গল্প হলেও সত্যি তো – বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

আমার স্ত্রী পারুলের মাথা ব্যথা। প্রচন্ড রকম মাথা ব্যথা। বিছানা থেকে কিছুতেই উঠতে পারছে না।তার চোখ ছলছল করছে জলে।

তবুও সে সকাল বেলা বিছানা থেকে উঠে গিয়ে রান্না বসাতে চাইলো।আমি তখন বললাম,’পারুল, যেভাবে আছো সেভাবেই শুয়ে থাকো।ঠান্ডায় উঠে কাজ করলে ব্যাথা আরো বাড়বে।’

পারুল বললো,’আমি না উঠলে ভাত রাঁধবে কে?মাছ কে খুটবে শুনি?’
‘মা করবে এসব। একদিন করলে তো আর দোষ হবে না। তাছাড়া তিনি তো জানেন তোমার অসুখ।’

পারুল তবুও উঠে যেতে চাইলো। কিন্তু আমি কিছুতেই তাকে উঠে যেতে দিলাম না।

এর একটু পরেই মার গলা শোনা গেল।মা চিৎকার করে বলছেন,’বউমা,ও বউমা?’

পারুল অতি কষ্টে বললো,’কী মা!’

মা এবার চেঁচিয়ে বললেন,’এখনও বলছো কী মা?বেলা কতো হলো শুনি? রান্না কে করে? বাড়িতে কী চাকর রেখেছো নাকি যে চাকর রাঁধবে আর তুমি নবাবজাদীর মতন শুয়ে শুয়ে আরাম করবে। রেস্ট নিবে?’

পারুল তখন চাপা স্বরে আমায় বললো,’শুধু আপনার জন্য। আপনি আমায় সব সময় বকা শোনান। আচ্ছা আপনার কী ভালো লাগে আমি অপমানিত হলে?’

কথাগুলো বলে কেঁদে ফেললো পারুল।

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আরেকটা আশ্চর্য বিষয় হলো আমি মার অযৌক্তিক কথাগুলোর কোন প্রতিবাদ করতে পারলাম না। আচ্ছা পৃথিবীর সব ছেলেগুলোই কী এমন?তারা কী তাদের মায়ের অযৌক্তিক এবং অশুদ্ধ আচরণের প্রতিবাদ করতে ভয় পায়?আমি জানি না।

কিন্তু আমি প্রতিবাদ করতে পারি না।কেন জানি একটা অজানা ভয় কাজ করে!

পারুল অসুস্থ শরীর নিয়েই উঠে গেল বিছানা থেকে। তারপর রান্না ঘরের দিকে যেতেই মা বললেন,’বিয়ে হয়েছে তো তিন বছর পাড় হয়ে গেল কিন্তু বাচ্চা কাচ্চা তো আর পয়দা করতে পারলা না!পারো শুধু অসুখ পয়দা করতা!

আসলে এইসব অসুখ না ভাব। আমার বাড়িতে থাকলে তাল বাহানা চলবো না।তাল বাহানা করতে হইলে বাপের বাড়িত যাও। ওইখানে গিয়ে করো।

আমার বাড়িত এইসব চলবো না।আমি আমার ছেলেরে আরেক বিয়া করাবো।দেশে বউয়ের অভাব নাই!’

কী থেকে কী শুরু হয়ে গেল!মা এমনি।একটু সুযোগ পেলেই হলো। তবে আর রক্ষে নেই।পারুলকে তিনি ইচ্ছে মতো বকবেন। অপমান অপদস্থ করবেন।এসব করে যে তিনি কী অমীয় প্রশান্তি লাভ করেন তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না!


পারুলের প্রতি মার অবহেলা বাড়ে।বাড়তেই থাকে দিনের পর দিন। একবার পারুলের মা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলেন।ওর মা যখন চলে যাবেন তখন আমার মা ওর মাকে বললেন,’বেয়াইন, আপনার ব্যাগটা দেন না একটু দেখি!’

পারুলের মা মৃদু হেসে মার কাছে ব্যাগ দিলেন।মা সেই ব্যাগ নিয়ে ঘরে গিয়ে খুঁটে খুঁটে দেখলেন পারুল কী কোন মূল্যবান কোন কিছু দিয়ে ফেলেছে কি না ব্যাগের ভেতর।

কিন্তু খুঁজে কোন কিছু না পেয়ে মা হতাশ মুখে বললেন,’বেয়াইন,আমি মজা করছি আপনার সাথে।দেখছি আর কী আপনার সাথে মজা করলে আপনার অবস্থা কেমন হয়!’

আমার শাশুড়ি শুধু মৃদু হাসলেন। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি সেই হাসির ভেতর একটা চাপা দুঃখ লুকোনো ছিল।

পারুলের এরপর কী কান্না।মা তখন বলেন,’আমার বাড়িত কান্নাকাটি চলবো না

কান্দো কেন? তোমার মারে কী পাড়ার মানুষের সামনে ল্যাংটা করছি নাকি আমি যে অপমানিত হয়ে কানতেছো?’

পারুল মার এমন বিশ্রী কথা শুনে লজ্জা এবং ঘৃণায় একেবারে চুপ হয়ে গেল।আমি তবুও মার এমন ব্যাবহারে কোন প্রতিবাদ করতে পারলাম না।


এর ঠিক দু’দিন পরেই হুট করে পারুলের ভাই এলো আমাদের বাড়িতে।সে এসে বললো,’পারুল তুই জলদি রেডি হয়ে নে।’
মা অবাক হয়ে বললেন,’রেডি হয়বো মানে?’

পারুলের ভাই বললো,’ওকে আমি নিয়ে যেতে সেছি।আর কখনো এ বাড়িতে পারুল আসবে না।’

মা তখন মুখ বিকৃত করে হাসলেন।আর বললেন,’বন্ধ্যা একটা মাইয়া তারে নিয়া অত ভাব।শুনো মিয়া,অত ভাব ভালো না।এর ফল কিন্তু খারাপ হবে। অনেক পস্তাবা তোমরা।মেয়েরে যে নিয়া যাইতেছো সে কিন্তু এই বাড়িতে কখনো ফিরতে পারবো না।তার জন্য এই বাড়িতে ফেরা আমি হারাম করে দিবো!’

পারুলের ভাই তখন বললো,’আপনি কী হারাম করবেন আমি নিজেই হারাম করে দিয়ে যাবো। আমার বোন এই বাড়িতে আর কোনদিন ফিরবে না।’

আমি তখন কথা বললাম। এই প্রথম মার কথার প্রতিবাদ করলাম। বললাম,’মা, এটা অন্যায় হচ্ছে। তুমি পারুলকে ফেরাও।’

মা আমায় ধমক দিয়ে বললেন,’কাপুরুষের মতো কথা বলা আমি পছন্দ করি না।তুই হইলি পুরুষ মানুষ। পুরুষ মানুষের জীবনে কোন কলঙ্ক নাই।তোর জন্য বাছাই করা বউ আনবো আমি।একটু খালি সবর কর।’

আমি বললাম,’না মা তুমি ঠিক করেছো না এটা। খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু।’

মা তখন আমার গাল খসে একটা চড় বসিয়ে দিলেন।আর বললেন,’আমারে তুই ঠিক বেঠিক শিখাস হারামজাদা।চুপ করে গিয়ে রুমে বসে থাক। আরেকবার শ্বাস ফেললে জিহ্বা কেটে ফেলবো তোর।’

মার কথা শুনে জব্বর ভয় পেলাম আমি।আর তক্ষুনি চুপ হয়ে গেলাম।একটা কথাও বললাম না আর।


এই ঘটনার তিন মাস পর অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটলো। আমার মায়ের হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পড়লো।মা একেবারে বিছানায় লেগে গেলেন।তার সেবার প্রয়োজন। কিন্তু সেবা করার মতো ঘরে কেউ নাই।মা তখন কাঁদতে শুরু করলেন।

মা আমার হাত ধরে একদিন কাঁদতে কাঁদতে বললেন,’ও বাজান, পৃথিবীতে মনে হয় আমার মতন খারাপ কপালের মানুষ নাই।আমি এমন খারাপ মানুষ যে নিজের ঘরে থাকা মূল্যবান জিনিসটা অবহেলা করে হারাইছি।

ও বাজান, পারুল আছিলো মাটির মতো একটা মানুষ।এমন মানুষ হয়না রে বাজান।আমি কেন যে ওর সাথে অত খারাপ আচরণ করতাম!’

কথাগুলো বলে মা কাঁদতে থাকেন। চিৎকার করে কাঁদেন। কাঁদতেই থাকেন।

আমি পারুলকে ফোন করি না। আমার সাহসে কুলিয়ে উঠে না।ওর সাথে যে আচরণ করা হয়েছে এরপরও আমি কীভাবে বলি যে পারুল, আমার মায়ের অসুখ, তুমি ফিরে এসো। এসে আমার মায়ের সেবা করো।

সেই মা যে তোমায় দিনের পর দিন অবহেলা করতো এবং যে কি না তোমায় এ বাড়িতে আসা হারাম ঘোষণা করেছিল!

কিন্তু পারুল কীভাবে যেন শুনে ফেলে মায়ের এই ভয়ংকর দুর্দিনের কথা। শোনার পরই সে অস্থির হয়ে উঠে।

সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো ছুটে আসে আমাদের বাড়িতে।কেউ তাকে ফিরিয়ে রাখতে পারে না।সে এসেই মার কাছে বসে।মা তখন তার হাত ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠেন। আমার মা পারুলের শাশুড়ি হন, কিন্তু শাশুড়ি হয়েও তিনি অদ্ভুত এক কান্ড করে বসেন তখন।

হঠাৎ করে পারুলের পা দুটি আঁকড়ে ধরে বলেন,’বউমা, তুমি আমার মা, তোমারে আমি মা ডাকলাম। তুমি যদি আমারে ক্ষমা না দেও তাইলে তোমার পাও আমি ছাড়তাম না!’

পারুল কাঁদতে লাগলো।আর জোর করে মার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার বুকের কাছে সেই হাত মুঠো করে ধরে বললো,’আপনার এই হাত আমার পায়ের জন্য নয়, আপনার এই হাত আমার আর আপনার ছেলের মঙ্গল কামনায় উপরে তুলে দোয়া করার জন্য।

আপনি যদি এই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে একবার দোয়া করেন, মাবুদ, মাবুদ গো, তুমি আমার সন্তানের ঔরসে পবিত্র আরেক সন্তান দান করো। মাবুদ, তুমি আমার পুত্রবধূর শূন্য কোল ভরে দাও।

আল্লাহ গাফুরুর রাহীম। তিনি আপনার এই দোয়া কখনোই ফেলে দিতে পারবেন না।’

মা তখন ফ্যালফ্যাল করে পারুলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।যেন আজ কোন কথা বলার শক্তি তার আর নেই। তিনি চির বধির হয়ে উঠেছেন!
আর আমি আড়ালে আবডালে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলাম,সময় থাকতে কেন মানুষ বুঝতে পারে না।

সময়ে সবকিছু বুঝতে পারলে তো কাউকে ছোট হতে হয় না। সন্তানের স্ত্রীকেও আর পা ধরতে হয় না!

গল্প হলেও সত্যি তো

~ অনন্য শফিক

আরো পড়ুন – তুমি আমার মোনালিসা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *