গল্পটি অসমাপ্ত (১ম খণ্ড) – নতুন প্রেমের উপন্যাস

গল্পটি অসমাপ্ত (১ম খণ্ড) – নতুন প্রেমের উপন্যাস: আলতাব চৌধুরী একটু লজ্জাই পেলেন কথা গুলো শুনে। চাপা স্বরে বললেন, আস্তে। সব জায়গায় আমার মান – ইজ্জতের ফালুদা না করলে তোর চলে না।


পর্ব ১

~ আপনাকে ঠকাতে চাইনা। তাই সত্য কথা বলতে চাই। আমি আপনাকে ভালোবাসি না আর বাসতেও পারবো না। আমার মন প্রাণ জুড়ে একজনেরই বাস। এমনকি…

মৌমি মেয়েটার গলা খানিক কাঁপলো। মোটা কাঁচের আড়াল দিয়ে পরশ চকিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। বাসর রাতে নিজ স্ত্রীর থেকে এরকম কিছু শোনা প্রত্যাশাজনক হয়? মৌমি নিজেকে প্রচন্ড শক্ত রাখলো। রয়ে সয়ে বলল, আমি প্রেগন্যান্ট।

বিয়ের আগেই কথাটা বলতে চাইছিলাম কিন্তু বাবা-মা রাজী হয়নি। আমাকে জোরপূর্বক বিয়ে করাতে বাধ্য করেছে, এমনটাই ধরেন৷ চাইতেও অনেক কথাই খুলে বলতে পারিনি আপনাকে৷ দুঃখীত আমি…

নতজানু হয়ে রইলো মেয়েটি। পরশের বুকের ভেতরে উত্তাল ঢেউ। সারাটি জীবন ধরে একটি পুরুষ যেই রাতের অপেক্ষায় থাকে, যার অপেক্ষায় থাকে, আজ তাকে পেয়েও পেলো না। পাওয়া হলো না প্রাপ্ত ভালোবাসা টুকু! সম্মান টুকু! সদ্য বিবাহ করা স্ত্রীর মুখ থেকে শুনতে হচ্ছে অদ্ভুত রকমের কথা!

পরশের সাড়া না পেয়ে মৌমি ধীর ভাবে মাথা তুলে তাকালো। একজোড়া চোখ অবাক ভাবে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে।

থমথমে গলায় আবার বলল, আপনি চাইলেই আমায় ডিভোর্স দিতে পারেন। আমার তরফ থেকে কোনো সমস্যা নেই। আর প্লিজ আমাকে দোষারোপ করবেন না। আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম আপনাকে সবটা জানাতে।

কিন্তু ঐ যে বললাম.. বাবা-মা.. আমাকে একঘরে বেধে ফেলেছিল। আমাকে সময় বা সুযোগই দেওয়া হয়নি আপনার সাথে আলাদা ভাবে কথা বলার জন্য…
মৌমি থামে। দম নেয়। হাপাচ্ছে খুব সে। পরশের মায়া হলো কেনো জানি। এতকিছু শোনার পরও নরম গলায় বলল, পানি খাবেন?
মৌমি অবাক হয় এবার৷ ভেবেছিল লোকটা চিল্লাফাল্লা করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে। অথচ তেমন কিছুই ঘটলো না। কণ্ঠটাও কি নরম! এত নম্র ভদ্র ব্যবহারের মানে? সমস্ত চিন্তার সুতো ছিঁড়ে মৌমি বলে উঠে, জি, খাবো..
~ এক মিনিট..

পরশ উঠে পানি নিয়ে আসে এক গ্লাস। মৌমির দিকে এগিয়ে দিলো। মাথার ঘোমটা খুলে ফেলে মৌমি৷ পানি খেয়ে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। শীতল গলায় বলল, ধন্যবাদ।
~ না, না, ধন্যবাদের কিছু নেই।

পানির গ্লাস টা জায়গা মতো রেখে মৌমির সামনে এসে বসলো পরশ। পরশের এত ভালো আচরণ মৌমির কাছে অদ্ভুত ঠেকছে। নিজের কৌতূহল দমাতে না পেরে প্রশ্ন করলো, আপনি এতকিছু শুনেও রিয়েক্ট করলেন না যে! আমাদের ভেতর এখনো কিছুই হয়নি কিন্তু। চাইলেই এই সম্পর্ক শেষ করে আপনি নতুন সম্পর্কে জড়াতে পারেন।

এবার পরশ হাসলো, কোনোকিছু হওয়া দিয়ে বুঝি সম্পর্ক তৈরি হয়?

মৌমি ইতস্ততভাবে বলল, না, না, ওমন কিছু বোঝাতে চাইনি। সম্পর্কের মতো এত সুন্দর জিনিস এই নোংরা জিনিস দিয়ে তৈরি হওয়ার মানেই হয়না।

~ কোনটাকে নোংরা বললেন আপনি?
~ যেটার ভার পেটে বয়ে বেড়াচ্ছি!

~ হাহ! এটাকে নোংরা বলবেন না প্লিজ। নোংরা সেই সম্পর্ক যেই সম্পর্কে এটাই মূখ্য। বর্তমানের ভাষায়, খাওয়া শেষ তো সম্পর্ক শেষ। এটাই নোংরা সম্পর্কের উদাহারন। কিন্তু বিয়ের পর এটা হওয়া, মোটেও নোংরা নয়। বরং পবিত্র।

~ গায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছেন?
~ আরে না! আমি আবার নুনের ছিটা দিতে যাবো কেনো? থাক বাদ দিন এসব। তর্ক করলেই তর্ক..

~ হু..
মৌমি চুপসে যায়। পরশ অনেকক্ষণ যাবত চুপচাপ মৌমির সামনেই বসে রইলো। গায়ের রং উজ্জ্বল, থুতনিতে একটা কাটা দাগ, কপালের বাম পাশটায় ও একটা কাটার দাগ।

সরু নাক, আর পাতলা ঠোঁট। দেখতে খারাপ না মেয়েটা। পরশের বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। উঠে দাঁড়ায় সে। নিঃসংকোচে বলে উঠে, আপনার সিগারেটের ধোঁয়ায় সমস্যা হয়?

মৌমি ঈষৎ কেঁপে ওঠে বলে, নাহ..
সেকেন্ড দুই চুপ থেকে প্রশ্ন করে, কেনো?
পরশ বিছানার তল থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, সিগারেট খাবো তাই..

মৌমি মাথা নিচু করে রইলো। পরশ জানালার কাছে এগিয়ে গেলো। মুখে সিগারেট নিয়ে লাইটার বের করলো পকেট থেকে। তারপর.. সিগারেট জ্বালাতে গিয়েও থেমে গেলো।

কি যেনো ভেবে আবার বিছানায় এসে বসলো। সিগারেট আর লাইটার রেখে দিলো বিছানার পাশের ড্রয়ারে। মৌমি পরশের কর্মকান্ড দেখে অবাক হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে৷ মুখে একরাশ বিষ্ময় ফুঁটিয়ে বলল, খেলেন না যে?
~ ভালো লাগছে না তাই..

~ আপনি আমার কথা শুনে আপসেট হয়ে গেছেন। বুঝতে পারছি। মৌমির অপরাধী কণ্ঠ। পরশ হালকা হাসলো, এসব কথা শুনে কেউ বুঝি খুশি হতে পারে?

মৌমি নিশ্চুপ, নিরুত্তর। নিজেকে নর্দমার মতো ছোট, নিচ, নোংরা মনে হচ্ছে নিজের কাছে। জীবন নামক জলতরঙ্গ কোথা থেকে কোথায় যে নিয়ে এলো…! মৌমি ক্ষীণ গলায় বলল, আপনি ভালো কিছু ডিজার্ভ করেন। তাই আমাকে ডিভোর্স দিন। জীবন টাকে নতুন ভাবে শুরু করুন..

পরশ এবারেও হাসলো কৌতুক ছলে। বলল, তারপর? আপনার ফ্যামিলি, আমার ফ্যামিলি, সমাজ, সব কিছু খুন ইজিলি মেনে নিবে? না?

মৌমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। পরশ উত্তরের অপেক্ষা করে। কিন্তু নিশ্চুপ মৌমি কে দেখে বলে, উত্তর নেই? বিয়ে করার আগেই এসব প্রশ্নের উত্তর ভাবা উচিত ছিল। ডিভোর্স বললাম আর হয়ে গেল। এত সহজ না যতটা মনে হয়।

সবসময় সবকিছু নিজের জন্য নয়, পরিবার সমাজের কথা ভেবেও করতে হয়।

~ আমি পরিবারের কথা ভেবেই বিয়েটা করেছিলাম..
~ বাদ দিন। আমার কপালে যা লিখা ছিল, তাই তো হবে। আপনাকে দোষ দেই না, দোষ সব কপালের..

পরশ ব্যর্থ ভঙ্গিতে হাসে। কপালে হাত ছুঁয়ে দেখলো। মৌমির খারাপ লাগা কাজ করছে বুকের ভেতর। সে কি সত্যিই চেষ্টা করেছিল সবকিছু ভেঙে বলার? যদি সত্যি সত্যি চেষ্টা করে থাকতো তাহলে কি সব খুলে বলা যেত না?

সুযোগ খুঁজে পাওয়া যেত না? উঁহু, মাঝে মাঝে শত চেষ্টা করেও অনেক কিছু হাসিল করা যায় না। মৌমি তো কম ধকল পোহায় নি পরশ কে তার অতীত খুলে বলার জন্য। অথচ.. ফলাফল শূন্য…

সময় কাটে৷ আধারের রাত আরো আধার হয়। মৌমি হাটুতে মুখ গুঁজে চুপচাপ বসে আছে। পরশ বসে আছে হেলান দিয়ে.. নীরবতা কাটিয়ে পরশ বলে, আমরা কি নতুন করে জীবন শুরু করতে পারিনা?
মৌমি চমকে তাকায়। এমনটা এই লোকের থেকে আশাই ছিল না তার। মৌমি প্রশ্ন যেন বুঝতে পারলো না। সেই ভঙিমায় বলে উঠে, জি?

~ বললাম, আমরা কি নতুন করে জীবন শুরু করতে পারিনা? আপনার আগে যা হয়েছে তা সব ভুলে পারবেন কি আমার সাথে নতুন জীবন শুরু করতে?

মৌমির যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। প্রচুর অবাক সে। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে পরশের দিকে। পরশ ফের বলে, তাকে ভুলতে খুব কষ্ট হবে?

মৌমি তৎক্ষনাৎ উত্তর করে, হুঁ, সে শুধু দেহেই নয়, মনেও মিশে আছে। এমন ভাবে মিশে আছে যে তাকে ভুলতে হলে নিঃশ্বাস টাও ভুলতে হবে।

পরশ গাঢ় শ্বাস ফেলে, ঠিকাছে। তার জায়গা চাইবো না৷ কিন্তু আমাকে কি আলাদা কোনো জায়গা দেওয়া যায় না? মনের ভেতর?
~ আপনি আমার সব কিছু জেনেও মেনে নিতে চাইছেন? কেনো?
~ কারণ, এটাই আমার কপালে ছিল।

নিয়তি যা, তা মেনে নিতে পারি আমি। আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। আর মনে রাখবেন, বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্ক আল্লাহর হুকুম ছাড়া তৈরি হয় না। এছাড়াও বা কোথায় লেখা আছে যে একজন গর্ভবতী নারীকে বিবাহ করা যাবে না?

~ আর ও? পেটের দিকে ইশারা করে প্রশ্ন করে মৌমি। পরশ উত্তরে চমৎকার ভাবে হাসি দিয়ে বলে, ও থাকুক৷ ওই নিষ্পাপ প্রাণ টার কি দোষ? ও আমার পরিচয়ে বড় হবে। যদি আপনি চান…
মৌমি পরশের মুখ পানে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীর সব পুরুষ কাপুরুষ হয় না…অমানুষ হয় না…


পর্ব ২

বাহিরে ঘোর অন্ধকার। আজ অমাবস্যার রাত বলে কথা। প্রকৃতি অন্ধকার কে একটু বেশিই গাঢ় করে ফেলেছে।

এই অমাবস্যার রাতে সব ভূত পেত্নীরা বাইরে আসে। যাকেই পায় তারই ঘাড় মটকে দেয়। বাড়ির সামনে যে বট গাছ টা আছে, ওটায় তো সাত টা পেত্নীর আস্তানা। এমনটাই ধারণা মৌমির। সন্ধ্যা হতেই ঘরের দোর আটকে দিয়েছে মৌমি। সবকটি জানালাও বন্ধ। ভ্যাপসা গরমে রুম উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে।

রাত নটার দিকে বিছানা জুড়ে বইপত্র মেলে বসেছে মৌমি। সকালে হানিফ স্যারের অংক ক্লাস আছে। এবার সে মাধ্যমিক দিবে। অংক গুলো ঠিকঠাক ভাবে করে না নিয়ে গেলে মাইর একটাও মিস নেই! এমন সময় মৌমির মা মাজেরা বেগম রুমে ঢুকেন। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে বলেন, এভাবে সব কিছু আটকায় রাখছিস ক্যান? জানালা গুলা খোল। কি গরম ঘরটায়!

মাজেরা বেগম নিজেই জানালা খুলতে উদ্যত হতে নেন। মৌমি আৎকে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। আতংকিত গলায় বলে, ওমা! না, না, জানালা খুলো না…
কেঁদেই দিবে মৌমি। মাজেরা বেগম বিষম খান। আগ্রহ থেকে জানতে চান, কেন?

~ আজ অমাবস্যা। দেখো না কত অন্ধকার! এই সময় বাইরে তারা থাকেন। ঘুরে বেড়ান। কাউকে পছন্দ হলেই ঘাড় মটকে দেন।
এখানে “তারা” বলতে ভূত ~ পেত্নী ~ জ্বিনদের কথা বলেছে মৌমি। মাজেরা বেগম বুঝলেন।

তবুও জানালা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একদলা শীতল বাতাস সারা ঘরময় জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো৷ মাজেরা বেগম প্রাণ ভরে শ্বাস নিলেন৷ তারপর তৃপ্তির গলায় বলেন, যতই ফ্যানের বাতাস খাই না কেনো। প্রকৃতির বাতাস, আলাদাই.. এর সাথে কৃত্রিমের তুলনা নেই।

সেসব কথার উত্তর উপেক্ষা করে কাঁদোকাঁদো গলায় মৌমি বলল, তুমি জানালা টা খুললে কেনো? ওইদিকে দেখো, ওই যে বটগাছ টা৷ ওটায় কত তাদের বসবাস জানো? আমার রুম থেকে স্পষ্ট দেখা যায়…

মাজেরা বেগম আফসোসের গলায় বলেন, এতবড় ঢিঙ্গি মেয়ে। অথচ কত ভয়! তোর বান্ধবী টিয়াও তো কত সাহসী। আর তুই?
~ টিয়ার সাথে আমার তুলনা কোথায়?

সেতো অমাবস্যার রাতেও মানুষের বাড়ির বাগান ঘুরে বেড়ায়। চুরির ধান্দা সবসময়!
~ হা হা হা! আমরাও ছোট থাকতে কত চুরি করছি জানিস? চুরি করার মজাই আলাদা…
~ কি জানি, আমি তো করিনাই।

তাই জানিও না..
মৌমি বইয়ের দিকে মুখ গুঁজে। জানালার সামনেই মাজেরা বেগম দাঁড়িয়ে রইলেন। মেয়ের সাথে তার অনেক গল্প করতে ইচ্ছে করছে এখন। তার ছোট বেলাকার সমস্ত গল্প।

কত চুরি করেছে, কার গাছের ফল খেয়েছে, কোন নদীর মাছ ধরেছে.. ইত্যাদি ইত্যাদি সব কীর্তিকালাপ ইচ্ছে করছে মেয়ের কাছে খুলে বলতে। যৌবন কালে মাজেরা বেগম এই গ্রামেরই মেয়ে ছিল,

এই গ্রামেই ছোট থেকে বেড়ে ওঠা তার৷ শেষ সমাপ্তিটাও বোধহয় এই গ্রামেই হবে…
মাজেরা বেগম মৌমির পড়ায় মনোযোগীতা দেখে ধীর পায়ে হাটা ধরেন। ঠিক তখনি মৌমি ডেকে উঠলো,

মা..
মাজেরা বেগম থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, হুঁ..
~ মা, ভাইয়া? আমার একটা অংক বুঝিয়ে দিতো যদি একটু..
হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, এমন ভঙ্গিমায় বলে ওঠেন, কিছুক্ষণ আগে বের হলো কই যেন।

~ কই গেছো? মৌমির প্রশ্ন।
~ আমাকে সে বলে গেছে নাকি?

মৌমি ঠোঁট উল্টে বলল, যখনি তাকে দরকার হয় তখনি সে নাই! কি একটা অবস্থা!

মাজেরা বেগম চলে যান। মৌমি পড়ায় মন দিতে গিয়েও পারছে না। মা জানালা টা খুলেই গেছেন। ওই জানালা দিয়েই স্পষ্ট বটগাছ টা চোখে ভাসছে তার। উঠে গিয়ে জানালা টা অফ করার শক্তি টা পর্যন্ত নাই। থাক, মৌমি কাথা মুড়া দিয়ে পড়ায় মনোযোগ ফেরানোর চেষ্টা করলো….

~ তৈরি হওনি এখনো? পরশের কথায় আধশোয়া অবস্থায় চোখ খুলে তাকায় মৌমি। তার গোছানো জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাওয়ার প্রথম অধ্যায়ের পাতা স্মৃতিতে খুলে বসেছিল সে। পরশ কে চোখের সামনে দেখে উঠে বসে দ্রুত। জড়ানো গলায় বলে, চোখ লেগে এসেছিল। আমি এক্ষুনি তৈরী হচ্ছি।

~ একমিনিট..মৌমি উঠার চেষ্টা করতেই বলে ওঠে পরশ। মৌমি থেমে ঠায় বসে রইলো। পরশ মৌমির গভীর চোখ পানে দৃষ্টি ফেলে বলে, ক্লান্ত লাগছে?

মৌমি ধীর গতিতে বলে, হুঁ..
~ ওখানে অনেকটা সময় থাকতে হবে। আসতে আসতে সন্ধ্যাও হতে পারে। তুমি পারবে তো থাকতে?

~ আমাদেরই রিসিপশন। না থাকতে পারলেও তো থাকতে হবে তাইনা?

উত্তরে পরশ একটু থেমে বলল, ঠিক আছে৷ আমি তোমার খেয়াল রাখবো৷ যেকোনো প্রবলেম হলেই আমাকে শেয়ার করবে ওকে?
~ জি।
কথা শেষে মৌমি উঠে দাঁড়ায়। এগোয় বাথরুমের দিকে৷ আজ তার আর পরশের রিসিপশন। বিয়েটা খুব ধুমধামের সাথে না হলেও রিসিপশন টা ধুমের সাথেই করবে পরশের পরিবার।

ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসে মৌমি। তখনি পরশের ছোট বোন, পাপিয়া দুজন মেয়েকে নিয়ে ঘরে ঢুকে হুড়মুড় করে। পরশ কে ঠেলে রুম থেকে বের করে দিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে মৌমিকে সাজানোর জন্য।

গাঢ় নেভি ব্লু রংয়ের লেহেঙ্গায় সজ্জিতা মৌমি। পাপিয়ার হাত ধরে ধরে ধীর পায়ে এসে গাড়িতে বসে। পরশ আগে থেকেই গাড়িতে বসে ছিল। মৌমি এসে তার পাশে বসলো। নতুন করে বধুর বেসে মৌমিকে দেখে পরশের বুকের কোথাও খুব সূক্ষ্ম একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়। কেন তার সাথেই এমনটা হলো!

কেনো? সে তো এমন কাউকে চেয়েছিল যে তাকে খুন ভালোবাসবে, যার দিনের শুরু আর রাতের শেষ হবে পরশকেই ঘিরে, যার সুখ ~ দুঃখের বন্ধু একমাত্র পরশই হবে। যার সমস্ত ক্লান্তির অবসান ঘটবে পরশের বুকে৷ অথচ… অথচ পেলো টা কি?

পরশের বুক হাহাকারে ভরে উঠে। পরশ চোখ ফিরিয়ে নেয়৷ পরমুহূর্তেই একটা কথা মাথায় চলে আসায় শান্ত হয় সে। তার জীবন তাকে নিয়ে যে রহস্য তৈরি করে রেখেছে, তাতে কোনো মেয়েই তার জীবনে আসার কথা ছিল না৷

তবুও তো এসেছে একজন। এই তো বেশ৷ একে নিয়েই সুখে সংসার করতে সমস্যা কোথায়? অতীত তো সবার জীবনেই থাকে। সেটাকে গ্রহণ করার মানসিকতা না থাকলে কেউ কি জীবনে সফল হয়? সুখী হয়?


পর্ব ~ ৩

রেহানা চৌধুরী অধির আগ্রহে কমিউনিটি সেন্টারের বাহিরে তাকিয়ে আছেন। আলতাব চৌধুরী তার একজন বন্ধুকে দরজায় রিসিভ করতে এসে নিজ স্ত্রী কে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে ফেললেন। মৃদু ধমকের স্বরে বললেন, তুমি এখানে কেন? ভেতরে যাও।

রেহানা চৌধুরী ধমকটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন। বললেন, তোমার দরকার হলে তুমি যাও। আমি এখানেই থাকব। ওরা আসুক, এরপর ঢুকবো একেবারে।

~ ওরা আসার আগ পর্যন্ত এভাবেই দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে? মানুষ কি ভাববে?

~ যার যা ভাবার ভাবুক না। তাতে আমাদের সমস্যাটা কই? তুমি এখানে কেন আসছো? তোমার ফাও প্যাঁচাল কিন্তু আমার ভালো লাগতেছে না।

রেহানা চৌধুরী খানিকটা রাগী স্বরে বললেন কথাটি। আলতাব চৌধুরী সাফাই দেওয়ার ভঙিমায় বললেন, আমার এক বন্ধু আসবে। ওকে রিসিভ করতেই…

আলতাব চৌধুরীর কথা শেষ করবার আগেই তার বন্ধু এসে হাজির হন। আলতাব চৌধুরী কে পরম খুশিতে জড়িয়ে ধরলেন। প্রফুল্লচিত্তে বললেন, আরে ব্যাটা! কতদিন পর! তোর ভুড়ি এত বাড়ছে কেনো? ডায়েট করিস না? সকালে জগিং~এ যাস না?

আলতাব চৌধুরী একটু লজ্জাই পেলেন কথা গুলো শুনে। চাপা স্বরে বললেন, আস্তে। সব জায়গায় আমার মান – ইজ্জতের ফালুদা না করলে তোর চলে না।

~ নাহ, চলে না৷ ভাবি, কেমন আছেন?
রেহানা চৌধুরীর কথা বলার ইচ্ছে না থাকলেও জোরপূর্বক হাসলেন, এইতো মামুন ভাই, ভালো৷ আপনি ভালো তো?

~ আমিও আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি।
আলতাব চৌধুরী তাড়া দিয়ে উঠেন, চল, ভেতরে চল।
~ ভাবি যাবে না?
~ ওর কাজ আছে একটু। তুই চল..
মামুন কে জোর করে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন আলতাব চৌধুরী। রেহানা চৌধুরী হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

অতিরিক্ত প্যাঁচালি মানুষ তার একদম পছন্দ নন। অথচ তার ভাগ্যে অতিরিক্ত প্যাঁচাল পারার মানুষই জুটেছে!

গাড়ির ভেতর থেকে পরশের হাতটা ধরে ধীর গতিতে নামে মৌমি। রেহানা চৌধুরী হইহই করে ছুটে এলেন।

এসেই মৌমির আরেক হাত ধরে ব্যস্ত গলায় বললেন, আসায় সমস্যা হয়নি তো কোনো?
নিচু কণ্ঠে মৌমির উত্তর, নাহ..
পরশ বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করে, তুমি বাহিরেই ছিলে?
~ হু। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে। তোদের অপেক্ষায়।

~ সবাইকে ফেলে আমাদের অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটা কি ঠিক হলো মা?

~ ঠিক বেঠিকের কি আছে এখানে? আমার বউয়ের জন্য আমি অপেক্ষা করেছি। এতে কার কি? বেশি কথা বলবি না। চল, ভেতরে চল।

রেহানা চৌধুরীর তাড়া পেয়ে পরশ আগে আগে হেটে যায়। মৌমি রেহানা চৌধুরীর হাত ধরে ধীর গতিতে পিছু পিছু হাটা ধরে। রেহানা চৌধুরী এক নাগাড়ে বকবক করে যাচ্ছে।

অথচ সেদিকে মৌমির একদম খেয়াল নেই। তার মন বলছে, এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ কে ঠকানো হচ্ছে। এদের সত্যি টা বলে দেওয়া উচিত। কিন্তু যদি সত্যিটা বলে দেয়, এরা এখনের মতোই ভালোবাসবে ওকে?

পুরো স্টেজটা হরেক রকমের টিউলিপ ফুলে ভরতি। লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, সাদা, সবুজ, গোলাপী আবার নানান ধরনের মিশেলে কালার.. ওদিকে তাকালেই চোখ ধাধাচ্ছে মৌমির।

এর আগে বাস্তবে কখনো টিউলিপ ফুল দেখা হয়নি বলে মিশি ফ্যালফ্যাল নয়নে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। রেহানা চৌধুরী তার দৃষ্টি লক্ষ করে বিষয়টি বুঝতে পেরে বলল, তোমার শ্বশুরের কান্ড এসব। তার অনেক শখ ছিল একমাত্র ছেলের রিসিপশন হবে একদম ইউনিক ভাবে।

তাই এই আইডিয়া। ভারত থেকে আনানো হয়েছে ফুল গুলি। সুন্দর না?
মৌমি গলা ধরে আসে। কোনোরকমে বলল, খুব সুন্দর..
রেহানা চৌধুরী মৌমিকে স্টেজের উপর উঠায়। স্টেজের উপর দুটি রাজকীয় চেয়ার দেওয়া।

একটিতে আগে থেকেই পরশ বসে আছে। মৌমি গিয়ে অন্য চেয়ার টিতে বসার সাথে সাথেই সবাই হাতে তালি দেওয়া শুরু করলো। মৌমি ভয় পেয়ে গেলো হঠাৎ এত শব্দের জন্য। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল।

স্থির ভাবে বসে রইলো চুপচাপ। রেহানা চৌধুরী মাইক হাতে এনাউন্সমেন্ট করলেন, লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যানস, প্লিজ ওয়েলকাম মাই ডিয়ারেস্ট সান পরশ এন্ড হিজ ওয়াইফ মৌমি। ওদেএ দুজন কে অঢেল শুভেচ্ছা ও দোয়া দিয়ে যাবেন। যেন ওদের নতুন দম্পতি জীবন সুখের হয়, আনন্দের হয়।

রেহানা চৌধুরীর কথা শেষে আবারো হাতে তালির শোর শোনা যায়। মৌমির বুকচিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোয়।

উনারা কতই না এক্সাইটেড ওকে নিয়ে৷ অথচ! যখন জানবে সত্যিটা, কেমন লাগবে তাদের? উনাদের এই নিষ্পাপ অনুভূতি নিয়ে খেলা কি মৌমির ঠিক হচ্ছে?

মৌমির বুকচিঁড়ে আবারো একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে পড়ে। বউ দেখার পর্ব শুরু হয়। একেকজন আসছে, মৌমির হাতে উপহার তুলে দিচ্ছে, মৌমির মায়াবতী মুখ খানা মহিলারা নিজেদের হাতের আঁজলায় তুলে দোয়াও করে যাচ্ছে।

পরশ আড়চোখে সেসব দেখে নিজমনে স্বগতোক্তি করে, সবাই তো বউকে নিয়েই ব্যস্ত! তাহলে এখানে আমার আসার দরকার টা কি ছিল? বুঝলাম না ভাই!
মৌমি স্পষ্ট শুনলো কথাটা। সঙ্গে সঙ্গে ফিক করে হেসে ফেললো। পরশ থতমত খেলো।

মৌমিও হাসি থামালো।
সময় যত যাচ্ছে চারিদিকে লোকের সমাগম বাড়ছে। মৌমির হাত দুটো ব্যথা হয়ে গেছে উপহার গ্রহণ করতে করতে। একটা সময় সারপ্রাইজ পাওয়া অথবা উপহার পাওয়া, এসব নিয়ে মৌমি খুব খুশি হয়ে পড়তো৷

এক্সাইটেড ফিল করতো। অথচ এখন ভাল লাগে না৷ সত্যিই, সময়ের সাথে সাথে অনেক অনুভূতিরাই ফ্যাকাসে হয়ে যায়! ঠোঁট টাও টনটন করছে। কতক্ষণ মুখে হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকা যায়? মৌমি ঘোলা ঘোলা চোখ মেলে দেখতে পায়, মাজেরা বেগম ওর দিকেই এগিয়ে আসছে৷

মাকে পেলে সন্তানদের মাঝে যে~ধরনের উৎফুল্লতা কাজ করে, মৌমির মাঝে সেরকম কিছুই দেখা গেল না৷ উল্টো তার কপাল কুঁচকে এলো৷ সে যেন বড়ই বিরক্ত তার মায়ের উপর। মেয়ের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মাজেরা বেগম বললেন, ” কেমন আছিস মা? “

~”ভালো। ” মৌমির উদাসীন গলা। মাজেরা বেগম বুঝেও বুঝলেন না৷ আবার জিজ্ঞেস করেন, “সব ঠিকঠাক চলছে তো? ভাল লাগছে ও বাড়িতে? “

~” হু…”
~” ঠিক মতো কথা বলছিস না যে! ক্লান্ত? “
~” নাহ। “

মাজেরা বেগম চুপ করে রইলেন। এর চেয়ে বেশি মৌমির থেকে আর কিছু আশাই করা যায় না। মেয়েটা কেমন বদলে গেছে!
ধীরে ধীরে বিকেল নেমে আসে।

মৌমির পেটের মধ্যে পাঁক দিয়ে উঠছে বারবার। মৌমি একহাত পেটে চেপে পরশের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। পরশ জিজ্ঞেস করে, “ক্ষিদা লাগছে? “
~” হু… অনেক। “
~” আমি দেখছি। “

পরশ নিজের আসন ছেড়ে উঠে যায়। প্রায় মেহমানদেরই খাওয়া শেষ। পরশ একটা টেবিল সুন্দর করে সাজাতে বলে। মৌমি, সে সাথে তাদের পরিবারের সবাই খাওয়া দাওয়া করবে তাই। মৌমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। অবশেষে খাবারের মুখ দেখা গেল!
কিন্তু মৌমি কিছুই খেতে পারলো না।

পোলাও, রোস্টের গন্ধে মৌমির পেটের ভেতর থেকে সব খাবার উগলে গলায় চলে আসে৷ মৌমি নিজেকে সামলাতে না পেরে দৌঁড়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোয়। সবাই হতবাক। পরশ বিষয়টা বুঝতে পেরে মৌমির পেছন পেছন দৌঁড়ায়। মাজেরা বেগমের বুকটা অজানা আশংকায় কেঁপে উঠে। মৌমির শ্বশুরবাড়ির লোকজন আবার সন্দেহ করবে না তো!

বটগাছের আড়ালে দুজনের ছায়া। মৌমির অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। ওখানে কারা? তেনারা নয়তো? ওহ আল্লাহ! মৌমির বুক অতি উচ্চ গতিতে ধুকপুক ধুকপুক করা শুরু করে।

মৌমি কাথার তল দিয়ে দু চোখ বের করে বটগাছের তলাতেই তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুঝলো, ওগুলো মানুষ। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। মৌমির ভয় কমে কৌতূহল বাড়লো। কাথা থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে জানালার সামনে এসে নিচু হয়ে বসলো।

বাহির থেকে কেউ~ই বুঝবে না এবার যে জানালার কাছে কেউ আছে। মৌমি লক্ষ করতে থাকে তাদের। ছেলে~মেয়ে দুটি একজন আরেকজন কে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে। মিনিট দুই ওভাবেই কাটে। তারপর একে অপরের থেকে আলাদা হয়।

মেয়েটি বিদায় জানিয়ে তার পথ ধরে। ছেলেটিও হাটা ধরে। ওর গন্তব্য মৌমিদের বাড়ির দিকেই। মৌমি অবাক চোখে দেখছে সব টা। ছেলেটি হাটতে হাটতে মৌমির জানালার সামনে দিয়ে ক্রস করে চলে যায়। ঠিক তখনি তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পারে মৌমি।

বিষ্ময়ে ফেটে পড়লো মৌমি। কি দেখলো এটা! এটা তো তার ভাই, তার আপন বড় ভাই, শাওন! তার মানে ওই মেয়েটা শাওন ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড? অথচ মৌমিকে একটু বললো পর্যন্ত না। মৌমির ঈষৎ অভিমান হয়৷ সে সিদ্ধান্ত নেয়, ভাইয়ের সাথে আর কথাই বলবে না।

শাওন রুমে এসে ফ্রেশ হয়। তারপর গামছা খুঁজে বেড়ায় মুখ মুছার জন্য।

~” মৌ, মৌ রে.. গামছা কই? গামছা দিয়ে যা.. এই মৌ.. মৌ..”
মৌমি ধমক মেরে বলল, “মৌ, মরছে। কবরস্থানে আছে এখন। কি দরকার তারে? “

শাওন হেসে ফেললো।

~” এত পংটামি কেমনে করোস? গামছা টা দিয়ে যা। “
~” পারবো না। তোমার গার্লফ্রেন্ড কে বলো। “
~” গার্লফ্রেন্ড?

আমার আবার গার্লফ্রেন্ড আসবে কোত্থেকে? ” শাওন আকাশ থেকে পড়ার ভান করলো।
~” একদম ঢং করবা না। বুঝছো? আমি সব দেখছি। “
~” কি দেখছিস? “

~” ওই বটগাছের তলায় একটা মেয়েকে নিয়ে জাপটে ধরে ছিলা তুমি…”
শাওন মৌমির মুখ চেঁপে ধরে, ” আস্তে! আম্মু শুনে ফেলবে তো। “
মৌমি শাওনের হাতে কাঁমড় বসিয়ে দেয়। শাওন ওহ মা গোবলে সরে যায়। মৌমি চেঁচিয়ে বলে, ” শুনলে শুনুক৷ তোমার সাথে কোনো কথা নাই আমার।

কোনো কথা নাই ভাইয়া..”
মৌমি রুম ত্যাগ করার জন্য উদ্যত হলে, শাওন ওর হাত ধরে টান দেয় পেছন থেকে। মৌমি দাঁড়িয়ে পড়ে৷ শাওন মৌমিকে টেনে রুমের মাঝামাঝি জায়গায় এনে অনুরোধের সুরে বলল, “যা দেখেছিস, তা কাউকে বলিস না।

দোহাই তোর। প্লিজ…”
মৌমি উত্তর না দিয়ে মুখ ভার করে রইলো৷ শাওন আবার বলল, “একমাস যাবত সম্পর্ক। বেশিদিন হয়নাই৷ তোকে বলব, বলব, করেও বলতে পারিনি। আসলে ভয় পাচ্ছিলাম। তুই যদি কাউকে বলি দিস! “

মৌমির অভিমান কিছুটা হলেও কমলো। বলল, “আমাকে চেনো না তুমি? কতবার বাবার পকেট দিয়ে টাকা চুরি করেছো৷ কতবার মায়ের জমানো টাকা সব গায়েব করে দিয়েছো৷ রাত ভর বাহিরে ঘুরে বেরিয়েছো৷ সেসব আমি ঢেকে রাখিনি সব?

তাও তোমার বিশ্বাস নাই আমার উপর? “
~” আরেহ! বিশ্বাস তো আছে৷ কিন্তু ওসব থেকে এসব আলাদা ব্যাপার না? “

~” আচ্ছা, বাদ দাও। মেয়েটা কে সেটা বলো..”
~” কাউকে বলবি না তো? আর রিয়েক্ট করবি না তো কোনো? “
~” না বাবা। বলো..”
শাওন ইতস্ততভাবে বলল, “টিয়া। “

~” কিহ! ” মৌমির মুখ হা হয়ে যায়। টিয়া! তার ফ্রেন্ড? ফ্রেন্ড বললে কম হবে, আত্মার বন্ধু সে… ছোটবেলা থেকে দুজনে সব খানে একসাথে। সবাই ওদের মানিকজোড় বলে ডাকে এইজন্যে। সেই টিয়া ওর ভাইয়ের, একমাত্র বড় ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড?

মৌমি অনেকক্ষণ যাবত হাকরে রইলো। শাওন চাপাস্বরে বলল, “কাউকে বলিস না প্লিজ.. জানিসই তো ওর আব্বা ~ আম্মা কেমন ধরনের৷ জানলে ওরে খুন করে গাঙে ভাসিয়ে দিবে। “
~” ও আমার এত ক্লোজ ফ্রেন্ড! অথচ আমাকেও একটাবার বললো না? “
~” ভুল বুঝিস না ওকে।

আমিই কাউকে জানাতে মানা করছিলাম৷ ওকে আমি খুব ভালোবাসি৷ অকালে ওর সাথে আমার সম্পর্ক টা ঝরে পড়ুক, সেটা আমি চাইনি। “
মৌমি চোখ খুলে। একমণ সমান ভারী দীর্ঘশ্বাস পিছলে পড়ে তার বুকের পাড় থেকে।

শাওন ~ টিয়ার সম্পর্ক টা যদি ভালো থাকতো, ওর জীবনটাও তছনছ হতো না কোনোভাবেই…ওয়াশরুমের দরজায় শব্দ হচ্ছে। পরশ ডাকছে বাহির থেকে। মৌমি কল্পনা থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে দিলো। পরশ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “ঠিক আছো তো তুমি? “
মৌমি মলিন ভাবে হেসে বলল, “আমি ঠিক আছি। “


পর্ব ~ ৪

আত্মীয় স্বজনরা ফুসুরফাসুর করছেন। রেহানা চৌধুরী, আলতাব চৌধুরী হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বিয়ের রিসিপশনে বিবাহিত কন্যার এরকম হঠাৎ দৌঁড়ে যাওয়া, কেমন একটা কানাঘুষা সৃষ্টি করেছে। মাজেরা বেগম এক কোণায় শক্ত হয়ে বসে আছেন।

আজ যদি মৌমির বাবা এখানে আসতেন, তবে কি মাজেরা বেগম এভাবে অসহায় হয়ে পড়তেন? তিনি সব সামলে নিতেন।
পরশের হাত ধরে মৌমি ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে। রেহানা চৌধুরী এগিয়ে যান।

মৌমি ~ পরশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন,
~” তুমি এভাবে দৌঁড়ে গেলে কেন? কি সমস্যা? “
মৌমি ভয়ে কুঁকড়ে যায়। পরশ মৌমির চেপে ধরা হাতটা আরো জোরে চেপে বলল,
~” খালি পেট ছিল।

পোলাও আর রোস্টের কড়া গন্ধে পেট মোচড় দিয়ে উঠছে। ভাবছে বমি হয়ে যাবে। এই জন্য এভাবে দৌঁড়ে চলে গেছে। “
~” ওহ। এখন ঠিক আছ? “
মৌমি ঘাড় কাত করে বলে,
~” জি। “
~” ঠিক আছে।

আসো..”
রেহানা চৌধুরী মৌমির হাত ধরায় পরশের থেকে মৌমি হাত ছাড়িয়ে নেয়৷ তারপর রেহানা চৌধুরীর সাথে এগিয়ে চলে খাবার টেবিলের দিকে।

অনেক রাত হয়ে যায় মৌমি আর পরশের বাসায় ফিরতে ফিরতে। খাওয়া দাওয়ার পর বিকেলে কন্সার্ট করা হয়েছিল। মৌমি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শোয়। ইদানীং একটু খাটনিতেই শরীর বেশ খারাপ লাগে। ওর তিনমাস হতে চললো!

পরশ বাথরুমে যাওয়ার আগে বলল,
~” বাসায় পোলাও মাংস রান্না হইছে৷ খেতে পারবে? নাকি অন্য কিছু খাবে? “

মৌমি চোখ মুদা অবস্থায় জবাব দেয়,
~” সম্ভব না খাওয়া। “
~” তাহলে অন্য কি খাবে? “

~” আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি স্যুপ করে নিব নি নিজের জন্য। আর কিছুর প্রয়োজন নেই। “
~” তোমার ইচ্ছা..”
পরশ বাথরুমে ঢুকে গেলো।

মৌমি ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলো পুরোনো স্মৃতিতে…
আজ সকালে স্কুল যাওয়ার সময় টিয়াকে ডাকতে যায়নি মৌমি।

স্কুলে গিয়েও টিয়ার সাথে কথা বলেনি। টিয়ার থেকে দূরে দূরে বসেছে। আকস্মিক ঘটনায় টিয়া পুরোপুরি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। হঠাৎ মৌমির হলো টা কি! স্কুল ছুটি শেষে মৌমি ব্যাগ গুছিয়ে নিজের মতো চলে আসতে নিলে ওর পথ আটকে

দাঁড়ালো টিয়া। কোমরে হাত গুঁজে রাম ধমক দিয়ে উঠলো সে।
~” এই তোর সমস্যা কি? আমাকে অবহেলা করতেছিস ক্যান? পাত্তাই দিচ্ছিস না! “
মৌমি শীতল গলায় বলল,
~” রাস্তা ছাড়। “

~” ছাড়ব না। আমাকে জবাব দে। কি হইছে তোর। “
~” এমনি। কিছুনা। “

~” কিছুনা বললেই তো হবে না৷ জবাব দে..”
টিয়া মৌমির দুকাধে হাত রাখার জন্য উদ্যত হতেই মৌমি চেঁচিয়ে বলে,
~” একদম ছুঁবি না।

কেমনে পারলি আমার থেকে এতবড় জিনিসটা লুকাতে? কেমনে পারলি? বল..! “
টিয়া থতমত খেলো। আমতাআমতা করে বলে,
~” ক..কি লুকাইছি? “

~” জানিস না? “
~” তুই খোলাশা করে বল, প্লিজ..”
~” তুই আমার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক করোস, এটা আমাকে বলছিস? “
টিয়া চুপ হয়ে গেলো।

মৌমি বকেই চললো,
~” নেংটা কালের বান্ধবী তুই আমার। এই এইটুকুন দেখছি তোরে৷ তোর নাড়ী নক্ষত্র সব আমার জানা শোনা। সেই আমার থেকে তুই লুকালি? আমার থেকে?

ধর তোর জায়গায় আমি থাকতাম যদি, কেমন লাগতো তোর? “
টিয়া ভোঁতা মুখে উত্তর করলো,
~” খারাপ।
~” আমার তো আরো বেশি খারাপ লাগতেছে। খুব খুব খুউউব… তুই যে কেমনে পারলি! “

মৌমি একটা হতাশার নিশ্বাস ছাড়ে। টিয়া থেমে থেমে প্রশ্ন করে,
~” কিভাবে জানছিস তুই? “
~” ভাইয়াই বলছে। কাল রাতে বটগাছ তলায় আপনাদের দেখে ফেলছি আমি। “

~” ওহ..”
~” এবার সর। বাসায় যেতে দে..”
টিয়া কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
~” তোর ভাই~ই মানা করছিল তাই বলিনি। প্লিজ মাফ করে দে আমাকে। প্লিজ…আর হবে না।

প্লিজ ক্ষমা কর। “
টিয়া আর একটু হলে কেঁদে ফেলবে এমন একটা অবস্থা। মৌমির তীব্র মন খারাপ থাকলেও টিয়ার কর্মকান্ড দেখে সে হেসে ফেললো। টিয়ার চোখ দিয়ে তখন অঝোর ধারা বইছে…
মৌমি তা দেখে আরো জোরে হেসে উঠে। টিয়া থমকে কান্না থামায়।

নাক টেনে লম্বা গলায় বলে,
~” তুই হাসছিস? হাস, সমস্যা নাই। তারপরেও রাগ করে থাকিস না আর প্লিজ। দয়া কর বোন। আমি তোকে প্রথমেই বলতে চাইছিলাম, বিশ্বাস কর।

একমাত্র তোর ভাইয়ার জন্যেই…”
মৌমি টিয়ার একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে গুঁজে বলল,
~” হইছে চুপ কর। আমি বুঝছি সব। যাইহোক বাদ দে। আয় একসাথে বাসায় যাই..”

টিয়া হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে,
~” সত্যি? মাফ করছিস? “

~” বন্ধুত্বে নো সরি, নো থ্যাংকিউ। এটা ভুলে গেছিস? “
টিয়া স্মিথ হেসে বলল,
~” ভুলিনি। “

~” তাহলে আর সরি বলিস না৷ চল বাসায় যাই..”
টিয়াকে তার বাসার সামনে ছেড়ে দিয়ে মৌমি যখন নিজের বাসায় যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়, তখন একটি চিকন কণ্ঠ তার নাম ধরে ডেকে ওঠে।
~” মৌমি..এই মৌমি..”

মৌমি পেছন ফিরে দেখে শেফালী বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। ঘামে কর্দমাক্ত চেহারা। অতি পুরোনো শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম টুকু মুছতে মুছতে বললেন,

~” ভেতরে আয়। আজ শেরপুটির ঝোল রেধেছি। খেয়ে যাবি, আয়..”
শেফালী বেগম টিয়ার আম্মা। টিয়া তার কাছে যেমন, মৌমিও তার কাছে ঠিক ওমনটাই। মৌমি মাথা নাড়িয়ে টিয়াদের বাড়ির ভেতরে ঢোকে। খাওয়ার টেবিলে এসে বসতেই তার চুক্ষু চড়কগাছ। কম হলেও ৮ পদের রান্না!

মৌমি ফিসফিস করে টিয়াকে জিজ্ঞেস করে,
~” এত খাবার? কার জন্য? আমার জন্য তো নিশ্চয়ই নয়। “
টিয়া জবাবে বলল, “তুই কি আমাদের বাড়ির স্পেশাল গেস্ট নাকি! তুই হলি আমাদেরই একজন। তোর জন্য ওত আয়োজন করতে পারবো না বাপু! এসব ভাইয়ার জন্য। ভাইয়া আসছে… “
~” কোন ভাই? “

~” ছোট ভাই। “

~” ওহ! “
মৌমির বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ কাজ করা শুরু করে। টিয়ার তিন ভাই। বড় জন, আতিক, মেঝো জন, ছাবিদ, আর ছোট জন, নীল। নীলের নীল নাম রাখার পেছনে অবশ্য একটা কারন আছে। উনার চোখের রং টা পুরো গাঢ় নীল বর্ণের। দেখতে ইংরেজদের মতো ধবধবে সাদা। টিয়ার মা শ্যামলা বর্ণের হলেও টিয়ার বাবা অতিরিক্ত ফর্সা। নীল তারই বহিঃপ্রকাশ।

অপরদিকে আতিক, ছাবিদ, শ্যামলা বর্ণের। কেন জানি মৌমির নীলকে প্রচুর ভাল লাগে। কেন লাগে সে কথা মৌমি নিজেও জানিনা।

হয়তো নীলের নীল চোখের জন্য নয়তো অন্যকিছু! পড়াশোনার সুবাদে নীল ঢাকায় থাকে। বছরে এক দুবার বাড়ি আসে। যখন যখন আসে, সে সময় গুলো মৌমির জন্য ঈদের চাঁদ দেখার ন্যায় আনন্দের।
মৌমির সমস্ত চিন্তার সুতো ছিড়ে গেলো টিয়ার কথায়,
~” খাচ্ছিস না কেন? ধ্যান কই? “
~” আরে খাচ্ছি তো। “

মৌমি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক সময় নিয়ে ধীর গতিতে খাওয়া সম্পন্ন করে। এই ভেবে যদি নীলও খেতে আসে! কিন্তু মৌমির ভাবনায় সেগুড়ে বালি। নীল এলো না।

মৌমি আর টিয়াই খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। টিয়ার রুমে গিয়ে বসলো মৌমি৷ টিয়া দরজা আটকে দিয়ে একটা বাক্স বের করলো ড্রয়ার থেকে। সেটা মৌমিকে দেখিয়ে বলল,
~” এখানে সব আছে। তোর ভাইয়া যেগুলা গিফট করছে, সেগুলা সব..”
মৌমি উৎসাহের সাথে বাক্স খুললো।

একটা ঘড়ি, একটা আংটি, কিছু শুকিয়ে যাওয়া গোলাপফুল, অনেকগুলো চিঠি আর কিছু চকলেটের খোঁসা। মৌমি ফোঁস করে একটা রাগী শ্বাস ছেড়ে বলল,
~” বাহ! আমি যখন পা ধইরা কান্দি চকলেটের জন্য তখন তো দেয় না। আর তোমারে ঠিকই দেয়। আজকে বাসায় যাই একবার। খবর আছে ভাইয়ার..”

টিয়া স্মিত হাসলো।

মৌমি এবার মনোযোগ দিল চিঠিগুলোর দিকে। একটা চিঠি তুলে নিয়ে বলল,
~” মাথামোটা টা কি লিখছে দেখি। “

টিয়া ছোঁ মেরে মৌমির হাত থেকে চিঠিটা সরিয়ে নেয়। বলে,
~” এগুলা অনেক পার্সোনাল। প্লিজ, এগুলা দেখিস না। “
~” আমি না তোর বেস্টু! “

~” হুঁ, তবুও…প্লিজ..”
মৌমি ছেড়ে দিল, “আচ্ছা যা..দেখলাম না। আচ্ছা একটা কথা বল তো.. ভালোবাসা, প্রেম, এসব করতে কেমন? আমি তো কখনো করিনাই তাই বুঝতেছি না। “

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে টিয়ার মুখে একটা আলাদা মুগ্ধতা ছেয়ে গেল, যেটা মৌমির চোখ এড়ালো না।

~” ভালোবাসা যে কি জিনিস তা নিজেও জানিনা বুঝলি! আসলে যে ভালোবাসে একমাত্র সেই বুঝবে এর মর্ম। জানিস, যাকে ভালোবাসে মানুষ তার জন্য তখন নিজের জীবন টাও বিপন্ন করতে গায়ে বাধবে না। দিন রাতের সেকেন্ড সেকেন্ড মুহূর্ত সব টাই তাকে ঘিরে ভাবনায় কাটে৷ যেকোনো সুন্দর জিনিস দেখলেই মন চায় তাকে নিয়ে উপভোগ করতে।

নিজের সবচেয়ে দুঃখের সময়ে তার কথাই আগে মনে পড়ে। সুখের সময় গুলোতেও সেম। তার জন্য আলসে মন টাও সবসময় সেজেগুজে থাকতে চায়। তার জন্য নিজেকে আলাদা মাধুর্যতায় সাজাতে ইচ্ছে করে৷ কিভাবে যে তোকে বুঝাই ভালোবাসা কি জিনিস! এর ব্যাপারে যত বলব ততই কম! “

টিয়া থামে। দম নেয় লম্বা করে। তারপর দম ছেড়ে ঠোঁটের কিনারায় হাসি ফুঁটায়। মৌমি টিয়ার দিকে ঝুকে অনুসন্ধানী গলায় বলে,
~” এসব বলার সময় ভাইয়ার কথাই ভাবছিলি তাইনা? “
টিয়া লাজুক হয়ে উত্তর করে,

~” যাকে ভালোবাসি তাকে নিয়েই তো ভাববো! “
মৌমি টিয়ার কথা শুনতেই থেমে যায়। টিয়া না হয় শাওন ভাইকে ভালোবাসে তাই তার কথা ভাবছে। তাহলে মৌমির চোখের তারায় নীলের নীল চোখ জোড়া ভেসে উঠলো কেন?

টিয়াদের বাড়ি থেকে বিকেলের দিকে ফিরে আসে মৌমি। তার ছোট্ট মনটা বড্ড খারাপ আজ। অনেক বার নীলের দেখা পাওয়ার চেষ্টা করেও কাজ হয়নি। কারন নীল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে…


পর্ব ৫

শাওন মৌমিকে চেপে ধরলো,
~” টিয়াদের বাড়ি ছিলি না? ও কি করছে রে? আমার ব্যাপারে কি কি কথা হলো? এই মৌ… মুখে টেপ মেরে না থেকে বল তো..”
মৌমি শাওন কে মারে এক রাম ধমক,

~” ভাইয়া! প্লিজ একটু চুপ হও। আমাদের গল্প করার টপিকের অভাব পড়েনাই যে তোমাকে নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান করবো, ওকে? “
মৌমি গটগট করে নিজের রুমে আসে। ব্যাগ টা ছুড়ে মারে পড়ার টেবিলের উপর।

ওদিকে শাওন ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। মৌমির এরূপ আচরণের কারণ তার মাথায় কোনোভাবেই ঢুকছে না। মৌমির কি হলো? কেন এরকম করলো নিজের ভাইয়ের সাথে?
মৌমি বিছানায় নিজের মাথা চেপে বসে রইলো।

কিছুই ভালো লাগছে না তার৷ কিছুই না। কেন একবার নীল এলো না! এত ঘুম কেনো তার? মৌমির নীলের ঘুমের উপর রাগ জন্মায়।

শাওন একবার ভাবে মৌমির কাছে গিয়ে ওকে দেখে আসবে। আবার ভাবে, দরকার নেই। সময় কাটে৷ সন্ধ্যার দিকে ঘুম থেকে উঠে মৌমি।

চিন্তার বেড়াজালে আটকে কখন যে ঘুমিয়ে গেছিল সে! চোখজোড়া ডলতে ডলতে রুম ছেড়ে বের হলো। মাজেরা বেগম চা বানাচ্ছিলেন। মৌমি জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
~” মা, ভাইয়া কই? “

~” ছাদে বোধহয়। দেখ গিয়ে..” ব্যস্ত গলায় বললেন মাজেরা বেগম। মৌমি ধীর পায়ে ছাদের দিকে পা বাড়ালো।

~” রাত দশটা! খাওয়া দাওয়া করা লাগবে না? ” পরশ একটু কর্কশ কণ্ঠেই কথাটা বলে ওঠে। মৌমি চমকে চোখ খুলে।

চমকানোর জন্য তার শরীর টাও ঈষৎ কেঁপেছে। পরশ আবার বলল, “নিজের প্রতি এর অবহেলা তোমার! কেন? নিজের জন্য না হোক, পেটে যেজন আছে তার জন্য হলেও নিয়ম মাফিক খাবার খেতে হবে। দুপুরের খাবার টাও অল্প খেয়েছ একদম। “

মৌমি নিচুগলায় বলল,
~”আমার খেতে ইচ্ছে করে না। আমার কি দোষ তাতে? “
~” নাহ তোমার দোষ না। দোষ তোমার অবস্থার। এই অবস্থায় মেয়েদের খেতে ইচ্ছা করেনা। এটাই স্বাভাবিক।

তাই বলে খাওয়া বন্ধ করে দিলে চলবে? জোর করে হলেও খেতে হবে। নিজেও বাঁচতে হবে, তাকেও বাঁচাতে হবে। স্যুপ খেতে চাইছিলা না? এই নাও… এবার উঠো। খাবা এখন। “

মৌমি হাকরে তাকিয়ে আছে পরশের দিকে। পরশের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে, না জানি কতবছরের পুরোনো সম্পর্ক তাদের! পরশের একেকটি কথায় কতই না অধিকার, আবদার! মৌমিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে পরশ অপ্রস্তুত বোধ করে। রয়ে সয়ে বলল,

~” এভাবে কি দেখছো? উঠবে না? “
~” উঠবো..”
মৌমি ধীর গলায় বলে উঠে বসে। পরশ তার সামনে স্যুপের বাটিটা রেখে বলে,
~” খেয়ে নাও। আমি আসছি..”
পরশ চলে যেতে চাইলে মৌমি বলে ওঠে, “শুনুন…”
পরশ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
~” কি? “

~” আমার আর আমার বেবিকে নিয়ে এত চিন্তা! কেন? ও তো আমার বেবি, আপনার না। অন্য কারো সন্তান ও..”
মৌমির আগ্রহী গলা। সত্যিই পরশের প্রতিটা আচরণ তার কাছে অদ্ভুতের থেকেও অদ্ভুতুরে….
পরশ কেমন একটা রহস্যময় হাসি প্রদান করলো। বলল,
~” ধীরেসুস্থে খেয়ে নাও।

তারপর আমার গল্প বলব..”
পরশ চলে যায়। মৌমির ছোট্ট মাথায় রাজ্যের চিন্তারা ভর করেছে। কি গল্প? কি? পরশের জীবনেও মৌমির মতো ঘটনা আছে কি? নাহ! এটা হওয়া সম্ভব না। মৌমির সাথে যা ঘটেছে, তা একটি মেয়ের সাথেই ঘটতে পারে। ছেলের সাথে না। প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম ~ নীতি আছে তো!

মৌমি ঝটফট খাওয়া শেষ করে। রেহানা চৌধুরী একবার এসে বউকে দেখে যান। টুকটাক দুটা কথা বলে তিনি ঘুমাতে চলে যান। আলতাব চৌধুরী ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আজকে সবার উপর দিয়েই কম বেশি ধকল গেছে।

মৌমি একা হয়ে পড়লে পরশ রুমে ঢুকে। দরজা আটকে দিয়ে মৌমির সামনাসামনি আসতেই, গভীর আগ্রহে মৌমি বলল,
~” আপনার গল্প বলুন এবার..”

পরশ আবার সেই রহস্যময় হাসি দিল। এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
~” এর ইচ্ছা আমার গল্প শোনার? “

~” জি। বলুন না..”
~” একটা নারীর নারীত্বই যেমন তার কাছে মূল্যবান, মর্যাদাপূর্ণ, একজন পুরুষের কাছেও তার পুরুষত্ব তেমন! তুমি তো মা হতে পেরেছ, কিন্তু আমি কোনোদিন বাবা হতে পারব না।

ইয়েস, আই এম টেলিং দ্য ট্রুথ। আমি কোনোদিন ভাবিনি আমার জীবনে কেউ জড়াবে! অথচ তুমি জড়িয়েছো। সাথে আরেকজন জড়িয়েছে! এই দুজনকে নিয়েই আমি পৃথিবীর আলো দেখতে চাই। পৃথিবীর মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে চাই। তাই তুমি আর ও, দুজনেই আমার কাছে সমান ইম্পর্ট্যান্ট। “

একশ্বাসে কথাগুলো বলে হাপিয়ে ওঠে পরশ। তাই থামে সে। জিরিয়ে দম নেয়। মৌমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। পরশের চোখ কোণায় চিকচিক নোনাপানির রেখা…. মৌমি আচমকা বলে ওঠে,
~” কাঁদবেন না, প্লিজ..”

পরশ নাক টেনে চোখে চলে আসা পানিটুকুও চোখ দিয়ে শুষে নেয়। কান্না আটকায়। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে,
~” থাকবা আমার সাথে? আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত? “
মৌমি মুখে অস্পষ্ট হাসি ফুঁটিয়ে বলল,
~” কেন নয়? “


পর্ব ৬

(বর্তমান)
সামনে বসে থাকা মেয়েটার দিকে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে নীল। মেয়েটার নাম মেঘা। নীলের চেয়ে বয়সে সাত বছরের ছোট। এত পুচকে একটা মেয়ের সমন্ধে নীলের খারাপ বৈ ভালো কোনো ধারণা হচ্ছে না।

মেঘা নিজেকে গুটিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার কপালে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনেকগুলো ভাঁজ পড়া। চোখে ভয়। নীল গলা খ্যাঁক করে বলে উঠলো,
~” তোমাকে কতদিন মানা করেছি আমাকে ফলো না করার জন্য? “
মেঘা কিছু একটা ভেবে বলল,
~” নয়দিন মানা করেছিলেন। আমি গুণে রেখেছি। “
নীলের রাগ ক্রমেই বাড়তে থাকে।

~” ফাজলামি করো? এই মেয়ে? হাটুর বয়সি তুমি আমার। লজ্জা করেনা নিজের বড় ভাইয়ের সমান কাউকে লাভ ইউ বলতে? তার পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতে? “

মেঘা মুখ তুলে নীলের চোখে চোখ রাখে। বলে,
~” আপনি তো আর আপন বড় ভাই না। বা দূর সম্পর্কের কেউ না। আপনাকে চিনিই দশদিন যাবত!

তো লজ্জা করবে কেন? “
~” তোমার স্পর্ধা তো কম না। ভালোই তর্ক জানো! “
~” হবু বয়ফ্রেন্ড কে শাসানো স্পর্ধার মধ্যে পড়েনা। “

~” কীহ! ” নীলের চোখ রসগোল্লার সাইজ হয়। লাফিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তা দেখে মেঘাও দাঁড়িয়ে যায়।

তার মুখ থেকে ভয়ের রেখা চলে গেছে। সেখানে একধরণের দুষ্টুমির রেখা ফুঁটে উঠেছে। নীল কিছু বলার আগেই মেঘা বলল,

~” লিখে রাখুন, একদিন আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড হবেনই। আমাকে একদিন ভাল বাসতেই হবে আপনার। আজ যাই…”
মেঘা হাই হিল জুতার গটগট আওয়াজ তুলে চলে যায়। নীল ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটাকে আর একবার দেখুক তার আশেপাশে, চড় মেরে গা যদি না ফাটিয়ে দেয়, তবে নীলের নাম সে নিজেই পাল্টে ফেলবে!


(অতীত)

সকাল সকাল টিয়াদের বাড়ি গিয়ে হাজির হয় মৌমি। নীলকে একবার দেখার আশায়। সারারাত ভেবে আবিষ্কার করলো, তার কিশোরী মন একগুচ্ছ শুভ্র ভালোবাসার অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

আর সেই শুভ্র অনুভূতির মালিক, একমাত্র নীল…
কিন্তু টিয়া বলল, “নীল ভাইয়া কাল রাতেই ঢাকায় ফিরে গেছে। তার এক ক্লোজ বন্ধু ভীষণ অসুস্থ তাই..”
কথাটা শুনতেই মৌমির মনে নেমে আসে বিষন্নতা। চোখ গুলো ভিজে উঠে মনের অজান্তেই। টিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
~” কাঁদছিস কেন?

কি হলো তোর? “
মৌমি উত্তর দিতে পারে না। টিয়ার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদে। টিয়া হতবিহ্বলের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। মৌমির এরূপ আচরণ করার কারণ টা খুঁজে পায় না।

একসময় মৌমি শান্ত হয়। টিয়ার বুক থেকে মাথা তুলে চোখের জল মুছে ফেলে। গলার স্বর একদম স্বাভাবিক করে বলে,
~” স্কুল যাবি না?

চল..”
টিয়া মৌমির থুতনিতে হাত দিয়ে, মুখটাকে উঁচু করে তোলে। অনুসন্ধানী গলায় জিজ্ঞেস করে,
~” তোর কি হইছে।

আমাকে বল..”
মৌমি মাথা এদিক ওদিক নাড়ায়। দূর্বল গলায় বলল,
~” কিছুনা। “
টিয়া জোর দেয়,
~” আমার কসম! “

মৌমি চুপসে যায়। অসহায় চোখে টিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। টিয়া ফের জোর দিয়ে বলে,
~” কি? বল…”
মৌমির বুকচিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পিছলে বের হয়। অনুতপ্ত গলায় বলে,

~” নীল ভাইয়াকে নিয়ে নিজের অজান্তেই আমার মন ভাবতে শুরু করেছে। কি করব আমি বল? “
টিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। চেঁচিয়ে বলে,
~” কিহ! “

মৌমি চুপ করে থাকে। টিয়া সময় নিয়ে স্বাভাবিক হয়। পুরো বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে,
~” তুই কি ভাইয়াকে পছন্দ করিস? “
মৌমি নিচুগলায় বলল,
~” মেবি! “

টিয়ার ভেতরটা খুশিতে ভরে উঠে। সে মৌমির হাত দুটো চেপে ধরে খুশি খুশি গলায় বলে উঠে,
~” আমি ব্যবস্থা করে দেই? ভাইয়ার সাথে কথা বলবি? “
মৌমি ভীষণ ভাবে চমকালো।

সে টিয়ার থেকে এমন আচরণ আশা করেনি। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে টিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। টিয়া সেই প্রশ্ন বুঝতে পেরে বলে,
~” আমি বুঝেছি তোর প্রশ্ন। কাকে কখন কার চোখে ভাল লেগে যাবে, সেটা কেউ বলতে পারেনা।

সেই ভাল লাগা আটকানোর জন্য আমি কে? ভাবিস না তোর ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আছে তাই আমি তোর টাও এক্সেপ্ট করছি! যদি আমার আর শাওনের সম্পর্ক নাও থাকতো তবুও আমি তোকে সাপোর্ট করতাম। কারণ আই লাভ ইউ..”
মৌমির চোখ খুশিতে ভরে উঠে। টিয়াকে ঝাপটে ধরে কেঁদে ফেলে সে। ভাঙা আওয়াজ তুলে বলে,
~” লাভ ইউ ঠু…. ইউ আর দ্য বেস্ট.
..”
স্কুল শেষে দুই বান্ধুবী বাসায় ফিরে আসে। টিয়া নীলের নাম্বার টা জোগাড় করে মৌমিকে একটা কাগজে লিখে দেয়। মৌমি নাম্বার নিয়ে খুশিমনে বাড়ি ফিরে আসে।

টিয়া শিখিয়ে দিয়েছে রাতে ফোন দেবার জন্য। যেকোনো বাহানায় দুটো কথা বলার জন্য। কথা বলতে বলতেই একে অপরের কাছাকাছি আসা যাবে একসময়…
রাতে খাবার পর, মৌমি শুয়ে পড়ে নিজের রুমে। সাথে রেখেছে মায়ের ফোনটা। কিন্তু মাজেরা বেগম খানিক বাদে এসেই মৌমিকে জিজ্ঞেস করলেন,

~” আমার ফোন টা পাচ্ছি না। আমার ফোন কি তোর কাছে? “
মৌমি বিরক্ত মুখে বলল,
~” হু আমার কাছে। “
~” দে তো…”

~” কেন? “
~” আমার দরকার তাই! “
~” আজকে আর দরকার লাগবে না কোনো তোমার। আমার কাছেই থাকুক। আমি এফএম শুনবো। “

মাজেরা বেগম তবুও বললেন, “পরে শুনিস। দে…”
মৌমি চেঁচিয়ে বলে,
~” নাহ। বললাম তো আজ শুনবো। “
মাজেরা বেগম হতভম্ব হয়ে পড়লেন।

মেয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে চলে গেলেন রুম থেকে। মৌমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। মৌমির চিল্লানি শাওনের কানেও যায়। সে মৌমির ঘরের দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু মাকে মৌমির রুম থেকেই বের হতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
~” ও এভাবে চেঁচালো কেনো মা? “

মাজেরা বেগম উত্তপ্ত মেজাজে বললেন,
~” জানিনা। ফোন চাইলাম। দিলো তো না, উল্টা চেঁচালো! “
~” ওর ফোন দিয়ে কি কাজ? “
~” কিসের রেডিও শুনবে নাকি! “
শাওন আনমনে বলল,

~” ইদানীং ওর জানো কি হইছে। শুধু শুধু রিয়েক্ট করে বসে! “
নীল মাত্রই বাসায় ফিরেছে। তার বন্ধু সাদিক বাইক এক্সিডেন্ট করে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছে।

একব্যাগ রক্তও দিয়েছে নীল তাকে। হাসপাতাল থেকে আসতেই ক্লান্ত শরীর টা বিছানায় এলিয়ে দিল। ঠিক তখনি ফোনটা বেজে উঠলো। নীল ফোন বের করে দেখলো, আননোন নাম্বার। রাত বাজে সাড়ে এগারোটা। এত রাতে আননোন নাম্বার থেকে কল! নীল রিসিভ করলো,
~” হ্যালো..”
নীলের মোটা পুরুষালী কণ্ঠ শুনেই মৌমির বুকের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়। রগে রগে ছড়িয়ে পড়ে শিরশিরানি। পাজরে পাজরে ধরে কাঁপন। মৌমি তাৎক্ষণিক কোনো কথা বলতে পারলো না। সাময়িক ভাবে বোবা হয়ে গেল সে।

নীল ভ্রু কুঁচকে আবার বলে উঠে,
~” হ্যালো… কে বলছেন? “

মৌমি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
~” হ্য~হ~হ্যা~ল~লো..”
নীলের কুঁচকে যাওয়া ভ্রু আরো কুঁচকে গেল। গলায় বিষ্ময় ঢেলে বলল,
~” কে? কে আপনি? “
মৌমি পূর্বের ন্যায় কাঁপা গলায় বলল,
~” আমি…আমি মৌমি। “
~” কোন মৌমি? “

মৌমি এরপর কি উত্তর করবে বুঝতে পারল না। দ্রুত ফোনের লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে ফেলে। নীল আবার ডায়েল করে একই নাম্বারে, কিন্তু নাম্বার বন্ধ।

নীলের বিগড়ে যাওয়া মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। এটা নিশ্চয়ই রিমঝিমের কাজ! নীল মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, কালকেই ভার্সিটি গিয়ে রিমঝিম কে একটা উচিত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।


পর্ব ৭

সারারাত নীলকে নিয়ে জল্পনায় কেটেছে মৌমির।

ঘুমের পরিমাণ হয়েছে কম। তাই সকালে সময় মতো উঠতে পারলো না। এমনকি মাজেরা বেগম এসে অনেক ডাকাডাকি করলেন তাও মৌমি উঠলো না। মাজেরা বেগম বেশ রাগী গলাতেই তখন বললেন,
~” সারারাত রেডিও শুনার কুফল এটা। আজ থেকে ফোন চাইস, দিবোনি পিঠের মধ্যে! “

কথাগুলো মৌমির কান দিয়ে ঢুকেও ঢুকলো না। সে পূর্বের মতোই মরাঘুমে আচ্ছন্ন। দেড়িতে উঠার ফলে স্কুল মিস… মৌমি ছাদে নিভুনিভু চোখ নিয়ে দাঁড়ায়। উত্তর পানে মুখ করে মুক্ত বাতাসে নিজেকে সিক্ত করে নিতে নিতে মুখে ব্রাশ তুলে নেয়। এমন সময়ে পেছন থেকে শাওন ডাকে,

~” মৌ..”
মৌমি পেছন ঘুরে তাকায়। শাওন কে দেখা মাত্রই চোখমুখ কেমন যেন বিকৃত করে ফেলে। বিরক্ত গলায় বলল,
~” কিহ? “
শাওন অত্যাশ্চর্য হয়ে বলল,
~” তোর কি হইছে বল তো।

কেমন কেমন জানি করোস তুই! ইদানীং কারো সাথেই ভালো ব্যবহার করিস না। আবার আমাদের উপস্থিতিও সহ্য করতে পারিস না। “
মৌমি মুখ ভর্তি ফেনা নিয়ে বলে,
~” কিছুনা। “

~” মুখ থেকে ফেনা ফালা। সুন্দর ভাবে কথা বল। “
মৌমি ফেনা ফালায় ঠিকই, কিন্তু সুন্দর ভাবে কথা বলে না। উল্টো তেঁতে বলে,
~” সমস্যা কি ভাই তোমার? তোমার জ্বালায় ব্রাশ টাও করা যাবে না নাকি! “

~” আজিব! জ্বালালাম কই! আমি তোকে আস্ক করলাম জাস্ট। “
~” যাও তো…কথা বলার মুড নাই আমার। “
শাওন ভারী ক্ষেপে গেল। রাগী স্বরে বলল,
~” এক চড়ে সব কয়টা দাঁত ফালায় দিব। বেয়াদব মেয়ে! “

মৌমি মুখ ভেংচি মেরে বলে,
~” তাহলে তোমার সিক্রেট টাও সবাই জেনে যাবে। “
~” এইজন্যেই তোকে জানাতে চাইনাই। এখন এগুলা নিয়াই ব্ল্যাকমেইল করবি আমাকে। “

~” বুঝছো যখন, বলতেছো ক্যান? সরো.. ফ্রেশ হবো আমি। টিয়াদের বাসায় যাব। “
~” ও স্কুলে..”
~” জি না.. ও বাসায়। আমি না গেলে ও কোনোদিনও স্কুল যায় না। “

রিমঝিম ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকা মনে টোনার ক্যাম্পের দিকে আগায়। একজন এসে বলে গেল, নীল নাকি তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। ব্যাপার টা খুব অদ্ভুত। বেশ কিছুদিন যাবত হাত ধুয়ে নীলের পিছনে পড়েছে রিমঝিম। নীল কে যেই দেখবে সেই ফিদা হবে।

এত্ত কিউট ও! আর চেহারায় ইনোসেন্ট ভাব স্পষ্ট। কিন্তু নীল কোনো এক বিশেষ কারনে কাউকেই পাত্তা দেয়না। কোনো মেয়ের প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে না৷ হয়তো ওর এই বিশেষ কারনের জন্যেই মেয়েরা আরো বেশি পাগল হয়ে যায় ওর প্রতি….

নীল একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিল। রিমঝিম কে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়ালো। রিমঝিমের পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। যেন পৌষের তীব্র শীতে ধরেছে তাকে।

হাটার গতি শ্লথ করে স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে। নীল~ই এগিয়ে আসে। মুখে শক্ত ভাব তার।
রিমঝিম মিইয়ে যাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে,
~” কি জন্য ডেকেছেন? “

নীল সেকথার জবাবে রিমঝিম কে ঠাটিয়ে একটা চড় মারে। পুরো ক্যাম্পের সবাই স্তব্ধ। যে যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। যে যে কাজ করছিল, সব ফেলে স্থির হয়ে গেল।

রিমঝিম প্রচন্ড শক খেলো। বিষ্ময়ে চোখ দুটো গোলগোল হয়ে গেলো। ঠিক তখনি তার বিষ্ময় আরো বাড়াতে নীল দ্বিতীয় চড় টা মারে। রিমঝিম দুগালে হাত চেপে ফুঁপিয়ে উঠে। নীল আক্রোশে ফেটে পড়া গলায় বলে,
~” ভার্সিটিতে আসো ছেলে পটানোর জন্য? এতদিন ভার্সিটির ভেতরে যা করছো, তার জন্য ক্ষমা করা যায়।

কিন্তু ফোন নাম্বার নিয়ে সিনিয়র দের হয়রানি করো? এই মেয়ে এত সাহস কে দিয়েছে তোমাকে? নেক্সট টাইম যদি আর কখনো আমার নাম্বারে তোমার ফোন আসে, তবে দুটার বদলে চারটা চড় খাবে। মনে থাকে যেন।

গো…লিভ নাও..”
নীল ধমকা ~ ধমকিতে রিমঝিম চুপসে যায়। ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে না গিয়ে। মাথায় ঘুরছে অন্য কথা। সে কখন নীলকে ফোন করলো? তার কাছে তো নীলের নাম্বারই নাই।

রিমঝিম সাতপাঁচ ভাবনা থামিয়ে বুকে সাহস নিয়ে ধীর গলায় জানতে চায়,
~” আমি কখন ফোন দিলাম আপনাকে? আমার কাছে আপনার ফোন নাম্বার তো নাই। “

নীলের চোখ বড়বড় হয়। চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
~” ফাজিল মেয়ে। আবার মিথ্যা বলো? আরো দুইটা খাওয়ার শখ জন্মাইছে? “
রিমঝিমের চোখের পাতা ভিজে জুবুথুবু হয়ে যায়। সে আকস্মিক ভাবে কোনো কথা বলতে পারেনা।

আশেপাশের সবাই কেমন ভাবে তাকিয়ে আছে। রিমঝিমের ইচ্ছে করছে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে। মনে প্রাণে দোয়া করছে সে, যেন ধরণী মাতা তার মাটি ফাকা করে দিয়ে রিমঝিম কে ভেতরে ঢুকতে আহ্বান করে…
রিমঝিম নিজেকে সামলায়।

কেঁদে ফেলে সবার সামনে নিজেকে আরো ছোট বানাতে চায়না। মুখ তুলে লম্বা শ্বাস নেয়। থেমে থেমে বলে,
~” আমি সত্যিই কাল ফোন দেইনি আপনাকে। আমার কাছে আপনার নাম্বার নেই।

তবুও কিসের জন্য এরুপ করলেন আমি জানিনা। “
রিমঝিম ঘুরে দাঁড়ায়। এক ছুটে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যায়। নীল হাতের ইশারায় একটা ছোট্ট ছেলেকে কোল্ড ড্রিংকস দিতে বলে। নীলের বন্ধুরা ওকে ঘিরে দাঁড়ায়। আসিফ বলে,
~” ভাই, ঠিক করলি কাজ টা? হোক জুনিয়র।

তবুও… মেয়ে মানুষ। “
নীল কোল্ড ড্রিংকসের মুখে চুমুক লাগিয়ে বলে,
~” আমি একবার ভেবেই কাজ করি। দ্বিতীয় বার কোনো কিছু ভাবার টাইম নাই। “

রনি তাই শুনে জবাবে বলল,
~” এই একবার ভাবনা টাই তোর জীবনে কোনোদিন কাল হয়ে দাঁড়াবে। দেখিস..”

রিমঝিম বাথরুমের দরজা আটকে কাঁদছে। কি যন্ত্রণাদায়ক সেই কান্না! এর আগে এত অপমানিত সে কখনো হয়নি। কখনো না….
রোজা, বিথী, লামিয়া বাথরুমের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

রোজা ক্রমাগত দরজায় আঘাত করে চেঁচিয়ে বলছে,
~” রিঝি, একবার খোল দরজা টা। প্লিজ দোস্ত…একবার দরজা টা খোল। “
ওপাশ থেকে রিমঝিমের এই বিষয়ে সাড়া শব্দ নেই কোনো। সে কেঁদেই যাচ্ছে।

রোজা আবারো দরজায় আঘাত করে একই কথা বলে। বিথী রোজার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,
~” দোস্ত থাম। ওকে ওর মত ছাড়। ও অনেক হার্ট হইছে। আমরা ওকে এখন প্রেশার না দিই। “

রোজা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
~” কুত্তার বাচ্চা একটা!

সিনিয়র আর একটু সুন্দর হইছে দেইখা মাথা কিনা নিছে। মাইয়া গো গায়ে হাত তুলতেও গায়ে বাধে না। “
লামিয়া মাঝ দিয়ে বলল,
~” ডিপার্টমেন্ট ডিনের কাছে বিচার দিব? কি বলিস? “
বিথী বলল,

~” লাভ নেই। নীল ভাইয়ের গ্যাং অনেক বড়। ভার্সিটির অর্ধেক প্রোগ্রাম তাদের আওতায় থাকে। দেখিস না, প্রফেসররাও নমো নমো করে চলে ওদেরকে। “

~” তো? তাই বলে বিনা কারনে রিমঝিমের সাথে এরকম করবে সেটা আমরা মেনে নিব? এগুলা মেনে নেওয়া যায়? আলাদা ভাবে বলতো বা একলা এক জায়গায় তো না হয় বাদ দিতাম। কিন্তু সবার সামনে। পুরা ভার্সিটি জানাজানি হয়ে গেছে, জানিস। ” তেঁতে বলল রোজা।
~” আমরা কি করতে পারি বল?

যদি করার কিছু থাকতো অবশ্যই করতাম৷ আমরা তো ওর বন্ধু৷ নাকি? কিন্তু আসলে তো করার কিছুই নাই রে। নীল ভাইয়ার বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে আমাদের সাহায্য কেউ~ই করবে না। বরং হল ছাড়া হবো। “

রোজা, লামিয়া, বিথী, সকলেই সমস্বরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ক্ষমতাবানদের সাথে পেরে উঠা, খুবই কষ্টকর….
বাথরুমের ভেতর থেকে ওদের তিনজনরেই কথোপকথন শুনলো রিমঝিম। তার কান্না থেমে এলো।

ক্ষত হওয়া বুকটা আরো ক্ষত হলো। ভেবেছিল নীলকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়াবে। কিন্তু…

তবে কি এই অপমানের ভার কাধে বয়ে বেড়াতে হবে চিরকাল?
রোজা, বিথী, লামিয়া অনেক চেষ্টা করেও রিমঝিম কে বাথরুমের ভেতর থেকে বের করতে পারে না। তাই তারা ব্যর্থ মনে চলে যায়। থাকুক মেয়েটা একা। নিজের কষ্ট নিজেই সামলে উঠুক…
ওরা চলে গেলে বের হয় রিমঝিম।

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল কেউ আছে কিনা৷ নাহ, কেউ নেই। রিমঝিম সুযোগ পেয়ে লনে গিয়ে দাঁড়ায়। লনে গ্রিল নেই। রিমঝিম দোতালার লন থেকে নিচের দিকে এক পলক তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে তার বুকটা কেঁপে উঠে। এখান থেকে পড়লে মৃত্যু ছাড়া উপায় নেই।

আত্মহত্যা মহাপাপ, অথচ মৃত্যু ছাড়া গতিও নেই। এত অপমান নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারেনা। রিমঝিম চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। কয়েক সেকেন্ড থেমে লাফিয়ে পড়লো নিচের দিকে…

দুম করে কিছু একটা পড়ায় মাঠে উপস্থিত সবাই সেদিকে ছোটে। কি পড়লো, কি পড়লো? সবার ভেতর আগ্রহ। সকলে জায়গা টায় উপস্থিত হতেই সবার শিরদাঁড়া বেয়ে টপটপ করে ঘাম নামলো। রিমঝিম!

রিমঝিমের মাথা ফেটে গেছে। নাক থেতলে গেছে। হাত পায়ের হাড্ডি ভেঙেছে। অবস্থা বেগতিক তার। কয়েকজন ছেলে রিমঝিম কে ধরাধরি করে একটা কাঠের তক্তার উপর শোয়ায়। তারপর তারা ছোটে হাসপাতালের দিকে….

এত ঘটনা ঘটে যাওয়ার মাঝে নীল তখনো টোনার ক্যাম্পাসেই ছিল। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত সে। ঠিক তখনি একটা হই হুল্লোড় ভাব শুরু হলো সব ছাত্র ~ ছাত্রীদের মাঝে। সবাই~ই কিছু একটা শুনে ছুটে যাচ্ছে। নীল রনি কে বলল,
~” কি হইছে? গিয়ে জেনে আয় তো। “

রনি আদেশ পালন করল। কতকজন ছেলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো ঘটনা কি। তাদের থেকে রিমঝিমের সুইসাইড সম্পর্কে শুনে রনির মাথা ঘুরে গেল। সেও হতভম্বের ন্যায় ছুটে এলো। হাপাতে হাপাতে বলল,

~” দোস্ত, রিমঝিম সুইসাইড করছে। দোতালা থেকে লাফ দিছে। “
নীল সহ বাকি সবাই সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। নীল ভারী চমকিত গলায় বলল,
~” কিহ! “

টিয়া বাড়িতেই ছিল। মৌমি টিয়াকে দেখে দীর্ঘ হেসে বলল,
~” আমি জানতাম তুই স্কুল যাসনাই। “

~” তুই আসিস নাই দেখেই যাইনাই। সারারাত কথা বলছিস নাকি ভাইয়ার সাথে? সকালে উঠতে পারিস না ক্যান? “

এহেন প্রশ্নে মৌমির মুখ ভোঁতা হয়ে গেল। বলল,

~” কচু কথা বলছি। একটুখানি কথা বলছি। সে জিজ্ঞেস করছে কোন মৌমি। আমি আর কি উত্তর দিব ভেবে না পেয়ে লাইন কেটে দিছি। “
টিয়া একগাল হাসে।

~” তোর দ্বারা প্রেম সম্ভব না। “
মৌমি মুখ ভেংচে বলে,
~” আর তোমার দ্বারা খুব সম্ভব? না? “

লেখা – মাজফুজা মনিরা

চলবে

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “গল্পটি অসমাপ্ত (১ম খণ্ড) – নতুন প্রেমের উপন্যাস” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – গল্পটি অসমাপ্ত (শেষ খণ্ড) – বাংলা প্রেমের উপন্যাস

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *