থ্রিলার গল্প – হ্যাকারের ডার্ক ওয়েবে হারানো রহস্য – পর্ব ১: ইন্টারনেট জগত ছাড়া বর্তমান থ্রিলিং কোন স্টোরি বাস্তবেও সম্ভব না। ডার্ক নেটের সামান্য ভুল আপনাকে কি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, তা নিয়ে আমাদের আজকের এই থ্রিলিং স্টোরি। চলুন রহস্য ডুব দিতে শুরু করি।
তিনটি গুলির শব্দ
ঠাস, ঠাস, ঠাস……পর পর তিনটি গুলির শব্দ, একটি আর্তনাদ, তারপর পিন পতন নীরবতা।
অতঃপর রাত ১২ টায় পার্টি শেষে বাড়ি ফেরার পথে এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন গফুর চৌধুরী। পিছনে ফিরে না তাকিয়ে প্রাণপণে দৌড় দিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। অবশেষে প্রায় ১০ মিনিট দৌড়ানোর পর তিনি পৌছে গেলেন বাড়ির সামনে। তারপর, বাড়ির দরজায় গায়ের যতো শক্তি ছিলো তা দিয়ে আঘাত করেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
দরজা খুলে তাকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে তার স্ত্রী সালমা। ভেবে নিলেন, তিনি মাতাল হয়ে এসেছেন। বছরে একবার দু’বার পার্টিতে গেলে তিনি একটু আধটু মদ খান। তবে কখনো মাতাল হন না। এ বিষয়ে তিনি সবসময় বলতেন, মদ খাই আরাম লাগার জন্য। যদি মাতালই হয়ে যাই তাহলে আরাম লাগছে তা বুঝবো কী করে?
যাই হোক, তাকে টেনে হিচড়ে কোনোমতে বিছানার মধ্যে শুইয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন সালমা। তারপর, বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন স্বামীর পাশে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সালমা পাশ ফিরে দেখলেন গফুর তার পাশে নেই। তড়িঘড়ি করে তিনি বিছানা ছেড়ে সমগ্র বাড়ি ঘুরে দেখলেন। তারপর, দরজার কাছে আসতেই দরজা ভেতর থেকে খোলা দেখে বুঝলেন, গফুর সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়ে গেছেন।
সকাল সকাল গফুরের আকস্মিক প্রস্থান দেখে কিছুটা বিষ্মিত হলেন সালমা। তবে বিষয়টাকে তিনি খুব একটা পাত্তা না দিয়ে লেগে পড়লেন গৃহস্থলির কাজে। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো তবু গফুর ফিরলেন না। বিকেলেও যখন গফুর ফিরলেন না তখন বেশ চিন্তিত হয়ে সালমা তার প্রতিবেশিদের বিষয়টি জানালেন। তারা গফুরের সন্ধানে আশেপাশের সব জায়গা খুঁজে দেখলো কিন্তু কোথাও গফুরের কোনো খোঁজ নেই। হতাশ হয়ে তারা যখন সালমাকে খবরটি জানালো ঠিক তখনই সালমার ফোনে কল এলো। কলটি ধরতেই একজন তাকে পুলিশ স্টেশনে আসতে বললো। তিনি তড়িঘড়ি করে সাথে দু’জনকে নিয়ে ছুঁটে গেলেন পুলিশ স্টেশনে।
পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সালমা তার পরিচয় দিতেই একজন পুলিশ অফিসার তাকে লাশ ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলো। তারপর, টেবিলের উপর রাখা লাশটির মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে বললো, স্যরি মিসেস গফুর, আপনার স্বামী আর এই পৃথিবীতে নেই।
নিথর হয়ে সালমা কিছুক্ষণ লাশটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। লাশটির বুকে তিনটি গুলি করা হয়েছে। তবে, মুখ পুড়িয়ে একদম বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। চেনার কোনো উপায় নেই। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ লাশটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে সালমা বললেন, এটা গফুর না। এটা গফুর হতেই পারে না।
পুলিশ অফিসার শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, মিসেস গফুর, উই আর রিয়েলি স্যরি। বাট লাশের পকেটে ওর ওয়ালেট, ফোন পাওয়া গিয়েছে। সবকিছু দেখে নিশ্চিত হয়ে আমরা আপনাকে খবর দিয়েছি।
রহস্যময় লাশ
সালমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, গফুর এতোটা ফর্সা না। তাছাড়া ওর পীঠে একটি বড় সেলাই আছে। গতবছর মাঝরাতে বাড়ি ফেরার সময় ওর সাথের জিনিসপত্র ছিনতাই হয়ে যায়। ওর থেকে সবকিছু নেওয়ার পর যাবার সময় ওরা ওর পীঠে কোপ বসিয়ে দেয়। সেই কোপের দাগ কাধ অব্ধি ছিলো। কিন্তু এই লাশে সেটা নেই।
সালমার কথা শুনে পুলিশ অফিসার লাশটিকে উল্টিয়ে দেখলেন, লাশটির পীঠে কোনো সেলাইয়ের দাগ নেই।
বিষ্মিত হয়ে তিনি বললেন, তাহলে এটি কার লাশ? আর, গফুরই বা কোথায়?
সালমা তখন বললেন, জানি না। সকাল সকাল ও ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু, তারপর আর ওর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করা শেষে আমি আশেপাশের মানুষ দিয়ে ওর খোঁজ করাই, কিন্তু কোনো খোঁজ পাই নি। তারপর, ভেবেছিলাম আপনাদের জানাবো, তার আগেই আপনি আমাকে ফোন করে এখানে আসতে বললেন।
পুলিশ অফিসার সালমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আপনি ওর সাথে যেয়ে কেস ফাইল করুন। আমরা দেখি আপনার জন্য কী করতে পারি।
সালমা তখন শান্ত ভঙ্গিতে তবে দৃঢ় গলায় বললেন, কেসটা আপনাদের দেখতে হবে না। আমি জানি এই রহস্যের সমাধান কে করতে পারবে। আমি তার কাছেই যাবো।
পুলিশ অফিসার বিষ্মিত হয়ে বললেন, কে?
সালমা বললেন, অনিমেষ রাহমান।
অফিসে নিজ কক্ষে বসে সিগারেট টানতে টানতে গফুরের কেসের বিবৃতি পড়ছে অনিমেষ। সালমার সাথে কথা বলে তার যতটুকু মনে হলো গতরাতে অস্বাভাবিক কিছু একটা হয়েছিলো গফুরের সাথে। কেননা, সালমা তাকে মাতাল ভেবে শুইয়ে দিলেও তার মুখ থেকে মদের কোনো গন্ধ তার নাকে লাগে নি। এবং গফুর স্বাভাবিকের চেয়ে খুব জোরেই দরজায় আঘাত করেছিলো। এছাড়া আজ ওখানে পুলিশ একটি লাশ খুঁজে পায়, যেই লাশের পকেটে গফুরের সবকিছু পাওয়া গেছে। তাহলে কী গতরাতে গফুর হত্যাকান্ড দেখেছিলো? যদি দেখে থাকে তাহলে কী তার অস্তিত্ব খুনীরা টের পেয়েছিলো? যদি পেয়েই থাকে তাহলে গফুরকে গতরাতেই মেরে ফেলে নি কেনো? আর কেনই বা গফুর সকাল সকাল কাওকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে গেছে?
তাহলে কি গফুরের সাথে হত্যাকান্ডটির কোনো সংযোগ আছে?
প্রশ্নগুলো অনিমেষকে অস্থির করে তুলছিলো। কোনোভাবেই সে কিছু মেলাতে পারছে না। আর যতক্ষণ না সে মেলাতে পারবে, ততক্ষণ সে কোনোকিছুকে সন্দেহ করে এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই সে খুব করে চেষ্টা করছিলো সবগুলো ঘটনা সংযোগ করে একটা ঘটনার চিত্র কল্পনায় আনা। ঠিক সেসময় ফরেন্সিক ল্যাবে ডাক্তার সিমলা তাকে যাবার জন্য খবর দিলো।
ইন্টারনেটের ফাঁদ
ফরেন্সিক ল্যাবে আসার পর সিমলা অনিমেষকে জানালো, খুন আনুগফুর ১১:৩০ থেকে ১২:৩০ এর মধ্যে হয়েছে। তবে শরীরে কোনো গুলি পাওয়া যায় নি। এছাড়া, ডেডবডিতে কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায় নি।
সবকিছু শুনে অনিমেষ বললো, আইডেন্টিফাই করতে পেরেছো লোকটা কে?
সিমলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, না। বাট, চেষ্টা করছি। দেখি কিছু বের করতে পারি কি না।
ফরেন্সিক ল্যাব থেকে হতাশ হয়ে ফিরে আসলো অনিমেষ। অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে সে ভাবতে লাগলো, কীভাবে কেসটার সমাধান করা যায়। ঠিক সেসময় তার মনে পড়ে, বেশ কিছুদিন আগের হারানো মানুষের তালিকা খুঁজলে হয়তো কাউকে না কাউকে পাওয়াই যাবে। তাছাড়া, গফুরের সম্পর্কে আরো বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া দরকার।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সেই পুলিশ স্টেশনে ফোন করলো অনিমেষ। তারপর পুলিশ অফিসারকে বললো, বিগত একমাসে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের তালিকাটি দিতে।
পুলিশ অফিসার অনিমেষকে লাইনে রেখে ডাটাবেস চেক করলো। তারপর বললো, স্যরি স্যার। ডাটাবেস অনুসারে বিগত একমাসে কোনো নিখোঁজ কেস ফাইল করা হয় নি। বিষয়টায় অনিমেষের কেমন যেনো খটকা লাগলো। সে পুলিশ অফিসারকে বললো, আপনি একটু কষ্ট করে অফলাইনের কেসের ফাইলগুলো চেক করুন। আমি আসছি।
ফোনে পুলিশ অফিসারকে কথাটি বলে অনিমেষ চলে গেলো গফুরের বাসায়। গফুরের বাসায় কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে সে গফুরের ল্যাপটপ ছাড়া আর কিছুই পেলো না। ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে সে সালমার সাথে গফুরের সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলতে যাবে ঠিক তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই পুলিশ অফিসার বললো, স্যার যেখানেই থাকেন না কেনো তাড়াতাড়ি সরে পড়েন। পুলিশ স্টেশনে বোমা হামলা হয়েছে।
আমাদের ডাটাবেস হ্যাক করা হয়েছে। বিগত একমাসে তিনজন নিখোঁজ হয়েছে। কিন্তু, সেসবকিছু ডাটাবেসে নাই। সম্ভবত, ওরা আপনাকে ট্রেস করেছে। আপনি কী করছেন, না করছেন সবকিছুতেই ওরা নজরদারি করছে।
একথাটি বলে সে নিখোঁজদের নাম অনিমেষকে বলতে যাবে ঠিক সেসময় একটি গুলির শব্দ পাওয়া গেলো।
ফরেন্সিক ল্যাব
গুলির শব্দ পেয়ে অনিমেষ বললো, আপনি ঠিক আছেন তো? কোনো কিছু হয় নি তো আপনার? হ্যালো? হ্যালো?
ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পাওয়ায় অনিমেষ সালমাকে বললো, প্লিজ আমার গাড়িতে উঠুন। এক্ষুণি। কোনো প্রশ্ন করবেন না।
সালমা অনিমেষের কথা শুনে চুপ করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। ঠিক তখনই বিকট শব্দে একটা বিস্ফোরণ হলো। চোখের সামনে উড়ে গেলো গফুরের বাড়ি।
অনিমেষ সেদিকে একবার তাকিয়ে সোজা ড্রাইভিং সিটে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তারপর ডানে বায়ে না দেখে সোজা ফুল স্পিডে গাড়ি চালানো শুরু করলো। ঠিক সেসময় সামনে থেকে একজন গাড়িতে গুলি চালালো। আর গুলিটা এসে লাগলো অনিমেষের গায়ে।
কোনোমতে গায়ে গুলি লাগা অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে অনিমেষ পৌছে গেলো ফরেন্সিক ল্যাবে। ফরেন্সিক ল্যাবে পৌছাতেই সালমা ভেতরে গিয়ে সিমলাকে অনিমেষের অবস্থা জানালো। সিমলা অনিমেষের কথা শুনে বাহিরে চলে আসলো। তারপর, অনিমেষের অবস্থা দেখে বললো, এক্ষুণি ওকে হসপিটালাইজড করতে হবে।
অপারেশন থিয়েটারে চলছে অনিমেষের। বাহিরে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে ডিবির সহকর্মীরা। ওদিকে কান্না করতে করতে প্রায় অসুস্থ হয়ে গেছে ডা: সিমলা। অনিমেষের সাথে দীর্ঘ ৪ বছর কাজ করার পর তার সাথে এক মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে অনিমেষের। প্রেম হয় নি তাদের। তবুও অনিমেষের প্রতি এক অদ্ভুত মায়াবোধ করে সে। পৃথিবীতে সম্ভবত সে একজন মানুষকে ভালোবাসে, আর সেই মানুষটা অনিমেষ। এখন সে মৃত্যুর সাথে লড়ছে।
প্রায় একঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বের হলেন। বিমর্ষ মুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, আই অ্যাম স্যরি। হি ইজ নো মোর।
ডাক্তারের কথা শুনে সিমলা একদম স্থির হয়ে বসে পড়লো। পৃথিবীর কোনো অনুভূতি যেনো তাকে আর স্পর্শ করতে পারছে না। ঠিক সেসময় সিমলার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, ডাক্তার সিমলা আপনি আমার সাথে একটু আসবেন।
সিমলা যন্ত্রের মতো ডাক্তারকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে থাকলো। আর পেছনে পড়ে রইলো তার ভালোবাসার মানুষ। চলবে…
শেষ পর্ব- থ্রিলার গল্প – হ্যাকারের ডার্ক ওয়েবে হারানো রহস্য – শেষ