সাঁঝের বেলার রাঙা গোধূলি – Ekta bhalobasar golpo story: জীবনের সমস্ত প্রাপ্ত আঘাত তার অন্তর পাথরে পরিণত করে তুললো। দেহ গঠনে অপরিবর্তন তবে মনে আজ তার বিশাল পরিবর্তন ঘটে। সে আজ বুঝেই নিল এই পৃথিবীর প্রেম ভালোবাসা তার মতো শেকর ছাড়া মানুষের জন্য নয়।
পর্ব ১৯
“সারা বাসায় চল।”
“না আমি এখন যাবো না।”
“দেখ তোর মামা কিন্তু এখনই চলে আসবে। পরে বকা দিলে ঠেকাবো না আমি।”
পংক্তির এমন ধমকিতেও সারার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ নেই। মিরার সাথে আনন্দে খেলছে সে। পংক্তি অনুনয়ের সুরে পুনরায় বললো,
“মা আমার লক্ষিসোনা,চাঁদের কণা। চল বাসায় চল। কাল আবার আসিস চল মা।”
“না!”সারার মুখে বিরক্তি।
পংক্তি ঘড়ির দিকে তাকায়। পাঁচ মিনিট কম আটটা বাজতে। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আজ মানুষটার এতো দেরি কেন হচ্ছে, ভাবতেই দুশ্চিন্তা জেঁকে বসলো মাথায়। এদিকে সারাকে কোনোমতেই ওঠানো যাচ্ছে না।
আজ এই মেয়ে নিজেও বকা খাবে পংক্তিকেও খাওয়াবে। পড়ালেখা বাদ দিয়ে দু’জন এই বাসায় বসে আছে দেখলে রক্ষা নেই। পংক্তি সারাকে জোর করে টেনে তোলে। সাথে সাথেই মিরা পংক্তির হাত চেঁপে ধরে,
“আন্টি নিচ্ছ কেন? খেলা শেষ হয় নাই তো।”
“মিরা,সোনাপাখি! কাল আবার খেলো। আজ সারা বাসায় যাক।”
পংক্তির কথা শুনতে নারাজ মিরা,সারা। দুটোতেই ভ্যা ভ্যা করে কান্না জুড়ে দিয়েছে। সোনিয়া রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে কান্নার শব্দ শুনে।
“কী হয়েছে পংক্তি?”
“আরে আপা দেখো কী শুরু করছে দু’টো। উনাকে তুমি চেনোই তো এসে আমাদের এসময় এখানে দেখলে রাগ করবে।”
“আমি বুঝিয়ে বলবো তুই ছাড় সারাকে। এদিকে আয়।” পংক্তির হাত ধরে টেনে রান্নাঘরে আসে সোনিয়া। সারা,মিরা অশ্রুসিক্ত চোখে হেঁসে আবার খেলায় মশগুল হয়। সোনিয়া তরকারী বাটিতে বাড়তে বাড়তে বলে,
“তোর মতো হিমান্ত ভাইকে কেউ বুঝবে না এটা তুই জানিস?”
“যাও! তুমিও না। কিসের মধ্যে কী বলো?”
“ওমা! লজ্জা পাচ্ছে কেমন করে দেখো? পাগলি একটা, এতো ভালোবাসিস মানুষটাকে তাহলে বলিস না কেন?”
“যাও তোমার সাথে কথা নেই।” লজ্জায় রক্তাভ হয়ে উঠে দাঁড়ায় পংক্তি। নত মুখে ওড়না আঙুলে প্যাঁচাতে লাগলো আনমনে। সোনিয়া তরকারীর বাটিটা পংক্তির হাতে দিল।
লজ্জায় নত হওয়া পংক্তির থুতনি ধরে মুখ তুলে বললো,
“সময় থাকতে বলে দে পংক্তি। সময় অসময় হতে দেরি করে না।” পংক্তির আরক্ত হওয়া মুখটা হঠাৎই মলিন হয়ে যায়। ছলছল চোখে তাকায় সোনিয়ার দিকে। তার মন পিঞ্জরে চিন চিনে ব্যথা অনুভব করছে। তা বুঝতে পেরে সোনিয়া মুচকি হেঁসে পংক্তির মাথায় হাত রেখে দোয়া করে।
অফিস শেষে ডাক্তারের সাথে দেখা করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল হিমান্ত। সামনে বাজার দেখে সেদিকে গেল। দুটো ইলিশ,রুই আর কিছু কাঁচা সবজি কিনতে কিনতে বেশ খানিক সময় পার হলো তার। মাছের বাজারের গন্ধে হিমান্তের পেটে মোচর দেয়। জীবন মানুষকে কতো রূপ দেখায়। কোথায় কখন কোন মোড়ে এনে ছেড়ে দেয় তা হয়তো কল্পনাও করা মুশকিল।
বড়লোক বাপের একমাত্র সন্তান হওয়ার সূত্রে অনেক আরাম আয়েশই মিলেছে তার। তবে তাতে শান্তি ছিল না। আজ সেই আরাম আয়েশ নেই তবে শান্তি আছে মনে। বাজারে দরদাম করা এখনও সে শেখে নি। তার মনে হয় দোকানিরা তার থেকে বেশিই দাম নেয়। দুনিয়াটাই এমন হয়ে গেছে, যে যাকে ঠকিয়ে জিততে পারে। হিমান্তের এসব পছন্দ না। জীবনে সে অনেক ঠকেছে। আর ঠকতে চায় না।
এখন যা আছে তাই আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টাই তার জীবনের মূল লক্ষ্য। বাসার সামনের গলিতে ঢুকতেই ফার্মেসি। সেখান থেকে একপাতা এলার্জির ট্যাবলেট নিলো হিমান্ত। ইলিশ খাওয়ার আগে এটার প্রয়োজন আছে। যাদের এলার্জির সমস্যা তাদের জীবনটাই বেদনার। গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর ঘামে ভিজে একাকার শরীর। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই বাড়িওয়ালার সাথে দেখা।
“আসসালামু ওয়ালাইকুম আঙ্কেল, ভালো আছেন আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন বাবা।”
“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।”
হিমান্তের হাতে বাজার দেখে মৃদু হেঁসে বললেন,
“বাজার করে আসলেন বুঝি?”
“জ্বী! কিছু বলবেন আঙ্কেল।”
বাড়িওয়ালা উসখুস করে একসময় সহাস্যে বললো,
“আমার মেয়ে মানে আপনার ছাত্রীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্র ফ্রান্স প্রবাসী। ওখানেই পড়াশোনা ওখানেই সেটেল এখন সে। তো পরশু গায়ে হলুদ তারপর বিয়ের অনুষ্ঠান। আপনারা সপরিবারে নিমন্ত্রিত।”
হিমান্ত হাসি মুখে দাওয়াত গ্রহণ করলো। বললো,
“গায়ে হলুদে এটেন্ড করতে না পারলেও বিয়েতে ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করবো আঙ্কেল।”
বাড়িওয়ালা মজিদ সাহেব বিনীত ভাবে অনুরোধ করলো,
“আপনাকে দুটো দিনই আসতে হবে। চাচা হয়ে ভাতিজার কাছে আবদার এটা। আমার মেয়ে স্যার বলতে পাগল। আপনি না আসলে কষ্ট পাবে তাছাড়া আপনাকে আমার বিশেষ পছন্দ।”
কথাটা বলে থেমে গেলেন বাড়িওয়ালা। সহসায় মুখে কী এক বিষন্নতা ফুটে উঠলো তার।
হিমান্ত অনুতপ্তের সুরে বললো,
“আ’ম সরি আঙ্কেল। আমার সব কথায় তো আপনি জানেন। মারিয়াকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মারিয়া অনেক ভালো মেয়ে। ও ভালো কিছু ডিজার্ভ করে। আর আপনাদের মতো মানুষ হয় না৷ আপনি আমার রক্তসম্পর্কীয় কেউ নন, তবুও অনেক কিছু হয়ে দাঁড়িয়েছেন এ ক’মাসে। আমি নিতান্তই লজ্জিত আপনাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে।”
“না! না বাবা আপনি আপনার জায়গায় সঠিক। আপনার মতো পরের ভালো কয়জন ভাবে? আল্লাহ আপনার জীবন সুন্দর করুক আঙ্কেল হিসেবে এই দুয়ায় করি। আপনি এ যুগের পুরুষ ছেলে অপেক্ষায় অনেক ভালো। সৎ, নিষ্ঠাবান। একারনেই আপনাকে আমার এতো পছন্দ।”
হিমান্ত স্মিত হাস্যে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিয়ে উপরে ওঠে। তিন মাস আগে বাড়িওয়ালা তার কাছে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব রাখে। হিমান্ত দারুন শকড হয়েছিল বিষয়টা শুনে। কী জবাব দেবে সেটাই যেন ভুলে বসেছিল তখন। বাড়িওয়ালা তাকে অত্যন্ত আদর,সম্মান করে। আসতে যেতে খোঁজ খবর নেয়। মেয়ের জন্য তিনি নাকি প্রথম দিনই হিমান্তকে মনে মনে পছন্দ করেছিলেন।
ক্রমশ হিমান্তের আচার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি এমন চূড়ান্ত প্রস্তাব দিতে মনস্থির করেন। তার আশা ভরসার মূল্য হিমান্ত দিতে পারে নি। হিমান্ত নিজের অতীত সংক্ষেপে মজিদকে জানায়। সব শুনে মজিদ সাহেব মনোকষ্ট পান। জ্বামাতা বানাতে না পেরে যতোটা কষ্ট পান তারচেয়েও দ্বিগুণ কষ্ট পান হিমান্তের সমস্যার কথা শুনে।
হিমান্ত তাকে সরাসরি বলে দিয়েছে সে কোনোদিন পিতা হতে পারবে না। এরপর অনেকদিন দু’জনের দেখা সাক্ষাৎ হলেও নিরব থেকেছে পরস্পর। ধীরে ধীরে সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়। বাড়িওয়ালা সত্যি হিমান্তকে ছেলের আসনে বসিয়েছিল। আর তাইতো হিমান্তের সমস্যার কথা তিনি তার পরিবারকে কিছুই জানান নি। অন্য সমস্যা দেখিয়ে পরিবারকে হিমান্তের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারন বুঝিয়েছেন।
বাসায় এসে গোসল সারে হিমান্ত। বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় পড়ায় মাথা ব্যথা করছে। মনিরা মেয়েটা দু’দিন ধরে মোবাইল করে না। হিমান্ত মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল করলো। কয়েকবার রিং হলো কিন্তু ধরলো না। চিন্তা হচ্ছে হিমান্তের। মেয়েটার প্রতি মায়া জন্মে গেছে। হিমান্তের জীবন বদলে দিতে মনিরা মেয়েটা দারুন অবদান রেখেছে।
অথচ ওর নিজের জীবনই অন্ধকারে রয়ে গেল। হিমান্তের অনেক ইচ্ছা মেয়েটার জন্য কিছু করার। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে হিমান্ত।
মাছ কুটে বেঁছে সারাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল পংক্তি। মোবাইলের দিকে নজর যাচ্ছে বার বার।
গুনে গুনে দশবার কল করেছে মনিরাকে সে। কল তো ধরেই নি উল্টো মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। পংক্তির বুক ফেঁটে কান্না আসছে। নিঃশব্দে কাঁদলো কিছুক্ষণ মোবাইল হাতে নিয়ে। চোখ মুছে খাবারের জন্য হিমান্তকে ডাকতে গেল। দরজায় নক করতেই ভারী গলায় ভেতর থেকে জবাব দিল,
“এসো।”
পংক্তি থমথমে মুখে দরজা ধরে দাঁড়াল। পুরো ঘরটায় ড্রিম লাইটের হালকা আলো। একনজর সামনে বসা মানুষটাকে দেখে নিল সে। নিচু স্বরে বললো,
“আপনি খাবেন না?”
“ইচ্ছা করছে না।” হিমান্তের কন্ঠস্বরে কেমন বিষন্নতা স্পষ্ট। পংক্তি আবার চোখ তুলে তাকালো। উদাসীন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ফ্লোরে হিমান্ত। দু’হাতে কিছুক্ষণ পরপর কপাল টিপছে। পংক্তি প্রশ্ন করলো,
“আপনার কি মাথা ব্যথা করছে?”
“হুম।”
“মাথা চিপে দেব?”কথাটা বলেই হিমান্তের দিকে সচকিত হয়ে তাকায় পংক্তি। হিমান্তও কম বিস্মিত হয় নি।
দু’জনের চোখাচোখি হয় এই পর্যায়ে। হিমান্ত দৃষ্টি সরিয়ে গম্ভীরমুখে বলে,
“না”
লজ্জিত পংক্তি মাথা নিচু করে চলে যেতে উদ্যত হয়। নিজের সাহসে নিজেই বিস্মিত সে। হিমান্তকে এ’কথা বলার সাহস তার কী করে হলো সেটাই ভাবছে। তার ভাবনায় ছেদ পড়লো হিমান্তের পিছু ডাকে।
“পংক্তি “
“জ্বী”
“আসো।”
হিমান্তে কন্ঠে “আসো”শব্দটায় কী মাদকতা আছে পংক্তি জানে না। শুধু বুঝতে পারছে তার দেহমনে শিহরন জেগেছে এ’কথায়। পংক্তি ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। এরমধ্যে দু’জনে একে অপরকে দেখলো একপলক। দু’জনের মনে একই গতিতে ঝড় উঠেছে। দৃষ্টিজুড়ে তারই আভাষ।
শুধু মস্তিষ্ক দ্বিধান্বিত। পংক্তি কাঁপা কাঁপা হাতে হিমান্তের কপাল টিপছে। এই প্রথম তাকে ছুঁতে পারলো পংক্তি। তার এতোকাছে এসে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। মানুষটার গায়ের সুবাস পংক্তির হৃদয় তোলপাড় করছে। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখ বন্ধ করে আছে সে। বেশকিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর হিমান্ত হঠাৎই সরে বসলো।
শীতল গলায় বললো,
“আমি রক্তে মাংসে গড়া অনুভূতি সম্পন্ন পুরুষ পংক্তি। এতো কাছে আর এসো না। ভুল হয়ে যেতে পারে।”
হিমান্ত রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। পুরো রুম জুড়ে নিরবতা এমুহূর্তে। পংক্তি নির্বাক, স্থির চোখে বসে আছে। মাথায় বার বার হিমান্তের বলা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। কথাগুলোর অর্থ সে বুঝতে চাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছে না। হঠাৎই চোখের কোনা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তার।
পর্ব ২০
দ্বিতীয় ক্লাস শেষে বেরুতেই মোবাইলে বার্তা আসার শব্দ হলো। হিমান্ত মোবাইলটা অন করে দেখলো মনিরার দশটা মিসড কল। দ্রুত কল লিস্টে গিয়ে কল করলো সে। দু’তিনবার কল হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করলো মনিরা। ভগ্ন গলার স্বরে বললো,
“ভালো আছেন স্যার।”
“এই মেয়ে কতোবার বলেছি স্যার বলতে না। আমি কী এখনও তোমার স্যার? ভাইয়া বলো।”
হিমান্তের আদুরে ধমকে মনিরা কাষ্ঠ হাসি হাসলো। বললো,
“আচ্ছা ঠিক আছে। ভাইয়া একটা কথা বলবো আজ আপনাকে। কথা দিন রাখবেন।”
“ওসব পরে শুনছি আগে বলো সমস্যার সমাধান হয়েছে? সুমন কী এখনও ঝামেলা করছে? করলে বলো। ওর ঘাড় ধরে সোজা করিয়ে ছাড়বো। আর ডাক্তার দেখিয়েছ? বাচ্চা ঠিক আছে তো?”হিমান্তের উদ্বিগ্নতা দেখে মনিরা নিঃশব্দে কাঁদে। সেই মুহূর্তে চুপ করে রইল সে।
হিমান্তকে নিজের অবস্থা বুঝতে দিতে যাচ্ছে না কোনোমতেই। চট করে নিজেকে সামলে নিল। তারপর শব্দ করে হেঁসে বললো,
“সব ঠিক আছে। আপনি আগে আমার কথাটা শুনুন প্লিজ।”
“আমার কিন্তু মোটেও তেমন মনে হচ্ছে না। তুমি আমাকে বলেছিলে সব বলবে। এখন যদি কিছু লুকাও,অনেক কষ্ট পাব আমি মনিরা।”
“কিচ্ছু লুকাচ্ছি না আমি। লুকানোর মতো কিছুই নেই আমার জীবনে। সবই তো জানেন৷ আমার সমস্যার কথা বাদ দিন এবার যেটা বলি সেটা শুনুন।”
“বলো।”
“তার আগে ওয়াদা করেন যা চাইব তাই দেবেন?”
“আচ্ছা দেব। তবে ভেবে চেও তোমার এই ভাইয়ের কিন্তু সীমিত সামর্থ্য।” হিমান্তের কথা শুনে মনিরা মৃদু হাসলো। শান্ত গলায় বললো,
“আপনার সামর্থ্যের বাইরে কিছুই চাইবো না আমি। এটাই আপনার কাছে শেষ চাওয়া আমার। প্লিজ ভাইয়া! পংক্তিকে জীবনসঙ্গিনী করুন।”
“মনিরা!”হিমান্ত চকিত কন্ঠে জবাব দিল। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না মনিরা তাকে এমন কথা বলতে পারে। মনিরা বিষন্ন স্বরে বললো,
“আপনি কথা দিয়েছেন আমাকে। প্লিজ ভাইয়া।”
“তুমি সব জেনেও এসব আবদার কী করে করতে পারো?”গলা চড়ে গেল হিমান্তের। মনিরা বললো,
“সমস্যা কোথায় বলুন? আপনি পিতা হতে পারবেন না তাই তো? পৃথিবীতে কী একা আপনিই এমন বলুন? আল্লাহ যার ভাগ্যে যা রেখেছে তাই হবে। তাই বলে জীবন তো থেমে থাকে না৷ তাছাড়া আপনার ধারণা ভুলও হতে পারে।”
“ভুল হতে পারে? কোনো ভুল টুল নেই। তুমি অন্য কিছু চাও। আমি কিছুইতেই এ’কথা দিতে পারবো না।” হিমান্তের ভেতর অস্থির হয়ে উঠছে। কী চেয়ে বসলো মেয়েটা। এটা কোনোদিন সম্ভব নয়। কোনোদিন না।
মনিরা জোর গলায় বলে,
“আপনি অস্বীকার করতে পারবেন আপনি পংক্তিকে ভালোবাসেন না? আপনি এটাও জানেন ঐ মেয়েটা আপনার ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খায় পাগল হয়ে আছে। কেন নিজের সাথে অন্যায় করছেন বলুন?”
“চুপ করো মনিরা। চুপ করো। ভালোবাসা মানে পাওয়া নয়।
ভালোবাসা অর্থ প্রিয় মানুষটিকে সুখী করা। পংক্তিকে বিয়ে করে, আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে ওর জীবনটা আমি নষ্ট করতে পারবো না। ও অবুঝ, আমি অবুঝ না। হয়তো একটু কষ্ট পাবে তবে সারাজীবন ভালো থাকবে ও। ওর ক্ষতি আমি করতে পারবো না। তাতে নিজে যতোই কষ্ট পাই না কেন!”হিমান্তের কন্ঠস্বর ধরে আসে। চোখের সীমানায় জল থই থই।
মনিরা হিমান্তের সকল যুক্তি অগ্রাহ্য করে বললো,
“পংক্তির সুখ আপনাকে ঘিরেই। আজ ওর মাঝে যে পরিবর্তন সবই আপনার জন্য। ও আপনাকে ছাড়া বাঁচবে না। তাছাড়া ওকে দূরে ঠেলে আপনি বাঁচতে পারবেন বলুন তো?”
“মনিরা কেন বুঝতে পারছ না তুমি? আমি এক ধ্বংসাবশেষ। হাড়-হাভাতে। আমার জীবনে জড়িয়ে ওর জীবনের সাধ আহ্লাদ আমি শেষ করে দিতে পারবো না।
তাছাড়া ও আমার জীবনের চরম সত্য গুলো জানে না। জানলে ওর এই কমবয়সী আবেগ নিমেষেই দূর হয়ে যাবে।”
মনিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“তাহলে আপনার কথায় রাখছি। তবে এক শর্তে?”
“আবার কী শর্ত?”
“আপনার সব কিছু জানার পরও যদি পংক্তি আপনাকে এখনের মতোই চায়, তবে আপনি মেনে নেবেন ওকে। ওয়াদা করুন।”
“মনিরা তুমি কী পাগল হয়ে গেছ?”
“আপনি হ্যাঁ বলুন।”
“মনিরা!”
“ভাইয়া প্লিজ!”
“ওকে ঠিক আছে। এখন খুশি তুমি।” মনিরা সত্যি খুশি হলো।
ওর সকল চিন্তা দূর হলো হিমান্তের কথায়। হিমান্ত মনিরার আজকের কথাবার্তা একদম স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। আজ হঠাৎ এসব কেন বললো? হিমান্ত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েক বার প্রশ্ন করেও সদুত্তর পেল না। কল কাটার আগে অদ্ভুত একটা কথা বললো। মনিরা বললো,”পংক্তি চাইলেও যেন হিমান্ত তাকে না ছাড়ে। পংক্তি অবুঝ,অল্প বয়স। তাকে সামলে রাখার দায়িত্ব আজ থেকে হিমান্তের। হিমান্ত যেন ছায়া হয়ে থাকে পংক্তির পাশে। হিমান্ত ছাড়া পংক্তির আর কেউ রইলো না। হিমান্ত যেন এই কথাটা না ভোলে।”
হিমান্ত মনিরার কথাগুলোর অনেকগুলো অর্থ দাঁড় করলো। শেষে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই মোবাইলের কল কাট হলো। হিমান্তের মন কেমন করছে যেন! কোনো অশনি সংকেতের আভাষ দিচ্ছে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। মনের ভুল হবে হয়তো ভেবে মাথা থেকে চিন্তাগুলো দূর করতে চাইলো কিন্তু হলো না। মনিরার অদ্ভুত আচরন আর কথা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে কিছুক্ষণ আগে আসা টেক্সটটার কথা বেমালুম ভুলে গেল।
সোনিয়া আজ প্রেগন্যান্সির টেস্ট করিয়েছে। টেস্ট পজেটিভ এসেছে। প্রথম সন্তান আগমনের খুশিতে আত্মহারা সে। স্বামীকে জানিয়ে পংক্তিকে জানানোর জন্য ছুটে এলো। স্কুল থেকে বেশ কিছুসময় হয়েছে পংক্তি ফিরেছে। আজও অনেক খানি পথ এগিয়ে দিয়েছে তাকে মৌসুম।
মোটামুটি ভালোই কথা হয়েছে দু’জনের মধ্যে। রায়হানের মতো মজার ছেলে মৌসুম। কথায় কথায় মানুষ হাসাতে সিদ্ধহস্ত। সোনিয়া রুমে ঢুকে পংক্তিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল। পংক্তি প্রথমে হকচকিয়ে গেল, শেষে সব শুনে হাসলো সে। পংক্তি নিজেও খুশি জাহির করলো সোনিয়ার বেবি হবে শুনে।
কথাবার্তার একপর্যায়ে সোনিয়া দুষ্টুমি করে বললো,
“তোরাও বিয়েটা করে ফেল। দু’জনই মাশাল্লাহ সুন্দর আছিস। ছেলেমেয়েগুলো আরও সুন্দর হবে। কিরে ছেলে না মেয়ে কোনটা আগে চায় তোর?”সোনিয়া শব্দ করে হেঁসে উঠলো কথাটা বলেই। লজ্জায় সোনিয়ার বাহুতে মুখ লুকিয়ে ফেলে পংক্তি।
নিচুস্বরে বলে,
“তুমিও না! গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। এখনও বিয়েই হলো না আর তুমি আছো বাচ্চা নিয়ে। সারার মামা আমাকে বউ না ছাই করবে। যে ভাব তার। আমার কী মনে হয় জানো? সে আমাকে পছন্দই করে না। কোনোদিন দেখবা একটা রূপসী বিয়ে করে হাজির হবে।” পংক্তির গলায় ক্ষোভ ঝরে। যেন এখনই কাঁদতে পারলে শান্তি পায় সে।
সোনিয়া পংক্তিকে মুখোমুখি বসিয়ে মুখ তুলে বলে,
“জি না। এটা তোমার ভুল ধারণা ছাড়া কিছুই না। তুই জানিস বাড়িওয়ালা তার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল তোর উনাকে।”
“কি বলো?”পংক্তি বড় বড় চোখে তাকায়। বুকটা হঠাৎই কেঁপে ওঠে ওর।
“হ্যাঁ! বাড়িওয়ালি সেদিন নাকি আপাকে দাওয়াত দিতে এসে কথায় কথায় বলে ফেলেছে কথাটা।”
“উনি কী বলেছিল?”প্রশ্নটা করতেই টুপ করে জল গড়ালো পংক্তির দু’চোখ বেয়ে। বিষন্নতার কালো মেঘ জমেছে চোখে মুখে। সোনিয়া মজা করে বললো,
“কী আর বলবে? হ্যাঁ বলেছিল!”পংক্তি সেই মুহূর্তে সকল শক্তি হারিয়ে বসে। মাথাটা ঘুরে গেল। পড়েই যেত ভাগ্যিস সোনিয়া ধরে বসিয়ে দেয়।
ভয়ার্ত স্বরে সোনিয়া বলে,
“এই তুই এমন করছিস কেন? এখনই তো পড়ে যেতি না ধরলে।”
“আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আপা। আমাকে বিষ দাও নয়তো মেরে ফেলো। তাকে অন্যের সাথে দেখার আগে মরেই যাবো আমি।”
“ধুরু ছেরি! আমি তো মস্করা করলাম। সোজা হ। কী ভালোবাসা মাগো মা! শুধু একটু বলছি বিয়েতে রাজি তাতেই তোর এই অবস্থা? আল্লাহ তোরে ধৈর্য্য দিক। গাধী ছেরি হিমান্ত ভাই রাজি হলে মারিয়ার অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হতো?”
“তাহলে তুমি যে বললে? উনি কী রাজি হননি?
“না! তিনি মানা করে দিয়েছেন। আমার তো মনে হয় তিনিও তোকে পছন্দ করেন। হয়তো তোর এসএসসির জন্য অপেক্ষা করছেন।”
“সত্যি বলছো?”পংক্তির দূর্বল শরীর সহসায় ঝাঁড়া দিয়ে উঠলো। আনন্দ তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে। সোনিয়া আশ্বস্ত করতেই গলা জড়িয়ে ধরে পংক্তি। পারে না খুশিতে নেচে দিতে। সোনিয়া মনে মনে দুয়া করে সে যা ভেবেছে তাই যেন হয়। নয়তো এই মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। ভালোবাসার সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে পংক্তি। হিমান্ত ছাড়া চারিদিকে অন্ধকার দেখে সে। কাঁচা বয়সের পাকা পিরিতি একেই বুঝি বলে। হয় শেষ হবে, নয় শেষ করবে।
রাতে বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে পড়াতে বসেছে হিমান্ত। মাথাটা ধরেছে খুব। অবসাদে শরীর জড় হয়ে আছে। মেজাজটাও বিশেষ ভালো নেই হিমান্তের। পংক্তি চুপচাপ মাথানিচু করে পড়ছে সামনে। হিমান্ত সারার দিকে তাকিয়ে দেখে ঘুমঘুম চোখে ঢুলছে সারা। চোখ রাঙিয়ে ধমকে ওঠে হিমান্ত,
“সারা! কী করছ? পড়ো জোড়ে জোড়ে।”
“আমি ঘুমাবো। ঘুম পেয়েছে আমার।”
“সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা। আমি আসার আগ পর্যন্ত ঐ বাসায় বসে খেলো তুমি। আর পড়তে বসলেই ঘুম?”
“তুমি আসার আগেই চলে আসি আমি। কালও এসেছিলাম৷। বলো আন্টি। তবুও তুমি ধমকাচ্ছ কেন?”
ঠোঁট উল্টে ফুঁপাতে থাকে সারা। পংক্তির মায়া হয়। চেয়ার ছেড়ে উঠতেই হিমান্তের ধমকের কোঁপে পড়ে,
“তুমি উঠছ কেন? পড়ায় ফাঁকি দিতে পারলেই মজা তোমাদের তাই না? তোমার আস্কারা পেয়ে পেয়ে এমন অধঃপতন সারার। আদর দিতে বলেছি তাই বলে আদরে বাদর বানাতে বলি নাই।” পংক্তির কিছুতেই হজম হলো না হিমান্তের এমন ব্যবহার আজ। রাগে ক্ষোভে সর্ব শরীর জ্বলছে ওর।
হিমান্ত আবার ধমক দিতেই ফুঁসে ওঠে পংক্তি,
“এতোই যখন সমস্যা বলুন চলে যাই আমি। আমিই খারাপ হয়েছে? দিন ঘাড় ধরে বের করে দিন। সবসময়ই ধমকাবে না হয় বকবে। এতোই খারাপ মনে হয় আমি! তাহলে রেখেছেন কেন? তাড়িয়ে দিন। ভালো কাওকে নিয়ে আসুন যান।”
রাগে কাঁপছে পংক্তির শরীর। সাথে কান্নার জোয়ার তো আছেই চোখে। সারা হা করে চেয়ে আছে। একবার মামার হতভম্ব হওয়া মুখটা তো একবার পংক্তির রাগে লাল হওয়া মুখটা দেখছে সে। হিমান্ত নিজের ভুল বুঝতে পেরে দু’হাতে মুখ ঢেকে ঝুঁকে বসে। মনিরার কথায় সে এতোটাই চিন্তিত ছিল যার কারনে মেজাজ গিয়েছিল চড়ে। হিমান্ত উঠে পংক্তির সামনে দাঁড়ালো।
পংক্তি নাক টেনে টেনে তখনও কাঁদছে। কী মনে করে যেন ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসলো হিমান্ত! পংক্তির বাহু ধরতে গেলে রাগে সরে দাঁড়ায় পংক্তি। হিমান্ত তা স্বত্বেও জোর করে পংক্তির বাহুজোড়া ধরে সামনে বসায়। পংক্তির মুখের দিকে ঝুঁকে বলে,
“সরি পংক্তি! “
“সরি কেন বললেন?
সরি বলা লাগবে না। আমাকে তাড়িয়ে দিন। আমি চলে যায়।” হাত দিয়ে ক্রমাগত চোখ, নাক মুছছে সে। কন্ঠস্বর কাঁপছে। এতোদিনের চাপা ক্ষোভ, অভিমান সব জাহির করে দিল আজ সে। হিমান্ত নিজ হাতে পংক্তির চোখের জল মুছে সকৌতুকে অপরাধী সুরে বললো,
“তোমাকে তাড়িয়ে দেব এমন সাধ্য আমার আছে বলো? তুমি তো এ’ঘরের প্রাইম মিনিস্টার। কাঁদে না আর। সরি বললাম তো!”পংক্তি তবুও থামে না। নত মুখে কেঁদেই যাচ্ছে সে।
হিমান্ত সারাকে কাছে টেনে পংক্তিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
“আজ কোনো পড়া টরা নেই। আজ আমরা বাইরে চটপটি, ফুসকা খেতে যাব।”
“আমি কোথাও যাব না।” পংক্তি রাগ করে উঠতেই হিমান্ত ওর একটা হাত টেনে ধরে। কিছুটা রাগেই বলে,
“কি হচ্ছে কী? এবার কী মাইর লাগাবো তোমাকে?”
“লাগান মাইর। ঐই তো পারেন।”
পংক্তির কথা শেষ না হতেই ঘাড় ধরে একদম মুখের কাছে নিয়ে আসে হিমান্ত। হিমান্তের ভারী নিঃশ্বাস এসে পড়ছে পংক্তির মুখে। বুকের ভেতর কাঁপন ধরে যায় পংক্তির। পিটপিট করে ভেজা চোখের তাকাতেই হিমান্তের রক্তবর্ণ চোখের রোষানলে পড়ে। তবুও জেদ করে চোখে চোখ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। হিমান্ত এমন শক্ত করে ঘার ধরে রেখেছে নড়তেও পারছে না পংক্তি।
আবার বেশিক্ষণ তাকিয়েও থাকতে পারছে না ভয়ে,লজ্জায়। হিমান্ত পংক্তির কানের কাছে মুখ এনে চাপা স্বরে বলে,
“মেরুন রঙের ড্রেসটা পড়ে তৈরি হয়ে নাও। আর একবার যদি চলে যাওয়ার কথা শুনেছি ঠ্যাং ভেঙে বসিয়ে রাখবো। সাহস বেড়ে গেছে তাই না? মেরে গুঁড়া করে পকেটে ভরে রাখবো। দেখব কী করে যাও।”
হিমান্ত কথা বলার একপর্যায়ে পংক্তির গালের সাথে ওর গাল ঘঁষা লাগে। পংক্তি চোখ খিঁচে বন্ধ করে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকটা দুরুদুরু করছে ওর। চোখ খুলবে সে শক্তিও নেই চোখের পাতায়। হিমান্ত কিছুক্ষণ পংক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। যেতে যেতে তৈরি হওয়ার জন্য সারা,পংক্তিকে তাগাদা দেয়। পংক্তিকে মরার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে সারা বিছানায় দাঁড়িয়ে বলে,
“কী হয়েছে আন্টি?”
“মরণ হয়েছে আমার। তোর মামা আমাকে মেরেই ফেললো রে সারা। এতো কাছে কেউ আসে বল? আমার হৃদপিণ্ড ফাঁটতে ফাঁটতে ফাটলো না।” বিছানায় ধপ করে বসে বুকের বা’পাশ শক্ত করে চেপে ধরে ব্যথাহত স্বরে বিড়বিড় করে,”আর কতো পুড়াবে সখা তোমার প্রেমানলে,
কাছে এসে দূরে ঠেলার এ’খেলা তোমার শেষ হবে কবে?
হয় মারো নয় তোমার বুকে টানো।
এমন করে বিরহের তুস অনলে আমায় আর না জ্বালো।”
পর্ব ২১
জনবহুল এই শহরের মানুষের মাঝে ছুটে চলার ব্যস্ততা। লাল, সবুজ বাতির ইশারায় থামে চলে গাড়িগুলো। কর্মব্যস্ততায় ভাটা পড়লেও পুরোপুরি মিইয়ে যায় নি। যেদিকে চোখ যায় মানুষের পদচারনায় মুখরিত। গাড়ির হর্নের কর্কশ আওয়াজ সাথে মানুষের হাক ডাকে অন্ধকারের নিস্তব্ধতা যেন ম্লান হয়েছে এখানে।
পংক্তি ফুচকার প্লেট থেকে একটু একটু করে ফুচকা খাওয়াচ্ছে সারাকে। হিমান্ত আড়চোখে লক্ষ্য করছে একটা ফুচকাও পংক্তি মুখে দিচ্ছে না। ফিরেও তাকাচ্ছে না সে হিমান্তের দিকে। রাগ হচ্ছে হিমান্তের পংক্তির উপর। চোয়াল শক্ত করে চাপা স্বরে বললো,
“খাচ্ছ না কেন?”
“খাব না!”অভিমানী স্বরে কাট-ছাট জবাব দিল পংক্তি। হিমান্ত এবার আরও রেগে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে পংক্তির হাত চেঁপে ধরলো খুব জোরে। ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে পংক্তি। হিমান্ত তাতেও ছাড়লো না হাত।
ধমকে বললো,
“চুপচাপ খাও। আরও দুই বাটি খাবা তুমি। আমার উপর রাগ দেখাও। এতো ঝাল কথায় তোমার? ঝালে আজ ঝাল কাটাবো ওয়েট!”ওড়নার অবগুন্ঠনের ফাঁক দিয়ে ভ্রুকুটি করে তাকায় পংক্তি। হাতের ব্যথায় চোখ সজল হয়ে উঠেছে তবুও পাষান লোকটা ছাড়ছেই না তাকে।
হিমান্ত স্থির চোখের তারায় পংক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে ফুচকাওয়ালাকে বললো,
“বেশি ঝাল দিয়ে দুইপ্লেট ফুচকা দিন তো মামা।”
পংক্তির মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দেয় হিমান্ত। সারাকে টেনে কোলে বসিয়ে নরম গলায় বলে,
“আরও খাবা মা?”
“না।”
“তাহলে মামার কোলে বসে আন্টির ফুচকা খাওয়া দেখো। আন্টির ঝাল খুব পছন্দ তো! তাই আজ ঝাল খাওয়াবো আন্টিকে।” সারা মুচকি হাসে। ওর সরল মনে মামার গড়ল চিন্তা প্রবেশ করে নি। সে উৎসুক চোখে অপেক্ষা করছে পংক্তির খাওয়া দেখবে বলে। পংক্তির জেদ চেপেছে হিমান্তের খোঁচা মারা কথা শুনে।
সে সব খাবে। তারপর যা হয় দেখা যাবে। হিমান্ত যদি তাকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায় তবে তাই হবে। দুইপ্লেট ফুচকা সামনে সাজানো। পংক্তি দুটো ফুচকা মুখে দিতেই জিহ্বা জ্বলতে লাগলো। এখনও আঠারোটা বাকি। ঝালের কারনে ইতোমধ্যে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করছে ওর। হিমান্ত একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে।
তার চোখের ভাষা বিভ্রান্তিকর। পংক্তি একটা একটা করে দশটা মুখে দিল। চোখ, মুখ,ঠোঁট লাল হয়ে গেছে ঝালে। কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে মনে হলো। তবুও পংক্তি শেষ প্লেটটার দিকে হাত বাড়ায়। হিমান্তের স্থির, কঠিন দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে মুচকি হাসে সে। পংক্তি হাত বাড়াতেই হিমান্ত প্লেটটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়।
পংক্তিকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে টপাটপ মুখে পুড়ে ফেললো সবগুলো ফুচকা। অবস্থা বেহাল হিমান্তের। সে বরাবরই ঝাল কম খায়। আর এ’তো পুরো বোম্বে মরিচ। সাত সমুদ্র তের নদীর পানি খেলেও বুঝি ঝাল যাবে না মুখ থেকে। দ্রুত দাম চুকিয়ে সারাকে কোলে নিয়ে, অন্যহাতে পংক্তির হাতটা শক্ত করে ধরে হাঁটা ধরলো সে।
পংক্তি নিজেও ঝালে কাহিল তবুও লোকটার মুখ দেখে ওর বেশিই কষ্ট হচ্ছে। ফর্সা গাল পাকা ডালিমের মতো টকটকে লাল হয়ে গেছে। বাসায় এসেই রুমে ঢুকে পড়লো হিমান্ত। মুখে বালিশ চাপা দিয়ে চিৎকার করলো ঝালের কারনে। সামনে রাখা পানির বোতলের সবটুকুই খেল তবুও অবস্থার উন্নতি হলো না। চুলমুঠ করে গোঙাচ্ছে সে।
তখনই কেউ সামনে এসে বসলো তার। অন্ধকারে মুখতুলে তাকালো হিমান্ত। হাঁটুমুড়ে সামনে বসে আছে পংক্তি। দৃষ্টিজোড়া আফিমের চেয়েও নেশাচ্ছন্ন। হিপনোটাইজের মতো হয়ে রইল কতোক্ষন হিমান্ত। পংক্তির কোমল হাতটা তার হাত স্পর্শ করতেই সচকিত হয় সে।
নড়েচড়ে ধমকের সুরে বলে,
“এখানে কী করছ? রুমে যাও।”
“ঝাল দেওয়া ফুচকা খেলেন কেন আপনি?”
পংক্তির গলার স্বর ছায়াপড়া পুকুরের জলের মতো শীতল,শান্ত। দৃষ্টিতে তার মোহনীয়তা। হিমান্ত বিব্রতবোধ করলো।
বললো,
“সব কথা তোমাকে বলা লাগবে? যাও রুমে যাও।”
“আমাকে কষ্ট দিতে না পারলে যান কেন সে চেষ্টা করতে? কষ্ট দিয়ে দূরে ঠেলতে চান তাই না? আপনার সে গুঁড়ে বালি। যতো দূরে ঠেলবেন ততোই কাছে আসবো। ঠিক এমন করে।
“কথা শেষ করেই হিমান্তের ঠোঁটে গভীর চুম্বন করে বসে পংক্তি। মুখে মধু এনেছিল কি’না কে জানে? হিমান্তের ঝাল নিমেষেই গায়েব হয়ে গেল তাতে। হিমান্তের ঘোর কাটলো কিছুক্ষণ পরই। ঘোর কাটতেই ধাক্কা মেরে ফেলে দিল পংক্তিকে। পংক্তির আবেগের রেশ কাটার আগেই হিমান্ত বাহুধরে টেনে তুলে রুমের বাইরে বের করে দিল।
পংক্তির মুখের উপর শব্দ করে দরজা লাগিয়ে রুদ্ধ হওয়া দম ছাড়লো হিমান্ত। পংক্তি স্থির চোখে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে তার অন্য ভাব। এই পংক্তিকে দেখলে কে বলবে এই মেয়েই একদিন ভয়ে তটস্থ থাকতো। অথচ আজ সে এমন কিছু করলো যা তার কল্পনার বাইরে ছিল। পংক্তি জোরে জোরে শ্বাস ফেলে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
টানা একঘন্টা শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজলো পংক্তি। মাথার যন্ত্রণা কমেছে এতোক্ষনে। হালকা লাগছে দেহ। কাপড় পড়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইলো ঘুমন্ত সারার পাশে। শরীর কাঁপছে পংক্তির। চোখের পাতা অবশ হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল পংক্তি।
রাত তিনটে বেঁজে দশ মিনিট। ঘুটঘুটে অন্ধকার রুম জুড়ে। অন্যদিনের মতো এক ছটাক আলোও যেন কোথাও নেই এ’রুমের। পংক্তির ঘুম ভেঙে গেল। ক্ষুধা লেগেছে খুব। শরীরটাকে টেনেটুনে বিছানায় বসলো পংক্তি। তখনই চোখে পড়লো জানালার পর্দার পেছনে মনুষ্য আকৃতির অবয়ব। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল জলের স্রোত নেমে গেল পংক্তির। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো,
“কে?”
খ্যাঁচখ্যাঁচ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই এলো না জবাবে। পংক্তি হিমান্ত ভেবে কাঁপা স্বরে আবার প্রশ্ন করলো,
“হিমান্ত আপনি?”শান্ত রুমটার আবহাওয়া হঠাৎই অশান্ত হয়ে উঠলো। যেন হিমান্ত নাম শুনে বড়ই নাখোশ সে। কালবৈশাখীর প্রবল বাতাসের মতো জানালার পর্দা উড়ছে।
পংক্তি ঘাবড়ে গেল সেই মূহুর্তে। লাইট অন করতে যাবে সে সামর্থ্যও তার শরীরে নেই। অকস্মাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল রুমটার মধ্যে দিয়ে। সেই আলোয় অস্পষ্ট ভাবে দেখলো জানালার পাশে দাঁড়ানো সেই অবয়বকে। অবয়বটি অন্ধকার ঠেলে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো পংক্তির সম্মুখে। ভয়ে কন্ঠরুদ্ধ পংক্তির। চিৎকার করতে চেয়েও পারছে না সে।
আবার বিদ্যুৎচমক হলো। সেই আলোয় স্পষ্ট দেখলো অবয়বটিকে। পংক্তি এতোক্ষন যাকে অবয়ব মনে করেছিল সেটা ছিল হিমান্ত। সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো হিমান্তের শরীরে। চিতায় পোড়া লাশের মতো জ্বলছে হিমান্ত। নির্বাক অনুভূতিশূন্য মৃতদেহের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে।
চোখজোড়া শুধু ছলছল তার। তার সকল ব্যথা ঐ চোখের মনিকোঠায় বন্দী হয়ে রয়েছে যেন। পংক্তি এ দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না। বিকট আর্তচিৎকার করে জ্ঞান হারালো সে।
পংক্তির জ্ঞান ফিরলো ভোরে। শিওরে সোনিয়া বসেছিল। চিন্তায় মুখটা তার একটুখানি। পংক্তিকে চোখ খুলতে দেখে স্বস্তি পেল সে।
হিমান্তকে ডাক দিতেই হিমান্ত ছুটে এসে পংক্তির মাথায় হাত রাখলো শিওরে বসে। উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
“পংক্তি, শুনছ?”ভয়,দূর্বলতায় আড়ষ্ট হয়ে আছে পংক্তির কন্ঠস্বর। জবাব দিতে চেয়েও দিতে পারছে না। হিমান্তের শক্ত কঠিন মনটা নদীর জোয়ারে তীর ভাঙার মতো ভাঙতে লাগলো।
পংক্তির গালে হাত রেখে ধরা গলায় বললো,
“কষ্ট হচ্ছে?”হিমান্তের ভেজাচোখ জোড়া দেখে রাত্রের কথা মনে পড়ে গেল পংক্তির। সর্বশক্তি সঞ্চয় করে জাপটে ধরলো হিমান্তেকে। হিমান্তের শরীরের হাত বুলাতে বুলাতে অস্ফুটে স্বরে বললো,
“আপনার কিছুই হবে না। আমি হতেই দেব না।”
হিমান্তের কপালে ভাঁজ পড়লো পংক্তির ভয়ার্ত স্বরে বলা কথাগুলো শুনে। পংক্তিকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো হিমান্ত। কী এক ভয়ানক আতঙ্ক সেই মূহুর্তে গ্রাস করলো তাকে!
রায়হান আজ তিনদিন ধরে রুম ছেড়ে বেরোয় না।
কয়েকবার চেষ্টা করেছে ধারালো ব্লেড শিরায় চালাতে কিংবা ফ্যানে ঝুলানো চাদরে ঝুলে পড়তে। কিন্তু সাহসে কুলাচ্ছে না। প্যাকেটের পর প্যাকেট সিগারেট শেষ করছে রায়হান। ফ্লোরে তারই উচ্ছিষ্ট ছড়ানো ছিটানো। জীবন তাকে এ কোন পরীক্ষায় ফেলল? সে এখন কী করবে? যাকে এতো দিন মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসলো সে মেয়ে নয় একজন ছেলে! এক বছরের সম্পর্ক মৃদুলার সাথে তার।
ফেসবুকে পরিচয় তারপর প্রেম। সম্পর্কের গভীরতা বাড়লে নানা সময়ই দেখা হয়েছে ওদের। রায়হান ভালোবাসায় এতোটাই অন্ধ হয়ে গেছিল যে, মৃদুলার আড়ালের মৃদুলকে সে আবিষ্কার করতেই পারে নি। গত পরশু তারা গাজিপুরে এক রিসোর্টে গিয়েছিল। সেখানে গিয়েই মৃদুলা তাকে নিজের সত্যটা জানায়। মৃদুল জানায় স্কুলজীবন থেকেই সে গে। তার কয়েকজন সহপাঠীও এমন ছিল।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে পাল্টাতে থাকে। নিজেকে সম্পূর্ণ নারী ভাবতে থাকে সে। তার পরিবারের কেউই এ বিষয়ে জানে না কারন তাদের সবার অলক্ষ্যে সে মৃদুলা। রায়হানকে মৃদুল ওরফে মৃদুলা বোঝায় গে হওয়াটা তার সৃষ্ট নয়। এটা জেনেটিক বিষয়। প্রকৃতিগত ভাবেই সে শরীরে তো ছেলে কিন্তু মনের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ মেয়ে। তার কামনা কোনো মেয়ে নয় বরং ছেলে। সোশাল সাইটে রায়হানকে দেখামাত্রই তার মধ্যে কামনাভাব জাগে।
ভালোবাসতে ইচ্ছা হয়েছে। রায়হানকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসে তাইতো নিজের সত্যটা তারই কাছে উন্মোচন করলো। এবার রায়হান যদি তাকে অস্বীকার করে, তবে তার সামনে আত্মহননের পথ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। রায়হান সব শুনে কোনোমতে ছুটে পালিয়ে এসেছিল সেদিন। পালিয়ে এসে কোনো লাভ হয় নি রায়হানের কারন সে মৃদুলার প্রতি অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। মৃদুলাকে ভোলা তারপক্ষে কঠিন।
মৃদুলার পুরুষ হওয়ার সত্য উন্মোচিত হওয়ার পরও আবেগ কমে নি তার প্রতি রায়হানের। কারন সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না মৃদুলার সত্য। এদিকে মোবাইলে নানা ভাবে রায়হানকে বোঝাচ্ছে মৃদুল। নিজের হাত কেটে ছবি তুলে পাঠিয়েছে, আকুতি করছে তার ডাকে সাড়া দিতে। দরকার হলে তারা ফরেন সেটেল হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে সমকামিতা বৈধ।
রায়হানের বড় ভাই রেজওয়ান সিদ্দিকী সিলেট গিয়েছিল মাসখানেকের জন্য। গতপরশু ফিরেছে সে। ফেরার পর থেকে একবারও ছোট ভাই রায়হানের মুখ দেখে নাই। তারউপর কিছুক্ষণ আগে মা চিন্তিত মুখে এসে বলে গেল রায়হান ঘরবন্দি তিনদিন ধরে। রেজওয়ানের চিন্তা হচ্ছে ভাইকে নিয়ে। স্ত্রী রিমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“রিমা, রায়হানের বিষয়ে কিছু জানো তুমি?”
“তোমার ভাই কারো কথা কী শোনে? বাবা নিষেধ করার পরও ঐ হিমান্তের সাথে সম্পর্ক রেখেছে। আবার ইদানিং দেখছি কেমন উদ্ভট আচরন করছে। আমি কিছু বললে তো দশ কথা বলে দেয়। আমার কোনো মূল্য আছে নাকি এ’বাড়ি। বাবা আমাকে তোমার মতো একটা মোল্লার সাথে বিয়ে দিয়ে আমার জীবনটাই শেষ করে দিল।
এটা মানা সেটা মানা। সব কিছুতেই তোমাদের সমস্যা। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না তোমার পরিবারের লোকজন সম্পর্কে।” মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল রিমা। রিমার সাথে রেজওয়ানের বৈবাহিক সম্পর্ক তেমন স্বাভাবিক নয়।
রেজওয়ান জানে রিমা তাকে এখনও মন থেকে মানতে পারে নি। এ যুগের আধুনিকা নারী সে। রেজওয়ানের মতো দাড়িওয়ালা, পাঞ্জাবি, টুপি পড়া ছেলে তার অপছন্দ।
রেজওয়ান হাসিমুখে স্ত্রীকে নানাভাবে বোঝায়। আরহাম জন্মের পর থেকেই কিছুটা নরম হয়েছে রিমার মন। কিন্তু পুরোপুরি নয়। রেজওয়ান চায় রিমা তাকে পরিপূর্ণ ভাবে মেনে নিক। দু’দন্ড হেঁসে বুকে মাথা রাখুক কিন্তু এমনটা হয় না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রেজওয়ান। ছোট ভাইয়ের দরজায় কয়েকবার টোকা দেয়। রায়হান প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে দরজা সামান্য একটু খোলে। অবজ্ঞায় মুখটা সিটকে বলে,
“কী বলবে বলো?”
“ভাইকে সালাম দিতে হবে না? সালাম,,,,
“ভাইয়া প্লিজ! তোমার নসিয়ত অন্য একদিন শুনবো। এখন প্লিজ যাও তুমি।” রায়হান মুখের উপর দরজা লাগাতে গেলে, রেজওয়ান দরজা ধরে হালকা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। পুরো রুমে সিগারেটের ধোঁয়ার উৎকট গন্ধ। জানালা বন্ধ থাকায় ভ্যাপসা গরমের আঁচ লাগছে গায়ে। রেজওয়ান নাকে হাত চেঁপে জানালা খুলে দিল। সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলানো চাদর, সাইড টেবিলে রাখা ব্লেড দেখে আৎকে উঠলো সে।
আতঙ্কিত চোখে চেয়ে বললো,
“এসব কী রায়হান? কি হয়েছে ভাই আমার? বল!”রায়হানের কাঁধে হাত রেখে সজোরে ঝাকুনি দিল রেজওয়ান। রায়হানের শক্ত কঠিন মুখ সহসায় করুন হতে লাগলো। শব্দ করে কেঁদে ভাইকে জড়িয়ে ধরে টেনে টেনে বললো,
“ভাইয়া হেল্প মি প্লীজ! আমি মরতে চাই না। আমি মৃদুলাকে চাই ভাইয়া। আই লাভ মৃদুলা।”
রেজওয়ান বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবেই নেওয়ার চেষ্টা করলো। রায়হানকে বিছানায় বসিয়ে স্বান্তনার সুরে বললো,
“ভালোবাসলেই মরতে হবে নাকি পাগল? ভালোবাসা তো বাঁচতে শেখায়,নতুনভাবে জীবনটা উপভোগ করতে শেখায় তাহলে মরতে কেন চাচ্ছিস তুই? ওহ! বুঝেছি ভয় পাচ্ছিস বাবা মানবে কি না? আমি আছি না? আমি বাবাকে বোঝাব। সাহস রাখ মনে। নিয়ত অটুট রাখ।”
রায়হান ভাইয়ের দিকে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে আছে। ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক তার তেমন একটা গভীর নয়। কারনটা ভাইয়ের জীবনপদ্ধতি। রেজওয়ান তাকে সবসময়ই ইসলামিক জীবনপদ্ধতিতে চলতে বলতো যেটা রায়হানের মনঃপুত হতো না। একারনেই এড়িয়ে চলতো ভাইকে সে।
অথচ আজ মনে হচ্ছে ভাই তার কতো কাছের। সবই সে ভাইকে বলতে পারবে অবলীলায়। তাই হলো, মৃত্যুর ছায়া থেকে পরিত্রাণ পেতে একে একে সব কথা খুলে বললো ভাইকে রায়হান। রেজওয়ান এমন ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কয়েকমিনিট লাগলো স্বাভাবিক হতে তার। ভাইয়ের বিমর্ষ, করুন মুখটা দেখে কষ্ট হলো রেজওয়ানের।
চোখের সম্মুখে বন্ধুসম ভাই হিমান্তকে শেষ হতে দেখেছে এমনই এক অনাচারের জন্য। কারন ভিন্ন হলেও দু’টোই হচ্ছে ইসলামে নিষিদ্ধ এবং ঘৃণিত বিষয়। রায়হানের বেলায় সমকামিতা আর হিমান্তের বেলায় ব্লাক ম্যাজিক বা কালো জাদু। হিমান্তকে সে যন্ত্রণার কবল থেকে মুক্ত করতে পারে নি তবে ছোট ভাইকে ঐ পথে যেতে দেবে না রেজওয়ান।
আল্লাহ পাক হয়তো তার পরীক্ষা নিচ্ছে। আতঙ্কে অশান্ত হওয়া রেজওয়ানের মনটা ভীষণ রকম কষ্ট পাচ্ছে। তার প্রিয়জনদের সে বিপদের সম্মুখীন হতে দেবে না। রেজওয়ান লম্বা শ্বাস নিল। মনে মনে আল্লাহ পাকের কাছে শুকরিয়া করলো সঠিক সময়ে সত্যিটা জানতে পারায়। রায়হান বড় আশা নিয়ে চেয়ে আছে ভাইয়ের মুখপানে।
রেজওয়ান হাসার চেষ্টা করে বললো,
“তুই লূত (আ) নাম শুনেছিস রায়হান?”
“হ্যাঁ! উনি আল্লাহর একজন নবী ছিলেন।”
“তার কওম বা জাতি কী জন্যে ধ্বংস হয়েছে জানিস?”রায়হান বিরক্তবোধ করলো ভাইয়ের প্রশ্নে। মাথা নাড়াল সে জানে না। ভাইয়ের বিরক্তি বুঝে রেজওয়ান মুচকি হাসলো। রায়হানের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললো,
“নবী লূত ( আ) এর কওমের লোকেরা একপর্যায়ে সমকামিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের অনেক বোঝানোর পরও তারা নবীর কথা অগ্রাহ্য করে। তারাই ছিল পৃথিবীর বুকে প্রথম সমকামিতা সৃষ্টি কারী।
সমকামিতা ইসলামের চোখে ঘৃণিত। পৃথিবীর মধ্যে যত ঘৃণিত কাজ মনুষ্য দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে সমকামীতা তার মধ্যে অন্যতম। ইসলামে সমকামিতা জঘন্য পাপ বলে গন্য। এটা জাতি বিধ্বংসী। হাজার বোঝানোর পরও যখন লূত(আ) এর কওমের লোকেরা সমকামিতা ছাড়লো না তখন আল্লাহ পাকের তরফ থেকে তাদের উপর নেমে এলো গজব। পবিত্র কোরআনের সূরা হুদে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে
আয়াত-৮২ অর্থ : অবশেষে যখন আমার হুকুম এসে পৌঁছাল, তখন আমি উক্ত জনপদকে উপরকে নীচে করে দিলাম এবং তার উপর স্তরে স্তরে কাঁকর পাথর বর্ষণ করলাম।
জর্ডানে অবস্থিত ডেড সি বা মৃত সাগর সেই গজবেরই চিহ্ন বহন করছে রায়হান। এই সাগরের বিশেষত্ব হলো এখানে কেউ ডোবে না। এমন অনেক সমকামী জাতির উপরই নেমে এসেছে গজব। ইতিহাস এখনও সেসবের সাক্ষ্য বহন করে।”
“কিন্তু ভাই মৃদুলা বলেছে সমকামীতা জেনেটিক। এতে ওদের কোনো হাত থাকে না। তাহলে ওরা কেন দোষী হবে বলো? প্রকৃগত ভাবে প্রাপ্ত যৌনপ্রবৃত্তির কাছে তারা তো নিরুপায়।”
“আমি যদি বলি সমকামিতা জেনেটিক নয় তাহলে বিশ্বাস করবি তুই? আচ্ছা চল তোকে বিজ্ঞানীদের ভাষায়ই বলি। নব্বইয়ের দশকে সমকামীতা নিয়ে রিসার্চ করা হয়। যে রিসার্চ করেছিল সে বলেছিল সমকামীতা জেনেটিক। সমকামী জিন থাকে বলেই নাকি মানুষ সমকামী হয়। কিন্তু তার এই থিওরি ভুল প্রমানিত করে রবার্ট নাইট, জর্জ রাইস। তারা প্রমাণ করে সমকামী জিন বলে কোনো জিন মানুষের মধ্যে নেই।
তাহলে কি এটাই প্রতিয়মান হয় না সমকামীতা কোনো জেনেটিক বিষয় না। তাই সব দিক দিয়ে বিচার করলে এটাই প্রমাণিত সমকামিতা গর্হিত কাজ। যতো আধুনিক যুক্তিই আসুক না কেন সমকামিতা বৈধ নয়। কারন মহান আল্লাহ এটাকে বৈধতা দেয় নি। আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
“স্মরণ কর লূতের কথা, তিনি তাঁর কওমকে বলেছিলেন, তোমরা কেন অশ্লীল কাজ করছ? অথচ এর পরিণতির কথা তোমরা অবগত আছ! তোমরা কি কামতৃপ্তির জন্য নারীদেরকে ছেড়ে পুরুষে উপগত হবে?
তোমরা তো এক বর্বর সম্প্রদায়। উত্তরে তাঁর কওম শুধু এ কথাটিই বললো, লূত পরিবারকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক যারা শুধু পাকপবিত্র সাজতে চায়। অতঃপর তাঁকে ও তাঁর পরিবারবর্গকে উদ্ধার করলাম তাঁর স্ত্রী ছাড়া। কেননা, তার জন্যে ধ্বংসপ্রাপ্তদের ভাগ্যই নির্ধারিত করেছিলাম।”
(কুরআন 27:54-57)
সমকামিতা মানসিক রোগ। নিয়মিত কাউন্সেলিং, ট্রিটমেন্টে এটা থেকে সুস্থতা মেলে। সবচেয়ে বড় কথা আল্লাহ ভীতি থাকলে সে কখনও এমন পাপের পথে পা বাড়াবে না। আর তার জন্য আমাদের ইসলামকে আঁকড়ে ধরতে হবে। ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। নয়তো ঐদিন দূরে নয় যেদিন আমাদের অবস্থাও লূত( আ) জাতির মতো ভয়াবহ হবে।
“জাবির (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স) বলেছেন, আমি আমার কওমের জন্য সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা আশঙ্কা করি সেটা হল লুতের কওম যা করত সেটা যদি কেউ করে… “(তিরমিজি, 1457)
পর্ব ২২
“ভাইয়া আমার ভয় করছে। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো ভাইয়া। আমি ধ্বংস হতে চাই না, আল্লাহর অসন্তোষে পড়তে চাই না। আমাকে বাঁচাও ভাইয়া। আমি শান্তির জীবন চাই।” রায়হান রেজওয়ানকে দু’হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে সে। রেজওয়ান ছোট ভাইয়ের সুমতিতে খুশি।
রায়হানের মাথায় চুমু দিয়ে সিক্ত স্বরে বললো,
“সব কিছুর মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআ’লা। তিনি রহমানুর রাহিম! তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর রায়হান। তিনি বান্দার খালি হাত ফেরান না। জানিস রায়হান, আল্লাহ যার কল্যাণ কামনা করেন সেই হেদায়েত প্রাপ্ত হয়। শক্ত হ ভাই। মন দিয়ে নয় বিবেক দিয়ে চিন্তা কর। তারপর সিদ্ধান্ত নে সঠিক পথে চলবি নাকি বিপথে পা বাড়াবি।”
“আমি সঠিক পথে যাব ভাইয়া। আমাকে সঠিক পথ দেখাও।”
“আল্লাহ তোর সহায় হোন। আল্লাহ পাক ও তার রাসূলের দেখানো পথে চল ইনশাআল্লাহ তিনিই তোকে সঠিক দিশায় নিয়ে যাবেন। তুই শুধু আল্লাহর উপর অটুট বিশ্বাস রাখ ভাই আমার।”
রায়হান মনে স্বস্তি ফিরে পায়। ভাইয়ের চোখে তাকিয়ে সে শরীরে পুনরায় জোর উপলব্ধি করে। রেজওয়ান নিজ হাতে রায়হানের রুম পরিষ্কার করে। রায়হান বিস্মিত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ভাইকে তার একসময় অসহ্য লাগতো আর আজ মনে হচ্ছে সেরা মানুষ তার ভাই। কী মায়া, মততা মেশানো পবিত্র মুখটায় অথচ একদিন রাগ হতো এই মুখ দেখতে। আজ নুরানি লাগছে। চক্ষু,অন্তর প্রশান্ত হচ্ছে ভাইকে দেখে। এই পরিবর্তনের কারন কী? রায়হানকে একদৃষ্টিতে তাকাতে দেখে হাত মুছে পাশে বসে রেজওয়ান। সহাস্যে বলে,
“এভাবে তাকিয়ে আছিস যে?”
“আচ্ছা ভাইয়া আজ তোমাকে এতো পবিত্র, সুন্দর লাগছে কেন? তোমার হাসিতে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে।”
“কারন তোর মন পবিত্র হয়েছে আজ। যার মন পবিত্র থাকে তার চোখে সবই সুন্দর মনে হয়। আল্লাহর সৃষ্টির প্রকৃত রূপ দর্শন করে সে তখন।”
রায়হান মুগ্ধ হয়ে সব কথা শোনে। আজ তার কাছে সবই ভালো লাগছে। মনে নাপাকি, সঙ্গত খারাপ হলে এই ভালোলাগাটা আসে না। তখন সুন্দর জিনিসও অসুন্দর মনে হয়। রেজওয়ান রায়হানকে বোঝায় মৃদুলার বিষয়ে সে যেন কাওকে কিছু না বলে। রায়হান প্রশ্ন করলে রেজওয়ান বোঝায়। আমাদের উচিত না যাকে তাকে নিজেদের গোপনীয় কথা জানানো। ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা) বলেছেন, গোপন কথা যতক্ষণ তোমার কাছে আছে সে তোমার বন্দী। কিন্তু কারো নিকট তা প্রকাশ করা মাত্রই তুমি তার বন্দী হয়ে গেলে।
তাই রায়হান, যার কাছে তোমার কথা নিরাপদ থাকবে এবং ভালো কিছু পরামর্শ পাবে শুধু তাকেই বলো, অন্যথায় বলো না। তাছাড়া একজন মুসলমান অপর মুসলমানের দোষ গোপন করলে কেয়ামতে আল্লাহ তাআ’লা তার দোষ গোপন করবেন। মৃদুলাকে আমি বোঝাবো। সে বিশ্বাস করে তোকে একটা কথা বলেছে সেটা এমন কাওকে বলিস না যার কারনে ওকে অপদস্থ হতে হয়। রায়হান এবার সম্মত হয় ভাইয়ের কথায়।
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে দুই ভাই মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আরিফ সিদ্দিকী মসজিদেই ছিলেন। ছোট ছেলেকে পাঞ্জাবি,টুপি পরিহিত দেখে অবাক হোন। রায়হানের হঠাৎ পরিবর্তন তাকে যতোটা অবাক করে তারচেয়েও বেশি আনন্দিত করে। তিন বাপ বেটা সানন্দে নামাজে দাঁড়ায়।
আজ মোনাজাতে কেঁদেছেন আরিফ সিদ্দিকী। মনের এককোনে আর এক চিলতে আশা বেঁধেছেন রায়হানের মতো তার বড়ভ্রাতার পরিবর্তনের। শেষ বয়সে এসে ভাইয়ের কথা তার আজকাল বেশিই মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে মন চায় সকল রাগ,অভিমান ভুলে ভাইয়ের কাছে ছুটে যেতে কিন্তু পারেন না,আত্মসম্মানবোধে বাঁধে।
নামাজ শেষে রেজওয়ান চলে এসেছে কিন্তু রায়হান আসে নি। ইমাম সাহেবের পাশে বসিয়ে দিয়ে এসেছে রেজওয়ান তাকে। এই সময়টা ইমাম সাহেব মসজিদে আগত যুবক, বৃদ্ধসহ সববয়সীদের সম্মুখে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। উদ্দেশ্য পথভ্রষ্টদের নিকট ইসলামের আলো পৌঁছে দেওয়া। মসজিদ মুখী করা।
রেজওয়ান বাড়ির গেটে ঢুকতেই মা এবং স্ত্রীর মুখোমুখি হয়। দু’জনই সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও তার মা হিজাব পড়েছে কিন্তু স্ত্রী রিমা পড়ে নি। এটা দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল রেজওয়ানের।
মুখটা গম্ভীর করে স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বললো,
“হিজাব বাঁধো নি কেন? তোমাদের দু’জনরই উচিত পরিপূর্ণভাবে পর্দা করা। ইসলামে পর্দা ফরজ।”
“দেখলেন তো মা! আপনাকে বলিনি আগে আগে বের হই, আপনার ছেলের সামনে পড়লেই হাদিস শুনাবে। মিললো তো?”রিমার কন্ঠস্বরে ক্ষোভ আর বিরক্তির মিশ্রন। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছে তার।
রেজওয়ান সেটা দেখে পুনরায় বললো,
“আমি জানি আমার কথায় তুমি রাগ করেছ কিন্তু তাতে কিছুই করার নেই আমার রিমা। তোমাদের জন্য আমি দাইয়ুস ব্যক্তিদের খাতায় নাম লেখাতে পারবো না। তাছাড়া তোমাদের আমি ভালোবাসি। আমি চাই আমার ভালোবাসার মানুষগুলো ভালো থাকুক সেটা হোক ইহকাল কিংবা পরকাল। আশা করি আমার কথা বুঝেছ তুমি। আমাকে জাহান্নামী করতে যদি দাইয়ুসের তালিকায় তুলতে চাও তাহলে কিছুই বলার নেই আমার।”
রেজওয়ান কিছুটা রাগ করেই বাসায় চলে এলো। কিছুক্ষণ পর রিমাও এলো। মুখ ফুলিয়ে রেজওয়ানের কিনে দেওয়া আবায়া পড়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল সে। রেজওয়ান মুচকি হাসলো রিমার যাওয়ার পথে চেয়ে।
হিমান্তর বাড়িওয়ালার মেয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হচ্ছে ছাঁদে। লাল, নীল মরিচ বাতির আলোয় সন্ধ্যের পূর্বলগ্ন বড়ই মনোরম লাগছে। চারিপাশে সাউন্ড বক্স থেকে ভেসে আসা হিন্দি, বাংলা গানে তাতে যেন আমেজ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পংক্তি হলুদ শাড়ি আর হিজাব বেঁধে সোনিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সারা,মিরা গানের তালে তালে একবার হাত নেড়ে তো আরেকবার লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে। সবার দৃষ্টি একটু পরপরই পড়ছে ওদের উপর। হবু নববধূ মারিয়া হলুদ শাড়ি আর অর্কিড ফুলের গহনা পড়ে স্টেজে বসে আছে। আনন্দ উপচে পড়ছে চোখে মুখে তার। পংক্তি রাতের ঘটনা অনেকখানি ভুলে গেছে এতোক্ষনে।
এই রমরমা উৎসবের আবহাওয়ায় এসে তার মনটা এখন ভালো। সোনিয়া একটু পর পর পংক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। সারা,মিরার দুষ্টুমিতে পংক্তির ঠোঁটের কোনে যখন হাসি ফোঁটে তা দেখে সোনিয়াও হাসে। হলুদ লাগানোর একফাঁকে মারিয়ার বন্ধু, বান্ধবী নিয়ম করে সামনে এসে নাচছে। পংক্তির মনোযোগ সেদিকে ততোটা নেই। ওর তৃষ্ণিত নয়ন শুধু হিমান্তকে খোঁজে। হিমান্তকে না পেলেও পংক্তির দৃষ্টি থমকে যায় একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মৌসুমের দিকে।
চট করে সোনিয়ার পেছনে লুকিয়ে পড়ে সে। সোনিয়া ভ্রুকুটি করে এমন করার কারন জিজ্ঞেস করলে পংক্তি ভয়ে ভয়ে জানায়,
“ঐ যে সামনের লম্বা ছেলেটাকে দেখছ না? হলুদ পাঞ্জাবি পড়া, হেঁসে হেঁসে কথা বলছে বন্ধুদের সাথে। ঐটাই মৌসুম। আপা ভয় করছে আমার।”
“কেন?”
“আরে ওকে চেনো না তুমি। দেখলেই হইছে গোলাপী গোলাপী বলে পাগল করে ছাড়বে।”
“বখাটে নাকি? দেখতে তো ভদ্রই মনে হচ্ছে।”
“বখাটে না। ভালো তবে বকবক শুরু করলে থামে না। আর কিসব বলে। হাসি পায় আবার লজ্জাও লাগে।”
“পছন্দ করিস?”সোনিয়া টিপ্পনি কাটে। পংক্তি চোখ কপালে তুলে বলে,
“যাও! জীবনেও ওমন পছন্দ আমি ওকে করি না। আমার সকল পছন্দ, অপছন্দ, ভালোবাসা, ভালোলাগা তো সারার মামাকে ঘিরে।” পংক্তির গাল লাল হয়ে গেল লজ্জায়। সোনিয়া মজাচ্ছলে বললো,
“তাহলে মাহিন কী ছিল? তাকেও তো একদিন ভালোবাসতি।”
“আপা, মাহিনকে আমি কোনোদিন ভালোবাসি নি। ভালোবাসতে চেয়েছিলাম ওর কথায় ভুলে, বিশ্বাসও করেছিলাম। তার একরত্তি মূল্য ও দেয় নি। বিশ্বাস ভাঙার জ্বালা তুমি বুঝবে না আপা।” পংক্তির চোখদুটো ছলছল হয়ে ওঠে। কান্না ঠেলে আসে। সোনিয়ার খারাপ লাগে। পংক্তিকে কষ্ট দেয়ার মানসে সে কথাগুলো বলে নি। পংক্তির হাতটা ধরে অনুতপ্ত হয়ে বলে,
“আমি তোকে কষ্ট দেওয়া জন্য কথাগুলো বলি নি বিশ্বাস কর। আমি শুধু মজা করছিলাম।”
সোনিয়ার মলিন মুখটা দেখে পংক্তি নিজের কষ্ট লুকিয়ে ফেলে। ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
“আমি ঠিক আছি। এতো কষ্ট পাওয়া লাগবে না তোমার।” হেঁসে দেয় পংক্তি। যদিও মনটা তার বিষিয়ে উঠেছিল মাহিনের নাম শুনে। পংক্তি যতোই নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করুক না কেন মৌসুমের নজরে সে ঠিক পড়লো। তবে আশ্চর্যের বিষয় মৌসুম এগিয়ে এলো না।
হয়তো সে পংক্তির ভীরু চোখের ভাষা বুঝেছে! শুধু দূর থেকে মুচকি হেসে ইশারায় হাই বললো। পংক্তি এদিক সেদিক তাকিয়ে জোর করে হাসলো মৌসুমের হাইয়ের জবাবে। এরপর যতোবার ওদের চোখাচোখি হলো দু’জনই মুচকি হাসলো। পংক্তির মনে যাকে নিয়ে ভয় ছিল সে কিন্তু তার সূক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ঠিকই সব দেখেছে। হিমান্ত ছাঁদের এককোনে দাঁড়িয়ে মারিয়ার হবুশ্বশুরের সাথে কথা বলছিল। মারিয়ার হবুশ্বশুর পারভেজ চৌধুরী হিমান্তের বাবা হানিফ সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হিমান্তের বিষয়ে সবই জানেন তিনি। হিমান্তকে সামনে পেয়ে বোঝাতে লাগলেন।
হানিফ সিদ্দিকী হিমান্তের জন্য কতোটা কষ্ট পাচ্ছেন সবই জানালেন। হিমান্ত নত মুখে সব শুনে গেল। কারন তার ও’বাড়ি ফেরার কোনো ইচ্ছায় নেই, তবে বাবার জন্য খারাপ লাগে। ওবাড়ির ইটের ভাঁজে ভাঁজে কপটতা,ভণ্ডামি আর কী এক বিভৎসতা যেন লুকিয়ে আছে! দম বন্ধ হয়ে যায় সিদ্দিকী ম্যানশনের পরিবেশে হিমান্তের। হিমান্ত পারভেজ আঙ্কেলের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে, চোখের কোনা দিয়ে পংক্তিকে দেখছিল।
এই মেয়েকে দেখলে মনটা অশান্ত হয়ে ওঠে হিমান্ত। বিরান, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া হৃদয়জমিনে দখিনা পবন বয় পংক্তিকে দেখামাত্রই। সে যে একজন পুরুষ তারও যে অনুভূতি আছে এ’কথা হিমান্ত ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। পংক্তির নত হওয়া ভীরু চোখের পাতার শিরা উপশিরার কম্পনে অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে পুনরায় অঙ্কুরিত হয়েছে।
এই মেয়ের চোখে যতোবার চোখ পড়ে বিদ্যুৎ খেলে যায় শরীরে। আর আজ তো আগ্নেয়গিরির উত্তাপ বইছে হিমান্তের দেহে। হিমান্ত চোখ নামিয়ে নেয় পংক্তির থেকে আর ঠিক তখনই অপর পার্শ্বে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে চোখ পড়ে। দু’জনের ইশরায় হাসাহাসি তাকে ব্যথিত করে। কী এক মর্মপীড়ায় দারুনভাবে আহত হয় তার মন! পংক্তির উপর হঠাৎই রাগ জমে তার মনে। অনুভূতির আগ্নেয়গিরি এখন রাগের আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়। পংক্তি কিছু দেখা বা বোঝার আগেই রাগ চেপে নিচে নেমে আসে হিমান্ত।
মারিয়ার হবু ননদ প্রসূন। হবু ভাবিকে প্রসূনের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আসার পর থেকেই সে ভাবির পাশে বসে গল্প জুড়েছে। ভিডিও কলে কথা হয়েছে এর আগে তাদের। আজ সামনাসামনি হলো,সকল জমানো কথা সে একএক করে বলছে। ভাইয়ের পছন্দ, অপছন্দের কথা সহ ভাই সম্পর্কিত অনেক কথায় বলছে। কথা বলার এক ফাঁকে মধ্যে হুট করেই প্রসূন ভাই আবরারকে ভিডিও কল করে।
মারিয়া লজ্জায় আরক্ত হয় আবরারের ঠোঁটে হাসি দেখে। ভাই ভাবিকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে সরে আসে প্রসূন। ঠিক তখনই পংক্তির হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ওর নজরে পড়ে। সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকে পংক্তিকে প্রসূন। আফরিন কখন থেকে মেয়েকে খুঁজছে। বয়স উনিশ অথচ হাবভাবে বাচ্চামি ভরা মেয়েটার। নতুন আত্মীয় বাড়ি এসেও চঞ্চল সে।
একদন্ড চোখের সামনে থাকছে না। আফরিন খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল প্রসূনকে। হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আফরিন পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়ের কাঁধে রাখতেই চমকে যায় প্রসূন। মেয়ের চমকিত মুখখানি দেখে ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করে আফরিন,
“কি হয়েছে?”
“আম্মু দেখো ঐ মেয়েকে”
“কেন কী হয়েছে মেয়েটার?”পাল্টা প্রশ্ন করে আফরিন অদূরে দাঁড়ানো পংক্তির দিকে তাকায়। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতটা ধ্বক করে ওঠে আফরিনের। চোখজোড়া দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। কতোক্ষন ওভাবে তাকিয়ে ছিলেন জানেন না। প্রসূনের হালকা ধাক্কায় স্বাভাবিক হন তিনি।
জোর করে ঠোঁটে হাসি টেনে বলেন,
“সুন্দর মেয়েটা! কেন বলতো? ফ্রেন্ডশিপ করবি? তোর তো আবার মতিগতির ঠিক নেই। যখন যা খুশি তাই করিস।” কথাটা বলে একা একাই শব্দ করে হাসলেন। নিজের মনের অবস্থা লুকানোর জন্যেই তার এই অভিনয়। প্রসূন মায়ের অভিনয়টা ধরতে পারলো কিনা বোঝা গেল না এই মুহূর্তে। তবে গম্ভীর হয়ে গেল ওর মুখটা। থমথমে গলায় বললো,
“আম্মু মেয়েটার চেহারা একদম আব্বুর মতো না?”
পর্ব ২৩
আফরিন মেয়ের কথার জবাব দিলেন না। হঠাৎ মেয়ের উপর রেগে গেলেন তিনি। প্রসূন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল মায়ের আচমকা ধমকে। এদিক সেদিক তাকাতেই দেখলো অনেকে আড়চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের উপর অভিমান হলো প্রসূনের। কাঁদো কাঁদো মুখ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল সে। আফরিন স্থির চোখে তাকিয়ে আছে পংক্তির দিকে। এরমধ্যে পারভেজ চৌধুরী হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে এলেন স্ত্রী, কন্যার দিকে। প্রসূনের কাঁধে হাত রেখে স্ত্রীকে কিছু বলবেন, তার আগেই আফরিন ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পাশ কেটে চলে গেলেন।
পারভেজ চৌধুরী ততোটা অবাক হলেন না কারন স্ত্রীর এরূপ ব্যবহারে তিনি অভ্যস্ত। তার কর্মফলই আফরিন তাকে ক্ষণে ক্ষণে দেয়। আঠারো উনিশ বছর আগে যে আঘাত তিনি আফরিনকে দিয়েছিলেন আফরিন সেটা ভোলে নি। ধোঁকা মানুষের ভেতর পর্যন্ত বিষিয়ে দেয় আর সেটা যদি দেয় স্বামী স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রী স্বামীকে তবে তার চেয়ে মৃত্যু উত্তম! মৃত্যু উত্তম। আফরিন প্রতিনিয়ত এই কথায় শোনায়, বোঝায় ইশারা ইঙ্গিতে পারভেজ চৌধুরিকে।
“কবিতা! কি ছিলে তুমি? মরিচিকা নাকি এক পশলা হঠাৎ আসা বৃষ্টি। যে এলে আর হারিয়ে গেলে চিরতরে। আমি তোমায় ভালোবেসে ধোঁকাবাজ! না তুমি বুঝলে আমার মন, না আমার সহধর্মিণী বুঝলো। আমি আপনজনের সম্মুখে দাঁড়ানো এক পাপিষ্ঠ। যার লজ্জা হয় না স্ত্রীর ঘৃণিত চোখে তাকিয়েও।
যার বিন্দুমাত্র অনুতাপ হয় না তোমাকে ভালোবাসতে পেরেও।” দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে পারভেজ চৌধুরীর ভেতর থেকে। চোখ দুটো সজল হয়। বাবার পান্ডুর হওয়া মুখখানা দেখে কষ্ট হয় প্রসূনের। বাবার বাহুতে মাথা ঠেঁকিয়ে বলে,
“ছোট মা কী খুব সুন্দর ছিল আব্বু! যার কারনে আমার মা’কে কষ্ট দিলে তুমি? উনার জন্যেই আজ তোমার আর আম্মুর মাঝে দুরুত্ব।
আই হেইট হার। আই হেইট হার।” প্রসূন ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে নেমে যায় নিচে। পারভেজ চৌধুরী থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে বিরবির করে,
“সে সুন্দরী ছিল না তবে মায়াবতী ছিল রে মা।
আমার কবিতা বড্ড মায়াবতী ছিল। শুনেছ কবিতা! শুনেছ তুমি? আমার মেয়ে তোমাকে ঘৃণা করে। অথচ তুমি বলেছিলে তোমাকে ত্যাগ করলে সে তোমাকে ঘৃণা করবে না। তুমি সবার কথা ভাবলে শুধু আমার কথা ভাবলে না কবিতা। ফিরে এসো তুমি। ঐ মরণ কসম তুলে নাও কবিতা। আমার মিথ্যার ক্ষমা দাও। তোমাকে দেখার জন্য এই দুচোখে প্রচন্ড ভাদ্র নেমেছে আমার।”
ছাঁদের নির্জন কোনে দাঁড়িয়ে শূন্যের পানে চেয়ে রয় পারভেজ চৌধুরী। চোখে তার ঘন বরষা, হৃদয়জুড়ে হাহাকার। আফরিন হবু বেয়াইনের সাথে কথাবলার একফাঁকে পংক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে।
মারিয়ার মা হনুফা বেগম অবজ্ঞার সুরে জবাব দেয়,
“ঐ মেয়ে! ও আমাদের তিনতলায় ভাড়া থাকে। শুনেছি এতিম। বাপ মা নাই তাই ওর দূরসম্পর্কের এক ভাই আছে তার কাছে থাকে। ঐ যে বাচ্চাটা দেখছেন হলুদ ফ্রক পড়া, ঐটারে দেখাশোনা করে। এককথায় বলতে গেলে কাজের মেয়ে। ছেলেটা মানে ওর ঐ দূরসম্পর্কের ভাই নেহাতই ভালো বলে পড়ালেখা শেখায়, আপনজন মনে করে। তবে!”
“তবে কী আপা?”
“না মানে কিভাবে বলি!”হনুফার ইতস্তততা দেখে আফরিনের মন অস্থির হয়ে ওঠে। পুরো কথা না শুনলে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না সে। কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে আবার প্রশ্ন করে,
“নিঃসংকোচে বলুন আপা। আমরা তো এখন আর পর কেউ নই।”
“তা ঠিক। আসলে আপা আমার কী মনে হয় জানেন? এই মেয়ের সাথে ওর ঐ দূরসম্পর্কের ভাইয়ের অবৈধ সম্পর্ক আছে। আপনিই ভাবেন আপা আগুন আর ঘি কী পাশাপাশি থাকতে পারে। কোনো রিয়াকশন হবে না? যুবতি সুন্দরী মেয়ে আবার ছেলেটা মাশাল্লাহ কী বলবো আপা! যেমন ভদ্র তেমনি সুপুরুষ।
পুরুষ মানুষের দোষ কী বলেন? হাতের কাছে সহজলভ্য মেয়ে মানুষ পেলে তারা কী ছাড়ে? সব দোষ এই ছেমরির। দেখেন কেমনে হিহি করে হাসছে। দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না আসলে তো পাকা ঐ কাজে। আমি খোঁজ নিচ্ছি তলে তলে বুঝলেন আপা। একবার শুধু একটা উপযুক্ত প্রমাণ পাই তারপর কী যে করুম ওরে।”
হনুফা দাঁত কিড়মিড় করে পংক্তির দিকে তাকিয়ে। চোখের তারায় আগুন জ্বলে ওর। পারলে সেই আগুনে এখনই ভস্মীভূত করে ছাড়ে পংক্তিকে সে। আফরিন আনমনা হয়ে যায়। তার মাথা থেকে কিছুতেই প্রসূনের বলা কথা যাচ্ছে না। কোনো এক অদ্ভুত কারনে আফরিনের নিজের কাছেও মেয়েটিকে কবিতা এবং পারভেজের সংমিশ্রণ লাগছে।
আর তাতেই বিপি লো হচ্ছে মনে হলো আফরিনের। বেখেয়ালি ভাবে হেঁটে নিচে নেমে এলো সে। হনুফা বেয়াইনকে এভাবে যেতে দেখে ভ্রুকুটি করে মুখ সিটকালো। পংক্তির দিকে ফিরে পৃথিবীর কুখ্যাত গালি নিক্ষেপ করে সে। হনুফার ধারণা এই মেয়ের কারনেই হিমান্ত তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
আরিফ সিদ্দিকীর পরিবার দু’পক্ষ থেকেই আমন্ত্রিত। তিনি নিচে বসে মেয়ের বাবা মজিদ ও বড় ভাইয়ের বন্ধু পারভেজের সাথে কুশলাদি বিনিময় করছেন। রিমা ও তার শ্বাশুড়ি রাশেদা ছাঁদে উঠে এলো। সবার সাথে আলাপ করার এক ফাঁকে পংক্তির দিকে এগিয়ে গেলো দু’জন। হিমা এবং রাশেদার সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। তারা সম্পর্কে জা হলেও ছিল বোনের মতো।
পংক্তি এর আগে এদের কাওকে দেখে নি তাই স্বভাবতই সে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করে। রাশেদা কথায় কথায় হিমান্তের কথা জিজ্ঞেস করলে পংক্তি জানায় সে অনেকক্ষণ তাকে দেখে নি। রাশেদা সারাকে আদর করে হিমান্তকে খুঁজতে যায়। এদিকে রিমা পংক্তির আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। দৃষ্টিতে অবজ্ঞার ভাব এনে চাপাস্বরে বলে,
“হিমান্ত ভাই তোমাকে নিজের কাছে এনে রেখেছে কারণ কী?
শুনেছি পড়াচ্ছেনও। বিনিময়ে কী দাও বলো তো?”
সোনিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় রিমার কথা শুনে। সে কিছু বলতে গেলে পংক্তি হাত চেপে ধরে। নিজেকে সামলে নিয়ে এক চিলতে হাসি দিয়ে বলে পংক্তি,
“বিনিময় তো করে ব্যবসায়ীরা। আমি বা উনি ব্যবসায়ী নই। আমরা মানবতার খাতিরে পরস্পরকে দেখছি। তারপরও যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা?
থাক বললাম না বুঝে নিন। বুদ্ধি তো কম নাই আপনার।”
“এতো সাহস আমাকে উল্টো জবাব দাও। শুনেছি তুমি নাকি কথায় বলো না এখন তো দেখছি খই ফুটছে মুখে। খই ফুটবেই বা না কেন? ফাঁস হওয়ার ভয় নেই বলেই তো কুকর্ম করছ। আজ যদি হিমান্ত ভাই সন্তান জন্মদানে সক্ষম হতো তবেই না ভয় আসতো।”
“একদম বাজে কথা বলবেন না তার সম্পর্কে।” ফুঁসে ওঠে পংক্তি। সোনিয়া শান্ত করার চেষ্টা করে। রিমা এদিক সেদিক তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসে। নেকা নেকা ভঙ্গিতে বলে,
“বাজে কথা! ওমা তুমি বুঝি জানো না?
মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে হিমান্ত ভাই আসল কথায় গোপন করেছে তোমার কাছে। যাক আমিই বলে দিচ্ছি। শোনো হিমান্ত ভাই আর তার আগের বউ মানে আহানা ভাবির দাম্পত্য ভাঙার কারন হিমান্ত ভাই নিজে। তার তো মাথায়ও গন্ডগোল, সাথে নাকি আবার জ্বিনও আছে। বেচারি আহানা ভাবি স্বামী সুখ না পেয়ে পরকীয়া করতে বাধ্য হলো। তা তোমাকে খুশি রেখেছে কীভাবে? বলো বলো?”
“ছিঃ! “
“ছিঃ! সত্যি কথা বললে সবাই ছিঃই বলে। বিয়ে না করে এক বাসায় থাকবা আর আমরা বললেই ছিঃ। উপরে আল্লাহ আছে সব দেখছেন তিনি। ভালো হয়ে যাও। নষ্টা মেয়েলোক কোথাকার!”রিমা মুখের উপর কথাটা বলে রাগে গজগজ করতে করতে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পংক্তির মাথা ঘুরে যায় রিমার কথা শুনে।
একে তো এতো নোংরা কথা বলে গেল। তারউপর হিমান্ত সম্পর্কে বলা কথাটা শুনে পংক্তির পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। সোনিয়া ধরে বসায় ওকে। পংক্তি ফুঁপিয়ে উঠলো সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে। সোনিয়া স্বান্তনা দিয়ে বলে,
“শান্ত হ। যে যা বলবে তাই শুনবি নাকি। নিজে বেয়াদব মহিলা একটা। কথাবার্তায় বোঝা যায় তিনিই কেমন মেয়েলোক। তুই কাদিস না পংক্তি। চল বাসায় চল।”
সবার চোখে আড়ালে সোনিয়া পংক্তিকে বাসায় নিয়ে আসে। পংক্তি কিছুক্ষণ শোকগ্রস্ত মানুষের ন্যায় চুপচাপ থেকে উঠে দাঁড়ায়। অনেক কেঁদেছে সে। গলা ব্যথা করছে টেনে টেনে কাঁদায়। সোনিয়ার বাঁধা উপেক্ষা করে ধীর পায়ে চলে আসে নিজেদের বাসায়।
হিমান্ত ঘরেই ছিল। রাগে ওর শরীর জ্বলছে পংক্তি আর ছেলেটার হাসাহাসি দেখার পর থেকে। অন্ধকার ঘরে কপালে হাত ঠেঁকিয়ে শুয়ে ছিল। তখনই দরজা ধাক্কে ভিতরে ঢুকলো পংক্তি। পংক্তির শরীরের গন্ধেই ওর উপস্থিতি টের পায় হিমান্ত তবুও আগের মতো নির্বিকার সে। পংক্তি চোখ মুছে ধরা গলায় প্রশ্ন করে,
“আপনি কী কোনোদিন বাবা হতে পারবেন না?”
হিমান্ত এমন প্রশ্ন শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল। প্রশ্নটা শোনামাত্রই বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল সে। কপালের রগ ফুলে উঠেছে ওর। পংক্তি প্রশ্নের জবাব না পেয়ে হিমান্তের কাছে ছুটে আসে। অপ্রকৃতিস্থতের মতো হিমান্তের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে চিৎকার করে বলে,
“জবাব দিচ্ছেন না কেন? জবাব দিন?”
“কলার ছাড়ো পংক্তি।” হিমান্তের কন্ঠস্বর গম্ভীর, থমথমে। পংক্তির ঔদ্ধত্যে মেজাজ চরম পর্যায়ের খারাপ হিমান্তের। পংক্তি মাথা নাড়ায় সে কলার ছাড়বে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে সে। হিমান্ত নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসলো এবার। খপ করে পংক্তির চুলের মুঠি ধরে মুখের কাছে টেনে এনে উচ্চ স্বরে বলে,
“কেন ছাড়বি না কলার?
কেন? আমি কি হতে পারবো আর কি হতে পারবো না সেটা শুনে তোর কী? হ্যাঁ আমি পারবো না হতে কোনোদিন বাবা, তো! তোর কী দরকার এসবে? নিজের জায়গা কেন ভুলে যাস তুই? কেন ভুলে যাস? কী হই আমি তোর? কিছুই না! নাথিং। কোন অধিকারে এতো কাছে আছিস আমার?”
“ভালোবাসি যে তাই।” পংক্তি শান্ত কন্ঠে জবাব দেয়। টপটপ করে জল গড়াচ্ছে ওর দু’চোখ বেয়ে। হিমান্ত পংক্তির চুলের মুঠি ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সমস্ত শরীর কাঁপছে ওর। সকল ভাবনা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। দাঁতে দাঁত চেপে পংক্তির দিকে ঘুরে দাঁড়ায় হিমান্ত। নত মুখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে পংক্তি। অশ্রুজলে সিক্ত হয়ে পুনরায় বলে,
“হ্যাঁ ভালোবাসি। ভালোবাসি আমি আপনাকে।”
যেকোনো প্রেমিকের কাছেই প্রেমিকার বলা এই শব্দাবলী বহু কাঙ্ক্ষিত। হিমান্তের কাছে কাঙ্ক্ষিত হয়েও এই মুহূর্তে সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। পংক্তির কথা শেষ হতেই সজোরে চড় বসিয়ে দেয় হিমান্ত পংক্তির গালে। চড়টা এতো জোরেই ছিল যে, ছিটকে দেয়ালে উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে পংক্তি। হিমান্ত নিজের চুল টেনে কান্না প্রতিরোধ করে সর্বশক্তি দিয়ে। চিৎকার করে বলে,
“ভালোবাসি! ভালোবাসার কী বুঝিস তুই হ্যাঁ?
আরেকবার যদি এসব ভাবনা তোর মাথায় আসে মেরে শেষ করে ফেলবো তোকে। এসএসসি হতে দে তারপর ভালো ছেলে দেখে তোকে বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করবো আমি। ভালোবাসি! কেন ভালোবাসতে গেলি আমাকে তুই? আমি কারো ভালোবাসার যোগ্য না। তোর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে আমাকে ভালোবাসলে। বল আমাকে তুই ভালোবাসিস না। বল না পংক্তি বল?”
ছুটে গিয়ে উপুড় হয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা পংক্তিকে কোলের মাঝে নিয়ে সোজা করে হিমান্ত। পংক্তির নাক, ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। বেহুশ হয়ে নেতিয়ে পড়েছে ওর দেহ হিমান্তের কোলে।
“আমি মৃতপ্রায় মানুষ পংক্তি। কিছুই নেই আমার তোমাকে দেওয়ার। দেখলে তো তোমাকে কষ্ট দিলাম। আমাকে ভালোবেসে দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না তুমি। পোড়া মন আমার তবুও তোমায় ভালোবাসে।
এতো বোঝায় বোঝে না। আমি নিজেকে শেষ করে দেব তবুও আমার ভালোবাসার আগুনে তোমায় পুড়তে আমি দেব না পংক্তি। আমাকে ভালোবাসতে তোমাকে আমি দেব না।”
পংক্তিকে বুকে জড়িয়ে শব্দ করে কাঁদে হিমান্ত। চারদেয়ালের মাঝেই গুমরে মরে হিমান্তের সেই কান্নার শব্দ।
পর্ব ২৪
সারা এদিক ওদিক তাকিয়ে পংক্তি কিংবা সোনিয়া কাউকে পেল না। হাসি খুশি প্রাণবন্ত সারার মুখটা সহসায় চুপসে গেল। মিরার কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই,সে আপন মনেই নেচে, হেঁসে যাচ্ছে।
আরহাম দূর থেকে সারাকে লক্ষ্য করছিল বেশকিছুক্ষন ধরে। সুযোগ বুঝে মায়ের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে এসে সারার দিকে এগোয় সে। সারার পেছনে দাঁড়িয়ে দুষ্টু হাসি হেঁসে সারার চুল ধরে দেয় এক টান। টান টা এতো জোরেই ছিল যে সারা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। পেছন ফিরে আরহামকে দেখে পিলে চমকে গেল তার।
“কিরে ছিঁচকাদুনি?”কোমরে দু’হাত রেখে ভ্রু নাড়ায় আরহাম। সারা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতে লাগলো ভয়ে। মিরা অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল, ছেলেটা সারার চুল টেনেছে তা মিরা সচক্ষে দেখেছে। ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসে মিরা।
সারা এবং আরহামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আরহামকে লক্ষ্য করে উঁচু গলায় বলে,
“এই ছেলে আমার বারবির চুল টেনেছিস কেন?”
“বারবি! আমি তো এই বলদিটার চুল টেনেছি। ছিঁচকাদুনি, বলদি,গাধি।” আরহাম খামচি মারার জন্য হাত আগাতেই মিরা ধমকে ওঠে,
“তুই বলদ,গাধা।”
আরহামের হাতে খামচি মেরে ধরে মিরা। আরহাম হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে মিরার ধমক খেয়ে। সারার দিকে তাকিয়ে দেখে সারার চোখে ভয়ের রেশ নেই, এতেই যেন রাগ ওঠে আরহামের। তেড়ে আসে মারতে। মিরা সে সুযোগ না দিয়ে আরহামের বুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় নিচে। আরহাম রাগে ফুঁসে ওঠে,
“তুই আমাকে ধাক্কা মারলি কেন?”
“তুই ওকে মারতে আসলি কেন?”আরহাম, মিরা মুখোমুখি দাড়িয়ে ফোঁসে। সারা ভয়ার্ত চোখে দু’জনকে দেখে যাচ্ছে। মিরার হঠাৎ কি মনে হলো আর তাতেই ঠোঁট টিপে হেঁসে উঠলো সে। আরহাম রাগে গাল ফুলিয়ে ভ্রুকুটি করলো মিরার হঠাৎ হাসির কারন উদঘাটনে। মিরা হেঁসে বললো,
“বল তিন তলা বিল্ডিং?”
“বললে কী ওকে মারতে দিবি?”আরহামের কথা শুনে মিরা চোখ পাকিয়ে সারার দিকে তাকিয়ে আবার ঠোঁট টিপে আসে। বলে,
“হ্যাঁ দিব। বল সাত তলা বিল্ডিং?”
আরহাম মোটেও ভরসা পাচ্ছে না কথা বলতে। কিন্তু এই মুহূর্তে সারাকে না মারতে পারলেও শান্তি লাগছে না ওর। বাধ্য হয়ে মুখটা শক্ত করে বলে,
“সাত তলা বিল্ডিং।”
“কুত্তা তোর ডার্লিং। হি! হি! হি!”আরহামের গালে কষে চড় বসিয়ে সারাকে নিয়ে ছুটে নিচে নেমে আসে মিরা। পেছনে দাঁড়ানো আরহামের চিৎকার আর কান্না শুনতে পেয়ে সারা, মিরা হেসে কুটিকুটি হয়। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে সারা প্রশ্ন করে,
“এটা তুই কোথা থেকে শিখেছিস মিরা?”
“সিক্রেট, তবে তোকে তো বলায় যায়। আমাদের স্কুলে এক মেয়ে আছে। যখন কাওকে ঝগড়ায় হারাতে পারে না তখন এসব বলে। হি! হি!”মিরা আবার ঠোঁট টিপে হাসে। সারাও সাথে সাথে হাসে। সারা জানায় সে আরহামকে অনেক ভয় পায়। আগে যখন পংক্তি আন্টি ছিল না তখন ওর মামা ওকে আরহামদের বাসায় রেখে যেত। আরহাম খুব পাঁজি, সে সর্বদা সারার চুল টানতো,মারতো। এজন্যই আরহামকে দেখলে ওর ভয় লাগে।
মিরা সব শুনে দু’হাত বগলদাবা করে বলে,
“আবার পায় সামনে ওর পাঁজিগিরি থাবড়ানি দিয়ে ঠিক করে দিব। আমার নাম মিরা! মিরা দ্যা টেরর। মারবো এখানে পড়বে গিয়ে মায়ের কোলে। হু হাহাহা।”
মিরার ভঙ্গি করে বলা কথা শুনে সারা উৎফুল্ল চিত্তে হেঁসে ওঠে। মিরা সারার সাথে গলাগলি করে বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। মিরা সারাকে সতর্ক করে এসব কথা যেন সে কাওকে না বলে। সারা হাসিমাখা মুখে সেটা মেনে নেয়। শিশুদের আলাদা এক জগৎ থাকে। তারা সেটাকে নিজেদের মতো করে চালাতে চায়। মিরাও চায় সেরকম।
তাতে সে সারার রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করছে। বন্ধুত্ব শিখিয়ে দেওয়া লাগে না। ভালোবাসার টানে, আত্মার টানে আপনা আপনিই দায়িত্বশীল হয় বন্ধুরা একে অপরের প্রতি।
রাত অনেক হয়েছে। চারপাশ শান্ত, নিস্তব্ধ। ঘরজুড়ে আধার নেমেছে। তবে ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়, শহরে বৈদ্যুতিক বিচ্ছিন্নতা না হলে রাতের অন্ধকার ততোটাও অন্ধকার নয়।
এ যেন আলো আঁধরির খেলা। পংক্তির হুশ ফিরেছে খানিকক্ষণ আগে। চোখ মেলতেই সম্মুখে ঘুমন্ত সারাকে দেখে। ড্রেসটাও খোলে নি সে। ওভাবেই এসে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে পংক্তির গলা জড়িয়ে। শরীরে বল পাচ্ছে না তবুও টেনেটুনে নিজেকে বসায় পংক্তি। সাবধানে সারার গায়ের কাপড়টা খুলে আবার শুয়ে দেয়। সারার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে দুএক ফোঁটা জল গড়ায় পংক্তির চোখ থেকে। দু’চোখ জুড়ে আজ শূন্যতা, হৃদয় প্রত্যাখ্যানের খরতাপে খাঁ খাঁ করছে।
উত্তরার নিজদের বাসায় পৌঁছামাত্রই প্রসূন দাদিজানের নিকটে গিয়ে সব খুলে বলে। আবিদা খানম নাতনির কথা শুনে বাকরুদ্ধ। তবে রাগে কিংবা চিন্তায় নয়, খুশিতে। কবিতাকে তার বড় পছন্দ ছিল। তার মানে এই নয় তিনি আফরিনকে অপছন্দ করেন! আফরিন তার ভাতিজি, আফরিনকে পুত্রবধু করার সাধ তারই ছিল এবং তিনি ছেলেকে জোর করিয়েই রাজি করিয়েছিলেন তাতে।
কবিতাকে তার ছেলে পারভেজ স্কুল জীবন থেকে পছন্দ করতো কিন্তু বলতে পারে নি তখন। এরমধ্যে কবিতারা মানিকগঞ্জ চলে গেল। পারভেজ স্কুল ছেড়ে কলেজ তারপর ভার্সিটি শেষ করে যোগ দিল পিতার ব্যবসায়ে। আবিদা খানম ছেলের মনের কথা বোঝার চেষ্টা না করেই ভাতিজির সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন।
পারভেজ ভাগ্য বলে মেনে নিল সব। বিয়ের কয়েকবছর পর আবরারের জন্ম হলো। ততোদিনে পারভেজ আমেরিকা সেটেল হয়েছে সপরিবারে। প্রসূন যখন আফরিনের গর্ভে পারভেজ ঢাকাস্থ গার্মেন্টস ব্যবসায়ের কিছু কাজে বাংলাদেশ ফেরে। সেখানেই ঘটনাচক্রে পুনরায় দেখা হয় পারভেজ, কবিতার। পারভেজ বুঝতে পারে কবিতার প্রতি তার আবেগ, অনুভূতি বিন্দুমাত্র কম হয় নি বরং কবিতাকে দেখামাত্রই তীব্রতর রূপ নিয়েছে।
কবিতা তাকে পূর্বে চিনতো না কারন পারভেজের ভালোবাসা ছিল একপাক্ষিক। কবিতার কাঁধে ছিল পরিবারের দায়িত্ব, মা,ভাইয়ের পরিবার আর সে। ভাইয়ের একার বেতনে এতোবড় সংসার চালানো কষ্ট হচ্ছিল। বাবার মৃত্যুর পর পড়ালেখা বন্ধ হয়েছিল কবিতার তারপর থেকেই সে অর্থ উপার্জনের জন্য গার্মেন্টসে চাকুরী করে। পারভেজ শত চেষ্টাইয়ো এবার আর নিজেকে রুখতে পারে না। কবিতার পরিস্থিতি তাকে ব্যথিত করে।
ধীরে ধীরে দু’জনের আলাপচারিতা বাড়তে থাকে তারপর শুরু হয় প্রণয়। পারভেজ যখন গোপনে তারসাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় তখনও কবিতা জানতো না পারভেজ বিবাহিত। কবিতাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে নিজের সকল সত্য গোপন করে পারভেজ৷ কিন্তু তার অন্ধ প্রেমিক সত্তা এটা ভুলেই গিয়েছিল সত্যকে কখনও চাপা দিয়ে রাখা যায় না। হলোও তাই বছর গড়াতেই কবিতা সব জেনে যায়।
ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে কবিতা। নিরব হয়ে যায়। তার নিরবতা ভাঙে আফরিনের বলা ধারালোর কথার আঘাতে। আফরিনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আবিদা খানম এসেছিলেন কবিতা কাছে। সেদিন আবিদা কিছু বলার পূর্বেই কবিতা অদ্ভুত করে হেঁসেছিল। সেই হাসিতে কোনো প্রাণ ছিল না, না ছিল কোনো ছন্দ। আঘাতে আঘাতে বিক্ষত হওয়া মানুষ যখন জোর করে হাসে ঠিক তেমন হাসি।
পারভেজের সকল অনুরোধ উপেক্ষা করে সেদিন চিরতরে ত্যাগ করেছিল কবিতা পারভেজকে। তাদের তালাক হওয়ার সুযোগ হয় নি কারন কবিতার হদিশ আর কেউ পায় নি এরপর। পারভেজ কিংবা আবিদা খানম বা তার পরিবার কেউ জানতো কবিতার ঐ দিনগুলোর কষ্ট। সে পারভেজকে বলতে পারেনি তাদের ভালোবাসার চিহ্ন তার গর্ভে।
কবিতা আফরিনকে কথা দিয়েছিল তার ছায়াও আর আফরিনের পরিবারে পড়বে না। কবিতা কথা রেখেছিল শেষদিন পর্যন্তও। জীবনের শেষদিনটুকুতেও সে পারভেজকে স্মরণ করে কেঁদেছিল, তবুও পেছন ফিরে তাকায় নি। পংক্তি সবকিছুই শুনেছে তার নানীর কাছে। তার মায়ের কষ্ট তাকে আরও বেশি নিজের মধ্যে গুটিয়ে ফেলেছিল শৈশবের দিনগুলোতে।
আবিদা খানম প্রসূনকে পংক্তি সম্পর্কিত নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। প্রসূন একসময় বিরক্ত এবং রাগ হয়ে গেল দাদির কৌতুহল দেখে। উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পা ফেলে বেরিয়ে গেল সে। আবিদা খানম এবার নড়েচড়ে বসলেন। মোবাইলে কিছু খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন তিনি।
আজ মারিয়ার বিয়ে।
মেয়ের বিবাহের কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে মজিদ আহমেদ সপরিবারে পার্শ্ববর্তী কমিনিউটি সেন্টারে চলে গেছেন। ফ্লাটটাতে মাঝে মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস আনা নেওয়ার জন্য আসছেন যাচ্ছেন তিনি। হিমান্ত,সোনিয়ার স্বামী, দুলাভাই মিলে সহযোগিতা করছেন মজিদ সাহেবকে। হিমান্ত বুকের মাঝে চাপ অনুভব করছে। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে একটু পরপর। খুব তাড়াতাড়িই হাঁফিয়ে উঠছে সে আজ। ভেতরের উত্তেজনা চাপা রাখাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে হিমান্ত।
সে এমনিতে সিগারেট খায় না তবে আজ পুরো দু’প্যাকেট শেষ করেছে এই অল্প সময়ের মধ্যে। মনটা আনচান করছে পংক্তিকে দেখার জন্য। মেয়েটাকে কাল কেন মারলো সে এই যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে পুড়ছে হিমান্ত। তার মনের অবস্থা কিছুটা এমন “না ছাড়ব তোমায় প্রিয়া, না করব দূর। তাতে যাতনায় জ্বলে পুড়ে হই না কেন আত্মঘাতি।”
সারা ঘুম থেকে উঠেই দৌড়ে মিরার কাছে চলে গেছে। পংক্তি জড়পদার্থের মতো বিছানায় শুয়ে আছে স্থির দৃষ্টি মেলে। মা’কে আজ ওর বড্ড বেশিই মনে পড়ছে।
মায়ের মুখ দেখা হয়নি, কেমন ছিল তার মা সেটাও পংক্তি জানে না। মায়ের ছবি টবি ছিল না নানীর কাছে। মৃত্যুর পূর্বে সব পুড়িয়ে ফেলেছিল তার জনম দুঃখিনি মা। পংক্তি যতো পরিণত হয়েছে ততোই বুঝতে পেরেছে তার মায়ের অব্যক্ত কথা। বিনা দোষে তাকে দোষী হতে হয়েছে অন্য কারো স্বামীকে ভালোবাসার দায়ে। এই লজ্জা, অপমান শেষদিনও সে ভুলতে পারে নি। মায়ের মৃত্যুর ক্ষোভ প্রবলভাবে বিদ্যমান পংক্তির ভেতরে।
সে সবসময়ই প্রার্থনা করেছে জীবনের কোনো মোড়েই যেন জন্মদাতার সম্মুখীন তাকে হতে না হয়। তার এবং তার মায়ের কষ্টের কারন যে লোক তাকে পংক্তি দেখতে চায় না। মেয়েদের জীবনের প্রথম হিরো হয় বাবা। কিন্তু পংক্তির চোখে প্রথম ঘৃণ্য ব্যক্তি তার বাবা। বেঁচে থাকার জন্য যদি বাবার কাছে যাওয়া বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায় তবে পংক্তি মরে যাবে। তবুও বাবা নামক ঐ লোকের কাছে যাবে না। হাঁটুতে মুখ ঢেকে মা! মা বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে পংক্তি।
বিয়েতে কী পড়বে সেটা জানার জন্য সোনিয়া এসেছিল পংক্তির কাছে। সদর দরজা খোলা পেয়ে অবাকই হয় সোনিয়া। ভেতরে ঢুকতেই পংক্তি কান্নার শব্দ পেয়ে ছুটে যায়। সোনিয়াকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদে পংক্তি। সোনিয়া পংক্তির কান্নার কারন কিছুটা হলেও আন্দাজ করে। মনটা খারাপ হয়ে যায় সোনিয়ার। সে যে ভয় পেয়েছিল তাই হলো। আবার ভাঙলো পংক্তির মন।
পংক্তির কাটা ঠোঁট, গালের একপাশে হিমান্তের হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ দেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সোনিয়াকে ওভাবে তাকাতে দেখে ফিক করে হেঁসে ওঠে পংক্তি। চোখ কাঁদে, ঠোঁট হাসে তার প্রতিনিয়ত পাওয়া কষ্টের পেষনে। সোনিয়ার ভয় করে পংক্তির এরূপ হাসি দেখে।
পংক্তিকে বুকে টেনে বলে,
“শান্ত হ পংক্তি। সুখ দুঃখ মিলেই জীবন। সুখের স্থায়িত্ব কম হতে পারে তবে তা ঘুরে ফিরে আসবে। পাতা ঝরা শীতের রুক্ষতা শেষে যেমন আসে ফাল্গুনী দখিনা পবন। রুক্ষ প্রাণে প্রাণে নতুন ছন্দে প্রকৃতি রাঙে তখন।”
“দেখেছ এ গাল, এ ঠোঁটের আঘাত। এই তো আমার ফাল্গুনের রাঙা আবিরের রঙ।
আমার ভালোবাসার রঙ। আমি আর রঙ চাই না আপা। অনেক হয়েছে দেখা স্বপ্ন আমার। অনেক! তুমি জানো আপা!আমার মনে হয় মায়ের ভাগ্য মেয়ে পায়। আমার মা কোনোদিন সুখ পায় নি তাহলে আমি কি করে পাব বলো?
আমার ঘাট হয়েছে আপা! “
“পংক্তি! “সোনিয়া বিস্ময়ে তাকায় পংক্তির রুক্ষ, কঠিন দৃষ্টি পানে। পংক্তি স্থির চোখে শূন্যে তাকিয়ে বলে,
“নিজের জায়গা খুব চিনেছি, পেয়ে তোমার দেওয়া ব্যথা, ভয় নেই আর যাবো না প্রিয় তোমার চরণতলে ঠুকতে মাথা।”
সোনিয়া অনেক বুঝিয়ে পংক্তিকে তৈরি করে নিয়ে অনুষ্ঠানে আসে। সারা, মিরাও ওদের সামনে শিশুসুলভ আনন্দে মজা করতে করতে এগিয়ে যায়। পংক্তি বোরখা পড়েছে আজ। একদম সাদামাটা সাজহীন এসেছে সে।
পংক্তি কমিনিউটি সেন্টারে যাওয়ার পরপরই বাসায় আসে হিমান্ত। তার কাছে বাসার ডুব্লিকেট চাবি আছে। গোসল শেষে পাঞ্জাবি পড়ে তৈরি হয়ে নেয় সে। তার ভেতরের অস্থিরতা এখনও বিদ্যমান। বিয়ের আসরে এসে চমকে যায় রেজওয়ানকে দেখে। আজ বহুদিন পর দু’জনের দেখা হলো। দু’জনই আনন্দিত এক অপরকে দেখে।
রেজওয়ান এগিয়ে এসে কোলাকুলি করলো ভাইয়ের সাথে। রায়হান একটু অদূরে পংক্তি, সোনিয়ার সাথে কথা বলছিল। হিমান্ত সেদিক তাকাতেই পংক্তির সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো, শূন্যতায় ভরা চোখজোড়া অভিমানে ফিরিয়ে নিল পংক্তি। হিমান্তের বুক জুড়ে তীব্র দহন হলো তাতে। রেজওয়ান হিমান্তের দৃষ্টি অনুসরণ করে সব বুঝে নিল। মনে মনে খুশিই হলো সে।
হিমান্তের কাঁধে হাত রেখে বললো
“ভালোবাসার সার্থকতা প্রকাশেই, অপ্রকাশে তো আছে শুধু ব্যর্থতা। সময় গেলে সাধন হবে না বুঝলি তো?”
রেজওয়ানের ঠোঁটের কোনে হাসি। হিমান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ার টেনে বসে। দুঃখভারাক্রান্ত মনে বলে,
“যে প্রকাশে ভালোবাসার মানুষটা কষ্ট পাবে সেটা অপ্রকাশিত থাকাই উচিত। তাতে বৃথা হোক প্রেম মোর কিংবা জনম।”
রেজওয়ান হিমান্তের পাশের চেয়ারটায় বসে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। হিমান্তের দিকে তাকিয়ে দেখলো, হিমান্ত এখনও মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাইয়ের বিমর্ষতার কারন রেজওয়ান বুঝে নিল। হিমান্তকে সাহায্য করার আগে ওর মন মানসিকতা একটু যাচাই করতে চাচ্ছে সে।
রেজওয়ান বললো,
“If winter Comes, Can Spring be far behind. “
হিমান্ত বিষাদে ডুবে বলে,
“পি বি শেলির কবিতা এখনও পড়িস তুই? তবে কী জানিস রেজু কারো কারো জীবনে বসন্তের আগমন ঘটে না৷ যেমন আমার! “এই টুকু বলে হিমান্ত জন কিটসের ওড টু নাইটিঙ্গেল কবিতার কয়েক চরণ আওড়ায়,
“My heart aches, and a drowsy Numbness pains
My sense,as though of hemlock I had drunk.
“
“এতোটা হতাশ হওয়া উচিত নয় হিমান্ত। সুখ আপেক্ষিক, ভালো থাকাটাই বড় কথা। একজন মানুষ চাইলেই ভালো থাকতে পারে। মানুষের ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনো বাঁধায় টিকতে পারে না।
চেষ্টা করার আগেই পরাজিত সৈনিক হওয়া কী উচিত? জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়ে যাওয়ার নামই তো জীবন। মন থেকে হেরে গেলে কী মূল্য থাকে এই জীবনের”
“এসব বই পত্রের নীতিকথা ভাই আমার। জীবনের সাথে এসব যায় না।”
রেজওয়ান বললো,
“কে বলেছে তোকে একথা? সমস্যা যখন আছে এর সমাধানও রয়েছে। শুধু প্রয়োজন ধৈর্য ধরে সেটাকে খুঁজে বের করা।”
হিমান্তের কন্ঠস্বর হঠাৎই রুক্ষ হয়ে গেল। বললো,
“তবে কী তুই বলতে চাস আমার সমস্যার সমাধান আছে? কী সমাধান আছে বল? ঝাড়ফুঁক!”
রেজওয়ান বিশ্লেষণ করে বললো,
“ঝাড়ফুঁক নয় ওটাকে রুকইয়াহ বলে।
প্রত্যেকের অন্তরেই কিছু ব্যথা থাকে। তবে যারা আল্লাহর উপর ভরসা রাখে তারাই আরোগ্য লাভ করে। ( বেলাল ফিলিপ্স)
বিশ্বাস করে একবার করেই দেখনা হিমান্ত ভাই আমার। দু’টো মাস শুধু দু’টো মাস তুই এই চিকিৎসা নে পরিপূর্ণ বিশ্বাসের সাথে। তুই নিজেই পরিবর্তন বুঝতে পারি তখন।”
হিমান্ত হতাশ দৃষ্টিতে রেজওয়ানের মুখটা পর্যবেক্ষণ করে। হিমান্তের মনে হাজারটা দ্বিধাদ্বন্দ কাজ করছে এমুহূর্তে। রেজওয়ান ভেবেছিল অন্য সব বারের মতো এবারও হয়তো হিমান্ত তাকে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু না, তাকে অবাক করে হিমান্ত রাজি হলো এবার। রেজওয়ানের খুশি দেখে কে! হিমান্ত দু’চোখ ভরে ভাইয়ের হাসিমাখা মুখটা দেখতে থাকে।
তখনই সম্মুখে এসে দাঁড়ায় হিমান্তের মামি আকলিমা বেগম। সদ্য স্বাভাবিক হওয়া মুখটা তৎক্ষণাৎ অস্বাভাবিক আর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে হিমান্তের। আকলিমা সহাস্যে এগিয়ে এসে বলে,
“কেমন আছো আব্বা?”
“কেমন আশা করেন আপনি মামি? অবশ্যই ভালো নয়। বিশ্বাস করুন আমি অনেক ভালো আছি।” নিরস কন্ঠে জবাব দেয় হিমান্ত।
“আমি তোমার খারাপ কেন চাইবো বাপ? আমি কী তোমারে আর মৃদুল কে আলাদা চোখে দেখি বলো?”
আকলিমার বিমর্ষ মুখখানি দেখে হিমান্ত ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। বলে,
“এতো দারুন অভিনয় কী করে করেন বলুন তো মামি? মৃদুল আর আমি আপনার চোখে এক তাই না? তাহলে কী মৃদুলকেও আপনি মেরে ফেলতে চান? ঠিক যেভাবে আমাকে প্রতিনিয়ত তিলতিল করে মারছেন। আপনি ভেবেছেন আমি কিছুই জানি না তাই না?
আমি সব জানি মামি। সারা আমাকে সব বলেছে। ঐ টুকু মেয়েকেও ছাড়েন নি আপনার স্বার্থসিদ্ধির জন্য। মামি প্লিজ আমার সামনে থেকে সরে যান। প্লিজ মামি!”
হিমান্তের উঁচু আওয়াজে আকলিমা ঘাবড়ে যায়। আশপাশে তাকিয়ে ভীষণরকম লজ্জা পান তিনি। সবাই আড়চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সবাই কী শুনেছে হিমান্ত এতোক্ষণ তাকে যা বলেছে? আকলিমা ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে।
“বেয়াদবের বংশ বেয়াদব! আমাকে চোখ দেখাস? তোর চোখ উপড়ে নেওয়া এই আকলিমার কনিষ্ঠ আঙুলের কাজ। আগে তোর বুইড়া বাপটারে মারি তারপর তোরে আমি যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে মারবো। বজ্জাত ঘরে বজ্জাত! ক্ষমতা জানোস আমার? তুই কেন তোর চৌদ্দ গুষ্ঠির ক্ষমতা নাই আমার ক্ষতি করার। আমাকে কষ্ট দেবে এমন সাধ্য কার? তোদের সিদ্দিকী বংশের নাম নিশানা আমি মুছে দেব অথচ তোরা টেরও পাবি না। আমার ক্ষমতা সমন্ধে কোনো ধারণায় তোদের নেই।
আমি সব পারি, সব!”
আকলিমা তার অপ্রকাশিত কথাগুলো ভেবে অহংকারে শির উন্নত করে। তার লোভী চোখজোড়া ধ্বংস কামনায় জ্বলে ওঠে। লোকসম্মুখে সে যতোটা আন্তরিক অগোচরে তারচেয়ে দ্বিগুণ ভয়ানক পিশাচী।”
চলবে,,,
ব্যক্তিগত কারনবশতঃ নিয়মিত গল্প দিতে সমস্যা হচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট সময় অব্দি থাকবে এই সমস্যা তারপর আবার নিয়মিত পাবেন। আমার আইডি, গ্রুপ সব ক্লোজ আছে বর্তমানে। যখন ফুরসৎ পাবো পেজে গল্প দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবো। পরিশেষে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত অনিয়ম করে গল্প দেওয়া জন্য।
পর্ব ২৫
আকলিমা ষড়যন্ত্রের জালের উপর দরদের পর্দা টানলো। তাতে বিন্দুমাত্র লাভ হলো না। হিমান্ত এবার আর মোটেও পাত্তা দিল না তার নাকে কান্না। বাড়ি ছাড়ার মাস ছয়েক আগের ঘটনা।
হিমান্তের সেদিন মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয়। সামান্যের জন্য বেঁচে গিয়েছিল সেইবার হিমান্ত। এরপর সুস্থ হলো তারপর আবার ডান হাত ভাঙলো সিঁড়ি থেকে পড়ে। এক মাস না যেতেই পায়ে আঘাত পেল সে ফের। হিমান্ত স্বাভাবিক দুর্ঘটনা বলে মনে করেছিল সেসব।
সে এমন সময় অতিবাহিত করছিল যখন তার মধ্যে ব্যথা বেদনা ছাড়া কিছুই বাকি ছিল না। মনে যদি ব্যথা থাকে দেহের ব্যথায় কিবা হয়? তার ক্ষেত্রেও ষোলো আনা সত্যি ছিল কথাটা। সমস্যা দেখা দিয়েছিল সারাকে নিয়ে। সারার চঞ্চলতা একেবারেই শেষ হতে লাগলো। কেমন একটা আতঙ্কিত দেখাতো তাকে সর্বক্ষণ।
হিমান্ত বারকয়েক জিজ্ঞেসা করেও সদুত্তর পায় না। শেষমেশ নিজেই একদিন হড়বড়িয়ে এসে সব বলে সারা। আকলিমা তাকে হিমান্তের পুতুল বানিয়ে বলে আজ তোর মামার এক্সিডেন্ট হবে। সারা এমনিতেও আকলিমাকে ভয় পেত। তারউপর চোখ বড় বড় করে বলা কথাগুলো শুনে বাচ্চা মেয়েটা আরও ভয় পেল। যখন দেখলো তার মামার সত্যি সত্যি আকলিমার ভাষ্যমতের মতোই এক্সিডেন্ট হয়েছে তখন তার ভয়ের মাত্রা চূড়ান্ত।
হিমান্ত সেদিনও কথাগুলো গুরুত্ব দেয় নি। ভীষণ রাগ উঠেছিল মামির উপর। একটা বাচ্চা মেয়েকে ভয় দেখানো অতি সহজ জেনেও এমন একটা কথা কেন বলতে গেলেন তিনি? সারা দিনদিন অসুস্থ হতে লাগলো। শরীর ভেঙে পড়লো মেয়েটার। সারা সারাক্ষণ আতঙ্কিত থেকেও হিমান্তকে সে আগলে রাখার চেষ্টা করে। মাত্র চার বছর বয়স অথচ তার আচার ব্যবহার ঐ’কদিনে চৌদ্দ পনেরো বছরের মেয়েদের মতো হতে লাগলো।
চোখের ভাষায় একটা পূর্নাঙ্গ ভাব এলো সেসময় সারার। জেদ, অভিমানের মতো শিশুসুলভ অনেক আচরনেই কমে গেল তার মধ্যে। হিমান্তের না বলা কথা সে অকপটে বলে দিতে পারতো শুধু মাত্র মুখ দেখে। এই অপরিণত ভাব হিমান্তের কাছে স্বাভাবিক মনে হয় নি। সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো এই বাড়ির দেয়ালের ইটের ভাঁজে ভাঁজে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা। যা এতোকাল চক্ষুগোচর হয়নি তা যেন একমুহূর্তে প্রত্যক্ষ করে সে।
নিজের জন্য তার কোনো আশংকা নেই। যতো ভয় সব সারার জন্য। এই মেয়েটাই তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন ছিল সেসময়। কোনোমতে সে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল। আব্বার সাথে ঝগড়া হয়ে সুবিধা হলো তাতে। আব্বা সেদিন তাকে যেকথা গুলো বলেছিল দারুন কষ্ট পেয়েছিল হিমান্ত। মায়ের মৃত্যুর পর আব্বার আর তার সম্পর্কের মাঝে যে দেয়াল গড়ে ওঠে তা যেন কিছুতেই আর ভাঙে নি পরবর্তীতে। ক্রমশ সে দেয়াল আরও বাড়তে থাকে।
উপরে উপরে সে যতোই আব্বার প্রতি রাগ দেখাক আদৌতে সে আব্বা পাগল ছেলে। আব্বার দুরত্ব তাকে কতোটা পীঁড়া দেয় তা কাওকে বোঝাতে পারে না হিমান্ত। হতভাগ্য তো সেই সব মানুষ, যারা নিজেদের আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। ভেতরে দুঃখের, অভিমানের পাহাড় জমিয়ে একসময় দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। সবাই জানলো মানুষটা রগচটা, আত্মকেন্দ্রিক। কেউ টের পেল না মানুষটার মনে কতোটা কষ্ট ছিল।
রেজওয়ান কাঁধে হাত রাখতেই চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে হিমান্তের ভেতর থেকে। আকলিমা ততক্ষনে সরে গেছে অবস্থা বেগতিক দেখে। হিমান্তের দু’চোখ আব্বাকে খুঁজছে। কতোদিন মানুষটাকে সে দেখে নি। হিমান্তের মতো আরিফ সিদ্দিকীর চঞ্চল নজরও বড় ভাইয়ের খোঁজে ব্যাকুল। পারভেজ চৌধুরী হয়তো বুঝেছে সে ব্যাকুলতা। তাইতো এগিয়ে এলো হবু বেয়াইয়ের কাছে। জানালো হানিফ সিদ্দিকী সিঙ্গাপুর গেছে চিকিৎসার জন্য। কাওকেই জানায় নি সে এ’কথা। ছেলের বিয়েতে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করার একপর্যায়ে সত্যিটা জানায় হানিফ তাকে।
আরিফ মনে দারুন কষ্ট পায় ভাইয়ের অসুস্থতার কথা জানতে পেরে। হানিফ সিদ্দিকীর কী অসুখ সে সম্পর্কে কেউ অবগত নয়। এমনকি বন্ধু পারভেজও না। কথাটা বলার সময় পারভেজকে খুব চিন্তিত দেখালো। আরিফ সিদ্দিকীও চুপসে গেল সেই সঙ্গে।
সোনিয়া পংক্তিকে জোর করায় পংক্তি অল্প করে কাচ্চি খেল। সারা, মিরা খাওয়া শেষ করে স্টেজের সামনে নাচ দেখছে। পংক্তির মন, চক্ষু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বার বার খুঁজছে হিমান্তকে। চোখের কোনা দিয়ে দেখে যাচ্ছে মানুষটাকে সে। এই জনমে বুঝি লোকটার মায়া সে কাটিয়ে উঠতে পারবে না আর। তাকে না পাওয়ার আশ তার মিটবে না কোনোদিন। পংক্তির চোখের সীমানা জলে ভরে ওঠে।
আবরার বেশ রোমান্টিক গোছের স্বামী হবে বলে মারিয়ার ধারণা। পাশে বসে মারিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে আবরার। লোকচক্ষুর অন্তরালে কথা বলার নাম করে দু’বার চুমুও খেয়েছে সে মারিয়াকে। সাথে দুষ্টু মিষ্টি কথার জ্বালাতন তো আছেই। মারিয়া আধুনিকা তবুও তাঁর লজ্জার সীমা রইলো না আবরারের এহেন কাজে।
হনুফা স্টেজে বসা কনেরূপে মেয়েকে দেখে তাকিয়ে আছেন। আবরারকে জামাতা হিসেবে তার ভালোই লেগেছে তবে হিমান্তের মতো নয়। হিমান্তের প্রত্যাখ্যান হনুফা বেগম এখনও মানতে পারেন নি। তার মনে ক্ষোভ রয়েছে এ নিয়ে। চোখ ঘুরাতেই পংক্তিকে দেখে সেই ক্ষোভ দ্বিগুণ হলো তাঁর। এই মেয়েকে তিনি একদমই সহ্য করতে পারেন না। হিমান্তের আশপাশে তো মোটেও না।
দাঁতে দাঁত পিষে অগ্নিচোখে চেয়ে আছেন পংক্তির দিকে। তখনই পাশ থেকে চাপা স্বরে দু’জন মানুষের আলাপ আলোচনা তাঁর কানে এলো। অনেকের কথার মাঝে এই এইদুজনের কথা তাঁর কানে এলো কারন কথাগুলো হচ্ছিল পংক্তি আর হিমান্তকে ঘিরে।
তড়িৎ গতিতে হনুফা সরে এলো কথাগুলো স্পষ্টভাবে শোনার জন্য। মধ্যম গড়নের ফর্সা মহিলাটি তাঁরই বয়সী হবে হয়তো। কালো বোরখায় আবৃত দেহ। তবে মুখটুকু অনাবৃত। যার সাথে কথা বলছে সেই লোকটা মধ্য বয়স ধরা চলে।
পেটমোটা, চশমা পরিহিত। ধূর্ত চোখের চাহনী। লোকটা এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টি রেখে চাপা স্বরে বললো,
“আম্মা আপনারে বলেছিলাম না এই মেয়ে সাংঘাতিক কিসিমের! বিশ্বাস হলো তো?”
“আরে আজিজ চুপ কর। বাড়ি গিয়ে এ নিয়ে কথা হবে।”
আকলিমার নিষেধ অমান্য করে আজিজুল আবার বললো,
“চুপ কর! চুপ কর! বললে কী হবে বলেন?
আমি না হয় চুপ থাকলাম। আমি তো এমনিতেও চুপ থাকি। কিন্তু এই মাইয়্যার করবেন কী? আপনার সব সাধনায় পানি ঢালতে ওর সময় লাগব না। কতো কইরা কইলাম আম্মা হিমান্তরে ফিরাই আনেন। না! উনি মহাজ্ঞানী মহিলা, তাঁর ধারণা হিমান্ত বাড়ি থেইক্যা বার হইয়া পথে পথে ঘুইরা মরবো। কই মরছে? দেহেন ভালো কইরা চোখ ফুটাইয়া দেহেন।
কেমন তরতাজা, শক্ত সামর্থ্য হইয়া গেছে এ’কমাসে। আর ঐ ফকিন্নি মাতারি আমারে মাইর খাওয়াইয়া এহন হিমান্তের চোখে সতী সাবিত্রি। আম্মা আমার শরীর জ্বলতাছে আম্মা। আপনার জ্বামাইরে এমনে অপমান করলো যারা তাগো আপনে কিচ্ছু কন না। ঘর জ্বামাই বইলা আইজ আমার মান নাই। ফাঁসি দিমু আইজ আমি।”
“উফ! থাম তো আজিজ। এই মেয়ে কী হিমান্তর সাথে থাকে?”আকলিমা বোরখা পরিহিত পংক্তির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আজিজ গজগজ করে বলে,
“আপনে জানেনই না এই মাইয়্যা কই থাকে? আল্লাহ! এই মহিলা আবার নিজেরে জ্ঞানী কয়। বালের জ্ঞানী তুমি ফুপু। আজ আট/ নয় মাস সে হিমান্তের সাথে আছে।”
আজিজ রাগের মাথায় শ্বাশুড়ি থেকে আকলিমাকে ফুপুর দোরগোড়ায় টেনে আনে। আম্মা বলে যে সম্মান টুকু সে করে ফুপু বলতেই তার সিকি ভাগও করে না। আকলিমা আজিজের ব্যবহার পরিবর্তনে মনে মনে রেগে যান। হিমান্তের ত্যাড়া কথায় মেজাজ তার এমনিতেও চড়া। এখন আরও চড়ে বললেন,
“তুই কেমন করে জানোস? আগে কস নাই কেন?”
“কেমনে কমু? আমি তো গার্মেন্টসের মালিকানা হাতানোর তালে ছিলাম। আপনেই তো কইছেন হিমান্তের ব্যাপারটা আপনি দেখবেন। এই দেখার নমুনা আপনার? গেছে হিমান্ত আপনার হাত থেইক্যা সাথে সিদ্দিকী বংশের সব সহায় সম্পত্তি। বুইড়া সিদ্দিকী মরলে বালডাও হইব না এখন আর।
ওহন বইয়া বইয়া আঙ্গুল চুষেন।” আজিজ কথা শেষ করতেই আকলিমা কষে চড় বসায় ওর গালে। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে,
“চুপ থাক হারামজাদা। বেশি বকবক করোস কেন আমার সামনে? চিনোস না আমারে? জিহ্বা টাইনা ছিঁইড়া ফালামু এমনে কথা কইলে আবার।”
“হ! মাইরাই ফালাও না কেন? সব শেষ তোমার সব!”
আজিজ গালে হাত দিয়ে ভয়ে ভয়ে বলে। আজিজের মুখে তুমি সম্বোধন শুনে আকলিমা আরেক চড় দিতেই যাবে, হনুফা এসে বাঁধা দিল। হনুফার অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনে আকলিমা, আজিজ দু’জনই চমকে যায়।
হনুফা একগাল হেঁসে তাদের অভয় দেয়। সে এতোক্ষণ লুকিয়ে যা শুনেছেন তার অর্থ দাঁড়ায় এরা দু’জনও পংক্তি, হিমান্তকে অপছন্দ করে। যদিও হনুফা শুধু পংক্তিকে অপছন্দ করে। পংক্তির ক্ষতি চাইতেই সে এসে এদের সাথে যোগ দিয়েছে। আকলিমা, আজিজ নিজেদের উদ্দেশ্যে গোপন রেখে হনুফার সকল কথা শোনে।
সব শুনে আকলিমার মনের ভাব বোঝা গেল না। তবে আজিজ মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পেল হনুফার কথা শুনে। আজিজ পংক্তি সম্পর্কে নানা সত্য মিথ্যা মিলিয়ে বলে হনুফাকে। সব শুনে হনুফা যেন ঈদের চাঁদ পেল। সে তার ইচ্ছার কথা দু’জনকে জানালে আকলিমা গড়িমসি করলেও আজিজ হনুফাকে সাহায্য করার অঙ্গীকার করে। হনুফা বেগমকে একপাশে নিয়ে ষড়যন্ত্রের জান বুনতে থাকে আজিজ।
আবিদা খানম আসার পর থেকেই প্রসূনকে ধরেছে পংক্তিকে দেখবে বলে। প্রসূন বিরক্ত হয়ে শেষমেশ রাজি হলো দাদীজানের কথায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অনেকক্ষন খুঁজেও মেয়েটাকে পেল না সে। পরে ভাবলো আজ হয়তো আসে নি মেয়েটা। মেয়েটাকে কী তার দাদীজান নাতনি হিসেবে ধরে নিয়েছে? তার মানে প্রসূনের সৎ বোন! ওহ নো! প্রসূন মেয়েটাকে কোনোদিন সৎ বোন হিসেবে মানবে না, নেভার। তার আদরে ভাগ বসাবে মেয়েটা।
শুধু কী আদরে! তার সকল কিছুতেই ভাগ বসাবে হয়তো মেয়েটা। না! মেয়েটাকে এতোটা গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। মাথা ব্যথার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা প্রসূনের। যেদিন থেকে দেখেছে সেদিন থেকেই ওর আব্বু আম্মুর মাঝে দুরত্ব কয়েক ক্রোশ বেড়েছে আগের তুলনায়। চিন্তায় চিন্তায় ওর মা অসুস্থ প্রায়।
সব দেখেও দাদীজান সর্বক্ষন কানের কাছে এই মেয়ে সম্পর্কে শুনতে ব্যাকুল। প্রসূনের মেজাজ চিটচিট করছে মেয়েটার উপর রাগে। রাগে মুখ কঠিন করে পাশ কাটতে গিয়েই ধাক্কা খেল এক যুবকের সাথে। হেংলা পাতলা গঠনের গৌরবর্ণের ছেলেটা ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। প্রসূন রাগী গলায় বললো,
“আর ইউ ব্লাইন্ড?”
“জি না! নিয়মিত ছোট মাছের তরকারি খাই। চোখের জ্যোতি প্রখর বলতে পারেন। কেন আপনার কী ব্লাইন্ড ছেলে প্রয়োজন?”রায়হান মুচকি হেঁসে জবাব দিল। প্রসূন ঝাঁড়ি মেরে বললো,
“রাস্কেল, ননসেন্স।”
“জি ধন্যবাদ এতো দারুন কমপ্লিমেন্ট দেওয়ার জন্য।”
“এটা কমপ্লিমেন্ট নয় তিরস্কার ছিল মি.। বাংলাদেশে মনে হয় দিন দিন পাগলের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।” প্রসূন রায়হানের পাশ কাটতেই রায়হান সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ফের। চোখ রাঙিয়ে বলে প্রসূন,
“সমস্যা কী আপনার? আসলেই তো বেয়াদব আপনি।”
“স্যরি বলার জন্যেই বেয়াদব হতে হলো। স্যরি! ম্যাডাম ফুলি। বাই দ্যা ওয়ে আমি রায়হান সিদ্দিকী।” প্রসূনের রাগী মুখটা সাথে সাথে লজ্জায় একটুখানি হয়ে গেল। এরপর আর মুখতুলে চাইলো না সে একবারও। অস্থিরতা বেড়ে গেল তার ভেতরে। কোনোমতে পালিয়ে এলো রায়হানের সম্মুখ থেকে। রায়হান ঠোঁট কামড়ে হাসছে প্রসূনের ঘাবড়ে যাওয়া মুখটা দেখে। ফিরে ফিরে বার বার প্রসূনকে দেখছিল সে। প্রসূন যতো চেষ্টা করছিল লুকানোর রায়হানের চোখজোড়া ততোই তাকে খুঁজে নিচ্ছিল।
গতকালই সে জেনেছে এই মেয়ের সাথে আগামী মাসে তার আকদ। বিয়েতে আসার মূল উদ্দেশ্যে তার প্রসূনকে দেখা। রায়হানের বড় ভাবি, মা প্রসূনের সাথে কথা বলছে। বাঘিনী লজ্জায় বিড়াল হয়ে আড়চোখে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। সিঁড়ির এককোনে দাঁড়িয়ে হাসছে রায়হান তা দেখে। আচমকা একটা হাত তাকে টেনে আনলো আড়ালে। হাতের মালিক আর কেউ নয় মৃদুল। রায়হানের খুশি মুহূর্তে আতঙ্কে রূপ নিল। রায়হানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জড়িয়ে ধরলো সে।
মৃদুলের স্পর্শে ঘৃণা হচ্ছে আজ রায়হানে। ঠেলে সরিয়ে দেয় মৃদুলকে সে। রায়হানের এমন আচরনে চোখে জল এসে যায় মৃদুলের। ভেজা গলায় বলে,
“এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে আমায় তুমি রায়হান? মানুষের জেন্ডারই কী সব? মন কী কিছুই না? আমি মন থেকে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।”
“পাগল তুমি। তুমি একটা ছেলে ঠিক আমার মতোই মৃদুল। একজন ছেলে অন্য একটা ছেলের জীবনসঙ্গী কী করে হতে পারে? তোমাকে আমি কোনোদিন ভালোবাসিনি। তবে মৃদুলা নাম্নী কাওকে বেসেছিলাম এবং সেটা ছিল আমার চরম ভুল। আমার এবং তোমার মাঝে কোনো সম্পর্ক না ছিল, না ভবিষ্যতে থাকবে। ক্লিয়ার।”
“না ক্লিয়ার না। আই লাভ ইউ বেবি। প্লিজ ডোন্ট গো। এই দেহ, এই শরীর কিছুই না।
সব মোহ। আসল তো এই মন। আমার মন তোমাকে চায়। আমি জানি তোমার মনও আমাকে চায়। প্লিজ রায়হান একসেপ্ট মাই লাভ। প্লিজ!”রায়হানের হাত ধরে অনুনয় করে মৃদুল। চোখের জলে মুখ ভাসছে তার। রায়হানের খারাপ লাগলেও ভাইয়ের কথা মনে করে মন শক্ত করে। বলে,
“মৃদুল ভালোবাসা প্লিজ বললেই হয় না।
তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ। আর সবচেয়ে বড় কথা তুমি যা বলছ তা মহাপাপ।” রায়হান ভাইয়ের বলা সব কথা বুঝিয়ে বলে মৃদুলকে। কিন্তু তাতে লাভ হয় না। মৃদুল তার কথায় অনড়। তার আচরণে স্পষ্ট প্রকাশিত সে যে কোনো মূল্যে রায়হানকে চায়। মৃদুলের একগুঁয়েমিতে রায়হান ক্ষিপ্ত হয়। রাগের বশে হয়ে একপর্যায়ে বলেই ফেলে,
“দেখো মৃদুল বেশি বাড়াবাড়ি করো না।
আমি তোমাকে কিংবা তোমার এই পাগলামীকে একদম টলারেট করবো না এরপর। মানুষ হিসেবে তোমাকে সঠিক জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু তুমি নিচ্ছ না। দেন ফাইন! তোমার যা খুশি তুমি করো বাট আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। যদি করো আমি তোমার ফ্যামিলিতে তোমার নামে কমপ্লেন করতে বাধ্য হব।” রায়হান রাগে তৎক্ষণাৎ স্থান ত্যাগ করল। কান্নায় ভেঙে পড়ল মৃদুল বিচ্ছেদের দহনে জ্বলে পুড়ে। রায়হানের প্রত্যাখ্যানে পাগলপ্রায় সে।
যথারীতি বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়।
আবেগঘন পরিবেশে সৃষ্টি হয় মারিয়ার বিদায়ে। মজিদ ও হনুফা দম্পতির একটাই মেয়ে। মেয়েকে বিদায় দিয়ে মজিদ সাহেব কান্নায় ভেঙে পড়েন। হনুফা বেগমও চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন। নিকট আত্মীয় স্বজন এসে তাদের নিয়ে গেল বাসায়। হিমান্ত সব ঠিকঠাক করে বাসায় এলো মধ্য রাতে। সারাদিন তেমন কিছু খেতে পারে নি সে।
ক্ষুধা লেগেছে বড্ড এখন। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। এই অবস্থায় বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা নাই হিমান্তের। এই রুমেই কাপড় পাল্টে রান্নাঘরের বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে নিল। খাবারের আশায় পাতিলের ঢাকনা সরাতেই পাশে রাখা স্টেইনলেস স্টিলের গ্লাসটা ঝনঝন শব্দে পড়ল নিচে। হিমান্ত কপাল চাপড়ে গ্লাস উঠাতে নিচে ঝুঁকে বসে।
“কিছু খাবেন? ভাত বেড়ে দেব?”শীতল গলায় প্রশ্ন করলো পংক্তি।
হিমান্ত গ্লাসটা জায়গা মতো রেখে ঘুরে তাকালো। ততোক্ষণে দৃষ্টি নামিয়ে নিয়েছে পংক্তি। হিমান্ত জবাব দেবে ঠিক তখনই পংক্তির গালের পাশের দাগটা আর ঠোঁটের ক্ষতটা লক্ষ্য করলো সে। বুকের পাশে মোচড় দিয়ে উঠেছে সাথে সাথে হিমান্তের। হিমান্তের নজরের গতিবিধি বুঝে পংক্তি চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।
“পংক্তি “
পংক্তি মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়াল হিমান্তের পিছু ডাকে। কান্নার আওয়াজ গলা অব্দি ঠেলে আসতে চাচ্ছে ওর। দাঁত কামড়ে ঢোক গিলে দ্রুত পা চালিয়ে রুমে চলে এলো পংক্তি। বালিশে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁদছে সে। হিমান্তের অস্তিত্ব উপলব্ধি করছে পাশে পংক্তি। তাতে কান্নার জোয়ার যেন দ্বিগুন গতিতে বাড়ে তার। হিমান্তর খুব ইচ্ছা করছে পংক্তিকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিতে এই মুহূর্তে।
নিগূঢ় আলিঙ্গণে বেঁধে দু’ঠোঁটে সমস্ত কষ্টের জল শুষে নিয়ে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে। কিন্তু পারলো না। তাকে সমাজ,ধর্ম বাঁধা দিল এমনটা করতে। ধীর পায়ে সরে এলো পংক্তির পাশ থেকে হিমান্ত। ক্ষুধার উদ্রেক তার মধ্যে নেই এখন আর। আছে একবুক হাহাকার। দু’চোখ পংক্তিকে পাওয়ার তৃষ্ণায় নিস্প্রভ। হৃদয়জুড়ে বেজায় দহন তার।
দুই দিন পরের ঘটনা!
হিমান্তকে জরুরী তলব করেছে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। হিমান্ত সেখানে পৌঁছাতেই জানতে পারে কেউ তার এবং পংক্তির নামে কুৎসা রটিয়েছে। উপস্থিত সবার সামনে হিমান্ত স্পষ্টভাষায় বলে,
“এসব ভিত্তিহীন এবং মিথ্যাচার। পংক্তির সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক নাই যার কারনে আপনাদের সমাজ নষ্ট হবে।”
মুরুব্বী গোছের একজন জবাব দেয়,
“চোর কী কোনোদিন বলবে সে চুরি করেছে। তুমি স্বীকার করেছ ঐ মেয়ে তোমার জ্ঞাতি গোষ্ঠীর কেউ না। তাহলে এতোদিন একজন যুবতী মেয়ে তোমার সাথে কেন আছে?”
“সংযত হয়ে কথা বলুন আপনি। সে এতিম। তার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিল না। আর আমার ভাগ্নিকে দেখাশোনা করার জন্য ওকে আমার প্রয়োজন ছিল।”
মুরুব্বী কিছু বলতে গেলে প্রভাবশালী শাহিন বাঁধা দেয়। হিমান্তকে উদ্দেশ্যে করে গম্ভীর গলায় বলে,
“সে যাই হোক! এখন আর তাকে তুমি তোমার বাসায় রাখতে পারবে না।”
“কিন্তু কেন? আপনাদের তো বললাম আমি সব।” হিমান্ত ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
শাহিন কড়াস্বরে হিমান্তকে লক্ষ্য করে বলে,
“তোমার কথায় তো সমাজ চলবে না। তোমাদের নামে অভিযোগ তোমরা অনৈতিক সম্পর্কে আছো। তুমি যদি সঠিকই হও তো ছেড়ে দাও ঐ মেয়েকে। আমরাই একটা ব্যবস্থা করবো ওর। তবুও তুমি তাকে ঐ বাসায় রাখতে পারবে না।”
“আপনার কী ধারণা আমি আপনাদের এসব হুমকি ধামকিতে ভয় পেয়ে পংক্তিকে রাস্তায় নামিয়ে দেব? নো! আপনারা ওর দায়িত্ব নিলে নৈতিক আমি নিলে সেখানে অনৈতিক হয়ে গেল? বাহ! আপনাদের এসব আজাইরা প্যাঁচাল অন্য কাওকে শুনাইন। আমি আপনাদের এলাকা ছেড়ে চলে যাব। তবুও আপনাদের অন্যায় কথাবার্তা মানতে রাজি নই। কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ সেটা শেখার জন্য হিমান্ত আপনাদের মতো সুবিধাবাদী লোকদের কাছে আসবে না।”
উপস্থিত সবার মুখের উপর কথাগুলো বলে একপ্রকার রাগ দেখিয়ে চলে আসে হিমান্ত। শাহিনের কাছে হিমান্তের আচরণ ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিল। সবাই মনে মনে খেঁপে ওঠে হিমান্তের বিরুদ্ধে। তাদের রাগের আগুনে ঘি ঢালে আজিজ এবং হনুফা। পংক্তি এখনও স্কুল থেকে ফেরে নি। হিমান্ত তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করে। মাথা ধরেছে প্রচন্ড। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কালই বাড়িওয়ালাকে না করে দেবে সে। দরকার হলে দু’মাসের ভাড়া চুকিয়ে কাল পরশু এলাকা ছাড়বে তবুও পংক্তিকে ছাড়া তার পক্ষে অসম্ভব।
এই মেয়েকে ছাড়তে হবে শুনামাত্রই হিমান্তের বুকে চিনচিন ব্যথা শুরু হয়েছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হিমান্ত চুল মুঠ করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়।
পংক্তির স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়ালো। বাসায় তালা খোলা দেখে আশ্চর্য হয় পংক্তি। কলিং বেল কয়েকবার চাপতেই হিমান্ত দরজা খুলে দেয়।
পংক্তি আড়চোখে একপলক হিমান্তের চিন্তাগ্রস্হ মুখটা দেখে ভাবুক হলো। ফ্রেশ হয়ে খাবার গরম করে হিমান্তের রুমের দরজায় নক করে পংক্তি। হিমান্ত জানায় সে খাবে না। পংক্তিও খেল না সেই চিন্তায়। পংক্তি ঐদিনের পর থেকে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না হিমান্তের সাথে। হিমান্তও আগের মতো গম্ভীরমুখে থাকে সর্বদা। পংক্তি খেয়াল করেছে আজকাল নিয়মিত নামাজ পড়ছে হিমান্ত। রাত জেগে তাহাজ্জুদও পড়ার চেষ্টা করছে।
হিমান্তের জীবন সুন্দর হলে পংক্তি খুশি হবে। তার হিমান্ত ভালো থাক, নিরাপদ থাক এই দুয়া সে সবসময় করে। পংক্তির ধারণা হিমান্ত তাকে নিয়ে হয়তো ডিস্টার্ব থাকে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসএসসি শেষ হলে এখান থেকে চলে যাবে সে। কিন্তু চিন্তা হয় সারাকে নিয়ে। ওর জন্য কোথাও চলে যেতে মন চায় না পংক্তির অপরদিকে হিমান্তের গম্ভীরতাও তাকে কষ্ট দেয়।
সন্ধ্যার পরপরই নেতৃস্থানীয় লোকগুলো হিমান্তের বাসায় এসে জড়ো হয়। হিমান্তের তখনকার ব্যবহারে শাহিন দারুন চটেছে। হিমান্তের সকল কথা শুনতে নারাজ তারা। কয়েকজন মহিলা টেনে হিঁচড়ে পংক্তিকে রুম থেকে বের করে আনে। বাড়িওয়ালির উস্কানিতে নানা অশালীন কথাবার্তা বলতে থাকে পংক্তিকে। হিমান্ত বাঁধা দিতে গেলে শাহিনের পালিত গুন্ডা গুলোর সাথে হাতাহাতি হয় হিমান্তের।
এই সুযোগে পংক্তিকে মনের খায়েশ মিটিয়ে লাঞ্ছিত করে বাড়িওয়ালিসহ আশেপাশের মহিলারা। বাড়িওয়ালি এমন ভাব করে যেন সে পংক্তিকে বাঁচাচ্ছে। আসলে এসব তারই কথায় হচ্ছে। পংক্তিকে এভাবে নাজেহাল করে বেজায় আনন্দ পাচ্ছে মনে মনে সে। শাহীনের গুন্ডা বাহিনীকে কোনোমতে মেরে ধরে মহিলামন্ডলীর মাঝখান থেকে পংক্তিকে নিরাপদ দুরত্বে নিয়ে আসে হিমান্ত।
পংক্তি ভয়ে কাঁপছে থরথর করে। হিমান্ত পংক্তিকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলে,
“আপনারাও তো মেয়ে। আপনাদের অনেকের মেয়ের বয়সী ও। ওর সাথে এমন করতে বাধলো না আপনাদের বিবেকে। ওর কী দোষ? বলুন? ও অসহায়, এতিম! ছিঃ ধিক্কার দেওয়ার ভাষাও আমার নাই। পশুদের চেয়েও ঘৃণ্য আপনারা সবাই। যদি কোনো দোষ করে থাকি সেটা আমি করেছি।
শাস্তি দিলে আমাকে দিতেন ওকে কেন দিলেন? এতোগুলো মানুষ মিলে দু’জনকে হেনস্তা করে কী জাহির কারতে চাচ্ছেন আপনারা? এই আপনাদের সমাজের ন্যায় নীতি? সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই রাস্তার কুকুরের মতো হামলে পড়েন। আসেন দেখি কার কলিজা কতো বড়।
আসেন!”
মহিলাগুলো আড়ালে সরে যায় হিমান্তের গর্জনে। শাহিন এগিয়ে আসলে হিমান্তে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নাক বরাবর ঘুষি মেরে ফেলে দেয়।
মজিদ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আরিফ সিদ্দিকীকে মোবাইল করে সব জানায়। আরিফ সিদ্দিকী সকল মান অভিমান ভুলে ছুটে আছে কালক্ষেপণ না করে। শাহিন হিমান্তকে মারতে উদ্যত হলে আরিফ সিদ্দিকী এসে বাঁধা দেয়। শাহিনের কলার চেঁপে ধরে থাপ্পড় মারে।
রাগে হুঙ্কার দিয়ে ওঠে,
“তোর সাহস কী করে হয় আমার ভাতিজার গায়ে হাত তোলার? তোর মতো হাজারটা কুত্তা সিদ্দিকীরা পালে জানিস তুই? রেজওয়ান পুলিশ কমিশনারকে মোবাইল কর। তোর কতো ক্ষমতা আজ আমি দেখে নেব শাহিন। আমার ভাতিজার গায়ে হাত উঠিয়েছিস তুই।”
শাহিন ঘাবড়ে যায় আরিফ সিদ্দিকীকে এখানে দেখে। এই এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে আরিফ সিদ্দিকীও একজন। এই হিমান্ত আরিফ সিদ্দিকীর ভাতিজা জানলে ভুলেও আসতো না সে। ঝামেলা এড়াতে গলার স্বর নরম করে শাহিন।
বলে,
“মুরুব্বী রাগেন কেন? আমরা তো মারামারি করতে আসি নাই। আপনার ভাতিজা আপোষে মানলো না। সেই প্রথম হাত উঠিয়েছে আমার ছেলেদের উপর। আমরা তো শুধু ঐ মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সমাজে অনৈতিকতা তো মেনে নেওয়া যায় না বলেন?”
রেজওয়ান বাবাকে শান্ত করে শাহিনকে ধমক দিয়ে বলে,
“আপনি সমাজে যে কী নৈতিকতা করছেন তার নমুনা তো দেখছি আমরা। দয়াকরে মিথ্যা বলে পাপ বাড়িয়েন না আর। একটা অসহায় মেয়েকে এতোগুলো মানুষ মিলে লাঞ্ছিত করলেন। এই আপনাদের ন্যায়? এই মেয়েকে যে কারনে অপমান, অপদস্থ করলেন তার উচিত জবাব আজ আমি আপনাদের দেব। রায়হান!”
“জি ভাইয়া।”
“কাজি সাহেবকে ডেকে নিয়ে আয়। আজ এই মুহূর্তে হিমান্ত পংক্তির বিয়ে হবে। তারপর পুলিশ কমপ্লেন হবে এই মানুষরূপী অমানুষ গুলোর বিরুদ্ধে।”
পংক্তিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে কাঁদছে সোনিয়া। স্বামীর বাঁধা উপেক্ষা করে সে এগিয়ে আসতে পারে নি পংক্তিকে সাহায্য করতে। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে তার মন। গায়ের বসন স্থানে স্থানে ছেঁড়া পংক্তির। এলোপাথাড়ি চড় লাথি যে যেভাবে পেরেছে মেরেছে তাকে ভীরের মধ্যে।
পংক্তির চোখে মুখে এখনও সেই আতঙ্ক। জ্বরের রোগীর মতো শরীর কাঁপছে ভয়ে। হিমান্ত বোবার মতো চেয়ে আছে সে দৃশ্য দেখে। একটা মানুষ কতটা অসহায় হলে প্রিয়তমার এমন লাঞ্ছনা দেখতে বাধ্য হয় সচক্ষে। রেজওয়ান শক্ত করে দু’হাতে জাপটে ধরে আছে হিমান্তকে। হিমান্তের সমস্ত শরীর রাগে শক্ত হয়ে আছে। মুখ চোখ অগ্নিবর্ণ ধারণ করেছে। রেজওয়ান কোনোমতে শান্ত করে পাঞ্জাবি টুপি পড়িয়ে কাজির সামনে বসায় হিমান্তকে।
পংক্তিকে সোনিয়া শাড়ি পড়িয়েছে। ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে সে। আরিফ সিদ্দিকীর অভিভাবকত্বে বিয়ে সম্পন্ন হয় হিমান্ত পংক্তির। পংক্তিকে হিমান্ত পেতে চেয়েছিল কিন্তু এভাবে নয়। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে আজ ওর। পংক্তির এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী করছে সে। নির্বাক, স্থির হয়ে গেছে হিমান্ত।
আরিফ সিদ্দিকী ভাতিজা ও ভাজিতার নববধূকে বাড়িতে নিয়ে আসে। পংক্তিকে গেষ্ট রুমে বিশ্রাম করতে দিয়ে রেজওয়ানের মা সারাকে নিয়ে এসে বসে বসার ঘরে। রিমা শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে,
“কী অবস্থা ওর আম্মা?”
“এখনও কাঁদছে মেয়েটা। মানুষের নিজেদের নৈতিকতার ঠিক নেই তারা আবার অন্যের নৈতিকতা ঠিক করতে আসে। মেয়েটাকে কী ভাবে মেরেছে! তার উপর ভয় যা পেয়েছে মেয়েটা! মনে হয় রাতে জ্বর টর আসবে। বউমা ওষুধ আছে তো জ্বরের?
“জি আছে।
“এই মেয়েটার মুখ দেখলেই মায়া লাগে। কথাবার্তা কতো মার্জিত আর ভদ্র। সবকিছুতেই সারল্য বিদ্যমান। প্রথমদিন দেখেই ভালো লেগেছিল মেয়েটাকে আমার। তুমি জানো বউ মা! হিমান্তের মা’ও কিন্তু এমন সহজ সরল ছিল। সহজ সরল হওয়া মনে হয় উচিত না গো মা। সহজ সরল মানুষের কষ্ট বেশি।
সবাই তাদের কষ্ট দেয়। মানুষ আর মানুষ নেই। তা নাহলে সব জেনেবুঝেও এই ভালো মানুষগুলোকে কেউ অ্যাটার্ক করে? দুনিয়ায় আজকাল খারাপ মানুষের রাজত্ব। ভালো মানুষের তো কদরই নেই।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বললেন,”অত্যাচারিতের জন্য আল্লাহই আছে। তিনিই জালেমদের বিচার করবে।” রেজওয়ানের মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের জল মুছলেন। রিমা মনে মনে অনুতপ্ত হলো পংক্তি সাথে করা সেদিনের ব্যবহারের জন্য
পর্ব ২৬
“ভালোবাসা মোর ভালোবাসা নয়, কলঙ্কমালা হয়ে এলো গলে।”
গায়ে ভীষণ জ্বর নিয়ে খোলা চোখে দেয়ালে পড়া রাতের আলো আঁধারির খেলা দেখছে পংক্তি। দেহ মন জুড়ে শূন্যতা তার। স্থির চোখের মণিকোঠায় ক্ষণে ক্ষণে সেই ভয়ানক লাঞ্ছনার দৃশ্য ভেসে উঠছে। তখনই বর্ষার মহাপ্লাবনের ধারার মতো জল গড়াচ্ছে তার নয়নের কোনা বেয়ে।
জীবনের সমস্ত প্রাপ্ত আঘাত তার অন্তর পাথরে পরিণত করে তুললো। দেহ গঠনে অপরিবর্তন তবে মনে আজ তার বিশাল পরিবর্তন ঘটে। সে আজ বুঝেই নিল এই পৃথিবীর প্রেম ভালোবাসা তার মতো শেকর ছাড়া মানুষের জন্য নয়। তার জন্ম হয়েছে মা’কে শেষ করে তাহলে অন্যের সুখের কারন কী করে হবে সে? আজ তারই কারনে হিমান্ত অপমানিত। তার কী যোগ্যতা হিমান্তের বধূ হওয়ার! খোদ হিমান্তই সেদিন তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
আর আজ না চাইতেও পংক্তি নাম্নী অবাঞ্ছিত ঝরা ফুলের মালা গলে পড়েছে সে। পংক্তি সোজা হয়ে বসলো বিছানার উপর। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে সাথে মনও। তবে দুটো পোড়ার কারন ভিন্ন, যন্ত্রণাও ভিন্ন। দু’চোখের জল দু’হাতে মুছে মনে মনে ভেবে নিল তার করণীয় কাজ।
তিনদিন পর মুখোমুখি হয় হিমান্ত পংক্তি। নিস্প্রভ চোখের তারায় একপলক হিমান্তকে দেখে দৃষ্টি নামিয়ে নিল পংক্তি।
হিমান্তের দৃষ্টি অনড় তার বধূর উপর। মাত্র তিনটে দিন অথচ তাদের দু’জনের কাছেই মনে হলো এই তিন দিন তিন সহস্র বছরের সমতুল্য ছিল। হিমান্ত যেখানে আগামীর স্বপ্ন বুনতে ব্যস্ত, পংক্তি সেখানে স্বপ্ন কবরে নামাতে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। খাবার টেবিলে পাশাপাশি বসা দু’জন। অস্থিরতা দু’দিকেই সমান তালে বাড়ছে। একজন মনের গোপন অভিলাষ ব্যক্ত করবে বলে অস্থির তো অন্যজন ব্যথার সমুদ্রে সলিল সমাধি হবে বলে মনস্থির। সারা ছুটে এসে মামার কোলে বসে। পংক্তিকে আড়চোখে দেখছে সে।
আজকাল পংক্তি তার সাথে তেমন কথাই বলে না। বললেও তাতে আগের মতো মমতা নেই। আরহাম প্রথমদিন সারাকে মারলেও রিমার বকা খেয়ে এবং বুঝানোর পর সারার সাথে তার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এতে অবশ্য রিমার অবদানের সাথে সাথে মিরারও বড় একটা ভূমিকা রয়েছে। মিরা স্কুল শেষ করেই সন্ধ্যা অব্দি থাকে এ বাড়ি সারার সাথে।
মিরা থাকতে সারাকে কেউ কিছু বলবে এমন সাধ্য কার!
অন্যপাশে বসা আরহাম ইশারায় পংক্তির সামনে রাখা মিকিমাউস আকৃতির সল্ট পটটা চায় সারার কাছে। সারা পংক্তির শুকনো মুখটা দেখে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় না বলে আরহামকে। আরহাম চটে যায়। চোখ রাঙায় ওটা দিতে। সারা জানে আরহাম তার সাথে ভালো ব্যবহার করলেও কথা না শুনলে ঠিকই সুযোগ বুঝে মারবে।
যদিও মিরা আছে তবুও আরহাম তো আরহামই। সারা ভীরু নয়নে আরেকবার পংক্তিকে দেখে নিল। কলের পুতুলের মতো খাচ্ছে পংক্তি। সারা চোখ বুলিয়ে নিল খাবার টেবিলে বসা সবার দিকে। তার মামা আরহামের বাবাইয়ের সাথে কথা বলছে। ওদিকে আরহাম অধৈর্য হয়ে পড়েছে সারার ঢিলেমিতে।
সে ইশারা ইঙ্গিতে তাড়া দিচ্ছে সারাকে দ্রুত পটটা দেওয়ার জন্যে। সারা গাল ফুলিয়ে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ধীরে ধীরে হাত বাড়ালো পংক্তির সম্মুখে রাখা পটটার দিকে। সারা ভীরু হাতের ইতস্তততা পংক্তি বুঝেও না বোঝার ভান ধরে রইল। এ ছাড়া তার যে আর কোনো উপায় নেই। সবাইকে সে একসাথে খুশি করতে পারবে না।
সারা তার কাছে আসতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে, এযে কতোটা কষ্টের তা শুধু পংক্তিই জানে। সারা পটটা কোনোমতে নিজের অধিকারে আনতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। আরহামের ঠোঁটের কোনেও হাসি ঝিলিক দেয়। রিমা লক্ষ্য করে পংক্তি একটা পরোটার অর্ধেকও শেষ করে নি। প্রথম দেখার মতো নেই আর মেয়েটা মোটেও। রিমার কেমন যেন খটকা লাগে পংক্তির হাবভাবে।
সে এটা বলেওছে শ্বাশুড়ি এবং স্বামীকে। কিন্তু লাভ হয় নি তাতে কিছুমাত্র। তাদের ভাষ্যমতে পংক্তির সাথে যা হয়েছে তাতে সে বড়োসড়ো ট্রমার মধ্যে আছে হয়তো। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই। আসলেই কী তাই! রিমার তা একদম মনে হয় না। পংক্তি যে ট্রমার মধ্যে আছে সেটা স্পষ্ট তার চেহারায় অথবা স্থবির আচরনে;কিন্তু পূর্বাভাষ বলছে এটা সহজে স্বাভাবিক হবার নয়। রিমা হাত বাড়িয়ে পংক্তির হাতের উপর রাখে।
নরমসুরে বলে,
“পংক্তি! খাচ্ছো না কেন ঠিকমতো?”
“খাচ্ছি তো ভাবি।” শব্দ তিনটে যেন যুদ্ধ করে বেরিয়ে এলো কন্ঠস্বর ছেড়ে। এমন দূর্বল আর নির্লিপ্ত গলার স্বরে সবাই পংক্তির দিকে ফিরে তাকালো। সচকিত হয় না কেউ।
কারন তাদের অজানা নয় এই মেয়েটির মানসিক ভঙ্গুর অবস্থা সম্বন্ধে। সবার দৃষ্টি পংক্তির উপর তবে সেই দৃষ্টির মধ্যে একজনের দৃষ্টির তাপ পংক্তিকে পুড়াচ্ছে। ভেতর পর্যন্ত দহন হচ্ছে সেই তাপে। নত দৃষ্টি আরও নত করে সবার অলক্ষ্যে দু’ফোটা অশ্রু ফেললো পংক্তি। দু’ফোটা অশ্রু বিসর্জিত হলো বলতে বলতে,
“আজ এক্ষনে কেন হয় না মৃত্যু আমার? আপনার বিরহ যে মৃত্যু অপেক্ষা শ্রেয়।”
হিমান্তের সেদিনের প্রত্যাখ্যানে, ধারণার বিষ মস্তিষ্কে ধারণ করে ভুল বুঝলো পংক্তি। সে চোখ তুলে একটিবার দেখলো না আর ঐ দু’চোখে তাকে পাওয়ার কী তীব্র ব্যাকুলতা বিরাজ করছে। যে যাকে অনিচ্ছার তাপ ভাবছে আসলে তো তা ভালোবাসা ব্যক্ত করতে না পারার বিকিরণ।
আরিফ সিদ্দিকী উঠে এসে পংক্তির মাথায় স্নেহের হাত রেখে স্বান্তনা দেয়। এই মেয়েটার হাসি দেখার ইচ্ছা আরিফ সিদ্দিকীর খুব। তার ধারণা এই মেয়েটা হাসলে তার মৃত ভাবির মতো হাসবে।
কথাটা অবান্তর শোনালেও আরিফ সিদ্দিকী মনে মনে এই সাধই পোষন করে। হিমা ভাবির হাসি ছিল সরল নির্ভেজাল। শান্ত প্রকৃতির মতো। অদ্ভুত কারনে আরিফ পংক্তির মাঝে সেইসব কিছু খোঁজে। স্ত্রীকেও বলেছে সে একথা। তার সহধর্মিণী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছে,
“আমারও মনে হয় মেয়েটির সাথে ভাবির কোথাও মিল রয়েছে। হয় না এমন?
হয়তো। মানুষের সাথে মানুষের মিল হতেই পারে। একটু মিল আছে বলেই তুমি হয়তো বাকি মিলগুলোও খুঁজছ।”
আরিফ সিদ্দিকীও মনে মনে বুঝ নিয়েছে ‘ তাই হয়তো হবে।”
আরিফ সিদ্দিকী মমতা মাখানো কন্ঠে বলে,
“খাচ্ছ না কেন মা? খাও মা! খাও। মনে কষ্ট রেখো না।
সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।”
আরিফ সিদ্দিকী চলে যাওয়ার পর বেগম সিদ্দিকীও এসে পংক্তিকে স্বান্তনার বাণী শোনায়। গত দুই দিন ধরে এই কাজটা তারা নিয়মিতই করছেন তবুও পংক্তির মানসিক অবস্থার উন্নতি নেই। সবসময় স্বান্তনার জলে যন্ত্রণার আগুন নেভে না! হয়তো হিমান্তের স্বান্তনার প্রয়োজন ছিল কিন্তু সে নিজেই আছে নিজের দ্বিধান্বিত মন নিয়ে। ভাঙা মন তার সহজে দাঁড়াতে পারছে না। বড্ড নড়বড় করছে।
রায়হানের মোবাইল স্ক্রিনে প্রসূনের নাম ভেসে ওঠায় দ্রুত খাবার টেবিল ছাড়ে সে। রেজওয়ান ইশারায় রিমাকে ভেতরে আসতে বলে উঠে চলে যায়। আরহাম, সারাও উঠে গিয়ে পাশের বসার ঘরে কার্টুন দেখছে। ডায়নিংএ কেবল দুটো প্রাণী এখন। হিমান্ত গলা পরিষ্কার করে কাশে। পংক্তি চমকে ওঠে, যেন ঘোরে ছিল এতোক্ষন সে। হিমান্ত কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। কন্ঠস্বরে জড়তা, কী বলে শুরু করবে সেটাতেও তার দ্বিধা।
এভাবে মানুষটার পাশে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে পংক্তির। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ায় পংক্তি। সে উঠতেই হিমান্তও চট করে মুখোমুখি দাঁড়ায়। মানুষটার গায়ের সুগন্ধ এসে মন মাতাল করে দিচ্ছে পংক্তির। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে সে পারলো না তাই। গুটিগুটি পায়ে রুমে চলে এলো হিমান্তের পাশ কেটে। হিমান্ত কপাল কুঞ্চিত করে চেয়ে আছে পংক্তির যাওয়ার পথে। রাগ আসলেও রাগ সে করলো না। আজ যে করেই হোক পংক্তিকে সে সব বলবে।
কিন্তু কী করে? তার আর পংক্তির বয়সের ব্যবধান ১৩ বছর। তারউপর তার যা অতীত যেসব কী পংক্তি মেনে নিতে পেরেছে মন থেকে? তারই কারনে লাঞ্ছিত হতে হলো সে তো আর অজানা নেই হিমান্তের। এসব চিন্তায় চিন্তিত হয়ে তার মন আরও দূর্বল। তবুও আজ তাকে কিছু তো বলতে হবে। এভাবে কয়দিনই বা চলবে আর। যা সিদ্ধান্ত আজই নিতে হবে। পংক্তির মনমরা মুখটা দেখে হিমান্ত মর্মাহত হয় প্রতিনিয়ত।
তারও উচিত ছিল পংক্তিকে স্বান্তনা দেবার, কিন্তু সে এতোটাই জড়তার মধ্যে পড়েছে হঠাৎ সম্পর্ক বদলে যা সহজে কাওকে বোঝানোর সাধ্য তার নেই। হিমান্ত ভাবনা চিন্তা একপাশ করে গটগট করে হেঁটে পংক্তির দরজার সামনে থামে। দরজা ধাক্কা দিতে তার মধ্যে আবার ইতস্ততা এসে ভর করলো। সব শব্দ, বাক্য গোলমেলে হয়ে গেল, যা সে সাজিয়ে এনেছিল পংক্তিকে বলবে বলে।
আকাশে গুড় গুড় শব্দে মেঘ ডাকছে। কালো মেঘে ঢেকে আছে সমস্ত আকাশ। আঁধার নেমেছে সর্বত্রজুড়ে। দমকা হাওয়ার সাথে তুমুল বেগে ঝড় উঠলো মুহূর্তে। হিমান্তের মনোজগতেও তার ছিঁটেফোটা পড়লো রুমে ঢোকামাত্র। অবগুন্ঠন ফেলে খোলা জানালার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে পংক্তি। কোমর ছাড়ানো কুন্তল তার হাওয়ার তালে এলোমেলো উড়ছে। বাতাসের সাথে আসা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে লেপ্টে আছে পংক্তির সম্মুখভাগের দেহবসন।
চিবুক ছুঁয়ে সগর্বে জল পড়ছে পংক্তির গ্রীবাসুন্দরে। এ দৃশ্য কোন পুরুষের মনেই না ঝড় তোলে? হিমান্তের সকল ভাবনারা আজ এইক্ষণে ছন্নছাড়া,উদভ্রান্ত। স্থির দৃষ্টি মেলে ক্রমাগত ঢোক গিলছে সে তৃষ্ণিত চাতকের ন্যায়। সকল ব্যবধানে, জড়তার বেড়াজাল ছিঁড়ে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে এলো পংক্তির অতি নিকটে।
হাত পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে পংক্তি। হিমান্তের উপস্থিতিতে যে তার বুকের মাঝেও ঝড় উঠেছে প্রবল বেগে। কী হতে চলেছে তার জ্ঞান তাদের দু’জনেরই আছে আবার নেই। কাছে আসা না আসার দোলাচল থেকে নিজেদের মুক্ত অনুভব করছে তারা এই ক্ষণে দাঁড়িয়ে। দু’জনে দুজনার মুখোমুখি। পংক্তির নত মুখ আজ উঁচু হয় হিমান্তের হাতের স্পর্শে। হিমান্ত পংক্তির থুতনি তুলতেই শুভদৃষ্টি হয় দুজনের। উভয়ের হৃদয়ের অনাবৃষ্টিতে ঝরঝর করে পশলা বৃষ্টি পড়ে। কী ছিল মনে আর কী ছিল ধ্যানে সবই ভুলেছে তারা এক্ষনে এই অভিসারে! যা ছিল সজাগে তা কেবলই এক হওয়ার প্রবল বাসনা।
বৃষ্টি যেমন আকাশ ফুঁড়ে মাটিতে মিশছে, ঠিক তেমনি করে আজ হিমান্ত পংক্তি মিশে গেল একে অপরের মাঝে। হিমান্তের বাহুডোরে সে আজ যে ব্যথা পেল তাতে তার সমস্ত ব্যথা বিলীন হলো। এ যেন ব্যথায় কাটে ব্যথা!
বাইরের প্রচন্ড ঝর ঝাপ্টা উপেক্ষা করে রায়হান এসেছে প্রসূনের কাছে। দুজনে একটি ক্যাফেটেরিয়ায় মুখোমুখি বসা। চিন্তিত মুখে একটু পরপরই তাকাচ্ছে এক অন্যের মুখে।
অস্থিরতা ধরে রাখতে না পেরে শেষমেশ প্রসূনই বললো,
“বিশ্বাস করো আমি ওমন করে মৃদুলকে বলতে চাইনি, কিন্তু কী করতাম তুমিই বলো? খুবই বাজে বিহেইভিয়ার ছিল ওর। মেজাজ সামলে রাখতে পারি নি সেসময়।” প্রসূনের গলা ধড়ে আসে। রায়হান উঠে গিয়ে পাশে বসে। প্রসূনের হাতদুটো শক্ত ধরে রইলো সে। এবার সত্যি সত্যি কেঁদে দিল প্রসূন। বললো,
“বিশ্বাস করো তুমি! আমি কোনোদিন চাইনি ওর খারাপ হোক। ও সুইসাইড করবে বুঝি নি আমি।”
“হুশশ! শান্ত হও প্রসূন। তোমার কোনো দোষ নেই। মানুষ নিজের কর্মেই ভোগে। মৃদুলের পরিণতির জন্য ও নিজেই দায়ী। তাকে কম বোঝানো হয়নি। তবুও সে গোঁ ধরে বসেছিল। শান্ত হও তুমি। নিজেকে কেন দায়ী করছ ওর অপমৃত্যুর জন্য। তোমার কোনো দোষ নেই।” রায়হান দু’হাতে পংক্তির চোখের জল মুছে দেয়। প্রসূন মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পায়। উচ্ছ্বাসিত স্বরে বলে,
“সত্যি বলছ?”
“হুম।” প্রসূনকে সাহস দিলেও রায়হান বেশ আতঙ্কে আছে মৃদুলের সুইসাইডের কারনে। কে জানতো সত্যি সে সুইসাইড করবে। গত কিছুদিন ধরে সে প্রসূন এবং রায়হানকে হুমকি দিচ্ছে রায়হান তাকে মেনে না নিলে সুইসাইড করবে। রায়হান এবং প্রসূন দু’জনই মৃদুলের এমন আচরনে বিরক্ত এবং তিক্ত হয়।
তার রেশ ধরেই তিক্ত কথা শোনাতে বাধ্য হয় দু’জন। কে জানতো সত্যি এমন অঘটন ঘটিয়ে বসবে মৃদুল। মৃদুলের মৃত্যুতে একদিকে যেন খারাপ লাগছে রায়হানের অন্যদিকে ভয় হচ্ছে সুইসাইড ইস্যুতে তারা না জড়িয়ে যায় আবার!
পংক্তি দু’চোখ ভরে দেখছে প্রিয় মানুষটার মুখ। লজ্জায় আরক্ত তার মুখখানি তবুও সে আড়চোখে দেখে যাচ্ছে মানুষটার ঘুমন্ত চেহারা। দু’হাতের উষ্ণ আবেশে আলিঙ্গন করে রেখেছে হিমান্ত পংক্তিকে। ঘুমন্ত হিমান্তের ভারী নিঃশ্বাস এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে পংক্তির বদন। তাতে যেন আরও আরক্ত, আরও রাঙা হচ্ছে তার মুখ।
দু’জনের অনাবৃত দেহের উপর একখানা গোলাপী চাদরের আচ্ছাদন মাত্র। সিলিং ফ্যানের বাতাসে হিমান্তের চুলের একাংশ উড়ে উড়ে কপালে পড়ছে। পাছে হিমান্তের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, এই ভেবে পংক্তির ভীরু হাতখানি সতর্কের সাথে চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে পাশে সরায়। তাতে বোধকরি লাভ তো হলোই না উল্টো ঘুম ভেঙে গেল হিমান্তের।
ঘুমজড়ানো চোখে অপলক চেয়ে রইল সে পংক্তির অবনমিত মুখপানে। হিমান্তের মনে হলো পৃথিবী তার সকল সৌন্দর্য্য বুঝি ঢেলে দিয়েছে পংক্তির সর্বাঙ্গে। তার দুবাহুর বাঁধনে রক্ত মাংসের কোনো মানবী না অপ্সরা! স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিলে এতো সুন্দর হতে পারে হিমান্তের জ্ঞান বহির্ভূত ছিল।
এই যুবতী বধূটি তার কতো আকাঙ্খার তা কী কোনোদিন কাউকে বলা হবে হিমান্তের? না! সে কেন বলবে কাউকে! সবই তার হৃদয় কুঠিতে সযত্নে গোপন করে রাখবে। একান্তই তার করে। এই রাঙা বধূটি এবং তাকে নিয়ে সমস্ত ভাবনাগুলোকে। পরক্ষনেই হিমান্তের মনে পড়লো পংক্তিকে সে নিজের সব কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু এই মুহূর্তটাকে ওসব গুরুগম্ভীর কথায় ব্যয় করার ইচ্ছা তার একটু হলো না।
পংক্তি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে হিমান্তের কাছ থেকে কিছু শোনার প্রত্যাশায়। হিমান্তের পবিত্র স্পর্শে তার সকল কলঙ্ক তো ঘুঁচেছে, বাকি মনের কোনে এখনও জমে আছে কিছু অভিমান। হিমান্ত আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ঠোঁট আলগা করে কিছু বলবে বলে। ঠিক তখনই মোবাইল কর্কশ শব্দে ভাইব্রেট হতে থাকে। বিরক্ত হিমান্তের চোখে মুখে উপচে পড়েছে।
মোবাইল হাতে নিতে কপাল কুঞ্চিত হয় স্ক্রিনে ভাসা নামটা দেখে। তড়িঘড়ি করে পংক্তিকে ছেড়ে উঠে বসে বিছানার একপাশে সে। হিমান্তের আব্বার পিএ মোবাইল করেছে। আব্বার কথা মনে পড়তেই চট করে মোবাইল রিসিভ করে হিমান্ত। ওপাশের ব্যক্তিটি কি বললো বোঝা গেল না তবে হিমান্তকে খুবই পেরেশান দেখালো।
কোনোকিছু খেয়াল না করে দ্রুত কাপড় পড়ে বেরিয়ে গেল সে। পংক্তি হতবাক হিমান্তের আচরণে। তার বর্ষাবিধৌত মনের জমিন আবার অভিমানের খরতাপে ফাঁটছে। অশ্রুসিক্ত হয়ে মুখ ফুলিয়ে রইলো সে। সারাটা দিন গেল এলো না হিমান্ত। বাসার কেউ কিছু বললো না পংক্তিকে। সংকোচ কাটিয়ে তারও কিছু জিজ্ঞেস করার হলো না।
দিন ফুরিয়ে গোধূলির রাঙা আলো মুছে গেল আঁধার নামে। বাসার ডোরবেল বেজে ওঠে সশব্দে। বড় আশা নিয়ে ছুটে গিয়েছিল পংক্তি হিমান্তকে দেখবে বলে, কিন্তু তার স্থানে দীর্ঘদিন পর দেখা হলো মাহিনের সাথে। মলিন চেহারায় হাসিটা বড্ড বেমানান লাগছিল মাহিনের মুখে। পংক্তিকে দেখামাত্রই চোখদুটো তার স্থির হয়ে রইল। মজিলা ছুটে এসে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করলো পংক্তিকে ধরে। কিছুসময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে ছিল পংক্তি।
তার যন্ত্রণাময় অতীত আবার ফিরে এসেছে তার দুয়ারে। কী চাইছে জীবন তার কাছে? এ কেমন খেলা খেলছে ভাগ্য! তার পূর্ব ভাবনাগুলো কী তার নিয়তি হবে! পংক্তির বুকটা ভয়ে দুরুদুরু করে। হিমান্ত! এই নামের মানুষটাকে তার এখন বড় প্রয়োজন।
পংক্তির দূর্বল মন পারবে না সব সামাল দিতে। মাহিন যদি তাকে নিয়ে যায়? না! পংক্তির অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে। মজিলা নিজের কৃতকর্মের জন্য বার বার ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছে। পংক্তির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। তার দৃষ্টি জ্ঞান সদর দরজার দিকে অনড়।
রাত আটটা অব্দি অপেক্ষা করেও যখন হিমান্ত এলো না মজিলা আরিফ সিদ্দিকীর অনুমতিতেই পংক্তিকে সাথে করে নিয়ে রওনা হলো। পংক্তি কিছুতেই আসতে চাচ্ছিল না, কিন্তু মামির অনুনয় দেখে রেজওয়ানের বাবা মা বুঝালো পংক্তিকে,
“হাজার হোক মামি তো! বলছে যখন গিয়ে দু’দিন থেকে আসো। আশা করে এসেছে না গেলে বেয়াদবী হবে।
হিমান্ত আসার সাথে সাথে পাঠিয়ে দেব।” পংক্তি অনিচ্ছা স্বত্বেও রাজি হলো। সারাকে সঙ্গে নেবে বলে কাপড় পড়াচ্ছিল, কিন্তু রিমা এবং রেজওয়ানের মা নিতে দিল না। আরহামও ছাড়ছিল না। পংক্তির কেন যেন ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ যাওয়ায় বুঝি তার শেষ যাওয়া! আর হয়তো সে দেখবে না এই মানুষগুলোকে। সারাকে বুকের সাথে মিশিয়ে শব্দ করে কেঁদে ওঠে পংক্তি।
আরহাম কে কাছে ডেকে বলে,
“আমার ডল টাকে মারবে না তো আরহাম? আন্টি খুব কষ্ট পাবে ডলকে কষ্ট দিলে।” আরহাম মাথা নাড়ালো সে সারাকে আর কষ্ট দেবে না। পংক্তি সারার মিষ্টি মুখটা আঁজলা ভরে তুলে বলে,
“আন্টি পঁচা তাই মা?”
সারা ছলছল করুন চোখে না সূচক মাথা নাড়ায়। পংক্তি সারার কপালে চুমু দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আন্টি চলে যাচ্ছি। তুমি কাঁদবে না হ্যাঁ। আরহাম কথা দিয়েছে সে তোমাকে মারবে না আর। ভয় পাবে না একদম ঠিক আছে মা। তোমার মামা আসলে বলবে আমি তার অপেক্ষায় আছি।”
“তুমি কোথায় যাচ্ছ আন্টি? আমিও যাব।”
পংক্তি জবাব দেয় না। চলে আসার আগ পর্যন্ত সারাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল বুকের মাঝে। এখনও চোখে ভাসছে সারার কান্নারত মুখের ছবি। অন্যদিকে হিমান্তের চিন্তায় পংক্তির প্রাণ ওষ্ঠাগত। শাঁই শাঁই করে গাড়ি ছুঁটছে। ঝড়ের সাথে তাল মিলিয়ে বৃষ্টি নামলো আবার। যেদিন পংক্তি মামা বাড়ি ছেড়েছিল সেদিনও ছিল এমনই এক বর্ষণস্নাত রাত। কী অদ্ভুত মিল দু’টো সময়ের!
পর্ব ২৭
পংক্তির মামিরা বাসা পরিবর্তন করে অভিজাত এলাকার ফ্লাটে উঠেছে। আপাত দৃষ্টিতে তাদের আচার- ব্যবহার, পোষাক পরিচ্ছেদ সবকিছুতেই পরিবর্তনের হাওয়া। বাসার আসবাবপত্রে আভিজাত্যের ছোঁয়া। পংক্তি চোখ ঘুরিয়ে দেখছে সব। সবকিছুর এমন পরিবর্তন স্বাভাবিক মনে হলেও পংক্তির চোখে কেন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। বোধ হওয়ার পর যেই মামির তুচ্ছ তাচ্ছিল্য আর রূঢ় ব্যবহার ছাড়া কিছুই পংক্তি পায়নি অথচ আজ সেই মামি তাকে মন উজার করে আদর আপ্যায়ন করছে। আসার পর থেকে মাহিন আড়েঠারে তাকে দেখে যাচ্ছে। এই দৃষ্টি পংক্তির চেনা। মাহিনের এই দৃষ্টির মায়াজালে পড়েছিল সে একদিন। মাহিন ইতস্তততা কাটিয়ে পংক্তির পাশে বসে বসলো। এক চিলতে শুকনো হাসি টেনে বললো,
“কেমন আছিস তুই?”
“ভালো।” ছোট্ট করে জবাব দিল পংক্তি। মাহিন পংক্তির দিকে চোখ তুলে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। শেষে বললো,
“আমাদের তো ভুলেই গিয়েছিস। কিছুই কী ছিলাম না তোর জীবনে আমরা?”
“তেমন কিছুই না। সম্পর্ক আপনারা রাখেন নি। আমি তো সব ক্ষেত্রেই তুচ্ছ মানুষ। আমার মনে রাখা না রাখাতে কার কী এসে যায়?”
“এতো রাগ আমাদের উপর। তবে তোর রাগের যথেষ্ট কারণ আছে বৈকি! আমি ছোট পানির মাছ বেশি পানিতে গিয়ে চোখে ধাঁধা দেখেছিলাম রে পংক্তি। তোকে কষ্ট দিয়ে তার যথার্থ শাস্তিই আমি পেয়েছি। আমাকে ক্ষমা করতে পারিস না পংক্তি?”পংক্তির হাতটা শক্ত করে চেঁপে ধরে মাহিন। পংক্তি সর্ব শক্তি ব্যয়ে হাত ছাড়িয়ে সরে বসে।
কন্ঠস্বর কঠিন করে বলে,
“আমার কারো উপর কোনো রাগ নেই। আপনার উপর তো একদমই নেই। কেন জানেন? কারন আমি আমার সকল রাগ, অভিমান, ভালোবাসা আমার স্বামীকে সঁপেছি। তাকে ঘিরেই আমার সবকিছু।” পংক্তি একমুহূর্তের জন্যেও আর অপেক্ষা করে না। দ্রুত পায়ে মিলির রুমে আসে। মাহিনের মতিগতি তার মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না। তবে কথাগুলো বলতে পেরে নিজেকেই বাহবা দিল পংক্তি। বেশ কথা শিখেছে সে।
মাহিনের চোখ কপালে উঠেছে কথাগুলো শুনে। পংক্তি সিনা টান করে বসে। ভয় কেন সে পাবে? একদম ভয় পাবে না আর। তার স্বামী আছে তার পাশে। হিমান্তের অর্ধাঙ্গিনী সে, তবে কেন মাহিনকে ভয় পাবে? হিমান্ত তার স্বামী! উফ! কথাটা বলতে, শুনতে, ভাবতেই তার হৃদয়ে কাঁপন ধরে। চোখের সম্মুখে প্রজ্জ্বল হয় সকালের সেই মধুর স্মৃতি। বিছানায় শুয়ে বালিশটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে পংক্তি।
“তোমার ছোঁয়ায় ধন্য আমি ও প্রাণপতি।
দমকা হাওয়ার মতো ছুঁয়ে গেলে চলে, এখন আমার হাল যে বেগতিক।”
সত্যি এ অনুভূতি ব্যক্ত করার মতো নয় পংক্তির। তার অভিমান পুনরায় বিলুপ্ত। অভিমানের স্থানে বিরহের মধুর অনুরণন ঝঙ্কিত হচ্ছে। রাতটা সেই স্মৃতি বুকে নিয়েই কাটলো পংক্তির। ফজরের আজানের সাথে সাথেই উঠে বসলো। বর্ষাশেষের ঝকঝকে সকালটা বেশ লাগছে।
সবকিছুর মধ্যেই পবিত্রতা,স্নিগ্ধতা। কোথাও পড়েছিল বৃষ্টি আল্লাহ পাকের রহমত। এ সময় দোয়া কবুলের সময়। তবে গতসকালে হিমান্তের বুকে মাথা রেখে যে দুয়া সে করেছিল তা কী পূরণ হবে? ইনশাআল্লাহ হবে। দৃঢ় বিশ্বাস পংক্তির এটা।
ফজর নামাজ শেষে মোনাজাতে আবারও একই দুয়া চাইল সে। তার সকল কিছুই তো এখন ঐ মানুষটাকে ঘিরেই। আস্থা,স্বপ্ন,ভালোবাসা!
সকালে নাস্তা সেড়ে পংক্তি বিছানায় চুপচাপ বসেছিল। মনটা উদাসীন তার হিমান্তের বিরহে। মানুষটা কখন আসবে? একা রাত কী করে কাটলো তার পংক্তিকে ছাড়া? পংক্তির তো দিবসরজনী কাটছেই না তাকে না দেখে।
পংক্তি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরতেই ভ্রুকুটি করে মিলির চাহনী লক্ষ্য করে। মুচকি হেঁসে ভ্রু নাড়াতেই মিলি অবাক কন্ঠে বলে,
“আপা তুই এতো সুন্দর কী করে হলি রে?”
“কেন আগে কী অসুন্দর ছিলাম নাকি?”মুখভরা হাসি পংক্তির। মিলি মুগ্ধ হয়ে বোনের মুখখানি দেখছে। মিলি বলে,
“তা না। তবে এখন অনেক বেশি সুন্দর হয়েছিস। আগে যদি কেউ জিজ্ঞেস করতো তোর পংক্তি আপা কেমন দেখতে রে? আমি বলতাম শ্যামবর্ণ, শীর্ণদেহ আর কেমন গোমড়ামুখী।”
“এখনও তো আমি এমনই আছি।” দু’হাতে চুল খোঁপা বেঁধে জবাব দেয় পংক্তি। মিলি ঘার নাড়িয়ে বলে,
“একদম না। এখন তুই ফর্সা হয়ে গেছিস। তোর গা কী তুলতুলে! আগে তো হাসতিই না এখন কেমন হাসছিস। তোকে হাসলে কতো মিষ্টি লাগে তুই জানিস না আপা। আমি ছেলে হলে তো নির্ঘাৎ হার্ট ফেল করতাম।”
মিলির কথা শুনে পংক্তি শব্দ করে হেঁসে ওঠে। আচমকা মিলি জাপটে ধরে পংক্তিকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে,
“আমি তোর সাথে অনেক দুর্ব্যবহার করেছি তাই না আপা? বিশ্বাস কর এমনটা আমি করতে চাইনি কিন্তু,,,।” মিলির কথা জড়িয়ে আসে। বাইরে তাকাতেই মায়ের চোখ রাঙানি দেখে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
“দুলাভাই কেমন রে আপা? তোকে কী খুব ভালোবাসে?”
মিলির মুখে দুলাভাই ডাক পংক্তিকে ঈষৎ লজ্জায় ফেলে। মুচকি হেসে পংক্তি কিছু বলবে তার আগেই মজিলা রুমে ঢুকে রুক্ষস্বরে মেয়েকে ধমকে বলে,
“দুলাভাই আবার কী রে? ওটা কোনো বিয়ে হলো? এসব বিয়ে আমরা মানি না। আমাদের মেয়ে আমরাই দেখেশুনে বিয়ে দেব। জোরজবরদস্তির বিয়ে কী বিয়ে নাকি? খবরদার আবার যদি দুলাভাই বলেছিস তুই?”
মজিলার এমনতর কথা শুনে পংক্তির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম।
যে পংক্তি মামির কোনো কথার কোনোদিন প্রত্যুত্তর করে নি, আজ সেই পংক্তি ক্ষিপ্র স্বরে বলে বসলো,
“বিয়ে তো বিয়েই মামি। আল্লাহ পাক হয়তো আমার ভাগ্যে বিয়েটা এভাবে লিখে রেখেছিলেন। জবরদস্তি বলে এখানে কিছুই নেই। আমার সম্মতিতেই বিয়ে হয়েছে। আমি এই বিয়ে মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছি। ভালো হয় আপনারাও মেনে নিন। না মানলে আমার কিছু করার নাই। সে মিলির দুলাভাই এবং তাই ই থাকবে।”
পংক্তির এমন কথার টোনে মজিলা থমকে যায়। চোখ কপালে তুলে হাঁ করে মাথা নাড়ায় সে। মিলি মায়ের এমন অবস্থা দেখে মিটমিট করে হাসে। মজিলা ঐ অবস্থায় রান্না ঘরে ফিরে আসে। রাগে তার শরীর জ্বলছে। বিড়বিড় করে যতো কটুবাক্য, অশ্লীল বাক্য সব বিসর্জন করে পংক্তির নামে।
মজিদ সাহেব স্ত্রী হনুফার সাথে কথা বলা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছেন। তার স্ত্রী এতোবড় জঘন্য অন্যায় করতে পারে তা যেন ভাবতেই পারছেন না তিনি। হিমান্ত শুধু তার মুখ চেয়ে মামলা তুলে নিয়েছে। নিজেকে ছোট মনে হয়েছিল সেদিন। লজ্জায় চোখ তুলে তাকান নি হিমান্তের দিকে। হনুফার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। হিংসায় অন্ধ হয়েছিলেন তিনি। যার যথাযথ শাস্তিই পেয়েছেন। স্বামী, কন্যা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেউ কথা বলছে না। কান্নায় ভেঙে পড়েন হনুফা। সেদিন থানায় শাহিনের নামে মামলা করা হলে ভয়ে সে সত্যিটা উগলে দেয়।
লেডি কনস্টেবল এসে ধরে নিয়ে যায় হনুফাকে অন্যদিক থেকে তুলে আনা হয় আজিজুলকে। হনুফাকে দেখে ধিক্কার দিয়েছিল হিমান্ত। সেই দৃষ্টি মনে পড়লে মরে যেতে ইচ্ছা করে হনুফার। ভবিষ্যৎ পরিণতি চিন্তা না করে হিংসায় অন্ধ হয়ে সে পাপ করে বসেছে। যার ক্ষমা নেই কারো কাছে। বিপি লো হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে হনুফা। চোখের সম্মুখে অন্ধকার হয়ে আসছে। বিড়বিড় করে ক্ষমা চাইছে সে। আবছা আলোয় স্বামীকে দেখে চোখের জল ছেড়ে পা জড়িয়ে ধরলো বড় কষ্টে শিষ্টে উঠে।
চৌদ্দশিকের ভেতরের পাতলা ডাল আর আধাফোটা ভাত গোগ্রাসে গিলছে আজিজুল। ভোজন রসিক সে, অথচ এখানে কেবল তিনবেলা যেসব খাবার দেওয়া হয় তা অতি নগন্য। পুরো একদিন না খাওয়া ছিল সে। এমন পাতলা ডাল, নিম্নমানের তরকারী আর শক্ত ভাত তার রুচিতেই টানছিল না। এদিকে না খেয়েও থাকতে পারে নি। শেষে যা পেয়েছে তাই গিলছে। জেলের অন্য কয়েদিরা টিপ্পনী করে হাসছে। বলছে,
“স্পেশাল কাম কইরা স্পেশাল শ্বশুরবাড়ি আইছ। ওহন এই খাবার ছাড়া আর কী পাইবা? যাহা জোটে গিলিয়া যাও মিয়া। নয়তো এটাও সটকে যাবে রিজিক থেইক্যা।”
আজিজুলের পেট ভরে না এতো অল্প খাবারে। বউটার কথা আজ বড় মনে পড়ছে তার। কতো আদর আপ্যায়ন কইরা তারে খাওয়াইত। দু’টো আস্ত মুরগির রোষ্ট, এক গামলা গরুর গোশত ভুনা,খাসির রেজালা সাথে মিষ্টি তো দিতোই। আহা রে বউ টা আমার! বউয়ের প্রতি সকল অন্যায়ে আজ তার মন কাতর। বউটা তার খারাপ স্বভাব জেনেও কোনোদিন টু শব্দ করে নি। বিনা স্বার্থে স্বামী সেবা করে গেছে। বিনিময়ে ধোঁকা, গালমন্দ আর অবহেলা ছাড়া কিছুই দেয়নি আজিজুল তাকে।
বড়ই সহজ সরল তার বউটা। একটু কঠিন হলেই বুঝি আজিজুলের জন্য ভালো হতো। তাহলে রাগ করতো, ঘরজামাই বলে খোটা দিত, পরনারীর পিছে যাওয়ায় অভিমান অভিযোগে তুলকালাম কান্ড ঘটাত। এতে করে আজিজুল বিরক্ত হতো, মনে মনে আরও বকতো,হয়তো মারতোও তবুও একদিন বউয়ের ভয়ে সে ভালো হয়ে যেত।
সব দোষ তার বউয়ের সহজ সরল হওয়ায়! বউ জাতের এতো সহজ সরল উচিত না। বিভ্রান্ত স্বামীকে পথে আনতে গেলে একটু তো ত্যাড়া হতে হবে। কিন্তু তার বউ শুধু ভালোই বেসে গেল! ভালোবাসায় কী স্বামী ভালো হয়? আজিজুল বউকে সামনে জ্ঞান করে একা একাই উপদেশ দিতে লাগলো। তার মতো মতিভ্রষ্ট, দুশ্চরিত্র স্বামীকে ভালো করার উপদেশ!
মামি কিছুতেই ছাড়বে না তবুও অনেক বলে কয়ে শেষে মাহিনের কথাতেই পংক্তিকে যাওয়ার অনুমতি দিল।
তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছে মজিলা! মাহিন তাকে নিয়ে যাবে এবং সাথে করে নিয়ে আসবে। মনিরার নতুন ঠিকানাও পংক্তির জানা নেই। গত কয়েকদিন ধরে কল করে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। মাহিন আশ্বাস দিল ঠিকানা খুঁজে দেবে সে। মাহিনের মুখের উপর না করতে পারলো না পংক্তি। অনিচ্ছা স্বত্বেও মাহিনের সাথে বের হতে হলো তাকে। আজকাল মনটা বড্ড বেশিই কু ডাকছে। মনিরার এমন লাপাত্তা হওয়াটাও স্বাভাবিক নয় পংক্তির নিকট।
সকল দ্বিধাদ্বন্দ ভুলে পংক্তি মাহিনের সাথে রওনা হলো। পুরাতন বাসার কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে একজন বলতে পারলো মনিরার বর্তমান ঠিকানা। সেখানেই রওনা হলো ওরা। দিন যতো ঘনাচ্ছে পংক্তির মনটা ততই খারাপ হচ্ছে। হিমান্ত এলো না কেন? তার কী কিছু হয়েছে? একটা কল কী করতে পারত না? নাকি তার কিছু আসে যায় না পংক্তির থাকা না থাকাতে?
পংক্তির মাথা ঘুরছে থেকে থেকে এসব চিন্তা করে।
প্রাপ্ত ঠিকানায় পৌঁছে যা শোনে তাতে পংক্তির চোখের সম্মুখে ঝাপসা হয়ে ওঠে। তিনসেডের আধা পাকা বাড়িটাকে ঘিরে মানুষের জটলা বেঁধেছে। মাহিন ভীর ঠেলে এগিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই শুনলো,দাম্পত্য কলহের জের ধরে সুমন ভারী কিছু দিয়ে গতকাল মনিরার মাথায় আঘাত করে।
বাড়ির বাকি ভাড়াটিয়ারা মুমূর্ষু অবস্থায় পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে ভর্তি করে মনিরাকে। অন্তঃসত্ত্বা মনিরাকে সুমন বিভিন্নভাবেই নির্যাতন করছিল গত কয়েকমাস ধরে। থানা পুলিশও হয়েছে এ নিয়ে তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। সুমনের ব্যবহার দিনদিন জানোয়ারের চেয়েও নিম্ন হতে থাকে। শারীরিক মানসিক এতো টর্চারে মনিরা এমনিতেও ভেঙে পড়েছিল। তার উপর গতকালের মারে রক্তক্ষরণ হয় প্রচুর, পেটেও আঘাত পায়।
রাতে জ্ঞান ফিরেছিল। বিড়বিড় করে কিছু বলছিল কিন্তু কেউ বোঝে নি। শেষ রাতে অবস্থা খারাপের দিকে যায়। ঘন্টা খানেক বাদেই কর্তব্যরত ডাক্তার মনিরাকে মৃত বলে জানায়। একটু আগে লাশ আনা হয়েছে। লোকটা থেমে থেমে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। পেছন দাঁড়ানো পংক্তি বোধশক্তিহীন মানুষের মতো বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। মাহিন অবস্থা সুবিধার না ভেবে পংক্তিকে নিয়ে ফিরে যেতে চাচ্ছিল।
পংক্তি রক্তবর্ণ চক্ষু দিয়ে মাহিনের দিকে এমন ভাবে তাকায় যা দেখে হাত ছেড়ে দেয় মাহিন। পংক্তি ছুটে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মনিরার লাশের পাশে। চাদরে ঢেকে রেখেছে গলা অব্দি মৃত মনিরার দেহ। ফ্যাকাশে চেহারার মনিরার মৃত মুখটা কাঁপা হাতে স্পর্শ করে পংক্তি। গলা দিয়ে চিঁচিঁ শব্দ বের হয়। কাঁদতেও পারছে না শোকে কাতর পংক্তি। আশেপাশে সবাই উৎসুক চোখে চেয়ে আছে পংক্তির দিকে। ঠান্ডা বরফের ন্যায় মনিরার ফ্যাকাশে মুখখানিতে তখনও আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট।
নাকের মাঝ বরাবর, কপালের আংশিক অংশের সেলাইয়ে পংক্তি হাত বুলিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। পংক্তির গগনবিদারী কান্না উপস্থিত সবার চোখে জল আনে। দু’তিন মহিলা এগিয়ে আসে সান্ত্বনা দিতে। একজন মধ্যবয়সী মহিলা বিলাপ করে বলে,
“আরে মনি রে, সুখ আর তুই পাইলি না। আমারে কইত। ও কাকি আমার কপালে মনে হয় সুখ নাই গো। আমি বুঝ দিতাম ওরে মনিরা এমনে কইতে হয় না।
সুখ কী চিরকাল থাকে নাকি? সুখ দুঃখ মিইলাই জীবন। ধৈর্য ধর সব হইব। আল্লাহ আমি কেন কইলাম ধৈর্য ধরবার ওরে। কেন কইলাম না ছাইড়া দে ঐ হারামীর পুত রে। অমানুষের সাথে কী সুখ হয়? হয় না! মাইরা ফালাইলো আমাগো মনিরে। আহারে কী ভালো মাইয়্যা আছিল আমাগো মনি! আল্লাহ তুমি তারে তোমার কাছে নিয়া গেলা। ভালোই করছ আল্লাহ।
এই দুইন্না ওগো জন্য জাহান্নাম। মাইয়্যা মাইষের জন্য জাহান্নাম এই দুইন্না।” মহিলাটি দম নিয়ে আবার বলতে লাগলো,
“যেই বয়সে মাইয়্যারা খেইল্যা বেড়ায়, ঐ বয়সে মনিরার বিয়া হইল এক ঘাটের মরার লগে।
মা মরলে বাপ হয় তালই। সৎ মায়ে উঠতে মারে বসতে মারে। খাইতে খোটা,নাইতে খোটা। টাহার লোভে কচি মাইয়্যাডারে বিয়া দিয়া দিল বুইড়ার লগে। দিন দুই যাইতেই বুইয়া গেল মইরা। আমাগো মনি এট্টুক মাইয়্যা কিচ্ছু বোঝে না। বুইড়ার পোলা মাইয়্যা ঘার ধইরা দিল বাইর কইরা। সৎমাও ঘরে তুললো না। কান্দে আর কান্দে মাইয়্যাডা। আমি দুগা ভাত খাওয়াইলাম। কইলাম কান্দিস না। যা তোর মামা বাড়ি যা গা। গাড়িতে উঠাই দিলাম। সেই যে গেল পুতুলের মতোন মাইয়্যাডা আর আইলো পাগলী বেশে।
হারামী সব হারামীর পুত! মা মরা অসহায় বাচ্চা মাইয়্যাডারে খাবলাইয়া খাইসে সব। সব জাহান্নামে পুড়বি তোরা। আল্লাহর লানত পড়বো তগো উপরে। আমার সামতে আইয়া খালি হাসে,খালি হাসে। আমি কই ও ছেরি এতো হাসোচ ক্যান? ফুর্তিতে ধরে না তোর? কয় হ গো কাকি, দুইন্না ভরা ফুর্তি। দেখলেই হাসি পায়। জবর হাসি পায়। আবার হাসে। কইলজায় মোচড় মারে গো সেই হাসি দেইখ্যা আমার।
কাছে রাইখ্যা মাইনষের বাড়িত কামে দিলাম। সেইডা ছাইড়া গার্মেন্টস ধরলো। পোড়া কপাল মনির। শকুনে ওঁৎ পাইতা ছিল সেইহানেও। সুমন্নারে সুমন্না! আল্লাহ তোরে জোহরে কহোরে মারবো। সুখের স্বপন দেখাইয়া মাইয়্যাডারে মাইরা ফেললি তুই। মর তুই সুমন্না। আল্লাহ তোর বিচার করুক।” মহিলা বুক চাপড়ায় আর মাতম করে। সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসে অনেকে। তাদের চোখেও জল।
পংক্তি কান্নার গতি কমিয়ে মনিরার রক্ত শূন্য শীতল মুখটা একদিকে কাত করে। কান্নার তোড়ে কন্ঠনালি কাঁপছে পংক্তির। শরীরে অসাড়তা এসে ভর করেছে। টেনে টেনে জড়ানো শব্দে বলে,
“দেখ এমন কেন করছিস তুই? আমি কিন্তু অনেক রাগ করব এবার মনি। চোখ খোল! খোল না চোখ। তুই ছাড়া কে আমাকে বুঝবে বল? আমি কার কাছে সব বলবো? কথা বলনা মনি? এই মনি, দেখ আমি আসছি। তোর সাথে কতোকথা বলবো আজ। উঠে বস। জানিস আমার বিয়ে হয়েছে। খুশি হস নি?
আমি জানি তোর চেয়ে বেশি কেউ খুশি হবে না একথা শুনে। তুই কেন এলিনা আর? আমার মোবাইল ধরিস নি কেন? আমি খুব রাগ করেছি। জড়িয়ে ধর আমাকে। ধর না। এই মনি, উঠ না রে। আমার কী হবে তোকে ছাড়া? আমি কী করবো তোকে ছাড়া? এই তুই আমাকে ফাঁকি কেন দিলি? মনি, এই মনি কথা বল। আমার মনি কথা কেন বলে না। কেউ বলেন না ওকে একটু কথা বলতে। এই মনি, মনিরে,,।
উপস্থিত সবচেয়ে কঠিন হৃদয়ের ব্যক্তিটিও আজ অঝরে কেঁদেছেন। মাহিন চোখ মুছে কয়েকজন মহিলাকে বলে পংক্তিকে উঠানোর চেষ্টা করে কিন্তু উঠাতে পারে না। পাগলের মতো কেঁদে যাচ্ছে মনিরার লাশ ধরে পংক্তি। তার পৃথিবী আজ লণ্ডভণ্ড প্রিয় বান্ধবীর অকাল প্রয়াণে। কাকে বুঝাবে কী হারিয়েছে সে! কাঁদতে কাদতে মূর্ছা যায় পংক্তি। ধরাধরি করে একজনের ঘরের বিছানায় শুয়ে দেওয়া হয়। হিজাব খুলে তেলপানি মাথায় দিয়ে বাতাস করছে কয়েকজন। মাহিন পাঁজাকোলে করে ঐ ভাবেই গাড়িতে উঠিয়ে বাসায় নিয়ে আসে পংক্তিকে।
মনিরার সৎমাকে খবর দেওয়া হলেও তিনি আসেন নি। কাফনের কাপড় কেনা নিয়ে একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া দাফনের ব্যবস্থা কোথায় হবে সে নিয়েও আলাপআলোচনা চলছে মুরুব্বিদের মধ্যে। কারো কারো ভাগ্য সত্যিই নির্মম হয়। মনিরার পরিণতিতে এলাকার সবার মধ্যেই বেদনা পরিলক্ষিত।
চাপাগুঞ্জন ভাঙলো রায়হানের আগমনে। নিজের পরিচয় দিয়ে মনিরার শেষকৃত্যের সকল দায়ভার সে নিল। জানাজা শেষে দাফন করা হলো সিদ্দিকী বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে। একদিন আগেই যেখানে নতুন একটা কবর হয়েছিল। দু’টো জীবন চলে গেল। এই দুনিয়াটা ভেলকি মাত্র। এই একরূপ তো এই ভিন্নরূপ।
বিপথের পথিকের সম্মুখভাগের পথ আপাতদৃষ্টিতে চাকচিক্যময় মনে হলেও তা দুর্গম, হতাশাপূর্ণ। পথের শেষে কেবই তারা দুঃখ পায়। জীবন আমাদের কতো রূপ দেখায়, কতো মোড়ে দাঁড় করায় তার ইয়ত্তা নেই। যে ভেলকিবাজির সত্য বোঝে সেই তো দিনশেষে সফলকাম,চিরসুখী।
পর্ব ২৮
“আপা ওঠ! এই আপা!”মিলির ক্রমাগত হাঁক ডাকেও পংক্তি নির্লিপ্ত। গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে বিছানার এককোনে। গতকাল মাহিন অচেতন অবস্থায় পংক্তিকে নিয়ে আসার ঘন্টা খানেক বাদেই পংক্তি স্বাভাবিক হয়। স্বাভাবিক হতেই আবার যেতে চেয়েছিল মনিরার বাসায় সে।
শেষবারের মতো মনিরাকে দেখার জন্য হাতে পায়ে ধরেছিল সবার। তার সকল কাকুতি মিনতি অগ্রাহ্য করে মজিলা ও মাহিন। সারাটা দিন বিরতি দিয়ে দিয়ে কেঁদেছে পংক্তি। কিচ্ছুটি মুখে দেয়নি। হিমান্ত কেন এলো না, খোঁজও কেন নিল না। সেই চিন্তায়ও আরও কষ্ট পাচ্ছে তার মন। হিমান্ত পাশে থাকলে আজ সে মনিরাকে শেষবারের মতো দেখতে পেত।
মনিরার করুন মৃত্যু পংক্তির ভেতর বাহির এলোমেলো করে দিয়েছে। একা, নিঃসঙ্গ অনুভব করছে নিজেকে সে। হিমান্তের উপর প্রচন্ড অভিমান বাসা বাঁধে তার মনে। পংক্তির খাওয়া, না খাওয়া নিয়ে মজিলার কোনো মাথাব্যথা নেই। মাহিন ঘুরেফিরে কয়েকবার অনুরোধ করেও খাওয়াতে পারে নি শেষমেষ মিলিকে পাঠিয়েছে।
মিলি ডেকে ডেকে গলা শুকিয়ে ফেলার অবস্থা, অথচ পংক্তির কোনো সাড়াশব্দ নেই। ড্যাবড্যাবিয়ে স্থির চোখে জানালার বাইরে দৃষ্টি মেলে শুয়ে আছে সে। মিলির খারাপ লাগছে পংক্তির এহেন অবস্থা দেখে। তার পংক্তি আপার জীবনে শিরে সংক্রান্তি! তার মা, ভাই পংক্তিকে তো এমনি এমনি আনে নি এখানে। তাদের মন মস্তিষ্কে কী ভয়ানক প্লান চলছে তা যে মিলি ভালো করেই জানে; কিন্তু সেইবা কী করবে? গলা টিপে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে মা, ভাই তাকে। নয়তো মিলি ঠিক সতর্ক করত তার দুঃখিনী আপাকে।
মাহিন দরজায় দাঁড়িয়ে মিলির চোখের চাহনি দেখে মনের কথা আন্দাজ করে নেয়। নিঃশব্দে এসে সজোরে চেঁপে ধরে মিলির হাত। টেনে বাইরে এনে কষিয়ে চড় বসিয়ে দেয় মিলির গালে। আতঙ্কিত চোখে ফুঁপাতে থাকে মিলি। ভাঙা ভাঙা শব্দে বলে,
“আপাকে ছেড়ে দে তোরা। ওর তো বিয়ে হয়েই গেছে। আর কতো কষ্ট দিবি মেয়েটাকে?”
মাহিন একহাতে মিলির গলা অন্য হাতে মুখ চেঁপে ধরে চাপা গর্জনে বলে,
“জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো এ বিষয়ে টু শব্দ করলে। তোকে বলেছি না চুপ, সুতরাং চুপ। হুশশ! আমাকে চিনিস তো? বোন তো কী হয়েছে, তোকে মারতে আমার সামান্য বাঁধবে না। পংক্তিকে আমার চাই বুঝেছিস তুই? একটা কেন একশটা বিয়ে হয়ে গেলেও পংক্তি শুধুই আমার।”
মজিলা সময় মতো দৌড়ে এসে মেয়েকে মাহিনের হাত থেকে বাঁচায়। মিলি অনবরত কাঁশছে দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস টেনে। মজিলা ছেলেকে শান্ত করে মেয়েকে শাসায়। মিলিকে ঘরে এনে আরও কয়েকদফা হুমকি ধামকি দিয়ে বুঝিয়ে বের হয়ে আসে মজিলা বেগম। মাহিন বরাবরই খেপাটে কিসিমের। টুম্পা ছেড়ে যাওয়ার পর উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করেছে। গতমাস থেকেই বেড়েছে তার পাগলামো ভয়ানকভাবে।
পংক্তি! পংক্তি! তার নাকি পংক্তিকে চায়। মিলির মা প্রথমে রাজি হয় না, কিন্তু যখন পংক্তির দাদিজান এসে পংক্তি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়। তখন মজিলাও একপায়ে সম্মতি দেয় মাহিনের কথায়। পংক্তিকে এখন মা ছেলে উভয়েরই প্রয়োজন। একজন হারানো ভালোবাসা ফেরত চায় তো অন্যজন অঢেল সম্পদের একাংশের ওয়ারিশ পারভেজ কন্যাকে পুত্রবধূ করতে অস্থির।
বিকেলের দিকে হঠাৎ বাসায় এসে হাজির আবিদা খানম। মজিলা কিছুটা হকচকিয়ে গেল অসময়ে আবিদা খানমের উপস্থিতিতে। মজিলার প্লান ছিল চটজলদি মাহিনের সাথে পংক্তির বিয়েটা দিয়েই খবর দেবেন আবিদা খানমকে। কিন্তু এতো আরেক ঝামেলা বাঁধলো। এখন যদি পংক্তি নিজের বিয়ের ব্যাপারে মুখ খোলে তবে তো সব শেষ।
আবিদা খানমকে মেকি হাসি দিয়ে ঘরে বসতে দেয় মজিলা। মাহিনও বাসায় নাই কী করবেন তিনি এখন? আবিদা খানমের ঝটিকা আগমনে মনে মনে দারুন রাগ হয় মজিলা। আবিদা খানম হাসিমুখে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে বলে,
“কই?
আমার বুবুজান কই? কী গো মা, ডাকো তারে। তুমি না বলছিলে গতকাল সে ফিরবে তোমার ভাইবাড়ি থেকে।”
“ফিরেছে তো। অনেকটা পথ জার্নি করেছে, খুবই ক্লান্ত। শুয়ে আছে ঘরে। আপনি বসেন আমি গিয়ে ডেকে আনছি।”
মজিলা পংক্তিকে ডাকার উদ্দেশ্যে ঘুরতেই আবিদা খানম তাকে থামিয়ে দেয়। আবিদা খানম বলেন,
“থাক শুয়ে থাক। আমিই বরং ভেতরে যাই। কোনরুমে দেখায় দাও।” মজিলার রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। পংক্তির যে পরিবর্তন তিনি গতকাল দেখেছেন তাতে ভয়টা যেন বেশিই কাজ করছে। মজিলাকে চুপ দেখে আবিদা খানম চশমার ফাঁক দিয়ে ভ্রুকুটি করে বলে,
“কোনো সমস্যা মা?”
“না! কোনো সমস্যা নাই। চলেন।” মজিলার একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তার ভয় হচ্ছে পংক্তি যদি সব বলে দেয়। মজিলার সোনার ডিমপাড়া মুরগি পংক্তি। তাকে সহজে হাতছাড়া করবে না মজিলা। অনেকটা বাধ্য হয়ে আবিদা খানমের মনরক্ষার্থে, পংক্তি যে রুমে আছে সেখানে নিয়ে আসেন।
আবিদা খানমের দু’চোখ ক্ষয়ে যাচ্ছিল নাতনিকে দেখার জন্য। বিছানার উপর গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা মেরুন রঙের থ্রিপিস পরিহিতা মেয়েটিকে দেখে আনন্দে অশ্রু ফেলছেন তিনি। পংক্তির মুখটা অপরপাশে ঘোরানো থাকায় এগিয়ে গেলেন আবিদা খানম। শিওরে বসে অপেক্ষা করলেন নাতনির ঘুরে তাকানোর। আশ্চর্য হলেন তিনি, পাশ ফিরলোই না তার নাতনি। ভ্রুকুটি করে পাশে দাঁড়ানো মজিলার দিকে তাকালেন।
মজিলা দুঃখী মুখ করে বললো,
“ওর বান্ধবী গতকাল মারা গেছে। মেয়েটা আমার সেই শোকে পাথর। খাওয়া নাওয়া বন্ধ করে মরার মতো পড়ে আছে কাল থেকে।”
“হঠাৎ! এক্সিডেন্ট হয়েছিল নাকি?”
“না গো খালাম্মা!,,,।” মজিলা একে একে মাহিনের কাছ থেকে শোনা সব কথায় আবিদা খানমকে বলে। সব শুনে দুঃখপ্রকাশ করে আবিদা খানম। পংক্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“ঐ নরপিশাচটাকে পুলিশ ধরে নাই? তোমার ছেলেকে বলবে ঐ থানার ভারপ্রাপ্ত ওসির নাম্বারটাও দিতে আমাকে। পালিয়ে যাবে কই? ধরা তো একদিন পড়বেই।”
মজিলা আবিদা খানমের সুরে সুর মিলায়। আবিদা খানম পংক্তির কপালে হাত রেখে স্নেহভরা কন্ঠে ডাকে,
“বুবুজান, ও বুবুজান। দেখো কে আসছি?”
পংক্তি সময় নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ খোলে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসে এলোমেলো কাপড়ে,উদভ্রান্ত নজরে। আবিদা খানম নাতনির এমন করুন অবস্থা দেখে চোখের পানি ছেড়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন। পংক্তি কিছুই বুঝলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মামির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মজিলা অনিচ্ছাকৃত হাসি টেনে বললো,
“তোর দাদিজান। তোরে দেখতে আসছে।”
পংক্তির অথর্ব শরীরে মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল। মুখ শক্ত করে আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে সরে বসে। আবিদা খানম নাতনির রাগের কারন বুঝে চুপচাপ থাকেন কিছুক্ষণ। চশমা খুলে আঁচলে চোখ মুছে অপরাধী মুখে বলেন,
“আমি বুঝি তোমার রাগের কারণ। তোমার মা এভাবে অকালে চলে যাবে ভাবতে পারি নি। তোমার আব্বুও জানত না কবিতা নেই। কিছুদিন আগেই তাকে জানানো হয়েছে সব কথা। অনেক খুঁজে তোমাকে পেয়েছি গো বুবু।
তোমার আব্বুর অবস্থা বেশি ভালো না। ভেঙে পড়েছে সব শুনে। তুমি যে তার সন্তান সে সেটাই জানতো না। তোমারে দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে আমার ছেলেটা। দেখা করবা না বুবু, আব্বুর সাথে?”
“না!”কঠিন দৃষ্টিনিক্ষেপ করে জবাব দেয় পংক্তি।
“আমাদের ক্ষমা করা যায় না বুবু? যা হইছে তা তো আর ঠিক করতে পারবো না। তবে যা আছে তা সাজিয়ে গুছিয়ে নিলে সমস্যা কই বলো? আমার সাথে চলো বুবু।”
“না! আপনি চলে যান। আপনাদের কাওকে আমার প্রয়োজন নেই। আপনার ছেলেকে বলে দেবেন। তিনি যেন কষ্ট না পান। এতোদিন যা ভেবে এসেছেন তাই ভেবেই যেন বাকিটা জীবন পার করেন। আমি তার মেয়ে কোনোদিন ছিলাম না এবং হবও না। আমি শুধুই মৃত কবিতার মেয়ে।”
আশৈশব জমানো ক্ষোভ পিতৃগোষ্ঠির উপর পংক্তির। দাদিজানকে দেখে কন্ঠস্বর তাই তীব্র হয়ে ওঠে। রক্তের বাঁধন না যায় খন্ডন। পংক্তি পিতার অসুস্থতার কথা শুনে কষ্ট পায়। ঘৃণা বুঝি বিলীন হলো পিতার কষ্ট পাওয়ার কথা শুনে। তার মন চাইছে দাদিজানকে জড়িয়ে নিজের কষ্টের কথা বলতে,কিন্তু অভিমান আর রাগ তার হৃদয় কঠিন করে তুললো।
আবিদা খানম পংক্তির হাত ধরে অনুরোধ করে,
“আমাদের ভুল হয়েছে বুবু। যা শাস্তি চাও দাও তবুও দূরে ঠেলে দিও না আর। চলো বুবু।”
“বললাম তো যাব না। দূরে আমি ঠেলি নি আপনাদের বরং আপনারাই আমার মা এবং আমাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন। একটাবার খোঁজ কেন নেন নি? এখন আসছেন ভুল শুধরাতে। আর আপনার সেই পুত্রবধূর কী সমস্যা নেই আমাকে নিয়ে এখন? তিনি মেনে নেবেন আমাকে? আমি আমার মায়ের মেয়ে। আমার মা যেমন কারো সংসারে ভাগ বসাতে রাজি ছিল না আমিও কারো পিতার ভাগে ভাগ বসাবো না।
এতোদিন পিতৃপরিচয় ছাড়াই বেঁচে মরে আছি বাকিটা জীবনও আল্লাহ চালিয়ে নেবে। পায়ে ধরি আপনার চলে যান। আমি বেয়াদবী করতে চাই না। আপনি আমার জন্মদাতার মা। আমি তাকে পিতা বলে না মানি তবুও সে আমার পিতা। আমার সেই জন্মদাতা পিতার মাকে আমি কষ্ট দিতে চাই না। প্লীজ চলে যান।” পংক্তির হিঁচকি উঠে যায় কাঁন্নার তোড়ে।
“বুবু একটু শান্ত হও। আজ তোমার মা বেঁচে থাকলেও কী এমন বলতে পারতে তুমি? কবিতা কোনোদিন পারভেজের কষ্ট দেখতে পেত না। রাগ করে না বুবু আমার। চলো।”
“এজন্যই তো অকালে মরেছে কবিতা। আমি কবিতা হতে চাই না। কবিতা আমার মা। তিনি মরে শিখিয়ে গেছেন তার মেয়ের বাঁচতে হলে কী করতে হবে। আমি তাই করছি। আমার মা যে বাড়ি স্বীকৃতি পায় নি, আমারও প্রয়োজন নেই সেই বাড়ির স্বীকৃতির।”
পংক্তি আবিদা খানমের চোখের জল উপেক্ষা করে চোখ মুছে অন্য রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। অনেক ডাকাডাকির পরও সে বের হয় না। আবিদা খানম হতাশ হয়ে সোফায় বসে পড়ে। অশ্রুসজল চোখে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। কতো আশা বুকে করে এসেছিলেন, সবই বুঝি নিরাশা হয়ে পড়ে রইল দরজার ওপাশে। মজিলা এতোক্ষণ সব দেখেশুনে বিরক্ত।
পংক্তির উপর তার চরম রাগ হচ্ছে। মজিলার সোনার ডিম দেওয়া হাঁস কিনা বলছে ডিম দিব না? মজিলা কী তাই হতে দেবে? কক্ষনো না। পংক্তির প্রত্যাখ্যানে বেদনাহত আবিদা খানমের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে মজিলা বলে,
“খালাম্মা মন খারাপ কইরেন না। বাচ্চা মাইয়্যা। বয়স বেশি না তো।
বুদ্ধি কম, আবেগ বেশি। আপনি দুই তিনদিন বাদে আসেন। এরমধ্যে আমি বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাবো। আমারে মায়ের মতো সম্মান করে। কবিতা তো জন্ম দিয়াই মইরা গেল। এই দু’হাতে পালছি পুলছি। আজ পর্যন্ত ফুলের টোকাটাও দেই না মাইয়্যাডারে। আমার কথা ঐ ফেলতে পারবো না। আপনি মনে কোনো দুঃখ নিয়েন না। সব ঠিক হয়ে যাইব। যান বাড়ি যান।”
মজিলা এই মুহূর্তে আবিদা খানমকে তাড়াতে পারলেই যেন বাঁচে। আবিদা খানম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে আসেন। তিনি ঘুর্ণাক্ষরেও টের পেলেন না একটু পর কী তাণ্ডব মজিলা তার আদরের নাতনির উপর চালাবে। এসেছিলেন নাতনিকে ফিরিয়ে নিতে কিন্তু কে জানে আর হবে কিনা দেখা দু’জনের?
আবিদা খানম যাওয়ার ঘণ্টা খানেক বাদেই মাহিন বাড়ি ফেরে। মিলি এসময় টিউশনিতে থাকে। মজিলা ছেলেকে সব বলে দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করতে তাড়া দেয়। মাহিন রাজি হয় মায়ের কথায়। মজিলা পংক্তিকে দু’বার ডাকতেই দরজা খোলে পংক্তি। চোখ মুখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে অতিরিক্ত কান্নার কারনে। ভারী স্বরে মামি এবং মাহিনকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
“আমি আজই ফিরে যাব। আমাকে দিয়ে আসেন।”
“কোথায়?”মাহিনের নির্বিকার ভঙ্গি দেখে পংক্তি চটে যায়। তার মেজাজ এমনিতেও ভালো ছিল না। উঁচু গলায় পংক্তি বলে,
“কোথায় মানে কী? যেখান থেকে আনা হয়েছে, আমাকে সেখানেই দিয়ে আসো। যদি তোমাদের যেতে সমস্যা হয় তাহলে আমিই একাই চলে যাচ্ছি।”
পংক্তি ঘরে ঢুকে ব্যাগ গুছাতে আরম্ভ করে। মাহিন আর মামির চাহনি পংক্তিকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। পংক্তি বোরখা খুঁজে পায় না। পুরোরুম খুঁজেও যখন বোরখা পেল না। ওভাবেই বের হয়ে আসলো মাথায় ওড়না টেনে। দরজার লক খুলতেই মাহিন পংক্তিকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের বিছানায় ছুড়ে ফেলে। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“কোথায় যাবি তুই? ঐ হিমান্তের কাছে? সে তো তোর খোঁজ ও নিলো এপর্যন্ত। তুই তার কাছে কী, এখনও বুঝিস নাই? বোকা রে তুই পংক্তি। অনেক বড় বোকা। তুই বোকা তাই বলে আমি তো বোকামি করতে দিতে পারি না বার বার তোকে।”
ভয়ে আড়ষ্ট পংক্তিকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে মাহিন। পংক্তি প্রাণপণ চেষ্টা করে কিন্তু নিজেকে ছাড়াতে সে পারে না। মজিলা হেঁসে হেঁসে ছেলেকে বলে,
“আরে আরে করছিস কী? বিয়েটা তো করে নে আগে। কাজীকে কল কর। আজ এক্ষুণি তোদের বিয়ে হবে। মুহিবকেও বল আসতে সাক্ষী নিয়ে।”
মাহিন হাতের বন্ধন শিথিল করতেই পংক্তি মাহিনকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে বসে। ভয়ার্ত পংক্তি বিস্মিত হয়ে বলে,
“বিয়ে! কার বিয়ে? আমি কাওকে বিয়ে করবো না। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এমন অন্যায় তোমরা করো না আমার সাথে। আমার স্বামীর কাছে যেতে দাও আমাকে। আল্লাহর দোহায় লাগে।”
পংক্তির অনুনয় ভরা কান্নায় মাহিন কিংবা মজিলা কারোই মন গলে না। মজিলা এলোপাথাড়ি চড় কিল যা পারে দিয়ে পংক্তিকে আঘাত করে। দু’জনের হাত এবং কথার নির্যাতনে একসময় পংক্তি দূর্বল হয়ে পড়ে। ভয়, আতঙ্কে তার বুক ঢিপঢিপ করছে। দু’চোখে আষাঢ়ে বন্যা অথচ গলায় জৈষ্ঠ্য খরা। মাহিন এগিয়ে এসে দু’হাতে পংক্তির মুখটা ধরে।
কিছুটা ধামকির সুরে বলে,
“দেখ পংক্তি যা হয়েছে ভুলে যা। ভুলে গেলে কী হবে জানিস? সবার ভালো হবে। তোর ঐ হিমান্ত, যাকে স্বামী! স্বামী! বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছিস। এখানে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত একটা খোঁজ নিয়েছে তোর? তারা তোকে চায় না রে। কেন বুঝিস না? সে যদি প্রকৃতই তোকে ভালোবাসত তবে একটিবার কল করত না?
কল করেছে? এতো বোকা তুই! আমারই অন্যায় হয়েছে, ভুল হয়েছে তোকে সে’সময় আঘাত দিয়ে। আমি তোকে হারিয়ে বুঝেছি। তুই আমার জন্য কী! দ্বিতীয়বার তোকে হারাতে চাই না আমি। তুই চাইলেও না। দরকার হলে তোকে মেরে তোর লাশের সাথে সংসার করবো তবুও তোকে কোথাও যেতে দেব না আর। যাবি ঐ হিমান্তের কাছে বল? যাবি? গেলে তোর সাথে ওকেও শেষ করে ফেলব। চিনিস না আমাকে তুই? বল চিনিস তো নাকি?”
উন্মাদের মতো রক্ত বর্ণ চোখে হিংস্র ভঙ্গিতে কথাগুলো শেষ করে মাহিন। পংক্তির কন্ঠস্বর কাঁপছে। মাহিন জবাবের আশায় চেয়ে আছে পংক্তির দিকে। দু’চোখের জল ফেলে ঢোক গেলে পংক্তি। শুকনো গলায় টেনে টেনে বলে,
“আমিও কোথাও যাব না। তার কিছু কর না তুমি প্লীজ!”
“তাহলে বল আমাকে বিয়ে করবি। বল?”
“করবো।” ভয়ে চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায় পংক্তির। থরথরিয়ে সর্বাঙ্গ কাঁপছে তার।
মাহিনের চিৎকারে মজিলা পর্যন্ত আঁতকে ওঠে। সে দ্রুত ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তার ছেলে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। কখন কী করে বসে ঠিক ঠিকানা নেই। মাহিন পংক্তির কাটা ঠোঁট, গাল, এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে পুনরায় বলে,
“হিমান্তের কাছে যাবি? ওর নাম মুখে নিবি আর?”
“না! “
পংক্তির জবাবে বিজয়ী হাসি হাসে মাহিন। শক্ত করে পংক্তিকে বুকে জড়িয়ে পংক্তির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“শুধু শুধু মারগুলো খাইলি কেন? বড় হচ্ছিস না তুই? এখন তোর তো বোঝা উচিত কারা তোর আপন। মারি, কাটি, বকি আমরাই তোর আপন। আমাদের ছেড়ে ঐ অজানা অচেনা মানুষদের কাছে গিয়ে কেন থাকবি? তোর ভালোবাসা তো আমি তাই না? তুই আমাকে শুধু ভালোবাসিস। শুধু আমাকেই। তোর জীবনে আমিই শুরু, আমিই শেষ।”
মাহিনের শীতল ভঙ্গির খোলসের আবডালে ভয়ংকর দানবীয় শক্তি বিরাজ করছে। পংক্তির একটু প্রতিবাদেই মুহূর্তে জেগে উঠবে সেই ঘুমন্ত দানব। ঝাঁপিয়ে পড়বে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে। পংক্তি একা, অসহায়, বড় অসহায় এখন সে। তার সাধ্য নেই এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরে সে। সৃষ্টিকর্তাই পারে তাকে বাঁচাতে নয়তো নিজেই মহাপাপ করে বসবে আজ। আত্মাহুতি দেবে সকল জ্বালা, যন্ত্রণা বুকে নিয়ে।
পংক্তি আসন্ন বিপদ উপলব্ধি করে বোবা হয়ে যায়। তার শব্দকোষ শূন্য এই ক্ষণে। দু’চোখে শ্রাবন ধারা, হৃদয়জমিনের উপর প্রবাহিত কালবোশেখীর তাণ্ডবে উদ্বাস্তু তার মন। বোধশক্তি স্থবির হয়ে পড়েছে ভয়ে।
পর্ব ২৯
“আম্মু করছ কী? সরে এসো! এসো বলছি!”ময়নার উচ্চ আওয়াজে পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে আজিজুল।
“কী হয়েছে ময়না?”
“আম্মু পায়খানা করে আবার সারা গা মাখিয়েছে।” বলতে বলতে কেঁদে ভাসায় ময়না। গত ছয়মাস ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন তার মা আকলিমা বেগম। একমাত্র সন্তান মৃদুলের অপমৃত্যু কিছুতেই সহ্য করতে পারেন নি আকলিমা এবং মঞ্জুর। হঠাৎ করেই তাদের জীবন উলোট পালোট হয়ে যায় সন্তানের মৃত্যুতে।
মঞ্জুর স্ট্রোক করে। মৃত্যুর পূর্বে স্ত্রীকে সবকিছুর জন্য দোষারোপ করে যান। এতো শোক সহনীয় ছিল না আকলিমার। সন্তান হারিয়ে এমনিতেই শোকে পাথর ছিলেন, তারউপর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু এবং দোষারোপে তিনি ব্রেন স্ট্রোক করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বসেন। কী করেন কোনো বোধ নেই।
এই হাসেন, আবার এই কাঁদেন! বোধশক্তিহীন জড়পদার্থের মতো পড়ে থাকে ঘরের এককোনে। ময়না বা কাজের লোক নিয়মমতো তার সকল কাজ করে দেয়। আজ একটু হেরফের হওয়ায় বিছানায় মলমূত্র করে পুরো শরীরে মাখিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন।
আজিজুলের গলা শুকিয়ে আসে। ক্রন্দনরত স্ত্রীকে বসার ঘরে এসে বসায়। বুয়াকে তাড়া দেয় দ্রুত শ্বাশুড়িকে পরিষ্কার করিয়ে দেওয়ার জন্য।
জেল থেকে ফেরার পর হিমান্ত তাদের সিদ্দিকী ম্যানশন থেকে উত্তরার ফ্লাটে শিফট হতে আদেশ করে। কড়া ভাষায় সতর্ক করে দেয় পরবর্তীতে যেন আজিজুলের ছায়াও না পড়ে তার সামনে। নেহাৎ সে ময়নার স্বামী বলে বেঁচে গেল তবে বারবার এমন সদয় হিমান্ত হবে না। আজিজুল মধ্যবিত্তের জীবন অতিবাহিত করছে। তাতে দুঃখ থাকলেও কিছুই করার নেই তার। ময়নার কথা ভেবে দু’টো ফ্লাট ওর নামে করে দিয়েছে হিমান্ত।
একটাতে তারা আছে অন্যটা ভাড়া দেওয়া। আজিজুলের মাঝে মধ্যে ইচ্ছা করে পাগলি শ্বাশুড়িকে রাস্তায় ফেলে আসতে। কিন্তু পারে না সেটা করতে। ময়নাও আগের মতো নেই। অনেক বোঝা শিখে গেছে সে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বেড়ালও আক্রমনাত্মক হতে বাধ্য হয়।
শ্বাশুড়ির পরিণতি আজিজুলের জন্য চরম শিক্ষা। ছোট ছোট সন্তান দুটোর কথা চিন্তা করে আজিজুল সৎভাবে জীবনযাপনের চেষ্টা করছে। আজিজুল চেষ্টা করেও চরিত্র শুধরাতে পারে নি। এই একটা জিনিস কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছে না। পাপের শাস্তির ভয় ছাপিয়ে অন্যায় কাজ এখনও মাঝেমধ্যে করে সে।
কথায় আছে না, স্বভাব যায় না মলে, আর ইল্লৎ যায় না ধুলে। চারিত্রিক স্খলন এখনও তার মধ্যে রয়েছে। যে কাজ আগে ক্ষমতার জোরে করত সে কাজ আকজাল পয়সা দিয়ে করে অতি গোপনে। আগে দিনান্তে, নিশান্তে এখন মাসান্তে গমনাগমন হয় গণিকালয়ে। তবে অবশ্যই সুযোগ বুঝে, বিপদ এড়িয়ে।
আরিফ সিদ্দিকীর পুরো পরিবারকে সিদ্দিকী ম্যানশনে ফিরিয়ে এনেছে হিমান্ত। আরিফ সিদ্দিকী মন থেকে রাজি ছিলেন না, তবু এলেন। মৃত ভাইয়ের শেষ ইচ্ছা এবং হিমান্তের মানসিক সাপোর্টের তাগিদে তাকে আসতেই হলো সপরিবারে। প্রসূন রায়হানের বিয়ে হয়েছে মাস তিনেক আগেই।
পরিবারের সবার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে সাধামাটা বিয়ে করেছে তারা। শ্বাশুড়িকে বলে বাবা পারভেজ চৌধুরীকে দেখতে বেরোয় প্রসূন।
বাবা পারভেজ চৌধুরী হার্টের পেশেন্ট। পংক্তি নিখোঁজ হওয়ার পরপরই হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি।
এদিকে হারানো নাতনির শোকে কেঁদে কেঁদে চোখে ছানি পড়ে গেছে আবিদা খানমের। দিনরাত আল্লাহকে ডাকছেন নাতনিকে ফিরে পাবার আশায়। সবার চোখের আড়ালে আফরিনও কষ্টে দু’ফোটা চোখের পানি ফেলে সৎ মেয়ের জন্য। তারই জন্য পংক্তির আজ এই পরিণতি। তিনি একটু উদার হয়ে কবিতাকে মেনে নিলে হয়তো মেয়েটার ভাগ্যে এ দূর্গতি হতো না,কিন্তু কিইবা করতেন তিনি। স্ত্রী হয়ে স্বামীর ভাগ কেউ কী দিতে পারে?
এই পর্যায়ে যে, সব মেয়েলোকই বড় কৃপণ!
রেজওয়ানের দোয়া আল্লাহ তাআ’লা কবুল করেছেন। রিমাকে সে যেভাবে চেয়েছিল সেভাবেই পেয়েছে। তাদের বৈবাহিক জীবন সুখের বলা চলে এখন।
স্কুল শেষে বাসা ফিরে সোজা সারার রুমে উঁকি দেয় আরহাম। সারা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে খোলা জানালায় দৃষ্টি মেলে। পা টিপে টিপে সারার পেছনে দাঁড়িয়ে আচমকা শব্দ করে। সারার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখতে পেল না আরহাম। সারার মুখের দিকে ঝুঁকে রেগে বলে,
“ভয় পেলি না কেন তুই?”
“পেয়েছি তো ভয়।”
সারার নাকে নাকে বলা কথা শুনে আরহামের রাগ উবে যায়। সারার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেখে সারা কাঁদছে। আরহাম দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলে,
“মামনির কথা মনে পড়ছে?”
সারা মাথা নাড়ায় শব্দ করে কেঁদে। আরহাম পুনরায় বলে,
“কাঁদিস না। আল্লাহ মামনিকে একদিন ঠিক ফিরিয়ে দেবে। তখন আমি কী করবো জানিস?”
সারা ঘাড় নাড়ায়, সে জানে না। আরহাম ছুটে গিয়ে একটা দড়ি নিয়ে আসে। সেটা দেখিয়ে বলে,
“এটা দিয়ে বেঁধে রাখব তোর মামা আর মামনিকে। তারপর তুই আর আমি দরজায় তালা মেরে বাইরে পাহারা দেব। ঠিক আছে?”
“হুম।” সারা চোখ মুছে মাথা ঝাকায়। আরহাম কাছে গিয়ে একহাতে সারার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুই কাঁদিস না আর সারা। আন্টি আমাকে বলে গেছে তোকে যেন না কাঁদাই। ফিরে এসে শুনলে তো খারাপ বলবে আমাকে। কাঁদিস না প্লীজ।” সারা কান্না থামিয়ে হাসার চেষ্টা করে। আরহামের মনে স্বস্তি ফেরে সারার হাসি দেখে।
“চল নিচে গিয়ে খেয়ে নেই। একটু পর তো মিরা আসবে সোনিয়া আন্টির সাথে।”
“সাদ আসবে না?”
“আসবে তো। সাদ তো ছোট্ট বাবু। ওকে রেখে কী আসবে নাকি। তুই না অনেক বোকা রে সারা।”
“হুমম। মামা বলে মামনির মতো বোকা আমি। নাকের ডগায় অভিমানে ভরা আর মাথাভর্তি গোবর। বুদ্ধি সব হাঁটুতে নাকি! বুদ্ধি কী হাঁটুতে থাকে বল তো?”সারা গাল ফুলিয়ে বলতেই আরহাম খিলখিল করে হেঁসে ওঠে। সারা হাসে না। পংক্তির স্মৃতি, সাথে মামার কষ্টে স্থির তার দৃষ্টিজোড়া। মামা যতোবার উক্ত কথা বলে, ততবার কাঁদে। সারা যেন বুঝতে না পারে সে কান্না তাই সারাকে জড়িয়ে ধরে। সারা তো সব বোঝে এখন।
সব!
জুম্মার নামাজ শেষে সিদ্দিকীদের পারিবারিক কবরস্থানে প্রবেশ করে হিমান্ত। বাবা,মা,দাদি সহ পরিবারের অন্যান্যদের কবর জিয়ারত শেষে মনিরার কবরটাও জিয়ারত করে হিমান্ত। কতো কাছের ছিল এই মানুষগুলো, অথচ আর তারা দূর বহুদূর। ভালো থাক মানুষগুলো, মনে প্রাণে দুয়া করে হিমান্ত। পিতার ঘাসে ভরা সবুজে আচ্ছাদিত কবরটার পাশে বসে নিরবে চোখের জল ফেলে।
সেদিন হিমান্তের বাবা সিদ্দিকী সাহেবের পিএ জাফরুল্লাহ মোবাইল করে বলেছিল,
“বাবা হিমান্ত, সিদ্দিকী স্যার তার অন্তিম সময়ে তোমাকে দেখতে চাওয়ার আশা ব্যক্ত করেছে। তোমার আসার সকল ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুমি কী আসবে,,,!”জাফরুল্লাহ থেমে গেলেন। বাকি কথা তিনি বলতেই পারলেন না। কান্নার তোড় সামলে বহুকষ্টে বললেন,
“যতদ্রুত সম্ভব চলে আসো বাবা।”
হিমান্ত, কেবল হিমান্তই জানে পিতার মুমূর্ষু অবস্থার কথা শুনে তার কী হাল হয়েছিল সেদিন। বাকশক্তিহীন, বোধশক্তিহীন হয়ে পাগলের মতো বেরিয়ে এসেছিল। ভাগ্যিস রেজওয়ান ঐ অবস্থায় দেখেছিল তাকে। রেজওয়ান সহযোগিতা না করলে হয়তো বাবাকে শেষবার দেখাই হতো না সেদিন হিমান্তের। জীবন একহাতে দেয়, তো অন্যহাতে নিয়েও নেয়।
মায়ের মৃত্যু থেকে এ পর্যন্ত কী অসহনীয় কষ্টে দিনাতিপাত করছিল সে, তা শুধু সেই জানে। তার আপন মামি সম্পদ, প্রতিপত্তির লোভে তাকে একটু একটু করে শেষ করছিল। ব্যর্থ জীবনের গ্লানি ঘুচাতে কতোবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছে সে। তার সবকিছু থমকে গিয়েছিল সেসময়। মনের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল হিমান্ত। অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল মরার জন্য। শারীরিক, মানসিক সব দিক দিয়ে সে ছিল বিধ্বস্ত এক মানব।
প্রতিটি মানুষেরই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকে। পুরুষ হিসেবে হিমান্তের ক্ষেত্রেও তেমনটা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কালো জাদুর কারনে তার এই আকর্ষণ ম্লান হতে থাকে। কামনা বাসনা দিনদিন কমতে থাকে। এই কারনগুলোই তাকে দিনকেদিন আহানার থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
সঙ্গীবিহীন একাকী হয়ে যায় সে। আহানা তবুও মানিয়ে গুছিয়ে চলতে চাইলো, কিন্তু এ সমাজের কিছু সংকীর্ণমনা মানুষের উৎপীড়নে পারলো না আহানা শেষ পর্যন্ত। রাগ, জেদ পুষে পা বাড়াল পরকীয়ার পথে। হিমান্তের অক্ষমতা আহানার মাথা নত করে দিয়েছিল। সে বোঝেনি নিম্ন কাজে শির উন্নত নয় অবনতই হয়।
মিউচুয়াল ডিভোর্স হলো দু’জনের। হিমান্ত জানত আহানার মনে তখনও শুধু সেই ছিল। আহানা চলে যাওয়ার পর হিমান্তের জীবন হয় আরও দুর্বিষহ। শারীরিক অসুস্থতা দিন দিন বাড়তেই থাকে। প্রচন্ড মাথা ব্যথা, পিঠ ব্যথা এমনকি রাতে ভয়ানক হ্যালুসিনেসনে হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে নেশায় ডুব দিল। আত্মাহত্যার চেষ্টাও করে হ্যালুসিনেসনের আতঙ্ক কাটতে।
সেসময় তার বাবা সিদ্দিকী সাহেব ডাক্তার, কবিরাজের পেছনে লাখ লাখ টাকা ঢেলেছিলেন। একমাত্র পুত্র, চোখের মণিকে সুস্থ করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ফল হিমান্ত সুস্থ হলো তবে স্বাভাবিক নয়। মেজাজ সর্বক্ষণ চিরচিরে থাকত। ভালো ব্যবহার পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল তার কাছে। বাপ ব্যাটাতে কথা হলেই বাকবিতণ্ড। যার কারনে কথা বলায় বন্ধ হলো তাদের। কী না দুর্বিষহ স্মৃতি ছিল তার।
সৃষ্টিকর্তা তাকে সত্য দেখাতে চেয়েছিল। নিজের সক্ষমতা,শক্তির উৎস কী জানলো হিমান্ত একসময়। তার মরুদ্যান সঞ্জীবিত হলো পংক্তির আগমনে। স্যাঁত স্যাঁতে অন্ধকার জীবনে একফালি সূর্য রশ্মি হয়ে এসেছিল পংক্তি।
পংক্তিকে যেদিন প্রথম গার্মেন্টসে দেখেছিল, সেদিনই ভেতর বাহির ঝড় উঠেছিল কোন এক অজানা কারনে। বহুকাল পর একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। প্রথম ভালোলাগার শুরু সেখান থেকে। মনিরার অনুরোধে দ্বিতীয়বার এবং স্থায়ীভাবে তার জীবনে এলো পংক্তি।
যতোই দেখছিল ততই যেন ভালোলাগা ভালোবাসাতে পরিণত হচ্ছিল। প্রকাশ করতে গেলেই অতীত হামলে পড়ত। ধিক্কার জানাত,”রক্ষক হয়ে ভক্ষকের কাজ করছিস? তুই কারো যোগ্য নস। কারো না।” হিমান্ত দমে যেত। এড়িয়ে চলত। ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে তার প্রাণপ্রিয়া তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। এই উপলব্ধি কী যে সুখ দিয়েছিল তা শুধু হিমান্তই জানে।
তার চৌচির হওয়া হৃদয় জমিনে রঙ বেরঙের পুষ্পে পুষ্পে ভরে তুলেছিল পংক্তির অধিকারবোধ। কিন্তু হায়ঃ ফের তার অতীত তাকে ধিক্কার জানালো,
“আবার একটা মেয়ের জীবন তুই শেষ করতে চাচ্ছিস? তুই বড় স্বার্থপর,নীচ হিমান্ত! নিজের স্বার্থে মেয়েটার জীবনটাকে জাহান্নাম বানাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিস? ছিঃ ছিঃ।”
পংক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেই যেন দ্বিতীয়বার মরলো হিমান্ত। হতাশা আবার জেঁকে বসলো তার শিরায় শিরায়। ভেবেছিল এই শেষবার আর নিজের অনুভূতিগুলোকে উৎসাহ সে দেবে না। তার সে আশা নিরাশায় রয়ে গেল।
রাক্বি দ্বারা রুকইয়াহ করার কারনে তার মানসিক,শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। পাশাপাশি ডাক্তারেও দেখায় সে। ভেবেছিল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেলে সাহস করে বলবে মনের কথা। কিন্তু তা আর হলো না। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। পংক্তির রাগ ভাঙানো হলো না তার আর। অভিমান পুষে হারিয়ে গেল তার বধূ।
মজিদ সাহেবের বাড়ির সেই ভাড়া বাসায় চুপচাপ বসে আছে হিমান্ত। দৃষ্টিজুড়ে তার চৈত্রের দাবদাহ। আজ ছ’টা মাস তার পংক্তি হারিয়ে গেছে। ছয় মাসের এক একটি মুহূর্ত কিভাবে কেটেছে তা শুধু হিমান্তই জানে। বুকের পাশটা তার হাহাকার করে মৃতপ্রায়। একটা মিরাকল ঘটুক,ফিরে আসুক তার প্রাণপ্রিয়া। হিমান্তের আর কিছুই চায় না। শুধু পংক্তিকে তার চায়। পংক্তি বিছানার যে পাশে ঘুমাত সেখানে গিয়ে হাঁটু মুড়ে শুয়ে আছে হিমান্ত।
চোখের জল যেন শুকিয়ে গেছে তার পংক্তির স্মৃতিতে কেঁদে কেঁদে। মোবাইল বাজছে অথচ তার যেন কিছুই খেয়াল নেই। সবকিছু ধূসর আর মলিন মনে হয়। মোবাইল রিংটোন বারকয়েক বাজার পর হিমান্ত উঠে বসে। মোবাইল স্ক্রিনে রেজওয়ানের নাম৷ মোবাইল রিসিভ করে উদাসীনভাবে কানের কাছে নেয় হিমান্ত। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন রেজওয়ানের কন্ঠস্বর।
“হিমান্ত কই তুই? কতোবার কল করেছি হুশ কই তোর? হিমান্ত শুনছিস?”
“হু!”রাশভারী কন্ঠস্বরে জবাব হিমান্তের। মোবাইলের ওপাশে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। রেজওয়ান বলে,
“একটু তো নিজেকে সামলে নে। এভাবে চলতে থাকলে বাঁচবি না তো তুই।”
“তোর কী মনে হয় আমি বেঁচে আছি? উইথ আউট হার আ’ম অলরেডি ডেড ইনসাইড রেজু। যেদিন পংক্তি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সেদিনই মরে গেছি আমি। সব দোষ আমার। কেন সেদিন বলে গেলাম না পংক্তিকে আমি। কেন বললাম না তোমাকে ভালোবাসি আমি পংক্তি। অনেক বেশিই ভালোবাসি।” হিমান্ত কান্নায় ভেঙে পড়ে কথাগুলো বলতে বলতে। রেজওয়ানের গলা ধড়ে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে অপরাধী সুরে বলে,
“সেদিন আমিও যদি তোর কথায় গুরুত্ব দিতাম তবে আজ হয়ত এদিন দেখতে হতো না।”
“তোর কোনো দোষ নেই রেজু। সব দোষ আমার। আমি বাবার অসুস্থতার খবর শুনে দিকবিদিকশূন্য হয়ে গিয়েছিলাম। কোনোকিছু না ভেবে ইমারজেন্সি ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর চলে গেলাম। আমার উচিত ছিল পংক্তিকে বলে যাওয়া। উচিত ছিল তোদের সতর্ক করা মাহিন সম্পর্কে। আমার ভুলে আমি আমার সব হারিয়ে ফেলেছি রে। আমার পংক্তিকে হারিয়ে ফেলেছি আমি।”
“আমাকে তুই বলেছিলি পংক্তিকে ফিরিয়ে আনতে ওদের বাড়ি থেকে,আমার ব্যর্থতা আমি সেটা পারিনি। শালারা ধুরন্ধর! মূল শুদ্ধ বাসা পরিবর্তন করেছিল। তিনদিন লেগেছিল নতুন ঠিকানা পেতে। ভুল আমাদের সবারই ছিল।
বাবা মায়ের উচিত ছিল মোবাইল নাম্বার রেখে দেওয়া, কিন্তু তারাও কী ভেবেছিল মানুষ এমন ভয়ানক হতে পারে! মানুষগুলো কেমন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। আপন আত্মীয়, অথচ কেমন নির্মম আর নিষ্ঠুর!”রেজওয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ভাবুক হয়ে পড়ে কিছুক্ষণ সে। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে হিমান্তের করুন আহাজারিতে।
“তুই বল রেজু কী করলে আমি আমার পংক্তিকে ফিরে পাব। বল আমাকে? আমি যে আর পারছি না এভাবে বাঁচতে।”
হিমান্তকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না রেজওয়ান। গত ছয়মাসে ঢাকা শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেছে পংক্তিকে। মাহিনকে সপরিবারে গ্রেফতার করা হয়েছে কিডন্যাপিং কেসে। কয়েকদফা রিমান্ডে নেওয়ার পরও মাহিন কিংবা ওর পরিবার পংক্তির নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে কিছুই বলতে পারে নি।
বারবারই অনুনয় করছে তারা নির্দোষ। পংক্তি স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে পালিয়েছে। পংক্তির নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনোই হাত নেই। এদের কথা হিমান্ত বিশ্বাস করে না। সে হাড়ে হাড়ে চেনে এই অমানুষগুলোকে। মানুষের ছদ্মবেশে শয়তান এরা! শুধু পংক্তি নিখোঁজ নয়, পংক্তির সাথে মাহিনের একমাত্র বোন মিলিও নিখোঁজ। এখানেই গড়মিল লাগছে সবার।
মাহিন কিংবা তার পরিবার মিলির বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দেয়। মিলি তার প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে তাই তারা মিলির ব্যাপারে কিছুই জানে না। পুলিশ সহ হিমান্ত পার্সোনালি খোঁজ নিয়েছিল মিলির সম্পর্কে এবং যেটা জানতে পারে তাতে সন্দেহ আরও পোক্ত হয়। মিলি সম্পর্কে যা বলেছে তার পরিবার, মিলি মোটেও তেমন মেয়ে নয়। শান্ত এবং ভদ্র মেয়ে বলেই সে পরিচিত। ছেলেঘটিত তেমন কিছুই ঘটে নি বলে দাবি পুরোনো প্রতিবেশী ও স্কুলের বন্ধু, শিক্ষকদের। তারাই উল্টো দোষ দিচ্ছে মিলির পরিবারকে।
মিলির কয়েকজন বন্ধু জানিয়েছে মিলি নিখোঁজ হওয়ার পূর্বে ভীত থাকত সর্বক্ষণ। যেদিন নিখোঁজ হয়েছিল সেদিন প্রচন্ড আতঙ্কিত দেখা গিয়েছিল তাকে। পায়ের তলা ক্ষয় করে ফেলেছে পংক্তির খোঁজে হিমান্ত। বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যখনই একটা ক্লু পেয়েছে ছুটে গেছে সে। কিন্তু প্রতিবারই রিক্ত হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। হঠাৎ আগত দমকা হাওয়ায় কোথায় যেন হারিয়ে গেল তার প্রেয়তমা।
হিমান্ত ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছে। তার পংক্তি কোথায় আছে, কেমন আছে সে জানে না! এতোগুলো দিন কেটে গেল, অথচ কিছুই জানতে পারলো না হিমান্ত। বুকের জমিনের তপ্ত বালুচরে একটু একটু করে ধূসর হচ্ছে তার আশা। সব হারিয়ে যাকে আগলে বাঁচতে চাইলো সেই এখন নিখোঁজ। হিমান্তের উপর তার এতো অভিমান যে একটিবার ভাবলো না তার কথা। তাকে ছাড়া এই হিমান্ত জ্বলন্ত সিগারেটের ন্যায় একটু একটু করে ছাই হচ্ছে পুড়ে পুড়ে। সেদিনের সেই প্রত্যাখ্যানের এমন শাস্তি তার পাওনা ছিল?
মারিয়ার বিয়েতে তোলা পংক্তির ছবিখানি হিমান্তের মোবাইলের লক স্ক্রিনে,হোম স্ক্রিনের ওয়ালপেপারে সেট করা। সারাটাদিন সেই হাসিমুখ দেখে হাপিত্যেশ করে কাটে হিমান্তের। আর অনুচ্চারিত হয় শার্ল বোদলেয়ারের কবিতার চরণ,
পর্ব ৩০
দু’টো লেকচার ক্লাস শেষে জোহরের নামাজ আদায় করতে ভার্সিটি সংলগ্ন মসজিদে ঢুকল হিমান্ত। রবের নিকট আজও তার কাতর প্রার্থনা একই রইল। মসজিদ থেকে বেরিয়ে মাথার টুপিটা খুলে পকেটে পুরে, জুতা পড়ে নিল সে। উদাসীন দৃষ্টিতে হেঁটে যাচ্ছিল দূর্বল পদে।
“হিমান্ত!”
পরিচিত কন্ঠস্বরও আজকাল অপরিচিত হয়ে গেছে হিমান্তের কাছে। পিছু ডাক শুনে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা জাগলো না থামার। একইভাবে হেঁটে চলছে সে। মেয়েলি কন্ঠের ডাকটা পুনরায় শুনতে পেল। তবুও থামল না হিমান্ত। দ্রুততার সাথে সম্মুখে এসে পথ আগলে দাঁড়ালো সেই মেয়েলি কন্ঠের রমণীটি। চোখে, মুখে তার বিস্তর ক্ষোভের আভাস।
তীব্র স্বরে বললো,
“এতোটাই ঘৃণ্য তোমার কাছে আমি? একটিবার ফিরে তাকানোর বোধটুকুও কী হলো না তোমার হিমান্ত?”
“সরি আহানা! কী যেন হয়েছে আমার। সব শুনে বুঝেও নিরুত্তর হয়ে যাই। সবকিছুতেই বিতৃষ্ণা জেগেছে।” হিমান্ত উদাসীন দৃষ্টিতে চারপাশের চলন্ত গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলে,
“তারপর বলো। কেমন আছ? বাসার সবাই কেমন আছে?”
আহানার ক্ষোভ শীতের ঝরা পাতার মতো ঝরে পড়ে বিষন্নতার দমকা হাওয়ায়। আহানা স্থির চাহনীতে কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল তার বদলে যাওয়া ভালোবাসাকে। বয়সটা যেন এ’কমাসে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে হিমান্তের। মুখটা মলিন, চোখের নিচে কালি পড়ে বসে গেছে। মুখভর্তি চাপ দাঁড়িতে অবশ্য খারাপ লাগছে না। আহানা দৃষ্টি অনড় রেখেই বললো,
“তুমি কী এই মুহূর্তে ব্যস্ত?”
“খুব একটা না। কেন কিছু বলবে?”
“হ্যাঁ! তবে এই রোদফাটা আকাশের নিচে নয়। চলো ঐ রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি। যাবে তো?”
“কেন নয়? চলো।”
দু’জনে নিরবে ব্যস্ত রাস্তা ছেড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো। আহানা হাসিমুখে প্রশ্ন করে,
“কী খাবে বলো?”
“কিছুই না। আমি রোজা আজ।”
“তাহলে তোমাকে এখানে নিয়ে আসাটা অন্যায় হলো।” আহানার গলার স্বরে অপরাধী সুর। হিমান্ত পকেট থেকে মোবাইল বের করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
“ডোন্ট বি ফিল গিল্টি। কী বলতে চেয়েছিলে সেটাই বলো?”
“আমি ডিভোর্স নিতে চাচ্ছি আলভীর থেকে।”
হিমান্ত ভ্রুকুটি করে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে বললো,
“কারণটা কী আমি?”
“তা নয়? আবার তেমনই। ওর ধারণা আমি ওকে ভালোবাসি না। তাছাড়া তোমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করার দায় প্রতিনিয়ত আমাকে দিচ্ছে সে।”
“আমি যতোটুকু বুঝি,জানি ও তোমাকে অনেক ভালোবাসে। এতো ভালোবাসে যে তোমার চোখে এখনও আমার প্রতিচ্ছবি সহ্য করে ভালোবেসে যাচ্ছে। তুমি বলছ সম্পর্ক নষ্টের দায় তোমাকে দেয়? দায় দেয় না, তোমার মনে নিজের জায়গা না পেয়ে সামটাইমস আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
তুমি ভালোবাসো ওকে। মন উজার করে ভালোবাসো,দেখবে সেখানে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই পাবে না। ডিভোর্সের পথে হেঁটো না প্লীজ! আমি তো পথ হারিয়ে পথ পেয়েছি, আলভী পাবে না,তুমিও পাবে না।”
“এটাই কি তোমার মনের কথা?”
হিমান্ত বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আহানার দৃষ্টি পড়ে। মুচকি হেঁসে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ।”
“তুমি কী আমাকে একটুও চাও না আর হিমান্ত। হ্যাঁ মানছি আমার ভুল হয়েছে। আমার উচিত ছিল তোমাকে সাপোর্ট করা,তোমাকে,,, “আহানার কন্ঠস্বর কান্নায় জড়িয়ে যায়। হিমান্ত টিস্যু পেপার এগিয়ে দিয়ে বলে,
“শান্ত হও আহানা। যেটা অতীত সেটাকে অতীতেই রাখো। আমার বর্তমান আমার অতীতকে শুধু দুর্বিষহ স্মৃতি হিসেবেই ধারণ করে। এর বেশি নয়। তুমি ভালোভাবেই অবগত আছ আমার বর্তমান সম্পর্কে। সেখানে তুমি বা তোমার ছায়াও নেই।”
“প্লীজ হিমান্ত!”
“প্লীজ হোয়াট!আহানা? টেল মি? তুমি আবারও ভুল করছ। আমি বলছি, মাথা ঠান্ডা করে ভাবো একবার। যা চলে গেছে সেটাকে মনে এনো না আর। তাতে দুঃখ ছাড়া সুখ পাবে না। বর্তমানকে আঁকড়ে ধরো। অনেষ্ট হও সম্পর্কে। দেখবে সুখ, ভালোবাসা সবই খুঁজে পাবে। বিলিভ ইওর ডিসিশন। বিলিভ ইওরসেলফ।”
আহানা নত মাথায় নিরবে কাঁদছে। হিমান্তের অস্বস্তি হচ্ছে বসে থাকতে এভাবে। হালকা কেঁশে আবার বললো হিমান্ত,
“কেঁদো না আহানা। ভুল সবাই করে। আমিও করেছি তার চরম মূল্যও দিচ্ছি। তুমি এমনটা আর করো না। আলভী তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে। তুমিও চেষ্টা করো, ভরসা রাখো সব ঠিক হয়ে যাবে। আশা করবো এরপর যখন দেখা হবে তোমার মুখে প্রকৃত আনন্দটুকুই দেখতে পাব।”
আহানা চোখ মুছে হাসার চেষ্টা করে বলে,
“তুমি অনেক বদলে গেছ হিমান্ত। তবে দুঃখ এতোটুকুই তোমার বদলে যাওয়ার কারণ আমি নই অন্য কেউ।”
হিমান্ত প্রত্যুত্তর করলো না। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি টেনে ম্লান মুখে উঠে দাড়াতে চাইলে বাঁধা দিল আহানা। আহানা মুখ তুলে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
“চলে যাবে বুঝি?”
“হ্যাঁ, একটু পর ক্লাস আছে।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“করো।”
“মেয়েটাকে এতো কেন ভালোবাসো তুমি?”
আহানা লক্ষ্য করলো হিমান্তের ঠোঁটে চওড়া হাসি। হিমান্ত আহানার দিকে চেয়ে শীতল গলায় বললো
“সব প্রশ্নের জবাব থাকে না আহানা তবে হ্যাঁ তাকে ভালোবাসার কারণ সেই। তার অবনত দু’নয়ন, অক্ষির নেত্রপল্লবের অস্থির শিরা উপশিরা, সদা কম্পনশীল দু’ওষ্ঠ,অবগুন্ঠের আড়ালে তার লাজুক রাঙা বদনখানি আমাকে বাধ্য করেছে ভালোবাসতে। তুমি জানো আহানা, আমি একসময় ভাবতাম জীবন বুঝি যন্ত্রণার নাম। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে শঠতা করে করে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই তো খাঁটি মানুষের কদর করতে পারি নি।
তাকে তুমি ভেবে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু তাকে হারিয়ে বুঝেছি সে আর তুমি এক নও। আমার কাছে সে আমার চেয়েও আপন এবং ঘনিষ্ঠ। আত্মার আত্মীয় বুঝি একেই বলে তাই না আহানা?”
হিমান্তের চোখে মুখে মুগ্ধতার রেশ লক্ষ্য করে আহানা। ভেতরটা অতৃপ্তিতে রুক্ষ হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে অস্থির হয়ে যায়। শ্লেষ করে বলে,
“খুব ইবাদত করছ তাকে ফিরে পেতে?”
“ইবাদত তো এক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা। যখন সব হারিয়ে নিঃস্ব তখন তো তিনিই পাশে ছিলেন, ইনশাআল্লাহ থাকবেনও। তিনি চাইলে অবশ্যই আমার স্ত্রী, আমার ভালোবাসা ফিরবে, চিরতরের জন্য ফিরবে। তা হঠাৎ এ’কথা বললে কেন?”
“না মানে, তোমার কপালে কড়া পড়ে গেছে তো তাই বললাম।” হিমান্তের জবাবে আহানার মুখে ঘন আধার নামে। মুচকি হেঁসে উঠে দাঁড়ালো হিমান্ত। বললো,
“ওহ! এবার যে আমাকে যেতেই হবে আহানা৷ আসি তাহলে।”
“তোমাকে আঁটকে রাখার অধিকার কিংবা সাহস আজ আর নেই আমার। ভালো থেকো। তাকে ফিরে পাও সেই কামনায় করি।”
“যাজাকাল্লাহ! আল্লাহ তোমার কল্যাণ করুন। ভালো থেকো।” রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে আসে হিমান্ত। অপলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রয় আহানা। হিমান্তের বলে যাওয়া কথা বার বার মনে করে চোখের জল ছাড়ে সে।
ক্লাসে ঢোকার পূর্ব মুহূর্তে রেজওয়ান কল করে। হিমান্ত মোবাইল রিসিভ করে যা শোনে তাতে যারপরনাই খুশি হয় সে। ডিপার্টমেন্ট প্রধানের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে দ্রুত চলে আসে স্থানীয় থানায়। থানার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিল রায়হান,রেজওয়ান।
হিমান্ত এসে পৌঁছাতেই রেজওয়ান বললো,
“মিলি এসেছিল ওর এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। ওর ঐ বান্ধবী আমার ব্যবসা সূত্রে পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মেয়ে। গত মাসে গিয়েছিলাম ওদের বাসায় মনে আছে তোর?”
“হ্যাঁ! তারপর বল।” অস্থির শোনাল হিমান্তের গলার স্বর। শুধু কী গলার স্বর! অস্থিরতা তার বুকের বা’পাশেও।
রেজওয়ান বললো,
“ঐ বড় ভাই সকালে মোবাইল করে জানালো, মিলি নামে একজন তার মেয়ের সাথে দেখা করতে আসছে। তিনি গোপনে জেনেছিলেন বিষয়টা। শোনামাত্রই ছুটে যায় সেখানে। সিওর না হয়ে তোকে জানাতে চাই নি। মিলি আসার সাথে সাথেই এখানে নিয়ে এসেছি পুলিশের সহায়তায়।” রেজওয়ান এতোক্ষনে দম ছাড়ে। হিমান্ত থেমে যায়।
রেজওয়ানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“আমি ফিরে পাব তো আমার পংক্তিকে রেজওয়ান?”
“ইনশাআল্লাহ। ভরসা রাখ আল্লাহ তা’আলার উপর। চল ভেতরে চল।”
হিমান্ত গিয়ে দেখে লেডি কনস্টেবল জেরা করে যাচ্ছে মিলিকে। কুঁজো হয়ে ভীতু ভঙ্গিতে বসে আছে মিলি। একপর্যায়ে ধৈর্য্য হারা হয়ে সজোরে চপেটাঘাত করে কনস্টেবল মিলিকে। হিমান্ত থমক দিতে সরে দাঁড়ায় কনস্টেবল। হিমান্তকে দেখামাত্রই চট করে দাঁড়িয়ে পড়ে মিলি। ভয়ে তার সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গ কাঁপছে।
কিশোরগঞ্জ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের হাওর অঞ্চল নিকলি। বর্ষাকালে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি দেখে মুগ্ধ হবে না এমন মানুষ পাওয়া ভার। বাতাসের দোলনায় হাওরের জল দুলে দুলে ঢেউ তোলে। নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে আসে। মনের গহীনের ব্যথা বেদনা অনেকটা হালকায় হয় তাতে বুঝি। একটু পর সূর্য অস্তাচলগামী হবে। সকল কিছু উপেক্ষা করে সে দৃশ্য দেখতে জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে তাই মেয়েটি। পা ডুবিয়ে বসা মেয়েটাকে লক্ষ্য করে গান গেয়ে এগিয়ে এলো মৌসুম।
একটা ছিল সোনার কন্যা
মেঘ বরণ কেশ
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ
দুই চোখে তার আহারে কি মায়া
নদীর জলে পড়ল কন্যার ছায়া
হাত খালি… গলা খালি
কন্যার নাকে… নাকফুল
সেই ফুল পানিতে ফেইলা
কন্যা করল ভুল…
কন্যা ভুল করিস না
ও কন্যা ভুল করিস না
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলব না
“বাহ! তোমাকেই তো খুঁজছে বাংলাদেশ। গানের প্রতিযোগিতায় নাম লেখাচ্ছ না কেন বলতো? চমৎকার গানের গলা তোমার।” হাসি মুখে মজাচ্ছলে বললো মেয়েটা।
“আমার এ গান শুধু তোমারই জন্য। তোমারই জন্য, তোমারই জন্য পংক্তি।”
চোখ ছোট ছোট করে ভ্রুকুটি করে হাওরের জলে ডোবানো পা দু’টো উঠিয়ে মৌসুমের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। কটমট করে তাকিয়ে বলে,
“আমার সাথে এমন ফাতরামি করে কী মজা পাও তুমি? যাকে বলার তার সাথে তো ঝগড়া করেই গেলে।”
“যাকে বলার মানে কী? আমার সবকিছু তো তোমাকে ঘিরেই, আফটার অল আমার ক্রাশ তুমি।” এক চোখ টিপে হাসি চেঁপে বলে মৌসুম।
“আবার! নেহাৎ তুমি আমার বয়সে বড়, নয়তো মেরে তক্তা করে সোফা বানিয়ে মিলিকে গিফট করতাম৷ ফাজিল জানি একটা।”
পংক্তির রাগ দেখে মৌসুম হো হো শব্দে হেঁসে ওঠে। পংক্তির মাথায় গাট্টা মেরে বলে,
“তোরা দু’বোনই নীরস। একটা ঝগড়া করতে মুখিয়ে থাকে, আরেকটা গাল ফুলিয়ে। তোদের নিয়ে যতো জ্বালা আমার।”
“আমরা খুব জ্বালায় তোমাকে তাই না?”পংক্তির বিমর্ষ হওয়া মুখ দেখে কপাল চাপড়ায় মৌসুম। পংক্তির বাড়ন্ত পেটটা লক্ষ্য করে বলে,
“জগৎবিখ্যাত একখান মা পাবি রে তুই। এক লাইন সবসময়ই বেশি বোঝে তোর মা। আরে আমি করলাম মজা আর ও কিনা সিরিয়াসলি নিল। তোরা আমাকে আপনই ভাবিস না। আমি রেহেনা আন্টিকে গিয়ে এখনই বলছি।”
“মৌসুম দাঁড়াও।”
“কী!”
“সরি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। তুমি পর নও আমার কিংবা মিলির। সেদিন তুমি যদি না থাকতে,,,,!”
পংক্তির মুখের কথা কেড়ে নেয় মৌসুম। বিরক্ত স্বরে বলে,
“আবার সেই কথা। এক কথা বার বার শুনতে ভাললাগে না।”
“কিন্তু আমার বলতে ভালো লাগে। সেদিন মিলি সাহস করে আমাকে নিয়ে পালিয়ে এলো। আঘাতে আঘাতে দূর্বল আমি। এক কদম হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছিল। কোথায় যাব দ্বিধান্বিত যখন তখন তুমি সামনে এলে। সেই রাতে ঐ রাস্তায় তোমাকে পেয়ে আমি বাকরুদ্ধ ছিলাম। তুমি আমার অবস্থা টের পেয়ে নিয়ে এলে রেহেনা আন্টির বাসায়।
রেহেনা আন্টি তোমার খালামনি হয় সেদিনই জানলাম। তারপর সব পেছনে ফেলে চলে এলাম এই ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের নিকলিতে। প্রকৃতির ছায়া সুনিবিড় জলের তীরে কোলে কেটে গেল ছয় মাস। সুস্থ হলাম আমি। এখন নিত্যদিন কাটে আমার অনাগত সন্তানের পথচেয়ে।” পেটে উপর হাত রাখতেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পংক্তির বিমর্ষ মুখখানা।
“তোমার কিন্তু উচিত ছিল হিমান্তের কাছে ফিরে যাওয়া।”
“না!”তীব্র অভিমান পংক্তির কন্ঠস্বরে।
“কেন এই চোর,পুলিশ খেলা তোমাদের? তোমার অভিমানে ভুগবে তোমার অনাগত সন্তান। এটা কী সঠিক হবে? আমি সেদিনও বলেছিলাম আজও বলব ফিরে যাও তোমার ভালোবাসার কাছে।”
পংক্তি জবাব দিল না। নিকলি বেড়িবাঁধের সম্মুখের হাওরের অথৈ জলে দৃষ্টি নিবদ্ধ তার। মৌসুম জানে পংক্তি এ বিষয়ে আর একটি কথাও বলবে না। মনে মনে রাগ হয় মৌসুমের পংক্তির জেদ দেখে। মৌসুম ফের বললো,
“এতো জেদ ভালো নয় পংক্তি।”
“তুমি কিছুই বুঝবে না মৌসুম। আমি তাকে ছাড়া কিভাবে বেঁচে আছি তা শুধু আমিই জানি। আমার আত্মসম্মানবোধ আমাকে তার থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। সে কেন এলো না সেদিনগুলতে? কেন খোঁজ নিল না আমার? কি মূল্য আমার তার কাছে? অনুগ্রহ নয়, তার ভালোবাসার আবেশে জড়িয়ে সম্মানের সাথে থাকতে চাই আমি৷ যেদিন এমনটা হবে সেদিনই ফিরব।” পংক্তি মনে মনে কথাগুলো বললেও বাহ্যিকভাবে তাকে নিরুত্তর পেল মৌসুম। রাগে মুখ শক্ত করে চলে যেতে উদ্যত হলে পংক্তি পিছু ডাকে।
“মিলিকে বলে দাও তোমার মনের কথা। আমার বোন তো? দেরি করলে হারাবে কিন্তু।”
মৌসুম জবাব দেবে তখনই অদূরে বাইকের শব্দ শুনে থেমে যায়। ঘুরে দু’জনে আগত বাইকটার দিকে তাকিয়ে চোখাচোখি করে। বেশখানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে যায় বাইকটা। বাইকার ব্যক্তিটি কালো হেলমেট পরিহিত থাকায় চেহারা দেখা যাচ্ছে না৷ বাইকারের পেছন থেকে মিলিকে নামতে দেখে চক্ষু চড়কগাছ দু’জনের। মৌসুম রেগে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যায় মিলি দিকে।
“যাও চুপচাপ এগিয়ে যাও।” বাইকারের গম্ভীর গলার স্বরে মিলিকে বেশ ঘাবড়ানো মনে হলো। বিনাবাক্য ব্যয়ে চুপচাপ সামনে এগোতে লাগলো সে। মৌসুম মিলির কাছে এসে বাইকের উপর সোজা এবং স্থির বসে থাকা পুরুষটার দিকে তাকায়। আপাদমস্তক কালো প্যান্ট, কালো ব্লেজারে এবং হেলমেটে ঢাকা ব্যক্তিটি। মৌসুম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে মিলিকে প্রশ্ন করে,
“কে লোকটা?”
“দুলা-ভা-ই”মিলির কথা শেষ হতেই মৌসুম চট করে ঠোঁট বসিয়ে দিল মিলির ঠোঁটের উপর। এমনিতেই ভয়ে,আতঙ্কে প্রাণ ওষ্ঠাগত মিলির। তারউপর মৌসুমের আচমকা এমন আচরনে চমকে জ্ঞান হারানোর অবস্থা তার। ভাগ্যিস সময়মতো মৌসুম দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে।
“এই মিলি?”মিলির গালে মৃদু আঘাত করে ডাকতে থাকে মৌসুম। বেচারির সব বুঝে উঠতে একটু সময়ই লাগলো। মৌসুমকে ধাক্কা মেরে দূরে ঠেলে রেগে বললো,
“এমন করলেন কেন?”
“দুলাভাই বললে কেন? আমি কী তোমার দুলাভাই? আমি তো তোমার হবু বর।”
“বলদ একটা! আপনাকে কে দুলাভাই বলছে?”ঝাঁঝালো জবাব মিলির।
“তাহলে?”
“তাহলে আপনার মাথা। ঐদিকে তাকান একবার।” মৌসুম ফিরে তাকিয়ে বড়সড় রকমের শকড হলো। হেলমেট খুলে ধীরে ধীরে বাইক ছেড়ে নামতে দেখলো হিমান্তকে সে। পংক্তির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে হিমান্ত। মৌসুম পংক্তিকে ডেকে সেটা বলবে সে অবস্থাও তার নেই। শকড এমনই লেগেছে যে কথা বন্ধ তার। শুধু দেখেই যাচ্ছে।
মৌসুম মিলিকে চুমু দিতেই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল পংক্তি।
তার চোখে সেই রাতের স্মৃতি ভাসছে। এমনই করে সেও একদিন চুমু দিয়েছিল তার মানুষটাকে। বিনিময়ে প্রত্যাখ্যানেই পেয়েছিল। অভিমানে চোখের জল পড়ে পংক্তির।
“আমি যে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি। কোথায় আপনি? কেন খুঁজে নিচ্ছেন না? কেন এই অভিমানের করাতকলে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া আমাকে বাঁচাতে আসছেন না? কেন? কেন?”
চারপাশে অথৈ জল আর মাঝের এক টুকরো সরু রাস্তায় পংক্তি দাঁড়িয়ে আছে। জলের ছোট বড় ঢেউ এসে আছরে পড়ছে বাঁধের কিনারে। ঢেউয়ের তালে দূরে ভেসে যাচ্ছে নৌকা,ট্রলার। আকাশে নীড়ে ফেরা পাখিদের ঝাঁক। পংক্তি কবে ঘরে ফিরবে? তার চিরচেনা আপন ঘরে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পংক্তি। সূর্য ডুবে গেছে।
অন্ধকার নামবে নামবে করেও নামছে না,কারণ তখনও বিদ্যমান সাঁঝের আকাশে রাঙা গোধূলি। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য কয়েকগুন বেড়েছে এই রাঙা আলোয়। পংক্তি নিকটে আগত পদধ্বনি শুনে ঘাড় ফিরায়। ফ্যাকাশে মুখে, বিস্ফোরিত নয়নে দেখছে সম্মুখে দাঁড়ানো চেনা মানুষটাকে।
কতো পরিবর্তন হয়েছে মানুষটার। আভিজাত্য মাখা মুখটায় মলিনতা। গলা শুকিয়ে আসছে মানুষটার দৃষ্টির তপ্ততায়। মানুষটার অশ্রুসজল চোখদুটো রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে। যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। পংক্তি দৃষ্টি নামাতেই গেলেই নির্দয় ভাবে চেপে ধরে মানুষটা পংক্তির গাল। মাথা নাড়িয়ে বোঝায়,”দৃষ্টি নামাবে না।”
পংক্তি পারছে না ঐ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে। তার ক্রমশ ভারী হওয়া নেত্র পল্লব ঝুঁকতে মরিয়া। কিন্তু কোনোমতেই সেটা হতে দিচ্ছে না মানুষটা। পংক্তি গালের অস্তিত্ব হারিয়ে বসেছে। ব্যথায় অঝোরে চোখ ফেটে জল গড়াচ্ছে তার। অস্ফুট স্বরে বলতে বাধ্য হয় তাই,
“ব্যথা পাচ্ছি ছাড়ুন।”
গাল ছাড়লেও পংক্তিকে এক ঝটকায় শক্ত বাহুবন্ধনে বেঁধে নিল হিমান্ত। পংক্তির দু’গালে পাগলের মতো চুম্বন করে বলতে থাকে,
“ভালোবাসি প্রিয়তমা আমার। ভালোবাসার অধিক কিছু থেকে থাকলে সেটাও তোমার জন্য।”
পংক্তির কপালে কপাল ঠেকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে হিমান্ত। অনেকক্ষণ পরস্পরের শ্বাস,প্রশ্বাস অনুভব করে দুজন। উভয়ের চোখের জল আজ মিলেমিশে একাকার। সেই মিলনের জলে রাগ, অভিমান গেল ধুয়ে। আঁধার নামছে আগত সকালের প্রত্যাশায়।
সুন্দর সকাল!
সভয়ে হিমান্তের হাতটা নিজে গাল থেকে নিয়ে বাড়ন্ত পেটটার উপর রাখে পংক্তি। হিমান্ত চমকে দু’কদম পিছিয়ে সরে যায়। এতোবড় প্রাপ্তিতে তার হাঁ হওয়া মুখটা দু’হাতে ঢেকে আনন্দে দিশেহারা হয়। স্ত্রী,সন্তান প্রাপ্তিতে আনন্দে আত্মহারা সে। কী বলবে, কী করবে ভেবে পায় না।
এগিয়ে এসে হাঁটু মুড়ে বসে পংক্তির পেটে কপাল ঠেকিয়ে বলে,
“আমার সৃষ্টিকর্তা সাক্ষী। আজ তুমিও জেনে রাখো। চোখের তারায় তোমাদের বসিয়ে রাখব আমি। দেখি কী করে পালিয়ে যায় তোমার মা আবার?”
হিমান্ত মুখ তুলে পংক্তির অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার শাস্তি কী আরও বাকি আছে?”
“হ্যাঁ! যাবজ্জীবন আমাকে বাহুবন্ধনের শক্ত বাঁধনে বেঁধে রাখার শাস্তি বাকি।” নাক ফুলিয়ে দু’হাত বাড়ায় পংক্তি।
হিমান্ত উঠে দাঁড়িয়ে একহাতে পংক্তির মাথাটা বুকের উপর নিয়ে অন্যহাতে পংক্তিকে নিজের সাথে বেঁধে নেয়। দু’হাতে হিমান্তের বুকের ব্লেজার খামচে ধরে, পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে লাজুক রাঙা হয় পংক্তি। তার দোয়া অবশেষে কবুল হয়েছে। সে আর হিমান্ত এক হয়েছে। পংক্তির লজ্জা রাঙা মুখটায় গাঢ় চুম্বন করে হিমান্ত।
মুচকি হেঁসে বলে,
“শাস্তি মঞ্জুর হলো মিসেস হিমান্ত। এই অপরাধী অপরাধ কবুল করল নিজেকে তোমায় দিয়ে। চিরজীবন তোমাকে, শুধু তোমাকে ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা করে।”
লেখা – তানিশ শেখ
সমাপ্ত
(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “সাঁঝের বেলার রাঙা গোধূলি – Ekta bhalobasar golpo story” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)
আরো পড়ূন – সাঁঝের বেলার রাঙা গোধূলি (১ম খণ্ড) – Ekta bhalobasar golpo story