থ্রিলার গল্প – হ্যাকারের ডার্ক ওয়েবে হারানো রহস্য – শেষ পর্ব: প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি হটাৎ গুলির শব্দ এবং গুলিতে মারা যাওয়া একজনের ফরেনসিক ল্যাবে নিয়ে যাওয়া। এই কেসটা একটা রহস্যের জন্ম দিয়েছে। চলুন জেনে নেই কি সেই রহস্য? কার ফাঁদে আটকে পড়ে কে?
রহস্যময় কেস
অনিমেষের আকস্মিক মৃত্যুতে কেসটা বন্ধ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সময় তো কখনো থেমে থাকে না। কারো জন্ম-মৃত্যুতে মানুষের অনুভূতি হয়তো থমকে যেতে পারে। কিন্তু সময় তো তার জন্য অপেক্ষা করে না। পৃথিবী তার নিজ নিয়মে চলতে থাকে।
সেই নিয়মে অনিমেষের স্থানে কেসটি তুলে দেওয়া হলো সদ্য গোয়েন্দা বিভাগে যোগদান করা পীযুষ এর হাতে। পীযুষ ছাত্রজীবনে তুখোড় মেধাবী একজন ছাত্র ছিলো। ছোটবেলা থেকে গোয়েন্দা উপন্যাস, সিনেমা সব গিলে খেয়েছে। একসময় শার্লক হোমসের সংস্পর্শে এসে একা একাই সে তদন্ত করার চেষ্টা করতো। কিন্তু, এটাতো বাংলাদেশ। এখানে শার্লক হোমস হওয়া কখনোই সম্ভব না। স্বেচ্ছায় কোনো কিছুর করার উপায় এ দেশে নেই, যা কিছু করতে হবে একটা প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হয়েই করতে হবে।
এই সত্যটা উপলব্ধি করার পর সে উঠে পড়ে লেগেছিলো গোয়েন্দা বিভাগে যোগদান করতে। এবং শেষমেষ সে সফলও হয়েছে। তার এই আগ্রহ ও মেধা দেখেই গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান তাকে বাজিয়ে দেখার জন্য কেসটি তুলে দেয়। যদিও অনিমেষের মতো তুখোড় একজন গোয়েন্দার মৃত্যু হওয়ার মতো মারাত্নক কেস নতুনদের হাতে তুলে দেওয়াটা নিতান্তই বোকামী। কেননা, গোয়েন্দা বিভাগে একটি কথা প্রচলিত আছে, যেই কেস অনিমেষ সমাধান করতে পারবে না, সেই কেস আর কেউ কখনোই পারবে না। এখন দেখা যাক, অনিমেষের যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে পীযুষ কি পারবে কেসটির সমাধান করে অনিমেষের শূণ্যস্থান পরিবর্তন করতে?
ফরেন্সিক ল্যাবে এসে কেসটি নিয়ে পীযুষ কথা বলতে চাইলো ডা: সিমলার সাথে। কিন্তু, ডা: সিমলা কোনো কথারই উত্তর দিলো না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো পীযুষর দিকে। কিছুক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থেকে সে পীযুষকে বললো, স্যরি মিস্টার পীযুষ। আমার দ্বারা হবে না। আমি গোয়েন্দা বিভাগ থেকে রিজাইন করছি।
পীযুষ কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো; তারপর বললো, দেখেন ডা: অনিমেষ স্যার এই কেসের জন্য হারিয়ে গেছেন। তার জীবনে কোনো কেসই অসম্পূর্ণ ছিলো না। আপনি কি চান, স্যারের জীবনের শেষ কেসটা অসম্পূর্ণ থাকুক?
সাইবার শেল
আপনার রিজাইনের সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি; তবে, আমি আপনাকে অনুরোধ করবো স্যারের জীবনের শেষ কেসটা সম্পূর্ণ করে তারপর রিজাইন করুন।
পীযুষ এর কথা শুনে ডা: কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর ফরেন্সিক রিপোর্টগুলো ওর হাতে তুলে দিয়ে বললো, তবে এটাই হোক আমাদের জীবনের শেষ কেস; আর তোমার জীবনের প্রথম কেস।
পীযুষ ডা: সিমলার কথা শুনে ফরেন্সিক রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখন ওকে ডা: ডাক দিলো আবার। তারপর বললো, শেষবারের মতো অনিমেষ যখন এখানে এসেছিলো তখন হাতে করে একটা ল্যাপটপ নিয়ে এসেছিলো। দেখো, ওখান থেকে কিছু পাও কি না।
পীযুষ সিমলার কাছ থেকে ল্যাপটপটি নিয়ে চলে আসলো অফিসে।
ল্যাপটপটি পাসওয়ার্ড প্রটেক্টেড। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় খোলা সম্ভব না। কিন্তু, পীযুষ তার জীবনের একটা বড় সময় কাটিয়েছে হ্যাকিং শিখতে। যদিও এই কাজটি সে নিভৃতে করে গ্যাছে, কখনো কাউকে বলে নি। তবে, তার হ্যাকিং স্কিল যে অনেক ভালো সেটা সে জানে। কেননা, বিভিন্ন সময় সে তার স্কিল টেস্ট করার জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বিশিষ্ট সাইটগুলো হ্যাক করার চেষ্টা করতো। এবং এখন পর্যন্ত সে ব্যর্থ হয় নি কখনো। তবে, একবারে সব হতো না। এর জন্য তাকে বারবার আরো অনেক কিছু শিখে চেষ্টা করতে হতো।
সেই সুপ্ত স্কিল ব্যবহার করে পীযুষ খুব সহজেই ল্যাপটপটির সিকিউরিটি ধাপ অতিক্রম করলো। এক্ষেত্রে তার যে বিষয়টি খটকা লাগলো, তা হলো গফুর তার ল্যাপটপে খুব কঠিন একটা পাসওয়ার্ড দিয়ে রেখেছিলো, যেটা সাধারণত কোনো সাধারণ মানুষ করে না। তারপর, সে এই সন্দেহ থেকে পুরো ল্যাপটপটা ভালোভাবে চেক করতে যে জিনিসটি বুঝতে পারলো তা হলো, ল্যাপটপটিতে ইন্টারনেট ব্যবহার করাটা অনেকটা নিজেকে মৃত্যুফাঁদে ফেলার মতো। কেননা, ল্যাপটপটি ট্রেস করা হচ্ছে। সাধারণ কেউ বিষয়টি বুঝবে না। এমনকি খুব ভালো মানের হ্যাকার না হলেও এটা জানতেই পারবে না। কিন্তু, কিসের জন্য ট্রেস করা হয়েছে?
তখন তার চোখে পড়লো একটা ফোল্ডার। যার ভেতরে প্রায় আরো একশোটা ফোল্ডার। আর প্রতিটা ফোল্ডারে প্রায় একই রকম ফোল্ডার। এক্ষেত্রে বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা লুকানো আছে। এই ফাইলগুলাতে অনেক গুতাগুতি করার পর সে আবিষ্কার করলো টর (Tor) ব্রাউজার!
হ্যাকিং কৌশল
টর ব্রাউজার চোখে পড়ার পর বাকীটা বুঝতে আর পীযুষের বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলো না। সে বুঝতে পারলো, আসলে কাহিনী কী ঘটেছে।
সে টর ব্রাউজার ওপেন না করে পুরো ল্যাপটপটা ভালো করে ঘাটাঘাটি করতে থাকলো। তারপর, অনেক খোঁজাখুঁজির পর খুঁজে পেলো গফুরের ইমেইলের আইডি, পাসওয়ার্ড। এক্ষেত্রে এই ল্যাপটপ কিংবা অন্যকোনো ল্যাপটপ থেকে ইমেইলে লগইন করাটা সেইফ হবে না। তাই, পীযুষ অফিস থেকে বের হয়ে চলে গেলো তার বর্তমান অবস্থান থেকে অনেক দূরে। কেননা, ইমেইল লগইনের ইনফরমেশন ডাটাবেইসে থাকবে। আর, সেক্ষেত্রে আইপি ট্রেস করে অবস্থান জানা যাবে। এক্ষেত্রে ভিপিএন ব্যবহার করা যেতো, কিন্তু কী দরকার এই রিস্ক নেওয়ার।
ঢাকা শহরের বাহিরের এক সাইবার ক্যাফে তে এসে পীযুষ ভিপিএন ব্যবহার করে ইমেইলে ঢুকলো। কিন্তু, ইমেইলে কোনো মেসেজ নেই। তখন পীযুষ ডাটাবেইস থেকে মেসেজগুলো রিকভার করে নিলো।
এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখা ভালো, আমাদের যে সাধারণ ব্রাউজারগুলো আছে যেমন: মজিলা ফায়ারফক্স, গুগল- এসব কিছুতে যতই লগইন হিস্টোরি ডিলেট করা হোক না কেনো, সবই ডাটাবেসে সেভ থাকে।
সেখান থেকে রিকভার করে পীযুষ জানতে পারলো গফুরের পার্টনার ছিলো পলাশ। তারা দু’জনে অবৈধ অস্ত্র কিনে সাপ্লাই দিতো। কিন্তু, কিছুদিন আগে যাদের কাছ থেকে তারা অস্ত্র কিনতো, তাদের সাথে কেনা নিয়ে কি যেনো ঝামেলা হয়। তারপর থেকে গফুর আর পলাশের জীবন হুমকির মুখে পড়ে যায়।
এখন গফুর আর পলাশ কোথা থেকে অস্ত্র কিনতো, তা বুঝতে পীযুষ এর একটুও অসুবিধে হয় নি। কেননা, ইমেইলে একটা ওয়েবসাইটের নাম দেওয়া আছে। আর যেহেতু সাইটের শেষে .onion লেখা, সেহেতু এটা হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
তাই, পীযুষ কম্পিউটারটিতে টর ব্রাউজার সেটাপ দিলো। টর ব্রাউজার হলো ফায়ারফক্সের মতো ব্রাউজার, তবে, পার্থক্য হলো এখানে ডাটাবেসে কোনো তথ্য সেভ হয় না। আর এদের ওয়েব অ্যাড্রেসের শেষে .com হয় না, হয় .onion। সাধারণ বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা তাদের গুরুত্বপূর্ণ নথি, খুব গোপন কিছু একে অপরের সাথে শেয়ার করার জন্য টর ব্রাউজার ব্যবহার করে থাকে। আর, এসব কিছু শুধুমাত্র আদান প্রদান হওয়া মানুষ ছাড়া আর কেউ জানে না। ইন্টারনেটের এই জগতটিকে বলা হয় ডিপ ওয়েব।
এতোটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু, বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়। অন্ধকার জগতের মানুষেরা তাদের সুবিধার জন্য এটি ব্যবহার করা শুরু করে। আর ইন্টারনেটের এই অন্ধকার জগৎটিকে বলা হয় ডার্ক ওয়েব।
ডার্ক ওয়েবের জগৎ
ডার্ক ওয়েবে হ্যাকিং থেকে শুরু করে মাদক দ্রব্য, বিষ, অস্ত্র এমনকি মানুষের কেনা বেঁচা করা হয়। তারপর এখানে পাওয়া যায় চাইল্ড পর্ণ। এক্ষেত্রে পর্ণ ভেবে ফেললে হবে না, সাথে জেনে রাখা ভালো লাইভে এসে সবকিছু করা হয়, আর কমেন্টে মানুষ অর্থের বিনিময়ে তার সাথে কী করতে হবে তা বলে দেয়। যেমন: ১ বিটকয়েন দেওয়া হলো, বাচ্চাটির চোখ গেলে দেওয়ার জন্য। আর পে করা হলে লাইভে সরাসরি তা করে দেখানো হয়! এছাড়াও আছে মানুষকে মারার জন্য খুনী ভাড়া করার সুযোগ ইত্যাদি।
আর এসবক্ষেত্রে পে করা হয় বিট কয়েনে। বিট কয়েন হলো ক্রিপ্টো কারেন্সি, যা কে পে করছে কে গ্রহণ করছে তা কখনো আইডেন্টিফাই করা যায় না। এক্ষেত্রে যে পে করবে, আর যে গ্রহণ করবে তার আসল অ্যাকাউন্ট শো না করে করবে পাবলিক অ্যাকাউন্ট, যেটাতে কোনো ইনফরমেশনই থাকে না। আর এই পাবলিক অ্যাকাউন্টটা একেকজনের জন্য একেকটা শো করে। তাই, লেনদেন কোথায় হলো তা কেউ জানতেই পারবে না। এজন্য বিটকয়েনকে বলা হয় সবচেয়ে নিরাপদ মানি ট্রান্সফারিং ওয়ে। তবে, জেনে রাখা ভালো, ১ বিট কয়েন= ৪,২৪,৫৯৯.৯১ টাকা। আর এই বিটকয়েন সবদেশে সবদেশে গ্রহণ যোগ্য না। তবে, এটা দিয়ে শপিং করা যাবে বিভিন্ন অনলাইন শপে।
যাই হোক, ভিপিএন অন করে টর ব্রাউজারে ঢুকে সাইটটিতে গেলো পীযুষ। দীর্ঘ ৫ ঘন্টা চেষ্টা করার পর অবশেষে সাইটটি সে হ্যাক করতে সক্ষম হলো। এক্ষেত্রে কাজটা কঠিন হতো যদি সাইটটা বিদেশী কেউ তৈরী করতো। সাইটটি বাংলাদেশী হওয়ায় এতোটা নিরাপত্তার ধার ধারে নি অ্যাডমিনরা। কেননা, আমাদের মতো অনুন্নত দেশে এসব নিয়ে সরকারের খুব একটা মাথাব্যাথা নাই। আর থাকবেই বা কেমনে? এফবিআই যেখানে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমরাই বা কী করবো?
ডার্ক ওয়েবের ফাঁদে পা
যাই হোক, আইপি ট্র্যাক করে পীযুষ চলে আসলো অফিসে। তারপর, দলবল নিয়ে চলে গেলো ওদের ধরতে।
ট্রেস করা অবস্থানে আসার পর পীযুষ দেখলো এক বিশাল বড় প্রতিষ্ঠান। আর, সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক আবদুল সাত্তার ওয়েব সাইটির অ্যাডমিন। তাকে গ্রেফতারের পর জানা গেলো, এই সাইটটি কিনে নেওয়ার জন্য গফুর আর পলাশ চেষ্টা করছিলো। ঠিক সে সময় সেও সাইটটি কিনতে চাইলো। এ নিয়ে যখন সাইটটির আগের অ্যাডমিনের সাথে কথা হয়, তখন সে আমার কাছে ওদের কথা বলে। কেননা, ওরা আমার থেকে বেশি টাকা দিয়ে সাইটটা কিনে নিতে চাচ্ছে। তখন আমি ওয়েব থেকে থেকে খুনী ভাড়া করে ওদের খুন করাই। তারপর, অ্যাডমিনের কাছ থেকে সাইটটি কিনে নিই। তখন, সে আমাকে বলে সে ওদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলো। তবে, তাদের দেওয়া টাকার পরিমান কম ছিলো বলে আমার কাছে আইডেনটিটি ডিসক্লোজ করে।
পীযুষ ওর কথা শুনে বললো, সাইটটির অ্যাডমিন ইউজার নেম আর পাসওয়ার্ড দাও।
তারপর, আবদুল সাত্তারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওর ল্যাপটপ দিয়ে সাইটটি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সেই অ্যাড্রেসে ঢুকতেই পীযুষর সামনে লেখা আসলো,
sorry this web page is not available.
ঠিক সে মুহুর্তে আবদুল সাত্তারের ল্যাপটপে একটা ভিডিও বার্তা অটোমেটিকালি ওপেন হলো।
কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা একজন ইলেক্ট্রনিক ভয়েসে বলছে,
ইন্টারনেটের নাড়ি নক্ষত্র জানা ছাড়া কখনো ডার্ক ওয়েবে ঢুকতে হয় না। তা না হলে এরকমই হয় আবদুল সাত্তার।
আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে দিয়ে কাজটি করিয়েছিলাম। আর, তুমি না করলে ওদেরকে দিয়ে করাতাম। তোমার তোমরা কেউই ইন্টারনেট সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখো না। ভিপিএন দিয়ে ডার্ক ওয়েবে কখনো নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। আগামীবার থেকে একথা মনে রেখো।
আর, দিনশেষে লাভটা আমারই হলো। ওরাও মরলো, তুমিও জেলে যাবে। তোমাদের টাকাগুলা আমার হয়ে গেলো। আর, সাইটটাও আমি ফেরত নিয়ে নিলাম। হাহাহা।
সমাপ্ত