তোমার নিসা (১ম খণ্ড) – পাগল প্রেমের পাগলামি গল্প

তোমার নিসা (১ম খণ্ড) – পাগল প্রেমের পাগলামি গল্প: প্রণয় মোবাইল হাত থেকে রেখে চুপ করে রইল। নিসা প্রণয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রণয়কে ঝাপটে ধরল। এদিকে হুট করে নিসা বুকে এসে পড়ায় টাল সামলাতে পারেনি।


পর্ব ১

গায়ে হলুদের স্টেজ থেকে ওয়াশরুমে যাওয়ার বাহানা করে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বাস স্ট্যান্ডের সামনে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিসা। লাল পাড়ের কাচা হলুদের মাঝে সবুজ রঙা শাড়িটির কুচি একহাতে চেপে ধরে অন্যহাতে আঁচল টেনে মুখের একাংশ ঢেকে একবার রাস্তার ডান পাশে তো একবার বাম পাশে তাকিয়ে সময় গুনতে লাগল কাঙ্ক্ষিত মানুষটি আসার।

সন্ধ্যার আকাশ রাতের কোলে ঢোলে পড়তেই ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো যেন দিনশেষে স্বস্তি খুঁজতে নিজের নীড়ে ফেরার উদ্দেশ্যে হুড়মুড়িয়ে পড়ছে মাঝ রাস্তার যান্ত্রিক শক্তির পেছনে।

শত শত গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে কিন্তু তার মধ্যে একটি গাড়িও নিসার অপেক্ষার অবসান ঘটাতে পারেনি। হঠাৎই রাস্তার বা পাশ থেকে ইউটার্ন নিয়ে ডান পাশে একটি কালো রঙের বাইক আসতে দেখে নিসার বুকটা ধক করে উঠল। চোখেমুখে হাসির ঝলক ফুটিয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে মুখের আঁচল টেনে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“প্রণয়!”

“হ্যাঁ, দ্রুত বাইকে উঠো।”
নিসা কোনো কথা না বলে তড়িঘড়ি করে বাইকে উঠে বসে পড়ল।
কিছুটা দূরে যেতেই বাইক চালানোর ফাঁকে প্রণয় ঘাড় কাত করে বলল,
“আমাকে আসতে দেখে এতো অবাক হয়েছিলে যে, কী ভেবেছিলে তোমাকে ঘর থেকে বের করে আমি আর আসব না?”

“না, মোটেও না। এসব ভাবা তো দূরে কথা, মনের অজান্তেও কখনো একটিবারের জন্যও এই কথাটি মনে আসেনি।”
“যদি এসব ভাবনা মনের কোণে না-ই এসে থাকে তাহলে একটু আগে আমাকে ওমন করে দেখছিলে কেন?”

“এটাও বুঝি এখন খুলে বলতে হবে? বাসা থেকে সেই কখন পালিয়ে এসেছি। এতক্ষণে হয়তো বাসায় সবার খবরও হয়ে গিয়েছে আমি ঘরে নেই। আর সেই সুবাদে এদিকে কেউ না কেউ আসবেই আসবে তখন যদি কেউ আমাকে এখানে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে কী হবে ভাবতে পারছ? তাই তোমাকে দেখে এতটা খুশি হয়েছিলাম।”
“তাই বুঝি?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই। এখন বেশি কথা না বলে সামনে তাকিয়ে ঠিকমতো বাইক চালাও তো। নাহলে দেখা যাবে এক্সিডেন্ট করে এখানেই চিৎপটাং হয়ে আছি।”
“তোমার মুখে কিছুই আটকায় না নিসা? রাস্তাঘাটে কেউ এরকম কথা কি বলে?”
“আচ্ছা ভুল হয়েছে। এবার অন্তত সামনে তাকিয়ে বাইকটা চালাও।”
প্রণয় কথা না বাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে বাইক চালাতে লাগল।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর বাইকটি একটি বাড়ির সামনে থেমে গেল। প্রণয় হ্যালমেট খুলে বলল,
“চলো ভেতরে।”

নিসা বাইক থেকে নেমে শাড়ির আঁচল দুই আঙুলের ফাঁকে পেঁচিয়ে আমতাআমতা করে বলল,
“নিশ্চয়ই মা ঘরে আছে এখন যদি হঠাৎ করে আমি ঘরে যাই মা কী ভাববে!”
“কী আর ভাববে, এই যে তার যুবক ছেলে অন্যের ঘরের যুবতী মেয়েকে হলুদ সন্ধ্যার আসর থেকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। হো হো”
“এই মুহূর্তেও তোমার হাসি পাচ্ছে? যেখানে কি-না আমি টেনশনে মরছি সেখানে তোমার হাসি পাচ্ছে?”
“হাসি পাওয়ার মতো প্রশ্ন করো বলেই হাসি পাচ্ছে নয়তো কি পেত?”
“মানে!”

“তুমি কি ভুলে গিয়েছ ফ্ল্যাটে আমি একা থাকি?”
জিহবায় কামড় বসিয়ে নিসা মুখ কাচুমাচু করে বলল,
“সত্যি, আমি না ভয়ে, চিন্তায় একবারে ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি একা থাকো।”

দরজার লক খুলে জুতো একপাশে রেখে প্রণয় নিসার সামনে হাত বাড়ালো।
“নীল পাথর, নতুন করে স্বাগতম জানাই আমার ভুবনে। চোখ ধাঁধানো তোমার নীলচে আভা দিয়ে ছড়িয়ে দাও প্রশান্তির হাওয়া এই মন পাজরে।”
প্রণয়ের হাতে হাত রেখে নিসা উৎকন্ঠা স্বরে বলল,
“বাব্বাহ! এখনের ভেতর তাল মেলানো ছন্দও বানিয়ে ফেলে?”

“না, বানিয়েছি বললে ভুল হবে। এটা আমি বানাইনি। হঠাৎ করে মনে আসল সঙ্গে সঙ্গে মুখে বলেছি এই যা এর থেকে বেশি কিছুই না।”
“তারপরও বেশ ভালোই হয়েছে। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কোনোকিছু জিজ্ঞেস করতে অনুমতি আবার কবে থেকে নেয়া শুরু করলে?”
মৃদু হেসে নিসা বলল,
“তুমি আমায় নীল পাথর বলে ডাকো কেন? নীল পাথর কি তোমার বেশ পছন্দের?”

“পছন্দ না হলে কি আর তোমায় ডাকতাম? আর পছন্দ টাও বড় কথা না, আসল কথা হলোনীল পাথর সবার কাছে থাকে না আর থাকলেও সবার গলায় মানায় না। কেননা নীল পাথর বেশ দামী আর মূল্যবান। যেটা সবার কাম্য নয়, ঠিক যেমনটা তুমি। তোমার থেকে মূল্যবান আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। তোমার জন্ম সবধরনের পুরুষ মানুষের জন্য হয়নি। তোমাকে বোঝার ক্ষমতা সবার মাঝে নেই। তাই তোমাকে সবসময় নীল পাথর বলে ডাকি। শুধুমাত্র আমার মূল্যবান নীল পাথর।”
“এতটা গভীরভাবে ভাবো কি করে তুমি?”

“আমার গভীর ভাবনা দেখে তুমি আবার আবেগে আপ্লুত হয়ে যেও না। তা নাহলে বিয়ের আগেই নির্লজ্জের মতো রাত কাটবে দু’জনার মাঝে।”
নিসা কিছু বলতে যেয়েও পারল না, লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে যে তার। চুপচাপ রুমের ভেতর চলে গিয়ে দরজা ভেতর থেকে ভিড়িয়ে দিল।
এদিকে নিসার লাজুক মুখ দেখে প্রণয় মুখ চেপে হেসে পাশের রুমে চলে গেল।

রাতের ঘন আঁধার সরে রোদের হাতছানি মিলতেই ঘুম ভেঙে যায় প্রণয়ের। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠতে নিলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে রাতে নিসার সেই বউ সাজে মনকাড়া লাজুক চাহনির মুহূর্তের কথা। হঠাৎই ভ্রু কুচকে গেল তার। মনে মনে বলল,
“ইশ! কী ভুলটাই না করেছি কাল। নিসা কে দেখতে এত সুন্দর লাগছিল আর আমি কিছুই বললাম না! এটা কী করে সম্ভব হলো? না, কাজটা একদমই ঠিক হয় নি।

তবে রাতের করা ভুল শুধরে নিতে আজ তো বলতেই পারি। হ্যাঁ, আজই বলব আর এখনই বলব। দেরি হলে যদি অভিমান করে নিসা রাগ করে বসে!”
ভেবেই বিছানা ছেড়ে উঠে হাতমুখ ধুয়ে এগুলো নিসার ঘরের দিকে। বাহির থেকে দরজা হালকা ফাঁক করতেই প্রণয় হা হয়ে গেল। সে কি সঠিক দেখছে না ভুল, এখনো বোধগম্য হচ্ছে না তার। চোখ কচলাতে কচলাতে ধীর পায়ে ঘরের ভেতর এসে নিসার মাথা বরাবর দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে সামান্য ঝুঁকে বলল,
“নিসা! নিসা!”

প্রথম ডাকের পর দ্বিতীয় ডাক দিতেই ধরফরিয়ে নিসা শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ল। এলোমেলো চুলের ভাজে হাত গুঁজে হাই তোলার মাঝে বলল,
“সকাল হয়ে গিয়েছে বুঝি?”
“বাহিরের ঝলমলে আকাশ যেভাবে চোখে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে, দেখে তো মনে হচ্ছে সকাল হয়েই গিয়েছে।”
“কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার অভ্যাসটা কি তোমার যাবে না?”

“অভ্যাস জিনিসটা মানুষ জন্মলগ্ন থেকে নিয়ে আসে জানো না? সে যাই হোক, তোমাকে কিন্তু দেখতে বেশ লাগছে। এসেছিলাম বউ সাজে রাতের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে কিন্তু, এসে যে তোমার আরেক আগুন রূপ দেখতে পাবো সেটা তো কখনো ভাবিই নি।”
প্রণয়ের কথা শুনে নিসা বুঝতে পারল না তার এই আগুন রূপের বর্ননা কিসের ভিত্তিতে দিয়েছে সে। তাই নিসা নিজেই এর রহস্য উদঘাটন করতে ঘাড় নিচু করে নিজের মাথা থেকে পা অবধি ভালো করে তাকাতেই তার চোখ যেন ছানাবড়া হয়ে যায়! একবার নিজের পরনের জামার দিকে তো একবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বিছানার একপাশে থাকা কাঁথা টি ঝট করে হাতে তুলে নিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলল নিসা।

“আরে আরে, কাঁথা মুড়ি দিলে কেন? বেশ তো লাগছিল দেখতে। আর সবচেয়ে ভালো লাগছিল তোমার ওই বুকের মাঝের লম্বা ভাজ টা। জাস্ট পাগল করে দেয়ার মতো। তাই ভাবছি এখন থেকে তোমাকে আমার কাপড় পড়িয়েই রাখব। তাতে হবে কী, তোমার জন্য আলাদা কাপড় কিনে টাকা নষ্ট করার প্রয়োজন পড়বে না আবার কারণে অকারণে তোমার প্রেমে পাগল হতে সময়ও লাগবে না। কী বলো?”

“প্রণয়!”নিসা মুখ গোমড়া করতেই প্রণয় বিছানার একপাশে বসে বলল,
“তোমার জামার প্রয়োজন আমাকে বলোনি কেন? আমি না-হয় নানান ঝামেলায় কাপড়ের কথা ভুলে গিয়েছি কিন্তু তুমি যখন রাতে চেঞ্জ করবে ভেবেছিলে তোমার তো একটিবারের জন্যও হলেও মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল আমাকে, তাই না?”

“বলে কী হবে তুমি কি ওতো রাতে আমার জন্য মার্কেটে গিয়ে কাপড় এনে দিতে? না-কি তুমি কাপড় কিনবে বলে দোকানদাররা তোমার জন্য না ঘুমিয়ে দোকান খুলে বসে থাকত?”
“সেই চিন্তা তো তোমার না, আমার কি করতাম আর কি না করতাম সেটা না’হয় আমার উপরই ছেড়ে দিতে।”
এইটুকু বলে প্রণয় এগুলো পড়ার টেবিলের কাছে। একটি খাকি প্যাকেট নিসার সামনে ধরে বলল,


পর্ব ২

গতকাল সকালে যখন তুমি বললে, আজ রাতেই এক কাপড়ে বাড়ি থেকে পালাবে তখনই গিয়ে এ দুটো জামা কিনে এনেছিলাম তোমার জন্য। কিন্তু ভোলামন বলে কথা তার কি এতকিছু মনে করে রাখার দায় পড়েছে! তাই আর রাতে তোমায় দেয়া হয় নি তবে, এখনো তেমন একটা সময় পার হয় নি। তাই বলছি কি জামা টা দ্রুত পড়ে রেডি হয়ে নাও কখন কে চলে আসে বলা তো যায় না।”

প্যাকেট টি নিসা হাতে নিয়ে সামান্য ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“কখন কে আসবে মানে কি? তুমি না বলেছিলে এ ঘরে তুমি একাই থাকো। তোমার বাবা, মা ভাই কেউ তোমার সাথে থাকে না।”
“ভুল কিছু তো বলিনি।”
“তাহলে একটু আগে বললে যে, কে কখন এসে পড়ে ঠিক নেই।”

“শোনো, আমার পরিবারের এখানে কেউই থাকে না এটা যেমন সত্যি তেমনি এটাও সত্যি যে, এই ঘরে যেকোনো সময় যে কেউ চলে আসতে পারে।”
“তোমার কথার অর্থ কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না প্রণয়।”
“অল্প বয়সের মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে বড় করতে চাইলে যা হয় আর কি!”
“মানে!”

“কিছু না, এবার আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনো। এই ঘরে মানে এই ফ্ল্যাটে আমরা একত্রে তিনজন ছাত্র সাবলেটে থাকি। কারণ ফ্ল্যাটের যে ভাড়া সেটা আমাদের কারো পক্ষেই একা বেয়ার করা সম্ভব না, আর না ম্যাচে থাকার অভ্যেস আছে। তাই তিন বন্ধু মিলে ঠিক করেছিলাম মাস্টার্স কমপ্লিট করার আগ পর্যন্ত তিনজন একসাথেই থাকব। এতে স্বল্প খরচে ভালো পরিবেশেও থাকা গেল আর টাকাও সেভ হলো।”
“তারমানে এখানে আরও দু’জন ছেলে থাকে তাই তো?”

“হুম, আর সেজন্যই বলেছিলাম দ্রুত কাপড় চেঞ্জ করে ফেলতে। কারণ ওরা দু’জন অলরেডি কাজী কে নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। এখন এসে যদি তোমার এ অবস্থা দেখে কেমন হবে বুঝতেই তো পারছ।”

“তাহলে কাল রাত তারা কোথায় ছিল? তোমার সাথে কি পাশের রুমে ঘুমিয়েছে না-কি বাসাতেই ফেরেনি? আর আমি তো রাতে দরজা আনলক করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখন যদি তারা গভীর রাতে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরেও যায় তুমি আমি তো কেউই জানব না। আর তোমার গেঞ্জির গলা যে বড় ঘুমের মাঝে আমার কি হাল ছিল সেটা তো তুমি নিজেই দেখেছ।

এই অবস্থা যদি তারাও দেখে থাকে আমার সম্মানের কী ফালুদা হবে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।”
“তোমার কী মনে হয় সেই ভাবনা আমার নেই? আর এমনিতেও ওরা দু’জন ওরকম ছেলেও নয় তারপরও আমি চাই নি কোনো প্রকার রিস্ক নিতে। তাই কাল ওদের বাড়িতেই রাখি নি অন্য বন্ধুর বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।”

“ও, কিন্তু কাল রাতই কি শেষ? এখন থেকে তো এখানে থাকতে হবে। তখন তাদের মাঝে কীভাবে থাকব আমি?”
“আরে আজকে বিয়ে হয়ে গেলে তো আমি নিজেই তোমার সাথে থাকব তখন আর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কাল রাতে তো তোমাকে একা ঘুমোতে হয়েছে তাই ওদের পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।”
“ও আচ্ছা।”

“হুম, এখন যাও দ্রুত জামা টা পড়ে এসো ওয়াশরুম থেকে।”
“এখনই একটু পরে পড়ি।”
“আরে বুঝতে পারছ না কেন, নিলয় আর মুহিত তো কাজী কে নিয়ে এক্ষুনি চলে আসবে।”
সন্ধ্যা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
“এখন তো সবে সকাল ৭:১১ বাজে। এই সাত সকালে কোন কাজী বসে থাকবে তোমার বিয়ে পড়ানোর উদ্দেশ্যে?”

“আরে উনি তো আমাদের পরিচিত, বলতে পারো বড় ভাইয়ের মতো। উনার সাথে আমরা সবকিছুই শেয়ার করি। তো গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে ফেরার পর উনাকে কল করে সবকিছু খুলে বলেছিলাম। উনি বলেছেন, আজ সকালে আসবেন। এদিকে নিলয় আর মুহিতও ওদিক থেকেই আসবে। তাই আমি ওদের বলে দিয়েছিলাম যেহেতু এক রাস্তা দিয়েই আসবে তাহলে আসার সময় যেন উনাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসে।”

“ও আচ্ছা, কিন্তু এই নিলয়, মুহিতটাই বা কে?”
“আল্লাহ, তুমি আমাকে তুলে নাও। আর যদি সেটা না পারো দড়ি ফালাও আমি নিজেই উঠে পড়ছি।”
“এই কথা বললে কেন তুমি?”

“কেন বলব না সেটা বলতে পারো? একটু আগেই তোমাকে বললাম আমার দুই বন্ধু কাজী কে নিয়ে আসছে। এখন যখন তাদের নাম বলে বললাম, কাজী নিয়ে আসছে তুমি এখন বলছ এরা কারা! তো এই প্রশ্ন শুনে কার না ইচ্ছে হবে এই কথা বলতে!”
“বুঝি নি বলেই তো বলেছি তা না-হলে কি বলতাম?”

এরকই মাঝে কলিংবেল বেজে উঠতে প্রণয় তড়িঘড়ি করে বলল,
“এই রে সবাই বোধহয় চলে এসেছে। এখন কী হবে? তোমার তো জামা টাও পড়া হয় নি। সেই কখন থেকে বলেছিলাম জামাটা পড়ে নাও জামাটা পড়ে নাও কিন্তু কে শোনে কার কথা!”

“কিন্তু”
“আর কথা বলে সময় নষ্ট করো না প্লিজ। বাহিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। তুমি দ্রুত গিয়ে কাপড়টা চেঞ্জ করে নাও আর আমিও দরজাটা খুলে সবাইকে পাশের রুমে বসিয়ে কাগজপত্র ভাজ করে নিচ্ছি।”
এইটুকু বলে প্রণয় চলে গেল দরজা খুলতে আর নিসা হাতের ভাজে কাপড় নিয়ে পা বাড়ালো ওয়াশরুমের দিকে।

কাগজপত্র ভাজ করা শেষে নিসার ডাক পড়তেই টকটকে লাল রঙের একটি সেলওয়ার কামিজ পড়ে নিসা এলো ঘরের ভেতর। নিলয়, মুহিতের সাথে প্রণয় নিজেও সরাসরি মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো নিসার দিকে। বিড়বিড় করে বলে উঠল,
“জামাটা কেনার সময়ও বুঝতে পারি নি আমার হুরপরিটাকে এ জামা টাতে সত্যিকারের হুরপরির মতোই দেখতে লাগবে।”

পাশ থেকে নিলয় গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“কী রে ভাই, এ কোন পরী জুটলো তোর কপালে? একটা মানুষ এতটা সুন্দর কী করে হতে পারে? ওকে দেখে মনে হচ্ছে আল্লাহ যেন নিজ হাতে একে খুব যত্নসহকারে সৃষ্টি করেছেন। এই মুহূর্তে তো আমার বেশ সন্দেহ হচ্ছে এ আদৌ মানুষ না-কি পরী!”

নিলয়ের কাঁধে আস্তে করে খোঁচা মেরে মুহিত ফিসফিস করে বলল,
“আমাদের ভাবী এতটা সুন্দর কেন জানিস না? আমাদের বন্ধু যে কোটি তে একজন। তার বউ সুন্দরী না হয়ে উপায় আছে?”
“কথায় দম আছে তোর। তবে ভাবিটা কিন্তু একেবারেই পিচ্চি তাই না মুহিত?”

“তা ঠিক বলেছিস। আচ্ছা প্রণয়, ভাবির বয়স কত রে?”
প্রণয় এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
“একটা মেয়ে দশম শ্রেণীতে পড়লে তার বয়স ঠিক কত হতে পারে জানিস না?”

মুহিত গাল ফুলিয়ে বলল,
“সে তো জানিই তাও সঠিক বয়সটা জানার জন্যই জিজ্ঞেস করেছিলাম।”

“১৫ওর একুরেট বয়স১৫।
এরই মাঝে কাজী বলে উঠলেন,
“তোমরা যদি এত ফিসফিস করো আমি কাজটা শুরু করব কীভাবে?”

প্রণয় উল্টো ধমকের সুরে নিলয় ও মুহিতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই তোরা একটু থামতে পারিস না? জায়গা বুঝে না, সময় বুঝে না শুধু কানের কাছে ফিসফিস করেই যাস।”
এইটুকু বলে কাজীর দিকে মুখ করে প্রণয় বলল,
“ভাই আপনি আপনার কাজ শুরু করেন তো। আমি আর নিসা একেবারে তৈরি আছি।”

বলেই সামনে হাঁটু ভাজ করে বসা নিসার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল প্রণয় নিসার তার কথার মত আছে কি-না! নিসার পক্ষ থেকেও উল্টো মুচকি হাসির রেখার সন্ধান পেয়ে প্রণয় দু’কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি কাজীর সামনে এগিয়ে ধরে বলল,
“শুভ কাজে দেরি করতে নেই ভাই। এই নিন ছবি আর শুরু করুন আপনার সকল কার্যক্রম।


পর্ব ৩

বিয়ে শেষে কাজী চলে যেতেই নিলয় বলে উঠল,
“শুধুমাত্র মিষ্টি খেয়ে পেট ভরে না-কি? আমার তো ভীষণ খিদে পেয়েছে। এই প্রণয়, ২০০ টাকা দেয় তো সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসি।”
প্রণয় ভেংচি কেটে বলল,
“খাবি তুই আমি টাকা দিব কেন? নিজের টাকা দিয়ে অন্যকে না খাওয়াস অন্তত নিজে তো খেতে পারিস।”

“ও হ্যালো, আমার টাকা দিয়ে আমি খাই না-কি খাই না সেটা তুই কীভাবে জানিস? তোকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমার টাকা দিয়ে খাবো না-কি? আরেকটা কথা হচ্ছে আমার খিদে পেলেও টাকা টা আজকে তোকেই দিতে হবে।”
“মানে কি!”
“মানে কিছুই না। বিয়ে করেছিস তুই, ট্রিট তো তোকেই দিতে হবে তাই না।”

“এটা কিন্তু কোনো কথা না নিলয়। বিয়ে করেছি বলেই যে ট্রিট দিতে হবে আমাকে এটা কোনো কথা না। আর এসব কথা হয়তো হাদিস কোরআনেও লেখা নেই আমি শিউর।”

মুহিত নিসার দিক মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল,
“ভাবী, দেখেছেন আপনার বর টা কেমন কিপ্টে? মাত্র বিয়ে করেছে কোথায় খুশির চোটে সবাইকে খোলাসা মনে খাওয়াবে তা না, সে আছে তার হিসেব নিয়ে।”
নিসা মুচকি হাসল। প্রণয় তা দেখে বলল,
“এটাকে মোটেও হিসেব বলে না মুহিত। আমি জাস্ট ইসলামিক নিয়মের কথা বলেছি।”

মুহিত চোখে মেরে বলল,
“সে যাই বলিস না কেন এবার কিন্তু তোর রেহায় নেই।”

নিলয়ও তালে তালে মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, এবার তোকে ছাড়ছি না, দেয় ২০০ টাকা দেয়। আর এখন যদি না করিস ২০০ কিন্তু ডাবল হয়ে ৪০০ হয়ে যাবে। তাই বলছি অকারণে ‘না’ শব্দটা উচ্চারণ না করে যা চাচ্ছি দিয়ে দেয়। আমাদের ইচ্ছেও পূরণ হোক আর তোর জরিমানাও না হোক।”

নিসা গলা চেপে খুব শান্ত ভাবে বলল,
“এরকম করছ কেন, ভাইয়ারা তো তেমন কিছু চায়নি। একটা ট্রিটই তো চেয়েছে তাও আবার মাত্র ২০০ টাকার। যাও, টাকাটা দিয়ে দাও।”

প্রণয় মুখ ভেংচি কেটে ২০০ টাকা নিলয়ের হাতে দিয়ে বলল,
“ভুলে যাস না, এই দিনটা আমারও একদিন আসবে। তাই আজ টাকা পেয়ে আমাকে হারিয়েছিস ভাবিস না। একদিন তুইও হারবি এ আমি বলে দিলাম।”
“হো হোসেদিনটা তুই দেখার সুযোগ পেলে তো।”

নিলয় হাসির ছলে কথাটুকু বলে নাস্তা আনার উদ্দেশ্যে মেইন দরজা খুলে বাহিরে এক পা রাখতেই চোখ কপালে উঠে গেল।
“পুলিশ!”
ওসি আরমান হাসানের ইশারায় দারোগা নিলয়কে ঝাপটে ধরে বলল,
“নিসা কোথায়?”

“আরে আরে, আপনার আমাকে এভাবে চেপে ধরেছেন কেন? ছাড়ুন ছাড়ুন বলছি।”
পুলিশের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি ছেলের মাঝে একটি ছেলে কিছুটা সামনে এসে নিলয়ের শার্টের কলার চেপে বলল,
“নিসা কোথায়? ওকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস তোরা?”

আরমান হাসান ছেলেটিকে নিলয়ের থেকে দূরে সরিয়ে বলল,
“রনি, তোমরা যদি এভাবে রিয়েক্ট করো তাহলে আমরা কেন? আমাদের না এনে তোমরা নিজেরাই পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করতে।”
নিলয়ের দিকে আগুন্তুক দৃষ্টি রেখে রনি কড়া গলায় বলল,
“সরি মামা।”

আরমান হাসান পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে বলল,
“রাফি, তোমার বড় ভাই রনি কে সামলাও আর ব্যাপারটা আমাদের বুঝতে দাও।”
বলে আরমান হাসান নিলয়কে উদ্দেশ্য করে বলল,
“ভেতরে চলো।”
“ভেতরেকিন্তু কেন?”

নিলয়ের তোতলানো কথার সুর শুনে আরমান হাসান সামনে এগুতে এগুতে বলল,
“সার্চ করব বলে।”
এইটুকু বলেই দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। আর তার পিছু নিল রনি, রাফিসহ পুলিশের পুরো টিম সাথে হাত বাঁধা নিলয়ও।
মেইন দরজা পেরোতেই হাতের বাম পাশের প্রথম রুমটির ভেতর রনি ও রাফির চোখ পরতেই দেখতে পায়, তাদের ছোট্ট বোন নিসা প্রণয়ের বাহুডোরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।

মুহুর্তের মাঝে যেন তাদের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেল। রনি দু’লাফে রুমের ভেতর গিয়ে একটানে নিসাকে প্রণয়ের থেকে দূরে সরিয়ে রাফির হাতে দিয়ে প্রণয়ের কলার চেপে কর্কশ কন্ঠে বলল,
“তোর সাহস কী করে হয় আমার বোনের কাছে ঘেঁষার? তোকে কতবার নিষেধ করেছিলাম আমার বোনের থেকে দূরে থাকতে? যে বোনের এই বয়সে হেসে খেলে বেড়াবার কথা সেই বোনকে এই তোর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বিয়ে পর্যন্ত দিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না, আমার বোনটার জীবন ধ্বংস তুই করেই ছাড়লি।”

বলেই প্রণয়ের গালে ঠাস করে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিল রনি। গালে হাত দিয়ে প্রণয় মাথা তুলে রনির দিকে তাকাতেই রাফি ঘাবড়ে গেল! এই বুঝি প্রণয় তার ভাই রনিকে উল্টো হাত দিয়ে বসবে! আর প্রণয় যদি একবার রনিকে পাকরাও করতে পারে রনি একা কেন, এরকম আরও চারটে রনিও প্রণয়ের বিশাল দেহের সাথে পেরে উঠবে না। কিন্তু না, প্রণয় সেরকম কিছুই করেনি। মার খেয়েও নিসার দিকে একপলক চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। যার ফলে রাফির মনে কিঞ্চিৎ পরিমাণ সহানুভূতি কাজ করে প্রণয়ের প্রতি।

বলল,
“ভাইয়া, মাথা গরম করে প্রণয়কে মেরো না। আরমান মামা তো আছেন উনাকেই বিষয়টা বুঝতে দাও।”
“তুই চুপ থাক”
রাফিকে ধমক দিতেই আরমান হাসান রনিকে বললেন,
“ওকে ছেড়ে দাও রনি। আমরা যে কাজে এসেছি সেটা সম্পূর্ণ করতে দাও।”

“ওকে ছেড়ে দিতে বলছেন মামা? আপনি ওকে ছেড়ে দিতে বলছেন? আপনি কি জানেন না, গত রাতটা আমাদের জন্য কী ছিল? কতটা অপমানের ছিল? আর অপমানের কথা বাদই দিলাম, নিসার নিখোঁজ সংবাদ পেয়ে বাবা মায়ের কী আধমরা অবস্থাটা হয়েছিল সে কি আপনি জানেন না? আপনি কি জানেন না, নিসা কাল সারাটা রাত ঘরের বাহিরে ছিল। তাও আবার এর কাছে। আমার অবুঝ বোনটার সাথে কী হয়েছে তা আপনার ধারণা আছে মামা?”

“জানব না কেন, সবটাই জানি। আর এটাও জানি, আইন কখনো নিজের হাতে তুলে নিতে নেই। আর সেজন্যই বলছি নিসাকে নিয়ে তোমরা ফিরে যাও আর প্রণয়কে আইনের হাতে ছেড়ে দাও। আর হ্যাঁ, যত দ্রুত সম্ভব নিসার জবানবন্দি সমেত একটা নারী নির্যাতনের মামলা টুকে যেও। এতে সবকিছুই সুবিধে হবে।”
বলেই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ৪ জন দারোগাকে বললেন প্রণয়, নিলয় ও মুহিতকে অন্য গাড়িতে তুলে দ্রুত থানায় নিয়ে হাজতে পুড়তে।

আরমান হোসেনের কথানুযায়ী দারোগারা প্রণয় ও তার বন্ধুদের ধরে নিয়ে যেতে নিলে নিসা রাফির হাত ছাড়িয়ে প্রণয়ের কাছে গিয়ে বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি? আমাকে একা রেখে কোথায় চলে যাচ্ছ? আর কাদের হাতেই বা রেখে যাচ্ছ! তুমি কি জানো না, এরা চায় না আমি তোমার সাথে থাকি, তোমার হয়ে বাঁচি। বিশ্বাস করো এদের বুক কাঁপবে না আমার অমতে, আমার বুক ফাঁটা আর্তনাদ শুনেও অন্যের ঘরে পাঠাতে। কিন্তু তুমি তো জানো, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। বাঁচতে পারব না আমি তুমিহীনা এ ভুবনে।”

নিসার ধবধবে সাদা মুখখানি কান্নার বেগে ও গভীরতা সংমিশ্রণে গোলাপি রঙে পরিণত দেখে প্রণয় শত কষ্টের মাঝেও মুচকি হেসে নিসাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কেঁদো না। তোমার চোখে এই নোনাজল মানায় না। আল্লাহকে তো বিশ্বাস করো, তার উপরই বিশ্বাস রেখো। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“কিন্তু আমি যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না প্রণয়”
এর মাঝেই আরমান হাসান ধমকের সুরে দারোগাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“এখানে কি সিনেমান শুটিং হচ্ছে যে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছ। কখন বলেছি এদের এখান থেকে নিয়ে যেতে? এখনও নিয়ে যাওয়ার ‘ন’ ও দেখতে পাচ্ছি না যে?”
দারোগারা আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না। নিসাকে ছাড়িয়ে প্রণয়, নিলয় ও মুহিতকে টানতে টানতে নিয়ে গেল।

পর্ব ৪

প্রণয়কে নিয়ে যেতেই নিসা মেঝেতে বসে তার বড় ভাই রনির পা জাপটে ধরে কাঁদতে লাগল। বলল,
“ও ভাইয়া ভাইয়া, তোমরা প্রণয়কে ছেড়ে দাও না, প্লিজ ভাইয়া ওকে ছেড়ে দাও। তোমরা যেরকম ভাবছ বিশ্বাস করো ও সেরকম ছেলে না। এমনকি এই যে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি সেটাও ওর প্ল্যান নয়। ও বলেছিলও বলেছিল তোমাদের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নিতে কিন্তু আমিই রাজি হইনি। আর এই যে পালানোর প্ল্যান এটাও আমার। ওর তো কোনো দোষ নেই ভাইয়া। তোমরা ওকে প্লিজ ছেড়ে দাও।”

“নিসা, আমার পা ছাড় বলছি।”
রনির কর্কশ গলা শুনেও নিসার বোধগম্য হয়নি। সে নিজের মত করে রনির পা জাপটে ধরে বিভিন্ন প্রলাপ বকছে আর কেঁদেই যাচ্ছে।
রনি বেশ ক’বার ভালো ভাবে নিসা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে উঠানোর চেষ্টা করলেও বারংবারই ব্যার্থ হলো।

একপর্যায়ে রনি বিরক্ত হয়ে নিসাকে টেনে দাঁড় করিয়ে সজোরে এক থাপ্পড় দিল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“দিন দিন লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে বেহায়ার শেষ সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিস দেখি। লজ্জা করছে না এতগুলো মানুষের সামনে এরকম বেহায়াপনা করতে? প্রেমে এতো মত্ত হয়ে গিয়েছিস যে, চোখের লজ্জা পর্দা টাও খেয়ে ফেলেছিস?”

ছোট বোন নিসাকে পাগলের মত কাঁদতে দেখে রাফির সহ্য হল না। রনির হাত থেকে নিসাকে ছাড়িয়ে নিল রাফি। বলল,
“ভাইয়া, আগে আমরা বাসায় যাই তারপর না’হয় এসব কথা বলা যাবে।”
“তুই চুপ থাক। ওকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হবে সে আমি খুব ভালো করেই জানি। বাবা, মা আর তুই এ তিন’জন মিলে ওকে আদরে আদরে বাদর বানিয়ে দিয়েছিস। যার ফল সরূপ আজকের এই দিনটি দেখতে হচ্ছে। কিন্তু আর না, অনেক হয়েছে। অনেক ছাড় দিয়ে ফেলেছি ওকে। এবার যা হবে আমাদের কথানুযায়ীই হবে।”
“তাই বলে মানুষগণ দেখিয়ে উপযুক্ত মেয়ের গায়ে হাত তুলে?”

“তুই দেখেছিস ও কেমন বেহায়ার মত করছিল। আর ওর গায়ে হাত তুললাম কোথায়, সবে তো একটা থাপ্পড়ে মেরেছি। তারপরও যদি ঠিক না হয় আমি জানি, বেঁধে পেটালে একেবারে ঠিক হয়ে যাবে।”
“ও যদি ওর মাঝে থাকত তাহলে কি আজ ওর এই দশা হতো? তুমি কেন বুঝতে চাইছ না ভাইয়া, সব সমস্যার সমাধান গরম মাথায় করা যায় না।”
“তোর মত ঠান্ডা মাথাও রাখতে পারছি না আমি।”

“তবে ভাইয়া”
দু’ভাইয়ের কথা আরমান হাসান বললেন,
“এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে সময় নষ্ট না করে দ্রুত বাড়িতে যাও। আপা আর দুলাভাই তো তোমাদের পথ চেয়ে বসে আছে আবার নিসার মন পরিবর্তন করাও খুব জরুরী।”

রনি বলল,
“জ্বি মামা।”
“তাহলে আর দেরী করো না বেড়িয়ে পড়ো। তোমরা বের হলে ফ্ল্যাট তালা মারা হবে। আর আমিও থানার উদ্দেশ্যে রওনা হই।”
বলেই আরমান হাসান বেড়িয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে।

গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির মেইন গেইটে দাঁড়াতেই চারিপাশে মানুষের গিজগিজ দেখে নিসার মুখ চুপসে গেল। শান্ত হয়ে শোনার চেষ্টা করল দূর থেকে ভেসে আসা তাকে নিয়ে নানান কথাবার্তার সুর। যার মধ্যে বহু ব্যবহৃত শব্দগুলো হচ্ছে নষ্টা, চরিত্রহীনা, কলঙ্কিনী ইত্যাদি।
নিসা নিঃশব্দে কাঁদছে। চোখ বেয়ে অঝোরে ঝড়ে যাচ্ছে নোনাজলের ধারাগুলো। মানুষের ছিঃ ছিঃ আর ধিক্কার শুনে ইচ্ছে করছে এখনই সে আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও সেই রাস্তাটাই অবলম্বন করুক। তার দু’পায়ের এক পা ও চলছে না।

মাথা নিচু করে সটান দাঁড়িয়ে থেকে কেবল সুঁইয়ের ন্যায় কথার ধার দিয়ে বুক ফুঁটো করছে সে। ব্যাপারটি লক্ষ্য করে রাফি আলতো করে নিসার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“মানুষকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিস। মানুষ তো কথা বলবেই। তাই সেসব কথায় কান দিয়ে লাভ নেই। শুধু শুধু সময় আর মন দুটোই নষ্ট হবে। তাই এদের কথায় কান না দিয়ে ভেতরে চল।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিসা বাড়ির ভেতর পা রাখতে নিলেই পাশ থেকে এক প্রতিবেশী আন্টি বলে উঠলেন,
“নাগর যখন ঠিক করাই ছিল শুধু শুধু বিয়েতে মত দিয়ে বাবা মায়ের মুখে চুনকালি না মাখালেই পারতে। একটু আগে বরপক্ষের বাড়ি থেকে লোকজন এসে কী অপমানটাই না করে গেল। ছি ছিতো নিসা, তুমি একা কেন? তোমার নাগর আসেনি বুঝি?”

আরেকজন বলে উঠল
“কী যে বলেন না ভাবি! আজকালকার ছেলেরা কি বোকা না-কি যে প্রেমে পড়ে অন্ধ হয়ে যাবে! যে মেয়ে কিনা বিয়ের আগে পর পুরুষের সাথে রাত কাটাতে পারে, সেই মেয়ে যে অন্যকারো সাথে রাত কাটাতে পারবে না তার কি কোনো সন্দেহ আছে? তাই ছেলেরা আজকাল এসব মেয়েদের সাথে দিনেরাতে শুধু মজমাস্তিই করে বিয়ে করে না। এই যে দেখছেন না, নিসাকে; রাতটা ফুর্তি করে নিসার হাতে ভাঙা হারিকেন ঝুলিয়ে দিয়ে ছেলে গায়েব।”
“হ্যাঁ, একেবারে খাঁটি কথা বলেছেন ভাবি। এসব মেয়েদের এরকমই হয়।”

ধুম মেরে এতক্ষণ সবকিছু শুনছিল রাফি। কী বা বলবে সে, অপরাধ তো তাদের বোনই করেছে কথা তো শুনতে হবেই। কিন্তু সবকিছুর যে একটা লিমিট আছে সেটা হয়তো তারা ভুলে গিয়েছে। সেই লিমিট টুকু মনে করিয়ে দিতে রাফি কড়া গলায় বলল,
“আন্টি, আপনাদের দু’জনকে কিছু কথা বলছি। নিসা কিন্তু আপনাদের সন্তান না, নাতনি সমতুল্য। কেননা আপনাদের ছেলেমেয়েরাই আমাদের দু ভাইয়ের থেকে অনেক বড়। আর নিসা সে তো আপনাদের ছেলেমেয়েদের থেকে ছোট হওয়া দূরে থাক আমাদের থেকেই অনেক ছোট। আমাদের সাথেই ওর বয়স ডিস্টেন্স প্রায় ১২/১৩ বছরের। তাহলে আপনাদের ছেলেমেয়েদের সাথে ওর বয়সের ডিস্টেন্স কত হবে বুঝতেই পারছেন।

তাহলে কেন অযথা ওকে এভাবে হ্যারেজ করছেন। যেই কথাগুলো ওকে শুনাচ্ছেন আপনাদের আর নিসার বয়সের পার্থক্যের সাথে কি সেই কথাগুলো যায়? এই কথাগুলো না বলে, ওর গালে দুটো দুটো, চারটে কষিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিতেন তাও আপনাদের বয়সের সাথে শোভনীয় দেখাতো। আর কথা শোনানো ব্যাপারটি না সব বয়সের সাথে যায় না। অবশ্য আমার মতে কথা শোনানো টাই একটি ঘৃণিত কাজ। কেননা কথা শোনানোতে যার বিরুদ্ধে বলছে তার ইমেজ ফুঁটে উঠে না, ফুঁটে উঠে যে বলছে তার ইমেজ। ফুঁটে উঠে তার ভেতর শিক্ষার অভাব ঠিক কতটা আছে সেই পরিমাণ। সেই সাথে ফুঁটে উঠে কতটা নিচু মনের সেটাও। আসছি আন্টি। আসসালামু আলাইকুম।”

বলেই নিসার হাত ধরে ভেতরে চলে গেল রাফি।
রাফির হাত ধরে নিসাকে ঘরের ভেতর ঢুকতে দেখে রনির স্ত্রী রেখা রাফির স্ত্রী শিল্পীকে ডেকে বলল,
“শিল্পী শিল্পী, এদিকে আয়। দেখ, আমাদের নিসা এসেছে।”
রেখা নিসাকে বুকে জড়িয়ে বলল,
“কোথায় চলে গিয়েছিলি আমাদের ফেলে? তুই জানিস না, বাবা মা তোকে ছাড়া পাগল পাগল হয়ে যায়। আর এই ঘরএই ঘর তো তোকে ছাড়া একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে।”

নিসার মাথায় হাত রেখে পাশ থেকে শিল্পী বলল,
“হ্যাঁ রে নিসা। তোকে ছাড়া একরাতেই দম বন্ধ হয়ে আসছিল সবার। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি তোকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেললাম। আর বুঝি তোর এই মুখখানি দেখব না।”
রেখা ও শিল্পীর এতগুলো কথা শুনেও নিসা এমন একটি ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো যেন একটি কথাও তার কান ভেদ করে মস্তিষ্কে যেতে পারে নি। নিঃশব্দে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালে মা নাদিরা খাতুন বললেন,
“কোথায় গিয়েছিলি?”

নিসা কোনো কথা বলছে না, কেবল চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ থেকে বাবা সুলতান সাহেব বললেন,
“নাদিরা, মেয়েটা সবেই এসেছে। ওকে ফ্রেশ হওয়ার সময়টুকু দাও।”
নাদিরা খাতুন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিসার সামনে এগিয়ে থুতনি ধরে মুখখানি উঁচু করে বললেন,
“প্রেমিকের সাথে রাত কাটানো শেষ?”
“মা!”
“তোর ওই নোংরা মুখ দিয়ে আমাকে আর কক্ষনো মা বলে ডাকবি না। অন্তত তোর জন্য তোর এই মা মরে গিয়েছে। আজ থেকে জানবি তোর মা মৃত।”

পর্ব ৫

“মা!”
“চুপ। আর একবারও ওই অপবিত্র মুখ দিয়ে আমাকে মা বলে ডাকবি না। আমার তো ভাবতেও ঘেন্না করছে তোর মতো কীটকে আমি আমার এই পেটে জায়গা দিয়েছিলাম।”
নিসা চোখের জল মুছে মা নাদিরা খাতুনের হাতে ধরে বলল,
“মা, তুমি আমার কথাটা একবার শুনো। সবাই ভুল বুঝুক কিন্তু তুমি তো আমার মা, তুমি তোমার মেয়েকে একটু বুঝার চেষ্টা করো।”

এক ঝাড়িতে নিসার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নাদিরা খাতুন বললেন,
“এই তুই আমার হাত কেন ধরেছিস? তোর সাহস কতবড় তুই আমার হাত ধরেছিস? আর তোর কথা কী শুনব! তোর কথা শোনার মত অবশিষ্ট কিছু কি রেখেছিস?”
“মা”
নিসার কথা শেষ হবার আগে নাদিরা খাতুন আবারও বললেন,
“সবাই বলত তুই ছোট মানুষ। কিন্তু তুই যে এতবড় হয়ে গিয়েছিস কেউ বুঝতেই পারল না। ডাইরেক্ট বেটা ধরে গলায় ঝুলে পড়েছিস। আচ্ছা, কাজটা করার আগে তোর লজ্জা করলো না?”

নিসা ফের নাদিরা খাতুনের হাত ধরে কিছু বলতে নিলে নাদিরা খাতুন এক থাপ্পড়ে মেঝেতে ফেলে দিলেন নিসাকে। নিজেও মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে নিসার গলা টিপে বললেন,
“তোকে বলেছিলাম না আমাকে ধরবি না? তাহকে কেন ধরেছিস, কোন সাহসে ধরেছিস বল। তোর জন্য আজ আমাদের এতবছরের মান সম্মান ধুলোয় মিশে গিয়েছে। শুধুমাত্র তোর জন্য আজ বাড়ির বাহিরে মানুষ জড়ো হয়ে ছিছিক্কার করে আমার সুখের বাড়িকে নরকে পরিণত করছে। শুধুমাত্র তোর জন্যে পরিবার পরিজন, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি সবাই আমাদের মুখে চুনকালি মেখে একঘরে করে দেবে। তাই এতো কলঙ্ক নিয়ে তোর বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। মরে তুইও শান্তি পা আর আমাদেরও শান্তি দেয়।”

বলেই শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নাদিরা খাতুন মেয়ে নিসার গলা টিপতে লাগল”
“আরে আরে, কী করছেন মা? মেয়েটাকে মেরে ফেলবেন না-কি?”নাদিরা খাতুনের হাত থেকে নিসাকে ছাড়ানোর ফাঁকে কথাটি বলল রেখা। শিল্পীও পেছন থেকে নিসাকে ধরে বলল,
“বাচ্চা মানুষ। বয়সই বা কত ওর! এ বয়সের ছেলেমেয়েরা তো কতকিছুই করে। ও না-হয় একটা ভুল করেই ফেলেছে তার জন্য আপনি মা হয়েও যদি এরকম ব্যবহার করেন, মেয়েটা যাবে কোথায় ভেবে দেখেছেন?”

“এই একটা ভুলই যে ওর জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে সেটা কি তোমাদের অজানা? এই একটা ভুলের জন্যই যে ও সমাজের চোখে কলঙ্কিনী, নষ্টা হয়ে সারাজীবন বাঁঁচবে এটাও কি তোমাদের অজানা শিল্পী?”
“তাই বলে এভাবে শাসন করবেন মা? আর এটাকে তো শাসন করাও বলে না, যথারীতি মেরে ফেলা।”
“হ্যাঁ, আমি ওকে মেরেই ফেলতে চাই। ওর বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।”

বলেই শিল্পীর উপর দিয়ে নিসার গলা ফের টিপে ধরতে গেলে বাবা সুলতান সাহেব নাদিরা খাতুনকে টেনে দূরে সরিয়ে বললেন,
“রেখা, শিল্পী তোমরা দু’জন নিসাকে ভেতরে নিয়ে যাও। তোমাদের শাশুড়ি মা’কে আমি দেখছি।”
রেখা ও শিল্পী একমিনিটও আর দাঁড়ালো না। নিসাকে জড়িয়ে ধরে দ্রুত চলে গেল ঘরের ভেতর।

“কী রে প্রণয়, সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল এখনো তোর সেই চাচাতো ভাই আর ভাবি এলো না যে?”
প্রণয় দু’হাত পেছনে বেঁধে মাথা নিচু করে হাজতের ভেতর পায়চারি করার তালে এতটাই বিভোর ছিল নিলয় যে কিছু বলেছে সে শুনতেই পায়নি। মুহিত বসা থেকে এগিয়ে এসে প্রণয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কী রে, কী ভাবছিস এতো?”

প্রণয় পায়চারি বন্ধ করে স্থির দাঁড়িয়ে বলল,
“অজপাড়াগায়ে মধ্যবিত্ত পরিবার। দুটোই মাত্র সন্তান। বড় ছেলে তো উচ্চ শিক্ষিত হয়ে বড় লোক বাড়িতে বিয়ে করে ঘর জামাই হয়ে বসে আছে। ছোট ছেলে অবশ্যই সেরকম হবে না। বাবা মায়ের কষ্ট নির্ঘাৎ সে উপলব্ধি করবে। এই ছোট ছেলে ছাড়া যে তাদের বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন নেই। তাদের বিশ্বাস একদিন তাদের ছোট ছেলে অনেক বড় হয়ে তাদের সারাজীবনের সকল কষ্ট ঘুঁচে দিবে। তাই তো বাবা মা কষ্ট করে সেই ছোট ছেলেকে শহরে পাঠিয়েছিল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবে বলে! আর আজ সেই ছোট ছেলে পড়ালেখা বাদ দিয়ে হাজতে বসে দিনপার করছে।”

মুহিত কী বলবে বুঝতে পারছে না। নিলয়ের দিকে ইশারা দিতে নিলয় এসে বলল,
“এতো ভাবিস না। কয়েক ঘন্টারই তো ব্যাপার, তোর ভাইয়া ভাবী আসুক নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
“সে তো আমিও জানি কিন্তু, যদি না’হয়! ক’দিন বাদেই অনার্স ফাইনাল এক্সাম তখন কী হবে ভাবতে পারছিস? ৪ বছরের কষ্ট আমার বিফলে যাবে।”

“শুধু কি তোর যাবে? সাথে তো আমার ও মুহিতেরও যাবে তাই না?”
“না না, সেই ভয় পাস না। যদি কিছু হয় আমার হবে তোদের না। আসল অপরাধী তো আমি তোরা না।”

মুহিত পাশ থেকে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি না, তুই নেগেটিভ কেন ভাবছিস। পজিটিভও তো হতে পারে তাই না?”
প্রণয় মুচকি হেসে সিমেন্টে পাকা করা লম্বা বেঞ্চের মাঝে বসে বলল,
“শুনেছিলি ওসি ওরফে নিসার মামা কী বলেছিলেন?”

পাশে নিলয় ও মুহিত বসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে প্রণয় বলল,
“বলেছেন পাকাপোক্ত একটি ডায়েরি লিখাতে অর্থাৎ নারী নির্যাতনের মামলা। আর নারী নির্যাতনের মামলায় আমাকেই আসামী করবে তোদের না।”
মুহিত বলল,
“তোর কি মনে হয় ওরা আদৌ সেই মামলা করতে পারবে?”

“সে আমি জানি করতে পারবে না। নিসা কখনোই সাক্ষী হয়ে সেই মামলা করতে আসবে না কিন্তু”
নিলয় বলল,
“কিন্তু কি?”
“কিন্তু নিসা সেজে যদি অন্যকেউ কেস টা করে যায় তখন!”
“পাগল হয়েছিস? নিসা সেজে আসলেই হলো, পুলিশরা কি এমনি এমনি ইউনিফর্ম পড়ে এখানে বসে আছে?”

মুহিতের কথা শুনে আস্তে করে মুহিতের মাথায় থাপ্পড় মেরে নিলয় বলল,
“ভুলে যাচ্ছিস কেন, এই থানার ওসি নিসার মামা। চাইলে অনেক অসম্ভবকেই তিনি সম্ভব করতে পারে।”
হঠাৎ করে প্রণয় চোখের জল ফেলে বলল,
“এই মুহূর্তে নিসার উপর দিয়ে কী ঝড় বইছে একমাত্র আল্লাহ পাকই জানেন। ছোট্ট একটা মেয়ে কী করে সহ্য করবে এত যন্ত্রণা! পরিবারের কটু কথা, আত্মীয়স্বজনদের ছিছিক্কার আর পাড়া প্রতিবেশী তো রয়েছেই।”

মুহিত ভ্রু কুচকে বলল,
“তুই এখনো নিসাকে নিয়ে ভাবছিস প্রণয়? ওর ভাইয়ের করা এতকান্ডের পরেও তোর মুখ দিয়ে নিসার কথা বের হচ্ছে?”
“ভুলে যাস না মুহিত, নিসা কিন্তু আমার প্রেমিকা না যে ওকে আমি ভুলে যাবো। বিয়ে করেছি আমি ওকে। আল্লাহকে সাক্ষী করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে ওকে। তাই ফার্দার যেন এসব কথা না শুনি।”

প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে নিলয় বলল,
“সেই কখন মেসেজ দিলি তোর ভাইকে। এখনো যে কেন আসছে না বুঝতেই পারছি না।”

পর্ব ৬

“আসবে, মেসেজ চোখে পড়লে অবশ্যই আসবে। সেসব নিয়ে তুই ভাবিস না।”
বলতে না বলতেই জেলের বাহির থেকে প্রণয়ের চাচাতো ভাই সামির বললেন,
“প্রণয়!”

সামিরকে দেখে প্রণয়ের যেন প্রাণ ফিরে এলো। দু’লাফে সামিরের বরাবর দাঁড়িয়ে জেলের এপাশ থেকে বলল,
“ভাইয়া, তুমি এসেছ? ভাবি আসে নি? আমি তো তোমাকে একা আসতে বলিনি, ভাবিকে সহ আসতে বলেছিলাম।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এসেছে। তোর ভাবিও এসেছে। কী কারণে তোরা এখানে সেটা তো আমরা জানি না, তাই টেম্পোরারি একটা বেলের কাগজ এনে ওসিকে তোর ভাবি দেখাচ্ছে। অন্তত দিন সাতেকের একটা বেল পাবি। এর মাঝে যে মামলাটা দিয়েছে সে যদি উঠিয়ে নেয় তাহলে বেল কেটে গেলেও দ্বিতীয়বার আর তোকে এখানে আসার প্রয়োজন পড়বে না।”

“ওহ্।”
“হুম, তো কী কারণে আসতে হলো এখানে? আর কে-ই বা করেছে অভিযোগ?”
“ভাইয়া, আগে বের হয়ে নি এখান থেকে তারপর সেসব কথা পড়ে বলব।”
এরই মাঝে এক দারোগা এসে জেলের তালা খুলে দিয়ে বলল,
“বের হোন সবাই।”

প্রণয়, নিলয় ও মুহিত দ্রুত জেল থেকে বেড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। প্রণয় বলল,
“ভাইয়া চলো।”
“যাবকোথায় যাব?”
“আমাদের সাথে নিসার বাড়িতে।”

পেছন থেকে কাগজপত্র ভাজ করতে করতে প্রণয়ের ভাবি নিতু এসে বললেন,
“ভাবি সবকিছু করল কিন্তু সেই ভাবিকে ছোট্ট একটা ধন্যবাদ না দিয়ে উল্টো ভাবিকে ফেলে ভাইকে নিয়ে চলে যাওয়ার কথা হচ্ছে?”
“ভাবি উকিল বলেই তো করেছে নয়তো কি করত। তাই ভাবিকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। ভাবি তো আপনই পর না।”

“সেটাও কথা কিন্তু যাবে কোথায় সেটা তো বলো। কারণ তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে মামলার বিষয়ে।”
“আসলে ভাবি, আমি নিসার বাড়িতে যাচ্ছি।”
“মামলাটা নিসার পরিবার করেছিল না?”

সামির চমকে উঠলেন নিতুর কথা শুনে। বললেন,
“কী বলছ কী নিতু? নিসার পরিবার মামলা করে প্রণয়কে জেলে পাঠিয়েছে? এত বড় সাহস তাদের আমার ভাইকে জেলে পাঠিয়েছে?
“হুম, সেরকমই তো শুনে এলাম নিসার মামার থেকে। আর এও শুনে এলাম প্রণয় না-কি নিসাকে গায়ে হলুদের স্টেজ থেকে পালিয়ে নিয়ে এসেছিল গতকাল রাতে। আর রাতটা না-কি প্রণয়ের ফ্ল্যাটে ওরা একসাথেই থেকেছে। নিসার পরিবার রাত থেকে বহু খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে সকাল বেলা নিসার সন্ধান পায় প্রণয়ের ফ্ল্যাট থেকে।”

নিতুর কথাগুলো শুনে সামিরের ভ্রু দুটো কিঞ্চিৎ পরিমাণ কুচকে গেল। বলল,
“কথাগুলো যে বললে এগুলো কি আদৌ সত্য নিতু? আমার তো মনে হয় না প্রণয় আর নিসাকে নিয়ে এতটা গভীর ভাবনায় যাওয়া ঠিক হবে। আরেকটা কথা হলো এই জেলখানায় তুমির নিসার মামাকে আবার কোথায় পেলে?”
“আরে এই থানার ওসি মিঃ আরমান হলেন নিসার আপন মামা। তো সেই আমাকে এই কথাগুলো বললেন।”
“ওহ্।”

বলেই সামির প্রণয়ের দিকে তাকালেন। বললেন,
“তোর ভাবি যে কথাগুলো বলল সেগুলো কি সত্য প্রণয়? তুই নিসাকে নিয়ে গতকাল পালিয়ে গিয়েছিলি?”
মাথা নিচু করে প্রণয় বলল,
“হুম ভাইয়া। নিসাকে নিয়ে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস করো এছাড়া আমার করার কিছুই ছিল না।

নিসার পরিবার জোর করে ওকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। এদিকে নিসা সেই বিয়ে করতে নারাজ। বারবার আমাকে হুমকি দিচ্ছিল আত্মহত্যা করবে বলে। সেই সময়ে আমি কি করতাম বলো। আর তুমি তো জানো নিসাকে আমি ঠিক কতটা ভালোবাসি। কিন্তু তারপরওতারপরও আমি চেয়েছিলাম নিসা অন্যজনকে বিয়ে করে সুখী হোক। আমার মত বেকার যুবকের জন্য ঘর থেকে পালিয়ে নিজের জীবন নরক না করে তুলক। কিন্তু নিসাই যে মানছিল না, তাই বাধ্য হয়েই ওকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।”

সামির কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। বেশ কিছুটা সময় পার হবার পর বললেন,
“নিসা যত যাই বলুক না কেন, তোর এই কাজটা করা মোটেও ঠিক হয়নি প্রণয়। তোর এই কাজটা করার আগে অন্তত একবার আমাকে কিংবা তোর ভাবিকে জানানোর প্রয়োজন ছিল।”

পাশ থেকে মিতু বললেন,
“সামির, আমাদের এই মুহূর্তে এসব কথা বাদ দিয়ে আগে থানা থেকে বের হওয়া উচিৎ। বাহিরে গিয়েও তো এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারব।”

মুহিত বলল,
“হ্যাঁ ভাবি, এখান থেকে যত দ্রুত বের হবো আমাদের জন্য তত মঙ্গল।”
সামির আর কথা না বলে থানা থেকে বেড়িয়ে গেল। পেছন পেছন বেড়িয়ে গেল প্রণয়সহ সকলেই। সামিরের নিয়ে আসা গাড়ির কাছে দাঁড়াতেই প্রণয় বলল,
“ভাইয়া!”
“নিসার বাড়ি যেতে হবে?”ভারী গলায় বললেন সামির।

“হুম।”
এইটুকু বলেই প্রণয় চুপ হয়ে গেল। এদিকে সামির প্রণয়ের নিরবতা দেখে বললেন,
“আরও কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। মানুষের কাছ থেকে শোনার চেয়ে তোর থেকে শোনাও মঙ্গলজনক।”
প্রণয় কি বলবে বুঝতে পারছে না। তারপরও বুকে দম নিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলল,
“ভাইয়া, আজ সকালে আমি নিসাকে বিয়ে করে ফেলেছি।”

সামিরের সাথে সাথে নিতুও হা হয়ে রইলো প্রণয়ের কথা শুনে। তাদের মুখের ভাষা যেন এক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে ফেলেছে দু’জন। চোখ পাকিয়ে নিতু বললেন,
“কী বলছ কী প্রণয়? তোমার কি মাথা ঠিক আছে?”
“ভাবি এছাড়া আমার আর কোনো রাস্তা ছিল না। আমি নিসাকে হারাতে পারব না ভাবি, কিছুতেই হারাতে পারব না।”

সামির বললেন,
“নিসার পরিবার কি জানে? মানে সকালে যে পুলিশের দলবল নিয়ে এসেছিল তারা, তখন কি তাদের সব বলে দিয়েছিলি?”
প্রণয় বলল,
“তখন পর্যন্ত তো কিছুই জানত না তারা। আর না আমরা কাউকে বলেছি তবে এখন নিসার থেকে সব জেনে গিয়েছে কি-না সেটা বলতে পারব না।”

“এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভবিষ্যতের কথা ভাবা উচিৎ ছিল তোর। তুই নিজেই একটা স্টুডেন্ট। নিজের খাবার খরচই জোগাতে পারিস না, বউয়ের খরচ কীভাবে জোগাবি? শুধু যে খাওয়ার খরচ সেটাও তো না ওষুধপত্র, কাপড়-চোপড়, বাড়িভাড়া ইত্যাদি। ওহো তারউপর আবার বউয়ের পড়ালেখার খরচও তো আছে! কীভাবে সামাল দিবি ভেবে দেখেছিস?”
প্রণয় কোনো কথা বলছে না, চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে সামির প্রণয়ের নিরবতা দেখে বললেন,
“গাড়িতে উঠ।”

“কেন ভাইয়া?”
“বিয়ে যখন করেই ফেলেছিস, ওই পরিবার নামক জেলখানায় বউকে তো আর একা রাখা যাবে না। পাশে তোকে পেলেও মনে সাহস পাবে। আর মানুষের যে কটুকথা ছিড়ি, অল্প বয়সের মেয়েটা সেই কথার ধাঁর একা বহনও করতে পারবে না।”

সামিরের কথা শুনে প্রণয়ের চোখেমুখে মুহূর্তের মাঝে হাসির ঝলক ফুটে উঠল। সেই হাসি দেখে নিতু বললেন,
“না হেসে দ্রুত গাড়িতে উঠেন দেবরজি। আমার জা কে তো বিপদ থেকে মুক্ত করতে হবে তাই না?”
সামির এবার লজ্জায় মুখ টিপে হেসে দ্রুত গাড়িতে বসে পড়ল।

পর্ব ৭

কী হলো নিসা কিছু বলছিস না যে? রেখা ভাবি সেই কখন থেকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর তুই চুপ করে আছিস এটা কেমন কথা?”নিসার এলোমেলো চুল আঁচড়ে বেনী করার ফাঁকে কথাগুলো বলল শিল্পী।
“কী বলব ভাবি? আমার কোনো কথা কি বিশ্বাস করার যোগ্য?”

নিসার থুতনি ধরে আদুরে গলায় রেখা বলল,
“এটা কেমন কথা বললি নিসা! তোর কথাআমাদের নিসা বুড়ির কথা বিশ্বাস করব না, এটা কখনো হতে পারে? তবে হ্যাঁ, অন্যদের কথা বলতে পারছি না। কিন্তু, তোর এই দুই ভাবি যে তোকে চোখ বুজে বিশ্বাস করে সেটা তো তুই জানিস।”

মুচকি হেসে নিসা বলল,
“কী করে জানব ভাবি;তোমরা যদি এতই বিশ্বাস করতে আমাকে তাহলে তো বারবার জিজ্ঞেস করতে না, এই একরাতের মাঝে প্রণয়ের সাথে আমার শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয়েছে কি-না। কারণ তোমরা যদি সত্যি অর্থে আমাকে বিশ্বাস করতে তাহলে এর উত্তর তোমাদের কাছেই থাকত, আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনই পড়তো না।”

শিল্পী বলল,
“আমরা তোকে পূর্ণ বিশ্বাস করি নিসা কিন্তুওই সময়টাকে আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না।”
রেখা বলল,
“হ্যাঁ নিসা, শিল্পীর কথার সাথে আমিও একমত। আমাদের সন্দেহের জায়গাটাই হচ্ছে ওই সময় আর ওই আবদ্ধ ঘর টাকে ঘিরে। কেননা আমরা বিবাহিতরা খুব ভালো করেই জানি, দুটো ভালোবাসার মানুষ একটি আবদ্ধ ঘরে থাকলে ঠিক কী কী হতে পারে। আর সেই জানা থেকেই তোকে জিজ্ঞেস করা।”

“সেটাই তো বললাম রেখা ভাবি, তোমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি নেই।”
রেখা চোখমুখ কুচকে বলল,
“এতকথা বুঝি না নিসা। মা বলেছেন তোকে জিজ্ঞেস করতে, তাই আমরা জিজ্ঞেস করছি। এখন সোজাসুজি উত্তরটা তুই দিয়ে দেয় তাতেই তোর আর আমাদের সবার মঙ্গল।”

“আর কীভাবে বললে তোমরা বুঝবে যে, আমি এমন কিছু করিনি যার জন্যে তোমাদের মাথা নিচু হবে! মানছি আমি প্রণয়ের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু পালানোর মানে এই না যে, আমি ওর সাথে রাত কাটাতে গিয়েছিলাম। আর সত্যি কথা বলতে কি জানোআমি রাত কাটাতে চাইলেও না, প্রণয় কখনোই চাবে না এরকম একটি জঘন্য কাজ করতে। ও আমাকে ভালোবাসে আমার শরীরকে না।

গতরাতে ওর বাড়িতে থাকলেও ওর ঘরে আমি থাকি নি কারণ ও নিজেই আমাকে ওর ঘরে রাখে নি। ও থেকেছে একঘরে আর আমি অন্যঘরে। তারপরও কি কোনো সন্দেহ থাকার কথা ভাবি?”
নিসার কথা শুনে রেখা, শিল্পী দু’জনেই বেশ চমকে গেল! শিল্পী বলল,
“মানেতোরা দু’জন দু ঘরে থেকেছিস!”
“হ্যাঁ ভাবি, আমরা দু’জন দু ঘরে থেকেছি। একটিবারের জন্যেও কেউ কারো ঘরে উঁকি পর্যন্ত দিই নি। তারপরও তোমরা আমাকে অবিশ্বাস করছ।”

এইটুকু বলেই নিসা কেঁদে দিল। আবারও বলল,
“আর মা, সে কি করে ভাবতে পারল যে, আমি ওসব বাজে কাজ করব? সে না আমাকে জন্ম দিয়েছে! সে কি জানে না আমি ঠিক কি কি করতে পারি?”
নিসাকে বুকে টেনে নিয়ে রেখা বলল,
“আরে পাগলী কাঁদছিস কেন? তুই কাঁদলে কি আমাদের ভালো লাগে? তুই তো আমাদের ঘরের বাচ্চা। আর সেই বাচ্চার চোখে জল থাকলে আমাদের বুকটা কেমন করে বুঝিস না?”

নিসাও রেখাকে জড়িয়ে ধরে আরও কাঁদতে আরম্ভ করল। বলল,
“মা কি করে পারল আমাকে অবিশ্বাস করতে? আমি জানি, গতকালের ঘটনার পর থেকে মায়ের কাছে আমি অনেক খারাপ। তাই বলে এরকম জঘন্যতম কাজ করব এটা মা ভাবল কী করে? আমার উপর মা’র এতটুকুও বিশ্বাস নেই?”
“সত্যি বলতে কী জানিস, মায়ের যন্ত্রণা তুই এখন বুঝবি না। যেদিন নিজে মা হবি ঠিক সেদিন বুঝবি একজন মায়ের যন্ত্রণা ঠিক কতটা তীব্র। একটি মেয়ের সম্মান বজায় রাখা তার মায়ের জন্য ঠিক কতটা কষ্টকর সেটা একজন মা’ই ভালো জানেন।”

হাতের চিরুনী বিছানার উপর রেখে শিল্পী বলল,
“শোন নিসা, বর্তমানের যুগটা এখন এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে নিজ পরিবারের কাছে ৬ মাসের কন্যা শিশুও সুরক্ষিত নয়। সে জায়গায় তুই তো একটি উর্তী বয়সের মেয়ে। এই যে ক’দিন আগের ঘটে যাওয়া ঘটানার কথাতেই আয়, তুইও হয়তো দেখেছিলি খবরে! ৯ মাসের ভাস্তিকে আপন চাচা ধর্ষণ করেছে। এই ঘটনাটা কি সত্যি ঘটার কথা ছিল? ওই ৯ মাসের শিশুটার শরীরে কী এমন কোনো যৌবনের চিহ্ন ফুঁটে উঠেছিল যার জন্য আপন চাচা নিজের আবেগ সামলাতে পারেনি? যার জন্যে যৌবন বিহীনই ওই শিশুটির নাম কামাতে হয়েছে ধর্ষিতা? বল ছিল কোনো চিহ্ন?”

নিসা মাথা নিচু করে রেখার বুক থেকে মাথা উঠিয়ে চুপচাপ বসে আছে। মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বের হচ্ছে নিসার। অবশ্য বের হওয়ার কথাও না, তার ভাবি যে সত্যি কথাই বলছে। তাই এই কথাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে কি কথা আসতে পারে নিসা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তাই রেখা বলল,
“কী হলো শিল্পীর কথা উত্তর দিচ্ছিস না যে?”

তারপরও নিসা কিছু বলল না। রেখা নিজেই আবার বলল,
“এখন তুই বল যে কন্যা শিশুর কি-না তার আপন চাচার কাছে সেফ নয়, সেখানে তোর মত মেয়ে প্রেমিকের কাছে সেফ থাকবে এটা কি বিশ্বাস করার মত? তাও আবার তোর মায়ের কাছে? যেই মা কি-না তার মেয়ের সম্মানের জন্য সারাটা জীবন মেয়েকে বুক ছাড়া করে নি সেই মেয়ে পুরো একটা রাত মিসিং তাও আবার প্রেমিকের সাথে। সেই মা কি করে বিশ্বাস করবে ওই প্রেমিক তার মেয়েকে খুবলে খায় নি? যেই যুগে কি-না একটা মেয়েকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য মানুষ নামক কিছু নরখাদক ওত পেতে বসে থাকে সেই জায়গায় একজন মা কি করে বিশ্বাস করবে ওই প্রেমিক তার মেয়ের দেহকে আবদ্ধ ঘরে পেয়ে এমনি এমনি ছেড়ে দিবে?”
“প্রণয় সেরকম না ভাবি।”মাথা নিচু করেই নিসা কথাটি বলল।

“আচ্ছা, ধরে নিলাম প্রণয় খুব ভালো। সে কিছুই করে নি কিংবা করার ইচ্ছাও পোষণ করে নি কিন্তু এ সমাজের মানুষ কি সেটা বিশ্বাস করবে?”
“আমি জানি আমি ঠিক কী। তাই মানুষ কিংবা সমাজ কী বলল বা কী বলবে তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।”
রেখা মুচকি হেসে আর কিছু বলল না। এদিকে শিল্পী নিসার মাথায় হাত রেখে বলল,
“তুই ঠিক তো জগৎ ঠিক। আর আমরা চাই যেন তুই নিজেকে ঠিক রাখতে পারিস।”

বলেই শিল্পী বসা উঠে গেল সাথে রেখাও। দু’জন ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে নিলেই নিসা বলে উঠে,
“একটা কথা ছিল আমার।”
ঘাড় ফিরিয়ে রেখা বলল,
“শুনছি বল।”

নিসা বলতে নিলেও বলতে পারছে না। শব্দগুলো যেন দু’ঠোঁটের মাঝে এসেও বারবার ফিরে যাচ্ছে। তারপরও হাঁসফাঁস করে বলল,
“আজ সকালেপ্রণয় ও আমার বিয়ে হয়েছে।”

পর্ব ৮

কথাটি শোনামাত্র ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল রেখা। শিল্পী কিছুটা সামনে এগিয়ে বলল,
“কী বললি?”
“আজ সকালেই প্রণয় আর আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”

বলা মাত্রই শিল্পী ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল নিসার বা গালে। বলল,
“তোকে যতটা ছোট ভেবে সন্তান স্নেহ দিয়েছিলাম, তুই আসলে ততটা ছোট না। ভেতরে ভেতরে খুব পেকে গিয়েছিস যেটাকে কি-না মাত্রাতিরিক্ত বলে।”
এদিকে রেখা শান্ত গলায় বলল,
“তোর বিয়ের বয়স কি সত্যিই পার হয়ে যাচ্ছিল নিসা?”

নিসা মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। রেখা বেশ কিছুটা সময় নিসার উত্তরের অপেক্ষা করে ব্যর্থ হয়ে উঠে দাঁড়ালো। শিল্পীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“চেষ্টা তো করলাম বহুত বিষয়টি নিজেরা সামলানোর জন্য, কিন্তু এখনএখন মনে হচ্ছে বাবা-মা ছাড়া এ বিষয়টি কেউ সামলাতে পারবে না।
বলেই ঘর ছেড়ে চলে গেল রেখা।

দুই ছেলে রনি, রাফি ও স্ত্রী নাদিরা খাতুনকে নিয়ে মেয়ে নিসার বিষয়ে কথা বলার জন্য গোল হয়ে বসতেই রেখা এলো।
নাদিরা খাতুন বললেন,
“কিছু বলবে রেখা?”
“জ্বি, হ্যাঁ আসলে মা”
“কী জ্বি, হ্যাঁ করছ? যা বলার পরিষ্কার করে বলোতো।”

রেখা বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই কলিংবেল বেজে উঠল। সুলতান সাহেব বললেন,
“মা, আগে দরজা খুলে দেখোতো কে এসেছে।”
“জ্বি বাবা।”
দ্রুত পায়ে দরজা খুলে দরজার ওপারের মানুষটিকে দেখে রেখা যথারীতি বিস্মিত হয়ে গেল! বলল,
“প্রণয়! তুমি এখানে?”

প্রণয় নামটি শুনতেই সবাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আর রনির তো পায়ের রক্ত যেন টগবগ টগবগ করে মাথা চড়ে গেল। দু লাফে দরজার কাছে গিয়ে প্রণয়ের কলার চেপে ধরতেই পেছনে তাকিয়ে হা হয়ে গেল। কলার ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ম্যাডাম, আপনি এখানে?”

নিতু প্রণয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
“একজন মানুষ কিংবা অতিথি তোমাদের বাড়িতে এলে বুঝি তোমরা এভাবে স্বাগতম জানাও?”
“আপনি জানেন না ম্যাডাম, এই জানোয়ার আমাদের সাথে কি করেছে। আমাদের সুখের পরিবারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমাদের সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে।”
“মুখ সামলে কথা বলো রনি। তুমি যাকে জানোয়ার বলে সম্বোধন করছ, সে কিন্তু আমার দেবর।”

রনি যেন জমে পুরো ফ্রিজ হবার উপক্রম। এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে প্রণয়কে নয়, নিজেকে মেরে কুটি কুটি করতে। এ কি করল সে, এভাবে নিজের হাতে ধরে নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করে ফেলল।
এদিকে নিতু কারো অনুমতি ছাড়াই ঘরে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে বললেন,
“কী ভাবছ রনি! নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করে ফেলেছ কি-না?”

সুলতান সাহেব বললেন,
“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, আসল ব্যাপারটা কি! রনি, কী হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলতো।”
রনি বলার আগেই নিতু বললেন,
“কাকা, রনির প্রয়োজন নেই আমি নিজেই বলছি আসল কাহিনী কি!”

বলেই রনির দিকে তাকালো নিতু। নিজেই আবার বললেন,
“আমি হলাম এডভোকেট নিতু। নিতু আফরোজা সামির। গত ৮ বছর যাবৎ আমি এই পেশার সাথেই আছি। আর আপনার ছেলেও যখন এই পেশার সাথে জড়িত সেই সূত্রে আপনার ছেলে আমার চেম্বার থেকেই ওকালতির সব শিখে পড়ে নিচ্ছে। কেননা সিনিয়র হওয়ার সুবিধার্থে আমার আন্ডারেই আপনার ছেলের ট্রেনিং টা পড়েছে। যে ট্রেনিংয়ের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে আপনার ছেলে রনি ছোট্ট একটা সার্টিফিকেট পাবে। যেটা কিনা ওর এই জগতে টিকে থাকতে বহু কাজে ব্যবহৃত হবে। আর পুরোটাই নির্ভর করবে আমার দেয়া সেই সার্টিফিকেটের উপর। আশা করব এখন আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন।”

“ও বুঝতে পেরেছি আপনি তাহলে রনির সেই ম্যাডাম।”
“জ্বি।”
রনি হাঁসফাঁস করে বলল,
“প্রণয় আপনার কেমন দেবর হয় ম্যাডাম?”
“সেটা জেনে তুমি কি করবে?”

“আসলে ম্যাডাম…”কিছু বলতে নিয়েও নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে চুপ হয়ে গেল রনি। নিতু বললেন,
“আমার দেবর কোন দিক থেকে ফেলনা যে, তোমাদের বোনকে বিয়ে দিতে এতো নারাজ তোমরা! এমনকি পুলিশে কমপ্লেইন করতেও বাধ্য হয়েছ। ভাল করে তাকিয়ে দেখেছ প্রণয়ের দিকে? এরকম একটা ছেলে তো লাখে কেন, কোটি তেও মেলা অসম্ভব। যেমন সে লম্বা, তেমন তার স্বাস্থ্য আর তেমনই তার গায়ের রঙ! কি নেই তার মাঝে বলো, বলো প্রণয়ের মাঝে কী চাও। ও হো প্রণয় তো এই শহরের না, এই শহরে তার কিছুই নেই। গ্রামের ছেলে গ্রামে বড় হয়েছে এটাই কি তোমাদের মূল সমস্যা?”

মুহুর্তের মাঝে রনি চোখমুখের ভাষা পরিবর্তন করে বলল,
“না না, এগুলো কোনো সমস্যাই না। এতদিন তো ওর পরিবার পরিজন কাউকে চিনতাম না তাই আর কিতবে এখন তো বুঝতেই পারছি ও কোন পরিবারের। তা নাহলে আপনার মতো একজন মানুষ বুঝি ওই বাড়ির বউ হয়।”

“বুঝলে তো ভালোই। তাহলে কি আমি ধরে নেব নিসা আমাদের বাড়ির বউ?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। নিসা তো আপনাদেরই। যেখানে আপনি আছেন সেখানে কি আর কোনো কথা চলে! আপনি যা বলবেন যেভাবে বলবেন ঠিক সেই সেই ভাবেই হবে।”

সুলতান সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“কী বলছিস কী রনি? তোর মাথা ঠিকাছে? বোঝা নেই শোনা নেই বলে দিচ্ছিস মেয়ে তাদের! এটা কেমন কথা?”

রনি চোখমুখ ঘুরিয়ে বাবাকে চুপ করাতে চাইলেও সুলতান সাহেব চুপ হলেন না। বললেন,
“আমার একটা মাত্র মেয়ে। আমি বুঝেশুনে আমার মেয়েকে বিয়ে দিব। তোর কথায় এভাবে হুট করে আমি তো আমার মেয়েকে বিয়ে দিব না।”
“আহাবাবা! চুপ করো না। নিসা তোমার মেয়ে হলেও আমার কিন্তু বোন। আমি কি না জেনেই বিয়ের কথা বলছি?”
“তুই তোর স্বার্থে বলছিস আমার মেয়ের স্বার্থে না। তাই তুই এই বিষয়ে আর একটা কথাও বলবি না।”

এপর্যায়ে রনি সুলতান সাহেবের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
“বেশি বুঝো না বাবা। আমি যা করছি তোমার মেয়ের আর আমাদের ভালোর জন্যই করছি। এই মহিলার ক্ষমতা সম্পর্কের তোমার কোনো ধারণাই নেই। তারউপর এইবছর দাঁড়াচ্ছে এমপি ইলেকশনে আর তার জেতার সম্ভাবনা ৯৯৫%।

সেখানে যদি তার কথায় তোমার মেয়েকে বিয়ে না দি, তাহলে মনে করো তোমার মেয়ের এই জীবদ্দশায় আর কখনো বিয়ে হবে না। সেই সাথে এই এলাকায় শান্তিতে আর থাকাও লাগবে না। তখন তোমার মেয়ের আর তোমার পরিবারের কী হবে ভেবে দেখেছ? তাই বলছি বেশি কথা না বলে, যা বলছি তা বুঝার চেষ্টা করো।”

রনির কথা শুনে সুলতান সাহেবের মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বের হচ্ছে না। চোখমুখ কুচকে আস্তে করে সোফায় এক কোণে বসে পড়ল।
এদিকে রনির ফিসফিসানিও সুলতান সাহেবের গোমড়া মুখ দেখে নিতুর পাশে সামির বসে বললেন,
“তো কী ভাবলেন কাকা? মেয়ে কি দিবেন?”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুলতান সাহেব বললেন,
“রাফি, যা কাজী ডেকে নিয়ে আয়।”

“কাজী লাগবে না বাবা। বিয়ে ওদের আজ সকালেই হয়ে গিয়েছে।”বলেই মাথা নিচু করে ফেলল রেখা।
রেখার মুখ থেকে কথাটি শোনামাত্র সুলতান সাহেব, নাদিরা খাতুন, রনি ও রাফি সকলের মুখই হা হয়ে গেল। চোখ দুটো বড় বড় করে নাদিরা খাতুন বললেন,
“বিয়ে হয়ে গিয়েছে! কে বলেছে তোমাকে নিসার এই ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে? এরা বলেছে, এদের কথা বিশ্বাস করো তুমি?”
“মা উনারা কেন বলবেন? উনাদের সাথে কি আমার আলাদা কোনো কথা হয়েছে যে উনারা বলবেন। উনাদের যা কথা হয়েছে সব তো আপনাদের সাথে, আমার সাথে নয়।”

“তাহলেতাহলে কে বলেছে তোমাকে?”
রেখা মাথা নিচু করে অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“নিসা, নিসা বলেছে আমাকে।”

নিতু বললেন,
“আজ সকালেই প্রণয় নিসার বিয়ে হয়েছে। যেটা কি-না আপনাদের মতো আমাদেরও অজানা ছিল। থানা থেকে বের হতেই প্রণয় আমাদের সবটা খুলে বলে আর তারপরই আমরা আপনাদের বাসায় ছুটে আসি”
নিতুর কথা শেষ হবার আগেই নাদিরা খাতুন বললেন,
“আপনাদের বউকে নিয়ে যেতে তাই তো? একটু অপেক্ষা করুন, আমি নিজেই আপনাদের বউকে নিয়ে আসছি।”

পর্ব ৯

বলেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে চলে গেলেন নাদিরা খাতুন। মিনিট দুয়েক বাদে নিসার হাত ধরে টানতে টানতে বসার ঘরে এনে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,
“এই নিন আপনাদের বৌমা।

তবে হ্যাঁ, আজকের পর থেকে আপনাদের এই বৌমা বিষয়ক ভালো হোক কিংবা মন্দ কোনো প্রকার কথা বলতে এখানে আসবেন না। কেননা এই মুহূর্তের পর থেকে আমাদের পুরো পরিবারের জন্য আপনাদের এই বৌমা মৃত।”
নিসা চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। পাশ থেকে সুলতান সাহেব বললেন,
“নাদিরা, কী বলছ তুমি?”

চোখ পাকিয়ে নাদিরা খাতুন বললেন,
“তুমি এর মাঝে কোনো কথা বলবে না। ছেলের কথায় ওই মহিলাকে ভয় পেয়ে যখন মেয়েকে বলি দিয়েই দিচ্ছ, তুমি এর মাঝে টুশব্দটিও করবে না বলে দিচ্ছি।”
নাদিরা খাতুনের চেঁচিয়ে কথা বলা দেখে রনি হা হয়ে গেল! একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার ম্যাডাম নিতুর দিকে তাকাচ্ছে। মায়ের হাত ধরে গলা নামিয়ে বলল,
“মা প্লিজ এভাবে সিনক্রিয়েট করো না। উনারা শুনলে ব্যাপারটা খুবই বাজে দেখাবে।”

এই টুকু বলতেই নাদিরা খাতুন আরও একবার চেঁচিয়ে উঠলেন। রনির দিকে আগুন্তক দৃষ্টি তাকিয়ে বললেন,
“চুপ, আর একটা কথাও না। এতক্ষণ তোর ম্যাডামের অনেক পাওয়ার দেখেছি কিন্তু আর না। কী করবে কী হ্যাঁ, সমাজ ছাড়া করবে? বাড়ি ছাড়া করবে? করুক, হবো আমি সমাজ ছাড়া, বাড়ি ছাড়া তারপরও আমি মুখ বুজে থাকব না।”

বলেই নাদিরা খাতুন চোখ পাকিয়ে তাকালেন নিতুর দিকে। দু কদম এগিয়ে নিসাকে সামনে ধাক্কা দিয়ে বললেন,
“এই নিন আপনাদের বাড়ির বউকে এনে দিলাম। এবার খুশি তো? আর হ্যাঁ, আপনার ভাষ্যমতে এবার হয়তো আপনি আমার পরিবারকে শেষ করার আগে আর আমার ছেলের ক্যারিয়ার নষ্ট করার আগে নিশ্চয়ই দু বার ভাববেন তাই না? ব্যাস, এইটুকুতেই আমার চলবে।”
নিতু বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আপনি কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছেন কাকী।”

“ভবিষ্যতের এমপিকে আমি ভুল বুঝব এটা তো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। সে যাই হোক, আপনাদের বউকে তো দিয়ে দিয়েছি আপনারা এখন আসতে পারেন। তবে হ্যাঁ, একটা কথা মাথায় রাখবেন আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেন আপনাদের বাড়ির বউ এইমুখো না হয়।”

নাদিরা খাতুন হনহন করে ভেতরে চলে যেতে নিলে প্রণয় গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“মা!”
মা ডাক শুনে নাদিরা খাতুন থমকে দাঁড়ালেন। প্রণয় আবারও বলতে লাগল,
“আচ্ছা মা, আপনার একমাত্র মেয়েকে যার সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তার মাঝে এমন কি আছে যা আমার মাঝে নেই? দয়া করে যদি এই কথাটি খুলে বলতেন আমার জন্য খুবই উপকার হতো।”

“আমার মেয়ের জন্য কেমন যোগ্যতার ছেলে বাছাই করব, তার কৈফিয়ত কি তোমাকে দিব?”
“আমি কৈফিয়তের কথা বলিনি মা। জাস্ট জানার আগ্রহ থেকে জিজ্ঞেস করেছি কারণ তাহলে তার যোগ্যতা আর নিজের অপারগতার সাথে যাচাই করে দেখতাম।”

“শুনেছিলাম তুমি নাকি ভীষণ ভদ্র ছেলে। তাএই বুঝি তোমার ভদ্রতার নমুনা?”
“আমি কিন্তু অভদ্রতামির কিছুই করিনি মা আর আপনার সাথে তো প্রশ্নই আসে না। কেননা আপনি নিসার মা আর নিসার মানে আমারও মা।”

“দেখো কী যেন নাম! ও হ্যাঁ, প্রণয়। দেখো প্রণয় অকারণে কথা বাড়িয়ো না, তোমার সাথে কথা বলার মত কোনো ইচ্ছা বা রুচি আমার নেই। তুমি তোমার বউকে নিতে এসেছ নিয়ে যাও। এমনিতেই অনেক তামাশা দেখেছে পাড়া প্রতিবেশী এখন শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে নতুন করে আর তামাশে দেখিও না।”
“বারবার বলছেন নিসা আমাদের বাড়ির বউ, আপনার কি কেউ হয় না নিসা?”

“আমার যদি সত্যিকার অর্থেই কেউ হতো তাহলে কি আজ ও তোমার বউ থাকতো না-কি আজ আমি ওকে জ্যান্ত মাটি দিয়ে তোমার হাতে ছেড়ে দিতাম?”
প্রণয়ের মুখ চুপসে ছোট হয়ে গেল। নাদিরা খাতুন আবারও বললেন,
“আচ্ছা প্রণয়, তুমি যে ওকে বিয়ে করলে খাওয়াবে কী? দিন শেষে মাথার উপর ছাদ দিবে কোত্থেকে? সংসারের খরচই বা কীভাবে জোগাড় দিবে? তুমি তো স্টুডেন্ট কোনো চাকরিবাকরি করো না, নিজের খরচই চালাতে পারো না তারউপর আবার বউ! তাহলে কোন হিসেবে বিয়েটা করলে একটু বলোতো? আর কার ভরসাতেই বা করলে?”

প্রণয় এবারো চুপ থেকেই গেল। কেননা কথাগুলো যে একটি মিথ্যে না, আর মিথ্যে না বলেই এই কড়া সত্যের উত্তরও প্রণয়ের জানা নেই। নাদিরা খাতুন এবারও প্রণয়ের নিরবতা দেখে বললেন,
“জানতাম এই প্রশ্নেরও উত্তর থাকবে না। আর আমিও যে কী না, যাকে জ্যান্ত মৃত করে দিয়েছি আজীবনের জন্য তার জীবন ধারনের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আসলেই দিন দিন মাথা শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

“মা!”
নিসা অস্পষ্ট স্বরে টলমলে চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আওয়াজ দিতেই নাদিরা খাতুন সেই ডাক কে পাত্তা না দিয়ে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর ভাব ফুটিয়ে বললেন,
“এই ছেলে তোমাকে না বললাম চলে যেতে, এখনো দাঁড়িয়ে আছো যে? যেতে ইচ্ছে করছে না বুঝি! ও হোএখন বুঝেছি কোন হিসেবে তুমি বিয়েটা করেছিলে।

ভেবেছিলে এই বাড়ির একটা মাত্র মেয়ে কোনো না কোনো উপায়ে এ বাড়িতে ঢুকার ব্যবস্থা করে ধীরে ধীরে সব হাত করে নেবে তাই তো? কিন্তু এটা মনে রেখো যতদিন আমি আছে ততদিন তো তুমি এ বাড়ির চৌকাঠও পেরোতে পারবে না। যাও, এক্ষুনি বেড়িয়ে যাও বলছি।”

প্রণয়ের বেশ আত্মসম্মানে লাগল নাদিরা খাতুনের কথাগুলো শুনে। ভেবেছিল কিছু বলবে কিন্তু একেবারে চুপও থাকতে পারল না সে।
“বিয়ে যখন করেছি মাঝ রাস্তায় ফেলে তো দিতে পারব না। যেখানে থাকি যেভাবেই থাকি না কেন, বউকে নিয়েই থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করব। কারো উপর ভর দেয়ার ছেলে প্রণয় নয়।”বলেই নিসার দিকে তাকালো প্রণয়। বলল
“তো নিসা, যাবেযাবে আমার সাথে?”

নিসা মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে রইলো। প্রণয় বলল,
“কী হলো কথা বলছ না যে? কী এতো ভাবছ যে একটা ছোট্ট উত্তর দিতে এতো সময় লাগছে। না-কি এতক্ষণে ব্রেইন ওয়াশ করে ফেলেছে তোমার?”
নিসা একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে, একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার প্রণয়ের দিকে। বাবা-মায়ের চোখের ভাষা কঠিন থেকে কঠিনতর দেখে বলল,
“যেখানে আমি জীবিত থেকেও মৃত সেখানে থাকার ইচ্ছে আমার নেই।”

বলেই এক কাপড়ে বাড়ির বাহিরে চলে গেল নিসা। আর তার পিছু পিছু ছুটে গেল প্রণয়সহ সকলেই।
এদিকে নিসা চলে যাওয়ার পর নাদিরা খাতুনও নীরবে চোখের জল ছেড়ে দিলেন। এতক্ষণ নিজের যন্ত্রণাকে মাটি চাপা দিয়ে রাখলেও মেয়ে চলে যাওয়ায় আর সেটা চাপা দিয়ে রাখতে পারলেন না। মনে হচ্ছে যেন শত বছরের নোনা জল একবারে উপচে উঠেছে মাটি ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে। তাই চোখের জল আড়াল করতে মুখে কাপড় ধরে দ্রুত চলে গেলেন নাদিরা খাতুন নিজ রুমে।

পর্ব ১০

রাত ৮ টা। কেবলই সামির ও নিতু প্রণয় আর নিসাকে সংসারের বারো দিক বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। কিন্তু নিসার মাথায় যেন কিছুই ঢুকছে না, অবশ্য ঢোকাতেও চাইছে না সে। একে তো বাবা মায়ের কথা বারবার মনে পড়ছে তারউপর মুহিত ও নিলয়ের সাথে ফ্ল্যাট শেয়ার করা নিয়ে মাথা ধরে আসছে। তবে বাবা মায়ের মুখটাই যেন তার সবচেয়ে বড় দূর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

এদিকে প্রণয় ঘরে ঢুকে নিসাকে মাথা নিচু করে গুটিশুটি মেরে বিছানার এক কোণে বসে থাকতে দেখে দরজা লক করে নিসার পাশে বসে বলল,
“মন খারাপ?”

নিসা চুপ করেই রইলো। প্রণয় নিসার হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“কথা বলছ না যে? মন খারাপ? বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে?”

“বাবা-মা’কে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি। তারা আমাকে যেভাবে বড় করেছে, যে স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছে তাদের এই কষ্ট পাওয়া মোটেও কাম্য ছিল না।”
“তোমাকে তো বলেছিলাম তাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে নাও। কেন করোনি তুমি? আজ যদি তুমি ওই ছেলেকে বিয়ে করে নিতে তাহলে কি তারা কষ্ট পেত? কখনোই পেত না। আর না তুমি নিজেওআফসোস করার সুযোগ পেতে।”

বলেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল প্রণয়।
“কে বলেছে তোমাকে আমি আফসোস করছি?”
“কারো বলা লাগবে কেন, তোমার চিন্তিত মুখটাই কি আমার বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়?”

“আচ্ছা প্রণয়, বাবা-মায়ের কথা মনে পড়লেই যে এই বিয়ে নিয়ে আফসোস করা হবে এটা তুমি কেন ধরে নিচ্ছ? আমি তো সেসব আফসোসের কথা নাও ভাবতে পারি তাই না? যে বাবা-মায়ের কাছে জীবনের এতটা বছর কাটিয়ে এসেছি সেই বাবা-মা’কে তো আর মুহূর্তের মাঝে ভুলে যেতে পারব না। আর ভুলে যেতে পারব না বলেই মন খারাপ তো হবেই। এটাই তো স্বাভাবিক। তুমি অযথা এটার সাথে আফসোস শব্দটা কেন মেলাচ্ছ?”
“আচ্ছা, সেসব কথা বাদ দাও তো। কথা বললেই কথা বাড়বে তাই ওসব কথার মাঝে আজ না গেলেই ভালো।”
“কিন্তু তোমার ওই কথাটা আমার মোটেও ভালো লাগেনি প্রণয়।”

“আহাবললাম তো বাদ দাও। আর হ্যাঁ, ওই কথাটা আমার ভুল হয়েছে। তার জন্য আমি সরি। এখন আশা করি তোমার আর খারাপ লাগবে না!”
নিসা মুচকি হাসল। পরক্ষনেই হালকা গলায় বলল,
“নিলয় আর মুহিত ভাইয়া কি অলয়েজ আমাদের সাথে থাকবে না-কি অন্য কোথাও থাকার বন্দবস্ত করবে?”

“তোমার কি ওদের সাথে থাকতে কোনো সমস্যা হবে? না মানেশুধু তোমার আমার জন্যে যদি পুরো ফ্ল্যাট টা ভাড়া নি তাহলে অনেক খরচ হয়ে যাবে। দেখা যাবে মাস শেষে খাওয়ার খরচও টিকবে না। তাই ভাবছিলাম এখন তো একরুমেই দিব্যি চলবে, তো একরুমেই না’হয় থাকি আর অন্যরুমে ওরা দু’জন থাকুক। তাহলে হবে কি ভাড়া টা দু’ভাগে ভাগ হয়ে টাকা টাও বেঁচে গেল আর মাস শেষে টানাপোড়েনের ঝামেলাও থাকবে না।”

“ও, তো ভাড়া কত এই ফ্ল্যাটের?”
“ফ্ল্যাটের রুম দুটো ছোট তো তাই ভাড়া বেশি না। গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল সহ-ই ৫২০০ টাকা।”
“তাহলে একেক রুমের ভাগে পড়বে ২৬০০ করে।”
“হুম, তবে একরুম ২৬০০ কিন্তু আমাদের মত স্টুডেন্ট যারা আছে তাদের জন্য অনেক।”

“হ্যাঁ, তা ঠিক। আচ্ছা প্রণয়, তুমি যেই ৩টি টিউশনি করো তার থেকে মাসে মোট কত করে পাও?”
প্রণয় বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল নিসার প্রশ্ন শুনে! নিসা যে প্রথম রাতেই এমন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে সে ভাবতে পারে নি। তাই আমতা আমতা করেই বলল,
“আসলে হয়েছে কি তিনজন স্টুডেন্টই ছোট ক্লাসের তো, তাই তেমন একটা ভালো অঙ্কের টাকা পাই না।

“সেটা তো জানি কিন্তু এক্সেক্টলি কত পাও সেটাই জানতে চাইছিলাম।”
“ও”
কিছুটা দম নিয়ে প্রণয় বলল,
“মানথলি ৮১০০ টাকার মত পড়ে।”

নিসার ভ্রু সামান্য কুচকে গেল।
“৮১০০! এ সামান্য ক’টা টাকা দিয়ে সংসার চলবে কীভাবে? তারউপর যদি একটা বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যায় তার খরচ চালাব কী করে? আর একটা বাচ্চার পেছনে তো সামান্য খরচ হয় না, পুরো একটা সংসার খরচই ধরতে গেলে বাচ্চার পেছনে চলে যায়। বাচ্চার লেকটোজেন, কাপড়চোপড়, ডাইপার ইত্যাদি এসবের পেছনেই তো অনেক টাকার প্রয়োজন পড়ে। তাহলে এই টাকা দিয়ে আমরা চলব কীভাবে?”

“তুমি একটু বেশি ভাবছ নিসা। সবেই তো বিয়ে করলাম আমরা। এখনই কি বাচ্চা নেব না-কি! আর তুমি নিজেই তো একটা বাচ্চা, তোমাকে আবার কি বাচ্চা দিব। তাই বাচ্চা নিয়ে এখন ভেবো না।”
“আমি বাচ্চা! আমাকে দেখে তোমার বাচ্চা মনে হয়?”

“বাচ্চা না-তো কি বুড়ি?”
“না, বুড়ি হবো কেন? তবে বাচ্চাও না এটা ঠিক।”
“ও আচ্ছা।”
“হুম, বাচ্চার বিষয় না’হয় গেল কিন্তু সংসার চলবে কী করে আমাদের? বর্তমানের যে যুগ, এ যুগে এ সামান্য টাকা দিয়ে চলা অনেক টাফ।”

“হয়তো টাফ, তবে এটা নিয়েও তুমি ভেবোই না, কেননা টাকা না থাকলেও তোমাকে টাকার কষ্ট আমি দিব না। নিজে না খেলে তোমাকে খাওয়াবো। যেহেতু তোমার সব দায়িত্ব আমার উপর। তবে আমার মনে হয় এই ৮০০০ টাকা দিয়ে দু’জনের দিব্যি চলে যাবে ইনশাআল্লাহ। আর এমনতো না যে, এই কটা টাকা দিয়েই আমি আমার পুরো জীবন চালানোর হিসেব কষছি। মাত্র তো কটা মাস বাকি তারপরই অনার্স শেষ আর অনার্সের সার্টিফিকেট পেলে একটা ভালো মানের জব পাবো সেটা তো তুমি জানই। তাই এই ক’টা দিন একটু কষ্ট করো তারপরই সব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”
“ইনশাআল্লাহ। তো কবে থেকে টিউশনি যাবে?”

“কবে থেকে যাবো মানে? টিউশনি অফ কবে করলাম, টিউশনি তো আমার রানিং চলছে।”
“হ্যাঁ, সে তো জানি। তবে আমরা গ্রামে তোমাদের বাড়ি যাবো না, সেখানে কতদিন থাকবে তারপর সেখান থেকে ফিরে কবে থেকে টিউশনি শুরু করবে সেটাই জিজ্ঞেস করেছি।”

“ও আচ্ছা। সামনে বাচ্চাদের এক্সাম তাই বেশিদিন গ্রামে থাকা যাবে না, অবিভাবকরা রাগারাগি করবে। আর এর উপরই তো আমাদের সংসার তাই এটাকে অবহেলা করাও ঠিক হবে না, তাই ভাবছি আজ তো মঙ্গলবার বার বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টিউশনি করে সেদিন রাতের গাড়িতেই বাড়ি যাবো। শুক্র, শনি দুদিন থেকে রবিবার দিন ব্যাক করব। ভালো হবে না?”

“ভালো কি-না জানি না, তবে মন্দও না। কেননা দুদিনের জন্য বাড়ি যাবো কেমন যেন লাগে। আবার নিজেরা নিজেরা বিয়ে করেছি মানুষ কি বলবে সেটার জন্যেও বেশিদিন থাকতে ইচ্ছে করবে না, তাই দু দিক বিবেচনা করে মনে হচ্ছে ভালোই হবে।”
“হুম বুঝলাম। কিন্তু ম্যাডাম আজকের রাতটা কি কথা বলেই পার করবে না-কি ঘরটা আঁধারও করবে?”
“আঁধার করে কি হবে? আঁধার আমি ভয় পাই জানো না?”

নিসার হাতে চিমটি কেটে বলল,
“তোমার বুকে সারা রাত ঘুরেফিরে খেলা করলেও কি ভয় করবে?”
“উফফতুমি না!”
বলেই নিসা উঠে চলে যেতে নিলে প্রণয় দাঁড়িয়ে নিসাকে পাজ কোলে তুলে নিল।

বলল,
“পালাচ্ছো কোথায়? বাসর রাতে যে বউ কে পালাতে নেই জানো না?”
এইটুকু বলেই দুষ্টু হাসি দিয়ে এগিয়ে গেল ফুলবিহীন বিছানায় বাসর রাত নামক অনুভূতি দিয়ে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের দাড়প্রান্তে।

পর্ব ১১

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ প্রণয় ও নিসা হাতে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেইন রাস্তার ধারে। তাদের গন্তব্যস্থল ময়মনসিংহের কাচিজুলি। সেই কখন থেকে দু’জন দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তাদের প্রত্যাশিত বাস টি আসার নামই নেই।
“আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব প্রণয়? তোমাদের ওইদিকের বাসের তো দেখাই মেলছে না।”
“আরে আসবে আসবে, চিন্তা করো না।”

“কখন আসবে? কম সময় তো হলো না দাঁড়িয়ে আছি।”
“আরে ওই তো এসে গিয়েছে। চলো চলো।”
“কোথায়?”
“আরে ওই যে দেখছ না, বড় বাস আলম এশিয়া এদিকে আসছে ওইটা।”

“ও।”
বাস এদিকে আসতেই প্রণয় বলল,
“এই মামা, ময়মনসিংহ কাচিজুলি কত করে?”
“২০০ মামা। কয়জন আপনেরা?”

“২ জন। আর মামা এয়ারপোর্ট থেকে ময়মনসিংহ ২০০ টাকা এটা কেমন কথা! অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছেতো কম টম রাখা যায় না?”
“না মামা কম তো রাখা যাইব না। আর সবসময় টাকা দেখলে হইব, বাসের কোয়ালিটি দেখবেন না?”
“দেখেছি কিন্তু আমি ৩৫০ এর উপর এক টাকাও দিতে পারব না।”
“না মামা সাড়ে তিনশ তো হইত না। যান আর বিশ টাকা বাড়ায় দিয়েন।”

“না, আমি আর একটাকাও দিব না। সাড়ে তিনশ হলে নাও নয়তো”
“আচ্ছা আচ্ছা, আসেন। রাইত কইরা আর কথা বাড়ানের দরকার নাই আইসা পড়েন।”
বলেই কন্টেকটার প্রণয়ের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে বাসে জোড়ে একটা বারি দিয়ে বলল,
“আস্তে, মহিলা আছে।”

বাসে উঠে জানালার পাশের সিটে নিসা বসল। প্রণয় ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে বলল,
“এগুলো একটু হাতে রাখো।”

“কী এগুলো? তুমি এতগুলো পলিথিন কেন নিয়ে এসেছ? তোমার কি আবার বমি টমি করার অভ্যাস আছে না-কি?”
প্রণয় ঠিক করে বসে নিসার হাত থেকে পলিথিন গুলো নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
“বমির অভ্যেস আমার না, যদি তোমার থাকে তাই সাথে করে পলিথিন নিয়েছি।

যাতে বিপদের সময় কাজে লাগে। আর লং জার্নিতে অনেকেরই এই সমস্যাটা থাকে।”
“তবে লং জার্নিতে আমার এই সমস্যা আছে আর সেটা তোমাকে আমি কখনো বলেছি বলে আমার তো মনে পড়ছে না।”
“আমি কি বলেছি যে তুমি আমাকে বলেছ? আমি তো নিজে থেকেই এই বন্দবস্ত করেছি যদি কাজে লাগে তার জন্য।”

“কিন্তু আমি তো বমি করি না, আর এগুলো কাজেও লাগবে না।”
“আহা, কাজে না লাগলে তো সবচেয়ে বেস্ট তবে, সাথে রাখতে তো সমস্যা নেই। আর এমনও তো হতে পারে বমি তোমার না হয়ে আমার হলো তাই না?”
“হ্যাঁ, হতেই পারে।”

“হুম, তাই রেখেছি। যারই প্রবলেম হোক না কেন পলিথিন তো রয়েছেই।”
“হ্যাঁ, ভালো করেছ ভালো করেছ। সমস্যায় পড়ার থেকে আগেভাগেই বন্দবস্ত করে রাখা ভালো।”
“হুম।”

“আচ্ছা, তুমি তো বলেছিলে তোমাদের বাড়ি ময়মনসিংহের গোয়ালকান্দি। তাহলে গাড়িতে উঠার সময় গোয়ালকান্দি না বকে কাচিজুলি বললে কেন?”
“আরে গোয়ালকান্দি তো এলাকার নাম। সেখানে কি এই বাস চলে না-কি! গোয়ালকান্দি যাওয়ার জন্য প্রথমে আমাদের কাচিজুলি নামতে হয় তারপর সেখান থেকে অটো তে করে গোয়ালকান্দি যেতে হয়। ডাইরেক্ট বাস দিয়ে সেখানে যাওয়া যায় না”
“ও আচ্ছা, তো আমরা যে বাড়ি যাচ্ছি তোমার বাবা-মা কি জানেন?”

“মনে তো হয় জানে। সামির ভাইয়া তো বলেছিল বাবাকে কল করে সব বুঝিয়ে বলে দিবে। এখন বলেছি কি-না আমি শিউর না।”
“ফোন দিয়ে একবার জিজ্ঞেস করো। যদি বলতে ভুলে যায় আর আমরা অজানার মাঝে বাড়িতে উঠি বেশ সমস্যা হতে পারে।”
“না সমস্যা নেই। আমি যতটুকু ভাইয়াকে চিনি ও এতটা কেয়ারলেস না। ও নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাবাকে ফোন দিয়ে সবটা বলে দিয়েছে। তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না, যা হবে সব ভালোই হবে ইনশাআল্লাহ।”

“ভালো হলেই ভালো। আচ্ছা, এই সামির ভাইয়া আর নিতু ভাবির বয়স দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ বড় তোমার থেকে তাই না?”
“বড় মানে! তাদের ছেলে আছে আমার সমান। আমার বড় কাকার বড় ছেলে উনি বয়স তো হবেই।”
“কি বলছ কি তুমি উনার এত বয়স! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। তবে বয়স বেশি সেটা আগেই বুঝেছি কিন্তু এত বয়স হবে কল্পনাও করিনি।”

“হুম বুঝা যায় না উনাদের দেখলে। আসল কথা হচ্ছে, সুখে থাকলে যা হয় আর কি!”
“কথা ঠিক তোমার। কিন্তু তারা তো তোমার থেকে অনেক বড় তাহলে তুমি তাদের আপনি না বলে তুমি করে বলো কেন?”

“আরে পাগল যত বড়ই হোক না কেন, তারা তো আমার ভাই, ভাবী তাই না? তাহলে তুমি করে বললে সমস্যা কোথায়? আর ভাইয়াই বলেছিল আপনি করে না বলতে তাই আমি তুমি করে বলি।”
“ও আচ্ছা।”

“হুম।”
“এই আমরা এখন কোথায় আছি গো?”
প্রণয় জানালা দিয়ে বাহিরের দিক তাকিয়ে বলল,
“সবে আব্দুল্লাহপুর ক্রস করেছি। এখনো ময়মনসিংহ যেতে বহুদূর।”

“তাহলে তো মনে হয় আমি একটা ঘুম দিয়ে উঠতে পারব কি বলো।”
“হ্যাঁ, সে তো তুমি পারই। এমনিতেই আজকাল রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারো না তুমি, এখন যদি ঘুমিয়ে একটু পুষিয়ে নিতে পারো।”

নিসা চোখ ঘুরিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,
“রাস্তাঘাটেও তোমার দুষ্টুমি! তুমি পারোও।”
“আমি যে কি পারি সেটা তোমাকে রাতেই বুঝাই আবার এখন কি পারো পারো বলছ?”

“হয়েছে আর একটা কথাও বলবে না। আমার মাথা ভীষণ ব্যাথা করছে। আমি এখন একটু ঘুমোবো। তুমি মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দাও তো যেন দ্রুত ঘুম চলে আসে।”
বলেই প্রণয়ের বুকে মাথা রেখে মুচকি হেসে চোখ বুজে ফেলল নিসা। প্রণয়ও একগাল হেসে নিসাকে একহাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে অন্যহাত চুলের ভাজে পরম যত্নে গুঁজে দিল।

রাত ১২:২৭ বাজে। ঘুম ঘুম চোখে কেবলই প্রণয়ের হাত ধরে বাস থেকে নামল নিসা।

“ঘুমের রেশ দেখি এখনো কাটেনি। যেভাবে দুলছ মনে তো হচ্ছে রাস্তাতেই শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বে।”
“রাত কটা বাজে হুশ আছে তোমার? কোথায় অটো খুঁজবে তা না, আমাকে নিয়ে মজা করছ।”
“আমি হচ্ছি গরিব বাবার বড়লোক ছেলে। আমাকে রিসিভ করার জন্য অন্যদের মত গাড়ি না আসলেও অটো ঠিকই চলে আসবে। তাই অটো খোঁজার চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।”
“মানে?”

“আরে বাবা নিজেই কিছুক্ষণ আগে কল দিয়েছিল। বলেছে, অনেকক্ষণ আগেই পাশের বাড়ির মনিরকে অটো দিয়ে পাঠিয়েছে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাই আমরা যেন অটো খুঁজতে দূরে কোথাও না গিয়ে স্ট্যান্ডেই দাঁড়িয়ে থাকি। তাহলে মনিরের খুঁজে পেতে সুবিধে হবে।”
“ও আচ্ছা। তাহলে তো ভালোই হলো বাবা সব জেনে গিয়েছেন। তারপরও ভয় লাগছে কিন্তু ভয় লাগলে তো কিছু করার নেই, এখন শুধু বাড়িতে গিয়ে সিচুয়েশান বুঝার অপেক্ষা।”

“হুম সেটাই।”
এরই মাঝে অটোর আওয়াজ কানে ভেসে আসতেই প্রণয় চোখ পাকিয়ে তাকালো। ব্যাগ হাতে তুলে বলল,
“ওই তো মনির এসে গিয়েছে।”

পর্ব ১২

মাথায় দু’হাত লম্বা ঘোমটা টেনে প্রণয়ের পিছু পিছু নিসা ঘরে পা রাখতেই প্রণয়ের মা পারভীন আলম নিসার হাত ধরে বললেন,
“মা, ভালো আছ? আহা, মুখটা তো পুরো শুকিয়ে গিয়েছে। আমার মা’টারমনে হয় অনেক কষ্ট হয়েছে এই রাত করে গ্রামের পথ ধরে আসতে।”
“না না, আমি একদম ঠিকাছি মা।”

“তোমরা ভাল থাকলেই তো আমরা ভাল থাকি মা। আচ্ছা, রাস্তায় কিছু খেয়েছিলে? প্রণয় কিছু খাওয়ায় নি তোমাকে?”
পাশ থেকে প্রণয়ের বাবা শাহ আলম সাহেব বেশ ভারি গলায় বললেন,
“পারভীন, ছোট বউকে নিয়ে ভেতরে যাও। তোমার ছেলের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

“এত রাত করে আবার কী কথা তোমার? যা কথা হবার কাল সকালে হবে, আজ আর দরকার নেই। কম জার্নি করে এসেছে ওরা!”
“সবসময় বাজে বকো না তো পারভীন। তোমাকে যা বলেছি তুমি শুধু সেটা করো।”

শাহ আলম সাহেবের তীক্ষ্ণ গলার স্বর শুনে রীতিমত পারভীন আলম ভড়কে গেলেন। ঢোক গিলে চুপচাপ নিসাকে নিয়ে ভেতরে যেতে নিলে শাহ আলম সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ালো নিসা। অর্ধ নুইয়ে পায়ে ধরে সালাম করতে নিলে শাহ আলম সাহেব আমতা আমতা করে মাথায় হাত রেখে হালকা গলায় বললেন,
“হয়েছে হয়েছে, উঠো। পায়ে ধরে সালাম করা বেদাত জানো না? সে তোমার থেকে বয়সে কিংবা সম্পর্কের দিক থেকে যতই বড় হোক না কেন, কক্ষনো আর কারো পায়ে ধরে সালাম করবে না বুঝলে?”

নিসা মাথা নিচু করেই হালকা নাড়ল।
শাহ আলম সাহেব নিজেই আবার বললেন,
“কিসে পড়ো তুমি?”
“আসলে ক্লাস টেনে পড়ি আমি।”

কথাটি শোনামাত্র একপলক প্রণয়ের দিকে তাকালেন তিনি। আরেক পলক নিসার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এইটুকু বয়সে জীবনের এতবড় একটি সিদ্ধান্ত নিতে ভয় করে নি? বুক কাঁপেনি তোমার? বাবা-মায়ের কথা কি মনে পড়ে নি? আর সবচেয়ে বড় কথা সঠিক মানুষের হাতে তো না-ও পড়তে পারতে তাই না?”

নিসা কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এদিকে নিসাকে নীরব দেখে শাহ আলম সাহেব বললেন,
“যাও, শাশুড়ি মায়ের সাথে ভেতরে যাও।”

নিসা যেতেই শাহ আলম সাহেব প্রণয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পেছনে দু’হাত মুঠ বেঁধে বললেন,
“এর জন্য কি তোকে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাঠিয়েছিলাম প্রণয়? তুই তো তোর ভাই শামস এর মতই কাজটা করলি। সেও পড়ার নাম করে শহরে গিয়ে বড়লোক বাড়ির জামাই হয়ে বসে আছে, আর তুইও পড়ার নাম করে শহরে গিয়ে বিয়ে করে বসে আছিস।

এটাই কি ছিল তোর মা আর আমার সারাজীবনের ত্যাগ তিতিক্ষার প্রাপ্য? আচ্ছা, তুই যে আবেগের বশে এই বাচ্চা মেয়েটাকে ঘর ছাড়া করলি দুদিন পর যখন সংসারের টানাপোড়েনের মাঝে সে পড়বে তখন সে যে এই সবকিছুর জন্য তোকে দায়ী করবে সেটা ভেবে দেখেছিস? আর যখন সে ভালোমন্দ সবকিছু বুঝতে পারবে, অভাবি সংসারের কষ্ট, জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করতে পারবে তখন যে অল্প বয়সের করা ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে সংসার ও তার মাঝে নিয়ে আসবে দূরত্বতা সেটা ভেবে দেখেছিস?”

অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়। অবশ্য এছাড়া যে তার আর কোনো কাজও নেই। কেননা তার বাবা যে একটি কথাও ভুল বলছে না, সবগুলো কথারই যথেষ্ট যথার্থতা আছে।
“কী হলো কথা বলছিস না যে?”

“এছাড়া আমার আর কোনো রাস্তা ছিল না বাবা। ওর পরিবার ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। তখন আমি কি করে সেই বিয়েকে ঠেকাব বুঝে উঠতে পারি নি। তাই বাধ্য হয়ে ওকে নিয়ে পালিয়ে ছিলাম আমি।”

“এই মেয়ে ছাড়া কি ত্রিভুবনে আর কোনো মেয়ে নেই যে, এই ছাত্র অবস্থায় তোকে বিয়ে করতে হলো! না-কি তোর বিয়ের সময় পার হয়ে যাচ্ছে কোনটা?”
“ত্রিভুবনে মেয়ে থাকবে না কেন, অসংখ্য মেয়ে আছে তবে, নিসা কিন্তু দ্বিতীয়টি নেই। এই ত্রিভুবন জুড়ে নিসা একটাই আছে আর একটাই থাকবে।”

কিছুটা সময় থেমে শাহ আলম সাহেব বললেন,
“এখন সংসার চালাবি কি করে ভেবে দেখেছিস? সংসার তো আর তোর মুখের ধারালো শব্দের দ্বারা চলবে না, সংসার চালাতে হলে টাকার প্রয়োজন। তো সেই টাকা পাবি কোথায় সংসার চালানোর?”

“এখনো অবধি কিছু টিউশনি আছে তো সেগুলো দিয়েই না’হয় চলব। বিলাশবহুল ভাবে না পারি দু’বেলা ডাল ভাত খেয়ে তো বাঁচতে পারব তাহলেই হবে। বিপদে যখন পড়েছি উদ্ধারও তো হতে হবে তাই না?”
“দেখিস মাঝ রাস্তায় যেন আবার হাপিয়ে পড়িস না। জীবন নামক পথ টা ছোট হলেও বেশ বড়। সেখানে পেরে ওঠা খুবই দুর্লভ।”

প্রণয় মুচকি হেসে বলল,
“দোয়া করো বাবা। একমাত্র তোমাদের দোয়াই পারবে জীবনের বড় বড় বিপদ গুলোর গভীর প্রশস্ত পথ থেকে দ্রুত মুক্তি দিতে।”
শাহ আলম সাহেব মুচকি হেসে প্রণয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। সকালে আবার দ্রুত উঠতে হবে। গ্রামের সবাই যে নতুন বউকে দেখতে আসবে।”
“আচ্ছা বাবা।”

“আর হ্যাঁ, সবাই কিন্তু জানে সামির নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোকে বিয়ে করিয়েছে তুই একা করিস নি। তো সেই হিসেবে সবার সামনে কথা বলিস।”
প্রণয় কিছুক্ষণ তার বাবা দিকে তাকিয়ে রইলো। হুট করে বুকে বুক মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে কাপা স্বরে বলল,
“বর্তমান যুগে ছেলেমেয়েদের বন্ধুস্বরূপ তোমাদের মত বাবা মা ভীষণ প্রয়োজন।”

পিঠে আলতো করে হাত রেখে শাহ আলম সাহেব বললেন,
“হয়েছে হয়েছে, এবার যা ফ্রেশ হয়ে নেয়।”

প্রণয় পানির জগ হাতে নিয়ে দরজা লাগাতেই নিসা গা থেকে ওড়নাটা খুলে ইজি চেয়ারে ছড়িয়ে দিয়ে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
“আজ ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। আর মাথা তো ভনভন করে শুধু ঘুরছে।”

“জার্নি করলে এরকম একটু আধটু তো লাগবেই। আর যাদের জার্নি করার অভ্যাস থাকে না, তাদের তুলনামূলক একটু বেশিই কষ্ট হয়।”
“হুম, একদম ঠিক বলেছ। গাড়ি থেকে নেমে তো আমার মনে হয়েছিল এক্ষুণি কেউ একটা বিছানা ওখানে পেতে দিক আমি আরমসে ঘুমিয়ে পড়ি। কী জার্নি রে বাবা!”

প্রণয় পানির জগ টেবিলে রাখা অবস্থায় হো হো করে হেসে নিসার পাশে আধশোয়া হয়ে বসে বলল,
“সে তো আমি তখনই বুঝেছিলাম আর বাসে তোমার যে ঘুম, আমি জাস্ট অবাক!”
“জার্নি করলে আমার ওরকম-ই হয়। আর শুধু আমার না অনেকেরই হয় তাই এতে অবাক হওয়ার মত কিছুই নেই।”

“তা ঠিক তবে তোমার ঘুমের স্টাইল দেখেই কিন্তু আমি বেশি অবাক হয়েছি! সেসময় তোমাকে দেখে মনে হয়নি তুমি বাসে বসে ঘুমোচ্ছ, মনে হয়েছে বদ্ধ ঘরে বরের ভালবাসা পাওয়ার প্রবল ইচ্ছায় ঘুমের ভান ধরে বুক সাগরে খেলে বেড়াচ্ছ।”

কথাটি শোনামাত্র নিসার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। একলাফে শোয়া থেকে উঠে প্রণয়ের একটু কাছ ঘেঁষে বসে বলল,
“মানে কি বলছ তুমি”
“বাসে যতক্ষন তুমি ঘুমিয়েছিলে পুরোটা সময় তোমার হাত আমার বুকের মাঝে দৌড়াদৌড়ি করেছে। একবার বা পাশে তো একবার ডান পাশে, একবার উপরে তো একবার মাঝখানে এভাবেই পুরোটা রাস্তা পার হয়েছে।”

“আল্লাহ, কি বলছ তুমি! মানুষ দেখলে কি বলবে আর তুমিতুমি আমাকে ডাক দাওনি কেন? তাহলেও তো নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে পারতাম।”
“আরে পাগল মানুষ দেখবে কী করে! আমরা কি সামনের সিটের দিকে বসেছিলাম না-কি! আর রাতের বেলা ও লাইট কিছুটা দূরে হওয়ায় মানুষের চোখে তেমন কিছু ধরাও পড়ে নি।”

“ধরা পড়লে তো মান সম্মানের ফালুদা হয়ে যেত। তবে তুমি আমাকে ডাক না দিয়ে ঠিক করো নি, ইনকেস যদি কেউ দেখত কী হতো বলো।”
“কী হতো কিছুই না, আমরা তো আর প্রেমিক প্রেমিকা না যে বাসের চিপা চুপায় বসে রঙিন প্রেম করছিলাম। তুমি আমার বউ, জার্নি সহ্য না করতে পেরে ঘুমিয়ে যেতে পারো এটা তো দোষের কিছু না। আর যদি বলো বুকে সেই হাত দেয়ার কথাটা, তাহলে সবাই এটাও জানে ঘুমের ঘোরে মানুষের সেন্স কাজ করে না তাই এটাও তেমন কোন বিষয় না।”

“তা ঠিক তবে তুমি প্রমাণ দিতে কি করে যে আমরা সত্যিই বাসের চিপায় প্রেম করছি না, আমরা সত্যিকারের হাজবেন্ড ওয়াইফ? তুমি তো আর সাথে করে কাবিন নামা নিয়ে ঘুরো না, অবশ্য কাগজ হাতে পাও-ও নি তাহলে কেমন করে প্রমাণ দিতে?”
“কাবিন নামা নিয়ে নাই ঘুরতে পারি কিন্তু বিয়েত ছবি তো আছে সেটা কি প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়?”
“উফফ, তোমার মাথায় তো সেই বুদ্ধি। বিয়ের ছবির কথা তো আমার মাথাতেও আসত না কিংবা এখনো আসে নি।”

“এমনি এমনি কি বলি তোমার বর ভীষণ ব্রিলিয়েন্ট! তোমার বরের মাথায় আসলেও অনেক বুদ্ধি।”
“হ্যাঁ, সেতো পদে পদেই প্রমাণ পাচ্ছি।”
বলেই নিসা হেসে ফেলল। প্রণয় নিজেও হেসে নিসাকে আলতো করে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে চুলের ভাজে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
“আমার বাবা মা কে কেমন লাগল তোমার?”

পর্ব ১৩

ভালো, অত্যন্ত ভালো মনের মানুষ তারা দুজন। তা না হলে আমাদের এতবড় অপরাধের শাস্তি না দিয়ে এভাবে বুকে আগলে ধরত না।”
“তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম আমার বাবা মা অত্যন্ত নরম মনের। বাবা মাঝেমধ্যে কিছুটা শক্ত হলেও মা কখনোই হতে পারে না।”
“হ্যাঁ, মা একেবারেই মাটির মানুষ। আমাকে দেখে কিছু না বলে সোজা বুকে জড়িয়ে ধরল। আমি সেসময় তো এক্কেবারে বোকা হয়ে গিয়েছিলাম।”
“মা একটু ওরকম টাইপেরই। প্রচুর সহজ সরল আর সবচেয়ে বড় কথা হল গ্রামের থাকে তো ওতো প্যাঁচ ট্যাঁচ বুঝে না।”
“হুম তা ঠিক।”

বলেই নিসা প্রণয়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বলল,
“আচ্ছা প্রণয়, তুমি এরকম কেন বলোতো। ছেলে মানুষের এরকম অভ্যাস আমার মোটেও ভালো লাগে না।”
প্রণয় চোখমুখ ঘুরিয়ে বলল,
“আমি এরকম কেন মানে? আর কোন অভ্যাসের কথা বলছ তুমি?”
“কেন বুঝতে পারছ না?”
“বুঝবো কি করে যদি পুরোটা খুলে না বলো।”

“তুমি সবার সাথে এত মিনমিনিয়ে কথা বলো কেন? তুমি কি কারোর টাকায় খাও, পড়ো, তাহলে কেন এত চুপচাপ থাকো? ওভাবে তো মেয়েরা থাকে। তুমি অন্যান্য ছেলেদের মত দাপটের সাথে কথা বলতে পারো না?”
“আমি মেয়েদের মত কথা বলি? কী বলছ তুমি এসব।”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি আমি। তুমি মেয়েদের মতই কথা বলো। সেদিন জেলে যাওয়ার আগে ভাইয়ারা যখন তোমাকে ধরল তুমি চুপ করেছিলে। কেন চুপ করেছিলে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারো নি? তারপর জেল থেকে ফিরে যখন আমাদের বাসায় এলে আমাকে নিয়ে যেতে তখনও চুপ করে রইলে। আল্লাহ তোমাকে মুখ দেয় নি কথা বলার? আর এরকম তো মেয়েরা করে।”

“চুপ থাকলেই মেয়ে হয়ে যায়?”
“হ্যাঁ, মেয়েই তো হয়ে যায়। আর যেসব ছেলেরা এরকম মেয়েদের মত করে তাদের আমার মোটেও ভালো লাগে না।”
“আচ্ছা, তোমার সাথে সম্পর্ক থাকাকালীন আমাকে কখনো কারো সাথে কথা বলতে দেখেছ?”
“আমি কোথা থেকে দেখব? তুমি কি সারাদিন আমার সাথে থাকতে না-কি!”
“আমি কিন্তু সেকথা বলিনি। আমি বলেছি বাহিরে কোথাও কোনদিন কারো সাথে কথা বলতে দেখেছ?”

“হ্যাঁ, সে তো কতই দেখেছি। তখন তুমি অনেক ভালোভাবে বেশ দাপটের সাথে কথা বলতে যেটা আমার ভালো লাগে। কিন্তু এখন সব জায়গায় চুপ করে থাকো। তোমার বন্ধু নিলয়, মুহিত কিংবা তোমার ভসি সামির ও ভাবি নিতুই সব কথা বলে। আর মাঝেমধ্যে তুমি বললেও বিড়বিড়িয়ে বলল। কেন, এভাবে বলবে কেন?”
“আচ্ছা নিসা, বয়সে যারা বড় তাদের মুখের উপর কথা বলা কি ঠিক? আমার কিন্তু মনে হয় না এই ব্যাপারটা ঠিক। তোমার বাবা-মা আমার থেকে বয়সে বড় আর তোমার ভাইয়েরা সম্পর্কে। তাদের মুখের উপর কথা বলে পুরুষত্ব দেখানোর প্রয়োজনও আমি বোধ করি না। অন্তত আমার বাবা মা আমাকে ওই শিক্ষাটা দেয় নি।”
“কিন্তু তোমার সাথে ওই মিনমিনে স্বভাবটা যায় না।”

“হতে পারো সুন্দরী কিন্তু তোমার কথানুযায়ী আমার সাথে তোমাকে যায় না। তোমার মত খাটো মেয়ে আমার দেহের সাথে কোনদিক থেকেই মানায় না।”
নিসার মুখটুকু প্রায় চুপসে গেল। আর তা দেখে প্রণয় বলল,
“দেখো নিসা দেহ উঁচা লম্বা হলেই যে সব ব্যাপারে সবার সাথে দাপট দেখাতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিশেষ করে যারা আমার বড় তাদের সাথে দাপট ব্যাপারটা মানায়ও না। আর দাপট দেখাতে হবেই বা কেন, আমি কি গুন্ডা যে কারো কথা পছন্দ না হলে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাকে নিজের কথার লাইনে কথা বলাতে হবে?”

“আমি কি তোমাকে গুন্ডা বলেছি?”
“বলোনি কিন্তু হতে বলছ। বাংলা সিনেমার নায়ক টাইপের গুন্ডা। নায়িকাকে নিজের করে কাছে পেতে না পেরে নায়িকার বাবা-মা, ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করার মত যোগ্যতা ন্যায় গুন্ডা।”

“এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। তুমি আমার কথাটা যেভাবে নিচ্ছ আমি কিন্তু ওতটা গভীরে ভেবেও বলিনি।”
“সেই যাই হোক বলেছ তো এটাই বড় কথা।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বড় কথাই তো। আমি বলেছি যে, আমার কথা তো বড় হবেই।”

“সত্যিই নিসা বয়স অনুযায়ী তোমার ম্যাচিউরিটি অত্যন্ত বেশি। আমার বাস্তব জ্ঞান অনুযায়ী একটি ১৫ বছরের মেয়ের এতদিকে এতে সূক্ষভাবে খেয়াল আমি আগে দেখি নি কখনো। তবে এই খেয়াল সব ব্যাপারে প্রয়োগ না করাই আমার মতে ভালো।”
“বুঝেছি আমি কথা না বললেই তো শান্তি! যাও আমি আর কোনো কথা বলব না, তোমার যেভাবে ইচ্ছে যা ইচ্ছে করো আমি আর কোনো বিষয়ে মাথা ঘামাবো না, কিছু বলবও না।”

নিসার কথার ভাজে ভার অনুভব করে মাইন্ড ঘুরাতে প্রণয় চোখ পাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“বুঝে বলছ তো?”
“হুম বুঝেই বলছি।”
“আমার যেভাবে ইচ্ছা, যা ইচ্ছে তাই করব কিন্তু বুঝে নিও।”

“বললাম তো করো।”
একটানে নিসাকে নিজের বুকে উপর টেনে বিছানায় শুয়ে পড়ল প্রণয়। নিসার ঘন চুলের গোছা থুবড়ে পড়ে আছে প্রণয়ের চোখমুখ জুড়ে। প্রণয় সেই চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিতেই তার চোখ পড়ল চুলের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে থাকা নিসার বুকের মাঝের গাঢ় রেখাটির উপর। চুলের ভাজ থেকে হাত ছাড়িয়ে বুকের রেখাটির মাঝে ছুঁয়ে দিতেই চোখ বুজে ফেলল নিসা।

নিসার অনুভূতি বহিঃপ্রকাশ হতেই প্রণয় বলল,
“এই রেখাটির উপর বিয়ের দিন সকাল থেকেই ফিদা হয়ে আছি। সেদিন ছিলে আমার ঝোলা গেঞ্জি পড়নে তাই এত স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছিলাম। আর আজ ওড়না গায়ে না থাকায় ফের আরও গভীর স্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম। তবে সেদিনের থেকে আজ আরও বেশি আকর্ষণ সৃষ্টি করছে এই রেখাটি।”

নিসা এখনো চোখ বুজে চুপ করেই রয়েছে। এদিকে প্রণয় নিসার নীরব সম্মতি বুঝতে পেরে এক ঝটকায় নিসাকে বুকের উপর থেকে সরিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উল্টো নিজে নিসার উপর শরীরের ভার মেলে দিয়ে রেখাটির দিকে পিপাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আর কক্ষনো আমার সামনে অর্থাৎ এরকম বদ্ধ ঘরে ওড়না গায়ে রাখবে না।

কেননা তোমার বুকের এই গাঢ় রেখার নেশায় যে আমার বিলীন হওয়া খুব করে জরুরী।”
বলেই হাত উঁচু করে ঘরের আলো নিভিয়ে নিসার জামা একটানে খুলে বুকের মাঝের রেখাটিতে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো প্রণয়।

সকাল সকাল নিসা গোসল করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছতে নিলেই প্রণয়ের দুর্সম্পর্কের কাকী এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ভাবি, ও ভাবি ঘরে আছেন না-কি?”
পারভীন আলম মাথায় ঘোমটা টেনে ভেজা হাত শাড়ির আঁচলে মুছতে মুছতে বাহিরে এসে বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আছি এসো ভেতরে এসো।”

বলেই বারান্দায় চেয়ার টেনে দিলেন পারভীন আলম।
“মিনা, খাদিজা বসো তোমরা দুজন।”
“বসব বলেই তো এসেছি ভাবি। নতুন বউ এসেছে বাড়িতে তার সাথে পরিচয় করতে হবে না, কাকী শ্বাশুড়ি বলে কথা!”

মিনার কথা শুনে পারভীন আলম মুচকি হেসে বললেন,
“সে আবার বলতে, বউয়ের উপর ছড়ি ঘুরাতে হবে যে।”
“হা হা এবার নিন পরিচিয় পর্বটা তাহলে সেড়ে দিন।”
“ও হ্যাঁ।”

বলেই নিসার কাছে এগিয়ে গেলেন পারভীন আলম। কাঁধ জড়িয়ে ধরে বললেন,
“বৌমা, এই যে দু’জন কে দেখছ তারা হলেন সম্পর্কে তোমার কাকী। যিনি এতক্ষণ যাবৎ কথা বলেছেন উনি হলেন মিনা আর তার পাশের জন খাদিজা।”
“ও আচ্ছা।”বলেই নিসা মুচকি হেসে ভেজা চুল ছেড়ে আগের মতই দাঁড়িয়ে রইলো।
এদিকে নিসার কান্ড দেখে মিনা, খাদিজাসহ পারভীন আলম নিজেও হতভম্ব হয়ে গেলেন।

পর্ব ১৪

তারপরও পারভীন আলম নিসার অল্প বয়সের কথা ভেবে বিষয়টাকে নেগেটিভ না ধরে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
“বৌমা, কাকীদের সালাম করো।”
“জ্বি আচ্ছা।”

নিসা মাথায় ঘোমটা বিহীন নিচু হয়ে সালাম করতে নিলেই খোলা চুলগুলো কাঁধে এসে পড়ে। সালাম করার বদলে দাঁড়িয়ে চুলগুলো পেছনে নিয়ে ফের সালাম করার জন্য ঝুঁকতে নিলেই মিনা বললেন,
“থাক তোমাকে আর সালাম করতে হবে না। তোমার মত নির্লজ্জ, বেহায়া, বেয়াদব মেয়ের থেকে সালাম নিলেও আমাদের পাপ লাগবে।”

মিনার কথার সাথে গলা মিলিয়ে খাদিজাও বলে উঠলেন,
“হ্যাঁ, কি মেয়েরে বাবা! এমন মেয়ে তো জন্মেও দেখিনি। কাল এসেছে শ্বশুর বাড়ি আর আজই সে নির্লজ্জের মত ভেজা চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে সবার সম্মুখে। না আছে মাথাত ঘোমটা আর না আছে বউ মানুষের আব্রু। এমনভাবে ভেজা চুল মেলে টপর টপর করে পানি ফেলে সবাইকে দেখাচ্ছে সে যেন একাই স্বামীর সোহাগ পায় আর দুনিয়ার সব মহিলারা যেন স্বামীকে চোখেও দেখতে পায় না।

বাপ মার কি শিক্ষেরে বাবা! হুহ”
“আর তারউপর বড় মানুষদের সম্মান করাও তো শিখে নি। দু’জন বয়স্ক মানুষ এসেছি আর বয়সের কথা বাদই দিলাম সম্পর্কের কথাই বলি। দুর্সম্পর্কের হলেও শাশুড়ি তোদু’জন শাশুড়ি এসেছি কিন্তু মেয়ে তার মতই নির্লজ্জের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। বসার জায়গা টুকু দিল না!”

মিনাকে থামিয়ে খাদিজা বলল,
“কি যে বলছেন না, যে মেয়ে সামান্য সালাম টুকু দেয় নি সে দিবে বসার জায়গা! আরে বুঝেন না সবই বাবা-মায়ের শিক্ষা। এজন্যই শহরে মেয়েকে কখনো বাড়ির বউ করতে নেই। এদের চরিত্রই খারাপ থাকে। তা নাহলে কেউ এভাবে চলতে পারে তাও শ্বশুর বাড়িতে! ছি ছি ছি”
নিসার সুন্দর ধবধবে সাদা মুখখানি মুহূর্তের মধ্যে টকটকে লাল রঙে পরিণত হয়ে গেল। চোখের সাদা অংশটুকু রক্তলাল হয়ে এখনি যেন বেয়ে পড়বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত তরল লাল পদার্থ গুলো।

আর তা দেখে পারভীন আলম মিনা ও খাদিজার উদ্দেশ্যে বললেন,
“এই তোমরা থামবে। সবকিছু এত নেগেটিভ ভাবে কিভাবে নাও বুঝি না। তোমাদের বয়সের অভিজ্ঞরা দিয়ে মেয়েটার এত খারাপ দিক খুঁড়ে খুঁড়ে বের করছ এটা বের করতে পারছ না মেয়েটার বয়স কত?”

মিনা বললেন,
“দেখুন ভাবি আপনি নিজে নিজের বৌ এর দোষ ঢাকলেই যে মানুষও ঢাকবে সেটা ভাববেন না। আর আমরা তো ভুল কিছু বলছি না। প্রয়োজন হলে গ্রামের দশটা মানুষকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করুন যে কার মাঝে ভুল আছে। আমাদের কথায় না-কি আপনার গুনবতী বৌয়ের চালচলনে।”

খাদিজা বললেন,
“আচ্ছা আপনি দেখুন ভাবি, আপনার বিয়ের বয়স তো কম হল না, শাশুড়িও হয়েছেন বেশ ক’বছর হয়ে গিয়েছে আর বয়সও ধরতে গেলে তিনকালের এক কালে এসে ঠেকেছে। বয়স অনুযায়ী শরীরের অশান্তির জন্যে আপনার এখন খোলামেলা ভাবে থাকার কথা কিন্তু আপনি কি তা করেন? করেন না তোএই যে এখনো মাথায় দশ হাত ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কারণ এটাই হচ্ছে মেয়ে মানুষের আব্রু। তারউপর যদি হয় নতুন বউ তাহলে তো কথাই নেই। আর এদিকে আপনার বাড়ির নতুন বৌয়ের অবস্থা আপনি নিজেই বিবেচনা করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন আমরা ভালো বলছি না-কি খারাপ।”

পারভীন আলম বললেন,
“তোমাদের কথা ভুল তা আমি বলছি না কিন্তু মেয়েটার বয়সও তোমাদের দেখা উচিৎ। আমার কিংবা তোমাদের হাঁটুর সমান বয়সও মেয়ের হয়নি। এই বয়সে কি করে এতকিছু খেয়াল রাখবে বলো।”
“এর থেকেও কম বয়সে কিন্তু আমরা শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেছি ভাবি।”

“কিন্তু মিনা আমাদের যুগ আর এই যুগ মাঝে কিন্তু আকাশ পাতাল ফারাক। আমরা ছোট থেকে তৈরি হয়েছি সংসারি মনোভাব নিয়ে যেটা কি-না এই যুগের মেয়েদের মাঝে খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। কারণ ওরা বড় হয়েছে পড়াশোনার মাঝে জীবন উজ্জ্বল করার মনোভাব নিয়ে যেটা কি-না আবার আমাদের মাঝে দুষ্কর ছিল।”

মিনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে পারভীন আলমের উত্তরটি ভালো না লাগায় খাদিজা বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললেন,
“হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন ভাবি। এখনকার মেয়েদের আমাদের যুগের সাথে তুলনা করা খুবই বেমানান। কেননা এখনকার মেয়েরা আমাদের হাঁটুর বয়সী না হয়েও, সংসারী মনোভাব না হয়েও, স্বামীকে বশ করার ক্ষমতা ঠিকই রাখে।

তা নাহলে যে মেয়ে অল্প বয়স বলে বড়দের সম্মান করা বুঝে না, ভেজা চুল ছেড়ে লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি, পাড়াপ্রতিবেশিদের সামনে ঘুড়ে বেড়ানো বুঝে না সে আবার কেমন করে স্বামীর সাথে থাকা বুঝে তাই না!”
মিনাও দাঁড়িয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, এক্কেবারে ঠিক কথা বলেছেন।

অল্প বয়স বলে কোনকিছুই সে বুঝে না কিন্তু স্বামীর সঙ্গ বেশ ভালো করেই বুঝে। কালে কালে যে আরও কত কি দেখব হুহ”
খাদিজা এক পা সামনে বাড়িয়ে মিনাকে বললেন,
“ভাবি আমি চললাম। আপনি থাকতে চাইলে থাকুন আর যেতে চাইলে চলুন। আমার আর একমুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।”

মিনাও ঘুরে বললেন,
“আমি থাকব মানেযেখানে বেহায়া, নির্লজ্জের বাস সেখানে থাকতে আমার বয়েই গিয়েছে।”
বলেই খাদিজা ও মিনা হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন ঘর থেকে।

পারভীন আলম নিসার দিকে তাকিয়ে দেখল নিসা মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে যাচ্ছে। মাথায় হাত রেখে বললেন,
“নতুন বউ তুমি। মাথায় ঘোমটা দিয়ে মুরব্বি দের সালাম করা উচিৎ ছিল তোমার।”

নিসা মুখে কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নাড়ল। তাই পারভীন আলম নিজেই আবার বললেন,
“আর নতুন বউদের চুল খুলে রাখা ঠিক না। এটা খুবই দৃষ্টিকটুর দেখায়। বউ মানুষের চুল খোলা দেখলে গ্রামের মানুষ নানান কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। আবার গ্রামের নিয়মও বলতে পারো। তাই এটা নিয়ে মন খারাপ করো না। যাও নিজ ঘরে যাও।”

বলেই পারভীন আলম ভেতরে চলে গেলেন। এদিকে নিসাও মাথা উঁচু করে একপলক বাহিরে তাকিয়ে নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

বিকেল ৫ টা বাজে। প্রণয় সেই কখন ঘুম থেকে উঠে বসে আছে কিন্তু নিসার ঘুম এখনো ভাঙেনি। অবশ্য নিসা ঘুমে বিভোর হয়ে আছে না-কি ঘুমের ভান ধরে আছে সেটাই ধরতে পারছে না প্রণয়। কেননা সেই সকাল থেকেই অজানা এক কারণে নিসা বেশ ভার ভার হয়ে আছে তার সাথে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিচ্ছে না, আবার নিজেও মুখ ফুটে কিছু বলছে না।

“নিসা, এই নিসা শুনছ? বেলা অনেক হয়েছে তো আর কত ঘুমাবে?”
নিসার কোমর ধরে ঝাকুনি দিয়ে প্রণয় কথাগুলো বললেও নিসা কিছু বলল না। এমনকি ঘুম থেকে উঠা তো দূরের কথা কিঞ্চিৎ পরিমাণ নড়লও না। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগল প্রণয়ের। তাই আবারো ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,

পর্ব ১৫

“কী হলো নিসা কথা বলছ না কেন? সেই সকাল থেকে এভাবে মজে আছে। সমস্যা টা কি হয়েছে অন্তত আমাকে তো বলতে পারো।”
এবারও নিসা চুপটি করে চোখ বুজেই রয়েছে। প্রণয় একটানে নিসাকে শোয়া থেকে উঠিয়ে সোজা করে বসালো। যার জন্য নিসা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। চোখ দুটো বেশ বড় বড় করে তাকাতেই প্রণয় বলল,
“তোমার ড্যাবড্যাবিয়ে থাকা চোখ দুটো স্পষ্ট বলে দিচ্ছে তুমি এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলে না। যদি ঘুমিয়েই না থাকো তাহলে এতটা সময় এভাবে অভিনয় করার কারণটা কি?”

“তোমার কাছে অভিনয় মনে হলেও আমি ঘুমোচ্ছিলাম।”বলেই চোখের দিক পরিবর্তন করল নিসা। এতে যেন প্রণয় আরও গভীরভাবে বুঝে গেল এক ঘূর্ণিঝড়ের আভাস।
“কী হয়েছে নিসা? তোমার মুখ ওমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?”
“কোথায় কি হয়েছে! আমি একেবারে ঠিকাছি।”

“না, তুমি ঠিক নেই। আর তা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আচ্ছা, কেউ কিছু বলেছে তোমাকে? কিংবা কোনোকিছুর জন্য সমস্যা হচ্ছে তোমার?”
“বললাম তো কিছু হয়নি অযথা কেন কথা বাড়িয়ে মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছ।”
বলেই নিসা আবার গুটিশুটি মেরে পা ভাজ করে শুয়ে পড়ল। কিন্তু প্রণয় যে এভাবে মানার মানুষ নয়। সে-ও আবার নিসাকে শোয়া থেকে টান দিয়ে উঠিয়ে বসিয়ে বলল,
“অকারণে তোমার মাথা বিগড়ে যায় এটা তো আমার অজানা ছিল। তারমানে নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে যেটা আমার অগোচরে আছে। বলো নিসা কে কি বলেছে তোমাকে।”

এবার নিসা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। সকাল থেকে চুপচাপ থেকে কাউকে কিছু বলবে না ভাবলেও প্রণয়ের জোরাজুরির কাছে হার মানতে হল তাকে। মুহূর্তে মধ্যে মাথা নিচু কিরে চোখের জল ফেলতে লাগল।
“কি হলো কাঁদছ যে! কি হয়েছে তোমার? আমাকে খুলে বলো প্লিজ। আচ্ছা বাবা কিংবা মা কিছু বলেছে তোমাকে?”
নিসা মুখে কিছু না বললেও মাথা ঝাঁকিয়ে না করল প্রণয়কে।

“তাহলে তাহলে কে, কে বলেছে তোমাকে?”
নিসা এবার মিনা ও খাদিজার বলা সব কথা প্রণয়কে বলে কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রণয়ের বুকে। এদিকে প্রণয় সবটা শুনে অবাক হওয়ার থেকে বেশি চিন্তায় পড়ে গেল নিসাকে এখন সে বিষয়টা কীভাবে বুঝিয়ে বলবে তা নিয়ে।

এদিকে প্রণয়ের নীরবতা দেখে মাথা তুলে নিসা বলল,
“কী হল কথা বলছ না যে? ও তুমি তো আবার বড়দের মুখের উপর কথা বলো না, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”
“বড়দের মুখের উপর কথা বলি না এটা পড়ের ব্যাপার। আর আমি যে সব বড়দের উপর কথা বলি না তা কিন্তু ভেবো না। বিশেষ বিশেষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে চুপ করে থাকি তাই বলে যে সবার সাথে চুপ করে থাকি তা না। কিন্তু”
“কিন্তু কি?”

“সব জায়গায় সবকিছু বলার মুখ থাকে না। যেমনটা এখানে নেই।”
“মানে!”
“তোমার বয়স অল্প ঠিকাছে, তবে গ্রাম কিন্তু বয়স কম বেশি বিচার করবে না। গ্রামের হিসেব অনুযায়ী একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানেই সর্বজ্ঞানের জ্ঞানী হয়ে যাওয়া। যার ফলে তোমার এরকম হেয়ালী আচরণ তারা মেনে নিতে পারে নি।

এটা গেল গ্রামের হিসাব এবার আসো বাস্তবতা তে। আচ্ছা নিসা, তোমাদের শহরে যখন বিয়ে হয় নতুন বউ শ্বশুর বাড়ি আসে না না, অনির্দিষ্ট ভাবে কাউকে বলছি কেন, তোমার নিজের দুই ভাবিই তো আছেন। তো তাদের যখন বিয়ে করিয়ে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে এলে তারা কীভাবে চলাফেরা করেছে খোলামেলা?”

“আমি কি খুব খোলামেলা ভাবে চলেছি প্রণয়?”
“তোমাকে যেটা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর আগে দাও, তারপর আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।”
“না, খোলামেলা চলেফেরা করে নি।”
“তাহলে কীভাবে চলেছে?”

“মাথায় ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে।”
“আর”
“কি?”
“ব্যবহার কেমন ছিল? নতুন বউ হিসেবে লাজুক না-কি নিজ ঘরের মত স্বাভাবিক? ঘুম থেকে উঠে নতুন বউ হিসেবে কখনো কি তারা ভাজা চুল ছেড়ে তোমাদের সামনে দাঁড়িয়েছিল না-কি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ভেজা চুল হাত খোপা করে রেখেছিল?”

“তাই বলে শারীরিক সম্পর্ক নিয়ে ওভাবে মায়ের সামনে কথা শুনাবে? আমি কতটা লজ্জ পেয়েছিলাম তুমি জানো?
“কাজটা তো লজ্জা পাওয়ার মতই করেছ তাই না?”
নিসা এবার আর কোনো কথা বলল না।

এদিকে প্রণয় নিসার হাত নিজের দুহাতের মাঝে নিয়ে বলল,
“তোমার বয়স অনেক অল্প। তারউপর বাড়ির ছোট ও খুব আদরের মেয়ে এবং বোন তুমি। তারা তোমাকে অনেক কিছু থেকেই তোমাকে আগলে রেখেছে যার ফলে অনেক কিছুই তুমি বুঝো না। কিন্তু এ বিষয় গুলো আমি বুঝলেও সবাই বুঝতে নাও পারে। তবে সত্যি কথা কি জানো, আজকের বিষয়টা আমি নিজেও মানতে পারছি না। কাকীদের জায়গায় যদি আমি হতাম তাহলে আজ তারা যে কথাগুলো বলেছেন, হয়তো সেগুলো আমিও বলতাম।”

নিসা চোখ দুটো বড় করে মুখ খুলতে নিলেই প্রণয় বলল,
“আমার কথা শেষ হলে তুমি কথা বলো।”

নিসা পুনঃরায় চুপ হয়ে গেল। প্রণয় বলল,
“বয়স কম হলেও তুমি হচ্ছো এ বাড়ির বউ তাও আবার নতুন বউ। তোমার তো কিছু হলেও সাধারণ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তুমি কোন হিসেবে সাত সকাল বেলা গোসল করে ভেজা চুল নিয়ে ঘোমটা ছাড়া বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকো। নতুন বউয়ের মাথা থেকে তো ঘোমটা পড়াই বেমানান আর সেখানে ভেজা চুল ছাড়া তো কল্পনার বাহিরে। এ বাড়িতে তো তোমার শ্বশুর শাশুড়ি থাকে তাই না? তারা দেখলে কি ভাববে বলো। এটা যেমন তোমার জন্য লজ্জা ঠিক তদ্রূপ তাদের জন্যেও লজ্জা। তাই না?”

“হুম।”
“এবার আসো ব্যবহারের দিকে। তুমি যখন দেখেছ কাকীরা এসেছেন তোমার উচিৎ ছিল না, তাদের গিয়ে সালাম করা? পায়ে হাত দিয়ে না করো মুখে অন্তত সালাম দেয়া। তাদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা। বাড়ির বউ হিসেবে তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করা। যেটা কি-না আমার মা করেছে সেটা তোমার করা উচিৎ ছিল না?”
“হুম।”
“তুমি কি তা করেছ? করো নি। তোমার ভাষ্যমতে তুমি কিছুই বলো নি। তাহলে কি এটা বাজে দেখায় না?”
“হুম।”

“তাহলে বাহিরের মানুষকে আমি কি বলে কথা শোনাতে যাবো বলো, যেখানে কি-না আমার ঘরেই সমস্যা। আমার কি মুখ আছে? দশজন মানুষ শুনলে আমাকেই তো কথা শোনাবে।”
“আমি আসলে বুঝতে পারি নি প্রণয়। তুমি এভাবে না বুঝালে হয়তো আজও বুঝতাম না। তাদেরকে ভুল আর নিজেকে সঠিক বলে মনের ভেতর ধারণা পুষে রাখতাম।”

“আমরা শহরে থাকি বলে যে, আমরাই সঠিক হবো তা কখনো ভেবো না। গ্রামের মানুষ শহরের মানুষের মত অধিক জ্ঞান গ্রহণ না করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শহর থেকেও গ্রামের মানুষের জ্ঞান বেশি হয়ে থাকে।”
“আমি কাকীদের কাছে ক্ষমা চাইব। তাদের কিছু না বলে আমার ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা সত্যি উচিৎ হয় নি। আমার ভাবিরাও যদি আমার মত এরকম করে দাঁড়িয়ে থাকত আমি শিউর আমার মা কখনোই মেনে নিত না। সেখানে মা আমাকে কিছুই বলে নি। আমি মায়ের কাছেও ক্ষমা চাইব।”

বলেই নিসা বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যেতে নিলেই প্রণয় নিসার হাত চেপে একটানে নিজের কোলে ফেলে দিল। কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“যা ভুল হয়েছে সেটা তো আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তাই সেই ভুলকে পুনঃরায় নেড়ে গভীর করো না। সামনে থেকে এসব বিষয়ে খেয়াল রেখো তাহলে হবে।”

“কিন্তু”
নিসার মুখের সামনে আঙুল ধরে প্রণয় বলল,
“ভালো বউরা কি বরের উপর দিয়ে বেশি কথা বলে?”
নিসা মুখ কাচুমাচু করে মাথা নাড়তেই প্রণয় মুচকি হেসে ফেলল। বুকে জড়িয়ে হাসির শব্দ মৃদু বাড়াতে নিলেই দরজার বাহির থেকে পারভীন আলম বলে উঠলেন,
“প্রণয়, বাজার থেকে তোর বাবা পেয়াজু এনেছে। বউকে নিয়ে শিঘ্রই বসার ঘরে চলে আয়। অপেক্ষা করছি আমরা।”

পর্ব ১৬

পারভীন আলমের ডাক পড়তেই প্রণয় বসা থেকে দ্রুত উঠে পড়ল। বলল,
“ও শোনো, কাল খুব ভোরেই কিন্তু আমরা বেড়িয়ে যাবো। তাই নাস্তা করে এসে যা গোছগাছ করার এখনি করে ফেলো। নাহলে পরে কিন্তু সময় কুলিয়ে উঠতে পারবে না।”
“গতকাল রাতে এলাম, মাঝে এই আজকের দিনটাই শুধু থাকলাম। আবার আগামীকালই চলে যাবো! কেমন যেন দেখাচ্ছে না? আর বাবা-মা শুনলেই বা কি বলবে?”
“যাওয়ার বিষয়ে বাবা-মা’কে বলেছি। তারা প্রথম দিকে অমত করলেও পরবর্তীতে আমার টিউশনি গুলোর কথা ভেবে আর অমত করেনি। কারণ এ টিউশনির উপরই তো এখন আমার সবকিছু। আমি তো আর একা না যে, টিউশনি না থাকলেও প্রভাব পড়বে না জীবনযাপনে।”

“হুম আচ্ছা, তাহলে কিছুক্ষণ বাদেই সব গুছিয়ে ফেলব আমি।”
এরই মাঝে পারভীন আলমের কিছুই উচ্চস্বরে আবার ডাক পড়তেই প্রণয় বলল,
“এই রে মা খেপেছেচলো চলো।”

পরের দিন দুপুর ১টা। রুমে ঢুকে ফুল স্পীডে ফ্যান চালিয়ে দরজা লক করে ব্যাগপত্র মেঝেতে রেখেই প্রণয়, নিসা দুজনেই সটান হয়ে বিছানায় গা মেলে দিল। কিছুটা সময় ধুম মেরে শুয়ে থেকে নিসা বলল,
“গোসল করে খেয়ে দেয়ে একবারে বিশ্রাম নিলে ভালো হতো না?”
“হুম, তুমি ঢুকে পড়ো গোসলে আর ততক্ষণে আমি একটু বিশ্রাম নিই।”

একহাতে ভর দিয়ে মাথা সামান্য উঁচু করে নিসা বলল,
“আমি নিজে গোসলে ঢোকার জন্য কথাটা বলি নি, তোমার জন্য বলেছি। তুমি আগে গোসলে যাও।”
“আরে তুমি আর আমি কিএকজন গেলেই হলো। তুমি চলে যাও প্লিজ। আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।”
“আমি গোসলে চলে গেলে এই যে বাড়ি থেকে জিনিস গুলো এনেছ সেগুলো গোছাবে কে? তুমি গেলে তো এই ফাঁকে আমি জিনিসগুলো গুছিয়ে ফেলতে পারতাম তাই না?”

“এখনি গোছাতে হবে এমন কোনো কথা আছে? তুমি গোসল করে এসে গোছাও। তাহলেই তো হলো।”
“এই কাচা তরকারি, মাছ-মাংস, হাবিজাবি এগুলো আমি গোসল করে এসে গোছাবো? মাথা ঠিকাছে তোমার?”
নিসার একের পর এক কথা শুনে প্রণয় শোয়া থেকে উঠে বসল। বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে বলল,
“তুমি কি এখন আমাকে বিশ্রাম নিতেই দিবে না নিসা?”

“এটা বিশ্রাম নেয়ার সময়ও না প্রণয়। দ্রুত গোসলে চলে যাও। আমি গিয়ে ব্যাগ থেকে জিনিসগুলো বের করি।”
বলেই নিসা শোয়া থেকে উঠে দরজা খুলে রান্নাঘর থেকে কিছু পাতিল এনে মেঝেতে বসে পড়ল।
এদিকে প্রণয় কোনো কথা না বলে বিরক্তি ভাব ফুটিয়েই কাঁধে তোয়ালে পেঁচিয়ে গোসলে চলে গেল।
এরই মাঝে নিলয় দরজার বাহির থেকে প্রণয় বলে ডাক দিতেই নিসা বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে একহাতে গায়ে পেঁচিয়ে বলল,
“ও তো গোসলে ঢুকেছে ভাইয়া।”

নিলয় বাহির থেকেই বলল,
“ও আচ্ছা, তাহলে ভাবি আমি চললাম। আর আপনারা ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে খেতে চলে আসুন। খাবার তৈরি আছে।”
“বাহির থেকে চলে যাচ্ছেন কেন ভাইয়া? ভেতরে আসুন।”
“না না, সমস্যা নেই।”

“কি সমস্যা নেই, আর এত ইতস্তত বোধই বা করছন কেন? ছোট বোনের ঘরে আসতে এতো ইতস্তত বোধ থাকতে আছে না-কি! আসুন ভেতরে আসুন।”
নিলয় এবার হাসিমুখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“ছোট বোন যেহেতু বানিয়ে ফেলেছেন আর না আসি কি করে! তাই চলেই এলাম।”
“এসেছেন বেশ করেছেন। ভাইবোনের মাঝে এত দূরত্ব ভালো না।”

নিলয় হেসে দিল নিসার কথা শুনে। বিছানার এক কোণে বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আন্টি দেখি এবার অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছেন! অবশ্য দিবে না, ছেলে কি আর একা! ছেলের যে এখন বউও হয়েছে।”
নিসা মুচকি হেসে কড়কড়া ভাজা হাসের পিস গুলো বক্স থেকে পাতিলে নিতে নিতে বলল,
“মা’কে অনেক করে বলেছিলাম এত কিছু না দিতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, মায়ের সাথে সাথে বাবাও জোর করে সবকিছু দিয়ে দিল।

“ভালোই হয়েছে দিয়েছে। অনেকদিন হলো বড় তেলযুক্ত হাসের মাংস খাওয়া হয়নি। এই সুবাদে না-হয় খেয়ে নিব।”
“তা তো খাবেনই তবে মা কিন্তু শুধু আপনার প্রিয় হাসের মাংসই দেয়নি দেশি মুরগীও দিয়েছে। সাথে আরও অনেক কিছু।”
“ওয়াওতাই না-কি! সত্যি বলতে দেশি খাবারের স্বাদই আলাদা।”
“হুম।”
“আচ্ছা ভাবি, তো আপনি এগুলো গোছান আমি গিয়ে দেখি মুহিত গোসল থেকে বের হয়েছে না-কি। আসলে রান্নাবান্না করেছি এখনো গোসল করি নি তো কেমন যেন নিজের গায়ের গন্ধ নিজের নাকেই বাঁধছে।”
নিসা এবার জোরেই হেসে দিল। বলল,
“আচ্ছা, যান তবে।”

নিলয় ঘর থেকে বের হতেই প্রণয় গোসল সেরে মাথা মুছতে মুছতে বারান্দায় গিয়ে তোয়ালে ছড়ানোর ফাঁকে বলল,
“কে এসেছিল? নিলয় না-কি মুহিত?”
“নিলয় ভাইয়া।”
“ও তো কেন এসেছিল কিছু বলেছে?”
“হ্যাঁ, রান্নাবান্না করে রেখেছে এখন গোসল করে খেতে যাওয়ার জন্য বলতে এসেছিল।”
“ও আচ্ছা, তো কাজ কি শেষ হয়েছে তোমার?”

“হ্যাঁ, হয়েছে তবে সম্পূর্ণ না। সব জিনিসগুলো বক্স, প্যাকেট এগুলো থেকে বের করেছি। এখন শুধু জায়গারটা জায়গায় রাখা বাকি। কিন্তু এই মাছ-মাংস গুলো কোথায় রাখব সেটাই তো বুঝতে পারছি না।”
“না বুঝার কি আছে মা তো আর কাচা মাছ-মাংস দিয়ে দেয়নি যে পঁচে যাবে। সময় সময় একটু গরম করে ফেলবে তাহলেই হবে।”
“এতো গরম কত করব বলো। আর আমি কি আর পাকা সংসারী যে এতকিছুর তাল সামলাতে পারব।”

“সংসার যখন শুরু করেছ সংসারী তো হতে হবে তাই না? তাই এখন থেকেই না-হয় শুরু করো।”
“তা ঠিকাছে তবেএকটা ফ্রিজ হলে ভালো হতো। এভাবে কতদিন খাবারদাবার গরম করব বলো। আচ্ছা, তোমার টিউশনির সেলারি পাবা কবে?”
প্রণয় ভ্রু কুচকে ফেলল নিসার কথায়। বলল,
“তুমি কি এই মুহুর্তে ফ্রিজ কেনার কথা ভাবছ?”

“ভাবা টা কি দোষের কিছু? বর্তমান যুগে কি ফ্রিজ ছাড়া চলা যায়? আর খাবারদাবার যতই বারবার গরম করি না কেন রাতে যে ইঁদুর, পোকামাকড় সেগুলোর উপর দিয়ে চলাচল করবে না, মুখ দিবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? ফ্রিজে রাখলে তো এসব দিক থেকে টেনশন ফ্রি থাকা যাবে।”
“তোমার যুক্তিগুলো ঠিক আছে তবে তোমাকে এটাও বিবেচনা করতে হবে আমি একজন স্টুডেন্ট। বললেই আমার দ্বারা সব অসাধ্য সাধন করা সম্ভব নয়। আর তা ছাড়া মাস শেষে আমি কতটাকা পাই সেটাও তো তোমাকে বুঝতে হবে তাই না?”

“আহা তুমি এতো চাপ নিচ্ছ কেন? আজকাল তো ইলেকট্রনিক আইটেম কিস্তিতেও আনা যায়। আমরা না-হয় সেভাবেই আনব।”
“তুমি বুঝতে পারছ না নিসা। আমার এ ক’টা টাকা দিয়ে ঘরভাড়া, খাবার খরচ, পড়াশোনা খরচ এবং আরও অন্যান্য খরচাদি চালিয়ে কিস্তি চালানো সম্ভব নয়।”
“কে সম্ভব না, অবশ্যই সম্ভব। আমরা যদি একটু কষ্ট করে চলি আর অন্যান্য খরচাদি কমিয়ে নিয়ে আসি তাহলেই তো এই কিস্তি আমরা চালাতে পারব।”

“এতটা চাপ নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না নিসা। এই কিস্তি ছাড়াই আমাদের চলতে হিমসিম খেতে হবে। আর কিস্তি ঘাড়ের উপর নিলে তো কথাই নাই।”
“ধ্যাৎ ভালো লাগে না, সংসার জীবন শুরুতে এই প্রথম কিছু একটা চেয়েছি এতেই না করে দিলে হুহ”
বলেই নিসা বসা থেকে উঠে পাতিল হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যেতে নিলেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রণয় বলল,
“আগে না বলতে যেভাবে রাখব সেভাবে থাকবে? গাছ তলা বললে গাছ তলাতেই। তাহলে এখন কেন এত কিছু লাগছে?”

পেছনে ফিরে নিসা বলল,
“জীবনে চলতে সবকিছুরই প্রয়োজন হয়।”
“তারমানে ওই কথাগুলো আবেগের বসে বলেছিলে তাই না?”
এ পর্যায়ে নিসা চুপ হয়ে গেল। প্রণয় বসা থেকে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“এতদিন বুঝতাম না একটি কথার মানে, বলতে পারো বিশ্বাসই করতাম না তবে আজ করছি যে, সংসারে অভাব উঁকি দিলে যে ভালোবাসাও জানালা দিয়ে পালায় সেটা আজ বিশ্বাস করছি।”

বলেই নিসাকে পাশ কাটিয়ে প্রণয় চলে গেল নিলয় ও মুহিতের ঘরের ভেতর।

পর্ব ১৭

নীরব থাকতে থাকতে কখন যে নিসা ঘুমিয়ে পড়ে সে নিজেও জানে না। তবে প্রণয়ের নড়াচড়াতেই সেই অজানা ঘুমের আবার ব্যঘাতও ঘটে যায়। ঘাড় কাত করে প্রণয়ের দিকে ফিরে দেখে আধশোয়া অবস্থায় প্রণয় বেশ মনোযোগ সহকারে মোবাইল চাপাচাপি করছে। নিসা নিজের মোবাইলের লক খুলে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। রাত ১১:০২ বাজে। শোয়া থেকে উঠে বসল নিসা। প্রণয়ের দিকে না তাকিয়েই বলল,
“ক’টা বাজে দেখেছ?”

“তোমাকে ঘুমোতে তো নিষেধ করি নি। তুমি তোমার মতো ঘুমিয়ে পড়ো।”
“আমি কিন্তু আমার ঘুমের জন্য বলিনি, তোমার ঘুমের জন্য বলেছি। এতটা পথ জার্নি করে এসেছ, দুপুরে বিশ্রাম নাও নি এমনকি রাতেও বসে বসে মোবাইল চেপে যাচ্ছ শরীরটা কি ঠিক থাকবে?”

“সময় হলে ঘুমিয়ে পড়ব। তুমি এতো চিন্তা করতে যেও না।”
“তুমি এখনো রাগ করে আছ আমার উপর? ভুল করেছি মানছি এবং দুপুর থেকে নাহলেও ৫/৬ বার তোমাকে সরিও বলেছি। তারপরও কি এমন করার মানে আছে বলো।”

“আমি তো বলি নি তোমার সাথে রাগ করেছি আর এটাও বলছি না যে তুমি ভুল করেছ। তোমার কথা ঠিক। তোমার চাওয়াটাও ঠিক। আর হাজবেন্ড হিসেবে সেগুলো বাস্তবায়ন না করতে পারা আমার ব্যর্থতা। তাই অযথা নিজেকে দোষারোপ করো না।”
প্রণয়ের কথার ভাজে ভার ভার শব্দ অনুভব করে নিসা নরম সুরে বলল,
“এখানে কখনোই তোমার ব্যর্থতা প্রকাশ পায় না, তুমি তো সবে স্টুডেন্ট। পড়ালেখাও শেষ হয়নি জব তো দূরের কথা। এই অবস্থায় নিজেকে চালানোই টাফ তারউপর আমি এখন তোমার উপর, সমস্যা তো হবেই। এই সমস্যাকে যদি এখন তুমি ব্যর্থতার নাম দাও এটা তো আর হলো না তাই না?”

প্রণয় মোবাইল হাত থেকে রেখে চুপ করে রইল। নিসা প্রণয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রণয়কে ঝাপটে ধরল।
এদিকে হুট করে নিসা বুকে এসে পড়ায় টাল সামলাতে পারেনি। পেছনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে যেতেই বুঝতে পারল নিসা তার বুকে। নিসাকে বুকে পেয়ে আর নিজের রাগকে ধরে রাখতে পারল না। মুচকি হেসে নিসাকে জড়িয়ে ধরতেই নিসা কাচুমাচু করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
“চুপ করে আছ কেন? বললাম তো সরি! ভুল হয়ে গিয়েছে তবে, সত্যি বলছি আমি আর কখনো এরকম অসামঞ্জস্যপূর্ণ আবদার করব না। এবারের মত ক্ষমা করে দাও প্লিজ।”

নিসার এলোমেলো চুলের ভাজে হাত গুঁজে দেবার ফাঁকে প্রণয় বলল,
“কি করব বলো। আমার হাত পা এখন চারিদিক থেকে বাঁধা। মাত্র ২/৩ টা টিউশনি দিয়ে কি সংসার চালানো যায়? আর সংসার চালাবো কি এখনো তো শুরুই করি নি, করলে বুঝতে পারব যে আদৌ এই টাকায় সংসার চলবে কি-না! আর শুধু যে সংসার তা তো নয়, তোমার আমার পড়ালেখাও তো আছে।”
প্রণয়ের বুক থেকে নিসা মাথা উঠিয়ে বলল,
“আমার পড়ালেখা! আমি তো আর পড়ব না।”

“পড়বে না মানে!”
“হ্যাঁ, আমি আর পড়ালেখা করব না। আমার পড়ালেখা করতে একদমই ভালো লাগে না। আমি এখন শুধু সংসার করতে চাই। তোমার সংসারের গৃহিনী হতে চাই।”
“একটি স্ত্রীর মাঝে সংসারী মনোভাব থাকা প্রতিটি হাজবেন্ডেরই চাওয়া তবে, স্ত্রী শিক্ষিত হওয়াও অত্যন্ত জরুরি।”
“কিন্তু”
“কোনো কিন্তু না, তোমাকে পড়তে হবে। আর খুব মনোযোগ সহকারেই পড়তে হবে। কোনো প্রকার হেয়ালিপনা চলবে না, বুঝতে পেরেছ?”

নিসা মুখ গাল ফুলিয়ে বলল,
“হুম।”
প্রণয় দাঁত কেলিয়ে বলল,
“আহারে পড়ালেখার কথা শুনে বউটার আমার মুখ ফেকাসে হয়ে গিয়েছে। কি কষ্ট, কি কষ্ট!”
“তুমি কি আমাকে নিয়ে মজা করছ?”

“না, মোটেই না। তোমাকে নিয়ে মজা করতে যাব কেন, তোমার সাথে কি আমার মজা করার সম্পর্ক? তোমার সাথে তো আমার খেলা করার সম্পর্ক।”
“মানে! কি খেলা কিসের খেলা?”
“আরে বুঝো না, যেটা দিয়ে যেটা দিয়ে ধুরু বাবা বলতে পারব না, চলো প্র‍্যাক্টিকাল খেলেই বুঝিয়ে দেই।”
বলেই বেড সুইচ অফ করে নিসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রণয়।

সন্ধ্যা ৭:২৩ বাজে। টিউশনি সেরে সবেই প্রণয় মুখ কালো করে ঘরে এসে ঢুকল। নিসা দ্রুত এক গ্লাস পানি প্রণয়ের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“কি ব্যাপার তোমাকে আজ এত মনমরা দেখাচ্ছে কেন? স্টুডেন্টদের আজ মেরেছ না-কি অভিভাবকদের সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে? কোনটা?”
প্রণয় পানির গ্লাসের সম্পূর্ণ পানি এক নিমিষে শেষ করে ফাঁকা গ্লাসটি নিসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“না, সেরকম কিছুই হয় নি।”

“তাহলেসেরকম কিছু না হলে কি হয়েছে সেটা বলো।”
“গত মাসের বেতন দুই স্টুডেন্টের পেলেও একজনের টা এখনো পাই নি। আজ চাইতেই নানান রকমের সমস্যার কথা শুনিয়ে দিল। তারপর আবার বলল আগামী শনিবার না-কি দিবে। এরকম করলে পড়াতে ইচ্ছে হয় বলো। নিজের পড়াশোনার ফাঁকে টিউশনি করিই তো দুটো টাকার জন্য, এখন যদি সেই টাকাটাও সময় মত না পাই কিরকম বিরক্ত লাগে!”

“আচ্ছা থাক এসব নিয়ে আর মন খারাপ করো না, দিবে না সেরকম কিছু তো আর বলেনি। মানুষের সমস্যা তো থাকতেই পারে, ক’দিন আগপিছ হলে কিছু হবে না।”
“হুম, তবে প্রতি মাসে এরকম তো আর ভালো লাগে না।”
“হুম তা ঠিক কিন্তু কি করবে বলো। আমরা এখন চাপে আছি তাই কিছু বলাও যাবে না, বললে তো পরে টিউশনি নিয়েই টানাটানি লাগবে।”
“হুম। আচ্ছা মা যে তেলের পিঠা দিয়েছিল আছে কি? প্রচন্ড খিদে পেয়েছে থাকলে দাও তো।”
“দাঁড়াও আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”

নিসা দ্রুত একটি বাটিতে ৫ পিস পিঠা ও এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। প্রণয়ের সামনে ধরে বলল,
“আচ্ছা প্রণয়, যেখানে পড়াতে যাও সেখানে বিকেলের নাস্তা হিসেবে কিছু খেতে দেয় না?”
“দেয় তবে মাঝেমধ্যে প্রতিদিন এতো ঝামেলা কে করতে চায় বলো।”
“হুম।”

প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে নিসা বলল,
“মায়ের পিঠা গুলো কিন্তু সত্যিই দারুণ হয়েছে তাই না?”
“হুম, তবে আসল পিঠাই তো এখনো খাওনি। মায়ের হাতের পাক্কন পিঠা যে এত্তো টেস্ট কি বলব তোমাকে!”
“পাক্কন পিঠা সেটা আবার কোনটা?”

“আরে একটা সাদা বক্সে ডিজাইন করা পিঠা দিয়েছে দেখোনি? যেমন ধরো- পাতা, ফুল, পাখা এই ডিজাইনের পিঠাগুলো দিয়েছে না, এগুলোই পাক্কন পিঠা।”
“ও আচ্ছা এগুলো?”
“হ্যাঁ এগুলোই, খেয়ে দেখো অনেক মজা।”

“আচ্ছা।”
“হুম।”
বলেই প্রণয় পিঠা খেতে লাগল। কিছুক্ষণ পর বলল,
“আমি এখানে গোগ্রাসে খাচ্ছি আর তুমি হাত পা গুটিয়ে এভাবে বসে আছ কেন? এখান থেকে পিঠা নিয়ে খাও।”
“না না, এখন পিঠা খাব না। দুপুরে খেয়েছিলাম যে এখনো গলায় তেল লেগে আছে মনে হচ্ছে। তাই এখন আর একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না, তারচেয়ে ভালো তোমার খিদে লেগেছে তুমিই খাও।”

“বেশি না খাও অন্তত একটা তো খেতে পারো তাই না?”
বলেই হাতে পিঠা নিয়ে নিসাকে খাইয়ে দিতে নিলে নিসা হাতে ধরে বলল,
“প্লিজ প্লিজ, এরকম করো না। বিশ্বাস করো আমার একদমই খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“আমার হাতেও না?”

এবার আর নিসা কিছু বলতে পারল না। চুপচাপ মুখে পুড়ে নিল পিঠা টি। প্রণয় মুচকি হেসে বলল,
“ইমোশনাল ব্ল্যাক করা শিখে গিয়েছি কি বলো।”
“হুম সেটাই তো দেখছি।”কথাটি বলে প্রণয়ের সাথে সাথে বলে নিসাও হেসে দিল।

পর্ব ১৮

শনিবার সন্ধ্যা ৬:৩০ বাজে। টিউশনি থেকে বের হয়ে ফুটপাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়। পকেটে আছে ২৭০০ টাকা। এই টাকার জন্য গত একসপ্তাহ ধরে কতই না অপেক্ষা করেছে সে! ভেবেই ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল প্রণয়। এরই মাঝে নিলয় পেছন থেকে এসে বলল,
“কি রে প্রণয়, বাসায় না গিয়ে বাহিরে জরুরী তলব করলি যে?”
প্রণয় পেছনে ফিরে বলল,
“ও এসেছিস! মুহিত কোথায়? ও আসে নি?”

“না, ও তো আসেনি আসলে ও একটু বাহিরে গিয়েছে।”
“কোথায় গিয়েছে? আমি না তোকে বলেছিলাম ওকে নিয়ে আসতে! তাহলে ওই বাহিরে যেতে দিলি কি করে?”
“আরে কি করব বল, ওর সখিনা সরি সোহানা গত দুইদিন ধরে ওর উপর সেই লেভেলের ক্ষেপে আছে। আলটিমেটাম দিয়েছে এখন যদি দেখা না করে রিলেশনই ব্রেকআপ করে দিবে। সেই ভয়েই মুহিত বেটা দৌড়ের উপর টেম্পো ধরেছে।”
বলেই নিলয় হাসতে লাগল। এদিকে প্রণয়ের এই মুহুর্তে হাসি না আসলেও ভদ্রতা রক্ষার্থে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলল,
“যেটা আনতে বলেছিলাম এনেছিস?”

“হ্যাঁ এনিছি তো কিন্তু কেন আনতে বললি সেটাই তো বললি না।”
“বলব বলব, সবই বলব এখন চল আমার সাথে।”
“কোথায় যাব?”

“এই একটু সামনে!”
“এই তোর মাথায় ঠিক কি ঘুরপাক খাচ্ছে সোজাসুজি বলত আমাকে।”
“বললাম তো বলব, আগে যেখানে যেতে বলছি সেখানে তো চল।”
বলেই নিলয়ের কাঁধে হাত ঝুলিয়ে প্রণয় সামনে এগুতে লাগলো।

মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরই ওয়ালটন শোরুমের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রণয়। বলল,
“ভেতরে চল।”
“শোরুমে যাব! শোরুমে তোর কি কাজ?”বেশ অবাক ভঙ্গিতেই প্রশ্নটি করল নিলয়।
“কাজ আছে বলেই তো যাব তাই না! এবার তোকে যেটা আনতে বলেছিলাম দেয় তো।”

নিলয় পকেট থেকে একহাজার টাকার ৪ টি নোট বের করে দিয়ে বলল,
“এখনো কিন্তু বললি না এই টাকাগুলো দিয়ে তুই কি করবি আর এই শোরুমেই বা তোর কি কাজ!”
“ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবি।”

বলেই প্রণয় শোরুমের কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। টিভি, এসির পাশ কাটিয়ে ফ্রিজের পাশে গিয়ে একটির পর একটি ঘুরে ফিরে দেখতেই নিলয় চোখ দুটো বড় বড় করে বলে উঠলো,
“তুই কি ফ্রিজ কিনবি? এই টাকা তুই ফ্রিজ কেনার জন্য আনতে বলেছিস?”

“হুম, ফ্রিজ কেনার জন্যেই।”
“তোর মাথা ঠিকাছে? এই অবস্থায় তুই ফ্রিজ কিনবি কি করে?”
“আরে কিস্তিতে নিব তো। মাস শেষে অল্প করে কিস্তি হবে তেমন একটা সমস্যা হবে না।”

“মাস শেষে তোর উপার্জনের ক্ষমতা টাও কিন্তু সীমিত। তারউপর এখন আছে ভাবি। দুজনের খরচ চালিয়ে, ঘরভাড়া দিয়ে হাতে কিছুই থাকবে কি-না সন্দেহ আছে। আবার সামনে তো ফাইনাল এক্সামের ফরম ফিলাপের খরচও রয়েছে। কিভাবে তুই এতকিছু সামাল দিবি?”
“তোর কথা ঠিকাছে কিন্তু নিসার দিকটাও আমার দেখা জরুরী। পরিবারের ছোট মেয়ে, সে তো এতো অভাব দেখে বড় হয়নি এখন যতটা দেখছে কিংবা সামনে দেখবে।

তবে আমি জানি ভালোবাসার খাতিরে সে এই অভাব কেও মুখ বুজে সহ্য নিবে। সেদিন ওকে দেখলাম একটু ঠান্ডা পানি খাওয়ার জন্য অনেক ছটফট ছটফট করেছে কিন্তু আমাকে মুখ ফুটে কিছুই বলে নি। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল সেদিন ওর এরকম ছটফটানি দেখে। কোন ঘরের মেয়ে কোথায় এসে পড়েছে তাই শুধু ভেবেছি সারাদিন। তারপরই ঠিক করি যত কষ্টই হোক না কেন, ছোট হলেও একটা ফ্রিজ কিনে আনব। স্বামী হিসেবে এতটুকু দায়িত্ব তো আমাকে পালন করতেই হবে তাই না?”
“কি বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না, তবে তোর কাছে যেটা ভালো লাগে সেটাই কর। আর আমরা তো সবসময় তোর পাশে আছিই।”
“এই জীবন যুদ্ধে এটাই তো আমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র নিলয়।”

নিলয় মুচকি হেসে বলল,
“এসে যে ঘুরে ঘুরে ফ্রিজ দেখলি কোনোটা কি পছন্দ হয়েছে?”
“হয়েছিল তারপরও তুই একটু দেখতো কেমন লাগে।”
বলেই প্রণয় একটি কালচে নীল রঙের ফ্রিজের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
“কেমন এটা?”

নিলয় নরমাল ও ডিপ খুলে দেখে বলল,
“ভেতরটা বেশ ভালো তবে ফ্রিজের কালার টা আরও বেশি ভালো। ফ্রিজ নীল রঙেরই বেশি মানায়। আচ্ছা এটা কত সিফটি দেখেছিস?”
প্রণয় কিছুটা ঝুঁকে ফ্রিজের গায়ে লেগে থাকা স্টিকার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলল,
“১৫৫ সিফটি।”

“১৫৫ সিফটি বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে না? এই মুহূর্তে এত বড় ফ্রিজের তো কোনো প্রয়োজন নেই তোদের। ছোট খাটো দেখে ১২ সিফটির মধ্যে নেয় তোদের টোনাটুনির সংসারের জন্য এক্কেবারে পারফেক্ট আর তোর জন্যও সুবিধা হবে।”
“মন্দ বলিস নি তবে ১২ সিফটির ফ্রিজ গুলো তেমন একটা সুন্দর না, আর ফ্রিজের ভেতরেও তেমন জায়গা নেই।”
“টাকা যেরকম দিবি জিনিস তো সেরকমই আসবে তাই না?”

“দুটোর মাঝে টাকার পরিমাপটা তেমন কিন্তু কমবেশি না। মাত্র ৩/৪ হাজার টাকার কমবেশি। এখন যদি এই ৩/৪ হাজার টাকার কথা ভেবে ১২ সিফটির ফ্রিজ নিই তাহলে টাকার তুলনায় জিনিসটা খুব নিম্ন মানের আসবে। কথায় তো আছে, বড় জিনিসের দাম বড় হলেও ছোট জিনিসের তুলনায় সাশ্রয়ী।”
“তা ঠিক, আচ্ছা তাহলে ম্যানেজার কে ডাক দিয়ে কথাবার্তা ফিক্সড করে নিই।”
বলেই শোরুমের ম্যানেজারকে ডাক দিল নিলয়।

ম্যানেজার আসতেই প্রণয় বলল,
“এখানে সর্বোচ্চ কত মাসের কিস্তিতে পণ্য বিক্রি করা হয়?”
ম্যানেজার বললেন,
“কিস্তিতে নিবেন?”

“জ্বি।”
“আমরা সর্বোচ্চ তিনমাসের কিস্তিতে পণ্য বিক্রি করে থাকি। তবে অবশ্যই আপনাকে প্রথমে কিছু টাকা দিয়ে পেমেন্ট করতে হবে।”
“হ্যাঁ তা তো অবশ্যই।”
বলেই প্রণয় তার পছন্দ করা ফ্রিজটা ম্যানেজারকে দেখিয়ে বলল,
“এটা কত হলে বিক্রি করতে পারবেন?”

“এই ফ্রিজের বর্তমান মুল্য ২৬০০০। আর আপনি যেহেতু কিস্তিতে নিবেন আপনাকে ২৬০০০ টাকা-ই দিতে হবে। কিস্তির ক্ষেত্রে কখনো ছাড় দেয়া যায় না।”
“কিস্তিতে নিব বলে যে ছাড় দেয়া যাবে না এটা কোনো কথা না। এমনকি এই কথার কোনো যৌক্তিকতাও নেই।”
“দাদা, আপনি এক কাজ করুন আপনি আরও চার পাঁচটা দোকান ঘুরে আসুন। কোত্থাও কিস্তিতে কেনা পণ্যের ওপর ছাড় দিবে না।”
“আচ্ছা, তাহলে প্রতি মাসে কিস্তির পরিমাণ কত হবে?”

“আপনি এখন যতটুকু পেমেন্ট করবেন তার উপর নির্ভর করবে। অর্থাৎ আপনি এখন যা পেমেন্ট করবেন সেটা বাদে বাকি যে টাকা থাকবে সেটাকে তিনভাগে ভাগ করে যে অংকটা আসবে সেটা আপনাকে প্রতি মাসের ২০ তারিখে দিতে হবে।”
“ওআচ্ছা, এক মিনিট একটু অপেক্ষা করুন আমি এক্ষুনি আসছি।”

বলেই সামান্য দূরে গিয়ে পকেট থেকে নিলয়ের দেয়া ৪০০০ টাকা ও টিউশন থেকে পাওয়া নিজের ২৭০০ টাকা এক করে সেখানে থেকে ২০০ টাকা আলাদা করে পকেটে ঢুকিয়ে বাকি ৬৫০০ টাকা মুঠ করে এনে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বলল,
“ফ্রিজের দাম তো ২৬০০০। এখন আপাতত ৬৫০০ দিয়ে পেমেন্ট করি বাকিটা মাসে মাসে দিয়ে ক্লিয়ার করে নিব।”
“জ্বি অবশ্যই। আর আপনার মাসিক কিস্তিও কিন্তু ৬৫০০ তেই এসে দাঁড়াচ্ছে।”

“জ্বি, সেই হিসেব করেই পেমেন্ট করছি।”
“ওকে।”
“তাহলে আপনি ফ্রিজ প্যাক করে ভ্যানে তুলে দেবার ব্যবস্থা করে দিন আর এই ফাঁকে আমি ক্যাশ কাউন্টারে টাকার হিসেবটা মিটিয়ে ফেলি।”
“ওকে।”
বলেই ম্যানেজার চলে যেতেই প্রণয়ও কাউন্টারের দিকে চলে গেল।

পর্ব ১৯

কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই শোয়া থেকে উঠে মেইন দরজা খুলতে গেল নিসা। দরজার মেলে দিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই নিসার মুখ খুলে হা হয়ে গেল। বলল,
“প্রণয়, এটা আমাদের?”

“পাড়াপ্রতিবেশির হলে কি আমাদের দরজা সামনে দাঁড়িয়ে ঘরে ঢোকার অপেক্ষা করত?”
“তুমি তুমি এটা কেন করতে গিয়েছ? আমাদের হাতে কি বেহিসাব টাকা আছে না-কি যে এই দুঃসময়ে এসব জিনিস কেনার প্রয়োজন বোধ করেছ?”
নিসার কথা শোনামাত্র প্রণয় চোখ বুজে ফেলল। তার পাশে যে দোকান থেকে আসা দুটো মানুষ রয়েছে। ফ্রিজ ঠিকঠাক ভাবে চালু হয়েছে কি-না সেটাই দেখতে এসেছে তারা। কিন্তু প্রণয় শুরু থেকে এই ভয় টাই পেয়েছিল। এই ফ্রিজ দেখে না জানি তাদের সামনে তাকে নিসার কোন লজ্জাজনক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আর ঠিক সেটাই হলো।

“এসব কথ পড়ে হবে। এখন ভেতরে যাও, ফ্রিজ নিয়ে ঢোকার জন্য যথেষ্ট জায়গা লাগবে।”বলে প্রণয় চোখের ইশারা করতেই নিসা ভেতরে চলে যায়।
আর প্রণয়ও সবাইকে নিয়ে হাতাহাতি করে ফ্রিজটা ঘরের ভেতর নিয়ে গেল।

মিনিট বিশেকের মধ্যে ফ্রিজ জায়গা মত সেট করে লোক দুটোকে বিদায় দিল প্রণয়। পাশ থেকে নিলয় বলল,
“ভাবী তো এখনো রুমের ভেতর বসে আছে। ফ্রিজ দেখতেও এলো না, বোধহয় অভিমান করেছে। যা বুঝিয়ে শুনিয়ে ভাবীকে নিয়ে আয়। তোর এত কষ্টের জিনিস যার জন্যে এনেছিস সে যদি মন ভরে না দেখে, তোর মন কি ভরবে!”

নিলয়ের কথা শুনে প্রণয় স্মিত হেসে এগুলো নিজের রুমের দিকে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখে নিসা শুকনো কাপড় ভাজ করে আলনায় লাইন করে ভাজে ভাজে গুছিয়ে রাখছে।
পেছন থেকে নিসাকে জড়িয়ে প্রণয় বলল,
“রাগ করেছ?”

প্রণয়ের প্রশ্ন শুনে নিসা চমকে উঠল!
“রাগ! আমি রাগ করব কেন? রাগ করার মত কিছু হয়েছে না-কি, আমি তো বুঝতে পারছি না!”
“কেন, ঘরে ঢোকার সময় তোমাকে ওভাবে কথা বললাম, সেটা আমার মোটেও ঠিক হয় নি। আসলে বাহিরের মানুষ ছিল আর তাদের সামনে তুমি সংসারের টানাপোড়নের কথা বলতে শুরু করেছিলে তাই আর কি! প্লিজ, রাগ করো না বউ।”

নিসা হেসে বলল,
“সত্যি বলছি আমি রাগ করিনি। আর ওখানে তো রাগ করার মত কিছু হয়ওনি। তাহলে রাগ করতে যাব কেন বলো?”
“সত্যিই রাগ করোনি?”

“সত্যিই রাগ করিনি।”
“তাহলে একবারের জন্যেও বাহিরে এসে ফ্রিজটা দেখলে না কেন?”
“ওএর জন্য ভেবেছ রাগ করেছি? আসলে হয়েছে কি আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো বরাবরের মত এবারও অন্য ছেলেদের সামনে আমার যাওয়াটা পছন্দ করো নি তাই আমাকে ভেতরে আসতে বলেছিলে। সেজন্যই এতক্ষণ ঘরে একা বসেছিলাম আর তাদের চলে যাবার অপেক্ষা করছিলাম।”

প্রণয় কপালে একহাত দিয়ে বলল,
“এইজন্যহায় আল্লাহ! আমি কি অন্য পুরুষের সামনে যেতে একেবারেই নিষেধ করেছিলাম? আমি বলেছিলাম তুমি একা যখন থাকবে রাস্তায় হোক বা ঘরে যতটা সম্ভব নিজেকে দূরে দূরে রাখবে। আর এখন তো ঘরে আমি আছি, এখন নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখার কি প্রয়োজন?”

নিসা এক ভ্রু উঁচু করে বলল,
“এই বিশ্লেষণটা তো আগে দাও নি। তাহলে এই বিশ্লেষণ আমি কি করে বুঝব?”
“হ্যাঁ, তাও ঠিক। আচ্ছা, এখন এসব কথা বাদ দিয়ে করিডোরে চলো। ফ্রিজ করিডোরেই রেখেছি।”

“করিডোরেকরিডোরে কেন? আমাদের ঘরে কি কম জায়গা আছে না-কি যে করিডোরে রাখতে হবে? ঘরের এক কোণে রাখলেই তো পারতে।”
“সে তো পারতাম কিন্তু পারলেই যে করতে হবে এটা কোনো কথা না। নিলয়, মুহিত আছে আমাদের পাশের রুমে। ওদের যেকোন সময় ঠান্ডা পানি খাওয়ার ইচ্ছা হলে কিংবা ফ্রিজে কিছু রাখার প্রয়োজন বলে মনে করলে ওরা কি বারবার তোমার ঘরের ভেতর ঢুকে জিনিসপত্র রাখবে আর নিবে? তুমি আমি দুজনেই তখন বিরক্ত হবো সাথে ওরাও। তাই ওখানেই রেখেছি কারোই বিরক্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই, যে যার মত ব্যবহার করো।”

“টাকা তোমার আর ব্যবহার করবে যে যার মতো? তোমার জিনিসের প্রতি, তোমার এক কষ্টের টাকার প্রতি তোমার কোনো দয়া মায়া নেই? আমাদের জিনিস আমরা যেভাবে সফটলি ব্যবহার করব তারা কি ওভাবে করবে? কখনোই করবে না। কিন্তু নষ্ট হলে কেউ পাশে এসে দাঁড়াবেও না, ওই তোমাকেই আবার ভর্তুকি দিয়ে ঠিক করাতে হবে।”

“তুমি একটু বেশিই ভেবে ফেলছ না নিসা? নিলয়, মুহিতকে তুমি কতদিন হলো চেনো যে এভাবে কথা বলছ? কারো সম্পর্কে না জেনেশুনে কথা বলো না, আগে সম্পূর্ণ ডিটেইলস জানবে তারপর বলবে। এখন কি যাবে?”

নিসা চোখের দৃষ্টি পরিবর্তন করে চুপচাপ রইলো। হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। প্রণয় নিজেই আবার বলল,
“টিউশনির এ ক’টা টাকা দিয়ে সংসার চলবে কি করে তাই জানি না। এই অজানার মাঝেই ফ্রিজের টেনশন মাথায় তুলে নিলাম। মাস শেষে ফ্রিজের কিস্তি দিয়ে হাতে থাকবে ১৫০০ টাকা যেটা কি-না ঘর ভাড়ার জন্যই দিয়ে দিতে হবে।

পরবর্তীতে খাবো কি, চলব কি করে কিছুই জানি না, তারপরও এত টেনশনের মাঝেও ফ্রিজ এনেছিলাম তোমার মুখে হাসি দেখার জন্যে। কিন্তু তোমার মুখের হাসি দেখা তো দূরের কথা ফ্রিজ টাই দেখতে গেলে না, এটাই কি আমার প্রাপ্য ছিল? পরিশেষে আমার রেজাল্ট শূন্য থাকবে এটাই কি আমার পাওনা নিসা?”
প্রণয়ের কথাগুলো শুনে নিসার বেশ খারাপ লাগল। বলল,
“সরি! আসলে আমি একটু অন্যভাবে ভেবেছিলাম।”

“কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে সব ধরনের ভাবনা এপ্লাই করতে নেই নিসা। নিলয় আর মুহিত এরা দু’জন শুধু আমার বন্ধু নয় ভাইও বলতে পারো। ওরা আমার বিপদে যেভাবে এগিয়ে এসেছে এ ভুবনে আর সেভাবে কেউ এগিয়ে আসবে না। তাই প্লিজ ওদের সম্পর্কে একটু ভেবেচিন্তে কথা বলো প্লিজ।”
“হুম, আচ্ছা চলো ফ্রিজটা দেখে আসি।”
প্রণয় স্মিত হেসে এগুলো দরজার দিকে।

দুদিন যেতে না যেতেই প্রণয়ের মাথা গুলিয়ে যেতে লাগল সংসার চালাতে গিয়ে। হাতে এক পয়সাও নেই। গত দুইদিন যাবৎ নিলয় আর মুহিতের টাকায় চলেছে সে কিন্তু, পুরো মাস তো এখনো বাকিই রয়েছে। কীভাবে চলবে সে! কোনোরকম ৪টা মাস আল্লাহ আল্লাহ করে পার করলেই কিস্তির ঝামেলা গেলেই সে মুক্ত। টিউশন করে যে ক’টাই টাকা পায় সে, ওটা দিয়ে অনায়েসে সে সংসার চালাতে পারবে। কিন্তু এ ৪ মাস কিভাবে সামলাবে সে! ভাবতেই সামিরের নাম্বারে ডায়াল করল প্রণয়
“হ্যালো ভাইয়া!”
“হ্যাঁ বল, কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কেমন আছ? আর ভাবি ভাবি কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ, সবাই ভালো আছে। তোদের কি খবর সেটা বল। নিসা কি হাসিখুশি আছে না-কি!”
“না ভাইয়া, ও অনেক হাসিখুশিতেই আছে কোনো সমস্যা নেই। তবে”
“তবে কি?”

প্রণয় একে একে ফ্রিজ কেনা থেকে শুরু করে তাদের চলার সমস্যা পর্যন্ত সবকথা খুলে বলল সামিরকে। সামির বলল,
“এই সামান্য কথা বলতে এত দ্বিধাদ্বন্দে ভুক্তে হয়? আমি আর নিতু তো প্রথমেই তোকে বলেছিলাম যে কোনো সমস্যা হলে নিঃসংকোচে বলবি।”

“হুম, বলেছিলে কিন্তু নিজের কাছেও তো খারাপ লাগে। যেখানে নিজের মায়ের পেটের ভাইয়ের উপর অধিকার খাটাতে পারি না, সেখানে তোমাকে কত জ্বালাবো বলো।”

“হয়েছে আর পাকনামো কথা বলতে হবে না, অনেক বলেছিস। এখন আমি অফিসে আছি বুঝলি রাতে কথা হবে। আর হ্যাঁ, এখনি অবশ্যই বিকাশ চেক করে নিবি। রাখছি ভাই, আল্লাহ হাফেয।”

বলেই সামির ফোনের লাইন কেটে দিতেই প্রণয় জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকায়। মিনিট দুয়েকের মধ্যে বিকাশ টোন বেজে উঠতেই প্রণয় মোবাইল চেক করে দেখে ১৫০০০ টাকা পাঠিয়েছে সামির। মুহূর্তের মধ্যে তার চোখেমুখে ভেসে থাকা অস্থিরতা ছাপ উধাও হয়ে গেল। খুশি সামলাতে না পেরে সামিরকে আবারও ফোন দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ।

তুমি যে আমাকে কতবড় টেনশন থেকে মুক্ত করেছ তুমি নিজেও জানো না। আমার তো পুরো আগামী তিনমাসের খাওয়া আর হাত খরচের সমস্যা ছিল যেটা কি-না এখন তুমি দিয়ে দিয়েছ। আমার তো মনে হয় আগামী তিনমাস খাওয়ার খরচ আর হাত খরচ চালিয়েও ২/১ হাজার টাকা হাতে থাকবে। তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছি না।”

সামির মুচকি হেসে বললেন,
“তোর বড় ভাই আমি। আর বড় ভাই হওয়ার সুবাদে এতটুকু দায়িত্ব পালন করার যথেষ্ট অধিকার আছে আমার। তাই এসব ধন্যবাদ টন্যবাদের কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না, ঠিকাছে?”
“হুম ভাইয়া।”

“আচ্ছা এখন তাহলে রাখ। জরুরী কিছু কাজ করছি। আর হ্যাঁ, সময় করে নিসাকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসিস কেমন!”
“আচ্ছা ভাইয়া।”
“হুম, ভালো থাকিস।”
প্রণয় ফোন রেখেই গায়ে শার্ট ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়ল বিকাশ থেকে টাকা তুলে বাজার করার উদ্দেশ্য।

৫ মাস পর…….

লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “তোমার নিসা – পাগল প্রেমের পাগলামি গল্প” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ। )

আরো পড়ূন – তোমার নিসা (শেষ খণ্ড) – পাগল প্রেমের পাগলামি গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *