ভালোবাসি তাই – ভালোবাসার গল্প ২০২১: হঠাৎ করেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে কেউ আমার পেছন পেছন আসছে। কিন্তু পিছনে ফিরে সন্দেহ করার মতো কাউকেই দেখছি না আমি। তবুও….
পর্ব ১
গ্লাসে পানি ভরছিলাম খালামনির বলা কথাটা শুনে হাত থেকে গ্লাসটা পড়ে গেলো। আওয়াজ শুনে মা ছুটে এলো আমার কাছে। মা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
কি হলো মেঘা? গ্লাসটা পড়লো কি করে?
কিছু হয়নি মা। হাত ফসকে পড়ে গেছে।
কোথাও লাগেনি তো?
না কোথাও লাগেনি।
আমি আর কিছু না বলে ছুটে চলে এলাম আমার ঘরে। তোমায় কি করে বলবো মা কোথায় লেগেছে। খুব লেগেছে মা, আমার বুকে খুব লেগেছে।
ছোটবেলা থেকে যাকে ভালোবেসে এসেছি তার সাথেই নিজের বড় বোনের বিয়ের কথা সহ্য করতে পারছি না আমি।
বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে কেউ আমার হৃদপিণ্ডটায় আঘাত করছে অনবরত। ভালোবাসা হারানোর কষ্টটা বুঝি এরকমই হয়।
আমি আফিফা জান্নাত মেঘা, আমার বড় বোন আলিফা জান্নাত মালিহা, বড় ভাই আফনান রাফাত আর মা – বাবাকে নিয়েই আমাদের সুখী পরিবার। যার সাথে আমার বোনের বিয়ের কথা চলছে সে আমার খালাতো ভাই মিহির আহমেদ ফুয়াদ।
যখন ভালোবাসা কি জানতাম না তখন থেকেই ফুয়াদ ভাইয়াকে আমার ভালো লাগতো। কিন্তু ভালোবাসা কি জানার পর থেকে বুঝতাম ফুয়াদ ভাইয়ার প্রতি ভালোলাগাটা আসলে ভালোবাসা। তখন থেকেই ফুয়াদ ভাইয়াকে ভালোবেসেছি। আমার সব কল্পনায় শুধু ফুয়াদ ভাইয়ার স্থান ছিলো। তাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনেছি আমি। আমার প্রতিটা নিশ্বাসে শুধু একটাই নাম মিশে আছে ‘ফুয়াদ’।
ফুয়াদ ভাইয়াকে ছোট থেকে ভালোবাসলেও উনাকে জানিয়ে ছিলাম তিন বছর আগে। কিন্তু উনি আমায় মেনে নেন নি। অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবুও আমি অনেকবার উনার কাছে ভালবাসার দাবি নিয়ে গেছি আর প্রত্যেকবার উনি আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু হাল ছাড়িনি আমি। আমার বিশ্বাস ছিলো একদিন ফুয়াদ ভাইয়া আমার ভালোবাসা বুঝবে। আমাকে ভালোবেসে নিজের করে নেবে।
কিন্তু আজ আমার নিজেরই বড় বোনের সাথে উনার বিয়ের কথা চলছে। ফুয়াদ ভাইয়াও নিশ্চয়ই রাজি। উনি তো বলেছিলেন খালামনি যাকে তার জন্য পছন্দ করবে তাকেই উনি বিয়ে করবেন। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে কেনো ফুয়াদ ভাইয়া, কেনো আমায় ভালোবাসলেন না। একটু কি ভালোবাসা যেতো না আমায়।
আপুর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে নাহয় কিছু করতে পারতাম আমি।কিন্তু এখন তো কিছুই করতে পারবো না। আপু কি এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে? আমার সব স্বপ্নগুলো কি তাহলে অপূর্ণই থেকে যাবে? ফুয়াদ ভাইয়া কি কখনো আমার ভালোবাসা বুঝতে পারবে না? আমরা তিন ভাই – বোন একে অপরকে অনেক ভালোবাসি কিন্তু এখন কি আমার আর আপুর মাঝে দূরত্ব তৈরী হবে? আর কিছু ভাবতে পারছি না আমি। মাথাটা ভাড় হয়ে আসছে আমার। একপাশে ফুয়াদ ভাইয়া আরেক পাশে আপু। দুজনকেই যে আমি খুব ভালোবাসি।
হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শে পিছনে ফিরে দেখি আপু দাড়িয়ে আছে।
- তুই কি কাঁদছিস মেঘা?
আপুর প্রশ্নে চোখের পানি মুছে নিয়ে বললাম,
- আমি কেনো কাঁদতে যাবো। চোখে কিছু একটা পড়েছে।
- ওহ
- তুমি কি কিছু বলবে আপু?
- তুই কি কিছুই জানিস না?
- কোন বিষয়ে?
- আমার আর ফুয়াদ ভাইয়ার বিয়ের বিষয়ে।
আপুর কথা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবু্ও মুখে হাসি এনে বললাম,হ্যাঁ, খালামনির কাছ থেকে শুনলাম।
আমাকে মা এইমাত্র জানালো। এখন আমার মত চাইছে মা আর খালামনি। আমি রাজি থাকলে ফুয়াদ ভাইয়ার মাস্টার্স ফাইনাল এক্সাম শেষে বিয়ের কথা চিন্তা করছে তারা।
আমি মিথ্যে একটা হাঁসি দিয়ে বললামভালোই তো তাহলে।
- কিন্তু আমার একটা সমস্যা আছে।
- কি সমস্যা?
- আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না।
- আপুর কথা শুনে মনে হচ্ছে জীবন ফিরে পেয়েছি। অনেক খুশি লাগছে।
আমার রীতিমতো লুংগী ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু আপাতত ইচ্ছেটাকে সাইডে রেখে আপুর কাধে হাতটা রেখে বললাম,কেনো আপু? তুমি কি কাওকে ভালোবাসো?
না। আমি অন্য যে কাওকে বিয়ে করে নেবো কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারবো না।
- কেনো আপু?
- কারণ ফুয়াদ ভাইয়া অনেক রাগী। আমি উনাকে অনেক ভয় পাই। এতো রাগী মানুষের সাথে আমি সারাজীবন থাকতে পারবো না।
- তাহলে এখন কি করবে?
আপাতত কিছুই বলবো না। ফুয়াদ ভাইয়ার এক্সাম পর্যন্ত অপেক্ষা করবো ভাবছি। এতোদিনে যদি দেখি ফুয়াদ ভাইয়ার রাগ আমি সামাল দিতে পারবো তাহলে ভেবে দেখবো। আর যদি মনে হয় সামলাতে পারবো না। তাহলে রাজি হবো না।
তারমানে আপুর ভালো লাগলে বিয়েটা কনফার্ম। বুকটা চিনচিন করে উঠলো। তাহলে বিয়েটা হয়েই যাবে?
কিন্তু যদি আপু রাজি না হয়? তারমানে আমার কাছে এখনো সুযোগ আছে। ফুয়াদ ভাইয়া যদি একয়দিনে আমায় ভালোবেসে ফেলে। আমার ভালোবাসা যাতে ব্যার্থ না হয় তার শেষ চেষ্টা করবো আমি।
আপু নিজের ঘরে চলে গেছে। আর আমি আয়নার সামনে চলে এলাম। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছি নিজেকে। আমি দেখতে খুব খারাপ? কিন্তু সবাই যে বলে আমায় পুতুলের মতো সুন্দর দেখতে। কতো ছেলেরাও তো আমায় প্রপোজ করে। তাহলে ফুয়াদ ভাইয়া কেনো ভালোবাসে না আমায়? না, এবার তো আপনাকে আমায় ভালোবাসতেই হবে। কালকে থেকেই আমার মিশন শুরু। এবার কিছুতেই হার মানবো না আমি। গেট রেডি মিস্টার ফুয়াদ।
পর্ব ২
প্রায় এক ঘন্টা ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুলগুলোকে কিছুতেই বাধতে পারছি না। কতরকমভাবে বাধছি কিন্তু কোনোটাই মনে ধরছে না আমার। মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে চুলগুলোকে কেঁচি দিয়ে ঘ্যাচাং করে কেটে ছোট করে ফেলি। কিন্তু তখনই মনে পড়ে ফুয়াদ ভাইয়ার কথা। লম্বা চুল উনার অনেক পছন্দ। যদিও আমার চুলের প্রসংশা কোনোদিনই করেন নি উনি। তাতে কি লম্বা চুল উনার পছন্দ এটাই বড় কথা।
আমার পেছনে সোফায় বসে চুপচাপ আমার কাজ দেখে চলেছে বেস্টু সারা। তার মুখের অবস্থা দেখেই বুঝা যাচ্ছে আমার কাজে প্রচুর বিরক্ত সে। তার বিরক্তি দমাতে আমিই বললাম,
কিরে মুখটাকে এমন কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানিয়ে রেখেছিস কেনো?
আমার কথায় চেচিয়ে বলে উঠলো সারা তো কি করবো? রাতে ফোন করে বললি আজ যেনো একটু তারাতাড়ি তোদের বাসায় চলে আসি। তোর কথামতো চলেও এলাম। কিন্তু আসার পর থেকেই তুই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছিস। না নিজে কিছু বলছিস আর না আমাকে কিছু বলতে দিচ্ছিস। তোর কাজ দেখতে দেখতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি অথচ তুই করতে করতে হাঁপাচ্ছিস না।
রিল্যাক্স, এতো হাঁপাস না পরে হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হয়ে যাবি।
ফাজলামো বন্ধ করবি প্লিজ। ব্যাপার কি বলতো আজ তোর মুড এতো ভালো কেনো আর সাজুগুজুই বা করছিস কেনো?
আমার মুড অলটাইম ভালো থাকে। আর সাজুগুজুর কি দেখলি সামান্য কাজল, লিপস্টিক আর চুলটা বাধছি।
তোর জন্য এটুকুই অনেক সাজ। সে যাই হোক যাবি তো ভারসিটি কিন্তু হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে বয়ফ্রেন্ডর সাথে ডেটিংএ যাচ্ছিস।
তার থেকেও বেশি কিছু।
মানে?
আরে ভারসিটিতে ফুয়াদ ভাইয়ার সামনে যাবো না?
সেতো রোজই যাস তাহলে আজ এতো হম্বিতম্বি কেনো রে?
কারণ আজ থেকে আমার নিউ মিশন শুরু।
কিসের মিশণ?
ফুয়াদ ভাইয়াকে আমার ভালোবাসাটা বোঝানোর মিশন।
এটা কি তুই আজ নতুন শুরু করলি নাকি এটাতো সেই তিন বছর আগে থেকেই শুরু করেছিস।
কিন্তু এটাই শেষ চেষ্টা। এবার আর না পারলে উনাকে সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবো আমি।
তোর কি মনে হয় তিন বছরে যে তোর ভালোবাসা বুঝলো না সে এইকয়দিনেই তোর ভালোবাসা বুঝবে?
সারার কথায় বুক চিরে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। আমি নিজেও জানি ফুয়াদ ভাইয়া এতো সহজে মেনে নিবেন না আমায়। উনার সব অপমান সহ্য করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রেখেছি আমি। এখন শুধু একটাই চাওয়া উনি যেনো আমার ভালোবাসাটা বুঝতে পারেন।
কিরে কি ভাবছিস?
না কিছু না।
যেচে অপমানিত হতে যাবি?
ধুর অপমানিত হতে যাবো কেনো। আর তুই কি বলতো কোথায় আমাকে সাহস দিবি তা না আমায় আরো দুর্বল করে দিচ্ছিস।
আমি তোকে দুর্বল করে দিচ্ছি?
তা নয়তো কি। একটা কথা কি জানিস বেস্টফ্রেন্ড হচ্ছে গ্লুকজের মতো। দুজনের কাজই হচ্ছে দুর্বল হয়ে গেলে শক্তি যোগান দেওয়া।
হয়েছে তোর মহামূল্যবাভ ভাষণ থামা। এখানে বস আমি চুল বেধে দিচ্ছি।
অবশেষে সারা সমস্যার সমাধান স্বরূপ চুলে ক্রিসক্রস বেণী করে দিলো। সবুজ থ্রিপিস, মাথায় বেণী, হাতে চিকন ফিতার কালো ঘড়ি, চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক ব্যাস আমি তৈরি। সারার সাথে বেরিয়ে পরলাম ভারসিটির উদ্দেশ্য।
আমি আর ফুয়াদ ভাইয়া একই ভারসিটিতে পড়ি। উনি মাস্টার্সে আর আমি অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। আপু অন্য ভারসিটিতে অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। আমি আরেকটা ভারসিটিতে সুযোগে পেয়েছিলাম কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়া এইখানে পড়েন বলে এই ভারসিটিতে ভর্তি হয়েছি।
ভারসিটিতে ঢুকতেই চোখ পরলো ক্যাম্পাসে। ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন ফুয়াদ ভাইয়া। কি সুন্দর করে হাসছেন উনি। এই হাসিটাই তো সারাজীবন দেখতে চাই আমি।
সারাকে ক্লাসে পাঠিয়ে ফুয়াদ ভাইয়ার কাছে গেলাম। আমাকে দেখেও কোনো ভাবান্তর হলো না উনার। অথচ উনার সব ফ্রেন্ড আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আমি মিষ্টি করে হেসে উনাকে বলে উঠলাম
আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে ফুয়াদ ভাইয়া। একটু এদিকে আসবেন?
আমার সাথে তোর আবার কিসের কথা?
সেটা শুনলেই বুঝতে পারবেন। এখন একটু ওদিকে চলুন না প্লিজ।
আমার কথায় উঠে দাঁড়ালেন উনি। উনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার সাথে যেতে হচ্ছে উনাকে। দুজনেই চলে আসছিলাম তখনই উনার ফ্রেন্ড তানভীর ভাইয়া বলে উঠলেন
হেই মেঘা তোমায় আজ দারুণ লাগছে।
উনার কথায় কেমন অস্বস্থি হচ্ছে আমার। তবুও মুচকি হেসে বললাম
ধণ্যবাদ, ভাইয়া।
এসব নেকামো করার জন্য আমার সময় নেই। তারাতাড়ি আয়।
ফুয়াদ ভাইয়ার কথায় চলে এলাম উনার সাথে। বড় বটগাছটার নিচে এসে বললাম
এসব হচ্ছেটা কি ভাইয়া?
কিসব হচ্ছে?
আপনি জানেন না আমি কিসের ব্যাপারে কথা বলছি?
ভণিতা না করে কি বলতে চাইছিস সেটা বল।
আপনি কি জানেন না আপনার আর আপুর বিয়ের কথা চলছে?
হ্যাঁ, জানি তো।
আপনি কি বিয়েটা করবেন?
না করার কি আছে। তোকে আমি আগেও বলেছি মা যাকে আমার জন্য পছন্দ করবে আমি তাকেই বিয়ে করবো।
আপনি এটা করতে পারেন না ফুয়াদ ভাইয়া।
কেনো পারি না?
কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি।
এই তোর লজ্জা করে না। তোকে বারবার ফিরিয়ে দেওয়ার পরেও বেহায়ার মতো আমাকে ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিস।
না করে না। আমি আপনাকে এতো ভালোবাসি আপনি কখনোই তার মূল্য দেননি। আমাকে একটু বলবেন প্লিজ কেনো আপনি আমায় ভালোবাসেন না।
তোর মতো বেহায়া মেয়েকে আর যাই হোক ভালোবাসা যায় না।
আমি বেহায়া?
অভিয়েসলি, এতোকিছুর পরেও তুই আমার পেছনে পড়ে আছিস। মিনিমাম সেল্ফ-রেস্পেক্টটুকুও নেই তোর মাঝে।
উনার কথায় চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে। কাউকে সত্যি ভালোবাসলেই বোধ হয় আমরা বেহায়া হয়ে যাই।
এসব ন্যাকা কান্না বন্ধ কর। বিয়ে আমি মালিহাকেই করছি।
কিন্তু আপু যদি আপনাকে বিয়ে না করে?
এই মিহির আহমেদ ফুয়াদকে রিজেক্ট করার যোগ্যতা তোর বোনের নেই। তবে আমি জানি মালিহা আমাকে ভয় পায়। প্রমিস করছি ওর মন থেকে সব ভয় দূর করে দেবো। ওভারঅল আমি মালিহাকেই বিয়ে করছি সেটাও তোরই চোখের সামনে। গট ইট?
আর একমিনিটও দাঁড়ালেন না উনি। গটগট করে চলে গেলেন আমার সামনে থেকে। ফুয়াদ ভাইয়া যেটা বলে সেটাই করে। তাহলে কি সত্যি সত্যিই আপু রাজি হয়ে যাবে?
কিরে এবারেও মানলো না তো?
সারার কথার কোনো জবাব দিলাম না। কিই বা বলার আছে আমার।
এই তুই না বললি বেস্টফ্রেন্ড হলো গ্লুকজের মতো। তাই তোকে শক্তি দিতে চলে এলাম। একদম মন খারাপ করবি না। উনি একদিন তোকে ঠিকই বুঝবে। শুধু একটাই চিন্তা সেদিন খুব দেরি না হয়ে যায়।
জীবনের শেষ নিঃশ্বাসের আগেও যদি উনি আমাকে ভালোবাসার কথা বলেন তাহলেও আমি উনাকে মেনে নেবো।
ক্লাস শেষ করে মাঠে হাঁটছি আমি আর সারা। তখনই কানে এলো তানভীর ভাইয়ার কন্ঠ।
হেই মেঘা বাসায় চলে যাচ্ছো?
জ্বি ভাইয়া।
চলো আজকে তোমাদের দুজনকে ফুচকা ট্রিট দেই।
সারা বললো কেনো ভাইয়া?
এমনি আজকে আমার মুড অনেক ভালো তো তাই ভাবলাম তোমাদের ট্রিট দিই।
মুড ভালো থাকলেই ট্রিট দেয় এটা আজকে নতুন শুনলাম। তাও আবার ফ্রেন্ডদের নয় জুনিয়রদের। এমনিতেই আমি ফুচকা পাগল তার ওপর উনি এতো করে বললেন তাই আর না করতে পারলাম না। খাওয়া শেষে চলে এলাম বাসায়। কিন্তু বাসায় এসেই এতো ভালো একটা খবর পাবো ভাবতে পারিনি আমি।
পর্ব ৩
বাসায় আসতেই মা বললো খালামনি আমাকে তাদের বাসায় যেতে বলেছে। খবরটা আমার কাছে ছিলো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। কষ্টের মাঝেও কেমন সুখ সুখ ফিল হচ্ছে। আমি খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
আজ এতো খুশি কেনো?
এবার মাকে কি উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছি না।… সত্যিই তো সামান্য একটা কথায় কতটা খুশি হয়ে গেছি আমি।… আমার আবার একটা সমস্যা আছে… অতিরিক্ত খুশি হয়ে গেলে মুখ থেকে হাঁসি সরতেই চায় না।.. আমি যতই থামাতে চেষ্টা করি হাঁসিটা ততই বেড়ে যায়।.. তাই হাঁসি থামানোর বৃথা চেষ্টা না করে হাঁসিমুখেই মাকে বললাম
আসলে খালামনিকে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছিলো.. এখন তো ইচ্ছেটা পূরণ হবে তাই খুশি খুশি লাগছে।
আমার কথায় মা অবাক হয়ে বললো
একদিন আগেই তো তোর খালামনি এলো আমাদের বাসায়।
সেটাই তো.. একদিন আগে। মানে বুঝতে পারছো.. ২৪ ঘন্টা হয়ে গেছে। ২৪ ঘন্টায় ১৪৪০ মিনিট, আবার ১৪৪০ মিনিটে ৮৬৪০০ সেকেন্ড। ও মাই গড, ৮৬৪০০ সেকেন্ড ধরে খালামনিকে দেখিনা। তাইতো আমার চোখদুটো শুধু বলছে খালামনিকে দেখবো খালামনিকে দেখবো।
কথা শেষে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি মাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে।… শুধু মুখের সাইজটা বড় হয়ে আছে… যার ভেতর দিয়ে আস্ত একটা আলু অনায়াসে ঢুকে যাবে।
তোর এসব ফালতু লজিক তোর কাছেই রাখ। আমরা বুঝতে গেলে মাথা ঘেটে ঘ হয়ে যাবে। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে তোর খালামনির কাছে যা।
যাচ্ছি।
আমার ঘরে যাচ্ছিলাম তখনই দেখা হলো আপুর সাথে।… আপু কেমন মুচকি মুচকি হাঁসছে।.. আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো
কিরে এভাবে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিস?
ফুয়াদ ভাইয়াদের বাসায়।
ফুয়াদ ভাইয়ার নাম শুনে আপুর গাল লাল হয়ে গেছে।.. ছোট করে শুধুওহ বলে চলে গেলো নিজের ঘরে।.. আজই প্রথম আপু এমন অদ্ভুত বিহেভ করলো।.. ব্যাপারটা ঠিক কি বুঝে উঠতে পারলাম না। এখন এতো সময়ও নেই।.. এ বিষয়ে পরে রিসার্চ করা যাবে। আপাতত আমার উদ্দেশ্য খালামনির বাসা।
সেই কখন খালামনির বাসায় এসেছি কিন্তু একবারও ফুয়াদ ভাইয়াকে দেখলাম না।… চুপচাপ বসে থাকতে না পেরে খালামনিকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম
ফুয়াদ ভাইয়া বাসায় নেই?
না। সেতো সারাদিনই বাড়ির বাইরে থাকে। তাইতো ভাবছি ফাইনাল এক্সাম হয়ে গেলেই আমাদের বিজনেসে বসিয়ে দিয়ে বিয়েটা তারাতাড়ি দিয়ে দেবো।
ওহ
হঠাৎ করেই মাথায় একটা বুদ্ধি এলো ফুয়াদ ভাইয়ার জন্য রান্না করবো। তাই খালামনিকে জিজ্ঞেস করলাম
রাতের রান্না হয়ে গেছে, খালামনি?
না এখনো করিনি। এখন যাবো।
তার প্রয়োজন নেই। আজকে আমি রান্না করবো।
তুই পারবি না। পরে দেখা যাবে শরীর পুড়িয়ে ফেলবি।
আমি কোনো বাচ্চা মেয়ে না খালামনি। তাছাড়া তোমার বোন আমাকে সব কাজ শিখিয়েছে। তাই সমস্যা হবে না।
তবুও
তুমি একা একা কথা বলতে থাকো আমি রান্নাঘরে গেলাম।
এই না দাঁড়া আমিও আসছি।
প্রায় একঘন্টার মধ্যে ফুয়াদ ভাইয়ার সব ফেভারিট খাবার রান্না করে ফেললাম। একটা জিনিস আমার প্রচন্ড বিরক্তিকর লেগেছে। সেটা হলো উনি ঝাল একদম কম খান। ভাবছি উনার সাথে আমার বিয়ে হলে ঝাল খাওয়া শিখে যাবে কারণ আমি একটা ঝালখোর। ভাইয়া বলে অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার জন্য নাকি আমি ওর সাথে সবসময় ঝগড়া করি।
রান্না শেষে ফুয়াদ ভাইয়ার ঘরটাও নিজ হাতে গুছিয়ে দিয়েছি। এখন উনি বাসায় থাকলে নির্ঘাত বলতেন ইউ বেহায়া মেয়ে, আমার ঘরে কেনো এসেছিস? বেরিয়ে যা ঘর থেকে।..হাহ, আমার ক্ষেত্রে উনার মুখ থেকে একটাই শব্দ বের হয়বেহায়া। মাঝে মাঝে তো মনে এই শব্দটা আবিষ্কারই হয়েছে ফুয়াদ ভাইয়া যেনো আমার উপর প্রয়োগ করতে পারে তার জন্য।
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে ধ্যায়ান ভাঙলো। খালামনির বদলে আমিই গেলাম দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখি ফুয়াদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন।উনি আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন আর আমি বত্রিশ পাটি বের করে হাসি দিচ্ছি। হেঁসে হেঁসেই বললাম
চলে এসেছি।
তাতো দেখতেই পারছি। পাগলের মতো না হেঁসে সামনে থেকে সর।
উনি ড্রয়িংরুমে যেতেই খালামনি বললো ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।
একটুপর আমি, খালামনি, আংকেল আর ফুয়াদ ভাইয়া একসাথে খেতে বসলাম। ফুয়াদ ভাইয়া খাবারগুলো দেখে অনেক খুশি হয়েছেন। হবে না কেনো.. সব যে উনার পছন্দের খাবার। খাবার খাওয়ার সময় উনি বললেন
আজকের রান্না তো সেই হয়েছে মা।
কারণ আজকে রান্নার হাত বদলে গেছে।
তার মানে কি তুমি প্রতিদিন ডান হাতে রান্না করো আর আজ বাম হাতে করেছো? এরকম হলে কিন্তু এখন থেকে বাম হাতেই রান্না করবে। তাই না বাবা?
একদম ঠিক বলেছিস
ফাজলামো বন্ধ কর। রান্নার হাত বদলেছে মানে আজকে আমি রান্না করিনি।
তাহলে কে করেছে?
মেঘা।
খালামনির কথায় মুখটা ছোট হয়ে গেছে উনার। আমার দিকে তাকাতেই চোখ মেরে একটা ক্লোজআপ হাসি দিলাম আমি।….উনার মুখটা দেখার মতো হয়ে আছে। ভুলবশত হলেও আমার প্রসংশা করে খুব বাজেভাবে ফেসে গেছেন উনি। ইশ! মনের মাঝে শান্তিরা যেনো বলছে আমরা এসে গেছি মেঘা.. আমরা এসে গেছি।
উনি খাওয়া শেষে চুপচাপ উঠে গেলেন।.. আমিও চললাম উনার পিছু পিছু।.. যেই উনার ঘরে ঢুকতে যাবো উনি আটকে দিলেন আমায়।
তুই এখানে কি করিস?
আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।
তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই।
তো আমি কি করবো? আমার তো আছে।
যা বলার তারাতাড়ি বলে চলে যা।
চলুন বিয়ে করে ফেলি।
আমিতো কয়েকদিন পরেই করে ফেলছি। তোরও যদি করার ইচ্ছে থাকে তাহলে খালামনিকে পাত্র খুজতে বলছি।
আরে আমি বলছি চলুন আমরা একে অপরকে বিয়ে করে ফেলি। দেখুন, লজিকও বলছে আমরা যেনো একসাথে থাকি।
হোয়াট?
হ্যাঁ, এই যে দেখুন আপনি একদম ঝাল খেতে পারেন না আর আমি ঝালখোর, আপনি বেশি কথা পছন্দ করেন না আর আমি সবসময় বেশি কথা বলি, আপনি আমায় সহ্য করতে পারেন না আর আমি আপনাকেই ভালোবাসি। মানে আমি আর আপনি পুরাই বিপরীত। বিজ্ঞান বলে বিপরীতধর্মী পদার্থ একে অপরকে আকর্ষণ করে। তার মানে কি দাঁড়ালো?
কি?
এটাই যে আমার আর আপনার একসাথে থাকা উচিৎ। আর সেজন্য তো আমাদের বিয়েটা করতে হবে।
আমার কথায় চেচিয়ে উঠলেন উনি।
বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে। এক্ষুনি মানে এক্ষু্নি যাবি। রাইটা নাউ।
কেনো আমি কি ভুল কিছু বল….
আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে টেনে উনার ঘর থেকে বের করে দিলেন।
আর যেনো এই ঘরের আশেপাশে না দেখি।
আশেপাশে না ঘরের ভেতরেই দেখবেন। চ্যালেন্জ করছি একটুপর আপনি নিজে আমায় ডেকে নিয়ে আসবেন এই ঘরে।
মরে গেলেও না।
মরতে যাবেন কেনো বেঁচেও থাকবেন আর আমায় আপনার ঘরেও ডাকবেন।
ওকে চেলেঞ্জ এক্সেপটেড।
গুড বয়।
আর কিছু না বলে পা বারালাম গেস্টরুমের উদ্দেশ্যে। আবার উনার হেরে যাওয়া মুখটা দেখতে পারবো ভেবেই শান্তি লাগছে। আজকে কি শান্তির মেলা বসেছে নাকি সবকাজেই কেমন শান্তি শান্তি লাগছে। ঘরে এসে চুপচাপ সারার সাথে চ্যাটিং করছি। ওকে খাবার টেবিলের ঘটনার কথা বলতেই হাঁসতে হাঁসতে লুটুপুটি খাচ্ছে।
একটুপরই শুনতে পেলাম ফুয়াদ ভাইয়া খালামনিকে ডাকছে। তারমানে কাজ হয়ে গেছে। এবার আমার এন্ট্রি নেওয়ার পালা।
পর্ব ৪
ফুয়াদ ভাইয়ার চেচামেচি শুনে চলে এলাম ড্রয়িংরুমে।.. উনি খালামনিকে জিজ্ঞেস করছেন
- আমার ফোন কোথায় মা?
- তোর ফোন তো তোর হাতেই।
-এই ফোন না মা।.. যেটা সবসময় বাসায় থাকে সেটা।
- ঘরেই হবে হয়তো। খুঁজে দেখ।
- খুঁজে পাইনি বলেই তো তোমার কাছে এসেছি। ঘর গুছানোর সময় কোথায় রেখেছো?
- তোর ঘর তো আমি গুছাই নি।.. মেঘা গুছিয়েছে।
খালামনির কথায় আমার দিকে তাকালেন উনি।.. আমি আমার মুখে যথাসম্ভব ইনোসেন্ট ভাবটা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছি।
-আমার ফোন কোথায় রেখেছিস?
- আপনার ঘরেই তো আছে। ভালো করে খুঁজেছেন তো?
-তো তোর কি মনে হয় যে তুই বলে দেওয়ার পরে খুঁজবো?
এবার খালামনি বললো
- যাতো মেঘা, ওর ঘরে গিয়ে ফোনটা খুঁজে দে।
- আমি উনার ঘরে যাবো না খালামনি।
- কেনো?
- তোমার ছেলেই আমাকে উনার ঘরে যেতে বারণ করেছে।
- কি বলছিস তুই?
- হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। তুমিই বলো উনি না করার পরও আমি কেনো উনার ঘরে যাবো? যদি উনি নিজের মুখে আমাকে উনার ঘরে যেতে বলেন তাহলে যেতে পারি।
আমার কথায় রাগী দৃষ্টিতে তাকালেন উনি।… তাতে আমার কি?.. তখন তো খুব ভাব নিয়ে বললোচ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড। এবার বুঝো ঠেলা।..নিজের উপর কেমন প্রাউড ফিল হচ্ছে।.. ইশ! এতো বুদ্ধি আমার মাথায় আসে কিভাবে? রাগে উনার মুখ লাল টোমেটো হয়ে গেছে।… আমি শিউর, আপু যদি এখন এখানে উপস্থিত থাকতো তাহলে ভয়ে সারাজীবনের জন্য বিয়ে করার চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দিতো।.. আপু আমার বোন হয়েও কেনো যে এতো ভিতু এটা গবেষণার বিষয়।.. যেখানে বাবা – মা আমাকে আর ভাইয়াকে হাজার বকলেও আমাদের উপর তার কোনো প্রভাব পড়ে না সেখানে আপুর দিকে রেগে তাকাতেই তার চোখ ছলছল করে ওঠে।… আমদের তিন ভাই – বোনের মধ্যে আপুই সবচেয়ে শান্ত, ভদ্র, সংসারী একটা মেয়ে।.. সেজন্যই হয়তো খালামনি ওকে ফুয়াদ ভাইয়ার বউ হিসেবে পছন্দ করেছে।.. খালামনির কথায় ঘোর কাটলো আমার।
- কিরে ফুয়াদ, মেঘাকে বল তোর ঘরে গিয়ে ফোন খুঁজে দিতে।
এমুহূর্তে ফোনটা উনার অনেক প্রয়োজন বলে দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে উনার ঘরে যেতে বলে দ্রুত চলে গেলেন উনি। আমিও উনার সাথে হাটছি। উনি কোনো কথা বলছেন না। হয়তো রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টায় নিয়োজিত আছেন। কিন্তু আমি তো তা হতে দেবো না। আমি হেলেদুলে হেটে গুনগুন করে গান গাইছি। আমার এরকম ব্যবহারের ওয়ান এন্ড অনলি উদ্দেশ্য উনার রাগ আরো বাড়িয়ে দেওয়া। আমি সফলও হয়েছি। রাগে যেকোনো মুহুর্তে ফেটে পড়তে পারেন উনি। আচ্ছা, উনি ফেটে গেলে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকির মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে নাকি? তবে এই মুহূর্তে গান গাওয়া বন্ধ না করলে আমার মৃত্যু যে নিশ্চিত তা বেশ বুঝতে পারছি আমি। তাই বুদ্ধিমানের মতো গান গাওয়া বন্ধ করে দিলাম।
উনার ঘরে এসে ফোনটা খুঁজে বের করে দিতেই সেটা নিয়ে বিছানায় বসে পরলেন উনি।… ফোনে চুপচাপ কিছু একটা করছেন। ভাবটা এমন যেনো এ ঘরে উনি ছাড়া একটা মশাও উপস্থিত নেই।… অথচ আমি আস্ত একটা মেঘা দাঁড়িয়ে আছি উনার সামনে।.. ইশ! বেচারা আবারো হেরে গেলো। তাই হয়তো কথা বলতে চাইছে না আমার সাথে।
- বলেছিলাম না আপনি নিজে আমায় ডেকে আনবেন। দেখুন সেটাই কিন্তু হয়েছে। আপনি হেরে গেছেন আর আমি জিতে গেছি।
- এই খুশিতে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে যা।
- তাহলে তো আমি মরে যাবো। আমি মরে গেলে আপনাকে ভালোবাসবে কে?
- কেনো, মালিহা।
- আপুর ভালোবাসা ভয়ের নিচে চাপা পরে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। তার থেকে বরং আমায় ভালোবাসুন কাজে লাগবে।
- তোর মুখে সবসময় ভালোবাসার কথা লেগে থাকে কেনো রে?
- ভালোবাসি তাই। এনিওয়ে, কফি আনবো আপনার জন্য?
আমার কথা শুনে উনি উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত করে আমার ডান হাত চেপে ধরলেন। চোখ থেকে যেনো আগুন ঝরছে। মনে হচ্ছে হাতটা বুঝি ভেঙেই গেলো। ব্যাথায় চোখের কোণে পানি এসে গেছে আমার। কিন্তু সেদিকে খেয়ালই নেই উনার। উনি নিজের মতো বলেই চলেছেন।
- কি ভাবছিস তুই? আমার জন্য রান্না করে, আমার ঘর গুছিয়ে, আমার জন্য কফি এনে আমার মন জয় করে ফেলবি? সেটা কখনো হবে না। আর কতবার, কিভাবে বললে বুঝবি যে আমি তোকে ভালোবাসি না। তুই তো আর অবুঝ বাচ্চা না।বুঝতে পারিস না তোকে আমার সহ্য হয় না? আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ, আই ওয়ান্ট মালিহা। ইয়েস আই জাস্ট ওয়ান্ট মালিহা নট ইউ। বুঝতে পেরেছিস?
আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ কথাটা শুনে আমার একদম খারাপ লাগে নি কিন্তুআই ওয়ান্ট মালিহা কথাটা তীরের মতো লেগেছে মনে। উনার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে চলে এলাম ঘর থেকে। এখন আর ঘুম আসবে না তাই হাটতে লাগলাম ছাদের দিকে।
রাত কয়টা বাজে জানা নেই। ছাদের দোলনায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। আকাশে আজ চাঁদ নেই তবে রয়েছে অসংখ্য তারার মেলা। চারদিকে বিরাজমান নিরব নিস্তব্ধতাই জানান দিচ্ছে অনেক রাত হয়ে গেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। আশেপাশের বাসার আলোতে মৃদু আলোকিতো হয়ে আছে ছাদ। বাতাসের ঝাপটায় শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে উঠছে বারবার।
মাথায় নির্দিষ্ট কোনো চিন্তা আসছে না আমার। সব ভাবনাগুলো একসাথে এসে জরো হচ্ছে বলে ঠিক কি ভাবছি সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। তবেআই ওয়ান্ট মালিহাকথাটা বেশ ভালো করেই জেকে বসেছে মাথায়। আচ্ছা আমি কি একটু বেশিই করে ফেলছি? আমার কি উচিত ফুয়াদ ভাইয়াকে উনার নিজের মতো ছেড়ে দেওয়া? হয়তো। এতোদিন তো শুধু বলতেন উনি আমাকে চান না কিন্তু আজ তো এর সাথে আরও একটা কথা বললেন উনি আপুকে চান। আমি বোধ হয় উনাকে বেশিই বিরক্ত করে ফেলছি।
যখন আপু আর উনার মাঝে সব ঠিক হয়ে যাবে তখন তো বিয়েটা হয়েই যাবে। আমি তো সেটা আটকাতে পারবো না। আমার উচিৎ এখন থেকে এটা মেনে নেওয়া নাহলে পরে হয়তো আরো কষ্ট পাবো। যে ভালোবাসার ভবিষ্যৎ নেই সেটা নিয়ে পড়ে থাকাটা নিছকই বোকামী।
থাক না উনি উনার মতো।.. ভালোবাসতে হবে না আমাকে। আমিই নাহয় সারাজীবন দূর থেকে ভালোবেসে যাবো উনাকে।.. ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। অনেকেই তো আছে যারা নিজেদের ভালোবাসার মানুষটাকে পায় না।… তাই বলে কি তাদের ভালোবাসা মরে যায়?.. যায় না তো। আমিও নাহয় তাদের দলেরই একজন হয়ে গেলাম।
এসব কথা ভেবে মস্তিষ্ককে সন্তুষ্ট করতে পারলেও মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না আমি।… শুধু ভাবছি যখন ওদের দুজনকে একসাথে দেখবো তখন নিজেকে সামলাতে পারবো তো?.. ঠিক রাখতে পারবো নিজেকে?… নাকি ভুল কোনো কাজ করে বসবো?
আজ আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে, অনেক ইচ্ছে করছে।কিন্তু কেনো জানি কান্না আসছে না।… চোখের পানিগুলোও আমার কষ্ট বুঝতে চাইছে না।.. তারাও আজ আমার সঙ্গ দিতে নারাজ। আমার ভাবনার মাঝেই ছাদে কারো উপস্থিতি টের পেলাম।… বুঝতে পারছি এটা ফুয়াদ ভাইয়া। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে উনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না মোটেও।… থাক না উনি উনার জায়গায় আমি বরং চন্দ্রহীন আকাশ দেখি।
তখন হয়তো উনার কথা শুনানো শেষ হয়নি।.. তাই আবার এসেছে আমাকে অপমান করে নিজের মনকে হালকা করতে আর আমার মনে জন্ম দিতে পাহাড়সম বিষন্নতা।.. উনার কথাগুলো শুনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি আমি। হয়তো আর কখনো আমাকে অপমান করার সুযোগটাই দেবো না উনাকে।… তাই আজ যতো ইচ্ছা অপমান করে নিক উনি আমি বাধা দেবো না।…আমি যখন চিন্তার জগতে ব্যাস্ত তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে দোলনায় আমার পাশে এসে বসে পরলেন ফুয়াদ ভাইয়া।… আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কি সত্যি সত্যিই ফুয়াদ ভাইয়া? উনি নিজে আমার পাশে এসে বসেছেন? ইগোতে লাগছে না উনার? নাকি চ্যালেঞ্জে হেরে গিয়ে পাগল- টাগল হয়ে গেলেন?
আমি এবার ভালো করে তাকালাম উনার দিকে। উনার দৃষ্টিও আমাতে নিবদ্ধ। কেমন যেনো অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছেন উনি আমার দিকে। কি শীতল সেই চাহনি। উনার এরকম দৃষ্টির সাথে পরিচিত নই আমি।… উনি যখনই আমার দিকে তাকান তখনই উনার চোখে ফোটে উঠে একরাশ বিরক্তি নয়তো রাগ। কিন্তু আজ এই চোখ জোরার ভাষা বুঝতে পারছি না।
আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে উনি বলে উঠলেন
- সরি।
- সরি কেনো?
- তখন তোর সাথে ওরকম বিহেভ করা ঠিক হয়নি আমার।.. রাগে কি থেকে কি করে ফেলেছি বুঝতে পারি নি।.. হাতে কি খুব লেগেছে?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। হাতে এটুকু ব্যাথা দিয়েছেন তাতেই উনি অনুতপ্ত।.. অথচ মনে যে ক্রমাগত ব্যাথা দিয়েই চলেছেন তার জন্য কি উনার মধ্যে একটুও অনুতপ্ততা কাজ করে না? .. কে জানে? এ মুহূর্তে আমার সামনে বসে থাকা ফুয়াদ ভাইয়াকে ভীষণ অচেনা লাগছে আমার।… উনি আমায় সরি কেনো বলছেন? আমি কষ্ট পেয়েছি বলে নাকি উনি নিজেকে অপরাধী মনে করছেন বলে?… আমার কোনো উত্তর না পেয়ে উনিই বলা শুরু করলেন।
- তখন তোকে ওভাবে কষ্ট দিতে চাই নি আমি।.. কখনো দিতেও চাই না।.. কিন্তু আমি যে কেনো তোকে সহ্য করতে পারি না সেটা আমি নিজেও জানি না।.. তুই যখন আমার সামনে এসেভালোবাসিভালোবাসি করিস তখন প্রচুর রাগ হয় আমার।.. রাগের বশেই না চাইতেও তোকে কষ্ট দিয়ে ফেলি।.. আচ্ছা, আমি যতদূর জানি তোর পরিবারের কেউও যদি কখনো তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে তুই রাগ করে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিস।। তাহলে আমি যে তোর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করি তবুও তুই আমার কাছে কেনো ফিরে আসিস?
- ভালোবাসি তাই।
- আবারো এই এক কথা। তুই কি বুঝতে পারিস না আমি তোকে কখনোই ভালোবাসবো না? কিছুদিন পর আমার আরেকটা পরিচয় হবেতোর বড় বোনের হাসবেন্ড।.. তাই এসব উল্টাপাল্টা কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দে।
কেনো জানি উনার কথায় প্রচুর রাগ হলো আমার।.. দোলনা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উনার কলার চেপে ধরলাম আমি।.. আমার এমন কাজে উনি যে অনেক অবাক হয়েছেন সেটা উনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।.. তাতে আমার কি? আমি আজ বলবো, যতক্ষন ইচ্ছা হয় বলবো।
- সো মিস্টার ফুয়াদ, কি যেনো বলছিলেন আপনি? সব যেনো মাথা থেকে ঝেরে ফেলে দিই।.. তাইতো? এটা কি এতোই সোজা?.. সম্ভব হলে তো আরো আগেই ঝেরে ফেলতাম আমি।.. আপনার বলা তিক্ত তিক্ত কথাগুলো শুনার জন্য বসে থাকতাম না নিশ্চয়ই।.. একদিন আপনিও কাউকে ভালোবাসবেন। হয়তো এই কেউটা হবে আমার আপু। তাতে কি, ভালো তো বাসবেন।.. আপনি সবসময় বলেন না, আমার কোনো আত্মসম্মান নেই। আমার আত্মসম্মান সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই আপনার।… কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে আত্মসম্মানটা কোনো কাজেই আসে না আমার। আমি কি পারতাম না আপনি আমায় অপমান করার পর ইগো দেখিয়ে আপনার থেকে দূরে সরে যেতে?.. অবশ্যই পারতাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস যে ভালোবাসা সামান্য ইগোর কাছে হেরে যায় সেটা আর যা-ই হোক ভালোবাসা অন্তত নয়।.. তাই ইগো নামক ব্যধিটা আমি কখনো আমার মাঝে পুষি নি।.. আপনার কি মনে হয় যখন আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, তখন আমার কষ্ট হয় না? হ্যাঁ, আমারও কষ্ট হয়। কারণ আমি কোনো রোবট নই, রক্তে – মাংসে গড়া মানুষ। যখন আমার খারাপ লাগে তখন ভাবি আর যাবো না আপনার সামনে। আর কখনো বিরক্ত করবো না আপনাকে।.. কিন্তু বিশ্বাস করুন যখন আপনাকে দেখি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না আমি। কষ্টগুলোকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছুটে চলে যাই আপনার কাছে৷ কিন্তু আর না।… এখন থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করবো। আপনার প্রতি ভালোবাসাটা হয়তো শেষ হয়ে যাবে না তবে সেটা আর প্রকাশও করবো না আমি।.. প্রমিস করছি এখন থেকে আমি আপনার খালাতো বোন হিসেবেই কথা বলবো আপনার সাথে। আমি কাল সকালেই চলে যাবো।.. সম্ভব হলে এখনি চলে যেতাম কিন্তু সেটা যখন আর হচ্ছে না তখন এটুকু সময়ের জন্য নাহয় সহ্য করে নিন আমায়।
উনার কলার ছেড়ে দিয়ে উল্টো দিকে হাটা ধরলাম। উনি কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু আমি না শুনেই চলে এলাম।… পিছনে ফিরে নিজেকে আরো দুর্বল করে তোলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার। রাত শেষে আসবে নতুন এক সকাল।.. এই নতুন সকাল থেকেই নাহয় নতুন করে শুরু করবো সব।.. হয়তো কাল থেকে ফুয়াদ ভাইয়ার প্রতি ভালোবাসাটা সুপ্ত হয়ে পড়ে থাকবে মনের কোণে।
পর্ব ৫
সকাল সাতটার কাছাকাছি। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি। রাতে আর ঘুমানো হয়ে উঠে নি আমার। চোখদুটো হালকা জ্বলছে। কাল রাতের পর আর ফুয়াদ ভাইয়ার সামনে পড়তে চাই নি। তাই এই সকালবেলাতেই চলে এসেছি উনাদের বাসা থেকে। কাউকে অবশ্য বলে আসিনি। খালামনি জানতে পারলে এতো সকালে কখনোই আমাকে আসতে দিতো না। খুব ভোরে খালামনিকে তার নিজের ঘরে নামাজ পড়তে দেখেছিলাম। পরে আর দেখা হয় নি। বাসার মেইন গেটটাও খোলা ছিলো। হয়তো আঙ্কেল মসজিদে যাওয়ার সময় খুলে ছিলেন পরে আর বন্ধ করা হয়ে উঠে নি।
ভাবছি এখনই কোনো গাড়িতে উঠবো না। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্ত না হয়ে যাই ততক্ষন পর্যন্ত হাঁটতেই থাকবো। এই ব্যাস্ত শহরের ব্যাস্ত সকালটা এভাবে অনুভব করার সুযোগ হয়ে উঠে নি কখনো। রাস্তায় যানবাহনের আনাগোনা দেখে বোঝার উপায় নেই এখন সকাল না দুপুর। মনে হচ্ছে কে কার আগে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই। জীবীকার তাগিদে যে হাজারো মানুষ রোজ চোখের ঘুম বিসর্জন দিয়ে ছুটে চলে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে তার এক বিরাট বড় উদাহরণ এই সকাল। চারদিকে ইট -পাথরের দেয়ালের কৃত্রিমতা ভেদ করে বিশুদ্ধ বাতাসটাও যেনো প্রবাহিত হতে চাইছে না এই শহরে। কারো মাঝে একটু বিশুদ্ধ শ্বাস নেওয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করছি না আমি। সবাই যে যার কাজে ব্যাস্ত, আশেপাশের কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় তাদের নেই। আর পাঁচটা দিনের মতো আজকের দিনটাও যদি আমার কাছে স্বাভাবিক হতো তাহলে হয়তো আমিও ভাবতাম না এসব। কিন্তু আজ আশেপাশের পরিবেশটাকে নিয়ে ভাবার ইচ্ছেটা নিজের মাঝে প্রবলভাবে অনুভব করছি।
খালামনির বাসা থেকে আমাদের বাসার প্রায় এক ঘন্টার মতো দুরত্ব। আমি ঠিক কতক্ষন ধরে হাঁটছি তা খেয়াল নেই আমার। হাতঘড়িটায় সময়টা দেখার ইচ্ছেও করছে না। আজ তো আমার কোনো তাড়া নেই, তাই আজ সময়জ্ঞানহীনভাবেই হাঁটতে থাকবো।
হঠাৎ করেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে কেউ আমার পেছন পেছন আসছে। কিন্তু পিছনে ফিরে সন্দেহ করার মতো কাউকেই দেখছি না আমি। তবুও মনে হচ্ছে কেউ একজন আড়াল থেকে খুব সুক্ষ্যভাবে লক্ষ্য করে চলেছে আমায়।
কিন্তু কে এমন করবে? আমার পিছু নিয়ে কার কি লাভ? একবার ভাবছি হয়তো মনের ভুল। আরেকবার ভাবছি সত্যিই কি মনের ভুল? এতোটা ভুল করছি আমি? হ্যাঁ, মনের ভুলই হবে হয়তো। সব চিন্তাভাবনা ফেলে রেখে আবারো হাঁটতে লাগলাম আমি।
পাশ দিয়ে যাওয়া একটা লোকের সাথে ধাক্কা লেগে হাত থেকে পার্সটা পরে গেলো নিচে। আমি সেটা তুলতে গেলেই অস্বাভাবিক কিছু ঘটলো আমার সাথে। আচমকাই কেউ একজন ধাক্কা দিলো আমায়। আমি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলাম তখনই আবার কেউ আমায় ধরে ফেললো।
গাড়িগুলো শনশন শব্দ করে ছুটে চলেছে রাস্তায়। কি ভয়ানক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। কোনোভাবে যদি পড়ে যেতাম, বাঁচার কোনো আশাই থাকতো না আমার। ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। হার্ট এতো জোরে বিট করছে যে মনে হচ্ছে সে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য বিদ্রোহ শুরু করেছে।
নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সামনে তাকালাম আমি। উদ্দেশ্য কে আমাকে বাঁচিয়ে দিলো তাকে দেখা। তাকিয়ে দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সারা। চোখের আকার দেখে মনে হচ্ছে অনেক রেগে আছে সে। কিন্তু তার রাগের কারণটাই বুঝতে পারছি না আমি।
- সারা, তুই এখানে?
- কেনো, আমার জায়গায় আজরাঈল থাকলে খুশি হতি নাকি?
- কিসব বলছিস? আজরাঈল কেনো থাকতে যাবে?
-আমি কি বলছি তুই বুঝতে পারছিস না?
- তুই বুঝিয়ে বললে না বুঝবো।
- সুইসাইড করতে কেনো গেছিলি?
- কি? পাগল হয়ে গেছিস তুই? আমি সুইসাইড করতে যাবো কোন আনন্দে?
-মানুষ আনন্দে নয় দুঃখে সুইসাইড করে।
- আমার এমন কোনো দুঃখ নেই যে মরে যেতে চাইবো।
- তাহলে কি গাড়িটা ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য তার নিচে পড়তে চাইছিলি?
- তুই ভুল বুঝছিস আমাকে। ট্রাস্ট মি, আমি ইচ্ছে করে পড়ি নি। কেউ ধাক্কা মেরেছে আমাকে।
আমার কথায় চুপ করে গেলো সারা। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর বলে উঠলো
- কিন্তু তোকে ধাক্কা মারতে যাবে কে?
- সেটাই তো বুঝতে পারছি না আমি। আমার পার্সটা নিচে পরে গেলো, আমি সেটা তুলতে গেলাম আর তখনই কেউ ধাক্কা মারলো। তাই কে ছিলো তাকে দেখতে পারি নি।
-পার্সটা পড়লো কি করে?
- পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা লোকের গায়ের সাথে লেগে পরে গেছিলো।
- তাহলে হয়তো তুই পার্স তুলার সময় আবার অন্য কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাচ্ছিলি। আই মিন, পুরো ঘটনাটাই অনিচ্ছাকৃত। নাহলে তোকে ধাক্কা মেরে কার কি লাভ?
সারার কথা শুনে আমারো তাই মনে হচ্ছে। সত্যিই তো আমাকে কেউ কেনো ধাক্কা মারতে যাবে? সারার কথাই হয়তো ঠিক। এতো লোকের ভীরে কারো সাথে ধাক্কা লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনিচ্ছাকৃত হলেও কতো বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। সারা না থাকলে হয়তো এতক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকতো আমার নিঃপ্রাণ দেহ।
- আচ্ছা তুই এতো সকালে এখানে কি করছিলি? তুই না ফুয়াদ ভাইয়াদের বাসায় গেছিলি?
- হ্যাঁ, ওখান থেকেই বাসায় যাচ্ছিলাম।
- তাই বলে এতো সকালে? আরেকটু পরে বের হতি।
- এমনি ভালো লাগছিলো না। তাই চলে যাচ্ছিলাম।
- কি হয়েছে বলতো?
- কি হবে?
- কিছু তো হয়েছে। নাহলে যে তুই ফুয়াদ ভাইয়াদের বাসায় গেলে আসতেই চাস না সেই তুই বলছিস ভালো লাগছে না। ব্যাপার কি বলতো?
- কোনো ব্যাপার নেই। সবসময় পরিস্থিতি এক থাকে না।
- হুম বুঝলাম। কি হয়েছে বলতে হবে না। চল আমাদের বাসায় যাই।
- তোদের বাসায় কেনো যাবো? আমি এখন আমাদের বাসায় যাবো।
- তো যা না। যাওয়ার পরে আন্টি যখন জিজ্ঞেস করবে এতো সকালে কেনো চলে এলি তখন কি উত্তর দিবি? বলবি যে ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে কোনো কারণে ঝামেলা করে চলে এসেছিস?
সত্যিই তো একথাটা আগে আমার মাথায় আসে নি। বাসার সবাই জানে আমি খালামনির বাসায় যাওয়ার জন্য পাগল। এখন সেই বাসা থেকেই এতো সকালে চলে এসেছি দেখলে সবাই ভাববে কিছু হয়েছে। তার থেকে বরং সারার সাথে ওদের বাসায় চলে গেলে ভালো হবে। আরেকটু পরে নাহয় বাসায় চলে যাবো।
- কিরে ভাবনা শেষ হলো?
- হুম।
- যাচ্ছিস তো?
- হ্যাঁ, চল।
সারাদের বাসার সবাই বাসাতেই আছে। সকালবেলায়ই ওদের বাসায় কেমন উৎসব উৎসব ভাব। সারার বড় আপু বেড়াতে এসেছে বলে এতো আয়োজন। ভাবছি আমার আপুও যদি বিয়ের পরে বাসায় আসে তখন কি আমাদের বাসায়ও এমন আনন্দ হবে? হবে হয়তো। কিন্তু কথা হচ্ছে আমি মন থেকে আনন্দ করতে পারবো কি না। আমি এসব ভাবতে ভাবতেই সারার সাথে তার ঘরে চলে এলাম। তখনই দৌড়ে এলো কিউট গুলুমুলু একটা ছোট ছেলে। তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এটা সারার আপুর ছেলে।
- সালা, তোমায় হাতা থেস?
- হ্যাঁ, বাবা আমার হাটা শেষ।
- আমায় দন্য তক্কেত এনেতো?
- এই রে একদম ভুলে গেছি। কালকে এনে দেবো ঠিকাছে?
সারার কথায় মুখটা কালো হয়ে বাচ্চাটার। আমার পার্সে কয়েকটা চকলেট ছিলো। বাসা থেকে আসার সময় ভাইয়া দিয়েছিলো কিন্তু খাওয়ার সুযোগ হয় নি। আমি চকলেটগুলো তার দিকে বারিয়ে দিয়ে বললাম
- এই নাও বাবু, চকলেটস।
বাচ্চাটা একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার সারার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো অপরিচিত কারোর থেকে কিছু নেওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি আছে তার উপরে। ওর অবস্থা দেখে আমার ছোটবেলার কথা মনে পরে যাচ্ছে। আগে যখন স্কুলে যেতাম মা বারবার করে বলতো মেঘা, অপরিচিত কেউ কোনোকিছু খেতে দিলে খাবে না। তার সাথে যেতে বললেও যাবে না।
তখন আমি শুধু মাথা নাড়তাম যার অর্থ হ্যাঁ, যাবো না। কিন্তু মনে মনে ভাবতাম অবশ্যই খাবো। কেউ আমাকে টাকা ছাড়া চকলেট দিলে আমি কেনো নেবো না? অবশ্যই নেবো। কিন্তু আফসোস, আজ পর্যন্ত এমন অপরিচিত কোনো ব্যক্তির আগমন ঘটে নি। এটা সত্যি সত্যিই অনেক কষ্টের কথা।
- সালা, আমি কি এই আন্তির তক্কেত নিবো?
- হ্যাঁ, বাবা নাও।
- তুমি অনেক বায়ো আন্তি।
ওর কথায় মুচকি হাঁসলাম আমি। তার সামনে হাটু মুরে বসে জিজ্ঞেস করলাম
- তোমার নাম কি বাবু?
- মুয়াম্মত।
- মোহাম্মদ?
- হ্যাঁ।
- অনেক সুন্দর নাম। কে রেখেছে এই নামটা?
- সালা।
- সালা রেখেছে?
- সালা না তো, সালা।
সারা বললো
- তুমি এখন যাও বাবা। আমরা পরে খেলা করবো।
- থিকাতে। আততায়াইকুম আন্তি।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম।
মোহাম্মদ চলে যেতেই সারাকে বললাম,
- তোর আপুর ছেলে তো দেখি হেব্বি টেলেন্টেড।
- কেনো? এখানে টেলেন্টের কি দেখলি?
- আরে তোকে খালামনি থাকে সোজা শালা বানিয়ে দিলো। এটা কি কম বড় টেলেন্ট?
- ওর এই কথাগুলোর জন্যই তো ওকে এতোটা ভালোবাসি আমি। জানিস মেঘা, মোহাম্মদের জন্মের আগে আমার খুব রাগ হতো। কারণ আমার মনে হতো ওর জন্মের পর আপু আমাকে আর আগের মতন ভালোবাসবে না। হিংসা হতো খুব। কিন্তু ও আমাদের মধ্যে আসার পর আমার ধারণা পুরো পাল্টে গেছে। প্রবাদ আছে না, মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি আমার ক্ষেত্রে এখন তাই হচ্ছে। ও তো আমার আপুরই অংশ। তাই ওকে ভালোবাসা মানে আপুকে ভালোবাসা। ওদের দুজনকেই আমি খুব ভালোবাসি। আচ্ছা তুই বস আমি একটু আসছি।
সারা চলে গেলে জানালার পাশটায় এসে দাঁড়ালাম আমি। জানালার বাইরে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবছি।
আমি নিশ্চয়ই অনেক সার্থপর? নাহলে নিজের আপুর আনন্দে খুশি হতে পারবো কিনা তা নিয়েও দ্বিধায় ভুগছি কেনো? আমিও তো আমার আপুকে খুব ভালোবাসি। সারা তার আপুকে যতটা ভালোবাসে তার থেকেও ভালোবাসি। ফুয়াদ ভাইয়ার জন্য আমি নিজের বোনের সাথে দুরত্ব কেনো বারাবো? আমিও আমার আপুর সাথে এভাবেই থাকবো। ওর সাথে অনেক আনন্দ করবো। আচ্ছা, খুব কি ক্ষতি হতো যদি আমি ফুয়াদ ভাইয়াকে ভালো না বাসতাম? বেসেছি তো কি হয়েছে? তার জন্য আপুর সাথে আমার সম্পর্ক কখনোই খারাপ হতে দিবো না, কখনোই না।
পর্ব ৬
বাসায় আসার পর থেকেই সবার পাগলামী সহ্য করে চলেছি আমি। আপু তো পারে কেদেঁ কেঁদে সাগর বানিয়ে ফেলে। আল্লাহ আমার বোনটা এতো ইমোশনাল কেনো? মা, বাবা, ভাইয়া তারাও কত কথা শুনাচ্ছে আমায়।
এই মুহূর্তে ইট দিয়ে সারার আস্ত মাথাটা গুরাগুরা করতে ইচ্ছা করছে আমার। ফাজিল মেয়ে, কি দরকার ছিলো রাস্তার ঘটনার কথা বাড়িতে বলে দেওয়ার? এখন সবার লেকচারগুলো কি সে শুনছে? নাতো। সেই তো আমাকেই বসে বসে সবার উপদেশ গিলতে হচ্ছে।
- চোখ কি হাতে নিয়ে হাঁটিস নাকি? এখন তো মনে হচ্ছে সিনেমার নায়িকাদের মতো তোর জন্যও বডিগার্ড রাখতে হবে।
ভাইয়ার গা জ্বালানো কথায় মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি কি ইচ্ছে করে পড়ে যেতে চেয়েছিলাম নাকি? কি থেকে কি হয়ে গেছে আমি নিজেই তো বুঝতে পারছিলাম না। সবাই মিলে আমাকেই দোষ দিচ্ছে। আমার পার্স পড়ে গেছে আমি সেটা উঠাবো না? এখন আমার ঐ লোকটার উপর রাগ লাগছে যার সাথে ধাক্কা লেগে পার্সটা নিচে পড়ে গেছিলো। ব্যাটা আর কারো সাথে ধাক্কা খেতে পারলি না? আমার কাছেই কেনো মরতে এসেছিলি? এর নামে মামলা করে উচিৎ।
- তোর কোথাও লাগে নি তো?
আপুর কথার উত্তর না দিয়ে আমিই প্রশ্ন করলাম
- আমি কি মরে গেছি?
আমার কথায় আপু অবাক হয়ে বললো
- কি আজেবাজে কথা বলছিস তুই। মরতে যাবি কেনো?
- তাহলে এভাবে মরাকান্না জুরে দিয়েছো কেনো?
আমার কথা শুনে আপু জরিয়ে ধরলো আমায়। হয়তো আমার মুখ থেকে মরার কথাটা শুনে কষ্ট পেয়েছে। আমিও জরিয়ে ধরলাম আপুকে। আপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলছে
- তোর কিছুই হবে না। তুই না থাকলে এই বাড়িটাকে সারাক্ষন মাতিয়ে রাখবে কে? বাবা – মা যখন বকবে তখন আমার হয়ে কথা বলা, ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করা, রেগে গেলে চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখা এসব কে করবে শুনি? আর কখনো এমন কথা মুখে আনবি না।
- আচ্ছা আনবো না। হ্যাপি?
আপু মুচকি হেঁসে বললো
- হুম।
আপুর হাঁসির বদলে আমিও এক চিলতে হাঁসি ফেরত দিলাম। বাবা – মাও হালকা হেঁসে চলে গেলো নিজেদের ঘরে। হয়তো তারা আমাদের তিন ভাই – বোনের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখে অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করছেন। একটুপর আপুও চলে গেলো নিজের ঘরে। আপু চলে যেতেই ভাইয়া আমার কাছে এসে মাথায় গাট্টা মেরে বললো
- কিরে, রাস্তায় হাঁটার সময় কোন প্রেমিকের কথা চিন্তা করছিলি যে অন্যকিছুই খেয়াল ছিলো না।
- কি বললি তুই? আমি প্রেমিকের কথা চিন্তা করছিলাম?
- তা নয়তো কি। বুঝি বুঝি সব বুঝি।
- ওও তুই সব বুঝিস তাই না? তাহলে ঝাড়ুর বারি খেতে কেমন লাগে সেটাও বুঝিস নিশ্চই?
- তুই কি আমাকে থ্রেট দিচ্ছিস?
- তোর কি মনে হয়?
- আমার কিছু মনে হয় না। তুই থাক আমি গেলাম।
- এই এখন পালাচ্ছিস কেনো? দাঁড়া, দাঁড়া বলছি।
ভাইয়া তার ঘরের দিকে দৌড় দিলো। আমিও ওর পেছন পেছন দৌড়াচ্ছি। আজকে ধরতে পারলে সত্যি সত্যিই মেরে আলুভর্তা বানিয়ে দেবো।
Tum mere ho iss pal mere ho
Kal shayad ye alam naa rahe
Kuch aisa ho tum tum naa raho
Kuch aisa ho hum hum na rahe
Yeh raaste alag ho jaaye
Chalte chalte hum kho jaaye
Main phir bhi tumko chahunga
Main phir bhi tumko chahunga (×2)
সেই কখন থেকে ভারসিটির ক্যান্টিনে বসে আছি। এমুহূর্তে বিরক্তির সর্বোচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করছি আমি। একরাশ বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমার সামনে বসে থাকা সারার দিকে। সে চেহারায় দুঃখী দুঃখী ভাব এনে আরিজিৎ সিং এর গান শুনে চলেছে। এই নিয়ে সাতবার একটা গানই বাজিয়ে চলেছে তার মোবাইলে। গানের লিরিক্সগুলো মুখস্ত হয়ে গেছে আমার। নিজের নাম ভুলে গেলেও যেতে পারি কিন্তু গানের লিরিক্সগুলো কোনোদিনো ভুলবো না আমি। আমার মনে হচ্ছে মোবাইলেরও যদি প্রাণ থাকতো তাহলে এতক্ষণে সারার গালে ঠাস ঠাস করে চড় মেরে বলতো অন্য কোনো গান চোখে দেখিস না নাকি? এই এক গান প্লে করতে করতে বোরিং লাগছে আমার। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাই বেচারা মোবাইল বাবাজি সারার নির্দেশ অনুযায়ী এই গানটাই প্লে করে চলেছে বারবার।
আর চুপচাপ বসে থাকতে পারছি না আমি। কেমন যেনো বমি বমি পাচ্ছে আমার। কোনোকিছুর উপর খুব বেশি বিরক্ত হয়ে গেলেই আমার বমি পায়। যদিও শেষ পর্যন্ত বমি করা হয়ে উঠে না আর। তাই হয়তো এবারেও হবে না। কিন্তু এভাবে একজায়গায় বসে থাকাটাও আমার পক্ষে সম্ভব নয় আর। তাই সারাকে বললাম
- আর কতক্ষণ?
- কি, আর কতক্ষণ?
- ওফ, আর কতক্ষণ চলবে তোর এসব পাগলামী?
- তোর কাছে এটা পাগলামী মনে হচ্ছে?
- তা নয়তো কি।
- তোর মধ্যে কি ইমোশন বলতে কিছু নেই, মেঘা? তোর কি একটুও কান্না পাচ্ছে না?
- আরে আজব তো, শুধু শুধু কোনো কারণ ছাড়া কান্না পেতে যাবে কেনো?
- সেটাই তো। কোনো কারণ ছাড়া কান্না পাবে কেনো। কিন্তু আমার অনেক কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার যদি একটা এক্স থাকতো!
- পাগলের মতো কিসব আবোল তাবোল বকছিস তুই? কান্না পাওয়ার সাথে এক্সের কি কানেকশন?
-আছে আছে কানেকশন আছে। আরিজিৎ সিং এর গান শুনলে এক্স না থাকলেও এক্সের জন্য কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া কাঁদলে তো লোকে পাগল বলবে। তাই ভাবছি একটা এক্স থাকলে নাহয় তার জন্য কাঁদতে পারতাম আমি।
- বাহ বাহ মানুষ হাঁসার জন্য কারণ খুঁজে আর তুই কাঁদার জন্য কারণ খুঁজছিস। মানতে হবে তুই একটা এক্সট্রা-ওরডিনারি মেয়ে। তোকে তো নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিৎ।
- তুই আমার প্রসংশা করছিস নাকি অপমান করছিস বলতো?
- তোর যেটা মনে হয় সেটাই। এনিওয়ে, এতই যখন এক্সের সখ, তখন এতো এতো ছেলেরা যে প্রপোজাল দেয় সেখান একটা এক্সেপ্ট করে নিতে পারিস না?
- মনের মতো কাউকে পেলে না করবো?
- এসব ফিল্মি ডায়লগ বাদ দে। যত্তসব আজাইরা চিন্তাভাবনা।
আমাদের কথার মাঝেই ফুয়াদ ভাইয়া উনার বন্ধুদের সাথে ক্যান্টিনে প্রবেশ করলেন। উনার বন্ধুদের মধ্যে আছেন তানভীর ভাইয়া, নয়ন ভাইয়া আর ফয়সাল ভাইয়া। উনারা চারজনেই যে অনেক ক্লোজ ফ্রেন্ড সেটা উনাদের দেখলেই বোঝা যায়। ভারসিটিতে সবসময় একসাথেই থাকেন।
সেদিনের পর থেকে ফুয়াদ ভাইয়াকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি আমি। উনাকে দেখলেই শুধু আই ওয়ান্ট মালিহাকথাটা মনে পরে যায় আমার। ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। উনার দিকে তাকালেই মনে হয় ছুটে গিয়ে বলি ভালোবাসি, ভালোবাসি। কিন্তু এমনটা আর কখনোই করতে চাই না আমি। উনার প্রতি কিছুতেই দুর্বল হওয়া চলবে না আমার। আচ্ছা ফুয়াদ ভাইয়া কি বুঝতে পারছেন না যে আমি উনাকে ইগনোর করছি? একটুও কি খারাপ লাগছে না উনার?
ধুর, আমিও যে কি ভাবছি। উনাকে আমি ইগনোর করছি কিনা সেটা নিয়ে ভাবার সময় আছে নাকি উনার। উনি তো এটাই চেয়েছিলেন যেনো আমি আর উনার পিছনে পরে না থাকি। তাই উনার খারাপ লাগবে কেনো? উনার তো খুশি হওয়ার কথা।
ফুয়াদ ভাইয়া আর উনার বন্ধুরা আমাদের পাশের টেবিলে এসে বসলেন। আমি আর সেদিকে তাকাচ্ছি না। উনাদের মধ্য থেকে তানভীর ভাইয়া আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
- কেমন আছো মেঘা?
- আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা?
- আমরাও ভালো আছি। তোমরা এখানে কি করছো?
- ক্যান্টিনে মানুষ কি করতে আসে ভাইয়া?
- ওপস, সরি। ক্যান্টিনে তো সবাই খেতেই আসে। তোমাদের খাওয়া শেষ?
- না। এখনো শেষ হয়নি।
- তুই কি এখন বসে বসে ওর সাথে কথা বলবি নাকি কিছু অর্ডার করবি?
ফুয়াদ ভাইয়ার কথায় তানভীর ভাইয়া চুপচাপ খাবার অর্ডার করতে চলে গেলেন। একটু পর ফিরে এসে আবার একই জায়গায় বসলেন উনি। আমাদের খাবার এসে পড়েছে। তাই চুপচাপ খাচ্ছি আমি আর সারা। আড়চোখে ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি বন্ধুদের সাথে কথা বলছেন কিন্তু তানভীর ভাইয়া আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তানভীর ভাইয়ার বিহেভিয়ারে মাঝে মাঝে প্রচুর অস্বস্থিতে পরে যাই আমি।
আমার অস্বস্থিটা কাউকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য খুব মনোযোগে খাচ্ছি। এতটা মনোভাব বোধহয় ফিজিক্স ক্লাসেও কোনোদিন দেইনি আমি। তাহলে হয়তো সর্বোচ্চ নাম্বার পেতে পারতাম৷ হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলেন তানভীর ভাইয়া। আমার কপালের উপরে পরে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিলেন উনি। উনার এমন কান্ডে আমিসহ বাকি সবাইও অবাক হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এখন উনি নিজের মধ্যে নেই। যখন উনি বুঝতে পারলেন কি করে ফেলেছেন তখন তারাতাড়ি করে নিজের দৃষ্টি নামিয়ে ফেললেন। আমতা আমতা করে বললেন
- সরি সরি আই এম এক্সট্রিমলি সরি। আমি আসলে বুঝতে পারি নি। আমি ভাবলাম চুলগুলো কপালে পড়ে থাকায় তোমার হয়তো প্রবলেম হচ্ছে। তাই….
উনি আর কিছু না বলে চুপ করে গেলেন। সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে। হয়তো ভাবছে আমি এখন কেমন রিয়েকশন দেবো? কিন্তু আমি মুচকি হেঁসে বললাম
- ইটস ওকে ভাইয়া। আমি কিছু মনে করি নি।
আমার এমন উত্তরে যেনো জান ফিরে পেলেন উনি। হন্তদন্ত হয়ে বলে উঠলেন
- থেঙ্ক ইউ সো মাচ। আমি জানতাম তুমি কিছু মনে করবেন না। এজন্যই তো তোমাকে আমার এতো ভালো লাগে।
তানভীর ভাইয়ার কথায় অবাক হয়ে বললাম
- মানে?
- না মানে কিছু না।
বিরাট একটা শব্দ কানে আসতেই সবাই সামনে তাকালাম। ফুয়াদ ভাইয়া উনার চেয়ারটা লাথি মেরে ফেলে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন ক্যান্টিন থেকে। ফুয়াদ ভাইয়ার এমন আচরণে সবাই মিলে আরেক দফা অবাক হলাম। অবাকের রেশ কাটিয়ে তানভীর ভাইয়ারাও দৌড়ে গেলেন উনার পিছু পিছু।
আমি বসে বসে ভাবছি ফুয়াদ ভাইয়ার রাগের কারণটা কি। কিন্তু আমার মাথায় এমন কিছুই আসছে না যার কারণে উনি রেগে গেলেন। সারার কথায় ভাবনার সুতো ছিড়লো আমার
- আজকে সবাই এমন অদ্ভুত বিহেভ করছে কেনো রে?
- সেটা আমি কিভাবে জানবো?
- সেটাও ঠিক। কিন্তু তানভীর ভাইয়ার ব্যবহারে কেমন অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি।
- তোর নাক পচে গেছে হয়তো। নাহলে ব্যবহারেরও গন্ধ হয় নাকি।
- ধুর, হেয়ালি ছাড় তো। বলছি তানভীর ভাইয়াকে আজ কিন্তু অন্নেক ড্যাসিং লাগছিলো।
- তো আমি কি করবো? উনার জন্য কি মিস্টার ওয়ার্লডের প্রতিযোগিতার আয়োজন করবো?
- এতো রেগে যাচ্ছিস কেনো? তানভীর ভাইয়াও কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়ার থেকে কম হ্যান্ডসাম না।
- উনি ফুয়াদ ভাইয়ার থেকে বেশি হ্যান্ডসাম না কম হ্যান্ডসাম এটা দিয়ে আমি কি করবো?
- কেনো প্রেম করবি?
- উল্টাপাল্টা কথা বলা বন্ধ করবি সারা? আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে আর কখনো কারো তুলনা করবি না।
ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম ক্যান্টিন থেকে। সারার এসব কথা শুনে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। সে আমাকে পিছন থেকে ডেকেই চলেছে। কিন্তু আমি কথা বলছি না। সারাকে মাথার উপর তুলে একটা আছাড় মারতে পারলে বোধহয় শান্তি পেতাম।
হাটতে হাটতে হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লাগলো আমার। আমি তারাতাড়ি সরে দাঁড়ালাম। কিন্তু একি আমি তো ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে ধাক্কা খেয়েছি দেখছি। কিছু বুঝার আগেই আমায় থাপ্পড় মারলেন উনি। আমি উনার দিকে তাকিয়ে আছি। এই সামান্য একটা কারণে ভারসিটির সবার সামনে আমায় থাপ্পড় মারলেন উনি?
- সারাক্ষণ শুধু ছেলেদের ইম্প্রেস করার ধান্দা তাই না? এতোটা নির্লজ্জ কেনো তুই? ছেলেদের গায়ের উপরে পড়তে এতো ভালো লাগে তোর? থার্ডক্লাস মেয়ে কোথাকার।
ফুয়াদ ভাইয়ার বলা শেষ কথাটায় মাথায় রক্ত উঠে গেলো আমার। সবার সামনেই উনার কলার ধরে বলতে লাগলাম
- কি বললেন আপনি? আমি থার্ডক্লাস মেয়ে? কি করেছি আমি যে আপনি আমাকে থার্ডক্লাস মেয়ে বলছেন? আমি কি ইচ্ছে করে আপনার সাথে ধাক্কা খেয়েছি নাকি। আচ্ছা মানলাম আমি ইচ্ছে করেই আপনার গায়ের উপর পড়েছি তাহলে আপনি কেনো ধাক্কা খেলেন আমার সাথে? সরে যেতে পারলেন না? নাকি আপনারও মেয়েদের গায়ের উপর পড়তে ভালো লাগে?
- মেঘা।
- এখন চিৎকার করছেন কেনো। অন্যের উপর খুব সহজেই মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ফেলা যায়, তাই না? আসলে কি জানেন? পুকুরের এপাশের চোর কিন্তু ওপাশের ইমামকেও চোরই মনে করে।
ভারসিটির সবাই খুব মজা নিয়েই আমাদের কথা শুনে চলেছে। উনার কলার ছেড়ে দৌড়ে চলে এলাম ভারসিটির বাইরে। আজ ফুয়াদ ভাইয়া খুব বেশি করে ফেলেছে। তাই উনার সাথে এটুকু হওয়ারই ছিলো। সবসময় আমিই কেনো সহ্য করবো। উনাকেও বুঝতে হবে আমিও প্রতিবাদ করতে পারি।
পর্ব ৭
পড়ন্ত বিকেল। সুর্য মামা জানান দিচ্ছে তার অস্ত যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বাসন্তি রঙের শাড়ি পরে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি। রাস্তার দুপাশে মস্ত বড় বড় ঝাউগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে প্রবাহিত হচ্ছে উষ্ণ বাতাস। আমার পায়ের নুপুরের শব্দের সাথে বাতাসের শব্দ মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছে এক অন্যরকম সুর। এককথায় রোমাঞ্চকর একটা পরিবেশ।
এরকম পরিবেশে প্রিয়জনের সাথে থাকতে পারাটা অনেক আনন্দের। তাই আমিও আনন্দিত। আমার পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন ফুয়াদ ভাইয়া। উনার গায়েও বাসন্তি রঙের পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীর বুকের দিকটায় লাল রঙের সুতার কাজ করা যেমনটা আছে আমার শাড়ীর আঁচলে। চুপচাপ হেঁটে চলেছি দুজন। দুজনের নিরবতাটাই যেনো বলে দিচ্ছে একে অপরের না বলা কত কথা।
হঠাৎ করেই ফুয়াদ ভাইয়া আরো কাছে এসে আমার একটা হাত নিয়ে নিলো নিজের হাতের দখলে। সাথে সাথে কেঁপে উঠলাম আমি। এক অন্যরকম ভালোলাগা ছেয়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়ে। ইশ! ভালোবাসার মানুষটার এতটা কাছে আসলে বুঝি এমনই ভয়ানক অনুভুতি হয়?
আমি নির্লজ্জের মতো উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। শেষ বিকেলের সুর্যের লাল আভায় উনার ফর্সা মুখ জ্বলজ্বল করছে। এক অদ্ভুত মায়া ভেসে উঠছে উনার মুখে। আজ মনে হচ্ছেমায়াবী শব্দটাও উনার জন্য ব্যবহৃত হতে পেরে নিজেকে ধণ্য মনে করছে। আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি সেটা ফুয়াদ ভাইয়া ঠিকই বুঝতে পেরেছেন কিন্তু কিছু বলছেন না। নিরবতা কাটিয়ে আমিই প্রশ্ন করলাম
- আমরা কোথায় যাচ্ছি?
উনি সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন
- যাওয়ার পরেই দেখতে পারবি।
- প্লিজ বলুন না কোথায় যাচ্ছি।
- তুই কি আমায় বিশ্বাস করিস না?
- এমা না না। আমি আপনাকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।
- কেনো করিস?
- ভালোবাসি তাই।
আমার উত্তরে উনি মুচকি হাঁসলেন শুধু। কিছু বললেন না। আমিও আর প্রশ্ন করলাম না। কিছু কিছু সময় পরিবেশটা নিরব থাকলেই ভালো লাগে।
হঠাৎ কানে এলো মিষ্টি একটা মেয়েলি কন্ঠ। কেউ আমার নাম ধরে ডেকে চলেছে পেছন থেকে। আমরা দুজনেই পিছনে তাকালাম। এই মেয়েটা আর কেউ না, আমার আপু। সেও ঠিক আমার মতই সাজিয়েছে নিজেকে।
আপুকে দেখেই মনের মাঝে এক অজানা ভয় সৃষ্টি হলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছে ফুয়াদ ভাইয়াকে হারিয়ে ফেলছি আমি। উনি কি আপুর কাছে চলে যাবেন? আর আমার সাথে হাঁটবেন না? আমার সাথে হাঁটতে ভালো লাগছে না উনার? নাকি উনার ভালোলাগাটুকু আপুর মাঝেই নিহিত? না আর ভাবতে পারছি না আমি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। ভাবনাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে মাথায়। এ কেমন অসহ্যকর অনুভুতি। নিজের বোনকে দেখে এতটা ভয় পাচ্ছি কেনো আমি?
আপু আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি শক্ত করে জরিয়ে ধরলাম ফুয়াদ ভাইয়ার হাত। আপু আলতো করে নিজের হাতটা রাখলো আমার গালে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেই চলেছে
- এই মেঘা, মেঘা। চোখটা খোল নারে বাবু। আমার দিকে তাকা। আরে তুই শুনতে পারছিস? আরে তাকা না আমার দিকে।
আপু এমন অদ্ভুত কথা বলছে কেনো? আমি তো তার দিকেই তাকিয়ে আছি। কই, আমার চোখ তো বন্ধ নয়। চোখ যদি বন্ধই না থাকে তাহলে খোলবো কি করে? আমাকে ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে দেখে কি আপু পাগল হয়ে গেছে? এতক্ষন আস্তে আস্তে কথা বললেও এবার আমার নাম ধরে জোরে চিৎকার করলো আপু।
চোখ পিটপিট করে তাকালাম আমি। একি, আমি তো আমার বিছানায়। আমার গায়ে তো শাড়ী নেই। আর না আমার পাশে আছে ফুয়াদ ভাইয়া। এবার আপুর দিকে তাকালাম। আপুও তো শাড়ী পড়ে নি। তারমানে এতোক্ষন আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? হ্যাঁ, স্বপ্ন বলেই তো ফুয়াদ ভাইয়া এতো ভালো বিহেভ করছিলো আমার সাথে। বাস্তবে যেটা কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু এটা আমার জীবনের বেস্ট স্বপ্ন ছিলো। আপুর কথায় স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করা বাদ দিলাম আমি।
- কিরে ঘুম শেষ হয়েছে?
- হুম।
- দুপুরে খাওয়ার পরে কেউ এভাবে রাতের মতো ঘুমায়?
- আমি ঘুমাই।
- বুঝলাম। এবার চল তারাতাড়ি রেডি হো।
- কেনো আমরা কি কোথাও যাচ্ছি?
- হ্যাঁ, সবাই না। শুধু তুই আর আমি।
- কোথায়?
- সেটা গেলেই বুঝতে পারবি। প্লিজ না করিস না?
আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম
- ঠিক আছে তুমি রেডি হও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
একটুপর রেডি হয়ে আপুর ঘরে গেলাম। আপু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে কাজল দিচ্ছে। আমি যেতেই আমার দিকে কাজলটা বারিয়ে দিয়ে বললো
- নে তুইও লাগিয়ে নে।
- আমার প্রয়োজন নেই। তুমি তো জানো আমার কাছে সাজতে ভালো লাগে না।
- তাই বলে সামান্য কাজল লাগানো যাবে না?
- যাবে তো। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে না। প্লিজ আপু জোর করো না।
- ঠিক আছে তোর যা ইচ্ছা।
সেই কখন থেকে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি আমি আর আপু। এখনে এভাবে বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না আমার। কিন্তু আপুকে কিছু বলতেও পারছি না। আপু বললো কেউ একজন আসবে তার জন্য অপেক্ষা করতে।অপেক্ষা শব্দটা কোনো কালেই পছন্দ নয় আমার। তার উপর এমন একটা জায়গায় কারো জন্য অপেক্ষা করাটা আরো বেশি অপছন্দের।
প্রত্যেকটা টেবিলেই কাপলসরা বসে আছে। শুধুমাত্র আমাদের টেবিলেই আমরা দুবোন বসে আছি। এত্ত এত্ত কাপলের মাঝে আমাদের দুবোনকে বেমানান লাগছে নিশ্চই। কেউ যে কারণেই হাঁসছে না কেনো আমার কাছে মনে হচ্ছে আমাদের দেখেই হাঁসছে। কিন্তু আপুর অন্য কোনো দিকে নজর নেই। সে রেস্টুরেন্টের ছাদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে আর মুচকি মুচকি হাঁসছে। বুঝলাম না, ছাদে কি কোনো কমেডি শো চলছে? কিন্তু আমি তো দেখতে পারছি না।
আমার চোখ আটকে গেলো রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে। রেস্টুরেন্টে ঢুকছে ফুয়াদ ভাইয়া। একদম কালো গেটাপ। দুধসাদা শরীরে কালো রঙটা অনেক সুন্দর মানিয়েছে। কিন্তু উনি এখানে কি করছেন? আপুর দিকে তাকিয়ে দেখি সে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার মানে আমরা এতোক্ষণ ফুয়াদ ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
ফুয়াদ ভাইয়া এগিয়ে এসে বললো
- সরি, একটু দেরি হয়ে গেলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে ফেলি নি তো তোমাকে?
- না না ঠিক আছে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি শুধু। এই প্রথম ফুয়াদ ভাইয়ার মুখ থেকে আপুকে তুমি করে ডাকতে শুনলাম। আগে তো উনি আমাদের দুজনকেই তুই করে ডাকতেন। তারমানে উনি আপুর সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।
এখন এই দীর্ঘশ্বাসটাই আমার সঙ্গী। ফুয়াদ ভাইয়া বোধ হয় এতক্ষণ খেয়াল করেন নি আমায়। কিন্তু যখন আমার দিকে তাকালেন তখনই রাগে লাল হয়ে গেলো উনার চোখ। উনি রাগটাকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন
- ও এখানে কি করছে, মালিহা?
- না মানে আমার সাথে এসেছে।
- কেনো?
- আমিই নিয়ে এসেছি।
- কেনো? একা আসলে কি হতো? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে তুমাকে খেয়ে ফেলতাম।
- না আসলে আমার একা আসতে কেমন লাগছিলো। তাই ভাবলাম মেঘাকে নিয়ে আসি।
- আমাদের কি কোনো প্রাইভেসি নেই? আমাদের দুজনের মধ্যে থার্ড পারসন হিসেবে ওকে নিয়ে আসা কি খুব জরুরী ছিলো?
ফুয়াদ ভাইয়া যে আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করছেন তা বেশ বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু কিছু বলছি না। আপুর সামনে আমি কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না।
- ও নিজেই নিশ্চই তোমার সাথে এসেছে? আমার তো এটাই মনে হচ্ছে। সত্যি, মানুষ এতোটা ছেচড়া কি করে হতে পারে?
- না না আপনি ভুল বুঝছেন। ওতো জানতোই না যে আমরা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।
- মিথ্যা বলে লাভ নেই। আমি সব বুঝতে পারছি।
আপু আর ফুয়াদ ভাইয়ার কথার মাঝেই তানভীর ভাইয়ার গলা শুনা গেলো।
- আরে ফুয়াদ, তুই এখানে কি করছিস?
- এসেছি একটা কাজে। এবার বল তুই এখানে কি করছিস?
- আমি তো এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম কিন্তু তোকে দেখে ভেতরে ঢুকলাম।
- ওহ।
এবার তানভীর ভাইয়া আপুর দিকে তাকিয়ে বললেন
- আই থিঙ্ক, তুমি মালিহা। মেঘার বোন। এম আই রাইট?
- জ্বি।
- বুঝতেই পারছিলাম। তোমাদের চেহারার মিল আছে। এনিওয়ে মেঘা, মালিহা নাহয় ওর উডবির সাথে দেখা করতে এসেছে। তুমি কেনো এসেছো?
আমি কিছু বলার আগেই ফুয়াদ ভাইয়া বললেন
- কেনো আবার। অন্যের প্রাইভেসি নষ্ট করতে।
এতোক্ষণ ধরে সব সহ্য করলেও এবার আর রাগটা ধরে রাখতে পারলাম না। একটা বাইরের লোকের সামনে উনি আমাকে অপমান করে চলেছেন। আমি চিৎকার করে বললাম
- শেষ হয়েছে বলা? শান্তি পাচ্ছেন এখন? আমাকে অপমান করে কি লাভ হয় আপনার? সেই কখন থেকে বলেই চলেছেন। আরে আপু যে বলছে আমি জানতামও না যে আপনি এখানে আসবেন। সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না? সত্যি বলছি, আমি যদি জানতাম যে এখানে আপনার সাথে দেখা হবে তাহলে কখনোই আসতাম না। ট্রাস্ট মি, আপনার এই মুখটা দেখার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।
আপু আমাকে থামাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি থামছি না। রেস্টুরেন্টের সবার দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে। বাঙালির এই এক স্বভাব, কোথাও কোনো ঝামেলা হচ্ছে আর তারা সেদিকে তাকাবে না সেটা তো হতে পারে না। এক পর্যায়ে তানভীর ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো
- তোরা কথা বল। আমি মেঘাকে নিয়ে যাচ্ছি।
তানভীর ভাইয়ার একথা শুনে যেনো ফুয়াদ ভাইয়া আরো রেগে গেলেন। আপুকে কিছু একটা বলে খুব দ্রুত বেরিয়ে গেলেন রেস্টুরেন্টের বাইরে৷ উনি বাইক নিয়ে এসেছিলেন বলে বাইকে উঠে হাই স্পিডে চলে গেলেন। সবাই চুপ করে আছে। তানভীর ভাইয়া আমাকে বললেন
- বুঝতে পারছি না ফুয়াদ ইদানিং এমন অদ্ভুত বিহেভ করছে কেনো? তুমি মন খারাপ করো না।
আমি কিছু বললাম না৷ আপু আমার কাছে এসে বললো
- এতোটা সিনক্রিয়েট না করলেও পারতি। অন্তত আমার জন্য হলেও চুপ করে থাকতি। তোর থেকে এটা আশা করি নি আমি।
আপুর কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমি সিনক্রিয়েট করেছি? অথচ ফুয়াদ ভাইয়া যে আমাকে অপমান করলো সেটা চোখে পরলো না আপুর? আজকাল আপুও কেমন হয়ে যাচ্ছে।
বাসায় আসার পর থেকে আমার সাথে একটা কথাও বলছে না আপু। বুঝতে পারছি না ওখানে আমার দোষটা কি ছিলো। মন খারাপ করে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি। এখন মনে হচ্ছে এরকমটা না করলেও পারতাম। আবার মনে হচ্ছে যা করেছি ঠিকই করেছি। আচ্ছা, আমি কি আজকাল ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে বেশি রুড বিহেভ করে ফেলছি?
ফোনের রিংটোনে ধেয়ান ভাঙলো আমার। এটাতো ফুয়াদ ভাইয়ার নাম্বার। উনি আমায় ফোন করছেন কেনো? ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত কেউ একজন বলে উঠলো
- আপনি কি মেঘা বলছেন?
- জ্বি।
ফুয়াদ আপনার কি হন?
- জি আমার খালাতো ভাই।
- ওহ। আপনি তারাতাড়ি একটু সিটি হসপিটালে চলে আসুন।
- কেনো?
- মিস্টার ফুয়াদের এক্সিডেন্ট হয়েছে।
লোকটার কথা শুনে শরীর কাঁপছে আমার। মাথায় শুধু ঘুরছে আমাকে হস্পিটালে যেতে হবে। কোনোভাবে ছাদ থেকে নেমে এলাম আমি।
পর্ব ৮
হাসপাতালের করিডোরে বসে আছি সবাই। সবার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। কেউ কিছু বলছে না। হয়তো কি বলা উচিৎ সেটাই বুঝতে পারছে না। নয়ন ভাইয়া, ফয়সাল ভাইয়া আর তানভীর ভাইয়া গেছে ডক্তারের সাথে কথা বলতে। যে লোকটা আমাকে ফোন করেছিলেন তিনিও আমাদের সাথেই আছেন। তার বর্ণণানুসারে ফুয়াদ ভাইয়া অনেক স্পিডে বাইক চালাচ্ছিলেন আর তখনই একটা প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা খান।
এককোণে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছি আমি। আমার পাশেই বসে আছে আপু। আপু বরাবরই একটু বেশি ইমোশনাল। একটুকিছুতেই কেঁদে কেঁদে গা ভাসিয়ে দেয়। স্বভাবানুসারে এখনও চুপ করে চোখের পানি ফেলে চলেছে সে।
- কেনো করলি এরকম? তখন যদি তুই এমনটা না করতি তাহলে উনি এতো স্পিডে বাইক চালাতো না আর এক্সিডেন্টও হতো না। এখন ভালো লাগছে তোর?
আপুর কথায় কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই আমার। সত্যিই তো, আমিই ফুয়াদ ভাইয়ার এক্সিডেন্টের জন্য দ্বায়ী। আমি তো জানতাম ফুয়াদ ভাইয়ার রাগ অনেক বেশি। তবু্ও তখন কেনো যে এমন করলাম।
তানভীর ভাইয়ার ডাকে আমরা সবাই সামনে তাকালাম। নয়ন ভাইয়া আর ফয়সাল ভাইয়ার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। উনার মাথায় আর পায়ে ব্যান্ডেজ করা। খালামনি দৌড়ে গেলেন ফুয়াদ ভাইয়ার কাছে। কান্না করতে করতে বললেন
- তুই ঠিক আছিস তো বাবা?খুব লেগেছে না? কেনো যে এই বাইক নিয়ে পরে থাকিস? আজকে যদি তোর কিছু একটা হয়ে যেতো তাহলে আমি আর তোর বাবা কি করতাম?
- ওফ মা কান্নাকাটি থামাও তো। কিছু হয় নি আমার। শুধু মাথায় আর পায়ে একটু লেগেছে।
ফয়সাল ভাইয়া বললেন
- হ্যাঁ আন্টি, টেনশন করবেন না। বেশি কিছু হয়নি। ডাক্তার বলেছে একটু রেস্ট নিলেই পায়ের আর মাথার ক্ষত ভালো হয়ে যাবে। ব্যাস এটুকুই।
ফয়সাল ভাইয়ার কথা শুনে সবাই একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিলো যেনো।ফুয়াদ ভাইয়াকে নিয়ে খালামনিদের বাসায় চলে এলাম সবাই। এর মধ্যে আমি একবারও ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। কি করে তাকাতাম? আমি।নিজেই তো এর জন্য দ্বায়ী। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস আমার নেই। মা আর ভাইয়া বাসায় চলে গেছে। খালামনি আমাকে আর আপুকে যেতে দেয় নি। আমরা খালামনির বাসায় থাকবো। তানভীর ভাইয়ারাও থেকে গেছে আজকের জন্য। ফুয়াদ ভাইয়া তার ঘরেই শুয়ে আছেন। সবাই উনার সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। উনি যদি আমাকে দেখে আরো উত্তেজিত হয়ে পরেন? উনার এখন উত্তেজিত হওয়া একদম ঠিক হবে না।
সবাই একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে। ফুয়াদ ভাইয়া নাকি একটু একা থাকতে চাইছে। কিন্তু আমার যে উনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। উনি রাগ করবেন জেনেও উনার ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে। সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে পা বারালাম ফুয়াদ ভাইয়ার রুমের দিকে। কিন্তু ভেতরে ঢুকার আগেই কেউ পিছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলো। আমি পিছনে ঘুরে দেখি আপু আমার হাত ধরে আছে।
- কোথায় যাচ্ছিস?
- ফুয়াদ ভাইয়ার ঘরে।
- তোর কি একটুও বুদ্ধি নেই মেঘা?
- কেনো?
- ফুয়াদ ভাইয়া যদি তোকে দেখে আরো রেগে যান, তখন?
- তুমি কি করে জানো যে উনি রেগে যাবেন?
- এটা এমনিতেই বুঝা যায়। তখন তো তোর সাথে রাগ করেই চলে এসেছিলেন। এখন আবার তোকে দেখলে রেগে যাবেন না?
- কিন্তু আমি কোনো কথা বলবো না। শুধু দেখেই চলে আসবো।
- ওফ, তুই বুঝতে চাইছিস না কেনো? থাক তোর আর বুঝতে হবে না। তুই এখান থেকে যা।
- আপু…
- মন খারাপ করিস না। উনি রাগ না করলে আমি অবশ্যই তোকে যেতে দিতাম।
- ইটস ওকে আপু। আমি মন খারাপ করিনি।
আমি ঘরে না গিয়ে ছাদে চলে এলাম।খালামনির বাসার এই ছাদটাই আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। উনার বাসায় এসেছি অথচ ছাদে আসিনি এমন কখনো হয়নি। তবে ছাদে আসার আরেকটা বড় কারণ হলো ফুয়াদ ভাইয়া। এখানে এলে প্রত্যেকবারই উনার কোনো কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। আর আমি মন ভালো করতে চলে আসি ছাদে।
কেবল রাত আটটা বাজে। আজকে আকাশে মস্ত বড় থালার মতো একটা চাঁদ উঠেছে। জোৎস্নার আলোতে পুরো ছাদটাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ফুয়াদ ভাইয়াকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে খুব। কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই।
কারো পায়ের শব্দে পিছনে ফিরলাম। তানভীর ভাইয়া ছাদে এসেছেন। আমাকে দেখে হালকা হেঁসে পাশাপাশি এসে দাঁড়ালেন উনি।
- এতো রাতে ছাদে কি করছো?
- এতো রাত কোথায়? কেবল আটটা বাজে।
- তবুও, ভয় করে না তোমার?
- ভয় করবে কেনো?
- না অনেকেরই তো রাতে একা একা ছাদে আসতে ভয় করে।
- আমার করে না। আমি রাত বারোটায়ও একা ছাদে আসতে পারি।
- তার মানে তুমি সাহসী।
- একা ছাদে আসতে পারলেই সাহসী হওয়া যায়?
- ঠিক তা না। তোমাকে আমার কাছে সাহসী মেয়েই মনে হয়। এনিওয়ে, মন খারাপ?
- না তো।
- মিথ্যা কথা বলছো কেনো?
- আপনি কি করে জানেন আমার মন খারাপ?
- গেস করলাম। বাই এনি চান্স তুমি কি ফুয়াদের এক্সিডেন্টের জন্য নিজেকে দ্বায়ী করছো?
তানভীর ভাইয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ছলছল চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি কত সহজেই আমার মনের কথা বুঝতে পেরে গেলেন।
- তার মানে আমিই ঠিক। আরে এখানে তোমার দোষটা কোথায় বলোতো? ফুয়াদ যদি এতো জোরে বাইক চালায় তাহলে তুমি কি করতে পারো?
- কিন্তু উনি তো আমার কথা শুনেই রাগ করে এতো স্পিডে বাইক চালাচ্ছিলেন।
- ওহহো আবার এই একই কথা। তখনতো ফুয়াদও তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলো। তাই তোমার নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনো কারণ নেই। বুঝলে?
- হুম বুঝলাম।
- কিচ্ছু বোঝনি তুমি।
- আপনাকে কে বললো আমি কিচ্ছু বুঝিনি?
- কেউ বলেনি। তুমি যদি আমার কথা বুঝতে তাহলে এখনও মন খারাপ করে থাকতে না।
- আমি মন খারাপ করে নেই তো।
- তাহলে একটু হেঁসে দেখাও তো।
- আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি কোনো বাচ্চার মন ভালো করতে চাইছেন।
- যেমনই মনে হোক এখন তোমাকে হাঁসতে হবে। এটাই শেষ কথা।
- আপনি আমাকে জোর করে হাঁসাবেন নাকি।
- জোর করবো না। কিন্তু তুমি এখন না হাঁসলে আমি কেঁদে দেবো।
তানভীর ভাইয়ার এমন বাচ্চামো কথা শুনে আমি জোরে হেঁসে দিলাম। আমি হাঁসছি আর উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও হাঁসি থামিয়ে উনার দিকে
তাকালাম। উনার চোখে বিরাজ করছে একরাশ মুগ্ধতা। চাঁদের আলোতে কি স্নিগ্ধ লাগছে উনার মুখটা। উনার চোখের দিকে তাকালে যে কেউই মায়ায় পরে যাবে। চোখজোড়ার গভীরতা যে অনেক। আমি তারাতাড়ি নিজের দৃষ্টি সংযত করলাম। এই প্রথম ফুয়াদ ভাইয়া ছাড়া অন্য কোনো ছেলের দিকে এভাবে তাকালাম আমি। এখন নিজের কাছেই কেমন লাগছে আমার। কি ভাবলেন উনি।
উনি আমার কানের কাছে এসে বললেন
- চাঁদের হাঁসির সাথে আরেকটা পরীর হাঁসি দেখতে পেরে আমি নিজেকে ধণ্য মনে করছি মেডাম। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমায় এ সুযোগটা দেওয়ার জন্য। এই চাঁদনি রাতটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে।
আমি তানভীর ভাইয়ার কথার কোনো মানে বুঝতে পারছি না। এখান পরী পেলেন কোথায় উনি? কই আমি তো দেখতে পারছি না? আর আমিই বা পরী দেখার সুযোগ করে দিলাম কি করে? তানভীর ভাইয়া আর কিছু না বলে চলে গেলেন। আমি কতক্ষণ ধরে চিন্তা করেও কোনো উত্তর না পেয়ে চলে এলাম ছাদ থেকে।
রাত প্রায় দুইটা বাজে। কিছুতেই ঘুম আসছে না আমার। ফুয়াদ ভাইয়াকে দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। এখন তো উনি ঘুমাচ্ছেন। আমি যদি এই ফাকে গিয়ে উনাকে দেখে আসি তাহলে তো উনি বুঝতেও পারবেন। হ্যাঁ, এটাই ভালো হবে। মাথার কাছ থেকে ওড়নাটা নিয়ে গলায় জরিয়ে হাঁটতে লাগলাম ফুয়াদ ভাইয়ার ঘরের দিকে।
পা টিপে টিপে উনার ঘরে এসে দাঁড়ালাম আমি। ঘরের লাইটটা অফ করা। তবু্ও ঘরের সবকিছুই স্পষ্ট। আস্তে আস্তে উনার মাথার পাশটাতে গিয়ে বসলাম। উনার শ্বাসের ঘনত্ব থেকেই বুঝতে পারছি উনি গভীর ঘুমে নিমগ্ন। মাথার ব্যান্ডেজটাতে হালকা হালকা রক্তের ছোপ। রক্ত দেখেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। উনার এই অবস্থার জন্য কোনো না কোনোভাবে আমিই দ্বায়ী এটা কিভাবে মেনে নেবো আমি?
আমি উনার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আস্তে আস্তে বলতে লাগলাম
- সরি, আমি তখন এমনটা করতে চাইনি। কিন্তু রাগে মাথা ঠিক ছিলো না। আপনিই বলুন, তানভীর ভাইয়া তো একটা বাইরের লোক। হতে পারে আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড কিন্তু আমার কাছে তো একজন বাইরের লোক। আপনি উনার সামনে আমাকে অপমান করছিলেন। আমি সেটা মেনে নিতে পারিনি। তাই বলে আপনি এতো জোরে বাইক চালাবেন? আপনার কিছু হলে তো আমি মরেই যেতাম। আপনি আমায় ভালো না বাসলেও আমি তো বাসি। সেদিন বলেছিলাম আপনার প্রতি ভালোবাসাটা আর প্রকাশ করবো না তাই দেখুন এই রাতের বেলা লুকিয়ে লুকিয়ে এখানে এসেছি। আমার ভালোবাসা অপ্রকাশিত হয়েই পরে থাক কিন্তু আপনি কষ্ট পান এটা আমি কখনোই চাইনি।
কথা বলতে বলতে কখন চোখ থেকে পানি পরা শুরু করেছে বুঝতেই পারিনি আমি। তারাতাড়ি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। উল্টোদিকে ঘুরতেই হাতে অনুভব করলাম। ভয়ে বুক ধুকধুক করছে আমার। তাহলে কি ফুয়াদ ভাইয়া জেগে গেলো? উনি কি এবার অনেক রাগারাগি করবেন? কি হবে এখন? ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরলাম আমি। যা ভাবছি তাই। ফুয়াদ ভাইয়া জেগে গেছেন। তবে উনার চোখে মুখে রাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।
- এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ঘরে আসার কারণটা কি আমি জানতে পারি?
- আসলে আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই….
- তাই তুই এতো রাতে একটা ছেলের ঘরে চলে এলি।
-…………….
-কি হলো এখন কথা বলছিস না কেনো?
- আপনি রেগে যাবেন না প্লিজ। আপনার শরীরের জন্য ভালো হবে না।
- হুহ, নিজেই কষ্ট দিয়ে এখন নিজেই যত্ন করছিস?
উনার কথায় অবাক হলাম আমি।
- আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি?আমার কোন কাজে আপনি কষ্ট পেয়েছেন বলুন না। আমি তা শুধরে নিতে চেষ্টা করবো।
- রাহু…..না কিছু না। তুই তোর ঘরে যা মেঘা। কেউ দেখতে পেলে খারাপ ভাববে।
- হ্যাঁ, যাবো তো। এক্ষুনি চলে যাবো। আপনি শুধু বলুন আমার কোন কাজে আপনি কষ্ট পেয়েছেন।
- তোকে আমি যেতে বলছি না।তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? তারাতাড়ি যা।
- হুম যাচ্ছি। আপনি শুয়ে পরুন।
-সেটা তোর ভাবতে হবে না।
ধীর পায়ে হেঁটে চলে এলাম ঘরে। আপু গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমিও পাশে শুয়ে পরলাম। অনেক্ষন যাবৎ এপাশ ওপাশ করার পরও ঘুমাতে পারলাম না আমি। ঘুমানোর ব্যার্থ চেষ্টা না করে চলে গেলাম বেলকনিতে। চেয়ারে বসে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলাম বাইরে। আজ রাতটা হয়তো এভাবে নির্ঘুমই কেটে যাবে আমার।
পর্ব ৯
আজ প্রায় এক সপ্তাহ পর বাসায় ফিরলাম আমি আর আপু। ফুয়াদ ভাইয়া এখন অনেকটাই সুস্থ। একয়দিনে উনি একবারও আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন নি। করবেই বা কিভাবে? আমার সাথে তো উনার সেভাবে কথায় হয়নি। অবশ্য আমিও বেশি কোনো কথা বলার চেষ্টা করি নি। আপু আর খালামনি সবসময় ফুয়াদ ভাইয়ার আশেপাশে থাকতো। উনার কখন কি প্রয়োজন তার খেয়াল রাখতো। আমি শুধু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। কখনো ভেতরে যাওয়া হতো না।
একয়দিনে খালামনির বাসায় নয়ন ভাইয়া, ফয়সাল ভাইয়া আর তানভীর ভাইয়ার আনাগোনা লেগেই ছিলো। নয়ন ভাইয়া আর ফয়সাল ভাইয়া কখনো কখনো আসতে না পারলেও তানভীর ভাইয়া নিয়মিত আসতেন। তানভীর ভাইয়া অনেক মজার একজন মানুষ। কখনো উনার কাজে হাঁসতে হাঁসতে গড়াগড়ি খেয়েছি আবার কখনো উনার অদ্ভুত ব্যবহারে অবাক হয়েছি। তানভীর ভাইয়াকে যতটুকু চিনতে পেরেছি উনি খুব ভালো মনের একজন মানুষ।
বাসায় আসতে আসতে প্রায় সন্ধা হয়ে গেছে। আমি আমার ঘরে এসেই সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলাম ফ্রেশ হতে। ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দেখি আপু বসে আছে আমার বিছানার উপরে। আমি মুখ মুছতে মুছতে বললাম
- ফ্রেশ হওয়া শেষ তোমার?
- হুম।
- কিছু বলবে আপু?
- হ্যাঁ।
- কি বলবে, বলো?
আপু বিছানা থেকে উঠে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। আমার হাত ধরে বললো
- তুই আমার উপর রাগ করে আছিস। তাই না?
- আমি তোমার উপর রাগ করতে যাবো কেনো? তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
- তুই সত্যিই আমার উপর রাগ করিস নি?
- তোমার উপর রেগে থাকার কোনো কারণ আছে নাকি?
- আছে তো।
- কি কারণ?
- ঐ যে সেদিন আমি তোকে ফুয়াদ ভাইয়ার ঘরে যেতে দিই নি। ফুয়াদ ভাইয়ার এক্সিডেন্টের জন্য তোকে কথা শুনিয়েছি।
- আরে, তুমি এখনো এটা নিয়ে পরে আছো? আমি তো এটা কবেই ভুলে গেছি। সেদিন মাথা ঠিক ছিলো না তোমার। তাই কি বলতে কি বলেছো তুমি নিজেই বুঝতে পারো নি। আর ফুয়াদ ভাইয়ার ঘরে তো ভালোর জন্যই যেতে দাও নি। আমাকে দেখলে হয়তো উনি রেগে যেতেন যেটা উনার শরীরের জন্য ভালো হতো না। তাই তো তুমি আমায় উনার ঘরে যেতে দাও নি। এখানে রাগ করার কি আছে?
- আমি জানতাম তুই ঠিকই বুঝতে পারবি।
- দেখতে হবে না বোনটা কার? সে যাই হোক, আর কিছু বলবে?
- হ্যাঁ, আরেকটা কথা বলার ছিলো।
- তো বলে ফেলো।
- না মানে কিভাবে যে বলবো?
- ওহ মাই গড, তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছো আপু?
আপু কোনো কথা না বলে উল্টো দিকে ঘুরে গেলো। আপু যে কিছু একটা নিয়ে লজ্জা পাচ্ছে সেটা বেশ বুঝা হয়ে গেছে আমার। আমিও কিছু না বলে আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কারণ আমি যদি এখন আপুকে কথাটা বলার জন্য ফোর্স করি ও সেটা জীবনেও বলতে পারবে না। তার থেকে বরং লজ্জা কাটিয়ে নিজে থেকেই বলুক।
আপু অনেক্ষন যাবৎ আঙুল মুচরামুচরি করে কথাটা বলার জন্য সাহস অর্জন করলো। আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না যে কি এমন কথা যার জন্য এতোকিছু। আপু চট করেই বলে ফেললো
- আমি ফুয়াদ ভাইয়াকে বিয়ে করতে রাজি।
- মানে?
- আরে আমি বলেছিলাম না যে ফুয়াদ ভাইয়ার ফাইনাল এক্সাম পর্যন্ত দেখবো উনার রাগ সামলাতে পারবো কিনা?
- হ্যাঁ, বলেছিলে।
- আমার মনে হয় উনার ফাইনাল এক্সাম পর্যন্ত আর অপেক্ষা করতে হবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমি ফুয়াদ ভাইয়াকে বিয়ে করতে রাজি।
আপুর কথা শুনে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি তো আগে থেকেই এটা মেনে নিয়েছিলাম তবু্ও কেনো এতো খারাপ লাগছে আমার? আমি ছোট করে উত্তর দিলাম
- ওহ। তাহলে তুমি এটা আমায় বলছো কেনো? মা
-বাবাকে বলো। তারাই তো তোমার মতামত জানতে চাইছিলো। - ধুর, তুই কি পাগল? আমি নিজে গিয়ে মা-বাবাকে কি করে বলবো?
- তাহলে কে বলবে?
- কে আবার, তুই।
- আমি বলবো?
- হ্যাঁ, তুই মা-বাবাকে গিয়ে বলবি যে আমি এই বিয়েতে রাজি। প্লিজ প্লিজ না করিস না। দেখ আমি তোর কাছেই কথাটা বলতে কতটা সময় নিয়েছি। তাহলে মা-বাবাকে কি করে বলবো? প্লিজ তুই একটু বলে দে।
- আচ্ছা ঠিক আছে বলবো।এবার খুশি?
- অনেক খুশি। এই জন্যই তো তোকে আমি এতো ভালোবাসি।
আপু চলে যাওয়ার পর বিছানায় এসে বসলাম আমি। ফোনটা হাতে নিয়ে গেলারীতে ঢুকলাম। ফুয়াদ ভাইয়ার ছবিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছি। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পরছে আমার। তারমানে ফুয়াদ ভাইয়াকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম আমি। উনি সত্যি সত্যিই আপুকে বিয়ে করে ফেলবেন। কিন্তু আমি কি করবো? যাকে ভালোবাসি তার সাথেই নিজের বোনকে কি করে সহ্য করবো?
রাতে খাবার টেবিলে বসে আছি আমি, আপু, ভাইয়া আর মা-বাবা। সবাই চুপচাপ খাবার খাচ্ছি। এটা আমার বাবার কড়া নিষেধ। খাওয়ার সময় নো কথা-বার্তা। আর আমরাও বাধ্য সন্তানের মতো বাবার এই নিষেধ মেনে চলি। আপু সেই কখন থেকে আমাকে ইশারা করে চলেছে যেনো কথাটা বলি।
খাওয়া- দাওয়া শেষে বাবা – মাকে বললাম আমি কিছু বলতে চাই। আমার কথা শুনার জন্যই তারা তখন থেকে বসে আছে। কিন্তু আমিও কথাটা বলতে পারছি না। তবে সেটা আপুর মতো লজ্জায় নয় কষ্টে। অনেক্ষন ধরে নিজেকে সামলে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললাম
- তোমরা ফুয়াদ ভাইয়া আর আপুর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছিলে না বাবা?
- হ্যাঁ বলছিলাম। কিন্তু মালিহা তো ওর কোনো সিদ্ধান্ত জানায় নি আমাদের।
- বাবা, আপু এই বিয়েতে রাজি।
- তুমি কি করে জানো মেঘা?
- আপু নিজেই বলেছে।
আপুর দিকে তাকালো বাবা। আপু চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা কোনো ভণিতা না করেই বললো
- মেঘা যা বলছে তা কি ঠিক মালিহা?
আপু মাথা নিচু করেই উত্তর দিলো
- হুম।
- আলহামদুলিল্লাহ, এটা তো ভালো কথা। আপাকে এক্ষুনি জানানো দরকার।
আপুর এই উত্তরে যেনো আনন্দের সাগর মিশে ছিলো। তাইতো সবাই কত খুশি হয়েছে। যেখানে পরিবারের সবাই খুশি সেখানে আমারও নিশ্চই খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু আমি চাইলেও যে খুশি হতে পারছি না। সবাই যখন আনন্দ করতে ব্যাস্ত আমি তখন হুহু করে কেঁদে দিলাম। আমার কান্নায় সবাই অবাক হয়ে গেছে। হয়তো এখানে কাঁদার কি কারণ সেটাই বুঝতে পারছে না তারা। ভাইয়া তারাতাড়ি আমার কাছে এসে বললো
- কি হয়েছে মেঘা? তুই কাঁদছিস কেনো?
কান্নার ফলে কথা বলতে পারছি না আমি। কান্নাগুলো গলায় দলা পেকে যাচ্ছে আমার। ধরা গলায় কোনোমতে বললাম
- কিছু হয়নি।
- কিছু হয়নি মানে? কোনো কারণ কি তুই কাঁদছিস নাকি।
আমি ভাইয়াকে জাপটে ধরলাম। কান্নার গতি আরো বেড়ে আমার। বাবা-মা আর আপুও কান্নার কারণ জানতে চাইছে। কিন্তু আমি কি করে আসল কারণটা বলবো?
- কিছু হয়নি আমার। আসলে আপুর বিয়ে হয়ে গেলে তো আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যাবে তাই কান্না পাচ্ছে।
আমার কথায় মা বললো
- ধুর পাগলী মেয়ে। মালিহা কি একেবারে চলে যাবে নাকি। আপার বাসা তো বেশি দুরে নয়। ওর যখন ইচ্ছা এখানে আসবে আর তোর যখন ইচ্ছা ওখানে চলে যাবি। বুঝলি?
আমি মাথা নাড়লাম শুধু। ভাইয়া বললো
- এই ছোট একটা কারণে কাঁদছিস? আর আমি ভাবলাম কি না কি?
আমি এখনো ভাইয়াকে জরিয়ে ধরেই বসে আছি। ভাবছি আপুর জন্য কাঁদছি ভেবে সবাই কত সহজে কান্না না করার সমাধান দিয়ে দিলো। আমার কাঁদার আসল কারণ জানতে পারলে কি এভাবেই সমাধান করে দিতো সবাই? কে জানে?
ভারসিটির লাইব্রেরিতে বসে আছি আমি। সারা আজকে কোনো এক বিশেষ কারণে ভারসিটি আসে নি। তাই আমার মনটা লবণ ছাড়া তরকারির মতো হয়ে আছে। ভাবলাম কোনো বই পড়ে মনের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করি। সেই কখন থেকে বইগুলো দেখে চলেছি কিন্তু কোনটা পড়বো বুঝে উঠতে পারছি না।
অবশেষে একটা বই হাতে নিলাম পড়বো বলে। বইটা নিয়ে টেবিলে বসার জন্য জায়গা থেকে সরে আসতেই একটা কাঁচ ভাঙার শব্দ এলো কানে। পিছনে ঘুরে দেখি একটা কাঁচের বোতল ভেঙে পড়ে আছে নিচে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে দেয়ালের সাথে লেগে ভেঙে গেছে বোতলটা। আমি যেই জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক সেই জায়গায় পড়ে আছে। তারমানে আমি আরেকটু পরে সেখান থেকে আসলেই আমার মাথায় লাগতো বোতলটা। কিন্তু এই লাইব্রেরিতে কাঁচের বোতল এলো কোথা থেকে? আর সেটা দেয়ালেই বা ছুড়ে মারলো কে?
কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। সবটা কেমন রহস্যময়। সেদিন রাস্তায় ধাক্কা খাওয়া আর আজকে এই কাঁচের বোতল।সবকিছুই কি কাকতালীয়? কিন্তু আমার সাথেই কেনো ঘটছে এমন?
পর্ব ১০
বাড়ির পেছনের বাগানটায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। ভর দুপুরের রোদের তীব্রতা চারদিকে। এমন সময় নিশ্চই কেউ বাগানে দাঁড়িয়ে থাকে না। কিন্তু আমি আছি।এইমুহূর্তে বাড়ির ভেতরে থাকার থেকে এই বাগানে দাঁড়িয়ে থাকাটা বেশি শান্তিময় মনে হচ্ছে আমার।
ফুয়াদ ভাইয়ারা এসেছেন আজ।ড্রয়িংরুমে সবাই মিলে কথা বলছে। আমি সেখানে যাইনি। কারণ তারা সবাই কি নিয়ে কথা বলছে সেটা আমি জানি। ওখানে সবার সাথে বসে থাকাটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। বাড়িতে থাকতেই ইচ্ছে করছে না আমার। খালামনিরা আসবে বলে ভারসিটিও যাওয়া হয়নি আজ। সবাই যে আজ খুব খুশি সেটা তাদের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়া খুশি কিনা সেটা উনার মুখ দেখে বুঝতে ব্যার্থ হয়েছি আমি। খুশিই হবেন হয়তো। উনার তো খুশি না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
রোদের তাপে বাগানের ব্যাঞ্চটাও গরম হয়ে আছে৷ হাত দিয়ে ধরলেই মনে হয় হাতটা পুড়ে যাবে। বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখারও ইচ্ছে নেই। কারণ বাগানের প্রতিটি কোণাও দেখা হয়ে গেছে আমার। বাগানের সবগুলো গাছের মধ্যে একটা গাছকে আমি সবচেয়ে বেশি যত্ন করি। কারণ সেই গাছটা আমাকে আমার জন্মদিনের উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন ফুয়াদ ভাইয়া। তখনও উনি আমার সাথে স্বাভাবিকই ছিলেন। আমার প্রত্যেকটা জন্মদিনে প্রথম উইশটা আমি ফুয়াদ ভাইয়ার কাছ থেকেই পেতাম। কিন্তু উনাকে আমি ভালোবাসি এই কথাটা জানার পর থেকেই উনি কেমন হয়ে গেছেন। সবসময় আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। এককথায় উনি সহ্যই করতে পারেন না আমায়। এখন ভাবি, কেনো যে উনাকে ভালোবাসার কথা বলতে গেলাম আমি?
চিন্তা করায় এতই বিভোর ছিলাম যে ফুয়াদ ভাইয়া কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি আমি। হঠাৎ মনে হলো আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। আমি ঘুরতেই দেখতে পেলাম পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। আমি আজ আর উনার মুখের দিকে তাকালাম না। উনার প্রতি আর কোনো ফিলিংস কাজ করতে দেওয়া চলবে না আমার। ভাবছি বাগান থেকে চলে যাবো এখন। কিন্তু এভাবে কোনো কথা না বলে চলে যাওয়াটাও হয়তো ঠিক হবে না। তাই সামনের দিকে তাকিয়েই বললাম আমি
- কথা বলা শেষ সবার?
- না, বড়রা এখনো কথা বলছে।
- ওহ। তাহলে আপনি চলে এলেন যে?
- বড়দের মাঝে বসে থাকাটা অত্যন্ত বিরক্তিকর।
- আমার থেকেও বেশি বিরক্তিকর কিছু আছে আপনার লাইফে?
আমার কথার কোনো জবাব দিলেন না ফুয়াদ ভাইয়া। আমিও যে উনার জবাবের আশায় বসে আছি এমনটাও নয়। উনি হয়তো আমার দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন এবার৷ আমার দৃষ্টি এখনো সামনের দিকে। যদিও সামনে তাকিয়ে থাকার মতো কিছুই নেই৷ কিন্তু আমি তাকিয়ে আছি। মাঝে মাঝে কারণ ছাড়াই অনেক কাজ করতে হয় আমাদের। হঠাৎ করেই ফুয়াদ ভাইয়া বলে উঠলেন
- তুই অনেক বদলে গেছিস মেঘা।
উনার কথায় অবাক হলাম আমি। একটু অবাক নয় একেবারে অনেকটাই অবাক হয়েছি। আমি বদলে গেছি না আগের মতোই আছি সেটা উনি খেয়াল করেছেন বুঝি? তারমানে আমার দিকেও নজর আছে উনার?
- আমি বদলে গেছি?
- হ্যাঁ, অনেক বদলে গেছিস।
- আমার কাছে তো মনে হচ্ছে না।
- যে পাল্টে যায় তার নিজের কাছে মনে হয় না যে সে পাল্টে গেছে।
- আচ্ছা মানলাম আমি পাল্টে গেছি। কিন্তু সেটা আপনি বুঝলেন কি করে?
- বুঝার অনেক কারণ আছে। আমার এক্সিডেন্ট হওয়ার পর একদিন রাতেই শুধু আমার ঘরে এসেছিলি তুই। তারপর প্রায় এক সপ্তাহের মতো ছিলি আমাদের বাসায়। একদিনও আসিস নি আমার ঘরে।
- আমি আপনার ঘরে গেলে আপনি সিনক্রিয়েট করবেন ভেবে যাই নি। আর আপনিও আমার জন্য আশা করে বসেছিলেন না নিশ্চই?
আমার কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফুয়াদ ভাইয়া। উনার দীর্ঘশ্বাসের কারণটা বুঝতে পারছি না আমি। কতক্ষন সময় চুপ থেকে আবার বলে উঠলেন
- আগেও তো তোর জন্য আশা করে বসে থাকতাম না কিন্তু তখন তো ঠিকই আসতিস।
- পরিস্থিতি সবসময় এক থাকে না।
- এখন পরিস্থিতির দোষ দিচ্ছিস? খুব না বলতি আমায় ভালোবাসিস। এই তোর ভালোবাসা?
- সেদিন আমি আপনাকে কি বলেছিলাম আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন। কিন্তু আমি ভুলিনি।বলেছিলাম আপনার প্রতি ভালোবাসাটা আর কোনো দিনও প্রকাশ করবো না আমি। আর আজ হঠাৎ এসব কথা আসছে কেনো। আপনি নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন। আশা করি সুখী হবেন।
ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। উনার এমন শান্ত ব্যবহার মেনে নিতে পারছি না আমি। মনে হচ্ছে উনার এমন ব্যাবহারের মাধ্যমে উনি আমার মনের ক্ষতগুলোকে বারিয়ে দিচ্ছেন ক্রমাগত। আজকে হঠাৎ কি হলো উনার? এই ভর দুপুরে বাগানে এসেছেন আমার সাথে কথা বলতে? আর কিছু না বলে উল্টো দিকে ঘুরে পা বারালাম বাগান থেকে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সফল হতে পারলাম না আমি। একটু এগিয়ে আসতেই হাতে টান পরলো আমার। পিছন থেকে আমার হাত টেনে ধরেছেন ফুয়াদ ভাইয়া।
ফুয়াদ ভাইয়ার এই কাজে আরেক দফা অবাক হলাম আমি। হাতে চিমটি কাটা ছাড়াই বুঝতে পারছি এটা কোনো স্বপ্ন নয়। একদম সত্যি। উনার এমন বিহেভিয়ারে আমি খুশি হবো না রাগ করবো বুঝে উঠতে পারছি না। আগে হলে হয়তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম আমি। কিন্তু এখন তো আমার রেগে যাওয়া উচিৎ। দুদিন পর উনি সারাজীবনের জন্য আপুর হাত ধরবেন আর এখন আমার হাত ধরে টানাটানি করছেন। সে হিসেবে আমার এখন অবশ্যই রাগ করা উচিৎ। কিন্তু আমি চাইলেও রেগে যেতে পারছি না আবার খুশিও হতে পারছি না।
ফুয়াদ ভাইয়া আমার দিকে কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছেন। আমার হাত ধরে রেখেই উনি বললেন
- সেদিন শুধু একথাটাই বলিস নি। আরো একটা কথা বলেছিলি যেটা আমার মনে আছে।
- কি কথা?
- যে ভালোবাসা সামান্য ইগোর কাছে হেরে যায় সেটা ভালোবাসা অন্তত নয়। তুই এখন ইগো দেখিয়ে দুরে সরে যাচ্ছিস। তারমানে কি তোরটাও ভালোবাসা ছিলো না?
ফুয়াদ ভাইয়ার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে উনার মুখোমুখি দাঁড়ালাম আমি। উনার চোখের দিকে তাকিয়েই বললাম
- এটা ইগো নয় সেক্রিফাইজ।
- সেক্রিফাইজ?
- হ্যাঁ, সেক্রিফাইজ। আমি না চাইলেও এই সেক্রিফাইজটা করতে হবে আমায়। কেনো জানেন? কারণ আমার ভালোবাসাটা ছিলো একতরফা। আপনি তো আমায় কোনোদিনও ভালোবাসেন নি। আর বাসবেনও না। আর এখন আপনি, আপু দুজনেই এই বিয়েতে রাজি। সে হিসাবে আমি আপনাদের মধ্যে একজন তৃতীয় ব্যাক্তি মাত্র। আর সেক্রিফাইজ শব্দটা বোধ হয় তৃতীয় ব্যাক্তিদের জন্যই তৈরি হয়েছে। তারা না চাইলেও তাদেরই সবসময় সেক্রিফাইজ করতে হয়। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।
আমি আবারো চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই ফুয়াদ ভাইয়া বলে উঠলেন
- সত্যি সত্যিই কি সেক্রিফাইজ? নাকি ভালোবাসার জন্য নতুন কাউকে পেয়ে গেছিস?
- মানে?
- তুই সত্যিই মানেটা বুঝতে পারছিস না?
- না বুঝতে পারছি না। ভালোবাসা কি বাজারের কোনো পণ্য যে একেক সময় একেক জনকে দিয়ে দেবো? নাকি আমার ভালোবাসাকে আপনার ঠুনকো মনে হয়? কোনটা?
- সেটা তো তুই নিজেই ভালো বলতে পারবি।
আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উনি বাগান থেকে চলে গেলেন। আর আমি এখনো ওখানে দাঁড়িয়েই উনার কথার মানে বুঝতে চেষ্টা করছি। আমি নতুন কাউকে পেয়ে গেছি মানে?
রাত ১০:০০ টা বেজে গেছে। রাতের খাওয়া – দাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে এসে পরেছি আমি। ফুয়াদ ভাইয়ারা সন্ধ্যায় চলে গেছে। দুপুরের পর আর নিজের ঘর থেকে বের হইনি। ঘরে বসে বসে সারাদিন ধরে শুধু ফুয়াদ ভাইয়ার বলা কথাটার মানে খুঁজে বেরিয়েছি৷ কিন্তু বারবারই ব্যার্থ হয়েছি আমি।
বিছানায় চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। এতো তারাতাড়ি ঘুম আসবে না আমার। কিন্তু চোখদুটো খুলা রাখতেও যেনো একঝাক আলসেমি ঘিরে ধরছে আমায়। এই মুহূর্তে চোখ খুলাটা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ বলে মনে হচ্ছে। এভাবে শুয়ে থাকতেই ভালো লাগছে আমার।
কিন্তু আমার ভালো লাগাটা বোধ হয় আমার মোবাইলটা সহ্য করতে পারেনি। তাই তো সেই কখন থেকে গলা ছেড়ে চিৎকার করে চলেছে সে। আমার এখন ইচ্ছে হচ্ছে ফোনের ভেতর ঢুকে গিয়ে ফোনের ওপাশের ব্যাক্তিটিকে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মেরে আসি। কল করার আর সময় পায়নি।
বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার মাঝে। যত ইচ্ছা বাজতে থাকুক। আমার যখন মন চাইবে আমি তখনই রিসিভ করবো। ততক্ষন নাহয় ফোনের রিংটোনটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো কাজ করুক। আমি চোখ বুজে শুয়ে আছি আর চারপাশে মিউজিক বাজছে। একদম বাংলা নাটকের মতো।
গুনে গুনে পাক্কা এগারোবার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ করলাম আমি। কানে নিতেই ভেসে আসলো সারার কন্ঠ
- ফোন কি মঙ্গল গ্রহে ফেলে রেখেছিলি নাকি?
- সেটা তোর না জানলেও চলবে। কিসের জন্য ফোন করেছিস সেটা বলে ফটাফট ফোন রাখ। ব্যাস্ত আছি আমি।
- কি নিয়ে এতো ব্যাস্ত তুই? যে আমার ফোনটাও এতক্ষন ধরতে পারলি না?
- শুয়ে শুয়ে চোখে ঘুম ডেকে আনতে ব্যাস্ত ছিলাম। এনিয়ে আর একটা কথাও বলবি না। ফোন কেনো করেছিস সেটা বলবি এক্ষুনি, ফাস্ট।
আমার কথায় যে সারার সর্বাঙ্গ রাগে রি রি করছে সেটা ফোনের এপাশ থেকেই বুঝতে পারছি আমি। রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এগারোবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরে কেউ এমন উত্তর দিলে অবশ্যই রাগ উঠে যাবে। সে অনুযায়ী সারাও রেগে গেছে। কিন্তু তাতে আমার কি?
আমার সাথে রাগ দেখিয়েও যে কোনো লাভ হবে সেটা সারা নিজেও জানে। কারণ সে যখনই আমার উপর রাগ দেখায় আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। যেনো তার রাগ করা আর না করায় কিছু যায় আসে না আমার। তাই শেষ পর্যন্ত রাগটা আমার উপর পুরোপুরি ঝারা হয়ে উঠে না তার।
প্রতিবারের মতো এবারেও নিজের রাগটাকে হজম করে নিয়ে বললো
- দোস্ত, শোন না।
- শোনার জন্যই তো ফোনটা কানে ধরে আছি।
- দোস্ত আমি না অনেক এক্সাইটেড।
- তো?
- এমা, তুই জিজ্ঞেস করবি না আমি কি নিয়ে এক্সাইটেড?
- আমি জিজ্ঞেস না করলেও যে তুই বলবি সেটা আমি জানি।
- অবশ্যই বলবো। বলার জন্যই তো ফোন করেছি।
- তো বলে ফেল।
- আজকে তো তুই ভারসিটি আসিস নি। ভারসিটি থেকে কক্সবাজারে একটা ট্যুরের আয়োজন করা হয়েছে। সেই জন্যই তো আমি এতো এক্সাইটেড।
- ওহ, ভালো।
- শুধু ভালো? তুই খুশি হোসনি?
- হুম, হয়েছি তো।
- তোর কথা শুনে তো তা মনে হচ্ছে না।
- আর মনে হতেও হবে না। কাল ভারসিটিতে দেখা হচ্ছে। এখন রাখছি।
সারাকে কিছু বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দিলাম আমি। সত্যিই তো কক্সবাজার যাওয়ার কথা শুনে একটুও খুশি হয়নি আমি।আমার মধ্যেখুশিনামক অনুভুতিটাই কি মরে গেলো নাকি?
ভারসিটির বড় বটগাছটার নিচে বসে আছি আমি আর আর সারা। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সারা।আমি তানভীর ভাইয়ার সাথে ঘটে যাওয়া নানান মজার আর অদ্ভুত ঘটনাগুলো তাকে বলার পর থেকেই ভাবনায় মগ্ন হয়েছে সে। জগদীশ চন্দ্র বসু বেশি ভাবতেন বলে নাম দেওয়া হয়েছিলোভাবুক ছেলেটি। আমার এখন সারাকেও ভাবুক মেয়েটি নামে আখ্যায়িত করতে ইচ্ছে করছে। গণিতের কোনো সমস্যা সমাধান করতে গিয়েও বোধ হয় এতোটা ভাবেনি সারা। সবসময় তো আমাকেই জিজ্ঞেস করেএই মেঘা, একের সাথে এক যোগ করলে কত হয় রে? দুই থেকে কি তিন বিয়োগ করা যায়?। আর এখন সেই মেয়েটাই গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভেবে চলেছে। এটা তো কিছুতেই হজম করতে পারছি না আমি। আমার কাছে মনে হয় এই বিষয়টা যদি আমি এতো সহজে করে ফেলি তাহলে পৃথিবী থেকে হজমী নামক বস্তুটার ব্যাবহারই উঠে যাবে। এমা, তাহলে তো হাজার হাজার মানুষ পেটের সমস্যায় ভুগবে। এটা তো কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। তাই আমি বললাম
- কি নিয়ে এতো ভাবছিস?
- হুম, ভাবছি।
- ভাবছিস সেটা তো আমিও দেখতে পারছি। কিন্তু কি নিয়ে এতো ভাবছিস। আমার তো মনে হচ্ছে ভাবতে ভাবতেই শহীদ হয়ে যাবি তুই।
- ওফ, বাজে কথা বলা বন্ধ কর। আমি তো তানভীর ভাইয়ার কথা ভাবছি।
- তুই আবার তানভীর ভাইয়াকে নিয়ে পরলি কেনো?
- কারণ আছে বান্ধবী, অনেক কারণ আছে। আমার মনে হয় তানভীর ভাইয়া প্রেমে পড়েছে।
- ওহ মাই গড, সত্যি? আচ্ছা তুই কিভাবে জানলি? আর কার প্রেমে পড়েছেন উনি?
- কার আবার, তোর।
সারার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। তানভীর ভাইয়া নাকি আমার প্রেমে পরেছেন। যত্তসব গাজাখুরি কথা-বার্তা।
- তোর এতক্ষনের ভাবনা বিফলে গেলো রে, সারা। এতো ভেবেও আসল মানুষকে বের করতে পারলি না।
- জ্বী না। আমার ভাবনা একদমই বিফলে যায়নি। আমি শিউর তানভীর ভাইয়া তোরই প্রেমে পড়েছে।
- চাপা মারা বন্ধ কর। উনি আমার প্রেমে পরতে যাবে কোন দুঃখে?
আমার কথায় সারা অবাক হওয়ার ভান করে বললো
- কি বলছিস তুই এসব? আমি তো চাপা কাকে বলে সেটাই জানিনা। তাহলে চাপা মারবো কি করে?
- ওওও তুমি চাপা কাকে বলে জানো না। তাই না? আচ্ছা ঠিক আছে, আমি সুন্দর করে চাপার সঙ্গাটা বলে দিচ্ছি তোমায়।
- হ্যাঁ, বল। আমিও শিখি চাপা কাকে বলে।
- আংশিক সত্যকে কেন্দ্র করিয়া মিথ্যার সমান ব্যাসার্ধ নিয়া অংকিত বৃত্তচাপকে চাপা বলে।
- রাইট, আংশিক সত্যকে কেন্দ্র করিয়া। মানে আংশিক হলেও সত্য যে তানভীর ভাইয়া তোর প্রেমে পড়েছে।
- আবার এই এক কথা। তুই বসে থাক আমি গেলাম।
- এই না, না, দাঁড়া আমিও আসছি।
সারাও দৌড়ে এসে হাটতে লাগলো আমার পাশাপাশি। ভারসিটির গেট পর্যন্ত আসতেই থেমে গেলাম আমরা। হুট করে কোত্থেকে এক ছেলে এসে হাটু গেরে বসে পরলো আমাদের সামনে। কিছু বুঝার আগেই বলে উঠলো
- আই লাভ ইউ।
ছেলেটা বোধহয় অনেক তাড়ায় আছে তাইতো বেচারা ফুলটাকেও উল্টো করে ধরে আছে। কথা সেটা না। কথা হচ্ছে ছেলেটা প্রপোজ কাকে করলো? আমি আর সারা দুজনেই কনফিউজড হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি বারবার।
ছেলেটা সেই কখন থেকে বসে আছে নিচে। আর বেশিক্ষন বসে থাকলে হয়তো প্যান্টটাই ফেটে যাবে তার। কনফিউশান দূর করতে আমিই প্রশ্ন করলাম
- আপনি কাকে প্রপোজ করছেন ভাইয়া?
আমার প্রশ্ন শুনে ছেলেটা লজ্জারাঙা হয়ে বললো
- তোমার বান্ধবীকে শালীকা।
কি আজব! একমুহূর্তেই আমাকে শালীকা বানিয়ে ফেললো ছেলেটা। সারার দিকে তাকিয়ে দেখি কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। তাই আমিও সেটা শোনার প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। সারা বললো
- আপনার মাথা ঠিক আছে তো ভাইয়া?
সারার কথায় ছেলেটা একটু মনক্ষুন্ন হলো যেনো। যাকে সে গার্লফ্রেন্ড বানাতে চাইছে সে তাকে ভাইয়া বলে ডাকছে। আহারে বেচারা! ছেলেটা বললো
- কেনো?
- আরে আমি বিবাহিতা একটা মেয়ে। আর আপনি আমায় প্রপোজ করছেন?
- কি বলছো তুমি। আমি তো জানি তুমি বিয়ে করোনি।
- আসলে ভাইয়া আমি আর আমার হাজবেন্ডের লাভ মেরেজ তো। তাই পরিবারের কেউ মেনে নিতে চায়নি। কিন্তু অনেক কষ্ট করে রাজি করিয়েছি। পরিবারের লোক ছাড়া অন্য কেউ এখনও জানে না।তাই না মেঘা?
সারার কথায় আমিও মাথা নাড়লাম যার অর্থ হ্যাঁ, কেউ জানে না। আমাদের কথা ছেলেটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি হয়তো। তাই বললো
- তুমি মিথ্যা কথা বলছো।
- একদম না। আমি সত্য কথা বলছি। আচ্ছা দাঁড়ান। আমার হাজবেন্ডও এই ভারসিটিতে পড়ে। আমি এক্ষুনি ওকে ডেকে আনছি। মেঘা তুইও দাঁড়া।
সারা ছুটে চলে গেলো ভারসিটির ভেতরে। এতক্ষন সারার কথা শুনে একটুও অবাক হইনি আমি। কারণ যে ছেলেই ওকে প্রপোজ করে সে ছেলেকেই ও এই একই কথা বলে। সারার একটা বড় গুণ হলো মিথ্যে কথা বলার সময় এতটা কনফিডেন্ট থাকে যে, যেকেউই কনফিউজড হয়ে যায়। যেমনটা এই ছেলেটাও হয়ে গেছে। কিন্তু এই ভারসিটিতে ওর হাজবেন্ড পড়ে মানে? ও কি সত্যি সত্যিই বিয়ে করে ফেললো নাকি।
আমি এবার ছেলেটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। চেহারা, উচ্চতা সবমিলিয়ে মাশাআল্লাহ পুরাই বাংলা সিনেমার দিলদারের মতো।
একটুপরই আমাদের কাছে এলো সারা। সারার সাথে আছে তানভীর ভাইয়া। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তানভীর ভাইয়া সারার হাজবেন্ড?
- এই যে ভাইয়া, ইনিই আমার হাজবেন্ড। কিগো বলো না।
সারায় ইশারায় তানভীর ভাইয়া ঝটপট উত্তর দিলো
- হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি ওর হাজবেন্ড। তোমার সাহস তো কম না আমার ওয়াইফকে প্রপোজ করো।
তানভীর ভাইয়ার উত্তরে মুখ কালো হয়ে গেলো ছেলেটার। বাংলা সিনেমায় যেমন নায়ক নায়িকা কষ্ট পেলে মনের ভেতর ঘুর্নিঝড় শুরু হয়ে যায়। ইয়া বড় বড় ঢেউ আছড়ে পরে সাগরের বুকে। আমার মনে হয় ছেলেটার মনেও সেরকমই চলছে। কিন্তু সিনেমায় ঘুর্নিঝড়টা দেখা গেলেও ছেলেটার ক্ষেত্রে তা দৃশ্যমান নয়।
তানভীর ভাইয়াকে সরি বলে চলে গেলো ছেলেটা। এবার ওদের দুজনের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালাম আমি। কিন্তু সারা আমাকে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে তানভীর ভাইয়াকে বললো
- থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া। আপনি নিজেও জানেন না কত বড় উপকার করলেন আমার।
- ইটস ওকে শালীকা। তোমাকে হেল্প করতে পেরে আমি ধন্য।
তানভীর ভাইয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। আজকে কি সবাইকেশালীকা রোগে ধরলো নাকি। তখন ঐ ছেলেটা আমায় শালীকা বললো আর এখন তানভীর ভাইয়া সারাকে শালীকা বলছে। যখনই বুঝতে পারলাম ওরা এতক্ষণ নাটক করছিলো তখন আর হাঁসি আটকে রাখতে পারলাম না আমি। হাঁসি আটকে রাখলে যেকোনো মুহুর্তে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো। কিন্তু এতো তারাতাড়ি মরার কোনো সখ নেই আমার। তাই জোরে জোরে হেঁসে দিলাম আমি।
আমার হাঁসি থামলো তানভীর ভাইয়ার কথা শুনে। যখন উনি বললেন
- এভাবে হেঁসো নাগো। বুকে ব্যাথা লাগে আমার।
এটুকু বলেই সারাকে হাই ফাইভ করে চলে গেলেন উনি। আমি আবুলের মতো দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি বউ সাজালেন সারাকে আর বুকে ব্যাথা লাগে আমি হাঁসলে? কি অদ্ভুত!
পর্ব ১১
রহস্য শব্দটাই কেমন যেনো রহস্যময় লাগে আমার কাছে। সিনেমায় কোনোকিছুর রহস্য উদঘাটন করাটা যতটা সহজভাবে দেখানো হয় বাস্তবজীবনে তা ততটাও সহজ নয়। এমুহূর্তে আমিওরহস্য উদঘাটন নামক সমস্যায় ভুগছি। আমার হাতেই রয়েছে একটা পার্সেল। পার্সেলের গায়ে প্রেরকের কোনো নাম বা ঠিকানা কিছুই নেই। আমাকে এটা কে পাঠালো সেটাই একটা রহস্য। পার্সেলটা কি খুলবো নাকি খুলবো না এই নিয়ে দ্বিধাদন্দে জর্জরিত আমি।
সন্ধ্যায় একা একা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলাম। টিভি দেখছিলাম বললে ভুল হবে। টিভির দিকে তাকিয়ে ছিলাম শুধু। মাথায় তো ভর করেছিলো অন্য চিন্তা। কাল সকালেই আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র -জুনিয়র সবাই যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন হলো ফুয়াদ ভাইয়া। এখন সবসময় উনার থেকে দুরে দুরে থাকি আমি। খালামনির বাসায় যাওয়াও কমিয়ে দেয়েছি এখন। আগে তো কারণ ছাড়াই খালামনির বাসায় চলে যেতাম কিন্তু এখন হাজার কারণ থাকলেও নিজে না গিয়ে ভাইয়াকে পাঠাই। ভারসিটিতেও উনার সামনে যাই না। মোটকথা উনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখিনি আমি। সবসময় পালিয়ে বেড়াই ফুয়াদ ভাইয়ার থেকে। যেনো উনি কোনো ডাক্তার আর আমি ইঞ্জেকশন দিতে ভয় পাওয়া রোগী।
উনার থেকে এতো দূরে দূরে থাকার পরও আগামী দুইটা দিনের জন্য আবার কাছাকাছি থাকতে হবে আমাদের।
ভেবেছিলাম আমি যাবোই না কক্সবাজার। কিন্তু বাসার সবাই জেনে গেছে ভারসিটি থেকে ট্যুরের আয়োজন করা হয়েছে। এখন যদি আমি না যাই তাহলে হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে আমায়। তাই না চাইতেও যেতে হচ্ছে আমার।
ফুয়াদ ভাইয়ার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে তা শুধু আমিই জানি। সেখানে আবার উনার আশেপাশে থাকলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো তো?নাকি উনার প্রতি আরো দুর্বল হয়ে যাবো?
এসব চিন্তাই মাথায় ঘুরছিলো আমার। তখনই কানে এলো কলিংবেলের শব্দ। বাড়ির সবাই যে যার ঘরে আছে। তাই একঝাক বিরক্তি নিয়ে আমিই গেলাম দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই দেখতে পেলাম শ্যামবর্ণের একজন ছেলেকে। হাতে কিছু একটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ড্রেস আপ দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা একজন ডেলিভারি বয়। আমি তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই সে বলে উঠলো
- ম্যাম, আফিফা জান্নাত মেঘা কে? উনার নামে একটা পার্সেল আছে।
- জ্বী, আমিই আফিফা জান্নাত মেঘা।
- ওহ তাহলে তো এটা আপনার জন্যই। এই নিন।
আমার হাতে পার্সেলটা ধরিয়ে দিয়েই চলে গেলো ছেলেটি। এতক্ষন ছেলেটাকে ডেলিভারি বয় মনে হলেও এখন আমার কিছুতেই তাকে ডেলিভারি বয় মনে হচ্ছে না। আমি যতদূর জানি, পার্সেল নেওয়ার পরে একটা কাগজে সিগনেচার করতে হয়। কিন্তু আমার সাথে তো এমন কিছুই হয় নি।
সব চিন্তা-ভাবনাকে সাইডে রেখে পার্সেলটার দিকে তাকালাম প্রেরকের নাম দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু হতাশ হতে হলো আমায়। না আছে কারো নাম আর না আছে কোনো ঠিকানা। সেই থেকেই পার্সেল হাতে নিয়ে বসে আছি আমি।
পার্সেলের ভেতরে কি আছে সেটাও জানতে ইচ্ছে করছে খুব। মন বলছে মেঘা, খুলে ফেল।ভেতরে কি আছে দেখবি না? কিন্তু মস্তিষ্ক বলছেএকদম খুলবি না। যদি ভেতরে ক্ষতিকারক কিছু থাকে? মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে মনকেই বিজয়ী ঘোষণা করে পার্সেলটা খুলতে লাগলাম আমি।
পার্সেল খুলতেই অবাক হয়ে গেলাম। ভেতরে আছে হালকা ডিজাইনের একটা কালো রঙের থ্রিপিস। আশ্চর্য! আমায় থ্রিপিস পাঠালো কে? আমি কি কারো কাছে চেয়েছিলাম নাকি? কই, আমার তো তেমন কিছু মনে পরছে না। আমি শিউর কেউ ভুল করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। অন্যের জিনিস ব্যাবহার করা তো ঠিক না। কিন্তু এখন এটা কি করবো আমি? ভাবলাম এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপতত জামাটা আমার আলমারিতেই পরে থাক।
সোফা থেকে উঠে পা বারালাম আমার ঘরের দিকে৷ আলমারিতে রাখতে যাওয়ার সময় জামার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা কাগজ। আমি কাগজটা উঠিয়ে নিয়ে খুলে দেখলাম। কাগজে লিখা
আমার তরফ থেকে ছোট্ট একটা উপহার। আশা করি এটা পরেই কক্সবাজারে যাবে। তাহলে খুব খুশি হবো আমি।
কাগজের লিখাগুলো পড়ে অন্য কিছু না বুঝলেও জামাটা যে আমার জন্যই পাঠানো হয়েছে সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলাম আমি। কিন্তু কে পাঠাতে পারে এই প্রশ্নটাই ঘুরাঘুরি করছে মাথায়। আর বেশিকিছু না ভেবে পার্সেলটা তুলে রাখলাম আলমারিতে। কিন্তু কালকে এই জামাটা কিছুতেই পরবো না আমি। কে না কে পাঠিয়েছে। তার খুশির জন্য নাকি এই জামাটা পরতে হবে আমায়। কি আজব!
রাতের খাওয়া – দাওয়া শেষ করে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। তখনই পিছন থেকে ডেকে উঠলো আপু। তার দিকে তাকাতেই মিষ্টি করে হেঁসে বললো
- তোর প্যাকিং করা শেষ, মেঘা?
- কিসের প্যাকিং?
- আরে কাল যে কক্সবাজার যাচ্ছিস তার জন্য প্যাকিং করবি না?
- ওহ, তুমি এই প্যাকিং এর কথা বলছো?
- হ্যাঁ।
- না, এখনো করিনি।
- কি? কালকে সকালবেলা বেরিয়ে যেতে হবে আর তুই কিনা এখনো প্যাকিং করিস নি?
- আরে তুমি এতো টেনশন করছো কেনো? এখন শুরু করবো।
- আচ্ছা ঠিক আছে চল আমিও হেল্প করছি।
- না, থাক লাগবে না।
- আমি তোর মতামত জানতে চেয়েছি? আমি যখন বলেছি হেল্প করবো তখন তো করবোই। তোর বারণ শুনতে হবে নাকি আমায়?
- আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। চলো।
বিছানায় পা তুলে গুটিশুটি মেরে বসে আছি আমি। আর আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ব্যাগ গোছাচ্ছে আপু। আমার কি লাগবে না লাগবে সব খেয়াল করে ব্যাগে ঢুকাচ্ছে সে। আপুর কাজকর্মে মনে হচ্ছে সারাজীবনের জন্য কোথাও চলে যাচ্ছি আমি। তাই কোনোকিছুই দিয়ে দিতে ভুল করছে না সে।
-দেখ তো আরো কিছু লাগবে নাকি?
- এতোকিছু দিচ্ছো কেনো? মাত্র তো দুইদিনের জন্য যাচ্ছি। প্রয়োজনিয় জিনিসগুলো নিলেই চলবে।
- এখানে যা আছে সবকিছুই তোর প্রয়োজনীয়। সো, নো মোর ওয়ার্ড। ওকে?
- ওকে।
- গুড গার্ল।
আমাদের কথার মাঝেই আপুর ফোনের রিংটোন বেজে বেজে জানান দিচ্ছে যে কেউ আপুকে কল করেছে। আপু ফোনটা রিসিভ করে লাউড স্পিকারে রেখে আবারো ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে ফুয়াদ ভাইয়ার কন্ঠ।
- হ্যালো, মালিহা।
- জ্বী বলুন।
- কি করছিস সরি কি করছো?
- তেমন কিছু না।
- ওহ
- আপনি কি কিছু বলবেন?
- না মানে তেমন কিছু না। এই আরকি…
ফুয়াদ ভাইয়ার কথা শুনে মনে হচ্ছে উনি কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু সেটা বলতে সংকোচ বোধ করছেন। উনি কি বুঝতে পেরে গেছেন যে আপু এখন আমার সাথে আছে? কিন্তু এটা তো উনার জানার কথা নয়। উনি হয়তো আপুর সাথে কোনো পারসোনাল কথা বলবেন। আমার এখানে থাকাটা উচিৎ হবে না। তাই ভাবছি অন্যরুমে চলে যাবো। দরজার দিকে হাটতে লাগলেই ফুয়াদ ভাইয়ার কথা শুনে থমকে দাঁড়ালাম আমি।
- আসলে কালকে তো আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। আর খুব সকালেই বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। এতো সকালে মেঘার একা একা বাসা থেকে ভারসিটি আসা ঠিক হবে না। তুমি বরং রাফাতকে বলে দিও, ও যেনো মেঘাকে ভারসিটি পর্যন্ত ড্রপ করে দেয়।
- আচ্ছা ঠিক আছে আমি ভাইয়াকে বলে দেবো। কিন্তু এর জন্য আপনি আমায় ফোন না করে মেঘার কাছেই ফোন করতে পারতেন।
আপুর কথায় চুপ হয়ে গেলেন ফুয়াদ ভাইয়া। পরমুহূর্তেই বলে উঠলেন
- আচ্ছা আমি এখন রাখছি। একটু ব্যাস্ত আছি।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
ফুয়াদ ভাইয়ার বলা কথাগুলো কানে বাজছে আমার। আমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেছেন উনি? এটা কি সত্যি? আমার বিষয়ে ভেবেছেন ফুয়াদ ভাইয়া? চোখদুটো কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। আচ্ছা আমি কি কাঁদছি? কিন্তু কেনো কাঁদছি? ফুয়াদ ভাইয়া আমার খেয়াল রাখার কথা বলেছেন সেই খুশিতে? কিন্তু এখানে খুশি হওয়ার কি আছে? আমি উনার খালাতো বোন হই সেই হিসেবেই হয়তো বলেছেন কথাটা। এটা ভেবেই চোখ মুছে ফেললাম আমি। ফুয়াদ ভাইয়ার জন্য আর এক ফোটাও চোখের পানি ফেলবো না। কাঁদলেই কি উনাকে পেয়ে যাবো? না তো। সেটা যখন হবেই না তাহলে শুধু শুধু কাঁদার কোনো মানেই হয় না।
সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো আপু। আমিও ঘরের লাইট অফ করে শুয়ে পরলাম। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে। তাই রাত জাগা চলবে না। কিন্তু ঘুমগুলো চোখে ধরা দিলে তো। তারা বোধ হয় আমার চোখে ধরা দেবে না বলে পণ করেছে। এই রাতটাও যে ফুয়াদ ভাইয়ার কথা ভাবতে ভাবতে কেটে যাবে সেটা খুব ভালোই বুঝতে পারছি। উনার কথা না ভাবতে চাইলেও ভেবে ফেলি আমি। মাঝে মাঝে নিজের উপরই প্রচুর বিরক্ত লাগে আমার। তখন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি ফুয়াদ ভাইয়াকে বাদ দিয়ে কি আর কোনো কিছু নিয়ে ভাবা যায় না? এর উত্তর স্বরূপ আমার মন শুধু একটা কথাই বলেতোমার সবটা জোরেই যে আছে তাকে বাদ দিয়ে কিভাবে কিছু চিন্তা করবে তুমি?
পর্ব ১২
তারাহুড়া জিনিসটাই যেকোনো কাজ ভেস্তে যাওয়ার মূল কারণ হতে পারে। যে কাজে যত বেশি তারাহুড়া করা হয় সে কাজ শেষ করতে তত বেশি দেরি হয়ে যায়। যেমনটা এখন আমার সাথে হচ্ছে। তারাহুড়া করতে গিয়ে গোছানো জিনিসগুলোও অগোছালো করে ফেলছি আমি।
ভারসিটি থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়বে সাতটা ত্রিশে। এখন বাজে সাতটা। আমাদের বাসা থেকে ভারসিটি যেতে সময় লাগে প্রায় আধা ঘণ্টা। আর আমি এখনো বাসা থেকেই বের হতে পারিনি। রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে আমার। ইচ্ছে করছে ভাইয়াকে সিলিং ফ্যানের সাথে উল্টোকরে ঝুলিয়ে রাখি। সেই সকাল ছয়টা থেকেই তাকে ডেকে চলেছি আমি। আর সেআর ৫ মিনিট, আর ২ মিনিট করতে করতেই এক ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছে।
অনেক যুদ্ধ করে শেষমেশ ভাইয়াকে ঘুম থেকে তুলতে সফল হয়েছি আমি। এখন সে তৈরি হতে ব্যাস্ত। যাচ্ছে আমায় ভারসিটি ড্রপ করে দিতে কিন্তু ভাব দেখে মনে হচ্ছে প্রথমবারের মতো শশুড়বাড়ি যাচ্ছে সে। জাস্ট অসহ্য।
অবশেষে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম আমি আর ভাইয়া। ভাইয়া ফুল স্পিডে বাইক চালাচ্ছে আর আমি পেছনে বসে দোয়া – দুরুদ পড়ে চলেছি। আমার বিশ্বাস আর কক্সবাজার যাওয়া হবে না আমার। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় টুস করে এক্সিডেন্ট হবে আর আমি টপ করে উপরে চলে যাবো। কিন্তু আমার বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণিত করে ভারসিটির সামনে বাইক থামালো ভাইয়া। এতক্ষণে সস্তির নিঃশ্বাস ফেললেম আমি। তাড়াতাড়ি করে বাইক থেকে নেমে ভাইয়াকে বিদায় জানিয়ে চলে এলাম ভারসিটির ভেতর।
হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম সাতটা তেইশ বেজে গেছে। আর একটু পরই বাস ছেড়ে দেবে। তাই সবাই বাসে উঠে পরেছে। পাঁচটা বাস দাঁড়িয়ে আছে ভারসিটির মাঠে৷ আমার এখন কোনটাতে উঠা উচিৎ সেটাই বুঝতে পারছি না আমি। এই সারাটাকেও চোখে পরছে না কোথাও। কোন বাসে আছে কে জানে।
সবগুলো বাসই প্রায় ভরে গেছে বোধহয়। সবার শেষের বাসের কাছে যেতেই সারাকে দেখতে পেলাম। চুপচাপ বাসের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। এই কেউটা যে আমি সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগলো না আমার। তারাতাড়ি করে তার কাছে গেলাম আমি। আমাকে দেখেই রেগে গেলো সারা। রাগী গলায়ই বললো
- এতো তারাতাড়ি চলে এলি যে? আরো ঘন্টাখানিক পরে আসতে পারতি?
সারার কথার স্টাইলই বলে দিচ্ছে কতটা রেগে গেছে সে। কিন্তু তাতে আমার কি? আমি কোনোকালেই ওর রাগের পরোয়া করি না। তাই প্রতিবারের মতো এবারেও মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললাম
- আমিও সেটাই ভাবছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম আজকে নাহয় একটু আগেই চলে যাই।
আমার উত্তরে রাগ আরো বেড়ে গেলেও তা দমন করলো সারা। ওর অবস্থা দেখে মাঝেমাঝে খুব হাসি পায় আমার। দুজনেই চুপচাপ উঠে গেলাম বাসে। যা ভাবছিলাম তাই। বাস পুরো ভরে গেছে। তিনটা সিট খালি আছে মাত্র। ভালোভাবে চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম এই বাসের প্রায় বেশিরভাগই আমাদের সিনিয়র। কয়েকজন শুধু আমাদের ক্লাসমেট। হয়তো তারাও দেরি করে আসায় এই বাসেই জায়গা পেয়েছে। নয়তো কেউ কখনো সখ করে সিনিয়রদের সাথে বসতে আসবে না। সিনিয়ররা পাশে থাকলে মজা করা যায় নাকি।
হঠাৎই চোখ গেলো মাঝামাঝির একটা সিটে। চোখ বন্ধ করে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে প্রচুর বিরক্ত উনি। হয়তো বাস এখনো ছাড়ছে না বলে। ফুয়াদ ভাইয়ার পাশেই বসে আছেন তানভীর ভাইয়া। তাদের সামনের সিটেই আছেন নয়ন ভাইয়া আর ফয়সাল ভাইয়া। মজার বিষয় হলো উনারা চারজনের গেটাপই কালো। আশ্চর্য! সবাই মিলে কালোই কেনো পরলেন? ইশ! এখন আফসোস হচ্ছে আমার। আমিও যদি ঐ কালো ড্রেসটা পরে আসতাম!
এক বালতি আফসোস নিয়েই খালি সিটটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি আর সারা। যখনই বসতে যাবো তখনই বাধলো আরেক ঝামেলা। আমাদের দুজনেরই জানালার পাশের সিট চাই। খালিই আছে মাত্র তিনটা সিট তারমধ্যে একটা হলো জানালার পাশে। সারা কিছুতেই জানালার পাশ ছাড়া বসবে না। আমি তাকে কতকরে বলছি কিন্তু সে আমার কথা শুনতে নারাজ। আমি ওকে শেষবারের মতো বললাম
- সারা, বাবু। আমি না তোর বেস্টু। বেস্টুর জন্য তো একটু সেক্রিফাইজ করতেই হয়। তাই না?
- হ্যাঁ, একদম ঠিক কথা বলেছিস। বেস্টুর জন্য একটু সেক্রিফাইজ করতে হয়।
- এই তো বুঝেছিস। আমি জানতাম তুই বুঝবি। এজন্যই তো তোকে এতো ভালোবাসি আমি। এখন সর তো আমি এখানে বসবো।
- তোকে এখানে বসতে বলেছে কে?
- কেনো তুই-ই তো বললি।
- আমি তোকে এখানে বসতে বলিনি। বলেছি বেস্টুর জন্য সেক্রিফাইজ করতে হয়। আর আমিও যেহেতু তোর বেস্টু তাই তোর তোর উচিৎ আমার জন্য এটুকু সেক্রিফাইজ করা। ঠিক বললাম না মেঘা, বেবি?
কি ভয়ানক! আমার কথার জালে আমাকেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে এই মেয়ে। কিন্তু এখন কি আর করার। ফেঁসেই যখন গেছি তখন তো ওর কথাই মানতে হবে আমায়। তাই চুপচাপ গিয়ে বসে পরলাম নিজের জায়গায়। সারা আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাঁসছে। আমাকে হারাতে পেরে সে যতটা খুশি হয়েছে ততটা খুশি বোধ হয় পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেও হয়নি।
- দাঁত কেলানো বন্ধ করবি প্লিজ? তোর দাঁতগুলো যে সুন্দর সেটা সবাইকে জানাতে হবে না।
আমার কথায় সারার হাঁসি না থেমে আরো বেড়ে গেলো। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। ওর দিকে তাকালেই রাগ বেরে যাবে আমার। কিন্তু সেটা আমি এমুহূর্তে কিছুতেই চাইছি না।
আমরা ফুয়াদ ভাইয়াদের পাশের সিটেই বসেছি। আমি আর তানভীর ভাইয়া পাশাপাশি। আজকেও প্রথম থেকেই তানভীর ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝলাম না, আমি কি পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্য হয়ে গেছি? নাহলে তানভীর ভাইয়া এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেনো? উনি কি বুঝতে পারেন না এতে আমার অস্বস্তি হয়?
দুপুর প্রায় দুইটা। এখনো বাসেই বসে আছি আমরা। কক্সবাজার পৌঁছাতে আরো অনেক দেরী। এতক্ষণ ধরে এই একই জায়গায় বসে থাকতে থাকতে বোরিং লাগছে আমার। অথচ সবাই কতো মজা করছে। প্রথমে ভেবেছিলাম সিনিয়ররা সাথে থাকায় এতোটাও হৈ-হুল্লোড় হবে না আমাদের বাসে। কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে সিনিয়র- জুনিয়র সবাই একসাথে মজা করছে। সাউন্ড বক্সে তো মিউজিক বাজছেই সেই সাথে সবাই গলা মেলাচ্ছে। সবাই যে খুব ভালো গাইছে তেমনটাও নয়। কারো কারো গলা শুনে মনে হচ্ছে কাক চিৎকার করে গান গাইছে। তবু্ও তাদের থামার নাম নেই। দেখে মনে হচ্ছে বেসুরো গলায় গান গেয়েই প্রচন্ড আনন্দিত তারা।
সবাই আনন্দ করায় ব্যাস্ত থাকলেও আমার কিছুই ভালো লাগছে না। সবকিছুই অসহ্য লাগছে।উরে উরে কক্সবাজার চলে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। ইশ! আমার যদি ডোরেমনের মতো একটা এনিহয়ার ডোর থাকতো তাহলে কখনো এখানে বসে থাকতাম না আমি। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাই না চাইতেও এখানে বসে থাকতে হচ্ছে আমায়।
সারাদিনে আমার সাথে একটা কথাও বলেননি ফুয়াদ ভাইয়া। এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও মন বলছে একটাবার কি কথা বলা যায় না আমার সাথে? খালাতো বোন হিসেবেই নাহয় একটু কথা বলুক তাহলেও চলবে। মনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে মনকে বুঝালাম যে আমি এমন কিছু চাইতে পারি না। এটা ঠিক না। আর আমি নিজেই তো ফুয়াদ ভাইয়ার থেকে দুরে থাকতে চাইছি। তাহলে এখন কেনো উনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে আমার?
হঠাৎ বাস থেমে যাওয়ায় ভাবনার সুতো ছিড়লো আমার। বাস থেমে যাওয়ার কারণটা বুঝতে চেষ্টা করছি আমি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি একটা রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়েছে আমাদের বাস। ঘরির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য বাস দাঁড় করানো হয়েছে।
একে একে সবাই নামতে শুরু করলো। সারাও নেমে গেছে। আমিও উঠে দাঁড়ালাম নেমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। অনেক্ষন যাবৎ বসে থাকায় ভালো করে হাঁটতে পারছি না আমি। ধীরে ধীরে নেমে এলাম বাস থেকে। এখন অনেকটাই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বন্ধ খাঁচা থেকে মুক্তি মিলেছে আমার।
রেস্তোরাঁয় এসে সবাই মুখ -হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এখন আর কোনোকিছুতে বিরক্তি লাগছে না আমার। টেবিলে বসতে গিয়েও দেখি বসার জায়গা নেই। আজকে মনে হচ্ছেদেরিশব্দটা আমার জন্যই তৈরী হয়েছিলো। সবক্ষেত্রেই আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আজ।
একবস্তা বিরক্তি নিয়ে পেছনের দিকের টেবিলে বসার জন্য পা বারাতেই তানভীর ভাইয়ার ডাক শুনতে পেলাম। উনাদের টেবিলে একটা চেয়ার খালি আছে। আমি তানভীর ভাইয়ার কাছে যেতেই উনি বললেন
- এখানে বসে পরো, মেঘা। পেছনে ফ্যানের বাতাস পাবে না।
তানভীর ভাইয়ার কথাটা একদম ঠিক। রেস্তোরাঁর অবস্থা এতোটাও ভালো না। মাথার উপরে ফ্যানগুলো ঝুলছে ঠিকই কিন্তু তারমধ্যে প্রায় সবগুলোই অকেজো। রেস্তোরাঁর মালিক বোধহয় ফ্যানগুলোকেই শো-পিস হিসেবে ব্যাবহার করছেন।
- কি হলো, বসে পরো?
তানভীর ভাইয়ার কথায় কি করবো বুঝতে পারছি না আমি। এই গরমে পিছনে বসে খাওয়াটাও সম্ভব নয়। আবার তানভীর ভাইয়াদের সাথে বসতেও কেমন লাগছে আমার। যদিও ফুয়াদ ভাইয়া এখানে আছেন। কিন্তু তাতে কি? উনি নিজেও তো একজন ছেলে। চারজন ছেলের মাঝে একা একটা মেয়ে ব্যাপারটা কেমন যেনো।
অনেক কল্পনা জল্পনা করে শেষমেশ বসেই পরলাম তানভীর ভাইয়ার পাশে। ঠিক আমার সামনে চোখ-মুখ শক্ত করে বসে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো কারণে রেগে আছেন উনি। আমি এখানে বসেছি বলে রেগে গেলেন নাতো? এই কথাটা মাথায় আসতে ঠিক করলাম এখান থেকে উঠে যাবো। আমার জন্য ফুয়াদ ভাইয়া রেগে যাক সেটা আমি চাইনা। উনি রেগে গেলে মাথা ঠিক থাকে না উনার। যেখানে সেখানে সিনক্রিয়েট করে বসেন। এখন এমন কিছু হলে লজ্জায় পরতে হবে আমায়।
সিদ্ধান্তমতে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তানভীর ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন
- উঠে পরলে কেনো?
- আমি পেছনেই ঠিক আছি ভাইয়া। সমস্যা নেই।
আমি চলে আসতে নিলেই আমার হাত টেনে ধরলো তানভীর ভাইয়া। উনার কাজে আজকেও অবাক হয়েছে সবাই। উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন
- কোনো কথা হবে না আর। এখানেই বসবে তুমি।
আমি তানভীর ভাইয়াকে কিছু না বলে ফুয়াদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। আচমকাই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন ফুয়াদ ভাইয়া। ফয়সাল ভাইয়া উনাকে জিজ্ঞেস করলেন
- তোর আবার কি হলো? দাঁড়িয়ে পরলি কেনো?
উনার ঠাসঠাস জবাব
- ভালো লাগছে না আমার। খাবো না আমি। তোরা খাওয়া শেষ করে বাসে চলে আয়। আমি গেলাম।
কারো আর কোনো কথা না শুনেই বাসে উঠে পরলেন ফুয়াদ ভাইয়া। এখন মনে হচ্ছে আমারই ভুল। প্রথমেই এখানে বসা উচিৎ হয় নি আমার। আমার জন্য এখন ফুয়াদ ভাইয়া না খেয়ে চলে গেলেন।
তানভীর ভাইয়া জোর করে উনার পাশে বসালেন আমায়। আমার সামনেই রয়েছে একগাদা খাবার। এতক্ষণ ক্ষুধা লাগলেও এখন খেতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। ফুয়াদ ভাইয়া না খেয়ে থাকবেন আর আমি কিনা পেট ভরে খাবো। খাবার সামনে নিয়ে চুপ করে বসে থাকায় তানভীর ভাইয়া বললেন
- কি হলো খাচ্ছো না কেনো?
- ভাইয়া, আমার না খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি খাবো না ভাইয়া।
আমার উত্তরে ধমকে উঠলেন তানভীর ভাইয়া
- খেতে ইচ্ছে করছে না মানে কি? ফুয়াদ আর তোমার কি হয়েছে বলোতো। দুজনেরই খেতে ইচ্ছে করছে না। নো মোর সিঙ্গেল ওয়ার্ড। চুপচাপ খাবারটা ফিনিস করবে তুমি। নাও শুরু করো।
তানভীর ভাইয়ার ধমকে কোনো কথা না বলে খেতে শুরু করলাম আমি। চুপচাপ খাচ্ছি আর ভাবছি তানভীর ভাইয়া এভাবে কেনো কথা বলছেন আমার সাথে? উনার কথায় আমার প্রতি অধিকারবোধ স্পষ্ট। কিসের এতো অধিকারবোধ উনার?কই, আমি তো উনাকে এতো অধিকার দিই নি?
পর্ব ১৩
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চারদিকে। এইমাত্র কক্সবাজার এসে পৌঁছালো আমাদের বাস। সারাদিনের জার্নিতে সবার অবস্থাই নাজেহাল। যেহেতু আমিও সবার কাতারে পরি তাই আমার অবস্থাও একইরকম। চরমরকম ক্লান্ত হয়ে গেছি সবাই। তবে এই ক্লান্তির মাঝেও রয়েছে একগুচ্ছ ভালোলাগা।
সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় ঠিক করা হয়েছে এখন সোজা হোটেলে যাওয়া হবে। সব ধরনের ঘুরাঘুরি উরাউরি হবে কাল সকাল থেকে। একে একে বাস থেকে নেমে গেলো সবাই। আমি এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম। সবার সাথে নামতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কিতে আলু ভর্তা হয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার। পুরো বাস এখন খালি। এখন নেমে যেতে কোনো সমস্যা নেই। আমিও নামতে যাবো তখনই চোখ গেলো পাশের সিটে। সিটে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। মনে হয় ঘুমিয়ে পরেছেন উনি। উনার ঘুমন্ত মুখেও ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ঘুমের মাঝেই ভ্রুদুটি কুচকে আছে উনার। থেকে থেকে চোখের পাপড়িগুলোও কেঁপে উঠছে। আবছা আলোয় এই ক্লান্তিভরা মুখটাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী মনে হচ্ছে আমার। ইচ্ছে করছে উনাকে জিজ্ঞেস করি কি দরকার ছিলো নিজেকে কালোয় সাজানোর। উনি কি জানেন না কালো রঙে কতটা মারাত্মক লাগে উনাকে।
আলতো হাতে উনার মুখটা ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। সত্যিই কি ছুঁয়ে দেবো একবার? কিন্তু এটা কি ঠিক হবে? হ্যাঁ, হয়তো ঠিক হবে না। মন তো আর সেটা মানতে চাইছে না। কিন্তু আমার তো মানাতেই হবে। যার উপর আমার কোনো অধিকার নেই তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে এভাবে লক্ষ্য করাটা একদমই ঠিক কাজ নয়।
আমার তো উনার থেকে আরো দূরে থাকার কথা। সেই চেষ্টায়ই তো নিয়োজিত আছি আমি।যেকেউই বলবে আমারই উচিৎ ফুয়াদ ভাইয়া আর আপুর মাঝ থেকে সরে আসা। কিন্তু সব কি এতই সহজ? যাকে ছোট থেকে পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছি এতো সহজেই কি তাকে অন্য কারো সাথে মেনে নেওয়া যায়? তবুও আমি চেষ্টা করছি। হয়তো একটাসময় সফলও হবো আমি। মেনে নিতে পারবো সব। কারণ আমিও তো মানুষ। আর মানুষ চাইলেই সব পারে। হয়তো কষ্ট হবে কিন্তু পারবো তো।
বাইরে সবার কথার আওয়াজে ঘোর কাটলো আমার। সবাই সেই কখন নেমে গেছে। আমাদেরও এখন নেমে যেতে হবে। ফুয়াদ ভাইয়াকে কি আমিই জাগিয়ে দেবো? কিন্তু উনি যদি রেগে যান? রেগে গেলে যাবেন। এভাবে তো আর এখানে সারারাত বসে থাকা যাবে না।
একবুক ভয় নিয়ে এগিয়ে গেলাম ফুয়াদ ভাইয়ার কাছে। ইদানিং উনার রাগকে অনেক ভয় করে আমার। অথচ আগে উনার রাগটাই ভালো লাগতো। হাত দিয়ে উনার গা ঝাকাতেই চোখ মেলে তাকালেন উনি। আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কতক্ষণ। পরক্ষণেই আমায় টেনে নিজের পাশে বসিয়ে কাঁধে মাথা রাখলেন উনি। পুরো ফ্রিজড হয়ে বসে আছি আমি।এইমুহূর্তে আমার সাথে ঠিক কি হচ্ছে সেটাই বুজতে চেষ্টা করছি। ফুয়াদ ভাইয়া তো দুপুরে খায়নি। আচ্ছা, ক্ষুধার ঠেলায় পাগল টাগল হয়ে গেলেন নাতো? আমার কাঁধে মাথা রেখেই কিছু একটা বিরবির করছেন উনি। উনার কথাগুলো বুঝার জন্য আরেকটু কাছে গেলাম। উনি অস্ফুট স্বরে বলছেন
- তুমি এমন কেনো মেঘা? আগে যখন আমার জন্য পাগলামী করতে তখন অনেক রাগ হতো। আর এখন যখন আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছো, খারাপ লাগছে আমার। তোমার আলতু – ফালতু লজিকগুলোও খুব মিস করি আমি। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম যে তুমি আমার সামনে আর না আসো। কিন্তু এখন কেনো কষ্ট হচ্ছে আমার? চোখ বন্ধ করলেই তোমার মুখটা দেখতে পাই। আচ্ছা, আমি কিতুমি রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছি?
ফুয়াদ ভাইয়ার কথাগুলো কানে বাজছে আমার। এতোটা আবেগমিশ্রিত কন্ঠে আমার সাথে কখনো কথা বলেননি উনি। উনার কথাগুলোর মানে বুঝতে পারছি না। তবে উনি যে এখনো ঘুমের ঘোরে আছেন সেটা বুঝতে পারছি। ঘুমের ঘোরে আবোল -তাবোল বকছেন। সজ্ঞানে কোনোদিনও আমার সাথে এভাবে কথা বলবেন না উনি।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম শুধু। কি হতো যদি উনি নিজের সেন্সে থেকে এইকথাগুলো বলতেন আমায়? ঘুমের ঘোরেই হোক আর যেভাবেই হোক এই প্রথম আমায় তুমি বলে সম্বোধন করলেন ফুয়াদ ভাইয়া। ভাবতেই একরকম শুভ্রতা ছেয়ে গেলো মনে।
এভাবে বসে থাকা যাবে না আর। বুঝতে পারছি না যতই ফুয়াদ ভাইয়ার কাছ থেকে দূরে যেতে চাই ততই উনার কাছে এসে পরি আমি। এবার একটু জোরে ঝাকুনি দিলাম ফুয়াদ ভাইয়াকে। সাথে সাথে ধরফরিয়ে উঠে বসলেন উনি। চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে হয়তো কোথায় আছেন সেটা বুঝার চেষ্টা করছেন। আমায় উনার পাশে বসে থাকতে দেখেই মুখশ্রী লাল হয়ে গেলো উনার। বুঝতে পারছি উনি রেগে গেছেন। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন
- তুই আমার পাশে কি করছিস? বাকি সবাই কোথায়?
এবার আমারো রাগ হচ্ছে। নিজেই টেনে পাশে বসালো এখন নিজেই প্রশ্ন করছে। আজব পাবলিক। নিজের রাগ সংবরন করে আমিও দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলাম
- কক্সবাজার এসে গেছি আমরা। তাই সবাই নেমে গেছে। আর আমি আপনার পাশে ছিলাম কেনো জানেন? আপনাকে একা পেয়ে আপনার সম্মান লুটে নিতে চেয়েছিলাম আমি। তাই আপনার পাশে গিয়ে বসেছিলাম। হয়েছে শান্তি? পেয়েগেছেন উত্তর?
আমার কথায় হা করে তাকিয়ে আছেন ফুয়াদ ভাইয়া। হুহ, তাতে আমার কি? আমি উনাকে হা করে থাকার সুযোগ করে দিয়ে নেমে এলাম বাস থেকে। উনার যত ইচ্ছা হা করে দাঁড়িয়ে থাকুক।হাকরা নিয়ে গবেষণা করে ফেলুক। আই ডোন্ট কেয়ার।
হোটেলে আগে থেকেই রুম বোক করা ছিলো আমাদের। তাই বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় নি। ছেলে -মেয়ে আলাদা আলাদা। তবে সবার রুমই সেকেন্ড ফ্লোরে। নিজেদের জিনিস পত্র নিয়ে এগুতে লাগলাম রুমের দিকে। হঠাৎ মনে পরলো আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই। কিন্তু বাসায় তো জানাতে হবে যে আমরা সেফলি পৌঁছে গেছি। তাই সারাকে ডেকে দাঁড় করালাম আমি।
- কি হয়েছে?
- শোন না। আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই। রিচার্জ করাতে হবে।
- তো?
- তো মানে কি? আমি এখন রিচার্জ করাতে যাচ্ছি।
- এখানে কোথায় করাবি?
- সামনেই আসার সময় একটা দোকান দেখেছি।
- কিন্তু এখন তোর একা যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
- ধুর কিচ্ছু হবে না। তোরা যা আমি যাবো আর আসবো।
- ঠিক আছে। সাবধানে যাবি আর তারাতাড়ি ফিরবি।
- ওক্কেই, বাবু।
সারাকে বলে চলে এলাম রিচার্জ করাতে। এসে দেখি দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে এসে থামালাম দোকানিকে। আমি উনাকে রিচার্জ করার কথা বলছি আর উনি চট্টগ্রামের ভাষায় কিসব বলছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না আমার। আশেপাশে এমন কাউকে দেখছিও না যে আমাকে উনার কথার মানে বুঝিয়ে দেবে। নিজেকে কেমন এলিয়েন এলিয়েন লাগছে। আগে জানলে এই ভাষাটা রপ্ত করে রাখতাম আমি। উনার কথার মাথা -মুন্ডু বুঝতে না পেরে সোজা উল্টোদিকে হাটতে লাগলাম।
শুধু শুধু এলাম এই দোকানে। রিচার্জ তো হলোই না উল্টো পুরো মাথাটাই ঘেটে ঘ হয়ে গেলো আমার। কি দরকার ছিলো আমাদের দেশে এতগুলো আঞ্চলিক ভাষা থাকার? কিছু কম হলেও তো হতো।
এমুহূর্তে আমার মধ্যে বিরক্তি প্লাস রাগ দুটোই জেকে বসেছে যেনো। মনে হচ্ছে সামনে যাকেই পাবো তাকেই এক লাথি মেরে উগান্ডায় পাঠিয়ে দেবো। যদিও এটা আমার ভাবনাতেই সমাপ্ত। বাস্তবে কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু তাতে কি? ভাবতে তো আর কোনো দোষ নেই। কোনোকিছু বাস্তবে করা না গেলেও ভেবে ভেবেই শান্তি পাওয়া যায়। যেমনটা এখন আমি পাচ্ছি। আআহ শা….ন্তি।
রাগ বিরক্তির মিশ্র অনুভূতি নিয়েই ফিরে এলাম হোটেলে। রুমের দিকে হাটছি। কিন্তু আমি তো কোনটা আমাদের রুম এক্সাক্ট জানি না। শুধু জানি সেকেন্ড ফ্লোরে। ফোনেও ব্যালেন্স নেই যে সারাকে ফোন করে যেনে নেবো। আল্লাহ,আজ কি ঝামেলাদের যাওয়ার জায়গার অভাব পরেছে নাকি। সব ঝামেলা আমার ঘাড়েই এসে জুটেছে।
হোটেলের রিসিপশন থেকে ফোন করলাম সারাকে
- হ্যালো, কে বলছেন?
- আমি মেঘা।
- তুই?
- হ্যাঁ, এখন বকবক না করে বল আমাদের রুমটা কোনদিকে?
- সিড়ির ডানপাশের তিন নাম্বার রুমে আছি আমরা।
- আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আসছি।
ফোনটা কেটে দিয়ে চলে এলাম দুতলার সিড়ির ডানপাশের তিন নাম্বার রুমে। দরজাটা খোলাই আছে। কেউ হয়তো বাইরে আছে। ওহ, আমি নিজেই তো বাইরে। হয়তো আমার জন্যই খুলে রাখা হয়েছে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম আমি। ঘরে দেখি কেউ নেই। তারমানে আমি ছাড়াও অনেকেই বাইরে আছে। বিছানায় চোখ যেতেই দেখলাম কেউ একজন কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। এতই যখন শীত করছে তখন এসিটা কমিয়ে নিলেই তো পারে। আর কেই বা এত ক্লান্ত হয়ে গেছে যে ফ্রেশ না হয়েই এমনভাবে শুয়ে পরেছে? আমি শিউর এটা সারা। ওর অভ্যাসই এমন। একেতো রিচার্জ করাতে না পারায় রেগে আছি তার উপর সারার এমন কান্ড আগুনে ঘি ঢালার মতো আমার রাগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
ওয়াশরুম থেকে পানির কলকল আওয়াজ আসছে। তার মানে ওয়াশরুমেও কেউ আছে। আমার ব্যাগটা বিছানার একপাশে ছুড়ে রেখে সারার পাশেই শুয়ে পরলাম আমি। এর উদ্দেশ্য ওর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো। আমি কাথার উপর দিয়েই শুরশুরি দিতে লাগলাম ওকে। কিন্তু ওর মনে হয় গন্ডারের চামড়া। এতো শুরশুরি দেওয়ার পরেও কোনো হেলদুল নেই তার। কি আশ্চর্য! ঘুমিয়ে কি অনুভুতিহীন হয়ে গেলো সারা?
ওয়াশরুমের দরজা খুলার শব্দে সেদিকে তাকালাম আমি। একি, টাওয়াল দিয়ে মাথা মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন ফুয়াদ ভাইয়া। উনি আমাদের রুমে কি করছেন? মাথা ঠিক আছে তো উনার? ছি ছি শেষপর্যন্ত মেয়েদের ঘরে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পরেছেন উনি? উনাদের ওয়াশরুম খালি না থাকলে অন্য ছেলেদের ওয়াশরুমে চলে যেতে পারতেন।
টাওয়ালটা রেখে বিছানার দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় করে ফেললেন ফুয়াদ ভাইয়া। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন
- তুই এখানে কি করিস?
- আমারো তো একই প্রশ্ন। আপনি আমাদের রুমে কি করেন?
- হোয়াট রাবিশ? এটা তোদের রুম নয়। এটা আমাদের রুম।
এসব কি বলছেন ফুয়াদ ভাইয়া? কিন্তু সারা যে বললো এটা আমাদের রুম। যদি ফুয়াদ ভাইয়ার কথা সত্যি হয় তাহলে আমি এতক্ষণ ধরে কার পাশে শুয়ে আছি? আমার পাশে শুয়ে থাকা ব্যাক্তির মুখের উপর থেকে কাথাটা সরাতেই দিলাম এক চিৎকার।
আমার চিৎকারে লাফিয়ে উঠলেন তানভীর ভাইয়া। আমায় উনার দিকে ঝুকে থাকতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তারাতাড়ি করে সরে এলাম আমি। ইশ! কি লজ্জা কি লজ্জা। লজ্জায় আলমারির ভেতর ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।
তানভীর ভাইয়া কতক্ষণ চেষ্টার পর আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাথা চুলকাতে শুরু করলেন। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে রেখেছি আমি। কিভাবে তাকাবো তানভীর ভাইয়ার দিকে? উনি কি না কি ভাবলেন আমায়?
হুট করেই কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সামনের দিকে যেতেই দেখলাম সারাকে। ওর কাছে যেতেই বললো
- এতো দেরি লাগে আসতে?
- তুই আমাকে কোথায় আসতে বলেছিলি?
- কেনো? সিড়ির ডানপাশের তিন নাম্বার রুমে।
- ভালো করে দেখতো এটা কোন পাশ?
আমার কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো সারা। তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছি আমি। ভুলটা বুঝতে পেরে আমার দিকে ঘুরে জোরপূর্বক হাঁসি দিলো সে। ঠোঁটদুটোকে প্রসারিত করেই বললো
-সরি, দোস্ত। তুই তো জানিসই আমি ডান আর বামের মাঝে সবসময় গুলিয়ে ফেলি। তাই…..
-কেনো রে তুই কি ক্লাস ওয়ানে পড়া বাচ্চা যে কোনটা ডানদিক আর কোনটা বামদিক বুঝতে পারিস না?
- সরি তো।
- রাখ তোর সরি। সরি ধুয়ে কি পানি খাবো আমি?
- সরি ধুয়ে পানি খেতে যাবি কেনো? পানি তো খাবি গ্লাস ধুয়ে।
সারার বেক্কলমার্কা কথায় ইচ্ছে করছে নিজের চুল নিজে ছিড়ে ফেলি। কিন্তু বেশি রাগ উঠলে চুপ থাকাই বেটার। তাই আমিও চুপচাপ চলে এলাম রুমে। এবারে ঠিক রুমেই এসেছি। একদম বামদিকের তিন নাম্বার রুমে। আল্লাহ সারার ডান – বামের ঝামেলার চক্করে পরে আমি কতটা লজ্জায় পরর গেলাম। এখন তানভীর ভাইয়ার সামনে যাবো কি করে?
পর্ব ১৪
সবাই মিলে বিচে ঘুরছি। চারপাশে হাজারো মানুষ। এতো লোকজনের চিৎকার চেচামেচিতে সমুদ্রের পানির আওয়াজটা শুনারও উপায় নেই। এখানে না এলে শব্দ দূষণ কাকে বলে বুঝতেই পারতাম না। ছোট ছোট ঢেউগুলো পায়ে এসে আছড়ে পরায় ছোটখাটো ধাক্কা অনুভুত হচ্ছে। সুর্যের আলোর তীব্রতার কারণে ভালো করে চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছে না।
ছেলেদের মাঝে অনেকেই পানিতে নেমে পরেছে। আর আমরা মেয়েরা তীরে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
সবাই নানা আনন্দ করতে ব্যাস্ত থাকলেও আমি ব্যাস্ত লজ্জা থেকে বাঁচতে। আমার লজ্জা পাওয়ার একমাত্র কারণ তানভীর ভাইয়া। সবার সাথে তানভীর ভাইয়াও আছেন। উনার মাঝে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা দেখতে পারছি না আমি। প্রত্যেকের সাথেই দিব্যি স্বাভাবিক আচরণ করছেন উনি। অথচ আমি উনার দিকে তাকাতেই পারছি না। তাকালেই শুধু কালকের ঘটনার কথা মনে পরছে আমার।
একটা জিনিস সেই কখন থেকে লক্ষ্য করছি। আমি যতই তানভীর ভাইয়ার আড়ালে আড়ালে থাকতে চাইছি উনি ততই আমার আশেপাশে চলে আসছেন। বুঝতে পারছি উনি ইচ্ছে করেই এমন করছেন। আমাকে লজ্জা পেতে দেখে উনার কি লাভ কে জানে।
হঠাৎই ফুয়াদ ভাইয়ার কথা মনে পরলো আমার। উনাকে দেখতে পারছি না কোথাও। না চাইতেও চোখদুটো শুধু উনাকেই খুঁজে চলেছে। দূরে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ফুয়াদ ভাইয়াকে। মনে হচ্ছে ফোনে কারো সাথে কথা বলছেন।
আমি ধীরে এগুতে লাগলাম সেদিকে। উনার কাছে গিয়ে পেছন থেকে বললাম আমি
- এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কি করছেন?
আমার গলা শুনে চমকে উঠলেন ফুয়াদ ভাইয়া। হয়তো এমুহূর্তে আমাকে এক্সপেক্ট করেন নি উনি।
- কিছু না।
- তাহলে সবার সাথে ওখানে যান।
- ইচ্ছে নেই।
- এটা কেমন কথা? ইচ্ছে নেই কেনো?
- সেটা তোকে বলতে যাবো কেনো। আর তুইতো ভালোই ইনজয় করছিস সবার সাথে। হঠাৎ আমার কথা মনে হলো কেনো?
- বিশেষ কোনো কারণ নেই।ওখানে সবাই আছে শুধু আপনিই নেই। তাই আরকি….
- হুম সেটাই তো। বিশেষ কোনো কারণ থাকবে কেনো? তোর এই বিশেষ কারণের জন্য তো বিশেষ মানুষ আছেই।
- মানে?
- মানেটা তো তুইই ভালো জানিস।
- কিসব বলছেন আপনি। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
- না বুঝাই ভালো। থাকনা তুই তোর মতো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোর। তার জন্য তো মালিহা আছেই।
- হুম জানি।
আমার উত্তরটা মনে হয় পছন্দ হয়নি ফুয়াদ ভাইয়ার। কাছে এসে আমার বাম গাল শক্ত করে চেপে ধরলেন উনি। আমি উনার এমন আচরণে আশ্চর্য হয়ে গেছি। মুহুর্তেই উনার চোখের রং লাল হয়ে গেলো। ফুয়াদ ভাইয়ার এমন চাহনি আমি চিনি। উনি যখন খুব রেগে যান তখন উনার চোখ লাল হয়ে যায়। কিন্তু এখন এখন উনার রাগের কারণটা কি বুঝতে পারছি না।উনি আমার গাল চেপে ধরেই বলতে লাগলেন
- কেনো জানবি তুই? বল কেনো জানবি? আমায় নিয়ে ভাবার জন্য মালিহা কেনো থাকবে? অন্যদের নিয়ে ভাবতে এতই ব্যাস্ত হয়ে গেছিস যে আমার কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না। কেনো এত ব্যাস্ততা তোর?
ফুয়াদ ভাইয়া উনার মতো বলেই চলেছেন। আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি শুধু। উনার কোনো কথাই কানে আসছে না আমার।
ফুয়াদ ভাইয়া রেগে গেলে কোনোকিছুই মাথায় আনেন না। তখন উনি কি করে বসেন নিজেই জানেন না। উনি আমার গাল ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন। আমি এখনো ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে কি হচ্ছে কিছুই মাথায় আসছে না আমার।
দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। ফুয়াদ ভাইয়া ইদানিং যেমন বিহেভ করছেন তা উনার সাথে যায় না। এই ভালো তো এই খারাপ। পাশে তাকিয়ে দেখলাম ফুয়াদ ভাইয়া নেই। আমিও আর খুঁজে দেখার প্রয়োজন বোধ করলাম না। ভাবতে চাই না আর উনাকে নিয়ে। সত্যিই তো উনার জন্য তো আপু আছে। কিন্তু আমি অন্যদের নিয়ে ভাবতে ব্যাস্ত হয়ে গেছি এই কথাটা কেনো বললেন উনি? এসব চিন্তা করতে গিয়ে আজকের দিনটাকে মাটি করতে চাই না। কিছু কথার মানে নাহয় না-ই জানলাম।
আবার চলে এলাম সবার মাঝে। কেউ সেলফি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে কেউবা স্পিডবোটে চড়ে ঘুরছে। সারাকে খুঁজছি আমি। বিচে আসার পর থেকেই সে উধাও। কোথায় আছে কে জানে। কিছুদূরেই দেখতে পেলাম সারাকে। একা একা ঝিনুক কুড়াচ্ছে সে।তার স্বপ্ন ছিলো কক্সবাজার এসে খালি পায়ে হেঁটে ঝিনুক কুড়াবে। এখন তা করছে ঠিকই তবে খালি পায়ে নয়। রোদের তাপে অনেক গরম হয়ে আছে বালি। তাই খালি পায়ে হাঁটা প্রায় অসম্ভব।
তার কাছে যেতেই সে চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। মুচকি হেঁসে উঠে দাঁড়ালো। কতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো সারা।
- চল হাঁটি।
সারার কথার মধ্যে কেমন গম্ভীরতা ফুটে উঠছে আজ। সবসময় বোকা বোকা কথা বলে আমায় রাগিয়ে তোলা মেয়েটার এমন গম্ভীর আচরণ অবাক হওয়ার বিষয়। আমিও অবাক হয়েছি। তবে আমার চেহারায় তা ফুটিয়ে তুলছি না। সারার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম তার পাশাপাশি।
চুপচাপ হাঁটছি আমি আর সারা। আমার কাছে এটা ভালো লাগছে না একটুও। সারার বকবক করাটাই ভালো লাগে আমার। এমন চুপচাপ স্বভাব নয়। আমি যখন সারার এমন আচরণ নিয়ে গবেষণা করতে ব্যাস্ত তখনই সে বলে উঠলো
- পারবি না। তুই কিছুতেই পারবি না।
ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না আমি। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে বলছে পারবো না। কি পারার কথা বলছে সেটাই তো জানি না।
- কি পারবো না আমি?
- ফুয়াদ ভাইয়াকে ভুলতে পারবি না।
- মানে?
এবার হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে ঘুরলো সারা। আঙুল দিয়ে আমার গাল ইশারা করে বললো
- এমন অবস্থা হয়েছে কি করে?
- কেনো কি হয়েছে?
- পুরো গালটাই লাল হয়ে গেছে তোর।
- ওহ। না মানে আসলে তখন গালটা চুলকাচ্ছিলো তো। তাই খুব জোরে জোরে চুলকেছিলাম। এজন্য লাল কার্ড গেছে।
আমার উত্তরে আবারো হাঁসলো সারা। বুঝতে পারছি না এখানে হাঁসির কি আছে। আমি তো কোনো জোক্স শোনাই নি। ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে রেখেই সারা বললো
- আমি সবিটাই দেখেছি। তাই মিথ্যে বলে লাভ নেই। এতোটা ভালো কি করে বাসিস তুই? হাজার অপমানের পরেও ফুয়াদ ভাইয়াকে ভুলতে পারিস নি। হ্যাঁ, হয়তো আগের মতো পাগলামি করিস না। কিন্তু তুই স্বীকার করতে বাধ্য যে তুই এখনো উনাকে ভালোবাসিস। কি ঠিক বললাম তো?
- ভালোবাসা কি শেষ হয়ে যাওয়ার জিনিস? একদমই না। তবে হ্যাঁ, জীবনে চলার পথে একটাসময় হয়তো ভালোবাসাটা বাস্তবতার আড়ালে চাপা পরে যায়। কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো তেমন কিছুই হবে।
- তোকে একটা কথা বলি?
- তুই কিছু বলার জন্য পারমিশন নিস কবে থেকে? যা বলার বল
- ফুয়াদ ভাইয়াকে ভুলার জন্য নতুন কাউকে তোর জীবনে জায়গা দিতে পারিস না?
- মানে?
- মানে, এমন কাউকে নিয়ে ভাব যে তোকে ভালোবাসে। তাকে নিয়ে নয় যাকে তুই ভালোবাসিস।বুঝতে পারছিস কি বলছি।
- তাহলেই কি ফুয়াদ ভাইয়াকে ভুলে যাবো?
- পুরোপুরি জানি না। তবে আমার মনে হয় পারবি। অন্তত চেষ্টা তো করতে পারিস।
- ভেবে দেখবো।
- তোর যা ইচ্ছা। আমি জোর করছি না। কিন্তু এতে সবার ভালো হবে। ফুয়াদ ভাইয়া আর মালিহা আপুর কথা ভেবেই নাহয় চেষ্টা কর। আর তোর আশেপাশেই হয়তো এমন কেউ আছে বলে আমার মনে হয়।
- জানি না আমি। প্লিজ, এসব কথা বাদ দে। আমার ভালো লাগছে না। ঘুরতে এসেও এসব ঝামেলা নিয়ে ভাবতে চাই না আমি।
- আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চল।
- কোথায়?
- সামনের দোকানগুলোতে। অনেক কিছু কিনবো আজ।
- ঠিক আছে চল।
সমুদ্রের তীর থেকে একটু দুরেই দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো ছোট ছোট দোকান। নানা ধরনের জিনিসে ভরপুর। ক্রেতাদের ভীড় অনেক। এই দোকাগুলোর বিক্রেতারা আবার চলিত ভাষায় কথা বলছে। তাই তাদের সবার কথা বুঝতে পারছি। তবে তাদের মধ্যে অনেকেই কথার শেষেযে শব্দটা ব্যাবহার করছে। এর কারণটা কি সেটা জানতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। কিন্তু জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে না পাওয়ায় ইচ্ছেটাকে নিজের মাঝেই দমিয়ে রাখলাম আমি।
ঘুরে ঘুরে দেখছি সব জিনিস। ইচ্ছে করছে সবকিছু কিনে ফেলি। বেশিরভাগ জিনিসই সামুদ্রিক উপাদান ব্যাবহার করে তৈরী। কতকিছু কিনে ফেলেছে সারা। কিন্তু আমি কিছুই কিনতে সফল হইনি এখনো। এতোকিছুর মধ্যে ঠিক কোনটা নেবো তা বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের সামনে যতবেশি অপশন রাখা হয় আমরা ততবেশি কনফিউজড হয়ে যাই।
ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একটা পায়েলে। সাদা পাথরের সাধারণ একটা পায়েল। কিন্তু এই সাধারণ পায়েলটাকেই অসাধারণ লাগছে আমার কাছে। ওটা হাতে নিয়ে দোকানিকে দাম জিজ্ঞেস করতে যাবো তখনই সারার ডাক পরলো। কি হয়েছে দেখার জন্য চলে এলাম তার কাছে। পায়েলটা আর কেনা হলো না।
সারাদিন অনেক ঘুরাঘুরি করে এইমাত্র ফিরলাম হোটেলে। আজকেও ক্লান্ত হয়ে পরেছি আমি। রুমে এসেই ঢুকে পরলাম ওয়াশরুমে। সবার আগে ফ্রেশ হতে হবে আমায়। নয়তো কিছুতেই শান্তি পাবো না আমি।
ওয়াশরুম থেকে সোজা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সারাদিনের ক্লান্তি যেনো মুহুর্তেই কেটে গেছে। এখন অনেকটাই ভালো লাগছে। পানি খাওয়ার জন্য বেড সাইড টেবিলের উপর রাখা গ্লাসটা হাতে নিতেই কিছু একটা পড়ে গেলো নিচে। দেখলাম ছোট একটা বক্স পড়ে আছে। ওটা তুলে আবার আগের জায়গাতে রাখতে গেলাম আমি। কিন্তু বক্সের উপর আমার নাম লিখা দেখে আর রাখলাম না।
কিছু না ভেবেই খুলে ফেললাম বক্সটা। অবাক হওয়ার বিষয় হলো বক্সের ভিতর সেই পায়েল। আমি পায়েলটা হাতে নিতেই নিচে একটা চিরকুট দেখতে পেলাম। চিরকুট খুলে আরো অবাক হলাম আমি। সেদিন ড্রেসের সাথে যে চিরকুট ছিলো সেটার হাতের লিখা আর এই চিরকুটের লিখা সেইম। তারমানে একই লোক পাঠিয়েছে এগুলো। কিন্তু কে পাঠিয়েছে? আর কেনোই বা পাঠিয়েছে? ভাবলাম পায়েলটা ফেলে দেবো। কে না কে পাঠিয়েছে। আমি কেনো রাখবো? নিজে এসে দিয়ে যেতে পারলো না?
কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলাম একটা পায়েলই তো। ফেলে দেওয়ার দরকার নেই। তাছাড়া এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো। ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে না। তাই বিছানায় বসে পায়েলটা পরে নিলাম আমি। চিরকুটের লেখাগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। গুটিগুটি অক্ষরে লিখা
বেস্ট ফ্রেন্ডের ডাক শুনে এটা ফেলেই চলে এলে? অন্যের জন্য এভাবেই নিজের পছন্দের জিনিসগুলো ছেড়ে দাও বুঝি?
লিখাটা পড়ে হাঁসি আসছে আমার। এটাতো তেমন কিছুই না। লোকটা তো আর জানে না যে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে পছন্দের জিনিসটাই অন্যের জন্য ছেড়ে দিয়েছি।
পর্ব ১৫
রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে এসেছি সবাই। সারাদিনের ঘুরাঘুরিতে ক্ষিধেও পেয়েছে প্রচুর। কিন্তু হাজার ক্ষিধে থাকা সত্বেও ভালো করে খেতে পারছি না আমি। কিভাবে খাবো? কেউ যদি সারাক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে কি খাওয়া যায়? একদমই না। তাই আমিও খেতে পারছি না।
আমাদের পাশের টেবিলেই বসে আছেন তানভীর ভাইয়া। রেস্টুরেন্টে আসার পর থেকেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। বুঝতে পারছি না আমার মুখে কি এমন আছে যার জন্য উনি এভাবে তাকিয়ে আছেন। এদিকে উনাকে কিছু বলতেও পারছিনা আমি। কালকের ঘটনার পর উনার সাথে কথা বলাটা আমার পক্ষে অনেক কঠিন। আর উনি এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছেন সেই কখন থেকে।
আমি মুখ কাচুমাচু করে বসে আছি। খাবার সামনেই পরে আছে। আজকে যে আর খাওয়া হবে মা সেটা এতক্ষনে বুঝা হয়ে গেছে আমার। তানভীর ভাইয়াও হয়তো খাচ্ছেন না। তাইতো ফয়সাল ভাইয়া উনার পেটে কুনি মেরে বললো
- কি মামা? পাশে তাকিয়ে থাকলেই কি পেট ভরবে? খাবারটাতো তোর সামনে আছে পাশে না।
ফয়সাল ভাইয়ার প্রশ্নের উত্তরে তানভীর ভাইয়া মুচকি হেঁসে বললেন
- পেট ভরার আগে মন ভরাটা বেশি জরুরী রে দোস্ত। আমি এখন সেটাই করছি।
নয়ন ভাইয়া ফোড়ন কেটে বললেন
- কিন্তু তোমার মন ভরানোর চক্করে যে আরেকজনের খাওয়া হচ্ছে না মামা। শুধু নিজের দিকটা দেখলেই হবে?
নয়ন ভাইয়ার কথায় তারাতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলেন তানভীর ভাইয়া। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো খুব বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন উনি। উনি মাথা চুলকে চুলকে বললেন
- ভালো কথা বলেছিস দোস্ত। আসলে খেয়ালই ছিলো না আমার।
তানভীর ভাইয়ার উত্তরে নয়ন ভাইয়া আর ফয়সাল ভাইয়া শয়তানি হাঁসি দিলেও ফুয়াদ ভাইয়া চোখমুখ শক্ত করে বললেন
- আজকাল অন্য কোনোদিকেই তোর খেয়াল থাকছে না রে তানভীর। যেদিকে খেয়াল রাখার প্রয়োজন নেই সেদিকেই শুধু খেয়াল রাখছিস।
ফুয়াদ ভাইয়া যে এই কথাটা আমায় উদ্দেশ্য করে বললেন সেটা বুঝে গেছি আমি। কারণ কথাটা বলার সময় উনি আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সেটা উনার দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পেরেছি।উনার এই কথার মানে বোধহয় তানভীর ভাইয়া বুঝতে পারেন নি। তাই উনি জিজ্ঞেস করলেন
- কি বলছিস তুই ফুয়াদ। তোর কথার অর্থ বুঝলাম না।
- না বুঝার কি আছে।
- তুই কিছুদিন ধরেই কেমন আলাদা বিহেভ করছিস আমার সাথে।
ফুয়াদ ভাইয়া এবার একটু জোরেই বললেন
- সবার কাছেই কেনো মনে হচ্ছে আমি আলাদা বিহেভ করছি? আমি কি এমন করেছি সবার সাথে?
ফুয়াদ ভাইয়ার এমন রিয়েক্ট করায় সবাই অবাক হয়ে গেছে। ফুয়াদ ভাইয়া নিজেও হয়তো অবাক হয়ে গেছেন। কারণ তানভীর ভাইয়ার সাথে উনি আগে কখনো এভাবে কথা বলেননি। উনি কতক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলে উঠলেন
- সরি দোস্ত, তুই তো জানিসই যে রেগে গেলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। আর এখন আমি অন্য একটা বিষয়ে রেগে ছিলাম। তাই সেই রাগটা তোর উপর ঝেরে ফেলেছি আমি।
তানভীর ভাইয়া হেঁসে হেঁসে বললেন
- শাল, তুই সরি বলছিস কেনো? আমি জানি তুই কেমন। এটাও বুঝেছি যে তুই রেগে আছিস। নাহলে আমার সাথে কখনো এভাবে কথা বলতি না। আমি কিছু মনে করি নি।
পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক করে সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এখন আমিও খেতে পারছি। তানভীর ভাইয়া আর তাকাচ্ছেন না আমার দিকে। কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়া একটু পরপরই তাকাচ্ছেন। কিন্তু এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না আমার। আমি তো মন প্রাণ দিয়ে শুধু খেয়েই যাচ্ছি আর খেয়েই যাচ্ছি।
ডিনার করে চলে এসেছি হোটেলে। পরে আর কোনো ঝামেলাই হয়নি ফুয়াদ ভাইয়া আর তানভীর ভাইয়ার মাঝে। কিন্তু হোটেলে ফেরার সময় একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি আমি। ফুয়াদ ভাইয়া আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে কেমন রেগে গেছিলেন। যেনো আমি উনার জুতো চুরি করে এনে পরে ফেলেছি। উনার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকিয়েছিলাম আমার পায়ের দিকে। কিন্তু রেগে যাওয়ার মতো কিছুই দেখতে পাই নি। আমার পায়ে তো আমার জুতোই ছিলো। তাহলে উনি কেনো রেগে গেছিলেন সেই কারণটা অজানাই থেকে গেছে।
বিছানায় বসে বসে সারার বকবকানি শুনে চলেছি। আজকের দিনটা কেমন লেগেছে তারই বর্ননা দিচ্ছে সে। সারার ভাষ্যমতে তার একটা ইচ্ছা অপুর্ণই রয়ে গেছে। তার কল্পনা ছিলো সে যখন খালি পায়ে বালির উপর দিয়ে হাটবেঁ তখন তার পা কোনোকিছুতে লেগে কেটে যাবে। আর সে সিনেমার নায়িকাদের মতো ভাব নিয়ে নিচে বসে পরবে। ঠিক সেই সময়ই এন্ট্রি নেবে তার হিরো। একদম সিনেমাটিক কাহিনি। কিন্তু তার কল্পনা কল্পনাই থেকে গেলো। পা কেটে যাওয়া তো পরের কথা খালি পায়েই হাটতে পারেনি সে। তাই এখন সেটা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছে সারা।
বেস্টুর দুঃখে আমারো দুঃখ পাওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। তাই আমিও মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব এনে তার কথা শুনে চলেছি।
হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠতেই মুখভঙ্গির পরিবর্তন করলাম আমি। ফোনটা হাতে নিতেই আপুর নামটা ভেসে উঠলো চোখে। সবাইকে একটু আস্তে কথা বলতে বলে ফোন রিসিভ করলাম আমি। ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম আপুর গলা
- কি করছিস, মেঘা?
- এইতো বসে আছি সবার সাথে।
- ওহ। কেমন কাটলো আজকের দিন?
- হুম, ভালো।
- একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
- তো পারমিশন চাইছো কেনো? যা ইচ্ছা জিজ্ঞেস করো।
- ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে কি তোর কোনো ঝামেলা হয়েছে? মানে তুই কি উনার সাথে কোনো বেয়াদবি করেছিস?
- উনার সাথে আমি বেয়াদবি করেছি? কে বললো এসব?
- কেউ বলেনি। আমার মনে হয়েছে।
- হঠাৎ এরকম মনে হওয়ার কারণ?
- আসলে আজকে দুপুরে তোকে ফোন করেছিলাম কিন্তু তোর ফোন বন্ধ ছিলো।
- হ্যাঁ, চার্জ ছিলো না। কিন্তু এটার সাথে ফুয়াদ ভাইয়ার কি সম্পর্ক?
- তোর ফোন বন্ধ থাকায় ফুয়াদ ভাইয়াকে ফোন করেছিলাম তোর খোজ নিতে।
- তো?
- উনাকে তোর কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি রেগে গেলেন আর বললেন উনার কাছে তোর কোনো খবর নেই। তোর খেয়াল রাখার জন্য নাকি অন্য কেউ আছে। আমি যেনো তার কাছে ফোন করি।
আপুর কথা শুনে না চাইতেও অবাক হয়ে গেলাম আমি। এখানেও অন্য কেউ। বুঝতে পারছি না ফুয়াদ ভাইয়া কথায় কথায় অন্য কেউ,অন্য কেউ করেন কেনো। উনার এই কথা বলার কারণটা কি সেটা উনিই জানেন।
- আমি কিছুই জানি না আপু। উনি বোধহয় অন্য কোনো কারণে রেগে ছিলেন। তাই হয়তো….
- হুম বুঝতে পেরেছি। কিছুদিন আগেও উনি উনার রাগ কন্ট্রোল করে ফেলেছিলেন কিন্তু এখন আবার আগের মতো হয়ে গেছেন।
- ডোন্ট ওয়ারি, সব ঠিক হয়ে যাবে।
- হুম।
- আচ্ছা এখন রাখি।
- ঠিক আছে।
আপুর ফোন কেটে দিয়ে আবার সবার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম আমি। উদ্দেশ্য ফুয়াদ ভাইয়ার এসব কথার মানে খুজার চেষ্টা করবো না। কিন্তু চাইলেই কি সব পারা যায়? অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাথায় বারবার একটা কথাই ঘুরছে এইঅন্য কেউটা কে?
রাত একটা কি দেড়টা বাজে। ঘুমিয়ে আছি সবাই। সারা ঘরময় অন্ধকার। ঘুমের মাঝেই মনে হচ্ছে কেউ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কে তাকিয়ে আছে তা জানতে ইচ্ছে করছে আবার চোখ মেলতেও ইচ্ছে করছে না। তবু্ও পিটপিট করে তাকাতে চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু তার আগেই কেউ মুখ চেপে ধরলো আমার। অন্ধকারে তাকে দেখতেও পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে যেনো। কাউকে ডাকতেও পারছি না।
বেড সাইড টেবিলের উপর রাখা গ্লাসটা হাত দিয়ে ফেলে দিলাম আমি। সাথে সাথে লোকটা আমার মুখ ছেড়ে দিয়ে দ্রুত চলে গেলো। কাঁচ ভাঙার আওয়াজে জেগে গেছে সবাই। কি হয়েছে সেটাই জানতে চাইছে। কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারছি না। কথাগুলো গলায় এসে আটকে যাচ্ছে বারবার। ভয়ে সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে আমার। কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে থম মেরে বসে আছি আমি। আমি নিজেই তো হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত। কে করছে এমন? কেনোই বা করছে এসব? আর আমার সাথেই কেনো ঘটছে এসব?
পর্ব ১৬
গোধূলি লগ্নের ঝাপসা আলোয় ছেয়ে আছে চারদিক। আজকেও বিচে এসেছি ঘুরতে। তবে সবাই আসেনি। হোটেলেই থেকে গেছে অনেকে৷ আমারো আসার ইচ্ছে ছিলো না৷ সারার জোরাজোরিতে শুধুমাত্র আসা হয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না এলে অনেক কিছু মিস করতাম।
বিচে এখন এতোটাও ভীড় নেই। চারপাশে বইছে বাতাস সেইসাথে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ। আকাশটা কেমন লাল হয়ে আছে যেনো তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। এমন একটা পরিবেশে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে।
একা একাই হাটছি আমি। সারার সাথেই হাটতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার এককথা এই পরিবেশটাকে ফীল করার জন্য একা থাকা সবচেয়ে প্রয়োজন। আমরা দুজন একসাথে থাকা মানেই বকবক করা। সেজন্য আলাদা আলাদাই হাটতে হবে আমাদের। তাই এখন একা একাই হাটতে হচ্ছে আমায়। সারা অবশ্য ভুল কিছু বলে নি। সত্যিই এখন একা থাকতে ভালো লাগছে।
এসব কিছুর ভীড়ে যে কালকে রাতের ঘটনা আমি ভুলে গেছি এমনটা না। কিন্তু এখন ওসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না আমার। আমার সাথে ঠিক কি হয়েছিলো সেটা কাউকেই বলিনি আমি। বলেছি দুঃস্বপ্ন দেখেছি। নাহলে আমার জন্য পুরো ট্যুরটাই নষ্ট হয়ে যেতো। আজকে সারাদিনই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ করেছি সবার সাথে।
সাগরের তীর ধরে হেটে যাওয়ায় ঢেউগুলো এসে পায়ে লাগছে আমার। আমার দৃষ্টি অস্থির সেই সাথে ভাবনাও। মাথার ভেতর সবটাই মনে হচ্ছে ফাঁকা হয়ে আছে। মস্তিষ্কও হয়তো জটিল কিছু ভাবতে চাইছে না আজ। পরিবেশটাকে অনুভব করতে চাইছে শুধু।
আমি যখন নিজের সাথে সময় কাটাতে মগ্ন হয়ে আছি তখনি মনে হলো আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে কেউ। তার দৃষ্টি বোধ হয় আমার দিকেই। কিন্তু আমি এখনো তাকাই নি সেদিকে। তবে বুঝতে পারছি এটা তানভীর ভাইয়া।
এমন ভাবে দুজন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি যেনো কথা বললেই ফাঁসি হয়ে যেতে পারে আমাদের। তাই কথা না বলাই শ্রেয়। কিন্তু তানভীর ভাইয়ার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না খারাপ লাগছে সেটা বুঝতে পারছি না আমি। এবার মনে হচ্ছে উনার দিকে তাকালো উচিৎ আমার। নয়তো ভাববেন আমি ইগো দেখাচ্ছি।
তানভীর ভাইয়ার দিকে ঘুরতেই দেখলাম উনি এখনো তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনার এই চাহনির মানে যে আমি বুঝতে পারি না এমনটাও নয়। কিন্তু আমি বুঝতে চাই না। কারণ আমার সবটা জোরেই শুধু ফুয়াদ ভাইয়া রয়েছে। চাইলেও সেই জায়গাটা কাউকে কখনো দিতে পারবো না আমি।
হালকা লাল আভায় তানভীর ভাইয়ার মুখও লাল হয়ে আছে। ছোট ছোট চুলগুলো অবাধ্যের মতো কপালে এসে পরছে বারবার। আজ হালকা গোলাপি রঙের একটা শার্ট গায়ে জরিয়েছেন তিনি। না চাইতেও ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে উনার তুলনা করে ফেলছি আমি। তবে আমার কাছে ফুয়াদ ভাইয়াই বেস্ট সবসময়।
- এভাবে তাকিয়ে থেকো না আমার লজ্জা লাগে তো।
তানভীর ভাইয়ার কথায় ভীমড়ি খেলাম আমি। আজকেও উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি? উফ, কি অস্বস্থিকর। মিটমিটিয়ে হাঁসছেন তানভীর ভাইয়া।
- থাক আর লজ্জায় লাল হতে হবে না।
- না মানে আসলে।
- এতো কথা বলতে হবে না। চলো একসাথে হাঁটি।
যদিও আমার একা একা হাঁটতেই ভালো লাগছে তবুও না করলাম না আমি। এভাবে কারো মুখের উপর সরাসরিনা শব্দটা ব্যবহার করা যায় না।
- চলুন।
আবারো হাঁটছি দুজন। কথা না বলার ইচ্ছেটা দুজনের মাঝেই প্রকট। হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত আবদার করে বসলেন তানভীর ভাইয়া। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন
- আমি কি তোমার হাতটা ধরে হাঁটতে পারি, মেঘা?
কি নিঃসঙ্কোচ আবদার! উনার কথায় মনে হচ্ছে আমার হাঁতটা ধরার অধিকার শুধু উনারই আছে। এখন উনি অনুমতি চাইছেন মাত্র। তবে উনার চোখে চলছে হাত ধরতে দেওয়ার আকুতি। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি।
অনেক্ষন আমার কোনো সাড়া না পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললেন তানভীর ভাইয়া। হয়তো খারাপ লাগছে উনার। কিন্তু আমি কি করতে পারি এখন? অনুমতি দেবো উনাকে? দিলে কি খুব বেশি খারাপ হয়ে যাবে? শুধু হাতটাই তো ধরতে চেয়েছেন উনি।
আমি চেহারায় স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনে মুচকি হেঁসে বললাম
- পারেন।
আমার এই উত্তরে অবাক হয়ে গেছেন তানভীর ভাইয়া। হয়তো বিশ্বাস করতে পারছেন না যে আমি রাজি হয়ে গেছি। উনাকে স্বাভাবিক করতে আবারো বলে উঠলাম আমি
- কি হলো ধরবেন না?
- হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই।
তানভীর ভাইয়া হাত বারানোর আগেই আমি উনার হাত ধরে হাটতে লাগলাম। আমার এই আচরণে হয়তো আরো অবাক হয়েছেন উনি। তবে খুশিও হয়েছেন প্রচুর। আমি খুশি কি না জানি না। তবে উনাকে খুশি দেখে ভালো লাগছে আমার৷
কোন এক গোধূলি লগ্নের এমন সময়ই আমি কারো হাত ধরে হাটার স্বপ্ন দেখতাম। আর এই কেউটা ছিলো ফুয়াদ ভাইয়া। আজকে আমি হাটছি ঠিকই কিন্তু আমার হাতে রাখা হাতটা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত একজন ব্যাক্তির৷
এখন মাঝরাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। সারাদিন কালকের কথা মনে না হলেও রাতের পর থেকে আবার মাথায় এই চিন্তাই ভর করেছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে চলেছি শুধু। বাসায় থাকলে এতক্ষণে চলে যেতাম বেলকনিতে। কিন্তু এখন তাও সম্ভব নয়। কেনো জানি ভয় করছে ভীষণ।
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবু্ও হাত বারিয়ে পানিটা খেতে ইচ্ছে করছে না। আমি বোধ হয় দিনদিন অলসের গোডাউন হয়ে যাচ্ছি। কিছুই করতে ইচ্ছে করে না আমার।
আচমকাই মনে হলো রুমে অন্য কেউ আছে। বুকের ভেতর ঢাক-ঢোল বেজে চলেছে ক্রমাগত। আমি শিউর কালকের লোকটাই এসেছে আবার। হয়তো কাল তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তাই আজ আবার এসেছে। আমি সোজা হয়ে শুয়ে আছি। লোকটাকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমি জেগে আছি।
লোকটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমার ভয় চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে। আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি চিৎকার করার। উনি আমার মাথার কাছে এসে বসলেন। ঠিক করেছি এখনই চিৎকার করবো আমি। উনি নিশ্চয়ই মারতে এসেছেন আমায়।
কিন্তু আমার ভাবনায় এক ট্যাংক পানি ঢেলে অবাক হওয়ার মতো কাজ করে বসলেন লোকটি। আমার দিকে ঝুকে কপালে একটা চুমু একে দিলেন উনি। আমি তো ফ্রিজড হয়ে গেছি। সাথে আশ্চর্যও হয়েছি। কালকে এলেন মারতে আর আজকে……..। আর ঘুমিয়ে থাকার নাটক না করে চোখ খুলে ফেললাম আমি। কিন্তু অন্ধকারে মুখটা দেখতে পারছি না।
আমি জেগে গেছি বুঝে যাওয়ায় আজকেও দ্রুত চলে গেলেন উনি। কেনো যেনো আমিও আটকাই নি। আটকাবো কি করে? আমার আশেপাশের কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না আমার। যখন বুঝতে পারলাম আমি লোকটাকে খুব সহজেই ছেড়ে দিয়েছি তখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। চাইলেই তো আটকে রাখতে পারতাম আমি।
কিন্তু উনি রুমে ঢুকলেন কি করে? আমি যেতদূর জানি দরজাতো ভেতর থেকে বনশ ছিলো। আর কালকেই যদি কেউ মারতেই আসে তাহলে আজকে এমন করার মানে কি? তাহলে কি এই দুজন এক না? আর কিছু ভাবতে পারছি না আমি। শুরু হয়ে গেছে অসহ্য মাথা ব্যাথা।
পর্ব ১৭
বাসে বসে আছি। আজকে ফিরে যাচ্ছি আমরা। সবাই এখনো উঠে নি বাসে। তাই বসে বসে অপেক্ষা করছি। আজ জানালার পাশেই বসেছি আমি। আমার পাশেই আছে সারা। কোনো কারণে আমার মন খারাপ সেটা হয়তো বুঝতে পেরেছে সে। তাই আজ আর জানালার পাশে বিসা নিয়ে ঝামেলা করে নি।
সবাই বাসে উঠে যাওয়ার পর বাস ছাড়লো ঢাকার উদ্দেশ্যে। সিটে মাথা হেলিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি আমি। বাতাসের ঝাপটায় চুলগুলো মুখের সামনে এসে পরছে বারবার। মুখে কেমন যেনো শুরশুরি লাগছে আমার। কিন্তু এভাবেই চুপ করে বসে আছি। যেনো অনুভতিহীন একটা মাটির পুতুল আমি।
কালকে আমাদের রুমে কে এসেছিলো তা আমি জানি না। কিন্তু কেনো যেনো খুব পরিচিত লেগেছে আমার কাছে। কোনো এক অজানা টানে কিছুই করতে পারিনি আমি। আগের দিন রাতে তো এমন অনুভূতি হয় নি। এখন আমি শিউর যে কাল রাতের ব্যাক্তি আর এর আগের রাতের ব্যাক্তি সম্পুর্ন আলাদা। তাদের উদ্দেশ্যও ছিলো আলাদা।
আজ আমরা জুনিয়ররা সবাই একসাথে। তাই ফুয়াদ ভাইয়ারা অন্য বাসে আছেন। খুব মিস করছি উনাকে। মনে হচ্ছে আমার পাশের সিটটায় যদি সারার বদলে ফুয়াদ ভাইয়া থাকতেন! কিন্তু এই ইচ্ছা তো কোনোদিনই পূরণ হবার নয়।
- কি নিয়ে মন খারাপ তোর?
সারার প্রশ্ন কানে এলেও তা এড়িয়ে গেলাম আমি। চুপ করেই বসে রইলাম।
- কিরে কথা বলবি না?
- প্লিজ সারা, এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার।
- ওহ, আচ্ছা ঠিক আছে। তুই চুপ করে বসে থাক। আমি বরং ঘুমাই। এতোক্ষণ চুপ করে বসে থাকার চেয়ে ঘুমানোই ভালো।
- হুম।
আবারও আগের মতোই বসে রইলাম আমি। আজ বাসে সবাই নিরব। কোনো মিউজিক বাজছে না আর না কেউ গলা মেলাচ্ছে। তবে ভালোই লাগছে এভাবে। চোখ বন্ধ করতেই চোখে ভাসছে ফুয়াদ ভাইয়ার চেহারা। ফুয়াদ ভাইয়াকে কি আমি কোনোদিনই ভুলতে পারবো না? এই প্রশ্নের উত্তরটা জানা যে আমার খুব প্রয়োজন।
ভারসিটির মাঠে এসে থেমেছে আমাদের বাস। আজকেও প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে নেমে গেলাম সবাই। খুব ঘুম পাচ্ছে এখন আমার। মাঠেই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরতে ইচ্ছে করছে। যেহেতু এই ইচ্ছাটাও পূরণ হবার নয় তাই চোখে-মুখে পানি দিয়ে ঘুম দূর করার চেষ্টা করলাম আমি।
একে একে সকলেই চলে যাচ্ছে যে যার বাসার উদ্দেশ্যে। আমি আর সারা একপাশে দাঁড়িয়ে আছি। সারা তার ভাইয়াকে ফোন করে বলে দিয়েছে যেনো তাকে এসে নিয়ে যায়। এই সন্ধ্যায় একা একা যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমিও ফোন বের করলাম ভাইয়াকে ফোন করবো বলে। কিন্তু তার আগেই হুট করে কোথা থেকে তানভীর ভাইয়া এসে বললেন
- এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো তোমরা?
- ভাইয়া এসে নিয়ে যাবে তো তাই।
- ওহ, তুমি চাইলে আমি দিয়ে আসতে পারি।
- না ভাইয়া, লাগবে না।
আমি তানভীর ভাইয়াকে না করলেও উনি হয়তো জোর করে হলেও আমায় উনার সাথে নিয়ে যেতেন। কিন্তু তার সুযোগ না দিয়েই ফুয়াদ ভাইয়া ঝড়ের গতিতে এসে আমার হাত টেনে ধরে তানভীর ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন
- তোর কষ্ট করতে হবে না রে ভাই। যেহেতু ও আমার কাজিন তাই আমিই পৌছে দেবো ওকে।
- কিন্তু তোর বাসা তো ওদের বাসার উল্টো দিকে।
- সমস্যা নেই। আজকে আমি আর বাসায় যাবো না। মেঘাদের বাসায়ই থাকবো।
ফুয়াদ ভাইয়ার কথার পরিপ্রেক্ষিতে তানভীর ভাইয়া ছোট করেওহ বললেন শুধু।
সারা আর তানভীর ভাইয়াকে বিদায় জানিয়ে আমাকে নিয়ে ভারসিটি থেকে বেরিয়ে এলেন ফুয়াদ ভাইয়া। রাস্তায় এসে একটা রিকশা দাঁড় করালেন উনি। আমি কিছুই বলছি না। নিরব দর্শকের মতো দেখে চলেছি মাত্র। ভাবতেই অবাক লাগছে ফুয়াদ ভাইয়া আমার সাথে এক রিকশায় বসে যাবেন। আর এখনও পর্যন্ত আমার হাতটা উনার হাতেই আছে। আমার কাছে তো অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়ারও কি আমার মতো আলাদা ফিলিংস কাজ করছে নাকি সেটা জানি না।
রিকশায় উঠে বসেছি দুজন। দুজনের মাঝে যথাসম্ভব দুরত্ব বজায় রাখার চেষ্টায় আছি আমি। কিন্তু ফুয়াদ ভাইয়া আজ তেমন কিছুই করছেন না। আগে তো আমার পাশে বসা দূর ভাবতেই পারতেন না উনি। আর আজ কত অবলীলায় বসে আছেন আমার পাশে। মনে হচ্ছে সবটাই আমার স্বপ্ন। আদৌ কি এটা সম্ভব?
সময় থেমে থাকে না। সে গতিশীল। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিনটা মাস। ফুয়াদ ভাইয়ার ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়ে গেছে। এখন উনি নিজেদের ব্যাবসায় হাত দিয়েছেন।
কথা ছিলো উনার এক্সাম শেষ হয়ে গেলেই এনগেজমেন্ট হবে। কথামতো তাই করা হবে। কালকেই ওদের এনগেজমেন্ট। সারা বাড়িতে সেটারই তোর জোর চলছে। সব আত্মীয় – স্বজনরা চলে এসেছেন বাসায়। সারা বাড়ি গমগম করছে। বাচ্চারা মাতিয়ে তুলেছে পুরো বাড়ি।
এনগেজমেন্ট হবে কাল কিন্তু বাড়ির ভেতরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আজকেই এনগেজমেন্ট। শুনেছি বড় বোনের বিয়েতে ছোট বোন সবচেয়ে বেশি মজা করে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা পুরো উল্টো। বুঝতে পারছি না আমি খুশি নাকি খুশি নই। আপুর বিয়ে সেই হিসেবে আমার খুশি হওয়ার কথা। আবার, ফুয়াদ ভাইয়ার বিয়ে হিসেবে কষ্ট পাওয়ার কথা।
এইমুহূর্তে আমার মধ্যে ঠিক কোন অনুভূতি কাজ করছে তা বুঝতে পারছি না আমি। তবে আমি খুশিই হবো এই প্রতিজ্ঞা করেছি। শুধু শুধু কষ্ট পাওয়ার কোনো মানেই হয় না। কার জন্য কষ্ট পাবো? যার কাছে কিনা আমার কোনো মূল্যই নেই।
পর্ব ১৮
নিজের ঘরে বসে আছি আমি। বাড়িতে থাকতেই ভালো লাগছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। অন্যসময় হলে হয়তো ছাদে গিয়ে বসে থাকতাম। কিন্তু এখন সেটাও পারবো না। বাড়ির ছাদটাও দখল করে বসে আছে সবাই।
ভাবতেই অবাক লাগছে কাল আমার আপুর বিয়ে। অথচ আমি মন খারাপ করে নিজের ঘরে বসে আছি। বড় বোনের বিয়েতে নাকি ছোট বোন অনেক মজা করে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। এর কারণটা শুধু ফুয়াদ ভাইয়া। ফুয়াদ ভাইয়ার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এতক্ষনে পুরো বাড়ি মাথায় করে রাখতাম আমি। বুঝতে পারছি না এখনই এতো খারাপ লাগছে তাহলে পরে ওদের দুজনকে একসাথে দেখবো কি করে?
কফির মগটা হাতে নিয়ে চলে এলাম বেলকনিতে। আজকে আকাশে চাঁদও নেই তারাও নেই। পুরো অন্ধকার। আশেপাশের বাসার জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসছে ছোট ছোট আলোকরশ্মি। তবে তা দিয়ে এই অন্ধকার কাটছে না বরং অন্ধকারটাকে আরো স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে। ঝাপসা চোখে এই অন্ধকারেই তাকিয়ে আছি আমি। আজ মনে হচ্ছে আলো নয় অন্ধকারই ভালো আমার জন্য।
কফিতে চুমুক দিতেই চোখ – মুখ কুচকে এলো আমার। ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় তেঁতো লাগছে। তাই ওটা রেখে দিলাম পাশে। সবার চেচামেচি এখনও আসছে কানে। এমনিতেই মাথা ব্যাথা করছে অনেক। তার উপর এসব ভালো লাগছে না আমার। কিন্তু সবাই তো আর আমার ভালোলাগা নিয়ে বসে থাকবে না। এটা ভেবেই চুপ করে আছি আমি।
হঠাৎ ফোনের রিংটোন কানে আসতেই চলে এলাম ঘরে। ফোনের স্ক্রিনে জলজল করে ভাসছে তানভীর ভাইয়ার নাম। উনি এখন কেনো ফোন করলেন কে জানে। ফোনটা রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না মোটও। কিন্তু করতে তো হবেই। নাহলে উনি অভদ্র ভাববেন আমায়। হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোন রিসিভ করলাম আমি।
- আসসালামু আলাইকুম।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছো মেঘা?
- জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাইয়া। আপনি?
- আমিও ভালো আছি। আই এম সো এক্সাইটেড।
- কেনো ভাইয়া?
- আরে কাল আমার বেস্টফ্রেন্ডের এনগেজমেন্ট না? তাই। ফুয়াদ তো আমাদের সবার আগেই বিয়ে করে ফেলছে। আমরাই সিঙ্গেল রয়ে গেলাম।
- ওহ। আপনারা সবাই আসছেন তো কালকে?
- অবশ্যই। ফুয়াদের এনগেজমেন্ট আর আমরা আসবো না?
- হুম, আচ্ছা ভাইয়া এখন রাখি। একটু কাজ আছে।
- ওহ। ঠিক আছে তাহলে। কাল দেখা হচ্ছে।
- জ্বী।
ফোন রেখে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। অনেক্ষন যাবৎ ঘরে আছি। বড় বোনের বিয়েতে ছোটবোনই নেই ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতো। তাই আর ঘরে না থেকে সবার সাথে আড্ডা দেবো বলে ঠিক করেছি। সবসময় নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য দিলে চলে না।
ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২:৩০ টা ছুইছুই। ঘুমানোর প্রস্তুতি চলছে। সবে মাত্র ঘরে এলাম আমি। একা একা বসে থাকার চেয়ে সবার মাঝে থেকে হাঁসি-ঠাট্টা করায় মনটা হালকা লাগছে এখন। গেস্টরুমে বাহিরের আত্নীয়-স্বজনরা থাকবে। আর খুব কাছের যারা আছে তাদেরকে আমাদের সাথেই থাকতে হবে। নয়তো জায়গা হবে না। ভাবছি এনগেজমেন্টেই এই অবস্থা বিয়েতে না জানি কি হবে।
আমার কাজিনরা সবাই আমাদের তিন ভাই বোনের ঘরে থাকবে বলে ঠিক করেছে। তাদের মধ্যে অহনা আপু, দিশা আপু আর লাবণ্য আপু আমার ঘরে থাকবে বলে যুদ্ধ করছে। তিনজনই আমার ঘরে থাকতে চায়। অন্য ঘর চলবে না। বিছানায় ঘুমাতে না পারলে সোফায় ঘুমাবে কিন্তু আমার ঘরেই থাকবে। ওদের তিনজনের ঝগড়া দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার ঘরে ঘুমানোর এতো ইচ্ছা কেনো তা বুঝতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি নিশ্চিন্তে খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। আমার ঘরটা কেনো ওদের এতো প্রয়োজন সেটা আমি জানি।
আসল কথা হলো ওরা তিনজনই আমার বড়। তাই আমি ওদের সব কথা মেনে চলি। ওরাও আমার উপর ছুরি ঘুরায়। সেই সুযোগে তারা আমার সামনে নির্ভয়ে তাদের বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে পারে। যেটা অন্য কারো সামনে সম্ভব নয়। আজ সারাদিনেও হয়তো কথা হয়নি বয়ফ্রেন্ডের সাথে। তাই এখন কথা বলবে হয়তো। সেজন্যই আমার ঘরটা এতো প্রিয় তাদের।
ঝগড়া থামিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তিনজনই আমার ঘরে থাকবে। তবে তাদেরকে শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে আমার ঘুমের যেনো বারোটা বাজানো না হয়। তারা সোফায় থাকবে না ফ্লোরে সেটা তাদের ব্যাপার। তারাও খুশি মনে রাজি হয়ে গেছে।
সারা ঘরে এখন আমরা চারজন। অহনা আপু আর লাবণ্য আপু চলে গেছে বেলকনিতে। তাদের প্রেম কত রাত পর্যন্ত চলবে সেটা জানা নেই আমার। ওদের কান্ড দেখে মুচকি মুচকি হাঁসছি আমি। এছাড়া আর করার কিছুই নেই। এসবের মাঝে ঘুম আসবে বলেও মনে হয় না।
চোখ বুজে শুয়ে আছি আমি আর আমার পাশেই শুয়ে আছে দিশা আপু। কোনোকিছু নিয়ে ঝগড়া চলছে দিশা আপু আর তামিম ভাইয়ার মধ্যে। সেটা ওদের কথার ধরন দেখেই বুঝতে পারছি। কিন্তু ঝগড়ার কারণটা বুঝতে পারছি না। এটা সম্পূর্ণ ওদের ব্যাক্তিগত বিষয়। অন্যের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে আমি কখনোই পছন্দ করি না। তবে আজ কেনো যেনো জানতে ইচ্ছে করছে।
এক পর্যায়ে রাগ করে ফোন রেখে দিলো দিশা আপু। মনে হচ্ছে তামিম ভাইয়াকে কিছু একটা বুঝাতে ব্যার্থ হয়েছে সে। তাকে এখন সামনে পেলে হয়তো স্কুলের গণিত টিচারের মতো দু – একটা চড় থাপ্পড়ও মেরে বসতো দিশা আপু। আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম
- ঝগড়া হয়েছে তোমাদের?
- ঠিক ঝগড়া না ভুল বুঝাবুঝি চলছে।
আমি সংকোচ নিয়েই বলে উঠলাম
- আমায় কি বলা যাবে আসল ব্যাপারটা কি?
আমার কথা শুনে আমার দিকে ঘুরলো দিশা আপু। চুপচাপ তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আমি একটা ঢুক গিলে বললাম
- না মানে যদি বলতে চাও আরকি।
- না বলার কি আছে? আর তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো?
- ভয় পাচ্ছি না। কেমন লাগছে যেনো। যতই হোক এটা তোমাদের পারসোনাল মেটার।
- হুর, রাখ তোর পারসোনাল মেটার। বড় বোনের প্রেমের ব্যাপারে ছোট বোন জানবেই। এখানে পারসোনাল বলতে কিছু নেই।
- হুম, তাহলে বলো।
- আসলে আমি আমার একটা ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলেছিলাম আজ।
- তো?
- আসলে ওই ফ্রেন্ডটা একটা ছেলে। আর তামিম কেনো জানি না ওকে পছন্দ করে না। তাই ওর সাথে কথা বলতে নিষেধ করেছে। ওর নিষেধ করে সত্বেও কেনো কথা বলেছি এটা নিয়ে ঝগড়া চলছে।
- ওহ।
আর কিছু বললাম না আমি। কেমন আজব লাগছে। জাস্ট কথাই তো বলেছে তার জন্যই এতো কিছু? দুজনেই চুপ করে শুয়ে আছি। বেলকনি থেকে ভেসে আসছে অহনা আপু আর লাবণ্য আপুর ফিসফিসানি। হঠাৎ করেই হেঁসে দিলো দিশা আপু। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। মাত্রই রাগে ফুসফুস করছিলো আবার এখন হাঁসছে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
- হাঁসছো কেনো আপু?
- তামিমের কথা ভেবে।
- মানে?
- ও সত্যিই আমাকে অনেক ভালোবাসে।
- কিভাবে বুঝলে?
- আরে ভালোবাসে বলেই তো অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারে না আমায়। রাগারাগি করে আমার সাথে। আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পর। কাল তারাতাড়ি উঠতে হবে।
- হুম।
এপাশ ঘুরে শুয়ে রই পরলাম। দিশা আপুর কথাগুলো মাথায় ঘুরাঘুরি করছে। ভালোবাসলেই অন্য কারো সাথে সহ্য করা যায় না? হয়তো। তাই তো আমি ফুয়াদ ভাইয়াকে আপুর সাথে দেখে কষ্ট পাই। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করলাম আমি। আমি তানভীর ভাইয়ার সাথে যতবারই কথা বলেছি ততবারই অদ্ভুত রিয়েক্ট করেছেন ফুয়াদ ভাইয়া। কেমন রেগেমেগে আগুন হয়ে যেতেন উনি। কিন্তু উনি তো আমায় ভালোবাসেন না। তাহলে রাগ করেন কেনো?
সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে ব্যাস্ততা। নিজের হাতে আপু আর ফুয়াদ ভাইয়ার এনগেজমেন্টের কাজ করছি আমি। সবার সাথে হাঁসি – মজায়ও পিছিয়ে নেই। এমন ব্যাবহার করছি যেনো সব স্বাভাবিক।
- আরে বাহ, তুই যে এতো স্ট্রং আজকে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম নারে?
হঠাৎ সারার গলা পেয়ে পিছনে তাকালাম আমি। ওকে আজ তারাতাড়ি চলে আসতে বলেছিলাম। তাই সে এসে গেছে। কিন্তু ওর কথায় সবাই অবাক হয়ে গেছে। সারা এটা কেনো বলেছে আমি সেটা জানলেও অন্য কেউ তো আর জানে না? এই মেয়ের এক স্বভাব অলওয়েজ উল্টাপাল্টা জায়গায় উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলে। আর সমস্যায় পরতে হয় আমায়।
- স্ট্রং মানে? তুমি কি বলছো সারা?
ভাইয়ার প্রশ্নে সারা বুঝতে পারলো কোথায় কি বলে ফেলেছে সে। এবার মুখ কাচুমাচু করে আমার দিকে তাকালো সারা। আমি চোখ গরম করে তাকিয়ে আছি যার অর্থআজ তোর খবর আছে। সারা তার মুখে জোরপূর্বক হাঁসি এনে বললো
- কিছু না ভাইয়া। আসলে মেঘা যে এতো এতো কাজ করতে পারে সেটা তো আমি জানতাম না। তাই আরকি বললাম যে ও স্ট্রং।
-ওহ, সেটাই বলো। তাই তো বলি মেঘা আর স্ট্রং? ওহ মাই গড।
ভাইয়ার দিকে রেগে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম
- তো কি বলতে চাইছিস তুই? তুই জানিস আমি ডোরেমনের জিয়ানের মতো শক্তিশালী। এক ঘুষি মেরে তোর সব দাঁত ফেলে দিতে পারি।
- থাক বোন থাক। তুই যে একটা গুন্ডী সেটা বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে গর্ব করে বলতে হবে না। পরে দেখা যাবে তোর আর বিয়েই হবে না।
- আমাত বিয়ে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তোকে কোন মেয়ে বিয়ে করবে সেটা নিয়ে ভাব। যত্তসব।
সারার দিকে চোখ রাঙিয়ে চলে এলাম নিজের ঘরে। সারাও শুকনো ঢুক গিলে চলে এলো আমার পিছু পিছু। আমি চুপচাপ জামাকাপড় গোছাচ্ছি। গোছানো গুলোও গুছাচ্ছি। এর একমাত্র কারণ আমি রেগে আছি সেটা সারাকে বুঝানো। সেও আমার কাছে এসে দাঁত কেলিয়ে বললো
- রাগ করেছো জানু?
-…………….
- কি হলো? কথা বলো? আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি।
- এক পাও বাইরে রাখলে ঐ দিনের ছেলেটার সাথে ঘাড় ধরে বিয়ে দিয়ে দিবো বলে দিলাম।
- তাহলে কথা বলিস না কেনো?
- এমনি।
- তখনের কথাটা কিন্তু একেবারে সত্যি। তুই অনেক স্ট্রং মেঘা। নিজের ভালোবাসাকে নিজেরই আপুর হাতে তুলে দিচ্ছিস।
- তোর ভুল হচ্ছে কোথাও। আমি তুলে দিচ্ছি না। যদি ফুয়াদ ভাইয়াও আমায় ভালোবাসতো তাহলে এটাকে তুলে দেওয়া বলা যেতো। আমিতো জাস্ট সেক্রিফাইজ করছি।
- সেটাও ঠিক। তোকে একটা বুদ্ধি দিই?
- কি?
- চল দুজন একসাথে বসে আরজিৎ সিং এর সেড সং শুনি। আহা কি মজা হবে।
- সারা……
- থাক থাক লাগবে না তুই কাজ কর। এখানে তো তেমন কোনো কাজ নেই তুই বরং পুরো ঘরটাকে এলোমেলো করে ফেল। পরে দুজনে মিলে গুছিয়ে রাখবো।
- আর একটা কথা বললে তোকে আমি বড়ইয়ের আচাড় খায়িয়ে দেবো।
- ওয়াক থু। বড়ই আচাড়? না রে যেদিন বড়ই আচাড়ে পোকা দেখেছি সেদিন থেকে বড়ই নাম শুনলেই বমি আসে।
- হুম। সো বাঁচতে চাইলে মুখ অফ নো বকবকিং।
- ওকে ওকে।
- এইতো ভালা গার্ল।
- হুম রে জানু।
পর্ব ১৯
বিকেলবেলা সবার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আছি আমি। সবাই এসে গেছে প্রায়। এতো মানুষের ভীড়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাড়িটা যেনো মাছের বাজারে পরিণত হয়ে গেছে। মেইন রিচুয়াল শুরু হবে সন্ধ্যায়। সারা বাড়ি সাজানো হয়ে গেছে। বাড়ির ভেতরটা দেখে বুঝার উপায় নেই যে এখানে এনগেজমেন্ট হচ্ছে না বিয়ে।
গ্রাম থেকে যেসব আত্মীয় স্বজনরা এসেছে তারা সবাই বকবক করতে করতে কান খেয়ে ফেলছে। কতরকম কৌতুহল তাদের। নানুবাড়ির সবাই ফুয়াদ ভাইয়াদের বাসায় আছে। তাদের সাথেই আসবে। একসাথে ছেলেপক্ষ আর মেয়েপক্ষ হলে যা হয় আরকি। সবাই মিলে সন্ধ্যায় কোন ড্রেস পরবে, কিভাবে সাজবে এমনকি কোন স্টাইলে সেলফি তুলবে তাও ঠিক করে ফেলেছে। আমি চুপচাপ বসে আছি শুধু। যতই নিজেকে ঠিক রাখতে চাইছি না কেনো তা পেরে উঠছি না। মনে হচ্ছে কি যেনো হারিয়ে ফেলছি আমি।
সারাকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। এই অল্প সময়েই কি সুন্দর আমার সব কাজিনদের সাথে মিশে গেছে। ওর এই গুণটা অনেক ভালো লাগে আমার। মনে হয় সবার সাথে মিশে যাওয়ার এক ম্যাজিকাল পাওয়ার নিয়ে জন্মেছে সে। খুব তারাতাড়ি ভাব করে নেয় সবার সাথে। আমিও সবার সাথে মিশতে পারি। তবে এতো তারাতাড়ি না।
আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো যখন শুনতে পেলাম সবাই বলছে ফুয়াদ ভাইয়ারা এসে গেছে। সবার সেকি উচ্ছাস! ফুয়াদ ভাইয়াকে তো আর প্রথম দেখছে না তারা। কিন্তু এবার সবার রিয়েকশন আলাদা। এতোদিন উনাকে এবাড়ির ছেলে হিসেবে দেখতো আর এখন থেকে দেখবে জামাই হিসেবে সেজন্য হয়তো এমন করছে তারা। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে এখানে। চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাতে পারছি না আমি। একঝাঁক শুণ্যতা ঘীরে ধরছে আমায়।
- মেঘা কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ। এতক্ষণ ধরে ঠিক থাকতে পারলে এখন পারবি না কেনো?
সারার কথায় অনেকটা স্বাভাবিক হলাম আমি। বেস্টফ্রেন্ড মানেই হয়তো দুর্বলতা কাটিয়ে তোলার আরেক মাধ্যম। কঠিন সময়ে যাকে পাশে পাওয়া যায়। যার একটা কথায়ই হারিয়ে যাওয়া মনোবল খুজে পাওয়া যায়। সারার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলাম আমি যার অর্থহ্যাঁ, আমি পারবো। আমার উত্তরে এক টুকরো হাঁসি উপহার দিলো সে।
এবার সামনের দিকে তাকালাম আমি। না চাইতেও আবার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। আজকেও কালো রঙে নিজেকে সাজিয়েছেন ফুয়াদ ভাইয়া। মুখে ঝুলে আছে মৃদু হাঁসি। উনার সাথেই আছেন উনার বন্ধুরা।
আলাদা একটা ঘর বরাদ্দ করা হলো ফুয়াদ ভাইয়াদের জন্য।সন্ধ্যা পর্যন্ত যেখানে উনি আর উনার বন্ধুরা থাকবেন। সমস্যা হলো যখন উনাদের ঐ ঘরে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠলো। আজ সবাই এমন ভাব করছে যেনো ফুয়াদ ভাইয়া কোনো এলিয়েন। উনাদেরকে ঐ ঘরে কে দিয়ে আসবেন সেটা নিয়েই ভাবনাচিন্তার শেষ নেই। বুঝতে পারছি না এমন করার কি আছে। আগে তো ফুয়াদ ভাইয়া একা একাই সারা বাড়িতে ঘুরে বেরাতো। তাহলে আজকে আবার কাউকে সাথে যেতে হবে কেনো? আজব!
- দিশা তুই যা ফুয়াদের সাথে।
মায়ের আদেশে মুখ কাচুমাচু করে ফেললো দিশা আপু। কুচকে যাওয়া মুখ নিয়েই আমতা আমতা করে বললো
- চাচী প্লিজ আমি যাবো না।
- কেনো?
- আমার কেমন লজ্জা লাগছে।
- আরে পাগল এখানে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
- জানি না। প্লিজ চাচী।……. এক কাজ করো মেঘাকে পাঠাও তাহলেই তো হয়।
দিশা আপুর কথা শুনে সারার দিকে তাকালাম আমি। সে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
- আমি কেনো আপু? তোমরা যাও না।
- একদম না। তুই যাবি। তুইই ঠিক আছিস। তাই না বলো চাচী?
- দিশা ঠিকই বলেছে। তুইই ওদের নিয়ে যা।
এবার তো আর কিছু করার নেই আমার। সবার ফাপড়ে পরে গেছি। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফুয়াদ ভাইয়াদের সাথে উঠে এলাম আমি। ফুয়াদ ভাইয়া আমার পাশেই আছে। কিন্তু আমি তাকাচ্ছিনা উনার দিকে। কি দরকার শুধুশুধু কষ্ট বাড়ানোর?
উনাদের ঘরে রেখেই চলে আসার জন্য পা বারালাম আমি। কিন্তু তখনই শুনতে পেলাম তানভীর ভাইয়ার ডাক।
- হেই মেঘা। কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনারাও ভালোই আছেন নিশ্চয়ই?
- হ্যাঁ, আমরা তো বিনদাস আছি।
- হুমম ভালো। আচ্ছা আমি আসি?
- একটা কথা বলবো তোমায়?
- জ্বী বলুন।
- আমার মাও এসেছে আজকে। তোমার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন।
- আমার সাথে?
- হ্যাঁ, তুমি কি একটু কথা বলবে মার সাথে?
- আচ্ছা চলুন।
- হুমম চলো।
তানভীর ভাইয়ার সাথে আবারও চলে এলাম ড্রয়িংরুমে। ড্রয়িংরুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন মা আর একজন মহিলা। আমায় নিয়ে সেখানেই গেলেন তানভীর ভাইয়া। উনি মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন
- মা এই যে মেঘা।
তানভীর ভাইয়ার কথা শুনে আমার দিকে তাকালেন উনি। আমিও ভালো করে তাকালাম উনার দিকে। অসম্ভব রূপের অধিকারী উনি। এই বয়সেও চেহারার লাবণ্যতা কমে যায়নি। উনি আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
- আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমিই মেঘা?
- জ্বি।
- কিরে তানভীর ওতো দেখি যেমন রূপবতী তেমন গুণবতী একটা মেয়ে। এমন মেয়ে আজকাল পাওয়া দুষ্কর।
তানভীর ভাইয়া মাথা চুলকে হাসলেন শুধু কিছু বললেন না। আমার এবার চরম অস্বস্তি হচ্ছে। প্রকাশ্যে নিজের প্রসংশা শুনলে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হয়। যেটা একদমই ভালো লাগে না আমার। উনি এবার মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
- ভাবী আপনার দুই মেয়েই তো অনেক ভালো। একদম চাঁদের টুকরো যেনো।
আন্টির কথা শুনে মাও হেঁসে দিলেন। মা যে এই কথায় গর্ব বোধ করছে সেটা বুঝতে পারছি আমি। তবে অন্য কেউ যাতে এটা না বুঝতে পারে তাই অন্য কথায় চলে গেলো মা। আমিও তাদের বিদায় জানিয়ে চলে এলাম নিজের ঘরে। সকাল থেকে সবার সাথে আছি। এবার একটু নিজেকে সময় দেওয়ার প্রয়োজন।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে আসছে সবার হাঁসাহাঁসির আওয়াজ। নিজের ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। হাতে মেরুন কালারের একটা গাউন। এনগেজমেন্ট পার্টিয়ে পড়ার জন্য কিনেছিলাম। কিনেছিলাম বললে ভুল হবে আপু কিনিয়ে ছিলো। সব মেয়েরা অন্য একটা ঘরে সাজতে ব্যাস্ত। পার্লারের মহিলারা এসেছে সাজাতে। সবাই সেখানেই সাজছে। আমাকেও জোর করেছিলো। কিন্তু আমি যাইনি। এমনিতেই সাজাসাজি ভালো লাগে না আমার। আর আজকে তো আরো সম্ভব না।
বাহিরেই যেতে ইচ্ছে করছে না আমার। আচ্ছা, আমি ওখানে না গেলে কি কেউ খুঁজবে আমায়? হয়তো খুঁজবে নয়তো না। এতো মানুষের মাঝে আমায় নিয়ে ভাবার সময় পাবে কেউ?
সে যাই হোক আমায় তো যেতেই হবে। যাকে ভালোবাসি তার জীবনের এতো বড় একটা সময়ে আমি উপস্থিত থাকবো না? অভিয়েসলি থাকবো। নিজের চোখে দেখবো সবটা। এসব ভেবে নিয়েই ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলাম আমি। উদ্দেশ্য গাউনটা পরবো। কিন্তু দরজার আওয়াজে ঘুরে তাকালাম পিছনে।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মা। কিছু একটা বলতে চাইছে মনে হচ্ছে কিন্তু বলতে সংকোচ বোধ করছেন হয়তো। মায়ের এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকায় কেমন সন্দেহ হচ্ছে আমার। তাই আমিই বললাম
- কিছু বলবে মা?
- না মানে একটা কথা বলার ছিলো তোকে।
- তো বলো।
- কিভাবে যে বলি।
মায়ের এমন কথায় জোরে জোরে হেঁসে দিলাম আমি। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আমি কোনোমতে হাঁসি থামিয়ে বললাম
- মা, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি একটা ছেলে। আর আমায় প্রপোজ করতে এসেছো। তাই ঠিকভাবে কথা বলতে পারছো না। হাউ ফানি। তুমি বয়ফ্রেন্ড আর আমি গার্লফ্রেন্ড। বাহ বাহ
- ফাইজলামি বন্ধ না করলে টেনে মারবো এক চড়। ফাজিল মেয়ে।
- তো আমি কি করবো? তোমার হাবভাব দেখে যা মনে হচ্ছে তা-ই তো বললাম। সত্যি কথা বললেই দোষ। যাও আর কথাই বলবো না আমি। এই মুখ অফ। যা বলার তুমি বলো।
- বলছিলাম যে
- কি বলছিলে?
- দেখ, মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস তখন একদিন তো বিয়ে করে অন্যের ঘরে যেতেই হবে। তাইনা?
মায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। চলছে আপুর বিয়ের কাজ আর কথা হচ্ছে আমার মেয়ে হওয়া নিয়ে? অদ্ভুত! আমি আবুলের মতোই মাথা নারলাম অর্থাৎ হ্যাঁ, যেতে হবে। আমার সায় পেয়ে মা আবার বলতে শুরু করলো
- একটা কথা বলবো। পুরো না শুনে কিছু বলবি না তুই।
- আচ্ছা ঠিক আছে।
- শোন, তানভীর আছে না ফুয়াদের বন্ধু?
- হ্যাঁ। তো?
- আগে শোন। তানভীরের মা তোর আর তানভীরের বিয়ের কথা বলছে।
- মা? কিসব বলছো তুমি?
- হ্যাঁ, দেখ মেঘা। একদিন না একদিন বিয়ে তো করতেই হবে। সেখানে তানভীর ভালো একটা ছেলে, পরিবার ভালো সবদিক দিয়েই পারফেক্ট। আমরা তো এমন ভালো কারো কাছেই আমাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চাইবো। তাই না? আমি তোর উপর জোর খাটাবো না। তোর নিজঃস্ব একটা মতামত আছে। শুধু বলবো, তানভীরের মতো ভালো ছেলে আর নাও পেতে পারি।
মায়ের আর কোনো কথা কানে যাচ্ছে না আমার। মাথাটা যেনো হ্যাং হয়ে গেছে। সবকিছু উলোটপালোট লাগছে। মায়ের দিকে তাকাতেই চোখে পরলো এক উদ্বিগ্ন চেহারা। আচ্ছা, আমি যদি না করে দিই তাহলে কি এই চেহারায় কষ্ট পাওয়ার ছাপ পরে যাবে? হয়তো না। তবে এই মুখটায় খুশি ফুটে উঠবে না। আমার উত্তরটা যদিহ্যাঁ হয় তাহলে হয়তো সুপাত্রের হাতে মেয়ে তুলে দেওয়ার আনন্দে মায়ের মুখে ভেসে উঠবে অন্যরকম প্রশান্তি। কিন্তু আমি? আমি কি খুশি হবো?মায়ের খুশির থেকে কি আমার নিজের খুশি বেশি? কি করা উচিৎ এখন আমার?
চলবে
লেখিকাঃ আফিফা জান্নাত মাইশা
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “ভালোবাসি তাই – ভালোবাসার গল্প ২০২১” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ুন – ভালোবাসি তাই – ভালোবাসার গল্প ২০২১