সিজোফ্রেনিয়া

সিজোফ্রেনিয়া – অদৃশ্য সাইকোর মানসিক জগতের গল্প | Schizophrenia

সিজোফ্রেনিয়া – অদৃশ্য সাইকোর মানসিক জগতের গল্প: ছোটবেলায় বাংলা সিনেমায় যখন দেখতাম নায়ক তার নায়িকা হারিয়ে পাগল প্রায়, তখন অনেক খারাপ লাগত তার জন্য কিন্তু যখন দেখতাম সে তার নায়িকার সাথে কথা বলছে, দেখছে, স্পর্শ করছে কিন্তু বাকিরা কেউ তা দেখছে না। তখন তাকে সবাই পাগল ভাবা শুরু করে। আমিতো তখন কষ্ট ভুলে হেসে মরি। ভাবি এরকম রূপকথা কে যে লেখে!

সিজোফ্রেনিয়া কি?

পাঁচ বছর আগেও এটাকে পুরো রূপকথা ভাবতাম কিন্তু একদিন পত্রিকায় যখন দেখলাম যে এটা একটা মানসিক রোগ, যার নাম সিজোফ্রেনিয়া এবং এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাংলাদেশে ১০ লাখ, এখন হয়তো ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। হয়তো ভাবছেন কই এরকম মানুষ তো দেখি না! কিভাবে এতগুলো হয়!

হুম, আছে, আপনার চারপাশেই আছে। কিন্ত আমরা এগুলো ভিন্ন নাম দেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা এদের পাগল বা ভূতে ধরা বলে চালিয়ে দেই। কারণ অদ্ভুত ও অবাস্তব আচরণ এ রোগের মূল লক্ষণ। সিজো আক্রান্ত মানুষ মনে করে তার ঐশ্বরিক পাওয়ার আছে, সে সবার থেকে আলাদা, তার দ্বারা পৃথিবী উপকৃত হবে, পৃথিবীর মানুষ সবাই ভুল পথে আছে।

এজন্য সে অনেক কিছু বলার ও করার চেষ্টা করে, কিন্ত যখন সে দেখে যে কেউ তার কথার মূল্যায়ন করছে না বরং পাগল ভাবছে তখন সে একা হয়ে যায়। কল্পনায় ভাসতে থাকে, ভাবতে ও আশা করতে থাকে কেউ তার কথাগুলো বুঝবে, তার কথার সাথে একমত হবে। এমতাবস্থায় সে যদি প্রিয়জন হারার কোন শকড পায় তখন কল্পনায় এত বেশি তাকে চাওয়া ও ভাবা শুরু করে যে ব্রেন আর অন্যকাজে ফোকাস না করতে পেরে তার এই কল্পনাকেই সাজাতে থাকে, ব্যাস শুরু হয় ব্রেনের অদৃশ্য খেলা। ঠিক যেমন আমরা স্বপ্ন দেখার সময় বাস্তব ভাবি।

আপনি স্বপ্নে দেখেছেন আপনার  বিয়ে হয়েছে, দুই তিন হালি বাচ্চাও হয়েছে, এটা কিন্তু সত্য এবং আপনি অবশ্যই দেখেছেন কিন্ত তা চোখ দিয়ে না, ব্রেনের ভিজুয়াল সিস্টেম দিয়ে। আপনি কিন্তু এক্ষেত্রে আপনার জায়গা থেকে সত্য কারণ আপনি স্বপ্নে তা দেখেছেন। ঠিক তেমনটাই সত্য যখন কেউ পাশে বসে থাকা কাউকে দেখে ও কথা বলে। পার্থক্য শুধু আপনি ঘুমে স্বপ্ন দেখেছেন আর সে জেগে স্বপ্ন দেখছে। কারণ সে এতটাই সে বিষয় নিয়ে ভেবেছে যে ব্রেনকেও কাবু করে ফেলেছে। আবার কল্পশক্তি প্রবল হওয়ায় বেশীরভাগ সিজোরাই সৃজনশীল ও তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন হয়। যেমন- নোবেল বিজয়ী ‘গেইম থিওরীর জনক’ বিজ্ঞানী ন্যাশ ছিলেন সিজোফ্রেনিয়ার (Schizophrenia) রোগী।

সিজোফ্রেনিয়া কেন হয়?

এখন প্রশ্ন হতে পারে কারা এই রোগে ভোগে আর কেনই বা ভোগে? উত্তর খুব সহজ, প্রথমত, বংশগতি জীনের অসম বিন্যাস যা হরমোন ডিসব্যালেন্স তৈরী করে, যেখানে কারো হাত নেই। দ্বিতীয়ত, বঞ্চিত পরিবার, অধিকার এবং মানসিক চাপ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারা, নির্যাতন সহ্য করা এবং মানসিক অস্থিরতা এর জন্য দায়ী। মুখ বুঝে সব অন্যায় অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অসহায়ের মত কারো অপেক্ষা করা। অনেকটা রাজকুমার এসে বন্দী রাজকন্যাকে উদ্ধার করে ঘোড়ায় চড়ে রূপকথার রাজ্যে প্রবেশ করার মত।

আমরা সব মানুষই যখন বাস্তবে অনেক আশা করে কিছু পাই না তখন কল্পনা ও স্বপ্নে তার স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করি, বলতে গেলে আমরা সবাই কল্পপ্রেমী। সিজোরা অনেক বেশি কল্পনা ও স্বপ্ন কাতর হয় যার জন্য তারা হ্যালোসিনেশনে ভুগে বেশি। যখন সে বলে তার সামনে একজন দাড়িয়ে, তাকে ভয় দেখাচ্ছে বা ভালবাসছে তখন সে একবিন্দু মিথ্যা বলছে না, তার জায়গা থেকে সে সত্য যতটা সত্য আপনার স্বপ্ন।

কিন্তু আমরা ভালো মানুষেরা হয় তাকে পাগল ভাবি নয়তো ভুতে ধরা বলে এড়িয়ে চলি। উল্টাপাল্টা চিকিৎসা করাই ঠিক যেমন সাপে কাটলে ওঝায় বিশ্বাসী ছিলাম আমরা এখনো তেমনটাই আছি। সিজোরা কাল্পনিক চরিত্রের জন্য কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে, ক্যারেক্টার পরিবর্তন করে, কখনো শান্ত কবুতর আবার কখনো ভয়ানক দানব ঠিক যেমন- আয়নাবাজী সিনেমার চঞ্চল ও জোকারের মত।

আর এই অস্বাভাবিকতা কে আমরা না বুঝে কতই না ভুলভাল চিকিৎসা করাই, কতই না মারধর করি। অথচ চিকিৎসায় সিজোরা ৭৫ ভাগ স্বাভাবিক হয়ে যায় বাকি ২৫ ভাগ বংশগত জীনের কারণে অপরিবর্তিত থাকে, যাদের নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে গল্প

তবে খুশির খবর এই যে আমরা আগের থেকে অনেকটাই সচেতন হয়েছি, মনগড়া আর ভন্ডদের বিতাড়িত করে সঠিক চিকিৎসায় ঝুঁকছি, শহরের মানুষ গ্রামের তুলনায় সচেতন বেশী তাই সেখানে গ্রামের মত এত আজগুবি, কুসংস্কার ও প্রতারণামূলক কাজ খুব কম হয়। আপনি নিজেই চিন্তাশক্তি দিয়ে ভেবে দেখুন তো কথাটা ঠিক কিনা। গ্রামের মানুষ এখনো রূপকথা আর লোককথায় একজন স্বাভাবিক মানুষকেও ভুলভাল চিকিৎসা দিয়ে রোগী বানিয়ে ফেলছে।

আমার এলাকায় একজন মধ্যবয়স্ক চাচা যে আমাকে ছোটবেলায় খুব আদর করত তাকে এসব আজগুবি ও ভন্ড চিকিৎসায় তীলে তীলে কষ্ট পেয়ে মরতে দেখেছি। আসলে এগুলো তো চিকিৎসা নয়, চিকিৎসা নামক ভন্ড প্রতারণা, মরণ ফাঁদ। দশ জনের মধ্যে একজন হয়তো সাধারণ হ্যালোসিনেশনে ভুগে, যে কিনা এমনি ঠিক হয়ে যায়, সে যখন এই ভন্ডের কাছে সাধারণ কিছু খেয়ে ভালো হয়, তখন তাকেই গুরু মানা ও অলৌকিক ভাবা শুরু করে মানুষ, অনেকটা ঝড়ে বক পড়ে…ফকিরের কেরামতি বাড়ে ব্যাপারটার মত।

আর স্বাভাবিক ৮০ ভাগের বেশি মানুষ জীবনে কোন না কোন সময় হ্যালুসিনেট (অদৃশ্য কাউকে দেখা) করে বিভিন্ন মানসিক চাপের চিন্তায় ও অস্থিরতায়। আর তারা এটাকে অদ্ভুত ব্যাপার মনে করে অন্ধ বিশ্বাসকে জায়গা করে নেয়। চোখ যে কত বড় ধোঁকাবাজ তা যদি উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে এগুলোর আসল ব্যাপার বুঝতে পারবেন। যাইহোক এতো বলে কাজ নেই, যে বুঝে তার জন্য ইশারায় যথেষ্ট।
আসুন আমরা সচেতনতা, ভালোবাসা, সেবা এবং সঠিক চিকিৎসা দিয়ে সিজোদের স্বাভাবিক জীবন উপহার দেই।।

লেখা- Nerjhor

আরো পড়ুন- সিনোফবিয়া বা কুকুর ভীতি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *