অতঃপর প্রণয় (শেষ খণ্ড) – Premer golpo kahini

অতঃপর প্রণয় (শেষ খণ্ড) – Premer golpo kahini: ইরিনের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এইমানুষটা এমন কেন? সারারাত রাস্তায় জেগে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে অথচ ভালোভাবে দুটো কথা বলতে তার যত অসুবিধে। রাগে গটগট করে হোস্টেলের দিকে ফিরে গেলো সে


পর্ব ১৩

ইত্তি আর মিতু এতক্ষনযাবত ইরিনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। কথা ছিলো আয়াজ হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসবে ইরিনকে। কিন্তু সে মত পাল্টে ফেলেছে। ইরিন টুঁ শব্দটিও করলো না। শ্বশুর শাশুড়ি, মা বাবাসহ বাড়ির বড়দের সালাম করে ইত্তিদের সাথে বেরোনো জন্য তৈরী হয়ে নিলো। আয়াজ সোফায় বসে তুতুরী সাথে দুষ্টুমি করছে। ইরিন সদর দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় শুধু বলল,
~ আসি।
আয়াজ একবার তাকিয়ে আবার তুতুরীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইত্তি টেনশনে পড়ে গেছে। ইরিন রেগে আছে কি না সে বুঝতে পারছে না। মিতুকে ইশারা করলো সে।

মিতু যেহেতু একটা মেয়ে এইমুহূর্তে আরেকটা মেয়ের মনের অবস্থা সে নিশ্চই বুঝতে পারবে। মিতু তাকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলো সে কনফিউজড। ইত্তি বাসার নিচে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,
~ তুই ঠিক আছিস?
ইরিন জবাব দিলো না। পূর্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। ইত্তি আবার জিজ্ঞাসা করলো,
~ ইরিন?
ইরিন গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলল,
~ আমি ঠিক আছি ইত্তি।

হেলাল সাহেবের গাড়িতে করে ওদের যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। আয়াজের বড় ভাই মহসিন যাচ্ছে তাদের সাথে। তিনি এখনো নামেন নি, তাই ওরা অপেক্ষা করছে।
দশমিনিটের মাথায় মহসিন নেমে এলো। ইরিন দীর্ঘশ্বাস চেপে বিড়বিড় করে বলল,
~ আমি আর আসবো না মিআয়াজ। আপনি আমার পা ধরে মাফ চাইলেও আমি আসবো না।
বস্তুত ইরিনের মনের অবস্থা হচ্ছে আয়াজ যদি এইমুহূর্তেও এসে তাকে বলে হোস্টেলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই সে অতিউৎসাহের সহিত গাড়ি থেমে নেমে যাবে। কিন্তু আয়াজ আসে নি। ইরিন হতাশভাবে হোস্টেলে ফিরে এলো।

বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আয়াজের ঘুম আসছে না। অনেক্ষন যাবত বারান্দায় বসে আছে সে। ইরিন চলে যাওয়ার পর থেকেই ফাঁকা ফাঁকা অনুভূরি হচ্ছে তার। হঠাৎ করে কেন এমন হচ্ছে? অনেকদিন যাবত ইরিনের ওপর রাগ করে ছিলো সে। কিন্তু কখনো এমন অনুভূতি হয় নি। এখন কেন এমন হচ্ছে? ইরিনকে ভীষণ ভাবে মিস করছে সে। ভীষণ, ভীষণ, ভীষণভাবে।

ইরিনকে কি একটা ফোন করবে সে? ইরিন ধরবে? ধরবে না। নিশ্চই তার ওপর রেগে আছে।
দ্রুত গায়ে শার্ট চড়িয়ে নিলো আয়াজ। এইমুহূর্তে ইরিনকে তার সামনে চাই। কেন চাই? কি কারনে চাই? সে কিচ্ছু জানে না। কিন্তু চাই। গাড়ির চাবি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো সে। তাদের এপার্টমেন্টের দারোয়ান মোতালেব হোসেনকে ঘুম থেকে টেনে তুলে গেট খোলার ব্যবস্থা করলো।

ইরিনের হোস্টেলের সামনে এসে ইরিনের নাম্বারে ডায়াল করলো। ইরিন ফোন সাইলেন্ট করেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি ঘুম চলে এসেছে তার। ফলাফল
স্বরূপ ফোন ধরতে পারলো না। আয়াজ গেটের নিচে দাঁড়িয়ে বারবার ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছে, রিং হচ্ছে কিন্তু ইরিন ফোন ধরছে না। ইরিন কি তাহলে ঘুমিয়ে পড়েছে? অস্থির ভাবে এদিক ওদিক পায়চারি করছে সে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ইরিনের সাথে দেখা হচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত শান্তি পাবে না সে।

ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো ইরিনের। বিছানা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। কফি তে চুমুক দিয়ে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। সে ঠিক করেছে আজকের পরীক্ষাটা সে দেবে না। কফি খেতে খেতে ঠান্ডা বাতাসে নিজেকে সিক্ত করার অনুভূতি নিচ্ছে সে। হোস্টেলের রাস্তায় চোখ পড়তেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেলো।

নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভালো করে লক্ষ্য করলো। মানুষটা এদিক ওদিক হাঁটাহাটি করছে। কাছেই গাড়ি পার্ক করা। কপালে হাত রেখে কিছুক্ষন চিন্তা করলো ইরিন। ঘটনার আগাগোড়া কিছুই বুঝত পারছে না। দ্রুত রুমে ঢুকে ফোন চেক করলো সে। সাতটা মিসড কল উঠে আছে। প্রথমটা রাত তিনটায়। তারপরেরটা তিনটা দুই, তারপর তিনটা চার, তিনটা সাত। সবশেষে পৌনে চারটায়। ইরিনের বুক ধড়ফড় করছে। আয়াজের নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়ে কেটে দিলো। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে নিচে নেমে এলো। তখনও বাইরে আবছা অন্ধকার। গেটে দারোয়ান ঘুমাচ্ছে। ইরিন গেট খোলার জন্য অনুনয় বিনয় করলো। কিন্তু তিনি গেট খুলতে নারাজ। এত সকালে গেট খোলার পারমিশন নেই। ইরিনের প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা। মানুষটা নিশ্চই সারারাত এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো।

অবশেষে মর্নিং ওয়াকের অযুহাত দিয়ে গেট খুলতে সক্ষম হলো সে। দ্রুত পা চালিয়ে গাড়ির কাছে গেলো সে। আয়াজ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরিনকে দেখে হতবম্ভ হয়ে গেলো। আগুনলাল চোখজোড়ায় ঢুলুঢুলু ভাব। অপ্রস্তুত ভাবে হাসলো। দুজনের কেউই কোন কথা বলতে পারলো না। তবে এইমুহূর্তে আয়াজের শান্তি লাগছে। আবছা আলোতে ইরিনকে ভীষন সুন্দর লাগছে। আলতো করে তার গালটা টেনে দিতে ইচ্ছে করছে।
নিরবতা ভেঙে আয়াজ বলল,
~ তুই কি আজকে পরীক্ষা দিবি?

~ হ্যাঁ।
~ প্রিপারেশন আছে?
~ না। এখন গিয়ে পড়বো।
~ না দিলে হয় না?

আয়াজের আকুতিভরা চাহনি ইরিনের একেবারে কলিজায় গিয়ে লেগেছে। নিজেকে সংযত করে বলল,
~ না হয় না।
~ আমার ওপর রাগ বলছিস?
~ না।
~ তবে?

~ তবে আর কি? পরীক্ষা যখন দিতেই হবে শুধু শুধু পিছিয়ে লাভ কি?
আয়াজ নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কেন এতরাতে ইরিনের হোস্টেলে ছুটে এসেছে, কেন সারারাত জেগে হোস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো এই নিয়ে একটা প্রশ্নও করলো না ইরিন তাকে। বলল,
~ আপনি কি কিছু বলবেন?

~ কেন?
~ আমি পড়তে বসবো।
~ তুই সিউর পরীক্ষা দিবি?
~ তাই তো বললাম।
~ ঠিক আছে যা।

ইরিনের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। এইমানুষটা এমন কেন? সারারাত রাস্তায় জেগে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে অথচ ভালোভাবে দুটো কথা বলতে তার যত অসুবিধে। রাগে গটগট করে হোস্টেলের দিকে ফিরে গেলো সে। আয়াজ মূর্তির মত তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিন অদৃশ্য হতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। ইরিনের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অশ্রুবিসর্জনটাও অদেখাই থেকে গেলো তার। অথচ সে দিব্যি হাসছে।

পরীক্ষা কি দিয়েছে ইরিন নিজেও জানে না। উইদাউট প্রিপারেশন পরীক্ষা দিয়েছে সে। নির্ঘাত ফেল করবে। পরীক্ষা শেষে, সে আর ইত্তি একসাথে বেরোচ্ছিলো গেটে আয়াজকে দাঁড়ানো দেখে ইত্তি সটকে পড়লো। ইরিন একবার ভাবলো দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাবে। কিন্তু পরোক্ষনেই মত পরিবর্তন করে ফেললো। আয়াজ কেন এসেছে তার জানা দরকার! আয়াজের কাছে এগিয়ে যেতেই আয়াজ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
~ এক্সাম কেমন হয়েছে?
~ ভালো না।

~ জানতাম আমি। শুধুশুধু আমাকে আবার আসতে হলো।
~ আপনার উদ্দেশ্য কি?
ইরিনের কড়া জিজ্ঞাসাবাদ। আয়াজ মৃদু হেসে বলল,
~ তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে।
~ বলুন।

~ এখানে না বাসায়।
~ আমি বাসায় যাবো না।
~ ইরিন প্লিজ! তোকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করার মত শক্তি আমার গায়ে নেই। বিশ্বাস কর, একফোঁটাও নেই। সোনা, বাবু, ময়না, আমি তোকে বিনীত ভাবে অনুরোধ করছি তুই প্লিজ গাড়িতে উঠে বস।

ইরিন দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। আয়াজ এমন সিরিয়াস মুহূর্তে তার সাথে মশকরা করছে? দরকার নেই ইরিনের! আর কিচ্ছু শোনার দরকার নেই।
আয়াজ দ্রুত সামনে এসে দাঁড়ালো। ইরিনের হাত ধরে টেনে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বলল,
~ সত্যি ইরিন বিশ্বাস কর, সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে আমার খুব কষ্ট হয়েছে।
~ আপনি শুধু শুধু তামাসা করছিলেন কেন?
~ তুই বাসায় যাবি না বললি কেন?

আয়াজ গাড়ি স্টার্ট দিলো। সারারাস্তায় ইরিন একটা কথাও বলে নি। চুপচাপ বসে ছিলো। বাসায় পৌঁছাতে সোহেলি বেগম আয়াজ আর ইরিনকে দেখে চমকে উঠলেন। ইরিনের হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে গেলেন। ফিসফিস করে বললেন,
~ ঘটনা কি?

ইরিন কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। আয়াজ ফ্রেশ হয়ে মায়ের ঘরে এলো। ইরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
~ রুমে আয়। তোর সাথে কথা আছে।
ইরিন শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকালো। তিনি ইশারায় যেতে বললেন। আয়াজের পিছু পিছু রুমে ঢুকলো সে। আয়াজ আবারও ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দিলো। বেরিয়ে এসে দেখলো ইরিন খাটের ওপর বসে পা দোলাচ্ছে। চেয়ার টেনে ইরিনের মুখোমুখি বসলো। সে তাকাতেই ইরিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

~ এই হরিণ তাকা আমার দিকে। তাকা না?
ইরিন আগের মত বসে রইলো।
~ তোকে হরিণ কেন ডাকি জানিস?

ইরিনের কোন নড়চড় নেই। আয়াজ নিজে নিজেই বলল,
~ তোর চোখদুটো হরিণের চোখের মত মায়াবী তাই।
ইরিনের হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে, তীব্রগতিতে লাফাচ্ছে। তবুও জবাব দিলো না সে। আয়াজ ওর হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
~ আমি তোকে সেই ছোটবেলা থেকে ভালোবাসি।

ইরিন অবাক চোখে আয়াজের দিকে তাকালো। আয়াজ জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
~ তোর মনে আছে প্রথমবার সবাই মিলে যখন আমাদের দুজনের বিয়ে ঠিক করেছিলো? তখন আমি টুয়েলভ এ ছিলাম। সারাদিন তোর সাথে ঝগড়া? বড়আপু যখন আমাকে ফিসফিস করে জানালো মা আমাদের বিয়ে দিতে চাইছেন তখন আমি কিন্তু মনে মনে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম তুই না করে দিবি। তাই আমিও না করে দিয়েছিলাম।

ইরিন অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছে। আয়াজ বলল,
~ তারপর তোর এইচ এসসি পরীক্ষার আগে বাবা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি আছে কি না তখন কিন্তু আমি আর না করি নি। তবে আমার ইচ্ছে ছিলো তোর পড়ালেখা যখন মোটামুটি শেষের পর্যায়ে আসবে তখন বিয়েটা হবে। কিন্তু তোর পাগলামির জন্য হুট করে আমাকে ডিসিশন চেইঞ্জ করতে হলো। এবার আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিবি তুই?
~ কী?

~ তুই আমাকে ভালোবাসিস?
ইরিন মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
~ কখনো না।

আয়াজ হাসলো। ইরিনের খোঁপা করা চুল গুলো টেনে দিয়ে বলল,
~ ইশস! কখনো না! বললেই হলো? কালতে রাতে তুই মায়ের সামনে কি বলেছিলি মনে আছে?
~ ভুল বলেছি। একদম ভুল।

~ -হুম। আর?
~ আর মানে?
~ আচ্ছা যা, বিশ্বাস করে নিলাম। তুই রাগিস না।
~ আপনি আর কিছু বলবেন?

~ -হুম। আমি বুঝতে পেরেছি বিয়ের পর সত্যি মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে থাকা উচিৎ। স্বামীর সেবা করা উচিৎ। সেই হিসেবে তোরও তোর শ্বশুর বাড়িতে থাকার অধিকার আছে।
ইরিনের মাথায় আসছে না আয়াজ হঠাৎ মত পরিবর্তন করলো কেন? গতকাল রাতে সে নিজেই ইরিনের থাকা নিয়ে তুলকালাম বাধিয়েছে অথচ আজকেই মত পরিবর্তন করে ফেলেছে? রহস্যটা কি?

আয়াজ বলল,
~ তবে আমার একটা শর্ত আছে। তুই যদি আমাকে কথা দিস, পড়াশোনা ঠিকমত করবি তাহলে হোস্টেলে থাকার দরকার নেই। বাসায় থাকতে পারবি। কারণ আমি আন্টিকে কথা দিয়েছি তোর পড়াশোনা শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেবো না। এবার তুই বল, তোর কি মতামত? বাসায় যদি থাকতে চাস তাহলে পড়াশোনায় কোন ফাঁকিবাজি করা যাবে না। মন দিয়ে পড়াশোনা শেষ করতে হবে। যতদিন আমি আছি সকালে দিয়ে আসবো। ছুটির সময় নিয়ে আসবো।
~ ঠিক আছে।

~ তবে নেক্সট উইক থেকে আমি কিন্তু ঢাকায় থাকছি না।
আজকে সকালেই খবরটা পেয়েছে আয়াজ। সরকারি হাসপাতালে চাকরী হয়ে গেছে তার। তবে পোস্টিং হয়েছে ঢাকার বাইরে।
~ কোথায় যাবেন আপনি?

~ আমার পোস্টিং ঢাকার বাইরে পড়েছে। যশোরে। তোর সমস্যা হবে না। তুই বাবার সাথে কলেজে আসা যাওয়া করবি।
ইরিন জবাব দিলো না। মৌনমুখে বসে রইলো। আয়াজ মুচকি হেসে বলল,
~ ভালো হয়েছে না? আমি চলে গেলে শান্তিতে থাকতে পারবি।
~ কবে যাবেন?
~ নেক্সট উইক।
~ ভালো।

আয়াজ হঠাৎ লম্বা হয়ে ইরিনের পাশে খাটে শুয়ে পড়লো। ইরিনের হাতটা টেনে বুকের ওপর রেখে বলল,
~ অনেক ভালোবাসার কথা বলে ফেলেছি। এবার তুই একটু ভালোবাসা দেখা। স্বামীর সেবা কর। সারারাত তোর জন্য মশার কামড় খেয়েছি। মহিলা হোস্টেলের মশাগুলো কম করে হলেও আমার লিটার খানেক রক্ত খেয়েছে। দুর্বল হয়ে গেছি আমি। এবার তুই সেবা করে সুস্থ কর।
আয়াজ চোখ বন্ধ করে ইরিনের কোমর জড়িয়ে ধরলো। ইরিনের আবার বুক ধড়ফড় করছে। সারা শরীরঝিমঝিম করছে। আয়াজ চোখ বন্ধ করেই বলল,
~ হরিণ? কি ভাবছিস তুই?

ইরিনের হঠাৎ রেশমার কথা মনে পড়ে গেলো। কৌতুহল বশতই জিজ্ঞেস করলো,
~ রেশমার সাথে আপনার কি সম্পর্ক? আপনি যদি আমাকেই ভালোবাসেন তাহলে রেশমাকে বিয়ে করবেন বলেছেন কেন?
~ এত ঘটনা ঘটে গেলো তুই এখন রেশমাআপুকে নিয়ে পড়ে রইলি?

~ কথা ঘোরাচ্ছেন কেন? রেশমা আবার আপনার আপু হলো কবে থেকে?
~ উনি আমার সিনিয়র। আমার রাগ উঠে গিয়েছিলো তোর ওপর। তাই রাগ করে বলেছিলাম।
~ রেশমার কথাই কেন বলেছিলেন?

~ কারণ রেশমা আপুর একটা ছেলে আছে। আমি জানি তুই পরে আমাকে প্রশ্নটা করবি। তাই ভেবেচিন্তা উনার নামই বলেছি। তুই তো আবার ঝগড়ুটে!
~ মিথ্যে বলার আর জায়গা পান না তাইনা? ঐ মেয়েকে দেখলে কেউ বলবে না তার ছেলে আছে।
আয়াজ তাল মিলিয়ে বলল,
~ ঠিক বলেছিস। হট না?

ইরিন সরু চোখে আয়াজের দিকে তাকালো। আয়াজ চোখ বন্ধ রেখেই হাসছে। দুম করে আয়াজের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো সে। রাগে চোখমুখ লাল করে ফেললো। তাকে কষ্ট দিয়ে কি শান্তি পায় আয়াজ? আয়াজের চুল গুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে ইচ্ছেমত টানলো। আয়াজ তখনো হাসছে।
~ এত জোরে টানছিস কেন? ব্যথা পাই তো।

ইরিন চুল টানাটানির পরিমান বাড়িয়ে দিয়ে আবারও কৈফিয়ত নেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
~ আমি কি আরাম পাওয়ার জন্য টানছি? কি বলেছেন আপনি? রেশমা, হট না? খুব হট?
~ ইরিন লাগছে। টাক বানিয়ে ফেলবি নাকি?
~ হ্যাঁ ফেলবো।

~ এই যে তুই বউদের মত আচরণ শুরু করে দিলি। বিয়ে হয়ে গেছে বলে ভাবিস না আমি তোর সাথে মারামারি করবো না? ছাড় বলছি! আমি ধরলে কিন্তু রেহাই নেই। পরে আমার দোষ দিতে পারবি না।
ইরিন আয়াজের গায়ের ওপর উঠে গেছে।

ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
~ কি বললেন আপনি? নিজে দোষ করে আবার আমাকে মারবেন বলছেন? মারবেন আমাকে?
~ না। চুমু খাবো। আয় চুমু খাই! যদিও সকালে ব্রাশ করি নি ব্যাপার না। আমি নিশ্চিত এলাচির সুঘ্রাণ পাবি।
টেনে নিজের চুল থেকে ইরিনের হাত দুটো সরিয়ে নিলো আয়াজ। দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
~ লেট’স স্টার্ট?

ইরিন নাকমুখ বিকৃত করে বলল,
~ আপনি একটা খাটাস। আমার বোধশক্তি থাকতে এই জীবনেও কোনদিন আমি আপনাকে চুমু খাবো না।
~ খাবি না?

~ জীবনেও না।
~ ঠিক আছে, আমি আয়াজ রহমান শপথ করে বলছি তোকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বানিয়ে হলেও আমি চুমু খাবোই খাবো। ব্রাশ না করেই খাবো। আহা! কি সুন্দর এলাচির সুঘ্রাণ! তুই একবার চুমু খেয়েই দেখ না।

ইরিনের বমি আসছে। আয়াজের রুচিবোধ এত জঘন্য কেন? ওয়াক! থু!
আয়াজ আবারও ভিলেনটাইপ হাসি দিয়ে বলল,
~ ইরিন? জাস্ট একটা।

আয়াজের রীতিমত তার হাতদুটো নিজের হাতের বাধনে আটকে ফেলেছে। ইরিন অবস্থা কাঁদোকাঁদো। তার এমন অবস্থা দেখে আয়াজের দম ফেটে হাসি আসছে। ইরিন পা দুটো এলোমেলো ছুঁড়ে সতর্ক করে বলল,
~ আমি কিন্তু সবাইকে বলে দেবো? খবরদার না। আঁআঁআঁআঁ!
আয়াজ তাকে আধশোয়া করে ফেলেছে। ইরিন কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
~ আপনি প্লিজ ব্রাশ করে আসুন।

~ তুই কোন দেশের হেলথ মিনিস্টার, তোকে চুমু খেতে আমার ব্রাশ করা লাগবে?
আয়াজ আলগোছে একটা চুমু খেয়েই নিলো ইরিনের ঠোঁটে। তারপর মুচকি হেসে ইরিনের ইরিনের হাতদুটো ছেড়ে দিলো। সাথে সাথেই ইরিন হামলে পড়লো তার ওপর। এলোপাথাড়ি কিল দিয়ে বলল,
~ খবিশ লোক! আমি এখন আপনার গায়ে বমি করবো। করবই করবো।

সোহেলি এসেছিলেন নাস্তার জন্য ডাকতে। রুমে ঢুকে এদের দুজনের অবস্থা দেখে তার চোখ কপালে উঠে গেলো। এসব কি হচ্ছে? বিছানার বালিশ নিচে পড়ে আছে। চাদরের অবস্থা এলোমেলো। এদের কি বিয়ের পরেও কোন কান্ডজ্ঞান হয় নি? এসব ছেলেমানুষি করছে কেন? তাঁকে দেখে দুজনেই ভদ্র হয়ে বসেছে। সোহেলি ধমকে উঠে বললেন,
~ এসব কি আয়াজ?

আয়াজ সুবোধ বালকের মত বলল,
~ আমি কিছু জানি না মা। হরিণকে জিজ্ঞেস করো।
ইরিন রাগে ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে সোহেলি বেগমের সামনেই থাবড়া মেরে আয়াজের নাক ফাটিয়ে দিতে। বদ লোক! কি সুন্দর তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে। সোহেলি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ওদের দুজনকে ডাইনিং টেবিলে যাওয়ার কথা বলে গেলেন। তিনি বেরিয়ে যেতেই শুরু হলো পুনরায় মারামারি, কাটাকাটি।

পর্ব ১৪

আয়াজের জয়েনিং এর বাকি আর মাত্র চারদিন আছে। পরশু যশোর যাবে সে। এদিকে আজকে তাদের ব্যাচ থেকে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। সবগুলো জুনিয়র ব্যাচকে ইন্টার্ন ডাক্তাররা সবাই ট্রিট দেবে। গ্র‍্যান্ড ফিস্ট! পুরো ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছে, কনসার্টও হবে, নামীদামী শিল্পিদের নিয়ে আসা হয়েছে, চারদিকে হৈচৈ পরিবেশ!

ইরিন জাম কালারের একটা শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে এসেছে, মাথায় ফুলের ক্রাউন! টুকটুকে সুন্দর লাগছে ওকে!
এসেই আয়াজকে খুঁজছে, কিন্তু তার দেখাই নেই! উনি যেখানেই যান হাওয়া হয়ে যান। তবে আয়াজ অবশ্য ইরিনের অলক্ষে চুপিচুপি এসে কয়েকবার ইরিনকে দেখে গেছে।

ইরিন সেল্ফি তুলছে, কোথা থেকে ইত্তি এসে হাজির। উঁচু হয়ে ইরিনের মাথার ওপর দিয়ে সেল্ফি পোজ দিলো। তারপর নিজের ফোন বের করে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে বলল,
~ তোর এত দেরী হলো কেন?

~ বলবো না।
ইরিন পার্লারে থেকে সেজে এসেছে। তাই তার দেরী হয়েছে। ইত্তি হাসলো, বেশ সুন্দরভাবে হাসলো। তারপর মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করলো,
~ তুই কি রেগে আছিস?
~ ছাগলের মত প্রশ্ন করছিস কেন?

~ ওকে মানুষের মত প্রশ্ন করছি, মিস তাসনিয়া ইরিন আপনি কি রেগে আছেন?
~ -মিস নয় মিসেস!
~ ওকে মিসেস তাসনিয়া ইরিন এবার বলুন আপনি রেগে আছেন কেন?
~ তুই আমার সেল্ফি গুলো সব নষ্ট করে দিয়েছিস! আমি একটা ছবিও আপলোড দিতে পারবো না এখন!
~ ওমা কেন?

~ তুই বুঝবি না। যা সর, খাম্বার মত সামনে দাঁড়িয়ে থাকিস না।
~ আমার সাথে দাঁড়ালে তোকে বাইট্টা দেখায় সেইজন্য?

~ ইত্তি আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
~ কুল, কুল, কুল! এত হাইপার হচ্ছিস কেন? আয় আরো কয়েকটা সেল্ফি তুলি? তোকে নিয়ে সেল্ফি তুললে আমি সেলিব্রেটি হয়ে যাবো, আফটার অল তুই ক্যাম্পাসের চার্মিং হিরোর বউ!
~ তোর গার্লফ্রেন্ড কই?

~ আমাকে তো বলল পাঁচমিনিটের ভেতর আসছে। তারপর থেকে ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে, এখনো আসার নামগন্ধ নেই, তোরা মেয়েরা কি যে এত সাজগোজ করিস আল্লাহই জানে!
~ কেন সাজলে কি সমস্যা? তোর হিংসে হয়? তুই সাজবি?

ইত্তি আবারও হাসলো, ইরিন চোখ সরিয়ে নিলো।
~ তুই আমাকে নিয়ে পড়েছিস কেন?
~ পড়বো! একশোবার পড়বো, আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই পড়বো, তুই একটা বলদ।
~ আমি বলদের মত কি করলাম?

~ বলদের মত কি করলি মানে? তুই তো বলদই! একেবারে অস্ট্রেলিয়ান বলদ! শুধু বলদ না তুই একটা ছাগল! রাম ছাগল, ব্লাক বেঙ্গল ছাগল!
ইত্তি অনবরত হেসে যাচ্ছে, ইরিনের মুখ বন্ধ নেই, এত পরিমান কথা বলে যাচ্ছে। তার পেছনে আয়াজের এর উপস্থিতিটুকুও টের পায় নি। আয়াজ ইত্তিকে ইশারায় চুপ থাকতে নির্দেশ দিয়ে নিজে ইরিনের পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ইত্তির হাসি ক্রমাগত বাঁড়ছে।

~ ইত্তি আমি কিন্তু টেনে তোর চুল সব ছিঁড়ে ফেলবো বলে দিলাম। তুই জানিস না তোর চেহারা বান্দরের মত! তুই যে এমন বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসছিস তুই জানিস তোর মুখ থেকে কি পরিমাণ বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে তুই জানিস? একেবারে পঁচা মাছের বিশ্রী গন্ধ! আমার বমি আসছে! ওয়াক!
সে বমি করার জন্য পেছনে ফিরতেই স্ট্যাচু হয়ে গেলো। আয়াজ লাফ দিয়ে দূরে সরে গেছে, ইত্তি অট্টহাসি ঠেকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
~ আমি আসি আয়াজ ভাই!

ইরিনের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না। আয়াজ এগিয়ে গিয়ে ইত্তিকে একটা লিস্ট বুঝিয়ে দিলো। স্টুডেন্ট দের লিস্ট, কেউ বাদ পড়েছে কি না চেক করার জন্য!
ইত্তি চলে যেতেই আয়াজ ভ্রু কুঁচকে ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন ভ্রূজোড়া নাচিয়ে বলল,
~ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? নজর লেগে যাবে তো।
~ হাউ ফানি!
~ বুঝি বুঝি হিংসে হচ্ছে না?

~ থাক আমি কিছু বলবো না। কিছু বললে তো তুই আবার ইত্তির মত আমাকেও একগাদা কথা শুনিয়ে দিবি।
~ লাগবে না আপনার বলা। আমি জানি আমাকে সুন্দর লাগছে।
~ সেজেছিস তো আমার টাকা দিয়ে।
~ আপনি আবার আমাকে টাকার খোঁটা দিচ্ছেন?
~ হ্যাঁ দিলাম।

~ আমার চাইতে আপনার টাকা বেশি হয়ে গেলো?
~ অবশ্যই হলো না। আগে আমার টাকা তারপর তুই।
~ ঠিক আছে আমি বাসায় গিয়ে আপনার টাকা আপনাকে ফেরত দিয়ে দেবো।

~ থাক। আগে যখন মাফ করে দিয়েছি এবারের টাকাও মাফ করে দিলাম।
ইরিম ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরে ঢুকে গেলো।
আয়াজ মুচকি হেসে গুনগুন করে গাইলো,
~ যখনই পড়েছে নজর, আমি তো হয়ে গেছি তোর!

রাগে ইরিনের মাথানষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আয়াজ তাকে আবারও টাকার খোঁটা দিয়েছে। এদিকে খোঁচা লেগে তার শাড়িও ছিঁড়ে গেছে। রাগে হল থেকে বেরিয়ে সোজা হোস্টেলের দিকে হাঁটা ধরলো সে। হোস্টেলে এসে ইরিন শাড়ি খুলে থ্রিপিস পরে নিলো। মেকাপ তুলে মুখ ধুয়ে নিলো। প্রোগ্রামে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। হোস্টেল প্রায় ফাঁকাই, কেবল থার্ড ফ্লোরে ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েরা আছে। খাওয়া শেষ করে তারা চলে এসেছে। তাদের কালকে পরীক্ষা আছে তাই। বাকিরা সবাই প্রোগ্রামে এটেন্ড করতে চলে গেছে।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব প্রায় শেষ হতে চলেছে, আয়াজ পুরো অডিটোরিয়াম ঘুরেও ইরিনের দেখা পেলো না। ইরিন কি চলে গেছে নাকি? খুঁজে পাক শুধু একবার, চড়িয়ে বেহুঁশ করে দেবে! আস্ত বেয়াদব একটা! যেখানেই যাবে তাকে পেরেশান করে ছাড়বে!
গেট দিয়ে বেরোতেই ইত্তিহাদের সাথে দেখা। সাথে মিতু। আয়াজকে দেখে লজ্জায় কাঁচুমাচু করছে। আয়াজ নিজেও অস্বস্তি নিয়ে ওর কাছে গেলো।
~ এই ইত্তিহাদ?

~ জ্বী ভাই? কিছু বলবেন?
~ না মানে তোদের মেয়েরা সবাই খেয়েছে?
~ জ্বী ভাই! আমরা সবাই তো একসাথেই বসলাম।
~ লিস্টের সবাই? তুই সিউর? কেউ বাদ পড়ে নি তো?
~ না ভাই, আমার জানামতে তো কেউ বাদ পড়ে নি।

~ আচ্ছা ঠিক আছে, যা ভেতরে যা!
আয়াজ গেট থেকে বেরিয়ে হোস্টেলের দিকে গেলো। আয়াজের ভেবে নিয়েছে ইরিন বোধহয় তার ওপর রাগ করে একা একা হোস্টেলে চলে গেছে। ইরিনের হোস্টেলের দিকে যাওয়ার পথে একটা ইটের টুকরার সাথে ধাক্কা খেয়ে নখ উলটে গেছে তার। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে নখ বেধে নিলো সে।

হোস্টেলের নিচে এসে আয়াজ অনবরত ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ইরিন ধরছে না। এবার মেসেজ টোন বেজে উঠতেই সে মেসেজ বক্সে গেলো।
~ তাড়াতাড়ি নিচে আয়! আমি অপেক্ষা করছি।

~ আমি আসবো না। আপনি চলে যান।
আয়াজ কোন রিপ্লাই দিলো না। মিনিট পাঁচেক ওয়েট করে অবশেষে ইরিন নিচে নামলো আয়াজ আলো থেকে সরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে!
ইরিন কাছে গিয়ে ডাক দিলো,
~ কই আপনি?

আয়াজ ফোন বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলো। এবার আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। এদিকে পুরো নিস্তব্দ! কেউ নেই! অন্ধজারে গা ছমছম করছে ইরিনের। হাতড়ে আয়াজের হাত ধরার চেষ্টা করলো কিন্তু পেলো না! আয়াজ ওর কাছ থেকে সরে দূরে দাঁড়িয়েছে।

বজ্রকন্ঠে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
~ তুই চলে এলি কেন? হোস্টেলে একা একা কি করছিলি?
ইরিন জবাব দেওয়ার জন্য মুখ খুললো কিন্তু কিছু বলার আগেই মুখ দিয়ে অস্পষ্টভাবে ‘আহ! ‘ শব্দ হলো। আয়াজ ঠাটিয়ে চড় মেরেছে তাকে। অন্ধকারে এতটা নির্ভুলভাবে কিভাবে কেউ টার্গেট করতে পারে? ইরিনের মাথা ভনভন করছে। সে আবারও কিছু বলতে নিলে আয়াজ খপ করে তার হাত টেনে ধরলো। শক্তভাবেই চেপে ধরেছে।

~ এত তেজ কেন তোর? নিজেকে কি ভাবিস? একা একা হোস্টেলে আসলি কোন সাহসে? তোর কোন ভয় নেই? দুনিয়াসুদ্ধ লোক ওইদিকে! তুই একা বের হয়েছিস কাকে জিজ্ঞেস করে?

ইরিন মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে আছে। থার্ড ফ্লোরে যে মেয়েরা আছে সেই কথা রাগে আয়াজকে বললো না সে। কি দরকার বলার? কোন কথাবার্তা ছাড়াই আয়াজ তাকে চড় মেরেছে। এবার মেরে ফেললেও ইরিন কিচ্ছু বলবে না। আয়াজ রাগে দাঁতমুখ খিঁচে বলল, এই তুই চুপ করে আছিস কেন? যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দে! দে বলছি একা হোস্টেলে বসে ছিলি কেন তুই?
ইরিন ব্যাথায় কেঁদে দিলো। আয়াজ এবার হাতের চাপ কমিয়ে দিলো। ধমক দিয়ে বলল, এই চুপ! একদম কাঁদবি না। কিছু হলেই চোখের পানি। একদম নাটক করবি না!

ইরিন কান্না থামিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কিছুটা শান্ত হতেই আয়াজ তার হাত ছেড়ে দিলো। একটু পরে আলতো করে ইরিনের ডানহাত ধরে জোরপূর্বক অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলো, কিন্তু যাওয়ার পথে অসাবধানতা বশত আবার হোঁচট খেলো সে। রাগে সজোরে লাথি মারলো পাথর বরাবর। তাতে তার উলটে যাওয়া নখ দিয়ে রক্তের ফোয়ারা বইতে শুরু করেছে। তবু রাগে থামলো না। ইরিনের হাত ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্যান্ডেলের এর দিকে হাঁটছে। দ্রুত হাঁটার কারনে খুঁড়িয়ে হাটার ধরনটা বোঝা যাচ্ছে না। সারা রাস্তায় তার জুতো চুইতে রক্ত ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়েছে। লাইটের আলোতে আসতেই ইরিনের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
~ সোজা ভিতরে যা। আমি আসছি।

ইরিন তখনও আয়াজের পায়ের অবস্থা খেয়াল করে নি। তার কথার প্রতি উত্তরে আগুনলাল চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।
হস্পটালে ঢুকে পায়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিলো আয়াজ। তারা আসার আগেই খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হয়ে গেছে। একটু পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্লেটে করে খাবার নিয়ে ইরিনের কাছে এলো। তাকে দেখে ইরিনের বান্ধবীরা সরে দূরে গিয়ে বসেছে। ইরিনও উঠে যেতে নিলো। আয়াজ তার হাত চেপে ধরে বলল,
~ যাচ্ছিস কেন?

~ আমি প্রোগ্রাম দেখবো।
~ খাবার?
~ কেন নিয়ে এসেছেন? আমি খাবো না!
~ তোর জন্য কে এনেছে? আমি তো আমার জন্য এনেছি।
~ তাহলে এখানে নিয়ে এলেন কেন?

~ তুই খাইয়ে দিবি।
ইরিন ঝাড়ি মেরে উঠে চলে যাচ্ছিলো। আয়াজের সাথে পেরে উঠলো না। আয়াজ তার হাত ধরে রেখেছে।
~ খাওয়া শেষ হলে তার পর যাবি।
ইরিন চোখমুখ লাল করে বলল,
~ আপনি আমাকে আর একটা কথা বললে এখানে একটা সিন ক্রিয়েট হয়ে যাবে।

~ হ্যাঁ। এই সিন ক্রিয়েট করা ছাড়া আর পারিস কি তুই?
~ আপনি গায়ে পড়ে ঝগড়া কেন করতে চাইছেন? আমি আপনার সাথে কোন কথা বলতে চাইছি না আপনি বুঝতে পারছেন না?
~ হ্যাঁ পারছি। কিন্তু গায়েপড়া তো তাই তুই না চাইলেও তোকে কথা বলতে হবে।

ইরিনের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিনা দোষে তাকে চড় মেরেছে আয়াজ। আয়াজের সাথে বিন্দুমাত্র কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। আয়াজ নিজেই ভাত মাখিয়ে তার মুখের সামনে ধরলো। ইরিনের বান্ধবীরা দূর থেকে মুখ টিপে হাসছে। ইত্তি এসেছিল আয়াজের পায়ের ব্যথার ওষুধ দিয়ে যেতে। ওষুধ আনতে তাকেই পাঠিয়েছে আয়াজ। ভেতরে ঢুকে থতমত খেয়ে আবার বেরিয়ে গেলো। ইরিন ঠেলে আয়াজের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
~ দরদ দেখানো লাগবে না। মেরে আমার হাড় মাংস গুঁড়া করে দিয়ে এখন এসেছেন দরদ দেখাতে?
~ বাসায় গিয়ে তুইও আমাকে ইচ্ছেমত মারিস। এখন খেয়ে নে প্লিজ।
~ বললাম তো আমি খাবো না।

~ লক্ষ্মী মেয়ে না তুই?
ইরিন মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। আয়াজ হাতের প্লেট রেখে ইরিনের বাম হাত দিয়ে ইরিনের ডানহাতটা টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। ইরিন আবারও ঝাড়া মেরে
ফেলে দিলো। বললো,
~ আমি খাবো না।

~ না খেলে এখাম থেকে উঠতে পারবি ন।
ইরিন জবাব দিলো না। আয়াজ ভাত মাখিয়ে বলল,
~ হাঁ কর?

~ এবার আমি ছুঁড়ে ফেলে দেবো সব।
বলতে দেরী ইরিনের ছুঁড়ে মারতে দেরী হয় নি। আয়াজ হতবম্ভ হয়ে নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। আর অনেকগুলো চোখ তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ইরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ খুশি?

ইরিন মৌনমুখে বসে রইলো। আয়াজ আয়াকে খাবার গুলো পরিষ্কার করতে বলে আরেক প্লেট খাবার নিয়ে এলো। নতুন করে খাবার মাখিয়ে ইরিনের মুখের কাছে ধরে বলল,
~ হাঁ কর।

ইরিন জেদ বজায় রেখে বসে রইলো। আয়াজ প্লেট নামিয়ে কিছুক্ষন স্থির ভাবে ইরিনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। ইরিনের চোখে পানি। আবারও ইরিনের মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে অনুরোধের সুরে বলল,
~ দয়া করে হাঁ কর ইরিন।

ইরিন হাঁ করলো না তো করলো না। আয়াজ সবার অলক্ষে তার গালে একটা চুমু খেয়ে পুনরায় অনুরোধের সুরে বলল,
~ কি করতে হবে বল? তোর পা ধরে মাফ চাইতে হবে?

ইরিন চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকালো। এবার হাঁ করে লোকমাটা মুখে নিলো সে। আয়াজ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে সে চুপচাপ খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে আয়াজ তার মুখ মুছিয়ে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের দিকে নিয়ে গেলো। ওদেরকে বেরোতে দেখে ইত্তি হাতে ওষুধের প্যাকেট নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে দিলো। ওষুধ দেখে ইরিন জিজ্ঞেস করলো,
~ কি হয়েছে ইত্তি? ওষুধ কার জন্য?

~ তুই জানিস না?
ইত্তি অবাক হয়ে একবার আয়াজের দিকে একবার ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন অবাক হয়ে বলল,
~ কি?

আয়াজ বলল,
~ কিছু না। তুই ইত্তির সাথে প্যান্ডেল গিয়ে বয়। আমি আসছি।
ইরিন নড়লো না। গোঁ ধরে বলল,
~ ওষুধ কার জন্য?
~ আমার জন্য। হোঁচট খেয়ে পা কেটে গেছে।

ইরিন আয়াজের পায়ের দিকে তাকালো। পায়ের ব্যান্ডেজের ওপর দিয়েও খানিকটা রক্ত লেগে আছে। এই জন্যই আয়াজ তাকে নিয়ে বেরোনোর সময় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছিলো। ইত্তি চলে যাচ্ছিলো ইরিন পুনরায় তাকে ডাক দিয়ে বলল,
~ তুই একটা রিক্সা জোগাড় করে নিয়ে আয় তো। আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।
আয়াজ বলল, কেন?
~ কেন আবার? বাসায় যাবো।
~ অনুষ্ঠান?

~ এই পা নিয়েও আপনার অনুষ্ঠান দেখার এত শখ?
~ আমি আমার কথা বলছি না। তুই থাকবি না?
ইরিন জবাব না দিয়ে ইত্তিকে রিক্সা আনতে পাঠিয়ে দিলো। ইত্তি রিক্সা নিয়ে আসতেই দুজনে রিক্সায় উঠে পড়লো। রিক্সায় উঠেই পায়ের ব্যথায় আয়াজের জ্বর চলে এসেছে। ইরিনের কাধে মাথা রেখে চুপচাপ বসে রইলো সে। ইরিন প্রথমে সরিয়ে দিতে চাইলো, কিন্তু জ্বর এসেছে বুঝতে পেরে চুপ করে গেলো। আয়াজ আবারও ইরিনের গালে চুমু খেয়ে বললো,
~ হরিণ আমার। তুই আমাকে ধাক্কা দিয়ে রিক্সা থেকে ফেলে দে কিন্তু এমন রাগ করে থাকিস না প্লিজ।

ইরিন বিরক্ত কন্ঠে বলল,
~ আবোলতাবোল না বকে চুপচাপ আমাকে ধরে বসে থাকুন।
আয়াজ কিছুক্ষন নিরব থেকে হঠাৎ ইরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
~ তুই কি নিষ্ঠুর রে ইরিন? একা একাই খেয়ে নিলি? আমি যে খেলাম না একবারও তো জিজ্ঞেস করিস নি!
আয়াজ জ্বরের ঘোরে ছোট বাচ্চাদের মত ঢং করে কথা বলছে। ইরিন প্রথমে বুঝলো না। মুখ বাকিয়ে বলল,
~ খান নি কেন? আমি আপনাকে নিষেধ করেছি?

~ তুই আমাকে জিজ্ঞেস করলি না কেন? আমি কতবার তোর মুখের দিকে তাকিয়েছি তুই জানিস? তুই একবারও আমাকে খেতে বললি না।
~ ঢং।
আয়াজ তার কাধ থেকে মাথা সরিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। ইরিনের মায়া হচ্ছে। অসুস্থ মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,
~ এদিকে ফিরুন।

~ না।
~ না ফিরলে আমি আপনার সাথে আর কথা বলবো না।
আয়াজ মুখ ফিরালো। ইরিন তার কপালের আউলাঝাউলা চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল,
~ বাসায় গিয়ে আমি নিজ হাতে আপনাকে খাইয়ে দেবো। ঠিক আছে?
~ দিবি তো?
~ দিবো। এবার চুপ করে বসে থাকুন।

পর্ব ১৫

আয়াজের জয়েনিং এর দুমাসের মাথায় তার চাচাতো বোন সুহানার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো। এই উপলক্ষে আজকে দুই মাস পর সে বাসায় ফিরেরে। আয়াজের চাচা সপরিবারে কানাডা থাকেন। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষ্যেই গতমাসে দেশে ফিরেছেন তারা। ছোটবেলা থেকেই সুহানা কানাডায় বড় হয়েছে। তাই শখ করে গ্রামের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আয়াজে চাচা। আয়াজরা সবাই আজকে সন্ধ্যায় রওনা হবে। দুদিন আগে ইরিনের মায়মুনা বেগমের সাথে দেখা করতে গেছে।

ইরিনের যাত্রাবাড়ীর ফ্ল্যাটে গতমাসেই উঠে গেছেন তারা। মায়মুনা বেগমই তাড়াতাড়ি করে ফ্ল্যাটে উঠেছেন। একই এপার্টমেন্ট মেয়ের বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ির তাই তিনি ইরিনের বাবাকে প্রায় জোর করেই রাজী করিয়েছেম ফ্ল্যাটে উঠার জন্য। ফ্ল্যাটের সামান্য কিছু কাজ বাকি ছিলো, তাই ইরিনের বাবা চাইছিলেন আরো কিছুদিন পরে উঠতে কিন্তু মায়মুনা বেগম মানলেন না। বাধ্য হয়েই ইরিনের বাবাকে বদলি হতে হলো।
আয়াজের আসার খবর শুনে ইরিন দুপুরে চলে এসেছে। কিন্তু এসে দেখলো আয়াজ বাসায় নেই। কিসের যেন ফর্ম ফিলাপ করতে গেছে বলে গেলো।

রওনা হওয়ার কিছুক্ষন আগে আয়াজ বাসায় এলো। এসেই দ্রত গোসল সেরে রেডি হয়ে নিলো সে। হালকা বেগুনী রংয়ের একটা টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার পরেছে সে। অনেক দূরের রাস্তা তাই বাসার সবাই-ই ক্যাজুয়্যাল পোশাক পরে বেরিয়েছে। ভারি জামাকাপড় পরলে বেশিক্ষণ গাড়িতে বসে থাকা যায় না। অস্বস্তি লাগে।
ইরিন পরেছে। ফুলহাতা ফতুয়া আর লং স্কার্ট। চুলগুলো খোঁপা করে মাথায় বউদের মত ওড়না দিয়েছে। ছোটখাটো একটা পুতুল মনে হচ্ছে তাকে! আয়াজ মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষন চেয়ে রইলো। তার ইচ্ছে করছে ইরিনের তুলতুলে নরম গালে একটা কামড় বসিয়ে দিতে।
আয়াজ গাড়িতে উঠতেই। ইরিন চেঁচিয়ে উঠে বললো,
~ আমার ব্যাগ? আমার ব্যাগ আনা হয় নি?

ইরিনের ব্যাগ সে তার রুম থেকে বের করতে ভুলে গেছিলো। ড্রাইভার ড্রয়িংরুম থেকেই সবার ব্যাগ নিচে নামিয়েছে। ইরিনের ব্যাগ ভেতরে ছিলো বিধায় রয়ে গেছে।
ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে আয়াজ গেলো ইরিনের ব্যাগ আনতে। রুমে ঢুকেই সে হতবাক হয়ে গেলো। সব মিলিয়ে ব্যাগ মোট চারটা। ইরিন প্রচন্ড সাজুনি। বিয়ের সাজগোছ জামাকাপড় কিচ্ছু বাকি রাখে নি সে। আয়াজের ভাবছে এতগুলো ব্যাগ তো সিনেমার নায়িকারা সাথে করে নেয় না। ইরিনের কি কখনো বুদ্ধিসুদ্ধি হবে না? হতাশ হয়ে চারটা ব্যাগ নিয়ে নিচে নামলো সে।

ব্যাগ গাড়ি পেছনে রেখে গাড়িতে উঠতেই ইরিন ফিসফিস করে বলল, থ্যাংক ইউ।
~ ফিসফিস করে কথা বলছিস কেন?
ইরিন জবাব না দিয়ে আবারো ফিসফিস করে বললো,
~ আপনি এত শুকিয়ে গেছেন কেন?

~ তোকে বারণ করেছি না ফিসফিস করবি না? আমার অস্বস্তি লাগে।
~ ঠিক আছে আর করবো না।
ইরিন চুপ করে গেলো। আয়াজ কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
~ তুই এতগুলো ব্যাগে কি নিয়েছিস?
~ কেন?

~ না। আর কিছু বাকি আছে কি না তাই। ব্যাগ তো চারটাই না? বাদ পড়ে নি তো?
ইরিন চোখ পাকিয়ে বললো,
~ আমার সাজগোজের জিনিস নিয়ে আপনার এত প্রবলেম কেন?
~ তারমানে সব সাজগোজের জিনিস নিয়েছিস? ভালো। খুব ভালো। বিয়ের দিন তোকে চেনা গেলেই হয়।
ইরিন আবার চোখ পাকাতেই আয়াজ হেসে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। কিছুক্ষন বাদে পাশে ফিরতেই দেখলো ইরিন অলরেডি তার কাধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।

গাড়ি থেকে নামার কিছুক্ষণ আগে ইরিনের ঘুম ভাঙলো। সারা রাস্তা আয়াজের কাধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে এসেছে সে। ঘুম থেকে উঠে দেখলো আয়াজ ফোন নিয়ে ব্যস্ত! ইরিন চোখ পিটপিট করে উঁকি দিলো আয়াজ ফোনে কি করছে সেটা দেখার জন্য, তখনই ফোনের স্ক্রিনে সেটা দেখে আয়াজ তার দিকে তাকিয়ে বললো,
~ এই সোজা হয়ে বয়! উঁকি দিচ্ছিস কেন?
ইরিন সোজা হয়ে বসলো। ওড়না ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি তো টাইম দেখছিলাম, কয়টা বাজে? আমাদের আর কতক্ষণ লাগবে?
নিজের মিথ্যে বলার প্রতিভা দেখেই নিজেই মুগ্ধ হলো সে।

~ আধঘন্টা!
~ আরো আধঘন্টা?
~ কেন কি হয়েছে?
~ সেই কখন থেকে গাড়িতে বসে আছি। ক্লাতিতে আবার মাথা ঘুরছে। হাত পা ব্যথা করছে।

আয়াজ জানালার গ্লাস খুলে দিলো। ফুরফুরে বাতাস আসছে। এসি অন করা ছিলো বিধায় গাড়ির গ্লাস বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আয়াজের নির্দেশে এসি বন্ধ করে দিলো ড্রাইভার। ইরিন জানার বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতি দেখছে। ভোরের আলো ফুটেছে অনেক আগে। ঘুমে ছিলো বিধায় খবর ছিলো না। ঠান্ডা বাতাসে শরীর ফুরফুরে লাগছে।
মিনিট বিশেকের মাঝেই পৌঁছে গেলো তারা। হেলাল সাহেবদের গাড়ি তাদের আগে পৌঁছেছে। নিচতলার ডাইনিং এ বসে চা খাচ্ছে সবাই। এদিকে বাড়ির কিছু মেরামত কাজ চলছে। অনেকদিন পর এসেছে বিধায় রং করানো হচ্ছে। দরজা জানালা চেইঞ্জ করা হচ্ছে। উৎসব পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে অলরেডি। মুরুব্বি দের সালাম করে আয়াজ ভেতরে ঢুকে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য। ইরিন সালাম করে সোহেলি বেগমের পাশেই বসে রইল।
সেদিন সারাদিন বোরিংই কেটেছিলো ইরিনের। সবার সাথে পরিচয় করে নিয়েছে কেবল।

পরেরদিন সকাল থেকেই শুরু হলো জোর বৃষ্টি। আয়াজদের গ্রামের বাড়ির সামনের উঠান পাকা নয়। বৃষ্টির পানিতে কাদাপানি একেবারে মাখামাখি অবস্থা। মহিলারা অনেকেই দল বেধে বৃষ্টিতে ভিজতে নেমেছে। ছোট ছোট বাচ্চারাও আছে। হৈ হৈ, রৈ রৈ পরিবেশ।

পুরুষেরা বৃষ্টির পানি মাথায় নিয়ে পুকুরে গোসল করতে চলে গেছে। হেলাল সাহেবও উৎফুল্ল মনে ভিজতে চলে গেছেন। আয়াজ আলসেমির জন্য যেতে পারে নি। তার জন্য মোটরে পানি তুলে গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইরিনও সবার সাথে কাদামাটিতে লাফালাফি করছে। এর ওর গায়ে কাদা ছুড়ে মারছে আর খুশিতে লাফাচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একপলক দেখে আয়াজ গোসল করতে ঢুকে গেলো। মনে মনে বিরক্ত হলো সে, ইরিনকে বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করেছিলো সে। বৃষ্টির সাথে যেই পরিমান ঠাণ্ডা পড়ছে তাতে হুট করে জ্বর জ্বর সর্দি বাধিয়ে বসার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ইরিন তাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আয়াজ আর ডাকলো না। কারণ এই মুহূর্তে ডাকলেও সে শুনবে না। আয়াজ দীর্ঘশ্বাস চুপচাপ গোসল করতে চলে গেলো। ইরিন শখ করে সাজগোজের জিনিসত্র নিয়ে এসেছে বিয়ে উপলক্ষ্যে, এখন জ্বর সর্দি না বাধালেই হয়।

ঘন্টাখানেক বাদে সে গোসল করে বেরিয়ে হাত দিয়ে চুলের পানি ঝাড়ছিলো। এমন সময় তুতুরী এসে বললো,
~ মামা, মামী আছাড় খেয়ে পড়ে পা মচকে ফেলেছে।
আয়াজ চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
~ বেশ হয়েছে। কোমর ভাঙ্গে নি?

তুতুরী ফ্যালফ্যাল করে তার দিকে চেয়ে আছে। আয়াজ ভেবেছে লাফালাফি করতে গিয়ে হয়ত খানিকটা ব্যথা পেয়েছে তাই আমলে নিলো না। আয়াজের পরনে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আয় নীল ট্রাউজার। হ্যাঙারে থেকে টিশার্ট বের করে গায়ে দিচ্ছিলো সে, মুক্তা এসে জানালো সোহেলি বেগম তাকে ডাকছে ইরিনকে তুলে আনার জন্য।
~ আমি মাত্র গোসল করে এসেছি ভাবি।
আয়াজের কথা শেষে না হতেই সোহেলি হন্তদন্ত হয়ে আয়াজের ঘরে ছুটে এলেন। কাঁদোকাঁদো স্বরে বললেন,
~ জলদি আয় বাবা। সর্বনাশ হয়ে গেছে। ইরিনের পা মচকে গেছে! বেচারী শখ করে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েছিলো, কাদামাটিতে পা পিছলে মচকে গেছে। ব্যথায় উঠতে পারছে না।

বাইরে এখনো তুমুল বৃষ্টি। ইরিন উঠোনে পা মেলে বসে কাঁদছে। কেউ ধরতে এলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিচ্ছে। সেই ভয়ে সবাই দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
আয়াজ দ্রুত বেরিয়ে এসে দেখলো ইরিন উঠানে বসে চিৎকার করছে।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উঠোনে নেমে গেলো আয়াজ। কাদামাটিতে সে নিজেই বারবার পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলো। ইরিনকে পাঁজকোলা করে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এলো। তার গায়েও কাদামাটি লেগে মাখামাখি। ইরিনকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ইরিন কান্না বন্ধ করে হাঁ করে আয়াজের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াজের টিশার্ট তার গায়ের কাদায় মাখামাখি। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। আয়াজ তার দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিলো। আয়াজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোহেলি বেগমকে পাঠিয়ে দিলেন। সোহেলি ওয়াশরুমে ঢুকে ইরিনকে গোসল করিয়ে বের করে নিয়ে এলেন। ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই শুরু হলো তার পায়ের জন্য ঘরোয়া চিকিৎসা। সে তখনো কান্না করে যাচ্ছে। বস্তুত ইরিন যতটা না ব্যথা পেয়েছে তার চেয়ে বেশি চিৎকার করে সবাইকে বেহুঁশ বানিয়ে ফেলছে। সোহেলি সবার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন ইরিন। মুক্তা এসে ইরিনের পায়ে হলুদ গরম করে লাগিয়ে দিলো।

হেলাল সাহেব, মহসিনসহ বাড়ির অন্যান্য পুরুষেরা গোসল সেরে সবে বাড়ি ফিরেছে। ইরিনের চিৎকারে হেলাল সাহেব আর মহসিন দৌঁড়ে এলেন। হেলাল সাহেব ইরিনের পায়ের অবস্থা পরীক্ষা করে জানালেন সামান্য মচকেছে। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

ইরিন ঘরে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আস্তে আস্তে পায়ের ব্যথা বাড়ছে। প্রথমে খুব একটা মালুম না হলেও এখন ব্যথা যথেষ্ট বেড়ে গিয়েছে। তার পায়ে হলুদ পোড়া লাগিয়ে কাপড় দিয়ে বেধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যথা কমছে না। খাটের কাছে জানালার পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদছে সে। বাইরে তখনো বৃষ্টি। দুপুরের খাবারের পর আয়াজ রেস্ট নিতে এসেছিলো। ইরিন তাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পুনরায় জানালার বাইরে তাকালো। রুমে কারেন্ট নেই। আকাশ মেঘলা থাকায় ঘর প্রায় অন্ধকার। ইরিনের চেহারা ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে কান্নার কারনে তার শরীর মৃদু কেঁপে কেঁপে উঠছে। আয়াজ নরম সুরে বললো,
~ বেশি ব্যথা করছে?

ইরিন ফোঁপানো বেড়ে গেলো। পরোক্ষনেই কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করলো। কাউকে কিচ্ছু বলবে না সে। কিচ্ছু না! বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আয়াজ পাশে দাঁড়িয়ে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
~ বৃষ্টি দেখবি?

ইরিন মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। তার নিঃশব্দ চোখের পানি গাল ভিজিয়ে ফেলেছে। আয়াজ তাকে কোলে করে বারান্দায় নিয়ে গেলো। বারান্দা গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। বাইরে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বৃষ্টিতে লাফালাফি করছে। ইরিনের ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। কই ওদের তো কেউ পিছলে পড়ছে না? ইরিনকেই কেন পড়তে হলো? ইরিন দুহাতে আয়াজের গলা জড়িয়ে ধরে তার বুকের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়ে চুপ করে রইলো। তার খুব জোরে কান্না পাচ্ছে। এত সাধ করে বিয়েতে এসেছে।

এখন ভাঙ্গা পা নিয়ে কি করে মজা করবে সে? তার সাথেই কেন এমন হলো? বাইরে কি সুন্দর বৃষ্টি, সবাই ভিজছে। আর সে খোঁড়া হয়ে ঘরে বসে আছে।
বারান্দায় আবছা আলো আবছা অন্ধকার। আয়াজ কখনো বৃষ্টি দেখছে কখনো ইরিন দেখছে। ইরিন গাল ফুলিয়ে আদুরে বেড়ালের মত চুপচাপ তার বুকে মুখ গুঁজে আছে। আয়াজ আরো কিছুক্ষন তাকে নিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর রুমে নিয়ে এসে খাটে বসিয়ে দিয়ে বলল,
~ দেখি পা সোজা কর।

ইরিন পা সোজা করতেই তার পায়ে বাঁধা হলুদ লাগানো কাপড়টা খুলে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো বেশি মচকেছে কি না। ইরিন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। আয়াজ আশ্বাস দিয়ে বলল,
~ বেশি মচকায় নি। রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। ঠিকমত রেস্ট নে, কাল সকালেই দেখবি ঠিক হয়ে গেছে।
ইরিন ঘাড় কাত করে সায় জানালো। আয়াজ খাটে ইরিনের পাশে শুয়ে গায়ে কাথা টেনে নিয়ে বললো,
~ আয় শুবি।

ইরিন মাথা দোলালো। এর মানে সে শোবে না। আয়াজ তাকে টেনে শুইয়ে দিয়ে বলল,
~ শুয়ে থাক, দেখবি ব্যথা কমে যাবে।

ইরিন কোনরূপ প্রতিবাদ করলো না। আয়াজে বুকের ওপর মাথা দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলো। আয়াজ তার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,
~ আমি বারণ করলে তো শুনবি না। এখন পড়ে যে পা মচকালো কার ক্ষতি হলো? কষ্ট কি আমি পাচ্ছি? তাইজন্যই বলি চলাফেরা করতে সাবধানে করবি। বড় হয়েছিস জ্ঞানবুদ্ধি খরচ করে কাজ করতে শিখ। সারাক্ষণ বাচ্চাদের মত লাফালাফি করাটা একটু কমা।
ইরিন জবাব দিলো না। আয়াজের আরেকটু কাছে সরে এসে একেবারে চুপচাপ লেপ্টে রইলো তার সাথে। আয়াজ তাকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলো।

পরের দিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। বৃষ্টির কারনে সুহানার বিয়ের আপাতত বন্ধ আছে। ইরিনের পায়ের ব্যথাও কমেছে। সে দিব্যি সবার সাথে হাসি তামাসা করছে। দুপুর পর্যন্ত আয়াজ ঘরেই ছিলো। দুপুরের পর বৃষ্টি বন্ধ থাকায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বেরিয়ে গেলো। আড্ডা শেষে বিকেলবেলা বাড়িতে ফেরার সময় মাঝপথেই শুরু
হলো তুমুল বৃষ্টি। আয়াজের কাছে অবশ্য ছাতা আছে। ছাতা মাথা খুব সাবধানে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলো সে। উঠোনের কাছে এসেই থমকে গেলো। ইরিন উঠোনের কাদামাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। সারা গা কাদায় মাখামাখি। তাকে ঘিরে আয়াজের চাচাতো ভাইয়ের বউয়েরা সহ ইরিনের বয়সী কিছু তরুণীও বৃষ্টিতে ভিজে লাফালাফি করছে। আয়াজের হতবাক হয়ে গেলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাগে বাঁশের একটা কঞ্চি জোগাড় করে নিলো সে। আজকে ইরিনের ছাল তুলে ফেলবে। মোচড় খাওয়া পা নিয়ে সে ভিজতে নেমেছে কোন সাহসে?

বস্তুত ইরিন তাকেই পাহারা দিচ্ছিলো। সে ঘর থেকে বেরোতেই সোহেলি বেগমের কাছ থেকে অনেক অনুনয় বিনয় করে বৃষ্টিতে ভেজার অনুমতি নিয়েছে। ভিজতে নামলেও সে একজায়গায় স্থির হয়েই ভিজছিলো। গতকালের পা মচকে যাওয়ার ভয়ে লাফালাফি করার সাহস পেলো না। কিন্তু আয়াজ তো আর এসবের কিছুই জানে না। ইরিনকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেই সে বেশ ক্ষেপে গেছে। তাকে কঞ্চি হাতে এগিয়ে আসতে দেখেই ইরিন সারা গায়ে কাদামাটি নিয়ে একছুটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো।

বাকিরা মেয়েরা সবাই ভয়ে হতবম্ভ হয়ে আছে। ভাবিরা মুখ টিপে হাসছে। দোতলার বারান্দা থেকে সোহেলি বেগমও দেখেছেন। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতে হেলাল সাহেবের কাছে গেলেন ঘটনা বর্ণনা করার জন্য। আয়াজ কঞ্চি ফেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পা ধুয়ে নিলো। জুতোয় কাদামাটি লেগে এক অবস্থা। ভালোমত পা ধুয়ে ভেতরে ঢুকলো সে, যেন কিছুই হয় নি। এদিকে ইরিন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা সোহেলির রুমে চলে গেছে। আজকে আর ভুলেও এই রুম ছেড়ে বেরোবে না সে।

পর্ব ১৬

তুমি অমন দৌড়ানি দিলা ক্যান বউ? , ইরিনকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললেন বৃদ্ধ জামিলা খাতুন। ইরিনের তাকে চিনতে পেরেছে। সম্পর্কে ইনি হেলাল সাহেবের চাচি। সেই হিসেবে আয়াজের দাদি। ইরিন খাটের ওপর বেজার মুখে বসে আছে। জামিলা খাতুন ইরিনের সামনে বসে বলল,
~ খাও নাই ক্যান? ভাইয়ের ওপরে রাগ করছো?

ইরিন জবাব না দিয়ে নতমুখে বসে রইলো। ডাইনিং টেবিলে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা খেতে বসেছে। লোকজন বেশি হওয়ায় আলাদা আলাদা করে খেতে বসেছে সবাই। ইরিন আগেই মুক্তাকে জানিয়ে দিয়েছে সে খাবে না। মুক্তা ইচ্ছে করেই নিজে না এসে জামিলা খাতুনকে পাঠিয়েছে ইরিনকে ডাকার জন্য। মুক্তাকে নানান ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন জামিলা খাতুন। সে কেবল লজ্জায় লাল হয়ে আঁচল চাপা দিয়ে হেসেছে। মহসিন দুতিনবার তার এমন হাসার কারণ জিজ্ঞাসা করেছে। লজ্জায় বলতে পারে নি সে। ইরিনের মুখ ভার দেখেই জামিলা খাতুনকে পাঠিয়েছে সে। জমিলা গুরুগম্ভীর কন্ঠে বললেন,
~ শোন বউ একটা কথা বলি, পুরুষ মানুষেরে বেশি লাই দিবা না।

লাই পেলে মাথায় উঠে এরা। এদেরকে সব সময় কড়াকড়িতে রাখতে হয়। নাহলে দেখবা হাতের বাইরে চলে গেছে। কথায় কথায় তোমারে উঠাবে আর বসাবে। তোমার বয়স কম। বুদ্ধিসুদ্ধি হয় নাই। তাই বড় হিসেবে তোমাকে কিছু উপদেশ দেই। শোনো, এমন ভয় পাওয়া চলবো না। সে তোমারে শাসন করার আগে তুমি তারে শাসনে করবা। সে যদি একধমক দেয় তুমি ফিরাইয়া ধমক দিবা তিনটা। কথা কি কইলাম বুঝছো?

ইরিনের এসব ক্যাচাল ভালো লাগছে না। জমিলা খাতুন কি বলছে তার একফোঁটা সে মনোযোগ দিয়ে শোনে নি। তার তো রাগে আয়াজকে এইমুহূর্তেই টাক বানিয়ে ফেলতে মন চাইছে। আয়াজ এভাবে কেন দৌড়ালো তাকে? আর সে-ই বা কেন দৌড় দিলো? তার তো উচিৎ ছিলো দাঁড়িয়ে থেকে আয়াজকে ভড়কে দেওয়া? কথায় আছে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। ইরিনের অবস্থাও তাই। মুড অফ করে বসে রইলো সে। জমিলা ইরিনের সাথে কথা বলে মজা পাচ্ছেন না। ইরিনের ঘর থেকে বেরিয়ে আয়াজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।

আয়াজ খাটের ওপর বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো। জমিলা খাতুন ভেতরে ঢুকে বললেন,
~ কেমন পুরুষ তুমি? তোমার বউ রাগ কইরা না খাইয়া বইসা আছে আর তুমি ভালোমানুষের মত বইসা কাজ করো?
~ ইরিন খায় নি?
~ না। সে তোমার ওপর রাগ করে আছে।

~ আমার ওপর? আমি কি করেছি?
~ তুমি তারে বিকেলবেলা সবার সামনে দৌড়ানি দিলা ক্যান?
~ ও পায়ের ব্যথা নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েছিলো কেন?
~ মাইয়া মানুষের নানান ধরনের শখ আছে। বৃষ্টিতে ভিজাও একটা শখ। তুমি বুঝবা না। এখন যাও বউয়ের কাছে গিয়া মাফ চাও। নাইলে সে খাবে না বলছে।

আয়াজ হাসছে। জামেলা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন,
~ শোনো বউ হইলো ঘরের লক্ষ্মী। কথায় কথায় তারে বকাঝকা করবা না। ভুল করলে বুঝায় বলবা, ভালোবাইসা বলবা।
তিনি একটু থেমে আবারো সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন,
~ যাও। বউয়ের কাছে যাও। তার মান ভাঙাও। না মানলে পায়ে ধরবা। কানে ধরে উঠবস করবা। সারারাত তার পাশে বসে অনুনয় বিনয় করবা।

তারপর আয়াজের কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বললো,
~ তাতেও যদি কাজ না হয়, ঝাপ্টাইয়া ধইরা আদর করবা। দেখলা চোখের পলকে রাগ উধাও। বয়সকালে আমি যখন রাগ কইরা থাকলে তোমার দাদাজান আমারে !
এইটুকু বলে হাসছেন তিনি। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন বললেন,
~ আমি যাই।

আয়াজও ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
~ ঠিক আছে দাদু আপনি যান। আমি আসছি।

ইরিন মুক্তার ঘরে বসে টিভি দেখছে। আয়াজ সোহেলি বেগমের ঘর খুঁজে এসে মুক্তার ঘরে এসে ঢুকলো। মুক্তা আলমারির জামাকাপড় গোচ্ছাছে। আয়াজ ভেতরে ঢুকতেই ইরিন এমন ভান করলো যেন তাকে দেখতেই পায় নি। আয়াজ তার পাশে বসে মুক্তার দিকে একবার তাকালো। মুক্তা তার অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসছে। আয়াজ ইরিনকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,
~ ভাবি। ভুল হয়ে গেছে। মস্ত বড় ভুল। আর হবে না। এবারের মত মাফ করে দিলে ভালো হয়।

ইরিন টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিলো। আয়াজ আবারো বললো,
~ ভাবি। আমি তো বললাম আর হবে না।

ইরিন তার দিকে ঝাঁঝালো চোখে একবার তাকিয়ে পুনরায় টিভির দিকে দৃষ্টি দিলো। আয়াজও তার পাশে খাটে গিয়ে বসে বললো,
~ ভাবি। আমি কানেধরে ক্ষমা চাইছি। আর হবে না!
মুক্তা হাসি থামাতে পারছে না। অবশেষে ওদের দুজনকে একান্তে মান অভিমান ভাঙ্গানো সুযোগ করে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা আটকে বেরিয়ে গেলো সে। যাওয়ার সময় আয়াজের মাথায় চাটি মেরে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়ে গেলো, ‘বেস্ট অফ লাক। ‘
ইরিন সোফার ওপর পা উঠিয়ে বসেছে। আয়াজ টিভির সুইচ বন্ধ করে দিয়ে তার পাশে এসে বসে বললো,
~ খাস নি কেন তুই?

ইরিন নিরুত্তর। আয়াজ তার হাত ধরতে নিলেই ঝাড়া মেরে হাতদুটো কোলের ভেতর ঢুকিয়ে নিলো।
আয়াজ চট কদে হাটুগেড়ে তার সামনে বসে পড়লো। ইরিনের কোমর জড়িয়ে ধরে বললো,
~ সরি। এই যে দেখ কান ধরলাম।

~ আপনি আমাকে ছাড়ুন। সবার সামনে আমাকে দৌড়ানি দিয়ে এখন ভালোবাসা দেখাতে এসেছেন? লাগবে না আমার এমন ভালোবাসা।
আয়াজ হঠাৎ ওকে পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ওর দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে আধশোয়া হয়ে ওর মুখোমুখি বসলো। ইরিন ছাড়া পাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে। আয়াজ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
~ দাদু বলছিলেন বউ রাগ করলে নাকি তাকে বেশি বেশি করে আদর করতে হয়। এতে নাকি রাগ কমে যায়।
ইরিন জবাব দিলো না। অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো। আয়াজ তার গালে গাল ঘষে বললো,
~ রাগ করিস না হরিণ। তুই তো আমার লক্ষ্মী বউ।

ইরিনের এখন ছাড়াপাওয়ার জন্য মোচড়ামুচড়ি করছে না। শান্ত হয়ে বসে আছে। আয়াজ পলকহীন ভাবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলতো করে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল,
~ কালকে আমরা বৃষ্টিতে ভিজবো। তুই আর আমি। তুই ভিজবি আমি দেখবো। কেমন?
~ আপনি ভিজবেন?

~ হ্যাঁ!
আয়াজ এখনো তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আয়াজের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। ইরিনের তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত উঠে বসলো। আয়াজ মুচকি মুচকি হাসছে।
~ চল। রুমে চল।
~ আপনি যান। আমি আসছি।

আয়াজ বেরিয়ে গেলো। ইরিনের ভীষণ লজ্জা লাগছে। সেই ছোট্টবেলা থেকে চেনা এই মানুষটা কাছে আসলে ইদানীং তার বেশ লজ্জা লাগে। এই মানুষটার সাথে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যে সে ঝগড়া করতে পারে ভালোবাসার কথা ততটা স্বাচ্ছন্দ্যে বলতে পারে না। সমস্ত শরীর লজ্জায় নুইয়ে আসে। শরীর আড়ষ্ট হয়ে আসে।
আয়াজ বেরিয়ে যেতেই মুক্তা এসে বললো,
~ মা তোকে খেতে ডাকছেন।
~ যাচ্ছি।

পরেরদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি নেই। আকাশ একদম পরিষ্কার। সুহানার বিয়ের আয়োজন চলছে। ইরিন কয়েকবার আয়াজের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়েছে যেন বৃষ্টি না আসাটাও আয়াজের দোষ। দুপুরে ঝকঝকা রোদ উঠলো। ইরিন রাগে চোখমুখ লাল করে বললো,
~ আপনি আগেই জানতেন না? আজকে বৃষ্টি হবে না? তাই আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলেন?
আয়াজ অসহায় কন্ঠে বললো,
~ আমি কি করে জানবো আজকে বৃষ্টি হবে না? আমি কি ওয়েদার ফোরকাস্ট জানি?
~ জানতেন আপনি সব জানতেন।

~ বিশ্বাস কর হরিণ, আমি সত্যি জানতাম না। আচ্ছা আজকে না হলে কাল ভিজবো আমরা।
~ লাগবে না। আমি আর জীবনেও কোনদিন বৃষ্টিতে ভিজবো না। মিথ্যেবাদী কোথাকার।
ইরিন রাগে গটগট করে হেটে চলে গেলো। আয়াজ রীতিমত অবাক হয়ে চেয়ে আছে। বৃষ্টি না আসার সাথে তার দোষ কোথায়?

ঘন্টাখানেক বাদেই আকাশে মেঘ জমা হলো। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। মেঘ ডাকছে। বলতে না বলতেই শুরু হলো ভারি বর্ষণ। দুপুরের খাবারে পর সবাই যার যার ঘরে রেস্ট কিচ্ছে। ইরিনও ঘরে কাথামুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আয়াজ তার পাশে বসে মৃদু স্বরে ডাক দিয়ে বললো,
~ এই হরিণ? বৃষ্টিতে ভিজবি না? উঠ, দেখ? বাইরে কি সুন্দর বৃষ্টি হচ্ছে?
ইরিন আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। জানালার বাইরে তাকাতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,
~ ছাদে যাবেন?
~ আয়।

ছাদে উঠে আয়াজ দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলো। ইরিন একদৌঁড়ে ছাদের মাঝ বরাবর চলে গিয়েছে। দুহাত মেলে বৃষ্টিতে ভিজচ্ছে সে। আয়াজ রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার বৃষ্টিবিলাস দেখছে। হঠাৎ করেই ইরিনকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলো সে,
~ ইরিন তোর বান্ধবীদের কারো বিয়ে হয়েছে?
~ তিনজনের হয়েছে। দুজজের বাচ্চাও আছে।
~ বাহ! ওরা জানে তোর বিয়ে হয়েছে?
~ জানে।

~ তোকে জিজ্ঞেস করে নি তোর বেবি আছে কি না?
আয়াজ বুঝতে পারলো ইরিন লজ্জা পেয়েছে। জবাব না দিয়ে ছাদের অন্যপাশে চলে গিয়েছে সে। এর মধ্যেই ছাদের দরজায় দুমদাম আওয়াজ শুরু হলো। আয়াজ দরজা খুলতে যাচ্ছিলো ইরিন দৌড়ে এসে তার হাত চেপে ধরে বললো,
~ খুলবেন না। প্লিজ!
~ কেন?
~ ওরা কি ভাববে?

আয়াজ স্থিরভাবে কিছুক্ষন ইরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললো। ইরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
~ না খুললে আরো বেশি কিছু ভাববে!
ইরিন চেহারার লাজুক ভাব। আয়াজের ভালো লাগছে। ইদানীং ইরিন কথায় কথায় কেমন লজ্জা পায়। ভীষণ আদুরে লাগে দেখতে। ছাদের দরজা খুলতেই মুক্তাসহ আরো অনেকে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো। মুক্তা বললো,
~ এদিকে আমরা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছি। আর মিয়া বিবি ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মধ্যে রোমান্স করো?

~ রোমান্সের আর সময় পেলাম কই ভাবি? মাত্র এসেছি এর মধ্যেই তো তোমরা চলে এলে।
তার কথা শুনে সবাই খিলখিলিয়ে হাসছে। আয়াজের চাচাত ভাইয়ের বউ রোকসানা ইরিনকে খোঁচা মেরে বললো,
~ ইরিন ভাবিকে সত্যি করে বলতো আয়াজ এতক্ষন কি করছিলো?

আয়াজ বললো,
~ ভাবি আসো দেখাই কি করছিলাম। ওকে কেন জিজ্ঞেস করছো? আমাকে জিজ্ঞেস করো আমি দেখাই?
আরেকদফা হাসির রোল পড়লো। রোকসানা চোখ পাকিয়ে বললো,
~ ঠিক আছে তুমিই বলো। ছাদের দরজা বন্ধ করে কি করছিলে দুজনে? দরজা খুলতে এতক্ষন লাগলো কেন?

আয়াজ চট করে ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিনের চেহারায় বিব্রত ভাব। আয়াজ হেসে উঠে বললো,
~ ঐপাশে ছিলাম তো তাই শুনতে পাই নি!
~ ঐপাশে কি করছিলা দুজনে?
~ কি শুনলে তুমি খুশি হবে?
~ সত্যি কথা বলো।

আয়াজ হাসছে। সবাই তার দিকে চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছে। ইরিনের মাথায় আসছে না এরা সবাই এমন নির্লজ্জের মত কথা বলছে কি করে? সবার কথার মাঝখানে একছুটে নিচে নেমে গেলো সে। কিন্তু আয়াজের রেহাই হলো না। তাকে ঘিরে সবাই জোট বেধে দাঁড়িয়েছে।
~ সত্যি কথা না বললে তোমাকে ছাড়ছি না।

আয়াজ বুঝতে পেরেছে একটা কিছু না শোনা পর্যন্ত এই মহিলা পার্টি তাকে ছাড়ছে না। সে লাজুক লাজুক ভাব নিয়ে বললো,
~ তোমরা যা ভাবছো তাই!
কথা শেষ করে সে প্রস্থান। আপন মনেই হাসছে সে! আহা! কি সুন্দর মিথ্যে।

পর্ব ১৭

ইরিন জামাকাপড়ের ব্যাগ খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। ব্যাগের সব জামাকাপড় দলামোচড়া হয়ে আছে। এখন সে কি পরবে? এখানে আসার আগে তাড়াহুড়োতে সব জামাকাপড় এলোমেলো করে ব্যাগে ঢুকিয়েছিলো। এখন ব্যাগ খুলতেই দেখলো সব কাপড় একেবারে দলামোচড়া হয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা। এদিকে সবাই মিলে শহরের মার্কেটে যাবে। যদিও বিয়ের শপিং সবার আগেই হয়ে গেছে তবুও মেয়েরা টুকটাক জিনিসপত্র কেনাকাটা করবে।

মার্কেট থেকে পার্লারে যাবে সবাই মিলে। মেয়েরা সবাই ফেসিয়্যাল করবে, মেনিকিউর, পেডিকিউর, চুল রিবোন্ডিং আরো কত কি? ইরিন আয়াজের কাছে থেকে পাঁচহাজার টাকা খসিয়েছে। আয়াজ প্রথমে দিতে চায় নি। এতগুলো টাকা শুধুমাত্র মুখের মাখামাখি আর চুলের কাটাকাটিতে চলে যাবে সে মানতে পারছে না। ইরিন বহুত জোরজবরদস্তি করে উদ্ধার করেছে। সবাই মার্কেটে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।
কিন্তু ইরিন ব্যাগের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে বসে আছে। আয়াজ মাত্র বাজার থেকে এসেছে। বিছানায় ছড়ানো ছিটানো জামাকাপড়গুলো একসাইডে সরিয়ে ফ্যানের নিচে বসলো সে। ইরিনের কান্না পাচ্ছে। মার্কেটে কি পরে যাবে সে?

আয়াজ হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
~ সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। বসে আছিস কেন?

~ আমি যাবো না।
~ কেন?
~ আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।

আয়াজ বুঝতে পারছে না তার কাছে থেকে জোর করে টাকা হাতিয়ে নেবার পরে হঠাৎ ইরিনের মতিভ্রম হলো কেন?
~ টাকা কি আরো লাগবে? মানিব্যাগে আছে নিয়ে যা।
~ আমি যাবো না।
~ কেন যাবি না কেন?

~ আমার ইচ্ছে।
আয়াজ ফ্রেশ হতে চলে গেলো। এই মেয়ের কখন কি খেয়াল উঠে সে নিজেও জানে না। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে এসে ইরিনকে আগের মতই চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ইরিনের কাছে এসে দাঁড়াল।

~ কি হয়েছে তোর?
~ কিছু হয় নি।
~ ইরিন এবার কিন্তু আমার হাতে মার খাবি?

~ আমি বলেছি না কিছু হয় নি? আপনি আপনার কাজ করুন না। আমাকে নিয়ে পড়েছেন কেন?
ইরিন হনহন করে বেরিয়ে যেতে নিলো। আয়াজ তার হাত চেপে ধরে বললো,
~ কি হয়েছে আমাকে বলবি তো? কেউ কিছু বলেছে?

~ না।
~ তাহলে?
ইরিন তার জামাকাপড়ের দিকে ইশারা করে বললো,
~ আমার সব জামাকাপড় কুঁচকে গেছে। এই কুঁচকানো জামাকাপড় পরে আমি যাবো কি করে?
~ আয়রন করে নিলেই তো হয়।

~ এখন আয়রন করতে বসলে রেডি হবো কখন? দেরী হয়ে যাবে। ওরা এতক্ষন আমার জন্য বসবে না।
~ যা তুই রেডি হয়ে নে। আমি আয়রন করে দিচ্ছি।
~ ওরা যদি চলে যায়?

~ আমি দিয়ে আসবো। যা তাড়াতাড়ি কর!
ইরিনের চোখদুটো খুশিতে চকমক করে উঠলো। মেকআপ বক্স খুলে সাজতে বসে গেলো সে। আয়াজ জামাকাপড় হাতে নিয়ে বললো,
~ কোনটা পরবি দেখিয়ে দিয়ে যা?

ইরিন ঘিয়ে রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ বের করে দিলো। আয়াজ বসে তার জামা আয়রন করছে, আর সে নিশ্চিন্ত মনে সাজুগুজু করছে। আয়াজের আয়রন করা শেষ কিন্তু তার সাজুগুজু শেষ হলো না। একটু পর মুক্তা এলো তাকে ডাকতে। তখনো ইরিনের সাজুগুজু কমপ্লিট হয় নি। মুক্তা প্রায় জোর করে টেনে তুলে নিয়ে গেলো তাকে।

ইরিন পায়ে আলতা দিয়েছে। নাকে নথ, কানে ছোট ছোট দুল, চুলগুলো দুদিকে বেনী করা। হলুদ রংয়ের একটা সুতি শাড়ী একপ্যাঁচি করে পরেছে, গাঁয়ের বধুদের মতো লাগছে ওকে। শুধু কোমরে একটা কলসি জড়ানো থাকলে পারফেক্ট হত! আজকে সুহানার হলুদে সবাই গায়ের বধু সাজবে ঠিক করেছে।
আয়াজ তার ঘরে বসে ল্যাপটপে মুভি দেখছে। ইরিন সেজেগুজে দুএকবার উঁকি দিয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার বর মহাশয় সেটা খেয়াল করেন নি। তিনি গভীর মনোযোগের সহিত মুভির ইন্ডিং পার্ট দেখছেন।

মুভি শেষ করে যখন উঠলেন তখনও ইরিন একবার ভেতরে এসেছে। আয়াজ তখন রুম থেকে বেরোচ্ছিলো, ইরিন দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তার সাথে ধাক্কা খায়। তখনও আয়াজ ভাবলেশহীনভাবে ইরিনের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ইরিনের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, আয়াজ এমন কেন? মহসিন ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার তার বউয়ের প্রশংসা করে ফেলেছে। আর ইনি? তার বউ যে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটাই খেয়াল করেন নি। ইরিনের ইচ্ছে করে আয়াজকে বউ সাজিয়ে নিজের সামনে বসিয়ে রাখতে। সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো যে খুব সহজ ব্যাপার নয় আয়াজকে বুঝিয়ে দিতে। শাড়ি পরিয়ে একগাদা মেকাপ মুখে মাখিয়ে দিয়ে বলতে, দেখ কেমন লাগে।

আয়াজ নিচতলার বিশাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে শিলনোড়ায় হলুদ পেষা দেখছে। সুহানার গায়ে হলুদ আজকে সন্ধ্যায়। আজকাল তো শিলনোড়া বিরল বস্তু, ঘরে ঘরে ব্লেন্ডার থাকায় শিলনোড়ার ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে গ্রামে এখনো এর ব্যবহার আছে। ইরিন আয়াজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, আমার যদি সাহস থাকতো তাহলে আমি আপনাকে ঠিক এইভাবে শিলনোড়ায় পিষতাম। অসভ্য লোক।
আয়াজ নিচতলায় নেমে এসেছে। ইরিন কাছে গিয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
~ আপনি হামানদিস্তা চিনেন?

আয়াজ চেঁচিয়ে উঠে বললো,
~ কী?
~ হামানদিস্তা!
~ কি এটা?
~ ওটা দিয়ে মষলা পিষে!
~ তো এখন আমি কি করবো?

~ করবো তো আমি!
ইরিন বিড়বিড় করে বলল, ওটার ভিতর নুন মরিচ ঢেলে আমি আপনাকে পিষবো! পিষে পিষে ভর্তা বানাবো। তারপর সেই ভর্তা ছাগলকে খাওয়াবো!
আয়াজ তার কথার আগাগোড়া কিছুই শুনলো না শিলনোড়ায় পিষনের শব্দে। ইরিনের ঠোঁট দুটো নড়তে দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি বিড়বিড় করছিস?
~ কিছু না।

আয়াজ ভেতরে চলে গেলো। ইরিন রাগে সামনের কাজের মেয়েটাকে সরিয়ে নিজে পিষতে বশে গেলো। আয়াজ কি অন্ধ? সে কি দেখতে পায় নি ইরিন সাজুগুজু করে আছে? কাঁচা হলুদের টুকরো গুলোকে আয়াজ ভেবে আচ্ছামত পিষলো কিছুক্ষন। হলুদ পেষার সময় আরো একটা কাজ করলো সে। হলুদে ইচ্ছেমত লবণমরিচ মেশালো। তা দেখে সামনে বশে থাকা মেয়েটা আতংকে চোখমুখ ফ্যাকাসে করে ফেলেছে। ইরিন উঠে চলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ ফিরে এসে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
~ মরিচমেশানো হলুদ ফেলে দিও সুলতানা।

~ জি আইচ্ছা।
কিন্তু কাজের ফাঁকে সুলতানা হলুদ ফেলার কথা ভুলে গেছিলো ফলাফল স্বরূপ সেই মরিচ মেশানো হলুদই সুহানাকে লাগানো হলো।

সুহানার প্রচন্ড চিৎকারে সবার কানের তালা ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা। অনবরত ঠান্ডা পানি ঢালা হচ্ছে মুখে, তাতে করেও চিৎকার কমছে না। সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। সবাই ওকে নিয়েই ব্যস্ত! হলুদের বাটিতে মরিচ আসবে কোথা থেকে?

কাজের মেয়েটাকে ডেকে আনা হলো! অবশেষে প্রচন্ড ধমকাধমকিতে সে স্বীকার করে ফেললো যে হলুদের মরিচ ইরিন মিশিয়েছে। শুধু মরিচ না নুনও মিশিয়েছে! হেলাল সাহেব, সোহেলি, রেশমি সবাই অস্থির এই খবর শোনার পর। ইরিনের সাথে তো সুহানার আগে কখনো দেখাই হয় নি, ইনফেক্ট গ্রামে আসার পর পরিচয় হলো, তাহলে কিসের শত্রুতা থেকে ইরিন এমন একটা কাজ করলো?

ইরিন গোমড়ামুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আয়জ পাঞ্জাবী পরে রেডি হয়ে বেরোচ্ছিলো। ইরিনকে একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টেনে তাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘরের লাইট অফ। আলমারির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইরিন। আয়াজ দাঁড়িয়েছে তার মুখোমুখি। একেবারে কাছাকাছি। ভ্রুজোড়া নাচিয়ে হাসিমুখে বললো,

~ কি ব্যাপার হরিণ? সাজুগুজু করে বারবার আমার সামনে ঘুরঘুর করছিস? মতলব টা কি তোর? মার্ডার করবি? খবরদার!
~ ঢং। দেখি ছাড়ুন।
~ চুপ। একদম চুপ। কোন কথা বলবি না তুই।

ইরিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একেবারে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ইরিন নড়তে পারছে না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আয়াজ তার কানের লতিকে আলতো করে একটা কামড় দিয়ে বললো,
~ হরিণ?

ইরিনের ঘোর লাগছে। অন্ধকারে দুটো মানুষ কাছাকাছি, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। একে ওপরের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। বুকের ভেতর ধুপধুপ করে ইরিনের। কোনরকমে জবাব দিলো সে,
~ হু?
আয়াজের হাতদুটো ইরিনের কোমর চেপে ধরেছে। ফিসফিস করে বললো,
~ আয় চল আমরাও একটা বেবি নিয়ে ফেলি? আমার এভাবে থাকতে কষ্ট হয়। খুব কষ্ট। আন্টিকে আমি বুঝিয়ে বলবো। নাতি নাতনী আসার খবর শুনলে তিনি রাগ করে থাকতে পারবেন না। তোর পড়াশোনার কোন ক্ষতি হবে না। বাবুকে আমি দেখে রাখবো। কেমন?

ইরিনের হাসি পাচ্ছে। এখন রোমান্স করার সময়? একটুপরেই সুহানার গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হবে। এই মানুষটা এমন কেন? সময়মত কিচ্ছু বলতে পারে না। অসময়ে সব গুলিয়ে একসাথে বলে দিচ্ছে।

~ ছাড়ুন আমাকে, সবাই অপেক্ষা করছে।
~ না। ছাড়বো না। আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে কিসব উল্টোপাল্টা অনুরোধ করে বসে আছেন। আমি হাদারাম সেইটা ধরেই বসে আছি। আজকে থেকে সব বাদ! শুধু বউ আর আমি! তুই আর আমি।

ইরিন ঠোঁট কামড়ে হাসছে। আয়াজ ওর গালে হালকা কামড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
~ হাসবি না খবরদার।
~ উহ্! কামড় দিচ্ছেন কেন? ব্যথা পাই তো!
~ ওয়াক থু। তোর গালে সব মেকাপ!

ইরিন চোখ পাকালো। অতঃপর আয়াজ মুচকি হেসে তার গালে গভীর আবেগে চুমু খেতে যাচ্ছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে তার রোমান্সের বারোটা বাজিয়ে তখনই দরজায় নক। দরজার বাইরে মুক্তা দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর ভঙিতে জানালো হেলাল সাহেব ইরিনকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ইরিন মুচকি হেসে দ্রত বেরিয়ে গেল। আয়াজও তার পেছন পেছন বেরলো। হেলাল সাহেব হঠাৎ ইরিনকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন সে বুঝতে পারছে না?

ভেতরে ঢুকে আয়াজ হেলাল সাহেবের পাশে বসলো। সোহেলিও আছে। হেলাল সাহেব শান্ত গলায় ইরিনকে প্রশ্ন করলেন, হলুদে লবণ মরিচ মিশিয়েছো কেন মা?
ইরিন চমকে উঠলো। প্রথমে জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে বসে রইলো। হেলাল সাহেব পুনরায় নরম কন্ঠে বললেন,
~ -কি হলো চুপ করে আছো কেন মা? তুমি কি ইচ্ছে করে হলুদের সাথে লবণ মরিচ মিশিয়েছো?
ইরিনের নতমুখে বললো,
~ জি বাবা।

হেলাল সাহেব, আয়াজ, সোহেলি সবাই চমকে উঠে একে অপরের দিকে তাকালেন। সোহেলি ধমক দিয়ে বললেন,
~ কি উল্টোপাল্টা কথা বলছিস তুই?

ইরিন কেঁদে ফেললো। আয়াজ অসহায় চেহারা নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। কি হচ্ছে না হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ইরিন কিসের হলুদে মরিচ মিশিয়েছে? কেন? ইরিন কান্না থামিয়ে আয়াজকে দেখিয়ে বললো,
~ আমি উনার ওপর রাগ করে হলুদের মরিচ মিশিয়েছি।

আয়াজ তব্দা খেয়ে গেলো। ইরিন বলছে কি? অন্য সময় হলে হেলাল সাহেব হেসে উড়িয়ে দিতেন কিন্তু আজকে পারলেন না। তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধের না। অহংকারী স্বভাবের। তার কানে এসব কথা পৌঁছালে লঙ্কাকাণ্ড বাধাবেন তিনি। হেলাল সাহেব বেশ কড়া কন্ঠেই ইরিনকে জিজ্ঞাসা করলেন,
~ আয়াজের ওপর রাগ করে তুমি সুহানার হলুদে মরিচ মিশিয়েছো কেন?
ইরিন পুনরায় ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
~ ভুল হয়ে গেছে বাবা।

আয়াজ স্থির চোখে ইরিনের দিকে চেয়ে আছে। ইরিন তার ওপর রাগ করে হলুদে মরিচ কেন মিশিয়েছে সে বুঝতে পারছে না। কিসের রাগ তার ওপর ইরনের? ইরিনের কান্নার বেগ বাড়ছে। হেলাল সাহেবের ইশারায় সোহেলি টেনে ঘরে নিয়ে গেলো তাকে। তিনি ইরিনকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে না যেতেই আয়াজের বড় চাচা এবং চাচী ভেতরে ঢুকলেন। কাজের মেয়ের কাছ থেকে ইরিনের মরিচ মেশানোর খবর শুনেছেন তারা। আয়াজের চাচা যদিও চুপ করে ছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী চুপ করে রইলেন না। কড়া মেজাজে হেলাল সাহেবকে ইরিন সম্পর্কে বেশ কিছু কটূ কথা শুনিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। অপমানে হেলাল সাহেবে মুখ লাল হয়ে গেছে। স্থিরভাবে বসে রইলেন তিনি।

আয়াজ বাবার সামনে নতমুখে বসে রইলো। ঘটনাগুলো এততাড়াতাড়ি ঘটেছে যে সে বুঝে উঠতে পারছে না তার কি করা উচিৎ? তবে সবকিছু মাথা থেকে সরিয়ে দিলেও একটা জিনিসই তার খুব লাগছে। বাবার অপমান!
হেলাল সাহেব ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন,

~ তুই কিছু মনে করিস না বাবা। তোর চাচী একটু রাগী।
ছোটবেলা থেকেই আয়াজ দেখে এসেছে তার চাচা, চাচী বিদেশে থাকেন। এর মাঝখানে দু একবার বোধহয় দেশে এসেছিলেন। তাই বড় চাচী মানুষটি কেমন সে সম্পর্কে আয়াজের কোন ধারণাই ছিলো না। কিন্তু আজকে তার ভালোভাবেই বোঝা হয়ে গেছে এই মহিলা যতই ভালোমানুষি দেখাক না কেন প্রচন্ড দাম্ভিক এবং অহংকারী প্রকৃতির।

আয়াজ বাবার সামনে থেকে উঠে ঘরে চলে এলো। বাবা যেমন ছেলেকে বোঝে তেমনি ছেলেও বাবাকে বোঝে। হেলাল সাহেব কতটা অপমান বোধ করছেন সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। তাদের নিজেদের ব্যাপার হলে নিশ্চই বাবা হাসিমুখে ইরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেন, এসব কোন ব্যাপার না মামনি। মন খারাপ করো না। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। বাবার জন্য দুঃখ হচ্ছে আয়াজের।

ইরিন কাঁদছে। সোহেলি বেগম তার পাশে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আয়াজ ভেতরে ঢুকে বললো,
~ তুমি বাইরে যাও মা। ইরিনের সাথে আমার কিছু কথা আছে।
সোহেলি প্রথমে যেতে চাইলেন না। আয়াজের কড়া নির্দেশে উঠে যেতে বাধ্য হলেন। আয়াজ দরজা আটকে ইরিনের সামনে এসে দাঁড়ালো,
~ হলুদে মরিচ কেন মিশিয়েছিস ইরিন?

ইরিন জবাব না দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আয়াজ আবারো জিজ্ঞেস করলো,
~ ইরিন কান্না বন্ধ কর। আমার কথার জবাব দে। হলুদে কেন মিশিয়েছিস মরিচ?
~ আপনার ওপর রাগ করে।
~ আমার ওপর রাগ করে? কেন?

~ আপনার ওপর আমার রাগ উঠেছিলো তাই।
আয়াজ ধারণা করে নিয়েছে ইরিন তার ওপর ছেলেমানুষি ধরনের কোন রাগ করে এই কাজ করেছে। পুরো ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে বললো,
~ আমার ওপর রাগ উঠেছিলো যখন আমার মুখে ছুঁড়ে মারলি না কেন মরিচ? হলুদে কেন মিশিয়েছিস?

ছোটবেলা থেকেই ইরিন এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের কাছে ভালোবাসা পেয়ে এসেছে। বিশেষ করে হেলাল সাহেব এবং সোহেলির কাছ থেকে। হেলাল সাহেব কখনোই তার সাথে এভাবে মুখ কালো করে কথা বলেন নি। এমনকি সে যখন সোহাগকে বিয়ে করবে বলেছিলো তখনো না। কিন্তু আজকে সামান্য একটা ভুলের জন্য সবাই তার সাথে খুব খারাপ ব্যাবহার করছে। অভিমানে কান্নার দলা পাকিয়ে আসছে তার।
~ আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি কি ইচ্ছে করে করেছি?

~ না তুই ইচ্ছে করে করিস নি। কিন্তু করেছিস তো? তোর এই সব ছেলেমানুষির জন্য সুহানা বেচারি শুধুশুধু কষ্ট পাচ্ছে।
~ আমি তো সুলতানাকে বলেছিলাম মরিচ মেশানো হলুদ ফেলে দিতে। সে ফেলেনি কেন?
~ তুই নিজে যখন হলুদে মরিচ মিশিয়েছিস তখন তুই নিজে ফেলে দিয়ে এলি না কেন?
~ আমার ভুল হয়ে গেছে।

~ এটা ভুল নয় ইরিন। খামখেয়ালিপনা। ছেলেমানুষি। শুধুমাত্র তোর জন্য বড়চাচী বাবাকে যাচ্ছেতাই কথাবার্তা বলে চলে গেছেন। আমি শুধু হাঁ করে দেখে গেছি। তুই বুঝতে পারছিস আমার কতটা খারাপ লাগছে?
~ আমার খারাপ লাগছে না? সবাই মিলে আমাকে বকছেন? মনে হচ্ছে যেন আমি সুহানা আপুকে বিশ মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছি!
~ আর সেটুকুরই বাকি আছে বোধহয়।

ইরিন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আয়াজ একবারও তার মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছে না? ইরিনের কি খারাপ লাগছে না? সে চোখমুছে থমথমে গলায় বললো,
~ আপনি তো জানতেন আমি এমন। আমাকে বিয়ে করেছেন কেন?
~ তুই প্রসঙ্গ বদলাচ্ছিস কেন?

~ আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।
~ তুই তখন ছোট ছিলি তাই তোর কাজকর্মগুলো সবার কাছে ছেলেমানুষি মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। এখন এসব পাগলামি বন্ধ কর। এখানে শুধু আমি আর তুই নই। আরো অনেকে লোক আছে। সবাই তোর এসব ছেলেমানুষি মেনে নেবে না।

ইরিন দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
~ সবাই নয় বলুন আপনি মানতে পারছেন না। আপনি আমাকে নিজের মত করে চালাতে চাইছেন। আমি যাই করি তাতেই আপনার না। হলুদে মরিচ মেশানো নিয়ে কেউ আমাকে এত কথা শোনায় নি যতকথা আপনি আমাকে শুনিয়েছেন। কিন্তু একটা কথা ক্লিয়ারলি শুনে রাখুন আমি যেমন আছি তেমনই থাকবো। একটুও বদলাবো না।

আয়াজ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে। ইরিন পুনরায় তিক্ত কন্ঠে বললো,
~ খারাপ লাগছে তাই না? সত্যি কথা শুনলে সবারই খারাপ লাগে। আপনারও লাগছে।

ইরিন রাগ করে বেরিয়ে গেলো। মুক্তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো সে। আয়াজ হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব তো ইরিনের ছেলেমানুষি কথাবার্তা নয়? খুবই কঠোর ধরনের কথাবার্তা। তবে ইরিন কি তাকে একটুও ভালোবাসে নি? হঠাৎ করে বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ারের ওপর বসে রইলো। মাথা থেকে ইরিনের বলা কথাগুলো কিছুতেই সরাতে পারলো না। কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠছে! অবশেষে আলমারি থেকে নিজের জিনিসপত্র বের করে গোছাতে শুরু করলো সে।

সোহেলি ছেলেকে শান্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। খবর শুনে হেলাল সাহেবও ছুটে এসেছেন। ছেলেকে বাধা দিয়ে বললেন,
~ রাগ করিস না বাবা। সবাই মিলে একসাথে রাগ করলে মেয়েটা যাবে কার কাছে।
~ আমি ওর ওপর রাগ করি নি। আমি শুধু ওকে ওর মত থাকতে দিতে চাইছি।

হেলাল সাহেব মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আয়াজ বাবামাকে সালাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বাবার হাত ধরে বললো,
~ আমি জানি বাবা, বড়চাচীর কথায় তুমি খুব কষ্ট পেয়েছো। তার জন্য তুমি ইরিনের ওপর রাগ করে আছো। তুমি ওর ওপর রাগ করে থেকো না বাবা প্লিজ। তুমি তো জানো ও ছেলেমানুষ। হুটহাট যা করতে মন চায় তাই করে বসে। লুকোচুরি করে কিছু করা ওর ধাতে নেই। তুমি প্লিজ ওকে ক্ষমা করে দিও। ইরিন আমার চেয়ে তোমাদের ওপর বেশি ভরসা করে। তুমি রাগ করেছো বলেই ওর বেশি অভিমান হয়েছে।

হেলাল সাহেব ছেলের রাগটা ঠিক কোন জায়গায় হয়েছে বুঝতে পারলেন না। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
~ তুই একদম চিন্তা করিস না। তোর যা ঠিক বলে মনে হয় তুই কর। ইরিনকে আমরা সবাই মিলে দেখে রাখবো।

মুক্তা এসে ইরিনকে আয়াজের চলে যাওয়ার খবরটা দিতেই ইরিন চমকে উঠলো। মুক্তা তার হাত ধরে টানাটানি করে বললো,
~ তুই এখনো বসে আছিস কেন? আয়াজ চলে যাচ্ছো তো?
~ যাক।

ইরিন একফোঁটাও নড়লো না। থম মেরে বসে রইলো। তবে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। আয়াজের এত রাগ তার ওপর? এই তাকে ভালোবাসে আয়াজ? কচুবাসে। যাক! চলে যাক। ইরিনের কি? সে জীবনেও আটকাবে না। কেন আটকাবে? ইরিনের কি ঠেকা পড়েছে? তিনি নিজের ইচ্ছে তে যাচ্ছেন। ইরিন তো তাকে যেতে বলে নি? রাগের বশে দুটো কথা বলে ফেলেছে তার জন্য চলে যেতে হবে? এমন ভালোবাসার দরকার নেই ইরিনের।
মুক্তা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলো। আয়াজ ব্যাগ গুছিয়ে মুক্তার ঘরে এসে ঢুকলো। ইরিনের খাটের ওপর হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। আয়াজ শান্ত স্থির কন্ঠ বললো,

~ আমি যাচ্ছি ইরিন!
ইরিন আগেই মতই বসে রইলো। তার চোখের পানি পায়ের পাতার ওপর পড়ছে। মুখটা নিচু করেই রাখলো। তার অভিমানিনী মুখটা আয়াজকে দেখাতে চাইলো মা। নিশ্চুপ ভাবে বসে রইলো। আয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
~ তুই ঠিকই বলেছিলি ইরিন, তুই আমাকে একটুও ভালোবাসিস না। তুই তো শুধু রাগই করতে জানিস। যাইহোক, আমি যশোরে ফিরে যাচ্ছি। তুই তোর মত থাকিস। আমি আর তোর কোন কিছুতে বাধা দিবো না। কিচ্ছুতে না। তোর যখন যা করতে মন চায় তুই করিস। যদি মন চায় পড়াশোনাটুকু ঠিক মত করিস। তুই খুব ভালো ছাত্রী। একটু মনোযোগ দিলেই পারবি। আমি আসি।

মুখে হাত দিয়ে ফোঁপানোটা আটকালো ইরিন। নিজেকে শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,
~ আপনার যেখানে ইচ্ছে যান। আমাকে বলছেন কেন?

আয়াজ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরে ধীরে দরজার দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো,
~ আমি যাচ্ছি ইরিন?
~ যান।

বস্তুত আয়াজ চাইছিলো ইরিন একবার তাকে সরি বলুক। একবার তাকে যেতে নিষেধ করুক। আর ইরিন চাইছিলো আয়াজ তাকে সরি বলুক! আগের মত ভালোবেসে ইরিনের রাগ ভাঙাক! কিন্তু না দুজনের একজনও কিছু বলতে পারল না। পরস্পরের অভিমান নিয়ে দূরে সরে রইল। দুপক্ষই চাইছে অপরপক্ষ আত্মসমর্পণ করুক কিন্তু কেউ নিজে আত্মসমর্পণ করতে রাজী নয়!

বিয়ের দিন ইরিন কাপড়ের ব্যাগ খুলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। তার সব জামাকাপড় আয়রন করে ভাঁজমত রাখা আছে। সেদিন ইরিন মার্কেটে চলে যাবার পর আয়াজ তার ব্যাগের সব জামাকাপড় আয়রন করে গুছিয়ে দিয়ে গেছে। ইরিন রাগে অভিমানে সব এলোমেলো করে ফেললো। এলোমেলো জামাকাপড় হাতে নিয়ে অনেক্ষন মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো। বিড়বিড় করে বললো, আপনার আয়রন করা জামাকাপড় আমি পরবো না। কিছুতেই না।

পর্ব ১৮

সুহানার বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর দিনই সবাই ঢাকায় চলে এলো। সবকিছু শুরু হলো নতুন নিয়মে। ইরিন রোজকার নিয়মে কলেজে যায়। ক্লাস করে। বাসায় ফিরে পড়াশোনা করে। মাঝেমধ্যে সোহেলির কাজে টুকটাক সাহায্য করে।
আজকে রবিবার। ইরিন কলেজে গেছে। সোহেলি ড্রয়িংরুমে বসে মুক্তার সাথে সাংসারিক আলাপ করছিলেন। এমন সময় তাঁর ফোন বেজে উঠলো। আয়াজ ফোন করেছে।

~ হ্যালো মা?
~ কেমন আছিস বাবা?

আয়াজের জ্বর। জ্বর নিয়ে হস্পিটালে ডিউটি করছে সে। আজকে রোগীদের প্রচুর ভিড়। দম ফেলার সময় নেই। ডিউটি করতে করতে হাঁপিয়ে গেছে। এর ফাঁকেই সুযোগ করে সোহেলিকে ফোন করেছে বাসার সবার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য।
~ আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?
~ আমরা সবাই ভালো আছি। তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন বাবা?

~ কালকে রাত থেকে গায়ে গায়ে হালকা জ্বর। টেনশন করার কিছু নেই।
~ ওষুধ পত্র নিয়েছিস?
~ হ্যাঁ। আচ্ছা মা বাবা কি বাসায় আছে?
~ তোর বাবা চেম্বারে।

~ ও, তোমার শরীর কেমন? ভাবি? ভাইয়া, ওরা কেমন আছে?
~ আমি ভালো আছি। তোর ভাবি, ভাইয়া সবাই ভালো আছে।
আয়াজ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ফোনের ওপাশ থেকে ফিসফিসিয়ে বললো,
~ ইরিন কেমন আছে মা?

আয়াজ না থেমেই গলাটা আরো খাদে নামিয়ে নিলো, যেন ইরিন ফোনের ওপাশ থেকে তার কথা শুনতে পাচ্ছে। ফিসফিস করে বললো,
~ ও কি আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করে?

ছেলের প্রশ্নের জবাবে সোহেলি কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ইরিন আয়াজের ব্যাপারে কিছুই জানতে চায় নি। তিনি অবশ্য ইরিনকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুক্তার সাথে আয়াজের কথা বলেন। ইরিন যে শোনা না তাও নয়। আড়াল থেকে আড়িপেতে শোনে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না। তবে সেটুকু তো আর ছেলেকে বলা যায় না। সোহেলি ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য মিথ্যে বললেন,
~ বলে তো। রোজ তোর কথা জিজ্ঞেস করে।

তুই ফোন করেছিস কি না? ভালো আছিস কি না। নিজের শরীরের যত্ন নিচ্ছিস কি না। এসব জিজ্ঞেস করে।
আয়াজের গলাটা উৎফুল্ল শোনালো। মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
~ ও কি ভালো আছে মা? ঠিকমত পড়াশোনা করছে তো?
~ করছে।
~ ঠিক আছে মা। আমি এখন রাখছি তাহলে।

ক্লাস শেষে করিডোরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো ইরিন। ইত্তি এসে মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
~ কি রে ইরিন, তোর কি মন খারাপ?
~ না তো?

~ কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে তোর মন খারাপ?
~ তোর এমন মনে হওয়ার কারণ?
~ কারণ তোর মুখটা বেলুনের মত চুপসে আছে।
~ তাই নাকি?

~ হুম। একটু আগে আয়াজ ভাইয়ের সাথে কথা হলো। তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন? তোর সাথে কথা হয় নি?
চাপা অভিমানে বুক ভার হয়ে এলো ইরিনের। কই আয়াজ তো তাকে ফোন করে নি?

একবারও জানতে চায় নি ইরিন কেমন আছে? সে তো রোজ আয়াজের ফোনের অপেক্ষা করে বসে থাকে। রাগ হলো তার। ইত্তিকে ফোন দিয়ে ন্যাকামি করা হচ্ছে? বোঝাতে চাইছে তিনি ইরিনকে খুব ভালোবাসেন? কি সুন্দর ছলনা। সবার কাছে ভালো সাজতে চাইছেন? এতই যখন ভালোবাসা তখন ইরিনকে ফোন করলো না কেন?

~ কি রে? কথা হয় নি তোর সাথে?
~ না!
~ কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ?

ক্ষোভ জমা হলো ইরিনের কন্ঠে, যার খোঁজ রাখার কথা সে একটা ফোন পর্যন্ত করে না আর এ এসেছে ঢং দেখাতে। থমথমে গলায় বললো,
~ এসব ঢং তোর গার্লফ্রেন্ডকে গিয়ে দেখা। আমার সাথে এসব নেকামি একদম করবি না।

~ রাগছিস কেন? আমি তো ভালো কথাই জিজ্ঞেস করলাম?
~ না করবি না। আমি ভালো আছি না খারাপ আছি তা দিয়ে তুই কি করবি?
~ আচ্ছা বাবা আমি আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবো না। তুই ঝগড়া করিস না প্লিজ।
~ কি বললি তুই?

ইরিনের অকারণে রেগে যাওয়া দেখে ইত্তি হেসে ফেললো। কিন্তু ইরিন কাঁদছে। অভিমানের পাহাড় জমা হলো বুকের ভেতর। ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
~ হ্যাঁ আমি তো ঝগড়ুটে। আমি খুব খারাপ। তো আসছিস কেন আমার সাথে কথা বলতে?
ইত্তি অবাক হয়ে ইরিনের দিকে চেয়ে আছে। কোমল স্বরে বললো,
~ তুই কাঁদছিস কেন?

ইরিন জবাব দিলো না। ইত্তি পুনরায় মোলায়েম কন্ঠে বললো,
~ তোর কি আয়াজ ভাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে?
ইরিন ফুঁপিয়ে উঠলো। ইত্তি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগেই তো আয়াজের সাথে তার কথা হলো। ইরিনের কথা জানতে চাইলো? এর মাঝখানে ঝগড়া হলো কখন?

~ চুপ করে আছিস কেন ইরিন? তোর কি আয়াজ ভাইয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে?
~ জানি না।
~ জানি না মানে?
~ আজকে দেড়মাস উনার সাথে আমার কোন যোগাযোগ নেই।
~ মানে?

~ হুম। বিগত দেড়মাস যাবত উনি আমার কাছে একটা ফোন পর্যন্ত করে নি। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি সেই খবরটুকুও নেই নি। এমনকি বিয়ের অনুষ্ঠানের পর থেকে আর বাসায় আসে নি। আমি আর পারছি না ইত্তি। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। মরে যেতে চাই আমি।
~ কি সব উল্টোপাল্টা কথা বলছিস? আয়াজ ভাইয়ের সাথে আমার প্রায়ই কথা হয়। উনি তো সবসময়ই তোর কথা জিজ্ঞেস করে?

ইরিনের অভিমান কমলো না। বরং দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। থমথমে গলায় বললো,
~ এবার যদি জিজ্ঞেস করে বলবি ইরিন মরে গেছে। তার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই।
~ থাম! পাগলের মত কি সব বলছিস তুই? আমি আয়াজ ভাইয়ের সাথে কথা বলবো।

~ খবরদার যদি তুই উনাকে কিছু বলেছিস! তোর সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। উনি যখন আমাকে ছাড়া থাকতে পারছে আমিও পারবো। আরো বেশি করে পারবো। তুই কি ভাবছিস আমি উনার জন্য মরে যাবো? কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবো? নো, নেভার। আমি কখনো তা করবো না। আমি নিজের মত ভালো থাকতে জানি। লাগবে না আমার কারো সিমপ্যাথি!

দুপুরে খাবার টেবিলে সোহেলি ইরিনকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুক্তাকে বললেন,
~ আয়াজের জ্বর বউমা। শরীর বোধহয় ভালো নেই। কাজেরও বোধহয় খুব চাপ যাচ্ছে। বাসার সবার কথা জিজ্ঞেস করলো। আমি বলেছি আমরা সবাই ভালো আছি। আমাদের নিয়ে চিন্তা করার কোন দরকার নেই।

কথাটা শেষ করে তিনি ভয়ে ভয়ে ইরিনের দিকে তাকালেন। ইরিন চুপচাপ খাচ্ছে। বস্তুত সে খাচ্ছে না। খাবার গিলছে। তার চোখে অলরেডি পানি চলে এসেছে। সোহেলি ইরিনের রিয়েকশনের আশায় চুপ করে রইলেন। কিন্তু ইরিন একটা কথাও বললো না। চুপচাপ খাবারে পানি ঢেলে উঠে চলে গেলো। সোহেলি আবারও মনে মনে হতাশ হলো।

ইরিন খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। আয়াজ সবার সাথেই কথা বলে। অথচ ইরিনকে একটা ফোন পর্যন্ত করলো না। চাপা অভিমানে নিজেকে শান্ত করার জোর চেষ্টা চালালো সে। নিজের প্রবোধ দিলো, কষ্ট পাওয়ার কোন দরকার নেই। কার জন্য কষ্ট পাবে সে?

যেই মানুষটা এতদিনে একবারও ইরিনের খোঁজ নেই নি তার জন্য? ইরিন রোজ ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে মানুষটার একটা ফোনের অপেক্ষায়। অথচ সে দিব্যি ইরিনকে ভুলে ভালো আছে। তার জন্য ইরিন কষ্ট পাবে না।
রাগে আছাড় মেরে নিজের ফোন ভেঙ্গে ফেললো। ফোন যখন আসেই না তখন এই জিনিস রেখে লাভ কি? আর অপেক্ষা করবে না সে।

রাতের দিকে আয়াজ আবার সোহেলির নাম্বারে ফোন করলো। সোহেলি শোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আয়াজ টুকটাক কথাবার্তা সেরে বললো,
~ ইয়ে মানে, মা তুমি কি আমার জ্বরের কথা ইরিনকে বলেছো?

সোহেলি ছেলের জন্য দুঃখ বোধ করলেন। তিনি দুপুর বেলা খাবার টেবিলে ইরিনকে শুনিয়ে শুনিয়ে আয়াজের জ্বরের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ইরিন তো কিছুই বলে নি! খাবার টেবিল ছেড়ে সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করেছে আর বেরোয় নি। তিনি আবারো ছেলেকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
~ হ্যাঁ বাবা।

বলেছি। সে তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। আমি আর তোর ভাবি মিলে অনেক কষ্ট শান্ত করেছি।
আয়াজ মনে মনে দুঃখ বোধ করলো। ইরিন নিশ্চই অনেক কান্নাকাটি করছে? সোহেলিকে বললো,
~ কেন বলেছো মা? ও কি খুব বেশি কান্নাকাটি করছে?

~ করছে তো। খুব করছে!
~ আমি কি ওকে একটা ফোন করবো?

~ কর না।
~ ঠিক আছে আমি ওকে ফোন করছি তাহলে। এখন রাখি।
~ খোদা হাফেজ!
আয়াজ অনেকবার ইরিনের নাম্বারে ট্রাই করলো কিন্তু বন্ধ আসছে। অবশেষে আবার সোহেলির নাম্বারে ডায়াল করলো সে।
~ হ্যাঁ মা?
~ কী বাবা?

~ ইরিনের ফোন বন্ধ আসছে কেন? ও কি ঠিক আছে?
সোহেলি ইরিনের ফোন ভাঙ্গার কথা কিছুই জানেন না। তিনি ভেবেছেন ইরিন রাগ করে ফোন ধরছে না কিংবা সুইচড অফ করে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস চেপে বললেন,
~ একদম ঠিক আছে। ও ঘুমাচ্ছে। আমি কি ডেকে দেবো?
~ থাক ডাকার দরকার নেই। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলো, আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে টেনশন করার দরকার নেই।

~ ঠিক আছে বাবা রাখি?
~ হ্যাঁ মা। রাখছি খোদা হাফেজ।
সোহেলি ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের সাথে মিথ্যে বলায় তার খুব খারাপ লাগছে। এদিকে সত্যিটাও বলতে পারছেন না পাছে ছেলে দুঃখ পায়।

ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। আয়াজের টেনশন হচ্ছে। ইরিন তো এত সকাল সকাল ঘুমায় না। ওর ফোন সুইড অফ বলছে কেন? ইরিনের কি শরীর খারাপ? নাকি অন্য কিছু? সোহেলি বেগম কি আয়াজের কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন? অবশেষে ভেবেচিন্তে মুক্তার ফোনে ফোন দিলো আয়াজ। লাজুক কন্ঠে বললো,
~ ভাবি মা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি কি কষ্ট করে ইরিনকে একটু ডেকে দিতে পারবে? আমি ওর ফোনে ফোন করেছিলাম। সুইচড অফ বলছে।

~ আচ্ছা ঠিক আছে দাঁড়াও, আমি দেখছি।
মুক্তার ফোন নিয়ে ইরিনের ঘরে ঢুকলো। ইরিন ওয়াশরুম। ফোন টেবিলের ওপর রেখে ওয়াশরুমের দরজা নক করে বললো,
~ তোর ফোন এসেছে ইরিন। আমি টেবিলের ওপর রেখে যাচ্ছি।

মুক্তা ফোন রেখে বেরিয়ে গেলো। ইরিন ওয়াশরুম থেকে বেরোতে বেরোতে ফোন কেটে গেলো। একটু পর আবার রিং হলো। স্ক্রিনে আয়াজের নাম দেখে চমকে উঠলো সে। পুরোনো অভিমান মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। এতদিন বাদে তার খবর নিতে এসেছে? সবার ফোনে ফোন করে তার খবর নিয়ে নিজেকে মহান প্রমাণ করতে চাইছেন? এতদিন কোথায় ছিলো ভালোবাসা?

ফোন রিসিভ করলো না ইরিন। ফোন হাতে নিয়ে বসে রইলো। কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। আয়াজ আবারো ফোন দিলো। আবারো ফোন কেটে গেলো। পরোক্ষনেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো ইরিন। নিজেকে নিজে বোঝালো ফোন রিসিভ করে আয়াজকে ইচ্ছেমত কথা শুনিয়ে দিবে।

এতদিন বাদে কেন ফোন করেছে ইরিনকে? মায়া দেখাতে? লাগবে না ইরিনের কোন মায়া! আবার ফোন বেজে উঠতে ফোন রিসিভ করে শক্ত কন্ঠে বললো,
~ বেহায়ার মত কেন বারবার ফোন দিচ্ছেন আমাকে? আমি আপনার সাথে কথা বলতে চাইছি না। আপনি বুঝতে পারছেন না?

ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো কেবল তারপরই ফোন কেটে গেলো। ইরিন রাগে অভিমানে ফোন আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেললো। একবার বলতেই ফোন কেটে দিলো? এই ভালোবাসে তাকে? সব নাটক! মিথ্যে অভিনয়। ইরিনকে এখন আর উনার সহ্য হয় না। ঘরের দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমে ঢুকে অনেক্ষনযাবত কাঁদলো। রাগে দুঃখে আলমারি থেকে আয়াজের জিনিসপত্র সব ফেলে দিলো। কিচ্ছু রাখবে না সে। কিচ্ছু না। সোহেলি অস্থির হয়ে ছেলের কাছে আবার ফোন দিলেন।

পর্ব ১৯

সোহেলি আয়াজে সাথে কথা বলছিলেন। ইরিন গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলো। খাটের ওপর মাথা নিচু করে বসে রইলো। সোহেলি তার কাছে এগিয়ে আসতেই ফুঁপিয়ে উঠলো। ক্রমেই ফোঁপানো বাড়লো। সোহেলি বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলেন মেয়েটার মুখখানা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে।

আঙ্গুলের ডগায় অভিমানী মুখখানা তুলে ধরতেই ইরিন তাঁকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। ছোট বাচ্চাদের মত গলা ফাটিয়ে কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেললো। সোহেলি অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করলেন। মুচকি হেসে তার চোখের পানি মুছে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
~ কান্না বন্ধ কর। আয়াজ আসছে।

ইরিনের ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষন উনার দিকে চেয়ে রইলো। পরোক্ষনেই খুশিতে, লজ্জায়, আনন্দে মুখখানা রাঙ্গা হয়ে উঠলো। সোহেলি হেসে উঠে বললেন,
~ মেরে তোকে সোজা করবে বলেছে। নে ধর কথা বল?

ইরিন হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো। ফোন কানে দিয়ে চুপ করে রইলো। ওপর পাশে থেকে আয়াজ চুপচাপ ফোন কানে ধরে রইলো। ইরিনের ফোঁপানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আওয়াজটা তার বুকে গিয়ে লাগছে একদম। নরম, কোমল স্বরে বললো,
~ ”হ্যালো।

তার গলা শুনেই ইরিনের কান্নার বেগ বেড়ে গেলো। গলা জড়িয়ে এলো। নিজেকে সামলে কোনরকমে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলো সে,
~ হ্যা লো?

আয়াজ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মোলায়েম কন্ঠে বললো,
~ পাগলামি করে লাভটা কি হলো? নিজেও কষ্ট পেলি আমাকেও কষ্ট দিলি!
কান্না চাপাতে গিয়ে ইরিনের হেঁচকি উঠে গেছে। ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
~ আপনি আসবেন?
~ আমি গাড়িতে।

ইরিনের সমস্ত হৃদয় জুড়ে কত ডিগ্রী গলনাংকের শীতল স্পন্দন বয়ে গেলো সে নিজেও জানে না। মলিন মুখখানায় ফুটে উঠলো হাজার পাওয়ারি নিঃশব্দ হাসি। খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। সোহেলি গভীর দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন আর হাসছেন।

চেইঞ্জ করার জন্য আলমারি খুলতেই আয়াজের বুকের ওপর টলে পড়লো ইরিন। বিস্ময়ে হাঁ হয়ে আছে আয়াজ! আলমারির ভেতর ইরিন? কীভাবে? কেমন করে? ইরিন জ্ঞান হারিয়েছে। ওকে পাঁজকোলা করে তুলে তাড়াতাড়ি খাটে শুইয়ে দিলো সে। চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো।

সন্ধেবেলা যখন ইরিনের জ্ঞান ফিরলো হাতে স্যালাইন পুশ করা দেখলো। ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলো আয়াজের ঘরে। রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! রুমে আয়াজ নেই। সে উঠে বসার চেষ্টা করতেই আয়াজ গলায় ঝোলানো তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। খালি গা! বুকের কাছে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে, মোমের মত পলিশ করা মনে হচ্ছে ওর শরীরটাকে। লজ্জা মাথা নামিয়ে ফেললো ইরিন। আয়াজ মাথা মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো, এখন কেমন লাগছে?

~ ভালো!
আয়াজ কাছে এসে ওর স্যালাইন চেক করে বললো,
~ স্যালাইন শেষ! তুই খুলতে পারবি?

ইরিন মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। সে খুলতে পারবে না। আয়াজ ওর পাশে বসে খুব যত্নসহকারে ক্যানুলা আলগা করে দিলো। ব্যথায় ‘আহ’ করে উঠলো ইরিন। চোখে পানি চলে এলো। আয়াজ ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার সুই বিঁধানো জায়গায় ফুঁ দিতে শুরু করলো। কোমল গলায় বললো,
~ একটু ধৈর্য ধর। সামান্য ব্যথা। একটু পরেই কমে যাবে।

ইরিনের ব্যথা করছে না। সামান্য একটু সুঁইয়ের ফোঁড়ে আর কতটুকুই বা ব্যথা লাগে। তবে হাত সরাল না সে। চুপচাপ বসে রইলো। আয়াজ তুলোতে হেক্সিসল নিয়ে তার কাটা জায়গা মুছে দিয়ে। তারপর একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। ইরিন মুগ্ধ হয়ে দেখছে। কি সুন্দর স্নিগ্ধ মুখ! দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। অথচ ইরিন? দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে। ব্যান্ডেজ লাগানো শেষে আয়াজ বললো,
~ হয়ে গেছে। আর ব্যথা করবে না।

ইরিন বেরোতে গিয়ে দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে এলো। তার হাতে স্যালাইন এর খালি ব্যাগ আর তুলো। আয়াজ খাটের ওপর লম্বা হয়ে শুয়েছে। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। একে শরীর খারাপ তার ওপর জার্নি করে এসেছে। ইরিনকে ফিরে আসতে দেখে বললো,
~ কিছু বলবি?
এতক্ষন যাবত কারো সাড়া শব্দ না পেয়ে ইরিন মাথা নিচু করে বললো,
~ বাসায় কেউ নেই?

আমি কি করে জানবো? চুরি করতে এসেছিস তুই, তুই জানিস না বাসায় কেউ আছে কি নেই?
ইরিনের মুখ লজ্জায় আরক্তিম হয়ে গেলো। ইসশ! জ্ঞান হারালো কিভাবে সে? কি সুন্দর আয়াজকে সারপ্রাইজ দেওয়া যেত? আলমারি খুললেই টুক করে চুমু খেয়ে নিতো আয়াজের গালে। তার হঠাৎ বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার কারনে পুরো প্ল্যানটাই মাটি! এদিকে আয়াজ কম্বলের নিচে মাথা মুড়িয়ে নিয়েছে।

ইরিনের প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে, এমন কেন এই মানুষটা? একটু ধরা দিলে কি হয়? এই যে ইরিন সোনালি কালারের ব্লাউজের সাথে টকটকে লাল শাড়ি পরে সেজেছে কার জন্য? একটা বার দেখলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে? উনার প্যান্টের জিপ আটকে যাবে?

না ট্রাউজারের ফিতে? নাকি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীর ঘোরা? কোনটাই আটকাবে না। তাহলে? হি ইজ টু রুড!
কাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে ইরিন আলমারিতে ঢুকে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলো? এসব তো উনার চোখে পড়ে না?

কেবল ইরিনের রাগটাই চোখে পড়ে। হাতের তুলাটা ফেলে দিলো সে, স্যালাইন ব্যাগটাও ছুঁড়ে মারলো। তারপর সটাং করে আয়াজের কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লো, আহ! মিষ্টি ঘ্রাণ! মুখ বন্ধ করে নাক দিয়ে লম্বা নিশ্বাস টানলো সে। মাত্র সাওয়ার নিয়েছে আয়াজ। সারা গায়ে মিষ্টি গন্ধ!
~ কি ধারালো শাড়ি পরেছিস? আমার চামড়া ছিলে যাচ্ছে। সর।

~ যাক ছিলে সরবো না আমি!
আয়াজ কিছু বললো না। চুপচাপ শুয়ে রইলো। ইরিন তাকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
~ আপনি কি টায়ার্ড?

আয়াজ উপরে নিচে মাথা দোলালো।
~ আমি আদর করে দিলেই দেখবেন সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে।

আয়াজ তব্দা মেরে খানিকক্ষণ তার দিকে চেয়ে রইলো। হতবাক হয়ে বললো,
~ এসব অশ্লীল কথা কোথায় শিখেছিস তুই? লজ্জাশরম নাই তোর?

ইরিন দ্বিগুন বেগে তার টি-শার্ট মুঠোয় চেপে ধরে বললো,
~ না নেই।
~ আমার লজ্জা লাগছে ইরিন ছাড়! কি করছিস?

~ লাগুক! আমি তো লজ্জা পাচ্ছি না?
ইরিন আয়াজের টি-শার্ট টানাটানি শুরু করে দিলো। আয়াজ ওর হাত চেপে ধরে বললো,
~ কি করছিস কি তুই?

ইরিন ফিসফিস করে তার কানে কিছু একটা বললো। আয়াজ বিড়বিড় করে বলল,
~ মাত্র গোসল করে এসেছি আমার ঠান্ডা লেগে যাবে।

~ লাগুক!
~ -তুই কি চাইছিস ঠাণ্ডায় আমি মরে যাই?
~ আমি কেন চাইবো আপনি মরে যান? আমি তো আপনাকে মারতে চাই, এইযে এভাবে চেপে ধরে!
আয়াজ ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে বলল, বুকের ওপর থেকে সর ইরিন, আমার প্যালপিটিশন হচ্ছে, তুই ভর্তা করে ফেলছিস আমাকে!

~ ভর্তাই করবো আপনাকে কেন ভর্তা করবো জানেন? আপনাকে খাওয়ার জন্য! গিলে ফেলবো একদম!
~ -তুই না একটু আগে বেহুঁশ হলি? গায়ে এত জোর এলো কী করে? ভালো কথা, তুই আলমারিতে ঢুকেছিলি কেন?

~ আপনার জামাকাপড় খাওয়ার জন্য, তখন তো আপনি ছিলেন না তাই আপনার জামাকাপড় খাবো বলে ঢুকেছি, ওগুলোতে আপনার গায়ের মিষ্টি একটা ফ্লেভার আছে। এখন তো আপনি চলে এসেছেন তাই আপনাকে গিলে খাবো!
~ হজম করতে পারবি?

~ হজম করবো কেন?
~ তাহলে গিলে কি করবি?
~ স্টোর করে রাখবো। আপনি যাতে আমাকে ছেড়ে আর কোথায় যেতে না পারেন সেই জন্য।
~ আচ্ছা?
~ হুম।

আয়াজ হাই তুললো। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু তার। ইরিনের ওর মুখের কাছ থেকে হাত নামিয়ে দিয়ে বললো,
~ এই আপনি হাই তুলছেন কেন? আমি এখন আপনাকে ঘুমাতে দেবো না।
~ ঘুম আসছে তো?
~ না আপনি এখন ঘুমাতে পারবেন না।
~ আয় তুইও ঘুমা।

আয়াজ ওকে টেনে নিতেই ইরিন তার বুকের ভেতর ঢুকে গুটিসুটি মারলো ঠিকই কিন্তু শান্ত থাকলো না। একবার এদিকে নড়ছে, তো আবার অন্যদিকে। কনুই দিয়ে আয়াজকে ঠেলা শুরু করে দিলো। শক্ত করে চেপে ধরলো তাকে। আয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
~ থাক লাগবে না আমার ঘুমানো। ঘুম হয়ে গেছে! তুই দয়া করে ছাড় আমাকে! আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

ইরিন ছাড়লো না। একেবারে সেঁটিয়ে রইল আয়াজের সাথে। তার বুকে আলতো করে কামড় বসিয়ে দিলো বিজয়ী হাসি বলল,
~ আর কখনো আমাকে কষ্ট দিবেন? বলুন। বলুন বলছি। না হলে আবার কামড় দিবো?
আয়াজ মুচকি হাসলো। আদুরে গলায় বললো,
~ কষ্ট হয় তাহলে?

ইরিনের হাসি হাসি মুখটা চুপচাপ হয়ে গেলো। জবাব না দিয়ে পলকহীন ভাবে আয়াজের মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। কি নিষ্ঠুর লোক! কষ্ট দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করছে কষ্ট হয় কি না? ইরিন কেন বলবে? কিচ্ছু বলবে না। আয়াজ ঠোঁট কামড়ে হেসে চলেছে। ইরিন রাগে আয়াজের নাক বরাবর ধারালো কামড় বসিয়ে দিলো। আয়াজের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। ব্যথায় নাকমুখ কুঁচকে বললো,
~ হ্যাঁ কামড়া, কামড়া। কামড়ে হাড্ডিমাংস সব তুলে নে, বদ মেয়ে। আমি তো আছিই শুধু তোর অত্যাচার সহ্য করার জন্য।

ইরিন চট করে তার ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে নিলো। আয়াজ স্তব্ধ! দুহাতে তাকে আঁকড়ে ধরলো ইরিন। সে পরাস্ত! প্রতিবাদহীন ভাবে পরাস্ত! এতদিনের রাগ, জেদ, অভিমান সব ইরিনের পাগলামির কাছে পরাজিত!

একেরপর এক হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে আয়াজ, একেতো জ্বর, তারওপর দুবার গোসল! হাঁচি সাথে শরীর গরম অনুভূত হচ্ছে। ইরিন মিটমিট করে হাসছে। রক্তচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকালো আয়াজ।
এদিকে তার ঢাকায় আসার খবর শুনে রেশমি এসেছে দেখা করতে।
ভেতরে ঢুকেই আয়াজের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো রেশমি,
~ তোর ঘাড়ের কাছে লাল হয়ে আছে কেন আয়াজ? নাকের ওপর কি হয়েছে?

আয়াজ নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
~ আলমারির ইঁদুর কামড়ে দিয়েছে!
~ কি? আলমারিতে ইঁদুর?

~ হ্যাঁ। গোসলের জন্য জামাকাপড় নিবো বলে আলমারি খুলেছিলাম, খুলতেই লাফ দিয়ে কাধে উঠে গেলো। ঝেড়ে ফেলে গোসল করতে গেলাম !
রেশমি চোখবড় বড় করে তাকিয়ে আছে। সাততলায় ইঁদুর? তাও আলমারিতে? অবাক হয়ে বললো,
~ তারপর?

~ তারপর আর কি গোসল করে কম্বলের নিচে ঢুকতেই ইঁদুরটা আবার হাজির, পুরো শরীর ঝাঁজরা করে দিয়েছে কামড়ে।
ইরিনের হাসি হাসি মুখটা চুপসে গেছে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বসে আছে সে। লজ্জায়, অস্বস্তিতে চোখমুখ, কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে। মুক্তা মুখটিপে হেসে যাচ্ছে।

রেশমি মুক্তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,
~ সাততলায় ইঁদুর আসলো কি করে ভাবি? তোমরা ওষুধ আনো নি? ইঁদুরের কামড় কিন্তু মারাত্মক, প্লেগ রোগের সম্ভাবনা আছে। এই আয়াজ তুই টিকা নিয়েছিস তো!
আয়াজ বোনের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
~ টিকা? হ্যাঁ নিবো। তবে এই বাসায় বোধহয় একটাই ইঁদুর। আমি একটু আগেই ভাবিকে বলছিলাম ইঁদুর মারার ওষুর আনতে হবে! রাত বিরাতে কামড় দিলে তো সমস্যা?

সোহেলি আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন আর মুখ টিপে হাসছেন। ইরিন যে আয়াজের আলমারিতে লুকিয়ে ছিলো সেটা তিনি জানতেন। কিন্তু রেশমি তো আর জানে না? সে আলমারিতে ইঁদুর ঢোকার কথা শুনে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে। আয়াজ সুযোগ বুঝে মজা নিচ্ছে। রেশমি আরো কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিলো সোহেলি এসে তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন। তারপর যতটুকু বলা যায় বললেন, বাকিটুকু ইশারা ইঙ্গিতে ঘটনার সারসংক্ষেপ বুঝিয়ে দিলেন।

রেশমি ভেতরে চলে গেলে আয়াজ উঠে দাঁড়ালো। আজকে রাতেই আবার তাকে ব্যাক করতে হবে। ছুটি নিয়ে আসতে পারে নি। তার ডিউটির ভার অন্য একজনের কাছে দিয়ে এসেছে। হস্পিটাল থেকে একটু আগেও ফোন এসেছে। ইরিন তার চলে যাওয়ার খবর শুনেছে। হাঁ কিংবা না কিছুই বলে নি।

চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলো। আয়াজ একটু পর নিজের জামাকাপড় গোছানোর জন্য রুমে ঢুকতেই ইরিন ফট করে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘরের লাইট অফ। আয়াজ লাইটের সুইচ হাতড়ে লাইট অন চাইলে ইরিন বাধা দিলো।
~ লাইট বন্ধ থাক।

জিরো পাওয়ায়ের ডিম লাইটটা অন করল সে। ড্রেসিংটেবিলের ওপর বড় মোমবাতি জ্বলছে। তার পাশে দাঁড়ালো ইরিন। ওর পরনে কালো জর্জেট শাড়ি। কালো স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে পরেছে। গলায় চিকল স্বর্নের একটা লকেট। হাতে কালো রেশমি চুড়ি। আয়াজ হাঁ করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। তার শরীর ঝিমঝিম করছে। মোহাবিষ্ট লাগছে। দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বললো,
~ তুই আমার চাকরি খেতে চাইছিস বদ মেয়ে। আমি তোকে ছাড়বো না। ছুটি নিয়ে আসি তারপর তোর এসব ঢং আমি বের করবো।

ইরিন মুখ টিপে হাসছে। আয়াজ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে, কিন্তু বেরোচ্ছে না। ইরিন দুহাতের চুড়ি রিনিঝিনি বাজিয়ে বললো,
~ আমি কি আপনাকে আটকে রেখেছি? আপনি যান।

আয়াজ দরজা বন্ধ করে ফিরে এলো। ইরিন দুহাত মুখে চাপা দিয়ে হাসছে। আয়াজ কে তার দিকে অগ্নিচক্ষু নিয়ে তাকাতে দেখে কাছে এগিয়ে গেলো সে। নিজের ক্ষীন কটিতে আয়াজের শক্ত পেশিবহুল হাত দুটো রেখে ফিসফিস করে বললো,
~ যাবেন? বাজি রাখলাম? আপনি যদি যেতে পারেন
~ চুপ। বেয়াদপ!

ইরিনের হাসি থামছে না। দুহাতে আয়াজের গলা জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হাসছে সে।
আয়াজ বিড়বিড় করে বললো, এবার বোধহয় নিউমোনিয়া হয়ে যাবে!

রাত্রিবেলা আয়াজের বুকের ওপর শুয়ে আছে ইরিন। আয়াজ ফোনে কথা বলছে। তার কথা বলা শেষ হতেই ইরিন ওর শার্টের বোতাম ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
~ বাসর রাতে প্রত্যেক স্বামী তার বউকে গিফট দেয়। হিসেবমত আজকে আমাদের !

এইটুকু বলে ইরিন বখাটে টাইপ একটা চোখ মারলো।
~ তুই দিন দিন ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস ইরিন!
~ এখন বলুন আপনি আমাকে কি গিফট দিবেন?

~ তুই আমাকে সালাম করেছিস? বিয়ের রাতে তো বউরা স্বামীদের পা ছুঁয়ে সালাম করে।
~ ইশস শখ কত!
~ তাহলে আবার গিফট চাইছিস কেন?

~ কিপ্টুস একটা।
~ হ্যাঁ কিপ্টুস!
আয়াজ উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই ইরিন টুক করে তাকে সালাম করে বসলো। আয়াজ হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। যেন হঠাৎ করে কি ঘটেছে বুঝতে পারছে না সে। ইরিন গুটি গুটি পায়ে তার বুকের কাছে সরে এসে অভিমানী কন্ঠে বললো,

~ আমার কোন গিফট লাগবে না। আপনি শুধু সারাজীবন আমাকে এভাবে ভালোবাসবেন তাহলেই হবে। আপনি আমাকে ভুল বুঝলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। আমি সবার মত বলতে পারি না কিন্তু আমার কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়।
আয়াজ মুচকি মুচকি হাসছে। ইরিন ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
~ আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। আর কোন পাগলামি করবো না। কিন্তু আপনি আর কখনো এভাবে রাগ করে চলে যাবেন না। বলুন যাবেন না?

~ যাবো না।
~ গেলে?
আয়াজ মিটমিট করে হাসতে হাসতে বললো,
~ যাবো কিভাবে? তুই নিজেই তো গিলে নিয়েছিস?
ইরিন লজ্জা পেয়ে বললো,
~ যাহ!

আয়াজ শব্দ করে হাসছে। কি সুন্দর লাগছে তার হাসিটা। ইরিন ঠোঁট কামড়ালো। আরেকটু জ্বালাবে নাকি মানুষটাকে? পরে ভাবলো নাহ! সে তো ভালো হয়ে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। আয়াজ একেবারে ওর কানের সাথে ঠোঁট লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো, আরেকটু পাগলামি তুই করতেই পারিস হরিণ। আমি কিছু মনে করবো না।

(যেভাবে সবাই মিলে ইরিনকে বকছেন। বাপরে বাপ! আমি তো ভয় পাইয়া গেছি। এখন লাভটা কি হইলো? তারা জামাইবউ তো ঠিকই মিল্লা গেছে। মাঝখান থেইক্যা আপনারা গলা ফাটাইছেন। যাই হোক আমি চেষ্টা করেছি যাতে ইন্ডিংটা আপনাদের ভালো লাগে। কেমন হয়েছে আপনারাই বলতে পারবেন

লেখা – অরিত্রিকা আহানা

সমাপ্ত

(পাঠক আপনাদের ভালোলাগার উদ্দেশ্যেই প্রতিনিয়ত আমাদের লেখা। আপনাদের একটি শেয়ার আমাদের লেখার স্পৃহা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আমাদের এই পর্বের “অতঃপর প্রণয় – Premer golpo kahini” গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানালাম। ধন্যবাদ।)

আরো পড়ূন – অতঃপর প্রণয় (১ম খণ্ড) – Premer golpo kahini

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *