সেলফাইটিস – সেলফি আসক্তি ভয়াবহ মানসিক রোগ: স্মার্টফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরা আর সোশাল মিডিয়া আমাদের জীবনকে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। সময় কাটানোর জন্য এখন বেশির ভাগ তরুণরা এগুলোকে প্রথম সারিতে রেখে দিয়েছে। কিন্তু কথায় আছে ‘এভরি ইফেক্ট হ্যাস এ্যা সাইডইফেক্ট’ আর এটা এটোতাই ভয়াবহ একটি মানসিক রোগের জন্ম দিয়েছে, যেটা প্রতি মুহুর্তে অসংখ্য প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে।
বলছিলাম সেলফাইটিস বা সেলফি রোগের কথা। বলতে গেলে সবারই এই রোগটা আছে। তবে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিকতার উপর ভিত্তি করে একে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়।
প্রথমত, বর্ডার লাইন সেলফাইটিস, যারা দিনে অন্তত তিনটি সেলফি তোলে কিন্তু সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করে না। দ্বিতীয়ত, একিউট সেলফাইটিস, যারা দিনে অন্তত তিনটি সেলফি তোলে এবং তিনটিই পোস্ট করে। তৃতীয়ত, ক্রনিক সেলফাইটিস, যারা লাগামহীন ভাবে দিনে কমপক্ষে ছয়টি সেলফি তোলে এবং কিছুক্ষণ পরপর পোস্ট করে।
সেসেলফাইটিস রোগ কি এবং কেন হয়?
এরা যদি একদিন সেলফি না তুলতে পারে তাহলে প্রচন্ড মন খারাপ করে। বলতে গেলে সেলফি না তুললে তার ভালই লাগে না।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, না হয় সেলফি তুললাম, শেয়ারও করলাম তাতে সমস্যা কি? বা রোগ কেন?
আছে অনেক সমস্যা আছে। আপনি যত সেলফি তুলবেন তত নিজের ফেস দেখবেন আর ততই খুঁত খুঁজে পাবেন, অন্যের সাথে তুলনা আসবে, আফসোস হবে, মন খারাপ হবে। তখন আরো স্টাইলিশ হট লুকিংয়ের জন্য এডিটিং করবেন, সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে ইচ্ছা হবে। ওয়াও এত লাইক, লাভ রিয়াক্ট আর সুন্দর সুন্দর কমেন্ট, ইনবক্স জ্যাম হয়ে গেছে, নিজেকে বেশ দামী কেউ একজন মনে হবে।
ব্যাস, আপনার আত্মবিশ্বাসও জ্যামে আটকে গেল। ধীরে ধীরে আপনি বিশ্বাস করে নিবেন যে আসল ছবির মূল্য নেই, একটু স্টাইল করে ছবি তুলতে হবে, জোস একটা এডিটিং দিতে হবে। এভাবে প্রতিবার আরো বেশি ভালো করে সেলফি তোলার চেষ্টা করবেন, বেশি লাইক-কমেন্ট পাওয়ার আশায় সেলফি তুলতে তুলতে সেলফি আসক্তি ধরে বসবে।
যারা বাস্তবে তেমন মূল্যায়ন পায় না, বন্ধুমহলে অবহেলিত হয় এবং নিজের একাকীত্ব নিয়ে বিষন্ন একমাত্র তারাই এই সেলফি নেশায় ডুবে যায়। নিজেকে মূল্যায়িত করতে, আর একাকীত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে সে সোশাল মিডিয়ায় নিজেকে প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
একটা ভার্চুয়াল দুনিয়ায় প্রবেশ শুরু হয়, যেখানে অনেক কম্পিটিশন। আর টিকে থাকার লড়াইয়ে ভয়ানক সব স্টান্ট হয়।
জীবনে রিস্ক নিয়ে হলেও এমন সব সেলফি তোলার ইচ্ছা হবে, যা ভাইরাল করতে মন চাইবে। আর এমন সব ভয়ানক রিস্ক নিয়ে শুধুমাত্র ভারতেই ২০১৯ সালে ২৬০ জন মানুষ বিভিন্ন এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। তাহলে সারা বিশ্বে কত হবে ভাবুন!
সেলফি পাগলদের জীবন
সেলফি আসক্তিরা সবচেয়ে যে জিনিসটি হারিয়ে ফেলে তা হল আত্মবিশ্বাস এবং বাস্তবতা। আর সেলফি শেয়ার করে সোশাল মিডিয়াতে যে সময় সে অপচয় করে তার জন্য দিনশেষে সে প্রচন্ড হতাশায় ভুগে। ক্রনিক সেলফাইটিসে আক্রান্ত সব মানুষ ডিপ্রেশনের চূড়ায় অবস্থান করে, আর বেশিরভাগই জীবনে কোন না কোন সময় সুইসাইড এটেম্ট করে। এই মানুষগুলো প্রচন্ড মাত্রায় আবেগী হয়, একটা অচেনা মানুষ যদি বাজে কমেন্ট করে তাহলে এটা নিয়েই তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। বলতে গেলে তার জীবনের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকে না, সোশাল মিডিয়া ও ভার্চুয়াল বন্ধুরা নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে ব্যক্তিত্বহীন ও অসহায় করে তোলে।
নিজেকে প্রমোট করা আর অন্যকে দেখানোর নেশায় সে মনের অজান্তেই নিজের প্রাইভেসি ভেঙ্গে ফেলে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বন্ধুত্ব তৈরী করে, যারা সুযোগ পেলেই তাকে নিয়ে হাস্যরসের কোন উপকরণ বানিয়ে ফেলে। ফলে মানুষের প্রতি বিশ্বাস উঠে যেতে শুরু করে, নিজেকে একসময় আর ভালো লাগে না, তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সেও ফেক আচরণ শুরু করে।
সেলফি আসক্তি থেকে বাঁচার উপায়
যারা এটাকে উপলব্ধি করে এবং কাজে ব্যস্ত থাকে তারা ধীরে ধীরে এমনিতেই এই মানসিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসে কিন্তু যারা পারে না, তাদের জীবনটা দূর্বিসহ হয়ে উঠে। সম্পর্কের টানাপোড়ন আর কাজের অনীহায় সে জীবন থেকে অনেক কিছু হারাতে শুরু করে, যা পরবর্তীতে ডিপ্রেশন থেকে শুরু করে আরো নতুন কোন মানসিক রোগের সৃষ্টি করে যার মধ্যে ইন্সোমেনিয়া বা ঘুমের সমস্যা অন্যতম। কারণ সেলফি পাগলরা রাত জাগতে এবং অনিয়ম করতে ভালবাসে। যেহেতু মুখ তাদের প্রধান বিষয় তাই মেদ জমানোর ভয়ে না খেয়ে থাকার একটা বদ অভ্যাস তৈরি হয়। শারীরিক ও মানসিক ভাবে সে অনেক দূর্বল হয়ে পড়ে, যার ক্ষতি পূরণে অনেক কিছু হারাতে হতে পারে।
আমাদের উচিত যে কোন কাজ বা বিষয় যখন নেশায় আশক্ত হতে থাকে তখন মাঝে মাঝে গ্যাপ দিয়ে দেয়া, যা অভ্যস্ততা থেকে আমাদের বাঁচায়, যেমন- ফেসবুক আসক্তি মনে হলে দু-তিন দিনের জন্য একেবারে অফ রাখা। এভাবে শুরু থেকেই যদি আমরা অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে কষ্টও কম, আর অভ্যাস আমাদের দাসও করতে পারবে না।
আশা করি, সকলে বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পারবেন, আপনার বন্ধু-বান্ধব যেন এই সেলফির মত ভয়াবহ কোন আসক্তির পথে পা না বাড়ায় এজন্য তাকে সময় দিন, যত্ন নিন। একমাত্র আপনার মূল্যায়ন ও ভালোবাসাই পারে এই ডিপ্রেশন জগত থেকে ফিরিয়ে আনতে এবং একে জয় করতে।।
লেখা- Nerjhor