স্বামী স্ত্রীর প্রেম কাহিনী – সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে: মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম। আব্বা মারা যাওয়ার তিন মাসের মাথায় মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে ঘরে তুলে এনেছিলাম। বিয়ের দিন রাতে তার মুখের একটি কথা পুরো স্তব্ধ করে দিয়েছিলো আমাকে। কথাটি ছিল কোন পর্যন্ত পড়েছেন?
আমি মাথা নিচু করে রেখেছিলাম। সে পুনরায় প্রশ্নটি করায় আমি আমতা আমতা করে উত্তর দিয়েছিলাম.. কোনো রকম মেট্রিক পাস করে আব্বার দোকান দেখাশোনা করছি। পরমুহুর্তে সে আবার বললো-
জানেন আমি কোন পর্যন্ত পড়েছি ? এবারো বরাবরের মতোন মাথা নিচু করেই বললাম, জি জানি, ডিগ্রি পাস করেছেন।
আমার মাথা নিচু করা দেখে সে ও বোধহয় কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো তাইতো হুট করেই বললো যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমার বড্ড ক্লান্ত লাগছে আমি ঘুমাবো। আপনিও ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। কিছুটা মনমরা হয়ে সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে গেলাম তাকে দেখে মনে হলো এ আমি অন্যকোনো নারীকে দেখছি। একদম আলাদা, চঞ্চলা, ঘন কালো কেশের অধিকারী একজন মানবী।
হেসে হেসে মা এবং চাচীদের সাথে কথা বলছিলো। আমাকে দেখে সকলে খানিকটা চুপ হয়ে গিয়েছিলো। আমিও কিছুটা লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুকুর পাড়ে চলে যাই। পুকুর পাড়ে গিয়ে নানাজনের কানাঘুষা শুনে কিছুটা বিব্রতবোধ করেছিলাম।
হাসিঠাট্টা সমেত দূরসম্পর্কের চাচাত ভাই রমিছ বলছিলো “মা মরা মেয়ে বিয়ে করছিস তোর কপালে জামাই আদর নাই”। তার কথায় তাল দিয়ে অন্যরাও হু হু করে হেসে উঠেছিলো। আমি দ্রুতলয়ে মুখ ধুয়ে ঘরে এসে পড়েছিলাম।
রুমে এসে দেখি নিপু পরিপাটি হয়ে খাটে বসে পা দুলাচ্ছিলো। আমাকে দেখে কিছুটা হকচকিত হয়ে বসলো। আমি গামছা হাতে নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকানোর সাথে সাথেই সে প্রশ্ন করে বসলো কিছু লাগবে কী না। আমি কেবল বললাম আচ্ছা আপনি ডিগ্রি পাস করেও আমার মতো মেট্রিক পাস একটা ছেলেকে কেন বিয়ে করেছেন?
সে কিছুটা নত স্বরে বললো, মা মারা যাওয়ার পর বাবা’ই আমাকে মানুষ করেছে। দিনমজুর বাবার ঘরে এত বড় ধামড়া মেয়ে যে ডিগ্রি পাস করতে পেরেছি সেটাই কম কীসে!
মেট্রিক পাসের পর থেকে পাড়ার বাচ্চাদের পড়িয়ে যা টাকা পেতাম তা দিয়েই কোনোরকম পড়ার খরচ জুগিয়েছি। আমার জেদের কাছে বাবাও কিছু বলেন নি।
মাসকয়েক আগে আমাদের পাশের বাড়ির মকবুল কাকার বাড়িতে আপনার মা আমাকে দেখে এবং পছন্দ করে। পরে বাবাকে বলায় বাবার মুখে একঝলক হাসি দেখেছিলাম। মা মরার পর বাবার মুখে সহসা হাসি দেখি নি। সেইদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাবার মুখে আর মলিনতা আসতে দিবো না। তবে এটাও সত্যি যে, আপনার সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করেছি, জেনেছি ও।
এবার আমি কিছুটা হকচকিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, তো কী জানতে পারলেন আমার সম্পর্কে?
সে সরলমনে উত্তর দিয়েছিলো “আপনি একজন ভালো মানুষ”।
সেই একটি কথায় পুরোদিন অনেকটা আনন্দে কেটেছিলো। এভাবে মাসখানেক সময় কেটে গিয়েছিলো। আমাদের সম্পর্কের মাঝে ধীরেধীরে বোঝাপড়া ব্যাপারটা আরো সুন্দর হচ্ছিলো। একদিন গঞ্জে যাবার উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলাম হুট করে সে আবদার করে বসলো তাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
আমি কেবল জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘কোথায়’?
তারপর সে এসে আমার মোটরসাইকেলের পেছনে বসল। আমার মনে হচ্ছিলো পৃথিবীর সমস্ত খুশি আমার মধ্যে এসে ভর করেছিলো। মা এসে বললো সাবধানে যেন গাড়ি চালাই। “ফি আমানিল্লাহ” বলে বের হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রথমে তার কলেজ এবং তারপর পুরো থানা এরিয়া ঘুরেছিলাম। রাস্তার খানাখন্দে একটু ঝাঁকুনি লাগলেই সে পরম নির্ভরতায় আমার কাঁধ চেপে ধরছিলো। সেদিন তার ভরসার হাত হতে পেরে নিজেকে একজন সাহসী মানুষ মনে হয়েছিলো।
মায়ের সঙ্গে তার ভীষণ ভাব হয়ে গিয়েছিল। দুপুরে খাবার খেতে এসে দেখতাম কখনো মা নিপুর মাথা আঁচড়ে দিচ্ছে তো কখনো নিপু আর মা কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। এ নিয়ে পাড়ার চাচীরাও হিংসেতে জ্বলে যেত।
মাঝেসাঁঝে রমিছের মা এসে বউ শাশুড়ির মাঝে দ্বন্ধ লাগানোর চেষ্টা করতো। কিন্তু বউ শাশুড়ি মিলে কিভাবে রমিছের মাকে জব্দ করেছে সেই গল্প শুনতাম খেতে বসে কখনো মায়ের মুখে তো কখনো নিপুর মুখে।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সুখের দিনগুলো। কিন্তু কথায় আছে সুখ বেশিদিন কপালে সয় না। আমাদের কপালেও সয়নি সুখ। একদিন ভোরবেলা গঞ্জ থেকে খবর আসে আমাদের দু’টো দোকান সহ প্রায় ২২টি দোকান পুড়ে গেছে আগুনে। কোনো রকম দৌড়ে গঞ্জে গিয়ে দেখি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। একদম পথে বসে গিয়েছিলাম।
মা হার্ট এ্যাটাক করেছিলো। মাকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করালাম। দোকানের পোড়া সকল জিনিষ পরিষ্কার করা, আবার মায়ের জন্য দৌড়াদৌড়ি করা সব একসাথে করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তখন পরম মমতায় দুটো হাত আমাকে শক্তি দিয়েছিলো।
নিপু দিনরাত এক করে মায়ের সেবা করেছিলো। মা সুস্থ্য হয়ে গেলে বাড়ি নিয়ে আসি। জমানো স্বল্প কিছু টাকায় নতুন করে দোকান দেয়া সম্ভব ছিলো না। তবুও লোনের চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একদিন রাতে মা আর নিপু এসে আমার পাশে বসলো। খানিকটা অনুনয়ের সুরে নিপু বললো…
দেখেন আমি তো পড়াশোনা করেছি। এতো পড়াশোনা করে যদি সংসারে এই অভাবের সময় কোনো কাজেই না লাগি তাহলে কী লাভ বলুন।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি চাকরি করবো। দু’টো এনজিও আর একটি ব্যাংকে এপ্লাই করেছি। মা’ও রাজি আছেন। আপনার সম্মতি চাচ্ছি। আমি কেবল মাথা নিচু করে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানিয়েছিলাম। বুঝে গিয়েছিলাম অভাবের তাড়না।
কয়েকদিন পর ব্যাংকের চাকরির পরিক্ষা হয়। ভাগ্যক্রমে নিপু টিকে যায়। প্রতিদিন আমি ওকে মোটর সাইকেল করে দিয়ে আসতাম আর নিয়ে আসতাম। এভাবেই দিন যেতে লাগলো।
মায়ের অসুধের খরচ, সংসারের খরচ পুরোটাই নিপুর বেতনের টাকা দিয়ে চলতো। একজন নারী যে সংসারের জন্য ঠিক কতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে আমি সেদিন বুঝেছিলাম। ভোরে উঠে নামাজ পড়েই রান্নাঘরে ছুটতো। সবার জন্য রান্না করে মাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে খাওয়াতো, নিজে খেতো তারপর গোসল সেরে সোজা অফিসে চলে যেতো।
অফিস থেকে ফিরেই মায়ের ঘরে গিয়ে আগে মায়ের খোঁজ নেয়া, খেয়েছে কি না দেখা, ঠিকমতো অষুধ খেয়েছে কি না চেক করা সব নিজহাতে করতো।
মাসকয়েক পরে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আমিও আবার নতুন করে দোকান দাঁড় করাই।
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝেমধ্যেই লোকমুখের কানুঘুষা শুনতাম বউয়ের টাকায় খাই, বউয়ের টাকায় দোকান দিয়েছি, লজ্জা শরম নাই ইত্যাদি। কিন্তু এসব কথাতে আমার এতটুকুও কিচ্ছু যায় আসতো না। কারণ আমার অভাবের সময় কোনো পাড়া প্রতিবেশি আমার পাশে দাঁড়ায়নি। বরং দাঁড়িয়েছে আমার স্ত্রী, আমার সহধর্মিণী।
ধীরে ধীরে ব্যাংক লোন শোধ হলো, ব্যবসাও চাঙ্গা হতে লাগলো। মা ও বারবার করে বলতো তাঁর একজন নাতি/নাতনী চাই। একা একা থাকতে আর ভালো লাগে না পুরো বাড়িতে। যখনই বাচ্চার কথা উঠতো নিপুকে দেখতাম লজ্জায় লাল হয়ে যেত।
বিয়ের বছর চারেক বাদে খোদা মুখ তুলে তাকিয়েছিলো। একদিন ভোরে নিপুর বমি করা দেখে মা নিপুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। দুপুরে গঞ্জ থেকে ফিরে যখন মহাখুশির খবর টি পাই আত্মহারা হয়ে মা এবং নিপুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিলাম। আমার চোখে পানি দেখে তাদের চোখের কোণেও পানি এসে গিয়েছিলো। মহল্লার সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিলাম।
নিপুকে সময়মতো মা’ই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতো। গাছের ডাব, পাকা পেয়ারা কিংবা ডালিম এটাসেটা ফল নিত্যদিন খাওয়াতো। মাঝেমধ্যে পাড়ার চাচীরা বলতো বাহ্ রে কায়েসের মায়ের শখ দেখলে বাঁচি না। আমরা বোধহয় মা হইনাই, আমরা বোধহয় সন্তান জন্ম দিই নাই। এত আহ্লাদ তো করি নাই।
মা আর নিপুকে দেখতাম সবার কথা হেসে উড়িয়ে দিতো। চাচীরাও পাত্তা না পেয়ে নাক ঝামটি মেরে চলে যেতো। দিন যেতে লাগলো আর পরম মুহুর্ত ঘনিয়ে আসতে লাগলো।
তখনকার দিনে এখনকার মতোন সিজার বা এতো আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিলো না। তারপরও সদরের মোটামুটি ভালো হাসপাতালেই ডেলিভারি করানোর ব্যাবস্থা করিয়েছিলাম।
নিপুকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে আমি আর মা দাঁড়িয়ে কেবল আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছিলাম।
ঘণ্টাখানিকের মাথায় ডাক্তারআপা একটি ফুটফুটে চাঁদকে আমার হাতে দিয়েছিলো।
সেই ফুটফুটে মায়াভরা মুখটির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটেই বলেছিলাম ডাক্তার আপা আমার নিপু কেমন আছে ?
ডাক্তার আপা চেহারা টা মলিন করে বলেছিলো তার অবস্থা আশংঙ্কাজনক। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। তারা চেষ্টা করছে যেন কোন সমস্যা না হয়।
না সেদিন তারা সমস্যা সমাধানে এতটুকুও ত্রুটি রাখে নি। সকলে মিলে চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু আমার সেই পরম ভরসার হাতদুটো সেদিন আর আমার কাঁধে শক্ত করে ধরার জন্য পাই নি। উজ্জ্বল আরোর সদা হাস্যোজ্জ্বল সূর্যটা সেদিন আর আলো ছড়ায় নি।
যখন ডাক্তার আপা এসে বললো তাদের পক্ষে সম্ভব নাহ তখন হাউমাউ করে নিপুর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। সে কেবল দু’হাত এগিয়ে নিজের মেয়েকে কোলে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু নিতে পারে নি। এতটুকুন শক্তিও অবশিষ্ট ছিলো না আমার সেই ভরসার শেষ আবাসস্থলের কাছে।
মা বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলো। ছোট্ট শিশুর কান্না আর মায়ের আহাজারি চিৎকারে বনের ঘুঘুরাও সেদিন কেঁদেছিলো। কাঁদতে পারি নি কেবল আমি। চিৎকার করে বলতে পারি নি নিপু আমি কাকে ভরসা করে বাঁচবো! বিপদে কে আমাকে সান্ত্বনা দিবে?
অন্তঃস্বত্বা থাকাকালীন নিপু প্রায়’ই বলতো আচ্ছা আমি মারা গেলে কি আপনি আবার বিয়ে করবেন ?
আমি ভেবাচেকার মত চেয়ে থাকতাম। পরক্ষণেই নিপু বলতো দেখেন আমাদের ছেলে বা মেয়ে যে-ই হোক না কেন আমি মরে গেলে তাকে মানুষের মত মানুষ করবেন কথা দেন।
পরম নির্ভরতার হাত দু’টো ধরে আমি কথা দিয়েছিলাম। তাইতো এই আটান্ন বছরের জীবনে আর কাউকে জীবনসঙ্গী করি নি। আমি আর মা মিলে বহু কষ্টে তোকে মানুষ করেছি মা।
জীবনে এতটুকু অভাব বুঝতে দেই নি। যখন যা চেয়েছিস তা দিয়েছি।
এ পর্যন্ত বলেই কায়েস সাহেব তাঁর একমাত্র মেয়ে নিরুপমার দিকে তাকালেন। নিরুপমার দু’চোখ বেয়ে অঝর ধারায় পানি ঝরছে।
কায়েস সাহেব আবারো বলতে লাগলেন…
শোন মা সংসারে ঝামেলা হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের পুরো জগতে বহু রকমের মানুষ থাকে। সেই মানুষের মনও বহুরকম। তোর শাশুড়ি তোকে সামান্য একটু আধটু কিছু বলেছে বলেই তুই সংসার ছেড়ে আলাদা হয়ে যাবি এটা কিন্তু অন্যায়। নিলয় তোর স্বামী হওয়ার আগে তোর শাশুড়ির সন্তান। আর সন্তানের উপর মায়ের অধিকার বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তুই তোর শাশুড়ির সাথে বন্ধুর মতো মিশে যা। তাকে বুঝার চেষ্টা কর। তার মন কী বলে শোন।
দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। তোর মা আর দাদীর দোয়া সর্বদা তোর সাথে আছে।
বছর কয়েক পর…
নিরুপমা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। আজ নিরুপমার ছেলে প্রথম স্কুলে যাবে। এ নিয়ে নিরুপমার শাশুড়ির খুশির অন্ত নেই। যাকে পাচ্ছে তাকেই বলছে আমার নাতি স্কুলে যাবে। জজ ব্যারিষ্টার হবে। আর শাশুড়ির এমন আচরণ দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে নিরুপমার। আর মনে পড়ে বাবার বলা সেই কথাটি “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে”। দরকার কেবল একটু সঠিক সময় আর ধৈর্য্যের।
গল্প :- “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে
গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে”
মোঃ আমজাদ হোসাইন
আরো পড়ুন – বাসর রাতের প্রেমের কাহিনী