে তোকে প্রয়োজন। আমার আমিটাকে সামলানোর জন্য হলেও যে তোকে প্রয়োজন। তুই বুঝতে পারছিস না? তোকে এভাবে দেখে কষ্ট হচ্ছে আমার।
আমি আমার কানকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। ফুয়াদ ভাইয়া এগুলো বলছেন? আমি অবিশ্বাসী কন্ঠে বললাম
- আমায় দেখে আপনার কষ্ট হচ্ছে? কিন্তু কেনো?
- ভালোবাসি তাই। তোকে ভালোবাসি তাই কষ্ট হচ্ছে। বুঝতে পারিস না তুই?
বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি আমি। কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছি না। হঠাৎই মাথায় আসলো এখানে তো আমরা একা নই। বাকিরাও আছে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ঝটপট আপুর দিকে তাকালাম আমি। সেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে। মা হয়তো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তার আগেই আপু বললো
- তোমরা সবাই বাইরে যাও মা। আমার ওদের সাথে কথা আছে। প্লিজ যাও।
সবাই চুপচাপ বেরিয়ে গেলো। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। আপু কেমন রিয়েক্ট করতে পারে বুঝতে পারছি না ফুয়াদ। ফুয়াদ ভাইয়াও অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
- আপু প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না। আমি ফুয়াদ ভাইয়াকে……..
- তুই এতোটা নাটক করতে পারিস?
- আপু
- কি, আপু হ্যাঁ? তুই ফুয়াদ ভাইয়াকে ভালোবাসিস সেটা আমায় বলতে পারতিনা? একবার বলেই দেখতি। তাহলে আমি জীবনেও এই বিয়েতে রাজি হতাম না। যাকে ভালোবাসিস তাকে নিজেরই বোনের সাথে সহ্য করতে পারতি? আমি জানি প্রিয় মানুষটাকে অন্য কারো সাথে দেখার কষ্ট কতটা? এই একই কষ্টের আগুনে আমার নিজের বোনকে পুড়তে দিতাম না আমি। আর কিছু বলবো না। তবে একটা কথা বলছি তুই হয়তো আমার সাথে ফ্রী হতে পারিস নি কখনো। নয়তো এতো বড় একটা কথা আমার থেকে লোকাতি না।
আপুর কথার কোনো উত্তর দিতে পারলাম না আমি। তবে ফুয়াদ ভাইয়া বললেন
- মেঘার কোনো দোষ নেই মালিহা। ও তখনই তোকে এই কথাটা বলতো যখন আমিও ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু আমি তো ওকে বারাবার ফিরিয়ে দিতাম। আসলে আমি নিজেই জানতাম না যে আমিও ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। এ কয়দিনে বুঝতে পেরে গেছি যে ওকে ছাড়া আমার চলবে না। কিন্তু ততক্ষণে তো অনেক দেরি হয়ে গেছে।
- আপনি এতোটা কষ্ট দিয়েছেন ওকে? ভাবতে পারছি না ফুয়াদ ভাইয়া।
আবারও মাথা নিচু করে ফেললেন ফুয়াদ ভাইয়া। তিনজনই চুপ করে আছি। হঠাৎই কেবিনে ঢুকলেন কয়েকজন পুলিশ। উনারা আমার দিকে এগিয়ে এলেন। ফুয়াদ ভাইয়াকে একজন প্রশ্ন করলেন,
- ইনিই মিস আফিফা?
- জ্বি।
- উনি কি এখন আমাদের সাথে কথা বলতে পারবেন?
- জ্বি পারবেন।
সবার মধ্যে থেকে কালো করে একটা লোক আমায় জিজ্ঞেস করলেন
- এখন কেমন আছেন ম্যাম?
- অনেকটাই ভালো।
- আমাদের সাম্প্রতিক কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আপনাকে।
- জ্বি বলুন।
- আপনার সাথে কে এমন করলো তাকে কি আপনি চেনেন?
অফিসারের এ প্রশ্নেই মনে পড়ে গেলো কালকের সেই ভয়ানক ঘটনার কথা। এতক্ষণ যেটা মনেই আসেনি আমার। ভাবতে পারছি না তানভীর ভাইয়া এসব করেছেন। কাল উনার হিংস্র এক চেহারা দেখতে পেলাম আমি। তানভীর ভাইয়াকে ভালো না বাসলেও উনার এই রূপ মেনে নিতে পারছি না। আমি স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলাম
- জ্বি, উনাকে আমি চিনি। উনি আমার উডবি হাজবেন্ড মিস্টার তানভীর।
আমার উত্তরে যেনো কারেন্টের শক খেলো সবাই। ফুয়াদ ভাইয়া বলে উঠলো
- কি বলছিস এসব? পাগল হয়ে গেছিস? কার নামে কি বলছিস জানিস তুই?
- হুম জানি। এমন একজন লোকের সম্পর্কে বলছি যে কিনা আমার জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছে।
- আমি জানি তোর ভুল হচ্ছে। তানভীর এমন করতেই পারে না। আরে ওতো তোকে ভালোবাসতো। তাহলে কেনো করবে এসব?
- উনি কেনো আমার সাথে এসব করলেন সেটা তো আমি নিজেও জানি না। তাছাড়া সেটা যদি তানভীর ভাইয়া না হন তাহলে উনি এখন কোথায়?
- জানি না। তানভীরকে কোথাও খুজে পাচ্ছি না।
- খুজে পাবেন কি করে? উনি তো পালিয়ে গেছেন।
এবার অফিসার জিজ্ঞেস করলেন
- আপনি উনাকে স্পষ্ট দেখেছিলেন ম্যাম?
- না স্যার। উনি মাস্ক পড়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমি উনার কন্ঠ চিনি। প্লিজ এখন আবার বলবেন না যে কেউ উনার কন্ঠ নকল করে কথা বলেছিলো। দয়া করে আমার ফোনটা আমায় এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন তাহলেই সব বুঝতে পারবেন।
- ওকে ম্যাম।
কিছুক্ষণ পরেই আমার ফোন নিয়ে কেবিনে এলো সারা। ফোনটা আমায় দিয়ে বসে পড়লো আমার পাশে। অশ্রুসিক্ত চোখে অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বললো
- আমি নিজেও একজন সাক্ষী স্যার। আমার কথা শুনেই বাগানে গেছিলো মেঘা। এখন নিজের প্রতিই রাগ হচ্ছে আমার। আমি যদি ওকে যেতে না দিতাম তাহলে হয়তো এমন কিছুই হতো না। আমায় ক্ষমা করে দে মেঘা। আমি ইচ্ছে করে করিনি।
- চুপ করবি তুই? আমার ইচ্ছা না থাকলে কি শুধু তোর কথা শুনে চলে যেতাম বাগানে? আমি নিজেই গেছিলাম। তাই নিজেকে ব্লেইম করা বন্ধ কর।
ফোনের মেসেজ অপশনে গিয়ে তানভীর ভাইয়ার করা মেসেজটা দেখালাম সবাইকে। এটা দেখার পরই ধপ করে চেয়ারে বসে মাথা চেপে ধরলেন ফুয়াদ ভাইয়া।
পর্ব ২৭
এই হাসপাতালে আছি আজ প্রায় বাইশ দিন হতে চললো। এখানের প্রতিটি দিন ছিলো দমবন্ধকর। বন্দী পাখির মতো ছটফট করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না আমার। এতোকিছুর মাঝেও ফুয়াদ ভাইয়ার কেয়ারনেস দেখে অবাক হয়েছি শুধু। যেই উনি আমায় সহ্য করতে পারতেন না সেই উনি এখন আমায় চোখের আড়াল হতে দেন না যেনো। আমার কি লাগবে না লাগবে সবকিছুর খেয়াল রেখেছেন উনি। এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন উনি হাসপাতালে আসেননি।
তানভীর ভাইয়ার খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনো। পুলিশ হন্ন হয়ে খোঁজে চলেছে উনাকে। আমিও অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি কোনদিন উনি ধরা পরবেন সে আশায়। শাস্তি দেওয়ার কথা পরে আগে তো আমায় জানতে হবে ঠিক কি দোষে এতো বড় ক্ষতি করলেন উনি আমার।
মুখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে আজ। সে নিয়েই ডাক্তারদের মাঝে প্রচুর ব্যাস্ততা। আমি চুপচাপ বসে বসে মনে শক্তি যোগার করছি। কারণ আজ যে খুব বড় একটা ধাক্কা খেতে হবে আমায়। সেটা আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। এতোদিন তো কত কত এসিড ভিকটিমদের দেখতাম আর দুঃখ প্রকাশ করতাম। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ আমি নিজেই একজন এসিড ভিকটিম। একয়দিনে একচোখে দেখে দেখে অভ্যেস হয়ে গেছে আমার। বা চোখের উপর ব্যান্ডেজ থাকায় ডান চোখ দিয়েই দেখতে হয় সব।
আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সারা আর ফুয়াদ ভাইয়া।বাকি সবাই কেবিনের বাইরে। সারার মাঝেও যে ভয় কাজ করছে সেটা তাকে দেখেই বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু আজ তার ভয় কাটানোর মতো অবস্থা আমার নেই। তাই আমিও চুপ করে বসে আছি।
- মা, তুমি রেডি তো?
ডাক্তার চাচার এই কথায় বুকটা ধক করে উঠলো। সারা গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেছে। সাহস যোগাতে শক্ত করে চেপে ধরলাম সারার হাত। সেও চোখের ইশারায় ভরসা দিলো আমায়। হঠাৎ কোমড়ে কারো স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠলাম আমি। পাশে তাকিয়ে দেখি আমার কোমড় চেপে দাঁড়িয়ে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। উনার চোখে চোখ পড়তেই আমার আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালেন উনি। ধীর কন্ঠে বলে উঠলেন
- ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব ঠিকই হবে ইনশাআল্লাহ।
- কিন্তু আমার তো ভয় হচ্ছেই। চাইলেও স্বাভাবিক থাকতে পারছি না আমি।
আমার কথায় বড় একটা শ্বাস নিলেন ফুয়াদ ভাইয়া। আমায় সম্পুর্ন উনার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন
- আমার চোখের দিকে তাঁকা। একটানা তাঁকিয়ে থাকবি। অন্য কোনো দিকে যেনো নজর না যায়।
ফুয়াদ ভাইয়ার আদেশ অনুযায়ী উনার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আমি। কেমন যেনো নেশা ধরে যাচ্ছে আমার। উনিও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি আগেও ফুয়াদ ভাইয়ার চোখের দিকে তাঁকিয়ে থেকেছি কিন্তু তখন এমন অনুভূতি হয় নি। কারণ তখন উনি আমার দিকে তাঁকাতেন না। আর তাকালেও সে দৃষ্টি আজকের মতো শান্ত হতো না।
- এখনো ভয় করছে?
ফুয়াদ ভাইয়ার প্রশ্ন কানে আসতেই ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এখন আর আগের মতো ভয় করছে না আমার। তাই আমি মাথা নেড়ে জানান দিলাম যে ভয় করছে না আর।
- গুড। এবার বল তুই রেডি তো?
- হ্যাঁ। যা হওয়ার হবে।
সারা আর ফুয়াদ ভাইয়াকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। একটা চেয়ারে গুটিশুটি মেরে বসে আছি আমি। ডাক্তার চাচা মুচকি হেঁসে আমায় ভয় না পেতে আশ্বস্ত করলেন। একয়দিনে অনেক ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে উনার সাথে। নিজের মেয়ের মতো খেয়াল রেখেছেন উনি আমার।
আলতো হাতে ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করলেন ডাক্তার চাচা। আমি চোখ বন্ধ করে বসে আছি। ধীরে ধীরে মুখের বা পাশটায় কেমন অনুভূত হতে লাগলো। বুঝতে পারছি ব্যান্ডেজ খুলে ফেলায় এমন হচ্ছে।
- এবার তো চোখ খুলো মা? সব ঠিক আছে দেখো।
সব ঠিক আছে ডাক্তার চাচার একথা যেনো ম্যাজিকের মতো কাজ করলো। ফট করে চোখ মেলে তাকালাম আমি। কিন্তু বুঝতে পারিনি এটা ডাক্তার চাচার স্বান্তনা ছিলো মাত্র। দুচোখ মেলে তাকালেও ডান চোখেই দেখতে পারছি আমি। যেমনটা ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় ছিলো। আমি টলমলে চোখে সারা আর ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে তাকালাম একবার। চোখ বন্ধ করে নিজের ওড়না খামচে দাঁড়িয়ে আছে সারা। চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে চলেছে নোনাজল। ফুয়াদ ভাইয়ার চোখেও পানি টলমল করছে তবে উনি কাঁদছেন না। ওদের এমন রিয়েক্ট করার কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না আমার। আমি তো এখনও বলিনি যে আমি বা চোখে দেখতে পারছি না। তাহলে ওরা কেনো এমন করছে?
ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার চাচার দিকে তাকালাম আমি। তিনি মুখে মিষ্টি হাঁসি বজায় রেখেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ধরা গলায় বললাম
- চাচা, বা চোখে কিছুই দেখতে পারছি না আমি।
এবার মাথা নিচু করে ফেললেন চাচা। নিচের দিকে তাঁকিয়েই ছাড়লেন একটা দীর্ঘশ্বাস। আবার নিরাস ভঙ্গিতে বললেন
- এমন কিছুই ডাউট হচ্ছিলো। এখানে আমাদের কিছু করার নেই মা। তোমার বা চোখে আর দেখতে পাওয়ার কোনো চান্স নেই। আই এম এক্সট্রিমলি সরি।
একথায় আমার ভীষণ কষ্ট পাওয়ার কথা থাকলেও খুব বেশি কষ্ট পাচ্ছি না আমি। বারবার ভাবছি বা চোখে দেখতে পাবো না তো কি হয়েছে? ডান চোখে তো দেখতে পাবো। আমার এতেই চলবে। এমনও তো হতে পারতো যে দুটো চোখেই দেখতে পারতাম না। তখন? একটা চোখ ভালো আছে এটা নিয়েই হাজার শুকরিয়া।
- ডক্টর কোনোকিছুই কি করার নেই আপনাদের? প্লিজ ডক্টর। ওর বয়স মাত্র ঊনিশ বছর। সামনে ওর পুরো জীবন পরে আছে।
- আই আম সরি মিস্টার ফুয়াদ। বাট সত্যি সত্যিই কিছু করার নেই আমাদের।
চাচার কথা যেনো মেনে নিতে পারছেন না ফুয়াদ ভাইয়া। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন উনি। সারা এখনো মাটির পুতুলের মতো স্তব্ধ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎই আমি বললাম
- আমায় একটা আয়না দেওয়া যাবে চাচা। প্লিজ
ডাক্তার চাচা কতক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন আমার মুখপানে। তারপরেই বললেন
- শিউর। বাট বী স্ট্রং। ওকে?
- ওকে।
এক নার্সের সাহায্যে আয়না আনানো হলো কেবিনে। চাচা কাঁপা হাতে আয়নাটা বারিয়ে দিলেন আমার দিকে। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে চমকে উঠলাম আমি। স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। সারা শরীর থরথর করে কেঁপে চলেছে। সারা আর ফুয়াদ ভাইয়ার ওরকম রিয়েক্ট করার কারণ এখন পুরো স্পষ্ট আমার কাছে৷
বা পাশে চোখের পাশ থেকে থুতনি পর্যন্ত ঝলসে যাওয়া চামড়ায় ভীষণ অচেনা লাগছে নিজেকে। না চাইতেও ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলে চলেছি আমি। আলতো হাতে পাশের টেবিলটায় আয়নাটা রেখে দিলাম। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়তো আমার মনের অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করছে। আমি স্বাভাবিকভাবে ডাক্তার চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম
- আমি কি আজই বাসায় যেতে পারি চাচা?
- হ্যাঁ আজকেই তোমায় ছেড়ে দেওয়া হবে।
- ওহ। কিন্তু কখন?
- এখনই যেতে পারবে তুমি।
আমি সারাকে উদ্দেশ্য করে বললাম
- তুই এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে আমার সাথে বাইরে চল। বাহিরে সবাই আছে নিশ্চই? সবাইকে তো দেখাতে হবে আমার নিউ লুক। তাই চল।
সারা কিছু না বলে অবাক হয়ে তাকালো ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে। ফুয়াদ ভাইয়া তারাতাড়ি আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে বললেন
- আমার সাথে চল। আমি নিয়ে যাচ্ছি তোকে।
জানি না কি হলো আমার। আমি চিৎকার করে বললাম
-হাত ছাড়ুন আমার। আপনাকে বলেছি আমি? সব বিষয় নিয়ে আপনার নাক না গলালেও চলবে। নিজের পথ দেখুন।
আমার এমন ব্যবহার হয়তো ফুয়াদ ভাইয়া আশা করেন নি। তাই অবাক হয়ে বললেন
-তুই এভাবে কথা বলছিস কেনো?
- তো কিভাবে কথা বলবো? আমি ভালো করেই কথা বলছি। আপনি এখনো আমার হাত ধরে আছেন কেনো? ছাড়তে বলছি না?
ফুয়াদ ভাইয়া চুপচাপ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দুরে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ উনাকে দেখে খারাপ লাগছে আমার। বুঝতে পারছি না কেনো এমন ব্যাবহার করলাম আমি। তবে কেনো জানিনা ফুয়াদ ভাইয়ার হাত ধরাটা সহ্য হয়নি আমার। মনে হচ্ছিলো দয়া করছেন উনি আমায়। আমিও মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে নিলাম কেবিন থেকে। তখনই পেছন থেকে ডেকে উঠলেন ডাক্তার চাচা।
- মেঘা, মাই প্রিন্সেস।
- জ্বি চাচা।
-তোমায় মিস করবো খুব।
- আমিও চাচা। আমার কিন্তু যখনই ইচ্ছে হবে তখনই চলে আসবো এ হসপিটালে।
- অবশ্যই। আমি অপেক্ষা করবো।
- হুম
- আরেকটা কথা মা। তুমি যথেষ্ট স্ট্রং একটা মেয়ে। তাই বলছি সবসময়ই এমন স্ট্রং থাকবে। আবেগের বশে ভুল কোনো পদক্ষেপ তোমার থেকে কাম্য নয়। মনে রাখবে, এ দেশে এমন অনেক মেয়ে আছে যারা এসিড নিক্ষেপের পরও বেঁচে আছে। তারা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে। তারা হেরে যায় নি।
ডাক্তার চাচা কি ইঙ্গিত করছেন সেটা বুঝতে পারছি আমি। আমিও মুচকি হেঁসে উত্তর দিলাম
- ডোন্ট ওয়ারি চাচা। এর থেকে বেশি কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছি আমি। সেসময় যখন ভুল কিছু করিনি এখনো করবো না। তাই চিন্তা করবেন না। আজ আসি চাচা। আল্লাহ হাফেজ।
- ওকে মাই প্রিন্সেস। আল্লাহ হাফেজ।
কেবিন থেকে বেরোতেই এক অন্যরকম প্রশান্তি পেলাম। আজ কতদিন পর কেবিনের বাইরে বেরিয়েছি আমি। খাঁচার পাখিকে মুক্ত করলে তাদেরও বুঝি এমন আনন্দ হয়?
অন্য কোনো হাসপাতাল হলে হয়তো সব মানুষ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। কিন্তু এখানে কেউ তেমনভাবে তাকাচ্ছে না। কারণ এটা তাদের জন্য স্বাভাবিক। এ হাসপাতালের প্রতিটা মেয়েই এসিড ভিকটিম।
রিসিপশনের চেয়ারগুলোতে বসে আছে বাড়ির সবাই। আবারও বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। মায়ের অবস্থা কি হবে সেটাই ভাবতে পারছি না আমি। আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালাম তাদের সামনে। আমায় দেখেই দাঁড়িয়ে গেলো সবাই। আপু আর মায়ের কান্না শুরু হয়ে গেছে তৎক্ষনাৎ। ভাইয়া আর বাবা বোবার মতো তাকিয়ে আছে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম
- বাড়িতে যাবে না? কবে থেকে বাড়ি যাই না আমি? তারাতাড়ি চলো প্লিজ। এই ভাইয়া, শুধু দাঁড়িয়ে থাকবি? আমায় বাড়ি নিয়ে যাবি না?
ভাইয়া তারাতাড়ি মাথা নেড়ে বললো
- হুম চল চল। সত্যিই তো কবে থেকে বাড়ি যাসনা তুই। এই মালিহা কান্নাকাটি থামাতো। কাঁদার মতো কিছু হয়নি। বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তোরা চলে আয়। আমি মেঘাকে নিয়ে যাচ্ছি।
আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো ভাইয়া। তার চোখে জল মুখে হাঁসি। হাঁসিটা যে আমায় স্বান্তনা দেওয়ার জন্য সেটা বুঝতে আর বাকি নেই আমার। আমিও হাঁসি দিলাম। যে হাঁসিতে মিশে আছে ভাগ্যের প্রতি শুধু তুচ্ছতাচ্ছিল্যতা।
পর্ব ২৮
নিজের ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। খুব ভালো করে পর্যবেক্ষন করছি নিজেকে। একমাস আগেও আমি ছিলাম বাকি সবার মতো স্বাভাবিক। আর আজ নিজেকে নিজেই চিনতে পারছি না। আয়নায় নিজেকে দেখলে মনে হয় সেও আমায় ব্যাঙ্গ করে বলছেকি দেখতে এসেছো এখানে? নিজের বিকৃত হয়ে যাওয়া বিভৎস চেহারাটা দেখতে?
প্রায় একসপ্তাহ ধরে বাসায় এসেছি। বাসায় আসার পর থেকেই নিজেকে একমতন ঘরবন্দী করে রেখেছি আমি। আগের মতো সবার মাঝে থাকতে ভালো লাগে না আর। বেশি মানুষ সহ্য হয় না। সবার মাঝে নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হয় আমার। একা থাকতে ভালো না লাগলেও অন্যরকম প্রশান্তি খুজে পাই আমি।
পুরো ঘরে একবার ভালো করে তাকালাম। ঘরের সব জিনিসগুলো ঠিক আগের মতোই আছে। শুধু জিনিসগুলোর মালিকের জীবনটাই পাল্টে গেছে। আজকাল সারার সাথেও খুব একটা কথা বলি না আমি। সে রোজই আসে আমার কাছে। কিন্তু আমি কোনো না কোনো বাহানা দিয়ে এড়িয়ে চলি তাকে। কেনো জানিনা যেই আমার সাথে কথা বলতে আসে তাকে দেখেই মনে হয় দয়া দেখাতে এসেছে। কারো দয়া যে আমি চাইনা। এখন বোধহয় আমার নিজের বলতে কেউ নেই। আমি একা সম্পূর্ন একা। এসব ভাবতেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
আমার প্রিয় দুটো জায়গা ছাদ আর বেলকনিতেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি এখন। এই একমাসে অন্যকিছু না পাল্টালেও আমার জীবনটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। সেই হাঁসিখুশি প্রাণবন্ত আমিটা এখন হয়ে গেছি নিঃপ্রাণ কাঠের পুতুল।
আয়নার সামনে থেকে সরে এসে জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একচোখে সব দেখতে পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু সে দেখায় শান্তি পাওয়া যায় না। ভাবছি যারা দুচোখেই দেখতে পায় না তাদের কতটা কষ্ট হয়। খট করে দরজা খুলার আওয়াজে সেদিকে তাকালাম আমি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। ক্লান্ত তার চাহনি। উনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আবারো জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। কেনো যেনো উনার সাথে কথা বলার কোনো আগ্রহ খোজে পাচ্ছি না নিজের মাঝে।
- দোষটা কি আমাদের? বলবিতো সেটা?
আমি বাইরে তাকিয়েই উত্তর দিলাম
- কারো কোনো দোষ নেই।
- তাহলে কথা বলিস না কেনো আমাদের সাথে? সারাদিন একা একা থাকিস কেনো?
- কথা বলতে ভালো লাগে না তাই বলি না। আর একা থাকতে ভালো লাগে তাই থাকি।
- হেয়ালি বন্ধ কর।আর আমার দিকে তাঁকা। একটা জরুরি কথা বলতে এসেছি।
ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে ঘুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম
- বলুন কি বলবেন।
উনি চট করে বলে ফেললেন
- আমি যত তারাতাড়ি সম্ভব তোকে বিয়ে করতে চাই।
ফুয়াদ ভাইয়ার কথা কানে আসতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। শরীরের পশমগুলোও দাঁড়িয়ে গেছে। ফুয়াদ ভাইয়া আমায় বিয়ের কথা বলছেন? ভাবতে পারছি না আমি। একরাশ ভালোলাগা ছেয়ে গেলো মনে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো আমার এখনকার অবস্থার কথা। আমি ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে চোখ তুলে তাকালাম। উনি আগ্রহী দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি বলে উঠলাম
- কিন্তু আমি তো করতে চাই না?
- মানে কি?
- মানে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না।
আমার কথায় চুপ করে গেলেন ফুয়াদ ভাইয়া। আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আবারো বললেন
- তুই আমায় ভালোবাসিস। তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?
- বাস্তবতা মানে বোঝেন তো? আমায় বিয়ে করে নিজের জীবন কেনো নষ্ট করবেন আপনি?
- তোকে বিয়ে করলে আমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে?
- হবে না?
- আমি কিছু জানি না। আমি তোকে বিয়ে করবো। এটাই শেষ কথা।
- আপনি যা বলবেন সেটাই আমায় মেনে নিতে হবে?
- তুই এভাবে বলছিস কেনো? আমায় আর ভালোবাসিস না?
- হুম বাসিতো। আর ভালোবাসি বলেই তো আপনার জীবনটা নষ্ট করতে চাই না। আপনি আপুর সাথেই ভালো থাকবেন আশা করি।
আমার কথায় রেগে গেলেন ফুয়াদ ভাইয়া। চেচিয়ে বলে উঠলেন
- আমি তোকে ভালোবাসি আর তোকেই বিয়ে করবো। দেখি তুই কিভাবে আমায় দূরে সরিয়ে রাখিস?
রাগ নিয়েই দরজাটায় জোরে একটা লাথি দিয়ে চলে গেলেন উনি। আমি চুও করেই বসে পড়লাম বিছানায়। আজ সারার বলা কথাটা কানে বেজে চলেছে বারবার। সে বলেছিলো ফুয়াদ ভাইয়াও একদিন আমার ভালোবাসা বুঝবে কিন্তু সেদিন খুব বেশি দেরি না হয়ে যায়। আজ মনে হচ্ছে তার কথাটাই সত্যি হয়ে গেছে। কিন্তু আমিও তো আমার কথা রাখতে পারলাম না। আমিও তো বলেছিলাম আমার শেষ নিঃশ্বাসের আগেও যদি ফুয়াদ ভাইয়া আমায় ভালোবাসার কথা বলে আমি ফিরিয়ে দেবো না উনাকে। কিন্তু আজ আমিতো বেঁচে আছি তবুও ফুয়াদ ভাইয়াকে আগ্রহ করতে পারলাম। ফিরিয়ে দিলাম উনাকে। হ্যাঁ, যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তাকে আজ আমি নিজেই ফিরিয়ে দিয়েছি। এরকম ভাগ্য সবার হয় নাকি?
বিকাল ৫ টা। আপুর ঘরে আছি আমি। আমি আসতে চাই নি এখানে। আপু জোরকরে নিয়ে এসেছে আমায়। সেও নাকি কিসের জরুরি কথা বলতে চায় আমার সাথে। নিজেকে আজ প্রধানমন্ত্রী মনে হচ্ছে আমার। সবাই তাদের জরুরি কথা নিয়ে হাজির হচ্ছে আমার কাছে।
- এই নে কফি।
- আমার লাগবে না আপু।
- না লাগলেও নিতে হবে। কফি খাবো আর কথা বলবো।
আপুর সাথে তর্কে যেতে ইচ্ছে করছে না মোটেও৷ তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কফিটা হাতে নিলাম আমি। আপুও কফি হাতে বসে পড়লো আমার পাশে। কফিতে এক চুমুক দিয়েই বলে উঠলো সে
- কি হয়েছে তোর?
- কি হবে?
- ফুয়াদ ভাইয়াকে কি বলেছিস?
- জানি না।
- আচ্ছা আমিই বলে দিচ্ছি। তুই ফুয়াদ ভাইয়াকে বলেছিস উনি আমার সাথে ভালো থাকবে তোর সাথে নয়।
- হুম ঠিকই তো বলেছি।
- যাকে ভালোবাসে না তার সাথে সুখী থাকবে কি করে?
- পারবে। একটু সময় গেলেই পারবে। এই ধরো এখন যদি আমার সাথে এমন কিছু না ঘটতো। তাহলে তোমার আর উনার বিয়েটাতো হয়েই যেতো। তখন তো তোমায় নিয়েই ভালো থাকতে হতো। তাইনা?
আমার কথায় চুপ করে গেলো আপু। বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলে উঠলো
-যদি। সেটা তো এই যদিতেই আটকে আছে মেঘা। সেটা যখন হয়নি তখন তা নিয়ে বসে না থাকাটাই ভালো।
- হুম সেটা নিয়ে বসে থাকলাম না। কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়াকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় আপু। তোমার কাছে একটা রিকুয়েস্ট করবো। রাখবে তো?
- কি?
- প্লিজ তুমি ফুয়াদ ভাইয়াকে বিয়ে করে নাও।
- পাগল হয়ে গেছিস তুই? ভাবতে পারছিস কি বলছিস?
- হুম ঠিকই বলছি।
- তুই তোর জেদ নিয়েই বসে থাক আমি ফুয়াদ ভাইয়াকে কোনোদিনও বিয়ে করবো না।
- তাহলেও সমস্যা নেই। ফুয়াদ ভাইয়ার জন্য মেয়ের অভাব পড়বে না।
- এতো জেদ ভালো না মেঘা।
- প্রিয় মানুষটার ভালোর জন্য যদি জেদ ধরতে হয় তাহলে জেদই ভালো।
আমার কাটকাট কথায় আপু নিরাস হয়ে বসে রইলো। আমিও নিজের ঘরে আসার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ঘরে ঢুকলো ভাইয়া। ভাইয়ার চোখমুখে রাগ স্পষ্ট। সে কর্কশ গলায় আমায় আর আপুকে উদ্দেশ্য করে বললো
- নিচে চল।
আমি উত্তর দিলাম
- তোরা যা। আমি নিজের ঘরে যাচ্ছি। ভালো লাগছে না আমার।
- তোকেই তো যেতে হবে। তুইই আসল। তারাতাড়ি চল।
না চাইতেও ভাইয়া আর আপুর সাথে নিচে আসতে হলো আমায়। কিন্তু নিচে আসতেই অবাক হয়ে গেলাম আমি। মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তানভীর ভাইয়া। পাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম পুলিশের হাতেই ধরা পরেছেন উনি। তবে আজ কালো ভুরিওয়ালা অফিসারের জায়গায় রয়েছে সুদর্শন এক যুবক। সোফায় চোখ-মুখ শক্ত করে বসে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম
- কেমন আছেন ভাইয়া?
এতক্ষন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেও আমার কথায় আমার দিকে তাকালেন তানভীর ভাইয়া। আমায় দেখেই যেনো চমকে উঠলেন উনি। চোখজোড়ায় টইটম্বুর করছে নোনাজল। উনার এক্সপ্রেশনে আমিও অবাক হয়ে গেলাম। তানভীর ভাইয়াকে দেখে মনে হচ্ছে আমায় দেখে কষ্ট হচ্ছে উনার। অথচ উনি নিজেই তো আমার এই অবস্থার জন্য দ্বায়ী। তাহলে কষ্ট পাওয়ার কারণটা কি?
পর্ব ২৯
অবাকের রেশ কাটিয়ে তানভীর ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম,
- আপনার চোখে পানি যে? খুশি হননি বুঝি? আপনার তো খুশি হওয়ার কথা।
তানভীর ভাইয়া টলমলে চোখেই মুচকি হাঁসলেন। এবারো অবাক হলাম আমি। তবে সেটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন
- হুম খুশি হওয়ার কথা। আমি যা চেয়েছিলাম তাই তো হয়েছে কিংবা তবুও খুশি হতে পারছি না আমি। কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে আমার।
- কষ্ট হচ্ছে? আপনি নিজে আমার এ অবস্থার জন্য দ্বায়ী। এখন নিজেই বলছেন কষ্ট হচ্ছে?
-………………….
- হ্যাঁ এবার বলুনতো বিনা দোষে আমার সাথে এতটা জঘন্য কাজ কেনো করলেন আপনি?
আমার কথায় আবারো হাঁসলেন তানভীর ভাইয়া। উনার এতো হাঁসি পাচ্ছে কেনো সেটাই বুঝতে পারছিনা আমি। উনি ঠোঁটে হালকা হাঁসি ঝুলিয়ে রেখেই বললেন
- সত্যি সত্যিই কি তুমি নির্দোষ?
- মানে?
- মানে টা বুঝতে পারছো না?
- বুঝতে পারলে জিজ্ঞেস করতাম না নিশ্চই?
- আচ্ছা একটু দাঁড়াও তাহলেই বুঝতে পারবে।
তানভীর ভাইয়া তার ফোনটা বের করলেন। কতক্ষণ পরেই ফোনের স্ক্রিনটা আমার সামনে ধরলেন। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে একটা ছেলের মুখ। যেটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি।
-এটা তো রোহান।
- হ্যাঁ রোহান। আমার ছোট ভাই।
- ও আপনার ভাই?
- হ্যাঁ আমার ভাই। এখনো তুমি বলবে তুমি নির্দোষ?
- হ্যাঁ বলবো আমি নির্দোষ। কারণ আমি ভুল কিছুই করিনি।
- কে বলেছে করোনি। ও ভালোবাসতো তোমায়। তাই প্রপোজ করেছিলো। কিন্তু তুমি কি করেছো? মেলায় সবার সামনে অপমান করেছো। আরে ওর ভালোবাসা গ্রহণ না-ই করতে পারো তাই বলে অপমান করতে পারো না।
তানভীর ভাইয়ার কথায় অবাক হচ্ছি আমি। উনি না বুঝেই কত কথা বলে চলেছেন। উনার কথা শুনেই বুঝতে পারছি যে উনি আসল ঘটনাটাই জানেন না। আমি বলে উঠলাম
- আপনি এসব কিভাবে জানেন ভাইয়া?
- তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি হাস্যকর কথা বলছো? ও আমার ভাই হয়। সেদিন বাসায় এসে লজ্জায় অপমানে কেঁদেছিলো রোহান। একটা ছেলে খুব ছোট কোনো বিষয় নিয়ে কাঁদে না এটা বিশ্বাস করো নিশ্চই? ওর কাছে জানতে চাইলে ও সবটা বলেছিলো আমায়।
- ওহ আপনার ভাইয়ের কথা বিশ্বাস করে আপনি একটা মেয়ের সারাটা জীবন নষ্ট করে দিলেন? একবারো যাচাই করে দেখলেন না আসল সত্যিটা কি?
- মানে?
- মানে জানতে চান? তাহলে শুনুন, রোহান আমাদের ক্লাসমেট ছিলো আর আমরা এক কলেজেই পড়তাম সেটা জানেন নিশ্চই?
- হ্যাঁ
- আমরা জাস্ট ক্লাসমেট ছিলাম। ওর সাথে কথা বলতাম না কখনো। ইভেন সারা বাদে অন্য কারো সাথেই কথা বলতাম না আমি। কিন্তু একদিন হুট করেই ও প্রপোজ করে বসে আমায়। আমি প্রথমে অবাক হলেও পরে মুচকি হেঁসে বলে দিয়েছিলাম আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। সেদিন ও কিছু না বলে মুখ কালো করে চলে গেছিলো। আমি ভেবেছিলাম ও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে এরপর থেকে রোজই আমায় ডিস্টার্ব করা শুরু করে রোহান। প্রথম দিকে ভালো করে বললেও পরে রেগে যেতাম আর আমার পিছনে পরে থাকতে নিষেধ করতাম। কিন্তু ও আমার কথা মানলে তো। এভাবেই কলেজ লাইফের একদম শেষ প্রান্তে চলে আসি আমরা। সেদিন ছিলো ২৮ শে মার্চ। কলেজের সামনে মেলা বসেছিলো। আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। কারণ আর তিনদিন পর ছিলো আমাদের পরীক্ষা। কিন্তু সারা জেদ ধরে সে মেলায় যাবে। পড়তে পড়তে নাকি বোর হয়ে গেছে সে। তাই মেলায় গিয়ে মনটাকে একটু ফ্রেশ করে নিতে চায়। তো, তার জেদের কাছে হার মেনে নিয়ে পাড়ি জমালাম মেলার উদ্দেশ্যে। সেদিন রোহানও ছিলো মেলায়। এতোদিন যা-ই করুক না কেনো। সেদিন সব সীমা পাড় করে ফেলেছিলো সে। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই কোমড়ে কারো স্পর্শ পাই আমি। সাথে সাথেই চরম মাত্রায় রেগে যাই। কাজটা কে করেছে সেটা না দেখেই থাপ্পড় মেরে বসি। অবশ্য দেখলেও এটাই করতাম। মেলার ভীড়ে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সবার নজরে পরে সেটা। তাই সবাই মিলে অপমান করে রোহানকে। সেদিনই ছিলো ওর সাথে আমার শেষ দেখা। এই এক বছরে আর দেখিনি ওকে। তারপর পরীক্ষা, ভারসিটির ভর্তি কোচিং এসব কিছুর ব্যাস্ততায় ভুলেই যাই রোহান নামক কাউকে।
একদমে সবটা বলার পর তানভীর ভাইয়ার দিকে তাকালাম আমি। উনার গাল বেয়ে গরিয়ে চলেছে পানি। এবার পাশ থেকে পুলিশ অফিসার বলে উঠলেন
- সো, মিস্টার তানভীর। এবার আপনি এসব কিভাবে করলেন তার ডিটেইলস বলুন।
- ভারসিটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানে মেঘাকে দেখি আমি। প্রথম দেখাতেই ওকে চিনে যাই। পরে জানতে পারি ও হচ্ছে ফুয়াদের কাজিন। তারপর ওর সাথে পরিচয় হয়। ওর আচার ব্যবহারে অবাক হয়ে যেতাম। ওকে দেখে কখনো মনে হয়নি অকারণে কারো সাথে এতটা খারাপ কিছু করতে পারে।কিন্তু নিজের ভাইয়ের কথাও অবিশ্বাস করতে পারতাম না। তারপর রাস্তায় ধাক্কা দেওয়া, লাইব্রেরিতে কাঁচের বোতল ছুড়া, কক্সবাজারের হোটেলে মুখ চেপে ধরা সব আমি করেছিলাম। তবে ওকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে নয়। শুধুমাত্র ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। রাস্তায় সারাকে দেখেই ধাক্কা দিয়েছিলাম আর লাইব্রেরিতেও এমনভাবে বোতল ছুড়েছিলাম যাতে ওর কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু মেঘা তো মেঘাই। এতোকিছুর পরেও নিশ্চিত হয়ে চলাফেরা করতো সে। তারপর ঠিক করি বিয়ে করে সারাজীবন ইচ্ছেমতো অত্যাচার করা যাবে ওর উপর।
এটুকু বলেই থামলেন তানভীর ভাইয়া। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনে চলেছি সব। বুঝে উঠতে পারছি না কি করা উচিৎ আমার। ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে চোখ যেতেই উনার ভিজে উঠা লাল চোখ দেখতে পেলাম আমি। আবারো বলতে লাগলেন তানভীর ভাইয়া
- সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো কিন্তু গায়ে হলুদের দিনই সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হলো আমায়। সেদিন ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় মেঘাকে দেখে ফেলি আমি। জানিনা কেনো সেদিন না চাইতেও ফুয়াদের প্রতি হিংসা হয় আমার। মনে হচ্ছিলো আমার কলিজাটা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম মেঘার প্রতি দুর্বল আমি। এই দুর্বলতা সামান্য নয়। খুব বেশিই দুর্বল হয়ে গেছিলাম ওর উপর। কিন্তু আমার তো দুর্বল হওয়া চলতো না। তাহলে আমি যা চাইতাম তা হতো না। তাই সিদ্ধান্ত নিই এমন কিছু করবো যাতে কেউ কোনোদিন ওর দিকে তাকাতেও না পারে। তাতে আমার কাজটাও হয়ে যাবে আর মেঘা অন্য কারো হতে পারবে না। কারণ ওকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবো না আমি। তারপরেই…………
এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না। চিৎকার করে বললাম
- তারপর এতো নিকৃষ্ট একটা কাজ করে বসলেন। বুঝতে পারছেন? আপনার একটা ভুল সিদ্ধান্তে আমার পুরো ভবিষ্যতটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সমাজের কাছে একটা বোঝায় পরিণত হয়ে গেছি আমি। এখন তো জানতে পারলেন আমার কোনো দোষ ছিলো না। এবার বলুন পারবেন আমায় আগের মতো করে দিতে? পারবেন আমার বাঁ চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে? বলুন পারবেন?
হঠাৎ করেই অদ্ভুত কাজ করে বসলেন তানভীর ভাইয়া। আমার কাছে এসে হাত ধরে বলে উঠলেন
- আমি জানি খুব বড় দোষ করে ফেলেছি আমি। এর ক্ষমা হয়না। কিন্তু আমি যখন তোমার ক্ষতি করেছি তখন আমিই এই ক্ষতিপূরণ করতে চাই।
- মানে?
- তোমায় বিয়ে করে একটা সুন্দর ভবিষ্যত দিতে চাই তোমায়। দয়া করে আমায় একটা সুযোগ দাও মেঘা। তোমার এই অবস্থা সহ্য করতে পারছি না আমি।
আমি তানভীর ভাইয়াকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ফুয়াদ ভাইয়া আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন তানভীর ভাইয়ার থেকে। উনি শক্ত গলায় বললেন
-এতক্ষন ধরে তোর সব কথা শুনেছি। কিছু বলিনি। ট্রাস্ট মী, একঘন্টা আগে পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম মেঘা ভুল। কোনো ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে হয়তো। কিন্তু এখন তো সবটাই পরিষ্কার। আচ্ছা তানভীর? তোকে নিজের ভাইয়ের থেকে বেশি কিছু ভাবতাম আমি। সবসময় তো বলতি তোর এমন কোনো কথা নেই যেটা আমরা জানি না। তাহলে এই কথাটা কেনো জানলাম না। বল? বিশ্বাস কর তোর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে জাস্ট খুন করে ফেলতাম। কিন্তু তুই যে আমার কি সেটা তুই নিজেও জানিস। তাই বলছি এবার চুপ কর। নাহলে আর কতক্ষন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো সেটা জানি না আমি।
তানভীর ভাইয়া অস্পষ্ট গলায় বললেন
- ফুয়াদ, আমায় ভুল বুঝিস না দোস্ত। আমি সত্যিই মেঘাকে বিয়ে করতে চাই।
- তোর দয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। মেঘাকে নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে। এর জন্য আমি আছি। হ্যাঁ ওকে ভালোবাসি আমি।
ফুয়াদ ভাইয়ার কথায় চমকে গেলেন তানভীর ভাইয়া।
- তুই?
- হ্যাঁ আমি।
তানভীর ভাইয়া টলমলে চোখে তাকিয়ে বললেন
- হুম, মেঘা তোর মতো কাউকেই ডিজার্ব করে। আমার মতো কাউকে না। কিছুই বলার নেই আমার। নিজের দোষে নিজের ভালোবাসাকে হারাতে হলো আমায়। আমি সত্যি অনুতপ্ত।
এবার আমি বলে উঠলাম
- এটা কোনো হিন্দি সিরিয়াল নয় ভাইয়া। যে আপনি অনুতপ্ত হলেই আপনাকে ক্ষমা করে দেবো আমি। সরি, এতোটা মহৎ আমি নই। আপনাকে তো শাস্তি পেতেই হবে। আমি নিজে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যাবস্থা করবো। আমার মতো আপনার ভবিষ্যতটাও নষ্ট করে দেবো আমি।
- আমি নিজেকে ধণ্য মনে করবো। তুমি যে শাস্তি দেবে দাও। আমার কোনো আপত্তি নেই।
এবার ফুয়াদ ভাইয়া জড়িয়ে ধরলেন তানভীর ভাইয়াকে। তানভীর ভাইয়াও জড়িয়ে নিলেন উনাকে।
- কেনো এতো বড় একটা অপরাধ করলি তুই? আমি যে তোর এই অবস্থা দেখতে পারবো না। আবার মেঘার অপরাধীকেও শাস্তি না দিয়ে শান্তি পাবো না। এবার তুইই বল কি করবো আমি?
- আমার জন্য তুই কষ্ট পাস না দোস্ত। ফয়সাল আর সাদবকেও বলিস আমার জন্য যেনো কষ্ট না পায়। আমার দোষের শাস্তি আমিই পাবো।
- এতো সহজ? পারবো তোকে কষ্ট পেতে দেখতে?
- পারতে তো হবেই।
পর্ব ৩০
তানভীর ভাইয়াকে নিয়ে যাওয়া হলো। সবাই চলে যাওয়ার পর ফুয়াদ ভাইয়া সোফায় চুপ করে বসে রইলেন। সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মাঝ থেকে হঠাৎই শুনতে পেলাম কোনো পুরুষের কন্ঠ।পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলাম সেই যুবক পুলিশ অফিসারকে। যাকে আজই নতুন দেখেছি আমি। উনি আপুর কাছে গিয়ে হালকা কন্ঠে বললেন
- কেমন আছো মালিহা?
উনার কথায় আপু কেমন করে তাকালো যেনো। মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে উঠবে সে। তবে এই কান্নায় কষ্টের চেয়ে ক্রোধটাই বোধহয় বেশি। আপু তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলো
- ভালো আছি। খুব ভালো আছি। আমার তো ভালো থাকারই কথা। অবশ্যই ভালো আছি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি।
- আমি সত্যিটা জানতে চাইছি।
- তো আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে বলছি? মিস্টার লাবীবের সামনে মিথ্যে বলছি?
আপুর কথার প্রতিউত্তরে কিছুই বললেন না উনি। শুধু একটা শ্বাস নিয়ে বললেন
- আমার উপর রেগে আছো এখনো? রাগ করাটাই স্বাভাবিক। আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। পরিবার আর তোমার মাঝে পরিবারকেই প্রায়োরিটি দিয়েছি আমি। আমি তোমায় ঠকাতে চাইনি। কিন্তু কি করবো বলো? মায়ের কথা তো। তাই ফেলতে পারিনি। মায়ের ইচ্ছেতেই মামার মেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। কিছুই যে করার ছিলো না আমার। কিন্তু তোমার জায়গাটা কোনোদিন কাউকেই দিতে পারিনি আমি।
আমরা সবাই অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছি। ওদের কথার পুরোটা মানে না বুঝলেও সামান্য আঁচ করতে পেরেছি সবাই। আপু এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কান্নাজরিত কন্ঠেই বললো
- আমি তোমার পরিস্থিতিটা বুঝতে পারি লাবীব। আমি এতটাও স্বার্থপর নই যে কোনো মায়ের থেকে তার ছেলেকে কেড়ে নিতে চাইবো। তোমার এই সিদ্ধান্তে তোমার প্রতি সম্মান আরও বেড়ে গেছে আমার। আমিও তো ভালো থাকতে চাই। কিন্তু কি করবো বলো? আমার ভালো থাকার কারণটা যে তুমিই। তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভালো থাকবো কি করে বলোতো? প্রতিমুহূর্তে নিজের সাথে যুদ্ধ করি আমি। ভাবি তোমায় নিয়ে আর ভাববো না। কিন্তু বেহায়া মন শুধু তোমায় নিয়েই ভেবে চলে। জানো তো, ভারসিটির প্রোগ্রামের দিন আমি সবথেকে খুশি হয়েছিলাম। কারণ সেদিন তুমার চাকরির প্রথম দিন ছিলো। আর সেদিন তুমি বলেছিলে আমায় তোমার মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। আমি যেনো ভারসিটির সামনে অপেক্ষা করি। তুমি সেখানে আসবে। আমি খুশি হয়ে নীল শাড়িতে সাজিয়ে ছিলাম নিজেকে। কিন্তু ভাবতে পারিনি সেদিনই আমার জীবনের সবথেকে বড় ধাক্কা খেতে হবে আমায়। তুমি ভারসিটির সামনে এসেছিলে ঠিকই কিন্তু একা না। সাথে ছিলো তোমার সদ্য বিয়ে করা বউ। কাজী অফিস থেকে সোজা আমার কাছেই এসেছিলে তোমরা। বিশ্বাস করো সেদিনের পরে আর কোনোদিনই নীল শাড়ি পড়িনি আমি। কারণ আমায় এই শাড়িতে দেখতে যে তুমি বড্ড পছন্দ করতে। নীল শাড়ি দেখলেই তোমার কথা মনে পড়তো আমার।
আর কিছু না বলে অঝোরে কাঁদতে লাগলো আপু। এখানে উপস্থিত সবার চোখেই পানি। আমি ভাবতেও পারছিনা নিজের মধ্যে এতোটা কষ্ট জমিয়ে রেখেছিলো আপু। কখনো বুঝতেও পারিনি আমরা। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে আপু মুচকি হেঁসে বললো
- যাই হোক বললে না যে তোমার বউ কেমন আছে?
লাবীব ভাইয়াও পাল্টা হেঁসে বললেন
- হুম ভালো। সেও খুব ভালো আছে। সারাজীবনের মতো শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে সে।
লাবীব ভাইয়ার কথায় আরেক দফা অবাক হলাম আমরা। আপু বললো
- মানে?
- বিয়ের দুইমাস পরেই মারা গেছে মিমি।
আপু কাঁপাকাঁপা গলায় বললো
- অসুস্থ ছিলো?
- আজকাল আমাদের একটাই সমস্যা। কেউ মারা গেলেই মনে করি হয়তো সে কোনোভাবে অসুস্থ ছিলো। কিন্তু মিমির কোনো অসুখ ছিলো না। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। জানোতো? খুব ভালো মেয়ে ছিলো মিমি। আমি তার সাথে স্বাভাবিক নই এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো সে। সবসময় আমার সাথে মানিয়ে চলতে চেষ্টা করতো। কিন্তু ভালোভাবে সংসার করার আগেই পৃথিবী থেকে চলে গেলো।
আমরা এখনো চুপ করেই আছি। আর আপু কান্না করছে। হঠাৎই মা বলে উঠলো
- আমার দুই মেয়ের মনেই এতোটা চাপা কষ্ট ছিলো। আর আমি মা হয়ে জানতেই পারলাম না। এটা কি আমার ব্যার্থতা? নাকি আমার মেয়েরা বেশী ধৈর্যশীল।
ভাইয়া মাকে জাপটে ধরে বললো
- তুমি ব্যার্থ নও মা। তুমি সফল। তোমার দুই মেয়েই এতো ধৈর্য রাখতে পারে যে তাদের মনের কথা তাদের মনও জানতে পারে না। তোমার থেকেই তো এই শিক্ষা পেয়েছে বলো? তাই তুমি সফল।
লাবীব ভাইয়াও তার চোখ মুছে নিয়ে বললো
- মালিহা যে ধৈর্যশীল তা আমি আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু আজ জানতে পারলাম মেঘাও খুব বেশী ধৈর্যশীল। আসলে দুই বোনই তো। আচ্ছা যাই হোক, আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। আর মেঘা সবসময় এমন স্ট্রংই থাকবে। আমি তানভীরের সর্বোচ্চ শাস্তির চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। আজ আসি।
আমিও মাথা নাড়িয়ে লাবীব ভাইয়ার সাথে সম্মতি জানালাম। উনি সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বারাতেই আপু বলে উঠলো
- আজও কি আমায় একা করে দিয়ে চলে যাবে? গ্রহণ করা যায়না আমায়? আমি তো তোমার কাছেই ফিরতে চাই।
লাবীব ভাইয়া অবাক চোখে তাকালেন আপুর দিকে। কতক্ষণ তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন
- তুমি এখনো আমার কাছে ফিরতে চাও?
- হ্যাঁ।
- কেনো?
- ভালোবাসি তাই।
এবার লাবীব ভাইয়ার চোখেও পানি দেখতে পেলাম আমি। উনি বললেন
- আমার ভালো থাকার কারণটাও যে তুমি মালিহা। কিন্তু তুমি আমার কাছে ফিরতে পারো না। আমার থেকেও ভালো কাউকে তুমি পাবে ইনশাআল্লাহ। আর পিছু ডেকো না। তোমার ডাক অগ্রাহ্য করাটা আমার পক্ষে খুব কষ্টকর। প্লিজ। আসি।
খুব দ্রুত প্রস্থান করলেন লাবীব ভাইয়া। আপুও চলে গেলো নিজের ঘরে। একে একে সবাই চলে গেলো ড্রয়িংরুম থেকে। আমিও চলে আসতে চাইলে পেছন থেকে হাত টেনে ধরলেন ফুয়াদ ভাইয়া। উনি বললেন
- মেঘা………
- আপনি কি বলবেন সেটা জানি আমি। আমার উত্তরনা। দয়াকরে আর একই কথা বলবেন না আপনি।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে এলাম নিজের ঘরে। আজ আপুকে আমার থেকেও বেশী অসহায় মনে হচ্ছে। পেয়েও পাওয়া হলো না প্রিয় মানুষটাকে।
আজ প্রায় একমাস হয়ে গেছে তানভীর ভাইয়ার শাস্তি ঠিক হয়েছে। চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে উনার। শেষ যেদিন উনার সাথে দেখা হয়েছিলো সেদিন উনার মাঝে দেখতে পেরেছিলাম অনুতপ্ততা। কিন্তু এই অনুতপ্ততা তো আর আমায় ঠিক করে দিতে পারবে না। তাই উনার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম আমি।
আজকাল ফুয়াদ ভাইয়ার অত্যাচার বেড়ে গেছে প্রচুর। সারাক্ষণ আমার পেছনে পড়েই থাকে। একটাই কথা বিয়ে করবো কবে? আমার উত্তর বরাবরইনা। কতবার খালামনিকেও বলেছি উনার বিয়ে দিয়ে দিতে। কিন্তু তারও এক কথা।আমার ছেলে যা চায় তা-ই হবে। তুইই আমার বউমা হবি। তাই উনার সব রকম অত্যাচার সহ্য করতে হয় আমায়।
বিকাল চারটা কি পাঁচটা। আমার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু ঘুমের মাঝে হঠাৎই মনে হলো হাওয়ায় ভাসছি আমি। তাই চট করে চোখ খুলে দেখি আমি ফুয়াদ ভাইয়ার কোলে। আমি যেই চিৎকার দিতে যাবো উনি মুখ চেপে ধরলেন আমার। রাগী গলায় বললেন
- একদম চিৎকার করবি না বলে দিলাম। আমি চোর না ডাকাত? আমি আমার বউকে কোলে নিয়েছি সো নো চিল্লাফাল্লা। আর চাইলেও করতে পারিস আমার খুব একটা সমস্যা হবে না। সবাই জানে আমিই তোর ঘরে আছি।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাই ফুয়াদ ভাইয়ার হাতে বসিয়ে দিলাম এক কামড়। সাথে সাথে আমার মুখ থেকে হাত ছুটে গেলো উনার।
- তুই তো দেখি আস্ত একটা পেত্নী মিষ্টি।
ফুয়াদ ভাইয়ার মুখেমিষ্টি ডাক শুনে উনার দিকে তাকালাম আমি। উনি স্বাভাবিকভাবেই দাড়িয়ে আছেন।
- আপনি আমায় মিষ্টি বলে ডাকলেন?
- হুম ডাকলাম। কেনো কি হয়েছে?
- না কিছু হয়নি। আজ প্রায় চার বছর পর আমায় এই নামে ডাকলেন আপনি। এর আগে তো এই নামেই ডাকতেন।
- এখন থেকে এই নামেই ডাকবো বলে ঠিক করেছি।
- আচ্ছা আমায় কোল থেকে নামান। আমি কোনো বাচ্চা না যে কোলে নিয়ে ঘুরতে হবে। আর এসিডে আমার মুখটাই শুধু নষ্ট হয়েছে পা নয়। তাই হাঁটাচলা করতে কোনো সমস্যা হবে না।
- জানি তুই হাঁটতে পারবি। কিন্তু আমি তোকে ছাড়ছি না। আজ একটা স্পেশাল জায়গায় যাবো আমরা।
- বাড়ির সবাই?
- না। শুধু তুই আর আমি।
- আর কেউ যাবে না কেনো?
ফুয়াদ ভাইয়া চোখ টিপে বললেন
- সবাই আমাদের একটু প্রাইভেসি দিতে চায় হয়তো।
এবার লজ্জায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হবে আমার। ফুয়াদ ভাইয়া জেনে শুনে এমন করছেন। লজ্জা কাটাতে বলে উঠলাম
- স্পেশাল জায়গায় কি কোলে করে যেতে হবে ভাইয়া?
- তোর প্রশ্নের উত্তর পরে দেবো আগে বল এভাবে ভাইয়া বলে ডাকার কারণ কি? যেভাবে ভাইয়া ডাকিস তাতে আমি নিজেই কনফিউজড হয়ে যাই যে আমি তোর কাজিন না নিজের ভাই?
- আপনি তো আমার নিজের ভাই-ই হন। আমার মায়ের, মায়ের, বড় মেয়ের পেটের ছেলে। সেহিসেবে আপনি আমার পার্শ্ববর্তী মায়ের নিজের ভাই।
- তারমানে তুই ভাইয়া ডাকা বন্ধ করবি না তাই তো?
- অভিয়েসলি ভাইয়া। ভাইয়া ইস ভাইয়া।
- নো বেবী, তোমার ফুয়াদ ভাইয়া ইজ নট অনলি ভাইয়া। হী ইজ ইউর সাইয়া। আন্ডারস্ট্যান্ড? আর আমায় ভাইয়া ডাকবি তো? ডাকতে থাক। নো প্রবলেম বেবী। তাহলে তুমি তোমার নিজের বাচ্চার ফুপি হয়ে যাবে আর আমি মামা হয়ে যাবো। আমার এতে কোনো আপত্তি নেই। নিজের বাচ্চার মামা হওয়ার সৌভাগ্য সবার থাকে না। তাই আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।
আমি কিছু বলতে যাবো কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়া সেই সুযোগ না দিয়ে আমার মুখে হাত দিয়ে বললেন
- উফ মিষ্টি, ইউ আর সো কিউরিয়াস। এতো কিউরিসিটি ভালো না জান। এখন আর কোনো কথা হবে না। লেটস গো টু আওয়ার স্পেশাল প্লেস।
আমায় কোলে নিয়েই একমতন দৌড়ে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন ফুয়াদ ভাইয়া। ড্রয়িংরুমে বাবা বাদে সবাই উপস্থিত ছিলেন। লজ্জায় ফুয়াদ ভাইয়ার বুকের সাথে লেপ্টে ছিলাম শুধু। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হয়নি।
বাসার সামনেই ফুয়াদ ভাইয়ার গাড়ি দাঁড় করানো ছিলো। উনি দরজা খুলে আমায় বসিয়ে দিলেন সামনে। তারপর নিজেই বসলেন ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই মিউজিক বাজিয়ে দিলেন ফুয়াদ ভাইয়া।
আমি বললাম
- মিউজিক বন্ধ করুন প্লিজ।
- কেনো?
- এমনি। ভালো লাগে না আমার।
- হুর, তুই দেখি আস্ত আনরোমান্টিকের ডিব্বা। আরে মিউজিক না থাকলে প্রেমটা ঠিক জমে না।
- আজব! কিসের প্রেম? আমরা কি প্রেম করতে যাচ্ছি ভাইয়া?
- না তার থেকেও বেশী কিছু।
- মানে কি?
- উফ, তোর এই মানে মানের চক্করে আমার রোমান্টিক মোডটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একদম চুপ করে থাক নয়তো তোকে চুপ করানোর পথটা আমার জানা আছে। কি, দেখতে চাস সেটা?
আমি শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম
- এই যে আমি চুপ ভাইয়া। এইমুহুর্তের জন্য আমি কথা বলা ভুলে গেছি।
- গুড ওয়াইফ।
সারা রাস্তা আর কোনো কথা বলিনি আমি। তবে আজ বুঝতে পেরেছি কথা বলাটা আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কথা বলতে না পেরে পেটের ভেতর টর্নেডো শুরু হয়ে গেছে মনে হয়। হঠাৎ ব্রেক কষায় সামনের দিকে ঝুকে পড়লাম আমি। ফুয়াদ ভাইয়া তারাতাড়ি ধরে নিলেন আমায়।
- সরি সরি।
- ইটস ওকে ভাইয়া।
- ধুর কোথায় ভাবলাম তুইও ভয় পেয়ে আমায় জাপ্টে ধরবি তানা কি করলি? ভাইয়া বলে মুডটাই নষ্ট করে দিলি। আজব মেয়ে। এবার নাম তারাতাড়ি নয়তো আবারও কোলে নিয়ে হাঁটা ধরবো।
- এই না না। এক্ষুনি নামছি।
যতটা তারাতাড়ি গাড়ি থেকে নামলাম ঠিক ততটাই বড় ঝটকা খেলাম সামনের জায়গাটা দেখে। আমি প্রশ্ননিদ্ধ চোখে ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম
- আমরা এখানে কেনো ভাইয়া?
- তোরভাইয়া রোগ সারিয়ে তুলতেই এখানে এসেছি জান।
পর্ব ৩১ (শেষপর্ব)
সামনের একটা বিল্ডিংয়ের দরজার উপরে একটা সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লিখা কাজী অফিস। এটা দেখেই গলা শুকিয়ে আসছে আমার। ফুয়াদ ভাইয়ার স্পেশাল প্লেস যে এটাই সেটা এতক্ষনে বুঝে গেছি আমি। আমি আড়চোখে উনার দিকে তাকাতেই উনি বত্রিশ পাটি বের করে হাঁসি দিলেন। এখন নিজের উপরেই প্রচুর রাগ হচ্ছে। আমি কেনো আসতে গেলাম ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে? আমি কি পারতাম না উনাকে এক লাথি মেরে তবধা বানিয়ে দিতে?তাহলেই তো লেটা চুকে যেতো। এইকাজী অফিস নামক উল্টাপাল্টা জায়গায় আসতে হতো না। ফুয়াদ ভাইয়া বিটকেল এক হাঁসি দিয়ে বললেন
- কিগো? অতিরিক্ত খুশিতে স্টেচু হয়ে গেলে নাকি? সামনে চলো।
- এখানে কেনো এলাম আমরা?
- বললাম না তোরভাইয়া রোগ সারিয়ে তুলতে। মানে আর যেনো ভাইয়া না ডাকতে পারিস সেজন্য। আমরা এখানে বিয়ে করতে এসেছি।
- আজব! আমি বললাম না বিয়ে করবো না। আপনি এমন করছেন কেনো? এটাও একধরনের ছেচড়ামি ভাইয়া। আর আপনি নিশ্চই কোনো ছেচড়া নন? ছেচড়া তো আমি। আমার গুণটা নিজের মধ্যে ধারণ করাটা কি উচিৎ হচ্ছে আপনার?
আমার কথায় ফুয়াদ ভাইয়ার হাঁসি উবে গেলো। উনি অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বললেন
- বলতে থাক। আমি কিছু মনে করবো না। যা করেছি তার ফল তো ভোগ করতেই হবে। আমি সবকিছু সহ্য করতে পারবো। কিন্তু কোনোকিছুর বিনিময়েই তোকে হারাতে চাই না।
- বাহ আজ বলছেন আমায় হারাতে চাননা। কিন্তু কয়েকমাস আগেও আমি আপনার পিছু পিছু ঘুরতাম আর আপনি আমায় চাইতেন না। আচ্ছা বলুনতো আপুকে বিয়ে করার জন্য এতোটা ডেস্পারেট হয়ে গেছিলেন কেনো? তখন আমার কথা মনে পড়েনি? ওহ তখন তো আপনি আমায় ভালোই বাসতেন না। আচ্ছা হঠাৎ করেই কিভাবে আমায় ভালোবেসে ফেললেন আপনি?
ফুয়াদ ভাইয়া হালকা হেঁসে বললেন
- লাবীব ভাইয়ার কথা শুনলি না? মায়ের ইচ্ছা। আমার ক্ষেত্রেও তাই। অবশ্য আমার মা আমার ইচ্ছেটাকেই প্রায়োরিটি দিতো। কিন্তু তখন তো আমি আমার অনুভূতির নামটাই জানতাম না। নিজের ইগো নিয়েই বসে ছিলাম। কিন্তু কাউকে হারিয়েই আমরা তার মুল্য বুঝতে পারি। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তোকে যখন হারাতে বসেছিলাম তখনই তোর প্রতি নিজের অনুভূতির নামটা জানতে পেরেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম আমি ভালোবাসি তোকে। হারাতে হারাতে যখন পেয়ে গেছি তখন আর ছাড়ছি না। এবার আর কোনো কথা না বলে সোজা সামনে চল।
- আমি এই বিয়ে করবো না।
- তুই নিজেও জানিস আমি যা বলি তাই করি। এটাই নিশ্চই জানিস যে আমি লোকজন দেখে রিয়েক্ট করি না। মাঝরাস্তায় কোনো সিনক্রিয়েট হোক সেটা আপাতত চাইছি না আমি।
ফুয়াদ ভাইয়ার কথায় ভড়কে গেলাম আমি। উনার এই গুণ সমন্ধে আমার থেকে বেশি কেউ জানে না। ইজ্জতের ফালুদা বানাতে না চাইলে উনার কথামতো চলাই শ্রেয়। উনার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে হাঁটতে লাগলাম সামনের দিকে। ফুয়াদ ভাইয়াও আমার পিছু পিছু চললেন আর গান গাইতে থাকলেন
- যতই করো বাহানা, যতই করো না না না। বিয়ের ফুল ফুটলে বাজবে বিয়ের বাজনা।
রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। কিন্তু মান-সম্মানের স্বার্থে চুপ করে সব সহ্য করে চলেছি আমি।
সামনে কিসব কাগজপত্র নিয়ে একটা চেয়ারে বসে আছি আমি আর ফুয়াদ ভাইয়া। আমাদের সামনের চেয়ারেই বসে আছেন তথাকথিত কাজী সাহেব। পান খেয়ে খেয়ে দাঁত লাল করে ফেলেছেন তিনি। লাল হয়ে যাওয়া দাঁত নিয়েই ইয়া বড় বড় হাঁসি দিচ্ছেন কাজী সাহেব আর আমরাও তার হাঁসির উত্তরস্বরূপ জোরপূর্বক হাঁসি দিচ্ছি। তাতে উনি উৎসাহিত হয়ে আবারো হাঁসছেন। এই হাঁসাহাঁসির প্রতিযোগিতা শেষ করে সামনে থাকা কাগজে সিগনেচার করতে বলা হলো আমায়। আমি অসহায়ভাবে তাকালাম ফুয়াদ ভাইয়ার মুখের দিকে। উনি চোখের ইশারায় সিগনেচার করতে বললেন। আমি একটা ঢুক গিলে কাঁপা হাতেই সাইন করে দিলাম। আমার পরেই ফুয়াদ ভাইয়া বুলেট ট্রেনের গতিতে সাইন করে দিলেন। সাথে সাথেই বলে উঠলেন কাজী সাহেব
- আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা সুখী হও।
তারপর আবারো সেই হাঁসি। এইমুহুর্তে উনার মাথায় গাট্টা মেরে বলতে ইচ্ছে করছেচাচা আপনার হাঁসিটা বন্ধ করলেই আপাতত সুখী থাকবো আমরা। কিন্তু আফসোস সেটা বলা গেলো না।
আমাদের বিখ্যাত কাজী সাহেবকে বিদায় জানিয়েই চলে এলাম বাসার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে বসার পরই একটা বড় শ্বাস ছাড়লেন ফুয়াদ ভাইয়া। আমি বিরক্তিমাখা চাহনিতে তাকলাম উনার দিকে। উনি উনার সেই পাগল করা হাঁসি দিয়ে বললেন
- অবশেষে আমার স্বপ্ন পূরণ হলো। আর ওই কাজির ভয়ংকর হাঁসির থেকেও রেহাই পেলাম। উফ কি ভয়ানক হাঁসি। সারার বরের হাঁসিও এমন ভয়ানক হবে ইনশাআল্লাহ।
ফুয়াদ ভাইয়ার কথা শুনে হেঁসে উঠলাম আমি। শেষে কিনা এই কাজীর মতো বর জুটবে সারার কপালে। ইহা হাইস্যকর।
- যাক বাবা হাঁসলি তাহলে। একজনকে হাঁসাতে গিয়ে আরেকজনের হাঁসির বর্ণণা দিতে হলো আমায়।
- তো কে বলেছে আমায় হাঁসাতে? নিজেকে জোকার প্রমাণ করার কোনো মানে হয় না।
- আমার বউকে আমি হাঁসিয়েছি তাতে তোর কি?
ফুয়াদ ভাইয়াকে কিছু বলাই ভুল। তাই চুপ করে বাইরে তাকিয়ে রইলাম আমি। উনি মনের আনন্দে সিটি মারছেন।
গাড়িতে কখন ঘুমিয়ে গেছি সেটা বুঝতে পারিনি। আমার ঘুম ভাঙলো ফুয়াদ ভাইয়ার ডাকে। আড়মোড়া ভেঙে আশেপাশে তাকাতেই অবাক হলাম। ফুয়াদ ভাইয়া আমায় বাসায় না নিয়ে গিয়ে উনাদের বাসায় নিয়ে এসেছেন। আমি চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠলাম
- আমায় এখানে নিয়ে এলেন কেনো?
- তো কোথায় নিয়ে যাবো?
- আমাদের বাসায়।
- এটাই তো আমাদের বাসা।
- আরে ভাই আমার বাবার বাসায়।
- আবার ভাই? উফ। আচ্ছা ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। আর বিয়ের পর কেউ বাবার বাড়িতে থাকে? তারা তো শশুরবাড়িতে থাকে।
আমি আর কিছু না বলে চলে গাড়ি থেকে নেমে এলাম। উনার সাথে কথা বলা মানেই টাইম ওয়েস্ট। যেটা আপাতত করতে চাই না আমি।
বাড়ির সামনে এসে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন খালামনি। আমায় দেখেই খুশি হয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। এসব যে সবার জানা সেটা বুঝা হয়ে গেছে আমার। তাই আর কিছু বললাম না। ড্রয়িংরুমে আসতেই চোখে পড়লো নয়ন ভাইয়া আর ফয়সাল ভাইয়াকে। নয়ন ভাইয়া বলে উঠলেন
- কি ভাবি কি খবর।
- কাকে বলছেন ভাইয়া?
- তোমাকেই তো বলছি ভাবি।
- আমি ভাবি হলাম কবে থেকে?
- একঘন্টা চব্বিশ মিনিট আগেই তুমি আমাদের ভাবি হয়ে গেছো।
নয়ন ভাইয়াদের ফাজলামো ভালো লাগছে না আমার। কেমন চাপা রাগ কাজ করছে ফুয়াদ ভাইয়ার প্রতি। খালামনি আমায় ফ্রেশ হতে বলে চলে গেলেন খাবার বানাতে। আমি বরাবর যেই ঘরে থাকি সেই ঘরে গিয়েই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসতেই ফোন বেজে উঠলো আমার। ফোন হাতে নিতেই বুঝলাম এটা সারার কল। রিসিভ করতেই সে উচ্ছসিত হয়ে বললো
- কেমন লাগছে শশুড়বাড়িতে?
- মানে কি? তারমানে তুইও কি সব জানতি?
- আমার জানুর বিয়ে আর আমি জানবো না? তা কি করে হয়।
- ফাজিল মেয়ে। জানতি যখন তখন বললি না কেনো? তাহলে তো এভাবে ফেঁসে যেতে হতো না আমায়।
- আল্লাহ তোর মনে হচ্ছে তুই ফেঁসে গেছিস? আরে ইয়ার আমি তো এভাবেই ফেঁসে যেতে চাই। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আমার তো আর তোর মতো একটা ফুয়াদ ভাইয়া নেই।
- আজাইরা কথা বাদ দিয়ে অন্য কথা বল। নয়তো ফোন রাখ।
- হ্যাঁ এখন তো আজাইরা কথাই। বরকে পেয়ে বেস্টুকে তো আজাইরাই মনে হবে। থাকো তুমি। থাকো তোমার ফুয়াদকে নিয়ে। ভুলে যাও তোমার জীবনে সারা নামক কোনো মেয়ে ছিলো।
- এটা যেনো কোন মুভির ডায়লোগ?
- একবার সামনে পাই। পরে জানতে পারবি কোন মুভির ডায়লোগ। শয়তান মেয়ে তো……….
পুরো কথা শেষ না করতে দিয়েই টস করে ফোন কেটে দিলাম আমি। এখন তার গালির ভান্ডার নিয়ে বসবে সে। যেগুলো সব শুনতে শুনতে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। তাই আর শোনার ইচ্ছে নেই।
রাতের খাবার খাওয়ার জন্য আমায় নিচে নিয়ে এলেন খালামনি। খালামনির শশুড়বাড়ির কিছু লোকজন এসেছেন বাড়িতে। যাদের বেশিরভাগকেই চিনি না আমি। ডাইনিং টেবিলে ফুয়াদ ভাইয়ার পাশে বসানো হলো আমায়।
সবাই খাওয়া শুরু করলেও আমি খাবার নাড়াচাড়া করছি শুধু। এতোগুলো অপরিচিত মানুষের মাঝে বসে খেতে পারছি না। তবুও একটু একটু করে খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়ার ভাইয়ার চাচীর কথায় খাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেলো আমার। উনি হেঁসে হেঁসে বলে উঠলেন
- তোমার কপাল তো খুব ভালো মেঘা। আমাদের ফুয়াদ না থাকলেতো সারাজীবন বাবার ঘরেই বসে থাকতে হতো তোমায়। সত্যিই বাবা ফুয়াদ তুমি অনেক মহৎ।
উনার কথায় পুরো পরিবেশটাই পাল্টে গেলো মুহুর্তেই। আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। সত্যিই তো ফুয়াদ ভাইয়া অনেক মহৎ। আমার মতো মেয়েকে বিয়ে করে উনি উনার উদারতার পরিচয় দিলেন। কিন্তু আমি তো উনার দয়া চাইনি। সবই বোধহয় কপালের দোষ।
সবাই চুপ করে থাকলেও ফুয়াদ ভাইয়া খেয়েই চলেছেন। যেনো কিছুই হচ্ছেনা এখনো। উনি উনার খাওয়া শেষ করে হাত মুছে নিয়ে আরাম করে চেয়ারে বসলেন। তারপর চাচীকে উদ্দেশ্য করে বললেন
- উফ চাচী শুধু কি আমিই মহৎ? আমার পরিবারের সবাই তো মহৎ। এই যেমন ধরো চাচা। চাচা মহৎ বলেই তো তুমি কোনোদিন মা হতে পারবেনা জেনেও তোমায় বিয়ে করেছে। তাই না?
ফুয়াদ ভাইয়ার কথায় চুপসে গেলো চাচীর মুখ। পরিস্থিতির চাপে পরে আর কোনো কথা বলছেন না উনি। ফুয়াদ ভাইয়া আবারও বললেন
- সরি চাচী। আমি তোমায় কষ্ট দিতে এই কথা বলিনি। কিন্তু কি করবো বলো? তোমার কথার উত্তরে যে আমায় এটা বলতেই হলো। মনে রাখবে, পৃথিবীর কেউই সবদিক দিয়ে পারফেক্ট হয়না৷ সবারই কোনো না কোনো দুর্বলতা থাকে। তাই অন্যের দুর্বলতা নিয়ে তাকে আঘাত করার আগে আমাদের উচিৎ নিজের দুর্বলতাটা খেয়াল করা। তাহলেই আর অন্যকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতে বিবেকে বাধবে। আর চাচা সব জেনেও তোমায় বিয়ে করেছে কেনো? কারণ চাচা তোমায় ভালোবাসতো। আমার ক্ষেত্রেও কিন্তু তাই। আমিও মেঘাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। দয়া করে নয়।
এটুকু বলেই উঠে দাঁড়ালেন ফুয়াদ ভাইয়া। সিড়ি বেয়ে উঠে যেতে যেতে বললেন
- তোর খাওয়া শেষ হলেই ঘরে চলে আসবি মিষ্টি। আমি গেলাম।
আমিও কোনোমতে খেয়ে চলে এলাম ফুয়াদ ভাইয়ার ঘরে। ঘরে ঢুকতেই ফুয়াদ ভাইয়া এগিয়ে এসে বললেন
- এতো লেইট? আমি কখন থেকে ওয়েট করছি।
- কেউ অপেক্ষা করতে বলেছিলো আপনাকে?
- আমার বউয়ের জন্য আমি অপেক্ষা করবো সেটা কাউকে বলে দিতে হবে নাকি।
- আশ্চর্য! সবসময় বউ বউ করছেন কেনো? বিয়ে করে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? অবশ্য সেরকমই তো। আপনি আমায় বিয়ে না করলে তো কপাল পুড়তো আমার।
- তুই কি চাচীর কথায় কষ্ট পেয়েছিস? আচ্ছা সরি। চাচীর হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি।
- আরে আপনি ক্ষমা চাইছেন কেনো? উনি তো ঠিকই বলেছেন৷ তাছাড়া সত্যিটা তো এটাই যে আপনি দয়া করে বিয়ে করেছেন আমায়।
আমার কথা শেষ হতেই গালে জোড়ে একটা চড় পরলো। গালে হাত দিয়ে ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে তাকাতেই আতকে উঠলাম আমি। রক্তচক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সোজা বেলকনিতে চলে গেলেন উনি। আমি এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছি।
প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। ভয়ে উনার কাছে যেতে পারছি না। আবার এভাবে চুপ করে থাকতেও পারছি না। সাহস জুগিয়ে বেলকনিতে গিয়ে ফুয়াদ ভাইয়ার কাঁধে হাত রাখতেই আমার পায়ের কাছে হাটু মুড়ে বসে পড়লেন উনি। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনি আমার হাত ধরে নিয়ে বলতে লাগলেন
- কেনো এতো কষ্ট দিস আমায়? জানিস না তোর অবহেলা সহ্য করতে পারিনা আমি? আজ বুঝতে পারছি কতটা কষ্ট দিয়েছি আমি তোকে। আমি তো মাত্র এক মাসেই হাঁপিয়ে গেছি আর তুই চারবছর ধরে এই কষ্ট সহ্য করেছিস। সত্যিই আমি খুব খারাপ। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি তোকে দয়া করিনি। আই রিয়েলি লাভ ইউ। আমি যা করেছি তার শাস্তি তো আমায় পেতেই হবে। তাই আরো কষ্ট পেতেও রাজি আছি আমি। শুধু একটা কথা আমায় ছেড়ে যাসনা কখনো। প্লিজ। তাহলে হয়তো মরে যাবো আমি। আর বাঁচতে পারবো না।
আর কোনো কথা না বলে পাশে তাকিয়ে রইলেন ফুয়াদ ভাইয়া। তবে উনার চোখ বেয়ে যে কান্নারা ঝরে চলেছে অঝোর ধারায় সেটা চোখে পড়তে দেরি হলো না আমার। আমি ভাবতে পারছি না ফুয়াদ ভাইয়া কাঁদছেন? তাও আবার আমার জন্য? কিন্তু উনি কি বুঝতে পারছেন না উনার চোখের পানি আমার হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আমিও হাঁটু মুড়ে বসে পড়লাম ফুয়াদ ভাইয়ার সামনাসামনি। উনি আমার দিকে তাকাতেই উনার চোখ মুছে দিয়ে বললাম
- কাঁদছেন কেনো আপনি? জানেন না আমার কষ্ট হয়? সহ্য হয়না আপনার কান্না।
- কেনো?
- ভালোবাসি তাই।
আমার উত্তর পেয়েই আমায় জাপটে ধরলেন ফুয়াদ ভাইয়া। এতো শক্ত করে ধরায় দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার। তবুও কিছু বলছিনা আমি। এভাবেই ভালো লাগছে। উনি আমার ঘাড়েই নিজের চোখ মুছে নিলেন। এমন করায় শুরশুরি লাগলো আমার। আর আমিও হেঁসে উঠলাম জোরে জোরে। ফুয়াদ ভাইয়া আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন
- হাঁসার কারণ?
- শুরশুরি লাগলো যে।
- আল্লাহ কি আজব তুই।
- হ্যাঁ আজব। তাতে আপনার কি?
উনি আমার নাক টেনে বললেন
- আমারই তো সব বউ।
আমি মুখ ফুলিয়ে বাইরে তাকালাম। ফুয়াদ ভাইয়া বললেন
- ছাদে যাবি মিষ্টি? তোর তো রাতের বেলা ছাদে যাওয়া অনেক পছন্দের। দেখ, আজ আকাশে কত বড় চাঁদ। এই জোৎস্নার আলোতে আমি আমার জীবনের সবথেকে খুশির দিনটা কাটাতে চাই। কি যাবি?
- হুম যাবো। চলুন।
ফুয়াদ ভাইয়ার হাত ধরে হাঁটতে লাগলাম ছাদের দিকে। আজ যে আমারো খুব খুশির দিন। অপুর্ণতার মাঝেও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ আমি। নিজেকে অনেক সুখী মনে হচ্ছে আজ। নিজের হাতের মুঠোয় রাখা হাতটা যে আমারই প্রিয় মানুষটার।
তাড়াহুড়ো করে তৈরী হচ্ছি আমি। আর মাত্র দশ মিনিট পরেই বেরোতে হবে আমাদের। তাই ঝড়ের গতিতে সবকিছু করছি আমি।
আজ আপুর ছেলে মেহরাবের চতুর্থ জন্মবার্ষিকী। তাই এতোকিছু। ফুয়াদ ভাইয়ার কঠিন আদেশ সুন্দর করে সাজতে হবে আমায়। বুঝতে পারছি না এই চেহারায় সেজে করবোটা কি। সেই তো আঁচল দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে অর্ধেক মুখ। কিন্তু কি আর করার উনার আদেশ বলে কথা। তার উপর আবার আমার তিন বছরের মেয়েটাও চায় আমি সাজি। তার মেহরাব ভাইয়ার জন্মদিনের পার্টিতে তার মা সাজবে না এটা কি করে হয়।
আমার বিয়ের একমাস পরই আপুর বিয়ে হয়েছে৷ লাবীব ভাইয়াকেই জীবনসাথী হিসেবে পেয়েছে সে। তবে এজন্য কম কষ্ট করতে হয়নি আপুকে। লাবীব ভাইয়াও আপুকে উপেক্ষা করতে না পেরে গ্রহণ করে নিয়েছেন।
- তোর হয়নি এখনো?
- এই তো শেষ।
ফুয়াদ ভাইয়া আমার কাছে এগিয়ে এসে বললেন
- বাহ খুব সুন্দর লাগছে তো আমার বউকে।
আমি মুচকি হেঁসে বললাম
- এই নষ্ট হয়ে যাওয়া চেহারায় সৌন্দর্য খুজে পান আপনি?
- আমার কাছে তুই-ই সবচেয়ে সুন্দরী নারী। আমার বউ।
- আপনার কাছে আমায় সুন্দরী মনে হয় কেনো?
- ভালোবাসি তাই।
শত, সহস্র, লক্ষ, কোটি মানুষের ভীড়েও আমার শুধু তোকেই চাই
কারণটাতো একটাই ভালোবাসি তাই
ফুয়াদ ভাইয়ার কথায় আবারো হাঁসলাম আমি। তখনই শুনতে পেলাম আমার ছোট্ট মামনি ফুয়াদীর গলা। আধো আধো গলায় সে বলে উঠলো
- আমিও তোমাদেরই থাতে থাততে তাই। (আমিও তোমাদের সাথে থাকতে চাই)
আমরা দুজনেই বলে উঠলাম
- কেনো?
- বায়োবাতি তাই।
তিনজনেই হেঁসে উঠলাম একসাথে। ইশ! মেয়ের হাঁসিটাও একদম তার বাবার মতো ভয়ানক হয়েছে। আমিও যে আমার প্রিয় মানুষগুলোর সাথে সারাজীবন থাকতে চাই। কারণ? সেতো একটাই। ভালোবাসি তাই।
সমাপ্ত
এতোদিন ধৈর্য ধরে পাশে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। জানি খুব একটা ভালো হয়নি। আসলে কাঁচা হাতের লিখা তো। এটাই আমার প্রথম গল্প। তাই হয়তো অজস্র ভুল-ভ্রান্তি থেকে থাকবে। তার জন্য দুঃখিত। আর আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন প্লিজ। তাহলে হয়তো পরবর্তীতে আরো ভালো করতে পারবো।
লেখিকাঃ আফিফা জান্নাত মাইশা
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “ভালোবাসি তাই – ভালোবাসার গল্প 2021” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ুন – ভালোবাসার গল্প 2021 (১ম খণ্ড)